أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৭)
[* অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারা যাবেনা:-
*যারা অজ্ঞতায় নিমজ্জিত এবং গাফলতিতে বিভোর হওয়া যাবে না:-
** পৃথিবীতে বহু নিদর্শন রয়েছে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও! তোমরা কি ভেবে দেখবে না?:-
*আকাশে রয়েছে তোমাদের রুযী ও প্রতিশ্রুত সবকিছু। :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫১-যা-রিয়াত। পারা:২৬
১-৩০ নং আয়াত:-
সূরাটির তাফসীরে মনােনিবেশ করছি।:-
ফী জিলালিল কুরআন:-
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১
وَالذّٰرِیٰتِ ذَرۡوًا ۙ﴿۱﴾
শপথ ঝড়ো হাওয়ার।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২
فَالۡحٰمِلٰتِ وِقۡرًا ۙ﴿۲﴾
শপথ বোঝা বহনকারী মেঘপুঞ্জের,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৩
فَالۡجٰرِیٰتِ یُسۡرًا ۙ﴿۳﴾
শপথ স্বচ্ছন্দ গতি নৌযানের,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৪
فَالۡمُقَسِّمٰتِ اَمۡرًا ۙ﴿۴﴾
শপথ কর্ম বণ্টনকারী ফিরিশতাদের,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৫
اِنَّمَا تُوۡعَدُوۡنَ لَصَادِقٌ ۙ﴿۵﴾
তোমাদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৬
وَّ اِنَّ الدِّیۡنَ لَوَاقِعٌ ؕ﴿۶﴾
কর্মফল দিবস অবশ্যম্ভাবী।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৭
وَ السَّمَآءِ ذَاتِ الۡحُبُکِ ۙ﴿۷﴾
শপথ বহু পথ বিশিষ্ট আকাশের,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৮
اِنَّکُمۡ لَفِیۡ قَوۡلٍ مُّخۡتَلِفٍ ۙ﴿۸﴾
তোমরা তো পরস্পর-বিরোধী কথায় লিপ্ত।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৯
یُّؤۡفَکُ عَنۡہُ مَنۡ اُفِکَ ﴿ؕ۹﴾
তার ব্যাপারে সে-ই বিরক্ত যে হকের প্রতি বিমুখ।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১০
قُتِلَ الۡخَرّٰصُوۡنَ ﴿ۙ۱۰﴾
ধ্বংস হয়েছে অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১১
الَّذِیۡنَ ہُمۡ فِیۡ غَمۡرَۃٍ سَاہُوۡنَ ﴿ۙ۱۱﴾
যারা অজ্ঞতায় নিমজ্জিত এবং গাফলতিতে বিভোর।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১২
یَسۡـَٔلُوۡنَ اَیَّانَ یَوۡمُ الدِّیۡنِ ﴿ؕ۱۲﴾
তারা জিজ্ঞেস করে, ‘কর্মফল দিবস কবে হবে?’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৩
یَوۡمَ ہُمۡ عَلَی النَّارِ یُفۡتَنُوۡنَ ﴿۱۳﴾
যেদিন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে অগ্নিতে,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৪
ذُوۡقُوۡا فِتۡنَتَکُمۡ ؕ ہٰذَا الَّذِیۡ کُنۡتُمۡ بِہٖ تَسۡتَعۡجِلُوۡنَ ﴿۱۴﴾
বলা হবে ‘তোমারা তোমাদের শাস্তি আস্বাদন কর, তোমারা এ শাস্তিই ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে।’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৫
اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوۡنٍ ﴿ۙ۱۵﴾
তবে মুত্তাকীরা সেদিন বাগান ও ঝর্ণাধারার মধ্যে অবস্থান করবে।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৬
اٰخِذِیۡنَ مَاۤ اٰتٰہُمۡ رَبُّہُمۡ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَبۡلَ ذٰلِکَ مُحۡسِنِیۡنَ ﴿ؕ۱۶﴾
তাদের রব যা কিছু তাদের দান করবেন তা সানন্দে গ্রহণ করতে থাকবে। সেদিনটি আসার পূর্বে তারা ছিল সৎকর্মশীল।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৭
کَانُوۡا قَلِیۡلًا مِّنَ الَّیۡلِ مَا یَہۡجَعُوۡنَ ﴿۱۷﴾
রাতের বেলা তারা কমই ঘুমাতো।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৮
وَ بِالۡاَسۡحَارِ ہُمۡ یَسۡتَغۡفِرُوۡنَ ﴿۱۸﴾
তারপর তারাই আবার রাতের শেষ প্রহরগুলোতে ক্ষমা প্রার্থনা করতো।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৯
وَ فِیۡۤ اَمۡوَالِہِمۡ حَقٌّ لِّلسَّآئِلِ وَ الۡمَحۡرُوۡمِ ﴿۱۹﴾
তাদের সম্পদে অধিকার ছিল প্রার্থী ও বঞ্চিতদের।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২০
وَ فِی الۡاَرۡضِ اٰیٰتٌ لِّلۡمُوۡقِنِیۡنَ ﴿ۙ۲۰﴾
দৃঢ় প্রত্যয় পোষণকারীদের জন্য পৃথিবীতে বহু নিদর্শন রয়েছে।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২১
وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ ؕ اَفَلَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿۲۱﴾
এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও! তোমরা কি ভেবে দেখবে না?
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২২
وَ فِی السَّمَآءِ رِزۡقُکُمۡ وَ مَا تُوۡعَدُوۡنَ ﴿۲۲﴾
আকাশে রয়েছে তোমাদের রুযী ও প্রতিশ্রুত সবকিছু।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৩
فَوَ رَبِّ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ اِنَّہٗ لَحَقٌّ مِّثۡلَ مَاۤ اَنَّکُمۡ تَنۡطِقُوۡنَ ﴿٪۲۳﴾
তাই আসমান ও যমীনের মালিকের শপথ, একথা সত্য এবং তেমনই নিশ্চিত যেমন তোমরা কথা বলছো।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৪
ہَلۡ اَتٰىکَ حَدِیۡثُ ضَیۡفِ اِبۡرٰہِیۡمَ الۡمُکۡرَمِیۡنَ ﴿ۘ۲۴﴾
আপনার কাছে ইবরাহীমের সম্মানীত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে কি?
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৫
اِذۡ دَخَلُوۡا عَلَیۡہِ فَقَالُوۡا سَلٰمًا ؕ قَالَ سَلٰمٌ ۚ قَوۡمٌ مُّنۡکَرُوۡنَ ﴿ۚ۲۵﴾
যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সালাম।’ উত্তরে সে বলল, ‘সালাম। এরা তো অপরিচিত লোক।’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৬
فَرَاغَ اِلٰۤی اَہۡلِہٖ فَجَآءَ بِعِجۡلٍ سَمِیۡنٍ ﴿ۙ۲۶﴾
অতঃপর ইব্রাহীম সংগোপনে তার স্ত্রীর নিকট গেল এবং একটি (ভুনা) গোশতল বাছুর নিয়ে এল।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৭
فَقَرَّبَہٗۤ اِلَیۡہِمۡ قَالَ اَلَا تَاۡکُلُوۡنَ ﴿۫۲۷﴾
তা তাদের সামনে রাখল এবং বলল, ‘তোমরা খাচ্ছ না কেন?’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৮
فَاَوۡجَسَ مِنۡہُمۡ خِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡا لَا تَخَفۡ ؕ وَ بَشَّرُوۡہُ بِغُلٰمٍ عَلِیۡمٍ ﴿۲۸﴾
তখন তাদের সম্পর্কে তার মনে ভীতির সঞ্চার হল। তারা বলল, ‘ভয় পেয়ো না।’ অতঃপর তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্র-সন্তানের সুসংবাদ দিল।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৯
فَاَقۡبَلَتِ امۡرَاَتُہٗ فِیۡ صَرَّۃٍ فَصَکَّتۡ وَجۡہَہَا وَ قَالَتۡ عَجُوۡزٌ عَقِیۡمٌ ﴿۲۹﴾
তখন তার স্ত্রী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সামনে এল এবং মুখমন্ডল চাপড়িয়ে বলল, ‘(আমি তো) বন্ধ্যা বৃদ্ধা, (আমার সন্তান হবে কি করে?)’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৩০
قَالُوۡا کَذٰلِکِ ۙ قَالَ رَبُّکِ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡحَکِیۡمُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۳۰﴾
তারা বলল, ‘তোমার প্রতিপালক এরূপই বলেছেন। নিশ্চয় তিনিই প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।’
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটির একটি বিশেষ আবহ ও পরিবেশ রয়েছে। এর শুরুতেই আল্লাহর সৃষ্টিজগতের চারটি শক্তির উল্লেখ করা হয়েছে কিছুটা রহস্যময় ভাষায়। সূচনাতেই এই ধারণা দেয়া হয় যে, সে কতকগুলাে রহস্যময় জিনিসের সম্মুখীন। প্রথমেই আল্লাহ তায়ালা একটি বিষয়ে কসম খেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কসম ধুলিঝঞ্ঝার… তােমাদেরকে যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে, আর কর্মফল প্রদানের কাজ অবশ্যই সম্পন্ন হবে।’ প্রথম দফায় যে চারটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তা হচ্ছে ‘যারিয়াত’, ‘হামিলাত’, ‘জারিয়াত’ ও ‘মােকাসসিমাত’। এ শব্দ কয়টির অর্থ তেমন সুপরিচিত নয়। ফলে এটা এতােটা অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে যে, এর অর্থ জানার জন্যে প্রশ্ন ও উত্তরের প্রয়ােজন পড়ে। উপরন্তু এ শব্দ কয়টি মানুষের অনুভূতিতে অনুরূপ প্রভাব বিস্তার করে, আর এটাই বােধ হয় সূরার প্রথম উদ্দেশ্য। এরপর দ্বিতীয় দফা কসম খাওয়া হয়েছে এভাবে, ‘কসম বহু পথ বিশিষ্ট আকাশের। নিশ্চয় যে বিষয়ে তােমরা নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকো।’ অর্থাৎ যে সব বক্তব্যের মধ্যে কোনাে সময় ও সামঞ্জস্য নেই, যা কোনাে জ্ঞানভিত্তিক নয়, বরং অনুমান ভিত্তিক। সূরা এভাবে শুরু হওয়া এবং গােটা সূরা জুড়ে একই ধরনের বক্তব্যের প্রাধান্য পাওয়া সত্ত্বেও এর একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। সেই উদ্দেশ্য হলাে মানুষের মনকে আল্লাহর সাথে ও আল্লাহর অদৃশ্য জগতের সাথে যুক্ত করা, তাকে যাবতীয় পার্থিব মলিনতা থেকে পবিত্র করা এবং আল্লাহর একনিষ্ঠ এবাদাত ও আনুগত্যের পথের সকল বাধা থেকে তাকে মুক্ত করা। এ উদ্দেশ্যের সাথে সূরার দুটি আয়াতের বক্তব্যের মিল রয়েছে। যথা, ‘তােমরা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করাে এবং ‘আমি জিন ও মানুষকে একমাত্র আমার এবাদাতের জন্যে সৃষ্টি করেছি।’ প্রথমটিতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টিতে বান্দাদের সম্পর্কে আল্লাহর ইচ্ছা ব্যক্ত করা হয়েছে। যেহেতু জীবিকা উপার্জনে ব্যস্ত থাকা ও তদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজই আল্লাহর ইবাদতের পথে সবচেয়ে বড় বাধা, তাই এই সূরায় মানুষের অনুভূতিতে জীবিকার হাতে যিম্মী হওয়া থেকে মুক্ত করার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, মানুষের মনকে তার দিক থেকে নিশ্চিন্ত করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে মনকে পৃথিবী ও পার্থিব উপকরণাদির ওপর নয় বরং আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে এই সূরায় একাধিক জায়গায় বক্তব্য রাখা হয়েছে। কোথাও প্রত্যক্ষভাবে যথা ‘আকাশেই তােমাদের জীবিকা ও তােমাদের জন্যে প্রতিশ্রুত অন্যান্য জিনিস রয়েছে।’ ‘আল্লাহই জীবিকাদাতা এবং অটুট শক্তির অধিকারী। আবার কোথাও আভাস-ইংগিতে, যথা ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের প্রাপ্য রয়েছে।’ এবং হযরত ইবরাহীমের দানশীলতা ও অতিথিপরায়ণতার বিবরণ দানের মাধ্যমেও শিক্ষা দেয়া হয়েছে। সুতরাং এ সূরার কেন্দ্রীয় আলােচ্য বিষয় হলো, মন-মগজকে জীবিকার গােলামী, বাঁধা ও বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল করা ও তার কাছে আশ্রয় গ্রহণের শিক্ষা। অন্য সকল আলােচিত বিষয় ও ঘটনাবলী এই মূল বিষয় থেকেই উদ্ভূত। এ জন্যেই সূরাটি এভাবে কসমের মাধ্যমে ও অস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এবং তারপর আকাশের নামে শপথ ও বারবার আকাশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরার প্রথম দিকে পরহেযগার লােকদের যে ছবি আঁকা হয়েছে, যথা- ‘নিশ্চয় পরহেযগার লােকেরা বাগানসমূহে ও ঝর্নাসমূহে অবস্থান করবে।… তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে।’ এ আয়াতগুলােতে আল্লাহর প্রতি অনুরাগ ও নিষ্ঠা, রাত জেগে তার এবাদাত, শেষ রাতে তাঁর দরবারে ধরণা দেয়া, সেই সাথে সম্পদের লালসা ও প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং প্রার্থী ও বঞ্চিতের প্রাপ্য দেয়াকে পরহেযগারদের বৈশিষ্ট রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এ প্রসংগেই মােমেনদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে পৃথিবীতে ও তাদের নিজ সত্তায় আল্লাহর যে নিদর্শনাবলী বিরাজ করছে তার দিকে মনােযোেগ দিতে, আর সেই সাথে জীবিকা অর্জনের জীবিকার পার্থিব উপকরণগুলাের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হতে। বলা হয়েছে, ‘আর পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের জন্যে বহু নির্দশন রয়েছে, নিদর্শন রয়েছে তােমাদের সত্তার ভেতরেও। তবু কি তােমরা তা দেখতে পাওনা? আর আকাশে রয়েছে তােমাদের জীবিকা এবং যা যা তােমাদেরকে দেয়ার ওয়াদা করা হয়।’ এই প্রসংগে আকাশকে সুন্দরভাবে নির্মাণ করা, পৃথিবীকে বিস্তৃত করা, পৃথিবীতে জোড়ায় জোড়ায় প্রাণী ও উদ্ভিদ ইত্যাদি সৃষ্টি করা এবং এ সবের ওপর আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আকাশকে আমি নির্মাণ করেছি এবং আমি প্রশস্তকারী… অতএব আল্লাহর কাছে আশ্রয় নাও। নিশ্চয় আমি তােমাদের জন্যে প্রকাশ্য সতর্ককারী।’ সর্বশেষে সূরার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটি উচ্চারিত হয়েছে, যাতে আল্লাহ তায়ালা জ্বিন ও মানুষের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য কী, তার উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আমি আমার এবাদাত ব্যতীত আর কোনাে উদ্দেশ্যে জ্বিন ও মানুষকে সৃষ্টি করিনি। নিশ্চয় আল্লাহই জীবিকাদাতা, শক্তিশালী ও চিরঞ্জীব।’ এভাবে সূরাটিতে বিভিন্ন সুরে ও বিভিন্ন ভংগিতে একটা বক্তব্যই উচ্চারিত হয়েছে। তাহলাে, মানুষ যেন আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়। এ সূরার অতি সংক্ষেপে হযরত ইবরাহীম, লূত, মূসা, আদ জাতি, সামুদ জাতি ও নূহ(আ.)-এর সমকালীন মানবজাতির ঘটনাবলীর প্রতি ইংগিত দেয়া হয়েছে। হযরত ইবরাহীমের ঘটনার প্রতি ইংগিত দিতে গিয়ে সম্পদ ব্যয় করে আতিথেয়তা, তাকে একটি জ্ঞানী পূত্র দানের সুসংবাদ প্রদান এবং তাকে ও তার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে সন্তান দানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে। আর বাদবাকী ঘটনাগুলােতে আল্লাহর সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের বিবরণ দেয়া হয়েছে। যা তিনি সূরার শুরুতে কসম খেয়ে দিয়েছেন। যথা ‘তােমাদেরকে যা যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তা অবশ্যই সত্য।’ আর সূরার শেষে মােশরেকদেরকে যে হুমকি দেয়া হয়েছে, তাও সত্যে পরিণত করার বিবরণ দেয়া হয়েছে। সেই হুমকি হলাে, যালেমদের জন্যে তাদের সমমনাদের মতােই শাস্তি প্রাপ্য রয়েছে…’ আর এর কিছু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাফেরদের বংশধরেরা যেন আবহমান কাল ধরে পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করে আসছে ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করা জন্যে। বলা হয়েছে, অনুরূপভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোনাে রসূল এসেছে, অমনি তাকে জাদু-করে অথবা পাগল বলে অভিহিত করেছে। তবে কি তারা পরস্পরকে এ কথা বলার জন্যেই উদ্বুদ্ধ করে আসছে? আসলে তারা একটা গােমরাহ জাতি।। এ আলােচনা থেকে বুঝা গেলাে যে, এ সূরার কিসসা কাহিনী তার মূল আলােচ্য বিষয়ের সাথেই সংযুক্ত। সেই মূল বিষয়টি হলাে, আল্লাহর এবাদাতের জন্যে মনকে একাগ্র ও একনিষ্ঠ করা, তাকে সকল বাধাবন্ধন থেকে মুক্ত করা, ঈমান ও দৃঢ় প্রত্যয়ের অটুট বন্ধন দ্বারা তাকে আল্লাহর সাথে যুক্ত করা এবং সর্বশেষে সকল বাধাবিপত্তি ও ব্যস্ততাকে অতিক্রম করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পাঠিয়ে দেয়া। এবার সূরাটির তাফসীরে মনােনিবেশ করছি।
# প্রথমে সূরার প্রথম ছয়টি আয়াতের আলােচনায় আসা যাক। এই দ্রুতগামী ক্ষুদ্র ও সংক্ষিপ্ত কথাগুলাে, তার ভেতরকার কিছু অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য শব্দাবলীসহ মানুষের চেতনা ও অনুভূতিতে একটা বিশেষ প্রভাব বিস্তার ও একটা বিশেষ শিক্ষা ও ধারণা বদ্ধমূল করে দেয়। এগুলাে দ্বারা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনােযােগ আকর্ষণ করা হয় ও সতর্ক করা হয়। প্রথম যুগে অনেকে এ আয়াতগুলাের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করতেন বলে জানা যায়। তাফসীরে ইবনে কাসীরে বর্ণিত আছে যে, ইবনুল কাওয়া নামক এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে হযরত আলী বলেন, প্রথম আয়াত দ্বারা বায়ু, দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা মেঘ, তৃতীয় আয়াত দ্বারা নৌযান এবং চতুর্থ আয়াত দ্বারা ফেরেশতা বুঝানাে হয়েছে। অনুরূপভাবে ছাবীগ বিন আসাল তামীমীর প্রশ্নের জবাবে হযরত ওমরও অনুরূপ ব্যাখ্যা দেন। তামীমী বিদ্রুপাত্মকভাবে প্রশ্ন করেছে বুঝতে পেরে পরে তিনি তাকে শাস্তি দেন এবং সে তাওবা করে ও এর পুনরাবৃত্তি না করার জন্যে শপথ করে। ইবনে আব্বাস, ইবনে ওমর, মােজাহেদ, সাঈদ ইবনে যােবায়র, হাসান, কাতাদা, সুন্দী প্রমুখও অনুরূপ তাফসীর করেছেন। (ইবনে কাসীর) *চারটি বিস্ময়কর জিনিসের কসম : আল্লাহ তায়ালা বাতাসের কসম খেয়েছেন, যা ধুলাবালি, মেঘ, পানি ইত্যাদি বহন করে থাকে এবং মানুষের জানা-অজানা আরো অনেক কিছু বহন করে। অতপর পানিবাহী মেঘমালার নামেও কসম খেয়েছেন, যাকে তিনি যেদিক খুশী সেদিকে চালিত করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা পানিতে সাবলীলভাবে চলাচলকারী নৌযানগুলােরও কসম খেয়েছেন, যা তাঁরই দেয়া ক্ষমতাবলে চলাচল করে এবং পানি, নৌযান ও বিশ্ব-প্রকৃতিকে তিনি এমন সব বৈশিষ্ট দিয়েই সৃষ্টি করেছেন যা নৌযানের উক্ত সাবলীল চলাচলকে সম্ভব করে তােলে। অতপর সেইসব ফেরেশতার কসম যারা মহাবিশ্বের ব্যবস্থাপনার অর্পিত দায়িত্বকে বন্টন করে। অর্থাৎ, আল্লাহর নির্দেশকে| বহন করে এনে আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে বন্টন করে এবং বিভিন্ন রকমের কাজকে পৃথক করে মহাবিশ্বের প্রশাসনকে তদানুসারে বিভক্ত করে। বাতাস, মেঘ, নৌযান ও ফেরেশতারা আল্লাহর সৃষ্টিরই অন্তর্ভুক্ত। তিনি নিজের ক্ষমতা প্রয়ােগের জন্যে এগুলােকে হাতিয়ার হিসাবে ও নিজের ইচ্ছাকে আড়াল করার পর্দা হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। আর এগুলাের মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টিজগতে ও তার বান্দাদের মধ্যে তার ফয়সালা কার্যকর হয়ে থাকে। আবার এগুলাের নামে আল্লাহ তায়ালা কসমও খান শুধু এগুলাের গুরুত্ব প্রকাশের জন্যে, এগুলাের আড়ালে যে মহাসত্য লুকিয়ে আছে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করার জন্যে এবং আল্লাহর সদা সক্রিয় সেই হাতকে দেখবার সুযােগ দেয়ার জন্যে, যা এগুলােকে সৃষ্টি করে, পরিচালনা করে এবং আল্লাহর ফয়সালা বাস্তবায়িত করে, আর বাতাস, পানি ইত্যাদির এরূপ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ এগুলাের গােপন রহস্যের প্রতি মনকে আকৃষ্ট করে এবং এগুলাের স্রষ্টার সাথে তার সংযােগ সৃষ্টি করে। তা ছাড়া অন্যান্য দিক দিয়েও জীবিকা সংক্রান্ত আলােচনার সাথে এ জিনিস কয়টির সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয়। এ সূরার জীবিকা সংক্রান্ত আয়াতগুলাে জীবিকার চাপ ও গােলামী থেকে মনকে মুক্ত করে। বাতাস, মেঘ ও নৌযান কিভাবে জীবিকা ও তার উপকরণাদির সাথে যুক্ত তা তাে সুস্পষ্ট। কিন্তু ফেরেশতারা এবং তাদের দায়িত্ব বন্টনের কাজটি কিভাবে জীবিকার সাথে যুক্ত এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায় যে, জীবিকা ও ফেরেশতাদের বন্টিত দায়িত্বসমূহের অন্যতম। এভাবেই সূরার শুরু ও সূরার বিভিন্ন জায়গায় আলােচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মাঝে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তা স্পষ্ট বুঝা যায়।
# *কসম করে আল্লাহ যা বলতে চেয়েছেন : আল্লাহ তায়ালা উল্লেখিত চার রকম সৃষ্টির নামে কসম খেয়ে বলছেন, “নিশ্চয় তােমাদেরকে যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে তা সংঘটিত হবেই এবং কর্মফল প্রদানের কাজটি অবশ্যই সম্পন্ন হবে।’ আল্লাহ তায়ালা মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে অবশ্যই ভালাে কাজের ভালাে পুরস্কার এবং মন্দ কাজের মন্দ ফল দেবেন। পৃথিবীতে তিনি কর্মফল দান বিলম্বিত করলেও আখেরাতে বিলম্বিত করবেন না। সেখানে হিসাব-নিকাশ ও জবাবদিহী অবধারিত। কর্মফল প্রদানের কাজটি অবশ্যই সম্পন্ন হবে। অথাৎ প্রতিশ্রুতি দুনিয়ায় হােক বা আখেরাতে হোক পূরণ হবেই। আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে জীবিকা অন্যতম। পৃথিবীতে অনটনের মধ্য দিয়েই হােক বা প্রাচুর্যের মধ্য দিয়েই হােক যেভাবেই চান আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের জীবিকা নির্বাহ করবেনই। তাঁর প্রতিশ্রুতি অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় এ ক্ষেত্রেও বাস্তবায়িত হবে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা তিনি যেভাবে ও যে সময়ে ওয়াদা করেছেন, ঠিক সেই ভাবেই সেই ওয়াদা পূরণ করে থাকেন। এ ব্যাপারে তার কসমের প্রয়ােজন হয় না। তথাপি আল্লাহ তায়ালা তার সেসব সৃষ্টির নামে কসম খান শুধু ওগুলাের দিকে মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করার জন্যে, এগুলাের পেছনে আল্লাহর যে অসীম ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা নিহিত রয়েছে তা অনুধাবন করানাের জন্যে এবং এ কথা উপলব্ধি করানাের জন্যে যে, যে আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্বনিখিলের স্রষ্টা ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনাকারী, তার প্রতিশ্রুতি পূরণ হবেই, ভালাে ও মন্দ কাজের জন্যে তার কাছ থেকে মানুষকে প্রতিদান নিতে হবেই। আর সৃষ্টিজগতের স্বভাব-প্রকৃতি থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সৃষ্টিজগতের উৎপত্তি কোনাে আকস্মিক দুর্ঘটনা বা কাকতালীয় ঘটনা নয়। এভাবে এই কসম খাওয়ার কারণেই উক্ত সৃষ্টিগুলাে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রমাণ বহনকারী নিদর্শনে পরিণত হয়ে যায়। কেননা, কসম খাওয়ার কারণে মানুষের মন ওগুলাের দিকে আকৃষ্ট হয় ও চিন্তা-ভাবনা করতে অনুপ্রাণিত হয়। কাজেই এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এই কসম খাওয়া আসলে প্রকৃতির ভাষায় প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষা দান, প্রেরণা দান ও সহজাত বিবেককে সম্বােধন করার এক অনুপম পদ্ধতি।
#.জিলালিল কুরআন:-
*দ্বিতীয় পর্যায়ের কসমের ব্যাখ্যা : এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ের কসম নিয়ে আলােচনা করা যাক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সুগঠিত আকাশের কসম, তােমরা পরস্পরবিরােধী কথাবার্তায় লিপ্ত।’ এখানে আল্লাহ তায়ালা সুগঠিত ও সুসমন্বিত আকাশের কসম খেয়ে বলছেন যে, বাতিলপন্থীরা এমন পরস্পরবিরােধী কথাবার্তায় লিপ্ত থাকে, যার কোনাে স্থিতি ও স্থিরতা নেই, যার যতক্ষণ ইচ্ছা তার ওপর বহাল থাকে আর যার যখন ইচ্ছা তা থেকে সরে যায়। বাতিলপন্থীদের কথাবার্তা এ রকমই সব সময় টলমলে। অনুরূপভাবে বাতিলও এক টলমলে জিনিস। এর কোনাে স্থিতি নেই। যারা বাতিলকে গ্রহণ করে তাদের মধ্যে সব সময় বিরােধ ও অস্থিরতা লেগেই থাকে। তাদের এই অস্থিরতা, বিরােধ ও সন্দেহ তখনই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে, যখন চিরস্থির সুগঠিত ও সুসমন্বিত আকাশের সাথে তার তুলনা করা হয়। এরপর আরাে একধাপ অগ্রসর হয়ে বলা হয়েছে যে, তারা আখেরাত সম্পর্কে সন্দেহে লিপ্ত এবং সে সম্পর্কে কোনাে সত্যের সনদ তাদের জানা নেই। তাই এই প্রকাশ্য সত্য নিয়েও তারা পরস্পরবিরােধী কথায় লিপ্ত। অতপর তাদের কাছে কেয়ামতের সেই দিনটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে, ‘অনুমানকারীরা ধ্বংস হােক!… তারা জিজ্ঞাসা করে কর্মফল দিবস কবে আসবে?’ অনুমান বলতে সেই ধারণাকে বুঝায়, যা কোনাে সঠিক মানদন্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। মহান আল্লাহ স্বয়ং তাদের ধ্বংস কামনা করেছেন। কী সাংঘাতিক ব্যাপার। তিনি যদি কারাে ধ্বংস বা মৃত্যু কামনা করেন, তাহলে সেটা তাে তার পক্ষ থেকে ধ্বংসের ফয়সালারই নামান্তর। অনুমানকারীদের একটি বিশ্লেষণ বর্ণনা করা হয়েছে এই যে, তারা গােমরাহীতে সংজ্ঞাহীনভাবে ডুবে আছে। বাতিলপন্থীদের প্রকৃত চিত্র ঐঁকে দেয়া হয়েছে এখানে এই বলে যে, তারা সব কিছু ভুলে বসে আছে, আশেপাশের অবস্থা অনুভবই করে না, যেন মাতাল। তারা স্পষ্ট জিনিসকেও স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। যা সচেতন মানুষ মাত্রেই দেখে। ‘তাই তারা জিজ্ঞাসা করে যে, কর্মফল দিবস কবে হবে’ আসলে তাদের এ জিজ্ঞাসা জ্ঞানার্জনের জন্যে নয়, বরং ঠাট্টা ও বিদ্রুপের জন্যে। এ জন্যে যেদিনকে তারা অসম্ভব মনে করতাে সেদিন তাদের অবস্থা অর্থাৎ তাদের দগ্ধীভূত হওয়ার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘যেদিন তাদেরকে আগুনের ওপর জ্বালিয়ে যাচাই করা হবে।’ আর সেই সাথে তাদেরকে ঘােরতর কষ্টদায়ক কথা দিয়েও সেই কঠিন যন্ত্রণাময় দিনে যন্ত্রণার মাত্রা আরাে বাড়িয়ে দেয়া হবে। বলা হবে, এখন তােমাদের যাচাই বাছাই এর স্বাদ গ্রহণ করাে। ‘এই হচ্ছে সেই দিন, যার জন্যে তােমরা তাড়াহুড়া করতে।’ বস্তুত কর্মফল দিবস কবে হবে এ প্রশ্নের এটাই মােক্ষম জবাব যে, এই হচ্ছে সেই দিন, যার জন্য তারা তাড়াহুড়া করতে। আর এমন ভয়াবহ দৃশ্যকে তুলে ধরে অনুমানকারীদের যথার্থ জবাব দেয়া হয়েছে। আর এটা তাদের প্রতি আল্লাহর সেই মৃত্যু কামনার সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রয়ােগ। বলা হয়েছে, ‘যেদিন তাদেরকে আগুনের ওপর জ্বালিয়ে যাচাই করা হবে।’
*ঈমানদারদের কিছু বৈশিষ্ট্য : অপরদিকে রয়েছে অপর পক্ষের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। এ পক্ষটি দৃঢ় ঈমান পােষণ করে, আন্দাজ অনুমানে লিপ্ত হয় না। এ পক্ষটি অত্যন্ত আল্লাহভীরু, সতর্ক ও সংযত। এরা কোনাে একগুয়ে ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে না। রাত জেগে-এরা এবাদাত করে ও গুনাহ মাফ চায়। জীবনকে অলসতা ও উদাসীনতায় কাটিয়ে দেয় না। এই পক্ষ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় আল্লাহভীরু লােকেরা বাগান ও ঝর্ণায় অবস্থান করবে… তাদের সম্পদে প্রত্যাশী ও বঞ্চিতের প্রাপ্য রয়েছে।’ এ দলটি আল্লাহভীরু, সদা সচেতন এবং তাদের ওপর আল্লাহর প্রহরা ও তদারকী সম্পর্কে তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন। আর এ জন্যে তারা নিজেরাও নিজেদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখে ও সংযত থাকে। তারা তাদের প্রতিপালক যা দেন তা গ্রহণ করে বাগানে ও ঝর্ণায় অবস্থান করবে। অর্থাৎ তারা পৃথিবীতে থাকাকালে আল্লাহর এমন এবাদাত করতাে যেন তারা আল্লাহকে চাক্ষুষ দেখতে পেতো আর দৃঢ় বিশ্বাস রাখতাে যে, আল্লাহ তাদেরকে দেখতে পান। এরূপ দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীতে এবাদাত ও সৎ কাজ করে আসার ফল হিসাবে আল্লাহ তায়ালা যে অনুগ্রহ ও পুরস্কার দেবেন, তা নিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে বাগান ও ঝর্ণার কাছে অবস্থান করবে। তারা তার আগে সৎকর্মশীল ছিলাে। এখানে তাদের একটা প্রচন্ড আনুগত্যপূর্ণ, সংবেদনশীল ও স্বচ্ছ ছবি ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। ‘তারা রাত্রে খুব কমই ঘুমাতাে এবং শেষ রাত্রে গুনাহ মাফ চাইতাে।’ অর্থাৎ মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন, তখন তারা জেগে জেগে তাদের প্রতিপালকের কাছে ধরণা দিতাে, ক্ষমা ও দয়া ভিক্ষা চাইতাে। রাত্রে সামান্যই ঘুমাতো, গভীর রাতে তাদের প্রতিপালকের ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করতাে। বিছানা ত্যাগ করতাে এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা অর্জনের বাসনা তাদেরকে এতাে হাল্কা করে দিতাে যে, ঘুমের ভারে তাদের দেহ ভারী হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়তাে না। এ আয়াতের তাফসীর প্রসংগে হাসান বসরী বলেন, অর্থাৎ তারা সারারাত জাগবার চেষ্টা করতাে এবং রাতের একটা ক্ষুদ্র অংশই ঘুমিয়ে কাটাতাে। এভাবে রাতের শুরু থেকে এবাদাত করতে করতে শেষরাত হতাে এবং শেষ রাতে গুনাহ মাফ চাইতাে। আহনাফ বিন কায়েস বলতেন এর অর্থ রাতের বেশীরভাগ জেগে কাটানাে, তবে আমি এই দলভুক্ত হতে পারিনি। হাসান বসরী জানান যে, আহনাফ বিন কায়েস বলতেন, ‘আমি (স্বপ্নে) জান্নাতবাসীর আমলের সাথে নিজের আমলের তুলনা করলাম। দেখলাম তারা আমাদের চাইতে অনেক দূরে ও নাগালের বাইরে। আমাদের আমল তাদের ধারে-কাছেও ছিলাে না। কারণ তারা রাতে অতি অল্প ঘুমাতাে। তারপর দোযখবাসীর আমলের সাথে নিজের আমলের তুলনা করলাম। দেখলাম, তারা আল্লাহর কিতাব, রসূল ও আখেরাতে বিশ্বাস করে না। ফলে তাদের কোনাে নেক আমলই নেই। তবে যারা কিছু ভালাে কাজও করেছে এবং কিছু খারাপ কাজও করেছে, তাদেরকে আমাদের মধ্যে মােটামুটি ভালাে অবস্থায় দেখলাম।’ আবদুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম বলেন, বনু তামীমের এক ব্যক্তি আমার পিতাকে বললো, হে উসামার পিতা, আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের একটি সদগুণের উল্লেখ করেছেন। তাহলাে রাত্রে কম ঘুমানাে। অথচ এই সদগুণটি আমরা নিজেদের মধ্যে দেখতে পাই না। রাত্রে আমরা খুব কমই জাগি।’ আমার পিতা তাকে বললেন, তন্দ্রা এসে গেলে যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে পড়ে এবং জেগে উঠলে যে ব্যক্তি তাকওয়ার অনুশীলন করে তার জন্যে সুসংবাদ।’ বস্তুত সাহাবীদের অনুসারী দৃঢ় ঈমানের অধিকারী একদল মর্যাদাবান ব্যক্তি এই পর্যায়ে উন্নীত হবার চেষ্টা ও সাধনা করে থাকেন। কেননা, তারা এর নীচে অবস্থান করেন। আল্লাহ তায়ালা নিজের মনােনীত কিছু লোক এই শুধু এই পর্যায়ে উন্নীত হবার সুযােগ দিয়ে থাকেন। তাদেরকে তিনি মুহসিনীন নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। এ তাে হলাে আল্লাহর সাথে তাদের আচরণ। মানুষের সাথে ও ধন-সম্পদের সাথে তাদের আচরণও মােহসেনদের অনুরূপ, তাদের ধন-সম্পদে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের প্রাপ্য রয়েছে।’ অর্থাৎ যে চায় তাকেও তারা অংশ দেয়, আর যে চায় না, বরং নীরব থাকে এবং সে জন্যে বঞ্চিত থাকে, তাকেও তারা তাদের সম্পদের অংশ দেয়। এ অংশটা তারা স্বেচ্ছায় দিয়ে থাকে। অথচ নিজেদের জন্যে অপরিহার্য মনে করে। এই বক্তব্যটুকুর মধ্যে যে ইংগিত রয়েছে তা গােটা সূরার সম্পদ ও জীবিকা সংক্রান্ত আলােচনার সাথে সঙ্গতি-পূর্ণ। সূরার এতদসংক্রান্ত আলােচনায় মানুষের মনকে স্বার্থপরতা, কৃপণতা এবং জীবিকা উপার্জনে মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততার বাধা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
**বিশ্বাসীদের জন্যে নিদর্শন : অতপর মুত্তাকী বা আল্লাহভীরু ও মুহসিন তথা সদাচারীর লক্ষণ সমূহের বর্ণনা সম্পন্ন করার পর সূরার পরবর্তী অংশ পেশ করা হয়েছে, ‘আর বিশ্বাসীদের জন্যে পৃথিবীতে আল্লাহর নিদর্শনাবলী রয়েছে। তােমাদের নিজেদের ভিতরে রয়েছে।…’ পৃথিবীতে ও মানব সত্তায় বিরাজমান আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি এটি একটি মনােযােগ আকর্ষণকারী আহবান। নির্ধারিত জীবিকা ও ভাগ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হওয়ার জন্যেও এখানে আহবান জানানাে হয়েছে। অতপর নিজের নামে কসম খেয়ে বলেছেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত এই উক্তি সম্পূর্ণ সত্য ও নিশ্চিত। ‘বিশ্বাসীদের জন্যে পৃথিবীতে নিদর্শনাবলী রয়েছে এবং তােমাদের ভেতরেও রয়েছে, তােমরা কি দেখতে পাওনা?’ যে গ্রহটির ওপর আমরা বাস করি তা আল্লাহর নিদর্শনাবলী ও তাঁর বিস্ময়কর কারিগরীর কীর্তিতে পরিপূর্ণ এক মেলা। এ মেলায় যেসব বিস্ময়কর কীর্তি রয়েছে, এ যাবত আমরা তার সামান্য কিছুই জানতে পেরেছি। প্রতিদিন আমরা তার কিছু কিছু নতুন তথ্য জানতে পারি। এ ধরনের বিচিত্র সৃষ্টির আরাে একটা মেলা আমাদের অভ্যন্তরে লুকানাে রয়েছে। সেটি হচ্ছে মানবসত্তা। এ সত্তা অত্যন্ত রহস্যপূর্ণ। শুধুমাত্র পৃথিবী নামক গ্রহ নয় বরং গােটা সৃষ্টিজগতের যাবতীয় রহস্য মানবসত্তায় নিহিত রয়েছে। এই দুটি মেলার দিকেই উক্ত দুটি আয়াতে সংক্ষেপে ইংগিত করা হয়েছে। এ ইংগিত দিয়ে শুধুমাত্র সেইসব লােকের জন্যে মেলার দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে, যারা এ মেলা পরিদর্শন করতে চায়, দৃঢ় প্রত্যয় লাভ করতে চায় এবং নিজের জীবনের ডালিকে আনন্দ, শিক্ষা ও নির্ভুল জ্ঞান দ্বারা ভরে তুলতে চায়। বস্তুত এই আনন্দ, শিক্ষা ও নির্ভুল জ্ঞান হৃদয়কে উন্নত করে এবং আয়ুষ্কালকে বাড়িয়ে দেয়। পবিত্র কোরআনের প্রতিটি বক্তব্য সকল অবস্থায় সকল পরিবেশে ও সকল ক্ষেত্রে প্রযােজ্য ও কার্যোপযােগী। প্রতিটি মানুষের মন, বিবেক ও বােধশক্তিকে তা তার সাধ্য ও সামর্থ অনুপাতে সুনির্দিষ্ট কার্যোপকরণ ও জ্ঞান ভান্ডার দিতে সক্ষম। মানুষ যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি সাধন করবে, যতই তার উপলব্ধির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে। যতই তার তথ্য ও অভিজ্ঞতার ডান্ডার সমৃদ্ধ হবে এবং যতই সে বিশ্ব-প্রকৃতি ও আপন সত্তার ভেতরকার গােপন রহস্য জানতে পারবে, কোরআন থেকে তার অর্জিত জ্ঞান ততােই বৃদ্ধি পাবে। রাসূল(স.) এ সম্পর্কে নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও নিজের জানা গােপন তত্ত্ব ও তথ্যাবলীর আলােকেই কোরআন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, এটি এমন এক মহাগ্রন্থ, যার বিষয় ও বৈচিত্র কখনাে শেষ হয় না এবং বারবার এর কাছে প্রত্যাবর্তন করা সত্ত্বেও এটা কখনো পুরানাে হয় না। *কোরআন:অফুরন্ত নলেজ ব্যাংক : যারা এই কোরআনকে সর্বপ্রথম শুনেছে, তারা পৃথিবীতে ও মানবসত্তায় বিরাজিত আল্লাহর নিদর্শনাবলী থেকে নিজ নিজ অংশ লাভ করেছে আপন আপন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অন্তরের ঔজ্জ্বল্য অনুপাতে। অনুরূপভাবে প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্ম রকমারি জ্ঞান-বিজ্ঞান, তত্ত্ব-তথ্য ও অভিজ্ঞতার যথােচিত অংশ লাভ করেছে। আমরাও আমাদের জ্ঞান, তত্ত্ব-তথ্য ও অভিজ্ঞতার যা কিছু আমাদের প্রাপ্য এবং এই মহাবিশ্বের যা কিছু গােপন রহস্য আমাদের সামনে উদঘাটিত হয়, তা লাভ করতে পারবাে। আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও মহাবিশ্বে ও আপন সত্তায় বিরাজমান অনুদঘাটিত নিদর্শনাবলী নিজেদের জন্যে সংরক্ষিত দেখতে পাবে। এভাবে আল্লাহর এই দুটো মেলা সৃষ্টির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। পৃথিবী নামক এই গ্রহটি তার সকল জন্মগত বৈশিষ্ট সহকারে জীবনকে লালন ও সংরক্ষণের জন্যে প্রস্তুত এবং সে জন্যে প্রয়ােজনীয় সকল উপকরণাদিতে সমৃদ্ধ। জীবনের এই লালন ও সংরক্ষণ সে এমন সুন্দরভাবে করে যে, স্থবির গ্রহ সমূহ ও চলন্ত নক্ষত্রসমূহ সম্বলিত এই মহাবিশ্বের যতটুকু আমাদের পরিচিত তার কোথাও এ কাজ হয় না। এ যাবত যতগুলাে গ্রহ-নক্ষত্রের পরিচয় আমাদের হস্তগত হয়েছে, শুধু সেগুলোর সংখ্যা হলাে শত শত কোটি ছায়াপথ, যার প্রতিটি ছায়াপথে রয়েছে শত শত কোটি নক্ষত্র। আর গ্রহগুলাে নক্ষত্রসমূহের অধীন। {অবশ্য অতি সাম্প্রতিক কালে মংগলসহ সৌর জগতের কোনাে কোনাে গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ত্বের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা দারুণ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কে জানে আগামী দিনে এ ব্যাপারে আরাে কতাে নতুন তথ্য আবিস্কৃত হবে- যার ভিত্তিতে সৌর জগতের আরাে অনেক স্থানেই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির সম্পর্কে মানুষরা অনেক কিছুই জানতে পারবে।-সম্পাদক} এই অগণিতসংখ্যক গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে একমাত্র পৃথিবীই জীবনকে ধারণ ও লালনের উপযােগী। পৃথিবীর বহুসংখ্যক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার একটিরও যদি অভাব থাকতাে বা একটিও যদি ক্রটিপূর্ণ হতাে, তাহলে পৃথিবীতে যে ধরনের জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে, তা টিকতে পারতাে না। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর আকৃতি যদি বর্তমানের চেয়ে আরাে বড় বা ছােট হতাে, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব যদি বর্তমানের চেয়ে আরো বেশী বা কম হতাে, সূর্যের আকৃতি যদি বর্তমানের চেয়ে ছােট বা বড় এবং তার তাপমাত্রা যদি বর্তমানের চেয়ে কম বা বেশী হতো, পৃথিবী যদি তার মধ্যভাগে বর্তমানের চেয়ে আরাে বেশী বা কম চাপা হতাে, তার আহ্নিক গতি বা বার্ষিক গতি যদি বর্তমানের চেয়ে বেশী বা কম দ্রুত হতাে, তার উপগ্রহ চাঁদ যদি বর্তমানের চেয়ে ছােট বা বড় আকারের হতো বা পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব যদি আরাে বেশী বা কম হতাে এবং এ ধরনের আরাে বহু জানা বা অজানা বৈশিষ্ট যা জীবন ধারণের ও লালনের যােগ্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর | ভূমিকা পালন করে থাকে-যদি না থাকতাে, তবে এ গ্রহটিতে জীবনের অস্তিত্ব থাকতাে না। এটা কি আল্লাহর এই মেলায় প্রদর্শিত একটি বা একাধিক নিদর্শন নয়? তাছাড়া যে সকল প্রাণী এই পৃথিবীতে বাস করে, পৃথিবীর পৃষ্ঠে অবস্থান করে, শূণ্যে সাঁতার কাটে, পানিতে চলাচল করে বা পৃথিবীর গর্ভে লুকিয়ে থাকে, সেসব অগনিত প্রাণীর জন্যে পৃথিবীতে অসংখ্য প্রকারের তৈরী যৌগিক বা মৌলিক খাদ্য সংরক্ষিত আছে। এই সকল খাদ্য পৃথিবীর পৃষ্ঠে জন্মাক, কিংবা সূর্য থেকে আসুক, পানিতে ভাসমান থাকুক বা অন্য কোনাে জানা বা অজানা জগত থেকে আসুক, মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুসারে পর্যাপ্ত পরিমাণে তার সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। কেননা, তিনিই এই পৃথিবীকে এ ধরনের জীবনের লীলাভূমি হিসাবে সৃষ্টি করেছেন এবং জীবন যাপনের যাবতীয় প্রয়ােজনীয় উপকরণসহ তাকে অগণিত রকমের প্রাণীর জন্যে প্রস্তুত করেছেন। আর এই পৃথিবীর যেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক এবং যেদিকেই পদচারণা করা যাক, তার বিচিত্র দৃশ্যসমূহের কোনাে শেষ নেই। পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল, সাগর-উপসাগর, ঝর্না-পুকুর, পরস্পরের সাথে সংযুক্ত ভূখন্ডসমূহ, আঙ্গুরের বাগান, শস্যক্ষেত এবং খেজুরের বাগান ইত্যাদি সর্বত্র বিরাজমান। আর এ সকল দৃশ্য মহান স্রষ্টার কুশলী হাতের পরশে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। একটি ক্ষেতে যখন ফসল সবে উদগত হয় তখন তার এক দৃশ্য। আর ফসল যখন কাটা হয়ে যায় তখন আর এক দৃশ্য। অথচ জায়গাটা একই আছে, এক ইঞ্চিও এদিক-ওদিক সরেনি। আর এই পৃথিবীতে যে সকল সজীব সৃষ্টি বিরাজমান, চাই তা উদ্ভিদ হােক বা প্রাণী হােক, পাখি হোক বা মাছ হােক, পােকা-মাকড় বা সরীসৃপ হােক (মানুষ বাদে-কেননা মানুষের কথা কোরআন আলাদাভাবে উল্লেখ করেছে) এ সকল সৃষ্টির সংখ্যা গণনার তাে প্রশ্নই ওঠে না। কেননা তা সম্ভব নয়, এমনকি এগুলাে কত প্রকার ও কী কী তাও আজ পর্যন্ত নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। এর প্রতিটি সৃষ্টি বিস্ময়কর। এগুলাে সব আল্লাহর সেই বিস্ময়কর মেলার এক একটি অতুলনীয় সৃষ্টি। আর মেলার বিস্ময়ের কোনাে শেষ নেই। পৃথিবীর সকল মানুষ যদি পৃথিবীর এইসব সৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে থাকে এবং পৃথিবীর সকল বিস্ময়কর সৃষ্টি ও তাতে নিহিত নিদর্শনাবলী লিপিবদ্ধ করে, তবে কোনােদিন তা লিপিবদ্ধ করে শেষ করতে পারবে না। কোরআন মানুষকে এগুলাে নিয়ে শুধু চিন্তা-গবেষণা করতে বলে এবং এগুলােতে কী কী বিস্ময় ও উপকারিতা রয়েছে তা নির্ণয়ের চেষ্টা করতে বলে। *সৃষ্টির নিদর্শন শুধু মুমিনরাই বুঝতে পারে : তবে এসব বিস্ময়কর সৃষ্টিকে বুঝা ও তা দ্বারা উপকৃত হওয়া কেবল ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান মানুষের পক্ষেই সম্ভব। এ কথাই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের জন্যে বহু নিদর্শন রয়েছে।’ বস্তুত বিশ্বাস ও প্রত্যয়ই হৃদয়কে সঞ্জীবিত করে এবং এভাবে সঞ্জীবিত হৃদয়ই পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবনের ক্ষমতা রাখে। এই বিশ্বাসই পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় জিনিস দেখে তার গােপন রহস্য সম্পর্কে হৃদয়কে অবহিত করে এবং তার অন্তরালে যে কুশলতা ও সৃজনী ক্ষমতা রয়েছে, তা তাকে জানায়। বিশ্বাস ছাড়া এ সকল দৃশ্য সম্পূর্ণ মৃত ও অসার। ফলে তা মনকেও কোনাে তথ্য জানায় না এবং তা কোন কিছুতে সাড়া দেয় না। আল্লাহর এই উন্মুক্ত সৃষ্টিমেলাকে অনেকে চোখ ও হৃদয় বন্ধ করে অতিক্রম করে। এতে তারা কোনাে জীবনের স্পন্দন দেখতে পায় না। এর কোনাে ভাষা বুঝতে পারে না। কেননা, বিশ্বাস তাদের হৃদয়কে সঞ্জীবিত করেনি এবং তাদের আশপাশে জীবনীশক্তির বিস্তার ঘটায়নি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিজ্ঞানীও হতে পারে। তবে তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক বিষয়ই শুধু জানে। তার নিগূঢ় রহস্য জানতে পারে না। কেননা, বিশ্ব-প্রকৃতির নিগূঢ় রহস্য অনুধাবনের জন্য বদ্ধ হৃদয়কে খােলা যায় এই ঈমানের চাবি দিয়েই এবং ঈমানের আলাে দিয়েই তা দেখা যায়।
*মানুষই এক নিদর্শন : এরপর আর একটি বিস্ময়ের উল্লেখ করা হচ্ছে, ‘আর তােমাদের সত্তার মধ্যেও নিদর্শনাবলী রয়েছে।…’ বস্তুত মানুষ নামক এই সৃষ্টিই এই পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্বর্যজনক সৃষ্টি। কিন্তু মানুষ যখন ঈমান থেকে বঞ্চিত থাকে তার এই মূল্য ও মর্যাদা সে অনুধাবন করে না এবং তার সত্তায় যেসব নিদর্শন লুকিয়ে আছে, সে সম্পর্কেও সে উদাসীন থাকে। তার দৈহিক ও মানসিক উভয় গঠনই বিস্ময়কর। যেহেতু সে এই মহাবিশ্বের উপকরণাদি ও গুপ্ত রহস্য সমূহের প্রতীক, তাই তার বাহ্যিক দিকও বিস্ময়কর, আভ্যন্তরীণ দিকও। কবি যথার্থই বলেছেন, তুমি মনে করাে যে, তুমি একটা ক্ষুদ্র বস্তু। অথচ তােমার অভ্যন্তরে গােটা বিশ্বজগত লুকিয়ে রয়েছে। মানুষ যেখানেই থাকুক, সে যদি নিজ দেহ ও মনের দিকে দৃষ্টি দেয় ও তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে, তবে সে হতবুদ্ধি করে দেয়ার মতাে তত্ত্ব ও তথ্য পাবে। তার অংগ-প্রত্যংগের গঠন, অংগ-প্রত্যংগের দায়িত্ব ও দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি, পরিপাক প্রণালী, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রণালী, হৃৎপিন্ড ও শিরায় শিরায় রক্ত সঞ্চালিত হওয়া, স্নায়ুতন্ত্রী, তার গঠন প্রক্রিয়া ও দেহ রক্ষায় তার ভূমিকা, লালাগ্রন্থী এবং দেহের বিকাশের সাথে তার সম্পর্ক, লালাগ্রন্থীর কাজ, এই সকল অংশের সময় ও সহযােগিতা এবং এগুলাের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির সবই অলৌকিক ও বিস্ময়কর। এ সব বিস্ময়কর জিনিসের প্রতিটির আওতায় আবার বহু বিস্ময় রয়েছে। প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ ও তার প্রতিটি অংশ এক একটি অলৌকিক জিনিস যা দেখে মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়। তা ছাড়া প্রাণ ও তার জানা-অজানা শক্তিসমূহের গােপন রহস্য, বােধগম্য জিনিসসমূহ অনুধাবন করা ও অনুধাবন করার পদ্ধতি এবং তার স্মরণ করা ও স্মরণ করার পদ্ধতি এই সকল সংরক্ষিত তথ্য ছবি কোথায় আছে, কিভাবে আছে? কিভাবে হৃদয়ে এ সকল ছবি ও দৃশ্যের ছাপ পড়ে, কোথায় পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সকল তাে জানা বিষয়। আর অজানা বিষয়গুলাের তাে কোনাে সীমা-পরিসীমাই নেই। সেগুলাের লক্ষণ মাঝে মাঝে দেখা যায় এবং অদৃশ্য তথ্যাদি জানা যায়। অতপর আসে এই জাতিটির প্রজননের রহস্য। একটি মাত্র জীবকোষ গােটা মানব জাতির বৈশিষ্টসমূহ বহন ও সংরক্ষণ করে থাকে। সেই সাথে এই কোষ পিতামাতা ও নিকটতম পিতামহ ও মাতামহের বৈশিষ্টগুলাে ধারণ করে। প্রশ্ন জাগে যে, এতােসব বৈশিষ্ট উক্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষটিতে কোথায় থাকে? কিভাবেই বা তা আপনা-আপনি তার সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ বেয়ে চলে এবং এতাে নিখুঁতভাবে এই বিস্ময়কর মানুষের পুনর্জন্ম ঘটায়?{সাইয়েদ কুতুব শহীদ যখন এই কথাগুলাে তার তাফসীরে লিখেছেন, তখন বিজ্ঞানের সবচাইতে বড়ো আবিষ্কার হিউম্যান ডি এন এ সংক্রান্ত জেনিটিং ম্যাপ-এর বিষ্ময়কর তথ্য সমীক্ষাগুলাে তার সামনে ছিলাে না। সদ্য আবিষ্কৃত এসব তথ্য আমাদের সামনে আল্লাহর তায়ালার কিতাবে বর্ণিত প্রতিটি কথাকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত করেছে যতােই দিন এগুচ্ছে ততােই যেন মানব সৃষ্টি তত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞান আমাদের চোখের সামনে আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের নিত্যনতুন দিগন্ত খুলে ধরছে। বিষয়টি এতাে ব্যাপক ও জটিল যে, এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা নিয়ে আলােচনায় প্রবৃত্ত হওয়া মহাসাগর পাড়ি দেয়ার সমান। উৎসাহী পাঠকদের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পড়াশুনার আবেদন জানাবো।-সম্পাদক} একটি সদ্যপ্রসূত শিশু যে মুহূর্তে মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ট হয়ে পৃথিবীতে নিজের জীবন শুরু করে, নিজের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে, তার হৃৎপিন্ড ও কিডনীকে জীবন যাপন শুরু করার অনুমতি দেয়া হয়, সেই মুহূর্তে সেই শিশুটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলে মানুষ মাত্রেই বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারবে না এবং তার মন-মগযে ঈমানী আবেগের সয়লাব বয়ে যাবে। তারপর যে মুহূর্তে নবাগত শিশু একটু একটু করে ভাংগা ভাংগা ভাষায় প্রথমে এক একটা অক্ষর, তারপর একটা শব্দের ভগ্নাংশ তারপর পুরাে শব্দ এবং তারপর বাক্য উচ্চারণ করতে শেখে, তখন এই কথা বলার ভংগিটা পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে, এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। আমরা এটা সব সময় হতে দেখি বলে এই বিস্ময়কর কাজটি আমাদের মনে তেমন কোনাে সাড়া জাগায় না। কিন্তু একটু থেমে যদি চিন্তা-ভাবনা করি, তাহলে শুধু বিস্ময়কর নয় বরং অলৌকিক ঘটনা বলেই মনে হবে, এমন অলৌকিক যে, তা শুধু আল্লাহর অসীম কুদরতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এভাবে মানব শিশুর যে কোনাে খুঁটিনাটি তৎপরতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে প্রতিটি তৎপরতাই এক একটা অলৌকিক ঘটনা মনে হবে, যার বিস্ময় কখনাে শেষ হতে চায় না। প্রতিটি মানুষকে মনে হবে এক একটা পৃথক জগত। তাকে এমন একটি আয়নার মতাে মনে হবে, যার ভেতর দিয়ে গােটা বিশ্ব-প্রকৃতি প্রতিফলিত হয় এবং এমন অসাধারণ রূপে প্রতিফলিত হয় যে যুগ যুগ কালেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে না। আর প্রতিটি মানুষ এমন এক অভাবনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যার আকৃতি, স্বভাব-প্রকৃতি, জ্ঞান-বুদ্ধি, আত্মা ও চেতনা এবং তার অনুভূতিতে ও কল্পনায় বিশ্বজগতের যে ছবি প্রস্ফুটিত তা এসবের কোনাে কিছুতেই তার কোনাে তুলনা নেই। মহান আল্লাহর এই আজব ও অদ্ভুত সৃষ্টির প্রতিটি সদস্য যেন এক একটি ঐশী জাদুঘর। প্রত্যেক ব্যক্তি এক একটা স্বতন্ত্র নমুনা ও এক একটি অতুলনীয় সত্তার অধিকারী। এহেন ঐশী জাদুঘরের সংখ্যা কয়েক শত কোটি। এদের মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বজগত একটা নজিরবিহীন জগতে পরিণত। সৃষ্টির আদি থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত একটি বুড়ো আংগুলেও অন্য কোনাে বুড়াে আংগুলের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানবীয় সত্তার অনেক বিস্ময়কর বৈশিষ্টই প্রকাশ্যভাবে দৃশ্যমান। এজন্যেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তােমাদের সত্তায়ও অনেক নিদর্শন রয়েছে। তােমরা কি দেখতে পাওনা?’ বস্তুত যা দৃশ্যমান তার আড়ালে অনেক অদৃশ্য সত্যও লুকিয়ে আছে বলে আভাস পাওয়া যায়। মানব-সত্তায় বিরাজিত এইসব বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য কোনাে পুস্তকে লিপিবদ্ধ নেই। তা থাকাও সম্ভব নয়। কেননা, যে বৈশিষ্টগুলাে আমাদের জানা ও আমাদের চোখে দৃশ্যমান, শুধুমাত্র সেগুলাে লিখে রাখলে বিপুল সংখ্যক ভলিউমের প্রয়ােজন হবে, আর অজানাগুলাে তাে জানাগুলাের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশী, কোরআনও এগুলাে সম্পূর্ণরূপে উল্লেখ করেনি। তবে তা মানুষের হৃদয়ে এমন চেতনার সৃষ্টি করে যে, তা চাক্ষুষ দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি উভয় রকমের দৃষ্টি দিয়েই সেই ঐশী জাদুঘর দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকে। শুধু মানব নামক এই জাদুঘর নয় বরং চিন্তা-গবেষণার মধ্য দিয়ে পৃথিবী নামক এই সম গ্রহটিতেই সে তার ভ্রমণ সম্পূর্ণ করতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। আর তার সত্তার অভ্যন্তরের এই বিস্ময়কর সৃষ্টিকে যার সম্পর্কে সে এ যাবত উদাসীন রয়েছে, তাকেও পরিদর্শন করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
*কোরআন চেতনা জাগিয়ে তােলে : বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে মানুষ যে মুহূর্তগুলাে অতিবাহিত করে, নিসন্দেহে তা অত্যন্ত তৃপ্তিকর ও উপভােগ্য মুহূর্ত। শ্রেষ্ঠতম স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টির এই জাদুঘরকে আল্লাহর একজন যথার্থ অনুগত ও সঠিক বান্দার চোখ দিয়ে দেখা যথার্থই আনন্দদায়ক, আর যে ব্যক্তি তার গােটা জীবনই কাটিয়ে দেয় মহান স্রষ্টার এই বিচিত্র মেলা ও জাদুঘরকে পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে, সে যে কত মহিমান্বিত ও সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কোরআন মানুষকে এরূপ অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা দিয়ে নতুন করে সৃষ্টি করতে চায়, তাকে নতুন চেতনা ও অনুভূতি দিতে চায়, তাকে নতুন জীবন দিতে চায় এবং এমন সহায়-সম্বল ও সাজ-সরঞ্জাম দিতে চায় পৃথিবীতে যার কোনাে তুলনা নেই। কোরআন ঈমানেরই মাধ্যমে মানুষকে এরূপ উচ্চাংগের চিন্তা-গবেষণায় অনুপ্রাণিত করতে চায়। কিনা, ঈমানই মানুষের জন্যে এই মূল্যবান পাথেয় ও এই উচ্চাংগের সম্পদ প্রস্তুত করে দেয় এবং তাকে নিম্নস্তর থেকে ওপরে টেনে তােলে। পৃথিবীতে মােমেনদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে আগের এ আয়াতে পৃথিবীর মেলা এবং তােমাদের সত্তার মধ্যেও নিদর্শন রয়েছে এ আয়াতে মানব-সত্তার মেলার দিকে মনোেযােগ আকর্ষণ করা হয়েছে। অতপর এর পরই আকাশের অদৃশ্য মেলার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যেখানে জীবিকা বন্টিত ও নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আর আকাশে রয়েছে তােমাদের জীবিকা ও প্রতিশ্রুত অন্যান্য জিনিস। এটা একটা চমকপ্রদ বক্তব্য। যদিও জীবিকার বাহ্যিক উপকরণগুলাে পৃথিবীতেই প্রতিষ্ঠিত, যেখানে মানুষ পরিশ্রম ও চেষ্টা-সাধনা করে এবং তাতে করে সে জীবিকা ও সৌভাগ্য লাভের আশায় ও অপেক্ষায় থাকে, তথাপি কোরআন মানুষের দৃষ্টিকে আকাশের দিকে, অদৃশ্য জগতের দিকে তথা আল্লাহর দিকে ফেরায়। তার কাছ থেকেই জীবিকা লাভের প্রত্যাশা করতে বলে। পৃথিবী ও পৃথিবীতে বিরাজমান জীবিকার বাহ্যিক উপকরণগুলাে বিশ্বাসীদের জন্যে নিদর্শনস্বরূপ। এই নিদর্শনসমূহ মানুষের মনকে আল্লাহর দিকে ফেরায়, যাতে সে তার অনুগ্রহস্বরূপ জীবিকা অন্বেষণ করতে পারে, যাতে পার্থিব লোভ-লালসা থেকে ও জীবিকার বাহ্যিক উপকরণাদির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে এবং এসব জিনিসকে তার মাঝে ও এসব জিনিসের স্রষ্টার নৈকট্য লাভের মাঝে আড়াল হয়ে দাঁড়াতে না দেয়। প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তির মন উক্ত বক্তব্যকে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারে। সে বােঝে যে, পৃথিবীকে ও পৃথিবীর উপকরণাদি অবজ্ঞা করা এর উদ্দেশ্য নয়। সে তাে এই পৃথিবীতেই খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে আদিষ্ট এবং এই পৃথিবীকেই পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ করা তার দায়িত্ব। উক্ত বক্তব্য অর্থাৎ আকাশে রয়েছে তােমাদের জীবিকা এই কথা বলার একমাত্র উদ্দেশ্য এই যে, মােমেন যেন তার মনকে পৃথিবীর ওপরই নির্ভরশীল করে না ফেলে এবং পৃথিবীর উন্নয়ন ও বিনির্মাণে আল্লাহ তায়ালা থেকে উদাসীন হয়ে না যায়। সে কাজ করবে পৃথিবীতে, কিন্তু তার মনােযােগ থাকবে আল্লাহর দিকে। সে পার্থিব উপকরণাদিকে কাজের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করবে, কিন্তু এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে যে, সেসব হাতিয়ার তার রিযিকদাতা নয়। তার রিযিক নির্ধারিত রয়েছে আকাশে। আল্লাহ তায়ালা তার জীবিকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর আল্লাহ যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি দেন তা পূরণ না হয়েই পারে না। এইভাবে বাহ্যিক উপকরণাদির হাতে বন্দী হওয়া থেকে মােমেনের মন নিষ্কৃতি পায়। বরঞ্চ এই সকল উপকরণ থেকেই সে আকাশের বিশাল রাজ্যে উড্ডয়নের পাখা সংগ্রহ করে নেয়। কেননা, সে এই সকল উপকরণে এমনসব নিদর্শন দেখতে পায়, যা তাকে ওগুলোর স্রষ্টার সন্ধান দেয় এবং তার মনকে সেই মহান স্রষ্টার সাথে যুক্ত করে, যদিও তার পা দুটিকে পৃথিবীর মাটিতেই প্রতিষ্ঠিত রাখে। মানুষের সম্পর্কে আল্লাহর ইচ্ছা এটাই। যে মানুষকে তিনি মাটি দিয়ে তৈরী করেছেন, তার ভেতরে নিজের আত্মা সঞ্চালিত করেছেন এবং তাকে বিশ্বজগতের বহু সৃষ্টির চেয়ে উত্তম সৃষ্টিতে পরিণত করেছেন। ঈমানই মানুষের মধ্যে এই শ্রেষ্ঠত্ব এনে দেয়। যে পরিবেশে সে উৎকৃষ্টতম সৃষ্টি হিসাবে অবস্থান করতে পারে ঈমানই সে পরিবেশ সৃষ্টি করে। কেননা, সে তখন সেই পরিবেশে অবস্থান করে, যা তার জন্যে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। এটাই সেই ফেতরাত বা স্বাভাবিক অবস্থা, যার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। বিকৃতি ও বিভ্রান্তির কবলে পড়ার আগে এই স্বাভাবিক অবস্থা নিশ্চিত করাই ঈমানের দাবী।
*আল্লাহর নিজ সত্ত্বার কসম : পৃথিবী, মানব-সত্তা ও আকাশ সংক্রান্ত উল্লেখিত তিনটি আয়াতের পর আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী আয়াতে নিজের কসম খেয়ে এই সকল উক্তির সত্যতা প্রত্যয়ন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অতএব, আকাশ ও পৃথিবীর অধিপতির কসম, তােমাদের নৈমিত্তিক কথাবার্তার মতােই এটা সত্য। তাদের নৈমিত্তিক কথাবার্তা যে একটা বাস্তবতা, সেটা তারা সর্বদাই প্রত্যক্ষ করে থাকে। তা নিয়ে তারা কোনাে তর্কবিতর্ক করে না। সন্দেহে লিপ্ত হয় না এবং আন্দাজ-অনুমান প্রয়ােগ করে না। তদ্রুপ এই সকল উক্তিও অকাট্য সত্য ও বাস্তব। আর আল্লাহ তাে সবার চাইতে সত্যবাদী। *একটি চমকপ্রদ ঘটনা : প্রসংগত যামাখশারী কর্তৃক তাফসীরে কাশশাফে বর্ণিত একটি ঘটনার উল্লেখ করছি, বিখ্যাত মােফাসসের বলেন, আমি বসরার জামে মসজিদ থেকে আসছিলাম। এই সময় জনৈক বেদুইনের সাথে আমার দেখা হলাে। সে বললাে, তুমি কোন গােত্রের লােক? আমি বললাম, বনু আসমা গােত্রের। সে বললাে, কোথা থেকে আসছাে? আমি বললাম, যেখানে দয়াময়ের বাণী পড়া হয় সেখান থেকে। সে বললাে, আমাকে একটু পড়ে শােনাও তাে। আমি সূরা যারিয়াতের প্রথম থেকে পড়তে লাগলাম। যখন এই আয়াত পড়লাম যে, ‘আকাশে তােমাদের জীবিকা ও তােমাদের জন্যে প্রতিশ্রুত অন্যান্য জিনিস রয়েছে, তখন সে বললাে, থামাে। অতপর তার বাহন উষ্ট্রীটাকে যবাই করে দুদিক থেকে চলমান পথিকদের মধ্যে বিতরণ করে দিল। অতপর নিজের ধনুক ও তরবারি ভেঙ্গে ফেলে চলে গেলে। পরবর্তীকালে আমি যখন খলীফা হারুনুর রশীদের সাথে হজ্জে গেলাম, তখন তাওয়াফ করার সময় কে যেন আমাকে ডাক দিল। তাকিয়ে দেখলাম, সেই বেদুইন। খুবই জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে। সে আমাকে সালাম করলো এবং পুনরায় সূরা যারিয়াত পড়তে বললাে। আমি পড়তে লাগলাম। যখন আমি পড়লাম, ‘আকাশে তােমাদের জন্যে রিযিক রয়েছে…’ তখন সে চিৎকার করে বলে উঠলাে, আল্লাহ তায়ালা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা আমরা পেয়েছি। তারপর বললাে, আরাে আছে নাকি? আমি এরপর পড়লাম, ‘অতএব আকাশ ও পৃথিবীর অধিপতির কসম। এটা অবশ্যই সত্য …’ তখন সে পুনরায় চিৎকার করে বললাে, সোবহানাল্লাহ। মহান আল্লাহকে কে এতাে রাগলো যে, তিনি কসম খেলেন। নিশ্চয় লােকেরা তাঁর কথায় বিশ্বাস করেনি বলেই তিনি কসমের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।’ কথাটা সে তিনবার বললাে এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলাে। প্রামাণ্যতার দিক দিয়ে এ বর্ণনা শুদ্ধ বা অশুদ্ধ যাই হােক, এটি একটি মূল্যবান বর্ণনা বটে। আল্লাহর নিজের নামে করা এই শপথ যে কত গুরুত্বপূর্ণ, সে কথাই এ আয়াত আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বস্তুত যে বিষয়ে শপথ করা হয়েছে, শপথ না করলেও তা সত্য। এই ছিলাে সূরার প্রথমাংশ।
# *ইবরাহীম(আ.)-এর একটি ঘটনা : দ্বিতীয়াংশে ইবরাহীম, লূত, মূসা(আ.) এবং আদ জাতি, সামূদ জাতি ও নৃহের জাতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এসেছে এবং তা সূরার পূর্বাপর বক্তব্যের সাথে সংগতিপূর্ণ। এ অংশটি ২৪ থেকে ৩৭ তম আয়াত পর্যন্ত বিস্তৃত। এ আয়াতগুলাে নবীদের ইতিহাস সংক্রান্ত, যেমন পূর্ববর্তী আয়াতগুলাে পৃথিবী ও মানব-সত্তা সংক্রান্ত। পূর্ববর্তী অংশে যে সকল প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে, এ অংশে তার বাস্তবায়নের উল্লেখ রয়েছে। প্রথমে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে ইবরাহীম (আ.)-এর ঘটনা দিয়ে কথাটি শুরু হয়েছে। যথা, ইবরাহীমের সম্মানিত অতিথির ঘটনা কি তােমার কাছে পৌছেছে। এ দ্বারা দ্বিতীয় পর্বের সমগ্র আলােচনার জন্যে মনকে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই সাথে ইবরাহীমের অতিথিদের বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে যে, তারা সম্মানিত। হয়তাে হযরত ইবরাহীম তাদের সম্মান করেছিলেন বলেই এ কথা বলা হয়েছে। এখানে হযরত ইবরাহীমের অতিথিভক্তি বা অতিথিপরায়ণতা, বদান্যতা ও নিজের সম্পদকে অকাতরে ব্যয় করার বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তার অতিথিরা তার বাড়িতে এসে সালাম করলেন ও তিনি এর জবাব দিলেন। তিনি তাদেরকে চিনতেন না। তথাপি পরিচয় গ্রহণের অপেক্ষা না করেই তিনি নিজের স্ত্রীর কাছে ছুটে গিয়ে অতিথিদের খাবারের আয়ােজনে লেগে গেলেন। অনতিবিলম্বে তিনি এতাে খাবার নিয়ে এলেন যে, দশজনেরও বেশী লােক তা খেয়ে তৃপ্ত হতে পারতাে। অথচ তারা ছিলেন মাত্র তিনজন। ‘ইবরাহীম দ্রুতবেগে ছুটে গেলেন নিজের স্ত্রীর কাছে এবং একটি মােটাসোটা বকরী নিয়ে এলেন।’ অতপর যখন দেখলেন, তারা খাচ্ছেন না এবং খাওয়ার কোনাে লক্ষণও নেই, তখন খাদ্যদ্রব্যকে তাদের একেবারে কাছে এনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা খাবেন না?’ অতপর তিনি তাদের প্রতি আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। এর একটি সম্ভাব্য কারণ এই যে, কোনাে নবাগত অতিথি যখন খাদ্য গ্রহণ করে না, তখন বুঝা যায় যে, তার উদ্দেশ্য ভালাে নয় বরং তার কোনাে অসদুদ্দেশ্য রয়েছে। এর কারণ এও হতে পারে যে, তাদের মধ্যে আশ্চর্যজনক বা অস্বাভাবিক কিছু প্রত্যক্ষ করে থাকতে পারেন। ঠিক তখনই তারা নিজেদের আসল পরিচয় তুলে ধরলেন অথবা তাদেরকে আশ্বস্ত করলেন ও সুসংবাদ দিলেন। ‘তারা বললাে, ভয় পেয়ে না। অতপর তারা তাকে একটি জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিল।’ এটা ছিলাে তার বন্ধ্যা স্ত্রীর পেট থেকে ইসহাক(আ.)-এর ভূমিষ্ঠ হবার সুসংবাদ। ‘তখন তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে এলেন এবং মুখ চাপড়ে বললেন, আমি বুড়ি বন্ধ্যা হয়ে গেছি।’ তিনি সুসংবাদ শুনতে পেয়েছিলেন এবং তাতে বিস্ময়জনিত চিৎকার ফুটে উঠেছিলাে তার মুখ দিয়ে। মহিলাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি হাত দিয়ে মুখ চাপড়ে বললেন, একে তাে তিনি বন্ধ্যাই ছিলেন, তদুপরি একেবারেই বৃদ্ধা। এমতাবস্থায় এই সুসংবাদ তাকে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি করে ফেলেছিলাে। একেবারেই অপ্রত্যাশিত এই সুসংবাদে তিনি এতােই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, ফেরেশতারা যে সুসংবাদ বহন করে এনে থাকেন তা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। এই সময় প্রেরিত ফেরেশতারা মূল সত্যটি উদ্ঘাটন করে জানালেন যে, আল্লাহর শক্তি সীমাহীন এবং তিনি প্রতিটি বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সহকারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ‘তারা বললেন, তােমার প্রতিপালক এরকমই বলেছেন, তিনি মহাজ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যখনই কোনাে জিনিসকে ‘হও’ বলেন, অমনি তা হয়ে যায়। তিনি তাে হও বলেছেন। এরপর আর কী বলার থাকতে পারে? প্রচলিত অভ্যাস ও রীতিপ্রথা মানুষের কল্পনাশক্তি ও বােধশক্তিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে এবং যা দেখতে অভ্যস্ত নয় তা দেখলে অবাক হয়ে যায় ও ভাবে, এটা কী করে সম্ভব। কখনাে কখনাে হঠকারী হয়ে পড়ে এবং বলে, এটা হতে পারে না। অথচ আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতা সীমাহীন এবং তা তার নিজস্বগতিতেই চলে। ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ মানুষ কী দেখতে অভ্যস্ত বা অনভ্যস্ত তার তােয়াক্কা সে করে না। যখন যা খুশী তাই করে।