بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৪৭) [*‌‌*মানব ও জ্বিন জাতির বিস্ময়কর সৃষ্টি প্রক্রিয়া : – ***পানি সম্পদ আল্লাহর এক তুলনাহীন নেয়ামত :- **এ ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি জিনিসই ধ্বংস হয়ে যাবে:- ***অবিনশ্বর সত্ত্বা আল্লাহর কাছেই সকল সৃষ্টি মুখাপেক্ষী :- **মানব ও জ্বিন জাতির প্রতি আল্লাহর সতর্কবাণী : -] www.motaher21.net সূরা:৫৫:আর-রহমান। পারা:২৭ ১৪-৪৫ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪৭)
[*‌‌*মানব ও জ্বিন জাতির বিস্ময়কর সৃষ্টি প্রক্রিয়া : –
***পানি সম্পদ আল্লাহর এক তুলনাহীন নেয়ামত :-
**এ ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি জিনিসই ধ্বংস হয়ে যাবে:-
***অবিনশ্বর সত্ত্বা আল্লাহর কাছেই সকল সৃষ্টি মুখাপেক্ষী :-
**মানব ও জ্বিন জাতির প্রতি আল্লাহর সতর্কবাণী : -]
www.motaher21.net
সূরা:৫৫:আর-রহমান।
পারা:২৭
১৪-৪৫ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-

ফী জিলালিল কুরআন:

*মানব ও জ্বিন জাতির বিস্ময়কর সৃষ্টি প্রক্রিয়া : এভাবে আল্লাহর অনেকগুলাে নেয়ামত যথা কোরআন শিক্ষাদান, মানব সৃষ্টি, তাকে ভাষা ও বর্ণনা শিক্ষাদান, সূর্য ও চন্দ্রকে সুপরিকল্পিত অবস্থানে স্থাপন, আকাশকে ঊর্ধ্বে স্থাপন, দাঁড়িপাল্লা স্থাপন, পৃথিবী এবং তার ফলমূল ফসলাদি সৃষ্টির উল্লেখ করার পর আল্লাহ তায়ালা জ্বিন ও মানব জাতিকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘অতপর তােমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নেয়ামত তােমরা অস্বীকার করবে?’ বস্তুত এ ক্ষেত্রে জ্বিন ও মানব জাতি কর্তৃক আল্লাহর কোনাে নেয়ামত অস্বীকার করার অবকাশ থাকে না। প্রাকৃতিক নেয়ামতসমূহের বিবরণ দেয়ার পর এবার আল্লাহ জ্বিন ও মানুষের নিজ সত্ত্বার ভেতরে যেসব নেয়ামত দিয়ে রেখেছেন তার বিবরণ দিচ্ছেন। ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পােড়া মাটির ন্যায় শুকনাে মাটি থেকে…।’ বস্তুত সৃষ্টিই হচ্ছে আসল নেয়ামত। অস্তিত্ব ও অস্তিত্বহীনতার মাঝে যে দূরত্ব, তা এতাে বড় যে, মানুষের জানা কোনাে পরিমাপযন্ত্র দ্বারা তা নির্ণয় করা যায় না। যে সকল পরিমাপযন্ত্র মানুষের আয়ত্তাধীন বা মানুষের বােধশক্তির নাগালের অধীন, তা শুধু অস্তিত্বশীল জিনিসসমূহের পারস্পরিক পার্থক্য ও তার তোমরাই নিরূপণ করতে সক্ষম। অস্তিত্বশীল ও অস্তিত্বহীনের মধ্যে যে পার্থক্য তা মানবীয় বিবেক বুদ্ধি বা পরিমাপকযন্ত্র কোনাে অবস্থাতেই নির্ণয় করতে পারে না। জ্বিনদের অবস্থাও তথৈবচ, তারাও এমন এক সৃষ্টি, যার হাতে শুধু সৃজিত তথা অস্তিত্বশীল জিনিস পরিমাপ করার যন্ত্রই আছে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা যখন জ্বিন ও মানব জাতির সামনে তাদের সৃষ্টিকে নিজের নেয়ামত বা অবদান হিসাবে উল্লেখ করেন, তখন সেই নেয়ামতটিই উল্লেখ করেন, যা সম্পূর্ণরূপে মানুষের ক্ষমতার আওতা বহির্ভূত। অতপর আল্লাহ তায়ালা জ্বিন ও মানুষের সৃষ্টি উপাদানেরও উল্লেখ করেন। এটিও আল্লাহরই সৃষ্টি। ‘সালসাল’ হচ্ছে এমন শুকনাে মাটি, যার একটিকে আর একটি দিয়ে আঘাত করলে শব্দের সৃষ্টি হয়। এটা কাদা মাটি বা সাধারণ মাটি থেকে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মাঝের একটি স্তরবিশেষও হতে পারে। এ দ্বারা একথাও বুঝানাে হয়ে থাকতে পারে যে, প্রকৃতির উপাদানসমূহের মাঝে মানুষ ও মাটির সৃষ্টির উপাদান এক ও অভিন্ন। ‘আল্লাহ ও আধুনিক বিজ্ঞান’ নামক গ্রন্থের আরবী সংস্করণ ১৮০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, যেসব উপাদান দ্বারা মাটির সৃষ্টি হয়েছে, মানবদেহের সৃষ্টিও হয়েছে সেসব উপাদান দিয়েই। মানবদেহ গঠিত হয়েছে কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, ফসফরাস, সালফার, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লৌহ, ম্যাংগানিজ, তামা, কোবাল্ট, জিংক, সিলিকন, এলুমিনিয়াম, আয়োডিন, ফ্লোরাইড ও ক্লোরোফিল দ্বারা। মাটিও ঠিক এই উপাদানগুলাে দিয়েই তৈরী। এসব উপাদানের অনুপাতে এক মানুষের সাথে অন্য মানুষের এবং মাটি ও মানুষের মাঝে তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে এগুলাের মাঝে কোনাে প্রভেদ নেই। তাই বলে বিজ্ঞানের প্রমাণিত এই তত্ত্ব হুবহু কোরআনের ব্যাখ্যা বলে আবশ্যিকভাবে মেনে নেয়া যাবে না। কেননা, কোরআনের বক্তব্য দ্বারা বিজ্ঞানের এই তত্ত্ব বুঝানাে হয়ে থাকতে পারে, আবার অন্য কিছুও বুঝানাে হয়ে থাকতে পারে। মাটি, কাদা মাটি বা শুকনাে মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টির বহুসংখ্যক সম্ভাব্য পন্থার মধ্য থেকে অন্য কোনাে একটি পন্থাও এখানে বুঝানাে হয়ে থাকতে পারে। আমরা এই কথাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই যে, কোরআনের কোনাে উক্তিকে কখনােই কোনাে মানবীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উদ্ভাবনের মধ্যে বা কোনাে বৈজ্ঞানিক সূত্র বা তত্ত্বের মধ্যে সীমিত করা যাবে না। কেননা মানুষের যে কোনাে তত্ত্ব বা সূত্র বা আবিষ্কার উদ্ভাবন সঠিক বা ভ্রান্ত দুইই হতে পারে এবং মানুষের জ্ঞানের বিস্তৃতি ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যম বা উপকরণের মান উন্নত হওয়া বা সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তার উদ্ভাবিত তত্ত্ব বা তথ্য পরিবর্তিত ও সংশােধিত হতে পারে। কিছু কিছু সরলমনা ও নিষ্ঠাবান গবেষক কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণ করার সদুদ্দেশ্য নিয়ে কোরআনের উক্তির সাথে সেসব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা আবিষ্কার উদ্ভাবনের মিল বা সংগতি প্রমাণ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে যান, যা চিন্তা গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে অথবা এখনাে নিছক অনুমানের পর্যায়ে রয়েছে। তবে প্রকৃত ব্যাপার এই যে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও তত্ত্বের সাথে মিল বা সংগতি পাওয়া যাক বা না যাক, সর্বাবস্থায়ই কোরআন অলৌকিক ও অকাট্য সত্য। যে সকল আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও তত্ত্ব-তথ্য সর্বদাই পরিবর্তনশীল এবং সংশােধনযােগ্য, এমনকি কখনাে ভুল এবং কখনাে সঠিক প্রমাণিত হয়ে থাকে। এবং হওয়া সম্ভব, তার মধ্যে কোরআনের উক্তিকে সীমাবদ্ধ রাখা অসম্ভব। কোরআনের উক্তি সর্বদাই এই জাতীয় সীমাবদ্ধতার উর্ধে ও তা থেকে প্রশস্ত । কোরআনের ব্যাখ্যায় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উদ্ভাবন দ্বারা কেবল এতােটুকুই উপকৃত হওয়ার অবকাশ আছে যে, প্রকৃতিতে ও মানব সত্ত্বায় বিরাজিত আল্লাহর কোনাে নিদর্শনের যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা কোরআনে রয়েছে, কোনাে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে আমরা যখন অবিকল সে জিনিসেরই বাস্তব উপস্থিতির সন্ধান পাই, তখন আমাদের চিন্তা-চেতনায় কোরআনের এ উক্তির অর্থ অধিকতর ব্যাপকতা লাভ করে, কিন্তু এটা এই নিশ্চয়তা লাভের জন্যে যথেষ্ট নয় যে, বিজ্ঞানের উদ্ভাবিত এই তত্ত্ব বা তথ্যই কোরআনের এ উক্তির অনিবার্য অর্থ। এ দ্বারা শুধু এতােটুকু প্রমাণিত হয় যে, বৈজ্ঞানিক তথ্যটি হয়তাে বা কোরআনের এই উক্তির অর্থের একটা অংশ। এরপর আসে অগ্নিশিখা থেকে জ্বিন সৃষ্টির প্রসংগ। এটি মানুষের জ্ঞানের সীমা বহির্ভূত ব্যাপার। এ ব্যাপারে কোরআনই একমাত্র নিশ্চিত জ্ঞানের উৎস। আল্লাহর দেয়া তথ্য অকাট্য সত্য। কেননা, যিনি স্রষ্টা তিনিই তার সৃষ্টি সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভুল ও সবচেয়ে বেশী জ্ঞান রাখেন। জিনেরা পৃথিবীতে মানুষের সাথে জীবন যাপনে সক্ষম। তবে জিনেরা কিভাবে জীবন যাপন করে তা আমরা জানি না। তবে এটা নিশ্চিত, কোরআন তাদেরও সম্বােধন করেছে। সূরা আহকাফের আয়াত ‘ওয়া ইয্ সারাফনা ইলাইকা নাফারাম্ মিনাল জিন্মে…’ এর ব্যাখ্যার সময় আমি এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছি। এখানে সূরা আর রহমান স্পষ্ট যে, কোরআন তাদেরও সম্বোধন করেছে। এখানে জ্বিন ও মানুষ উভয়কে তাদের অস্তিত্ব লাভজনিত নেয়ামত স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে সম্বােধন করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যাকে যে জিনিস থেকেই তৈরী করে থাকুন না কেন, দুনিয়ায় তার আবির্ভূত হওয়া ও অস্তিত্ব লাভ করাটাই হলাে আসল নেয়ামত। এটাই অন্য সকল নেয়ামতের ভিত্তি। এ জন্যে এটিকে উল্লেখ করে ও এর ওপর সাধারণভাবে সকলকে সাক্ষী রেখে মন্তব্য করা হয়েছে যে, ‘তাহলে তােমরা জ্বিন ও মানুষ জাতি তােমাদের প্রতিপালকের কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করতে পার?’ বস্তুত চাক্ষুষ দর্শনের এই পর্যায়ে অস্বীকার করার অবকাশ নেই। (তিনি) উভয় উদয়াচল এবং উভয় অস্তাচলের প্রভু। ‘অতএব, তােমরা আল্লাহর কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?’ এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই মর্মে ইংগিত করা হয়েছে যে, বিশ্বচরাচরের যে দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক, সর্বত্রই আল্লাহ তায়ালা বিরাজমান। উদয়াচল ও অস্তাচল যেখানেই হােক, সেখানেই আল্লাহ তায়ালা তার প্রভুত্ব, পরাক্রম, সার্বভৌম ইচ্ছা, আলাে ও নির্দেশ সহকারে বিরাজমান আছেন। দুই উদয়াচল এবং দুই অস্তাচলের অর্থ সূর্য ও চন্দ্রের উদয় অস্তের জায়গা হতে পারে। ইতিপূর্বে সূর্য ও চন্দ্রকে আল্লাহর নেয়ামত হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সূত্র ধরে এখানে উভয়ের উদয় ও অস্তের জায়গাকে বা স্বয়ং উদয়াস্তকে আল্লাহর নেয়ামত হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকতে পারে। আবার এর অর্থ গ্রীষ্ম ও শীতকালে সূর্যের দুটি উদয়াচল এবং অস্তাচলও হতে পারে। এখানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলাে, উদয়াচল ও অস্তাচল বা পূর্ব ও পশ্চিম সর্বত্রই আল্লাহ তায়ালা বিদ্যমান, তার হাতেই গ্রহ-নক্ষত্ররাজির আবর্তন বিবর্তনের চাবিকাঠি এবং সর্বত্রই তাঁর আলাে ও তার প্রভুত্ব। এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করলে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে দৃষ্টিপাত করলে হৃদয়ে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের যে অনুভূতি জাগে, সেটাই এ আয়াতের মূল মর্মার্থ । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে এবং উদয়াচল ও অস্তাচল আল্লাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব এ বিশ্বজগতে আল্লাহর এক অন্য নেয়ামত ও দান। এ জন্যে এখানেও বলা হয়েছে যে, তােমরা আল্লাহর কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? উদয়াচল ও অস্তাচল আল্লাহর নিদর্শন হওয়া ছাড়াও জ্বিন এবং মানুষের ওপর আল্লাহর নেয়ামতও বটে। কেননা, এতে সমগ্র বিশ্ববাসীর কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এমনকি এ কথা বলাও অত্যুক্তি নয় যে, প্রাণীকুলের জীবন জীবিকাও সূর্য এবং চন্দ্রের উদয়াস্তের সাথে সম্পৃক্ত ও তার ওপর নির্ভরশীল। সূর্য ও চন্দ্রের উদয়াস্ত না হলে প্রাণীকুলের জীবনপ্রবাহ অচল স্তব্ধ হয়ে যেতাে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*পানি সম্পদ আল্লাহর এক তুলনাহীন নেয়ামত : মহাবিশ্বের দূরবর্তী বিষয়ের উল্লেখের পর এবার পৃথিবী ও তার পানি সম্পদের উল্লেখ করা হচ্ছে। এই সাথে উল্লেখ করা হচ্ছে যে, পানি সম্পদকে আল্লাহ সুনির্দিষ্ট মান, সুনির্দিষ্ট ধরনের ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ এবং সুনির্দিষ্ট উপযােগিতা ও উপকারিতায় সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি পাশাপাশি দুটি দরিয়া প্রবাহিত করেছেন, উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরাল, যা তারা অতিক্রম করে না। অতএব, তােমরা কোন নেয়ামতকে… উল্লিখিত দুটি দরিয়া দ্বারা লােনা পানির দরিয়া ও মিষ্টি পানির দরিয়াকে বুঝানাে হয়েছে। প্রথমটির মধ্যে সাগর-মহাসাগর এবং দ্বিতীয়টির মধ্যে নদনদী, খালবিল ও হ্রদ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা এগুলােকে পাশাপাশি চলতে দিয়েছেন, কিন্তু তারা একটি অন্যটির সাথে মিশ্রিত না হয়ে আপন স্বাতন্ত্র বজায় রেখে চলেছে। কেউ কারাে নির্দিষ্ট সীমা ও নির্ধারিত দায়িত্ব অতিক্রম করে না। উভয়ের মাঝখানে অন্তরাল দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টি করা প্রাকৃতিক ও স্বভাবজাত বিভিন্নতার অন্তরাল বুঝানাে হয়েছে। ভূপৃষ্ঠে পানির এই দ্বিধাবিভক্তি আকস্মিকভাবে ও রাতারাতি হয়নি। এটা এক বিস্ময়কর নিয়মে পরিকল্পিত ও নির্ধারিত হয়েছে। লােনা পানি পৃথিবীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশকে ঘিরে রেখেছে এবং এ সব জলাধারের একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত। আর শুষ্ক এক-চতুর্থাংশকেও কর্মোপযােগী রেখেছে এই লােনা পানির জলাধার সমূহ। এই বিপুল পরিমাণ লােনা পানি পৃথিবীর আবহাওয়াকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন রাখা জীবন যাপনের উপযােগী রাখার জন্যে অপরিহার্য ছিলাে । নিউইয়র্কস্থ একাডেমী অব সাইন্সের প্রেসিডেন্ট সি মরিসন মানুষ একা থাকে না’ (মূল ইংরেজী নাম লেখক উল্লেখ করেননি- অনুবাদক) আরবী অনুবাদ : আল ইলমু ইয়াদুউ ইলাল ঈমান (বিজ্ঞান ঈমানের দিকে ডাকে) নামক পুস্তকে লিখেছেন, ক্রমাগত গ্যাস- যার অধিকাংশই বিষাক্ত- উত্থিত হওয়া সত্তেও বাতাস কার্যত দূষণমুক্ত রয়েছে এবং মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে যতােটা ভারসাম্যপূর্ণ থাকা জরুরী, ততােটাই ভারসাম্যপূর্ণ রয়েছে। এই ভারসাম্য রক্ষার প্রধান চালিকাশক্তি হলাে সেই বিশাল ও প্রকান্ড জলাধার, অর্থাৎ মহাসাগর। সূর্য কিরণের প্রভাবে এই সুবিশাল ও সুপ্রশস্ত জলাধার থেকে ক্রমাগত বাষ্প ওপরে ওঠতে থাকে। অতপর এই বাষ্প আবার ফিরে আসে এবং বৃষ্টির আকারে বর্ষিত হয়। এই বৃষ্টি থেকে সকল আকৃতির পানির উৎসগুলােতে মিষ্টি পানি সংরক্ষিত হয়ে থাকে। মিষ্টি পানির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে নদনদী। মহাসাগরের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি, সূর্যের তাপ, মহাশূন্যের উচ্চতর স্তরসমূহের শীতলতা ও মহাশূন্যের অন্যান্য উপকরণের সমন্বয়ে বৃষ্টি তৈরী হয়, আর সেই বৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হয় মিষ্টি পানির ভান্ডার। আর এই মিষ্টি পানির কল্যাণেই টিকে থাকে উদ্ভিদ, মানুষ ও প্রাণীকুলের জীবন। প্রায় সকল নদনদীই সমুদ্রে পতিত হয়। এই নদনদী পৃথিবীর সকল লবণাক্ততা সমুদ্রে নিক্ষেপ করা সত্তেও তা সমুদ্রের প্রকৃতি পাল্টে দেয় না এবং নিজের সীমা অতিক্রম করে সমুদ্রের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। পক্ষান্তরে নদনদীতে পানির স্তর সাধারণত সমুদ্রের পানির স্তরের উর্ধ্বে থাকায় সমুদ্র তার মধ্যে পতিত হওয়া নদনদীর ওপর আগ্রাসন চালাতে এবং নিজের লােনা পানি দিয়ে নদীগুলােকে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয় না। ফলে সমুদ্র নদনদীর কাজে বাধা দেয়া ও তার স্বভাব প্রকৃতি পাল্টে দিতে সমর্থ হয় না। নদনদী ও সাগর মহাসাগরের মধ্যে এভাবেই আল্লাহ এক অলংঘনীয় প্রাচীর দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। ফলে একটি অপরটির কাজে বাধা দেয় না বা আগ্রাসন চালায় না। সুতরাং আল্লাহর নেয়ামতসমূহের বিবরণ দান প্রসংগে মিষ্টি পানি ও লােনা পানির উৎস দুটি এবং তাদের মাঝখানের অন্তরালকে উল্লেখ করাটা মােটেই অপ্রাসংগিক বা বিস্ময়ােদ্দীপক হয়নি। এ জন্যেই আল্লাহ তায়ালা এখানে পুনরায় বলেছেন, তাহলে তােমরা জ্বিন ও মানুষেরা তােমাদের প্রভুর কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?’   *মুক্তা ও প্রবাল সৃষ্টির তত্ত্ব : এরপর উল্লেখ করা হচ্ছে মনুষ্য জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিশিষ্ট সেসব নেয়ামতের কথা, যা উভয় প্রকারের দরিয়ায় পাওয়া যায়। ‘সে দুই দরিয়া থেকে উৎপন্ন হয় মুক্তা ও প্রবাল।’ মুক্তা আসলে এক ধরনের প্রাণী। ‘আল্লাহ তায়ালা ও আধুনিক বিজ্ঞান’ নামক গ্রন্থের ১০৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, সম্ভবত মুক্তা সমুদ্রের সবচেয়ে বিস্ময়কর জিনিস, সমুদ্রের সর্বনিনম্নন্তরে নেমে যায় সে একটা ঝিনুকের পেটে আশ্রয় নিয়ে, যাতে ঝিনুক তাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করে। তাবত প্রাণীজগত থেকে এই প্রাণীটি আলাদা। তার দৈহিক গঠন প্রণালী ও জীবন যাপন পদ্ধতি ভিন্ন। মাছ ধরা জেলের জালের মতাে তার অদ্ভুত সূক্ষ্ম জাল রয়েছে। এই জাল ফিল্টারের কাজ করে। ঝিনুকের পেটের ভেতরে পানি, বাতাস ও খাদ্য প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু পাথরের টুকরাে ও বালু ইত্যাদি ঢুকতে পারে না। জালের নীচে থাকে প্রাণীটির চার ঠোঁট বিশিষ্ট অনেকগুলাে মুখ। যখনই কোনাে বালুকণা, পাথরের টুকরো অথবা ক্ষতিকর প্রাণী ঝিনুকের ভেতরে জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে, অমনি প্রাণীটি নিজের ভেতর থেকে এক ধরনের পিচ্ছিল পদার্থ বের করে তা ঢেকে দেয়। তারপর জমাট বেঁধে তাকে মুক্তায় পরিণত করে। মুক্তার আকৃতি ভেতরে প্রবিষ্ট কণাটির আকৃতি অনুপাতে ছােট বা বড় হয়ে থাকে।’ আর প্রবালও আল্লাহর এক আজব সৃষ্টি। এটি সমুদ্রের পাঁচ মিটার থেকে তিনশ মিটার পর্যন্ত গভীরে বাস করে। দেহের নিম্নাংশ দ্বারা পাথর বা ঘাসের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখে। দেহের ঊর্ধ্বাংশে অবস্থিত তার মুখগহ্বর বহুসংখ্যক উপাংগ দ্বারা সজ্জিত, যাকে সে খাদ্য সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করে। এই সকল উপাংগ যে শিকার ধরে, তা সাধারণত ক্ষুদ্র চিংড়ি মাছ বা অনুরূপ ক্ষুদ্র জলজপ্রাণী হয়ে থাকে। এই উপাংগসমূহ যখনই শিকারের সংস্পর্শে আসে, তৎক্ষণাত তা অসাড় হয়ে পড়ে এবং তার সাথে যুক্ত হয়। তখন উপাংগগুলাে গুটিয়ে আসে এবং মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে। এই সময় শিকার মানুষের অন্ননালী সদৃশ সংকীর্ণ নালীর মাধ্যমে ভেতরে চলে যায়। এই প্রাণীটির বিপুল বংশ বৃদ্ধি ঘটে থাকে। এর অসংখ্য প্রজনন কোষ বাইরে এসে ডিম্বাণুগুলােকে সন্তানপ্রসূ বানায়। অতপর সেগুলাে সন্তানের আকারে জন্ম নিয়ে পাথর বা লতাপাতাকে জাপটে ধরে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তা স্বতন্ত্র জীবনে পরিণত হয়। তবে তা আসল প্রাণীর মতােই বাড়তে থাকে। আল্লাহর অপার সৃজনী ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন স্বরূপ প্রবাল আরাে একটি প্রক্রিয়ায় আপন বংশের বিস্তৃতি ঘটিয়ে থাকে। সেটা হচ্ছে একটির সাথে আরেকটি যুক্ত হয়ে বৃহৎ আকার ধারণ । এভাবে প্রবালের বৃক্ষ তৈরী হয়, যার কান্ড খুবই মযবুত ও শক্ত হয়ে থাকে। এর শাখা-প্রশাখাও খুবই মযবুত। প্রবাল বৃক্ষের উচ্চতা প্রায় ত্রিশ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। সমুদ্রের অভ্যন্তরে অনেক রং-বেরংয়ের প্রবাল দ্বীপ দেখা যায়। কোনােটা কমলা হলুদ, কোনােটা লাল খয়েরী, কোনােটা নীল যমররদ রংয়ের, আবার কোনােটা ধূসর রংয়ের হয়ে থাকে। লাল প্রবাল হচ্ছে এই প্রাণীর জীবন্ত অংশগুলাে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর যে কঠিন অংশটি টিকে থাকে, তার নাম। এর পাথুরে কাঠামােগুলাে দ্বারা চমকপ্রদ বসত গঠিত হয়। এই সব বসতির মধ্যে রয়েছে অষ্ট্রেলিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত প্রবাল পর্বতমালা, যাকে বৃহৎ প্রবাল প্রাচীর নামে আখ্যায়িত করা হয়। এই পর্বতমালার দৈর্ঘ্য এক হাজার ৩৫০ মাইল ও প্রস্থ ৫০ মাইল। এই অতি ক্ষুদ্রকায় প্রাণী দ্বারা উক্ত প্রাচীর গঠিত। (আল্লাহ ও আধুনিক বিজ্ঞান, আরবী সংস্করণ, পৃঃ ১০৬-১০৭)। মুক্তা ও প্রবাল থেকে বহু মূল্যবান গহনাপত্র বানানাে হয়ে থাকে। তাই আল্লাহ এই দুটি জিনিসকে তাঁর বিশেষ অবদান হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, ‘অতএব তােমরা তােমাদের প্রভুর কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?’ এরপর সমুদ্রে চলাচলকারী পাহাড়ের মত কতাে বড় বড় জাহাজের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আর তার জন্যে রয়েছে সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজসমূহ, যা পাহাড়ের মতাে। এই সকল নৌযানকে ‘আল্লাহর জন্যে’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কেননা, এগুলাে আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলেই চলাচল করে থাকে। সমুদ্রের অথৈ পানি ও উত্তাল তরঙ্গ মালা থেকে একমাত্র তিনিই এগুলােকে রক্ষা করে থাকেন। তিনিই এগুলােকে সমুদ্র পৃষ্ঠে ভাসমান রাখেন। তাই এগুলাে তার, এগুলাে বান্দাদের ওপর আল্লাহর বৃহত্তম নেয়ামতগুলাের অন্তর্ভুক্ত। কেননা, এ দ্বারা তাদের জীবিকা উপার্জন, পরিবহন, ভ্রমণ ও কল্যাণমূলক কাজ এতাে বেশী পরিমাণে সম্পন্ন হয়ে থাকে যে, তা উল্লেখ করার মতাে এবং কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না। এগুলাে এতাে বড় ও স্পষ্ট নেয়ামত যে, তা অস্বীকার করা খুবই কঠিন। সুতরাং তােমরা তােমাদের প্রভুর কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?

ফী জিলালিল কুরআন:

এবার দৃশ্যমান অস্তিত্ব ও সৃষ্টি জগতের নেয়ামতের প্রদর্শনী সমাপ্ত করে ধ্বংস রাজ্যের নেয়ামতসমূহের প্রদর্শনী শুরু করা হচ্ছে। *অবিনশ্বর সত্ত্বা আল্লাহর কাছেই সকল সৃষ্টি মুখাপেক্ষী : ‘পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে সবই ধ্বংসশীল। কেবল টিকে থাকবে তােমার প্রতিপালকের সত্ত্বা, যা সম্মানিত ও মহিমান্বিত…’ কোরআনের এই উক্তি উচ্চারিত হওয়া মাত্র শ্বাস প্রশ্বাস ধীর, শব্দ ক্ষীণ ও অংগ প্রত্যংগ শান্ত হয়ে যেতে থাকে। সকল প্রাণী ধ্বংসক্রিয়ার আওতায় এসে যায়, সকল তৎপরতা এর প্রভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়। আকাশ ও পৃথিবীর বিস্তীর্ণ দিগন্ত এর প্রভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, আর চিরঞ্জীব মহিমান্বিত সত্ত্বার মহত্ব ও গৌরব সমগ্র সত্ত্বা ও মনকে, স্থান ও কালকে এবং গােটা বিশ্ব নিখিলকে পরিপ্লুত করে। মানুষের ভাষা এই ধ্বংসের চিত্র পরিপূর্ণভাবে অংকন করতে সক্ষম নয়। কোরআনের উক্তির ওপর কোনাে কথা সংযােজন করাও তার সাধ্যাতীত। কোরআনের এ উক্তি মানব সত্ত্বাকে নিঝুম নিস্তব্ধতা, আচ্ছন্নকারী ভাবগাম্ভীর্য ও ভয়াল নীরবতায় নিমজ্জিত করে দেয়। যে বিশ্ব প্রকৃতি এক সময় জীবন ও কর্মতৎপরতায় মুখর ছিলাে, তাতে ধ্বংস ও মৃত্যুর নিস্তব্ধতা তুলে ধরে এ আয়াত। আর এরই পাশাপাশি তুলে ধরে চিরস্থায়িত্ব ও চিরঞ্জীবতার তত্ত্ব। চিরঞ্জীবতা ও চিরস্থায়িত্ব কিরূপ তার পরিচয় মানুষ কখনাে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা দ্বারা অর্জন করেনি। অথচ কোরআনের এই আয়াতটিতে তার সম্যক পরিচয় লাভ করা যায়। বিশ্ব প্রকৃতির সব কিছু একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, সেদিন আর কিছুই বাকি থাকবে না। একমাত্র মহিমান্বিত আল্লাহর সত্ত্বা চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী থাকবে। এই সত্যকে কোরআন একটি নেয়ামত হিসাবে জ্বিন ও মানব জাতির সামনে উপস্থাপন করছে এবং একইভাবে প্রশ্ন তুলে ধরছে যে, ‘অতপর তােমাদের প্রভুর কোন নেয়ামত তােমরা অস্বীকার করবে?’ এটি আসলেই একটি নেয়ামত; বরং প্রকৃতপক্ষে এটি সকল নেয়ামত্তে ভিত্তি ও উৎস। কেননা, চিরঞ্জীব সত্ত্বা আল্লাহ তায়ালাই সৃষ্টি করেছেন এই সমগ্র জগত, তার যাবতীয় নিয়ম বিধি, স্বভাব প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। তিনিই নির্ধারণ করেছেন এই বিশ্ব নিখিলের রীতিনীতি, পরিণতি ও কর্মফল। সেই চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী সত্ত্বাই সব কিছু সৃষ্টি করেন, রক্ষা করেন ও তত্ত্বাবধান করেন। তিনিই সব কিছুর হিসাব নেন, কর্মফল দেন এবং তিনিই চিরস্থায়িত্ব ও অমরত্বের সুউচ্চ শিখর থেকে ধ্বংসশীল জগত প্রত্যক্ষ ও পর্যবেক্ষণ করেন। কাজেই চিরস্থায়িত্বের তত্ত্ব থেকেই সকল নেয়ামতের উৎপত্তি হয়ে থাকে। বিশ্বজগত এই তত্ত্বের ও বাস্তবতার ওপর ভর করেই অস্তিত্ব লাভ করে এবং নির্ভুলভাবে পরিচালিত হয়। অন্য কথায় বলা চলে, নশ্বরতা ও ধ্বংসশীলতার আড়ালেই রয়েছে চিরস্থায়িত্ব, চিরঞ্জীবতা ও অবিনশ্বরতার অমােঘ সত্য। আর এই সত্য থেকে নির্গত হয় আরেকটি সত্য। সেটা হলাে এই যে, প্রত্যেক নশ্বর সৃষ্টি আপন অস্তিত্বের চাহিদা পূরণে চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী ও অভাবহীন মহান আল্লাহর মুখাপেক্ষী এবং তার দরবারে ধর্ণা দিতে বাধ্য। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তার কাছে প্রার্থনা করে, তিনি তাে প্রতিদিনই কোনাে কোনাে ব্যস্ততায় নিয়ােজিত থাকেন। অতএব তােমরা তােমাদের প্রভুর কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? আকাশ ও পৃথিবীর সকলে সব কিছু তার কাছেই তাে সব কিছু চায়। প্রার্থনা, আবেদন, নিবেদন একমাত্র তাঁর কাছেই তো করা যায়। অন্য কারাে কাছে চাওয়া যায় না। কেননা, অন্য সবাই মরণশীল। তাদের কাছে চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সকল সৃষ্টি কেবল তার কাছেই চায়, আর তিনি একাই সকলের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন এবং দেন। তার কাছে যে চায় সে কখনাে বিফল হয় না। তার কাছে ছাড়া অন্য কারাে কাছে যে চায়, সে ব্যর্থ হতে বাধ্য। এক মরণশীল আর এক মরণশীলকে কী দিতে পারে? এক মুখাপেক্ষী আর এক মুখাপেক্ষীকে কী দেয়ার ক্ষমতা রাখে! মহান আল্লাহ প্রতিদিনই কোনাে না কোনাে ব্যস্ততায় থাকেন। এই সীমাহীন ও কুলকিনারাহীন বিশ্বজগত তারই পরিকল্পনাধীন, তাঁরই ইচ্ছাধীন, তিনিই সবাইকে পরিচালনা করেন। মহাবিশ্বের প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি কণা, প্রতিটি অণু পরমাণু, প্রতিটি অংগ প্রত্যংগ, প্রতিটি কোষ তাঁরই নির্দেশে ও ব্যবস্থাপনায় চলে, প্রত্যেককে তিনি সৃষ্টি করেন, প্রত্যেককে তিনি কাজে নিয়ােজিত করেন এবং প্রত্যেকের কাজ তিনি তদারক করেন। প্রতিটি উদগত উদ্ভিদ, গাছের ডাল থেকে ভূপাতিত প্রতিটি পাতা, পৃথিবীর অন্ধকারময় স্থানে বিরাজমান প্রতিটি বীজ, প্রতিটি শুকনাে কিংবা ভিজা পদার্থ, পানি, প্রতিটি মাছ, ভূগর্ভের প্রতিটি পােকা মাকড়, ঝােপ জংগলের প্রতিটি পশু, গাছের ডালে বাসায় অবস্থানকারী প্রতিটি পাখি, প্রতিটি পাখির ডিম ও ছানা, প্রতিটি পাখা, পালক এবং প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর দেহের প্রতিটি কোষ তারই একচ্ছত্র পরিচালনা ও কর্তৃত্বের অধীন। যিনি একচ্ছত্র পরিচালক ও সর্বময় কর্তা, তিনি কখনাে এক কাজে ব্যস্ত হয়ে আরেক কাজ ভূলে থাকেন না। তার জ্ঞানের আড়ালে থাকে না কোনাে গােপন বা প্রকাশ্য বিষয়। তার অসংখ্য ব্যস্ততার মধ্যে একটি হচ্ছে পৃথিবীতে জিন ও মানুষের তদারকীজনিত ব্যস্ততা। তাই তিনি এই নেয়ামতটিই জ্বিন ও মানুষের কাছে তুলে ধরে বলেছেন, ‘তােমরা তােমাদের প্রভুর কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?’ ধ্বংস ও নশ্বরতার আড়ালে চিরঞ্জীবী ও অবিনশ্বরতা এবং এর ফলশ্রুতিতে একমাত্র চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর সত্ত্বার প্রতি সর্বাত্মক মনােনিবেশ, আত্মসমর্পণ এবং আপন বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ, করুণাবশত তাদের ও গােটা সৃষ্টি জগতের পরিকল্পনা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আল্লাহর ইচ্ছার প্রয়ােগ-এই নেয়ামতগুলাের বর্ণনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক নেয়ামতের বিবরণ সমাপ্ত করা হয়েছে। এরপর জ্বিন ও মানুষকে সম্বােধন করে আরেকটি নতুন ভাষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মানব ও জ্বিন জাতির প্রতি আল্লাহর সতর্কবাণী : এ ভাষণে কঠোর হুমকি ও সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এটি উচ্চারিত হয়েছে পরবর্তীতে আলােচ্য কেয়ামতের ভয়াবহ বর্ণনার ভূমিকা স্বরূপ। হে জ্বীন ও মানব, আমি অচিরেই তােমাদের জন্যে একাগ্রচিত্ত ও ব্যস্ততামুক্ত হয়ে যাবাে….’ কী সাংঘাতিক হুমকি! এতাে বড় হুমকির মুখে জ্বিন ও মানব, পাহাড়, পর্বত, গ্রহ, নক্ষত্র কোনাে কিছুই স্থির থাকতে পারে না। সর্বশক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ এই দুই দুর্বল সৃষ্টি জ্বিন ও মানবের হিসাব নিকাশ গ্রহণের জন্যে সৰ ব্যস্ততা পরিত্যাগ করবেন, হিসাব ও প্রতিশােধ নেবেন। এ এক অকল্পনীয় হুমকি ও শাসানি। আল্লাহ তায়ালা প্রকৃতপক্ষে ব্যস্ত থাকেন না যে, ব্যস্ততা মুক্ত হবেন। মানুষ যাতে ব্যাপারটা। সহজে বুঝতে পারে, সে জন্যেই এভাবে বলা হয়েছে। তাছাড়া হুমকিটা যাতে খুবই ভয়ােদ্দীপক হয় এবং তা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে, সেজন্যেই এই বাচনভংগি অবলম্বন করা হয়েছে। নচেত গােটা পৃথিবী যার ‘কুন’ শব্দটি বলাতেই সৃষ্টি হয়ে যায় এবং গোটা বিশ্বকে ধ্বংস করতে যার এক নিমেষের বেশী সময় লাগে না, তার শুধুমাত্র জিন ও মানব- এই দুই জাতিকে শাস্তি দিতে সবল ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হবার কী দরকার? অতপর এই ভয়াবহ হুমকি ও শাসানির প্রেক্ষাপটে এই দুই দুর্বল সৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, অতএব তােমরা তােমাদের প্রতিপালকের কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? এরপর এই হুমকি ও শাসানির কঠোরতা আবারও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এই মর্মে চ্যালেঞ্জ দিয়ে যে, তারা যদি পারে তবে আকাশ ও পৃথিবীর সীমানা অতিক্রম করে যেন চলে যায়! ‘হে জ্বীন ও মানুষ গােষ্ঠী! তােমরা যদি আকাশ ও পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে চলে যেতে পারে তবে যাও।…’ কীভাবে ও কোথায় যাবে? বিশেষ ক্ষমতা ছাড়া যেতে পারবে না।’ কেননা, যার ক্ষমতা আছে, সে ছাড়া কেউ ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারে না। অতপর পুনরায় তাদের প্রশ্ন করছেন, তােমাদের প্রতিপালকের কোন্ নেয়ামতকে তােমরা অস্বীকার করবে? জানা কথা যে, এর পরে তাদের মনে নিছক মৌখিকভাবেও কোনাে নেয়ামত অস্বীকার করার ক্ষমতা থাকতে পারে না, কিন্তু তথাপি এই হুমকি ও শাসানি চরম পর্যায়ে পৌছা পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হয়েছে। তোমাদের দিকে নিক্ষেপ করা হবে অগ্নিশিখা ও তামা, তখন তােমরা তা প্রতিরােধও করতে পারবে না। অতপর তােমাদের প্রভুর কোন নেয়ামত অস্বীকার করবে!’ এটি এমন চরম পর্যায়ের হুমকি ও শাসানি যে, মানুষ কিংবা অন্য কোনাে সৃষ্টির পক্ষে এর ভয়াবহতা কল্পনা করাও দুসাধ্য। কোরআনে এ হুমকির দৃষ্টান্ত খুবই কম। যেমন, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, বিত্তশালী অস্বীকারকারীদের দেখে নেই’, ‘আমার সৃষ্টি করা বান্দাকে ও আমাকে একাকী ছেড়ে দাও।’ কিন্তু এ সব শাসানির মধ্যে আমি অচিরেই তােমাদের জন্যে সকল ব্যস্ততামুক্ত হবাে’ কথাটা সবচেয়ে জোরদার, সবচেয়ে ভয়াবহ ও সবচেয়ে কঠিন শাসানি।। এখান থেকে সূরার শেষ অবধি কেয়ামতের প্রাক্কালের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও প্রলয় কান্ড, আখেরাতের দৃশ্যসমূহ এবং আযাব ও পুরস্কারের দৃশ্যসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। এই দৃশ্যসমূহের শুরুতেই একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা সূরার প্রথম দিককার উক্তিসমূহ ও সেগুলাের প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটের সাথে সংগতিপূর্ণ । যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে তখন তা রক্ত বর্ণের চামড়ার মতাে হয়ে যাবে। বস্তুত তখন আর অস্বীকার করার ক্ষমতা থাকবে না। ‘সেদিন কোনাে জ্বিন ও মানুষকে জিজ্ঞেস করা হবে না…’ এটি সেই কেয়ামতের দিনের বহু রকমের অবস্থার মধ্যে একটি বিশেষ অবস্থা। কখনাে বান্দাদের জিজ্ঞেস করা হবে, কখনাে কিছুই জিজ্ঞেস করা হবে না, কখনাে বা লােকেরা নিজেদের ব্যাপারে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে। কখনাে কোনাে কাজের ফলাফল তাতে যারা যারা অংশ নিয়েছে তাদের সকলের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে, আবার কখনাে বা টু শব্দটি করতে এবং বিন্দুমাত্র ঝগড়া-তর্ক করতে দেয়া হবে না। কেয়ামতের দিনটি হবে একটি দীর্ঘস্থায়ী দিন এবং তার প্রতিটি অবস্থাই হবে এক একটি মারাত্মক অবস্থা। এখানে আরাে একটা অবস্থা লক্ষণীয়। কোনাে মানুষ ও জ্বিনকে তখনই জিজ্ঞেস করা হবে, যখন প্রতিটি ব্যক্তির চরিত্র ও কাজ জানা যাবে এবং মুখমন্ডলের হাবভাব দেখেই বুঝা যাবে। খারাপ চরিত্রের লক্ষণ কালাে রং এবং ভালাে চরিত্রের লক্ষণ সাদা রংয়ের আকারে মুখমন্ডলে প্রকাশ পাবে। এ অবস্থায় আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করার অবকাশ কোথায়? অতএব তােমরা তােমাদের প্রভুর কোন্ নেয়ামত অস্বীকার করবে? অপরাধীদের তাদের মুখমন্ডল দেখেই চেনা যাবে, ফলে তাদের কপালের চুল ও পা ধরে। টেনে নেয়া হবে…’ এটি একটি চরম নিষ্ঠুরতা ও লাঞ্ছনাময় দৃশ্য। পাগুলাে মাথার সাথে মিলিয়ে বেঁধে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এমতাবস্থায় আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করার উপায় আছে কী? এই দৃশ্য উপস্থাপন এবং পা ও কপাল একত্রে বেঁধে দোযখে নিক্ষেপের দৃশ্য তুলে ধরার পর বলা হচ্ছে, ‘এই সেই জাহান্নাম, যাকে অপরাধীরা অস্বীকার করে থাকে। তারা তাতে ফুটন্ত তরল পদার্থের মাঝে ঘুরতে থাকবে।’ এই পানি এত চরম পর্যায়ের উত্তপ্ত হবে, যেন তা দোযখে রান্না করা খাবার। তারা জাহান্নাম ও এই তরল পদার্থের মাঝে ঘুরবে। আয়াতের ভাষা থেকে মনে হয় যেন তারা এখনই ঘুরছে। এ পর্যন্ত গেলাে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বিবরণ।

১৪-৪৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা :-
তাফসীরে‌ ইবনে কাছীর:-
১৪-২৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করছেন, তিনি মানুষকে বেজে ওঠা খোলার মত শুষ্ক মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আর জ্বিনকে সৃষ্টি করেছেন নিধূম অগ্নিশিখা হতে। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ফেরেশতাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে নূর (জ্যোতি) হতে, জ্বিনদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে নিধূম অগ্নিশিখা হতে এবং আদম (আঃ)-কে ঐ মাটি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে যার বর্ণনা তোমাদের সামনে করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাঁর কোন নিয়ামতকে অস্বীকার না করার হিদায়াত দান করেন। এরপর তিনি বলেনঃ তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা। অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের দুই উদয়াচল এবং গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের দুই অস্তাচল। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “আমি শপথ করছি উদয়াচল ও অস্তাচলের অধিপতির।” (৭০:৪০) গ্রীষ্মকালে ও শীতকালে সূর্য উদিত হওয়ার দুটি পৃথক জায়গা এবং অস্তমিত হওয়ারও দুটি পৃথক জায়গা। ওখান হতে সূর্য উপরে উঠে ও নীচে নেমে আসে। ঋতুর পরিবর্তনে এটা পরিবর্তিত হতে থাকে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের রব, তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই, সুতরাং তাকেই কর্মবিধায়ক বানিয়ে নাও।” (৭৩:৯) তাহলে এখানে মাশরিক ও মাগরিব দ্বারা এর জাতকে বুঝানো হয়েছে, আর দুটি মাশরিক ও দুটি মাগরিব দ্বারা বুঝানো হয়েছে সূর্যোদয়ের দুটি স্থানকে এবং সূর্যাস্তের দুটি স্থানকে। উদয় ও অস্তের দুটি করে পৃথক পৃথক স্থান থাকার মধ্যে মানবীয় উপকার ও কল্যাণ রয়েছে বলে আবারও আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলছেনঃ “হে মানব ও জ্বিন জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে? তার ক্ষমতার দৃশ্য অবলোকন কর যে, দুটি সমুদ্র সমানভাবে চলতে রয়েছে। একটির পানি লবণাক্ত এবং অপরটির পানি মিষ্ট। কিন্তু না ওর পানি এর পানির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে এর পানিকে লবণাক্ত করতে পারে, না এর পানি ওর সাথে মিশ্রিত হয়ে ওর পানিকে মিশ্র করতে পারে! বরং দুটোই নিজ নিজ গতিতে চলছে! উভয়ের মধ্যে এক অন্তরায় রয়েছে। সুতরাং না এটা ওটার সাথে এবং ওটা এটার সাথে মিশ্রিত বা মিলিত হতে পারে। এটা নিজের সীমানার মধ্যে রয়েছে এবং ওটাও নিজের সীমানার মধ্যে রয়েছে। আর কুদরতী ব্যবধান দুটোর মধ্যে রেখে দেয়া হয়েছে। অথচ দুটোরই পানি মিলিতভাবে রয়েছে। সূরায়ে ফুরকানের নিম্নের আয়াতের তাফসীরে এর পূর্ণ ব্যাখ্যা গত হয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “তিনিই দুই দরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট সুপেয় এবং অপরটি লোনা, খর; উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্তরায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান।” (২৫:৫৩)।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা আসমানের সমুদ্র ও যমীনের সমুদ্রকে বুঝানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, আসমানে যে পানির ফোঁটা রয়েছে এবং যমীনের সমুদ্রে যে ঝিনুক রয়েছে, এ দুটোর মিলনে মুক্তা জন্ম লাভ করে। এ ঘটনাটি তো সত্য বটে, কিন্তু এই আয়াতের তাফসীর এভাবে করা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। কেননা, এ আয়াতে এ দুটি সমুদ্রের মাঝে বারযাখ বা অন্তরায় থাকার বর্ণনা রয়েছে যা এটাকে ওটা হতে এবং ওটাকে এটা হতে বাধা দিয়ে রেখেছে। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, এ দুটো সমুদ্র যমীনেই রয়েছে। এমনকি দুটো মিলিতভাবে রয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরতে দুটোর পানি পৃথক থাকছে। আসমান ও যমীনের মাঝে যে ব্যবধান রয়েছে ওটাকে (আরবী) বলা হয় না। এ জন্যে সঠিক উক্তি এটাই যে, এ দুটো যমীনেরই সমুদ্র যে দুটোর বর্ণনা এ আয়াতে রয়েছে, একটি যে আসমানের এবং অপরটি যমীনের তা নয়। আয়াতে বলা হয়েছে যে, উভয় সমুদ্র হতে উৎপন্ন হয় মুক্তা ও প্রবাল, অথচ এগুলো পাওয়া যায় আসলে একটি সমুদ্র হতে, কিন্তু দুটোর উপর এর প্রয়োগ হয়েছে এবং এরূপ প্রয়োগ বৈধ ও সঠিক। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে দানব ও মানবের দল! তোমাদের কাছে কি তোমাদেরই মধ্য হতে রাসূলগণ আসেনি?” (৬:১৩০)

আর এটা প্রকাশ্য কথা যে, রাসূল শুধু মানুষের মধ্য হতেই হয়েছেন, জ্বিনদের মধ্য হতে কোন জ্বিন রাসূল রূপে আসেনি। তাহলে এখানে যেমন মানব ও দানবের মধ্য হতে রাসূল আগমনের প্রয়োগ শুদ্ধ হয়েছে, অনুরূপভাবে এই আয়াতেও দুটো সমুদ্রের উপরই মুক্তা ও প্রবাল উৎপন্ন হওয়ার প্রয়োগ সঠিক হয়েছে। অথচ এগুলো উৎপন্ন হয় শুধু একটিতে।

(আরবী) অর্থাৎ মুক্তা তো একটি সুপ্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত জিনিস। আর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ছোট মুক্তাকে মারজান বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন যে, মারজান বলা হয় বড় মুক্তাকে। এও বলা হয়েছে যে, উত্তম ও উচ্চমানের মুক্তাকে মারজান বলে। কারো কারো মতে লাল রঙ এর জওহর বা মূল্যবান পাথরকে মারজান বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন যে, মারজান বলা হয় লাল মোহরকে। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “তোমরা প্রত্যেকটা হতে বহির্গত গোশত খেয়ে থাকো যা টাটকা হয় এবং পরিধানের অলংকার বের করে থাকো।” (৩৫:১২) মাছ তো লোনা ও মিষ্ট উভয় পানি হতেই বের হয়ে থাকে, কিন্তু মণি-মুক্তা শুধু লোনা পানির সমুদ্রে পাওয়া যায়, মিষ্ট পানির সমুদ্রে নয়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আসমানের পানির যে বিন্দু সমুদ্রের ঝিনুকের মুখে সোজাভাবে পড়ে তাতেই মুক্তার সৃষ্টি হয়। আর যখন ঝিনুকের মধ্যে পড়ে না তখন আম্বর (সুগন্ধি দ্রব্য বিশেষ) জন্ম লাভ করে। মেঘ হতে বৃষ্টি বর্ষণের সময় ঝিনুকও মুখ খুলে দেয়। তাই এই নিয়ামতের বর্ণনা দেয়ার পর আবার বলেনঃ তোমাদের যে প্রতিপালকের এসব অসংখ্য নিয়ামত তোমাদের উপর রয়েছে তার কোন নিয়ামতকে তোমরা অস্বীকার করবে?

এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ সমুদ্রে বিচরণশীল পর্বত প্রমাণ অর্ণবপোতসমূহ তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন, যেগুলো হাজার হাজার মণ মাল এবং শত শত মানুষকে এদিক হতে ওদিকে নিয়ে যায়। এটাও আল্লাহ তা’আলারই নিয়ন্ত্রণাধীন। এই বিরাট নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি পুনরায় বলেনঃ এখন বল তো, তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ তোমরা অস্বীকার করবে?

হযরত উমরাহ ইবনে সুওয়ায়েদ (রঃ) বলেনঃ “আমি একদা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ)-এর সাথে ফুরাত নদীর তীরে ছিলাম। নদীতে একটি বিরাট জাহাজ চলে আসছিল। জাহাজটিকে আসতে দেখে হযরত আলী (রাঃ) ঐ জাহাজটির দিকে হাতের ইশারা করে (আরবী)-এই আয়াতটি পাঠ করেন। অতঃপর বলেনঃ “যিনি এই পর্বত প্রমাণ জাহাজকে নদীতে চালিত করেছেন ঐ আল্লাহর কসম! আমি হযরত উসমান (রাঃ)-কে হত্যাও করিনি, হত্যা করার ইচ্ছাও করিনি এবং হত্যাকারীদের সাথে শরীকও ছিলাম না।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
২৬-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, যমীনের সমস্ত মাখলূকই ধ্বংসশীল। এমন একদিন আসবে যে, এই ভূ-পৃষ্ঠে কিছুই থাকবে না। প্রত্যেক সৃষ্টজীবের মৃত্যু হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে সমস্ত আকাশবাসীও মরণের স্বাদ গ্রহণ করবে, তবে আল্লাহ যাকে চাইবেন সেটা অন্য কথা। শুধু আল্লাহর সত্তা বাকী থাকবে। তিনি সর্বদা আছেন এবং সর্বদা থাকবেন। তিনি মৃত্যু ও ধ্বংস হতে পবিত্র। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, প্রথমে তো আল্লাহ তা’আলা জগত সৃষ্টির বর্ণনা দিলেন, অতঃপর সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা বর্ণনা করলেন।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণিত দুআগুলোর মধ্যে একটি দু’আ নিম্নরূপও রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে চিরঞ্জীব, হে স্বাধিষ্ট-বিশ্ববিধাতা! হে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা! হে মহিমময় ও মহানুভব! আপনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, আমরা আপনার করুণার মাধ্যমেই ফরিয়াদ করছি। আমাদের সমস্ত কাজ আপনি ঠিক করে দিন! চোখের পলক বরাবর সময়ও আমাদেরকে আমাদের নিজেদের কাছে সমর্পণ করবেন না এবং আপনার সৃষ্টির কারো কাছেও নয়।”

হযরত শা’বী (রঃ) বলেনঃ “যখন তুমি পাঠ করবে তখন সাথে সাথে (আরবী) এটাও পড়ে নিয়ো।” এ আয়াতটি আল্লাহ তাআলার নিম্নের উক্তির মতইঃঅর্থাৎ “তাঁর (আল্লাহর) চেহারা বা সত্তা ব্যতীত সবকিছুই ধ্বংসশীল।” (২৮:৮৮)।

এরপর আল্লাহু তা’আলা স্বীয় সত্তার প্রশংসায় বলেনঃ “তিনি মহিমময় ও মহানুভব।’ অর্থাৎ তিনি সম্মান ও মর্যাদা লাভের যোগ্য। তিনি এই অধিকার রাখেন যে, তাঁর উচ্চপদ সুলভ মাহাত্ম্যকে স্বীকার করে নেয়া হবে, তার আনুগত্য মেনে নেয়া হবে এবং তার ফরমানের বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না। অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডেকে থাকে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি চায় তাদের সাথে তুমি নিজের নফসকে আটক রেখো৷” (১৮:২৮) আর যেমন তিনি দান-খয়রাতকারীদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে তাদের উক্তি উদ্ধৃত করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করে থাকি।” (৭৬:৯)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) -এর অর্থ হলো অর্থাৎ তিনি শ্রেষ্ঠত্ব ও আড়ম্বরপূর্ণ।

সমস্ত জগতবাসী ধ্বংস হয়ে যাবে এই খবর দেয়ার পর আল্লাহ তা’আলা এই সংবাদ দিচ্ছেন যে, এরপরে তাদেরকে পরকালে মহামহিমান্বিত আল্লাহর নিকট পেশ করা হবে। অতঃপর তিনি আদল ও ইনসাফের সাথে তাদের মধ্যে ফায়সালা করবেন। এরপরে আল্লাহ পাক পুনরায় বলেনঃ হে দানব ও মানব! সুতরাং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে।

অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মাখলূক হতে বেপরোয়া ও অভাবমুক্ত, বরং সমস্ত মাখলূক তারই মুখাপেক্ষী। সবাই তার কাছে ভিক্ষুক। তিনি ধনী, আর সবাই দরিদ্র। তিনি সবারই অভাব পূরণকারী। প্রত্যেক সৃষ্টজীব তাঁর দরবারে স্বীয় অভাব ও প্রয়োজনের কথা তুলে ধরে এবং ওগুলো পূরণের জন্যে তার কাছে আবেদন জানায়। তিনি প্রত্যহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যে রত। তিনি প্রত্যেক আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেন, প্রত্যেক প্রার্থীকেই তিনি দান করেন। যাদের অবস্থা সংকীর্ণ তাদেরকে প্রশস্ততা প্রদান করেন। বিপদগ্রস্তদেরকে পরিত্রাণ দেন, রোগীদেরকে দান করেন সুস্থতা, দুঃখীদের দুঃখ দূর করেন, অসহায়ের প্রার্থনা কবূল করেন ও তাকে প্রশান্তি দান করেন, পাপীরা যখন তাদের পাপের জন্যে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন তিনি তাদের পাপ ক্ষমা করে দেন। জীবন তিনিই দান করেন এবং মৃত্যুও তিনিই ঘটিয়ে থাকেন। সমস্ত আকাশবাসী ও পৃথিবীবাসী তাঁর সামনে তাদের হস্ত প্রসারিত করে রয়েছে এবং অঞ্চল পেতে আছে। ছোটদেরকে তিনিই বড় করেন। তিনিই বন্দীদেরকে মুক্তি দেন। সৎলোকদের প্রয়োজন পৌঁছানোর শেষ সীমা, তাদের প্রার্থনার লক্ষ্যস্থল এবং তাদের অভাব অভিযোগের প্রত্যাবর্তন স্থল তিনিই। গোলামদের মুক্তিদান তিনিই করেন এবং সক্কাজের প্রতি আগ্রহীদেরকে তিনিই পুরস্কার দান করে থাকেন। এটাই তার মাহাত্ম্য।

হযরত মুনীব ইযদী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করেন। তখন আমরা জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঐ শান কি? উত্তরে তিনি বললেনঃ “ওটা হলো পাপরাশি ক্ষমা করে দেয়া, দুঃখ করা এবং লোকেদের উত্থান ও পতন ঘটানো।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “মহামহিমান্বিত আল্লাহ (আরবী) একথা বলেছেন।” অতঃপর তিনি বলেনঃ ঐ শান হলো এই যে, তিনি গুনাহ মাফ করেন, দুঃখ-কষ্ট দূর করেন, কোন সম্প্রদায়ের উত্থান দেন এবং কোন সম্প্রদায়ের পতন ঘটান। (ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে আসাকির (রঃ)-ও প্রায় এরূপই বর্ণনা করেছেন। সহীহ্ বুখারীতেও এ রিওয়াইয়াতটি মুআল্লাক রূপে হযরত আবু দারদা (রাঃ)-এর উক্তিতে বর্ণিত আছে। মুসনাদে বারেও কিছু কম বেশীর সাথে মার’রূপে এটা বর্ণিত আছে)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা লাওহে মাহফুকে সাদা মুক্তা দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, যার দানা দুটি লাল পদ্মরাগের তৈরী। ওর কলম জ্যোতি, ওর কিতাব জ্যোতি, ওর প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের সমান। তিনি প্রত্যহ ওটাকে তিনশত বার দেখে থাকেন। প্রত্যেক দর্শনে তিনি জীবনদান করেন, মৃত্যু ঘটান, ইযত দেন, লাঞ্ছিত করেন এবং যা ইচ্ছা করেন তা-ই করে থাকেন।
৩১-৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:

ফারেগ বা মুক্ত হওয়ার অর্থ এটা নয় যে, এ সময় কোন ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছেন, বরং এটা ধমক হিসেবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ শুধু তোমাদের প্রতি মনোনিবেশ করার সময় নিকটবর্তী হয়ে গেছে। এখন সঠিকভাবে ফায়সালা হয়ে যাবে। এখন আল্লাহ তা’আলাকে আর কোন কিছুই মশগুল করবে না, বরং তিনি শুধু তোমাদেরই হিসাব গ্রহণ করবেন। আরবদের বাক পদ্ধতি অনুযায়ী একথা বলা হয়েছে। যেমন ক্রোধের সময় কেউ কাউকেও বলে থাকেঃ “আচ্ছা, অবসর সময়ে আমি তোমাকে দেখে নেবো।” এখানে এ অর্থ নয় যে, এখন সে ব্যস্ত রয়েছে। বরং ভাবার্থ হচ্ছেঃ একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি তোমাকে দেখে নিবো এবং তোমার অসাবধানতায় ও উদাসীনতায় তোমাকে পাকড়াও করবে।

(আরবী) দ্বারা মানব ও দাবনকে বুঝানো হয়েছে। যেমন সহীহ হাদীসে এসেছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “ (কবরে শায়িত ব্যক্তির চীৎকারের শব্দ) প্রত্যেক জিনিসই শুনতে পায় মানব ও দানব ব্যতীত।” অন্য রিওয়াইয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “মানুষ ও জ্বিন ছাড়া।” আর সূর বা শিঙ্গার হাদীসে। পরিষ্কারভাবে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ সাকালান হলো মানুষ ও জ্বিন। মহান আল্লাহ আবারও বলেনঃ সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? হে দানব ও মানব! তোমরা আল্লাহ তা’আলার হুকুম এবং তার নির্ধারণকৃত তকদীর হতে পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে পারবে না, বরং তিনি তোমাদের সকলকেই পরিবেষ্টন করে রয়েছেন। তার হুকুম তোমাদের উপর বিনা বাধায় জারী রয়েছে। তোমরা যেখানেই যাবে সেখানেও তাঁরই রাজত্ব। এটা প্রকৃতভাবে ঘটবে হাশরের মাঠে। সেখানে সমস্ত মাখলুককে ফেরেশতামণ্ডলী চতুর্দিক হতে পরিবেষ্টন করবেন। চতুম্পার্শ্বে তাদের সাতটি করে সারি হবে। কোন লোকই আল্লাহর দলীল ছাড়া এদিক ওদিক যেতে পারবে না। আর দলীল আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “সেদিন মানুষ বলবেঃ আজ পালাবার স্থান কোথায়? না, কোন আশ্রয় স্থল নেই। সেদিন ঠাই হবে তোমার প্রতিপালকেরই নিকট।” (৭৫:১০-১২) আল্লাহ পাক আরেক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা মন্দ কাজ করে তাদের মন্দ কাজের তুল্য শাস্তি দেয়া হবে, তাদের উপর লাঞ্ছনা সওয়ার হবে, তাদেরকে আল্লাহর পাকড়াও হতে কেউই রক্ষা করতে পারবে না, তাদের চেহারা অন্ধকার রাত্রির টুকরার মত হবে, তারা জাহান্নামবাসী, ওর মধ্যে তারা চিরকাল অবস্থানকারী।” (১০:২৭)

(আরবী) শব্দের অর্থ হলো অগ্নিশিখা যা ধূম্র মিশ্রিত সবুজ রঙ এর, যা পুড়িয়ে বা ঝলসিয়ে দেয়। কেউ কেউ বলেন যে, এটা হলো ধূম্রবিহীন অগ্নির উপরের শিখা যা এমনভাবে ধাবিত হয় যে, যেন ওটা পানির তরঙ্গ।

(আরবী) বলা হয় ধূম্রকে। এ শব্দটি নূনে যবর সহও এসে থাকে। এখানে কিন্তু কিরআত নূনে পেশসহই রয়েছে। কবি নাবেগার কবিতাতেও এ শব্দটি ধূমের অর্থে এসেছে। কবিতাংশটি হলোঃ

(আরবী) অর্থাৎ “ওটা আলোকিত হয় সলিতা বিশিষ্ট প্রদীপের আলোকের মত, যাতে আল্লাহ ধূম্র রাখেননি।” তবে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবী) দ্বারা ঐ অগ্নিশিখাকে বুঝানো হয়েছে যাতে ধূম্র থাকে না এবং তিনি তাঁর এ মতের প্রমাণ হিসেবে উমাইয়া ইবনে আবি সালাতের কবিতা পাঠ করে শুনিয়ে দেন। আর তিনি (আরবী)-এর অর্থ করেছেন শুধু ধূম্র যাতে শিখা থাকে। এর প্রমাণ স্বরূপ তিনি কবি নাবেগার উপরোক্তে কবিতাংশটি পেশ করেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, (আরবী) দ্বারা ঐ পাতিল বা কড়াইকে বুঝানো হয়েছে যাকে গলানো হবে এবং জাহান্নামীদের মস্তকের উপর ঢেলে দেয়া হবে। মোটকথা, ভাবার্থ হচ্ছেঃ যদি তোমরা কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দান হতে পালাবার ইচ্ছা কর তবে ফেরেশতামণ্ডলী ও জাহান্নামের দারোগারা তোমাদের উপর আগুন বর্ষিয়ে, ধূম্র ছেড়ে দিয়ে এবং তোমাদের মাথায় গলিত পাতিল বহিয়ে দিয়ে তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনবে। না তোমরা তাদের মুকাবিলা করতে পারবে, না প্রতিরোধ করতে পারবে এবং না পারবে তাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে। সুতরাং তোমাদের প্রতিপালকের কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করা তোমাদের মোটেই উচিত নয়।
৩৭-৪৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন। এটা অন্যান্য আয়াতগুলোতেও বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ পাকের উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “আকাশ বিদীর্ণ হয়ে বিশ্লিষ্ট হয়ে পড়বে।” (৬৯:১৬) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেদিন আকাশ মেঘপুঞ্জসহ বিদীর্ণ হবে এবং ফেরেশতাদেরকে নামিয়ে দেয়া হবে।” (২৫:২৫) অন্য এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে ও তার প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে এবং এটাই তার করণীয়।” (৮৪:১-২) চাদি ইত্যাদিকে যেমন গলিয়ে দেয়া হয় তেমনই আকাশের অবস্থা হবে। সেই দিন আকাশ লাল, হলদে, নীল, সবুজ ইত্যাদি বিভিন্ন রঙ ধারণ করবে। এটা হবে কিয়ামতের দিনের কঠিন ও ভয়াবহ অবস্থার কারণে।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন লোকদেরকে উঠানো হবে এবং ঐ অবস্থায় তাদের উপর আকাশ হতে হালকা বৃষ্টি বর্ষিত হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবী)-এর তাফসীরে বলেছেন। যে, সেদিন আকাশ লাল চামড়ার মত হয়ে যাবে। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, গোলাপী রঙ এর ঘোড়ার মত আকাশের রঙ হবে। আবু সালেহ (রঃ) বলেন যে, প্রথমে গোলাপী রঙ এর হবে, তারপর লাল হয়ে যাবে। গোলাপী রঙ এর ঘোড়ার রঙ বসন্তকালে হলদে বর্ণের দেখা যায় এবং শীতকালে ঐ রঙ পরিবর্তিত হয়ে লাল বর্ণ হয়ে যায়। ঠাণ্ডা বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে তার রঙ পরিবর্তিত হতে থাকে। অনুরূপভাবে আকাশের রঙও বিভিন্ন রঙএ পরিবর্তিত হতে থাকবে। ওর রঙ গলিত তামার মত হয়ে যাবে, যেমন গোলাপী রাওগানের (তেলের) রঙ হয়ে থাকে।আসমান এই রঙ হয়ে যাবে। আজ এটা সবুজ রঙ এর আছে, কিন্তু ঐদিন এর রঙ লাল হয়ে যাবে। এটা যয়তুন তেলের তলানি বা গাদের মত হয়ে যাবে। জাহান্নামের আগুনের তাপ ওকে গলিয়ে দিয়ে তেলের মত করে দিবে।

প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ সেই দিন না মানুষকে তার অপরাধ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হবে, না জিনকে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এটা ঐ দিন যে, কেউ কথা বলতে পারবে না এবং তাদেরকে কোন ওযর পেশ করার অনুমতি দেয়া হবে না।” (৭৭:৩৫-৩৬) আবার অন্য আয়াতে তাদের কথা বলা, ওযর পেশ করা, তাদের হিসাব গ্রহণ করা ইত্যাদিরও বর্ণনা রয়েছে। বলা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালকের শপথ! আমি অবশ্যই তাদের সকলকেই প্রশ্ন করবে।” (১৫:৯২) তাহলে ভাবার্থ এই যে, এক অবস্থা বা পরিস্থিতিতে এরূপ হবে এবং অন্য অবস্থা বা পরিস্থিতিতে ঐরূপ হবে। প্রশ্ন করা হবে, হিসাব গ্রহণ করা হবে এবং ওযর-আপত্তির সুযোগে শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর মুখে মোহর লাগিয়ে দেয়া হবে এবং হাত, পাও দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে। এরপরে আর জিজ্ঞাসাবাদের কোন প্রয়োজনই থাকবে না। ওযর-আপত্তিরও কোন সুযোগে থাকবে না। অথবা সমাধান এভাবে হতে পারে। যে, অমুক অমুক কাজ করেছে কি করেনি এ প্রশ্ন কাউকে করা হবে না। কেননা, আল্লাহ তা’আলার ওটা খুব ভালরূপেই জানা আছে। হ্যাঁ, তবে প্রশ্ন যা করা হবে তা হলোঃ “তুমি এ কাজ কেন করেছিলে?’ তৃতীয় উক্তি এই যে, ফেরেশতারা তাদেরকে কিছুই জিজ্ঞেস করবেন না। কেননা, তাঁরা তো তাদের চেহারা দেখেই তাদেরকে চিনে ফেলবেন এবং জাহান্নামের জিঞ্জীরে বেঁধে উল্টো মুখে টেনে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।

কেননা, এরপরেই রয়েছেঃ ‘অপরাধীদের পরিচয় পাওয়া যাবে তাদের চেহারা হতে।’ মুখ হবে কালো ও মলিন এবং চোখ হবে নীল বর্ণ বিশিষ্ট। অপরপক্ষে মুমিনদের চেহারা হবে মর্যাদা মণ্ডিত। তাদের অনূর অঙ্গগুলো চন্দ্রের ন্যায় চমকাতে থাকবে। জাহান্নামীদেরকে পাকড়াও করা হবে এবং পা ও মাথার ঝুটি ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, যেমনভাবে বড় জ্বালানী কাষ্ঠকে দুই দিকে ধরে চুল্লীতে নিক্ষেপ করা হয়। তাদের পিঠের দিক হতে জিঞ্জীর লাগিয়ে গর্দান ও পা-কে এক করে বেঁধে ফেলা হবে, কোমর ভেঙ্গে দেয়া হবে এবং পা ও কপালকে মিলিয়ে দেয়া হবে এবং এই ভাবে শৃংখলিত করা হবে।

কিন্দা গোত্রের একটি লোক হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট আগমন করেন। পর্দার পিছনে বসে তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনি কি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনেছেন যে, এমন এক সময় আসবে যখন তিনি কারো জন্যে কোন সুপারিশ করার অধিকার রাখবেন না?” উত্তরে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ, একদা একই কাপড়ে আমরা দুই জন ছিলাম, ঐ সময় আমি তাঁকে এই প্রশ্নই করেছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ “হ্যাঁ, যখন পুলসিরাত রাখা হবে ঐ সময় আমাকে কারো জন্যে শাফাআত করার অধিকার দেয়া হবে না। যে পর্যন্ত না আমি জানবো যে, স্বয়ং আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর যেই দিন কারো চেহারা হবে উজ্জ্বল এবং কারো চেহারা হবে মলিন, শেষ পর্যন্ত আমি চিন্তা করবে যে, আমার ব্যাপারে কি করা হবে বা আমার প্রতি কি অহী করা হবে! আর পুলসিরাতের নিকট, যখন ওটাকে তীক্ষ ও গরম করা হবে! তীক্ষ্ণতা ও প্রখরতার সীমা যে কি?” আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ওর তীক্ষতা ও গরমের সীমা কি? তিনি উত্তর দিলেনঃ “তরবারীর ধারের মত তীক্ষ্ণ হবে এবং আগুনের অঙ্গারের মত গরম হবে। মুমিন তো সহজেই পার হয়ে যাবে, তার কোনই ক্ষতি হবে না। আর মুনাফিক লটকে যাবে। যখন সে মধ্যভাগে পৌঁছবে তখন তার পা জড়িয়ে যাবে। সে তার হাত তার পায়ের কাছে নিয়ে যাবে। যেমন যখন কেউ নগ্ন পদে চলে, তখন যদি তার পায়ে কাঁটা ফুটে যায় এবং এতো জোরে ফুটে যে, যেন পা-কে ছিদ্র করে দিয়েছে, তখন সে যেভাবে অধৈর্য হয়ে তাড়াতাড়ি মাথা ও হাত ঝুকিয়ে দিয়ে পায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে, অনুরূপভাবে সেও ঝুঁকে পড়বে। এদিকে সে এভাবে ঝুঁকে পড়বে আর ওদিকে জাহান্নামের দারোগা তার পা ও মাথার ঝুঁটি ধরে জাহান্নামের জিঞ্জীর দ্বারা বেঁধে ফেলবেন। অতঃপর তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন। ওর মধ্যে সে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত পড়তে থাকবে।” আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লোকটি কি পরিমাণ ভারী হবে? তিনি জবাবে বললেনঃ “দশটি গর্ভবতী উন্ত্রীর মত।” অতঃপর তিনি (আরবী) (অর্থাৎ অপরাধীদের পরিচয় পাওয়া যাবে তাদের চেহারা হতে, তাদেরকে পাকড়াও করা হবে পা ও মাথার ঝুঁটি ধরে)। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি খুবই গরীব বা দুর্বল। এর কতকগুলো শব্দ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কথা হওয়া অস্বীকৃত। এতে এমন একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন যার নাম নীচের বর্ণনাকারী নেননি। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)

ঐ পাপী ও অপরাধীদেরকে বলা হবেঃ এটা সেই জাহান্নাম যা তোমরা অস্বীকার ও অবিশ্বাস করতে। এখন তোমরা ওটা স্বচক্ষে দেখছে। একথা তাদেরকে বলা হবে লাঞ্ছিত ও অপমাণিত করার জন্যে এবং তাদেরকে খাটো করে দেখাবার জন্যে। অতঃপর তাদের অবস্থা এই দাঁড়াবে যে, কখনো তাদের আগুনের শাস্তি হচ্ছে, কখনো গরম পানি পান করানো হচ্ছে যা গলিত তাম্রের মত শুধু অগ্নি, যা নাড়ী-ভূঁড়ি কেটে ফেলবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন তাদের গলায় গলাবন্ধ থাকবে এবং পায়ে বেড়ী থাকবে। তাদেরকে গরম পানি হতে জাহান্নামে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হবে এবং বারবার জ্বালানো হবে।” (৪০:৭১-৭২) হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, আসমান ও যমীন সৃষ্টির প্রাথমিক সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত ওটা গরম করা। হচ্ছে। হযরত মুহাম্মদ ইবনে কা’ব (রঃ) বলেন যে, অপরাধী ব্যক্তির মাথার খুঁটি ধরে তাকে গরম পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হবে। ফলে দেহের সমস্ত গোশত খসে যাবে ও হাড় পৃথক হয়ে যাবে। সুতরাং দুই চক্ষু ও অস্থির কাঠামো বা ঠাট শুধু রয়ে যাবে। এটাকেই (আরবী) বলা হয়েছে। (আরবী)-এর অর্থ বর্তমানও করা হয়েছে। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “বিদ্যমান কঠিন গরম পানির নহর হতে তাদেরকে পান করানো হবে।” (৮৮:৫) যা কখনো পান করা যাবে না। কেননা, ওটা আগুনের মত সীমাহীন গরম। কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) (৩৩:৫৩) এখানে এর দ্বারা খাদ্যের প্রস্তুতি ও রান্না হয়ে যাওয়া বুঝানো হয়েছে। যেহেতু পাপীদের শাস্তি এবং পুণ্যবানদের পুরস্কারও আল্লাহর ফযল, রহমত, ইনসাফ ও স্নেহ, নিজের এই শাস্তির বর্ণনা পূর্বে দিয়ে দেয়া যাতে শিরক ও অবাধ্যাচরণকারীরা সতর্ক হয়ে যায়, এটাও তার নিয়ামত, সেই হেতু আবারও তিনি প্রশ্ন করেনঃ সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?

১৪-৪৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
১৪-২৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ও জিন সৃষ্টির মূল উপাদান ও তাঁর কয়েকটি মহান নিদর্শনের কথা নিয়ে এসেছেন।

মানুষকে সৃষ্টি করেছেন صَلْصَالٍ বা এমন শুকনো মাটি হতে যাতে কোন কিছু দ্বারা আঘাত করলে আওয়াজ হয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন- صلصال দুর্ঘন্ধময় পঁচা মাটি। এখানে মানুষ বলতে আদম (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। যাঁর প্রথমত মাটি থেকে আকার তৈরি করা হয় অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাতে ‘রূহ্’ ফুঁকে দেন। অতঃপর আদম (আঃ)-এর বাম পাঁজরের হাড় হতে হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন এবং তাদের উভয়ের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।

আর জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন :

(وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُوْنٍ ‏ وَالْجَآنَّ خَلَقْنٰهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَّارِ السَّمُوْمِ) ‏

“আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠন্ঠনা মৃত্তিকা হতে, এর পূর্বে আমি জীনকে সৃষ্টি করেছি ধোঁয়াহীন আগুন হতে।” (সূরা হিজ্র ১৫ : ২৬-২৭)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ফেরেশতাদেরকে নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে যার বর্ণনা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৯৬)

(رَبُّ الْمَشْرِقَيْنِ وَرَبُّ الْمَغْرِبَيْنِ)

‘তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্ত্রণকারী’ অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের উদয়স্থলদ্বয় এবং অস্তস্থলদ্বয়ের মালিক। গ্রীষ্মকালে সূর্য সোজা পূর্বদিক বরাবর উদয় হয়, যার ফলে দিন বড় হয় আর রাত হয় ছোট। আর শীতকালে সূর্য পূর্বদিকের দক্ষিণ পার্শ্ব হতে উদয় হয়ে পশ্চিম দিকের দক্ষিণ পার্শ্বে অস্ত যায়, যার ফলে দিন ছোট হয় আর রাত হয় বড়। এ জন্য বলা হয়েছে দু’ উদয়াচল ও দু’ অস্তাচল।

তাছাড়াও সূর্য প্রতিদিনের উদয় ও অস্ত উভয় স্থলের তারতম্য হয়। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(فَلَآ أُقْسِمُ بِرَبِّ الْمَشٰرِقِ وَالْمَغٰرِبِ)

“আমি শপথ করছি উদয়াচল ও অস্তাচলের প্রতিপালকের।” (সূরা আল মা‘আ-রারিজ ৭০ : ৪০)

(مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيٰنِ)

‘তিনি দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন যারা পরস্পর মিলিত হয়’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : مرج-এর অর্থ ارسل বা প্রবাহিত করেন।

الْبَحْرَيْنِ দু সমুদ্র বলতে মিষ্টি পানি ও লোনা পানিবিশিষ্ট।

ইবনু জায়েদ বলেন- يَلْتَقِيٰنِ অর্থাৎ দুটি সমুদ্র পাশাপাশি প্রবাহিত হয় কিন্তু একটি অন্যটির সাথে সংমিশ্রণ হতে বাধা দেয় কারণ উভয়ের মাঝে রয়েছে বিশাল অন্তরায়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَھُوَ الَّذِیْ مَرَجَ الْبَحْرَیْنِ ھٰذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ وَّھٰذَا مِلْحٌ اُجَاجٌﺆ وَجَعَلَ بَیْنَھُمَا بَرْزَخًا وَّحِجْرًا مَّحْجُوْرًا) ‏

“তিনিই দু’ দরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট, সুপেয় এবং অপরটি লোনা, বিস্বাদ; উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্ত‎রায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান।” (সূরা আল ফুরকান ২৫ : ৫৩) এ সম্পর্কে সূরা ফুরকান-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

(يَخْرُجُ مِنْهُمَا اللُّؤْلُؤُ وَالْمَرْجَانُ)

অর্থাৎ মিষ্টি ও লোনা পানিবিশিষ্ট উভয় সমুদ্র হতে উৎপন্ন হয় মুক্তা ও প্রবাল, অথচ এগুলো পাওয়া যায় একটি সমুদ্র হতে, কিন্তু উভয়টির ওপর এর প্রয়োগ করা হয়েছে এরূপ প্রয়োগ বৈধ ও সঠিক। যেমন আল্লাহ বলেন :

( يٰمَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنْكُمْ)

‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্য হতে কি রাসূলগণ তোমাদের কাছে আসেনি। (সূরা আন‘আম ৬ : ১৩০) এটা সুস্পষ্ট কথা যে, রাসূল শুধুমাত্র মানুষের মধ্য হতেই এসেছেন, জিনদের মধ্য হতে কোন জিন রাসূল আসেনি। তাহলে এখানে যেমন মানব ও দানবের মধ্য হতে রাসূল আগমনের কথা প্রয়োগ শুদ্ধ হয়েছে, তেমনি এ আয়াতের দুটি সমুদ্রের ওপরই মুক্তা ও প্রবাল উৎপন্ন হওয়ার প্রয়োগ সঠিক হয়েছে।

اللُّؤْلُؤُ মুক্তা যা প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত জিনিস। الْمَرْجَان- কেউ বলেছেন : ছোট মুক্তাকে বলা হয়, আবার কেউ বলেছেন : বড় মুক্তাকে বলা হয়। ইবনু জারীর কতক সালাফদের থেকে এ বর্ণনা নিয়ে এসেছেন। ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ বলেন : মারজান হলো লাল মোহর। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন : (وَمِنْ كُلٍّ تَأْكُلُوْنَ لَحْمًا طَرِيًّا وَّتَسْتَخْرِجُوْنَ حِلْيَةً تَلْبَسُوْنَهَا) “তোমরা প্রত্যেকটি থেকেই টাটকা গোশত খাও এবং আহরণ কর মণি-মুক্তার অলঙ্কার যা তোমরা পরিধান কর।” (সূরা ফাতির ৩৫ : ১২)

মাছ লোনা ও মিষ্টি উভয় পানিতেই হয়ে থাকে, কিন্তু মণি-মুক্তা শুধু লোনা পানির মধ্যেই পাওয়া যায়, মিষ্টি পানিতে না। (ইবনু কাসীর)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আকাশ হতে যখন বৃষ্টি বর্ষণ হয় তখন সমুদ্রের ঝিনুক তাদের মুখ খুলে দেয়। বৃষ্টির যে ফোঁটা ঝিনুকের মাঝে পড়ে সেটাই মুক্তা হয়। (সনদ সহীহ, ইবনু আবী হাতেম- হা. ১৮৭৩৩-৪)

(وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنْشَاٰتُ)

‘পবর্ত সমতুল্য জাহাজসমূহ তাঁরই নিয়ান্ত্রণাধীন, যা সমুদ্রের বুকে চলাচল করে’ الْجَوَارِ হলো جارية-এর বহুবচন অর্থ হলো চলমান, الْمُنْشَاٰتُ অর্থ সুউচ্চ। অর্থাৎ সমুদ্রে চলমান পাহাড়সম উচ্চ জাহাজসমূহ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নিয়ন্ত্রণাধীন।

সূরা শূরাতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَمِنْ اٰيٰتِهِ الْجَوَارِ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ)

‏“তাঁর মহা নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হল পর্বত সদৃশ সমুদ্রে চলমান নৌযানসমূহ।” (সূরা শূরা- ৪২ : ৩২)

‘উমায়রাহ্ ইবনু সা‘দ বলেন : একদা আমি ‘আলী (রাঃ)-এর সাথে ফুরাত নদীর তীরে ছিলাম। নদীতে একটি বিরাট জাহাজ চলে আসছিল। জাহাজটিকে দেখে ‘আলী (রাঃ) ঐ জাহাজটির দিকে ইশারা করে

(وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنْشَاٰتُ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ)

আয়াতটি পাঠ করেন। অতঃপর বলেন : যিনি এ পর্বত সদৃশ জাহাজকে নদীতে চালিত করছেন ঐ আল্লাহ তা‘আলার কসম! আমি ‘উসমান (রাঃ)-কে হত্যা করিনি হত্যা করার ইচ্ছাও করিনি এবং হত্যাকারীদের সাথে শরীকও ছিলাম না। (ইবনু কাসীর)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মানব ও দানব সৃষ্টির মূল উপাদান জানলাম।
২. গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে সূর্যের উদয় ও অস্তে পার্থক্য রয়েছে।
৩. মণিমুক্তা ও প্রবাল উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও স্থান জানলাম।
৪. সমুদ্রে পাহাড়সম জাহাজ চলে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কৃপায়।
২৬-৩০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

পৃথিবীর বুকে যা কিছু আছে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, অনুরূপ আকাশে যারা আছে তারাও ধ্বংস হবে কেবলমাত্র চেহারাবিশিষ্ট সত্ত্বা আল্লাহ তা‘আলা আর তিনি যাকে ইচ্ছা করবেন তিনি বাকী থাকবেন।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَه۫)

“আল্লাহর চেহরা (সত্তা) ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল।” (সূরা আল ক্বাসাস ২৮ : ৮৮)

وجه অর্থ চেহারা যা আমাদের সকলের কাছে সুপরিচিত, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার চেহারা কেমন তা আমরা জানিনা যেমন অন্যান্য সকল সিফাতের ধরণ আমাদের কাছে অজ্ঞাত। কিন্তু আমরা ঈমান আনব যে, আল্লাহ তা‘আলার চেহারা রয়েছে যেমন বর্ণনা তিনি তাঁর কিতাবে এবং নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর হাদীসে দিয়েছেন।

حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لَأَحْرَقَ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَي إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ

আল্লাহ তা‘আলার হিজাব হল নূর, তা উন্মোচন করলে তাঁর দৃষ্টি যত দূর যাবে ততদূর পুড়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম হা. ১৭৯) সুতরাং এ চেহারা বিশাল চেহারা যা কোন সৃষ্টিজীবের সাথে তুলনা হতে পারে না। তাই আমরা বিশ্বাস করব আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত চেহারা রয়েছে যেমন তাঁর সত্তার জন্য উপযোগী। আমরা এটা সত্তা বা অন্য কিছু বলে ব্যাখ্যা করব না।

(يَسْأَلُه۫ مَنْ فِي السَّمٰوٰتِ)

‘আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে যা আছে সবাই তাঁর নিকট প্রার্থনা করে’ অর্থাৎ সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী এবং তাঁর দয়ার ভিখারী।

(كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِيْ شَأْنٍ) ‘তিনি প্রতিদিন (সর্র্বদা) মহান কার্যে রত’ প্রতিদিন বলতে সবসময়। شان (শান) অর্থ পূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ সব সময় তিনি কোন না কোন কাজে রত থাকেন।

কাউকে রোগী বানাচ্ছেন, কাউকে রোগ থেকে মুক্ত করছেন, কাউকে ধনী করছেন, আবার দরিদ্র করেন, কাউকে রাজা বানান, কাউকে মর্যাদা দেন আবার কাউকে অমর্যাদায় নিপতিত করেন। তিনি সর্বদাই কর্মরত।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(هُوَ اَلْحَيُّ الْقَيُّوْمُ لَا تَأْخُذُه۫ سِنَةٌ وَّلَا نَوْمٌ)

“যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। তন্দ্রা এবং নিদ্রা কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে না।’ (সূরা বাকারাহ ২ : ২৫৫)

আবূ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِيْ شَأْنٍ)

এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ঐ শান হলো এই যে, তিনি গুনাহ মাফ করেন, দুঃখ-কষ্ট দূর করেন, কোন সম্প্রদায়ের উত্থান দেন এবং কোন সম্প্রদায়ের পতন ঘটান। (ইবনু মাযাহ হা. ২০২, হাসান)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পৃথিবীর সব কিছু ধ্বংসশীল।
২. আল্লাহ তা‘আলার চেহারা রয়েছে তার প্রমাণ পেলাম।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সবাই তার মুখাপেক্ষী।
৩১-৩৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(سَنَفْرُغُ لَكُمْ)

‘হে মানুষ ও জিন! আমি শীঘ্রই তোমাদের প্রতি (হিসাব-নিকাশের জন্য) মনোনিবেশ করব’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে একটি ধমক। কারণ হিসাব-নিকাশের জন্য আল্লাহ তা‘আলা মনোনিবেশ করবেন এর অর্থ এই নয় যে, তিনি বর্তমানে কোন ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছেন; কারো দিকে খেয়াল করতে পারছেন না। এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে আকাশ-জমিনের প্রত্যেকটি সৃষ্টজীব আল্লাহ তা‘আলার কাছে তাদের অভাব-অনটন পেশ করে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রার্থনা পূর্ণ করার ব্যাপারে সর্বদাই এক বিশেষ শানে থাকেন। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আবেদন ও আবেদন মঞ্জুর করা সম্পর্কিত সব কাজ বন্ধ থাকবে, তখন কেবল কাজ থাকবে একটি এবং শানও হবে একটি তা হল হিসাব-নিকাশ ও ইনছাফসহকারে ফায়সালা করা (রূহুল মাআনী)। ইমাম বুখারী বলছেন : سنحاسبكم অচিরেই হিসাব নিব।

الثَّقَلٰنِ- হলো মানব ও জিন জাতি। হাদীসে এসেছে :

يسمعها كل شئ إلا الثقلين

অর্থাৎ ক্ববরের শাস্তি সবাই শুনতে পারবে কেবলমাত্র মানুষ ও জিন জাতি ব্যতীত। অন্য বর্ণনায় إلا الجن الإنس কথাটি উল্লেখ রয়েছে। (সহীহ বুখারী হা. ১৩৩৮)

(يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ…..)

‘হে জিন ও মানুষ জাতি! আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সীমা হতে যদি তোমরা বের হতে পার, তবে বের হয়ে যাও’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার কর্তৃত্বের বাইরে পলায়ন করে যেতে পারবে না। তিনি তোমাদেরকে তাঁর শ্রবণ, দর্শন, জ্ঞান ও ক্ষমতা দ্বারা বেষ্টন করে আছেন।

(يُرْسَلُ عَلَيْكُمَا….)

‘তোমাদের উভয়ের প্রতি প্রেরিত হবে অগ্নিশিখা ও ধোঁয়া, তোমরা তা প্রতিরোধ করতে পারবে না’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন- الشواظ হলো অগ্নিশিখা।

অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন : তা হলো ধোঁয়া। মুজাহিদ বলেন : شُوَاظٌ হলো অগ্নিশিখা যা ধুম্র মিশ্রিত সবুজ রং-এর যা পুড়িয়ে বা ঝলসিয়ে দেয়। وَّنُحَاسٌ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : নুহাস হলো আগুনের ধোঁয়া।

অর্থাৎ এ সময়ে একটি পরিস্থিতি বিরাজ করবে। যে সময়ে তোমরা অন্যের তো দূরের কথা নিজেদেরও সাহায্য করতে পারবে না। সুতরাং সে কঠিন বিপদের সময় কেউ কারো উপকারে আসবে না।

তাই যারা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বলে, আমরা আখিরাতে তোমাদের জন্য সুপারিশ করব, আমাদের মাধ্যম ছাড়া জান্নাতে যেতে পারবে না তাদের এসব কথা ছলনা ছাড়া কিছুই না, যেখানে নাবী-রাসূলগণ কিছু করতে পারবেন না, কিয়ামতের মাঠে সকল নাবী-রাসূল মানুষকে ফিরয়ে দেবেন, কেউ সুপারিশ করতে সাহস পাবেন না কেবল নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যতীত, সেখানে তথাকথিত পীর-ফকীরদের অবস্থান কোথায়? সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত আমরা কোন ব্যক্তির কথায় প্ররোচিত না হয়ে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রেখে যাওয়া তরীকায় ইবাদত করব, তাহলে নাজাত পাওয়ার আশা করা যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. প্রত্যেককে আল্লাহ তা‘আলা হিসাবের সম্মুখীন করবেন।
২. আল্লাহ তা‘আলার কর্তৃত্বের বাইরে কোন জায়গা নেই।
৩. কোন ব্যক্তি জান্নাতে নিয়ে যেতে বা কঠিন মুহূর্ত হতে নাজাত দিতে পারবে না।
৩৭-৪৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে কিয়ামত ও জাহান্নামের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন জাহান্নামীদের কিরূপ দেখাবে সে কথাও বর্ণনা করা হয়েছে।

কিয়ামতের দিন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে পড়বে, ফেরেশতাগণ পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। সেদিন আকাশ জাহান্নামের আগুনের প্রচণ্ড তাপের কারণে গলে রঙানো চামড়ার মতো লাল হয়ে যাবে।

الدِّهَانِ বলা হয় তেল বা লাল চামড়া। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَانْشَقَّتِ السَّمَا۬ءُ فَهِيَ يَوْمَئِذٍ وَّاهِيَةٌ) ‏

“এবং আকাশ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নিস্তেজ অবস্থায় বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে।” (সূরা আল হা-ক্বক্বাহ্ ৬৯ : ১৬)

(فَيَوْمَئِذٍ لَّا يُسْأَلُ…..)

‘সেদিন মানুষ ও জিনকে তার অপরাধ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হবে না’ এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করলেন কিয়ামত দিবসে কোন মানুষ ও জিনকে তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে না। এরূপ অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوْبِهِمُ الْمُجْرِمُوْنَ)

“অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না? ” (সূরা আল ক্বাসাস ২৮ : ৭৮)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : রাসূল এবং যাদের কাছে তাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে সবাইকে জিজ্ঞাসা করবেন। যেমন

(فَلَنَسْئَلَنَّ الَّذِيْنَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْئَلَنَّ الْمُرْسَلِيْنَ)

“অতঃপর যাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল তাদেরকে আমি অবশ্যই জিজ্ঞাসা করব এবং রাসূলগণকেও জিজ্ঞাসা করব।” (সূরা আল আ‘রাফ ৭ : ৬)

উভয়ের সমাধান হলো : যে আয়াতগুলোতে জিজ্ঞাসা করা হবে না উল্লেখ করা হয়েছে সে আয়াতগুলো খাস বা সীমাবদ্ধ। আর যে আয়াতগুলোতে জিজ্ঞাসা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা আম বা ব্যাপক।

কেননা না বোধক আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে শুধু পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে না। আর হ্যাঁ বোধক আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে সকল আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। এছাড়াও ‘আলিমগণ বলেছেন যে, প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা করা দু প্রকার :

(১) তিরষ্কারমূলক জিজ্ঞাসা করা, এটা এক প্রকার শাস্তি।
(২) তদন্তমূলক জিজ্ঞাসা, তথ্য সংগ্রহ করার জন্য জিজ্ঞাসা করা।

যে আয়াতগুলোতে জিজ্ঞাসা করবেন না বলা হয়েছে তা দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলার তদন্ত করার প্রয়োজন নেই তিনি সবকিছু জানেন। অতএব আয়াতের অর্থ হলো : সেদিন কোন মানুষ ও জিনকে তার অপরাধ সম্পর্কে জানার জন্য জিজ্ঞাসা করা হবে না অর্থাৎ, তারা যে আমলনামা হাতে পেয়েছে এবং তাতে তাদেরযে অপরাধের কথা উল্লেখ রয়েছে তা তারা করেছে কিনা এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনই হবে না, বরং তা সেদিন বিভিন্ন সাক্ষীর মাধ্যেমে প্রমাণিত হবে। যেমন তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও নবীদের সাক্ষ্য ইত্যাদি। (আযওয়াউল বায়ান)

بِسِيْمَاهُمْ- অর্থাৎ আলামত যা তাদের ওপর প্রকাশ পাবে, তা দ্বারা অপরাধীদের চেনা যাবে।

হাসান বাসরী ও কাতাদাহ্ (রহঃ) বলেন : অপরাধীদের চেনা যাবে কালো চেহারা ও নীল বর্ণ বিশিষ্ট চোখ দেখে। যেমন মু‘মিনদেরকে চেনা যাবে তাদের ওযূর অঙ্গসমূহে চাঁদের আলোর মতো চমকাতে দেখে।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

( یَّوْمَ تَبْیَضُّ وُجُوْھٌ وَّتَسْوَدُّ وُجُوْھٌﺆ فَاَمَّا الَّذِیْنَ اسْوَدَّتْ وُجُوْھُھُمْﺤ اَکَفَرْتُمْ بَعْدَ اِیْمَانِکُمْ فَذُوْقُوا الْعَذَابَ بِمَا کُنْتُمْ تَکْفُرُوْنَ) ‏

“সেদিন কিছু চেহারা হবে উজ্জ্বল এবং কিছু চেহারা হবে কালো। অতঃপর যাদের চেহারা কালো হবে (তাদেরকে বলা হবে), তোমরা কি ঈমান আনার পর কুফরী করেছিলে? সুতরাং তোমাদের কুফরী করার কারণে শাস্তি ভোগ কর।” (সূরা আলি ‘ইমরান ৩ : ১০৬)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ تَرَي الَّذِيْنَ كَذَبُوْا عَلَي اللّٰهِ وُجُوْهُهُمْ مُّسْوَدَّةٌ ط أَلَيْسَ فِيْ جَهَنَّمَ مَثْوًي لِّلْمُتَكَبِّرِيْنَ)‏

“তুমি কিয়ামতের দিন যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তাদের মুখ কাল দেখবে। অহংকারীদের আবাসস্থল কি জাহান্নাম নয়?” (সূরা যুমার ৩৯ : ৬০)

(فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِيْ وَالْأَقْدَامِ)

অর্থাৎ ফেরেশতারা তাদের ললাট ও পা একসাথে মিলিয়ে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন এবং বলবেন : এটা হল সে জাহান্নাম যা তোমরা অস্বীকার করতে।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : ললাট ও উভয় পা ধরা হবে, অতঃপর তা কাঠের মতো ভেঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। যহহাক (রহঃ) বলেন : জাহান্নামীদের ললাট ও উভয় পা পেছন দিক থেকে শিকল দ্বারা বাধা হবে। (ইবনু কাসীর)

(يَطُوْفُوْنَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ حَمِيْمٍ اٰنٍ)

‘তারা জাহান্নামের ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটোছুটি করবে’ অর্থাৎ কখনো তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি দেয়া হবে, আবার কখনো ফুটন্ত পানি পান করার শাস্তি দেয়া হবে।

اٰنٍ গরম পানি, যে পানি নাড়ীভূঁড়ি গলিয়ে দেয়। ==

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِذِ الْأَغْلٰلُ فِيْٓ أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلٰسِلُ ط يُسْحَبُوْنَ- فِي الْحَمِيْمِ ثُمَّ فِي النَّارِ يُسْجَرُوْنَ)

“যখন তাদের গলদেশে বেড়ি ও শৃঙ্খল থাকবে, তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর তাদেরকে দগ্ধ করা হবে অগ্নিতে।” (সূরা মু’মিন ৪০ : ৭১-৭২)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামতের দিন আকাশের কী ভয়াবহ অবস্থা হবে তা জানতে পারলাম।
২. পাপাচারীদের কী লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি হবে তাও জানতে পারলাম।

Leave a Reply