أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬৮/হে মুমিনগণ!:-৮৯)
[*হে মুমিনগণ!:-তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু:-
*যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন।
পারা:২৮
১১-১৮ নং আয়াত:-
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন:-১১
مَاۤ اَصَابَ مِنۡ مُّصِیۡبَۃٍ اِلَّا بِاِذۡنِ اللّٰہِ ؕ وَ مَنۡ یُّؤۡمِنۡۢ بِاللّٰہِ یَہۡدِ قَلۡبَہٗ ؕ وَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۱۱﴾
আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই আপতিত হয় না এবং কেউ আল্লাহর উপর ঈমান রাখলে তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন:-১২
وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ ۚ فَاِنۡ تَوَلَّیۡتُمۡ فَاِنَّمَا عَلٰی رَسُوۡلِنَا الۡبَلٰغُ الۡمُبِیۡنُ ﴿۱۲﴾
তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং তাঁর রসূলের আনুগত্য কর। কিন্তু যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে আমার রসূলের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে প্রচার করা।
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন:-১৩
اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ؕ وَ عَلَی اللّٰہِ فَلۡیَتَوَکَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۱۳﴾
আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই ; আর আল্লাহর উপরই মুমিনগণ যেন তাওয়াক্কুল করে।
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন:-১৪
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ مِنۡ اَزۡوَاجِکُمۡ وَ اَوۡلَادِکُمۡ عَدُوًّا لَّکُمۡ فَاحۡذَرُوۡہُمۡ ۚ وَ اِنۡ تَعۡفُوۡا وَ تَصۡفَحُوۡا وَ تَغۡفِرُوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۴﴾
হে মুমিনগণ!:-তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু।
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন:-১৫
اِنَّمَاۤ اَمۡوَالُکُمۡ وَ اَوۡلَادُکُمۡ فِتۡنَۃٌ ؕ وَ اللّٰہُ عِنۡدَہٗۤ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۵﴾
তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো তোমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। আর আল্লাহরই নিকট রয়েছে মহা পুরস্কার।
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন:-১৬
فَاتَّقُوا اللّٰہَ مَا اسۡتَطَعۡتُمۡ وَ اسۡمَعُوۡا وَ اَطِیۡعُوۡا وَ اَنۡفِقُوۡا خَیۡرًا لِّاَنۡفُسِکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِہٖ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۶﴾
তাই যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো। শোন, আনুগত্য করো এবং নিজেদের সম্পদ ব্যয় করো। এটা তোমাদের জন্যই ভালো। যে মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকলো সেই সফলতা লাভ করবে।
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন:-১৭
اِنۡ تُقۡرِضُوا اللّٰہَ قَرۡضًا حَسَنًا یُّضٰعِفۡہُ لَکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ شَکُوۡرٌ حَلِیۡمٌ ﴿ۙ۱۷﴾
যদি তোমরা আল্লাহকে করযে হাসানা দাও তাহলে তিনি তোমাদেরকে তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবেন এবং তোমাদের ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ সঠিক মূল্যায়ণকারী ও অতীব সহনশীল।
সুরা: ৬৪ : হার- জিতের দিন:-১৮
عٰلِمُ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿٪۱۸﴾
সামনে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সবকিছুই তিনি জানেন। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।
১১-১৮ আয়তের ব্যাখ্যা:-
১)তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
সুরা: আত-তাগাবুন
আয়াত নং :-১২
مَاۤ اَصَابَ مِنْ مُّصِیْبَةٍ اِلَّا بِاِذْنِ اللّٰهِ١ؕ وَ مَنْ یُّؤْمِنْۢ بِاللّٰهِ یَهْدِ قَلْبَهٗ١ؕ وَ اللّٰهُ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمٌ
আল্লাহর অনুমোদন ছাড়া কখনো কোন মুসিবত আসে না।যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করে আল্লাহ তার দিলকে হিদায়াত দান করেন।আল্লাহ সব কিছু জানেন।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-
# এখান থেকে ঈমানদারদের উদ্দেশ্য করে কথা বলা হয়েছে। এ পর্যায়ে কথাগুলো পড়ার সময় একথা মনে রাখতে হবে যে, এসব আয়াত যে সময়ে নাযিল হয়েছিল তা ছিল মুসলমানদের কঠোর বিপদ ও দুঃখের সময়। তারা মক্কায় বছরের পর বছর জুলুম-অত্যাচার সহ্য করার পর নিজেদের সবকিছু ছেড়ে মদীনায় চলে এসেছিলেন। যেসব ন্যায় ও সত্যপন্থী লোক তাদেরকে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছিলেন তাদের ওপরও দ্বিগুণ মুসিবত আপতিত হয়েছিল। একদিকে তাদেরকে আরবের বিভিন্ন অংশ থেকে তাদের কাছে চলে আসা শত শত মুহাজিরকে সহায়তা দিতে হচ্ছিল। অপরদিকে ইসলামের শত্রু সমগ্র আরবের লোকজন তাদের ওপর নিপীড়ন চালাতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল।
# এ বিষয়টি সূরা আল হাদীদের ২২-২৩ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেখানে ৩৯ থেকে ৪২ নম্বর টীকায় আমরা এর ব্যাখ্যাও পেশ করেছি। যে পরিস্থিতিতে এবং যে উদ্দেশ্যে সেখানে এ কথাটি বলা হয়েছিল ঠিক অনুরূপ পরিস্থিতিতে একই উদ্দেশ্যে এখানেও তা পুনরায় বলা হয়েছে। এখানে যে সত্যটি মুসলমানদের হৃদয়-মনে বদ্ধমূল করে দেয়া উদ্দেশ্য তা হচ্ছে, বিপদ-আপদ নিজেই আসে না। আর পৃথিবীতে কারো এমন শক্তিও নেই যে, সে যার ওপরে ইচ্ছা কোন বিপদ চাপিয়ে দেবে। কারো ওপর কোন বিপদ আসতে দেয়া না দেয়া সরাসরি আল্লাহর অনুমোদনের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহর অনুমোদন সর্বাবস্থায় কোন না কোন বৃহত্তর কল্যাণ ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে হয় যা মানুষ জানে না বা বুঝে উঠতে পারে না।
# বিপদ-আপদের ঘনঘটার মধ্যেও যে জিনিস মানুষকে সঠিক পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখে এবং কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতে পদস্খলন হতে দেয় না সেই একমাত্র জিনিসটি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান। যার অন্তরে আল্লাহর প্রতি ঈমান নেই সে এসব বিপদ-আপদকে হয় আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল মনে করে অথবা এসব বিপদ-আপদ দেয়ার ও দূর করার ব্যাপারে পার্থিব শক্তিসমূহকে কার্যকর বলে বিশ্বাস করে কিংবা সেসবকে এমন কাল্পনিক শক্তিসমূহের কাজ বলে মনে করে যাদেরকে মানুষের কুসংস্কারজনিত বিশ্বাস ক্ষতি ও কল্যাণ করতে সক্ষম বলে ধরে নিয়েছে অথবা তারা আল্লাহকে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী বলে নিখাদ ও নির্ভেজাল ঈমানের সাথে মানে না। ভিন্ন ভিন্ন এসব ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে মানুষ নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়। একটি বিশেষ সীমা পর্যন্ত সে বিপদ-আপদ বরদাশত করে বটে কিন্তু তারপরেই সে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। তখন সেসব আস্তানায়ই মাথা নত করে, সব রকম আপমান ও লাঞ্ছনা স্বীকার করে নেয়। এ সময় সে যে কোন হীন কাজ ও আচরণ করতে পারে। সব রকম ভ্রান্ত কাজ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। আল্লাহকে গালি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে। অপরদিকে যে ব্যক্তি একথা জানে এবং আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা’আলার হাতেই সবকিছু। তিনিই এই বিশ্ব-জাহানের মালিক ও শাসক। তাঁর অনুমোদনক্রমেই বিপদ-মসিবত আসতে এবং দূরীভূত হতে পারে। এই ব্যক্তির মনকে আল্লাহ তা’আলা ধৈর্য ও আনুগত্য এবং তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার ‘তাওফীক’ দান করেন। তাকে সাহস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সব রকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করার শক্তি দান করেন। অন্ধকার থেকে অন্ধকারতর পরিস্থিতিতেও তার সামনে আল্লাহর দয়া ও করুণা লাভের আশায় আলো প্রজ্জ্বলিত থাকে। অতি বড় কোন বিপদও তাকে এতটা সাহসহারা করতে পারে না যে, সে সত্য ও সঠিক পথ থেকে সরে যাবে বা বাতিলের সামনে মাথা নত করবে কিংবা আল্লাহ ছাড়া আর কারো দরবারে তার দুঃখ-বেদনার দাওয়াই বা প্রতিকার তালাশ করবে। এভাবে প্রতিটি বিপদ মসিবতই তার জন্য অধিক কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে কোন মসিবতই তার মসিবত থাকে না বরং পরিণামের দিক থেকে সরাসরি রহমতে পরিণত হয়। কেননা সে এই মসিবতে নিঃশেষ হয়ে যাক বা সফলভাবে উৎরিয়ে যাক— উভয় অবস্থায়ই সে তার প্রভুর দেয়া পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এ বিষয়টিই বুখারী ও মুসলিমের বর্ণিত একটি হাদীসে রসূলুল্লাহ ﷺ এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
عَجَباً لِلْمُؤْمِنِ, لاَ يَقْضِى اللَّهُ لَهُ قَضَاءً إِلاَّ كَانَ خَيْراً لَهُ, وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ, فَكَانَ خَيْرًا لَهُ, وإِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ, فَكَانَ خَيْرًا لَهُ, وَلَيْسَ ذَلِكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ-
“মু’মিনের ব্যাপারটিই বড় অদ্ভূত। আল্লাহ তার জন্য যে ফায়সালাই করুন না কেন তা সর্বাবস্থায় তার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। বিপদ-আপদে সে ধৈর্য অবলম্বন করে। এটা তার জন্য কল্যাণকর। সুখ-শান্তি ও সচ্ছলতা আসলে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটাও তার জন্য কল্যাণকর। মু’মিন ছাড়া আর কারো ভাগ্যেই এরূপ হয় না।”
# পূর্বাপর প্রসঙ্গের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এ কথাটির দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ এই যে, আল্লাহ তা’আলা জানেন কোন্ ব্যক্তি প্রকৃতই ঈমানদার এবং সে কিরূপ ঈমানের অধিকারী? তাই তিনি তার জ্ঞানের ভিত্তিতে সেই সব হৃদয়-মনের অধিকারীকে হিদায়াত দান করেন যার মধ্যে ঈমান আছে এবং তার মধ্যে যে মর্যাদার ও প্রকৃতির ঈমান আছে সেই পর্যায়ের হিদায়াত তাকে দান করেন। অপর অর্থটি এও হতে পারে যে, আল্লাহ তাঁর সেই মু’মিন বান্দার অবস্থা সম্পর্কে অনবহিত নন। তিনি তাকে ঈমান গ্রহণের আহবান জানিয়ে এবং ঈমান গ্রহণের সাথে দুনিয়ার কঠিন পরীক্ষাসমূহের মধ্যে ফেলে দিয়ে তাদেরকে ঐ অবস্থায়ই পরিত্যাগ করেননি। পৃথিবীতে কোন্ ঈমানদারের ওপর কি মসিবত চলছে আর কোন্ কোন্ পরিস্থিতিতে সে কিভাবে তার ঈমানের দাবীসমূহ পূরণ করছে তা তিনি জানেন। তাই এ বিষয়ে আস্থা রাখো যে, আল্লাহর অনুমোদনক্রমে যে মসিবতই তোমাদের ওপর আসুক না কেন আল্লাহর কাছে তার বৃহত্তর কোন কল্যাণকর উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে এবং তার মধ্যে বৃহত্তর কোন কল্যাণ লুক্কায়িত আছে। কেননা, আল্লাহ তাঁর ঈমানদার বান্দার কল্যাণকামী। তিনি তাদেরকে বিনা কারণে বিপদে ফেলতে চান না।
সুরা: আত-তাগাবুন
আয়াত নং :-১২
وَ اَطِیْعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ١ۚ فَاِنْ تَوَلَّیْتُمْ فَاِنَّمَا عَلٰى رَسُوْلِنَا الْبَلٰغُ الْمُبِیْنُ
আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রসূলের আনুগত্য করো। কিন্তু তোমরা যদি আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে সত্যকে স্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আমার রসুলের আর কোন দায়িত্ব নেই।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-
# এখানে এ কথার অর্থ হলো, অবস্থা ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন সর্বাবস্থায় আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে কিন্তু বিপদের ঘনঘটায় ঘাবড়ে গিয়ে যদি তোমরা আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে কেবল নিজেরই ক্ষতি করবে আমার রসূলের দায়িত্ব শুধু তোমাদেরকে ঠিকমত সত্য ও সঠিক পথটির সন্ধান বলে দেয়া। আর রসূল সে কাজটি ভালভাবেই করেছেন।
সুরা: আত-তাগাবুন
আয়াত নং :-১৩
اَللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ١ؕ وَ عَلَى اللّٰهِ فَلْیَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ
তিনিই আল্লাহ যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। ঈমানদারদের আল্লাহর ওপরেই ভরসা করা উচিত।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-
# খোদায়ীর সর্বময় ক্ষমতা ও ইখতিয়ার একমাত্র আল্লাহ তা’আলার হাতে। এই ক্ষমতা ও ইখতিয়ার অন্য কারো আদৌ নেই। তাই সে তোমাদের জন্য ভাল বা মন্দ ভাগ্য গড়তে পারে না। তিনি আনলেই কেবল সুসময় আসতে পারে এবং তিনি দূর করলেই কেবল দুঃসময় দূর হতে পারে। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহকে মনে-প্রাণে একমাত্র ইলাহ বলে স্বীকার করে সে আল্লাহর ওপর ভরসা করবে এবং একজন ঈমানদার হিসেবে এই বিশ্বাস রেখে দুনিয়াতে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে থাকবে যে, আল্লাহ যে পথ দেখিয়েছেন কেবল সে পথেই কল্যাণ নিহিত। এছাড়া তার জন্য আর কোন পথ নেই। এ পথে সফলতা লাভ হলে তা আল্লাহর সাহায্য, সহযোগিতা ও তাওফিকের মাধ্যমেই হবে; অপর কোন শক্তির সাহায্যে তা হওয়ার নয়। আর এ পথে যদি কঠোর পরিস্থিতি, বিপদাপদ, ভয়ভীতি ও ধ্বংস আসে তাহলে তা থেকেও কেবল তিনিই রক্ষা করতে পারেন, অন্য কেউ নয়।
সুরা: আত-তাগাবুন
আয়াত নং :-১৪
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّ مِنْ اَزْوَاجِكُمْ وَ اَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَّكُمْ فَاحْذَرُوْهُمْ١ۚ وَ اِنْ تَعْفُوْا وَ تَصْفَحُوْا وَ تَغْفِرُوْا فَاِنَّ اللّٰهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ
হে সেই সব লোক যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-
# এ আয়াতের দু’টি অর্থ। একটি অর্থ অনুসারে আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে বহুসংখ্যক ঈমানদার পুরুষকে তাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে, স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামীদের পক্ষ থেকে এবং পিতা-মাতাকে তাদের সন্তানদের পক্ষ থেকে যেসব কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় সেই সব পরিস্থিতির ক্ষেত্রে এ আয়াতটি প্রযোজ্য। ঈমান ও সত্য সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে একে অপরের পুরোপুরি বন্ধু ও সহযোগী হতে পারে একজন স্বামীর এরূপ স্ত্রী, একজন স্ত্রীর এরূপ স্বামী লাভ করা এবং আকীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক ও চরিত্রের দিক দিয়ে সকল সন্তান-সন্তুতিই চোখ জুড়ানোর মত হওয়া, পৃথিবীতে খুব কমই ঘটে থাকে। বরং সাধারণত দেখা যায় যে, স্বামী যদি নেককার ও ঈমানদার হয় তাহলে সে এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি লাভ করে থাকে যারা তার দ্বীনদারী, আমানতদারী এবং সততাকে নিজেদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করে। তারা চায় যে, তাদের স্বামী ও পিতা তাদের জন্য জাহান্নাম খরিদ করুক এবং হালাল ও হারামের বাছবিচার না করে যে কোন পন্থায় আরাম-আয়েশ, আমোদ-ফূর্তি এবং গোনাহ ও পাপের উপকরণ এনে দিক। কোন কোন সময় আবার এর ঠিক উল্টোটাও ঘটে থাকে। একজন নেক্কার ঈমানদার নারীকে এমন স্বামীর পাল্লায় পড়তে হয় যে স্ত্রীর শরীয়াত অনুসারে জীবন যাপন দুই চোখে দেখতে পারে না। আর সন্তানরাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদের গোমরাহী ও দুষ্কর্ম দ্বারা মায়ের জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। বিশেষ করে কুফর ও ঈমানের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সময় যখন একজন মানুষের ঈমান দাবী করে যে, আল্লাহ এবং তাঁর দ্বীনের জন্য সেই ক্ষতি স্বীকার করবে, দেশ ছেড়ে হিজরত করবে কিংবা জিহাদে অংশগ্রহণ করে নিজের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করবে তখন তার পথে তার স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনই সর্বপ্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এ আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার সময় বিপুল সংখ্যক মুসলমানের জন্য যে বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছিল এবং কোন অমুসলিম সমাজে ইসলাম গ্রহণকারী যে কোন ব্যক্তির জন্য আজও দেখা দেয় এ আয়াতটির দ্বিতীয় অর্থটি সেই বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত। সেই সময় মক্কা মুয়াযযমা ও আরবের অন্যান্য অংশে সাধারণভাবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতো যে, একজন লোক ঈমান এনেছে কিন্তু তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা ঈমান আনতে প্রস্তুত নয় শুধু তাই না বরং তারা তাকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সচেষ্ট। যেসব মেয়েরা তাদের পরিবারে একাকী ইসলাম গ্রহণ করতো তাদের জন্যও ঠিক একই পরিস্থিতির উদ্ভব হতো।
যেসব ঈমানদার নারী ও পুরুষ এ দু’টি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন তাদের উদ্দেশ্য করে তিনটি কথা বলা হয়েছেঃ
সর্বপ্রথম তাদের এই বলে সাবধান করা হয়েছে যে, পার্থিব সম্পর্কের দিক দিয়ে যদিও তারা মানুষের অতি প্রিয়জন কিন্তু দ্বীন ও আদর্শের দিক দিয়ে এরা তোমাদের ‘দুশমন’। তারা তোমাদের সৎকাজে বাধা দেয় এবং অসৎকাজের প্রতি আকৃষ্ট করে, কিংবা তোমাদের ঈমানের পথে বাধা সৃষ্টি করে এবং কুফরীর পথে সহযোগিতা করে কিংবা তারা কাফেরদের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করে মুসলমানদের সামরিক গোপণ তথ্য সম্পর্কে তারা তোমাদের নিকট থেকে যাই জানতে পারে তা ইসলামের শত্রুদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। এর যে কোন পন্থায়ই তারা দুশমনী করুক না কেন তাদের দুশমনীর ধরণ ও প্রকৃতিতে অবশ্যই পার্থক্য হয়। কিন্তু সর্বাবস্থায়ই তা দুশমনী। ঈমান যদি তোমাদের কাছে প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে সেই বিচারে তাদেরকে দুশমনই মনে করতে হবে। তাদের ভালবাসায় আবদ্ধ হয়ে এ বিষয়টি কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, তোমাদের ও তাদের মধ্যে ঈমান ও কুফর বা আনুগত্য ও অবাধ্যতার প্রাচীর আড়াল করে আছে।
এরপর বলা হয়েছে যে, তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকো। অর্থাৎ তাদের পার্থিব স্বার্থের জন্য নিজেদের পরিণাম তথা আখেরাতকে বরবাদ করো না। তোমাদের অন্তরে তাদের প্রতি ভালবাসাকে এতটা প্রবল হতে দিও না যে, তারা আল্লাহ ও রসূলের সাথে তোমাদের সম্পর্ক এবং ইসলামের প্রতি তোমাদের বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের প্রতি এতটা বিশ্বাস ও আস্থা রেখো না যাতে তোমাদের অসাবধানতার কারণে মুসলমানদের দলের গোপনীয় বিষয়সমূহ তারা অবগত হয়ে যেতে পারে এবং তা দুশমনদের হাতে পৌঁছে যায়। একটি হাদীসে রসূলুল্লাহ ﷺ মুসলমানদেরকে এ বিষয়টি সম্পর্কেই সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে,
يُؤْتَى بِرَجُلٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُقَالَ اَكَلَ عَيَالُهُ حَسَنَاتَهُ- “কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে। বলা হবে, তার সন্তান-সন্তুতিরা তার সব নেকী ধ্বংস করে ফেলেছে।”
সর্বশেষ বলা হয়েছে যে, তোমরা যদি ক্ষমা ও সহনশীলতা দেখাও এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। এর অর্থ হলো, তাদের শত্রুতা সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করা হচ্ছে শুধু এই জন্য যে, তোমরা সতর্ক থাকবে এবং নিজেদের আদর্শকে তাদের থেকে রক্ষা করার চিন্তা-ভাবনা করবে। এই সতর্কীকরণের অর্থ কখনো এ নয় যে, যা করতে বলা হলো তার চেয়ে আরো অগ্রসর হয়ে তোমরা স্ত্রী ও সন্তানদের মারতে শুরু করবে অথবা তাদের সাথে রূঢ় আচরণ করবে অথবা সম্পর্ক এমন তিক্ত করে তুলবে যে, তোমাদের এবং তাদের পারিবারিক জীবন আযাবে পরিণত হবে। কারণ এরূপ করার দু’টি স্পষ্ট ক্ষতি আছে। একটি হলো, এভাবে স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতির সংশোধনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। দ্বিতীয়টি হলো, এভাবে সমাজে ইসলামের বিরুদ্ধে উল্টা খারাপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া এভাবে আশেপাশের লোকদের দৃষ্টিতে মুসলামানদের আখলাক ও চরিত্রের এমন একটি চিত্র ভেসে উঠে যাতে তারা মনে করতে শুরু করে যে, ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে সে নিজের ঘরের ছেলেমেয়েদের জন্য পর্যন্ত কঠোর ও বদমেজাজী হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে এ কথাটিও মনে রাখা উচিত যে, ইসলামের প্রথম যুগে মানুষ যখন সবেমাত্র মুসলমান হতো এবং যদি তাদের পিতামাতা কাফেরই থেকে যেত তাহলে একটি সমস্যা দেখা দিত এই যে, তারা তাদের সন্তানদেরকে নতুন দ্বীন পরিত্যাগ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতো। তাদের জন্য আরো একটি সমস্যা দেখা দিতো তখন যখন তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা (কিংবা মেয়েদের ক্ষেত্রে তাদের স্বামী এবং সন্তানরা) কুফরকেই আঁকড়ে ধরে থাকতো এবং সত্য দ্বীনের পথ থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতো। প্রথমোক্ত পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য সূরা আনকাবূতের ( ১৮ আয়াত) এবং সূরা লোকমান( ১৪ ও ১৫ আয়াত ) –এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, দ্বীনের ব্যাপারে কখনো পিতামাতার কথা অনুসরণ করবে না। তবে পার্থিব ব্যাপারে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে। এখানে দ্বিতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, নিজের দ্বীনকে নিজের সন্তান-সন্তুতির হাত থেকে রক্ষা করার চিন্তা অবশ্যই করবে কিন্তু তাই বলে তাদের সাথে কঠোর আচরণ করবে না। বরং নমনীয় আচরণ করো এবং ক্ষমা ও উদারতা দেখাও। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আত তাওবা, আয়াত ২৩, ২৪ ; আল মুজাদালা, টীকা ৩৭ ; আল মুমতাহিনা, টীকা ১ থেকে ৩ ; আল মুনাফিকূন, টীকা ১৮ )।
সুরা: আত-তাগাবুন
আয়াত নং :-১৫
اِنَّمَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَ اَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ١ؕ وَ اللّٰهُ عِنْدَهٗۤ اَجْرٌ عَظِیْمٌ
তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা। আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে আছে বিরাট প্রতিদান।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-
# তাফহীমুল কুরআন, আল আনফালে বলা হয়েছে:-
# যে জিনিসটি সাধারণত মানুষের ঈমানী চেতনায় এবং নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং যে জন্য মানুষ প্রায়ই মুনাফেকী, বিশ্বাসঘাতকতা ও খেয়ানতে লিপ্ত হয় সেটি হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সন্তান-সন্ততির স্বার্থের প্রতি সীমাতিরিক্ত আগ্রহ। এ কারণে বলা হয়েছে, এ অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে অন্ধ হয়ে তোমরা সাধারণত সত্য-সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাও। অথচ এগুলো তো আসলে দুনিয়ার পরীক্ষাগৃহে তোমাদের জন্য পরীক্ষার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়। যাকে তোমরা পুত্র বা কন্যা বলে জানো, প্রকৃতপক্ষে সে তো পরীক্ষার একটি বিষয়। আর যাকে তোমরা সম্পত্তি বা ব্যবসা বলে থাকে, সেও প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষার আর একটি বিষয় মাত্র। এ জিনিসগুলো তোমাদের হাতে সোপর্দ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তোমরা অধিকার ও দায়-দায়িত্বের প্রতি কতদূর লক্ষ্য রেখে কাজ করো, দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে আবেগতাড়িত হয়েও কতদূর সত্য ও সঠিক পথে চলা অব্যাহত রাখো এবং পার্থিব বস্তুর প্রেমাসক্ত নফসকে কতদূর নিয়ন্ত্রণে রেখে পুরোপুরি আল্লাহর বান্দায় পরিণত হও এবং আল্লাহ তাদের যতটুকু অধিকার নির্ধারণ করেছেন ততটুকু আদায়ও করতে থাকো, এগুলোর মাধ্যমে তা যাচাই করে দেখা হবে।
এক্ষেত্রে তাবারানী হযরত আবু মালেক আশআরী (রা.) থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন সেটিও মনে রাখা দরকার। তিনি বলেছেনঃ “তুমি যে শত্রুকে হত্যা করতে পারার কারণে সফল হলে কিংবা সে তোমাকে হত্যা করলে তুমি জান্নাত লাভ করলে সে তোমার আসল শত্রু নয়। বরং তোমার ঔরষজাত সন্তানই হয়তো তোমার আসল শত্রু। এরপর তোমার শত্রু হচ্ছে তোমার মালিকাধীন অর্থ সম্পদ।” তাই এখানে এবং সূরা আনফালের উভয় জায়গাতেই বলা হয়েছে যে, যদি তোমার অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির ফিতনা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারো এবং আল্লাহর প্রতি ভালবাসাকে তাদের প্রতি ভালবাসার ওপর প্রাধান্য দিতে সক্ষম হও তাহলে আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য বিরাট পুরস্কার রয়েছে।
সুরা: আত-তাগাবুন
আয়াত নং :-১৬
فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَ اسْمَعُوْا وَ اَطِیْعُوْا وَ اَنْفِقُوْا خَیْرًا لِّاَنْفُسِكُمْ١ؕ وَ مَنْ یُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ
তাই যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো। শোন, আনুগত্য করো এবং নিজেদের সম্পদ ব্যয় করো। এটা তোমাদের জন্যই ভালো। যে মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকলো সেই সফলতা লাভ করবে।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-
# কুরআন মজীদে এক স্থানে বলা হয়েছে اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ “আল্লাহকে ভয় করার মত ভয় করো।” (আলে ইমরান, ১০২ ) অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا “আল্লাহ কারো ওপর তার সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দেন না।” (আল বাকারাহ, ২৮৬ ) এখানে বলা হচ্ছে, সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। এ তিনটি আয়াতের বিষয়বস্তু এক সাথে মিলিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায়, প্রথম আয়াতে আমাদের সামনে একটি মানদণ্ড পেশ করা হয়েছে সেখানে পৌঁছার জন্য প্রত্যেক মু’মিনের চেষ্টা করা উচিত। দ্বিতীয় আয়াত আমাদেরকে এই মৌলিক নীতি অবহিত করছে যে, কোন ব্যক্তির নিকট থেকেই তার সাধ্যাতীত কোন কাজ দাবী করা হয়নি। বরং আল্লাহর দ্বীনের অধীনে মানুষ ততটুকুই করার জন্য আদিষ্ট যা করার সামর্থ তার আছে। আর এ আয়াতটি প্রত্যেক ঈমানদারকে এ মর্মে পথনির্দেশনা দিচ্ছে যে, সে যেন সাধ্যানুসারে তাকওয়ার পথ অনুসরণে কোন ত্রুটি না করে। তার পক্ষে যতটা সম্ভব আল্লাহর হুকুম আহকাম পালন করা এবং তাঁর নাফরমানী থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। এক্ষেত্রে সে যদি অলসতা করে তাহলে পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবেনা। তবে যে জিনিস তার সাধ্যের অতীত (অবশ্য কোন্ জিনিস তার সাধ্যের অতীত তার ফায়সালা আল্লাহই ভালভাবে করতে পারেন) সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না।
:- আল হাশর, বলা হয়েছে:- ‘রক্ষা পেয়েছে’ না বলে বলা হয়েছে ‘রক্ষা করা হয়েছে’। কেননা আল্লাহ তা’আলার তাওফীক ও সাহায্য ছাড়া কেউ নিজ বাহু বলে মনের ঔদার্য ও ঐশ্বর্য লাভ করতে পারে না। এটা আল্লাহর এমন এক নিয়ামত যা আল্লাহর দয়া ও করুণায়ই কেবল কারো ভাগ্যে জুটে থাকে। شح শব্দটি আরবী ভাষায় অতি কৃপণতা ও বখিলী বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু শব্দটিকে যখন نفس শব্দের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করে شح النفس বলা হয় তখন তা দৃষ্টি ও মনের সংকীর্ণতা, পরশ্রীকাতরতা এবং মনের নীচতার সমার্থক হয়ে যায় যা বখলী বা কৃপণতার চেয়েও ব্যাপক অর্থ বহন করে। বরং কৃপণতার মূল উৎস এটাই। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ অন্যের অধিকার স্বীকার করা এবং তা পূরণ করা তো দূরের কথা তার গুণাবলী স্বীকার করতে কুন্ঠাবোধ করে। সে চায় দুনিয়ার সবকিছু সে-ই লাভ করুক। অন্য কেউ যেন কিছুই না পায়। নিজে অন্যদের কিছু দেয়া তো দূরের কথা, অপর কোন ব্যক্তি যদি কাউকে কিছু দেয় তাহলেও সে মনে কষ্ট পায়। তার লালসা শুধু নিজের অধিকার নিয়ে কখনো সন্তুষ্ট নয়, বরং অন্যদের অধিকারেও সে হস্তক্ষেপ করে, কিংবা অন্ততপক্ষে সে চায় তার চারদিকে ভাল বস্তু যা আছে তা সে নিজের জন্য দু’হাতে লুটে নেবে অন্য কারো জন্য কিছুই রাখবে না। এ কারণে এ জঘন্য স্বভাব থেকে রক্ষা পাওয়াকে কুরআন মজীদে সাফল্যের গ্যারান্টি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাছাড়া রসূলুল্লাহ ﷺ ও এটিকে মানুষের নিকৃষ্টতম স্বভাব বলে গণ্য করেছেন যা বিপর্যয়ের উৎস। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, নবী (সা.) বলেছেনঃ ( اتَّقُوا الشُّحَّ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءَهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ (مسلم – مسند احمد – بيهقى – بخارى فى الادب) ) হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনে আমরের বর্ণনার ভাষা হলোঃ ( أَمَرَهُمْ بِالظُّلْمِ فَظَلَمُوا وَأَمَرَهُمْ بِالْفُجُورِ فَفَجَرُوا- وَأَمَرَهُمْ بِالْقَطِيعَةِ فَقَطَعُوا (مسند احمد – ابو داؤد – نسائى) ) অর্থাৎ شح থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কারণ এটিই তোমাদের পূর্বের লোকদের ধ্বংস করেছে। এটিই তাদেরকে পরস্পরের রক্তপাত ঘটাতে এবং অপরের মর্যাদাহানি নিজের জন্য বৈধ মনে করে নিতে মানুষকে প্ররোচিত করেছে। এটিই তাদের জুলুম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে তাই তারা জুলুম করেছে। পাপের নির্দেশ দিয়েছে তাই পাপ করেছে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে বলেছে তাই তারা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ ঈমান ও মনের সংকীর্ণতা একই সাথে কারো মনে অবস্থান করতে পারে না। (ইবনে আবি শায়বা, নাসায়ী, বায়হাকী ফী শুআবিল ঈমান, হাকেম) হযরত আবু সাঈদ খুদরী বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেছেনঃ দুইটি স্বভাব এমন যা কোন মুসলমানের মধ্যে থাকতে পারে না। অর্থাৎ কৃপণতা ও দুশ্চরিত্রতা। (আবু দাউদ, তিরমিযী, বুখারী ফিল আদাব) কিছু সংখ্যক ব্যক্তির কথা বাদ দিলে পৃথিবীতে জাতি হিসেবে মুসলমানরা আজও সবচেয়ে বেশী দানশীল ও উদারমনা। সংকীর্ণমনতা ও কৃপণতার দিক দিয়ে যেসব জাতি পৃথিবীতে নজিরবিহীন সেই সব জাতির কোটি কোটি মুসলমান তাদের স্বগোত্রীয় অমুসলিমদের পাশাপাশি বসবাস করছে। হৃদয়-মনের ঔদার্য ও সংকীর্ণতার দিক দিয়ে তাদের উভয়ের মধ্যে যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায় তা ইসলামের নৈতিক শিক্ষার অবদান। এছাড়া তার অন্য কোন ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। এ শিক্ষাই মুসলমানদের হৃদয়-মনকে বড় করে দিয়েছে।
সুরা: আত-তাগাবুন
আয়াত নং :-১৭
اِنْ تُقْرِضُوا اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا یُّضٰعِفْهُ لَكُمْ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ١ؕ وَ اللّٰهُ شَكُوْرٌ حَلِیْمٌۙ
যদি তোমরা আল্লাহকে করযে হাসানা দাও তাহলে তিনি তোমাদেরকে তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবেন এবং তোমাদের ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ সঠিক মূল্যায়ণকারী ও অতীব সহনশীল।
# এটা আল্লাহ তা’আলার চরম উদারতা ও দানশীলতা যে, মানুষ যদি তাঁরই দেয়া সম্পদ তাঁর পথে ব্যয় করে তাহলে তিনি তা নিজের জন্য ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেন। অবশ্য শর্ত এই যে, তা “কর্জে হাসানা” (উত্তম ঋণ) হতে হবে। অর্থাৎ খাঁটি নিয়তে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে ছাড়াই তা দিতে হবে, তার মধ্যে কোন প্রকার প্রদর্শনীর মনোবৃত্তি, খ্যাতি ও নামধামের আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, তা দিয়ে কাউকে খোঁটা দেয়া যাবে না, দাতা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেবে এবং এছাড়া অন্য কারো প্রতিদান বা সন্তুষ্টি লক্ষ্য হবে না। এ ধরনের ঋণের জন্য আল্লাহর দু’টি প্রতিশ্রুতি আছে। একটি হচ্ছে, তিনি তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে ফেরত দেবেন। অপরটি হচ্ছে, এজন্য তিনি নিজের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কার দান করবেন। হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াত যখন নাযিল হয় এবং নবীর (সা.) পবিত্র মুখ থেকে লোকজন তা শুনতে পায় তখন হযরত আবদ দাহদাহ আনসারী জিজ্ঞেস করেনঃ হে আল্লাহর রসূল, আল্লাহ কি আমাদের কাছে ঋণ চান? জবাবে নবী (সা.) বলেনঃ হে আবুদ দাহদাহ, হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেনঃ আপনার হাত আমাকে একটু দেখান। নবী (সা.) তাঁর দিকে নিজে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আবুদ দাহদাহ নবীর (সা.) হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেনঃ “আমি আমার রবকে আমার বাগান ঋণ দিলাম” হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেনঃ সেই বাগানে ৬ শত খেজুর গাছ ছিল। বাগানের মধ্যেই ছিল আবুদ দাহদাহের বাড়ী। তার ছেলে মেয়েরা সেখানেই থাকতো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এসব কথাবার্তা বলে তিনি সোজা বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলেন এবং স্ত্রীকে ডেকে বললেনঃ “দাহদাহর মা, বেরিয়ে এসো। আমি এ বাগান আমার রবকে ঋণ হিসেবে দিয়ে দিয়েছি। স্ত্রী বললোঃ “দাহদাহর বাপ, তুমি অতিশয় লাভজনক কারবার করেছো” এবং সেই মুহূর্তেই সব আসবাবপত্র ও ছেলেমেয়েকে সাথে নিয়ে বাগান ছেড়ে চলে গেলেন” (ইবনে আবী হাতেম)। এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় সে সময় প্রকৃত মু’মিনদের কর্ম পদ্ধতি কেমন ছিল। এ থেকে একথাও বুঝা যায় যে, যে কর্জে হাসানাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে ফেরত দেয়ার এবং তাছাড়াও আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে সম্মানজনক পুরস্কার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা কেমন।
# যারা জেনে বুঝে নাফরমানী করে সেই সব অপরাধীদের সাথে যে ধরনের আচরণ করা হয় নেক কাজে সচেষ্ট বান্দাদের সাথে আল্লাহর আচরণ তেমন নয়। তাদের সাথে আল্লাহর আচরণ হচ্ছে (১) তারা নিজের পক্ষ থেকে যতটা সৎকর্মশীল হওয়ার চেষ্টা করে আল্লাহ তাদেরকে তার চেয়েও বেশী সৎকর্মশীল বানিয়ে দেন। (২) তাদের কাজকর্মে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায় অথবা সৎকর্মশীল হওয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে গোনাহ সংঘটিত হয় আল্লাহ তা উপেক্ষা করেন এবং (৩) যে সামান্য পরিমাণ নেক কাজের পুঁজি তারা নিয়ে আসে সেজন্য আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদা দেন এবং অধিক পুরস্কার দান করেন।
সুরা: আত-তাগাবুন
আয়াত নং :-১৮
عٰلِمُ الْغَیْبِ وَ الشَّهَادَةِ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ۠
সামনে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সবকিছুই তিনি জানেন। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।
১১-১৮ আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:-
‘কোনাে বিপদই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া সংঘটিত হয় না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তায়ালা তার হৃদয়কে হেদায়াত দান করেন, আর আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে অবগত।’ *ভালাে মন্দ সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হয় : এখানে এ বিষয়টি আলােচনার পটভূমি শুধু এটাই যে, সূরার এ অংশটির সূচনাতেই ঈমানের আহবান জানানাে হয়েছে। এখানে বুঝানাে হয়েছে, যে ঈমানের আহবান জানানাে হয়েছে, তা প্রতিটি জিনিসের কৃতিত্ব বা দায়দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহকেই দিয়ে থাকে এবং এইরূপ বিশ্বাস করতে উদ্বুদ্ধ করে যে, ভালো মন্দ যাই হােক, কেবলমাত্র আল্লাহর অনুমতিক্রমেই সংঘটিত হয়ে থাকে। এই সত্য মেনে না নিলে ঈমানই আনা হয় না। জীবনের শুভ-অশুভ যাবতীয় ঘটনার মুখােমুখি হবার সময় এটাই হয়ে থাকে মােমেনের যাবতীয় আবেগ অনুভূতির ভিত্তি ও উৎস। এমনও হতে পারে যে, এই সুরা নাযিল হবার সময় বাস্তবিকপক্ষে মােমেনদের ও মােশরেকদের মধ্যে এমন কোনাে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলাে, যা এই সূরার বা সূরার এই আয়াতের পটভূমি হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে পটভূমি যাই হােক, ইসলাম মােমেনের বিবেকে যে ঈমানী ভাবধারার সৃষ্টি করে, এটি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সে প্রতিটি ঘটনায় ও প্রতিটি তৎপরতায় আল্লাহর হাত সক্রিয় দেখতে পায় এবং তার লাভ লােকসান বা সুখ দুঃখ যাই অর্জিত হােক, তাতে তার মন শান্ত, নিশ্চিন্ত, স্থির ও অবিচল থাকে। দুঃখ ও ক্ষয়ক্ষতি হলে ধৈর্যধারণ করে, আর সুখ শান্তি অর্জিত হলে শােকর করে। কখনাে কখনাে এর চেয়েও উচ্চতর মানে উন্নীত হয়ে সুখ ও দুঃখ উভয় অবস্থাতেই শােকর আদায় করে। সুখের ন্যায় দুঃখেও সে আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত দেখতে পায়। কেননা, দুঃখে বা বিপদে তার আত্মশুদ্ধি ও গুনাহ মাফ হওয়ার সুযোগ লাভ হয়ে থাকে এবং সওয়াবের পাল্লা উভয় অবস্থায়ই ভারী দেখতে পায় অথবা উভয় অবস্থায়ই সঠিক কল্যাণ দেখতে পায়। বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল(স.) বলেন, মােমেনের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ধরনের। আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে যে ফয়সালাই করেন, তা তার জন্যে কল্যাণকর প্রমাণিত হয়। তার ওপর যদি বিপদ আপদ আসে, তবে সে ধৈর্যধারণ করে এবং সেটা তার জন্যে কল্যাণকর হয়। আর যদি সুখশান্তি আসে তবে সে শােকর আদায় করে এবং সেটাও তার জন্যে কল্যাণকর হয়। এমন অবস্থা মােমেন ছাড়া আর কারাে হয় না। ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার হৃদয়কে সুপথে চালিত করেন।’ কোনাে কোনাে প্রাচীন তাফসীরকার এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, আল্লাহর অদৃষ্ট বা তাকদীরে ঈমান আনা ও তার কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই হৃদয়ের এই সুপথপ্রাপ্তি বা হেদায়াত অর্জিত হয়। ইবনে আব্বাস(রা.) বলেন, এর অর্থ হলাে, আল্লাহ তায়ালা তার হৃদয়কে পরিপূর্ণ হেদায়াত দান করেন। আল্লাহর গােপন তথ্যের সন্ধান দেন এবং তাকে সকল জিনিস ও ঘটনাবলীর মূল উৎস অবহিত করেন। ফলে সে ঘটনাবলীর প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। তাই সে নিশ্চিন্ত ও স্থির থাকে। অতপর পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করে। ফলে ক্রুটিপূর্ণ আংশিক জ্ঞানের আর কোনাে প্রয়ােজন তার থাকে না। এ জন্যে আয়াতের শেষাংশে মন্তব্য করা হয়েছে, আল্লাহ তায়লা সর্ববিষয়ে জ্ঞানী। বস্তুত আল্লাহর জ্ঞানেরই একটা অংশের সন্ধান তিনি দিয়ে থাকেন যাকে হেদায়াত করতে চান তাকে। এ জন্যে শর্ত হচ্ছে বিশুদ্ধ ঈমান। ঈমান বিশুদ্ধ হলে সকল পর্দা অপসৃত হয়ে কিছু কিছু গােপন তত্ত্ব উদঘাটিত হয়। অতপর পরবর্তী আয়াতে ঈমানের দাওয়াত এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্যের আহবান জানানাে হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করাে ও রসূলের আনুগত্য করাে। কিন্তু যদি তা না করো তবে জেনে রেখাে, আমার নবীর দায়িত্ব প্রকাশ্য প্রচারের অতিরিক্ত কিছু নয়। যারা আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের আনুগত্য করতে অস্বীকার করেছে, তাদের পরিণতি কী হয়েছে তা ইতিপূর্বে জানানাে হয়েছে, আর এখানে বলা হচ্ছে যে, রসূল(স.) একজন প্রচারক ছাড়া আর কিছু নন। তিনি যখন প্রচার করেছেন তখন তাঁর দায়িত্ব পালন শেষ হয়েছে। এরপর যারা অস্বীকার করেছে তাদের ফলাফল পাওয়াটাই শুধু বাকী।
ফী জিলালিল কুরআন:-
*স্ত্রী, পুত্র, পরিজন যেন তামাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত না করে : পরবর্তী আয়াতে তাদের প্রত্যাখ্যান করা তাওহীদতত্ত্ব এবং আল্লাহর সাথে মােমেনদের কিরূপ সম্পর্ক থাকা উচিত তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই, আর আল্লাহর ওপরই মােমেনদের নির্ভর করা উচিত।’ বস্তুত তাওহীদ বিশ্বাস ঈমানের ভিত্তি। আর এর দাবি এই যে, একমাত্র আল্লাহর ওপরই মােমেনের তাওয়াক্কুল করা চাই। এটাই মােমেনের হৃদয়ে ঈমানী চেতনার কার্যকারিতার স্বাক্ষর। এই আয়াতকে মোমেনদের প্রতি পরবর্তী সম্বোধনের ভূমিকা বলা যেতে পারে। সূরার পূর্ববর্তী অংশের সাথে পরবর্তী অংশের এটাই যােগসূত্র। শেষাংশে মােমেনদের নিজ স্ত্রী, সন্তান ও সহায় সম্পদের অগ্নিপরীক্ষা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে এবং তাদের আল্লাহর ভয়, নেতার আনুগত্য ও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে এবং কৃপণতা থেকে নিবৃত্ত থাকতে বলা হয়েছে। এ সব নির্দেশ মেনে চললে তাদের জীবিকা বৃদ্ধি, গুনাহ মাফ, ও সার্বিক কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। সর্বশেষে প্রকাশ্য ও গােপন বিষয়ে আল্লাহর নির্ভুল জ্ঞান, তার ক্ষমতা ও পরাক্রম এবং বিচক্ষণতা ও বিজ্ঞতার কথা পুনব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘হে মােমেন ব্যক্তিরা! তােমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে তােমাদের শত্রু রয়েছে। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সাবধান হও।…’ ইবনে আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত আছে, মক্কাতে ইসলাম গ্রহণকারী কিছু লােক মদীনায় রসূল(স.)-এর কাছে যেতে চেয়েছিলাে, কিন্তু তাদের স্ত্রী ও সন্তানেরা তাদের যেতে বাধা দেয়। পরে যখন তারা মদীনায় যায়, দেখতে পায় যে, অন্য যারা আগে এসেছে তারা ইসলামে গভীর পান্ডিত্য অর্জন করে ফেলেছে। তাই তারা (ক্রুদ্ধ হয়ে) নিজ স্ত্রী ও সন্তানদের শাস্তি দিতে চায়। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেন যে, ‘তোমরা যদি ক্ষমা করে দাও তবে আল্লাহও ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।’ তবে কোরআনের আলােচ্য আয়াত উক্ত আংশিক ঘটনার তুলনায় ব্যাপকতর তাৎপর্যবহ। কেননা, এ আয়াতে স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যাপারে যে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, তা পরবর্তী আয়াতে উচ্চারিত সন্তান সন্তুতি ও ধনসম্পদ সংক্রান্ত সতর্কবাণীর মতােই। পরবর্তী আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘তােমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান সন্ততি হচ্ছে তােমাদের জন্যে পরীক্ষা স্বরূপ।’ স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে শক্র রয়েছে এই সতর্কবাণী মানব জীবনের একটি নিগূঢ় তত্ত্বের দিকে ইংগিত করছে। বস্তুত স্ত্রীরা ও সন্তানেরা কখনাে কখনাে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন করে দেয়। অনুরূপভাবে তারা মােমেনকে তার ঈমানের দাবী পূরণে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে, যখন তা তাকে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর ন্যায় ঝুঁকির সম্মুখীন করে তোলে। আল্লাহর পথে জেহাদকারীকে অনেক ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ কোরবানী স্বীকার করতে হয়। এতে সে নিজে ও তার পরিবার নিদারুণ অভাব এবং দারিদ্রেরও সম্মুখীন হয়। কখনাে সে নিজের আর্থিক কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু তার স্ত্রী ও সন্তানদের আর্থিক অনটন সহ্য করতে পারে না। ফলে হয় কৃপণতার আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয়ে ইতস্তত করে, নচেৎ কাপুরুষতা প্রদর্শন করে, যাতে পরিবার পরিজনের শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রাচুর্যের ঘাটতি না হয়। এভাবে পরিবার পরিজন তার শত্রুতে পরিণত হয়। কেননা, তারা তাকে কল্যাণ থেকে এবং তার মানব জন্মের মূল উদ্দেশ্য পূরণ থেকে ফিরিয়ে রাখে। কখনাে কখনাে তারা প্রত্যক্ষভাবেও বাধা দিতে পারে এবং ভিন্ন মতাবলম্বী হয়ে তার পথ রোধ করতে পারে। এটাও শত্রুতার ভিন্ন রূপ, আর এ সবই মােমেনের জীবনে সব সময় ঘটে থাকে। এ কারণে এই জটিল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে মােমেনদের সাবধান করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অতপর সন্তান সন্তুতি ও ধনসম্পদকে ফিতনা হিসাবে উল্লেখ করে পুনরায় সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। এখানে ফিতনা শব্দের দুই অর্থ, প্রথমত এই যে, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের সন্তান সন্তুতি ও ধনসম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করতে চান। তাই তােমরা সাবধান হয়ে যাও এবং পরীক্ষার সময়ে আল্লাহর প্রতি একাগ্র হও। স্বর্ণকার যেমন স্বর্ণকে আগুনে পুড়িয়ে খাদ বের করে ও খাঁটি স্বর্ণ বানায়, তেমনি আল্লাহ বান্দাকে সন্তান ও ধনসম্পদের পরীক্ষা দ্বারা খাঁটি বান্দায় পরিণত করেন। দ্বিতীয়ত, এই সব ধনসম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি তােমাদের গুনাহ ও আল্লাহর নাফরমানীর মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারে। কাজেই সতর্ক হও যেন এই ফিতনা তােমাদের আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে না পারে। এই উভয় অর্থই নিকটতর এবং গ্রহণযােগ্য। ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, একদিন রসূল(স.) খােতবা দিচ্ছিলেন। এই সময়ে হাসান ও হােসাইন এলাে। তাদের গায়ে লাল দুটো জামা ছিলাে। তারা চলছিলাে এবং আছাড় খাচ্ছিলাে। রসূল(স.) মিম্বার থেকে নামলেন এবং তাদের উভয়কে তুলে নিজের সামনে এনে রাখলেন। তারপর বললেন, আল্লাহ সত্য বলেছেন, তােমাদের সন্তান সন্তুতি ও ধন সম্পদ ফিতনা স্বরূপ। এই শিশু দুটিকে দেখলাম আছাড় খেতে খেতে হেঁটে চলেছে। আমি ধৈর্যধারণ করতে পারলাম না। খুতবা বন্ধ করে তাদের তুলে আনলাম। চিন্তার বিষয় যে, নিজের মেয়ের ছেলে দুটিকে নিয়ে স্বয়ং রসূলুল্লাহ(স.)-এর অবস্থা যখন এরূপ, তখন ব্যাপারটা সত্যই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং মানুষের হৃদয়ে যে ভাবাবেগ ও স্নেহমমতা সৃষ্টি করেছেন, তা যাতে তাকে সীমা অতিক্রম করতে প্ররােচিত না হলে মুমিনের শত্রু করতে পারে, সে জন্যে এই সতর্কবাণী ছিলাে অত্যন্ত জরুরী। তা যতােটা ক্ষতি করতে পারে, এই মায়ামমতা ততােটাই ক্ষতি করতে পারে। এ জন্যেই ধনসম্পদ ও সন্তান সন্তুতির ফিতনা এবং সন্তান ও স্ত্রীদের পক্ষ থেকে প্রচ্ছন্ন শক্রতা সম্পর্কে সাবধান করার পর আল্লাহর কাছে যে পুরস্কার রয়েছে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, দুনিয়াতে বান্দার জন্যে ফিতনা তাে রয়েছেই, তবে আল্লাহর কাছে তার জন্যে পুরস্কারও রয়েছে। পরবর্তী আয়াতে মােমেনদের সাধ্যমতাে আল্লাহর ভয় ও আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং তােমরা যতােটা সম্ভব আল্লাহকে ভয় করাে এবং শ্রবণ করাে ও আনুগত্য করাে…’ যতােটা সম্ভব এই কথাটার মধ্যে বান্দাদের প্রতি আল্লাহর স্নেহমমতা এবং বান্দার আনুগত্য ও আল্লাহ ভীতির শক্তি সামর্থ কতখানি, তা ফুটে ওঠেছে। বুখারী ও মুসলিমে আবু হােরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে রসূল(স.) বলেছেন, আমি যখন তােমাদের কোনাে কাজের আদেশ করি, তখন তােমরা যতােটা পারাে করবে, আর যখন কোন কিছু থেকে নিষেধ করি তখন তা পরিহার করবে।’ এ থেকে বুঝা গেলাে যে, আদেশের আনুগত্যের কোনাে নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। তাই তা যতােটা সম্ভব করতে হবে, কিন্তু নিষেধাজ্ঞা পুরােপুরিভাবেই মেনে চলতে হবে। অতপর তাদের দান করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যে উত্তম সম্পদ দান করো।’ বস্তুত মােমেনরা নিজেদের কল্যাণের জন্যেই দান করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিনে যে, তারা যেন উত্তম সম্পদ দান করে। এভাবে তিনি দান করা সম্পদকে দানকারীদের জন্যেই কল্যাণকর বলে আখ্যায়িত করছেন। সেই সাথে তিনি মনের সংকীর্ণতা ও কৃপণতাকে আর একটি অনিবার্য পরীক্ষা হিসাবে আখ্যায়িত করেন। যে ব্যক্তি কৃপণতা থেকে রক্ষা পায় সে যথার্থই সৌভাগ্যশালী। এ জিনিস থেকে রক্ষা পাওয়া আল্লাহর অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা নিজের মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা পায় তারাই সফলকাম হয়। অতপর আল্লাহর পথে ব্যয়ের জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তােমরা যদি আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তাহলে তিনি তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন এবং তােমাদের গুনাহ মাফ করবেন। আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত শােকর আদায়কারী ও ধৈর্যশীল।’ ভাবলে অবাক হতে হয় যে, আল্লাহ কতাে মহৎ। কতাে উদার! তিনিই বান্দাকে সৃষ্টি করেন, জীবিকা দেন, অতপর যা তার প্রয়ােজনের অতিরিক্ত তা দান করতে বলেন, দান করলে তাকে ঋণ হিসাবে আখ্যায়িত করেন, তার প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধি করেন, অতপর তার জন্যে শােকরও করেন। যে বান্দাকে তিনি সৃষ্টি করেন ও জীবিকা দেন, তার কাছে শােকর জ্ঞাপন করেন। আর বান্দা শােকর আদায়ে ভুল করলে তাতে ধৈর্যধারণ করেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাঁর নিজের গুণাবলী দ্বারা শিক্ষা দেন কিভাবে আমাদের ত্রুটি ও দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠতে পারি, কিভাবে ক্রমাগত ঊর্ধ্বে ওঠতে পারি এবং কিভাবে নিজেদের ক্ষুদ্র ও সীমিত শক্তির আওতায় তাঁর অনুকরণ করতে পারি। তিনি তাে তাঁরই সৃষ্ট আত্মা মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন। এভাবে তাকে সর্বদা সাধ্যমতাে উচ্চতর মানে উন্নীত হবার অভিলাষী বানিয়েছেন। এজন্যে উচ্চতর মর্যাদায় উন্নীত হবার সুযােগ সব সময় তার জন্যে উন্মুক্ত থাকে, যাতে সে পর্যায়ক্রমে সাধ্যমতাে উন্নতির উচ্চতর মার্গে আরােহণের চেষ্টা করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়। সূরার শেষ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তার সেই গুণের উল্লেখ করেছেন যা দিয়ে তিনি মানুষের অন্তর্যামী হয়েছেন। বলেছেন, ‘তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্য সব কিছু জানেন, তিনি মহাপরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী।’ বস্তুত প্রতিটি জিনিস আল্লাহর জ্ঞানের কাছে উন্মুক্ত, তার কর্তৃত্বাধীন, তাঁর বিচক্ষণতা এবং দক্ষতা দ্বারা পরিচালিত ও পরিকল্পিত। মানুষের এমনভাবে জীবন যাপন করা কর্তব্য, যাতে প্রতি মুহূর্তে সে উপলব্ধি করে যে, আল্লাহর চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার কর্তৃত্ব তার ওপর বিরাজমান এবং তিনি নিজ নিপুণ কৌশল দ্বারা দৃশ্য অদৃশ্য সবকিছুর ব্যবস্থাপনা করছেন। হৃদয়ে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল থাকা আল্লাহর ভয়, আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও আনুগত্য বহাল থাকার জন্যে যথেষ্ট।
১১-১৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
فَاٰمِنُوْا এখানে ’فا‘ ফা অক্ষরটিকে ‘ফা ফাসীহাহ’ বলা হয়
অর্থাৎ এর পূর্বে একটি শর্ত উহ্য রয়েছে। অর্থ হল যখন বিষয়টি এ রকমই যা বর্ণিত হয়েছে সুতরাং তোমরা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ নূর, কুরআনের প্রতিও ঈমান আন।
(لِيَوْمِ الْجَمْعِ)
‘সমাবেশ দিবসে’ সমাবেশ দিবসে বলতে কিয়ামত দিবসকে বুঝানো হয়েছে। কিয়ামত দিবসকে সমাবেশ দিবস বলার কারণ হল সেদিন সকল আদম সন্তান, জিন, আকাশবাসী ও জমিনবাসীকে একই ময়দানে সমবেত করা হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(ذٰلِكَ يَوْمٌ مَّجْمُوْعٌ لا لَّهُ النَّاسُ وَذٰلِكَ يَوْمٌ مَّشْهُوْدٌ)
“এটা সেদিন, যেদিন সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে; এটা সে দিন যেদিন সকলকে উপস্থিত করা হবে।” (সূরা হূদ ১১ : ১০৩)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(قُلْ إِنَّ الْأَوَّلِيْنَ وَالْاخِرِيْنَ لَمَجْمُوْعُوْنَ ৫ إِلٰي مِيْقَاتِ يَوْمٍ مَّعْلُوْم)
“বল : অবশ্যই পূর্ববর্তীগণ এবং পরবর্তীগণকে একত্রিত করা হবে এক নির্ধারিত দিনের নির্ধারিত সময়ে” (সূরা ওয়াকিয়া ৫৬ : ৪৯)
(مَآ أَصَابَ مِنْ مُّصِيْبَةٍ)
অর্থাৎ জান-মাল সন্তান-সন্ততি ইত্যাদিতে পতিত সকল বিপদ আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত ও তাঁর ফায়সালা অনুপাতেই হয়ে থাকে। কেউ বলেছেন : এ আয়াতটি কাফিরদের উক্তির প্রতিবাদস্বরূপ অবতীর্ণ হয়। তারা বলত মুসলিমরা সত্যের ওপর থাকলে দুনিয়াতে কোন বালা মসিবত তাদের ওপর আসত না। (ফাতহুল কাদীর)
(وَمَنْ یُّؤْمِنْۭ بِاللہِ)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমানসহ ঈমানের অন্যান্য রুকনের প্রতি বিশ্বাসী হয় এবং এ বিশ্বাস রাখে যে, ভাল-মন্দ ও আপদ-বিপদ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক ফায়সালাকৃত আর আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালার প্রতি আত্মসমর্পণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তর হিদায়াতের ওপর অটল রাখবেন।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : (يَهْدِ قَلْبَه۫) অর্থাৎ দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তর অটল রাখবেন। ফলে সে নিশ্চিত থাকবে যে, তার ওপর যে আপদ-বিপদ হয় তা ভুল করে আসে না, আর যে সকল আপদ-বিপদে আক্রান্ত হয় না তা ভুল করে তার থেকে সরে যায়নি। (ইবনু কাসীর)।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন : এর দ্বারা এমন লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা বিপদগ্রস্ত হলে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে এবং এ কথা বুঝতে পারে যে, এ বিপদ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতেই এসেছে। (সহীহ বুখারী)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : মু’মিনের কাজগুলা আশ্চর্যজনক, তার প্রত্যেক কাজ কল্যাণকর। তার ওপর কোন বিপদ আপতিত হলে ধৈর্য ধারণ করে-এটা তার জন্য কল্যাণকর, আর আনন্দদায়ক বিষয় হলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে; এটাও তার জন্য কল্যাণকর। এটা মু’মিন ছাড়া অন্য কারো জন্য নয়। (সহীহ মুসলিম হা. ৭৬৯২)
(وَأَطِيْعُوا اللّٰهَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নির্দেশ করেছেন তা অনুসরণ করো আর যা বর্জন করতে বলেছেন তা বর্জন করে চলো। আর যদি তা না করো তাহলে জেনে রেখো, তোমাদের কর্মের কারণে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পাকড়াও করা হবে না। তাঁর কাজ কেবল পৌঁছে দেওয়া। ইমাম জুহরী (রহঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার কাজ রাসূল প্রেরণ করা, রাসূলদের কাজ পৌঁছে দেওয়া আর আমাদের কাজ হল তা মেনে নেয়া। (ইবনু কাসীর)। সুতরাং আমাদের রাসূলের নির্দেশ মেনে চলা আবশ্যক।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. দুনিয়ায় যা কিছু ঘটে সব পূর্ব ফায়সালাকৃত ও আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতেই ঘটে থাকে।
২. মু’মিনদের প্রত্যেক কাজ কল্যাণকর, কারণ তারা সুখী অবস্থায় কৃতজ্ঞ হয় আর বিপদ-আপদের সময় ধৈর্য ধারণ করে।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য করা ওয়াজিব।
১৪-১৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
শানে নুযূল :
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁকে জনৈক ব্যক্তি
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْآ إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَّكُمْ فَاحْذَرُوْهُمْ)
এ আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : এরা হল ঐ সকল লোক যারা মক্কাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তারা ইচ্ছা করল নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট চলে আসবে কিন্তু তাদের স্ত্রী সন্তানরা আসতে অবাধ্য হল। অতঃপর তারা যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট চলে আসল তখন অন্যদেরকে দেখতে পেল যে, তারা দীনের ব্যাপারে অনেক জ্ঞান অর্জন করে নিয়েছে। তখন তারা স্ত্রী-সন্তানদের শাস্তি দিতে ইচ্ছা পোষণ করল। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (তিরমিযী হা. ৩৩১৭, হাসান)।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাপারে সতর্ক করে বলছেন যে, তোমাদের স্ত্রী-সন্তানদের অনেকেই তোমাদের জন্য শত্রু। অর্থাৎ অনেক স্ত্রী-সন্তান আছে যাদের কারণে মানুষ সৎআমল থেকে দূরে সরে যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَآ أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ ج وَمَنْ يَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَأُولٰ۬ئِكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ)
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন না করে-যারা এমন করবে (উদাসীন হবে) তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা মুনাফিকুন ৬৩ : ৯)
এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন فَاحْذَرُوْهُمْ অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে তাদের থেকে সতর্ক থেকো।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : নিশ্চয়ই শয়তান আদম সন্তানকে ঈমান থেকে বিরত রাখার জন্য তার পথে বসে এবং বলে : তুমি ঈমান আনবে? তোমার নিজের দীন ও বাপ-দাদার দীন বর্জন করবে? কিন্তু আদম সন্তান তার কথা না শুনে ঈমান আনে। তারপর শয়তান আদম সন্তানের হিজরতের পথে প্রতিবন্ধক হয় এবং বলে তুমি হিজরত করবে? তোমার সম্পদ ও পরিবার ছেড়ে দেবে? কিন্তু তার কথা না শুনে সে হিজরত করে। তারপর জিহাদের পথে প্রতিবন্ধক হয় এবং বলে : তুমি জিহাদ করে নিজেকে হত্যা করবে? তোমার স্ত্রীকে অন্যজন বিবাহ করে নেবে, তোমার সম্পদ ভাগ করে নেবে। কিন্তু তার কথার বিপরীত করে জিহাদ করে এবং শহীদ হয়। আল্লাহ তা‘আলার হক হল তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো। (সহীহ, নাসায়ী হা. ৩১৩৪, সহীহুল জামে হা. ১৬৫২)
মুজাহিদ (রহঃ) এ আয়াতের তাফসীর বলেন : মানুষ স্ত্রী, সন্তান ও সহায়-সম্পত্তির কারণে আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী করে। তাদের ভালবাসায় আল্লাহ তা‘আলার বিধানকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। (ইবনু কাসীর)।
(إِنَّمَآ أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ)
অর্থাৎ সম্পদ সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে পরীক্ষার বস্তু তারা তোমাদেরকে হারাম উপার্জন করতে প্ররোচিত করে এবং আল্লাহ তা‘আলার অধিকার আদায় করতে বাধা দেয়। অতএব তাদের ব্যাপারে সাবধান। একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুৎবা প্রদান করছিলেন এমন সময় হাসান ও হুসাইন (রাঃ) আগমন করল। তাদের গায়ে লাল রঙের জামা ছিল। তারা হোঁচট খেতে খেতে আসছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিম্বার থেকে নেমে এসে তাদেরকে উঠিয়ে নিলেন এবং নিজের সামনে বসিয়ে দিলেন। অতঃপর বললেন : আল্লাহ তা‘আলা সত্যই বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের সম্পদ ও সন্তান পরীক্ষার বস্তু। আমি এ দুজন বালককে দেখলাম হোঁচট খেতে খেতে আসছিল আমি ধৈর্য ধারণ করে থাকতে না পেরে কথা বন্ধ করে তাদেরকে নিয়ে আসলাম। ( তিরমিযী হা. ৩৭৭৪, আবূ দাঊদ হা. ১১০৯ সনদ সহীহ)।
এজন্য ঈমানের দাবী হল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সকলের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(قُلْ اِنْ کَانَ اٰبَا۬ؤُکُمْ وَاَبْنَا۬ؤُکُمْ وَاِخْوَانُکُمْ وَاَزْوَاجُکُمْ وَعَشِیْرَتُکُمْ وَاَمْوَالُ اۨقْتَرَفْتُمُوْھَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ کَسَادَھَا وَمَسٰکِنُ تَرْضَوْنَھَآ اَحَبَّ اِلَیْکُمْ مِّنَ اللہِ وَرَسُوْلِھ۪ وَجِھَادٍ فِیْ سَبِیْلِھ۪ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰی یَاْتِیَ اللہُ بِاَمْرِھ۪ﺚ وَاللہُ لَا یَھْدِی الْقَوْمَ الْفٰسِقِیْنَ)
“বল : ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পতœী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত’ আল্লাহ পাপিষ্ঠ সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।” (সূরা তাওবা ৯ : ২৪)
এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও তাঁদের উভয়কে ভালবাসতে হবে। উমার (রাঃ) বলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমি আপনাকে সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালবাসি, তবে আমার জীবনের চেয়ে বেশি নয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : না, সে সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ! যতক্ষণ না আমি তোমার নিজের জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয় হই (ততক্ষণ তুমি পূর্ণ মু’মিন হতে পারবে না)। কিছুক্ষণ পর উমার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আপনি আমার নিজের জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : হে উমার! এখন (তুমি পূর্ণ মু’মিন হলে)। (সহীহ বুখারী হা. ৬৬৩২)
(وَاللہُ عِنْدَھ۫ٓ اَجْرٌ عَظِیْمٌ)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধন-মাল, সন্তান-সন্ততির ভালবাসার মোকাবেলায় আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয় এবং তাঁর অবাধ্য হয় না তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতবাসীদেরকে বলবেন, হে জান্নাতবাসী! তারা বলবে : হে প্রভু আমরা হাযির। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : তোমরা কি সন্তুষ্ট? তারা বলবে : কেন আমরা সন্তুষ্ট হব না অথচ আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা আপনার কোন সৃষ্টিকে দেননি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : তোমাদেরকে কি এর চেয়ে উত্তম কিছু দেব? তারা বলবে : হে আমাদের প্রভু! এর চেয়ে উত্তম আর কী? আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : তোমাদের ওপর আমার সন্তুষ্টি অবধারিত হয়ে গেল, আজকের পর আর কোনদিন তোমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হব না। (সহীহ বুখারী হা. ৬৫৪৯, সহীহ মুসলিম হা. ২৮২৯)
(فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ)
অর্থাৎ তোমাদের প্রচেষ্টা ও সামর্থ্যানুপাতে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
فَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ فَاجْتَنِبُوهُ، وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ
আমি যখন তোমাদেরকে কোন কাজ থেকে নিষেধ করি তখন তোমরা তা হতে বিরত থাক, আর যখন আমি তোমাদেরকে কোন কাজের আদেশ দেই তখন সামর্থ্যানুযায়ী তা পালন কর। ( সহীহ বুখারী হা. ৭২৮৮)
কতক মুফাসসির বলেছেন : এ আয়াত সূরা নিসার ১ নম্বর আয়াতকে রহিত করে দিয়েছে। (ইবনু কাসীর)।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : না, সূরা নিসার ১ নম্বর আয়াতকে রহিত করেনি, বরং আল্লাহ তা‘আলাকে যথার্থ ভয় করার অর্থ হল তাঁর পথে যেমন প্রচেষ্টা করা উচিত তেমন প্রচেষ্টা করা। আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বাস্তবায়নে যেন কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় না করে। সর্বত্র ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে যদিও তা নিজের, বাপ-দাদা ও সন্তানাদির বিরুদ্ধে হয় (কুরতুবী)।
(وَاسْمَعُوْا وَأَطِيْعُوْا)
‘শোন ও আনুগত্য কর’ অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথাগুলোকে মনযোগসহ ও আমল করার উদ্দেশ্যে শোন। কেননা কেবল শুনে উপকারে আসবে না যতক্ষণ না আমল করা হবে।
(وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِه۪)
‘যারা অন্তরের কার্পণ্য হতে মুক্ত’ এ সম্পর্কে সূরা হাশরে আলোচনা করা হয়েছে।
(قَرْضًا حَسَنًا) অর্থাৎ হালাল পথে উপার্জিত বস্তু যা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে ব্যয় করা হয়। সেটাই হল করযে হাসানাহ। যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুটির জন্য কোন ব্যক্তিকে প্রদান করবে তখন আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিদান বৃদ্ধি করে দেন। এ সম্পর্কে সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. অনেক স্ত্রী-সন্তান স্বামী-পিতামাতার জন্য শত্রু। তাই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার।
২. যারা অন্যায় করবে তাদেরকে ক্ষমা ও দয়া করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
৩. শরীয়তের পালনীয় নির্দেশাবলী যথাসম্ভব পালন করা উচিত, কিন্তু নিষেধাজ্ঞা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা আবশ্যক।
৪. কৃপণতা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করার ফযীলত জানলাম।
৫. গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন।
১১-১৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১১-১৩ নং আয়াতের তাফসীর
সূরায়ে হাদীদেও এ বিষয়টি গত হয়েছে যে, যা কিছু হয় তা আল্লাহর হুকুমেই হয়। তাঁর ইচ্ছা ও নির্ধারণ ছাড়া কিছুই হয় না। এখন কোন লোকের উপর কোন বিপদ আপতিত হলে তার এটা বিশ্বাস করা উচিত যে, এ বিপদ আল্লাহর ফায়সালা ও নির্ধারণক্রমেই আপতিত হয়েছে। সুতরাং তার উচিত ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর মর্জির উপর স্থির থাকা। আর সে যেন পুণ্য ও কল্যাণের আশা রাখে। সে যেন আল্লাহর ফায়সালাকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়। তাহলে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তার অন্তরে হিদায়াত দান করবেন। সে তখন সঠিক বিশ্বাসের ঔজ্জ্বল্য স্বীয় অন্তরে দেখতে পাবে। আবার কোন কোন সময় এমনও হয় যে, ঐ বিপদের বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতেই অফুরন্ত কল্যাণ দান করে থাকেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, তার ঈমান দৃঢ় হয়ে যায়। সে বিশ্বাস রাখে যে, যে বিপদ তার উপর আপতিত হয়েছে তা আপতিত হওয়ারই ছিল এবং যা আপতিত হয়নি তা হওয়ারই ছিল না।
হযরত আলকামা (রাঃ)-এর সামনে এ আয়াতটি পাঠ করা হয় এবং তাঁকে এর ভাবার্থ জিজ্ঞেস করা হয়। তখন তিনি বলেনঃ “এর দ্বারা ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যে প্রত্যেক বিপদের সময় এই বিশ্বাস রাখে যে, ঐ বিপদ আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছে। অতঃপর সন্তুষ্ট চিত্তে সে তা সহ্য করে।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) ও হযরত মুকাতিল ইবনে হিব্বান (রঃ) বলেনঃ এর ভাবার্থ এই যে, সে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করে।
‘মুত্তাফাকুন আলাইহি’ এর হাদীসে রয়েছেঃ মু’মিনের জন্যে বিস্মিত হতে হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলা তার জন্যে যে ফায়সালাই করেন তা তার জন্যে কল্যাণকরই হয়ে থাকে। তার উপর কোন বিপদ আপতিত হলে সে সবর করে, সুতরাং তা হয় তার জন্যে কল্যাণকর। আবার তার জন্যে আনন্দদায়ক কোন ব্যাপার ঘটলে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং সেটাও হয় তার জন্যে কল্যাণকর। এটা মু’মিন ছাড়া আর কারো জন্যে নয়।”
হযরত উবাদাহ্ ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে এসে বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন্ আমল সর্বোত্তম?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আল্লাহ্ উপর ঈমান আনা, তাঁর সত্যতা বিশ্বাস করা এবং তাঁর পথে জিহাদ করা।” লোকটি বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) আমি এর চেয়ে কোন সহজ আমল কামনা করছি।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “তোমার ভাগ্যে যে ফায়সালা করে দেয়া হয়েছে ঐ ব্যাপারে তুমি আল্লাহকে তিরস্কার বা নিন্দে করবে না (বরং তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে)।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য কর। অর্থাৎ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ) যা করার আদেশ করেছেন তা পালন কর এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকো।
অতঃপর প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ্ বলেনঃ যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, (তবে জেনে রেখো যে,) আমার রাসূল (সঃ)-এর দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে প্রচার করা। অর্থাৎ যদি তোমরা মান্য না কর তবে তোমাদের আমলের জন্যে আল্লাহর রাসূল (সঃ) মোটেই দায়ী হবেন না। তাঁর দায়িত্ব তো শুধু স্পষ্টভাবে প্রচার করে দেয়া এবং তাঁর এ দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন। এখন তোমাদের দুষ্কর্মের শাস্তি তোমাদেরকেই ভোগ করতে হবে।
এরপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই, সুতরাং মু’মিনরা যেন আল্লাহর উপরই নির্ভর করে। প্রথম বাক্যে তাওহীদের খবর দেয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো তলব, অর্থাৎ আল্লাহর তাওহীদকে মেনে নাও এবং ইখলাসের সাথে শুধু তাঁরই ইবাদত কর।
যেহেতু নির্ভরযোগ্য একমাত্র আল্লাহ্ সেই হেতু মু’মিনদের উচিত একমাত্র তাঁরই উপর নির্ভর করা। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের অধিকর্তা, তিনি ব্যতীত কোন মা’বূদ নেই, অতএব তাঁকেই গ্রহণ কর কর্ম বিধায়করূপে।” (৭৩:৯)
১৪-১৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ্ তা’আলা স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেনঃ কতক স্ত্রী তাদের স্বামীদেরকে এবং কতক সন্তান তাদের পিতা-মাতাদেরকে আল্লাহ্ স্মরণ ও নেক আমল হতে দূরে সরিয়ে রাখে যা প্রকৃতপক্ষে শক্রতাই বটে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে। যারা উদাসীন হবে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (৬৩:৯)
এখানেও আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ তোমরা তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। দ্বীনের রক্ষণাবেক্ষণকে তাদের প্রয়োজন ও ফরমায়েশ পূর্ণ করার উপর প্রাধান্য দিবে। মানুষ স্ত্রী, ছেলে মেয়ে এবং মাল-ধনের খাতিরে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে এবং আল্লাহর নাফরমানী করে বসে। তাদের প্রেমে পড়ে আহকামে ইলাহীকে পৃষ্ঠের পিছনে নিক্ষেপ করে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, মক্কাবাসী কতক লোক ইসলাম কবূল করে নিয়েছিল, কিন্তু স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রেমে পড়ে হিজরত করেনি। অতঃপর যখন ইসলামের খুব বেশী প্রকাশ ঘটে তখন তারা হিজরত করে আল্লাহর নবী (সঃ)-এর নিকট চলে যায়। গিয়ে দেখে যে, যাঁরা পূর্বে হিজরত করেছিলেন তাঁরা বহু কিছুর জ্ঞান লাভ করেছেন। তখন এই লোকদের মনে হলো যে, তারা তাদের সন্তান-সন্ততিকে শাস্তি প্রদান করবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করলেনঃ তোমরা যদি তাদেরকে মার্জনা কর, তাদের দোষ-ক্রটি উপেক্ষা কর এবং তাদেরকে ক্ষমা কর তবে জেনে রেখো যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। অর্থাৎ এখন তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদেরকে ক্ষমা করে দাও, ভবিষ্যতের জন্যে সতর্ক থাকবে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্যে পরীক্ষা, আল্লাহরই নিকট রয়েছে মহাপুরস্কার।’ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন যে, এগুলো পেয়ে কে নাফরমানীতে জড়িয়ে পড়ছে এবং কে আনুগত্য করছে। আল্লাহ তা’আলার নিকট যে মহাপুরস্কার রয়েছে সেদিকে মানুষের খেয়াল রাখা উচিত। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণ রৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি, মানুষের নিকট মনোরম করা হয়েছে। এই সব ইহজীবনের ভোগ্যবস্তু। আর আল্লাহ্, তাঁর নিকট উত্তম আশ্রয়স্থল।” (৩:১৪) আরো, যা এর পরে রয়েছে।
হযরত আবূ বুরাইদাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) খুৎবাহ দিচ্ছিলেন এমন সময় হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ) লম্বা লম্বা জামা পরিহিত হয়ে এসে পড়লেন। তাঁরা জামার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে বাধা লেগে লেগে পড়ছিলেন ও উঠছিলেন, এই ভাবে আসছিলেন। তাঁরা তো তখন শিশু! জামাগুলো লাল রঙএর ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর দৃষ্টি তাঁদের উপর পড়া মাত্রই তিনি মিম্বর হতে নেমে গিয়ে তাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে আসলেন এবং নিজের সামনে বসিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি বলতে লাগলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা সত্য বলেছেন এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-ও সত্য কথা বলেছেন, তা হলোঃ “তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্যে পরীক্ষা।” এই দুই শিশুকে পড়ে উঠে আসতে দেখে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। তাই খুৎবাহ ছেড়ে এদেরকে উঠিয়ে নিয়ে আসতে হলো। (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটি হাসান গারীব বলেছেন)
হযরত আশআস ইবনে কায়েস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “কিনদাহ গোত্রের প্রতিনিধি দলের মধ্যে শামিল হয়ে আমিও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার সন্তান-সন্ততি আছে কি?” আমি উত্তরে বললামঃ জ্বী হ্যাঁ, আপনার খিদমতে হাযির হওয়ার উদ্দেশ্যে বের হবার সময় আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। যদি তার স্থলে একটি বন্য জন্তু হতো তবে ওটাই আমার জন্যে ভাল ছিল। তিনি একথা শুনে বললেনঃ “না, না, এরূপ কথা বলো না। এরাই হলো চক্ষু ঠাণ্ডাকারী এবং এরা মারা গেলেও পুণ্য রয়েছে। তারপর তিনি বললেনঃ “তবে হ্যাঁ, এরা আবার ভীরুতা ও দুঃখেরও কারণ হয়ে থাকে।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সন্তান অন্তরের ফল বটে, কিন্তু আবার সন্তানই কাপুরুষতা, কৃপণতা ও দুঃখেরও কারণ হয়।” (এ হাদীসটি হাফিয আবূ বকর আল বায্যার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবূ মালিক আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “শুধু ঐ ব্যক্তি তোমার শত্রু নয় যে, (সে কাফির বলে) তুমি (যুদ্ধে) তাকে হত্যা কর তবে ওটা হবে তোমার জন্যে সফলতা, আর যদি তুমি নিহত হও তবে তুমি জান্নাতে প্রবেশ করবে। বরং সম্ভবতঃ তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তোমার সন্তান, যে তোমার পৃষ্ঠ হতে বের হয়েছে। অতঃপর তোমার আর একটি চরম শত্রু হলো তোমার মাল, যার মালিক হয়েছে তোমার দক্ষিণ হস্ত। [এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তিবরানী (রঃ)]
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ “তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর।’ অর্থাৎ তোমরা তোমাদের শক্তি ও সাধ্য অনুযায়ী আল্লাহকে ভয় কর। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি যখন তোমাদেরকে কোন আদেশ করবো তখন তোমরা যথাসাধ্য তা পালন করবে এবং যখন নিষেধ করবো (কোন কিছু হতে) তখন তা হতে বিরত থাকবে।”
কোন কোন মুফাসসির বলেছেন যে, এই আয়াতটি সূরায়ে আলে ইমরানের নিম্নের আয়াতটিকে রহিতকারীঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণ না করে কোন অবস্থায় মরো না।” (৩:১০২) অর্থাৎ প্রথমে বলেছিলেনঃ “তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর। আর পরে বললেনঃ ‘তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর।
হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) বলেছেন, প্রথম আয়াতটি জনগণের কাছে খুবই কঠিন ঠেকেছিল। তাঁরা নামাযে এতো দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁদের পা ফুলে যেতো। আর তাঁরা সিজদায় এতো দীর্ঘক্ষণ ধরে পড়ে থাকতেন যে, তাঁদের কপালে ক্ষত হয়ে যেতো। তখন আল্লাহ তা’আলা এই দ্বিতীয় আয়াতটি নাযিল করে তাঁদের উপর হালকা করে দিলেন। আরো কিছু মুফাসসিরও একথাই বলেছেন যে, প্রথম আয়াতটি মানসূখ এবং দ্বিতীয় আয়াতটি নাসেখ।
অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর অনুগত হয়ে যাও। তাদের আনুগত্য হতে এক ইঞ্চি পরিমাণও এদিক ওদিক হয়ো না। আগেও বেড়ে যেয়ো না এবং পিছনেও সরে এসো না। আর আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে যা দিয়ে রেখেছেন তা হতে তোমাদের আত্মীয়-স্বজনকে ফকীর-মিসকীন ও অভাবগ্রস্তদেরকে দান করতে থাকো। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি যে ইহসান করেছেন ঐ ইহসান তোমরা তাঁর সৃষ্টজীবের প্রতি করে যাও। তাহলে এটা হবে তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর যদি এটা না কর তবে দুনিয়ার ধ্বংস তোমরা নিজেরাই নিজেদের হাতে টেনে আনবে। (আরবি) এর তাফসীর সূরায়ে হাশরের এই আয়াতে গত হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর তবে তিনি তোমাদের জন্যে ওটা বহুগুণ বৃদ্ধি করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। অর্থাৎ তোমাদের দরিদ্র ও অভাগ্রস্তদের উপর খরচ করাই হলো আল্লাহ তা’আলাকে উত্তম ঋণ দেয়া। সূরায়ে বাকারাতেও এটা গত হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। অর্থাৎ তোমাদের অপরাধসমূহ তিনি মার্জনা করবেন। এ জন্যেই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা এখানে বলেনঃ আল্লাহ গুণগ্রাহী অর্থাৎ তিনি অল্প সকাজের বেশী পুণ্য দান করেন এবং তিনি সহনশীল অর্থাৎ তিনি পাপ ও অপরাধসমূহ ক্ষমা করে থাকেন এবং স্বীয় বান্দাদের পাপ দেখেও দেখেন না। অর্থাৎ ক্ষমার চক্ষে দেখেন। তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। এর তাফসীর ইতিপূর্বে কয়েকবার গত হয়েছে।