بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৭৪)
[* *আপােষহীনতা ইসলামী আন্দোলনের শর্ত : –
*জঘন্যতম ৯টি চারিত্রিক দোষ :-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।
পারা:২৯
৮-১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৮
فَلَا تُطِعِ الۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۸﴾
সুতরাং তুমি মিথ্যাবাদীদের আনুগত্য করো না।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৯
وَدُّوۡا لَوۡ تُدۡہِنُ فَیُدۡہِنُوۡنَ ﴿۹﴾
তারা চায় যে, তুমি নমনীয় হও। তাহলে তারাও নমনীয় হবে।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১০
وَ لَا تُطِعۡ کُلَّ حَلَّافٍ مَّہِیۡنٍ ﴿ۙ۱۰﴾
এবং অনুসরণ করো না তার, যে কথায় কথায় শপথ করে, যে লাঞ্ছিত।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১১
ہَمَّازٍ مَّشَّآءٍۭ بِنَمِیۡمٍ ﴿ۙ۱۱﴾
পশ্চাতে নিন্দাকারী, যে একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে বেড়ায়।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১২
مَّنَّاعٍ لِّلۡخَیۡرِ مُعۡتَدٍ اَثِیۡمٍ ﴿ۙ۱۲﴾
যে কল্যাণের কাজে বাধাদান করে, যে সীমালংঘনকারী, পাপিষ্ঠ।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১৩
عُتُلٍّۭ بَعۡدَ ذٰلِکَ زَنِیۡمٍ ﴿ۙ۱۳﴾
রূঢ় স্বভাব এবং তদুপরি কুখ্যাত ,
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১৪
اَنۡ کَانَ ذَا مَالٍ وَّ بَنِیۡنَ ﴿ؕ۱۴﴾
কারণ সে সম্পদশালী ও অনেক সন্তানের পিতা।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১৫
اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِ اٰیٰتُنَا قَالَ اَسَاطِیۡرُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۱۵﴾
তার নিকট আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হলে সে বলে, এটা তো সেকালের উপকথা মাত্র।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১৬
سَنَسِمُہٗ عَلَی الۡخُرۡطُوۡمِ ﴿۱۶﴾
আমি তার শুঁড় (নাক) দাগিয়ে দেব।
সুরা: আল-ক্বলম
৮-১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:-
*আপােষহীনতা ইসলামী আন্দোলনের শর্ত : মক্কার মােশরেকরা তাদের পোষণ করা আকীদা বিশ্বাসের অনেক কিছু বর্জন করতে প্রস্তুত ছিলাে যদি রসূল(স.)ও তাঁর আনীত আকীদা বিশ্বাসের কিছু অংশ ছেড়ে দিতে রাজী হতেন, যার দিকে তিনি সবাইকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন। তারা তাদের পৌত্তলিক ধ্যান ধারণার ব্যাপারে আপােস করতে, শিথিল হতে এবং কেবল বাহ্যিক প্রদর্শনী করতে প্রস্তুত ছিলাে, যাতে রসূল(স.) ও তার আদর্শ ও আকীদার ব্যাপারে তদ্রুপ করতে প্রস্তুত হয়ে যান। অর্থাৎ তাদের অবস্থা এই যে, তারা এমন কোনাে আকীদার ধারক বাহক নয়, যাকে তারা আন্তরিকভাবে সত্য ও সঠিক বলে মানে। তারা কেবল তার বাহ্যিক দিকটাকেই মানে এবং তাকে গােপন করে রাখাই সমীচীন মনে করে। আল্লাহ তায়ালা সে কথাই বলছেন পরবর্তী আয়াতে, ‘কাজেই সেই সব অবিশ্বাসীর অনুসরণ করাে না, যারা প্রত্যাশা করে যে, তােমরা আপােস করতে রাজী হলে তারাও আপােস করবে।’ এটা ছিলাে একটা দরকষাকষির ব্যাপার। এ যেন পথের মাঝখানে সাক্ষাতকার, যা ব্যবসায়ীরা সচরাচর করেই থাকে। অথচ ব্যবসায় ও আকীদা বিশ্বাসে অনেক পার্থক্য। আকীদা বিশ্বাসের কিছুই বাদ দেয়া যায় না। কেননা তার ছােট বড় সবটাই সমান। বরঞ্চ প্রকৃত সত্য এই যে, আকীদায় আদৌ কোনাে ছােট বড় নেই। আকীদা সবই পরস্পরের পরিপূরক। এর কোনাে একটির ব্যাপারেও কেউ অন্যের কথা মতাে কাজ করে না এবং কখনো তার কিছুই বর্জন করে না। ইসলাম ও জাহেলিয়াত পরস্পরের সাথে মিলিত হবে এটা অসম্ভব । জাহেলিয়াতের প্রতি ইসলামের এই আপােসহীন ভূমিকা সকল দেশে ও সকল কালে অব্যাহত। অতীতের জাহেলিয়াত বর্তমানের জাহেলিয়াত ও ভবিষ্যতের জাহেলিয়াত সবই এখানে সমান। জাহেলিয়াত ও ইসলামের মাঝখানে যে দূরত্ব ও ব্যবধান, তা অতিক্রম করার কোনাে উপায় নেই, এই দূয়ের মাঝখানে কোনাে পুল বা সাঁকোও নেই। কোনাে ভাগ বাটোয়ারা বা জোড়াতালি দিয়েও এ ব্যবধান ঘােচানাে যায় না। উভয়ে উভয়কে নিশ্চিহ্ন করতে সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত। এ সংগ্রামে কোনো মীমাংসা বা সন্ধির অবকাশ নেই। বহুসংখ্যক রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, রাসূল(স.) যাতে আপােস রফায় প্রস্তুত হয়ে যান, তাদের দেবদেবীর নিন্দা না করেন, তাদের পূজা উপাসনাকে ভুল কাজ না বলেন অথবা তাদের কোনাে ধর্মীয় ব্যাপারে সহযােগিতা করেন এবং প্রয়ােজনে তার বিনিময়ে তারাও তাঁর ধর্মীয় কোনাে কোনাে বিষয়ে সহযােগিতা করে, আর আরব জনসাধারণের সামনে মােশরেক নেতাদের মানম কিছুটা রক্ষা পায়, এ জন্যে তারা রসূল(স.)-এর কাছে বিভিন্ন রকমের আপােসের প্রস্তাব দিতাে। সামাজিক দ্বন্দ্ব মীমাংসার এটা অবশ্যই একটা চিরাচরিত রীতি। কিন্তু রসূল(স.) তার দ্বীনের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প ছিলেন। কোনাে মতেই আপােস মীমাংসা বা নতি স্বীকারে তিনি প্রস্তুত হননি। অথচ এ দ্বীনি বিষয় ছাড়া অন্যসব ব্যাপারে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিনয়ী, সবচেয়ে আপােস প্রয়াসী, সবচেয়ে সদাচারী এবং সহজ সরল আচরণে সবচেয়ে বেশী উদগ্রীব। কিন্তু দ্বীন দ্বীনই। ইসলাম ইসলামই। এ ব্যাপারে তিনি কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এ ক্ষেত্রে তিনি অবিকল আল্লাহর এই নির্দেশের অনুগত ছিলেন যে, ‘তােমার প্রতি যারা ঈমান আনে না তাদের তুমি আনুগত্য করবে না।’ এমনকি যে সময়ে রাসূল(স.) মক্কায় সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন ছিলেন, যখন শুধুমাত্র তার ইসলাম প্রচারের দায়ে ও তার মুষ্টিমেয় সংগীদেরকে দুর্বিষহ নির্যাতনসহ অবরুদ্ধ জীবন যাপন করতে হচ্ছিলাে, তখনও তারা ধৈর্য ধারণ করেছিলেন। যে কথা বলা উচিত, তা তিনি ক্ষমতাদর্পী প্রতাপশালী যুলুমবাজদের মুখের সামনেও বলতে কুণ্ঠিত হননি। অত্যাচারীদের মন একটু গলবে ও সদয় হবে কিংবা যুলুমের মাত্রা কিছুটা লাঘব হবে এই আশায় তিনি দ্বীন প্রচারের কাজে এক মুহূর্তের জন্যেও বিরতি দেননি কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ইসলামী আকীদা ও আদর্শের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন একটি কথা থেকেও নীরবতা অবলম্বন করেননি। *নবী চরিত্রের সুকঠিন দৃঢ়তা : ইবনে হিশাম স্বীয় সীরাত গ্রন্থে ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল(স.) যখন তার জাতির কাছে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন, তখন প্রথম প্রথম জাতি তাকে এড়িয়ে চলেনি, তার ওপর ক্ষিপ্তও হয়নি। কিন্তু আমার জানা মতে, তিনি যেই তাদের দেবদেবীর নিন্দা সমালােচনা শুরু করলেন, অমনি তারা তার বিরােধী হয়ে গেলাে এবং সবাই এক হয়ে তার শক্রতা শুরু করলাে। কেবল মুষ্টিমেয় সংখ্যক লােকই ইসলাম গ্রহণ করলাে এবং তাও কারাে কাছে প্রকাশ করতাে না। রাসূল(স.)-এর চাচা আবু তালেব অবশ্য যথারীতি তার প্রতি স্নেহ ও সহানুভূতি প্রদর্শন করতেন এবং তাঁকে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। ফলে রসূল(স.) আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। কেউ তাঁর পথ রােধ করতে পারলাে না। কোরায়শ নেতারা যখন দেখলাে যে, তাদের শিরকী, কুফুরী ও দেবদেবীদের নিন্দা সমালােচনায় রাসূল(স.) কিছুতেই দমছেন না, আর তার চাচা আবু তালিব তাকে স্নেহ আদরে লালন করে চলেছেন এবং তাকে তাদের কাছে সমর্পণ না করে সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছেন, তখন কতিপয় শীর্ষস্থানীয় কোরায়শ নেতা আবু তালেবের কাছে উপস্থিত হলাে। এদের মধ্যে ছিলাে রবীয়ার দুই ছেলে ওৎবা ও শায়বা, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আবুল বুখতারী আস বিন ও হিশাম, আসওয়াদ ইবনুল মােত্তালেব, ইবনে আসাদ আবু জেহেল ওরফে আবুল হিকাম আমর ইবনে হিশাম, ওলীদ ইবনে মুগীরা, হাজ্জাজের দুই ছেলে নবীহ ও মােনাব্বেহ প্রমূখ। তারা বললাে, হে আবু তালিব, আপনার ভ্রাতুস্পুত্র আমাদের দেব-দেবীর নিন্দা এবং আমাদের ধর্মের সমালােচনা করেছে। শুধু তাই নয়, সে আমাদেরকে বােকা ঠাউরিয়েছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে বিপথগামী সাব্যস্ত করেছে। আপনি পারলে ওকে এই কাজ থেকে নিবৃত্ত করুন, নচেত ওকে শায়েস্তা করতে আমাদেরকে সুযােগ দিন। আপনিও তাে আমাদের ধর্মমতের অনুসারী এবং ওর বিপক্ষে। কাজেই আমরা যদি ওকে শায়েস্তা করে দেই, তবে আপনারও কাজ হবে অথচ আপনার নিজের কিছু করতে হলাে না।’ আবু তালেব তাদেরকে সৌজন্যপূর্ণ ও বিনম্র ভাষায় বুঝিয়ে সুজিয়ে বিদায় করলেন। এ ঘটনার পরও রসূল(স.) ইসলামের প্রচার ও দাওয়াতের কাজ অব্যাহত রাখলেন। ফলে এরপর রসুলের(স.) সাথে তাদের বিরােধ আরাে গুরুতর আকার ধারণ করলাে। উভয়ের পারস্পরিক দূরত্ব ও ঘৃণা বিদ্বেষ বেড়ে গেলাে। কোরায়শের লােকেরা রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে ক্রোধে অধীর হয়ে উঠলাে এবং একে অপরকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কে দিতে লাগলো। এরূপ বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতিতে তারা পুনরায় আবু তালিবের কাছে হাযির হলাে। তারা বললাে, ‘হে আবু তালিব! আমাদের ভেতরে আপনি যেমন বয়সে প্রবীণ, তেমনি মান মর্যাদায়ও বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। আমরা আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র নিবৃত্ত রাখতে আপনাকে অনুরােধ করেছিলাম। কিন্তু আপনি তার কাজ বন্ধ করতে পারেননি। আল্লাহর কসম, আমরা এ অবস্থা সহ্য করতে পারবাে না। আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে তিরস্কার করা হতে থাকবে, আমাদেরকে বােকা ঠাওরানাে হতে থাকবে এবং আমাদের দেব-দেবীদের নিন্দা করা হতে থাকবে এটা আমরা চলতে দেবাে না। এখন হয় আপনি ওকে আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলা থেকে বিরত রাখুন, নচেৎ আমরা আপনার ও ওর বিরুদ্ধে একসাথে লড়াইতে লিপ্ত হবাে। যতক্ষণ দু’পক্ষের এক পক্ষ নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায় ততক্ষণ এ লড়াই থামবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এ কথাগুলাে বলেই তারা চলে গেলাে। এবার আবু তালিব প্রমাদ গুণলেন। কোরায়শের লােকেরা এভাবে শত্ৰু হয়ে যাওয়ায় তিনি খুবই বিব্রত বােধ করতে লাগলেন। অথচ রসূল(স.) কে তাদের হাতে তুলে দিতেও তার মন সাড়া দিলাে না, আবার তারা এভাবে এসে অপমানসূচক আচরণ করে যেতে থাকবে তাও তিনি মেনে নিতে পারলেন না। অগত্যা তিনি রসূল(স.) কে ডেকে বললেন, ‘হে ভাতিজা! তােমার স্বগােত্রীয় লােকেরা আমার কাছে এসেছিলাে এবং এসব কথা বলে গেছে। (তিনি তাদের বক্তব্যের বিবরণ দিলেন।) এখন তুমি নিজেকে এবং আমাকে উভয়কেই রক্ষা করাে। আমার সাধ্যাতীত বােঝা আমার ওপর চাপিও না।’ এ কথা শুনে রসূল(স.) বলেন, তার চাচা বুঝি একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তিনি হয়তাে তাকে অপদস্থ হবার জন্যে তাদের হাতে তুলে দেবেন এবং হয়তাে তিনি এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে তাকে আর রক্ষা করতে পারলেন না। তাই তিনি বললেন, চাচাজান! আল্লাহর কসম, ওরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ তুলে দেয় এবং আমাকে এ কাজ ত্যাগ করতে বলে, তথাপি আমি ত্যাগ করবাে না, যতক্ষণ না আল্লাহর দ্বীন পৃথিবীতে বিজয়ী হয় অথবা আমি এ কাজ করতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাই।’ এ কথা বলার সাথে সাথে রসূল(স.)-এর চোখে অশ্রু এলাে এবং তিনি কেঁদে ফেললেন। অতপর যেই চলে যেতে উদ্যত হলেন, আবু তালিব তাকে ডেকে বললেন, ভাতিজা! আমার কাছে এসো। তিনি কাছে এগিয়ে গেলে আবু তালিব বললেন, ভাতিজা! তুমি যাও, তােমার যা ভালাে লাগে তা বলতে থাকো। আল্লাহর কসম, আমি তােমাকে কোনাে কারণেই কারাে কাছে সোপর্দ করবাে না।’ এই ছিলাে ইসলামের প্রচার ও দাওয়াতের কাজে রাসূল(স.)-এর দৃঢ়তা ও অবিচলতার চিত্র। আর এই দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখিয়েছিলেন এমন সময়, যখন পৃথিবীতে তার সর্বশেষ রক্ষক, সহায় ও দুর্গরূপী চাচা তার দায়িত্ব ত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। অথচ এই চাচাই তাকে তাঁর রক্তপিপাসু দুশমনদের হাত থেকে রক্ষা করে আসছিলেন। মূলত এ চিত্র তাৎপর্য, প্রভাব, অভিব্যক্তি এবং শব্দ- সব কিছুর দিক দিয়েই অভিনব, অতুলনীয়, বিস্ময়কর ও তেজোদ্দীপ্ত। যে আকীদা বিশ্বাসের জন্যে তার এই দৃঢ়তা, তা যতখানি নতুন ও অভিনব এটিও ততখানি অভিনব। সে আকীদা বিশ্বাস যতখানি বিস্ময়কর ও মনােমুখধকর, এটিও ততখানি মনােমুগ্ধকর। সে আকীদা যতখানি তেজস্বী ও শক্তিশালী, এটিও ততখানি শক্তিশালী। তাই এই চিত্রটি আল্লাহর এই সুমহান উক্তির যথার্থতা প্রতিপন্ন করে যে, ‘নিশ্চয়ই তুমি মহৎ চরিত্রের অধিকারী।’ ইবনে ইসহাকের অপর একটি বর্ণনায় আর একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। মক্কার মােশরেকরা যখন রসূল(স.)-এর সাথে আর কোনােভাবেই এঁটে উঠতে পারছিলাে না এবং প্রতিটি গােত্র তার মধ্যকার মােমেন নরনারীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ও ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেও যখন সুবিধা করতে পারছিলাে না, তখন এ ঘটনাটি ঘটে। এ সময় বিশিষ্ট কোরায়শ নেতা উতবা অন্যান্য কোরায়শ নেতাদের সাথে বসেছিলাে, আর রাসূল (স.) মসজিদুল হারামে একাকী বসেছিলেন। ওৎবা বললে, ওহে কোরায়শ জনতা, আচ্ছা, আমি যদি মােহাম্মাদের কাছে যাই এবং কিছু কিছু প্রস্তাবের ভিত্তিতে আলােচনা করি তাহলে কেমন হয়? তাকে এমন কিছু প্রস্তাব দিতে পারি, যার কিছু অংশও হয়তাে সে মেনে নেবে, ফলে সে আমাদের ধর্ম নিয়ে বিরূপ কথাবার্তা বলা বন্ধ করবে।’ এ সময় হামযা(রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং রসূল(স.)-এর সংগী সাথীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। উতবার কথা শুনে সবাই একযােগে বললাে, ঠিক আছে। তুমি যাও এবং আলােচনা করাে।’ ওৎবা গিয়ে রাসূল(স.)-এর কাছে বসলাে। অতপর সে বললাে, ‘হে ভাতিজা! তুমি তাে ভালো করেই জানাে যে, আমাদের মধ্যে তােমার মর্যাদা কতাে উচ্চে। অথচ তুমি তােমার গােত্রের কাছে একটা মারাত্মক বিব্রিকর তত্ত্ব নিয়ে এসেছ। এ দ্বারা তাদের ঐক্য বিনষ্ট করেছ, তাদেরকে নির্বোধ ঠাওরিয়েছে, তাদের ধর্ম ও দেবদেবীর নিন্দা করেছে, তাদের মৃত পূর্বপুরুষদেরকে অবিশ্বাসী সাব্যস্ত করেছ। এখন আমার কথা শােনাে, আমি তােমার কাছে কয়েকটি প্রস্তাব রাখছি, তুমি তা বিবেচনা করে দেখ। হয়তাে এর অন্তত কিছু অংশ তুমি মেনে নিবে। তখন রাসূল(স.) বললেন, আচ্ছা বলুন, শুনবো। সে বললাে, ভাতিজা! তুমি যদি এই নয়া ধর্ম প্রচার দ্বারা ধন সম্পদ লাভের বাসনা পোষণ করে থাকো তবে আমরাই তােমাকে চাঁদা আদায় করে এতাে টাকা দিবাে যে, তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী হয়ে যাবে। আর যদি সম্মান লাভের আশায় এসব করে থাক, তাহলে আমরা তােমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে নিবাে। তখন তােমাকে বাদ দিয়ে আমাদের কোনাে ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। আর যদি রাজা হতে চাও, তাহলে আমরা তােমাকে রাজা হিসাবে বরণ করে নিবাে। আর যদি মনে করাে, যে জিনটি তােমার কাছে আসে, তার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে আমরা তােমাকে এ থেকে উদ্ধার করতে সব রকমের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবাে এবং প্রয়ােজন হলে প্রচুর সম্পদ ব্যয় করে তােমাকে আরােগ্য করে তুলব। আসলে এমন ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে থাকে, যেখানে একজন মানুষের অধীনস্থ জ্বিন তার ওপর পরাক্রান্ত হয়ে ওঠে, আর এ রকমের অবস্থার প্রতিকার উপযুক্ত চিকিৎসা ছাড়া সম্ভব হয় না। এ পর্যন্ত উৎবার কথা রসূল(স.) মনোেযােগ দিয়ে শুনছিলেন। কথা শেষ হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ওলিদের বাবা! আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? সে বলল, হা। রসূল(স.) বললেন, ‘এবার আমার কথা শুনুন। সে বলল, বেশ, বলো। তখন রসূল(স.) বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম সহকারে সূরা ‘হা-মীম-আস সিজদা’ পড়তে শুরু করলেন। ও পিঠের পেছনে হাত রেখে তার ওপর হেলান দিয়ে মনােযােগ দিয়ে শুনতে লাগলাে। সুরার ৪র্থ রুকুর সিজদার আয়াত পর্যন্ত পড়ে তিনি সিজদা করলেন। তারপর বললেন! ওহে ওলিদের বাবা, যা শুনলেন, তা তাে শুনলেনই। এখন আপনিই বিবেচনা করুন। এরপর ওৎবা উঠে তার সাথীদের কাছে গেল। দূর থেকে তাকে দেখেই তারা পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলাে যে, ওলীদের বাবা যেরকম মুখমন্ডল নিয়ে গিয়েছিল, এখন মনে হয় তা বদলে গেছে। এটা তাদের কাছে গিয়ে বসা মাত্রই সবাই বলে, ‘তোমার কী হয়েছে?’ ওতবা বলল, কি আর বলব? আমি এমন কথা শুনেছি, আল্লাহর কসম, তেমন কথা আর কখনাে শুনিনি। আল্লাহর কসম, তা কোনাে কবিতা নয়, যাদুও নয়, জ্যোতিষীদের কথাও নয়। ওহে কোরায়শ জনতা! তােমরা আমার কথা শােনাে। এই সমস্যাটা তােমরা আমার ওপর ছেড়ে দাও। মোহাম্মদ যা করছে তা তাকে করতে দাও। তােমরা তাকে একলা থাকতে দাও। কেননা আল্লাহর কসম, তার কাছে আমি যে বাণী শুনেছি, একদিন তার খ্যাতি সর্বত্র ছড়াবে। আরবরা যদি তাকে হত্যা করে তা হলে অন্যদের দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে। আর যদি সে আরবদের ওপর জয়ী হয়, তবে তার রাজত্ব তােমাদেরই রাজত্ব হবে, তার সম্মান তােমাদেরই সম্মান হবে এবং তােমরা তাকে পেয়ে ইনশাআল্লাহ সুখী হবে। এ কথা শুনে সবাই বলল, আল্লাহর কসম, হে ওলিদের বাবা, মােহাম্মদ তার ভাষা দিয়ে তােমাকেও জাদু করেছে! ওৎবা বলল, ‘আমার মতামত আমি ব্যক্ত করলাম। এখন তােমরা যা ভালাে মনে করাে তাই কর। অপর এক বর্ণনায় আছে যে, ও সূরা হামীম আস সিজদা-এর তেলাওয়াত শুনতে শুনতে যখন এ আয়াতে উপনীত হলাে, ‘তারা যদি এ দাওয়াতকে উপেক্ষা করে তা হলে তুমি বলে দাও যে, আমি তােমাদেরকে আদ ও সামুদ জাতির ওপর আপতিত বিকট চিৎকারের মতাে বিপদ থেকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছি।’ তখন সে ভীত হয়ে রসূল(স.)-এর মুখের ওপর হাত রেখে বললাে, ‘হে মােহাম্মদ। তােমাকে আল্লাহর দোহাই এবং রক্ত সম্পর্কের দোহাই দিচ্ছি, আর বলাে না। সে ঘাবড়ে গিয়ে ভেবেছিলাে যে, এক্ষুণি বুঝি সেই আযাব এসে পড়বে। এরপর সে নিজের লােকদের কাছে চলে যায়। উপরােক্ত দুটি বর্ণনার যেটিই সঠিক হােক না কেন, এটা যে কাফেরদের পক্ষ থেকে দরকষাকষির একটা নমুনা ছিলাে, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। অনুরূপভাবে এখানে রসূল(স.)-এর মহৎ ও অনুপম চরিত্রেরও দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। ওৎবার অসার ও ফালতু কথা রসূল(স.)-এর কর্ণপাতের যােগ্য ছিলাে না। তথাপি তিনি তা ধৈর্যের সাথে শ্রবণ করে যে আদবের পরিচয় দেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। *মােশরেকদের অপর একটি কৌশল : সমস্ত কথা বলা শেষ হলে শুধু শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? এর ভেতরে একাধারে সত্যের প্রতি অবিচল আস্থা এবং অন্যের কথা শ্রবণের উচুমানের আদব এই দুটি মহৎ চারিত্রিক গুণই প্রতিফলিত হয়েছে। ইবনে ইসহাকের আরেকটি বর্ণনায় দরকষাকষির তৃতীয় একটি রূপও দেখতে পাওয়া যায়। সেটি নিম্নরূপ, একদিন রাসূল(স.) কা’বা তাওয়াফ করছিলেন, এসময় তাঁর সামনে উপস্থিত হলাে আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব, ওলীদ ইবনুল মুগীরা, উমাইয়া ইবনে খালাফ এবং আ’স ইবনুল ওয়ায়েল। এরা সবাই নিজ নিজ গােত্রের প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন। তারা বললেন, হে মােহাম্মদ, এসাে, আমরা এই মর্মে আপােস করি যে, তুমি যার এবাদাত করাে আমরাও তার এবাদাত করবাে আর আমরা যার এবাদাত করি তুমিও তার এবাদাত করবে। তাহলে এ কাজে তুমি ও আমরা সমঅংশীদার হয়ে যাবাে। তুমি যার এবাদাত করাে সে যদি আমরা যার এবাদাত করি তার চেয়ে ভালা হয়, তাহলে তার এবাদাতের কিছু কৃতিত্ব আমরাও অর্জন করবাে। আর যদি আমাদের দেব-দেবীরা তােমার মাবুদের চেয়ে ভালাে হয়, তাহলে তুমিও আমাদের দেব-দেবীদের কল্যাণের কিছু অংশ পাবে। এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলেন, ‘হে মােহাম্মদ। তুমি বলে দাও, হে অবিশ্বাসীরা! তােমরা যার এবাদাত করাে আমি তার এবাদাত করব না…।'(সূরা আল কাফিরুন) এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের হাস্যকর আপােস প্রস্তাবের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দিয়ে দিলেন আর রসূল(স.) স্বীয় প্রতিপালকের নির্দেশ মােতাবেক তাদের জবাব দিয়ে দিলেন।
সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-১৬
سَنَسِمُهٗ عَلَى الْخُرْطُوْمِ
শিগগীরই আমি তার শুঁড় দাগিয়ে দেবো।
ফী জিলালিল কুরআন:
*জঘন্যতম ৯টি চারিত্রিক দোষ : এর পরের কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সেসব অবিশ্বাসীর মধ্য থেকে একজনের প্রতি ইংগিত করে তার আনুগত্য করতে রাসূল(স.)-কে বিশেষভাবে নিষেধ করছেন। তার ঘৃণ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিচ্ছেন এবং তাকে ভয়ংকর অপমানের হুমকি দিচ্ছেন। এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আসলে আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-এর জীবনের দুর্লভ চারিত্রিক উপাদানটিকে আর একবার স্পষ্ট করে তুলে ধরলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ঘন ঘন শপথকারী সেই নরাধমের আনুগত্য করাে না, যে নিন্দুক, চোগলখাের, কৃপণ, যুলুমবাজ, পাপিষ্ঠ, কুটভাষী ও জারজ । তার এতাে ধৃষ্টতার কারণ শুধু এই যে, তার অনেক ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি রয়েছে। যখনই তার সামনে আমার আয়াতগুলাে পড়া হয় অমনি বলে উঠে যে, এতাে সেকেলে কিচ্ছাকাহিনী। আমি অচিরেই তার শুঁড়ে দাগ লাগিয়ে দেবাে। অনেকের মতে এ লােকটি হচ্ছে ওলীদ ইবনুল মুগীরা। এই নরাধম সম্পর্কে সূরা আল মুদ্দাসসির-এর কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়েছে, আমাকে এবং আমার সৃষ্টি করা ওই নরাধমকে একলা ছেড়ে দাও। যাকে আমি প্রচুর সম্পদ দিয়েছি, সদা উপস্থিত সন্তান-সন্তুতি দিয়েছি এবং তার মান সম্মান ও প্রভাব প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটিয়েছি। এরপরও সে আরাে বেশী পাওয়ার জন্যে লালায়িত। না, কখখনাে নয়। সে আমার আয়াতগুলাের বিরুদ্ধে ভীষণ বিদ্বেষপরায়ণ।’… আমি অচিরেই তাকে সাকার নামক দোজখে দগ্ধ করব। এই ব্যক্তি কিভাবে রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে চক্রান্তের পর চক্রান্ত এঁটেছে, সাহাবীদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে, ইসলাম প্রচারের কাজে কিভাবে বাধা দিয়েছে এবং ইসলাম গ্রহণেচ্ছু লােকদেরকে কিভাবে দূরে হটিয়ে দিয়েছে, সে সম্পর্কে বহুসংখ্যক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। অনেকের মতে সূরা আল-কালামের এ আয়াতগুলাে আখনাস বিন শুরাইকের উপলক্ষে নাযিল হয়েছে। ওলীদ এবং আখনাস এরা দুজনই দীর্ঘদিন পর্যন্ত রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক শত্রুতা ও হিংসাত্মক অভিযান চালিয়েছিলাে। এ সূরায় যে কঠোর নিন্দাবাদ এবং সূরা আল মুদ্দাসসির যে ভয়াবহ হুমকি উচ্চারিত হয়েছে আর অন্যান্য সূরাতেও যেখানে যে কড়া সমালোচনা করা হয়েছে, তা দ্বারা একথাই বুঝা যায় যে, ওলীদই হােক বা আখনাসই হােক, রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে শত্রুতায় তারা অত্যন্ত জঘন্য ভূমিকায় ছিলাে এবং তাদের মানসিকতা ছিলাে অত্যন্ত নিকৃষ্ট, দুর্নীতিপরায়ণ এবং যাবতীয় সৎ প্রবণতা থেকে বঞ্চিত। অবশ্য অধিকাংশ বর্ণনা অনুসারে এই ব্যক্তি ছিলাে ওলীদ ইবনে মুগীরা-আখনাস নয়। কোরআন এখানে এই নরাধমের নয়টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছে এবং এর প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যই অত্যন্ত জঘন্য। •প্রথমত. সে অতিমাত্রায় ও কথায় কথায় শপথকারী। কথায় কথায় ও ঘন ঘন শপথকারী মাত্রেই মিথ্যুক হয়ে থাকে। সে জানে যে লােকে তাকে মিথ্যুকই ভাবে এবং বিশ্বাস করে না। এ জন্যেই সে বেশী করে শপথ করে, যাতে তার মিথ্যা চিরস্থায়ী হয় এবং তার পক্ষে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা জন্মে। •দ্বিতীয়ত. সে এতাে হীনমনা ও নিচ যে, কেউ তাকে শ্রদ্ধা তাে করেই না, উপরন্তু তার কোনাে আত্মসম্মান বােধও নেই। তার এই হীনমন্যতাও তাকে ঘন ঘন শপথ করতে বাধ্য করে। কেননা তাকে অন্যরাও যেমন বিশ্বাস করে না, তেমনি তার নিজের ওপরও নিজের আত্মবিশ্বাস নেই। যদিও তার ধন সম্পদ সন্তান সন্তুতি ও প্রভাব প্রতিপত্তি প্রচুর। বস্তুত হীনতা ও নিচতা এমন একটা মানসিক ব্যাধি যা অত্যন্ত প্রতাপশালী ক্ষমতাদর্পী শাসককেও আক্রান্ত করতে পারে। পক্ষান্তরে মহত্ব ও আত্মসম্মানবােধ এমন একটা গুণ যা থেকে একজন সম্মানী মানুষ কখনাে বঞ্চিত হয় না। এমনকি পার্থিব সহায় সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকলেও না। •তৃতীয়ত. পরনিন্দা ও ছিদ্রান্বেষণ করা তার স্বভাব। মানুষের উপস্থিতিতেই হােক কিংবা অসাক্ষাতেই হােক, সে ইশারায় ইংগিতে ও কথাবার্তায় তাদের নিন্দা করে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত ঘৃণীত স্বভাব। এটি একটি কাপুরুষােচিত স্বভাব এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভদ্রতার বিরােধী। ছােট বড় সবাইকে সম্মান করা মানবীয় চরিত্র ও ইসলামী চরিত্রের অধিচ্ছেদ্য অংশ। কোরআনের একাধিক জায়গায় এই পরনিন্দা ও কুৎসা রটনার কঠোর সমালােচনা করা হয়েছে। সূরা আল হুমাযাতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক নিন্দুক ও ছিদ্রান্বেষীর জন্যে জাহান্নামের আযাব নির্ধারিত রয়েছে।’ সূরা আল হুজুরাত-এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মােমেনরা, কোনো গােষ্ঠী যেন অপর কোনাে গােষ্ঠীকে ঠাট্টা উপহাস না করে। তারা তাদের চেয়ে উত্তমও হতে পারে। নারীরাও যেন অন্য নারীদেরকে ঠাট্টা উপহাস না করে, তারা তাদের চেয়ে ভালােও হতে পারে। একে অপরের কুৎসা রটনা এবং একে অপরকে খারাপ নামে ডেকো না। বস্তুত এ সবই হচ্ছে এক এক ধরনের নিন্দা। •চতুর্থত. সে চোগলখোর, অর্থাৎ একজনের কাছে গিয়ে আরেকজনের এমন দুর্ণাম করে যে, তার ফলে উভয়ের মন খারাপ হয় এবং প্রীতি স্নেহের বন্ধন ছিন্ন হয়। এটা একটা জঘন্য ও নিকৃষ্ট স্বভাব। আত্মমর্যাদাবােধসম্পন্ন কোনাে মানুষ কিংবা অন্যদের কাছে সম্মান লাভে আকাঙ্খী কেউ নিজের ভিতরে এ ধরনের গুণ লালন করতে পারে না। এমনকি যারা চোগলখােরের চুগলী শােনার জন্যে কান পেতে থাকে তারাও চোগলখােরকে অন্তর দিয়ে সম্মান করে না। রসূল(স.) স্বয়ং সবাইকে নিষেধ করতেন যেন কেউ তার কাছে তার কোনাে সাহাবী সম্পর্কে এমন কোনাে কথা না বলে যাতে তার ওপর তার মন খারাপ হয়। তিনি বলতেন, ‘তােমাদের কেউ যেন আমার কাছে আমার কোনাে সাহাবী সম্পর্কে কোনাে খারাপ কথা না। বলে। কেননা আমি চাই সম্পূর্ণ নির্মল ও পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে আমি তােমাদের কাছে আসি।’ বােখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, একবার দুটি কবরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূল(স.) বললেন, এদের উভয়ের আযাব হচ্ছে, আর এ আযাবের কারণ বড় কিছু নয়। একজন প্রস্রাবের সময় গােপনীয়তা অবলম্বনে যত্নবান হতাে না, আর অপরজন চোগলখুরি করে বেড়াতাে। এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রসূল(স.) বলেছেন, চোগলখাের ব্যক্তি বেহেশতে যাবে না। (ইবনে মাজা ব্যতীত সকল সহীহ হাদীসগ্রন্থ)। আর একবার রসূল(স.) বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ তারা, যাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা মনে পড়ে। আর নিকৃষ্টতম মানুষ হলাে চোগলখাের, যে প্রিয়জনদের ভিতর বিরােধ সৃষ্টি করে এবং নির্দোষ লােকদের দোষ খুজে বেড়ায়।’ এই ঘৃণ্য চারিত্রিক দোষটি সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার আগে মানুষের মন বিগড়ে দেয়, সম্পর্ক নষ্ট করে দেয় এবং কুৎসা রটনাকারীকে সমাজের নিকৃষ্টতম মানুষে পরিণত করে। আর সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করার আগে মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা ধ্বংস করে দেয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি সাধন করে। তাই ইসলাম চোগলখুরিকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরী বিবেচনা করে। •পঞ্চমত. সে সকল কল্যাণ ও মংগলের প্রতিবন্ধক। কল্যাণ থেকে নিজেকে এবং অন্যকে সমভাবে বঞ্চিত রাখতাে। ঈমান হচ্ছে সকল কল্যাণের উৎস। সেই ঈমান থেকে সে সব সময় সবাইকে বাধা দিতাে। বর্ণিত আছে যে, সে তার সন্তানদেরকে ও আত্মীয়স্বজনকে সর্বদাই বলতাে যে, তােমাদের কেউ মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করলে আমি তার কোনাে উপকার করতে পারবাে না। যখনই তার কোনাে আপনজন রসূল(স.)-এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে বলে তার মনে হতাে, তখনই এ ধরনের হুমকি দিয়ে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখতাে। এ জন্যে কোরআন তাকে ‘কল্যাণের প্রতিবন্ধক’ এই বিশেষণ দ্বারা চিত্রিত করেছে। কেননা সে তার কথা ও কাজ দ্বারা যে কোনাে মংগলের পথ আগলে রাখতাে। •ষষ্ঠত. সে ছিলাে চরম সীমা অতিক্রমকারী। সত্য ও ন্যায়ের সীমা অতিক্রম করাই ছিলাে তার স্থায়ী স্বভাব। রসূল(স.) তাঁর আপনজন ও মুসলমানদের ব্যাপারে সে সীমা অতিক্রম করতাে। তাদেরকে হেদায়াত ও ইসলামের পথে অগ্রসর হতে বাধা দিতাে। সীমা অতিক্রম করা, আগ্রাসন, একটা ঘৃণ্য চারিত্রিক দোষ। কোরআন ও হাদীস এই দোষের কঠোর সমালােচনা করেছে এবং ইসলাম এ দোষের যে কোনাে রূপকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এমনকি পানাহারের ব্যাপারেও সীমা লংঘন করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার দেয়া পবিত্র জীবিকা থেকে আহার করাে তবে সে ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করাে না।’ কেননা ন্যায়বিচার, মধ্যম পন্থা অবলম্বন ও ভারসাম্য রক্ষা করা ইসলামের মৌল বৈশিষ্ট্য। •সপ্তমত, সে পাপিষ্ঠ অর্থাৎ সে অব্যাহতভাবে পাপে লিপ্ত থাকার কারণে পাপাচার তার স্থায়ী স্বভাবে পরিণত হয়। এখানে তাকে শুধু পাপিষ্ঠ বলা হয়েছে এবং কি কি পাপে সে লিপ্ত হয় তার উল্লেখ করা হয়নি। পাপাচার তার বৈশিষ্ট্য এবং পাপ তার চরিত্রের স্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য অংশ-এ কথাই এখানে বুঝানাে হয়েছে। •অষ্টমত, সে উগ্র, একগুঁয়ে, গোঁয়ার, যুলুমবাজ, হিংস্র, কটুভাষী, দুরাচার ও লােভাতুর। মূল আরবী শব্দ হচ্ছে উতুলুন। উল্লেখিত একাধিক খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলাের সমাবেশই এর তাৎপর্য। কেউ কেউ বলেন, উগ্র ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির দুরাচারী, অতি মাত্রায় পেটুক, সৎ কাজের পথে বাধা দানকারী ও প্রতিহিংসা পরায়ণ ব্যক্তি কে আরবীতে উতুল্লিম’ বলা হয়। হযরত আবুদ্দারদার ব্যাখ্যা অনুসারে সব সময় খাওয়ার চিন্তায় বিভাের থাকে তার কথাই বুঝানাে হয়েছে। বদস্বভাব, মাত্রাতিরিক্ত পেটুক, ভীষণ কৃপণ ও অর্থগৃধু ব্যক্তিকেও উতুল্লুন বলা হয়। তবে উতুলুন শব্দটি এই সমস্ত কু-খাসলাতের অধিকারী ব্যক্তি বুঝতে অন্য যে কোনাে শব্দের চেয়ে বেশী উপযােগী। এ শব্দটি সর্বদিক দিয়ে এই ব্যক্তির বিভৎস ব্যক্তিত্বের নিখুঁত ছবি তুলে ধরে। •নবমত. কোরআনের ভাষায় সে যানীম। এটি ইসলামের কোনাে শত্রুর মধ্যে যে সব নিন্দনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্টের সমাবেশ ঘটা সম্ভব তার সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য যাদের ভিতরে বিরাজ করে তারাই প্রচন্ডভাবে ইসলামের শত্রুতা চালিয়ে যেতে পারে। যানীমের অর্থ একাধিক। একটি অর্থ হলো, যার বংশ পরিচয় অজানা বা সন্দেহজনক, কোনাে গােত্রে প্রবেশ করা নাম গােত্রহীন ব্যক্তি, যে ব্যক্তি নিজের কুকর্মের আধিক্য ও ঘৃণ্য স্বভাবের জন্যে ব্যাপক কুখ্যাতি অর্জন করে। এই শেষােক্ত অর্থটি ওলিদ ইবনুল মুগীরার সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। শব্দটি তার ওপর প্রয়ােগের দরুণ তাকে যদিও গােত্রের সবচেয়ে হীন ও নিচু ব্যক্তি বলে মনে হয়, কিন্তু সে ছিলাে একজন প্রতাপশালী বলদর্পী ধুরন্দর ব্যক্তি। এসব ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করার পর আল্লাহ তায়ালা তার চরিত্রের আর একটি কালাে দিক উন্মোচন করছেন। সেটি হলাে আল্লাহর আয়াতের সাথে তার আচরণ এবং সেই সাথে এই আচরণের জন্যে তাকে ধিক্কার দিয়েছেন। কেননা আল্লাহর দেয়া বিপুল বিত্তবৈভব ও সন্তানাদির প্রতিদানে সে আল্লাহর আয়াতের সাথে এহেন আচরণ করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যেহেতু তার অনেক ধন সম্পদ ও সন্তানাদি আছে, তাই তার সামনে আমার আয়াত পড়া হলে সে বলে ওঠে যে, এতাে হচ্ছে প্রাচীন আমলের কিংবদন্তির গল্প।’ একজন মানুষ আল্লাহর দেয়া অগাধ ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততির প্রতিদানে যদি আল্লাহর আয়াতগুলােকে উপহাস করে-তার চেয়ে জঘন্য আচরণ আর কি হতে পারে? এই একটিমাত্র অসৎ গুণ পূর্বে বর্ণিত সব কয়টি নিকৃষ্ট চারিত্রিক গুণের সমান। এ জন্যেই আল্লাহর পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছে বজ্র কঠোর হুমকি। এ হুমকি দেয়া হয়েছে ধন সম্পদ ও সন্তান সন্তুতির জন্যে তার গর্ব ও অহংকারের বিরুদ্ধে। ইতিপূর্বে নিজের পদমর্যাদা ও বংশ মর্যাদার কারণে অহংকার বােধ করার জন্যেও তিরস্কার ভৎর্সনা করা হয়েছে। সেই সাথে আল্লাহর অকাট্য প্রতিশ্রুতিও উচ্চারিত হয়েছে যে, ‘আমি অচিরেই তার শুঁড়ে দাগ দিয়ে দিব।’ খুরতুম-এর শাব্দিক অর্থ যদিও শুঁড়, কিন্তু প্রচলিত পরিভাষায় এর অর্থ হলাে শুকরের নাকের উঁচু অংশ। সম্ভবত এখানে এই শেষােক্ত অর্থই গৃহীত হয়েছে এবং তার নাকের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। আবার আরবী ভাষায় ‘আনফ’ বা নাক দ্বারা রূপক অর্থে সম্মান বুঝানাে হয়। তাই তার শুঁড়ে তথা নাকে দাগ দেবাে এ কথার অর্থ দাঁড়ায় তাকে অপমান করবাে। এ কথা নিসন্দেহে বলা যায় যে, ওলীদ এই আয়াতগুলাে দ্বারা নিদারুণ অপমানে জর্জরিত হয়েছিলাে। কেননা সে এমন একটি জাতির লােক ছিলাে, যারা ছােট খাটো নিন্দাসূচক কবিতাকেও যথার্থ নিন্দা মনে করতাে, এমনকি তা ভিত্তিহীন নিন্দা হলেও। আরবের সম্ভ্রান্ত লােক মাত্রেই কবিদের সমালােচনা এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতাে। আর যদিও এই নিন্দা সমালােচনা কোনাে কবির পক্ষ থেকে নয় বরং স্বয়ং আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টার পক্ষ থেকে করা হয়, তাহলে কি অবস্থা হতে পারে সহজেই অনুমেয়। এই সমালােচনার কোনো তুলনা নেই। কেননা এটি এমন অমর ও অক্ষয় গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে, যা সমগ্র বিশ্বে ও সকল মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়বে আর এর ফলে এটি পৃথিবীতে একটা চিরস্থায়ী কলংক হিসাবে বিরাজ করবে। আল্লাহর রসূল(স.) ও তার দ্বীনের দুশমনের জন্যে এরূপ ধিক্কার ও নিন্দারই প্রয়ােজন ছিলাে। ধনবল ও জনবল নিয়ে গর্বিত ব্যক্তিদের জন্য এখানে আল্লাহ তায়ালা উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনা আরবদের জানা ছিলাে বলে প্রতীয়মান হয়। এ ঘটনার শিক্ষা এই যে, আল্লাহর দেয়া ধন সম্পদ নিয়ে অহংকার করা, কৃপণতা ও অন্যদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার পরিণতি অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে থাকে। এ ঘটনা দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, মানুষের হাতে যত ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি আছে, তা পরীক্ষা আলােচ্য ঘটনার নায়কদেরকেও এরূপ পরীক্ষায় নিক্ষেপ করা হয়েছিলাে। মক্কার কাফেরদেরকেও বিপুল ধন সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং এ পরীক্ষার সুফল বা কুফল তাদেরকে ভােগ করতেই হবে।
৮-১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-৯
وَدُّوْا لَوْ تُدْهِنُ فَیُدْهِنُوْنَ
তারা তো চায় তুমি নমনীয়তা দেখালে তারাও নমনীয়তা দেখাবে।
# ইসলাম প্রচারের কাজে তুমি কিছু শিথিলতা দেখালে এরাও তোমার বিরোধিতায় কিছুটা নমনীয়তা দেখাবে। কিংবা তাদের গোমরাহীকে প্রশ্রয় দিয়ে যদি দ্বীনের মধ্যে কিছুটা কাটছাঁট করতে রাজী হয়ে যাও তাহলে এরাও তোমার সাথে আপোষ রফা করে নেবে।
সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-১০
وَ لَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَّهِیْنٍۙ
তুমি অবদমিত হয়ো না তার দ্বারা যে কথায় কথায় শপথ করে, যে মর্যাদাহীন,
# মূল আয়াতে مَهِينٍ (মাহিনিন) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি নগণ্য, তুচ্ছ এবং নীচু লোকদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটা কথায় কথায় শপথকারী ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট। সে কথায় কথায় কসম খায়। কারণ সে নিজেই বুঝে যে লোকে তাকে মিথ্যাবাদী মনে করে। কসম না খাওয়া পর্যন্ত লোকে তাকে বিশ্বাস করবে না। তাই সে নিজের বিবেকের কাছে হীন এবং সমাজের কাছেও তার কোন মর্যাদা নেই।
সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-১২
مَّنَّاعٍ لِّلْخَیْرِ مُعْتَدٍ اَثِیْمٍۙ
কল্যাণের কাজে বাধা দেয়,জুলুম ও বাড়াবাড়িতে সীমালংঘন করে,
# আয়াতে مَنَّاعٍ لِلْخَيْرِ (মান্নাইল্লিলখায়ের) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় অর্থ-সম্পদ ও যাবতীয় ভাল কাজকেও خير (খায়ের) বলা হয়। তাই শব্দটিকে যদি অর্থ-সম্পদ অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার মানে হবে সে অত্যন্ত বখীল এবং কৃপণ। কাউকে কানাকড়ি দেয়ার মত উদারতা এবং মন-মানসও তার নেই। আর যদি خير খায়ের শব্দটি নেকী ও ভাল কাজের অর্থে গ্রহণ করা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে তার একটি অর্থ হতে পারে, সে প্রতিটি কল্যাণের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। আরেকটি অর্থ হতে পারে সে ইসলাম থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে অত্যন্ত তৎপর।
সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-১৩
عُتُلٍّۭ بَعْدَ ذٰلِكَ زَنِیْمٍۙ
চরম পাপিষ্ঠ ঝগড়াটে ও হিংস্র৮ এবং সর্বোপরি বজ্জাত।
# আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হলো عُتُل (ওতুল্লিন)। আরবী ভাষায় عتل ওতুল বলা হয় এমন লোককে যে অত্যন্ত সুঠামদেহী ও অধিকমাত্রায় পানাহারকারী। অধিকন্তু চরম দুশ্চরিত্র ঝগড়াটে এবং হিংস্র ও পাষণ্ড।
# মূল আয়াতে زَنِيمٍ (যানীম) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবদের ভাষায় এ শব্দটি এমন অবৈধ সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে পরিবারের লোক নয়, কিন্তু তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। সাঈদ ইবনে জুবাইর এবং শাবী বলেনঃ এ শব্দটি এমন লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যে তার অন্যায় ও দুষ্কৃতির কারণে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এসব আয়াতে বর্ণিত বৈশিষ্টগুলো যে ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তার সম্পর্কে মুফাসিসরগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কেউ বলেছেন যে, সে ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা। কেউ আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগুসের নাম উল্লেখ করেছেন। কেউ আখনাস ইবনে শুরাইককে এই ব্যক্তি বলে চিহ্নিত করেছেন। আবার কেউ কেউ অন্য ব্যক্তির প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু কুরআন মজীদে তার নাম উল্লেখ না করে শুধু বৈশিষ্টগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে সে মক্কায় বেশ পরিচিত ছিল। তাই তার নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল না। এসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা মাত্র যে কোন লোক বুঝতে পারতো, কার প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে।
সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-১৪
اَنْ كَانَ ذَا مَالٍ وَّ بَنِیْنَؕ
কারণ সে সম্পদশালী ও অনেক সন্তানের পিতা
# এ আয়াতটির সম্পর্কে পূর্বোক্ত আয়াতগুলোর সাথেও হতে পারে এবং পরের আয়াতের সাথেও হতে পারে। পূর্বোক্ত আয়াতগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ হবে, বিপুল অর্থ-সম্পদ এবং অনেক সন্তান আছে বলে এ ধরনের লোকের দাপট ও প্রভাব-প্রতিপত্তি মেনে নিয়ো না। পরবর্তী আয়াতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ হবে, বিপুল অর্থ-সম্পদ ও অনেক সন্তান থাকার কারণে সে অহংকারী হয়েছে। তাকে আমার আয়াত শুনালে সে বলে এসব তো প্রাচীনকালের কিস্সা কাহিনী মাত্র।
#সে যেহেতু নিজেকে খুব মর্যাদাবান মনে করতো তাই তার নাককে শুঁড় বলা হয়েছে। নাক দাগিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে লাঞ্ছিত করা। অর্থাৎ আমি তাকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গাতেই এমন লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবো যে, এ লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে সে কখনো নিষ্কৃতি পাবে না।
৮-১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৮-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
যারা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তাদের অনুসরণ করতে এখানে আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করছেন। এটা সকল মিথ্যুকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ তারা আনুগত্য পাওয়ার অধিকার রাখে না। এজন্য যে, মুশরিকরা চায়-তারা যে ধর্মের ওপর আছে সে ব্যাপারে আপনি একটু নম্রভাব প্রকাশ করুন এবং একাত্মতা ঘোষণা করুন।
تُدْهِنُ অর্থ একমত পোষণ করা, অথবা অন্যায়ের বিরোধিতা না করা ও এ ব্যাপারে নম্রতা দেখানো।
حَلَّاف হল যে ব্যক্তি বেশি বেশি শপথ করে। همان হল যে ব্যক্তি গীবত ও ঠাট্টা করে অপরের দোষত্র“টি বর্ণনা করে।
نَمِيْم বলা হয় যে ব্যক্তি ফাসাদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে এক জনের কথা অপর জনের কাছে বলে বেড়ায়। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’টি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি বললেন : এ দু’ কবরবাসীকে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে, অবশ্য বড় কোনো অপরাধের কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। একটি অপরাধ হল : প্রস্রাব করার সময় প্রস্রাবের ছিটা থেকে বেঁচে থাকত না, অপরটি হল : এক জনের দোষ অপর জনের কাছে বলে বেড়াত। (সহীহ বুখারী হা. ১৩১২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامٌ
চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৬০৫৬)
مَّنَّاع অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজে ভাল কাজ করা হতে বিরত থাকে এবং অপরকেও ভাল কাজে বাধা দেয়। (ইবনু কাসীর)।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : ইসলাম থেকে তার সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে বাধা দেয়।
(مُعْتَدٍ أَثِيْم)
অর্থাৎ অন্যায় ও অবাধ্য কাজে শরীয়তের সীমা অতিক্রম করে।
عُتُلّ যে কর্কশ ভাষায় কথা বলে, রূঢ় আচরণ করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতীদের সংবাদ দেব না? তারা বলল : হ্যাঁ, তিনি বললেন : প্রত্যেক দুর্বল ও দুর্বল করে রাখা হয় এমন ব্যক্তি। তারা আল্লাহ তা‘আলার নামে কোন শপথ করলে আল্লাহ তা‘আলা তা পূরণ করেন। আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সংবাদ দেব না? তারা বলল : হ্যাঁ, তিনি বললেন : প্রত্যেক রূঢ় আচরণকারী, কর্কশ ভাষী ও অহংকারী (সহীহ বুখারী হা. ৪৯১৮, সহীহ মুসলিম হা. ২৮৫৩) অন্য বর্ণনায় রয়েছে : প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে নিজেকে কোন জাতির সাথে সম্পৃক্ত করে অথচ সে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয় ও প্রত্যেক অহংকারী। (সহীহ মুসলিম হা. ২৮৫৩)
زَنِيْم বলা হয় এমন ব্যক্তি যে নিজেকে কোন গোত্রের দিকে সম্পৃক্ত করে, আসলে সে ঐ গোত্রের লোক নয়।
মোট কথা আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এসব অসৎ চরিত্রের অধিকারী কাফির-মুশরিকদের অনুসরণ করতে বারণ করছেন।
(أَنْ كَانَ ذَا مَالٍ)
এ আয়াতগুলো ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ ও অন্যান্য কাফিরদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। কারণ তাদের ধন সম্পদ, সন্তান-সন্ততির গৌরবেই তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়েছে এবং দীন ইসলাম গ্রহণে অহংকার প্রকাশ করেছে। যেমন সূরা মুদ্দাসসিরে আল্লাহ তা‘আলা তুলে ধরেছেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
وَاعْلَمُوْآ أَنَّمَآ أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ لا وَّأَنَّ اللهَ عِنْدَه۫ٓ أَجْرٌ عَظِيْمٌ
“ আর জেনে রাখ যে, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এক পরীক্ষাস্বরূপ এবং আল্লাহরই নিকট মহাপুরস্কার রয়েছে।” (সূরা আনফাল ৮ : ২৮)
(سَنَسِمُه۫ عَلَي الْخُرْطُوْمِ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এর অর্থ তরবারী দ্বারা নাক কেটে ফেলা। তিনি আরো বলেছেন : এটি যার ব্যাপারে নাযিল হয়েছে তার নাক বদরের দিন তরবারী দ্বারা কাটা হয়েছিল। কাতাদাহ বলেন : কিয়ামতের দিন তার নাক কাটা হবে নির্দশন স্বরূপ যাতে তাকে চেনা যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
يُعْرَفُ الْمُجْرِمُوْنَ بِسِيْمَاهُم
“অপরাধীদেরকে চেনা যাবে তাদের আলামত হতে।” (সূরা আর রহমান ৫৫ : ৪১)
এসব নাযিল হয়েছে ওয়ালিদ বিন মুগীরাহ্ এর ব্যাপারে। তাকে আল্লাহ তা‘আলা এত তিরস্কার করেছেন যা অন্য কাউকে করেননি। কেউ বলেছেন : আল্লাহ তা‘আলা তাকে এ শাস্তি দুনিয়াতেই দিয়েছেন। যেমন বদরের দিন তাদের নাককে
তলোয়ারের নিশানা বানানো হয়েছিল। আবার কেউ বলেছেন : এটা কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের নিদর্শন হবে। তাদের নাক দেগে চিহ্নিত করা হবে।
এসব আয়াত ওয়ালিদ বিন মুগীরাহর ব্যাপারে নাযিল হলেও তা প্রত্যেক ঐ সব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা উল্লিখিত দোষে দুষ্ট হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এসব দোষে দুষ্ট হওয়া হতে বিরত রাখুন। আমীন!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আয়াতে বর্ণিত খারাপ চরিত্রের অধিকারীদের নিন্দা প্রকাশ করা হয়েছে।
২. অধিকাংশ মানুষের সঠিক ধর্ম পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার সম্পদ ও সন্তান।
৩. খারাপ চরিত্রের অধিকারী অনুসরণের যোগ্য হতে পারে না।
৮-১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৮-১৬ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! আমি তো তোমাকে বহু নিয়ামত, সরল-সঠিক পথ মহান চরিত্র দান করেছি, সুতরাং তোমার জন্যে এখন উচিত যে, যারা আমাকে অস্বীকার করছে তুমি তাদের অনুসরণ করবে না। তারা তো চায় যে, তুমি নমনীয় হবে, তাহলে তারাও নমনীয় হবে। ভাবার্থ এই যে, তুমি তাদের বাতিল মাবুদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়বে এবং সত্য পথ হতে কিছু এদিক ওদিক হয়ে যাবে। এরূপ করলে তারা খুশী হবে।
মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি অধিক শপথকারী ইতর প্রকৃতির লোকদেরও অনুসরণ করবে না। যারা ভ্রান্ত পথে রয়েছে তাদের লাঞ্ছনা ও মিথ্যা বর্ণনা প্রকাশ হয়ে পড়ার সদা ভয় থাকে। তাই তারা মিথ্যা শপথ করে করে অন্যদের মনে নিজেদের সম্পর্কে ভাল ধারণা জন্মাতে চায়। তারা নিঃসঙ্কোচে মিথ্যা কসম খেতে থাকে এবং আল্লাহর পবিত্র নামগুলোকে অনুপযুক্ত স্থানে ব্যবহার করে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ হলো মিথ্যাবাদী। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে দুর্বল চিত্ত লোক। হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ ‘মুকাবির’ এবং (আরবি) এর অর্থ দুর্বল। (আরবি) এর অর্থ গীবতকারী, চুগলখোর, যে বিবাদ লাগাবার জন্যে এর কথা ওকে এবং ওর কথা একে লাগিয়ে থাকে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) দু’টি কবরের পার্শ্ব দিয়ে গমন করার সময় বলেনঃ “এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, আর এদেরকে খুব বড় (পাপের) কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। এদের একজন প্রস্রাব করার সময় পর্দা করতো না এবং অপরজন ছিল চুগলখোর।”
মুসনাদে আহমাদে হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “চুগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) এ হাদীসটি ঐ সময় শুনিয়েছিলেন যখন তাঁকে বলা হয় যে, এ লোকটি আমীর-উমারার নিকট (গোয়েন্দারূপে) কথা পৌঁছিয়ে থাকে।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আসমা বিনতু ইয়াযীদ ইবনে সাকন (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম লোক কারা এ খবর কি আমি তোমাদেরকে দিবো না?” সাহাবীগণ উত্তরে বলেনঃ “হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদেরকে এ খবর দিন!” তিনি তখন বললেনঃ “তারা হলো ঐ সব লোক যাদেরকে দেখলে মহামহিমান্বিত আল্লাহকে স্মরণ হয়!” তারপর তিনি বললেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের নিকৃষ্ট লোকদের সংবাদ দিবো না? তারা হলো চুগলখোর, যারা বন্ধুদের মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে থাকে এবং সৎ ও পবিত্র লোকদের উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকে।” (ইমাম ইবন মাজাহও (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
এরপর আল্লাহ তা’আলা ঐ সব লোকের আরো বদ অভ্যাসের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা কল্যাণের কার্যে বাধা দান করে, তারা সীমালংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ। অর্থাৎ তারা নিজেরা ভাল কাজ করা হতে বিরত থাকে এবং অন্যদেরকেও বিরত রাখে, হালাল জিনিস ও হালাল কাজ হতে সরে গিয়ে হারাম ভক্ষণে ও হারাম কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা পাপী, দুষ্কর্মপরায়ণ ও হারাম ভক্ষণকারী। তারা দুশ্চরিত্র, রূঢ় স্বভাব এবং তদুপরি কুখ্যাত। তারা শুধু সম্পদ জমা করে এবং কাউকেও কিছুই দেয় না।
মুসনাদে আহমাদে হযরত হারিসাহ ইবনে অহাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকের পরিচয় দিবো না? প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি, যাকে দুর্বল মনে করা হয় (সেই জান্নাতী)। যদি সে আল্লাহর নামে কোন শপথ করে তবে আল্লাহ তা বাস্তবায়িত করে দেন। আর আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীর সংবাদ দিবো না? প্রত্যেক অত্যাচারী, যালিম ও অহংকারী (জাহান্নামী)।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাখরীজ করেছেন) অন্য এক হাদীসে আছেঃ “প্রত্যেক জমাকারী ও বাধাদানকারী, অশ্লীলভাষী এবং রূঢ় স্বভাব ব্যক্তি (জাহান্নামী)।
আর একটি বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ (আরবি) কে? উত্তরে তিনি বলেনঃ “দুশ্চরিত্র, রূঢ় স্বভাব, অত্যধিক পানাহারকারী, লোকদের উপর অত্যাচারকারী এবং বড় পেটুক ব্যক্তি।” (এ হাদীসটি বহু সংখ্যক বর্ণনাকারী মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন)
হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে আকাশ কাঁদে যাকে আল্লাহ তা’আলা শারীরিক সুস্থতা দান করেছেন, পেট পুরে খেতে দিয়েছেন এবং জায়গা-জমি, ধন-সম্পদ (অর্থাৎ দুনিয়ার ভোগ্যবস্তু সবকিছুই) দান করেছেন এতদসত্ত্বেও সে জনগণের উপর অত্যাচার করে থাকে।” (এ হাদীসটিও দুই মুরসাল পন্থায় বর্ণিত হয়েছে)
মোটকথা (আরবি) ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় যার দেহ সুস্থ ও সবল, বেশী পানাহারকারী এবং খুবই শক্তিশালী। আর (আরবি) হলো ঐ ব্যক্তি যে বদনামী কুখ্যাত। আরবদের পরিভাষায় (আরবি) ঐ লোককে বলা হয় যাকে কোন এক সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করা হয়, আসলে কিন্তু সে ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত নয়। আরব কবিরাও এটাকে এই অর্থেই ব্যবহার করেছেন, অর্থাৎ যার নসবনামা সঠিক নয়। কথিত আছে যে, এর দ্বারা আখনাস ইবনে শুরায়েক সাকাফীকে বুঝানো হয়েছে, যে বানু যারা গোত্রের মিত্র ছিল। আবার কেউ কেউ বলেন যে, আসওয়াদ ইবনে আবদি ইয়াগুস যুহরীদের বুঝানো হয়েছে। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, জারজ সন্তান উদ্দেশ্য।
এটাও বর্ণিত আছে যে, কর্তিত কান বিশিষ্ট বকরী, যে কান তার গলদেশে ঝুলতে থাকে, এরূপ বকরীকে যেমন পালের মধ্যে সহজেই চেনা যায় ঠিক তেমনই মুমিনকে কাফির হতে সহজেই পৃথক করা যায়। এ ধরনের আরো বহু উক্তি রয়েছে। কিন্তু সবগুলোরই সারমর্ম হলো এই যে, (আরবি) হলো ঐ ব্যক্তি যে কুখ্যাত এবং যার সঠিক নসবনামা এবং প্রকৃত পিতার পরিচয় জানা যায় না। এ ধরনের লোকদের উপর শয়তান খুব বেশী জয়যুক্ত হয় এবং তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন হাদীসে এসেছেঃ “জারজ সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অন্য এক হাদীসে আছেঃ জারজ সন্তান তিনজন মন্দ লোকের একজন, যদি সেও তার পিতা-মাতার মত আমল করে।”
এরপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তাদের দুষ্কর্মের কারণ এই যে, তারা ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে সমৃদ্ধশালী। আমার নিয়ামতসমূহের শুকরিয়া আদায় তো দূরের কথা, তারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং ঘৃণার স্বরে বলেঃ এটা তো সেকালের উপকথা মাত্র। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমাকে ছেড়ে দাও এবং তাকে যাকে আমি সৃষ্টি করেছি অসাধারণ করে। আমি তাকে দিয়েছি বিপুল ধন-সম্পদ এবং নিত্যসঙ্গী পুত্রগণ। আর তাকে দিয়েছি স্বাচ্ছন্দ জীবনের প্রচুর উপকরণ। এরপরও সে কামনা করে যে, আমি তাকে আরও অধিক দিই। না, তা হবে না, সে তো আমার নিদর্শনসমূহের উদ্ধত বিরুদ্ধাচারী। আমি অচিরেই তাকে ক্রমবর্ধমান শাস্তি দ্বারা আচ্ছন্ন করবো! সে তো চিন্তা করলো এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো! অভিশপ্ত হোক সে! কেমন করে সে এই সিদ্ধান্ত করলো! আরও অভিশপ্ত হোক সে! কেমন করে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো! সে আবার চেয়ে দেখলো। অতঃপর সে কুঞ্চিত করলো ও মুখ বিকৃত করলো। অতঃপর সে পিছনে ফিরলো এবং দম্ভ প্রকাশ করলো, এবং ঘোষণা করলোঃ এটাতো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এটা তো মানুষেরই কথা। আমি তাকে নিক্ষেপ করবো সাকারে। তুমি কি জান সাকার কি? ওটা তাদেরকে জীবিতাবস্থায় রাখবে না ও মৃত অবস্থায় ছেড়ে দিবে না। এটা তো গাত্র চর্ম দগ্ধ করবে! সাকার-এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে উনিশ জন প্রহরী।” (৭৪:১১-৩০)
আল্লাহ তা’আলা এরপর বলেনঃ আমি তার নাক দাগিয়ে দিবো। অর্থাৎ আমি তাকে এমনভাবে লাঞ্ছিত করবো যে, তার লাঞ্ছনা কারো কাছে গোপন থাকবে না। সবাই তার পরিচয় জেনে নিবে। যেমন দাগযুক্ত নাক বিশিষ্ট লোককে এক নযর দেখলেই হাজার হাজার লোকের মধ্যেও চিনতে অসুবিধা হয় না এবং সে তার নাকের দাগ গোপন করতে চাইলেও গোপন করতে পারে না, অনুরূপভাবে ঐ লাঞ্ছিত ও অপমানিত ব্যক্তির লাঞ্ছনা ও অপমান কারো অজানা থাকবে না। এটাও কথিত আছে যে, বদরের দিন তার নাকে তরবারীর আঘাত লাগবে। এটাও বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন নাকে জাহান্নামের মোহর লেগে যাবে, অর্থাৎ মুখ বন্ধ করে দেয়া হবে। তাহলে নাক দ্বারা মুখমণ্ডল উদ্দেশ্য হবে। ইমাম আবূ জা’ফর ইবনে জারীর (রঃ) এই সমুদয় উক্তি বর্ণনা করে বলেনঃ এই উক্তিগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এই ভাবে হতে পারে যে, এসবই ঐ ব্যক্তির মধ্যে একত্রিত হবে। এটাও হবে এবং ওটাও হবে। দুনিয়াতেও সে অপমানিত হবে, সত্য সত্যই তার নাকে দাগ দেয়া হবে এবং কিয়ামতের দিনেও সে দাগযুক্ত অপরাধী হবে। প্রকৃতপক্ষে এটাই সঠিকতমও বটে।
মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “বহু বছর ধরে বান্দা আল্লাহর নিকট মুমিন রূপে লিখিত হয়, কিন্তু সে এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে যে, আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন। পক্ষান্তরে বান্দা আল্লাহর নিকট বহু বছর ধরে কাফির রূপে লিখিত হয়, কিন্তু সে এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে যে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। যে ব্যক্তি মানুষের দোষারোপকারী এবং চুগলখোর অবস্থায় মারা যাবে, কিয়ামতের দিন তার নাকের উপর তার দুই ওষ্ঠের দিক হতে দাগ দিয়ে দেয়া হবে, যা পাপীর নিদর্শনরূপে গণ্য হবে।”