أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১০৫)
[ ** *মানবজাতির নেতা হিসেবে মােমেনদের কিছু বৈশিষ্ট্য : –
**নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়,
**তাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করা হলে তার মোকাবিলা করে:-]
www.motaher21.net সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫
৩৭-৪৮ নং আয়াত:-
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩৭
وَ الَّذِیۡنَ یَجۡتَنِبُوۡنَ کَبٰٓئِرَ الۡاِثۡمِ وَ الۡفَوَاحِشَ وَ اِذَا مَا غَضِبُوۡا ہُمۡ یَغۡفِرُوۡنَ ﴿ۚ۳۷﴾
যারা বড় বড় গোনাহ এবং লজ্জাহীনতার কাজ থেকে বিরত থাকে এবং ক্রোধ উৎপত্তি হলে ক্ষমা করে,
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩৮
وَ الَّذِیۡنَ اسۡتَجَابُوۡا لِرَبِّہِمۡ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ ۪ وَ اَمۡرُہُمۡ شُوۡرٰی بَیۡنَہُمۡ ۪ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ﴿ۚ۳۸﴾
যারা তাদের রবের নির্দেশ মেনে চলে, নামায কায়েম করে এবং নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়, আমি তাদের যা রিযিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩৯
وَ الَّذِیۡنَ اِذَاۤ اَصَابَہُمُ الۡبَغۡیُ ہُمۡ یَنۡتَصِرُوۡنَ ﴿۳۹﴾
এবং তাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করা হলে তার মোকাবিলা করে।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪০
وَ جَزٰٓؤُا سَیِّئَۃٍ سَیِّئَۃٌ مِّثۡلُہَا ۚ فَمَنۡ عَفَا وَ اَصۡلَحَ فَاَجۡرُہٗ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّہٗ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۴۰﴾
খারাপের প্রতিদান সমপর্যায়ের খারাপ। অতঃপর যে মাফ করে দেয় এবং সংশোধন করে তাকে পুরস্কৃত করা আল্লাহর দায়িত্ব।আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪১
وَ لَمَنِ انۡتَصَرَ بَعۡدَ ظُلۡمِہٖ فَاُولٰٓئِکَ مَا عَلَیۡہِمۡ مِّنۡ سَبِیۡلٍ ﴿ؕ۴۱﴾
যারা জুলুম হওয়ার পরে প্রতিশোধ গ্রহণ করে তাদের তিরস্কার করা যায় না।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪২
اِنَّمَا السَّبِیۡلُ عَلَی الَّذِیۡنَ یَظۡلِمُوۡنَ النَّاسَ وَ یَبۡغُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ ؕ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۴۲﴾
কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অহেতুক বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়। তাদের জন্যই রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪৩
وَ لَمَنۡ صَبَرَ وَ غَفَرَ اِنَّ ذٰلِکَ لَمِنۡ عَزۡمِ الۡاُمُوۡرِ ﴿٪۴۳﴾
অবশ্যই যে ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমা করে, নিশ্চয় তা দৃঢ়-সংকল্পের কাজ।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪৪
وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ وَّلِیٍّ مِّنۡۢ بَعۡدِہٖ ؕ وَ تَرَی الظّٰلِمِیۡنَ لَمَّا رَاَوُا الۡعَذَابَ یَقُوۡلُوۡنَ ہَلۡ اِلٰی مَرَدٍّ مِّنۡ سَبِیۡلٍ ﴿ۚ۴۴﴾
আল্লাহ নিজেই যাকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করেন আল্লাহ ছাড়া তাকে সামলানোর আর কেউ নেই। তোমরা দেখতে পাবে এসব জালেমরা যখন আযাব দেখবে তখন বলবে এখন কি ফিরে যাবারও কোন পথ আছে?
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪৫
وَ تَرٰىہُمۡ یُعۡرَضُوۡنَ عَلَیۡہَا خٰشِعِیۡنَ مِنَ الذُّلِّ یَنۡظُرُوۡنَ مِنۡ طَرۡفٍ خَفِیٍّ ؕ وَ قَالَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ الۡخٰسِرِیۡنَ الَّذِیۡنَ خَسِرُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ وَ اَہۡلِیۡہِمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ فِیۡ عَذَابٍ مُّقِیۡمٍ ﴿۴۵﴾
তুমি দেখতে পাবে এদের জাহান্নামের সামনে আনা হলে অপমানে আনত হতে থাকবে এবং দৃষ্টির আড়ালে বাঁকা চোখে তাকে দেখতে থাকবে। যারা ঈমান এনেছিলো সেই সময় তারা বলবেঃ প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা আজ কিয়ামতের দিন নিজেরাই নিজেদেরকে এবং নিজেদের সংশ্লিষ্টদেরকে ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪৬
وَ مَا کَانَ لَہُمۡ مِّنۡ اَوۡلِیَآءَ یَنۡصُرُوۡنَہُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ سَبِیۡلٍ ﴿ؕ۴۶﴾
আল্লাহর শাস্তির বিরুদ্ধে ওদের সাহায্য করার জন্য ওদের কোন অভিভাবক থাকবে না এবং আল্লাহ কাকেও পথভ্রষ্ট করলে তার কোন গতি নেই।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪৭
اِسۡتَجِیۡبُوۡا لِرَبِّکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ یَوۡمٌ لَّا مَرَدَّ لَہٗ مِنَ اللّٰہِ ؕ مَا لَکُمۡ مِّنۡ مَّلۡجَاٍ یَّوۡمَئِذٍ وَّ مَا لَکُمۡ مِّنۡ نَّکِیۡرٍ ﴿۴۷﴾
তোমরা তোমাদের রবের ডাকে সাড়া দাও আল্লাহর পক্ষ থেকে সে দিন আসার আগে, যা অপ্রতিরোধ্য; যেদিন তোমাদের কোন আশ্রয়স্থল থাকবে না এবং তোমাদের কোন অস্বীকার থাকবে না ।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪৮
فَاِنۡ اَعۡرَضُوۡا فَمَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ عَلَیۡہِمۡ حَفِیۡظًا ؕ اِنۡ عَلَیۡکَ اِلَّا الۡبَلٰغُ ؕ وَ اِنَّاۤ اِذَاۤ اَذَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنَّا رَحۡمَۃً فَرِحَ بِہَا ۚ وَ اِنۡ تُصِبۡہُمۡ سَیِّئَۃٌۢ بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ فَاِنَّ الۡاِنۡسَانَ کَفُوۡرٌ ﴿۴۸﴾
যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনাকে তো আমরা এদের রক্ষক করে পাঠাইনি। আপনার কাজ তো শুধু বাণী পৌঁছে দেয়া। আর আমরা যখন মানুষকে আমাদের পক্ষ থেকে কোন রহমত আস্বাদন করাই তখন সে এতে উৎফুল্ল হয় এবং যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের বিপদ-আপদ ঘটে, তখন তো মানুষ হয়ে পড়ে খুবই অকৃতজ্ঞ।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মানবজাতির নেতা হিসেবে মােমেনদের কিছু বৈশিষ্ট্য : প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির মধ্যে এই চেতনা থাকা একান্ত জরুরী, এর ফলেই সে প্রভুত্ব-কর্তৃত্বের বহু দাবীদারদের সামনে তার মাথা নত করবাে না। তার অন্তর থাকবে নিশ্চিত নির্লিপ্ত নির্ভিক। সে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারও কাছে কিছু পাওয়ার আশা রাখবে না বা তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয়ও করবে না দুঃখ দুর্দশা ও দীর্ণ দশার মধ্যে সে একজন বলিষ্ঠ সৈনিকের মতােই অবিচল থাকবে এবং শান্তি-সমৃদ্ধি ও উন্নতির দিনগুলােতে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ভরা মন নিয়ে সে থাকবে হৃষ্টচিত্ত। নেয়ামত ভরা সুদিনের নাগাল পেয়ে সে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যা খুশী তাই করবে না, তেমনি দুঃখভরা দুর্দিনের আগমনে কষ্টের বােঝা বইতে না পেরে নিজেকে মুষড়ে পড়তে দেবে না। তবে একজন নেতা বা পরিচালকের জন্যে তাওয়াক্কুলের এই বলিষ্ঠ গুণটি আরও বেশী জরুরী, কেননা সে সত্য সন্ধানীদের যাবতীয় দায়িত্বভার বহন করে থাকে। এরপর বলা হচ্ছে, ‘আর যারা বড় বড় গুনাহ এবং লজ্জাকর কাজগুলাে থেকে বেঁচে থাকে।’ যে সমাজে লােভ লালসার প্রতিযােগিতা চলছে, যেখানে ইন্দ্রিয়লিপ্সার হাতছানি মনকে উদাস করে দেয়, যেখানে অসংখ্য লােভনীয় বস্তু হৃদয়কে প্রলুব্ধ করে সেখানে সত্য সন্ধ একদল আদম সন্তান সকল কিছুর আকর্ষণকে প্রত্যাখ্যান করে বড় বড় অপরাধজনক কাজ ও লজ্জাকর আচরণ থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে এটা বড় চাট্টিখানি কথা নয়, নয় এটা কোনাে সহজ ব্যাপার। এর জন্যে সর্বপ্রথম প্রয়ােজন পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী হওয়া। বলিষ্ঠ ঈমানের অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে এটা অবশ্যই একটা লক্ষণ যে মানুষ কবীরা গুনাহসমূহ ও লজ্জাকর যাবতীয় আচার আচরণ থেকে নিজেকে বাঁচায়। আর সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব তারাই বহন করতে পারে যারা অন্যান্য গুণ সমষ্টির সাথে অবশ্যভাবীরূপে উপরােক্ত গুণ দুটিরও অধিকারী হয়। কোনাে ব্যক্তি কবীরা গুনাহ বা পার্থিব জীবনের এমন কোনাে অন্যায় কাজ, যার দ্বারা নিজ স্বার্থের কারণে অপরকে কষ্ট দেয়া হয় এই ধরনের অপরাধের মুখােমুখী হয়ে যদি ঈমানের দাবী অনুযায়ী কেউ তার অন্তরকে সাফ ছুতরা বা পবিত্র-পরিচ্ছন্ন না রাখতে পারে তাহলে সত্যসন্ধানী জামায়াতের নেতৃত্বে সে (বেশী দিন) টিকে থাকতে পারে না বা সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে না। সেই যামানায় একটি মােমেন জামায়াতের অন্তর যারা ওপরে উল্লেখিত গুণের অধিকারী হয়েছিলেন, বিশেষ করে রসূল কর্তৃক পরিচালিত একদল লােকের মধ্যে যারা সেই উন্নত মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন, যার দিকে এই মহাগ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে সেই প্রথম দলটি উল্লেখিত গুণাবলীর পুরােপুরি অধিকারী হওয়ায় সমগ্র মানবমন্ডলীকে পরিচালনা করার যােগ্যতাও তারা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমন যােগ্যতার অধিকারী তারা হয়েছিলেন যে তাদের পূর্বে বা পরে অনুরূপ যােগ্যতা আর কারও মধ্যে দেখা যায়নি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ নশ্বর মানব সৃষ্টির দুর্বলতা জানেন। এজন্যে তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন নেতৃত্ব দান করার জন্যে কোন কোন গুণের প্রয়োজন। তিনিই জানেন এর কোনাে কোনাে গুণ তিনি তাকে দিয়েছেন। সে গুণগুলাে হচ্ছে বড় বড় গুনাহ, লজ্জাকর স্বভাব ও কাজকর্ম থেকে দূরে থাকা। এই পরিহারযােগ্য দোষের মধ্যে ছােট ছােট গুনাহ ও সাধারণ অপরাধকে গণ্য করা হয়নি। আল্লা সােবহানাহু ওয়া তায়ালার মেহেরবানীর ভান্ডার এতাে প্রশস্ত যে সেখানে এসব ছােটো খাটো ত্রুটি বিচ্যুতি ও মামুলি অপরাধগুলােকে গােনা হয় না, কারণ তাঁর বান্দার শক্তি-সামর্থ্য ও দুর্বলতা তার থেকে বেশী আর কে জানে। বান্দার মধ্যে লজ্জানুভূতি থাকা-এটা তার নেককার বান্দার জন্যে আল্লাহর দেয়া এক বিশেষ মেহেরবানী। এ গুণটি তাকে দেয়া একটি মােহনীয় আকর্ষণ। উল্লেখযােগ্য কোনাে কিছু না থাকলেও এই গুণটিই তাকে সবার মাঝে প্রিয় করে তােলে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তরফ থেকে প্রদত্ত বান্দার প্রতি উদারতা ও মহানুভবতা যেখানে মানুষকে লজ্জাবনত বানায়, সেখানে তার ক্ষমাশীলতা মর্যাদাবান মানুষের মধ্যে লজ্জাবনত ভাব আনে। এর ফলে যখন তারা রেগে যায়। (প্রতিশােধ না নিয়ে) তারা মাফ করে দেয়। করুণাময় আল্লাহ তায়ালা মানুষের হােট-খাট দোষ-ত্রুটি ও ভুল ভ্রান্তি ধরবেন না বলে আলােচ্য আয়াতে প্রছন্নভাবে যে ইশারা দিয়েছেন এবং তার পরপরই তাদের মধ্যে যে ক্ষমাশীলতার গুণ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন তাতে পরােক্ষভাবে বুঝা যায় যে আল্লাহ রাব্বুল ইযযত বান্দাদের মধ্যে দয়া প্রদর্শন ও ক্ষমা করার গুণটি খুবই পছন্দ করেন। আর এই জন্যেই মােমেনদের অন্যতম প্রধান গুণ হিসেবে উল্লেখ করতে গিয়ে নাযিল করছেন, ‘যখন তারা রাগ করে তারা মাফ করে দেয়।’ অর্থাৎ রাগ করার পর ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং আল্লাহর প্রশংসিত বান্দা হওয়ার মহান আশায় (কারাে দ্বারা অনুরুদ্ধ হওয়ার পূর্বেই) তারা নিজেদের থেকেই মাফ করে দেয়। এইভাবে এ মানুষের মাধ্যমে আর একবার ইসলামের মহানুভবতার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলাে। তার মহামূল্যবান শিক্ষা সমুজ্জ্বল হলাে। ইসলাম মানুষকে এমন কোনাে নির্দেশ দেয় না, যা পালন করা তার সাধ্যের বাইরে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন, তিনিই সবার ও সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। কাজেই তিনি ভালাে করেই জানেন যে, ক্রোধ মানুষের সহজাত এক স্বভাব, যা তার প্রকৃতির মধ্য থেকেই উদিত হয়। এই জন্যেই এ বৃত্তিটি সর্বদা এবং সবৈব মন্দ হতে হবে তা জরুরী নয়। এ জন্যে, আল্লাহর (সন্তুষ্টি লাভের জন্যে), তার দ্বীনকে কায়েম করার উদ্দেশ্যে এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে অবশ্যই এটা এক বাঞ্চিত গুণ, এরই মধ্যে যে কাজের জন্যে এর প্রয়ােগ প্রয়ােজন সেখানে তা করা হলে ক্রোধও একটি বড় গুণ বলে বিবেচিত হবে এবং সে অবস্থায় মােটেই তা হারাম বা কোনাে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না। বরং অস্তিত্ব, তার প্রকৃতি ও তার স্বভাবের মধ্যে এ গুণটি তখন হবে অত্যন্ত কল্যাণবহ, তখন মানুষ ব্যক্তিগত কোনাে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অথবা দ্বীনী কোনাে ব্যাপারে বিরােধ বাধলে ক্ষমা করতে সক্ষম হবে। একই অপরাধে দেখা যায় একজন বে-ঈমান সেই বিষয়ে ক্ষমা করতে পারে না, যা একজন ঈমানদার ব্যক্তি পারে, কারণ ঈমানদার ক্ষমাশীলতাকে একটি দৃষ্টান্তমূলক সওয়াবের কাজ মনে করে। মনে করে এ গুণটি ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংগ, যেহেতু রসূল(স.) থেকে সে জানতে পেরেছে যে, তিনি নিজের ব্যক্তিগত কোনাে ব্যাপারে কখনও কারও ওপর রাগ করেননি। তিনি আল্লাহর জন্যে রাগ করেছেন, আর আল্লাহর জন্যে যখন তিনি রাগ করেছেন তখন তাকে কেউ থামাতে পারেনি। তবে এটা সত্য, মােহাম্মদ(স.)-এর জন্যে ছিলো এটা মহা উচু মর্যাদার স্তর, তার মতাে ধৈর্যশীল ও ক্ষমা করার যােগ্যতা আর কারাে আসবে না এবং আল্লাহ তায়ালাও অন্য কোনাে ঈমানদার ব্যক্তির কাছে সে পরিমাণ ক্ষমাশীলতা দাবীও করেন না। তিনি সাধ্যের বাইরে কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দেন না, কেউ ইচ্ছা করলেও তাঁর মতাে ক্ষমাশীল হতে পারবে না, এ জন্যে মােমেনদের জন্যে হুকুম হচ্ছে, রাগের সময় সাধ্যমতাে ক্ষমা করার চেষ্টা করে যাবে এবং ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রতিশােধ নেয়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে যাবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা তাদের রবের ডাকে সাড়া দেবে।’ এইভাবে মােমেনরা তাদের ও তাদের রবের মধ্যে অবস্থিত সম্পর্ক স্থাপনের গােপন বাধা বিপত্তিগুলােকে দূর করতে সক্ষম হয়েছিলাে। আসলে মানুষে মানুষে এবং মানুষ ও আল্লাহর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের পথে ক্রোধ অবশ্যই একটি বড় বাধা। কাজেই বাস্তবেও দেখা যায়, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তােলার ক্ষেত্রে বান্দার ব্যক্তিগত আবেগ উচ্ছাস, ব্যক্তিগত রুচি, ক্রোধ ও উত্তেজনা অনেক সময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহর আনুগত্য করার ব্যাপারে বাইরের বাধা যাইই থাকুক না, ভেতরের বাধাও কিছু কম নয়। মানুষের নানাপ্রকার ঝোক প্রবণতা আছে, আছে লোভ লালসা, আছে অলসতা ও শয়তানী প্রবণতা। আছে আন্তরিকতা, আবেগ উচ্ছাস ও ক্রোধ এসব কিছুই মানুষের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। এগুলোর আকর্ষণ থেকে যখন মানুষ মুক্ত হতে পারে তখনই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সকল পথ তার সামনে খুলে যায়, আর তখনই সে নির্বিঘ্নে তার মালিকের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়, সে তখন তার মালিকের সকল আহ্বানে সাড়া দিতে পুরােপুরি প্রস্তুত হয়ে যায়। তখন আল্লাহর কোনাে নির্দেশ পালন করার ব্যাপার তার আভ্যন্তরীণ কোনাে বাধা আর তাকে থামাতে পারে না। এইভাবে সাধারণত মানুষ তার রবের আনুগত্য করে থাকে। এবারে সুনির্দিষ্টভাবে আনুগত্যমূলক কিছু বিষয় সম্পর্কে উল্লেখ করা হচ্ছে, ‘আর তারা নামায কায়েম করে।’ এই পবিত্র দ্বীন ইসলামের মধ্যে নামাযের স্থান অতি উচ্চে। যখন কোনাে ব্যক্তি কালেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করে ইসলামের মধ্যে তখনই তার ওপর শাহাদাতের বাস্তব প্রমাণস্বরূপ এই প্রথম হুকুম এসে যায়। অর্থাৎ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সর্বময় ক্ষমতার মালিক হওয়ার যে ঘোষণা সে কথা আকারে দিয়েছিলাে সেটাকে বাস্তব কাজ রুকু-সিজদার মাধ্যমে প্রমাণিত করে এসব ক্রিয়ার মাধ্যমে সে জানায় যে সবাইকে ছেড়ে, সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একনিষ্ঠভাবে সে তার ব্যক্তি সত্ত্বার সর্বোচ্চ অংগ-মাথাকে আল্লাহর সামনে ঝুঁকিয়ে দিয়ে ঘােষণা দেয়। বান্দা তার মনিবের দরবারে এসে হাযির হয়। এইভাবে রবের সাথে আবদ এর (বান্দার) সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তারপর মােহাম্মদ (স.) স্বীকৃতি দেয়া হয় আল্লাহর রসূল হিসাবে ‘আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ উচ্চারনের মাধ্যমে। এক কাতারে দাড়ানাে এবং একই সাথে রুকু সিজদার মাধ্যমে মানুষের সাম্য ঘােষণা করা হয়। এ সময়ে কেউ কারও আগে বা পরে মাথা উত্তোলন করে না। আর হয়তাে এই সাম্যের কথা বলতে গিয়েই যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইকামাতে সালাতের পর শূরা বা পরামর্শ করার কথা বলা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তাদের কাজ হবে তাদের নিজের মধ্যে পরামর্শভিত্তিক।’ এখানে ব্যাখ্যায় এ কথাই আসে যে, তাদের জীবনের সকল কাজই পরামর্শভিত্তিক হতে হবে। সবখানেই এই পরামর্শের রং ছড়িয়ে পড়বে। জানা যায় যে এ সূরাটি মক্কী যিন্দেগীতে অবতীর্ণ হয়েছে, অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই এ সূরাটি নাযিল হয়েছে, সুতরাং এ কথা পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে আরও বেশী গুরুত্ব সহকারে মুসলমানদের জীবনের সর্বত্র পরামর্শের এ ধারা চালু হতে হবে। যদিও পরবর্তীতে ঠিক সেই অর্থে ইসলামী রাষ্ট্র আর কায়েম হয়নি, যেমন খােলাফায়ে রাশেদীন-এর আমল পর্যন্ত চালু ছিলাে। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই যে ইসলামী রাষ্ট্রের বহু বৈশিষ্ট্যই ইসলামী জামায়াতের মধ্যে বর্তমান থাকে নির্দিষ্ট একটি ভূখন্ডের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধিকার ছাড়া ইসলামী জামায়াতের মধ্যে অন্যান্য সকল রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। এ জন্য সেখানে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত তেমনি করেই নিতে হবে যেমন মক্কী স্তরে রাষ্ট্র পাওয়ার আগে নেয়া হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ইসলামী জামায়াতের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের এমন বহু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যেসব বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কোনাে কথা কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়নি। পরবর্তীতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকুক আর নাই থাকুক, যেখানে ইসলামী জামায়াত থাকবে সেখানে জামায়াতী সকল সিদ্ধান্তই পরামর্শভিত্তিক হতে হবে। আর এই জন্যেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই আলােচ্য সূরাটি নাযিল করা হয়েছে এবং এর মধ্যে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বাধ্যতামূলক বলে ঘােষণা করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পরামর্শ করা যতাে জরুরী, তার থেকে বেশী জরুরী হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না থাকাবস্থায় পরামর্শ করা। এ ব্যাপারে আলােচ্য সূরাতে সুস্পষ্ট হকুম নাযিল হওয়ায় ওপরের কথাটি আরও অধিক প্রামাণ্য বলে বুঝা যায়। ইসলামী জীবন যাপন করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই এ কথার গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং গােটা মানবমন্ডলীকে পরিচালনার জন্যে যে জামায়াতকে পছন্দ করা হবে, তার জন্যে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার গুণটি থাকা এক বিশেষ গুণ বলে বিবেচিত হবে বরং পরিচালক হওয়ার জন্যে এ গুণটি অপরিহার্য। শূরার (বা পরামর্শ সভার) মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত এমন কোনাে স্থির ও স্থায়ী বস্তু নয় যে, কোনাে ইস্পাত কঠিন ফর্মার মধ্যে ফেলে দিয়ে তাকে নির্মাণ হয়েছে, যার পরিবর্তন খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে পড়েছে। বিশেষ কোনাে যামানার কিছুসংখ্যক লােক কর্তৃক বিশেষ কোনাে পরিস্থিতির আলােকে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, এ জন্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা যেন কোরআন হাদীসের অকাট্য সিদ্ধান্ত বিরােধী না হয়, সে দিকে খেয়াল রেখে পরবর্তী পরিস্থিতিতে মুসলিম জনগণের প্রয়োজনে পরামর্শভিত্তিক যে কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়ার দ্বার চিরদিনের জন্যে খোলা রয়েছে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এমন স্থূল বস্তু নয়, নয় কোনাে প্রাণহীন ও যুক্তিবিহীন শব্দসমষ্টি, যা শুধু কথা আকারেই থেকে যাবে, বরং এ জীবন ব্যবস্থা সত্য নিষ্ঠ ও শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্যে মানুষের করুণাময় মালিকের পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বাধিক কল্যাণকর ব্যবস্থা যা মানুষের হৃদয়ে ঈমানের এক প্রশ্রবণ প্রবাহিত করেছে, যাৱা এ প্রশ্রবণ থেকে আকণ্ঠ পান করেছে তারা এর মাধুর্যে আপ্লুত হয়েছে। তাদের চেতনা ও ব্যবহারিক জীবন এ ব্যবস্থার মনােহর রং-এ রঞ্জিত হয়ে গেছে। বিশেষ কোনো চিন্তা ভাবনা না করে এবং আন্তরিকতার সাথে ও গভীরভাবে ঈমানের তাৎপর্য পর্যালােচনা না করে ইসলামের যে এলােপাথাড়ি সমালােচনা করা হয় বা এর সামগ্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যারা হঠকারিতাপূর্ণ উক্তি করে, তারা অবশ্যই কোনাে ভালাে কাজ করে না। তাদের বুঝা দরকার যে, ইসলামী ব্যবস্থা, ভিত্তিহীন ও যুক্তিহীন কোনাে ভাসমান কথাসমষ্টি নয়। যারা ইসলামী আকীদা অনুযায়ী ঈমানের তাৎপর্য বুঝে না তাদের কাছে হঠাৎ করে মনে হয় যেন এ ব্যবস্থার পেছনে বুঝি কোনাে যুক্তি বুদ্ধি নেই। অতএব জেনে রাখা দরকার যে, এ আকীদার মূলে রয়েছে এমন গভীর ও যুক্তিপূর্ণ বিশ্বাস যা মানুষের অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। এই আকীদার ভিত্তিতেই এক শৃংখলাপূর্ণ সংগঠন গড়ে ওঠে। প্রশ্ন হতে পারে এর মধ্যে এমন কোনাে নিয়ম কানুন আছে যা মানুষের মন মানসিকতাকে প্রভাবিত করে, যা যুক্তি বুদ্ধি দ্বারা ও বাস্তব অবস্থার নিরিখে সবকিছুকে জীবনের উপযােগী করে পেশ করে এবং কোন উপায়ে মানুষকে তা বশীভূত করে ফেলে। হা এটা এই জন্যেই সম্ভব হয়েছে যেহেতু ইসলামের সকল হুকুম আহকাম সবই মানুষের অস্তিত্বের সম্পূর্ণ উপযােগী। এ ব্যবস্থা মানুষের জীবনের সমস্যাগুলাে সমাধান করতেই এসেছে। এজন্যে ইসলামী ব্যবস্থা চালু হলে যেসব জটিলতার উদ্ভব হতে পারে সেগুলা চিহ্নিত করে বুদ্ধিগ্রাহ্য উপায়ে এবং এমন যুক্তিসংগতভাবে সেগুলাের সমাধান দেয়া হয়েছে যা মানুষ বুঝতে পারে এবং যার বাস্তবতা ও উপকারিতা মানুষ তার জীবনেই অনুভব করতে পারে। এই জন্যে পরামর্শের সুযোগ ও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তারপর এমন সব আয়াত এবং রসূল(স.)-এর পক্ষ থেকে এমন সব হাদীস এসেছে যা সেসব সমস্যার সমাধানের দিকে ইংগিত করেছে। এ জন্যে দেখা যায়, কোনাে ইসলামী সংগঠন এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না যা একদম আনকোরা এবং যার সাথে কোরআন হাদীসের কোনাে সংযােগ নেই। ইসলামী সংগঠন কোরআন ও হাদীসকে সামনে রেখে যখন পরামর্শ করে তখন অবশ্যই তারা দেখতে পায়, অতীতের মুসলমানদের মধ্য অনুরূপ কিছু সমস্যা ও তার সমাধান কিভাবে এসেছে, দেখা গেছে ইসলামী সংগঠনের মধ্যে নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমানের অস্তিত্ব, যা সকল যামানাতেই বাস্তব অবস্থাকে সামনে রেখে এবং আল্লাহ তায়ালা ও তার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য বোধ রেখে পরামর্শের ভিত্তিতে তাদের সমস্যাসমূহের সমাধান বের করতে সক্ষম হয়েছে। এটা যদি না হতাে তাহলে মানুষের জীবন অচল হয়ে যেতাে এবং সঠিক সমাধান দিতে না পারার কারণে মানুষ ইসলামের কার্যকারিতা সম্পর্কে হতাশ হয়ে এ মহান ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করতাে। কিন্তু দুনিয়া দেখে নিয়েছে, অতীতে যেসব দেশে বা অঞ্চলে ইসলামী ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, সে সকল স্থানে শূরা বা পরামর্শ সভার মাধ্যমে ইসলাম সকল সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, কিভাবে এবং কোত্থেকে ইসলাম এই সত্য সঠিক ব্যবস্থা পেলাে? কোত্থেকে পেলাে মানুষ এর সঠিক সন্ধান? এর জওয়াব হচ্ছে, ইসলামী ব্যবস্থা যখন এসেছে তখন সর্বপ্রথম এক ব্যক্তি এ ব্যবস্থাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে এর উপযােগিতা প্রচার করেছে এবং নিজের জীবনকে ইসলামের এক বাস্তব নমুনা হিসাবে পেশ করেছে। তখন ধীরে ধীরে এ ব্যবস্থা সামাজিক ব্যবস্থার রূপ নিয়েছে। অতপর এক মুসলিম জামায়াত এর আওতাভুক্ত হয়ে এর থেকে নিজেদের জীবনের সমাধান নিতে থেকেছে। এই ভাবে তারা বাস্তবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এইটিই একমাত্র বাবস্থা যা সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যা কিছু রিযিক তাদেরকে আমি মহান আল্লাহ দিয়েছি, তার থেকে ওরা খরচ করে।’ যাকাতের আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে মক্কী যিন্দেগীতে এই ভাবে মানুষকে সাহায্য করার জন্যে খরচ করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কিত আয়াত মক্কী যিন্দেগীতে নাযিল হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করা ও সুনির্দিষ্ট খাতসমূহে ব্যয় করার নির্দেশ এসেছে দ্বিতীয় হিজরী সালে, কিন্তু ইসলামী জামায়াত গঠিত হওয়ার পর থেকেই পারস্পরিক সহযােগিতা ও সমবেদনা প্রদর্শনের কাজ অনেক আগে থেকেই চলে আসছিলাে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আয়াত নাযিল করে আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলমানদেরকে দান খয়রাত করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন যেন সমাজের সচ্ছল লােকেরা দরিদ্র আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীকে সাহায্য করার দায়িত্ব পালন করতে পারে। দাওয়াতী কাজের জন্যে ‘ইনফাক’ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা হয় এবং তার সাথে যদি কিছু খরচ বা ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, তখন দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে কিছু পরিবর্তন আসে। মন নরম হয়, মানুষ চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং তাদের অন্তরের সংকীর্ণতা দূর হতে থাকে। তখন দুনিয়াবী মহব্বত কমতে থাকে এবং আল্লাহর নেয়ামত লাভ করার জন্যে মন উন্মুখ হয়ে ওঠে। যেহেতু ধন-সম্পদ-এর মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, তাই তিনি সম্পদ বন্টনের ব্যাপারে তারতম্য রেখে দেখতে চান, কে তার মহব্বতে এবং তার ওপর ভরসা রেখে তার বান্দার প্রতি দরদ দেখায়। এ জন্যে ‘ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ’-এর মাধ্যমে ঈমানের পূর্ণত্বের পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়। মুসলিমদের দলবদ্ধ ঐক্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সচ্ছল লােকদের জন্যে ‘ইনফাক’ বা দান খয়রাত করা অপরিহার্য। দলীয় জীবনের সংহতি বহুলাংশে এ উদার ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। দলীয় জীবনের অর্থই হচ্ছে দলের সদস্যরা পরস্পরের প্রতি দরদী হবে, একের দুঃখ দূর করার জন্যে অন্যকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে এবং কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে পারস্পরিক একতার বন্ধনকে মযবুত বানাবে। আর এ বন্ধনকে ও দলীয় সংহতিকে তখনই পূর্ণত্ব দান করা সম্ভব হবে যখন দলের সদস্যদের মধ্যে চোখে পড়ার মতাে আকাশ পাতালসম অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না, যেমন ইসলামের প্রথম যুগে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর মােহাজের ও আনসারদের অবস্থার মধ্যে তেমন কোনাে পার্থক্য থাকেনি। আনসাররা সে সময়ে কোনাে চাপে পড়ে যে এইভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা নয়, বরং তারা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের মহব্বতে এবং গভীরভাবে আখেরাতের যিন্দেগীতে বিশ্বাস থাকার কারণে সেই ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। যখন আল্লাহর মহব্বত দুনিয়া এবং দুনিয়ার যে কোনাে জিনিসের ওপর বিজয়ী হলে এবং মুসলমানদের পারস্পরিক ব্যবহার তার প্রমাণ পেশ করলাে তখনই তাদের ওপর যাকাত ফরয করার হুকুম রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকরী করার আদেশ নাযিল হলাে। সকল অবস্থাতেই আল্লাহর নেক ও প্রিয় বান্দা-গােষ্ঠীর (মােমেন জামায়াতের) মধ্যে ইনফাক এমন একটি মহামূল্যবান গুণ হিসাবে বিরাজ করেছে, যার কারণে তারা স্বতস্ফূর্তভাবে। বিশ্ববাসীর নেতারূপে বরিত হয়েছেন। *জুলুম নির্যাতনের সময় প্রতিশােধ গ্রহণের মূলনীতি : এরপর আলােচনা এসেছে আন্দোলনবিরােধীদের অত্যাচারের স্বীকার হলে কখন কতােটুকু প্রতিশােধ নেয়া যাবে। সে সম্পর্কে কোরআনের নির্দেশনা। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা হচ্ছে সেসব মানুষ যখন তাদের ওপর কোনাে যুলুম করা হয়েছে তখন তারা তার বদলা নিয়েছে।’ আল কোরআনের মক্কী সূরাগুলােতে মুসলমানদের জন্যে এই প্রতিশােধ গ্রহণকেও এক বিশেষ গুণ এবং তাদের এক বিশেষ এবং তাদের এক বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার উল্লেখ ইতিপূর্বে বহুস্থানে এসেছে। যুলুম করা হলে প্রতিশোধ নেয়ার এ গুণটিকে মুসলিম জামায়াতের মধ্যে সদা-সর্বদাই এক মৌলিক ও মহৎ গুণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে তারা কোনাে যুলুমকে মুখ বুজে সহ্য করবে না, যুলুমের কাছে মাথানত করবে না, তাদের ওপর বাড়াবাড়ি করা হলে অবশ্যই তারা এর প্রতিশােধ নেবে। এর জন্যে শক্তি সঞ্চয় করবে এবং প্রয়ােজনীয় সকল প্রকার সাজ সরঞ্জাম যােগাড় করবে। এটা সেই জামায়াতের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য যাদের উত্থান ঘটানাে হয়েছে গােটা মানবমন্ডলীকে পরিচালনার জন্যে। এই যােগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে যেন তারা সর্বোত্তম জাতিতে পরিণত হতে পারে, যেন তারা সকল ভাল কাজের নির্দেশ দিতে পারে এবং নিষেধ করতে পারে সমস্ত মন্দ কাজ থেকে। এভাবে তারা যেন গােটা মানবমন্ডলীর জন্যে ন্যায়-নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। আর তাদের এই ভূমিকাই আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রিয়। তাই আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘(দুনিয়ায়) সকল মান-ইযযত গৌরব ও মর্যাদার অধিকারী আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রসূল ও মুমিরা।’ সুতরাং এ মুসলিম জামায়াতের প্রকৃতি এবং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে যখনই তাদের ওপর আক্রমণ করা হবে অথবা তাদের ওপর কেউ বাড়াবাড়ি করবে তখন তারা তার উচিত জবাব দেবে, যে কোনাে বিদ্রোহাত্মক পদক্ষেপকে দমন করবে। তবে হাঁ, যতােদিন জবাব দেয়ার মতাে পরিস্থিতি, শক্তি বা সামর্থ যােগাড় না হবে ততােদিন তারা সবর করতে থাকবে, যেমন মক্কী যিন্দেগীতে মুসলমানদের সবর করতে বলা হয়েছে, খাস করে আরবের প্রথম যুগের মুসলমানদেরকে এই সবর-এর মাধ্যমে তাদের ঈমানের প্রমাণ পেশ করতে হয়েছে এবং ট্রেনিং নিতে হয়েছে আল্লাহর পথে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার। তখন তাদেরকে সহায্য করার আক্রমণের জন্যে উদ্যত হাতকে থামিয়ে দেয়ার, নামায কায়েম করার ও যাকাত আদায় করার হুকুম দেয়া হয়েছে। আক্রমণ করা হলে প্রতিশােধ গ্রহণ না করে সহ্য করার এ নির্দেশটি ছিলাে নিতান্ত সাময়িক। ইসলামী জামায়াতের জন্যে এটা কোনাে স্থায়ী নিয়ম ছিলাে না। মুসলমানদের মক্কী যিন্দেগীতে বিনম্র মেজাজের স্বভাব নিয়ে থাকা ও প্রতিপক্ষকে তাদের মধুর স্বভাব প্রদর্শন ও আল্লাহর মহব্বতে সহনশীল থাকার মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য বুঝবার সুযােগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসবের মধ্য থেকে একটি জিনিস আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, মক্কী যিন্দেগীতে মুসলমানদের এককভাবে কষ্ট দেয়া হয়েছে, দলীয়ভাবে বা মক্কী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তক্রমে তাদের ওপর যে হামলা করা হয়েছে, তা নয়। আসলে তৎকালীন আরব-উপদ্বীপে কোনাে কেন্দ্রীয় সরকার বা শাসন ব্যবস্থা ছিলাে না। আরব গােত্রগুলাে এখানে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করতাে এবং প্রত্যেক গােত্রেরই ছিলো নিজস্ব কিছু নিয়ম কানুন, যা তারা মেনে চলতাে। গােত্রীয় নেতা বা দলপতিরাই প্রকৃতপক্ষে ছিলাে তাদের পরিচালক। আর এজন্যেই যেসব মানুষ কোনাে মুসলিম ব্যক্তিকে কষ্ট দিতাে, তারা বিশেষ করে সে ব্যক্তির নিজেরই পরিবারের বা গােত্রীয় লোক হতাে। সাধারণভাবে এক গোত্রের কোনাে লােককে অন্য গোত্রের কেউ হামলা করতে সাহসী হতাে না, কারণ তাতে গােত্রীয় যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সমূহ আশংকা থাকতাে। মতাদর্শ যার যাইই থাকুক না কেন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ গোত্রের কাছ থেকে সর্বাবস্থায় সহায়তা পেতাে। বিচ্ছিন্ন এক আধটা ঘটনা ছাড়া এমন কখনাে হয়নি যে, নিজ গােত্রের বাইরে কোনাে মুসলিম ব্যক্তিকে অথবা ব্যক্তিদের এককভাবে বা দলীয়ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। অনেক সময় দেখা গেছে, গােত্রপতি অথবা ব্যক্তিগতভাবে গােলামের মালিকরা তাদের দাসদেরকে অত্যাচার করেছে। কিন্তু মুসলমানরা ব্যক্তিগতভাবে বা সম্মিলিতভাবে যখন কোনাে মযলুম ব্যক্তিকে খরীদ করে আযাদ করে দিয়েছে। তখন তার ওপর আর কেউ আক্রমণ করতে সাহসী হয়নি। আর রসূল(স.)ও চাননি যে, ঘরে ঘরে মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি লেগে যাক। বরং তিনি চেয়েছেন, কোনাে কঠিন ও নিষ্ঠুর ব্যবহারের পরিবর্তে তাদের মধ্যে গড়ে উঠুক নরম ও সহৃদয়তাপূর্ণ ব্যবহার। এর মধ্যে একটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য বিষয় হচ্ছে সেই সময়ে আরব দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি এমনই ছিলাে যে, তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রাধান্য ও গৌরব প্রদর্শন করা পছন্দ করতাে, হকপন্থী কোনাে দুর্বল বা অসহায় ব্যক্তিকে পেলে, তার ওপর নির্যাতন চালানাের দ্বারা আমোদ উপভােগ করতাে আর এ জন্যেই কোনাে অসহায় বা দুর্বল মুসলমানকে পেলে তাকে অত্যাচারের টার্গেট বানাতাে। বিশেষ করে যদি সে নিজ আদর্শের ওপর টিকে থাকার জন্যে দৃঢ়তা দেখাতাে। এইভাবেই চলছিলাে অসহায় মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের ষ্টীম রােলার। আর অনুমান করা হয় যে, সেই সময়ে অবরােধের যে ঘটনাটি ঘটেছিলাে তাতে অন্যান্য গােত্রের লােকদের সাথে বনী হাশেম গােত্রের মুসলমানরাও সেই অবরােধের মধ্যে ঘেরাও হয়ে একই ভাবে অত্যাচারের শিকার হয়েছে এবং মক্কার বাইরে ‘শিয়াবে আবু তালিব’-এ গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আরব তথা মক্কার সেই গােত্রীয় আধিপত্যবােধ বা তাদের প্রাধান্য বিস্তারের মনােভাবই তাদেরকে এমন নিষ্ঠুর অবরােধের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলাে। এ সময়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একত্রিত হওয়ার কারণে তারা এতাে বেশী হৃদয়হীন হতে পেরেছিলাে, কিন্তু অবশেষে তাদের আত্মমর্যাদাবােধ জেগে উঠলাে এবং সেই নিষ্ঠুর অবরােধের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হয়ে গেলো, তারা ছিড়ে ফেলে দিলাে সেই চুক্তিনামাটি যার ভিত্তিতে তারা মুসলমানদেরকে বয়কট করেছিলাে এবং এইভাবে একটানা দীর্ঘ তিন বছরের সেই নিষ্ঠুর ও যুলুমপূর্ণ চুক্তি ভেংগে গেলাে। সেই জাহেলী যুগের অবস্থাটা ছিলাে এই যে সারা আরব জুড়ে সদা-সর্বদা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও তরবারির ঝনঝনানি লেগেই থাকতাে। তারা সবাই তাদের পেশী শক্তির গৌরব করতাে, এ জন্যে তারা কোনাে নিয়ম শৃংখলার কাছে মাথা নত করতাে না। এই অবস্থায় একমাত্র আল্লাহভীরু কোনাে ইসলামী ব্যক্তিত্বের পক্ষেই এই একগুয়েমী স্বভাবকে দমন করা সম্ভব ছিলাে। সকল কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যারা আল্লাহর পথ গ্রহণ করেছিলাে, তারাই তাদের প্রাচুর্যকে কোনাে এক লক্ষ্য অর্জনের পথে ব্যয় করতে পারতাে, পারতাে সকল প্রতিকূল অবস্থাতে সবর করতে, অপরকেও সবর করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারতাে এবং তাদের পেশীশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাে। একমাত্র আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী ব্যক্তিরাই যে কোনাে আক্রমণের মুখে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে পারতাে। এ জন্যেই যে কোনাে কষ্টদায়ক ব্যবহারের সময়ে মুসলমানদের সবর করার জন্যে আহ্বান জানানাে হয়েছে, যা ইসলামী চরিত্রের অপরিহার্য একটি গুণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। ইসলাম বরাবার প্রত্যেক মুসলমানকে শিক্ষা দিয়েছে যেন সে সর্বদা তার আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যে মেজাজের ভারসাম্য আনে ও সর্বাবস্থায় সবর এখতিয়ার করে। এইভাবেই যেন সে, চরম বিরােধিতাপূর্ণ অবস্থার মধ্যে কদম না থামিয়ে দৃঢ়ভাবে নিজ লক্ষ্যপথে এগিয়ে যায় । এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের মক্কী জীবনে চলতে হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, যেন তারা কারাে সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলে এবং কোনাে আক্রমণের জবাব না দিয়ে সবর এখতিয়ার করে। কিন্তু এটাও শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, এটা তাদের সাময়িক ভূমিকা, এটা অবশ্যই তাদের কোনাে স্থায়ী নীতি হবে না। অবশেষে তাদেরকে যে নীতির দিকে এগিয়ে যেতে হবে, তা হচ্ছে, অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হলে তাদেরও রুখে দাড়াতে হবে এবং আগ্রাসীদেরকে এমন সমুচিত শিক্ষা দিতে হবে, যেন পুনরায় আক্রমণের সখ মিটে যায়। তাই এরশাদ হয়েছে, ‘তাদেরকে যখন অন্যায় আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয় তখন তারা সমুচিত জওয়াব দেয়।’ এই নীতি জীবনের সমস্ত ব্যাপারের জন্যেই প্রযােজ্য, যেমন বলা হয়েছে, কোনাে অন্যায় আচরণের প্রতিদানে অনুরূপ আচরণ বাঞ্ছনীয়। প্রতিশােধ গ্রহণের এটাই মূল কথা, অর্থাৎ কঠিন আচরণের পরিবর্তে অনুরূপ কঠিন আচরণই হতে হবে, যেন অন্যায় কাজের প্রসার না ঘটে এবং অন্যায়কারী বে-পরওয়া না হয়ে যায়। তার অন্যায় কাজের সমুচিত শাস্তি তাকে পেতেই হবে, যেন সে অহংকারী হয়ে আরও বেশী অন্যায় কাজ করতে না পারে। অন্যায়কারীকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না হয় এবং কেউ যদি তাকে প্রতিহত না করে তাহলে তার অন্যায় কাজ ও নিষ্ঠুর আচরণ সীমাহীনভাবে বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, তার দ্বারা অগণিত অকল্যাণ সাধিত হতে থাকবে এবং কোনাে বাধা না পাওয়ায় নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে চলতে থাকবে, আর নিশ্চিন্তে চলতে থাকবে তার অনিষ্টকারিতা। কিন্তু রহমানুর রহীম আল্লাহ তায়ালা ব্যবস্থায় মহানুভবতার এ সুযােগ রাখা হয়েছে যে যদি কেউ আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়ার আশায় ক্রোধ সংবরণ করে এবং সংশােধনের পথ উন্মুক্ত করার অভিলাষে ক্ষমা প্রদর্শন করে, তাহলে অবশ্যই তা ভালাে। এটা হচ্ছে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। তবে অবশ্যই এটা খেয়াল রাখতে হবে যে ক্ষমার প্রশ্ন তখন আসবে যখন প্রতিশােধ গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু শুধু উদারতা ও মহানুভবতার কারণেই প্রতিশােধ না নিয়ে ক্ষমা করা হচ্ছে। এমনই অবস্থায় ক্ষমার মাধ্যমে সংশােধনী আনা সম্ভব হবে এবং সংশােধনী প্রচেষ্টায় সেই ক্ষমার গুরুত্ব ও মূল্য অনুভূত হবে। অহংকারী ও সীমালংঘনকারী যখন বুঝবে যে উদার মনে ও মহানুভবতা প্রদর্শন করতে গিয়ে তাকে ক্ষমা করা হয়েছে। কোনাে দুর্বলতা বা অক্ষমতার কারণে নয়, একমাত্র তখনই সে লজ্জিত হবে এবং অনুভব করবে যে, তার যে বিপক্ষীয় ব্যক্তি তাকে ক্ষমা করেছে সে অবশ্যই শক্তিশালী। সত্য কথা হচ্ছে, যে শক্তিশালী ব্যক্তি মাফ করতে পারে অবশ্যই সে তার নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও মর্যাদাবান বানায়। সুতরাং এই পর্যায়ে ক্ষমাশীলতা তার জন্যে কল্যাণ ও মর্যাদা বয়ে আনে এবং তার প্রতিপক্ষকে সংশােধিত হতে সাহায্য করে। একই ভাবে এ কথাও সত্য যে, দুর্বলতার সময়ে বা প্রতিশােধ নেয়ার প্রশ্নে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা অক্ষম হলে ক্ষমার কোনাে কথা উচ্চারণ করা যাবে না। তা হবে দুর্বলতা দেখানোর শামিল এবং তার ফলে আক্রমণকারীর দর্প ও অনিষ্টকারিতা আরও বহুগুণে বেড়ে যাবে। সে অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার সাহায্যের ওপর ভরসা করে প্রতিশােধ গ্রহণ করার জন্যে যে কোনাে ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং অবশ্যই সে ক্ষেত্রে আল্লাহ রব্বুল ইযযতের সাহায্য পাওয়া যাবে, যেহেতু তার মযলুম কোনাে বান্দার দুর্বলতার সুযােগে কোনাে যালেমের যুলুম বেড়ে যাক, এটা কিছুতেই তিনি চান না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই তিনি যালেমদেরকে পছন্দ করেন না।’ এটা হচ্ছে সেই প্রথম মূলনীতির ওপর আরও গুরুত্ব আরােপকারী কথা যেখানে বলা হয়েছে অন্যায় আচরণের অনুরূপ আচরণ দিয়ে শােধ নেয়া প্রয়ােজন। এটা হচ্ছে একটা দিক। আর একটা দিক হচ্ছে, যে অন্যায় প্রতিরােধ করতে গিয়ে সাথে সাথে শােধ না নিয়ে একটু অপেক্ষা করা অথবা ক্ষমা প্রদর্শন করা এবং প্রতিশােধ নিতে গিয়ে সীমা অতিক্রম না করা। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রয়ােজন। এরশাদ হচ্ছে, ‘অত্যাচারিত হওয়ার পর যে যে ব্যক্তি প্রতিশােধ নেবে, তাদের ওপর কোনাে অভিযোেগ নেই। অভিযােগ তাে তাদের ওপর যারা মানুষের ওপর যুলুম করে এবং দুনিয়াতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করে বেড়ায়। তারাই হচ্ছে সেসব ব্যক্তি যাদের জন্যে বেদনাদায়ক আযাব রয়েছে।’ সুতরাং নির্যাতিত অবস্থায় যে প্রতিশােধ নেবে এবং অন্যায় ব্যবহারের প্রতিদানে অনুরূপ ব্যবহার করবে এবং প্রতিশােধ নিতে গিয়ে সীমালংঘন করবে না, অর্থাৎ যতােটুকু পাওনা ঠিক ততােটুকু করবে, তার বেশী নয়, তাকে কোনাে দোষ দেয়া যাবে না। সে তাে শরীয়ত নির্ধারিত হক ব্যবস্থার ওপর নেই, এজন্যে তার ওপর কারাে কোনাে ক্ষমতা খাটানাের অধিকার নেই এবং তার প্রতিশােধ নেয়ার পথ আটকানাের অধিকার কারও নেই। যারা মানুষের ওপর যুলুম করে এবং অন্যায়ভাবে দুনিয়াতে হামবড়াভাব দেখাতে চায় তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করা ওয়াজেব। যখন এইভাবে যালেম নির্বিঘ্নে তার যুলুম চালিয়ে যেতে থাকবে। তার যুলুম থেকে তাকে বিরত করার জন্য কেউ কোনাে বাধা দেবে না, সে অবস্থায় পৃথিবীতে কোনাে সংশােধনী আসতে পারবে না। সে অবস্থায় অসংখ্য অন্যায়কারী ও যুলুমবাজ লােকদের দ্বারা আল্লাহর যমীন ভরে যাবে, কেউ তাদের মােকাবেলা করার মতাে বা তাদের দমন করার মতাে কেউ থাকবে না। আর আল্লাহ তায়ালা এই সব অহংকারী যালেমদের জন্যে বেদনাদায়ক আযাব ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তাদেরকে অন্যায় কাজ থেকে থামিয়ে দেয়া এবং তাদের অন্যায় করার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া। এরপর আল্লাহ রব্বুল আলামীন ভারসাম্যপূর্ণ এবং এক মধ্যম পথ অবলম্বন করার দিকে, আত্ম সংযম, সবর এবং ব্যক্তিগত অবস্থার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাপারে মহানুভবতা প্রদর্শন করার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। আর আল্লাহ তায়ালা তাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন যারা, ওপরে বর্ণিত মতে প্রতিশােধ নেয়ার ক্ষমতা রাখে তবু ক্ষমা করে দেয়। কেননা সবর ও মহানুভবতা প্রদর্শনে মর্যাদা বাড়ে, যিল্লতি বা হীনতা আনে না, যার দ্বারা সৌন্দর্য ও সম্প্রীতি আসার সম্ভাবনা থাকে, অপমান বা অমর্যাদা নয়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি সবর করবে ও মাফ করবে অবশ্যই সে বড় দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দেবে।’ আলােচ্য প্রসংগে উল্লেখিত আয়াতগুলাে থেকে সামগ্রিকভাবে উভয়পক্ষের মধ্যে মধ্যম পথ। অবলম্বন ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার প্রতিষ্ঠা করার শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে এবং আল্লাহ তায়ালা চাইছেন যে, মানুষের মনমগয পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হােক, মুক্ত হােক তারা হিংসা বিদ্বেষ ও ব্যক্তিগত ক্রোধ থেকে। আরও মুক্ত হােক তারা চারিত্রিক দুর্বলতা ও সর্ব প্রকার হীনতা থেকে। তারা যুলুম ও অন্যায় কাজ ও ব্যবহার পরিহার করুক। তার পরিবর্তে তাদের মধ্যে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক এবং সর্বাবস্থায় তার সন্তুষ্টি প্রাপ্তির আশা স্থাপিত হােক। সবর ও অবিচলিত থাকার মহাগুণ হচ্ছে এ কঠিন পথ পরিক্রমায় তাদের মুল পাথেয়! মােমেনদের মধ্যে সাধারণভাবে যখন এসব মহৎ গুণাবলী গড়ে উঠবে, তখন এমন ইসলামী জামায়াত সংগঠিত হতে পারবে, যারা গােটা মানবমন্ডলীকে পরিচালনা করার যােগ্য হবে, আর তখনই তারা হবে সর্বোত্তম জাতি যারা সর্বাধিক স্থায়িত্বের দাবীদার হবে। বলিষ্ঠ ঈমান ও তাদের রবের ওপর তাওয়াক্কুল করার কারণে তারা সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্যে পথপ্রদর্শক হওয়ার মর্যাদা লাভ করবে।
*পথভ্রষ্টদের অবমাননার দৃশ্য : যেসব মােমেনের জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন উন্নতি ও কল্যাণ নির্ধারণ করে রেখেছেন, তাদের মধ্যে বাঞ্ছিত গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করার পর, সামনের পৃষ্ঠাগুলােতে তিনি যালেম ও গােমরাহ লােকদের জন্যে যেসব হীনতা দীনতা গ্লানি ও যেসব ক্ষতির অপেক্ষা করছে তারও কিছু বর্ণনা দিচ্ছেন। ‘যাকে আল্লাহ তায়ালা, গােমরাহ করবেন… তার জন্য (নাজাতের) নেই কোনো উপায়।’ (আয়াত ৪৪-৪৬) অবশ্যই আল্লাহর ফয়সালার কোনাে পরিবর্তন হবে না। সে ফয়সালাকে ফেরানােও যাবে না। আর আল্লাহ তায়ালা যা করতে চাইবেন তাকে থামিয়ে দেয়ার কেউ নেই। এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা যাকে গােমরাহ করতে চাইবেন তাঁর এ সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছার পর তাকে বাঁচানাের জন্যে তার পাশে আর কোনাে বন্ধু এসে দাঁড়াবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই জানেন, বান্দার সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে। তিনি আরও জানেন তার কিছু বান্দার গােমরাহ হওয়ার বিষয়টি। সুতরাং, কিছু ভুল পথের পথিক বান্দা তার থাকবেই, এটা পূর্ব থেকেই ফয়সালা হয়ে রয়েছে এবং যাদের সম্পর্কে ফয়সালা হয়ে রয়েছে তাদের জন্যে এমন কোনাে বন্ধু বা পরিচালক থাকবে না যারা তাদেরকে ভুল পথ থেকে সরিয়ে সঠিক পথে আনতে পারবে অথবা তাদের গােমরাহীর নির্ধারিত সাজা থেকে বাঁচানাের মতােও কেউ থাকবে না। আর অবশিষ্ট আয়াতে যাদের দৃশ্য সামনে আসছে, তাদেরকেও বাঁচানাের মতাে কেউ থাকবে না, যেমন বলা হয়েছে, ‘দেখবে যালেমদেরকে, তারা যখন আযাব দেখবে, তখন তারা বলে উঠবে এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কোনাে পথ আছে কি? তুমি আরও দেখবে তাদেরকে, যখন আযাবের মধ্যে তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তখন অপমানের গ্রানিতে তারা মাথা নত করে থাকবে, তারা গােপনে গােপনে (পরস্পরের প্রতি) তাকাতে থাকবে।’ যালেমরা যেহেতু দুনিয়ার বুকে ছিলাে অহংকারী বিদ্রোহী সীমালংঘনকারী, সুতরাং তাদের উপযুক্ত অবস্থা হবে এটাই যে তারা রােজ হাশরের দিনে প্রকাশ্য লাঞ্ছনার মধ্যে অবস্থান করতে থাকবে। তারা আযাব দেখার সাথে সাথে দুনিয়ায় থাকাকালে যারা তাদের নেতা কর্তা ছিলাে তাদেরকেও কাছাকাছি দেখতে পাবে এবং সে সময়ে তাদের মনােযােগ আকর্ষণ করে তারা কাতর হয়ে জিজ্ঞাসা করবে ‘(এখান থেকে) বেরিয়ে যাওয়ার কোনাে উপায় আছে কি?’ এ অবস্থাটা হবে বড়ই অবমাননাকর হতাশা ও আফসােসে ভরা। সেই ধ্বংসাত্মক অবস্থা তারা দেখা সত্তেও তাদের মনে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে কিছু ক্ষীণ আশা জাগতে থাকবে। তাদেরকে যখন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তখন তাদের মাথা থাকবে অবনত। আল্লাহর ভয়ে বা লজ্জার কারণে নয়, বরং লাঞ্ছনা গঞ্জনা ও অপমানের গ্লানিতে তাদের মাথা অবনমিত থাকবে। তাদেরকে যখন আগুনের দিকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তখন তাদের চোখ থাকবে অবনমিত। লজ্জা ও হীনতার গ্লানিতে তারা চোখ তুলে চাইতে পারবে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা অর্ধনির্লিমিত চোখে চাইতে থাকবে।’ এটা হবে তাদের যিল্লতির এক কঠিন দৃশ্য। এই সময়ে দেখা যাবে, যারা (দুনিয়াতে) ঈমান এনেছে, তারা ওখানে নেতৃত্ব দানকারী হিসাবে অবস্থান নেবে, তারা ধীর স্থির চিত্তে কথা বলতে থাকবে, ভাষণ দিতে থাকবে। তাদের বক্তব্য পেশের কথা জানাতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, “ঈমানদাররা বলবে নিশ্চয়ই সেদিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাই যারা তাদের নিজেদের ও নিজেদের (আদর্শিক) পরিবারের জন্যে ক্ষতি ডেকে এনেছে।” অর্থাৎ, এরা সব দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আর ওখানে অবস্থানকারী সকলেই হীনতা দীনতার কারণে লজ্জাবনত হয়ে থাকবে, বলবে, ‘ফিরে যাওয়ার কোনাে যায়গা আছে কি!’ দোযখে নিক্ষিপ্তদের পরিণতি দেখে সাধারণভাবে যে মন্তব্য আসবে, তা হচ্ছে, ‘ওই দেখাে, অবশ্যই যালেমরা স্থায়ী আযাবের মধ্যে নিপতিত হয়েছে।’ ‘হায়, আজ কোনাে সাহায্যকারী পাওয়া অসম্ভব হয়ে গেছে এবং (নাজাতের) সকল পথ আজ রুদ্ধ হয়ে গেছে।’ সেইদিনের এই দৃশ্যের বর্ণনাকে সামনে রেখে সীমালংঘনকারী ও অহংকারীদেরকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, যেন তারা অনাকাংখিতভাবে সেই আযাব এসে যাওয়ার পূর্বেই তাদের রবের ডাকে সাড়া দেয়। কারণ যখন আযাব এসেই যাবে তখন এমন কোনাে আশ্রয় তারা পাবে না, যা তাদেরকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাতে পারবে। সেদিন সেখানে এমন কোনাে সাহায্যকারী থাকবে না, যা তাদেরকে সেই নিকৃষ্ট গন্তব্য স্থান থেকে সরিয়ে দিতে পারবে। এরপর রসূল(স.)-কে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, যেন তিনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, কারণ তাদেরকে সতর্ক করা সত্তেও যখন তারা তার কথাকে উপেক্ষা করেছে, তখন তাদের কথা আর চিন্তা করা উচিত নয়। যেহেতু তার কাজ শুধু পৌছে দেয়া, তাদের জন্যে তাকে দায়ী করা হবে না বা তিনি তাদের তত্ত্বাবধায়কও নন। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের রবের ডাকে সাড়া দাও, সেই দিন আসার আগে যেদিন একবার এসে গেলে তােমার রবের কাছ থেকে সেই দিনকে আর সরিয়ে নেয়া যাবে না। সেদিন তোমাদের জন্যে কোনাে আশ্রয়স্থল থাকবে না। আর থাকবে না তােমাদের জন্যে সেই দিনকে সরিয়ে নেয়ার মতাে কেউ। এরপরও যদি ওরা মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, সে অবস্থায় (তােমার আর কিছু করার নেই) তােমাকে তাে ওদের অভিভাবক বানানাে হয়নি তােমার কাজ হচ্ছে শুধু পৌছে দেয়া।’ এরপর আল্লাহ রব্বুল আলামীন সেই সব মানুষের প্রকৃতি উন্মোচিত করছেন যারা এই ভাবে সত্যের বিরােধিতা করছে এবং সত্য সঠিক জীবন প্রণালীর প্রতি বিদ্বেষ পােষণ করছে। এই আচরণের দ্বারা তারা নিজেদেরকে যে আযাবের মুখােমুখি করে দিচ্ছে, তা আজকে মােটেই তারা বুঝতে পারছে না। এ আযাব থেকে বের হওয়ার সম্ভাবনা তাদের খুবই ক্ষীণ, সেদিন সকল নেয়ামত থেকে তারা বঞ্চিত হবে, তারা কষ্টের চোটে অস্থির থাকবে, সেদিন তাদের সংকটের কোনাে সীমা বা শেষ থাকবে না। আজকের সুখের দিনে তারা যেভাবে চলছে তা জানাতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আমি যখন তাদেরকে আমার রহমতের স্বাদ গ্রহণ করাই, তখন তার আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়, আর যদি তাদের আচরণের দরুণ তাদেরকে কোনাে দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে তখন তারা অস্থির হয়ে যায় এবং আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত নেয়ামতকে অস্বীকার করে বসে ও অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়।’
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩৭-৩৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা সে উত্তম এবং চিরস্থায়ী নেয়ামত লাভ করার জন্য কিছু গুণাবলী উল্লেখ করেছেন, অবশ্যই মানুষকে সে গুণে গুণান্বিত হতে হবে। তবে সে সব গুণাবলীর পূর্বে সঠিক ঈমান আনতে হবে, কারণ ঈমান ছাড়া কোন সৎ আমল গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রথম গুণ :
(وَعَلٰي رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ)
অর্থাৎ সর্বকাজে ও সর্বাবস্থায় পালনকর্তার ওপর ভরসা রাখে। তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে কার্যনির্বাহী মনে করে না। বিপদে পড়লে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো কাছে যায় না।
দ্বিতীয় গুণ :
(وَالَّذِيْنَ يَجْتَنِبُوْنَ كَبَا۬ئِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ)
অর্থাৎ যারা কবীরা গুনাহ বিশেষতঃ ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকে। কুরআনে প্রত্যেক স্থানে فَوَاحِشَ শব্দ ব্যভিচার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কবীরা গুনাহর মধ্যে সকল গুনাহ শামিল তারপরেও কেন আলাদাভাবে ব্যভিচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে? কারণ এটি একটি নির্লজ্জ কর্ম ও সংক্রামক ব্যাধি।
তৃতীয় গুণ :
(وَإِذَا مَا غَضِبُوْا هُمْ يَغْفِرُوْنَ)
অর্থাৎ তারা রাগান্বিত হয়েও মানুষকে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখে। মানুষকে ক্ষমা করে দেয়া একটি মহৎ গুণের পরিচয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের জন্য কারো থেকে পরিশোধ নিতেন না, যদি আল্লাহ তা‘আলার সম্মান নষ্ট না করত। (সহীহ বুখারী হা. ৬৭৮৬)
চতুর্থ গুণ :
(وَالَّذِيْنَ اسْتَجَابُوْا لِرَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلٰوةَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কোন আদেশ পাওয়া মাত্রই বিনা দ্বিধায় তা কবূল করতে ও পালন করতে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া। সে আদেশ মনের অনুকূলে হোক অথবা প্রতিকূলে হোক। এতে ইসলামের সকল ফরয কর্ম পালন এবং হারাম কর্ম থেকে বেঁচে থাকা শামিল। ফরয কর্মসমূহের মধ্যে সালাত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সালাত এমন একটি ইবাদত এটা পালন করলে অন্যান্য ফরয কর্ম পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়।
পঞ্চম গুণ :
(وَأَمْرُهُمْ شُوْرٰي بَيْنَهُمْ)
অর্থাৎ পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কার্য সম্পাদন করে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ج فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَي اللّٰهِط إِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّـلِيْنَ)
“এবং কার্য সম্পর্কে তাদের সাথে পরামর্শ কর; অতঃপর যখন তুমি (কোন বিষয়ে) সঙ্কল্প করছ তখন আল্লাহর প্রতি ভরসা কর এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্ভরশীলগণকে ভালবাসেন।” (সূরা আলি ‘ইমরান ৩ : ১৫৯)
তাই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোন কাজ করতেন তখন সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে কাজ করতেন যাতে তাদের আত্মতৃপ্তি লাভ হয়। পরবর্তী খলীফাগণও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণে পরামর্শভিত্তিক কাজ করতেন। যেমন উমার (রাঃ) মৃত্যুর পূর্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি শুরা কমিটি গঠন করে গিয়েছিলেন যারা পরবর্তী খলীফা নির্ধারণ করেছিলেন।
ষষ্ঠ গুণ :
(وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنْفِقُوْنَ)
অর্থাৎ তারা আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক থেকে সৎ কাজে ব্যয় করে। ফরয যাকাত, নফল দান-সাদকাহ সবই এর মধ্যে শামিল। কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণির লোক আল্লাহর আরশের ছায়াতলে ছায়া পাবে। তাদের এক শ্রেণি যারা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় দান করে এমনভাবে যে তার ডান হাত কী দান করেছে বাম হাত জানে না। অর্থাৎ মানুষকে দেখানোর জন্য ব্যয় করে না।
সপ্তম গুণ :
(وَالَّذِيْنَ إِذَآ أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنْتَصِرُوْنَ)
অর্থাৎ তারা অত্যাচারিত হয়ে সমান সমান প্রতিশোধ গ্রহণ করে এবং তাতে সীমালংঘন করে না। এটা প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় গুণের ব্যাখ্যা ও বিবরণ। তবে এখানে আলাদাভাবে উল্লেখের কারণ হল কেউ অত্যাচারিত হয়ে প্রতিশোধ নিলে তিরস্কার করা যাবে না।
তারা প্রতিশোধ নিতে চাইলে নিতে পারে। কিন্তু শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা ক্ষমা করে দেয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যেমন ইউসুফ (আঃ) বলেছিলেন,
(قَالَ لَا تَثْرِيْبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ ط يَغْفِرُ اللّٰهُ لَكُمْ ز وَهُوَ أَرْحَمُ الرّٰحِمِيْنَ )
“সে বলল : ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’’ (সূরা ইউসুফ ১২ : ৯২)
অতএব যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে সকল প্রকার কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে, সালাত কায়েম করবে, পরামর্শ করে কাজ করবে এবং আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করবে তাদের জন্য রয়েছে আখিরাতে অপরিমেয় নেয়ামত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার আবাস ক্ষণস্থায়ী এবং তা ধ্বংসশীল।
২. পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে, তবে তা অবশ্যই সৎ কাজ, মন্দ কাজ নয়।
৩. প্রতিশোধ গ্রহণ অপেক্ষা ক্ষমা করে দেয়া উত্তম।
৪. রাগের মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
৪০-৪৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এখানে আল্লাহ তা‘আলা দন্ডের বা শাস্তির তিনটি স্তর বর্ণনা করেছেন- ১. ন্যায় বিচার করা, ২. অনুগ্রহ করে দেয়া, ৩. জুলুম করা। ন্যায় বিচার হল “মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ” অর্থাৎ কেউ যদি কাউকে হত্যা করে তাহলে তাকেও হত্যা করতে পারবে, কেউ কারো ওপর জুলুম করলে তার ওপরও অনুরূপ জুলুম করতে পারবে। মোট কথা কেউ অপরাধ করলে প্রতিশোধমূলক তাকেও অনুরূপ শাস্তি প্রদানের অধিকার রাখে। কারণ মন্দ কর্মের প্রতিদান কখনো ভাল হতে পারে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَمَنِ اعْتَدٰي عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوْا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدٰي عَلَيْكُمْ ص وَاتَّقُوا اللّٰهَ وَاعْلَمُوْآ أَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ)
“যদি কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করে, তবে তোমরাও তার প্রতি সে পরিমাণ অত্যাচার কর যতটুকু সে করেছে। আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখ যে, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা বাকারাহ ২ : ১৯৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوْا بِمِثْلِ مَا عُوْقِبْتُمْ بِه۪ ط وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِّلصّٰبِرِيْنَ)
“যদি তোমরা শাস্তি দাও, তবে ঠিক ততখানি শাস্তিই দেবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর তবে ধৈর্যশীলদের জন্য তাই তো উত্তম।” (সূরা নাহ্ল ১৬ : ১২৬) এর দ্বারা মূলত ক্বিসাস নেয়া বৈধ হওয়ারই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে।
তবে কেউ যদি আঘাত প্রাপ্ত হয়েও ক্ষমা করে দেয় তাহলে সে এর জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট পুরষ্কার প্রাপ্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَمَنْ تَصَدَّقَ بِه۪ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّه۫)
“তবে কেউ তা ক্ষমা করে দিলে তা তার (ক্ষমাকারীর) জন্য পাপের কাফফারা হবে। ” (সূরা মায়িদাহ্ ৫ : ৪৫)
হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ক্ষমা করে দেয়ার কারণে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে দেন। (সহীহ মুসলিম ৪ : ২০০১)
অতএব, অত্যাচারিত হবার পর সে অনুপাতে যদি কেউ বদলা নিতে চায় তাহলে তার জন্য এটা বৈধ এবং এ কারণে সে গুনাহগারও হবে না। তবে যদি কেউ বদলা গ্রহণ না করে বরং অত্যাচারীকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে এটাই উত্তম এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির জন্য এটা একটি দৃঢ়-সংকল্পের কাজ।
তবে যদি বদলা নিতে চায় তাহলে সে অনুপাতেই নিতে হবে এর চেয়ে বেশি নেয়া যাবে না। বেশি নিলে সীমালঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং সে অপরাধী হবে। যেমন একটি জুলুম হল কিসাস আদায় করার পর দিয়াত দেয়া।
(إِنَّمَا السَّبِيْلُ عَلَي الَّذِيْنَ يَظْلِمُوْنَ)
‘শুধু তাদের বিরুদ্ধে দোষারোপ করা হবে যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে’ এখানে সকল প্রকার অত্যাচার শামিল। তা সম্পদে হতে পারে, রক্তে হতে পারে বা সম্মানে হতে পারে।
সুতরাং মানুষ মানুষের প্রতি অন্যায় করতে পারে, তাই বলে সে অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বেশি অত্যাচার করা নেহায়েত অপরাধ। বরং ক্ষমার ঊর্ধ্বে কিছ্ইু নেই। ক্ষমা করে দিলে অন্যায়কারী নিজে নিজেই লজ্জিত হবে, তাছাড়া অত্যাচারিত ব্যক্তির সম্মান তো আল্লাহ তা‘আলার কাছে আছেই।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মন্দের প্রতিদান মন্দই হয়ে থাকে।
২. প্রতিশোধ গ্রহণ করা অপেক্ষা ক্ষমা করে দেয়াই উত্তম।
৩. ক্ষমা করে দেয়ার মাধ্যমে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
৪৪-৪৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বর্ণনা করেছেন যে, হিদায়াত দান করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি ব্যতীত আর কোন হিদায়াত দানকারী নেই, যে মানুষকে সৎ পথের হিদায়াত দান করতে পারে। তিনি যাকে হিদায়াত দান করেন কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না, আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন কেউ তাকে হিদায়াত দান করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(مَنْ يَّهْدِ اللّٰهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ ج وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَه۫ وَلِيًّا مُّرْشِدًا)
“আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথপ্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনও তার কোন পথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না।” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ১৭)
এরপর কিয়ামতের মাঠে কাফির-মুশরিকদের অবস্থা কেমন হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : কিয়ামাতের মাঠে কাফির-মুশরিকরা যখন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা শুধু পলায়নের স্থান খুঁজবে কিন্তু তারা তথায় কোনই পলায়নের জায়গা খুঁজে পাবে না। আর তাদেরকে যখন জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত করা হবে তখন তারা অপমানে অবনত অবস্থায় অর্ধ নির্মীলিত চোখে তাকাবে। কিন্তু তারা তথায় কোন প্রকার শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন : “তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদেরকে অগ্নির পার্শ্বে দাঁড় করান হবে এবং তারা বলবে, ‘হায়! যদি আমাদেরকে (পৃথিবীতে) আবার ফিরিয়ে দেয়া হত তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। বরং পূর্বে তারা যা গোপন করেছে তা এখন তাদের নিকট প্রকাশ পেয়েছে এবং তারা প্রত্যাবর্তিত হলেও যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল পুনরায় তারা তাই করত এবং নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।” (সূরা আন‘আম ৬ : ২৭-২৮)
তারা তথায় শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার জন্য কোনই সাহায্যকারী পাবে না।
(وَقَالَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)
মু’মিনরা (কিয়ামতের দিন) বলবে : অর্থাৎ যখন কাফির-মুশরিকদেরকে মু’মিনদের থেকে আলাদা করা হবে এবং জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে তখন মু’মিনরা এ কথা বলবে। কেউ বলেছেন যখন মু’মিনরা জান্নাতে চলে যাবে এবং কাফিরদের শোচনীয় অবস্থা প্রত্যক্ষ করবে তখন এ কথা বলবে।
(وَأَهْلِيْهِمْ) ‘পরিজনবর্গের ক্ষতি সাধন করেছে’ অর্থাৎ নিজেদেরকে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করে জাহান্নামে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং পরিবারকেও জাহান্নামে নিয়ে গেছে। কারণ সে নিজে দীন মানেনি, পরিবারকেও মানতে দেয়নি। কেউ বলেছেন, পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ততা হল জান্নাতের হুরদেরকে হারিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের এমন কেউ নেই যার দু’টি আবাসস্থল নেই। একটি আবাসস্থল জান্নাতে অপরটি জাহান্নামে। যখন কেউ মারা যায় আর জাহ্ন্নাামে প্রবেশ করে তখন জান্নাতে তার জায়গাটি জান্নাতবাসীরা দখল করে নেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা মু’মিনূনে বলেছেন “তারাই জান্নাতের উত্তরাধিকারী” (ইবনু মাযাহ হা. ৪৩৪১, সিলসিলা সহীহাহ হা. ৪৪৭৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. হিদায়াত দানকারী একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ না।
২. যারা দুনিয়াতে অন্যায়-অপকর্ম করবে তারা আখিরাতে শাস্তি থেকে বাঁচার কোনই পথ খুঁজে পাবে না এবং তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবে না।
৩. প্রত্যেকের জন্য জান্নাত ও জাহান্নামে স্থান নির্ধারিত রয়েছে। যে যেস্থানের আমল করবে সে সেস্থান পাবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৩৭-৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:
অতঃপর মহান আল্লাহ এই পুণ্য লাভ করার পন্থা বলে দিচ্ছেন যে, ঈমান দৃঢ় হতে হবে, যাতে পার্থিব সুখ-সম্ভোগকে পরিত্যাগ করার উপর ধৈর্যধারণ করা যেতে পারে। আল্লাহ তা’আলার উপর পূর্ণ নির্ভরশীল হতে হবে যাতে ধৈর্যধারণে তাঁর নিকট হতে সাহায্য লাভ করা যায় এবং তাঁর আহকাম পালন করা এবং অবাধ্যচিরণ হতে বিরত থাকা সহজ হয়। আর যাতে কবীরা গুনাহ ও নির্লজ্জতা পূর্ণ কাজ হতে দূরে থাকা যায়। এই বাক্যের তাফসীর সূরায়ে আ’রাফে গত হয়েছে। ক্রোধকে সম্বরণ করতে হবে, যাতে ক্রোধের অবস্থাতেও সচ্চরিত্রতা এবং ক্ষমাপরায়ণতার অভ্যাস পরিত্যক্ত না হয়। যেমন সহীহ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজের প্রতিশোধ কারো নিকট হতে কখনো গ্রহণ করেননি। হ্যা, তবে আল্লাহর আহকামের বেইজ্জতী হলে সেটা অন্য কথা। অন্য হাদীসে এসেছে যে, কঠিন ক্রোধের সময়েও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র মুখ হতে নিম্নের কথাগুলো ছাড়া আর কিছুই বের হতো নাঃ “তার কি হয়েছে? তার হাত ধূলায় ধূসরিত হোক।”
ইবরাহীম (রঃ) বলেন যে, মুমিনরা লাঞ্ছিত হওয়া পছন্দ করতেন না বটে, কিন্তু আবার শত্রুদের উপর ক্ষমতা লাভ করলে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না, বরং ক্ষমা করে দিতেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ (মুমিনদের আরো বিশেষণ এই যে,) তারা তাদের প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দেয়, রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য করে, তার আদেশ ও নিষেধ মেনে চলে, নামায কায়েম করে যা হলো সবচেয়ে বড় ইবাদত এবং নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর।”(৩:১৫৯) এ জন্যেই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অভ্যাস ছিল যে, তিনি যুদ্ধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাহাবীদের (রাঃ) সাথে পরামর্শ করতেন যাতে তাদের মন আনন্দিত হয়। এর ভিত্তিতেই আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার (রাঃ) আহত হওয়ার পর মৃত্যুর সম্মুখীন হলে ছয়জন লোককে নির্ধারণ করেন, যেন তারা পরস্পর পরামর্শ করে তার মৃত্যুর পরে কোন একজনকে খলীফা মনোনীত করেন। ঐ ছয় ব্যক্তি হলেনঃ হযরত উসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ), হযরত যুবায়ের (রাঃ), হযরত সা’দ (রাঃ) এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)। সুতরাং তারা সর্বসম্মতিক্রমে হযরত উসমান (রাঃ)-কে খলীফা মনোনীত করেন।
এরপর আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের আর একটি বিশেষণ বর্ণনা করছেন যে, তারা যেমন আল্লাহর হক আদায় করেন, অনুরূপভাবে মানুষের হক আদায় করার। ব্যাপারেও তারা কার্পণ্য করেন না। তাঁদের সম্পদ হতে তারা দরিদ্র ও অভাবীদেরকেও কিছু প্রদান করেন এবং শ্রেণীমত নিজেদের সাধ্যানুযায়ী প্রত্যেকের সাথে সদ্ব্যবহার ও ইহসান করে থাকেন। তবে তারা এমন দুর্বল ও কাপুরুষ নন যে, যালিমদের হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন না, বরং তাঁরা অত্যাচারিত হলে পুরোপুরিভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ করে থাকেন। এভাবে তারা অত্যাচারিতদেরকে অত্যাচারীদের অত্যাচার হতে রক্ষা করেন। এতদসত্ত্বেও কিন্তু অনেক সময় ক্ষমতা লাভের পরেও তারা ক্ষমা করে থাকেন। যেমন হযরত ইউসুফ (আঃ) তাঁর ভাইদেরকে বলেছিলেনঃ
(আরবী) অর্থাৎ “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন!”(১২:৯২) আর যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ আশিজন কাফিরকে ক্ষমা করে দেন যারা হুদাবিয়ার সন্ধির বছর সুযোগ খুঁজে চুপচাপ মুসলিম সেনাবাহিনীতে ঢুকে পড়েছিল। যখন তাদেরকে গ্রেফতার করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে পেশ করা হয় তখন তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে ছেড়ে দেন। আর যেমন তিনি গাওরাস ইবনে হারিস নামক লোকটিকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সে ছিল ঐ ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিদ্রিত অবস্থায় তাঁর তরবারীখানা হাতে উঠিয়ে নেয় এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) জেগে উঠেন এবং তরবারীখানা তার হাতে দেখে তাকে এক ধমক দেন। সাথে সাথে ঐ তরবারী তার হাত হতে পড়ে যায় এবং তিনি তা উঠিয়ে নেন। ঐ অপরাধী তখন গ্রীবা নীচু করে তার সামনে দাড়িয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে (রাঃ) ডেকে তাদেরকে এ দৃশ্য প্রদর্শন করেন এবং ঘটনাটিও বর্ণনা করেন। অতঃপর তাকে ক্ষমা করে দিয়ে ছেড়ে দেন। অনুরূপভাবে লাবীদ ইবনে আসম যখন তার উপর যাদু করে তখন তা জানা এবং প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাকে মাফ করে দেন। এভাবেই যে ইয়াহূদীনী তাঁকে বিষ পানে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিল তার থেকেও তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তার নাম ছিল যয়নব। সে মারাহাব নামক ইয়াহদীর ভগ্নী ছিল। যে ইয়াহূদীকে হযরত মাহমূদ ইবনে সালমা (রাঃ) খায়বারের যুদ্ধে হত্যা করেছিলেন। ঐ ইয়াহুদিনী বকরীর কাঁধের গোশতে বিষ মাখিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে পেশ করেছিল। স্বয়ং কাঁধের গোশতই নিজের বিষ মিশ্রিত হওয়ার কথা তাঁর নিকট প্রকাশ করেছিল। মহিলাটিকে তিনি ডেকে পাঠিয়ে এটা জিজ্ঞেস করলে সে তা স্বীকার করে। তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে সে বলেঃ “আমি মনে করেছিলাম যে, যদি আপনি সত্যই আল্লাহর নবী হন তবে এটা আপনার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি আপনি আপনার দাবীতে মিথ্যাবাদী হন তবে আপনার (আধিপত্য) হতে আমরা আরাম পাবো।” এটা জানতে পারা এবং তার উপর ক্ষমতা লাভের পরেও তিনি তাকে ক্ষমা করে দিয়ে ছেড়ে দেন। পরে অবশ্য তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কেননা, ঐ বিষ মিশ্রিত খাদ্য খেয়েই হযরত বিশর ইবনে বারা (রাঃ) মারা গিয়েছিলেন। ফলে কিসাস হিসেবে ঐ মহিলাটিকেও হত্যা করা হয়েছিল। এ সম্পৰ্কীয় আরো বহু আসার ও হাদীস রয়েছে। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৪০-৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ ‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ।’ যেমন অন্য জায়গায় বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে কেউ তোমাদেরকে আক্রমণ করবে তোমরাও তাকে অনুরূপ আক্রমণ করবে।”(২:১৯৪) এর দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, প্রতিশোধ গ্রহণ করা জায়েয। কিন্তু ক্ষমা করে দেয়াই হচ্ছে ফযীলতের কাজ। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখমের কিসাস বা প্রতিশোধ রয়েছে। তবে যে ব্যক্তি মাফ করে দিবে ওটা তার জন্যে তার গুনাহ মাফের কারণ হবে।”(৫:৪৫) আর এখানে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে ক্ষমা করে দেয় ও আপোষ-নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট আছে।” হাদীসে আছেঃ “ক্ষমা করে দেয়ার কারণে আল্লাহ তা’আলা বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।”
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তিনি যালিমদেরকে পছন্দ করেন না। অর্থাৎ প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপারে যে সীমালংঘন করে তাকে আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন না। সে আল্লাহর শত্রু। মন্দের সূচনা তার পক্ষ হতেই হলো এটা মনে করা হবে।
অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘অত্যাচারিত হবার পর যারা প্রতিবিধান করে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।’
হযরত ইবনে আউন (রঃ) বলেনঃ “আমি (আরবী) শব্দটির তাফসীর জানবার আকাঙ্ক্ষা করছিলাম। আমাকে আলী ইবনে যায়েদ ইবনে জাদআন (রঃ) তাঁর মাতা উম্মে মুহাম্মাদ (রাঃ)-এর বরাত দিয়ে বলেন, যিনি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট যাতায়াত করতেন, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট গমন করেন। ঐ সময় হযরত যয়নব (রাঃ) তথায় উপস্থিত ছিলেন। এটা কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জানা ছিল না। তিনি আয়েশা (রাঃ)-এর দিকে হাত বাড়ালে হযরত আয়েশা (রাঃ) ইঙ্গিতে হযরত যয়নবের উপস্থিতির কথা তাঁকে জানিয়ে দেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর হাত টেনে নেন। হযরত যয়নব (রাঃ) তখন হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে গালমন্দ দিতে শুরু করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি চুপ হলেন না। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে অনুমতি দিলেন যে, তিনি যেন হযরত যয়নব (রাঃ)-এর কথার উত্তর দেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) যখন তাঁকে উত্তর দিতে শুরু করলেন তখন হযরত যয়নব (রাঃ) তাকে আর পেরে উঠলেন না। সুতরাং তিনি সরাসরি হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট গমন করে তাঁকে বলেনঃ “হযরত আয়েশা (রাঃ) আপনার সম্পর্কে এরূপ এরূপ কথা বলেছেন এবং এরূপ এরূপ করেছেন।” একথা শুনে হযরত ফাতেমা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “কা’বার প্রতিপালকের শপথ! তোমার আব্বার (অর্থাৎ আমার) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি ভালবাসা রয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ ফিরে যান এবং হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেন। অতঃপর হযরত আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট গমন করে তাঁর সাথে আলাপ আলোচনা করেন। এ ঘটনাটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর বর্ণনাকারী তার রিওয়াইয়াতে প্রায়ই অস্বীকার্য হাদীসগুলো আনয়ন করে থাকেন এবং এই রিওয়াইয়াতটিও মুনকার বা অস্বীকার্য।
ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) ঘটনাটি এভাবে আনয়ন করেছেন যে, হযরত যয়নব (রাঃ) ক্রোধান্বিতা অবস্থায় পূর্বে কোন খবর না দিয়েই হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে আগমন করেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হযরত আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে কিছু বলেন। তারপর হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে ঝগড়া করতে শুরু করেন। কিন্তু হযরত আয়েশা (রাঃ) চুপ থাকেন। হযরত যয়নব (রাঃ)-এর বক্তব্য শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে বলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) জবাব দিতে শুরু করলে হযরত যয়নব (রাঃ)-এর মুখের থুথু শুকিয়ে যায়। তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কথার জবাব দিতে পারলেন না। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চেহারা মুবারক হতে দুঃখের চিহ্ন দূর হয়ে গেল।
মোটকথা (আরবী)-এর অর্থ হলো অত্যাচারিত ব্যক্তির অত্যাচারী ব্যক্তি হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করা।
বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, যালিমের বিরুদ্ধে যে বদদু’আ করলো সে প্রতিশোধ নিয়ে নিলো। এ হাদীসটিই ইমাম তিরমিযীও (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর বর্ণনাকারী সম্পর্কে সমালোচনা রয়েছে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ‘শুধু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে যারা মানুষের উপর যুলুম করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়। সহীহ হাদীসে এসেছে যে, গালিদাতা দুই ব্যক্তির (পাপের) বোঝা প্রথম গালিদাতার উপর পড়বে যে পর্যন্ত না অত্যাচারিত ব্যক্তি প্রতিশোধ গ্রহণে সীমালংঘন করে।
প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ “এরূপ অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণকারী ব্যক্তির জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।’ অর্থাৎ কিয়ামতের দিন এরূপ ব্যক্তি কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।
হযরত মুহাম্মাদ ইবনে ওয়াসি (রঃ) বলেন, একবার আমি মক্কার পথে যাত্রা শুরু করি। দেখি খন্দক বা পরিখার উপর সেতু নির্মিত রয়েছে। আমি ওখানেই রয়েছি এমন সময় আমাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বসরার আমীর মারওয়ান ইবনে মাহলাবের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আবু আবদিল্লাহ! তুমি কি চাও?” আমি উত্তরে বললামঃ আমি এই চাই যে, সম্ভব হলে আপনি বানু আদ্দীর ভাইএর মত হয়ে যান। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “তিনি কে?” আমি জবাব দিলামঃ তিনি হলেন আলা ইবনে যিয়াদ। তিনি তার এক বন্ধুকে একবার কোন এক কাজে নিযুক্ত করেন। অতঃপর তিনি তার কাছে এক পত্র লিখেনঃ “হামদ ও সানার পর, সমাচার এই যে, যদি সম্ভব হয় তবে তুমি তোমার কোমরকে (পাপের বোঝা হতে শূন্য রাখবে, পেটকে হারাম থেকে রক্ষা করবে এবং তোমার হাত যেন মুসলমানদের রক্ত ও মাল দ্বারা অপবিত্র না হয়। যখন তুমি এরূপ কাজ করবে তখন তোমার উপর কোন গুনাহ থাকবে না। কুরআন কারীমে আল্লাহ পাক বলেন- ‘শুধু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়। এ কথা শুনে মারওয়ান বলেনঃ “আল্লাহ জানেন যে, তিনি সত্য বলেছেন এবং কল্যাণের কথাই জানিয়েছেন। আচ্ছা, এখন আপনি কি কামনা করেন?” আমি উত্তরে বললামঃ আমি চাই যে, আমাকে আমার বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দেয়া হোক। তিনি তখন বললেনঃ “আচ্ছা, ঠিক আছে।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
যুলুম ও যালিম যে নিন্দনীয় এটা বর্ণনা করে এবং যুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণের অনুমতি দিয়ে এখন ক্ষমা করে দেয়ার ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘অবশ্য যে ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমা করে দেয়, ওটা তো হবে দৃঢ় সংকল্পেরই কাজ।’ এর ফলে সে বড় পুরস্কার এবং পূর্ণ প্রতিদান লাভের যোগ্য হযরত ফুযায়েল ইবনে আইয়ায (রঃ) বলেনঃ তোমার কাছে কোন লোক এসে যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তবে তুমি তাকে উপদেশ দিবেঃ ভাই! তাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। ক্ষমা করার মধ্যেই বড় মঙ্গল নিহিত রয়েছে। আর এটাই তাকওয়া প্রমাণ করে। যদি সে এটা অস্বীকার করে এবং স্বীয় অন্তরের দুর্বলতা প্রকাশ করে তবে তাকে বলে দাও- যাও, প্রতিশোধ নিয়ে নাও। কিন্তু দেখো, এতে যেন সীমালংঘন না হয়, আর আমি এখনো বলছি যে, তুমি বরং ক্ষমা করেই দাও। এই দরযা খুব প্রশস্ত, আর প্রতিশোধ গ্রহণের রাস্তা খুবই সংকীর্ণ। জেনে রেখো যে, ক্ষমাকারী আরামে মিষ্টি ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে প্রতিশোধ গ্রহণকারী প্রতিশোধ গ্রহণের নেশায় সদা মেতে থাকে। এর চিন্তায় তার ঘুম হয় না।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে গালমন্দ দিতে শুরু করে। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-ও তথায় বিদ্যমান ছিলেন। তিনি বিস্মিতভাবে মুচকি হাসছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) নীরব ছিলেন। কিন্তু লোকটি যখন গালি দিতেই থাকলো তখন তিনিও কোন কোনটির জবাব দিতে লাগলেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) অসন্তুষ্ট হলেন এবং সেখান হতে চলে গেলেন। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লোকটি আমাকে মন্দ বলতেই ছিল এবং আপনি বসে বসে শুনছিলেন। আর আমি যখন তার দু’ একটি কথার জবাব দিলাম তখন আপনি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে আসলেন (কারণ কি?)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে উত্তরে বললেনঃ “জেনে রেখো যে, তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত নীরব ছিলে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতা তোমার পক্ষ থেকে তার কথার জবাব দিচ্ছিলেন। অতঃপর যখন তুমি নিজেই জবাব দিতে শুরু করলে তখন ফেরেশতা সরে পড়লেন এবং মাঝখানে শয়তান এসে পড়লো। তাহলে বলতো আমি শয়তানের বিদ্যমানতায় কিভাবে বসে থাকতে পারি?” অতঃপর তিনি বললেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! জেনে রেখো যে, তিনটি জিনিস সম্পূর্ণরূপে সত্য। প্রথমঃ যার উপর কেউ জুলুম করে এবং সে তা সহ্য করে নেয়, আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা অবশ্যই বাড়িয়ে দেন এবং তাকে সাহায্য করেন। দ্বিতীয়তঃ যে ব্যক্তি সদ্ব্যবহার ও অনুগ্রহের দরযা খুলে দিবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখার। উদ্দেশ্যে মানুষকে দান করতে থাকবে, আল্লাহ তার ধন-মালে বরকত দান করবেন এবং আরো বেশী প্রদান করবেন। তৃতীয়তঃ যে ব্যক্তি মাল-ধন বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ভিক্ষার দরযা খুলে দিবে, এর কাছে, ওর কাছে চেয়ে বেড়াবে, আল্লাহ তার বরকত কমিয়ে দিবেন এবং তার মাল-ধন কমেই থাকবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সুনানে আবি দাউদের মধ্যেও এ রিওয়াইয়াতটি রয়েছে। বিষয়ের দিক দিয়ে এটি বড়ই প্রিয় হাদীস)
৪৪-৪৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করছেন যে, তিনি যা চান তাই হয়। তাঁর ইচ্ছার উপর কেউ বাধা দিতে পারে না এবং যা তিনি চান না তা হয় না। কেউ তাকে তা করাতে পারে না। যাকে তিনি সুপথে পরিচালিত করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ সুপথে পরিচালিত করতে পারে না। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনই তার কোন পথ প্রদর্শনকারী। অভিভাবক পাবে না ।”(১৮১৭)
মহান আল্লাহ বলেনঃ যালিমরা যখন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তুমি তাদেরকে বলতে শুনবেঃ প্রত্যাবর্তনের কোন উপায় আছে কি? অর্থাৎ মুশরিকরা কিয়ামতের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষা করবে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি যদি দেখতে! যখন তাদেরকে জাহান্নামের উপর দাঁড় করানো হবে তখন তারা বলবেঃ হায়! যদি আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হতো, আমরা আমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করতাম না এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম! বরং পূর্বে যা তারা গোপন করতো আজ তা প্রকাশ হয়ে গেছে, যদি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়াও হয় তবে আবার তাই করবে যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী।”(৬:২৭-২৮)
ইরশাদ হচ্ছেঃ তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে যে, তাদেরকে জাহান্নামের সামনে উপস্থিত করা হচ্ছে। অবাধ্যাচরণের কারণে তারা অপমানে অবনত। অবস্থায় অর্ধনিমীলিত নেত্রে তাকাতে থাকবে। কিন্তু যেটাকে তারা ভয় করবে ওটা থেকে তারা বাঁচতে পারবে না। শুধু এটুকু নয় বরং তাদের ধারণা ও কল্পনারও অধিক তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এটা হতে রক্ষা করুন।
ঐ সময় মুমিনরা বলবেঃ ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা নিজেদের ও নিজেদের পরিজনবর্গের ক্ষতি সাধন করেছে। এখানে তারা নিজেরাও চিরস্থায়ী নিয়ামত হতে বঞ্চিত হয়েছে এবং নিজেদের পরিজনবর্গকেও বঞ্চিত করেছে। আজ তারা পৃথক পৃথকভাবে চিরস্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। তারা সেই দিন আল্লাহর রহমত হতে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে যাবে। এমন কেউ হবে না যে তাদেরকে এই আযাব হতে রক্ষা করতে পারে। কেউ তাদের শাস্তি হালকা করতেও পারবে
না। ঐ পথভ্রষ্টদেরকে সেই দিন পরিত্রাণ দানকারী কেউই থাকবে না।
৪৭-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:
উপরে আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা দিয়েছিলেন যে, কিয়ামতের দিন ভীষণ বিপজ্জনক ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে। ওটা হবে কঠিন বিপদের দিন। এখানে আল্লাহ তা’আলা ঐ দিনের ভয় প্রদর্শন করছেন এবং ওর জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলছেনঃ আকস্মিকভাবে ঐ দিন এসে যাওয়ার পূর্বেই। আল্লাহর ফরমানের উপর পুরোপুরি আমল কর। যখন ঐদিন এসে পড়বে তখন তোমাদের কোন আশ্রয়স্থল মিলবে না এবং তোমরা এমন জায়গাও পাবে না যেখানে অপরিচিত ভাবে লুকিয়ে থাকবে, কেউ তোমাদেরকে চিনতে পারবে না।
এরপর পরাক্রমশালী আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ এই কাফির ও মুশরিকরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমাকে তো আমি তাদের রক্ষক করে পাঠাইনি। তাদেরকে হিদায়াত দান করা তোমার দায়িত্ব নয়। তোমার কাজ শুধু তাদের কাছে আমার বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া। আমিই তাদের হিসাব গ্রহণ করবো। এ দায়িত্ব আমার। মানুষের অবস্থা এই যে, আমি যখন তাদেরকে অনুগ্রহ আস্বাদন করাই তখন সে এতে উৎফুল্ল হয় এবং যখন তাদের কৃতকর্মের জন্যে তাদের বিপদ-আপদ ঘটে তখন মানুষ হয়ে যায় অকৃতজ্ঞ। ঐ সময় তারা পূর্বের নিয়ামতকেও অস্বীকার করে বসে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) নারীদেরকে বলেছিলেনঃ “হে নারীর দল! তোমরা (খুব বেশী বেশী) দান-খয়রাত কর, কেননা, আমি তোমাদের অধিক সংখ্যককে জাহান্নামে দেখেছি। তখন একজন মহিলা বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটা কেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “কারণ এই যে, তোমরা খুব বেশী অভিযোগ কর এবং স্বামীদের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো। তোমাদের কারো প্রতি তার স্বামী যদি যুগ যুগ ধরে অনুগ্রহ করতে থাকে, অতঃপর একদিন যদি তা ছেড়ে দেয় তবে অবশ্যই সে তার স্বামীকে বলবে- ‘তুমি কখনো আমার প্রতি অনুগ্রহ করনি।” অধিকাংশ নারীদেরই অবস্থা এটাই, তবে আল্লাহ যার প্রতি দয়া করেন এবং সৎকাজের তাওফীক প্রদান করেন এবং প্রকৃত ঈমানের অধিকারিণী বানিয়ে দেন তার কথা স্বতন্ত্র।
যে প্রকৃত মুমিন হয় সেই শুধু সুখের সময় কৃতজ্ঞ ও দুঃখের সময় ধৈর্যধারণকারী হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যদি সে সুখ ও আনন্দ লাভ করে তবে সে কৃতজ্ঞ হয়, আর এটাই হয় তার জন্যে কল্যাণকর। আর যদি তার উপর কষ্ট ও বিপদ-আপদ আপতিত হয় তখন সে ধৈর্যধারণ করে এবং ওটা হয় তার জন্যে কল্যাণকর। আর এই বিশেষণ মুমিন ছাড়া আর কারো মধ্যে থাকে না।”
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# তারা রুক্ষ ও ক্রুদ্ধ স্বভাবের হয় না, বরং নম্র স্বভাব ও ধীর মেজাজের মানুষ হয়। তাদের স্বভাব প্রতিশোধ পরায়ণ হয় না। তারা আল্লাহর বান্দাদের সাথে ক্ষমার আচরণ করে এবং কোন কারণে ক্রোধান্বিত হলেও তা হজম করে। এটি মানুষের সর্বোত্তম গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মজীদ একে অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য বলে ঘোষণা করেছে (আল ইমরান, আয়াত ১৩৪ ) এবং একে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাফল্যের বড় বড় কারণসমূহের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে (আল ইমরান, ১৫৯ আয়াত)। হাদীসে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ
وَمَا انْتَقَمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لِنَفْسِهِ فى شئ قط ، إِلاَّ أَنْ تُنْتَهَكَ حُرْمَةُ اللَّهِ (بخارى , مسلم)
“রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তিগত কারণে কখনো প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে আল্লাহর কোন হুরমত বা মর্যাদার অবমাননা করা হলে তিনি শাস্তি বিধান করতেন।”
#