أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৭০/হে মুমিনগণ!:-৯০ ও ৯১)
[* আল্লাহ যে জিনিস হালাল করেছেন তা তুমি হারাম করছো কেন?
*হে মুমিনগণ ! তোমারা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর আগুন থেকে:-
*হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কার, আন্তরিক তাওবা:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম
পারা:২৮
১-৮ নং আয়াত:-
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম:-১
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَاۤ اَحَلَّ اللّٰہُ لَکَ ۚ تَبۡتَغِیۡ مَرۡضَاتَ اَزۡوَاجِکَ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱﴾
হে নবী! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন, তুমি তা অবৈধ করছ কেন?[ষ তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাচ্ছ? আর আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম:-২
قَدۡ فَرَضَ اللّٰہُ لَکُمۡ تَحِلَّۃَ اَیۡمَانِکُمۡ ۚ وَ اللّٰہُ مَوۡلٰىکُمۡ ۚ وَ ہُوَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۲﴾
আল্লাহ তোমাদের জন্য কসমের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পন্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক এবং তিনি মহাজ্ঞানী ও মহা কৌশলী।
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম:-৩
وَ اِذۡ اَسَرَّ النَّبِیُّ اِلٰی بَعۡضِ اَزۡوَاجِہٖ حَدِیۡثًا ۚ فَلَمَّا نَبَّاَتۡ بِہٖ وَ اَظۡہَرَہُ اللّٰہُ عَلَیۡہِ عَرَّفَ بَعۡضَہٗ وَ اَعۡرَضَ عَنۡۢ بَعۡضٍ ۚ فَلَمَّا نَبَّاَہَا بِہٖ قَالَتۡ مَنۡ اَنۡۢبَاَکَ ہٰذَا ؕ قَالَ نَبَّاَنِیَ الۡعَلِیۡمُ الۡخَبِیۡرُ ﴿۳﴾
(এ ব্যাপারটিও লক্ষণীয় যে,) নবী তাঁর এক স্ত্রীকে গোপনে একটি কথা বলেছিলেন। পরে সেই স্ত্রী যখন (অন্য কারো কাছে) সেই গোপনীয় বিষয়টি প্রকাশ করে দিল এবং আল্লাহ নবীকে এই (গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করার) ব্যাপারটি জানিয়ে দিলেন তখন নবী (ঐ স্ত্রীকে) কিছুটা সাবধান করলেন এবং কিছুটা মাফ করে দিলেন। নবী যখন তাকে (গোপনীয়তা প্রকাশের) এই কথা জানালেন তখন সে জিজ্ঞেস করলোঃ কে আপনাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছে? নবী বললেনঃ আমাকে তিনি অবহিত করেছেন যিনি সবকিছু জানেন এবং সর্বাধিক অবহিত।
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম:-৪
اِنۡ تَتُوۡبَاۤ اِلَی اللّٰہِ فَقَدۡ صَغَتۡ قُلُوۡبُکُمَا ۚ وَ اِنۡ تَظٰہَرَا عَلَیۡہِ فَاِنَّ اللّٰہَ ہُوَ مَوۡلٰىہُ وَ جِبۡرِیۡلُ وَ صَالِحُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ۚ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ بَعۡدَ ذٰلِکَ ظَہِیۡرٌ ﴿۴﴾
তোমরা দু’জন যদি আল্লাহর কাছে তাওবা করো (তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম), কেননা, তোমাদের মন সরল সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে৭ আর যদি তোমরা নবীর বিরুদ্ধে পরস্পর সংঘবদ্ধ হও৮ তা হলে জেনে রাখো, আল্লাহ তার অভিভাবক, তাছাড়া জিবরাঈল, নেক্কার ঈমানদারগণ এবং সব ফেরেশতা তার সাথী ও সাহায্যকারী।
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম:-৫
عَسٰی رَبُّہٗۤ اِنۡ طَلَّقَکُنَّ اَنۡ یُّبۡدِلَہٗۤ اَزۡوَاجًا خَیۡرًا مِّنۡکُنَّ مُسۡلِمٰتٍ مُّؤۡمِنٰتٍ قٰنِتٰتٍ تٰٓئِبٰتٍ عٰبِدٰتٍ سٰٓئِحٰتٍ ثَیِّبٰتٍ وَّ اَبۡکَارًا ﴿۵﴾
নবী যদি তোমাদের মত সব স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন তাহলে অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের পরিবর্তে তাঁকে এমন সব স্ত্রী দান করবেন যারা তোমাদের চেয়ে উত্তম হবে।১০ সত্যিকার মুসলমান, ঈমানদার,১১ অনুগত, ১২ তাওবাকারিনী,১৩ ইবাদাত গোজার১৪ এবং রোযাদার।১৫ তারা পূর্বে বিবাহিত বা কুমারী যাই হোক না কেন।
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম:-৬
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ اَہۡلِیۡکُمۡ نَارًا وَّ قُوۡدُہَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ عَلَیۡہَا مَلٰٓئِکَۃٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا یَعۡصُوۡنَ اللّٰہَ مَاۤ اَمَرَہُمۡ وَ یَفۡعَلُوۡنَ مَا یُؤۡمَرُوۡنَ ﴿۶﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততিকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো মানুষ এবং পাথর হবে যার জ্বালানী। সেখানে রুঢ় স্বভাব ও কঠোর হৃদয় ফেরেশতারা নিয়োজিত থাকবে যারা কখনো আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না এবং তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে।
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম:-৭
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَا تَعۡتَذِرُوا الۡیَوۡمَ ؕ اِنَّمَا تُجۡزَوۡنَ مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ٪﴿۷﴾
হে কাফেরগণ! আজ ওযর প্রকাশ করো না। তোমরা যেমন আমল করছিলে তেমনটি প্রতিদানই দেয়া হচ্ছে।
সুরা: ৬৬: আত্-তাহরীম:-৮
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ تَوۡبَۃً نَّصُوۡحًا ؕ عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یُّکَفِّرَ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ یُدۡخِلَکُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ۙ یَوۡمَ لَا یُخۡزِی اللّٰہُ النَّبِیَّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَہٗ ۚ نُوۡرُہُمۡ یَسۡعٰی بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ بِاَیۡمَانِہِمۡ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَتۡمِمۡ لَنَا نُوۡرَنَا وَ اغۡفِرۡ لَنَا ۚ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۸﴾
হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কার—বিশুদ্ধ তাওবা ; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না নবীকে এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।’
১-৮ নং আয়তের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
ফী জিলালিল কুরআন: সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আল্লাহ তায়ালা যখন ইসলামকে সমগ্র মানব জাতির সর্বশেষ ও বিজয়ী জীবন ব্যবস্থা হিসাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন একে তিনি পূর্ণাংগ ও সর্বব্যাপী জীবন ব্যবস্থায় পরিণত করলেন, তাকে মানুষের যাবতীয় শক্তি, ক্ষমতা, যােগ্যতা ও প্রতিভার পরিপূরক বানালেন এবং সেই সাথে পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফার জন্যে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক সম্মানিত সৃষ্টির জন্যে যে ধরনের, যে পর্যায়ের ও যে মানের যোগ্যতা এবং প্রতিভা আবশ্যক, সেই ধরনের যােগ্যতা ও প্রতিভা মানুষকে দান করলেন। শুধু তাই নয়, ইসলামকে তিনি স্বাভাবিকভাবে জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার যােগ্যতা দান করলেন, তাকে একই সাথে পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও উচ্চতা দান করলেন। কোনাে গঠনমূলক শক্তিকে তিনি নিষ্ক্রিয় করেননি এবং কোনাে কার্যকর যােগ্যতাকে তিনি দমন করেননি। তিনি বরঞ্চ সকল শক্তি ও ক্ষমতাকে সক্রিয় করেছেন এবং সকল সুপ্ত যােগ্যতা ও প্রতিভাকে জাগ্রত করেছেন। সেই সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়া ও উর্ধে উন্নীত হওয়ার যােগ্যতার মাঝে সমন্বয় সাধন ও ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। আর এ কাজ এমন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছেন, যাতে পার্থিব জীবনে অবস্থান করেই আত্মা আখেরাতের সুখ সম্ভোগের যােগ্যতা অর্জন করে এবং নশ্বর পৃথিবীতে বসেই পারলৌকিক জগতের অবিনশ্বর জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা যখন তার নাযিল করা জীবন ব্যবস্থাকে এরূপ বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত করার ফয়সালা করলেন, তখন তিনি নিজের রসূল হিসাবেও এমন একজন মানুষকে মনােনীত করার সিদ্ধান্ত নিলেন যিনি এই জীবন ব্যবস্থার যাবতীয় গুণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ও মূর্ত প্রতীক। যাঁর মধ্যে সকল মানবীয় ক্ষমতা ও প্রতিভা পূর্ণতা লাভ করেছে, যার শারীরিক গঠন সুদৃঢ় ও নিখুঁত, যার চেতনা সদা জাগ্রত, যার অনুভূতি নির্ভুল এবং যিনি সকল অনুভবযােগ্য জিনিসকে সুষ্ঠুভাবে ও পূর্ণাংগভাবে অনুভব করেন। একই সাথে যিনি প্রগাঢ় দয়া, সহানুভূতি, স্নেহ, মমতা ও ভালােবাসার অধিকারী, যিনি অত্যন্ত জীবন্ত ও সরস মেজাজের অধিকারী, তীব্র সংবেদনশীল, সৌন্দর্যবােধসম্পন্ন, উদার ও দৃঢ়চেতা, যিনি আপন প্রবৃত্তির গােলামী করার পরিবর্তে প্রবৃত্তির ওপর প্রভুত্ব করেন, তাকে বশে রাখেন। সর্বোপরি যিনি এমন একজন নবী, যার অন্তরাত্মা মহাজাগতিক জ্যোতিতে উদ্ভাসিত, যার হৃদয় মেরাজের শক্তিতে শক্তিমান, আকাশ থেকে যাকে সম্বােধন করা হয়, যিনি মহান আল্লাহর জ্যোতি দেখতে পান এবং বাহ্যিক আকৃতিসমূহের আড়াল থেকে যার স্বভাব বিশ্ব চরাচরের অন্যান্য বস্তুর স্বভাবের সাথে একাকার হয়ে যায়, ফলে পাথরও তাঁকে সালাম করে, খেজুরের মৃত ডালও তাঁর কাছে কাদে এবং তার পায়ের তলে পড়ে ওহুদ পর্বতও কাঁপে। অতপর তার সত্তায় এই সকল শক্তি ভারসাম্যপূর্ণভাবে অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে তার সত্তা ঠিক সেই আদর্শের ন্যায় ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে যায়, যে আদর্শ তার জন্যে মনােনীত করা হয়েছে। অতপর আল্লাহ তায়ালা তার এই রসূলের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে তার উম্মত এবং সমগ্র মানব জাতির জন্যে একটা উন্মুক্ত গ্রন্থে পরিণত করেছেন। এই উন্মুক্ত গ্রন্থে উক্ত আদর্শের আকৃতি ও তার বাস্তব প্রয়ােগ দেখতে পাওয়া যায়। তাই রসূলের জীবনে তিনি কোনাে গুপ্ত রহস্য লুকায়িত রাখেননি; বরং তার বিভিন্ন দিক তিনি কোরআনে তুলে ধরেন। সাধারণ মানুষের জীবনে যেসব জিনিস সচরাচর পরস্পর থেকে লুকিয়ে রাখা হয়, তাও প্রকাশ করে দেন। এমনকি মানবীয় দুর্বলতার সেই দিকগুলােও আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ করে দেন, যা নিয়ে অন্য মানুষ ঘাটাঘাটি করার কোন প্রয়ােজন বােধ করে না। তথাপি আল্লাহর রাসূলের জীবনের এসব দিক জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার ইচ্ছাটাই যেন পরিলক্ষিত হয় কোরআনের বিভিন্ন সূরায়। আসলে রসুলের ব্যক্তিত্বে কোনাে গােপনীয় জিনিসই নেই। তাঁর গােটা জীবন, গােটা সত্ত্বা, গোটা ব্যক্তিত্ব তাদের ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলনের জন্যে। সুতরাং তার জীবনের একটা দিক তিনি কেনই বা লুকিয়ে রাখবেন, আর কেনই বা তা লুকিয়ে থাকবে? রসূলের জীবন হচ্ছে ইসলামী আকীদা ও আদর্শ বাস্তবায়নের নিকটতম দৃশ্যমান ক্ষেত্র। তিনি পৃথিবীতে এসেছেনই এজন্যে যে, নিজের সত্ত্বায় ও জীবনে এই আদর্শ প্রয়ােগ করে দেখিয়ে দেবেন, যেমন তিনি নিজের কথা ও নির্দেশাবলীর মাধ্যমে তা প্রচার করে থাকেন। এটাই ছিলাে রসূলের আগমন ও আবির্ভাবের উদ্দেশ্য। রাসূল(স.)-এর সাহাবীদের আল্লাহ তায়ালা এজন্যে উত্তম পুরস্কার দান করেন যে, তারা রসূলের জীবনের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম খুঁটিনাটি ঘটনাবলী শুধু সংরক্ষণই করেননি; বরং অনাগতকালের মানব জাতির কাছেও তা পৌছিয়ে দিয়েছেন ও হস্তান্তর করেছেন। ফলে রসূল(স.)-এর দৈনন্দিন জীবনের ছােট-বড় কোনাে ঘটনাই লিপিবদ্ধ হওয়া ও হস্তান্তরিত হওয়া থেকে বাদ পড়েনি। রসূল(স.)-এর জীবন বা রাসূলের জীবনে ইসলামী আদর্শের সকল খুঁটিনাটি বাস্তবায়ন এভাবে লিপিবদ্ধ করা আল্লাহর গৃহীত সিদ্ধান্তেরই একটা অংশ ছিলাে। তাই বলা যায়, কোরআনে ও হাদীসে রসূলের জীবনের যতােটুকু লিপিবদ্ধ হয়েছে তা সার্বিকভাবে সমগ্র মানব জাতির জন্যে এক অনন্য ও চিরস্থায়ী সম্পদ। এ সম্পদ কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকবে। আলােচ্য সূরার শুরুতে রাসূল(স.)-এর ঘরােয়া জীবনের একটি অংশ তার মহান সহধর্মিণীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের সাথে স্বয়ং রসূল(স.)-এর পারস্পরিক সম্পর্কের কিছু উত্তেজনাপূর্ণ দিক এবং রসূলের ও মুসলিম জাতির জীবনে এসব উত্তেজনার প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। অধিকন্তু রাসূল(স.)-এর ঘরােয়া জীবনে ও তার স্ত্রীদের মধ্যে সংঘটিত ঘটনাবলীর আলােকে মুসলিম জাতিকে প্রদত্ত সাধারণ নির্দেশাবলীতেও তার যে প্রতিফলন ঘটেছে, তাও এই সূরায় আলােচিত হয়েছে। এই সূরায় যে ঘটনাবলীর প্রতি ইংগিত দেয়া হয়েছে, তার সঠিক সময়কাল নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তবে এ সংক্রান্ত রেওয়ায়াতসমূহ সমূহ পর্যালোচনা করলে অন্তত এটুকু নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, এসব ঘটনা ঘটেছে যয়নব বিনতে জাহশের সাথে রসূল(স.)-এর বিয়ে হওয়ার পর। এই প্রসংগে রসূল(স.)-এর স্ত্রীদের ঘটনাবলী ও তার ঘরােয়া জীবনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলে তা এই সূরায় বর্ণিত উক্ত ঘটনাবলী সংক্রান্ত উক্তিসমূহ উপলব্ধি করতে সহায়ক হবে। এই সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরার ব্যাপারে আমি ইমাম ইবনে হাযমের গ্রন্থ জাওয়ামেউস্ সীরাহ ও ইবনে হিশাম প্রণীত সীরাত সংক্রান্ত গ্রন্থের ওপর নির্ভর করেছি। তবে উদ্ধৃতির মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত মন্তব্যও করেছি। রসূল(স.)-এর প্রথমা স্ত্রী হচ্ছেন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ(রা.)। তাঁর সাথে রসূল(স.)-এর বিয়ে হয় রসূলের বয়স যখন ২৫ (মতান্তরে ২৩ বছর)। খাদীজার বয়স তখন ৪০ বছর বা তারও বেশী। তিনি হিজরতের তিন বছর আগে ইন্তেকাল করেন। তার জীবদ্দশায় রসূল(স.) আর কাউকে বিয়ে করেননি। মৃত্যুকালে খাদীজার বয়স ৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে। খাদীজা(রা.)-এর ইন্তেকালের পর রসূল(স.) সওদা বিনতে যামআকে বিয়ে করেন। তিনি তেমন রূপবতীও ছিলেন না, বয়সের যুবতী ছিলেন না। তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী ও সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম সাকরাত বিন আমরের স্ত্রী ছিলেন এবং স্বামীর ইন্তেকালের পর বিধবা অবস্থায় তার সাথে রসূল(স.)-এর বিয়ে হয়। এরপর হযরত আবু বকর সিদ্দীক(রা.)-এর কন্যা আয়েশাকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্কা। তাই হিজরতের পরে ছাড়া তার সাথে রসূল(স.) দাম্পত্য জীবন শুরু করেননি। রসূলের স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র কুমারী এবং অন্য সকল স্ত্রী অপেক্ষা তাকেই তিনি বেশী ভালােবাসতেন। বর্ণিত আছে যে, বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিলাে ৯ বহুর এবং রসূল(স.)-এর সাথে তিনি দাম্পত্য জীবন কাটান ৯ বছর ৫ মাস। এরপর রসূল(স.) ইন্তেকাল করেন। এরপর রসূল(স.) বিয়ে করেন হযরত ওমরের কন্যা হাফসাকে। তিনি কুমারী ছিলেন না। হযরত ওমর প্রথমে তাকে আবু বকর ও পরে ওসমানের সাথে বিয়ে দিতে ছিয়েছিলেন, কিন্তু তারা উভয়ে অসম্মতি জানান। এ সময় রসূল(স.) ওমরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তাঁর মেয়ের জন্যে তিনি আবু বকর ও ওসমানের চেয়েও উত্তম বর জুটিয়ে দেবেন। অতপর তিনি নিজেই তাকে বিয়ে করেন। এরপর তিনি বিয়ে করেন যয়নব বিনতে খুযায়মাকে। তার প্রথম স্বামী হারেস বিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্র ওবায়দা বদর যুদ্ধে নিহত হয়। তিনি রসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় মারা যান। কারাে কারাে মতে, রাসূল(স.)-এর পূর্বে তাঁর স্বামী ছিলেন আবদুল্লাহ বিনতে জাহশ আল আসাদ যিনি ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হন। সম্ভবত এটি সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য তথ্য। ওহুদ যুদ্ধে আহত ও পরে সে কারণে শাহাদাত বরণকারী আবু সালামার বিধবা স্ত্রী উম্মে সালামা ও রাসূল(সা.) বিয়ে করেন। তিনি আবু সালামা পরিত্যক্ত সন্তানদেরও নিজ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। আপন ফুফাতাে বােন পরমা সুন্দরী জয়নব বিনতে জাহশ কে রাসূল(স.) বিয়ে করেন। ইতিপূর্বে তিনি তাকে নিজের মুক্ত গোলাম ও পালক পুত্র যায়দ বিন হারেসার সাথে বিয়ে দেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় যায়দ তাকে তালাক দেন। ২২তম পারায় সূরা আহযাবে আমি তার ঘটনা বর্ণনা করেছি। এই মহিলা রসূল(স.)-এর নিকটাত্মীয় ও পরমা সুন্দরী ছিলেন বিধায় হযরত আয়েশা তাঁকে নিজের কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন। অতপর তিনি হিজরী ৬ষ্ঠ সালের মাঝামাঝির দিকে বনুল মুস্তালিকের যুদ্ধের পর পরাজিত ইহুদী গােত্র বনুল মুস্তালিকের সর্দার হারেসের কন্যা জুয়ায়রিয়াকে বিয়ে করেন। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে হযরত আয়েশা বলেন, রাসূল(স.) যখন বনুল মুস্তালিকের যুদ্ধবন্দীদের সাহাবীদের মধ্যে বন্টন করেন, তখন জুয়ায়রিয়া সাবেত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস অথবা তার এক চাচাতাে ভাইয়ের ভাগে পড়েন। জুয়ায়রিয়া তার মনিবের কাছ থেকে মুক্তিপণের বিনিময়ে নিজের মুক্তির পক্ষে সম্মতি আদায় করেন। রূপে গুণে অসাধারণ এই মহিলাকে যেই দেখতাে, সেই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে যেতাে। তিনি নিজের মুক্তির জন্যে মুক্তিপণ সংগ্রহে সাহায্য চাইতে রসূল(স.)-এর কাছে আসেন। হযরত আয়েশা বলেন, এই মহিলাকে আমার ঘরের দরজার ওপর দাঁড়ানাে দেখামাত্রই আমি তাকে অবাঞ্ছিত মনে করেছিলাম। ভেবেছিলাম, তার মধ্যে যে চিত্তাকর্ষক রূপ-গুণ আমি দেখছি, রসূল(স.)-ও তা দেখবেন। যা হােক, মহিলা রসূল(স.)-এর সাথে সাক্ষাত করলেন এবং বললেন, হে রসূলুল্লাহ! আমি গােত্রপতি হারেস বিন আবী সেরারের কন্যা। আমি কী বিপদে আছি তা আপনার অজানা নয়। আমি তাে সাবেত বিন কায়সের ভাগে পড়েছিলাম। কিন্তু তাকে আমি মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দিতে সম্মত করেছি। এই মুক্তিপণ সংগ্রহে আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি। রসূল(স.) বললেন, এর চেয়ে উত্তম কোনাে প্রস্তাবে তুমি কি আগ্রহী? তিনি বললেন, সেটি কী? রসূল(স.) বললেন, আমি তােমার মুক্তিপণ দিয়ে দেবাে এবং তােমাকে বিয়ে করবাে। জুয়ায়রিয়া বললেন, হে রসূলুল্লাহ! আমি রাযি। রসূল(স.) বললেন, মুক্তিপণ আমি দিয়ে দিয়েছি। এরপর হােদায়রিয়ার সন্ধির পর রসূল(স.) আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবীবাকে বিয়ে করেন। তিনি মুসলমান হয়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। সেখানে তার স্বামী আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ ইসলাম ত্যাগ করে খৃষ্টান হয়ে যায় ও তাকে ত্যাগ করে। রসূল(স.) তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান এবং আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশী রসূল(স.)-এর পক্ষ থেকে তাকে মােহরানা দিয়ে দেন। অতপর তিনি সেখান থেকে মদীনায় চলে আসেন। খায়বর বিজয়ের পর তিনি বিয়ে করেন বনু নযীরের সর্দার হুওয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা সুফিয়াকে। তিনি ছিলেন কেনানা ইবনে আবিল হাকীকের স্ত্রী। এই ব্যক্তিও বিশিষ্ট ইহুদী নেতা ছিলাে। এই মহিলার সাথে রসূল(স.)-এর বিয়ের পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে ইবনে ইসহাক বলেন, সুফিয়া ও অপর এক যুদ্ধবন্দিনীকে রসূল(স.)-এর কাছে আনা হয়। তারা উভয়ে যখন নিহত একদল লাশের কাছে যাচ্ছিলাে তখন সুফিয়ার সহযাত্রী মহিলাটি মাথায় ধুলাে ছিটিয়ে মুখ চাপড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদা শুরু করলাে। তা দেখে রাসূল(স.) বললেন, ‘তােমরা এই শয়তান মহিলাটিকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও। আর সুফিয়াকে তার পেছনে রাখতে বললেন এবং তার গায়ের ওপর নিজের চাদর রাখলেন। তা দেখে সাহাবীরা বুঝতে পারলেন, রসূল(স.) সুফিয়াকে নিজের জন্যে পছন্দ করেছেন। উক্ত ইহুদী মেয়েটিকে দেখে রাসূল(স.) বেলালকে বললেন, হে বেলাল। এই দুই মহিলার সাথে তুমি যখন তাদের গােত্রের নিহত লােকদের লাশের স্তুপ দেখলে, তখন কি তােমার ভেতর থেকে দয়ামায়া ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলাে? এরপর তিনি বিয়ে করেন মায়মুনা বিনতুল হারেসকে। তিনি খালেদ ইবনুল ওয়ালীদ ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের খালা। রসূল(স.)-এর পূর্বে তার স্বামী ছিলাে আবু রুহম বিন আবদুল উযযা। এই মহিলাই রাসূল(স.)-এর সর্বশেষ স্ত্রী। এভাবে দেখা যায় যে, প্রত্যেক স্ত্রীর সাথে রসূল(স.)-এর বিয়ের পেছনে একটা সুনির্দিষ্ট ঘটনা ও কারণ ছিলাে। যয়নব বিনতে জাহশ ও জুয়ায়রিয়া বিনতুল হারেস ব্যতীত অন্য স্ত্রীরা বয়সে যুবতীও ছিলেন না কিংবা তেমন আকর্ষণীয় রূপবতীও ছিলেন না। হযরত আয়েশা(রা.) রসূল(স.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী ছিলেন। তিনি ছাড়া যে দু’জন স্ত্রী যুবতী ও রূপবতী ছিলেন (যয়নব ও জুয়ায়রিয়া), তাদের নিজেদের পেছনে অন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারণ সক্রিয় ছিলাে। অবশ্য তাদের দু’জনের মধ্যে যে চিত্তাকর্ষক উপাদানটি ছিলাে তা আমি অস্বীকার করছি না। এ ধরনের মানবীয় উপাদানগুলাে গুলো রাসূল(স.)-এর জীবনে যে থাকতে পারে সে কথা অস্বীকার করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। এ সব উপাদান কোনাে দূষণীয় জিনিস নয় যে, রসূল(স.)-এর জীবনে তার উপস্থিতির কথা অস্বীকার করে রসূলের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে, আর রসূলের দুশমনদের জন্যে তার উপস্থিতির অভিযােগ তােলা আনন্দদায়ক হবে। রসূল(স.)-কে তাে মানুষ হিসাবেই মনােনীত করা হয়েছে। তবে উচ্চতর ও মহত্তর মানুষ হিসাবে। বস্তুত তিনি আসলেই উচ্চতর ও মহত্তর মানুষ ছিলেন এবং তাঁর মধ্যে ও তার স্ত্রীদের মধ্যে যাবতীয় মানবীয় ভাবাবেগ মাত্রাভেদে বিদ্যমান ছিলাে। নিজ গৃহে নিজ স্ত্রীদের সাথে তিনি রসূল ও মানুষ হিসাবেই জীবন যাপন করেছেন। এভাবেই তিনি সৃজিত হয়েছেন এবং তাঁকে অকুণ্ঠভাবে একথা বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ‘আমার প্রতিপালক মহা পবিত্র। আমি একজন মানুষ ও রসূল ছাড়া তাে আর কিছু নই।’ স্ত্রীদের থেকে তিনি আনন্দ উপভােগ এবং তাদেরও আনন্দ দিতেন। তার সম্পর্কে হযরত আয়েশা(রা.) বলেন, রসূল(স.) যখন তাঁর স্ত্রীদের কাছে একান্তে মিলিত হতেন, তখন তিনি হতেন সবচেয়ে কোমল, বিনয় ও উদার মানুষ, তিনি থাকতেন সদা হাসিমুখ। তবে তিনি যে তাদের আনন্দ দিতেন এবং আনন্দ পেতেন, সেটা ছিলাে নেহাতই তার হৃদয় থেকে উদ্ভূত, তাঁর সুন্দর স্বভাব ও সদাচারজনিত এবং তার উদার সদয় ও মহৎ আচরণই ছিলাে তার উৎস। তাদের বৈষয়িক জীবনে কিন্তু ভােগবিলাসের চিহ্নমাত্র ছিলাে না; বরং তা ছিলাে অনেকাংশে নিছক মৌলিক প্রয়ােজন পূরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি যখন বিজয়ের পর বিজয় অর্জিত হতে থাকে এবং মুসলমানরা ‘গনীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) এবং ‘ফায়’ (বিনা যুদ্ধে বিজিত অঞ্চলে অধিকৃত সহায় সম্পদ) দ্বারা বিপুলভাবে সমৃদ্ধশালী হয়, তখনাে এরূপ অবস্থা অব্যাহত ছিলাে। ইতিপূর্বে সূরা আহযাবে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলের স্ত্রীরা তার কাছে সংসারের ব্যয়নির্বাহে আরাে একটু প্রশস্ততা ও সচ্ছলতার আবেদন জানিয়েছিলেন, কিন্তু এই আবেদনের ফলে তারা এক অভাবনীয় সংকটে পড়েছিলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের দুটো জিনিসের মধ্য থেকে যে কোনাে একটি গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। একদিকে আল্লাহ তায়ালা তার রসূল ও আখেরাতের সুখ, অপরদিকে পার্থিব ভােগের উপকরণ ও রসূলের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হওয়া, কিন্তু রসূলের সহধর্মিণীরা আল্লাহ তায়ালা, রাসূল ও আখেরাতকেই গ্রহণ করে নেন। তবে রসূল(স.)-এর পরিবারের সেই নবুয়ত-প্রভাবিত পরিবেশে জীবন যাপনের উদ্দেশ্য এটা ছিলাে না যে, তার অথবা তার স্ত্রীদের মন থেকে যাবতীয় মানবীয় আবেগ-অনুভূতির বিলােপ সাধন করতে হবে। বস্তুত এরূপ পরিস্থিতিতে কোনো পরিবারের স্ত্রীদের মধ্যে যে ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনােভাব থাকা স্বাভাবিক, তা তাদের মধ্যেও ছিলাে। ইতিপূর্বে হযরত আয়েশার এ বর্ণনা আমি উদ্ধৃত করেছি যে, জুয়ায়রিয়াকে দেখে তার রূপগুণে রসূলুল্লাহ(স.) মুগ্ধ হয়ে যেতে পারেন এই আশংকায় আয়েশা দেখামাত্রই তাঁর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কার্যতও তার আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়েছিলাে। অনুরূপভাবে, আয়েশা সুফিয়ার সাথে সম্পৃক্ত তার একটি ঘটনাও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, একদিন আমি রসূলুল্লাহ(স.)-কে বললাম, সফিয়ার যা অবস্থা!’ অর্থাৎ তার বেঁটে আকৃতি সম্পর্কে টিপ্পনী কেটেছিলাম। রসূল(স.) বললেন, তুমি এমন একটা কথা বলেছাে, যা সমুদ্রের বিশাল পানিরাশিতে মিশিয়ে দিলেও তা দূষিত হয়ে যাবে।’ হযরত আয়েশা আরাে বর্ণনা করেছেন, সূরা আহযাবের এ আয়াত যখন নাযিল হল, যাতে রসূলের স্ত্রীদের দুটি জিনিসের একটি গ্রহণের আহবান জানানাে হয়েছে, তখন তিনি আল্লাহ, তাঁর রসূল ও আখেরাতকে গ্রহণ করে নিলেন এবং রসূল(স.)-কে অনুরােধ করলেন যেন তিনি যা গ্রহণ করেছেন তার কথা অন্যান্য স্ত্রীকে না জানান। এই অনুরােধের উদ্দেশ্য কি তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। রসূল(স.) বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আমাকে ধিক্কারদাতা হিসাবে পাঠাননি। আমাকে পাঠিয়েছেন সহজভাবে যাবতীয় শিক্ষা দেয়ার জন্যে। কোনাে স্ত্রী যদি আমার কাছে জিজ্ঞাসা করে যে, তুমি কোনটি গ্রহণ করেছো, তাহলে আমি তাকে এই খবরটি জানিয়ে দেবাে। নিজের সম্পর্কে বর্ণিত হযরত আয়েশার এই বর্ণনাগুলো তাঁর অন্তর্নিহিত সত্যনিষ্ঠা ও ইসলামী শিক্ষার প্রেরণা থেকে উদ্ভূত। এগুলাে অন্যান্য মহিলাদের জন্যেও দৃষ্টান্ত স্বরূপ এবং এরূপ আদর্শ পারিবারিক জীবনেও যে মানবিক পরিবেশ অনিবার্যভাবে বিরাজ করে তা ফুটিয়ে তােলে। এ বর্ণনাগুলো থেকে আরাে জানা যায় যে, রাসূল(স.) তার উম্মতকে যেমন ইসলামের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে রেসালাতের দায়িত্ব পালন করতেন, তিনি তার পরিবারেও তদ্রুপ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে রেসালাতের দায়িত্ব পালন করতেন। যে ঘটনা উপলক্ষে সূরা তাহরীমের প্রথমাংশ নাযিল হয়েছে, তা রসূল(স.) ও তাঁর স্ত্রীদের জীবনে সংঘটিত বহু সংখ্যক ঘটনার অন্যতম। এ ঘটনা সম্পর্কে একাধিক রেওয়ায়াত বর্ণিত আছে, আমি সূরার তাফসীরে যথাস্থানে তা উল্লেখ করবাে। এই ঘটনা উপলক্ষে এবং এতে সংশ্লিষ্ট স্ত্রীদ্বয়কে যে তাওবার আহবান জানানাে হয়েছে, সে উপলক্ষে এ সূরায় সাধারণভাবে তাওবা এবং পরিবার পরিজনকে ইসলামী প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে দোযখ থেকে বাঁচানাের আহবান জানানাে হয়েছে। অনুরূপভাবে দোযখে কাফেররা কিরূপ দুর্দশায় নিপতিত হবে, তারও একটি দৃশ্য এ সূরায় দেখানাে হয়েছে। আর সূরার উপসংহার টানা হয়েছে হযরত নূহ ও হযরত লুতের স্ত্রীদ্বয়কে মুসলিম পরিবারের ভেতর কাফেরের দৃষ্টান্ত এবং ফেরাউনের স্ত্রীকে কাফের পরিবারে মােমেনের দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে। অনুরূপভাবে সর্বশেষে উল্লেখ করা হয়েছে ইমরানের স্ত্রী মরিয়মের প্রসংগ- যিনি নিজের পবিত্রতা বজায় রেখেছিলেন, আল্লাহর আত্মা থেকে ফুৎকার লাভ করেছিলেন, আল্লাহর বাণী ও তাঁর গ্রন্থকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন এবং যিনি আল্লাহর অনুগত ছিলেন। প্রথম পাঁচটি আয়াত যথা ‘হে নবী, কেন তুমি তােমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টির জন্যে নিজের ওপর হারাম করে নাও যা আল্লাহ তায়ালা তােমার জন্যে হালাল করেছেন…’ এর নাযিল হওয়ার কারণ প্রসংগে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে হযরত আয়েশা থেকে ইমাম বােখারী যে হাদীস বর্ণনা করেন তা নিম্নরূপ, হযরত আয়শা বলেন, রসূল(স.) যয়নব বিনতে জাহশের গৃহে মধু পান করতেন এবং তার কাছে রাত্র যাপন করতেন। এ কারণে আমি ও হাফসা স্থির করলাম যে, আমাদের দু’জনের কারাে কাছে যখনই রসূল(স.) আসবেন, অমনি তাকে বলা হবে, আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন। আমি তাে আপনার কাছ থেকে মাগাফীরের ঘ্রাণ পাচ্ছি (মাগাফীর সুস্বাদু অথচ দুর্গন্ধযুক্ত এক ধরনের খাদ্যদ্রব্য)। পরে রাসূল(স.) তাদের একজনের কাছে এলে সেই স্ত্রী তাকে উক্তরূপ কথা বললেন। রসূল(স.) জবাব দিলেন, কই, না তাে! মাগাফীর নয়, আমি যয়নব বিনতে জাহশের কাছে মধু খেতাম। তবে আর খাবাে না। আমি শপথ করেছি, তুমি আর কাউকে এ কথা জানিও না।’ এভাবে রসূল(স.) একটা হালাল জিনিসকে নিজের ওপর হারাম করে নিলেন। মনে হয় রসূল(স.) যে স্ত্রীকে এ কথা বলেছিলেন, তিনি তার সহযােগী অপর সতীনের কাছে কথাটা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। অতপর আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে বিষয়টা জানিয়ে দিলেন। অতপর রসূল(স.) তার সেই স্ত্রীর কাছে ফিরে গেলেন এবং তিনি তার সতীনের কাছে যা যা বলেছেন, তা খানিকটা উল্লেখ করলেন। নিজের স্বভাবগত ভদ্রতার খাতিরে তিনি সব কথার উল্লেখ করলেন না। কেবল দুই সতীনের আলােচনার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরলেন, যাতে সে স্ত্রী বুঝতে পারেন যে, রসূলুল্লাহ সব কিছু জেনে ফেলেছেন। রসূল(স.)-এর মুখে তাদের দুই সতীনের গােপন সংলাপের বিষয়বস্তু শুনে স্ত্রী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাকে কে অবহিত করলাে?’ সম্ভবত তিনি ভেবেছেন অপর সতীনই তাকে অবহিত করেছেন। কিন্তু রসূল(স.) তাকে জবাব দিলেন, ‘মহাজ্ঞানী সর্বজ্ঞ আল্লাহ তায়ালা আমাকে অবহিত করেছেন।’ অর্থাৎ আমি সেই উৎস থেকে এ তথ্য জেনেছি, যে উৎস সব কিছুই জানেন। এ দ্বারা রসূল(স.) এ কথাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, যে স্ত্রীর সাথে রসূল(স.) কথা বলেছেন, শুধু সেই স্ত্রী নয়, বরং রসূল নিজেও তাদের গােপন সলাপরামর্শ ও পরবর্তী সংলাপের কথা পুরোপুরি জানেন। এই ঘটনা ও এর মাধমে যে গোপন সলাপরামর্শের তথ্য উদঘাটিত হলাে, তার ফল দাঁড়ালাে এই যে, রসূল(স.) রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে কসম খেয়ে বললেন যে, এক মাসের মধ্যে কোনাে স্ত্রীর কাছেও ঘেঁষবেন না। এই সময়ে মুসলমানদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, রসূল(স.) তার স্ত্রীদের সকলকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর এই পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়। রসূল(স.)-এর ক্রোধ প্রশমিত হয় এবং রসূল(স.) স্বীয় স্ত্রীদের কাছে ফিরে যান। তবে এ সম্পর্কে আরাে বিশদ বিবরণ রয়েছে, যা বর্ণনা করার পূর্বে আমি এ সংক্রান্ত অপর হাদীসটির উল্লেখ করতে চাই। হযরত আনাস(রা.) থেকে নাসাঈ বর্ণনা করেন, রসূল(স.)-এর একজন দাসী ছিলাে, যার সাথে তিনি মাঝে মাঝে রাত্র যাপন করতেন। হযরত আয়েশা ও হাফসা তার বিরুদ্ধে রসূল(স.)-কে এতাে ক্ষেপিয়ে তােলেন যে, শেষ পর্যন্ত তিনি উক্ত দাসীকে নিজের ওপর হারাম করে নেন। এ কারণেই নাযিল হয়, ‘হে নবী, তুমি নিজের স্ত্রীদের খুশী করার জন্যে হালালকে হারাম করছো কেন?’ ইবনে জারীর ও ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, রাসূল(স.) হাফসার গৃহে স্বীয় পুত্র ইবরাহীমের মাতা মারিয়ার সাথে রাত্রি যাপন করেন। এতে হাফসা এতাে রেগে যান যে, মারিয়াকে অপমান করতে উদ্যত হন। তখন রসূল(স.) হাফসাকে প্রতিশ্রুতি দেন ও শপথ করেন যে, তিনি মারিয়াকে পরিত্যাগ করবেন। কিন্তু এ বিষয়টি কারাে কাছে প্রকাশ না করার জন্যে হাফসাকে আদেশ দেন। কিন্তু হাফসা বিষয়টি আয়েশার কাছে ফাঁস করে দেন। উল্লিখিত হাদীস দুটি বর্ণিত উভয় ঘটনাই সত্য হয়ে থাকতে পারে। তবে সম্ভবত শেষােক্ত ঘটনাটি আলোচ্য আয়াত কয়টির ভাষার সাথে অধিকতর সংগতিশীল। রাসূল(স.)-এর এতাে বেশী রেগে যাওয়া যে, তার পরিণামে স্ত্রীদের সকলকে একযােগে তালাক দিতে উদ্যত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত গড়াতে পারে, এর সাথে এই শেষােক্ত ঘটনাই অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। নাযুকতা ও স্পর্শকাতরতার বিচারে এই ঘটনাই এতােটা গুরুতর রূপ ধারণ করার কথা। তবে প্রথমােক্ত বর্ণনা অধিকতর নির্ভরযােগ্য সূত্রে প্রাপ্ত। বাস্তবে এটা সংঘটিত হওয়াও অসম্ভব নয় এবং রসূল(স.)-এর পরিবারে বিদ্যমান জীবন মানের আলােকে এই ঘটনা এরূপ গুরুতর আকার ধারণ করা বিচিত্র কিছু নয়। প্রকৃত ব্যাপার কী ছিলাে, তা আল্লাহই ভালাে জানেন। এরপর আলােচনায় আসা যাক ‘ঈলা’ অর্থাৎ স্ত্রীদের কাছে না যাওয়ার ব্যাপারে রসূলের শপথ গ্রহণ প্রসংগে । হযরত ইবনে আব্বাস থেকে ইমাম আহমাদ যে হাদীস বর্ণনা করেন, তাতেই এ ঘটনার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ হাদীসে ইসলামী সমাজের একটি দিকের চিত্র ফুটে ওঠে। হযরত ইবনে আব্বাস(রা.) বলেন, রসুল(স.)-এর যে দুই স্ত্রী সম্পর্কে সূরা তাহরীমের এ আয়াত নাযিল হয়েছিলাে যে, ‘তোমাদের উভয়ের অন্তর আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে তােমরা যদি তাওবা করাে, তবে তাে ভালােই হয়, সেই দুজন স্ত্রী কে কে, এ কথা আমি হযরত ওমরের কাছে জিজ্ঞেস করার জন্যে অনেক দিন যাবত ব্যাকুল ছিলাম এবং সুযােগের অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে একবার হযরত ওমর(রা.) হজ্জে গেলেন এবং আমিও তার সাথে হজ্জ আদায় করতে গেলাম। পথিমধ্যে এক জায়গায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আমীরুল মােমেনীন, রসূল(স.)-এর সেই দু’জন স্ত্রী কে কে, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেছেন যে, ‘তােমাদের উভয়ের আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে তােমরা যদি তাওবা করাে, তবে তাে ভালােই হয়?’ হযরত ওমর(রা.) বলেন, কী আশ্চর্য! হে ইবনে আব্বাস, (যুহরীর মতে, হযরত ওমর তার এই প্রশ্ন অপছন্দ করেছিলেন, তবে তার কাছে কোনাে তথ্য গােপন করেননি। তারা হচ্ছে আয়েশা ও হাফসা।’ এরপর হযরত ওমর পুরাে ঘটনা বিশদভাবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা কোরায়শ বংশীয়রা নারীদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতাম, কিন্তু আমরা যখন মদীনায় গেলাম, তখন সেখানে এমন এক সমাজ দেখলাম, যে সমাজে নারীর কর্তৃত্ব চলতাে। আমাদের মহিলারাও তাদের কাছ থেকে স্বামীর ওপর কর্তৃত্ব চালানাে শিখতে লাগলাে। আওয়ালীতে উমাইয়া ইবনে যায়দের পল্লীতে আমার বাড়ী ছিলাে। একদিন আমি আমার স্ত্রীর ওপর রেগে গেলাম। সে আমার সাথে তর্ক করতে লাগলাে। আমি তার এরূপ তর্ক করায় খুবই বিরক্তি প্রকাশ করলাম। সে বললো, তর্ক করায় তুমি বিরক্ত হচ্ছো কেন? রসূল(স)-এর স্ত্রীরাও তার সাথে তর্ক করে থাকে এবং তাদের কেউ কেউ তাে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার সাথে কথা বলে না। অতপর আমি হাফসার কাছে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে তর্ক করাে এবং তােমাদের কেউ কি তার সাথে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কথা বন্ধ করে থাকে? সে বললাে, হাঁ। আমি বললাম, এরূপ যে করে সে ধ্বংস হবেই। তােমাদের কেউ কি ভাবেও না যে, আল্লাহর রসূল যার ওপর রাগানিঊত হন, তার ওপর আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং রাগান্বিত হতে পারেন এবং সে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে? খবরদার, রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে তর্ক করবে না, তার কাছে কিছুই চাইবে না, আমার ধন-সম্পদ যা কিছু আছে তা থেকে তােমার যা মনে চায় চেয়ে নিয়ে। তোমার সতিন যদি তােমার চেয়ে বেশী সুন্দরী এবং রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে বেশী প্রিয় হয়ে থাকে, (হযরত আয়েশার দিকে ইংগিত করে) তবে সে জন্যে মনঃক্ষুন্ন হয়াে না। আমার একজন আনসারী প্রতিবেশী ছিলাে। সেই প্রতিবেশী ও আমি পালাক্রমে রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে যেতাম। একদিন সে যেতাে, একদিন আমি যেতাম এবং যেদিন যে ওহী নাযিল হতাে, পালাক্রমে তার খবর সে আমাকে জানাতাে আর আমি তাকে জানাতাম। আমরা বলাবলি করতাম, যে, গাসসান গােত্র আমাদের ওপর হামলা করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একদিন আমার উক্ত প্রতিবেশী রাতের বেলা এসে আমার দরজায় করাঘাত করলাে এবং ডাকলাে। আমি তার সামনে বেরিয়ে এলাম। সে বললাে, সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম কি হয়েছে? গাসসানীরা এসে গেলাে নাকি সে বললাে, না, তা নয়। তবে তার চেয়েও ভয়ংকর ও সাংঘাতিক ব্যাপার। রসূলুল্লাহ(স.) তাঁর স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। আমি সংগে সংগে বললাম, হাফসার সর্বনাশ হয়ে গেলাে। এ ঘটনা ঘটবে, তা আমি জানতাম। পরদিন ফজরের নামাযের অব্যবহিত পর আমি হাফসার কাছে গেলাম। দেখলাম সে কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রসূল(স.) কি তােমাদের তালাক দিয়েছেন? সে বললাে, জানি না। তিনি এই তাে এই পানকক্ষে আমাদের সংগ বর্জন করে অবস্থান করছেন। সংগে সংগে আমি এক কৃষ্ণকায় তরুণের কাছে এলাম। তাকে বললাম, ওমরের জন্যে অনুমতি চাও (অর্থাৎ রসূলের কাছ থেকে সাক্ষাতের অনুমতি এনে দাও)। তরুণ ভেতরে প্রবেশ করলাে। অতপর বেরিয়ে এসে বললাে, আপনার কথা রসূলের কাছে বলেছি। কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি। আমি তখন মসজিদে নববীর মিম্বারের কাছে গেলাম। দেখলাম, সেখানে বেশ কিছু লােক জড়াে হয়ে বসে আছে। তাদের কেউ কেউ কাঁদছে। আমি সেখানে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমার ভেতরকার আবেগ উত্তেজনা আমাকে অস্থির করে তুললাে। আমি তাই পুনরায় সে তরুণটির কাছে এলাম এবং আবারাে বললাম, ওমরের জন্যে অনুমতি এনে দাও। এবারও সে ভেতরে গিয়ে ফিরে এসে জানালাে, রসূলুল্লাহ(স) তাঁর সাক্ষাতের অনুমতি দানের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। আমি আবারও মিম্বারের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে কাটালাম। অতপর আবেগ উত্তেজনার বশে আবারাে সে তরুণের কাছে গেলাম এবং অনুমতি চাইতে অনুরােধ করলাম। এবারও সে আগের মতাে জানালাে, রসূলুল্লাহ(স.) নীরবতা অবলম্বন করেছেন। আমি অগত্যা ফিরে যেতে উদ্যত হলাম। আমি রওনা হতেই পেছনে থেকে উক্ত তরুণ ডাক দিলাে। সে বললাে, আপনাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। ভেতরে যান। আমি ভেতরে গেলাম এবং রসূলুল্লাহ(স.)-কে সালাম করলাম। দেখলাম তিনি একটি বালুভর্তি বিছানায় শুয়ে আছেন এবং সে জন্যে তার শরীরে দাগ হয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ(স.) আপনি স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। তিনি মাথা তুলে আমাকে বললেন, না। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার! ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা কোরায়শ বংশীয়রা নারীদের ওপর পুরুষদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতাম, কিন্তু মদীনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের ওপর তাদের স্ত্রীদের কর্তৃত্ব বিরাজ করছে। এখানকার মহিলাদের দেখাদেখি আমাদের মহিলারাও কর্তৃত্ব ফলানাে শিখেছে। একদিন আমার স্ত্রীর ওপর আমি রাগ করেছিলাম। সে আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিলাে। আমি তার তর্ক করায় বিরক্তি প্রকাশ করলাম। সে বললাে, আমার তর্ক করায় তুমি বিরক্ত হচ্ছে কেন! আল্লাহর কসম, রসূলের স্ত্রীরাও তাঁর সাথে তর্ক করে। এমনকি তাদের কেউ কেউ তার সাথে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কথা বন্ধ রাখে। এ কথা শুনে আমি বললাম, যে মহিলা এমন কাজ করে তার সর্বনাশ হবে। তােমরা কি ভাবো না যে, আল্লাহর রসূলের ক্রোধের কারণে তােমাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা ক্রুদ্ধ হতে পারেন এবং এতে তােমাদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে? এ কথার পর রসূলুল্লাহ(স.) মুচকি হাসলেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হাফসার কাছে গিয়েছিলাম, তাকে বলেছি যে, তােমার কোনাে সতিন যদি তােমার চেয়ে বেশী সুন্দরী হয় এবং রসূলের কাছে তােমার চেয়ে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে তুমি মনােক্ষুন্ন হয়াে না। রসূলুল্লাহ(স) আবারও মুচকি হাসলেন। আমি বললাম, আমি কি আশ্বস্ত হতে পারি ইয়া রাসূলাল্লাহ?’ তিনি বললেন, হাঁ। তখন আমি বসলাম। আমি ঘরের ভেতরে চতুর্দিকে তাকালাম। সেখানে রসূল(স.)-এর গাম্ভীর্যপূর্ণ অবস্থান ছাড়া আর কোনাে দর্শনীয় বস্তু আমার চোখে পড়লাে না। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আপনার উম্মতকে সচ্ছলতা দান করেন। আল্লাহ তায়ালা তার পারস্য ও রােম সাম্রাজ্যকেও সচ্ছলতা দান করেছেন। অথচ তারা আল্লাহর এবাদাত করে না। এ সময় রসূলুল্লাহ(স.) ওঠে বসলেন এবং বললেন, হে খাত্তাবের ছেলে, তুমি কি সন্দেহের মধ্যে আছাে? তারা তাে এমন জাতি, যাদের দুনিয়ার জীবনেই সকল সুখ শান্তি নগদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ…রাসূল(স.) স্বীয় স্ত্রীদের ওপর এতাে বেশী রুষ্ট হয়েছিলেন যে, এক মাসের মধ্যে তাদের কাছে যাবেন না বলে কসম খেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা তাকে তিরস্কার করেন (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী এবং নাসায়ীও যুহরীর সূত্রে একই ভাষায় এই হাদীস বর্ণনা করেছেন)। সীরাত গ্রন্থসমূহে এ ঘটনার যে বিবরণ পাওয়া গেছে, তা এখানে বর্ণনা করা হলাে। এবার আমি সূরাটির তাফসীরে মনােনিবেশ করছি।
ফী জিলালিল কুরআন: *রাগ অনুরাগ মিলিয়ে স্ত্রীদের সাথে প্রিয় নবীর সম্পর্ক : সূরাটি শুরু হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রসূলকে নিম্নোক্ত তিরস্কারের মাধ্যমে। ‘হে নবী। আল্লাহ যে জিনিস তােমার জন্যে হালাল করেছেন, তা নিজের স্ত্রীদের সন্তুষ্টির জন্যে হারাম করাে কেন?…’ এ অত্যন্ত কার্যকর ও তাৎপর্যময় তিরস্কার। মােমেনের জন্যে এটা বৈধ হতে পারে না যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্যে যে ভোগদ্রব্য বৈধ করা হয়েছে, তা সে নিজের ওপর অবৈধ করে নেবে। রসূল(স.) অবশ্য মধু অথবা মারিয়াকে শরয়ী পরিভাষা অনুসারে নিজের ওপর হারাম করেননি। কেবল নিজে তা ভােগ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে ওহীযােগে তিরস্কার করে জানিয়ে দেয়া হলাে যে, আল্লাহ তায়ালা যে জিনিস হালাল করেছেন, কারাে সন্তুষ্টির জন্যে ইচ্ছাকৃতভাবে তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করাও বৈধ নয়। ‘আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল’- এ কথা দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নিজেকে বঞ্চিত করাটা একটা শাস্তিযােগ্য কাজ, যদিও তাকে এ জন্যে দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। এটি একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত। আয়াতের ভাষা থেকে বুঝা যায়, রসূল(স.) কসম খেয়েছিলেন। তাই বলা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা এই কসম থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যে কাফফারা দেয়া ফরয করেছেন। কোনাে অন্যায় কাজের কসম খেলে এভাবে কাফফারা দিয়ে তা থেকে ফিরে যাওয়াই উত্তম। তিনি তােমাদের সহায় ও অভিভাবক। তাই তিনি তোমাদের দুর্বলতায় ও কষ্টে তােমাদের সাহায্য কৱেন। আর এ জন্যেই কষ্ট থেকে রেহাই দেয়ার জন্যে কসম থেকে উদ্ধার পাওয়ার বিধান দিয়েছেন। ‘আর তিনি মহাজ্ঞানী ও বিজ্ঞানময়’। সুতরাং তিনি জ্ঞান ও বিজ্ঞানসম্মত আইন বিধান রচনা করেন। তােমাদের শক্তি সামর্থের সাথে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা তােমাদের জন্যে উপযােগী ও কল্যাণকর, তারই নির্দেশ দিয়ে থাকেন। কাজেই তিনি যা নিষিদ্ধ করেছেন তা ছাড়া আর কোনাে কিছু নিজেদের ওপর নিষিদ্ধ করাে না। আর তিনি যা হালাল করেছেন তা ছাড়া আর কোনাে জিনিস নিজেদের জন্যে হালাল করে নিয়াে না। পূর্ববর্তী নির্দেশের সাথে এ মন্তব্য অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। এরপর উল্লেখ করা হয়েছে রসূলের সংলাপের কথা। এই সংলাপের বিষয়বস্তু কি ছিলাে ] তারও উল্লেখ এখানে করা হয়নি, আর তার বিস্তারিত বিবরণও দেয়া হয়নি। কেননা, এই বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং তা তার কোনাে স্থায়ী উপাদানও নয়। স্থায়ী উপাদান হচ্ছে এর তাৎপর্য ও ফলাফল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করাে, যখন নবী তার জনৈকা স্ত্রীকে একটি কথা গােপনে বললেন।’ একমাত্র কোরআনের উক্তি থেকেই আমরা জানতে পারি, মানব জাতির ইতিহাসের সে বিস্ময়কর মুহূর্তাটির একটি দৃষ্টান্ত সম্পর্কে। সেই মুহূর্তটিতে মানুষ নিছক আল্লাহর সাথে একান্তে মিলিত হয়, আর আল্লাহ তায়ালা তার কাজে প্রকাশ্যে ও সবিস্তারে হস্তক্ষেপ করেন। আমরা এ থেকে আরাে জানতে পারি যে, আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে তার দুই স্ত্রীর মাঝে তার সেই গােপন কথা সম্পর্কে যে সলাপরামর্শ হয়েছে, তা জানিয়ে দিয়েছেন এবং রসূল(স.) যখন সেই স্ত্রীর কাছে প্রত্যাবর্তন করেছেন, তখন শুধু সে কথাটার একাংশের প্রতি ইঙ্গিত দেয়াই যথেষ্ট মনে করেছেন। বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার প্রয়ােজন মনে করেননি। আর তিনি উক্ত স্ত্রীকে তার জ্ঞানের আসল উৎস কি তা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘অতপর যখন সে স্ত্রী তা ফাঁস করে দিলাে… সে বললাে, আমাকে জানিয়েছেন মহাজ্ঞানী সর্বজ্ঞ আল্লাহ তায়ালা।’ আল্লাহর সীমাহীন জ্ঞান ও অবগতির উল্লেখ এখানে গােপন ফন্দিফিকির এবং সলাপরামর্শের বেলায় অত্যন্ত কার্যকর ও তাৎপর্যময় ইংগিত। এ দ্বারা প্রশ্নকারীকে এই পরম সত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, যা হয়তাে সে ভুলে গিয়েছিলাে অথবা তা থেকে উদাসীন হয়ে গিয়েছিলাে। এ ইংগিত দ্বারা মানুষের মনকে সাধারণভাবেও এই সত্যটির বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, যা প্রতিবার কোরআন পাঠ করার সময় তার সামনে উদ্ভাসিত হয়।
ফী জিলালিল কুরআন: *মুসলিম নারীদের গুণ বৈশিষ্ট্য : পরবর্তীতে আয়াতে সম্পূর্ণ নতুনভাবে বক্তব্য রাখা হয়েছে। অতীতে সংঘটিত একটি ঘটনার বিবরণদান থেকে বক্তব্যের ধারা পরিবর্তন করে উভয় মহিলাকে এমনভাবে সম্বোধন করা হয়েছে যেন এটা বর্তমানের কোনাে ব্যাপার। ‘আল্লাহর দিকে তােমাদের উভয়ের মন বেঁকে যাওয়ার কারণে তােমরা যদি আল্লাহর কাছে তাওবা করাে, তা হলে তাে ভালােই। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তা হলে জেনে রেখাে, আল্লাহ তায়ালা, জিবরীল ও সৎকর্মশীল মােমেনরা তার বন্ধু। তদুপরি ফেরেশতারাও তার সাহায্যকারী।’ এই আয়াতের শুরুতে রয়েছে উক্ত উভয় স্ত্রীকে তাওবার দিকে আহবান- যাতে তাদের অন্তর আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত ও আকৃষ্ট হয়, যা কিনা আল্লাহ তায়ালা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাে। আর এই আহবানের পরেই রয়েছে এক ভয়ংকর হুঁশিয়ারী ও প্রচন্ড আক্রমণাত্মক বক্তব্য। এই প্রচন্ড আক্রমণাত্মক বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, রসূল(স.)-এর অন্তরে এ ঘটনা কতাে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলাে, যার কারণে রসূলের সহায়ক ও অভিভাবক হিসাবে আল্লাহ তায়ালা এবং জিবরাঈল, সৎকর্মশীল মােমেনদের ও সাধারণ ফেরেশতাদের দেখানাের প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিলাে, যাতে রসূল(স.)-এর মন সান্তনা ও প্রশান্তি লাভ করে এবং সে বিব্রতকর ঘটনার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়। নিসন্দেহে ঘটনাটা রাসূল(স.)-এর অনুভূতিতে এতাে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলাে যে, আয়াতের এই হুঁশিয়ারী ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য তার সাথে পুরােপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলাে। এটা কিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিলাে তা হয়তাে আমরা এই আয়াতের ভাষা থেকে এবং উপরােক্ত হাদীসে হযরত ওমরের প্রতিবেশীর বক্তব্য থেকে বুঝতে পারি। হযরত ওমর(রা.) যখন জিজ্ঞেস করলেন, গাসসানীরা এসে গেলাে নাকি? তখন সে প্রতিবেশী বললেন, ব্যাপারটা তার চেয়েও সাংঘাতিক। গাসসান ছিলাে সিরিয়ার অভ্যন্তরে আরব উপদ্বীপের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত রােম সাম্রাজ্যের ক্রীড়নক একটি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের আক্রমণ সে সময়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার ছিলাে, কিন্তু অপর ব্যাপারটি ছিলাে মুসলমানদের কাছে অধিকতর গুরুতর। মুসলমানরা উপলব্ধি করতাে যে, মহানবীর হৃদয়ে স্থিরতা ও তার গৃহের শান্তি সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর হৃদয়ের অশান্তি ও পারিবারিক অস্থিরতা মুসলিম জাতির জন্যে রােম সাম্রাজ্যের পদলেহী গাসসানীদের আক্রমণের চেয়েও মারাত্মক। বস্তুত মুসলমানদের এই বিবেচনা ও উপলব্ধি আল্লাহর বিবেচনার সাথে সমন্বিত ছিলাে এবং তা সম্পূর্ণ সঠিক ও নির্ভুল ছিলাে। অনুরূপভাবে পরবর্তী আয়াতের তাৎপর্য, রসূল(স.) তার বর্তমান স্ত্রীদের তালাক দিলে তাদের স্থলে আল্লাহ তায়ালা তাকে নতুন যে স্ত্রীদের দিতে পারেন, তাদের গুণ-বৈশিষ্ট্যের বিবরণ এবং ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট মাত্র দু’জন থাকলেও সকল স্ত্রীদের হুমকির আওতাভুক্ত করা থেকে বুঝা যায় যে, রসূল(স.)-এর পারিবারিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার যে অপরিসীম গুরুত্ব মুসলমানরা উপলব্ধি করেছিলেন, তাতে বিন্দুমাত্রও ভুল ছিলাে না। পরবর্তী আয়াতের ভাষা দেখুন,‘তিনি যদি তােমাদের তালাক দেন, তা হলে তার প্রতিপালক তাকে অচিরেই তােমাদের স্থলে তােমাদের চেয়েও উত্তম স্ত্রীদের দান করবেন, যারা হবে আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের আদেশের অনুসারী, ঈমানদার, বিনয়ী, তাওবাকারিণী, এবাদাতকারিণী, ভ্রমণকারিণী, কুমারী ও অকুমারী। এই গুণাবলী অর্জনের জন্যে পরােক্ষভাবে ও ইংগিতে রসূলের স্ত্রীদের আহবান জানানাে হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ইসলাম। অর্থাৎ ইসলামের বিধানের অনুসরণ ও আনুগত্য। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঈমান, যা মানুষের হৃদয়কে সংগঠিত ও সজীব করে। এই গুণটি পূর্ণতা ও বিশুদ্ধতা অর্জন করলে তা থেকেই ইসলামের জন্ম হয়। তৃতীয় গুণটি হলাে ‘কুনুত, অর্থাৎ বিনয়। এ দ্বারা হৃদয়ের আনুগত্য বুঝানাে হয়েছে। চতুর্থ গুণ তাওবা। তাওবা হলাে নিজের গুনাহের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া ও আল্লাহর অনুগত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। পঞ্চম গুণ এবাদাত। এটি হলাে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রক্ষার উপকরণ এবং তার দাসত্বের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। আর ৬ষ্ঠ গুণ হলাে ভ্রমণ। এ দ্বারা বুঝানো হয়েছে, আল্লাহর সৃষ্টির রাজ্যে বিচরণ তথা আল্লাহর অতুলনীয় সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তাভাবনা ও ধ্যান করা। আর এ সব গুণসহ তারা কুমারী এবং অকুমারীও হতে পারে, যেমন বর্তমান স্ত্রীরা উভয় প্রকারের রয়েছে। এটা বর্তমান স্ত্রীদের প্রতি হুমকিস্বরূপ। তাদের চাতুর্যপূর্ণ কলাকৌশলের দরুন রাসুল(স.)-এর মনে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছিলাে, তা দূর করার জন্যে এ হুমকির প্রয়ােজন ছিলাে। অন্যথায় রাসূল(স.) কোনাে ক্ষুদ্র কারণে রেগে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। এ আয়াতগুলাে নাযিল হওয়ার পর তাকে ও তার পরিবার পরিজনকে লক্ষ্য করে এতে যে কথাগুলাে বলা হয়েছে, তার ফলে রসূল(স.)-এর মন শান্ত হয়। মুসলমানদের সর্বাধিক ভক্তিভাজন এই পরিবারটিতে সাময়িক দুর্বিপাকের পর শান্তি ও স্থিতি ফিরে আসে। এ দ্বারা আসলে এই পরিবারকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে, আল্লাহর যমীনে তার বিধান কায়েমে এই পরিবারের ভূমিকার যথাযােগ্য মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং এ পরিবারের সদস্যদের মনােবল বহাল করা হয়েছে। এই হচ্ছে সেই মহান ব্যক্তির পারিবারিক জীবনের একটি দৃশ্য, যিনি একটি জাতি ও একটি রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টায় নিয়ােজিত ছিলেন, অথচ তার পূর্বে কেউ এ কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি এবং এ কাজের পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়নি, এমন একটি জাতি গঠন করতে তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যে জাতি আল্লাহর বিধান তার সর্বশেষ ও পূর্ণাংগ রূপ সহকারে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং এমন একটি আল্লাহভীরু ও আল্লাহভক্ত সমাজ বাস্তবরূপে প্রতিষ্ঠিত করবে, যা মানব জাতির সকল দুঃখ যন্ত্রণা প্রশমিত করবে। এই ছিলাে একজন অতীব মহৎ, উদার, মর্যাদাবান ও মহানুভব মানুষের বাস্তব জীবনের একটি চিত্র, যিনি একই সাথে একজন মানুষ হিসাবে ও একজন নবী হিসাবে জীবন যাপন করে গেছেন। এ দুই ধরনের জীবন যাপনে তার ভেতরে কোথাও কোনাে পার্থক্য, ভেদাভেদ, শূন্যতা বা সামঞ্জস্যহীনতার সৃষ্টি হয়নি। কেননা, তিনি একজন মানুষ রসূল হবেন এবং মানব জাতির জন্যে আল্লাহর সর্বশেষ খােদায়ী বিধান বা সর্বশেষ খােদায়ী বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হবেন, এটাই ছিলাে ‘আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত। এ বিধান ছিলাে পূর্ণাংগ বিধান, নাযিল হয়েছিলাে পূর্ণাংগ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ রসূলের ওপর। এ বিধানের অনুসরণ করলে মানুষ যে প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়, তার কোনাে গঠনমূলক গুণ, শক্তি বা প্রতিভা ও যােগ্যতা নিস্কৃয় বা অবদমিত হয় না, এটাই এ বিধানের পূর্ণতার লক্ষণ। বরঞ্চ এ বিধান মানুষকে মার্জিত ও পরিশীলিত করে, তাকে সুসভ্য করে এবং তার মনুষ্যত্বের লালন ও বিকাশ সাধন করে, আর তাকে তার উৎকর্ষের উচ্চতর শিখরে আরােহণ করায়। বস্তুত ইসলামকে যারা বুঝে শুনে পালন ও অনুসরণ করেছে, ইসলাম তাদের জীবনকে তার বাস্তব ও জীবন্ত নমুনায় পরিণত করেছে। রসূল(স.)-এর বাস্তব জীবন ছিলাে যাবতীয় মানবীয় অভিজ্ঞতা, মানবীয় চেষ্টা সাধনা এবং সহজাত মানবীয় দুর্বলতা ও পূর্ণতার সমাবেশ, কিন্তু এতদসত্তেও তাতে মিশ্রণ ঘটেছিলাে আল্লাহর দিকে আহবানের সুমহান বৈশিষ্ট্যের। এ বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণের বদৌলতে তাঁর সত্ত্বা পূর্ণতার সােপানসমূহ একে একে অতিক্রম করেছিলাে, যা তার পরিবার পরিজন ও নিকটতম মানুষের জীবনে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। রসূলের এই পূর্ণাংগ জীবন ছিলাে সফল চেষ্টা সাধনার বাস্তব অনুকরণীয় আদর্শ। যারা তাকে বাস্তব ও সহজ অনুকরণীয় আদর্শ বা নমুনা হিসাবে পেতে চাইতাে, তারা তাকে প্রতিনিয়ত দেখতাে ও অনুপ্রাণিত হতাে। তিনি যদি কোনাে অবাস্তব ও কাল্পনিক জগতে বিচরণকারী ব্যক্তিত্ব হতেন, তাহলে তার জীবন কেউ অনুসরণও করতে পারতাে না, তা দেখে কেউ অনুপ্রাণিতও হতাে না। মানব জাতির জন্যে প্রেরিত আল্লাহর সর্বশেষ বিধানকে এরূপ পূর্ণাংগ ও সর্বাত্মক বিধানে পরিণত করা, এমন এক ব্যক্তিকে রাসূল নামে মনােনীত করা, যিনি এ বিধানকে বাস্তব ও কার্যকর বিধানে পরিণত করে দেখিয়ে দেবেন এবং এই রসূলের জীবনকে এমন একটি উন্মুক্ত পুস্তকে পরিণত করা, যাকে সবাই পড়তে পারবে ও এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে।এ কাজগুলাের পেছনে নিহিত আল্লাহর মহৎ উদ্দেশ্যসমূহ এভাবেই সার্থকতা লাভ করেছিলাে।
ফী জিলালিল কুরআন: *নিজেকে ও নিজের পরিবারকে আগুন থেকে বাঁচাতে হবে : মুসলমানদের হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাতকারী এই ঘটনার আলােকে কোরআন পরবর্তী আয়াতে মােমেনদের তাদের পারিবারিক জীবনে ইসলামের শিক্ষা, প্রেরণা ও উপদেশদানের মাধ্যমে পরিবার পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচানাের জন্যে নির্দেশ দিয়েছে। সেই সাথে দোযখের কিছু দৃশ্য ও সেখানে কাফেরদের শােচনীয় দুর্দশার কিছু চিত্রও তুলে ধরেছে। আর ইতিপূর্বে নবীর দুজন স্ত্রীকে তাওবার আহবান জানানাের সূত্র ধরে পরবর্তী আয়াতে সাধারণ মুসলমানদের তাওবা করার আহ্বান জানিয়েছে এবং তাওবাকারীদের জন্যে অপেক্ষমাণ জান্নাতের দৃশ্য তুলে ধরেছে। অতপর নবী(স)-কে কাফের ও মােনাফেক উভয় গােষ্ঠীর সাথে জেহাদে লিপ্ত হওয়ার আদেশ দিয়েছে। এসব মিলেই তৈরী হয়েছে সূরার দ্বিতীয় আলােচ্য বিষয়। পরবর্তী কটি আয়াত লক্ষ্য করুন, ‘হে মােমেনরা! তােমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবার পরিজনকে আগুন থেকে বাঁচাও তাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম, যা অত্যন্ত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল’ প্রত্যেক মােমেনের ওপর তার নিজের ও তার পরিবার পরিজনের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর এবং গুরুতর দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে। তাদের সকলের জন্যেই রয়েছে দোযখের ঝুঁকি। মােমেনের কর্তব্য এই দোযখ থেকে নিজে বাঁচা ও পরিবার পরিজনকে বাঁচানাে। ‘দোযখে রয়েছে ভয়ংকর লেলিহান আগুন, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ সেখানে মানুষ ও পাথর একই রকম হীনতা, নিকৃষ্টতা ও অবমাননার সাথে নিক্ষিপ্ত ও দ্রবীভূত হবে, কোনাে রকম সুবিবেচনা ও সুদৃষ্টি মানুষের কপালে জুটবে না। এ কথা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না যে, যে আগুন পাথর দিয়ে জ্বালানাে হয় তা কতাে সাংঘাতিক ও ভয়াবহ আগুন হয়ে থাকে, আর সেই পাথরের সাথে একইভাবে দোযখের জ্বালানি হবে যে মানুষ, সে মানুষ কতাে তুচ্ছ ও কতাে অপমানিত। আর এই দোযখে বিদ্যমান বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট সব কিছুই ভয়ংকর। ‘তার ওপর থাকবে নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর ফেরেশতারা।’ অর্থাৎ যে ধরনের আযাব দেয়ার দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত থাকবে, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নির্মমতা হিংস্রতা দিয়েই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। ‘আল্লাহর আদেশ তারা অমান্য করে না বরং যা আদেশ করা হয় তাই তারা করে।’ অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ মান্য করা যেমন তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তেমনি আল্লাহর আদেশ পালন করার সামর্থও তাদের অপর বৈশিষ্ট্য। তারা তাদের স্বভাবগত নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতা সহকারে দোযখের ভয়ংকর আগুন প্রজ্বলনের দায়িত্বে নিয়ােজিত। আর মােমেনের কর্তব্য হলাে এই আগুন থেকে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে রক্ষা করা। এই আগুন থেকে আত্মরক্ষার ও পরিবার রক্ষার সুযােগ তার এখনই । দুনিয়ার জীবন শেষে এ সুযােগ থাকবে না। তখন আর ওযর আপত্তিতে কাজও হবে না, যেমন কাজ হবে না কাফেরদের ওযর আপত্তিতে। ‘হে কাফেররা, আজ ওযর আপত্তি পেশ করাে না। আজ তােমাদেরকে তােমাদের কর্মফল ভােগ করানাে হবেই।’ কেননা, কেয়ামতের দিন ওযর আপত্তি পেশ করার দিন নয়- ওটা কর্মফল পাওয়ার দিন। কাফেররা দোযখের উপযুক্ত কাজ করে এসেছে বলে দোযখই তাদের অবধারিত ঠিকানা।
ফী জিলালিল কুরআন: মােমেনদের কী হবে? তারা কিভাবে দোযখের আগুন থেকে নিজেদের ও নিজেদের আপনজনদের বাঁচাবে? আল্লাহ তায়ালা তাদের এর পথ বাতলে দিচ্ছেন এবং তাদের জন্যে আশার প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন এই বলে, ‘হে মােমেনরা, আল্লাহর কাছে খাঁটিভাবে তাওবা করাে। অচিরেই তােমাদের প্রতিপালক তােমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন…’ এই হচ্ছে বাঁচার পথ। খাঁটি তাওবা, যা হৃদয়কে খাঁটি ও খালেস বানায়, অতপর তা তাকে আর ধােকা দেয় না ও প্রবঞ্চিত করে না। তাওবা হচ্ছে খারাপ কাজ থেকে ফিরে আসা ও বিরত থাকার নাম। এর শুরু হয় অনুশােচনা দিয়ে এবং শেষ হয় সৎ কাজ ও আনুগত্যের মাধ্যমে। এই পরিপূর্ণ তাওবার মধ্য দিয়েই হৃদয় গুনাহের কলুষমুক্ত হয় এবং মানুষকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে। এটাই হচ্ছে তাওবাতুন নাসূহা তথা খাটি তাওবা, যা হৃদয়কে ক্রমাগত সতর্ক করে এবং কখনাে আর গুনাহের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে দেয় না। তাওবা যখন এমনই (পাপ থেকে পুরােপুরি নিবৃত্ত হওয়া, আর কখনাে পাপের ধারে-কাছেও না যাওয়া), তখন আশা করা যায় যে, আল্লাহ তা দ্বারা সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং তাওবাকারীদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যেদিন মােমেনদের গুনাহ মাফ করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, সেদিন কাফেরদের এমনভাবে লাঞ্চিত ও অপমানিত করবেন যে, তাদের কোনাে প্রকার ওযর-বাহানা করার সুযােগ পর্যন্ত দেবেন না বলে কিছু আগেই বলা হয়েছে। সেদিন আল্লাহ তার নবী ও মােমেনদেরকে লাঞ্ছিত করবেন না। ‘আল্লাহ তায়ালা নবী ও মােমেনদেরকে অপমানিত করবেন না’- এ কথাটা মােমেনদের বিশেষভাবে সম্মানিত ও আশান্বিত করেছে সেই অপমানের দিন যারা সম্মানিত হবে তাদের মধ্যে নবী(স.)-এর সাথে মােমেনদের একত্রিত করে এই বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মােমেনদের জন্যে সেদিন এমন এক আলাে প্রস্তুত রাখা হবে, যা তাদের সামনে ও ডানে চলতে থাকবে। সেই ভয়ংকর দুর্যোগময় দিনে এই আলাে দ্বারা তাদের চেনা যাবে, প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে এ আলাে দ্বারা তারা পথের সন্ধান পাবে এবং পরিশেষে এ আলাে তাদের সামনে ও ডানে চলতে চলতে জান্নাতে গিয়ে পৌঁছবে। সেদিন সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তারা আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের আলােকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদের তুমি রক্ষা করাে। নিশ্চয় তুমি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান।’ সেই কঠিন দিনে যখন মুখ নির্বাক ও অন্তর নিস্তব্ধ হয়ে যাবে, তখন তাদের এই দোয়া শেখানাে প্রকৃতপক্ষে দোয়াটি কবুল হওয়ারই আলামত। আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের এ দোয়া শেখাবেন এই জন্যে যে, তিনি এ দোয়া কবুল করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। সারকথা এই যে, আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের যে সম্মান ও আলা দান করবেন, তার ওপর এই দোয়া তার একটি বাড়তি নেয়ামত ও অনুগ্রহ। যে মােমেন এতাে সব নেয়ামত ও অনুগ্রহে সিক্ত হবে, তার আবার মানুষ ও পাথরের জ্বালানি দ্বারা প্রজ্বলিত দোযখের সাথে কিসের সম্পর্ক যে পুরস্কার ও শাস্তির উল্লেখ করা হলাে, তার উভয়টিই আগুন থেকে নিজেকে ও পরিবার পরিজনকে রক্ষা করার ব্যাপারে মােমেনের দায়িত্ব কতখানি, তা স্পষ্ট করে বলে দেয়। তাকে বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত লাভের যােগ্য করতেই বা এ দুটির ভূমিকা কী, তাও জানিয়ে দেয়। রসূল(স.)-এর পরিবারে সংঘটিত ঘটনার পটভূমিতে চিন্তা করলে আমরা আলােচ্য আয়াতগুলাের প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারি। নিজেকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করা এবং নিজের অন্তরকে সংশােধন করার ন্যায় নিজের পরিবার-পরিজনকে সঠিক পথে পরিচালিত করাও মােমেনের দায়িত্ব। সূরা তালাকে যেমন আমি বলেছি, ইসলাম শুধু ব্যক্তির নয়, পরিবারেরও জীবন বিধান। তাই পরিবারের প্রতি মােমেনের দায়িত্ব কী, তাও সে নির্ধারণ করে। মুসলিম পরিবার আসলে মুসলিম দল বা সংগঠনের ভিত্তি। এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ছােট বড় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত হয় জীবন্ত ইসলামী সমাজ। এক একটি মুসলিম পরিবার ইসলামের এক একটি দুর্গস্বরূপ। এই দুর্গ ভেতর থেকে অত্যন্ত মযবুত ও দুর্ভেদ্য থাকা চাই। তাতে কোথাও যদি ফাঁক বা ফাটল থেকে থাকে, তবে সে রকম প্রতিটি ফাটলে একজন মুসলমান পাহারাদার থাকা চাই, যাতে কেউ তা ভেদ করতে না পারে। অনুরূপভাবে ভেতর থেকেও যেন কেউ দুর্গের দেয়াল ভাংতে না পারে, তার ব্যবস্থা থাকা চাই। মােমেনের দায়িত্ব ও কর্তব্য এই যে, যেন ইসলামের দাওয়াত সর্বপ্রথম তার পরিবারের কাছে পৌছায় এবং এভাবে ইসলামের এই দুর্গটিকে নিরাপদ করে ও তার ফাটলগুলাে বন্ধ করে। এ কাজটি সম্পন্ন করার আগে দূরের কারাে কাছে দাওয়াত পৌছানাে তার দায়িত্ব নয়। পরিবার নামক এই দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণে মুসলিম মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা প্রয়ােজন। শুধু মুসলিম মাতাই এই দুর্গের নিরাপত্তা বিধানে যথেষ্ট নয়। ছেলেমেয়েদের গঠন করতে পিতা ও মাতা উভয়েরই প্রয়ােজন। শুধুমাত্র একদল পুরুষ দ্বারা ইসলামী সমাজ গঠনের চেষ্টা বৃথা। এ সমাজে মুসলিম মহিলাদেরও প্রয়োজন রয়েছে। তারাই নতুন প্রজন্মের রক্ষণাবেক্ষণকারিণী। আর এই নতুন প্রজন্ম হচ্ছে ভবিষ্যতের বীজ ও ফল দুটোই। এ জন্যে কোরআন পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যেই নাযিল হতাে। কোরআন পরিবার গঠন ও ইসলামী বিধানের আলােকে প্রতিষ্ঠিত করতাে, আর এ কারণেই মোমেনদের একদিকে যেমন নিজেদের দায়িত্ব অর্পণ করতাে, অপর দিকে তেমনি অর্পণ করতাে তাদের পরিবারের দায়িত্বও। এ দায়িত্বই অর্পণ করা হয়েছে ‘হে মােমেনরা তােমরা নিজেদেরকে ও তােমাদের পরিবার পরিজনকে আগুন থেকে বাচাও’- এই কথাটা বলার মধ্য দিয়ে। *মুসলিম স্ত্রীদের অপরিহার্য আদর্শ : যারা মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকেন, এ বিষয়টি তাদের খুব ভালােভাবে হৃদয়ংগম করা দরকার। এ ব্যাপারে প্রথম চেষ্টা নিয়ােজিত করতে হবে নিজ গৃহের প্রতি তথা নিজের স্ত্রী, মাতা পিতা, সন্তান সন্ততি ও সকল আত্মীয়-স্বজনের প্রতি। মুসলিম নারীকে মুসলিম পরিবার গঠনের সর্বাত্মক সুযােগ দিতে হবে। আর যে ব্যক্তি মুসলিম পরিবার গঠন করতে চাইবে, তাকে সর্বপ্রথম নিজের জন্যে খাঁটি মুসলমান স্ত্রী খুঁজতে হবে। নচেৎ মুসলিম সমাজ গঠনের কাজ অনেক বেশী বিলম্বিত হয়ে যাবে এবং মুসলিম সমাজরূপী দুর্গের প্রাচীরে প্রচুর ফাটলের সৃষ্টি হবে। ইসলামের সূচনাকালে ইসলামী পরিবার গঠন করার কাজটি এ যুগের চেয়ে অনেক বেশী সহজ ছিলাে। কেননা, মদীনায় একটা ইসলামী সমাজ বিদ্যমান ছিলাে এবং সে সমাজের ওপর ইসলামের নিরংকুশ কর্তৃত্ব বিরাজ করতাে। মানব জীবন সম্পর্কে ইসলামের যে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন চিন্তাধারা রয়েছে এবং সেই চিন্তাধারা থেকে যে আইন কানুন ও বিধিবিধান রচিত হয়, তার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলাে গােটা সমাজ ব্যবস্থা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে গােটা জাতির কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল এবং আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের নির্দেশ। ওহীর মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত নাযিল হতাে, সেটাই হতাে সর্বশেষ, চূড়ান্ত ও অকাট্য সিদ্ধান্ত। এই সমাজ বিদ্যমান থাকা এবং তার চিন্তাধারা ও মতাদর্শ মানব জীবনে প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত থাকার কারণে নারীর পক্ষে ইসলামের বিধান অনুসারে নিজের জীবন গড়া সহজ ছিলাে। পুরুষের পক্ষেও স্ত্রী ও সন্তানদের ইসলামের বিধান অনুসারে পরিচালিত করা এবং তদনুসারে জীবন যাপন করার উপদেশ দেয়া সহজ ছিলাে। আজকে আমরা এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবস্থান করছি, এক সর্বব্যাপী জাহেলী সভ্যতার অধীনে জীবন যাপন করছি। এ সভ্যতার অধীন সমাজ, সংস্কৃতি, আইন, নৈতিকতা, চালচলন, আচার আচরণ সব কিছুই জাহেলিয়াত থেকে উদ্ভূত। এই জাহেলী সমাজের সাথেই তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে আজকের নারী সমাজকে। যখনই কোনাে নারী ইসলামী নীতি ও আদর্শের অনুসরণ করতে চায়, তখন সে এই জাহেলী সমাজের পক্ষ থেকে দুঃসহ চাপের সম্মুখীন হয়। চাই সে স্বতস্ফূর্তভাবে ইসলামের প্রেরণায় উজ্জীবিত হােক, অথবা তার স্বামী, ভাই বা পিতা তাকে ইসলামের দিকে পথনির্দেশ করে থাকুক। সেকালে নারী পুরুষ নির্বিশেষে গােটা সমাজ ইসলামের অনুসারী ছিলাে। আর আজকের যুগে পুরুষরা এমন এক আদর্শের অনুসরণ করে, যার কোনাে অস্তিত্ব বাস্তব জগতে নেই (অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের আকারে যে ইসলামের অস্তিত্ব নেই তার অনুসরণ করে)। আর এই আদর্শের কট্টর বিরােধী সমাজের চাপের মুখে নারী সমাজ দিশাহারা। বস্তুত সমাজ ও তার প্রচলিত কৃষ্টির চাপ পুরুষের কাছে যত প্রবল ও তীব্রভাবে অনুভূত হয়, নারীর কাছে অনুভূত হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশী। এ কারণে এ সমাজ পুরুষের দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রথমত তার দায়িত্ব দোযখ থেকে নিজেকে বাঁচানাে, অতপর তার পরিবার পরিজনকে বাচানো। তাই তাকে এই দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। তাহলে প্রথম মুসলিম সমাজে একজন পুরুষ এই দায়িত্ব পালন করার জন্যে যতোটা চেষ্টা সাধনা করতাে, সে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী চেষ্টা সাধনা করবে, আর ঠিক তখনই যে ব্যক্তি ইসলামী পরিবার গঠনে ইচ্ছুক, তার কর্তব্য হবে সর্ব প্রথমে এই দুর্গের প্রহরী হিসাবে এমন একজন উপযুক্ত মহিলাকে খুঁজে বের করা, যার চিন্তাধারা ইসলামেরই হুবহু অনুসারী। আর এটা করতে গেলে তাকে অনেক ত্যাগ ও কোরবানী দিতে হবে। তাকে সমাজের চোখ ধাঁধানো সংস্কৃতি এবং আধুনিকা নারীর মিথ্যা ছলনা বিসর্জন দিয়ে ধর্মপ্রাণ নারীর সন্ধান করতে হবে, যে তাকে ইসলামী পরিবার গঠনে ও ইসলামের দুর্গ নির্মাণে সাহায্য করবে। আর মুসলিম পিতারা যদি ইসলামের পুনরুজ্জীবন চান, তবে তাদের কর্তব্য হবে নব প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের ইসলামের ছাঁচে গড়ে তােলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারদান এবং নিজেকে ও পরিবারকে দোযখ থেকে বাঁচানাের জন্যে আল্লাহ তায়ালা যে আহবান জানিয়েছেন তাতে সাড়া দান। এই প্রসংগে একটি কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইসলামের স্বাভাবিক দাবী হলাে এমন একটি দল বা সমাজ গঠন করা, যা হুবহু ইসলামের অনুগত হবে এবং যে সমাজে ইসলামের বাস্তব অস্তিত্ব প্রচলিত ও প্রতিফলিত হবে। ইসলাম রচিতই হয়েছে এই উদ্দেশ্যে যে, একটি দল বা সমাজ এমন প্রতিষ্ঠিত হবে, যার আকীদা, মতবাদ ও মতাদর্শ, আইন ও বিধান এক কথায়, তার গােটা জীবনের বিধানই হবে ইসলাম আর এমন একটি সমাজই ইসলামী আদর্শকে ইসলাম বিরােধী সমাজের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। (সূরা সফের তাফসীর দ্রষ্টব্য) ইসলামী সমাজের গুরুত্ব কতখানি, উপরােক্ত বক্তব্যের আলােকে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এই সমাজেই মুসলিম নারী ও মুসলমান তরুণী বসবাস করে। ইসলামের নিরাপত্তা বেষ্টনীর কল্যাণেই সে বিদ্যমান জাহেলী সমাজের চাপ থেকে রক্ষা পায়। ইসলামী মতাদর্শের দাবী এবং প্রতিষ্ঠিত জাহেলী সমাজের রীতিনীতির টানাপড়েনে তার আবেগ-উদ্দীপনা হারিয়ে যায় না। তাকে জীবনসংগিনী হিসাবে পেয়ে মুসলিম যুবক ইসলামের দুর্গ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় এবং সেই দুর্গের ভিত্তিতে গঠন করে ইসলামী শিবির। বস্তুত এমন একটি ইসলামী সমাজ বা সংগঠন সৃষ্টি হওয়া অত্যন্ত জরুরী, যার সদস্যরা ইসলামের আনুগত্যের জন্যে পরস্পরকে উপদেশ দিতে ও সাবধান করতে থাকে, যে সমাজ ও সংগঠন ইসলামের চিন্তা চেতনা, নীতি ও চরিত্র, ধ্যান ধারণা ও চালচলনের লালন, বিকাশ সাধন ও সংরক্ষণ করে এবং তার দিকে বিভ্রান্ত জাহেলী সমাজকে ইসলামের বাস্তব নমুনা দেখিয়ে আহবান জানায়, যাতে সে অন্ধকার থেকে ইসলামের আলােতে আসার প্রেরণা পায় এবং শেষ পর্যন্ত একদিন আল্লাহর ইচ্ছায় ইসলামের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তী বংশধর জাহেলিয়াত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ইসলামের ছায়ার নিচে আশ্রয় নেয়। প্রথমে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করার স্বার্থেই রসূল(স.)-কে ইসলামের ও মুসলমানদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে।