بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১২৫) [ * জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম, যাতে তারা কুরআন শোনে।:- কুফর ও ঈমানের চূড়ান্ত ফলাফল:-] www.motaher21.net সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ পারা:২৬ ২১-৩৫ নং আয়াত:- তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(বই#১১২৫)
[ * জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম, যাতে তারা কুরআন শোনে।:-
কুফর ও ঈমানের চূড়ান্ত ফলাফল:-]
www.motaher21.net

সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ পারা:২৬ ২১-৩৫ নং আয়াত:-

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২১
وَ اذۡکُرۡ اَخَا عَادٍ ؕ اِذۡ اَنۡذَرَ قَوۡمَہٗ بِالۡاَحۡقَافِ وَ قَدۡ خَلَتِ النُّذُرُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡہِ وَ مِنۡ خَلۡفِہٖۤ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّا اللّٰہَ ؕ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۲۱﴾
এদেরকে ‘আদের ভাই (হূদ)- এর কাহিনী কিছুটা শুনাও যখন সে আহক্বাফ: তার কওমকে সতর্ক করেছিলো। -এ ধরনের সতর্ককারী পূর্বেও এসেছিলো এবং তার পরেও এসেছে- যে আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করো না। তোমাদের ব্যাপারে আমার এক বড় ভয়ংকর দিনের আযাবের আশঙ্কা আছে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২২
قَالُوۡۤا اَجِئۡتَنَا لِتَاۡفِکَنَا عَنۡ اٰلِہَتِنَا ۚ فَاۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَاۤ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ ﴿۲۲﴾
তারা বললোঃ “তুমি কি এ জন্য এসেছো যে, আমাদের প্রতারিত করে আমাদের উপাস্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে দেবে? ঠিক আছে, তুমি যদি প্রকৃত সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে আমাদের যে আযাবের ভীতি প্রদর্শন করে থাকো তা নিয়ে এসো।”
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৩
قَالَ اِنَّمَا الۡعِلۡمُ عِنۡدَ اللّٰہِ ۫ۖ وَ اُبَلِّغُکُمۡ مَّاۤ اُرۡسِلۡتُ بِہٖ وَ لٰکِنِّیۡۤ اَرٰىکُمۡ قَوۡمًا تَجۡہَلُوۡنَ ﴿۲۳﴾
তিনি বললেন, ‘এ জ্ঞান তো শুধু আল্লাহ্‌রই কাছে। আর আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি শুধু তা-ই তোমাদের কাছে প্রচার করি, কিন্তু আমি দেখছি, তোমারা এক মূর্খ সম্প্রদায়।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৪
فَلَمَّا رَاَوۡہُ عَارِضًا مُّسۡتَقۡبِلَ اَوۡدِیَتِہِمۡ ۙ قَالُوۡا ہٰذَا عَارِضٌ مُّمۡطِرُنَا ؕ بَلۡ ہُوَ مَا اسۡتَعۡجَلۡتُمۡ بِہٖ ؕ رِیۡحٌ فِیۡہَا عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿ۙ۲۴﴾
‘অতঃপর যখন তারা তাদের উপত্যকার দিকে মেঘ আসতে দেখল তখন বলতে লাগল, ‘এ তো মেঘ আমাদেরকে বৃষ্টি দান করবে।’ না, বরং এটাই তো তা, যা তোমারা ত্বারান্বিত করতে চেয়েছ, এক ঝড়, এতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৫
تُدَمِّرُ کُلَّ شَیۡءٍۭ بِاَمۡرِ رَبِّہَا فَاَصۡبَحُوۡا لَا یُرٰۤی اِلَّا مَسٰکِنُہُمۡ ؕ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡقَوۡمَ الۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۲۵﴾
‘এটা তার রবের নির্দেশে সব কিছুকে ধবংস করে দেবে।’ অতঃপর তাদের পরিণাম এ হল যে, তাদের বসতিগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। এভাবে আমরা অপরাধী সম্পপ্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৬
وَ لَقَدۡ مَکَّنّٰہُمۡ فِیۡمَاۤ اِنۡ مَّکَّنّٰکُمۡ فِیۡہِ وَ جَعَلۡنَا لَہُمۡ سَمۡعًا وَّ اَبۡصَارًا وَّ اَفۡـِٕدَۃً ۫ۖ فَمَاۤ اَغۡنٰی عَنۡہُمۡ سَمۡعُہُمۡ وَ لَاۤ اَبۡصَارُہُمۡ وَ لَاۤ اَفۡـِٕدَتُہُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ اِذۡ کَانُوۡا یَجۡحَدُوۡنَ ۙ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ حَاقَ بِہِمۡ مَّا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿٪۲۶﴾
আমি তাদেরকে এমন কিছু দিয়েছিলাম যা তোমাদের দেইনি।৩০ আমি তাদেরকে কান, চোখ, হৃদয়-মন সব কিছু দিয়েছিলাম। কিন্তু না সে কান তাদের কোন কাজে লেগেছে, না চোখ, না হৃদয়-মন। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করতো।তারা সেই জিনিসের পাল্লায় পড়ে গেল যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৭
وَ لَقَدۡ اَہۡلَکۡنَا مَا حَوۡلَکُمۡ مِّنَ الۡقُرٰی وَ صَرَّفۡنَا الۡاٰیٰتِ لَعَلَّہُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۲۷﴾
আমি তোমাদের আশে পাশের বহু এলাকার বহু সংখ্যক জনপদ ধ্বংস করেছি। আমি আমার আয়াতসমূহ পাঠিয়ে বার বার নানাভাবে তাদের বুঝিয়েছি, হয়তো তারা বিরত হবে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৮
فَلَوۡ لَا نَصَرَہُمُ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ قُرۡبَانًا اٰلِـہَۃً ؕ بَلۡ ضَلُّوۡا عَنۡہُمۡ ۚ وَ ذٰلِکَ اِفۡکُہُمۡ وَ مَا کَانُوۡا یَفۡتَرُوۡنَ ﴿۲۸﴾
কিন্তু আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব সত্তাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিলো তারা কেন তাদেরকে সাহায্য করলো না। বরং তারা তাদের থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। এটা ছিল তাদের মিথ্যা এবং মনগড়া আকীদা-বিশ্বাসের পরিণাম, যা তারা গড়ে নিয়েছিলো।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৯
وَ اِذۡ صَرَفۡنَاۤ اِلَیۡکَ نَفَرًا مِّنَ الۡجِنِّ یَسۡتَمِعُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ ۚ فَلَمَّا حَضَرُوۡہُ قَالُوۡۤا اَنۡصِتُوۡا ۚ فَلَمَّا قُضِیَ وَلَّوۡا اِلٰی قَوۡمِہِمۡ مُّنۡذِرِیۡنَ ﴿۲۹﴾
স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জ্বিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনছিল, যখন তারা তার (নবীর) নিকট উপস্থিত হল, তারা একে অপরকে বলতে লাগল, ‘চুপ করে শ্রবণ কর।’ যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হল, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩০
قَالُوۡا یٰقَوۡمَنَاۤ اِنَّا سَمِعۡنَا کِتٰبًا اُنۡزِلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مُوۡسٰی مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ یَہۡدِیۡۤ اِلَی الۡحَقِّ وَ اِلٰی طَرِیۡقٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۳۰﴾
তারা বলেছিল, ‘হে আমাদের সম্প্রদায় ! নিশ্চয় আমারা এমন এক কিতাবের পাঠ শুনেছি যা নাযিল হয়েছে মূসার পরে, এটা তার সম্মুখস্থ কিতাবকে সত্যায়ন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে হেদায়াত করে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩১
یٰقَوۡمَنَاۤ اَجِیۡبُوۡا دَاعِیَ اللّٰہِ وَ اٰمِنُوۡا بِہٖ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ مِّنۡ ذُنُوۡبِکُمۡ وَ یُجِرۡکُمۡ مِّنۡ عَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۳۱﴾
হে আমাদের কওমের লোকেরা, আল্লাহর প্রতি আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনো। আল্লাহ‌ তোমাদের গোনাহ মাফ করবেন এবং কষ্টদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবেন।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩২
وَ مَنۡ لَّا یُجِبۡ دَاعِیَ اللّٰہِ فَلَیۡسَ بِمُعۡجِزٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَیۡسَ لَہٗ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءُ ؕ اُولٰٓئِکَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۳۲﴾
আর যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দেবে না সে না পৃথিবীতে এমন শক্তি রাখে যে আল্লাহকে নিরূপায় ও অক্ষম করে ফেলতে পারে, না তার এমন কোন সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক আছে যে আল্লাহর হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে। এসব লোক সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে ডুবে আছে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৩
اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اَنَّ اللّٰہَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ لَمۡ یَعۡیَ بِخَلۡقِہِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰۤی اَنۡ یُّحۡیِۦَ الۡمَوۡتٰی ؕ بَلٰۤی اِنَّہٗ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۳۳﴾
যে আল্লাহ‌ এই পৃথিবী ও আসমান সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে যিনি পরিশ্রান্ত হননি তিনি অবশ্যই মৃতদের জীবিত করে তুলতে সক্ষম, এসব লোক কি তা বুঝে না? কেন পারবেন না, অবশ্যই তিনি সব কিছু করতে সক্ষম।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৪
وَ یَوۡمَ یُعۡرَضُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا عَلَی النَّارِ ؕ اَلَیۡسَ ہٰذَا بِالۡحَقِّ ؕ قَالُوۡا بَلٰی وَ رَبِّنَا ؕ قَالَ فَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ بِمَا کُنۡتُمۡ تَکۡفُرُوۡنَ ﴿۳۴﴾
যে দিন এসব কাফেরকে আগুনের সামনে হাজির করা হবে সেদিন তাদের জিজ্ঞেস করা হবে, “এটা কি বাস্তব ও সত্য নয়?” এরা বলবে “হ্যাঁ, আমাদের রবের শপথ, (এটা প্রকৃতই সত্য) ।” আল্লাহ বলবেন : “ঠিক আছে, তাহলে তোমরা যে অস্বীকার করতে তার পরিণতি হিসেবে এখন আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো।”
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৫
فَاصۡبِرۡ کَمَا صَبَرَ اُولُوا الۡعَزۡمِ مِنَ الرُّسُلِ وَ لَا تَسۡتَعۡجِلۡ لَّہُمۡ ؕ کَاَنَّہُمۡ یَوۡمَ یَرَوۡنَ مَا یُوۡعَدُوۡنَ ۙ لَمۡ یَلۡبَثُوۡۤا اِلَّا سَاعَۃً مِّنۡ نَّہَارٍ ؕ بَلٰغٌ ۚ فَہَلۡ یُہۡلَکُ اِلَّا الۡقَوۡمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ﴿٪۳۵﴾
অতএব আপনি ধৈর্য ধারণ করুন যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। আর আপনি তাদের জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে তা যেদিন তারা দেখতে পাবে, সেদিন তাদের মনে হবে, তারা যেন দিনের এক দণ্ডের বেশী দুনিয়াতে অবস্থান করেনি। এ এক ঘোষণা, সুতরাং পাপাচারী সম্প্রদায়কেই কেবল ধ্বংস করা হবে।

তাফসীরে‌ ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২১-২৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার সম্প্রদায় যদি তোমাকে অবিশ্বাস ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তবে তুমি তোমার পূর্ববর্তী নবীদের (আঃ) ঘটনাবলী স্মরণ কর যে, তাদের সম্প্রদায়ও তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল।

আ’দ সম্প্রদায়ের ভাই দ্বারা হযরত হূদ (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তাঁকে আ’দে উলার (প্রথম আ’দের) নিকট পাঠিয়েছিলেন, যারা আহকাফ নামক স্থানে বসবাস করতো। (আরবী) শব্দটি (আরবী) শব্দের বহু বচন। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, (আরবী) হলো বালুকার পাহাড়। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, আহকাফ হচ্ছে পাহাড় ও গুহা। হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) বলেন যে, আহকাফ হলো হাযরে মাউতের একটি উপত্যকা, যাকে বারহূত বলা হয় এবং যাতে কাফিরদের রূহগুলো নিক্ষেপ করা হয়। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ইয়ামনে সমুদ্রের তীরে বালুকার টিলায় একটি জায়গা রয়েছে, যার নাম শাহার, সেখানেই এ লোকগুলো বসতি স্থাপন করেছিল।

ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) একটি বাব বা অনুচ্ছেদ,বেঁধেছেন যে, যখন কেউ দু’আ করবে তখন যেন সে নিজ হতেই শুরু করে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ আমাদের প্রতি ও আ’দ সম্প্রদায়ের ভাই এর প্রতি দয়া করুন।”

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আল্লাহ তাদের চতুষ্পর্শ্বের শহরগুলোতেও স্বীয় রাসূল প্রেরণ করেছিলেন। যেমন আল্লাহ পাক অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তবুও তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলঃ আমি তো তোমাদেরকে সতর্ক করছি এক ধ্বংসকর শাস্তির, আ’দ ও সামূদের অনুরূপ শাস্তির। যখন তাদের নিকট রাসূলগণ এসেছিল তাদের সম্মুখ ও পশ্চাৎ হতে এবং বলেছিলঃ তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করো না।” (৪১:১৩-১৪)

হযরত হূদ (আঃ)-এর এ কথার জবাবে তার সম্প্রদায় তাকে বললোঃ “তুমি আমাদেরকে আমাদের দেব-দেবীগুলোর পূজা হতে নিবৃত্ত করতে এসেছো? তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন কর। তারা মহান আল্লাহর শাস্তিকে অসম্ভব মনে করতো বলেই বাহাদুরী দেখিয়ে শাস্তি চেয়ে বসেছিল। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা ঈমান আনেনি তারা আল্লাহর শাস্তি তাড়াতাড়ি আসার কামনা করেছিল।”(৪২:১৮)

হযরত হুদ (আঃ) তার কওমের কথার উত্তরে বলেনঃ এর জ্ঞান তো শুধু। আল্লাহরই নিকট আছে। যদি তিনি তোমাদের এ শাস্তিরই যোগ্য মনে করেন। তবে অবশ্যই তিনি তোমাদের উপর শাস্তি আপতিত করবেন। আমার দায়িত্ব ততা শুধু এটুকুই যে, আমি আমার প্রতিপালকের রিসালাত তোমাদের নিকট পৌঁছিয়ে থাকি। কিন্তু আমি জানি যে, তোমরা সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান-বিবেকহীন লোক।

অতঃপর আল্লাহর আযাব তাদের উপর এসেই গেল। তারা লক্ষ্য করলো যে, একখণ্ড কালো মেঘ তাদের উপত্যকার দিকে চলে আসছে। ওটা ছিল অনাবৃষ্টির বছর। কঠিন গরম ছিল। তাই মেঘ দেখে তারা খুবই খুশী হলো যে, মেঘ তাদেরকে বৃষ্টি দান করবে। কিন্তু আসলে মেঘের আকারে ওটা ছিল আল্লাহর গযব যা তারা তাড়াতাড়ি কামনা করছিল। তাতে ছিল ঐ শাস্তি যা তাদের বস্তীগুলোর ঐ সব জিনিসকে তচনচ করে চলে আসছিল যেগুলো ধ্বংস হওয়ার ছিল। আল্লাহ ওকে এরই হুকুম দিয়েছিলেন। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে জিনিসের উপর দিয়ে ওটা যেতো, ক্ষয়প্রাপ্ত জিনিসের মত ওটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতো।”(৫১:৪২) এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তাদের পরিণাম এই হলো যে, তাদের বসতিগুলো ছাড়া আর কিছুই রইলো না। এই ভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি।

হযরত আবূ ওয়ায়েল (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত হারিস বিকরী (রাঃ) বলেনঃ “একদা আমি আলা ইবনে হারামীর (রাঃ) অভিযোগ নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হবার জন্যে যাত্রা শুরু করি। রাবজাহর পার্শ্ব দিয়ে গমনকালে বানী তামীম গোত্রের একটি বৃদ্ধা মহিলার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তার কাছে সওয়ারী ছিল না। তাই সে আমাকে বলেঃ “হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর সাথে আমার সাক্ষাতের প্রয়োজন আছে। তুমি কি আমাকে দয়া করে তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিবে?” আমি স্বীকার করলাম এবং তাকে আমার সওয়ারীর উপর বসিয়ে নিলাম। এভাবে আমরা উভয়েই মদীনায় পৌঁছলাম। আমি দেখলাম যে, মসজিদে নববীতে (সঃ) বহু লোকের সমাবেশ হয়েছে। তথায় কালো রঙ এর পতাকা আন্দোলিত হচ্ছে। হযরত বিলাল (রাঃ) তরবারী ঝুলিয়ে দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে দণ্ডায়মান রয়েছেন। আমি জনগণকে জিজ্ঞেস করলামঃ ব্যাপার কি? উত্তরে তারা বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ)-কে কোন দিকে প্রেরণ করতে চাচ্ছেন।” আমি তখন একদিকে বসে পড়লাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় মনজিলে অথবা তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। আমিও তখন তাঁর কাছে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করলাম। অনুমতি পেয়ে আমি তার কাছে হাযির হলাম এবং সালাম করলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমাদের মধ্যে ও বানু তামীম গোত্রের মধ্যে কোন বিবাদ ছিল কি?” আমি উত্তরে বললামঃ জ্বী, হ্যাঁ, ছিল এবং আমরাই তাদের উপর জয়যুক্ত হয়েছিলাম। আমার এই সফরে বানু তামীম গোত্রের এক বৃদ্ধা মহিলার সাথে পথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তার কাছে কোন সওয়ারী ছিল না। সে আমার কাছে আবেদন করলো যে, আমি যেন তাকে আমার সওয়ারীতে উঠিয়ে নিয়ে আপনার দরবারে পৌঁছিয়ে দিই। সুতরাং আমি তাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি এবং সে দরযায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকেও ডেকে নিলেন। সে আসলে আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আপনি আমাদের মধ্যে ও বানী তামীমের মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতার ব্যবস্থা করতে পারেন তবে এর দ্বারাই করুন! আমার একথা শুনে বৃদ্ধা মহিলাটি রাগান্বিতা হয়ে বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে এই নিঃসহায় ব্যক্তি আশ্রয় নিবে কোথায়?” আমি তখন বললামঃ সুবহানাল্লাহ! আমার দৃষ্টান্ত তো ঐ ব্যক্তির মতই হলো যে ব্যক্তি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে। এই বৃদ্ধা আমার সাথেই শত্রুতা করবে এটা পূর্বে জানলে কি আর আমি একে সঙ্গে করে নিয়ে আসি? আল্লাহ না করুন যে, আমিও আ’দ সম্প্রদায়ের দুতের মত হয়ে যাই! রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আ’দ সম্প্রদায়ের দূতের ঘটনাটি কি?” যদিও এ ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার চেয়ে বেশী ওয়াকিফহাল ছিলেন তথাপি আমাকে তিনি এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় আমি বলতে শুরু করলামঃ আ’দ সম্প্রদায়ের বসতিগুলোতে যখন কঠিন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায় তখন তারা তাদের একজন দূতকে প্রেরণ করে, যার নাম ছিল কাবল। এ লোকটি পথে মুআবিয়া ইবনে বিকরের বাড়ীতে এসে অবস্থান করে এবং তার বাড়ীতে মধ্যপানে ও তার ‘জারাদাতান’ নামক দু’জন দাসীর গান শুনতে এমনভাবে মগ্ন হয়ে পড়ে যে, সেখানেই তার একমাস কেটে যায়। অতঃপর সে জিবালে মুহরায় গিয়ে দু’আ করেঃ “হে আল্লাহ! আপনি তো খুব ভাল জানেন যে, আমি কোন রোগীর ওষুধের জন্যে অথবা কোন বন্দীর মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে আসিনি। হে আল্লাহ! আ’দ সম্প্রদায়কে ওটা পান করান যা আপনি পান করিয়ে থাকেন।” অতঃপর কালো রঙ এর কয়েক খণ্ড মেঘ উঠলো। ওগুলো হতে শব্দ আসলোঃ “তুমি যেটা চাও পছন্দ করে নাও।” তখন সে কঠিন কালো মেঘখণ্ডটি পছন্দ করলো। তৎক্ষণাৎ ওর মধ্য হতে শব্দ আসলোঃ “ওকে ছাই ও মাটিতে পরিণতকারী করে দাও, যাতে আ’দ সম্প্রদায়ের একজনও বাকী না থাকে।” আমি যতটুকু জানতে পেরেছি তা এই যে, তাদের উপর শুধু আমার এই অঙ্গুরীর বৃত্ত পরিমাণ জায়গা দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়েছিল এবং তাতেই তারা সবাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।” হযরত আবু ওয়ায়েল (রঃ) বলেন যে, এটা সম্পূর্ণ সঠিক বর্ণনা। আরবে এই প্রথা ছিল যে, যখন তারা কোন দূত পাঠাতো তখন তাকে বলতোঃ “তুমি আ’দ সম্প্রদায়ের দূতের মত হয়ো না।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা খুবই দুর্বল বর্ণনা। যেমন সূরায়ে আ’রাফের তাফসীরে গত হয়েছে)

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে কখনো এমনভাবে খিলখিল করে হাসতে দেখিনি যে, তাঁর দাঁতের মাড়ি দেখা যায়। তিনি মুচকি হাসতেন। যখন আকাশে মেঘ উঠতো এবং ঝড় বইতে শুরু করতো তখন তার চেহারায় চিন্তার চিহ্ন প্রকাশিত হতো। একদিন আমি তাকে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! মেঘ ও বাতাস দেখে তো মানুষ খুশী হয় যে, মেঘ হতে বৃষ্টি বর্ষিত হবে। কিন্তু আপনার অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত হয় কেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! ঐ মেঘের মধ্যে যে শাস্তি নেই এ ব্যাপারে আমি কি করে নিশ্চিন্ত হতে পারি? একটি সম্প্রদায়কে বাতাস দ্বারাই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। একটি সম্প্রদায় শাস্তির মেঘ দেখে বলেছিলঃ এটা মেঘ, যা আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করবে।”

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন আকাশের কোন প্রান্তে মেঘ উঠতে দেখতেন তখন তিনি তাঁর সমস্ত কাজ ছেড়ে দিতেন, যদিও নামাযের মধ্যে থাকতেন। আর ঐ সময় তিনি নিম্নের দু’আটি পড়তেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! এর মধ্যে যে অকল্যাণ রয়েছে তা হতে আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এ হাদীসটি অন্য সনদে বর্ণিত হয়েছে) আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে তিনি মহামহিমান্বিত আল্লাহর প্রশংসা করতেন। আর ঐ মেঘ হতে বৃষ্টি বর্ষিত হলে তিনি নিম্ন লিখিত দুআটি পাঠ করতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এর কল্যাণ, এর মধ্যে যা আছে তার কল্যাণ এবং এর সাথে যা পাঠানো হয়েছে তার কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আর আপনার নিকট এর অমঙ্গল, এর মধ্যে যা আছে তার অমঙ্গল এবং এর সাথে যা পাঠানো হয়েছে তার অমঙ্গল ও অনিষ্ট হতে আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি।”

যখন আকাশে মেঘ উঠতো তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর রঙ পরিবর্তন হয়ে যেতো। কখনো তিনি ঘর হতে বাইরে যেতেন এবং কখনো বাহির হতে ভিতরে আসতেন। যখন বৃষ্টি বর্ষিত হয়ে যেতো তখন তার এই বিচলিত ভাব ও উদ্বেগ দূর হতো। হযরত আয়েশা (রাঃ) এটা বুঝতে পারতেন। একবার তিনি তাঁকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বললেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! আমি এই ভয় করি যে, না জানি হয়তো এটা ঐ মেঘই হয় না কি যে সম্পর্কে আ’দ সম্প্রদায় বলেছিলঃ এটা তো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দান করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) সূরায়ে আ’রাফে আ’দ সম্প্রদায়ের ধ্বংসলীলার এবং হযরত হূদ (আঃ)-এর পূর্ণ ঘটনা অতীত হয়েছে। সুতরাং আমরা এখানে ওটার আর পুনরাবৃত্তি করছি না।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আ’দ সম্প্রদায়ের উপর অঙ্গুরীর বৃত্ত পরিমাণ জায়গা দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়েছিল। এই বাতাস প্রথমে গ্রামবাসীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অতঃপর তা প্রবাহিত হয় শহরবাসীর উপর। এদেখে তারা বলেঃ ‘এটা অবশ্যই আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করবে। কিন্তু ওর মধ্যে আসলে ছিল জংলী লোকেরা। তাদেরকে ঐ শহরবাসীদের উপর নিক্ষেপ করা হয়। ফলে তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যায়। ঐ সময় বাতাসের খাজাঞ্চীর উপর ওর ঔদ্ধত্য এতো তীব্র ছিল যে, ওটা দরযার ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
২৬-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা উম্মতে মুহাম্মাদ (সঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেনঃ আমি তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদেরকে সুখ-ভোগের উপকরণ হিসেবে যে ধন-মাল, সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি দিয়েছিলাম, সেই পরিমাণ তো তোমাদেরকে এখনো দেয়া হয়নি। তাদেরও কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ছিল। কিন্তু যখন তারা আমার নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে বসলো এবং আমার আযাবের ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করলো, অবশেষে যখন তাদের উপর আমার আযাব এসেই পড়লো, তখন তাদের এই বাহ্যিক উপকরণ তাদের কোনই কাজে আসলো না। ঐ আযাব তাদের উপর এসেই পড়লো যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো। সুতরাং তোমাদের তাদের মত হওয়া উচিত নয়। এমন যেন না হয় যে, তাদের মত শাস্তি তোমাদের উপরও এসে পড়ে এবং তাদের মত তোমাদেরও মূলোৎপাটন করে দেয়া হয়।

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ হে মক্কাবাসী! তোমরা তোমাদের আশে-পাশে একটু চেয়ে দেখো যে, তাদেরকে কিভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কিভাবে তারা তাদের কৃতকর্মের ফল পেয়ে গেছে। আহকাফ যা ইয়ামনের পাশেই হাযরা মাউতের অঞ্চলে অবস্থিত, তথাকার অধিবাসী আ’দ সম্প্রদায়ের পরিণামের দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ কর! আর তোমাদের ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী সামদ সম্প্রদায়ের পরিণামের কথাই একটু চিন্তা কর। ইয়ামনবাসী ও মাদইয়ানবাসী সম্প্রদায়ের পরিণামের প্রতি একটু লক্ষ্য কর। তোমরা তো যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে সেখান দিয়ে প্রায়ই গমনাগমন করে থাকো। হযরত লূত (আঃ)-এর বাহীরা সম্প্রদায় হতে তোমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তাদের বাসভূমিও তোমাদের যাতায়াতের পথেই পড়ে। এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি আমার নিদর্শনাবলী বিশদভাবে বিবৃত করেছি যাতে তারা সৎপথে ফিরে আসে।

ইরশাদ হচ্ছেঃ তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে মা’ব্দরূপে গ্রহণ করেছিল, যদিও এতে তাদের ধারণা এই ছিল যে, তাদের মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে, কিন্তু যখন তাদের উপর আল্লাহর আযাব এসে পড়লো এবং তারা তাদের ঐ মিথ্যা মা’ৰূদদের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো তখন তারা তাদের কোন সাহায্য করলো কি? কখনোই না। বরং তাদের প্রয়োজন ও বিপদের সময় তাদের ঐসব বাতিল মা’বূদ অন্তর্হিত হয়ে পড়লো। তাদেরকে খুঁজেও পাওয়া গেল না। মোটকথা, তাদেরকে পূজনীয় হিসেবে গ্রহণ করে তারা চরম ভুল করেছিল। তাদের মিথ্যা ও অলীক উদ্ভাবনের পরিণাম এই রূপই।
২৯-৩২ নং আয়াতের তাফসীর:

মুসনাদে আহমাদে হযরত যুবায়ের (রাঃ) হতে এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, এটা নাখলা নামক স্থানের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ সময় ইশার নামায আদায় করছিলেন। এসব জ্বিন তার আশে-পাশে একত্রিতভাবে দাড়িয়ে যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ওগুলো নাসীবাইনের জ্বিন ছিল। তারা সাতজন ছিল।

প্রসিদ্ধ ইমাম হাফিয আবু বকর বায়হাকী (রঃ) তাঁর দালাইলুন নবুওয়াত নামক গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে একটি রিওয়াইয়াত লিপিবদ্ধ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জ্বিনদেরকে শুনাবার উদ্দেশ্যেও কুরআন পাঠ করেননি এবং তাদেরকে তিনি দেখেননি। তিনি তো স্বীয় সাহাবীদের সাথে উকাযের বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। এদিকে ব্যাপার এই ঘটেছিল যে, শয়তানদেরও আকাশের খবরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের উপর উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হওয়া শুরু হয়েছিল। শয়তানরা এসে তাদের কওমকে এ খবর দিলে তারা বলেঃ “অবশ্যই নতুন কিছু একটা ঘটেছে। সুতরাং তোমরা অনুসন্ধান করে দেখো।” একথা শুনে তারা বেরিয়ে পড়লো। তাদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন দিকে গেল। যে দলটি আরব অভিমুখে গেল, তারা যখন তথায় পৌঁছলো তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উকাযের দিকে যাওয়ার পথে, নাখলায় স্বীয় সাহাবীদেরকে (রাঃ) ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন। ঐ জ্বিনদের কানে যখন তাঁর তিলাওয়াতের শব্দ পৌঁছলো তখন তারা তথায় থেমে গেল এবং কান লাগিয়ে মনোযোগের সাথে কুরআন পাঠ শুনতে লাগলো। এরপরে তারা পরস্পর বলাবলি করলোঃ এটাই ঐ জিনিস, যার কারণে আমাদের আকাশ পর্যন্ত পৌঁছার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এখান হতে ফিরে তারা সরাসরি তাদের কওমের নিকট পৌঁছে যায় এবং তাদেরকে বলেঃ “আমরা তো এক বিস্ময়কর কিতাব শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ-নির্দেশ করে, ফলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরীক স্থির করবো না।” এই ঘটনারই সংবাদ আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সূরায়ে জ্বিনে দিয়েছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ জ্বিনেরা অহী শুনতে থাকতো। একটা কথা যখন তাদের কানে যেতো তখন তারা ওর সাথে আরো দশটি কথা মিলিয়ে দিতো। সুতরাং একটি সত্য হতো এবং বাকী সবই মিথ্যা হয়ে যেতো। ইতিপূর্বে তাদের উপর তারকা নিক্ষেপ করা হতো না। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) প্রেরিত হলেন তখন তাদের উপর উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হতে লাগলো। তারা তাদের বসার জায়গায় যখন পৌছতো তখন তাদের উপর উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হতো। ফলে তারা সেখানে আর থাকতে পারতো না। তারা তখন এসে ইবলীসের নিকট এর অভিযোগ করলো। ইবলীস তখন বললো, অবশ্যই নতুন ব্যাপার কিছু ঘটেছে। তাই সে তার সেনাবাহিনীকে এই তথ্য উদঘাটনের জন্যে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিলো। একটি দল রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে নালার দুটি পাহাড়ের মাঝে নামায রত অবস্থায় পেলো। অতঃপর তারা গিয়ে ইবলীসকে এ খবর দিয়ে দিলো। ইবলীস তখন বললোঃ “এ কারণেই আকাশ রক্ষিত হয়েছে এবং তোমাদের তথায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ)-ও এ রিওয়াইয়াতটি এনেছেন)

হযরত হাসান বসরী (রঃ)-ও এ কথাই বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এ ঘটনার খবর রাখতেন না। যখন তার উপর অহী অবতীর্ণ হয় তখন তিনি তা জানতে পারেন। সীরাতে ইবনে ইসহাকে মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব (রঃ)-এর একটি দীর্ঘ রিওয়াইয়াত বর্ণিত আছে, যাতে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর তায়েফ গমন, তায়েফবাসীকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান এবং তাদের তা প্রত্যাখ্যান করণ ইত্যাদি পূর্ণ ঘটনা বর্ণিত আছে। ঐ শোচনীয় অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে দুআটি করেছিলেন সেটাও হযরত হাসান বসরী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। দু’আটি নিম্নরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি মানুষের উপর আমার শক্তির দুর্বলতা, আমার কৌশলের স্বল্পতা এবং আমার অসহায়তার অভিযোগ আপনার নিকট করছি। হে দয়ালুদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দয়ালু! আপনিই দয়ালুদের মধ্যে পরম দয়ালু। যাদেরকে দুর্বল মনে করা হয় আপনি তাদের প্রতিপালক। আপনি আমারও প্রতিপালক। আপনি আমাকে কার কাছে সমর্পণ করছেন? কোন দূরবর্তী শত্রুর কাছে কি, যে আমাকে অপারগ করবে? না কোন নিকটবর্তী বন্ধুর কাছে, যার কাছে আপনি আমার ব্যাপারে অধিকার দিয়ে রেখেছেন? যদি আমার প্রতি আপনার অসন্তোষ না থাকে তবে আমি আমার এ দুঃখ ও বেদনার জন্যে কোন পরোয়া করি না, তবে যদি আপনি আমাকে নিরাপদে রাখেন তাহলে এটা হবে আমার জন্যে সুখ-শান্তির ব্যাপার। আমি আপনার চেহারার ঔজ্জ্বল্যের মাধ্যমে, যার কারণে সমস্ত অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠেছে এবং যার উপর দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কাজের কল্যাণ নির্ভরশীল, আমার উপর আপনার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি নাযিল হোক এর থেকে আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আপনার সন্তুষ্টিই কামনা করি এবং পুণ্য কাজ করা ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকার ক্ষমতা একমাত্র আপনার সাহায্যের মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব।” এই সফর হতে প্রত্যাবর্তনের পথেই তিনি নাখলায় রাত্রি যাপন করেন এবং ঐ রাত্রেই নাসীবাইনের জ্বিনেরা তাঁর কুরআন-তিলাওয়াত শ্রবণ করে। এটা সঠিক তো বটে, কিন্তু এতে এই উক্তিটির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, জ্বিনদের আল্লাহর কালাম শ্রবণ করা হচ্ছে অহী শুরু হওয়ার সময়ের ঘটনা। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উপরে বর্ণিত হাদীস হতে এটা প্রমাণিত হয়। আর তার তায়েফে গমন হচ্ছে তাঁর চাচা আবূ তালিবের মৃত্যুর পরের ঘটনা, যা হিজরতের এক বছর অথবা খুব বেশী হলে দু’বছর পূর্বের ঘটনা। যেমন এটা সীরাতে ইবনে ইসহাক প্রভৃতি গ্রন্থে রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

আবু বকর ইবনে শায়বা (রঃ)-এর বর্ণনামতে ঐ জ্বিনদের সংখ্যা ছিল নয়। তাদের একজনের নাম ছিল যাভীআহ্। তাদের ব্যাপারেই (আরবী) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। সুতরাং এই রিওয়াইয়াত এবং এর পূর্ববর্তী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর রিওয়াইয়াতের চাহিদা এটাই যে, ঐ সময় যে জ্বিনগুলো এসেছিল তাদের উপস্থিতির খবর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর জানা ছিল না। তারা তো তার অজান্তে তার মুখে আল্লাহর বাণী শুনে ফিরে গিয়েছিল। এরপরে প্রতিনিধি হিসেবে জ্বিনেরা দলে দলে তাঁর খিদমতে উপস্থিত হয়েছিল। যেমন এই অলোচনা সম্বলিত হাদীস ও আসারগুলো নিজ নিজ স্থানে আসছে ইনশা আল্লাহ।

হযরত আব্দুর রহমান (রঃ) হযরত মাসরূক (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “যেই। রাত্রে জ্বিনেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে কুরআন শুনেছিল ঐ রাত্রে কে তাঁকে এ খবর অবহিত করে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমাকে তোমার পিতা হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে জ্বিনদের আগমনের খবর একটি গাছ অবহিত করেছিল। তাহলে খুব সম্ভব এটা প্রথমবারের খবর হবে এবং হাঁ বাচককে আমরা না বাচকের উপর অগ্রগণ্য মনে করবো। এও হতে পারে যে, যখন জুিনেরা তাঁর কুরআন পাঠ শুনছিল তখন তো তিনি এ খবর জানতেন না, কিন্তু ঐ গাছটি তাঁকে তাদের উপস্থিতির খবর প্রদান করে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। আবার এও হওয়া সম্ভব যে, এ ঘটনাটি এর পরবর্তী ঘটনাবলীর একটি হবে। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ্।

ইমাম হাফিয বায়হাকী (রঃ) বলেন যে, প্রথমবারে তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) জ্বিনদেরকে দেখেননি এবং বিশেষভাবে তাদেরকে শুনাবার জন্যে কুরআন পাঠও করেননি। হ্যা, তবে এর পরে জ্বিনেরা তাঁর কাছে আসে এবং তিনি তাদেরকে কুরআন পাঠ করে শুনিয়ে দেন এবং তাদেরকে তিনি মহামহিমান্বিত আল্লাহর দিকে আহ্বান জানান।

এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীস সমূহঃ

হযরত আলকামা (রঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “জ্বিনদের আগমনের রাত্রিতে আপনাদের মধ্যে কেউ কি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে ছিলেন?” উত্তরে তিনি বলেন, তাঁর সাথে কেউই ছিলেন না। তিনি সারা রাত আমাদের হতে অনুপস্থিত থাকেন এবং আমরা থেকে থেকে বারবার এই ধারণাই করি যে, সম্ভবতঃ কোন শত্রু তার সাথে প্রতারণা করেছে। ঐ রাত্রি আমাদের খুব খারাপভাবে কাটে। সুবহে সাদেকের কিছু পূর্বে আমরা দেখি যে, তিনি হেরা পর্বতের গুহা হতে প্রত্যাবর্তন করছেন। আমরা তখন তার কাছে আমাদের সারা রাত্রির অবস্থা বর্ণনা করি। তখন তিনি বলেনঃ “আমার কাছে জ্বিনদের প্রতিনিধি এসেছিল, যাদের সঙ্গে গিয়ে আমি তাদেরকে কুরআন শুনিয়েছি।” অতঃপর তিনি আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে যান এবং তাদের নিদর্শনাবলী ও তাদের আগুনের নিদর্শনাবলী আমাদেরকে প্রদর্শন করেন।”

শা’বী (রঃ) বলেন যে, জ্বিনেরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট খাদ্যের আবেদন জানায়। আমির (রঃ) বলেন যে, তারা তাঁর নিকট মক্কায় এ আবেদন জানিয়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “প্রত্যেক হাড়, যার উপর আল্লাহর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তা তোমাদের হাতে পূর্বের চেয়ে গোশত বিশিষ্ট হয়ে পতিত হবে। আর জন্তুর মল ও গোবর তোমাদের জন্তুগুলোর খাদ্য হবে। সুতরাং হে মুসলিমবৃন্দ! তোমরা এ দুটো জিনিস দ্বারা ইতিনজা করো না। এগুলো তোমাদের জ্বিন ভাইদের খাদ্য।” | অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “ঐ রাত্রে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে না পেয়ে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ি এবং তাঁকে আমরা সমস্ত উপত্যকা ও ঘাঁটিতে অনুসন্ধান করি।” অন্য একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আজ রাত্রে আমি জ্বিনদেরকে কুরআন শুনিয়েছি এবং তাদেরই মধ্যে এ কাজে রাত্রি কাটিয়েছি।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আজ রাত্রে তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছা করলে জ্বিনদের কাজে আমার সাথে থাকতে পারে।” তখন আমি ছাড়া আর কেউই এ কাজে তার কাছে হাযির হলো না। তিনি আমাকে সাথে নিয়ে চললেন। মক্কা শরীফের উঁচু অংশে পৌঁছে তিনি স্বীয় পা মুবারক দ্বারা একটি রেখা টানলেন এবং আমাকে বললেনঃ “তুমি এখানেই বসে থাকো।” অতঃপর তিনি সামনে অগ্রসর হন এবং এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি কিরআত পাঠ শুরু করেন। তারপর তার চতুর্দিকে এমন সব দল জমায়েত হয় যে, তাঁর মধ্যে ও আমার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে যায় এবং তার কিরআত আর আমার কানে আসেনি। এরপর আমি দেখি যে, মেঘখণ্ড যেভাবে ভেঙ্গে যায় সেই ভাবে তারা এদিক ওদিক যেতে লাগলো এবং খুব অল্প সংখ্যকই অবশিষ্ট থাকলো। তারপর ফজরের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) অবসর লাভ করলেন এবং সেখান হতে দূরে চলে গেলেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করে তিনি আমার নিকট আসলেন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “বাকীগুলো কোথায়?” আমি জবাবে বললামঃ এই যে তারা। অতঃপর তিনি তাদেরকে হাড় ও জন্তুর মল বা গোবর দিলেন। তারপর তিনি মুসলমানদেরকে এ দুটি জিনিস দ্বারা ইসতিনজা করতে নিষেধ করলেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এই রিওয়াইয়াতের দ্বিতীয় সনদে আছে যে, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে বসিয়েছিলেন, বসাবার পর তিনি তাঁকে বলেছিলেনঃ “সাবধান! এখান হতে সরবে না, অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।” অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, ফজরের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট এসে তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ না; না। আল্লাহর কসম! আমি জনগণের কাছে ফরিয়াদ করার ইচ্ছা করেছিলাম। কিন্তু আমি শুনতে পাই যে, আপনি লাঠি দ্বারা তাদেরকে ধমকাচ্ছেন এবং বলছেনঃ “তোমরা বসে পড়।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “তুমি যদি এখান হতে বের হতে তবে ভয় ছিল যে, তাদের কেউ হয়তো তোমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যেতো।” তারপর তিনি তাঁকে বললেনঃ “আচ্ছা, তুমি কিছু দেখেছিলে কি?” জবাবে তিনি বলেনঃ “হ্যা, লোকগুলো ছিল কালো, অপরিচিত, ভয়াবহ এবং সাদা কাপড় পরিহিত।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এগুলো ছিল নাসীবাইনের জ্বিন। তারা আমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল।

আমি তাদেরকে হাড় ও গোবর দিয়েছিলাম।” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এগুলোতে তাদের উপকার কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “প্রত্যেক হাড় তাদের হাতে আসামাত্রই ঐরূপ হয়ে যাবে ওটা খাওয়ার সময় যেরূপ ছিল অর্থাৎ গোশত বিশিষ্ট হয়ে যাবে। গোবরেও তারা ঐ দানা পাবে যা ঐদিনে ছিল যেই দিন ওটা খাওয়া হয়েছিল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ যেন পায়খানা হতে বের হয়ে হাড় অথবা গোবর দ্বারা। ইসতিনজা না করে।”

এই রিওয়াইয়াতের অন্য সনদে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আজ রাত্রে পনেরোজন জ্বিন, যারা পরস্পর চাচাতো ও ফুফাতো ভাই, কুরআন শুনার জন্যে আমার নিকট আসবে।” তাতে হাড় ও গোবরের সাথে কয়লার কথাও রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “সকাল হলে আমি ঐ জায়গায় গমন করে দেখি যে, ওটা ষাটটি উটের বসার সমান জায়গা।”

অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, যখন জ্বিনদের ভিড় হয়ে গেল তখন তাদের সরদার ওয়াযদান বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি এদেরকে এদিক ওদিক করে দিয়ে আপনাকে এই কষ্ট হতে রক্ষা করছি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আমার আল্লাহ তা’আলা হতে বড় রক্ষক আর কেউই নেই।” নবী (সঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার নিকট পানি আছে কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আমার নিকট পানি নেই বটে, তবে একটি পাত্রে খেজুর ভিজানো পানি (নবীয়) রয়েছে।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “উত্তম খেজুর ও পবিত্র পানি।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) মুসনাদে আহমাদের এ হাদীসে এও আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে বলেনঃ “আমাকে তুমি এই পানি দ্বারা অযু করিয়ে দাও।” অতঃপর তিনি অযু করেন এবং বলেনঃ “হে আল্লাহর বান্দা! এটা তো পবিত্র পানীয়।”

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) জ্বিনদের নিকট হতে ফিরে আসেন তখন তিনি ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলেন। সুতরাং হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ব্যাপার কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমার কাছে আমার মৃত্যুর খবর পৌঁছে গেছে।” এই হাদীসটিই কিছুটা বৃদ্ধির সাথে হাফিয আবু নঈম (রঃ)-এর কিতাবু দালাইলিন নবুওয়াতের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার পরে খলীফা হবেন এমন ব্যক্তির নাম করুন।” তিনি বললেনঃ ‘কার নাম করবো?” হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) জবাবে বললেনঃ “হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে মনোনীত করুন।” একথা শুনে তিনি নীরব থাকলেন। কিছু দূর চলার পর পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঐ অবস্থা হলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) পূর্বের ন্যায় প্রশ্ন করলেন এবং তিনি পূর্বের মতই উত্তর দিলেন। হযরত ইবনে মাসউদ খলীফা নির্বাচনের কথা বললে তিনি প্রশ্ন করেনঃ “কাকে?” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) উমার (রাঃ)-এর নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু এবারও রাসূলুল্লাহ (সঃ) নীরব থাকেন। আবার কিছু দূর যাওয়ার পর তার ঐ একই অবস্থা দেখা দিলে ঐ একই প্রশ্ন ও উত্তরের আদান প্রদান হয়। এবার হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হযরত আলী ইবনে আবি তালিব। (রাঃ)-এর নাম প্রস্তাব করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার সত্তার শপথ! যদি মানুষ তার আনুগত্য স্বীকার করে তবে তারা জান্নাতে চলে যাবে। কিন্তু এটা খুবই গারীব হাদীস এবং খুব সম্ভব এটা রক্ষিত নয়। আর যদি এর বিশুদ্ধতা মেনে নেয়া হয় তবে এ ঘটনাকে মদীনার ঘটনা স্বীকার করতে হবে। সেখানেও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে জ্বিনদের প্রতিনিধি দল এসেছিল, যেমন সত্বরই আমরা বর্ণনা করছি ইনশাআল্লাহ। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জীবনের শেষ সময় ছিল মক্কা বিজয়ের পরবর্তী সময়। যখন মানব ও দানব দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল এবং অবতীর্ণ হয়েছিল নিম্নের সূরাটিঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তার প্রবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো, তিনি তো তাওবা কবুলকারী।”(১১১:১-৩) এতে তাঁকে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হয়, যেমন এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি এবং আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর আনুকূল্য করেছেন।

এই হাদীসগুলো আমরা ইনশাআল্লাহ এই সূরার তাফসীরে আনয়ন করবো। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

উপরোক্ত হাদীসটি অন্য সনদেও বর্ণিত আছে। কিন্তু এর ইসনাদও গারীব বা দুর্বল এবং পূর্বাপর সম্পর্কও বিস্ময়কর।

হযরত ইকরামা (রাঃ) বলেন যে, এই জ্বিনগুলো জাযীরায়ে মুসিলের ছিল। তাদের সংখ্যা ছিল বারো হাজার। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) ঐ রেখা অংকিত জায়গায় বসেছিলেন। কিন্তু জ্বিনদের খেজুর বৃক্ষ বরাবর দেহ ইত্যাদি দেখে তিনি ভয় পান এবং পালিয়ে যাবার ইচ্ছা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিষেধাজ্ঞার কথা তার স্মরণ হয় যে, তিনি যেন ঐ অংকিত জায়গার বাইরে না। যান। যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে এটা বর্ণনা করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি যদি এর সীমা অতিক্রম করতে তবে কিয়ামত পর্যন্ত তোমার ও আমার মধ্যে সাক্ষাৎ লাভ সম্ভব হতো না।

অন্য এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, .. (আরবী)-এই আয়াতে যে জ্বিনদের বর্ণনা রয়েছে তারা ছিল নীনওয়ার জ্বিন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে বলেনঃ “আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন তাদেরকে কুরআন শুনিয়ে দিই তোমাদের মধ্যে কে আমার সাথে গমন করবে? এতে সবাই নিরুত্তর থাকে। তিনি দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন করেন। এবারও সবাই নীরব থাকে। তার তৃতীয়বারের প্রশ্নের জবাবে হুযায়েল গোত্রের লোক হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার সাথে আমিই যাবো।” সুতরাং তাকে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হাজুন ঘাঁটিতে গেলেন। একটি রেখা অংকন করে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে তথায় বসিয়ে দিলেন এবং তিনি সামনে অগ্রসর হলেন। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) দেখতে পেলেন যে, গৃধিনীর মত কতকগুলো জীব মাটির খুবই নিকট দিয়ে উড়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর খুবই গোলমাল শুনা গেল। শেষ পর্যন্ত হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জীবনের ব্যাপারে আশংকা করলেন। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর কাছে আসলেন তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! গোলমাল কিসের ছিল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “তাদের একজন নিহতকে নিয়ে গণ্ডগোল ছিল। তার ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল। তাদের মধ্যে সঠিক ফায়সালা করে দেয়া হলো। এ ঘটনাগুলো পরিষ্কার যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইচ্ছাপূর্বক গিয়ে জ্বিনদেরকে কুরআন শুনিয়েছিলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছিলেন। আর ঐ সময় তাদের যে মাসআলাগুলোর দরকার ছিল সেগুলো তাদেরকে বলে দেন। হ্যা, তবে প্রথমবার যখন জ্বিনেরা তার মুখে কুরআন শ্রবণ করে ঐ সময় না তিনি তাদেরকে শুনাবার উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করেন, না তাদের আগমন ও উপস্থিতি তিনি অবগত ছিলেন। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ কথা বলেন। এর পরে তারা প্রতিনিধিরূপে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর নিকট আগমন করে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইচ্ছা করে তাদের কাছে আসেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন তখন হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাঁর সাথে ছিলেন না। তবে অবশ্যই তিনি কিছু দূরে বসেছিলেন। এই ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।

যে রিওয়াইয়াতগুলোতে আছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ছিলেন এবং যেগুলোতে তার না থাকার কথা রয়েছে, এ দু’ এর মধ্যে সামঞ্জস্য এভাবেও হতে পারে যে, প্রথমবার তিনি সঙ্গে ছিলেন না এবং দ্বিতীয়বার ছিলেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এটাও বর্ণিত আছে যে, নাখলাতে যে জ্বিনগুলো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছিল ওগুলো ছিল নীনওয়ার জ্বিন। আর মক্কা শরীফে যেসব জ্বিন তার খিদমতে হাযির হয়েছিল ওগুলো নাসীবাইনের জ্বিন ছিল। যে। রিওয়াইয়াতগুলোতে রয়েছেঃ “আমরা ঐ রাত্রি মন্দভাবে অতিবাহিত করেছি’ এর দ্বারা হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) ছাড়া অন্যান্য সাহাবীদেরকে বুঝানো হয়েছে যেগুলোতে এটা জানা ছিল না যে, তিনি জ্বিনদেরকে কুরআন শুনাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা খুব দূরের ব্যাখ্যা। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

ইমাম হাফিয আবু বকর বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রয়োজন ও অযুর জন্যে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) একটি পাত্রে পানি নিয়ে তার সাথে যেতেন। একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছনে পিছনে গিয়ে তিনি পৌছেন, তখন তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “কে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমি আবু হুরাইরা (রাঃ)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাঁকে বললেনঃ “আমার ইসতিনজার জন্যে পাথর নিয়ে এসো, কিন্তু হাড় ও গোবর আনবে না।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ “আমি আমার ঝুলিতে পাথর ভরে নিয়ে আসলাম এবং তাঁর সামনে রেখেদিলাম। এর থেকে ফারেগ হয়ে যখন তিনি চলতে শুরু করলেন তখন আমিও তার পিছনে পিছনে চলতে লাগলাম। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হাড় ও গোবর আনতে নিষেধ করার কারণ কি? জবাবে তিনি বললেনঃ “আমার কাছে নাসীবাইনের জ্বিন প্রতিনিধিরা এসেছিল এবং তারা আমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল। আমি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা জানিয়েছিলাম যে, তারা যে হাড় ও গোবরের উপর দিয়ে যাবে তা যেন তারা তাদের খাদ্য হিসেবে পায়।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে প্রায় এভাবেই বর্ণিত আছে)

সুতরাং এ হাদীসটি এবং এর পূর্ববর্তী হাদীসগুলো এ ইঙ্গিতই বহন করে যে, জ্বিনদের প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এর পরেও এসেছিল। এখন আমরা ঐ হাদীসগুলো বর্ণনা করছি যেগুলো দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, জ্বিনেরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট কয়েকবার এসেছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে যে রিওয়াইয়াত ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে ওটা ছাড়াও অন্য সনদে তার হতে আরো রিওয়াইয়াত বর্ণিত আছে। তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত ইবনে। আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি … (আরবী) আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “তারা ছিল সাতজন জ্বিন। তারা নাসীবাইনে বসবাস করতো। তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজের পক্ষ হতে দূত হিসেবে জ্বিনদের নিকট পাঠিয়েছিলেন।”

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, ঐ জ্বিনদের সংখ্যা ছিল সাত। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের তিনজনকে হিরানের অধিবাসী ও চারজনকে নাসীবাইনের অধিবাসী বলেছেন। তাদের নামগুলো হলো হিসসী, হিসসা, মিনসী, সা’সির, নাসির, আরদূবিয়া, আখতাম।

আবূ হামযা শিমালী (রঃ) বলেন যে, জ্বিনদের এই গোত্রটিকে বানু শীসবান বলা হতো। এ গোত্রটি জ্বিনদের অন্যান্য গোত্রগুলো হতে সংখ্যায় বেশী ছিল এবং তাদেরকে সম্ভান্ত বংশীয় হিসেবে মান্য করা হতো। সাধারণতঃ এরা। ইবলীসের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, এরা ছিল নয়জন, যাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল যাভীআহ। তারা আসলে নাখলা হতে এসেছিল। কোন কোন গুরুজন হতে বর্ণিত আছে যে, তারা ছিল পনেরোজন, যেমন এ বর্ণনা পূর্বে গত হয়েছে।

একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, তারা ষাটটি সওয়ারীর উপর সওয়ার হয়ে এসেছিল। তাদের নেতার নাম ছিল ওয়ারদান। এটাও বর্ণিত আছে যে, তারা ছিল তিনশজন এবং এক রিওয়াইয়াতে তাদের সংখ্যা বারো হাজারও রয়েছে। এসবের মধ্যে সামঞ্জস্য এভাবে হতে পারে যে, প্রতিনিধিরা যেহেতু কয়েকবার এসেছিল, সেহেতু হতে পারে যে, কোনবার ছিল ছয়, সাত বা নয় জন, কোনবার এর চেয়ে বেশী ছিল এবং কোনবার এর চেয়েও বেশী ছিল। এর দলীল হিসেবে সহীহ বুখারীর এ রিওয়াইয়াতটিও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) যখন কোন বিষয় সম্পর্কে বলতেনঃ ‘আমার ধারণায় এটা এইরূপ হবে তখন তা প্রায় ঐরূপই হতো। একদা তিনি বসেছিলেন, এমন সময় একজন সুশ্রী লোক তার পার্শ্ব দিয়ে গমন করে। তাকে দেখে তিনি মন্তব্য করেনঃ “যদি আমার ধারণা ভুল না হয় তবে আমি বলতে পারি যে, এ লোকটি অজ্ঞতার যুগে লোকদের গণক বা যাদুকর ছিল। যাও, তাকে এখানে নিয়ে এসো।” লোকটি তার কাছে আসলে তিনি তার নিকট নিজের ধারণা প্রকাশ করলেন। সে তখন বললোঃ “আমি মুসলমানদের মধ্যে এমন বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোক আর দেখিনি।” হযরত উমার (রাঃ) তখন তাকে বললেনঃ “এখন আমার কথা এই যে, তুমি তোমার জানা কোন সঠিক ও সত্য খবর আমাদেরকে শুনিয়ে দাও।” সে বললোঃ “আচ্ছা, তাহলে শুনুন। আমি জাহিলিয়াতের যুগে লোকদের গণক ছিলাম। আমার কাছে আমার সাথী এক জ্বিন, যে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর খবর আমার নিকট এনেছিল তা হচ্ছে এই যে, একদা আমি বাজারে ছিলাম, এমন সময় সে অত্যন্ত ভীত-বিহ্বল অবস্থায় আমার কাছে এসে বললোঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি কি জ্বিনদের ধ্বংস, নৈরাশ্য এবং তাদের ছড়িয়ে পড়ার পর সংকুচিত হয়ে যাওয়া লক্ষ্য করনি এবং তাদের দুর্গতি দেখোনি?” এ কথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “সে সত্য কথা বলেছে। একদা আমি তাদের মা’ৰূদদের (মূর্তিগুলোর) পার্শ্বে ঘুমিয়েছিলাম, এমন সময় একটি লোক এসে তথায় একটি গোবৎস (বাছুর) যবেহ করলো। অকস্মাৎ এমন একটি ভীষণ শব্দ হলো এরূপ উচ্চ ও বিকট শব্দ আমি ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। সে বললোঃ “হে জালীজ! পরিত্রাণকারী বিষয় এসে গেছে। একজন বাকপটু ব্যক্তি বাক চাতুর্যের সাথে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলছেন।” শব্দ শুনে সবাই তো ভয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু আমি ওখানেই বসে থাকলাম যে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি ঘটে? দ্বিতীয়বার ওভাবেই ঐ শব্দই শুনা গেল এবং সে ঐ কথাই বললো। অতঃপর কিছুদিন পরেই নবী (সঃ)-এর নবুওয়াতের আওয়ায় আমাদের কানে আসতে শুরু হলো। এই রিওয়াইয়াতের বাহ্যিক শব্দ দ্বারা তো এটাই জানা যাচ্ছে যে, হযরত উমার ফারূক (রাঃ) স্বয়ং যবেহকৃত বাছুর হতে এই শব্দ শুনেছিলেন। আর একটি দুর্বল রিওয়াইয়াতে স্পষ্টভাবে এটা এসেও গেছে। কিন্তু বাকী অন্যান্য রিওয়াইয়াতগুলো এটা বলে দেয় যে, ঐ যাদুকরই নিজের দেখা-শুনার একটি ঘটনা এটাও বর্ণনা করেছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। ইমাম বায়হাকী (রঃ) এটাই বলেছেন এবং এটাই ভাল বলে মনে হচ্ছে। ঐ ব্যক্তির নাম ছিল সাওয়াদ ইবনে কারিব। যে ব্যক্তি এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে চায় তিনি যেন আমার ‘সীরাতে উমার’ নামক কিতাবটি দেখে নেন। সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্যে।

ইমাম বায়হাকী (রঃ) বলেনঃ খুব সম্ভব এটা ঐ যাদুকর বা গণক যার বর্ণনা নাম ছাড়াই সহীহ হাদীসে রয়েছে। হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মিম্বরে উঠে ভাষণ দিচ্ছিলেন। ঐ অবস্থাতেই তিনি জনগণকে জিজ্ঞেস করেনঃ “সাওয়াদ ইবনে কারিব এখানে আছে কি?” কিন্তু ঐ পূর্ণ এক বছরের মধ্যে কেউ হ্যা’ বললো না। পরের বছর আবার তিনি এটা জিজ্ঞেস করলেন। তখন হযরত বারা’ (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “সাওয়াদ ইবনে কারিব কে? এর দ্বারা উদ্দেশ্য কি?” জবাবে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর।” এভাবে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল এমতাবস্থায় হযরত সাওয়াদ ইবনে কারিব (রাঃ) তথায় অকস্মাৎ হাযির হয়ে যান। হযরত উমার (রাঃ) তখন তাকে বলেনঃ “হে সাওয়াদ (রাঃ)! তোমার ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক ঘটনাটি বর্ণনা কর ।” তিনি তখন বললেনঃ “হ্যা, তাহলে শুনুন। আমি ভারতবর্ষে গমন করেছিলাম এবং তথায় অবস্থান করছিলাম। একদা রাত্রে আমার সাথী জ্বিনটি আমার কাছে আসে। ঐ সময় আমি ঘুমিয়েছিলাম। সে আমাকে জাগ্রত করে এবং বলেঃ “উঠো এবং জ্ঞান-বিবেক থাকলে শুনে ও বুঝে নাও যে, লুওয়াই ইবনে গালিব গোত্রের মধ্য হতে আল্লাহর রাসূল (সঃ) প্রেরিত হয়েছেন।” অতঃপর সে কবিতায় বললোঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি জ্বিনদের অনুভূতি এবং তাদের বস্তা ও বিছানা-পত্র বাঁধা দেখে বিস্ময়বোধ করছি। তুমি যদি হিদায়াত লাভ করতে চাও তবে এখনই মক্কার পথে যাত্রা শুরু কর। তুমি বুঝে নাও যে, ভাল ও মন্দ জ্বিন সমান নয়। অতি সত্বর গমন কর এবং বানু হাশিমের ঐ প্রিয় ব্যক্তির সুন্দর চেহারা দর্শনের মাধ্যমে স্বীয় চক্ষুদ্বয় ঠাণ্ডা কর।”

আমাকে পুনরায় তন্ত্রায় চেপে ধরে এবং সে আবার আমাকে জাগিয়ে তোলে। অতঃপর বলেঃ “হে সাওয়াদ ইবনে কারিব (রাঃ)! মহামহিমান্বিত আল্লাহ নবী (সঃ)-কে পাঠিয়েছেন, সুতরাং তুমি তাড়াতাড়ি তাঁর নিকট গিয়ে হিদায়াত লাভে ধন্য হও।” দ্বিতীয় রাত্রে আবার সে আমার নিকট আসে এবং আমাকে জাগিয়ে দিয়ে কবিতার মাধ্যমে বলেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি জ্বিনদের অনুসন্ধান এবং তাদের বস্তা ও থলে কষা দেখে বিস্মিত হচ্ছি, তুমিও যদি সুপথ পেতে চাও তবে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাও। জেনে রেখো যে, ওদের দুই পা ওদের লেজের মত নয়। তুমি তাড়াতাড়ি উঠো এবং বানু হাশিমের ঐ পছন্দনীয় ব্যক্তির নিকট পৌঁছে যাও এবং তাঁকে দর্শন করে স্বীয় চক্ষুদ্বয়কে জ্যোতির্ময় কর।”

তৃতীয় রাত্রে সে আবার আসলো এবং আমাকে জাগ্রত করে কবিতার ভাষায় বললোঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি জ্বিনদের খবর জেনে নেয়া এবং তাদের যাত্রীদের যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ দেখে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি। তারা সব হিদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি মক্কার পথে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। তাদের মন্দরা ভালোদের মত নয়। তুমিও উঠো এবং বানু হাশিমের এই মহান ব্যক্তির খিদমতে হাযির হয়ে যাও। জেনে রেখো যে, মুমিন জ্বিনেরা কাফির জ্বিনদের মত নয়।”

পর্যায়ক্রমে তিন রাত্রি ধরে তার এসব কথা শুনে আমার হৃদয়ে ইসলামের প্রেম জেগে ওঠে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতি সম্মান ও ভালবাসায় আমার অন্তর পূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং আমি আমার স্ত্রীর পিঠে হাওদা কষে অন্য কোন জায়গায় অবস্থান না করে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে গেলাম। ঐ সময় তিনি মক্কা শহরে ছিলেন এবং জনগণ তার চতুম্পার্শ্বে এমনভাবে বসেছিলেন যেমন ঘোড়ার উপর কেশর থাকে। নবী (সঃ) আমাকে দেখেই বলে উঠলেনঃ “হে সাওয়াদ ইবনে কারিব (রাঃ)! তোমার আগমন শুভ হোক! তুমি আমার কাছে কি করে, কি উদ্দেশ্যে এবং কার কথায় এসেছে তা আমি জানি।” আমি তখন বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি কিছু কবিতা বলতে চাই, অনুমতি দিলে বলি। তিনি বললেনঃ “হে সাওয়াদ (রাঃ)! ঠিক আছে, তুমি বল।” তখন আমি বলতে শুরু করলামঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার নিকট আমার জ্বিন রাত্রে আমার ঘুমিয়ে পড়ার পর আসলো এবং আমাকে একটি সঠিক ও সত্য খবর দিলো। পর্যায়ক্রমে তিন রাত্রি সে আমার কাছে আসতে থাকলো এবং প্রতি রাত্রে আমাকে বলতে তাকলোঃ লুওয়াই ইবনে গালিবের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (সঃ) প্রেরিত হয়েছেন। আমিও। তখন সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম এবং তাড়াতাড়ি পথ অতিক্রম করে এখানে পৌঁছলাম। এখন আমি সাক্ষ্য দান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রতিপালক নেই এবং আপনি আল্লাহর বিশ্বস্ত রাসূল। আপনার শাফাআতের উপর আমার আস্থা রয়েছে। হে সর্বাপেক্ষা মহান ও পবিত্র লোকদের সন্তান! হে সমস্ত রাসূলের চেয়ে উত্তম রাসূল (সঃ)! আপনি যে আসমানী হুকুম আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন তা যতই কঠিন ও স্বভাব বিরুদ্ধ হোক না কেন, এটা সম্ভব নয় যে, আমরা তা। পরিহার করি। আপনি অবশ্যই কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশকারী হবেন। কেননা, সেই দিন সেখানে আপনি ছাড়া সাওয়াদ ইবনে কারিব (রাঃ)-এর সুপারিশকারী আর কে হবে?” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) খুব হাসলেন এবং বললেনঃ “হে সাওয়াদ (রাঃ)! তুমি মুক্তি পেয়ে গেছো।” হযরত উমার (রাঃ) এ ঘটনাটি শুনে হযরত সাওয়াদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “এখনো কি ঐ জ্বিন তোমার কাছে এসে থাকে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “যখন হতে আমি কুরআন পাঠ করতে শুরু করি তখন হতে আর সে আমার কাছে আসে না। আমি মহান আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে জ্বিনের পরিবর্তে তার পবিত্র কিতাব দান করেছেন।”

হাফিয আবু নাঈম (রঃ) স্বীয় ‘দালাইলুন নবুওয়াত’ নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, মদীনা শরীফেও জ্বিন-প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়েছিল। হযরত আমর ইবনে গাইলান সাকাফী (রঃ) হযরত আবদুল্লাহ। ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আমি অবগত হয়েছি যে, যেই রাত্রে জ্বিন-প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়েছিল সেদিন নাকি আপনিও তাঁর সাথে ছিলেন?” জবাবে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “হ্যা, এটা ঠিকই বটে।” হযরত আমর ইবনে গাইলান (রঃ) তখন তাঁকে বলেনঃ “আমাকে ঘটনাটি একটু শুনান তো?” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তখন বলতে শুরু করলেনঃ “দরিদ্র আসহাবে সুফফাকে লোকেরা রাত্রির খাবার খাওয়াবার জন্যে এক একজন এক একজনকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু আমাকে কেউই নিয়ে গেলেন না। আমি একাই রয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আমার পার্শ্ব দিয়ে গমনকালে আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “কে তুমি?” আমি উত্তরে বললামঃ আমি ইবনে মাসউদ (রাঃ)। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “তোমাকে কেউ নিয়ে যায়নি?” অতঃপর তিনি আমাকে বললেনঃ “আচ্ছা, তুমি আমার সাথেই চল, হয়তো কিছু মিলে যেতে পারে।” আমি তার সাথে চললাম। তিনি হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)-এর কক্ষে প্রবেশ করলেন। আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর বাড়ীর ভিতর হতে একজন দাসী এসে আমাকে বললো:“বাড়ীতে কোন খাবার নেই, আপনি আপনার শয়নস্থলে চলে যান। এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে জানাতে বললেন। আমি তখন। মসজিদে ফিরে আসলাম এবং কিছু কংকর জমা করে ছোট একটি ঢেরি করলাম এবং তাতে মাথা রেখে স্বীয় কাপড় জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। অল্পক্ষণ পরেই ঐ দাসী আবার আমার কাছে এসে বললোঃ “আল্লাহর রাসূল (সঃ) আপনাকে ডাকছেন।” আমি তখন তার সাথে চললাম এবং আমি মনে মনে এই আশা পোষণ করলাম যে, এবার অবশ্যই কিছু খাবার আমি পাবো। আমি গন্তব্যস্থলে পৌছলে দেখি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর হাতে খেজুর গাছের একটি সিক্ত ছড়ি, যেটাকে তিনি আমার বক্ষের উপর রেখে বললেনঃ “আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে তুমি আমার সাথে যাবে তো?” আমি জবাবে বললাম:আল্লাহ যা চান। তিনবার এই প্রশ্ন ও উত্তরের আদান-প্রদান হলো। অতঃপর তিনি চলতে শুরু করলেন এবং আমিও তার সাথে চলতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বাকী গারকাদে পৌছলেন। এরপর প্রায় ঐ বর্ণনাই রয়েছে যা উপরোল্লিখিত রিওয়াইয়াতগুলোতে গত হয়েছে। (এর ইসনাদ গারীব বা দুর্বল। এর সনদে একজন অস্পষ্ট বর্ণনাকারী রয়েছেন, যার নাম উল্লিখিত হয়নি)

হাফিয আবু নাঈম (রঃ) তাঁর দালাইলুন নবুওয়াত গ্রন্থে এনেছেন যে, মদীনার মসজিদে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ফজরের নামায আদায় করেন এবং ফিরে গিয়ে জনগণকে বলেনঃ “আজ রাত্রে জ্বিন প্রতিনিধিদের কাছে তোমাদের মধ্যে কে আমার সাথে যাবে?” কেউই তার এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তিনবারের প্রশ্নের পরেও কারো পক্ষ হতে কোন সাড়া এলো না। হযরত যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আমার পার্শ্ব দিয়ে গমন করার সময় আমার ডান হাতখানা ধরে আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলতে শুরু করেন। মদীনার পাহাড়গুলো হতে বহু দূর এগিয়ে গিয়ে একেবারে সমতল ভূমিতে পৌছে গেলেন। অতঃপর বর্শার সমান লম্বা লম্বা দেহ বিশিষ্ট মানুষ নীচে নীচে কাপড় পরিহিত অবস্থায় আগমন করতে শুরু করলো। আমি তো তাদেরকে দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম।” তারপর তিনি হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর হাদীসের অনুরূপ ঘটনা বর্ণনা করেন। (এ হাদীসটিও গারীব। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)

এই কিতাবেই একটি গারীব হাদীসে আছে, ইবরাহীম (রঃ) বলেনঃ “হযরত আব্দুল্লাহ্ (রাঃ)-এর সঙ্গীরা হজ্বপৰ্ব পালন উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আমিও তাঁদের মধ্যে একজন ছিলাম। পথে আমরা দেখি যে, একটি সাদা রঙ-এর সর্প পথে গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং ওটা হতে মেশকের সুগন্ধ আসছে। আমি আমার সঙ্গীদেরকে বললাম:আপনারা চলে যান। আমি এখানে অবস্থান করবো এবং শেষ পর্যন্ত সর্পটির অবস্থা কি হয় তা দেখবো। সুতরাং তারা সবাই চলে গেলেন। আর আমি ওখানেই রয়ে গেলাম। অল্পক্ষণ পরেই সাপটি মারা গেল। আমি তখন একটি সাদা কাপড়ে ওকে জড়িয়ে দিয়ে পথের এক পার্শ্বে দাফন করে দিলাম। অতঃপর রাত্রের আহারের সময় আমি আমার সাথীদের সাথে মিলিত হলাম। আল্লাহর কসম! আমি বসে আছি এমন সময় পশ্চিম দিক হতে চারজন স্ত্রী লোক আসলো। তাদের মধ্যে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলোঃ “আমরকে কে দাফন করেছে?” আমি প্রশ্ন করলাম:কোন্ আমর? সে বললোঃ “তোমাদের কেউ কি একটি সাপকে দাফন করেছে?” আমি উত্তরে বললামঃ হ্যাঁ, আমি দাফন করেছি। সে তখন বললোঃ “আল্লাহর কসম! তুমি একজন বড় বীর পুরুষকে দাফন করেছে, যে তোমাদের নবী (সঃ)-কে মানতো এবং যে তাঁর নবী হওয়ার চারশ’ বছর পূর্ব হতেই তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিল।” আমি তখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলার প্রশংসা করলাম। হজ্ব পৰ্ব পালন করে যখন আমরা হযরত উমার ফারুক (রাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে পথের ঘটনাটি বর্ণনা করলাম তখন তিনি বললেনঃ “স্ত্রী লোকটি সত্য কথাই বলেছে। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, সে তার উপর তার নবুওয়াত লাভের চারশ’ বছর পূর্বে ঈমান এনেছিল।” (এ হাদীসটি খুবই গরীব। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)

একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, সাপটিকে দাফনকারী লোকটি ছিলেন হযরত সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল (রাঃ)। কথিত আছে যে, তথায় দাফনকৃত সাপটি ছিল ঐ নয়জন জ্বিনের মধ্যে একজন যারা কুরআন শুনার জন্যে প্রতিনিধি হিসেবে নবী (সঃ)-এর নিকট আগমন করেছিলেন। তার মৃত্যু এসব জ্বিনের মধ্যে সর্বশেষে হয়েছিল।

আবু নাঈম (রঃ)-এর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, একটি লোক হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে বলেনঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! আমি একটি জংগলে ছিলাম। দেখি যে, দু’টি সাপ পরস্পর লড়াই করছে। শেষ পর্যন্ত একটি অপরটিকে মেরে ফেললো। অতঃপর আমি ওগুলোকে ঐ অবস্থায় রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করলাম। সেখানে দেখলাম যে, বহু সাপ নিহত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আর কতকগুলো সাপ হতে ইসলামের সুগন্ধ আসছে। আমি তখন ওগুলোকে এক এক করে শুকতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত একটি হলদে রঙ-এর ক্ষীণ সাপ হতে আমি ইসলামের সুগন্ধ পেলাম। আমি তখন ওকে আমার পাগড়ীতে জড়িয়ে দাফন করে দিলাম। অতঃপর আমি পথ চলতে শুরু করলাম, এমন সময় হঠাৎ একটি শব্দ শুনলামঃ “হে আল্লাহর বান্দা! তোমাকে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে হিদায়াত দান করা হয়েছে। ঐ সাপ দুটি জ্বিনদের গোত্র বানু শায়বান ও বানু কয়েসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে এবং তাদের মধ্যে যতগুলো নিহত হয়েছে তা তো তুমি স্বচক্ষে দেখেছো। তাদের মধ্যে একজন শহীদকে তুমি দাফন করেছে, যে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর মুখে তার অহী শুনেছেন।” এ কথা শুনে হযরত উসমান (রাঃ) লোকটিকে বললেনঃ “হে লোক! তুমি যদি তোমার বর্ণনায় সত্যবাদী হও তবে তো তুমি এক বিস্ময়কর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। আর যদি মিথ্যাবাদী হও তবে মিথ্যার প্রতিফল তুমিই পাবে।”

মহান আল্লাহ্ বলেনঃ (হে নবী সঃ!) তুমি স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জ্বিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনছিল, যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হলো তখন তারা একে অপরকে বলতে লাগলো:চুপ করে শ্রবণ কর। এটা তাদের একটা আদব বা শিষ্টাচার।

হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সূরায়ে আর-রাহমান শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন। অতঃপর তিনি স্বীয় সাহাবীদেরকে বলেনঃ “কি ব্যাপার, তোমরা যে সবাই নীরব থেকেছো? জ্বিনেরা তো তোমাদের চেয়ে উত্তম জবাবদাতা রূপে প্রমাণিত হলো”? যখনই আমি (আরবী) অর্থাৎ “সুতরাং তোমরা উভয়ে (দানব ও মানব) তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:১৩) এ আয়াতটি পাঠ করেছি তখনই তারা উত্তরে বলেছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার এমন কোন নিয়ামত নেই যা আমরা অস্বীকার করতে পারি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আপনারই প্রাপা।” (এ হাদীসটি ইমাম হাফিয বায়হাকী (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে গারীব বলেছেন)

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ “যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হলো, (আরবী) শব্দটির অর্থ কুরআন কারীমের নিম্নের আয়াতগুলোতেও একই রূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন নামায সমাপ্ত হবে।”(৬২:১০) (আরবী) অর্থাৎ “তিনি ওগুলোকে সপ্ত আকাশে সমাপ্ত করলেন।”(২:২৯) (আরবী) অর্থাৎ “যখন তোমরা তোমাদের হজ্বের কার্যাবলী সমাপ্ত করবে।”(২:২০০) ঐ জ্বিনগুলো তাদের কওমকে সতর্ক করার জন্যে তাদের কাছে ফিরে যাবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেমন তারা দ্বীনের বোধশক্তি লাভ করে। আর যখন তারা তাদের কওমের কাছে পৌছবে তখন যেন তাদেরকেও সতর্ক করে দেয়, হয়তো তারাও তাদের পরিত্রাণ লাভের আশায় সতর্কতা অবলম্বন করবে।”(৯:১২২) এই আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, জ্বিনদের মধ্যেও আল্লাহর বাণী প্রচারকারী ও ভয় প্রদর্শনকারী রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কাউকেও রাসূল করা হয়নি। এটা নিঃসন্দেহভাবে প্রমাণিত যে, জ্বিনদের মধ্যে রাসূল নেই। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তোমার (নবী সঃ-এর) পূর্বে যতগুলো রাসূল পাঠিয়েছিলাম সবাই তারা জনপদের অধিবাসী মানুষই ছিল, যাদের কাছে আমি অহী পাঠাতাম।”(১২:১০৯) অন্য এক আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী)অর্থাৎ “(হে নবী সঃ)! তোমার পূর্বে আমি যতগুলো রাসূল পাঠিয়েছিলাম তারা সবাই খাদ্য খেতো এবং বাজারে চলাফেরা করতো।”(২৫:২০) হযরত ইবরাহীম খলীল (আঃ) সম্পর্কে কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তার সন্তানদের মধ্যে নবুওয়াত ও কিতাব রেখে দিয়েছি।”(২৯:২৭) সুতরাং তার পরে যতগুলো নবী এসেছিলেন তাঁরা সবাই তারই বংশোদ্ভূত ছিলেন। কিন্তু সূরায়ে আনআমের (আরবী) অর্থাৎ “হে জ্বিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্য হতে কি রাসূলগণ তোমাদের নিকট আসেনি?”(৬:১৩০) এই আয়াতে এই দুই শ্রেণী বা জাতির সমষ্টি উদ্দেশ্য। সুতরাং এর প্রয়োগ শুধু একটি জাতির উপরই হতে পারে। যেমন আল্লাহ পাকের উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “উভয় সমুদ্র হতে উৎপন্ন মুক্তা ও প্রবাল।”(৫৫:২২) অথচ প্রকৃতপক্ষে এগুলো উৎপন্ন হয় একটি সমুদ্র হতেই।

এরপর জ্বিনদের আরো উক্তি উদ্ধৃত করা হচ্ছেঃ হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি যা অবতীর্ণ হয়েছে হযরত মূসা (আঃ)-এর পরে।’ হযরত ঈসা (আঃ)-এর কিতাব ইনজীলের বর্ণনা ছেড়ে দেয়ার কারণ এই যে, প্রকৃতপক্ষে এটা তাওরাতকে পূর্ণকারী। এতে বেশীর ভাগ উপদেশ অন্তরকে নরমকারী বর্ণনাসমূহ ছিল। হারাম ও হালালের মাসআলাগুলো খুবই কম ছিল। সুতরাং প্রকৃত জিনিস তাওরাতই থাকে। এ জন্যেই বিদ্বান জ্বিনগুলো এরই কথা উল্লেখ করেছে। এটাকেই সামনে রেখে হযরত অরাকা ইবনে নওফল যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর প্রথমবারে আগমনের অবস্থা শুনেন তখন তিনি বলেছিলেনঃ “ইনি হলেন আল্লাহ তা’আলার ঐ পবিত্র রহস্যবিদ যিনি হযরত মূসা (আঃ)-এর কাছে আসতেন। যদি আমি আরো কিছুদিন জীবিত থাকতাম, (শেষ পর্যন্ত)।

অতঃপর কুরআন কারীমের অন্য একটি বিশেষণের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, এটা এর পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী কিতাবের সত্যতা স্বীকার করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। সুতরাং কুরআন কারীম দুটি জিনিসকে অন্তর্ভুক্ত করে। একটি হলো খবর এবং অপরটি হলো দাবী বা যাজ্ঞা। অতএব, এর খবর হলো সত্য এবং দাবী বা যাচ্ছা হলো ন্যায় সঙ্গত। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালকের কথা সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ।”(৬:১১৫) আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি তাঁর রাসূল (সঃ)-কে পথ-নির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন।”(৯:৩৩) সুতরাং হিদায়াত হলো উপকার দানকারী ইলম এবং দ্বীন হলো সৎ আমল। জ্বিনদের উদ্দেশ্য এটাই ছিল।

জ্বিনেরা আরো বললোঃ “হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও।’ এতে এরই প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) দানব ও মানব এই দুই দলের নিকটই রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছেন। কেননা, তিনি জ্বিনদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন। আর তাদের সামনে তিনি কুরআন কারীমের ঐ সূরা পাঠ করেন যাতে এই দুটি দলকে সম্বোধন করা হয়েছে এবং তাদের নাম বরাবর আহকাম জারী করা হয়েছে এবং অঙ্গীকার ও ভয় প্রদর্শনের বর্ণনা রয়েছে। অর্থাৎ সূরায়ে আর-রহমান।

মহান আল্লাহ জ্বিনদের আরো কথা উদ্ধৃত করেনঃ (এরূপ করলে) তিনি (আল্লাহ) তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন।’ কিন্তু এটা ঐ অবস্থায় হতে পারে যখন (আরবী) কে অতিরিক্ত মেনে না নেয়া হবে, যেহেতু তাফসীরকারদের একটি উক্তি এটাও রয়েছে। আর আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী (আরবী)-এর স্থলে (আরবী) খুব কমই অতিরিক্ত হিসেবে এসে থাকে। আর যদি অতিরিক্ত মেনে নেয়া হয় তবে ভাবার্থ হবেঃ ‘আল্লাহ তা’আলা তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে পরিত্রাণ দিবেন। এই আয়াত দ্বারা কোন কোন আলেম এই দলীল গ্রহণ করেছেন যে, মুমিন জুিনেরাও জান্নাত লাভ করবে না। হ্যা, তবে তারা শাস্তি হতে পরিত্রাণ লাভ করবে। এটাই হবে তাদের সৎকর্মের প্রতিদান। যদি এর চেয়েও বেশী মর্যাদা তারা লাভ করতো তবে এ স্থলে ঐ মুমিন জ্বিনেরা ওটাকে অবশ্যই বর্ণনা করতো। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি এই যে, মুমিন জ্বিন জান্নাতে যাবে না। কেননা, তারা ইবলীসের বংশধর। আর ইবলীসের বংশধররা জান্নাতে যাবে না। কিন্তু সঠিক ও সত্য কথা এই যে, মুমিন জ্বিন। মুমিন মানুষের মতই এবং তারা জান্নাত লাভ করবে। যেমন এটা পূর্বযুগীয় মনীষীদের একটি দলের মাযহাব। জ্বিনেরা যে জান্নাত পাবে এর উপর কতকগুলো লোক নিম্নের আয়াতটিকে দলীল হিসেবে পেশ করেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদেরকে (হুরদেরকে) পূর্বে কোন মানুষ অথবা জ্বিন স্পর্শ করেনি।”(৫৫:৫৬) কিন্তু এই আয়াতকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এর চেয়ে তো বড় উত্তম দলীল হলো মহান আল্লাহর নিম্নের উক্তিটিঃ (আরবী) অর্থাৎ “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্যে রয়েছে দুটি উদ্যান (দুটি জান্নাত)। সুতরাং তোমরা উভয়ে (জ্বিন ও মানুষ) তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে।?”(৫৫:৪৬-৪৭) এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষ ও জ্বিনের উপর নিজের অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করছেন যে, তাদের মধ্যে যারা পুণ্যবান তাদের প্রতিদান হলো জান্নাত। আর মুমিন মানুষ অপেক্ষা মুমিন জিনেরাই এই আয়াতের বেশী শুকরিয়া আদায় করেছিল এবং এটা শোনামাত্রই বলেছিলঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার এমন কোন নিয়ামত নেই যা আমরা অস্বীকার করতে পারি।” এটা তো হতে পারে না যে, তাদের সামনে তাদের উপর এমন অনুগ্রহ করার কথা প্রকাশ করা হবে যা তারা লাভ করতেই পারবে না। মুমিন জ্বিনেরা যে জান্নাতে যাবে তার আর একটি দলীল এই যে, কাফির জ্বিন যখন জাহান্নামে যাবে যা ন্যায়ের স্থল, তখন মুমিন জ্বিন কেন জান্নাতে যাবে না যা অনুগ্রহের স্থল? বরং এটা তো আরো বেশী সঙ্গত। তাছাড়া এর উপর ঐ আয়াতগুলোকে দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে যেগুলোতে সাধারণভাবে মুমিনদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ এক জায়গায় বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘যারা ঈমান আনে ও সঙ্কর্ম করে তাদের আপ্যায়নের জন্যে আছে ফিরদাউসের উদ্যান।”(১৮:১০৭) অনুরূপ আরো বহু আয়াত রয়েছে। এই মাসআলাটিকে আমি একটি পৃথক রচনায় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য এবং আমি তারই নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

জান্নাতের তো অবস্থা এই যে, সমস্ত মুমিন তাতে প্রবেশ করার পরেও ওর মধ্যে সীমাহীন জায়গা শূন্য থাকবে। তাহলে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল জ্বিনদেরকে জান্নাতে প্রবেশ না করানোর কি কারণ থাকতে পারে? এখানে দুটি বিষয়ের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। (এক) পাপরাশি ক্ষমা করে দেয়া এবং (দুই) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে পরিত্রাণ দান করা। এ দু’টো থাকলেই তো জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়। কেননা, পরকালে নির্ধারিত রয়েছে জান্নাত, না হয় জাহান্নাম। সুতরাং যাকে জাহান্নাম হতে বাঁচিয়ে নেয়া হবে তার জন্যে জান্নাত অবধারিত হওয়া উচিত। আর এ ব্যাপারে কোন স্পষ্ট দলীল নেই যে, মুমিন জ্বিন জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ লাভ করা সত্তেও জানাতে যাবে না। যদি এই ধরনের কোন স্পষ্ট দলীল থেকে থাকে তবে আমরা তা মেনে নিতে প্রস্তুত আছি। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। হযরত নূহ (আঃ)-এর ব্যাপারটাই দেখা যাক। তিনি তাঁর কওমকে বলেছিলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(তোমরা ঈমান আনয়ন করলে) আল্লাহ তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিবেন এবং তোমাদেরকে নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ দিবেন।” (৭১:৪) সুতরাং এখানেও তাদের জানাতে প্রবেশ করার কথা উল্লেখ করা না হলেও এটা প্রমাণিত হয় না যে, তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। বরং এটা সর্বসম্মত বিষয় যে, তারা জান্নাতে অবশ্যই প্রবেশ করবে। সুতরাং এখানে জ্বিনদের ব্যাপারেও এটাই বুঝে নিতে হবে।

জিনদের ব্যাপারে কতকগুলো গারীব উক্তি বর্ণনা করা হয়েছেঃ হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জ্বিনেরা জান্নাতে তো প্রবেশ করবে না, তবে তারা জান্নাতের ধারে ধারে এবং এদিকে ওদিকে থাকবে।

কতক লোক বলেন যে, তারা জান্নাতে যাবে বটে, কিন্তু তথায় দুনিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা হবে। অর্থাৎ মানুষ জ্বিনকে দেখতে পাবে, কিন্তু জ্বিন মানুষকে দেখতে পাবে না।

কেউ কেউ বলেন যে, তারা জান্নাতে পানাহার করবে না। শুধু আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা ও তাঁর মহিমা কীর্তনই হবে তাদের খাদ্য, যেমন ফেরেশতাগণ। কেননা, তারা ফেরেশতাদেরই শ্রেণীভুক্ত। কিন্তু এ সমুদয় উক্তির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ আছে এবং এগুলো সবই দলীলবিহীন উক্তি।

এরপর উপদেশদানকারী জ্বিনেরা তাদের কওমকে বললোঃ “কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া না দেয় তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। তারাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।

এই বক্তৃতার পন্থা কতই না পছন্দনীয় এবং এটা কতই না আকর্ষণীয়! উৎসাহও প্রদান করা হয়েছে এবং ভীতিও প্রদর্শন করা হয়েছে। এ কারণেই তাদের অধিকাংশই সঠিক পথে চলে আসে এবং তারা দলে দলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। যেমন আমরা পূর্বে এটা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি এবং যার জন্যে আমরা মহান আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৩৩-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ যারা মৃত্যুর পর পুনর্জীবনকে অস্বীকারকারী এবং কিয়ামতের দিন দেহসহ পুনরুত্থানকে যারা অসম্ভব মনে করে তারা কি দেখে না যে, মহামহিমান্বিত ও প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ সমুদয় আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং এতে তিনি মোটেই ক্লান্ত হননি, বরং শুধু ‘হও’ বলতেই সব হয়ে গেছে? তিনি কি মৃতের জীবন দানে সক্ষম নন? অবশ্যই তিনি এতে পূর্ণ ক্ষমতাবান। যেমন অন্য আয়াতে তিনি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিই বেশী কঠিন, কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না।”(৪০:৫৭) আল্লাহ তা’আলা আকাশ ও পৃথিবী যখন সৃষ্টি করতে পেরেছেন তখন মানুষকে সৃষ্টি করা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন নয়, প্রথমবারই হোক অথবা দ্বিতীয়বারই হোক। এ জন্যেই তিনি এখানে বলেন। যে, তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। আর ওগুলোর মধ্যেই একটি হচ্ছে মৃত্যুর পরে পুনর্জীবিত করা এবং এটার উপরও তিনি পূর্ণ ক্ষমতাবান।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ ধমকের সূরে বলছেন যে, কিয়ামতের দিন কাফিরদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার পূর্বে জাহান্নামের ধারে দাঁড় করানো হবে এবং তাদেরকে নিরুত্তর করে দেয়া হবে। তারা কোন যুক্তি খুঁজে পাবে না। তাদেরকে বলা হবে:“এখন কি আল্লাহর ওয়াদা ও তার শাস্তিকে সত্য বলে বিশ্বাস করছো, না এখনো সন্দেহের মধ্যেই রয়েছে? এটা যাদু তো নয় এবং তোমাদের চক্ষু অন্ধতো হয়ে যায়নি? যা তোমরা দেখছো তা ঠিকই দেখছো, না প্রকৃতপক্ষে ঠিক নয়?” তখন তারা স্বীকার করে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় খুঁজে পাবে না। তাই তারা উত্তরে বলবেঃ “হ্যা, আমাদের প্রতিপালকের শপথ! সবই সত্য। যা বলা হয়েছিল তা সবই সঠিক হয়ে গেছে। এখন আমাদের মনে আর তিল বরাবরও সন্দেহ নেই।” তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “তাহলে এখন তোমরা শাস্তি আস্বাদন কর। কারণ তোমরা ছিলে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী।

অতঃপর মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তোমার সম্প্রদায় যদি তোমাকে অবিশ্বাস করে এবং তোমার মর্যাদা না দেয় তবে এতে মনঃক্ষুন্ন হওয়ার কোনই কারণ নেই। এটা কোন নতুন ব্যাপার নয়। তোমর পূর্ববর্তী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলদেরকেও তাদের সম্প্রদায় অবিশ্বাস করেছিল। কিন্তু তারা যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল তেমনই তোমাকেও ধৈর্যধারণ করতে হবে। ঐ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলদের নাম হচ্ছেঃ হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)। নবীদের (আঃ) বর্ণনায় তাঁদের নাম বিশিষ্টভাবে সূরায়ে আহযাবে। ও সূরায়ে শূরায় উল্লিখিত আছে। আবার এও হতে পারে যে, (আরবী) দ্বারা সমস্ত নবীকেই বুঝানো হয়েছে, তখন (আরবী)-এর (আরবী) টি (আরবী)-এর জন্যে হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

হযরত মাসরূক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) রোযাদার থাকতেন, অতঃপর ক্ষুধার্তই থাকতেন, আবার রোযা রাখতেন, অতপর ক্ষুধার্তই থাকতেন, পুনরায় রোযা রাখতেন এবং আবারও ক্ষুধার্ত রইতেন। অতঃপর বলতেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! নিশ্চয়ই দুনিয়া মুহাম্মাদ (সঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গের জন্যে মোটেই শোভনীয় নয়! হে আয়েশা (রাঃ)! নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলদের ধৈর্যের উপরই সন্তুষ্ট হন। (অর্থাৎ কষ্টে ও বিপদে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ ধৈর্যধারণ করলেও তিনি সন্তুষ্ট থাকেন)। ধৈর্য আল্লাহ তাআলার নিকট পছন্দনীয় এবং তিনি তাদের (আমার পূর্ববর্তী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলদের) উপর যে বিপদ-আপদ ও কষ্ট পৌছিয়েছিলেন তা আমার উপরও না পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না। যেমন তিনি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তুমি ধৈর্যধারণ কর যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।” সুতরাং (আমি যে কষ্টে পতিত হয়েছি এর উপর) আমি আমার সাধ্যমত ধৈর্যধারণ করবো যেমন তাঁরা ধৈর্যধারণ করেছিলেন এবং (আমি আল্লাহ তাআলার নিকট হতে শক্তি পাবো এ আশাতে একথা বলছি, কেননা) আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (ধৈর্যধারণের কোন শক্তি আমার নেই।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! এদেরকে অবশ্যই শাস্তিতে জড়িয়ে ফেলা হবে, তুমি এজন্যে তাড়াতাড়ি করো না। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদেরকে এবং সম্পদের অধিকারীদেরকে ছেড়ে দাও এবং তাদেরকে অল্প দিনের জন্যে অবকাশ দাও।”(৭৩:১১)

অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অতএব কাফিরদেরকে অবকাশ দাও, তাদেরকে অবকাশ দাও কিছুকালের জন্যে।”(৮৬:১৭)

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “যে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে তা যেদিন তারা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে যে, তারা যেন দিবসের এক দণ্ডের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি।’ যেমন অন্য এক আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেই দিন তারা এটা প্রত্যক্ষ করবে সেই দিন তাদের মনে হবে যে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাত অবস্থান করেছে।”(৭৯:৪৬) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেই দিন তাদেরকে একত্রিত করা হবে সেই দিন তাদের মনে হবে যে, তারা যেন দিবসের এক দণ্ডের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি।”(১০:৪৫)

মহান আল্লাহর উক্তিঃ (আরবী) (পৌঁছিয়ে দেয়া), এর দু’টি অর্থ হতে পারে। (এক) দুনিয়ায় অবস্থান শুধু আমার পক্ষ হতে আমার বাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্যে ছিল। (দুই) এই কুরআন শুধু পৌছিয়ে দেয়ার জন্যে। এটা এক স্পষ্ট ঘোষণা।

প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহর বাণীঃ ‘সত্যত্যাগী সম্প্রদায় ব্যতীত কাউকেও ধ্বংস করা হবে না। এটা মহামহিমান্বিত আল্লাহর ওয়াদা যে, যে ব্যক্তি নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে, তিনি তাকেই শুধু ধ্বংস করবেন। তাকেই তিনি শাস্তি প্রদান করবেন, যে নিজেকে শাস্তির উপযুক্ত করে ফেলবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(বই#১১২৫)
[ * জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম, যাতে তারা কুরআন শোনে।:-
কুফর ও ঈমানের চূড়ান্ত ফলাফল:-]
www.motaher21.net

সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ পারা:২৬ ২১-৩৫ নং আয়াত:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২১
وَ اذۡکُرۡ اَخَا عَادٍ ؕ اِذۡ اَنۡذَرَ قَوۡمَہٗ بِالۡاَحۡقَافِ وَ قَدۡ خَلَتِ النُّذُرُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡہِ وَ مِنۡ خَلۡفِہٖۤ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّا اللّٰہَ ؕ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۲۱﴾
এদেরকে ‘আদের ভাই (হূদ)- এর কাহিনী কিছুটা শুনাও যখন সে আহক্বাফ: তার কওমকে সতর্ক করেছিলো। -এ ধরনের সতর্ককারী পূর্বেও এসেছিলো এবং তার পরেও এসেছে- যে আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করো না। তোমাদের ব্যাপারে আমার এক বড় ভয়ংকর দিনের আযাবের আশঙ্কা আছে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২২
قَالُوۡۤا اَجِئۡتَنَا لِتَاۡفِکَنَا عَنۡ اٰلِہَتِنَا ۚ فَاۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَاۤ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ ﴿۲۲﴾
তারা বললোঃ “তুমি কি এ জন্য এসেছো যে, আমাদের প্রতারিত করে আমাদের উপাস্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে দেবে? ঠিক আছে, তুমি যদি প্রকৃত সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে আমাদের যে আযাবের ভীতি প্রদর্শন করে থাকো তা নিয়ে এসো।”
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৩
قَالَ اِنَّمَا الۡعِلۡمُ عِنۡدَ اللّٰہِ ۫ۖ وَ اُبَلِّغُکُمۡ مَّاۤ اُرۡسِلۡتُ بِہٖ وَ لٰکِنِّیۡۤ اَرٰىکُمۡ قَوۡمًا تَجۡہَلُوۡنَ ﴿۲۳﴾
তিনি বললেন, ‘এ জ্ঞান তো শুধু আল্লাহ্‌রই কাছে। আর আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি শুধু তা-ই তোমাদের কাছে প্রচার করি, কিন্তু আমি দেখছি, তোমারা এক মূর্খ সম্প্রদায়।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৪
فَلَمَّا رَاَوۡہُ عَارِضًا مُّسۡتَقۡبِلَ اَوۡدِیَتِہِمۡ ۙ قَالُوۡا ہٰذَا عَارِضٌ مُّمۡطِرُنَا ؕ بَلۡ ہُوَ مَا اسۡتَعۡجَلۡتُمۡ بِہٖ ؕ رِیۡحٌ فِیۡہَا عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿ۙ۲۴﴾
‘অতঃপর যখন তারা তাদের উপত্যকার দিকে মেঘ আসতে দেখল তখন বলতে লাগল, ‘এ তো মেঘ আমাদেরকে বৃষ্টি দান করবে।’ না, বরং এটাই তো তা, যা তোমারা ত্বারান্বিত করতে চেয়েছ, এক ঝড়, এতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৫
تُدَمِّرُ کُلَّ شَیۡءٍۭ بِاَمۡرِ رَبِّہَا فَاَصۡبَحُوۡا لَا یُرٰۤی اِلَّا مَسٰکِنُہُمۡ ؕ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡقَوۡمَ الۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۲۵﴾
‘এটা তার রবের নির্দেশে সব কিছুকে ধবংস করে দেবে।’ অতঃপর তাদের পরিণাম এ হল যে, তাদের বসতিগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। এভাবে আমরা অপরাধী সম্পপ্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৬
وَ لَقَدۡ مَکَّنّٰہُمۡ فِیۡمَاۤ اِنۡ مَّکَّنّٰکُمۡ فِیۡہِ وَ جَعَلۡنَا لَہُمۡ سَمۡعًا وَّ اَبۡصَارًا وَّ اَفۡـِٕدَۃً ۫ۖ فَمَاۤ اَغۡنٰی عَنۡہُمۡ سَمۡعُہُمۡ وَ لَاۤ اَبۡصَارُہُمۡ وَ لَاۤ اَفۡـِٕدَتُہُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ اِذۡ کَانُوۡا یَجۡحَدُوۡنَ ۙ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ حَاقَ بِہِمۡ مَّا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿٪۲۶﴾
আমি তাদেরকে এমন কিছু দিয়েছিলাম যা তোমাদের দেইনি।৩০ আমি তাদেরকে কান, চোখ, হৃদয়-মন সব কিছু দিয়েছিলাম। কিন্তু না সে কান তাদের কোন কাজে লেগেছে, না চোখ, না হৃদয়-মন। কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করতো।তারা সেই জিনিসের পাল্লায় পড়ে গেল যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৭
وَ لَقَدۡ اَہۡلَکۡنَا مَا حَوۡلَکُمۡ مِّنَ الۡقُرٰی وَ صَرَّفۡنَا الۡاٰیٰتِ لَعَلَّہُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۲۷﴾
আমি তোমাদের আশে পাশের বহু এলাকার বহু সংখ্যক জনপদ ধ্বংস করেছি। আমি আমার আয়াতসমূহ পাঠিয়ে বার বার নানাভাবে তাদের বুঝিয়েছি, হয়তো তারা বিরত হবে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৮
فَلَوۡ لَا نَصَرَہُمُ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ قُرۡبَانًا اٰلِـہَۃً ؕ بَلۡ ضَلُّوۡا عَنۡہُمۡ ۚ وَ ذٰلِکَ اِفۡکُہُمۡ وَ مَا کَانُوۡا یَفۡتَرُوۡنَ ﴿۲۸﴾
কিন্তু আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব সত্তাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিলো তারা কেন তাদেরকে সাহায্য করলো না। বরং তারা তাদের থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। এটা ছিল তাদের মিথ্যা এবং মনগড়া আকীদা-বিশ্বাসের পরিণাম, যা তারা গড়ে নিয়েছিলো।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:২৯
وَ اِذۡ صَرَفۡنَاۤ اِلَیۡکَ نَفَرًا مِّنَ الۡجِنِّ یَسۡتَمِعُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ ۚ فَلَمَّا حَضَرُوۡہُ قَالُوۡۤا اَنۡصِتُوۡا ۚ فَلَمَّا قُضِیَ وَلَّوۡا اِلٰی قَوۡمِہِمۡ مُّنۡذِرِیۡنَ ﴿۲۹﴾
স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জ্বিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনছিল, যখন তারা তার (নবীর) নিকট উপস্থিত হল, তারা একে অপরকে বলতে লাগল, ‘চুপ করে শ্রবণ কর।’ যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হল, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩০
قَالُوۡا یٰقَوۡمَنَاۤ اِنَّا سَمِعۡنَا کِتٰبًا اُنۡزِلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مُوۡسٰی مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ یَہۡدِیۡۤ اِلَی الۡحَقِّ وَ اِلٰی طَرِیۡقٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۳۰﴾
তারা বলেছিল, ‘হে আমাদের সম্প্রদায় ! নিশ্চয় আমারা এমন এক কিতাবের পাঠ শুনেছি যা নাযিল হয়েছে মূসার পরে, এটা তার সম্মুখস্থ কিতাবকে সত্যায়ন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে হেদায়াত করে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩১
یٰقَوۡمَنَاۤ اَجِیۡبُوۡا دَاعِیَ اللّٰہِ وَ اٰمِنُوۡا بِہٖ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ مِّنۡ ذُنُوۡبِکُمۡ وَ یُجِرۡکُمۡ مِّنۡ عَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۳۱﴾
হে আমাদের কওমের লোকেরা, আল্লাহর প্রতি আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনো। আল্লাহ‌ তোমাদের গোনাহ মাফ করবেন এবং কষ্টদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবেন।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩২
وَ مَنۡ لَّا یُجِبۡ دَاعِیَ اللّٰہِ فَلَیۡسَ بِمُعۡجِزٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَیۡسَ لَہٗ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءُ ؕ اُولٰٓئِکَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۳۲﴾
আর যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দেবে না সে না পৃথিবীতে এমন শক্তি রাখে যে আল্লাহকে নিরূপায় ও অক্ষম করে ফেলতে পারে, না তার এমন কোন সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক আছে যে আল্লাহর হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে। এসব লোক সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে ডুবে আছে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৩
اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اَنَّ اللّٰہَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ لَمۡ یَعۡیَ بِخَلۡقِہِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰۤی اَنۡ یُّحۡیِۦَ الۡمَوۡتٰی ؕ بَلٰۤی اِنَّہٗ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۳۳﴾
যে আল্লাহ‌ এই পৃথিবী ও আসমান সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে যিনি পরিশ্রান্ত হননি তিনি অবশ্যই মৃতদের জীবিত করে তুলতে সক্ষম, এসব লোক কি তা বুঝে না? কেন পারবেন না, অবশ্যই তিনি সব কিছু করতে সক্ষম।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৪
وَ یَوۡمَ یُعۡرَضُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا عَلَی النَّارِ ؕ اَلَیۡسَ ہٰذَا بِالۡحَقِّ ؕ قَالُوۡا بَلٰی وَ رَبِّنَا ؕ قَالَ فَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ بِمَا کُنۡتُمۡ تَکۡفُرُوۡنَ ﴿۳۴﴾
যে দিন এসব কাফেরকে আগুনের সামনে হাজির করা হবে সেদিন তাদের জিজ্ঞেস করা হবে, “এটা কি বাস্তব ও সত্য নয়?” এরা বলবে “হ্যাঁ, আমাদের রবের শপথ, (এটা প্রকৃতই সত্য) ।” আল্লাহ বলবেন : “ঠিক আছে, তাহলে তোমরা যে অস্বীকার করতে তার পরিণতি হিসেবে এখন আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো।”
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ:৩৫
فَاصۡبِرۡ کَمَا صَبَرَ اُولُوا الۡعَزۡمِ مِنَ الرُّسُلِ وَ لَا تَسۡتَعۡجِلۡ لَّہُمۡ ؕ کَاَنَّہُمۡ یَوۡمَ یَرَوۡنَ مَا یُوۡعَدُوۡنَ ۙ لَمۡ یَلۡبَثُوۡۤا اِلَّا سَاعَۃً مِّنۡ نَّہَارٍ ؕ بَلٰغٌ ۚ فَہَلۡ یُہۡلَکُ اِلَّا الۡقَوۡمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ﴿٪۳۵﴾
অতএব আপনি ধৈর্য ধারণ করুন যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। আর আপনি তাদের জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে তা যেদিন তারা দেখতে পাবে, সেদিন তাদের মনে হবে, তারা যেন দিনের এক দণ্ডের বেশী দুনিয়াতে অবস্থান করেনি। এ এক ঘোষণা, সুতরাং পাপাচারী সম্প্রদায়কেই কেবল ধ্বংস করা হবে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
**যেহেতু কুরাইশ নেতারা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা পোষণ করতো এবং নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও মোড়লিপনার কারণে আনন্দে আত্মহারা ছিল তাই এখানে তাদেরকে আদ কওমের কাহিনী শুনানো হচ্ছে। আরবে আদ জাতি এভাবে পরিচিত ছিল যে, প্রাচীনকালে এই ভূখণ্ডে তারা ছিল সর্বাধিক শক্তিশালী কওম। حقف শব্দটি اَحْقُافِ শব্দের বহুবচন। এর আভিধানিক অর্থ বালুর এমন সব লম্বা লম্বা টিলা যা উচ্চতায় পাহাড়ের সমান নয়। পারিভাষিক অর্থে এটা আরব মরুভূমির (الرُّبْعُ الخَالِى) দক্ষিণ পশ্চিম অংশের নাম, বর্তমানে যেখানে কোন জনবসতি নেই। পরের পৃষ্ঠায় মানচিত্রে এর অবস্থান দেখুনঃ

ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে আদ কওমের আবাস ভূমি ওমান থেকে ইয়ামান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর কুরআন মজীদ আমাদের বলছে, তাদের আদি বাসস্থান ছিল আল-আহক্বাফ। এখান থেকে বেরিয়ে তারা আশেপাশের দেশসমূহে ছড়িয়ে পড়েছিলো এবং দুর্বল জাতিসমূহকে গ্রাস করে ফেলেছিলো। বর্তমান কাল পর্যন্তও দক্ষিণ আরবের অধিবাসীদের মধ্যে একথা ছড়িয়ে আছে যে, এ এলাকাই ছিল আদ জাতির আবাস ভূমি। বর্তমানে “মুকাল্লা” শহর থেকে উত্তর দিকে ১২৫ মাইল দূরত্বে হাদ্রামাউতের একটি স্থানে লোকেরা হযরত হুদের (আ) মাযার তৈরী করে রেখেছে। সেটি হূদের কবর নামেই বিখ্যাত। প্রতি বছর ১৫ই শা’বান সেখানে ‘উরস’ হয়। ( -Arabia and the Isles, Harol Ingram, London, 1942, 1943, p208-211 (page link) ) আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার লোক সেখানে সমবেত হয়। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এ কবরটি হূদের কবর হিসেবে প্রমাণিত নয়। কিন্তু সেখানে তা নির্মাণ করা এবং দক্ষিণ আরবের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া কম করে হলেও এতটুকু অবশ্যই প্রমাণ করে যে, আঞ্চলিক ঐতিহ্য এই এলাকাকেই আদ জাতির এলাকা বলে চিহ্নিত করে। এছাড়া হাদ্রামাউতে এমন কতিপয় ধ্বংসাবশেষ (Ruins) আছে যেগুলোকে আজ পর্যন্ত স্থানীয় অধিবাসীরা হুদ আ: এর আবাসভূমি বলে আখ্যায়িত করে থাকে।

আহক্বাফ: অঞ্চলের বর্তমান অবস্থা দেখে কেউ কল্পনা করতে পারে না যে, এক সময় এখানে জাঁকালো সভ্যতার অধিকারী একটি শক্তিশালী জাতি বাস করতো। সম্ভবত হাজার হাজার বছর পূর্বে এটা এক উর্বর অঞ্চল ছিল। পরে আবহাওয়ার পরিবর্তন একে মরুভুমিতে পরিণত করেছে। বর্তমানে এই এলাকার একটি বিশাল মরুভূমি, যার আভ্যন্তরীণ এলাকায় যাওয়ার সাহসও কারো নেই। ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে ব্যাভেরিয়ার একজন সৈনিক এর দক্ষিণ প্রান্ত সীমায় পৌঁছেছিলো। তার বক্তব্য হলোঃ যদি হাদ্রামাউতের উত্তরাঞ্চলের উচ্চ ভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, তাহলে বিশাল এই মরুপ্রান্তর এক হাজার ফুট নীচুতে দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে মাঝে মাঝে এমন সাদা ভূমিখণ্ড যেখানে কোন বস্তু পতিত হলে তা বালুকা রাশির নীচে তলিয়ে যেতে থাকে এবং একেবারে পচে খসে যায়। আরব বেদুইনরা এ অঞ্চলকে ভীষণ ভয় করে এবং কোন কিছুর বিনিময়েই সেখানে যেতে রাজি হয় না। এক পর্যায়ে বেদুইনরা তাকে সেখানে নিয়ে যেতে রাজি না হলে সে একাই সেখানে চলে যায়। তার বর্ণনা অনুসারে এখানকার বালু একেবারে মিহিন পাউডারের মত। সে দূর থেকে তার মধ্যে একটি দোলক নিক্ষেপ করলে ৫ মিনিটের মধ্যেই তা তলিয়ে যায় এবং যে রশির সাথে তা বাধাঁ ছিল তার প্রান্ত গলে যায়। বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুনঃ The unveiling of Arabia. R.H.Kirnan, London, 1937.(page link)

The Empty Quarter, Philby, London, 1933. (full book link)

** কবে তোমাদের ওপর আযাব আসবে তা শুধু আল্লাহই জানেন। তোমাদের ওপর কবে আযাব নাযিল করতে হবে এবং কতদিন পর্যন্ত তোমাদের অবকাশ দেয়া হবে তার ফয়সালা করা আমার কাজ নয়।

** নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে আমার এই সতর্কীকরণকে তোমরা তামাশার বস্তু বলে মনে করছো এবং খেলার সামগ্রীর মত আযাবের দাবী করে চলেছো। আল্লাহর আযাব যে কী ভয়াবহ জিনিস সে ধারণা তোমাদের নেই। তোমাদের আচরণের কারণে তা যে তোমাদের কাছে এসে গেছে সে বিষয়েও তোমরা অবগত নও।
**এখানে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট নয় যে, কে তাদেরকে এই জবাব দিয়েছিলো। বক্তব্যের ধরন থেকে আপনাআপনি এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সেই সময় বাস্তব পরিস্থিতি তাদেরকে কার্যত যে জবাব দিয়েছিলো এটা ছিল সেই জবাব। তারা মনে করেছিলো এটা বৃষ্টির মেঘ, তাদের উপত্যকাসমূহ বর্ষণসিক্ত করার জন্য আসছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিল প্রচণ্ড ঝড়-তুফান, যা তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য এগিয়ে আসছিলো।
** আদ জাতির কাহিনী বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন সূরা আ’রাফ, টীকা ৫১ থেকে ৫৬ ; হূদ, টীকা ৫৪ থেকে ৬৫ ; আল মু’মিনুন, টীকা ৩৪ থেকে ৩৭ ; আশ শূআরা, টীকা ৮৮ থেকে ৯৪ ; আল আনকাবূত, টীকা ৬৫ ; হা-মীম আস সাজদা, টীকা ২০ ও ২১ ।
** অর্থ, সম্পদ, শক্তি, ক্ষমতা কোন বিষয়েই তোমাদের ও তাদের মধ্যে কোন তুলনা হয় না। তোমাদের ক্ষমতার ব্যাপ্তি মক্কা শহরের বাইরে কোথাও নেই। কিন্তু তারা পৃথিবীর একটি বড় অংশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিলো।
** এই সংক্ষিপ্ত আয়াতাংশে একটি গুরত্বপূর্ণ সত্য বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর আয়াতসমূহই সেই জিনিস যা মানুষকে প্রকৃত সত্যের সঠিক উপলব্ধি ও জ্ঞান দান করে। মানুষের যদি এই জ্ঞান ও উপলব্ধি থাকে তাহলে সে চোখ দিয়ে ঠিকমত দেখতে পায়, কান দিয়ে ঠিক মত শুনতে পায় এবং মন ও মস্তিষ্ক দিয়ে চিন্তা করতে ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু সে যখন আল্লাহর আয়াতসমূহ মানতে অস্বীকার করে তখন চোখ থাকা সত্ত্বেও ন্যায় ও সত্যকে চেনার মত দৃষ্টি লাভের সৌভাগ্য তার হয় না, কান থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি উপদেশ-বাণী শোনার বেলায় সে বধির হয় এবং মন ও মগজের যে নিয়ামত আল্লাহ তাকে দিয়েছেন তা দিয়ে সে উল্টা চিন্তা করে এবং একের পর এক ভ্রান্ত পরিণতির সম্মুখীন হতে থাকে। এমন কি তার সমস্ত শক্তি নিজের ধ্বংস সাধনেই ব্যয়িত হতে থাকে।
**তারা এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ঐ সব সত্তার সাথে ভক্তি শ্রদ্ধার সূচনা করেছিলো যে, এরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। এদের অসীলায় আমরা আল্লাহর কাছে পৌঁছতে পারবো। কিন্তু এভাবে অগ্রসর হতে হতে তারা ঐ সব সত্তাকেই উপাস্য বানিয়ে নেয়। সাহায্যের জন্য তাদেরকেই ডাকতে থাকে, তাদের কাছেই প্রার্থনা করতে শুরু করে এবং তাদের সম্পর্কে এ বিশ্বাস পোষণ করতে থাকে যে, তারাই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মালিক, তাদের সাহায্যের আবেদনে তারাই সাড়া দেবে এবং বিপদ থেকে উদ্ধার তারাই করবে। তাদেরকে এই গোমরাহী থেকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহ রসূলদের মাধ্যমে তাঁর আয়াত সমূহ পাঠিয়ে নানাভাবে তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা এই মিথ্যা খোদাদের দাসত্ব করতে বদ্ধপরিকর থাকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে এদেরকেই আঁকড়ে ধরে থাকার ব্যাপারে একগুঁয়েমি করতে থাকে। এখন বলো, যখন এই মুশরিক কওমের ওপর তাদের গোমরাহীর কারণে আল্লাহর আযাব আসলো তখন তাদের বিপদ ত্রাণকর্তা ও প্রার্থনা শ্রবণকারী উপাস্যরা কোথায় মরে পড়ে ছিলো? সেই দুর্দিনে তারা তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসলো না কেন?
** এ আয়াতের ব্যাখ্যা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ, হযরত যুবায়ের ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং হযরত হাসান বাসারী, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, যার ইবন্ হুবায়েশ, মুজাহিদ, ইকরিমা ও অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তিগণ থেকে যেসব বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে দেখা যায় তাঁরা সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, এ আয়াতে জিনদের প্রথম উপস্থিতির যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তা ‘নাখলা’ উপত্যকায় ঘটেছিলো। ইবনে ইসহাক, আবু নু’আইম ইসপাহানী এবং ওয়াকেদীর বর্ণনা অনুসারে নবী ﷺ যখন তায়েফ থেকে নিরাশ হয়ে মক্কায় ফেরার পথে নাখলা প্রান্তরে অবস্থান করেছিলেন এটা তখনকার ঘটনা। সেখানে এশা, ফজর কিংবা তাহাজ্জদের নামাযে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। সেই সময় জিনদের একটি দল সে স্থানে অতিক্রম করছিলো। তারা নবীর ﷺ কিরায়াত শোনার জন্য থেমে পড়েছিলো। এর সাথে সাথে সমস্ত বর্ণনা এ ব্যাপারেও একমত যে, জ্বীনেরা সেই সময় নবীর ﷺ সামনে আসেনি, কিংবা তিনিও তাদের আগমন অনুভব করেননি। পরে আল্লাহ তাঁকে তাদের আগমন এবং কুরআন তিলাওয়াত শোনার বিষয় অবহিত করেন।

যেখানে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল সে স্থানটি ছিল اَلزَّيْمَة অথবা اَلسَّيْلُ الْكَبِيْر কারণ এ দু’টি স্থানই নাখলা প্রান্তরে অবস্থিত। উভয়ই স্থানেই পানি ও উর্বরতা বিদ্যমান। তায়েফ থেকে আগমনকারী যদি তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করতে হয় তাহলে এ দু’টি স্থানের কোন একটিতে অবস্থান করতে পারে মানচিত্রে স্থান দু’টির অবস্থান দেখুনঃ (নিচে মানচিত্র আছে)
** এ থেকে জানা যায়, এসব জিন পূর্ব থেকে হযরত মূসা ও আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান রাখতো। কুরআন শোনার পর তারা বুঝতে পারলো পূর্ববর্তী নবী-রসূলগণ যে শিক্ষা দিয়েছেন এটাও সেই শিক্ষা। তাই তারা এই কিতাব এবং এর বাহক রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের ওপর ঈমান আনলো।
**নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহ থেকে জানা যায়, এরপর জিনদের প্রতিনিধি দল একের পর এক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের কাছে আসতে থাকে এবং তাঁর সাথে তাদের সামনা সামনি সাক্ষাত হতে থাকে। এ বিষয়ে হাদীস গ্রন্থ-সমূহ যেসব বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে তা একত্রিত করলে জানা যায়, হিজরতের পূর্বে মক্কায় এ রকম প্রায় ছয়টি প্রতিনিধি দল এসেছিলো।

এসব প্রতিনিধি দলের একটি সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেনঃ একদিন রসূলুল্লাহ ﷺ সারা রাত মক্কায় অনুপস্থিত ছিলেন। আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম এই ভেবে যে, তাঁর ওপর হয়তো আক্রমণ হয়ে থাকবে। প্রত্যুষে আমরা তাঁকে হেরা পর্বতের দিক থেকে আসতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেনঃ এক জিন আমাকে সঙ্গে করে নিতে এসেছিলো। আমি তার সাথে গিয়ে জিনদের একটি দলকে কুরআন শুনিয়েছি (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ)।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের আরো একটি বর্ণনা হচ্ছে, মক্কায় একবার নবী (সা.) সাহাবাদের (রা.) বললেনঃ আজ রাতে তোমাদের মধ্য থেকে কে আমার সাথে জিনদের সাথে সাক্ষাতের জন্য যাবে। আমি তাঁর সাথে যেতে প্রস্তুত হলাম। মক্কার উচ্চভূমি এলাকায় এক স্থানে দাগ কেটে নবী (সা.) আমাকে বললেনঃ এটা অতিক্রম করবে না। অতঃপর তিনি এগিয়ে গেলেন এবং দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলেন। আমি দেখলাম, বহু লোক তাঁকে ঘিরে আছে এবং তারা আমার ও নবীর ﷺ মাঝে আড়াল করে আছে (ইবনে জারীর, বায়হাকী, দালায়েলুন নবুওয়াত, আবু নু’আইম ইসপাহানী)।

আরো একটি ক্ষেত্রেও রাতের বেলা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলেন এবং নবী (সা.) মক্কার হাজুন নামক স্থানে জিনদের একটি মোকদ্দমায় ফয়সালা করেছিলেন। এর বহু বছর পর ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কুফায় কৃষকদের একটি দলকে দেখে বলেছিলেনঃ আমি হাজুনে জিনদের যে দলটিকে দেখেছিলাম তারা অনেকটা এই লোকগুলোর মত ছিল (ইবনে জারীর)।
**হতে পারে এই বাক্যাংশটি জিনদেরই উক্তির একটি অংশ। আবার এও হতে পারে যে, তাদের কথার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি যোগ করা হয়েছে। বক্তব্যের ধরন থেকে দ্বিতীয় মতটি অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।
**তোমাদের পূর্ববর্তী নবী-রসূলগণ যেভাবে বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত ধৈর্য ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের জাতির অসন্তুষ্টি, বিরোধিতা, বাধা-বিপত্তি ও নানা রকম উৎপীড়নের মোকাবিলা করেছেন তুমিও সে রকম করো এবং কখনো মনে এরূপ ধারণাকে স্থান দিও না যে, হয় এসব লোক অনতিবিলম্বে ঈমান আনুক, নয়তো আল্লাহ তাদের ওপর আযাব নাযিল করুক।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২১-২৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে ‘আদ সম্প্রদায় যাদের প্রতি হূদ (আঃ)-কে প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করেছিলেন কিন্তু তারা অবাধ্য হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে।

الْأَحْقَافِ ইয়ামান এলাকায় অবস্থিত একটি জনপদ। এ এলাকায় ছিল আদ জাতির বসবাস।

(وَقَدْ خَلَتِ النُّذُرُ)

অর্থাৎ হূদের পূর্বে ও পরে অনেক নাবী প্রেরণ করেছি যারা সবাই এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন এবং কিয়ামতের কঠিন শাস্তি সম্পর্কে অবগত করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلًا أَنِ اعْبُدُوا اللّٰهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ)

“আল্লাহর ‘ইবাদত করার ও তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি।” (সূরা নাহাল ১৬ : ৩৬)

কিন্তু হূদ (আঃ)-এর জাতি অবাধ্য হয়ে বলল : তুমি কি আমাদের মা‘বূদদের থেকে আমাদেরকে ফিরিয়ে রাখার জন্য এসেছ? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে তুমি যে আযাবের ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো। হূদ (আঃ) তাদের কথার সুন্দরভাবে জবাব দিলেন, বললেন : আযাব কখন আসবে তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, আমি কেবল আমার দায়িত্ব পালন করছি। আর তা হচ্ছে এর সংবাদ তোমাদের জানিয়ে দেওয়া।

(فَلَمَّا رَأَوْهُ عَارِضًا)

অর্থাৎ যখন তারা দেখতে পেল মেঘমালা তাদের দিকেই আসছে তখন তারা খুব খুশী হল যে, তাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ হবে, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল তাদের কর্মের শাস্তি। বাতাস দিয়ে এ জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা ধ্বংস করে দেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَأَمَّا عَادٌ فَأُهْلِكُوا بِرِيحٍ صَرْصَرٍ عَاتِيَةٍ سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَّثَمٰنِيَةَ أَيَّامٍ لا حُسُوْمًا فَتَرَي الْقَوْمَ فِيْهَا صَرْعٰي كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ ج فَهَلْ تَرٰي لَهُمْ مِّنْمبَاقِيَةٍ ‏)

“আর আ’দ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় দ্বারা। যা তিনি তাদের ওপর প্রবাহিত করেছিলেন বিরামহীনভাবে সাত রাত ও আট দিন, তুমি (উপস্থিত থাকলে) সেই সম্প্রদায়কে দেখতে খেজুর কাণ্ডের ন্যায় সেখানে ছিন্ন ভিন্নভাবে পড়ে আছে। তুমি কি তাদের কাউকেও অবশিষ্ট দেখতে পাও?” (সূরা হাক্কাহ ৬৯ : ৬-৮)

এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৬৫-৭২ নং আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।

আয়িশাহ (রাঃ) একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলেন : লোকেরা মেঘ দেখে আনন্দিত হয় যে, বৃষ্টি হবে। কিন্তু আপনার মুখমণ্ডলে এর বিপরীত চিন্তা ও অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়? তিনি বললেন : এ মেঘে যে আযাব নেই তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? এক জাতিকে তো বাতাসের আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তারাও মেঘ দেখে বলেছিল, এ মেঘ আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করবে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮২৯)

অন্য বর্ণনায় এসেছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন বাতাস পেতেন তখন এ দু‘আ পড়তেন

اللّٰهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِ هَذِهِ الرِّيحِ وَخَيْرِ مَا فِيهَا وَخَيْرِ مَا أُمِرَتْ بِهِ، وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ هَذِهِ الرِّيحِ وَشَرِّ مَا فِيهَا وَشَرِّ مَا أُمِرَتْ بِهِ

হে আল্লাহ তা‘আলা আমি তোমার কাছে এর কল্যাণ ও এর মধ্যে যে কল্যাণ রয়েছে এবং যে কল্যাণ দিয়ে তা প্রেরণ করেছ তার সব চাই। আর তার অকল্যাণ ও তার মধ্যে যে অকল্যাণ রয়েছে এবং যে অকল্যাণ নিয়ে তা প্রেরিত হয়েছে তার সব কিছু থেকে আশ্রয় চাই। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সালাত)

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ও রাসূলের অবাধ্যতার পরিণাম কী হয়েছিল তা পূর্ববর্তী জাতিদের থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। আমরাও যেন নিজের পায়ে কুড়াল মেরে বিপদ ডেকে না নিয়ে আসি।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতিদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, তাদের অবাধ্যতার পরিণাম কেমন হয়েছিল?
২. বৃষ্টি-বাতাসের আগমনে যে দু‘আ পড়তে হয় তা জানতে পারলাম।
২৬-২৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা আমাদের তুলনায় শক্তি-সামর্থ্যে ও প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে অনেক মজবুত ছিল। কিন্তু ঈমান না আনার কারণে তাদের কোন ক্ষমতাই আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির কাছে টিকে থাকতে পারেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(أَوَلَمْ يَسِيْرُوْا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوْا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِيْنَ كَانُوْا مِنْ قَبْلِهِمْ ط كَانُوْا هُمْ أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَّاٰثَارًا فِي الْأَرْضِ فَأَخَذَهُمُ اللّٰهُ بِذُنُوْبِهِمْ ط وَمَا كَانَ لَهُمْ مِّنَ اللّٰهِ مِنْ وَّاقٍ‏)‏

“তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখতো- তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছিল। পৃথিবীতে তারা ছিল এদের অপেক্ষা শক্তিতে এবং কীর্তিতে প্রবলতর, অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিলেন তাদের অপরাধের জন্য এবং আল্লাহর শাস্তি হতে তাদেরকে রক্ষা করার কেউ ছিল না।” (সূরা মুমিনুন ৪০ : ২১)

তাদেরকে শোনার জন্য কান, দেখার জন্য চোখ, বুঝার জন্য অন্তঃকরণ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এ সব তাদের কোন উপকারে আসেনি। ওপরে ‘আদ সম্প্রদায়ের কাহিনী বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে যাদেরকে কুফর ও নাবীদের অবাধ্যতার কারণে আযাব দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছিল। এখন মক্কাবাসীসহ পৃথিবীর সকল কাফিরদেরকে সতর্ক করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা এসব বিবরণ তুলে ধরেছেন। মক্কাবাসীরা সফরের সময় পূর্ববর্তী জাতিদের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেত। মক্কার এক দিকে সিরিয়া অপর দিকে ইয়ামান অবস্থিত, যেদিকেই তারা সফর করত সেদিকেই তারা বিভিন্ন জাতির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেত। তাই مَا حَوْلَكُمْ বলা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদেরকে তিরস্কার করে বলছেন : সান্নিধ্য লাভের জন্য তারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যাদেরকে আহ্বান করত তারা সহযোগিতা না করে উধাও হয়ে গেল কেন? কারণ তারা কোন ক্ষমতাই রাখে না। তাই আজও যারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে বা তাঁর সাথে অংশীস্থাপন করে অন্য কোন মা‘বূদ বা মাজারে শায়িত ব্যক্তি বা ওলী-আউলিয়াদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সুপারিশ করতে পারবে- এ বিশ্বাস রেখে তাদেরকে ডাকে তারা মূলত কোন উপকার করতে পারবেনা, বরং তারা নিজেরাই দিশেহারা হয়ে যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া কুফরী কাজ।
২. কোন প্রভাব-প্রতিপত্তি কিয়ামতের দিন কাজে আসবে না, ঈমান যদি না থাকে।
৩. প্রভাব-প্রতিপত্তি অধিকাংশ মানুষকে ঈমান আনতে বাধা সৃষ্টি করেছে।
৪. ‎আল্লাহ তা‘আলা‎কে বাদ দিয়ে যাদেরকে সুপারিশকারী হিসেবে ডাকা হচ্ছে তারা কোন উপকার করতে পারবে না।
২৯-৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

একদল জিন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুখে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করে মুসলিম হয়েছিল এবং তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গিয়ে ঈমান আনার প্রতি আহ্বান জানায় আর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করে। কারণ জিন জাতিও মানুষের মত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শরীয়ত মেনে নিতে বাধ্য। এতে মক্কার মুশরিকদেরকে তিরস্কারও করা হল যে, জিন জাতি কুরআন শুনে ঈমান নিয়ে আসলো আর তোমরা ঈমান আনলে না!

সহীহ মুসলিমের বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ ঘটনা মক্কার নিকটস্থ “নাখলা” নামক উপত্যকায় সংঘটিত হয়। সেখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করছিলেন। জীনেরা এ অনুসন্ধানে ছিল যে, আসমানে আমাদের ওপর অত্যাধিক কড়াকড়ি করে দেয়া হয়েছে এবং এখন সেখানে আমাদের যাওয়া প্রায় অসম্ভব করে দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে যার কারণে এ রকম হয়েছে। তাই পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন দিকে জীনদের দল ঘটনার অনুসন্ধানে ছড়িয়ে পড়ল। তাদেরই একটি অনুসন্ধানী দল এ কুরআন শুনে বুঝে নেয় যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রেরণের এ ঘটনাই হল আমাদের আসমানে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতার একমাত্র কারণ। জীনদের এ দলটি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর ঈমান আনে এবং ফিরে গিয়ে তাদের জাতিকে এ কথা জানায়। সহীহ বুখারীতে এ ঘটনা বিদ্যমান। (সহীহ বুখারী হা. ৩৮৫৯, সহীহ মুসলিম হা. ৪৪৯) এ সম্পর্কে সূরা জিনে আরো আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।

(أُنْزِلَ مِنْۭ بَعْدِ مُوْسٰي)

‘যা মূসা এর পর নাযিল করা হয়েছে’ ইবনু আব্বাস (আঃ) বলেন : জিনেরা ঈসা (আঃ)-এর কথা শোনেনি, তাই তারা বলেছে :

(أُنْزِلَ مِنْۭ بَعْدِ مُوْسٰي)।

কেননা কুরআন তো ইঞ্জিলের পর নাযিল হয়েছে যা ঈসা (আঃ)-এর ওপর নাযিল হয়েছে। বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা বলেন : তারা ইয়াহূদী ছিল, তাই তারা উক্ত কথা বলেছে।

(يَغْفِرْ لَكُمْ مِّنْ ذُنُوْبِكُمْ)

‘আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন’ আয়াতের ভাষ্যমতে আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহ্বানকারী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ডাকে যে ব্যক্তি সাড়া দেবে, তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তিনি যে সত্য নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও বিশ্বাস রাখবে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সাড়া দেবে না এবং ঈমান আনবে না তাকে ক্ষমাও করা হবে না, শাস্তি থেকেও রক্ষা করা হবে না। বরং তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

قَالَ ادْخُلُوْا فِيْٓ أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ فِي النَّارِ

“আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের পূর্বে যে জিন ও মানব দল গত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ কর’।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৩৪)

সুতরাং জিন হোক আর মানব হোক নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের কথা জানার পর তাঁর প্রতি ঈমান না আনলে সে জাহান্নামে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ، وَلَا نَصْرَانِيٌّ، ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ، إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ

সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! এ জাতির ইয়াহূদ ও খ্রিস্টান যে-ই হোক আমার কথা শোনার পর আমার প্রতি ঈমান না এনে মারা গেলে সে জাহান্নামবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ১৫৩)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মানব জাতির মত জিনদের মধ্যে ভাল-মন্দ উভয় শ্রেণিই রয়েছে।
২. ইসলামী শরীয়ত মানুষ ও জিন উভয় জাতির জন্য।
৩. ইসলামের দাওয়াত যার কাছে পৌঁছবে তারও সেই দাওয়াত কবূল করত অন্যকে সেদিকে দাওয়াত দেয়া আবশ্যক।
৪. ইসলাম সত্য ও সঠিক পথের দিক-নিদের্শনা দেয়।
৩৩-৩৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে মহান ‎আল্লাহর ক্ষমতা ও রুবুবিয়্যাহর বর্ণনা করা হয়েছে। মহান ‎আল্লাহ এ বিশাল আকাশসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আর এসব সৃষ্টি করাতে তাঁকে কোন ক্লান্তি স্পর্শ করেনি। যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে এবং অসম্ভব মনে করে তাদেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসাকারে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : তারা কি জানে না আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিন সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে তিনি ক্লান্ত হননি। সেই আল্লাহ তা‘আলা মৃত মানুষকে অবশ্যই জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন। সুতরাং পুনরুত্থানকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই, বরং দলীল ও যুক্তি দ্বারা তা প্রমাণিত।

কাফিরদেরকে কিয়ামতের দিন যখন জাহান্নামে উপস্থিত করা হবে তখন তাদেরকে বলা হবে এটা কি সত্য নয়? কাফিররা তা স্বীকার করবে। শুধু স্বীকারই নয়, বরং ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র নামে শপথ করে বলবে, কিন্তু এ স্বীকারোক্তি কোন উপকারে আসবে না।

(فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ)

‘অতএব (হে রাসূল!) তুমি সবর কর, যেমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ সবর করেছেন।’ যারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কষ্ট দেয় ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তাদের আচরণে ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দিচ্ছেন।

(أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ)

দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ হলেন- নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। এটাই প্রসিদ্ধ কথা। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জাতির ওপর দ্রুত আযাব কামনা করতে নিষেধ করছেন। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَذَرْنِيْ وَالْمُكَذِّبِيْنَ أُولِي النَّعْمَةِ وَمَهِّلْهُمْ قَلِيْلًا ‏)‏

“ছেড়ে দাও আমাকে এবং প্রাচুর্যবান মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের; আর কিছুকালের জন্য তাদেরকে অবকাশ দাও।” (সূরা মুযযাম্মিল ৭৩ : ১১-১২)

দ্রুত আযাব কামনা না করার কারণ হল পরকালে তাদের জন্য শাস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(نُمَتِّعُهُمْ قَلِيْلًا ثُمَّ نَضْطَرُّهُمْ إِلٰي عَذَابٍ غَلِيْظٍ)

“আমি অল্প সময়ের জন্য তাদেরকে সুখ-সম্ভোগ দেব, পুনরায় তাদেরকে বাধ্য করব কঠিন শাস্তি ভোগ করতে।” (সূরা লুকমান ৩১ : ২৪)

(لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا سَاعَةً)

‘যেন তারা দুনিয়ায় দিনের কিছু সময়ের বেশি ছিল না।’ যেমন ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ অন্যত্র বলেন :

(كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوْآ إِلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا ‏)‏

“যেদিন তারা তা দেখবে, তাতে তাদের মনে হবে যেন তারা (পৃথিবীতে) এক সন্ধ্যা অথবা এক সকালের অধিক অবস্থান করেনি।” (সূরা নাযিয়াত : ৭৯ : ৪৬)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ كَأَنْ لَّمْ يَلْبَثُوْآ إِلَّا سَاعَةً مِّنَ النَّهَارِ يَتَعَارَفُوْنَ بَيْنَهُمْ ط قَدْ خَسِرَ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِلِقَا۬ءِ اللّٰهِ وَمَا كَانُوْا مُهْتَدِيْنَ ‏)

“যেদিন তিনি তাদেরকে একত্রিত করবেন সেদিন তাদের মনে হবে যে, দিনের একমুহূর্তের বেশী তারা (দুনিয়াতে) অবস্থান করেনি; তারা পরস্পরকে চিনবে। আল্লাহর সাক্ষাত যারা অস্বীকার করেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা সৎ পথ প্রাপ্ত ছিল না।” (সূরা ইউনুস ১০ : ৪৫)

সুতরাং পরকালকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। যারা তা অস্বীকার করবে তাদের ঈমান থাকবে না বা তার প্রতি ঈমান আনা ছাড়া মু’মিন হওয়া যাবে না। তাই পরকাল অস্বীকারকারীদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তারা শাস্তি দেখে মনে করবে দুনিয়াতে তারা মাত্র কিছু সময় অবস্থান করেছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পুনরুত্থানের প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের অন্যতম রুকন।
২. কিয়ামতের দিন কাফিররা জাহান্নাম দেখে সত্য স্বীকার করবে কিন্তু এ স্বীকারোক্তি কোন কাজে আসবে না।
৩. ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র আনুগত্য ও নিষিদ্ধ কাজ বর্জনে ধৈর্য ধারণ করা ওয়াজিব।
৪. কিয়ামতের বিশাল দিনের তুলনায় কাফিররা মনে করবে দুনিয়াতে তারা মাত্র কিছু সময় অবস্থান করেছিল।

Leave a Reply