Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫০)
[*সৃষ্টি সম্পর্কে তোমরা জান,তবুও কেন শিক্ষা গ্রহণ করোনা?:-
*পবিত্রতা ছাড়া কুরআন স্পর্শ করতে পারে কী?:-
*মৃত্যু পথযাত্রীর বিদায়ী প্রাণবায়ূকে ফিরিয়ে আন না কেন?:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৬:”আল-ওয়াক্বিয়া”
পারা:২৭
৫৭-৯৬ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
২) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৩) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৫৭-৯৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:
*প্রথম ও দ্বিতীয় সৃষ্টি : ‘আমিই তােমাদের সৃষ্টি করেছি। তবু কি তােমরা বিশ্বাস করবে না?…'(৫৭-৬২) এ হচ্ছে প্রথম সৃষ্টি ও তার অবসানের প্রক্রিয়া, জন্ম ও মৃত্যুর পর্যায়ক্রমিক আবর্তন। মানব জীবনে এটা একটা বাস্তব ও সুপরিচিত ব্যাপার এবং সার্বজনীন চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। মানুষ কিভাবে বিশ্বাস না করে পারে যে, আল্লাহ তায়ালাই তাকে সৃষ্টি করেছেন? ‘বস্তুত আমিই তােমাদের সৃষ্টি করেছি…’ মানবসত্ত্বা এর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিলে ততটা চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হতাে না। ‘তোমরা যে বীর্যপাত করাে, তার কথা কি ভেবে দেখেছাে? ওটা কি তােমরা সৃষ্টি করাে না আমি সৃষ্টি করি?’ বস্তুত মানুষের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় তার নিজের ভূমিকা এর চেয়ে বেশী কিছু নয় যে, সে নিজের বীর্য কোনাে নারীর জরায়ুতে গচ্ছিত রাখে। এরপর তার নিজেরও কিছু করার থাকে না, সেই স্ত্রীলােকেরও না। মহান স্রষ্টার কুশলী হাত সম্পূর্ণ এককভাবে এই তুচ্ছ পানি নিয়ে কাজে নিয়ােজিত হয়। তিনি একাই একে সৃষ্টি করেন, এর বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধন করেন, তার দেহ নির্মাণ করেন ও তাতে আত্মা ফুঁকে দেন। এই প্রক্রিয়ার সূচনালগ্ন থেকে প্রতিটি মুহর্তে এক একটা অলৌকিক কান্ড ঘটতে থাকে। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ এই অলৌকিক কর্মকান্ড ঘটায় না। এই সৃষ্টিকর্মের রহস্য, স্বরূপ, এবং পদ্ধতি- এর কোনােটাই মানুষের জানা নেই, এতে অংশ গ্রহণ করা তাে দূরের কথা! এই মামুলী বিষয়টি প্রত্যেক মানুষই উপলব্ধি করতে পারে। আর এটুকু উপলব্ধি করাই এই অলৌকিক ব্যাপারটি অনুধাবন করার জন্যে যথেষ্ট, কিন্তু বীর্যপাতের পর যে একটি মাত্র কোষ জরায়ুতে আশ্রয় গ্রহণ করে, তার পরবর্তী কার্যক্রম তথা তার বিবর্তন ও বিকাশের ব্যাপারটা কল্পনারও বহির্ভূত। এটি এতাে বিস্ময়কর যে, এটি যদি বাস্তবে সংঘটিত না হতাে এবং তা প্রত্যেক মানুষ প্রত্যক্ষ না করতে পারতাে, তাহলে বিবেক এটিকে বিশ্বাস করতে সক্ষম হতাে না। এই একক কোষটি জরায়ুতে আশ্রয় নেয়ার পর শুরু হয় তার বিভাজন ও সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। ফলে কিছুদিনের মধ্যে তা পরিণত হয় লক্ষ কোটি কোষে। এসব কোষের এক একটি সমষ্টি বা কোষপুঞ্জ অন্যান্য কোষপুঞ্জ থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কেননা, যে মানুষটিকে সৃষ্টি করা হতে যাচ্ছে, তার শুধু অংশবিশেষ নির্মাণ করাই এক একটি কোষপুঞ্জের অর্পিত দায়িত্ব। কোনাে কোষপুঞ্জ দিয়ে হাড়, কোনাে কোষপুঞ্জ দিয়ে শিরা উপশিরা, কোনাে কোষপুঞ্জ দিয়ে চামড়া এবং কোনাে কোষপুঞ্জ দিয়ে স্নায়ুমন্ডলী তৈরী হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়। এরপর এক একটি অংগের কর্মক্ষমতা সৃষ্টির জন্যেও রয়েছে এক একটি কোষপুঞ্জ। কোনােটি চোখের কাজ, কোনােটি জিহ্বার কাজ, কোনােটি কানের কাজ এবং কোনােটি গ্রন্থির কাজ নিশ্চিত করে। এগুলাে পূর্বোক্ত কোষ পুঞ্জের তুলনায় অধিকতর সীমিত ও নির্দিষ্ট দায়িত্বসম্পন্ন। এদের প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র কোথায় তা জানে। ফলে একটি কোষপুঞ্জ তার নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র ভুলে গিয়ে অন্যত্র গিয়ে কাজ করবে না। যেমন চোখের কোষপুঞ্জ পেটে বা পায়ে নেমে গিয়ে কাজ করবে না। তা যদি করতাে, তাহলে নির্দিষ্ট জায়গার পরিবর্তে পেটে বা পায়ে চোখ তৈরী করে ফেলতাে। এ সব কোষ আল্লাহর ইলহামী নির্দেশে কাজ করে। তাই ভুল করে না। অনুরূপভাবে কানের কোষপুঞ্জ পায়ে নেমে গিয়ে সেখানে কান বানিয়ে দেয় না। এভাবে এই সকল কোষ আল্লাহর প্রত্যক্ষ তদারকিতে মানুষকে সুন্দরতম গঠন দিয়ে তৈরী করার কাজে নিয়ােজিত রয়েছে। কেননা, এক্ষেত্রে মানুষের নিজের কোনাে ভূমিকা নেই।(সূরা নাজমের ৪৫ ও ৪৬ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য) এ তাে হলাে সৃষ্টির সূচনা। কিন্তু এর অবসান তথা বিলুপ্তি বা মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রক্রিয়াও কম বিস্ময়কর নয়। এটিও মানুষের চোখে দেখা ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তােমাদের জন্যে মৃত্যু নির্ধারণ করেছি এবং আমি অক্ষম নই।’ মৃত্যু প্রত্যেক প্রাণীর অবধারিত পরিণতি। কিন্তু প্রশ্ন, মৃত্যু জিনিসটা কী? কিভাবে তা সংঘটিত হয়। মৃত্যুর এত শক্তি কেন যে, তাকে কেউ ঠেকাতে পারে না! বস্তুত এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিষয়, তাই কেউ এ থেকে নিস্তার পায় না এবং কেউ একে পেছনে ফেলে যেতে সক্ষম নয়। মৃত্যু মূলত সৃষ্টি প্রক্রিয়ার একটি পরিপূরক ঘটনা। ‘যাতে আমি অন্যদেরকে তােমাদের স্থলাভিষিক্ত করি…’ অর্থাৎ তােমাদের পর পৃথিবীকে গড়া ও তােমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর আল্লাহর খলীফা হিসাবে দায়িত্ব পালনের নিমিত্ত তােমাদেরকে মৃত্যু দিয়ে অন্যদের নিয়ে আসি। আল্লাহ তায়ালা- যিনি জীবনের স্রষ্টা, তিনি মৃত্যুরও স্রষ্টা। মৃতদের বিকল্প তৈরী করার জন্যে পূর্ববর্তীদের মৃত্যু দেয়া হয়। এটা দেয়া হয় পার্থিব জীবনের আয়ুষ্কাল পূর্ণ হওয়ার পর। নির্ধারিত আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেলেই পরকালীন জীবন শুরু হয়। ‘এবং তােমরা যে জগতকে জানাে না, সেখানে তােমাদের সৃষ্টি করি।’ অর্থাৎ সেই অদৃশ্য অজানা পরকালীন জগতে। সেই জগত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যতােটুকু জানান তা ছাড়া আর কেউ কিছু জানে না। এই পরবর্তী জগত সৃষ্টির পরই সৃষ্টি প্রক্রিয়া পূর্ণতা লাভ করে এবং গােটা মানব জাতির কাফেলা আপন গন্তব্যস্থলে পৌছে। বস্তুত এ হচ্ছে আখেরাতের জীবনের সূচনা। ‘তােমরা প্রথম সৃষ্টির কথা অবশ্যই জেনেছে। সেটা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাে না কেন?’ বস্তুত সেই প্রথম সৃষ্টি খুবই নিকট অতীতের কথা এবং তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এরূপ অনাড়ম্বর ও সাবলীল ভংগিতে কোরআন প্রথম সৃষ্টি ও শেষ সৃষ্টির বিবরণ দেয়। এটা সৃষ্টির স্বাভাবিক ও অমােঘ নিয়ম এবং মানুষের ঘনিষ্ঠতম জীবনের প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা। এতে কানাে জটিলতা নেই, কোনাে মগয পীড়নকারী দর্শনও নেই। সুতরাং এ নিয়ে বিতর্কেরও অবকাশ নেই। এ হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টা, মানবস্রষ্টা ও কোরআন নাযিল করনেওয়ালা আল্লাহর বাচনভংগি।
ফী জিলালিল কুরআন:
*ফল ফসল উৎপাদনের মাঝে আল্লাহর পরিচয় : এরপর পুনরায় কোরআন অত্যন্ত সহজ সাবলীল ভাষায় এমন একটি বিষয়ের দিকে মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করে, যা তাদের কাছে সুপরিচিত এবং প্রতিনিয়ত তাদের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার আওতায় আসে, অথচ সে সম্পর্কে তারা উদাসীন। ‘তােমরা যা চাষ করাে, তা নিয়ে ভেবে দেখেছাে কি?…'(৬৩-৬৭) মানুষের চোখের সামনেই ফলমূল ও ফসলাদি জন্মে, ফলে ও পাকে। এগুলাের ব্যাপারে মানুষের ভূমিকা কতােটুকু? মানুষ জমি চাষ করে, অতপর তার ভেতরে আল্লাহর সৃষ্টি করা বীজ বুনে আসে। এখানে তার কাজ শেষ হয়ে যায়। এরপর এই অলৌকিক কাজটিকে পূর্ণতা দান করে আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন হাত। এই হাত বীজটিকে অনুরূপ গাছ পুনরায় জন্মাতে নিয়ে যায়। সে তাকে একজন বিজ্ঞ মানুষের ন্যায় পর্যায়ক্রমে কাজে নিয়ােজিত করে। মানুষ তার কাজে ভুল করে, কিন্তু এই হাত তার কাজে একটিবারও ভুল করে না, বিপথগামী হয় না এবং নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল থেকে বিচ্যুত হয় না। এই সৃজনী হাত গােটা কার্যক্রম চলাকালে নিজ দায়িত্ব বহন করে এবং এমন বিস্ময়কর কাজ সম্পাদন করে, যা মানুষ কোনাে না কোনােভাবে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস করতে পারতাে না। কোনাে বিবেক এ কথা কল্পনাও করতে পারতাে না যে, একটি গমের দানার ভেতর অতাে বড় একটা গাছ, অতােগুলাে পাতা এবং অতােগুলাে গমের শীষ ও দানা লুকিয়ে থাকতে পারে। এও কল্পনা করতে পারতাে না যে, সামান্য একটি খেজুরের আঁটির ভেতরে অতাে বড় একটা আস্ত খেজুরের গাছ এবং তার আনুষংগিক জিনিসগুলো থাকতে পারে। সকাল-বিকাল এ ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে না দেখলে কোনাে মানুষ এটা কল্পনাও করতে পারতাে না। আর কোনাে মানুষ কি দাবী করতে পারবে যে, আল্লাহর যমীনের মাটি চাষ করে তাতে আল্লাহরই তৈরী বীজ বপন করা ছাড়া অতিরিক্ত কোনাে কাজ সে করেছে! ‘মানুষ বলে, আমরা ফসল উৎপন্ন করেছি। অথচ তারা চাষ করা ও বীজ বপন করা ছাড়া আর কিছু করে না।’ এই সমগ্র কর্মকান্ডে যেটি যথার্থই অলৌকিক, তা সবই মহান স্রষ্টা আল্লাহর কাজ। তিনি যদি চাইতেন তবে ফলস উৎপন্ন হওয়ার আগেই ক্ষেতের সমস্ত চারাগাছ ধ্বংস করে দিতে পারতেন। যদি তাই ঘটতাে, তাহলে মানুষ আফসােস করে বলতাে, ‘হায়, আমরা তাে ক্ষতিগ্রন্ত হলাম, বরং বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আল্লাহর মেহেরবানী যে, তিনি ফসল উদগত করেন।’ এ হচ্ছে জীবনের একটি রূপ, যা আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তদারক করে থাকেন। এটা যখন তার পক্ষে সহজ, তখন পরবর্তী সৃষ্টির কাজটিতে আর বিস্ময়ের কী আছে? ‘তোমরা যে পানি পান করাে, তা কি দেখেছাে? মেঘমালা থেকে সে পানি তােমরা বর্ষণ করাে, না আমি করি। আমি ইচ্ছা করলে সে পানিকে লবণাক্ত বানিয়ে দিতাম। তবু কি তােমরা কৃতজ্ঞ হবে না?’ বস্তুত এই পানি হচ্ছে জীবনের ভিত্তি ও উৎস। আল্লাহরই নির্ধারিত নিয়মানুযায়ী পানি না হলে জীবনের সৃষ্টি হতাে না। এই পানিতে মানুষের কী ভূমিকা ও অবদান আছে। তার ভূমিকা এতােটুকুই যে, সে পানি পান করে। পানিকে মেঘ থেকে বর্ষণকারী ও তার অন্যান্য উপাদান থেকে সৃজনকারী আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ নয়। তিনিই এই পানিকে মিষ্টি বানাের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নচেৎ লােনা পানিতে পরিণত করতে চাইলে তা আর খাওয়া যেতাে না এবং তা দিযে ফসল ফলানাে যেতো না। সুতরাং এই দুর্লভ অনুগ্রহের জন্যে আমাদের আল্লাহর শােকর আদায় করা উচিত। কোরআন যাদের কাছে সর্বপ্রথম এই বক্তব্য রেখেছে, মেঘ থেকে প্রত্যক্ষভাবে বর্ষিত পানিই ছিলাে সেদিন তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল এবং উৎসবাদির উপকরণ। এই পানিই ছিলাে তাদের আবেগ-উচ্ছ্বাসের ভিত্তি। তাদের কবিতা ও গান একে চিরঞ্জীব করে রেখেছে। মানব সভ্যতার উন্নয়নে আজ পানির গুরুত্ব মােটেই কমেনি; বরং বহু গুণ বেড়েছে। যারা বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে নিয়ােজিত এবং প্রথম পানির ব্যাখ্যায় সচেষ্ট, তারা পানির গুরুত্ব অন্যদের চেয়ে বেশী বুঝে। কেননা, পানির প্রয়ােজন ও চাহিদা মরুভূমির বেদুইন ও গবেষণায় নিয়ােজিত বৈজ্ঞানিকের একই সমান। ‘তােমরা যে আগুন জ্বালাও, তা নিয়ে কি ভেবে দেখেছাে? আগুনের গাছটা কি তােমরা বানিয়েছ, না আমি বানিয়েছি। আমিই ওটা বানিয়েছি শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে এবং পথিকের পাথেয় হিসাবে।’ মানুষের আগুন আবিষ্কার তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলাে। বরঞ্চ বলা যেতে পারে, এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়েছিলাে, কিন্তু নিত্যব্যবহার্য ও সুপরিচিত হওয়ার কারণে এটা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। মানুষ আগুন জ্বালায় বটে, কিন্তু এর জ্বালানি কাঠ কে বানানোর (কৃষি সংক্রান্ত আলােচনায় তা অতিক্রান্ত হয়েছে) গাছ কৃষি থেকেই উৎপন্ন। তবে এখানে বিশেষ লক্ষণীয় ব্যাপার হলাে ‘আগুনের গাছ’ কথাটা। আরবরা এক গাছের ডাল আর এক গাছের ডালের সাথে ঘষা দিয়ে আগুন জ্বালাতাে। এটা বেদুইনদের রীতি ছিলাে এবং সেই রীতি এখনাে চলছে। এখন মানব জাতির অভিজ্ঞতায় এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। অবশ্য আগুনের অলৌকিক অস্তিত্ব এবং গবেষক বিজ্ঞানীদের কাছে তার রহস্যময়তা কৌতূহলােদ্দীপক ও তাৎপর্যপূর্ণ। দুনিয়ার আগুনের উল্লেখ প্রসংগে এখানে আখেরাতের আগুনের বিষয়ে ইংগিত দেয়া হয়েছে। আমি আগুনকে শিক্ষণীয় বিষয় বানিয়েছি, অর্থাৎ জাহান্নামের আগুনকে স্মরণ করার উপায় বানিয়েছি। অনুরূপভাবে এই আগুনকে পর্যটকদের পাথেয় বানিয়েছি। শ্রোতাদের মনে এই বক্তব্যের গভীর প্রভাব পড়ার কথা। কেননা, এটা জনজীবনের একটি বাস্তব ও জীবন্ত সত্য। এসব তাৎপর্যপূর্ণ তত্ত্ব, তথ্য ও রহস্য আলােচনার পর এবং ঈমানের সহজ সাবলীল সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের পর এসব তত্ত্ব তথ্যের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে মনােযােগ দেয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্ব, প্রভুত্ব ও মহত্ত্ব। সৃষ্টির সামনে এই সত্য সর্বাত্মক শক্তি ও পরাক্রম নিয়ে আবির্ভূত হয়। তাই রসূল(স.)-কে এই সত্যের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরােপ করা ও তাৎক্ষণিকভাবে তাকে অন্তরে বদ্ধমূল করার আদেশ দেয়া হয়েছে। ‘অতএব তােমার মহান প্রভুর নামে তাসবীহ পাঠ করাে।’
ফী জিলালিল কুরআন:
এরপর কোরআনকে যারা অস্বীকার করে, তাদের দিকে পুনরায় দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। এ প্রসংগে কোরআনের ও বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর কসম দ্বারা যােগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে। *নক্ষত্ররাজির শপথ : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নক্ষত্রমন্ডলীর অবস্থানস্থলসমূহের নামে শপথ করছি। তোমরা যদি জানতে, তবে এটা খুবই গুরুতর শপথ। এটি একটি সুরক্ষিত গ্রন্থে স্থাপিত মহান সম্মানিত কোরআন। একে পবিত্র লােকেরা ছাড়া স্পর্শ করতে পারে না। বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা।’ সেকালের শ্রোতাদের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় সংখ্যক ব্যতীত কেউ নক্ষত্রমন্ডলীর অবস্থান জানতাে না, আর জানতাে না বলেই তারা খালি চোখে দেখে নক্ষত্রগুলােকে ঠিকমতাে চিনতাে না। এ জন্যেই পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘তােমরা যদি জানতে, তবে এটা খুবই গুরুতর শপথ।’ অবশ্য ইদানীংকালে আমরা এই শপথের গুরুত্ব আমাদের পূর্বসুরীদের চেয়ে বেশী জানি, যদিও নক্ষত্রমন্ডলীর অবস্থানের গুরুত্ব আমরাও খুব সামান্যই জানি। আমাদের এই সামান্য জ্ঞানের অর্জিত একটি তথ্য এই যে, এই বিশাল মহাশূন্যের অগণিত নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে যে নক্ষত্রটিতে আমাদের সৌরমন্ডল অবস্থিত, তার নক্ষত্র সংখ্যা হলাে একশ কোটি। ‘আল্লাহ তায়ালা ও আধুনিক বিজ্ঞান’ নামক গ্রন্থের ৩৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘মহাশূন্য বিশেষজ্ঞদের মতে কযেক হাজার নক্ষত্রের মধ্যে এমন নক্ষত্রও আছে, যা খালি চোখে দেখা যায়, এমন নক্ষত্রও আছে যা দূরবীক্ষণ দিয়ে দেখতে হয়। আবার এমন নক্ষত্রও আছে যা দূরবীক্ষণ ইত্যাদিও দেখতে পায় না, কেবল অনুভব করে। এতাে সব নক্ষত্র অস্বচ্ছ আকাশে সাঁতার কাটে অথচ একটি নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র অপর নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের কাছাকাছি হবে, বা এক নক্ষত্রের সাথে অপর নক্ষত্রের সংঘর্ষ বেধে যাবে, এমন কোনােই সম্ভাবনা নেই। কেননা, একটি থেকে অপরটির দূরত্ব প্রশান্ত মহাসাগরে ভাসমান একটি নৌকা থেকে ভূমধ্যসাগরে ভাসমান একটি নৌকার দূরত্বের মতাে। উভয় নক্ষত্র একই সমান গতিতে একই দিকে ধাবমান থাকে, অথচ তাদের মধ্যে কোনাে সংঘর্ষ লাগা একেবারে অসম্ভব না হলেও সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। প্রতিটি নক্ষত্র অন্যান্য নক্ষত্র থেকে ভারসাম্যপূর্ণ ও যুক্তিসংগত দূরত্বে অবস্থিত। সকল নক্ষত্রের সাথে তার সমন্বয় সাধন করা হয়েছে এবং এই বিস্তৃত মহাশূন্যের সকল সৃষ্টি পরিপূর্ণ ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এই হচ্ছে নক্ষত্রসমূহের অবস্থানের গুরুত্বের একটি দিক। কোরআনের প্রথম শ্রোতারা এ সম্পর্কে যা জানতাে, এটা তা থেকে অনেক বড়। আর এখন যেটুকু জানা গেছে, তাও এতদসংক্রান্ত প্রকৃত ও সার্বিক তথ্যের অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নক্ষত্রসমূহের অবস্থানস্থলসমূহের শপথ করছি।’ বস্তুত বিষয়টি এতাে পরিষ্কার যে, শপথের কোনাে প্রয়ােজন নেই। তােমরা যদি জানতে, তবে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ শপথ। বস্তুত শপথের যেখানে আদৌ প্রয়ােজনই নেই এবং শপথ ছাড়াই বিষয়টি পরিষ্কার, সেখানে শপথের এই ভংগি অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। ‘নিশ্চয় এটি মহাসম্মানিত কোরআন, সুরক্ষিত গ্রন্থে স্থাপিত, একে পবিত্র লােকেরা ছাড়া কেউ স্পর্শ করে না। এটি বিশ্বপ্রভুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’ অর্থাৎ তােমরা যেমন কোরআনকে জ্যোতিষীর বাণী, পাগলের প্রলাপ, আল্লাহর নামে মনগড়া প্রাচীন কিসসাকাহিনী এবং শয়তানের নিয়ে আসা কথা ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে থাকো, ওসব কিছুই নয়। এটা মহাসম্মানিত কোরআন। সুরক্ষিত গ্রন্থে প্রতিষ্ঠিত। এর ব্যাখ্যা পরবর্তী আয়াতে রয়েছে যে, পবিত্র লােকেরা ছাড়া একে কেউ স্পর্শ করে না। বস্তুত মােশরেকরা মনে করতো, শয়তানরা কোরআন নিয়ে এসেছে। এখানে তাদের সেই ধারণা খন্ডন করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর জ্ঞানে ও তার তত্ত্বাবধানে সুরক্ষিত কোরআন শয়তান স্পর্শ করতে পারে না। একে নিয়ে এসেছে পবিত্র ফেরেশতারা। এটাই এ আয়াতের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। সুতরাং ‘লা’ শব্দটি এখানে নেতিবাচক- নিষেধবাচক নয়। কেননা, পৃথিবীতে কার্যত পবিত্র ও অপবিত্র, মােমেন ও কাফের সব ধরনের লোকেই কোরআন স্পর্শ করে থাকে। কাজেই এই অর্থে গ্রহণ করলে নেতিবাচক অর্থ মানানসই হয় না। নেতিবাচক অর্থ মানানসই হয় যদি এটিকে কাফেরদের এই উক্তির সাথে সম্পৃক্ত করা যায় যে, কোরআনকে শয়তান নিয়ে এসেছে। আর বলা যায়, এ আয়াতে শয়তান কর্তৃক কোরআন বহন করে আনার ধারণা খন্ডন করা হয়েছে। কেননা যে সুরক্ষিত মূল গ্রন্থে কোরআন রয়েছে, সেখান থেকে তা স্পর্শ করা ও বহন করে আনার কাজ পবিত্র ফেরেশতারা ছাড়া আর কেউ করেনি। আর এই ব্যাখ্যা পরবর্তী আয়াত দ্বারা সমর্থিত হয়। ‘এটি নাযিল হয়েছে বিশ্বপ্রভুর পক্ষ থেকে।’ অর্থাৎ শয়তানের পক্ষ থেকে আসেনি। অবশ্য দুটি হাদীস দ্বারা এ আয়াতের অন্য অর্থ প্রকাশ পায়। সেটি এই যে, পবিত্র লােকেরা ছাড়া কেউ কোরআন স্পর্শ করতে পারবে না। তবে ইবনে কাসীর এই উভয় হাদীসের সনদ অনির্ভরযােগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এই হাদীস দুটি গ্রহণ না করা উচিত বলে রায় দিয়েছেন।
ফী জিলালিল কুরআন:
*মৃত্যুর করুণ দৃশ্য : অতপর সূরার শেষাংশ আলােচিত হচ্ছে। এতে মৃত্যুর সময়কার বর্ণনা রয়েছে, যা শরীরের প্রতিটি গ্রন্থিকে কাপিয়ে দেয় এবং সকল বিতর্কের অবসান ঘটায়। এটা সেই মুহূর্ত, যা এক জীবনের অবসান ও আর এক জীবন সূচনার মাঝখানে অবস্থিত। এখান থেকে ফিরে আসা কারাে পক্ষে সম্ভব নয়। ‘তবু কি তােমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করবে…'(৮১-৮৭) অর্থাৎ তোমাদের আখেরাত সম্পর্কে যে কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে কি এখনাে সন্দেহে পতিত থাকবে। কোরআন ও তাতে আলােচিত আখেরাতকে তােমরা এখনাে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে থাকবে? এতে আকীদা সংক্রান্ত যা কিছু বলা হয়েছে, তা কি তােমরা অগ্রাহ্য করতেই থাকবে? ‘আর তােমাদের এই মিথ্যা প্রতিপন্ন করাকে কি জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করবে?’ অর্থাৎ মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং অস্বীকার করাই তােমাদের ইহকাল ও পরকালের উপজীব্য বা সম্বল হয়ে দাড়াবে? আর এতাে খুবই নিকৃষ্ট ধরনের সম্বল। তােমাদের প্রাণবায়ু যখন কণ্ঠনালীতে পৌছে যাবে এবং তােমরা অজানা পথের সন্ধিস্থলে গিয়ে পৌছবে, তখন তােমাদের কী অবস্থা হবে? অতপর কোরআন সেই অবস্থাটার চিত্র তুলে ধরছে, যা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সংঘটিত হবে। এখানে অতি দ্রুতগতিতে পরিস্থিতির বিবরণ দেয়া হয়েছে। ‘অতঃপর যখন কারাে প্রাণ কোষ্ঠাগত হয় এবং তােমরা তাকিয়ে থাকো, তখন আমি তােমাদের অপেক্ষা তার বেশী নিকটে থাকি। কিন্তু তােমরা তা দেখতে পাও না।’ যেন প্রাণবায়ু নির্গত হওয়ার শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছি, যেন সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি এবং সেই যন্ত্রণা ও কষ্ট যেন অনুভব করছি এই কথাটার মধ্য দিয়ে, ‘অতপর যখন তােমাদের প্রাণবায়ু কষ্ঠাগত হয়।’ অনুরূপ ‘তােমরা তখন তাকিয়ে থাকো’- এই কথাটার মধ্য দিয়ে আমরা যেন উপস্থিত লােকদের হতাশা ও দিশাহারা করুণ দৃষ্টিকে দেখতে পাই। অতপর প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়, দুনিয়া ও তার যাবতীয় ভােগের উপকরণ ছেড়ে সে চলে যায়। সে এমন একটা জগতের দিকে অগ্রসর হয়, যা তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং তার ভালাে বা মন্দ কৃতকর্ম ছাড়া আর কোনাে সম্বলই সেখানে তার হাতে থাকে না। এ সময় তার চোখে যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, সে সম্পর্কে তার কোনাে কিছুই বলার অবকাশ থাকে না এবং তার আশপাশে যতাে বস্তু বা প্রাণী থাকে, তা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দর্শকরা তার দেহ দেখতে পায় বটে, কিন্তু দেহের ওপর বা অভ্যন্তরে কী ঘটছে তা দেখতে পায় না। আর তার কিছু করার ক্ষমতাও থাকে না। এখানে এসে মানুষের সমস্ত ক্ষমতা রহিত হয়ে যায়। তার সমস্ত অনুভূতি ও চেতনা স্তব্ধ হয়ে যায় এবং তার সমস্ত কাজের অবকাশও শেষ হয়ে যায়। এ পর্যায়ে এসে সে বুঝতে পারে যে, সে একেবারেই অক্ষম এবং অসহায়। অথচ আদৌ কোনাে বাদ প্রতিবাদ করার ক্ষমতা তার থাকে না। মানুষের দৃষ্টি, জ্ঞান ও তৎপরতার ওপর তখন পর্দা পড়ে যায়। অবশিষ্ট থাকে কেবল আল্লাহর ক্ষমতা ও আল্লাহর জ্ঞান। সন্দেহাতীতভাবে ও বিনা বাদ প্রতিবাদে যাবতীয় বিষয় একমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এ কথাই বলা হয়েছে নিচের আয়াতে। এখন আমি হয়ে যাই তােমাদের চেয়েও তার (অর্থাৎ মরণোন্মুখ ব্যক্তির) নিকটতর, অথচ তােমরা তা দেখতে পাও না।’ এখানে আল্লাহর প্রতাপ ও তার উপস্থিতির ভীতি গােটা পরিবেশকে ভাবগম্ভীর করে তােলে। যদিও আল্লাহ তায়ালা সব সময়ই সর্বত্র উপস্থিত থাকেন, কিন্তু এখানে যে বাচনভংগি ব্যবহৃত হয়েছে, তা মানুষের ভুলে যাওয়া স্মৃতিকে জাগিয়ে তােলে এবং হারিয়ে যাওয়া চেতনা পুনর্বহাল করে। মৃত্যুর মজলিস যখন বসে যায়, তখন আল্লাহর উপস্থিতির ভীতি ও প্রতাপ তাকে অধিকতর ভাবগম্ভীর করে তােলে। তদুপরি মরণােন্মুখ ব্যক্তির অসহায়ত্ব, ভীতি, বিচ্ছিন্নতা ও বিদায় গ্রহণ পরিবেশকে আরাে বেশী বিয়োগ ব্যথায় ভারাক্রান্ত করে তােলে। এহেন প্রকম্পিত ও বেদনাবিধুর অনুভূতির আওতায় পুনরায় চ্যালেঞ্জের ভাষা প্রয়োগ করে সকল বাদানুবাদ স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে, ‘যদি তােমাদের হিসাব-কিতাব না হওয়াই সত্য হয়, তবে তােমরা এই (বিদায়রত) আত্মাকে ফেরাও না কেন, যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকে।’ অর্থাৎ তােমরা যে বলে থাকো হিসাব নিকাশ কিছুই হবে না, সে কথাই যদি যথার্থ হয়, তা হলে তাে তােমরা মুক্ত, তােমাদের আর কোনাে হিসাব নিকাশ দিতে ও জবাবদিহি করতে হবে না। তাহলে বেশ তাে, কণ্ঠনালীতে পৌছে যাওয়া প্রাণকে ঠেকাও, যাতে সে হিসাব নিকাশ দিতে না যেতে হয়। অথচ তােমরা তার চারপাশে তাকিয়েই থাকো, আর সে বৃহত্তম জবাবদিহির কাঠগড়ার দিকে যেতে থাকো, তােমরা অক্ষম ও অসহায় দর্শকের মতাে তা তাকিয়ে দেখতে থাকো।
ফী জিলালিল কুরআন:
এই পর্যায়ে সকল বাদানুবাদ ও তর্কবিতর্ক বন্ধ হয়ে যায়। মানবসত্ত্বার ওপর এই অবধারিত মহাসত্য অর্থাৎ মৃত্যুর চাপ প্রবল ও অপ্রতিরােধ্য হয়ে ওঠে। সে এর বিরুদ্ধে কিছুমাত্র প্রতিরােধ রচনা করতে সক্ষম হয় না। অতপর এই প্রাণ বা আত্মার গন্তব্য অভিমুখী যাত্রার বিবরণ দেয়া হয়। কণ্ঠনালীতে পৌছেই সে দূর থেকে তার সেই গন্তব্য দেখতে পায়। সে এখন নশ্বর পার্থিব জীবন পেছনে ফেলে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে এবং জবাবদিহির দিকে এগিয়ে যায়, যাকে অবিশ্বাসীরা অস্বীকার করে থাকে। ‘অতপর সে যদি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের অন্তর্গত হয়, তাহলে তাে সুখ, শান্তি ও নেয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত তার প্রাপ্য হবে…।'(৮৮-৯৪) সূরার শুরুতে আমরা আল্লাহর নিকটতম ও ঘনিষ্ঠতম বান্দাদের নেয়ামতের কিছু দৃশ্য দেখে এসেছি। মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে আত্মা তার জন্যে অপেক্ষমাণ সেসব সুখ ও আনন্দের উপকরণ দেখতে পায়। রওহুন (সুখ), রায়হানুন (উত্তম জীবিকা) এবং জান্নাতুন নাঈম, (নেয়ামতপূর্ণ বেহেশত) এখানে খােদ এই ব্যবহৃত শব্দগুলাে থেকেই এক ধরনের সুখ, প্রাচুর্য, আনন্দ, মিষ্টতা ও প্রীতির অনুভূতি যেন ফুটে ওঠেছে। ‘আর যদি সে ডান দিকের লােকদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তা হলে…’ সহসা তাকে সম্বােধন করে বলা হচ্ছে যে, ডান দিকের অন্যান্য ভাইদের পক্ষ থেকে তােমার জন্যে সালাম। সেই মুহূর্তে সালাম যে কত প্রীতিকর ও আনন্দদায়ক, তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। কণ্ঠাগত আত্মা এই সালাম ও অভিবাদন শুনে অভিভূত, তৃপ্ত ও নিশ্চিন্ত হয় এবং ডান দিকের অন্যদের সাহচর্য লাভের জন্যে সানন্দে অপেক্ষা করতে থাকে। আর যদি সে বিভ্রান্ত মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তার আপ্যায়ন হবে উত্তপ্ত পানীয় দ্বারা এবং সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। দোযখের সেই উত্তপ্ত পানীয় মানের দিক থেকেও এবং শেষ অবলম্বন হিসাবেও অত্যন্ত নিকৃষ্ট জিনিস। আর জাহান্নামের সেই আযাব কত কঠিন ও ভয়াবহ, তা বর্ণনা করাই দুসাধ্য। পাপিষ্ঠ আত্মা দূর থেকে এসব জিনিস দেখতে পায় এবং নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারে যে, ওগুলাে তাকে ভােগ করতেই হবে। অবশেষে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাষায় সূরার পরিসমাপ্তি টানা হচ্ছে এই বলে যে, ‘এটা ধ্রুব ও অকাট্য সত্য। সুতরাং তুমি তােমার মহান প্রভুর নামে তাসবীহ পাঠ করাে।’ অর্থাৎ সূরার শুরুতেই যে বিভীষিকাময় ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে সত্যের মানদন্ডে যাচাই করে তার অকাট্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ঘােষিত হয়েছে। আর এই দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে আল্লাহর তাসবীহ ও মাহাত্ম ঘােষণা সহকারে তার প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের যে স্বতস্ফূর্ত প্রেরণা জাগে, সেই প্রেরণাকে সমুন্নত রাখার নির্দেশের মধ্য দিয়ে সূরাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে।
৫৭-৯৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৫৭-৬২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
যারা বস্তুবাদীতে বিশ্বাসী, পরকালে অবিশ্বাসী তাদের এরূপ চিন্তাকে খণ্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : আমিই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছি অথচ তোমরা কিছুই ছিলে না, এরপরেও কি তোমরা পুনরুত্থানে বিশ্বাস করবে না। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : হে মানবমণ্ডলী! তোমরা কি ভেবে দেখেছ? স্ত্রী সহবাসের সময় তোমাদের যে বীর্য স্ত্রীগর্ভে যায় তা থেকে মানুষের আকৃতি দিয়ে কে দুনিয়াতে আগমন ঘটায়? নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ তা‘আলাই তা করি। সামান্য পানি থেকে যদি আমি তোমাদের সৃষ্টি করতে পারি তাহলে কি পুনরায় সৃষ্টি করে পুনরুত্থান করাতে পারব না? অবশ্যই পারব। বরং এটা আরো অতি সহজ।
(نَحْنُ قَدَّرْنَا بَيْنَكُمُ الْمَوْتَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মৃত্যুর সময় নির্ধারিত করে রেখেছেন। অতএব যখন নির্ধারিত সময় এসে যাবে তখন কোন অগ্রও বিলম্ব হবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ ج فَإِذَا جَا۬ءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُوْنَ سَاعَةً وَّلَا يَسْتَقْدِمُوْنَ)
“প্রত্যেক জাতির এক নির্দিষ্ট সময় আছে। যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মুহূর্তকাল দেরী করতে পারে না এবং জলদীও করতে পারবে না।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৩৪)
(وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوْقِيْنَ)
এ অংশটুকুর সম্পর্ক পরের আয়াতের সাথে। অর্থাৎ তোমাদের স্থলে তোমাদের মত অনুরূপ জাতি আনয়ন করতে এবং তোমাদের আকৃতি বিকৃত করতে তিনি সক্ষম।
(وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ النَّشْأَةَ الْأُوْلٰي)
অর্থাৎ তোমরা জান যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন অথচ তোমরা কিছুই ছিলে না। তাহলে কেন তোমরা এটা অনুধাবন করছ না যে, তিনি পুনরায় তোমাদের সৃষ্টি করতে সক্ষম। সুতরাং এতে কোন সংশয় নেই আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক আত্মাকে দুনিয়ার কর্মের প্রতিদান দেয়ার জন্য পুনরুত্থিত করবেন। তাই আমাদের এমন কর্মই করা উচিত যা পরকালে উপকারে আসবে এবং জাহান্নামে যেতে প্রতিবন্ধক হবে।
৬৩-৭৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কয়েকটি নেয়ামতকে চিন্তার দৃষ্টিতে অবলোকন করার জন্য মানব জাতিকে দিকনির্দেশনা প্রদান করছেন। এগুলোতে মানুষের কোন হাত আছে নাকি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই করে থাকেন। যেমন যে বীজ কৃষক জমিনে বপন করে তা থেকে এমনিই ফসল হয়ে যায়? কৃষক শুধু ক্ষেতে বীজ বপনের উপযোগী করে বীজ বপন করে সে বীজ বিদীর্ণ করে, মাটি ভেদ করে অঙ্কুরিত করে, ফসল ফলান কে? তিনি হলেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে বীজের অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে ফসল সবুজ শ্যামল করে বড় করে তোলার পর পাকার উপক্রম হলেও শুকিয়ে খড়কুটোয় পরিণত করে দিতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বান্দার প্রতি অনুগ্রহশীল। حُطَامًا অর্থ খড়কুটো, আগাছা।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের কেউ যেন না বলে ‘যারা’আতু’ বা আমি রোপণ করেছি বরং বলবে ‘হারাসতু’ বা চাষ করেছি। কেননা আল্লাহ তা‘আলা হলেন ‘যারে’ বা রোপণকারী। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ২৮০১)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা আকাশ হতে যে সুপেয় পানি বর্ষণ করেন তা নিয়ে চিন্তা করতে বলছেন, তিনি ইচ্ছা করলে তা লবণাক্ত করে দিতে পারেন। الْمُزْنِ অর্থ মেঘমালা। أُجَاجًا অর্থ লবণাক্ত।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আগুন সম্পর্কে চিন্তা করার কথা বলছেন, যে আগুন মানুষ জ্বালায়। আগুন সৃষ্টি হয় যে বৃক্ষ থেকে তা তো আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টি করেছেন। বলা হয় আরবে দুটি গাছ আছে মার্খ ও আফার। এ দু’টি গাছের ডাল নিয়ে যদি পরস্পরের সাথে ঘষা দেয়া হয় তবে তা থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়।
(نَحْنُ جَعَلْنٰهَا تَذْكِرَةً)
অর্থাৎ দুনিয়ার আগুনকে আমি জাহান্নামের আগুনের স্মারক করে দিয়েছি। যেমন হাদীসে এসেছে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আদম সন্তান যে আগুন জালিয়ে থাকে তা জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ। (সহীহ বুখারী হা. ৩২৬৫, সহীহ মুসলিম হা. ২৮৪৩) এবং আগুন মুসাফিরদের উপকারী করে দিয়েছেন। আগুন মুকিমদের জন্যও তো উপকারী, তাহলে এখানে বিশেষভাবে মুসাফিরের কথা উল্লেখ করার কারণ কী? উত্তর : সাধারণ অবস্থায় মুসাফিরদের আগুন বেশি কাজে লাগে এবং জরুরী। আর এটাও হতে পারে দুনিয়ার জীবনটাই তো সফরের জীবন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের মুসাফির হিসেবেই বসবাস। তাই আগুন দুনিয়া নামক মুসাফির জীবনের জন্য উপকারী করেছেন আর পরকালের আগুনের স্মারক করেছেন। অতত্রব যে মহান আল্লাহ আমাদেরকে ফসল পানি ও আগুনসহ অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন সে মহান প্রতিপালকের নামে তাসবীহ পাঠ, শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করলে আল্লাহ তা‘আলাকে চেনা যায়।
২. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা দরকার।
৩. আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।
৭৫-৮২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
فَلَآ أُقْسِمُ এখানে لا আরবী অক্ষরটি কতক মুফাসসিরদের মতে অতিরিক্ত। মূল বাক্য হল
(أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُوْمِ)।
আর কতক মুফাসসিরগণ বলেছেন : এখানে لا অক্ষরটি অতিরিক্ত না, তবে তার কোন অর্থ এখানে হবে না। বরং এরূপ নিয়ে আসা হয় তখন, যখন না বোধক বিষয়ে শপথ করা হয়। এরূপ সূরা কিয়ামার শুরুতে আছে।
(بِمَوَاقِعِ النُّجُوْمِ)
এর অর্থ নিয়ে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। যেমন : ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এর অর্থ হল কুরআনের অবতরণ। কুরআন কদরের রাতে ঊর্ধ্বাকাশ থেকে দুনিয়ার আকাশে একত্রে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর প্রয়োজন মত দুনিয়াতে অবতীর্ণ হতে থাকে। এভাবে কয়েক বছরে পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়। তারপর ইবনু আব্বাস (রাঃ) এ আয়াত তেলাওয়াত করেন। মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : আকাশে নক্ষত্ররাজির অস্তাচল। যেমন বলা হয়
مطالعها ومشارقها
হাসান বাসরী ও কাতাদাহ (রহঃ) এ কথা বলেছেন। ইবনু জারীর (রহঃ) এ মত পছন্দ করেছেন।
অন্যত্র হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল কিয়ামতের দিন যখন তারকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। (ইবনু কাসীর)
এখানে مَوَاقِعِ দ্বারা উদ্দেশ্য তারকারজির উদয়াচল ও অস্তাচল এবং তাদের গন্তব্যস্থল ও কক্ষপথ।
(وَإِنَّه۫ لَقَسَمٌ لَّوْ تَعْلَمُوْنَ عَظِيْمٌ)
অর্থাৎ অবশ্যই এটা এক মহা শপথ। কেননা, তারকার উদয় অস্তর গন্তব্য ও চলার কক্ষপথ একটি সীমাহীন বড় ধরণের নিদর্শন।
(إِنَّه۫ لَقُرْاٰنٌ كَرِيْمٌ)
‘নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন’ এ আয়াতটি পূর্বের আয়াতের শপথের জবাব। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তারকার উদয় ও অস্তাচলের শপথ করে বলছেন যে, নিশ্চয়ই এ কুরআন একটি সম্মানিত কুরআন, এটা সাধারণ কোন বিদ্যা নয়। এতে যা কিছু রয়েছে তাতে কোন সংশয় নেই, তা আল্লাহর কালাম- নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য চিরস্থায়ী মু‘জিযাহ।
مَّكْنُوْنٍ অর্থ مستور عن عين الخلق
বা মানুষের দৃষ্টির আড়াল। ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন : এর উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়, কেউ বলেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল লাওহে মাহফূজ। অর্থাৎ এ কুরআন লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ, সংরক্ষিত। সঠিক কথা হল : ফেরেশতাদের হাতে যে কিতাব রয়েছে এখানে সে কিতাব উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(فِیْ صُحُفٍ مُّکَرَّمَةٍﭜﺫ مَّرْفُوْعَةٍ مُّطَھَّرَةٍۭﭝبِاَیْدِیْ سَفَرَةٍﭞکِرَامٍۭ بَرَرَةٍ)
“তা সম্মানিত কিতাবে (লাওহ মাহফূজে) লিপিবদ্ধ যা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পবিত্র। এমন লেখকদের হাতে থাকে। যারা সম্মানিত ও সৎ।” (সূরা আবাসা ৮০ : ১৩-১৬)
(لَّا یَمَسُّھ۫ٓ اِلَّا الْمُطَھَّرُوْنَ)
পূতপবিত্রগণ ছাড়া অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না। আয়াতের তাফসীরে বিভিন্ন মুফাসসিরদের মতামত তুলে ধরা হল :
১. তাফসীর মুয়াসসারে বলা হয়েছে : মাত্র ঐসকল ফেরেশতারাই কুরআন স্পর্শ করে যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রকার আপদ-বিপদ (أفات) ও গুনাহ থেকে পবিত্র করে রেখেছেন। অনুরূপভাবে এ কুরআনকে যারা শিরক ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত তারাই স্পর্শ করবে। (তাফসীর মুয়াসসার)
২. আয়সারুত তাফাসীরে বলা হয়েছে : কুরআন চাই লাওহে মাহফূজে হোক আর কপি আকারে আমাদের হাতে থাকুক তা ছোট-বড় সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত ব্যক্তিরাই স্পর্শ করবে। (আয়সারুত তাফাসীর)
৩. আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন : কুরআন সম্মানিত ফেরেশতা ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা বিপদ, গুনাহ ও ত্র“টি থেকে মুক্ত রেখেছেন। সুতরাং যখন পবিত্র ফেরেশতা ছাড়া তা স্পর্শ করতে পারবে না তখন শয়তান ও অপবিত্র কেউ স্পর্শ করার কোন প্রশ্নই আসে না। এ আয়াত (সতর্ককারীস্বরূপ) প্রমাণ করছে যে, কুরআন পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া স্পর্শ করতে পারবে না। (তাফসীর সা‘দী)
ইবনু আব্বাস (রাঃ)-সহ প্রমুখ সাহাবী ও তাবেয়ী বলেন : আয়াতে কিতাব দ্বারা আকাশে যে কিতাব আছে তা উদ্দেশ্য, আর পবিত্রগণ দ্বারা ফেরেশতা উদ্দেশ্য।
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার কাছে যে কিতাব আছে তা পবিত্রগণ ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারে না। আর দুনিয়ায় যে কুরআন আছে তা অপবিত্র অগ্নিপূজক, মুনাফিক সবাই স্পর্শ করে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রোম ও পারস্যসহ বিভিন্ন অমুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের কাছে কুরআনের আয়াত সম্বলিত চিঠি প্রেরণ করেছেন। তারা তা স্পর্শ করেছে। বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল আলিয়া (রহঃ) উক্ত মতকে সমর্থন করে বলেন : এ আয়াত দ্বারা তোমরা পাপাচারীরা উদ্দেশ্য না। ইবনু জায়েদ (রহঃ) বলেন : কুরাইশদের কাফিররা ধারণা করত এ কুরআন শয়তান নিয়ে এসেছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলে দিলেন, এ কুরআন পবিত্রগণ ছাড়া কেউ স্পর্শ করে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَا تَنَزَّلَتْ بِھِ الشَّیٰطِیْنُﰡوَمَا یَنْۭبَغِیْ لَھُمْ وَمَا یَسْتَطِیْعُوْنَﰢ اِنَّھُمْ عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُوْلُوْنَ)
“শয়তানরা (এ কুরআন) তাসহ অবতীর্ণ হয়নি। তারা এ কাজের যোগ্য নয় এবং তারা এটার সামর্থ্যও রাখে না। তাদেরকে (ওয়াহী) শ্রবণের সুযোগ হতে দূরে রাখা হয়েছে।” ( সূরা শুয়ারা ২৬ : ২১০-২১২)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ কথাটা উত্তম, তবে এ কথা পূর্বের কথাগুলোর বিপরীত নয়।
অন্যান্যরা বলেন : যারা ছোট ও বড় সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত তারাই এ কুরআন স্পর্শ করবে। এমতাবস্থায় لَّا یَمَسُّھ۫ٓ সংবাদসূচক বাক্যটির অর্থ হবে নিষেধসূচক, অর্থাৎ পবিত্রতা ছাড়া কুরআনের কপি স্পর্শ কর না। যেমন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : পবিত্রতা ছাড়া কুরআন স্পর্শ করবে না। (আবূ দাঊদ (মারাসিল) হা. ৯৪, সহীহুল জামে হা. ৭৭৮০)
উক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল উক্ত আয়াতটি যদিও লাওহে মাহফূজে অবস্থিত কুরআন ও ফেরেশতাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে কিন্তু মানুষেরাও এ সম্বোধনের অন্তর্ভুক্ত। তাই মুসলিমদের পবিত্র অবস্থা ছাড়া কুরআনকে স্পর্শ করা উচিত নয়। আল্লাহ তা‘আলা ভাল জানেন।
(أَفَبِهٰذَا الْحَدِيْثِ)
এখানে حديث দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য।
مُّدْهِنُوْنَ – এর এখানে অর্থ হল : মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা। অর্থাৎ তোমরা এ সম্মানিত কুরআন যা পবিত্র ফেরেশতা ছাড়া কোন শয়তান স্পর্শ করতে পারে না তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছ?
(وَتَجْعَلُوْنَ رِزْقَكُمْ…)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীর করে বলেন : তোমরা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে মিথ্যে প্রতিপন্ন কর ও কুফরী কর। (ইবনু কাসীর) যেমন বৃষ্টি পাওয়া একটি নেয়ামত। তোমরা আল্লাহ তা‘আলার এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে বলে থাক, অমুক তারকার কারণে বৃষ্টি পেয়েছি বা অমুক কারণে বৃষ্টি পেয়েছি। মূলত তোমাদের উচিত ছিল আল্লাহ তা‘আলার এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। তোমরা তা না করে অমুক অমুক কথা বলছ।
জায়েদ বিন খালেদ (রাঃ) বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতের বৃষ্টি শেষে হুদায়বিয়াতে আমাদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করেন। সালাত শেষে সাহাবীদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন : তোমরা কি জান, তোমাদের প্রতিপালক কী বলেন? তারা বলল : আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আমার একশ্রেণির বান্দা সকাল করে মু’মিন অবস্থায়, আরেক শ্রেণি সকাল করে কাফির অবস্থায়। যারা বলে : আল্লাহ তা‘আলার রহমতে বৃষ্টি অবতীর্ণ হয়েছে তারা আমার প্রতি ঈমানদার তারকার প্রতি কাফির। আর যারা বলে : অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টি হয়েছে তারা আমার প্রতি কাফির তারকার প্রতি বিশ্বাসী।
সুতরাং একজন মু’মিন যে কোন প্রকার রিযিক পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করবে, রিযিক পেয়ে বলবে না যে, অমুক কারণে এ রিযিক পেয়েছি।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআনের সম্মান ও মর্যাদা জানলাম।
২. কুরআন পবিত্র অবস্থায় ধরা ও পাঠ করা আবশ্যক।
৩. কোন তারকা উদয়ের কারণে বৃষ্টি হয় না বরং বৃষ্টি আল্লাহ তা‘আলার একটি নেয়ামত যখন ইচ্ছা তা দিয়ে থাকেন। তাই সকল নেয়ামতের জন্য একমাত্র তাঁরই শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
৮৩-৮৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
(بَلَغَتِ الْحُلْقُوْمَ)
অর্থাৎ যখন ফেরেশতাগণ রূহ বের করে নিয়ে যাবে তখন তোমরা দেখতে পাবে কিন্তু কিছু করতে পারবে না।
(وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান ও দর্শন দ্বারা মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট অবস্থানকারী ফেরেশতাদের চেয়েও অধিক নিকটে। কিন্তু তোমরা দেখতে পাওনা।
(مَدِيْنِيْنَ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এর অর্থ হলো محاسبين হিসাব নিকাশকারী, অডিটর। ইকরিমা, হাসান বাসরীসহ অনেক প্রসিদ্ধ মুফাসসির বলেন : এর অর্থ হলো عير صٰدِقِيْنَ অর্থাৎ যদি পুনরুত্থান ও প্রতিদানের প্রতি বিশ্বাসী না হও তাহলে এসব আত্মাগুলো ফিনিয়ে নিয়ে আস।
৮৮-৯৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এখানে আল্লাহ তা‘আলা প্রাগুক্ত তিন শ্রেণির মানুষের মৃত্যু ও পুনরুত্থানকালীন মর্যদাগত পার্থক্যের বর্ণনা করছেন। আলোচ্য আয়াতে তার প্রথম শ্রেণির কথা বলা হচ্ছে, যাদেরকে নৈকট্যপ্রাপ্ত বলা হয়। অর্থাৎ মুমূর্ষু ব্যক্তি যদি السَّابِقُوْنَ বা নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে তার জন্য রয়েছে উত্তম রিযিক, সুঘ্রাণ ও সুখময় জান্নাত যার সুসংবাদ ফেরেশতাগ.ণ মৃত্যুকালীন সময়ে প্রদান করেন। যেমন হাদীসে এসেছে : নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তির আত্মা কবয করার সময় রহমতের ফেরেশতা বলবে : হে পবিত্রআত্মা যা পবিত্র দেহে ছিলে, তুমি তাকে উত্তমভাবে পরিচালনা করেছো, আরাম ও বিশ্রামের দিকে বেরিয়ে আস, তোমার প্রতিপালক কখনো তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন না। (ইবনু মাযাহ হা. ৪২৬২, সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : رَوْحٌ অর্থ : বিশ্রাম رَيْحَانٌ অর্থ আরাম। এছাড়া এ ব্যাপারে অনেক উক্তি বর্ণিত আছে। (ইবনু কাসীর) আয়িশাহ (রাঃ) বলেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) فَرُوحٌ (রা অক্ষরে পেশ দিয়ে) পড়তেন। (তিরমিযী হা. ২৯৩৮, আবূ দাঊদ হা. ৩৯৯১, সহীহ) অর্থ হল : জান্নাতে তার অবস্থান ও সাচ্ছন্দ্য জীবন, এটাই হল রহমত যা হাসান বাসরী (রহঃ) তাফসীর করেছেন (কুরতুবী)।
দ্বিতীয় শ্রেণী হলো : যারা ডান হাতে আমলনামা পাবে। এরা হল সাধারণ মু’মিন। ফেরেশতাগণ এসব মু’মিনদের মৃত্যুকালীন সময়ে সুসংবাদ দিয়ে বলবে : তোমার প্রতি সালাম, অর্থাৎ তোমার কোন অসুবিধা নেই, তুমি শান্তিতে থাকবে, তুমি ডানপন্থীদের মধ্যে শামিল। কাতাদাহ ও ইকরিমা (রহঃ) বলেন : ফেরেশতারা সালাম দেবে। (ইবনে কাসীর)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( اِنَّ الَّذِیْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللہُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَیْھِمُ الْمَلٰ۬ئِکَةُ اَلَّا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَاَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِیْ کُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَﭭ نَحْنُ اَوْلِیٰ۬ؤُکُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَفِی الْاٰخِرَةِﺆ وَلَکُمْ فِیْھَا مَا تَشْتَھِیْٓ اَنْفُسُکُمْ وَلَکُمْ فِیْھَا مَا تَدَّعُوْنَﭮﺚنُزُلًا مِّنْ غَفُوْرٍ رَّحِیْمٍﭯ)
“নিশ্চয়ই যারা বলে : আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা এবং বলে : তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছিল তার সুসংবাদ পেয়ে আনন্দিত হও। আমরাই তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে; সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা চাইবে। এটা হল ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ হতে আপ্যায়ন।” (সূরা ফুসসিলাত ৪১ : ৩০-৩২)
তৃতীয় শ্রেণী হলো : কাফির বেইমান। মৃত্যুকালীন সময়ে আযাবের ফেরেশতারা জাহান্নামের অসহনীয় শাস্তির ভয় দেখাবে এসব সত্য বিবরণ তুলে ধরার পর আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলছেন : সুতরাং তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।
(إِنَّ هٰذَا لَهُوَ حَقُّ الْيَقِيْنِ)
‘নিশ্চয়ই এটা চূড়ান্ত সত্য’ অর্থাৎ বান্দাদের আমলানুযায়ী ভাল মন্দ যে প্রতিদানের কথা আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করলেন তা সত্য, তাতে কোন সংশয় নেই। এটা অবশ্যই সংঘটিত হবে। প্রত্যেকে তা প্রত্যক্ষ করবে এবং আমলের প্রতিদান ভোগ করবে।
(فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيْمِ)
‘অতএব, তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর’ উকবা বিন আমের আল জুহানী (রাঃ) বলেন : যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়, তখন তিনি বলেন : এটা তোমরা তোমাদের সালাতের রুকূতে রাখ। আর যখন
(سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَي)
অবতীর্ণ হলো তখন বললেন : এটা তোমরা তোমাদের সালাতের সিজদাতে রাখ। (আবূ দাঊদ হা. ৮৬৯, ইবনু মাযাহ হা. ৮৮৭ কিন্তু হাদীসটি দুর্বল)
জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যে ব্যক্তি
سبحان الله العظيم وبحمده
এ দু’আটি পড়বে তার জন্য জান্নাতে খেজুর গাছ রোপণ করা হবে। (তিরমিযী হা. ৩৪৬৪, ৩৪৬৫, ইবনু হিব্বান হা. ২৩৩৫, সিলসিলা সহীহাহ হা. ৬৪)
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : দুটি বাক্য যা উচ্চারণ করতে খুবই সহজ নেকীর পাল্লায় ওজনে ভারী এবং দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার কাছে অতি প্রিয়। বাক্য দুটি হলো :
سبحان الله وبحمده وسبحان الله العظيم
মহা পবিত্র আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর জন্য সমস্ত প্রশংসা; মহা পবিত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি মহামহিয়ান। (সহীহ মুসলিম, সহীহ বুখারী হা. ৭৫৬৩)
অতএব প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তির নৈকট্যশীল ও ডানপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য যথাযথ সৎ আমল করা উচিত এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে বেশি বেশি দু’আ করা উচিত যেন তিনি আমাদেরকে তাদের কাতারে শামিল করেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. তিন শ্রেণির মানুষের মাঝে যারা নৈকট্যশীল ও ডানপন্থী হবে তাদের সুখের অন্ত থাকবে না।
২. নৈকট্যপ্রাপ্ত ও ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্তদের মৃত্যুকালীন সুসংবাদের কথা জানলাম।
৩. কাফিরদের জন্য যে জাহান্নামের শাস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে তার বিবরণ জানা গেল।
৪. যারা ঈমান আনার পর তার ওপর অটল থাকে তাদের ফযীলত জানলাম।
৫. দুটি বাক্যের (দু‘আর) ফযীলত জানলাম।
৫৭-৯৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৫৭-৬২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত অস্বীকারকারীদেরকে নিরুত্তর করে দেয়ার জন্যে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার এবং লোকদের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার দলীল পেশ করতে গিয়ে বলেনঃ প্রথমবার যখন আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি যখন তোমরা কিছুই ছিলে না, তখন তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করা আমার পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। কারণ তোমাদের তখন তো কিছু না কিছু থাকবে?” যখন তোমরা তোমাদের প্রথম সৃষ্টিকে বিশ্বাস ও স্বীকার করছে তখন দ্বিতীয়বার সৃষ্ট হওয়াকে কেন অস্বীকার করছো? দেখো, মানুষের বিশেষ পানির বিন্দু তো স্ত্রীর গর্ভাশয়ে পৌঁছে থাকে। এটুকু কাজ তো তোমাদের। কিন্তু ঐ বিন্দুকে মানবাকৃতিতে রূপান্তরিত করা কার কাজ? এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, এতে তোমাদের কোনই দখল নেই, কোন হাত নেই, কোন ক্ষমতা নেই এবং কোন চেষ্টা-তদবীর নেই। এ কাজ তো শুধুমাত্র সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা রাম্বুল ইযযত আল্লাহর। ঠিক তদ্রুপ মৃত্যু ঘটাতেও তিনিই সক্ষম। আকাশ ও পৃথিবীবাসী সকলেরই মৃত্যুর ব্যবস্থাপক একমাত্র আল্লাহ। তাহলে যিনি এতো বড় ক্ষমতার অধিকারী তিনি এ ক্ষমতা রাখেন না যে, কিয়ামতের দিন তোমাদের মৃত্যুকে সৃষ্টিতে পরিবর্তিত করে যে বিশেষণে ও যে অবস্থায় ইচ্ছা তোমাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করবেন? প্রথম সৃষ্টি তিনিই করেছেন, আর এটা বিবেক সম্মত ব্যাপার যে, প্রথমবারের সৃষ্টি দ্বিতীয়বারের সৃষ্টি হতে কঠিনতর। সুতরাং কি করে তোমরা দ্বিতীয়বারের সৃষ্টিকে অস্বীকার করতে পার? এটাকেই অন্য জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “তিনিই আল্লাহ যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই দ্বিতীয় বার ওকে ফিরাবেন (পুনর্বার সৃষ্টি করবেন) এবং এটা তাঁর কাছে খুবই সহজ।” (৩০:২৭) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ
(আরবী) অর্থাৎ “মানুষ কি স্মরণ করে না যে, আমি তাকে প্রথমে সৃষ্টি করেছি যখন সে কিছুই ছিল না?” (১৯:৬৭) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু হতে? অথচ পরে সে হয়ে পড়ে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী। আর সে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়; বলে অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে কে যখন ওটা পচে গলে যাবে? বলঃ ওর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই যিনি এটা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।” (৩৬:৭৭-৭৯) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “মানুষ কি মনে করে যে, তাকে নিরর্থক ছেড়ে দেয়া হবে? সে কি স্থলিত শুক্রবিন্দু ছিল না?” অতঃপর সে রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়। তারপর আল্লাহ তাকে আকৃতি দান করেন ও সুঠাম করেন। অতঃপর তিনি তা হতে সৃষ্টি করেন যুগল নর ও নারী। তবুও কি সেই স্রষ্টা মৃতকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম নন?” (৭৫:৩৬-৪০)
৬৩-৭৪ নং আয়াতের তাফসীর:
মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা জমি চাষাবাদ করে থাকো, জমি চাষ করে বীজ বপন কর। আচ্ছা, এখন বলতো, তোমরা যে বীজ বপন করে থাকো তা অংকুরিত করার ক্ষমতা কি তোমাদের, না আমার? না, না, বরং ওকে অংকুরিত করা, তাতে ফুল-ফল দেয়ার কাজ একমাত্র আমার।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা (আরবী) বলো না, বরং (আরবী) বলো।” অর্থাৎ তোমরা বললঃ “আমি বীজ বপন করেছি,’ ‘আমি অংকুরিত করেছি’ একথা বলো না। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমি এ হাদীসটি শুনবার পর বলি, তোমরা কি আল্লাহ তাআলার নিম্নের উক্তি শুননিঃ “তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে চিন্তা করেছো কি? তোমরা কি বীজ অংকুরিত কর, না আমি অংকুরিত করি?” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ইমাম হাজর মাদরী (রঃ) এই আয়াত বা অনুরূপ আয়াত পাঠের সময় বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আমার প্রতিপালক! বরং আপনি (অংকুরিত করেন)।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমি ইচ্ছা করলে ওকে খড়-কুটায় পরিণত করতে পারি, তখন হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে তোমরা। অর্থাৎ অংকুরিত করার পরেও আমার মেহেরবানী রয়েছে যে, আমি ওকে বড় করি ও পাকিয়ে তুলি। কিন্তু আমার এ ক্ষমতা আছে যে, আমি ইচ্ছা করলে ওকে শুকিয়ে দিয়ে খড়-কুটায় পরিণত করতে পারি। এভাবে ওকে বিনষ্ট ও নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি। তখন তোমরা বলতে শুরু করবেঃ আমাদের তো সর্বনাশ হয়েছে। আমাদের তো আসলটাও চলে গেল। লাভ তো দূরের কথা, আমাদের মূলধনও মারা গেল। তখন তোমরা বিভিন্ন কথা মুখ দিয়ে বের করে থাকো। কখনো কখনো বলে থাকোঃ হায়! যদি আমরা এবার বীজই বপন না করতাম তবে কতই না ভাল হতো! যদি এরূপ করতাম বা ঐরূপ করতাম! ভাবার্থ এও হতে পারেঃ ঐ সময় তোমরা নিজেদের পাপের উপর লজ্জিত হয়ে থাকো।
(আরবী) শব্দটির দু’টি অর্থই হতে পারে। একটি হলো লাভ বা উপকার এবং অপরটি দুঃখ বা চিন্তা (আরবী) বলা হয় মেঘকে।
মহান আল্লাহ পানির ন্যায় বড় নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে বলেনঃ দেখো, এটা বর্ষণ করাও আমার ক্ষমতাভুক্ত। কেউ কি মেঘ হতে পানি বর্ষাবার ক্ষমতা রাখে? যখন এ পানি বর্ষিত হয় তখন ওকে মিষ্ট ও তিক্ত করার ক্ষমতা আমার আছে। এই সুমিষ্ট পানি বসে বসেই তোমরা পেয়ে থাকো। এই পানিতে তোমরা গোসল কর, থালা-বাসন ধৌত কর, কাপড় চোপড় পরিষ্কার কর, জমিতে, বাগানে সেচন করে থাকো এবং জীব-জন্তুকে পান করিয়ে থাকে। তবে তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না ওটাই কি তোমাদের জন্যে উচিত? রাসূলুল্লাহ (সঃ) পানি পান করার পর বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ আল্লাহর জন্যে সমস্ত প্রশংসা যিনি স্বীয় রহমতের গুণে আমাদেরকে সুমিষ্ট ও উত্তম পানি পান করিয়েছেন এবং আমাদের পাপের কারণে এই পানিকে লবণাক্ত এবং তিত করেননি।”
আরবে মুরখ ও ইফার নামক দুটি গাছ জন্মে যেগুলোর সবুজ শাখাগুলো পরস্পর ঘর্ষিত হলে আগুন বের হয়ে থাকে। এই নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেনঃ এই যে আগুন, যদ্বারা তোমরা রান্না-বান্না করে থাকো এবং আরো বহুবিধ উপকার লাভ করে থাকো, বলতো, এর মূল অর্থাৎ এই গাছ সৃষ্টিকারী তোমরা, না আমি? এই আগুনকে আমি উপদেশ স্বরূপ বানিয়েছি। অর্থাৎ এই আগুন দেখে তোমরা জাহান্নামের আগুনকে স্মরণ করবে এবং তা হতে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
হযরত কাতাদা (রঃ) বর্ণিত একটি মুরসাল হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের দুনিয়ার এই আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ।” সাহাবীগণ (রাঃ) একথা শুনে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটাই তো (জ্বালিয়ে দেয়ার জন্যে) যথেষ্ট।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যাঁ, এ আগুনকেও দু’বার পানি দ্বারা ধৌত করা হয়েছে। এখন এটা এই যোগ্যতা রেখেছে যে, তোমরা এর দ্বারা উপকার লাভ করতে পার এবং ওর নিকটে যেতে পার।” (এ হাদীসটি মুরসাল রূপে বর্ণিত হয়েছে এবং এটা সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ হাদীস)
(আরবী) দ্বারা মুসাফিরকে বুঝানো হয়েছে। কারো কারো মতে জঙ্গলে বসবাসকারীদের (আরবী) বলে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, প্রত্যেক ক্ষুধার্তকেই (আরবী) বলা হয়। মোটকথা, এর দ্বারা প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি উদ্দেশ্য যারই আগুনের প্রয়োজন হয়ে থাকে এবং আগুন দ্বারা উপকার লাভের মুখাপেক্ষী। প্রত্যেক আমীর, ফকীর, শহুরে, গ্রাম্য, মুসাফির এবং মুকীম সবারই আগুনের প্রয়োজন হয়ে থাকে। রান্না-বান্নার কাজে, তাপ গ্রহণ করার কাজে, আগুন জ্বালাবার কাজে ইত্যাদিতে আগুনের একান্ত দরকার। এটা আল্লাহ তা’আলার বড়ই মেহেরবানী যে, তিনি গাছের মধ্যে এবং লোহার মধ্যে আগুনের ব্যবস্থা রেখেছেন, যাতে মুসাফির ব্যক্তি ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে এবং প্রয়োজনের সময় কাজে লাগাতে পারে।
সুনানে আবু দাউদ প্রভৃতিতে হাদীস রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তিনটি জিনিসের মধ্যে মুসলমানদের সমান অংশ রয়েছে। তাহলে আগুন, ঘাস ও পানি।” সুনানে ইবনে মাজাহ্নতে রয়েছে যে, এ তিনটি জিনিস হতে বাধা দেয়ার কারো অধিকার নেই। একটি রিওয়াইতে মূল্যেরও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এর সনদ দুর্বল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যিনি এই বিরাট ক্ষমতার অধিকারী তাঁর সদা-সর্বদা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করা তোমাদের একান্ত কর্তব্য। যে আল্লাহ আগুন জ্বালাবার মত জিনিস তোমাদের উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন, যিনি পানিকে লবণাক্ত ও তিক্ত করেননি, যাতে তোমরা পিপাসায় কষ্ট না পাও, এই পানি তিনি করেছেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও প্রচুর পরিমাণ। তোমরা দুনিয়ায় এসব নিয়ামত ভোগ করতে থাকো এবং মহান প্রতিপালকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশে মোটেই কার্পণ্য করো না। তাহলে আখিরাতেও তোমরা চিরস্থায়ী সুখ লাভ করবে। দুনিয়ায় আল্লাহ তা’আলা এই আগুন তোমাদের উপকারের জন্যে বানিয়েছেন এবং সাথে সাথে এজন্যেও যে, যাতে তোমরা এর দ্বারা আখিরাতের আগুন সম্পর্কে অনুভূতি লাভ করতে পার এবং তা হতে বাঁচার জন্যে আল্লাহ তাআলার বাধ্য ও অনুগত হয়ে যাও।
৭৫-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত যহ্হাক (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলার এই কসমগুলো কালাম শুরু করার জন্যে হয়ে থাকে। কিন্তু এই উক্তিটি দুর্বল। জমহুর বলেন যে, এটা আল্লাহ তা’আলার কসম, তিনি তার মাখলুকের মধ্যে যার ইচ্ছা কসম খেতে পারেন এবং এর দ্বারা ঐ জিনিসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। কোন কোন মুফাসসিরের উক্তি এই যে, এখানে (আরবী) অতিরিক্ত এবং…. (আরবী) হলো কসমের জবাব। এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। অন্যেরা বলেন যে, এখানে (আরবী)-কে অতিরিক্ত বলার কোন প্রয়োজনই নেই। কালামে আরবের প্রথা হিসেবে এটা কসমের শুরুতে এসে থাকে। যখন কোন জিনিসের উপর কসম খাওয়া হয় এবং ওটাকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য হয় তখন কসমের শুরুতে এই এসে থাকে। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিম্নের উক্তিতে রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাত কখনো কোন স্ত্রীলোকের হাতকে স্পর্শ করেনি।” অর্থাৎ বায়আত গ্রহণের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) কখনো কোন নিঃসম্পর্ক স্ত্রীলোকের সাথে মুসাফাহা বা করমর্দন করেননি। অনুরূপভাবে এখানেও। কসমের শুরুতে নিয়ম অনুযায়ী এসেছে, অতিরিক্ত হিসেবে নয়। তাহলে কালামের ভাবার্থ হবেঃ কুরআন কারীম সম্পর্কে তোমাদের যে ধারণা আছে যে, এটা যাদু, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং এ পবিত্র কিতাবটি আল্লাহর কালাম। কোন কোন আরব বলেন যে, (আরবী) দ্বারা তাদের কালামকে অস্বীকার করা হয়েছে। অতঃপর আসল বিষয়ের স্বীকৃতি শব্দে রয়েছে।
(আরবী) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুরআন কারীম ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হওয়া। লাওহে মাহফুয হতে তো কদরের রাত্রিতে কুরআন কারীম একই সাথে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়। তারপর প্রয়োজন মত অল্প অল্প করে সময়ে সময়ে অবতীর্ণ হতে থাকে।
এই ভাবে কয়েক বছরে পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আসমানের সূর্যোদয়ের জায়গাকে বুঝানো হয়েছে। (আরবী) দ্বারা (আরবী) উদ্দেশ্য। হাসান (রঃ) বলেন যে, কিয়ামতের দিন ঐগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। যহাক (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ঐ তারকাগুলোকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো সম্পর্কে মুশরিকদের আকীদা বা বিশ্বাস ছিল যে, অমুক অমুক তারকার কারণে তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে।
এরপর ঘোষিত হচ্ছেঃ অবশ্যই এটা এক মহাশপথ! কেননা, যে বিষয়ের উপর শপথ করা হচ্ছে তা খুবই বড় বিষয়। অর্থাৎ এই কুরআন বড়ই সম্মানিত কিতাব। এটা বড়ই মর্যাদা সম্পন্ন, সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় কিতাবে রয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ যারা পূতঃপবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না। অর্থাৎ শুধু ফেরেশতারাই এটা স্পর্শ করে থাকেন। হ্যাঁ, তবে দুনিয়ায় এটাকে সবাই স্পর্শ করে সেটা অন্য কথা।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবী) রয়েছে। হযরত আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে, এখানে পবিত্র দ্বারা উদ্দেশ্য মানুষ নয়, মানুষ তো পাপী। এটা কাফিরদের জবাবে বলা হয়েছে। তারা বলতো যে, এই কুরআন নিয়ে শয়তান অবতীর্ণ হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় পরিষ্কারভাবে বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “এটা নিয়ে শয়তানরা অবতীর্ণ হয় না, না তাদের এই যোগ্যতা বা শক্তি আছে, এমনকি তাদেরকে তো এটা শ্রবণ হতেও দূর করে দেয়া হয়।” (২৬:২১০-২১২) এ আয়াতের তাফসীরে এ উক্তিটিই মনে বেশী ধরছে। তবে অন্যান্য উক্তিগুলোও এর অনুরূপ হতে পারে। ফারা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, এর স্বাদ ও মজা শুধুমাত্র ঈমানদার লোকেরাই পেতে পারে। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অপবিত্রতা হতে পবিত্র হওয়া। যদিও এটা খবর, কিন্তু উদ্দেশ্য হলো ইনশা। কুরআন দ্বারা এখানে মাসহাফ উদ্দেশ্য। ভাবার্থ হলো এই যে, মুসলমান অপবিত্র অবস্থায় কুরআন কারীমে হাত লাগাবে না। একটি হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরআন কারীমকে সাথে নিয়ে হারবী কাফিরদের দেশে যেতে নিষেধ করেছেন। কেননা, হতে পারে যে, শত্রুরা এর কোন ক্ষতি সাধন করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আমর ইবনে হাযাম (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে পত্রটি লিখে দিয়েছিলেন তাতে এও ছিলঃ “পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া যেন কেউ কুরআন স্পর্শ না করে।” (এ হাদীসটি ইমাম মালিক (রঃ) স্বীয় মুআত্তা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
মারাসীলে আবি দাউদে রয়েছে যে, যুহরী (রঃ) বলেনঃ “আমি স্বয়ং পত্রটি দেখেছি এবং তাতে এই বাক্যটি পাঠ করেছি।” যদিও এ রিওয়াইয়াতটির বহু সনদ রয়েছে কিন্তু প্রত্যেকটির বিষয়েই চিন্তা-ভাবনার অবকাশ আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ এই কুরআন কবিতা, যাদু অথবা অন্য কোন বিষয়ের গ্রন্থ নয়, বরং এটা সরাসরি সত্য। কারণ এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ। এটাই সঠিক ও সত্য কিতাব। এটা ছাড়া এর বিরোধী সবই মিথ্যা এবং সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যাত। তবুও কি তোমরা এই বাণীকে তুচ্ছ গণ্য করবে? এর জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কি এটাই হবে যে, তোমরা একে অবিশ্বাস করবে?
ইযদ গোত্রের ভাষায় (আরবী)-এর অর্থ (আরবী) বা কৃতজ্ঞতা এসে থাকে। মুসনাদের একটি হাদীসেও (আরবী) -এর অর্থ (আরবী) করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা বলে থাকো যে, অমুক তারকার কারণে তোমরা পানি পেয়েছো বা অমুক তারকার কারণে অমুক জিনিস পেয়েছো।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, বৃষ্টির সময় কোন কোন লোক কুফরী কালেমা বলে ফেলে। তারা বলে থাকে যে, বৃষ্টির কারণ হলো অমুক তারকা।
হযরত যায়েদ ইবনে খালিদ জুহনী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা হুদায়বিয়ায় অবস্থান করছিলাম, রাত্রে খুব বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল। ফজরের নামাযের পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) জনগণের দিকে মুখ করে বলেনঃ “আজ রাত্রে তোমাদের প্রতিপালক কি বলেছেন তা তোমরা জান কি?” জনগণ বললেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ “আজ আমার বান্দাদের মধ্যে অনেকে কাফির হয়েছে এবং অনেকে মুমিন হয়েছে। যে বলেছে যে, আল্লাহর ফযল ও করমে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, সে আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তারকাকে অস্বীকারকারী। আর যে বলেছে যে, অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, সে আমার সাথে কুফরী করেছে এবং তারকার উপর ঈমান এনেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম মালিক (রঃ) স্বীয় মুআত্তা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মুসলিমও (রঃ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে এটা বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আকাশ হতে যে বরকত নাযিল হয় তা কারো ঈমানের এবং কারো কুফরীর কারণ হয়ে থাকে (শেষ পর্যন্ত)।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন) হ্যাঁ, তবে এটা লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, একবার হযরত উমার (রাঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ “সুরাইয়া তারকা উদিত হতে কত দিন বাকী আছে?” তারপর তিনি বলেনঃ “জ্যোতির্বিদদের ধারণা এই যে, এই তারকা লুপ্ত হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর আবার দিগন্তে প্রকাশিত হয়ে থাকে। বাস্তবে এটাই হয় যে, এই প্রশ্নোত্তর ও ইসতিসকার (পানির জন্যে প্রার্থনার) সাত দিন অতিক্রান্ত হতেই বৃষ্টি বর্ষিত হয়। তবে এ ঘটনাটি স্বভাব এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এটা নয় যে, ঐ তারকাকেই তিনি বৃষ্টি বর্ষণের কারণ মনে করতেন। কেননা, এ ধরনের আকীদা তো কুফরী! হ্যাঁ, তবে অভিজ্ঞতাবলে কোন কিছু জেনে নেয়া বা কোন কথা বলে দেয়া অন্য জিনিস। এই ব্যাপারে বহু হাদীস (আরবী) অর্থাৎ আল্লাহ মানুষের জন্যে যে রহমত খুলে দেন তা কেউ বন্ধ রাখতে পারে না। (৩৫:২) এই আয়াতের তাফসীরে গত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে বলতে শুনেনঃ ‘অমুক তারকার প্রভাবে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। তখন তিনি বলেনঃ “তুমি মিথ্যা কথা বলেছে। এ বৃষ্টি তো আল্লাহ তাআলাই বর্ষণ করেছেন! এটা আল্লাহর রিযক।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যখনই রাত্রে কোন কওমের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে তখনই সকালে ঐ কওম ওর সাথে কুফরীকারী হয়েছে।” তারপর আল্লাহ তা’আলার নিম্নের উক্তিটি তিনি উদ্ধৃত করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা মিথ্যারোপকেই তোমাদের উপজীব্য করে নিয়েছে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, তাদের মধ্যে কোন উক্তিকারী উক্তি করেঃ “অমুক অমুক তারকার প্রভাবে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। (এ হাদীসটিও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে মারফু’ রূপে বর্ণিত আছেঃ “সাত বছর পর্যন্ত যদি মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে পতিত থাকে, তারপর যদি তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়, তবে তখনো তারা বলে বসবে যে, অমুক তারকা বৃষ্টি বর্ষণ করেছে।”
‘তোমরা মিথ্যারোপকেই তোমাদের উপজীব্য করে নিয়েছে। আল্লাহ পাকের এ উক্তি সম্পর্কে মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ তোমরা এ কথা বলো না যে, অমুক প্রাচুর্যের কারণ হলো অমুক জিনিস, বরং বললঃ সব কিছুই আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসে থাকে। সুতরাং ভাবার্থ এটাও। আবার ভাবার্থ এও হতে পারে যে, কুরআনে তাদের কোনই অংশ নেই, বরং তাদের অংশ এটাই যে, তারা এই কুরআনের উপর মিথ্যারোপ করে থাকে। এই ভাবার্থের পৃষ্ঠপোষকতা করে নিম্নের আয়াতদ্বয়ঃ (আরবী)
৮৩-৮৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যখন রূহ কণ্ঠাগত হয় অর্থাৎ যখন মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হয়, যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে এবং বলা হবেঃ কে তাকে রক্ষা করবে? তখন তার প্রত্যয় হবে যে, এটা বিদায়ক্ষণ। আর পায়ের সাথে পা জড়িয়ে যাবে।
সেই দিন আল্লাহর নিকট সব কিছু প্রত্যানীত হবে।” (৭৫:২৬-৩০) এ জন্যেই এখানে বলেনঃ তখন তোমরা তাকিয়ে থাকো। অর্থাৎ একটি লোক বিদায়ক্ষণে উপস্থিত। সে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছে, রূহ বিদায় হতে চলেছে। তোমরা সবাই তার পার্শ্বে বসে তার দিকে তাকাতে থাকো। কিন্তু তোমাদের কেউ কিছু করতে পারে কি? না, কেউই কিছু করতে সক্ষম নয়। আমার ফেরেশতারা ঐ মৃত্যুমুখী ব্যক্তির তোমাদের চেয়েও বেশী নিকটে রয়েছে যাদেরকে তোমরা দেখতে পাও। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “এবং তিনি তাঁর বান্দাদের উপর জয়যুক্ত, তিনি তোমাদের উপর রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রেরণ করেন। যখন তোমাদের মধ্যে কারো মৃত্যুর সময় এসে পড়ে তখন আমার প্রেরিতরা সঠিকভাবে তার মৃত্যু ঘটিয়ে থাকে। তারপর তারা সবাই তাদের সত্য মাওলার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে যিনি ন্যায় বিচারক এবং সত্ত্বর হিসাব গ্রহণকারী।” (৬:৬১-৬২)
আর এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তোমরা যদি কর্তৃত্বাধীন না হও তবে তোমরা ওটা অর্থাৎ প্রাণ ফিরাও না কেন? যদি তোমরা সত্যবাদী হও। অর্থাৎ যদি এটা সত্য হয় যে, তোমরা পুনরুজ্জীবিত হবে না এবং তোমাদেরকে হাশরের ময়দানে হাযির করা হবে না, যদি তোমরা হাশর-নশরে বিশ্বাসী না হও এবং তোমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না ইত্যাদি, তবে আমি বলি যে, তোমরা তাহলে ঐ রূহকে যেতে দিচ্ছ কেন? আটকিয়ে রাখো! যদি রূহ তোমাদের আয়ত্তাধীন হয়ে থাকে তবে কণ্ঠাগত প্রাণ বা রূহকে ওর আসল জায়গায় পৌঁছিয়ে দাও না? কিন্তু তোমরা তা কখনো পারবে না। সুতরাং জেনে রেখো যে, যেমন এই রূহকে আমি দেহে নিক্ষেপ করতে সক্ষম ছিলাম এবং তা তোমরা স্বচক্ষে দেখেছো, তেমনই বিশ্বাস রেখো যে, দ্বিতীয়বার ঐ রূহকে দেহে নিক্ষেপ করে নতুনভাবে জীবন দানেও আমি সক্ষম হবো। না তোমাদের নিজেদের জীবন সৃষ্টিতে কোন দখল আছে, না মৃত্যুতে কোন কর্তৃত্ব আছে, তাহলে পুনরুত্থানে তোমাদের দখল কোথা হতে আসলো? যেমন তোমরা বলছো যে, তোমরা মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবিত হবে না? তোমাদের ধারণা ও বিশ্বাস সম্পূর্ণ অমূলক।
৮৮-৯৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে ঐ অবস্থার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যা মৃত্যুর সময়, মৃত্যু যন্ত্রণার সময় এবং দুনিয়ার শেষ মুহূর্তে মানুষের হয়ে থাকে। হয়তো সে উচ্চ পর্যায়ের আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত হবে বা তার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের হবে, যার ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে, কিংবা হয়তো সে হতভাগ্য হবে, যে আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকেছে এবং সত্য পথ হতে গাফেল থেকেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যারা আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য প্রাপ্ত বান্দা, যারা তাঁর আহকামের উপর আমলকারী ছিল এবং অবাধ্যাচরণের কাজ পরিত্যাগকারী ছিল তাদেরকে তাদের মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা নানা প্রকারের সুসংবাদ শুনিয়ে থাকেন। যেমন ইতিপূর্বে হযরত বারা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস গত হয়েছে যে, রহমতের ফেরেশতারা তাদেরকে বলেনঃ “হে পবিত্র রূহ এবং হে পবিত্র দেহধারী রূহ! বিশ্রাম ও আরামের দিকে চল, পরম করুণাময় আল্লাহর দিকে চল যিনি কখনো অসন্তুষ্ট হবেন না।
(আরবী)-এর অর্থ হলো বিশ্রাম এবং (আরবী)-এর অর্থ হলো আরাম। মোটকথা, তারা দুনিয়ার বিপদাপদ হতে বিশ্রাম ও শান্তি লাভ করে থাকে। চিরস্থায়ী শান্তি ও প্রকৃত আনন্দ আল্লাহর গোলাম তখনই লাভ করে থাকে। তারা একটা প্রশস্ততা দেখতে পায়। তাদের সামনে রিযক ও রহমত থাকে। তারা জান্নাতে আদনের দিকে ধাবিত হয়। জান্নাতের একটি সবুজ সজীব শাখা প্রকাশিত হয় এবং তখনই আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত বান্দার রূহ কবয করা হয়। এটা হযরত আবুল আলিয়া (রঃ)-এর উক্তি। মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব (রঃ) বলেন যে, মৃত্যুর পূর্বেই মরণমুখী প্রত্যেক ব্যক্তিই সে জান্নাতী কি জাহান্নামী তা জানতে পারে।
মৃত্যু-যন্ত্রণার সময়ের হাদীসগুলো যদিও আমরা সূরায়ে ইবরাহীমের (আরবী) এ আয়াতের তাফসীরে আনয়ন করেছি, কিন্তু এটা এর সর্বোত্তম স্থান বলে এখানেও একটা অংশ বর্ণনা করছি।
হযরত তামীমুদ্দারী (রাঃ) নবী (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত মালাকুল মাউত (আঃ)-কে বলেনঃ “তুমি আমার অমুক বান্দার নিকট যাও এবং তাকে আমার দরবারে নিয়ে এসো। আমি তাকে দুঃখ-সুখ, কষ্ট-আরাম, আনন্দ-নিরানন্দ ইত্যাদি সব কিছুরই মাধ্যমে পরীক্ষা করেছি এবং তাকে আমার চাহিদা মোতাবিক পেয়েছি। এখন আমি তাকে চিরস্থায়ী সুখ প্রদান করতে চাই। তাকে আমার খাস দরবারে পেশ কর।” মালাকুল মাউত পাঁচশ জন রহমতের ফেরেশতা এবং জান্নাতের কাফন ও জান্নাতী খোশবু সাথে নিয়ে তার নিকট আগমন করেন। যদিও রাইহান (খোশবু) একই হয়, কিন্তু এর মাথায় বিশ প্রকারের রঙ থাকে। প্রত্যেকটিরই পৃথক পৃথক সুগন্ধি রয়েছে। আর তাদের সাথে থাকে সাদা রেশম এবং তাতে থাকে মেশক বা মৃগনাভী (শেষ পর্যন্ত)।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে (আরবী) অর্থাৎ (আরবী)-এর (আরবী) অক্ষরকে পেশ দিয়ে পড়তে শুনেছেন। কিন্তু সমস্ত কারী (আরবী) অর্থাৎ (আরবী) কে যবর দিয়ে পড়েছেন।
হযরত উম্মে হানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “মৃত্যুর পর কি আমরা পরস্পর মিলিত হবো এবং আমাদের একে অপরকে দেখবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “রূহ পাখী হয়ে যাবে যা গাছের ফল খাবে, শেষ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে। ঐ সময় রূহ নিজ নিজ দেহের মধ্যে প্রবেশ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমাদেই এ হাদীসের সহায়ক। রূপে আর একটি হাদীস রয়েছে, যার ইসনাদ খুবই উত্তম এবং মতনও খুব সবল) এ হাদীসে প্রত্যেক মুমিনের জন্যে বড়ই সুসংবাদ রয়েছে।
অন্য এক সহীহ রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, শহীদদের রূহগুলো সবুজ রঙ এর পাখীর অন্তরে অবস্থান করে, যে পাখী জান্নাতের সব জায়গায় ইচ্ছামত বিচরণ করে ও পানাহার করে এবং আরশের নীচে লটকানো লণ্ঠনে আশ্রয় নেয়।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, আবদুর রহমান ইবনে আবি লাইলা (রঃ) গাধায় সওয়ার হয়ে একটি জানাযার পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন। ঐ সময় তিনি বার্ধক্যে উপনীত হয়েছিলেন এবং তাঁর চুল দাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছিল। ঐ সময় তিনি বলেন যে, অমুকের পুত্র অমুক তাঁর নিকট বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ পছন্দ করে, আল্লাহ তাআলাও তার সাথে সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ অপছন্দ করে, তিনি তার সাথে সাক্ষাৎ অপছন্দ করেন।” একথা শুনে সাহাবীগণ (রাঃ) মাথা ঝুকিয়ে দিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমরা কাঁদছো কেন?” উত্তরে তারা বলেনঃ “আমরা তো মৃত্যুকে অপছন্দ করি (তাহলে তো আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকে আমাদের পছন্দ করা হলো না)?” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “আরে, তা নয়, তা নয়। বরং এটা হলো মৃত্যুকালীন অবস্থার কথা। ঐ সময় আল্লাহর নৈক্য প্রাপ্ত বান্দাদেরকে সুখ-শান্তিময় ও আরামদায়ক জান্নাতের সুংবাদ দেয়া হয়, যার কারণে তারা লাফিয়ে উঠে এবং চায় যে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা আল্লাহর সাথে মিলিত হবে, যাতে তারা ঐ সব নিয়ামত লাভ করতে পারে। তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলাও তাদের সাক্ষাৎ কামনা করেন। আর যদি সে সত্য অস্বীকারকারী ও বিভ্রান্তদের অন্যতম হয় তবে তাদেরকে অত্যুষ্ণ পানির আপ্যায়ন ও জাহান্নামের দহনের সুসংবাদ দেয়া হয়, যার কারণে তারা মৃত্যুকে অপছন্দ করে এবং রূহ লুকাতে থাকে এবং তাদের মন চায় যে, কোনক্রমেই তারা আল্লাহ তাআলার নিকট হাযির হবে না। সুতরাং আল্লাহ তাআলাও তাদের সাক্ষাৎকে অপছন্দ করেন।”
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যদি সে ডান দিকের লোকদের একজন হয় তবে মৃত্যুর ফেরেশতা তাকে সালাম দেয় এবং বলেঃ তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, তুমি আসহাবুল ইয়ামীনের অন্তর্ভুক্ত। তুমি আল্লাহর আযাব হতে নিরাপত্তা লাভ করবে। তাকে বলা হবেঃ হে দক্ষিণ পার্শ্ববর্তী! তোমার প্রতি সালাম বা শান্তি। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “যারা বলেঃ আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর অবিচলিত থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা এবং বলেঃ তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার জন্যে আনন্দিত হও। আমরাই তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে; সেথায় তোমাদের জন্যে রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং যা তোমরা ফরমায়েশ কর। এটা হলো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ হতে আপ্যায়ন।” (৪১:৩০-৩২)
ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ তোমার জন্যে স্বীকৃত যে, তুমি আসহাবুল ইয়ামীনের অন্তর্ভুক্ত। এটাও হতে পারে যে, সালাম এখানে দু’আর অর্থে এসেছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ কিন্তু সে যদি সত্য অস্বীকারকারী ও বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তার জন্যে আপ্যায়ন রয়েছে অত্যুষ্ণ পানির দ্বারা এবং জাহান্নামের দহন রয়েছে যা নাড়ী-ভূড়ি ঝলসিয়ে দিবে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এটা তো ধ্রুব সত্য। অতএব, তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।
হযরত উকবা ইবনে আমির জুহনী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর (আরবী) অবতীর্ণ হয় তখন তিনি বলেনঃ “এটা তোমরা তোমাদের রুকূতে রাখো।” আর যখন (আরবী) (৮৭:১) অবতীর্ণ হয় তখন বলেনঃ “এটাকে তোমরা তোমাদের সিজদায় রাখো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি (আরবী) বলে তার জন্যে জান্নাতে একটি গাছ রোপণ করা হয়।” ((এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দুটি বাক্য আছে যা উচ্চারণ করতে খুবই সহজ, ওযন দণ্ডের পরিমাণে খুবই ভারী এবং করুণাময় আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়, বাক্য দুটি হলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “মহা পবিত্র আল্লাহ, তার জন্যে সমস্ত প্রশংসা। মহাপবিত্র আল্লাহ, তিনি মহামহিম।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) তাঁর কিতাবের শেষে আনয়ন করেছেন)