أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৩৫/এবং কাফের-রা বলে:-১০) [*এবং কাফিররা বলে, ‘এ তো এক আশ্চর্য জিনিস ! :- *  *পুনরুজ্জীবনের জীবন্ত উদাহরণ :-   *মানুষের আমলের রেকর্ড :-] www.motaher21.net সূরা:৫০-ক্বাফ। পারা:২৬ ০১-২৯ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৫/এবং কাফের-রা বলে:-১০)
[*এবং কাফিররা বলে, ‘এ তো এক আশ্চর্য জিনিস ! :-
*  *পুনরুজ্জীবনের জীবন্ত উদাহরণ :-
*মানুষের আমলের রেকর্ড :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫০-ক্বাফ। পারা:২৬
০১-২৯ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৫০-ক্বাফ) : নামকরণ:

সূরার প্রথম বর্ণটিই এর নাম হিসেবে গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ এটি সেই সূরা যা ق (ক্বাফ) বর্ণ দিয়ে শুরু হয়েছে।
(৫০-ক্বাফ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

ঠিক কোন্ সময় এ সূরা নাযিল হয়েছে তা কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায় না। তবে এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝা যায়, এটি মক্কী যুগের দ্বিতীয় পর্যায়ে নাযিল হয়েছে। মক্কী যুগের দ্বিতীয় পর্যায় নবুওয়াতের তৃতীয় সন থেকে শুরু করে পঞ্চম সন পর্যন্ত বিস্তৃত। আমি সূরা আন’আমের ভূমিকায় এ যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করেছি। ঐসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিচার করলে মোটামুটি অনুমান করা যায় যে, সূরাটি নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে নাযিল হয়ে থাকবে। এ সময় কাফেরদের বিরোধিতা বেশ কঠোরতা লাভ করেছিল। কিন্তু তখনো জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়নি।
(৫০-ক্বাফ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :

নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহ থেকে জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে দু’ ঈদের নামাযে এ সূরা পড়তেন।

উম্মে হিশাম ইবনে হারেসা নাম্নী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিবেশিনী এক মহিলা বর্ণনা করেছেন যে, প্রায়ই আমি নবীর (সা.) মুখ থেকে জুমআর খুতবায় এ সূরাটি শুনতাম এবং শুনতে শুনতেই তা আমার মুখস্ত হয়েছে। অপর কিছু রেওয়ায়াতে আছে যে, তিনি বেশীর ভাগ ফজরের নামাযেও এ সূরাটি পাঠ করতেন। এ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নবীর (সা.) দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। সেজন্য এর বিষয়বস্তু অধিক সংখ্যক লোকের কাছে পৌঁছানোর জন্য বারবার চেষ্টা করতেন।

সূরাটি মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করলে এর গুরুত্বের কারণ সহজেই উপলব্ধি করা যায়। গোটা সূরার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আখেরাত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা মুয়াযযমায় দাওয়াতের কাজ শুরু করলে মানুষের কাছে তাঁর যে কথাটি সবচেয়ে বেশী অদ্ভূদ মনে হয়েছিল তা হচ্ছে, মৃত্যুর পর পুনরায় মানুষকে জীবিত করে উঠানো হবে এবং তাদেরকে নিজের কৃতকর্মের হিসেব দিতে হবে। লোকজন বলতো, এটা তো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। এরূপ হতে পারে বলে বিবেক-বুদ্ধি বিশ্বাস করে না। আমাদের দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু যখন মাটিতে মিশে বিলীন হয়ে যাবে তখন হাজার হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ঐসব বিক্ষিপ্ত অংশকে পুনরায় একত্রিত করে আমাদের দেহকে পুনরায় তৈরী করা হবে এবং আমরা জীবিত হয়ে যাব তা কি করে সম্ভব? এর জবাবে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এ ভাষণটি নাযিল হয়। এতে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট বাক্যে একদিকে আখেরাতের সম্ভাব্যতা ও তা সংঘটিত হওয়া সম্পর্কে প্রমাণাদি পেশ করা হয়েছে। অপরদিকে মানুষকে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা বিস্মিত হও, বিবেক-বুদ্ধি বিরোধী মনে করো কিংবা মিথ্যা বলে মনে করো তাতে কোন অবস্থায়ই সত্য পরিবর্তিত হতে পারে না। সত্য তথা অকাট্য ও অটল সত্য হচ্ছে এই যে, তোমাদের দেহের এক একটি অণু-পরমাণু যা মাটিতে বিলীন হয়ে যায় তা কোথায় গিয়েছে এবং কি অবস্থায় কোথায় আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত আছেন। বিক্ষিপ্ত এসব অণু-পরমাণু পুনরায় একত্রিত হয়ে যাওয়া এবং তোমাদেরকে ইতিপূর্বে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল ঠিক সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করার জন্য আল্লাহ তা’আলার একটি ইঙ্গিতই যথেষ্ট। অনুরূপভাবে তোমাদের এ ধারণাও একটি ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয় যে, এখানে তোমাদের লাগামহীন উটের মত ছেড়ে দেয়া হয়েছে, কারো কাছে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে না। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ তা’আলা নিজেও সরাসরি তোমাদের প্রতিটি কথা ও কাজ সম্পর্কে এমনকি তোমাদের মনের মধ্যে জেগে ওঠা সমস্ত ধারণা ও কল্পনা পর্যন্ত অবহিত আছেন। তাছাড়া তাঁর ফেরেশতারাও তোমাদের প্রত্যেকের সাথে থেকে তোমাদের সমস্ত গতিবিধি রেকর্ড করে সংরক্ষিত করে যাচ্ছে। যেভাবে বৃষ্টির একটি বিন্দু পতিত হওয়ার পর মাটি ফুড়ে উদ্ভিদরাজির অঙ্কুর বেরিয়ে আসে তেমনি নির্দিষ্ট সময় আসা মাত্র তাঁর একটি মাত্র আহবানে তোমরাও ঠিক তেমনি বেরিয়ে আসবে। আজ তোমাদের বিবেক-বুদ্ধির ওপর গাফলতের যে পর্দা পড়ে আছে তোমাদের সামনে থেকে সেদিন তা অপসারিত হবে এবং আজ যা অস্বীকার করছো সেদিন তা নিজের চোখে দেখতে পাবে। তখন তোমরা জানতে পারবে, পৃথিবীতে তোমরা দায়িত্বহীন ছিলে না, বরং নিজ কাজ-কর্মের জন্য দায়ী ছিলে। পুরস্কার ও শাস্তি, আযাব ও সওয়াব এবং জান্নাত ও দোযখ যেসব জিনিসকে আজ তোমরা আজব কল্প কাহিনী বলে মনে করছো সেদিন তা সবই তোমাদের সামনে বাস্তব সত্য হয়ে দেখা দেবে। যে জাহান্নামকে আজ বিবেক-বুদ্ধির বিরোধী বলে মনে করো সত্যের সাথে শত্রুতার অপরাধে সেদিন তোমাদের সেই জাহান্নামেই নিক্ষেপ করা হবে। আর যে জান্নাতের কথা শুনে আজ তোমরা বিস্মিত হচ্ছো মহা দয়ালু আল্লাহকে ভয় করে সঠিক পথে ফিরে আসা লোকেরা সেদিন তোমাদের চোখের সামনে সেই জান্নাতে চলে যাবে।

# مَجِيْدٌ শব্দ আরবী ভাষায় দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক, উচ্চ পদের অধিকারী, শ্রেষ্ঠ মহান এবং সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। দুই, দয়ালু, অধিক দানশীল এবং অতি মাত্রায় উপকারকারী। কুরআনের জন্য এ শব্দটি দু’টি অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআন মহান এ দিক দিয়ে যে, তার মোকাবিলায় দুনিয়ার আর কোন গ্রন্থই পেশ করা যেতে পারে না। ভাষা ও সাহিত্যিক মূল্যবোধের বিচারেও তা মু’জিযা আবার শিক্ষা ও জ্ঞানের বিচারেও তা মু’জিযা। কুরআন যে সময় নাযিল হয়েছিল সে সময়েও মানুষ কুরআনের বাণীর মত বাণী বানিয়ে পেশ করতে অক্ষম ছিল এবং আজও অক্ষম। তার কোন কথা কখনো কোন যুগে ভুল প্রমাণ করা যায়নি এবং যাবেও না। বাতিল না পারে সামনে থেকে এর মোকাবিলা করতে না পারে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে পরাজিত করতে। কুরআন অধিক দাতা এ দিক দিয়ে যে, মানুষ তার থেকে যত বেশী পথনির্দেশনা পাওয়ার চেষ্টা করে সে তাকে ততটাই পথনির্দেশনা দান করে এবং যত বেশী তা অনুসরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ সে ততই বেশী লাভ করতে থাকে। এর উপকার ও কল্যাণের এমন কোন সীমা নেই যেখানে পৌঁছে মানুষ এর মুখাপেক্ষী না হয়েও পারে কিংবা যেখানে পৌঁছার পর এর উপকারিতা শেষ হয়ে যায়।
# এ আয়াতাংশটি অলংকারময় ভাষার একটি অতি উত্তম নমুনা। অনেক বড় একটি বিষয়কে এতে কয়েকটি সংক্ষিপ্ত শব্দের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়েছে। যে ব্যাপারে কুরআনের শপথ করা হয়েছে তা বর্ণনা করা হয়নি। এ বিষয়টি উল্লেখ করার পরিবর্তে মাঝে একটি সূক্ষ্ম শূন্যতা রেখে পরবর্তী কথা ‘আসলে’ বা ‘বরং’ শব্দ দিয়ে আরম্ভ করা হয়েছে। কেউ যদি একটু চিন্তা-ভাবনা করে এবং যে পটভূমিতে একথা বলা হয়েছে সেদিকেও খেয়াল রাখে তাহলে শপথ ও ‘বরং’ শব্দের মাঝে যে শূন্যতা রেখে দেয়া হয়েছে তার বিষয়বস্তু কি তা সে জানতে পারবে। এখানে মূলত যে ব্যাপারে শপথ করা হয়েছে তা হচ্ছে, মক্কাবাসীরা কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত মানতে অস্বীকার করেনি বরং একেবারেই একটি অযৌক্তিক কারণে অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ তাদের স্বজাতির একজন মানুষ এবং তাদের নিজেদের কওমের এক ব্যক্তির আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্ককারী হয়ে আসা তাদের কাছে অতি আশ্চর্যজনক ব্যাপার। অথচ, বিস্ময়ের ব্যাপার হতে পারতো যদি আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে তাদের সাবধান করার কোন ব্যবস্থা না করতেন, কিংবা মানুষকে সাবধান করার জন্য মানুষ ছাড়া অন্য কিছুকে পাঠাতেন অথবা আরবদের সাবধান করার জন্য কোন চীনাকে পাঠিয়ে দিতেন। তাই অস্বীকৃতির এ কারণ একেবারেই অযৌক্তিক। সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষ নিশ্চিতভাবেই একথা মানতে বাধ্য যে, বান্দাদেরকে হিদায়াতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যই ব্যবস্থা হওয়া উচিত এবং সেটা হবে এভাবে যে, যাদের মধ্যে সাবধানকারীকে পাঠানো হয়েছে সে তাদেরই একজন হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই কি সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ এ কাজের জন্য পাঠিয়েছেন? এ বিষয়টি মীমাংসার জন্য আর কোন সাক্ষ্যের প্রয়োজন নেই, যে মহান ও শ্রেষ্ঠ কল্যাণময় কুরআন তিনি পেশ করেছেন সেটিই তার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট। এ ব্যাখ্যা থেকে জানা যায় যে, এ আয়াতে কুরআনের শপথ করা হয়েছে একথা বুঝানোর জন্য যে, মুহাম্মাদ ﷺ সত্যিই আল্লাহর রসূল এবং তাঁর রিসালাত সম্পর্কে কাফেরদের বিস্ময় অহেতুক। কুরআনের “মাজীদ” হওয়াকে এ দাবীর প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে।
# এটা ছিল তাদের দ্বিতীয় বিস্ময়। তাদের প্রথম ও প্রকৃত বিস্ময় মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে ছিল না, বরং তা ছিল এ বিষয়ে যে, তাদের নিজেদের কওমের এক ব্যক্তি দাবী করে বসেছে যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে সাবধান করার জন্য এসেছেন। তাছাড়া তারা আরো বিস্মিত হয়েছে এ কারণে যে, তিনি যে বিষয়ে তাদেরকে সাবধান করছিলেন তা হচ্ছে, সমস্ত মানুষকে মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবিত করা হবে, তাদেরকে একত্রিত করে আল্লাহর আদালতে হাজির করা হবে এবং সেখানে তাদের সমস্ত কাজ-কর্মের হিসেব নিকেশের পর পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে।
# একথা যদি তাদের বিবেক-বুদ্ধিতে না ধরে তাহলে তা তাদের বিবেক-বুদ্ধির সংকীর্ণতা। তাদের বিবেক-বুদ্ধির সংকীর্ণতার কারণে আল্লাহর জ্ঞান ও কুদরতও সংকীর্ণ হতে হবে তা নয়। এরা মনে করে, সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারী অসংখ্য মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশ যা মাটিতে মিশে গিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও বিক্ষিপ্ত হয়ে মিশে যাবে তা একত্রিত করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, ঐ সব দেহাংশের একেকটি যেখানে যে অবস্থায় আছে আল্লাহ তা’আলা তা সরাসরি জানেন, তাছাড়া আল্লাহর দফতরে তার পূর্ণাংগ রেকর্ডও সংরক্ষণ করা হচ্ছে। একটি ক্ষুদ্র অণুও তা থেকে বাদ পড়ছে না। যখন আল্লাহর নির্দেশ হবে সেই মুহূর্তেই তাঁর ফেরেশতারা উক্ত রেকর্ড দেখে একেকটি অণুকে খুঁজে বের করবে এবং সমস্ত মানুষ যে দেহ নিয়ে দুনিয়াতে কাজ করেছিল সেই দেহ তারা পুনরায় বানিয়ে দেবে।

আখেরাতের জীবন যে কেবল দুনিয়ার জীবনের মত দৈহিক জীবন হবে তাই নয় বরং দুনিয়াতে মানুষের যে দেহ ছিল আখেরাতেও প্রত্যেক মানুষের হুবহু সে একই দেহ হবে। কুরআন মজীদের যেসব আয়াতে একথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে এ আয়াতটিও তার একটি। যদি ব্যাপাটি তা না হতো তাহলে কাফেরদের কথার জবাবে একথা বলা একেবারেই অর্থহীন হতো যে, মাটি তোমাদের দেহের যা কিছু খেয়ে ফেলে তা সবই আমার জানা আছে এবং তার প্রতিটি অণু-পরমাণুর রেকর্ড আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা হা-মীম, আস সাজদা, টীকা ২৫)
# এ সংক্ষিপ্ত বাক্যাংশটিতে একটি অতি বড় বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। এর অর্থ তারা শুধু বিস্ময় প্রকাশ করা এবং বিবেক-বুদ্ধি বিরোধী ঠাওরানোকেই যথেষ্ট মনে করেনি। বরং যে সময় মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর সত্যের দাওয়াত পেশ করেছেন সে সময় তারা কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তাকে নির্জলা মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেছে। অবশ্যম্ভাবীরূপে তার যে ফল হওয়ার ছিল এবং হয়েছে তা হচ্ছে, এ দাওয়াত এবং এ দাওয়াত পেশকারী রসূলের ব্যাপারে এরা কখনো স্থির ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি। কখনো তাকে কবি বলে, কখনো বলে গণক কিংবা পাগল। কখনো বলে সে যাদুকর আবার কখনো বলে কেউ তাঁর ওপর যাদু করেছে। কখনো বলে নিজের বড়ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সে এ বাণী নিজে বানিয়ে এনেছে আবার কখনো অপবাদ আরোপ করে যে, অন্যকিছু লোক তার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তারাই তাকে এসব কথা বানিয়ে দেয়। এসব পরস্পর বিরোধী কথাই প্রকাশ করে যে, তারা নিজেদের দৃষ্টিভংগী সম্পর্কেই পুরোপুরি দ্বিধান্বিত। যদি তারা তাড়াহুড়ো করে একেবারে প্রথমেই নবীকে অস্বীকার না করতো এবং কোন রকম চিন্তা-ভাবনা না করে আগেভাগেই একটি সিদ্ধান্ত দেয়ার পূর্বে ধীরস্থিরভাবে একথা ভেবে দেখতো যে, কে এ দাওয়াত পেশ করছে, কি কথা বলছে এবং তাঁর দাওয়াতের স্বপক্ষে কি দলীল-প্রমাণ পেশ করছে তাহলে তারা কখনো এ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়তো না। এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, তাদের কাছে ঐ ব্যক্তি অপরিচিত কেউ ছিল না। সে অন্য কোনখান থেকে আকস্মিকভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। সে তাদের স্বজাতিরই একজন সদস্য ছিল। তাদের জানা শোনা লোক ছিল। তারা তাঁর চরিত্র ও কর্ম যোগ্যতা সম্পর্কে অনবহিত ছিল না। এমন একজন মানুষের পক্ষ থেকে যখন একটি কথা পেশ করা হয়েছিল তখন সাথে সাথে তা গ্রহণ না করলেও শোনামাত্রই তা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মতও ছিল না। তাছাড়া সেটি যুক্তি-প্রমাণহীন কথাও ছিল না। সে তার পক্ষে দলীল-প্রমাণ পেশ করেছিলো। তার প্রমাণাদি কতখানি যুক্তিসঙ্গত তা খোলা কান দিয়ে শোনা এবং পক্ষপাতহীনভাবে যাঁচাই বাছাই করে দেখা উচিত ছিল। কিন্তু এ নীতি গ্রহণ করার পরিবর্তে যখন তারা জিদের বশবর্তী হয়ে প্রথম পর্যায়েই তাঁকে অস্বীকার করে বসলো তখন তার ফল হলো এই যে, সত্য পর্যন্ত পৌঁছার একটি দরজা তারা নিজেরাই বন্ধ করে দিল এবং চারদিকে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ানোর অনেক দরজা খুলে নিল। এখন তারা নিজেদের প্রাথমিক ভুলকে যুক্তিসিদ্ধ করার পর পরস্পর বিরোধী আরো অনেক কথা গড়তে পারে। কিন্তু তিনি সত্য নবীও হতে পারেন এবং তার পেশকৃত কথা সত্যও হতে পারে এ একটি কথা চিন্তা করে দেখার জন্যও তারা প্রস্তুত নয়।
# উপরোল্লেখিত পাঁচটি আয়াতে মক্কার কাফেরদের ভূমিকার অযৌক্তিকতা স্পষ্ট করে দেয়ার পর মুহাম্মাদ ﷺ আখেরাতের যে খবর দিয়েছেন তার সত্যতার প্রমাণাদি কি তা বলা হচ্ছে। এখানে একথাটি ভালভাবে বুঝে নেয়া প্রয়োজন যে, কাফেররা যে দু’টি বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলো তার মধ্যে একটি অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে প্রারম্ভেই দু’টি প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। প্রথম প্রমাণটি হলো, তিনি তোমাদের সামনে কুরআন মজীদ পেশ করেছেন যা তাঁর নবী হওয়ার খোলাখুলি প্রমাণ। দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে তিনি তোমাদের নিজদের স্বজাতি ও জ্ঞাতি গোষ্ঠীর লোক। তিনি হঠাৎ আসমান থেকে কিংবা অন্য কোন অঞ্চল থেকে এসে হাজির হননি যে, তিনি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি কিনা আর এ কুরআন তাঁর নিজের রচিত কথা হতে পারে কিনা তা তাঁর জীবন, চরিত্র ও কর্ম যাঁচাই-বাছাই করে বিশ্লেষণ করা কঠিন নয় । অতএব তাঁর নবুওয়াত দাবী সম্পর্কে তোমাদের বিস্ময় অনর্থক। এ যুক্তি-প্রমাণ সবিস্তারে পেশ করার পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত দু’টি ইঙ্গিত আকারে বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা, মুহাম্মাদ ﷺ যে সময় মক্কায় দাঁড়িয়ে নিজে সেসব লোকদের কুরআন শুনাচ্ছিলেন যারা তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে যৌবন এবং পৌঢ়ত্ব পর্যন্ত তাঁর গোটা জীবন দেখেছিল, সে সময়ের প্রতিটি ব্যক্তির কাছে এসব ইঙ্গিতের বিস্তারিত পরিবেশ ও পটভূমি আপনা থেকেই সুস্পষ্ট ছিল। তাই তাঁর বর্ণনা বাদ দিয়ে দ্বিতীয় যে জিনিসটিকে ঐ সব লোক অদ্ভূদ ও বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী বলছে তার সত্যতার বিস্তারিত যুক্তি-প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে।
# এখানে আসমান বলতে পুরো ঊর্ধ্বজগতকে বুঝানো হয়েছে। যা মানুষ রাত-দিন তার মাথার ওপর ছেয়ে থাকতে দেখে। যেখানে দিনের বেলা সূর্য দীপ্তি ছড়ায়, রাতের বেলা চাঁদ এবং অসংখ্য তারকারাজি উজ্জল হয়ে দেখা দেয়। মানুষ যদি এগুলোকে খালি চোখেই দেখে তাহলেও সে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ে। আর দূরবীন লাগিয়ে দেখলে এমন একটি বিশাল সুবিস্তৃত সৃষ্টিজগত তার সামনে ভেসে ওঠে যার কোন সীমা পরিসীমা নেই। কোথায় শুরু এবং কোথায় শেষ হয়েছে বুঝা যাবে না। আমাদের পৃথিবীর চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বড় বিশালকার গ্রহসমূহ এর মধ্যে বলের মত ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের সূর্যের চেয়ে হাজার হাজার গুণ অধিক উজ্জল তারকা তার মধ্যে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আমাদের এ সৌরজগত তার একটি মাত্র ছায়াপথের এক কোণে পড়ে আছে। এ একটি মাত্র ছায়াপথে আমাদের সূর্যের মত কমপক্ষে আরো ৩ শত কোটি তারকা (স্থির বস্তু) বিদ্যমান এবং মানুষের পর্যবেক্ষণ এ পর্যন্ত এরূপ দশ লাখ ছায়াপথের সন্ধান দিচ্ছে। এ লক্ষ লক্ষ ছায়াপথের আমাদের সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী প্রতিবেশী ছায়াপথটি এত দূরে অবস্থিত যে, তার আলো সেকেণ্ডে এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিতে অগ্রসর হয়ে দশ লাখ বছরে আমাদের পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছে। এটা হচ্ছে সৃষ্টিজগতের সেই অংশের বিস্তৃতির অবস্থা যা এ পর্যন্ত মানুষের জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। আল্লাহর কর্তৃত্ব কত ব্যাপক ও বিস্তৃত তার কোন অনুমান আমরা করতে পারি না। হতে পারে, সমুদ্রের তুলনায় এক বিন্দু পানি যতটুকু মানুষের জানা সৃষ্টিজগত গোটা সৃষ্টিজগতের অনুপাতের ততটুকুও নয়। যে আল্লাহ এ বিশাল সৃষ্টিজগতকে অস্তিত্ব দান করেছেন, ভুপৃষ্ঠের ধীরগতি ও বাকশক্তি সম্পন্ন মানুষ নামে অভিহিত অতি ক্ষুদ্র জীব যদি সেই আল্লাহ সম্পর্কে মত প্রকাশ করে যে, মৃত্যুর পর তিনি তাকে পুনরায় জীবিত করতে পারবেন না তাহলে সেটা তার নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির সংকীর্ণতা মাত্র। তাতে বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা কি করে সীমিত হতে পারে!
# এ বিস্ময়কর বিস্তৃতি সত্ত্বেও এ বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা এমন সুশৃংখল ও মজবুত এবং তার বন্ধন এমন অটুট যে, তাতে কোথাও কোন চিড় বা ফাটল এবং কোথাও গিয়ে এর ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয় না। একটি উদাহরণের সাহায্যে এ বিষয়টি ভালভাবে বুঝা যেতে পারে, আধুনিক যুগের বেতার সংকেত ভিত্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-গবেষকগণ একটি ছায়াপথ পর্যবক্ষেণ করেছেন যাকে তারা উৎস ৩গ ২৯৫ (Source 3c 295) নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। উক্ত ছায়াপথ সম্পর্কে তাদের ধারণা হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের কাছে তার যে আলো এসে পৌঁছেছে তার চারশ’ কোটি বছরেরও বেশী সময় পূর্বে সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে থাকবে। এত দূর থেকে এসব আলোক রশ্মির পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছা কি করে সম্ভব হতো যদি পৃথিবী এবং উক্ত ছায়াপথের মাঝে বিশ্ব ব্যবস্থার ধারাবাহিকতার কোথাও ছিন্ন থাকতো এবং বন্ধনে ফাটল থাকতো। আল্লাহ তা’আলা এ সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামনে এ প্রশ্নই রেখেছেন যে, আমার সৃষ্ট বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থাপনায় যখন তোমরা একটি সামান্য ছিদ্রও দেখিয়ে দিতে পারো না তখন তোমাদের মগজে আমার দূর্বলতার এ ধারণা কোথা থেকে আসে যে, তোমাদের পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর হিসেব-নিকেশ নেয়ার জন্য আমি তোমাদের জীবিত করে আমার সামনে হাজির করতে চাইলে তা করতে পারবো না।

এটা শুধু আখেরাতের সম্ভাবনার প্রমাণই নয় বরং তাওহীদেরও প্রমাণ। চারশত কোটি আলোক বর্ষের (Light Year) দূরত্ব থেকে এসব আলোক রশ্মির পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছা এবং এখানে মানুষের তৈরী যন্ত্রপাতিতে ধরা পড়া খোলাখুলি একথা প্রমাণ করে যে, ঐ ছায়াপথ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত গোটা সৃষ্টিজগত একই বস্তুর তৈরী, তার মধ্যে একই রকম শক্তিসমূহ কর্মতৎপর রয়েছে এবং কোন প্রকার পার্থক্য ও ভিন্নতা ছাড়া তা একই রকম নিয়ম-কানুন অনুসারে কাজ করছে। তা না হলে এসব আলোক রশ্মি এ পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হতো না এবং পৃথিবী ও তার পরিবেশে ক্রিয়াশীল নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষ যেসব যন্ত্রপাতি তৈরী করেছে তাতেও ধরা পড়তো না। এতে প্রমাণিত হয়, একই আল্লাহ গোটা এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা, মালিক, শাসক ও ব্যবস্থাপক।
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আন নামল, টীকা ৭৩ , ৭৪, ৮১ ; আর রূম, টীকা ২৫ , ৩৩ , ৩৫ ; ইয়াসীন, টীকা ২৯ ।
# যুক্তি হচ্ছে, যে আল্লাহ এ পৃথিবী-গ্রহটিকে জীবন্ত সৃষ্টির বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান বানিয়েছেন, যিনি পৃথিবীর প্রাণহীন মাটিকে আসমানের প্রাণহীন পানির সাথে মিশিয়ে এত উচ্চ পর্যায়ের উদ্ভিদ জীবন সৃষ্টি করেছেন যা তোমরা তোমাদের বাগান ও শস্যক্ষেত রূপে শ্যামলিমায় ভরে উঠতে দেখছো এবং যিনি এ উদ্ভিদরাজিকে মানুষ ও জীব-জন্তু সবার জন্য রিযিকের মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সম্পর্কে তোমাদের এ ধারণা যে, মৃত্যুর পর তিনি পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম নন! এটি নিরেট নির্বুদ্ধিতামূলক ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমরা নিজের চোখে অহরহ দেখছো, একটি এলাকা একেবারে শুষ্ক ও প্রাণহীন পড়ে আছে, সৃষ্টির একটি বিন্দু পড়া মাত্রই তার ভেতর থেকে অকস্মাৎ জীবনের ঝর্ণাধারা ফুটে বের হয়, যুগ যুগ ধরে মৃত শিকড়সমূহ হঠাৎ জীবন ফিরে পায় এবং মাটির গভীর অভ্যন্তর ভাগ থেকে নানা রকম কীট ও পোকামাকড় বেড়িয়ে এসে নর্তন কুর্দন শুরু করে দেয়। মৃত্যুর পরে জীবন যে আবার অসম্ভব নয় এটা তারই স্পষ্ট প্রমাণ। তোমাদের এ স্পষ্ট পর্যবেক্ষণকে যখন তোমরা মিথ্যা বলতে পার না তখন তোমরা একথা কি করে মিথ্যা সাব্যস্ত করতে চাও যে, আল্লাহ তা’আলা যখন চাইবেন তখন তোমরা নিজেরাও ঠিক তেমনি মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে যেমনভাবে উদ্ভিদরাজির অঙ্কুর বেরিয়ে আসে। এ প্রসঙ্গে এ কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যে আবর ভূখণ্ডের বহু অঞ্চল এমন যেখানে কোন কোন সময় পাঁচ বছর পর্যন্ত বৃষ্টি হয় না। এমনকি কখনো কখনো তার চেয়েও বেশী সময় চলে যায় কিন্তু আসমান থেকে একবিন্দু বৃষ্টিও ঝরে না। উত্তপ্ত মরুভূমিতে এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ঘাসের মূল এবং কীট-পতঙ্গ ও পোকা-মাকড়ের জীবিত থাকা কল্পনাতীত। তা সত্ত্বেও কোন সময় যখন সেখানে সামান্য বৃষ্টিও হয় তখন ঘাস ফুটে বের হয় এবং কীট-পতঙ্গ ও পোকা-মাকড় জীবন লাভ করে। সুতরাং এত দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টির অভিজ্ঞতা যাদের নেই তাদের তুলনায় আরবের লোকেরা আরো ভালভাবে এ যুক্তি উপলব্ধী করতে সক্ষম।
# এর আগে সূরা ফুরকানর ৩৮ আয়াতে ‘আসহাবের রাসসের’ আলোচনা করা হয়েছে। এখানে দ্বিতীয় বারের মত তাদের উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে উভয় স্থানেই নবীদের অস্বীকারকারী জাতিসমূহের সাথে কেবল মাত্র তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের কোন বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করা হয়নি। আরবের কিংবদন্তীতে আর রাস নামে দু’টি স্থান সুপরিচিত। একটি নাজদে এবং দ্বিতীয়টি উত্তর হিজাযে। এর মধ্যে নাজদের আর রাস অধিক পরিচিত এবং জাহেলী যুগের কাব্য গাঁথায় এর উল্লেখই বেশী পাওয়া যায়। অসহাবুর রাস এ দু’টি স্থানের কোনটির অধিবাসী ছিল তা এখন নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কোন বর্ণনাতেই তাদের কাহিনীর নির্ভরযোগ্য বিশাদ বিবরণ পাওয়া যায় না। বড় জোর এতটুকু সঠিকভাবে বলা যেতে পারে যে, তারা ছিল এমন এক জাতি যারা তাদের নবীকে কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। তবে তাদের বিষয়ে কুরআন মজীদে শুধু ইঙ্গিত দিয়েই ক্ষান্ত থাকা হয়েছে। এতে বুঝা যায়, কুরআন নাযিলের সময় আরবরা ব্যাপকভাবে তাদের কাহিনী সম্পর্কে অবহিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে এসব বর্ণনা ও কাহিনী ইতিহাসে সংরক্ষিত হতে পারেনি।

# “ফেরাউনের কওম” বলার পরিবর্তে শুধু নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ সে তার জাতির ঘাড়ে এমনভাবে চেপে বসেছিল যে, তার সামনে তার জাতির কোন স্বাধীন বক্তব্য ও দৃঢ়তা অবশিষ্ট ছিল না। সে যে গোমরাহীর দিকেই অগ্রসর হতো তার জাতিও তার পেছনে ছুটে চলতো। তাই একা ঐ ব্যক্তিকে গোটা জাতির গোমরাহীর জন্য দায়ী করা হয়েছে। যেখানে জাতির মতামত ও কর্মের স্বাধীনতা আছে সেখানে তার কাজ-কর্মের দায়-দায়িত্ব সে জাতি নিজেই বহন করে। আর যেখানে এক ব্যক্তির একনায়কত্ব জাতিকে অসহায় করে রাখে সেখানে সেই এক ব্যক্তিই গোটা জাতির অপরাধের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নেয়। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, এ বোঝা এক ব্যক্তির ঘাড়ে উত্তোলিত হওয়ার পর জাতি তার দায়-দায়িত্ব থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি পেয়ে যায়। না, সেক্ষেত্রে নিজের ঘাড়ে এক ব্যক্তিকে এভাবে চেপে বসতে দিয়েছে কেন, সেই নৈতিক দুর্বলতার দায়িত্ব জাতির ওপর অবশ্যই বর্তায়। সূরা যুখরূফের ৫৪ আয়াতে এ বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

فَاسْتَخَفَّ قَوْمَهُ فَأَطَاعُوهُ إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمًا فَاسِقِينَ

“ফেরাউন তার জাতিকে গুরুত্বহীন মনে করে নিয়েছে এবং তারাও তার আনুগত্য করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল ফাসেক।” ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন সূরা, যুখরূফের ব্যাখ্যা, টীকা ৫ )

# তারা সবাই তাদের রসূলের রিসালাতকে অস্বীকার করেছে এবং মৃত্যুর পরে তাদেরকে পুনরায় জীবিত করে উঠানো হবে তাঁদের দেয়া এ খবরও অস্বীকার করেছে।
# যদিও প্রত্যেক জাতি কেবল তাদের কাছে প্রেরিত রসূলকেই অস্বীকার করেছিল। কিন্তু তারা যেহেতু এমন একটি খবরকে অস্বীকার করেছিল যা সমস্ত রসূল সর্বসম্মতভাবে পেশ করেছিলেন। তাই একজন রসূলকে অস্বীকার করা প্রকৃতপক্ষে সমস্ত রসূলকেই অস্বীকার করার নামান্তর। তাছাড়া এসব জাতির প্রত্যেকে কেবল তাদের কাছে আগমনকারী রসূলের রিসালাত অস্বীকার করেনি, বরং আল্লাহ‌ তা’আলার পক্ষ থেকে মানুষের হিদায়াতের জন্য কোন মানুষ যে আদিষ্ট হয়ে আসতে পারে একথা মানতে তারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং তারা ছিল মূলত রিসালাতেরই অস্বীকারকারী এবং তাদের কারো অপরাধই শুধুমাত্র একজন রসূলের অস্বীকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
# এটা আখেরাতের সপক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থাপন। এর পূর্বের ৬টি আয়াতে আখেরাতের সম্ভাবনার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। আর এ আয়াতে পেশ করা হয়েছে আখেরাতের বাস্তবতার প্রমাণ। সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম আখেরাত সম্পর্কিত যে আকীদা পেশ করেছেন তা যে সম্পূর্ণ সত্য ও বাস্তব তার প্রমাণ হিসেবে এ আয়াতে আরব ও তার আশেপাশের জাতিসমূহের ঐতিহাসিক পরিণতিকে পেশ করা হয়েছে। কারণ যে জাতিই তা অস্বীকার করেছে সে জাতিই চরম নৈতিক বিকৃতির শিকার হয়েছে। এমনকি পরিশেষে আল্লাহর আযাব এসে তাদেরকে পৃথিবী থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আখেরাতের অস্বীকৃতির সাথে নৈতিক বিকৃতির এ অনিবার্যতা যা ইতিহাসের আবর্তনের সাথে সাথে একের পর এক পরিলক্ষিত হয়—একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এ দুনিয়ায় মানুষকে প্রকৃতপক্ষে দায়িত্বহীন ও কৃতকর্মের জবাবদিহি মুক্ত করে ছেড়ে দেয়া হয়নি, বরং কার্যকাল শেষ হওয়ার পর তাকে তার সমস্ত কাজ-কর্মের জবাব দিতে হবে। এ কারণে যখনই সে নিজেকে দায়িত্বমুক্ত মনে করে দুনিয়ায় কাজ করে তখনই তার গোটা জীবন ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়। যখন কোন কাজের ক্রমাগতভাবে খারাপ ফলাফল দেখা দিতে থাকে তখন তা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, কাজটি বাস্তবতার পরিপন্থী।
# আখেরাতের সপক্ষে যুক্তি প্রমাণ পেশ করার পর বলা হচ্ছে, তোমরা আখেরাতকে মেনে নাও বা অস্বীকার করো সর্বাবস্থায় তা অবধারিত এবং তা এমন একটি বাস্তব ঘটনা যা তোমাদের অস্বীকার করা সত্ত্বেও সংঘটিত হবে। নবী-রসূলদের অগ্রিম সতর্ক বাণী বিশ্বাস করে সেই সময়ের জন্য পূর্বাহ্ণেই প্রস্তুতি গ্রহণ করলে তোমরা নিজেদেরই কল্যাণ করবে এবং বিশ্বাস না করলে নিজেরাই নিজেদের দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে। না মানলে আখেরাতের আগমন থেমে থাকবে না এবং আল্লাহর ন্যায়ের বিধান অচল হয়ে যাবে না।
# আমার ক্ষমতা ও জ্ঞান ভিতর ও বাহির থেকে এমনভাবে মানুষকে পরিবেষ্টিত করে আছে যে, আমার ক্ষমতা ও জ্ঞান তার যতটা নিকটে ততটা নিকটে তার ঘাড়ের শিরাও নয়। তার কথা শোনার জন্য আমাকে কোথাও থেকে আসতে হয় না। তার মনের মধ্যে উদিত কল্পনাসমূহ পর্যন্ত আমি সরাসরি জানি। অনুরূপভাবে তাকে যদি কোন সময় পাকড়াও করতে হয় তখনও আমাকে কোথাও থেকে এসে তাকে পাকড়াও করতে হয় না। সে যেখানেই থাকুক, সর্বদা আমার আয়ত্বাধীনেই আছে যখন ইচ্ছা আমি তাকে বন্দী করবো।
# এক দিকে আমি নিজে সরাসরি মানুষের প্রতিটি গতিবিধি এবং চিন্তা ও কল্পনা সম্পর্কে অবহিত। অপর দিকে প্রত্যেক মানুষের জন্য দু’জন করে ফেরেশতা নিয়োজিত আছে যারা তার প্রত্যেকেটি তৎপরতা লিপিবদ্ধ করছে। তার কোন কাজ ও কথাই তাদের রেকর্ড থেকে বাদ পড়ে না। অর্থাৎ আল্লাহর আদালতে যে সময় মানুষকে পেশ করা হবে তখন কে কি করে এসেছে সে বিষয়ে আল্লাহ নিজ থেকেই অবহিত থাকবেন। তাছাড়া সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এমন দু’জন সাক্ষীও উপস্থিত থাকবেন যারা তার কাজ-কর্মের লিখিত নথিভুক্ত প্রমাণাদি এনে সামনে পেশ করবেন। লিখিত এ প্রমাণাদি কেমন ধরনের হবে তার সঠিক ধারণা করা আমাদের জন্য কঠিন। তবে আজ আমাদের সামনে যেসব সত্য উদঘাটিত হচ্ছে তা দেখে এ বিষয়টি একেবারে নিশ্চিত মনে হয় যে, যে পরিবেশে মানুষ অবস্থান ও কাজ-কর্ম করে তাতে চতুর্দিকের প্রতিটি অণু-পরমাণুর ওপর তার কণ্ঠস্বর, ছবি ও গতিবিধির ছাপ পড়ে যাচ্ছে। এসব জিনিসের প্রত্যেকটিকে পুনরায় হুবহু সেই আকার-আকৃতি ও স্বরে এমনভাবে পেশ করা যেতে পারে যে, আসল ও নকলের মধ্যে সামান্যতম পার্থক্যও থাকবে না। মানুষ যন্ত্রপাতির সাহায্যে এ কাজটি অত্যন্ত সীমিত মাত্রায় করছে। কিন্তু আল্লাহর ফেরেশতারা এসব যন্ত্রপাতিরও মুখাপেক্ষী নয়, এসব প্রতিবন্ধকতায়ও আবদ্ধ নয়। মানুষের নিজ দেহ এবং তার চারপাশের প্রতিটি জিনিস তাদের জন্য টেপ ও ফিল্ম স্বরূপ। তারা এসব টেপ ও ফিল্মের ওপর প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি ছবি অতি সূক্ষ্ম ও খুঁটিনাটি বিষয়সহ অবিকল ধারণ করতে পারে এবং পৃথিবীতে ব্যক্তি যেসব কাজ করতো কিয়ামতের দিন তাকে তার নিজ কানে নিজ কণ্ঠস্বরে সেসব কথা শুনিয়ে দিতে পারে, নিজ চোখে তার সকল কর্মকাণ্ডের এমন জ্বলজ্যান্ত ছবি তাকে দেখিয়ে দিতে পারে যা অস্বীকার করা তার জন্য সম্ভব হবে না।

এখানে একথাটিও ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, আল্লাহ তা’আলা আখেরাতের আদালতে কোন ব্যক্তিকে কেবল নিজের ব্যক্তিগত জ্ঞানের ভিত্তিতে শাস্তি প্রদান করবেন না, বরং ন্যায় বিচারের সমস্ত পূর্বশর্ত পূরণ করে তাকে শাস্তি প্রদান করবেন। এ কারণে দুনিয়াতেই প্রত্যেক ব্যক্তির সমস্ত কথা ও কাজের পূর্ণাংগ রেকর্ড তৈরী করা হচ্ছে যাতে অনস্বীকার্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের প্রমাণাদি পেশ করা যায়।

# পরম সত্য নিয়ে হাজির হওয়ার অর্থ হচ্ছে মৃত্যুর যন্ত্রণা সেই পরম সূচনা বিন্দু যেখান থেকে দুনিয়ার জীবনে পর্দার আড়ালে লুকানো মহাসত্য উন্মুক্ত হতে আরম্ভ করে। এ সময় মানুষ সেই জগতটিকে স্পষ্ট পায় যার খবর নবী-রসূলগণ দিয়েছিলেন। তখন সে একথাও জানতে পারে যে, আখেরাত পুরোপুরি সত্য। জীবনের এ দ্বিতীয় পর্যায়ে সে সৌভাগ্যবান হিসেবে প্রবেশ করছে, না হতভাগ্য হিসেবে, সে সত্যও সে জানতে পারে।
# এটা সেই চরম সত্য যা মানতে তুমি টালবাহানা করেছিলে। তুমি পৃথিবীতে বন্ধনমুক্ত বলদের মত অবাধে বিচরণ করতে চাচ্ছিলে, আরো চাচ্ছিলে মৃত্যুর পর যেন আর কোন জীবন না থাকে যেখানে তোমার নিজের সমস্ত কাজ-কর্মের পরিণতি ভোগ করতে হবে। এ কারণে তুমি আখেরাতের ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে অবস্থান করতে এবং কোন সময় এ জগত বাস্তব রূপ লাভ করবে তা কোনক্রমেই মানতে প্রস্তুত ছিলে না। এখন দেখো, সেই আরেকটি জগতই তোমার সামনে বাস্তব হয়ে দেখা দিচ্ছে।
# এর অর্থ শিংগার ফুৎকার। এ ফুৎকারের সাথে সাথে সমস্ত মৃত লোক দৈহিক জীবন পেয়ে পুনরায় উঠে দাঁড়াবে। ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আন’আম টীকা ৪৭ ; ইবরাহীম, টীকা ৫৭ ; ত্বাহা, টীকা ৭৮ ; আল হজ্জ, টীকা ১ ; ইয়াসীন, টীকা ৪৬ ও ৪৭ ; আয যুমার, টীকা ৭৯ ।
# সম্ভবত এর দ্বারা সেই দু’জন ফেরেশতাকে বুঝানো হয়েছে যারা পৃথিবীতে ঐ ব্যক্তির সমস্ত কথা ও কাজের রেকর্ড প্রস্তুত করতে নিযুক্ত ছিল। কিয়ামতের দিন সিংগায় ফুৎকারের আওয়াজ উত্থিত হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক মানুষ যখন তার কবর থেকে উঠবে তৎক্ষণাৎ উক্ত দু’ফেরেশতা এসে তাকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে নেবে। একজন তাকে আল্লাহ তা’আলার আদালতের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে এবং অন্যজন তার ‘আমলনামা’ সাথে নিয়ে যাবে।
# এখন তুমি খুব ভাল করেই দেখতে পাচ্ছ যে, আল্লাহর নবী তোমাকে যে খবর দিতেন তার সব কিছুই আজকে এখানে বিদ্যমান।
# মুফাসসিরদের কেউ কেউ এর অর্থ বর্ণনা করেছেন এই যে, সাথী অর্থ ২১ আয়াতে বর্ণিত সাক্ষ্যদাতা ফেরেশতা। সে বলবেঃ এইতো এ ব্যক্তির ‘আমলনামা’ আমার কাছে প্রস্তুত আছে। অপর কিছু সংখ্যক মুফাস্সির বলেনঃ যে শয়তান পৃথিবীতে তার সাথে অনুক্ষণ লেগেছিল সাথী অর্থ সেই শয়তান। সে বলবে, এ ব্যক্তি সে-ই যাকে আমি আমার কব্জায় রেখে জাহান্নামের জন্য প্রস্তুত করেছি এখন সে আপনার সামনে হাজির। তবে কাতাদা ও ইবনে যায়েদ থেকে উদ্ধৃত ব্যাখ্যাই এর পূর্বাপর প্রসঙ্গের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা বলেন, সাথী বলতে বুঝানো হয়েছে সে ফেরেশতাকে যে তাকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসবে এবং সে নিজেই আল্লাহর আদালতে হাজির হয়ে আরয করবে, এ ব্যক্তি আমার তত্ত্বাবধানে ছিল। এখন সে মহান প্রভুর দরবারে হাজির।
# মূল আয়াতের বাক্যাংশ হচ্ছে أَلْقِيَا فِي جَهَنَّمَ “তোমরা দু’জন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো।” বক্তব্যের ধারাবাহিকতাই বলে দিচ্ছে যে, কবর থেকে উঠতেই অপরাধীকে যে দু’জন ফেরেশতা গ্রেফতার করেছিলো এবং আদালতে হাজির করেছিলো তাদের লক্ষ্য করে এ নির্দেশ দেয়া হবে।

# মূল আয়াতে كَفَّارٍ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দটির দু’টি অর্থ। একটি অর্থ হচ্ছে চরম অকৃজ্ঞ। অপরটি হচ্ছে, চরম সত্য প্রত্যাখানকারী।
# আরবী ভাষায় خير শব্দটি সম্পদ অর্থেও ব্যবহৃত হয় এবং কল্যাণ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে আয়াতের অর্থ হবে, তারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ থেকে বান্দা ও আল্লাহ কারো হকই আদায় করতো না। দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করলে আয়াতের অর্থ হবে, তারা কল্যাণের পথ থেকে নিজেরাই যে কেবল বিরত থাকতো তাই নয় বরং অন্যদেরকেও তা থেকে বিরত রাখতো। তারা পৃথিবীর কল্যাণের পথে বাঁধা হয়েছিলো। কোনভাবেই যেন কল্যাণ ও সুকৃতি বিস্তার লাভ করতে না পারে এ উদ্দেশ্যেই তারা তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিলো।

# নিজের প্রতিটি কাজে নৈতিকতার সীমালংঘনকারী। নিজের স্বার্থ, উদ্দেশ্যাবলী ও আশা-আকাংখ্যার জন্য যে, কোন কাজ করতে সে প্রস্তুত থাকতো। হারাম, পন্থায় অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতো এবং হারাম পথেই তা ব্যয় করতো। মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতো। না তার মুখ কোন বাধ্য-বাধকতায় সীমাবদ্ধ ছিল, না তার হাত কোন প্রকার জুলুম ও বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকতো। কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকেই সে যথেষ্ট মনে করতো না, বরং আরো অগ্রসর হয়ে সততা ও কল্যাণের পথের অনুসারীদেরকে সে উত্যক্ত করতো এবং কল্যাণের জন্য যারা কাজ করতো তাদের ওপর নির্যাতন চালাতো।

# মূল আয়াতে مُرِيبٍ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটির দু’টি অর্থ। এক, সন্দেহ পোষণকারী। দুই, সন্দেহের মধ্যে নিক্ষেপকারী। এখানে দু’টি অর্থই গ্রহণীয়। অর্থাৎ নিজেও সন্দেহের মধ্যে পতিত ছিলো এবং অন্যদের মনেও সন্দেহ সৃষ্টি করতো। তার কাছে আল্লাহ, আখেরাত, ফেরেশতা, অহী এক কথায় ইসলামের সব সত্যিই ছিল সন্দেহজনক। নবী-রসূলের পক্ষ থেকে ন্যায় ও সত্যের যে কথাই পেশ করা হতো তার ধারণায় তা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। তাই সে আল্লাহর অন্য বান্দাদের মধ্যেও এ রোগ ছড়িয়ে বেড়াতে। সে যার সাথেই মেলামেশার সুযোগ পেতো তার অন্তরেই কোন না কোন সন্দেহ এবং কোন না কোন দ্বিধা-সংশয় সৃষ্টি করে দিতো।

# যেসব বিষয় মানুষকে জাহান্নামের উপযুক্ত বানায় এ আয়াত ক’টিতে আল্লাহ তা’আলা সেগুলো নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেনঃ
(১) সত্যকে অস্বীকার,
(২) আল্লাহর প্রতি অকৃজ্ঞতা,
(৩) সত্য ও সত্যপন্থীদের সাথে শত্রুতা,
(৪) কল্যাণের পথের বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো,
(৫) নিজের অর্থ-সম্পদ দ্বারা আল্লাহ ও বান্দার হকসমূহ আদায় না করা।,
(৬) নিজের আচার-আচরণে সীমালংঘন করা,
(৭) মানুষের ওপর জুলুম ও বাড়াবাড়ি করা,
(৮) ইসলামের বিধানসমূহের সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা,
(৯) অন্যদের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করা এবং
(১০) প্রভুত্বে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা।
# এখানে বক্তব্যের ধরন থেকে স্বতঃই প্রকাশ পাচ্ছে যে, ‘সাথী’ অর্থ শয়তান–যে পৃথিবীতে তার পেছনে লেগেছিলো। বক্তব্যের ধরণ থেকে একথারও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ঐ ব্যক্তি ও তার শয়তান উভয়ে আল্লাহর আদালতে পরস্পর ঝগড়া করছে। সে বলছে, জনাব, এ জালেম আমার পেছনে লেগেছিলো এবং শেষ পর্যন্ত সে-ই আমাকে পথভ্রষ্ট করে ক্ষান্ত হয়েছে। সুতরাং শাস্তি পাওয়া উচিত তার। শয়তান তার জবাবে বলছেঃ জনাব, আমার তো তার ওপরে কোন হাত ছিল না যে, সে বিদ্রোহী হতে না চাইলেও আমি জোর করে তাকে বিদ্রোহী বানিয়ে দিয়েছি। এ দুর্ভাগার তো নিজেরই সৎকাজের প্রতি ঘৃণা এবং মন্দকাজের প্রতি আসক্তি ছিলো। তাই নবী-রসূলদের কোন কথাই তার মনোপুত হয়নি এবং আমার প্ররোচনায় সে ক্রমাগত বিপথগামী হয়েছে।
# তোমাদের দু’জনকেই আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম যে, তোমাদের মধ্যে যে অন্যকে বিভ্রান্ত করবে সে কি শাস্তি পাবে এবং যে বিভ্রান্ত হবে তাকে কি পরিণাম ভোগ করতে হবে। আমার এ সতর্কবাণী সত্ত্বেও তোমরা উভয়েই যখন অপরাধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত হওনি তখন এ মুহূর্তে ঝগড়া করে কি লাভ। এখন বিভ্রান্ত ও বিভ্রান্তকারী উভয়কে হওয়া ও বিভ্রান্ত করার শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে।

# আমার কাছে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোন নিয়ম নেই। তোমাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপের যে নির্দেশ আমি দিয়েছি তা এখন প্রত্যাহার করা যেতে পারে না। তাছাড়া বিপথগামী করার ও বিপথগামী হওয়ার শাস্তি আখেরাতে কি হবে সে বিষয়ে আমি পৃথিবীতে যে নিয়মের ঘোষণা দিয়েছিলাম তাও আর এখন পরিবর্তন করা যেতে পারে না।
# মূল আয়াতে ظَلَّامٍ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ চরম অত্যাচারী। একথার অর্থ এ নয় যে, আমি আমার বান্দার ব্যাপারে চরম অত্যাচারী নই বরং অত্যাচারী। এর অর্থ বরং এই যে, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হয়ে যদি আমি আমার প্রতিপালিত সৃষ্টির ওপরে জুলুম করি সেক্ষেত্রে আমি হবো চরম জালেম। তাই আমি আমার বান্দার ওপরে আদৌ কোন জুলুম করি না। যে শাস্তি তোমাকে আমি দিচ্ছি তা ঠিক ততখানি যার উপযুক্ত তুমি নিজেই নিজেকে বানিয়েছো। তোমার প্রাপ্য শাস্তির চাইতে সামান্য অধিক শাস্তিও তোমাকে দেয়া হচ্ছে না। আমার আদালত নির্ভেজাল ও পক্ষপাতিহীন ইনসাফের আদালত। কোন ব্যক্তি এখানে এমন কোন শাস্তি পেতে পারে না আসলেই সে যার উপযুক্ত নয় এবং নিশ্চিত সাক্ষ্য দ্বারা যা প্রমাণ করা হয়নি।

 

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৫/এবং কাফের-রা বলে:-১০)
[*এবং কাফিররা বলে, ‘এ তো এক আশ্চর্য জিনিস ! :-
*  *পুনরুজ্জীবনের জীবন্ত উদাহরণ :-
*মানুষের আমলের রেকর্ড :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫০-ক্বাফ। পারা:২৬
০১-২৯ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যায়:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
## ফাতহুল মাজিদ নামকরণ ও আলোচ্য বিষয় :

সূরা ক্বাফ সম্পূর্ণ মক্কায় অবতীর্ণ হয়। ইবনু আব্বাস ও কাতাদাহ (রাঃ) বলেন : তবে একটি আয়াত ব্যতীত, তাহল-

(وَلَقَدْ خَلَقْنَا السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِيْ سِتَّةِ أَيَّامٍ ق وَّمَا مَسَّنَا مِنْ لُّغُوْبٍ)।

অত্র সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখিত ‘ক্বাফ’ বর্ণটি থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

এ সূরাটি “ত্বিওয়ালে মুফাস্সাল”-এর প্রথম সূরা। সূরা ক্বাফ থেকে সূরা আন-নাযিআত পর্যন্ত সূরাগুলোকে طوال المفصل বলা হয়। আবার কেউ কেউ সূরা আল হুজুরাত থেকেও গণনা করেছেন। তবে প্রথমটি সঠিক। (ইবনু কাসীর ও ফাতহুল কাদীর, অত্র সূরা তাফসীরের শুরু)

কুত্ববাহ্ ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের প্রথম রাক‘আতে এ সূরা তিলাওয়াত করতেন। (সহীহ মুসলিম হা. ৪৫৮)

ওয়াকিদ আল লাইসী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদের সালাতে সূরা ক্বাফ ও সূরা আল ক্বামার তিলাওয়াত করতেন। (সহীহ মুসলিম হা. ৮৯১, আত্ তিরমিযী হা. ৫৩৪)

উম্মু হিশাম বিনতু হারেসাহ্ (রাঃ) বলেন : আমি সূরা ক্বাফ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুখ থেকে শিখেছি। তিনি প্রত্যেক জুমু‘আয় মিম্বারে দাঁড়িয়ে মানুষের সামনে এ সূরা পাঠ করতেন। (সহীহ মুসলিম, আবূ দাঊদ হা. ১০১২)

হাফিয ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : বড় ধরনের সমাবেশে (যেমন ঈদ, জুমু‘আহ্) এ সূরা পাঠ করার উদ্দেশ্য হলো এতে মানব সৃষ্টির সূচনা, পুনরুত্থান, আখিরাত, কিয়ামত, হিসাব, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে তা জানানোর জন্য। আল্লাহ অধিক জানেন। (ইবনু কাসীর)

১-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

قٓ (ক্বাফ) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এর অর্থ ও প্রকৃত উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : সমস্ত পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে এমন একটি পাহাড়ের নাম হল ক্বাফ। সম্ভবত এটা বানী ইসরাঈলের বর্ণিত কল্পকাহিনী। (আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন)

অতঃপর আল্লাহ সম্মানিত কুরআনের শপথ করেছেন। الْمَجِيْدُ শব্দের অর্থ সম্মানিত, অর্থাৎ কুরআন এমন একটি সম্মানিত কিতাব যা অর্থ ও শব্দগত দিক থেকে সকল আসমানী কিতাব থেকে সুউচ্চ ও মর্যাদাসম্পন্ন, বরকতময় ও গুণে পরিপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের শপথ করলেন, কারণ আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা তার নামে শপথ করতে পারেন, তবে মানুষ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করতে পারে না। কুরআন নিয়ে মহান আল্লাহর এ শপথের জবাব উহ্য রয়েছে, তা হলো- لَتُبْعَثُنَّ (তোমরা অবশ্যই কিয়ামাতের দিন পুনরুত্থিত হবে)। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এর জবাব হলো পরবর্তী আলোচ্য বিষয় যাতে নবুওয়াত ও পুনরুত্থানের কথাকে সুসাব্যস্ত করা হয়েছে।

(جَا۬ءَهُمْ مُنْذِرٌ مِنْهُمْ)

‘তাদের মধ্য হতে একজন সতর্ককারী আবির্ভূত হয়েছে’ অর্থাৎ তৎকালীন মক্কার কাফিররা এতে আশ্চর্যবোধ করত যে, তাদের মধ্য হতেই একজন ব্যক্তিকে রিসালাত প্রদান করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস যে, কোন ফেরেশতাকে নাবী হিসেবে পাঠানো হবে অথবা নাবীর সাথে কোন ফেরেশতাকে পাঠানো হবে।

যেমন তারা আশ্চর্য হয়ে বলত :

(وَقَالُوْا مَالِ ھٰذَا الرَّسُوْلِ یَاْکُلُ الطَّعَامَ وَیَمْشِیْ فِی الْاَسْوَاقِﺚ لَوْلَآ اُنْزِلَ اِلَیْھِ مَلَکٌ فَیَکُوْنَ مَعَھ۫ نَذِیْرًا)

“তারা বলে : ‘এ কেমন রাসূল’ যে আহার করে এবং হাটে-বাজারে চলাফেরা করে; তার কাছে কোন ফেরেশতা কেন অবতীর্ণ করা হল না, যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারীরূপে?’ (আল ফুরকান ২৫ :৭)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(اَکَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا اَنْ اَوْحَیْنَآ اِلٰی رَجُلٍ مِّنْھُمْ اَنْ اَنْذِرِ النَّاسَ وَبَشِّرِ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْٓا اَنَّ لَھُمْ قَدَمَ صِدْقٍ عِنْدَ رَبِّھِمْﺛ قَالَ الْکٰفِرُوْنَ اِنَّ ھٰذَا لَسٰحِرٌ مُّبِیْنٌ)‏

‘মানুষের জন্য এটা কি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি তাদেরই একজনের নিকট ওয়াহী প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তুমি মানুষকে সতর্ক কর‎ এবং মু’মিনদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট আছে উচ্চ মর্যাদা! কাফিররা বলে, ‘এ তো এক সুস্পষ্ট জাদুকর!’ (সূরা ইউনুস ১০ :২)

অর্থাৎ এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। রাসূল যদি মানুষ না হয়ে ফেরেশতা হতেন তাহলে মাটির মানুষের সমস্যা নূরের তৈরি ফেরেশতাগণ বুঝতে সক্ষম হত না। অতএব রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মত পিতার ঔরসে মায়ের গর্ভে রক্ত মাংসে সৃষ্টি মাটির মানুষ, তিনি কোন ফেরেশতাও নন বা নূরের তৈরিও নন। যেখানে মক্কার কাফিররা জানত রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মত একজন মানুষ, তাকে নবুআত দেয়া হয়েছে এবং এতে তারা আশ্চর্যও বোধ করেছে যে- নাবীদের খাবার, বাজার ইত্যাদির প্রয়োজন হয় নাকি? সেখানে আমাদের সমাজে একশ্রেণির মুসলিম বিশ্বাস করে নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাকি নূরের তৈরি। এক্ষেত্রে মক্কার মুশরিকদের চেয়ে এদের আকীদাহর অবস্থা কত নিম্নমানের!

কাফিররা আশ্চর্য হয়ে আরো বলে, আমরা মারা যাওয়ার পর মাটি হয়ে যাব, নিঃশেষ হয়ে যাব এর পরেও কি আবার আমাদেরকে জীবিত করা হবে, এরূপ গঠনাকৃতি দেয়া হবে? এটা তো কল্পনাতীত কথা, এরূপ সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। যেমন তাদের কথা আল্লাহ তা‘আলা তুলে ধরে বলেন :

(وَقَالُوا أَإِذَا ضَلَلْنَا فِي الْأَرْضِ أَإِنَّا لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ بَلْ هُمْ بِلِقَا۬ءِ رَبِّهِمْ كَافِرُونَ)

“আর তারা বলে, আমরা যখন মাটিতে মিশে শেষ হয়ে যাব, তখন কি আবার আমাদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করা হবে? বস্তুতঃ তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করে।” কাফিররা পুনরুত্থানকে অসম্ভব ও কল্পনাতীত মনে করে এরূপ কথা কুরআনে বহু স্থানে উল্লেখ রয়েছে। তাদের এসব কল্পনাতীত চিন্তার জবাবে

মহান আল্লাহ বলছেন :

(قَدْ عَلِمْنَا مَا تَنْقُصُ الْأَرْضُ مِنْهُمْ ج وَعِنْدَنَا كِتٰبٌ حَفِيْظٌ)

“আমি তো জানি মাটি তাদের কতটুকু ক্ষয় করে এবং আমার নিকট আছে সংরক্ষিত এক কিতাব।” (সূরা কাফ ৫০ :৪) সূরা তাগাবুনের ৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে নিজ সত্ত্বার শপথ করে বলেছেন : অবশ্যই পুনরুত্থান করানো হবে।

অর্থাৎ মাটি তাদের মাংসস্ত হাড় জীর্ণ করে খেয়ে ফেলুক, শরীর আলাদা আলাদা হয়ে যাক, আর যা কিছু হোক না কেন সব আল্লাহ তা‘আলা জানেন। সব কিছু লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এমন নয় যে কেউ টুকরো টুকরো হয়ে গেল বা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল তাকে আল্লাহ তা‘আলা ধরতে পারবেন না।

বানী ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি মারা যাওয়ার পূর্বে তার সন্তানদেরকে অসিয়ত করেছিল যে, আমি মারা গেলে আমার মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে উড়িয়ে দেবে। আল্লাহর শপথ, আল্লাহ আমাকে পাকড়াও করতে পারলে এমন শাস্তি দেবেন যা কাউকে দেয়া হয়নি। মারা যাওয়ার পর অসিয়ত অনুযায়ী সন্তানেরা তাই করল। আল্লাহ তা‘আলা জমিনকে নির্দেশ দিলেন মৃতদেহের ছাই একত্রিত করতে। জমিন তাই করল, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জীবিত করে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কেন এরূপ করেছ? সে বলল : আপনার ভয়ে, তখন আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ বুখারী হা. ৩৪৮১)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন : চিন্তা করুন! সূরাটি কত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে, দুনিয়াতে মানুষকে যে শরীর দেয়া হয়েছে সে শরীরেই তাকে পুনরুত্থিত করা হবে। এমন নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের দুনিয়ার শরীর পরিবর্তন করে নতুন শরীর প্রদান করবেন। এরূপ বিশ্বাস করা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করার শামিল। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

(وَهُوَ الَّذِي يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ)

“তিনিই সে সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি সূচনা করেছেন আবার তিনিই তা ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। আর এটা তাঁর জন্য খুবই সহজ।” (সূরা রুম ৩০ :২৭)

সুতরাং কিয়ামতের দিন সব কিছু আল্লাহ তা‘আলা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। মূলত কাফিররা সত্যকে তথা কুরআন, ইসলাম ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অস্বীকার করেছে। যার কারণে তারা সংশয়ে নিপতিত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কুরআনের মর্যাদা সম্পর্কে জানলাম।
২. নাবী-রাসূলদেরকে মানব জাতি থেকে প্রেরণ করা হয়েছে। তারা মাটির মানুষ নূরের তৈরি নয়।
৩. পুনরুত্থানের প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের অন্যতম একটি রুকন। তার প্রতি বিশ্বাস না থাকলে মু’মিন হওয়া যাবে না।
৪. মানুষকে কবরস্থ করা হোক, আর যা কিছু করা হোক না কেন তার পুনরুত্থান হবেই।

৬-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আকাশ-জমিন সৃষ্টি, আকাশকে তারকারাজি দ্বারা সুশোভিত করা, জমিনকে প্রশস্ত করা, আকাশ হতে বরকতময় বৃষ্টি নাযিল ইত্যাদি আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এসব সৃষ্টির দিকে চিন্তার দৃষ্টিতে তাকালে পুনরুত্থানের প্রতি নেতিবাচক ধারণা দূর হয়ে যাবে।

(أَفَلَمْ يَنْظُرُوْآ إِلَي السَّمَا۬ءِ)

‘তারা কি কখনও তাদের ওপরের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না’ অর্থাৎ তারা কি আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? তারা কি দেখে না, আল্লাহ তা‘আলা কী মজবুত, সুন্দর ও সুউচ্চ করে আকাশ সৃষ্টি করেছেন?

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(اَللّٰهُ الَّذِيْ رَفَعَ السَّمٰوٰتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا)

“আল্লাহই ঊর্ধ্বদেশে আকাশসমূহ স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত যা তোমরা দেখছ।” (সূরা রাদ ১৩ :২) শুধু সৃষ্টিই করেননি, সৃষ্টি করে তাকে বিশেষ করে দুনিয়ার আকাশকে তারকারাজি দ্বারা সুশোভিত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন :

(وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَا۬ءِ بُرُوْجًا وَّزَيَّنّٰهَا لِلنّٰظِرِيْنَ) ‏

“আমি আকাশে গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করেছি এবং তা সুশোভিত করেছি দর্শকদের জন্য” (সূরা হিজর ১৫ :১৬) আকাশ এত বিশাল ও বড় হওয়া সত্ত্বেও তাতে কোন ফাটল বা ছিদ্র নেই। অতএব এ বিশাল আকাশ সৃষ্টি করা কি মানুষ সৃষ্টি করার চেয়ে কঠিন নয়! মহান আল্লাহ বলেন :

(ءَاَنْتُمْ اَشَدُّ خَلْقًا اَمِ السَّمَا۬ئُﺚ بَنٰٿھَا)

“তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিন কাজ, না আকাশের? তিনিই এটা নির্মাণ করেছেন।” (সূরা নাযিআত ৭৯ :২৭)

باسقات অর্থ : طوالا تاهقات সুউচ্চ। نضيد অর্থ : স্তরে স্তরে বিন্যস্ত।

অর্থাৎ জমিন সৃষ্টি করে তা সমতল করে দিয়েছেন এবং পেরেকস্বরূপ পাহাড় দিয়েছেন যাতে তা স্থির থাকে এবং তা বসবাসের উপযোগী হবে। জমিনে উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন যা মানুষের উপকারে আসবে। মহান আল্লাহ বলেন :

(وَهُوَ الَّذِيْ مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيْهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهٰرًا ط وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرٰتِ جَعَلَ فِيْهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ)

“তিনিই ভূতলকে বিস্তৃত করেছেন এবং এতে পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক প্রকারের ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়।” (সূরা রাদ ১৩ :৩) এসব কিছুর মধ্যে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য উপদেশ। তাহল সব কিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। এ বিশাল বড় বড় বস্তু যে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন তিনি কি মানুষকে পুনরুত্থিত করতে সক্ষম নন। অবশ্যই সক্ষম, সুতরাং এখানেই জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা নিহিত।

মানুষ যাতে সহজেই পুনরুত্থানের কথা উপলব্ধি করতে পারে সে জন্য পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : আমি বৃষ্টি বর্ষণ করে যেমন মৃত জমিনকে জীবিত করি তেমনি তোমাদেরকে মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত করব।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা তবে এটুকু বিশ্বাস করলেই মু’মিন হওয়া যাবে না যতক্ষণ না একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে।
২. আল্লাহ তা‘আলার এসব সৃষ্টি তাঁর বড়ত্ব ও মহত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে।
৩. প্রত্যেক আত্মাকে হিসাব নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত হতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই।
৪. পুনরুত্থান চিরন্তন সত্য, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

১২-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী কয়েকটি জাতির কথা তুলে ধরছেন যারা তাদের নিকট প্রেরিত রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল, ফলে তাদের ওপর শাস্তি নেমে এসেছিল। যেমন-

নূহ (রহঃ)-এর জাতির কাছে তাঁকে, সামুদ জাতির কাছে সালেহ (রহঃ)-কে, আ‘দ জাতির কাছে হূদ (রহঃ)-কে, লূত (রহঃ)-এর জাতির কাছে লূত (রহঃ)-কে, “আসহাবে আইকাহ” বা জঙ্গলের অধিবাসীদের কাছে শু‘আইব (রহঃ)-কে এবং তুব্বা সম্প্রদায়ের কাছে নাবী প্রেরণ করেছেন। তারা তাদের কাছে আগত নাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। আইকাহ বলা হয় জঙ্গলকে, এটা বলার কারণ হল, এ অবাধ্য জাতি প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে নিজেদের বসতি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সেখানেই ধ্বংস করে দেন। এটাও বলা হয় যে, উক্ত জঙ্গলে ‘আইকাহ’ বলে একটা গাছকে তারা পূজো করত।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত সূরা আ‘রাফের ৮৫-৯৩ ও হূদের ৮৪-৯৫ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

রাস্ জাতি বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে বেশ কয়েকটি মত পাওয়া যায় তবে ইমাম ইবনু জারীর প্রাধান্য দিয়ে বলেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য “আসহাবুল উখদূদ”। এদের সম্পর্কে সূরা আল বুরূজ-এ আলোচনা আসবে ইনশা-আল্লাহ তা‘আলা।

কুরআনে দুজায়গায় তুব্বার উল্লেখ রয়েছে- এখানে এবং সূরা দুখানে। কিন্তু উভয় জায়গায় কেবল নামই উল্লেখ করা হয়েছে- বিস্তারিত কোন ঘটনা বিবৃত হয়নি। তাই এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণ দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। মূলত তুব্বা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম নয়, বরং এটা ইয়ামানের হিমইয়ারী সম্রাটের উপাধি বিশেষ। যেমন পারস্যের বাদশাকে কিসরা, রোমের বাদশাদেরকে কায়সার, মিশরের বাদশাদেরকে ফির‘আউন এবং হাবশা অর্থাৎ ইথিওপিয়ার রাজাদেরকে নাজ্জাসী বলা হত। তারা দীর্ঘকাল পর্যন্ত ইয়ামানের পশ্চিমাংশকে রাজধানী বানিয়ে আরব, শাম, ইরাক আফ্রিকার কিছু অংশ শাসন করেছিল।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমরা তুব্বাকে গালি দিও না। কারণ তিনি মু’মিন ছিলেন। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ২৪৩৩) এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, তুব্বা কোন ব্যক্তির নাম যিনি মু’মিন ছিলেন। মোটকথা তারা কালক্রমে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হয়ে যায়, মূর্তিপূজা ও অগ্নিপূজা শুরু করে ফলে আল্লাহ তা‘আলা আযাব দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন।

(فَحَقَّ وَعِيدِ) অর্থাৎ তারা নাবীদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে তাদের ওপর শাস্তি আপতিত হয়েছিল।

এর মাধ্যমে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা ও মক্কাবাসীসহ সারা পৃথিবীর কাফিরদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, যারাই ইতোপূর্বে নাবীদের অবাধ্য হয়েছে তারাই ধ্বংস হয়েছে তাই তোমরাও যদি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে এমন আচরণ কর তাহলে তোমাদের পরিণতি তাই হবে যা হয়েছিল তাদের।

(أَفَعَيِينَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ)

অর্থাৎ প্রথমবার সৃষ্টি করা যখন আমার জন্য কোন ব্যাপার ছিল না, তখন দ্বিতীয়বার জীবিত করা তো প্রথমবারের তুলনায় আমার জন্য আরো সহজ। মহান আল্লাহ বলেন :

(وَهُوَ الَّذِيْ يَبْدَؤُا الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُه۫ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ ط وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلٰي فِي السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ ج وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ)

“তিনি সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তিনিই আবার তা পুনরাবৃত্তি করবেন এটা তার জন্য খুবই সহজ। আসমান ও জমিনে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই। আর তিনিই প্রতাপশালী মহাবিজ্ঞ।” (সূরা রূম ৩০ :২৭)

হাদীসে কুদ্সীতে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন : আদম সন্তান আমাকে এই বলে কষ্ট দেয় যে, আমি তাকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম না যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টি করেছি। অথচ প্রথমবার সৃষ্টি করা দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করার চেয়ে বেশি সহজ নয়। (সহীহ বুখারী, সূরা আল ইখলাস-এর তাফসীর)

সুতরাং রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে পূর্বের জাতিরা যে শাস্তি ভোগ করেছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যেন আমাদের দ্বারা এমন আচরণ প্রকাশ না পায়।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা প্রদান ও কাফিরদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।
২. পূর্ববর্তী নাবীদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী জাতিদের কয়েকটির বর্ণনা পেলাম।
৩. নাবীদের বর্জন করার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পরিণতি কী হয়েছিল তা জানলাম।
৪. পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।

১৬-২২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর জ্ঞান দ্বারা তাদের গতিবেগ, কথা-বার্তা ও কাজ-কর্ম এমনকি অন্তরে কি উদ্রেক হয় তা সবকিছু বেষ্টন করে আছেন।

মহান আল্লাহ তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের ঘাড়ে অবস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটে। মানুষ মনে মনে কি চিন্তা-ভাবনা করে তাও আল্লাহ তা‘আলা জানেন। যেমন- হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমার উম্মাতের মনে যে কুমন্ত্রণা জাগে তা আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন যদি তা না বলে বা আমল করে। (সহীহ বুখারী হা. ৫২৬৯, মুসলিম হা. ১২৭)

وريد (শাহরগ) বলা হয় প্রধান অথবা এমন প্রাণ ধারক ধমনীকে যা কেটে গেলে মৃত্যু হয়ে যায়। এ ধমনী (কণ্ঠনালীর দু’ পাশে দু’টি মোটা আকারের শিরা) মানুষের কাঁধ পর্যন্ত থাকে। ইবনু কাসীর (রহঃ) نحن (আমরা) দ্বারা ফেরেশতাদেরকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ আমার ফেরেশতাগণ মানুষের শাহ রগের চেয়েও নিকটে।

(إِذْ يَتَلَقّٰي الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِيْنِ وَعَنِ الشِّمَالِ)

“যখন দুই গ্রহণকারী (ফেরেশতা) তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে’’ অর্থাৎ দুজন ফেরেশতা মানুষের ডান ও বাম পাশে বসে আমল লিপিবদ্ধ করে। ডান পার্শ্বের ফেরেশতা পুণ্য আর বাম পার্শ্বের ফেরেশতা পাপ কাজ লিপিবদ্ধ করে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের মাঝে রাতের ও দিনের ফেরেশতারা পালাক্রমে যাতায়াত করে। তারা (উভয় দল) ফজর ও ‘আসর সালাতে একত্রিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন আমার বান্দাদের কিভাবে রেখে এসেছ অথচ তিনি তাদের সম্পর্কে ভাল জানেন। তারা জবাবে বলেন : আমরা তাদের নিকট পৌঁছার সময় সালাত অবস্থায় পেয়েছিলাম আর রেখে আসার সময় সালাত অবস্থায় রেখে এসেছিলাম। (সহীহ মুসলিম হা. ৬৩২)

رقيب অর্থ : সংরক্ষণকারী, পর্যবেক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক আর عتيد অর্থ : হলো তৎপর, সদা-সর্বদা প্রস্তুত। অর্থাৎ মানুষের মুখ দিয়ে যত কথা বের হয় তা উঁচু আওয়াজে হোক আর নিচু আওয়াজে হোক তা পর্যবেক্ষকগণ লিপিবদ্ধ করে নেন। সুতরাং মানুষ তার মুখ দিয়ে কী বলছে তা বলার পূর্বে একটু ভেবে চিন্তা করে বলা উচিত। আমার কথা কি কোন উপকারে আসছে, না অনর্থক কোন কথা বলছি, আমার কথার দ্বারা মানুষের ক্ষতি করছি না কারো দোষত্র“টি বর্ণনা করছি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

مَنْ يَضْمَنُ لِيْ مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ

যে ব্যক্তি আমার কাছে দু’চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান ও দু’রানের মধ্যবর্তী স্থানের জামিন হবে আমি তার জন্য জান্নাতের জামিনদার হব। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪৭৪)

এ আয়াত এও প্রমাণ করছে- মুখ দিয়ে প্রকাশ না পেলে সে কথার জন্য পাকড়াও করা হবে না।

(وَجَا۬ءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ)

‘মৃত্যু যন্ত্রণা সত্যই আসবেই’ অর্থাৎ মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুর সময় বলেছিলেন : নিশ্চয়ই মৃত্যু যন্ত্রণা খুব বেদনাদায়ক। (সহীহ বুখারী হা. ৪০৯৪)

এ আয়াতের অন্য একটি অর্থ হলো : মৃত্যু যন্ত্রণা সত্য নিয়ে আসবে। অর্থাৎ মৃত্যুর সময় সত্য স্পষ্ট এবং সে সকল প্রতিশ্রুতির সত্যতা প্রকাশ হয়ে যায়। যা কিয়ামতের ব্যাপারে নাবীগণ বলেছেন।

(وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ)

‘আর শিংগায় ফুঁৎকার দেয়া হবে’ অর্থাৎ ইসরাফিল (রহঃ) মানুষকে কবর থেকে উত্থিত করার জন্য তৃতীয় ফুঁৎকার দেবেন। এ সম্পর্কে সূরা আলি ইমরান ৩ :১৭৩ নং আয়াতে আলোচনা হয়েছে।

(مَعَهَا سَا۬ئِقٌ وَشَهِيْدٌ)

‘তার সাথে থাকবে চালক ও সাক্ষী’ سَائِقٌ অর্থ হলো চালক, شَهِيدٌ অর্থ হলো সাক্ষী। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে একজন ফেরেশতা থাকবে যিনি তাকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে হাশরের ময়দানে, আর অন্য আরেকজন ফেরেশতা সাক্ষী দেবে এটাই সঠিক কথা। (ইবনু কাসীর- অত্র আয়াতের তাফসীর)

(لَقَدْ كُنْتَ فِيْ غَفْلَةٍ) –

‘তুমি এ দিবস সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিলে’ এ আয়াত দ্বারা কাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে সে সম্পর্কে ইবনু জারীর তাবারী তিনটি মত উল্লেখ করেছেন :

(১) এখানে সম্বোধন করা হয়েছে কাফিরদেরকে।
(২) এখানে উদ্দেশ্য খারাপ ভাল সকলেই।
(৩) এর দ্বারা উদ্দেশ্য নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। অর্থাৎ ওয়াহী করার পূর্বে তুমি কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলে। ওয়াহী করার মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম।

ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ তিনটি মতের মাধ্যমে জানা গেল : এখানে সম্বোধন সকলের জন্য প্রযোজ্য। আয়াতের অর্থ হলো : তুমি এ দিন সম্পর্কে গাফেল ছিলে, এখন পর্দা খুলে দিয়েছি ফলে দৃঢ়ভাবে দেখতে পাচ্ছো। অর্থাৎ প্রত্যেকে কিয়ামতের দিন দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হবে।

এমন কি কাফিরও সেদিন সোজা হয়ে যাবে কিন্তু তা উপকারে আসবে না। মহান আল্লাহ বলেন :

(وَلَوْ تَرٰٓي إِذِ الْمُجْرِمُوْنَ نٰكِسُوْا رُؤُوْسِهِمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ ط رَبَّنَآ أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوْقِنُوْنَ) ‏

“আর যদি তুমি দেখতে, যখন পাপীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে স্বীয় মাথা নীচু করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শ্রবণ করলাম, (এখন) তুমি আমাদেরকে পুনরায় (পৃথিবীতে) প্রেরণ কর; আমরা নেক কাজ করব। আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী হয়েছি।” (সূরা সাজদাহ্ ৩২ :১২)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার কুদরত ও জ্ঞান সম্পর্কে জানলাম যে তিনি তাঁর জ্ঞান দ্বারা সবকিছু বেষ্টন করে আছেন।
২. প্রত্যেকের আমল লিপিবদ্ধকারী দুজন ফেরেশতা সর্বদা নিযুক্ত রয়েছে।
৩. মৃত্যু যন্ত্রণা খুব ভয়াবহ।
৪. প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তার ব্যাপারে একজন সাক্ষী থাকবে।
৫. পুনরুত্থান ও প্রতিদানের প্রতি ঈমান আনা জরুরী।
২৩-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

প্রত্যেক মানুষের সাথে নিযুক্ত ফেরেশতা কিয়ামতের দিন আমল সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। বলবে এই দেখো তুমি যা কিছু করেছ সব কিছু আমি লিখে রেখেছি। অপরাধিরা আমলনামা পেয়ে যা বলবে : আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَوُضِعَ الْكِتٰبُ فَتَرَي الْمُجْرِمِيْنَ مُشْفِقِيْنَ مِمَّا فِيْهِ وَيَقُوْلُوْنَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هٰذَا الْكِتٰبِ لَا يُغَادِرُ صَغِيْرَةً وَّلَا كَبِيْرَةً إِلَّآ أَحْصَاهَا)

“এবং উপস্থিত করা হবে ‘আমালনামা এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে, তার কারণে তুমি অপরাধিদের দেখবে আতঙ্কগ্রস্ত‎ এবং তারা বলবে, ‘হায়, দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! যে ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়া হয়নি; বরং সমস্ত‎ই হিসেব রেখেছে।’ (সূরা কাহফ ১৮ :৪৯) আল্লাহ তা‘আলা তখন ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দেবেন ঐ পাপাচারীকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে।

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কিয়ামতের দিন জাহান্নাম তার গর্দান বের করে দিয়ে বলবে, আজ আমি তিন শ্রেণির মানুষের জন্য নিযুক্ত হয়েছি- (১) উদ্ধত ও সত্যের বিরুদ্ধাচরণকারীদের জন্য, (২) আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্যদের শরীক স্থাপনকারীদের জন্য, (৩) অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যাকারীর জন্য। জাহান্নাম এসব লোকদেরকে জড়িয়ে ধরবে অতঃপর তার তলদেশে নিক্ষেপ করবে। (মুয়াত্তা মালেক ৩/২৪০, সহীহ)

عنيد অর্থ সত্যবিমুখ, এটা কাফিরের প্রথম অপরাধ, দ্বিতীয় অপরাধ হল নিজে তো ভাল কাজ করেই না অপরকেও ভাল কাজে প্রবল বাধা দেয়। তৃতীয় অপরাধ হল তারা সীমালঙ্ঘনকারী, চতুর্থ অপরাধ হল তাওহীদের ব্যাপারে সন্দিহান। যার ফলে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করে। এ সমস্ত কাফিরদেরকে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে বলবেন।

(وَقَالَ قَرِيْنُهُ)

‘তার সহচর (শয়তান) বলবে’ এখানে সহচর হলো শয়তান, সে বলবে : হে আল্লাহ! আমি তাকে পথভ্রষ্ট করিনি, বরং সে নিজেই পথভ্রষ্ট ছিল। এ-কথা বলে সে দায়মুক্ত হয়ে যাবে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “যখন বিচারকার্য সম্পন্ন হবে তখন শয়তান বলবে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। আমার তো তোমাদের ওপর কোন আধিপত্য ছিল না, আমি কেবল তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ কর না, তোমরা নিজেদেরই প্রতি দোষারোপ কর‎। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমাকে উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক করেছিলে আমি তা অস্বীকার করছি, নিশ্চয়ই‎ জালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি‎।” (সূরা ইব্রাহীম ১৪ :২২)

আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : আমার কাছে ঝগড়া করো না, আমি পূর্বেই সতর্কবাণী প্রেরণ করেছিলাম। আমার কথার রদ-বদল হয় না। আমি বান্দার প্রতি জালিমও না। সুতরাং কিয়ামতের দিন শয়তানের দোষ দিয়ে রক্ষা পাওয়া যাবে না। সেদিন শয়তান উপযুক্ত প্রমাণ পেশ করে কেটে পড়বে। তাই আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত, যে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে দিন রাত এত অপরাধ করছি সে শয়তান আমাদেরকে জাহান্নামে পৌঁছে দিয়ে চলে যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামত দিবসে মানুষের সাথে নিযুক্ত ফেরেশতাদের সাক্ষীর কথা জানতে পারলাম।
২. আয়াতে বর্ণিত খারাপ গুণাবলী থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।
৩. শয়তান ও জাহান্নামবাসীদের ঝগড়ার কথা জানতে পারলাম।
৪. শয়তানের প্রতিশ্রুতি মিথ্যা, সে প্রতিশ্রুতির নামে ধোঁকা দিয়ে থাকে।
৫. আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি জুলুম করেন না।

# আয়াতের ব্যাখ্যায়:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# যেসব সূরাকে মুফাস্সাল সূরা বলা হয় ওগুলোর মধ্যে সূরায়ে কাফই প্রথম। তবে একটি উক্তি এও আছে যে, মুফাস্সাল সূরাগুলো সূরায়ে হুজুরাত হতে শুরু হয়েছে। সর্বসাধারণের মধ্যে এটা যে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে যে, মুফাস্সাল সূরাগুলো (আরবী) হতে শুরু হয় এটা একেবারে ভিত্তিহীন কথা। আলেমদের কেউই এর উক্তিকারী নন। মুফাস্সাল সূরাগুলোর প্রথম সূরা এই সূরায়ে কাফই বটে। এর দলীল হচ্ছে সুনানে আবি দাউদের ঐ হাদীসটি যা ‘বাবু তাহযীবিল কুরআন’-এর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আউস ইবনে হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ সাকীফ প্রতিনিধি দলের মধ্যে শামিল হয়ে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হই। আহলাফ তো হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রাঃ)-এর ওখানে অবস্থান। করেন। আর বানু মালিককে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজের ওখানে অবস্থান করান। তাঁদের মধ্যে মুসাদ্দাদ (রাঃ) নামক এক ব্যক্তি বলেনঃ “প্রত্যহ রাত্রে ইশা’র নামাযের পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট আসতেন এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে তাঁর নিজের কথা শুনাতেন। এমন কি বিলম্ব হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর পা পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতো। কখনো তিনি এই পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং কখনো ঐ পায়ের উপর। প্রায়ই তিনি আমাদের সামনে ঐ সব দুঃখপূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করতেন যেগুলো কুরায়েশরা ঘটিয়েছিল। অতঃপর তিনি বলতেনঃ “কোন দুঃখ নেই, আমরা মক্কায় দুর্বল ছিলাম, শক্তিহীন ছিলাম। তারপর আমরা মদীনায় আসলাম। এরপর মক্কাবাসী ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ফল হয় বালতির মত অর্থাৎ কখনো আমরা তাদের উপর বিজয়ী হই এবং কখনো তারা আমাদের উপর বিজয়ী হয়। মোটকথা, প্রত্যহ রাত্রে আমরা তাঁর প্রিয় সাহচর্য লাভ করে গৌরবান্বিত হতাম। একদা রাত্রে তাঁর আগমনের সময় হয়ে গেল কিন্তু তিনি আসলেন না। বহুক্ষণ পর আসলেন। আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আজ তো আসতে আপনার খুব বিলম্ব হলো (কারণ কি?) উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যাঁ, কুরআন কারীমের যে অংশ আমি দৈনিক পাঠ করে থাকি তা এই সময় পাঠ করছিলাম। অসমাপ্ত ছেড়ে আসতে আমার মন চাইলো না (তাই সমাপ্ত করে আসতে বিলম্ব হলো)।” হযরত আউস (রাঃ) বলেনঃ আমি সাহাবীদেরকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করলামঃ আপনারা কুরআন কারীমকে কিভাবে ভাগ করতেন? তাঁরা উত্তরে বললেনঃ “আমাদের ভাগ করার পদ্ধতি নিম্নরূপঃ

প্রথম তিনটি সূরার একটি মনযিল, তারপর পাঁচটি সূরার এক মনযিল, এরপর সাতটি সূরার এক মনযিল, তারপর নয়টি সূরার এক মনযিল, অতঃপর এগারোটি সূরার এক মনযিল এবং এরপর তেরোটি সূরার এক মনযিল আর শেষে মুফাসসাল সূরাগুলোর এক মনযিল।” এ হাদীসটি সুনানে ইবনে মাজাহতেও রয়েছে। সুতরাং প্রথম ছয় মনযিলে মোট আটচল্লিশটি সূরা হচ্ছে। তারপর মুফাসসালের সমস্ত সূরার একটি মনযিল হলো। আর এই মনযিলের প্রথমেই সূরায়ে কা’ফ রয়েছে। নিয়মিতভাবে গণনা নিম্নরূপঃ

প্রথম মনযিলের তিনটি সূরা হলোঃ সূরায়ে বাকারা, সূরায়ে আলে ইমরান এবং সূরায়ে নিসা। দ্বিতীয় মনযিলের পাঁচটি সূরা হলোঃ সূরায়ে মায়েদাহ, সূরায়ে আনআম, সূরায়ে আ’রাফ, সূরায়ে আনফাল এবং সূরায়ে বারাআত। তৃতীয় মনযিলের সাতটি সূরা হচ্ছেঃ সূরায়ে ইউনুস, সূরায়ে হূদ, সূরায়ে ইউসুফ, সূরায়ে রা’দ, সূরায়ে ইবরাহীম, সূরায়ে হিজর এবং সূরায়ে নাহল। চতুর্থ মনযিলের নয়টি সূরা হলোঃ সূরায়ে সুবহান, সূরায়ে কাহাফ, সূরায়ে মারইয়াম, সূরায়ে তোয়া-হা, সূরায়ে আম্বিয়া, সূরায়ে হাজ্ব, সূরায়ে মু’মিনূন, সূরায়ে নূর এবং সূরায়ে ফুরকান। পঞ্চম মনযিলের এগারোটি সূরা হচ্ছেঃ সূরায়ে শুআরা, সূরায়ে নামল, সূরায়ে কাসাস, সূরায়ে আনকাবূত, সূরায়ে রূম, সূরায়ে লোকমান, সূরায়ে আলিফ-লাম-মীম-আস্সাজদাহ, সূরায়ে আহযার, সূরায়ে সাবা, সূরায়ে ফাতির এবং সূরায়ে ইয়াসীন। ষষ্ঠ মনযিলের তেরোটি সূরা হলোঃ সূরায়ে আস-সফফাত, সূরায়ে সা’দ, সূরায়ে যুমার, সূরায়ে গাফির, সূরায়ে হা-মীম আসসাজদাহ, সূরায়ে হা-মীম-আইন-সীন-কাফ, সূরায়ে যুখরুফ, সূরায়ে দুখান, সূরায়ে জাসিয়াহ, সূরায়ে আহকাফ, সূরায়ে কিতাল, সূরায়ে ফাতহ এবং সূরায়ে হুজুরাত। তারপর শেষের মুফাসসাল সূরাগুলোর মনযিল, যেমন সাহাবীগণ (রাঃ) বলেছেন এবং এটা সূরায়ে কা’ফ হতেই শুরু হয়েছে যা আমরা বলেছি। সুতরাং আল্লাহ তা’আলার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা।

হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হযরত আবু ওয়াফিদ লাইসীকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “ঈদের নামাযে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কি পড়তেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “ঈদের নামাযে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সূরায়ে কাফ এবং সূরায়ে ইকতারাবাত পাঠ করতেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত উম্মে হিশাম বিনতে হারেসাহ (রাঃ) বলেনঃ “দুই বছর অথবা এক বছর ও কয়েক মাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এবং আমাদের চুল্লী একটিই ছিল। আমি সূরায়ে কা’ফ-ওয়াল-কুরআনিল মাজীদ, এই সূরাটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে শুনে শুনে মুখস্থ করে নিয়েছিলাম। কেননা, প্রত্যেক জুমআর দিন যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) জনগণের সামনে ভাষণ দেয়ার জন্যে মিম্বরের উপর দাড়াতেন তখন এই সূরাটি তিনি তিলাওয়াত করতেন। মোটকথা, বড় বড় সমাবেশে, যেমন ঈদ ও জুমআতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই সূরাটি পড়তেন। কেননা, এর মধ্যে সৃষ্টির সূচনা, মৃত্যুর পরে পুনর্জীবন, আল্লাহ তা’আলার সামনে দাঁড়ানো, হিসাব-কিতাব, জান্নাত-জাহান্নাম, পুরস্কার-শাস্তি, উৎসাহ প্রদান এবং ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:

(আরবী) হুরূফে হিজার মধ্যে একটি হরফ বা অক্ষর যেগুলো সূরাসমূহের প্রথমে এসে থাকে। যেমন (আরবী) ইত্যাদি। আমরা এগুলোর পূর্ণ ব্যাখ্যা সূরায়ে বাকারার তাফসীরের শুরুতে করে দিয়েছি। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। পূর্বযুগীয় কোন কোন গুরুজনের উক্তি এই যে, কাফ একটি পাহাড় যা সারা যমীনকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। মনে হয় এটা বানী ইসরাঈলের বানানো কথা যা কতক লোক তাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছে এই মনে করে যে, তাদের থেকে রিওয়াইয়াত গ্রহণ করা বৈধ। যদিও তা সত্যও বলা যায় না এবং মিথ্যাও না। কিন্তু আমার ধারণা এই যে, এটা এবং এই ধরনের আরো বহু। রিওয়াইয়াত তো বানী ইসরাঈলের অবিশ্বাসী লোকেরা গড়িয়ে বা বানিয়ে নিয়েছে যাতে দ্বীনকে তারা জনগণের উপর মিশ্রিত করে দিতে পারে। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে যে, যদিও এই উম্মতের মধ্যে বড় বড় আলেম, হাফি, দ্বীনদার ও অকপট লোক সর্বযুগে ছিল এবং এখনো আছে তথাপি আল্লাহর একত্ববাদে অবিশ্বাসী লোকেরা অতি অল্প কালের মধ্যে মাওযূ’ হাদীসসমূহ রচনা করে ফেলেছে! তাহলে বানী ইসরাঈল, যাদের উপর দীর্ঘ যুগ অতীত হয়েছে এবং যাদের মধ্যে হাফিয ও আলেমের সংখ্যা অতি নগণ্য ছিল, যারা আল্লাহর কালামকে মূলতত্ত্ব হতে সরিয়ে দিতো, যারা মদ্য পানে লিপ্ত থাকতো, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে বদলিয়ে দিতো, তারা যে অনেক কিছু নিজেরাই বানিয়ে নিবে এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। সুতরাং হাদীসে তাদের হতে যে রিওয়াইয়াতগুলো গ্রহণ করা জায়েয রাখা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ঐ রিওয়াইয়াত যেগুলো কমপক্ষে জ্ঞানে ধরে ও বুঝে আসে। ওগুলো নয় যেগুলো স্পষ্টভাবে বিবেক বিরোধী। যেগুলো শোনমাত্রই জ্ঞানে ধরা পড়ে যে, ওগুলো মিথ্যা ও বাজে। ওগুলো মিথ্যা হওয়া এমনই প্রকাশমান যে, এর জন্যে দলীল আনয়নের কোনই প্রয়োজন হয় না। সুতরাং উপরে বর্ণিত রিওয়াইয়াতটিও অনুরূপ। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

বড়ই দুঃখজনক যে, পূর্বযুগীয় ও পরবর্তী যুগের বহু গুরুজন আহলে কিতাব হতে এই ধরনের বর্ণনা ও কাহিনীগুলো কুরআন কারীমের তাফসীরে আনয়ন করেছেন। আসলে কুরআন মাজীদ এই প্রকারের রিওয়াইয়াতের মোটেই মুখাপেক্ষী নয়। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলারই প্রাপ্য।

মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান ইবনে আবি হাতিম আর রাযীও (রঃ) এখানে এক অতি বিস্ময়কর আসার হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন, যার সনদ সঠিক নয়। তাতে রয়েছেঃ আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা একটি সমুদ্র সৃষ্টি করেছেন যা গোটা পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে। এই সমুদ্রের পিছনে একটি পাহাড় রয়েছে যা ওকে পরিবেষ্টন করে আছে, ওরই নাম কাফ। আকাশ ও পৃথিবী ওরই উপর উঠানো রয়েছে। আবার এই পাহাড়ের পিছনে আল্লাহ তাআলা এক যমীন সৃষ্টি করেছেন যা এই যমীন হতে সাতগুণ বড়। ওর পিছনে আবার একটি সমুদ্র রয়েছে যা ওকে ঘিরে রয়েছে। আবার ওর পিছনে একটি পাহাড় আছে যা ওকে পরিবেষ্টন করে আছে। ওটাকেও কাফ বলা হয়। দ্বিতীয় আকাশকে ওরই উপর উঁচু করা আছে। এই ভাবে সাতটি যমীন, সাতটি সমুদ্র, সাতটি পাহাড় এবং সাতটি আকাশ গণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, আল্লাহর নিমের উক্তির তাৎপর্য এটাইঃ (আরবী) অর্থাৎ “এই যে সমুদ্র এর সহিত যদি আরো সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়।” (৩১:২৭) এর ইসনাদ ছেদ কাটা।

হযরত আলী ইবনে আবি তালহা (রাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে যা বর্ণনা করেছেন তাতে রয়েছে যে, (আরবী) আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে একটি নাম। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, (আরবী) অক্ষরটিও (আরবী) প্রভৃতি হুরূফে হিজার মতই একটি হরফ বা অক্ষর। সুতরাং এসব উক্তি দ্বারা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত বলে ধারণাকৃত পূর্বের উক্তিটি দূর হয়ে যায়। এটাও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা বুঝানো হয়েছেঃ “আল্লাহর কসম! কাজের ফায়সালা করে দেয়া হয়েছে এবং বলে অবশিষ্ট বাক্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যেমন কবির উক্তিঃ

(আরবী) অর্থাৎ “আমি তাকে (মহিলাটিকে) বললামঃ থামো, তখন সে বললো।” কিন্তু এই তাফসীরের ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, উহ্যের উপর ইঙ্গিতকারী কালাম পরিষ্কার হওয়া উচিত। তাহলে এখানে কোন্ কালাম রয়েছে যদদ্বারা এতো বড় বাক্য উহ্য থাকার প্রতি ইঙ্গিত করছো?

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা ঐ মহাসম্মানিত কুরআনের শপথ করছেন যার সামনে হতে ও পিছন হতে বাতিল আসতেই পারে না, যা বিজ্ঞানময় ও প্রশংসার্হ আল্লাহর নিকট হতে অবতারিত।

এই কসমের জবাব কি এ সম্পর্কেও কয়েকটি উক্তি রয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) তো কোন কোন নাহভী হতে বর্ণনা করেছেন যে, এর জবাব হলো (আরবী) হতে পূর্ণ আয়াত পর্যন্ত। কিন্তু এ ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। বরং এই কসমের জবাব হলো কসমের পরবর্তী কালামের বিষয় অর্থাৎ নবুওয়াত এবং দ্বিতীয় বারের জীবনকে সাব্যস্ত করণ, যদিও শব্দ দ্বারা এটা বলা হয়নি। এরূপ কসমের জবাব কুরআন কারীমে বহু রয়েছে। যেমন সূরায়ে (আরবী)-এর শুরুতে এটা গত হয়েছে। এখানেও ঐরূপ হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “কিন্তু কাফিররা তাদের মধ্যে একজন সতর্ককারী আবির্ভূত হতে দেখে বিস্ময় বোধ করে ও বলেঃ এটা তো এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার!’ অর্থাৎ তারা এ দেখে খুবই বিস্ময় প্রকাশ করেছে যে, তাদেরই মধ্য হতে একজন মানুষ কিভাবে রাসূল হয়ে গেল! যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “লোকেরা কি এতে বিস্ময় বোধ করেছে যে, আমি তাদেরই মধ্য হতে একজন লোকের উপর অহী অবতীর্ণ করেছি (এই বলার জন্যে) যে, তুমি লোকদেরকে ভয় প্রদর্শন কর….?” (১০:২) অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে এটা বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল না। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের মধ্যে যাকে চান রিসালাতের জন্যে মনোনীত করেন এবং মানুষের মধ্যে যাকে চান রাসূলরূপে মনোনীত করেন। এরই সাথে এটাও বর্ণিত হচ্ছে যে, তারা মৃত্যুর পরে পুনর্জীবনকেও বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখেছে। তারা বলেছেঃ আমরা যখন মরে যাবো এবং আমাদের মৃতদেহ গলে পচে মৃত্তিকায় পরিণত হয়ে যাবে, এরপরেও কি আমরা পুনরুত্থিত হবো? অর্থাৎ আমাদের অবস্থা এরূপ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের পুনর্জীবন লাভ অসম্ভব। তাদের এ কথার জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ মৃত্তিকা তাদের কতটুকু ক্ষয় করে তা তো আমি জানি। অর্থাৎ তাদের মৃতদেহের অণু-পরমাণু মাটির কোথায় যায় এবং কি অবস্থায় কোথায় থাকে তা আমার অজানা থাকে না। আমার নিকট যে রক্ষিত ফলক রয়েছে তাতে সব কিছুই লিপিবদ্ধ রয়েছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে তাদের গোশত, চামড়া, হাড়, চুল ইত্যাদি যা কিছু মৃত্তিকায় খেয়ে ফেলে তা আমার জানা আছে।

এরপর আল্লাহ তাআলা তাদের এটাকে অসম্ভব মনে করার প্রকৃত কারণ বর্ণনা করছেন যে, তারা আসলে তাদের নিকট সত্য আসার পর তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আর যারা এভাবে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের ভাল বোধশক্তি ছিনিয়ে নেয়া হয়। (আরবী) শব্দের অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন, অস্থির, প্রত্যাখ্যানকারী এবং মিশ্রণ। যেমন কুরআন কারীমে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই তোমরা বিভিন্ন উক্তির মধ্যে রয়েছে। কুরআনের অনুসরণ হতে সেই বিরত থাকে যাকে কল্যাণ হতে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।” (৫১:৮-৯)

৬-১১ নং আয়াতের তাফসীর:

এ লোকগুলো যেটাকে অসম্ভব মনে করছে, বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ ওর চেয়েও নিজের বড় শক্তির নমুনা তাদের সামনে পেশ করে বলছেনঃ তোমরা আকাশের দিকে চেয়ে দেখো, ওর নির্মাণ কৌশলের কথা একটু চিন্তা কর, ওর উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির প্রতি দৃষ্টিপাত কর এবং লক্ষ্য কর যে, ওর কোন জায়গায় কোন ছিদ্র বা ফাটল নেই। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ(আরবী) অর্থাৎ “যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না। আবার তাকিয়ে দেখো, কোন ত্রুটি দেখতে পাও কি?” অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে। (৬৭:৩-৪)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা যাতে যমীন হেলা-দোলা না করে। কেননা, যমীন চতুর্দিক হতে পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছে। আর আমি ওতে উদাত করেছি নয়ন প্রীতিকর সর্বপ্রকার উদ্ভিদ। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক জিনিসকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি যাতে তোমরা উপদেশ লাভ কর।” (৫১:৪৯)।

অতঃপর মহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আসমান, যমীন এবং এ ছাড়াও আল্লাহ তা’আলার ব্যাপক ক্ষমতার আরো বহু নিদর্শন রয়েছে, এগুলো আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে জ্ঞান ও উপদেশ স্বরূপ।

অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি আকাশ হতে কল্যাণকর বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তদ্দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ক শস্যরাজি এবং সমুন্নত খর্জুর বৃক্ষ যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। এগুলো আমার বান্দাদের জীবিকা স্বরূপ। বৃষ্টি দ্বারা আমি মৃত ও শুষ্ক ভূমিকে সঞ্জীবিত করে থাকি। ভূমি তখন সবুজ-শ্যামল হয়ে আন্দোলিত হতে থাকে। এভাবেই মৃতকে পুনর্জীবিত করা হবে এবং পুনরুত্থান এভাবেই ঘটবে। মানুষ তো এসব নিদর্শন দৈনন্দিন দেখছে। এরপরেও কি তাদের জ্ঞানচক্ষু ফিরবে না? তারা কি এখনো বিশ্বাস করবে না যে, আল্লাহ তাআলা মৃতকে পুনর্জীবন দান করতে পূর্ণরূপে ক্ষমতাবান? যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “অবশ্যই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি মানব সৃষ্টি অপেক্ষা খুব বড় (ভারী বা কঠিন)।” (৪০:৫৭) আর একটি আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা কি অনুধাবন করে না যে, আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী। সৃষ্টি করেছেন এবং এসবের সৃষ্টিতে কোন ক্লান্তি বোধ করেননি, তিনি মৃতের জীবনদান করতেও সক্ষম? বস্তুতঃ তিনি সর্বশক্তিমান।” (৪৬:৩৩) মহান আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অথাৎ “এবং তার একটি নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখতে পাও শুষ্ক, উর্বর, অতঃপর আমি ওতে বারি বর্ষণ করলে ওটা আন্দোলিত ও স্ফীত হয়; যিনি ভূমিকে জীবিত করেন তিনিই মৃতের জীবন দানকারী। তিনি তো সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (৪১:৩৯)।

১২-১৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা মক্কাবাসীকে ঐ শাস্তি হতে সতর্ক করছেন যা তাদের পূর্বে তাদের মত মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের উপর আপতিত হয়েছিল। যেমন হযরত নূহ (আঃ)-এর কওম, যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন এবং আসহাবুর রাস্স, যাদের পূর্ণ ঘটনা সূরায়ে ফুরকানের তাফসীরে গত হয়েছে। আর সামূদ, আ’দ, ফিরাউন এবং হযরত লূত (আঃ)-এর সম্প্রদায়, যাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ঐ যমীনকে আল্লাহ সড়া-পচা পাঁকে পরিণত করেছেন। এসব ছিল তাদের কুফরী, ঔদ্ধত্য এবং সত্যের বিরুদ্ধাচরণেরই ফল। আসহাবে আয়কাত দ্বারা হযরত শু’আয়েব (আঃ)-এর কওমকে এবং কাওমু তুব্বা দ্বারা ইয়ামনীদেরকে বুঝানো হয়েছে। সূরায়ে দুখানে তাদের ঘটনাও গত হয়েছে এবং সেখানে এর পূর্ণ তাফসীর করা হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তির কোন প্রয়োজন নেই। অতএব সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলারই প্রাপ্য। এসব উম্মত তাদের রাসূলদেরকে (আঃ) অবিশ্বাস করেছিল। তাই তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, একজন রাসূলকে (আঃ) অস্বীকারকারী যেন সমস্ত রাসূলকেই অস্বীকারকারী। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হযরত নূহ (আঃ)-এর কওম রাসূলদেরকে অস্বীকার করে ।” (২৬:১০৫)

অথচ তাদের নিকট তো শুধু হযরত নূহই (আঃ) আগমন করেছিলেন। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে তারা এমনই ছিল যে, যদি তাদের নিকট সমস্ত রাসূলও আসতেন তবুও তারা সকলকেই অবিশ্বাস করতো, একজনকেও বিশ্বাস করতো না। তাদের কৃতকর্মের ফল হিসেবে তাদের উপর আল্লাহ তা’আলার শাস্তির ওয়াদা পূর্ণ হয়েছে। অতএব মক্কাবাসী এবং অন্যান্য সম্বোধনকৃত লোকদেরও এই বদভ্যাস পরিত্যাগ করা উচিত। নচেৎ হয়তো ঐরূপ শাস্তি তাদের উপরও আপতিত হবে।

এরপর প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে, পুনঃসৃষ্টি বিষয়ে তারা সন্দেহ পোষণ করবে? প্রথমবার সৃষ্টি করা হতে তো দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা খুব সহজই হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রথমবার তিনিই সৃষ্টি করেছেন এবং পুনর্বার সৃষ্টিও তিনিই করবেন এবং এটা তার কাছে খুবই সহজ।” (৩০:২৭) মহামহিমানিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়; বলে- অস্তিতে প্রাণ সঞ্চার করবে কে যখন ওটা পচে গলে যাবে? বলঃ ওর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই যিনি এটা প্রথমবার সৃষ্টি করছেন। এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।” (৩৬:৭৮-৭৯)

সহীহ হাদীসে আছে যে, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আদম-সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়। সে বলে- আল্লাহ আমাকে পুনর্বার কখনই সৃষ্টি করতে পারবেন না। অথচ প্রথমবারের সৃষ্টি দ্বিতীয়বারের সৃষ্টি হতে আমার কাছে মোটেই সহজ নয়।

১৬-২২ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলছেন যে, তিনিই মানুষের সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর জ্ঞান সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে, এমনকি মানুষের মনে যে ভাল-মন্দ ধারণার উদ্রেক হয় সেটাও তিনি জানেন। সহীহ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের অন্তরে যে ধারণা আসে আল্লাহ তা’আলা তা ক্ষমা করে দিয়েছেন যে পর্যন্ত না তা তাদের মুখ দিয়ে বের হয়।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর।’ অর্থাৎ তাঁর ফেরেশতাগণ। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা আল্লাহর ইলম বা অবগতিকে বুঝানো হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্য এই যে, যাতে মিলন ও একত্রিত হওন অবশ্যম্ভাবী হয়ে না পড়ে যা হতে তাঁর পবিত্র সত্তা বহু দূরে রয়েছে এবং তিনি এটা হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। কিন্তু শব্দের চহিদা এটা নয়। কেননা, এখানে (আরবী) একথা বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে (আরবী) -এই কথা। যেমন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফটকারীর ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তোমাদের অপেক্ষা তার নিকটতর, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না।” (৫৬:৮৫) এর দ্বারাও ফেরেশতাদের তার এরূপ নিকটবর্তী হওয়া বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি যিকর (অর্থাৎ কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই ওর হিফাযতকারী ।” (১৫:৯) ফেরেশতারাই কুরআন কারীমকে নিয়ে অবতীর্ণ হতেন এবং এখানেও ফেরেশতাদের এরূপ নৈকট্য বুঝানো হয়েছে। এর উপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তাঁদেরকে ক্ষমতা প্রদান করেছেন। সুতরাং মানুষের উপর ফেরেশতাদেরও প্রভাব থাকে এবং শয়তানেরও প্রভাব থাকে। শয়তান মানুষের দেহের মধ্যে রক্তের মত চলাফেরা করে। যেমন আল্লাহর চরম সত্যবাদী নবী (সঃ) বলেছেন। এজন্যেই এর পরেই আল্লাহ তাআলা বলেনঃ দু’জন ফেরেশতা মানুষের ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অথাৎ “অবশ্যই আছে তোমাদের জন্যে তত্ত্বাবধায়কগণ; সম্মানিত লিপিকরবৃন্দ; তারা জানে তোমরা যা কর।” (৮২:১০-১২)

হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ফেরেশতারা মানুষের ভাল ও মন্দ সমস্ত আমল লিপিবদ্ধ করে থাকেন। এ ব্যাপারে হযরত ইবনে আব্বাস (রঃ)-এর দু’টি উক্তি রয়েছে। একটি উক্তিতো এটাই এবং অপর উক্তিটি এই যে, যে আমলের উপর পুরস্কার ও শাস্তি আছে শুধু ঐ আমলগুলোই লিখেন। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই বেশী প্রকাশমান। কেননা, প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা হচ্ছেঃ মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।

হযরত বিলাল ইবনে হারিস মুযানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির এমন কোন কথা উচ্চারণ করে যেটাকে সে বড় সওয়াবের কথা মনে করে না, কিন্তু আল্লাহ ওরই কারণে কিয়ামত পর্যন্ত স্বীয় সন্তুষ্টি তার জন্যে লিখে দেন। পক্ষান্তরে, সে কোন সময় আল্লাহর অসন্তুষ্টির এমন কোন কথা উচ্চারণ করে ফেলে যেটাকে সে তেমন কোন বড় গুনাহর কথা মনে করে না, কিন্তু ওরই কারণে আল্লাহ স্বীয় সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত তার জন্যে তার অসন্তুষ্টি লিখে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহও (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন) হযরত আলকামা (রঃ) বলেনঃ “এ হাদীসটি আমাকে বহু কথা হতে বাঁচিয়ে নিয়েছে।”

আহনাফ ইবনে কায়েস (রঃ) বলেন যে, ডান দিকের ফেরেশতা পুণ্য লিখেন এবং তিনি বাম দিকের ফেরেশতার উপর আমানতদার। বান্দা যখন কোন পাপকার্য করে তখন তিনি বাম দিকের ফেরেশতাকে বলেনঃ “থামো।” যদি সে তাড়াতাড়ি বা সাথে সাথে তাওবা করে নেয় তবে তিনি তাকে পাপ লিখতে দেন। কিন্তু তাওবা না করলে বাম দিকের ফেরেশতা ওটা লিখে নেন। (ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

হযরত হাসান বসরী (রঃ) (আরবী)-এ আয়াতটি তিলাওয়াত করার পর বলেনঃ “হে আদম সন্তান! তোমার জন্যে সহীফা খুলে দেয়া হয়েছে। দু’জন সম্মানিত ফেরেশতাকে তোমার উপর নিযুক্ত করা হয়েছে। একজন আছেন তোমার ডান দিকে এবং একজন আছেন বাম দিকে। ডানের জন তোমার পুণ্যগুলো লিপিবদ্ধ করছেন এবং বামের জন লিপিবদ্ধ করছেন তোমার পাপগুলো। এখন তুমি যা ইচ্ছা আমল কর, বেশী কর অথবা কম কর। যখন তুমি মৃত্যুবরণ করবে তখন এই দফতর জড়িয়ে নেয়া হবে এবং তোমার কবরে রেখে দেয়া হবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন যখন তুমি কবর হতে উঠবে তখন এটা তোমার সামনে পেশ করা হবে। একথাই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক মানুষের কর্ম আমি তার গ্রীবালগ্ন করেছি এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্যে বের করবে এক কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত। (তাকে বলা হবে) তুমি তোমার কিতাব পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্যে যথেষ্ট।” (১৭:১৩-১৪) তারপর তিনি বলেনঃ “আল্লাহর কসম! তিনি বড়ই ন্যায় বিচার করেছেন যিনি তোমাকেই তোমার নিজের হিসাব রক্ষক করে দিয়েছেন।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ভাল-মন্দ যা কিছু কথা মুখ হতে বের হয় তার সবই লিখা হয়। এমন কি মানুষ যে বলেঃ আমি খেয়েছি’, ‘আমি পান করেছি’, ‘আমি গিয়েছি’, ‘আমি এসেছি ইত্যাদি সব কিছুই লিখিত হয়। তারপর বৃহস্পতিবারে তার কথা ও কাজগুলো পেশ করা হয়। অতঃপর ভাল ও মন্দ রেখে দেয়া হয় এবং বাকী সব কিছুই সরিয়ে ফেলা হয়। আল্লাহ তা’আলার নিম্নের উক্তির অর্থ এটাইঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ যা চান মিটিয়ে দেন এবং যা চান ঠিক রাখেন এবং তাঁর নিকট উম্মুল কিতাব রয়েছে।” (১৩:৩৯)

হযরত ইমাম আহমাদ (রঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। তখন তিনি জানতে পারলেন যে, হযরত তাউস (রঃ)-এর মতে ফেরেশতারা এটাও লিখে থাকেন। তখন তিনি কাতরানোও বন্ধ করে দেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন যে, তিনি মৃত্যুর সময় উহ পর্যন্ত করেননি।

এরপর প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে মানুষ! মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে। ঐ সময় ঐ সন্দেহ দূর হয়ে যাবে যাতে তুমি এখন জড়িয়ে পড়েছে। ঐ সময় তোমাকে বলা হবেঃ এটা ওটাই যা হতে তুমি অব্যাহতি চেয়ে এসেছে। এখন ওটা এসে গেছে। তুমি ওটা হতে কোনক্রমেই পরিত্রাণ পেতে পার না। না তুমি এটাকে রোধ করতে পার, না পার এর সাথে মুকাবিলা করতে, না তোমার ব্যপারে কারো কোন সাহায্য ও সুপারিশ কোন কাজে আসবে। সঠিক কথা এটাই যে, এখানে সম্বোধন সাধারণভাবে মানুষকে করা হয়েছে, যদিও কেউ কেউ বলেন যে, এ সম্বোধন কাফিরদের প্রতি এবং অন্য কেউ অন্য কিছু বলেছেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি আমার পিতা (রাঃ)-এর মৃত্যুর সময় তাঁর শিয়রে বসেছিলাম। তিনি মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলেন। তখন আমি নিম্নের ছন্দটি পাঠ করলামঃ (আরবী) অর্থাৎ “যার অশ্রু থেমে আছে, ওটাও একবার টপ টপ করে পড়বে।” তখন তিনি মাথা উঠিয়ে বললেন, হে আমার প্রিয় কন্যা! তুমি যা বললে তা নয়, বরং আল্লাহ যা বলেছেন এটা তা-ই। তা হলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে; এটা হতেই তোমরা অব্যাহতি চেয়ে আসছে।” এই আসারের আরো বহু ধারা আমি সীরাতে সিদ্দীক (রাঃ)-এর মধ্যে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর মৃত্যুর বর্ণনায় আনয়ন করেছি।

সহীহ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় মূৰ্ছিত হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয় তখন তিনি চেহারা মুবারক হতে ঘাম মুছতে মুছতে বলেনঃ “সুবহানাল্লাহ! মৃত্যুর বড়ই যন্ত্রণা!”

(আরবী) এর কয়েক প্রকার অর্থ করা হয়েছে। প্রথম এই যে, (আরবী) এখানে (আরবী) হয়েছে, অর্থাৎ এটা ওটাই যেটাকে বহু দূরের মনে করতে। দ্বিতীয় এই যে, এখানে বা নেতিবাচক। তখন অর্থ হবেঃ “এটা ওটাই, যা হতে পরিত্রাণ পাওয়ার এবং যাকে সরিয়ে ফেলার তুমি ক্ষমতা রাখো না।

হযরত সুমরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (রঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মৃত্যু হতে পলায়ন করে তার দৃষ্টান্ত ঐ খেকশিয়ালের মত যার কাছে যমীন তার ঋণ চাইলো, তখন সে পালাতে শুরু করলো। পালাতে পালাতে যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়লো তখন নিজের গর্তে প্রবেশ করলো। যেহেতু যমীন সেখানেও ছিল সেহেতু ঐ যমীন তাকে বললোঃ “ওরে খেঁকশিয়াল! তুই আমার ঋণ পরিশোধ কর।” তখন সে সেখান হতে আবার পালাতে শুরু করলো। অবশেষে সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারালো। মোটকথা, ঐ খেঁকশিয়াল যেমন যমীন হতে পালাবার রাস্তা পায়নি, অনুরূপভাবে মানুষেরও মৃত্য হতে পালাবার রাস্তা বন্ধ। (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) স্বীয় মু’জামুল কাবীর’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

এরপর শিংগায় ফুঙ্কার দেয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা স্বলিত হাদীস গত হয়েছে। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘কিরূপে আমি শান্তি ও আরাম পেতে পারি, অথচ শিংগায় ফুঙ্কার দানকারী ফেরেশতা শিংগা মুখে নিয়ে রয়েছেন এবং গ্রীবা ঝুঁকিয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন যে, কখন তিনি নির্দেশ দিবেন, আর ঐ নির্দেশ অনুযায়ী তিনি শিংগায় ফুৎকার দিবেন!” সাহাবীগণ (রাঃ) আরয করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি বলবে?” উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা বলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক।”

মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ “সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি উপস্থিত হবে, তার সঙ্গে থাকবে চালক ও তার কর্মের সাক্ষী।’ একজন তাকে আল্লাহ তা’আলার দিকে চালিয়ে নিয়ে যাবেন এবং অপরজন তার কর্মের সক্ষ্য দিবেন। প্রকাশ্য আয়াত তো এটাই এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাকেই পছন্দ করেছেন। হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) মিম্বরের উপর এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন এবং বলেনঃ “একজন চালক তাকে হাশরের ময়দানের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাবেন এবং সাক্ষী হবেন যিনি তার কর্মের সাক্ষ্য দান করবেন।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) দ্বারা ফেরেশতাকে এবং (আরবী) দ্বারা আমলকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) ফেরেশতাদের মধ্য হতে হবেন এবং (আরবী) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো স্বয়ং মানুষ, যে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।

মহান আল্লাহর “তুমি এই দিবস সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, এখন তোমার সম্মুখ হতে পর্দা উন্মোচন করেছি। অদ্য তোমার দৃষ্টি প্রখর।” এই উক্তিতে সম্বোধনকৃত কে? এ সম্পর্কে তিনটি উক্তি রয়েছে। (এক) এই সম্বোধন কাফিরকে করা হবে। (দুই) এই সম্বোধন সাধারণ মানুষকে করা হয়েছে, ভাল ও মন্দ সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। (তিন) এর দ্বারা স্বয়ং নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। দ্বিতীয় উক্তির তাৎপর্য হচ্ছেঃ ‘আখিরাত ও দুনিয়ার মধ্যে ঐ সম্পর্ক রয়েছে যে সম্পর্ক বুয়েছে জাগ্রত ও স্বপ্নের অবস্থার মধ্যে। আর তৃতীয় উক্তির তাৎপর্য হলোঃ “হে বী (সঃ)! এই কুরআনের অহীর পূর্বে তুমি উদাসীন ছিলে! আমি তোমার উপর কুরআন অবতীর্ণ করে তোমার চোখের উপর হতে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। সুতরাং এখন তোমার দৃষ্টি প্রখর হয়ে গেছে। কিন্তু কুরআন কারীমের শব্দ দ্বারা তো এটাই প্রকাশমান যে, এটা সাধারণ সম্বোধন। অর্থাৎ প্রত্যেককে বলা হবেঃ তুমি এই দিন হতে উদাসীন ছিলে। কেননা, কিয়ামতের দিন প্রত্যেকের চক্ষু পূর্ণভাবে খুলে যাবে। এমনকি কাফিরও সেদিন সোজা হয়ে যাবে। কিন্তু তার সেদিন সোজা হওয়া তার কোন উপকারে আসবে না। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেদিন তারা আমার নিকট আসবে সেদিন তারা খুব বেশী শ্রবণকারী ও দর্শনকারী হয়ে যাবে।” (১৯:৩৮) মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “হায়, তুমি যদি দেখতে! যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে অধোবদন হয়ে বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম; এখন আপনি আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ করুন; আমরা সৎ কর্ম করবে, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী।” (৩২:১২)
২৩-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, যে ফেরেশতা আদম সন্তানের আমলের উপর নিযুক্ত রয়েছে সে কিয়ামতের দিন তার আমলের সাক্ষ্যদান করবে। সে বলবেঃ এই তো আমার নিকট আমলনামা প্রস্তুত। এতে একটুও কম-বেশী করা হয়নি।

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা ঐ ফেরেশতার কথা হবে যাকে (আরবী) বলা হয়েছে, যিনি তাকে হাশরের ময়দানের দিকে নিয়ে যাবেন। ইমাম ইবনে জারীর (রাঃ) বলেনঃ “আমার নিকট পছন্দনীয় উক্তি এটাই যে, এটা অন্তর্ভুক্ত করে এই ফেরেশতাকেও এবং সাক্ষ্যদানকারী ফেরেশতাকেও।

আল্লাহ তা’আলা আদল ও ইনসাফের সাথে মাখলুকের মধ্যে ফায়সালা করবেন।

(আরবী) শব্দটি দ্বিবচনের রূপ। কোন কোন নাহভী বলেন যে, কোন কোন আরব একবচনকে দ্বিবচন করে থাকে। যেমন হাজ্জাজের উক্তি প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। তিনি তাঁর জল্লাদকে বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা দু’জন তার গর্দান মেরে দাও।” অথচ জল্লাদ তো একজনই ছিল। কেউ কেউ বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে এটা নূনে তাকীদ, যার তাসহীল আলিফের দিকে করা হয়েছে। কিন্তু এটা খুব দূরের কথা। কেননা, এরূপ তো ওয়াকফ-এর অবস্থায় হয়ে থাকে।

বাহ্যতঃ এটাও জানা যাচ্ছে যে, এই সম্বোধন উপরোক্তে দু’জন ফেরেশতার প্রতি হবে। হাঁকিয়ে আনয়নকারী ফেরেশতা তাকে হিসাবের জন্যে পেশ করবেন এবং সাক্ষ্যদানকারী ফেরেশতা সাক্ষ্য দিয়ে দিবেন। তখন আল্লাহ তাআলা দু’জনকেই নির্দেশ দিবেনঃ “তোমরা দু’জন তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ কর।” যা অত্যন্ত জঘন্য স্থান। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে রক্ষা করুন!

আল্লাহ তা’আলা এরপর বলেনঃ কল্যাণকর কাজে প্রবল বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী, সন্দেহ পোষণকারী এবং আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপনকারী লোককে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর।

হাদীস গত হয়েছে যে, এই লোকদেরকে লক্ষ্য করে কিয়ামতের দিন জাহান্নাম স্বীয় গর্দান উঁচু করে হাশরের ময়দানের সমস্ত লোককে শুনিয়ে বলবেঃ “আমি তিন প্রকারের লোকের জন্যে নিযুক্ত হয়েছি। (এক) উদ্ধত ও সত্যের বিরুদ্ধাচরণকারীর জন্যে, (দুই) আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপনকারীর জন্যে এবং (তিন) ছবি তৈরীকারীর জন্যে।” অতঃপর জাহান্নাম এসব লোককে জড়িয়ে ধরবে। মুসনাদে আহমাদের হাদীসে তৃতীয় প্রকারের লোক ওদেরকে বলা হয়েছে যারা অন্যায়ভাবে হত্যাকারী।

অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ তার সহচর অর্থাৎ শয়তান বলবে- হে আল্লাহ! আমি তাকে পথভ্রষ্ট করিনি, বরং সে নিজেই পথভ্রষ্ট হয়েছিল। বাতিলকে সে স্বয়ং গ্রহণ করে নিয়েছিল। সে নিজেই সত্যের বিরোধী ছিল। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবেঃ আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি। আমার তো তোমাদের উপর কোন আধিপত্য ছিল না, আমি শুধু তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো না, তোমরা নিজেদেরই প্রতি দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক করেছিলে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। যালিমদের জন্যে তো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আছেই।” (১৪:২২)।

অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেন যে, তিনি মানুষ ও তার সঙ্গী শয়তানকে বলবেনঃ তোমরা আমার সামনে বাক-বিতণ্ডা করো না, কেননা আমি তো তোমাদেরকে পূর্বেই সতর্ক করেছি। অর্থাৎ আমি রাসূলদের মাধ্যমে তোমাদেরকে সতর্ক করেছিলাম এবং কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছিলাম। আর তোমাদের উপর দলীল-প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অতএব, জেনে রেখো যে, আমার কথার রদবদল হয় না এবং আমি আমার বান্দাদের প্রতি কোন অবিচার করি না যে, একজনের পাপের কারণে অন্যজনকে পাকড়াও করবে। প্রত্যেকের উপর হুজ্জত পুরো হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ পাপের যিম্মাদার।

২৩-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, যে ফেরেশতা আদম সন্তানের আমলের উপর নিযুক্ত রয়েছে সে কিয়ামতের দিন তার আমলের সাক্ষ্যদান করবে। সে বলবেঃ এই তো আমার নিকট আমলনামা প্রস্তুত। এতে একটুও কম-বেশী করা হয়নি।

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা ঐ ফেরেশতার কথা হবে যাকে (আরবী) বলা হয়েছে, যিনি তাকে হাশরের ময়দানের দিকে নিয়ে যাবেন। ইমাম ইবনে জারীর (রাঃ) বলেনঃ “আমার নিকট পছন্দনীয় উক্তি এটাই যে, এটা অন্তর্ভুক্ত করে এই ফেরেশতাকেও এবং সাক্ষ্যদানকারী ফেরেশতাকেও।

আল্লাহ তা’আলা আদল ও ইনসাফের সাথে মাখলুকের মধ্যে ফায়সালা করবেন।

(আরবী) শব্দটি দ্বিবচনের রূপ। কোন কোন নাহভী বলেন যে, কোন কোন আরব একবচনকে দ্বিবচন করে থাকে। যেমন হাজ্জাজের উক্তি প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। তিনি তাঁর জল্লাদকে বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা দু’জন তার গর্দান মেরে দাও।” অথচ জল্লাদ তো একজনই ছিল। কেউ কেউ বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে এটা নূনে তাকীদ, যার তাসহীল আলিফের দিকে করা হয়েছে। কিন্তু এটা খুব দূরের কথা। কেননা, এরূপ তো ওয়াকফ-এর অবস্থায় হয়ে থাকে।

বাহ্যতঃ এটাও জানা যাচ্ছে যে, এই সম্বোধন উপরোক্তে দু’জন ফেরেশতার প্রতি হবে। হাঁকিয়ে আনয়নকারী ফেরেশতা তাকে হিসাবের জন্যে পেশ করবেন এবং সাক্ষ্যদানকারী ফেরেশতা সাক্ষ্য দিয়ে দিবেন। তখন আল্লাহ তাআলা দু’জনকেই নির্দেশ দিবেনঃ “তোমরা দু’জন তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ কর।” যা অত্যন্ত জঘন্য স্থান। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে রক্ষা করুন!

আল্লাহ তা’আলা এরপর বলেনঃ কল্যাণকর কাজে প্রবল বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী, সন্দেহ পোষণকারী এবং আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপনকারী লোককে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর।

হাদীস গত হয়েছে যে, এই লোকদেরকে লক্ষ্য করে কিয়ামতের দিন জাহান্নাম স্বীয় গর্দান উঁচু করে হাশরের ময়দানের সমস্ত লোককে শুনিয়ে বলবেঃ “আমি তিন প্রকারের লোকের জন্যে নিযুক্ত হয়েছি। (এক) উদ্ধত ও সত্যের বিরুদ্ধাচরণকারীর জন্যে, (দুই) আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপনকারীর জন্যে এবং (তিন) ছবি তৈরীকারীর জন্যে।” অতঃপর জাহান্নাম এসব লোককে জড়িয়ে ধরবে। মুসনাদে আহমাদের হাদীসে তৃতীয় প্রকারের লোক ওদেরকে বলা হয়েছে যারা অন্যায়ভাবে হত্যাকারী।

অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ তার সহচর অর্থাৎ শয়তান বলবে- হে আল্লাহ! আমি তাকে পথভ্রষ্ট করিনি, বরং সে নিজেই পথভ্রষ্ট হয়েছিল। বাতিলকে সে স্বয়ং গ্রহণ করে নিয়েছিল। সে নিজেই সত্যের বিরোধী ছিল। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবেঃ আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি। আমার তো তোমাদের উপর কোন আধিপত্য ছিল না, আমি শুধু তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো না, তোমরা নিজেদেরই প্রতি দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক করেছিলে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। যালিমদের জন্যে তো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আছেই।” (১৪:২২)।

অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেন যে, তিনি মানুষ ও তার সঙ্গী শয়তানকে বলবেনঃ তোমরা আমার সামনে বাক-বিতণ্ডা করো না, কেননা আমি তো তোমাদেরকে পূর্বেই সতর্ক করেছি। অর্থাৎ আমি রাসূলদের মাধ্যমে তোমাদেরকে সতর্ক করেছিলাম এবং কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছিলাম। আর তোমাদের উপর দলীল-প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অতএব, জেনে রেখো যে, আমার কথার রদবদল হয় না এবং আমি আমার বান্দাদের প্রতি কোন অবিচার করি না যে, একজনের পাপের কারণে অন্যজনকে পাকড়াও করবে। প্রত্যেকের উপর হুজ্জত পুরো হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ পাপের যিম্মাদার।

Leave a Reply