بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৩০ /মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪৩} [*বাইয়াতে রিদওয়ানের:- বিনা ওজরে জিহাদে অংশ গ্রহণ না করা মুনাফিকী কাজ:- আসলে মুনাফিক-রা খুবই খারাপ মন-মানসিকতার লোক।:-] www.motaher21.net সূরা:৪৮-ফাত্হ।পারা:২৬ ৮-১৯ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩০ /মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪৩}
[*বাইয়াতে রিদওয়ানের:-
বিনা ওজরে জিহাদে অংশ গ্রহণ না করা মুনাফিকী কাজ:-
আসলে মুনাফিক-রা খুবই খারাপ মন-মানসিকতার লোক।:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৮-ফাত্হ।পারা:২৬
৮-১৯ নং আয়াত:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন :-

সূরা:৪৮-ফাত্হ-৮
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ شَاہِدًا وَّ مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا ۙ﴿۸﴾
হে নবী, আমি আপনাকে সাক্ষ্যদানকারী, সুসংবাদ দানকারী এবং সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি-
সূরা:৪৮-ফাত্হ-৯
لِّتُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ تُعَزِّرُوۡہُ وَ تُوَقِّرُوۡہُ ؕ وَ تُسَبِّحُوۡہُ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا ﴿۹﴾
যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর শক্তি যোগাও ও তাঁকে সম্মান কর; আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১০
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُبَایِعُوۡنَکَ اِنَّمَا یُبَایِعُوۡنَ اللّٰہَ ؕ یَدُ اللّٰہِ فَوۡقَ اَیۡدِیۡہِمۡ ۚ فَمَنۡ نَّکَثَ فَاِنَّمَا یَنۡکُثُ عَلٰی نَفۡسِہٖ ۚ وَ مَنۡ اَوۡفٰی بِمَا عٰہَدَ عَلَیۡہُ اللّٰہَ فَسَیُؤۡتِیۡہِ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿٪۱۰﴾
নিশ্চয় যারা তোমার বায়আত গ্রহণ করে, তারা তো আল্লাহরই বায়আত গ্রহণ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। সুতরাং যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে এবং যে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তিনি তাকে মহা পুরস্কার দেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১১
سَیَقُوۡلُ لَکَ الۡمُخَلَّفُوۡنَ مِنَ الۡاَعۡرَابِ شَغَلَتۡنَاۤ اَمۡوَالُنَا وَ اَہۡلُوۡنَا فَاسۡتَغۡفِرۡ لَنَا ۚ یَقُوۡلُوۡنَ بِاَلۡسِنَتِہِمۡ مَّا لَیۡسَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ ؕ قُلۡ فَمَنۡ یَّمۡلِکُ لَکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ شَیۡئًا اِنۡ اَرَادَ بِکُمۡ ضَرًّا اَوۡ اَرَادَ بِکُمۡ نَفۡعًا ؕ بَلۡ کَانَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا ﴿۱۱﴾
যুদ্ধ থেকে) পশ্চাতে থাকা মরুবাসীরা তোমাকে বলবে, ‘আমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিল, অতএব আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ তারা মুখে তা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই। তাদেরকে বল, ‘আল্লাহ তোমাদের কারো কোন ক্ষতি কিংবা মঙ্গল চাইলে কে তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারে? বস্তুতঃ তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১২
بَلۡ ظَنَنۡتُمۡ اَنۡ لَّنۡ یَّنۡقَلِبَ الرَّسُوۡلُ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِلٰۤی اَہۡلِیۡہِمۡ اَبَدًا وَّ زُیِّنَ ذٰلِکَ فِیۡ قُلُوۡبِکُمۡ وَ ظَنَنۡتُمۡ ظَنَّ السَّوۡءِ ۚۖ وَ کُنۡتُمۡ قَوۡمًۢا بُوۡرًا ﴿۱۲﴾
(কিন্তু আসল কথা তো তা নয় যা তোমরা বলছো) ; বরং তোমরা মনে করি নিয়েছ যে, রসূল ও মু’মিনগণ নিজেদের ঘরে কখনই ফিরতে পারবে না। এ খেয়ালটা তোমাদের অন্তরে খুব ভাল লেগেছিল এবং তোমরা খুবই খারাপ ধারণা মনে স্থান দিয়েছো, আসলে তোমরা খুবই খারাপ মন-মানসিকতার লোক।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৩
وَ مَنۡ لَّمۡ یُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ فَاِنَّاۤ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ سَعِیۡرًا ﴿۱۳﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না, আমি সেসব অবিশ্বাসীদের জন্য অবশ্যই জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত করে রেখেছি।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৪
وَ لِلّٰہِ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ یَغۡفِرُ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یُعَذِّبُ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۱۴﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই; তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। তিনি চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৫
سَیَقُوۡلُ الۡمُخَلَّفُوۡنَ اِذَا انۡطَلَقۡتُمۡ اِلٰی مَغَانِمَ لِتَاۡخُذُوۡہَا ذَرُوۡنَا نَتَّبِعۡکُمۡ ۚ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّبَدِّلُوۡا کَلٰمَ اللّٰہِ ؕ قُلۡ لَّنۡ تَتَّبِعُوۡنَا کَذٰلِکُمۡ قَالَ اللّٰہُ مِنۡ قَبۡلُ ۚ فَسَیَقُوۡلُوۡنَ بَلۡ تَحۡسُدُوۡنَنَا ؕ بَلۡ کَانُوۡا لَا یَفۡقَہُوۡنَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿۱۵﴾
তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে তখন যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিল, তারা অবশ্যই বলবে, ‘আমাদেরকে তোমাদের অনুসরণ করতে দাও।’ তারা আল্লাহর বাণী পরিবর্তন করতে চায়। বলুন, ‘তোমরা কিছুতেই আমাদের অনুসরণ করবে না। আল্লাহ আগেই এরূপ ঘোষণা করেছেন।’ তারা অবশ্যই বলবে, তোমারা তো আমাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছ।’ বরং তারা তো বোঝে কেবল সামান্যই।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৬
قُلۡ لِّلۡمُخَلَّفِیۡنَ مِنَ الۡاَعۡرَابِ سَتُدۡعَوۡنَ اِلٰی قَوۡمٍ اُولِیۡ بَاۡسٍ شَدِیۡدٍ تُقَاتِلُوۡنَہُمۡ اَوۡ یُسۡلِمُوۡنَ ۚ فَاِنۡ تُطِیۡعُوۡا یُؤۡتِکُمُ اللّٰہُ اَجۡرًا حَسَنًا ۚ وَ اِنۡ تَتَوَلَّوۡا کَمَا تَوَلَّیۡتُمۡ مِّنۡ قَبۡلُ یُعَذِّبۡکُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿۱۶﴾
এ পিছনে রেখে যাওয়া বদ্দু আরবদেরকে বলে দাওঃ “খুব শীঘ্রই তোমাদেরকে এমন সব লোকের সাথে লড়াই করার জন্য ডাকা হবে যারা বড়ই শক্তি সম্পন্ন।” তোমাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে, কিংবা তারা অনুগত হয়ে যাবে।সে সময় তোমরা জিহাদের নির্দেশ পালন করলে আল্লাহ‌ তোমাদেরকে উত্তম সওয়াব দিবেন। আর যদি তোমরা পিছনে হটে যাও যেমন পূর্বে হটে গিয়েছিলে, তাহলে আল্লাহ‌ তোমাদেরকে কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি দেবেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৭
لَیۡسَ عَلَی الۡاَعۡمٰی حَرَجٌ وَّ لَا عَلَی الۡاَعۡرَجِ حَرَجٌ وَّ لَا عَلَی الۡمَرِیۡضِ حَرَجٌ ؕ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ یُدۡخِلۡہُ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ۚ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّ یُعَذِّبۡہُ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿٪۱۷﴾
অন্ধের কোন অপরাধ নেই, খঞ্জের কোন অপরাধ নেই এবং পীড়িতেরও কোন অপরাধ নেই; এবং যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার নিচে নহরসমূহ প্রবাহিত ; কিন্তু যে ব্যক্তি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। তিনি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৮
لَقَدۡ رَضِیَ اللّٰہُ عَنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ یُبَایِعُوۡنَکَ تَحۡتَ الشَّجَرَۃِ فَعَلِمَ مَا فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ فَاَنۡزَلَ السَّکِیۡنَۃَ عَلَیۡہِمۡ وَ اَثَابَہُمۡ فَتۡحًا قَرِیۡبًا ﴿ۙ۱۸﴾
আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নিচে তোমরা কাছে বাইয়াত করছিলো। তিনি তাদের মনের অবস্থা জানতেন। তাই তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল যে করেছেন, পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে আশু বিজয় দান করেছেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৯
وَّ مَغَانِمَ کَثِیۡرَۃً یَّاۡخُذُوۡنَہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ عَزِیۡزًا حَکِیۡمًا ﴿۱۹﴾
এবং প্রচুর গনীমতের সম্পদ দান করেছেন যা তারা অচিরেই লাভ করবে। আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।

৮-১৯ নং আয়াতের তাফসির:-

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন :-
৮-১০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

‎আল্লাহ তা‘আলা‎ অত্র আয়াতে বলছেন, তিনি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করেছেন তাঁর উম্মাতের ভাল-মন্দ কর্ম ও কথা প্রত্যক্ষ করার জন্য এবং আল্লাহ তা‘আলার একত্ব ও বড়ত্বের সাক্ষীরূপে, যারা তাঁর আনুগত্য করবে তাদের সুসংবাদদাতা ও যারা আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হবে তাদেরকে সতর্ককারীরূপে। অন্যত্র বলা হয়েছে তিনি তাঁকে কিয়ামাতের দিন তাঁর উম্মাতের সাক্ষীরূপে পুনরুত্থিত করবেন এবং তিনি মু’মিনদের সুসংবাদদাতা ও কাফিরদের সর্তককারী। যেমন ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ বলেন :

(فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍۭ بِشَهِيْدٍ وَّجِئْنَا بِكَ عَلٰي هٰ۬ؤُلَا۬ءِ شَهِيْدًا)

“যখন আমি প্রত্যেক উম্মত হতে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব তখন কী অবস্থা হবে?” (সূরা নিসা ৪ : ৪১)

‎আল্লাহ তা‘আলা‎ বলেন :

(وَيَوْمَ نَبْعَثُ فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيْدًا عَلَيْهِمْ مِّنْ أَنْفُسِهِمْ وَجِئْنَا بِكَ شَهِيْدًا عَلٰي هٰ۬ؤُلَا۬ءِ)

“সেদিন আমি উত্থিত করব প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদেরই মধ্য হতে তাদের বিষয়ে এক একজন সাক্ষী এবং তোমাকে আমি আনব সাক্ষীরূপে এদের বিষয়ে।” (সূরা নাহল ১৬ : ৮৯)

আমর বিন আ‘স (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, কুরআনের এ আয়াত “আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে” তাওরাতে আল্লাহ তা‘আলা এভাবে বলেছেন : হে নাবী! আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও উম্মী লোকদের মুক্তিদাতারূপে। তুমি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি তোমার নাম রেখেছি নির্ভরকারী- যে রূঢ় ও কঠোরচিত্ত নয়, বাজারে শোরগোলকারী নয় এবং মন্দকে মন্দ দ্বারা প্রতিহতকারীও নয় বরং তিনি ক্ষমা করবেন এবং উপেক্ষা করবেন। বক্র জাতিকে সোজা না করা পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জান কবয করবেন না। তা এভাবে যে, তারা বলবে- আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। ফলে খুলে যাবে অন্ধ চোখ, বধির কান এবং পর্দা ঢাকা অন্তরসমূহ। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৩৮)

وَتُعَزِّرُوْهُ وَتُوَقِّرُوْهُ

‘তাকে সাহায্য করবে ও সম্মান করবে’ ( ه) সর্বনামের উদ্দেশ্য হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাই এখানে পূর্ণ ওয়াকফ বা তেলাওয়াতকালে থামতে হয়। অর্থাৎ তোমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্মান করবে, মর্যাদা দেবে এবং তাঁর হককে প্রাধান্য দেবে।

অতঃপর ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মান ও মর্যাদা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন : নিশ্চয়ই যারা তোমার কাছে বাইয়াত করেছে তারা মূলত ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র কাছেই বাইয়াত করেছে। যেমন অন্যত্র ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ বলেন :

(مَنْ يُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّٰهَ ج وَمَنْ تَوَلّٰي فَمَآ أَرْسَلْنٰكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظًا) ‏

“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল এবং কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে তোমাকে তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক প্রেরণ করিনি।” (সূরা নিসা ৪ : ৮০)

‎আল্লাহ তা‘আলা‎র হাত তাদের হাতের ওপর। এ বাইয়াতকে বাইয়াতে রিদওয়ান বলা হয়, কারণ এ বাইয়াতে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ছিল। অতএব যে ব্যক্তি এ অঙ্গীকার পূর্ণ করবে ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ তাকে প্রতিদান দেবেন আর যে ভঙ্গ করবে তার খারাপ পরিণতি তার দিকেই বর্তাবে। যেমন : ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ বলেন :

“নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের নিকট হতে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে তার বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে স্বসস্ত্র যুদ্ধ করে, হত্যা করে ও নিহত হয়। তাওরাত, ইন্জীল ও কুরআনে এ সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে আছে? তোমরা যে সওদা করেছ সে সওদার জন্য আনন্দিত হও আর এটাই মহাসাফল্য।” (সূরা তাওবাহ ৯ : ১১১)

বাইয়াতে রিদওয়ানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ :

ষষ্ঠ হিজরীতে মদীনায় একদা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বপ্নযোগে দেখলেন যে, তিনি ও সাহাবীগণ মাসজিদে হারামে প্রবেশ করছেন, কাবার চাবি গ্রহণ করছেন, উমরা করছেন, কেউ মাথা নেড়া করছেন আর কেউ চুল খাট করছেন। নাবীদের স্বপ্ন সত্য ও ওয়াহী। এ সংবাদ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের মাঝে দিলেন। সকলেই খুশি যে, এ বছর উমরা করতে মক্কায় যাবে। ফলে সকলে প্রস্তুতি নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা করল। যুলকাদা মাসের শুরুর দিকে সোমবার সকালে এ যাত্রা শুরু করেন। হুদায়বিয়া নামক স্থানে আসার পর কুরাইশরা বাধা প্রদান করে। কোনক্রমেই তারা মুসলিমদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না।

মীমাংসা করার জন্য বুদাইল বিন ওয়ারাকা মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে মধ্যস্থতা করে। সে ছিল খোযায়ী গ্রোত্রের লোক। তেহামার অধিবাসীদের মাঝে এ গোত্রই ছিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হিতাকাক্সক্ষী। বুদাইল বলল : আমি কা‘ব বিন লুওয়ায়কে দেখেছি যে, আপনার সাথে যুদ্ধ করা ও ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র ঘর হতে নিবৃত্ত রাখার জন্য তারা বদ্ধপরিকর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : কারো সাথে যুদ্ধ করার জন্য আমরা আসিনি। আমরা শুধু উমরা করার জন্য এসেছি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও অনেক কথা বললেন। শেষে বুদাইল বলল : আমি আপনার এসব কথা কুরাইশদের বলব। তারপর কুরাইশরা একের পর এক দূত প্রেরণ করতে থাকে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওসমান (রাঃ)-কে মক্কায় প্রেরণ করলেন এ নির্দেশ দিয়ে যে, তুমি গিয়ে বলবে আমরা যুদ্ধ করার জন্য আসিনি। আমরা এসেছি উমরা পালন করার জন্য। এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, কুরাইশরা ওসমানকে হত্যা করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এ সংবাদ শুনে ঘোষণা দিলেন- হে বৃক্ষের নিচে অবস্থানকারী সাহাবীগণ! আমার কাছে সংবাদ এসেছে, মক্কার কাফিররা ওসমানকে হত্যা করেছে। আমার কাছে বাইয়াত কর আমরা জীবন দিয়ে হলেও ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ নেব অথবা মক্কা বিজয় করব। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইয়াত গ্রহণ করলেন। সকলেই বাইয়াত করে এ বলে যে,

তারা মরে গেলেও পলায়ন করবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের হাতের ওপর অপর হাত রেখে বললেন, এটা ওসমানের পক্ষ হতে। বাইয়াত শেষে ওসমান (রাঃ) যখন ফিরে আসলেন তখন তিনিও বাইয়াত করলেন। এ বাইয়াত থেকে কেউ পিছপা হয়নি কেবলমাত্র একজন মুনাফিক ছাড়া। সে হল জাদ বিন কায়েস। এ বাইয়াতের ওপর ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ সন্তুষ্ট হয়ে আয়াত নাযিল করে দিলেন :

(لَقَدْ رَضِيَ اللّٰهُ عَنِ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ يُبَايِعُوْنَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ)

“নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নিচে তোমার হাতে বাইয়াত করেছে।” (আর-রাহিকুল মাখতুম)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিয়ামত দিবসে সাক্ষী, মু’মিনদের জন্য সুসংবাদদাতা, এবং কাফিরদের জন্য সতর্ককারী।
২. বাইয়াত হবে কেবলমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের কাছে। তথাকথিত কোন পীর ফকীরদের কাছে না।
৩. ওসমান (রাঃ)-এর মর্যাদা ও ফযীলত জানলাম।
৪. বাইয়াতে রিদওয়ানের প্রেক্ষাপট জানতে পারলাম।
১১-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

ষষ্ঠ হিজরীতে যখন স্বপ্নযোগে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখলেন যে, তিনি উমরা করার জন্য মক্কায় যাচ্ছেন তখন সকল সাহাবীদের মাঝে সাধারণ ঘোষণা দিলেন প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। সাহাবীরা প্রস্তুতি নিয়েছিল কিন্তু মদীনার চতুর্দিকে বসবাসকারী কয়েকটি গোত্র প্রস্তুতি নেয়নি।

যমন গিফার, মুযাইনা, জাহাইনা, আসলাম এবং দুআল গোত্রসমূহ। প্রস্তুতি না নেয়ার কারণ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে- তারা সন্তান-সন্ততি ও সম্পদের মোহে যেতে পারেনি।

‎আল্লাহ তা‘আলা‎ বলেন : তারা যেসব ওজর পেশ করে তা কেবল তাদের মুখের কথা, অন্তর থেকে বলছে না, মূলত এরা মুনাফিক। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল মুসলিমরা মক্কার মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করে পারবে না, সেখানে তাদের মৃত্যু অনিবার্য। তাই মৃত্যুর ভয়ে তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করেনি। তাই আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাদেরকে বলে দিতে নির্দেশ দিলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা যদি তোমাদের ক্ষতি বা উপকার করতে চান তাহলে তোমাদের পক্ষে কে তাঁর ফায়সালাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাখে? অর্থাৎ কারও কিছু করার নেই।

(وَمَنْ لَّمْ يُؤْمِنْ بِاللّٰهِ وَرَسُوْلِهِ)

‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনে না’ অর্থাৎ যারা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সকল আমলসমূহে ইখলাস রাখে না বরং মুনাফিকী পন্থা অবলম্বন করে ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ তাদেরকে জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি দিবেন।

অতএব কখনো একজন প্রকৃত মু’মিনকে সন্তান ও সম্পদের মোহ আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের নির্দেশ পালনে বিরত রাখতে পারে না। বরং সব কিছুর ওপর আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের ভালবাসাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

“বল : ‎ ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পতœী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর‎ এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস, তবে অপেক্ষা কর‎ আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত’ আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।” (সূরা তাওবা ৯ : ২৪)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. হুদায়বিয়ার সন্ধিতে যে-সকল মুনাফিক গোত্র শরীক হয়নি তাদের পরিচয় জানলাম।
২. ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র ব্যাপারে খারাপ ধারণা করা হারাম।
৩. মুনাফিকদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
৪. যারা কল্যাণমূলক কাজে পেছনে পড়ে থাকে তাদের তিরস্কার করা হয়েছে।
১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে খায়বার বিজয় ও সেখানে প্রভুত গনীমতের মাল লাভের ওয়াদা দিয়েছেন। খায়বার মদীনা পার্শ্ববর্তী একটি এলাকা যেখানে ইয়াহূদীরা বসবাস করত। যে-সকল বেদুঈনরা হুদায়বিয়ায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেনি তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন যে, তারা যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদেরকে খায়বার বিজয়ের পর গনীমতের মাল নেয়ার জন্য যেতে দেখে তখন বলে, আমাদেরকেও সাথে নাও। যাতে গনীমত নিতে পারি। কারণ তারা লক্ষণাদি দেখে জানতে পারে যে, খায়বার বিজয় হবে এবং অনেক গনীমত পাবে। অথচ তারা পূর্বে শত্র“দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে পিছপা ছিল। ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিয়ে তাদেরকে গনীমতের ভাগ দিতে নিষেধ করেছেন। এটা তাদের অপরাধের শাস্তি। কেননা ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ খায়বারের গনীমতের মাল তাদেরকে দেয়ার অঙ্গীকার দিয়েছেন যারা হুদায়বিয়াতে শরীক হয়েছিল।

(يُرِيْدُوْنَ أَنْ يُبَدِّلُوْا كَلَامَ اللّٰهِ)

‘এরা আল্লাহর কথা বদলে দিতে চায়’ মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : এটা ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র সে প্রতিশ্রুতি যা হুদায়বিয়ায় যারা শরীক হয়েছে তাদেরকে দিয়েছেন। অর্থাৎ হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশগ্রহণকারীরাই খায়বারের গনীমত পাবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা হুদায়বিয়ায় অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের জন্য খায়বারের যুদ্ধে শরীক হওয়া ও গনীমতের মালে অংশীদার হওয়া বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু এসব পেছনে থাকা লোকেরাও শরীক হতে চায়।

ইবনু জায়েদ বলেন : এটা হল ‎আল্লাহ তা‘আলা‎র কথা :

“আল্লাহ যদি তোমাকে তাদের কোন দলের নিকট ফেরত আনেন এবং তারা অভিযানে বের হবার জন্য তোমার অনুমতি প্রার্থনা করে, তখন তুমি বলবে, ‘তোমরা আমার সাথে কখনও বের হবে না এবং আমার সঙ্গী হয়ে কখনও শত্র“র সাথে যুদ্ধ করবে না। তোমরা প্রথমবার বসে থাকাই পছন্দ করেছিলে; সুতরাং যারা পেছনে থাকে তাদের সাথে বসেই থাক।” (সূরা তাওবা ৯ : ৮৩)

অতএব শুধু গনীমতের আশায় যুদ্ধ করা উচিত নয় বরং যুদ্ধ করতে হবে দীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। যুদ্ধ করতে গিয়ে সম্পদও পাওয়া গেলে আলহামদুলিল্লাহ।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলা হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশগ্রহণকারীদেরকে খায়বারের গনীমতের প্রতিশ্রতি প্রদান করেছেন।
২. মুনাফিকদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারলাম।
১৬-১৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যে-সকল বেদুঈনরা হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশগ্রহণ করেনি এবং তাতে অংশগ্রহণ না করার স্বপক্ষে বিভিন্ন মিথ্যা ওজর-আপত্তি পেশ করছে আর বলছে আমরাও তোমাদের সাথে যেতাম যদি আমাদের সম্পদ ও পরিবারের বেড়াজালে না পড়তাম তাদের সম্পর্কে ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ পরীক্ষামূলক বলছেন- হে নাবী! তুমি বলে দাও তোমাদেরকে এমন এক জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আহ্বান করা হবে যারা খুব শক্তিশালী, যুদ্ধ করে তাদেরকে হত্যা করতে হবে অথবা তারা আত্মসমর্পণ করবে। এখানে বিশেষভাবে শক্তিশালী জাতির কথা উল্লেখের অন্যতম একটি কারণ হল পেছনে থাকা বেদুঈনরা যদি সত্যিকার মু’মিন হয় এবং জিহাদের প্রতি আন্তরিকতা থাকে শুধু গনীমতের আশায় জিহাদে না যায় তাহলে শক্তিশালী জাতিকে কেউ ভয় করবে না। আর যদি অন্তরে মুনাফিকী থাকে তাহলে পূর্বের মতই বিভিন্ন মিথ্যা ওজর দেখিয়ে জিহাদে যাবে না।

এ শক্তিশালী জাতি কারা তা নিয়ে কয়েকটি মতামত পাওয়া গেলেও সঠিক কথা হল তারা পারস্য ও রোমবাসী এবং তাদের মত শক্তিশালী যারা রয়েছে। (তাফসীরে সা‘দী, অত্র আয়াতের তাফসীর)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা যুদ্ধ করবে এমন এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যাদের চক্ষু ছোট ছোট এবং নাক হবে চেপটা। তাদের চেহারা হবে ঢালের মত। আবূ সুফিয়ান (রাঃ) বলেন : তারা হল তুর্কী। (আবূ দাউদ হা. ৪৩০৪, ইবনু মাযাহ হা. ৪০৯৭, সহীহ)

অতঃপর সেসকল লোকদের বিবরণ দেয়া হচ্ছে যারা যথাযথ ওজর থাকার কারণে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। তারা হল অন্ধ, খোঁড়া, অসুস্থ।

কোন মুসলিম এমন সমস্যাগ্রস্ত হলে তার জন্য জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি রয়েছে তবে তাকে অবশ্যই জিহাদে গমণকারী মুজাহিদদের জন্য কল্যাণ কামনা করতে হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য করতে হবে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন :

(وَإِنْ تَتَوَلَّوْا كَمَا تَوَلَّيْتُمْ مِّنْ قَبْلُ يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيْمًا)

‘আর যদি তোমরা আগের মতোই পেছনে ফিরে যাও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব দেবেন’ যখন এ আয়াতটি নাযিল হল তখন সাহাবীদের মাঝে যারা বিকলাঙ্গ লোক ছিল তারা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করার যোগ্য নন। ফলে তারাও নাকি এ শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষিতে

(لَيْسَ عَلَي الْأَعْمٰي حَرَجٌ وَّلَا عَلَي الْأَعْرَجِ حَرَجٌ وَّلَا عَلَي الْمَرِيْضِ حَرَجٌ)

‘অবশ্য যদি অন্ধ, খোঁড়া ও রোগী জিহাদে না আসে তাহলে কোনো দোষ নেই’ এ আয়াত নাযিল হয়। (কুরতুবী)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. বিনা ওজরে জিহাদে অংশ গ্রহণ না করা মুনাফিকী কাজ।
২. যাদের জন্য যুদ্ধে না যাওয়ার অনুমতি রয়েছে তাদের উচিত মুজাহিদদের জন্য কল্যাণ কামনা করা।
৩. সত্যিকার মু’মিনরা কোন শক্তি ও সংখ্যাকে ভয় করে না, তারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য প্রকাশার্থে সর্বদা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।

১৮-১৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যে-সকল মু’মিন হুদায়বিয়ার দিন গাছের নিচে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল তাদের প্রতি ‎আল্লাহ ‎ সন্তুষ্ট সে সংবাদ এখানে দেয়া হয়েছে। তাদের সংখ্যা চৌদ্দশত জন।

তাদের অন্তরে যে ঈমান, সত্যতা ও ওয়াদা পূর্ণ করার মানসিকতা ছিল তা ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ পরীক্ষা করে জেনে নিলেন। তাদের অন্তরে যা ছিল তার প্রতিদানস্বরূপ ‎আল্লাহ তা‘আলা‎ প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং নিকটতম একটি বিজয় দান করলেন (অর্থাৎ সুসংবাদ দিলেন)। সে নিকটমত বিজয় হল খায়বার বিজয়। সে যুদ্ধে কেবলমাত্র হুদায়বিয়ায় অংশ গ্রহণকারী সাহাবীগণ অংশগ্রহণ করেছিল। আর এ যুদ্ধে মুসলিমরা অনেক গনীমত পেয়েছিল। (বিস্তারিত : আর-রাহীকুল মাখতুম, খাইবার যুদ্ধ)

জাবের (রাঃ) বলেন : হুদায়বিয়ার দিন আমাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

أَنْتُمْ خَيْرُ أَهْلِ الأَرْضِ

তোমরা পৃথিবীবাসীদের মধ্যে উত্তম মানুষ। (সহীহ বুখারী হা. ৪১৫৪) রাসূলুল্লাহ বলেন :

لَا يَدْخُلُ النَّارَ أَحَدٌ مِمَّنْ بَايَعَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ

যারা গাছের নিচে বাইয়াত করেছে তাদের কেউ জাহান্নামে যাবে না। (তিরমিযী হা. ৩৮৬০, সহীহ)

তারেক বিন আবদুর রহমান (রাঃ) বলেন : তিনি একদা হাজ্জ করতে গিয়ে দেখতে পান যে, কতকগুলো লোক এক জায়গায় সালাত আদায় করছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন : এটা কোন মাসজিদ? তারা বলল এটা ঐ গাছ, যে গাছের নিচে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের কাছ থেকে বাইয়াত নিয়েছিলেন। তারেক বললেন : আমি সাঈদ বিন মুসাইয়েব (রহঃ)-কে জানালাম, তিনি বললেন : আমার বাবা যিনি গাছের নিচে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে বাইয়াত করেছিল তিনি আমাকে বলেছেন যে, যখন আমরা আগামী বছর হাজ্জ করতে গেলাম তখন জায়গাটি ভুলে যাই, নির্ণয় করতে পারিনি। সাঈদ (রহঃ) বলেন যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীরা জানেনা আর তোমরা তা জেনে গেলে, তোমরা কি তাদের চেয়ে বেশি জান? (সহীহ বুখারী হা. ৪১৬৩)

সুতরাং পরবর্তীকালের লোকেরা নিছক অনুমানের মাধ্যমে কোন একটি বৃক্ষকে নির্দিষ্ট করে নিয়েছিল এবং তার নিচে জড়ো হয়ে সালাত আদায় শুরু করছিল। উমার (রাঃ) জানতেন যে, এটা সে বৃক্ষ নয় তাই শির্কের আশংকায় তিনি সে বৃক্ষটি কেটে ফেলেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারীদের ফযীলত সম্পর্কে জানলাম।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা দিয়ে গেছেন তার অতিরিক্ত করাই ধর্মে বাড়াবাড়ি করা।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৮-১০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেনঃ “হে নবী (সঃ)! আমি তোমাকে আমার মাখলুকের উপর সাক্ষীরূপে, মুমিনদেরকে সুসংবাদ দানকারীরূপে এবং কাফিরদেরকে ভয় প্রদর্শনকারীরূপে প্রেরণ করেছি।’ এ আয়াতের পূর্ণ তাফসীর সূরায়ে আহযাবে গত হয়েছে।

মহান আল্লাহ্ বলেনঃ যাতে তোমরা আল্লাহর উপর এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর উপর ঈমান আনয়ন কর এবং রাসূল (সঃ)-কে সাহায্য কর ও সম্মান কর, অর্থাৎ তার বুযুর্গী ও পবিত্রতা স্বীকার করে নাও এবং প্রাতে ও সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।

আল্লাহ্ পাক স্বীয় নবী (সঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ যারা তোমার বায়আত গ্রহণ করে তারা তো আল্লাহরই বায়আত গ্রহণ করে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য করে সে আল্লাহরই আনুগত্য করে।” (৪:৮০)

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর।অর্থাৎ তিনি তাদের সাথে আছেন এবং তাদের কথা শুনেন। তিনি তাদের স্থান দেখেন এবং তাদের বাইরের ও ভিতরের খবর জানেন। সুতরাং রাসূল (সঃ)-এর মাধ্যমে তাদের নিকট হতে বায়আত গ্রহণকারী আল্লাহ তা’আলাই বটে। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের নিকট হতে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন এবং এর বিনিময়ে তাদের জন্যে জান্নাত রয়েছে, তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে এবং তারা হত্যা করে ও নিহত হয়, আল্লাহ তাআলার এই সত্য ওয়াদা তাওরাত ও ইঞ্জিলেও বিদ্যমান রয়েছে এবং এই কুরআনেও মওজুদ আছে, আল্লাহ অপেক্ষা অধিক ওয়াদা পূর্ণকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমাদের উচিত এই বেচা কেনায় খুশী হওয়া এবং এটাই বড় কৃতকার্যতা।” (৯:১১১)।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে তার তরবারী চালনা করলো সে আল্লাহর নিকট বায়আত গ্রহণ করলো।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অন্য হাদীসে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন ওটাকে উথিত করবেন, ওর দুটি চক্ষু হবে যার দ্বারা ওটা দেখবে এবং একটি রসনা হবে যার দ্বারা ওটা কথা বলবে। সুতরাং ন্যায়ভাবে যে ওকে চুম্বন করেছে তার জন্যে ওটা সাক্ষ্য প্রদান করবে। অতএব, যে ওকে চুম্বন করে সে আল্লাহ তা’আলার নিকট বায়আত গ্রহণকারী।” অতঃপর তিনি (আরবী)-এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটিও বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ)) এ জন্যেই আল্লাহ তা’আলা এখানে বলেনঃ “যে ওটা ভঙ্গ করে, ওটা ভঙ্গ করবার পরিণাম তারই, অর্থাৎ এর শাস্তি তাকেই ভোগ করতে হবে, (এতে মহান আল্লাহর কোন ক্ষতি হবে না)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে তিনি তাকে পুরস্কার দেন।’ এই বায়আত হলো বায়আতে রিযওয়ান। একটি বাবলা গাছের নীচে এই বায়আত গ্রহণ করা হয়েছিল। এই ঘটনা হুদায়বিয়া প্রান্তরে সংঘটিত হয়। ঐদিন যেসব সাহাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন তাদের সংখ্যা ছিল তেরোশ। আবার চৌদ্দশ এবং পনেরশতের কথাও বলা হয়েছে, তবে মধ্যেরটিই সঠিকতম।

এব্যাপারে যেসব হাদীস এসেছেঃ হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “হুদায়বিয়ার দিন আমরা সংখ্যায় চৌদ্দশত ছিলাম।” ()

হযরত জাবির (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন “ঐ দিন আমরা চৌদ্দশ জন ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ কূপের পানিতে হাত রাখেন, তখন তার অঙ্গুলিগুলোর মধ্য হতে পানির ঝরণা বইতে শুরু করে। সাহাবীদের (রাঃ) সবাই এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। এটা সংক্ষিপ্ত। এ হাদীসের অন্য ধারায় রয়েছে যে, ঐদিন সাহাবীগণ খুবই পিপাসার্ত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর তৃণ বা তীরদানী হতে একটি তীর বের করে তাদেরকে দেন। তারা ওটা নিয়ে গিয়ে হুদায়বিয়ার কূপে নিক্ষেপ করেন। তখন ঐ কূপের পানি উথলিয়ে উঠতে শুরু করে, এমন কি ঐ পানি সবারই জন্যে যথেষ্ট হয়ে যায়। হযরত জাবির (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা। হয়ঃ “ঐদিন আপনারা কতজন ছিলেন? উত্তরে তিনি বলেনঃ “ঐদিন আমরা চৌদ্দশ জন ছিলাম। কিন্তু যদি আমরা এক লক্ষও হতাম তবুও ঐ পানি আমাদের জন্যে যথেষ্ট হয়ে যেতো।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ২. ইমাম মুসলিম (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, তাঁদের সংখ্যা ছিল পনেরশ’।

ইমাম বায়হাকী (রঃ) বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে তাদের সংখ্যা পনের শতই ছিল এবং হযরত জাবির (রাঃ)-এর প্রথম উক্তি এটাই ছিল। অতঃপর তাঁর মনে কিছু সন্দেহ জাগে এবং তিনি তাদের সংখ্যা চৌদ্দশ বলতে শুরু করেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তারা ছিল এক হাজার পাঁচশ পঁচিশ জন। কিন্তু তার প্রসিদ্ধ রিওয়াইয়াত এক হাজার চারশ জনেরই রয়েছে। অধিকাংশ বর্ণনাকারী ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের উক্তি এটাই যে, তারা চৌদ্দশত জন ছিলেন। একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, গাছের নীচে বায়আত গ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশ এবং সেই দিন মুহাজিরদের এক অষ্টমাংশ লোক মুসলমান হন।

মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ)-এর সীরাত গ্রন্থে রয়েছে যে, হুদায়বিয়ার বছর রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাতশ’ জন সাহাবী (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে বায়তুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা হতে যাত্রা শুরু করেন। তার যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল না। কুরবানীর সত্তরটি উটও তিনি সঙ্গে নেন। প্রতি দশজনের পক্ষ হতে একটি উট। তবে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ঐ দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথী ছিলেন চৌদ্দশ জন লোক। ইবনে ইসহাক (রঃ) এরূপই বলেছেন। কিন্তু এটা তাঁর ধারণা। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রক্ষিত রয়েছে যে, তাঁদের সংখ্যা ছিল এক হাজার এবং কয়েকশ, যেমন সত্বরই আসছে ইনশাআল্লাহ।

এই মহান বায়আতের উল্লেখ করার কারণঃ মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার (রঃ) স্বীয় সীরাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেনঃ অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন যে, তিনি যেন মক্কায় গিয়ে কুরায়েশ নেতৃবর্গকে বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) যুদ্ধের উদ্দেশ্যে আসেননি, বরং শুধু বায়তুল্লাহ শরীফের উমরা করার উদ্দেশ্যে এসেছেন। কিন্তু হযরত উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার ধারণামতে এ কাজের জন্যে হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ)-কে মক্কায় পাঠানো উচিত। মক্কায় আমার বংশের এখন কেউ নেই। অর্থাৎ বানু আদ্দী ইবনে কাবের গোত্রের লোকেরা নেই যারা সহযোগিতা করতো। কুরায়েশদের সাথে আমার যা কিছু হয়েছে তা তো আপনার অজানা নেই। তারা তো আমার উপর ভীষণ রাগান্বিত অবস্থায় রয়েছে। তারা আমাকে পেলে তো জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিবে না।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উমার (রাঃ)-এর এ মতকে যুক্তিযুক্ত মনে করলেন এবং হযরত উসমান (রাঃ)-কে আবু সুফিয়ান (রাঃ) এবং অন্যান্য কুরায়েশ নেতৃবর্গের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। হযরত উসমান (রাঃ) পথ চলতেই ছিলেন এমন সময় আব্বান ইবনে সাঈদ ইবনে আসের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়ে যায়। সে তাকে তার সওয়ারীর উপর উঠিয়ে নিয়ে মক্কায় পৌঁছিয়ে দেয়। তিনি কুরায়েশদের বড় বড় নেতাদের নিকট গেলেন এবং তাদের কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পয়গাম পৌঁছিয়ে দিলেন। তারা তাঁকে বললোঃ “আপনি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে চাইলে করে নিন।” তিনি উত্তরে বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পূর্বে আমি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবো এটা অসম্ভব ।” তখন তারা হযরত উসমান (রাঃ)-কে আটক করে নিলো। ওদিকে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, হযরত উসমান (রাঃ)-কে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। এই বর্বরতার পূর্ণ খবর শুনে মুসলমানগণ এবং স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) অত্যন্ত মর্মাহত ও বিচলিত হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এখন তো আমরা কোন মীমাংসা ছাড়া এখান হতে সরছি না!” সুতরাং তিনি সাহাবীদেরকে (রাঃ) আহ্বান করলেন এবং একটি গাছের নীচে তাঁদের নিকট হতে বায়আত গ্রহণ করলেন। এটাই বায়আতে রিযওয়ান নামে প্রসিদ্ধ। লোকেরা বলেন যে, মৃত্যুর উপর এই বায়আত গ্রহণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ আমরা যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করবো। কিন্তু হযরত জাবির (রাঃ) বলেন যে, এটা মৃত্যুর উপর বায়আত ছিল না, বরং এই অঙ্গীকারের উপর ছিল যে, তারা কোন অবস্থাতেই যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করবেন না। ঐ ময়দানে যতজন মুসলিম সাহাবী (রাঃ) ছিলেন, সবাই এই বায়আতে রিযওয়ান করেছিলেন। শুধু জাদ্দ ইবনে কায়েস নামক এক ব্যক্তি এই বায়আত করেনি যে ছিল বানু সালমা গোত্রের লোক। সে তার উষ্ট্রীর আড়ালে লুকিয়ে থাকে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও সাহাবীগণ (রাঃ) জানতে পারেন হযরত উসমান (রাঃ)-এর শাহাদতের খবরটি মিথ্যা।

হযরত উসমান (রাঃ) কুরায়েশদের নিকট বন্দী থাকা অবস্থাতেই তারা সাহল ইবনে আমর, হুওয়াইতির ইবনে আবদিল উযযা এবং মুকরি ইবনে হাফসকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট প্রেরণ করেন। এই লোকগুলো এখানেই ছিল ইতিমধ্যে কতক মুসলমানও মুশরিকদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে পাথর ও তীর ছুড়াছুড়িও হয়ে যায়। উভয়দল চীৎকার। করতে থাকে। ওদিকে হযরত উসমান (রাঃ) বন্দী আছেন আর এদিকে মুশরিকদের এ লোকগুলোকে আটকিয়ে দেয়া হয়। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঘোষক ঘোষণা করেনঃ “রূহুল কুদস (হযরত জিবরাঈল আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বায়আতের হুকুম দিয়ে গেছেন। আসুন, আল্লাহর নাম নিয়ে বায়আত করে যান!”এ ঘোষণা শোনা মাত্রই সাহাবীগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট দৌড়িয়ে আসেন। ঐ সময় তিনি একটি গাছের নীচে অবস্থান করছিলেন। সবাই তার হাতে বায়আত করেন যে, তাঁরা কখনো কোন অবস্থাতেই যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করবেন না। এখবর শুনে মুশরিকরা কেঁপে ওঠে এবং যতগুলো মুসলমান তাদের নিকট ছিলেন সবকেই ছেড়ে দেয়। অতঃপর তারা সন্ধির আবেদন জানায়।

ইমাম বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, বায়আত গ্রহণের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহ! উসমান (রাঃ) আপনার রাসূল (সঃ)-এর কাজে গিয়েছেন। অতঃপর তিনি নিজের একটি হাতকে অপর হাতের উপর রেখে হযরত উসমান (রাঃ)-এর পক্ষ হতে বায়আত গ্রহণ করেন। সুতরাং হযরত উসমান (রাঃ)-এর জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাত সাহাবীদের (রাঃ) হাত হতে বহু গুণে উত্তম ছিল।

সর্বপ্রথম যিনি এই বায়আত করেছিলেন তিনি ছিলেন হযরত আবু সিনান আসাদী (রাঃ)। তিনি সকলের আগে অগ্রসর হয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হাত বাড়িয়ে দিন যাতে আমি বায়আত করতে পারি।” তিনি বললেনঃ “কিসের উপর বায়আত করবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আপনার অন্তরে যা রয়েছে তারই উপর আমি বায়আত করবো।” তাঁর পিতার নাম ছিল অহাব।

হযরত নাফে’ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “লোকেরা বলে যে, হযরত উমার (রাঃ)-এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) পিতার পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে তা নয়। ব্যাপারটি এই যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির বছর হযরত উমার (রাঃ) তাঁর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে একজন আনসারীর নিকট পাঠান যে, তিনি যেন তার কাছে গিয়ে তাঁর নিকট হতে নিজের ঘোড়াটি নিয়ে আসেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) লোকদের নিকট হতে বায়আত নিচ্ছিলেন। হযরত উমার (রাঃ) এ খবর জানতেন না। তিনি গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) দেখতে পান যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে জনগণ বায়আত করছেন। তাঁদের দেখাদেখি তিনিও বায়আত করেন। তারপর তিনি স্বীয় ঘোড়াটি নিয়ে হযরত উমার (রাঃ)-এর নিকট যান এবং তাঁকে খবর দেন যে, জনগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে বায়আত করছে। এ খবর শোনা মাত্র হযরত উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে তাঁর হাতে বায়আত করেন। এর উপর ভিত্তি করেই জনগণ বলতে শুরু করেন যে, পিতার পূর্বেই পুত্র ইসলাম গ্রহণ করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সহীহ বুখারীর অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, জনগণ পৃথক পৃথকভাবে গাছের ছায়ায় বসেছিলেন। হযরত উমার (রাঃ) দেখেন যে, সবারই দৃষ্টি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতি রয়েছে এবং তাঁরা তাঁকে ঘিরে রয়েছেন। তখন তিনি স্বীয় পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! দেখে এসো তো, ব্যাপারটা কি?” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) এসে দেখেন যে, জনগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে বায়আত করছেন। এ দেখে তিনিও বায়আত করেন এবং এরপর ফিরে গিয়ে স্বীয় পিতা হযরত উমার (রাঃ)-কে খবর দেন। হযরত উমার (রাঃ)-ও তখন তাড়াতাড়ি এসে বায়আত করেন। হযরত জাবির (রাঃ) বলেনঃ “যখন আমাদের বায়আত করা হয়ে যায় তখন দেখি যে, হযরত উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাত ধারণ করে রয়েছেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি বাবলা গাছের নীচে ছিলেন।”

হযরত মাকাল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেন:“ঐ সময় আমি গাছের ঝুঁকে থাকা একটি ডালকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মাথার উপর হতে উঠিয়ে ধরেছিলাম। আমরা ঐদিন চৌদ্দশ জন ছিলাম।” তিনি আরো বলেনঃ “ঐদিন আমরা তার হাতে মৃত্যুর উপর বায়আত করিনি, বরং বায়আত করেছিলাম যুদ্ধক্ষেত্র হতে না পালাবার উপর।”

হযরত সালমা ইবনে আকওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি গাছের নীচে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে বায়আত করেছিলাম।” হযরত ইয়াযীদ (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আবু মাসলামা (রাঃ)! আপনারা কিসের উপর বায়আত করেছিলেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমরা মৃত্যুর উপর বায়আত করেছিলাম।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সালমা (রাঃ) হতেই বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “হুদায়বিয়ার দিন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে বায়আত করে সরে আসি। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে বলেনঃ “হে সালমা (রাঃ)! তুমি বায়আত করবে না?” আমি জবাবে বলিঃ আমি বায়আত করেছি। তিনি বললেনঃ “এসো, বায়আত কর।” আমি তখন তাঁর কাছে গিয়ে আবার বায়আত করি। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে সালমা (রাঃ)! আপনি কিসের উপর বায়আত করেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “মৃত্যুর উপর।” (এটাও সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত সালমা ইবনে আকওয়া (রাঃ) আরো বলেনঃ “হুদায়বিয়ার কূপে এতোটুকু পানি ছিল যে, পঞ্চাশটি বকরীর পিপাসা মিটাবার জন্যেও যথেষ্ট ছিল না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) ওর ধারে বসে তাতে থুথু নিক্ষেপ করেন। তখন ওর পানি উথলিয়ে ওঠে। ঐ পানি আমরাও পান করি এবং আমাদের জন্তুগুলোকেও পান করাই। ঐদিন আমরা চৌদ্দশ জন ছিলাম। আমার কাছে কোন ঢাল নেই দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি ঢাল দান করেন। অতঃপর তিনি লোকদের বায়আত নিতে শুরু করেন। তারপর শেষবার তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেনঃ “হে সালমা (রাঃ)! তুমি বায়আত করবে না?” আমি জবাবে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! প্রথমে যারা বায়আত করেছিলেন আমিও তাদের সাথে বায়আত করেছিলাম। মধ্যে আর একবার বায়আত করেছি। তিনি বললেনঃ “ঠিক আছে আবার বায়আত কর।” আমি তখন তৃতীয়বার বায়আত করলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “হে সালমা (রাঃ)! আমি তোমাকে যে ঢালটি দিয়েছিলাম তা কি হলো?” আমি উত্তরে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হযরত আমির (রাঃ)-এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে তাকে দেখি যে, তার কাছে কোন ঢাল নেই, তাই আমি তাঁকে ঢালটি প্রদান করেছি। তখন তিনি হেসে ওঠে আমাকে বললেন, হে সালমা (রাঃ)! তুমি তো ঐ ব্যক্তির মত হয়ে গেলে যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলঃ “হে আল্লাহ! আমার কাছে এমন একজনকে পাঠিয়ে দিন যে আমার নিকট আমার নিজের জীবন হতেও প্রিয়।” অতঃপর মক্কাবাসী সন্ধির জন্যে তোড়জোড় শুরু করে। যাতায়াত চলতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে সন্ধি হয়ে যায়। আমি হযরত তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ (রাঃ)-এর খাদেম ছিলাম। আমি তার ঘোড়ার ও তাঁর নিজের খিদমত করতাম। বিনিময়ে তিনি আমাকে খেতে দিতেন। আমি তো আমার ঘর বাড়ী ছেলে মেয়ে এবং মালধন ছেড়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর পথে হিজরত করে চলে এসেছিলাম। যখন সন্ধি হয়ে যায় এবং এদিকের লোক ওদিকে এবং ওদিকের লোক এদিকে চলাফেরা শুরু করে তখন একদা আমি একটি গাছের নীচে গিয়ে কাঁটা ইত্যাদি সরিয়ে ঐ গাছের মূল ঘেঁষে শুয়ে পড়ি। অকস্মাৎ মুশরিকদের চারজন লোক তথায় আগমন করে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সম্পর্কে কিছু অসম্মানজনক মন্তব্য করতে শুরু করে। আমার কাছে তাদের কথাগুলো খুবই খারাপ লাগে। তাই আমি সেখান হতে উঠে আর একটি গাছের নীচে চলে আসি। তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র খুলে ফেলে এবং গাছের ডালে লটকিয়ে রাখে। অতঃপর তারা সেখানে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়েছে এমন সময় শুনি যে, উপত্যকার নীচের অংশে কোন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করছেনঃ “হে মুহাজির ভাই সব! হযরত ইবনে যানীম (রাঃ) নিহত হয়েছেন!” একথা শুনেই আমি তাড়াতাড়ি আমার তরবারী উঠিয়ে নিই এবং ঐ গাছের নীচে গমন করি যেখানে ঐ চার ব্যক্তি ঘুমিয়েছিল। সেখানে গিয়েই আমি সর্বপ্রথম তাদের হাতিয়ারগুলো নিজের অধিকারভুক্ত করে নিই। তারপর এক হাতে তাদেরকে দাবিয়ে নিই এবং অপর হাতে তরবারী উঠিয়ে তাদেরকে বলিঃ দেখো, যে আল্লাহ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে মর্যাদা দান করেছেন তাঁর শপথ! তোমাদের যে তার মস্তক উত্তোল করবে, আমি এই তরবারী দ্বারা তার মস্তক কর্তন করে ফেলবো। যখন এটা মেনে নিলো তখন আমি তাদেরকে বললামঃ উঠো এবং আমার আগে আগে চলো। অতঃপর আমি তাদেরকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হলাম। ওদিকে আমার চাচা হযরত আমির (রাঃ) ও মুকরিয নামক আবলাতের একজন মুশরিককে গ্রেফতার করে আনেন। এই ধরনের সত্তরজন মুশরিককে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে সাহাবীদেরকে বলেনঃ “তাদেরকে ছেড়ে দাও। অন্যায়ের সূচনাও তাদের থেকেই হয়েছে এবং এর পুনরাবৃত্তিরও যিম্মাদার তারাই থাকবে। অতঃপর সূবকেই ছেড়ে দেয়া হয়। এরই বর্ণনা (আরবী)-এই আয়াতে রয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিমও (রঃ) প্রায় এই রূপই বর্ণনা করেছেন)

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনা দ্বারা এটা সাব্যস্ত যে, হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রাঃ)-এর পিতাও (রাঃ) গাছের নীচে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে বায়আত করেছিলেন। তিনি বলেনঃ “পরের বছর যখন আমরা হজ্ব করতে যাই তখন যে গাছের নীচে আমরা বায়আত করেছিলাম ওটা আমাদের কাছে গোপন থাকে, ঐ জায়গাটি আমরা চিনতে পারিনি। এখন যদি তোমাদের নিকট তা প্রকাশ পেয়ে থাকে তবে তোমরা জানতে পার।”

একটি রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “আজ তোমরা ভূ-পৃষ্ঠের সমস্ত লোক হতে উত্তম। আজ আমার দৃষ্টিশক্তি থাকলে আমি তোমাদেরকে ঐ গাছের জায়গটি দেখিয়ে দিতাম।

হযরত সুফিয়ান (রঃ) বলেন যে, এই জায়গাটি নির্দিষ্টকরণে মতভেদ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে লোকগুলো এই বায়আতে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের কেউই জাহান্নামে যাবে না।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যেসব লোক এই গাছের নীচে আমার হাতে বায়আত করেছে তারা সবাই জান্নাতে যাবে, শুধু লাল উটের মালিক নয়।” বর্ণনাকারী হযরত জাবির (রাঃ) বলেন আমরা তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম, দেখি যে, একটি লোক তার হারানো উট অনুসন্ধান করতে রয়েছে। আমরা তাকে বললামঃ চলো, বায়আত কর। সে জবাবে বললোঃ “বায়আত করা অপেক্ষা হারানো উট খোজ করাই আমার জন্যে বেশী লাভজনক।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি সানিয়াতুল মিরারের উপর চড়ে যাবে তার থেকে ওটা দূর হয়ে যাবে যা বানী ইসরাঈল থেকে দূর হয়েছিল। তখন সর্বপ্রথম বানু খাযরাজ গোত্রীয় একজন সাহাবী (রাঃ) ওর উপর আরোহণ করে যান। তারপর তার দেখাদেখি অন্যান্য লোকেরাও সেখানে পৌঁছে যান। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তোমাদের সকলকেই ক্ষমা করে দেয়া হবে, শুধু লাল উটের মালিক এদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, আমরা তখন ঐ লোকটির নিকট গিয়ে বললামঃ চলো, তোমার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। লোকটি জবাবে বললোঃ “আল্লাহর শপথ! যদি আমি আমার উট পেয়ে নিই তবে তোমাদের সঙ্গী (রাসূলুল্লাহ সঃ) আমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, এর চেয়ে ওটাই হবে আমার জন্যে বেশী আনন্দের ব্যাপার।” ঐ লোকটি তার হারানো উট খোজ করছিল। (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

বর্ণিত আছে যে, হযরত হাফসা (রাঃ) যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেন যে, এই বায়আতকারীদের কেউই জাহান্নামে যাবে না, তখন তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হ্যা যাবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাঁকে থামিয়ে দেন এবং তিরস্কার করেন। তখন হযরত হাফসা (রাঃ) আল্লাহর কালামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের প্রত্যেকেই ওটা (অর্থাৎ পুলসিরাত) অতিক্রম করবে।”(১৯:৭১) একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, এরপরেই আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “পরে আমি মুত্তাকীদেরকে উদ্ধার করবো এবং যালিমদেরকে সেথায় নতজানু অবস্থায় রেখে দিবো।” (১৯:৭২) (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত হাতিব ইবনে বুলতাআর (রাঃ) গোলাম হযরত হাতিব (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয় এবং বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হাতিব (রাঃ) অবশ্যই জাহান্নামে যাবে।” তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তুমি মিথ্যা বলছো। সে জাহান্নামী নয়। সে বদরে এবং হুদায়বিদায় হাযির ছিল।”

এই বুযুর্গ ব্যক্তিদের প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “যারা তোমার বায়আত গ্রহণ করে তারা তো আল্লাহরই বায়আত গ্রহণ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। সুতরাং যে ওটা ভঙ্গ করে ওটা ভঙ্গ করবার পরিণাম তারই এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে তাকে তিনি মহাপুরস্কার দেন।” যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নীচে তোমার বায়আত গ্রহণ করেছে, তাদের মনের বাসনা তিনি জেনেছেন, অতঃপর তিনি তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করেছেন এবং তাদেরকে আসন্ন এক বিজয় দ্বারা পুরস্কৃত করেছেন।” (৪৮:১৮)।

১১-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:

যেসব আরব বেদুঈন জিহাদ হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছিল এবং মৃত্যুর ভয়ে বাড়ী হতে বের হয়নি, আর মনে করে নিয়েছিল যে, এতো বড় কুফরী শক্তির সামনে তারা কখনো টিকতে পারবে না এবং যারা তাদের সঙ্গে লড়বে তাদের ধ্বংস অনিবার্য, তারা আর কখনো তাদের ছেলে মেয়েদের মুখ দেখতে পাবে না, যুদ্ধক্ষেত্রেই তারা সবাই নিহত হয়ে যাবে, কিন্তু যখন তারা দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সাহাবীবর্গ (রাঃ) সহ আনন্দিত অবস্থায় ফিরে আসলেন তখন তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে মিথ্যা ওযর পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে পূর্বেই অবহিত করেন যে, এই মন্দ অন্তর বিশিষ্ট লোকেরা তাঁর কাছে। এসে মুখে অন্তরের বিপরীত কথা বলবে এবং মিথ্যা ওযর পেশ করবে। তারা বলবেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছে, অতএব তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাদের এ কথার জবাবে বলেনঃ “তারা মুখে যা বলে তা তাদের অন্তরে নেই। সুতরাং হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলে দাও- যদি আল্লাহ তোমাদের কারো কোন ক্ষতি কিংবা মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা করেন তবে কে তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারে? তোমরা জেনে রেখো যে, তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত।” অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা মুনাফিক বা কপটদের কপটতা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তাঁর কাছে কোন কিছুই গোপন থাকে না। তিনি ভালরূপেই জানেন যে, মুনাফিকদের যুদ্ধ হতে পিছনে সরে থাকা কোন ওযরের কারণে ছিল না, বরং প্রকৃত কারণ ছিল তাদের অবাধ্যতা এবং কপটতা। তাদের অন্তর সম্পূর্ণরূপে ঈমান শূন্য। তারা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল নয় এবং রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যে যে কল্যাণ রয়েছে এ বিশ্বাস তাদের নেই। তারা নিজেদের প্রাণ ভয়ে ভীত। তারা নিজেরা যুদ্ধে মারা যাবে এ ভয়তো তাদের ছিলই, এমন কি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীদের (রাঃ) সম্পর্কেও তাদের ধারণা ছিল যে, তাঁরা সবাই নিহত হয়ে যাবেন, একজনও রক্ষা পাবেন না যিনি তাঁদের সংবাদ আনয়ন করতে পারেন। এই ধারণা তাদের অন্তরে প্রীতিকর মনে হয়েছিল। তাই, আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্পর্কে বলেনঃ “তোমরা মন্দ ধারণা করেছিলে, তোমরা তো ধ্বংসমুখী এক সম্প্রদায়।”

এরপর প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ “যারা আল্লাহ ও র সূল (সঃ)-এর প্রতি ঈমান আনে না, আমি ঐ সব কাফিরের জন্যে জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত রেখেছি।”

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় আধিপত্য, শাসন ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যে কেউ তার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তাঁর রহমতের দরযায় করাঘাত করে, তিনি তার জন্যে তাঁর রহমতের দরযা খুলে দেন। তার পাপ যত বেশীই হোক না কেন, যখন সে তাওবা করে তখন করুণাময় আল্লাহ তার তাওবা কবুল করে নেন। এবং তাকে ক্ষমা করে থাকেন।

১৫ নং আয়াতের তাফসির:-
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ যে বেদুঈনরা আল্লাহর রাসূল (সঃ) ও সাহাবী (রাঃ)-এর সঙ্গে হুদায়বিয়ায় হাযির ছিল না, তারা যখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে এবং সাহাবীদেরকে (রাঃ) খায়বারের বিজয়ের পর যুদ্ধলব্ধ মাল নেয়ার জন্যে যেতে দেখবে তখন আশা পোষণ করবে যে, তাদেরকেও হয়তো সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে। বিপদের সময় তো তারা পিছনে সরে ছিল, কিন্তু সুখের সময় মুসলমানদের সঙ্গে যাওয়ার তারা আকাক্ষা করবে। এ জন্যেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেন যে, তাদেরকে কখনোই যেন সঙ্গে নেয়া না হয়। যুদ্ধ যখন তারা করেনি। তখন গানীমাতের অংশ তারা কি করে পেতে পারে? যারা হুদায়বিয়ায় উপস্থিত ছিলেন তাঁদেরকেই আল্লাহ্ তা’আলা খায়বারের গানীমাতের ওয়াদা দিয়েছেন, তাদেরকে নয় যারা বিপদের সময় সরে থাকে, আর আরামের সময় হাযির থাকে।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তারা আল্লাহর কালাম পরিবর্তন করতে চায়। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা তো আহলে হুদায়বিয়ার সাথে খায়বারের গানীমাতের ওয়াদা করেছেন, অথচ এই মুনাফিকরা চায় যে, হুদায়বিয়ায় হাযির না হয়েও তারা আল্লাহর ওয়াদাকৃত গানীমাত প্রাপ্ত হবে। হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা আল্লাহর নিম্নের হুকুমকে বুঝানো হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “(হে নবী সঃ)! যদি আল্লাহ তোমাকে তাদের মধ্যে কোন দলের দিকে ফিরিয়ে আনেন এবং তারা তোমার কাছে জিহাদের জন্যে বের হবার অনুমতি প্রার্থনা করে তবে তুমি তাদেরকে বলে দাও- তোমরা আমার সাথে কখনো বের হবে না এবং আমার সাথে থেকে কখনো শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করবে না, তোমরা তো প্রথমবার আমাদের হতে পিছনে সরে থাকাকেই পছন্দ করেছে, সুতরাং এখন তোমরা পিছনে অবস্থানকারীদের সাথেই বসে থাকো।” (৯:৮৩) কিন্তু এই উক্তির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, এটা হলো সূরায়ে বারাআতের আয়াত যা তাবূকের যুদ্ধের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। আর তাবূকের যুদ্ধ হলো হুদায়বিয়ার সন্ধির বহু পরের ঘটনা। ইবনে জুরায়েজ (রঃ)-এর উক্তি এই যে, এর দ্বারা মুনাফিকদের মুসলমানদেরকেও তাদের সাথে জিহাদ হতে বিরত রাখাকেই বুঝানো হয়েছে।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলে দাও- তোমরা কিছুতেই আমাদের সঙ্গী হতে পারবে না। আল্লাহ্ পূর্বেই এরূপ ঘোষণা করেছেন।

আল্লাহ পাক বলেন যে, তারা তখন বলবেঃ তোমরা তো আমাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছো। তোমাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদেরকে গানীমাতের অংশ দেয়া।
আল্লাহ্ তা’আলা তাদের এ কথার জবাবে বলেনঃ প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন বোধশক্তি নেই।
১৬-১৭ নং আয়াতের তাফসীর:

যেসব মরুবাসী বেদুঈন জিহাদ হতে সরে রয়েছিল তাদেরকে যে এক প্রবল পরাক্রান্ত জাতির সহিত যুদ্ধ করার জন্যে আহ্বান করা হয়েছিল তারা কোন্ জাতি ছিল এ ব্যাপারে তাফসীরকারদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তারা বিভিন্ন জন বিভিন্ন উক্তি করেছেন। উক্তিগুলো হলোঃ (এক) তারা ছিল হাওয়াযেন গোত্র। (দুই) তারা সাকীফ গোত্র ছিল। (তিন) তারা ছিল বানু হানীফ গোত্র। (চার) তারা ছিল পারস্যবাসী। (পাঁচ) তারা রোমক ছিল। (ছয়) তারা ছিল মূর্তিপূজক জাতি। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা কোন নির্দিষ্ট গোত্র বা দলকে বুঝানো হয়নি, বরং সাধারণভাবে রণ-নিপুণ জাতিকে বুঝানো হয়েছে। যারা তখন পর্যন্ত মুকাবিলায় আসেনি। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা কুর্দিস্তানের লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তারা ছিল কুর্দি জাতি।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামত সংঘটিত হবে না যে পর্যন্ত না তোমরা যুদ্ধ করবে এমন এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যাদের চক্ষু হবে ছোট ছোট এবং নাক হবে বসা বসা। তাদের চেহারা হবে ঢালের মতো।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত সুফিয়ান (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা তুর্কীদেরকে বুঝানো হয়েছে। অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদেরকে এমন এক কওমের সঙ্গে জিহাদ করতে হবে যে, তাদের জুতাগুলো হবে চুল বিশিষ্ট।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, তারা হবে কুর্দী সম্প্রদায়।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা তাদের সহিত যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আত্মসমর্পণ করে। অর্থাৎ তোমাদের উপর জিহাদের বিধান দেয়া হলো এবং এই হুকুম অব্যাহত থাকবে।

মহান আল্লাহর উক্তি ও যদি তোমরা এই নির্দেশ পালন কর তবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে উত্তম পুরস্কার দান করবেন।” অর্থাৎ আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাদের উপর সাহায্য করবেন অথবা তারা যুদ্ধ না করেই ইসলাম কবুল করে নিবে। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্ বলেনঃ “আর যদি তোমরা পূর্বানুরূপ পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর, তবে তোমাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ অর্থাৎ হুদায়বিয়ার ব্যাপারে যেমন তোমরা ভীরুতা প্রদর্শন করে গৃহে রয়ে গিয়েছিলে, নবী (সঃ) ও সাহাবী (রাঃ)-এর সাথে অংশগ্রহণ করনি, তেমনই যদি এখনো কর তবে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে কঠিন বেদনাদায়ক শাস্তি প্রদান করবেন।

এরপর জিহাদকে ছেড়ে দেয়ার সঠিক ওযরের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, অন্ধের জন্যে, খঞ্জের জন্যে এবং রুগের জন্যে কোন অপরাধ নেই।’ এখানে আল্লাহ্ তা’আলা দুই প্রকারের ওযরের বর্ণনা দিয়েছেন। (এক) সদা বিদ্যমান ওযর এবং তা হলো অন্ধত্ব ও খোড়ামী। (দুই) অস্থায়ী ওযর এবং তা হলো রুগ্নতা। এটা কিছু দিন থাকে এবং পরে দূর হয়ে যায়। সুতরাং রুগ্ন ব্যক্তিদের ওযরও গ্রহণযোগ্য হবে যতদিন তারা রুগ্ন থাকে। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাদের ওযর আর গৃহীত হবে না।

এবার আল্লাহ পাক জিহাদের প্রতি উৎসাহিত করতে গিয়ে বলেন- যে কেউ (যুদ্ধের নির্দেশ প্রতিপালনের ব্যাপারে) আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে প্রবিষ্ট করবেন জান্নাতে, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, তিনি তাকে মর্মন্তুদ শাস্তি প্রদান করবেন। দুনিয়াতেও সে লাঞ্ছিত হবে এবং আখিরাতেও তার দুঃখের কোন সীমা থাকবে না। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
১৮-১৯ নং আয়াতের তাফসীর:

পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, এই বায়আতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশ’। হুদায়বিয়া প্রান্তরে একটি বাবলা গাছের নীচে এই বায়আত কার্য সম্পাদিত হয়েছিল।

হযরত আবদুর রহমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একবার হজ্ব করতে গিয়ে দেখতে পান যে, কতগুলো লোক এক জায়গায় নামায আদায় করছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “ব্যাপার কি?” তারা উত্তরে বলেঃ “এটা ঐ বৃক্ষ, যার নীচে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সাহাবীদের (রাঃ) নিকট হতে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন। হযরত আব্দুর রহমান (রাঃ) ফিরে এসে হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রাঃ)-কে ঘটনাটি বলেন। তখন হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রাঃ) বলেনঃ “আমার পিতাও এই বায়আতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, পর বছর তারা তথায় গমন করেন। কিন্তু তারা সবাই বায়আত গ্রহণের স্থানটি ভুলে যান। তারা ঐ গাছটিও দেখতে পাননি।” অতঃপর হযরত সাঈদ (রাঃ) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীগণ, যারা নিজেরা বায়আত করেছেন, তাঁরাই ঐ জায়গাটি চিনতে পারেননি, আর তোমরা জেনে নিলে! তাহলে তোমরাই কি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাহাবীগণ হতে ভাল হয়ে গেলে!” (এটা ইমাম বুখারী স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

মহান আল্লাহ্ বলেনঃ তাদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি অবগত ছিলেন। অর্থাৎ তিনি তাদের অন্তরের পবিত্রতা, ওয়াদা পালনের সদিচ্ছা এবং আনুগত্যের অভ্যাস সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। সুতরাং তিনি তাঁদের অন্তরে প্রশান্তি দান করলেন এবং আসন্ন বিজয় দ্বারা পুরস্কৃত করলেন। এ বিজয় হলো ঐ সন্ধি যা হুদায়বিয়া প্রান্তরে হয়েছিল। এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং সাহাবীগণ সাধারণ কল্যাণ লাভ করেছিলেন এবং এর পরপরই খায়বার বিজিত হয়েছিল। অতঃপর অল্পদিনের মধ্যে মক্কাও বিজিত হয় এবং এরপর অন্যান্য দুর্গ ও অঞ্চল বিজিত হতে থাকে এবং মুসলমানরা ঐ মর্যাদা, সাহায্য, বিজয়, সফলতা এবং উচ্চাসন লাভ করেন যা দেখে সারা বিশ্ব বিস্ময়াবিভূত, স্তম্ভিত এবং হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। এ জন্যেই আল্লাহ্ পাক বলেনঃ “আল্লাহ তাদেরকে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ দান করবেন, যা তারা হস্তগত করবে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

হযরত সালমা (রাঃ) বলেনঃ “আমরা দুপুরে হুদায়বিয়া প্রান্তরে বিশ্রাম করছিলাম এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঘোষণাকারী ঘোষণা করেনঃ “হে জনমণ্ডলী! আপনারা বায়আতের জন্যে এগিয়ে যান, রূহুল কুদ্স্ (আঃ) এসে পড়েছেন। আমরা তখন দৌড়াদৌড়ি করে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে গেলাম। তিনি ঐ সময় একটি বাবলা গাছের নীচে অবস্থান করছিলেন। আমরা তাঁর হাতে বায়আত করি।” এর বর্ণনা … (আরবী) এই আয়াতে রয়েছে। হযরত সালমা (রাঃ) আরো বলেনঃ “হযরত উসমান (রাঃ)-এর পক্ষ হতে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) স্বীয় এক হস্ত অপর হস্তের উপর রেখে নিজেই বায়আত করে নেন। আমরা তখন বললামঃ হযরত উসমান (রাঃ) বড়ই ভাগ্যবান যে, আমরা তো এখানেই পড়ে রয়েছি, আর তিনি হয়তো বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে নিয়েছেন। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “এটা অসম্ভব যে, উসমান (রাঃ) আমার পূর্বে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে, যদিও সে তথায় কয়েক বছর পর্যন্ত অবস্থান করে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম বর্ণনা করেছেন)

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩০ /মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪৩}
[*বাইয়াতে রিদওয়ানের:-
বিনা ওজরে জিহাদে অংশ গ্রহণ না করা মুনাফিকী কাজ:-
আসলে মুনাফিক-রা খুবই খারাপ মন-মানসিকতার লোক।:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৮-ফাত্হ।পারা:২৬
৮-১৯ নং আয়াত:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

সূরা:৪৮-ফাত্হ-৮
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ شَاہِدًا وَّ مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا ۙ﴿۸﴾
হে নবী, আমি আপনাকে সাক্ষ্যদানকারী, সুসংবাদ দানকারী এবং সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি-
সূরা:৪৮-ফাত্হ-৯
لِّتُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ تُعَزِّرُوۡہُ وَ تُوَقِّرُوۡہُ ؕ وَ تُسَبِّحُوۡہُ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا ﴿۹﴾
যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর শক্তি যোগাও ও তাঁকে সম্মান কর; আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১০
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُبَایِعُوۡنَکَ اِنَّمَا یُبَایِعُوۡنَ اللّٰہَ ؕ یَدُ اللّٰہِ فَوۡقَ اَیۡدِیۡہِمۡ ۚ فَمَنۡ نَّکَثَ فَاِنَّمَا یَنۡکُثُ عَلٰی نَفۡسِہٖ ۚ وَ مَنۡ اَوۡفٰی بِمَا عٰہَدَ عَلَیۡہُ اللّٰہَ فَسَیُؤۡتِیۡہِ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿٪۱۰﴾
নিশ্চয় যারা তোমার বায়আত গ্রহণ করে, তারা তো আল্লাহরই বায়আত গ্রহণ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। সুতরাং যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে এবং যে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তিনি তাকে মহা পুরস্কার দেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১১
سَیَقُوۡلُ لَکَ الۡمُخَلَّفُوۡنَ مِنَ الۡاَعۡرَابِ شَغَلَتۡنَاۤ اَمۡوَالُنَا وَ اَہۡلُوۡنَا فَاسۡتَغۡفِرۡ لَنَا ۚ یَقُوۡلُوۡنَ بِاَلۡسِنَتِہِمۡ مَّا لَیۡسَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ ؕ قُلۡ فَمَنۡ یَّمۡلِکُ لَکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ شَیۡئًا اِنۡ اَرَادَ بِکُمۡ ضَرًّا اَوۡ اَرَادَ بِکُمۡ نَفۡعًا ؕ بَلۡ کَانَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا ﴿۱۱﴾
যুদ্ধ থেকে) পশ্চাতে থাকা মরুবাসীরা তোমাকে বলবে, ‘আমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিল, অতএব আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ তারা মুখে তা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই। তাদেরকে বল, ‘আল্লাহ তোমাদের কারো কোন ক্ষতি কিংবা মঙ্গল চাইলে কে তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারে? বস্তুতঃ তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১২
بَلۡ ظَنَنۡتُمۡ اَنۡ لَّنۡ یَّنۡقَلِبَ الرَّسُوۡلُ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِلٰۤی اَہۡلِیۡہِمۡ اَبَدًا وَّ زُیِّنَ ذٰلِکَ فِیۡ قُلُوۡبِکُمۡ وَ ظَنَنۡتُمۡ ظَنَّ السَّوۡءِ ۚۖ وَ کُنۡتُمۡ قَوۡمًۢا بُوۡرًا ﴿۱۲﴾
(কিন্তু আসল কথা তো তা নয় যা তোমরা বলছো) ; বরং তোমরা মনে করি নিয়েছ যে, রসূল ও মু’মিনগণ নিজেদের ঘরে কখনই ফিরতে পারবে না। এ খেয়ালটা তোমাদের অন্তরে খুব ভাল লেগেছিল এবং তোমরা খুবই খারাপ ধারণা মনে স্থান দিয়েছো, আসলে তোমরা খুবই খারাপ মন-মানসিকতার লোক।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৩
وَ مَنۡ لَّمۡ یُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ فَاِنَّاۤ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ سَعِیۡرًا ﴿۱۳﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না, আমি সেসব অবিশ্বাসীদের জন্য অবশ্যই জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত করে রেখেছি।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৪
وَ لِلّٰہِ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ یَغۡفِرُ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یُعَذِّبُ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۱۴﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই; তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। তিনি চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৫
سَیَقُوۡلُ الۡمُخَلَّفُوۡنَ اِذَا انۡطَلَقۡتُمۡ اِلٰی مَغَانِمَ لِتَاۡخُذُوۡہَا ذَرُوۡنَا نَتَّبِعۡکُمۡ ۚ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّبَدِّلُوۡا کَلٰمَ اللّٰہِ ؕ قُلۡ لَّنۡ تَتَّبِعُوۡنَا کَذٰلِکُمۡ قَالَ اللّٰہُ مِنۡ قَبۡلُ ۚ فَسَیَقُوۡلُوۡنَ بَلۡ تَحۡسُدُوۡنَنَا ؕ بَلۡ کَانُوۡا لَا یَفۡقَہُوۡنَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿۱۵﴾
তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে তখন যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিল, তারা অবশ্যই বলবে, ‘আমাদেরকে তোমাদের অনুসরণ করতে দাও।’ তারা আল্লাহর বাণী পরিবর্তন করতে চায়। বলুন, ‘তোমরা কিছুতেই আমাদের অনুসরণ করবে না। আল্লাহ আগেই এরূপ ঘোষণা করেছেন।’ তারা অবশ্যই বলবে, তোমারা তো আমাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছ।’ বরং তারা তো বোঝে কেবল সামান্যই।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৬
قُلۡ لِّلۡمُخَلَّفِیۡنَ مِنَ الۡاَعۡرَابِ سَتُدۡعَوۡنَ اِلٰی قَوۡمٍ اُولِیۡ بَاۡسٍ شَدِیۡدٍ تُقَاتِلُوۡنَہُمۡ اَوۡ یُسۡلِمُوۡنَ ۚ فَاِنۡ تُطِیۡعُوۡا یُؤۡتِکُمُ اللّٰہُ اَجۡرًا حَسَنًا ۚ وَ اِنۡ تَتَوَلَّوۡا کَمَا تَوَلَّیۡتُمۡ مِّنۡ قَبۡلُ یُعَذِّبۡکُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿۱۶﴾
এ পিছনে রেখে যাওয়া বদ্দু আরবদেরকে বলে দাওঃ “খুব শীঘ্রই তোমাদেরকে এমন সব লোকের সাথে লড়াই করার জন্য ডাকা হবে যারা বড়ই শক্তি সম্পন্ন।” তোমাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে, কিংবা তারা অনুগত হয়ে যাবে।সে সময় তোমরা জিহাদের নির্দেশ পালন করলে আল্লাহ‌ তোমাদেরকে উত্তম সওয়াব দিবেন। আর যদি তোমরা পিছনে হটে যাও যেমন পূর্বে হটে গিয়েছিলে, তাহলে আল্লাহ‌ তোমাদেরকে কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি দেবেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৭
لَیۡسَ عَلَی الۡاَعۡمٰی حَرَجٌ وَّ لَا عَلَی الۡاَعۡرَجِ حَرَجٌ وَّ لَا عَلَی الۡمَرِیۡضِ حَرَجٌ ؕ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ یُدۡخِلۡہُ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ۚ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّ یُعَذِّبۡہُ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿٪۱۷﴾
অন্ধের কোন অপরাধ নেই, খঞ্জের কোন অপরাধ নেই এবং পীড়িতেরও কোন অপরাধ নেই; এবং যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার নিচে নহরসমূহ প্রবাহিত ; কিন্তু যে ব্যক্তি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। তিনি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৮
لَقَدۡ رَضِیَ اللّٰہُ عَنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ یُبَایِعُوۡنَکَ تَحۡتَ الشَّجَرَۃِ فَعَلِمَ مَا فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ فَاَنۡزَلَ السَّکِیۡنَۃَ عَلَیۡہِمۡ وَ اَثَابَہُمۡ فَتۡحًا قَرِیۡبًا ﴿ۙ۱۸﴾
আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নিচে তোমরা কাছে বাইয়াত করছিলো। তিনি তাদের মনের অবস্থা জানতেন। তাই তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল যে করেছেন, পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে আশু বিজয় দান করেছেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-১৯
وَّ مَغَانِمَ کَثِیۡرَۃً یَّاۡخُذُوۡنَہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ عَزِیۡزًا حَکِیۡمًا ﴿۱۹﴾
এবং প্রচুর গনীমতের সম্পদ দান করেছেন যা তারা অচিরেই লাভ করবে। আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (র) شاهد শব্দের অনুবাদ করেছেন اظهار حق كننده সত্য প্রকাশকারনী এবং অন্যান্য অনুবাদকগণ অনুবাদ করেছেন, “সাক্ষ্যদানকারী।” শাহাদাত শব্দটি এ দু’টি অর্থই বহন করে।
# মুসলমানদেরকে উপদেশ দেবার পর এবার আল্লাহ‌ তাঁর নবীকে সম্বোধন করে কয়েকটা সান্ত্বনার বাণী উচ্চারণ করেছেন। বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ আপনাকে আমি এসব উন্নত মর্যাদা দান করেছি। এ বিরোধীরা অপবাদ ও মিথ্যাচারের তুফান সৃষ্টি করে আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ আপনার ব্যক্তিত্ব তার অনেক ঊর্ধ্বে। কাজেই আপনি তাদের শয়তানির কারণে দুঃখ ভারাক্রান্ত হবেন না এবং তাদের প্রচারণাকে তিলার্ধও গুরুত্ব দেবেন না। নিজের আরোপিত দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকেন এবং তাদের মনে যা চায় তাই বকবক করতে বলুন। এ সঙ্গে পরোক্ষভাবে মু’মিন ও কাফের নির্বশেষে সকল মানুষকে বলা হয়েছে যে, কোন সাধারণ মানুষের সাথে তাদের মোকাবিলা হচ্ছে না বরং মহান আল্লাহ‌ যাঁকে মর্যাদার উচ্চমার্গে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন তেমনি এক মহান ব্যক্তিত্বের সাথে হচ্ছে তাদের মোকাবিলা।

# নবীকে সাক্ষী করার অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। তিন ধরনের সাক্ষ্য প্রদান এর অন্তর্ভুক্তঃ

একঃ মৌখিক সাক্ষ্যদান। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন যেসব সত্য ও মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নবী তার সত্যতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন এবং দুনিয়াবাসীকে পরিষ্কার বলে দেবেন, এটিই সত্য এবং এর বিরুদ্ধে যা কিছু আছে সবই মিথ্যা। আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ব, ফেরেশতাদের অস্তিত্ব, অহী নাযিল হওয়া, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অনিবার্যতা এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকাশ, দুনিয়া বাসীদের কাছে যতই অদ্ভূত মনে হোক না কেন এবং তারা একথাগুলোর বক্তাকে যতই বিদ্রূপ করুক বা তাকে পাগল বলুক না কেন, নবী কারো পরোয়া না করেই দাঁড়িয়ে যাবেন এবং সোচ্চার কন্ঠে বলে দেবেন, এসব কিছুই সত্য এবং যারা এসব মানে না তারা পথভ্রষ্ট। এভাবে নৈতিকতা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির যে ধারণা, মূল্যবোধ, মূলনীতি ও বিধান আল্লাহ‌ তাঁর সামনে সুস্পষ্ট করেছেন সেগুলোকে সারা দুনিয়ার মানুষ মিথ্যা বললেও এবং তারা তার বিপরীত পথে চললেও নবীর কাজ হচ্ছে সেগুলোকেই প্রকাশ্য জনসম্মুখে পেশ করবেন এবং দুনিয়ায় প্রচলিত তার বিরোধী যাবতীয় পদ্ধতিকে ভ্রান্ত ঘোষণা করবেন। অনুরূপভাবে আল্লাহর শরীয়াতে যা কিছু হালাল সারা দুনিয়া তাকে হারাম মনে করলেও নবী তাকে হালালই বলবেন। আর আল্লাহর শরীয়াতে যা হারাম সারা দুনিয়া তাকে হালাল ও ভালো গণ্য করলেও নবী তাকে হারামই বলবেন।

দুইঃ কর্মের সাক্ষ্য। অর্থাৎ দুনিয়ার সামনে যে মতবাদ পেশ করার জন্য নবীর আবির্ভাব হয়েছে তিনি নিজের জীবনের সমগ্র কার্মকান্ডের মাধ্যমে তার প্রদর্শনী করবেন। যে জিনিসকে তিনি মন্দ বলেন তাঁর জীবন তার সকল প্রকার গন্ধমুক্ত হবে। যে জিনিসকে তিনি ভালো বলেন তাঁর চরিত্রে তা পূর্ণমাত্রায় দেদীপ্যমান হবে। যে জিনিসকে তিনি ফরয বলেন তা পালন করার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে অগ্রণী হবেন। যে জিনিসকে তিনি গোনাহ বলেন তা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে কেউ তাঁর সমান হবে না। যে জীবন বিধানকে তিনি আল্লাহ‌ প্রদত্ত জীবন বিধান বলেন তাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি কোন প্রচেষ্টার ত্রুটি করবেন না। তিনি নিজের দাওয়াতে ব্যাপারে কতটা সত্যনিষ্ঠ ও আন্তরিকতা তাঁর নিজের চরিত্র ও কার্যধারাই সাক্ষ্য দেবে। তাঁর সত্তা তাঁর শিক্ষার এমন মূর্তিমান আদর্শ হবে, যা দেখে প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে, যে দ্বীনের দিকে তিনি দুনিয়াবাসীকে আহবান জানাচ্ছেন তা কোন্ মানের মানুষ তৈরি করতে চায়, কোন্ ধরনের চরিত্র সৃষ্টি তার লক্ষ্য এবং তার সাহায্যে সে কোন্ ধরনের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করে।

তিনঃ পরকালীন সাক্ষ্য। অর্থাৎ আখেরাতে যখন আল্লাহর আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে তখন নবী এ মর্মে সাক্ষ্য দেবেন, তাঁকে যে পয়গাম দেয়া হয়েছিল তা তিনি কোন প্রকার কাটছাঁট ও কমবেশী না করে হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সামনে নিজের কথা ও কর্মের মাধ্যমে সত্যকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার ব্যাপারে সামান্যতম ত্রুটি করেননি। এ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁর বাণী মান্যকারী কি পুরস্কার পাবে এবং অমান্যকারী কোন্ ধরনের শাস্তির অধিকারী হবে তার ফায়সালা করা হবে।

এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে, নবী ﷺ কে সাক্ষ্যদানের পর্যায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আল্লাহ‌ তাঁর প্রতি কত বড় দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন এবং এত উচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কত মহান ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। একথা স্পষ্ট, কথা ও কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সত্য দ্বীনের সাক্ষ্য প্রদান করার ক্ষেত্রে নবী ﷺ এর তিল পরিমাণও ত্রুটি হয়নি। তবেই তো তিনি আখেরাতে এই মর্মে সাক্ষ্য দিতে পারবেন, “আমি লোকদের সামনে সত্যকে পুরোপুরি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলাম।” আর তবেই তো আল্লাহর প্রমাণ (হুজ্জাত) লোকদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। অন্যথায় যদি সাক্ষ্য দেবার ব্যাপারে এখানে নাউযুবিল্লাহ তাঁর কোন ত্রুটি থেকে যায়, তাহলে না তিনি আখেরাতে তাদের জন্য সাক্ষী হতে পারবেন আর না সত্য অমান্যকারীদের অপরাধ সত্য প্রমাণিত হতে পারবে।

কেউ কেউ এ সাক্ষ্যদানকে এ অর্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন যে, নবী ﷺ আখেরাতে লোকদের কাজের ওপর সাক্ষ্য দেবেন এবং এ থেকে তারা একথা প্রমাণ করেন যে, নবী করীম ﷺ সকল মানুষের কার্যক্রম দেখছেন অন্যথায় না দেখে কেমন করে সাক্ষ্য দিতে পারবেন? কিন্তু কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে এ ব্যাখ্যা একবারেই ভ্রান্ত। কুরআন আমাদের বলে, লোকদের কার্যক্রমের ওপর সাক্ষ্য কায়েম করার জন্য তো আল্লাহ‌ অন্য একটি ব্যবস্থা করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁর ফেরেশতারা প্রত্যেক ব্যক্তির আমলনামা তৈরি করছে। (দেখুন সূরা কাফ ১৭-১৮ আয়াত এবং আল কাহ্‌ফ ৪৯ আয়াত) আর এজন্য তিনি মানুষের নিজের অংগ-প্রত্যংগেরও সাক্ষ্য নেবেন। (সূরা ইয়াসীন, ৬৫ ; হা মীম আস্ সাজদাহ, ২০-২১ ) বাকী রইলো নবীগণের ব্যাপার। আসলে নবীগণের কাজ বান্দাদের কার্যক্রমের ওপর সাক্ষ্য দেয়া নয় বরং বান্দাদের কাছে যে সত্য পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে তারা সাক্ষ্য দেবেন। কুরআন পরিষ্কার বলেঃ

يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ قَالُوا لَا عِلْمَ لَنَا إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ “যেদিন আল্লাহ‌ সমস্ত রসূলকে সমবেত করবেন তারপর জিজ্ঞেস করবেন; তোমাদের দাওয়াতের কি জবাব দেয়া হয়েছিল? তখন তারা বলবে, আমাদের কিছুই জানা নেই। সমস্ত অজ্ঞাত ও অজানা কথাতো একমাত্র তুমিই জানো।’ (আল মা-য়েদাহ, ১০৯)

আর এ প্রসঙ্গে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কুরআন বলে, যখন তাঁকে ঈসায়ীদের গোমরাহী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে তখন তিনি বলবেনঃ

وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ

“আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন পর্যন্ত তাদের ওপর সাক্ষী ছিলাম। যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিয়েছেন তখন আপনিই তাদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।” (আল মা-য়েদাহ, ১১৭)

নবীগন যে মানুষের কাজের ব্যাপারে সাক্ষী হবেন না এ সম্পর্কে এ আয়াতটি একেবারেই সুস্পষ্ট। তাহলে তাঁরা সাক্ষী হবেন কোন্ জিনিসের? এর পরিষ্কার জবাব কুরআন এভাবে দিয়েছেঃ

وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا “আর হে মুসলমানগণ! এভাবে আমি তোমাদেরকে করেছি একটি মধ্যপন্থী উম্মাত, যাতে তোমরা লোকদের ওপর সাক্ষী হবে এবং রসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হন।” (আল বাকারাহ, ১৪৩)

وَيَوْمَ نَبْعَثُ فِي كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيدًا عَلَيْهِمْ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَجِئْنَا بِكَ شَهِيدًا عَلَى هَؤُلَاءِ

“আর যেদিন আমি প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সাক্ষী উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো, যে তাদের ওপর সাক্ষ্য দেবে এবং (হে মুহাম্মাদ) তোমাকে এদের ওপর সাক্ষী হিসেবে নিয়ে আসবো।” (আন নাহল, ৮৯)

এ থেকে জানা যায়, কিয়ামতের দিন নবী ﷺ এর উম্মাতকে এবং প্রত্যেক উম্মাতের ওপর সাক্ষ্যদানকারী সাক্ষীদেরকে যে ধরনের সাক্ষ্যদান করার জন্য ডাকা হবে নবী ﷺ এর সাক্ষ্য তা থেকে ভিন্ন ধরনের হবে না। একথা সুস্পষ্ট যে, এটা যদি কার্যাবলীর সাক্ষ্যদান হয়ে থাকে, তাহলে সে সবের উপস্থিত ও দৃশ্যমান হওয়াও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর মানুষের কাছে তার স্রষ্টার পয়গাম পৌঁছে গিয়েছিল কিনা কেবল এ বিষয়ের সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যদি এ সাক্ষীদেরকে ডাকা হয়, তাহলে অবশ্যই নবী করীমকেও ﷺ এ উদ্দেশ্যেই পেশ করা হবে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও ইমাম আহমাদ প্রমুখগণ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবুদ দারদা, আনাস ইবনে মালেক ও অন্যান্য বহু সাহাবা থেকে যে হাদীসগুলো উদ্ধৃত করেছেন সেগুলোও এ বিষয়বস্তুর সমর্থক। সেগুলোর সম্মিলিত বিষয়বস্তু হচ্ছেঃ নবী ﷺ কিয়ামতের দিন দেখবেন তাঁর কিছু সাহাবীকে আনা হচ্ছে কিন্তু তারা তাঁর দিকে না এসে অন্যদিকে যাচ্ছে অথবা তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। নবী করীম ﷺ তাদেরকে দেখে নিবেদন করবেন, হে আল্লাহ! এরা তো আমার সাহাবী। একথায় আল্লাহ‌ বলবেন, তুমি জানো না তোমার পর এরা কি সব কাজ করেছে। এ বিষয়বস্তুটি এত বিপুল সংখ্যক সাহাবী থেকে এত বিপুল সংখ্যক সনদ সহকারে বর্ণিত হয়েছে যে, এর নির্ভুলতায় সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই। আর এ থেকে একথাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী ﷺ নিজের উম্মাতের প্রত্যেক ব্যক্তির এবং তার প্রত্যেকটি কাজের দর্শক মোটেই নন। তবে যে হাদীসে বলা হয়েছে যে, নবী (সা.) এর সামনে তাঁর উম্মাতের কার্যাবলী পেশ করা হয়ে থাকে সেটি কোনক্রমেই এর সাথে সংঘর্ষশীল নয়। কারণ তার মূল বক্তব্য শুধুমাত্র এতটুকু যে, মহান আল্লাহ‌ নবী করীমকে ﷺ তাঁর উম্মাতের কার্যাবলী সম্পর্কে অবহিত রাখেন। তার এ অর্থ কোথা থেকে পাওয়া যায় যে, তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির কার্যকলাপ চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছেন?

# এখানে এ পার্থক্যটা সামনে রাখতে হবে যে, কোন ব্যক্তিকে স্বে‌চ্ছাকৃতভাবে ঈমান ও সৎকাজের জন্য শুভ পরিণামের সুসংবাদ দেয়া এবং কুফরী ও অসৎকাজের অশুভ পরিণামের ভয় দেখানো এক কথা এবং কারো আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হয়ে প্রেরিত হওয়া সম্পূর্ণ আলাদা কথা। যে ব্যক্তিই আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পদে নিযুক্ত হবেন তাঁর নিজের সুসংবাদ ও ভীতি প্রদর্শনের পেছনে অবশ্যই কিছু ক্ষমতা থাকে, যার ভিত্তিতে তার সুসংবাদ ও সতর্কীকরণগুলো আইনের মর্যাদা লাভ করে। তার কোন কাজের সুসংবাদ দেয়ার অর্থ হয়, যে সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন শাসকের পথ থেকে তিনি প্রেরিত হয়েছেন তিনি এ কাজটি পছন্দনীয় ও প্রতিদান লাভের যোগ্য বলে ঘোষণা দিচ্ছেন। কাজেই তা নিশ্চয়ই ফরয বা ওয়াজিব বা মুস্তাহাব এবং কাজটি যিনি করেছেন তিনি নিশ্চয়ই প্রতিদান লাভ করবেন। আর তার কোন কাজের অশুভ পরিণামের খবর দেয়ার অর্থ হয়, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সত্তা সে কাজ করতে নিষেধ করছেন, কাজেই তা অবশ্যই হারাম ও গোনাহের কাজ এবং নিশ্চিতভাবেই সে কার্য সম্পাদনকারী শাস্তি লাভ করবে। কোন অনিয়োগকৃত সতর্ককারী ও সুসংবাদ দানকারী কখনো এ মর্যাদা লাভ করবে না।
# কোন কোন মুফাস্সির বলেছেন تُعَزِّرُوهُ ও تُوَقِّرُوهُ শব্দ দু’টির (হু) সর্বনাম দ্বারা রসূলুল্লাহ ﷺ এবং تُسَبِّحُوهُ শব্দের (হু) সর্বনাম দ্বারা আল্লাহ‌ তা’আলাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তাদের মতে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, “তোমরা রসূলকে সহযোগিতা দান করো এবং তাকে সম্মান ও মর্যাদা দেখাও আর সকাল ও সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকো। “কিন্তু একই বাক্যের মধ্যে সর্বনামসমূহ দ্বারা কোন ইঙ্গিত ছাড়াই দু’টি আলাদা সত্তাকে বুঝানো হবে তা সঠিক হতে পারে না। একারণে আরেক দল মুফাস্সিরের মতে সবগুলো সর্বনাম দ্বারা আল্লাহ‌ তা’আলাকেই বুঝানো হয়েছে। তাঁদের মতে বাক্যের অর্থ হচ্ছে, “তোমরা আল্লাহর সাথে থাকো, তাঁকে সম্মান ও মর্যাদা দেখাও এবং সকাল সন্ধ্যায় তাঁরই পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকো। “

সকাল সন্ধ্যায় পবিত্রতা বর্ণনা করার অর্থ শুধু সকাল সন্ধ্যায় নয়, বরং সর্বক্ষণ পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকা। এটা ঠিক তেমনি যেমন আমরা বলে থাকি অমুক জিনিসটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জুড়ে প্রসিদ্ধ। এর অর্থ এই নয় যে, শুধু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষই বিষয়টি জানে, বরং এর অর্থ হচ্ছে সারা পৃথিবীতেই তা পরিচিত ও আলোচিত।
# পবিত্র মক্কা নগরীতে হযরত উসমানের (রা.) শহীদ হয়ে যাওয়ার খবর শুনে রসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবায়ে কিরাম থেকে হুদাইবিয়া নামক স্থানে যে বাইয়াত নিয়েছিলেন সেই বাইয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিছু সংখ্যক বর্ণনা অনুসারে এ মর্মে বাইয়াত নেয়া হয়েছিলো যে, আমরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবো না। প্রথম মতটি হযরত সালামা ইবনে আকওয়া থেকে বর্ণিত হয়েছে আর দ্বিতীয়টি বর্ণিত হয়েছে ইবনে উমর, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ এবং মা’কাল ইবনে ইয়াসার থেকে। দু’টিরই প্রতিপাদ্য বিষয় এক। সাহাবীগণ এ সংকল্প নিয়ে রসূলুল্লাহর ﷺ হাতে বাইয়াতে গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা সবাই এখানে এ মুহূর্তেই কুরাইশদের সাথে বুঝাপড়া করবেন, এমনকি পরিণামে সবাই নিহত হলেও। প্রকৃতই হযরত উসমান শহীদ হয়েছেন না জীবিত আছেন এক্ষেত্রে তা যেহেতু নিশ্চিত জানা ছিল না তাই রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর পক্ষ থেকে নিজের একহাত অন্য হাতের ওপর রেখে বাইয়াত করলেন। এখানে হযরত উসমান (রা.) এ অসাধারণ মর্যাদা লাভ করলেন যে, নবী (সা.) নিজের পবিত্র হাতকে তাঁর হাতের স্থলাভিষিক্ত করে তাঁকে বাইয়াতে অংশীদার করলেন। হযরত উসমানের ﷺ পক্ষ থেকে নবীর ﷺ নিজের বাইয়াত করার অনিবার্য অর্থ হলো তাঁর প্রতি নবীর ﷺ এ মর্মে আস্থা ছিল যে, তিনি যদি উপস্থিত থাকতেন তাহলে অবশ্যই বাইয়াত করতেন।
# সে সময় লোকেরা যে হাতে বাইয়াত করেছিলো তা ব্যক্তি রসূলের হাত ছিল না, আল্লাহর প্রতিনিধির হাত ছিল এবং রসূলের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে এ বাইয়াত অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো।

# এখানে একটি অতি সূক্ষ্ম বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। আরবী ভাষায় সাধারণ নিয়ম অনুসারে এখানে عَاهَدَ عَلَيْهُ اللَّهَ পড়া উচিত ছিল। কিন্তু এ সাধারণ নিয়ম পরিত্যাগ করে এখানে عَلَيْهُ اللَّهَ পড়া হয়ে থাকে। আল্লামা আলূসী অস্বাভাবিকভাবে এ اعراب দেয়ার দু’টি কারণ বর্ণনা করেছেন। একটি হচ্ছে, এ বিশেষ ক্ষেত্রে যে মহান সত্তার সাথে চুক্তি সম্পাদন করা হচ্ছিলো তাঁর মর্যাদা ও জাঁকজমক প্রকাশ উদ্দেশ্য। তাই এখানে عليه এর পরিবর্তে عليه ই বেশী উপযুক্ত। অপরটি হচ্ছে, عليه এর হা সর্বনাম প্রকৃতপক্ষে هو এর স্থলাভিষিক্ত। আর এর মূল اعراب পেশ; যের নয়। তাই এর মূল اعراب চুক্তি পূরণের বিষয়ের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।
# এটা মদীনার আশেপাশের সেসব লোকদের কথা যাদেরকে উমরা যাত্রার প্রস্তুতিকালে রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সাথে রওনা হবার আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ঈমানের দাবীদার হওয়া সত্ত্বেও তারা বাড়ী ছেড়ে শুধু এ কারণে বের হয়নি যে, নিজেদের প্রাণ ছিল তাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, এরা ছিল আসলাম, মুযাইনা, জুহাইন, গিফার, আশজা, দ্বীন প্রভৃতি গোত্রের লোক।
# এর দু’টি অর্থ। একটি হচ্ছে, তোমার মদীনায় পৌঁছার পর এসব লোক এখন থেকে উমরা যাত্রায় শরীক না হওয়ার যে অজুহাত পেশ করবে তা হবে একটি মিথ্যা বাহানা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে কি কারণে তারা যায়নি তা তারা খুব ভাল করেই জানে। অপরটি হচ্ছে, আল্লাহর রসূলের কাছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করা মৌখিক জমা খরচ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে তারা যেমন নিজেদের এ আচরণের জন্য লজ্জিত নয়, তেমনি তাদের এ অনুভূতিও নেই যে, আল্লাহর রসূলকে সহযোগিতা না করে তারা কোন গোনাহর কাজ করেছে। এমনকি তাদের অন্তরে ক্ষমতা লাভের কোন আকংখাও নেই। নিজেরা কিন্তু মনে করে যে, এ বিপজ্জনক সফরে না গিয়ে তারা যারপর নেই বুদ্ধিমত্তার কাজ করেছে। আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের ক্ষমার পরোয়াই যদি তারা করতো তাহলে বাড়ীতে বসে থাকতে পারতো না।
# তোমাদের আমলের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহর যে জ্ঞান, সে জ্ঞানের ভিত্তিতেই তিনি ফয়সালা করবেন। তোমাদের আমল যদি শাস্তি পাওয়ার মত হয় আর আমি তোমাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করি তাহলেও আমার দোয়া আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করবে না। আর তোমাদের আমল যদি শাস্তি পাওয়ার মত না হয় আর আমি তোমাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া না করি তাহলে আমার দোয়া না করায় তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আমার নয় আল্লাহর। কারো মুখের কথা তাকে প্রতারিত করতে পারে না। তাই আমি যদি তোমাদের বাহ্যিক কথাবার্তাকে সত্য বলে স্বীকার করেও নেই এবং তার ভিত্তিতে তোমাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়াও করি তাতেও কোন ফায়দা নেই।
# তোমরা এই ভেবে খুশী হয়েছো, যে রসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহায্যকারী ঈমানদারগণ যে বিপদের মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন তা থেকে তোমরা নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছো। তোমাদের মতে এটা ছিল খুবই বুদ্ধিমত্তার কাজ। তাছাড়া একথা ভেবে খুশী হতে তোমাদের একটুও লজ্জাবোধ হলো না যে, রসূল ও ঈমানদারগণ এমন এক অভিযানে যাচ্ছেন যা থেকে জীবিত আর ফিরে আসতে পারবেন না। ঈমানের দাবীদার হয়েও তোমরা এতে উদ্বিগ্ন হলে না। বরং নিজেদের এ আচরণ তোমাদের এতই ভাল মনে হলো যে, তোমরা অন্তত রসূলের সাথে এ বিপদের মধ্যে নিজেদেরকে নিক্ষেপ করোনি।

# মূল আয়াতাংশ হচ্ছে كُنْتُمْ قَوْمًا بُورًا । بُور শব্দটি بائر শব্দের বহুবচন। بائر শব্দের দু’টি অর্থ। একটি অর্থ হচ্ছে পাপী ও বিকৃত ব্যাক্তি যে কোন ভাল কাজের যোগ্য নয়, যার উদ্দেশ্যে অসৎ ও বিকৃত। অপরটি হচ্ছে, ধ্বংসকারী, মন্দ পরিণাম এবং ধ্বংসের পথগামী।
#‌ আল্লাহ এখানে সুস্পষ্ট ভাষায় এমন সব মানুষকে কাফের ও ঈমানহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন যারা আল্লাহ‌ ও তাঁর দ্বীনের ব্যাপারে একনিষ্ঠ নয় এবং পরীক্ষার সময় দ্বীনের জন্য নিজের প্রাণ, সম্পদ ও স্বার্থের ঝুঁকি এড়িয়ে চলে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, এটা এমন কুফরী নয় যার ভিত্তিতে এ পৃথিবীতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে ইসলাম থেকে খারিজ বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এটা বরং এমন ধরনের কুফরী যার কারণে সে আখেরাতে বেঈমান বলে ঘোষিত হবে। এর প্রমাণঃ এ আয়াত নাযিলের পরেও যাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছিলো রসূলুল্লাহ ﷺ সেসব লোককে ইসলাম থেকে খারিজ ঘোষনা করেননি কিংবা কাফেরদের সাথে যে ধরনের আচরণ করা যায় সে রকম আচরণও করেননি।
# ওপরে উল্লেখিত চরম সাবধান বানীর পর আল্লাহর-‘গাফুর’ (ক্ষমাশীল) ও ‘রাহীম’ (পরম দয়ালু) হওয়ার উল্লেখের মধ্যে উপদেশের একটি সূক্ষ্ম দিক বিদ্যমান। এর অর্থ হচ্ছে, এখনো যদি তোমরা নিজেদের অসৎ ও নিষ্ঠাহীন আচরণ পরিত্যাগ করে সৎ ও নিষ্ঠার পথে আস তাহলে দেখবে আল্লাহ‌ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি তোমাদের অতীত ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেবেন এবং নিজেদের নিষ্ঠার কারণে তোমরা যে আচরণ পাওয়ার যোগ্য হবে ভবিষ্যতে তিনি তোমাদের সাথে সেই আচরণই করবেন।
# অচিরেই এমন সময় আসছে যখন এসব লোক-যারা আজ তোমার সঙ্গে এ বিপজ্জনক অভিযানে অংশ গ্রহণ এড়িয়ে গেল-তোমাকে এমন এক অভিযানে যেতে দেখবে যাতে তারা সহজ বিজয় এবং প্রচুর গনীমতের সম্পদ হস্তগত হচ্ছে বলে মনে করবে। তখন তারা নিজেরাই দৌড়ে এসে বলবে, আমাদেরকেও সাথে নিয়ে চলুন। বস্তুত হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তির তিন মাস পরই সে সুযোগ আসলো যখন রসূলুল্লাহ ﷺ খায়বারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অতি সহজেই তা দখল করে নিলেন। সে সময় প্রত্যেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো, কুরাইশদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের পর এখন শুধু খায়বারই নয়, তায়ামা, ফাদাক ওয়াদিউল কুরা এবং উত্তর হিজাযের অন্য সব ইহুদীও মুসলমানদের শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে না। এসব জনপদ এখন পাকা ফলের মতো সহজেই মুসলমানদের দখলে চলে আসবে। তাই আল্লাহ‌ তা’আলা এসব আয়াতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আগেই এ মর্মে সতর্ক করে দিলেন যে, মদীনার আশেপাশের সুযোগ সন্ধানী লোকেরা এসব সহজ বিজয় অর্জিত হতে দেখে তাতে ভাগ বসানোর জন্য এসে হাজির হবে। কিন্তু তুমি তাদেরকে পরিষ্কার বলে দেবে যে, তোমাদেরকে এতে ভাগ বসানোর সুযোগ দেখা কখনো দেয়া হবে না। এটা তাদের প্রাপ্য যারা বিপদ-মুসিবতের মোকাবিলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো।

# আল্লাহর ফরমান অর্থ খায়বার অভিযানে নবীর ﷺ সাথে কেবল তাদেরকেই যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে যারা হুদাইবিয়া অভিযানেও তাঁর সাথে গিয়েছিলেন এবং বাইয়াত রিদওয়ানেও তাঁর সাথে শরীক হয়েছিলেন। আল্লাহ‌ তায়ালা খাইবারের গনীমতের সম্পদ তাদের জন্যই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী ১৮ আয়াতে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
# “আল্লাহ পূর্বেই একথা বলেছেন”, কথাটি দ্বারা লোকের মনে এ মর্মে একটি ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, এ আয়াতের আগে এ বিষয়বস্তু সম্বলিত আরো কোন নির্দেশ নাযিল হয়ে থাকবে। এখানে সে দিকেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আর যেহেতু এ সূরার মধ্যে এ বিষয় সম্বলিত কোন নির্দেশ এর আগে পাওয়া যায় না। তাই তারা কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে তা অনুসন্ধান করতে শুরু করে এবং সূরা তাওবার ৮৪ আয়াতে তারা পেয়ে যায় যাতে আরেকটি প্রসঙ্গে এ একই বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃপক্ষে ঐ আয়াত এ ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। কারণ, ঐ আয়াত তাবুক যুদ্ধের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছিলো। আর তা নাযিল হয়েছিলো সূরা ফাতহ নাযিল হওয়ার তিন বছর পর। প্রকৃত ব্যাপার হলো, এ আয়াতটিতে এ সূরারই ১৮ ও ১৯ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আর “ইতিপূর্বেই আল্লাহ‌ বলছেন” কথাটির অর্থ এ আয়াতের পূর্বে বলা নয়, বরং পেছনে রেখে যাওয়া লোকদের সাথে এ কথাবার্তা হতে যাচ্ছিলো-যে সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আগেই দিকনির্দেশনা দেয়া হচ্ছে-খায়বার অভিযানে যাওয়ার সময়। অথচ সম্পূর্ণ সূরাটির-যার মধ্যে ১৮ ও ১৯ আয়াত আছে-তার তিন মাস পূর্বে হুদাইবিয়া থেকে ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে নাযিল হয়েছিলো। বক্তব্যের ধারা যদি পাঠক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে বুঝতে পারবেন, আল্লাহ‌ তা’আলা এখানে তাঁর রসূলকে এই বলে নির্দেশনা দিচ্ছেন যে, তোমার মদীনায় ফিরে যাওয়ার পর পিছনে থেকে যাওয়া এসব লোক যখন তোমার কাছে এসে এসব ওজর পেশ করবে তখন তাদেরকে এ জবাব দিবে এবং খায়বার অভিযানে যাত্রাকালে যখন তারা তোমার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করবে তখন তাদের একথা বলবে।
# মূল আয়াতে ব্যবহৃত বাক্যাংশ হচ্ছে أَوْ يُسْلِمُونَ । এর দু’টি অর্থ হতে পারে এবং এখানে দু’টি অর্থই উদ্দেশ্য। একটি অর্থ হচ্ছে, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। অপরটি হচ্ছে, তারা ইসলামী সরকারের বশ্যতা স্বীকার করবে।
# জিহাদে অংশ গ্রহণের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তির সামনে প্রকৃতই কোন ওজর প্রতিবন্ধক হবে তার কোন দোষ নেই। কিন্তু সুঠাম ও সবলদেহী মানুষ যদি ছল-ছুতার ভিত্তিতে বিরত থাকে তাহলে তাকে আল্লাহ‌ ও তাঁর দ্বীনের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান বলে স্বীকার করা যায় না। তাকে এ সুযোগও দেয়া যায় না যে, সে মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে, কিন্তু যখন ইসলামের জন্য কুরবানী পেশ করার সময় আসবে তখন নিজের জান ও মালের নিরাপত্তার চিন্তায় বিভোর হবে।

এখানে জেনে নেয়া দরকার যে, শরীয়াতে যাদেরকে জিহাদে অংশ গ্রহণ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে তারা দু’ধরনের মানুষ। এক, যারা দৈহিকভাবে যুদ্ধের উপযুক্ত নয়। যেমন অপ্রাপ্ত বয়স্ক, বালক, নারী, পাগল, অন্ধ, সামরিক সেবা দিতে অক্ষম এমন রোগগ্রস্ত লোক এবং হাত পা অকেজো হওয়ার কারণে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে অক্ষম ব্যক্তিরা। দুই, অন্য কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণে যাদের পক্ষে জিহাদে অংশ গ্রহণ কঠিন। যেমন: ক্রীতদাস, কিংবা এমন লোক যারা যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত, কিন্তু যুদ্ধাস্ত্র এবং অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করতে অক্ষম। অথবা এমন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, অতি সত্বর যার ঋণ পরিশোধ করা দরকার এবং ঋণদাতা যাকে অবকাশ দিচ্ছে না। অথবা এমন ব্যক্তি যার পিতা-মাতা বা তাদের কোন একজন জীবিত আছে এবং তারা তার সেবা-যত্নের মুখাপেক্ষী। এক্ষেত্রে এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন যে, পিতা-মাতা যদি মুসলমান হয় তাহলে তাদের অনুমতি ছাড়া সন্তানের জিহাদে যাওয়া উচিত নয়। তবে তারা যদি কাফের হয়, তাহলে তাদের বাধা দেয়ায় কারো জিহাদ থেকে বিরত থাকা জায়েজ নয়।
# হুদাইবিয়া নামক স্থানে সাহাবায়ে কিরামের কাছে যে বাইয়াত নেয়া হয়েছিল এখানে পুনরায় তার উল্লেখ করা হচ্ছে। এ বাইয়াতকে “বাইয়াতে রিদওয়ান” বলা হয়ে থাকে। কারণ, এ আয়াতে আল্লাহ‌ তা’আলা সুসংবাদ দান করেছেন যে, যারা এ ভয়ংকর পরিস্থিতিতে জীবন বাজি রাখতে সমান্য দ্বিধাও করেনি এবং রসূলের হাতে হাত দিয়ে জীবনপাত করার বাইয়াত করে ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ পেশ করেছে তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। সময়টি ছিল এমন যে, মুসলমানগণ শুধুমাত্র একখানা করে তরবারি নিয়ে এসেছিলেন এবং সংখ্যায় ছিলেন মাত্র চৌদ্দ শ’। তাদের পরিধানেও সামরিক পোশাক ছিল না বরং ইহরামের চাদর বাধা ছিল। নিজেদের সামরিক কেন্দ্র (মদীনা) থেকে আড়াই শ’ মাইল এবং শত্রুদের দূর্গ থেকে মাত্র ১৩ মাইল দূরে ছিল যেখান থেকে শত্রুরা সব রকমের সাহায্য লাভ করতে পারতো। আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূল এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি এ মানুষগুলোর মনে যদি আন্তরিকতার সামান্য ঘাটতিও থাকতো তাহলে তারা এ চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরিত্যাগ করে চলে যেতো এবং ইসলাম বাতিলের সাথে লড়াইয়ে চিরদিনের জন্য হেরে যেতো। আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা ছাড়া বাইরের এমন কোন চাপ তাদের ওপর ছিল না যা তাদেরকে এ বাইয়াত গ্রহণে বাধ্য করতে পারতো। আল্লাহর দ্বীনের জন্য সবকিছু করতে সে মুহূর্তেই তাদের প্রস্তুত হয়ে যাওয়া স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, তাঁরা তাদের ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী ও আন্তরিক এবং আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের ব্যাপারে বিশ্বস্ততার ক্ষেত্রে পূর্ণতার স্তরে উন্নীত। এ কারণে আল্লাহ‌ তা’আলা তাদেরকে সন্তুষ্টির এ সনদ দান করেছেন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার পর কেউ যদি তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয় কিংবা তাদেরকে তিরস্কার করার সাহস করে তাহলে তাদের বুঝাপড়া তাদের সাথে নয়, আল্লাহর সাথে। এক্ষেত্রে যারা বলে, যে সময় আল্লাহ‌ তা’আলা তাদেরকে সন্তুষ্টির এ সনদ দান করেছিলেন তখন তাঁরা আন্তরিক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরে তারা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য হারিয়ে ফেলেছেন, তারা সম্ভবত আল্লাহ‌ সম্পর্কে এ কুধারণা পোষণ করে যে, এ আয়াত নাযিল করার সময় তিনি তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতেন না। তাই শুধু এ সে সময়কার অবস্থা দেখে তিনি তাদেরকে এ সনদ পত্র দিয়ে ফেলেছেন। আর সম্ভবত এ না জানার কারণেই তাঁর পবিত্র কিতাবেও তা অন্তর্ভুক্ত করেছেন যাতে পরে যখন এরা অবিশ্বাসী হয়ে যাবে তখনো দুনিয়ার মানুষ তাদের সম্পর্কে এ আয়াত পড়তে থাকে এবং আল্লাহ‌ তা’আলার ‘গায়েবী ইলম’ সম্পর্কে বাহবা দিতে থাকে যিনি (নাউযুবিল্লাহ) ঐ অবিশ্বাসীদেরকে সন্তুষ্টির এ সনদপত্র দান করেছিলেন।

যে গাছর নীচে এ বাইয়াত অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সেটি সম্পর্কে হযরত ইবনে উমরের আযাতকৃত ক্রীতদাস নাফের এ বর্ণনাটি সাধারণভাবে ব্যাপক প্রচার লাভ করেছে যে, লোকজন সেখানে গিয়ে নামায পড়তে শুরু করেছিলো। বিষয়টি জানতে পেরে হযরত উমর (রা.) লোকদের তিরস্কার করেন এবং গাছটি কাটিয়ে ফেলেন। (তাবকাতে ইবনে সাদ ২য় খন্ড পৃঃ ১০০) কিন্তু এর বিপরীতমুখী কয়েকটি বর্ণনাও রয়েছে। হযরত নাফে, থেকেই তাবকাতে ইবনে সা’দে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে যে, বাইয়াতে রিদওয়ানের কয়েক বছর পর সাহাবায়ে কিরাম ঐ গাছটি তালাশ করেছিলেন কিন্তু চিনতে পারেননি এবং সে গাছটি কোনটি সে ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি হয়ে যায় (পৃঃ ১০৫) দ্বিতীয় বর্ণনাটি বুখারী, মুসলিম ও তবকাতে ইবনে সা’দে হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েবের। তিনি বলেনঃ আমার পিতা বাইয়াতে রিদওয়ানে শরীক ছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন পরের বছর আমরা যখন উমরাতুল কাযার জন্য গিয়েছিলাম তখন গাছটি হারিয়ে ফেলেছিলাম। অনুসন্ধান করেও তার কোন হদিস করতে পারিনি। তৃতীয় বর্ণনাটি ইবনে জারীরের। তিনি বলেন, হযরত উমর (রা.) তাঁর খিলাফত কালে যখন হুদাইবিয়া অতিক্রম করেন তখন জিজ্ঞেস করেন, যে গাছটি নিজে বাইয়াত হয়েছিলো তা কোথায়? কেউ বলে, অমুক গাছটি এবং কেউ বলেন অমুকটি। তখন হযরত উমর (র) বলেন, এ কষ্ট বাদ দাও, এর কোন প্রয়োজন নেই।
# এখানে سَّكِينَةَ অর্থ মনের সে বিশেষ অবস্থা যার ওপর নির্ভর করে কোন ব্যক্তি কোন মহত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ঠাণ্ডা মনে পূর্ণ প্রশান্তি ও তৃপ্তি সহ নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয় এবং কোন ভয় বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ফলাফল যাই হোক না কেন এ কাজ করতেই হবে।
# এটা খায়বার বিজয় ও সেখানকার গনীমতের সম্পদের প্রতি ইঙ্গিত। আর এ আয়াত এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে যে, আল্লাহ‌ তা’আলা এ পুরস্কারটি কেবল তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন যারা বাইয়াতে রিদওয়ানে শরীক ছিলেন। এ বিজয় ও গনীমতের সম্পদে তাদের ছাড়া আর করো শরীক হওয়ার অধিকার ছিল না। এ কারণে ৭ম হিজরী সনের সফর মাসে রসূলুল্লাহ ﷺ খায়বার আক্রমণের জন্য যাত্রা করলেন তখন তিনি কেবল তাদেরকেই সঙ্গে নিলেন। এতে সন্দেহ নেই যে, পরে নবী (সা.) হাবশা থেকে প্রত্যাবর্তনকারী মুহাজির এবং দাওস ও আশয়ারী গোত্রের কোন কোন সাহাবীকেও খায়বারের গনীমতের মাল থেকে কিছু অংশ দিয়েছিলেন। তবে তা হয় খুমুস (এক-পঞ্চমাংশ) থেকে নয়তো বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশ গ্রহণকারীদের সম্মতিক্রমে দিয়েছিলেন। কাউকে তিনি ঐ সম্পদের হকদার বানাননি।

তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*রাসূলের দায়িত্ব ও মুসলমানদের কর্তব্য : এরপর পুনরায় আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূল(স.)-কে সম্বােধন করেছেন, তাঁর কর্তব্য সম্পর্কে তাঁকে সচেতন করেছেন, তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অবহিত করেছেন, মােমেনদেরকেও তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেই সাথে সরাসরি তাদের বায়াতের দিকে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং যখন তারা রসূল(স.)-এর হাতে বায়াত করেছেন, তখন যে প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহ তায়ালার কুদরাতি হাতে বায়াত করেছেন, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রসূল(স.)-এর বাইয়াতকে সম্মানিত করাই এর উদ্দেশ্য। ‘আমি তােমাকে সাক্ষ্য প্রদানকারী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি…'(আয়াত ৮-১০) বস্তুত রসূল(স.) গােটা মানব জাতির ওপর সাক্ষী। তিনি সাক্ষ্য দেবেন যে, তিনি তাদের কাছে যে বাণী পৌঁছানাের জন্যে আদিষ্ট ছিলেন, তা পৌঁছে দিয়েছেন। অতপর তারা তাকে কিভাবে গ্রহণ করেছে, কেউ ঈমান এনেছে, কেউ কুফরী করেছে, আবার কেউ হয়েছে মােনাফেক। তাদের কেউ সমাজের সংস্কার ও সংশোধনের কাজ করেছে, আবার কেউ অরাজকতা ছড়িয়েছে। এভাবে তিনি নিজের রেসালাতের দায়িত্ব পালনের মতাে সাক্ষ্য দানের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি কল্যাণের, ক্ষমার, সন্তুষ্টির, অনুগত মােমেনদের শুভ প্রতিদানের সুসংবাদদাতা এবং কাফের, মােনাফেক, অরাজকতা বিস্তারকারী ও অবাধ্য লােকদের জন্য খারাপ পরিণতি, গযব, লানত ও শাস্তির দুঃসংবাদদাতা। এই হচ্ছে রসূলের দায়িত্ব। এরপর মােমেনদেরকে সম্বােধন করা হয়েছে, তাদের কাছে রেসালাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। তা হচ্ছে, তারা যেন আল্লাহ তায়ালা ও তার রসুলের প্রতি ঈমান আনে, ঈমানের দাবী অনুযায়ী কর্তব্য পালনের চেষ্টা সাধনা করে, আল্লাহ তায়ালার বিধান ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে আল্লাহকে সাহায্য করে, আল্লাহ তায়ালার মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করে এবং সকাল সন্ধ্যা তার তাসবীহ করে ও প্রশংসা করে। সকাল সন্ধ্যা দ্বারা পুরাে দিনকেই বুঝানাে হয়েছে। কেননা দিনের দুই প্রান্ত পুরাে দিনকেই ধারণ করে রাখে। আসল লক্ষ্য হলাে, প্রতি মুহুর্তে আল্লাহ তায়ালার স্মরন মনে রাখা। এ হচ্ছে ঈমানের ফল, যা রসূলকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণের মাধ্যমে মােমেনদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হয়। মুমিনদেরকে আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কযুক্ত করা ও তাদের সাথে আল্লাহ তায়ালার এমন বাইয়াত করিয়ে দেয়াই তার উদ্দেশ্য, যা রাসূল(স.)-এর তিরােধানেও বিচ্ছিন্ন হবে না। কেননা তিনি যখন তাদের হাতে হাত দিয়ে বাইয়াত করান, তখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই বাইয়াত করান, যারা তােমার সাথে বাইয়াত করে, তারা আল্লাহ তায়ালার সাথেই বাইয়াত করে। তাদের হাতের ওপর আল্লাহ তায়ালার হাত রয়েছে।’ মােমেনদের সাথে রসূল(স.)-এর বাইয়াতের এ এক অত্যন্ত মহিয়ান ও মর্মস্পর্শী চিত্র। তাদের প্রত্যেকে অনুভব করেন যে, তাদের হাতের ওপর মহান আল্লাহ তায়ালার হাত রয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বাইয়াতের সময় উপস্থিত থাকেন আল্লাহই বায়াতের আসল মালিক ও গ্রাহক। তার হাত বায়াতকারীদের হাতের ওপরে। একদিকে মানুষের হাত, আর একদিকে আল্লাহ তায়ালার হাত। কী অপূর্ব ব্যাপার। এ দৃশ্য মন থেকে বাইয়াত লংঘনের সকল চিন্তা দূর করে দেয়—চাই রসূল(স.) বিদায় হয়ে যান। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাে উপস্থিত। তিনি তাে কোথাও চলে যান না। এ বাইয়াত তাে তিনিই নিচ্ছেন। তিনিই এর তত্ত্বাবধায়ক। অতপর যে ভংগ করবে, সে নিজের ক্ষতির জন্যই ভংগ করবে।’ অর্থাৎ সর্বদিক দিয়ে সে ক্ষতিগ্ৰস্ত। আল্লাহ তায়ালা ও তার মাঝে সম্পাদিত লাভজনক চুক্তি ভংগ করলে সেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা ও বান্দার চুক্তি বহাল থাকলে বান্দাই লাভবান হয়। আল্লাহ তায়ালার তাে লাভ লােকসান কিছুই হয় না। তিনি তাে অমুখাপেক্ষী। আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভংগ করলে বান্দা এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে, সে আল্লাহ তায়ালার গযব ও শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যাবে। কেননা বায়াত ভংগ করাকে তিনি ঘােরতর অপছন্দ করেন ও তাতে তিনি অসন্তুষ্ট হন। তিনি ভালােবাসেন কেবল ওয়াদা পূরণকে ও ওয়াদাপূরণকারীকে। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সাথে কৃত চুক্তি বহাল রাখে, তাকে তিনি বিরাট পুরস্কার দিবেন।’ বিরাট পুরস্কার বলেই ক্ষ্যন্ত থাকা হয়েছে। সে পুরস্কারের আকার বা পরিমাণের কোনাে উল্লেখ নেই। সেটা এমন পুরস্কার যে, আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাকে বিরাট বলছেন, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার মানদণ্ডে, বিচার বিবেচনায় তা বিরাট, আর আল্লাহ তায়ালার বিবেচনা এতাে উচাংগের হয়ে থাকে যে, পৃথিবীর মরণশীল সৃষ্টি তা কল্পনাও করতে পারে না।

*দ্বীনের ডাকে যারা সাড়া দেয় না : বাইয়াতের তাৎপর্য বর্ণনা করা, তা পালন ও ভংগ করার পরিণতি বর্ণনা করার পর সেই সব বেদুইন আরবদের প্রসংগে আলােচনা করা হয়েছে। যারা রাসূল(স.) ও মুসলমানদের সাথে অভিযানে অংশ গ্রহণ না করে বাড়ীতে থেকে গিয়েছিলাে। এর কারণ ছিলাে আল্লাহ তায়ালার প্রতি তাদের খারাপ ধারণা এবং মােমেনদের ক্ষতি হবে ও অকল্যাণ হবে মনে করা। কেননা যে কোরায়শ দুই দুইবার মদীনার ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে, সরাসরি তাদের রাজধানী মক্কায় গিয়ে নিরাপদে ফিরে আশা মােমেনদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না বলে তারা মনে করেছিলাে। রসূল(স.)-কে তাদের প্রসংগে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, তিনি ও তার সাথী মােমেনরা সহী সালামতে ফিরে আসার পর তারা এসে নানারকমের ওযর পেশ করবে। কোরায়শ যে রসূলের সাথে শান্তিচুক্তি করেছে, যুদ্ধ করেনি, যে শর্তের বিনিময় হার তারা যে তার সাথে চুক্তি সম্পাদন করেছে এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কোরায়শ তাদের নীতি থেকে পিছু হটেছে এবং মােহাম্মদ(স.)-কে তাদের এমন এক সমকক্ষ শক্তি বলে স্বীকার করেছে, যার শত্রুতা থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করা উচিত ও যার সাথে আপােস রফা করা উচিত। এই বেদুইনরা প্রকৃতপক্ষে কোন কারণে তাদের সাথে যায়নি, তা এখানে ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। রসূল(স.) ও মােমেনদের সামনে তাদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সেই সাথে যারা অভিযানে গিয়েছিলাে তাদের জন্য দেয়া হয়েছে সুসংবাদ। আসল কারণ হলাে, তারা নিকটবর্তী স্থান ও সহজে অর্থ সম্পদ লাভের সম্ভাবনা থাকলে অবশ্যই তার সাথে যেত। এই সব পশ্চাদপসরণকারী বেদুইন আরবরা এ ধরনের সহজ ও লাভজনক অভিযানে যেতে চাইবে। সে ধরনের সুযােগ আসলে তখন তাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে ও কি জবাব দিতে হবে, তা এখানে শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের সহজ অভিযানে আর কখনাে সাথে নেয়া চলবে না বরং শুধুমাত্র হুদায়বিয়া গমনকারীদেরকেই নিতে হবে। তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, আরাে কিছু কষ্টদায়ক অভিযানের সুযােগ আসবে। তারা যদি অভিযানে শরীক হতে চায়, তবে তখন যেন শরীক হয়। তখন তাদের ভাগ্যবরাতে আল্লাহ তায়ালা যা বরাদ্দ করেন তাই হবে। তারা যদি রসূলের আনুগত্য করে, তবে তার বিরাট পুরস্কার পাবে। আর যদি অবাধ্যতা করে, তবে তারা কঠিন আযাব ভােগ করবে,। *পেছনে থাকা লোকদের অবস্থা : পিছিয়ে থাকা বেদুইনরা তােমাকে বলবে, আমাদের ধন সম্পদ ও পরিবারবর্গ আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিলাে, অতএব আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন, তারা মুখে যা বলে তাদের মনে তা থাকেনা…।'(আয়াত ১১-১৬) কোরঅান শুধু পেছনে পড়ে থাকা বেদুইনদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে ও তার জবাব দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। বরং এর সাথে সাথে অন্যান্যদের মানসিক ব্যাধির চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন প্ররােচনা, দুর্বলতা ও বিপথগামিতার উল্লেখ করে তার চিকিৎসার পথ দেখিয়েছে। সেই সাথে চিরন্তন সত্য ও চিরস্থায়ী নীতিমালারও বিবরণ দিয়েছে এবং অনুভূতি ও আচরণের নীতি শিক্ষা দিয়েছে। পিছিয়ে থাকা এসব বেদুইন গােত্রগুলাে ছিলাে গিফার, মােযায়না, আশজা, আসলাম প্রভৃতি। এরা সবাই মদীনার পার্শবর্তী গােত্র । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কেননা, তারা বলবে, আমাদের ধন সম্পদ ও পরিবার আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিলাে। এটা কোনাে ওযর নয়। সব মানুষেরই ধন সম্পদ ও পরিবার থাকে। এগুলাে যদি যথার্থই ঈমানী কর্তব্য পালনে বাধা দিতাে তাহলে কেউ এ দায়িত্ব পালন করতে পারতাে না। তারা আরাে বলবে, আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। অথচ তারা ক্ষমা প্রার্থনায় আন্তরিক নয়। আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলে দিচ্ছেন, তারা মুখে তাই বলে যা তাদের মনে থাকে না।’ অতপর সেই অবধারিত লাভ বা ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে, যা থেকে পেছনে পড়ে থাকলেও বাঁচা যায় না কিংবা এগিয়ে গেলেও অর্জন করা যায় না। সেই আল্লাহ তায়ালার শক্তির কথা বলা হচ্ছে, যা সকল মানুষকে ঘিরে রেখেছে এবং তাদের ভাগ্য বরাদ্দকে যেমন ইচ্ছা, তিনি তেমনি করেন। সেই পূর্ণাংগ খােদায়ী জ্ঞানের কথা বলা হচ্ছে, যার আলােকে তিনি তার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন, ‘বলাে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের ক্ষতি বা কল্যাণ করতে চাইলে তােমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত থেকে কে বাঁচাবে? এই প্রশ্নের মাঝে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত তাকদীরের কাছে আত্মসমর্পণ এবং তাঁর নির্দেশের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্যের ভাবটি ফুটে উঠেছে। কারণ, দ্বিধা দ্বন্দ্ব কখনও অমঙ্গলকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না এবং মঙ্গলকে পিছিয়েও দিতে পারে না। তাছাড়া মিথ্যা ওজুহাত দাঁড় করিয়েও কোনাে লাভ হয় না। কারণ, আল্লাহ তায়ালার কাছে কোনাে কিছুই অজানা নয়। তাই এসব ওজুহাত তার বিচারকে প্রভাবিত করতে পারবে না। তিনি নিজের অপার জ্ঞান অনুসারে ন্যায্য বিচারই করবেন। বলা বাহুল্য, কোরআনের এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষা ও উপদেশ দান করা। সময়, পরিস্থিতি ও পরিবেশ অনুসারে এ জাতীয় উপদেশ দান করা পবিত্র কোরআনের নিজস্ব একটা নিয়ম।

*মােনাফেকদের ধ্বংসের কারণ : আয়াতে বলা হয়েছে, ‘বরং তােমরা ধারণা করেছিলে যে, রসূল ও মােমেনরা তাদের বাড়ী ঘরে কিছুতেই ফিরে আসতে পারবে না এবং এই ধারণা তােমাদের জন্যে খুবই সুখকর ছিলাে’(আয়াত ১২) এখানে অত্যন্ত নগ্নভাবে ও জনসমক্ষে ওদের মনের গােপন কথাটি এবং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ওদের ধারণাটি প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। ওদের ধারণা ছিলাে, আল্লাহর রসূল ও তার সাহাবীরা মরণ ফাঁদের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কাজেই, তারা আর কখনও মদীনায় আপনজনের কাছে ফিরে আসতে পারবে না। ওদের ভাষ্য হলাে, যাদের সাথে লড়াই করে নিজেদের ভিটেমাটি মদীনায়ই মার খেতে হয়েছে, তাদের সাথেই আবার যুদ্ধ করতে যাচ্ছে ওরা! একথা বলে ওরা ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের কথাই বুঝাতে চেয়েছে। কিন্তু কথাটি বলতে গিয়ে ওরা ভুলেই গিয়েছিলো যে, যারা আল্লাহ তায়ালার খাঁটি ও নিষ্ঠাবান বান্দা, তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নযর থাকে। তাছাড়া ওদের দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন হওয়ার কারণে এবং ওদের অন্তর ঈমান ও বিশ্বাসের উষ্ণতাশূন্য হওয়ার ফলে তারা অনুধাবনই করতে পারেনি যে, দায়িত্বের বােঝা যতাে ভারীই হােকনা কেন, দায়িত্ব দায়িত্বই। আল্লাহ তায়ালার রসূলের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে এ দায়িত্বভার বহন করতেই হবে। এখানে বাহ্যিক লাভ লােকসানের হিসেব কষলে চলবে না। দায়িত্ব যখন এসেই গেছে তখন এর পরিণামের দিকে না তাকিয়ে তা পালন করতেই হবে। ওরা নিজেদের মতাে করেই এই ধারণা করেছিলাে। তাদের এই ধারণা এতাে প্রবল ছিলাে যে, অন্য কিছু দেখার বা ভাবার ফুরসৎ হয়নি ওদের। এটাই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার প্রতি কু-ধারণা পােষণ করার দৃষ্টান্ত। ওদের অন্তরলােক উজাড় ও শুন্য বলেই ওরা এ জাতীয় ধারণা পােষণ করতে পেরেছে। এই বর্ণনা ভঙ্গীটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ ও ব্যঞ্জনাময় । এখানে শূন্য ও পতিত জমির সাথে ওদের হৃদয়ের শূন্যতাকে তুলনা করা হয়েছে। ওদের অন্তরই কেবল শূন্য নয়, বরং ওদের গােটা অস্তিত্বই শূন্য ও মৃত। তাতে জীবনের কোনাে চিহ্ন নেই, উর্বরতা নেই, নেই কোনাে সারবত্তা। যে অন্তরে আল্লাহ তায়ালার প্রতি সুধারণা নেই, সে অন্তর শূন্য হবে না তাে কি? কারণ, এ জাতীয় অন্তর পরমাত্মার সাথে যােগসূত্রহীন। কাজেই তা শূন্য, মৃত এবং এর পরিণতি ধ্বংস ও বিনাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।  *মােমেনদের দুঃসময়ে মােনাফেকদের ভূমিকা : মােমেনদের সম্পর্কে যারা এ জাতীয় ধারণা পােষণ করে তাদের হৃদয়ও বেদুইন সম্প্রদায়ের মত পরমাত্মার সাথে সম্পর্কহীন। এদের অন্তরও শূন্য ও মৃত। এই শ্রেণীর লােকেরা মােমেনদের সম্পর্কে সবসময় এই ধরনের ধারণাই পােষণ করে থাকে বিশেষ করে যখন বাতিলের পাল্লাকে ভারী দেখতে পায়, পৃথিবীর বাহ্যিক শক্তিকে ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট লােকদের অনুকূলে দেখতে পায় এবং মােমেনদেরকে সংখ্যা বা প্রভাব প্রতিপত্তির দিক থেকে দুর্বল দেখতে পায় তখন এমন খারাপ ধারণা পােষণ করতে থাকে, আর তাই তখনকার যুগের বেদুইনরা এবং তাদের বর্তমান যুগের প্রেতাত্মারা যখনই মােমেনদেরকে বাহ্যিক শক্তি ও বাহাদুরীতে মত্ত কোনাে বাতিল সম্প্রদায়ের মুখােমুখি হতে দেখেছে- তখনই তাদের সম্পর্কে এই জাতীয় ধারণা পােষণ করেছে। শুধু তাই নয়, বরং নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে তখন তারা মােমেনদের সংশ্রবও ত্যাগ করে তারা ভাবতে থাকে এই বােকার দল তাে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের দাওয়াতী কাজও শেষ হয়ে যাবে, এ কারণে তারা এই ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা থেকে দূরে সরে থাকে। কিন্তু আল্লাহ পাক তাদের এই ভুল ধারণা ব্যর্থ করে দেন, এবং অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেন। কারণ, ক্ষমতার পাল্লা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার শক্ত মুঠোর মাঝে রয়েছে। তাই তিনি কখনও কোনাে জাতিকে উর্ধে তােলেন, আবার কখনও অধপতিত করেন। এই সত্যটি কেবল সেই মােনাফেক গােষ্ঠী উপলব্ধি করতে পারে না। যারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে সুধারণা পােষণ করে না।

*ক্ষমার সঠিক মানদন্ড : পরবর্তী আয়াতে পরকালে ক্ষমার মানদন্ড কি হবে সেদিকে ইংগিত করে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলকে বিশ্বাস করে না, আমি সেসব কাফেরের জন্যে জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত রেখেছি। ‘নভােমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তায়ালারই। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।'(আয়াত ১৩-১৪) ওরা জায়গা জমি ও ছেলে মেয়ের বাহানায় জেহাদে যাওয়া থেকে বিরত থাকতাে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের প্রতি যদি ওদের ঈমানই না থাকে তাহলে পরকালের সেই কঠিন শাস্তির সময় এসব জায়গা জমি ও ছেলেমেয়ে তাদের কোন কাজে আসবে? এখন কোন পাল্লাটি তারা গ্রহণ করবে সেটা সম্পূর্ণভাবে তাদের বিশ্বাসের ব্যাপার। তবে পরকালে কার কি পরিণাম হবে সে সম্পর্কে যিনি সুনির্দিষ্টভাবে জানাচ্ছেন তিনি কিন্তু এই আসমান ও যমীনের একক মালিক। কাজেই তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন এই অধিকার ও ক্ষমতা তার আছে। এটা ঠিক যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আমল অনুসারেই তাকে প্রতিদান দেবেন। তবে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী। তিনি কারও কাছে দায়বদ্ধ নন। এ সত্যটি তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিচ্ছেন যেন তা মানুষের মনে গেঁথে যায়। তাই বলে আল্লাহ তায়ালার এই স্বাধীন ইচ্ছা কর্মের ওপর ভিত্তি করে প্রতিদান নির্ধারণ করার নীতির বিপরীত নয়। বরং তার প্রতিদান নির্ধারণের এই নীতি ও সে স্বাধীন ইচ্ছা আওতাধীন। আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও দয়া হচ্ছে অত্যন্ত কাছের বন্ধু। কাজেই যারা এই ক্ষমা ও দয়া লাভ করতে চায় তাদেরকে এখনই সে সুযােগ গ্রহণ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় পরকালে কাফেরদের জন্য জাহান্নামের যে কঠিন শাস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছ, তাদের সেই শাস্তির সমমুখীন হতে হবে কারণ এটা আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা। এই ওয়াদা পূরণ করা হবেই।

*খায়বর বিজয় সম্পর্কিত কথা :পরের আয়াতে মােমেনদের জন্যে কি উত্তম প্রতিদান রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং এমন বর্ণনাভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে যা সেই প্রতিদানকে খুব নিকটের বলে প্রকাশ করছে। যেমন, ‘তােমরা যখন যুদ্ধলব্ধ ধন সম্পদ সংগ্রহের জন্যে যাবে, তখন যারা পশ্চাতে থেকে গিয়েছিলাে, তারা বলবে, আমাদেরকে তােমাদের সঙ্গে যেতে দাও। তারা আল্লাহ তায়ালার কালাম পরিবর্তন করতে চায়…'(আয়াত ১৫) অধিকাংশ মােফাসসের মনে করেন আলােচ্য আয়াতটি খায়বর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এই যুদ্ধ হুদায়বিয়ার সন্ধির কিছুকাল পরেই সংঘটিত হয়েছিলাে, অর্থাৎ সপ্তম হিজরীর মােহাররম মাসে। হুদায়বিয়ার সন্ধি এই যুদ্ধের দেড় দুই মাস আগে স্বাক্ষরিত হয়েছিলাে। এই যুদ্ধে প্রচুর পরিমানে গনিমতের মাল পাওয়া গিয়েছিলাে। খয়বরের কেল্লাগুলাে আরব উপদ্বীপ থেকে বিতাড়িত ইহুদী সম্প্রদায়ের সর্বশেষ আশ্রয় কেন্দ্র ছিলাে। এই কেল্লাগুলােতেই বনু নাযীর ও বনু কোরাইযা নামক দু’টো ইহুদী গােত্রের লােকেরা আশ্রয় নিয়েছিলাে। মােফাসসেরদের এই রায়টি ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়ে আসছে যে, যারা হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় বাইয়াত গ্রহণ করেছিলাে তাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা খায়বরের যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের মালামাল এককভাবে দান করার ওয়াদা করেন। অবশ্য আমি এই রায়ের পক্ষে কোরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট কোনাে বক্তব্য পাইনি। তবে প্রকৃত ঘটনা তখন যা ঘটেছিলাে, খুব সম্ভবত সেটার ওপর ভিত্তি করেই মােফাসসেররা উল্লেখিত রায়টি গ্রহণ করেছেন। কারণ গনিমতের গােটা মালামালই রসূলুল্লাহ(স.) হুদায়বিয়া বাইয়াত গ্রহণকারী সাহাবাদের মাঝে বন্টন করে দেন, তাতে আর কাউকে তিনি শরীক করেননি। যা হোক আলােচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে বেদুইন নও মুসলিমদের বক্তব্যের জবাব দিতে বলেছেন। সাথে সাথে তাকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, গনিমতের মালামালের লােভে প্রকৃত ও নিবেদিতপ্রাণ মােমেনদের সাথে যাওয়ার জন্য তারা যে আবদার করছে তা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের পরিপন্থী। রসূলকে আরাে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ওদেরকে যেতে নিষেধ করা হলে ওরা বলে উঠবে, ‘তােমরা আমাদের সাথে হিংসা করছে, তােমরা চাওনা আমরা গনিমতের মালের কোনাে হিস্যা পাই। আল্লাহ তায়ালা ওদের এই বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, এই বক্তব্য মূলত আল্লাহ তায়ালার হেকমত ও তকদীর সম্পর্কে ওদের অজ্ঞতার কারণেই এসেছে। অন্যথায় ওদের জানা উচিত ছিলো, জেহাদের ময়দানে যারা কেবল গনিমতের মালামালের জন্য লালায়িত থাকে তারা আল্লাহ তায়ালার রহমত ও অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়, আর যারা আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলের আনুগত্য করে এবং সব ধরনের লােভ লালসার উর্ধে থাকে তারাই আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়, তাদের ভাগ্যেই গনিমতের মাল জোটে। কারণ, জেহাদের ময়দানের কঠিন মুহূর্তগুলাে তাদের চোখের সামনে থাকা সত্তেও তারা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালনে কোনােরূপ পিছপা হয়নি।

*মােমেনদের জন্যে আল্লাহর পরীক্ষা : এরপর ওদেরকে একটি বিষয় জানিয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন। বিষয়টি হলো, আল্লাহ তায়ালা অচিরেই জেহাদ থেকে পিছিয়ে থাকা লােকগুলােকে একটা দুর্ধর্ষ জাতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে তাদের পরীক্ষা নেবেন। এই পরীক্ষায় তারা যদি সফলতা দেখাতে পারে তাহলে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে, আর যদি পুনরায় তারা অবাধ্যতা প্রদর্শন করে এবং জেহাদ থেকে পিছিয়ে থাকে তাহলে এটাই হবে তাদের জন্য সর্বশেষ পরীক্ষা। এ প্রসঙ্গে আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ঘরে বসে থাকা মরুবাসীদের জানিয়ে দাও, আগামীতে তােমাদের এক প্রবল পরাক্রান্ত জাতির সাথে যুদ্ধ করার জন্যে ডাকা হবে। তােমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে অথবা তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। তখন যদি তােমরা নির্দেশ পালন করাে, তবে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে উত্তম পুরস্কার দেবেন।…'(আয়াত ১৬) এই দুর্ধর্ষ জাতি বলতে কাদেরকে বুঝানাে হয়েছে, সে সম্পর্কে একাধিক বক্তব্য পাওয়া যায়, এরা কি রাসূলের যুগের কোনাে জাতি, না খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের কোনাে জাতি, এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে খুব সম্ভবত এরা রসূলের যুগের কোনাে জাতিই ছিলাে। পরীক্ষাস্বরূপ এদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করার জন্য তৎকালীন মদীনার আশেপাশে মরুবাসীদেরকে আহ্বান করা হয়েছিলাে। এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্য করার মতাে তা হচ্ছে পবিত্র কোরআনের শিক্ষা পদ্ধতি। এখানে দুর্বল চিত্তের লােকদের চিকিৎসার জন্য একটা মােক্ষম পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। একদিকে রয়েছে উপদেশ ও নির্দেশ, আর অপরদিকে রয়েছে বাস্তব পরীক্ষা। এর মাধ্যমে ওদের মনের প্রকৃত অবস্থা ওদের কাছেও ধরা পড়বে অনুসরণীয় আদর্শ ও মূল্যবােধ, সঠিক আচরণবিধি এবং ঈমানী চেতনা ও সন্ধান পাবে। যেহেতু আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সবাইকে জেহাদের জন্য বের হওয়াটা সে পরীক্ষার অন্যতম দাবী ছিলাে। তাই পরবর্তী আয়াতে সেই সব লােকের কথা বলা হচ্ছে যাদের জন্য বাস্তব অসুবিধার কারণে বাড়ীতে অবস্থান করা বৈধ হবে। এ কারণে তাদের কোনাে পাপও হবে না এবং কোনাে অপরাধ নেই। বলা হয়েছে ‘যে কেউ আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে তাকে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে ঝর্না প্রবাহিত হয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে তাকে তিনি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন।'(আয়াত ১৬) যারা অন্ধ ও খঞ্জর তাদের অপারগতা স্থায়ী। অপরদিকে যারা অসুস্থ, তাদের অপারগতা অস্থায়ী। কাজেই এই শ্রেণীর লােকদের জন্য জেহাদে অংশ গ্রহণ না করার অনুমতি রয়েছে। এখানে জেহাদের যে নির্দেশ এসেছে তাতে দু’টো দিকই রয়েছে, একটি হচ্ছে নির্দেশটি পালন করা, আর অপরটি হচ্ছে নির্দেশটি পালন না করা। উভয় দিকই মূলত মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। কাজেই যারা স্বেচ্ছায় আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের নির্দেশ পালন করবে, তারা জান্নাত লাভ করবে। অপরদিকে যারা নির্দেশ পালন করবে না, তাদের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। কাজেই এখন তারা নিজেরাই তুলনা করে দেখুক, জেহাদের কষ্টের পর যে উত্তম প্রতিদান লাভ করা যাবে সেটা লাভ- না জেহাদের না গিয়ে ঘরে বসে আরাম আয়েশ করার পর যে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে, সেটা ভালাে। এখন তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে তারা কোনটি গ্রহণ করবে।

এই গােটা পর্বটি মােমেনদের সম্পর্কে ও মােমনদের সাথে আলােচনায় পরিপূর্ণ। এই সৌভাগ্যবান দলটি হচ্ছে তাদের যারা গাছের নীচে বসে রসূলুল্লাহ(স.)-এর হাতে হাত দিয়ে আনুগত্য ও সাহায্যের শপথ নিয়েছিলেন। শপথ গ্রহণের এই দৃশ্যটি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দেখেছেন। তিনি এর সাক্ষী ছিলেন এবং এর অনুমােদন ও সত্যায়নকারীও তিনিই ছিলেন। যেন তিনি নিজে তাদের হাতের ওপর হাত রেখে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন। এই সৌভাগ্যবান দলটি হচ্ছে তাদের যাদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক তার রসূলকে বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা গাছের নীচে তােমার কাছে শপথ করলাে। আল্লাহ তায়ালা অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিলাে।…'(আয়াত, ১৮) তখন এদের সম্পর্কে তিনি বলে উঠলেন, ‘আজ তােমরাই হচ্ছ পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম'(বুখারী বর্ণিত হাদীস ১৬৮৫) এই সৌভাগ্যবান দলটি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তার রসূলের সাথে আলাপ করছেন। আবার সাথে সাথে সেই দলটির সাথে আলাপ করছেন। এই আলাপের মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, তাদের জন্য কোন কোন বিজয় ও কি কি মাল সম্পদ রাখা হয়েছে, এই যুদ্ধ যাত্রায় তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার কি কি সাহায্য সহযােগিতা রয়েছে এবং সবশেষে তাদের জন্যে কোন বিজয়ের আনন্দ রয়েছে। এই আলাপের মাধ্যমে তিনি কাফের গােষ্ঠীর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন এবং সে বছর সন্ধি ও আপোস করার পেছনে নিহিত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেছেন। সাথে সাথে তিনি তাদেরকে আরও জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মাসজিদুল হারামে প্রবেশ সংক্রান্ত রসূলের স্বপ্ন সত্য হবে এবং মােমেনরা নিরাপদে ও নির্ভয়ে সেখানে প্রবেশ করবে। শুধু তাই নয়, বরং গােটা বিশ্বে তার মনােনীত একমাত্র এ বিধানের বিজয় অবশ্যই হবে। পরিশেষে এই সৌভাগ্যবান ও অন্যম্য দলটির পরিচয় ও গুণাবলী তুলে ধরা হচ্ছে। এসব গুণাবলী নতুন কিছু নয়, বরং এর উল্লেখ পূর্ববর্তী আসমানী কেতাব তাওরাতেও এসেছে। এরপর তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও উত্তম প্রতিদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  *আল্লাহর সন্তুষ্টির সনদপত্র : আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা গাছের নীচে তােমার কাছে শপথ করলে…’ আজ আমি চৌদ্দশত বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই শুভ ও পবিত্র মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করতে চেষ্টা করছি, যে মুহুর্তটি সেদিন গােটা সৃষ্টিজগত প্রত্যক্ষ করেছিলাে। কারণ, এই মুহূর্তেই সৌভাগ্যবান মােমেন দলটি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে এই মহা সুসংবাদটি জানিয়েছিলেন। সে মুহূর্তে গােটা সৃষ্টিজগত এবং এর সুপ্ত বিবেক তথা সৌভাগ্যবান মােমেন দলটি সম্পর্কে উচ্চারিত ঐশী শুভ সংবাদে কতটুকু উদ্বেলিত হয়েছিলা সেটাও আমি অনুভব করার চেষ্টা করছি। শুধু তাই নয়, বরং খােদ সে সৌভাগ্যবান দলটির মনের অবস্থাও অনুভব করার চেষ্টা করছি- যারা নিজ কানে সে ঐশী সংবাদটি শুনছিলাে এবং বুঝতে পেরেছিলাে যে, মহান আল্লাহ তায়ালা যাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে ঘােষণা দিচ্ছেন তারা অন্য কেউ নয়, স্বয়ং তারাই। এই শুভ সংবাদ দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাদের অবস্থান ও অবস্থার বিবরণও দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘যখন তারা গাছের নীচে তােমার কাছে শপথ করেছে।… শুভ সংবাদ তারা অন্য কারো কাছ থেকে শুনেনি, বরং শুনেছিলাে তাদের সত্য ও সত্য বলে ঘােষিত নবীর কাছ থেকে, আর তিনি সংবাদটি পেয়েছিলেন মহান আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে। এই ঐশী শুভ সংবাদটি গ্রহণ করার আনন্দঘন মুহূর্তে সেই সৌভাগ্যবান দলের অবস্থা কি ছিলাে তা কি আপনারা বলতে পারবেন? সেই মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা নিজেই যেন তাদের প্রত্যেককে ইংগিত করে বলছিলেন, তুমিই সেই ব্যক্তি যার প্রতি আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমিই গাছের নীচে রাসূল(স.)-এর কাছে শপথ নিয়েছিলে, তােমার অন্তরের খবর আমি জানি, তাই তােমার প্রতি আমি শান্তি বর্ষণ করেছি। আমরা যখন পাঠ কবি, আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের বন্ধু তখন খুশী হয়ে চিন্তা করি এবং কামনা করি আমরা যেন মােমেনদের দলে শামিল থাকতে পারি। আবার যখন পড়ি, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন…’ তখন আমাদের আনন্দ আসে এবং মনে মনে বলি, আমরা কি সে ধৈর্যশীলদের দলভুক্ত হওয়ার আশা করতে পারি না? অপরদিকে সৌভাগ্যবান মােমেন দলটির প্রত্যেকেই সুনিশ্চিতভাবে জেনে গিয়েছিল যে, ঐশী শুভসংবাদে খােদ তাদের কথাই বলা হয়েছে এবং জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, তাদের প্রত্যেকের প্রতিই আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়েছেন ও তাদের অন্তরের উদ্দেশ্য ও বাসনা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন  *কি মহান সে ঘটনা! : আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তাদের অন্তরে কী ছিলাে, তা তিনি জেনেছিলেন…’ অর্থাৎ দ্বীনের প্রতি তাদের যে দরদ ছিলাে সেটা তিনি জানতে পেরেছিলেন এবং উস্কানি ও উত্তেজনাকর মুহূর্তে তাদের মাঝে যে সংযম ও ধৈর্য ছিলাে সেটাও তিনি জানতে পেরেছিলেন। রসূল(স.)-এর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তারা যে সাহসিকতা, সংযমশীলতা ও আনুগত্যের পরিচয় দিয়েছিলাে সেটাও তিনি জানতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন, তাদের প্রতি তিনি প্রশান্তি বর্ষণ করলেন এখানে প্রশান্তিকে বৃষ্টির রূপে দেখানাে হয়েছে যা তাদের প্রতি ধীরে ধীরে, নিশব্দে ও অনুত্তাল ধারায় বর্ষিত হচ্ছে এবং তাদের তেজোদীপ্ত, উদ্দীপিত, উত্তেজিত হৃদয়কে সিক্ত করে তাতে শীতলতা শান্তি, স্থিতি ও অনাবিল আনন্দের ধারা প্রবাহিত করছে।’

Leave a Reply