باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৬৯/তালাক সংক্রান্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও আলোচনা) [* তোমরা হয় যথাবিধি তাদেরকে রেখে নাও, না হয় তোমরা তাদেরকে যথাবিধি পরিত্যাগ কর:- *তোমাদের পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উত্তম পন্থায় ঠিক করে নাও:- *তালাকপরবর্তী সমস্যা ও তার সমাধান :- ** আল্লাহকে ভয় কর, হে বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ:-] www.motaher21.net সুরা: ৬৫: আত্-তালাক পারা:২৮ ১-১২ নং আয়তের ব্যাখ্যা:- ১)তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬৯/তালাক সংক্রান্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও আলোচনা)
[* তোমরা হয় যথাবিধি তাদেরকে রেখে নাও, না হয় তোমরা তাদেরকে যথাবিধি পরিত্যাগ কর:-
*তোমাদের পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উত্তম পন্থায় ঠিক করে নাও:-
*তালাকপরবর্তী সমস্যা ও তার সমাধান :-
** আল্লাহকে ভয় কর, হে বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক
পারা:২৮
১-১২ নং আয়তের ব্যাখ্যা:-
১)তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-১
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ اِذَا طَلَّقۡتُمُ النِّسَآءَ فَطَلِّقُوۡہُنَّ لِعِدَّتِہِنَّ وَ اَحۡصُوا الۡعِدَّۃَ ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ رَبَّکُمۡ ۚ لَا تُخۡرِجُوۡہُنَّ مِنۡۢ بُیُوۡتِہِنَّ وَ لَا یَخۡرُجۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّاۡتِیۡنَ بِفَاحِشَۃٍ مُّبَیِّنَۃٍ ؕ وَ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰہِ ؕ وَ مَنۡ یَّتَعَدَّ حُدُوۡدَ اللّٰہِ فَقَدۡ ظَلَمَ نَفۡسَہٗ ؕ لَا تَدۡرِیۡ لَعَلَّ اللّٰہَ یُحۡدِثُ بَعۡدَ ذٰلِکَ اَمۡرًا ﴿۱﴾
হে নবী! (তোমার উম্মতকে বল,) তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে ইচ্ছা কর তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে, ইদ্দতের হিসাব রেখো এবং তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো; তোমরা তাদেরকে তাদের বাসগৃহ হতে বহিষ্কার করো না এবং তারা নিজেও যেন বের না হয়; যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। আর যে আল্লাহর সীমা লংঘন করে, সে নিজের উপরই অত্যাচার করে।তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এর পর কোন উপায় করে দেবেন।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-২
فَاِذَا بَلَغۡنَ اَجَلَہُنَّ فَاَمۡسِکُوۡہُنَّ بِمَعۡرُوۡفٍ اَوۡ فَارِقُوۡہُنَّ بِمَعۡرُوۡفٍ وَّ اَشۡہِدُوۡا ذَوَیۡ عَدۡلٍ مِّنۡکُمۡ وَ اَقِیۡمُوا الشَّہَادَۃَ لِلّٰہِ ؕ ذٰلِکُمۡ یُوۡعَظُ بِہٖ مَنۡ کَانَ یُؤۡمِنُ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۬ؕ وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ یَجۡعَلۡ لَّہٗ مَخۡرَجًا ۙ﴿۲﴾
তাদের ইদ্দত পূরণের কাল আসন্ন হলে তোমরা হয় যথাবিধি তাদেরকে রেখে নাও, না হয় তোমরা তাদেরকে যথাবিধি পরিত্যাগ কর এবং তোমাদের মধ্য হতে দুই জন ন্যায়পরায়ণ লোককে সাক্ষী রাখ; তোমরা আল্লাহর জন্য সঠিক সাক্ষ্য দাও। এটা দ্বারা তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, তাকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। আর যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-৩
وَّ یَرۡزُقۡہُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ فَہُوَ حَسۡبُہٗ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بَالِغُ اَمۡرِہٖ ؕ قَدۡ جَعَلَ اللّٰہُ لِکُلِّ شَیۡءٍ قَدۡرًا ﴿۳﴾
এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রুযী দান করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করবে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট হবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেনই। আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-৪
وَ الّٰٓیِٴۡ یَئِسۡنَ مِنَ الۡمَحِیۡضِ مِنۡ نِّسَآئِکُمۡ اِنِ ارۡتَبۡتُمۡ فَعِدَّتُہُنَّ ثَلٰثَۃُ اَشۡہُرٍ ۙ وَّ الّٰٓیِٴۡ لَمۡ یَحِضۡنَ ؕ وَ اُولَاتُ الۡاَحۡمَالِ اَجَلُہُنَّ اَنۡ یَّضَعۡنَ حَمۡلَہُنَّ ؕ وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ یَجۡعَلۡ لَّہٗ مِنۡ اَمۡرِہٖ یُسۡرًا ﴿۴﴾
তোমাদের যেসব স্ত্রীদের মাসিক হবার আশা নেই, তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দতকাল হবে তিন মাস এবং যাদের এখনো মাসিক হয়নি তাদেরও। আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। আল্লাহকে যে ভয় করবে, তিনি তার সমস্যার সমাধান সহজ করে দেবেন।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-৫
ذٰلِکَ اَمۡرُ اللّٰہِ اَنۡزَلَہٗۤ اِلَیۡکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ یُکَفِّرۡ عَنۡہُ سَیِّاٰتِہٖ وَ یُعۡظِمۡ لَہٗۤ اَجۡرًا ﴿۵﴾
এটা আল্লাহর বিধান যা তিনি তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন। আর যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে তিনি তার পাপসমূহ মোচন করে দেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-৬
اَسۡکِنُوۡہُنَّ مِنۡ حَیۡثُ سَکَنۡتُمۡ مِّنۡ وُّجۡدِکُمۡ وَ لَا تُضَآرُّوۡہُنَّ لِتُضَیِّقُوۡا عَلَیۡہِنَّ ؕ وَ اِنۡ کُنَّ اُولَاتِ حَمۡلٍ فَاَنۡفِقُوۡا عَلَیۡہِنَّ حَتّٰی یَضَعۡنَ حَمۡلَہُنَّ ۚ فَاِنۡ اَرۡضَعۡنَ لَکُمۡ فَاٰتُوۡہُنَّ اُجُوۡرَہُنَّ ۚ وَ اۡتَمِرُوۡا بَیۡنَکُمۡ بِمَعۡرُوۡفٍ ۚ وَ اِنۡ تَعَاسَرۡتُمۡ فَسَتُرۡضِعُ لَہٗۤ اُخۡرٰی ؕ﴿۶﴾
তোমরা তোমাদের সামর্থ অনুযায়ী যে রকম বাসগৃহে থাকো তাদেরকেও (ইদ্দতকালে) সেখানে থাকতে দাও। তাদেরকে বিপদগ্রস্ত করার জন্য উত্যক্ত করো না। আর তারা গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য খরচ করো। তারপর তারা যদি তোমাদের সন্তানদের বুকের দুধ পান করায় তাহলে তাদেরকে তার বিনিময় দাও এবং (বিনিময়দানের বিষয়টি) তোমাদের পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উত্তম পন্থায় ঠিক করে নাও। কিন্তু (বিনিময় ঠিক করতে গিয়ে) তোমরা যদি একে অপরকে কষ্টকর অবস্থার মধ্যে ফেলতে চেয়ে থাকো তাহলে অন্য মহিলা বাচ্চাকে দুধ পান করাবে।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-৭
لِیُنۡفِقۡ ذُوۡ سَعَۃٍ مِّنۡ سَعَتِہٖ ؕ وَ مَنۡ قُدِرَ عَلَیۡہِ رِزۡقُہٗ فَلۡیُنۡفِقۡ مِمَّاۤ اٰتٰىہُ اللّٰہُ ؕ لَا یُکَلِّفُ اللّٰہُ نَفۡسًا اِلَّا مَاۤ اٰتٰىہَا ؕ سَیَجۡعَلُ اللّٰہُ بَعۡدَ عُسۡرٍ یُّسۡرًا ٪﴿۷﴾
সচ্ছল ব্যক্তি তার সচ্ছলতা অনুপাতে খরচ করবে। আর যাকে স্বল্প পরিমাণ রিযিক দেয়া হয়েছে সে আল্লাহ‌ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে খরচ করবে। আল্লাহ‌ যাকে যতটা সামর্থ দিয়েছেন তার চেয়ে অধিক দায়িত্ব তিনি তার ওপর চাপান না। অসম্ভব নয় যে, অসচ্ছলতার পর আল্লাহ‌ তাকে সচ্ছলতা দান করবেন।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-৮
وَ کَاَیِّنۡ مِّنۡ قَرۡیَۃٍ عَتَتۡ عَنۡ اَمۡرِ رَبِّہَا وَ رُسُلِہٖ فَحَاسَبۡنٰہَا حِسَابًا شَدِیۡدًا ۙ وَّ عَذَّبۡنٰہَا عَذَابًا نُّکۡرًا ﴿۸﴾
কত জনপদ দম্ভভরে তাদের প্রতিপালকের ও তাঁর রসূলদের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, ফলে আমি তাদের নিকট হতে কঠোর হিসাব নিয়েছিলাম এবং তাদেরকে দিয়েছিলাম কঠিন শাস্তি।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-৯
فَذَاقَتۡ وَبَالَ اَمۡرِہَا وَ کَانَ عَاقِبَۃُ اَمۡرِہَا خُسۡرًا ﴿۹﴾
তারা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করেছে। তাদের কৃতকর্মের পরিণাম ছিল শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-১০
اَعَدَّ اللّٰہُ لَہُمۡ عَذَابًا شَدِیۡدًا ۙ فَاتَّقُوا اللّٰہَ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ ۬ۚۖۛ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ؕ۟ۛ قَدۡ اَنۡزَلَ اللّٰہُ اِلَیۡکُمۡ ذِکۡرًا ﴿ۙ۱۰﴾
আল্লাহ তাদের জন্য কঠিন শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, হে বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ, যারা ঈমান এনেছ! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন উপদেশ।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-১১
رَّسُوۡلًا یَّتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ مُبَیِّنٰتٍ لِّیُخۡرِجَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ مِنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ ؕ وَ مَنۡ یُّؤۡمِنۡۢ بِاللّٰہِ وَ یَعۡمَلۡ صَالِحًا یُّدۡخِلۡہُ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ؕ قَدۡ اَحۡسَنَ اللّٰہُ لَہٗ رِزۡقًا ﴿۱۱﴾
এমন এক রাসূল, যে তোমাদের কাছে আল্লাহর সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করে তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনার জন্য। আর যে কেউ আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তিনি তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে ; আল্লাহ্‌ তো তাকে উত্তম রিযিক দেবেন।
সুরা: ৬৫: আত্-তালাক:-১২
اَللّٰہُ الَّذِیۡ خَلَقَ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ وَّ مِنَ الۡاَرۡضِ مِثۡلَہُنَّ ؕ یَتَنَزَّلُ الۡاَمۡرُ بَیۡنَہُنَّ لِتَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ۬ۙ وَّ اَنَّ اللّٰہَ قَدۡ اَحَاطَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عِلۡمًا ﴿٪۱۲﴾
আল্লাহ সেই সত্তা যিনি সাত আসমান বানিয়েছেন এবং যমীনের শ্রেণী থেকেও ঐগুলোর অনুরূপ। ঐগুলোর মধ্যে হুকুম নাযিল হতে থাকে। (এ কথা তোমাদের এজন্য বলা হচ্ছে) যাতে তোমরা জানতে পারো, আল্লাহ‌ সব কিছুর ওপরে ক্ষমতা রাখেন এবং আল্লাহর জ্ঞান সব কিছুকে পরিব্যপ্ত করে আছে।

সুরা: আত-তালাক
*ভূমিকা:৬৫
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

১-১২ নং আয়তের ব্যাখ্যা:-
১)তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

ফী জিলালিল কুরআন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এটি সূরা তালাক। এ সূরায় আল্লাহ তালাকের বিধিসমূহ বর্ণনা করেছেন। সূরা বাকারায় তালাকের কিছু বিধি বর্ণিত হয়েছে। সেখানে যে সব বিধি বাদ পড়েছে, তা আলােচ্য সূরায় বর্ণিত হয়েছে। তালাক পরবর্তী অবস্থা সংক্রান্ত কিছু পারিবারিক বিষয়ও এতে আলােচিত হয়েছে। যে তালাক আল্লাহর কাছে গ্রহণযােগ্য এবং তার নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী কার্যকরি হয়, সেই তালাকের উপযুক্ত সময় কোনটি, তাও এতে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, যখন তােমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে, তখন তাদের ইদ্দতের সময়ে তালাক দাও।’ তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর নিজ বাড়ীতে তথা তাকে তালাক দানকারী স্বামীর বাড়ীতেই থাকতে হবে। এটা তার অধিকারও এবং কর্তব্যও। সে ইদ্দতের ভেতরে সেখান থেকে বের হবে না, আর প্রামাণ্যভাবে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়া ছাড়া তাকে সেখান থেকে বের করাও যাবে না। |ইদ্দত পেরিয়ে যাওয়ার পর তার সে বাড়ী থেকে বের হওয়ার অধিকার থাকবে, যাতে সে নিজের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কেননা, ইদ্দতের মধ্যে তার স্বামী স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে তাকে দেয়া তালাক প্রত্যাহারও করেনি, তাকে স্ত্রী হিসাবে পুনর্বহালও করেনি। এই তালাক প্রত্যাহার ও স্ত্রী হিসাবে পুনর্বহালের উদ্দেশ্য যদি তার ক্ষতি করা, তাকে কষ্ট দেয়া এবং তার পুনর্বিবাহের পথ রােধ করা হয়, তা হলে সেটা অবশ্য গ্রহণযােগ্য হবে না। বলা হয়েছে, ‘যখন তাদের ইদ্দত পূর্ণ হবে তখন তাদের হয় স্বাভাবিকভাবে পুনর্বহাল করাে, নতুবা ভালােভাবে বিচ্ছিন্ন করে দাও।’ তবে পুনর্বহাল করাই হােক আর বিচ্ছিন্ন করাই হােক- ‘দুজন সাক্ষীর সামনে তা করতে হবে। সূরা বাকারায় ঋতুবতী স্ত্রীর ইদ্দতের মেয়াদ বর্ণনা করা হয়েছে। এই মেয়াদ হচ্ছে তিন ঋতু অথবা তিনটি ঋতুমুক্ত সময়। এ ব্যাপারে ফেকাহবিদদের মতভেদ রয়েছে। আর এখানে এই মেয়াদ বর্ণনা করা হয়েছে যাদের ঋতুর চির অবসান হয়ে গেছে এবং যেসব অপ্রাপ্তবয়স্কা কিশােরীর জন্যে, এখনাে যাদের আদৌ রজস্রাব শুরুই হয়নি। বলা হয়েছে, ‘তােমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যারা আর ঋতুবতী হবার আশা করে না, তাদের ব্যাপারে তােমরা সন্দিহান হলে তাদের ইদ্দত তিন মাস, আর যারা এখনাে ঋতুবতী হয়নি, তাদেরও ইদ্দত তিন মাস।’ আর গর্ভবতী মহিলার ইদ্দত বর্ণনা করা হয়েছে সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। অতপর তালাকপ্রাপ্তার বাসস্থান ও সন্তান প্রসবকাল পর্যন্ত তার ভরণ পােষণ সংক্রান্ত বিধি সবিস্তার বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যে বাসস্থানে তােমরা নিজেরা বসবাস করে আসছো এবং যা তােমাদের কাছে সহজলভ্য, সেই বাসস্থানেই তাদের (তালাক দেয়া স্ত্রীদের) থাকতে দাও।’ এরপর বর্ণনা করা হয়েছে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর ভূমিষ্ঠ সন্তানের দুধ খাওয়া সংক্রান্ত বিধি- ‘তারা যদি তােমাদের জন্যে তােমাদের সন্তানদের দুধ খাওয়ায়, তাহলে তাদের পারিশ্রমিক দাও…’ অতপর ভরণ পােষণ ও পারিশ্রমিক সংক্রান্ত নির্দেশ দেয়া হয়েছে- ‘যার যেমন সাধ্য আছে তার তেমন ভরণ পােষণ দেয়া উচিত…’ এভাবে সূরার আয়াতগুলাে তালাক ও তৎসংক্রান্ত প্রতিটি অবস্থা সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিধান দিয়েছে এবং তালাকের পরিণতিতে বিধ্বস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত বিধি ঘােষণা করেছে। সূরাটি অধ্যয়ন করে পাঠক বিস্ময়ে স্তম্ভিত না হয়ে পারে না। কেননা, এতে তালাকজনিত পরিস্থিতি ও তার ফলাফল সংক্রান্ত বহু সংখ্যক বিধি তুলে ধরার পাশাপাশি সতর্কবাণী ও আশ্বাসবাণী, প্রতিটি বিধির সাথে সাথে মন্তব্য, এই বিষয়টির সাথে আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহর শক্তি ও পরাক্রমের সংযােগ, আল্লাহর আদেশ লংঘনকারীদের ব্যাপারে এবং আল্লাহকে যারা ভয় করে তাদের নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ জীবনের ব্যাপারে আল্লাহর শাশ্বত নীতি, বারংবার সদাচার, উদারতা, পারস্পরিক সন্তোষ ও সম্মতি, অপরের জন্যে ত্যাগ স্বীকার, কল্যাণকর কাজের আকাংখা পােষণ করার পুন পুন নির্দেশ প্রদান এবং সৃষ্টি করা ও জীবিকা বিতরণ করা আর অভাব ও প্রাচুর্যের ব্যাপারে আল্লাহর পরিকল্পনার বিস্ময়কর সমাবেশ ঘটেছে। তালাক সংক্রান্ত আলােচনা প্রসংগে এত বিপুল সংখ্যক মহাজাগতিক তত্ত্বের উল্লেখ দেখে মানুষ মাত্রেই অভিভূত না হয়ে পারে না। এখানে ব্যক্তিগতভাবে রসূল(স.)-কে সম্বোধন করা হলেও এটা আসলে সকল মুসলমানের জন্যে সাধারণ নির্দেশ। রাসূল(স.)-কে ব্যক্তিগতভাবে সম্বােধন করার উদ্দেশ্য হলাে বিষয়টির গুরুত্ব বৃদ্ধি করা। প্রতিটি অবস্থা সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিধির এই বিশদ বিবরণ, এই বিধিসমূহ মেনে চলার জন্যে জোর তাগিদ প্রদান, এ বিধির বাস্তবায়নে ভয় ও আল্লাহ সচেতনতার পথ অবলম্বন এবং সদাচারে উদ্বুদ্ধকরণ ও অসদাচার থেকে সতর্কীকরণের জন্যে এতাে দীর্ঘ আলােচনার অবতারণা করা হয়েছে যে, এ দ্বারা মনে হয় এটাই পরিপূর্ণ ইসলাম। বস্তুত এ বিষয়টি নিয়েই কোরআন বিস্তারিত আলােচনা করে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের কাজটি তদারক করে থাকে। এতে আল্লাহভীরু লােকদেরকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে, একজন মােমেনের পক্ষে যতােটা উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হওয়া সম্ভব, ততােটাই উচ্চ মর্যাদায় তাকে উন্নীত করা হবে। পক্ষান্তরে যারা পথভ্রষ্ট ও বিকারগ্রস্ত এবং যারা স্ত্রীদের ক্ষতি সাধনে তৎপর, তাদের কঠোরতম শাস্তির হুমকি প্রদান করা হয়েছে। সদাচার, উদারতা ও নম্র আচরণকারীদের জন্যে উত্তম পুরস্কার ও কল্যাণময় প্রতিদানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। নিম্নোক্ত আয়াত গুলো পড়ার সময় পাঠকের সামনে উল্লিখিত বক্তব্যগুলাে পরিস্ফুট হবে, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো…এ হচ্ছে আল্লাহর সীমারেখা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজের ওপর যুলুম করে।…’ ‘তুমি জানাে না হয়তাে পরবর্তীকালে আল্লাহ তায়ালা কোনাে কিছু সংঘটিত করবেন।…’ ‘দু’জন সৎ সাক্ষী রাখাে এবং আল্লাহর জন্যে সাক্ষ্য স্থাপন করাে। এ হচ্ছে তাদের জন্যে উপদেশ, যারা আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতে বিশ্বাস করে।…’যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে একটা বহির্গমন পথ তৈরী করে দেন এবং সে কল্পনাও করতে পারে না এমন উপায়ে তাকে জীবিকা দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহ তায়ালাই তার জন্যে যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা নিজ লক্ষ্যে উপনীত হন। আল্লাহ তায়ালা সব জিনিসের জন্যেই একটা পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন।… ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে তার কাজ সহজ করে দেন… এ হচ্ছে তােমাদের কাছে নাযিল করা আল্লাহর বিধান। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে, আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ মাফ করে দেন এবং তাকে উত্তম প্রতিদান দেন…আল্লাহ তায়ালা কঠিন অবস্থার পর সহজ অবস্থার উদ্ভব করবেন। এরপর তার সামনে নিম্নোক্ত হুমকিও আসে- ‘অতীতে বহু জনপদের অধিবাসীরা তাদের প্রতিপালকের ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করেছে। ফলে আমি তাদের কাছ থেকে কঠোরভাবে হিসাব নিয়েছি এবং তাদের নিকৃষ্টতম শাস্তি দিয়েছি। ফলত তারা তাদের কর্মফল ভােগ করেছে এবং তাদের শেষ ফল ছিলাে দুর্গতি। আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে কঠিন আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ এরপরই সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে উল্লিখিত ভয়াবহ পরিণতি থেকে। রসূল ও তার সাথে কিতাবরূপী আলােকবর্তিকা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা যে নেয়ামত দান করেছেন তা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং বিরাট পুরস্কারের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, অতএব হে ঈমানদার বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা, আল্লাহকে ভয় করাে। আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কাছে স্মরণিকা নাযিল করেছেন আর রসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তােমাদের কাছে আল্লাহর আয়াতগুলাে স্পষ্ট করে পড়ে শােনান, যাতে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের অন্ধকার থেকে আলােকে নিয়ে আসতে পারেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন- যার নিচ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরদিন বসবাস করবে। আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে চমৎকার জীবিকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’ এরপর পাঠক সর্বশেষ যে উক্তিটি পাঠ করে তা হচ্ছে, মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত গুরুগম্ভীর ঘােষণা, ‘আল্লাহ হচ্ছেন তিনি, যিনি সাতটি আকাশ সৃষ্টি করেছেন, আর পৃথিবী থেকেও অনুরূপ সাতটি। এ সবের মাঝেই আল্লাহর বিধান নাযিল হয়। যেন তােমরা জানতে পার যে, আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে শক্তিমান এবং আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে জ্ঞানবান।’ এ সব কিছুই তালাকের বিধানের উপসংহার স্বরূপ। এভাবে আমরা এই ধাচের একটি পূর্ণাংগ সূরা দেখতে পাই, যা পারিবারিক জীবনের এই বিশেষ অবস্থা, তা থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমন্বয় ও সমাধান এবং জাগতিক ও মানসিক ক্ষেত্রে ঈমানের তত্ত্বগুলাের সাথে তার সংযােগ সাধনের ওপর কেন্দ্রীভূত। এটা ধ্বংসাত্মক অবস্থা, গঠনমূলক অবস্থা নয়। একটি পরিবারের ধ্বংস বা গঠন প্রক্রিয়া একটি রাষ্ট্রের ধ্বংস বা গঠন প্রক্রিয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এর একাধিক তাৎপর্য রয়েছে। এর সর্বপ্রথম তাৎপর্য হলাে ইসলামী বিধানে পরিবারের গুরুত্ব সংক্রান্ত। ইসলাম মূলত একটি পারিবারিক বিধান। পরিবার হচ্ছে মানুষের আশ্রয়স্থল ও মাথা গোঁজার ঠাই। এর আওতায়ই মানুষের স্নেহ, মমতা, সহানুভূতি, সৌজন্য, সৌহার্দ, পরিচ্ছন্নতা, পরস্পরকে আগলে রাখা ও পরস্পরের দুর্বলতা ঢেকে রাখার প্রশিক্ষণ পায়। এই পরিবেশেই মানুষের শৈশবের সূচনা ও যৌবনের উদ্ভব হয়। এখান থেকেই সঞ্চারিত হয় মমতার আবেগ ও পারস্পরিক একাত্মতার বন্ধন। এ কারণেই কোরআনের বিভিন্ন স্থানে পারিবারিক সম্পর্ককে এমন স্বচ্ছভাবে প্রস্ফুটিত করা হয়েছে যে, তা থেকে সহানুভূতি ও আত্মীয়তার বন্ধন স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন সূরা আররূমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তােমাদের জন্যে তােমাদের মধ্য থেকেই জোড়া সৃষ্টি করেছেন, যেন তােমরা তাদের কাছে বাস করতে পারাে, আর তােমাদের পরস্পরের মধ্যে দয়া ও মমতার সৃষ্টি করেছেন।’ সূরা আল বাকারায় বলা হয়েছে, ‘তারা তােমাদের জন্যে পােশাক স্বরূপ এবং তােমরা তাদের জন্যে পােশাক স্বরূপ।’ এর অর্থ দাঁড়ালাে এই যে, পরিবার হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের সংযােগ সেতু, স্থিতি ও বসবাসের সংযােগ সেতু, দয়া ও সহানুভূতির সংযােগ সেতু এবং দুর্বলতা আগলে রাখা ও সদাচারের সংযােগ সেতু। এ আয়াত দুটির ভাষা থেকেই স্নেহ-মমতার ভাব ফুটে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক ও সম্বন্ধের পূর্ণাংগ চিত্রই ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, যা ইসলাম পরিবারের ন্যায় দয়ামায়ার বন্ধনে আবদ্ধ অটুট মানবীয় সংগঠনটির ওপর ফরয করে দিয়েছে। একই সাথে এই মানবীয় সংগঠনটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলাে বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে মনুষ্য জীবনের সম্প্রসারণ। ইসলাম এই সকল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন বানায় এবং এর দাবী ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। সূরা বাকারার নিম্নোক্ত উক্তিতে এই ভাবধারা সুস্পষ্ট। যথা, ‘তােমাদের স্ত্রীরা তােমাদের জন্যে শস্যক্ষেত্র। সংখ্যাধিক্য ও উর্বরতার বিষয়টি এ উক্তিতে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইসলাম এই আশ্রয়স্থল প্রতিপালনস্থলকে নিজের সার্বিক প্রযত্ন ও তত্ত্বাবধানে লালন এবং সংরক্ষণ করে, আর ইসলামের সার্বিক প্রকৃতি অনুসারে এ ক্ষেত্রে সে শুধু আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত থাকে না, বরং আইনগত সংস্থাসমূহ আইনগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা দিয়েও তাকে সংহত করে। কোরআন ও সুন্নাহতে পরিবারের প্রতিটি অবস্থা সংক্রান্ত আইনগত বিধিসমূহে, সংশ্লিষ্ট নীতিগত নির্দেশাবলীতে, এতদসংক্রান্ত মন্তব্যসমূহে এবং এ বিষয়টি সরাসরি আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করার মধ্যে যে জিনিসটি পরিলক্ষিত হয় এবং যে জিনিসটি পূর্ণাংগভাবে উপলব্ধি করা যায়, তা হলাে, ইসলামী বিধি ব্যবস্থায় পরিবার অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ও আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। এ বিষয়টি এই সূরাতে যেমন বিদ্যমান, তেমনি অনান্য সূরাতেও বিদ্যমান। সূরা নিসায় আল্লাহর ব্যাপারে ও রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার ব্যাপারে একই সাথে সতর্ক থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। সূরা নিসার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মানব জাতি, তােমাদের সেই প্রতিপালককে ভয় করাে, যিনি তােমাদের একই মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন, একই মানুষ থেকে তার জোড়াও সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে বিপুল সংখ্যক পুরুষ ও নারীর বিস্তার ঘটিয়েছেন। যে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তােমরা পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে, তাকে ও রক্ত সম্বন্ধযুক্ত আত্মীয়দের ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তােমাদের তত্ত্বাবধায়ক।’ অনুরূপভাবে সূরা বনী ইসরাঈলে ও অন্যান্য সূরায় একই সাথে আল্লাহর এবাদাত ও পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের আদেশ দেয়া হয়েছে। সূরা বনী ইসরাঈলে বলা হয়েছে, ‘তােমার প্রতিপালক স্থির করেছেন যে, তােমরা তার ছাড়া আর কারাে এবাদাত করবে না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে।’ সূরা লােকমানেও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতার নির্দেশ একই সাথে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আমার শােকর করাে এবং তােমার পিতা মাতার।’ পরিবারকে এই সর্বোচ্চ গুরুত্বদান প্রকৃতপক্ষে পরিবারের ভিত্তিতে গােটা মানব জাতিকে গড়ে তােলার খােদায়ী পরিকল্পনার সাথে সংগতিপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, মানব জাতির প্রথম ভিত্তিমূল হবে আদম(আ.) ও তদীয় স্ত্রীর পরিবার এবং সেই পরিবার থেকে বহু সংখ্যক মানুষের সৃষ্টি হবে। আল্লাহ তায়ালা মাত্র কয়েকজন মানুষ থেকে এক সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ সৃষ্টি করতে পারতেন, কিন্তু এই সৃষ্টির জীবনে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকবে এটাই ছিলাে আল্লাহর প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য। পরিবারকে তিনি এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যেন তার সামগ্রিক জীবনধারা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের স্বভাব প্রকৃতি, সহজাত যােগ্যতা প্রতিভা এবং তার ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলীকে বিকশিত করে এবং তার জীবনে পরিবারের গভীরতম প্রভাব প্রতিফলিত হয়। অতপর এই একই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে পৃথিবীতে প্রেরিত আল্লাহর সর্বশেষ বিধান ইসলামী বিধানের প্রতি। এই বিধান মানব জাতির প্রথম সৃষ্টির সাথে সমন্বিত । আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছুই সৃষ্টি হয়, তার সাথে মানব সৃষ্টির একই রকম সংযোগ ও সমন্বয় রয়েছে। আলােচ্য সূরায় এবং কোরআনের সর্বত্র দাম্পত্য ও পারিবারিক সম্পর্ককে এত গুরুত্ব দেয়ার দ্বিতীয় তাৎপর্য এই যে, ইসলামী বিধান মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে সর্বোচ্চ পবিত্রতার মর্যাদা দিয়েছে। সে পবিত্রতা স্বয়ং আল্লাহর সাথে সংযােগের মহিমায় ভাস্বর । ইসলামী বিধান মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে শুধু যে সর্বোচ্চ পবিত্রতায় মন্ডিত করতে চায় তা নয়, বরং তাকে আধ্যাত্মিক পবিত্রতা ও চেতনাগত পরিচ্ছন্নতাদানের জন্যে পরিবারকে উপলক্ষ হিসাবে গ্রহণ করতে চায়। পৌত্তলিক আকীদা বিশ্বাস পােষণকারীর পরিবার সম্পর্কে ঠিক এর বিপরীত মনােভাব পােষণ করতাে। বিকৃত ধর্মের অনুসারীরাও আল্লাহর সৃষ্ট স্বভাব ধর্মের পরিপন্থী মনােভাব পােষণ করতাে। ইসলাম মানুষের প্রকৃতির দাবীকে প্রতিহত বা প্রত্যাখ্যান করে না এবং তা খারাপ বা অপবিত্রও মনে করে না। সে শুধু একে শৃংখলাবদ্ধ ও পরিশীলিত করে এবং পাশবিক স্তর থেকে উন্নীত করে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দেয়, যেখানে তা বহু সংখ্যক মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক সদাচারের উৎসে পরিণত হয় এবং যৌন সম্পর্ককে এতটা উন্নত মানবিক চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত করে, যে দৈহিক মিলনকে তা মানসিক, আন্তরিক ও আত্মিক মিলনে, এক কথায় দুইটি মানুষের মিলনে রূপান্তরিত করে। এ দুটি মানুষের জীবন, আশা আকাংখা, দুঃখবেদনা ও ভবিষ্যত ভাগ্য হয় সম্পূর্ণ অভিন্ন। ভাবী বংশধরের মধ্যেও সেই একই ভাবধারা প্রতিফলিত হয় যা কিনা একই গৃহে জন্ম গ্রহণ করে এবং যার রক্ষণাবেক্ষণ করে সেই গৃহেরই সন্তানেরা। (তাফসীর ফী যিলাল কোরআন, ১৮শ পারার ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য) ইসলাম বিয়েকে চরিত্রের পবিত্রতা, সততা ও উৎকর্ষ নিশ্চিত করার পন্থা ও মাধ্যম হিসাবে চিহ্নিত করে। ব্যক্তি বিশেষের জন্যে যখন অর্থাভাব বিয়ে করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তখন গােটা মুসলিম সমাজকে আহবান জানায় তার সদস্য পুরুষ ও মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে । সূরা নূরে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তােমাদের অবিবাহিত স্বাধীন পুরুষ ও মেয়েদের এবং বিবাহ যোগ্য দাস দাসীদের বিয়ে দাও। তারা যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকে তবে আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে তাদের সম্পদশালী বানিয়ে দিবেন। আল্লাহ তায়ালা তাে সব কিছু জানেন ও সব কিছু শােনেন। আর যারা বিয়ে করার আর্থিক সংগতি রাখে না, তারা যেন আল্লাহর অনুগ্রহে অভাব থেকে উদ্ধার না পাওয়া পর্যন্ত চরিত্রের হেফাযত করে।’ ইসলামী পরিভাষায় বিয়ের আর এক নাম এহসান- যার শাব্দিক অর্থ হলাে সংরক্ষণ। মােমেনদের মনে এ বিষয়টা চিরদিন বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, বিয়ে ছাড়া জীবন যাপন করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না- চাই তা যত ক্ষু্দ্র সময়ের জন্যেই হােক না কেন। রসূল(স.)-এর কন্যা ফাতেমার(রা.) এন্তেকালের অব্যবহিত পর হযরত আলী(রা.) যখন বিয়ে করার জন্যে তাড়াহুড়া করেন, তখন এই বলে তার ব্যাখ্যা দেন, ‘আমার আশংকা হয় যে, আমাকে বিপত্নীক অবস্থায় আল্লাহর সাথে দেখা করতে হবে।’ এ থেকে বুঝা যায়, বিয়ে একজন মােমেনের কাছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সিড়িরূপে গণ্য একটি এবাদাত বিশেষ। আর এ কারণে দাম্পত্য সম্পর্কও তার বিবেকের দৃষ্টিতে আল্লাহর এবাদাতের ন্যায় পবিত্র। সূরা তালাক ও অনুরূপ অন্যান্য সূরার বক্তব্যের তৃতীয় তাৎপর্য এই যে, এ দ্বারা ইসলামী বিধানের বাস্তবতা এবং মানুষ ও পার্থিব জীবনের প্রতি তার স্বভাবসুলভ আচরণ প্রমাণিত হয়। সেই সাথে এও প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম মানবতাকে অত্যন্ত সম্মানজনক স্তরে পৌছিয়ে দিতে চায়, আর সেটা করতে চায় তার সহজাত যোগ্যতা ও জীবনের বাস্তব সমস্যাবলীর মধ্য দিয়েই। এ জন্যে বিবেকনির্ভর এই বিষয়টি সম্পর্কে সে শুধু আইন জারি করেই ক্ষান্ত হয় না। শুধু উপদেশ দেয়াকেও যথেষ্ট মনে করে না; বরং মানব সত্ত্বার ও জীবনের বাস্তবতার মােকাবেলায় সে এই দুটিকেই কাজে লাগায়। দাম্পত্য সম্পর্কের মূল কথা হলাে স্থিতি ও স্থায়িত্ব। ইসলাম দাম্পত্য সম্পর্কের স্থিতি ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারে এমন সব ক’টি উপকরণ সরবরাহ করে, আর এ উদ্দেশ্যেই সে বিয়ে ও দাম্পত্য সম্পর্ককে এবাদাতের মর্যাদা দেয়। যে নর নারী দারিদ্রের কারণে বিয়ে করতে পারে না, তাদের সে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে সাহায্য করে। দাম্পত্য প্রেম প্রণয় যাতে স্থায়ী হয় এবং পথেঘাটে ও বাজারে রূপের প্রদর্শনী করার দিকে মন যাতে আকৃষ্ট না হয়, সে জন্যে বিপথগামিতা ও উচ্ছৃংখল আচরণ প্রতিরােধকারী বিধিনিষেধ (পর্দার বিধান) আরােপ করে। একই উদ্দেশ্যে সে ব্যভিচার ও ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরােপের বিরুদ্ধে দন্ডবিধি জারি করে। কোনাে গৃহে বহিরাগতের বিনা অনুমতিতে প্রবেশ ও গৃহের অভ্যন্তরেও পরিবারের সদস্যদের একে অপরের শয়নকক্ষে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে গৃহকে নিরাপদ, পবিত্র ও কলুষমুক্ত করে। সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা ইসলাম দাম্পত্য সম্পর্ককে সুশৃংখল বানায় এবং গৃহ ব্যবস্থাপনা দম্পতির যে সদস্য অধিকতর যােগ্য ব্যবস্থাপক তার নিয়ন্ত্রণে সোপর্দ করে, যাতে তা অরাজকতা, উচ্ছৃংখলতা ও বিবাদ-বিসম্বাদ থেকে রক্ষা পায়। আবেগ উদ্দীপক উপদেশ প্রদান ও আল্লাহভীতির চেতনা সৃষ্টি ছাড়াও আরাে যতাে রকম নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব, তা প্রদান করে ইসলাম পরিবারকে সর্বপ্রকার দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু মানব জীবনের বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, সকল রকমের নিশ্চয়তা ও উপদেশাবলী সত্তেও কখনাে কখনাে এমন কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে, যা দাম্পত্য সম্পর্কের ধ্বংস ও বিনাশ অনিবার্য করে তােলে। এ ধরনের পরিস্থিতি বাস্তবানুগভাবে মােকাবেলা না করে উপায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হয় এবং তা অস্বীকার করে কোনাে লাভ হয় না। কেননা, দাম্পত্য জীবন যাপন তখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা বৃথা ও ভিত্তিহীন হয়ে দাঁড়ায়। ইসলাম কখনাে পবিত্র দাম্পত্য সম্পর্ককে নিয়ে এতাে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে না যে, প্রথম সুযােগেই এবং দাম্পত্য কলহের প্রথম ধাক্কাতেই তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। সে বরঞ্চ এ সম্পর্ককে মযবুত করে এবং সর্বাত্মক চেষ্টার পর নিরাশ হওয়া ছাড়া তাকে ধ্বংস হতে দেয় না। ইসলাম পুরুষকে আহবান জানায়, ‘স্ত্রীদের সাথে সদাচরণ করাে। তাদের যদি তােমাদের অপছন্দ হয়, তবে এমন কোনাে কোনাে জিনিস তোমাদের অপছন্দ হবে, যাতে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের জন্যে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন।’ এভাবে ইসলাম চরম অপ্রীতিকর অবস্থায়ও ধৈর্য সহনশীলতার পথে পুরুষদের পরিচালিত করে এবং অপছন্দনীয় নারীর মধ্যেও কল্যাণের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত রাখে। বস্তুত অপছন্দনীয় স্ত্রীদের মধ্যেও যে আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে কোনাে কল্যাণ রাখেননি, সে কথা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না। আর তা যখন কেউ বলতে পারে না, তখন কল্যাণকে হারানাে কিভাবে সমীচীন হতে পারে? অপছন্দের মনােভাব পরিবর্তন করা, তার কুফল প্রতিরােধ করা এবং ভালােবাসা ও অনুরাগ পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে এর চেয়ে অলংকার সমৃদ্ধ ভাষা আর হতে পারে না। যা হােক, পরিস্থিতির যদি এতােদূর অবনতি ঘটে যে, পছন্দ অপছন্দের স্তর পেরিয়ে বিদ্রোহ ও ঘৃণার পর্যায়ে উপনীত হয়, তাহলেও ইসলাম প্রথম চোটেই তালাকের দিকে ধাবিত হয় না। সে বরঞ্চ তৃতীয় পক্ষের শুভাকাংখীদের জন্যে চেষ্টা তদবীর ও আপােষ মীমাংসার একটা সুযােগ রাখা অপরিহার্য মনে করে। সূরা নিসায় বলা হয়েছে, ‘তাদের মধ্যে তােমরা যদি অ-বনিবনার আশংকা করাে, তাহলে স্বামীর পক্ষ থেকে একজন সালিস এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন সালিস পাঠাও। তারা দুজনে যদি সংশােধন কামনা করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে বনিবনা সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা তাে সর্ববিষয়ে জ্ঞানী ও অবগত।’ আর কোনাে স্ত্রী যদি নিজের স্বামীর পক্ষ থেকে উপেক্ষা ও দাম্ভিকতার আশংকা করে, তা হলে তারা নিজেদের মধ্যে আপােষ-মীমাংসা করিয়ে নিলেও মন্দ হয় না। আপােষই সর্বোত্তম। কিন্তু এই মধ্যস্থতার সুযােগ যদি না পাওয়া যায়, তাহলে ব্যাপারটি গুরুতর হতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখার চেষ্টাও ব্যর্থ হবে। জোর-জবরদস্তিতে ব্যর্থতা আরাে প্রকট আকার ধারণ করবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের কাছে অপছন্দনীয় হওয়া সত্তেও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটানাে বিজ্ঞতার পরিচায়ক। মনে রাখতে হবে যে, তালাক আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত হালাল অতপর যদি স্বামী তালাক দেয়ার সিদ্ধান্তই নেয়, তাহলেও যখন ইচ্ছা তখন তালাক দেয়া যায় না। ইসলামী রীতি এই যে, তালাক দিতে হবে এমন অবস্থায়, যখন স্ত্রী ঋতুস্রাব থেকে পবিত্রতা অর্জন করেছে, কিন্তু পবিত্রতার এই মেয়াদে এখনাে স্বামীর সাথে সহবাস সংঘটিত হয়নি। এই মেয়াদটিতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়াও বিচিত্র নয় যে, ক্রোধ ও উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়ে যাবে। এমনকি উভয়ের মন পাল্টেও যেতে পারে এবং আল্লাহ তায়ালা উভয় বিবাদীকে আপোষ রফায় উদ্বুদ্ধ করে দিতেও পারেন। ফলে, তালাক হয়তাে আর সংঘটিতই হবে না। আর যদি তালাক সংঘটিত হয়েও যায়, তবে এর পরই আসে ইদ্দতের মেয়াদ । ইদ্দত হচ্ছে ঋতুবতী ও সন্তান ধারণে সক্ষম মহিলার জন্যে তিনটি পবিত্রাবস্থা, আর এখনাে রজস্রাব হয়নি এমন অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়ের জন্যে এবং আর কখনাে সন্তান হবে না এমন মহিলার জন্যে তিন মাস। আর গর্ভবতীদের জন্যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত। এই ইদ্দতকালে যদি ভালােবাসার আবেগ পুনরুত্থিত হয়, তবে তালাকের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করারও অবকাশ সৃষ্টি হতে পারে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক পুনর্বহালের ইচ্ছা জাগ্রত হতে পারে। কিন্তু এতাে সব ব্যবস্থা সত্তেও বিচ্ছেদ সংঘটিত হওয়া অসম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া অনিবার্য হয়ে দেখা দিতে পারে, যার মােকাবেলায় ইসলামকে বাস্তবানুগ কর্মপন্থা অবলম্বন করা জরুরী হয়ে পড়তে পারে এবং সে জন্যে তাকে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্যেই তালাকের বিস্তারিত বিধান দেয়া হয়েছে, যা এ কথাই প্রমাণ করে যে, ইসলাম জীবন সমস্যার সমাধানে অত্যন্ত বাস্তবানুগ। সেই সাথে সে মানুষকে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যেতে উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষলাভে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। এই সূরার সামগ্রিক বক্তব্য- যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে উদ্বুদ্ধকরণ, সতর্কীকরণ, খুঁটিনাটি বিধি ও মন্তব্য ইত্যাদি। এ সবের চতুর্থ তাৎপর্য এই যে, এগুলাে মুসলমানদের সমাজে উদ্ভূত সেসব পরিস্থিতির মােকাবেলা করে, যা ছিলাে জাহেলিয়াতের গ্লানিময় উত্তরাধিকার। নারীরা যে দুর্দশা ও বিকৃতির শিকার ছিলাে, তার প্রতিকারের জন্যে এতাে সব খুঁটিনাটি ও বিস্তারিত বিধি দেয়া হয়েছিলাে, যার ফলে নারীদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলার, দাম্পত্য জীবনে কোনাে অরাজকতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও নরনারীর সম্পর্কের ব্যাপারে আর কোনাে পশ্চাদমুখী ধ্যানধারণার অবকাশ থাকেনি। (তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন, ৪র্থ ও ২১শ পারা দ্রষ্টব্য)। এ পরিস্থিতি শুধু আরব উপদ্বীপেই বিরাজ করতাে না। তৎকালীন গােটা বিশ্বেরই অবস্থা ছিলাে এরূপ। পৃথিবীর সকল অঞ্চলে তখন নারীর অবস্থা ছিলাে ক্রীতদাসীর মতাে বা তার চেয়েও খারাপ। উপরন্তু নরনারীর যৌন সম্পর্ককে একটা নােংরামি হিসাবে দেখা হতাে এবং নারীকে দেখা হতাে এই নােংরামির প্রেরণাদানকারী শয়তানরূপে। বিশ্বব্যাপী এই শােচনীয় মানবেতর অবস্থা থেকে নারীকে ও দাম্পত্য সম্পর্ককে মুক্ত করে ইসলাম সেই অত্যুচ্চ মানে উন্নীত করেছিলাে, যার বর্ণনা ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে। নারীকে সে এমন সম্মান মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অধিকার দান করেছিলাে, যা তার কপালে ইতিপূর্বে আর কখনাে জোটেনি। এখন নারী শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাকে কেউ মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলে না, কেউ তার দিক থেকে অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নেয় না। এখন তাকে কেউ তার বিনা অনুমতিতে বিয়ে করতে চায় না, চাই সে কুমারী কিংবা অকুমারী যা-ই হােক না কেন। এখন গৃহবধু হলে সে আইনসংগত অধিকারের চেয়েও অনেক বেশী অধিকার ও মর্যাদাসম্পন্ন। আর তালাকপ্রাপ্তা হলেও তার অনেক অধিকার, যার বিবরণ এই সূরায়, সূরা বাকারায় এবং অন্যান্য সূরায় রয়েছে। ইসলাম নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্যে এতাে সব আইন রচনা এজন্যে করেনি যে, আরব দেশে ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নারীরা তাদের মানবেতর অবস্থা উপলব্ধি করে বিক্ষুব্ধ ছিলাে অথবা নারীদের এই পরিস্থিতি দেখে পুরুষরা অসন্তুষ্ট ছিলাে, কিংবা নারী অধিকার সংরক্ষণের জন্যে কোনাে আন্তআরব বা আন্তর্জাতিক নারী সংস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠেছিলাে। কিংবা নারীরা কোনাে পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছিলাে, বা নারীদের পরিস্থিতি উন্নয়নে কোনাে আন্দোলন শুরু হয়েছিলাে। এটা ছিলাে পৃথিবীবাসীর জন্যে আল্লাহর দেয়া অযাচিত বিধান ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ন্যায়বিচার। এটা ছিলাে আল্লাহর এই ইচ্ছার প্রতিফলন যে, মানুষের জীবন বিরাজমান মানবেতর অবস্থা থেকে উন্নীত হােক, দাম্পত্য সম্পর্ক জাহেলী যুগের নােংরামি থেকে পবিত্র হোক, একই মানব সত্ত্বা থেকে উদ্ভূত দম্পতি মানব সুলভ মর্যাদা ও অধিকার অর্জন করুক। কারণ এ হচ্ছে আল্লাহর মহান ও মহিমানবিত দ্বীন। এ দ্বীনকে কেবল সে ব্যক্তিই অগ্রাহ্য করতে পারে, যার বিবেক বিকৃত ও বিনষ্ট হয়ে গেছে। আল্লাহর বিধান পরিত্যাগ করে মানব রচিত বিধান কেবল সে ব্যক্তিই গ্রহণ করতে পারে, যে দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেয় এবং আপন কূ-প্রবৃত্তির গােলামী করে। এই প্রাসংগিক আলােচনা যা এই পারার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট থেকে এবং ইসলামী সমাজ গঠনের বিষয় থেকে অনেক বেশী দূরে অবস্থান করে না- এখানেই শেষ হচ্ছে। অতপর সূরায় আলােচিত বিধিসমূহ নিয়ে আমরা একে একে আলােচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি। সূরায় আলােচিত বিধিসমূহ আমাদের আলােচিত সংক্ষিপ্তসার থেকে ভিন্ন। এগুলাে জীবন্ত, চলন্ত, উদ্দীপনাময় ও প্রেরণাময় বিষয়। এ সব বিধান ফিকহের গ্রন্থাবলীতে অধ্যয়ন করা ও কোরআনে অধ্যয়ন করার মূল পার্থক্য এখানেই নিহিত।

ফী জিলালিল কুরআন:-

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী, তােমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দেবে, তখন তাদের ইদ্দত…'(আয়াত-১)  *তালাক সংক্রান্ত কিছু বিধান : এ হচ্ছে প্রাথমিক স্তর। এ হচ্ছে রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে প্রদত্ত প্রথম বিধি। প্রথমে ‘হে নবী’ বলার পরক্ষণেই স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, বিধিটা ব্যক্তিগতভাবে শুধু রসূলের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। তাই বলা হয়েছে, তােমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দেবে…’ এ দ্বারা প্রকারান্তরে এই বিধির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিধিটা গুরুত্বপূর্ণ বিধায় ব্যক্তিগতভাবে নবীর কাছে প্রেরণ করা হয়েছে যেন তিনি অন্যদেরকে তা অবহিত করেন। যখন তােমরা স্ত্রীদের তালাক দেবে, তখন তাদের ইদ্দত পর্যন্ত তালাক দিয়ো।- এই উক্তির ব্যাখ্যা প্রসংগে সহীহ বােখারী শরীফে নিম্নোক্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে, ‘হযরত ওমরের পুত্র আবদুল্লাহ হযরত ওমরকে জানালেন যে, তিনি স্বীয় স্ত্রীকে ঋতুবতী অবস্থায় তালাক দিয়েছেন। হযরত ওমর ব্যাপারটা রাসূল(স.)-কে জানালে তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন, তার উচিত তালাক প্রত্যাহার করা এবং স্ত্রীকে বহাল রাখা, যতােক্ষণ না সে পবিত্র হয়, অতপর পুনরায় ঋতুবতী হয় ও তারপর পুনরায় পবিত্র হয়। এরপর যদি তার তালাক দিতেই ইচ্ছা হয়, তাহলে তাকে স্পর্শ না করেই তালাক দেবে। এই হচ্ছে সেই ইদ্দত, যা পালন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা আদেশ দিয়েছেন।’ মুসলিম শরীফেও এই হাদীস এসেছে। তার ভাষা এরূপ, এই হচ্ছে সেই ইদ্দত, যার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আদেশ দিয়েছেন যে, তােমরা ইদ্দত পর্যন্ত তালাক দাও।’ এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়, তালাক দেয়ার জন্যে সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। স্ত্রী ঋতু থেকে পবিত্র হওয়ার পর বিনা সহবাসেই তালাক দিতে হবে। অন্যান্য হাদীস থেকে জানা যায় যে, তালাক দেয়ার আরাে একটা বৈধ অবস্থা আছে। সেটি হলাে, সুস্পষ্ট গর্ভ ধারণকালীন অবস্থা। একটা নির্দিষ্ট মেয়াদে এ কাজটি সীমিত করার পেছনে যে মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে তা এই যে, প্রথমত মনে তালাকের খেয়াল উদিত হওয়ার মুহূর্তে যে উত্তেজনা বিরাজ করছিলাে, তালাকের ঘােষণা বিলম্বিত হলে সেই উত্তেজনা প্রশমিত হবার আশা করা যায়। তা ছাড়া তালাকের পূর্বে স্ত্রী গর্ভবতী কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার সুযােগ পাওয়া যায়। স্বামী যদি জানতে পারে যে, তার স্ত্রী গর্ভবতী, তা হলে তালাক দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারে, কিন্তু গর্ভাবস্থা জানার পরেও যদি সে তালাকের ব্যাপারে এগিয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে, গর্ভবতী হলেও স্ত্রীকে তালাক দিতে সে বদ্ধপরিকর। তাই সহবাসবিহীন পবিত্রাবস্থার শর্তারােপের উদ্দেশ্য হলাে গর্ভাবস্থা না থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। আর গর্ভাবস্থা স্পষ্ট হওয়ার শর্তারােপের উদ্দেশ্য হলাে গর্ভ থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। পরিবার নামক ভবনের দৃশ্যমান ভগ্নদশা মেরামত করা ও তার ওপর আরাে কুড়াল চালনা ঠেকানাের জন্যে এটি হলো প্রাথমিক চেষ্টা। এর অর্থ এটা নয় যে, এই সময়ে তালাক দিলে তা কার্যকর হবে না। তালাক যখনই দেয়া হােক তা কার্যকর হবে (এটা অধিকাংশ ফেকাহবিদদের অভিমত। কারাে কারাে মতে এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যতীত তালাক কার্যকরই হবে না)। তবে আল্লাহর দৃষ্টিতে তা হবে ঘৃণিত কাজ। রসূল(স.)-এর দৃষ্টিতে তা হবে ধিকৃত কাজ। এ বিধি মােমেনের বিবেককে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধৈর্যধারণ ও আত্মসংবরণে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে যথেষ্ট। নির্দিষ্ট সময় এলে আল্লাহ যা চান তাই হবে। আর ইদ্দত গণনা করাে। কেননা, ইদ্দত গণনা না করলে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর অপেক্ষার মেয়াদ প্রলম্বিত এবং ইদ্দতের পরেও তার বিয়ে ঠেকিয়ে তার ক্ষতি সাধন করা হতে পারে। আবার ইদ্দতের মেয়াদ কমে গিয়ে গর্ভাবস্থা সন্দেহযুক্ত হয়ে যেতে পারে এবং তাতে গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে। গণনার মাধ্যমে সঠিক সময় নির্ণয়ের নির্দেশ থেকে বুঝা যায় যে, বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এটি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন ও সঠিক হিসাব দাবী করেন। ‘তােমরা আল্লাহকে ভয় করাে, যিনি তােমাদের প্রতিপালক। স্ত্রীরা সুস্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত না তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করাে না, আর তাদেরও বেরিয়ে যাওয়া উচিত নয়।’ প্রথমোক্ত সম্বোধনের পর এটা প্রথম হুঁশিয়ারি। স্ত্রীদের গৃহ থেকে বের করার নিষেধাজ্ঞা জারির আগে এটাই প্রথম সর্তকবাণী এবং আল্লাহকে ভয় করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরােপমূলক নির্দেশ। গৃহ যদিও স্বামীর, কিন্তু স্ত্রীদের গৃহ’ বলার উদ্দেশ্য হলাে ইদ্দতকালে তাদের বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করা। বর্ণিত আছে, যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হলে গৃহ থেকে বহিষ্কার করা যাবে তা ব্যভিচারও হতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যভিচারের শরীয়ত বিহিত শাস্তি কার্যকর করার জন্যে তাকে বের করতে হবে। আবার তা স্বামীর লােকদের কষ্ট দেয়া বা তালাকপ্রাপ্তা হয়েও স্বামীর বিরুদ্ধে উদ্ধত আচরণ ও কষ্টদায়ক আচরণও হতে পারে। কারণ, তালাকদত্তাকে স্বামীর বাড়ীতে থাকতে দেয়ার নির্দেশের পেছনে এই সদুদ্দেশ্য সক্রিয় ছিলাে যে, হয়তাে বা তালাক প্রত্যাহারের সুযােগ সৃষ্টি হবে। হয়তাে বা পুরনাে প্রেম ভালােবাসা পুনরুজ্জীবিত হবে অথবা অতীতের সুখময় স্মৃতি আবার জেগে ওঠবে। তালাকের কারণে স্বামী দূরে থাকলেও উভয়ে উভয়ের দৃষ্টিপথে থাকবে, ফলে তা স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন যাপনের সময় যেমন আবেগের সঞ্চার করতাে, তেমনি আবেগের সঞ্চার করে বসতে পারে, কিন্তু যদি স্বামী গৃহে বাস করা কালেও সে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, কিংবা তার লােকজনকে জ্বালাতন করে, অথবা তার সাথে খারাপ আচরণ করে, তাহলে আর সম্পর্ক উন্নয়ন, উত্তম ভাবাবেগ জাগ্রত হওয়া ও প্রেম-ভালোবাসার পুনরুজ্জীবনের কোনাে অবকাশ থাকতে পারে না। এরূপ ক্ষেত্রে ইদ্দতকালে তাকে স্বামীর বাড়ীতে থাকতে দেয়ার কোনাে সার্থকতা নেই। কেননা, তার স্বামীর সান্নিধ্যে অবস্থান তাদের সম্পর্ক আরাে ছিন্ন করবে। পুনরুজ্জীবিত করবে না। এ হচ্ছে আল্লাহর সীমানা। আল্লাহর সীমানা যে লংঘন করে সে নিজের ওপরই যুলুম করে। এ হচ্ছে দ্বিতীয় হুঁশিয়ারী। বস্তুত আল্লাহর এ আদেশ তদারকদারী আল্লাহ তায়ালা নিজেই। আল্লাহ তায়ালা নিজেই যে বিধির তদারক করছেন, তা লংঘন করার ধৃষ্টতা কোন্ মােমেন দেখাবে? এ রকম ধৃষ্টতার পরিণতি ধ্বংস ও বিনাশ ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ তায়ালার আদেশ লংঘন করে সে আল্লাহর আযাব ভােগ করার যােগ্যতা অর্জন করে। এটাই তার নিজের ওপরে যুলুম করার তাৎপর্য। সে তার স্ত্রীকে যুলুম করে নিজের আযাব ডেকে আনে। এটাই তার নিজের ওপর যুলুম । কেননা, তার স্ত্রী ও সে একই আদমের সন্তান। কাজেই যে কাজে স্ত্রীর ওপর যুলুম হয়, সে কাজে স্বয়ং স্বামীর ওপরও যুলুম হয়। তুমি জানাে না হয়তাে আল্লাহ তায়ালা এরপর নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাবেন।’ এটি একটি তাৎপর্যপূণ আভাস। বস্তুত আল্লাহর ইদ্দত পালনের আদেশদান এবং স্ত্রীদের স্বগৃহে বাস করতে দেয়ার আদেশদানের পেছনে আল্লাহর কী পরিকল্পনা ও কোন্ প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে কে জানে? স্পষ্টতই মনে হয়, এর পেছনে কোনাে আশার হাতছানি রয়েছে। হতে পারে পুরাে ব্যাপারটাই কল্যাণময়। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে এবং অসন্তোষ ও রাগ সন্তোষে পরিণত হতে পারে। আল্লাহর অদৃশ্য পরিকল্পনা সব সময় চলমান, পরিবর্তনশীল ও ঘটনাবহুল। আল্লাহর আদেশ ও পরিকল্পনার কাছে আত্মসমর্পণই সর্বোত্তম কাজ। তাঁর ভয়ে ভীত থাকাতেই সঠিক কল্যাণ নিহিত। মানুষের মন প্রায়ই বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, বর্তমানের সমস্যা ও পরিস্থিতিতেই সে নিমজ্জিত থাকে। ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে সাধারণত তার কোনাে ধারণা থাকে না। বর্তমানের কারাগারেই সে আবদ্ধ থাকে। সে ভাবে যে, বর্তমানই চিরস্থায়ী এবং এটাই সব সময় তার সংগে লেগে থাকবে। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক কারাগার, যা প্রায়ই চেতনাকে নিশ্চল ও বিকল করে দেয়। অথচ এ ধারণা সত্য নয়। আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য সব সময় সক্রিয়। সব সময় পরিবর্তনশীল এবং সব সময় মানুষ যা কল্পনাও করতে পারে না তাই সংঘটিত হয়ে থাকে। সংকীর্ণতার পর আনে প্রশস্ততা এবং সংকটের পর আনে সমাধান। আল্লাহ তায়ালা প্রতিদিনই ভিন্ন ধরনের কাজে নিয়ােজিত থাকেন। সে কাজ প্রথমে অদৃশ্য থাকে। অতপর তা তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। আল্লাহ তায়ালা চান এই সত্য মানুষের অন্তরে বদ্ধমূল থাকুক, যাতে তারা সর্বদা সেই জিনিসের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে, যা তিনি প্রতিনিয়ত সংঘটিত করে চলেছেন, যাতে পরিস্থিতি পরিবর্তনের আশার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত থাকে, যাতে তাদের মন সব সময় আশান্বিত থাকে এবং শুধুমাত্র বর্তমানের কারাগারে বন্দী না থাকে। প্রতিটি নবাগত মুহূর্তে মানুষ যা ভাবতেও পারে না তাই সংঘটিত হতে পারে। এ কথাই বলা হয়েছে আয়াতের শেষাংশে, ‘তুমি জান না হয়তাে বা আল্লাহ তায়ালা তারপর নতুন কিছু সংঘটিত করতে পারেন।’ সূরার দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াত লক্ষণীয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতপর স্ত্রীরা যখন তাদের ইদ্দত পূরণ করবে, তখন হয় তাদের ভালােভাবে রেখে দাও, নচেত ভালােভাবে বিচ্ছিন্ন করে দাও’ এ হচ্ছে দ্বিতীয় পর্যায় এবং এই দ্বিতীয় পর্যায়ের করণীয় কী তাও এখানে বলে দেয়া হয়েছে। ইদ্দত পূরণ করা বলতে বুঝায় ইদ্দতের মেয়াদ শেষ করা। তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর যে কয়েক প্রকারের ইদ্দতের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সেই ইদ্দতের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার আগে স্বামীর তালাক প্রত্যাহারের অধিকার রয়েছে। আর তালাক প্রত্যাহারই হচ্ছে স্ত্রীকে বহাল রাখা। স্বামীর এ অধিকারও আছে যে, ইদ্দত অতিবাহিত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তালাকের সিদ্ধান্তে অটল থাকা। এটা করলে স্ত্রী চূড়ান্তভাবে তার বিয়ে বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং নতুন স্ত্রী হিসাবে তাকে নতুনভাবে বিয়ে না করা পর্যন্ত সে স্বামীর জন্যে হালাল হবে না। আর স্ত্রীকে বহাল রাখুক বা বিচ্ছিন্ন করে দিক- উভয় অবস্থায় তার সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করার জন্যে স্বামীকে আদেশ দেয়া হয়েছে। তালাক প্রত্যাহার করে স্ত্রীর ক্ষতি করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইদ্দত শেষ হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে তালাক প্রত্যাহার করলাে, অতপর পুনরায় দ্বিতীয় তালাক দিলাে, পুনরায় একই কায়দায় তৃতীয় তালাক দিলাে, যাতে তাকে অবিবাহিতা অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়। অথবা তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেয়ার জন্যে তালাক প্রত্যাহার করলাে এবং স্ত্রী যাতে মুক্তিপণ দিয়ে তার কাছ থেকে অব্যাহতি পেতে সচেষ্ট হয়, সে জন্যে চক্রান্ত করলাে। এই সূরা নাযিল হবার সময় উক্ত উভয় প্রকারের অবস্থারই সৃষ্টি হতাে। আসলে মানুষের মনে যখনই আল্লাহভীতির অভাব দেখা দেয়, তখনই উক্ত দুই রকমের যুলুম চলে। দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্ব কিংবা বিচ্ছেদ উভয় অবস্থায়ই ইসলামের বিধান সঠিকভাবে প্রতিফলিত হওয়ার প্রধান গ্যারান্টি হলাে এই আল্লাহ ভীতি। অনুরূপভাবে তাকে গালিগালাজ, তিরস্কার, ধিক্কার, কটুবাক্য বর্ষণ ও ক্রোধ ইত্যাদির মাধ্যমে নির্যাতন করতেও নিষেধ করা হয়েছে। হৃদয়ের ভালােবাসা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে হবে সহৃদয়তার সাথে। আর অবসান ঘটাতে হলে তাও ঘটাতে হবে সৌজন্যের মধ্য দিয়ে। কেননা, স্ত্রী এক সময় স্বামীর কাছে ফিরেও আসতে পারে। সুতরাং এমন কোনাে তিক্ত স্মৃতি রেখে দেয়া উচিত নয়, যা তার প্রত্যাবর্তনের পর সম্পর্ক কলুষিত করে তুলবে। তা ছাড়া ইসলাম মানুষের মুখ ও মনকে যে ভদ্রতা শিক্ষা দেয়, তার দাবীও এই যে, যাই করা হােক ভদ্রজনােচিতভাবে ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে করতে হবে। বিচ্ছেদ অথবা তালাক প্রত্যাহার যেটাই ঘটুক তাতে দুজন সৎলােকের সাক্ষ্য গ্রহণ করতেই হবে, যাতে কোনাে সন্দেহের অবকাশ না থাকে। কেননা, লােকেরা হয়তাে তালাকের খবর জেনেছে, কিন্তু তালাক প্রত্যাহারের খবর জানতে পারেনি। তেমনটি হলে নানা রকমের সন্দেহ ছড়িয়ে পড়বে এবং নানা রকম গুজব রটবে। ইসলাম চায় মানুষের মনে ও মুখে দাম্পত্য সম্পর্কের প্রশ্নে পূর্ণ স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা বিরাজ করুক। কিছু কিছু ফেকাহ শাস্ত্রকারের মতে তালাক প্রত্যাহার বা বিচ্ছেদ সাক্ষী ছাড়াও কার্যকরি হয়ে যায়। অন্যদের মতে হয় না। তবে বিচ্ছেদ অথবা প্রত্যাহার উভয়টির পরে বা সাথে সাথে সাক্ষ্য নেয়া যে জরুরী, সে ব্যাপারে দ্বিমত নেই। আদেশ দেয়ার পর এর সাথে সংশ্লিষ্ট সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে মনােযােগ আকর্ষণ করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর জন্যে সাক্ষী সংগ্রহ করাে।’ বস্তুত তালাকের পুরাে ঘটনাটা তাে আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট। আর এতে সাক্ষী সাবুদ আল্লাহরই জন্যে। তিনিই এর আদেশ দিচ্ছেন। সাক্ষ্য কেমন টেকসই তাও তিনিই পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এর প্রতিফলও তিনিই দেবেন। এই সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে যা কিছু তৎপরতা সংঘটিত হবে, তা আল্লাহর সাথেই হবে, স্বামী, স্ত্রী বা জনগণের সাথে নয়। এ উপদেশ দেয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তিকে, যে আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতে বিশ্বাসী।’ তালাক সংক্রান্ত এই সকল নির্দেশ আখেরাতে ও আল্লাহতে যারা বিশ্বাসী, তাদের ওপরই জারি করা হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, তিনি তাদের এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা তাদের জন্যেই উপযােগী। আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের ওপর তাদের ঈমান যদি সত্যিকার ঈমান হয়ে থাকে, তাহলে এ উপদেশ দ্বারা তারা উপকৃত হবে ও শিক্ষা গ্রহণ করবে। এটা তাদের ঈমানের ও ঈমানের দাবীর সত্যতা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে একটা মুক্তির পথ বের করেন এবং সে কল্পনাও করতে পারে না এমন উপায়ে তাকে রিযিক দান করেন। মুক্তির পথ’ দ্বারা বুঝানাে হয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের সংকীর্ণতা অশান্তি থেকে মুক্তির পথ। আর কল্পনাও করতে পারে না এমন উপায়ে রিযিক দেয়া দ্বারা বুঝানাে হয়েছে, যে রিযিকের আশা করা যায় না এবং যে রিযিক উপার্জন করার পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এটা একটা সাধারণ ব্যাপার ও চিরন্তন সত্য। কিন্তু এটিকে তালাকের বিধানের সাথে যুক্ত করে বুঝানাে হয়েছে যে, এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে যখন আল্লাহভীরু লােকেরা আল্লাহকে ভয় করে চলে, তখন এ সত্য অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত হয়। এটি এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে বিবেক ও চেতনা যেমন নির্ভুল নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করে, তেমন আর কোনাে শক্তি করে না। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার সুযােগ অত্যন্ত ব্যাপক। আল্লাহর ভয় ও বিবেকের সচেতনতা ছাড়া এই স্বেচ্ছাচারিতা রােধ করার আর কোনাে উপায় নেই। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, তার জন্যে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেই ছাড়েন। দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছলচাতুরী ও চক্রান্তের সুযোগ খুবই প্রশস্ত এবং তার উপায়ও অনেক রয়েছে। এমনকি এ ক্ষেত্রে ছলচাতুরী থেকে বাঁচার চেষ্টা করলেও কখনাে কখনাে আরেক ধরনের ছলচাতুরীর শিকার হতে হয়। তাই এখানে এই মর্মে ইংগিত করা হচ্ছে যে, সম্ভাব্য ছলচাতুরী থেকে বাঁচার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল তথা নির্ভর করা উচিত। কেননা, আল্লাহর ওপর যে তাওয়াক্কুল করে তার জন্যে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট। আর আল্লাহ তায়ালা যে সিদ্ধান্ত নেন তা করেই ছাড়েন। তিনি যা স্থির করেন তা বাস্তবায়িত না হয়ে যায় না। তিনি যা চান তা কার্যকর হওয়া অবধারিত। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের অর্থই হচ্ছে এমন মহাশক্তিধর সত্ত্বার ওপর তাওয়াক্কুল করা, যিনি নিজের ইচ্ছা অবশ্যই কার্যকর করেন। কথাটা তালাক প্রসংগে বলা হলেও সকল ব্যাপারেই তা প্রযােজ্য। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো মানুষের মনে আল্লাহর ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিশুদ্ধ ধারণা এবং বিশ্বাস সৃষ্টি করা তবে তালাক প্রসংগে এ কথাটা বলা বিশেষ
তাৎপর্যবহ। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকটি জিনিসের জন্যে একটা মাত্রা নির্ধারণ করেছেন।’ অর্থাৎ সব কিছুরই নির্দিষ্ট পরিমাণ, সময়, স্থান, পরিবেশ, পরিস্থিতি, সমস্যা, ফলাফল ও কারণ রয়েছে। কোনাে কিছুই কাকতালীয় বা আকস্মিক নয়- চাই তা মহাবিশ্বের কোনাে জিনিস হােক, অথবা মানুষের সত্ত্বার অভ্যন্তরের কিছু হােক। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার ওপর ইসলামী চিন্তাধারার একটা বিরাট অংশের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত (সূরা ফোরকানে তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং তার একটা পরিকল্পনা ও মাত্রা নির্ধারণ করেছেন আর সূরা কামারে আমি প্রতিটি জিনিসকে একটি মাত্রা অনুসারে সৃষ্টি করেছি’- এই দুটি বাক্যের পর্যালােচনা প্রসংগে এ বিষয়টি সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছি)। তবে এই মৌলিক ও চিরন্তন সত্য এখানে উল্লেখ করা দ্বারা একে আল্লাহর নির্ধারিত তালাক ও তার সময়, ইদ্দত ও তার মেয়াদ, সাক্ষ্য ও সাক্ষ্য প্রদানের সাথে যুক্ত করেছে। আর এই বিধিগুলাে যে সৃষ্টিজগতে কার্যকর আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানের সাথে পুরােপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটাই এই উক্তির মর্মার্থ। ‘আর তােমাদের মধ্য হতে যে সকল মহিলা এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছে যে, তাদের আর রজস্রাব হবে না, তাদের ব্যাপারে তােমরা সন্দিহান হয়ে থাকলে তাদের ইদ্দত হবে তিন মাস…’ এ আয়াতে সেসব মহিলার ইদ্দতের মেয়াদ বর্ণনা করা হয়েছে, যারা অ-ঋতুবতী, যারা গর্ভবতী, যাদের (বয়ােবৃদ্ধা হওয়ার কারণে) রজস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে এবং যারা অপ্রাপ্ত বয়স্কা অথবা কোনাে রােগে আক্রান্ত থাকার কারণে এখনাে ঋতুবতী হয়নি। সূরা বাকারায় যে মেয়াদ বর্ণনা করা হয়েছে তা শুধু ঋতুবতীদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। সেটি হলাে তিনটি রজস্রাবকাল অথবা তিনটি রজস্রাবমুক্ত কাল। এ ব্যাপারে ফেকাহবিদদের মতভেদ রয়েছে। পক্ষান্তরে যে মহিলার রজস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে অথবা এখনাে রজস্রাব হয়নি, তার ইদ্দতের হিসাব কিভাবে হবে সে ব্যাপারে অস্পষ্টতা থেকে গিয়েছিলাে। তাই এ আয়াত এসে সেই অস্পষ্টতা দূর করে দেয় এবং উভয় শ্রেণীর মহিলার ইদ্দত তিন মাস স্থির করে। কারণ যে ঋতু দিয়ে ঋতুবতীদের ইদ্দত হিসাব করা হয়, তা থেকে এই দুজনই মুক্ত। আর গর্ভবতীদের ইদ্দত স্থির করা হয়েছে সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত, তালাকের পর সেই সময়টা দীর্ঘস্থায়ী হােক বা ক্ষণস্থায়ী হােক। যদিও প্রসবােত্তর স্রাবের ৪০টি রাতও পবিত্রতা অর্জনের মেয়াদ হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে, কিন্তু সেটা ইদ্দতের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা, সন্তান প্রসবের পর জরায়ুর পবিত্র হওয়া সুনিশ্চিত। তাই আর কোনাে কিছুর জন্যে অপেক্ষা করার দরকার নেই। আর যেহেতু তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তার তালাকদাতা স্বামী থেকে সন্তান প্রসবের সাথে সাথেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাই এরপর আর অপেক্ষা করার কোনাে সার্থকতাও নেই। কারণ, এরপর বিয়ে দোহরানাে ছাড়া আর সাবেক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনাে উপায় নেই। আল্লাহ তায়ালা যখন প্রতিটি জিনিসের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তখন কোনাে সার্থকতা ছাড়া কোনাে সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ হতে পারে না। এতাে গেলাে সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ। এরপরই আসছে বিবেক ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় মন্তব্য ও উপদেশ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে সংযত আচরণ করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে তার কাজ সহজ করে দেন।’ মানুষের দায়িত্ব পালন সহজ হয়ে যাক এটাই মানুষের সর্বোচ্চ প্রত্যাশা। আল্লাহ তায়ালা যদি তার কোনাে বান্দার কাজকর্ম সহজ করে দেন, তবে এটা তার জন্যে সবচেয়ে বড় নেয়ামত। এতে তার সকল কষ্ট দূর হয়ে যায়। আর আজীবন এমন কষ্টহীন জীবন যাপনের উল্লেখ দ্বারা তাকে তালাকের ব্যাপারেও সহজ সরল পথ অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এরপর এরশাদ হচ্ছে, এ হচ্ছে আল্লাহর বিধান, তিনি তােমাদের প্রতি নাযিল করেছেন।’ এখানে এই বিধানের উৎস সম্পর্কে সতর্ক করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, এটা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেছেন এবং যারা এর প্রতি ঈমান এনেছে তাদের কাছে নাযিল করেছেন। তারা যদি এ বিধান মেনে চলে তবেই তাদের ঈমানের যথার্থতা প্রমাণিত হবে এবং তাদের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে। এরপর পুনরায় তাকওয়া ও খােদাভীরুতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বিষয়টি আলােচনার শুরু থেকেই ক্রমাগত তাকওয়ার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ মাফ করবেন এবং তাকে বিরাট পুরস্কার দেবেন।’ প্রথমে কাজ সহজ করার ওয়াদা প্রদান করা হয়েছে, তারপর গুনাহ মাফ এবং সর্বশেষে বিরাট পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক ওয়াদাই বটে। এটা একটা সর্বাত্মক সিদ্ধান্ত এবং সর্বব্যাপী প্রতিশ্রুতি। তবে তালাকের বিষয়টির ওপরও এর প্রভাব পড়ে এবং এটা আল্লাহ তায়ালা ও তার অনুগ্রহ সম্পর্কে মনকে সচেতন করে তােলে। আল্লাহ তায়ালা যখন বান্দার কাজ সহজ করে দেন, তাকে ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কারের আশ্বাস দেন, তখন তার কাজে কোনাে জটিলতার সৃষ্টি কিভাবে হতে পারে?

সুরা: আত-তালাক
আয়াত নং :-7

لِیُنْفِقْ ذُوْ سَعَةٍ مِّنْ سَعَتِهٖ١ؕ وَ مَنْ قُدِرَ عَلَیْهِ رِزْقُهٗ فَلْیُنْفِقْ مِمَّاۤ اٰتٰىهُ اللّٰهُ١ؕ لَا یُكَلِّفُ اللّٰهُ نَفْسًا اِلَّا مَاۤ اٰتٰىهَا١ؕ سَیَجْعَلُ اللّٰهُ بَعْدَ عُسْرٍ یُّسْرًا۠

সচ্ছল ব্যক্তি তার সচ্ছলতা অনুপাতে খরচ করবে। আর যাকে স্বল্প পরিমাণ রিযিক দেয়া হয়েছে সে আল্লাহ‌ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে খরচ করবে। আল্লাহ‌ যাকে যতটা সামর্থ দিয়েছেন তার চেয়ে অধিক দায়িত্ব তিনি তার ওপর চাপান না। অসম্ভব নয় যে, অসচ্ছলতার পর আল্লাহ‌ তাকে সচ্ছলতা দান করবেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

*তালাকপরবর্তী সমস্যা ও তার সমাধান : পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘তোমরা যেখানে বাস করাে সেখানেই তাদের (ইদ্দতকালে) বাস করতে দাও…’ ইদ্দতকালে স্ত্রীকে গৃহে অবস্থান করতে দেয়া ও খােরপােষ দেয়া সংক্রান্ত বিস্তারিত আলােচনার উপসংহার টানা হয়েছে এই দুটি আয়াতে। আল্লাহর আদেশ এই যে, তাদের স্বামীর অনুরূপ বাসস্থানে বসবাস করার সুযােগ দিতে হবে। তার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ে রাখা চলবে না। তাদের আর্থিক সামর্থের অতিরিক্তও কিছু ব্যয় করা লাগবে না। সংকীর্ণ স্থানে বাস করতে দেয়া বা বাস করাকালীন দুর্ব্যবহার দ্বারা স্ত্রীর ক্ষতি সাধন করা যাবে না। গর্ভবতীদের ব্যাপারে বিশেষভাবে খােরপােষের উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও প্রত্যেক ইদ্দত পালনকারিণীর ভরণ পােষণই বাধ্যতামূলক। গর্ভবতীদের খােরপােষের উল্লেখ করে এ কথাই বুঝানাে হয়েছে যে, গর্ভের মেয়াদ দ্বারাই খােরপােষের মেয়াদ কম বা বেশী নির্ধারিত হবে। সন্তান প্রসব পর্যন্তই খােরপােষ দিতে হবে। কেননা, ওটাই তার ইদ্দতের শেষ সীমা। এরপর সন্তানকে দুধ খাওয়ানাের বিষয়টি আলােচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মাকে বিনা পারিশ্রমিকে এ কাজ করতে বাধ্য করেনি। শিশুটি তাে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ সন্তান। সুতরাং সে যতােদিন তাকে দুধ খাওয়াবে, ততােদিন পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার তার রয়েছে। ইসলামী বিধানে এটা মায়ের প্রতি প্রদত্ত সর্বোচ্চ সুবিধা। এই সাথে সে পিতামাতা উভয়কে এই শিশু সম্পর্কে হিতাকাংখী থাকতে ও তার কল্যাণ নিশ্চিত হয় এমনভাবে তার সাথে আচরণ করতে এবং পরস্পর পরামর্শ করতে আদেশ দিয়েছে। কেননা, সে তাদের উভয়ের কাছে আমানত। তাদের দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতার খেসারত যেন শিশুকে দিতে না হয়। কেননা, এই ব্যর্থতার দায় দায়িত্ব তাে তার ওপর পড়ে না। এ হচ্ছে আল্লাহর সেই সহজ সরল ব্যবস্থা, যার দিকে তিনি স্বামী-স্ত্রী উভয়কে আহবান জানান, কিন্তু তারা উভয়ে যদি অনমনীয় হয় এবং দুধ খাওয়ানাে ও তার পারিশ্রমিক দানের ব্যাপারে একমত না হয়, তা হলেও কিছু আসে যায় না। শিশুর অধিকার সর্বাবস্থায় নিশ্চিত ও সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাকে অন্য কেউ দুধ খাওয়াবে।’ অর্থাৎ তারা যখন অমনীয় থেকেছে এবং শিশুর প্রতিপালনে ব্যর্থ হয়েছে, তখন অন্য কেউ যদি এ কাজে এগিয়ে আসে, তবে মায়ের তাতে বাধা দেয়ার কোনাে অধিকার থাকবে না। এরপর খােরপােষের পরিমাণ কী হবে, সে বিষয়ে আলােচনা করা হয়েছে। যে পরিমাণ সহজসাধ্য হবে এবং সহযােগিতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে, সেটাই হবে খােরপােশের ন্যায়সংগত মাত্রা। স্বামীরও যুলুম করা চাই না, স্ত্রীরও বাড়াবাড়ি করা চাই না। আল্লাহ তায়ালা যাকে সচ্ছলতা দিয়েছেন, তার উচিত উদারভাবে ব্যয় করা চাই তা স্ত্রীর দৈনন্দিন খােরপোষের ব্যাপারেই হােক, বসবাসের সুযােগের ব্যাপারেই হােক কিংবা দুধ খাওয়ানাের পারিশ্রমিকের ব্যাপারেই হােক। আর যে ব্যক্তি সচ্ছল নয়; বরং অভাবপীড়িত, তার ওপর কোনাে চাপ নেই। তার সাধ্যের বাইরে খােরপােষ দিতে আল্লাহ তায়ালা বলেননি। আল্লাহই হচ্ছেন দাতা। তিনি না দিলে কেউ সম্পদ লাভ করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া বিত্ত বৈভব লাভের আর কোনাে উৎস নেই। তার কোষাগার ছাড়া আর কোনাে কোষাগার নেই। আল্লাহ তায়ালা কোনাে প্রাণীকে তার দেয়া জিনিসের বাইরে কোনাে দায়িত্ব অর্পণ করেন না। অতপর উভয়কে আশ্বাসবাণী শুনাচ্ছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অচিরেই জটিলতার পরে স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করবেন।’ এ থেকে বুঝা গেলাে যে, সংকীর্ণতার পর প্রশস্ততা এবং জটিলতার পর স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টির বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছার ওপরই নির্ভরশীল। তাই স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই উচিত সব কিছুতে আল্লাহর ওপরই নির্ভর করা এবং তাকেই ভয় করা। কেননা, দেয়া বা না দেয়ার নিরংকুশ ও একচ্ছত্র ক্ষমতা তারই। তার হাতেই রয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও জটিলতা, দারিদ্র্য ও সচ্ছলতা এবং সুখ ও দুঃখ। এ পর্যন্ত এসে তালাক ও তার ফলশ্রুতিজনিত সকল অবস্থা সংক্রান্ত বিধিবিধান সমাপ্ত হয়েছে। এর ফলে একটা সুস্পষ্ট সমাধান পাওয়া গেছে। তালাকবিধ্বস্ত গৃহের আর কোনাে সমস্যা অবশিষ্ট নেই। মানুষের মনে যেসব কুপ্ররােচণা সচরাচর এসে থাকে এবং মানুষের ভদ্রতা, সৌজন্য ও সহৃদয়তা প্রদর্শনে অন্তরায় সৃষ্টি করে থাকে, তাও এ আলােচনার মাধ্যমে দূর করা হয়েছে। তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী সন্তানকে দুধ পান করাক বা না করাক, তার প্রতি সহৃদয়তা ও উদারতা প্রদর্শন এবং তাকে ইদ্দতকালে আবাসিক সুবিধা ও খােরপােষ দিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আর এ সব সুবিধা দিলে অভাব অনটন, আর্থিক সংকট ও অর্থ বিনাশ ঘটতে পারে এরূপ আশংকা যেমন স্বামীর মন থেকে দূরীভূত করা হয়েছে, তেমনি স্ত্রীর মন থেকেও দরিদ্র সাবেক স্বামীর কাছ থেকে খােরপােষ কম বা নিম্নমানের পাওয়াজনিত ক্ষোভ এবং সচ্ছল সাবেক স্বামীর কাছ থেকে অধিকতর অর্থপ্রাপ্তির লােভ দূর করা হয়েছে। নিশ্চিত আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহভীরু মানুষের অভাব ও কষ্টের পর সচ্ছলতা স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসবে অকল্পনীয় উপায়ে, অভাবনীয় উৎস থেকে রিযিক আসবে এবং দুনিয়ার রিযিকের পর আখেরাতের বিরাট পুরস্কার ও গুনাহ থেকে অব্যাহতি লাভ করবে। অনুরূপভাবে যে তীব্র কলহ কোন্দল, মানােমালিন্য, রাগ ও ক্ষোভ হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে দম্পতিকে তালাকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাে, সেই ক্ষোভ ও দুঃখও দূর করা হয়েছে। আল্লাহর রহমতের আশা জাগিয়ে তুলে, তার সন্তোষ লাভের কামনা বাসনা উজ্জীবিত করে এবং তাকওয়া ও আল্লাহভীতির চেতনা সৃষ্টি করে তার মনকে নতুন উদ্দীপনায় উদ্দীপিত করা হয়েছে। তালাক উপদ্রুত দম্পতির মনের এই সার্বিক চিকিৎসা ও এই পুন পুন উচ্চারিত আশ্বাসবাণী দ্বারা সেই অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যা আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের একমাত্র গ্যারান্ট। বস্তুত বিবেকের সচেতনতা ও হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রচ্ছন্ন আল্লাহভীতি ছাড়া আর কোনাে জিনিস এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম নয়। নচেত শুধু আইনের বাধাই যদি একমাত্র বাধা হতাে, তাহলে দম্পতির মধ্যে যতক্ষণ তিক্ততা অব্যাহত থাকতো, ততােক্ষণ পরস্পরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা থেকে তাদের কেউ ঠেকাতে পারতাে না। এ আলোচনায় এমন কিছু নির্দেশিকাও রয়েছে, যাতে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী উদার মনােভাব সৃষ্টি হয়। যেমন ক্ষতি না করার নির্দেশ। বলা হয়েছে, ‘স্ত্রীদের ক্ষতি সাধন করাে না।’ এই একটি মাত্র নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এমন বহু প্রকারের কষ্টদায়ক আচরণ রােধ করা হয়েছে, যা নিছক একটি আইন দ্বারা রােধ করা যেতাে না, তা সে যতাে ব্যাপক ভিত্তিক আইনই হােক না কেন। এ নির্দেশের ভিত্তি হলাে আবেগ অনুভূতি জাগ্রত করা, সকল গােপনীয় বিষয়ে পরিজ্ঞাত আল্লাহর ভীতি সঞ্চার করা এবং দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহভীরু লােকদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা যে প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা স্মরণ করিয়ে দেয়া। বিশেষত জীবিকার ব্যাপারে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যার উল্লেখ বিভিন্ন ভংগিতে বার বার করা হয়েছে। কেননা, জীবিকার বিষয়টিই তালাকজনিত মানসিক জটিলতা নিরসনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কখনাে কখনাে এমনও হয়ে থাকে যে, স্বামী স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অথচ তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি প্রেম ও ভালােবাসা সুপ্ত থাকে। সামান্য একটু উজ্জীবনী শক্তির পরশ পেলেই তা আবার জেগে ওঠে। এই উজ্জীবনী শক্তি হচ্ছে উঁচু মানের সহৃদয় ব্যবহার, যা ইসলাম মুসলিম জাতিকে শিক্ষা দিতে চায়। আলােচনার এ পর্বটি শেষ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা সেসব লােকের বিষয়ে আলােচনা শুরু করেছেন, যারা আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের আদেশ অমান্য করেছে এবং অত্যন্ত শােচনীয় পরিণতি ভােগ করেছে, আর যেসব মােমেন বান্দা আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের আদেশের অনুগত, তাদের পুরস্কৃত করার ওয়াদাও ঘােষণা করেছেন।

ফী জিলালিল কুরআন: আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বহু জনপদ তাদের প্রতিপালকের ও রসূলের আদেশ অমান্য করেছে। ফলে, আমি তাদের কাছ থেকে কঠিন হিসাব নিয়েছি এবং ভয়ংকর শাস্তি দিয়েছি…’ এ আয়াত কটিতে একাধারে সতর্কবাণী উচ্চারণ, ঈমান আনার তাওফীক দিয়ে আল্লাহ তায়ালা যে অনুগ্রহ করেছেন, তা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং আখেরাতে তার জন্যে প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করা হয়েছে। আখেরাতের এই প্রতিদান যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে সম্মানজনক জীবিকা, সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর অবাধ্য ও রসূলের আদেশ অমান্যকারীকে পাকড়াও করা ও শাস্তি দেয়া আল্লাহর চিরন্তন রীতি। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহর পাকড়াও, তার শাস্তি ও তার নাফরমান বান্দাদের শােচনীয় পরিণতির বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে। অতপর তৃতীয় আয়াতে এই ভয়াবহ পরিণামকে কিছুটা বিলম্বিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সবের উদ্দেশ্য হলাে বিষয়টি পাঠকের মনে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করা, এটা কোরআনের একটা স্থায়ী রীতি।  *রসূলদের আহবান উপেক্ষাকারী জাতির পরিণতি : এই সতর্কবাণী পাঠ করে ক্ষণিকের জন্যে আমরা যদি দাঁড়াই, তাহলে দেখতে পাবাে যে, যখনই কোনাে জনপদ আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলের নাফরমানী করেছে, আল্লাহ তায়ালা তাকে একে একে শাস্তি দিয়েছেন। আমরা দেখতে পাই যে, এই সতর্কবাণীকে এখানে তালাক ও তদসংশ্লিষ্ট বিধিসমূহের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরা হয়েছে। এর ফলে তালাক ও তার বিধি আল্লাহর এই শাশ্বত রীতির সাথে সংযুক্ত হয়েছে। আর এই সংযুক্তি দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, তালাকের ব্যাপারটা শুধু পরিবার ও দম্পতির সমস্যা নয়, বরং এটা গােটা মুসলিম উম্মাহর সমস্যা। গােটা মুসলিম জাতি এ সমস্যার জন্যে দায়ী। এটি শরীয়তসম্মতভাবে সমাধান করা গােটা মুসলিম উম্মার কর্তব্য। শরীয়তবিরােধী পন্থায় এই সমস্যা অথবা অনুরূপ অন্য কোনাে সমস্যার সমাধান করা আল্লাহর বিধানের বিরােধিতারই নামান্তর। এ কাজ যে ব্যক্তিরা করবে আল্লাহর কাছে শুধু তারাই অপরাধী হবে না, বরং যে জনপদ বা যে জাতির লোকেরা এ কাজ করবে, সেই জনপদ ও সেই জাতি সামগ্রিকভাবে আল্লাহর কাছে দায়ী হবে। এটা হবে গোটা জাতির সামগ্রিকভাবে আল্লাহর বিধান ও আল্লাহর নির্দেশ লংঘন করার নামান্তর। কেননা, ইসলাম এসেছে এ জন্যে যে, তা পুরােপুরিভাবে বাস্তবায়িত করা হবে এবং গােটা মানব জীবনের ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। যে ব্যক্তি ইসলামের কোনাে বিধি লংঘন করবে, চাই তা তার ব্যক্তিগত জীবনেই হােক না কেন, সে তার গােটা জাতি বা গােটা জনপদকে আল্লাহর সেই শাস্তির দিকে ঠেলে দেবে, যে শাস্তি আবহমানকাল ধরে আল্লাহদ্রোহী জাতিগুলাে ভােগ করে এসেছে। সেই আল্লাহদ্রোহী জাতিগুলাে বা জনপদগুলাে নিজেদের অপকর্মের শাস্তি ভােগ করেছে এবং তাদের পরিণতি হয়েছে ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস । এ ক্ষয়ক্ষতি ও শান্তি তাদের শেষ বিচারের আগে এই পৃথিবীতেই ভােগ করতে হয়েছে। আল্লাহর বিধান লংঘন করার এ শাস্তি আমরা আমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলােকেও ভােগ করতে দেখেছি। অরাজকতা, ধ্বংস, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, বিজাতির যুলুম শােষণ, নিরাপত্তাহীনতা ও অশান্তি, স্থিতিহীনতা ও অনিশ্চয়তা ইত্যাদির আকারে তারা আল্লাহর এ আযাব ভােগ করেছে। আমরা শুধু অতীতে নয়, বর্তমানেও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জাতিকে এরূপ আযাব ভােগ করতে দেখছি। আর এ আযাবই শেষ নয়, এ ছাড়া আখেরাতের আযাবও নির্ধারিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে কঠিন আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ ইতিপূর্বে সুরা সাফে আমি বলেছি যে, ইসলাম একটা সামগ্রিক ও সামাজিক বিধান। একটি বিশেষ সামাজিক ব্যবস্থা সহকারে মুসলমানদের সমাজকে গড়ে তােলাই তার লক্ষ্য। তাই গােটা মুসলিম সমাজের ওপরই ইসলামের বিধিবিধান পালন করার দায়িত্ব অর্পিত। সে যদি তা লংঘন করে, তবে লংঘনের যে পরিণতি অন্যান্য জাতি ভােগ করেছে, তা তাকেও ভােগ করতে হবে। আর এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে সাবধান করতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলছেন, হে মুসলিম জাতি, তােমরা আল্লাহকে ভয় করাে, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কাছে একটা স্মরণিকা নাযিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এই স্মরণিকাকে রসূলের সত্ত্বার মাধ্যমে বাস্তবায়িত করেছেন। তাই পরবর্তী আয়াতে তার কথা এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যেন তিনি নিজেই এই স্মরণিকা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, একজন রসূল, যিনি তােমাদের সামনে আল্লাহর আয়াতগুলাে সুস্পষ্টভাবে পড়ে শােনান।’ এখানে একটি তাৎপর্যময় অকাট্য সত্য কথা বলা হয়েছে। সে কথাটা এই যে, প্রথমত আল্লাহর কাছ থেকে আগত এই স্মরণিকা মুসলিম জনতার কাছে এসেছে পরম সত্যবাদী রসূলের মাধ্যমে। আল্লাহর রসূল এর বিন্দুবিসর্গও গােপন করেননি। দ্বিতীয়ত, রসূলের ব্যক্তিত্ব নিজেই একটি স্মরণিকায় পরিণত হয়েছে। তিনি এ স্মরণিকার তথা কোরআনের বাস্তব চিত্র । কোরআন দ্বারা গঠিত তার এই সত্ত্বা স্বয়ং বাস্তব কোরআনের রূপ ধারণ করেছে। তিনি কোরআনের জীবন্ত চিত্র। রাসূল(স.) বাস্তবিকপক্ষেই তদ্রূপ ছিলেন। হযরত আয়েশাও একথাই বলেছেন, তার চরিত্র ছিলাে হুবহু কোরআন। তাঁর অন্তরে কোরআন সার্বক্ষণিকভাবে বিদ্যমান থেকে প্রতিমুহূর্তে কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে, তা শিক্ষা দিতেন, আর তিনি নিজে বাস্তব কোরআন হয়ে তদ্রূপ জীবন যাপন করতেন। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের ইসলামের পথে চালিত করে যে নেয়ামত দান করেছেন, তাদের জান্নাত প্রদানের ওয়াদা করে সেই নেয়ামত ও অনুগ্রহ আরাে বর্ধিত করেছেন। আর স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, এই জান্নাত হচ্ছে মােমেনের জন্যে সর্বোত্তম জীবিকা। তার সাথে পার্থিব জীবিকার কোনাে তুলনা হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তার জন্য চমৎকার জীবিকার ব্যবস্থা করেন। বস্তুত দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গায় তিনিই একমাত্র জীবিকাদাতা। তবে তার দেয়া এক জীবিকার চেয়ে আর এক জীবিকা উত্তম। তিনি কাকে কোন জীবিকা দেবেন সেটা তিনিই নির্ধারণ করেন। এভাবে তিনি দুনিয়ার জীবিকার চেয়ে জান্নাতের জীবিকার শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ইংগিত করেন।

ফী জিলালিল কুরআন:-  *আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব : সর্বশেষ আয়াতে পুনরায় সেই প্রাকৃতিক তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। অতপর সূরার বিষয়বস্তু, তাতে বর্ণিত বিধিবিধান ও নির্দেশাবলীকে আল্লাহর জ্ঞান, শক্তিমত্তা ও পরিকল্পনার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে, যা তার বিশাল সৃষ্টিজগতে প্রতিফলিত। সর্বশেষ আয়াতটিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা যিনি সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং অনুরূপ সংখ্যক পৃথিবীও সৃষ্টি করেছেন। এগুলাের মধ্যেই তার বিধান নাযিল হয়, যাতে তােমরা নিশ্চিতভাবে জানাে যে, আল্লাহ সকল জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান এবং তার জ্ঞান সকল জিনিসের ওপর পরিব্যাপ্ত।’ সাত আকাশ যে কী জিনিস, কেমন জিনিস, কেমন তার আকৃতি ও আয়তন, তা আমরা জানি না। অনুরূপভাবে সাত পৃথিবী সম্পকেও আমরা অজ্ঞ। আমরা যে পৃথিবীকে জানি, সেটা এ সাতটি পৃথিবীরই একটি হতে পারে আর বাকীগুলাের সন্ধান হয়তাে কেবল আল্লাহই জানেন। আয়াতে যে ‘মিছলাহুন্না’ অর্থাৎ অনুরূপ শব্দটি রয়েছে, তা দ্বারা এ কথাও বুঝানাে হয়ে থাকতে পারে যে, এই পৃথিবী ও আকাশ গঠনে বৈশিষ্ট্যে একই জাতের পদার্থ। তবে সর্বাবস্থায় মনে রাখতে হবে যে, এই আয়াতে যেসব জিনিসের নামােল্লেখ করা হয়েছে, সে সব আমাদের জানা ও পরিচিত জিনিস হতে হবে এমন কোনাে কথা নেই। কেননা, এই বিশ্ব নিখিলের সব জিনিস আমাদের জ্ঞানের আওতাভুক্ত নয়। তাই কোনাে নির্দিষ্ট জিনিস দেখিয়ে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে, কোরআন এই জিনিসটার কথাই বলতে চেয়েছে। গােটা বিশ্বজগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৃষ্টির রহস্য যদি কখনাে মানুষ অকাট্যভাবে ও সুনিশ্চিতভাবে জানতে পারে, তবে তখনই অনুরূপ কথা বলতে পারে, কিন্তু সেরূপ নিশ্চিত জ্ঞান তো কখনাে তার আয়ত্তে আসবে না। তবে এই বক্তব্য দ্বারা আমরা কেবল মনস্তাত্ত্বিকভাবে উপকৃত হতে পারি এবং বিশ্ব নিখিল সম্পর্কে একটা বিশুদ্ধ বিশ্বাস বা ঈমান গড়ে তুলতে পারি। ‘সাতটি আকাশ ও অনুরূপ সংখ্যক পৃথিবী’ কথাটার মধ্য দিয়ে এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে যে ইংগিত দেয়া হয়েছে, তাতে হৃদয়কে স্রষ্টার এমন এক বিশাল সৃষ্টির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, যার বিশালত্বের সামনে এই গােটা পৃথিবীও নিতান্ত ক্ষুদ্র। পৃথিবীতে সংঘটিত তালাক বা বিয়ের মতাে তুচ্ছ ও নগণ্য কিছু ঘটনা আর স্বামীর দেয়া কিছু টাকা অথবা স্ত্রীর ছেড়ে দেয়া কিছু টাকার দাবী তাঁর সামনে কিছুই নয়। এই সাত আকাশ ও সাত পৃথিবীর মাঝেই নাযিল হয় আল্লাহর বিধান। তালাক সংক্রান্ত আলােচ্য বিধানও তার আওতাভুক্ত। সুতরাং মানবীয় ধ্যানধারণা মানদন্ডের বিচারেও এই বিধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর এ বিধান লংঘন করা সেই মহাজাগতিক বিধান লংঘন করার মতােই গুরুতর, যে বিধান আকাশ, পৃথিবী, আল্লাহর ঘনিষ্ঠতম ফেরেশতারা এবং আকাশ ও পৃথিবীর অপরাপর সৃষ্টিও মেনে চলে। এ বিধান স্বয়ং আল্লাহর রসূল এনেছেন এবং এ দ্বারা পৃথিবীবাসীকে অন্ধকার থেকে আলােতে নিয়ে এসেছেন। এ বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করা অত্যন্ত অন্যায় ও দুর্ভাগ্যজনক, যা কোনাে বুদ্ধিমান মােমেনের কাজ হতে পারে না। এ বিধান আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে নাযিল হয়ে মােমেনের হৃদয়ে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করে যে, আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান। সুতরাং তাঁকে তাঁর ঈপ্সিত কাজ থেকে কোনাে কিছু ফিরিয়ে রাখতে বা বাধা দিতে পারে না। তিনি সর্ববিষয়ে জ্ঞান রাখেন। সুতরাং তার বিশাল রাজ্যের কোনাে জিনিস এবং এই বিশাল রাজ্যের অধিবাসীদের অন্তরের অন্তস্থলে লুকানাে কোনাে জিনিস তাঁর জ্ঞানের আওতাবহির্ভূত নয়। এই বক্তব্যটির দুটো সূক্ষ্ম তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত, যে আল্লাহ সর্ববিষয়ে অবগত, তিনিই এই বিধানগুলাে পালনের আদেশ দিয়েছেন। মানুষের সকল অবস্থা, সমস্যা, স্বার্থ, সুবিধা অসুবিধা ও যােগ্যতা অযােগ্যতা তার জানা। এ সব তাঁর জানা বলেই তিনি এ বিধান নাযিল করেছেন। সুতরাং এগুলাে অনুসরণ করার ব্যাপারে কারাে বিন্দুমাত্রও আপত্তি থাকা উচিত নয়। কেননা, তা সর্বজ্ঞ আল্লাহর রচিত বিধান। দ্বিতীয়ত, এই বিধানগুলাে মানা মানুষের বিবেক ও চেতনার ওপর নির্ভরশীল। কেননা, আল্লাহ তায়ালা সব কিছু জানেন, এই সত্যই বিবেকের সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট। যে আল্লাহ তায়ালা মানুষের মনের কোণে লুকানাে বিষয়ও জানেন, তাঁর ভয় ছাড়া আর কোনাে জিনিস দ্বারা যেখানে কোনাে লাভ হয় না, সেখানে আল্লাহর সর্ববিষয়ে জ্ঞাত হওয়া ও সর্বশক্তিমান হওয়ার বিষয়টি জানাই মানুষের সততার শ্রেষ্ঠ গ্যারান্টি।

Leave a Reply