أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৭)
[* অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারা যাবেনা:-
*যারা অজ্ঞতায় নিমজ্জিত এবং গাফলতিতে বিভোর হওয়া যাবে না:-
** পৃথিবীতে বহু নিদর্শন রয়েছে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও! তোমরা কি ভেবে দেখবে না?:-
*আকাশে রয়েছে তোমাদের রুযী ও প্রতিশ্রুত সবকিছু। :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫১-যা-রিয়াত। পারা:২৬
১-৩০ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১
وَالذّٰرِیٰتِ ذَرۡوًا ۙ﴿۱﴾
শপথ ঝড়ো হাওয়ার।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২
فَالۡحٰمِلٰتِ وِقۡرًا ۙ﴿۲﴾
শপথ বোঝা বহনকারী মেঘপুঞ্জের,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৩
فَالۡجٰرِیٰتِ یُسۡرًا ۙ﴿۳﴾
শপথ স্বচ্ছন্দ গতি নৌযানের,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৪
فَالۡمُقَسِّمٰتِ اَمۡرًا ۙ﴿۴﴾
শপথ কর্ম বণ্টনকারী ফিরিশতাদের,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৫
اِنَّمَا تُوۡعَدُوۡنَ لَصَادِقٌ ۙ﴿۵﴾
তোমাদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৬
وَّ اِنَّ الدِّیۡنَ لَوَاقِعٌ ؕ﴿۶﴾
কর্মফল দিবস অবশ্যম্ভাবী।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৭
وَ السَّمَآءِ ذَاتِ الۡحُبُکِ ۙ﴿۷﴾
শপথ বহু পথ বিশিষ্ট আকাশের,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৮
اِنَّکُمۡ لَفِیۡ قَوۡلٍ مُّخۡتَلِفٍ ۙ﴿۸﴾
তোমরা তো পরস্পর-বিরোধী কথায় লিপ্ত।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৯
یُّؤۡفَکُ عَنۡہُ مَنۡ اُفِکَ ﴿ؕ۹﴾
তার ব্যাপারে সে-ই বিরক্ত যে হকের প্রতি বিমুখ।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১০
قُتِلَ الۡخَرّٰصُوۡنَ ﴿ۙ۱۰﴾
ধ্বংস হয়েছে অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১১
الَّذِیۡنَ ہُمۡ فِیۡ غَمۡرَۃٍ سَاہُوۡنَ ﴿ۙ۱۱﴾
যারা অজ্ঞতায় নিমজ্জিত এবং গাফলতিতে বিভোর।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১২
یَسۡـَٔلُوۡنَ اَیَّانَ یَوۡمُ الدِّیۡنِ ﴿ؕ۱۲﴾
তারা জিজ্ঞেস করে, ‘কর্মফল দিবস কবে হবে?’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৩
یَوۡمَ ہُمۡ عَلَی النَّارِ یُفۡتَنُوۡنَ ﴿۱۳﴾
যেদিন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে অগ্নিতে,
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৪
ذُوۡقُوۡا فِتۡنَتَکُمۡ ؕ ہٰذَا الَّذِیۡ کُنۡتُمۡ بِہٖ تَسۡتَعۡجِلُوۡنَ ﴿۱۴﴾
বলা হবে ‘তোমারা তোমাদের শাস্তি আস্বাদন কর, তোমারা এ শাস্তিই ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে।’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৫
اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوۡنٍ ﴿ۙ۱۵﴾
তবে মুত্তাকীরা সেদিন বাগান ও ঝর্ণাধারার মধ্যে অবস্থান করবে।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৬
اٰخِذِیۡنَ مَاۤ اٰتٰہُمۡ رَبُّہُمۡ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَبۡلَ ذٰلِکَ مُحۡسِنِیۡنَ ﴿ؕ۱۶﴾
তাদের রব যা কিছু তাদের দান করবেন তা সানন্দে গ্রহণ করতে থাকবে। সেদিনটি আসার পূর্বে তারা ছিল সৎকর্মশীল।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৭
کَانُوۡا قَلِیۡلًا مِّنَ الَّیۡلِ مَا یَہۡجَعُوۡنَ ﴿۱۷﴾
রাতের বেলা তারা কমই ঘুমাতো।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৮
وَ بِالۡاَسۡحَارِ ہُمۡ یَسۡتَغۡفِرُوۡنَ ﴿۱۸﴾
তারপর তারাই আবার রাতের শেষ প্রহরগুলোতে ক্ষমা প্রার্থনা করতো।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-১৯
وَ فِیۡۤ اَمۡوَالِہِمۡ حَقٌّ لِّلسَّآئِلِ وَ الۡمَحۡرُوۡمِ ﴿۱۹﴾
তাদের সম্পদে অধিকার ছিল প্রার্থী ও বঞ্চিতদের।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২০
وَ فِی الۡاَرۡضِ اٰیٰتٌ لِّلۡمُوۡقِنِیۡنَ ﴿ۙ۲۰﴾
দৃঢ় প্রত্যয় পোষণকারীদের জন্য পৃথিবীতে বহু নিদর্শন রয়েছে।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২১
وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ ؕ اَفَلَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿۲۱﴾
এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও! তোমরা কি ভেবে দেখবে না?
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২২
وَ فِی السَّمَآءِ رِزۡقُکُمۡ وَ مَا تُوۡعَدُوۡنَ ﴿۲۲﴾
আকাশে রয়েছে তোমাদের রুযী ও প্রতিশ্রুত সবকিছু।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৩
فَوَ رَبِّ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ اِنَّہٗ لَحَقٌّ مِّثۡلَ مَاۤ اَنَّکُمۡ تَنۡطِقُوۡنَ ﴿٪۲۳﴾
তাই আসমান ও যমীনের মালিকের শপথ, একথা সত্য এবং তেমনই নিশ্চিত যেমন তোমরা কথা বলছো।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৪
ہَلۡ اَتٰىکَ حَدِیۡثُ ضَیۡفِ اِبۡرٰہِیۡمَ الۡمُکۡرَمِیۡنَ ﴿ۘ۲۴﴾
আপনার কাছে ইবরাহীমের সম্মানীত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে কি?
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৫
اِذۡ دَخَلُوۡا عَلَیۡہِ فَقَالُوۡا سَلٰمًا ؕ قَالَ سَلٰمٌ ۚ قَوۡمٌ مُّنۡکَرُوۡنَ ﴿ۚ۲۵﴾
যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সালাম।’ উত্তরে সে বলল, ‘সালাম। এরা তো অপরিচিত লোক।’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৬
فَرَاغَ اِلٰۤی اَہۡلِہٖ فَجَآءَ بِعِجۡلٍ سَمِیۡنٍ ﴿ۙ۲۶﴾
অতঃপর ইব্রাহীম সংগোপনে তার স্ত্রীর নিকট গেল এবং একটি (ভুনা) গোশতল বাছুর নিয়ে এল।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৭
فَقَرَّبَہٗۤ اِلَیۡہِمۡ قَالَ اَلَا تَاۡکُلُوۡنَ ﴿۫۲۷﴾
তা তাদের সামনে রাখল এবং বলল, ‘তোমরা খাচ্ছ না কেন?’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৮
فَاَوۡجَسَ مِنۡہُمۡ خِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡا لَا تَخَفۡ ؕ وَ بَشَّرُوۡہُ بِغُلٰمٍ عَلِیۡمٍ ﴿۲۸﴾
তখন তাদের সম্পর্কে তার মনে ভীতির সঞ্চার হল। তারা বলল, ‘ভয় পেয়ো না।’ অতঃপর তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্র-সন্তানের সুসংবাদ দিল।
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-২৯
فَاَقۡبَلَتِ امۡرَاَتُہٗ فِیۡ صَرَّۃٍ فَصَکَّتۡ وَجۡہَہَا وَ قَالَتۡ عَجُوۡزٌ عَقِیۡمٌ ﴿۲۹﴾
তখন তার স্ত্রী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সামনে এল এবং মুখমন্ডল চাপড়িয়ে বলল, ‘(আমি তো) বন্ধ্যা বৃদ্ধা, (আমার সন্তান হবে কি করে?)’
সূরা:৫১-যা-রিয়াত-৩০
قَالُوۡا کَذٰلِکِ ۙ قَالَ رَبُّکِ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡحَکِیۡمُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۳۰﴾
তারা বলল, ‘তোমার প্রতিপালক এরূপই বলেছেন। নিশ্চয় তিনিই প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।’
১-৩০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন :-
১-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত তুফায়েল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একবার তিনি মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে জনগণকে বলেনঃ “তোমরা আমাকে যে কোন আয়াত বা যে কোন হাদীস সম্বন্ধে ইচ্ছা প্রশ্ন করতে পার।” তখন ইবনুস সাকওয়া দাঁড়িয়ে বললোঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তা’আলার (আরবী) -এই উক্তির অর্থ কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “বাতাস।” “ (আরবী)-এর অর্থ কি?” সে জিজ্ঞেস করলো। “এর অর্থ মেঘ।” উত্তর দিলেন তিনি। “ (আরবী)-এর ভাবার্থ কি?” প্রশ্ন করলো সে। তিনি জবাবে বললেনঃ “এর ভাবার্থ হলো নৌযানসমূহ।” সে জিজ্ঞেস করলোঃ “ (আরবী)-এর অর্থ কি?” “এর অর্থ হলো ফেরেশতামণ্ডলী।” উত্তর দিলেন তিনি।
হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়া (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সাবীগ তামীমী হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট এসে বলেঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! (আরবী) সম্পর্কে আমাকে সংবাদ দিন!” উত্তরে তিনি বললেনঃ “ওটা হলো বাতাস। আমি যা বললাম তা যদি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আমি বলতে না। শুনতাম তবে তোমাকে এটা বলতাম না।” সে প্রশ্ন করলোঃ (আরবী)-এর অর্থ কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “ (আরবী) হলেন ফেরেশতামণ্ডলী। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এই অর্থ বলতে না শুনলে আমি তোমার কাছে এ অর্থ বলতাম না।” সে আবার প্রশ্ন করলোঃ “ (আরবী) কি?” তিনি উত্তর দিলেনঃ “ (আরবী) হলো নৌযানসমূহ। এ অর্থ যদি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে আমি না শুনতাম তবে তোমার কাছে আমি এ অর্থ বলতাম না।” অতঃপর তিনি তাকে একশ চাবুক মারার নির্দেশ দিলেন। সুতরাং তাকে একশ’ চাবুক মারা হলো এবং একটি ঘরে রাখা হলো। যখন তার দেহের ক্ষত ভাল হয়ে গেল তখন তাকে ডাকিয়ে নিয়ে পুনরায় একশটি বেত্রাঘাত করা হলো এবং তাকে সওয়ার করিয়ে দিয়ে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-এর নিকট হযরত উমার (রাঃ) পত্র লিখলেনঃ “এ ব্যক্তি যেন কোন মজলিসে না বসে।” কিছুদিন পর সে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-এর নিকট এসে কঠিনভাবে শপথ করে বললোঃ “এখন আমার মনের কু-ধারণা দূর হয়ে গেছে। আমার অন্তরে বদ-আকীদা আর নেই যা পূর্বে ছিল।” তখন হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে এ খবর অবহিত করলেন এবং সাথে সাথে একথাও লিখলেনঃ “আমারও ধারণা যে, সে এখন বাস্তবিকই সংশোধিত হয়ে গেছে।” উত্তরে হযরত উমার (রাঃ) হযরত আবূ মূসা (রাঃ)-কে লিখেনঃ “তাকে এখন মজলিসে বসার অনুমতি দেয়া হোক ।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি দুর্বল। সঠিক কথা এটাই জানা যাচ্ছে যে, হাদীসটি মাওকুফ অর্থাৎ হযরত উমর (রাঃ)-এর নিজের ফরমান। এটা মারফু হাদীস নয়)
আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার (রাঃ) সাবীগ তামীমীকে যে বেত্রাঘাত করিয়েছিলেন তার কারণ এই যে, তার বদ-আকীদা তার কাছে প্রকাশ পেয়েছিল এবং তার প্রশ্ন ছিল প্রত্যাখ্যান ও বিরুদ্ধাচরণ মূলক। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। তার এ ঘটনাটি প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে যা হাফিয ইবনে আসাকির (রঃ) পুরোপুরিভাবে বর্ণনা করেছেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ), হযরত হাসান (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত সুদ্দী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন হতে এই তাফসীরই বর্ণিত আছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এবং ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) তো এ আয়াতগুলোর তাফসীরে অন্য কোন উক্তি আনয়নই করেননি।
(আরবী) -এর ভাবার্থ যে মেঘ তা নিম্নের কবিতাংশের পরিভাষাতেও রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি নিজেকে তাঁরই বশীভূত করছি যার বশীভূত হয়েছে ঐ মেঘ যা পরিষ্কার সুমিষ্ট পানি উঠিয়ে নিয়ে থাকে।”
(আরবী) -এর অর্থ কেউ কেউ ঐ নক্ষত্ররাজি নিয়েছেন যেগুলো আকাশে চলাফেরা করে। এই অর্থ নিলে নীচ হতে উপরের দিকে উঠে যাওয়া হবে। প্রথমে বাতাস, তারপর মেঘ, তারপর নক্ষত্ররাজি এবং এরপর ফেরেশতামণ্ডলী, যারা কখনো কখনো আল্লাহ তা’আলার হুকুম নিয়ে অবতরণ করেন এবং কখনো পাহারার কাজ করার জন্যে তাশরীফ আনয়ন করেন। যেহেতু এসব কসম এই ব্যাপারে যে, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে এবং লোকদেরকে পুনর্জীবিত করা হবে সেই হেতু এগুলোর পরেই বলেনঃ “তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য এবং কর্মফল দিবস অবশ্যম্ভাবী।’ অতঃপর মহান আল্লাহ আকাশের কসম খেয়েছেন যা সুন্দর, উজ্জ্বল ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। পূর্বযুগীয় গুরুজনদের অনেকেই (আরবী) শব্দের এ অর্থই করেছেন। হযরত যহহাক (রঃ) প্রমুখ মনীষী বলেন যে, পানির তরঙ্গ, বালুকার কণা, ক্ষেতের ফসলের পাতা জোরে প্রবাহিত বাতাসে যখন আন্দোলিত হয় তখন এগুলোতে যেন রাস্তা হয়ে যায়। ওটাকেই (আরবী) বলা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীদের (রাঃ) এক ব্যক্তি হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের পিছনে মিথ্যাবাদী বিভ্রান্তকারী। তার মাথার চুল পিছনের দিকে ‘হুবুক’ ‘হুবুক’ অর্থাৎ কুঞ্চিত। আবূ সালেহ (রঃ) বলেন যে, (আরবী) দ্বারা কাঠিন্য বুঝানো হয়েছে। খাসীফ (রঃ) বলেন। (আরবী) -এর অর্থ হলো সুদৃশ্য। হাসান ইবনে হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, আকাশের সৌন্দর্য হলো নক্ষত্ররাজি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) দ্বারা সপ্তম আকাশকে বুঝানো হয়েছে। সম্ভবতঃ তার উদ্দেশ্য এই যে, প্রতিষ্ঠিত থাকে এমন তারকারাজি আকাশে রয়েছে। অধিকাংশ জ্যোতির্বিদের বর্ণনা এই যে, এটা অষ্টম আকাশে রয়েছে, যা সপ্তম আকাশের উপরে রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এই সমুদয় উক্তির সারাংশ একই অর্থাৎ এর দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত আকাশকে বুঝানো হয়েছে। আরো বুঝানো হয়েছে আকাশের উচ্চতা, ওর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ওর পবিত্রতা, ওর নির্মাণ চাতুর্য, ওর দৃঢ়তা, ওর প্রশস্ততা, তারকারাজি দ্বারা ওর জাক-জমকপূর্ণ হওয়া, যেগুলোর মধ্যে কতকগুলো চলতে ফিরতে থাকে এবং কতকগুলো স্থির থাকে, ওর সূর্য ও চন্দ্রের ন্যায় নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুষমামণ্ডিত হওয়া। এসব হচ্ছে আকাশের সৌন্দর্যের উপকরণ।
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ “হে মুশরিকের দল! তোমরা তো পরস্পর বিরোধী কথায় লিপ্ত রয়েছে। কোন কিছুর উপর তোমরা একমত হতে পারনি। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, তাদের কেউ কেউ তো সত্য বলে বিশ্বাস করতো এবং কেউ কেউ মিথ্যা মনে করতো।
অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “যে ব্যক্তি সত্যভ্রষ্ট সেই ওটা পরিত্যাগ করে।’ অর্থাৎ এই অবস্থা ওদেরই হয় যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট। তারা নিজেদের বাতিল, মিথ্যা ও বাজে উক্তির কারণে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। সঠিক বোধ ও সত্য জ্ঞান তাদের মধ্য হতে লোপ পেয়ে যায়। যেমন অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “তোমরা ও তোমাদের বাতিল মা’বৃদরা জাহান্নামী লোকদেরকে ছাড়া আর কাউকেও পথভ্রষ্ট করতে পারবে না।” (৩৭:১৬১-১৬৩) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা পথভ্রষ্ট শুধু সেই হয় যে নিজেই পথভ্রষ্ট হয়ে রয়েছে। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর থেকে ঐ ব্যক্তিই দূর হয় যাকে সর্বপ্রকারের কল্যাণ হতে দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছে। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, কুরআন কারীম হতে ঐ ব্যক্তিই সরে পড়ে যে ব্যক্তি পূর্ব হতেই এটাকে অবিশ্বাস করার উপর উঠে পড়ে লেগেছিল।
এরপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ ‘বাজে ও অযৌক্তিক উক্তিকারীরা ধ্বংস হোক।’ অর্থাৎ তারাই ধ্বংস হোক যারা বাজে ও মিথ্যা উক্তি করতো, যাদের মধ্যে ঈমান ছিল না, যারা বলতোঃ আমাদের পুনরুত্থান ঘটবে না। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ সন্দেহ পোষণকারীরা অভিশপ্ত। হযরত মুআয (রাঃ) স্বীয় ভাষণে এ কথাই বলতেন। এরা প্রতারক ও সন্দিহান।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ধ্বংস হোক তারা যারা অজ্ঞ ও উদাসীন। যারা বেপরোয়াভাবে কুফরী করতে রয়েছে। তারা প্রত্যাখ্যান করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করেঃ কর্মফল দিবস কবে হবে? আল্লাহ তা’আলা উত্তরে বলেনঃ এটা হবে সেই দিন, যেই দিন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে অগ্নিতে। যেমনভাবে সোনাকে আগুনে উত্তপ্ত করা হয় তেমনিভাবে তারা আগুনে জ্বলতে থাকবে। তাদেরকে বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের শাস্তি আস্বাদন কর, তোমরা এই শাস্তিই ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে। একথা তাদেরকে ধমকের সুরে বলা হবে।
১৫-২৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা আল্লাহভীরু লোকদের পরিণামের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, কিয়ামতের দিন তারা প্রস্রবণ বিশিষ্ট জান্নাতে অবস্থান করবে। তাদের অবস্থা হবে ঐ অসৎ লোকেদের অবস্থার বিপরীত যারা শাস্তি-সাজার মধ্যে, শংখল-জিঞ্জীরের মধ্যে এবং কঠিন মারপিটের মধ্যে থাকবে। এই মুমিনদের নিকট আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে যে দায়িত্ব ও কর্তব্য এসেছিল তা তারা যথাযথভাবে পালন করতো। আর এর পূর্বেও আন্তরিকতার সাথে কাজ করতো। কিন্তু দুই কারণে এই তাফসীরের ব্যাপারে কিছু চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। প্রথম কারণ এই যে, এ তাফসীর হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) করেছেন এ কথা বলা হয়। কিন্তু সহীহ সনদে এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) পর্যন্ত পৌঁছে না। ওর এ সনদটি সম্পূর্ণরূপে দুর্বল। দ্বিতীয় কারণ এই যে, (আরবী) পূর্বের বাক্য হতে (আরবী) হয়েছে। সুতরাং ভাবার্থ হবেঃ আল্লাহভীরু লোকেরা জান্নাতে আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতরাশি লাভ করবে। ইতিপূর্বে অর্থাৎ দুনিয়ায় তারা ভাল কাজ করতো। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ (তাদেরকে বলা হবেঃ) তোমরা পানাহার কর তৃপ্তির সাথে, তোমরা অতীত দিনে যা করেছিলে তার বিনিময়ে।” (৬৯:২৪)।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাদের আন্তরিকতাপূর্ণ কাজের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন যে, তারা রাত্রির সামান্য অংশই অতিবাহিত করতে নিদ্রায়। কোন কোন মুফাসসির বলেন যে, এখানে শব্দটি বা নেতিবাচক। তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজনের উক্তি হিসেবে অর্থ হবেঃ তাদের উপর এমন কোন রাত্রি অতিবাহিত হতো না যার কিছু অংশ তারা আল্লাহর স্মরণে না কাটাতেন। হয় রাত্রির প্রথমাংশে কিছু নফল পড়তেন, না হয় রাত্রির মধ্যভাগে পড়তেন। অর্থাৎ প্রত্যেক রাত্রের কোন না কোন সময় কিছু না কিছু নামায অবশ্যই পড়তেন। সারা রাত তারা শুয়ে কাটিয়ে দিতেন না।
হযরত আবুল আলিয়া (রঃ) প্রমুখ মনীষী বলেন যে, এ লোকগুলো মাগরিব ও ইশার নামাযের মাঝে কিছু নফল নামায পড়তেন। হযরত ইমাম আবু জাফর বাকির (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ তারা ইশার নামাযের পূর্বে ঘুমাতেন না।
কোন কোন তাফসীরকার বলেন যে, এখানে (আরবী) শব্দটি (আরবী) হয়েছে। অর্থাৎ তাঁদের দ্রিা রাত্রে খুব কম হতো। কিছু সময় ঘুমাতেন এবং কিছু সময় জেগে থাকতেন। আর যখন ইবাদতে মনোযোগ দিতেন তখন সকাল হয়ে যেতো।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ রাত্রির শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতো। হযরত আহনাফ ইবনে কায়েস (রঃ) এই আয়াতের এই ভাবার্থ বর্ণনা করার পর বলতেনঃ “বড়ই দুঃখজনক ব্যাপার যে, আমার মধ্যে এটা নেই।” তার ছাত্র খাজা হাসান বসরী (রঃ)-এর উক্তি রয়েছে যে, তিনি প্রায়ই বলতেনঃ “আমি যখন আমার আমল জান্নাতীদের আমলের সামনে রাখি তখন আমার আমলকে তাদের আমলের তুলনায় অতি নগণ্য দেখি। পক্ষান্তরে, যখন আমি আমার আমল জাহান্নামীদের আমলের সামনে রাখি তখন দেখি যে, তারা তো কল্যাণ হতে সম্পূর্ণরূপে দূরে ছিল। তারা ছিল আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকারকারী এবং মৃত্যুর পর পুনর্জীবনকে অবিশ্বাসকারী। সুতরাং আমার অবস্থা ঐ লোকেদের মত যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা ভাল ও মন্দ আমল মিশ্রিত করেছে।” (৯:১০২)
বানু তামীম গোত্রের একটি লোক হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ)-কে বললোঃ “হে আবু সালমা (রঃ)! এই গুণ তো আমাদের মধ্যে নেই যে, আমরা রাত্রে খুব কম ঘুমাই? আমরা তো খুব কম সময় আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে থাকি।” তখন তিনি বললেনঃ “ঐ ব্যক্তিও বড় ভাগ্যবান যে ঘুম আসলে শুয়ে পড়ে এবং যখন জেগে ওঠে তখন আল্লাহকে ভয় করতে থাকে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বলেন, প্রথম যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মদীনায় আগমন করেন তখন জনগণ তাঁকে দেখার জন্যে ভীড় জমায়। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আল্লাহর কসম। তার চেহারা মুবারকে আমার দৃষ্টি পড়া মাত্রই আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, এই জ্যোতির্ময় চেহারা কোন মিথ্যাবাদী লোকের হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সর্বপ্রথম যে কথা আমার কানে পৌঁছেছিল তা ছিলঃ “হে জনমণ্ডলী! তোমরা (দরিদ্রদেরকে) খাদ্য খাওয়াতে থাকো, আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখো, (মানুষকে) সালাম দিতে থাকো এবং রাত্রে নামায আদায় করো যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতে এমন কক্ষ রয়েছে যার ভিতরের অংশ বাহির হতে এবং বাহিরের অংশ ভিতর হতে দেখা যায়।” একথা শুনে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটা কাদের জন্যে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তাদের জন্যে, যারা নরম কথা বলে, (দরিদ্রদেরকে) খানা খেতে দেয় এবং রাত্রে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন তারা আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত যুহরী (রঃ) এবং হাসান (রঃ) বলেনঃ “এই আয়াতের ভাবার্থ এই যে, তারা রাত্রির অধিকাংশ তাহাজ্জুদে কাটিয়ে দেয়।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ “তারা রাত্রির সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করে।” হযরত যহহাক (রঃ) (আরবী) কে এর পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে মিলিয়ে দেন এবং (আরবী) হতে শুরু বলে থাকেন। কিন্তু এই উক্তিতে বড় কৃত্রিমতা রয়েছে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ রাত্রির শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতো।’ মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ ‘তারা নামায পড়ে। অন্যান্য তাফসীরকারগণ বলেন, এর অর্থ হচ্ছেঃ ‘তারা রাত্রে (ইবাদতে) দাঁড়িয়ে থাকে এবং সকাল হলে তারা নিজেদের পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সকালে তারা ক্ষমা প্রার্থনাকারী।” (৩:১৭) এই ক্ষমা প্রার্থনা যদি নামাযেই হয় তবে তো খুবই ভাল।
সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহে সাহাবীদের একটি জামাআতের কয়েকটি রিওয়াইয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন শেষ তৃতীয়াংশ রাত্রি অবশিষ্ট থাকে তখন প্রতি রাত্রে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেনঃ “কোন তাওবাকারী আছে কি? আমি তার তাওবা কবুল করবে। কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে। ক্ষমা করে দিবো। কোন যাজ্ঞাকারী আছে কি? আমি তাকে প্রদান করবে।” ফজর হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা এরূপই বলতে থাকেন।”
আল্লাহ তাআলা যে হযরত ইয়াকূব (আঃ) সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেছেন যে, তিনি তাঁর পুত্রদেরকে বলেছিলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।” এ ব্যাপারে অধিকাংশ তাফসীরকার বলেন যে, তাঁর এই ক্ষমা প্রার্থনা রাত্রির শেষ প্রহরেই ছিল।
এরপর আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের আর একটি গুণের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তাঁরা যেমন নামায পড়ে আল্লাহর হক আদায় করেন, অনুরূপভাবে মানুষের হকের কথাও তারা ভুলে যান না। তাঁরা যাকাত আদায় করে থাকেন। তারা জনগণের সঙ্গে সদাচরণ করেন, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখেন। তাদের ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে। যেমন হযরত হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ভিক্ষুকের হক রয়েছে যদিও সে ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করতে আসে। (এ হাদীস ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত মুজাহিদ (রঃ)-এর মতে মাহরূম বা বঞ্চিত হলো ঐ ব্যক্তি যার ইসলামে কোন অংশ নেই অর্থাৎ বায়তুল মালে কোন অংশ নেই, কোন কাজ-কামও হাতে নেই এবং কোন শিল্প ও কলা-কৌশলও তার জানা নেই যার দ্বারা সে জীবিকা উপার্জন করতে পারে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন যে, মাহরাম দ্বারা ঐ লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা কাজ-কাম কিছু জানে বটে, কিন্তু তা দ্বারা যা সে উপার্জন করে তা তাদের জীবন ধারণের জন্যে যথেষ্ট হয় না। যহহাক (রঃ) বলেন যে, মাহরূম হলো ঐ ব্যক্তি যে পূর্বে ধনী ছিল; কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে তার মাল-ধন ধ্বংস হয়ে গেছে। যেমন ইয়ামামায় যখন জলোচ্ছাস হলো এবং এক ব্যক্তির সমস্ত মাল-ধন ও আসবাব পত্র পানিতে ভেসে গেল তখন একজন সাহাবী (রাঃ) বললেনঃ “এ লোকটি মাহরূম বা বঞ্চিত। অন্যান্য বুযুর্গ মুফাসসিরগণ বলেন যে, মাহরূম হলো ঐ ব্যক্তি যে অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে না।
একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঐ ব্যক্তি মিসকীন নয় যে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং যাকে তুমি দু’ এক গ্রাস খাবার বা দু’ একটি খেজুর প্রদান করে থাকো, বরং মিসকীন ঐ ব্যক্তি যে এই পরিমাণ উপার্জন করে যা তার জন্যে যথেষ্ট নয় বা যা তার প্রয়োজন মিটায় না এবং তার এমন অবস্থা প্রকাশ পায় না যে, মানুষ তার অভাবের কথা জানতে পেরে তাকে কিছু দান করে।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) মক্কা যাচ্ছিলেন। পথে একটি কুকুর এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যায়। তিনি যবেহকৃত একটি বকরীর কাঁধ কেটে কুকুরটির সামনে নিক্ষেপ করেন এবং বলেনঃ “লোকেরা বলে যে, এটাও মাহরূম বা বঞ্চিত।” হযরত শাবী (রঃ) বলেনঃ “আমি ‘মাহরূম এর অর্থ জানতে অপারগ হয়ে গেছি।”
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ “মাহরূম হলো ঐ ব্যক্তি যার মাল নেই, তা যে কারণেই হোক না কেন। অর্থাৎ সে হয়তো মাল উপার্জন করতেই সক্ষম নয়, কিংবা হয়তো তার মাল ধ্বংস হয়ে গেছে কোন দুর্যোগের কারণে।”
হযরত হাসান ইবনে মুহাম্মাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাফিরদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দান করেন এবং তাঁরা গানীমাতও লাভ করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এমন কতগুলো লোক আগমন করে যারা গানীমতের মাল বন্টনের সময় উপস্থিত ছিল না। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। এই ঘটনা দ্বারা তো বুঝা যায় যে, এই আয়াতটি মাদানী। কিন্তু আসলে তা নয়, বরং এটি মক্কী আয়াত।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্যে ধরিত্রীতে নিদর্শন রয়েছে। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠে আল্লাহ তা’আলার ব্যাপক ক্ষমতার বহু নিদর্শন রয়েছে। এগুলো মহান সৃষ্টিকর্তার মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও বিরাটত্ব প্রমাণ করে। গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, কিভাবে তিনি দুনিয়ায় জীব-জন্তু ও গাছ-পালা ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিভাবে তিনি পর্বতরাজিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, মাঠ-ময়দানকে করেছেন বিস্তৃত এবং সমুদ্র ও নদ-নদীকে করে রেখেছেন প্রবাহিত। মানুষের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তিনি তাদের বর্ণ, আকৃতি, ভাষা, কামনা-বাসনা, বিবেক-বুদ্ধি, শক্তি-সামর্থ্য বিভিন্ন প্রকারের করেছেন। তাদের অঙ্গ-ভঙ্গী তাদের পাপ পুণ্য এবং দৈহিক গঠনের কথা চিন্তা করলেও বিস্মিত হতে হয়। প্রত্যেক অঙ্গ কেমন উপযুক্ত জায়গায় রয়েছে। এ জন্যেই এরপরেই বলেছেনঃ “তোমাদের নিজেদের মধ্যেও (নিদর্শন রয়েছে)। তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, যে ব্যক্তি নিজের সৃষ্টির কথা চিন্তা করবে, নিজের গ্রন্থীগুলোর বিন্যাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে সে অবশ্যই বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যে, তাকে আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্যেই ।
মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ “আকাশে রয়েছে তোমাদের জীবিকার উৎস অর্থাৎ বৃষ্টি এবং প্রতিশ্রুত সবকিছু অর্থাৎ জান্নাত।’ হযরত ওয়াসিল আহদাব (রঃ) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলেনঃ “আমার রিযক তো রয়েছে আসমানে, অথচ আমি তা অনুসন্ধান করছি যমীনে, এটা বড়ই দুঃখজনক ব্যাপারই বটে।” একথা বলে তিনি লোকালয় ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলে চলে যান। তিনি তিন দিন পর্যন্ত তো কিছুই পেলেন না। কিন্তু তৃতীয় দিনে দেখেন যে, টাটকা খেজুরের একটি গুচ্ছ তার পার্শ্বে আছে। তাঁর ভাই, যিনি তাঁর চেয়েও বেশী বিশুদ্ধ ও খাটি অন্তকরণ বিশিষ্ট লোক ছিলেন, তার সাথেই বেরিয়ে এসেছিলেন এবং তারা দুই ভাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত জঙ্গলেই জীবন কাটিয়ে দেন।
অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বয়ং নিজেরই শপথ করে বলেনঃ আমি তোমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছি অর্থাৎ কিয়ামত, পুনরুত্থান, শাস্তি ও পুরস্কার ইত্যাদি সবই সত্য। যেমন তোমাদের মুখ হতে বের হওয়া কথায় তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে না, অনুরূপভাবে এসব বিষয়েও তোমাদের সন্দেহ করা মোটেই উচিত নয়। হযরত মুআয (রাঃ) যখন কোন কথা বলতেন তখন তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে বলতেনঃ “নিশ্চয়ই এটা সত্য যেমন তুমি এখানে রয়েছে।”
হযরত হাসান বসরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা ঐ কওমগুলোকে ধ্বংস করুন যাদের জন্যে তাদের প্রতিপালক (আল্লাহ) শপথ করেছেন, অতঃপর তারা তা বিশ্বাস করেনি।” (এ হাদীসটি মুরসাল। কেননা, হযরত হাসান বসরী (রঃ) একজন তাবেয়ী। তিনি কোন সাহাবীর (রাঃ) নাম না নিয়ে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন)
২৪-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
এ ঘটনাটি সূরায়ে হূদ ও সূরায়ে হিজরে গত হয়েছে। মেহমান বা অতিথিরা ফেরেশতা ছিলেন, যারা মানুষের আকারে আগমন করেছিলেন। তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা সম্মান দান করেছিলেন। হযরত ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) এবং অন্যান্য আলেমদের একটি জামা’আত বলেন যে, অতিথিদেরকে আতিথ্য দান করা ওয়াজিব। হাদীসেও এটা এসেছে এবং কুরআন কারীমের বাহ্যিক শব্দও এটাই।
মানবরূপী ফেরেশতাগণ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে সালাম করেন এবং তিনি সালামের জবাব দেন। দ্বিতীয় (আরবী) শব্দের উপর দুই পেশ হওয়াটাই এর প্রমাণ। আল্লাহ তা’আলা এজন্যেই বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়া হবে তখন তোমরা ওর চেয়ে উত্তম (শব্দ) দ্বারা জবাব দিবে অথবা ওটাই ফিরিয়ে দিবে।” (৪:৮৬)
হযরত খলীল (আঃ) উত্তম পন্থাটিই গ্রহণ করেন। তারা যে আসলে ফেরেশতা ছিলেন তা হযরত ইবরাহীম (আঃ) জানতেন না বলে তিনি বলেনঃ “এরা তো অপরিচিত লোক।” ফেরেশতারা ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আঃ), হযরত মীকাঈল (আঃ) এবং হযরত ইসরাফীল (আঃ)। তাঁরা সুশ্রী যুবকের রূপ ধারণ করে এসেছিলেন। তাদের চেহারায় মর্যাদা ও ভীতির লক্ষণ প্রকাশমান ছিল। হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাদের খাদ্য তৈরীর কাজে মগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি নিঃশব্দে অতি তাড়াতাড়ি স্বীয় স্ত্রীর নিকট গমন করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই গো-বৎসের ভাজা গোশত নিয়ে তাদের সামনে হাযির হয়ে যান। তিনি ঐ গোশত তাঁদের নিকটে রেখে দেন এবং বলেনঃ “আপনারা খাচ্ছেন না কেন?” এর দ্বারা জিয়াফতের আদব জানা যাচ্ছে যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) মেহমানকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই এবং তাদের জন্যে তিনি যে খাবার আনছেন এ অনুগ্রহের কথা তাদেরকে বলেই নিঃশব্দে তাঁদের নিকট হতে চলে গেলেন এবং তাড়াতাড়ি উৎকৃষ্ট হতে উৎকৃষ্টতম যে জিনিস তিনি পেলেন তা প্রস্তুত করে নিয়ে আসলেন। তা ছিল অল্প বয়স্ক একটি তাজা গো-বৎসের ভাজা গোশত। এ খাদ্য তাদের সামনে রেখে দিয়ে তিনি তাদেরকে খেয়ে নেন’ একথা বললেন না। কেননা, এতে এক ধরনের হুকুম পাওয়া যাচ্ছে। বরং তিনি তার সম্মানিত মেহমানদেরকে অত্যন্ত বিনয় ও ভালবাসার সুরে বলেনঃ “আপনারা খেতে শুরু করছেন না কেন?” যেমন কোন ব্যক্তি কাউকেও বলে থাকেঃ “যদি আপনি দয়া, অনুগ্রহ ও সদাচরণ করতে চান তবে করতে পারেন।”
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “এতে তাদের সম্পর্কে তার মনে ভীতির সঞ্চার হলো।’ যেমন অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থৎ “সে যখন দেখলো যে, তাদের হস্তগুলো ওর দিকে প্রসারিত হচ্ছে না, তখন সে তাদেরকে অবাঞ্ছিত মনে করলো এবং তাদের সম্বন্ধে তার মনে ভীতির সঞ্চার হলো। তারা বললোঃ ভয় করো না, আমরা লুত (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। তখন তার স্ত্রী দাঁড়িয়েছিল এবং সে হাসলো।” (১১:৭০-৭১) মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ “অতঃপর আমি তাকে ইসহাক (আঃ)-এর ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকূব (আঃ)-এর সুসংবাদ দিলাম। সে বললোঃ কি আশ্চর্য! সন্তানের জননী হবো আমি যখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ! এটা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার। তারা বললোঃ আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময়বোধ করছো? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি প্রশংসার্হ ও সম্মানার্হ।”
মহান আল্লাহ এখানে বলেনঃ “তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলো। এ আয়াতে আছে যে, ফেরেশতারা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, আর পূর্ববর্তী আয়াতে রয়েছে, এ সংবাদ তাঁরা তার স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। সুতরাং ভাবার্থ এই যে, স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই এ সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল। কেননা, সন্তানের জন্মগ্রহণ উভয়ের জন্যেই খুশীর বিষয়।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এ সুসংবাদ শুনে হযরত ইবরাহীম। (আঃ)-এর স্ত্রীর মুখ দিয়ে জোর শব্দ বেরিয়ে আসলো এবং কপালে হাত মেরে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বললেনঃ “যৌবনে আমি বন্ধ্যা ছিলাম। এখন আমিও বৃদ্ধা এবং আমার স্বামীও বৃদ্ধ, এমতাবস্থায় আমি গর্ভবতী হববা?” তার এই কথা শুনে ফেরেশতারা বললেনঃ “এই সুসংবাদ আমরা আমাদের নিজেদের পক্ষ হতে দিচ্ছি না। বরং মহামহিমান্বিত আল্লাহই আমাদেরকে এ সুসংবাদ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তো প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। আপনারা যে মহা সম্মান পাওয়ার যোগ্য এটা তিনি ভালরূপেই জানেন। তাঁর ঘোষণা এই যে, এ বৃদ্ধ বয়সেই তিনি আপনাদেরকে সন্তান দান করবেন। তাঁর কোন কাজই প্রজ্ঞাশূন্য নয় এবং তার কোন হুকুমও হিকমত শূন্য হতে পারে না।”
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :
الذّٰرِيٰتِ (আল যারিয়াত) শব্দের অর্থ বাতাস, অত্র সূরার প্রথম আয়াতে الذّٰرِيٰتِ (আল যারিয়াত) শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, সেখান থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরার শুরুতে আল্লাহ তা‘আলা কয়েকটি শপথ করে বলছেন যে, তোমাদেরকে (কিয়ামতের) যে প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে তা সত্য এবং তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। তারপর মুত্তাকীদের তিনটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর মানুষকে চিন্তার দৃষ্টিতে কয়েকটি নিদর্শনের দিকে তাকানোর দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইবরাহীম (আঃ)-এর মেহমানের প্রসিদ্ধ ঘটনা ও লূত (আঃ)-এর জাতিকে মর্মান্তিক শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করার বর্ণনা এসেছে। তারপর পরপর কয়েকজন নাবীর অবাধ্য জাতির অবাধ্যতা ও আপতিত আযাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরার শেষ দিকে এক মানব ও জিন সৃষ্টির লক্ষ-উদ্দেশ্য ও আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করত তাঁর দিকে ধাবিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
১-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
وَالذَّارِيَاتِ অর্থ : বাতাস। এখানে এমন বাতাসকে বুঝানো যা ধূলাবালি উড়িয়ে নিয়ে যায়।
فَالْحَامِلَاتِ মেঘমালা বহনকারী, وقرا অর্থ : পানির ভারী বোঝা। অর্থাৎ এমন মেঘমালা যা পানির ভারী-বোঝা বহন করে নিয়ে যায়।
فَالْجَارِيَاتِ হলো নৌযান যা নদী ও সমুদ্রে চলাচল করে।
فَالْمُقَسِّمَاتِ ‘শপথ কর্ম বন্টনকারীদের’ দ্বারা সেসকল ফেরেশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশাবলী বণ্টন করে।
এসব বড় বড় নিদর্শনের শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তোমাদেরকে পুনরুত্থান ও হিসাব-নিকাশের যে ওয়াদা দেয়া হয়েছে তা সত্য, অবশ্যই তা বাস্তবায়িত হবে। আল্লাহ তা‘আলা যে জিনিসের শপথ করেন অন্যান্য জিনিসের তুলনায় তা অধিক গুরুত্বের দাবীদার। তাই বড় বড় নিদর্শনের শপথ করে পুনরুত্থানের বিষয়টির সত্যতার সাথে গুরুত্ব ব্যক্ত করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাখলুকের মধ্য হতে যে কোন জিনিসের নাম নিয়ে শপথ করতে পারেন। কিন্তু মানুষ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করতে পারে না। অন্যের নামে শপথ করা হারাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللّٰهِ فَقَدْ أَشْرَكَ
যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করল যে র্শিক করল। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ হা. ৩২৫১, সহীহ)
অতঃপর আকাশের শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : যে আকাশ (ذَاتِ الْحُبُكِ) অর্থাৎ- বহু কক্ষপথবিশিষ্ট (অন্য একটি অর্থ হলো : শপথ সুসজ্জিত ও আলোক-উজ্জ্বল আকাশের যা গ্রহ-নক্ষত্র ও তারকারাজি দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত)। হে মক্কাবাসী! তোমরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের ব্যাপারে যেসব কথায় লিপ্ত রয়েছো- যেমন কেউ বল : জাদুকর, কেউ বল : জ্যোতিষী, কেউ বল : পাগল ইত্যাদি এ সকল কথা বিরোধপূর্ণ যা সত্য নয়।
(يُؤْفَكُ عَنْهُ مَنْ أُفِكَ)
অর্থাৎ সে ব্যক্তিকে কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান আনা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে যে আল্লাহ তা‘আলার প্রমাণ ও দলীল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাকে কল্যাণের তাওফীক দেয়া হয়নি।
الْخَرَّاصُونَ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : তারা মুরতাদ। মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : এর অর্থ হল মিথ্যুক, যারা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে।
(غَمْرَةٍ سَاهُونَ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : কুফরী ও সংশয়ের মাঝে গাফেল হয়ে পড়ে আছে।
يُفْتَنُونَ -এর অর্থ হলো : يحرقون ويعذبون
যেভাবে সোনা আগুনে পুড়িয়ে যাচাই ও পরীক্ষা করা হয়, ঠিক ঐভাবে এদেরকেও আগুনে নিক্ষেপ করে শাস্তি দেয়া হবে। ==
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. পুনরুত্থান ও হিসাব-নিকাশের প্রতি ঈমান রাখতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা যে কোন জিনিসের শপথ করতে পারেন। কিন্তু মানুষ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের নামে শপথ করতে পারে না।
৩. যারা আখিরাতে অবিশ্বাসী তাদের প্রতি লা‘নত, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত।
১৫-১৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
অত্র আয়াতগুলোতে মুত্তাকীদের চিরস্থায়ী আবাসস্থল জান্নাতে অবস্থানের কথা ও তাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে।
(قَبْلَ ذٰلِكَ) দ্বারা উদ্দেশ্য হল- দুনিয়া। অর্থাৎ মুত্তাকীরা দুনিয়াতে সৎ কর্মপরায়ণ ছিল।
মুত্তাকীদের প্রথম বৈশিষ্ট্য : তারা রাতের সামান্য অংশই ঘুমায়। অর্থাৎ- রাতে কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصَلُّوا وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُونَ الجَنَّةَ بِسَلَامٍ
হে মানবমণ্ডলী! বেশি বেশি সালামের প্রসার করো, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখো, অভাবীদের খাদ্য দাও, রাতে সালাত আদায় করো যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে- শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী হা. ২৪৮৫, সহীহ)
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য : রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। আর ডাক দিয়ে বলেন: কেউ আমার কাছে তাওবাকারী আছো কি? আমি তার তাওবা কবূল করব। কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কেউ চাওয়ার আছো কি? আমি তাকে দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা বলতে থাকেন। (সহীহ মুসলিম, আবূ দাঊদ হা. ৪৭৩৩)
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য : মুত্তাকীদের সম্পদে-যারা চায় আর যারা অভাব থাকা সত্ত্বেও চক্ষু-লজ্জায় চায় না তাদের জন্য ওয়াজিব ও মুস্তাহাব উভয় হাক্ব রয়েছে। তারা এ হাক্বসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে।
আমরাও যেন এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারি সে জন্য যথাযথ চেষ্টা করতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মুত্তাকীদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অবগত হলাম, আমাদের উচিত এসব বৈশিষ্ট্য অর্জন করা।
২. আখিরাতে মুত্তাকীদের বাসস্থান জান্নাত।
৩. আল্লাহ তা‘আলা রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বান্দাদের ডাকে সাড়া দেন।
২০-২৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মানুষ যেন প্রকৃত মা‘বূদ ও স্রষ্টাকে চিনতে পারে সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে অনেক নিদর্শন দিয়েছেন যা মহান আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
খুঁটিবিহীন বিশাল প্রশস্ত আকাশ, ধু-ধু মরুভূমিকে বৃষ্টির পানি দ্বারা সবুজ-শ্যামল ও ফসলের উপযোগী করে দেয়া ইত্যাদি সব কিছুর মাঝে নিদর্শন রয়েছে যে- আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র মা‘বূদ, তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা। তাই আরবিতে বলা হয় :
وفي كل شئ له أية + تدل علي أنه واحد
অর্থাৎ প্রত্যেকটি জিনিসের মাঝে তাঁর নিদর্শন রয়েছে, যা প্রমাণ করে তিনি এক। (শরহুল আকীদাহ আত তাহাবীয়াহ পৃ. :২৫)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : তোমাদের নিজেদের মাঝেও নিদর্শন রয়েছে তোমরা কি দেখো না? কী সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, প্রত্যেকটি অঙ্গ উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করে করেছেন। যেমন একটাই জিহ্বা যা বিভিন্ন স্বাদের জিনিস অনুধাবন করতে পারে ইত্যাদি।
(وَفِي السَّمَا۬ءِ رِزْقُكُمْ)
অর্থাৎ আকাশে তোমাদের জীবিকা তথা বৃষ্টি রয়েছে যা নাযিল হয়ে ফসল উৎপন্ন করে এবং তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেয়া হয়েছে অর্থাৎ জান্নাত। ইবনু আব্বাস (রহঃ)-সহ অনেকে এ তাফসীর করেছেন। (ইবনু কাসীর- অত্র আয়াতের তাফসীর)
(إِنَّه۫ لَحَقٌّ مِّثْلَ مَآ أَنَّكُمْ تَنْطِقُوْنَ)
‘অবশ্যই এ-কথা তোমাদের কথোপকথনের মতই সত্য’ আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় স্বত্তার শপথ করে বলছেন, তিনি তোমাদেরকে যে ওয়াদা করেছেন তা সত্য। অতএব এ ব্যাপারে সে রকম সন্দেহ করো না যেমন তোমাদের পরস্পরের কোন কথার ব্যাপারে তোমরা সন্দেহ করে থাকো।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. পৃথিবীতে মহান আল্লাহ এমন নিদর্শন রেখেছেন যা তাঁর একত্বের প্রমাণ বহন করে।
২. মানুষ চিন্তা করলে সহজেই আল্লাহাকে চিনতে পারবে এবং তাঁর মহত্বের কাছে নতি স্বীকার করবে।
৩. কিয়ামত নির্ধারিত সময়ে সংঘটিত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
২৪-৩০ নং আয়াতের তাফসীর :
ইবরাহীম (আঃ) ও লূত (আঃ) সমকালীন নাবী। তারা উভয়ে চাচাতো বা খালাতো ভাই। লূত (আঃ)-এর জাতি পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম সমকামিতায় লিপ্ত হয়। তাদেরকে লূত (আঃ) বার বার বারণ করার পরেও যখন বিরত থাকল না। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য ফেরেশতা প্রেরণ করলেন।
এ ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ইব্রাহীম (আঃ)-এর বাড়ি হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ (১) ইবরাহীম (আঃ)-কে তাঁর সন্তান ইসহাকের সুসংবাদ দেয়ার জন্য, (২) লূত (আঃ)-এর অবাধ্য সম্প্রদায়ের ওপর আযাবের কথা জানিয়ে দেয়ার জন্য।
ফেরেশতাগণ ইবরাহীম (আঃ)-এর বাড়িতে মেহমানের বেশে আগমন করলেন। তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে সালাম দিলে ইবরাহীম (আঃ) সালামের জবাব দিয়ে বললেন- (قَوْمٌ مُّنْكَرُونَ) অর্থাৎ- আপনাদেরকে অপরিচিত মনে হচ্ছে। ইবরাহীম (আঃ) তাদেরকে চিনতে পারেননি যে, তারা ফেরেশতা। ইবরাহীম (আঃ) মেহমানদের আপ্যায়ন করার জন্য চুপিসারে স্ত্রীর কাছে গিয়ে ভূনা করা একটি গরুর বাছুর নিয়ে এসে খেতে বললেন। কিন্তু তারা খাচ্ছে না। এ অবস্থা দেখে তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। তারা বললেন : আপনি ভয় করবেন না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( فَلَمَّا رَآٰ اَیْدِیَھُمْ لَا تَصِلُ اِلَیْھِ نَکِرَھُمْ وَاَوْجَسَ مِنْھُمْ خِیْفَةًﺚ قَالُوْا لَا تَخَفْ اِنَّآ اُرْسِلْنَآ اِلٰی قَوْمِ لُوْطٍﮕوَامْرَاَتُھ۫ قَا۬ئِمَةٌ فَضَحِکَتْ فَبَشَّرْنٰھَا بِاِسْحٰقَﺫ وَمِنْ وَّرَا۬ئِ اِسْحٰقَ یَعْقُوْبَ)
“সে যখন দেখল তাদের হাত তার দিকে প্রসারিত হচ্ছে না, তখন তাদেরকে অবাঞ্ছিত মনে করল এবং তাদের সম্বন্ধে তার মনে ভীতি সঞ্চার হল। তারা বলল : ‘ভয় কর না, আমরা লূতের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি।’ আর তার স্ত্রী দণ্ডায়মান ছিল এবং সে হেসে ফেলল। অতঃপর আমি তাকে ইস্হাকের ও ইস্হাকের পরবর্তী ইয়া‘কূবের সুসংবাদ দিলাম। (সূরা হূদ ১১ :৭০-৭১)
তারপর তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে ইসহাক (আঃ)-এর সুসংবাদ দিলেন। ইবরাহীম (আঃ)-এর স্ত্রী অবাক, আমি বন্ধ্যা ও বৃদ্ধা, কিভাবে আমার সন্তান হবে। তারা বললেন : তোমার প্রতিপালক এরূপই বলেছেন।
তারপর ইবরাহীম (আঃ) তাদেরকে বললেন, তাহলে আপনাদের আসার উদ্দেশ্য কী? তখন ফেরেশতাগণ আয়াতে বর্ণিত কথাগুলো বললেন।
(فَمَا وَجَدْنَا فِيْهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِّنَ الْمُسْلِمِيْنَ)
‘এবং সেখানে একটি পরিবার (লূত এর পরিবার) ব্যতীত কোন মুসলিম আমি পাইনি।’ এ ঘরটি ছিল লূত (আঃ)-এর। সেখানে তাঁর দু’কন্যা এবং তাঁর ওপর ঈমান আনয়নকারী কিছু লোক ছিল। বলা হয় এরা মোট তেরজন ছিল। এদের মধ্যে লূত-এর স্ত্রী শামিল ছিল না। বরং সে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। (আয়সারুত্ তাফাসীর- অত্র আয়াতের তাফসীর)
এসব কিছুর মাঝে রয়েছে তাদের জন্য নিদর্শন যারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিকে ভয় করে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের স্বীকৃতি পাওয়া গেল। কারণ একজন উম্মি ব্যক্তির জন্য ওয়াহীর মাধ্যম ছাড়া এসব ঘটনা জানা সম্ভব না।
২. ইবরাহীম (আঃ)-অতিথিপরায়ণ ছিলেন, এমনকি অপরিচিত লোকদের ক্ষেত্রেও মেজবানের যথার্থ পরিচয় দিতেন ।
৩. আল্লাহ তা‘আলা যাকে যখন ইচ্ছা সন্তান দান করতে পারেন।
৪. লূত (আঃ)-এর সম্প্রদায় সর্বপ্রথম সমকামিতার অপরাধে লিপ্ত হয়, যার কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
৫. অপরিচিত লোক মেহমান হলে তাকে সম্মানের সাথে মেহমানদারী করা উচিত।