بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৭৩/ এবং কাফের-রা বলে:-২০) [* তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে পাগল নও। :- *নিঃসন্দেহে তুমি নৈতিকতার অতি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন।:-] www.motaher21.net সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম। পারা:২৯ ১-৭ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৭৩/ এবং কাফের-রা বলে:-২০)
[* তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে পাগল নও। :-
*নিঃসন্দেহে তুমি নৈতিকতার অতি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন।:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।
পারা:২৯
১-৭ নং আয়াত:-
আয়তের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।:-১
نٓ وَ الۡقَلَمِ وَ مَا یَسۡطُرُوۡنَ ۙ﴿۱﴾
নূন, শপথ কলমের এবং লেখকরা যা লিখে চলেছে তার।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।:-২
مَاۤ اَنۡتَ بِنِعۡمَۃِ رَبِّکَ بِمَجۡنُوۡنٍ ۚ﴿۲﴾
তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে পাগল নও।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।:-৩
وَ اِنَّ لَکَ لَاَجۡرًا غَیۡرَ مَمۡنُوۡنٍ ۚ﴿۳﴾
আর নিশ্চিতভাবেই তোমার জন্য এমন পুরস্কার রয়েছে যা কখনো ফুরাবে না।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।:-৪
وَ اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ ﴿۴﴾
নিঃসন্দেহে তুমি নৈতিকতার অতি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।:-৫
فَسَتُبۡصِرُ وَ یُبۡصِرُوۡنَ ۙ﴿۵﴾
শীঘ্রই তুমি দেখবে এবং তারাও দেখবে।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।:-৬
بِاَىیِّکُمُ الۡمَفۡتُوۡنُ ﴿۶﴾
তোমাদের উভয়ের মধ্যে কারা পাগলামীতে লিপ্ত।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।:-৭
اِنَّ رَبَّکَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ۪ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ ﴿۷﴾
নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক অধিক অবগত আছেন যে, কে তাঁর পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি অধিক জানেন, কারা সৎপথপ্রাপ্ত।
সুরা: আল-ক্বলম

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৬৮

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : সূরাটির নাযিল হওয়ার সঠিক সময় নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় । সূরার প্রথমাংশেরও নয়, পুরাে সূরারও নয়। সূরার প্রথমাংশটিই যে প্রথমে এবং শেষ অংশ যে শেষে নাযিল হয়েছে, এটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। এমনকি এই শেষােক্ত ধারণা অগ্রগণ্য কিনা তাও নির্ধারণ করার উপায় নেই। কেননা সূরার প্রথমাংশ ও শেষাংশের আলােচ্য বিষয় একই রকম। বিষয়টি হচ্ছে আল্লাহর রসূলের ওপর কাফেরদের আক্রমণাত্মক ও মারমুখাে হয়ে ওঠা এবং তাকে পাগল বা ভুতে ধরা ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করতে থাকা। বেশ কিছু বর্ণনায় এটিকে সূরা ‘আলাক’-এর পর নাযিল হওয়া দ্বিতীয় সূরা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সংকলনে যে এই সূরাটি দ্বিতীয় সূরা হিসাবে সংকলিত হয়েছিলাে, সে ব্যাপারেও কারাে দ্বিমত নেই। কিন্তু সূরার পূর্বাপর বক্তব্য, আলােচ্য বিষয় ও বাচনভংগী আমাদেরকে এই মত পােষণে বাধ্য করে যে, এটি সূরা আলাকের অব্যবহিত পরে নাযিল হওয়া সূরা তো নয়ই; বরং খুব সম্ভবত সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াতের সূচনা হওয়ার বেশ কিছুকাল পরে এটি নাযিল হয়েছিলাে। ইসলামের এই সার্বিক দাওয়াতের সূচনা হয়েছিলাে ব্যক্তিগত পর্যায়ের দাওয়াত চালু হওয়ার প্রায় তিন বছর পর। এই সূরা নাযিল হওয়ার সময়ে কোরায়শরা ইসলামী দাওয়াতকে সর্বতােভাবে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছিলাে এবং তার বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে উঠেছিলাে। এ জন্যে তারা রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে সেই জঘন্য উক্তিও করতে পেরেছিলাে যে, ‘তুমি একটা পাগল (নাউযুবিল্লাহ!) আর কোরআনও এ উক্তি খন্ডন ও তার প্রতিবাদ করা এবং ইসলাম বিরােধীদেরকে হুমকিও দিতে শুরু করেছিলাে। এই সূরায় সেই হুমকি বর্ণিত হয়েছে। এরূপ ধারণাও প্রচলিত আছে যে, সূরার প্রথমাংশ হয়তাে সূরা আলাকের প্রথমাংশের পরে নাযিল হয়েছিলাে এবং এ সূরার শুরুতে যে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি পাগল নও’- তা হয়তাে রাসূল(স.)-এর নিজের ভীতি দূর করার জন্যেই বলা হয়েছে। কেননা ওহীর প্রথম দিকে তিনি নিজের সম্পর্কেই শংকিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর মাথায় কোনাে গােলমাল হয়ে গেলাে কিনা এবং ওহী তাই কোনাে উপসর্গ কিনা। কিন্তু এই ধারণাটি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। কেননা রাসূল(স.)-এতদূর ঘাবড়ে গিয়েছিলেন বা এতখানি শংকিত হয়ে পড়েছিলেন, এর সপক্ষে কোনাে প্রামাণ্য বর্ণনা নেই। তাছাড়া সূরার নিরবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা সাক্ষ্য দেয় যে, ‘তুমি পাগল নও’ এ উক্তিটি সূরার শেষাংশের এই উক্তির সাথে মিল রয়েছে, ‘কাফেররা কোরআন শােনার পর তাদের চোখ দিয়েই তােমাকে পদস্খলিত করে দিতে চায় এবং বলে যে, সে তাে পাগল।’ বস্তুত এ অপবাদটিকে সুরার শুরুতেই খন্ডন করা হয়েছে। আগাগোড়া সুসমন্বিত বক্তব্য সম্মিলিত এ সূরাটি পড়লে মনে প্রাথমিকভাবে এমন একটি ধারণাই সৃষ্টি হয়। কোনাে কোনো বর্ণনায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, এ সূরায় কিছু মাদানী আয়াত রয়েছে। এই মতানুসারে ১৭শ আয়াত থেকে ৩৩তম আয়াত এবং ৪২তম আয়াত থেকে ৫০তম আয়াতগুলাে মাদানী। প্রথমাংশ বাগানের মালিকদের ও তাদের ওপর আপতিত দুর্যোগ সংক্রান্ত। আর দ্বিতীয়াংশ মাছের পেটে প্রবিষ্ট হযরত ইউনুস(আ.)-এর ঘটনা সম্বলিত। আমাদের মতে এ মতটিও সঠিক নয়। আমাদের মতে গােটা সূরাই মক্কী। কেননা উল্লিখিত আয়াতগুলাের বক্তব্যে মক্কী ভাবধারার সুগভীর ছাপ বিদ্যমান। সূরাটির আগাগোড়া বক্তব্য যেহেতু মক্কী, তাই আয়াতগুলােকে সূরার আলােচ্য বিষয় ও আলােচিত সমসাময়িক পরিস্থিতির আলোকে বিবেচনা করাই অধিকতর সমীচীন। সামগ্রিক বিবেচনায় আমরা এই মতটিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি যে, সূরাটি নাযিল হওয়ার ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় সূরা নয় বরং এটি নবুওত লাভের বেশ কিছুকাল পর সাধারণ দাওয়াতের সূচনা হওয়ার পর নাযিল হয়েছে। কারণ প্রথমত এর আগেই এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিলাে যে, ‘তােমার ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়স্বজনকে সতর্ক করাে।’ দ্বিতীয়ত, অতীত জাতিসমূহের কাহিনীসমূহ বর্ণিত হয়েছে এমন বেশ কিছু সূরা ও আয়াত এর আগেই নাযিল হয়েছিলাে। আর সে জন্যে কাফেরদের কেউ কেউ ওগুলােকে ‘প্রাচীনকালের উপাখ্যান’ বলে আখ্যায়িত করেছিলাে। তৃতীয়ত, কোরায়শকে গােষ্ঠীগতভাবে ও সার্বিকভাবে ইসলাম গ্রহণের আহবান ইতিপূর্বেই জানানাে হয়েছিলাে। আর কোরায়শ এ দাওয়াতকে মিথ্যা অপবাদ ও সর্বাত্মক আগ্রাসী আক্রমণ দ্বারা রুখতে চেয়েছিলাে। এর প্রতিক্রিয়ায় কাফেরদের বিরুদ্ধে যে তীব্র নিন্দাবাদ ও সমালােচনা এই সূরায় ধ্বনিত হয়েছে এবং সূরার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে প্রচন্ড হুমকি উচ্চারিত হয়েছে, তা স্পষ্টই প্রমাণ করে যে, এ সূরা ইসলামী দাওয়াতের প্রাথমিক যুগে নয়; বরং কঠিন প্রতিরােধ ও চরম শত্রুতার যুগে নাযিল হয়েছিলাে। চতুর্থত, এ সূরার সর্বশেষ দৃশ্যও আমাদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে। শেষের দিকের এ আয়াতটি লক্ষণীয়, ‘কাফের স্মরণিকা (কোরআন) শ্ৰবনের পর তাদের চোখ দিয়েই তােমাকে পদস্খলিত করে দিতে উদ্যত হয় এবং বলে যে, সে তো একটা আস্ত পাগল।’ এই আয়াতটি এমন একটি পরিস্থিতির দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে, যখন বড় বড় জনসমাবেশে ব্যাপকভাবে আগে থেকেই দাওয়াত দেয়া চালু হয়ে গিয়েছিলাে। মক্কার কাফেররা প্রকাশ্য সমাবেশে কুরআন শুনে, তারপর ক্রোধে অধীর হয়ে চোখ পাকানো এবং রসূল(স.)-কে পাগল বলতাে । দাওয়াতের সূচনা কালে এ পরিস্থিতি ছিলাে না। তখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রচার চলতো, ব্যক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিকে গােপনে দাওয়াত দেয়া হতাে। কাফেরদের প্রকাশ্য সমাবেশে দাওয়াত দেয়া হতাে না। এ ধরনের দাওয়াতের কাজ বিশ্বস্ত সূত্র মতে দাওয়াতের সূচনার তিন বছর পর চালু হয়। পঞ্চমত, এই সূরায় এমন কিছু আভাস ইংগিতও রয়েছে, যা দ্বারা মনে হয় যে, তখন মােশরেকরা রাসূল(স.)-কে ইসলামের দাওয়াত পেশ করার ব্যাপারে কিছু আপােস রফার প্রস্তাব দিয়েছিলাে, যেন তিনি মাঝপথে স্বীয় কাজে বিরতি দেন। সূরার এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা চায় তুমি কিছু নমনীয় হও, তাহলে তারাও নমনীয় হয়।’ এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দাওয়াত চলাকালে হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য, কেননা তখন তাতে তাদের কানে ক্ষতির আশংকা ছিলাে না। প্রকাশ্য দাওয়াত শুরু হওয়ার পরই মােশরেকদের শংকা বোধ করার কথা ছিলাে এবং এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার সম্ভাবনা ছিল। এ সব যুক্তি ও সাক্ষ্য প্রমাণের আলােকে বলা যায় যে, এ সূরা ইসলামী দাওয়াতের সূচনাকালে নয় তারও বেশ কিছুদিন পরে নাযিল হয়ে থাকবে। মনে হয় দাওয়াতের সূচনা এবং এই সূরা নাযিলের মাঝখানে তিন বছরের কম তো নয়ই বরং বেশী সময়ও কেটে যেয়ে থাকতে পারে। আর এ কথাও বােধগম্য মনে হয় না যে, তিন বছরে কোরআনের মােটেই কোনাে আয়াত বা সূরা নাযিল হয়নি। বরং এ সময়ে বহুসংখ্যক সূরা এবং বহু সংখ্যক আয়াত নাযিল হয়ে থাকতে পারে, যাতে হয়তাে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এই সূরার মতাে কোনাে আক্রমণাত্মক সমালােচনা করা হয়নি, কেবল সাদামাটাভাবে ইসলামী আকীদা বিশ্বাসই প্রচারিত হয়েছে। তাই বলে এসব যুক্তিতর্ক দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, এই সূরা এবং সূরা মুযযাম্মিল ও সূরা মুদ্দাসসির দাওয়াতের প্রাথমিক যুগের সূরাই নয়, যদিও তা একেবারে প্রাথমিক ওহী নয়। প্রাথমিক ওহী না হওয়ার কারণগুলাে আমরা ওপরে উল্লেখ করেছি। সে কারণগুলাে সূরা আল মুজ্জাম্মিল ও মুদ্দাসসিরের বেলায়ও প্রযােজ্য। এখানে প্রসংগত এ কথাটি উল্লেখ করা দরকার যে, আরব ভূমিতে যখন ইসলামের চারাগাছটি প্রথম লাগানাে হয় তখন শুধু আরব উপদ্বীপে নয়; বরং সমগ্র পৃথিবীতে বিরাজমান জাহেলিয়াতের কাছে তা একেবারেই অচেনা মনে হয়েছিলাে। এরূপ মনে হওয়ার কিছু কারণও ছিলো। আরবে জাহেলিয়াত নিজেকে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর উত্তরাধিকারী হবার দাবী করতাে। এটা ছিলাে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর আদর্শের সুস্পষ্ট বিকৃতি। কোরায়শী পৌত্তলিকরা তাদের এই ধর্মীয় ভন্ডামীকে রকমারি মিথ্যা ও মনগড়া কিচ্ছা-কাহিনীর আড়ালে লুকিয়ে রাখতাে। তাদের সমাজে বহু সংখ্যক হাস্যকর আকীদা-বিশ্বাস, রসম-রেওয়ায ও পূজা উপাসনা চালু ছিলাে। রসূল(স.) তাদের কাছে যে ধর্ম পেশ করলেন, তা মৌলিক নীতিমালা ও আদর্শের দিক দিয়ে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর মূল ধর্মের সাথে শুধু যে সামঞ্জস্যশীল ছিলাে তাই নয়, বরং তা এতাে নিখুঁত, নির্ভেজাল, স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও সহজ, সরল এবং এতাে পূর্ণাংগ ছিলাে যে, বিশ্ব মানবতার সর্বশেষ ও সর্বাপেক্ষা যুক্তিযুক্ত বিধান হবার যােগ্য প্রমাণিত হয়েছিলাে। ইবরাহীম(আ.) দ্বীনের নামে পৌত্তলিক কোরায়শদের ভন্ডামীর সাথে এই সত্যিকার ইসলামী ও ইবরাহীমী আদর্শের ব্যবধান এতাে বেশী ছিলাে যে, প্রথমটি থেকে দ্বিতীয়টিতে উত্তরণ ছিলাে এক বিরাট ও সর্বাত্মক পরিবর্তনের শামিল। কোরায়শরা এটা মেনে নিতে ও বরদাশত করতে রাজী ছিলাে না। কোরায়শ পৌত্তলিকরা এক আল্লাহর পরিবর্তে শত শত উপাস্য মানতো। ফেরেশতা, জ্বিন ও তাদের আত্মার প্রতিমূর্তির পূজা করতো। কোরআন তাদের সামনে পেশ করলাে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সত্তাকে, তার শক্তিমত্তা ও আর সকল সৃষ্টির সাথে তার ইচ্ছাকে অপরিহার্য শর্ত হিসাবে সংযুক্ত করলাে। পৌত্তলিকদের উক্ত আচরণটির সাথে কোরআনের এই দাওয়াতের ব্যবধান এতাে দুস্তর ছিলে যে, প্রথমটি পরিত্যাগ করে দ্বিতীয়টিকে গ্রহণ করা তাদের কাছে ছিলাে কল্পনারও অতীত। একদিকে ছিলাে আরব উপদ্বীপের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় পুরােহিত সম্প্রদায়, কা’বার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়ােজিত অভিজাত গােত্রীয় সরদাররা এবং তাদের চেয়ে নিচু জাত বলে বিবেচিত সাধারণ আরববাসী। আর অপরদিকে ছিলো কোরআন প্রবর্তিত সরলতা, আল্লাহর চোখে সকল মানুষের সমতা এবং কোনাে পুরােহিত ইত্যাদি ছাড়াই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের মাঝে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের তত্ত্ব। এই দুয়ের মাঝেও ছিলাে দুস্তর ব্যবধান, যা অতিক্রম করা মােটেই সহজ ব্যাপার ছিলাে না। তৎকালে জাহেলী সমাজে যে নৈতিক মূল্যবােধ প্রচলিত ছিলাে, তার সাথেও কোরআন বর্ণিত ও রসূল(স.)-এর পেশ করা নৈতিকতার সাথে দুস্তর ব্যবধান ছিলাে। শুধুমাত্র এই ব্যবধান নতুন মতাদর্শের সাথে কোরায়শ, তাদের চিন্তাধারা ও চরিত্রের সংঘাত বেধে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলাে। অথচ সেখানে শুধুমাত্র এই ব্যবধানই ছিলাে না বরং এর পাশাপাশি আরাে অনেক সামাজিক ধ্যান ধারণা ও চিন্তাধারা এমন ছিলাে, যা কোরায়শ নেতাদের কাছে হয়তাে তাদের ধর্মের চেয়েও অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিলাে। সামাজিক উঁচু নিচু ও আভিজাত্যবােধ তথা কৌলিন্য প্রথা এতাে প্রবল ছিলাে যে, কোরআনের বর্ণনা মােতাবেক এর প্রভাবে একজন বলে বসেছিলাে, ‘এই কোরআন দুই শহরের কোনাে প্রধান ব্যক্তির কাছে নাযিল হলাে না কেন?’ দুই শহর বলতে এখানে বুঝানাে হয়েছে মক্কা ও তায়েফকে। রসূল(স.)-এর উচ্চ বংশীয় মর্যাদা থাকা সত্তেও নবুওতের পূর্বে তিনি তেমন কোনাে সমাজপতি বা গােত্রপতি ছিলেন না। মক্কার কোরায়শ বংশ ও তায়েফের সাফীদ বংশে গােত্রপতির মর্যাদা ছিলো সব কিছুর উর্ধে। তাই সেসব সরদার ও মােড়লদের পক্ষে মােহাম্মদ(স.)-এর আনুগত্য মেনে নেয়া সহজ ছিলাে না। গােত্রীয় বা পারিবারিক আভিজাত্যবােধও এমন এক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছিলাে, যা আবু জেহেলের মতাে ব্যক্তিকে সত্য বাণীকে শুধুমাত্র এই বিবেচনায় প্রত্যাখ্যান করতে প্ররােচিত করেছিলাে যে, নবী(স.) বনু আবদে মানাফ গােত্রে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এ সংক্রান্ত ঘটনাটি এই যে, একবার আবু সুফিয়ান, আখনাস বিন শুরাইয়া ও আবু জেহেল বিন হারব কোরায়শের এই তিন দিকপাল রসূল(স.)-এর কোরআন তেলাওয়াত শােনার আগ্রহ কোনােভাবেই দমন করতে না পেরে একদিন গভীর রাতে বেরিয়ে পড়লাে। তার রসূল(স.)-এর বাড়ীর পাশে এক গোপন জায়গায় বসে সারা রাত কোরআন শুনলাে। এভাবে পর পর তিন রাত তারা শুনলাে। প্রতি রাতেই তারা পরস্পরে অংগীকারবদ্ধ হতাে যে, তারা এখানে আর আসবে না। কারণ কেউ দেখে ফেললে তাদের সম্পর্কে কোনাে বিরূপ ধারণা পোষণ করতে পারে। পরে আখনাস বিন শুরাইক আবু জেহেল এর কাছে জিজ্ঞাসা করল যে, মোহাম্মদের কোরআন আবৃত্তি শোনার পর তোমার মনোভাব কি? সে বলল, ‘কি আর শুনবাে? আসল কথা হলাে, বনু আবদে মানাফের সাথে আমাদের চিরকাল একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলাে। তারা মানুষকে খাইয়েছে, আমরা খাইয়েছি। তারা সামাজিক দায়দায়িত্ব বহন করেছে, আমরাও করেছি। তারা ছদকা করেছে, আমরাও করেছি। এমনকি আমরা যখন পাশাপাশি দুই ঘােড়ার মতাে ছুটেছি, তখন তারা হঠাৎ দাবী করে বসলাে যে, আমাদের ভেতরে একজন নবী আছে, তার কাছে আকাশ থেকে ওহী আসে। এমন কৃতিত্ব আমরা কবে দেখাতে পারবাে? আল্লাহর কসম, আমরা কখনাে তার প্রতি ঈমান আনবাে না এবং তাকে স্বীকার করবাে না।’ এই সব জাহেলী গােষ্ঠী বিদ্বেষ ও উগ্র জাত্যাভিমান ছাড়াও আরাে কিছু বিচার বিবেচনা আরব সমাজে এমনও ছিলাে, যার কারণে কোরায়শরা ইসলামের নব উদ্গত চারা গাছটিকে উপড়ে ফেলতে চাইছিলাে। এই সব বিচার বিবেচনার কোনাে নৈতিক বা মানবিক মূল্যবােধের সাথে নয় বরং শুধু জাহেলী চিন্তাচেতনা থেকে উদ্ভূত ব্যক্তিগত শ্রেণীগত বা গােত্রীয় স্বার্থপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাে। ইসলামের চারা গাছটির শিকড় মজবুত হওয়া ও শাখা প্রশাখা বিস্তারের আগেই তারা তাকে সমূলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলাে, কেননা পরে হয়তাে এ কাজ করা দুরূহ হয়ে যাবে। বিশেষত যখন ইসলাম ব্যক্তিগত দাওয়াতের যুগ পেরিয়ে সামষ্টিক দাওয়াতের যুগে প্রবেশ করেছে। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবীকে(স.) প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন। ফলে দাওয়াতের নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। কোরআন জাহেলিয়াতের প্রতিবাদ ও প্রতিরােধ করতে আরম্ভ করেছে এবং শিরকী আকীদা বিশ্বাস ও ভ্রান্ত চিন্তাধারার অযৌক্তিকতা প্রমাণ করে দিয়েছে, তখন হয়তাে পরে আর কখনাে এ সুযােগ আসবেই না। রসূল(স.) যদিও একজন নবী ছিলেন, স্বীয় প্রভুর কাছ থেকে ওহী লাভ করতেন এবং আল্লাহর উর্ধতন ও ঘনিষ্টতম ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তথাপি তিনি তো মানুষই ছিলেন। মানবীয় আবেগ উত্তেজনা তাকে মাঝে মাঝে বিব্রত করতাে। মােশরেকরা তার বিরুদ্ধে যে সহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাে এবং যে যুদ্ধ তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলাে, তা তাকে ও তার মুষ্টিমেয় মােমেন সাহাবাদেরকে জর্জরিত ও অস্থির করে তুলেছিলাে। মোশরেকরা রসূল(স.)-কে যে সব আজেবাজে কথা বলে কটাক্ষ করতাে ‘পাগল’ বলাও তার অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। আর এ ছাড়াও আরাে অনেক বিদ্রুপের বানে স্বয়ং রসূল(স.)-কে এবং তাঁর সাহাবীদেরকে বিদ্ধ করতাে—এ সবই তাদেরকে শুনতে হতাে। এ সব বিদ্রুপ ও মশকরা কোরআনের বিভিন্ন সূরায় বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও সাহাবীদের অনেকে নিজের ঘনিষ্টজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের দৈহিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হতাে। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, উপহাস-কটাক্ষ প্রত্যেক মানুষকে যতখানি ব্যথিত ও মর্মাহত করে, ততখানি আর কোনটাই করে না। এমনকি তার শিকার যদি খোদ রসূলও হন, তবে তিনিও এর ব্যতিক্রম নন। এ কারণেই আমরা আমপারার সূরা গুলো সহ সকল মক্কী সূরায় দেখতে পাই যে, আল্লাহ তায়ালা যেন রসূল(স.) ও তাঁর সাহাবীদেরকে কোলে নিয়ে আদর করছেন, তাদেরকে সান্তনা ও প্রবােধ দিচ্ছেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করছেন, তাদের প্রশংসা করছেন। ইসলামী দাওয়াতে ও রাসূল(স.)-এর ব্যক্তিত্বে ইসলামের যে চারিত্রিক মহত্ব ফুটে উঠেছে তা প্রকাশ করছেন। মােশরেকরা তাদের বিরুদ্ধে যেসব মনগড়া কথা বলে, তা খন্ডন করছেন এবং এই বলে দুর্বল মুসলিমদের আশ্বাস দিচ্ছেন যে, ‘তোমাদের শত্রু যত শক্তিশালীই হােক না কেন, তাদের নিয়ে তােমরা মাথা ঘামিও না, তােমাদের পক্ষে আমিই তাদের সাথে লড়বাে।’ সূরা আল-কালামের শুরু থেকেই আমরা রসূল(স.) সম্পর্কে এ ধরনের কথাবার্তা উচ্চারিত হতে দেখি । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কলমের শপথ এবং লােকেরা যা লিখে তার শপথ, তুমি স্বীয় প্রতিপালকের অনুগ্রহে পাগল নও। নিসন্দেহে তােমার জন্যে চিরস্থায়ী প্রতিদান রয়েছে। নিসন্দেহে তুমি এক সুমহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছো।’ দ্বিতীয় রুকুতে মােমেনদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এ সূরায় বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহভীরুদের জন্যে তাদের প্রতিপালকের কাছে নেয়ামতে পরিপূর্ণ বাগিচা রয়েছে। আমি কি মুসলিমদেরকে অপরাধীদের মতাে করে দেবাে? তােমাদের কি হয়েছে? এ কি ধরনের সিদ্ধান্তে তােমরা উপনীত হচ্ছে?’ অপর এক জায়গায় রসূল(স.)-এর জনৈক কট্টর দুশমন প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা বলেন, সেই ব্যক্তির অনুসারী হয়াে না, যে ব্যক্তি কথায় কথায় শপথ করে, অত্যধিক পরনিন্দুক ও চোগলখোর। সৎ কাজে বাধা দানে অতীব তৎপর, অত্যাচারী ও পাপিষ্ট, অতি মাত্রায় অহংকারী ও জারজ, প্রচুর সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির অধিকারী হওয়ার কারণে যার এতাে স্পর্ধা, যার সামনে কোরআন পাঠ করা হলেই বলে ওঠে, ‘সব তা সেকেলে কিচ্ছা কাহিনী। অচিরেই আমি তার শুঁড়ে দাগ দিয়ে দিবাে।’ অতপর যারা ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে তাদের সকল শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সুতরাং আমাকে এবং এই বাণীকে যে প্রত্যাখ্যান করে, তাকে তুমি ছেড়ে দাও। আমি প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে এমনভাবে তিলে তিলে শেষ করে দেবাে যে তারা টেরই পাবে না। আমি তাদেরকে ঢিল দেবাে। আমার কৌশল খুবই সুক্ষ্ম।’ এই কৌশল আখেরাতের সেই আযাবের অতিরিক্ত, যা অহংকারীদের অহংকারকে ধুলায় মিশিয়ে দেবে। যে দিন অত্যন্ত সংকটজনক পরিস্থিতি দেখা দেবে এবং তাদেরকে সেজদা করার আহবান জানানাে হবে, কিন্তু তারা তা করতে পারবে না। তাদের চোখ থাকবে আনত এবং তারা ঘােরতর লাঞ্ছনার শিকার হবে। অথচ ইতিপূর্বে তাদেরকে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় সেজদার জন্যে ডাকা হতো। অহংকারের পরিণাম প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা একটা বাগানের মালিকদের ঘটনাকে দৃষ্টান্ত হিসাবে এখানে উল্লেখ করেছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ধনবল ও জনবলে বলীয়ান হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী কুচক্রী কোরায়শ নেতাদের শাসানাে ও ভয় দেখানাে। সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা রাসূল(স.)-কে তাই অটুট ধৈর্য অবলম্বনের উপদেশ দিয়েছেন। ‘তোমার প্রভুর নির্দেশের জন্যে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করাে এবং মাছের পেটের অধিবাসীর মতাে হয়াে না।’ এই সান্তনা সহানুভূতি প্রশংসা ও প্রবােধসূচক বক্তব্য এবং ইসলামী দাওয়াত অস্বীকারকারিদের প্রতি কঠোর আক্রমণাত্মক ও হুমকিসূচক বক্তব্য উচ্চারণের পর আল্লাহ তায়ালা একই ধরনের কঠোর ভাষায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এসব কিছুর মধ্যদিয়ে আমরা সেই সময়কার মুসলমানদের কিছু বৈশিষ্টের সন্ধান পাই। সেটা ছিলাে মুসলমানদের দুর্বলতা ও সংখ্যা স্বল্পতার যুগ, তাদের জন্যে এক দুর্বিষহ কঠিন সময়। সেটা ছিলাে সেই শত্ৰু ভূখন্ডে দ্বীনের সেই মহতী চারাগাছটিকে রােপনের জন্যে মােমেনদের দুঃসাহসী চেষ্টার এক পবিত্র মুহূর্ত। অনুরূপভাবে সূরার বাচনভংগী ও বিষয়বস্তুর মধ্য দিয়ে আমরা সেই সময়কার ইসলামী আন্দোলন কি ধরনের পরিবেশ ও পরিস্থিতির সম্মুখীন ছিলাে তাও জানতে পারি। সেই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তৎকালীন চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, আবেগ অনুভূতি, চেতনা এবং সমস্যা সব কিছুতেই একটি আদিমতার ছাপ পরিস্ফুট ছিলাে। ইসলামী আন্দোলনের প্রতিরােধে তারা যে কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিলাে, তাতেই আমরা এই আদিমতার সাক্ষাৎ পাই। তারা রসূল(স.) কে ‘পাগল’ বলেছিলাে। এই অপবাদটি আরােপে বিন্দুমাত্রও বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করা হয়নি। কোনরূপ যুক্তি ও ভূমিকা ছাড়াই নবীর প্রতি অশ্রাব্য গালি ছুঁড়ে মারা ছাড়া তারা দ্বিমত প্রকাশের আর কোনাে ভাষাই খুঁজে পায় না, সভ্যতার সেই আদিম স্তরের লােকদের রীতিই এটা। আদিম স্তরের মানুষের উপযােগী এই ভাষার সরলতা আমরা দেখতে পাই তাদের মিথ্যা অপবাদ খন্ডনে আল্লাহ তায়ালা যে ভাষা প্রয়ােগ করেছেন তাতেও। তিনি বলেন, ‘তােমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি পাগল নও। তোমার জন্যে রয়েছে চিরস্থায়ী প্রতিদান। তুমি প্রতিষ্ঠিত আজ এক সুমহান চরিত্রের ওপর। অচিরেই তুমি দেখতে পাবে-দেখতে পাবে তারাও তােমাদের দু’পক্ষের মধ্যে কোনাে পক্ষ ভ্রান্তির মধ্যে আছে।’ অনুরূপভাবে এটা দেখতে পাই সূরার এ আয়াতে ঝংকৃত প্রকাশ্য রােষ কষায়িত হুংকারে, ‘আমাকে ও আমার বাণী প্রত্যাখ্যানকারীকে ছেড়ে দাও, আমি তাদেরকে পর্যায়ক্রমে (অধপতনের শেষ স্তরে) এমনভাবে নিয়ে যাবাে যে, তারা টেরও পাবে না। আমি তাদেরকে ঢিল দিয়ে দেই। আমার কৌশল অত্যন্ত সূক্ষ্ম।’ ভাষার এই সরলতা কাফেরদের এক ব্যক্তির ওপর পাল্টা গালাগাল বর্ষণের মধ্য দিয়েও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, নিন্দুক ও চোগলখাের, সৎ কাজে বাধা দানকারী, সীমাতিক্রমকারী পাপিষ্ঠ, ধিকৃত ও জারজ।…’ তুমি সেই ব্যক্তির অনুসরণ করাে না যে ঘন ঘন শপথ করে, যে অত্যন্ত নীচ, যে অতিশয় ভাষার উক্ত সরলতা আমরা বাগানের মালিকদের সংক্রান্ত সেই ঘটনাতেও দেখতে পাই, যা আল্লাহ তায়ালা এখানে দৃষ্টান্ত হিসাবে পেশ করেছেন। এটি ছিলাে এমন একটি দলের ঘটনা, যারা আপন চিন্তাধারায়, ধ্যান ধারণায়, অহংকারে, কথাবার্তায় ও চালচলনে অসভ্য ও নির্বোধ মানুষের মতই সরল ছিলাে। সূরার এক জায়গায় তাদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে, “তারা অতি সংগোপনে এরূপ শলাপরামর্শ করতে করতে রওনা হলাে যে, ‘আজ বাগানের ভেতরে কোনাে মিসকীনই যেন ঢুকতে না পারে।…’ সর্বশেষে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি যে বিতর্কের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তাতেও একই ধরনের সরল ও সহজবােধ্য বাচনভংগী দেখতে পাই, ‘তোমাদের কাছে কোনাে কিতাব আছে নাকি, যা তােমরা পড়ো? তাতে কি তােমাদের অতি পছন্দনীয় কথাবার্তা আছে? তােমাদের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর কেয়ামত পর্যন্ত এমন কোনাে শপথ চাপানাে রয়েছে কি, যার ভিত্তিতে তােমাদের যা ইচ্ছে তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে। হে নবী! ওদেরকে জিজ্ঞেস করো যে, এ সব বিষয়ে জবাব দেয়ার দায়িত্ব কে নেবে?’ এ সব প্রশ্ন থেকে বুঝা যায় মােশরেকরা কি ধরনের চিন্তাগত বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাে। সেই সাথে কোরআনের বিশিষ্ট বাচনভংগীর মাধ্যমে রাসূল(স.)-এর জীবনের ঘটনাবলী জানা যায়, জানা যায় ইসলামী দাওয়াত কি কি অবস্থার মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছিলাে, কোরআন সেই পরিবেশ এবং ইসলামী আন্দোলনে নিয়ােজিত সেই দলটিকে রাসূল(স.)-এর জীবনের শেষভাগে কতখানি উন্নীত করেছিলাে এবং তাকে সেই প্রাক ইসলামী জাহেলী চিন্তাধারা, ধ্যান ধারণা, চেতনা, মূল্যবােধ ও নির্বোধ সুলভ সরলতার স্তর থেকে কত উচ্চে উত্তোলন করেছিলাে। কোরআনের বর্ণনা থেকে আরাে জানা যায়, কুরআন থেকে হেদায়াত লাভের পর তাদের জীবনে, আকীদা বিশ্বাসে, ধ্যান-ধারণায়, মূলবােধে, আবেগ-অনুভূতিতে ও বাস্তবতায় মাত্র বিশ বছরের মধ্যে কি আমূল পরিবর্তন এসেছিলাে। বিশ বছর যদিও জাতিসমূহের জীবনে নিতান্তই অনুল্লেখযােগ্য একটি সময়, তবুও সেই সংক্ষিপ্ত সময়ে তাদের জীবনে যে সর্বব্যাপী ও সুদূরপ্রসারী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলাে, সমগ্র মানবেতিহাসে তার তুলনা নেই। সেই বিপ্লবের বদৌলতে তারা গােটা মানব জাতির নেতৃত্ব হস্তগত করেছিলাে এবং তাদের চিন্তাধারা ও স্বভাবচরিত্রের এতাে উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধন করেছিলাে, যা ইতিহাসে আর কখনাে সাধিত হয়নি। সেই নজিরবিহীন বিপ্লব সাধিত হয়েছিলাে আকীদা বিশ্বাসের ধরন ও গুণমানে, মানুষের পার্থিব জীবনে সেই আকীদা বিশ্বাসের বাস্তব রূপায়নে, সমগ্র মানবজাতিকে উদারতা ও সহমর্মিতার এক অখন্ড ও বিশালকার বৃত্তে সমবেতকরণ ও একীভূতকরণে, সর্বোপরি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের যাবতীয় চেতনাগত, চিন্তাগত, সামাজিক ও সাংগঠনিক প্রয়ােজন পূরণে তাদের জীবনে সংঘটিত এই সর্বাত্মক বিপ্লব ছিলাে আসলেই একটা অলৌকিক ঘটনা। এ বিপ্লব এবং এই সর্বাত্মক পরিবর্তন নিছক একটি সংখ্যালঘুকে সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত করা এবং একটি দুর্বল মানবগােষ্ঠীকে শক্তিমানে পরিণত করার চেয়ে অনেক বড় ও ব্যাপক ব্যাপার। কেননা ব্যক্তি মানুষের মনমানস ও স্বভাব চরিত্র গঠন গােষ্ঠী ও সমাজ মানস গঠনের চেয়ে অনেক কঠিন কাজ। তাফসীর এবার সূরার তাফসীরে মনােনিবেশ করা যাক।

সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-১

نٓ وَ الْقَلَمِ وَ مَا یَسْطُرُوْنَۙ

নূন, শপথ কলমের এবং লেখকরা যা লিখে চলেছে তার।

ফী জিলালিল কুরআন:

*কলমের শপথ : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নুন, কলমের শপথ এবং যা কিছু লােকেরা লিখে তার শপথ!… আমি অচিরেই তাকে তার শুড়ে দাগ দিবাে।’ সুরাটির শুরুতে আল্লাহ তায়ালা নুন ও কলম-এর শপথ করেছেন। নুন অক্ষরটির সাথে কলম লেখার এ সম্পর্ক কত ঘনিষ্ঠ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কলম ও লেখার নামে শপথ করার অর্থ হলাে এর মর্যাদাকে বড় করে তুলে ধরা এবং যে আরব জাতি এই পদ্ধতিতে জ্ঞান অর্জনে অভ্যস্ত ছিলো না তাকে এটা শেখার আদেশ দান করা। আরবে লেখার প্রচলন ছিলাে খুবই কম আর তাও ছিলাে খুবই নিম্নমানের। অথচ আল্লাহর জানা ছিলাে যে, এ সময় সে জাতিটির একটা বিশেষ ভূমিকা পালনের সময় ঘনিয়ে এসেছিলাে এবং সে জন্যে এই যােগ্যতার সৃষ্টি হওয়া ও তা তাদের মধ্যে বিস্তার লাভ করা খুবই জরুরী হয়ে উঠেছিলাে। কেননা ইসলামী আকীদা বিশ্বাসকে ও এই আকীদা ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থাকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া ও মানব জাতিকে প্রাপ্ত নেতৃত্ব দানের জন্যে এর প্রয়ােজন ছিলাে। এ বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্যে লেখা ও লেখনী যে একটা মৌলিক উপাদান সে বিষয়ে সন্দেহের কোনাে অবকাশই নেই। ‘পড়ো’; এ কথা দিয়ে ওহীর শুরু হলাে কেন? সূরা আলাক-এর প্রারম্ভিক আয়াতগুলাে দিয়ে পবিত্র কোরআন নাযিলের উদ্বোধন থেকেও উপরােক্ত তাৎপর্যের সমর্থন মিলে । তাতে বলা হয়েছে, ‘তুমি পড়াে তােমার মালিকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়াে, আর তােমার প্রভু হচ্ছেন সেই সর্বাধিক সম্মানিত সত্তা, যিনি কলম দ্বারা শিখিয়েছেন, মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানতাে না।’ আলােচ্য আয়াতে নিরক্ষর নবী(স.)-কে সম্বোধন করা থেকেও উক্ত তাৎপর্যের সমর্থন পাওয়া যায়। একটি সুনির্দিষ্ট মহৎ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা তাকে নিরক্ষর নবী করে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নিলেও তার কাছে পাঠানাে প্রথম ওহীতেই পড়া ও কলম দিয়ে শেখার বক্তব্য সন্নিবেশিত করলেন। শুধু তাই নয়, আরাে জোরদার মনােযােগ আকর্ষণীয় সংকেত দেয়া হলাে, ‘নুন’ অক্ষরের নামে, কলমের নামে এবং যা লােকেরা লিখে তার নামে শপথ করার মাধ্যমে। এটি ছিলাে আসলে মুসলিম জাতিকে প্রশিক্ষণ দান এবং আল্লাহর গুপ্ত জ্ঞান ভান্ডারে রক্ষিত পরিকল্পনার আওতাধীন বিশাল মহাজাগতিক ভূমিকা পালনে তাকে প্রস্তুত করার জন্যে আল্লাহর বিধান সংক্রান্ত একটি পাঠচক্র। আগেই বলে এসেছি যে, একমাত্র লেখার কাজটির গুরুত্ব ও মহত্বের প্রতি ইংগিত করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তায়ালা নুন, কলম ও লিখার শপথ করেছেন। এর দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য হলাে স্বীয় রসূলের ওপর মােশরেকদের আরােপিত অপবাদ খন্ডন। শুধু খন্ডন নয়, আল্লাহ তায়ালা সে অপবাদকে অসম্ভব ও সুদূর পরাহতও প্রমাণ করেছেন। কেননা তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহই প্রমাণ করে যে, তার ওপর আরােপিত অপবাদ সত্য হতে পারে না।

সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-৩

وَ اِنَّ لَكَ لَاَجْرًا غَیْرَ مَمْنُوْنٍۚ

আর নিশ্চিতভাবেই তোমার জন্য এমন পুরস্কার রয়েছে যা কখনো ফুরাবে না।

 

ফী জিলালিল কুরআন:

*মুহাম্মদ(স.) সম্পর্কে কাফেরদের ধারণা : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তােমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ তুমি পাগল নও।’ এই ক্ষুদ্র আয়াতে আল্লাহ তায়ালা একটা বিষয় প্রমাণ করতে এবং আরেকটি বিষয় খন্ডন করতে চান। প্রমাণ করতে চান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ তার নবীর ওপর রয়েছে। তােমার প্রতিপালক এই শব্দ দ্বয়ের প্রয়ােগে যে ঘনিষ্ঠতা ও প্রীতির ভাব প্রতিফলিত হয়, তা থেকেই। অনুগ্রহের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আবার এই একই কথা দ্বারা এই মর্মেও আভাস পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তায়ালা তার যে বান্দাকে নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন, ঘনিষ্ঠ করেছেন ও আপন করে নিয়েছেন, তার ওপর একই সাথে অনুগ্রহও বিতরণ করবেন এবং তাকে পাগলও বানাবেন এটা হতে পারে না। রাসূল(স.)-এর জীবনেতিহাসের ক্ষেত্রে যে কোনাে পাঠকের কাছেই এটা একটা নিদারুণ বিস্ময়ের ব্যাপার যে, যে মােশরেকরা নবুওতের অনেক বছর আগে রসূল(স.)-কে তাদের ভেতরের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ বলে স্বীকার করতাে, এমনকি হাজরে আসওয়াদ সরানাের ব্যাপারে তারা তাকে শালিসও মেনেছিলাে, তারাই কিনা তাকে নবুওতের পর পাগল বলে সাব্যস্ত করলাে! তারা তাকে শুধু যে অধিকতর বুদ্ধিমান মনে করতাে তা নয় বরং আল আমীন অর্থাৎ বিশ্বাসী ও সৎ উপাধিও তারা তাকে দিয়েছিলাে। তারা তাঁর কাছে তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র ও টাকাকড়ি গচ্ছিত রাখতে, এমনকি এমন প্রচন্ড শত্রুতার মধ্যে হিজরতের দিনও তার কাছে অনেকের আমানত গতি ছিলাে। সে জন্যে হযরত আলী(রা)-কে রাসূল(স.)-এর হিজরতের পরেও কিছুদিন মক্কায় থাকতে হয়েছিলাে, যাতে তিনি রাসূল(স.)-এর পক্ষ থেকে সেসব গচ্ছিত জিনিস ফেরত দিতে পারেন। অথচ তখন তার সাথে মােশরেকদের ঘােরতর শত্রুতা চলছিলাে। মক্কার মােশরেকরা তার নবুওত লাভের আগে তাকে একটিও মিথ্যা কথা বলতে শােনেনি। রােম সম্রাট হিরাক্লিয়াস যখন রসূল(স.)-এর দূত আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন, তােমরা কি তাকে তার নবুওতের আগে মিথ্যাবাদিতার দায়ে অভিযুক্ত করতে। আবু সুফিয়ান এর জবাবে বললাে, না। অথচ সে ইসলাম গ্রহণের আগে রসূল(স.)-এর কট্টর দুশমন ছিলো । হিরাক্লিয়াস বললেন, তিনি যখন মানুষের সাথে মিথ্যা বলেন না, তখন আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবেন কেমন করে। যে ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত মানুষটিকে তারা নিজেদের ভেতরে সবচেয়ে বিচক্ষণ ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী মনে করতাে, তার বিরুদ্ধে তারা কিভাবে এ জাতীয় অভিযোেগ আরােপ করলাে তা ভাবলে মানুষ মাত্রেই বিস্ময়ে স্তম্ভিত না হয়ে পারে না। ক্রোধ ও বিদ্বেষ তাদেরকে এতাে দূরে নিয়ে গিয়েছিলাে যে, জেনে শুনেও এমন ভুল কথা তারা বলতে পেরেছিলাে। আসলে হিংসা মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে দেয়। আর স্বার্থপরতা মানুষকে যে কোনাে মিথ্যা অপবাদ আরােপ করতে প্ররােচিত করে। এতে সে মােটেই কুণ্ঠাবোধ করে না। অথচ অপবাদ আরােপকারী নিজের সম্পর্কে অন্য যে কোনাে লােকের আগে এ কথা জানে যে, সে নিজেই এক ভয়ংকর মিথ্যাবাদী এবং মহাপাপী। তাই পরম স্নেহ, মমত্ব ও শ্রদ্ধাবােধ সহকারে কাফেরদের সেই হিংসা এবং সেই মিথ্যা অপবাদের জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি পাগল নও।’ তারপর বলা হচ্ছে, “নিশ্চয় তােমার জন্যে রয়েছে চিরস্থায়ী প্রতিদান।’ গাইরি মামনুন শব্দের অর্থ হচ্ছে অব্যাহত, অপ্রতিহত ও অফুরন্ত। অর্থাৎ তোমার যে প্রতিপালক তােমাকে নবুওতের মতাে নেয়ামত দিয়েছেন, তার কাছে তােমার জন্যে অফুরন্ত প্রতিদান রয়েছে। এখানেও আপন করে নেয়ার ইংগীত স্পষ্ট। সকল রকমের বঞ্চনা, লাঞ্চনা, যুলুম ও মােশরেকদের আরােপিত অপবাদের ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রবােধ দান এ আয়াতের মূল বক্তব্য। বস্তুত যাকে তার প্রতিপালক পরম স্নেহ, সমাদর ও মর্যাদা সহকারে বলেন যে, তােমার প্রতিপালকের কাছে তােমার অফুরন্ত পুরস্কার রয়েছে, তার হারানাের কি থাকতে পারে।
সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-৭

اِنَّ رَبَّكَ هُوَ اَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِیْلِهٖ١۪ وَ هُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِیْنَ

তোমার রব তাদেরকেও ভাল করে জানেন যারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আর তাদেরকেও ভাল করে জানেন যারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষ্য : এর পরই আসছে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য ও পরম সম্মান নির্ধারণী ঘােষণা, ‘নিশ্চয়ই তুমি অত্যন্ত মহান চরিত্রের অধিকারী।’ নবী(স.)-এর এ প্রশংসায় সমগ্র সৃষ্টিজগত মুখরিত হয়ে ওঠে। স্বয়ং বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর মুখ থেকে উচ্চারিত এই সুমহান প্রশংসা বাণীর মূল্য যে কত, তা লিখে ব্যক্ত করা লেখনীর সাধ্যাতীত এবং কল্পনা শক্তির কল্পনারও অতীত। এ হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহর সাক্ষ্য, আল্লাহর নিজস্ব মানদন্ডে নিজের একান্ত প্রিয় বান্দার মূল্যায়ন। সে মূল্যায়ন হচ্ছে এই যে, তুমি অতি উন্নত ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী। এই উন্নত ও মহৎ চরিত্র বলতে কি বুঝানো হয়েছে, সেটা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। সৃষ্টি জগতের আর কেউ এর যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। এই মহান আয়াতটিতে রসূল(স.)-এর যে মর্যাদা প্রতিফলিত হয়েছে তা একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষণীয়। প্রথমত, এটা খােদ আল্লাহর সাক্ষ্য। গােটা সৃষ্টিজগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ সাক্ষ্য প্রতিনিয়ত অনুরণিত হচ্ছে। গােটা বিশ্ববাসীর বিবেক এ সাক্ষ্যে মুখরিত। আল্লাহর ঘনিষ্ঠতম ফেরেশতারাও এ সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, সৃষ্টির প্রতিটি কণা ও বিন্দু থেকে এ সাক্ষ্য প্রকাশিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-কে এই সাক্ষ্য অর্জন ও গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করেছেন। রসূল(স.) নিজে জানেনও না যে, মহৎ চরিত্র কাকে বলে? কি তার মহত্ব? স্ৰষ্টা এই সাক্ষ্য কেন দিলেন? এই সাক্ষ্যের তাৎপর্য কি, এর শুরু কোথায় ও শেষ কোথায়, এর প্রতিক্রিয়া কি, এসব তত্ত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি যতখানি জেনেছেন, ততটা আর কেউ জানতে পারে না। রসূল(স.)-এর ব্যক্তিত্বের মহত্ব ও চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে, তিনি এর সপক্ষে আল্লাহর এই সাক্ষ্য লাভ করেছেন এবং অত্যন্ত প্রশান্তভাবে ও ভারসাম্য সহকারে তা অর্জন করেছেন।  *মুহাম্মদ(স.) সম্পর্কে তার সাথীদের সাক্ষ্য : সীরাত গ্রন্থাবলীতে রসূল(স.)-এর তার চারিত্রিক মাধুর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। তার বাস্তব জীবনের ঘটনাবলী সেইসব বর্ণনার চেয়েও চমকপ্রদ ছিলো। কিন্তু পবিত্র কোরআনের এই সাক্ষ্য সব কিছুর উর্ধে এবং সবচেয়ে বেশী মর্যাদাবান। কেননা এ সাক্ষ্য স্বয়ং বিশ্বপ্রভু আল্লাহর। আর এ সাক্ষ্য লাভ করার পর রসূল(স.)-এর প্রশান্ত অচঞ্চল ব্যক্তিত্বে কোনাে পরিবর্তন আসেনি। আসেনি কোনাে অহংকার ও আত্মগরিমা। মানুষের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের কোনাে উচ্চাভিলাষও তাঁর মধ্যে কখনাে জাগেনি। বস্তুত এটিও তার মহৎ ও অতুলনীয় চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আল্লাহ তায়ালা ভালােভাবেই জানতেন যে, তার রিসালাত ও নবুওতের উপযুক্ত কে। প্রকৃতপক্ষে রসূল(স.)-এর নিজের এই অতুলনীয় মহৎ ব্যক্তিত্বের কারণেই এই সর্বশেষ নবুওতের দায়দায়িত্ব গ্রহণের যােগ্য ছিলেন। বিশ্ব জগতে যত যােগ্যতা, মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব, তার সবই তার সত্তার মাঝে একত্রিত হয়েছিলাে। তাই তিনিই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হবার যােগ্য বিবেচিত হয়েছিলেন। তিনি যাবতীয় মহৎ চারিত্রিক গুণাবলীর জীবন্ত প্রতিমূর্তি ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা জানতেন এই রসূল তার ওহী এবং শ্রেষ্ঠতম চরিত্রের অধিকারী হওয়ার পরও কিছুমাত্র অহংকারও তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি জানতেন যে, এই সর্বশেষ রেসালাত শ্রেষ্ঠত্বে, সৌন্দর্যে, মহত্বে, পূর্ণতায় ও সত্যনিষ্ঠায় এতাে বড় হবে যে, তাকে ধারণ করতে আল্লাহর এই প্রশংসা লাভের যােগ্য শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক সৌন্দর্য ও সুষমামন্ডিত ব্যক্তিত্বেরই প্রয়ােজন। তাকে শুধু প্রশংসিত হলেই চলবে না, প্রশংসা লাভের পরও তাকে পূর্ণ ভারসাম্য, দৃঢ়তা, উদারতা, শিষ্টাচার বজায় রাখতে সক্ষম হতে হবে। কেননা এ প্রশংসা লাভের পরও তার কোনাে কাজে যদি আল্লাহর সমালােচনা বা তিরস্কার করেন, তবে তাও যেন তিনি একই ভারসাম্য, একই দৃঢ়তা ও একই ঔদার্য নিয়ে গ্রহণ করেন-যেমন করেন প্রশংসাকে। তার এই প্রশংসা যেমন তিনি প্রকাশ করছেন, সেই তিরস্কারকেও তেমনি প্রকাশ করবেন। দুটোর কোনটা থেকে এক অক্ষরও গােপন করবেন না। উভয় অবস্থাতেই তিনি থাকবেন একই রকমের উদারচেতা মহান নবী, অনুগত বান্দা এবং বিশ্বস্ত একনিষ্ঠ প্রচারক। উভয় অবস্থাতেই তিনি হবেন দৃঢ়তা ও স্থিরচিত্ততার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি হবেন গাম্ভীর্যে ও দৃঢ়তায় পর্বতের মতন অটল।  *মানুষ মােহাম্মদ ও রসুল মােহাম্মদ(স.) : বস্তুত মানুষ মুহাম্মাদের ব্যক্তিসত্তা যেমন রসূল মুহাম্মাদের ব্যক্তি সত্তারই বাস্তব রূপ, ঠিক তেমনি মানুষ মােহাম্মাদের সুমহান ব্যক্তিসত্তার শ্রেষ্ঠত্ব নবী মােহাম্মাদের শ্রেষ্ঠত্বেরই পরিণতি ও ফল। অনুরূপভাবে ইসলামের নিগুঢ় তত্ত্ব যেমন মানুষের নাগালের বাইরে, তেমনি ইসলামের পতাকাবাহী মােহাম্মাদের ব্যক্তিগত মহত্বের অতলান্ত রহস্যও মানুষের ধরা ছোঁয়ার উর্ধে। এই দুটি নিশুঢ় তত্ত্বের পর্যবেক্ষক কেবল দূর থেকে তাকে দেখতে সক্ষম, কিন্তু তার গভীরতম প্রকোষ্ঠে ও শেষ লক্ষ্যবিন্দুতে পৌছা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আমি বারবার স্তব্ধ হয়ে পড়ি। আমি উপলব্ধি করি যে, তিনি এ প্রশংসাকে পূর্ণ ভারসাম্য সহকারে, পরিপূর্ণ গাম্ভীর্য ও প্রশান্তি সহকারে, সম্পূর্ণ অবিচল ও অচঞ্চল চিত্তে গ্রহণ করেন। এহেন শ্রেষ্ঠতম দুর্লভ মর্যাদা লাভ করেও যিনি ভারসাম্য হারান না, ধরাকে সরা জ্ঞান করেন না, তিনি যে বিশ্ব জাহানে বাস্তবিক পক্ষেই শ্রেষ্ঠতম মানুষ, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়? রসূল(স.) আল্লাহর এই প্রশংসাকে কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন, সে বিষয়টি ভাবতে গিয়ে সত্যিকার অর্থে করতে পেরেছিলেন। মানবীয় পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের যে উজ্জ্বলতম অভিব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা কোনাে মানব সত্তার ভেতরে ঘটাতে পারেন, সেটা ঘটিয়েছিলেন মােহাম্মাদ(স.)-এরই পবিত্র ও নির্মল সস্তায়। আল্লাহর বাণীবাহক শ্রেষ্ঠ মানুষটি এই সত্তায় জীবন্ত রূপ লাভ করেছিলাে এবং ভূপৃষ্ঠে একটি মানুষের অবয়ব নিয়ে চলাচল করেছিলাে। আল্লাহ তায়ালা তাকেই তাঁর রসূল হবার যোেগ্য বলে চিহ্নিত ও মনােনীত করেছিলেন। তাকে শ্রেষ্ঠতম চরিত্রের অধিকারী বলে ঘােষণা করেছিলেন। সেই সাথে এ ঘোষণা করেছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এবং তার ফেরেশতারা তার ওপর প্রতিনিয়ত দরুদ ও সালাম প্রেরণ করে থাকেন। আর এতােবড় মর্যাদার জন্যে কোনাে নির্দিষ্ট বান্দাকে বাছাই করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।  *চারিত্রিক মহত্ব হচ্ছে ইসলামের প্রাণ শক্তি : মর্যাদা ও মহত্বের এই সর্বোচ্চ শিখরে শুধুমাত্র মুহাম্মদ(স.) আরােহণ আল্লাহ তায়ালা তার সর্বশেষ নবী ও রসূলের চরিত্রের এতাে প্রশংসা কেন করলেন? এ প্রশ্নে আমরা যতই ভাবি, ততই এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মােহাম্মাদের মানব সত্তায় যেমন সুন্দর ও মহৎ চরিত্রই ছিলাে সর্বাধিক মূল্যবান ও শ্রেষ্ঠতম উপাদান, তেমনি সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা ও চারিত্রিক মহত্ব ইসলামের মূল প্রাণ শক্তি ও ভিত্তি। যে ব্যক্তি মােহাম্মদ(স.)-এর জীবন ও চরিত্রকে এবং ইসলামের আকীদা, আদর্শ ও বিধানকে অধ্যয়ন করেছে, সে সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে যে, ইসলামী বিধানের আইনগত ও সাংস্কৃতিক মূলনীতিগুলাের ভিত্তি ইসলামের নৈতিক ও চারিত্রিক আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, সততা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী, ন্যায়বিচার, দয়া ও ক্ষমা, আত্মীয় স্বজনের প্রতি বিশেষ সদাচার, দরিদ্রের প্রতি দয়া, ওয়াদা পালন, কথা ও কাজের সামঞ্জস্য বিধান এবং মন ও বিবেকের সাথে কথা ও কাজের সময় এ সব গুণাবলীর বাস্তবায়নে ইসলাম ইতিবাচক আহবান জানায়। আর নিষেধ করে যুলুম, নির্যাতন, শােষণ, প্রতারণা ও অবৈধভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করতে, মানুষের জানমাল ইযযতের ক্ষতি করতে এবং যে কোনাে উপায়ে সমাজে অশ্লীলতার বিস্তার ঘটাতে। ইসলামী বিধানে উল্লিখিত ইতিবাচক কাজগুলাের প্রতিষ্ঠা ও নিষিদ্ধ কাজগুলাের উচ্ছেদকে ইসলামী নৈতিকার ভিত্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এই ভিত্তি নির্মাণ করার আহবান জানানাে হয়েছে চিন্তায়, কর্মে ও চেতনায়। বিবেকের গভীরে সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত, সামষ্টিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ণয়ে নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলামের সমগ্র জীবন বিধানে নৈতিকতার গুরুত্ব যে সর্বাধিক তা রসূল(স.)-এর নিম্নোক্ত বাণী থেকেও বুঝা যায়। ‘আমি শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক গুণাবলীর পূর্ণতা সাধনের জন্যে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি।’ অর্থাৎ তিনি তার গােটা রেসালাত ও নবুওতের সার সংক্ষেপ নির্ধারণ করেছেন। এই মহৎ উদ্দেশ্যকে তার হাদীসসমূহ এক এক করে প্রতিটি চারিত্রিক গুণকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিয়ােজিত। আর তার ব্যক্তিগত জীবন এমন একটি জীবন্ত উদাহরণ, নির্মল নিষ্কলংক ও সর্বোচ্চ মানের ছবি তুলে ধরে, যা স্বভাবতই আল্লাহর পক্ষ থেকে এই প্রশংসা লাভের যােগ্য যে, ‘তুমি সর্বোচ্চ মানের চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।’ বস্তুত এই প্রশংসা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবীকেই শুধু নয় বরং রসূলের আনীত জীবন বিধানের নৈতিক ও চারিত্রিক উপাদানকেও মহিমান্বিত করেছেন। এ দ্বারা মানুষের পার্থিব জীবনকে পরকালীন জীবনের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে এবং আল্লাহর ভক্তদেরকে আল্লাহর পছন্দনীয় জীবনের চরিত্রের সন্ধান দেয়া হয়েছে। আসলে চারিত্রিক বিধানকে এতাে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা ইসলামের বিরল ও একক কৃতিত্ব। কেননা ইসলাম যে নৈতিক ও চারিত্রিক বিধান পেশ করে, তা আশপাশের পরিবেশ থেকে বা পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভূত নয় মােটেই। এটা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার কোনাে রীতিপ্রথা, চলতি প্রজন্মের কোনাে স্বার্থ, কোনাে সুযােগ সুবিধা বা সম্পর্ক বন্ধন থেকেও এর উৎপত্তি ঘটেনি বা এ সবের ওপর তা নির্ভরশীলও নয়। শুধুমাত্র ওহী থেকেই এর উৎপত্তি এবং ওহীর ওপরই তা সর্বতােভাবে নির্ভরশীল। পৃথিবীর অধিবাসীদেরকে আল্লাহর অভিমুখী হতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে আকাশ থেকে ভেসে আসা বাণী এর উৎস। এ নৈতিক বিধানের উৎস আল্লাহর মহান গুণাবলী, যাতে মানুষ সাধ্যমত এ সব গুণ কে আপন জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারে, উচ্চমার্গের মানবতাকে বাস্তব রূপ দিতে পারে। আল্লাহর দেয়া সম্মান, মর্যাদা ও খেলাফতের যােগ্য হতে পারে এবং পরকালে উন্নত জীবনের অধিকারী হতে পারে। এই উন্নত জীবনের প্রতিই ইংগিত করা হয়েছে সূরা কামার-এর এ আয়াতে, ‘(আল্লাহভীরু লােকেরা…) সর্বশক্তিমান সম্রাটের সান্নিধ্যে সত্যবাদিতার আসনে অধিষ্ঠিত থাকবে।’ সুতরাং ইসলামের নৈতিকতা পার্থিব বিচার-বিবেচনার সীমায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি সীমাহীন, শর্তহীন এবং এর পরিধি মানুষ যত উর্ধে উঠতে পারে ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। কেননা এর লক্ষ্য হলাে আল্লাহর গুণাবলীকে আয়ত্ত করা ও বাস্তবায়িত করা। আর আল্লাহর গুণাবলীর কোনাে সীমা সরহদ নেই। এখানে আরাে উল্লেখ্য যে, এই নৈতিক গুণাবলী নিছক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত গুণাবলী নয় বরং সত্যবাদিতা, আমানতদারী, ন্যায়বিচার, দয়া ও বদান্যতা ইত্যাকার যে গুণের কথাই বলা হােক না কেন এর সবই একটা পরিপূরক ও সুসংহত বিধানের অংশ। সামাজিক বিধি-বিধান ও সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ অনুশীলন এই উভয় মিলে এমন একটা সার্বিক অবকাঠামাে গড়ে তােলে, যার ওপর মানুষের সামষ্টিক ও পূর্ণাংগ জীবন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সবার শেষে তা মহান আল্লাহর সাথে গিয়ে মিলিত হয়। পার্থিব জীবনের কোনাে বিচার-বিবেচনার সাথে তার সাযুজ্য ঘটেনা। ইসলামের এই পূর্ণাংগ নির্মল ও নিষ্কলুষ, ভারসাম্যপূর্ণ, সুদৃঢ়, সরল ও স্থীতিশীল নৈতিকতার আদর্শ হচ্ছে রসূল(স.) এর পবিত্র ব্যক্তিত্ব। আর এ জন্যেই তার সুমহান সত্তাকে লক্ষ্য করে এই প্রশংসাবাণী উচ্চারিত হয়েছিলাে যে, ‘তুমি শ্রেষ্ঠতম নৈতিক চারিত্রিক মানের অধিকারী। নিজের প্রিয়তম বান্দার এই প্রশংসা করার পর আল্লাহ তাকে দুশমন মােশরেকদের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে, যারা তােমার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপবাদ রটনা করেছিলাে এবং তোমাকে পাগল বলে অপমানিত করেছিলাে, তারাই যে গােমরাহী ও বিভ্রান্তিতে লিপ্ত সে কথা অচিরেই প্রমাণিত হবে। তিনি বলছেন, ‘অচিরেই তুমি দেখবে এবং তারা দেখবে-কে বিভ্রান্ত এবং বিপথগামী এবং কে সুপথপ্রাপ্ত তা তােমার প্রতিপালক সবচেয়ে ভালাে জানেন।’ আয়াতে যে মাফতুন শব্দটি রয়েছে তার অর্থ দু’রকম হতে পারে। প্রথমত, বিপথগামী। দ্বিতীয়ত, যাকে পরীক্ষা করা হয় এবং পরীক্ষার মাধ্যমে তার আসল স্বরূপ উন্মােচন করা হয়, এই দুটো অর্থই কাছাকাছি। এখানে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তাতে একদিকে যেমন রসূল(স.) ও তার সংগীদের জন্যে আশ্বাসবাণী রয়েছে, তেমনি রয়েছে সমানুপাতিকভাবে তার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাকারীদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হুঁশিয়ারী । রসূল(স.)-এর ওপর আরােপিত পাগলামীর অপবাদটির প্রকৃত তাৎপর্য যাই হােক না কেন, এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এ দ্বারা তারা রসূল(স.)-কে পুরােপুরি মস্তিষ্ক বিকৃত’ বুঝায়নি। কেননা বাস্তব অবস্থা এরূপ ব্যাখ্যার বিরােধী। তারা বলতাে যে, রসূল(স.) ঘাড়ে জ্বিন সওয়ার হতাে এবং এই অলংকার সমৃদ্ধ চমৎকার কথাবার্তা জ্বিনেরাই তাকে শেখায়। কবিদের সম্পর্কেও তারা এ রকম ভাবতাে। তারা মনে করতাে যে, প্রত্যেক কবির সাথে একটা শয়তান থাকে এবং সেই তাকে এমন অদ্ভুত কথাবার্তা শিখায়। রসূল(স.)-এর বাস্তব অবস্থার সাথে এ ব্যাখ্যা মােটেই খাপ খায়না। আর তার কাছে যে নিখুঁত, সুদৃঢ় অকাট্য সত্য ওহী আসে, তার সাথে এ ব্যাখ্যার মিল নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই প্রতিশ্রুতির মর্ম এই দাঁড়ায় যে, অনাগত ভবিষ্যত রসূল(স.) ও তাকে অবিশ্বাসকারী কাফেরদের মধ্যে কে বিপথগামী তা প্রকাশ করে দেবে। তিনি তাকে এই মর্মে আশ্বাস দিচ্ছেন যে, তােমার প্রভু এ কথা অন্য সবার চাইতে ভালাে জানেন যে, কে বিপথগামী এবং কে সুপথগামী। লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, তার রসূলকে তিনি ওহী যােগেও এ কথাটা বলছেন। এতে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা খোদ রাসূল(স.) এবং তার সংগীদের সুপথপ্রাপ্ত হবার কথা জানেন। কাজেই এ উক্তিতে একদিকে রসূল(স.)-এর জন্যে রয়েছে আশ্বাসবাণী, অপরদিকে তার শত্রুদের জন্যে রয়েছে গুরুতর দুঃসংবাদ। এরপর আল্লাহ তায়ালা আরাে স্পষ্ট করে তাদের পরিচয় তুলে ধরছেন এবং তাদের আবেগ অনুভূতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করছেন। যে জাহেলী ধারণা বিশ্বাসে তারা নিজেদের অবিচল আস্থা প্রকাশ করে থাকে তার ব্যাপারে আসলে তারা দোদুল্যমান। অথচ এই দোদুল্যমানতা লুকিয়ে রেখে তারা রসূল(স.)-এর সাথে তাঁর আনীত সত্য দ্বীন ও নির্ভুল ওহী সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়।

১-৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
২) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

(৬৮-আল-ক্বলম) : নামকরণ:

এ সূরাটির দুটি নাম; সূরা নূন এবং সূরা আল কলম। দুটি শব্দই সূরার শুরুতে আছে।
(৬৮-আল-ক্বলম) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এটিও মক্কী জীবনের প্রথম দিকে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্যতম। তবে এর বিষয়বস্তু থেকে স্পষ্ট হয় যে, এ সূরাটি যে সময় নাযিল হয়েছিলো তখন মক্কা নগরীতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিলো।
(৬৮-আল-ক্বলম) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

এতে তিনটি মূল বিষয় আলোচিত হয়েছে। বিরোধীদের আপত্তি ও সমালোচনার জবাব দান, তাদেরকে সতর্কীকরণ ও উপদেশ দান এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধৈর্যধারণ ও অবিচল থাকার উপদেশ দান।

বক্তব্যের শুরুতেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে, এসব কাফের তোমাকে পাগল বলে অভিহিত করছে। অথচ তুমি যে কিতাব তাদের সামনে পেশ করছো এবং নৈতিকতার যে উচ্চ আসনে তুমি অধিষ্ঠিত আছো তা-ই তাদের এ মিথ্যার মুখোশ উন্মোচনের জন্য যথেষ্ট। শিগগিরই এমন সময় আসবে যখন সবাই দেখতে পাবে, কে পাগল আর কে বুদ্ধিমান। অতএব তোমার বিরুদ্ধে বিরোধিতার যে তাণ্ডব সৃষ্টি করা হচ্ছে তা দ্বারা কখনো প্রভাবিত হয়ো না। আসলে তুমি যাতে কোন না কোনভাবে প্রভাবিত হয়ে তাদের সাথে সমঝোতা (Compromise) করতে রাজী হয়ে যাও, এ উদ্দেশ্যেই এ কাজ করা হচ্ছে।

অতপর সাধারণ মানুষকে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্য বিরুদ্ধবাদীদের মধ্য থেকে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির কার্যকলাপ তুলে ধরা হয়েছে। এ ব্যক্তিকে মক্কাবাসীরা খুব ভাল করে জানতো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূত-পবিত্র নৈতিক চরিত্রও তাদের সবার কাছে স্পষ্ট ছিলো। মক্কার যেসব নেতা তাঁর বিরোধিতায় সবার অগ্রগামী তাদের মধ্যে কোন ধরনের চরিত্র সম্পন্ন লোক শামিল রয়েছে তা যে কেউ দেখতে পারতো।

এরপর ১৭ থেকে ৩৩ আয়াত পর্যন্ত একটি বাগানের মালিকদের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। আল্লাহর নিয়ামত লাভ করেও তারা সে জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি। বরং তাদের মধ্যকার সর্বোত্তম ব্যক্তিটির কথাও তারা যথাসময়ে মেনে নেয়নি। অবশেষে তারা সে নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যখন তাদের সবকিছুই ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গিয়েছে তখনই কেবল তাদের চেতনা ফিরেছে। এ উদাহরণ দ্বারা মক্কীবাসীকে এভাবে সাবধান করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসূল করে পাঠানোর কারণে তোমরাও ঐ বাগান মালিকদের মতো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছো। তোমরা যদি তাকে না মানো তাহলে দুনিয়াতেও শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর এ জন্য আখেরাতে যে শাস্তি ভোগ করবে তাতো এর চেয়েও বেশী কঠোর।

এরপর ২৪ থেকে ৪৭ আয়াত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে কাফেরদেরকে বুঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কখনো সরাসরি তাদেরকে লক্ষ্য করে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। আবার কখনো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। আসলে সাবধান করা হয়েছে তাদেরকেই। এ সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে তার সার সংক্ষেপ হলো, আখেরাতের কল্যাণ তারাই লাভ করবে যারা আল্লাহভীতির ওপর ভিত্তি করে দুনিয়াবী জীবন যাপন করেছে। আল্লাহর বিচারে গোনাহগার ও অপরাধীদের যে পরিণাম হওয়া উচিত আল্লাহর অনুগত বান্দারাও সে একই পরিণাম লাভ করবে এরূপ ধ্যান-ধারণা একেবারেই বুদ্ধি-বিবেক বিরোধী। কাফেরদের এ ভ্রান্ত ধারণা একেবারই ভিত্তিহীন যে, তারা নিজের সম্পর্কে যা ভেবে বসে আছে আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে অনুরূপ আচরণই করবেন। যদিও এ বিষয়ে তাদের কাছে কোন নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি নেই। আজ এ পৃথিবীতে যাদেরকে আল্লাহর সামনে মাথা নত করার আহবান জানানো হচ্ছে তারা তা করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তারা সিজদা করতে চাইলেও করতে সক্ষম হবে না। সেদিন তাদেরকে লাঞ্ছনাকর পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কুরআনকে অস্বীকার করে তারা আল্লাহর আযাব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। তাদেরকে যে অবকাশ দেয়া হচ্ছে তাতে তারা ধোঁকায় পড়ে গেছে। তারা মনে করছে এভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা ও অস্বীকৃতি সত্ত্বেও যখন তাদের ওপর আযাব আসছে না তখন তারা সঠিক পথেই আছে। অথচ নিজের অজান্তেই তারা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কারণ তিনি দ্বীনের একজন নি:স্বার্থ প্রচারক। নিজের জন্য তিনি তাদের কাছে কিছুই চান না। তারা দাবি করে একথাও বলতে পারছে না যে, তিনি রসূল নন অথবা তাদের কাছে তাঁর বক্তব্য মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ আছে।

সবশেষে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে যে, চূড়ান্ত ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের পথে যে দু:খ-কষ্টই আসুক না কেন, ধৈর্যের সাথে তা বরদাশত করতে থাকুন এবং এমন অধৈর্য হয়ে পড়বেন না যা ইউনুস আলাইহি সালামের জন্য কঠিন পরীক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
#তাফসীরের ইমাম মুজাহিদ বলেনঃ কলম মানে যে কলম দিয়ে যিকর অর্থাৎ কুরআন মজীদ লেখা হচ্ছিলো। এ থেকে বুঝা যায়, যা লেখা হচ্ছিলো তা ছিল কুরআন মজীদ।

সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-২

مَاۤ اَنْتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُوْنٍۚ

তোমার রবের অনুগ্রহে তুমি পাগল নও।

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-

#!একথাটির জন্যই কলম ও কিতাবের নামে শপথ করা হয়েছে। অর্থাৎ অহী লেখক ফেরেশতাদের হাত দিয়ে কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ হচ্ছে। কুরআন মজীদ ফেরেশতাদের হাতে লিপিবদ্ধ হওয়াই কাফেরদের এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, নাউযুবিল্লাহ, রসূলুল্লাহ ﷺ পাগল। নবুওয়াত দাবী করার পূর্বে মক্কাবাসীরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কওমের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মনে করতো। তারা তাঁর দ্বীনদারী, আমানতদারী, বিবেক-বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার ওপর আস্থাশীল ছিলো। কিন্তু তিনি তাদের সামনে কুরআন মজীদ পেশ করতে শুরু করলে তারা তাঁকে পাগল বলে অভিহিত করতে লাগলো। এর সোজা অর্থ হলো, রসূলের ﷺ প্রতি পাগল হওয়ার যে অপবাদ তারা আরোপ করতো তাদের দৃষ্টিতে তার মূল কারণ ছিলো কুরআন। তাই বলা হয়েছে, কুরআনই এ অপবাদের অসারতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। নাউযুবিল্লাহ! তিনি পাগল হয়ে গিয়েছেন একথা প্রমাণ করা তো দূরে থাক অতি উচ্চমানের বিশুদ্ধ ও অলংকারপূর্ণ ভাষায় এরূপ উন্নত বিষয়বস্তু পেশ করাই বরং একথা প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী বর্ষিত হয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো বাহ্যিকভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বক্তব্য পেশ করা হলেও মূল লক্ষ্য হলো কাফেরদেরকে তাদের অপবাদের জবাব দেয়া। অতএব, কারো মনে যেন এ সন্দেহ দানা না বাঁধে যে, এ আয়াতটি নবী ﷺ যে পাগল নন এ মর্মে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য নাযিল হয়েছে। নবী (সা.) নিজের সম্পর্কে এমন কোন সন্দেহ পোষণ করতেন না যা নিরসনের জন্য তাঁকে এরূপ সান্তনা দেয়ার প্রয়োজন ছিলো। বরং এর লক্ষ্য কাফেরদেরকে এতোটুকু জানিয়ে দেয়া যে, কুরআনের কারণে তোমরা কুরআন পেশকারীকে পাগল বলে আখ্যায়িত করছো। তোমাদের এ অভিযোগ যে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন খোদ কুরআনই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। (আরো বেশী জানতে হলে দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা তূর, টীকা ২২)

#এ জন্য তাঁকে দেয়া হবে অগণিত ও চিরস্থায়ী নিয়ামত। কারণ আল্লাহর বান্দাদের হিদায়াতের জন্য তিনি চেষ্টা-সাধনা করেছেন। বিনিময়ে তাঁকে নানা রকম কষ্টদায়ক কথা শুনতে হচ্ছে। এসব সত্ত্বেও তিনি তাঁর এ কর্তব্য পালন করে চলেছেন।

সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-৪

وَ اِنَّكَ لَعَلٰى خُلُقٍ عَظِیْمٍ

নিঃসন্দেহে তুমি নৈতিকতার অতি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন।

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-
# এখানে এ আয়াতটির দু’টি অর্থ। একটি হলো, আপনি নৈতিক চরিত্রের সর্বোচ্চ মানের ওপর অধিষ্ঠিত। তাই আপনি আল্লাহর বান্দাদের হিদায়াতের কাজে এতো দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছেন। একজন দুর্বল নৈতিক চরিত্রের মানুষ এ কাজ করতে সক্ষম হতো না। অন্যটি হলো, কাফেররা আপনার প্রতি পাগল হওয়ার যে অপবাদ আরোপ করেছে তা মিথ্যা হওয়ার আরেকটি সুস্পষ্ট প্রমাণ আপনার উন্নত নৈতিক চরিত্র। কারণ উন্নত নৈতিক চরিত্র ও মস্তিস্ক বিকৃতি একসাথে একই ব্যক্তির মধ্যে থাকতে পারে না। যার বুদ্ধি-বিবেক ও চিন্তার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং মেজাজে সমতা নেই সেই পাগল। পক্ষান্তরে মানুষের উন্নত নৈতিক চরিত্র প্রমাণ করে যে, তার মস্তিষ্ক ও বিবেক-বুদ্ধি ঠিক আছে এবং সে সুস্থ ও স্বাভাবিক। তার মন-মানস ও মেজাজ অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নৈতিক চরিত্র কেমন তা মক্কার প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মানুষ চিন্তা করতে বাধ্য হবে যে, তারা কতই নির্লজ্জ। নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে এতো উন্নত একজন মানুষকে তারা পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে। তাদের এ অর্থহীন কথাবার্তা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য নয় বরং তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। কারণ শত্রুতার আক্রোশে উন্মত্ত হয়ে তারা তাঁর সম্পর্কে এমন কথা বলেছিলো, যা কোন বিবেকবান ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারে না। এ যুগের জ্ঞান-গবেষণার দাবীদারদের ব্যাপারও ঠিক তাই। তারাও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মৃগী রোগগ্রস্ত ও বিকৃত মস্তিষ্ক হওয়ার অপবাদ আরোপ করছে। দুনিয়ার সব জায়গায় কুরআন শরীফ পাওয়া যায় এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন বৃত্তান্তও সবিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে। যে কোন লোক তা অধ্যয়ন করলেই বুঝতে পারবে, যে এ অনুপম গ্রন্থ পেশকারী এবং এরূপ উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানুষটিকে মানসিক রোগী বলে আখ্যায়িত করে তারা শত্রুতার অন্ধ আবেগে আক্রান্ত হয়ে কি ধরনের অর্থহীন ও হাস্যকর প্রলাপ বকে চলেছে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম সংজ্ঞা দিয়েছেন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি বলেছেনঃ كان خلقه القران -“কুরআনই ছিলো তাঁর চরিত্র”। (ইমাম আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী ও ইবনে জারীর সামান্য কিছু শাব্দিক তারতাম্যসহ তাঁর এ বাণীটি বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন।) । এর মানে, রসূলুল্লাহ ﷺ দুনিয়ার সামনে শুধু কুরআনের শিক্ষাই পেশ করেননি। বরং তিনি নিজেকে তার জীবন্ত নমুনা হিসেবে পেশ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। কুরআনে যেসব নির্দেশ দেয়া হয়েছে সবার আগে তিনি নিজে সে মোতাবেক কাজ করেছেন। এতে যেসব বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে তিনি নিজে তা সবার আগে বর্জন করেছেন। কুরআন মজীদে যে নৈতিক গুণাবলীকে মর্যাদার কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেসব গুণে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে বেশী গুণান্বিত। আর কুরআন মজীদে যেসব বিষয়কে অপছন্দনীয় আখ্যায়িত করা হয়েছে তিনি নিজে ছিলেন তা থেকে সবচেয়ে বেশী মুক্ত। আরেকটি বর্ণনায় হযরত আয়েশা বলেনঃ রসূলুল্লাহ ﷺ কখনো কোন খাদেমকে মারেননি, কোন নারীর গায়ে হাত তোলেননি, জিহাদের ক্ষেত্র ছাড়া নিজ হাতে কখনো কাউকে হত্যা করেননি। *১ তাঁকে কেউ কষ্ট দিয়ে থাকলে তিনি কখনো তার প্রতিশোধ নেননি। কেবল আল্লাহর হারাম করা বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করলে তিনি তার শাস্তি দিয়েছেন। তাঁর নীতি ছিলো, কোন দু’টি বিষয়ের একটি গ্রহণ করতে হলে তা যদি গোনাহের কাজ না হতো তাহলে তিনি সহজতর বিষয়টি গ্রহণ করতেন। গোনাহের কাজ থেকে তিনি সবচেয়ে বেশী দূরে থাকতেন। (মুসনাদে আহমাদ) হযরত আনাস বর্ণনা করেছেন, আমি দশ বছর যাবত রসূলুল্লাহর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আমার কোন কাজ সম্পর্কে তিনি কখনো উহ! শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। আমার কোন কাজ দেখে কখনো বলেননিঃ তুমি এ কাজ করলে কেন? কিংবা কাজ না করলে কখনো বলেননিঃ তুমি এ কাজ করলে না কেন? (বুখারীও মুসলিম) *১.সীরাতে ইবনে হিশাম সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বাংলা অনুবাদ পৃষ্ঠা-১৯২ দেখুন। (অনুবাদক)

১-৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

নামকরণ :

কলম (الْقَلَم) একটি বস্তু যা দ্বারা লেখা হয়। এখানে কলমের অর্থ সাধারণ কলমও হতে পারে। এতে ভাগ্যলিপির কলম এবং ফেরেশতা ও মানবের লেখার কলম অন্তর্ভুক্ত। এখানে বিশেষত ভাগ্যলিপির কলমও বোঝানো যেতে পারে। ‘উবাদা বিন সামেত (রাঃ) বলেন : আমার পিতার মৃত্যুর সময় তিনি আমাকে ডেকে বললেন : আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। তারপর বললেন : তুমি লেখ। কলম বলল : কী লেখব? আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তুমি ভাগ্য লেখ এবং শেষ দিবস পর্যন্ত যা কিছু হবে তাও লেখ। (আহমাদ : ৫/৩১৭, তিরমিযী হা. ৩৩১৯, আবূ দাঊদ হা. ৪৭০০, সনদ সহীহ।) এ শব্দটি এ সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখ আছে বিধায় উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

১-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

ص، ق، ن এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা বাক্বারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এসব হুরূফের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী তা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। তবে সুদ্দী, কালবী ও মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : নূন দ্বারা উদ্দেশ্য হল সেই মাছ যা সাত জমিনের নিচে রয়েছে।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : নূন শব্দটি ‘আর-রহমান’ শব্দের শেষ অক্ষর, সূরা ইউনুসে الر রয়েছে, সূরা মুমিনে حم রয়েছে, আর এখানে ‘ن’ উল্লেখ রয়েছে। সব মিলে الرحمن হয়েছে (কুরতুবী)।

القلم একটি বস্তু যা দ্বারা লেখা হয়। এটি শিক্ষা গ্রহণের অন্যতম একটি উপকরণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ)

“যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন” (সূরা আলাক ৯৬ : ৪)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা যে কলম সৃষ্টি করেছেন এখানে তার কসম করছেন। উবাদা বিন সামেত (রাঃ) বলেন : আমার পিতার মৃত্যুর সময় তিনি আমাকে ডেকে বললেন : আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। তারপর বললেন : তুমি লেখ। কলম বলল : কী লিখব? আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তুমি ভাগ্য লেখ এবং শেষ দিবস পর্যন্ত যা কিছু হবে তাও লেখ। (আহমাদ ৫/৩১৭, তিরমিযী হা. ৩৩১৯, আবূ দাঊদ হা. ৪৭০০, সনদ সহীহ।)

কাতাদাহ বলেন : কলম বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ নেয়ামত। কেউ বলেছেন : আল্লাহ তা‘আলা সবার আগে কলম সৃষ্টি করার পর তা দ্বারা যা ভবিষ্যতে ঘটবে তা লাওহে মাহফূজে লিখে কলমকে আবার তাঁর নিকট আরশের ওপরে রেখে দিয়েছেন। তারপর দ্বিতীয় কলম সৃষ্টি করে জমিনে যা কিছু হবে তা লেখার নির্দেশ দিয়েছেন। (কুরতুবী)

مَا يَسْطُرُوْنَ অর্থাৎ ما يكتبون বা কলম যা লেখে। ইবনু আব্বাস বলেন : ফেরেশতারা আদম সন্তানের যে সকল আমল লেখে। আল্লাহ তা‘আলা এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের শপথের জবাবে বলছেন : নিশ্চয়ই হে মুহাম্মাদ! তোমার প্রভুর অনুগ্রহে তুমি পাগল নও। যেমন মক্কার কাফিররা বলে :

(وَقَالُوْا يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْ نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُوْنٌ) ‏

“তারা বলে ‘ওহে যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে! তুমি নিশ্চয় উন্মাদ।” (সূরা হিজর ১৫ : ৬)

غَيْرَ مَمْنُوْنٍ

অর্থাৎ নিরবিচ্ছিন্ন, অশেষ। নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে যে সকল কষ্টের সম্মুখীন হয়েছো তার জন্য আখিরাতে অশেষ পুরস্কার প্রস্তুত আছে।

(خُلُقٍ عَظِيْمٍ)

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে অনুগ্রহ করে যে চরিত্র দান করেছেন তার দ্বারা আপনি অনেক মহৎ। ইবনু আব্বাস বলেন :

علي دين عظيم من الأديان

তুমি সকল ধর্মের মধ্যে মহান ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে ধর্ম হল ইসলাম। এর চেয়ে কোন ধর্ম আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রিয় নয় এবং অন্য কোন ধর্মে তিনি সন্তুষ্ট নন। (কুরতুবী) আমের (রাঃ) বলেন : আমি উম্মুল মু’মিনিন আয়িশাহ (রাঃ) কে বললাম : আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্র সম্পর্কে অবগত করুন। তিনি বললেন : আপনি কি কুরআন পড়েননি? কারণ :

فَإِنَّ خُلُقَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّي اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ الْقُرْآنَ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্র ছিল কুরআন। (সহীহ মুসলিম, আবূ দাঊদ, আহমাদ হা. ২৪৬৪৫)

আল্লাহ তা‘আলা কেবল আমাদের নাবীর চরিত্রের ক্ষেত্রেই عَظِيْمٍ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, অন্য কোন নাবীর ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করেননি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجٰهِلِيْنَ)

“তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চল।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৯৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(لَقَدْ جَا۬ءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْمٌ) ‏

“অবশ্যই তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছে। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মু’মিনদের প্রতি সে দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।” (সূরা তাওবাহ ৯ : ১২৮)

আনাস (রাঃ) বলেন : আমি দশ বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমত করেছি, তিনি কোনদিন আমাকে বলেননি, হে আনাস! তুমি এ কাজ করলে কেন, আর এ কাজ করলে না কেন? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : নিশ্চয়ই আমি উত্তম চরিত্র পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি। (আহমাদ হা. ৮৯৫২, সহীহ) মোটকথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনটা ছিল কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।

আবূ যার (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তুমি যেখানেই থাক আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর, কোন খারাপ কাজ হয়ে গেলে সাথে সাথে একটি ভাল কাজ কর, কেননা সে ভাল কাজ খারাপ কাজের অপরাধ মুছে দেবে। আর মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার কর।

আবূ দারদা (রাঃ) বলেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কিয়ামতের দিন মুমিনের নেকীর পাল্লায় উত্তম চরিত্রের চেয়ে আর কিছুই ভারী হবে না। (তিরমিযী হা. ২০০২, সহীহ) এ ছাড়াও উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে।

(فَسَتُبْصِرُ وَيُبْصِرُوْنَ)

অর্থাৎ যখন সত্য প্রকাশিত হবে এবং কিছুই গোপন থাকবে না তখন তুমি মুহাম্মাদ জানতে পারবে এবং তারাও জানতে পারবে। প্রকৃত পক্ষে কে পথভ্রষ্ট-তুমি, না তারা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَإِنَّآ أَوْ إِيَّاكُمْ لَعَلٰي هُدًي أَوْ فِيْ ضَلَالٍ مُّبِيْنٍ)

“নিশ্চয়ই আমরা অথবা তোমরা সৎপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত কিংবা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পতিত।” (সূরা সাবা ৩৪ : ২৪) মূলত এখানে মক্কার কুরাইশ নেতাদের ধমক দেওয়া হয়েছে। কারণ এ সূরার সিংহভাগ ওয়ালিদ বিন মুগীরাহ, আবূ জাহল ও অন্যান্য কাফির নেতাদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।

الْمَفْتُوْنُ অর্থ : ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন المجنون বা পাগল। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেছেন : যে সত্যের ব্যাপারে ভ্রান্তিতে আছে এবং তা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। (ইবনু কাসীর)

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসারী হিসাবে প্রত্যেক মুসলিমের উচিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্র গ্রহণ করা। তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্র শান্তি বিরাজ করবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন।
২. মানুষের তাকদীর পূব থেকেই নির্ধারিত।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তম চরিত্রের অধিকারী যা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই সত্যায়ন করেছেন।
৪. আমাদের রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া উচিত।

Leave a Reply