بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৩৬/এবং কাফের-রা বলে:-১১) [* ‌কাফেরদের অবস্থা :- *বলপ্রয়োগে আনুগত্য আদায় করা তোমার কাজ নয়।:-] www.motaher21.net সূরা:৫০-ক্বাফ। পারা:২৬ ৩০-৪৫ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৬/এবং কাফের-রা বলে:-১১)
[* ‌কাফেরদের অবস্থা :-
*বলপ্রয়োগে আনুগত্য আদায় করা তোমার কাজ নয়।:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫০-ক্বাফ। পারা:২৬
৩০-৪৫ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যায়, তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩০
یَوۡمَ نَقُوۡلُ لِجَہَنَّمَ ہَلِ امۡتَلَاۡتِ وَ تَقُوۡلُ ہَلۡ مِنۡ مَّزِیۡدٍ ﴿۳۰﴾
সেদিন আমি জাহান্নামকে জিজ্ঞেস করব, ‘তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ?’ জাহান্নাম বলবে, ‘আরো আছে কি?’
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩১
وَ اُزۡلِفَتِ الۡجَنَّۃُ لِلۡمُتَّقِیۡنَ غَیۡرَ بَعِیۡدٍ ﴿۳۱﴾
জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের—কোন দূরত্বে থাকবে না।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩২
ہٰذَا مَا تُوۡعَدُوۡنَ لِکُلِّ اَوَّابٍ حَفِیۡظٍ ﴿ۚ۳۲﴾
তখন বলা হবেঃ এ হচ্ছে সেই জিনিস, যার কথা তোমাদেরকে আগাম জানানো হতো। এটা প্রত্যেক প্রত্যাবর্তনকারী ও সংরক্ষণকারীর জন্য,
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩৩
مَنۡ خَشِیَ الرَّحۡمٰنَ بِالۡغَیۡبِ وَ جَآءَ بِقَلۡبٍ مُّنِیۡبِۣ ﴿ۙ۳۳﴾
যারা গায়েব অবস্থায় দয়াময় আল্লাহকে ভয় করেছে এবং বিনীত চিত্তে উপস্থিত হয়েছে—
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩৪
ادۡخُلُوۡہَا بِسَلٰمٍ ؕ ذٰلِکَ یَوۡمُ الۡخُلُوۡدِ ﴿۳۴﴾
তাদেরকে বলা হবে, ‘শান্তির সাথে তোমরা তাতে প্ৰবেশ কর; এটা অনন্ত জীবনের দিন।’
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩৫
لَہُمۡ مَّا یَشَآءُوۡنَ فِیۡہَا وَلَدَیۡنَا مَزِیۡدٌ ﴿۳۵﴾
সেখানে তাদের জন্য যা চাইবে তাই থাকবে। আর আমার কাছে আরো কিছু অতিরিক্ত জিনিসও থাকবে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩৬
وَ کَمۡ اَہۡلَکۡنَا قَبۡلَہُمۡ مِّنۡ قَرۡنٍ ہُمۡ اَشَدُّ مِنۡہُمۡ بَطۡشًا فَنَقَّبُوۡا فِی الۡبِلَادِ ؕ ہَلۡ مِنۡ مَّحِیۡصٍ ﴿۳۶﴾
তাদের আগে বহু প্ৰজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যারা ছিল পাকড়াও করার ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে প্রবলতর,তারা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াত; তাদের কোন পলায়ণস্থল ছিল কি?
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩৭
اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَذِکۡرٰی لِمَنۡ کَانَ لَہٗ قَلۡبٌ اَوۡ اَلۡقَی السَّمۡعَ وَ ہُوَ شَہِیۡدٌ ﴿۳۷﴾
যাদের হৃদয় আছে কিংবা যারা একাগ্রচিত্তে কথা শোনে তাদের জন্য এ ইতিহাসে অনেক শিক্ষা রয়েছে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩৮
وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَا فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ٭ۖ وَّ مَا مَسَّنَا مِنۡ لُّغُوۡبٍ ﴿۳۸﴾
আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং তার মধ্যকার সকল জিনিসকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছি অথচ তাতে আমি ক্লান্ত হইনি।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৩৯
فَاصۡبِرۡ عَلٰی مَا یَقُوۡلُوۡنَ وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ قَبۡلَ طُلُوۡعِ الشَّمۡسِ وَ قَبۡلَ الۡغُرُوۡبِ ﴿ۚ۳۹﴾
অতএব তারা যা বলে, তাতে তুমি ধৈর্যধারণ কর এবং তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৪০
وَ مِنَ الَّیۡلِ فَسَبِّحۡہُ وَ اَدۡبَارَ السُّجُوۡدِ ﴿۴۰﴾
আবার রাতে পুনরায় তার গুণগান করো এবং সিজ্দা দেয়ার পরেও করো।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৪১
وَ اسۡتَمِعۡ یَوۡمَ یُنَادِ الۡمُنَادِ مِنۡ مَّکَانٍ قَرِیۡبٍ ﴿ۙ۴۱﴾
আর মনোনিবেশসহকারে শুনুন, যেদিন এক ঘোষণাকারী নিকটবর্তী স্থান হতে ডাকবে,
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৪২
یَّوۡمَ یَسۡمَعُوۡنَ الصَّیۡحَۃَ بِالۡحَقِّ ؕ ذٰلِکَ یَوۡمُ الۡخُرُوۡجِ ﴿۴۲﴾
যেদিন সকলে হাশরের কোলাহল ঠিকমত শুনতে পাবে, সেদিনটি হবে কবর থেকে মৃতদের বেরুবার দিন।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৪৩
اِنَّا نَحۡنُ نُحۡیٖ وَ نُمِیۡتُ وَ اِلَیۡنَا الۡمَصِیۡرُ ﴿ۙ۴۳﴾
আমিই জীবন দান করি, আমিই মৃত্যু ঘটাই। এবং আমার কাছেই সবাইকে ফিরে আসতে হবে সেদিন—
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৪৪
یَوۡمَ تَشَقَّقُ الۡاَرۡضُ عَنۡہُمۡ سِرَاعًا ؕ ذٰلِکَ حَشۡرٌ عَلَیۡنَا یَسِیۡرٌ ﴿۴۴﴾
যেদিন তাদের থেকে যমীন বিদীর্ণ হবে এবং লোকেরা ত্ৰস্ত-ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করবে, এটা এমন এক সমাবেশ যা আমাদের জন্য অতি সহজ।
সূরা:৫০-ক্বাফ:-৪৫
نَحۡنُ اَعۡلَمُ بِمَا یَقُوۡلُوۡنَ وَ مَاۤ اَنۡتَ عَلَیۡہِمۡ بِجَبَّارٍ ۟ فَذَکِّرۡ بِالۡقُرۡاٰنِ مَنۡ یَّخَافُ وَعِیۡدِ ﴿٪۴۵﴾
ওরা যেসব কথা বলে, তা আমি ভালো করেই জানি, বস্তুত তাদের কাছ থেকে বলপ্রয়োগে আনুগত্য আদায় করা তোমার কাজ নয়। কাজেই তুমি এ কুরআন দ্বারা আমার হুশিয়ারীকে যারা ডরায়, তাদেরকে তুমি উপদেশ দাও।

৩০-৪৫ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যায়, তাফসীরে ফি জমিদারির কুরআন বলেছেন:-
ফী জিলালিল কুরআন:

*জান্নাত জাহান্নামের দৃশ্য : বলা হচ্ছে, ‘যেদিন আমি জাহান্নামকে বলবাে যে, তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছো? সে বলবে, আরাে কিছু আছে নাকি?’ পুরাে দৃশ্যটা আলােচনারই দৃশ্য। এতে জাহান্নামকেও আলাপরত দেখানাে হয়েছে। এই প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে একটা বিস্ময়কর ও ভয়াল দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এই সমস্ত হঠকারী কাফেরের দল এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিরােধকারী সীমা অতিক্রমকারী ও সন্দেহ সৃষ্টিকারীর দলকে দোযখে নিক্ষেপ করে জাহান্নামকে জিজ্ঞাসা করা হবে। ‘তােমারে পেট ভরেছে তাে?’ কিন্তু সেই জ্বলন্ত পেটুক জাহান্নাম বলবে, ‘আরো আছে নাকি?’ কী সাংঘাতিক আতংকময় দৃশ্য! ভাবলেও গা শিউরে ওঠে! এই ভয়াল দৃশ্যের পাশাপাশি রয়েছে আরেকটা দৃশ্য। মনােরম, সন্তোষজনক, চিত্তাকর্ষক দৃশ্য। সেটি জান্নাতের দৃশ্য। আল্লাহভীরু সৎ লােকদের সম্মানজনক সম্বর্ধনার দৃশ্য। বলা হয়েছে, আল্লাহভীরু লােকদের খুবই কাছাকাছি জায়গায় জান্নাত খুলে রাখা হবে। ‘এই হচ্ছে সেই জিনিস, যা তােমাদেরকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি হতে…’ এখানে প্রত্যেক কথায় ও প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। জান্নাত এত নিকটবর্তী করা হবে যে, তাদেরকে কষ্ট করে আর তার কাছে যেতে হবে না, বরং জান্নাত নিজেই তাদের কাছে এগিয়ে আসবে। জান্নাতের সাথে সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টিজনিত পুরস্কার তাদের কাছে আসবে। ‘এই হচ্ছে তােমাদের জন্যেও প্রত্যেক অনুগত স্মরণকারী ব্যক্তির জন্যে প্রতিশ্রুত পুরস্কার। যে না দেখেও দয়াময়কে ভয় করে ও আনুগত্যপূর্ণ মন নিয়ে আসে-তার পুরস্কার।’ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এগুলাে তাদের জন্যে ঘােষিত বিশেষণ ও খেতাব। আল্লাহর মানদন্ডে তার অনুগত, আল্লাহকে স্মরণকারী, না দেখে আল্লাহকে ভয়কারী এবং আল্লাহ তায়ালার অনুগত। অতপর তাদেরকে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে এবং সেখান থেকে আর কখনাে বেরিয়ে আসতে হবে না। বলা হবে, ‘তােমরা শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ কর। সেটা হবে চিরস্থায়ী হবার দিন। অতপর এই জান্নাতবাসীদের সম্মানার্থে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আরাে ঘােষণা করা হবে, ‘সেখানে তারা যা চাইবে তা পাবে। অধিকন্তু অতিরিক্ত আরাে অনেক কিছু আমার কাছে তাদের জন্যে থাকবে।’ অর্থাৎ তাদের জন্যে যা কিছু আল্লাহর কাছে থাকবে, তারা চেয়ে-চিন্তে তার নাগাল পাবে না। আল্লাহর কাছে এই অতিরিক্ত জিনিসগুলাে থাকবে সীমাহীন ও অফুরন্ত পরিমাণে, থাকবে অযাচিতভাবে দেয়ার জন্যে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*অতীত জাতি সমূহের পরিণতি: এরপর আসবে সূরার শেষাংশ। সংক্ষেপে অথচ তীব্র ভাষায় ইতিহাস ও অতিক্রান্ত জাতিগুলাের কথা, মহাবিশ্বের এই উন্মুক্ত গ্রন্থের কথা, নতুন আংগিকে আখেরাত ও কেয়ামতের কথা এবং চেতনার অভ্যন্তরে ও অন্তরের অন্তস্তলে বদ্ধমূল করে দেয়া নির্দেশাবলী উচ্চারিত হয়েছে এ অংশে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের আগে আমি কত জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি অতএব যারা আমাকে ভয় করে তাদেরকে কোরআনের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দাও।’ এসব বক্তব্য যদিও এ সূরায় ইতিপূর্বে রাখা হয়েছে। কিন্তু কোরআনের এটা একটা বিস্ময়কর রীতি যে, সূরার প্রথম কোনাে জিনিস সবিস্তারে আলােচিত হয়, অতপর শেষ ভাগে সেই একই জিনিস একটু ভিন্ন আংগিকে ও ভিন্ন ভংগিতে সংক্ষিপ্তভাবে আলােচিত হয়ে থাকে। যেমন ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, ‘তাদের পূর্বে নূহের জাতি, রাসের অধিবাসীরা, সামুদ জাতি, আদ জাতি, ফেরাউন, লুতের ভাইয়েরা, আইকার অধিবাসীরা ও তুব্বার জাতি অস্বীকার করেছে। প্রত্যেক জাতি রসূলদেরকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করেছে। ফলে আমার হুমকি কার্যকর হয়েছে।’ এখানে বলা হয়েছে, ‘তাদের পূর্বে কত জাতিকে আমি ধ্বংস করেছি। তারা ওদের চাইতে বেশী শক্তিশালী ছিলাে এবং তারা দেশে দেশে অনুসন্ধান চালাতাে। তাদের কোনাে পালাবার জায়গা ছিলাে না।’ এখানে যে সত্যের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে, তা মূলত একই জিনিস। কিন্তু এর নতুন রূপটি পূর্বের রূপ থেকে ভিন্ন। এরপর এখানে সংযােজন করা হয়েছে প্রাচীন জাতিগুলাের দেশে দেশে বিচরণ ও জীবিকা অন্বেষণের বিষয়টি। আর এ কথাও বলা হয়েছে যে, তারা এমন এক মহাশক্তিধর শাসকের মুঠোর মধ্যে ছিলাে, যার হাত থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। অতপর এ বিষয়ে অধিকতর প্রাণবন্ত মন্তব্য করা হয়েছে এভাবে, ‘নিশ্চয়ই এতে রয়েছে স্মরণীয় বিষয় তাদের জন্যে যাদের মন আছে, অথবা যারা মনােযােগ দিয়ে শােনে।’ অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্তদের পরিণতিতে রয়েছে স্মরণীয় বিষয়, যার অনুধাবন করার মতাে অন্তর রয়েছে। এ সকল ঘটনা যাকে শিক্ষা গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে না, তার অন্তর হয় মরে গেছে, নতুবা তার কোনাে অন্তরই নেই। প্রকৃতপক্ষে স্মরণ ও শিক্ষা গ্রহণের জন্যে মনােযােগ দিয়ে ঘটনাগুলাে শােনা ও উপলব্ধি করাই যথেষ্ট। এতে অন্তরে ঘটনার প্রতিক্রিয়া হতে শুরু করে এবং সে প্রতিক্রিয়া যথার্থ ও ন্যায়সংগত। বস্তুত, মানুষের মন সাধারণত অতীতের ধ্বংস ও মৃত্যুর ঘটনাবলীর ব্যাপারে অত্যধিক স্পর্শকাতর। এ ধরনের সাড়া জাগানো ও চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ক্ষেত্রগুলােতে স্মৃতি জাগানাে ও প্রেরণা সঞ্চারণের জন্যে অপেক্ষাকৃত কম চেতনাসম্পন্ন হওয়াই যথেষ্ট বিবেচিত হয়ে থাকে। অধিকতর চেতনা সম্পন্নরা তাে আপনা থেকেই অতীত ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণে উন্মুখ থাকে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিতত্ব : প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, ‘তারা কি তাদের মাথার ওপরে বিরাজমান আকাশকে দেখে না (এবং ভাবে না যে) কিভাবে আমি তা নির্মাণ করেছি, সুসজ্জিত করেছি এবং তাতে কোনাে ফাটল ও ছেদ নেই। আর পৃথিবীকে প্রশস্ত করেছি, তাতে বহু পর্বত প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে প্রত্যেক রকমের জোড়া জোড়া নয়নাভিরাম উদ্ভিদ উদগত করেছি।’ আর এখানে সূরার শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘আমি আকাশ, পৃথিবী ও এই উভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছি। অথচ আমাকে কোনাে ক্লান্তি স্পর্শ করেনি।’ এখানে প্রকৃতি সংক্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি ক্লান্তি স্পর্শ না করার বিষয়টি সংযােজিত হয়েছে। এ দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, এই বিশাল সৃষ্টিজগতে সৃজনের কাজটি যখন আল্লাহর কাছে এতই সহজ, তখন মৃতকে জীবিত করা কেন সহজ হবে না? অথচ এ কাজটা আকাশ ও পৃথিবীর তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র। অনুরূপ ভাবে সূরার এই শেষ ভাগে নতুন আংগিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ‘অতএব তারা যত যা-ই বলুক, তাতে ধৈর্যধারণ কর। তােমার প্রভুর প্রশংসা সহকারে গুণকীর্তন কর সূর্যাস্তের আগে ও সূর্যোদয়ের আগে, আর রাত্রিকালেও এবং সেজদার পরেও তার গুণকীর্তন করো। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও সূর্যাস্ত পরবর্তী রাতের দৃশ্য-এই সবই আকাশ ও পৃথিবীর বৈশিষ্ট। আর এ সব কিছুর সাথে যুক্ত করা হচ্ছে আল্লাহর প্রশংসা, গুণকীর্তন ও সিজদাকে এই প্রেক্ষাপটে আখেরাতকে ও পুনরুজ্জীবনে আল্লাহর ক্ষমতাকে অস্বীকার করা সহ কাফেরদের যাবতীয় কথাবার্তায় ধৈর্যধারণ করতে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। প্রকৃতি সংক্রান্ত তত্ত্ব ও তথ্যের পুনরাবৃত্তির পরই একে ঘিরে এক নতুন আবহ ও নতুন পরিবেশ তৈরী হয়ে গেছে। এটি হচ্ছে ধৈর্য্য, প্রশংসা, গুণকীর্তন ও সিজদার পরিবেশ, আর এ সবই প্রকৃতির বৈশিষ্টসমূহের সাথে সংযুক্ত, যা আকাশ ও পৃথিবীতে দৃষ্টি দেয়া মাত্রই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত পরবর্তী প্রথম রাত্র দেখা মাত্রই এবং আল্লাহর জন্যে সিজদা করা মাত্রই স্নায়ুতন্ত্রীতে সাড়া জাগায়।

ফী জিলালিল কুরআন:

*সূরার মূল বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি : অতপর প্রাকৃতিক বৈচিত্রের বিবরণের সাথে যুক্ত আরেকটি নতুন বক্তব্য-ধৈর্যধারণ কর, গুণকীর্তন কর ও সিজদা কর, যখন তুমি দিন ও রাতের প্রতি মুহূর্তে সেই ভয়াবহ ঘটনার জন্যে অপেক্ষমাণ থাকবে, যাকে কেবল মাত্র উদাসীন ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ অবহেলা করে না। সেই ভয়াবহ ঘটনাটা হলাে কেয়ামত, যা এই সূরার কেন্দ্রীয় ও প্রধান আলােচ্য বিষয়। বলা হচ্ছে, ‘শােনাে, যেদিন ঘােষণাকারী নিকটবর্তী স্থান থেকে ঘােষণা করবে, যেদিন যথার্থই লােকেরা বিকট একটা ধ্বনি শুনবে।… এদের সমবেত করা আমার কাছে সহজ কাজ।’ এটা এক কঠিন দিনের চাঞ্চল্যকর দৃশ্য। ইতিপূর্বে এ দৃশ্য একটু ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছিলাে, ‘শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। সেটি হচ্ছে হুশিয়ারীর দিন। ‘প্রত্যেক ব্যক্তি একজন পরিচালক ও একজন দর্শকের সাথে আসবে…’ এখানে ‘বিকট ধ্বনি’ দ্বারা শিংগার ফুঁক বুঝানাে হয়েছে। এতে অভিযানের দৃশ্য ও অতীতের সকল মানুষের মাটি ফুঁড়ে বেরুনাের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেইসব অগণিত কবর ফুড়ে তারা বেরুবে, যাতে করে মৃতরা শাস্তি ভােগ করবে। কবি আবুল আলা আল মায়াররী বলেন, বহু কবর বহুবার নতুন করে কবরে পরিণত হয়েছে, পরস্পর বিরােধী লোকের ভীড় দেখে সে হাসতে থাকে। আর বহু সমাহিত ব্যক্তি সমাহিত হয়েছে পূর্ববর্তী সমাহিত ব্যক্তির ধ্বংসাবশেষের ওপর আর যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে এমনটি। বস্তুত সকল কবর এক সময় ভেঙেচুরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং কবরবাসীর হাড়গােড় পৃথিবীর দিকে দিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে এ সবের অবস্থানস্থল আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। এটি একটি অভাবনীয় দৃশ্য। আর এই সাড়া জাগানাে দৃশ্যের আড়ালে আল্লাহ তায়ালা সেই মহা সত্য অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি-রহস্য উদঘাটন করেন, যা নিয়ে তারা তর্ক-বিতর্ক করে এবং যাকে তারা অস্বীকার ‘নিশ্চয় আমিই মারি এবং আমিই বাঁচাই এবং আমার কাছেই সকলের প্রত্যাবর্তন।… এই একত্রিতকরণ আমার কাছে সহজ কাজ। সর্বশেষে কাফেরদের অব্যাহত প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকৃতির মােকাবেলায় রাসূল(স.)-এর মনােবল মজবুত করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যা বলে তা আমিই সবচেয়ে ভালাে জানি। তুমি তাদের ওপর পরাক্রমশালী নও। অতএব যে ব্যক্তি আমার হুঁশিয়ারীকে ভয় করে, তাকে কোরআন দ্ব্বারা স্মরণ করিয়ে দাও।’ বস্তুত তাদের বিরােধিতার কথা আল্লাহ তায়ালা যে সবচেয়ে ভালাে জানেন-এটা রসূলের সাস্ত্বনার জন্যে যথেষ্ট, আর এটা প্রকারান্তরে কাফেরদের প্রতি একটি হুশিয়ারী স্বরূপ। ‘তুমি তাদের ওপর ক্ষমতাবান নও। সুতরাং তুমি তাদেরকে ঈমান আনতে বাধ্য করতে পার না। কাজেই এ ক্ষেত্রে তােমার কোনাে দায়-দায়িত্ব নেই। এটা শুধু আমার দায়িত্ব। আমি তাদের তত্ত্বাবধায়ক ও দায়িত্বশীল।’ ‘কোরআন দ্বারা স্মরণ করিয়ে দাও….’ কেননা, কোরআন মানুষের মনকে কাপিয়ে দেয়। ফলে এমন কোনাে বিদ্রোহী মনকে সে আর বিদ্রোহের ওপর বহাল থাকতে দেয় না, যা কোরআনে বর্ণিত সত্যকে অস্বীকার করে। এ ধরনের সুরা যখন পেশ করা হয়, তখন ঈমান আনতে বাধ্য করতে পারে এমন পরাক্রমশালী লােকের তার প্রয়ােজন থাকে না। কেননা, এ সূরায় এমন শক্তি ও পরাক্রম রয়েছে, যা পরাক্রমশালী লােকদের থাকে না। এতে মানব-মনে রেখাপাত করার মতাে এমন বহু বক্তব রয়েছে, যা স্বৈরাচারী শাসকদের লাঠি বা তরবারির চেয়েও শক্তিশালী।

৩০-৪৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়, তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩০-৩৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

মহান আল্লাহ বলেন :

(لَأَمْلَئَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ)‏

“আমি অবশ্যই জিন ও মানুষ উভয়কে দিয়েই জাহান্নাম পরিপূর্ণ করব।” (আস্ সাজদাহ্ ৩২ :১৩) এ অঙ্গীকার অনুযায়ী মহান আল্লাহ কাফির জিন ও মানুষ জাতিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে জিজ্ঞাসা করবেন, তুই ভরে গেছিস, না ভরিসনি? সে উত্তরে বলবে, আরো আছে কি? অর্থাৎ যদিও আমি ভরে গেছি কিন্তু হে আল্লাহ! তোমার শত্র“দের জন্য আমার উদরে আরো ঢুকোনোর মতো স্থান আছে। জাহান্নামের সাথে আল্লাহ তা‘আলার এ কথোপকথন এবং জাহান্নামের উত্তর প্রদান আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতার কাছে মোটেও কোন অসম্ভব ব্যাপার না। হাদীসে এসেছে : জাহান্নামে মানুষকে নিক্ষেপ করা হবে আর জাহান্নাম বলবে : আরো আছে কি? এমনকি জাহান্নামে মহান আল্লাহ পা রাখবেন ফলে জাহান্নাম বলবে : ব্যাস্ ব্যাস্। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৪৮)

জাহান্নামে মহান আল্লাহ তাঁর পা রাখবেন ফলে জাহান্নাম বলবে, ব্যাস্ ব্যাস্ এরূপ ৬টির অধিক হাদীস রযেছে। (দেখুন :ইবনু কাসীর- এ আয়াতের তাফসীর)

সে দিন জান্নাত মুত্তাকীদের নিকটবর্তী করে দেয়া হবে। কোন দূরত্ব থাকবে না। আবার এর অর্থ কেউ এভাবে বলেছেন যে, যেদিন জান্নাত মুত্তাকিদের নিকটবর্তী করা হবে সে দিন দূরে নয়, কেননা তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। আর

كل ما هو ات فهو قريب

প্রত্যেক যা কিছু আসার তা নিকটবর্তী। (ইবনু কাসীর- এ আয়াতের তাফসীর)

(وَلَدَيْنَا مَزِيدٌ)

‘আমার নিকট রয়েছে তারও অধিক’ অর্থাৎ জান্নাতীগণ জান্নাতে যা কিছু চাইবে সব পাবে। এমনকি তারা যা চাইবে আল্লাহ তা‘আলার কাছে তার চেয়ে আরো বেশি আছে। বেশি যা দেবেন মুহাদ্দিসগণ তার তাফসীর করেছেন- আল্লাহ তা‘আলার দীদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوا الْحُسْنٰي وَزِيَادَةٌ ط وَلَا يَرْهَقُ وُجُوْهَهُمْ قَتَرٌ وَّلَا ذِلَّةٌ )

“যারা কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য আছে কল্যঅণ এবং আরও অধিক। কলঙ্ক ও হীনতা তাদের মুখমণ্ডলকে আচ্ছন্ন করবে না।” (সূরা ইউনুস ১০ :২৬)

মু’মিনরা পরকালে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে এ সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ، كَمَا تَرَوْنَ هَذَا القَمَرَ، لاَ تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ، فَإِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ لاَ تُغْلَبُوا عَلَي صَلاَةٍ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا فَافْعَلُوا

তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে অবশ্যই দেখতে পাবে যেমন এ চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তা দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। (এরূপ সুস্পষ্টভাবেই আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে) সুতরাং তোমরা যদি পার সূর্যোদয়ের পূর্বের সালাত ও সূর্যাস্তের পূর্বের সালাত আদায় করতে পরাজয় বরণ করবে না তাহলে তাই কর। (সহীহ বুখারী হা. ৫৫৪, সহীহ মুসলিম হা. ৬৩৩) এ সম্পর্কে পূর্বে একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

অন্য হাদীসে এসেছে : যখন জান্নাতীগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : তোমরা কি আরো কিছু চাও, আমি বৃদ্ধি করে দেব? জান্নাতীগণ বলবে : আপনি কি আমাদের চেহারা উজ্জ্বল করেননি? আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেননি? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তখন আল্লাহ তা‘আলা পর্দা তুলে দেবেন এবং জান্নাতীরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে। তাদেরকে জান্নাতে যা দেয়া হয়েছে তা এত প্রিয় হবে না যত প্রিয় হবে আল্লাহ তা‘আলাকে দর্শন করা। (সহীহ মুসলিম হা. ৪৬৭)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলা ও জাহান্নামের মাঝে কথোপকথন হবে। কথা বলা আল্লাহর একটি গুণ।
২. আল্লাহ তা‘আলার “পা” রয়েছে তার প্রমাণ পেলাম।
৩. জান্নাত মুত্তাকীদের অতি নিকটবর্তী করে দেয়া হবে।
৪. মু’মিন জান্নাতে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে, কোন অন্তরায় থাকবে না। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার আকার সাব্যস্ত হয়। তবে এর ধরণ সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত।
৫. জান্নাতে যাওয়ার উপকরণ ও জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় জানলাম।
৩৬-৪০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ বলছেন : এ সকল মুশরিক কুরাইশের পূর্বে কত জাতিকে আমি ধ্বংস করেছি; তারা তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ও প্রতাবশালী ছিল। কিন্তু যখন শাস্তি এসেছে তারা কেউ রক্ষা পায়নি।

(فَنَقَّبُوْا فِي الْبِلَادِ)

(দেশে বিদেশে বিচরণ করত)-এর একটি অর্থ এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন শহরে মক্কাবাসীর চেয়েও বেশি ভ্রমণ করত। কিন্তু যখন আমার আযাব এলো, তখন তারা না কোথাও আশ্রয় পেল, আর না পালানোর কোন পথ পেল।

এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার আছে সজাগ বোধগম্য হৃদয় অথবা যে মনোযোগসহ শ্রবণ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি সচেতন সে পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সতর্ক হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাফরমানীর কাজে লিপ্ত হবে না।

لُّغُوْبٍ অর্থ ক্লান্ত হওয়া, কাতাদাহ ও কালবী (রহঃ) বলেন : মদীনার ইয়াহূদীরা বিশ্বাস করত আল্লাহ তা‘আলা ছয় দিনে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করেছেন, শুরু করেছেন রবিবার আর শেষ করেছেন জুম‘আবার, শনিবার বিশ্রাম নিয়েছেন- তাদের এ ভ্রান্ত বিশ্বাসকে খন্ডন করার জন্য উক্ত আয়াত নাযিল হয় (কুরতুবী)। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা কোন কাজে ক্লান্ত বোধ করেন না বরং তিনি কোন কাজ করার ইচ্ছা করলে শুধু বলেন- ‘কুন’ বা ‘হও’ আর তা সাথে সাথেই হয়ে যায়। তবে ছয় দিনে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করার পিছনে আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ কোন হিকমত রয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা প্রদান করছেন যে, তুমি তাদের অসার কথায় ধৈর্য ধারণ করো। আর সকাল-সন্ধ্যা, রাতের কিয়দাংশে ও সালাত শেষে তাসবীহ পাঠ করো।

(وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ)

ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : মিরাজের পূর্বে সূর্যোদয়ের আগে, ফজরের সময় দু’ রাকআত আর আসরের সময় দু’রাকআত সলাত ফরয ছিল। অতঃপর আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফারয করার মাধ্যমে তা রহিত করে দেন। (ইবনু কাসীর- এ আয়াতের তাফসীর)

জারীর ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একরাতে আমি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন তিনি চৌদ্দ তারিখের রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন : তোমরা যেমন এ চাঁদটি দেখতে পাচ্ছ তেমনিভাবে তোমরা তোমাদের রবকে দেখতে পাবে এবং তাঁকে দেখার ব্যাপারে বাধা বিঘœ হবে না। তাই তোমাদের সামর্থ্য থাকলে সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের আগের সালাতের ব্যাপারে পরাজিত হবে না। তারপর তিনি পাঠ করলেন : তোমার প্রতিপালকের প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা বর্ণনা কর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৫১, সহীহ মুসলিম হা. ৬৩৩)

সূর্যোদয়ের পূর্ব বলতে ফজরের সালাত সূর্যাস্তের পূর্বে বলতে ‘আসরের সালাতকে বুঝানো হয়েছে। আর রাতের কিয়দাংশ সালাত আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা হলো তাহাজ্জুদের সালাত।

(وَأَدْبَارَ السُّجُودِ)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এর উদ্দেশ্য ফরয সালাতের পর তাসবীহ পাঠ করা। প্রমাণ আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : দরিদ্র মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে বলেন : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ধনী লোকেরা তো উচ্চ মর্যাদা ও চিরস্থায়ী নেয়ামত লাভ করে ফেলেছেন! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : কিভাবে? তাঁরা বললেন : আমাদের মতো তারাও সালাত আদায় করে, সিয়াম পালন করে। কিন্তু তারা দান-সদকা করে আর আমরা করতে পারি না এবং তারা গোলাম আযাদ করে, আমরা পারি না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : আমি কি তোমাদেরকে এমন আমলের কথা বলে দেব না যা করলে তোমরাই সর্বাপেক্ষা অগ্রগামী থাকবে, তোমাদের ওপর কেউ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারবে না?

তারপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরয সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ ও ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করতে বললেন। (সহীহ বুখারী হা. ৮৪৩)

আর কেউ বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মাগরিবের পর দু’রাক‘আত সালাত পড়া।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পাপাচারীদের উভয় জগতের ভয় দেখানো বৈধ।
২. পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের থেকে তারাই শিক্ষা গ্রহণ করে যাদের জীবন্ত আত্মা রয়েছে ও যারা মনোযোগসহ শোনে।
৩. সালাতের মাধ্যমে ধৈর্য ধারণ ও সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।
৪১-৪৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(يُنَادِ الْمُنَادِ)

“একজন আহ্বানকারী আহ্বান করবে” এ ঘোষণাকারী হলেন ইসরাফিল (আঃ), এ সময় শিঙ্গার ফুঁৎকারে লোকেরা হাশরের মাঠে উপস্থিত হবে। অর্থাৎ এটা হবে দ্বিতীয় ফুৎকার।

(مَكَانٍ قَرِيْبٍ)

‘নিকটবর্তী স্থান’ অর্থাৎ জমিনের নিকটতম স্থান থেকে। আবার কেউ কেউ

صخرة بيت المقدس

(বাইতুল মুকাদ্দাসের পাথর) বুঝিয়েছেন। এটা আকাশের নিকটতম স্থান।

কোন কোন বিদ্বান বলেন এর অর্থ হলো : প্রত্যেক ব্যক্তি এ শব্দের আওয়াজ এমনভাবে শুনতে পাবে যেন নিকট থেকেই আসছে। (ফাতহুল কাদীর- এ আয়াতের তাফসীর)

সেদিন মানুষ সেই শিঙ্গার ফুঁৎকার সত্যি শুনতে পাবে আর ক্ববর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে হাজির হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَإِذَا هُمْ مِّنَ الْأَجْدَاثِ إِلٰي رَبِّهِمْ يَنْسِلُوْنَ)

“শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা কবর থেকে নিজের প্রতিপালকের দিকে ছুটে যাবে।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬ :৫১)

سِرَاعًا অর্থাৎ আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিতে দ্রুত উঠবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(يَوْمَ يَخْرُجُوْنَ مِنَ الْأَجْدَاثِ سِرَاعًا كَأَنَّهُمْ إِلٰي نُصُبٍ يُّوْفِضُوْنَ ‏)‏

“সেদিন তারা কবর হতে বের হবে দ্রুত বেগে, মনে হবে যে, তারা কোন একটি আস্তানার দিকে ছুটে আসছে।” (সূরা মাআরিজ ৭০ :৪৩)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(يَوْمَ يَدْعُوْكُمْ فَتَسْتَجِيْبُوْنَ بِحَمْدِه۪ وَتَظُنُّوْنَ إِنْ لَّبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيْلًا)‏

‘যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করবেন, এবং তোমরা তাঁর প্রশংসার সাথে তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবে এবং তোমরা মনে করবে, তোমরা অল্প সময়ই (দুনিয়াতে) অবস্থান করেছিলে।’ (সূরা ইস্রা ১৭ :৫২)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : সর্বপ্রথম আমার কবর ফাটা হবে। (তিরমিযী হা. ৩১৪৮, সহীহ)

(وَمَا أَنْتَ عَلَيْهِمْ بِجَبَّارٍ)

অর্থাৎ তুমি তাদের ওপর জবরদস্তিকারী নও।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُصَيْطِرٍ ‏ إِلَّا مَنْ تَوَلّٰي وَكَفَرَ)‏

“তুমি তাদের যিম্মাদার নও। তবে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে ও কুফরী করলে।” (সূরা আল গাশিয়াহ্ ৮৮ :২২-২৩)

অতএব যারা আল্লাহ তা‘আলার শাস্তিকে ভয় করে তাদেরকে কুরআন দ্বারা উপদেশ দাও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِنْ مَّا نُرِيَنَّكَ بَعْضَ الَّذِيْ نَعِدُهُمْ أَوْ نَتَوَفَّيَنَّكَ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلٰغُ وَعَلَيْنَا الْحِسَابُ)‏

“তাদেরকে যে শাস্তি‎র প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তার কিছু যদি তোমাকে দেখাই অথবা যদি এর পূর্বে তোমার মৃত্যু ঘটাই (উভয় অবস্থাতেই) তোমার কর্তব্য তো কেবল প্রচার করা এবং হিসেব-নিকেশ একমাত্র আমার কাজ।” (সূরা রা‘দ ১৩ :৪০)

কাতাদাহ (রহঃ) এ দু‘আটি পড়তেন : হে আল্লাহ তা‘আলা! আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করো যারা তোমার শাস্তিকে ভয় করে, তোমার প্রতিশ্রুতির আশা করে। হে অনুগ্রহকারী, হে দয়াময়। (ইবনু কাসীর, এ আয়াতের তাফসীর)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. পুনরুত্থানের প্রমাণ পেলাম।
২. দা‘ওয়াতী কাজে জবরদস্তি করার প্রয়োজন নেই।
৩. কুরআন দিয়ে আহ্বান করলেন যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে তারা সাড়া দেবে।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৬/এবং কাফের-রা বলে:-১১)
[* ‌কাফেরদের অবস্থা :-
*বলপ্রয়োগে আনুগত্য আদায় করা তোমার কাজ নয়:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫০-ক্বাফ। পারা:২৬
৩০-৪৫ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৩০-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:

যেহেতু আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি ওকে পূর্ণ করবেন, সেহেতু কিয়ামতের দিন যেসব দানব ও মানব ওর যোগ্য হবে তাদেরকে ওর মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে এবং আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা ওকে জিজ্ঞেস করবেনঃ “তুমি পূর্ণ হয়েছে কি?” উত্তরে জাহান্নাম বলবেঃ “যদি আরো কিছু পাপী বাকী থাকে তবে তাদেরকেও আমার মধ্যে নিক্ষেপ করুন!” সহীহ বুখারী শরীফে এই আয়াতের তাফসীরে এই হাদীস রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “পাপীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং সে আরো বেশী চাইতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা স্বীয় পা তাতে রাখবেন, তখন সে বলবেঃ “যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে।” মুসনাদে আহমাদে এটাও রয়েছে যে, ঐ সময় জাহান্নাম সংকুচিত হয়ে যাবে এবং বলবেঃ আপনার ইযযতের কসম! এখন যথেষ্ট হয়েছে।” আর জান্নাতে জায়গা ফাঁকা থেকে যাবে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা একটা নতুন মাখলুক সৃষ্টি করে ঐ জায়গা আবাদ করবেন।

সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, একবার জানাত ও জাহানামের মধ্যে কথোপকথন হয়। জাহান্নাম বলেঃ “আমাকে প্রত্যেক অহংকারী ও উদ্ধত ব্যক্তির জন্যে তৈরী করা হয়েছে।” আর জান্নাত বলেঃ “আমার অবস্থা এই যে, যারা দুর্বল লোক, যাদেরকে দুনিয়ায় সম্মানিত মনে করা হতো না তারাই আমার মধ্যে প্রবেশ করবে।” আল্লাহ তাআলা জান্নাতকে বলেনঃ “তুমি আমার রহমত। আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এই রহমত দান করবে।” আর জাহান্নামকে তিনি বলবেনঃ “তুমি আমার শাস্তি। তোমার মাধ্যমে আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করবে। যা, তোমরা উভয়েই পূর্ণ হয়ে যাবে।” তখন জাহান্নাম তো পূর্ণ হবে না, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা স্বীয় পদ ওতে রাখবেন। তখন সে বলবেঃ “যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে।” ঐ সময় ওটা ভরে যাবে এবং ওর সমস্ত জোড় পর পর সংকুচিত হয়ে যাবে। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় মাখলুকের কারো প্রতি কোন যুলুম করবেন না। জান্নাতে যে জায়গা বেঁচে যাবে ওটা পূর্ণ করার জন্যে মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য মাখলুক সৃষ্টি করবেন।

মুসনাদে আহমাদে জাহান্নামের উক্তি নিম্নরূপ রয়েছেঃ “ঔদ্ধত্য প্রকাশকারী ও অহংকারী বাদশাহ ও শরীফ লোকেরা আমার মধ্যে প্রবেশ করবে।” মুসনাদে আবূ ইয়ালায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা আমাকে তাঁর সত্তার পরিচিতি প্রদান করবেন। আমি তখন সিজদায় পড়ে যাবো। আল্লাহ তা’আলা তাতে খুবই সন্তুষ্ট হবেন। তারপর আমি তার এমন প্রশংসা করবে যে, তিনি অত্যন্ত খুশী হবেন। এরপর আমাকে শাফাআত করার অনুমতি দেয়া হবে। অতঃপর আমার উম্মত জাহান্নামের উপরের পুল অতিক্রম করতে শুরু করবে। কেউ কেউ তো চোখের পলকে পার হয়ে যাবে। কেউ কেউ তা অতিক্রম করবে দ্রুতগামী ঘোড়ার চেয়েও দ্রুত গতিতে। এমন কি এক ব্যক্তি হাঁটুর ভরে চলতে চলতে তা অতিক্রম করবে এবং এটা হবে আমল অনুযায়ী। আর জাহান্নাম আরো বেশী চাইতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত তাল্লাহ তা’আলা তাতে তার পা রেখে দিবেন। তখন সে সংকুচিত হয়ে যাবে এবং বলবেঃ যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। আমি হাউযের উপর থাকবো।” সহাবীগণ (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হাউয কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আল্লাহর কসম! ওর পানি দুধের চেয়েও সাদা, মধুর চেয়েও মিষ্ট, বৰফের চেয়েও ঠাণ্ডা এবং মৃগনাভী অপেক্ষাও সুগন্ধময়। তথায় বরতন থাকবে ত”কাশের তারকার চেয়েও বেশী। যে ব্যক্তি ওর পানি পেয়ে যাবে সে কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না। আর যে ব্যক্তি ওর থেকে বঞ্চিত থাকবে সে কোন জায়গাতেই পান পাবে যদদ্বারা সে পরিতৃপ্ত হতে পারে।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, জাহান্নাম বলবেঃ “আমার মধ্যে কোন জায়গা আছে কি যে, আমার মধ্যে আরো বেশী (সংখ্যক দানব ও মানবের অবস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে?” হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, জাহান্নাম বলবেঃ “আমার মধ্যে একজনেরও আসার জায়গা আছে কি? আমি তো পরিপূর্ণ হয়ে গেছি।” হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, ওর মধ্যে জাহান্নামীদেরকে নিক্ষেপ করা হবে, শেষ পর্যন্ত সে বলবেঃ “আমি পূর্ণ হয়ে গেছি।” সে আরো বলবে? “আমার মধ্যে বেশীর জায়গা আছে কি?” ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) প্রথম উক্তিটিকেই গ্রহণ করেছেন। এই দ্বিতীয় উক্তিটির ভাবার্থ এই যে, যেন ঐ গুরুজনদের মতে এই প্রশ্ন এর পরে হবে যে, আল্লহ তা’আলা স্বীয় পদ ওর মধ্যে রেখে দিবেন। এরপর যখন তাকে প্রশ্ন করা হবে, “তুমি কি পরিপূর্ণ হয়েছে?” সে তখন জবাব দিবেঃ “আমার মধ্যে এমন কোন জায়গা বাকী আছে কি যে, কেউ সেখানে আসতে পারে?” অর্থাৎ একটুও জায়গা ফাকা নেই।

হযরত আউফী (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেনঃ এটা ঐ সময় হবে যখন তাতে একটা সুচ পরিমাণ জায়গাও ফাকা থাকবে না। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

মহান আল্লাহ বলেনঃ জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন যা দূরে নয়। কেননা, যার আগমন নিশ্চিত সেটাকে দূরে মনে করা হয় না।

(আরবী)-এর অর্থ হলোঃ প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী ও গুনাহর কাজ হতে দূরে অবস্থানকারী। হলো ঐ ব্যক্তি যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং তা ভঙ্গ করে। হযরত উসায়েদ ইবনে উমায়ের (রাঃ) বলেন যে, (আরবী)হলো ঐ ব্যক্তি যে কোন মজলিস হতে উঠে না যে পর্যন্ত না ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং যে পরম করুণাময় আল্লাহকে না দেখেই ভয় করে অর্থাৎ নির্জনেও আল্লাহর ভয় অন্তরে রাখে। হাদীসে আছে যে, ঐ ব্যক্তিও কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবে যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চক্ষু হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যারা না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে এবং বিনীত চিত্তে উপস্থিত হয় তাদেরকে বলা হবেঃ শান্তির সাথে তোমরা ওতে অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশ কর। আল্লাহর সমস্ত শাস্তি হতে তোমরা নিরাপত্তা লাভ করলে। আর ভাবার্থ এও হবে যে, ফেরেশতারা তাদেরকে সালাম করবেন।

এটা অনন্ত জীবনের দিন অর্থাৎ তোমরা জান্নাতে যাচ্ছ চিরস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে, যেখানে কখনো মৃত্যু হবে না, যেখান হতে কখনো বের করে দেয়ার কোন আশংকা থাকবে না এবং স্থানান্তরও করা হবে না।

মহান আল্লাহ বলেনঃ সেথায় তারা যা কামনা করবে তাই পাবে এবং আমার নিকট রয়েছে তারো অধিক।

হযরত কাসীর ইবনে মুররাহ (রঃ) বলেনঃ -এর মধ্যে এও রয়েছে যে, জান্নাতবাসীর পার্শ্বদিয়ে একখণ্ড মেঘ চলবে যার মধ্য থেকে শব্দ আসবেঃ ‘তোমরা কি চাও? তোমরা যা চাইবে তাই বর্ষিয়ে দিবো।’ সুতরাং তারা যা কামনা করবে তাই বর্ষিত হবে। হযরত কাসীর (রঃ) বলেনঃ যদি আল্লাহ তা’আলা আমার নিকট ঐ মেঘ হাযির করে এবং আমি কি চাই তা জিজ্ঞেস করা হয় তবে আমি অবশ্যই বলবেঃ সুন্দর পোশাক পরিহিতা সুন্দরী কুমারী যুবতী মহিলা বর্ষণ করা হোক।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তোমাদের যে পাখীরই গোশত খাওয়ার ইচ্ছা হবে, তৎক্ষণাৎ ওটা ভাজা অবস্থায় তোমাদের সামনে হাযির হয়ে যাবে।”

মুসনাদে আহমাদের মারফু হাদীসে রয়েছেঃ “জান্নাতবাসী যদি সন্তান চায় তবে একই সময়ে গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও সন্তানের যৌবনাবস্থা হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন) জামে তিরমিযীতে রয়েছেঃ “সে যেভাবে চাইবে সেভাবেই হয়ে যাবে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ আমার নিকট রয়েছে আরো অধিক। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা ভাল কাজ করেছে তাদের জন্যে উত্তম পুরস্কার রয়েছে এবং আরো অধিক রয়েছে।” (১০:২৬)

সুহায়েব ইবনে সিনান রূমী (রঃ) বলেন যে, এই আধিক্য হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার দর্শন। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন যে, জান্নাতবাসীরা প্রত্যেক শুক্রবারে আল্লাহর দর্শন লাভ করবে। (আরবী)-এর অর্থ এটাই।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট একটি সাদা দর্পণ নিয়ে আগমন করেন যার মধ্যস্থলে একটি বিন্দু ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “এটা কি?’ উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “এটা জুমআর দিন, যা খাস করে আপনাকে ও আপনার উম্মতকে দান করা হয়েছে, যাতে সবাই আপনাদের পিছনে রয়েছে, ইয়াহূদীরাও এবং খৃষ্টানরাও। এতে বহু কিছু কল্যাণ ও বরকত রয়েছে। এতে এমন এক সময় রয়েছে যে, ঐ সময় আল্লাহর নিকট যা চাওয়া হয় তা পাওয়া যায়। আমাদের ওখানে এর নাম হলো , (আরবী) বা আধিক্যের দিন।” নবী (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে জিবরাঈল (আঃ)! (আরবী)কি?” জিবরাঈল (আঃ) উত্তরে বললেনঃ “আপনার প্রতিপালক জান্নাতুল ফিরদাউসে একটি প্রশস্ত ময়দান বানিয়েছেন যাতে মৃগনাভির টিলা রয়েছে। জুমআর দিন আল্লাহ তা’আলা স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী ফেরেশতাদেরকে অবতীর্ণ করেন। ওর চতুর্দিকে আলোর মিম্বরসমূহ থাকে যেগুলোতে নবীগণ (আঃ) উপবেশন করেন। শহীদ ও সিদ্দীকগণ তাঁদের পিছনে ঐ মৃগনাভীর টিলাগুলোর উপর থাকবেন। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলবেনঃ “আমি তোমাদের সাথে কৃত ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছি। এখন তোমরা আমার নিকট যা ইচ্ছা চাও, পাবে।” তাঁরা সবাই বলবেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার সন্তুষ্টি চাই।” তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “আমি তো তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েই গেছি। এ ছাড়াও তোমরা চাও, পাবে। আমার নিকট আরো অধিক রয়েছে। তারা তখন জুমআর দিনকে পছন্দ করবেন। কেননা, ঐ দিনেই তারা বহু কিছু নিয়ামত লাভ করেন। এটা ঐ দিন যেই দিন আপনার প্রতিপালক আরশের উপর সমাসীন হবেন। ঐ দিনেই হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়। ঐ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে ইমাম শাফেয়ীতে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) তাঁর কিতাবুল উম্মের কিতাবুল জুমআর মধ্যেও এ হাদীসটি আনয়ন করেছেন)

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এই আয়াতের তাফসীরে একটি খুব বড় ‘আসার’ আনয়ন করেছেন যাতে বহু কথাই গারীব বা দুর্বল।

হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতী ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যে সত্তর বছর পর্যন্ত এক দিকেই মুখ করে বসে থাকবে। অতঃপর একজন হুর আসবে যে তার স্কন্ধে হাত রেখে তার দৃষ্টি নিজের দিকে ফিরিয়ে দিবে। সে এমন সুন্দরী হবে যে, সে তার গণ্ডদেশে তার চেহারা এমনভাবে দেখতে পাবে যেমনভাবে আয়নায় দেখা যায়। সে যেসব অলংকার পরে থাকবে ওগুলোর এক একটি ক্ষুদ্র মুক্তা এমন হবে যে, ওর কিরণে সারা দুনিয়া উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। সে সালাম দিবে, তখন ঐ জান্নাতী উত্তর দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবেঃ “তুমি কে?” সে উত্তরে বলবেঃ “আমি হলাম সে-ই যাকে কুরআনে বলা হয়েছে। তার গায়ে সত্তরটি হুল্লা (পোশাক বিশেষ) থাকবে, এতদসত্ত্বেও তার সৌন্দর্য ও ঔজ্জ্বল্যের কারণে বাহির হতেই তার পদনালীর মজ্জা দৃষ্টিগোচর হবে। তার মাথায় মণি-মুক্তা বসানো মুকুট থাকবে যার সমান্যতম মুক্তা পূর্ব ও পশ্চিমকে আলোকিত করার পক্ষে যথেষ্ট হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন)

৩৬-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:

ইরশাদ হচ্ছেঃ এই কাফিররা কতটুকু ক্ষমতা রাখে? এদের পূর্বে এদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী এবং সংখ্যায় অধিক লোকদের এই অপরাধের কারণেই আল্লাহ তা’আলা ধ্বংস করে দিয়েছেন, যারা শহরে বহু কিছু স্মৃতিসৌধ ছেড়ে গেছে। ভূ-পৃষ্ঠে তারা বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। তারা দীর্ঘ সফর করতো। আল্লাহর শাস্তি দেখে তা হতে বাঁচার পথ তারা অনুসন্ধান করতে থাকে। কিন্তু তাদের ঐ চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। আল্লাহর পাকড়াও হতে কে বাঁচতে পারে? প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ কাফিরদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ তোমরা মনে রেখো যে, যখন আমার শাস্তি এসে যাবে তখন ভূষির মত উড়ে যাবে। প্রত্যেক জ্ঞানী ও বিবেকবান ব্যক্তির জন্যে এতে যথেষ্ট উপদেশ ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যে নিবিষ্ট চিত্তে এটা শ্রবণ করে তার জন্যেও এতে শিক্ষা ও উপদেশ আছে।

অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এগুলোর অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছি ছয় দিনে এবং এতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়িনি। এতেও এটা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা’আলা মৃত্যুর পর পুনর্জীবন দান করতে পূর্ণরূপে ক্ষমতাবান। কেননা, এতো বড় মাখলুককে যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন তাঁর পক্ষে মৃতকে পুনর্জীবিত করা মোটেই কঠিন নয়।

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ অভিশপ্ত ইয়াহূদীরা বলতো যে, আল্লাহ তা’আলা ছয় দিনে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম গ্রহণ করেন। আর ঐ দিনটি ছিল শনিবার। ঐ দিনের নামটিই তারা। রেখে তবে ছেড়েছিল। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা তাদের এই বাজে ধারণাটি খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি ক্লান্তই হননি, কাজেই বিশ্রাম কিসের? যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ(আরবী) অর্থাৎ “তারা কি অনুধাবন করে না যে, আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এসবের সৃষ্টিতে কোন ক্লান্তি বোধ করেননি, তিনি মৃতের জীবনদান করতেও সক্ষম? বস্তুতঃ তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (৪৬:৩৩)

আর যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অবশ্যই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করা মানব সৃষ্টি করা অপেক্ষা বহুগুণে বড় (কঠিন)।” (৪০:৫৭) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদেরকেই কি সৃষ্টি করা কঠিন, না আকাশ, যা তিনি বানিয়েছেন?” (৭৯:২৭)

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! অতএব তারা তোমাকে যা বলে তাতে তুমি মনঃক্ষুন্ন হয়ো না বরং ধৈর্যধারণ কর, তাদেরকে অবকাশ দাও, তাদেরকে ছেড়ে দাও এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে এবং রাত্রে তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।

মিরাজের পূর্বে ফজরের ও আসরের নামায ফরয ছিল এবং রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর এবং তার উম্মতের উপর এক বছর পর্যন্ত তাহাজ্জুদের নামায ওয়াজিব থাকে। তারপর তাঁর উম্মতের উপর হতে এর বাধ্যবাধকতা রহিত হয়ে যায়। অতঃপর মিরাজের রাত্রে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয়, যেগুলোর মধ্যে। ফজর ও আসরের নাম যেমন ছিল তেমনই থাকে। সুতরাং সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে এ কথার দ্বারা ফজর ও আসরের নামাযকে বুঝানো হয়েছে।

হযরত জারীর ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা (একদা) নবী (সঃ)-এর নিকট বসেছিলাম। তিনি চৌদ্দ তারিখের চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং বলেনঃ “তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের সামনে হাযির করা হবে এবং তাকে তোমরা এমনিভাবে দেখতে পাবে যেমনভাবে এই চাঁদকে দেখছো। সুতরাং তোমরা পারলে অবশ্যই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বের নামাযকে কখনো ছাড়বে না।” অতঃপর তিনি .. (আরবী)-এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ) এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে আরো বলেনঃ ‘রাত্রেও তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।’ যেমন অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, এটা তোমার এক অতিরিক্ত বর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।” (১৭:৭৯)

(আরবী) দ্বারা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে নামাযের পরে তাসবীহ পাঠকে বুঝানো হয়েছে।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, দরিদ্র মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ধনী লোকেরা তো উচ্চ মর্যাদা ও চিরস্থায়ী নিয়ামত লাভ করে ফেলেছেন!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “কিরূপে?” তারা জবাবে বললেনঃ আমাদের মত তারাও নামায পড়েন ও রোযা রাখেন। কিন্তু তারা দান-খয়রাত করেন যা আমরা করতে পারি না এবং তাঁরা গোলাম আযাদ করেন, আমরা তা করতে সমর্থ হই না।” তিনি তখন তাদেরকে বললেনঃ “এসো, আমি তোমাদেরকে এমন আমলের কথা বলে দিই যা তোমরা করলে তোমরাই সর্বাপেক্ষা অগ্রগামী হয়ে যাবে, তোমাদের উপর কেউই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে না। কিন্তু তারাই পারবে যারা তোমাদের মত আমল করবে। তোমরা প্রত্যেক নামাযের পরে সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এবং আল্লাহু আকবার’ তেত্রিশবার করে পাঠ করবে।” (কিছু দিন পর) তারা আবার আসলেন এবং বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের ধনী ভ্রাতাগণও আমাদের এ আমলের মত আমল করতে শুরু করেছেন!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করে থাকেন।”

দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এর দ্বারা মাগরিবের পরে দুই রাকআত নামাযকে বুঝানো হয়েছে। হযরত উমার (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং হযরত আবু উমামাও (রাঃ) এ কথাই বলেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত শা’বী (রঃ), হযরত নাখঈ (রঃ) এবং হযরত কাতাদা (রঃ)-এরও এটাই উক্তি।

হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে দুই রাকআত নামায পড়তেন, শুধু ফজর ও আসরের পরে পড়তেন না । (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) আব্দুর রহমান (রঃ) প্রত্যেক নামাযের পরে’ একথা বলেছেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একটি রাত্রি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট অতিবাহিত করি। তিনি ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে দুই রাকআত নামায হালকাভাবে আদায় করেন। তারপর তিনি (ফরয) নামাযের জন্যে বাড়ী হতে বের হন এবং আমাকে বলেনঃ “হে ইবনে আব্বাস (রাঃ)! ফজরের পূর্বে দুই রাকআত নামায হলো (আরবী)এবং মাগরিবের পরে দুই রাকআত নামায হলো (আরবী)।” এটা ঐ রাত্রির ঘটনা, যে রাত্রিতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাহাজ্জুদের তেরো রাকআত নামায রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে আদায় করেছিলেন এবং ঐটি ছিল তার খালা হযরত মায়মূনা (রাঃ)-এর পালার রাত্রি। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে গারীব বলেছেন। হ্যাঁ, তবে তাহাজ্জুদের মূল হাদীস তো সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও রয়েছে। সম্ভবতঃ পরবতী কথাটি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিজের কথাই হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
৪১-৪৫ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত কা’ব আহবার (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা একজন ফেরেশতাকে বায়তুল মুকাদ্দাসে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে একথা বলার নির্দেশ দিবেনঃ “সড়া-গলা অস্থিসমূহ এবং হে দেহের বিচ্ছিন্ন অংশসমূহ! আল্লাহ তোমাদেরকে একত্রিত হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। তোমাদের মধ্যে তিনি ফায়সালা করবেন।” সুতরাং এর দ্বারা সূর বা শিংগাকে বুঝানো হয়েছে। এই সত্য ঐ সন্দেহ ও মতভেদকে দূর করে দিবে যা ইতিপূর্বে ছিল। এটা হবে কবর হতে বের হয়ে যাওয়ার দিন।

মহান আল্লাহ বলেনঃ প্রথমে সৃষ্টি করা, তারপর ফিরিয়ে আনা এবং সমস্ত মাখলুককে এক জায়গায় একত্রিত করার ক্ষমতা আমার রয়েছে। ঐ সময় প্রত্যেককে আমি তার আমলের প্রতিদান প্রদান করবে। প্রত্যেকে তার ভাল-মন্দের প্রতিফল পেয়ে যাবে। যমীন ফেটে যাবে। সবাই তাড়াতাড়ি উঠে দাড়িয়ে যাবে। আল্লাহ তা’আলা আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, যার ফলে মাখলুকের দেহ অংকুরিত হতে শুরু করবে, যেমন কাদায় পড়ে থাকা শস্য বৃষ্টি বর্ষণের ফলে অংকুরিত হয়। যখন দেহ পূর্ণরূপে গঠিত হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তা’আলা হযরত ইসরাফীল (আঃ)-কে শিংগায় ফুৎকার দেয়ার হুকুম করবেন। সমস্ত রূহ শিংগার ছিদ্রে থাকবে। হযরত ইসরাফীল (আঃ)-এর শিংগায় ফুৎকার দেয়ার সাথে সাথে রূহগুলো আসমান ও যমীনের মাঝে ফিরতে শুরু করবে। ঐ সময় মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলবেনঃ “আমার ইযযত ও মর্যাদার কসম! অবশ্যই প্রত্যেক রূহ নিজ নিজ দেহের মধ্যে চলে যাবে। যাকে সে দুনিয়ায় আবাদ করে রেখেছিল।” তখন প্রত্যেক রূহ নিজ নিজ দেহে চলে যাবে এবং যেভাবে বিষাক্ত জন্তুর বিষক্রিয়া চতুষ্পদ জন্তুর শিরায় শিরায় অতি তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায় সেই ভাবে ঐ দেহের শিরা উপশিরায় অতিসত্বর রূহ চলে যাবে। আর সমস্ত মাখলুক আল্লাহর ফরমান অনুযায়ী দৌড়তে দৌড়তে অতি তাড়াতাড়ি হাশরের মাঠে হাযির হয়ে যাবে। এই সময়টি হবে কাফিরদের উপর অত্যন্ত কঠিন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেদিন তিনি তোমাদেরকে ডাক দিবেন তখন তোমরা তাঁর প্রশংসাসহ তার আহ্বানে সাড়া দিবে এবং তোমরা ধারণা করবে যে, তোমরা খুব অল্পই বসবাস করেছো।” (১৭:৫২)।

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সর্বপ্রথম আমার কবরের যমীন ফেটে যাবে।”

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “এই সমবেত সমাবেশকরণ আমার জন্যে সহজ। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার হুকুম একবার ছাড়া নয়, চক্ষু অবনত হওয়ার মত।” (৫৪:৫০) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের সকলকে সৃষ্টি করা এবং মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করা একটি প্রাণকে মেরে পুনর্জীবিত করার মতই (অতি সহজ), নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।” (৩১:২৮)।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ‘তারা যা বলে তা আমি জানি (এতে তুমি মন খারাপ করো না)। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ (হে নবী সঃ)! অবশ্যই আমি জানি যে, তারা যা বলছে এতে তোমার মন সংকীর্ণ হচ্ছে। (কিন্তু তুমি সংকীর্ণমনা হয়ে না বা মন খারাপ করো না, বরং) তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং সিজদাকারীদের অর্থাৎ নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত হও। আর তোমার পতিপালকের ইবাদতে লেগে থাকো যে পর্যন্ত না তোমার মৃত্যু হয়। (১৫:৯৭-৯৯)

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তুমি তাদের উপর জবরদস্তিকারী নও’ অর্থাৎ তুমি তাদেরকে জোরপূর্বক হিদায়াতের উপর আনতে পার না এবং এরূপ করতে আদিষ্টও নও। এও অর্থ হয়ঃ তুমি তাদের উপর জোর-জবরদস্তি করো না। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই উত্তম। কেননা, শব্দে ‘তুমি তাদের উপর জোর-জবরদস্তি করো না এরূপ নেই। বরং আছে- তুমি তাদের উপর জাব্বার নও। অর্থাৎ “হে নবী! তুমি শুধু তাবলীগ করেই তোমার কর্তব্য সমাপ্ত কর। (আরবী) শব্দটি (আরবী) শব্দের অর্থেও এসে থাকে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে তুমি উপদেশ দান কর কুরআনের সাহায্যে। অর্থাৎ যার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, তার শাস্তিকে যে ভয় করে এবং তাঁর রহমতের আশা করে, তাকে তুমি কুরআনের মাধ্যমে উপদেশ দাও। এতে সে অবশ্যই উপকৃত হবে এবং সঠিক পথে চলে আসবে। যেমন আল্লাহ পাক অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার দয়িত্ব শুধু পৌছিয়ে দেয়া এবং হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আমার।” (১৩:৪০) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “অতএব তুমি উপদেশ দাও, তুমি তো একজন উপদেশদাতা। তুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও।” (৮৮:২১-২২)।

অন্য এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদেরকে হিদায়াত করা তোমার দায়িত্ব নয়, বরং আল্লাহ যাকে চান হিদায়াত দান করে থাকেন।” (২:২৭২) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হিদায়াত দান করতে পার না, বরং আল্লাহ যাকে চান হিদায়াত দান করে থাকেন।” (২৮:৫৬) এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা এখানে বলেনঃ “তুমি তাদের উপর জবরদস্তিকারী নও, সুতরাং যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে তুমি উপদেশ দান কর কুরআনের সাহায্যে।

হযরত কাতাদা (রঃ) দু’আ করতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! যারা আপনার শাস্তিকে ভয় করে এবং আপনার নিয়ামতের আশা রাখে, আমাদেরকে আপনি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত করুন! হে অনুগ্রহশীল, হে করুণাময়!”

৩০-৪৫ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যায়, তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে, এখন আমার মধ্যে আর অধিক মানুষের স্থান সংকুলানের অবকাশ নেই। অপরটি হচ্ছে, আরো যত অপরাধী আছে তাদের নিয়ে আসুন। প্রথম অর্থ গ্রহণ করলে একথা থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তাহলো অপরাধীদেরকে এমন গাদাগাদি করে জাহান্নামে ভরা হয়েছে যে, সেখানে একটি সুঁচ পরিমাণ স্থানও আর অবশিষ্ট নেই। তাই জাহান্নামকে যখন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তোমার উদর কি পূর্ণ হয়েছে? তখন সে বিব্রত হয়ে জবাব দিচ্ছে এখনো কি আরো মানুষ আছে? দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করলে মনে এরূপ একটি ধারণা সৃষ্টি হয় যে, সে সময় জাহান্নাম অপরাধীদের প্রতি এমন ভীষণভাবে রুষ্ট থাকবে যে, সে ‘আরো কেউ আছে কি’ বলে চাইতে থাকবে এবং সেদিন যেন কোন অপরাধী রেহাই না পায় তাই কামনা করবে।

এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয় যে, আল্লাহ তা’আলার এ প্রশ্ন এবং জাহান্নামের এ জবাবের ধরণ কি হবে? এটা কি শুধু রূপক বর্ণনা? না কি বাস্তবে জাহান্নাম প্রাণ সত্তাধারী বাকশক্তি সম্পন্ন কোন বস্তু যাকে সম্বোধন করা যেতে পারে এবং সে-ও কথার জবাব দিতে পারে? প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে অকাট্যভাবে কোন কিছু বলা যেতে পারে না। হতে পারে এটা একটা রূপক কথা। পরিস্থিতির সঠিক চিত্র তুলে ধরার জন্য প্রশ্নোত্তর আকারে জাহান্নামের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন কোন লোক যদি বলে, আমি গাড়ীকে বললাম, তুমি চলছো না কেন? সে জবাব দিল, আমার মধ্যে পেট্রোল নেই। তবে এটাও পুরোপুরি সম্ভব যে, কথাটি বাস্তব ভিত্তিকই হবে। কারণ, পৃথিবীর যেসব জিনিস আমাদের কাছে অচেতন জড় পদার্থ এবং বাকশক্তিহীন যেসব জিনিস সম্পর্কে আমাদের এ ধারণা পোষণ করা ঠিক নয় যে, তা আল্লাহর কাছেও অবশ্যই তদ্রুপ অচেতন জড় ও বাকশক্তিহীন পদার্থ হবে। স্রষ্টা তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির সাথে কথা বলতে পারেন এবং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি তাঁর কথার জবাবও দিতে পারে। তার ভাষা আমাদের কাছে যতই দুর্বোধ্য হোক না কেন।

# আল্লাহ তা’আলার আদালতে কোন ব্যক্তি সম্পর্কে যেই মাত্র ফায়সালা হবে যে, সে মুত্তাকী এবং জান্নাতলাভের উপযুক্ত, তৎক্ষণাত সে তার সামনে জান্নাতকে বিদ্যমান পাবে। জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছার জন্য তাকে কোন দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে না যে, তাকে পায়ে হেঁটে কিংবা কোন বাহনে বসে ভ্রমণ করে সেখানে পৌঁছতে হবে। তাই ফায়সালার সময় ও জান্নাতে প্রবেশের সময়ের মধ্যে কিছু সময়ের ব্যবধান থাকবে। বরং একদিকে ফায়সালা হবে অন্যদিকে সে তখনই জান্নাতে প্রবেশ করবে। যেন তাকে জান্নাতে পৌঁছানো হয়নি, জান্নাতকেই উঠিয়ে তার কাছে নিয়ে আসা হয়েছে। এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, আখেরাতের স্থান ও কালের ধারণা আমাদের এ পৃথিবীর স্থান ও কালের ধারণা থেকে কতটা ভিন্ন হবে। দ্রুততা ও বিলম্ব এবং দূর ও নিকট সম্পর্কে এ পৃথিবীতে আমাদের যে জ্ঞান আছে সেখানে তা সবই অর্থহীন হবে।
# মূল আয়াত اَوَّابٍ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা অনেক ব্যাপক অর্থবহ। এর অর্থ এমন ব্যক্তি যে নাফরমানী এবং প্রবৃত্তির আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার পথ পরিহার করে আনুগত্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ অবলম্বন করেছে, যে আল্লাহর পছন্দ নয় এমন প্রতিটি জিনিস পরিত্যাগ করে এবং আল্লাহ যা পছন্দ করে তা গ্রহণ করে, বন্দেগীর পথ থেকে পা সামান্য বিচ্যুত হলেই যে বিচলিত বোধ করে এবং তাওবা করে বন্দেগীর পথে ফিরে আসে, যে অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের সমস্ত ব্যাপারে তাঁর স্মরণাপন্ন হয়।

# মূল আয়াতে حَفِيْظٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ “রক্ষাকারী।” এর দ্বারা এমন লোককে বুঝানো হয়েছে যে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা, তাঁর ফরযসমূহ, হারামসমূহ এবং তার দায়িত্বে ন্যস্ত আমানতসমূহ রক্ষা করে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ওপর আরোপিত অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করে, যে ঈমান এনে তার রবের সাথে যে চুক্তি ও অঙ্গিকারে আবদ্ধ হয়েছে তা রক্ষা করে, যে তার শক্তি, শ্রম ও চেষ্টা-সাধনার পাহারাদারি করে যাতে এসবের কোনটি ভ্রান্ত কাজে নষ্ট না হয়, যে তাওবা করে তা রক্ষা করে এবং তা ভঙ্গ হতে দেয় না, যে সর্বাবস্থায় আত্মসমালোচনা করে দেখতে থাকে যে, সে তার কথায় ও কাজে কোথাও তার রবের নাফরমানী তো করছে না?

# সে কোথাও রহমান বা পরম দয়ালু আল্লাহর দেখা পেতো না এবং নিজের ইন্দ্রিয়সমূহ দ্বারাও কোনভাবেই তাঁকে অনুভব করতে পারতো না। তা সত্ত্বেও তাঁর নাফরমানী করতে সে ভয় পেতো। অন্যান্য অনুভূত শক্তি এবং প্রকাশ্যে দৃষ্টিগোচর হয় এমন সব শক্তি ও সত্তার তুলনায় তার মনে অদেখা রহমানের ভয় অধিক প্রবল ছিল। তিনি ‘রহমান’ বা দয়ালু একথা জানা সত্ত্বেও তাঁর রহমতের ভরসায় সে গোনাহর কাজে লিপ্ত হয়নি, বরং সব সময়ই তাঁর অসন্তুষ্টিকে ভয় পেয়েছে। এভাবে আয়াতটি ঈমানদার ব্যক্তির দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গুণের প্রতি ইঙ্গিত করে। একটি হচ্ছে, অনুভূত ও দৃষ্টিগোচর না হওয়া সত্ত্বেও সে আল্লাহকে ভয় করে। অপরটি হচ্ছে, সে আল্লাহর রহমত গুণটি সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও গোনাহ করার দুঃসাহস করে না। এ দু’টি গুণই তাকে আল্লাহর কাছে মর্যাদার অধিকারী করে তোলে। তাছাড়াও এ আয়াতের মধ্যে আরো একটি সূক্ষ্ম বিষয়ও আছে যা ইমাম রাযী বর্ণনা করেছেন। বিষয়টি হচ্ছে, আরবী ভাষায় ভয় বুঝাতে خوف ও خشيت এ দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয়। এ দু’টি শব্দের অর্থে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। خوف শব্দটি সাধারণত এমন ভয় বুঝাতে ব্যবহৃত হয় যা কারো শক্তির সামনে নিজের দুর্বলতার অনুভূতির কারণে নিজের মধ্যে সৃষ্টি হয়। আর خشيت বলা হয় এমন এমন ভীষণ ভয়কে যা করো বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা থেকে মানুষের মনে সৃষ্টি হয়। এখানে خوف এর পরিবর্তে خشيت শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, শুধু শাস্তির আশঙ্কায়ই মু’মিন বান্দার অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয় না। তার চেয়েও বড় জিনিস অর্থাৎ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মর্যাদার অনুভূতি সবসময় তার মনে এক ভয়ানক ভীতিভাব জাগিয়ে রাখে।
# মূল কথাটি হচ্ছে قَلْبٍ مُنِيْبٍ নিয়ে এসেছে। منيب শব্দটির উৎপত্তি انابت থেকে যার অর্থ একদিকে মুখ করা এবং বারবার সেদিকেই ফিরে যাওয়া। যেমন কম্পাসের কাঁটা সবসময় মেরুর দিকেই মুখে করে থাকে। আপনি তাকে যতই নাড়া চাড়া বা ঝাঁকুনি দেন না কেন তা ঘুরে ফিরে মেরুর দিকে চলে আসে। অতএব قَلْبٍ مُنِيْبٍ অর্থ এমন হৃদয়-মন যা সব দিক থেকে এক আল্লাহর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। অতঃপর সারা জীবন তার ওপরে যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন তাতে সে বার বার তার দিকেই ফিরে এসেছে। এ বিষয়টাকেই আমরা ‘অনুরক্ত মন” কথাটি দিয়ে ব্যক্ত করেছি। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর কাছে প্রকৃত সম্মানের অধিকারী সে ব্যক্তি যে শুধু মুখে নয় বরং পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে সরল মনে তাঁর একান্ত আপনজন হয়ে আসে।
# মূল আয়াতাংশ হচ্ছে ادْخُلُوهَا بِسَلَامٍ । سلام শব্দটিকে যদি নিরাপত্তা অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার অর্থ হবে, সব রকম দুঃখ, দুশ্চিন্তা, চিন্তা ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদ হয়ে এ জান্নাতে প্রবেশ করো। তবে যদি শান্তি অর্থেই গ্রহণ করা হয় তাহলে অর্থ হবে, এ জান্নাতে এসো, আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে তোমাকে সালাম। যে গুণাবলী থাকলে কোন ব্যক্তি জান্নাতলাভের উপযুক্ত হয় এসব আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সে গুণাবলী বর্ণনা করেছেন। ঐগুলো হচ্ছেঃ
(১) তাকওয়া,
(২) আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন,
(৩) আল্লাহর সাথে নিজের সম্পর্কের সযত্ন পাহারাদারী,
(৪) আল্লাহকে না দেখে এবং তাঁর ক্ষমা পরায়ণতায় বিশ্বাসী হয়েও তাঁকে ভয় করা এবং
(৫) অনুরক্ত হৃদয়-মন নিয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছা অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত অনুরক্ত থাকার আচরণ করে যাওয়া।
# তারা যা চাইবে তাতো পাবেই। কিন্তু আমি তাদেরকে আরো এমন কিছু দেব যা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা তো দূরের কথা তাদের মন-মগজে তার কল্পনা পর্যন্ত উদিত হয়নি।

# তারা শুধু নিজেদের দেশেই শক্তিমান ছিল না পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেও প্রবেশ করে দখল জমিয়েছিলো এবং ভুপৃষ্ঠের দূর-দূরান্ত পর্যন্ত তাদের লুটতরাজের অপকর্ম বিস্তার লাভ করেছিলো।
# যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে পাকড়াও করার সময় সমুপস্থিত হলো তখন কি তাদের শক্তি তাদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলো? পৃথিবীতে কোথাও কি তারা আশ্রয় লাভ করেছিলো? তাহলে কোন ভারসায় তোমরা এ আশা পোষণ করো যে, আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তোমরা কোথাও আশ্রয় পেয়ে যাবে?
# অন্য কথায় যাদের নিজেদের অন্তত এতটুকু বিবেক-বুদ্ধি আছে যে, সঠিক চিন্তা করতে পারে কিংবা উদাসীনতা ও পক্ষপাত থেকে এতটুকু পবিত্র ও মুক্ত যে, যখন অন্য কেউ তাকে প্রকৃত সত্য বুঝায় তখন একাগ্রভাবে তার কথা শোনো। এমনভাবে নয় যে, শ্রোতার মন-মগজ অন্য দিকে ব্যস্ত থাকায় উপদেশদাতার কথা কানের পর্দার ওপর দিয়েই চলে যায়।
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা হা-মীম আস সাজদার তাফসীর, টীকা, ১১ থেকে ১৫ পর্যন্ত।
# প্রকৃত ব্যাপার হলো, আমি গোটা এ বিশ্ব-জাহান মাত্র ছয় দিনে সৃষ্টি করেছি এবং তা সৃষ্টি করে আমি ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়িনি যে, পুনরায় তা সৃষ্টি করার সাধ্য আর আমার নেই। এখন এসব নির্বোধরা যদি তোমার কাছে মৃত্যুর পরের জীবনের খবর শুনে তোমাকে বিদ্রূপ করে এবং পাগল বলে আখ্যায়িত করে তাহলে ধৈর্য অবলম্বন করো। ঠাণ্ডা মাথায় এদের প্রতিটি অর্থহীন কথা শোন এবং তোমাকে যে সত্যটি পেশ করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে তা পেশ করতে থাকো।

এ আয়াতে আনুষঙ্গিকভাবে ইহুদী ও খৃস্টানদের প্রতি একটি সূক্ষ্ম বিদ্রূপ প্রচ্ছন্ন আছে। কারণ, ইহুদী ও খৃস্টানদের বাইবেলের এ কল্পকাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা ছয় দিনে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছেন (আদিপুস্তক, ২:২)। বর্তমানে যদিও খৃস্টান পাদরীরা এতে লজ্জাবোধ করতে শুরু করেছে এবং তারা পবিত্র বাইবেলের উর্দূ অনুবাদে ‘বিশ্রাম নিয়েছেন’ কে ‘বিরত হয়েছেন’ কথায় পরিবর্তন করেছে। তা সত্ত্বেও কিং জেমসের নির্ভরযোগ্য ইংরেজী বাইবেলে (And he rested on seventh day) কথাটি স্পষ্ট বর্তমান আছে। ১৯৫৪ খৃস্টাব্দে ইহুদীরা ফিলাডেলফিয়া থেকে যে অনুবাদ প্রকাশ করেছে তাতেও একথাটি আছে। আরবী অনুবাদেও فاسبترح فى اليوم السابع কথাটি আছে।
# এটাই সেই পন্থা যার মাধ্যমে মানুষ ন্যায় ও সত্যের জন্য আন্দোলনে মর্মান্তিক ও নিদারুণ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার এবং নিজের চেষ্টা-সাধনার সুফল অর্জিত হওয়ার সম্ভবানা থাকা সত্ত্বেও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সারা জীবন ন্যায় ও সত্যের বাণী সমুন্নত করার এবং পৃথিবীকে কল্যাণের পথে আহবান জানানোর ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার শক্তি অর্জন করতে পারে। এখানে রবের প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করা অর্থ নামায। কুরআন মজীদের যেখানেই প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করাকে নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত করে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানেই এর অর্থ হয়ে থাকে নামায। “সূর্যোদয়ের পূর্বে” ফজরের নামায। “সূর্যাস্তের পূর্বে দু’টি নামায আছে। একটি যোহরের নামায এবং অপরটি আসরের নামায। রাতে আছে মাগরির ও এশার। তাছাড়া তৃতীয় আরেকটি নামায হিসেবে তাহাজ্জুতের নামাযও রাতের তাসবীহর অন্তর্ভুক্ত। ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা বনী ইসরাঈল, টীকা ৯১ থেকে ৯৭ পর্যন্ত। ত্বাহা, টীকা ১১১ ; আর রূম, টীকা ২৩ ও ২৪ । তাছাড়া সিজদা শেষ করার পরে যে তাসবীহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার অর্থ নামাযের পরের যিকরও হতে পারে এবং ফরযের পরে নফল নামায আদায় করাও হতে পারে। হযরত উমর, হযরত আলী, হযরত হাসান ইবনে আলী, হযরত আবু হুরাইরা, ইবনে আব্বাস, শা’বী মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান বাসরী, কাতাদা, ইবরাহীম নাখয়ী ও আওযায়ী এর অর্থ বলেছেন মাগরিবের পরের দু’রাকআত নামায। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস এবং অপর একটি রেওয়ায়াত অনুসারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের ধারণাও এই যে, এর অর্থ নামাযের পরের যিকর। ইবনে যায়েদ বলেন, একথার উদ্দেশ্যে হচ্ছে ফরযের পরেও নফল আদায় করা হোক।

বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার গরীব মুহাজিররা এসে বললো হে আল্লাহর রসূল, বড় বড় মর্যাদা তো বিত্তবান লোকেরাই লুফে নিল। নবী (সা.) বললেনঃ কি হয়েছে? তারা বললোঃ আমরা যেমন নামায পড়ি বিত্তবান লোকেরাও তেমনি নাযাম পড়ে। আমরা রোযা রাখি তারাও তেমনি রোযা রাখে। কিন্তু তারা দান করে আমরা দান করতে পারি না এবং তারা ক্রীতদাস মুক্ত করে আমরা করতে পারি না। রসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ আমি কি তোমাদের এমন কাজ বলে দিব, যা করলে তোমরা অন্য লোকদের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে যাবে? তবে যারা সে কাজটিও করবে তাদের বাদ দিয়ে। সে কাজটি হচ্ছে তোমরা প্রত্যেক নামাযের পরে ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ ‘আলহামদুল্লিহ’ এবং ‘আল্লাহু আকবার’ বলো। কিছুদিন পরে তারা এসে বললো, এ আমলের কথা আমাদের বিত্তবান ভাইয়েরাও শুনেছে এবং তারাও এ আমল করতে শুরু করেছে। একথা শুনে তিনি বললেনঃ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ । একটি রেওয়ায়াতে এ তাসবীহর সংখ্যা ৩৩ বারের পরিবর্তে দশবার করে পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ রসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে প্রত্যেক নামাযের পরে ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ ও আলহামদুল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়তে বলেছিলেন। পরে এক আনসারী বলেছিলেনঃ আমি স্বপ্নে দেখেছি কেউ যেন আমাকে বলছে যদি তুমি এ তিনটি তাসবীহ ২৫ বার করে পড় এবং তারপর ২৫ বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড় তাহলে অধিক উত্তম হবে। নবী (সা.) বললেনঃ ঠিক আছে, সেভাবেই করতে থাকো। (আহমাদ, নাসায়ী, দারেমী)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী বলেনঃ রসূলুল্লাহ ﷺ যখন নাময শেষ করে বসতেন তখন আমি তাঁকে এ দোয়া পড়তে শুনতামঃ

سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ – وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ – وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (احكام القران للجصاص)

এছাড়াও নামাযের পরবর্তী যিকরের আরো কতিপয় পন্থা রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয়েছে। যারা কুরআন মজীদের এ নির্দেশনা অনুসারে আমল করতে ইচ্ছুক তারা যেন হাদীসগ্রন্থ মিশকাতের আয যিকর বা’দাস সালাম অনুচ্ছেদ থেকে নিজের সবচেয়ে মনমত একটি দোয়া বেছে নেয় এবং সেটি আমল করে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের বর্ণিত দোয়ার চাইতে ভাল দোয়া আর কি হতে পারে? তবে একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, দোয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট কিছু শব্দ মুখে উচ্চারণ করাই নয়। বরং ঐসব শব্দে যে অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে মন-মগজে তা দৃঢ় ও বদ্ধমূল করা। তাই যে দোয়াই করা হোক না কেন ভাল করে তার অর্থ বুঝে নিতে হবে এবং তা মনে রেখেই দোয়া পড়তে হবে।

# যেখানেই যে ব্যক্তি মরে পড়ে থাকবে কিংবা পৃথিবীতে যেখানেই তার মৃত্যু সংঘটিত হয়েছিল সেখানেই তার কাছে আল্লাহর ঘোষকের এ আওয়াজ পৌঁছবে যে, উঠ এবং তোমার রবের কাছে হিসেব দেয়ার জন্য চলো। এ আওয়াজ হবে এমন যে, ভুপৃষ্ঠের আনাচে-কানাচে যেখানেই যে ব্যক্তি জীবিত হয়ে উঠবে সেখানেই সে মনে করবে, যে আহ্বানকারী নিকটেই কোথাও থেকে তাকে আহবান করেছে। একই সময়ে গোটা পৃথিবীর সব জায়গায় সমানভাবে এ আওয়াজ শোনা যাবে। এ থেকেও কিছুটা অনুমান করা যায় যে, আখিরাতের স্থান ও কাল বর্তমান আমাদের এ পৃথিবীর স্থান ও কালের তুলনায় কতটা পরিবর্তিত হবে এবং সেখানে কেমন সব শক্তি কি ধরনের আইনানুসারে তৎপর ও সক্রিয় থাকবে।

# মূল আয়াতাংশ হচ্ছে يَسْمَعُونَ الصَّيْحَةَ بِالْحَقِّ । এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে, সমস্ত মানুষই মহাসত্য সম্পর্কিত আহবান শুনতে পাবে। অপর অর্থটি হচ্ছে হাশরের কলরব ঠিকমতই শুনতে পাবে। প্রথম অর্থ অনুসারে বক্তব্যের সারমর্ম দাঁড়ায় মানুষ নিজ কানে সেই মহাসত্যের আহবান শুনতে পাবে যা তারা পৃথিবীতে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না, যা অস্বীকার করতে তাদের ছিল চরম একগুঁয়েমী এবং যার সংবাদদাতা নবী-রসূলদের তারা বিদ্রূপ করতো। দ্বিতীয় অর্থ অনুসারে এর প্রতিপাদ্য বিষয় দাঁড়ায় এই যে, নিশ্চিতভাবেই তারা হাশরের কলরব-কোলাহল শুনবে, তারা নিজেরাই জানতে পারবে, এটা কোন কাল্পনিক বিষয় নয়, বরং প্রকৃতই হাশরের কলরব-কোলাহল। ইতিপূর্বে তাদেরকে যে হাশরের খবর দেয়া হয়েছিলো তা যে সত্যিই এসে হাজিরৌ হয়েছে এবং এ যে তারই শোরগোল উত্থিত হচ্ছে সে ব্যাপারে তাদের কোন সন্দেহই থাকবে না।

# তিন নম্বর আয়াতে কাফেরদের যে কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে এটা তারই জবাব। তারা বলতো, আমরা যখন মরে মাটিতে মিশে যাবো তখন আমাদেরকে আবার জীবিত করে উঠানো হবে তা কি করে হতে পারে। এভাবে পুনরুত্থান তো অসম্ভব ও অযৌক্তিক। তাদের এ বক্তব্যের জবাবে বলা হয়েছে, এ হাশর অর্থাৎ একই সময়ে আগের ও পরের সমস্ত মানুষকে জীবিত করে একত্রিত করা আমার জন্য একেবারেই সহজ। কোন ব্যক্তির মাটি কোথায় পড়ে আছে তা জানা আমার জন্য আদৌ কোন কঠিন ব্যাপার নয়। এসব বিক্ষিপ্ত অণু-পরমাণুর মধ্যে কোন্গুলো যায়েদের আর কোন্গুলো বকরের তা জানতেও আমার কোন কষ্ট হবে না। এসব অণু-পরমাণুকে আলাদাভাবে একত্রিত করে একেকজন মানুষের দেহ পুনরায় তৈরী করা এবং ঐ দেহ হুবহু আগের ব্যক্তিত্ব নতুনভাবে সৃষ্টি করে দেয়া আমার জন্য কোন শ্রমসাধ্য ব্যাপার নয়, বরং আমার একটি মাত্র ইঙ্গিতেই তৎক্ষণাৎ তা হতে পারে। আদমের সময় থেকে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানুষ সৃষ্টি হয়েছে আমার একটি মাত্র আদেশে তারা সবাই অতি সহজে সমবেত হতে পারে। তোমাদের অতি ক্ষুদ্র বুদ্ধি-বিবেক একে অসম্ভব মনে করলে মনে করুক। বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার ক্ষমতার কাছে তা অসম্ভব নয়।
# এ আয়াতাংশে যুগপৎ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য সান্ত্বনা এবং কাফেরদের জন্য হুমকি বিদ্যমান। নবীকে ﷺ উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে যে, এসব লোক তোমার বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা রটনা করছে মোটেই তার পরোয়া করো না। আমি সবকিছু জানি। তাদের সাথে বুঝা পড়া করা আমার কাজ। কাফেরদের হুঁশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে যে, তোমরা আমার নবীর বিরুদ্ধে যেসব বিদ্রূপাত্মক উক্তি করছো সেজন্য তোমাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হবে। আমি নিজে প্রতিটি কথা শুনেছি। তোমাদেরকে তার মাশুল দিতে হবে।
# এর অর্থ এ নয় যে, নবী ﷺ জোর করে নিজের কথা মানুষকে মানাতে চাইতেন কিন্তু আল্লাহ‌ তা’আলা তা থেকে তাঁকে বিরত রেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবীকে ﷺ সম্বোধন করে কাফেরদের একথা শুনানো হচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে, তোমাদের কাছে আমার নবীকে শক্তি প্রয়োগকারী করে পাঠানো হয়নি। তোমাদেরকে জোর করে মু’মিন বানানো তার কাজ নয়, তোমরা মানতে না চাইলেও তিনি তোমাদেরকে তা মানতে বাধ্য করবেন। তাঁর দায়িত্ব কেবল এতটুকু যে, সাবধান করে দিলে যারা সতর্ক হয়ে যাবে তিনি তাদেরকে কুরআন শুনিয়ে প্রকৃত সত্য বুঝিয়ে দেবেন। এরপরও যদি তোমরা না মানো তাহলে নবী তোমাদের সাথে বুঝাপড়া করবেন না, বরং আমি নিজে তোমাদের সাথে বুঝাপড়া করবো।

Leave a Reply