بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৪১) [*‌‌রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওয়াহী ছাড়া দীনী বিষয়ে কোন কথা বলেননি। :- *রাসূল(স.) জিবরাইলকে নিজের চোখে দেখেছেন : -] www.motaher21.net সূরা:৫৩:আন-নাজম। পারা:২৭ ১-১৮ নং আয়াত:- ১-১৮ আয়াতের ব্যাখ্যা:- তাফসীর : ১) তাফহীমুল কুরআন:- ২) ফী জিলালিল কুরআন:

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪১)
[*‌‌রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওয়াহী ছাড়া দীনী বিষয়ে কোন কথা বলেননি। :-
*রাসূল(স.) জিবরাইলকে নিজের চোখে দেখেছেন : -]
www.motaher21.net
সূরা:৫৩:আন-নাজম।
পারা:২৭
১-১৮ নং আয়াত:-
১-১৮ আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীর :
১) তাফহীমুল কুরআন:-
২) ফী জিলালিল কুরআন:

সূরা:৫৩:আন-নাজম-১
وَ النَّجۡمِ اِذَا ہَوٰی ۙ﴿۱﴾
তারকারাজির শপথ‌‌ যখন তা অস্তমিত হলো।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-২
مَا ضَلَّ صَاحِبُکُمۡ وَ مَا غَوٰی ۚ﴿۲﴾
তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয়,
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৩
وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡہَوٰی ؕ﴿۳﴾
সে নিজের খেয়ালখুশী মতো কথা বলে না।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৪
اِنۡ ہُوَ اِلَّا وَحۡیٌ یُّوۡحٰی ۙ﴿۴﴾
যা তার কাছে নাযিল করা হয় তা অহী ছাড়া আর কিছুই নয়।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৫
عَلَّمَہٗ شَدِیۡدُ الۡقُوٰی ۙ﴿۵﴾
তাকে মহাশক্তির অধিকারী একজন শিক্ষা দিয়েছে, যে অত্যন্ত জ্ঞানী।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৬
ذُوۡ مِرَّۃٍ ؕ فَاسۡتَوٰی ۙ﴿۶﴾
সে সামনে এসে দাঁড়ালো।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৭
وَ ہُوَ بِالۡاُفُقِ الۡاَعۡلٰی ؕ﴿۷﴾
আর তিনি ছিলেন ঊর্ধ্বদিগন্তে।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৮
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلّٰی ۙ﴿۸﴾
তারপর কাছে এগিয়ে এলো এবং ওপরে শূন্যে ঝুলে রইলো।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-৯
فَکَانَ قَابَ قَوۡسَیۡنِ اَوۡ اَدۡنٰی ۚ﴿۹﴾
ফলে তাদের মধ্যে দু ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১০
فَاَوۡحٰۤی اِلٰی عَبۡدِہٖ مَاۤ اَوۡحٰی ﴿ؕ۱۰﴾
তখন আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১১
مَا کَذَبَ الۡفُؤَادُ مَا رَاٰی ﴿۱۱﴾
যা তিনি দেখেছেন, তার অন্তঃকরণ তা মিথ্যা বলেনি ;
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১২
اَفَتُمٰرُوۡنَہٗ عَلٰی مَا یَرٰی ﴿۱۲﴾
যা সে নিজের চোখে দেখেছে তা নিয়ে কি তোমরা তার সাথে ঝগড়া করো?
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১৩
وَ لَقَدۡ رَاٰہُ نَزۡلَۃً اُخۡرٰی ﴿ۙ۱۳﴾
আর অবশ্যই তিনি তাকে আরেকবার দেখেছিলেন।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১৪
عِنۡدَ سِدۡرَۃِ الۡمُنۡتَہٰی ﴿۱۴﴾
সিদরাতুল মুনতাহার নিকট।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১৫
عِنۡدَہَا جَنَّۃُ الۡمَاۡوٰی ﴿ؕ۱۵﴾
যার সন্নিকটেই জান্নাতুল মা’ওয়া অবস্থিত।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১৬
اِذۡ یَغۡشَی السِّدۡرَۃَ مَا یَغۡشٰی ﴿ۙ۱۶﴾
সে সময় সিদরাকে আচ্ছাদিত করছিলো এক আচ্ছাদনকারী জিনিস।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১৭
مَا زَاغَ الۡبَصَرُ وَ مَا طَغٰی ﴿۱۷﴾
তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি।
সূরা:৫৩:আন-নাজম-১৮
لَقَدۡ رَاٰی مِنۡ اٰیٰتِ رَبِّہِ الۡکُبۡرٰی ﴿۱۸﴾
অবশ্যই তিনি তার রবের মহান নিদর্শনাবলীর কিছু দেখেছিলেন ;

তাফসীর :
১) তাফহীমুল কুরআন:-
২) ফী জিলালিল কুরআন:-

১-১৮ আয়াতের ব্যাখ্যা:-
(৫৩-নাজম) : নামকরণ:

সূরার একেবারে প্রথম শব্দ وَالنَّجْمِ থেকে গৃহীত। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এটিও সূরার শিরোনাম নয়। শুধুমাত্র পরিচয় চিহ্ন স্বরূপ এ শব্দটিকে সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
(৫৩-নাজম) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ও নাসায়ীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, أَوَّلُ سُورَةٍ أُنْزِلَتْ فِيهَا سَجْدَةٌ َالنَّجْمِ (সর্ব প্রথম যে সূরাটিতে সিজদার আয়াত নাযিল হয়েছে, সেটি হচ্ছে আন-নাজম, । এ হাদীসের যে অংশসমূহ আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ, আবু ইসহাক এবং যুহায়ের ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক ইবনে মাসউদের রেওয়ায়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে জানা যায় যে, এটি কুরআন মজীদের প্রথম সূরা যা রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কুরাইশদের এক সমাবেশে (ইবনে মারদুইয়ার বর্ণনা অনুসারে হারাম শরীফের মধ্যে) শুনিয়েছিলেন। সমাবেশে কাফের ও ঈমানদার সব শ্রেণীর লোক উপস্থিত ছিল। অবশেষে তিনি সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করলে উপস্থিত সবাই তাঁর সাথে সিজদা করে। এমনকি মুশরিকদের বড় বড় নেতা যারা তাঁর বিরোধিতার অগ্রভাবে ছিল তারাও সিজদা না করে থাকতে পারেনি। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন; আমি কাফেরদের মধ্যে মাত্র এক ব্যক্তি অর্থাৎ উমাইয়া ইবনে খালফকে দেখলাম, সে সিজদা করার পরিবর্তে কিছু মাটি উঠিয়ে কপালে লাগিয়ে বললো: আমার জন্য এটাই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে আমি নিজ চোখে তাকে কাফের অবস্থায় নিহত হতে দেখেছি।

এ ঘটনার অপর একজন চাক্ষুষদর্শী হলেন হযরত মুত্তালিব ইবনে আবী ওয়াদা’আ। তিনি তখনও মুসলমান হননি। নাসায়ী ও মুসনাদে আহমাদে তাঁর নিজের বক্তব্য এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে যে, নবী ﷺ সূরা নাজম পড়ে সিজদা করলেন এবং উপস্থিত সবাই তাঁর সাথে সিজদা করলো। কিন্তু আমি সিজদা করিনি। বর্তমানে আমি তার ক্ষতিপূরণ করি এভাবে যে, এ সূরা তিলাওয়াতকালে কখনো সিজদা না করে ছাড়ি না।

ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন, ইতিপূর্বে নবুয়াতের ৫ম বছরের রজব মাসে সাহাবা কিরামের একটি ছোট্ট দল হাবশায় হিজরত করেছিলেন। পরে ঐ বছর রমযান মাসেই এ ঘটনা ঘটে অর্থাৎ রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কুরাইশদের জনসমাবেশে সূরা নাজম পাঠ করে শোনান এবং এতে কাফের ও ঈমানদার সবাই তাঁর সাথে সিজদায় পড়ে যায়। হাবশায় মুহাজিরদের কাছে এ কাহিনী এভাবে পৌঁছে যে, মক্কায় কাফেররা মুসলমান হয়ে গিয়েছে। এ খবর শুনে তাদের মধ্যেকার কিছু লোক নবুয়াতের ৫ম বছরের শাওয়াল মাসে মক্কায় ফিরে আসেন। কিন্তু এখানে আসার পরে জানতে পারেন যে, জুলুম-নির্যাতন আগের মতই চলছে। অবশেষে হাবশায় দ্বিতীয়বার হিজরত করার ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে প্রথমবারের হিজরতের তুলনায় অনেক বেশী লোক মক্কা ছেড়ে চলে যায়।

এভাবে প্রায় নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, সূরাটি নবুয়াতের ৫ম বছরের রমযান মাসে নাযিল হয়েছিলো।
(৫৩-নাজম) : ঐতিহাসিক পটভূমি :

নাযিল হওয়ার সময়-কাল সম্পর্কে এ বিস্তারিত আলোচনা থেকে কিরূপ পরিস্থিতিতে এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল তা জানা যায়। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ নবুয়াত লাভের শুরু থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শুধু ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং বিশেষ বিশেষ বৈঠকেই আল্লাহ্‌র বাণী শুনিয়ে মানুষকে আল্লাহ্‌র দ্বীনের দিকে আহবান জানিয়ে আসছিলেন। এ সুদীর্ঘ সময়ে তিনি কখনো কোন জনসমাবেশে কুরআন শোনানোর সুযোগ পাননি। কাফেরদের চরম বিরোধীতাই ছিল এর প্রধান অন্তরায়। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও প্রচারণামূলক তৎপরতায় কিরূপ প্রচণ্ড আকর্ষণ এবং কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে কি সাংঘাতিক প্রভাব আছে তারা খুব ভাল করেই জানতো। তাই তাদের চেষ্টা ছিল তারা নিজেরাও এ বাণী শুনবে না, অন্য কাউকেও শুনতে দিবে না এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকমের ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে শুধু নিজেদের মিথ্যা প্রচার প্রোপাগাণ্ডার জোরে তাঁর এ আন্দোলনকে দমিয়ে দেবে। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একদিকে তারা বিভিন্ন স্থানে একথা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো যে, মুহাম্মাদ ﷺ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়েছেন এবং লোকদেরকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। অপরদিকে তাদের স্থায়ী কর্মপন্থা ছিল এই যে, নবী ﷺ যেখানেই কুরআন শোনানোর চেষ্টা করতেন সেখানেই হট্টগোল, চিৎকার হৈ-হল্লা শুরু করিয়ে দিতে হবে যাতে যে কারণে তাঁকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত লোক বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে তা যেন লোকে আদৌ জানতে না পারে। এ পরিস্থিতিতে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ একদিন পবিত্র হারাম শরীফের মধ্যে কুরাইশদের একটি বড় সমাবেশে হঠাৎ বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন। সূরা নাজম আকারে এখন যে সূরাটি আমাদের সামনে বর্তমান, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে রসূলের ﷺ মুখে তা বক্তৃতা আকারে পরিবেশিত হলো। এ বাণীর প্রচণ্ড প্রভাবে অবস্থা দাঁড়ালো এই যে, তিনি তা শুনাতে আরম্ভ করলে এর বিরুদ্ধে বিরোধীদের হট্টগোল ও হৈ-হল্লা করার খেয়ালই হলো না। আর শেষের দিকে তিনি যখন সিজদা করলেন তখন তারাও সিজদা করলো। পরে তারা এই ভেবে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করলো যে, আমরা একি দুর্বলতা দেখিয়ে ফেললাম। এজন্য লোকজনও তাদেরকে এ বলে তিরস্কার করলো যে, এরা অন্যদের এ বাণী শুনতে নিষেধ করে ঠিকই কিন্তু আজ তারা কান পেতে তা শুধু শুনলো না, মুহাম্মাদ ﷺ এর সাথে সিজদাও করে বসলো। অবশেষে তারা এ মর্মে মিথ্যা অপবাদ রটায় যে, আরে মিয়া, আমরা তো أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّى – وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى কথাটির পর মুহাম্মাদ ﷺ মুখ থেকে تلك الغرائقة العلى وان شفاعتهن لترجى (এরা সব উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন দেবী। তাদের শাফায়াতের আশা অবশ্যই করা যায়) কথাটি শুনেছিলাম। তাই আমরা মনে করেছিলাম যে, মুহাম্মাদ ﷺ আমাদের পথে ফিরে এসেছে। অথচ তারা যে কথাটি শুনতে পেয়েছে বলে দাবি করেছিলো, এ সমগ্র সূরাটির পূর্বাপর প্রেক্ষিতের মধ্যে তা কোথাও খাটে না। এ ধরনের একটি উদ্ভট বাক্যের সাথে এ সূরার মিল খুঁজে পাওয়া একমাত্র কোন পাগলের পক্ষেই সম্ভব। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল-হজ্ব, টীকা- ৯৬ থেকে ১০১, ।
(৫৩-নাজম) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

মক্কার কাফেররা কুরআন ও হযরত মুহাম্মাদ ﷺ এর প্রতি যে আচরণ ও নীতি অবলম্বন করে চলেছিলো তাদের ঐ নীতি ও আচরণের ভ্রান্তি সম্পর্কে সাবধান করে দেয়াই এ সুরার মূল বিষয়বস্তু। বক্তব্য শুরু করা হয়েছে এভাবে যে, মুহাম্মাদ ﷺ বিভ্রান্ত বা পথভ্রষ্ট ব্যক্তি নন যেমনটি, তোমরা রটনা করে বেড়াচ্ছো। আর ইসলামের এ শিক্ষা ও আন্দোলন তিনি নিজে মনগড়া ভাবে প্রচার করেছেন না যেমনটা তোমরা মনে করে বসে আছো। বরং তিনি যা কিছু পেশ করেছেন তা নির্ভেজাল অহী ছাড়া আর কিছুই নয়। এ অহী তাঁর ওপর নাযিল করা হয়। তিনি তোমাদের সামনে যে সব সত্য বর্ণনা করেন তা তাঁর অনুমান ও ধারণা নির্ভর নয়, বরং নিজ চোখে দেখা অকাট্য সত্য। যে ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁকে এ জ্ঞান দেয়া হয় তাকে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। তাঁকে সরাসরি তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ পরিদর্শন করানো হয়েছে। তিনি যা কিছু বলছেন চিন্তা-ভাবনা করে বলছেন না, দেখে বলছেন। যে জিনিস একজন অন্ধ দেখতে পায় না অথচ একজন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি দেখতে পায়, সে জিনিস নিয়ে চক্ষুষ্মানের সাথে অন্ধের বিতর্কে লিপ্ত হওয়া যেমন, মুহাম্মাদ ﷺ এর সাথে তাওহীদ আখেরাত প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তোমাদের তর্ক করা ঠিক তেমনি। এরপর ক্রমান্বয়ে তিনটি বিষয়ে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে:

প্রথমত শ্রোতাদের বুঝানো হয়েছে তোমরা যে ধর্মের অনুসরণ করছো তা কতকগুলো ধারণা ও মনগড়া জিনিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তোমরা লাত, মানাত ও উযযার মত কয়েকটি দেব-দেবীকে উপাস্য বানিয়ে রেখেছো, অথচ প্রকৃত খোদায়ীর ক্ষেত্রে তাদের নাম মাত্রও অংশ নেই। তোমরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ্‌র কন্যা ধরে নিয়ে বসে আছ। কিন্তু নিজেদের কন্যা সন্তান থাকাকে তোমরা লজ্জা ও অপমানের বিষয় বলে মনে কর। তোমরা নিজের পক্ষ থেকে ধরে নিয়েছো যে, তোমাদের এ উপাস্যরা আল্লাহ্‌ তা’আলার কাছে তোমাদের কাজ আদায় করে দিতে পারে। অথচ আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভকারী সমস্ত ফেরেশতা সম্মিলিতভাবেও আল্লাহ্‌কে তাদের কোন কথা মানতে বাধ্য বা উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। তোমাদের অনুসৃত এ ধরনের আকীদা-বিশ্বাসের কোনটিই কোন জ্ঞান বা দলীল প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এগুলো নিছক তোমাদের প্রবৃত্তির কিছু কামনা-বাসনা যার কারণে তোমরা কিছু ভিত্তিহীন ধারণাকে বাস্তব ও সত্য মনে করে বসে আছো। এটা একটা মস্ত বড় ভুল। এ ভুলের মধ্যেই তোমরা নিমজ্জিত আছো। সত্যের সাথে যার পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে সেটিই প্রকৃত আদর্শ। সত্য মানুষের প্রবৃত্তি ও আকাংখার তাবেদার হয় না যে, সে যাকে সত্য মনে করে বসবে সেটিই সত্য হবে। প্রকৃত সত্যের সাথে সঙ্গতির জন্য অনুমান ও ধারণা কোন কাজে আসে না। এজন্য দরকার জ্ঞানের। সে জ্ঞানই তোমাদের সামনে পেশ করা হলে তোমরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে এবং উল্টা সে ব্যক্তিকেই পথভ্রষ্ট সাব্যস্ত করো যে তোমাদের সত্য কথা বলেছেন। তোমাদের এ ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হওয়ার মূল কারণ হলো, আখেরাতের কোন চিন্তাই তোমাদের নেই। কেবল দুনিয়াই তোমাদের উদ্দেশ্য হয়ে আছে। তাই সত্যের জ্ঞান অর্জনের আকাংখা যেমন তোমাদের নেই, তেমনি তোমরা যা আকীদা-বিশ্বাসের অনুসরণ করছো তা সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক তারও কোন পরোয়া তোমাদের নেই।

দ্বিতীয়ত, লোকদের বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ই সমগ্র বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র মালিক মোক্তার। যে তাঁর পথ অনুসরণ করছে সে সত্য পথ প্রাপ্ত আর যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত সে পথ ভ্রষ্ট। পথভ্রষ্ট ব্যক্তির পথভ্রষ্টতা এবং সত্য-পন্থীর সত্য পথ অনুসরণ তাঁর অজানা নয়। তিনি প্রত্যেকের কাজ কর্মকে জানেন। তাঁর কাছে অন্যায়ের প্রতিফল অকল্যাণ এবং সুকৃতির প্রতিদান কল্যাণ লাভ অনিবার্য। তুমি নিজে নিজেকে যা-ই মনে করে থাকো এবং নিজের মুখে নিজের পবিত্রতার যত লম্বা চওড়া দাবীই করো না কেন তা দিয়ে তোমার বিচার করা হবে না। বরং আল্লাহ্‌র বিচারে তুমি মুত্তাকী কিনা তা দিয়ে তোমার বিচার করা হবে। তুমি যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে অবস্থান করো তাহলে তাঁর রহমত এত ব্যাপক যে, তিনি ছোট ছোট গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।

তৃতীয়ত, কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার শত শত বছর পূর্বে দ্বীনে হকের যে কয়টি মৌলিক বিষয় হযরত ইবরাহীম, ও মূসার সহীফাসমূহে বর্ণনা করা হয়েছিল তা মানুষের সামনে এজন্য পেশ করা হয়েছে যে, মানুষ যেন এরূপ ভ্রান্ত ধারণা পোষন না করে যে, মুহাম্মাদ ﷺ একটি সম্পূর্ণ নতুন দ্বীন নিয়ে এসেছেন, বরং মানুষ যাতে জানতে পারে যে, এগুলো মৌলিক সত্য এবং আল্লাহ্‌র নবীগণ সব সময় এ সত্যই প্রচার করেছেন। সাথে সাথে ঐসব সহীফা থেকে একথাও উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, আদ, সামূদ, নূহ ও লূতের কওমের ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল ছিল না। আজ মক্কার কাফেররা যে জুলুম ও সীমালংঘন থেকে বিরত থাকতে কোন অবস্থাতেই রাজি হচ্ছে না, সে একই জুলুম ও সীমালংঘনের অপরাধেই আল্লাহ্‌ তা’আলা তাদের ধ্বংস করেছিলেন।

এসব বিষয় তুলে ধরার পর বক্তৃতার সমাপ্তি টানা হয়েছে এ কথা বলে যে, চূড়ান্ত ফায়সালার সময় অতি নিকটবর্তী হয়েছে। তা প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই। চূড়ান্ত সে মুহুর্তটি আসার পূর্বে মুহাম্মাদ ﷺ ও কুরআনের মাধ্যমে তোমাদেরকেও ঠিক তেমনিভাবে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে যেভাবে পূর্ববর্তী লোকদের সাবধান করা হয়েছিল। এখনই এ কথাগুলোই কি তোমাদের কাছে অভিনব মনে হয়? এজন্যই কি তা নিয়ে তোমরা ঠাট্টা তামাসা করছো? এ কারণেই কি তোমরা তা শুনতে চাও না, শোরগোল ও হৈ চৈ করতে থাকো। যাতে অন্য কেউও তা শুনতে না পায়? নিজেদের এ নির্বুদ্ধিতার জন্য তোমাদের কান্না আসে না? নিজেদের এ আচরণ থেকে বিরত হও, আল্লাহ্‌র সামনে নত হও এবং তাঁরই বন্দেগী করো।

এটা ছিল বক্তব্যের অত্যন্ত মর্মস্পর্শী উপসংহার যা শুনে কট্টর বিরোধীরাও নিজেদের সংবরণ করতে পারেনি। তাই রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ আল্লাহ্‌র বাণীর এ অংশ পড়ে সিজদা করলে তারাও স্বত:ষ্ফূর্তভাবে সিজদায় পড়ে যায়।

# মূল আয়াতে النجم শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ এবং সুফিয়ান সাওরী বলেন এর অর্থ সপ্তর্ষিমণ্ডল (Pleiades)। ইবনে জারীর ও যামাখশারী এ মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ, আরবী ভাষায় শুধু النَّجْم শব্দ বলা হলে তা দ্বারা সাধারণত সপ্তর্ষিমণ্ডলকেই বুঝানো হয়ে থাকে। সুদ্দী বলেন, এর অর্থ শুক্রগ্রহ (Venus)। আবু উবায়দা নাহবীর বক্তব্য হলো, এখানে النَّجْم বলে সমস্ত তারকাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বলতে চাওয়া হয়েছে যখন সকাল হলো এবং সমস্ত তারকা অস্তমিত হলো। পরিবেশ ও স্থান-কাল-পাত্রের বিচারে আমাদের কাছে এ শেষ মতটিই অধিক অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
# রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে বুঝানো হয়েছে এবং কুরাইশদের সম্বোধন করা হয়েছে। মূল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছেصَاحِبُكُمْ (তোমাদের বন্ধু)। আরবী ভাষায় صاحب বলতে বন্ধু, সাথী, নিকটে অবস্থানকারী এবং সাথে উঠা-বসা করে এমন লোককে বুঝায়। এখানে নবীর ﷺ নাম উল্লেখ করা বা “আমার রসূল” বলার পরিবর্তে “তোমাদের বন্ধু” বলে তাঁর কথা উল্লেখ করার মধ্যে অত্যন্ত গভীর তাৎপর্য আছে। এভাবে কুরাইশদের একথা বুঝানো হয়েছে যে, তোমাদের কাছে যে ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে তিনি তোমাদের এখানে বাইরে থেকে আসা কোন অপরিচিত ব্যক্তি নন যে, আগে থেকে তোমাদের সাথে তাঁর কোন জানা শোনাই নেই। তিনি তোমাদের নিজ কওমের লোক। তোমাদের মধ্যেই তিনি থাকেন এবং বসবাস করেন। তিনি কে, কি তাঁর পরিচয়, তিনি কেমন চরিত্র ও কর্মের অধিকারী মানুষ, কেমন তাঁর আচার-আচরণ, কেমন তাঁর অভ্যাস ও স্বভাব চরিত্র এবং আজ পর্যন্ত তোমাদের মাঝে তাঁর জীবন কেমন কেটেছে তা তোমাদের প্রতিটি শিশু পর্যন্ত জানে। তাঁর সম্পর্কে কেউ যদি নির্লজ্জের মত কিছু বলে তাহলে তাঁকে জানে তোমাদের মধ্যে এমন বহু মানুষ বর্তমান যারা নিজেরাই বিচার করে দেখতে পারে, একথা তাঁর ব্যাপারে প্রযোজ্য হয় কিনা।
# এটিই মূল কথা যার জন্য অস্তমিত তারকা বা তারকারাজির শপথ করা হয়েছে। পথভ্রষ্ট হওয়ার অর্থ পথ না চেনার কারণে কারো ভুল পথে চলা এবং বিপথগামী হওয়ার অর্থ জেনে শুনে কারো ভুল পথ অবলম্বন করা। আল্লাহ‌র এ বাণীর তাৎপর্য হলো মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের একান্ত পরিচিত ব্যক্তি। তিনি পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী হয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে তোমাদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে ভুল। প্রকৃতপক্ষে তিনি পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী কিছুই হননি। একথা বলতে যে কারণে তারকারাজির অস্তমিত হওয়ার শপথ করা হয়েছে তা হলো, রাতের অন্ধকারে যখন তারকা জ্বল জ্বল করে তখন কোন ব্যক্তি তার চারপাশের বস্তুকে স্পষ্ট দেখতে পায় না এবং বিভিন্ন বস্তুকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেয়ে সেগুলো সম্পর্কে ভুল অনুমান করতে পারে। যেমন অন্ধকারে দূরে থেকে কোন গাছ দেখে তাকে ভূত মনে করতে পারে। রশি পড়ে থাকতে দেখে তাকে সাপ মনে করতে পারে। বালুকাস্তুপের কোন পাথর উঁচু হয়ে থাকতে দেখে কোন হিংস্র জন্তু বসে আছে বলে মনে করতে পারে। কিন্তু যে সময় তারকাসমূহ অদৃশ্য হয়ে যায় এবং সকালের আলো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তখন প্রতিটি বস্তু তার মূল আকার-আকৃতিতে মানুষের সামনে প্রকাশ পায়। সে সময় কোন বস্তুর মূল রূপ ও আকার আকৃতির ব্যাপারে কোন সন্দেহের সৃষ্টি হয় না। তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ ﷺ এর ব্যাপারটিও তাই। তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব অন্ধকারে ঢাকা নয়, বরং আলোক উদ্ভাসিত ভোরের মত স্পষ্ট। তোমরা জানো, তোমাদের এ ‘বন্ধু” একজন অতি নম্র স্বভাব, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তাঁর সম্পর্কে কুরাইশদের কোন ব্যক্তির এ ভুল ধারণা কি করে হতে পারে যে, তিনি পথভ্রষ্ট হয়েছেন। তোমরা এও জান যে, তিনি অত্যন্ত সদিচ্ছা পরায়ণ এবং সত্যবাদী মানুষ। তোমাদের কেউ তাঁর সম্পর্কে কি করে এ মত পোষণ করতে পারে যে, তিনি জেনে শুনে শুধু যে নিজে বাঁকা পথ অবলম্বন করে বসে আছেন তাই নয়, অন্যদেরও সে বাঁকা পথের দিকে আহবান জানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
# যেসব কথার কারণে তোমরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছো যে, তিনি পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী হয়েছেন সেসব কথা তাঁর মনগড়া নয় কিংবা তাঁর প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ঐসবের উৎস নয়। তা আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে তাঁর ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি নিজে নবী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেননি। তাই নিজের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য নবুওয়াতের দাবী করে বসেছেন এমন নয়। বরং আল্লাহ‌ তা’আলা অহীর মাধ্যমে যখন তাঁকে এ পদে অভিষিক্ত হতে আদেশ দিলেন তখনই তিনি তোমাদের মাঝে রিসালাতের তাবলীগ তথা প্রচারের জন্য তৎপরতা শুরু করলেন এবং বললেন, আমি তোমাদের জন্য আল্লাহ‌র নবী। একইভাবে ইসলামের এ আন্দোলন, তাওহীদের এ শিক্ষা, আখেরাত, হাশর-নাশর এবং কাজকর্মের প্রতিদানের এ খবর মহাবিশ্বে ও মানুষ সম্পর্কে এসব সত্য ও তথ্য এবং পবিত্র জীবন যাপন করার জন্য যেসব নীতিমালা তিনি পেশ করেছেন এসবও তাঁর নিজের রচিত দর্শন নয়। আল্লাহ‌ তা’আলা অহীর মাধ্যমে তাঁকে এসব বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন। অনুরূপভাবে তিনি তোমাদেরকে যে কুরআন শুনিয়ে থাকেন তাও তাঁর নিজের রচিত নয়। এসব আল্লাহ‌র বাণী। এসব বাণী অহীর মাধ্যমে তাঁর ওপর নাযিল হয়।

এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে, নবী ﷺ সম্পর্কে আল্লাহ‌ তা’আলার এ উক্তি যে, “তিনি নিজের খেয়াল খুশীমত কথা বলেন না, যা বলেন তা তাঁর কাছে নাযিলকৃত অহী ছাড়া আর কিছুই নয়।” তাঁর পবিত্র মুখ থেকে উচ্চারিত কোন্‌ কোন্‌ কথার সাথে সম্পর্কিত? তিনি যত কথা বলতেন এ উক্তি কি তার সবটার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? নাকি কিছু কিছু কথার ওপর প্রযোজ্য আর কিছু কথার জন্য প্রযোজ্য নয়? এর জবাব হচ্ছে আল্লাহ‌ তা’আলার এ উক্তি কুরআন মজীদের ক্ষেত্রে তো প্রযোজ্য হবেই। কুরআন মজীদ ছাড়া আরো যেসব কথা নবী সাল্লাল্লাহু ﷺ এর পবিত্র মুখ থেকে উচ্চারিত হতো তাও অনিবার্যরূপে তিন ভাগে বিভক্ত হতে পারে।

দ্বীনের প্রচার ও আল্লাহ‌র পথে মানুষকে আহবানের জন্য তিনি যেসব কথাবার্তা বলতেন অথবা কুরআন মজীদের বিষয়বস্তু তার শিক্ষা এবং আদেশ-নিষেধ ও হিদায়াতসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হিসেবে যা কিছু বলতেন অথবা কুরআনেরই উদ্দেশ্য ও দাবী পূরণ করার জন্য যেসব বক্তৃতা করতেন বা লোকদের উপদেশ ও শিক্ষা দিতেন এগুলো এক শ্রেণীর কথা। এসবকথা সম্পর্কে এরূপ সন্দেহ করার আদৌ কোন অবকাশ নেই যে, তিনি (নাউযুবিল্লাহ্‌) মনগড়া ভাবে বলতেন। এ ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে তাঁর মর্যাদা ছিল কুরআনের সরকারী ভাষ্যকার বা মুখপত্র এবং আল্লাহ‌ তা’আলার মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে। কুরআনের প্রতিটি শব্দ যেসব নবীর ﷺ ওপরে নাযিল করা হতো অনুরূপ এসব কথার প্রতিটি শব্দ যদিও তাঁর ওপর নাযিল করা হতো না কিন্তু তা অবশ্যই তাঁর ওপর নাযিলকৃত ওহীর জ্ঞান ভিত্তিক ছিল। এসব কথা ও কুরআনের মধ্যে শুধু এতটুকু পার্থক্য ছিল যে, কুরআনের ভাষা ও ভাব সব কিছুই আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে ছিল। এসব কথার অর্থ ও ভাব আল্লাহ‌ তাঁকে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের ভাষায় ও শব্দে তা প্রকাশ করতেন। এ পার্থক্যের কারণে কুরআনকে “অহীয়ে জলী” (প্রকাশ্য অহী) এবং নবীর ﷺ অবশিষ্ট এসব কথাবার্তাকে “অহীয়ে খফী” (অপ্রকাশ্য অহী) বলা হয়।

নবীর ﷺ দ্বিতীয় আরেক প্রকারের কথাবার্তা ছিল যা তিনি আল্লাহ‌র বিধানের তাবলীগ ও প্রচারণার চেষ্টা সাধনায় এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার তৎপরতার ক্ষেত্রে বলতেন। এ কাজে তাঁকে মুসলমানদের জামায়াতের নেতা এ পথ প্রদর্শক হিসেবে বিভিন্ন রকমের অসংখ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হতো। এসব ব্যাপারে অনেক সময় তিনি তাঁর সঙ্গী সাথীদের পরামর্শও গ্রহণ করেছেন, নিজের মত বাদ দিয়ে তাদের মতও গ্রহণ করেছেন। তাদের জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে কোন কোন সময় স্পষ্টভাবে বলেছেনও যে, একথা আমি আল্লাহ‌র আদেশে নয়, নিজের মত হিসেবেই বলছি। তাছাড়া অনেকবার এ রকমও হয়েছে যে, তিনি নিজের ইজতিহাদের ভিত্তিতে কোন কথা বলেছেন কিন্তু পরে আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে তার পরিপন্থী নির্দেশনা এসেছে। এ ধরনের যত কথা তিনি বলেছেন তার কোন কথাই আদৌ এমন ছিল না এবং থাকতে পারে না যা তাঁর প্রবৃত্তির খেয়ালখুশী ও কামনা-বাসনার ফল। এখন প্রশ্ন হলো, তাঁর এ ধরনের সব কথা কি অহী ভিত্তিক ছিল? এ প্রশ্নের জবাব হলো, যেসব কথা সম্পর্কে তিনি নিজে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, একথা আল্লাহ‌র নির্দেশ ভিত্তিক নয়, কিংবা যে ক্ষেত্রে তিনি সাহাবীদের (রাঃ) পরামর্শ চেয়েছেন এবং তাদের মতামত গ্রহণ করেছেন অথবা যেসব ক্ষেত্রে কোন কথা বা কাজ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ‌ তা’আলা তার পরিপন্থী হিদায়াত নাযিল করেছেন সে কথা ছাড়া তাঁর আর সব কথাই পূর্বোক্ত ধরনের কথাসমূহের মত ‘অহীয়ে খফী’র অন্তর্ভুক্ত। তাই ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও পথ প্রদর্শক, মু’মিনদের দলের সরদার এবং ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকের যে পদ মর্যাদায় তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন তা তাঁর রচিত বা মানুষের প্রদত্ত ছিল না। তিনি আল্লাহ‌ তা’আলার পক্ষ থেকে এ কাজ করার জন্য আদিষ্ট ও নিযুক্ত হয়েছিলেন। এ পদমর্যাদার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে গিয়ে তিনি যা কিছু বলতেন এবং করতেন তা আল্লাহ‌র ইচ্ছার প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা নিয়ে করতেন। এক্ষেত্রে যেসব কথা তিনি তাঁর ইজতিহাদের ভিত্তিতে বলতেন, তাঁর ঐসব ইজতিহাদের অনেকগুলো আল্লাহ‌র কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় ছিল। আল্লাহ‌ তাঁকে জ্ঞানের যে আলো দিয়েছিলেন ওগুলো তা থেকে উৎসারিত ছিল। এ কারণে তাঁর ইজতিহাদ যেখানেই আল্লাহ‌র পছন্দের বাইরে চলে গিয়েছে সেখানে তৎক্ষনাত “অহীয়ে জলী’র মাধ্যমে তা সংশোধন করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ‌র পক্ষ থেকে তাঁর কোন কোন ইজতিহাদের এ সংশোধনই এ কথা প্রমাণ করে যে, তাঁর অবশিষ্ট সমস্ত ইজতিহাদ হুবহু আল্লাহ‌র মর্জির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

তৃতীয় আরেক রকমের কথা ছিল যা মানুষ হিসেবে নবী ﷺ সাধারণ কাজকর্মে বলতেন। নবুওয়াতের দায়-দায়িত্ব পালনের সাথে এসব কথার কোন সম্পর্ক ছিল না। এ ধরনের কথা তিনি নবী হওয়ার পূর্বেও বলতেন এবং নবী হওয়ার পরেও বলতেন। এ ধরনের কথা সম্পর্কে সর্ব প্রথমে বুঝে নিতে হবে যে, ঐ গুলো নিয়ে কাফেরদের সাথে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিল না। এসব কথার কারণে কাফেররা তাঁকে পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী বলেনি।

তারা এ অভিযোগ আরোপ করতো প্রথম দুই শ্রেণীর কথার ক্ষেত্রে। তাই তৃতীয় প্রকারের কথা আদৌ আলোচ্য বিষয় ছিল না। অতএব আল্লাহ‌ তা’আলার এ বাণী এ প্রকারের কথার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ঐ প্রকারের কথা এখানে আলোচনা বহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও এটা বাস্তব যে, জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মুখ থেকে কখনো সত্যের পরিপন্থী কোন কথা বের হতো না। নবী ও মুত্তাকী সুলভ জীবন যাপনের জন্য আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর জন্য কথা ও কাজের যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তাঁর কথা ও কাজ সদা সর্বদা সে গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। তাই প্রকৃত পক্ষে ঐ সব কথার মধ্যেও অহীর নূর প্রতিফলিত হতো। কোন কোন সহীহ হাদীসে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ থেকে একথাটিই বর্ণিত হয়েছে। মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে এক সময় নবী ﷺ বলেছিলেন,

لاَ أَقُولُ إِلاَّ حَقًّا

”আমি সত্য কথা ছাড়া কিছু বলি না।” এক সাহাবী বললেনঃ

إِنَّكَ تُدَاعِبُنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ “হে আল্লাহ‌র রসূল, অনেক সময় তো আপনি আমাদের সাথে হাসি-ঠাট্টাও করেন।”

জবাবে নবী ﷺ বললেন

ঃ “ إِنِّى لاَ أَقُولُ إِلاَّ حَقًّا

“প্রকৃতপক্ষে তখনো আমি সত্য ছাড়া কিছু বলি না।”

মুসনাদে আহমাদ ও আবু দাউদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেনঃ আমি রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর পবিত্র মুখ থেকে যা-ই শুনতাম তা সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে লিখে রাখতাম। কুরাইশরা আমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করলো তারা বলতে শুরু করলো, তুমিতো সব কথাই লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছো। অথচ রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ তো মানুষ। অনেক সময় রাগান্বিত হয়েও কোন কথা বলেন। এতে আমি লেখা ছেড়ে দিলাম। পরবর্তী সময়ে আমি এ বিষয়টি নবীর ﷺ কাছে বললে তিনি বললেনঃ

اكْتُبْ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ إِلاَّ حَقٌّ

“তুমি লিখতে থাকো, যাঁর মুঠিতে আমার প্রাণ, সে মহান সত্ত্বার শপথ, আমার মুখ থেকে সত্য ছাড়া কখনো কোন কথা উচ্চারিত হয়নি।”

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আমার গ্রন্থ তাফহীমাত, ১ম খণ্ড, শিরোনাম “রিসালাত আওর উসকে আহকাম।” (নির্বাচিত রচনাবলী, ১ম খণ্ড)।

# তাঁকে শিক্ষাদানকারী কোন মানুষ নয়, যা তোমরা মনে করে থাকো। মানব সত্ত্বার ঊর্ধ্বের একটি মাধ্যম থেকে তিনি এ জ্ঞান লাভ করেছেন। “মহাশক্তির অধিকারী” অর্থ কারো কারো মতে আল্লাহ‌র পবিত্র সত্ত্বা। কিন্তু তাফসীরকারদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ ব্যাপারে একমত যে, এর অর্থ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), কাতাদা, মুজাহিদ এবং রাবী, ইবনে আনাস থেকে এ মতটিই বর্ণিত হয়েছে। ইবনে জারীর, ইবনে কাসীর, রাযী, আলূসী, প্রমুখ তাফসীরকারগণও এমতটিই গ্রহণ করেছেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেব এবং মাওলানা আশরাফ আলী সাহেবও তাদের অনুবাদে এটিই অনুসরণ করেছেন। সত্য বলতে কি, কুরআন মজীদের অন্যান্য বর্ণনা থেকেও এটি প্রমাণিত হয়েছে। সূরা তাকভীরে আল্লাহ‌ তা’আলা বলেছেনঃ

إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ – ذِي قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِينٍ – مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِينٍ وَمَا صَاحِبُكُمْ بِمَجْنُونٍ – وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِينِ (ايات : 19-23)

“প্রকৃতপক্ষে এ এক মহাশক্তিধর সম্মানিত ফেরেশতার বর্ণনা, আরশের অধিপতির কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান। তাঁর আদেশ পালিত হয় এবং সেখানে অত্যন্ত বিশ্বাসী। তোমাদের বন্ধু মোটেই পাগল নন। তিনি সে ফেরেশতাকে আসমানের পরিষ্কার দিগন্তে দেখেছেন।”

যে ফেরেশতার মাধ্যমে নবীর ﷺ হৃদয়-মনে এ শিক্ষা নাযিল করা হয়েছিল সূরা বাকারার ৯৭ আয়াতে সে ফেরেশতার নামও বলে দেয়া হয়েছেঃ قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ بِإِذْنِ اللَّهِ

যদি এসব আয়াত সূরা ‘নাজমের’এ আয়াতের সাথে মিলিয়ে পাঠ করা হয় তাহলে এ ব্যাপারে আদৌ সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, মহাশক্তিধর শিক্ষক বলতে যে, আল্লাহ‌ তা’আলাকে নয়, বরং জিবরাঈলকে বুঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে আদৌ কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এ বিষয়ে পরে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, জিবরাঈলকে কি করে রসুলুল্লাহ্‌ ﷺ এর শিক্ষক বলা যায়। তাহলে তো এর অর্থ দাঁড়াবে তিনি শিক্ষক আর নবী ﷺ ছাত্র। এভাবে তো নবীর ﷺ তুলনায় জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মর্যাদা অধিক বলে স্বীকার করে নেয়া হয়। কিন্তু এরূপ সন্দেহ করা ভুল। কারণ, জিবরাঈল নবীকে ﷺ তাঁর নিজের জ্ঞান শিক্ষা দিতেন না যে, তার মর্যাদা অধিক হয়ে যাবে। তাঁকে আল্লাহ‌ তা’আলা রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ পর্যন্ত জ্ঞান পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম বানিয়েছিলেন। শিক্ষার মাধ্যম বা বাহক হওয়ার কারণে তিনি রূপক অর্থ নবীর ﷺ শিক্ষক ছিলেন। এতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কোন ব্যাপার নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার পর রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে নামাযের সঠিক সময় জানানোর জন্য তাঁকে দু’দিন পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহ‌ তা’আলা জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী এবং মুয়াত্তা প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে সহীহ সনদে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এসব হাদীসে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ নিজেই বলেছেন যে, তিনি মুক্তাদী হয়েছিলেন এবং জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ইমাম হয়ে নামায পড়েয়েছিলেন। এভাবে শুধু শিক্ষার জন্য তাঁকে ইমাম বানানোর অর্থ এ নয় যে, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবীর ﷺ চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। এটাও ঠিক অনুরূপ ব্যাপার।
# মূল আয়াতেذُو مِرَّةٍ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনে আব্বাস ও কাতাদা একে সুন্দর ও জাঁকজমকপূর্ণ অর্থে গ্রহণ করেছেন। মুজাহিদ, হাসান বাসরী, ইবনে যায়েদ এবং সুফিয়ান সাওরী বলেনঃ এর অর্থ শক্তিশালী। সাঈদ ইবনে মুসাইয়েবের মতে এর অর্থ জ্ঞানের অধিকারী। হাদীসে নবী ﷺ বলেছেনঃ لَا تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِيٍّ وَلَا لِذِي مِرَّةٍ سَوِيٍّ এ হাদীসে ذومرة শব্দকে তিনি সুস্থ ও সবল অর্থ ব্যবহার করেছেন। আরবী বাকরীতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে, সক্ষম, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী অর্থেও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এখানে জিবরাঈল আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে আল্লাহ‌ তা’আলা এ ব্যাপক অর্থব্যঞ্জক শব্দটি ব্যবহার করেছেন এই জন্য যে, তাঁর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক উভয় প্রকার শক্তি পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান। এর সবগুলো অর্থ এক সাথে বুঝানোর মত কোন শব্দ বাংলা ভাষায় নেই। তাই অনুবাদে আমরা এর মধ্য থেকে একটি অর্থকে গ্রহণ করেছি। কারণ, পূর্বের আয়াতাংশেই দৈহিক শক্তির পূর্ণতার উল্লেখ করা হয়েছে।
# দিগন্ত অর্থ আসমানের পূর্ব প্রান্ত যেখানে সূর্য উদিত হয় এবং দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ে। সূরা তাকভীরের ২৩ আয়াতে একেই পরিষ্কার দিগন্ত বলা হয়েছে। দু’টি আয়াত থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায় যে, নবী ﷺ প্রথমবার যখন জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেন তখন তিনি আসমানের পূর্ব প্রান্ত থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। নির্ভরযোগ্য কিছুসংখ্যক রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁকে মূল যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছিলেন সে সময় তিনি মূল আকৃতিতে ছিলেন। যে রেওয়ায়াতে এ বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে পরে আমরা তার সবগুলোই উদ্ধৃত করবো।
# আসমানের পূর্ব দিগন্তের উপরের দিকে আবির্ভূত হওয়ার পর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন এবং অগ্রসর হতে হতে তাঁর কাছে এসে উপর দিকে শূন্যে ঝুলে থাকলেন। এরপর তিনি তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন এবং এতটা নিকটবর্তী হলেন যে, তাঁর এবং রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মধ্যে মুখোমুখি দু’টি ধনুকের জ্যা পরিমাণ কিংবা তার চেয়েও কিছু কম ব্যবধান রইলো। সাধারণভাবে মুফাসসিরগণ قَابَ قَوْسَيْنِ অর্থ দুই ধনুক পরিমাণই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) قوس শব্দের অর্থ করেছেন হাত এবং كَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ অর্থ করেছেন এই যে, উভয়ের মাঝে তখন দুই হাত পরিমাণ ব্যবধান ছিল মুখোমুখি লাগানো দু’টি ধনুকের মধ্যবর্তী ব্যবধানের সমান কিংবা তার চেয়ে কিছু কম ব্যবধান ছিল বলার অর্থ এই নয় যে, দুরত্বের পরিমাণ নির্ণয়ের ব্যাপারে আল্লাহ‌ তা’আলার কোন সন্দেহ হয়েছে, (নাউযুবিল্লাহ্‌)। এ ধরনের বাচনভঙ্গী গ্রহণের কারণ হলে সব ধনুক একই পরিমাপের হয় না। সূতরাং ঐ হিসেব অনুসারে যদি কোন কোন দূরত্ব বর্ণনা করা হয় তাহলে দূরত্বের পরিমাণে অবশ্যই কম বেশী হবে।
# মূল আয়াত হচ্ছে, فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى । এ আয়াতাংশটির দু’টি অনুবাদ সম্ভব। একটি হচ্ছে, তিনি আল্লাহ‌র বান্দার প্রতি যা কিছু অহী নাযিল করার ছিল তা করলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তিনি অহী করলেন নিজের বান্দার ওপর যা কিছু অহী করার ছিল। প্রথম অনুবাদ করা হলে তার অর্থ হবে জিবরাঈল আল্লাহ‌র বান্দাকে অর্থাৎ রসূল ﷺ কে অহী দিলেন যা তাঁকে অহী দেয়ার ছিল। দ্বিতীয় অনুবাদটি করলে তার অর্থ হবে আল্লাহ‌ তা’আলা জিবরাঈলের মাধ্যমে তাঁর বান্দাহকে অহী দিলেন যা অহী দেয়ার ছিল। তাফসীরকারগণ এ দু’টি অর্থই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রথম অর্থটাই পূর্বাপর বিষয়ের সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল। হযরত হাসান বাসরী এবং ইবনে যায়েদ থেকে এ অর্থটাই বর্ণিত হয়েছে এক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, عَبدُهُ শব্দের ه সর্বনাম اوحى ক্রিয়ার কর্তার প্রতি ইঙ্গিত করার পরিবর্তে আল্লাহ‌র প্রতি কিভাবে ইঙ্গিত করবে? কারণ সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোথাও আদৌ আল্লাহ‌র নাম উল্লেখিত হয়নি। এর জবাব হলো, যেখানে বক্তব্যের পূর্ব প্রসঙ্গ দ্বারা সর্বনামের উদ্দিষ্ট বিশেষ ব্যক্তির প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেখানে পূর্বে উল্লেখ করা হোক বা না হোক সর্বনাম দ্বারা আপনা থেকেই সে ব্যক্তিকে বুঝাবো। কুরআন মজীদে এর অনেকগুলো দৃষ্টান্ত আছে। যেমনঃ আল্লাহ‌ তা’আলা বলেছেনঃ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ “আমি কদরের রাতে তা নাযিল করেছি।” এখানে কোথাও কুরআনের উল্লেখ মোটেই করা হয়নি। কিন্তু বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, ه সর্বনাম দ্বারা কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ

وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوا مَا تَرَكَ عَلَى ظَهْرِهَا مِنْ دَابَّةٍ

“আল্লাহ্‌ যদি মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করতে শুরু করেন তাহলে তার পৃষ্ঠে জীবন্ত কিছুই রাখবেন না।”

এখানে আগে বা পরে পৃথিবীর কোন উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু কথার ধরন থেকে আপনিই প্রকাশ পায় যে, তার পৃষ্ঠ অর্থ ভূ-পৃষ্ঠ। সূরা ইয়াসীনে বলা হয়েছে وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ

“আমি তাকে কবিতা শিক্ষা দেইনি। আর কবিতা তার জন্য শোভাও পায় না।” এখানে পূর্বে বা পরে কোথাও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু কথার ধরন থেকে প্রকাশ পায় যে, সর্বনামগুলো তাঁর প্রতি ইঙ্গিত করেছে। সূরা আর-রহমানে বলা হয়েছেঃ كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ

“তার ওপরে যা আছে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে।” এখানে আগে ও পরে পৃথিবী পৃষ্ঠের কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু বাচনভঙ্গি দ্বারা বুঝা যায় عليها এর সর্বনাম ها দ্বারা সেদিনকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

সূরা ওয়াকিয়ায় বলা হয়েছেঃ إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً

“আমি তাদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করবো। আশে পাশে এমন কোন বস্তু নেই যার প্রতি هُنّ শব্দটি দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। কথার ভঙ্গি থেকে প্রকাশ পায় যে, এর দ্বারা জান্নাতের নারীদের বুঝানো হয়েছে। জিবরাঈল নিজের বান্দাকে অহী দিলেন اَوْحَى اِلَى عَبْدِهِ আয়াতাংশের অর্থ যেহেতু এরকম হতে পারে না। তাই “জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহ‌র বান্দাকে অহী দিলেন কিংবা আল্লাহ‌ জিবরাঈলের মাধ্যমে তাঁর বান্দাকে অহী দিলেন।” অনিবার্যরূপে এই অর্থই গ্রহণ করতে হবে।
# দিনের আলোতে, পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় এবং খোলা চোখে মুহাম্মাদ ﷺ যা কিছু দেখলেন সে সম্পর্কে তাঁর মন বলেনি যে, এসব দৃষ্টিভ্রম কিংবা আমি কোন জ্বিন বা শয়তান দেখছি কিংবা আমার সামনে কোন কাল্পনিক ছবি ভেসে উঠেছে এবং জেগে জেগেই কোন স্বপ্ন দেখছি। বরং তাঁর চোখ যা দেখছিলো মন হুবহু তাই বিশ্বাস করেছে। তিনি যে সত্যি সত্যিই জিবরাঈল এবং যে বাণী তিনি পৌঁছিয়ে দিচ্ছিলেন তাও বাস্তবে আল্লাহ‌র অহী সে ব্যাপারে তার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি।

এখানে প্রশ্ন জাগে যে, কি কারণে এ বিস্ময়কর ও অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখা সত্ত্বেও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মনে আদৌ কোন সন্দেহ সৃষ্টি হলো না এবং তিনি পূর্ণ নিশ্চয়তা সহ জানতে পারলেন যে, তাঁর চোখ যা দেখছে তা প্রকৃতপক্ষেই সত্য ও বাস্তব, কোন কাল্পনিক বস্তু বা কোন জিন কিংবা শয়তান নয়? এ প্রশ্ন নিয়ে আমরা যখন গভীরভাবে চিন্তা করি তখন পাঁচটি কারণ আমাদের বোধগম্য হয়।

প্রথম কারণ, যে পারিপার্শিক অবস্থা ও পরিবেশ দেখার কাজটি সংঘটিত হয়েছিল সেটাই তার সত্যতা সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করে দেয়। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ অন্ধকারে মুরাকাবারত অবস্থায় স্বপ্নে কিংবা অর্ধ জাগ্রত অবস্থায় এ দর্শন লাভ করেছিলেন না, বরং তখন সকালের পরিষ্কার আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত ছিল, তিনি পুরোপুরি জাগ্রত ছিলেন, খোলা আকাশে এবং দিনের পূর্ণ আলোতে তিনি নিজ চোখে ঠিক তেমনিভাবে এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন যেমন কোন ব্যক্তি পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস দেখে থাকে। এতে যদি সন্দেহের অবকাশ থাকে তাহলে আমরা দিনের বেলা নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মানুষ, ঘরবাড়ী, মোট কথা যা কিছু দেখে থাকি তা সবই সন্দেহ যুক্ত এবং শুধু দৃষ্টিভ্রম ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।

দ্বিতীয় কারণ, নবী ﷺ এর মানসিক অবস্থাও এর সত্যতার স্বপক্ষে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করেছিলো। তিনি পূর্ণরূপে স্বজ্ঞান ও সুস্থ ছিলেন। তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ সুস্থ ও সচল ছিল। তাঁর মন-মগজে পূর্ব থেকে এরূপ কোন খেয়াল চেপে ছিল না যে, এ ধরনের কোন দর্শন লাভ হওয়া উচিত বা হতে যাচ্ছে। এরূপ চিন্তা এবং তা অর্জন করার চেষ্টা থেকে মন-মগজ সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল। এ পরিস্থিতিতে তিনি আকস্মিকভাবে এ ঘটনার মুখোমুখি হলেন। তাই সন্দেহ করার আদৌ কোন অবকাশ ছিল না যে, চোখ কোন বাস্তব দৃশ্য দেখছে না, বরং সামনে এসে দাঁড়ানো একটি কাল্পনিক বস্তু দেখছে।

তৃতীয় কারণ, এ পরিস্থিতিতে তাঁর সামনে যে সত্ত্বা আবির্ভূত হয়েছিল তা এত বিরাট, এত জাঁকালো, এত সুন্দর এবং এতই আলোকোদ্ভাসিত ছিল যে, ইতিপূর্বে নবীর ﷺ চিন্তায় ও ধ্যান-ধারণায় এরূপ সত্ত্বার কল্পিত রূপও আসেনি। সুতরাং তা তাঁর কল্পনা প্রসূতও ছিল না। কোন জিন বা শয়তান এমন জাঁকালো হতে পারে না। তাই তিনি তাকে ফেরেশতা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ থেকে বর্থিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেনঃ সে সময় আমি জিবরাঈলকে দেখেছি, তাঁর তখন ছয়শত ডানা ছিল (মুসনাদে আহমাদ)। অপর একটি বর্ণনায় আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আরো ব্যাখ্যা করেছেন যে, জিবরাঈল আলাইহিস সালামের এক একটি ডানা এমন বিশাল ছিল যে, গোটা দিগন্ত জুড়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল (মুসনাদে আহমাদ)। আল্লাহ‌ তায়ালা নিজে তাঁর অবস্থাকে شَدِيدُ الْقُوَى এবং ذُو مِرَّةٍ শব্দ দিয়ে বর্ণনা করেছেন।

চতুর্থ কারণ, সে সত্ত্বা যেসব শিক্ষা দান করেছিলেন তাও এ সাক্ষাতের সত্যতা সম্পর্কে প্রশান্তিদায়ক ছিল। তাঁর মাধ্যমে তিনি হঠাৎ যেসব জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গোটা মহাবিশ্বের প্রকৃত সত্য ও তাৎপর্যের ধারক যেসব জ্ঞান লাভ করলেন তাঁর মন-মগজে সে সম্পর্কে কোন ধারণাও ছিল না। তাই তিনি সন্দেহ করেননি যে, আমারই ধ্যান-ধারণা ও কল্পনা সুবিন্যস্ত হয়ে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। অনুরূপভাবে ঐ জ্ঞান সম্পর্কে এমন সন্দেহ পোষণেরও কোন অবকাশ ছিল না যে, শয়তান ঐ আকৃতিতে এসে তাঁকে ধোঁকা দিচ্ছে। কারণ, মানুষকে শিরক ও মূর্তিপূজার পরিবর্তে নির্ভেজাল তাওহীদের শিক্ষা দেয়া কি কখনো শয়তানের কাজ হতে পারে, না শয়তান কোনদিন এমন কাজ করেছে? আখেরাতের জবাবদিহি সম্পর্কে কি শয়তান কখনো মানুষকে সাবধান করেছে? জাহেলীয়াত ও তার রীতিনীতির বিরুদ্ধে কি মানুষকে কখনো ক্ষেপিয়ে তুলেছে? নৈতিক গুণাবলীর প্রতি কি আহবান জানিয়েছে? না কি কোন ব্যক্তিকে বলেছে তুমি নিজে শুধু এ শিক্ষাকে গ্রহণ কর তাই নয়, বরং গোটা বিশ্বের বুক থেকে শিরক জুলুম এবং পাপ পঙ্কিলতাকে উৎখাত এবং ঐসব দুস্কৃতির জায়গায় তাওহীদ, ন্যায়বিচার এবং তাকওয়ার সুফলসমূহ প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাও?

পঞ্চম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, আল্লাহ‌ তা’আলা যখন কোন ব্যক্তিকে নবুওয়াত দানের জন্য বাছাই করেন তখন তাঁর হৃদয়-মনকে সব রকম সন্দেহ সংশয় ও শয়তানী প্ররোচনা থেকে মক্ত করে দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় দ্বারা পূর্ণ করে দেন। এ অবস্থায় তাঁর চোখ যা দেখে এবং কান যা শোনে তার সত্যতা সম্পর্কে তাঁর মন-মগজে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয় না। তিনি সম্পূর্ণ উদার ও উন্মুক্ত মনে এমন প্রতিটি সত্যকে গ্রহণ করে নেন যা তাঁর রবের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে প্রকাশ হয়। তা চোখে দেখার মত প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষন হতে পারে, ইলহামী জ্ঞান হিসেবে তার মনে সৃষ্টি করা হতে পারে কিংবা অহীর পয়গাম হিসেবে আসতে পারে একটি একটি করে যার প্রতিটি শব্দ শুনানো হয়ে থাকে। এর সবকটি ক্ষেত্রেই নবীর এ উপলব্ধি পুরোপুরিই থাকে যে, তিনি সব রকম শয়তানী হস্তক্ষেপ থেকে চূড়ান্তভাবে সুরক্ষিত। যে আকারেই হোক না কেন যা কিছু তাঁর কাছে পৌঁছেছে তা অবিকল তাঁর প্রভুর নিকট থেকে এসেছে। আল্লাহ‌ প্রদত্ত সমস্ত অনুগ্রহ ও নিয়ামতের মত নবীর এ উপলব্ধি ও অনুভূতিও এমন একটি নিশ্চিত জিনিস যার মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি বা বিভ্রান্তির কোন সম্ভাবনা নেই। মাছের যেমন তার সাঁতারু হওয়া সম্পর্কে অনুভূতি আছে এবং তা আল্লাহ‌ প্রদত্ত। এতে যেমন বিভ্রান্তির লেশমাত্র থাকতে পারে না। অনুরূপ নবীর তাঁর নবী হওয়া সম্পর্কে যে অনূভূতি তাও আল্লাহ‌ প্রদত্ত হয়ে থাকে। কখনো এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে এ সন্দেহ জাগে না যে, নবী হওয়ার ব্যাপারে হয়তো সে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।
# দিনের আলোতে, পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় এবং খোলা চোখে মুহাম্মাদ ﷺ যা কিছু দেখলেন সে সম্পর্কে তাঁর মন বলেনি যে, এসব দৃষ্টিভ্রম কিংবা আমি কোন জ্বিন বা শয়তান দেখছি কিংবা আমার সামনে কোন কাল্পনিক ছবি ভেসে উঠেছে এবং জেগে জেগেই কোন স্বপ্ন দেখছি। বরং তাঁর চোখ যা দেখছিলো মন হুবহু তাই বিশ্বাস করেছে। তিনি যে সত্যি সত্যিই জিবরাঈল এবং যে বাণী তিনি পৌঁছিয়ে দিচ্ছিলেন তাও বাস্তবে আল্লাহ‌র অহী সে ব্যাপারে তার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি।

এখানে প্রশ্ন জাগে যে, কি কারণে এ বিস্ময়কর ও অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখা সত্ত্বেও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মনে আদৌ কোন সন্দেহ সৃষ্টি হলো না এবং তিনি পূর্ণ নিশ্চয়তা সহ জানতে পারলেন যে, তাঁর চোখ যা দেখছে তা প্রকৃতপক্ষেই সত্য ও বাস্তব, কোন কাল্পনিক বস্তু বা কোন জিন কিংবা শয়তান নয়? এ প্রশ্ন নিয়ে আমরা যখন গভীরভাবে চিন্তা করি তখন পাঁচটি কারণ আমাদের বোধগম্য হয়।

প্রথম কারণ, যে পারিপার্শিক অবস্থা ও পরিবেশ দেখার কাজটি সংঘটিত হয়েছিল সেটাই তার সত্যতা সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করে দেয়। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ অন্ধকারে মুরাকাবারত অবস্থায় স্বপ্নে কিংবা অর্ধ জাগ্রত অবস্থায় এ দর্শন লাভ করেছিলেন না, বরং তখন সকালের পরিষ্কার আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত ছিল, তিনি পুরোপুরি জাগ্রত ছিলেন, খোলা আকাশে এবং দিনের পূর্ণ আলোতে তিনি নিজ চোখে ঠিক তেমনিভাবে এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন যেমন কোন ব্যক্তি পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস দেখে থাকে। এতে যদি সন্দেহের অবকাশ থাকে তাহলে আমরা দিনের বেলা নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মানুষ, ঘরবাড়ী, মোট কথা যা কিছু দেখে থাকি তা সবই সন্দেহ যুক্ত এবং শুধু দৃষ্টিভ্রম ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।

দ্বিতীয় কারণ, নবী ﷺ এর মানসিক অবস্থাও এর সত্যতার স্বপক্ষে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করেছিলো। তিনি পূর্ণরূপে স্বজ্ঞান ও সুস্থ ছিলেন। তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ সুস্থ ও সচল ছিল। তাঁর মন-মগজে পূর্ব থেকে এরূপ কোন খেয়াল চেপে ছিল না যে, এ ধরনের কোন দর্শন লাভ হওয়া উচিত বা হতে যাচ্ছে। এরূপ চিন্তা এবং তা অর্জন করার চেষ্টা থেকে মন-মগজ সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল। এ পরিস্থিতিতে তিনি আকস্মিকভাবে এ ঘটনার মুখোমুখি হলেন। তাই সন্দেহ করার আদৌ কোন অবকাশ ছিল না যে, চোখ কোন বাস্তব দৃশ্য দেখছে না, বরং সামনে এসে দাঁড়ানো একটি কাল্পনিক বস্তু দেখছে।

তৃতীয় কারণ, এ পরিস্থিতিতে তাঁর সামনে যে সত্ত্বা আবির্ভূত হয়েছিল তা এত বিরাট, এত জাঁকালো, এত সুন্দর এবং এতই আলোকোদ্ভাসিত ছিল যে, ইতিপূর্বে নবীর ﷺ চিন্তায় ও ধ্যান-ধারণায় এরূপ সত্ত্বার কল্পিত রূপও আসেনি। সুতরাং তা তাঁর কল্পনা প্রসূতও ছিল না। কোন জিন বা শয়তান এমন জাঁকালো হতে পারে না। তাই তিনি তাকে ফেরেশতা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ থেকে বর্থিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেনঃ সে সময় আমি জিবরাঈলকে দেখেছি, তাঁর তখন ছয়শত ডানা ছিল (মুসনাদে আহমাদ)। অপর একটি বর্ণনায় আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আরো ব্যাখ্যা করেছেন যে, জিবরাঈল আলাইহিস সালামের এক একটি ডানা এমন বিশাল ছিল যে, গোটা দিগন্ত জুড়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল (মুসনাদে আহমাদ)। আল্লাহ‌ তায়ালা নিজে তাঁর অবস্থাকে شَدِيدُ الْقُوَى এবং ذُو مِرَّةٍ শব্দ দিয়ে বর্ণনা করেছেন।

চতুর্থ কারণ, সে সত্ত্বা যেসব শিক্ষা দান করেছিলেন তাও এ সাক্ষাতের সত্যতা সম্পর্কে প্রশান্তিদায়ক ছিল। তাঁর মাধ্যমে তিনি হঠাৎ যেসব জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গোটা মহাবিশ্বের প্রকৃত সত্য ও তাৎপর্যের ধারক যেসব জ্ঞান লাভ করলেন তাঁর মন-মগজে সে সম্পর্কে কোন ধারণাও ছিল না। তাই তিনি সন্দেহ করেননি যে, আমারই ধ্যান-ধারণা ও কল্পনা সুবিন্যস্ত হয়ে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। অনুরূপভাবে ঐ জ্ঞান সম্পর্কে এমন সন্দেহ পোষণেরও কোন অবকাশ ছিল না যে, শয়তান ঐ আকৃতিতে এসে তাঁকে ধোঁকা দিচ্ছে। কারণ, মানুষকে শিরক ও মূর্তিপূজার পরিবর্তে নির্ভেজাল তাওহীদের শিক্ষা দেয়া কি কখনো শয়তানের কাজ হতে পারে, না শয়তান কোনদিন এমন কাজ করেছে? আখেরাতের জবাবদিহি সম্পর্কে কি শয়তান কখনো মানুষকে সাবধান করেছে? জাহেলীয়াত ও তার রীতিনীতির বিরুদ্ধে কি মানুষকে কখনো ক্ষেপিয়ে তুলেছে? নৈতিক গুণাবলীর প্রতি কি আহবান জানিয়েছে? না কি কোন ব্যক্তিকে বলেছে তুমি নিজে শুধু এ শিক্ষাকে গ্রহণ কর তাই নয়, বরং গোটা বিশ্বের বুক থেকে শিরক জুলুম এবং পাপ পঙ্কিলতাকে উৎখাত এবং ঐসব দুস্কৃতির জায়গায় তাওহীদ, ন্যায়বিচার এবং তাকওয়ার সুফলসমূহ প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাও?

পঞ্চম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, আল্লাহ‌ তা’আলা যখন কোন ব্যক্তিকে নবুওয়াত দানের জন্য বাছাই করেন তখন তাঁর হৃদয়-মনকে সব রকম সন্দেহ সংশয় ও শয়তানী প্ররোচনা থেকে মক্ত করে দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় দ্বারা পূর্ণ করে দেন। এ অবস্থায় তাঁর চোখ যা দেখে এবং কান যা শোনে তার সত্যতা সম্পর্কে তাঁর মন-মগজে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয় না। তিনি সম্পূর্ণ উদার ও উন্মুক্ত মনে এমন প্রতিটি সত্যকে গ্রহণ করে নেন যা তাঁর রবের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে প্রকাশ হয়। তা চোখে দেখার মত প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষন হতে পারে, ইলহামী জ্ঞান হিসেবে তার মনে সৃষ্টি করা হতে পারে কিংবা অহীর পয়গাম হিসেবে আসতে পারে একটি একটি করে যার প্রতিটি শব্দ শুনানো হয়ে থাকে। এর সবকটি ক্ষেত্রেই নবীর এ উপলব্ধি পুরোপুরিই থাকে যে, তিনি সব রকম শয়তানী হস্তক্ষেপ থেকে চূড়ান্তভাবে সুরক্ষিত। যে আকারেই হোক না কেন যা কিছু তাঁর কাছে পৌঁছেছে তা অবিকল তাঁর প্রভুর নিকট থেকে এসেছে। আল্লাহ‌ প্রদত্ত সমস্ত অনুগ্রহ ও নিয়ামতের মত নবীর এ উপলব্ধি ও অনুভূতিও এমন একটি নিশ্চিত জিনিস যার মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি বা বিভ্রান্তির কোন সম্ভাবনা নেই। মাছের যেমন তার সাঁতারু হওয়া সম্পর্কে অনুভূতি আছে এবং তা আল্লাহ‌ প্রদত্ত। এতে যেমন বিভ্রান্তির লেশমাত্র থাকতে পারে না। অনুরূপ নবীর তাঁর নবী হওয়া সম্পর্কে যে অনূভূতি তাও আল্লাহ‌ প্রদত্ত হয়ে থাকে। কখনো এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে এ সন্দেহ জাগে না যে, নবী হওয়ার ব্যাপারে হয়তো সে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।
# এটা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সাথে নবী ﷺ এর দ্বিতীয়বারের মত সাক্ষাত। এ সাক্ষাতের সময় জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবীর ﷺ সামনে তাঁর আসল চেহারায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ সাক্ষাতকারের স্থান বলা হয়েছে سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى । সাথে সাথে একথাও বলা হয়েছে যে, তার নিকটেই “জান্নাতুল মা’ওয়া” অবস্থিত। আরবীতে ‘সিদরা’ বলা হয় রবই গাছকে আর ‘মুনতাহা’ অর্থ শেষ প্রান্ত সুতরাং سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে শেষ প্রান্তে অবস্থিত বরই-গাছ। আল্লামা আলূসী “রুহুল মাআনীতে” এর ব্যাখ্যা করেছেনঃ اليها ينتهى علم كل عالم وما وراء ها لا يعلمه الا الله “এ পর্যন্ত গিয়ে সব জ্ঞানীর জ্ঞান শেষ হয়ে যায়। এর পরে যা আছে তা আল্লাহ‌ ছাড়া কেউ জানে না।” ইবনে জারীর তাঁর তাফসীরে এবং ইবনে কাসীর” انهاية فى غريب الحديث والاثر এও প্রায় অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। বস্তু জগতের শেষ প্রান্তে অবস্থিত সে কুল বৃক্ষ কেমন এবং তার প্রকৃতি ও পরিচয় কি তা জানা আমাদের জন্য কঠিন। এটা আল্লাহ‌ তা’আলার সৃষ্ট মহাবিশ্বের এমন রহস্যাবৃত বিষয় যেখানে আমাদের বোধ ও উপলব্ধি পৌঁছতে অক্ষম। যাই হোক, সেটা হয়তো এমন কোন জিনিস যা বুঝানোর মানুষের ভাষায় سدرة শব্দের চেয়ে অধিক উপযুক্ত শব্দ আল্লাহ‌ তা’আলা আর কোন কিছুকে মনে করেননি।

“জান্নাতুল মা’ওয়া”র আভিধানিক অর্থ এমন জান্নাত যা অবস্থান স্থল হতে পারে। হযরত হাসান বাসরী বলেনঃ এটি সেই জান্নাত যা আখেরাতে ঈমানদার ও তাকওয়ার অধিকারী লোকেরা লাভ করবে। এ আয়াত দ্বারাই তিনি প্রমাণ করেছেন যে, এ জান্নাত আসমানে অবস্থিত। কাতাদা (রাঃ) বলেনঃ এটাই সে জান্নাত যেখানে শহীদদের রূহসমূহ রাখা হয়। আখেরাতের যে জান্নাত পাওয়া যাবে এটা সে জান্নাত নয়। ইবনে আব্বাসও (রাঃ) একথাই বলেন। তিনি অধিক এতটুকু বলেছেন যে আখেরাতে ঈমানদারগণ যে জান্নাত লাভ করবেন এটা সে জান্নাত নয়। সে জান্নাতের স্থান এ পৃথিবীতেই।
# তার অবস্থাও প্রকৃত বর্ণনার অতীত। সেটা ছিল এমন আলোকোচ্ছটা মানুষ যার কল্পনাও করতো না এবং মানুষের কোন ভাষা তার বর্ণনা দিতেও সক্ষম নয়।
# একদিকে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর চরম সহ্য ও গ্রহণ ক্ষমতার অবস্থা ছিল এই যে, এ ধরনের সাংঘাতিক আলোকোচ্ছ্বটার সামনেও তাঁর দৃষ্টি কোন রকম ঝলসে যায়নি। তিনি পূর্ণ প্রশান্তিসহ ঐ সব দেখেছেন। অপরদিকে তাঁর সংযম ও একাগ্রতার পরাকাষ্ঠা ছিল এই যে, যে উদ্দেশ্যে তাঁকে ডেকে নেয়া হয়েছিল সেদিকেই তিনি তাঁর মন-মগজ ও দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। যেসব বিস্ময়কর দৃশ্যাবলী সেখানে ছিল তা দেখার জন্য তিনি একজন কৌতুহলী ও বিমুগ্ধ দর্শকের মত এদিক সেদিক দৃষ্টি দেননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কোন ব্যক্তি কোন পরাক্রমশালী বাদশাহর দরবারে যাওয়ার সুযোগ লাভ করলো এবং সেখানে সে এমন জাঁকজমকপূর্ণ কিছু জিনিস দেখতে পেল যা সে কোন দিন কল্পনার চোখ দিয়েও দেখেনি। লোকটি যদি নীচাশয় হয় তাহলে সেখানে গিয়ে সে বিস্ময় বিমুঢ় হয়ে পড়বে এবং দরবারের আদব কায়দা সম্পর্কে যদি অজ্ঞ হয় তাহলে শাহী মর্যাদা সম্পর্কে অমনযোগী হয়ে দরবারের সাজ সজ্জা দেখার জন্য সবদিকে ঘুরে ঘুরে তাকাতে থাকবে। কিন্তু একজন উঁচুমনা ও বুদ্ধিমান, রীতিনীতি ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে সচেতন এবং কর্তব্য পরায়ণ কোন ব্যক্তি সেখানে গিয়ে হতভম্ব হবে না এবং দরবারের দৃশ্য দেখার জন্যও ব্যস্ত হয়ে পড়বে না। সে গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে সেখানে হাজির হবে। যে উদ্দেশ্যে তাকে দরবারে ডাকা হয়েছে সেদিকে মনোনিবেশ করবে। এ আয়াতে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর এ গুণটির প্রশংসা করা হয়েছে।
# এ আয়াত থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পায় যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ আল্লাহ‌ তা’আলাকে দেখেননি কেবল তার বিশাল ও বিপুল নিদর্শনাদি দেখেছেন। যেহেতু পূর্বাপর প্রসঙ্গ বিচারে দ্বিতীয় বারও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর সে সত্ত্বার সাথে সাক্ষাত হয়েছিল যার সাথে প্রথম বার সাক্ষাত ঘটেছিল। তাই অনিবার্যরূপে একথা মানতে হবে যে, প্রথমবার তিনি উঁচু দিগন্তে যাকে দেখেছিলেন তিনিও আল্লাহ‌ ছিলেন না এবং দ্বিতীয়বার سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى ’র কাছে যাকে দেখেছিলেন তিনিও আল্লাহ‌ ছিলেন না। এ দু’টি ক্ষেত্রের কোন একটিতেও যদি তিনি আল্লাহ‌কে দেখতেন তাহলে তা হতো এমন একটি অতি গুরুত্ব পূর্ণ ব্যাপার যা অবশ্যই স্পষ্ট করে বলে দেয়া হতো। হযরত মূসা সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে তিনি আল্লাহ‌ তা’আলাকে দেখার প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে জবাব দেয়া হয়েছিল لَنْ تَرَانِي “তুমি আমাকে দেখতে পারবে না।” (আল আ’রাফ- ১৪৩ )। সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, হযরত মূসাকে যে মর্যাদা দেয়া হয়নি তা যদি রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে দেয়া হতো তাহলে তা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হতো। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি কুরআন মজীদে কোথাও বলা হয়নি, নবী ﷺ তাঁর রবকে দেখেছিলেন। পক্ষান্তরে মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে সূরা বনী ইসরাঈলেও বলা হয়েছে, আমি আমার বান্দাকে নিয়ে গিয়েছিলাম এজন্য যে, তাকে আমার নিদর্শনাদি দেখাবো।” ( لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ) আর ‘সিদরাতুল মুনতাহায়’ যাওয়া প্রসঙ্গে এখানে বলা হয়েছে যে, তিনি তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শন দেখেছেন।

لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى

এসব কারণে বাহ্যত এ বিতর্কের কোন প্রয়োজনই ছিল না যে, এ দু’টি ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ আল্লাহ‌ তা’আলাকে দেখেছিলেন, না জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন? কিন্তু যে কারণে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা হচ্ছে, এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীসসমূহে মতানৈক্য দেখা যায়। এ বিষয়ে বিভিন্ন সাহাবা কিরাম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ আমরা নীচে এক এক করে বর্ণনা করলাম।

একঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহঃ হাদীস গ্রন্থ বুখারীর কিতাবুত তাফসীরে হযরত মাসরূক থেকে বর্ণিত হয়েছে, আমি হযরত আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম; “আম্মাজান, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ কি আল্লাহ‌কে দেখেছিলেন? ” তিনি জবাব দিলেন।”তোমার একথা শুনে আমার গায়ের পশম শিউরে উঠেছে। তুমি কি করে ভুলে গেলে যে, তিনটি বিষয় এমন যা কেউ দাবী করলে মিথ্যা দাবী করা হবে।” (তার মধ্যে প্রথম কথাটি হয়রত আয়েশা (রাঃ) যা বললেন, তা হচ্ছে) “কেউ যদি তোমাকে বলে যে, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহ‌কে দেখেছিলেন, তাহলে সে মিথ্যা বলে।” তারপর হযরত আয়েশা (রাঃ) এ আয়াতগুলো পাঠ করলেন। لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ (দৃষ্টিসমূহ তাঁকে দেখতে সক্ষম নয়।)

وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلَّا وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولًا فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ

“কোন মানুষেরই এমন মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ‌ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তবে হয় অহী হিসেবে বা পর্দার আড়াল থেকে কিংবা তিনি কোন ফেরেশতা পাঠাবেন এবং সে তাঁর ইচ্ছা মাফিক তার প্রতি অহী নাযিল করবে।” এরপর তিনি বললেনঃ “তবে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দু’বার তাঁর আসল আকৃতিতে দেখেছেন।”

এ হাদীসের একটি অংশ বুখারীর কিতাবুত তাওহীদের ৪র্থ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া বাদউল খালক অধ্যায়ে ইমাম বুখারীর মাসরূক বর্ণিত যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তাতে মাসরূপ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। হযরত আয়েশার একথা শুনে আমি বললাম তাহলে আল্লাহ‌ তা’আলার একথার কি অর্থ হবে? ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى – فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى তিনি বললেন এর দ্বারা জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। তিনি সব সময় মানুষের রূপ ধরে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর কাছে আসতেন। কিন্তু ঐ সময় তিনি তাঁর আসল আকৃতিতে তাঁর কাছে এসেছিলেন এবং তাঁর শরীরে গোটা দিগন্ত আড়াল হয়ে গিয়েছিল।

মুসলিম কিতাবুল ঈমানের باب فى ذكر كدرة المنتهى এ হযরত আয়েশার (রাঃ) সাথে মাসরূকের এ কথোপকথন অধিক বিস্তারিত রূপে উদ্ধৃত হয়েছে। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছেঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ যে ব্যক্তি দাবী করে যে, মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর রবকে দেখেছেন সে আল্লাহ‌ তা’আলার প্রতি অতি বড় অপবাদ আরোপ করে।” মাসরূক বলেনঃ আমি হেলান দিয়ে বসেছিলাম। একথা শুনে আমি উঠে বসলাম এবং বললাম উম্মুল মু’মিনীন তাড়াহুড়ো করবেন না। আল্লাহ‌ তা’আলা কি বলেন নি وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى এবং وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِينِ জবাবে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ এ উম্মতের মধ্যে আমিই সর্ব প্রথম এ ব্যাপারে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেনঃ

إِنَّمَا هُوَ جِبْرِيلُ عليه السلام, لَمْ أَرَهُ عَلَى صُورَتِهِ الَّتِى خُلِقَ عَلَيْهَا غَيْرَ هَاتَيْنِ الْمَرَّتَيْنِ- رَأَيْتُهُ مُنْهَبِطًا مِنَ السَّمَاءِ سَادًّا عِظَمُ خَلْقِهِ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ والأَرْضِ-

তিনি তো ছিলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁকে যে আকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সে আসল আকৃতিতে আমি তাঁকে এ দু’বার ছাড়া আর কখনো দেখিনি। দু’বারই আমি তাঁকে আসমান থেকে নেমে আসতে দেখেছি। সে সময় তাঁর বিশাল সত্তা পৃথিবী ও আসমানের মধ্যবর্তী সমগ্র শূন্যলোক ছেয়ে ফেলেছিলো।” মাসরূক বর্ণিত এ হাদীস ইবনে মারদুইয়া যে ভাষায় বর্ণনা করেছেন তা হচ্ছেঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেনঃ আমিই সর্ব প্রথম রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছিলামঃ আপনি কি আপনার রবকে দেখেছিলেন? জবাবে নবী ﷺ বললেন, না। “আমি তো জিবরাঈলকে আসমান থেকে নেমে আসতে দেখেছিলাম।”

দুইঃ হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহঃ বুখারী কিতাবুত তাফসীর, মুসলিম কিতাবুল ঈমান এবং তিরমিযী আবওয়াবুত তাফসীরে যির ইবনে হুবাইশ থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى আয়াতটির তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে এমন আকৃতিতে দেখেছেন যে, তাঁর ছয়শত ডানা ছিল। মুসলিমে অন্যান্য রেওয়ায়াতে مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى এবং لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى আয়াতেরও এ একই তাফসীর আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে যির ইবনে হুবাইশ বর্ণনা করেছেনঃ মুসনাদে আহমাদে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদের এ তাফসীর যির ইবনে হুবাইশ ছাড়া আবদুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ এবং আবু ওয়ায়েলের মাধ্যমেও বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়াও মুসনাদে আহমাদে যির ইবনে হুবাইশের আরো দু’টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যাতে হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ) وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى – عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى আয়াতের তাফসীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُ جِبْرِيلَ عند سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى عليه سِتُّمِائَةِ جَنَاحٍ-

“রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেনঃ “আমি জিবরাঈলকে সিদরাতুল মুনতহার কাছে দেখেছি। সে সময় তাঁর ছয়শত ডানা ছিল।”

এ একই বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস শাকীক ইবনে সালামা থেকে ইমাম আহমদও বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসে বলেছেন, আমি আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদের (রাঃ) মুখ থেকে শুনেছি যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ নিজে বলেছিলেনঃ আমি জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে এ আকৃতিতে “সিদরাতুল মুনহাতায়” দেখেছিলাম।

তিনঃ আতা ইবনে আবী রাবাহ হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কে وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেনঃ رَأَى جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ নবী ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন (মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)। চারঃ ইমাম মুসলিম কিতাবুল ঈমানে হযরত আবু যার গিফারীর মাধ্যমে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে শাকীক বর্ণিত দু’টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। এক রেওয়াতে তিনি বলেছেনঃ আমি রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আপনার রবকে দেখেছিলেন? জবাবে নবী ﷺ বললেনঃ نُورٌ أَنَّى أَرَاهُ । অপর রেওয়ায়াতে বলেছেনঃ তিনি আমার এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেনঃ رَأَيْتُ نُورًا । ইবনুল কাইয়েম زاد المعاد গ্রন্থে নবী ﷺ এর প্রথম উক্তির অর্থ বর্ণনা করে বলেছেন আমার ও আল্লাহ‌কে দেখার মধ্যে প্রতিবন্ধক ছিল নূর। তিনি দ্বিতীয় উক্তির অর্থ বর্ণনা করেছেন এই যে, আমি আমার রবকে দেখিনি, বরং নূর দেখেছি।” নাসায়ী ও ইবনে আবী হাতেম নিম্নোক্ত ভাষায় হযরত আবু যারের (রাঃ) বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ অন্তর দিয়ে তাঁর রবকে দেখেছেন, চোখ দিয়ে দেখেন নি।”

পাঁচঃ ইমাম মুসলিম কিতাবুল ঈমানে হযরত আবু মুসা আশ’আরী (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীসে নবী ﷺ বলেছেনঃ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ “আল্লাহ্‌ তা’আলার সৃষ্টির মধ্য থেকে কারো চোখই আল্লাহ‌ তা’আলা পর্যন্ত পৌঁছেনি।”

ছয়ঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসসমূহঃ মুসলিমের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাসকে – مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى- وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى আয়াত দু’টির অর্থ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ তাঁর রবকে দু’বার অন্তর দিয়ে দেখেছেন। মুসনাদে আহমাদেও এ হাদীসটি আছে। আতা ইবনে আবী রাবাহর বরাত দিয়ে ইবনে মারদুইয়াহ ইবনে আব্বাসের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ আল্লাহ‌ তা’আলাকে চোখ দিয়ে নয়, অন্তর দিয়ে দেখেছিলেন। নাসায়ীতে ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবনে আব্বাস বলেছেনঃ

اتعجبون ان تكون الخلة لابراهيم والكلام لموسى والروية لمحمد؟

“আল্লাহ্‌ তা’আলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন, মূসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলে তাঁকে সম্মানিত করেছেন এবং মুহাম্মাদ ﷺ কে তাঁর দর্শনলাভের মর্যাদা দিয়েছেন” এতে কি তোমরা বিস্ময়বোধ করছো? হাকেমও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং একে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।

তিরমিযীতে শা’বী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবনে আব্বাস এক মজলিসে বললেনঃ আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর সাক্ষাত লাভ ও কথোপকথনকে মুহাম্মাদ ﷺ ও মূসা আলাইহিস সালামের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তিনি মুসা আলাইহিস সালামের সাথে দু’বার কথা বলেছেন এবং মুহাম্মাদ ﷺ তাঁকে দু’বার দেখেছেন।” ইবনে আব্বাসের এ কথা শুনে মাসরূক হযরত আয়েশার (রাঃ) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ মুহম্মাদ ﷺ কি তাঁর রবকে দেখেছিলেন? তিনি বললেনঃ “তুমি এমন কথা বলেছো যা শুনে আমার পশম শিউরে উঠেছে।” এরপর হযরত আয়েশা (রাঃ) ও মাসরূকের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে আমরা উপরে হযরত আয়েশার (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে উদ্ধৃত করেছি।

তিরমিযীতেই অন্য যেসব হাদীস ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে তার একটিতে তিনি বলেছেন, নবী ﷺ আল্লাহ‌ তা’আলাকে দেখেছিলেন। দ্বিতীয় একটি হাদীসে বলেছেন; দু’বার দেখেছিলেন এবং তৃতীয় আরেকটি হাদীসে বলেছেন, তিনি অন্তর দিয়ে আল্লাহ‌ তা’আলাকে দেখেছিলেন।”

মুসনাদে আহমাদে ইবনে আব্বাস বর্ণিত একটি হাদীসে আছেঃ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُ رَبِّى تَبَارَكَ وَتَعَالَى

“আমি আমার মহাকল্যাণময় ও মর্যাদাবান রবকে দেখেছি।” আরেকটি হাদীসে তিনি বলেনঃ

أَنَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم قَالَ أَتَانِى رَبِّى اللَّيْلَةَ فِى أَحْسَنِ صُورَةٍ – أَحْسِبُهُ يَعْنِى فِى النَّوْمِ-

রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেনঃ “আমার রব আজ রাতে অতীব সুন্দর আকৃতিতে আমার কাছে এসেছিলেন। আমার মনে হয় নবীর ﷺ এ কথার অর্থ তিনি স্বপ্নে আল্লাহ‌ তা’আলাকে দেখেছিলেন।” তাবারানী ও ইবনে মারদুইয়াহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত একটি হাদীসে এও উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ দু’বার তাঁর রবকে দেখেছেন। একবার দেখেছেন চোখে আরেকবার দেখেছেন অন্তর দিয়ে।

সাতঃ মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযী বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন? নবী ﷺ জবাব দিলেনঃ আমি তাঁকে দু’বার অন্তর দিয়ে দেখেছি। (ইবনে আবী হাতেম)। এ বর্ণনাটিকে ইবনে জারীর যেরূপ ভাষায় উদ্ধৃত করেছেন তা হচ্ছে, নবী ﷺ বললেনঃ “আমি তাঁকে চোখ দিয়ে অন্তর দিয়ে দু’বার দেখেছি।”

আটঃ মি’রাজের ঘটনা প্রসঙ্গে শারীক ইবনে আব্দুল্লাহ্‌র বরাত দিয়ে ইমাম বুখারী কিতাবুল তাওহীদে হযরত আনাস ইবনে মালেক বর্ণিত যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তাতে এ কথাগুলো আছেঃ حَتَّى جَاءَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى وَدَنَا الْجَبَّارُ رَبُّ الْعِزَّةِ فَتَدَلَّى حَتَّى كَانَ مِنْهُ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى فَأَوْحَى اللَّهُ فِيمَا أَوْحَى إِلَيْهِ خَمْسِينَ صَلاَةً- “তিনি যখন সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলেন তখন মহাপরাক্রান্ত ও মহিমান্বিত আল্লাহ‌ তাঁর নিকটবর্তী হলেন এবং তার উপর দিকে শূন্যে অবস্থান করলেন। এমন কি নবী ﷺ ও তাঁর মধ্যে মুখোমুখি দু’টি ধনুকের মধ্যকার সমান বা তার চেয়েও কম ব্যবধান রইলো। অতঃপর আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর কাছে যেসব বিষয়ে অহী করলেন তার মধ্যে পঞ্চম ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশও ছিল।”

কিন্তু এ হাদীসের সনদ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে ইমাম খাত্তাবী, হাফেজ ইবনে হাজার, ইবনে হাযম এবং الجمع بين الصحيحين প্রণেতা হাফেয আবদুল হক যেসব আপত্তি উত্থাপন করেছেন তা ছাড়াও সবচেয়ে বড় আপত্তি হচ্ছে এটি স্পষ্টরূপে কুরআনের পরিপন্থী। কারণ, কুরআন মজীদে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে। তার মধ্যে প্রথমটি নবুওয়াতের প্রাথমিক যুগে একটি উঁচু দিগন্তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে دَنَا فَتَدَلَّى – فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى বিষয়ক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। আর দ্বিতীয়টি সিদরাতুল মুনতাহার সন্নিকটে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু ওপরে বর্ণিত এ রেওয়ায়াতটি দু’টি সাক্ষাতের ঘটনাকে একসাথে মিলিয়ে জগাখিচুড়ি করে একই সাক্ষাত বানিয়ে ফেলেছে। অতএব কুরআন মজীদের পরিপন্থী হওয়ার কারণে কোন ক্রমেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে না।

এরপর ওপরে বর্ণিত হাদীসগুলোর প্রসঙ্গে আসা যাক। ও গুলোর মধ্যে আবার হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসগুলোই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁরা উভয়েই ঐকমত্য সহকারে খোদ রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ থেকে একথা বর্ণনা করেছেন যে, উভয় ক্ষেত্রেই তিনি আল্লাহ‌ তা’আলাকে নয়, জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন। তাছাড়া এসব হাদীস কুরআন মজিদের বক্তব্য ও ইঙ্গিতের সাথেও সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ। এছাড়া হযরত আবু যার (রাঃ) এবং হযরত আবু মূসা আশ’আরী (রাঃ) নবীর ﷺ যেসব উক্তি উদ্ধৃত করেছেন তা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে হাদীস গ্রন্থসমূহে হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস থেকে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে গুরুতর অনৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কোন হাদীসে উভয় সাক্ষাতকেই চাক্ষুষ সাক্ষাত বলা হয়েছে, কোনটিতে উভয় সাক্ষাতকেই অন্তরের সাক্ষাত বলা হয়েছে, কোনটাতে একটি সাক্ষাতকে চাক্ষুষ অপরটিকে অন্তরের বলা হয়েছে, আবার কোনটিতে চাক্ষুষ দর্শনকে পরিষ্কার ভাষায় অস্বীকার করা হয়েছে। এসব বর্ণনার একটিও এমন নয় যাতে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর নিজের উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে। আর যেখানে তারা রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর নিজের কোন কথা বা উক্তি উদ্ধৃত করেছেন সেখানে প্রথমত কুরআন মজীদে বর্ণিত এ দু’টি সাক্ষাত লাভের কোনটিরও নামের উল্লেখ নেই। তাছাড়া তাদের একটি রেওয়ায়াতের ব্যাখ্যা অন্য রেওয়ায়াতের থেকে যা জানা যায় তা হচ্ছে নবী ﷺ কোন সময়ই জাগ্রত অবস্থায় আল্লাহ‌ তা’আলাকে দেখেননি, স্বপ্নে আল্লাহ‌ তা’আলাকে দেখেছিলেন। তাই প্রকৃতপক্ষে এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাসের সাথে সম্পর্কিত রেওয়ায়াতসমূহের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে না। অনুরূপভাবে মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযীর বর্ণনাসমূহে যদিও রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে কিন্তু যেসব সাহাবায়ে কিরাম নবী ﷺ থেকে একথা থেকে একথা শুনেছেন তাতে তাদের নাম বলা হয়নি। তার একটিতে আবার বলা হয়েছে যে, নবী ﷺ চাক্ষুষ দেখার বিষয় সরাসরি অস্বীকার করেছেন।

ফী জিলালিল কুরআন:-

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আলােচ্য সূরাটির প্রধান অংশ মনে হয় কবিতা আকারে নাযিল হয়েছে। এর প্রতিটি ছত্রের মধ্যকার চমৎকার ছন্দ ও শব্দাবলীর পারস্পরিক মিল পাঠকের মনে প্রাণ মাতানাে এমন এক ঝংকার তােলে, যা যে কোনাে সংগীতের মূর্ছনাকে হার মানায়। সংগীতের এই ধ্বনি সূরাটির সর্বত্র যদিও এক মনােমুগ্ধকর আবেগের পরশ বুলিয়ে দেয়, তবুও সূরাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠে, পাঠককে তা সচেতন করে তােলে। তার হৃদয়-কমলে ভাবের আবেগ সৃষ্টির জন্যে এবং আলােচ্য বিষয়টির গুরুত্ব বাড়ানাের উদ্দেশ্যে কখনও কখনও সমার্থবােধক শব্দের সংযোজন করা হয়েছে, অথবা কখনও পংক্তির শেষে চমৎকার মিল দেখানাে হয়েছে। এইভাবে কোরআনের বর্ণনা পদ্ধতি অনুসারে মূল উদ্দেশ্যকে অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে; যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমরা কি লাত ও ওযযাকে দেখােনি, দেখোনি কি মানাত নামীয় তৃতীয় আরাে একজনকে?’ যদি বলা হতাে ‘মানাতাল্ উখরা’, তাহলে ছন্দ পতন ঘটতাে। আবার যদি বলা হতাে ‘আ-মানাতাস্ সালিছাতা’ তাহলেও লাইনের শেষে মিল থাকতাে না। আর যেহেতু যে কোনাে বাক্যের প্রত্যেকটি শব্দের নিজস্ব একটি মূল্যমান রয়েছে, তাই অর্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রত্যেকটি বাক্যের প্রতিটি শব্দের শেষে যেমন মিল রাখা হয়েছে, তেমনি ছন্দ পতন না ঘটে সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে। এমনই পরবর্তী দুটি আয়াতের ছন্দের সাথে মিল রাখতে গিয়ে মাঝে আর একটি শব্দ ‘ইযান’ ব্যবহার করা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে শুধু ছন্দ ঠিক রাখার জন্যেই ইযান শব্দটি বসানাে জরুরী মনে করা হয়েছে, কারণ এ শব্দটি ছাড়াই বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ হয়। এইভাবে কথাকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তােলার জন্যে ছন্দের মিল-এর দিকে বিশেষভাবে খেয়াল দেয়া হয়েছে। এখানে এই সুরের মূর্ছনার দুটি উল্লেখযােগ্য দিক লক্ষ্য করা যায়। একটি হচ্ছে এর বর্ণনাভংগি, যা পাঠকের অন্তরে ভাবের এক তরংগ সৃষ্টি করে এবং রব্বুল আলামীনের সাথে তার নিবিড় সম্পর্কের কথা জানায়, বিশেষ করে সূরাটির প্রথম ও শেষ ভাগে এ বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। প্রথম ভাগের ছন্দময় কথাগুলাে পাঠকের হৃদয়কে এমন আবেগমুগ্ধ করে যে, সে যেন সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে নাচতে থাকে এবং প্রেমাস্পদের সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা তার মধ্যে এক মধুময় কম্পন সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত কথাগুলাে বান্দা ও প্রভুর মধ্যে সম্পর্কের যুক্তিপূর্ণ কথাগুলােকে তুলে ধরে। আর এই দুটি অধ্যায়ের মাঝের কথাগুলাে আবেগ ও যুক্তির মধ্যে এক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। সৃষ্টি রহস্যের বাস্তব চিত্র এবং অজানা-অচেনা অথচ গভীর ও আকর্ষণীয় এক মধুময় সম্পর্কের আবেগ যেন এক মায়াময় ছায়া যা পাঠকের হৃদয়পটে নূরানী আলাের এক শুভ্র সমুজ্জ্বল ছটা ছড়িয়ে দেয় এবং ভক্তের হৃদয়কে প্রভুর অস্তিত্ববাহী আদিগন্তব্যাপী রহস্যরাজির সাথে গভীরভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। সৃষ্টির উন্মুক্ত অঙ্গনে সঞ্চরণশীল বিশ্বস্ত বার্তাবাহক জিবরাঈল(আ.) সে রহস্যজাল ভেদ করে সম্মানিত রসূল(স.)-এর কাছে আল্লাহর বাণী বহন করে হাযির হয়েছেন তা আর বুঝতে কষ্ট হয় না। সৃষ্টি রহস্যের দৃশ্য-অদৃশ্য ছবি সঞ্চরণশীল গ্রহ-উপগ্রহ ও তারকারাজি, ইন্দ্রিয়গাহ্য বিষয়াদি এবং আত্মিকভাবে অনুভব করার মতাে বিষয়সমূহ সব কিছুই পরস্পর এক অবিচ্ছেদ্য সুতায় গাঁথা রয়েছে। আলােচ্য সূরার চমৎকার ছন্দময় আয়াতগুলাের সুরের ঝংকারে এ সত্যটি ধরা পড়ে। তারপর দেখা যায় শ্বাসরােধকারী এক আশ্চর্য আবেগ ছড়িয়ে রয়েছে সূরাটির সর্বত্র। এই আবেগের চিহ্নগুলাে পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে নীচে বর্ণিত অধ্যায়গুলােতে যা পাঠকের হৃদয়কে গভীরভাবে প্রভাবিত করে তাকে উজ্জীবিত করে তােলে তার অস্তিত্বের অণুপরমাণুগুলাের মধ্যে এক প্রকম্পন সৃষ্টি হয়, সে ভাবের আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠে এবং আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়। সূরাটির আলােচ্য বিষয় তাই যা অন্যান্য মক্কী সূরার মধ্যে বর্তমান, অর্থাৎ ঈমান-আকীদার মূল বিষয়গুলাে, ওহী, আল্লাহ তায়ালার একত্ব এবং আখেরাত। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায় যে, ওহীর সত্যতা সম্পর্কে গভীর বিশ্বাস জন্মানাে এবং শিরক ও-এর অলীক ধারণা-কল্পনার। অসারতা প্রমাণের জন্যে এ সূরাটির মধ্যে বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হয়েছে। সূরাটির প্রথমাংশে আলোচ্য বিষয়ের লক্ষ্য হচ্ছে ওহীর প্রকৃতি ও তাৎপর্য পেশ করা এবং এ বিষয়ের পক্ষে সাক্ষ্য বহনকারী বিভিন্ন প্রমাণের মধ্যে দুটি প্রমাণ হাযির করে ওহীর সত্যতা ও বাস্তবতা তুলে ধরা। এ বিষয়ে রসূল(স.) এবং জিবরাঈল(আ.)-এর সাথে সাক্ষাত, তাঁকে খােলা চোখে সুবিস্তীর্ণ ময়দানে বাস্তবে প্রত্যক্ষ করা এবং মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগত আয়াতসমূহ দ্বারা তার সাক্ষ্যদানও এ সূরার মধ্যে পেশ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে মােশরেকদের দাবী করা দেব-দেবী লাত, উযযা ও মানাত এবং ফেরেশতাকুল সম্পর্কে তাদের কাল্পনিক ধারণা সম্পর্কে বিবরণ পেশ করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে তাদের আল্লাহর কন্যা হওয়া সম্পর্কে কল্পকাহিনীর কথা এবং নিছক ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে গড়ে উঠা বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার কথা। অথচ অনুমান সত্যপ্রাপ্তির পথে মােটেই সহায়ক নয়। পাশাপাশি এ কথাও তুলে ধরা হয়েছে যে, আমাদের মধ্যে আল্লাহর রসূল(স.) বর্তমান রয়েছেন, যিনি তাদেরকে সেই জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে আহবান করে যাচ্ছেন যার দিকে তিনি পরিপূর্ণ দৃঢ়তা, চাক্ষুষ সাক্ষ্য ও পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে এ পর্যন্ত ডেকে এসেছেন। সূরার তৃতীয় অংশে রসূলুল্লাহ(স.)-কে বিশেষভাবে পার্থিব সেইসব বিষয়গুলাে এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে যা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে দেয় এবং শুধু দুনিয়ার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে এবং এমন সব ধাঁধাঁয় লাগিয়ে দেয় যার কল্যাণকারিতা সম্পর্কে তার কোনাে জ্ঞানই নেই। আখেরাত ও আখেরাতের জীবনে মানুষের অতীত কার্যকলাপের যে প্রতিদান দেয়া হবে সে সম্পর্কে তাকে ইংগিত দেয়া হয়েছে। জানানাে হয়েছে যে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তাদের সৃষ্টির দিন ও পৃথিবীতে প্রেরণের দিন থেকেই অবগত এবং তখন থেকেই সবার অবস্থা আল্লাহ তায়ালা জানেন, জানেন তাদেরকে তখনও যখন তারা মায়ের পেটে ভ্রুণ হিসাবে অবস্থান করে। তারা নিজেরা নিজেদের সম্পর্কে যেটুকু জানে তার থেকেও বেশী তিনি তাদেরকে জানেন। সুতরাং এই জ্ঞানের ভিত্তিতেই তিনি তাদের হিসাব-নিকাশ নেবেন ও প্রতিদান দেবেন, কোনাে আন্দায-অনুমানের ভিত্তিতে নয় । আর এইভাবে অবশেষে তাদের কাজের যথাযথ ফল আমাদের ভোগ করতে হবে। সূরার চতুর্থ ও শেষ অংশে, আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তি কি, সে বিষয়ে আলােচনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বার্তাবাহক আগমনের সূচনা থেকে নিয়ে এক এক করে তাঁর অনুসারী বৃদ্ধি পাওয়া, সূক্ষ্মভাবে প্রতিটি কাজের হিসাব গ্রহণ, ইনসাফের সাথে প্রতিদান দেয়ার ব্যবস্থা এবং সৃষ্টির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে স্বাধীনভাবে তাদের সকল কাজ নিয়ে আল্লাহ তায়ালার দরবারে হাযির হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলােচনা এসেছে। এসব কিছুর সাথে আরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে প্রাচীনকালের সত্য বিরােধী ও সত্য অস্বীকারকারীদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া সম্পর্কে, যারা শেষ পর্যন্ত ধরাপৃষ্ঠ থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে। তাই বলা হচ্ছে, এ ব্যক্তি হচ্ছে পরবর্তী সতর্ককারীদের মতই একজন সতর্ককারী। কেয়ামত আগতপ্রায়, (কিন্তু কখন এটা বাস্তবে সংঘটিত হবে) আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত তা অন্য কেউ প্রকাশ করতে পারে না। সেই জন্যেই কি তােমরা এ ব্যাপারে আশ্চর্যবােধ করছ এবং হাসি-বিদ্রুপ করছে, আর ভয়াবহতা বুঝতে না পারার কারণে কাঁদছ না বরং তােমরা কি কৌতুক করছাে? (সময় থাকতেই সাবধান হও) আল্লাহর কাছে অবনত মাথায় কুঁকে পড়াে এবং নিরংকুশভাবে তাঁরই আনুগত্য করাে।’ এইভাবেই সূরাটির সূচনা ও পরিসমাপ্তির কথাগুলাের মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য যােগসূত্র রয়েছে তা সর্ব সাধারণের বোধগম্য হয়ে ফুটে উঠেছে।
# ‘কসম নক্ষত্রের যখন তা ডুবে যায়, তােমাদের সাথী পথভ্রষ্ট হয়নি বা সঠিক পথ পরিত্যাগও করেনি। আর সে মনগড়া কোনাে কথাও বলে না, যা বলে তা তাে ওহী যা তার ওপর অবতীর্ণ হয়… অবশ্যই সে তার রব-এর মহান নিদর্শনগুলাে দেখেছে।’ সূরার শুরুতে যে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী পেশ করা হয়েছে, শুভ্র সমুজ্জ্বল সে সুন্দর শােভাসাগরে কিছু সময় অবগাহন করার সময় আমরা কম্পিত হৃদয়ে অনুভব করি যে, মােহাম্মদ(স.) এমনই স্নিগ্ধ পরিবেশে জিবরাঈল(আ.)-এর সাক্ষাত যখন পেয়েছিলেন তখন তার হৃদয় কেমন ভাবাবেগে পূর্ণ হয়েছিলাে। আমরা কল্পনার চোখে যেন দেখতে পাচ্ছি সেই আলােকময় পাখাগুলাে যা ঝাপটা মেরে এ মহান ফেরেশতাকে উর্ধাকাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাে। আমরা শুনতে পাচ্ছি ধীরগতিতে তালে তালে উত্থিত সে পাখার মৃদু মধুর ধ্বনি। একইভাবে আরও যেন শুনতে পাচ্ছি সে উড্ডয়নের শব্দ কখনও অস্পষ্ট আবার কখনও খুবই স্পষ্টভাবে। পেয়ারা নবী মােহাম্মদ(স.)-এর সাথে আমরাও যেন চোখ বন্ধ করে সেই মনােরম দৃশ্য অবলােকন করছি, যেন পর্দাটা সরে গেলেই উর্ধাকাশের সেই মহান দৃশ্য দৃষ্টিপটে ভেসে উঠবে। শােনা যাবে, দেখাও যাবে এবং সে দৃশ্য যেন দীর্ঘদিন হৃদয়ের পর্দায় অম্লান রয়ে যাবে। এই সেই দৃশ্য যা প্রিয় নবী(স.)-এর স্বচ্ছ হৃদয়পটে বিশেষভাবে অংকিত হয়েছিলাে। অবশ্য আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের প্রতি অনেক মেহেরবানী করেছেন এবং এসব দৃশ্যেগুলাের জীবন্ত ছবি তাদের সামনে তুলে ধরে তাদেরকে সঞ্জীবিত করে তুলেছেন, তাদের অন্তরের সন্দেহ ও দুশ্চিন্তার কলুষ-কালিমা ঘুচিয়ে দিয়েছেন। উর্ধাকাশের স্বচ্ছতার মতই তাদের অন্তরের গগনে স্বচ্ছতা এনে দিয়েছেন। তাদেরকে ধীরে ধীরে এবং এক এক পা করে এমনভাবে বিভিন্ন দৃশ্য ও অবস্থার মধ্য দিয়ে তার রহস্য-ভান্ডারের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন যে অবশেষে তাদের মন পরিপূর্ণ সন্দেহমুক্ত হয়ে গিয়েছে ও এমনভাবে সে দৃশ্য মযবুত হয়ে গিয়েছে যেন তারা নিজ চোখে সে রহস্য ভান্ডারকে দেখতে পেয়েছে। আল্লাহর শপথ বাক্য তাই, এই সঞ্জীবনী গুণটিই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তারকার কসম খাওয়া, কসম তারকার যখন তা অস্তমিত হয়। আর তারকার চমকানাে, পতন বা নিকটে আসা এগুলাে সবই জিবরাঈল(আ.)-এর উর্ধাকাশে গমনের সাথে সামঞ্জস্যশীল। আর সে উর্ধাকাশে প্রতিভাত হলাে, তারপর নিকটতর হলাে এবং নেমে এলাে এত কাছে যেন মাত্র দুটি ধনুকের মধ্যকার ব্যবধানের মতই দূরত্ব রয়ে গেল, বা তার থেকেও নিকটে চলে এলাে। তারপর আল্লাহর বান্দার নিকটে পেশ করলাে সেই কথাগুলাে যে আল্লাহ তায়ালা নিজে তাকে দিয়েছিলেন। এমনিভাবে প্রথম দৃষ্টিপাতের পর থেকে নিয়ে সে দৃশ্য, তার সঞ্চালন, তার ছায়া ও তার বাস্তব কাজের মধ্যে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য বুঝা যায়। ‘কসম তারকার যখন তা অস্তমিত হয়।’ তারকার এই কসম খাওয়ার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তবে সব থেকে গ্রহণযােগ্য যে ব্যাখ্যাটি আমাদের বুঝে আসে, তা হচ্ছে তারকা বলতে ‘শি’রা’ নামক তারাটিকে বুঝানাে হয়েছে। কোনাে কোনাে আরব যার পূজা করতাে এবং এই সূরার মধ্যে পরবর্তী এক জায়গায় শি’রা’র উল্লেখও এসেছে; যেমন বলা হয়েছে আর তিনিই শি’রা’র রব। প্রাচীন কালে ‘শি’রা’ তারাটিকে মহা সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা হতো। আর প্রাচীন মিসরীয়রা শি’রার তলদেশ দিয়ে গমন করতে পারাকে প্রচুর সম্পদশালী হওয়ার পূর্বাভাস মনে করতাে। এ কারণে তাক লাগিয়ে থাকতাে তারা শি’রা-কে খুঁজে পাওয়ার জন্যে এবং এর নড়া-চড়া প্রত্যক্ষ করার জন্যে বিস্তর সময় ব্যয় করতে। ইরান ও আরবের প্রাচীন লােকদের মধ্যে সমভাবে এই নক্ষত্রের মূল্যায়ন করা হতাে। সুতরাং, আলােচ্য সূরার মধ্যে তারকা বলতে এই তারাটিকেই বুঝানাে হয়েছে বলে অধিকাংশ লােকের ধারণা। এখানে ভালােবাসার প্রতীক বুঝাতে গিয়ে এই তারাটিই অধিক প্রাসংগিক যার দিকে আমরাও ইংগিত করেছি। অপর আর একটি অর্থ হচ্ছে, উজ্জীবিত করা, কারণ তারা বলতে প্রায়ই অত্যন্ত বিরাট এমন এক জিনিসকে বুঝায় যা নড়াচড়া করে বা স্থান পরিবর্তন করে, সুতরাং কোনাে স্থানের সাথে বিজড়িত সঞ্চারণশীল কোনাে জিনিস উপাস্য হতে পারে না। মাবুদ বা উপাস্য মহান সেই সত্তা যিনি স্থান-কালের সীমার উর্ধে বিরাজমান স্থায়ী শক্তি। আরব সাধারণ ও তৎকালীন পৃথিবীর সভ্য জাতিসমূহের কাছে সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে বিবেচিত এই তারার কসম খেয়ে বলতে চাওয়া হয়েছে যে, নবী(স.) সেই সৌভাগ্যের প্রতীক যিনি তারার প্রভুর তরফ থেকে প্রেরিত এবং তিনি প্রেরিত হয়েছেন ওহী নিয়ে যা তিনি তাদের কাছে পেশ করছেন।

 

ফী জিলালিল কুরআন:

*রাসূল(স.) জিবরাইলকে নিজের চোখে দেখেছেন : জিবরাঈল(আ.)-কে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার এই সৌভাগ্য সংঘটিত হয়েছে যেমন কাছ থেকে, তেমনি দূর থেকেও। তাই এই ওহীর মধ্যে একাধারে বার্তা, শিক্ষা, বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করা এবং বিশ্বাসের দৃঢ়তা পাওয়া যায়। এ এমন একটি অবস্থা যার মধ্যে কোনাে সন্দেহ-সংশয় বা মিথ্যা হওয়ার আশংকা বা তর্ক-বিতর্ক করার কোনাে সুযােগ নেই। তাই এরশাদ হয়েছে, ‘অন্তর মিথ্যা বলেনি সেই বিষয়ে যা সে নিজের চোখে দেখেছে।’ এমতাবস্থায় তােমরা কি তার সাথে ঝগড়া করতে চাও সে ব্যাপারে যা সে নিজের চোখে দেখেছে? চোখের দেখা ভুল হলেও হতে পারে, কিন্তু অন্তরের চোখে দেখা (গভীরভাবে দেখার বাস্তবতা উপলব্ধি করা) আরও বেশী বাস্তব এবং আরও বেশী দৃঢ়। তিনি নিজ চোখে দেখলেন, তারপর তার কাছে এই দেখাটা নিশ্চিত হয়ে গেল এবং তার অন্তরে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে গেল যে, তিনিই ওহী বহন করে নিয়ে এসেছেন। সে ফেরেশতা এসেছেন তার কাছে আল্লাহর কথাগুলো তাকে শেখাতে এবং সে কথাগুলােকে তার মাধ্যমে মানবমন্ডলীর কাছে পৌছে দিতে। বর্ণনা ধারার এ পর্যায়ে এসে যাবতীয় তর্ক-বিতর্ক ও ওহীর সত্যতা সম্পর্কে ঝগড়া-ঝাটির সকল সুযােগ খতম হয়ে গেল। মনের নিশ্চিন্ততা ও অন্তরের প্রশান্তি এসে যাওয়ার পর জিবরাঈল(আ.) ও মােহাম্মদ(স.) এই দুই ব্যক্তির কারাে মধ্যে আর কোনাে সংশয়ই রইলাে না। জিবরাঈল(আ.)-কে তার নিজ আসল মূর্তিতে রসূল(স.) শুধু এই একবারই দেখেছিলেন এমন নয়, আরও একবার এই আসল চেহারায় দেখার কাজ সংঘটিত হয়েছিলাে। তাই এরশাদ হচ্ছে, আর তাকে সে অবশ্যই দেখেছে আর একবার, সিদরাতুল মােতাহার নিকটে, যার কাছে রয়েছে জান্নাতুল মা’ওয়া (চিরস্থায়ী বাসস্থানের বাগিচা), সে সময়ে সেই গাছটিকে জিবরাঈল (আ.)-এর অবয়ব পুরােপুরিভাবে ঢেকে ফেলেছিলাে। এ দৃশ্য সে (মােহাম্মদ) স্থির দৃষ্টি দিয়ে দেখেছে, তার নযর সরেও যায়নি এবং অতিরিক্ত কিছুও সে দেখেনি। সেদিন সে তার রব-এর বহু বিরাট বিরাট নিদর্শন দেখেছে। এই দেখার ঘটনা ঘটে ইস্রা কিংবা মিরাজ-এর রাতে-এটিই বিশ্বস্ত রেওয়ায়াতসমূহের কথা মােহাম্মদ(স.)-সে দিনও তার খুব কাছাকাছি পৌছে যান। সে দিনও তিনি তাঁর সেই অবয়ব ও চেহারা নিয়ে ‘সিদরাতুল মুনতাহার’ কাছে অবস্থান করছিলেন, যে চেহারায় আল্লাহ পাক তাকে সৃষ্টি করেছেন। সিদরা শব্দটি বলতে একটি গাছকে বুঝায়, আর সিদরাতুল মুনতাহা বলতে সেই গাছটিকে বুঝায় যেখানে এসে মেরাজ-এর সফরের একপর্যায় শেষ হয়ে গিয়েছিলাে। এরই নিকটে অবস্থিত জান্নাতুল মা’ওয়া, অথবা বলা যায় এখানে এসেই মিরাজ (আরােহণ কাজ) সমাপ্ত হয়েছিলাে, অথবা বলা যায় এ পর্যন্ত এসে জিবরাঈল(আ.)-এর মােহাম্মদ(স.)-কে সংগ দান করার কাজটি শেষ হয়েছিলাে। এখানে তিনি পেছনে থেকে গিয়েছিলেন এবং মােহাম্মদ(স.) একাই পরবর্তী পর্যায়ের দিকে আরােহণ করেছিলেন, যা তাকে তার রব-এর আরশ-এর আরও আরও নিকটতর করে দিয়েছিলাে। এ সকল অবস্থা আল্লাহ তায়ালার রহস্যরাজির মধ্যে বিশেষ বিশেষ রহস্য যা বুদ্ধি ও জ্ঞানের বাইরে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার সম্মানিত বান্দা মােহাম্মদ(স.)-কে তা প্রত্যক্ষ করিয়েছিলেন। এর বেশী আমাদেরকে কিছু জানানাে হয়নি এবং এ সবের আরও বিস্তারিত অবস্থা আমাদের পক্ষে জানার আর কোনাে উপায়ও নেই। এর থেকে বেশী জানা আমাদের শক্তির বাইরে। মানুষ ও ফেরেশতাকুলের সৃষ্টিকর্তা সর্বজ্ঞ ও আল্লাহ তায়ালাই এ সম্পর্কে বলতে পারেন, যেহেতু মানুষ ও ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ একমাত্র তিনিই জানেন। আরও বেশী গুরুত্ব ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা জন্মানাের উদ্দেশ্যে সিদরাতুল মুনতাহার কাছে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলাে তার দিকে কিছু ইংগিত করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন সে ঢেকে ফেললাে পুরােপুরিভাবে সেই গাছটিকে।’ এর বিস্তারিত আর কোনাে বর্ণনা দেয়া হয়নি বা কোনাে সীমাও নির্ধারণ করা হয়নি। এ বিষয়ক বিবরণ ও সীমা নির্ধারণ সম্পর্কিত যে কথাগুলাে এসেছে তা এর বিরাটত্ব ও গুরুত্ব তুলে ধরার জন্যেই বলা হয়েছে মাত্র। তবে এসব কিছু যে নিরেট সত্য সঠিক এবং সন্দেহাতীত বাস্তবতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরশাদ হচ্ছে, (‘এ মহাদুশ্য দেখতে দেখতে তাঁর) দৃষ্টি সরে যায়নি বা বিভ্রান্তও হয়নি’-এসময় প্রিয় নবী(স.)-এর চোখে কোনাে ধাঁধা লাগেনি বা তার দৃষ্টি ফিরেও আসেনি, বরং এ ছিলাে খােলা চোখের স্পষ্ট এবং সুনিশ্চিত দেখা, যার মধ্যে কোনাে সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। মােহাম্মাদুর রসূলুলাহ(স.) সেখানে তার রব-এর বহু বিরাট বিরাট নিদর্শন নিজ চোখে দেখেছিলেন। খােলা চোখের চাহনি দিয়ে সেদিন প্রিয় নবী(স.) হৃদয়ের প্রশান্তিসহ সরাসরি বহু রহস্য অবলােকন করেছিলেন। এসব কিছুর মধ্যে আসল গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি হচ্ছে ওহী। এই ওহীর বিষয়টিকে গুরুত্ববহ করে তােলার জন্যে এত সব আয়ােজন, যাতে করে ওহীর সত্যতা ও বাস্তবতা মানুষের অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারে ও সর্বপ্রকার সন্দেহ-মুক্ত করে দিতে পারে। আনতে পারে নিশ্চিত বিশ্বাস, স্থাপন করতে পারে আল্লাহর সাথে সরাসরি সম্পর্ক। আল্লাহ পাককে বলিষ্ঠভাবে জানা ও চেনার পথ সহজ হয়ে যায়। তিনি যে সদা সর্বদা তাঁর অনুগত বান্দাদের সাথেই আছেন এই অনুভূতি জোরদার হয় এবং তার কাছেই যে সকলকে অবশেষে ফিরে যেতে হবে, তার বাস্তবতা সুপ্রশস্তভাবে যেন মানুষের বােধগম্য হয়। এই সুনিশ্চিত বিশ্বাস নিয়েই তােমাদের সেই সংগী দ্বীন-ইসলামের দাওয়াত নিয়ে সমাজের বুকে দাঁড়াচ্ছেন যাকে তােমরা উপেক্ষা করছো, তার কথার সত্যতাকে অস্বীকার করছো এবং ওহীর সত্যতা সম্পর্কে নানা প্রকার সন্দেহ আরােপ করছো। অথচ তিনি তােমাদের সেই সংগী যাকে তােমরা এ পর্যন্ত জেনেছো, চিনেছো এবং তার যাবতীয় অবস্থা তােমাদের নিশ্চিতভাবে জানা রয়েছে। এমন তাে নয় যে, তিনি তােমাদের মধ্যে একজন আগন্তুক, যার কারণে তাকে অচেনা, অজানা মনে করতে পারাে এবং অবহেলা করতে পারাে। তাই তাঁর রব-প্রতিপালক তার সত্যতা ঘােষণা করছেন এবং তার সত্যতা সম্পর্কে কসম দিয়ে কথা বলছেন, আর কেমনভাবে তিনি তার কাছে ওহী পাঠালেন তার বর্ণনা পেশ করছেন। এ মহান আমানত তিনি কোন পাত্রে দান করছেন, কাকে দিচ্ছেন তিনি এতবড় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, কিভাবেই বা তার সাথে সাক্ষাত করলেন এবং কোথায় বা দেখলেন তাকে-এসব কিছুর বিশদ বর্ণনা আল্লাহ পাক পেশ করছেন। এই হচ্ছে অতি নিশ্চিত সে বিষয়টি যার দিকে মােহাম্মদ(স.) দাওয়াত দিচ্ছেন।

Leave a Reply