بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৩৯) [*‌‌  *সৃষ্টিজগত সম্পর্কে জড়বাদীদের চিন্তাধারা:- যারা আজ, তামাসাচ্ছলে নিজেদের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যস্ত আছে:-] www.motaher21.net সূরা:৫২-আত-তূর। পারা:২৭ ১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:- # তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:- # তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৯)
[*‌‌  *সৃষ্টিজগত সম্পর্কে জড়বাদীদের চিন্তাধারা:-
যারা আজ, তামাসাচ্ছলে নিজেদের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যস্ত আছে:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫২-আত-তূর। পারা:২৭

১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
সূরা:৫২-আত-তূর-১
وَ الطُّوۡرِ ۙ﴿۱﴾
শপথ ত্বূর (পর্বতের),
সূরা:৫২-আত-তূর-২
وَ کِتٰبٍ مَّسۡطُوۡرٍ ۙ﴿۲﴾
এবং এমন একখানা খোলা গ্রন্থের শপথ,
সূরা:৫২-আত-তূর-৩
فِیۡ رَقٍّ مَّنۡشُوۡرٍ ۙ﴿۳﴾
যা সূক্ষ্ম চামড়ার ওপর লিখিত।
সূরা:৫২-আত-তূর-৪
وَّ الۡبَیۡتِ الۡمَعۡمُوۡرِ ۙ﴿۴﴾
শপথ বায়তুল মা’মূরের,
সূরা:৫২-আত-তূর-৫
وَ السَّقۡفِ الۡمَرۡفُوۡعِ ۙ﴿۵﴾
সুউচ্চ ছাদের,
সূরা:৫২-আত-তূর-৬
وَ الۡبَحۡرِ الۡمَسۡجُوۡرِ ۙ﴿۶﴾
শপথ উদ্বেলিত (প্রজ্বালিত) সমুদ্রের,
সূরা:৫২-আত-তূর-৭
اِنَّ عَذَابَ رَبِّکَ لَوَاقِعٌ ۙ﴿۷﴾
নিশ্চয় আপনার রবের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী,
সূরা:৫২-আত-তূর-৮
مَّا لَہٗ مِنۡ دَافِعٍ ۙ﴿۸﴾
যার রোধকারী কেউ নেই।
সূরা:৫২-আত-তূর-৯
یَّوۡمَ تَمُوۡرُ السَّمَآءُ مَوۡرًا ۙ﴿۹﴾
তা ঘটবে সেদিন, যেদিন আসমান প্রচণ্ডভাবে প্রকম্বিত হবে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১০
وَّ تَسِیۡرُ الۡجِبَالُ سَیۡرًا ﴿ؕ۱۰﴾
এবং পাহাড় শূন্যে উড়তে থাকবে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১১
فَوَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿ۙ۱۱﴾
ধ্বংস রয়েছে সেদিন সেসব অস্বীকারকারীদের জন্য।
সূরা:৫২-আত-তূর-১২
الَّذِیۡنَ ہُمۡ فِیۡ خَوۡضٍ یَّلۡعَبُوۡنَ ﴿ۘ۱۲﴾
যারা আজ, তামাসাচ্ছলে নিজেদের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যস্ত আছে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৩
یَوۡمَ یُدَعُّوۡنَ اِلٰی نَارِ جَہَنَّمَ دَعًّا ﴿ؕ۱۳﴾
সেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৪
ہٰذِہِ النَّارُ الَّتِیۡ کُنۡتُمۡ بِہَا تُکَذِّبُوۡنَ ﴿۱۴﴾
‘এটাই সে আগুন যাকে তোমারা মিথ্যা মনে করতে।’
সূরা:৫২-আত-তূর-১৫
اَفَسِحۡرٌ ہٰذَاۤ اَمۡ اَنۡتُمۡ لَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿ۚ۱۵﴾
এখন বলো, এটা কি যাদু না এখনো তোমরা উপলব্ধি করতে পারছো না?
সূরা:৫২-আত-তূর-১৬
اِصۡلَوۡہَا فَاصۡبِرُوۡۤا اَوۡ لَا تَصۡبِرُوۡا ۚ سَوَآءٌ عَلَیۡکُمۡ ؕ اِنَّمَا تُجۡزَوۡنَ مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۶﴾
যাও, এখন এর মধ্যে ঢুকে দগ্ধ হতে থাকো। তোমরা ধৈর্য্য ধর আর না ধর, এখন উভয়টিই তোমাদের জন্য সমান। তোমরা যেমন কাজ করে এসেছো ঠিক তেমন প্রতিদানই তোমাদের দেয়া হচ্ছে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৭
اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ نَعِیۡمٍ ﴿ۙ۱۷﴾
মুত্তাকীরা সেখানে বাগান ও নিয়ামতসমূহের মধ্যে অবস্থান করবে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৮
فٰکِہِیۡنَ بِمَاۤ اٰتٰہُمۡ رَبُّہُمۡ ۚ وَ وَقٰہُمۡ رَبُّہُمۡ عَذَابَ الۡجَحِیۡمِ ﴿۱۸﴾
তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা দেবেন, তারা তা সানন্দে উপভোগ করবে এবং তিনি তাদেরকে রক্ষা করবেন জাহান্নামের শাস্তি হতে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৯
کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا ہَنِیۡٓـًٔۢا بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿ۙ۱۹﴾
তোমরা যেসব কাজ করে এসেছো তার বিনিময়ে মজা করে পানাহার করো।
সূরা:৫২-আত-তূর-২০
مُتَّکِئِیۡنَ عَلٰی سُرُرٍ مَّصۡفُوۡفَۃٍ ۚ وَ زَوَّجۡنٰہُمۡ بِحُوۡرٍ عِیۡنٍ ﴿۲۰﴾
তারা সামনা-সামনি রাখা সুসজ্জিত আসনসমূহে হেলান দিয়ে বসবে এবং আমি সুনয়না হুরদের সাথে তাদের বিয়ে দেব।
সূরা:৫২-আত-তূর-২১
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ اتَّبَعَتۡہُمۡ ذُرِّیَّتُہُمۡ بِاِیۡمَانٍ اَلۡحَقۡنَا بِہِمۡ ذُرِّیَّتَہُمۡ وَ مَاۤ اَلَتۡنٰہُمۡ مِّنۡ عَمَلِہِمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ ؕ کُلُّ امۡرِیًٴۢ بِمَا کَسَبَ رَہِیۡنٌ ﴿۲۱﴾
যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং তাদের সন্তানরাও ঈমানসহ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে আমি তাদের সেসব সন্তানকেও তাদের সাথে (জান্নাতে) একত্রিত করে দেব। এবং তাদের কর্মফল আমি কিছুমাত্র হ্রাস করব না।
প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ।
সূরা:৫২-আত-তূর-২২
وَ اَمۡدَدۡنٰہُمۡ بِفَاکِہَۃٍ وَّ لَحۡمٍ مِّمَّا یَشۡتَہُوۡنَ ﴿۲۲﴾
আমি তাদেরকে সব রকমের ফল, গোশত এবং তাদের মন যা চাইবে তাই প্রচুর পরিমাণে দিতে থাকবো।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৩
یَتَنَازَعُوۡنَ فِیۡہَا کَاۡسًا لَّا لَغۡوٌ فِیۡہَا وَ لَا تَاۡثِیۡمٌ ﴿۲۳﴾
সেখানে তারা একে অপরের নিকট হতে গ্রহণ করবে পান-পাত্র, যা হতে পান করলে কেউ অসার কথা বলবে না এবং পাপ কর্মেও লিপ্ত হবে না।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৪
وَ یَطُوۡفُ عَلَیۡہِمۡ غِلۡمَانٌ لَّہُمۡ کَاَنَّہُمۡ لُؤۡلُؤٌ مَّکۡنُوۡنٌ ﴿۲۴﴾
তাদের (সেবায়) তাদের কিশোরেরা তাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করবে; যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৫
وَ اَقۡبَلَ بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ یَّتَسَآءَلُوۡنَ ﴿۲۵﴾
তারা একে অপরকে অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৬
قَالُوۡۤا اِنَّا کُنَّا قَبۡلُ فِیۡۤ اَہۡلِنَا مُشۡفِقِیۡنَ ﴿۲۶﴾
তারা বলবে, নিশ্চয় আগে আমরা পরিবার-পরিজনের মধ্যে শংকিত অবস্থায় ছিলাম।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৭
فَمَنَّ اللّٰہُ عَلَیۡنَا وَ وَقٰىنَا عَذَابَ السَّمُوۡمِ ﴿۲۷﴾
অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে উত্তপ্ত ঝড়ো হাওয়ার শাস্তি হতে রক্ষা করেছেন।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৮
اِنَّا کُنَّا مِنۡ قَبۡلُ نَدۡعُوۡہُ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡبَرُّ الرَّحِیۡمُ ﴿٪۲۸﴾
নিশ্চয় আমরা আগেও আল্লাহকে ডাকতাম, নিশ্চয় তিনি কৃপাময়, পরম দয়ালু।

১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ ও ফযীলত :

الطُّوْرِ তূর সে পাহাড় যেখানে মূসা (আঃ) মহান আল্লাহ তা‘আলা সাথে বাক্যালাপ করেছিলেন। এ পাহাড়টিকে “তূরে সাইনা”-ও বলা হয়। এ طور শব্দ থেকেই সূরার নাম ‘তূর’ রাখা হয়েছে।

যুবাইর ইবনু মুত‘ঈম (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে মাগরিবের সালাতে সূরা ‘তূর’ পড়তে শুনেছি। তাঁর চেয়ে উত্তম সুর বা উত্তম কিরাআতে আর কারো কাছে শুনিনি। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৫৩)

উম্মে সালামাহ্ (রাঃ) বলেন : আমার অসুস্থতার কথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালাম। তিনি বললেন : তুমি আরোহী হয়ে মানুষের পেছনে তাওয়াফ করো। আমি সেভাবেই তাওয়াফ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইতুল্লাহর পাশে সালাতে

(وَالطُّوْرِ- وَكِتَابٍ مَّسْطُورٍ)

পড়ছিলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৫৩)

১-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

وَالطُّورِ পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, ‘তূর’ সে পাহাড় যেখানে মূসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার সাথে বাক্যালাপ করেছিলেন। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর) এ পাহাড়ের শপথ করেছেন তার সম্মান ও মর্যাদা এবং তাতে যে সকল নিদর্শন রয়েছে তার দিকে লক্ষ্য রেখে।

হাফিয ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : ‘তূর’ বলা হয় এমন পাহাড়কে যেখানে গাছপালা জন্মায়। যেমন মূসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলা সাথে যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে বাক্যালাপ করেছিলেন এবং যেখান হতে ‘ঈসা (আঃ)-কে পাঠিয়েছিলেন। আর যে পাহাড়ে কোন প্রকার গাছপালা জন্মায় না তাকে “তূর” বলা হয় না; তাকে “জাবাল” বলা হয়। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

(وَكِتَابٍ مَّسْطُوْرٍ)

‘শপথ কিতাবের, যা লিখিত আছে’ مَسْطُورٍ অর্থ হলো : লিপিবদ্ধ, লিখিত বস্তু। কেউ বলেছেন- এটা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো লাওহে মাহফূজ। কেউ বলেছেন : কুরআন মাজীদ, কেউ বলেছেন : মানুষের আমলনামা যা ফেরেশতাগণ লিখে থাকে।

(رَقٍّ مَّنْشُوْرٍ) ‘খোলা পত্রে’ অর্থ : পাতলা চামড়া যার ওপর লেখা হয়। منشور অর্থ : উন্মুক্ত, বিস্তৃত এ আয়াতের সম্পর্ক পূর্বের আয়াতের সাথে।

(وَالْبَيْتِ الْمَعْمُوْرِ)

‘শপথ বায়তুল মা’মূরের’ বাইতুল মা‘মুর হলো সপ্ত আকাশের ওপর অবস্থিত সে ‘ইবাদতখানা যেখানে ফেরেশতারা ‘ইবাদত করেন। এ ‘ইবাদতখানা ফেরেশতাগণের দ্বারা এমনভাবে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে যে, প্রত্যহ এতে সত্তর হাজার করে ফেরেশতা ‘ইবাদতের জন্য প্রবেশ করেন। যাদের কিয়ামত পর্যন্ত পুনরায় প্রবেশের পালা আসবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মি‘রাজের হাদীসে বলেন (সপ্তম আকাশ অতিক্রম করার পর) :

অতঃপর আমাকে বাইতুল মা‘মূরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা ‘ইবাদতের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে থাকেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের পুনরায় আসার পালা আসবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৩২০৭, সহীহ মুসলিম হা. ৪৩৪)

অর্থাৎ ফেরেশতারা সেখানে ‘ইবাদত ও তাওয়াফ করে, যেমন দুনিয়াবাসী কা‘বা ঘর তাওয়াফ করে। সেটা আকাশবাসীদের জন্য কাবা। এজন্য ইবরাহীম (আঃ) বাইতুল মা‘মূরে পিঠ লাগিয়ে বসে আছেন, কারণ তিনি দুনিয়ার কাবা তৈরি করেছেন। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

(وَالسَّقْفِ الْمَرْفُوعِ)

‘শপথ সমুন্নত আকাশের’ এ থেকে আকাশকে বুঝানো হয়েছে যা পৃথিবীর জন্য ছাদস্বরূপ। পবিত্র কুরআনে এটাকে “সুরক্ষিত ছাদ” বলা হয়েছে।

(وَجَعَلْنَا السَّمَا۬ءَ سَقْفًا مَّحْفُوْظًا ج وَّهُمْ عَنْ اٰيٰتِهَا مُعْرِضُوْنَ)‏

“এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ; কিন্তু তারা আকাশস্থিত নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা আম্বিয়া- ২১ :৩২)

(وَالْبَحْرِ الْمَسْجُورِ)

‘এবং শপথ উদ্বেলিত সমুদ্রের’ আলিমগণ এখানে দু’ধরনের তাফসীর করেছেন।

(১) مسجور অর্থাৎ সমুদ্রকে আগুন হিসেবে প্রজ্জ্বলিত করা। কেননা সমুদ্রকে কিয়ামতের দিন আগুন দ্বারা প্রজ্জ্বলিত করা হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

( فِي الْحَمِيْمِ ৫لا ثُمَّ فِي النَّارِ يُسْجَرُوْنَ)‏

“ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর তাদেরকে দগ্ধ করা হবে অগ্নিতে।” (সূরা আল মু’মিন ৪০ :৭২)

(২) مسجور অর্থ مملوء বা পরিপূর্ণ। কেননা সমুদ্র পানি দ্বারা পরিপূর্ণ। مسجور-এর উভয় অর্থের কথা এ আয়াতে রয়েছে।

(وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ)‏

“এবং সমুদ্রগুলোকে যখন উদ্বেলিত করা হবে।” (সূরা আত্ তাকভীর ৮১ :৬)

এ সব মাখলুকের শপথ করার পর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি আসবেই। এর কোন প্রতিরোধকারী নেই।

(تَمُوْرُ السَّمَا۬ءُ) — مور

অর্থ হলো : আন্দোলন, অস্থিরতা। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আকাশের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা এবং মহাশূন্যে ভ্রাম্যমান তারকারাজি ঝরে ও খসে পড়ার কারণে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, সেটাকেই বুঝানো হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : চরমভাবে নড়াচড়া করবে।

(وَتَسِيْرُ الْجِبَالُ)

অর্থাৎ পাহাড়গুলো দ্রুত চলবে, ফলে তা ধূলিকণার মতো পাতলা হয়ে যাবে।

সে কঠিন দিনে তাদের জন্য দুর্ভোগ যারা মিথ্যুক, যারা দুনিয়াতে বাতিলের সাথে ছিল আর ধর্মকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে ছিল।

(يُدَعُّوْنَ إِلَي نَارِ) শব্দের অর্থ হলো : শক্তি ব্যবহার করে জোরপূর্বক হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী :

(فَذٰلِكَ الَّذِيْ يَدُعُّ الْيَتِيْمَ)

“এ তো হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে (নিরীহ) এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়।” (সূরা আল মা‘ঊন ১০৭ :৩)

উক্ত আয়াত দু’টি বিষয় শামিল করেছে-

(১) কাফিরদেরকে সেদিন শক্তি ব্যবহার করে জোরপূর্বক জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে।

আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে এটা তাদের পরিণাম।

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(وَأَمَّا الَّذِيْنَ فَسَقُوْا فَمَأْوٰهُمُ النَّارُ ط كُلَّمَآ أَرَادُوْآ أَنْ يَّخْرُجُوْا مِنْهَآ أُعِيْدُوْا فِيْهَا وَقِيْلَ لَهُمْ ذُوْقُوْا عَذَابَ النَّارِ الَّذِيْ كُنْتُمْ بِه۪ تُكَذِّبُوْنَ)‏

“আর যারা পাপ কাজ করেছে তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেথায় ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে, আগুনের স্বাদ গ্রহণ (শাস্তি ভোগ) কর যা তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে।” অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(اِنْطَلِقُوْٓا اِلٰی مَا کُنْتُمْ بِھ۪ تُکَذِّبُوْنَﭬاِنْطَلِقُوْٓا اِلٰی ظِلٍّ ذِیْ ثَلٰثِ شُعَبٍﭭ لَّا ظَلِیْلٍ وَّلَا یُغْنِیْ مِنَ اللَّھَبِﭮاِنَّھَا تَرْمِیْ بِشَرَرٍ کَالْقَصْرِﭯکَاَنَّھ۫ جِمٰلَتٌ صُفْرٌ) ‏

‘‘তোমরা চল তারই দিকে যাকে মিথ্যা মনে করতে। ==

চল সে ছায়ার দিকে যার তিনটি শাখা রয়েছে, যে ছায়া শীতল নয় এবং যা অগ্নিশিখা হতে রক্ষাও করে না, নিশ্চয়ই তা নিক্ষেপ করবে প্রাসাদতুল্য স্ফুলিঙ্গ। যা (দেখে মনে হবে) হলুদ বর্ণের উট।” (সূরা মুরসালাত ৭৭ :২৯-৩৩)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলা যে কোন মাখলুকের শপথ করতে পারেন, কিন্তু বান্দা কেবল আল্লাহ তা‘আলা নাম ছাড়া অন্য নামে শপথ করতে পারবে না।
২. মিথ্যুকদের জন্য কিয়ামতের দিন দুর্ভোগ।
৩. যেমন কর্ম তেমন ফল।
৪. কিয়ামতের পূর্বে আকাশ ও জমিনের কঠিন অবস্থা সম্পর্কে জানলাম।
১৭-২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

জাহান্নামীদের দুর্ভোগের আলোচনা করার পর এখানে জান্নাতীদের শান্তিময় জীবন-যাপনের কথা আলোচনা করা হয়েছে।

যারা ঈমানের সাথে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করত : তাঁর আদেশ পালন ও নিষেধ বর্জন করে ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক জীবন-যাপন করবে এবং এ ঈমানের ওপর অটল থেকে মৃত্যু বরণ করবে তারা মৃত্যুর পর নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। তারা সেখানে সকল প্রকার ভোগ্য সামগ্রী উপভোগ করবে, কোন প্রকার শাস্তির মুখোমুখি তাদের হতে হবে না।

مَصْفُوفَةٍ অর্থ সারিবদ্ধ, অর্থাৎ জান্নাতে সারিবদ্ধ খাট বিছানো থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা আনতনয়না হুরদের সাথে জান্নাতীগণকে বিবাহ দিয়ে দেবেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. তাক্বওয়ার ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল।
২. মুত্তাকীদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহের বর্ণনা পেলাম।
৩. ঈমান ও সৎ আমল জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম কারণ।
৪. জান্নাতীদের সুখময় জীবন সম্পর্কে জানা গেল।
২১-২৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যে-সকল ঈমানদার তাদের তাক্বওয়া ও সৎ আমলের মাধ্যমে জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদা লাভে ধন্য হবে, তাদের সন্তান-সন্তুতিরাও যদি বাপ-দাদার ঈমানের অনুসারী হয়ে সঠিক আমল করে তাহলে এসব সন্তানেরা বাপ-দাদার সাথে জান্নাতে থাকবে। যদিও সৎ আমলে পিতৃ পুরুষদের সমতুল্য না হয় কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের সৎ আমলকে বাড়িয়ে দেবেন যাতে সন্তানদেরকে দেখে পিতৃ পুরুষদের চক্ষু শীতল হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের সন্তানদেরকে জান্নাতে মু’মিনদের সমমর্যাদা দান করবেন যদিও আমলে তাদের সমপর্যায়ে না পৌঁছে। যাতে তাদের সন্তানদের দেখে চক্ষু শিতল হয়। তারপর এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ২৪৯০)

(وَمَا أَلَتْنَاهُمْ) অর্থাৎ আমি তাদের সৎ আমলের প্রতিদান কম করে দেব না।

رَهِينٌ -এর অর্থ مرهون অর্থাৎ আবদ্ধ। প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমলের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।

এতে মু’মিন ও কাফির সবাই শামিল। যে ভাল আমল করবে সে ভাল প্রতিদান পাবে আর যে খারাপ আমল করবে সে খারাপ প্রতিদান পাবে। অথবা এর দ্বারা শুধু কাফিররা উদ্দেশ্য।

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(کُلُّ نَفْسٍۭ بِمَا کَسَبَتْ رَھِیْنَةٌﭵاِلَّآ اَصْحٰبَ الْیَمِیْنِ)

“প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের কাছে দায়বদ্ধ, তবে দক্ষিণপার্শ্বস্থ ব্যক্তিরা (ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্তগণ) নয়।” (সূরা মুদ্দাস্সির ৭৪ :৩৮-৩৯)

অতঃপর জান্নাতীদের জন্য জান্নাতে যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে তার বিবরণ দেয়া হচ্ছে।

(وَأَمْدَدْنَاهُمْ)

অন্যত্র এ ফলমূল ও গোশত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَّفَاكِهَةٍ كَثِيْرَةٍ لا ‏ لَّا مَقْطُوْعَةٍ وَّلَا مَمْنُوْعَةٍ)ا ‏

“আর প্রচুর ফলমূল, যা শেষ হবে না ও যা নিষিদ্ধও হবে না।” (সূরা ওয়া-ক্বি‘আহ্ ৫৬ :৩২-৩৩)

সূরা আল ওয়াকিয়াহ্-তে এ সম্পর্কে আলোচনা আরো বিস্তারিত আসবে।
(لَا لَغْوٌ فِيهَا وَلَا تَأْثِيمٌ)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(يُطَافُ عَلَيْهِمْ بِكَأْسٍ مِّنْ مَّعِيْنٍملا‏ بَيْضَا۬ءَ لَذَّةٍ لِّلشّٰرِبِيْنَ ج ‏ لَا فِيْهَا غَوْلٌ وَّلَا هُمْ عَنْهَا يُنْزَفُوْنَ)‏

“তাদেরকে ঘুরে ফিরে পরিবেশন করা হবে বিশুদ্ধ সরাবে পূর্ণ পানপাত্র। তা শুভ্র উজ্জ্বল, পানকারীদের জন্য খুব সুস্বাদু। তাতে ক্ষতির উপাদানও থাকবে না এবং তাতে তারা মাতালও হবে না।” (সূরা সা-ফ্ফাত ৩৭ :৪৫-৪৭)

(كَأَنَّهُمْ لُؤْلُؤٌ مَكْنُونٌ) কিশোরদের দেখতে এত সুন্দর যেন তারা মুক্তার মতো।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(يَطُوْفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُوْنَ لابِأَكْوَابٍ وَّأَبَارِيْقَ لا وَكَأْسٍ مِّنْ مَّعِيْنٍ لا لَّا يُصَدَّعُوْنَ عَنْهَا وَلَا يُنْزِفُوْنَ)

“তাদের সেবায় ঘোরাফেরা করবে চির কিশোররা। পানপাত্র, ঘটি ও শরাবে পরিপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে, (এরা হাজির হবে। সেই সূরা পানে তাদের মাথা ব্যথা হবে না, তারা জ্ঞান হারাও হবে না।” (সূরা ওয়াকিআহ্ ৫৬ :১৭-১৯)

يَتَسَا۬ءَلُونَ অর্থাৎ আপোষে তারা পরস্পর দুনিয়ার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করবে।

(إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِي أَهْلِنَا)

অর্থ জান্নাতিরা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদে বলবে, আমরা দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলার আযাব সম্পর্কে শংকিত ছিলাম।

এজন্য আমরা শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য যতœবান ছিলাম। তাই আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে অনুগ্রহ করেছেন এবং শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন।

السَّمُومِ সামূম বলা হয় লু-হওয়া কে, যা ঝলসে দেয় এমন গরম হাওয়াকে বুঝায়।

نَدْعُوهُ অর্থাৎ আমরা একমাত্র তাঁর ‘ইবাদত করতাম তাঁর সাথে কাউকে শরীক করতাম না। জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য কেবল তাঁরই কাছে প্রার্থনা করতাম।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ঈমানদার পিতৃপুরুষ ও সন্তানাদির ফযীলত।
২. প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমলের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।
৩. দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তিকে ভয় করার ফযীলত।

১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৫২-তূর) : নামকরণ:

সূরার প্রথম শব্দ وَالطُّورِ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে।

(৫২-তূর) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

বিষয়বস্তুর আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে বুঝা যায়, মক্কী জীবনের যে যুগে সূরা আয যারিয়াত নাযিল হয়েছিল এ সূরাটিও সে যুগে নাযিল হয়েছিল। সূরাটি পড়তে গিয়ে একথা অবশ্যই মনে হয় যে, এটি নাযিল হওয়ার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, তবে তখনও চরম জুলুম-অত্যাচার শুরু হয়েছিল বলে মনে হয় না।

(৫২-তূর) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

এ সূরার প্রথম রূকু’র বিষয়বস্তু আখেরাত। সূরা যারিয়াতে এর সম্ভাবনা, অবশ্যম্ভাবিতা এবং সংঘটিত হওয়ার প্রমাণাদি পেশ করা হয়েছিল। সেজন্য এখানে তার পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। তবে আখেরাত প্রমাণাকারী কয়েকটি বাস্তব সত্য ও নির্দেশনের শপথ করে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, তা নিশ্চিতভাবেই সংঘটিত হবে এবং তার সংঘটন রোধ করতে পারে এ শক্তি করো নেই। এরপর বলা হয়েছে তা সংঘটিত হলে তার অস্বীকারকারীদের পরিণাম কি হবে এবং তা বিশ্বাস করে তাকওয়ার নীতি অবলম্বনকারীগণ আল্লাহ তা’আলার নিয়ামত দ্বারা কিভাবে পুরস্কৃত হবেন।

এরপর কুরাইশ নেতারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে যে নীতি অনুসরণ করে চলছিল দ্বিতীয় রুকূ’তে তার সমালোচনা করা হয়েছে। কখনো তারা নবীকে (সা.) গণক, কখনো পাগল, কখনো কবি বলে আখ্যায়িত করে সাধারণ মানুষকে তাঁর বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত করতো যাতে মানুষ তাঁর আনীত বাণীর প্রতি ধীর ও সুস্থ মস্তিষ্কে মনোযোগ না দেয়। নবীকে (সা.) তারা নিজেদের জন্য একটি মহা বিপদ বলে মনে করতো এবং প্রকাশ্যেই বলতো, তাঁর ওপর কোন বিপদ আপতিত হলে আমরা তাঁর হাত থেকে বেঁচে যেতাম। তারা তাঁর বিরুদ্ধে এ বলে অভিযোগ করতো যে, এ কুরআন তিনি নিজেই রচনা করছেন এবং আল্লাহর নামে পেশ করছেন। তাই তিনি যা করছেন তা ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা বার বার উপহাস করে বলতো নবুওয়াত দানের জন্য আল্লাহ তা’আলা এ ব্যক্তিকে ছাড়া আর মানুষ খুঁজে পাননি। তারা তাঁর ইসলামী আন্দোলন ও তা প্রচারের বিরুদ্ধে এতই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতো যে, তিনি যেন কিছু চাওয়ার জন্য তাদের পিছু লেগে রয়েছেন আর তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাঁর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা নিজেরা বসে বসে চিন্তা করতো, তাঁর বিরুদ্ধে কি চক্রান্ত করলে তাঁর এ আন্দোলন ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এসব করতে গিয়ে তারা কি ধরনের জাহেলী ও কুসংস্কারমূলক আকীদা-বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছে যার গভীর অন্ধকার থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পূর্ণ নিস্বার্থভাবে নিজের জীবনপাত করছেন সে সম্পর্কে কোন অনুভূতিই তাদের ছিল না। আল্লাহ তা’আলা তাদের এ আচরণের সমালোচনা করে পরপর কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন। এসব প্রশ্নের প্রতিটি হয় তাদের কোন অভিযোগের জবাব, নয়তো তাদের কোন মুর্খতা বা কুসংস্কারের সমালোচনা। এরপর বলা হয়েছে, ঐ লোকদেরকে আপনার নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাসী বানানোর জন্য কোন মু’জিযা দেখানো একেবারেই অর্থহীন। কারণ এরা এমন একগুঁয়ে যে, তাদেরকে যাই দেখানো হোক না কেন এরা তার অন্য কোন ব্যাখ্যা করে পাশ কাটিয়ে যাবে এবং ঈমান গ্রহণ করবে না।

এ রুকূ’র শুরুতেও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, এসব বিরোধী শক্তি ও শত্রুদের অভিযোগ ও সমালোচনার তোয়াক্কা না করে তিনি যেন নিজের আন্দোলন ও উপদেশ-নসীহতের কাজ ক্রমাগত চালিয়ে যেতে থাকেন। রুকূ’র শেষাংশে তাঁকে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, তিনি যেন অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে আল্লাহর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত এসব বিরোধিতার মোকাবিলা করতে থাকেন। এর সাথে সাথে তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে যে, তাঁর প্রভু তাঁকে শত্রুদের মোকাবিলায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে অসহায় ছেড়ে দেননি। বরং সবসময় তিনি তাঁর তদারক ও তত্বাবধান করছেন। তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময় না আসা পর্যন্ত আপনি সবকিছু বরদাশত করতে থাকুন এবং নিজ প্রভুর ‘হামদ ও তাসবীহ’ অর্থাৎ প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করে সেই শক্তি অর্জন করুন যা এরূপ পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাজ করার জন্য দরকার হয়।
# তূর শব্দের প্রকৃত অর্থ পাহাড়। আর الطُّور শব্দের অর্থ সেই বিশেষ পাহাড় যার ওপরে আল্লাহ‌ তা’আলা হযরত মূসাকে নবুওয়াত দানে সম্মানিত করেছিলেন।
#‌ প্রাচীনকালে যেসব গ্রন্থ ও লিখিত বস্তুকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হতো সেগুলোকে কাগজের পরিবর্তে হরিণের চামড়ায় লেখা হতো। বিশেষত এসব চামড়া লেখার জন্য পাতলা অথবা ঝিল্লির আকারে তৈরী করা হতো এবং পরিভাষায় একেই رق বলা হতো। আহলে কিতাবগণ সাধারণত এই رق এর ওপরেই তাওরাত, যাবুর, ইনযীল এবং নবীদের সহীফাসমূহ লিখে রাখতো যাতে তা দীর্ঘ দিনের জন্য সংরক্ষিত থাকতে পারে। এখানে খোলা গ্রন্থ অর্থ আহলে কিতাবের কাছে বর্তমান পবিত্র গ্রন্থসমূহের এ সমষ্টি। একে উন্মুক্ত কিতাব বলার কারণ হচ্ছে তা দুষ্প্রাপ্য ছিল না, বরং পাঠ করা হতো এবং তাতে কি লিপিবদ্ধ ছিল তা সহজেই অবহিত হওয়া যেতো।
# হযরত হাসান বাসরীর মতে ‘আবাদ ঘর’ অর্থ খানায়ে কা’বা যা কোন সময়ই হজ্জ, উমরা এবং তাওয়াফ ও যিয়ারতকারী থেকে শূন্য থাকে না। কিন্তু হযরত আলী, ইবনে আব্বাস, ইকরিমা, মুজাহিদ, কাতাদা, দাহ্হাক, ইবনে যায়েদ ও অন্য সব মুফাসসিরদের মতে এর অর্থ বায়তুল মা’মূর যার উল্লেখ মি’রাজের প্রসঙ্গে নবী ﷺ করেছিলেন এবং যার দেয়াল গাত্রে তিনি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লামকে হেলান দিয়ে থাকতে দেখেছিলেন। মুজাহিদ, কাতাদা ও ইবনে যায়েদ বলেন, পৃথিবীবাসীদের জন্য খানায়ে কা’বা যেমন আল্লাহ পরস্তদের কেন্দ্র তেমনি প্রত্যেক আসমানে তার বাসিন্দাদের জন্য একটি করে কা’বা আছে যা আল্লাহর ইবাদতকারীদের জন্য অনুরূপ কেন্দ্রের মর্যাদা রাখে। মি’রাজের সময় নবী ﷺ ঐ সব কা’বার একটি দেয়ালে হযরত ইবরাহীমকে হেলান দিয়ে থাকতে দেখেছিলেন। এর সাথে হযরত ইবরাহীমের সম্পর্ক থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। কারণ তিনিই ছিলেন পৃথিবীর কা’বার প্রতিষ্ঠাতা। এ ব্যাখ্যাটি সামনে রেখে বিবেচনা করলে তা হযরত হাসান বাসরীর ব্যাখ্যার পরিপন্থী হবে না। বরং দু’টি ব্যাখ্যা মিলিয়ে আমরা এভাবে বুঝতে পারি যে, এখানে কেবল পৃথিবীর কা’বার শপথ করা হয়নি বরং বিশ্ব-জাহানে বর্তমান সমস্ত কা’বার শপথ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে।
# উঁচু ছাদ অর্থ আসমান, যা পৃথিবীকে একটি গম্বুজের মত আচ্ছাদিত করে আছে বলে মনে হয়। এখানে এ শব্দটি গোটা ঊর্ধ্বজগতকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ক্বাফ, টীকা ৭)।
# মূল আয়াতে الْبَحْرِ الْمَسْجُورِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। কোন কোন মুফাস্সির একে ‘আগুনে ভর্তি’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ একে শূন্য ও খালি অর্থে গ্রহণ করেন যার পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ একে আবদ্ধ বা আটকিয়ে রাখা অর্থে গ্রহণ করেন। তাদের মতে এর অর্থ হচ্ছে, সমুদ্রকে আটিকিয়ে বা থামিয়ে রাখা হয়েছে যাতে তার পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হারিয়ে না যায় এবং স্থলভাগকে প্লাবিত করে না ফেলে এবং পৃথীবীর সব অধিবাসী তাতে ডুবে না মরে। কেউ কেউ একে মিশ্রিত অর্থে গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ এর মধ্যে মিঠা ও লবনাক্ত পানি এবং গরম ও ঠাণ্ডা সব রকম পানি এসে মিশ্রিত হয়। আর কেউ কেউ একে কানায় কানায় ভরা ও তরংগ বিক্ষুব্ধ অর্থে গ্রহণ করেন। এসব অর্থের মধ্যে প্রথম দু’টি অর্থের পরিবেশ ও অবস্থার সাথে কোন মিল নেই। সমুদ্রের এ দু’টি অবস্থা, অর্থাৎ এর তলদেশ ফেটে সমস্ত পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তা আগুনে পূর্ণ হয়ে যাবে—কিয়ামতের সময় প্রকাশ পাবে। যা সূরা তাকভীরের ৬ আয়াত এবং সূরা ইনফিতারের ৩ আয়াতেও বর্ণিত হয়েছে। এ অবস্থা এখন বর্তমান নেই, ভবিষ্যতে সংঘঠিত হবে। তাই এ ঘটনার শপথ করে বর্তমান কালের লোকজনকে আখেরাত সংঘটিত হওয়ার কথা কি করে বিশ্বাস করানো যেতে পারে? তাই এ দু’টি অর্থ বাতিল করে الْبَحْرِ الْمَسْجُورِ অর্থ আবদ্ধ, মিশ্রিত, পূর্ণ ও তরংগ বিক্ষুদ্ধ অর্থে গ্রহণ করা যেতে পারে।
# এটি সেই মহাসত্য যার জন্য এ পাঁচটি জিনিসের শপথ করা হয়েছে। রবের শাস্তি অর্থে আখেরাত। যেহেতু এখানে আখেরাত বিশ্বাসকারীদের সম্বোধন না করে আখেরাত অবিশ্বাসকারীদের সম্বোধন করা হয়েছে আর তাদের জন্য আখেরাত আসার অর্থই হচ্ছে আযাব আসা তাই তাকে কিয়ামত, আখেরাত কিংবা প্রতিফল দিবস বলার পরিবর্তে “রবের আযাব” বলা হয়েছে। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার কথা বলে যে পাঁচটি জিনিসের শপথ করা হয়েছে তা কিভাবে কিয়ামতের সংঘটিত হওয়া প্রতিপাদন করে এখন একটু গভীরভাবে তা ভেবে দেখুন। তূর এমন একটি জায়গা যেখানে একটি অবদমিত ও নিষ্পেষিত জাতির উত্থান ঘটানো এবং একটি বিজয়ী ও জালেম জাতির পতন ঘটানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আর এ সিদ্ধান্ত প্রাকৃতিক বিধানের (Physical law) ভিত্তিতে ছিল না বরং নৈতিক বিধান (Moral law) ও প্রতিফল বিধানের ভিত্তিতে ছিল। তাই আখেরাতের পক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে তূরকে একটি উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের মত একটি অসহায় জাতির উত্থান ঘটানো এবং ফেরাউনের মত এক জবরদস্ত শাসককে সেনাবাহিনীসহ ডুবিয়ে দেয়া—যার ফায়সালা এক নিঝুম রাতে তূর পর্বতে গৃহীত হয়েছিল—এ ব্যাপারে মানবেতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত যে বিশ্ব-জাহানের বিশাল সাম্রাজ্যের স্বভাবসুলভ দাবী এই যে, মানুষের মত একটি বুদ্ধিমান ও স্বাধীন সৃষ্টির নৈতিক জবাবদিহি ও কর্মফল বিধানের আওতায় থাকা উচিত। আর এ দাবীর পূর্ণতা সাধনের জন্যই এমন একটি হিসেবের দিন আবশ্যক যেদিন গোটা মানবজাতিকে একত্রিত করে তার হিসেব নেয়া হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা যারিয়াত টীকা, ২১ )।

পবিত্র আসমানী গ্রন্থসমূহের শপথ করার কারণ হচ্ছে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় যত নবী-রসূল এসেছেন এবং তাঁরা যেসব কিতাব এনেছেন, প্রতি যুগে তাঁরা সেই একটি মাত্র খবরই দিয়েছেন, যা আজ মুহাম্মাদ ﷺ দিচ্ছেন। অর্থাৎ পূর্বের ও পরের সমস্ত মানুষকে জীবিত হয়ে একদিন আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে এবং নিজের কৃতকর্ম অনুসারে পুরস্কার বা শাস্তি পেতে হবে। এমন কোন আসমানী কিতাব কখনো আসেনি যাতে এ খবর দেয়া হয়নি। কিংবা উল্টা মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ দুনিয়ার জীবনই জীবন। মৃত্যুর পরে তো মানুষ মাটিতে পরিণত হবে। সুতরাং এ জীবনের পরে কোন হিসেব-নিকেশর বালাই নেই।

বায়তুল মা’মূরের শপথ করার কারণ হলো, সে যুগে বিশেষভাবে আরবের লোকদের জন্য কা’বা ঘরের ইমারত এমন একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যা আল্লাহর নবী-রসূলদের সত্যবাদিতার স্পষ্ট প্রমাণ পেশ করছিল এবং মহান আল্লাহর পরিপূর্ণ হিকমত এবং চরম শক্তিমত্তা যে তাদের পৃষ্ঠপোষক সে সাক্ষ্যও পেশ করেছিল। এসব আয়াত নাযিলের আড়াই হাজার বছর পূর্বে উষর ও জনবসতিহীন পাহাড়সমূহের মধ্যে কোন লোক-লস্কর ও সাজ-সরঞ্জাম ছাড়াই এক ব্যক্তি আসেন এবং তাঁর স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে সম্পূর্ণ অসহায়ভাবে রেখে চলে যান। কিছুদিন পর সে ব্যক্তি পুনরায় সেখানে আসেন। এই জনহীন স্থানটিতে আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেন এবং লোকজনের প্রতি এ বলে আহবান জানান, হে লোকজন, এখানে আস এবং এ ঘরে হজ্জ আদায় করো। এ নির্মাণ কাজ ও আহবান এমন বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, ঐ ঘরটিই সমগ্র আরববাসীর কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ আহবানে সাড়া দিয়ে মানুষ আরবের প্রত্যেক প্রান্ত থেকে লাব্বায়কা লাব্বায়কা বলে ছুটে আসে। আড়াই হাজার বছর পর্যন্ত এ ঘর এমন শান্তির আস্তানা হয়ে থাকে যে, এর চারদিকে গোটা দেশময় খুনখারাবি চলতে থাকলেও এ ঘরের সীমানায় এসে কারো গায়ে হাত তোলার দুঃসাহস কারো হয়না। তাছাড়া এ ঘরের কল্যাণেই আবর ভূমি প্রতি বছর চার মাসের জন্য এমন নিরাপত্তা লাভ করে যে, কাফেলাসমূহ তখন নিঃশঙ্কচিত্তে ভ্রমণ করে, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমে ওঠে এবং ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বাজার বসতে থাকে। তাছাড়া এ ঘরের এমন প্রভাব বজায় থাকে যে, পুরো এ সময়কালে অতি বড় কোন জালেমও সেদিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। আর যে এরূপ দুঃসাহস করেছে সে আল্লাহর এমন গযবের শিকার হয়েছে যে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। এসব আয়াত নাযিল হওয়ার মাত্র ৪৫ বছর পূর্বে লোকজন এ রকম একটি মজার ঘটনা নিজ চোখে দেখেছিল এবং তা দর্শনকারী বহু লোক সে সময় মক্কায় জীবিতও ছিল। এমন পরিস্থিতিতেই এ আয়াতগুলো তাদের শোনানো হচ্ছিলো। আল্লাহর নবী যে ফাঁকা বুলি আওড়ান না এর চেয়ে তার বড় প্রমাণ আর কি হতে পারতো? আল্লাহর নবীদের চোখ এমন কিছু দেখতে পান যা অন্যদের দৃষ্টিগোচর হয় না, তাদের মুখ থেকে এমন সব মহাসত্য বেরিয়ে আসে সাধারণ মানুষের বিবেক-বুদ্ধি যার ধারে কাছেও যেতে পারে না। তারা বাহ্যত এমন অনেক কাজ করেন যা দেখে এক যুগের লোক পাগলামী মনে করে বসে। কিন্তু তা দেখেই শত শত বছরের পরের লোকজন তাদের দূরদৃষ্টিতে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে। এ ধরনের মহান ব্যক্তিগণ সর্বসম্মতভাবে প্রতি যুগেই যখন এ খবর দেন যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং এক ‘হাশর নাশর’ অনুষ্ঠিত হবে, তখন তাকে পাগলের প্রলাপ মনে করাটাই পাগলামি।

সুউচ্চ ছাদ (আসমানী) এবং তরঙ্গবিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের শপথ করার কারণ হলো, এ দু’টি জিনিস আল্লাহর হিকমত এবং ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করে। তাছাড়া এ হিকমত ও ক্ষমতা দ্বারাই আখেরাতের সম্ভাব্যতা, অনিবার্যতা ও সংঘটিত হওয়া প্রমাণিত হয়। আসমান কিভাবে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে সে সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে সূরা ক্বাফের ব্যাখ্যায় ৭নং টীকায় আলোচনা করেছি। বাকী থাকে শুধু সমুদ্রের বিষয়টি। তবে যে ব্যক্তি মুক্ত মনে ও অস্বীকার করার আগাম হঠকারী সিদ্ধান্ত ছাড়া সমুদ্র সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে, তার মন সাক্ষ্য দিতে বাধ্য যে, পৃথিবীর বুকে পানির এত বড় ভাণ্ডারের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়াটাই এমন এক কারিগরী যা কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল হতে পারে না। তাছাড়া এর সাথে এত বেশী যৌক্তিক বিষয় তত্ত্ব সংশ্লিষ্ট আছে যে, আকস্মিকভাবে এরূপ জ্ঞানগর্ভ ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা চালু হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সমুদ্রে অসংখ্য জীবজন্তু সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এর প্রত্যেকটি প্রজাতিকে সমুদ্রের যে গভীরতায় বসবাসের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তার দৈহিক ব্যবস্থাপনাও সেই গভীরতার উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুদ্রের মধ্যে প্রতিদান কোটি কোটি জীবজন্তুর মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। এসব জীবজন্তুর দেহ যাতে পচে গলে না যায় সেজন্য এর পানি লবণাক্ত বানানো হয়েছে। সমুদ্রের পানি একটি নির্দিষ্ট সীমায় থামিয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর ফাটলের মধ্যে প্রবেশ করে তা তার অভ্যন্তরে নেমে যায় না কিংবা স্থলভাগে উঠে তা প্লাবিত করে দেয় না। লাখ লাখ ও কোটি কোটি বছর ধরে তা এ সীমার মধ্যেই থেমে আছে। পানির এ বিশাল ভাণ্ডার বহাল থাকার কারণেই পৃথিবীর স্থলভাগে বৃষ্টির ব্যবস্থা হয়। সূর্যের তাপ এবং বায়ু প্রবাহ সম্পূর্ণ নিয়মিতভাবে এ ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। প্রাণীশূন্য না হওয়ার এবং এর মধ্যে নানা রকমের জীবজন্তু সৃষ্টি হওয়ার সুফল হয়েছে এই যে, মানুষ সমুদ্র থেকে ব্যাপক পরিমাণে তার খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় বহু জিনিস লাভ করেছে। একটি নির্দিষ্ট সীমায় থেমে থাকার কারণে মহাদেশে ও দ্বীপগুলো টিকে আছে, যেখানে মানুষ বাস করছে। তা কতকগুলো অলংঘনীয় নিয়ম মেনে চলার কারণে সেখানে মানুষের জাহাজ চালানো সম্ভব হয়েছে। মহাজ্ঞানী ও মহাক্ষমতাধরের ক্ষমতা ছাড়া এ সুব্যবস্থাপনার কল্পনাও করা যেতে পারে না এবং এ ধারণাও পোষণ করা যায় না যে, মানুষ এবং পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টির কল্যাণের সাথে সম্পৃক্ত সমুদ্রের এ সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার যে সম্পর্ক তা আকস্মিক ও এলোপাতাড়িভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এটা যদি এ বিষয়ের অনস্বীকার্য প্রমাণ হয় যে, এক মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর আল্লাহ পৃথিবীর বুকে মানুষকে আবাদ করার জন্য আরো অসংখ্য ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে বিশাল এ লবণাক্ত সমুদ্র সৃষ্টি করেছেন তাহলে সে ব্যক্তি হবে চরম আহামক, যে মহাজ্ঞানী সেই আল্লাহ থেকে এমন মূর্খতা প্রত্যাশা করে যে, তিনি এ সমুদ্র থেকে মানুষের শস্য ক্ষেতসমূহ সিক্ত করে তার মাধ্যমে মানুষকে রিযিক দানের ব্যবস্থা করে দিবেন কিন্তু কখনো তাকে জিজ্ঞেস করবেন না যে, তুমি আমার রিযিক খেয়ে কিভাবে তার হক আদায় করেছো? তাছাড়া তিনি এ সমুদ্রের বুকে মানুষকে জাহাজ চালানোর ক্ষমতা দিবেন কিন্তু একথা কখনো জিজ্ঞেস করবেন না যে, তুমি ন্যায় ও সত্যের আনুগত্য করে জাহাজ চালিয়েছো না তার সাহায্যে সারা বিশ্বে ডাকাতি করে বেড়িয়েছো? অনুরূপভাবে যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতার একটি নগণ্য বিস্ময়কর নমুনা এ বিশাল সমুদ্রের সৃষ্টি, যিনি মহাশূন্যে আবর্তনকারী ঝুলন্ত এ গ্রহ পৃষ্ঠে পানির এত বড় ভাণ্ডার ধরে রেখেছেন, যিনি তার মধ্যে এমন বিশাল পরিমাণ লবণ গুলিয়ে দিয়েছেন, যিনি এর মধ্যে নানা রকমের অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন এবং এর মধ্য থেকেই তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন, যিনি প্রতি বছর সেখান থেকে শত শত কোটি টন পানি উঠিয়ে বাতাসের কাঁধে তুলে নিয়ে যান এবং কোটি কোটি বর্গমাইল ব্যাপী শুষ্ক অঞ্চলে নিয়মিতভাবে বর্ষণ করে চলেছেন তাঁর সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করাও চরম মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয় যে, তিনি মানুষকে একবার সৃষ্টির করার পর এমন অক্ষম হয়ে যান যে, পুনরায় তাকে সৃষ্টি করতে চাইলেও করতে পারেন না।

# মূল আয়াতাংশ হলো تَمُورُ السَّمَاءُ مَوْرًا । আরবী ভাষায় مور আবর্তিত হওয়া, কেঁপে কেঁপে ওঠা, ঘুরপাক খাওয়া এবং বারবার সামনে ও পেছনে চলা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। কিয়ামতের দিন আসমানের যে অবস্থা হবে একথাটির মাধ্যমে তা বর্ণনা করে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, সেদিন ঊর্ধ্বজগতের সমস্ত ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কেউ যদি সেদিন আকাশের দিকে তাকায় তবে দেখবে যে, সেই সুশোভিত নকশা বিকৃত হয়ে গিয়েছে যা সবসময় একই রকম দেখা যেতো আর চারদিকে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে।

# অন্য কথায় ভূপৃষ্ঠের আকর্ষণ ও বন্ধন পাহাড়াকে আটকে রেখেছিল তা শিথিল হয়ে যাবে এবং তা সমূলে উৎপাটিত হয়ে এমনভাবে শূন্যে উড়তে থাকবে যেন মেঘমালা ভেসে বেড়াচ্ছে।
# তারা নবীর কাছে কিয়ামত, আখেরাত, জান্নাত ও দোযখের কথা শুনে সেগুলোকে হাসির খোরাক বানাচ্ছে এবং এ বিষয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে গভীরভাবে চিন্তা করার পরিবর্তে কেবল বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করছে। আখেরাত নিয়ে তাদের বিতর্কের উদ্দেশ্য এর তাৎপর্য বুঝার প্রচেষ্টা নয়, বরং তা একটা খেলা যা দিয়ে তারা মনোরঞ্জন করে থাকে। কিন্তু এটা তাদের কোন্ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে আদৌ কোন উপলব্ধি নেই।
# দুনিয়াতে রসূল যখন তোমাদেরকে এ জাহান্নামের আযাব সম্পর্কে সাবধান করতেন তখন তোমরা বলতে, এটা কেবল কথার যাদুগিরি। আমাদেরকে এভাবে বোকা বানানো হচ্ছে। এখন বলো, তোমাদের সামনে বিদ্যমান এ জাহান্নাম কি সেই যাদুর খেলা, নাকি এখনো বুঝে উঠতে পারনি, যে জাহান্নামর খবর তোমাদের দেয়া হতো তোমরা সে জাহান্নামের মুখোমুখি হয়েছো?

# যারা নবী-রসূলদের দেয়া খবরের ওপর ঈমান এনে দুনিয়ায় থাকতেই নিজেদের বাঁচানোর ব্যবস্থা করেছে এবং যেসব ধ্যান-ধারণা ও কাজ-কর্মের কারণে মানুষ জাহান্নামের উপযুক্ত হয় তা থেকে দূরে অবস্থান করেছে।
# কোন ব্যক্তির জান্নাতে প্রবেশের কথা বলার পর তাকে দোযখ থেকে বাঁচিয়ে নেয়ার কথা বলার বাহ্যত কোন প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু কুরআন মজীদের কয়েকটি জায়গায় এ দু’টি কথা আলাদা করে বলার কারণ হলো, কোন ব্যক্তির দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা পেয়ে যাওয়াটিই একটা বিরাট নিয়ামত। “আল্লাহ তাকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করেছেন” এ বাণীটি মূলত একটা মহাসত্যের প্রতি ইঙ্গিত। মহাসত্যটি হলো, কোন ব্যক্তির দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা পেয়ে যাওয়া কেবল আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানীতে সম্ভব। অন্যথায় মানবিক দূর্বলতা প্রত্যেক ব্যক্তির আমলে এমন সব অপূর্ণতার সৃষ্টি করে যে, আল্লাহ তা’আলা যদি তাঁর মহানুভবতা দিয়ে তা উপেক্ষা না করেন এবং মুহাসাবা বা হিসেব-নিকেশ নিতে শুরু করেন তাহলে কেউ-ই পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারে না। তাই জান্নাতে প্রবেশাধিকার পাওয়া আল্লাহর যত বড় নিয়ামত, দোযখ থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করে নেয়া তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
# এখানে “মজা করে” কথাটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থ বহন করে। মানুষ জান্নাতে যা লাভ করবে কোন প্রকার কষ্ট বা পরিশ্রম ছাড়াই তা লাভ করবে। তা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া বা ঘাটতি পড়ার আদৌ কোন সম্ভাবনা সেখানে থাকবে না। সেজন্য মানুষকে কোন খরচও করতে হবে না। তা হুবহু তার আকাঙ্ক্ষা ও মনের পছন্দ মত হবে। যত চাইবে এবং যখনই চাইবে সামনে এনে হাজির করা হবে। সেখানে সে মেহমান হিসেবে অবস্থান করবেন না যে, কিছু চাইতে লজ্জাবোধ করবে। সে যা কিছু লাভ করবে তা তার অতীত কাজের প্রতিদান হিসেবে এবং নিজের বিগত দিনের উপার্জনের ফল হিসেবে লাভ করবে। ঐ সব বস্তু পানাহারের কারণে কোন রকম রোগের আশঙ্কা থাকবে না। ক্ষুধা নিবারণ এবং জীবন ধারণের জন্য ঐ সব নিয়ামত হবে না বরং শুধু স্বাদ ও আনন্দ লাভের জন্য হবে। ব্যক্তি তা থেকে যত মজা ও স্বাদ লাভ করতে চাইবে ততই করতে পারবে; তাতে কোন প্রকার বদহজম হবে না। তাছাড়া ঐ সব খাদ্য কোন প্রকার নোংরা বর্জ্য সৃষ্টি করবে না। সুতরাং পৃথিবীতে মজা করে পানাহার করা যে অর্থ বহন করে জান্নাতে মজা করে পানাহার করা তা থেকে অনেক বেশী ব্যাপক উন্নত অর্থ বহন করে।
# এ বিষয়টি ইতিপূর্বে সূরা রা’দের ২৩ আয়াত এবং সূরা মু’মিনের ৮ আয়াতেও উল্লেখিত হয়েছে। তবে এখানে পূর্বে দু’টি জায়গায় উল্লেখিত সুখবরের চেয়ে অতিরিক্ত একটি বড় সুখবর শোনানো হয়েছে। সূরা রা’দের আয়াতে শুধু এতটুকু বলা হয়েছিল যে, জান্নাতবাসীদের পিতা-মাতা-সন্তান-সন্তুতি এবং স্ত্রীদের মধ্যে যেসব ব্যক্তি নেককার তারা সবাই তার সাথে জান্নাতে যাবে। আর সূরা মু’মিনে বলা হয়েছে যে, ফেরেশতারা ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর কাছে এ বলে দোয়া করে যে, তাদের সন্তান, স্ত্রী এবং বাপ-দাদার মধ্যে যারা নেককার তাদেরকেও জান্নাতে তাদের সাথে একত্রিত করে দাও। ঐ দু’টি আয়াতের বক্তব্যের চেয়ে অধিক যে কথাটি বলা হয়েছে, তা হচ্ছে সন্তান যদি কোন না কোন পর্যায়ের ঈমানসহ তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাহলে সেক্ষেত্রে সর্বোত্তম ঈমান ও আমলের কারণে তার পিতা যে মর্যাদা লাভ করেছে, আমলের দিক দিয়ে ঐ মর্যাদার উপযুক্ত না হলেও সন্তানদেরকে পিতার সাথে একত্রিত করা হবে। এই একত্র হওয়া মাঝে মাঝে গিয়ে সাক্ষাত করার মত হবে না। এজন্য اَلْحَقْنَا بِهِمْ কথা ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ হলো জান্নাতে তাদেরকে পিতা-মাতার সাথেই রাখা হবে। এছাড়া আরো সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে যে, সন্তানদের সাথে একত্রিত করার জন্য পিতা-মাতাদের হ্রাস করে পদাবনিত করা হবে না। বরং পিতা-মাতাদের সাথে একত্রিত করার জন্য সন্তানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরে উঠানো হবে।

এখানে একথাটিও বুঝে নিতে হবে, যে নিজ ইচ্ছায় ও সংকল্পে ঈমান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং নেককার মুরুব্বীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে এ বাণী তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু কোন ঈমানদার ব্যক্তির সন্তান যদি ভাল মন্দ উপলব্ধি করার মত বয়সে উপনীত হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে তবে তাদের ব্যাপারে কুফরী ও ঈমান এবং আনুগত্য ও অবাধ্যতার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাদের তো এমনিতেই জান্নাতে যাওয়ার কথা এবং তাদের পিতা-মাতার চোখ জুড়ানোর জন্য তাদের সাথে একত্রে রাখার কথা।
# এখানে “জিম্মী” বা “বন্ধক” শব্দটি রূপক ব্যবহার অত্যন্ত অর্থবহ। কোন ব্যক্তি যদি কাউকে কিছু ঋণ দেয় এবং ঋণদাতা তার পাওনা আদায়ের নিশ্চয়তা হিসেবে ঋণ গ্রহীতার কোন জিনিস নিজের কাছে বন্ধক রাখে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ঋণ পরিশোধ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বন্ধকী বস্তু মুক্ত হবে না। তাছাড়া নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি বন্ধকী বস্তু মুক্ত না করে তাহলে বন্ধকী বস্তুটি বাজেয়াপ্ত বা হাতছাড়া হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলাও মানুষের মধ্যকার লেনদেনের বিষয়টিকে এখানে বন্ধকী লেনদেনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে যে সাজ-সরঞ্জাম, যেসব শক্তি, যেসব যোগ্যতা এবং যেসব ইখতিয়ার দিয়েছেন তা যেন মালিক তার বান্দাকে ঋণ দিয়েছেন। এ ঋণের জামানত হিসেবে বান্দা নিজেই আল্লাহর কাছে বন্ধক বা জিম্মী হয়ে রয়েছে। বান্দা যদি এসব সাজ-সরঞ্জাম, শক্তি এবং ইখতিয়ার সঠিক ভাবে ব্যবহার করে নেকী অর্জন করে— যে নেকী দ্বারা এসব ঋণ পরিশোধ হবে, তাহলে সে বন্ধকী মাল অর্থাৎ নিজেকে মুক্ত করে নেবে। অন্যথায় তা বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হবে। পূর্ববর্তী আয়াতের পরপরই একথা বলার কারণ হচ্ছে, সৎকর্মশীল ঈমানদারগণ যত বড় মর্যাদা সম্পন্নই হোক না কেন তাদের সন্তানরা নিজেদের কর্ম দ্বারা নিজেদের সত্তাকে মুক্ত না করলে তাদের বন্ধক মুক্তি হতে পারে না। বাপ-দাদার কর্ম সন্তানদের মুক্ত করতে পারে না। তবে সন্তানরা যদি যে কোন মাত্রার ঈমান ও সৎকর্মশীলদের আনুগত্য দ্বারা নিজেরা নিজেদের মুক্ত করতে পারে তাহলে আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে তাদেরকে নিম্ন মর্যাদা থেকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে বাপ-দাদার সাথে একত্রিত করে দেবেন। এটা নিছক আল্লাহ তা’আলার মেহেরবানী ও দয়া। সন্তানরা বাপ-দাদার সৎকাজের এ সুফলটুকু অন্তত লাভ করতে পারে। তবে তারা যদি নিজেদের কর্মদ্বারা নিজেরাই নিজেদেরকে দোযখের উপযোগী বানায় তাহলে এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, বাপ-দাদার কারণে তাদেরকে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। সাথে সাথে এ আয়াত থেকে একথাও বুঝা যায় যে, নিম্ন মর্যাদার নেক সন্তানদের নিয়ে উচ্চ মর্যাদার নেক পিতা-মাতার সাথে একত্রিত করে দেয়া প্রকৃতপক্ষে সেসব সন্তানের কর্মের ফল নয়, বরং তা ঐসব পিতা-মাতার কর্মের ফল। তারা নিজেদের আমল দ্বারা এ মর্যাদা লাভের উপযুক্ত হবে। তাই তাদের মন খুশী করার জন্য সন্তানদেরকেও তাদের সাথে একত্রিত করা হবে। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা মর্যাদা হ্রাস করে তাদেরকে তাদের সন্তানদের কাছে নিয়ে যাবেন না। বরং সন্তানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাদের কাছে নিয়ে যাবেন; যাতে নিজ সন্তানদের থেকে দূরে অবস্থানের কারণে মনকষ্ট না হয় এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিয়াতমসমূহ পূর্ণ করে দেয়ার ক্ষেত্রে এ কমতিটুকু না থেকে যায়।
# এ আয়াতটিতে জান্নাতবাসীদেরকে সব রকমের গোশত সরবরাহ করার কথা উল্লেখ আছে। আর সূরা ওয়াকিয়ার ২১ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদেরকে পাখীর গোশত দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে। এ গোশত কি প্রকৃতির হবে তা আমরা সঠিক জানি না। কিন্তু কুরআনের কোন কোন আয়াতে এবং কোন কোন হাদীসে জান্নাতের দুধ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তা জীব-জন্তুর পালন থেকে নির্গত হবে না। জান্নাতের মধু সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তা মৌমাছির মধু হবে না। আর জান্নাতের শরাব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তা ফল পচিয়ে তার নির্যাসে তৈরী হবে না। আল্লাহর কুদরতে এগুলো ঝর্ণাসমূহ থেকে নির্গত হবে এবং নদীতে প্রবাহিত হবে। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, জান্নাতের গোশতও জবাইকৃত জীব-জন্তুর গোশত হবে না, বরং কুদরতি পন্থায় তৈরী হবে। যে আল্লাহ মাটির উপাদানসমূহ থেকে সরাসরি দুধ, মধু ও শরাব তৈরী করতে সক্ষম, তিনি এসব উপাদান দিয়েই জীব-জন্তুর গোশতের চেয়েও অধিক সুস্বাদু গোশত তৈরী করে দিতে পারেন। এটা তাঁর ক্ষমতার অসাধ্য নয়। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাফ্ফাত টীকা ২৫ ; সূরা মুহাম্মাদ, টীকা ২১ , ২২ , ২৩ )।
# সেই শরাব নেশা সৃষ্টিকারী হবে না। তাই তা পান করে কেউ মাতাল হয়ে বেহুদা ও আবোলতাবোল বকবে না, গালি-গালাজ করবে না, চড় থাপ্পড় দেবে না। কিংবা দুনিয়ার শরাব পানকারীদের মত অশ্লীল ও অশালীন আচরণ করবে না। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাফ্ফাত, টীকা ২৭ )।

# এ সূক্ষ্ম বিষয়টি বিশেষ লক্ষণীয় যে, غِلْمَانُهُمْ বলা হয়নি, বরং غِلْمَانٌ لَهُمْ বলা হয়েছে। যদি غِلْمَانُهُمْ বলা হতো তাহলে তা থেকে এ ধারণা করা যেতে পারতো যে, দুনিয়ায় যারা তাদের খাদেম ছিল জান্নাতেও তাদেরকেই তাদের খাদেম বানিয়ে দেয়া হবে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে দুনিয়ার যে ব্যক্তিই জান্নাতে যাবে সে তার উপযুক্ত পাত্র হিসেবেই যাবে এবং দুনিয়ায় সে যে প্রভুর খেদমত করতো বেহেশতেও তাকে সেই প্রভুর খাদেম বানিয়ে দেয়া হবে তার কোন কারণ নেই। বরং এমনও হতে পারে যে, কোন খাদেম তার নেক আমলের কারণে জান্নাতে প্রভুর চেয়েও উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। সুতরাং غِلْمَانٌ لَهُمْ বলে এ ধারণা পোষণের কোন অবকাশই রাখা হয়নি। এ শব্দটি এ বিষয়টি পরিষ্কার করে দেয় যে, এরা হবে সেই সব বালক যাদেরকে জান্নাতে তাদের খেদমতের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাফ্ফাত, টীকা ২৬) ।

# আমরা সেখানে বিলাসিতায় ডুবে এবং আপন ভূবনে মগ্ন থেকে গাফলতির জীবন যাপন করিনি। সেখানে সবসময়ই আমাদের আশঙ্কা থাকতো যে, কখন যেন আমাদের দ্বারা এমন কোন কাজ হয়ে যায়, যে কারণে আল্লাহ আমাদের পাকড়াও করবেন। এখানে বিশেষ করে নিজের পরিবারের লোকদের মধ্যে ভয়ে ভয়ে জীবন যাপন করার উল্লেখ করার কারণ এই যে, মানুষ বেশীর ভাগ যেজন্য গোনাহে লিপ্ত হয় তা হচ্ছে তার সন্তান-সন্তুতির আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করা এবং তাদের দুনিয়া নির্মাণের চিন্তা। এজন্য সে হারাম উপার্জন করে, অন্যদের অধিকার লুণ্ঠন করে এবং নানা রকম অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। এ কারণে জান্নাতের বাসিন্দারা পরস্পর বলবে বিশেষভাবে যে জিনিসটি আমাদেরকে মন্দ পরিণাম থেকে রক্ষা করেছে তা হচ্ছে, নিজের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে জীবন যাপন করতে গিয়ে তাদের আরাম-আয়েশে রাখার এবং তাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার ততটা চিন্তা ছিল না যতটি চিন্তা ছিল এ ব্যাপারে যে, তাদের জন্য আমরা যেন এমন পন্থা অবলম্বন করে না বসি, যার দ্বারা আমাদের আখেরাত বরবাদ হয়ে যাবে, আর নিজের সন্তানদেরকেও আমরা এমন পথে নিয়ে যাবো যা তাদেরকে আল্লাহর আযাবের উপযোগী বানিয়ে দেবে।

# মূল আয়াত سَّمُومِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ চরম উষ্ণ হওয়া। অর্থাৎ দোযখ থেকে উত্থিত উত্তপ্ত হওয়ার ঝাপটা।

Leave a Reply