Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১২৬ )
[** الذين كفروا وصدوا عن سبيل اللها
যারা কুফরী করেছে এবং আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিয়েছে:-
কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা :-
*আল্লাহকে সাহায্য করা বলতে কী বুঝায় : -]
www.motaher21.net
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। পারা:২৬
১-৯ নং আয়াত:-
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -১
اَلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ صَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَضَلَّ اَعۡمَالَہُمۡ ﴿۱﴾
যারা কুফরী করেছে এবং আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিয়েছে আল্লাহ তাদের সমস্ত কাজ-কর্ম ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -২
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ اٰمَنُوۡا بِمَا نُزِّلَ عَلٰی مُحَمَّدٍ وَّ ہُوَ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّہِمۡ ۙ کَفَّرَ عَنۡہُمۡ سَیِّاٰتِہِمۡ وَ اَصۡلَحَ بَالَہُمۡ ﴿۲﴾
আর যারা ঈমান এনেছে নেক কাজ করেছে এবং মুহাম্মদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে৪ তা মেনে নিয়েছে- বস্তুত তা তো তাদের রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অকাট্য সত্য কথা- আল্লাহ তাদের খারাপ কাজগুলো তাদের থেকে দূর করে দিয়েছেন৫ এবং তাদের অবস্থা শুধরে দিয়েছেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -৩
ذٰلِکَ بِاَنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوا اتَّبَعُوا الۡبَاطِلَ وَ اَنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّبَعُوا الۡحَقَّ مِنۡ رَّبِّہِمۡ ؕ کَذٰلِکَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ لِلنَّاسِ اَمۡثَالَہُمۡ ﴿۳﴾
এটা এজন্যে যে, যারা কুফরী করেছে তারা বাতিলের অনুসরণ করেছে এবং যারা ঈমান এনেছে তারা তাদের রবের প্রেরিত সত্যের অনুসরণ করেছে। এভাবে আল্লাহ মানুষের জন্য তাদের দৃষ্টান্তসমূহ উপস্থাপন করেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -৪
فَاِذَا لَقِیۡتُمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَضَرۡبَ الرِّقَابِ ؕ حَتّٰۤی اِذَاۤ اَثۡخَنۡتُمُوۡہُمۡ فَشُدُّوا الۡوَثَاقَ ٭ۙ فَاِمَّا مَنًّۢا بَعۡدُ وَ اِمَّا فِدَآءً حَتّٰی تَضَعَ الۡحَرۡبُ اَوۡزَارَہَا ۬ۚ۟ۛ ذٰؔلِکَ ؕۛ وَ لَوۡ یَشَآءُ اللّٰہُ لَانۡتَصَرَ مِنۡہُمۡ وَ لٰکِنۡ لِّیَبۡلُوَا۠ بَعۡضَکُمۡ بِبَعۡضٍ ؕ وَ الَّذِیۡنَ قُتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ فَلَنۡ یُّضِلَّ اَعۡمَالَہُمۡ ﴿۴﴾
অতএব এসব কাফেরের সাথে যখনই তোমাদের মোকাবিলা হবে তখন প্রথম কাজ হবে তাদেরকে হত্যা করা। এভাবে তোমরা যখন তাদেরকে আচ্ছাতম পর্যুদস্ত করে ফেলবে তখন বেশ শক্ত করে বাঁধো। এরপর (তোমাদের ইখতিয়ার আছে) হয় অনুকম্পা দেখাও, নতুবা মুক্তিপণ গ্রহণ করো যতক্ষণ না যুদ্ধবাজরা অস্ত্র সংবরণ করে। এটা হচ্ছে তোমাদের করণীয় কাজ। আল্লাহ চাইলে নিজেই তাদের সাথে বুঝাপড়া করতেন। কিন্তু (তিনি এ পন্থা গ্রহণ করেছেন এ জন্য) যাতে তোমাদেরকে পরস্পরের দ্বারা পরীক্ষা করেন। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হবে আল্লাহ কখনো তাদের আমলসমূহ ধ্বংস করবেন না।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -৫
سَیَہۡدِیۡہِمۡ وَ یُصۡلِحُ بَالَہُمۡ ۚ﴿۵﴾
তিনি তাদের পথপ্রদর্শন করবেন। তাদের অবস্থা শুধরে দিবেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -৬
وَ یُدۡخِلُہُمُ الۡجَنَّۃَ عَرَّفَہَا لَہُمۡ ﴿۶﴾
এবং তাদেরকে সেই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পরিচয় তিনি তাদেরকে আগেই অবহিত করেছেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -৭
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تَنۡصُرُوا اللّٰہَ یَنۡصُرۡکُمۡ وَ یُثَبِّتۡ اَقۡدَامَکُمۡ ﴿۷﴾
হে মুমিনগণ ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সমূহ সুদৃঢ় করবেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -৮
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَتَعۡسًا لَّہُمۡ وَ اَضَلَّ اَعۡمَالَہُمۡ ﴿۸﴾
যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে শুধু ধ্বংস। আল্লাহ তাদের কাজ-কর্ম পণ্ড করে দিয়েছেন।
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। আয়াত -৯
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ کَرِہُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاَحۡبَطَ اَعۡمَالَہُمۡ ﴿۹﴾
এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করেছে। কাজেই তিনি তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল করে দিয়েছেন।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ। এ সূরার আরেক নাম সূরা আল কিতাল। এই নামটিই সূরার আসল নাম। কারণ এর আলােচ্য বিষয় কিতাল বা যুদ্ধ। যুদ্ধই এর প্রধান উপাদান। যুদ্ধই এর বক্তব্য এবং যুদ্ধই এর মূল সুর। সূরাটির আলােচ্য বিষয় যে যুদ্ধ তা এর সূচনা থেকেই স্পষ্ট। আক্রমণাত্মক ভাষায় কাফেরদের পরিচয় দান এবং সম্মানজনক ভাষায় মােমেনদের পরিচয় দানের মাধ্যমে সূরার শুরুতেই কাফেরদেরকে আল্লাহর দুশমন ও মােমেনদেরকে আল্লাহর বন্ধু হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। এভাবে সূরার শুরু থেকেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর মূল্যায়নে উভয় গােষ্ঠীর এই পরিচয়ই হচ্ছে চিরন্তন ও শাশ্বত। অন্য কথায় বলা চলে যে, সূরার প্রথম শব্দ থেকেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ও ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা কুফরি করেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সমস্ত সৎ কাজগুলােকে বিনষ্ট করে দিয়েছেন। আর যারা ঈমান এনেছে, সৎ কাজ করেছে এবং বিশেষত মােহাম্মদের ওপর যা কিছু নাযিল হয়েছে, তার প্রতি ঈমান এনেছে- কেননা তা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত সত্য, আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল পাপ মােচন করে দিয়েছেন এবং তাদের মনকে পরিশুদ্ধ করে দিয়েছেন। কারণ কাফেররা বাতিলের অনুসারী আর মােমেনরা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত সত্যের অনুসারী। আল্লাহ তায়ালা এভাবেই মানুষের কাছে তাদের অবস্থা বর্ণনা করে থাকেন।(আয়াত ১-৩) কাফেরদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘােষণার পর মােমেনদের দ্ব্যর্থহীনভাবে আদেশ দেয়া হয়েছে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে। এ আদেশ দেয়া হয়েছে অত্যন্ত দৃপ্ত অথচ সুললিত ছন্দময় কণ্ঠে। সেই সাথে রণাঙ্গনে সর্বাত্মক লড়াই ও হত্যাযজ্ঞ চালানাের পর আটক যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে কী করণীয়, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যখন তােমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, তখন তাদেরকে হত্যা করবে। যখন তােমরা তাদেরকে পুরােপুরি পরাভূত করবে, তখন তাদেরকে শক্তভাবে বেঁধে ফেলবে। তারপর হয় তাদেরকে অনুগ্রহ দেখাবে অথবা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেবে, যতক্ষণ না যুদ্ধ বিরতি হয়। এ আদেশ অবশ্যই মেনে চলতে হবে।(আয়াত ৭) এই সাথে কাফেরদেরকে কঠোর হুমকি দেয়া হয়েছে, আর মােমেনদের জন্যে ঘােষিত হয়েছে। আল্লাহর সর্বাত্মক সাহায্য ও অভিভাবকত্বের আশ্বাস। আরাে ঘোষিত হয়েছে যে, কাফেরদেরকে চরম লাঞ্ছনা, ধ্বংস ও অসহায় অবস্থায় নিক্ষেপ করা হবে, তারা কি পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে না? করলে দেখতে পেতাে তাদের পূর্ববর্তী কাফেরদের কী শােচনীয় পরণতি হয়েছে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা বিধ্বস্ত করে ছেড়েছেন। সকল কাফেরের জন্যে অনুরূপ পরিণতিই অপেক্ষা করছে। কারণ আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের অভিভাবক, আর কাফেরদের কোনাে অভিভাবক নেই। অনুরূপভাবে রসূল(স.)-কে যে মক্কা নগরী বহিষ্কার করেছিলাে তাকেও হুমকি দেয়া হয়েছে, নগরী তােমাকে বহিষ্কার করেছিলাে, তার চেয়েও শক্তিশালী অনেক নগরী ছিলো। আমি সেগুলােকে ধ্বংস করে দিয়েছি। সেগুলাে কোনাে সাহায্যকারী ছিলাে না।(আয়াত ১৩) এরপর ঈমান ও কুফরী সম্পর্কে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে কাফেরদের অবস্থা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পর্যালােচনার মধ্য দিয়ে উল্লেখিত হুমকি উচ্চারণের পর আলােচনা সামনে এগিয়ে চলে। মুমিনের পবিত্র হালাল জীবিকা উপভােগ করা ও কাফেরের পশুর মতাে নানারকমের মজাদার খাদ্য খাওয়ার মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য, সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ তায়ালা ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহমান। আর কাফেররা কেবল ভােগ করে এবং পশুর মতাে খাওয়া দাওয়া করে। দোযখই তাদের বাসস্থান।'(আয়াত ১২) তারপর মােমেনরা জান্নাতে যে সকল মজাদার খাদ্য ও পানীয় উপভোগ করবে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলাের মধ্যে রয়েছে খাটি ও নির্মল পানীয়, স্বাদ বিকৃত হয়নি এমন দুধ, মজাদার পানীয় এবং স্বচ্ছ ও নির্মল মধু। আর এসব তারা বহমান নদী খালের আকারে পাবে। সেই সাথে তারা উপভােগ করবে রকমারি ফলমূল এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ক্ষমার ন্যায় মহাদানও। এসব বলার পর জিজ্ঞেস করা হয়েছে, যে সব মােমেন ও সৎকর্মশীল বান্দা এসব নেয়ামত উপভােগ করবে তারা কি দোযখে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থানকারী ও দোযখের গরম পানি খেয়ে নাড়িভুড়ি ছিন্ন হয়ে যাওয়া কাফেরদের মতাে? কাফের ও মােমেনদের সম্পর্কে এই সুস্পষ্ট বিবরণ দেয়ার পর মােনাফেকদের নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এসব মােনাফেক ও ইহুদীরা মদীনায় নবগঠিত ইসলামী সমাজের জন্যে এমন হুমকি হয়ে বিরাজ করছিলাে যে, তা একই সময়ে মক্কায় ও তার আশপাশে অবস্থানকারী মােশরেকদের হুমকির চেয়ে কোনাে অংশেই কম ছিলাে না। সুরায় উল্লেখিত বিভিন্ন ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই সূরার সময়কাল ছিলাে বদর যুদ্ধের পরে ও খন্দক যুদ্ধের আগে যখন ইহুদীদের শক্তি ও প্রতাপ ক্রমে খর্ব ও মােনাফেকদের কেন্দ্র ক্রমে দুর্বল হয়ে আসছিলাে। (সূরা আহযাবে আমি এ বিষয়ে উল্লেখ করেছি।) এ সূরায় মােনাফেকদের সম্পর্কে যা কিছু আলােচনা করা হয়েছে, তাতে প্রথম থেকেই যুদ্ধ ও আক্রমণের দামামা বাজানাে হয়েছে, কাফেররা কিভাবে রাসূল(স.)-এর কথা শােনা এড়িয়ে চলতাে, মােনাফেকরা তাঁর মজলিসে বসেও তার কথা একাগ্রতার সাথে শুনতে ও বুঝতে চেষ্টা করতাে না- তা এ আলােচনায় ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, সবশেষে বলা হয়েছে, তাদের বিপথগামিতা ও কুফরির কারণে তাদের মনের ওপর সিল মেরে দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও আছে যে, তােমার কথা শােনে, কিন্তু তােমার কাছ থেকে বের হয়েই জ্ঞানীজনদেরকে জিজ্ঞেস করে, মােহাম্মদ এই মাত্র কী বললাে? আসলে আল্লাহ তায়ালা তাদের হৃদয়ের ওপর সিল মেরে দিয়েছেন এবং তারা প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে থকে।(আয়াত ১৬) এরপর তাদেরকে কেয়ামতের হুঁশিয়ারী জানানাে হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, সেদিন তাদের সম্বিত ফিরে আসার কোনােই সম্ভাবনা থাকবে না। তবে কি তারা কেয়ামতের অপেক্ষায় রয়েছে যা তাদের কাছে হঠাৎ এসে পড়বে? তার আলামতগুলাে তাে এসেই গেছে। কেয়ামত এসে গেলে তাদের আর উপদেশ গ্রহণের সুযােগ কোথায়? এরপর মােনাফেক ও দুর্বল মােমেনদের সেই কাপুরুষতা ও অস্থিরতার বিবরণ দেয়া হয়েছে, যে দুর্বলতা যুদ্ধের আদেশ দেয়ার সময় কিছু কিছু দেখিয়েছিলাে, ‘মােমেনরা’ বলে থাকে একটা সূরা নাযিল হয় না কেন? কিন্তু যখনই একটা অকাট্য সূরা নাযিল হয় এবং তাতে যুদ্ধের আদেশ দেয়া হয়, অমনি তুমি দেখতে পাও যে, যাদের মনে মােনাফেকীর ব্যাধি রয়েছে, তারা তােমার দিকে মৃত্যুর ভয়ে সংজ্ঞা হারানাে লােকের মতাে তাকায়। এরপর পরবর্তী তিনটি আয়াতে তাদেরকে আল্লাহর অনুগত হওয়া, সত্যাশ্রয়ী হওয়া ও ঈমানের ওপর স্থিতিশীল হওয়ার জন্যে উপদেশ দেয়া হয়েছে, তাদের হীনতা ও নীচতার নিন্দা করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে ও অভিসম্পাত দেয়া হয়েছে, ‘অতএব তাদের জন্যে উত্তম হলাে আনুগত্য ও ভালাে কথা বলা। যখন জেহাদের ফয়সালা করা হয়, তখন তারা যদি আল্লাহর প্রতি ঈমানের সত্যতার প্রমাণ দিতাে, তবে তা তাদের জন্যে কল্যাণকর হতাে। অতএব, তােমরা যদি ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হও, তবে কি তােমাদের পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার সম্ভাবনা রয়েছে আর তােমরা কি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তাদেরকে তাে আল্লাহ তায়ালা অভিসম্পাত দিয়েছেন এবং বধির ও অন্ধ করে দিয়েছেন।(আয়াত ২১-২৩) এরপর তাদের শয়তানের বন্ধুত্ব গ্রহণ ও ইহুদীদের সাথে দহরম মহরম পাতিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবার কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। তারা যে মুসলিম সমাজের সাথে নিজেদেরকে জড়িয়ে রাখে, অথচ তারা সে সমাজের সদস্য নয়। সেই সমাজের সামনে তাদের প্রত্যেককে পৃথক পৃথকভাবে অপমানিত করে দেয়া এবং সেই অপমানিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করানাের হুমকিও দেয়া হয়েছে। এই সমাজে বসবাস করেও তারা শুধু যে সেই সমাজের সদস্য নয়, তাই নয় বরং তারা সেই সমাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তেও লিপ্ত। একথাই বলা হয়েছে ২৫ থেকে ৩১ নং আয়াতে, নিশ্চয় যারা নিজেদের কাছে সত্য পথ পরিষ্কার হওয়ার পরও তা থেকে পিছিয়ে যায়, শয়তান তাদের এ কাজকে শােভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। তৃতীয় ও শেষ পর্বে কোরায়শ বংশীয় কাফের ও ইহুদীদের প্রসংগ পুনরায় আলােচিত হয়েছে এবং এই দুই গােষ্ঠীর কঠোর নিন্দা করা হয়েছে, ‘সত্য পথের সন্ধান পাওয়ার পর যারা কুফরী করেছে, অন্যদেরকে সত্য দ্বীন গ্রহণে বাধা দিয়েছে এবং রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে, তারা আল্লাহর কোনাে ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি তাদের সকর্মগুলােকে অচিরেই বাতিল করে দেবেন। এ পর্বে মােমেনদেরকেও সতর্ক করা হয়েছে যে, তাদের (ভুলভ্রান্তির কারণে) তাদের ওপরও যেন তাদের শত্রুদের ওপরে আপতিত শাস্তির মতাে কোনাে শান্তি নেমে না আসে। বলা হয়েছে, হে মােমেনরা, তােমরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করাে এবং তােমাদের কৃত সৎকর্মগুলােকে নষ্ট করাে না। সেই সাথে অমুসলিমদের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের মুখে নিজেদের ঈমানের দৃঢ়তা বহাল রাখার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তােমরা ভগ্ন হৃদয় হয়াে না। গায়ে পড়ে কাফেরদের সাথে আপােষ করতে যেওনা। কেননা শেষপর্যন্ত তােমরাই বিজয়ী হবে এবং আল্লাহ তায়ালা তােমাদের সাথেই রয়েছেন। আর আল্লাহ তায়ালা কখনােই তােমানের সৎকর্মগুলােকে নষ্ট করবেন না।’ এই অংশে আরাে একটা বিষয় আলােচিত হয়েছে এবং তা হচ্ছে, দুনিয়ার জীবন আখেরাতের তুলনায় খুবই তুচ্ছ এবং দুনিয়ার ওপর সব সময় আখেরাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে দুনিয়ার সকল সহায় সম্পদকে বর্জন করতে হবে সে কথা বলা হয়নি। কেননা আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং তিনি যদি তাদেরকে আল্লাহর পথে আরাে বেশী সম্পদ ব্যয় করতে পীড়াপীড়ি করেন, তাহলে তারা মনে কতাে সংকীর্ণতা ও কষ্ট অনুভব করবে, তা তিনি ভালাে করেই জানেন। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন, দুনিয়ার জীবন খেলাধুলা ছাড়া আর কিছু নয়। তােমরা যদি ঈমান আনাে ও তাকওয়া অবলম্বন করো, তবে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে তােমাদের প্রতিদান দেবেন এবং তােমাদের ধন সম্পদ চাইবেন না। তিনি যদি তােমাদের সম্পদ চেয়ে পীড়াপীড়ি করেন, তাহলে তােমরা কার্পণ্য করবে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের হিংসা বিদ্বেষ প্রকাশ করে দেবেন। সূরার শেষ আয়াতে এই বলে মুসলমানদেরকে হুমকি দেয়া হয়েছে যে, তারা যদি আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয়ে কার্পণ্য করে, তিনি তাদের জায়গায় অন্য কোনাে জাতির উতথান ঘটাবেন ‘তােমাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহ্বান জানানাে হচ্ছে। কিন্তু তােমাদের অনেকেই কার্পণ্য করে। যে ব্যক্তি কার্পণ্য করে, সে নিজের ক্ষতি সাধনের জন্যেই কার্পণ্য করে। আল্লাহ তায়ালা ধনী, তােমরা দরিদ্র। তােমরা যদি ব্যয় করতে না চাও, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের পরিবর্তে অন্য কোনাে জাতিকে নিয়ে আসবেন। তারা তােমাদের মতাে হবে না।’ এভাবে সূরার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক নাগাড়ে কেবল যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। এর সর্বত্রই যুদ্ধের পরিবেশ, ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। এর প্রত্যেকটা আয়াতেই বলতে গেলে যুদ্ধের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। সূরার শুরু থেকেই প্রত্যেকটা আয়াতের শেষে এমনভাবে শব্দ চয়ন করা হয়েছে যেন প্রত্যেকটাই এক একটা ভারী ক্ষেপণাস্ত্র । যেমন- আ’মালাহুম, বালাহুম, আমছালাহুম, আহওয়াআহুম, আখবারাকুম। এমনকি আয়াত শেষের যে শব্দগুলো অপেক্ষাকৃত হালকা, সেগুলােও শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা তরবারীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন, আওয়ারাহা, আমছালাহা ইত্যাদি। তাছাড়া এখানে শব্দের ঝংকারে যে ধরনের কঠোরতা রয়েছে, শব্দ দ্বারা যে চিত্র অংকন করা হয়েছে, তাহলাে, ‘তোমরা যখন কাফেরদের মােকাবেলায় আসবে তখন তাদের গর্দানে মারবে। আর হত্যা ও গ্রেফতারীকেও ভয়াবহ করে চিত্রিত করা হয়েছে, যখন তােমরা ভালােমতাে তাদের রক্তপাত সম্পন্ন করবে, তখন শক্ত করে তাদের বেঁধে ফেলে। অনুরূপভাবে কাফেরদের বিরুদ্ধে যে বদদোয়া করা হয়েছে তাও করা হয়েছে ভয়ংকর নিষ্ঠুরতাবােধক শব্দ দিয়ে। যেমন, যারা কুফরী করেছে তারা নিপাত যাক এবং তাদের সৎ কাজগুলাে বিনষ্ট হয়ে যাক। অতীতের কাফেরদের ধ্বংসের বিবরণটাও দেয়া হয়েছে এমন ভাষায় যা শাব্দিক ও ভাব উভয় দিক দিয়েই ভয়াবহ। যেমন, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ধ্বংস করে দিন এবং কাফেরদের জন্যেও অনুরূপ। আর দোযখের আযাবের ছবিটা এখানে কিভাবে তুলে ধরা হয়েছে দেখুন, তাদেরকে গরম পানি খাওয়ানাে হবে। ফলে সে পানি তাদের নাড়িভুড়িকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলবে। মােনাফেকদের ভীরুতা ও কাপুরুষতার দৃশ্যও দেখানাে হয়েছে এভাবে, ‘তারা তােমার দিকে তাকায় মৃত্যুর ভয়ে বেহুশ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির মতাে। এমনকি জেহাদ থেকে পিঠটান দেয়ার বিরুদ্ধে মােমেনদেরকে প্রদত্ত হুঁশিয়ারীও এসেছে কঠোরতম ও চুড়ান্ত ভাষায়, ‘যদি তােমরা পিঠটান দাও, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের পরিবর্তে এমন এক জাতিকে আনবেন, যারা তােমাদের মতাে হবে না।(আয়াত ৩৮) এভাবেই সূরাটির আলােচ্য বিষয়, তার দৃশ্য ও ছবি, তার প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ এবং তার সূর ও ঝংকার সবই পরস্পরের সাথে সুসমন্বিত ও সংগতিপূর্ণ। { কোরআনের এই অপূর্ব ভাষা শৈলী শুধু তারাই বুঝতে পারবেন যাদের আরবী ভাষায় বিশাল সাহিত্য ভান্ডার সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে।-সম্পাদক }
‘যারা কুফুরী করেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল সৎকাজকে বিপথগামী করে দেবেন, আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কাজ করেছে…’(আয়াত ১-৩) কোনাে পূর্ব ঘােষণা বা হুমকি হুঁশিয়ারী ছাড়া সম্পূর্ণ আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু করলে যে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভট ঘটে, এই সূরার সূচনাও হয়েছে তদ্রুপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে, অনেকটা ভূমিকাহীনভাবে। যারা কুফরী করেছে এবং নিজেদেরকে বা অন্যদেরকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, তাদের যাবতীয় সৎকাজকে আল্লাহ তায়ালা বিপথগামী করে দেবেন অর্থাৎ সেগুলােকে তিনি ব্যর্থ ও বিনষ্ট করে দেবেন। তবে এই বিনষ্ট ও বাতিল হওয়াটা একটু সক্রিয় ধরনের। যেন আমরা এই সকাজগুলােকে উদভ্রান্তভাবে চলতে চলতে অবশেষে ধ্বংস ও নষ্ট হয়ে যেতে দেখতে পাই। এই সংকাজগুলােকে সজীব প্রাণীর রূপ দেয়া হয়েছে এবং সেগুলােকে বিপথগামী ও ধ্বংস করা হয়েছে। এখানে এমন একটা যুদ্ধের দৃশ্য ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, যে যুদ্ধে জনগণ থেকে সৎ কাজগুলােকে এবং সৎকাজগুলাে থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা হবে-যার পরিণামে ধ্বংস ও বিপথগামিতা অনিবার্য হয়ে উঠবে। *মােমেন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য : ধ্বংস ও নষ্ট হয়ে যাওয়া এই সৎকাজগুলাে দ্বারা সম্ভবত সেই কাজগুলােকেই বুঝানাে হয়েছে যার পেছনে কাফেরদের সদুদ্দেশ্য নিহিত থাকে এবং যাকে বাহ্যত মহৎ কাজ বলেই মনে হয়। কিন্তু যেহেতু ঈমান ছাড়া সৎকাজের কোনাে মূল্য নেই, তাই এই সদুদ্দেশ্য প্রবণতা নিতান্তই বাহ্যিক ও লােক দেখানাে। এর অন্তরালে কোনাে বাস্তব ও সার পদার্থের অস্তিত্ব থাকে না। কাজের পেছনে যে প্রেরণা ও উদ্দীপনা সক্রিয় থাকে, সেটাই আসল বিবেচ্য বিষয়, কাজের শুধু বাহ্যিক রূপ বিবেচ্য বিষয় নয়। এই প্রেরণা ও উদ্দীপনা ভালাে হতে পারে। তবে প্রেরণা ও উদ্দীপনার ভিত্তি ও উৎস যদি ঈমান না হয়, তাহলে তা একটা ক্ষণস্থায়ী ও তাৎক্ষণিক ভাবাবেগ বা হুজুগ ছাড়া আর কিছু নয়। এ ধরনের সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী ভাবাবেগ এমন কোনাে শাশ্বত আদর্শ বা জীবন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত নয়, যার চিরস্থায়ী পরকালীন জীবনের সাথে বা সৃষ্টি জগতের মৌল নিয়ম বা বিধির সাথে যােগসূত্র রয়েছে। সুতরাং যে মূল উৎস থেকে মানব সত্ত্বার উৎপত্তি, তার সাথে মানব সত্ত্বাকে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্যে ঈমান অপরিহার্য। ঈমান আনার মাধ্যমে এই উৎসের সাথে তার বন্ধন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে মানব সত্ত্বার সকল দিক বিকশিত হবে এবং তার সব রকমের আবেগ অনুভূতির ওপর ঈমানের প্রভাব পড়বে। তখনই সৎ কাজ হবে অর্থবহ ও তাৎপর্যবহ। তখনই সৎ কাজের শুধু সুনির্দিষ্ট মহৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকবে। তখনই তার সৎ কাজ স্থিতিশীল ও স্থায়ী হবে, আর তখনই তা হবে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির সকল অংশ ও অংগকে সুসংহতকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী শাশ্বত আল্লাহর বিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ, আর তখনই এই ঈমান মােমেনের প্রত্যেকটা কাজ ও প্রত্যেকটা তৎপরতার জন্যে এই বিশ্বজগতের অবকাঠামােতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেবে এবং তাকে তার লক্ষ্যে পৌছে দেবে। অপরদিকে যারা ঈমানদার ও সৎ কাজে লিপ্ত এবং মােহাম্মাদের ওপর যা কিছু নাযিল হয়েছে তার ওপর ঈমান এনেছে- কেননা তা তাদের মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত প্রকৃত সত্য।…’ এখানে দু’বার ঈমানের উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ঈমানে যদিও মােহাম্মদের ওপর নাযিল করা ওহীর ওপর ঈমান আনা অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু পরবর্তীতে পুনরায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তাকে অধিকতর স্বচ্ছতা দান করা হয়েছে এবং তার প্রকৃত বৈশিষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রকৃত বৈশিষ্ট হলো এই যে, ওটাই যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত একমাত্র প্রকৃত সত্য বিধান মােমেনের হৃদয়ে সুদৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল। এই ঈমানের পাশাপাশিই অবস্থান করে তার সৎ কাজ, যা তার বাস্তব জীবনে প্রতিনিয়ত স্বতঃস্কূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে থাকে। এই সৎ কাজ তার ঈমানেরই ফল ও ফসল। এই সৎকাজই প্রমাণ করে যে, তার অন্তরে ঈমান রয়েছে এবং তা সর্বক্ষণ তাকে সৎকাজের প্রেরণা ও উদ্দীপনা যােগাচ্ছে। সৎকর্মে উদ্দীপ্ত এই ঈমানদারদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সমস্ত গুনাহ মােচন করে দেবেন। অথচ কাফেরদের কার্যকলাপ বাহ্যত সৎকর্ম বলে মনে হলেও তার অবস্থা ঠিক এর বিপরীত। কাফেরদের কাজশুলাে সৎকাজ হলেও তা বাতিল হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে মােমনদের কাজগুলাে পাপ কাজ হলেও তা মাফ করে দেয়া হবে। এ দু’টো সম্পূর্ণ পরস্পর বিরােধী। এ কথা বলে বুঝিয়ে দেয়া হলাে যে, আল্লাহর কাছে ঈমানের মূল্য ও কদর কতাে বেশী। শুধু আল্লাহর কাছেই নয় জীবনের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেও ঈমানের মূল্য ও মর্যাদা অত্যাধিক। তাই বলা হয়েছে ‘এবং তিনি তাদের মনকে সংশােধন করে দেবেন।’ মনের সংশােধন এতাে বড় একটা নেয়ামত যে, এর সুফল, গুরুত্ব ও মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনা করে এটিকে ঈমানের পরেই স্থান দেয়া হয়েছে। মনকে সংশােধন করার তাৎপর্য এই যে, ঈমানের মাধ্যমে মন পরিপূর্ণ প্রশান্তি, বিশ্রাম, আত্মবিশ্বাস, সন্তোষ ও শান্তি লাভ করে থাকে। মন যখন পরিশুদ্ধ হয়, চিন্তা ও চেতনা তখন সুষ্ঠু ও সরল হয়, হৃদয় ও বিবেক সন্দেহ-সংশয় ও জড়তা থেকে মুক্ত হয়। স্নায়ু ও অনুভূতি নিখুত ও নির্মল হয় এবং শান্তি ও নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে মানবসত্ত্বা পূর্ণ আশ্বস্ত ও সন্তুষ্ট হয়। এরপর আর কোনাে নেয়ামত ও সম্পদ আর কী হতে পারে? বস্তুত এটাই মনুষত্বের উজ্জ্বলতম ও মহত্তম স্তর। মােমেন ও কাফেরের এই বিপরীতধর্মী অবস্থার কারণ কী? এর কারণ কোনাে স্বজনপ্রীতি নয়, এটা কোনাে কাকতালীয় ঘটনা নয় এবং কোনাে বিবেচনাহীন স্বেচ্ছাচারিতাও নয়। এর পেছনে শাশ্বত মৌল সত্যের সম্পর্ক রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে আল্লাহর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে চলে আসা চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়ম। সত্যকে তিনি সে দিন থেকেই সব কাজের ভিত্তি বানিয়েছেন। ‘কেননা কাফেররা বাতিলের অনুসারী আর মােমেনরা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত সত্যের অনুসারী।’ এই মহাবিশ্বে বাতিলের কোনাে শেকড় নেই। তাই বাতিল ক্ষয়িষ্ণু ধ্বংসশীল ও ক্ষণস্থায়ী। আর যারা বাতিলের অনুসারী এবং বাতিলের ওপর ভিত্তি করে যে সব মতাদর্শের সৃষ্টি হয়েছে তাও মরণশীল ও ধ্বংসশীল। আর কাফেররা যখন বাতিলের অনুসারী, তখন তাদের যাবতীয় নেক আমল নষ্ট হতে বাধ্য এবং তার কিছু আর অবশিষ্ট থাকতে পারে না। অপরদিকে সত্য চিরন্তন ও শাশ্বত। সত্যের ওপর আকাশ ও পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত। সত্যের শিকড় গাথা রয়েছে সমগ্র মহাবিশ্বের পরতে পরতে, গভীর থেকে গভীরে। এ জন্যে যা কিছুই সত্যের সাথে যুক্ত ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা চিরন্তন, শাশ্বত ও অবিনশ্বর। আর মােমেন যখন সত্যের অনুসারী, তখন আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং তাদের অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করবেন। বস্তুত সত্য এটা স্বচ্ছ ও স্পষ্ট জিনিস। সত্য তার স্থায়ী শেকড়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তার উপাদানসমূহ অবিনশ্বর। সত্য কখনাে ক্ষণস্থায়ী নয়, কাকতালীয় নয় এবং আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে তাদের উদাহরণসমূহ তুলে ধরেন। আর এভাবেই তাদের জন্যে সেই মৌলিক নীতিমালা রচনা করেন, যার আলােকে তারা নিজেদেরকে ও নিজেদের কার্যকলাপকে সংগঠিত করে। ফলে তারা কোন আদর্শ ও উদাহরণের আওতাধীন, তা তাদের কাছে পরিচিত ও চিহ্নিত থাকে। তারা আদর্শহীন হয় না এবং জীবন যাপনের মূলনীতি নিয়ে তারা দিশেহারা হয় না।
*কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা : সূরার প্রথম আয়াত যে মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই মােমেনদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয়। সেই মূলনীতি হলাে এই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে মােহাম্মদ(স.)-এর কাছে যে বিধান নাযিল হয়েছে, সেটাই চিরন্তন ও শাশ্বত মহা সত্য। সেই মহাসত্য পৃথিবীতে শুধু টিকে থাকার জন্যে নয় বরং মানব জাতির জীবন ও মূল্যবােধের ওপর তার আধিপত্যশীল ও পরাক্রান্ত হবারও অধিকার রয়েছে, যাতে সমগ্র মানবজাতি সত্যের সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং তার ভিত্তিতে নিজেদের জীবনকে তারা গড়ে তােলে। আর যারা কুফরি করেছে, তারা বাতিল ও মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেই বাতিল ও মিথ্যার উৎখাত হওয়া উচিত। মানব জীবনের ওপর তাদের কোনাে প্রভাব বিস্তার আদৌ সমীচীন নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতপর যখনই তােমরা কাফেরদের মুখােমুখী হবে, তখনই তাদের গর্দান মারতে থাকবে। যখন তােমরা তাদেরকে ভালাে মতাে হত্যা করে সারবে, তখন বাদবাকীদেরকে শক্তভাবে বেঁধে ফেলাে তারপর হয় অনুগ্রহ দেখিয়ে তাদের ছেড়ে দিও, নচেৎ মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিও- যতক্ষণ যুদ্ধ বিরতি না হয় ততক্ষণ…’ এখানে মুখােমুখী হওয়া দ্বারা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে মুখােমুখী হওয়া বুঝানাে হয়েছে, নিছক মুখােমুখী হওয়া নয়। কেননা এই সূরা নাযিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আরব উপদ্বীপে মােশরেকরা দুশ্রেণীতে বিভক্ত ছিলাে, যুদ্ধরত ও সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ। তখনাে সূরা তাওবা নাযিল হয়নি, যা মোশরেকদের মেয়াদী চুক্তিকে মেয়াদ পর্যন্ত ও অমেয়াদী চুক্তিকে চার মাস পর্যন্ত সীমিত করে দিয়েছিলাে এবং সেই মেয়াদের পর মােশরেকদেরকে আরব উপদ্বীপের যেখানেই পাওয়া যাক, ইসলাম গ্রহণ না করলে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলাে। কেননা সূরা তাওবা নাযিল হয়েছিলাে ইসলামের কেন্দ্রীয় ভূখণ্ড আরব উপদ্বীপকে একমাত্র ইসলামের আবাস ভূমি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। (মনে রাখতে হবে, সুরা তাওবার এই বিধান আরব উপদ্বীপের বাইরের মােশরকদের ওপর প্রযােজ্য নয়। সেখানে মােশরেকরা জিযিয়া দিয়ে বসবাস করতে চাইলে তা গ্রহণ করা হবে।-সম্পাদক) মুখােমুখী হবার পর গর্দান মারা তথা হত্যা করার যে নির্দেশ এখানে দেয়া হয়েছে, সেটা স্বভাবতই তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেয়া ও তা তাদের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যানের পরই কার্যকর হবে তার আগে নয়। সূরার পটভূমি ও আলােচ্য বিষয়ের সাথে সংগতি রেখে এখানে হত্যার কার্যক্রমটিকে প্রত্যক্ষভাবে ও অনুভবযোগ্য করে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, বলা হয়েছে যখন তােমরা তাদেরকে ভালােভাবে হত্যা করবে, তখন বাদ বাকীদেরকে শক্তভাবে বেঁধে ফেলাে। আয়াতে ইছখান শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হলাে, ব্যাপক ও চরমভাবে হত্যা করা, যতক্ষণ না শক্রর শক্তি ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয় এবং পুনরায় আক্রমণ বা আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা আর না থাকে, একমাত্র তখনই, তার আগে নয়। যারা জীবিত ধরা পড়বে তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে এবং কঠোরভাবে গ্রেফতার করা হবে- যতক্ষণ শক্রর শক্তি অবশিষ্ট থাকবে। তাদের পুনরাক্রমণের সম্ভাবনা খতম করাই হবে এই হত্যার উদ্দেশ্য। অধিকাংশ মােফাসসেরের মতে, এই আয়াতের ব্যাখ্যা এটাই। এই ব্যাখ্যা অনুসারে এই আয়াত ও সূরা আনফালের সেই আয়াতের বক্তব্যে কোনাে বিরােধ থাকে না, যে আয়াতে রসূল(স.) ও মুসলমানদেরকে বদর যুদ্ধে বেশী করে যুদ্ধবন্দী গ্রহণের জন্যে ভৎর্সনা করা হয়েছিলাে। কেননা আল্লাহর দৃষ্টিতে আরো বেশী সংখ্যক মােশরেককে হত্যা করাই ছিলাে শ্রেয়। সূরা আনফালের সেই দু’টো আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন কোনাে নবীর পক্ষে এটা সংগত নয় যে, পৃথিবীতে আল্লাহর শত্রুদের নিপাত না করা পর্যন্ত যুদ্ধবন্দী গ্রহণ করবে।(আয়াত ৬৭-৬৮) সুতরাং সর্বপ্রথম কাজ হলাে, শক্রর শক্তি ধ্বংস করা ও তার প্রতাপ খর্ব করার জন্যে হত্যা ও রক্তপাত করা, এরপর গ্রেফতার। এর যৌক্তিকতা সুস্পষ্ট। কেননা যুদ্ধের প্রথম উদ্দেশ্যই হলাে, ইসলামের প্রতি বৈরী আগ্রাসী শক্তিকে ধ্বংস করা, বিশেষত যখন সংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানদের শক্তি কম ছিলাে এবং মােশরেকরা সংখ্যাগুরু ছিলাে। সে সময়ে একজন যুদ্ধরত অমুসলিমকে হত্যা করা শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্যে খুবই প্রয়ােজনীয় ছিলাে। ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমনদের শক্তি ধ্বংস করা ও তাদেরকে আক্রমণ ও আত্মরক্ষায় অক্ষম করে দেয়ার জন্যে যখন যতােটা জরুরী, তখন ততােটা নিপাত করার পক্ষে যে আদেশ সর্বকালেই প্রযােজ্য। তবে এরপর যাদেরকে বন্দী হিসাবে গ্রহণ করা হবে, তাদের ব্যাপারে কী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে, সেটা সুরা মােহাম্মদের এই আয়াতে স্থির করে দেয়া হয়েছে। কোরআনের একমাত্র এ আয়াতেই বন্দীদের ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। সে নীতি হলাে, ‘হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা হবে, নতুবা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে।’ অর্থাৎ হয় কোনাে বিনিময় ছাড়াই তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে, নচেত কোনাে অর্থ, কাজ বা মুসলিম বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। আয়াতে তৃতীয় কোনাে নির্দেশনা নেই। অর্থাৎ মােশরেক বন্দীদেরকে দাস হিসাবে গ্রহণ বা হত্যা করা বা অন্য কোনাে কিছু করার অবকাশ নেই। তবে বাস্তবে এরূপ ঘটেছে যে, রসূল(স.) ও খলীফারা কোনাে কোনাে বন্দীকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দাস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে কিছু বন্দীকে তারা হত্যাও করেছেন। এখানে আমি এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে বিশিষ্ট হানাফী ইমাম আবু বকর আল জাসসাসের গ্রন্থ ‘আহকামুল কোরআন’-এ ও তার টীকায় বর্ণিত কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। উদ্ধৃতির পর আমি নিজের মতামতও ব্যক্ত করবাে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন তােমরা কাফেরদের মুখামুখী হবে, তখন গর্দান মারতে থাকবে… এ প্রসংগে ইমাম আবু বকর বলেন, আয়াতের এ অংশটির সুস্পষ্ট বক্তব্য এই যে, এই সময়ে কাফেরদেরকে হত্যা করা জরুরী। অবশ্য ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটানাের পরের কথা স্বতন্ত্র। এ ধরনের কথা আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেছেন, কোনাে নবীর পক্ষে সমীচীন নয় যে, পৃথিবীতে ব্যাপক হত্যাকান্ড না ঘটানাে পর্যন্ত বন্দী গ্রহণ করবে। এ বক্তব্য সঠিক, সুতরাং উভয় আয়াতে কোনাে বিরোধ নেই। হযরত ইবনে আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, এটা বদর যুদ্ধের দিনের ব্যাপার। তখন মুসলমানরা সংখ্যায় ছিলাে কম। পরে যখন তাদের সংখ্যা বেড়ে গেলাে এবং তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি জোরদার হলাে, তখন আল্লাহ তায়ালা বন্দীদের সম্পর্কে নাযিল করলেন, ‘হয় অনুগ্রহ করাে, নচেত মুক্তিপণ গ্রহণ করাে এ সময় আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.) ও মুসলমানদেরকে সুযােগ দিলেন হয় তাদেরকে হত্যা করে ফেলুক, নচেত দাসদাসীতে পরিণত করুক, নচেত মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দিক। আবু ওবায়েদ নামক জনৈক বর্ণনাকারী বলেন হযরত ইবনে আব্বাস(রা.) বলেছেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থাকায় আমরাও ওটা বর্জন করেছি। তবে বন্দীদেরকে হত্যা করার কোনাে বৈধতা আয়াতে পাওয়া যায় না। আয়াতে কেবল অনুগ্রহ প্রদর্শন অথবা মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তিদানের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সুদ্দীর মতে, ‘হয় অনুগ্রহ প্রদর্শন করাে, নচেত মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দাও, এ আয়াত মনসুখ (রহিত) মােশরেকদের যেখানে পাও হত্যা করাে সূরা তাওবার এ আয়াত দ্বারা ওটা রহিত হয়ে গেছে। আবু বকর বলেন, ‘যখন তােমরা কাফেরদের মুখােমুখী হবে, তখন গর্দান মারতে থাকো। কোনাে নবীর পক্ষে এটা সংগত নয় যে, তার হাতে বন্দীরা থাকবে, যতক্ষণ না ব্যাপক হত্যাকান্ড সংঘটিত করে …’ এবং তাদেরকে যদি যুদ্ধের ভেতরে পাও, তবে তাদেরকে ও তাদের পেছনে যারা রয়েছে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দাও’- এ তিনটি আয়াতের হুকুম রহিত নাও হতে পারে এবং এটা স্থায়ী নির্দেশ হতে পারে। কেননা আল্লাহ তায়ালা মােশরেকদের সর্বতােভাবে দমন ও পরাজিত না করা পর্যন্ত ব্যাপকভাবে হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন এবং বন্দী হিসাবে তাদের আটক করতে নিষেধ করেছেন। এ আদেশ আল্লাহ তায়ালা তখনই দিয়েছেন যখন মুসলমানদের সংখ্যা কম ছিল এবং তাদের শত্রু মােশরেকদের সংখ্যা বেশী ছিল। মােশরেকদেরকে যখন হত্যা করে ও বিতাড়িত করে সম্পূর্ণভাবে দমন ও পরাস্ত করা সম্পন্ন হবে, তখন অবশিষ্টদেরকে বন্দী করা যাবে। সুতরাং ইসলামের প্রথম যুগের মতাে অবস্থায় মুসলমানরা কখনাে পতিত হলে তখন তাদের জন্যে এই নির্দেশকে বহাল রাখা কর্তব্য। আমার মতে, ‘মােশরেকদেরকে যেখানে পাও হত্যা করাে’ এ আদেশ মােহাম্মদের নির্দেশটি সর্বাবস্থায় ও সর্বক্ষেত্রে প্রযােজ্য। দেশময় সর্বাত্মক হত্যা ও দমন অভিযান পরিচালিত হওয়ার পর অবশিষ্ট শক্রদেরকে বন্দী করা যাবে। সূরা তাওবার নাযিলের পর রসূল(স.)-এর খলিফারা স্বভাবত এটাকেই এ ব্যাপারে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাড়া বন্দীদেরকে হত্যা করা বৈধ নয়। সেই ব্যতিক্রমধর্মী বিশেষ অবস্থাগুলাের বিবরণ পরে আসছে। *মুক্তিপণ প্রসংগে ইসলাম : এবারে দেখা যাক, ‘পরে হয় অনুগ্রহ দেখিও, নচেত মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দিও’ এ আদেশটির তাৎপর্য কী। বাহ্যত এ আদেশের দাবী হচ্ছে দুটো বিষয়ের যে কোনাে একটা। হয় অনুগ্রহ সহকারে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দাও, নচেত মুক্তিপণ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে মুক্তিদান করাে। এ থেকে স্পষ্টতই বুঝা যায়, বন্দীদেরকে হত্যার কোনাে বৈধতা নেই। অতীতের মনীষীরা এ ব্যাপারে কিছু ভিন্নমত পােষণ করেছেন। যেমন হযরত হাসান থেকে বর্ণিত যে, তিনি বন্দী হত্যা অপছন্দ করতেন। তিনি বলেছেন, হয় অনুগ্রহ দেখাও, নচেত মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দাও। আশয়াস বলেন, আমি আতা’কে বন্দী হত্যার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, হয় অনুগ্রহ দেখাও, নচেত মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দাও। হাসানকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, রসূল(স.) বদরের যুদ্ধবন্দীদের সাথে যা করেছেন, তাই করা হবে, হয় অনুগ্রহ করা হবে, নচেত মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে। হযরত ইবনে ওমর(রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইসতাখার অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী একজনকে হত্যা করার জন্যে তার কাছে সােপর্দ করা হয়। কিন্তু তিনি হত্যা করতে অস্বীকার করলেন এবং এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, অর্থাৎ হত্যা করার বৈধতা আয়াতে নেই বলে তিনি মনে করেন। মােজাহেদ ও মােহাম্মাদ, ইবনে সিরিন থেকেও বর্ণিত আছে যে, তারা বন্দী হত্যা পছন্দ করতেন না। সুদ্দী থেকে আমরা বর্ণনা করেছি যে, ‘হয় অনুগ্রহ দেখাও, নচেত মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দাও’ এ আদেশ মােশরেকদেরকে যেখানেই পাও, হত্যা কর দ্বারা রহিত। ইবনে জুরাইয থেকেও বর্ণিত যে, এটা রহিত। তিনি বলেন, রসূল(স.) বদর যুদ্ধের দিন ওকবা ইবনে আবু মুইতকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করেন। আবু বকর বলেন, মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলের আলেমরা বন্দী হত্যার বৈধতা সম্পর্কে একমত। রসূল(স.) যে বন্দী হত্যা করিয়েছিলেন, বিশেষত বদর যুদ্ধের দিন ওকবা ইবনে আবি মুইতকে ও নাযার ইবনুল হারেসকে সে সম্পর্কে এতাে বেশী বর্ণনা এসেছে, যা অবিশ্বাস করা অসম্ভব। ওহুদ যুদ্ধের দিনও তিনি বন্দী কবি আবু ইয্যতকে হত্যা করেছিলেন। হযরত সা’দ ইবনে মােয়াযের রায় মােতাবেক তিনি বনু কোরায়যার বয়স্ক পুরুষদের হত্যা ও তাদের সন্তানদেরকে দাস দাসী বানান। তাদের মধ্য থেকে যােবায়র বিন বাতাকে কৃপা প্রদর্শন করেন। খয়বরের একাংশকে শক্তি প্রয়ােগ ও অপর অংশকে আপােসে জয় করেন। ইবনে আবিল হাকীককে অংগীকারাবদ্ধ করেন যে, সে কোনাে তথ্য গেপন করবে না। কিন্তু পরে তার বিশ্বাসঘাতকতা ও তথ্য গোপন প্রকাশ হয়ে পড়লে তাকে হত্যা করেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি হিলাল বিন খাতাল, মিকয়াস বিন হুবাবা, আবদুল্লাহ বিন আবি সারাহ ও আরাে কয়েকজনকে হত্যা করেন। তিনি নির্দেশ দেন যে, এই লােকগুলােকে কাবা শরীফের পর্দা আঁকড়ে ধরা অবস্থায় পেলেও হত্যা করবে। তিনি মক্কাবাসীকে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেন এবং তাদের ধন সম্পদকে গনীমতে পরিণত করেননি। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ(রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক(রা.)-কে বলতে শুনেছেন, আমি যেদিন ফুজায়াতে গিয়েছিলাম, সেদিন তাকে পুড়িয়ে না মেরে তাকে মুক্ত অবস্থায় হত্যা করা কিংবা নিরাপদে মুক্ত করে দেয়াটাই আমি পছন্দ করতাম। হযরত আবু মূসা(রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, সুস নগরীর জনৈক কৃষক সরদার যখন একদল লােকের প্রাণের নিরাপত্তা চাইলাে এবং তাদের মধ্যে সে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করলাে না, তখন তিনি তাকে নিরাপত্তা প্রদত্তদের অন্তর্ভুক্ত করলেন না এবং হত্যা করলেন। রসূল(স.) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে উদ্ধৃত এইসব বিশুদ্ধ বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বন্দীকে হত্যা করা বা বাঁচিয়ে রাখা উভয়ই জায়েয আছে এবং এ ব্যাপারে সকল অঞ্চলের আলেমরা একমত। (হত্যার বৈধতা আয়াত থেকে নয় বরং রসূল(স.) ও কতিপয় সাহাবীর দৃষ্টান্ত থেকে গৃহীত। যে পরিস্থিতিতে এই হত্যাকান্ডগুলাে ঘটেছে, তা পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, এসব হত্যাকান্ডের জন্যে সুনির্দিষ্ট অবস্থা ও ব্যতিক্রমী কার্যকারণ দায়ী, নিছক যুদ্ধ বা বন্দীদশাই এর একমাত্র কারণ নয়। যেমন নাযার ইবনুল হারেস ও ওকবা ইবনে আবু মুইত উভয়েই রাসূল(স.) ও তার আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলাে। কবি আবু ইযযতের অবস্থাও অনুরূপ বনু কোরায়যারও বিশেষ ভূমিকা ছিলো এবং তার আগেই সা’দ বিন মােয়াজকে শালিশ মেনেছিলাে। এভাবে আমরা সকল ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমধর্মী কারণ ও পটভূমি দেখতে পাই, যা দ্বারা জানা যায় যে, এই আয়াতে বন্দীদেরকে মুক্তিপণসহ বা মুক্তিপণ ছাড়া মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে যে সাধারণ আদেশ রয়েছে, এক্ষেত্রে তা প্রযােজ্য নয়। ইমামদের মধ্যে মুক্তিপণ নিয়ে মতভেদ ঘটেছে। হানাফী মাযহাবের ইমামরা সবাই এই মর্মে একমত যে, বন্দীকে অর্থ সম্পদের বিনিময়ে ছাড়া যাবে না এবং যুদ্ধরত কাফেরদের সন্তানদেরকে গােলামী বাদী বানানাের পর তাদেরকে বিক্রি করাও জায়েয নয়। কেননা তাতে আশংকা আছে যে, তারা একদিন পুনরায় যুদ্ধ করতে আসবে। ইমাম আবু হানিফা বলেছেন, বন্দীদেরকে মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে ছাড়া যাবে না যাতে তাদের দ্বারা আর কখনাে যুদ্ধ শুরু হতে না পারে। আবু ইউসুফ ও মােহাম্মদ(র.) বলেন, মুসলমান যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে মােশরেক যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়াতে কোনাে দোষ নেই। ইমাম ছাওরী ও আওযায়ীর অভিমতও এটাই। আওযায়ী বলেন, যুদ্ধরত অমুসলিমদের মধ্য থেকে যারা দাসদাসীতে পরিণত হয়েছে তাদেরকে বিক্রি করা জায়েয। তবে তাদের পুরুষদেরকে মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে ছাড়া বিক্রি করা যাবে না। মাযানী ইমাম শাফেয়ীর মত উদ্ধৃত করেন যে, মুসলিম শাসক বিজিতদেরকে ক্ষমাও করতে পারেন, তাদেরকে মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দিতেও পারেন। মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে বা মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তিদানের প্রবক্তারা এই আয়াত দিয়ে যুক্তি দেখান যে, হয় অনুগ্রহ দেখাও, নচেত মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দাও। এ আদেশ স্পষ্টই দাবী করে যে, অর্থকড়ি অথবা মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া বৈধ। তারা এ যুক্তিও দেখান যে, রসূল(স.) অর্থকড়ি নিয়ে বদরের যুদ্ধবন্দীদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়ে যে অমুসলিম বন্দীদেরকে ছাড়া বৈধ, তার সপক্ষে তারা ইবনুল মােবারকের বর্ণনা থেকে প্রমাণ দেন। এই বর্ণনায় আছে যে, বনু সাকীফ রসূল(স.)-এর দু’জন সাহাবীকে বন্দী করে। আর বনু আমের বিন সাসায়া গােত্রের একজনকে বন্দী করেন রাসূল(স.)-এর সাহাবীরা। শেষোক্ত বন্দী দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিলাে এমতাবস্থায় রসূল(স.) তার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন সে রসূল(স.)-কে ডাকলাে। তিনি তার দিকে এগিয়ে গেলেন। সে জিজ্ঞেস করলাে, আমাকে কি কারণে বন্দী করা হয়েছে। রসূল(স.) বললেন, তােমার মিত্রদের (বনু সাকীফ) অপরাধে। বন্দী বললাে, আমি ইসলাম গ্রহণ করবাে। রসূল(স.) বললেন, তুমি স্বাধীন অবস্থায় যদি এ কথা বলতে, তাহলে তুমি সর্বাত্মক সফলতা লাভ করতে। (অর্থাৎ তোমার কথা গ্রহণযােগ্য হতাে) এরপর রসূল(স.) চলে যেতে লাগলেন। তখন লােকটি তাঁকে আবারও ডাকলাে। তিনি এগিয়ে এলেন। সে বললাে, আমি ক্ষুধার্ত। আমাকে খেতে দিন। রসূল(স.) বললেন, এটা তোমার প্রয়োজন। অতপর রসূল(স.) তাকে বনু সাকীফ কর্তৃক আটক করা দুজন মুসলমানের মুক্তির বিনিময়ে মুক্তি দিলেন। আমার মতে, অর্থকড়ি বা মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে দ্বিমত পােষণকারী ইমাম জাসসাসের সাথীদের যুক্তির চেয়ে মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দেয়ার প্রবক্তাদের যুক্তি অধিকতর অগ্রগণ্য। ইমাম জাসসাস তার হানাফী সমমনা ফকীহদের মতকে অগ্রগণ্যতা দিয়ে তার যুক্তির সমাপ্তি টেনেছেন। তিনি বলেন, আয়াতে অনুগ্রহ প্রদর্শন ও মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দেয়ার পক্ষে যে বক্তব্য রয়েছে এবং বদরের যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে, তা সূরা তাওবার এ আয়াত, মােশরেকদেরকে যেখানে পাও হত্যা করাে দ্বারা মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে, আমরা এ কথা সুদ্দী ও ইবনে জুরাইয থেকেও বর্ণনা করেছি। তা ছাড়া সূরা তাওবার এ আয়াত দ্বারাও তা রহিত বুঝা যায়, ‘যারা আলাহ তায়ালা ও আখেরাতে বিশ্বাস করে না তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো… যতক্ষণ না তারা স্বহস্তে বিনীতভাবে জিযিয়া না দেয়।’ অতএব এ দুটো আয়াতে ইসলাম গ্রহণ অথবা জিযিয়া না দেয়া পর্যন্ত কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব বলা হয়েছে। অর্থকড়ি নিয়ে বা অন্য কিছুর বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তি দেয়া এর পরিপন্থী। তাফসীরকার ও ঐতিহাসিকরা এ ব্যাপারে একমত যে, সূরা তাওবা সূরা মোহাম্মদের পরে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং সূরা তাওবার আদেশ দ্বারা সূরা মুহাম্মদ এর আদেশ রহিত হওয়া অনিবার্য। আমি ইতিপূর্বে বলেছি যে, সূরা তাওবায় মুশরিকদের হত্যার যে আদেশ রয়েছে, তা কেবল আরব উপদ্বীপের মােশরেকদের মধ্যে সীমিত। এর বাইরের মােশরেক ও আহলে কিতাবদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা যায়। আত্মসমর্পণের সময় জিযিয়া গ্রহণ করলেই যে মুসলমানদের হাতে তার আর কোনাে বন্দী থাকতে পারবে না এমন কোনাে কথা তাে নেই। বন্দী থাকলে এই বন্দীদের কী উপায় হবে? আমি বলবাে, মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে মুক্তি দিতে পারবে- যদি তারা এতােটা প্রতাপশালী থাকে যে, এখনাে আত্মসমর্পন করেনি এবং জিজিয়া দিতে রাযি নয়। জিযিয়া দিতে রাযি হলে তাে সমস্যা আপনা আপনিই সমাধান হয়ে যায়। এটা একটা ভিন্ন অবস্থা। কাজেই যখন জিযিয়া দিতে সম্মত না হওয়ার কারণে সমস্যা থেকে যায়, তখন বন্দীদের বিধান বলবত থেকে যায়। সারকথা এই যে, কোরআনের এই ভাষ্যই বন্দীদের বিধানসম্বলিত একমাত্র কোরআনী ভাষ্য। এ ছাড়া কোরআনের আর যতাে ভাষ্য রয়েছে, তাতে বন্দীদশা ছাড়া অন্যান্য অবস্থার বিধানসমূহ বিদ্যমান রয়েছে। এ ভাষ্যটি হচ্ছে এ সংক্রান্ত স্থায়ী মূলনীতি। এ মূলনীতির বাইরে যা কিছু কার্যত ঘটেছে, তা বিশেষ ও সাময়িক পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্যেই ঘটেছে। উদাহরণ স্বরূপ, কোনাে কোনাে বন্দীকে হত্যার ঘটনা নিতান্তই ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা নবীর সব সময়ই থাকতে পারে। তাদেরকে হয়তাে বন্দী করা হয়েছে পূর্বের কোন অপরাধের জন্যে নিছক যুদ্ধ করতে আসার কারণে নয়। হয়তাে সে একজন গুপ্তচর ছিলাে, তখন বন্দী হয়ে এসেছে। ফলে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধেই তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে বন্দী হিসাবে নয় । বন্দী হিসাবে আটক করাটা ছিলাে তাকে পাকড়াও করার ওসিলা মাত্র। *দাস প্রথা প্রসঙ্গে : এখন বাকী থেকে যাচ্ছে দাসত্বের বিষয়টি। এই তাফসীরের বিভিন্ন স্থানে আমি বলেছি যে, একটা বিশ্বজনীন পরিস্থিতি ও যুদ্ধ বিগ্রহের ক্ষেত্রে বিরাজমান কিছু সার্বজনীন প্রথা ও ঐতিহ্যের মােকাবেলা করতে গিয়েই আমাদের এটা অবলম্বন করতে হয়েছে। যুদ্ধবন্দীদেরকে অনুগ্রহ প্রদর্শন করে বিনা মুক্তিপনে ছেড়ে দেয়া অথবা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়ার এই মূলনীতিটা সর্বাবস্থায় বাস্তবায়িত করা ইসলামের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশেষত যখন ইসলামের শত্রুরা মুসলিম বন্দীদেরকে নির্বিচারে দাস দাসীতে পরিণত করেছে। এ জন্যেই রসূল(স.) এ মূলনীতিটাকে কোনাে কোনাে অবস্থায় বাস্তবায়িত করেছেন এবং কিছু বন্দীকে অনুগ্রহপূর্বক কোনাে কিছুর বিনিময় ছাড়াই মুক্তি দিয়েছেন, আবার কতককে মুসলিম বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে মুক্তি দিয়েছেন। কতককে আবার আর্থিক পণের বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছেন। কিছু ভিন্ন পরিস্থিতিতে বন্দীদেরকে দাস দাসী হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছে। কারণ বিরাজমান পরিস্থিতিতে তার অন্য কোনাে সমাধান সম্ভবপর ছিলাে না। এমন যদি কখনাে ঘটে যে, যুদ্ধরত সকল পক্ষ এই মর্মে একমত হয় যে, বন্দীদেরকে দাস দাসী করা হবে না, তাহলে তখন ইসলাম তার একমাত্র ইতিবাচক মূলনীতিতে অর্থাৎ “হয় অনুগ্রহপূর্বক বিনা পণে মুক্তি- নচেত মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দেয়া-এর নীতিতে ফিরে আসবে। কেননা তখন দাসত্বের অনুকূল বিশ্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বস্তুত দাসত্ব কোনাে অপরিহার্য বিধানও নয়, যুদ্ধবন্দী সমস্যার সমাধানের এটা কোনাে ইসলামী মূলনীতিও নয়। পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট উক্তি ও বিভিন্ন বাস্তব অবস্থা ও ঘটনাবলীর আলােকে আমার কাছে যে মতটা সঠিক মনে হয়েছে, সেটাই আমি এখানে তুলে ধরলাম। প্রকৃত পক্ষে কোনােটা সঠিক ও নির্ভুল মত তার সন্ধান কেবল আল্লাহ তায়ালাই দিতে পারেন। এই সাথে এ কথাও বুঝে নেয়া ভালাে যে, আমি যে মতটা তুলে ধরেছি, কোরআনের বাণী ও বিরাজমান বিশ্ব পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে আমি এটাকেই যুক্তিসঙ্গত মনে করেছি। এমন নয় যে, আমি বন্দীদেরকে দাস দাসীতে পরিণত করাকে একটা কলংক মনে করি এবং তা থেকে ইসলামকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি! এমন ধারণা আমার অন্তরে কখনােই স্থান পায়নি। ইসলাম যদি এই মতকেই গ্রহণযােগ্য মনে করে, তবে তাই ভালাে। কেননা কোনাে কৃষ্টিবান মানুষই এমন দাবী করতে পারে না যে, সে যে মত পােষণ করে, সেটাই আল্লাহর সর্বোত্তম পছন্দসই মত। আমি শুধুমাত্র কোরআনী ভাষ্য ও তার অন্তর্নিহিত ভাবধারারই অধীন এবং কোরআনের ভাষ্যের আলােকেই আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আর এই যুদ্ধ বিগ্রহ, হত্যাকান্ড, বন্দী আটক করা এবং বন্দীদের ব্যাপারে এই নীতি অবলম্বন ততক্ষণ পর্যন্তই কার্যকর থাকবে যতক্ষণ যুদ্ধের অবসান না ঘটবে। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলাম ও তার শত্রুদের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার অবসান না ঘটে। সুতরাং এটা হচ্ছে একটা চিরস্থায়ী মূলনীতি। কেননা রাসূল(স.) বলেছেন, জেহাদ কেয়ামতের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে।(আবু দাউদ) অর্থাৎ যতক্ষণ আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী না হয়, ততদিন চলতে থাকবে। *জেহাদ একটি পরীক্ষা : কাফেরদের ওপর নিজের দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের সাহায্যের মুখাপেক্ষী বলে তাদের তিনি ওপর এই জেহাদ ফরয করেননি এটা মােটেই ঠিক নয়। আসলে আল্লাহ তায়ালা কখনাে কারাে মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাফেরদেরকে একাই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। তিনি জেহাদের হুকুম দিয়ে কেবল তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। আর এই পরীক্ষার ফলাফলের আলােকে তাদের মান ও মর্যাদা নির্ণয় করতে চান। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তায়ালা চাইলে (যারা কাফের) তাদের ওপর (নিজ ক্ষমতাবলেই বিজয়ী হতে পারেন। কিন্তু তিনি চান তােমাদের কাউকে দিয়ে কাউকে পরীক্ষা করতে। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের কৃতকর্মকে তিনি কখনাে বৃথা করে দেবেন না। এই সমস্ত লােক যারা কুফরী করে ও আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে এবং সর্বকালে পৃথিবীর সর্বত্র তাদেরই মতাে যতাে আল্লাহদ্রোহী স্বৈরাচারী ও অরাজকতা সৃষ্টিকারী রয়েছে, যারা অহংকার ও দাম্ভিকতার সাথে চলাফেরা করে এবং তাদের অনুসারীদের সামনে নিজেদেরকে দোর্দন্ড প্রতাপশালীরূপে যাহির করে—এরা সবাই আল্লাহর মুষ্টিমেয় নগণ্য সৃষ্টি মাত্র। এরা পৃথিবী নামক আল্লাহর এই বিন্দুতুল্য জায়গাটায় বসবাস করে। এতােসব গ্রহ নক্ষত্র, নিহারিকা, ছায়াপথ এবং আরাে অসংখ্য জগতের মাঝখানে এই পৃথিবী অবস্থিত, যেসবের সংখ্যা ও আয়তন আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। এসব জগত এতাে বড় মহাশূন্যে বিক্ষিপ্তভাবে বিচরণ করে যে, এগুলােকে কতকগুলাে কণা বা বিন্দুর মতাে মনে হয় এবং এগুলােকে আল্লাহ তায়ালাই সামাল দিয়ে রাখেন, নিয়ন্ত্রণ করেন ও এগুলাের ভেতরে সমন্বয় সাধন করেন। এই বিশাল মহাশূন্যে বিচরণকারী বিন্দুবত এই পৃথিবীতে বসবাসকারী এই লােকগুলাে তাদের অনুসারীরা এক কথায় গােটা পৃথিবীবাসী ক্ষুদ্র পিপড়ের সমতুল্য। বরঞ্চ সত্যি বলতে গেলে তারা ধূলিকণার মতাে। আরাে সত্য করে বলতে গেলে, তারা আল্লাহর শক্তির সামনে কোনাে পদার্থই নয়। আল্লাহ তায়ালা যখন মােমেনদেরকে কাফেরদের সাথে লড়াই করার আদেশ দেন, তাদেরকে চূড়ান্তভাবে পরাভূত ও শায়েস্তা করার পর আটক করার আদেশ দেন, তখন আল্লাহ তায়ালা মােমেনদেরকে নিজের শক্তির প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনি ইচ্ছা করলে কাফেরদেরকে প্রকাশ্যে ও প্রত্যক্ষভাবে শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। যেমন কোনাে কোনা জাতিকে বন্যা, ঝড় ও বিকট ধ্বনি দিয়ে করেছেন। এমনকি এ সবের সাহায্য না নিয়েও তাদেরকে ধ্বংস করতে পারতেন। তবে তিনি তার মােমেন বান্দাদের কল্যাণ কামনা করেন, তাই তাদেরকে পরীক্ষা করেন, তাদেরকে লালন পালন করেন, সংশোধন করেন এবং তাদের জন্যে বড় বড় পুন্যকর্মের সহজ পথ দেখিয়ে দেন। তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করেন, আর এই পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মােমেনদের অন্তরে মহৎ ভাবাবেগ ও মনােবল সৃষ্টি করে দেন। যে সত্যের প্রতি সে ঈমান আনে, তাকে নিজের জীবনের চেয়েও মূল্যবান ও মর্যাদাবান মনে করার চেয়ে মহত্তর ভাবাবেগ আর কিছুই হতে পারে না। এরূপ মনে করার কারণেই সে সেই সত্যের জন্যে লড়াই করে হত্যা করে ও নিহত হয়। এই সত্যের জন্যে সে বাঁচে ও মরে বিধায় এর ব্যাপারে সে কোনাে আপােস করে না, এই সত্যকে ছাড়া বেঁচে থাকতে চায় না এবং এর অধীনে ছাড়া সে বেঁচে থাকা পছন্দই করে না। তিনি তার মােমেন বান্দাদেরকে লালন পালন করতে ও প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করতে চান। এ জন্যে তাদের মন থেকে তিনি পৃথিবীর সহায় সম্পদের লােভ লালসা দূর করে দিতে চান। অথচ তাদের পক্ষে এই লােভ লালসা থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। আল্লাহ তায়ালা তাদের যাবতীয় দুর্বলতাকে সবলতায় ও অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতায় রূপান্তরিত করতে চান এবং তাদের মনের সকল কলুষতাকে দূর করতে চান। যাতে তাদের সমস্ত লােভ লালসা থাকবে এক পাল্লায়, আর আল্লাহর জেহাদের দাওয়াত গ্রহণ ও তার সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা থাকবে অপর পাল্লায়। এই শেষের পাল্লাটি তার আগের পাল্লার চেয়ে ভারী হবে। তখন আল্লাহর কাছে প্রমাণিত হবে যে, তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হলে তারা ভালাে পথকে গ্রহণ করে, তারা না জেনে না বুঝে বাধ্য হয়ে কোনাে কিছু গ্রহণ করে না, বরং বুঝে শুনে স্বাধীনভাবে যা কল্যাণকর তাই গ্রহণ করে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সংশােধন করতে চান। আল্লাহর পথে জেহাদে প্রতি মুহূর্তে যে কষ্ট ও যন্ত্রণায় ভুগতে হয় এবং প্রতি মুহূর্তে যেভাবে মৃত্যুর ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়, তাতে মানুষের মনে এ ধরনের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করার অভ্যাস জন্মে। মৃত্যুভীতি সাধারণ মানুষকে তাদের জীবন, চরিত্র, মূল্যবােধ ও বিচার বিবেচনার মানদন্ড সম্পর্কে অত্যাধিক সতর্ক ও দায়িত্বশীল করে তােলে, যাতে মৃত্যু থেকে সে রক্ষা পেতে পারে। অথচ যে ব্যক্তি প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুকির সম্মুখীন হতে অভ্যস্ত, তার কাছে মৃত্যু কোনাে ভয়ের বিষয় বলেই মনে হয় না, এটা তার কাছে নিতান্ত সহজ ব্যাপার হয়ে যায় । সে মৃত্যু থেকে রক্ষা পাক অথবা মৃত্যুর কবলে পড়ুক দুটোই তার কাছে সমান। বান্দা যদি সদা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ রাখে ও তার প্রতি মনােযােগী থাকে, তবে তার এই সার্বক্ষণিক স্মরণ ও আল্লাহমূখিতা তার ওপর এতােটা তীব্রভাবে কার্যকর হয়, যতােটা হয় বস্তুর ওপর বিদ্যুতের। এই সার্বক্ষণিক স্মরণ ও আল্লাহমূখিতা তাকে মৃত্যু ও আখেরাতের ভাবনার অত্যন্ত কাছে পৌঁছিয়ে দেয় এবং মৃত্যুর ভয় তার মন থেকে দূর করে দেয় । সুতরাং আল্লাহর পথে জিহাদ বলতে গেলে মানুষের অন্তরাত্মাকে নতুন রঙে রংগিন করে এবং তাকে পরিশুদ্ধ স্বচ্ছ ও নির্মল করে। জেহাদের সাথে সম্পৃক্ততা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের বিবেক ও মনের পরিশুদ্ধিই সাধন করে না, বরং গােটা মানব সমাজে সংস্কার ও সংশােধনেও কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কেননা যে মােজাহেদরা এর নেতৃত্ব দেন, তারা থাকেন দুনিয়ার যাবতীয় লােভ লালসা ও ভােগ বিলাসের উর্ধে। তারা অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। আল্লাহর পথে থেকে তারা সর্বক্ষণ পরকাল ও মৃত্যু চিন্তায়ই সময় কাটান, যা তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা থেকে ও তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বা উদাসীন করে রাখতে পারে না। এ ধরনের লােকদের হাতে যখন নেতৃত্ব থাকে, তখন গােটা পৃথিবীই পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়, আর গােটা পৃথিবীর অধিবাসীরাই হয়ে যায় পরিশুদ্ধ, শান্তশিষ্ট ও মার্জিত। তাদের পক্ষে এই নেতৃত্বের পতাকা কুফরি শক্তি, নৈরাজ্যবাদী শক্তি ও বিপথগামী শক্তির হাতে সমর্পণ করা অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টকর হয়ে দাড়ায়। কেননা এই পতাকাকে তারা জেহাদ করে বহু প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছিলাে এবং নিজেদের জন্যে নয়, বরং আল্লাহর জন্যে এই পতাকাকে হস্তগত করতে তারা নিজেদের প্রতিটি মূল্যবান সম্পদকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। জিহাদের আরো একটা বৈশিষ্ট এই যে, আল্লাহ তায়ালা যাদের কল্যাণ চান, তাদের জন্যে তারা সন্তুষ্টি ও সীমাহীন পুরস্কার লাভের জন্যে এটাকে অত্যন্ত সহজ করে দেন। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালা যাদের অকল্যাণ চান, তাদের জন্যে সমুচিত গযব ও আযাব লাভেরও এটা একটা সহজ উপায় হয়ে যায়। প্রত্যেক বান্দার জন্যেই আল্লাহ তায়ালা সেই পথ সহজ করে দেন, যার জন্যে তার সৃষ্টি হয়েছে। আর কে কিসের জন্যে সৃষ্টি হয়েছে তা আল্লাহ তায়ালা সম্যক অবগত আছেন। এ জন্যেই আল্লাহর পথে যারা জেহাদ করে নিহত হয়েছে, তাদের পরিণতি সম্পর্কে বলা হচ্ছে- যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের সৎকাজগুলােকে আল্লাহ তায়ালা কখনাে বিপথগামী করে দেবেন না। তিনি তাদেরকে সুপথগামী করবেন, তাদের মনকে পরিশুদ্ধ করবেন এবং তাদেরকে সেই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পরিচয় তিনি তাদের কাছে আগেই তুলে ধরেছেন। তাদের সৎকাজগুলােকে কখনাে বিপথগামী করবেন না। লক্ষণীয় যে কাফেরদের সম্পর্কে ঠিক এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে, যারা কুফরি করেছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সৎ কাজগুলােকে বিপথগামী করে দেবেন। মােমেনদের সৎ কাজগুলাে সুপথগামী হবার অর্থ এই যে, সেগুলাের উদ্দেশ্য সফল হবে, সেগুলাে মনযিলে মাকসুদে পৌছে যাবে এবং যে মহাসত্য থেকে তার উদ্ভব ঘটেছে, তার সাথে তা অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকে। বস্তুত সমস্ত সৎকাজেরই উদ্ভব ঘটেছে পৃথিবীর বুকে সত্যকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে। তাই সৎকাজগুলাে চিরস্থায়ী ও সুরক্ষিত। তা কখনাে নষ্ট হয় না। কেননা তার উৎস সত্য, চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব। কখনাে তা নষ্ট হতে পারে না। এরপর আমরা আরাে একটা মহা সত্যের সম্মুখীন হই। সেটি হলো, আল্লাহর পথে শাহাদাতপ্রাপ্তদের অনন্ত জীবন। এ সত্য ইতিপূর্বে আল্লাহর আরাে একটা উক্তি থেকেও প্রমাণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাকে তােমরা মৃত বলো না, বরঞ্চ তারা জীবিত। তবে তােমার তা বুঝতে পার না।’ অবশ্য এখানে এর বর্ণনাভংগী নতুন ও অভিনব। অর্থাৎ পৃথিবীতে সে যেমন হেদায়াত, সুপথগামিতা ও পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতাে, তেমনি মৃত্যুর পরেও সে হেদায়াতের পথেই তার অভিযাত্রা অব্যাহত রাখবে, গােমরাহী তাকে স্পর্শ করবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সুপথগামী করবেন এবং তাদের মনকে পরিশুদ্ধ করবেন।’ বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন তাদের প্রভু। এই প্রভুর জন্যেই তারা জীবন উৎসর্গ করেছিলো, আর তিনিই তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, শাহাদাত লাভের পরও তার হেদায়াতের পথে থাকবে, শাহাদাতের পরও তাদের অন্তর সংশােধিত হবে, তাদের আত্মা পৃথিবীর অবশিষ্ট সমন্ত নােংরামি থেকেও পবিত্র হবে, অথবা অধিকতর পবিত্রতা অর্জন করবে, যাতে যে ফেরেশতাদের জগতে সে স্থান লাভ করেছে সেখানে যেন সে তাদের মতোই পবিত্র ও পুন্যময় হয়ে অবস্থান করতে পারে। বস্তুত শহীদদের ইহকালীন জীবন ও পরকালীন জীবন বিচ্ছিন্ন কিছু নয় বরং তা একটা অখণ্ড ও নিরবিচ্ছিন্ন জীবন। কেবল দুনিয়ার সাধারণ মানুষ তা দেখবার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত বিধায় দেখতে পায় না। সেটা এমন এক জীবন, যার চিরস্থায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাকে অধিকতর পরিচ্ছন্নতা, স্বচ্ছতা, ঔজ্জ্বল্য ও চাকচিক্য দান করেন এবং অধিকতর হেদায়াত দান করেন। সে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠে। সবশেষে তাদের সেই প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন করেন, যার সম্পর্কে তিনি বলেন, আর তাদেরকে সেই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পরিচিতি তাদের কাছে (আগেই) তুলে ধরেছেন। ইমাম আহমদ কর্তৃক স্বীয় মােসনাদে উদ্ধৃত একটি হাদীসে তার উল্লেখ রয়েছে। রসূল(স.) বলেছেন, শহীদের ছয়টা বৈশিষ্ট, রক্তের প্রথম ফোটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তার সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়, সে বেহেশতে কোথায় থাকবে তা দেখতে পায়, হুরদের সাথে তার বিয়ে হয়। কেয়ামতের ভয়াবহ আতংক ও কবরের আযাব থেকে সে রক্ষা পাবে এবং ঈমানের পােশাক পরিধান করবে। ইমাম আহমদ একই বক্তব্যসম্বলিত আরাে একটা হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে আরাে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শহীদ বেহেশতে আগেই সে বেহেশতে তার থাকার জায়গা দেখতে পাবে। এটাই হলাে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক শহীদদের কাছে জান্নাতের পরিচয় তুলে ধরার মর্ম। এটা আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত বা সুপথগামিতারই ধারাবাহিকতা। শহীদদের পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার পরও তাদের অন্তরের পরিশুদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতা অর্জনের এই ধারা চালু থাকবে।
*আল্লাহকে সাহায্য করা বলতে কী বুঝায় : আল্লাহর পথে শহীদদের এই দুর্লভ সম্মান, এই সন্তুষ্টি, এই তদারকী এবং এই উচ্চতর মর্যাদা লাভের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তায়ালা মােমেনদেরকে আল্লাহর জন্যে সর্বতােভাবে নিবেদিত হতে এবং পার্থিব জীবনে তার দ্বীনের বিজয়ে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করছেন। আর এই সাহায্যের বিনিময়ে তাদেরকে জিহাদের ময়দানে মযবুত কদমে টিকে থাকা ও তাঁর শত্রুদেরকে বিপর্যন্ত ও বিপথগামী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘হে মােমেনরা, তােমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তােমাদের পাগুলােকেও টিকিয়ে রাখবেন, আর যারা কাফের, তাদের ধ্বংস সাধিত হবে, তাদের সৎকাজগুলাে বৃথা ও বিপথগামী হবে। কেননা তারা আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে অপছন্দ করেছিলাে। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদের সৎকর্ম নষ্ট কর দিয়েছেন।’ এখন প্রশ্ন এই যে, মােমেনরা আল্লাহকে কিভাবে সাহায্য করবে, যাতে এই সাহায্য করার প্রতিদান হিসাবে তারা আল্লাহর সাহায্য পেতে পারে এবং দ্বীনের দাবী পূরণের সংগ্রামে টিকে থাকতে পারে? এর জবাব এই যে, আল্লাহর জন্যে তার বান্দারা জানমালসহ যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করবে, তার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ কোনাে ধরনের শিরকে লিপ্ত না হােক, তার নিজের জানমাল ও যাবতীয় প্রিয়বস্তুর চেয়ে আল্লাহ তায়ালাই তার কাছে প্রিয় হােক। তার চলন, বলন, আবেগ, অনুভূতি আশা আকাঙ্খা ও কামনা বাসনায় আল্লাহ তায়ালাই তার সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তদাতা হােক। এটা স্বভাবতই প্রত্যেক বান্দার কাছে আল্লাহর প্রাপ্য ও কাম্য, আর এটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বান্দা কর্তৃক আল্লাহর সাহায্য অর্থাৎ আল্লাহর দাবী পূরণ। মানুষের পার্থিব জীবন যাপনের জন্যে আল্লাহর একটা আইন ও বিধান রয়েছে, যার ভিত্তি গােটা বিশ্বজগত ও জীবন সংক্রান্ত বিশেষ দৃষ্টিভংগী, আদর্শ ও মূল্যবােধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর সেই আইন ও জীবনবিধানকে সাহায্য করলেই এবং কোনাে ব্যতিক্রম ছাড়া জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানকে সর্বময় কর্তৃত্ব দান করলে ও বাস্তবায়িত করলেই সামষ্টিক জীবনে আল্লাহকে সাহায্য করা হবে। ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়’ এবং ‘তােমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করাে’ আল্লাহর এই দুটো উক্তির মর্ম সম্পর্কে আমাদের একটু চিন্তা ভাবনা করা প্রয়ােজন। এখানে সুস্পষ্টতই লক্ষণীয় যে, নিহত হওয়া ও সাহায্য করা উভয় অবস্থার সাথেই আল্লাহর কথা যুক্ত রয়েছে। সুতরাং এই দুটোই আল্লাহর পথে ও আল্লাহর জন্যে হওয়া জরুরী। কিন্তু ঈমানের দুর্বলতায় আচ্ছন্ন কোনাে কোনাে প্রজন্ম এই মানে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়। ফলে শাহাদাত, একমাত্র অর্থে ব্যবহৃত হয় না। *জেহাদ হবে শুধু আল্লাহর পথে : মনে রাখতে হবে, জেহাদ যখন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, মৃত্যু যখন একমাত্র আল্লাহর পথেই সংঘটিত হবে এবং আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য ও বিজয় যখন একমাত্র আল্লাহর জন্যেই অর্জিত হবে- ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উভয় ক্ষেত্রে কেবল তখনই আল্লাহর কাছে জেহাদ ও শাহাদাত গ্রহণযোগ্য হবে এবং কেবল তখনই তার প্রতিদান হবে জান্নাত, যখন জেহাদের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করা। আল্লাহর আইনকে মানুষের হৃদয়ে, বিবেকে, চরিত্রে ও আচরণে সর্বময় কর্তৃত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠিত করা এবং আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচারবিভাগসহ সকল রাষ্ট্রীয় অংগনে শরীয়তকে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের আসনে আসীন করার উদ্দেশে হলেই কেবল জেহাদকে যথার্থ জেহাদ ও শাহাদাতকে প্রকৃত শাহাদাতরূপে গণ্য করা হবে এবং তখনই জান্নাত হবে তার প্রতিদান। হযরত আবূ মূসা(রা.) থেকে বর্ণিত আছে রাসূল(স.)-কে এমন তিন ব্যক্তি সম্পর্ক প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাদের একজন বীরত্বের খাতিরে লড়াই করেছিলাে, দ্বিতীয়জন হঠকারিতা ও প্রতিহিংসার রশে লড়াই করেছিলাে এবং তৃতীয়জন লােক দেখানাের উদ্দেশ্য নিয়ে লড়াই করেছিলাে। জিজ্ঞেস করা হয়েছিলাে যে, এ তিন জনের মধ্যে কোন জন আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছে? রসূল(স.) জবাব দিলেন, যে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হােক এ উদ্দেশ্যে লড়াই করেছে, সেই একমাত্র আল্লাহর পথের যোদ্ধা। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ) একমাত্র এই উদ্দেশ্য ও এই পতাকার খাতিরে ছাড়া আর কোনাে উদ্দেশ্য ও পতাকা এমন নেই, যার জন্যে কেউ জেহাদ করলে বা জেহাদ করে নিহত হলে তার জন্যে আল্লাহর বেহেশত প্রদানের ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। ইসলামের আসল নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত প্রজন্মগুলাের কাছে যুদ্ধ বিগ্রহের যে সব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সাধারণভাবে প্রচলিত, তার ভেতরে আর যা কিছুই হােক, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার বাসনা অন্তর্ভুক্ত থাকে না। যারা ইসলামের দাওয়াতের কাজে ব্যাপৃত, তাদের এই স্বতঃসিদ্ধ ও সহজবােধ্য কথাটা উপলব্ধি করা দরকার। দ্বীনের দাওয়াতকে তাদের অন্তরে এতােটা নির্ভেজাল ও’ নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত করা প্রয়ােজন, যেন তার সাথে বিদ্যমান পরিবেশ ও বিপথগামী প্রজন্মের লােকদের বিকৃত চিন্তাধারা এবং কোনাে অনৈসলামিক ধ্যান ধারণার মিশ্রণ না ঘটতে পারে। বস্তুত যে জেহাদ আল্লাহর আদর্শকে সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ট ও বিজয়ী আদর্শে পরিণত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়, তা কোনাে জেহাদ নয়। মন মানসিকতায় ও বিবেকে, চরিত্রে ও আচরণে, সমাজ ব্যবস্থায় ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, এক কথায় জীবনের সকল দিক ও বিভাগের পারস্পরিক সম্পর্ক, যােগাযোগ ও লেনদেনে সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধানই একমাত্র অনুসরণীয় আদর্শ হবে- একমাত্র এ উদ্দেশ্যে পরিচালিত যুদ্ধ বিগ্রহ ও লড়াই সংগ্রামই আল্লাহর পথের জেহাদ হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। এ ছাড়া আর যে উদ্দেশ্যেই যুদ্ধ বিগ্রহ বা সংগ্রাম পরিচালিত হােক তা আল্লাহর পথে বা আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরিচালিত জেহাদ নয় । তা শুধু শয়তানের পথের লড়াই। সে লড়াইতে কেউ নিহত হলে সে নিহত শহীদ নয়। সে মৃত্যু শাহাদাতও নয়, তার প্রতিদান জান্নাতও নয় এবং তার প্রতিদানে কোনাে সাহায্য বিজয় বা ময়দানে টিকে থাকার শক্তির যােগানও আসবে । এ ধরনের লড়াই নিছক ভাওতা, ভন্ডামি, বিপথগামিতা ও ভুল চিন্তার ফল ছাড়া আর কিছু নয়। যারা দাওয়াতের কাজে নিয়ােজিত নয়, তারা যদি এই ভাওতা ভন্ডামি ও কুচিন্তা থেকে মুক্ত হতে নাও পারে, তাহলে অন্ততপক্ষে আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের মন মগয বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তা চেতনাকে সমকালীন সমাজে প্রচলিত এই সব অপযুক্তি থেকে মুক্ত রাখা উচিত। কেননা তা আল্লাহর প্রথম ও যৌক্তিক শর্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। *আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে : বস্তুত এটা হলাে আল্লাহর আরােপিত শর্ত যা তিনি মােমেনদের ওপর আরােপ করেছেন। আর এর বিনিময়ে তিনি তাদেরকে সাহায্য, বিজয় ও সংগ্রামের ময়দানে দৃঢ়তা ও মনােবল অটুট রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। কখনাে যদি কিছু কালের জন্যে এই প্রতিশ্রুতির বিপরীত কিছু ঘটে, তবে তা হবে অন্য কোনাে মহৎ উদ্দেশ্যে সংঘটিত পরিকল্পিত ও নির্ধারিত ব্যাপার, যা সাহায্য ও দৃঢ়তা দানের ওয়াদার সাথে সাথে বাস্তবায়িত হয়। এ ব্যাখ্যা তখনই প্রযােজ্য, যখন এটা সঠিক প্রমাণিত হবে যে, মােমেনরা তাদের সাধ্যমতাে শর্ত পূরণ করেছে এবং তা সত্তেও আল্লাহর সাহায্য আসেনি। এখানে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তােমাদেরকে দৃঢ়তা দান করবেন এ কথাটা একটু গভীর চিন্তা ভাবনার দাবী রাখে। প্রাথমিকভাবে এ রকম ধারণা জন্মে যে, আল্লাহর সাহায্য আসার আগেই দৃঢ়তা অর্জিত হয় এবং দৃঢ়তার মাধ্যমেই সাহায্য ও বিজয় আসে, এ ধারণাই সঠিক। কিন্তু আয়াতে দৃঢ়তার উল্লেখ হয়েছে পরে এবং এ দ্বারা মনে হয়, এখানে দৃঢ়তার তাৎপর্য কিছুটা ভিন্নতর। অর্থাৎ বিজয় ও তার দায় দায়িত্ব বহনে দৃঢ়তা। (অর্থাৎ বিজয়কে ও তার সুফলকে টিকিয়ে রাখার জন্যে যে ঈমানী দৃঢ়তা প্রয়ােজন, তা আল্লাহ তায়ালা দান করবেন) বস্তুত কুফরী ও ঈমানের মধ্যে এবং সত্য ও গােমরাহীর মধ্যে যে লড়াই চলে, আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের মাধ্যমে সে লড়াই শেষ হয়ে যায় না। সাহায্য ও বিজয়ের ফলে বিজয় লাভকারীর ওপর ব্যক্তিগতভাবে কিছু দায় দায়িত্ব যেমন অর্পিত হয়, তেমনি সামাজিকভাবেও কিছু দায় দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত হয়। উপরস্তু বিজয়ের জন্যে অহংকারে মত্ত না হওয়া এবং এর শৈথিল্য আসতে না দেয়াও একটা দায়িত্ব। বিপদ মুসিবতে ও নির্যাতনে অনেকেই দৃঢ়তা দেখাতে পারে, কিন্তু বিজয় ও প্রাচুর্য লাভের পর অনেকেই দৃঢ়তা দেখাতে পারে না। আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় অর্জনের পর সত্যের ওপর মনের দৃঢ়তা, দায়িত্ব ও পরিশুদ্ধি অব্যাহত রাখাটা খােদ বিজয়েরও উর্ধ্বের একটা ধাপ বা স্তর। সম্ভবত এ আয়াতে সে দিকেই ইংগিত দেয়া হচ্ছে। প্রকৃত তত্ত্ব একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন।
*আল্লাহকে সাহায্য করা বলতে কী বুঝায় : আল্লাহর পথে শহীদদের এই দুর্লভ সম্মান, এই সন্তুষ্টি, এই তদারকী এবং এই উচ্চতর মর্যাদা লাভের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তায়ালা মােমেনদেরকে আল্লাহর জন্যে সর্বতােভাবে নিবেদিত হতে এবং পার্থিব জীবনে তার দ্বীনের বিজয়ে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করছেন। আর এই সাহায্যের বিনিময়ে তাদেরকে জিহাদের ময়দানে মযবুত কদমে টিকে থাকা ও তাঁর শত্রুদেরকে বিপর্যন্ত ও বিপথগামী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘হে মােমেনরা, তােমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তােমাদের পাগুলােকেও টিকিয়ে রাখবেন, আর যারা কাফের, তাদের ধ্বংস সাধিত হবে, তাদের সৎকাজগুলাে বৃথা ও বিপথগামী হবে। কেননা তারা আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে অপছন্দ করেছিলাে। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদের সৎকর্ম নষ্ট কর দিয়েছেন।’ এখন প্রশ্ন এই যে, মােমেনরা আল্লাহকে কিভাবে সাহায্য করবে, যাতে এই সাহায্য করার প্রতিদান হিসাবে তারা আল্লাহর সাহায্য পেতে পারে এবং দ্বীনের দাবী পূরণের সংগ্রামে টিকে থাকতে পারে? এর জবাব এই যে, আল্লাহর জন্যে তার বান্দারা জানমালসহ যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করবে, তার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ কোনাে ধরনের শিরকে লিপ্ত না হােক, তার নিজের জানমাল ও যাবতীয় প্রিয়বস্তুর চেয়ে আল্লাহ তায়ালাই তার কাছে প্রিয় হােক। তার চলন, বলন, আবেগ, অনুভূতি আশা আকাঙ্খা ও কামনা বাসনায় আল্লাহ তায়ালাই তার সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তদাতা হােক। এটা স্বভাবতই প্রত্যেক বান্দার কাছে আল্লাহর প্রাপ্য ও কাম্য, আর এটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বান্দা কর্তৃক আল্লাহর সাহায্য অর্থাৎ আল্লাহর দাবী পূরণ। মানুষের পার্থিব জীবন যাপনের জন্যে আল্লাহর একটা আইন ও বিধান রয়েছে, যার ভিত্তি গােটা বিশ্বজগত ও জীবন সংক্রান্ত বিশেষ দৃষ্টিভংগী, আদর্শ ও মূল্যবােধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর সেই আইন ও জীবনবিধানকে সাহায্য করলেই এবং কোনাে ব্যতিক্রম ছাড়া জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানকে সর্বময় কর্তৃত্ব দান করলে ও বাস্তবায়িত করলেই সামষ্টিক জীবনে আল্লাহকে সাহায্য করা হবে। ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়’ এবং ‘তােমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করাে’ আল্লাহর এই দুটো উক্তির মর্ম সম্পর্কে আমাদের একটু চিন্তা ভাবনা করা প্রয়ােজন। এখানে সুস্পষ্টতই লক্ষণীয় যে, নিহত হওয়া ও সাহায্য করা উভয় অবস্থার সাথেই আল্লাহর কথা যুক্ত রয়েছে। সুতরাং এই দুটোই আল্লাহর পথে ও আল্লাহর জন্যে হওয়া জরুরী। কিন্তু ঈমানের দুর্বলতায় আচ্ছন্ন কোনাে কোনাে প্রজন্ম এই মানে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়। ফলে শাহাদাত, একমাত্র অর্থে ব্যবহৃত হয় না। *জেহাদ হবে শুধু আল্লাহর পথে : মনে রাখতে হবে, জেহাদ যখন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, মৃত্যু যখন একমাত্র আল্লাহর পথেই সংঘটিত হবে এবং আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য ও বিজয় যখন একমাত্র আল্লাহর জন্যেই অর্জিত হবে- ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উভয় ক্ষেত্রে কেবল তখনই আল্লাহর কাছে জেহাদ ও শাহাদাত গ্রহণযোগ্য হবে এবং কেবল তখনই তার প্রতিদান হবে জান্নাত, যখন জেহাদের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করা। আল্লাহর আইনকে মানুষের হৃদয়ে, বিবেকে, চরিত্রে ও আচরণে সর্বময় কর্তৃত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠিত করা এবং আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচারবিভাগসহ সকল রাষ্ট্রীয় অংগনে শরীয়তকে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের আসনে আসীন করার উদ্দেশে হলেই কেবল জেহাদকে যথার্থ জেহাদ ও শাহাদাতকে প্রকৃত শাহাদাতরূপে গণ্য করা হবে এবং তখনই জান্নাত হবে তার প্রতিদান। হযরত আবূ মূসা(রা.) থেকে বর্ণিত আছে রাসূল(স.)-কে এমন তিন ব্যক্তি সম্পর্ক প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাদের একজন বীরত্বের খাতিরে লড়াই করেছিলাে, দ্বিতীয়জন হঠকারিতা ও প্রতিহিংসার রশে লড়াই করেছিলাে এবং তৃতীয়জন লােক দেখানাের উদ্দেশ্য নিয়ে লড়াই করেছিলাে। জিজ্ঞেস করা হয়েছিলাে যে, এ তিন জনের মধ্যে কোন জন আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছে? রসূল(স.) জবাব দিলেন, যে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হােক এ উদ্দেশ্যে লড়াই করেছে, সেই একমাত্র আল্লাহর পথের যোদ্ধা। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ) একমাত্র এই উদ্দেশ্য ও এই পতাকার খাতিরে ছাড়া আর কোনাে উদ্দেশ্য ও পতাকা এমন নেই, যার জন্যে কেউ জেহাদ করলে বা জেহাদ করে নিহত হলে তার জন্যে আল্লাহর বেহেশত প্রদানের ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। ইসলামের আসল নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত প্রজন্মগুলাের কাছে যুদ্ধ বিগ্রহের যে সব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সাধারণভাবে প্রচলিত, তার ভেতরে আর যা কিছুই হােক, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার বাসনা অন্তর্ভুক্ত থাকে না। যারা ইসলামের দাওয়াতের কাজে ব্যাপৃত, তাদের এই স্বতঃসিদ্ধ ও সহজবােধ্য কথাটা উপলব্ধি করা দরকার। দ্বীনের দাওয়াতকে তাদের অন্তরে এতােটা নির্ভেজাল ও’ নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত করা প্রয়ােজন, যেন তার সাথে বিদ্যমান পরিবেশ ও বিপথগামী প্রজন্মের লােকদের বিকৃত চিন্তাধারা এবং কোনাে অনৈসলামিক ধ্যান ধারণার মিশ্রণ না ঘটতে পারে। বস্তুত যে জেহাদ আল্লাহর আদর্শকে সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ট ও বিজয়ী আদর্শে পরিণত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়, তা কোনাে জেহাদ নয়। মন মানসিকতায় ও বিবেকে, চরিত্রে ও আচরণে, সমাজ ব্যবস্থায় ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, এক কথায় জীবনের সকল দিক ও বিভাগের পারস্পরিক সম্পর্ক, যােগাযোগ ও লেনদেনে সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধানই একমাত্র অনুসরণীয় আদর্শ হবে- একমাত্র এ উদ্দেশ্যে পরিচালিত যুদ্ধ বিগ্রহ ও লড়াই সংগ্রামই আল্লাহর পথের জেহাদ হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। এ ছাড়া আর যে উদ্দেশ্যেই যুদ্ধ বিগ্রহ বা সংগ্রাম পরিচালিত হােক তা আল্লাহর পথে বা আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরিচালিত জেহাদ নয় । তা শুধু শয়তানের পথের লড়াই। সে লড়াইতে কেউ নিহত হলে সে নিহত শহীদ নয়। সে মৃত্যু শাহাদাতও নয়, তার প্রতিদান জান্নাতও নয় এবং তার প্রতিদানে কোনাে সাহায্য বিজয় বা ময়দানে টিকে থাকার শক্তির যােগানও আসবে । এ ধরনের লড়াই নিছক ভাওতা, ভন্ডামি, বিপথগামিতা ও ভুল চিন্তার ফল ছাড়া আর কিছু নয়। যারা দাওয়াতের কাজে নিয়ােজিত নয়, তারা যদি এই ভাওতা ভন্ডামি ও কুচিন্তা থেকে মুক্ত হতে নাও পারে, তাহলে অন্ততপক্ষে আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের মন মগয বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তা চেতনাকে সমকালীন সমাজে প্রচলিত এই সব অপযুক্তি থেকে মুক্ত রাখা উচিত। কেননা তা আল্লাহর প্রথম ও যৌক্তিক শর্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। *আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে : বস্তুত এটা হলাে আল্লাহর আরােপিত শর্ত যা তিনি মােমেনদের ওপর আরােপ করেছেন। আর এর বিনিময়ে তিনি তাদেরকে সাহায্য, বিজয় ও সংগ্রামের ময়দানে দৃঢ়তা ও মনােবল অটুট রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। কখনাে যদি কিছু কালের জন্যে এই প্রতিশ্রুতির বিপরীত কিছু ঘটে, তবে তা হবে অন্য কোনাে মহৎ উদ্দেশ্যে সংঘটিত পরিকল্পিত ও নির্ধারিত ব্যাপার, যা সাহায্য ও দৃঢ়তা দানের ওয়াদার সাথে সাথে বাস্তবায়িত হয়। এ ব্যাখ্যা তখনই প্রযােজ্য, যখন এটা সঠিক প্রমাণিত হবে যে, মােমেনরা তাদের সাধ্যমতাে শর্ত পূরণ করেছে এবং তা সত্তেও আল্লাহর সাহায্য আসেনি। এখানে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তােমাদেরকে দৃঢ়তা দান করবেন এ কথাটা একটু গভীর চিন্তা ভাবনার দাবী রাখে। প্রাথমিকভাবে এ রকম ধারণা জন্মে যে, আল্লাহর সাহায্য আসার আগেই দৃঢ়তা অর্জিত হয় এবং দৃঢ়তার মাধ্যমেই সাহায্য ও বিজয় আসে, এ ধারণাই সঠিক। কিন্তু আয়াতে দৃঢ়তার উল্লেখ হয়েছে পরে এবং এ দ্বারা মনে হয়, এখানে দৃঢ়তার তাৎপর্য কিছুটা ভিন্নতর। অর্থাৎ বিজয় ও তার দায় দায়িত্ব বহনে দৃঢ়তা। (অর্থাৎ বিজয়কে ও তার সুফলকে টিকিয়ে রাখার জন্যে যে ঈমানী দৃঢ়তা প্রয়ােজন, তা আল্লাহ তায়ালা দান করবেন) বস্তুত কুফরী ও ঈমানের মধ্যে এবং সত্য ও গােমরাহীর মধ্যে যে লড়াই চলে, আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের মাধ্যমে সে লড়াই শেষ হয়ে যায় না। সাহায্য ও বিজয়ের ফলে বিজয় লাভকারীর ওপর ব্যক্তিগতভাবে কিছু দায় দায়িত্ব যেমন অর্পিত হয়, তেমনি সামাজিকভাবেও কিছু দায় দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত হয়। উপরস্তু বিজয়ের জন্যে অহংকারে মত্ত না হওয়া এবং এর শৈথিল্য আসতে না দেয়াও একটা দায়িত্ব। বিপদ মুসিবতে ও নির্যাতনে অনেকেই দৃঢ়তা দেখাতে পারে, কিন্তু বিজয় ও প্রাচুর্য লাভের পর অনেকেই দৃঢ়তা দেখাতে পারে না। আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় অর্জনের পর সত্যের ওপর মনের দৃঢ়তা, দায়িত্ব ও পরিশুদ্ধি অব্যাহত রাখাটা খােদ বিজয়েরও উর্ধ্বের একটা ধাপ বা স্তর। সম্ভবত এ আয়াতে সে দিকেই ইংগিত দেয়া হচ্ছে। প্রকৃত তত্ত্ব একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন।
*কাফেরদের চরম ব্যর্থতা : ‘আর যারা কুফরী করে তারা ব্যর্থ হােক এবং আল্লাহ তায়ালা তাদের সৎকাজগুলােকে বিপথগামী করে দেবেন।’ এটা বিজয় ও দৃঢ়তার বিপরীত। ব্যর্থ হােক বলে যে বদদোয়া করা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের সব কর্মকান্ড নিস্ফল করে দেয়ার সিদ্ধান্তই ঘােষিত হয়েছে। এরপর পুনরায় সৎকাজগুলােকে বিপথগামী করার উল্লেখ দ্বারা তার পুরােপুরি ধ্বংস ও বিনাশ সাধনের কথাই বলা হয়েছে। ‘এর কারণ এই যে, তারা আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে অপছন্দ করেছে। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদের সৎ কাজগুলােকে বাতিল করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-এর ওপর যে কোরআন, শরীয়ত, জীবন বিধান ও সদুপদেশ নাযিল করেছেন, তার প্রতি কাফেরদের মনে যে বিরাগ ও অসন্তোষ বিরাজ করতাে, এখানে তারই ছবি তুলে ধরা হয়েছে। এই বিরাগ ও অসন্তোষই তাদেরকে কুফরি, হঠকারিতা, বিদ্বেষ ও গােয়ার্তুমির দিকে ঠেলে দিতাে। আল্লাহর সেই নিখুত ও নির্ভুল বিধানের প্রতি যারা স্বভাবগতভাবেই বিদ্বেষ ও আক্রোশ পােষণ করে এবং এই বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাব প্রকৃতির অধিকারী হওয়ার দরুণ যাদের অন্তরে ভেতরে ভেতরেই দ্বন্দ্ব সংঘাত চলে, এখানে তাদেরই মানসিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এ ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন লােকের সাক্ষাত সকল যুগে ও সকল স্থানেই পাওয়া যায়। এ ধরনের লােকেরা ইসলাম ও ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনাে ব্যক্তি বা জিনিসের প্রতি এতাে বেশী বিদ্বিষ্ট ও উন্নাসিক হয়ে থাকে যে, এর নাম শুনতেই তারা বিচ্ছু দংশিত মানুষের ন্যায় আতংকে দিশেহারা হয়ে যায়। তাই কোনাে আলাপ আলােচনায় ইসলামের কোনাে উল্লেখ এমনকি আভাস ইংগিতও যাতে না হতে পারে, সে জন্যে তারা সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বন করে। একটু লক্ষ্য করলেই এ ধরনের একটা অবস্থা বােধ হয় আমাদের চোখের সামনে খােলামেলাভাবেই প্রত্যক্ষ করা যাবে। আর আল্লাহর নাযিল করা বাণীর প্রতি এই বিরাগ ও বিদ্বেষের ফল এই হয়েছিলাে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সমস্ত সৎকর্ম বাতিল ও নস্যাত করে দিয়েছিলেন, সকর্মগুলােকে বাতিল করা কোরআনের একটা সুপরিচিত পরিভাষা। এ পরিভাষা দ্বারা কোরআন একটা বিশেষ প্রক্রিয়ার বিবরণ দেয়। কেননা মূল আয়াতে আহবাতা (বাতিল করা অর্থে) যে শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে, তার মূল হলাে ‘হুবুত। আভিধানিক অর্থে এক ধরনের বিষাক্ত ঘাস খাওয়ার দরুণ গবাদি পশুর পেট ফুলে যাওয়াকে ‘হুবুত’ বলা হয়। এর দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, বিষাক্ত ঘাস খেয়ে এসব পশু যেভাবে পেটফুলে মরে, কাফেরদের ওহীবিদ্বেষ ও ইসলামবিরাণী মানসিকতার কারণে তাদের সৎকাজগুলােও সেইভাবে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস ও বিনাশপ্রাপ্ত হয়। এভাবে এটা যেন একটা ধ্বংস প্রক্রিয়ার জীবন্ত ছবি। আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে অপছন্দ করার পরিণামে তাদের বড় বড় সৎ কাজ বিষাক্ত ঘাস খাওয়া গবাদি পশুর পেটের ন্যায় ফুলে ফেঁপে এভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়!