أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩১ / এবং কাফির রা বলে -৬)
[* *বিজয়ের স্পষ্ট ওয়াদা :-
*যারা কুফরী করে, মসজিদে হারামে যেতে বাধা দেয়:-
*আল্লাহ তাঁর রসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন:-
*সমস্ত জীবন বিধানের ওপর ইসলাম জয়যুক্ত হবে:-
মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল(সঃ) আর যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে আপোষহীন:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৮-ফাত্হ।পারা:২৬
২০-২৯ নং আয়াত:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২০
وَعَدَکُمُ اللّٰہُ مَغَانِمَ کَثِیۡرَۃً تَاۡخُذُوۡنَہَا فَعَجَّلَ لَکُمۡ ہٰذِہٖ وَ کَفَّ اَیۡدِیَ النَّاسِ عَنۡکُمۡ ۚ وَ لِتَکُوۡنَ اٰیَۃً لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ یَہۡدِیَکُمۡ صِرَاطًا مُّسۡتَقِیۡمًا ﴿ۙ۲۰﴾
আল্লাহর তোমাদরকে অঢেল গনীমতের সম্পদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যা তোমরা লাভ করবে। তিনি তোমাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিজয় দিয়েছেন এবং তোমাদের বিরুদ্ধে মানুষের হাত উত্তোলনকে থামিয়ে দিয়েছেন যাতে মু’মিনদের জন্য তা একটি নিদর্শন হয়ে থাকে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে সোজা পথের হিদায়াত দান করেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২১
وَّ اُخۡرٰی لَمۡ تَقۡدِرُوۡا عَلَیۡہَا قَدۡ اَحَاطَ اللّٰہُ بِہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرًا ﴿۲۱﴾
আরো বহু সম্পদ রয়েছে, যা এখনো তোমরা অধিকারভুক্ত করতে পারনি, তা তো আল্লাহর আয়ত্তে আছে। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২২
وَ لَوۡ قٰتَلَکُمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَوَلَّوُا الۡاَدۡبَارَ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡنَ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیۡرًا ﴿۲۲﴾
যারা কুফরী করেছে তারা যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তবে তারা অবশ্যই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে, তারপর তারা কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২৩
سُنَّۃَ اللّٰہِ الَّتِیۡ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلُ ۚۖ وَ لَنۡ تَجِدَ لِسُنَّۃِ اللّٰہِ تَبۡدِیۡلًا ﴿۲۳﴾
এটাই আল্লাহ্র বিধান—পূর্ব থেকেই যা চলে আসছে, আপনি আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন পাবেন না।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২৪
وَ ہُوَ الَّذِیۡ کَفَّ اَیۡدِیَہُمۡ عَنۡکُمۡ وَ اَیۡدِیَکُمۡ عَنۡہُمۡ بِبَطۡنِ مَکَّۃَ مِنۡۢ بَعۡدِ اَنۡ اَظۡفَرَکُمۡ عَلَیۡہِمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرًا ﴿۲۴﴾
তিনিই সেই সত্তা যিনি মক্কা ভূমিতে তাদের হাত তোমাদের থেকে আর তোমাদের হাত তাদের থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের ওপর তোমাদেরকে আধিপত্য দান করার পর। তোমরা যা কিছু করছিলে আল্লাহ তা দেখছিলেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২৫
ہُمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ صَدُّوۡکُمۡ عَنِ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ وَ الۡہَدۡیَ مَعۡکُوۡفًا اَنۡ یَّبۡلُغَ مَحِلَّہٗ ؕ وَ لَوۡ لَا رِجَالٌ مُّؤۡمِنُوۡنَ وَ نِسَآءٌ مُّؤۡمِنٰتٌ لَّمۡ تَعۡلَمُوۡہُمۡ اَنۡ تَطَـُٔوۡہُمۡ فَتُصِیۡبَکُمۡ مِّنۡہُمۡ مَّعَرَّۃٌۢ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ۚ لِیُدۡخِلَ اللّٰہُ فِیۡ رَحۡمَتِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ لَوۡ تَزَیَّلُوۡا لَعَذَّبۡنَا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡہُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿۲۵﴾
এরাই তো সেসব লোক যারা কুফরী করেছে, তোমাদেরকে মসজিদে হারামে যেতে বাধা দিয়েছে এবং কুরবানীর উটসমূহকে কুরবানী গাহে পৌঁছতে দেয়নি। যদি (মক্কায়) এমন নারী পুরুষ না থাকতো যাদেরকে তোমরা চিন না অজান্তে তাদেরকে পদদলিত করে ফেলবে এবং তাদের কারণে তোমরা বদনাম কুড়াবে এমন আশঙ্কা না থাকতো (তাহলে যুদ্ধ থামানো হতো না। তা বন্ধ করা হয়েছে এ কারণে) যে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা যেন তাঁর রহমতের মধ্যে স্থান দেন। সেসব মু’মিন যদি আলাদা হয়ে যেতো তাহলে (মক্কাবাসীদের মধ্যে) যারা কাফের ছিল আমি অবশ্যই তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতাম।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২৬
اِذۡ جَعَلَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فِیۡ قُلُوۡبِہِمُ الۡحَمِیَّۃَ حَمِیَّۃَ الۡجَاہِلِیَّۃِ فَاَنۡزَلَ اللّٰہُ سَکِیۡنَتَہٗ عَلٰی رَسُوۡلِہٖ وَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ اَلۡزَمَہُمۡ کَلِمَۃَ التَّقۡوٰی وَ کَانُوۡۤا اَحَقَّ بِہَا وَ اَہۡلَہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمًا ﴿٪۲۶﴾
যখন কাফিররা তাদের অন্তরে পোষন করেছিল গোত্রীয় অহমিকা — অজ্ঞতার যুগের অহমিকা । তখন আল্লাহ্ তাঁর রাসূল ও মুমিনদের উপর স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন ; আর তাদেরকে তাকওয়ার কালেমায় সুদৃঢ় করলেন, আর তারাই ছিল এর অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত। আর আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২৭
لَقَدۡ صَدَقَ اللّٰہُ رَسُوۡلَہُ الرُّءۡیَا بِالۡحَقِّ ۚ لَتَدۡخُلُنَّ الۡمَسۡجِدَ الۡحَرَامَ اِنۡ شَآءَ اللّٰہُ اٰمِنِیۡنَ ۙ مُحَلِّقِیۡنَ رُءُوۡسَکُمۡ وَ مُقَصِّرِیۡنَ ۙ لَا تَخَافُوۡنَ ؕ فَعَلِمَ مَا لَمۡ تَعۡلَمُوۡا فَجَعَلَ مِنۡ دُوۡنِ ذٰلِکَ فَتۡحًا قَرِیۡبًا ﴿۲۷﴾
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাঁর রসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন- যা ছিল সরাসরি হক। ইনশাআল্লাহ তোমরা পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে অবশ্যই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে। নিজেদের মাথা মুণ্ডন করবে, চুল কাটাবে এবং তোমাদের কোন ভয় থাকবে না। তোমরা যা জানতে না তিনি তা জানতেন। তাই স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করার পূর্বে তিনি তোমাদেরকে এ আসন্ন বিজয় দান করেছেন।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২৮
ہُوَ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَہٗ بِالۡہُدٰی وَ دِیۡنِ الۡحَقِّ لِیُظۡہِرَہٗ عَلَی الدِّیۡنِ کُلِّہٖ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰہِ شَہِیۡدًا ﴿ؕ۲۸﴾
তিনিই তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর একে জয়যুক্ত করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
সূরা:৪৮-ফাত্হ-২৯
مُحَمَّدٌ رَّسُوۡلُ اللّٰہِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ مَعَہٗۤ اَشِدَّآءُ عَلَی الۡکُفَّارِ رُحَمَآءُ بَیۡنَہُمۡ تَرٰىہُمۡ رُکَّعًا سُجَّدًا یَّبۡتَغُوۡنَ فَضۡلًا مِّنَ اللّٰہِ وَ رِضۡوَانًا ۫ سِیۡمَاہُمۡ فِیۡ وُجُوۡہِہِمۡ مِّنۡ اَثَرِ السُّجُوۡدِ ؕ ذٰلِکَ مَثَلُہُمۡ فِی التَّوۡرٰىۃِ ۚۖۛ وَ مَثَلُہُمۡ فِی الۡاِنۡجِیۡلِ ۚ۟ۛ کَزَرۡعٍ اَخۡرَجَ شَطۡـَٔہٗ فَاٰزَرَہٗ فَاسۡتَغۡلَظَ فَاسۡتَوٰی عَلٰی سُوۡقِہٖ یُعۡجِبُ الزُّرَّاعَ لِیَغِیۡظَ بِہِمُ الۡکُفَّارَ ؕ وَعَدَ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ مِنۡہُمۡ مَّغۡفِرَۃً وَّ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿٪۲۹﴾
মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল ; আর তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, তাদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবেন। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার প্রভাবে পরিস্ফুট ; এটাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইঞ্জীলে তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নিৰ্গত হয় কচিপাতা, তারপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীর জন্য আনন্দদায়ক। এভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের ।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*বিজয়ের স্পষ্ট ওয়াদা : এরপর বলা হয়েছে, ‘এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন…’ এখানে প্রথমে হুদায়বিয়ার সন্ধিকে বিজয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ এই সন্ধির মাধ্যমেই তাদের কাংখিত বিজয়ের সূচনা হয়েছিলাে। এই বিজয়ের একটি হচ্ছে খায়বার যুদ্ধের বিজয়। এই বিজয়কেই অধিকাংশ মুফাসসিরগণ ‘আসন্ন বিজয়’ এর ব্যাখ্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হুদায়বিয়া সন্ধির পর পরই আল্লাহ তায়ালা এটা মােমেনদেরকে দান করেছিলেন। এরপর বলা হয়েছে, ‘এবং বিপুল পরিমাণে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, যা তারা লাভ করবে…’ বিপুল পরিমাণের যুদ্ধলব্ধ মালামাল হয় তারা বিজয়ের সাথে সাথে লাভ করবে। (যেটা খায়বার যুদ্ধের সময় তারা লাভ করেছিলাে) অথবা হুদায়বিয়ার সন্ধির পরবর্তীকালে লাভ করবে। যদি এখানে বিজয় বলতে হােদায়বিয়ার সন্ধিকেই বুঝানাে হয়ে থাকে তাহলে এই হবে তার অর্থ। কারণ, এই সন্ধির পর মুসলমানরা বেশ কিছু যুদ্ধের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে নিতে পেরেছিলাে ফলে তাদের পক্ষে একাধিক যুদ্ধে বিজয় লাভ করার সুযােগ হয়েছিলাে। এরপর বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ এই মন্তব্যটি পূর্ববর্তী আয়াতগুলাের মর্মার্থের সাথে একান্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, সন্তুষ্টি, বিজয় ও যুদ্ধলব্ধ মালামালের প্রতিশ্রুতির মাঝে শক্তি ও ক্ষমতা প্রকাশ পায়। তদ্রুপ এসব বিষয়ে প্রজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও প্রকাশ পায়। কারণ এ দুটো গুণ না থাকলে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারতেন না। আগের আয়াতগুলােতে রসূলের হাতে হাত মিলিয়ে শপথ গ্রহণকারী সৌভাগ্যবান মােমেনদের সম্পর্কে রসূলকে অবহিত করার পর এখন স্বয়ং সেই মােমেনদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ তায়ালা কথা বলছেন, এই সন্ধি সম্পর্কে আলােচনা করছেন এবং সেই বিজয় সম্পর্কেও আলােচনা করছেন, যে বিজয় লাভ করতে গিয়ে তাদেরকে ধৈর্য ও সাহসের পরিচয় দিতে হয়েছিলাে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে বিপুল পরিমাণে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ওয়াদা দিয়েছেন, যা তােমরা লাভ করবে। তিনি তা তােমাদের জন্যে ত্বরান্বিত করবেন…'(আয়াত ২০-২১) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ঘােষিত এই শুভসংবাদটি মােমেন বান্দারা নিজ কানে শুনেছিলাে এবং তা তারা বিশ্বাস করেছিলাে। এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছিলাে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য বিপুল পরিমাণের যুদ্ধলব্ধ মালামাল ব্যবস্থা করে রেখে দিয়েছেন। যতােদিন তারা জীবিত ছিলাে ততােদিন তারা এই ওয়াদার সত্যতার প্রমাণ নিজ চোখে দেখেছে। এখানে তাদেরকে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সে যুদ্ধলব্ধ মালামাল অতিসত্বরই দান করবেন। তাই বলা যায়, হুদায়বিয়ার সন্ধিই এখানে তাদের জন্য যুদ্ধলব্ধ মালামাল হিসেবে এসেছে, ইবনে আব্বাস(রা.)-এর পক্ষ থেকে এই ব্যাখ্যাটিই বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাও তাই সাক্ষ্য দেয় এবং স্বয়ং রসূলুল্লাহ(স.)-এর একটি হাদীসও এই মতটিকেই প্রতিষ্ঠিত করে। ইতিপূর্বে হাদীসটি আমরা উল্লেখ করেছি। অথবা বলা যায়, যুদ্ধলব্ধ এই মালামাল বলতে খায়বার বিজয়ের মাধ্যমে লন্ধ মালামাল বুঝানাে হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটা মত বিশিষ্ট তাবেয়ী মােজাহেদ এর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। কারণ, হুদায়বিয়া সন্ধির পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে কাছাকাছি যুদ্ধটি ছিলাে খায়বার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুসলমানরা প্রচুর পরিমাণে গনীমতের মাল লাভ করেছিলাে। তবে প্রথম মতটিই সর্বাধিক যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযােগ্য। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের প্রতি তার অন্যতম কৃপার কথা স্মরণ করিয়ে বলছেন যে, ‘তিনি তােমাদেরকে শক্রদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।’ আসলেই আল্লাহ তায়ালা মােমেনদেরকে মক্কার মােশরেকদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তাছাড়া তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী আরাে অন্যান্য শত্রুদের হাত থেকেও তিনি তাদেরকে রক্ষা করেছেন। শত্রুদের তুলনায় তাদের সংখ্যা সব সময়ই কম ছিলাে। কিন্তু তা সত্তেও তারা নবীর সাথে করা শপথ পূর্ণ করে দেখিয়েছে এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বও পুরােপুরি পালন করেছে। আর তাই আল্লাহ তায়ালা ও তাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এরপর বলা হয়েছে, ‘যাতে এটা মােমেনদের জন্য একটা নিদর্শন হয়’ অর্থাৎ যে হুদায়বিয়ার সন্ধি প্রথম তাদের কাছে অপছন্দনীয় মনে হয়েছিলাে এবং তাদের মনের ওপর একটা বােঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাে সেটা সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, পরবর্তীতে সেটা তাদের জন্য একটা নিদর্শন হয়ে থাকবে এবং এর মাঝেই তাদের শুভ পরিণতি ও উত্তম প্রতিদান নিহিত থাকবে। যেহেতু এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি তাদের আনুগত্য ও আত্মনিবেদন প্রকাশ পাবে, তাই এর পরিণতি ও প্রতিদান শুভ হবে উত্তম হবে। এই সত্যটি জানার পর তাদের মনে শান্তি বিরাজ করবে, স্থিতি ফিরে আসবে এবং বিশ্বাস ও আস্থা জন্মাবে। আলােচ্য আয়াতের পরের অংশে বলা হয়েছে, ‘এবং তােমাদেরকে পরিচালিত করবেন’ অর্থাৎ তােমাদের আনুগত্য, আত্মসমর্পণ, সততা ও নিষ্ঠার প্রতিদানস্বরূপ তােমাদেরকে তিনি সরল পথে পরিচালিত করবেন, আর এভাবেই তারা নিজেদের আনুগত্য ও সততার প্রতিদানস্বরূপ গনীমতের মালামালও লাভ করবে এবং সৎ পথের সন্ধানও পাবে। ফলে সবদিক থেকেই তারা লাভবান হবে। এর দ্বারা বান্দাদেরকে আল্লাহ তায়ালা একথাই শিক্ষা দিচ্ছেন যে, তার ইচ্ছা ও পছন্দই হচ্ছে চূড়ান্ত, আর বান্দার দায়িত্ব হচ্ছে এই ইচ্ছার প্রতি আত্মসমর্পণ করা এবং তা বাস্তবায়নে আত্মনিয়ােগ করা।
“আল্লাহর পক্ষ থেকে আরাে একটি সুসংবাদ : পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আর একটি অনুগ্রহের সুসংবাদ দিচ্ছেন, আর সেটা হচ্ছে একটি বিজয়ের সুসংবাদ। এই বিজয় লাভ করা মােমেনদের ক্ষমতাবলে সাধ্যাতীত ছিলাে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে এবং নিজ শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়ােগ করে তাদের জন্যে এ বিজয়টি এনে দেন। আয়াতের নিজস্ব ভাষায় বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘আরও একটি বিজয় রয়েছে যা এখনও তােমাদের অধিকারে আসেনি, আল্লাহ তায়ালা তা বেষ্টন করে আছেন। আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান'(আয়াত ২১) আলােচ্য আয়াতে কোনাে বিজয়টির কথা বলা হয়েছে, সে বিষয়েও বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেন, এটি হলাে মক্কা বিজয়ের ঘটনা। কেউ বলেন, খায়বার বিজয়ের ঘটনা। আবার কেউ কেউ বলেন, এটা পারস্য ও রােম বিজয়ের সুসংবাদ। আবার অনেকে মনে করেন, এর দ্বারা হুদায়বিয়া সন্ধি পরবর্তী সকল বিজয়ের কথাই বুঝানাে হয়েছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযােগ্য এবং প্রসঙ্গের সাথে সামঞ্জপূর্ণ রায়টি হচ্ছে এই যে, এর দ্বারা মক্কা বিজয়ের কথা বুঝানাে হয়েছে। কারণ, মক্কা বিজয়ের ঘটনা এই সন্ধি চুক্তি লংঘন করার কারণেই ঘটেছিলাে। উল্লেখ্য যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি দুই বছরের বেশী টিকেনি। দুই বছরের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়াই মুসলমানরা মক্কা জয় করে নেয়। অথচ এই মক্কা জয় করা ছিলাে তাদের জন্য একটা কঠিন বিষয়। এই মক্কাতেই তারা কাফেরদের আক্রমণ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলাে। হেদায়বিয়ার সন্ধির বছরে সেখান থেকেই তাদেরকে ফিরে আসতে হয়েছিলাে। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এই মক্কাকে যুদ্ধ ছাড়াই মুসলমানদের হাতে ফিরিয়ে দেন। কারণ, তিনি সব কিছুই পারেন এবং সব কিছুই তার ক্ষমতার আওতাধীন। আসলে এখানে সুসংবাদটিকে রহস্যময় করে বর্ণনা করা হয়েছে। নির্দিষ্ট করে ও খােলাসা করে কিছুই বলা হয়নি। কারণ, এই সুসংবাদসম্বলিত আয়াতটি যখন অবতীর্ণ হয় তখন বিষয়টি ছিলাে সম্পূর্ণ অজানা ও অদৃশ্য। কাজেই এখানে সেটা আকারে ইংগিতে বর্ণনা করা হয়েছে। এর ফলে বিষয়টির প্রতি আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা জন্ম নেবে। সাথে সাথে মােমেনদের অন্তরে একধরনের সান্তনা ও প্রশান্তিও জন্ম নেবে। হুদায়বিয়া সন্ধির ফলে মােমেন বান্দারা তাৎক্ষণিকভাবে এবং ভবিষ্যতে কি কি ফল লাভ করবে তা উল্লেখ করার পর প্রসঙ্গক্রমে পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে যে, এই চুক্তির দ্বারা প্রকৃতপক্ষে মােমেন-রাই বিজয় হয়েছে। তারা দুর্বল এবং প্রতিপক্ষ শক্তিশালী বলে এই সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরের নির্দেশ দেয়া হয়নি, বরং আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কোনাে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষ কাফেরের দল যদি মুমিনদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতো তাহলে সেই কাফেরের দলই হেরে যেত। কারণ, এটাই আল্লাহ তায়ালার চিরন্তন নিয়ম। যখনই কোনাে চূড়ান্ত মুহুর্তে মােমেন ও কাফেররা মুখােমুখি হয়েছে তখনই এই নিয়ম অনুসারে কাফেরদের পরাজয় ঘটেছে। তাই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যদি কাফেররা তােমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতাে, তবে অবশ্যই তারা পেছন ফিরে পালিয়ে যেতাে। তখন তারা কোনাে অভিভাবক ও সাহায্যকারী পেতাে না। এটাই আল্লাহ তায়ালার নীতি যা পূর্ব থেকে চলে আসছে। তুমি আল্লাহ তায়ালার নীতিতে আদৌ কোনাে পরিবর্তন পাবে না।'(আয়াত ২২-২৩) আর এই অপরিবর্তনীয় নীতির ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়েছে মােমেনদের বিজয় ও কাফেরদের পরাজয়। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এই নীতিটি যখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ঘােষণা করা হচ্ছিলাে তখন মােমেনদের অন্তরে কি ধরনের বিশ্বাস, আস্থা ও প্রশান্তি জন্ম নিয়েছিলাে? হ্যা, এটাই হচ্ছে চিরন্তন ও শাশ্বত নীতি। তবে এর বাস্তবায়নে মাঝে মধ্যে বিলম্ব ঘটে থাকে। এর পেছনে অবশ্য অনেক কারণ থাকতে পারে। এই কারণ কখনও সঠিক পথ ও সঠিক নীতির ওপর অটল থাকা না থাকার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। আবার কখনও মােমেনদের বিজয় আর কাফেরদের পরাজয় নিশ্চিত করার মতাে পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি করা বা না করার সাথেও সম্পর্কিত হতে পারে। এসব কারণ সম্পর্কে সঠিকভাবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানেন। তবে আল্লাহ তায়ালার এই শাশ্বত ও চিরন্তন নিয়মের ব্যত্যয় অবশ্যই ঘটে না। কারণ আল্লাহ তায়ালার কথা কখনও অসত্য হতে পারে না। আর তিনিই বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালার নীতিতে তুমি কখনও পরিবর্তন পাবে না।’
*আল্লাহ তায়ালার একটি অনুগ্রহ : এরপর আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের সামনে তার আর একটি অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করছেন, আর সেটা হলাে, কাফেরদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করা আল্লাহর ওয়াদা। এটা ঘটেছিলাে কাফেরদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর যখন মােমেনদেরকে আল্লাহ তায়ালা বিজয়ী করেছিলেন তখন। এই আয়াত দ্বারা মক্কা বিজয়ের সময় ঘটে যাওয়া একটা বিশেষ ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। এই ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, চল্লিশজন বা এর কম ও বেশীসংখ্যক মােশরেক মুসলমানদের শিবিরে ঢুকে তাদের ক্ষতি করতে চেয়েছিলাে। কিন্তু মুসলমানরা তাদেরকে পাকড়াও করে ফেলে এবং তাদেরকে রসূলুল্লাহ(স.)-এর সামনে নিয়ে হাযির করে। তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। এ সম্পর্কেই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিই মক্কা শহরে তাদের হাত তােমাদের থেকে এবং তােমাদের হাত তাদের থেকে নিবারিত করেছেন তাদের ওপর তােমাদেরকে বিজয়ী করার পর'(আয়াত ২৪) ঘটনাটি ঘটে গেছে এবং সবাই তা জেনেও নিয়েছে। তারপরও আল্লাহ তায়ালা সে ঘটনাটি এই বিশেষ ভঙ্গিতে বর্ণনা করছেন। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা বুঝাতে চান এবং প্রমাণ করতে চান যে, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে ও হচ্ছে তার পেছনে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও তদবীর কার্যকর। এই সত্যটি জানার পর মােমন বান্দার মনে আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস আরও দৃঢ় হবে, সে তখন বিশ্বাস করবে যে, সব কিছু আল্লাহই করেন, তিনিই তাকে চালান, তিনিই তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কাজেই তাঁর প্রতিই পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে হবে, তার হাতেই নির্দ্বিধায় নিজেকে সঁপে দিতে হবে, তার মনােনীত বিধানেই তাকে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হবে, গােটা আবেগ অনুভূতি নিয়ে, হৃদয় মন দিয়ে এবং সকল ধ্যান ধারণা দিয়ে এই ইসলামকে গ্রহণ করতে হবে, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে যে, হুকুমদাতা একমাত্র আল্লাহই, আল্লাহ তায়ালার পছন্দই সঠিক পছন্দ, তাঁর নির্ধারিত তাকদির ও ইচ্ছা অনুযায়ী তার পছন্দ ও অপছন্দমাফিক মানুষকে চালানাে হয়, তবে তিনি সব সময়ই মানুষের মঙ্গল চান। তাই মানুষ যখন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ তায়ালার হাতে সঁপে দেয় তখন খুব সহজেই সে মঙ্গলের পথে ধাবিত হয়। তিনি মানুষের সব বিষয় সম্পর্কে অবগত। তিনি তাদের গােপন ও প্রকাশ্য সকল বিষয়ই দেখেন ও জানেন। তাই যখন তিনি তাদের জন্য কোনাে কিছু মনােনীত করেন তখন তা জেনে ও বুঝেই করেন। তিনি এর দ্বারা কখনও তাদের অমঙ্গল কামনা করেন না। তিনি যা ফয়সালা করেন তা জেনে ও বুঝেই করেন। তিনি এর দ্বারা কখনও তার বান্দাদের অমঙ্গল কামনা করেন না এবং তাদের কোনাে প্রাপ্যই তিনি ব্যর্থ যেতে দেন না। তাই আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, তােমরা যা কিছু করাে তা আল্লাহর তায়ালা দেখেন।
“আল্লাহর কাছে বিধর্মীদের স্থান : পরবর্তী আয়াতে মুসলমানদের শত্রুদের সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার মাপকাঠিতে তাদের স্থান কোথায় তা বলা হয়েছে। এদের কার্যকলাপ, মুসলমানদের সাথে এদের আচরণ এবং আল্লাহ তায়ালার ঘর থেকে মুসলমানদেরকে দূরে সরিয়ে রাখার মতাে যে জঘন্য কাজ এরা করে তা আল্লাহ তায়ালা কোন দৃষ্টিতে দেখেন সে বিষয়েও আলােচনা করা হয়েছে। খােদ মােমেনদের আল্লাহ তায়ালা কোনাে দৃষ্টিতে দেখেন সেটাও এখানে আলােচিত হয়েছে। যেমন আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারাই তাে কুফরী করেছে এবং অবস্থানরত কোরবানীর জন্তুদেরকে যথাস্থানে পৌঁছতে…'(আয়াত ২৫) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে ও তার মাপকাঠিতে ওরা প্রকৃতভাবেই কাফের ও বেঈমান। তাই তিনি তাদের জন্য এই ঘৃণ্য ও অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন যে, ‘ওরাই তাে কুফরী করেছে’- এই মন্তব্য দ্বারা আল্লাহ তায়ালা বুঝাতে চেয়েছেন- এই বিশেষণের উপযুক্ত একমাত্র ওরাই এবং এই বিশেষণ যেন ওদের অস্থি মজ্জায় মিশে রয়েছে। কাজেই তারা আল্লাহ তায়ালার কাছে অত্যন্ত ঘৃণ্য জাতি। কারণ, তিনি কুফরীকে ঘৃণা করেন এবং কাফেরদেরকেও ঘৃণা করেন। ওদের আরাে একটি ঘৃণ্য কাজের কথা আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেন। আর তা হলাে আল্লাহর মুমিন বান্দাদেরকে তারই ঘর থেকে ওরা ফিরিয়ে রাখে এবং কোরবানীর জন্তুগুলােকে যথাস্থানে পৌছার পথে ওরা বাধার সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালার ঘরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া এবং কোরবানীর পশুগুলােকে কোরবানীর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করা জাহেলী যুগেও বিরাট পাপের বিষয় ছিলাে এবং ইসলামেও তা জঘন্য পাপ বলে বিবেচিত। শুধু তাই নয়, বরং তখনকার আরব উপদ্বীপে প্রচলিত ও পরিচিত সকল ধর্ম, প্রথা ও রীতি নীতিতেও তা ঘৃণ্য ও জঘন্য কাজ বলে বিবেচিত ছিলাে। অর্থাৎ মুসলিম ও কাফের নির্বিশেষে সকলের দৃষ্টিতেই কাজটি ঘৃণ্য কাজ হিসেবে গণ্য। তাহলে বুঝা গেলাে যে, কাফেরদের হাত থেকে মােমেনদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য কেবল তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করাই নয়, বরং এর পেছনে আরাে একটি মহান উদ্দেশ্য নিহিত আছে। সেটার প্রতি ইংগিত করে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, যদি সেদিন মক্কা নগরীতে এমন কিছু মােমেন নরনারী না থাকতাে- যাদেরকে তােমরা জানতে না। তাছাড়া এই আশঙ্কা যদি না হতাে যে, না জেনে তাদেরকে পদদলিত করার পর তােমরা অনুতপ্ত হবে তাহলে এ যুদ্ধ কিছুতেই বন্ধ করা হতাে না। আয়াতে বলা হয়েছে যে, মক্কায় বেশ কিছু অসহায় ও দুর্বল মুসলিম নরনারী ছিলাে যারা তখনও মদীনায় হিজরত করতে পারেনি। মােশরেকদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গােপন রেখেছিলাে। যদি মক্কা বিজয়ের দিন যুদ্ধ বেধে যেতাে, আর মুসলমানরা মক্কায় আক্রমণ করতাে তাহলে মক্কার সেই অজ্ঞাত ও অপরিচিত মুসলমানদের ওপরও তারা চড়াও হতাে এবং তাদেরকে হত্যা করতাে। তখন মানুষ বলাবলি করার সুযােগ পেতাে যে, মুসলমানরা মুসলমানদেরকে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, বরং পরবর্তীতে এই ভুলবশত হত্যার জন্য তাদেরকে রক্তপণও দিতে হতাে। এখানে আরাে একটি উদ্দেশ্য নিহিত আছে। আর তাহলাে, যেসব কাফেরও ছিলাে যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা জানতেন যে, এরা পরে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। এখন যদি এই লােকগুলাে আসল ও প্রকৃত কাফেরদের থেকে স্বতন্ত্র থাকতাে এবং তাদের ভিন্ন কোনাে পরিচয় থাকতাে তাহলে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দিতেন। আর তখন তারা কাফেরদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে পারতাে। তাই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যেন আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমতে দাখিল করে নেন। যদি তারা সরে যেতাে, তবে আমি অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা কাফের তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিতাম।’
“কাফেরদের অহংকার ও গােড়ামী : এখানে আল্লাহ তায়ালা তার মনােনীত, অনন্য ও সৌভাগ্যবান মােমেন বান্দাদের সামনে তার কর্ম ও সিদ্ধান্তের পেছনে লুকায়িত রহস্য ও উদ্দেশ্যবলীর দু’একটি দিক তুলে ধরেছেন। এরপর পুনরায় কাফেরদের স্বভাব চরিত্র ও তাদের মন মানসিকতার প্রতি ইংগিত করে বলেন, ‘কেননা, কাফেররা তাদের অন্তরে জাহেলী যুগের জেদ পােষণ করত।'(আয়াত ২৬) বলা বাহুল্য, তাদের এই জেদ কোনাে বিশ্বাস বা মতাদর্শের কারণে ছিলাে না। বরং এই জেদ ছিলাে নিতান্তই অহংকার, গোড়ামী ও গােয়ার্তুমীর কারণে। এই জেদের বশবর্তী হয়েই তারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে, সাহাবাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার ঘরে প্রবেশে বাধা দিয়েছে এবং কোরবানীর জন্য আনীত পশুগুলােকে কোরবানীর নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে দেয়নি। আর এই কাজগুলাে করতে গিয়ে তারা প্রচলিত সব ধরনের রীতিনীতি ও আদর্শের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করেছে। তাদের এই মূর্খতা ও বর্বরতাপূর্ণ আদর্শের খাতিরে তারা সব ধরনের প্রথাবিরােধী ও ধর্মবিরােধী জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং এর খাতিরে তারা সেই পবিত্র ঘরটির পবিত্রতা নষ্ট করেছে যার পবিত্রতার দোহাই দিয়ে তারা মক্কায় নিরাপদে বসবাস করছিলাে। এমনকি তারা এই বর্বরতাপূর্ণ আদর্শের খাতিরে সেই নিষিদ্ধ মাসগুলাের পবিত্রতাও নষ্ট করেছে যার পবিত্রতা জাহেলী ও বর্বর যুগেও রক্ষিত হয়েছে এবং ইসলামী যুগেও রক্ষিত হয়েছে। তাদের এই জেদ কেবল মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ছিলাে না, বরং যারাই তাদেরকে শান্তির প্রস্তাব দিয়েছে এবং রসূলুল্লাহ(স.) ও তাঁর সাথীদেরকে আল্লাহ তায়ালার ঘরে প্রবেশে বাধা দেয়ার জন্য মন্দ বলেছে, তাদের বিরুদ্ধেও ছিলাে। এই জেদের কারণেই তারা সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগেই সােহায়ল বিন আমরকে রসূলের হাতে সমর্পণ করতে, চুক্তিনামায় আল্লাহ তায়ালার নাম লিখতে এবং মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ(স.) লিখতে আপত্তি জানায়। অহেতুক গোঁড়ামী ও মূর্খতাপূর্ণ জেদের বশবর্তী হয়েই তারা এসব করেছিলাে। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা জানতেন যে ওদের অন্তরে সত্যকে মেনে নেয়ার মত উদারতা নেই এবং সত্যের সাথে আপােস করার মতাে যােগ্যতাও ওদের মাঝে নেই, তাই ওদের মনে এ জাতীয় জেদ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। অপরদিকে এ জাতীয় জেদ থেকে মােমেনদেরকে মুক্ত রেখেছিলেন। এর পরিবর্তে বরং তাদের মনে শান্তি, স্বস্তি ও আল্লাহভীতির গুণ সৃষ্টি করেছিলেন। এ সম্পর্কে আয়াতে বলা হয়েছে, অতপর আল্লাহ তায়ালা তার রসূল ও মােমেনদের ওপর স্বীয় প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং তাদের জন্যে সংযমের দায়িত্ব অপরিহার্য করে দিলেন। বস্তুত তারাই ছিলাে এর অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত। সাকীনাহ শব্দ দ্বারা এখানে স্থিরতা ও গাম্ভীর্য বুঝানাে হয়েছে। আর ‘তাকওয়া’ শব্দ দ্বারা বুঝানাে হয়েছে সতর্কতা ও আনুগত্য। আর এ দুটো গুণ কেবল সেসব অন্তরের জন্যই প্রযােজ্য যে অন্তর বিশ্বাসী ও স্রষ্টার সাথে যুক্ত এবং আস্থা ও স্থিতিশীলতার গুণে গুণান্বিত। যে দু’টো গুণ কেবল সেই অন্তরেই থাকতে পারে যে অন্তর প্রতিটি কাজে, প্রতিটি পদক্ষেপে নিজ প্রভুর অস্তিত্ব অনুভব করে, যে অন্তরে কোনাে অহংকার নেই, দম্ভ নেই। যে অন্তর নিজের জন্য নয়, বরং নিজ ধর্ম ও নিজ স্রষ্টার জন্য রাগান্বিত হয়। তাই এই জাতীয় অন্তরকে শান্ত ও স্থির হওয়ার নির্দেশ দিলে তা পালন করে এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকে। আর সে কারণেই মােমেন বান্দাদেরকে তাকওয়া ও সংযমের জন্য অধিকতর যােগ্য ও উপযুক্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রভুর পক্ষ থেকে দেয়া এটা হচ্ছে তাদের জন্য আর একটি বিশেষণ। আল্লাহ তায়ালার বিচারে ও তার মাপকাঠিতে মােমেন বান্দারা এই বিশেষণসহ অপরাপর বিশেষণের উপযুক্ত বলে সাব্যস্ত হয়েছে। এটা নিসন্দেহে তাদের জন্য একটা অতিরিক্ত সম্মান। তিনি বান্দাদের সকল বিষয় সম্পর্কে অবহিত আছেন বলেই এই ঘােষণা দিয়েছেন। তাই আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, “আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’
*দ্বীনের বিজয় সুনিশ্চিত : ইতিপূর্বে আলােচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, যারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর দেখা সত্য স্বপ্নের সুসংবাদ পেয়ে তার কাছ থেকে চলে এসেছিলাে তাদের কারাে কারাে মনে আশংকা সৃষ্টি হয়েছিলাে যে, এই স্বপ্নের ফলাফল খুব সম্ভবত সেই বছরেই বাস্তব হয়ে দেখা দেবে না এবং তাদেরকে হয়তাে আল্লাহ তায়ালার ঘর ওমরাহ না করেই ফিরে আসতে হবে। তাই পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, রসূলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই এবং সবার মনের আশা পূর্ণ হবেই। কেবল আল্লাহ তায়ালার ঘরে প্রবেশ করেই তারা ক্ষান্ত হবে না বরং এর চেয়েও বড় একটা একটা কাজ সেদিন তারা সমাধা করবে। আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ’আল্লাহ তায়ালা তার রসুলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তােমরা অবশ্যই মাসজিদে হারামে প্রবেশ করবে, নিরাপদে মাথা মুন্ডিত অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়। তােমরা কাউকে ভয় করবে না। অতপর তিনি জানেন যা তােমরা জানােনা। এছাড়াও তিনি দিয়েছেন তােমাদেরকে একটি আসন্ন বিজয়।'(আয়াত ২৭)। আলােচ্য আয়াতে দুটো সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এর একটি হলাে, রসূলের স্বপ্ন সত্য বলে প্রমাণিত হওয়া, নিরাপদে আল্লাহ তায়ালার ঘরে প্রবেশ করা এবং নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে হজ্জ বা ওমরাহ আদায় করার পর মাথা মুন্ডানাে অথবা চুল কাটা। এই সুসংবাদটি এক বছর পরেই ফলেছিলাে। আর দ্বিতীয় সুসংবাদটি হলাে মক্কা বিজয়। হােদায়বিয়ার সন্ধির মাত্র দু’ বছর পরই এটিও মহা সমারােহে ও অত্যন্ত ঘটা করে বলেছিলে। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে গােটা আরব জাহানে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের বিজয় সুচিত হয়। *ইনশাআল্লাহ বলা : আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘আল্লাহ তায়ালা চাইলে তােমরা অবশ্যই মাসজিদে হারামে প্রবেশ করবে’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মােমেনদেরকে ঈমানী শিষ্টাচার শিক্ষা দিচ্ছেন। কারণ, কাবা ঘরে প্রবেশ করার বিষয়টি সুনিশ্চিত ও সুনির্ধারিত হওয়া সত্তেও এখানে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে শর্ত হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মােমেন বান্দাদের অন্তরে এই সত্যটিকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান যে, তার ইচ্ছা অবাধ, শর্তহীন ও নিরঙ্কুশ এবং এই ইচ্ছাই চূড়ান্ত। এই সত্যটিকে পবিত্র কোরআন বারবার তুলে ধরে, এমনকি যেখানে ওয়াদার কথা বলা হয়েছে, সেখানেও এই ইচ্ছার শর্তটি আরােপ করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তায়ালার ওয়াদার কখনও বরখেলাপ হয় না। তবে এই ওয়াদার সাথেও তার স্বাধীন ইচ্ছার সম্পর্ক চিরন্তন। এই সত্যটিকে মােমেনদের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা গেঁথে দিতে চান, যেন এটাকে তারা ইসলামের অন্যতম শিষ্টাচার হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। *ঘটনার মুল প্রেক্ষাপট : এখন আমরা মূল ঘটনার দিকে যাচ্ছি। একাধিক বর্ণনায় দেখা যায় যে, হােদায়বিয়ার সন্ধির পরের বছর অর্থাৎ সপ্তম হিজরীর যিলকদ মাসে রসূলুল্লাহ(স.) হুদায়বিয়া বায়াত গ্রহণকারী সাহাবাদেরকে নিয়ে ওমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় রওয়ানা হন। তিনি ‘যুল হােলাইফা’ নামক মিকাত থেকে এহরাম বাঁধেন এবং কোরবানীর পশু সাথে করে নিয়ে যান, যেমনটি তিনি এর আগের বছর করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম(রা.) তার সাথে তালবিয়া পড়তে পড়তে অগ্রসর হচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ(স.) যখন মাররুজ জাহরান নামক স্থানের কাছে পৌঁছলেন, তখন ঘােড়া ও অস্ত্রসহ মােহাম্মদ বিন মাসলামাকে মক্কা পাঠিয়ে দিলেন। মক্কার মােশরেক বাসিন্দারা তাকে দেখে অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মনে করে যে, রসূলুল্লাহ(স.) তাদের ওপর আক্রমণ করবেন। তারা আরাে মনে করলাে যে, দশ বছর মেয়াদী যুদ্ধবিরতির যে চুক্তি তার সাথে করা হয়েছিলো তা তিনি ভঙ্গ করেই মক্কায় আক্রমণ করতে এসেছেন। তাই তারা মক্কার সকল বাসিন্দার কাছে এই আক্রমণের খবর পৌছে দিলাে। রসূলুল্লাহ(স.) মাররুজ জাহরানে যখন পৌঁছলেন, সেখান থেকে তিনি তখন আল্লাহ তায়ালার ঘর দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি সকল অস্ত্রসস্ত্র ও তীর ধনুক ইয়াজেজ নামক উপত্যকায় পাঠিয়ে দিলেন এবং খাপবন্দি তলােয়ার সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন। মক্কার দিকে চলার সময় কোরায়শ নেতারা তার কাছে মিকরায বিন হাফস নামক একজন লােককে পাঠায়। সে রাসূল(স.)-কে লক্ষ্য করে বললো, ‘মোহাম্মদ! তুমি কখনও চুক্তি ভঙ্গ করেছো বলে আমাদের জানা নেই। তখন রসূলুল্লাহ(স.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার?’ সে বললাে, তুমি অন্ত্রশস্ত্র ও তীর ধনুক নিয়ে আমাদের এখানে প্রবেশ করেছো। উত্তরে রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, ‘তােমার কথা ঠিক নয়, আমাদের অস্ত্রগুলাে ইয়াজেজ উপত্যকায় পাঠিয়ে দিয়েছি। তখন লােকটি বললাে, ‘এটাই আমরা জানতাম, কারণ তুমি একজন সৎ ও নীতিবান লােক।’ রসূলের আগমনের খবর পেয়ে মক্কার নেতৃস্থানীয় কাফেররা অত্যন্ত ক্রোধ ও ক্ষোভ নিয়ে রাসূল(স.) ও তাঁর সাথীদের দেখার জন্য রাজপথে বের হয়ে এলাে। মক্কার সাধারণ নারী পুরুষ ও শিশুরা রাস্তার দু’ধারে এবং বাড়ীর ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে রসূল(স.)-এর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিলাে। রসূলুল্লাহ(স.) মক্কায় প্রবেশ করলেন, সাহাবায়ে কেরাম তালবিয়া পড়তে পড়তে তার সামনে চলছিলেন। কোরবানীর পশুগুলাে ‘যী-তুয়া’ নামক স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন আল্লাহর রসূল(স.) যে উটে আরােহণ করেছিলেন, আজও সেই একই উটে আরােহণ করে মক্কায় প্রবেশ করলেন। উটটির লাগাম ছিলাে আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনসারী(রা.)-এর হাতে । তিনিই উটটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এভাবেই রসূলুল্লাহ(স.)-এর স্বপ্ন সত্য হয় এবং আল্লাহ তায়ালার দেয়া ওয়াদাও পূর্ণ হয়। মক্কা বিজিত হয়, আল্লাহ তায়ালার দ্বীন বিজয়ী হয় এবং গােটা আরব উপদ্বীপে এর প্রসার ঘটে।
এরপর আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ ওয়াদাও বাস্তবায়িত হয়। সে ওয়াদাটা হলাে এই, “তিনিই তার রসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত জীবন বিধানের ওপর জয়যুক্ত করেন। সত্য প্রতিষ্ঠাতারূপে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট।'(আয়াত ২৮) আল্লাহ তায়ালার এই ওয়াদা পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে। সত্য দ্বীনের জয় হয়েছে। এই বিজয় কেবল আরব উপদ্বীপ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ের মধ্যেই গােটা পৃথিবীতে এর বিস্তার ঘটে। গােটা পারস্য সম্রাজ্যে এর বিস্তার ঘটে, রােমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকায় এর বিস্তার ঘটে । এমনকি ভারত ও চীনসহ দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপ (ইন্দোনেশিয়া) পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটে। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ ও গােটা ষষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীতে এসব এলাকাতেই আবাদ ছিলাে। আল্লাহ তায়ালার এই সত্য বিধানের বিজয় এখনও অব্যাহত রয়েছে। এমনকি এর বিজিত অধিকাংশ এলাকায় বিশেষ করে ইউরােপ ও ভূমধ্যসাগরের দ্বীপগুলােতে এর রাজনৈতিক পতনের পরও এবং গােটা বিশ্বে অন্যান্য জাতির তুলনায় মুসলিম জাতির প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পাওয়া সত্তেও ইসলামের প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে। এটা মানতেই হবে যে, জীবন বিধান হিসেবে পৃথিবীর বুকে অন্যসব মতাদর্শের তুলনায় ইসলামের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্য এখনও অল্লান রয়ে গেছে। কারণ, মূল হিসেবে এটা একটা শক্তিশালী ব্যবস্থা এবং প্রকৃতির দিক থেকেও এটা একটা শক্তিশালী বিধান। এই বিধান তলােয়ার বা কামানের জোরে চলে না। বরং চলে এর অন্তর্নিহিত শক্তি, বৈশিষ্ট ও স্বভাবমুখীতার গুণে। এই বিধানের মাঝে দেহ ও আত্মার প্রয়ােজন মেটানাের মতাে যােগ্যতা রয়েছে। এর মাঝে জাগতিক উন্নতি ও অগ্রগতির প্রয়ােজন মেটানাের মতাে যােগ্যতা রয়েছে এবং সকল পরিবেশ ও সকল শ্রেণীর মানুষের প্রয়ােজন মেটানাের মত যােগ্যতাও রয়েছে। এই বিধানে কুঁড়েঘরে বসবাসকারী একজন দরিদ্র মানুষের চাহিদা মেটানাের উপাদান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সুউচ্চ অট্টালিকায় বসবাসকারী একজন বিত্তশালীর চাহিদাও। কোনো বিধর্মী বিদ্বেষমুক্ত হয়ে এটাকে জানার চেষ্টা করে তাহলে সে এর যথার্থতা, এর অন্তর্নিহিত শক্তি, এর দিকদর্শনের ক্ষমতা এবং মানুষের বহুবিধ ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানাের যােগ্যতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। তাই বলা হয়েছে, ‘এসব বিষয়ের স্বাক্ষী হিসেবে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট’ আল্লাহ তায়ালার এই ওয়াদা বাহ্যিক রাজনৈতিক রূপে প্রকাশ পেয়েছে রসুলুল্লাহ(স.)-এর নবুওত লাভের পর থেকে এক শতাব্দী পূর্ণ হওয়ার আগেই। তেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালার এই ওয়াদা এখনও বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং সেটা হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক রূপে। অন্যান্য ধর্মের ওপর এই সত্য ধর্মের প্রাধান্য এখনও অব্যাহত আছে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ইসলামই একমাত্র শ্বাশ্বত জীবন বিধান যা সব ধরনের পরিস্থিতিতে কাজ করতে এবং নেতৃত্বদানে সক্ষম। আমার মনে হয় ইসলামের এই বাস্তব গুণটি আজ যারা অনুধাবন করতে পারছে না তারা স্বয়ং এই দ্বীনের অনুসারীরা। অন্যথায় বিধর্মীরা এটা ঠিকই অনুধাবন করতে পারে, ইসলামকে তারা ভয়ও করে এবং সে কারণেই তাদের প্রতিটি পলিসি ও নীতি নির্ধারণের সময় ব্যাপারটি বিবেচনায় রাখে।
*সাহাবায়ে কেরামদের গুণাবলী : এখন আমরা আলােচ্য সূরার শেষ দিকে এসে গেছি। এখানে আমরা সাহাবায়ে কেরামের একটা উজ্জ্বল ও অনন্য রূপের সন্ধান পাচ্ছি যা কোরআনের অনুপম বর্ণনায় জীবন্ত ও চাক্ষুষ হয়ে উঠেছে। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও রেযামন্দীপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবান এই দলটির ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে পবিত্র কোরআন বলছে, ‘মােহাম্মাদ আল্লাহ তায়ালার রসূল এবং তার সহচরদের বৈশিষ্ট হলাে যে, তারা কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখতে পাবে। তাদের মুখমন্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন…’ (আয়াত ২৯) পবিত্র কোরআনের অনুপম বর্ণনাশৈলীতে সাহাবায়ে কেরামের কি অপূর্ব চিত্র ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এই চিত্রে সাহাবায়ে কেরামের প্রধান কয়েকটি অবস্থার প্রতিকৃতি ধরা পড়েছে। এখানে তাদের প্রকাশ্য অবস্থাও ধরা পড়েছে এবং গোপন অবস্থাও ধরা পড়েছে। এখানে কাফেরদের সাথে তাদের আচরণের দিকটিও এসেছে এবং তাদের পরস্পরের মধ্যকার সম্পর্কের দিকটিও এসেছে। বলা হয়েছে, ‘কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল’ অপরদিকে এবাদাত বন্দেগীতে তাদের অবস্থা কি দাঁড়ায়, তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তারা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে তাদের স্বভাব চরিত্রে, আচার আচরণে এবং তাদের বাহ্যিক অবয়বে কি প্রভাব ও চিহ্ন রাখে তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তাদের মুখমন্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন এবং তাদের এই বিশেষ চিহ্নটির বর্ণনা তাওরাত ও ইঞ্জিলেও এসেছে।’ বিশেষ করে ইঞ্জিলে তাদের পরিচিতিটা এভাবে এসেছে, ‘তাদের অবস্থা যেমন একটি চারাগাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতপর তা শক্ত ও মযবুত হয় এবং কান্ডের ওপর দৃঢ়ভাবে দাড়ায় চাষীদেরকে আনন্দে অভিভূত করে যাতে আল্লাহ তায়ালা তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন।’ শেষের এই আয়াতগুলােয় প্রথমেই মুহাম্মাদ(স.)-এর প্রধান পরিচয় ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ সােহায়ল বিন আমর সহ অন্যান্য মােশরেকের দল হুদায়বিয়ার চুক্তিনামায় এই বিশেষণটি যােগ করার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলাে। তাই আলােচ্য আয়াতে এই বিশেষণটি আরাে জোরালােভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, সাথে সাথে অপূর্ব বর্ণনাভঙ্গিতে সাহাবায়ে কেরামের উজ্জল প্রতিকৃতি অংকন করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মােমেনদের অবস্থা ও পরিস্থিতির বিভিন্ন রূপ ছিলাে। তবে এখানে তাদের সর্বাধিক পরিচিত অবস্থাগুলাে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের জীবনের এই প্রধান প্রধান অবস্থাগুলাে উল্লেখ করে প্রকারান্তরে তাদের প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ও সম্মানের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম কারণটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তারা কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং পরস্পর সহানুভূতিশীল…’ কাফেরদের প্রতি কঠোর হওয়ার অর্থ কাফের পিতামাতা, ভাই বােনদের, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের প্রতি কঠোর হওয়া। তাই দেখা যায়, কুফরির কারণে তারা আপনজনদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলো। অপরদিকে তারা পরস্পর ছিলাে সহানুভূতিশীল ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবব্ধ। এই ভ্রাতৃত্ব রক্তের নয়, বরং আদর্শের। তাদের কঠোরতা ছিলাে আল্লাহ তায়ালার খাতিরে এবং সহানুভূতি ও মমত্ববােধও ছিলাে আল্লাহর খাতিরেই । তাদের জিঘাংসা ছিলাে আদর্শের খাতিরে এবং উদারতাও ছিলাে আদর্শের খাতিরে। তাদের নিজের জন্য কিছু ছিলাে না এবং নিজেদের স্বার্থেও কিছু ছিলাে না। তারা একমাত্র আদর্শের জন্যেই নিজেদের আবেগ অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতাে এবং এই আদর্শের জন্যেই নিজেদের আচার আচরণ ও সম্পর্ককেও নিয়ন্ত্রণ করতাে। এই আদর্শের কারণেই তারা শত্রুদের প্রতি কঠোর হতাে এবং এই আদর্শের কারণেই পরস্পরের প্রতি সদয় হতাে। মােটকথা আমিত্ব বলতে তাদের মাঝে কিছুই ছিলাে না। আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারাে জন্য তারা আবেগ প্রবণ হতাে না। আল্লাহ তায়ালার সাথে তাদের যে বন্ধন ছিলাে সেটাই ছিলাে অপরাপর সকল বন্ধনের মাপকাঠি। সাহাবায়ে কেরামের প্রতি যে বিশেষ সম্মান দেখানাে হয়েছে তার আর একটি কারণ হচ্ছে, একনিষ্ট এবাদাত বন্দেগী । বলা হয়েছে, তাদেরকে তুমি রুকু ও সেজদারত দেখতে পাবে এখানে যে বর্ণনাভঙ্গি ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তাতে বুঝা যায় যে, তারা যেন সকল অবস্থায় ও সকল স্থানে এবাদাত বন্দেগীতেই মত্ত আছে। রুকু ও সেজদা শব্দ দুটো সামগ্রিক এবাদাতের অর্থ প্রকাশ করছে। আর এবাদতের অর্থ হচ্ছে আনুগত্য ও দাসত্ব। তাই এ শব্দ দুটো দিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মনের প্রকৃত অবস্থাটা তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের গােটা জীবনটাই কেটেছে আল্লাহ তায়ালার এবাদত বন্দেগী ও আনুগত্যের মধ্য দিয়ে। সাহাবায়ে কেরামের তৃতীয় যে চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে সেটি হচ্ছে তাদের মনজগতের চিত্র। এ চিত্র সামগ্রিক আবেগ অনুভূতির স্থায়ী চিত্র। এ চিত্র তাদের আশা আকাংখা ও কামনা বাসনার প্রকৃত চিত্র। কারণ, তাদের একমাত্র কামনা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি। এই অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির বাইরে তাদের আর কিছুই চাওয়ার ছিলােনা, তাই তাদের সকল চিন্তা এবং তাদের সকল চাওয়া পাওয়া এই অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতাে। সাহাবায়ে কেরামের চতুর্থ চিত্রটি হচ্ছে তাদের এবাদত বন্দেগীর বাহ্যিক প্রভাবের চিত্র। এই চিত্রে আমরা তাদের মুখমন্ডলের উজ্জ্বলতা, দীপ্তি, পরিচ্ছন্নতা ও স্বচ্ছতা দেখতে পাই। আরাে দেখতে পাই এবাদত রিয়াযতের ফলে সৃষ্ট শুভ্র ও স্নিগ্ধ দ্যুতি। এটা কপালের সেই কালাে চিহ্ন নয় যা সিজদার কারণে শব্দটি পাঠ করার সাথে সাথে মনে আসে। এখানে সেজদা বলতে সামগ্রিক এবাদত বুঝানাে হয়েছে। আর যেহেতু সিজদার মাঝে আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভয়, ভক্তি, বিনয় আনুগত্য ও দাসত্বের পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশ পায়, তাই এবাদাত বন্দেগীর অর্থ প্রকাশ করার জন্য এই সিজদা শব্দটাই ব্যবহার করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, চেহারায় সিজদার চিহ্ন বলতে এই ভয় ভক্তি ও বিনয়ের চিহ্নই বুঝায়। তাই যারা মনে প্রাণে আল্লাহ তায়ালার এবাদাত বন্দেগী করে। তাদের চেহারায় অহংকার, দাম্ভিকতা ও রুঢ়তার ভাব থাকে না। বরং এর পরিবর্তে চেহারায় জন্ম নেয় ভদ্রতাসূলভ বিনয়, নির্মল স্বচ্ছতা, সমৃদ্ধ দীপ্তি এবং হাল্কা বিমর্ষতা যার ফলে মােমেনের চেহারায় উজ্জ্বলতা কোমলতা ও ভদ্রতা আরও বৃদ্ধি পায় । এই দৃশ্যগুলােতে যে চির ভাস্বর রূপটি ফুটে উঠেছে তা নতুন কিছু নয়, বরং তা চিরন্তন ও আদি। আর সে কারণেই এ চিত্রটির সন্ধান তাওরাতেও পাই। আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামের এই বৈশিষ্ট ও গুণাবলী তাদের আবির্ভাবের আগেই মূসা(আ.)-এর ওপর নাযিল করা কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে তাদের আগমনের শুভ সংবাদ দিয়েছেন। ইঞ্জিল কিতাবে মুহাম্মদ(স.)-এর আগমন ও তার সাহাবাদের গুন বৈশিষ্ট আলােচনা করা হয়েছে, তাদের বিভিন্ন গুণাবলী ও চিহ্ন বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে সাহাবাদের এই জামায়া’ত একটা মযবুত বাড়ন্ত চারাগাছের সাথে তুলনা করা হয়েছে, এই চারাগাছ থেকে কচি পাতা জন্ম নেয়। কিন্তু তাতে করে চারাগাছটি দুর্বল হয় না, বরং আরাে শক্ত হয়, মযবুত হয়, ভরাট হয় এবং নিজ কান্ডের ওপর সােজা হয়ে দাঁড়ায়। এতে কোনাে বক্রতা থাকে না এবং কোনােরূপ ক্রটিও থাকে না। আলােচ্য আয়াতে চিত্রায়িত দৃশ্যটির এটাই হচ্ছে বাহ্যিক রূপ। কিন্তু যারা কৃষিকার্যে পারদর্শী ও অভিজ্ঞ, যারা জানে কোনটি বাড়ন্ত চারা, আর কোনটি রুগ্ন চারা তারা এ দৃশ্যটি দেখে আনন্দিত হয়, অভিভূত হয়। তাই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যা চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে’… এখানে চাষী শব্দ দ্বারা রসূলুল্লাহ(স.)-কে বুঝানাে হয়েছে। কারণ, ইসলাম নামক বাগানে তিনি যে চারা লাগিয়েছিলেন, সেই চারা বড় শক্তিশালী হয়ে এবং পুষ্ট হয়ে বাগানের শােভা বর্ধন করেছিলাে। এই শক্তিশালী বৃক্ষরাজী সাহাবায়ে কেরাম ব্যতীত আর কেউ নয়। তাই এদেরকে দেখে প্রিয়নবী আনন্দিত হন। অপরদিকে এই শস্য শ্যামল ও সমৃদ্ধ বাগান দেখে কাফেরদের মনে হিংসা, বিদ্বেষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যাতে আল্লাহ তায়ালা এর দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন…’ এখানে অন্তর্জালা সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারা সেই কথাই বুঝানাে হয়েছে যে, এই বাগান মূলত আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় তার রসূলের হাতে আবাদ করা বাগান, আর এই বাগান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল(স.)-এর শত্রুদের মনে ক্ষোভ ও যন্ত্রণা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাে। এই দৃষ্টান্ত আকম্মিক ঘটে যাওয়া কোনাে বিষয় নয়, বরং এর অস্তিত্ব তকদিরের পাতায়ই রয়ে গেছে। এরপরও রসূলুল্লাহ(স.) ও তাঁর সাহাবাদের আগমনের অনেক আগেই পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি নাযিল করা কিতাব এর উল্লেখ এসেছে। ইঞ্জিলে রাসূল(স.)-এর আগমনের সুসংবাদ প্রদানের পাশাপাশি তার সাহাবাদের গুণাবলীও উল্লেখ করা হয়েছে। তেমনিভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা তার অমর গ্রন্থ আল কোরআনে রসূল(স.)-এর পুন্যাত্মা সাহাবাদের মনােনীত দলটির গুণাবলীর উল্লেখ করে তাদের স্মৃতিকে অমর ও অক্ষয় করে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এর ফলে তাদের স্মৃতি গােটা সৃষ্টিজগতে অক্ষয় হয়ে থাকবে এবং যতােদিন আল্লাহ তায়ালার এই অমরবাণী পাঠ করা হবে ততােদিন কুলমাখলুক এই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে এবং তা স্মরণ রাখবে। শুধু তাই নয়, বরং ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য এই স্মৃতি একটা আদর্শ হয়ে টিকে থাকবে এবং তাদের মাঝেও অনুরূপ গুণাবলী সৃষ্টির প্রেরণা যােগাবে, ফলে তাদের মাঝে ঈমানের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। সাহাবায়ে কেরামের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে, তার চেয়েও বড় আর একটি সম্মান তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। আর সেটা হলাে, ক্ষমা ও মহা প্রতিদান। যদিও আয়াতে এই ক্ষমা ও প্রতিদানের ওয়াদা ঈমান ও সৎকাজের গুণে গুণান্বিত সকলের জন্য করা হয়েছে, তারপরও সাহাবায়ে কেরামরাই সর্বপ্রথম এই ওয়াদার ফল ভােগ করবেন। কারণ, ঈমান ও সৎকাজের গুণ তাদের মাঝে ছিলাে পূর্ণাংগরূপে। ক্ষমা ও মহা প্রতিদান নিজেই একটা বড় সম্মানের বিষয়। তেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিও একটা বড় সম্মানের বিষয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার দান তাে অসীম, তার অনুগ্রহ তাে অসীম। দীর্ঘ চৌদ্দশত বছর পর আমি আবার সেই সৌভাগ্যবান দলটির চেহারা ও তাদের মনের অবস্থাটা অনুভব করতে চেষ্টা করছি। আল্লাহর রহম, সন্তুষ্টি, সম্মান ও মহান ওয়াদার ধারা একের পর এক যখন তাদেরকে প্লাবিত করছিলাে, তখন তাদের অবস্থাটা কী ছিলাে, সেটাই আমি অনুভব করার চেষ্টা করছি। যখন আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে, আল্লাহ তায়ালার মাপকাঠিতে এবং আল্লাহ তায়ালার কিতাবে নিজেদের মান মর্যাদার কথা তারা জানতে পারছিলাে, শুনতে পাচ্ছিলাে তখন তাদের মনের অবস্থা কি দাঁড়িয়েছিলাে, সেটাই আমি এই চৌদ্দশত বছর পরে অনুভব করতে চেষ্টা করছি। আমি আমার কল্পনার দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, তারা হুদায়বিয়া থেকে ফিরছে, আর তখনই তাদের সামনে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হলাে, সাথে সাথে তাদেরকে তা পড়ে শুনানাে হলাে, তার মাঝে তারা নিজেদের মন, আত্মা, আবেগ ও অনুভূতি এবং বৈশিষ্ট ও স্বকীয়তার পূর্ণ ছাপ দেখতে পাচ্ছে। এরপর তারা একজন আর একজনের চেহারার দিকে তাকাচ্ছে এবং যে নেয়ামতের প্রভাব মনের মাঝে অনুভব করছে সেটাকে নিজের গােটা অস্তিত্বের মাঝেই দেখতে পাচ্ছে। সাহাবায়ে কেরাম উর্ধজগতের যে মহা উৎসবের মাঝে বিচরণ করেছিলেন সেই আনন্দঘন ও পবিত্র মুহূর্তগুলাে আমি এখানে বসে অনুভব করতে চেষ্টা করছি। কিন্তু সশরীরে যে মানুষটি সেই উৎসবে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেনি, তার পক্ষে সেই অপার্থিব আনন্দ অনুভব করা কি করে সম্ভব? তাই দূরে বসে শুধু কল্পনাই করা। তবে আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন এবং সাহাবায়ে কেরামের গুণে গুণান্বিত করেন তাদের জন্য এই দূরত্ব ও ব্যবধান অপসারিত করে দেন। তাই মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে কায়মনো বাক্যে ফরিয়াদ জানাচ্ছি, হে মাবুদ! তুমি জানো, আমি গােনাহগার, আমি তােমার এই পাথেয়র দিকেই তাকিয়ে আছি!
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# খায়বার বিজয়ের পর মুসলমানরা ক্রমাগত আর যেসব বিজয় লাভ করে এর দ্বারা সেসব বিজয়কে বুঝানো হয়েছে।
# এর অর্থ হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি। এ চুক্তিকেই সূরার প্রারম্ভে ফাতহুম মুবীন’ (সুস্পষ্ট বিজয়) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
# তিনি কাফের কুরাইশদের এতটা সাহস দেননি যে, হুদাইবিয়াতে তারা তোমাদের সাথে লড়াই বাধিয়ে বসতে পারতো। অথচ সমস্ত বাহ্যিক অবস্থার দিক থেকে তারা অনেক ভাল অবস্থানে ছিল এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তোমাদের পাল্লা তাদের চেয়ে অনেক বেশী দুর্বল বলে মনে হচ্ছিলো। এছাড়াও এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে, সে সময় কোন শত্রুশক্তি মদীনার ওপর আক্রমণ করতে সাহস পায়নি। অথচ যুদ্ধক্ষম চৌদ্দ শ’ যোদ্ধা পুরুষ মদীনার বাইরে চলে যাওয়ার কারণে মদীনার যুদ্ধক্ষেত্র অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলো এবং ইহুদী ও মুশরিক ও মুনাফিকরা এ পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে লাভবান হতে পারতো।
# যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের নীতিতে স্থির সংকল্প থাকে এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা করে ন্যায় ও সত্যের পক্ষ অবলম্বনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। আল্লাহ তাদের কতভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দান করেন পুরস্কৃত করেন তার নিদর্শন।
# তোমরা আরো দূরদৃষ্টি ও দৃঢ় বিশ্বাস অর্জন করবে। ভবিষ্যতেও এভাবেই আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে ন্যায় ও সত্যের পথে অগ্রসর হতে থাকবে। আর এসব অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাদান করবে যে, আল্লাহর দ্বীন যে পদক্ষেপের দাবী করছে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করাই মু’মিনের কাজ। আমার শক্তি কতটা এবং বাতিলের শক্তি কত প্রবল এ বাছ বিচার ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে যেন সে পড়ে না থাকে।
# খুব সম্ভবত এখানে মক্কা বিজয়ের প্রতি ইঙ্গিত দান করা হয়েছে। কাতাদাও এ মত পোষণ করেছেন এবং ইবনে জারীরও এটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহর একথাটার উদ্দেশ্য যা বুঝা যায় তা হচ্ছে, মক্কা এখনো তোমাদের করায়ত্ত হয়নি। তবে তাকে আল্লাহ পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন এবং হুদাইবিয়ার এ বিজয়ের ফলশ্রুতিতে তাও তোমাদের করায়ত্ত হবে।
# হুদাইবিয়াতে যুদ্ধ হলে তোমাদের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আল্লাহ এ জন্য সেখানে যুদ্ধ সংঘটিত হতে দেননি তা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন কিছু যা পরবর্তী আয়াতসমূহে বর্ণনা করা হচ্ছে। সে উদ্দেশ্য ও কৌশল যদি বাধা না হতো এবং আল্লাহর তা’আলা এখানে যুদ্ধ সংঘটিত হতে দিতেন তাহলে নিশ্চিতভাবে কাফেররাই পরাজয় বরণ করতো এবং পবিত্র মক্কা তখন বিজিত হতো।
# এখানে আল্লাহর বিধান বলতে বুঝানো হয়েছে, যেসব কাফের আল্লাহর রসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন এবং তাঁর রসূলকে সাহায্য করেন।
# ইসলামের জন্য যে আন্তরিকতা নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে তোমরা জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলে এবং বিনা বাক্যে যেভাবে রসূলের আনুগত্য করেছিলে আল্লাহ তা দেখেছিলেন। তিনি এও দেখেছিলেন যে, কাফেররা সত্যিই বাড়াবাড়ি করছে। তোমাদের হাতে তৎক্ষণাৎ সেখানেই তাদেরকে শাস্তি দেয়া ছিল পরিস্থিতির দাবী। কিন্তু এসব সত্ত্বেও একটি বৃহত্তর কল্যাণের জন্য তিনি তোমাদের হাতে তাদের ওপর এবং তাদের হাত তোমাদের ওপর উত্তোলিত হওয়া থেকে বিরত রেখেছিলেন।
টিকা:৪৪) আল্লাহ তা’আলা যে উদ্দেশ্য ও কৌশলের কারণে হুদাইবিয়াতে যুদ্ধ হতে দেননি এটাই সে উদ্দেশ্য ও কৌশল। এ উদ্দেশ্য ও কৌশলের দু’টি দিক আছে। একটি হচ্ছে সে সময় মক্কায় এমন অনেক নারী ও পুরুষ বর্তমান ছিলেন। যারা হয় তাদের ঈমান গোপন রেখেছিলেন নয়তো তাদের ঈমান গ্রহণ সম্পর্কে সবার জানা থাকলেও নিজেদের অসহায়ত্বের কারণে হিজরত করতে সক্ষম ছিলেন না এবং জুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলো। যদি এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধ সংঘটিত হতো এবং মুসলমানরা কাফেরদেরকে চরমভাবে পর্যুদস্ত করে পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করতো তাহলে অজানা ও অচেনা হওয়ার কারণে কাফেরদের সাথে এ মুসলমানরাও নিহত হতো। এ কারণে মুসলমারা নিজেরও দুঃখ ও পরিতাপে দগ্ধ হতো এবং আরবের মুশরিকরাও একথা বলার সুযোগ পেয়ে যেতো যে, যুদ্ধের ময়দানে নিজেদের দ্বীনি ভাইয়ের হত্যা করতেও এসব লোক দ্বিধাবোধ করেনা। তাই আল্লাহ তা’আলা অসহায় এ মুসলমানদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে এবং সাহাবীদেরকে মনোকষ্ট ও বদনাম থেকে রক্ষার জন্য এক্ষেত্রে যুদ্ধ সংঘটিত হতে দেননি। এ উদ্দেশ্য ও কৌশলের আরেকটি দিক এই যে, আল্লাহ তা’আলা কুরাইশদেরকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত করে মক্কা বিজিত করাতে চাচ্ছিলেন না। বরং তিনি চাচ্ছিলেন, দুই বছরের মধ্যে তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে এমন অসহায় করে ফেলবেন যেন কোন প্রতিরোধ ছাড়াই তারা পরাজিত হয় এবং সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে আল্লাহর রহমের মধ্যে প্রবেশ করে। মক্কা বিজয়ের সময় এ ঘটনাটিই ঘটেছিল।
এক্ষেত্রে একটি আইনগত বিতর্ক দেখা দেয়। যদি আমাদের এ কাফেরদের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে এবং কাফেরদের কব্জায় কিছু সংখ্যক মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ থাকে আর তাদেরকে তারা মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সামনে নিয়ে আসে কিংবা আমরা কাফেরদের যে শহরের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছি সেখানে কিছু মুসলিম বসতি থেকে থাকে, কিংবা কাফেরদের যুদ্ধ জাহাজ আক্রমণের পাল্লায় এসে পড়ে এবং কাফেররা তার মধ্যে কিছু সংখ্যক মুসলমানকে রেখে দেয় তাহলে এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা কি তাদের ওপর গোলাবর্ষণ করতে পারি? এ প্রশ্নের জবাবে ফকীহগণ যেসব সিদ্ধান্ত ও মতামত দিয়েছেন তা নিম্নরূপঃ
ইমাম মালেক (র) বলেন, এরূপ পরিস্থিতিতে গোলাবর্ষণ না করা উচিত। এ আয়াতটিকে তিনি এর দলীল হিসেবে পেশ করেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের রক্ষার জন্যই তা হুদাইবিয়াতে যুদ্ধ হতে দেননি। (আহকামুল কুরআন-ইবনুল আরাবী)। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা একটা দুর্বল দলীল। আয়াতের মধ্যে এমন কোন শব্দ নেই যা থেকে এ বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, এরূপ পরিস্থিতিতে হামলা করা হারাম ও না জায়েয। এর দ্বারা বড় জোর এতটুকু কথা প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য হামলা করা থেকে বিরত থাকা যেতে পারে, যদি বিরত থাকার ক্ষেত্রে এআশঙ্কা সৃষ্টি না হয় যে, কাফেররা মুসলামানদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করবে, কিংবা তাদের বিরুদ্ধে আমাদের বিজয় লাভ করার সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
ইমাম আবু হানীফা (রা.), ইমাম আবু ইউসূফ (র), ইমাম যুফার (র) এবং ইমাম মুহাম্মাদ (র) বলেন, এ পরিস্থিতিতে গোলাবর্ষণ করা সম্পূর্ণরূপে জায়েয। এমনকি কাফেররা যদি মুসলমানদের শিশুদেরকেও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সামনে খাড়া করে তবুও তাদের ওপর গোলা বর্ষণ করায় কোন দোষ নেই। এ অবস্থায় যেসব মুসলমান মারা যাবে তাদের জন্য কাফ্ফারা বা রক্তপণও মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব হবে না। (আহকামুল কুরআন-জাসসাস, ইমাম মুহাম্মাদের কিতাবুস সিয়ার, অনুচ্ছেদঃ কাতউল মায়ে আন আহলিল হারব)।
ইমাম আওযায়ী এবং লাইস ইবনে সা’দ বলেন, কাফেররা যদি মুসলমানদের ঢাল বানিয়ে সামনে ধরে তাহলে তাদের ওপর গুলি চালানো উচিত নয়। অনুরূপ আমরা যদি জানতে পারি যে, তাদের যুদ্ধ জাহাজে আমাদের বন্দীও আছে তাহলে সে অবস্থায় উক্ত যুদ্ধ জাহাজ না ডুবানো উচিত। কিন্তু আমরা যদি তাদের কোন শহরের ওপর আক্রমণ চালাই এবং জানতে পারি যে, ঐ শহরে মুসলমানও আছে তাহলেও তাদের ওপর গোলাবর্ষণ করা জায়েয। কারণ, আমাদের গোলা কেবল মুসলমানদের ওপরই পড়বে তা নিশ্চিত নয়। আর কোন মুসলমান যদি এ গোলাবর্ষনের শিকার হয়ও তাহলে তা আমাদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের উদ্দেশ্যমূলক হত্যা হবে না, বরং তা হবে আমাদের ইচ্ছা বাইরের একটা দুর্ঘটনা। (আহকামুল কুরআন-জাসসাস)।
এ ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ীর (র) মাযহাব হলো, এ অবস্থায় যদি গোলাবর্ষণ অনিবার্য না হয় তাহলে ধ্বংসের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার চেষ্টা চালানো উত্তম যদিও এক্ষেত্রে গোলাবর্ষণ করা হারাম নয় তবে নিঃসন্দেহে মাকরূহ। তবে প্রকৃতই যদি গোলাবর্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং সন্দেহ থাকে যে, এরূপ না করা হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি কাফেরদের জন্য লাভজনক এবং মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর হবে তাহলে সে ক্ষেত্রে গোলাবর্ষণ করা জায়েয। তবে এ পরিস্থিতিতে ও মুসলমানদের রক্ষা করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাছাড়া ইমাম শাফেয়ী এ মতও পোষণ করেন যে, যদি কাফেররা যুদ্ধের ময়দানে কোন মুসলমানকে ঢাল বানিয়ে ধরে এবং কোন মুসলমান তাকে হত্যা করে তাহলে তার দু’টি অবস্থা হতে পারেঃ এক, হত্যাকারীর জানা ছিল যে, সে মুসলমান। দুই, সে জানতো না যে, সে মুসলমান। প্রথম অবস্থায় রক্তপণ ও কাফ্ফারা উভয়টিই তার ওপর ওয়াজিব এবং দ্বিতীয় অবস্থায় শুধু কাফ্ফারা ওয়াজিব। (মুগনিউ মুহতাজ)।
# জাহেলী সংকীর্ণতা অর্থ হলো, এক ব্যক্তির শুধু তার মর্যাদা রক্ষার জন্য কিংবা নিজের কথার মর্যাদা রক্ষার জন্য জেনে শুনে কোন অবৈধ কাজ করা। মক্কার কাফেররা জানতো এবং মানতো যে, হজ্জ ও উমরার জন্য বায়তুল্লাহর যিয়ারত করার অধিকার সবারই আছে। এ ধর্মীয় কর্তব্য পালনে বাধা দেয়ার অধিকার করো নেই। এটা ছিল আরবের সুপ্রাচীন ও সর্বজন স্বীকৃত আইন। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদেরকে অন্যায় ও অসত্যের অনুসারী এবং মুসলমানদেরকে সম্পূর্ণ ন্যায় ও সত্যের অনুসারী বলে জানা সত্ত্বেও শুধু নিজেদের মর্যাদা রক্ষার খাতিরে মুসলমানদের উমরা করতে বাধা দান করে। এমনকি মুশরিকদের মধ্যেও যারা সত্যানুসারী ছিল তারাও বলেছিলো যে, যারা ইহরাম অবস্থায় কুরবানীর উট সাথে নিয়ে উমরা পালন করতে এসেছে তাদেরকে বাধা দেয়া একটি অন্যায় কাজ। কিন্তু কুরাইশ নেতারা শুধু একথা ভেবে বাধা দিতে বদ্ধপরিকর ছিল যে, মুহাম্মাদ ﷺ যদি এত বড় দলবল নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন তাহলে সমগ্র আরবে আমাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। এটাই ছিল তাদের জাহেলী সংকির্ণতা।
# এখানে سَّكِينَةَ অর্থ ধৈর্য ও মর্যাদা যা দিয়ে নবী ﷺ এবং মুসলমানগন কাফের কুরাইশদের এ জাহেলী সংকীর্ণতার মোকাবিলা করেছিলেন। তাঁরা তাদের এ হঠকারিতা ও বাড়াবাড়িতে উত্তেজিত হয়ে সংযম হারিয়ে ফেলেছিলেন না এবং তাদের মোকাবিলায় এমন কোন কথাও তারা বলেননি যা ন্যায়ের সীমা ছাড়িয়ে যায় ও সত্যের পরিপন্থী হয় কিংবা যার কারণে কাজ সুন্দর ও সার্থকভাবে সম্পাদিত হওয়ার পরিবর্তে আরো বেশী এলোমেলো ও বিশৃংখল হয়ে যায়।
# যে প্রশ্নটি মুসলমানদের মনে বারবার খটকা সৃষ্টি করেছিলো এটি তারই জবাব। তারা বলতো, রসূলুল্লাহ ﷺ তো স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি মসজিদে হারামে প্রবেশ করেছেন এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেছেন। কিন্তু কি হলো, যে, আমরা উমরা আদায় করা ছাড়াই ফিরে যাচ্ছি। এর জবাবে রসূলুল্লাহ ﷺ যদিও বলেছিলেন যে, স্বপ্নে তো এ বছরই উমরা আদায় করার কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু না কিছু উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা মুসলমানদের মনের মধ্যে দেখিয়েছিলাম আর তা ছিল পুরোপুরি সত্য এবং নিশ্চিতভাবেই তা পূরণ হবে।
# এখানে আল্লাহ তা’আলা নিজে তাঁর প্রতিশ্রুতির সাথে ইনশাআল্লাহ কথাটি ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে যে, আল্লাহ নিজেই যখন এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তখন তাকে আল্লাহর চাওয়ার সাথে শর্তযুক্ত করার অর্থ কি? এর জবাব হচ্ছে, এখানে যে কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে তার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ যদি না চান তাহলে তিনি এ প্রতিশ্রুতি পালন করবেন না। বরং যে প্রক্ষিতে এ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে এর সম্পর্ক তার সাথে। মক্কার কাফেররা যে ধারণার বশবর্তী হয়ে মুসলমানদেরকে উমরা থেকে বিরত রাখার জন্য এ খেলা খেলছিলো তা হচ্ছে আমরা যাকে উমরা করতে দিতে চাইবো সে-ই কেবল উমরা করতে পারবে এবং যখন করতে দিব তখনই মাত্র করতে পারবে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেছেন, এটা তাদের ইচ্ছার ওপর নয়, বরং আমার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এ বছর উমরা হতে না পারার কারণ এটা নয় যে, মক্কার কাফেররা তাই চেয়েছিলো। বরং তা হয়েছে এ জন্য যে, আমি তা হতে দিতে চাইনি। আমি যদি চাই তাহলে ভবিষ্যতে এ উমরা হবে, কাফেররা তা হতে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করুক না করুক। সাথে সাথে একথার মধ্যে এ অর্থও প্রচ্ছন্ন আছে যে, মুসলমানরা যে উমরা করবে তাও নিজের ক্ষমতায় করবে না। আমি যেহেতু চাইবো যে তারা উমরা করুক তাই তারা উমরা করবে আমার ইচ্ছা যদি এর পরিপন্থী হয় তাহলে নিজেরাই উমরা আদায় করে ফেলবে এতটা শক্তি-সমর্থ তাদের মধ্যে নেই।
# পরের বছর ৭ম হিজরীর যুল-কা’দা মাসে এ প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়। ইতিহাসে এ উমরা উমরাতুল কাযা নামে খ্যাত।
# একথা থেকে প্রমাণিত হয় উমরা ও হজ্জ আদায়ের সময় মাথা মুণ্ডন আবশ্যিক নয়, বরং চুল ছেঁটে নেয়াও জায়েয। তবে মাথা মুণ্ডন উত্তম। কারণ, আল্লাহ তা’আলা তা প্রথমে বর্ণনা করেছেন এবং চুল ছাঁটার কথা পরে উল্লেখ করেছেন।
# এখানে একথা বলার কারণ হলো যখন হুদাইবিয়াতে সন্ধিচুক্তি লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিলো সে সময় মক্কার কাফেররা নবীর ﷺ সম্মানিত নামের সাথে রসূলুল্লাহ কথাটি লিখতে আপত্তি জানিয়েছিলো, তাদের একগুঁয়েমির কারণে নবী (সা.) নিজে চুক্তিপত্র থেকে একথাটি মুছে ফেলেছিলেন। তাই আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, আমার রসূলের রসূল হওয়া একটি অনিবার্য সত্য, কারোর মানা বা না মানাতে তাতে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না। কিছু লোক যদি তা না মানে না মানুক। তা সত্য হওয়ার জন্য আমার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। তাদের অস্বীকৃতির কারণে এ সত্য পরিবর্তিত হয়ে যাবে না। তাদের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও এ রসূল আমার পক্ষ থেকে যে হিদায়াত ও দ্বীন নিয়ে এসেছেন তা অন্য সব দ্বীনের ওপর বিজয় লাভ করবে। তা ঠেকিয়ে রাখার জন্য এসব অস্বীকারকারীরা যত চেষ্টাই করুক না কেন।
‘সব দ্বীন’ বলতে বুঝানো হয়েছে সেসব ব্যবস্থাকে যা দ্বীন হিসেবে গণ্য। আমরা পূর্বেই তাফহীমুল কুরআন সূরা যুমারের ব্যাখ্যায় :-
# এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এ আয়াতটি পড়ার সময় অমনোযোগী হওয়া উচিত নয়। বরং এর অর্থ ও প্রতিপাদ্য বিষয়টি ভালভাবে বুঝার চেষ্টা করা উচিত। এর মৌলিক বিষয় দু’টি। এ দু’টি বিষয় বুঝে নেয়া ছাড়া আয়াতটির অর্থ অনুধাবন সম্ভব নয়। একটি বিষয় হচ্ছে, এখানে আল্লাহর ইবাদাত করতে বলা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সে ইবাদাত হবে এমন যা আনুগত্যকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে করা হয়।
ইবাদাত শব্দের শব্দমূল বা ধাতু হচ্ছে عبد । এ শব্দটি আরবী ভাষায় ‘স্বাধীন’ শব্দের বিপরীত শব্দ হিসেবে ‘দাস’ বা ‘ক্রীতদাস’ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এ অর্থের দিক দিয়ে ‘ইবাদাত’ শব্দের মধ্যে দু’টি অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। একটি অর্থ হচ্ছে পূজা-অর্চনা। আরবী ভাষার বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ আছে عبد الله অর্থাৎ التنسك , والتعبد , تأله له । আরেকটি অর্থ হচ্ছে সবিনয় আনুগত্য এবং সন্তুষ্টি ও সাগ্রহ আদেশ পালন। যেমন “লিসানুল আরবে” বলা হয়েছেঃ
الطاعة – العبادة ومعنى العبادةِ في اللغة الطاعةُ مع الخُضُوعِ – وكلُّ من دانَ لملك فهو عابد له (وقومهما لنا عابدون) والعابد , الخاضع لربه المستسلم المُنْقاد لأَمره- عبدَ الطاغوتَ , أَطاعه يعني الشيطانَ فيما سَوّلَ له وأَغواه- إِياك نعبد, أَي نُطِيعُ الطاعةَ التي يُخْضَعُ معها- اعبدوا ربكم , أَطيعوا ربكم-
সুতরাং অভিধানের এসব নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা অনুসারে আল্লাহর ইবাদাত করা অর্থ শুধু তাঁর পূজা-অর্চনার দাবী করাই নয়, বরং বিনা বাক্যে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন, তাঁর শরয়ী আইন-কানুন সন্তুষ্ট চিত্তে সাগ্রহে মেনে চলা এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মনে প্রাণে অনুসরণ করার দাবীও বুঝায়। আরবী ভাষায় دين (দ্বীন) শব্দ কতিপয় অর্থ ধারণ করেঃ
একটি অর্থ হচ্ছে, আধিপত্য ও ক্ষমতা, মালিকানা ও প্রভুত্বমূলক মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও সার্বভৌম ক্ষমতা এবং অন্যদের ওপর সিদ্ধান্ত কার্যকারী করা। তাই “লিসানুল আরবে” আছেঃ
دان الناسَ أَي قَهَرَهم على الطاعة- دِنْتُهم أَي قَهرْتهم- دِنْتُه ¸ سُسْته و مَلَكْتُه- وفي الحديث : الكيِّس من دانَ نَفْسَه , أَي أَذلها واستعبدها- الديان , القاضى , الحكم , القهار , ولا انت اى لست بقاهرلى فتسوس امرى- ما كان ليأخذ اخاه فى دين الملك , اى فى تضاء الملك-
দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আনুগত্য, আদেশ পালন ও দাসত্ব। লিসানুল আরব অভিধানে আছেঃ
الدين , الطاعة – دنته ودنت له , اى اطعته – والدين الله , انما هو طاعته والتعبد له – فى الحديث اريد من قريش كلمة تدين لهم بها العرب , اى تطيعهم وتخضع لهم – ثم دانت بعد الرباب , اى ذلت له واطاعته – يمرقون من الدين , اى انهم يخرجون من طاعة الامام المفترض الطاعة , المدين , العبد – فلولا ان كنتم غير مدينين , اى غير مملوكين – الدين , العادة والشأن – يقال ما زال ذلك دينى وديدنى , اى عادتى الدين , الطاعة – دنته ودنت له , اى اطعته – والدين الله , انما هو طاعته والتعبد له – فى الحديث اريد من قريش كلمة تدين لهم بها العرب , اى تطيعهم وتخضع لهم – ثم دانت بعد الرباب , اى ذلت له واطاعته – يمرقون من الدين , اى انهم يخرجون من طاعة الامام المفترض الطاعة , المدين , العبد – فلولا ان كنتم غير مدينين , اى غير مملوكين –
তৃতীয় অর্থ হচ্ছে অভ্যাস ও পন্থা-পদ্ধতি—- মানুষ যা অনুসরণ করে। লিসানুল আরবে আছে, الدين , العادة والشأن – يقال ما زال ذلك دينى وديدنى , اى عادتى এ তিনটি অর্থের প্রতি খেয়াল এ আয়াতে ‘দ্বীন’ শব্দটি এমন কর্মপদ্ধতি ও আচরণকে বুঝায় যা মানুষ কারো শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার এবং কারো আনুগত্য গ্রহণ করার মাধ্যমে অবলম্বন করে। আর “দ্বীন”কে শুধু আল্লাহর জন্য নিবেদিত করে তাঁর দাসত্ব করার অর্থ হলো “আল্লাহর দাসত্বের সাথে মানুষ আর কাউকে শামিল করবে না বরং শুধু তাঁরই পূজা করবে, তাঁরই অনুসরণ এবং তাঁরই হুকুম আহকাম ও আদেশ পালন করবে।”
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
আয়াত নং ২৮ এর তাপসীর:-
# সব দ্বীন’ বলতে বুঝানো হয়েছে সেসব ব্যবস্থাকে যা দ্বীন হিসেবে গণ্য। আমরা পূর্বেই তাফহীমুল কুরআন সূরা যুমারের ব্যাখ্যায় ৩ টীকায় এবং সূরা শূরার ২০ টীকায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে আল্লাহ তা’আলা যে কথাটি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন তা হচ্ছে শুধু এ দ্বীনের প্রচার করাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল একে দ্বীন হিসেবে গণ্য সমস্ত জীবনাদর্শের ওপর বিজয়ী করে দেয়া। অন্য কথায় জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগের ওপর কোন বাতিল জীবনাদর্শ বিজয়ী হয়ে থাকবে আর বিজয়ী সে জীবনাদর্শ তার আধিপত্যাধীনে এ দ্বীনকে বেঁচে থাকার যতটুকু অধিকার দেবে এ দ্বীন সে চৌহদ্দির মধ্যেই হাত পা শুটিয়ে বসে থাকবে এ উদ্দেশ্যে নবী (সা.) এ দ্বীন নিয়ে আসেননি। বরং তিনি এ জন্য তা এনেছেন যে, এটাই হবে বিজয়ী জীবনাদর্শ। অন্য কোন জীবনাদর্শ বেঁচে থাকলেও এ জীবনাদর্শ যে সীমার মধ্যে তাকে বেঁচে থাকার অনুমতি দেবে সে সীমার মধ্যেই তা বেঁচে থাকবে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা যুমারের তাফসীর, টীকা ৪৮ )
(সুরা শুয়ারা)
(টিকা:২০) প্রথম আয়াতে যে কথাটি বলা হয়েছিলো এখানে সেই কথাটিই আরো বেশী পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ﷺ কোন নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নন। নবী-রসূলদের মধ্যে কেউই কোন নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। প্রথম থেকেই সমস্ত নবী-রসূল আল্লাহর পক্ষ থেকে একই দ্বীন পেশ করে আসছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সেই একই দ্বীন পেশ করছেন। এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম হযরত নূহের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপ্লাবনের পর তিনিই ছিলেন বর্তমান মানব গোষ্ঠীর সর্বপ্রথম পয়গস্বর। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি শেষ নবী। তারপর হযরত ইবরাহীমের (আ) নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আরবের লোকেরা যাঁকে তাদের নেতা বলে মানতো। সর্বশেষে হযরত মুসা এবং ঈসার কথা বলা হয়েছে যাঁদের সাথে ইহুদী ও খৃস্টানরা তাদের ধর্মকে সম্পর্কিত করে থাকে। এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, শুধু এই পাঁচজন নবীকেই উক্ত দ্বীনের হিদায়াত দান করা হয়েছিলো। বরং একথা বলে দেয়াই এর উদ্দেশ্য যে, পৃথিবীতে যত নবী-রসূলই আগমন করেছেন তাঁরা সবাই একই দ্বীন নিয়ে এসেছেন। নমুনা হিসেবে এমন পাঁচজন মহান নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাঁদের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ সুবিখ্যাত আসমানী শরীয়তসমূহ লাভ করেছে।
যেহেতু এ আয়াতটি দ্বীন ও দ্বীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোকপাত করেছে। তাই সে বিষয়ে ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাকে বুঝে নেয়া আবশ্যকঃ বলা হয়েছে شَرَعَ لَكُمْ “তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন।” شَرَعَ শব্দের আভিধানিক অর্থ রাস্তা তৈরী করা এবং এর পারিভাষিক অর্থ পদ্ধতি, বিধি ও নিয়ম-কানুন রচনা করা। এই পারিভাষিক অর্থ অনুসারে আরবী ভাষায় تشريع শব্দটি আইন প্রণয়ন (Legislation) شرع এবং شريعة শব্দটি আইন (Law ) এবং شارع শব্দটি আইন প্রণেতার (Law giver) সমার্থক বলে মনে করা হয়। আল্লাহই বিশ্ব-জাহানের সব কিছুর মালিক, তিনিই মানুষের প্রকৃত অভিভাবক এবং মানুষের মধ্যে যে বিষয়েই মতভেদ হোক না কেন তার ফায়সালা করা তাঁরই কাজ। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের যেসব মৌলিক সত্য বর্ণিত হয়েছে তারই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে আল্লাহর এই আইন রচনা। এখন মৌলিকভাবে যেহেতু আল্লাহই মালিক, অভিভাবক ও শাসক, তাই মানুষের জন্য আইন ও বিধি রচনার এবং মানুষকে এই আইন ও বিধি দেয়ার অনিবার্য অধিকার তাঁরই। আর এভাবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে বলা হয়েছে مِنَ الدِّينِ ‘দ্বীন’ থেকে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী এর অনুবাদ করেছেন আইন থেকে। অর্থাৎ আল্লাহ শরীয়ত নির্ধারণ করেছেন আইনের পর্যায়ভুক্ত। আমরা ইতিপূর্বে সূরা যুমারে ৩নং টীকায় دِّينِ শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছি তা যদি সামনে থাকে তাহলে একথা বুঝতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, দ্বীন অর্থই কারো নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তার আদেশ-নিষেধের আনুগত্য করা। এ শব্দটি যখন পন্থা বা পদ্ধতি অর্থে ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ হয় এমন পদ্ধতি যাকে ব্যক্তি অবশ্য অনুসরণীয় পদ্ধতি এবং তার যার নির্ধারণকারীকে অবশ্য অনুসরণযোগ্য বলে মেনে চলে। এ কারণে আল্লাহর নির্ধারিত এই পদ্ধতিকে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আইন বলার পরিষ্কার অর্থ হলো এটা শুধু সুপারিশ (Recomendation) ও ওয়াজ-নসীহতের মর্যাদা সম্পন্ন নয়। বরং তা বান্দার জন্য তার মালিকের অবশ্য অনুসরণীয় আইন, যার অনুসরণ না করার অর্থ বিদ্রোহ করা। যে ব্যক্তি তা অনুসরণ করে না সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আধিপত্য, সার্বভৌমত্ব এবং দাসত্ব অস্বীকার করে।
এরপরে বলা হয়েছে, দ্বীনের বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত এ আইনই সেই আইন যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো নূহ, ইবরাহীম ও মূসা আলাইহিমুস সালামকে এবং এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সে নির্দেশই দান করা হয়েছে। এ বাণী থেকে কয়েকটি বিষয় প্রতিভাত হয়। এক-আল্লাহ এ বিধানকে সরাসরি সব মানুষের কাছে পাঠাননি, বরং মাঝে মধ্যে যখনই তিনি প্রয়োজন মনে করেছেন এক ব্যক্তিকে তাঁর রসূল মনোনীত করে এ বিধান তার কাছে সোপর্দ করেছেন। দুই-প্রথম থেকেই এ বিধান এক ও অভিন্ন। এমন নয় যে, কোন জাতির জন্য কোন একটি দ্বীন নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং অন্য সময় অপর এক জাতির জন্য তা থেকে ভিন্ন ও বিপরীত কোন দ্বীন পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে একাধিক দ্বীন আসেনি। বরং যখনই এসেছে এই একটি মাত্র দ্বীনই এসেছে। তিন-আল্লাহর আধিপত্য ও সার্বভৌমত্ব মানার সাথে সাথে যাদের মাধ্যমে এ বিধান পাঠানো হয়েছে তাদের রিসালাত মানা এবং যে অহীর দ্বারা এ বিধান বর্ণনা করা হয়েছে তা মেনে নেয়া এ দ্বীনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তির দাবীও তাই। কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত তা আল্লাহর তরফ থেকে বিশ্বাসযোগ্য (Authentic) হওয়া সম্পর্কে ব্যক্তি নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ সে এই আনুগত্য করতেই পারে না।
অতঃপর বলা হয়েছে, এসব নবী-রসূলদেরকে দ্বীনর বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত এই বিধান দেয়ার সাথে তাগিদসহ এ নির্দেশও দেয়া হয়েছিলো যে, أَقِيمُوا الدِّينَ শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী এ আয়াতাংশের অনুবাদ করেছেন, “দ্বীনকে কায়েম করো” আর শাহ রফিউদ্দিন ও শাহ আবদুল কাদের অনুবাদ করেছেন, “দ্বীনকে কায়েম রাখো” এই দু’টি অনুবাদই সঠিক। اقامت শব্দের অর্থ কায়েম করা ও কায়েম রাখা উভয়ই। নবী-রসূলগণ আলাইহিমুস সালাম এ দু’টি কাজ করতেই আদিষ্ট ছিলেন। তাঁদের প্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল, যেখানে এই দ্বীন কায়েম নেই সেখানে তা কায়েম করা। আর দ্বিতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল যেখানে তা কায়েম হবে কিংবা পূর্ব থেকেই কায়েম আছে সেখানে তা কায়েম রাখা। একথা সুস্পষ্ট যে কোন জিনিসকে কায়েম রাখার প্রশ্ন তখনই আসে যখন তা কায়েম থাকে। অন্যথায় প্রথমে তা কায়েম করতে হবে, তারপর তা যাতে কায়েম থাকে সেজন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
এই পর্যায়ে আমাদের সামনে দু’টি প্রশ্ন দেখা দেয়। একটি হলো, দ্বীন কায়েম করার অর্থ কি? অপরটি হলো, দ্বীন অর্থই বা কি যা কায়েম করার এবং কায়েম রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে? এ দু’টি বিষয়ও ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার।
কায়েম করা কথাটি যখন কোন বস্তুগত বা দেহধারী জিনিসের জন্য ব্যবহৃত হয় তখন তার অর্থ হয় উপবিষ্টকে উঠানো। যেমন কোন মানুষ বা জন্তুকে উঠানো। কিংবা পড়ে থাকা জিনিসকে উঠিয়ে দাঁড় করানো। যেমন বাঁশ বা কোন থাম তুলে দাঁড় করানো অথবা কোন জিনিসের বিক্ষিপ্ত অংশগুলোকে একত্র করে সমুন্নত করা। যেমনঃ কোন খালি জায়গায় বিল্ডিং নির্মাণ করা। কিন্তু যা বস্তুগত জিনিস নয়, অবস্তুগত জিনিস তার জন্য যখন কায়েম করা শব্দটা ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ শুধু সেই জিনিসের প্রচার করাই নয়, বরং তা যথাযথভাবে কার্যে পরিণত করা, তার প্রচলন ঘটানো এবং কার্যত চালু করা। উদাহরণস্বরূপ যখন আমরা বলি, অমুক ব্যক্তি তার রাজত্ব কায়েম করেছে তখন তার অর্থ এ হয় না যে, সে তার রাজত্বের দিকে আহবান জানিয়েছে। বরং তার অর্থ হয়, সে দেশের লোকদেরকে নিজের অনুগত করে নিয়েছে এবং সরকারের সকল বিভাগে এমন সংগঠন ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করেছে যে, দেশের সমস্ত ব্যবস্থাপনা তার নির্দেশ অনুসারে চলতে শুরু করেছে। অনুরূপ যখন আমরা বলি, দেশে আদালত কায়েম আছে তখন তার অর্থ হয় ইনসাফ করার জন্য বিচারক নিয়োজিত আছেন। তিনি মোকদ্দমাসমূহের শুনানি করছেন এবং ফায়সালা দিচ্ছেন। একথার এ অর্থ কখনো হয় না যে, ন্যায় বিচার ও ইনসাফের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা খুব ভালভাবে করা হচ্ছে এবং মানুষ তা সমর্থন করছে। অনুরূপভাবে কুরআন মজীদে যখন নির্দেশ দেয়া হয়, নামায কায়েম করো তখন তার অর্থ কুরআন মজীদের দাওয়াত ও তাবলীগ নয়, বরং তার অর্থ হয় নামাযের সমস্ত শর্তাবলী পূরণ করে শুধু নিজে আদায় করা না বরং এমন ব্যবস্থা করা যেন ঈমানদারদের মধ্যে তা নিয়মিত প্রচলিত হয়। মসজিদের ব্যবস্থা থাকে, গুরুত্বের সাথে জুমআ ও জামা’য়াত ব্যবস্থা হয়, সময়মত আযান দেয়া হয়, ইমাম ও খতিব নির্দিষ্ট থাকে এবং মানুষের মধ্যে সময়মত মসজিদে আসা ও নামায আদায় করার অভ্যাস সৃষ্টি হয়। এই ব্যাখ্যার পরে একথা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামদের যখন এই দ্বীন কায়েম করার ও রাখার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো, তার অর্থ শুধু এতটুকুই ছিল না যে, তাঁরা নিজেরাই কেবল এ দ্বীনের বিধান মেনে চলবেন এবং অন্যদের কাছে তার তাবলীগ বা প্রচার করবেন, যাতে মানুষ তার সত্যতা মেনে নেয়। বরং তার অর্থ এটাও যে মানুষ যখন তা মেনে নেবে তখন আরো অগ্রসর হয়ে তাদের মাঝে পুরো দ্বীনের প্রচলন ঘটাবেন, যাতে সে অনুসারে কাজ আরম্ভ হতে এবং চলতে থাকে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে দাওয়াত ও তাবলীগ এ কাজের অতি আবশ্যিক প্রাথমিক স্তর। এই স্তর ছাড়া দ্বিতীয় স্তর আসতেই পারে না। কিন্তু প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন এই নির্দেশের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বানানো হয়নি, দ্বীনকে কায়েম করা ও কায়েম রাখাকেই উদ্দেশ্য বানানো হয়েছে। দাওয়াত ও তাবলীগ অবশ্যই এ উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নয়। নবী-রসূলদের মিশনের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দাওয়াত ও তাবলীগ করো একথা বলা একেবারেই অবান্তর।
এখন দ্বিতীয় প্রশ্নটি দেখুন। কেউ কেউ দেখলেন, যে দ্বীন কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা সমানভাবে সমস্ত নবী-রসূলের দ্বীন। কিন্তু তাদের সবার শরীয়ত ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যেমন আল্লাহ কুরআন মজীদে বলেছেন لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا “আমি তোমাদের প্রত্যেক উম্মতের জন্য স্বতন্ত্র শরীয়ত এবং একটি পদ্ধতি নির্ধারিত করে দিয়েছি।” তাই তারা ধরে নিয়েছে যে, এ দ্বীন অর্থ নিশ্চয়ই আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান নয়, এর অর্থ শুধু তাওহীদ, আখেরাত, কিতাব ও নবুওয়াতকে মানা এবং আল্লাহর ইবাদাত করা। কিংবা বড় জোর তার মধ্যে শরীয়তের সেই সব বড় বড় নৈতিক নীতিমালাও অন্তর্ভুক্ত যা সমস্ত দ্বীনের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
কিন্তু এটি একটি অপরিপক্ব মত। শুধু বাহিক্যভাবে দ্বীনের ঐক্য ও শরীয়তসমূহের বিভিন্নতা দেখে এ মত পোষণ করা হয়েছে। এটি এমন একটি বিপজ্জনক মত যে যদি তা সংশোধন করা না হয় তাহলে তা অগ্রসর হয়ে দ্বীন ও শরীয়তের মধ্যে এমন একটি পার্থক্যের সূচনা করবে যার মধ্যে জড়িয়ে সেন্ট পল শরীয়তবিহীন দ্বীনের মতবাদ পেশ করেছিলেন এবং সাইয়েদেনা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উম্মতকে ধ্বংস ও বিপর্যস্ত করেছিলেন। কারণ, শরীয়ত যখন দ্বীন থেকে স্বতন্ত্র একটি জিনিস আর নির্দেশ দেয়া হয়েছে শুধু দ্বীন কায়েমের জন্য, শরীয়ত কায়েমের জন্য নয় তখন মুসলমানরাও খৃস্টানদের মত অবশ্যই শরীয়তকে গুরুত্বহীন ও তার প্রতিষ্ঠাকে সরাসরি উদ্দেশ্য মনে না করে উপেক্ষা করবে এবং দ্বীনের শুধু ঈমান সম্পর্কিত বিষয়গুলো ও বড় বড় নৈতিক নীতিসমূহ নিয়েই বসে থাকবে। এভাবে অনুমানের ওপর নির্ভর করে دين এর অর্থ নিরূপণ করার পরিবর্তে কেনই বা আমরা আল্লাহর কিতাব থেকেই একথা জেনে নিচ্ছি না যে, যে দ্বীন কায়েম করার নির্দেশ এখানে দান করা হয়েছে তার অর্থ কি শুধু ঈমান সম্পর্কিত বিষয়সমূহ এবং কতিপয় বড় বড় নৈতিক মূলনীতি না শরীয়তের অন্যান্য আদেশ নিষেধও? কুরআন মজীদ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি কুরআন মজীদে যেসব জিনিসকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে নিম্নোক্ত জিনিসগুলোও আছেঃ
একঃوَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ-البينة : 5
“তাদেরকে এছাড়া আর কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা একনিষ্ঠ চিত্তে দ্বীনকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে কেবল তাঁরই ইবাদাত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে এটাই সঠিক দ্বীন।” এ আয়াত থেকে জানা যায়, নামায এবং রোযা এই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। অথচ নামায ও রোযার আহকাম বিভিন্ন শরীয়তে বিভিন্ন রকম ছিল। পূর্ববর্তী শরীয়তসমূহে বর্তমানের মত নামাযের এই একই নিয়ম-কানুন, একই খুঁটি-নাটি বিষয়, একই সমান রাকআত, একই কিবলা, একই সময় এবং এই একই বিধি-বিধান ছিল একথা কেউ বলতে পারে না। অনুরূপ যাকাত সম্পর্কেও কেউ এ দাবী করতে পারে না যে, সমস্ত শরীয়তে বর্তমানের ন্যায় যাকাতের এই একই হিসাব, একই হার এবং আদায় ও বন্টনের এই একই বিধি-নিষেধ ছিল। কিন্তু শরীয়তের ভিন্নতা সত্ত্বেও আল্লাহ এ দু’টি জিনিসকে দ্বীনের মধ্যে গণ্য করেছেন।
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ…………… الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ…………..-المائدة: 3 . “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহকৃত জন্তু, দমবন্দ হয়ে, আঘাত প্রাপ্ত হয়ে, ওপর থেকে পড়ে কিংবা ধাক্কা খেয়ে মরা জন্তু অথবা যে জন্তুকে কোন হিংস্র প্রাণী ক্ষত-বিক্ষত করেছে কিন্তু তোমরা তাকে জীবিত পেয়ে যবেহ করেছো কিংবা যে জন্তুকে কোন আস্তানায় জবেহ করা হয়েছে। তাছাড়া লটারীর মাধ্যমে নিজের ভাগ্য সম্পর্কে অবহিত হতে চাওয়াকেও তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে। এসবই গুনাহর কাজ। আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গিয়েছে। তাই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম।” এ থেকে জানা গেল যে, শরীয়তের এসব হুকুম আহকামও দ্বীনের মধ্যে শামিল।
তিনঃ قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ- التوبة: 29 “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যারা আল্লাহ ও আখেরাত দিবসে বিশ্বাস করে না, আর আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা কিছু হারাম করেছেন তা হারাম করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না।” এ থেকে জানা যায়, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যেসব আদেশ-নিষেধ করেছেন তা মানা ও তার আনুগত্য করাও দ্বীন।
চারঃ الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ- النور: 2 “ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ উভয়কে একশটি করে বেত্রাঘাত করো। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করো তাহলে দ্বীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি মায়া-মমতা ও আবেগ যেন তোমাদেরকে পেয়ে না বসে।” مَا كَانَ لِيَأْخُذَ أَخَاهُ فِي دِينِ الْمَلِكِ- يوسف: 76 “বাদশার দ্বীন অনুসারে ইউসুফ তার ভাইকে পাকড়াও করতে পারতো না।” এ থেকে জানা গেলো, ফৌজদারী আইনসমূহও দ্বীনের মধ্যে শামিল। ব্যক্তি যদি আল্লাহর দেয়া ফৌজদারী আইন অনুসারে চলে তাহলে সে আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী আর যদি বাদশার দ্বীন অনুসারে চলে তাহলে বাদশাহর দ্বীনের অনুসারী।
এ চারটি উদাহরণই এমন যেখানে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধানকে সুস্পষ্ট ভাষায় দ্বীন বলা হয়েছে। কিন্তু গভীর মনোযোগ সহকারে দেখলে বুঝা যায়, আরো যেসব গোনাহর কারণে আল্লাহ জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন (যেমন ব্যভিচার, সুদখোরী, মু’মিন বান্দাকে হত্যা, ইয়াতীমের সম্পদ আত্নসাৎ, অন্যায়ভাবে মানুষের অর্থ নেয়া ইত্যাদি) যেসব অপরাধকে আল্লাহর শাস্তির কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে (যেমনঃ লূতের কওমের মত পাপাচার এবং পারস্পরিক লেনদেনে শু’আইব আলাইহিস সালামের কওমের মত আচরণ) তার পথ রুদ্ধ করার কাজও অবশ্যই দ্বীন হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। কারণ, দ্বীন যদি জাহান্নাম ও আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করার জন্য না এসে থাকে তাহলে আর কিসের জন্য এসেছে। অনুরূপ শরীয়তের যেসব আদেশ-নিষেধ লংঘনকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম বাসের কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে সেই সব আদেশ-নিষেধও দ্বীনের অংশ হওয়া উচিত। যেমন উত্তরাধিকারের বিধি-বিধান বর্ণনা করার পর বলা হয়েছেঃ
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ- النساء: 14
“যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হবে এবং আল্লাহর সীমাসমূহ লংঘন করবে আল্লাহ তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।”
অনুরূপ আল্লাহ যেসব জিনিসের হারাম হওয়ার কথা কঠোর ভাষায় অকাট্যভাবে বর্ণনা করেছেন, যেমনঃ মা, বোন ও মেয়ের সাথে বিয়ে, মদ্যপান, চুরি, জুয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান। এসব জিনিসের হারাম হওয়ার নির্দেশকে যদি “ইকামাতে দ্বীন” বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার মধ্যে গণ্য করা না হয় তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ কিছু অপ্রয়োজনীয় আদেশ-নিষেধও দিয়েছেন যার বাস্তবায়ন তাঁর উদ্দেশ্য নয়। অনুরূপ আল্লাহ যেসব কাজ ফরয করেছেন, যেমনঃ রোযা হজ্জ-তাও দ্বীন প্রতিষ্ঠার পর্যায় থেকে এই অজুহাতে বাদ দেয়া যায় না যে, রমযানের ৩০ রোযা পূর্ববতী শরীয়তসমূহে ছিল না এবং কা’বায় হজ্জ করা কেবল সেই শরীয়তেই ছিল যা ইবরাহীমের (আ) বংশধারার ইসমাঈলী শাখাকে দেয়া হয়েছিলো।
প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির কারণ হলো, ভিন্ন উদ্দেশ্যে ( لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ) (আমি তোমাদের প্রত্যেক উম্মতের জন্য একটি শরীয়ত ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি) আয়াতের এ অর্থ করা যে, যেহেতু প্রত্যেক উম্মতের জন্য শরীয়ত ছিল ভিন্ন কিন্তু কায়েম করতে বলা হয়েছে দ্বীনকে যা সমানভাবে সব নবী-রসূলের দ্বীন ছিল, তাই দ্বীন কায়েমের নির্দেশের মধ্যে শরীয়ত অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ এ আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সূরা মায়েদার যে স্থানে এ আয়াতটি আছে তার পূর্বাপর অর্থাৎ ৪১ আয়াত থেকে ৫০ আয়াত পর্যন্ত যদি কেউ মনযোগ সহকারে পাঠ করে তাহলে সে জানতে পারবে আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ যে নবীর উম্মতকে যে শরীয়ত দিয়েছিলেন সেটিই ছিল তাদের জন্য দ্বীন এবং সেই নবীর নবুওয়াত কালে সেটিই কায়েম করা কাম্য ও উদ্দেশ্য ছিল। এখন যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের যুগ, তাই উম্মতে মুহাম্মাদীকে যে শরীয়ত দান করা হয়েছে এ যুগের জন্য সেটিই দ্বীন এবং সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করাই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা। এরপর থেকে ঐ সব শরীয়তের পরস্পর ভিন্নতা। এ ভিন্নতার তাৎপর্য এ নয় যে, আল্লাহর প্রেরিত শরীয়তসমূহ পরস্পর বিরোধী ছিল। বরং এর সঠিক তাৎপর্য হলো, অবস্থা ও পরিবেশ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ঐ সব শরীয়তের খুটিনাটি বিষয়ে কিছু পার্থক্য ছিল। উদাহরণস্বরূপ নামায ও রোযার কথাই ধরুন। সকল শরীয়তেই নামায কায়েম ফরয ছিল কিন্তু সব শরীয়তের কিবলা এক ছিল না। তাছাড়া নামাযের সময়, রাকআতের সংখ্যা এবং বিভিন্ন অংশে কিছুটা পার্থক্য ছিল। অনুরূপ রোযা সব শরীয়তেই ফরয ছিল। কিন্তু রমযানের ৩০ রোযা অন্যান্য শরীয়তে ছিল না। এ থেকে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঠিক নয় যে, নামায ও রোযা ‘ইকামাতে দ্বীন’ বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ঠিকই, কিন্তু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নামায পড়া এবং নির্দিষ্ট কোন সময়ে রোযা রাখা ইকামতে দ্বীনের নির্দেশ বহির্ভূত। বরং এর সঠিক অর্থ হলো, প্রত্যেক নবীর উম্মতের জন্য তৎকালীন শরীয়তে নামায ও রোযা আদায়ের জন্য যে নিয়ম-পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছিলো সেই সময়ে সেই পদ্ধতি অনুসারে নামায পড়া ও রোযা রাখাই ছিল দ্বীন কায়েম করা। বর্তমানেও এসব ইবাদতের জন্য শরীয়তে মুহাম্মাদীতে যে নিয়ম-পদ্ধতি দেয়া হয়েছে সে মোতাবেক এসব ইবাদাত বন্দেগী করা ‘ইকামাতে দ্বীন’। এ দু’টি দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে শরীয়তের অন্যসব আদেশ-নিষেধও বিচার করুন।
যে ব্যক্তি চোখ খুলে কুরআন মজীদ পড়বে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে যে, এ গ্রন্থ তার অনুসারীদেরকে কুফরী ও কাফেরদের আজ্ঞাধীন ধরে নিয়ে বিজিতের অবস্থানে থেকে ধর্মীয় জীবন-যাপন করার কর্মসূচী দিচ্ছে না, বরং প্রকাশ্যে নিজের শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, চিন্তাগত, নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আইনগত ও রাজনৈতিক ভাবে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জীবনপাত করার জন্য অনুসারীদের কাছে দাবী করছে এবং তাদেরকে মানব জীবনের সংস্কার ও সংশোধনের এমন একটি কর্মসূচী দিচ্ছে যার একটা বৃহদাংশ কেবল তখনই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে যদি সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ঈমানদারদের হাতে থাকে। এ কিতাব তার নাযিল করার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ- النساء: 105
“হে নবী, আমি ন্যায় ও সত্যসহ তোমার কাছে এই কিতাব নাযিল করেছি যাতে আল্লাহ তোমাকে যে আলো দেখিয়েছেন তার সাহায্যে তুমি মানুষের মধ্যে ফায়সালা করো।”
এই কিতাবে যাকাত আদায় ও বন্টনের যে নির্দেশাবলী দেয়া হয়েছে সেজন্য তা সুস্পষ্টভাবে এমন একটি সরকারের ধারণা পেশ করেছে যে, একটি নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে যাকাত আদায় করে হকদারদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেবে (আত তাওবা ৬০ ও ১০৩ আয়াত )। এই কিতাবে সুদ বন্ধ করার যে আদেশ দেয়া হয়েছে এবং সুদখোরী চালু রাখার কাজে তৎপর লোকদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে (আল বাকারা ২৭৫-২৭৯ আয়াত) তা কেবল তখনই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে যখন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে ঈমানদারদের হাতে থাকবে। এই কিতাবে হত্যাকারীর থেকে কিসাস গ্রহণের নির্দেশ (আল বাকারা ১৭৮ আয়াত), চুরির জন্য হাত কাটার নির্দেশ (আল মায়েদা ৩৮ আয়াত ) এবং ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের জন্য হদ জারী করার নির্দেশ একথা ধরে নিয়ে দেয়া হয়নি যে, এসব আদেশ মান্যকারীদেরকে কাফেরদের পুলিশ ও বিচারালয়ের অধীন থাকতে হবে। এই কিতাবে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ (আল বাকারা- ১৯০-২১৬ আয়াত) একথা মনে করে দেয়া হয়নি যে, এ দ্বীনের অনুসারীরা কাফের সরকারের বাহিনীতে সৈন্য ভর্তি করে এ নির্দেশ পালন করবে। এ কিতাবে আহলে কিতাবদের নিকট থেকে জিযিয়া আদায়ের নির্দেশ (আত তাওবা ২৯ আয়াত ) একথা ধরে নিয়ে দেয়া হয়নি যে, মুসলমানরা কাফেরদের অধীন থেকে তাদের থেকে জিযিয়া আদায় করে এবং তাদের রক্ষার দায়িত্ব নেবে। এ ব্যাপারটি শুধু মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। দৃষ্টিশক্তির অধিকারীরা মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের মধ্যে স্পষ্টতই দেখতে পারেন, প্রথম থেকেই যে পরিকল্পনা ছিল তা ছিলো দ্বীনের বিজয় ও কর্তৃত্ব স্থাপন, কুফরী সরকারের অধীনে দ্বীন ও দ্বীনের অনুসারীদের জিম্মি হয়ে থাকা নয়। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা বনী-ইসরাইল, আয়াত ৭৬ ও ৮০ ; সূরা কাসাস, আয়াত ৮৫-৮৬ ; সূরা রূম, আয়াত ১ থেকে ৬ ; সূরা আস সাফফাত , আয়াত ১৭১ থেকে ১৭৯ , (টীকা ৯৩-৯৪) এবং সূরা সোয়াদ, ভূমিকা ও ১১ আয়াত ১২ টীকাসহ।
ব্যাখ্যার এই ভ্রান্তি যে জিনিসটির সাথে সবচেয়ে বেশী সাংঘর্ষিক তা হচ্ছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের বিরাট কাজ। যা তিনি ২৩ বছরের রিসালাত যুগে সমাধা করেছেন। তিনি তাবলীগ ও তলোয়ার উভয়টির সাহায্যেই যে গোটা আরবকে বশীভূত করেছিলেন এবং বিস্তারিত শরীয়ত বা বিধি-বিধানসহ এমন একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় আদর্শ কায়েম করেছিলেন যা আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডে, সামাজিক চরিত্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি, রাজনীতি ও ন্যায় বিচার এবং যুদ্ধ ও সন্ধিসহ জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত ছিল তা কে না জানে? এ আয়াত অনুসারে নবী ﷺ সহ সমস্ত নবী-রসূলকে ইকামাতে দ্বীনের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো নবীর ﷺ এসব কাজকে যদি তার ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করা না হয় তাহলে তার কেবল দু’টি অর্থই হতে পারে। হয় নবীর ﷺ বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করতে হবে (মা’আযাল্লাহ) যে, তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন শুধু ঈমান ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কিত বড় বড় মূলনীতিসমূহের তাবলীগ ও দাওয়াতের জন্য কিন্তু তা লংঘন করে তিনি নিজের পক্ষ থেকেই একটি সরকার কায়েম করেছিলেন, যা অন্যসব নবী-রসূলদের শরীয়ত সমূহের সাধারণ নীতিমালা থেকে ভিন্নও ছিল অতিরিক্তও ছিল। নয়তো আল্লাহর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করতে হবে যে, তিনি সূরা শূরায় উপরোক্ত ঘোষণা দেয়ার পর নিজেই তাঁর কথা থেকে সরে পড়েছেন এবং নিজের নবীর নিকট থেকে ঐ সূরায় ঘোষিত “ইকামাতে দ্বীনের” চেয়ে কিছুটা বেশী এবং ভিন্ন ধরনের কাজই শুধু নেননি, বরং উক্ত কাজকে পূর্ণতা লাভের পর নিজের প্রথম ঘোষণার পরিপন্থী দ্বিতীয় এই ঘোষণাটিও দিয়েছেন যে, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ (আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম) নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা। এ দু’টি অবস্থা ছাড়া তৃতীয় এমন কোন অবস্থা যদি থাকে যেক্ষেত্রে ইকামাতে দ্বীনের এই ব্যাখ্যাও বহাল থাকে এবং আল্লাহ কিংবা তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও না আসে তাহলে আমরা অবশ্যই তা জানতে চাইবো।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়ার পর আল্লাহ এ আয়াতে সর্বশেষ যে কথা বলেছেন তা হচ্ছে وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ “দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টি করো না” কিংবা “তাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ো না।” দ্বীনে বিভেদের অর্থ ব্যক্তির নিজের পক্ষ থেকে এমন কোন অভিনব বিষয় সৃষ্টি করা এবং তা মানা বা না মানার ওপর কুফর ও ঈমান নির্ভর করে বলে পীড়াপীড়ি করা এবং মান্যকারীদের নিয়ে অমান্যকারীদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া, অথচ দ্বীনের মধ্যে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। এই অভিনব বিষয়টি কয়েক ধরনের হতে পারে। দ্বীনের মধ্যে যে জিনিস নেই তা এনে শামিল করা হতে পারে। দ্বীনের অকাট্য উক্তিসমূহের বিকৃত প্রায় ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে অদ্ভূত আকীদা-বিশ্বাস এবং অভিনব আচার-অনুষ্ঠান আবিষ্কার করা হতে পারে। আবার দ্বীনের উক্তি ও বক্তব্যসমূহ রদবদল করে তা বিকৃত করা, যেমন যা গুরুত্বপূর্ণ তাকে গুরুত্বহীন বানিয়ে দেয়া এবং যা একেবারেই মোবাহ পর্যায়ভুক্ত তাকে ফরয ও ওয়াজিব এমনকি আরো অগ্রসর হয়ে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বানিয়ে দেয়া। এ ধরনের আচরণের কারণেই নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামদের উম্মতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর এসব ছোট ছোট দলের অনুসৃত পথই ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করেছে যার অনুসারীদের মধ্যে বর্তমানে এই ধারণাটুকু পর্যন্তও বর্তমান নেই যে, এক সময় তাদের মূল ছিল একই। দ্বীনের আদেশ-নিষেধ বুঝার এবং অকাট্য উক্তিসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে মাসয়ালা উদ্ভাবন করার ক্ষেত্রে জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর কিতাবের ভাষার মধ্যে আভিধানিক, বাগধারা ও ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে যার অবকাশ আছে সেই বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত মতভেদের সাথে এই বিবাদের কোন সম্পর্ক নেই। এই বিষয় সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত ২১৩, টীকা ২৩০ ; সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৯, টীকা ১৬ ও ১৭ , আয়াত ৫১, টীকা ৪৮ ; সূরা আন নিসা, আয়াত ১৭১, টীকা ২১১ থেকে ২১৬ ; আল মায়েদা আয়াত ৭৭, টীকা ১০১ , আল আন’আম, আয়াত ১৫৯, টীকা ১৪১ ; সূরা আন নাহল, আয়াত ১১৮ থেকে ১২৪, টীকা ১১৭ থেকে ১২১ ; সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৯২-৯৩, টীকা ৯১ , আল হাজ্জ, আয়াত ৬৭-৬৯, টীকা ১১৬, ১১৭ ; আল মু’মিনুন, আয়াত ৫১ থেকে ৫৬, টীকা ৪৫ থেকে ৪৯ ; সূরা আল কাসাস, আয়াত ৫৩ ও ৫৪, টীকা ৭৩ ; সূরা আর রূম, আয়াত ৩২ থেকে ৩৫, টীকা ৫১ থেকে ৫৪ ।
# আয়াতে ২৯
মূল আয়াতাংশ হচ্ছে أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ । আরবী ভাষায় বলা হয় فُلَانٌ شَدِيْدٌ عَلَيْه নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করা তার জন্য কঠিন। কাফেরদের প্রতি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের কঠোর হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তারা কাফেরদের সাথে রূঢ় এবং ক্রুদ্ধ আচরণ করেন, বরং এর অর্থ হচ্ছে, তারা তাদের ঈমানের পরিপক্কতা, নীতির দৃঢ়তার চারিত্রিক শক্তি এবং ঈমানী দূরদর্শিতার কারণে কাফেরদের মোকাবিলায় মজবুত পাথরের মত অনমনীয় ও আপোষহীন। তারা চপল বা অস্থিরমনা নন যে, কাফেররা তাদেরকে যেদিকে ইচ্ছা ঘুরিয়ে দেবে। তারা নরম ঘাস নন যে, কাফেররা অতি সহজেই তাদেরকে চিবিয়ে পিষে ফেলবে। কোন প্রকার ভয় দেখিয়ে তাদেরকে স্তব্ধ করা যায় না। কোন লোভ দেখিয়ে তাদের কেনা যায় না। যে মহত উদ্দেশ্যে তারা জীবন বাজি রেখে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত হয়েছেন তা থেকে তাদের বিচ্যুত করার ক্ষমতা কাফেরদের নেই।
# তাদের মধ্যে যতটুকু কঠোরতা আছে তা কাফেরদের জন্য, ঈমানদারদের জন্য নয়। ঈমানদারদের কাছে তারা বিনম্র, দয়া পরবশ, স্নেহশীল, সমব্যাথী ও দুঃখের সাথী। নীতি ও উদ্দেশ্যের ঐক্য তাদের মধ্যে পরস্পরের জন্য ভালবাসা, সাযুজ্য ও গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছে।
# সিজদা করতে করতে কোন কোন নামাযীর কপালে যে দাগ পড়ে তা এখানে বুঝানো হয়নি। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে আল্লাহভীরুতা, হৃদয়ের বিশালতা, মর্যাদা এবং মহৎ নৈতিক চরিত্রের প্রভাব যা আল্লাহর সামনে মাথা নত করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কোন মানুষের চেহারায় ফুটে ওঠে। মানুষের চেহারা একখানা খোলা গ্রন্থের মত যার পাতায় পাতায় মানুষের মনোজগতের অবস্থা সহজেই অবলোকন করা যেতে পারে। একজন অহংকারী মানুষের চেহারা একজন বিনম্র ও কোমল স্বভাব মানুষের চেহারা ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন দুশ্চরিত্র মানুষের চেহারা একজন সচ্চরিত্র ও সৎমনা মানুষের চেহারা থেকে আলাদা করে সহজে চেনা যায়। একজন গুণ্ডা ও দুশ্চরিত্রের চেহারা-আকৃতি এবং একজন সম্ভ্রান্ত ও পবিত্র ব্যক্তির চেহারা-আকৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকে। আল্লাহ তা’আলার এ উক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এসব সঙ্গী-সাথী এমন যে, কেউ তাদের একবার দেখা মাত্রই অনুধাবন করতে পারবে তারা সৃষ্টির সেরা। কারণ তাদের চেহারায় আল্লাহ ভীরুতার দীপ্তি সমুজ্জল। এ বিষয়টি সম্পর্কে ইমাম মালেক (র) বলেন, সাহাবীদের সেনাদল যে সময় সিরীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে তখন সিরীয়ার খৃস্টানরা বলেছিলোঃ ঈসার (আ) হাওয়ারীদের চালচলন সম্পর্কে আমরা যা যা শুনে আসছি এদের চালচলন দেখছি ঠিক তাই।
# সম্ভবত ‘এখানে বাইবেলের’ দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকের ৩৩ অধ্যায়ের ২ ও ৩ শ্লোকের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। যেখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে কল্যাণময় শুভ আগমের কথা বলতে গিয়ে তার সাহাবীদের জন্য “পবিত্রদের” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ছাড়া সাহাবায়ে কিরামের আর কোন গুণ বা পরিচয় যদি তাওরাতে বর্ণিত হয়ে থাকে তাহলে তা এখান এ বিকৃত তাওরাতে নেই।
# হযরত ঈসা আলাইহি ওয়া সালামের একটি বক্তৃতায় এ উপমাটি বর্ণিত হয়েছে এবং বাইবেলের ‘নুতন নিয়মে’ তা উদ্ধৃত হয়েছে এভাবেঃ “তিনি আরো কহিলেন, ইশ্বরের রাজ্য এইরূপ। কোন ব্যক্তি যেন ভূমিতে বীজ বুনে; পরে রাত দিন নিদ্রা যায় ও উঠে, ইতিমধ্যে যে বীজ অঙ্কৃরিত হইয়া বাড়িয়া উঠে, কিরূপে তাহা সে জানে না। ভূমি আপনা আপনি ফল উৎপন্ন করে; প্রথমে অঙ্কুর পরে শীষে তাহার পর শীষের মধ্যে পূর্ণ শস্য। কিন্তু ফল পাকিলে সে তৎক্ষণাৎ কাস্তে লাগায়। কেননা শস্য কাটিবার সময় উপস্থিত। ……………তাহা একটা সরিষা দানার তুল্য; সেই বীজ ভূমিতে বুনিবার সময় ভূমির সকল বীজের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র বটে, কিন্তু বুনা হইলে তাহা অঙ্কুরিত হইয়া সকল শাক ইহতে বড় হইয়া ওঠে এবং বড় বড় ডাল ফেলে; তাহাতে আকাশের পক্ষিগণ তাহার ছায়ার নীচে বাস করিতে পারে। “( মার্ক, অধ্যায়, ৪, শ্লোক, ২৬ থেকে ৩২; এই বক্তৃতার শেষাংশ মথি লিখিত সুসমাচারের ১৩ অধ্যায়ের ৩১ ও ৩২ শ্লোকেও বর্ণিত হয়েছে)
# একদল এ আয়াতে ব্যবহৃত مِنْهُمْ ও من (মিন) শব্দটিকে تبعيض অর্থে (অর্থাৎ তাদের কিছু সংখ্যক লোককে বুঝাতে) ব্যবহার করে আয়াতের অনুবাদ করেন, “তাদের মধ্যে যারা ঈমান গ্রহণ এবং নেক কাজ করেছে তাদেরকে ক্ষমা ও বড় পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। “এভাবে তারা সাহাবায়ে কিরামের (রা.) প্রতি দোষারোপের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং দাবী করে যে, এ আয়াত অনুসারে সাহাবীদের (রা.) মধ্যে অনেকেই মু’মিন ও নেককার ছিলেন না। কিন্তু এ ব্যাখ্যা এ সূরারই ৪, ৫ , ১৮ এবং ২৬ আয়াতের পরিপন্থী এবং এ আয়াতের প্রথমাংশের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যারা হুদাইবিয়াতে নবীর ﷺ সাথে ছিলেন ৪ ও ৫ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তাদের মনে প্রশান্তি নাযিল করা ও তাদের ঈমান বৃদ্ধি করার কথা উল্লেখ করেছেন এবং কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই তাদের সবাইকে জান্নাতে প্রবেশ করার কথা সুখবর দান করেছেন। আর যারা গাছের নীচে নবীর ﷺ কাছে বাইয়াত হয়েছিলেন ১৮ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তাদের সবার জন্য তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রেও কোন ব্যতিক্রমের উল্লেখ নেই। ২৬ আয়াতেও নবীর ﷺ সমস্ত সঙ্গী-সাথীর জন্য মু’মিনীন, শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাদের প্রতি তাঁর প্রশান্তি নাযিলের খবর দিয়েছেন এবং বলেছেন যে এসব লোক তাকওয়ার নীতি অনুসরণের অধিক যোগ্য ও অধিকারী। এখানেও একথা বলা হয়নি যে, তাদের মধ্যে যারা মু’মিন কেবল তাদের জন্যই এ সুসংবাদ দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া এ আয়াতেও প্রথমাংশে যে প্রশংসা বাক্য বলা হয়েছে তা তাদের সবার জন্য বলা হয়েছে যারা আল্লাহর রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলেন। কথাটি হচ্ছে যারাই আপনার সাথে আছে এরূপ এবং এরূপ। এরপর আয়াতের শেষাংশে পৌঁছে একথা বলার এমন কি অবকাশ থাকতে পারে যে, তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক ঈমানদার ও নেককার ছিলেন এবং কিছু সংখ্যক লোক তা ছিলো না। তাই এখানে من মিন শব্দটিকে تبعيض অর্থে গ্রহণ করা বাক্য বিন্যাসের পরিপন্থী। প্রকৃতপক্ষে এখানে من (মিন) শব্দটিকে স্পষ্ট করে বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ (মূর্তিসমূহের অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো)। আয়াতে تبعيض ن من অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তা না হলে আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে মূর্তিসমূহের যেগুলো অপবিত্র সেগুলো থেকে দূরে থাকো। এর অর্থ হবে এই যে, কিছু মূর্তিকে পবিত্র বলেও ধরে নিতে হবে। আর সেগুলোর পূজা থেকে বিরত থাকা আবশ্যিক হবে না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২০-২৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
হুদায়বিয়ার পরের বছর ৭ম হিজরীতে সংঘটিত খায়বারের যুদ্ধ ও তার গনীমতের ব্যাপারে এখানে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَعَدَكُمُ اللّٰهُ مَغَانِمَ كَثِيْرَةً)
‘আল্লাহ তোমাদেরকে বিপুল পরিমাণ গনীমতের মাল দেয়ার ওয়াদা করছেন’ মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : আজ পর্যন্ত মুসলিমরা যত গনীমত পেয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত গনীমত পাবে সব এতে শামিল। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
(فَعَجَّلَ لَكُمْ هَذِهِ)
‘এটা তিনি তোমাদের জন্য তরান্বিত করেছেন’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা খায়বার বিজয় করে দিয়ে নগদ তার গনীমতগুলো দিলেন।
(وَكَفَّ أَيْدِيَ النَّاسِ عَنْكُمْ)
‘আর তিনি মানুষের হাত তোমাদের (ওপর প্রসারিত করা) থেকে বিরত রেখেছেন’ অর্থাৎ তোমাদেরকে শত্র“দের অনিষ্ট থেকে হিফাযত করেছেন। যে অনিষ্ট করার জন্য তারা মনে মনে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছিল। এরা হল উআইনা বিন হিচন আল ফাযারী, আউফ বিন মালেক ও তাদের সাথে আরও যারা খায়বারের ইয়াহূদীদের সাহায্য করার জন্য এসেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি করে দেন ফলে তারা তাদেরকে সহযোগিতা করেনি।
(وَلِتَكُوْنَ اٰيَةً لِّلْمُؤْمِنِيْنَ)
‘যাতে মু’মিনদের জন্য এটা নিদর্শন হয়ে থাকে’ অর্থাৎ খায়বারের গনীমতের মাল প্রদান করলেন মু’মিনদের জন্য একটি নিদর্শনস্বরূপ যে, আল্লাহ তা‘আলা যে সংবাদ দেন তা সত্য, তিনি যে প্রতিশ্রুতি দেন তা সত্য এবং প্রতিদান দেবেন তাও সত্য।
(وَأُخْرٰي لَمْ تَقْدِرُوا عَلَيْهَا)
‘এ ছাড়া আরও গনীমতের মাল (তোমাদের দেয়ার ওয়াদা তিনি করেছেন), যা এখনো তোমরা লাভ করতে পারনি’ অর্থাৎ আরও গনীমতের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন যা সে সময় তোমরা অর্জন করতে সক্ষম হওনি, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তা তোমাদের আয়ত্তে এনে দিয়েছেন। তা আল্লাহ তা‘আলার কর্তৃতাধীন। আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন তা তোমাদের হস্তগত করে দেবেন। অতএব অবশ্যই তোমরা তা পাবে। এটা কোন গনীমত তা নিয়ে মতভেদ বিদ্যমান।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : তা হল খায়বার। কাতাদাহ বলেন : তা হল মক্কা বিজয়, হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন : তা হল ফারেস ও রোম বিজয়। ইবনু জারীর এ মত পছন্দ করেছেন।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : কিয়ামত পর্যন্ত যত বিজয় ও গনীমত পাওয়া যাবে তার সবই এতে শামিল। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মু’মিনদের জন্য একটি সুসংবাদ যে, তিনি মু’মিনদেরকে তাদের শত্র“দের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করবেন। কাফিররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা ও যুদ্ধ করতে আসলে যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না বরং মুসলিমদের শক্তি ও সাহস দেখে পেছনে পলায়ন করবে। সুতরাং মুসলিমদেরকে কাফিরদের শক্তি ও সংখ্যা দেখে ভয় করার কিছুই নেই। মুসলিমরা যদি সাহাবীদের মত ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান হয় এবং দুনিয়ার ওপর পরকালকে প্রাধান্য দেয় তাহলে আল্লাহর এ কথার সত্যতা সাহাবীরা যেমন দেখেছেন বর্তমান মুসলিমরাও দেখতে পাবে।
بطن مكة – ‘বাতনে মাক্কা’ বলতে হুদায়বিয়া নামক স্থানকে বুঝানো হয়েছে।
(وَهُوَ الَّذِيْ كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ)
শানে নুযুল :
আনাস (রাঃ) বলেন : মক্কার ৮০ জনের মত লোক তানইমের পাহাড় হতে নাবী ও সাহাবীদের ওপর হামলা করার জন্য অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় আগমন করে। আমরা তাদের সহজেই ধরে ফেললাম এবং আমরা লজ্জাবোধ করলাম তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (সহীহ মুসলিম হা. ১৮০৮)
মুসনাদ আহমাদের বর্ণনায় এসেছে- আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল বলেন : আমরা হুদায়বিয়ায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সে গাছের নিচে ছিলাম যে গাছের কথা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। একদা ত্রিশজন যুবক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ চালালে রাসূলুল্লাহ তাদের ওপর বদ দু‘আ করলেন ফলে আল্লাহ তাদের চক্ষু ছিনিয়ে নিলেন। আল্লাহর রাসূল তাদেরকে বললেন : তোমরা কি কারো ওয়াদা করে এসেছ অথবা তোমাদেরকে কি কেউ নিরাপত্তা দিয়েছে? তারা বলল : না, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের ছেড়ে দিলেন। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (মুসনাদ আহমাদ হা. ১৬৮০০, সহীহ)
অতএব আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের ওপর তাঁর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন যে, তিনি তোমাদেরকে মক্কার কাফিরদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন এবং তারাও তোমাদের আয়ত্তে আসার পরেও রক্ষা পেয়ে গেছে। এরা ছিল মক্কার সেই মুশরিকরা যারা হুদায়বিয়ার দিন মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বের হয়েছিল, মুসলিমরা তাদেরকে ধরে ফেলেছিল কিন্তু ছেড়ে দিয়েছে, যুদ্ধ করেনি, তারা আনুমানিক ৮০ জনের মত। (তাফসীর মুয়াসসার পৃঃ ৫১৪)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার প্রতিশ্রুতি সত্যে পরিণত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় ও তার ইনতেকালের পরেও।
২. মু’মিনদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ।
৩. আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে শত্র“দের বিরুদ্ধে সাহায্য করেন।
২৫-২৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মক্কার কুরাইশ কাফিরদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন যে, তারা নিজেরা আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদকে অস্বীকার করেছে, তোমাদেরকে হুদায়বিয়ার দিন মাসজিদে হারামে যেতে বাধা দিয়েছিল এবং হাদী (যে পশু হাজীরা সাথে নিয়ে এসেছিল) তা স্বস্থানে তথা হারামে পৌঁছতে বাধা দিয়েছিল। তাদেরকে এসব অপরাধের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু মক্কায় এমন কিছু দুর্বল মু’মিন নর-নারী ছিল যারা ঈমান গোপন করে রেখেছিল তাদের সম্পর্কে তোমরা জানতে না। যদি যুদ্ধের অনুমতি দিতেন তাহলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হত ফলে তোমরাও অজ্ঞাতসারে ক্ষতিগ্রস্ত হতে।
জুনাইদ বিন সাবা বলেন : দিনের প্রথমভাগে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরুদ্ধে কাফির অবস্থায় যুদ্ধ করেছিলাম। আর দিনের শেষভাগে মুসলিম হয়ে তার সাথে যুদ্ধ করেছি। আমাদের ব্যাপারেই নাযিল হয়েছে :
(وَلَوْلَا رِجَالٌ مُّؤْمِنُوْنَ وَنِسَا۬ءٌ مُؤْمِنَاتٌ)
তিনি বলছেন : আমরা ৯ জন ছিলাম; ৭ জন পুরুষ, দুজন স্ত্রী। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, ৯/৩৯৮, সনদ জাইয়িদ)
مَعْكُوْفًا অর্থ বা আটক করা, বাধা দেয়া। অর্থাৎ মক্কার মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের সাথে কুরবানীর পশু জবাই করার স্থানে পৌঁছতে বাধা দিয়েছিল। হাদীর সংখ্যা ছিল ৭০টি। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অনুগ্রহে সেস্থানে হালাল হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। এ থেকে জানা গেল ইহরাম বাঁধার পর মক্কা প্রবেশ করতে বাধাগ্রস্থ হলে সে স্থানেই ইহরাম থেকে হালাল হয়ে কুরবানী করে নেবে। যেমন সাহাবী জাবের (রাঃ) বলছেন, আমরা হুদায়বিয়ার বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে উটে সাত জন আর গরুতে সাত জন শরীক হয়ে কুরবানী করেছি। (সহীহ মুসলিম হা. ১৩১৮)
ইবনু উমার বলেন : উমরার উদ্দেশ্যে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে বের হলাম, কুরাইশরা বাইতুল্লাহ থেকে আমাদেরকে বাধা দিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার উট জবাই করলেন এবং মাথা মুণ্ডন করে নিলেন। (সহীহ বুখারী হা. ১৮১২)
مَّعَرَّةٌ অর্থ পাপ, জরিমানা, ইমাম কুরতুবী বলেন, এর অর্থ হল দোষ। অর্থাৎ অজ্ঞাতসারে মক্কার মুসলিমদের ক্ষতি করলে তোমাদের পাপ হত, জরিমানা আবশ্যক হত এবং তোমরা দোষের পাত্র হতে।
لَوْ تَزَيَّلُوا শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, আলাদা হয়ে থাকা। অর্থাৎ যদি মু’মিনরা মক্কার কাফিরদের থেকে আলাদা থাকত তাহলে তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিতাম। সুতরাং কোন এলাকায় কাফিরদের সাথে মুসলিম থাকলে পৃথক না করা পর্যন্ত হামলা করা যাবে না।
(إِذْ جَعَلَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ قُلُوْبِهِمُ)
‘যখন কাফিররা তাদের অন্তরে জাহেলী ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করল’ এটা হল সে সময়ের কথা যখন উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে হুদায়বিয়ার সন্ধি লেখা হয়। আলী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দিলেন বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম লিখতে। তিনি লিখলেন। কাফিররা প্রতিবাদ জানালো যে, রহমান ও রহীমকে আমরা চিনি না। আমরা যে শব্দ ব্যবহার করি বিসমিকাল্লা-হুম্মা (হে আল্লাহ তা‘আলা তোমার নাম নিয়ে) তাই দিয়ে শুরু কর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেনে নিলেন। অতঃপর রাসূল লেখালেন : ‘এটা সেই চুক্তিপত্র যাতে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল মুহাম্মাদ মক্কাবাসীদের সাথে সন্ধি করছেন। কাফিররা বলতে লাগল : ঝগড়ার মূল কারণ হল আপনার রিসালাত নিয়ে। আমরা যদি আপনার রিসালাত মেনেই নিতাম তাহলে যুদ্ধই হতো না। অতএব মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’র পরিবর্তে মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ লেখুন। আলী (রাঃ)-কে এ রকমই লেখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা. ২৬৯৮, সহীহ মুসলিম হা. ১৭৮৩)
আয়াতে (حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ)
বলতে কাফিররা যে বিসমিল্লহির রহমানির রহীম ও মুহাম্মাদ রাসূলল্লাহ লেখাকে মেনে নিতে পারেনি তার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এসব জাহিলী যুগের কাজ। তাদের পাপের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তর কুফরীতে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন।
(فَأَنْزَلَ اللّٰهُ سَكِينَتَهُ عَلَي…)
‘তখন আল্লাহ তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করলেন’ অর্থাৎ মু’মিনরা বাহ্যিক দেখতে পাচ্ছে এ সন্ধির সকল শর্ত তাদের বিপক্ষে। যার কারণে তারা রাগান্বিত। ফলে আল্লাহ তা‘আলা প্রশান্তি নাযিল করলেন যাতে তাঁর বিধানের ওপর ধৈর্যধারণ করে, রাগান্বিত না হয়। আর তাকওয়ার বাক্য
لا إله إلا الله
এর ব্যাপারে সুদৃঢ় রাখলেন।
অত্র আয়াতের তাফসীরে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তাকওয়ার কালিমা হল লা ইলাহা ইল্লালাহ। (তিরমিযী হা. ৩২৬৫, সহীহ)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কেউ হাজ্জ বা উমরা উদ্দেশ্যে মক্কায় যেতে বাধাপ্রাপ্ত হলে সে ব্যক্তি যেখানে বাধাপ্রাপ্ত হবে সেখানেই হালাল হয়ে যাবে এবং হাদী জবাই করে নেবে।
২. মুসলিমদের ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকা আবশ্যক যাতে অজ্ঞাতসারে তাদের দ্বারা কোন মুসলিম কষ্ট না পায়।
৩. হুদায়বিয়ার সন্ধি বাহ্যিক দিক থেকে মুসলিমদের বিপক্ষে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল মুসলিমদের বিজয়ের অন্যতম মাধ্যম।
২৭-২৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ষষ্ঠ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বপ্নযোগে দেখলেন যে, তিনি সাহাবীদের নিয়ে মক্কায় গিয়ে বাইতুল্লাহয় ওমরা পালন করছেন। নাবীদের স্বপ্ন সত্য ও ওয়াহী, সে স্বপ্নের বর্ণনা সাহাবীদের সামনে পেশ করলে সকলেই উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় রওনা দিলেন। কিন্তু হুদায়বিয়াতে বাধাগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসলে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের বললেন, আমরা ওমরা করব। কিন্তু আমরা তো ওমরা করতে পারলাম না। এ কথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শোনার পর বললেন : আমি কি তোমাদের বলেছি, এ বছরই ওমরা করব? সকলেই বলল, না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : অচিরেই তোমরা মক্কায় গিয়ে ওমরা আদায় করতে পারবে। (সহীহ বুখারী হা. ৩১৮১)
صدق শব্দটি كذب এর বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। যে কথা বাস্তবের অনুরূপ তাকে صدق এবং যে কথা অনুরূপ নয় তাকে كذب বলা হয়। মাঝে মাঝে কাজকর্মের জন্যও এ শব্দ ব্যবহার করা হয়। তখন এর অর্থ হয় কোন কাজকে বাস্তবায়িত করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ رِجَالٌ صَدَقُوْا مَا عَاهَدُوا اللّٰهَ عَلَيْهِ)
“মু’মিনদের মধ্যে কতক লোক এমনও আছে যারা আল্লাহ্র সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার বাস্তবায়িত করেছে” (সূরা আহযাব ৩৩ : ২৩) এমন সময় শব্দের দুটি কর্তৃবাচক ক্রিয়া থাকে। আলোচ্য আয়াতেও এমন দুটি ক্রিয়া রয়েছে : একটি হল رَسُوْلَهُ অপরটি হল الرُّؤْيا ।
পরবর্তী বছর মুসলিমরা নিরাপদে ওমরা আদায় করে। কেউ মাথা নেড়া করে আর কেউ চুল খাট করে। এদিকেই আয়াতগুলো ইঙ্গিত করছে।
ভবিষ্যত কাজের জন্য ইনশাআল্লাহ তা‘আলা বলা উচিত : এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মাসজিদে হারামে প্রবেশের কথা বলেছেন যা ভবিষ্যতে হওয়ার কথা ছিল তাই ইনশাআল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলা নিজের চাওয়া সম্পর্কে তিনি সর্বাধিক জ্ঞাত, তাঁর এরূপ বলার প্রয়োজন ছিলনা। এতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল ও তাঁর উম্মাতকে শিক্ষা দেয়ার জন্য ইনশাআল্লাহ ব্যবহার করলেন (কুরতুবী)। তাই ভবিষ্যতে কোন কাজ করার দৃঢ়সংকল্প করলে তাতে ইনশাআল্লাহ বলা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَا تَقُوْلَنَّ لِشَیْءٍ اِنِّیْ فَاعِلٌ ذٰلِکَ غَدًاﭦاِلَّآ اَنْ یَّشَا۬ئَ اللہُ)
“কখনই তুমি কোন বিষয়ে বল না, “আমি সেটা আগামীকাল করব, ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ এ কথা না বলে।’ (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ২৪)
সুলাইমান (আঃ) বলেছিলেন : আমি আজ রাতে একশত অথবা নিরানব্বই জন স্ত্রীর সাথে সহবাস করব, প্রত্যেকে এমন সন্তান প্রসব করবে যারা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তার জিহাদ করবে। তার সাথী তাকে বলল : ইনশাআল্লাহ বলেন। তিনি ইনশাআল্লাহ বললেন না, ফলে একজন ছাড়া কেউ গর্ভবতী হয়নি। (সহীহ বুখারী হা. ২৮১৯)
(مُحَلِّقِيْنَ رُؤُوْسَكُمْ وَمُقَصِّرِيْنَ)
“(কেউ কেউ) মাথা কামাবে, (কেউ কেউ) চুল কাটবে” সহীহ বুখারীতে এসেছে : পরবর্তী বছর কাযা ওমরায় মুআবিয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র কেশ কাঁচি দ্বারা কর্তন করেছিলেন। এটা কাযা ওমরারই ঘটনা। কেননা বিদায় হাজ্জে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথা মুণ্ডন করেছিলেন (কুরতুবী)।
(فَعَلِمَ مَا لَمْ تَعْلَمُوا…… قَرِيبًا)
‘তিনি জানেন তোমরা যা জান না।’ অর্থাৎ সে বছর উমরা আদায় না করে ফিরে আসা তার পরবর্তী বছর উমরা করার মধ্যে যে কল্যাণ রয়েছে তা কেবল আল্লাহ তা‘আলাই জানেন, তোমরা জান না।
(فَتْحًا قَرِيبًا) নিকটতম বিজয় বলতে খায়বার ও মক্কা বিজয়সহ সন্ধির সফলতা অধিকহারে ইসলাম গ্রহণের কথাকে বুঝানো হয়েছে। কেননা এটাও এক প্রকার মহাবিজয়। হুদায়বিয়ার সময় মুসলিমরা ছিলেন দেড় হাজার। এর দু’বছর পর মুসলিমরা বিজয়ী হিসেবে মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার।
(لِيُظْهِرَهُ عَلَي الدِّينِ كُلِّهِ)
‘যাতে ঐ দীনকে অন্য সব দীনের ওপর বিজয়ী করেন’ অন্যান্য ধর্মসমূহের ওপর ইসলামের এ বিজয় দলীলাদির দিক দিয়ে তো সব সময়কার জন্য অনস্বীকার্য বটেই এমনকি পার্থিব ও সৈন্য সামন্তের দিক দিয়েও প্রথম শতাব্দী এবং তারপর সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত যতক্ষণ তারা জয়যুক্ত ছিলেন এবং আজও পার্থিব বিজয় লাভ সম্ভব যদি মুসলিমরা প্রকৃত ঈমানে উজ্জিবীত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَا تَهِنُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ)
“আর তোমরা হীনবল ও দুঃখিত হয়ো না বস্তুত যদি তোমরা বিশ্বাসী হও, তবে তোমরাই জয়ী হবে।” (সূরা আলি ইমরান ২ : ১৩৯)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. নাবীদের স্বপ্ন সত্য।
২. স্বপ্নের ব্যাখ্যা এক বছর বা তার বেশি সময় পরেও বাস্তবায়িত হতে পারে।
৩. হাজ্জ বা উমরার পর মাথা মুণ্ডণ বা চুল খাট করা উভয়টা যায়েয। তবে মুণ্ডণ করা উত্তম।
৪. ভবিষ্যতে করা হবে এমন যে-কোন কাজের ক্ষেত্রে ইনশাআল্লাহ বলা উচিত।
৫. ইসলাম সত্য ও বিজয়ী ধর্ম।
২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
সমগ্র কুরআনের কোথাও আল্লাহ তা‘আলা নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাম নিয়ে আহ্বান করেননি বরং তাঁর গুণাবলী ও পদবীর মাধ্যমে আহ্বান করেছেন, যেমন
(يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ, يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ)
ইত্যাদি। কিন্তু অন্যান্য নাবীদের ক্ষেত্রে তাদের নাম ধরে আহ্বান করেছেন যেমন
(يَا إِبْرَاهِيمُ, يَا مُوسَي)
ইত্যাদি। কুরআনের মাত্র চার জায়গায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাম মুহম্মাদ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নামের পাশে তাঁর উপাধি ও পদবীও উল্লেখ করা হয়েছে যা তাঁর মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছে। এসব স্থানে তাঁর নাম উল্লেখ করার মধ্যে উপকারিতা হল হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্রে আলী (রাঃ) যখন তাঁর নাম “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” লিপিবদ্ধ করেন তখন কাফিররা এটা মিটিয়ে “মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ” লিপিবদ্ধ করতে পীড়াপীড়ি করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার আদেশে তা মেনে নেন। পরিবর্তে আল্লাহ তা‘আলা এ স্থানে বিশেষভাবে তাঁর নামের সাথে “রাসূলুল্লাহ” শব্দ কুরআনে উল্লেখ করে একে চিরস্থায়ী করে দিলেন যা কিয়ামত পর্যন্ত লিখিত ও পঠিত হবে। এ সম্পর্কে সূরা হুজুরাতে আরও আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।
(وَالَّذِيْنَ مَعَه)
‘যারা তাঁর সাথে আছে’ অর্থাৎ সাহাবীগণ। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাতের পর সাহাবীদের প্রশংসনীয় কয়েকটি গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ প্রতিকুল পরিবেশ ও শত নির্যাতনের পরেও ঈমান ও আমলের মাধ্যমে সাহাবীরা যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন পৃথিবীর কোথাও এমন কোন ইতিহাস মেলে না। তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মাতের জন্য সাহাবীদেরকে নমুনা হিসেবে রেখে যান এবং তাদের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে জন্য কুরআনেও তাদের গুণাবলী ও লক্ষণাদি বর্ণনা করে তাদের অনুসরণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এস্থলে তাদের প্রথম যে গুণ উল্লেখ করা হয়েছে তা হল :
(أَشِدَّا۬ءُ عَلَي الْكُفَّارِ رُحَمَا۬ءُ بَيْنَهُمْ)
‘যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফিরদের ওপর কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে সহানুভূতিশীল, কোমল’ কাফিরদের মোকাবেলায় তাদের কঠোরতা সর্বক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছে। তারা ইসলামের জন্য বংশগত সম্পর্ক বিসর্জন দিয়েছেন, বদরের যুদ্ধে নিজের কাফির পিতাকে হত্যা করতে ইতস্ততবোধ করেননি। আর নিজেদের মাঝে সহানুভূতি ও আন্তরিকতার উপমা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুহাজিররা মদীনায় হিজরত করে আসলে আনসাররা নিজেদের সম্পদে ও জায়গায় ভাগ দিয়েছেন এমনকি নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মুহাজির ভাইদের জন্য বৈধ করে দিতে কুন্ঠাবোধ করেননি।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مَنْ یَّرْتَدَّ مِنْکُمْ عَنْ دِیْنِھ۪ فَسَوْفَ یَاْتِی اللہُ بِقَوْمٍ یُّحِبُّھُمْ وَیُحِبُّوْنَھ۫ٓﺫ اَذِلَّةٍ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اَعِزَّةٍ عَلَی الْکٰفِرِیْنَ)
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দীন হতে ফিরে গেলে শীঘ্রই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাঁকে ভালবাসবে; তারা মু’মিনদের প্রতি কোমল ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে।” (সূরা মায়িদা ৫ : ৫৪)
দ্বিতীয় গুণ : তারা রুকু-সিজদা তথা ইবাদতে পাবন্দি।
(تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا)
‘তুমিতাদেরকে দেখবে রুকূ-সিজদারত অবস্থায় আল্লাহর মেহেরবানী ও সন্তুষ্টি তালাশে মগ্ন’ অর্থাৎ তারা বেশি বেশি সালাত আদায় করে যার অন্যতম রুকন হল রুকু ও সিজদা। তারা সালাতকে এত ভালবাসে যে, রাতে-দিনে সুযোগ পেলেই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য সালাতে মশগুল হয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(تَتَجَافٰي جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّطَمَعًا ز وَّمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنْفِقُوْنَ )
“তাদের দেহ-পার্শ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় যে, তারা তাদের প্রতিপালককে আহ্বান করতে থাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।” (সূরা সিজদাহ ৩২ : ১৬)
(سِيْمَاهُمْ فِيْ وُجُوْهِهِمْ مِّنْ أَثَرِ السُّجُوْدِ)
‘তাদের চেহারায় সিজদার আলামত রয়েছে’ হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন : এর অর্থ হল মুসল্লীদের মুখমণ্ডলের সেই নূর যা কিয়ামতের দিন প্রকাশ পাবে। একদা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমাযানের ২১ তারিখের রাতে ফজরের সালাত আদায় করলেন (রাতের বেলা বৃষ্টি হয়েছিল) ফলে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কপালে পানি ও কাদার চিহ্ন লেগে ছিল। হাসান বাসরী বলেন : কিয়ামতের দিন তা শুভ্রু হয়ে থাকবে। (সহীহ বুখারী হা. ২০১৮)
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে রয়েছে… যখন আল্লাহ তা‘আলা বান্দার মাঝে বিচার করা শেষ করবেন তখন তিনি জাহান্নামীদের মধ্য হতে যাদেরকে ইচ্ছা করবেন জাহান্নাম হতে বের করতে ফেরেশতাদের নির্দেশ দেবেন যারা “লা ইলাহা ইল্লালাহ” বলেছে কিন্তু কোন শিরক করেনি। ফেরেশতারা তাদেরকে জাহান্নামে সিজদার আলামত দেখে চিনতে পারবে, আগুন আদম সন্তানের সব কিছু খেয়ে ফেলবে কিন্তু সিজদার আলামত পুড়তে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের আগুনের জন্য সিজদার আলামত পুড়িয়ে দেয়া হারাম করে দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী হা. ৭৪৩৮, মুসলিম হা. ১৮২)
ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন : আমার কাছে এ সংবাদ এসেছে যে, খ্রিস্টানরা সিরিয়া বিজয়ী সাহাবীদেরকে দেখলে বলত- এরা মূসার অনুসারী হাওয়ারীদের থেকে উত্তম। কারণ এ উম্মাতের কথা পূর্ববর্তী কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, আর এ উম্মাতের সর্বশ্রেষ্ঠ হল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী। আল্লাহ তা‘আলা আসামানী কিতাবে বিশেষভাবে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা এখানে বলেছেন : তাদের উপমা রয়েছে তাওরাতে এবং তাদের উপমা রয়েছে ইঞ্জিলে। তা হল এই যে, যেমন একটি শস্যক্ষেত, যার চারাগাছগুলো অঙ্কুরিত হয়ে পরে সেগুলো শক্ত ও পুষ্ট হয় পরে তা কাণ্ডের ওপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীকে আনন্দিত করে। এমনিভাবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীগণ শুরুতে খুবই নগণ্য সংখ্যক ছিলেন। এক সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যতীত মাত্র তিনজন মুসলিম ছিলেন। পুরুষদের মধ্যে আবূ বকর, মহিলাদের মধ্যে খাদীজা ও বালকদের মধ্যে আলী (রাঃ)-এরপর আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এমনকি বিদায় হাজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে হাজ্জে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের সংখ্যা ছিল দেড় লক্ষাধিক। ইমাম বাগাভী বলেন : ইঞ্জিলে সাহাবায়ে কেরাম এর দৃষ্টান্ত আছে যে, তারা শুরুতে নগণ্য সংখ্যক হবে তারপর তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং শক্তি অর্জিত হবে।
এ আয়াতের ভিত্তিতেই ঈমাম মালিক (রহঃ) বলেছেন : রাফিজিরা কাফির। কারণ তারা সাহাবীদের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করে। কেননা যারাই সাহাবীদেরকে গালিগালাজ ও বিদ্বেষ পোষণ করবে এ আয়াতের ভিত্তিতে তারা কাফির।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي، فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَنْفَقَ أَحَدُكُمْ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيفَهُ
তোমরা আমার সাহাবীদেরকে গালি দিও না। ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ তোমাদের কেউ যদি উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করে তাহলেও তাদের একমুদ বা অর্ধ মুদ সমপরিমাণ ব্যায়ের সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম হা. ২৫৪০)
(لِيَغِيْظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ)
‘এভাবে আল্লাহ মু’মিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সাহাবায়ে কেরামকে উল্লেখিত গুণে গুণান্বিত করেছেন এবং তাদেরকে দুর্বলতার পর শক্তি এবং সংখ্যাস্বল্পতার পর সংখ্যাধিক্য দান করেছেন যাতে এগুলো দেখে কাফিরদের অন্তর্জ্বালা হয় এবং তারা হিংসার অনলে দগ্ধ হয়। আবূ ওরওয়া যুবায়রী (রহঃ) বলেন : একবার আমরা ইমাম মালেক (রহঃ)-এর মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। জনৈক ব্যক্তি কোন একজন সাহাবীকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য রাখল। তখন ইমাম মালেক অত্র আয়াতটি পূর্ণ তেলাওয়াত করতঃ যখন
(لِيَغِيْظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ)
পর্যন্ত পৌঁছলেন তখন বললেন : যার অন্তরে কোন একজন সাহাবীর প্রতি ক্রোধ আছে সে এ আয়াতের শাস্তি ভোগ করবে। (কুরতুবী)
(وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)
‘যারা ঈমান আনে’ এখানে من অব্যয়টি বর্ণনামূলক, অর্থ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ঈমানদার ও সৎআমলকারী মু’মিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা দিয়েছেন তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন এবং অনেক উত্তম প্রতিদান দেবেন। এ থেকে জানা গেল সকল সাহাবী প্রকৃত ঈমানদার, তাদের সবাইকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাদের সবাই জান্নাতী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَالسّٰبِقُوْنَ الْأَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهٰجِرِيْنَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِيْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِإِحْسَانٍ لا رَّضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِيْ تَحْتَهَا الْأَنْهٰرُ خٰلِدِيْنَ فِيْهَآ أَبَدًا ط ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ )
“মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিুদেশে নদী প্রবাহিত হয়, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। এটাই হল মহাসাফল্য।” (সূরা তাওবা ৯ : ১০০)
সুতরাং সাহাবীদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা, তাদেরকে গালিগালাজ করা এবং তাদেরকে নিয়ে সমালোচনা করা ঈমানের পরিপন্থী কাজ। একজন মু’মিনের অন্তর ও মুখে সাহাবীদের ব্যাপারে ভাল ও স্বচ্ছ ধারণা থাকবে। তাদেরকে ভালবাসা ঈমান ও দীন আর তাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরী ও মুনাফিকী।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের স্বীকৃতি পেলাম।
২. সাহাবীদের ফযীলত জানতে পারলাম।
৩. যারা বেশি বেশি সালাত আদায় করে তাদের ফযীলত অন্যান্যদের ওপর অনেক বেশি।
৪. সাহাবীদের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরী, যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২০-২৪ নং আয়াতের তাফসীর:
যুদ্ধে লভ্য বিপুল সম্পদ দ্বারা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর যুগের এবং পরবর্তী সব যুগেরই গানীমাতকে বুঝানো হয়েছে। ত্বরান্বিতকৃত গানীমাত দ্বারা খায়বারের গানীমাত এবং হোদায়বিয়ার সন্ধি উদ্দেশ্য। আল্লাহ্ তা’আলার এটাও একটি অনুগ্রহ যে, তিনি কাফিরদের মন্দ বাসনা পূর্ণ হতে দেননি, না তিনি মক্কার কাফিরদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন এবং না তিনি ঐ মুনাফিকদের মনের বাসনা পূর্ণ করেছেন যারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে গমন না করে বাড়ীতেই রয়ে গিয়েছিল। তারা মুসলমানদের উপর না আক্রমণ চালাতে পেরেছে, না তাদের। সন্তানদেরকে শাসন-গর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এটা এ জন্যে যে, একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই যে প্রকৃত রক্ষক ও সাহায্যকারী এ শিক্ষা যেন মুসলমানরা গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং তারা যেন শত্ৰু সংখ্যার আধিক্য ও নিজেদের সংখ্যার স্বল্পতা দেখে সাহস হারিয়ে না ফেলে। তারা যেন এ বিশ্বাসও রাখে যে, প্রত্যেক কাজের পরিণাম আল্লাহ পাক অবগত রয়েছেন। বান্দাদের জন্যে এটাই উত্তম পন্থা যে, তারা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ অনুযায়ী আমল করবে এবং এতেই যে তাদের জন্যে মঙ্গল রয়েছে এ বিশ্বাস রাখবে। যদিও আল্লাহর ঐ নির্দেশ বাহ্যিক দৃষ্টিতে স্বভাব-বিরুদ্ধরূপে পরিলক্ষিত হয়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হতে পারে যে, তোমরা যা অপছন্দ কর ওটাই তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক।” (২:২১৬)
মহান আল্লাহর উক্তি ও ‘আল্লাহ তোমাদেরকে পরিচালিত করেন সরল পথে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় বান্দাদেরকে তাদের আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যের কারণে সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং গানীমাত ও বিজয় ইত্যাদিও দান করেন, যা তাদের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলার ক্ষমতার বাইরে কিছুই নেই। তিনি স্বীয় মুমিন বান্দাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তাদের জন্যে কঠিন সহজ করে দিবেন। তাই তিনি বলেনঃ আরো বহু সম্পদ আছে যা এখনো তোমাদের অধিকারে আসেনি, ওটা তো আল্লাহর নিকট রক্ষিত আছে। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। তিনি তার মুমিন বান্দাদেরকে এমন জায়গা হতে রূযী দান করে থাকেন যা তারা ধারণাও করতে পারে না।
এই গানীমাত দ্বারা খায়বারের গানীমাতকে বুঝানো হয়েছে যার ওয়াদা হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় করা হয়েছিল। অথবা এর দ্বারা মক্কা বিজয় বা পারস্য ও রোমের সম্পদকে বুঝানো হয়েছে। কিংবা এর দ্বারা ঐ সমুদয় বিজয়কে বুঝানো হয়েছে যেগুলো কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানরা লাভ করতে থাকবে।
এরপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা শুভসংবাদ শুনাচ্ছেন যে, তাদের কাফিরদেরকে ভয় করা ঠিক নয়। কেননা, তারা যদি তাদের সাথে মুকাবিলা করতে আসে তবে পরিণামে তারা অবশ্যই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, তখন তারা কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। কারণ, এটা হবে তাদের আল্লাহ্ ও তার রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধে লড়াই। সুতরাং তারা যে পরাজিত হবে এতে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকতে পারে কি?
অতঃপর প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ্ বলেনঃ আল্লাহর বিধান ও নীতি এটাই যে, যখন কাফির ও মুমিনদের মধ্যে মুকাবিলা হয় তখন তিনি মুমিনদেরকে কাফিরদের উপর জয়যুক্ত করে থাকেন এবং সত্যকে প্রকাশ করেন ও মিথ্যাকে দাবিয়ে দেন। যেমন বদরের যুদ্ধে তিনি মুমিনদেরকে কাফিরদের উপর জয়যুক্ত করেন। অথচ কাফিরদের সংখ্যাও ছিল মুমিনদের সংখ্যার কয়েকগুণ বেশী এবং তাদের যুদ্ধাস্ত্রও ছিল বহুগুণে অধিক।
এরপর মহান আল্লাহ্ বলেন:তোমরা আল্লাহ্ তা’আলার এই অনুগ্রহের কথাও ভুলে যেয়ো না যে, তিনি মক্কা উপত্যকায় মুশরিকদের হস্ত তোমাদের হতে নিবারিত করেন এবং তোমাদের হস্ত তাদের হতে নিবারিত করেন তাদের উপর তোমাদেরকে বিজয়ী করবার পর। অর্থাৎ তিনি মুশরিকদের হাত তোমাদের পর্যন্ত পৌঁছতে দেননি, তারা তোমাদেরকে আক্রমণ করেনি। আবার তোমাদেরকেও তিনি মসজিদে হারামের পার্শ্বে যুদ্ধ করা হতে ফিরিয়ে রাখেন এবং তোমাদের ও তাদের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দেন। এটা তোমাদের জন্যে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় দিক দিয়েই উত্তম। এই সূরারই তাফসীরে হযরত সালমা ইবনে আকওয়া (রাঃ) বর্ণিত যে হাদীসটি গত হয়েছে তা স্মরণ থাকতে পারে যে, যখন সত্তর জন কাফিরকে বেঁধে সাহাবীগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সামনে পেশ করেন তখন তিনি বলেনঃ “এদেরকে ছেড়ে দাও। মন্দের সূচনা এদের দ্বারাই হয়েছে এবং এর পুনরাবৃত্তিও এদের দ্বারাই হবে।” এ ব্যাপারেই (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন মক্কার আশিজন কাফির সুযোগ পেয়ে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় তানঈম পাহাড়ের দিক হতে নেমে আসে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) অসতর্ক ছিলেন না। তিনি তৎক্ষণাৎ সাহাবীদেরকে (রাঃ) খবর দেন। সুতরাং তাদের সকলকেই গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হয় এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সামনে পেশ করা হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) দয়া করে তাদের সবকেই ছেড়ে দেন। এরই বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ)-ও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল আল মুযানী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি। বলেনঃ “যে গাছটির কথা কুরআন কারীমের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে ঐ গাছটির নীচে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) অবস্থান করছিলেন। আমরাও তাঁর চতুম্পার্শ্বে ছিলাম। ঐ গাছটির শাখাগুলো রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কোমর পর্যন্ত লটকে ছিল। তার সামনে হযরত আলী (রাঃ) বিদ্যমান ছিলেন এবং সুহাইল ইবনে আমরও তাঁর সামনে ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে বলেনঃ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখো। এ কথা শুনে সুহাইল রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর হাত ধরে নেয় এবং বলেঃ “রহমান ও রাহীমকে আমরা চিনি না। আমাদের এই সন্ধিপত্রটি আমাদের দেশপ্রথা অনুযায়ী লিখিয়ে নিন।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তখন হযরত আলী (রাঃ)-কে বলেনঃ (আরবী) “লিখো।” তারপর লিখলেনঃ “এটা ঐ জিনিস যার উপর আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) মক্কাবাসীর সাথে সন্ধি করেছেন।” এ কথায় সুহাইল পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাত ধরে নেয় এবং বলেঃ “আপনি যদি আল্লাহর রাসূল (সঃ)-ই হন তাহলে তো আমরা আপনার উপর যুলুম করেছি। এই সন্ধি নামায় ঐ কথাই লিখিয়ে নিন। যা আমাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে বললেনঃ “লিখো, এটা ঐ জিনিস যার উপর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ (সঃ) মক্কাবাসীর সাথে সন্ধি করেছেন। ইতিমধ্যে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত ত্রিশজন কাফির যুবক এসে পড়ে। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাদের বিরুদ্ধে বদ দু’আ করেন। আল্লাহ্ তাদেরকে বধির করে দেন। সাহাবীগণ (রাঃ) উঠে তখন তাদেরকে পাকড়াও করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমাদেরকে কেউ কি নিরাপত্তা দান করেছে, না তোমরা কারো দায়িত্বের উপর এসেছো?” তারা উত্তরে বলেঃ “না।” এতদসত্ত্বেও নবী (সঃ) তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং ছেড়ে দেন। তখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা …. (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে ইযী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) যখন কুরবানীর জন্তু সঙ্গে নিয়ে চললেন এবং যুলহুলাইফা নামক স্থান পর্যন্ত পৌছে গেলেন তখন হযরত উমার (রাঃ) আরয করলেনঃ “হে আল্লাহর নবী (সঃ)! আপনি এমন এক কওমের পল্লীতে যাচ্ছেন যাদের বহু যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে, আর আপনি এ অবস্থায় যাচ্ছেন যে, আপনার কাছে অস্ত্র-শস্ত্র কিছুই নেই।” হযরত উমার (রাঃ)-এর একথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তোক পাঠিয়ে মদীনা হতে অস্ত্র-শস্ত্র এবং সমস্ত আসবাবপত্র আনিয়ে নিলেন। যখন তিনি মক্কার নিকটবর্তী হলেন তখন মুশরিকরা তাকে বাধা দিলো এবং বললো যে, তিনি যেন মক্কায় না যান। তিনি সফর অব্যাহত রাখলেন এবং মিনায় গিয়ে অবস্থান করলেন। তার গুপ্তচর এসে তাকে খবর দিলেন যে, ইকরামা ইবনে আবু জেহেল পাচশ’ সৈন্য নিয়ে তার উপর আক্রমণ করতে আসছে। তিনি তখন হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ)-কে বলেনঃ “হে খালিদ (রাঃ)! তোমার চাচাতো ভাই সেনাবাহিনী নিয়ে আমাদের উপর হামলা করতে আসছে, এখন কি করবে?” উত্তরে হযরত খালিদ (রাঃ) বলেনঃ “তাতে কি হলো? আমি তো আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর তরবারী?” সেই দিন হতেই তাঁর উপাধি দেয়া হয় সাইফুল্লাহ্ (আল্লাহর তরবারী)। অতঃপর হযরত খালিদ (রাঃ) বলেনঃ “আপনি আমাকে যেখানে ইচ্ছা এবং যার সাথে ইচ্ছা মুকাবিলা করতে পাঠিয়ে দিন।” এরপর হযরত খালিদ (রাঃ) ইকরামা (রাঃ)-এর মুকাবিলায় বেরিয়ে পড়েন। যুদ্ধ ঘাঁটিতে উভয়ের মধ্যে মুকাবিলা হয়। হযরত খালিদ (রাঃ) তাঁকে এমন কঠিনভাবে আক্রমণ করেন যে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে টিকতে না পেরে মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। হযরত খালিদ (রাঃ) ইকরামা (রাঃ)-কে মক্কার গলি পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু ইকরামা (রাঃ) পুনরায় নতুনভাবে সজ্জিত হয়ে মুকাবিলায় এগিয়ে আসেন। এবারও তিনি পরাজিত হয়ে মক্কার গলি পর্যন্ত পৌছে যান। ইকরামা (রাঃ) তৃতীয়বার আবার আসেন। এবারও একই অবস্থা হয়। এরই বর্ণনা …(আরবী)-এই আয়াতে রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সফলতা সত্ত্বেও কাফিরদেরকেও বাঁচিয়ে নেন যাতে মক্কায় অবস্থানরত দুর্বল মুসলমানরা ইসলামী সেনাবাহিনী কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। (ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন)
কিন্তু এই রিওয়াইয়াতের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এটা হুদায়বিয়ার ঘটনা হওয়া অসম্ভব। কেননা, তখন পর্যন্ত হযরত খালিদ (রাঃ)-ই তো মুসলমান হননি। বরং ঐ সময় তিনি মুশরিকদের সেনাবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন, যেমন এটা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এও হতে পারে যে, এটা উমরাতুল কাযার ঘটনা। কেননা, হুদায়বিয়ার সন্ধিনামায় এটাও একটা শর্ত ছিল যে, আগামী বছর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কায় আসবেন এবং তিন দিন পর্যন্ত তথায় অবস্থান করবেন। সুতরাং এই শর্ত মুতাবেক যখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) মক্কায় আগমন করেন তখন মক্কাবাসী মুশরিকরা তাকে বাধাও দেয়নি এবং তার সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহেও লিপ্ত হয়নি।
অনুরূপভাবে এটা মক্কা বিজয়ের ঘটনাও হতে পারে না। কেননা, ঐ বছর রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরবানীর জন্তু সঙ্গে নিয়ে যাননি। ঐ সময় তো তিনি যুদ্ধের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। সুতরাং এই রিওয়াইয়াতে বড়ই গোলমাল রয়েছে। এটা অবশ্যই ত্রুটিমুক্ত নয়। সুতরাং এ ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর গোলাম হযরত ইকরামা (রাঃ) বলেন যে, কুরায়েশরা চল্লিশ বা পঞ্চাশজন লোককে এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে যে, তারা যেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সেনাবাহিনীর চতুর্দিকে ঘোরাফেরা করে এবং সুযোগ পেলে যেন তাদের ক্ষতি সাধন করে কিংবা যেন কাউকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এদের সকলকেই পাকড়াও করা হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সবকেই ক্ষমা করেন ও ছেড়ে দেন। তারা তার সেনাবাহিনীর উপর কিছু পাথর এবং তীরও নিক্ষেপ করেছিল।
এটাও বর্ণিত আছে যে, ইবনে যানীম (রাঃ) নামক একজন সাহাবী হুদায়বিয়ার একটি ছোট পাহাড়ের উপর আরোহণ করেছিলেন। মুশরিকরা তার প্রতি তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে শহীদ করে দেয়। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁর কিছু অশ্বারোহীকে তাদের পশ্চাদ্ধাবনে পাঠিয়ে দেন। তারা তাদের সবকেই গ্রেফতার করে আনেন। তারা ছিল বারো জন অশ্বারোহী। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আমার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে কোন নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে কি?” তারা উত্তরে বলেঃ “না।” তিনি আবার প্রশ্ন করেনঃ “কোন অঙ্গীকার ও চুক্তি আছে কি?” তারা জবাব দেয়ঃ “না।” কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে ছেড়ে দেন। এই ব্যাপারেই (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২৫-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আরবের মুশরিক কুরায়েশগণ এবং যারা তাদের সাথে এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ ছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা তাদেরকে সাহায্য করবে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, প্রকৃতপক্ষে এ লোকগুলো কুফরীর উপর রয়েছে। তারাই মুমিনদেরকে মসজিদুল হারাম হতে নিবৃত্ত করেছিল, অথচ এই মুমিনরাই তো খানায়ে কা’বার জিয়ারতের অধিকতর হকদার ও যোগ্য ছিল। অতঃপর তাদের ঔদ্ধত্য ও বিরোধিতা তাদেরকে এতো দূর অন্ধ করে রেখেছিল যে, আল্লাহর পথে কুরবানীর জন্যে আবদ্ধ পশুগুলোকে যথাস্থানে পৌছতেও বাধা দিয়েছিল। এই কুরবানীর পশুগুলো সংখ্যায় সত্তরটি ছিল। যেমন সত্বরই এর বর্ণনা আসছে ইনশাআল্লাহ্।
এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ হে মুমিনগণ! আমি যে তোমাদেরকে মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি প্রদান করিনি এর মধ্যে গুপ্ত রহস্য এই ছিল যে, এখনও কতগুলো দুর্বল মুসলমান মক্কায় রয়েছে যারা এই যালিমদের কারণে না তাদের ঈমান প্রকাশ করতে পারছে, না হিজরত করে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হতে সক্ষম হচ্ছে এবং না তোমরা তাদেরকে চেনো বা জানো। সুতরাং যদি হঠাৎ করে তোমাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হতো এবং তোমরা মক্কাবাসীর উপর আক্রমণ চালাতে তবে ঐ খুঁটি ও পাকা মুসলমানরাও তোমাদের হাতে শহীদ হয়ে যেতো। ফলে, তোমরা তাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে। তাই, এই কাফিরদের শাস্তিকে আল্লাহ্ কিছু বিলম্বিত করলেন যাতে ঐ দুর্বল মুমিনরাও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যাদের ভাগ্যে ঈমান রয়েছে তারাও ঈমান আনয়ন করে ধন্য হতে পারে। যদি তারা পৃথক হতো তবে আমি তাদের মধ্যে যারা কাফির তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি প্রদান করতাম।
হযরত জুনায়েদ ইবনে সুবী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি দিনের প্রথমভাগে কাফিরদের সাথে মিলিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। ঐ দিনেরই শেষ ভাগে আল্লাহ্ তা’আলা আমার অন্তর ফিরিয়ে দেন এবং আমি মুসলমান হয়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে মিলিত হয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। আমাদের ব্যাপারেই …(আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। আমরা ছিলাম মোট নয়জন লোক, সাতজন পুরুষলোক এবং দু’জন স্ত্রী লোক।”
অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত জুনায়েদ (রাঃ) বলেনঃ “আমরা ছিলাম তিনজন পুরুষ ও নয়জন স্ত্রী লোক।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আল্লাহ্ পাকের এ উক্তি সম্পর্কে বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে ? যদি এই মুমিনরা ঐ কাফিরদের সাথে মিলে ঝুলে না থাকতো তবে অবশ্যই আমি ঐ সময়েই মুমিনদের হাত দ্বারা কাফিরদেরকে কঠিন বেদনাদায়ক শাস্তি দিতাম। তাদেরকে হত্যা করে দেয়া হতো।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ যখন কাফিররা তাদের অন্তরে পোষণ করতো গোত্রীয় অহমিকা- অজ্ঞতা যুগের অহমিকা, এই অহমিকার বশবর্তী হয়েই তারা সন্ধিপত্রে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম লিখাতে অস্বীকার করে এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নামের সাথে রাসূলুল্লাহ্ কথাটি যোগ করাতেও অস্বীকৃতি জানায়, তখন আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ) ও মুমিনদের অন্তর খুলে দেন এবং তাদের উপর স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করেন, আর তাদেরকে তাকওয়ার বাক্যে সুদৃঢ় করেন অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ কালেমার উপর তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত রাখেন। যেমন এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি এবং যেমন এটা মুসনাদে আহমাদের মারফু হাদীসে বিদ্যমান রয়েছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, আমি জনগণের সাথে জিহাদ করতে থাকবো যে পর্যন্ত না তারা বলেঃ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই’ সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই’ এ কথা বললো সে তার মাল ও জানকে আমা হতে বাঁচিয়ে নিলো ইসলামের হক ব্যতীত এবং তার হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আল্লাহর।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) আল্লাহ তা’আলা এটা স্বীয় কিতাবে বর্ণনা করেছেন। এক সম্প্রদায়ের নিন্দামূলক বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ্ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের নিকট আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই বলা হলে তারা অহংকার করতো।” (৩৭:৩৫) আর এখানে আল্লাহ্ তা’আলা মুমিনদের প্রশংসার বর্ণনা দিতে গিয়ে এও বলেনঃ “তারাই ছিল এর অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত।
এ কালেমা হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’। তারা এতে অহংকার প্রকাশ করেছিল। আর মুশরিক কুরায়েশরাও এটা হতে হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন অহংকার করেছিল। এরপরেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের সাথে একটা নির্দিষ্ট সময়কালের জন্যে সন্ধিপত্র পূর্ণ করে নিয়েছিলেন। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-ও এ হাদীসটি এরূপ বৃদ্ধির সাথে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রকাশ্যভাবে এটা জানা যাচ্ছে যে, এই পরবর্তী বাক্যটি বর্ণনাকারীর নিজের উক্তি অর্থাৎ হযরত যুহরী (রঃ)-এর নিজের উক্তি, যা এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যেন এটা হাদীসেই রয়েছে। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ইখলাস বা আন্তরিকতা উদ্দেশ্য। আতা (রঃ) বলেন যে, কালেমাটি হলো নিম্নরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই, রাজত্ব তারই এবং প্রশংসাও তাঁরই, এবং তিনি প্রত্যেক জিনিসের উপর ক্ষমতাবান।” হযরত সাওর (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা (আরবী) উদ্দেশ্য। হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে (আরবী) -এই কালেমাকে। হযরত ইবনে উমার (রাঃ)-এর এটাই উক্তি। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দান উদ্দেশ্য, যা সমস্ত তাকওয়ার মূল। হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ এ কালেমাও উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করাও উদ্দেশ্য। হযরত আতা খুরাসানী (রঃ) বলেন যে, কালেমায়ে তাকওয়া হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই কালেমাটি। হযরত যুহরী (রঃ) বলেন যে, এই কালেমা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই কালেমাটি।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা বলেনঃ ‘আল্লাহ সমস্ত বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখেন। অর্থাৎ কল্যাণ লাভের যোগ্য কারা এবং শিরুকের যোগ্য কারা তা তিনি ভালভাবেই অবগত আছেন।
হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ)-এর কিরআত রয়েছে নিম্নরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “কাফিররা যখন তাঁদের অন্তরে অজ্ঞতাযুগের অহমিকা পোষণ করেছিল তখন তোমরাও যদি তাদের মত অহমিকা পোষণ করতে তবে ফল এই দাঁড়াতো যে, মসজিদুল হারামে ফাসাদ সৃষ্টি হয়ে যেতো।”
হযরত উমার (রাঃ)-এর কাছে যখন হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ)-এর এ কিরআতের খবর পৌছে তখন তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েন। কিন্তু হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) তাকে বলেনঃ “এটা তো আপনিও খুব ভাল জানেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে সদা যাতায়াত ও উঠাবসা করতাম এবং আল্লাহ্ তাঁকে যা কিছু শিখাতেন, তিনি আমাকেও তা হতে শিক্ষা দিতেন!” তাঁর এ কথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “আপনি জ্ঞানী ও কুরআনের পাঠক। আপনাকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ) যা কিছু শিখিয়েছেন তা আপনি পাঠ করুন ও আমাদেরকে শিখিয়ে দিন!” (এ হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হুদায়বিয়ার কাহিনী এবং সন্ধির ঘটনায় যেসব হাদীস এসেছে সেগুলোর বর্ণনাঃ
হযরত মিসওয়ার ইবনে মুখরিমা (রাঃ) এবং হযরত মাওয়ান ইবনে হাকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বায়তুল্লাহ্র যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। কুরবানীর সত্তরটি উট তাঁর সঙ্গে ছিল। তাঁর সঙ্গীদের মোট সংখ্যা ছিল সাতশ’। প্রতি দশজনের পক্ষ হতে এক একটি উট ছিল। যখন তারা আসফান নামক স্থানে পৌঁছেন তখন হযরত বির ইবনে সুফিয়ান (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কুরায়েশরা আপনার আগমনের সংবাদ পেয়ে মুকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। তারা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোও সঙ্গে নিয়েছে এবং চিতা ব্যাঘ্রের চামড়া পরিধান করেছে। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে যে, এভাবে জোরপূর্বক আপনাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দিবে না। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ)-কে তারা ছোট এক সেনাবাহিনী দিয়ে কিরা’গামীম পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়েছে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “কুরায়েশদের জন্যে আফসোস যে, যুদ্ধ-বিগ্রহই তাদেরকে খেয়ে ফেলেছে। এটা কতই না ভাল কাজ হতো যে, তারা আমাকে ও জনগণকে ছেড়ে দিতো। যদি তারা আমার উপর জয়যুক্ত হতো তবে তো তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যেতো। আর যদি আল্লাহ তাআলা আমাকে লোকদের উপর বিজয়ী করতেন তবে ঐ লোকগুলোও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যেতো। যদি তারা তখনো ইসলাম কবুল না করতো তবে আমার সাথে আবার যুদ্ধ করতে এবং ঐ সময় তাদের শক্তিও পূর্ণ হয়ে যেতো। কুরায়েশরা কি মনে করেছে? আল্লাহর শপথ! এই দ্বীনের উপর আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবো এই পর্যন্ত যে, হয় আল্লাহ্ আমাকে তাদের উপর প্রকাশ্যভাবে জয়যুক্ত করবেন, না হয় আমার গ্রীবা কেটে ফেলা হবে।” অতঃপর তিনি তার সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলেন যে, তাঁরা যেন ডান দিকে হিযের পিছন দিয়ে ঐ রাস্তার উপর দিয়ে চলেন যা সানিয়াতুল মিরারের দিকে গিয়েছে। আর হুদায়বিয়া মক্কার নীচের অংশে রয়েছে। খালিদ (রাঃ)-এর সেনাবাহিনী যখন দেখলো যে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) পথ পরিবর্তন করেছেন তখন তারা তাড়াতাড়ি কুরায়েশদের নিকট গিয়ে তাদেরকে এ খবর জানালো। ওদিকে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) যখন সানিয়াতুল মিরারে পৌঁছেছেন তখন তার উজ্জ্বীটি বসে পড়ে। জনগণ বলতে শুরু করে যে, তার উজ্জ্বীটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এ কথা শুনে বললেনঃ “আমার এ উষ্ট্রী ক্লান্তও হয়নি এবং ওর বসে যাওয়ার অভ্যাসও নেই। ওকে ঐ আল্লাহ্ থামিয়ে দিয়েছেন যিনি মক্কা হতে হাতীগুলোকে আটকিয়ে রেখেছিলেন। জেনে রেখো যে, আজ কুরায়েশরা আমার কাছে যা কিছু চাইবে আমি আত্মীয়তার সম্পর্ক হিসেবে তাদেরকে তা-ই প্রদান করবো।” অতঃপর তিনি তার সেনাবাহিনীকে শিবির সন্নিবেশ করার নির্দেশ দিলেন। তাঁরা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এই সারা উপত্যকায় এক ফোঁটা পানি নেই।” তিনি তখন তাঁর তৃণ (তীরদানী) হতে একটি তীর বের করে একজন সাহাবী (রাঃ)-এর হাতে দিলেন এবং বললেনঃ “এখানকার কোন কূপের মধ্যে এটা গেড়ে দাও।” ঐ তীরটি গেড়ে দেয়া মাত্রই উচ্ছ্বসিতভাবে পানির ফোয়ারা উঠতে শুরু করলো। সমস্ত সাহাবী পানি নিয়ে নিলেন এবং এর পরেও পানি উপর দিকে উঠতেই থাকলো। যখন শিবির সন্নিবেশিত হলো এবং তাঁরা প্রশান্তভাবে বসে পড়লেন তখন বুদায়েল ইবনে অরকা খুযাআ’হ্ গোত্রের কতক লোকজনসহ আগমন করলো। বুদায়েলকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ কথাই বললেন যে কথা বি ইবনে সুফিয়ানকে বলেছিলেন। লোকগুলো ফিরে গেল এবং কুরায়েশদেরকে বললোঃ “তোমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ব্যাপারে বড়ই তাড়াহুড়া করেছে। তিনি তো যুদ্ধ করতে আসেননি, তিনি এসেছেন শুধু বায়তুল্লাহ্র যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে। তোমরা তোমাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পুনরায় চিন্তা-ভাবনা করে দেখো।” প্রকৃতপক্ষে খুযাআ গোত্রের মুসলমান ও কাফির সবাই রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর পক্ষপাতী ছিল। মক্কার খবরগুলো তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পৌছিয়ে দিতো।
কুরায়েশরা বুদায়েল ও তার সঙ্গীয় লোকদেরকে বললোঃ “যদিও রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এই উদ্দেশ্যেই এসেছেন তবুও আমরা তো তাকে এভাবে হঠাৎ করে মক্কায় প্রবেশ করতে দিতে পারি না। কারণ তিনি মক্কায় প্রবেশ করলে জনগণের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়বে যে, তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছেন, কেউ তাঁকে বাধা দিতে পারেনি।” অতঃপর তারা মুকরিয ইবনে হাক্সকে পাঠালো। এ লোকটি বনি আমির ইবনে ঈ গোত্রভুক্ত ছিল। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সাহাবীদেরকে বললেনঃ “এ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী লোক।” অতঃপর তিনি তাকেও ঐ কথাই বললেন যে কথা ইতিপূর্বে দু’জন আগমনকারীকে বলেছিলেন। এ লোকটিও ফিরে গিয়ে কুরায়েশদের নিকট সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলো। অতঃপর তারা হালীস ইবনে আলকামাকে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট পাঠালো। এ লোকটি আশেপাশের বিভিন্ন লোকদের নেতা ছিল। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে (রাঃ) বলেনঃ “এ লোকটি এমন সম্প্রদায়ের লোক যারা আল্লাহর কাজের সম্মান করে থাকে। সুতরাং তোমরা কুরবানীর পশুগুলোকে দাঁড় করিয়ে দাও।” সে যখন দেখলো যে, চতুর্দিক হতে কুরবানী চিহ্নিত পশুগুলো আসছে এবং দীর্ঘদিন থামিয়ে রাখার কারণে এগুলোর লোম উড়ে গেছে তখন সে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট না গিয়ে সেখান হতেই ফিরে আসে এবং কুরায়েশদেরকে বলেঃ “হে কুরায়েশের দল! আমি যা দেখলাম তাতে বুঝলাম যে, মুহাম্মাদ (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীদেরকে (রাঃ) বায়তুল্লাহর যিয়ারত হতে নিবৃত্ত করা তোমাদের উচিত নয়। আল্লাহর নামের পশুগুলো কুরবানীস্থল হতে নিবৃত্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটা চরম অত্যাচারমূলক কাজ। ওগুলোকে নিবৃত্ত রাখার কারণে ওগুলোর লোম পর্যন্ত উড়ে গেছে। আমি এটা স্বচক্ষে দেখে আসলাম।” কুরায়েশরা তখন তাকে বললো:“তুমি তো একজন মূখ বেদুঈন। তুমি কিছুই বুঝো না। সুতরাং চুপ করে বসে পড়।” তারপর তারা পরামর্শ করে উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফীকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পাঠিয়ে দিলো। সে যাওয়ার পূর্বে কুরায়েশদেরকে সম্বোধন করে বললোঃ “হে কুরায়েশের দল! যাদেরকে তোমরা ইতিপূর্বে মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নিকট পাঠিয়েছিলে, তারা তোমাদের নিকট ফিরে আসলে তোমরা তাদের সাথে কি ব্যবহার করেছে তা আমার অজানা নেই। তোমরা তাদের সাথে বড়ই দুর্ব্যবহার করেছে। তাদেরকে মন্দ বলেছে, তাদের অসম্মান করেছে, অপবাদ দিয়েছে এবং তাদের প্রতি কু-ধারণা পোষণ করেছে। আমার অবস্থা তোমাদের জানা আছে। আমি তোমাদেরকে পিতৃতুল্য মনে করি এবং আমাকে তোমাদের সন্তান মনে করি। তোমরা যখন বিপদে পড়ে হা-হুতাশ করেছে তখন আমি আমার কওমকে একত্রিত করেছি। যারা আমার কথা মেনে নিয়েছে আমি তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এবং তোমাদের সাহায্যের জন্যে আমি আমার জান, মাল ও কওমকে নিয়ে এগিয়ে এসেছি।” তার একথার জবাবে কুরায়েশরা সবাই বললোঃ “তুমি সত্য কথাই বলেছো। তোমার সম্পর্কে আমাদের কোন মন্দ ধারণা নেই।” অতঃপর সে চললো এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে তাঁর সামনে বসে পড়লো। তারপর সে বলতে লাগলোঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আপনি এদিক ওদিকে থেকে কতকগুলো লোককে একত্রিত করেছেন এবং এসেছেন স্বীয় কওমের শান-শওকত নিজেই নষ্ট করার জন্যে। শুনুন, কুরায়েশরা দৃঢ় সংকল্প করেছে, ছোট ছোট বাচ্চাদেরকেও তারা সঙ্গে নিয়েছে, চিতাবাঘের চামড়া তারা পরিধান করেছে এবং আল্লাহকে সামনে রেখে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছে যে, কখনই এভাবে জোরপূর্বক আপনাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দিবে না। আল্লাহর কসম! আমার তো মনে হয় যে, আজ যারা আপনার চতুষ্পর্শ্বে ভীড় জমিয়েছে, যুদ্ধের সময় তাদের একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।” ঐ সময় হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লহ (সঃ)-এর পিছনে বসেছিলেন। তিনি থামতে না পেরে বলে উঠলেনঃ “যাও, লাত’ (দেবী)-এর স্তন চোষণ করতে থাকো! আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ছেড়ে পালাবো?” উরওয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলো ? “এটা কে?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “এটা আবু কুহাফার পুত্র।” উরওয়া তখন হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললোঃ “যদি পূর্বে আমার উপর তোমার অনুগ্রহ না থাকতো তবে আমি অবশ্যই তোমাকে এর সমুচিত শিক্ষা দিতাম!” এরপর আরো কিছু বলার জন্যে উরওয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দাড়ি স্পর্শ করলো। হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা সেখানে দাড়িয়েছিলেন। তিনি উরওয়ার এ বেআদবী সহ্য করতে পারলেন না। তাঁর হাতে একখানা লোহা ছিল, তিনি তা দ্বারা তার হাতে আঘাত করে বললেনঃ “তোমার হাত দূরে রাখো, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দেহ স্পর্শ করো না।” উরওয়া তখন তাঁকে বললোঃ “তুমি বড়ই কর্কশভাষী ও বাকা লোক।” এদেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুচকি হাসলেন। উরওয়া জিজ্ঞেস করলোঃ “এটা কে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “এটা তোমার ভ্রাতুস্পুত্র মুগীরা ইবনে শু’বা (রাঃ)।” উরওয়া তখন হযরত মুগীরা (রাঃ)-কে বললোঃ “তুমি বিশ্বাসঘাতক। মাত্র কাল হতে তুমি তোমার শরীর ধুতে শিখেছে। (এর পূর্বে পবিত্রতা সম্বন্ধে তুমি অজ্ঞ ছিলে)। মোটকথা উরওয়াকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ জবাবই দিলেন যা ইতিপূর্বে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তাকে নিশ্চিত করে বললেন যে, তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি। সে ফিরে চললো। এখানকার দৃশ্য সে স্বচক্ষে দেখে গেল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁকে অত্যধিক ভালবাসে ও সম্মান করে। তাঁর অযুর পানি তারা হাতে হাতে নিয়ে নেন। তার মুখের থুথু হাতে নেয়ার জন্যে তারা প্রস্পর প্রতিযোগিতা করেন। তাঁর মাথার একটি চুল পড়ে গেলে প্রত্যেকেই তা নেয়ার জন্যে দৌড়িয়ে যান। সে কুরায়েশদের নিকট পোঁছে তাদেরকে বললোঃ “হে কুরায়েশের দল! আমি পারস্য সম্রাট কিসরার এবং আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর দরবারেও গিয়েছি। আল্লাহর কসম! আমি এ সম্রাটদেরও ঐরূপ সম্মান ও মর্যাদা দেখিনি। যেরূপ মর্যাদা ও সম্মান মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দেখলাম। তাঁর সাহাবীবর্গ (রাঃ) তাঁর যে সম্মান করেন এর চেয়ে বেশী সম্মান করা অসম্ভব। তোমরা এখন চিন্তা-ভাবনা করে দেখো এবং জেনে রেখো যে, মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সাহাবীগণ এমন নন যে, তাঁদের নবী (সঃ)-কে তোমাদের হাতে দিয়ে দিবেন।”
রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে ডেকে মক্কাবাসীর নিকট তাঁকে পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু এর পূর্বে একটি ঘটনা এই ঘটেছিল যে, একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত খারাশ ইবনে উমাইয়া খুযায়ী (রাঃ)-কে তাঁর সা’লাব নামক উষ্ট্রে আরোহণ করিয়ে মক্কায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কুরায়েশরা উটকে কেটে ফেলে এবং তাকেও হত্যা করার ইচ্ছা করে, কিন্তু আহাবীশ সম্প্রদায় তাঁকে বাঁচিয়ে নেন। সম্ভবতঃ এই ঘটনার ভিত্তিতেই হযরত উমার (রাঃ) উত্তরে বলেছিলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আশংকা করছি যে, মক্কাবাসীরা আমাকে হত্যা করে ফেলবে এবং সেখানে আমার গোত্র বানু আদ্দীর কোন লোক। নেই যে আমাকে কুরায়েশদের কবল হতে রক্ষা করতে পারে। সুতরাং আমার মনে হয় যে, হযরত উসমান (রাঃ)-কে পাঠানোই ভাল হবে। কেননা, তাদের দৃষ্টিতে হযরত উসমানই (রাঃ) আমার চেয়ে অধিক সম্মানিত ব্যক্তি।” হযরত উমার (রাঃ)-এর এ পরামর্শ রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভাল মনে করলেন। সুতরাং তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-কে ডেকে নিয়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন এবং তাঁকে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন কুরায়েশদেরকে বলেনঃ “আমরা যুদ্ধ করার জন্যে আসিনি, বরং আমরা এসেছি শুধু বায়তুল্লাহর যিয়ারত ও ওর মর্যাদা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে।” হযরত উসমান (রাঃ) শহরে সবেমাত্র পা রেখেছেন, ইতিমধ্যে আবান ইবনে সাঈদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়ে যায়। সে তখন তার সওয়ারী হতে নেমে গিয়ে হযরত উসমান (রাঃ)-কে সওয়ারীর আগে বসিয়ে দেয় এবং নিজে পিছনে বসে যায়। এভাবে নিজের দায়িত্বে সে হযরত উসমান (রাঃ)-কে নিয়ে চলে যেন তিনি মক্কাবাসীর কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পয়গাম পৌঁছিয়ে দিতে পারেন। সুতরাং তিনি সেখানে গিয়ে কুরায়েশদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাণী শুনিয়ে দেন। তাঁরা তাঁকে বললোঃ “আপনি তো এসেই গেছেন, সুতরাং আপনি ইচ্ছা করলে বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করে নিতে পারেন। কিন্তু তিনি উত্তরে বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাওয়াফ না করা পর্যন্ত আমি তাওয়াফ করতে পারি না। এটা আমার পক্ষে অসম্ভব।” তখন কুরায়েশরা হযরত উসমান (রাঃ)-কে আটক করে ফেলে। তাঁকে তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ফিরে যেতে দিলো না। আর ওদিকে ইসলামী সেনাবাহিনীর মধ্যে এ খবর রটে যায় যে, হযরত উসমান (রাঃ)-কে শহীদ করে দেয়া হয়েছে।
যুবহীর (রঃ) রিওয়াইয়াতে আছে যে, এরপর কুরায়েশরা সুহায়েল ইবনে আমরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পাঠিয়ে দেয় যে, সে যেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে সন্ধি করে আসে। কিন্তু এটা জরুরী যে, এ বছর তিনি মক্কায় প্রবেশ করতে পারেন না। কেননা এরূপ হলে আরববাসী তাদেরকে তিরস্কার করবে যে, মুহাম্মাদ (সঃ) আসলেন অথচ তারা তাকে বাধা দিতে পারলো না।
সুহায়েল এই দৌত্যকার্য নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হলো। . তাকে দেখেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “মনে হচ্ছে যে, কুরায়েশদের এখন সন্ধি করারই মত হয়েছে, তাই তারা এ লোকটিকে পাঠিয়েছে।” সুহাইল রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে কথা বলতে শুরু করলো। উভয়ের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা চলতে থাকলো। সন্ধির শর্তগুলো নির্ধারিত হলো। শুধু লিখন কার্য বাকী থাকলো। হযরত উমার (রাঃ) দৌড়িয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট গেলেন এবং তাঁকে বললেনঃ “আমরা কি মুমিন নই এবং এ লোকগুলো কি মুশরিক নয়?” উত্তরে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “হ্যা অবশ্যই আমরা মুমিন ও এরা মুশরিক।” “তাহলে দ্বীনের ব্যাপারে আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ করার কি কারণ থাকতে পারে?” প্রশ্ন করলেন হযরত উমার (রাঃ)! হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন হযরত উমার (রাঃ)-কে বললেনঃ “হে উমার (রাঃ)! রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পাদানী ধরে থাকো। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল (সঃ)। হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি।” অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট গিয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি মুসলমান নই এবং তারা কি মুশরিক নয়?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই আমরা মুসলমান এবং তারা মুশরিক।” তখন হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “তাহলে আমরা আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে দুর্বলতা প্রদর্শন করবো কেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। আমি তার হুকুমের বিরোধিতা করতে পারি না। আর আমি এ বিশ্বাস রাখি যে, তিনি আমাকে বিনষ্ট ও ধ্বংস করবেন না।” হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “আমি বলার সময় তো আবেগে অনেক কিছু বলে ফেললাম। কিন্তু পরে আমি বড়ই অনুতপ্ত হলাম। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমি বহু রোযা রাখলাম, বহু নামায পড়লাম, বহু গোলাম আযাদ করলাম এই ভয়ে যে, না জানি হয়তো আমার এই অপরাধের কারণে আমার উপর আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে কোন শাস্তি এসে পড়ে।”
রাসূলুল্লাহ (সঃ) সন্ধিপত্র লিখবার জন্যে হযরত আলী (রাঃ)-কে ডাকলেন এবং তাঁকে বললেনঃ “লিখো- ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।” তখন সুহায়েল প্রতিবাদ করে বললোঃ “আমি এটা বুঝি না, জানি না (আরবী) লিখিয়ে নিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে বললেনঃ “ঠিক আছে, তাই লিখো।” তারপর তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে বললেনঃ “লিখো- এটা ঐ সন্ধিপত্র যা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) লিখিয়েছেন। এবারও সুহায়েল প্রতিবাদ করে বললোঃ “আপনাকে যদি রাসূল বলেই মানবো তবে আপনার সাথে যুদ্ধ করলাম কেন? লিখিয়ে নিন- এটা ঐ সন্ধিপত্র যা আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ (সঃ) লিখিয়েছেন এবং সুহায়েল ইবনে আমর লিখিয়েছেন এই শর্তের উপর যে, (এক) উভয় দলের মধ্যে দশ বছর পর্যন্ত কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ হবে না। জনগণ শান্তি ও নিরাপদে বসবাস করবে। একে অপরকে বিপদাপদ হতে রক্ষা করবে। (দুই) যে ব্যক্তি তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট চলে যাবে তিনি তাকে ফিরিয়ে দিবেন। পক্ষান্তরে যে সাহাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হতে কুরায়েশদের নিকট চলে আসবে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না। উভয় দলের যুদ্ধ বন্ধ থাকবে এবং সন্ধি প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কেউ শৃংখলাবদ্ধ ও বন্দী হবে না। (তিন) যে কোন গোত্র কুরায়েশ অথবা মুসলমানদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ ও মিত্র হতে পারবে। তখন বানু খুযাআহ গোত্র বলে উঠলোঃ “আমরা মুসলমানদের মিত্র হলাম এবং তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ থাকলাম।” আর বানু বকর গোত্র বললোঃ “আমরা কুরায়েশদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ থাকলাম এবং তাদের মিত্র হলাম।” (চার) এ বছর রাসূলুল্লাহ (সঃ) উমরা না করেই ফিরে যাবেন। (পাঁচ) আগামী বছর রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীবর্গসহ মক্কায় আসবেন এবং তিন দিন অবস্থান করবেন। ঐ তিন দিন মক্কাবাসীরা অন্যত্র সরে যাবে। (ছয়) একজন সওয়ারের জন্যে যতটুকু অস্ত্রের প্রয়োজন, এটুকু ছাড়া বেশী অস্ত্র তারা সঙ্গে আনতে পারবেন না। তরবারী কোষের মধ্যেই থাকবে।
তখনও সন্ধিপত্রের লিখার কাজ চলতেই আছে এমতাবস্থায় সুহায়েলের পুত্র হযরত আবূ জানদাল (রাঃ) শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়তে পড়তে মক্কা হতে পালিয়ে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে যান। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) মদীনা হতে যাত্রা শুরু করার সময়ই বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন যে, তারা অবশ্যই বিজয় লাভ করবেন। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এটা স্বপ্নে দেখেছিলেন। এজন্যে বিজয় লাভের ব্যাপারে তাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এখানে এসে যখন তারা দেখলেন যে, সন্ধি হতে চলেছে এবং তাঁরা তাওয়াফ না করেই ফিরে যাচ্ছেন, আর বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজের উপর কষ্ট স্বীকার করে সন্ধি করছেন তখন তারা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। এমন কি তাদের এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, তারা যেন ধ্বংসই হয়ে যাবেন। এসব তো ছিলই, তদুপপারি আবু জানদাল (রাঃ), যিনি মুসলমান ছিলেন এবং যাকে মুশরিকরা বন্দী করে রেখেছিল ও নানা প্রকার উৎপীড়ন করছিল, যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এসেছেন তখন তিনি কোন প্রকারে সুযোগ পেয়ে লৌহ শৃংখলে আবদ্ধ অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে যান। তখন সুহায়েল উঠে তাঁকে চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করে এবং বলেঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আমার ও আপনার মধ্যে ফায়সালা হয়ে গেছে, এরপরে আবু জানদাল (রাঃ) এসেছে। সুতরাং এই শর্ত অনুযায়ী আমি একে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, ঠিক আছে।” সুহায়েল তখন হযরত আবু জানদাল (রাঃ)-এর জামার কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললো। হযরত আবু জানদাল (রাঃ) উচ্চস্বরে বলতে শুরু করেনঃ “হে মুসলিমবৃন্দ! আপনারা আমাকে মুশরিকদের নিকট ফিরিয়ে দিচ্ছেন? এরা তো আমার দ্বীন ছিনিয়ে নিতে চায়!” এ ঘটনায় সাহাবীবর্গ (রাঃ) আরো মর্মাহত হন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবূ জানদাল (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ “হে আবূ জানদাল (রাঃ)! ধৈর্য ধারণ কর ও নিয়ত ভাল রাখো। শুধু তুমি নও, বরং তোমার মত আরো বহু দুর্বল মুসলমানের জন্যে আল্লাহ তা’আলা পথ পরিষ্কার করে দিবেন। তিনি তোমাদের সবারই দুঃখ, কষ্ট এবং যন্ত্রণা দূর করে দিবেন। আমরা যেহেতু সন্ধি করে ফেলেছি এবং সন্ধির শর্তগুলো গৃহীত হয়ে গেছে, সেহেতু বাধ্য হয়েই তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। আমরা বিশ্বাসঘাতক ও চুক্তি ভঙ্গকারী হতে চাই না।” হযরত উমার (রাঃ) হযরত আবূ জানদাল (রাঃ)-এর সাথে সাথে তার পার্শ্ব দিয়ে চলতে থাকলেন। তিনি তাকে বলতে থাকলেনঃ “হে আবূ জানদাল (রাঃ)! সবর কর। এতো মুশরিক। এদের রক্ত কুকুরের রক্তের মত (অপবিত্র)।” হযরত উমার (রাঃ) সাথে সাথে চলতে চলতে তাঁর তরবারীর হাতলটি হযরত আবূ জানদাল (রাঃ)-এর দিকে করেছিলেন এবং তিনি চাচ্ছিলেন যে, তিনি যেন তরবারীটি টেনে নিয়ে স্বীয় পিতাকে হত্যা করে ফেলেন। কিন্তু হযরত আবূ জানাল (রাঃ)-এর হাতটি তাঁর পিতার উপর উঠলো না। সন্ধিকাৰ্য সমাপ্ত হলো এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) হারামে নামায পড়তেন এবং হালাল স্থানে তিনি অস্থির ও ব্যাকুল থাকতেন।
অতঃপর তিনি জনগণকে বললেনঃ “তোমরা উঠো এবং আপন আপন কুরবানী করে ফেললা ও মাথা মুণ্ডন কর।” কিন্তু একজনও এ কাজের জন্যে। দাঁড়ালো না। একই কথা তিনি তিনবার বললেন। কিন্তু এরপরেও সাহাবীদের (রাঃ) পক্ষ হতে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। রাসূলুল্লাহ তখন ফিরে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাঁকে বললেনঃ “জনগণের কি হলো তারা আমার কথায় সাড়া দিচ্ছে না?” জবাবে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এখন তাঁরা যে অত্যন্ত মর্মাহত তা আপনি খুব ভাল জানেন। সুতরাং তাদেরকে কিছু না বলে আপনি নিজের কুরবানীর পশুর নিকট গমন করুন এবং কুরবানী করে ফেলুন। আর নিজের মস্তক মুণ্ডন করুন। খুব সম্ভব আপনাকে এরূপ করতে দেখে জনগণও তাই করবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ কাজই করলেন। তার দেখাদেখি তখন সবাই উঠে পড়লেন এবং নিজ নিজ কুরবানীর পশু কুরবানী করলেন এবং মস্তক মুণ্ডন করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীগণ (রাঃ) সহ সেখান হতে প্রস্থান করলেন। অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছেন এমন সময় সূরায়ে আল ফাত্হ্ অবতীর্ণ হয়। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
সহীহ বুখারীতে এ রিওয়াইয়াতটি রয়েছে। তাতে আছে যে, তাঁর সামনে এক হাজার কয়েক শত সাহাবী (রাঃ) ছিলেন। যুল হুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছে কুরবানীর পশুগুলোকে চিহ্নিত করেন, উমরার ইহরাম বাঁধেন এবং খুযাআহ গোত্রীয় তাঁর এক গুপ্তচরকে গোয়েন্দাগিরির জন্যে প্রেরণ করেন। গাদীরুল আশতাতে এসে তিনি খবর দেন যে, কুরায়েশরা পূর্ণ সেনাবাহিনী গঠন করে নিয়েছে। তারা আশে-পাশের এদিক ওদিকের বিভিন্ন লোকদেরকেও একত্রিত করেছে। যুদ্ধ করা ও আপনাকে বায়তুল্লাহ শরীফ হতে নিবৃত্ত করাই তাদের উদ্দেশ্য।
সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে বললেনঃ “তোমরা পরামর্শ দাও। আমরা কি তাদের পরিবার পরিজন ও সন্তান-সন্ততির উপর আক্রমণ করবো? যদি তারা আমাদের নিকট আসে তবে আল্লাহ তা’আলা তাদের গর্দান কর্তন। করবেন অথবা তাদেরকে দুঃখিত ও চিন্তিত অবস্থায় পরিত্যাগ করবেন। যদি তারা বসে থাকে তবে ঐ দুঃখ ও চিন্তার মধ্যেই থাকবে। আর যদি তারা মুক্তি ও পরিত্রাণ পেয়ে যায় তবে এগুলো হবে এমন গর্দান যেগুলো মহামহিমান্বিত আল্লাহ কর্তন করবেন। দেখো, এটা কত বড় যুলুম যে, আমরা না কারো সাথে যুদ্ধ করতে এসেছি, না অন্য কোন উদ্দেশ্যে এসেছি। আমরা তো শুধু আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি, আর তারা আমাদেরকে এ কাজ হতে নিবৃত্ত করতে চাচ্ছে! বল তো, আমরা তাহলে কেন তাদের সাথে যুদ্ধ করবো না?” তার একথার জবাবে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। চলুন, আমরা অগ্রসর হই। আমাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধ-বিগ্রহ করা নয়। কিন্তু কেউ যদি আমাদেরকে আল্লাহর ঘর হতে নিবৃত্ত করে তবে আমরা তার সাথে প্রচণ্ড লড়াই করবো, সে যে কেউই হোক না কেন।” আল্লাহর রাসূল (সঃ) তখন সাহাবীদেরকে (রাঃ) বললেনঃ “তাহলে আল্লাহর নাম নিয়ে চলো আমরা এগিয়ে যাই।” আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “কুরায়েশদের অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) এগিয়ে আসছে। সুতরাং তোমরা ডান দিকে চলো। খালিদ (রাঃ) এ খবর জানতে পারলেন না। অবশেষ তারা সানিয়া নামক স্থানে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর খালিদ (রাঃ) এখবর পেয়ে কুরায়েশদের নিকট দৌড়িয়ে গেলেন এবং তাদেরকে এ খবর অবহিত করলেন। এ রিওয়াইয়াতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উস্ত্রীর নাম কাসওয়া’ বলা হয়েছে। তাতে এও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “কুরায়েশরা আমার কাছে যা চাইবে আমি তাদেরকে তাই দিবো যদি না তাতে আল্লাহর মর্যাদার হানী হয়।” অতঃপর যখন তিনি স্বীয় উস্ত্রীকে হাঁকালেন তখন ওটা দাড়িয়ে গেল। তখন জনগণ বললেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উষ্ট্রী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আমার উষ্ট্রী ক্লান্ত হয়নি, বরং ওকে হাতীকে নিবৃত্তকারী (আল্লাহ) নিবৃত্ত করেছেন।” বুদায়েল ইবনে অরকা খুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হতে গিয়ে যখন কুরায়েশদের নিকট জবাব পৌঁছিয়ে দিলো তখন উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী দাড়িয়ে নিজেকে তাদের কাছে ভালভাবে পরিচিত করলো, যেমন পূর্বে এ বর্ণনা দেয়া হয়েছে, অতঃপর সে কুরায়েশদেরকে একথাও বলেঃ “দেখো, এই লোকটি খুবই জ্ঞান সম্মত ও ভাল কথা বলেছে। সুতরাং তোমরা এটা কবুল করে নাও।” তারপর সে নিজেই যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে তাঁর ঐ জবাবই শুনালো তখন সে তাকে বললোঃ “শুনুন জনাব, দু’টি ব্যাপার রয়েছে, হয়তো আপনি বিজয়ী হবেন এবং তারা (কুরায়েশরা) পরাজিত হবে, নয়তো তারাই বিজয়ী হবে এবং আপনি হবেন পরাজিত। যদি প্রথম ব্যাপারটি ঘটে অর্থাৎ আপনি বিজয় লাভ করেন এবং তারা হয় পরাজিত, তাতেই বা কি হবে? তারা তো আপনারই কওম। আর আপনি কি এটা কখনো শুনেছেন যে, কেউ তার কওমকে ধ্বংস করেছে? আর যদি দ্বিতীয় ব্যাপারটি ঘটে যায় অর্থাৎ আপনি হন পরাজিত এবং তারা হয় বিজয়ী তবে তো আমার মনে হয় যে, আজ যারা আপনার পাশে রয়েছে তারা সবাই আপনাকে ছেড়ে পালাবে।” তার এ কথার জবাব হযরত আবু বকর (রাঃ) যা দিয়েছিলেন তা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে।
হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে যে, যে সময় উরওয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে কথাবার্তা বলছিল ঐ সময় তিনি (হযরত মুগীরা রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মাথার নিকট দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর হাতে তরবারী ছিল এবং মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ। যখন উরওয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দাড়িতে হাত দেয় তখন তিনি তরবারীর নাল দ্বারা তার হাতে আঘাত করেন। ঐ সময় উরওয়া হযরত মুগীরা (রাঃ)-এর পরিচয় পেয়ে তাকে বলেঃ “তুমি তো বিশ্বাসঘাতক। তোমার বিশ্বাসঘাতকতায় আমি তোমার সঙ্গী হয়েছিলাম।” ঘটনা এই যে, অজ্ঞতার যুগে হযরত মুগীরা (রাঃ) কাফিরদের একটি দলের সাথে ছিলেন। সুযোগ পেয়ে তিনি তাদেরকে হত্যা করে দেন এবং তাদের মালধন নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হন এবং ইসলাম কবুল করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “তোমার ইসলাম আমি মঞ্জুর করলাম বটে, কিন্তু এই মালের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।” উরওয়া এখানে এ দৃশ্যও দেখে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) থুথু ফেললে কোন না কোন সাহাবী তা হাতে ধরে নেন। তার ওষ্ঠ নড়া মাত্রই তাঁর আদেশ পালনের জন্যে একে অপরের আগে বেড়ে যান। তিনি যখন অযু করেন তখন তার দেহের অঙ্গগুলো হতে পতিত পানি গ্রহণ করবার জন্যে সাহাবীগণ কাড়াকাড়ি শুরু করে দেন। যখন তিনি কথা বলেন তখন সাহাবীগণ এমন নীরবতা অবলম্বন করেন যে, টু শব্দটি পর্যন্ত শোনা যায় না। তাঁকে তাঁরা এমন সম্মান করেন যে, তার চেহারা মুবারকের দিকেও তারা তাকাতে পারেন না, বরং অত্যন্ত আদবের সাথে চক্ষু নীচু করে বসে থাকেন। উরওয়া কুরায়েশদের নিকট ফিরে গিয়ে এই অবস্থার কথাই তাদেরকে শুনিয়ে দেয় এবং বলেঃ “মুহাম্মাদ (সঃ) যে ন্যায়সঙ্গত কথা বলছেন তা মেনে নাও।”
বানু কিনানা গোত্রের যে লোকটিকে কুরায়েশরা উরওয়ার পরে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পাঠিয়েছিল তাকে দেখেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) মন্তব্য করেছিলেনঃ “এ লোকেরা কুরবানীর পশুর বড়ই সম্মান করে থাকে। সুতরাং হে আমার সাহাবীবর্গ! তোমরা কুরবানীর পশুগুলোকে দাঁড় করিয়ে দাও এবং তার দিকে হাঁকিয়ে দাও।” যখন লোকটি এ দৃশ্য দেখলো এবং সাহাবীদের (রাঃ) মুখের ‘লাব্বায়েক’ ধ্বনি শুনলো তখন বলে উঠলোঃ “এই লোকদেরকে বায়তুল্লাহ হতে নিবৃত্ত করা বড়ই অন্যায়। তাতে এও রয়েছে যে, মুকরিযকে দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এ একজন ব্যবসায়িক লোক।” সে বসে কথাবার্তা বলতে আছে এমন সময় সুহায়েল এসে পড়ে। তাকে দেখেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে বলেনঃ “এখন সুহায়েল এসে পড়েছে।” সন্ধিপত্রে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখায় যখন সে প্রতিবাদ করে তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর রাসূল, যদিও তোমরা স্বীকার না কর ।” এটা এই পরিপ্রেক্ষিতে ছিল যে, যখন তাঁর উষ্ট্ৰীটি বসে পড়েছিল তখন তিনি বলেছিলেনঃ “এরা আল্লাহ তাআলার মর্যাদা রক্ষা করে আমাকে যা কিছু বলবে আমি তার সবই স্বীকার করে নিবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) সন্ধিপত্র লিখাতে গিয়ে বলেনঃ “এ বছর তোমরা আমাদেরকে বায়তুল্লাহ যিয়ারত করতে দিবে।” সুহায়েল তখন বলেঃ “এটা আমরা স্বীকার করতে পারি না। কেননা, এরূপ হলে জনগণ বলবে যে, কুরায়েশরা অপারগ হয়ে গেছে, কিছুই করতে পারলো না।” যখন এই শর্ত হচ্ছিল যে, যে কাফির মুসলমান হয়ে রাসলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট চলে যাবে তাকে তিনি ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন। তখন মুসলমানরা বলে উঠেনঃ “সুবহানাল্লাহ! এটা কি করে হতে পারে যে, সে মুসলমান হয়ে আসবে, আর তাকে কাফিরদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হবে।” এরূপ কথা চলছিল ইতিমধ্যে হযরত আবূ জানদাল (রাঃ) লৌহ শৃংখলে আবদ্ধ অবস্থায় এসে পড়েন। সুহায়েল তখন বলেঃ “একে ফিরিয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “এখন পর্যন্ত ততা সন্ধিপত্র পূর্ণ হয়নি। সুতরাং একে আমরা ফিরিয়ে পাঠাই কি করে?” সুহায়েল তখন বললোঃ “আল্লাহর কসম! আমি তাহলে অন্য কোন শর্তে সন্ধি করতে সম্মত নই।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তুমি বিশেষভাবে এর ব্যাপারে আমাকে অনুমতি দাও।” সে জবাব দিলোঃ “না, আমি এর ব্যাপারেও আপনাকে অনুমতি দিবো না।” তিনি দ্বিতীয়বার বললেন। কিন্তু এবারেও সে প্রত্যাখ্যান করলো। মুকরিয বললোঃ “হ্যা, আমরা আপনাকে এর অনুমতি দিচ্ছি।” আবু জানদাল (রাঃ) বললেনঃ “হে মুসলমানের দল! আপনারা আমাকে মুশরিকদের নিকট ফিরিয়ে দিচ্ছেন? অথচ আমি তো মুসলমান রূপে এসেছি। আমি কি কষ্ট ভোগ করছি তা কি আপনারা দেখতে পান না?” তাঁকে মহামহিমান্বিত আল্লাহর পথে কঠিন শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। তখন হযরত উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে যা কিছু বলেছিলেন তা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। হযরত উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আরো বললেনঃ “আপনি কি আমাদেরকে বলেননি যে, তোমরা সেখানে যাবে ও বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা, তা তো বলেছিলাম। কিন্তু এটা তো বলিনি যে, এটা এ বছরই হবে?” হযরত উমার (রাঃ) তখন বলেনঃ “হ্যা, একথা আপনি বলেননি বটে।” রাসুলল্লাহ বলেনঃ “তাহলে ঠিকই আছে, তোমরা অবশ্যই সেখানে যাবে এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে।” হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “অতঃপর আমি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট গেলাম এবং ঐ কথাই তাঁকেও বললাম।” এর বর্ণনা পূর্বে গত হয়েছে। এতে একথাও রয়েছে যে, তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে বলেনঃ “তিনি কি আল্লাহর রাসূল নন?” উত্তরে হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “হ্যা, অবশ্যই তিনি আল্লাহর রাসূল।” তারপর হযরত উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ভবিষদ্বাণীর কথা উল্লেখ করেন এবং ঐ জবাবই পান যা বর্ণিত হলো এবং যে জবাব স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) দিয়েছিলেন।
এই রিওয়াইয়াতে এও রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় হস্ত দ্বারা নিজের উটকে যবেহ করেন এবং নাপিতকে ডেকে মাথা মুণ্ডিয়ে নেন তখন সমস্ত সাহাবী (রাঃ) এক সাথে দাঁড়িয়ে যান এবং কুরবানীর কার্য শেষ করে একে অপরের মস্তক মুণ্ডন করতে শুরু করেন এবং দুঃখের কারণে একে অপরকে হত্যা করার উপক্রম হয়।
এরপর ঈমান আনয়নকারিণী নারীরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আসেন যাদের সম্পর্কে (আরবী) এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী হযরত উমার (রাঃ) তার দু’জন মুশরিকা স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন, যাদের একজনকে বিয়ে করেন মু’আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রাঃ) এবং অন্যজনকে বিয়ে করেন সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এখান হতে প্রস্থান করে মদীনায় চলে আসেন। আবূ বাসীর (রাঃ) নামক একজন কুরায়েশী, যিনি মুসলমান ছিলেন। সুযোগ পেয়ে তিনি মক্কা হতে পলায়ন করে মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পৌঁছে যান। তার পরেই দু’জন কাফির রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয় এবং আরয করেঃ “চুক্তি অনুযায়ী এ লোকটিকে আপনি ফিরিয়ে দিন। আমরা কুরায়েশদের প্রেরিত দূত। আবূ বাসীর (রাঃ)-কে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে আমরা এসেছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আচ্ছা, ঠিক আছে, তাকে আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি।” সুতরাং তিনি আবূ বাসীর (রাঃ)-কে তাদের হাতে সমর্পণ করলেন। তারা দু’জন তাঁকে নিয়ে মক্কার পথে যাত্রা শুরু করলো। যখন তারা যুলহুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছলো তখন সওয়ারী হতে অবতরণ করে খেজুর খেতে শুরু করলো। আবূ বাসীর (রাঃ) তাদের একজনকে বললেনঃ “তোমার তরবারীখানা খুবই উত্তম।” উত্তরে লোকটি বললোঃ “হ্যা, উত্তম তো বটেই। ভাল লোহা দ্বারা এটা তৈরী। আমি বারবার এটাকে পরীক্ষা করেছি। এর ধার খুবই তীক্ষ্ণ।” হযরত আবু বাসীর (রাঃ) তাকে বললেনঃ “আমাকে ওটা একটু দাও তো, ওর ধার পরীক্ষা করে দেখি।” সে তখন তরবারীটা হযরত আবু বাসীর (রাঃ)-এর হাতে দিলো। হাতে নেয়া মাত্রই তিনি ঐ কাফিরকে হত্যা করে ফেলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি এ অবস্থা দেখে দৌড় দিলো,এবং একেবারে মদীনায় পৌঁছে নিশ্বাস ছাড়লো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে দেখেই বললেনঃ “লোকটি অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত্র অবস্থায় রয়েছে। সে ভয়াবহ কোন দৃশ্য দেখেছে। ইতিমধ্যে সে কাছে এসে পড়লো এবং বলতে লাগলোঃ “আল্লাহর কসম! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে এবং আমিও প্রায় নিহত হতে চলেছিলাম। দেখুন, ঐ যে সে আসছে।”
এরই মধ্যে হযরত আবু বাসীর (রাঃ) এসে পড়লেন এবং আরয করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ তা’আলা আপনার দায়িত্ব পূর্ণ করিয়েছেন। আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাকে তাদের হাতে সমর্পণ করে দিয়েছেন। এখন মহান আল্লাহর এটা দয়া যে, তিনি আমাকে তাদের হাত হতে রক্ষা করেছেন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আফসোস! কেমন লোক এটা? এততা যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করলো! যদি তাকে কেউ এটা বুঝিয়ে দিতো তবে কতইনা ভালো হতো! রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর একথা শুনে হযরত আবু বাসীর (রাঃ) সতর্ক হয়ে গেলেন এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে, সম্ভবতঃ রাসূলুল্লাহ। (সঃ) পুনরায় তাকে মুশরিকদের কাছে সমর্পণ করবেন। তাই তিনি মদীনা হতে বিদায় হয়ে গেলেন এবং দ্রুত পদে সমুদ্রের তীরের দিকে চললেন। সমুদ্রের তীরেই তিনি বসবাস করতে লাগলেন। এ খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো। হযরত আবূ জানদাল (রাঃ), যাকে এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হুদায়বিয়া হতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, সুযোগ পেয়ে মক্কা হতে পালিয়ে আসেন এবং সরাসরি হযরত আবু বাসীর (রাঃ)-এর নিকট চলে যান। এখন অবস্থা এই দাঁড়ায় যে, মুশরিক কুরায়েশদের মধ্যে যে কেউই ইসলাম গ্রহণ করতেন তিনিই সরাসরি আবূ বাসীর (রাঃ)-এর কাছে চলে আসতেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকতেন। শেষ পর্যন্ত তাদের একটি দল হয়ে যায়। তারা এখন এ কাজ শুরু করেন যে, কুরায়েশদের যে বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়ার দিকে আসতো, এ দলটি তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিতেন। ফলে তাদের কেউ কেউ নিহতও হতো এবং তাদের মালধন এই মুহাজির মুসলমানদের হাতে আসতো। শেষ পর্যন্ত মক্কার কুরায়েশরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। অবশেষে তারা মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট দূত পাঠিয়ে দেয়। তারা বলেঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! দয়া করে সমুদ্রের তীরবর্তী ঐ লোকদেরকে মদীনায় ডাকিয়ে নিন। আমরা তাদের দ্বারা খুবই উৎপীড়িত হচ্ছি। তাদের মধ্যে যে কেউ আপনার কাছে আসবে তাকে আমরা নিরাপত্তা দিচ্ছি। আমরা আপনাকে আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি এবং তাদের আপনার নিকট ডাকিয়ে নিতে অনুরোধ করছি।”
রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের আবেদন মঞ্জুর করলেন এবং ঐ মুহাজির মুসলমানদের নিকট লোক পাঠিয়ে তাদের সকলকে ডাকিয়ে নিলেন। তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ … (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করলেন।
মুশরিক কুরায়েশদের অজ্ঞতা যুগের অহমিকা এই ছিল যে, তারা সন্ধিপত্রে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখতে দেয়নি এবং নবী (সঃ)-এর নামের সাথে রাসূলুল্লাহ’ লিখবার সময়েও প্রতিবাদ করেছিল এবং তাঁকে বায়তুল্লাহ শরীফের যিয়ারত করতে দেয়নি।
হাবীব ইবনে আবি সাবিত (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু অয়েল (রাঃ)-এর নিকট গেলাম এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন, আমরা সিফফীনে ছিলাম। একটি লোক বললেনঃ “তোমরা কি ঐ লোকদেরকে দেখোনি যাদেরকে আল্লাহর কিতাবের দিকে আহ্বান করা হয়?” হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা।” তখন সাহল ইবনে হানীফ (রাঃ) বলেনঃ “তোমরা নিজেদেরকে অপবাদ দাও। আমরা নিজেদেরকে হুদায়বিয়ার দিন দেখেছি অর্থাৎ ঐ সন্ধির সময় যা নবী (সঃ) ও মুশরিকদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। যদি আমাদের যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য থাকতো তবে অবশ্যই আমরা যুদ্ধ করতাম।” অতঃপর হযরত উমার (রাঃ) এসে বললেনঃ “আমরা কি হকের উপর নই এবং তারা কি বাতিলের উপর নয়?” আমাদের শহীদরা জান্নাতী এবং তাদের নিহতরা কি জাহান্নামী নয়?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই।” হযরত উমার (রাঃ) তখন বললেনঃ “তাহলে কেন আমরা দ্বীনের ব্যাপারে দুর্বলতা প্রকাশ করবো এবং ফিরে যাবো? অথচ আল্লাহ তাআলা আমাদের মধ্যে কোন ফায়সালা করেননি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে খাত্তাবের (রাঃ) পুত্র! নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর রাসূল। তিনি কখনো আমাকে বিফল মনোরথ করবেন না।” একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) ফিরে আসলেন, কিন্তু ছিলেন অত্যন্ত রাগান্বিত। অতঃপর তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট গমন করেন এবং উভয়ের মধ্যে অনুরূপই প্রশ্নোত্তর হয়। এরপর সূরায়ে ফাতহ অবতীর্ণ হয়।
কোন কোন রিওয়াইয়াতে হযরত সাহল ইবনে হানীফ (রাঃ)-এর এরূপ উক্তিও রয়েছেঃ “আমি নিজেকে হযরত আবু জান্দাল (রাঃ)-এর ঘটনার দিন দেখেছি যে, যদি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হুকুমকে ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার থাকতো তবে অবশ্যই আমি ফিরিয়ে দিতাম।” তাতে এও রয়েছে যে, যখন সূরায়ে ফাহ্ অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে ডেকে এ সূরাটি শুনিয়ে দেন।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছেঃ যখন এই শর্ত মীমাংসিত হয় যে, মুশরিকদের লোক মুসলমানদের নিকট গেলে তাকে মুশরিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হবে, পক্ষান্তরে যদি মুসলমানদের লোক মুশরিকদের নিকট যায় তবে তাকে মুসলমানদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হবে না। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলা হয়ঃ “আমরা কি এটাও মেনে নিবো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা! কারণ আমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি তাদের নিকট যাবে তাকে আল্লাহ তাআলা আমাদের হতে দূরেই রাখবেন।” (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমেও বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “যখন খারেজীরা পৃথক হয়ে যায় তখন আমি তাদেরকে বলিঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন যখন মুশরিকদের সাথে সন্ধি করেন তখন তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে বলেনঃ “হে আলী (রাঃ)! লিখো- এগুলো হলো ঐ সন্ধির শর্তসমূহ যেগুলোর উপর আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) সন্ধি করেছেন।” তখন মুশরিকরা প্রতিবাদ করে বলেঃ “আমরা যদি আপনাকে রাসূল বলেই মানতাম তবে কখনো আপনার সাথে যুদ্ধ করতাম না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে আলী (রাঃ)! ওটা মিটিয়ে দাও। আল্লাহ খুব ভাল জানেন যে, আমি তার রাসূল। হে আলী (রাঃ)! ওটা কেটে দাও এবং লিখো- এগুলো ঐ শর্তসমূহ যেগুলোর উপর মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল্লাহ (সঃ) সন্ধি করেছেন। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ) অপেক্ষা বহুগুণে উত্তম ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ওটা কাটিয়ে নিলেন। এতে তাঁর নবুওয়াতের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হলো না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) সত্তরটি উট কুরবানী করেছিলেন যেগুলোর মধ্যে একটি উট আবূ জেহেলেরও ছিল। যখন এ উটগুলোকে বায়তুল্লাহ হতে নিবৃত্ত করা হলো তখন উটগুলো দুগ্ধপোষ্য শিশুহারা মায়ের মত ক্রন্দন করলো।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
২৭-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:
রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি মক্কা গিয়েছেন এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেছেন। তার এই স্বপ্নের বৃত্তান্ত তিনি মদীনাতেই স্বীয় সাহাবীদের (রাঃ) সামনে বর্ণনা করেছিলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির বছর যখন তিনি উমরার উদ্দেশ্যে মক্কার পথে যাত্রা শুরু করেন তখন এই স্বপ্নের ভিত্তিতে সাহাবীদের এটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এই সফরে তারা সফলতার সাথে এই স্বপ্নের প্রকাশ ঘটতে দেখতে পাবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন তাঁরা উল্টো ব্যাপার লক্ষ্য করেন এমনকি সন্ধিপত্র সম্পাদন করে তাদেরকে বায়তুল্লাহর যিয়ারত ছাড়াই ফিরে আসতে হয় তখন এটা তাদের কাছে খুবই কঠিন ঠেকে। সুতরাং হযরত উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি তো আমাদেরকে বলেছিলেনঃ “আমরা বায়তুল্লাহ শরীফে যাবো ও তাওয়াফ করবো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হ্যা, এটা সঠিক কথাই বটে, কিন্তু আমি তো একথা বলিনি যে, এই বছরই এটা করবো?” হযরত উমার (রাঃ) জবাব দেনঃ “হ্যা আপনি একথা বলেননি এটা সত্য।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “তাহলে এতো তাড়াহুড়া কেন? তোমরা অবশ্যই বায়তুল্লাহ শরীফে যাবে এবং তাওয়াফও অবশ্যই করবে।” অতঃপর হযরত উমার (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে এ প্রশ্নই করলেন এবং ঐ একই উত্তর পেলেন।
এখানে (আরবী) ইসতিসনা বা এর ব্যতিক্রমও হতে পারে এ জন্যে নয়, বরং এখানে এটা নিশ্চয়তা এবং গুরুত্বের জন্যে।
এই বরকতময় স্বপ্নের প্রকাশ ঘটতে সাহাবীগণ (রাঃ) দেখেছেন এবং পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে মক্কায় পৌঁছেছেন এবং ইহরাম ভেঙ্গে দিয়ে কেউ কেউ মাথা মুণ্ডন করিয়েছেন এবং কেউ কেউ কেশ কর্তন করিয়েছেন। সহীহ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা মাথা মুণ্ডনকারীদের উপর দয়া করুন।” সাহাবীগণ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “চুল কর্তনকারীদের উপরও কি?”
রাসূলুল্লাহ (সঃ) দ্বিতীয়বারও ঐ কথাই বললেন। আবার জনগণ ঐ প্রশ্নই করলেন। অবশেষে তৃতীয়বার বা চতুর্থবারে তিনি বললেনঃ “চুল-কর্তনকারীদের উপরও আল্লাহ দয়া করুন।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের কোন ভয় থাকবে না। অর্থাৎ মক্কায় যাওয়ার পথেও তোমরা নিরাপত্তা লাভ করবে এবং মক্কায় অবস্থানও হবে তোমাদের জন্যে নিরাপদ। উমরার কাযায় এটাই হয়। এই উমরা সপ্তম হিজরীর যুলকাদাহ মাসে হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) হুদায়বিয়া হতে যুলকাদাহ মাসে ফিরে এসেছিলেন। যুলহাজ্জাহ ও মুহাররাম মাসে তো মদীনা শরীফেই অবস্থান করেন। সফর মাসে খায়বার গমন করেন। ওর কিছু অংশ বিজিত হয় যুদ্ধের মাধ্যমে এবং কিছু অংশের উপর আধিপত্য লাভ করা হয় সন্ধির মাধ্যমে। এটা খুব বড় অঞ্চল ছিল। এতে বহু খেজুরের বাগান ও শস্য ক্ষেত্র ছিল। খায়বারের ইয়াহূদীদেরকে তিনি সেখানে খাদেম হিসেবে রেখে দিয়ে তাদের ব্যাপারে এই মীমাংসা করেন যে, তারা বাগান ও ক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ও কাজকর্ম করবে এবং উৎপাদিত ফল ও শস্যের অর্ধাংশ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে প্রদান করবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) খায়বারের সম্পদ শুধু ঐ সব সাহাবীর মধ্যে বন্টন করেন যারা হুদায়বিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ছাড়া আর কেউই এর অংশ প্রাপ্ত হননি। তবে তাঁরা এর ব্যতিক্রম ছিলেন যারা হাবশে হিজরত করার পর তথা হতে ফিরে এসেছিলেন। যেমন হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাঃ) ও তার সঙ্গীরা এবং হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা। হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে যেসব সাহাবী (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সবাই তার সাথে খায়বার যুদ্ধেও শরীক ছিলেন, শুধু আবু দাজানাহ সাম্মাক ইবনে খারশাহ (রাঃ) শরীক ছিলেন না, যেমন এর পূর্ণ বর্ণনা স্বস্থানে রয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) মদীনায় ফিরে আসেন। তারপর সপ্তম হিজরীর যুলকাদাহ মাসে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কার পথে যাত্রা শুরু করেন। তার সাথে হুদায়বিয়ায় অংশ গ্রহণকারী সাহাবীগণও ছিলেন। যুলহুলাইফা হতে ইহরাম বাঁধেন এবং কুরবানীর উটগুলো সাথে নেন। বলা হয়েছে যে, ওগুলোর সংখ্যা ছিল ষাট। তাঁরা ‘লাব্বায়েক’ শব্দ উচ্চারণ করতে করতে যখন মাররুয যাহরানের নিকটবর্তী হলেন তখন মুহাম্মাদ ইবনে সালমা (রাঃ)-কে কিছু ঘোড়া ও অস্ত্র-শস্ত্রসহ আগে আগে পাঠিয়েছিলেন। এ দেখে মুশরিকদের প্রাণ উড়ে গেল, কলিজা শুকিয়ে গেল। তাদের ধারণা হলো যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) পূর্ণ প্রস্তুতি ও সাজ-সরঞ্জামসহ এসেছেন। অবশ্যই তিনি এসেছেন যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। উভয় দলের মধ্যে দশ বছর কোন যুদ্ধ হবে না’ এই যে একটি শর্ত ছিল তিনি তা ভঙ্গ করেছেন। তাই, তারা মক্কায় দৌড়িয়ে গিয়ে মক্কাবাসীকে এ খবর দিয়ে দিলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন মাররুয যাহরানে পৌঁছলেন যেখান হতে কা’বা ঘরের মূর্তিগুলো দেখা যাচ্ছিল, তখন তিনি শর্ত অনুযায়ী সমস্ত বর্শা, বল্লাম, তীর, কামান বাতনে ইয়াজিজে পাঠিয়ে দেন। শুধু তরবারী সঙ্গে রাখেন এবং ওটাও কোষবদ্ধ থাকে। তখনো তিনি পথেই ছিলেন, ইতিমধ্যে মুশরিকরা মুকরিযকে তাঁর নিকট পাঠিয়ে দেয়। সে এসে বলেঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! চুক্তি ভঙ্গ করা তো আপনার অভ্যাস নয়?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “ব্যাপার কি?” সে উত্তরে বললোঃ “আপনি তীর, বর্শা ইত্যাদি সাথে এনেছেন?” তিনি জবাব দেন:“না, আমি তো ওগুলো বাতনে ইয়াজিজে পাঠিয়ে দিয়েছি?” সে তখন বললোঃ “আপনি যে একজন সৎ ও প্রতিজ্ঞাপালনকারী ব্যক্তি এ বিশ্বাস আমাদের ছিল।” অতঃপর মক্কার মুশরিক কুরায়েশরা মক্কা শহর ছেড়ে চলে গেল। তারা দুঃখে ও ক্রোধে ফেটে পড়লো। আজ তারা মক্কা শহরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও তার সাহাবীবর্গকে দেখতেও চায় না। যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু মক্কায় রয়ে গেল তারা পথে, প্রকোষ্ঠে এবং ছাদের উপর দাঁড়িয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে এই পবিত্র, অকৃত্রিম ও আল্লাহ ভক্ত সেনাবাহিনীর দিকে তাকাতে থাকলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীবর্গ (রাঃ) ‘লাব্বায়েক’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরবানীর পশুগুলোকে যী-তওয়া নামক স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর কাসওয়া নামক উষ্ট্রীর উপর আরোহণ করে চলছিলেন। যার উপর তিনি হুদায়বিয়ার দিন আরোহণ করেছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা আনসারী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উষ্ট্রীর লাগাম ধরে ছিলেন এবং নিম্নের কবিতাটি পাঠ করছিলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাঁর নামে, যার দ্বীন ছাড়া কোন দ্বীন নেই (অর্থাৎ অন্য কোন দ্বীন গ্রহণযোগ্য নয়)। ঐ আল্লাহর নামে, মুহাম্মাদ (সঃ) যাঁর রাসূল। হে কাফিরদের সন্তানরা! তোমরা তাঁর (রাসূল সঃ-এর) পথ হতে সরে যাও। আজ আমরা তাঁর প্রত্যাবর্তনের সময় তোমাদেরকে ঐ মারই মারবো যে মার তার আগমনের সময় মেরেছিলাম। এমন মার (প্রহার) যা মস্তিষ্ককে ওর ঠিকানা হতে সরিয়ে দিবে এবং বন্ধুকে বন্ধুর কথা ভুলিয়ে দিবে। করুণাময় (আল্লাহ) স্বীয় অহী অবতীর্ণ করেছেন যা ঐ সহীফাগুলোর মধ্যে রক্ষিত রয়েছে যা তাঁর রাসূল (সঃ)-এর সামনে পঠিত হয়। সর্বাপেক্ষা উত্তম মৃত্যু হলো শাহাদাতের মৃত্যু যা তাঁর পথে হয়। হে আমার প্রতিপালক! আমি এই কথার উপর ঈমান এনেছি।” কোন কোন রিওয়াইয়াতে কিছু হের ফেরও রয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, এই উমরার সফরে যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মাররুম্ যাহ্রান নামক স্থানে পৌছেন তখন সাহাবীগণ (রাঃ) শুনতে পান যে, মক্কাবাসী বলছে:“এ লোকগুলো (সাহাবীগণ) ক্ষীণতা ও দুর্বলতার কারণে উঠা-বসা করতে পারে না।” একথা শুনে সাহাবীগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আপনি অনুমতি দেন তবে আমরা আমাদের সওয়ারীর কতকগুলো উটকে যবেই করি এবং ওগুলোর গোশত খাই ও শুরুয়া পান করি এবং এভাবে শক্তি লাভ করে নব উদ্যমে মক্কায় গমন করি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে তাদেরকে বললেনঃ “না, এরূপ করতে হবে না। তোমাদের কাছে যে খাদ্য রয়েছে তা একত্রিত কর।” তাঁর এই নির্দেশমত সাহাবীগণ (রাঃ) তাদের খাদ্যগুলো একত্রিত করলেন এবং দস্তরখানা বিছিয়ে খেতে বসলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দু’আর কারণে খাদ্যে এতো বরকত হলো যে, সবাই পেট পুরে খেলেন ও নিজ নিজ থলে ভর্তি করে নিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীবর্গসহ মক্কায় আসলেন এবং সরাসরি বায়তুল্লাহ শরীফে গেলেন। কুরায়েশরা হাতীমের দিকে বসেছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) চাদরের পাল্লা ডান বগলের নীচ দিয়ে বের করে বাম কাঁধের উপর রেখে দিলেন। তিনি সাহাবীদেরকে (রাঃ) বললেন:“জনগণ যেন তোমাদের মধ্যে অলসতা ও দুর্বলতা অনুভব করতে না পারে।” তিনি রুকে চুম্বন করে দৌড়ের মত চালে তাওয়াফ শুরু করলেন। রুকনে ইয়ামানীর নিকট যখন পৌছলেন, যেখানে কুরায়েশদের দৃষ্টি পড়ছিল না, তখন সেখান হতে ধীরে ধীরে চলে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত পৌছলেন। কুরায়েশরা বলতে লাগলো:“তোমরা হরিণের মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে, চলা যেন তোমরা পছন্দই কর না।” তিনবার রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এভাবে হালকা দৌড়ে চলে হাজরে আসওয়াদ হতে রুকনে ইয়ামানী পর্যন্ত চলতে থাকলেন। তিন চক্র এভাবেই দিলেন। সুতরাং মাসনূন তরীকা এটাই। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, বিদায় হজ্বেও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এভাবেই তাওয়াফের তিন চক্রে রমল করেছিলেন অর্থাৎ হালকা দৌড়ে চলেছিলেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, প্রথম দিকে মদীনার আবহাওয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীদের (রাঃ) স্বাস্থ্যের প্রতিকূল হয়েছিল। জ্বরের কারণে তারা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীগণসহ মক্কায় পৌঁছেন তখন মুশরিকরা বলেঃ “এই যে লোকগুলো আসছে, এদেরকে মদীনার জ্বর দুর্বল ও অলস করে ফেলেছে।” আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে মুশরিকদের এই উক্তির খবর অবহিত করেন। মুশরিকরা হাতীমের নিকট বসেছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সাহাবীদেরকে (রাঃ) নির্দেশ দেন যে, তারা যেন হাজরে আসওয়াদ থেকে নিয়ে রুকনে ইয়ামানী পর্যন্ত তাওয়াফের প্রথম তিন চক্রে দুলকী দৌড়ে চলেন এবং রুকনে ইয়ামানী হতে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত চার চক্রে স্বাভাবিক গতিতে চলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) পূর্ণ সাত চক্রেই রমল বা দুলকী দৌড়ের নির্দেশ দেননি। এটা শুধু দয়ার কারণেই ছিল।
মুশরিকরা যখন দেখলো যে, সাহাবীগণ সবাই কুদে লাফিয়ে স্ফূর্তি সহকারে চলছেন তখন তারা পরস্পর বলাবলি করেঃ “এদের সম্পর্কে যে বলা হতো যে, মদীনার জ্বর এদেরকে দুর্বল ও অলস করে ফেলেছে এটাতো গুজব ছাড়া কিছুই নয়। এ লোকগুলো তো অমুক অমুকের চেয়েও বেশী চতুর ও চালাক?”
একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যুলকাদাহ মাসের ৪ তারিখে মক্কা শরীফে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, ঐ সময় মুশরিকরা কাঈকাআনের দিকে ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাফা মারওয়ার দিকে দৌড়ানোও মুশরিকদেরকে তাদের শক্তি দেখানোর জন্যেই ছিল।
হযরত ইবনে আবি আওফা (রাঃ) বলেনঃ “ঐ দিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে পর্দা করেছিলাম, যাতে কোন মুশরিক অথবা নির্বোধ তাঁর কোন ক্ষতি করতে না পারে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) উমরার উদ্দেশ্যে বের হন, কিন্তু কাফির কুরায়েশরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তাঁকে বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করতে দেয়নি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেখানেই কুরবানী করেন অর্থাৎ হুদায়বিয়াতেই কুরবানী দেন এবং মস্তক মুণ্ডন করিয়ে নেন। আর তাদের সাথে সন্ধি করেন। সন্ধির একটি শর্ত এই ছিল যে, তিনি এই বছর উমরা না করেই ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর উমরা করার জন্যে আসবেন। ঐ সময় তিনি তরবারী ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র সাথে আনতে পারবেন না এবং মক্কায় তিনি ঐ কয়েকদিন অবস্থান করবেন যা মক্কাবাসী চাইবে। ঐ শর্ত অনুযায়ী পরের বছর রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ ভাবেই মক্কায় আসেন এবং তিন দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন। তারপর মুশরিকরা বলেঃ “এখন আপনি বিদায় গ্রহণ করুন!” সুতরাং তিনি ফিরে আসলেন। (এ হাদীসটিও ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় সহীহ’গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
হযরত বারা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যুলকাদাহ মাসে উমরা করার ইচ্ছা করেন, কিন্তু মুশরিকরা তাকে বাধা প্রদান করে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের সাথে এই মীমাংসা করেন যে, তিনি মাত্র তিন দিন মক্কায় অবস্থান করবেন। যখন সন্ধিপত্র লিখার কাজ শুরু করা হয় তখন লিখা হয়ঃ “এটা ঐ পত্র যার উপর আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) সন্ধি করেছেন।” তখন মক্কাবাসী বললোঃ “যদি আমরা আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলে মানতাম তবে কখনো বাধা প্রদান করতাম না। বরং আপনি মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল্লাহ লিখিয়ে নিন।” তিনি তখন বললেনঃ “আমি আল্লাহর রাসূলও এবং মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল্লাহও বটে।” অতঃপর তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ শব্দটি কেটে দাও।” হযরত আলী (রাঃ) তখন বললেনঃ “আল্লাহর কসম! আমি এটা কখনো কাটতে পারবো না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেই সন্ধিপত্রটি হাতে নিয়ে ভালরূপে লিখতে না পারা সত্ত্বেও লিখেনঃ “এটা ঐ জিনিস যার উপর মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল্লাহ (সঃ) সন্ধি করেছেন।” তা এই যে, তিনি মক্কায় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন না, শুধু তরবারী নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন এবং সেটাও আবার কোষবদ্ধ থাকবে। আরো শর্ত এই যে, মক্কাবাসীদের যে কেউ তার সাথে যেতে চাইবে তাকে তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন না। পক্ষান্তরে তাঁর সঙ্গীদের কেউ যদি মক্কায় থেকে যেতে চায় তবে তিনি তাকে বাধা দিতে পারবেন না।” অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কায় আসলেন এবং নির্ধারিত সময় কেটে গেল। তখন মুশরিকরা হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট এসে বললোঃ “মুহাম্মাদ (সঃ)-কে বলুন যে, সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, সুতরাং এখন বিদায় হয়ে যেতে হবে।” তখন নবী (সঃ) বেরিয়ে পড়লেন। এমন সময় হযরত হামযা (রাঃ)-এর কন্যা চাচা চাচা বলে তাঁর পিছন ধরলো। হযরত আলী (রাঃ) তখন তার অঙ্গুলী ধরে হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং তাঁকে বললেনঃ “তোমার চাচার মেয়েকে ভালভাবে রাখো।” হযরত ফাতেমা (রাঃ) আনন্দের সাথে মেয়েটিকে তার পাশে বসালেন। এখন হযরত আলী (রাঃ), হযরত যায়েদ (রাঃ) এবং হযরত জাফর (রাঃ)-এর মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেল। হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ “আমি একে নিয়ে এসেছি, এটা আমার চাচার কন্যা।” হযরত জাফর (রাঃ) বললেনঃ “এটা আমার চাচাতো বোন এবং তার খালা আমার পত্নী।” হযরত যায়েদ (রাঃ) বললেনঃ “এটা আমার ভাইয়ের কন্যা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ ঝগড়ার মীমাংসা এই ভাবে করলেন যে, মেয়েটিকে তিনি তার খালাকে প্রদান করলেন এবং বললেন যে, খালা মায়ের স্থলাভিষিক্তা।” হযরত আলী (রাঃ)-কে তিনি বললেনঃ “তুমি আমা হতে এবং আমি তোমা হতে (অর্থাৎ আমার ও আমি তোমার)।” হযরত জাফর (রাঃ)-কে বললেনঃ “দৈহিক গঠনে ও চরিত্রে আমার সাথে তোমার পূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে ।” হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে বললেনঃ “তুমি আমার ভাই ও আযাদকৃত ক্রীতদাস।” হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি হযরত হামযা (রাঃ)-এর কন্যাকে বিয়ে করছেন না কেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “এটা আমার দুধ ভাই-এর কন্যা। (তাই তার সাথে আমার বিবাহ বৈধ নয়)।”
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ জানেন তোমরা যা জান না। এটা ছাড়াও তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এক সদ্য বিজয়।’ অর্থাৎ এই সন্ধির মধ্যে যে যৌক্তিকতা রয়েছে তা আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন, তোমরা জান না। এরই ভিত্তিতে তোমাদেরকে এই বছর মক্কা যেতে দেয়া হলো না, বরং আগামী বছর যেতে দিবেন। আর এই যাওয়ার পূর্বেই যার ওয়াদা স্বপ্নের আকারে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দেয়া হয়েছিল, তোমাদেরকে সেই আসন্ন বিজয় দান করা হলো। আর ঐ বিজয় হলো সন্ধি যা তোমাদের এবং তোমাদের শত্রুদের মধ্যে হয়ে গেল।
এরপর আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে সুসংবাদ শুনাচ্ছেন যে, তিনি স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে এই শত্রুদের উপর এবং সমস্ত শক্রর উপর বিজয় দান করবেন। এজন্যেই তাকে তিনি পথ-নির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন। শরীয়তে এ দুটি জিনিসই থাকে, অর্থাৎ ইলম ও আমল। সুতরাং শরয়ী ইলমই সঠিক ও বিশুদ্ধ ইলম এবং শরয়ী আমলই হলো গ্রহণযোগ্য আমল। সুতরাং শরীয়তের খবরগুলো সত্য এবং হুকুমগুলো ন্যায়সঙ্গত।
আল্লাহ তাআলা এটাই চান যে, সারা দুনিয়ায় আজমে, মুসলমানদের মধ্যে ও মুশরিকদের মধ্যে যতগুলো দ্বীন রয়েছে সবগুলোর উপরই স্বীয় দ্বীনকে জয়যুক্ত করবেন। এই কথার উপর আল্লাহই সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট যে, মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর রাসূল এবং তিনিই তাঁর সাহায্যকারী। এসব ব্যাপারে মহিমাময় আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
এই আয়াতের প্রথমে নবী (সঃ)-এর বিশেষণ ও গুণের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যে, তিনি আল্লাহর সত্য রাসূল। তারপর তার সাহাবীদের (রাঃ) গুণাবলীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে যে, তাঁরা কাফিরদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনকারী এবং মুসলমানদের প্রতি বিনয় ও নম্রতা প্রকাশকারী। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা মুমিনদের সামনে নরম ও কাফিরদের সামনে কঠোর ।” (৫:৫৪) প্রত্যেক মুমিনেরই এরূপ স্বভাব হওয়া উচিত যে, সে মুমিনদের সামনে বিনয় প্রকাশ করবে এবং কাফিরদের সামনে হবে কঠোর। কুরআন কারীমে ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের পার্শ্ববর্তী কাফিরদের সাথে জিহাদ কর, তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা অনুভব করে।” (৯:১২৩)
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “পারস্পরিক প্রেম প্রীতি ও নম্রতার ব্যাপারে মুমিনদের দৃষ্টান্ত একটি দেহের মত। যদি দেহের কোন অঙ্গে ব্যথা হয় তবে সারা দেহ ব্যথা অনুভব করে ও অস্থির থাকে। জ্বর হলে নিদ্রা হারিয়ে যায় ও জেগে থাকতে হয়।”
রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেনঃ “এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে প্রাচীর বা দেয়াল স্বরূপ যার এক অংশ অপর অংশকে দৃঢ় ও শক্ত করে। তারপর তিনি এক হাতের অঙ্গুলীগুলো অপর হাতের আঙ্গুল গুলোর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেখিয়ে দেন।
তারপর তাদের আরো বিশেষণ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা ভাল কাজ খুব বেশী বেশী করেন, বিশেষ করে তাঁরা নিয়মিতভাবে নামায প্রতিষ্ঠিত করেন যা সমস্ত পূণ্য কাজ হতে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম।
অতঃপর মহান আল্লাহ তাদের পুণ্য বৃদ্ধিকারী বিষয়ের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা পুণ্য কাজগুলো সম্পাদন করেন আন্তরিকতার সাথে এবং এর দ্বারা তারা কামনা করেন আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর সন্তুষ্টি। তাঁরা তাঁদের পুণ্য কাজের প্রতিদান আল্লাহ তা’আলার নিকটই যাজ্ঞা করেন এবং তাহলো সুখময় জান্নাত। মহান আল্লাহ তাদেরকে এই জান্নাত দান করবেন এবং সাথে সাথে তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্টও থাকবেন। এটাই খুব বড় জিনিস।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, চেহারায় সিজদার চিহ্ন দ্বারা সচ্চরিত্র উদ্দেশ্য। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা হলো বিনয় ও নম্রতা।
হযরত মানসূর (রঃ) হযরত মুজাহিদ (রাঃ)-কে বলেনঃ “আমার তো ধারণা ছিল যে, এর দ্বারা নামাযের চিহ্ন উদ্দেশ্য যা মাথায় পড়ে থাকে।” তখন হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা তো তাদের কপালেও পড়ে থাকে যদিও তাদের অন্তর ফিরাউনের চেয়েও শক্ত হয়।
হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, নামায তাদের চেহারা সুন্দর করে দেয়। পূর্বযুগীয় কোন কোন গুরুজন হতে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি রাত্রে বেশী নামায পড়বে তার চেহারা সুন্দর হবে। সুনানে ইবনে মাজাহতে হযরত জাবির (রাঃ)-এর রিওয়াইয়াতে এই বিষয়ের একটি মারফু হাদীসও রয়েছে। কিন্তু সঠিক কথা এই যে, এটা মাওকুফ হাদীস। কোন কোন মনীষীর উক্তি আছে যে, পুণ্যের কারণে অন্তরে নূর বা জ্যোতি সৃষ্টি হয়, চেহারায় ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পায়, জীবিকার পথ প্রশস্ত হয় এবং মানুষের অন্তরে প্রেম-প্রীতি সৃষ্টি হয়।
আমীরুল মুমিনীন হযরত উসমান (রাঃ) বলেন যে, যে ব্যক্তি স্বীয় আভ্যন্তরীণ অবস্থা সংশোধন করে এবং গোপনে ভাল কাজ করে, আল্লাহ তাআলা তার মুখমণ্ডলে ও জিহ্বার ধারে তা প্রকাশ করে থাকেন। মোটকথা, অন্তরের দর্পণ হলো চেহারা। সুতরাং অন্তরে যা থাকে তা চেহারায় প্রকাশিত হয়। অতএব, মুমিন যখন তার অন্তর ঠিক করে নেয় এবং নিজের ভিতরকে সুন্দর করে তখন আল্লাহ তা’আলা তার বাহিরকেও জনগণের দৃষ্টিতে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন।
হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেন যে, যে ব্যক্তি তার অভ্যন্তরকে ঠিক ও সংশোধন করে, আল্লাহ তা’আলা তার বাহিরকেও সুসজ্জিত করেন।
হযরত জুনদুব ইবনে সুফিয়ান বাজালী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি যে বিষয় গোপন রাখে, আল্লাহ তা’আলা তাকে ওরই চাদর পরিয়ে দেন। যদি সে ভাল বিষয় গোপন রাখে তবে ভাল এর চাদর এবং যদি মন্দ বিষয় গোপন রাখে তবে মন্দেরই চাদর পরিয়ে থাকেন। (এ হাদীসটি আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আরযামী নামক এর একজন বর্ণনাকারী পরিত্যক্ত)
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ যদি কোন কাজ কোন শক্ত পাথরের মধ্যে ঢুকেও করে যার মধ্যে কোন দরযাও নেই এবং কোন ছিদ্রও নেই। তবুও তা আল্লাহ তাআলা লোকের সামনে প্রকাশ করে দিবেন, তা ভালই হোক অথবা মন্দই হোক।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ভাল পন্থা, উত্তম চরিত্র এবং মধ্যম পথ অবলম্বন নবুওয়াতের পঁচিশটি অংশের মধ্যে একটি অংশ।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
মোটকথা, সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-এর অন্তর ছিল কলুষ মুক্ত এবং আমলও ছিল উত্তম। সুতরাং যার দৃষ্টি তাদের পবিত্র চেহারার উপর পড়তো, সে তাদের পবিত্রতা অনুভব করতে পারতো এবং সে তাদের চাল-চলনে ও মধুর আচরণে খুশী হতো।
হযরত মালিক (রাঃ) বলেন যে, যখন সাহাবীগণ সিরিয়া জয় করেন তখন তথাকার খৃষ্টানরা তাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠেঃ “আল্লাহর কসম! এঁরা তো হযরত ঈসা (আঃ)-এর হাওয়ারীগণ (হযরত ঈসা (আঃ)-এর ১২জন শিষ্যকে হাওয়ারী বলা হয়) হতেও শ্রেষ্ঠ ও উত্তম!’ প্রকৃতপক্ষে তাদের এ উক্তিটি চরম সত্য। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে এই উম্মতের ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্ব বিদ্যমান রয়েছে। এই উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীবর্গ (রাঃ)। এঁদের বর্ণনা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে এবং পূর্বের ঘটনাবলীর মধ্যে বিদ্যমান আছে। এ জন্যেই মহান আল্লাহ বলেন যে, তাওরাতে তাদের বর্ণনা এই রূপই এবং ইঞ্জীলেও।
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা হতে নির্গত হয় কিশলয়। অতঃপর এটা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীর জন্যে আনন্দদায়ক। অনুরূপভাবে সাহাবীগণও (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পৃষ্ঠপোষক এবং সাহায্যকারী ছিলেন। তাঁরা তাঁর সাথেই সম্পর্ক রাখতেন যেমন চারাগাছের সম্পর্ক থাকে ক্ষেত্রের সাথে।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “এই ভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন।
হযরত ইমাম মালিক (রঃ) এই আয়াতটি রাফেযী সম্প্রদায়ের কুফরীর উপর দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কেননা, তারা সাহাবায়ে কিরামের (রাঃ) প্রতি শক্রতা পোষণ করে থাকে। আর যারা সাহাবীদের (রাঃ) প্রতি শত্রুতা পোষণ করে তারা কাফির। এই মাসআলায় উলামার একটি দলও ইমাম মালিক (রঃ)-এর সাথে রয়েছেন। সাহাবায়ে কিরামের ফযীলত এবং তাদের পদস্খলন সম্পর্কে কটুক্তি করা হতে বিরত থাকা সম্পর্কীয় বহু হাদীস এসেছে। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তাঁদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের প্রতি নিজের সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের জন্যে এটাই কি যথেষ্ট নয়?
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ ঈমানদার ও সকর্মশীলদের জন্যে আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, তিনি তাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন এবং তাদেরকে মহাপুরস্কার অর্থাৎ উত্তম জীবিকা, প্রচুর সওয়াব এবং বড় বিনিময় প্রদান করবেন। আল্লাহর ওয়াদা সত্য ও অটল। এটা কখনো পরিবর্তন হবে না এবং এর ব্যতিক্রম হবে না। তাঁদের পদাংক অনুসরণকারীদের জন্যেও এ অঙ্গীকার সাব্যস্ত আছে। কিন্তু তাদের যে মর্যাদা ও ফযীলত রয়েছে তা এই উম্মতের অন্য কারো নেই। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং তাঁদেরকে সন্তুষ্ট রাখুন। আর জান্নাতুল ফিরদাউসকে তাঁদের আশ্রয়স্থল ও আবাসস্থল করুন! আর তিনি করেছেনও তাই।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আমার সাহাবীদেরকে (রাঃ) গালি দিয়ো না ও মন্দ বলো না। যাঁর অধিকারে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড়ের সমানও স্বর্ণ খরচ করে (অর্থাৎ দান করে) তবুও তাঁদের কারো এক মুদ্দ (প্রায় এক পোয়া) এমনকি অর্ধ মুদ্দ পরিমাণ (দানকৃত) শস্যের সমান সওয়াবও সে লাভ করতে পারবে না (অর্থাৎ তাদের কেউ এ পরিমাণ শস্য দান করে যে সওয়াব পেয়েছেন, তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড়ের সমান সোনা দান করেও ঐ সওয়াব লাভ করতে পারবে না)।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)