أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১৩)
[ ** মৃত মানুষদের ব্যাপারে কোরআনের বক্তব্য : ‘যখন মরিয়মের ছেলের দৃষ্টান্ত দেয়া হলাে…:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ পারা:২৫
৫৭-৬৫ নং আয়াত:-
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৫৭
وَ لَمَّا ضُرِبَ ابۡنُ مَرۡیَمَ مَثَلًا اِذَا قَوۡمُکَ مِنۡہُ یَصِدُّوۡنَ ﴿۵۷﴾
যখন মারয়্যাম-তনয় (ঈসা)র দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়, তখন তোমার সম্প্রদায় শোরগোল আরম্ভ করে দেয়,
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৫৮
وَ قَالُوۡۤاءَ اٰلِہَتُنَا خَیۡرٌ اَمۡ ہُوَ ؕ مَا ضَرَبُوۡہُ لَکَ اِلَّا جَدَلًا ؕ بَلۡ ہُمۡ قَوۡمٌ خَصِمُوۡنَ ﴿۵۸﴾
এবং বলে, ‘আমাদের দেবতাগুলি শ্রেষ্ঠ, না ঈসা?’ এরা কেবল বিতর্কের উদ্দেশ্যেই তোমাকে এ কথা বলে। বস্তুতঃ এরা তো এক বিতর্ককারী সম্প্রদায়।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৫৯
اِنۡ ہُوَ اِلَّا عَبۡدٌ اَنۡعَمۡنَا عَلَیۡہِ وَ جَعَلۡنٰہُ مَثَلًا لِّبَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ﴿ؕ۵۹﴾
ইবনে মারয়াম আমার বান্দা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি তাঁকে নিয়ামত দান করেছিলাম এবং বনী ইসরাঈলদের জন্য আমার অসীম ক্ষমতার একটি নমুনা বানিয়েছিলাম।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৬০
وَ لَوۡ نَشَآءُ لَجَعَلۡنَا مِنۡکُمۡ مَّلٰٓئِکَۃً فِی الۡاَرۡضِ یَخۡلُفُوۡنَ ﴿۶۰﴾
আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের পরিবর্তে ফিরিশতাদেরকে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করতে পারতাম।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৬১
وَ اِنَّہٗ لَعِلۡمٌ لِّلسَّاعَۃِ فَلَا تَمۡتَرُنَّ بِہَا وَ اتَّبِعُوۡنِ ؕ ہٰذَا صِرَاطٌ مُّسۡتَقِیۡمٌ ﴿۶۱﴾
নিশ্চয় ঈসা কিয়ামতের একটি নিদর্শন; সুতরাং তোমরা কিয়ামতে অবশ্যই সন্দেহ পোষণ করো না এবং আমার অনুসরণ কর। এটিই সরল পথ।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৬২
وَ لَا یَصُدَّنَّکُمُ الشَّیۡطٰنُ ۚ اِنَّہٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۶۲﴾
শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই এ হতে নিবৃত্ত না করে, সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৬৩
وَ لَمَّا جَآءَ عِیۡسٰی بِالۡبَیِّنٰتِ قَالَ قَدۡ جِئۡتُکُمۡ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ لِاُبَیِّنَ لَکُمۡ بَعۡضَ الَّذِیۡ تَخۡتَلِفُوۡنَ فِیۡہِ ۚ فَاتَّقُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوۡنِ ﴿۶۳﴾
ঈসা যখন সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছিলো, বলেছিলোঃ আমি তোমাদের কাছে হিকমত নিয়ে এসেছি এবং এজন্য এসেছি যে, তোমরা যেসব বিষয়ে মতানৈক্য পোষণ করছো তার কিছু বিষয়ের তাৎপর্য প্রকাশ করবো। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৬৪
اِنَّ اللّٰہَ ہُوَ رَبِّیۡ وَ رَبُّکُمۡ فَاعۡبُدُوۡہُ ؕ ہٰذَا صِرَاطٌ مُّسۡتَقِیۡمٌ ﴿۶۴﴾
প্রকৃত সত্য এই যে, আল্লাহই আমার ও তোমাদের রব। তাঁরই ইবাদত করো। এটাই সরল-সোজা পথ।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৬৫
فَاخۡتَلَفَ الۡاَحۡزَابُ مِنۡۢ بَیۡنِہِمۡ ۚ فَوَیۡلٌ لِّلَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مِنۡ عَذَابِ یَوۡمٍ اَلِیۡمٍ ﴿۶۵﴾
কিন্তু (তাঁর এই সুস্পষ্ট শিক্ষা সত্ত্বেও) বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী পরস্পর মতপার্থক্য করলো।৫৮ যারা জুলুম করেছে তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক দিনের আযাব।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মৃত মানুষদের ব্যাপারে কোরআনের বক্তব্য : ‘যখন মরিয়মের ছেলের দৃষ্টান্ত দেয়া হলাে…’(আয়াত ৫৭-৬৫) ইবনে ইসহাক স্বীয় সীরাত গ্রন্থে লিখেছেন, একদিন রাসূল(স.) মাসজিদুল হারামে (পবিত্র কাবা সংলগ্ন মসজিদে) ওলীদ ইবনে মুগীরার সাথে বসেছিলেন। সহসা নযর ইবনুল হারেস এসে তাদের সাথে বসলাে। সেই মজলিসে কোরায়শ নেতাদের আরাে অনেকে উপস্থিত ছিলাে। রসূল(স.) তাদের সাথে কথা বললেন। নযর ইবনুল হারেসকে দেখতে পেয়ে তার সাথেও কথা বললেন এবং তাকে লা জবাব করে দিলেন। তারপর সবাইকে লক্ষ্য করে সূরা আম্বিয়ার এই আয়াতটা (৯৮ নং) পড়লেন, ‘তােমরা এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তােমরা যাদের উপাসনা করাে তারা জাহান্নামের কাঠ। তােমরা সবাই সেখানে প্রবেশ করবে। এরপর রসূল(স.) চলে গেলেন। এই সময় আব্দুল্লাহ ইবনু যাবয়ারী আত-তামীমী এসে মজলিসে বসলাে। ওলীদ ইবনে মুগীরা তাকে বললাে, আজ নযর ইবনুল হারেস আব্দুল মােত্তালেবের পৌত্রের সামনে টিকতেই পারেনি। মােহাম্মদ(স.) দাবী করেছে যে, আমরা ও আমরা যে সব দেবতার উপাসনা করি, তারা জাহান্নামের কাঠ। আবদুল্লাহ ইবনুয যাবয়ারী বললাে, আল্লাহর শপথ, আমি যদি মােহাম্মদকে পেতাম, তবে তার সাথে তর্ক করতাম। তােমরা মােহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করাে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর যার যার পূজো করা হয়, তারা সবাই কি তাদের পূজারীদের সাথে জাহান্নামে যাবে? আমরা তার ফেরেশতাদের পূজা করি। ইহুদীরা ওযায়েরের পূজা করে এবং খৃষ্টানরা মারইয়ামের ছেলে ঈসার পূজা করে।’ আব্দুল্লাহ ইবনুয যাবয়ারীর কথায় ওলীদ ও তার সাথীরা চমৎকৃত হলাে। তারা দেখলাে যে, সে জোরদার যুক্তি উত্থাপন করেছে এবং তর্কে জয় লাভ করার যােগ্যতা লাভ করেছে। অবিলম্বে প্রশ্নটা রসূল(স.)-এর কাছে করা হলাে। তিনি বললেন, যে ব্যক্তিই আল্লাহর বিকল্প উপাস্য সেজে উপাসনা পাওয়ার প্রত্যাশা করবে, সেই তার উপাসকদের সাথে থাকবে । কেননা তারা একমাত্র শয়তানের ও শয়তান যাকে পূজা করার আদেশ দেয় তারই পূজা করে থাকে। এই সময়ে আল্লাহ তায়ালা সূরা আম্বিয়ার ১০১ নং আয়াত নাযিল করলেন, যাদের জন্যে আমার পক্ষ থেকে আগে থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে।’ অর্থাৎ হযরত ওযায়ের, হযরত ঈসা এবং অন্যান্য বিদ্বান ও পুন্যবান ব্যক্তিরা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যের মধ্য দিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়া সত্তেও লােকেরা তাদের উপাসনা করেছে। তাদের তিরােধানের পর পরবর্তী কালের পথভ্রষ্ট লােকেরা তাদেরকে উপাস্য ও মনিবরূপে গ্রহণ করেছে। তারা জাহান্নাম থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবেন। এ আয়াতটা নাযিল হয় হযরত ঈসা সম্পর্কে যে প্রশ্ন তােলা হয় এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তার উপাসনাও করা হয় বলে যে ওজুহাত খাড়া করা হয়, সেই বিষয়ে। ওলীদ ও তার উপস্থিত সাথীরা রসূল(স.)-এর উপস্থাপিত এই যুক্তিতে লা-জবাব হয়ে গেলাে ও থতমত খেয়ে গেলাে। আর যখনই মারইয়ামের ছেলের উদাহরণ দেয়া হলাে, অমনি তােমার জাতি হৈ চৈ শুরু করে দিলাে। অর্থাৎ তােমার আদেশ ও আহ্বান থেকে মানুষকে দূরে সরানাের জন্যে হৈ চৈ শুরু করে দিলাে। তাফসীরে কাশশাফে বলা হয়েছে, রসূল(স.) যখন কোরায়শের সামনে এই আয়াত পড়লেন, ‘তােমরা নিজেরা ও আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর যাদের তােমরা উপাসনা করো তারা জাহান্নামের কাঠ তখন তারা তার প্রতি ভীষণ ক্ষিপ্ত, ক্রুব্ধ ও রুষ্ট হলাে। আব্দুল্লাহ ইবনু যারয়ারী বললাে, ‘হে মােহাম্মদ, এ ব্যাপারটা কি শুধু আমাদের ও আমাদের দেবতাদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য, না সকল জাতির জন্যে? রাসূল(স.) বললেন, তােমাদের জন্যে, তােমাদের দেবতাদের জন্যে এবং সকল জাতির জন্য। সে বললাে, তাহলে কাবার অধিপতির শপথ, আমি তােমার সাথে তর্ক না করে ছাড়ছিনে। তুমি কি দাবী করাে না যে, মারইয়ামের ছেলে ঈসা একজন নবী? তুমি তাে তার ও তার মায়ের প্রচুর প্রশংসা করে থাকো। তুমি এও জানাে যে, খৃষ্টানরা ওদের উভয়কে (ঈসা ও মারইয়ামকে) উপাসনা করে থাকে। ওযায়েরেরও উপাসনা করা হয়। ফেরেশতাদের উপাসনা করা হয়। এরা সবাই যদি দোযখে যায়, তাহলে আমরা ও আমাদের দেবতারাও তাদের সাথে দোযখে যেতে রাযী আছি। এরপর তারা খুব উল্লাস প্রকাশ করে ও অট্টহাসি করে। রসূল(স.) নীরব হয়ে যান। এই সময় আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলেন, ‘নিশ্চয় যাদের সম্পর্কে আমার পক্ষ থেকে আগে থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত হয়ে আছে’(আম্বিয়া ১০১) আর এই আয়াতটা (যােখরুফ ৫৭) নাযিল হলাে। ৫৭ নং আয়াতটার মর্ম হলাে, আব্দুল্লাহ ইবনুয যারয়ারী যখন মারইয়ামের ছেলে হযরত ঈসার উদাহরণ দিলাে এবং খৃষ্টানরা তার উপাসনা করে থাকে এই বলে রসূল(স.)-এর সাথে তর্ক শুরু করে দিলাে, তখনি তােমার গােত্রের লােকেরা-অর্থাৎ কোরায়শরা এই উদাহরণ শুনে উল্লাসে ফেটে পড়লাে ও হৈ চৈ শুরু করে দিলাে। কারণ তারা শুনেছিলাে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু যারয়ারীর যুক্তিতে তিনি থতমত খেয়ে গেছেন ও লা জবাব হয়ে গেছেন-যেমনটি কোনাে জনগােষ্ঠী একটা বিষয়ে তর্কাতর্কি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ জয় লাভ করলে হৈ চৈ ও শােরগােল করে থাকে। অবশ্য এই শব্দটা ইয়াসুদ্দুনা উচ্চারণ করলে তার অর্থ হচ্ছে, তারা এই উদাহরণের ফলে আসকারা পেয়ে সত্য থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করে এবং নিজেরাও সত্যকে এড়িয়ে যায় ও উপেক্ষা করে। শব্দটা ইয়াসিদ্দু ও ‘ইয়াসু্দ্দু’ দুই ভাবেই উচ্চারিত হয়ে থাকে, যেমন ইয়াকু ও ইয়াকে ইত্যাদি। ‘আর তারা বলে, আমাদের উপাস্য ভালাে, না উনি?’ অর্থাৎ আমাদের উপাস্যরা তাে তােমার মতে ঈসার চেয়ে ভালাে নয়। আর ঈসাই যখন দোযখের কাঠ হবে, তখন আমাদের উপাস্যদের ব্যাপারটা সহজেই বােধগম্য। কাশশাফ প্রণেতা এই তাফসীর কোথা থেকে গ্রহণ করেছেন, তা উল্লেখ করেননি। অবশ্য মােটামুটিভাবে ইবনে ইসহাকের বর্ণনার সাথে এর মিল রয়েছে। উভয় ব্যাখ্যা থেকেই মাশরেকদের বক্রতা ও তর্কপ্রিয়তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কোরআন তাদের স্বভাব প্রকৃতির যে চিত্র একেছে, এখানে অবিকল সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। কোরআন বলেছে, ‘তারা হলাে একটা ঝগড়াটে গােষ্ঠী।’ অর্থাৎ ঝগড়া বিবাদে তারা যেমন জেদী ও হঠকারী, তেমনি চতুর ও ধড়িবাজ। তারা প্রথম থেকেই জানে রসূল(স.) তাদেরকে কী বলতে চান এবং কোরআন তাদেরকে কিসের দাওয়াত দেয়। সবকিছু জেনে বুঝেও তারা সহজ সরল কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জটিল ও বক্র বানানাের চেষ্টা করে। তারা সাধারণ ও সহজবােধ্য শব্দের ভেতরে কৃত্রিম বিতর্কের মাধ্যমে সংশয় সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। এ ধরনের তর্কে কোনােই লাভ হয় না। কেবল ক্ষতিই হয়ে থাকে। কৃত্রিমতা, নিষ্ঠাহীনতা, অস্থিরতা ও দোদুল্যমানতা, সত্যের ব্যাপারে হঠকারিতা ও গােয়ার্তুমি এবং ইচ্ছাকৃতভাবে কোনাে শব্দে, বাক্যে বা পটভূমিতে সংশয় সৃষ্টি, এই সব খারাপ চারিত্রিক বৈশিষ্টই এ জাতীয় তর্ক থেকে অর্জিত হয়ে থাকে। এ জন্যেই রসূল(স.) এমন বিতর্কে অংশগ্রহণ করা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, যার উদ্দেশ্য সত্যকে পাওয়া নয়, বরং যেন তেন প্রকারে বিজয়ী হওয়া। ইবনে জরীর বলেন, হযরত আবু উমামা থেকে বর্ণিত যে, একবার রসূল(স.) মুসলিম জনতার সামনে এসে দেখলেন, তারা কোরআন নিয়ে তর্ক বিতর্ক করছে। তিনি এতে এতাে রেগে গেলেন যে, মনে হচ্ছিলাে, যেন তার মুখে সেকা ঢেলে দেয়া হয়েছে। তারপর বললেন, আল্লাহর কিতাবের একাংশ দিয়ে অপর অংশকে আঘাত করাে না। মনে রেখাে, কোনাে জাতি তখনই পথভ্রষ্ট হয়, যখন কলহ কোন্দল ও ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়। তারপর পড়লেন, ‘তােমার সাথে তর্ক করার উদ্দেশ্যেই তারা এই উদাহরণ দিয়েছে। আসলে তারা হচ্ছে একটা ঝগড়াটে মানবগােষ্ঠী।’ তারা বললাে, আমাদের উপাস্যরা ভালাে, না তিনি। মহান আল্লাহর এ উক্তিটার আরাে একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে। তাদের ফেরেশতা সংক্রান্ত ভিত্তিহীন ধারণার সম্বলিত আয়াতগুলাে থেকে এর আভাস পাওয়া যায়। সেই সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটা হলাে, তারা এ দ্বারা বুঝিয়েছে যে, খৃষ্টানদের একাংশ কর্তক হযরত ঈসার উপাসনার চেয়ে তাদের ফেরেশতার উপাসনা অনেক ভালাে। কেননা তাদের ধারণা অনুসারে ফেরেশতারা আল্লাহর মেয়ে বিধায় তারা হযরত ঈসার চেয়ে আল্লাহর অধিকতর নিকটবর্তী এবং তা বংশগত এবং চরিত্রগত উভয় দিক দিয়ে। আর তারা নিছক তর্কের খাতিরে ছাড়া আর কোনাে উদ্দেশ্যে এই উদাহরণ দেয়নি, ‘আসলে তারা তর্কপ্রিয় গােষ্ঠী’ এই উক্তি দ্বারা যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা দ্বারা ইবনুয যারয়ারীর কথাও বুঝানাে হয়েছে যে, খৃষ্টানদের পক্ষ থেকে হযরত ঈসার উপাসনাকে দৃষ্টান্ত হিসাবে পেশ করা অর্থহীন। কেননা খৃষ্টানদের তাওহীদ বিচ্যুতি কোনাে যুক্তি নয় বরং তাদের নিজেদের মূর্তি পূজা ও ফেরেশতা পূজার মতােই এটাও একটা বিকৃতি ও ভ্রষ্টতা। এক বিকৃতি আর এক বিকৃতির পক্ষে যুক্তি হতে পারে না। আর এক বিকৃতিকে অন্য বিকৃতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলাও যায় না। কারণ দুটোই ভ্রষ্টতা। কোনাে কোনাে তফসীরকার এই ব্যাখ্যাটাকে গ্রহণ করেছেন এবং এ ব্যাখ্যা মানানসইও বটে। এ জন্যেই এর পরে মন্তব্য করা হয়েছে! ‘সে তাে একজন বান্দা ছাড়া আর কিছু নয়, যার ওপর আমি অনুগ্রহ বর্ষণ করেছি…’ অর্থাৎ সে কোনাে মাবুদ নয় যে, তার উপাসনা করতে হবে। যেমন খৃষ্টানদের একটা গােষ্ঠী তার উপাসনা করে থাকে। সে আল্লাহর একজন অনুগৃহীত বান্দা মাত্র। তারা তার উপাসনা করায় ঈসা(আ.)-এর কোনাে দোষ নেই। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার ওপর অনুগ্রহ করেছেন শুধু এ জন্যেই যেন সে বনী ইসরাঈলের জন্যে দৃষ্টান্ত হয়। তারা তার দিকে তাকাবে এবং তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা তার দৃষ্টান্ত ভুলে গিয়েছিলাে এবং বিপথগামী হয়েছিলাে। পুনরায় ফেরেশতা সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণার প্রসংগ তােলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ফেরেশতারা তাদের মতােই আল্লাহর একশ্রেণীর সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে ফেরেশতাদেরকে তাদের উত্তরাধিকারী বানাতে পারতেন, অথবা কতক মানুষকে ফেরেশতায় রূপান্তরিত করে পৃথিবীতে তাদের উত্তরাধিকারী বানাতে পারতেন।(আয়াত ৬০) মােদ্দাকথা, সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছাই শেষ কথা। তিনি যা সৃষ্টি করতে চান, তা-ই হয়। আল্লাহর কোনাে সৃষ্টি তাঁর সাথে বংশগত কোনাে সম্পর্ক নেই। তার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক নিছক স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক, বান্দা ও মাবুদের সম্পর্ক, উপাসক ও উপাস্যের সম্পর্ক। এর বেশী কিছু নয় এবং এ থেকে পৃথক কিছুও নয়।
**ঈসা(আ.)-এর সঠিক ইতিহাস ও কেয়ামতের পূর্বে তার অবতরণ : এরপর হযরত ঈসা কিভাবে তাদেরকে কেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তার বিবরণ দেয়া হয়েছে। ‘আর সে তাে (ঈসা) কেয়ামতের প্রতীক…!'(আয়াত ৬১) বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যাতে কেয়ামতের পূর্বে আকাশ থেকে হযরত ঈসার পৃথিবীতে নেমে আসার সংবাদ দেয়া হয়েছে। সে তাে কেয়ামতের প্রতীক, এই কথাটা দ্বারা সেই দিকেই ইংগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি কেয়ামতের আগমন বার্তা বয়ে আনবেন। অন্য এক কিরাতে ‘আলামুন পড়া হয়েছে, যার অর্থ আলামত বা নিদর্শন। ইলমুন ও আলামুন। উভয়টা প্রায় একই অর্থ বহন করে। হযরত আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল(স.) বলেছেন, যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ করে বলছি, অচিরেই তােমাদের মধ্যে মারইয়ামের ছেলে ঈসা ন্যায়বিচারক শাসক হয়ে আসবেন, তিনি ক্রুশ ভাংবেন, শূয়াের হত্যা করবেন, জিযিয়া আরােপ করবেন এবং এতাে সম্পদ বিতরণ করবেন যে, নেয়ার মতাে লােক পাওয়া যাবে না। তখন একটা সেজদা দুনিয়া ও তার যাবতীয় সম্পদের চেয়ে মূল্যবান হবে।(মালেক, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ) হযরত জাবের থেকে বর্ণিত, রাসূল(স.) বলেছেন, আমার উম্মতের একটা দল সত্যের জন্যে কেয়ামত পর্যন্ত লড়াই করতে থাকবে এবং বিজয়ী হবে। তখন মারইয়ামের ছেলে ঈসা(আ.) অবতরণ করবেন। তখন তাদের নেতা বলবে, ‘আসুন, আমাদেরকে নামায পড়ান। তিনি বলবেন, না। তােমরাই একে অপরের নেতা। আল্লাহ তায়ালা এভাবে এই উম্মাতকে সম্মানিত করেছেন।(সহীহ মুসলিম) এটা সেই সব অজানা ও অদৃশ্য সত্যের অন্যতম, যার পূর্বাভাস দিয়েছেন রসূল(স.) এবং যার উল্লেখ এই কোরআনেও করা হয়েছে। কেয়ামত পর্যন্ত অটুট এই দুই উৎস কোরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে যা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, তা ছাড়া কোনাে মানুষের কাছ থেকে এ সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না। অতএব, তােমরা কেয়ামত সম্পর্কে সংশয় করাে না। আমার অনুসরণ করাে। এটা সঠিক পথ। তারা কেয়ামত সম্পর্কে সংশয়াপন্ন ছিলো। কোরআন তাদেরকে এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করার আদেশ দিয়েছে। রসূলের মুখ দিয়ে তাকে অনুসরণ করার আহ্বানও জানিয়েছে। কেননা একমাত্র তিনিই নির্ভুল পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন, যার অনুসরণ করলে আর গােমরাহ হবার ভয় থাকে না। পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদের বিপথগামিতা ও ভ্রষ্টতা শয়তানের অনুসরণের ফল। আনুগত্য ও অনুসরণ করতে হলে রসূলের আনুগত্য করাই উত্তম, শয়তানের নয়।(আয়াত ৬২) মানুষের সাথে শয়তানের যে চিরন্তন যুদ্ধ তাদের আদি পিতা হযরত আদমের সময় থেকে চলে আসছে, তার কথা কোরআন সব সময় স্মরণ করিয়ে দেয়। সবচেয়ে নির্বোধ হলাে সেই ব্যক্তি, যে জানে যে, তার একজন শত্ৰু সব সময় তার বিরুদ্ধে ওঁৎ পেতে আছে, তারপরও সে তার ব্যাপারে সতর্ক হয় না; বরং তার তাবেদার হয়ে যায়। মানুষ এই পৃথিবীতে যততদিন বেঁচে থাকবে, ততােদিন সে যাতে শয়তানের সাথে এই চিরন্তন লড়াইতে বিজয়ী হয়ে টিকে থাকতে পারে, সে জন্যে ইসলাম তাকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে। আর এই লড়াইয়ে জিতলে তার জন্যে এতাে পুরস্কার নির্দিষ্ট করে রেখেছে, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। আবার এ লড়াইয়ে হেরে গেলে তার জন্যে এতাে শান্তি নির্ধারণ করে রেখেছে, যা তার ধারণারও অতীত। এভাবেই সে তার ভেতরেই লড়াইয়ের শক্তিকে এই চিরন্তন লড়াইয়ে নিয়ােজিত করেছে। এ লড়াই মানুষকে খাঁটি মানুষ বানায়। তাকে সকল সৃষ্টির সেরা বানায়। ইসলাম এই পৃথিবীতে মানুষের তার ওই চিরশত্রু শয়তানের ওপর বিজয় লাভ করাকে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করে। কেননা এভাবেই সে অকল্যাণ, অন্যায় ও অসত্যের ওপর বিজয়ী হবে এবং সত্য, কল্যাণ ও পবিত্রতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
** এরপর হযরত ঈসা ও তার আনীত আদর্শের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এবং তার আগমনের আগে ও পরে তারা যে মতভেদে লিপ্ত হয় তা বর্ণনা করা হয়েছে। (আয়াত ৬৩-৬৫) এ আয়াতগুলাের সারকথা এই যে, ঈসা(আ.) তার জাতির কাছে সুস্পষ্ট ও অকাট্য প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলেন। এসব প্রমাণাদির মধ্যে সেই সব অলৌকিক জিনিসও অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহতায়ালা তার হাত দিয়ে সংঘটিত করেছিলেন, আর সত্য ও সঠিক পথের সন্ধান দানকারী বাণী ও নির্দেশণাবলীও এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি তার জাতিকে বলেছিলেন, আমি তােমাদের কাছে হেকমত তথা প্রজ্ঞা ও তত্ত্বজ্ঞান নিয়ে এসেছি। যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া প্রজ্ঞা ও তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে, সে বিপুল কল্যাণ লাভ করে, যাবতীয় পদস্খলন থেকে নিরাপদ থাকে, উদাসীনতা ও শৈথিল্য থেকে রক্ষা পায় এবং তার সকল কাজে ভারসাম্য নিশ্চিত হয়। হযরত ঈসা এসেছিলেন তাদের কিছু মতভেদের মীমাংসা করে দিতে। হযরত মূসার শরীয়তের বহু বিষয়ে তারা মতভেদের শিকার হয় এবং বহু দল উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। তিনি তাদেরকে আল্লাহর অনুগত্যের আহ্বান জানান এবং নির্ভেজাল ও আপােসহীন তাওহীদের বাণী বজ্র নির্ঘোষে ঘােষণা করেন। ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমারও প্রভু, তােমাদেরও প্রভু।’ তিনি এ কথা বলেননি যে, আমি একজন ইলাহ’ বা মাবুদ। তিনি এও বলেননি যে, ‘আমি আল্লাহর ছেলে’। এমনকি তিনি ঘুর্নাক্ষরেও ইংগিত দেননি যে, তার পক্ষ থেকে দাসত্ব আর সারা বিশ্বের প্রভু আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রভুত্বের সম্পর্ক ছাড়া আর কোনাে সম্পর্ক আছে। তিনি তাদেরকে বললেন, এ হচ্ছে সঠিক ও সহজ সরল পথ এতে কোনাে বক্রতা নেই, নেই কোনাে ভ্রষ্টতা বা পদস্খলন। কিন্তু তার পরে যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে পূর্ববর্তীদের মতােই। দলে দলে বিভক্ত হয়েছে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ও বিনা প্রমাণে। ‘অতএব তাদের জন্যে দুর্ভোগ যারা অন্যায় করেছে…'(আয়াত ৬৫) হযরত ঈসা বনী ইসরাইলের রসূল হয়ে এসেছিলেন। তারা রােম সম্রাটের অধীনে যে যুলুমের শিকার হচ্ছিলো তা থেকে তাদেরকে হযরত ঈসা(আ.) মুক্ত করবেন এই আশায় তারা তার অপেক্ষায় ছিলাে। অথচ দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর তিনি যখন এলেন, তখন তাকে তারা প্রত্যাখ্যান করলাে, এমনকি তাকে শূলে চড়ানাের চক্রান্ত পর্যন্ত করলাে। হযরত ঈসা(আ.) যখন এলেন, তখন বনী ইসরাঈলকে বহুসংখ্যক দলে উপদলে বিভক্ত দেখলেন। তন্মধ্যে চারটে দলই ছিলাে প্রধান। ১.সাদুকীয়ীন : ‘সাদুক’ এর নেতৃত্বাধীন দল। হযরত দাউদ ও সােলায়মান(আ.) থেকে যে ধর্মীয় নেতৃত্বের উদ্ভব হয়েছিলাে, সাদুক ও তার পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। শরীয়ত মােতাবেক তার বংশ পরম্পরা হযরত মূসার ভাই হারুন থেকে নির্গত । কেননা তার বংশধরই হায়কালে সোলায়মান দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলাে। তারা তাদের এই কাজ ও পেশার দাবীতে এবাদাতের বাহ্যিক আকৃতি ও নিয়ম কানুনে অত্যধিক কঠোর ছিলাে। তারা বিদয়াতকে অস্বীকার করতাে। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে তারা স্বেচ্ছাচারিতার পক্ষপাতী ছিলেন এবং জীবনের স্বাদ উপভােগ করতাে এমনকি তারা কেয়ামতের অস্তিত্বও স্বীকার করতাে না। ২.ফিররীসীন : এ দলটা সাদুকীয়ীনদের প্রতিপক্ষ ছিলাে। আনুষ্ঠানিক এবাদাতে এবং তার বাহ্যিক আকৃতি ও নিয়ম কানুনে সাদুকীয়ীনদের কঠোরতাকে তারা পছন্দ করতাে না। সাদুকীয়ীনদের আখেরাত ও কেয়ামতের হিসাব নিকাশ অস্বীকার করারও তারা ঘাের বিরােধী ছিলাে। ফিররীসীনদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলাে সুফীবাদ ও দুনিয়ার আরাম আয়েশ পরিহার। অবশ্য তাদের কেউ কেউ জ্ঞানীগুণী ও বিদ্বান হওয়ার সুবাদে দাম্ভিক ও অহংকারী হয়ে গিয়েছিলাে। হযরত ঈসা(আ.) তাদের এই দোষটার কঠোর সমালােচনা করেছিলেন। ৩.সামেরীয়ন : এই দলটা ইহুদী ও আশােরীদের সংমিশ্রণে গঠিত ছিলাে। এরা আদি যুগের পাঁচ খানা পুস্তক মেনে চলতাে। এই পাঁচ খানা পুস্তক মূসার পুস্তক নামে পরিচিত। এছাড়া পরবর্তী কালের আর সব পুস্তককে তারা অস্বীকার করতাে, যদিও অন্যরা তার পবিত্রতাকে স্বীকার করে। ৪.আসেয়ীন বা আসেনীয়ীন : এরা বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত। এরা অন্যান্য ইহুদী উপদল থেকে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে থাকতাে। ব্যক্তিগত জীবনে তারা কঠোর ব্যয় সংকোচের নীতি অবলম্বন করে আর সামষ্টিক জীবনে তারা শৃংখলা ও ঐক্যের অনুসারী। এ ছাড়া সেখানে আরাে বহু ছােট ঘােট উপদলও ছিলাে এবং বনী ইসরাঈলের ভেতরে আকীদা বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে ব্যাপক বিশৃংখলা ও মতানৈক্য বিরাজ করতাে। বনী ঈসরাইল রােমাণ সম্রাজ্যের শােষণ ও অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে প্রত্যাশিত ত্রাণকর্তার হাতে মুক্তি লাভের প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন গুণছিলাে। এ সময়েই হযরত ঈসা(আ.) তাওহীদের বাণী নিয়ে তাদের কাছে এলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালাই আমাদের ও তােমাদের একমাত্র প্রভু। কাজেই তােমরা তার এবাদাত করাে। তিনি এমন এক শরীয়ত চালু করলেন যাতে বাহ্যিক ও আনুষ্ঠানিক এবাদাতের আগে উদারতা, আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও অন্তরের পরিচ্ছন্নতার প্রতি শুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এ প্রসংগে হযরত ঈসা(আ.)-এর কয়েকটা সুপ্রসিদ্ধ বাণী বর্ণনা করা হয়ে থাকে। যেমন, তারা বড় বড় বােঝা তৈরী করে এবং জনগণকে তা বহন করতে পীড়াপীড়ি করে, অথচ নিজেরা তার দিকে একটা আংগুলও এগিয়ে দেয় না। তারা কেবল লােক দেখানা কাজ করে। তারা তাদের আকর্ষণীয় বেশভূষা ও লম্বা চওড়া পােশাক পরে, বড় বড় মজলিসে ও ভােজের আয়ােজনে সর্বাগ্রে আসন লাভের চেষ্টা করে এবং হাট বাজারে চলবার সময় লােকজনের সালাম ও অভিবাদন পাওয়ার প্রত্যাশা করে। তারা চায়, লােকেরা তাদেরকে সর্বত্র স্যার স্যার ও হুযুর হুযুর করুক। তাদের জন্যে হযরত ঈসার বক্তব্য, হে অন্ধ সমাজপতিরা, যারা সামান্য মশামাছি নিয়ে বাছবিছার করাে, আর আস্ত উট গিলে খাও। তােমরা পেয়ালা ও থালার বহিরাংশ খুব পরিষ্কার করাে বটে। তবে ভেতরে ভেতরে তােমরা নােংরামি ও ব্যাভিচারে লিপ্ত। হে লেখক সম্পদ্রায় ও লােক দেখানাে ফিররীসীনরা, তােমাদের পােড়া কপাল। তােমরা হচ্ছো সুসজ্জিত সমাধি সৌধের মতাে। তার বহিরাংগন খুবই সুন্দর ও রংগীন আর ভেতরে হাডিড ও কংকাল। হযরত ঈসা(আ.)-এর এই উক্তিগুলা অধ্যয়ন করার সময় আমাদের এ যুগের পেশাদার ধর্মীয় নেতাদের চেহারা মানসপটে ভেসে ওঠে। মনে হয় এ শ্রেণীর পেশাদার ধার্মিকেরা পৃথিবীতে বার বার আসে এবং লােকেরা প্রতিনিয়তই তাদেরকে দেখতে পায়। এরপর হযরত ঈসা(আ.) আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। তারপর তার অনুসারীরা নানা মতভেদের শিকার হলাে এবং দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়লাে। কেউবা তাকে খােদা বানিয়ে নিলাে, কেউবা তাকে আল্লাহর ছেলে ঠাওরালাে। অন্যরা আল্লাহকে তিন উপাস্যের তৃতীয় জন বলে আখ্যায়িত করার ধৃষ্টতা দেখালাে। এই তিন জনের একজন তাদের দৃষ্টিতে মারইয়ামের ছেলে ঈসা(আ.)। এভাবে হযরত ঈসা যে তাওহীদের বাণী নিয়ে এলেন, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলাে। তিনি জনগণকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেয়া ও এককভাবে তার এবাদাত করার যে আহ্বান জানালেন, তা বৃথা হয়ে গেলাে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতপর তাদের ভেতর থেকে বিভিন্ন দল বিভিন্ন মতাে অবলম্বন করলাে।…'(আয়াত ৬৫)
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# ইতিপূর্বে এ সূরার ৪৫ আয়াতে বলা হয়েছে “তোমাদের পূর্বে যে রসূলগণ অতিক্রান্ত হয়েছেন তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো আমি বন্দেগী করার জন্য রহমান আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য মনোনীত করেছি কিনা?” মক্কাবাসীদের সামনে যখন এ বক্তব্য পেশ করা হচ্ছিলো তখন এক ব্যক্তি হাদীসসমূহে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে আবদুল্লাহ ইবনুয যিবা’রা আপত্তি উথাপন করে বললোঃ “কেন খৃস্টানরা মারয়ামের পুত্র ঈসাকে খোদার পুত্র মনে করে তার ইবাদাত করে কিনা? তাহলে আমাদের উপাস্যের দোষ কি? ” এতে কাফেরদের সমাবেশে হাসির রোল পড়ে গেল এবং শ্লোগান শুরু হলো, এবার আচ্ছা মত জব্দ হয়েছে, ঠিকমত ধরা হয়েছে। এখন এর জবাব দাও। কিন্তু তাদের এই বাচালতার কারণে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন না করে প্রথমে তা পূর্ণ করা হয়েছে এবং তারপর আপত্তিকারীর প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। (প্রকাশ থাকে যে, তাফসীর গ্রন্থসমূহে এ ঘটনা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করা হয়েছে। ঐ সব সূত্র সম্পর্কে অনেক মতভেদ আছে। কিন্তু আয়াতটির পূর্বাপর প্রসঙ্গ এবং ঐসব বর্ণনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার পর আমরা ওপরে যা বর্ণনা করেছি সেটিই আমাদের মতে ঘটনার সঠিক রূপ বলে প্রতিভাত হয়েছে)।
# অসীম ক্ষমতার নমুনা বানানোর অর্থ হযরত ঈসাকে বিনা বাপে সৃষ্টি করা এবং তাঁকে এমন মু’জিযা দান করা যা না তাঁর পূর্বে কাউকে দেয়া হয়েছিলো না পরে। তিনি মাটি দিয়ে পাখি তৈরি করে তাতে ফুঁ দিতেন আর অমনি তা জীবন্ত পাখি হয়ে যেতো। তিনি জন্মান্ধকে দৃষ্টিশক্তি দান করতেন এবং কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতেন। এমনকি মৃত মানুষকে পর্যন্ত জীবিত করতেন। আল্লাহর বাণীর তাৎপর্য হচ্ছে, শুধু অসাধারণ জন্ম এবং এসব বড় বড় মু’জিযার কারণে তাঁকে আল্লাহর দাসত্বের ঊর্ধ্বে মনে করা এবং আল্লাহর পুত্র বলে আখ্যায়িত করে তাঁর উপাসনা করা নিতান্তই ভ্রান্তি। একজন বান্দা হওয়ার চেয়ে অধিক কোন মর্যাদা তাঁর ছিল না। আমি তাকে আমার নিয়ামতসমূহ দিয়ে অভিসিক্ত করে আমার অসীম ক্ষমতার নমুনা বানিয়ে দিয়েছিলাম। (বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ইমরান, টীকা ৪২ থেকে ৪৪ ; আন নিসা, ১৯০ ; আল মায়েদা, টীকা ৪০ , ৪৬ ও ১২৭ ; মারয়াম, টীকা ১৫ থেকে ২২ ; আল আম্বিয়া, টীকা ৮৮ থেকে ৯০ ; আল মু’মিনূন, টীকা ৪৩ )।
# আরেকটি অনুবাদ হতে পারে তোমাদের কোন কোন লোককে ফেরেশতা বানিয়ে দেবো।
# এ আয়াতাংশের অনুবাদ এও হতে পারে যে তিনি কিয়ামত সম্পর্কে জ্ঞানের একটি মাধ্যম। এখানে এই মর্মে একটি প্রশ্ন দেখা দেয় যে, ‘সে’ শব্দ দ্বারা কি জিনিস বুঝানো হয়েছে? হযরত হাসান বাসারী এবং সাঈদ ইবনে জুবায়েরের মতে এর অর্থ ‘কুরআন মজীদ’। অর্থাৎ কিয়ামত আসবে কুরআন মজীদ থেকে মানুষ তা জানতে পারে। কিন্তু এ ব্যাখ্যা পূর্বাপর প্রসঙ্গের সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন। কথার মধ্যে এমন কোন ইঙ্গিত বর্তমান নেই যার ভিত্তিতে বলা যাবে যে এখানে কুরআনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অন্য সব তাফসীরকারগণ প্রায় সর্বসম্মতভাবে এ মত পোষণ করেন যে, এর অর্থ হযরত ঈসা ইবনে মারয়াম এবং পূর্বাপর প্রসঙ্গের মধ্যে এটাই সঠিক। এরপর প্রশ্ন আসে, তাঁকে কোন অর্থে কিয়ামতের নিদর্শন অথবা কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞানের মাধ্যম বলা হয়েছে? ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, ইকরিমা, কাতাদা, সুদ্দী, দাহহাক, আবুল আলিয়া ও আবু মালেক বলেন, এর অর্থ হয়রত ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় আগমন, যে সম্পর্কে বহু হাদীসে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তিনি দ্বিতীয় বার যখন পৃথিবীতে আগমন করবেন তখন বুঝা যাবে কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে। কিন্তু এসব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মহাসম্মান সত্ত্বেও একথা মেনে নেয়া কঠিন যে, এ আয়াতে হযরত ঈসার পুনরাগমনকে কিয়ামতের নিদর্শন অথবা সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভের মাধ্যম বলা হয়েছে। কেননা, পরের বাক্যই এ অর্থ গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধক। তাঁর পুনরাগমন কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞানের মাধ্যমে শুধু তাদের জন্য হতে পারে যারা সেই যুগে বর্তমান থাকবে অথবা সেই যুগের পরে জন্ম লাভ করবে। মক্কার কাফেরদের জন্য তিনি কিভাবে কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞানের মাধ্যম হতে পারেন যার কারণে তাদেরকে সম্বোধন করে একথা বলা সঠিক হবে যে, ‘অতএব তোমরা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করো না’। অতএব, অন্য কয়েকজন মুফাসসির এ আয়াতের যে ব্যাখ্যা পেশ করেছেন আমাদের মতে সেটিই সঠিক ব্যাখ্যা। তাঁদের মতে এখানে হযরত ঈসার বিনা বাপে জন্ম লাভ, মাটি দিয়ে জীবন্ত পাখি তৈরী করা এবং মৃতকে জীবিত করাকে কিয়ামতের সম্ভাবনার একটি প্রমাণ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহর বাণীর তাৎপর্য এই যে, যে আল্লাহ বিনা বাপে সন্তান সৃষ্টি করতে পারেন এবং যে আল্লাহর এক বান্দা মাটির একটি কাঠামোর মধ্যে জীবন সঞ্চার করতে ও মৃতদের জীবিত করতে পারেন তিনি মৃত্যুর পর তোমাদের ও সমস্ত মানুষকে পুনরায় জীবিত করবেন তা তোমরা অসম্ভব মনে করো কেন?
# কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা থেকে যেন বিরত না রাখে।
# ঈসা আলাইহিস সালাম একথা কখনো বলেননি যে, আমি আল্লাহ অথবা আল্লাহর পুত্র। তোমরা আমার উপাসনা করো। অন্য সব নবী-রসূল যে দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং এখন মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের যে দাওয়াত দিচ্ছেন তাঁর দাওয়াত তাই ছিল। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ইমরান, টীকা ৪৫ থেকে ৪৮ ; আন নিসা, টীকা ২১৩ , ২১৭ ও ২১৮ ; আল মায়েদা, টীকা ১০০ , ১৩০ ; মারয়াম, টীকা ২১ থেকে ২৩ )।
# একটি গোষ্ঠী তাঁকে অস্বীকার করে বিরোধিতায় এতদূর অগ্রসর হলো যে, তাঁর প্রতি অবৈধভাবে জন্মলাভ করার অপবাদ আরোপ করলো এবং নিজেদের ধারণায় তাঁকে শূলি বিদ্ধ করে তবেই ক্ষান্ত হলো। আরেকটি গোষ্ঠী তাঁকে মেনে নিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে লাগামহীন বাড়াবাড়ি করে তাঁকে আল্লাহ বানিয়ে ছাড়লো এবং একজন মানুষের আল্লাহ হওয়ার বিষয়টি তাদের জন্য এমন জটিলতা সৃষ্টি করলো যার সমাধান করতে করতে তাদের মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট দলের সৃষ্টি হলো। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নিসা, টীকা ২১১ থেকে ২১৬ ; আল মায়েদা, টীকা ৩৯ , ৪০ , ১০১ ও ১৩০ )।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৫৭-৬৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
‘ঈসা (আঃ) সম্পর্কে মক্কার কুরাইশদের যেমন ধ্যান-ধারণা ছিল সে সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। তারা ‘ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কোন উপমা শুনলে হট্টগোল করত এবং বলত : আমাদের দেবতাগুলো শ্রেষ্ঠ, না ঈসা? তারা তর্ক-বিতর্ক, বাক-বিতণ্ডা করার জন্যই এরূপ কথা-বার্তা বলত। তাদের এ কথার উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : সে কোন প্রভু বা উপাস্য নয় যে, তোমরা তাকে দেবতার সাথে তুলনা করছ, সে শুধুমাত্র আমার একজন বান্দা যার প্রতি আমি নবুওয়াত দান করার মাধ্যমে অনুগ্রহ করেছি মাত্র। সে আমার একজন বান্দা ব্যতীত আর কিছুই নয়। ঈসা (আঃ)-এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহের বর্ণনা সূরা মায়িদার ১১০ নম্বর আয়াতেও বর্ণিত হয়েছে। ধর্মীয় ব্যাপারে এরূপ বাক-বিতন্ডা করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে।
আবূ উসামা (রাঃ) বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের কাছে বের হলেন, এমন সময় তারা কুরআন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব রাগ করলেন এমনকি মনে হল যেন তাঁর চেহারায় সিরকা ঢেলে দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন : তোমরা কুরআনের এক অংশ দ্বারা অন্য অংশের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করো না। কারণ যারা এরূপ বাগ-বিতন্ডা করেছে তারাই পথভ্রষ্ট হয়েছে। (তিরমিযী হা. ৩২৫৩, সহীহ)
এসব আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে তিন ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রথম বর্ণনা হল- ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরাইশদেরকে বললেন : হে কুরাইশগণ! আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যারই ইবাদত করা হয় তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। কুরাইশরা বলল : আপনি কি মনে করেন না ঈসা (আঃ) একজন নাবী ও সৎ বান্দা ছিলেন। আপনার যদি এ বিশ্বাস থাকে তাহলে জেনে নিন তিনি তো আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের ইবাদত করতেন। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ৩২০৮)
দ্বিতীয় বর্ণনা হল- আব্দুল্লাহ বিন যিবা’রা নামক এক ব্যক্তিকে কুরাইশরা বলল : তুমি কি শুনছ মুহাম্মাদ বলেন :
(إِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ ط أَنْتُمْ لَهَا وَارِدُوْنَ)
তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদত কর সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে। (সূরা আম্বিয়া ২১ : ৯৮) তখন সে ব্যক্তি বলল, আমি যদি উপস্থিত থাকতাম তাহলে তার জবাব দিতাম। তারা বলল কী জবাব দিতে? সে ব্যক্তি বলল, আমি বলতাম- খ্রিস্টানরা ঈসা (আঃ)-এর ইবাদত করে আর ইয়াহূদীরা উজাইর এর ইবাদত করে। তাহলে তারা দুজন কি জাহান্নামের ইন্ধন? তার কথা শুনে কুরাইশরা খুবই আনন্দিত হল। এর জবাবে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করলেন :
(إِنَّ الَّذِيْنَ سَبَقَتْ لَهُمْ مِّنَّا الْحُسْنٰٓي لا أُولٰ۬ئِكَ عَنْهَا مُبْعَدُوْنَ)
“যাদের জন্য আমার নিকট হতে পূর্ব হতে কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদেরকে তা হতে দূরে রাখা হবে।” (সূরা আম্বিয়া ২১ : ১০১)
তৃতীয় বর্ণনা হল- কাতাদাহ বলেন : একদা মক্কার মুশরিকরা প্রচার করতে লাগল, মুহাম্মাদ চায় তার ইবাদত করা হোক যেমন ঈসা (আঃ)-এর জাতি ঈসা (আঃ)-এর ইবাদত করে। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (কুরতুবী)
(وَلَوْ نَشَا۬ئُ لَجَعَلْنَا مِنْکُمْ مَّلٰ۬ئِکَةً فِی الْاَرْضِ یَخْلُفُوْنَﮋ)
“আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের পরিবর্তে ফেরেশতাদেরকে জমিনে প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করতাম, তারা জমিনে বসবাস করত” এবং তাদের কাছে ফেরেশতা রাসূল প্রেরণ করতাম। কিন্তু তোমারা তো মানুষ, তোমাদের কাছে ফেরেশতা রাসূল হিসেবে প্রেরণ করলে তা সঙ্গতিপূর্ণ হবে না। সুতরাং তোমাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার রহমত যে, তিনি তোমাদের মতই মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন যাতে তিনি তোমাদের সকল সমস্যা ও দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারেন।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‘ঈসা সে তো হলো কিয়ামতের একটি নিদর্শন। অর্থাৎ- কিয়ামত পূর্ব মুহূর্তে ‘ঈসা (আঃ)-কে পৃথিবীতে পুনরায় প্রেরণ করা হবে আর তার পরপরই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এতে কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় নেই।
এ আয়াতের অন্য একটি কিরাত (তেলাওয়াত পদ্ধতি) ব্যাপারটিকে শক্তিশালী করে, যেমন :
وَإِنَّهُ لَعَلَمٌ لِّلسَّاعَةِ
আইন অক্ষরে ও লাম অক্ষরে যবর দিয়ে। অর্থাৎ ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ কিয়ামতের একটি বিশেষ আলামত। এ কিরাত ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ ও অন্যান্য মুফাসসিরদের থেকে বর্ণিত।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত এ আয়াতের তাফসীরে বলেন : এটা কিয়ামত দিবসের পূর্বে ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ। (মুসনাদে আহমাদ হা. ২৯২১,সহীহ)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) কে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন : আল হামদুল্লিাহ, ঈসা (আঃ) জীবিত। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত- তোমাদের মাঝে ঈসা (আঃ) অবতরণ করবেন একজন ন্যায়পরায়ণ বিচারক ও ইমাম হিসেবে। তিনি শূলী ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং জিযিয়া তুলে ফেলবেন (তাফসীরে মানার ৩/৩১৭.) ঈসা (আঃ) কর্তৃক স্বজাতির কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আসা ও এক আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহ্বান করার পরেও জাতির লোকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেল এবং মতানৈক্য করল।
(فَاخْتَلَفَ الْأَحْزَابُ)
এখানে খ্রিস্টানদেরই বিভিন্ন দলকে বুঝানো হয়েছে। এরা আপোষে ‘ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী মত পোষণ করে। একদল তাঁকে আল্লাহর পুত্র, অন্যদল তাঁকে আল্লাহ ও তিনের মধ্যে একজন মনে করল আর একদল তাঁকে মুসলিমদের মতো আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল হিসেবে গ্রহণ করল। যারা রাসূল হিসেবে গ্রহণ না করে অন্য মত অবলম্বন করেছে তারাই জালিম। তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। (তাফসীরে মুয়াসসার, তাফসীর অত্র আয়াত)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. ‘ঈসা (আঃ)-এর পুনঃআগমন কিয়ামতের একটি নিদর্শন।
২. ‘ঈসা (আঃ) হলেন শুধুমাত্র আল্লাহর একজন বান্দা ও রাসূল মাত্র, এর বেশি কিছু নন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো ‘ইবাদত করা যাবে না। একমাত্র তাঁরই ‘ইবাদত করতে হবে। কেননা তিনি ব্যতীত সঠিক কোন মা‘বূদ নেই।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫৭-৬৫ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ) এবং হযরত যহ্হাক (রঃ) বলেন যে, (আরবী)-এর অর্থ হলোঃ “তারা হাসতে লাগলো।’ অর্থাৎ এতে তারা বিস্ময়বোধ করলো। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ “তারা হতবুদ্ধি হলো এবং হাসতে লাগলো। ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ “তারা মুখ ফিরিয়ে নিলো।’ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ) তাঁর ‘সীরাত গ্রন্থে এর যে কারণ বর্ণনা করেছেন তা এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা প্রমুখ কুরায়েশদের নিকট আগমন করেন। সেখানে নযর ইবনে হারিসও এসে পড়ে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে কথাবার্তা বলতে শুরু করে। সে যুক্তি-তর্কে টিকতে না পেরে লা-জবাব বা নিরুত্তর হয়ে যায়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরআন কারীমের নিম্নের আয়াতটি পাঠ করে শুনিয়ে দেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই তোমরা ও তোমাদের মা’বৃদরা জাহান্নামের ইন্ধন হবে।”(২১:৯৮) তারপর তিনি সেখান হতে চলে আসেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে আবদুল্লাহ ইবনে যাবআলী তামীমী আগমন করে। তখন ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা তাকে বলেঃ “নযর ইবনে হারিস তো আবদুল মুত্তালিবের সন্তানের (পৌত্রের) নিকট হেরে গেছে। শেষ পর্যন্ত সে তো আমাদেরকে ও আমাদের মা’বূদদেরকে জাহান্নামের ইন্ধন বলে দিয়ে চলে গেল।” সে তখন বললোঃ “আমি থাকলে সে নিজেই নিরুত্তর হয়ে যেতো। যাও, তোমরা গিয়ে তাকে প্রশ্ন করঃ আমরা এবং আমাদের সমস্ত মা’রূদ যখন জাহান্নামী তখন এটা অপরিহার্য যে, ফেরেশতারা, হযরত উযায়ের (আঃ) এবং ঈসা (আঃ)ও জাহান্নামী হবেন? কেননা, আমরা ফেরেশতাদের উপাসনা করে থাকি, ইয়াহূদীরা হযরত উযায়ের (আঃ)-এর উপাসনা করে এবং খৃষ্টানরা হযরত ঈসা (আঃ)-এর ইবাদত করে?” তার একথা শুনে মজলিসের লোকেরা সবাই খুব খুশী হলো এবং বললো যে, এটাই সঠিক কথা। নবী (সঃ)-এর কানে যখন এ সংবাদ পৌঁছলো তখন তিনি বললেনঃ “প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি, যে গায়রুল্লাহর ইবাদত করে এবং প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে খুশী মনে নিজেদের ইবাদত করিয়ে নেয়, এরূপ উপাসক ও উপাস্য উভয়েই জাহান্নামী। ফেরেশতারা এবং নবীরা (আঃ) না নিজেদের ইবাদত করার জন্যে কাউকেও নির্দেশ দিয়েছেন, না তারা তাতে সন্তুষ্ট। তাদের নামে আসলে এরা শয়তানের উপাসনা করে। সেই তাদেরকে শিরকের হুকুম দিয়ে থাকে। আর তারা তার সেই হুকুম পালন করে।” তখন …. (আরবী)-এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ হযরত ঈসা (আঃ), হযরত উযায়ের (আঃ) এবং এঁদের ছাড়া অন্যান্য যেসব আলেম ও ধর্ম যাজকদের এরা উপাসনা করে, যারা নিজেরা আল্লাহর আনুগত্যের উপর কায়েম ছিলেন এবং শিরকের প্রতি অসন্তুষ্ট ও তা হতে বাধাদানকারী ছিলেন, তাঁদের মৃত্যুর পরে এই পথভ্রষ্ট অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে মা’বুদ বানিয়ে নেয়, তারা সম্পূর্ণরূপে নিরপরাধ ।
আর ফেরেশতাদেরকে যে মুশরিকরা আল্লাহর কন্যা বিশ্বাস করে নিয়ে তাদের উপাসনা করতো তা খণ্ডন করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা বলে যে, দয়াময় (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন, অথচ তিনি। তা হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র, বরং তারা (ফেরেশতারা) তো তার সম্মানিত বান্দা।”(২১:২৬) এর দ্বারা তাদের এই বাতিল আকীদাকে খণ্ডন করা হয়। আর হযরত ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “যখন মরিয়ম (আঃ)-এর পুত্রের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়, তখন তোমার সম্প্রদায় শশারগোল শুরু করে দেয়। এরপর মহান আল্লাহ হযরত ঈসা (আঃ)-এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ “সে তো ছিল আমারই এক বান্দা যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং করেছিলাম বানী ইসরাঈলের জন্যে দৃষ্টান্ত। আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের মধ্য হতে ফেরেশতা সৃষ্টি করতে পারতাম, যারা পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী হতো। ঈসা (আঃ) তো কিয়ামতের নিদর্শন।” অর্থাৎ হযরত ঈসা (আঃ)-এর মাধ্যমে আমি যেসব মু’জিয়া দুনিয়াবাসীকে দেখিয়েছি, যেমন মৃতকে জীবিত করা, কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করা ইত্যাদি, এগুলো কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দলীল হিসেবে যথেষ্ট। সুতরাং তোমরা কিয়ামতে সন্দেহ পোষণ করো না এবং আমাকেই অনুসরণ কর। এটাই সরল পথ।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে তাদের মা’ৰূদদের জাহান্নামী হওয়ার কথা শুনে তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ “ইবনে মরিয়ম (আঃ) সম্পর্কে আপনি কি বলেন?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।” তারা কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে বললো, “আল্লাহর শপথ! এ ব্যক্তি তো শুধু এটাই চায় যে, আমরা যেন তাকে প্রভু বানিয়ে নিই যেমন খৃষ্টানরা হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ)-কে প্রভু বানিয়ে নিয়েছিল। তখন আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “এরা তো শুধু বাক-বিতণ্ডার উদ্দেশ্যেই তোমাকে একথা বলে।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) একদা বলেনঃ “কুরআন কারীমের মধ্যে এমন একটি আয়াত রয়েছে যার তাফসীর কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি। আমি জানি না যে, সবাই কি এর তাফসীর জানে, না না জেনেও জানার চেষ্টা করে না?” তারপর তিনি মজলিসে অন্য কিছুর বর্ণনা দিতে থাকলেন, অবশেষে মজলিস শেষ হয়ে গেল এবং তিনি উঠে চলে গেলেন। তার সঙ্গীগণ তাঁকে আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ না করার জন্যে খুব আফসোস করতে লাগলেন। তখন ইবনে আকীল আনসারী (রাঃ)-এর মাওলা আবু ইয়াহইয়া (রঃ) বললেনঃ “আচ্ছা, আগামী কাল সকালে তিনি আগমন করলে আমি তাকে আয়াতটির তাফসীর জিজ্ঞেস করবো।” পরদিন তিনি আগমন করলে হযরত আবু ইয়াহইয়া (রাঃ) পূর্ব দিনের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ঐ আয়াতটি কি?” উত্তরে তিনি বললেন, শুনো, কুরায়েশদেরকে একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করেন:“কেউ এমন নেই, আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করা যেতে পারে এবং তাতে কল্যাণ থাকতে পারে।” তখন কুরায়েশরা বললোঃ “খৃষ্টানরা কি হযরত ঈসা (আঃ)-এর ইবাদত করে না? আপনি কি হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর নবী এবং তার মনোনীত বান্দা মনে করেন না? তাহলে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই একথা বলার অর্থ কি হতে পারে?” তখন … (আরবী)-এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ “যখন হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ)-এর বর্ণনা আসলো তখন এ লোকগুলো হাসতে শুরু করলো।” আর ঈসা (আঃ) কিয়ামতের নিদর্শন’ এর ভাবার্থ এই যে, হযরত ঈসা (আঃ) কিয়ামতের পূর্বে বের হয়ে আসবেন।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং এ রিওয়াইয়াতটি পরবর্তী বাক্যটি ছাড়া ইমাম ইবনে আবি হাতিমও (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, আমাদের দেবতাগুলো ভাল, না এই ব্যক্তি? তাদের এই উক্তির ভাবার্থ হচ্ছেঃ আমাদের মা’বুদ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) হতে উত্তম।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবী) রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ এরা শুধু বাক-বিতণ্ডার উদ্দেশ্যেই তোমাকে একথা বলে। অর্থাৎ তাদের এটা বিনা দলীল-প্রমাণে ঝগড়া। মিথ্যার উপরই তারা তর্ক-বিতর্ক করছে। তারা নিজেরাও জানে যে, তারা যেটা বলছে ভাবার্থ সেটা নয় এবং তাদের প্রতিবাদ ও আপত্তি নিরর্থক। কেননা, প্রথমতঃ আয়াতে (আরবী) শব্দ রয়েছে, যা জ্ঞান-বিবেকহীনের জন্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর দ্বিতীয়তঃ আয়াতে কুরায়েশদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে যারা মূর্তি, প্রতিমা, পাথর ইত্যাদির পূজা করতো। তারা হযরত ঈসা (আঃ)-এর পূজারী ছিল না। সুতরাং নবী (সঃ)-কে তারা শুধু বাক-বিতণ্ডার উদ্দেশ্যেই এ কথা বলে। অর্থাৎ তারা যে কথা বলে সেটা যে বাকপটুত্ব শূন্য তা তারা নিজেরাও জানে।
হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কোন কওম হিদায়াতের উপর থাকার পর কখনো পথভ্রষ্ট হয় না যে পর্যন্ত না তাদের মধ্যে দলীল-প্রমাণ ছাড়াই বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়ার রীতি চলে আসে।” অতঃপর তিনি (আরবী)-এ আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম ইবনে জারীর (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)
মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে এ হাদীসেরই শুরুতে রয়েছেঃ “নবীর আগমনের পর কোন উম্মত পথভ্রষ্ট হয়নি, কিন্তু তাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার প্রথম কারণ হলো তকদীরকে অবিশ্বাস করা। আর নবীর আগমনের পর কোন কওম পথভ্রষ্ট হয়নি, কিন্তু তখনই পথভ্রষ্ট হয়েছে যখন তাদের মধ্যে কোন দলীল-প্রমাণ ছাড়াই বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়ে পড়ার রীতি চালু হয়েছে।”
হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার সাহাবীদের মধ্যে এমন সময় আগমন করেন যখন তারা কুরআন কারীমের আয়াতগুলো নিয়ে পরস্পর তর্ক-বিতর্ক করছিলেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের উপর ভীষণ রাগান্বিত হন। অতঃপর তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “তোমরা এভাবে আল্লাহর কিতাবের আয়াতগুলোর একটির সাথে অপরটির টক্কর লাগিয়ে দিয়ো না। জেনে রেখো যে, এই পারস্পরিক বাক-বিতণ্ডার অভ্যাসই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল।” অতঃপর তিনি (আরবী)-এই আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ ঈসা (আঃ) তো ছিল আমারই এক বান্দা যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং তাকে আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন বানিয়ে বানী ইসরাঈলের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। যেন তারা জানতে পারে যে, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাই করার তিনি ক্ষমতা রাখেন।
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের মধ্য হতে ফেরেশতা সৃষ্টি করতে পারতাম, যারা পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী হতো।
কিংবা এর অর্থ হচ্ছেঃ যেমনভাবে তোমরা একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছ তেমনিভাবে তাদেরকেও করে দিতাম। দুই অবস্থাতেই ভাবার্থ একই।
মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ তোমাদের পরিবর্তে তাদের দ্বারা দুনিয়া আবাদ করতাম।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “ঈসা (আঃ) তো কিয়ামতের নিদর্শন।’ এর ভাবার্থ ইবনে ইসহাক (রঃ) যা বর্ণনা করেছেন তা কিছুই নয়। আর এর চেয়েও বেশী দূরের কথা হচ্ছে ওটা যা কাতাদা (রঃ), হাসান বসরী (রঃ) এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেছেন। তা এই যে, (আরবী) সর্বনামটি ফিরেছে কুরআনের দিকে। এই দু’টি উক্তিই ভুল। বরং সঠিক কথা এই যে, (আরবী) সর্বনামটি ফিরেছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর দিকে অর্থাৎ হযরত ঈসা (আঃ) কিয়ামতের একটি নিদর্শন। কেননা, উপর হতে তারই আলোচনা চলে আসছে। আর এটা স্পষ্ট কথা যে, এখানে হযরত ঈসা (আঃ)-এর কিয়ামতের পূর্বে নাযিল হওয়াকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তার মৃত্যুর পূর্বে (হযরত ঈসা আঃ-এর মৃত্যুর পূর্বে) প্রত্যেক আহলে কিতাব তার উপর ঈমান আনবে। তারপর কিয়ামতের দিন সে তাদের উপর সাক্ষী হবে।”(৪:১৫৯)।
এই ভাবার্থ পূর্ণভাবে প্রকাশ পায় এই আয়াতেরই দ্বিতীয় পঠনে, যাতে রয়েছে (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই সে (হযরত ঈসা আঃ) কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আলামত বা লক্ষণ।”
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা হলো কিয়ামতের লক্ষণ, অর্থাৎ হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ)-এর কিয়ামতের পূর্বে আগমন। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও এরূপই বর্ণিত হয়েছে। আবুল আলিয়া (রঃ), আৰূ মালিক (রঃ), ইকরামা (রাঃ), হাসান (রঃ), কাতাদা (রঃ) যহহাক (রঃ) প্রমুখ গুরুজন হতেও অনুরূপই বর্ণিত আছে।
মুতাওয়াতির হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) খবর দিয়েছেন যে, কিয়ামতের দিনের পূর্বে হযরত ঈসা (আঃ) ন্যায়পরায়ণ ইমাম ও ইনসাফকারী হাকিম রূপে অবতীর্ণ হবেন। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা কিয়ামতে সন্দেহ পোষণ করো না, বরং এটাকে নিশ্চিত রূপে বিশ্বাস কর এবং আমি তোমাদেরকে যে খবর দিচ্ছি তাতে তোমরা আমার অনুসরণ কর, এটাই সরল পথ। শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই আমার এই সরল সঠিক পথ হতে নিবৃত্ত না করে। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
হযরত ঈসা (আঃ) স্বীয় কওমকে বলেছিলেনঃ হে আমার কওম! আমি তোমাদের নিকট এসেছি হিকমত অর্থাৎ নবুওয়াত নিয়ে এবং দ্বীনী বিষয়ে তোমরা যে মতভেদ করছো তা স্পষ্ট করে দিবার জন্যে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাই বলেন। এই উক্তিটিই উত্তম ও পাকাপোক্ত। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ঐ লোকদের উক্তিকে খণ্ডন করেছেন যারা বলেন যে, (আরবী) (কতক) শব্দটি এখানে (আরবী) (সমস্ত) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন যে, হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর কওমকে আরো বলেনঃ “সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমারই অনুসরণ কর। আল্লাহই তো আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। মনে রেখো যে, তোমরা সবাই এবং আমি নিজেও তার গোলাম এবং তাঁর মুখাপেক্ষী। আমরা তার দরবার ফকীর। সুতরাং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা আমাদের সবারই একান্ত কর্তব্য। তিনি এক ও অংশী বিহীন। এটাই হলো তাওহীদের পথ, এটাই সরল সঠিক পথ।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “অতঃপর তাদের কতিপয় দল মতানৈক্য সৃষ্টি করলো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। কেউ কেউ তো হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলেই স্বীকার করলো এবং এরাই ছিল সত্যপন্থী দল। আবার কেউ কেউ তাঁর সম্পর্কে দাবী করলো যে, তিনি আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ)। আর কেউ কেউ তাকেই আল্লাহ বললো (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা)। আল্লাহ তা’আলা তাদের দুই দাবী হতেই মুক্ত ও পবিত্র। তিনি সর্বোচ্চ, সমুন্নত ও মহান। এ জন্যেই মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ দুর্ভোগ এই যালিমদের জন্যে। কিয়ামতের দিন তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করা হবে।