أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১০৬)
[ * *সম্পদ, সন্তান ও সচ্ছলতা একমাত্র আল্লাহর দান:-]
www.motaher21.net সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫
৪৯- ৫৩ নং আয়াত:-
সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫#৪৯
لِلّٰہِ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ ؕیَہَبُ لِمَنۡ یَّشَآءُ اِنَاثًا وَّ یَہَبُ لِمَنۡ یَّشَآءُ الذُّکُوۡرَ ﴿ۙ۴۹﴾
আসমানসমূহ ও যমীনের আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছে তা-ই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছে কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছে পুত্ৰ সন্তান দান করেন,
সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫#৫০
اَوۡ یُزَوِّجُہُمۡ ذُکۡرَانًا وَّ اِنَاثًا ۚ وَ یَجۡعَلُ مَنۡ یَّشَآءُ عَقِیۡمًا ؕ اِنَّہٗ عَلِیۡمٌ قَدِیۡرٌ ﴿۵۰﴾
যাকে ইচ্ছা পুত্র ও কন্যা উভয়টিই দেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি সব কিছু জানেন এবং সব কিছু করতে সক্ষম।
সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫#৫১
وَ مَا کَانَ لِبَشَرٍ اَنۡ یُّکَلِّمَہُ اللّٰہُ اِلَّا وَحۡیًا اَوۡ مِنۡ وَّرَآیِٔ حِجَابٍ اَوۡ یُرۡسِلَ رَسُوۡلًا فَیُوۡحِیَ بِاِذۡنِہٖ مَا یَشَآءُ ؕ اِنَّہٗ عَلِیٌّ حَکِیۡمٌ ﴿۵۱﴾
কোন মানুষেরই এমন মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ্ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ছাড়া, অথবা পর্দার আড়াল ছাড়া, অথবা এমন দূত প্রেরণ ছাড়া, যে দূত তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ওহী করেন, তিনি সর্বোচ্চ, হিকমতওয়ালা।
সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫#৫২
وَ کَذٰلِکَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ رُوۡحًا مِّنۡ اَمۡرِنَا ؕ مَا کُنۡتَ تَدۡرِیۡ مَا الۡکِتٰبُ وَ لَا الۡاِیۡمَانُ وَ لٰکِنۡ جَعَلۡنٰہُ نُوۡرًا نَّہۡدِیۡ بِہٖ مَنۡ نَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِنَا ؕ وَ اِنَّکَ لَتَہۡدِیۡۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿ۙ۵۲﴾
এভাবে আপনার প্রতি আমার নির্দেশ থেকে রূহকে ওহী করেছি; আপনি তো জানতেন না কিতাব কি এবং ঈমান কি! কিন্তু আমরা এটাকে করেছি নূর, যা দ্বারা আমরা আমাদের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে হেদায়াত দান করি; আর আপনি তো অবশ্যই সরল পথের দিকে দিকনির্দেশনা করেন—
সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫#৫৩
صِرَاطِ اللّٰہِ الَّذِیۡ لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ اَلَاۤ اِلَی اللّٰہِ تَصِیۡرُ الۡاُمُوۡرُ ﴿٪۵۳﴾
সেই আল্লাহর পথের দিকে যিনি যমীন ও আসমানের সব জিনিসের মালিক। সাবধান, সব কিছু আল্লাহর দিকেই ফিরে যায়।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*সম্পদ, সন্তান ও সচ্ছলতা একমাত্র আল্লাহর দান : এরপর জানানাে হচ্ছে যে, মানুষ সুখ দুঃখ, স্বচ্ছলতা এবং বঞ্চনা যাইই পাক না কেন সবই আল্লাহর কাছ থেকে পায়। তাহলে কল্যাণের অধিকারী হলে কেনই বা তারা আনন্দে এমন আত্মহারা হবে, আর একটু দুঃখ পেলেই বা সে কেন এতাে ভেংগে পড়বে? এমন আচরণের দ্বারা আসলে মানুষ নিজেকে সকল কিছুর মালিক আল্লাহ তায়ালা থেকে সরিয়ে নেয় সর্ব অবস্থার ওপর যার মালিকানা বিরাজমান। এরশাদ হচ্ছে, ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর বাদশাহী আল্লাহর হাতে… নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু জানেন সবকিছু করতে সক্ষম।’(আয়াত ৪৯-৫০) ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি তাে আল্লাহ রব্বুল আলামীনেরই দান। এরা আল্লাহর মেহেরবানীর প্রতীক, যাকে ইচ্ছা তিনি দেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা তিনি তুলে নেন। সবই তাঁর মেহেরবানী। এরা মানুষের অন্তরের বড়ই কাছাকাছি বিষয়, আর মানুষ বড়ই অনুভূতিশীল জীব। এ জন্যে ইতিপূর্বে রিযিক বা জীবনের জন্যে প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সম্পর্কে অনেক কথা আল কোরআনে এসে গেছে। এখানে রেযেক সম্পর্কিত কথা সন্তান সন্তুতির উল্লেখ দ্বারা পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হচ্ছে, যেহেতু জীবনে মানুষের প্রয়ােজনীয় যা কিছু আছে তার মধ্যে সন্তান সন্তুতি অবশ্যই একটি। আর অন্যান্য ধন দৌলতের মতাে সন্তান সন্তুতি ও আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। আর এ কথা পেশ করা যে, আসমান ও যমীনের বাদশাহী আল্লাহরই হাতে-এ কথার মধ্যে ছােট বড় এবং প্রত্যেক বস্তুর সকল অংশ সবই আল্লাহর মালিকানাধীন এবং সব কিছুর ওপর রয়েছে আল্লাহর বাদশাহী ও কর্তৃত্ব। এমনি করে বলা হয়েছে, ‘তিনি যা চান তাইই সৃষ্টি করেন।’ এখানে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে সেই সব জানদার বা প্রাণী সত্ত্বার কথা যার ওপর এখানে কিছু আলােচনা আসছে। এই যে মানুষ ধন-সম্পদের জন্য পাগল পারা তার গতি তাে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই দিকে, যিনি সকল কিছুকে পয়দা করেন। মানুষ খুশী হয় এমন জিনিসও তিনি পয়দা করেন, আবার এমন জিনিসও তিনি পয়দা করেন যাতে মানুষ দুঃখিত হয়। তিনি মানুষকে কখনও তার পছন্দনীয় জিনিস দান করেন, আবার কখনও তার থেকে তার প্রিয় জিনিস কেড়ে নেন। এরপর দান করা ও কেড়ে নেয়ার অবস্থা সম্পর্কে কিছু বিস্তারিত আলােচনা আসছে, যাকে ইচ্ছা তিনি কন্যা সন্তান দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন পুত্র সন্তান, আবার কখনও পুত্র ও কন্যা জোড়ায় জোড়ায় দেন, অর্থাৎ পুত্র দেন কন্যাও দেন। আবার চাইলে কাউকে কিছু দেনও না, বানিয়ে দেন বন্ধা। অথচ এসব কিছু তাে আল্লাহরই হুকুমের গোলাম। তিনি ছাড়া এ সব জিনিসের ওপর এখতিয়ার খাটানোর ক্ষমতা আর কারও নেই। তিনি তার জ্ঞান মােতাবেক এসব কিছুকে পরিচালনা করেন। আর কাকে তিনি কী দেবেন, তার জ্ঞান অনুযায়ী তিনি পূর্বে সব কিছুই ঠিক করে রেখেছেন এবং বিশ্ব চরাচরের যা এসব কিছুকে তিনি তাঁর জ্ঞান ও কুদরত মােতাবেক চালিয়ে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু জানেন-সবার ওপর ক্ষমতাবান।
**ওহী নাযিলের অভাবনীয় অকল্পনীয় পদ্ধতি : সূরাটির সমাপ্তি পর্যায়ে এসে আলােচনা প্রসংগ আবার মােড় নিচ্ছে প্রথম সেই সত্যটির দিকে যাকে কেন্দ্র করে সূরাটির আলােচনা চলছিলাে, আর তা হচ্ছে ওহী ও রেসালাত সম্পর্কিত কথা। বর্তমান আলােচনাকে আবার সেই দিকেই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে যেন এই আলােচনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ও তার পছন্দনীয় বান্দাদের মধ্যে বিরাজমান সম্পর্কের অবস্থা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সর্বোতভাবে এবং পরিপূর্ণ জোর দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তার নিবেদিত প্রাণ বান্দাদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্কের কথা ঘােষণা করছেন। বিশেষ করে জানাচ্ছেন তার শেষ রসূল মােহাম্মদ(স.)-এর সাথে তাঁর মহব্বতের কথা, যেহেতু তার ওপরেই তাঁর সেই রেসালাত সমাপ্ত করতে যাচ্ছেন যার মাধ্যমে বিশ্বের মানুষকে তিনি সর্বাধিক কল্যাণ দিতে চান এবং তাদেরকে সরল সঠিক ও সুদৃঢ় পথে পরিচালিত করতে চান। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার সাথে ওহীর মাধ্যমে অথবা পর্দার আড়াল থেকে কথা বলেন, অন্য কোনােভাবে নয়, অথবা তিনি তার বার্তাবাহককে পাঠান যে তার হুকুমের ততােটুকু বার্তা নিয়ে আসে যতােটুকু তিনি চান। অবশ্যই তিনি জানেন, বিজ্ঞানময়। শােনাে, আল্লাহর দিকে ফিরে যায় সকল কাজ’ (আয়াত ৫১-৫৩) ওপরের আয়াতগুলাে অকাট্যভাবে জানাচ্ছে যে মানুষের পক্ষে আল্লাহর সাথে মুখােমুখি হয়ে কথাবার্তা বলা সম্ভব নয়। হযরত আয়শা(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি মনে করে, মােহাম্মদ(স.) তার রবকে দেখেছেন সে আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরােপ করে।(বুখারী ও মুসলিম উভয়ের মধ্যেই হাদীসটি এসেছে) মানুষের কাছে আল্লাহর ওহী এই তিন পদ্ধতির যে কোনাে একটা পদ্ধতিতে আসে; এক. সরাসরি ওহী যা মােহাম্মদ(স.)-এর অন্তরের মধ্যে কোনাে মাধ্যম ছাড়াই এমনভাবে প্রেরণ করা হয় যে তিনি সুনিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যে, তা আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে এসেছে। দুই. পর্দার আড়াল থেকে কথা বলা হয়। যেমন মূসা(আ.)-এর সাথে তিনি পর্দার আড়াল থেকে কথা বলেছিলেন। মুসা(আ.) আল্লাহকে দেখতে চেয়েছিলেন। তার জবাবে বলা হয়েছিলাে, না, ‘মুসা, সরাসরি আমাকে তুমি দেখতে পারবে না, দেখার ইচ্ছা করে মূসা যখন তুর পাহাড়ের দিকে তাকালেন তখন সাথে সাথে তিনি বেঁহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। তারপর যখন তার হুশ হলাে, বললেন, মহা পবিত্র তুমি, হে আল্লাহ, আমি তাওবা করলাম। ঘােষণা দিচ্ছি যে, আমি বিশ্বাসীদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি।’ তিনি, ‘অথবা তিনি একজন বার্তাবাহক পাঠান’ আর তিনি হচ্ছেন ফেরেশতা সে তাঁরই নির্দেশে-যতােটা তিনি চান, ওহী নিয়ে আসে।’ ফেরেশতার মাধ্যমে যে ওহী আসে তা কয়েকটি নিয়মে, যেমন রাসূল(স.) থেকে জানা গেছে। এক. তার সাথে উক্ত ফেরেশতা এক ভয় বিজড়িত পরিবেশে এমনভাবে সাক্ষাত করেছেন যে, তিনি সেই ফেরেশতার উপস্থিতি অন্তরে অনুভব করেছেন, কিন্তু তাকে চোখে দেখেননি, যেমন রসূল(স.) বলেন, ‘সেই পবিত্র আত্মা আমার ভয় জড়িত অন্তরের মধ্যে এ কথা এনে দিতেন যে, কোনো মানুষ ততােক্ষণ মরবে না যতােক্ষণ না তার জন্যে বন্ধ করা রিযিক সে পুরােপুরিভাবে পেয়ে যাবে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করাে এবং তার কাছে উত্তম ভাবে চাও। দুই. রসূল(স.)-এর কাছে (উক্ত) ফেরেশতা একজন মানুষের রূপ ধরে আসতেন, অতপর তিনি এমনভাবে রসূল(স.)-কে সম্বোধন করে কথা বলতেন যে, তার বক্তব্য রসূল(স.)-এর অন্তরে সংরক্ষিত হয়ে যেতাে। তিন. তিনি জিবরাঈল ফেরেশতা রসূল(স.)-এর কাছে এক ঘন্টাধ্বনি আকারে আসতেন এবং এই আগমন রসূল(স.)-এর ওপর অত্যন্ত ভারী এক চাপ সৃষ্টি করতাে, এমনকি এই ভারত্বের অনুভূতির তীব্রতায়, কঠিন শীতের দিনেও তিনি প্রচন্ডভাবে ঘেমে যেতেন। এই ভারত্বের লক্ষণ আরও যেভাবে প্রকাশ পেতাে তা হচ্ছে, যখন উটের ওপর অবস্থান করা অবস্থায় এইভাবে ওহী আসতাে তখন উটের পিঠ (সেই ভারতের তীব্রতায়) প্রায় মাটির সাথে মিশে যেতাে। আরও স্পষ্টভাবে এই ভারতুের লক্ষণ আর একটি ঘটনা থেকে জানা যায়। একদিন যায়েদ ইবনে সাবিতের উরুর ওপর রসূল(স.)-এর উরুর কিয়দংশ স্পর্শ করে ছিলাে। হযরত যায়েদ(রা.) বলেন, এমন সময়ে ঘন্টাধ্বনির মতো ওহী আসতে শুরু করলে তিনি তার উরুর ওপর চাপটা এতাে বেশী অনুভব করছিলেন যে, মনে হচ্ছিলে যে তার উরুর হাডিড চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যাচ্ছে। চার. সে ফেরেশতা (জিবরাঈল)-কে রসূল(স.)- অবিকল তার নিজস্ব আকৃতিতে দেখেছেন এবং সে সময়ে তিনি রসূল(স.)-এর কাছে আল্লাহর বাণী ততােটা পৌছে দিয়েছেন, যতােটা তাকে পৌছুতে বলা হয়েছে। এই ভাবে (উক্ত ফেরেশতাকে আসল চেহারায়) দেখা রসূল(স.)-এর যিন্দেগীতে দুই বার সম্ভব হয়েছে। সূরায়ে নাজম এর উল্লেখ এসেছে। (ইমাম শামসুদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ ইবনে কাইয়েম রচিত ‘যাদুল মায়াদ’ গ্রন্থ থেকে এ রেওয়ায়াতটি পাওয়া গেছে) এই হচ্ছে ওহী আসার বিভিন্ন পদ্ধতি ও উপায় এবং ফেরেশতার সাথে রসূল(স.)-এর সরাসরি সাক্ষাতের অবস্থা। যিনি এসব বিভিন্ন পদ্ধতি ও মাধ্যমে ওহী পাঠিয়েছেন, ‘তিনি মহান, তিনি বিজ্ঞানময়।’ তিনি তার মহান মর্যাদাপূর্ণ এসব পদ্ধতিতে ওহী পাঠিয়েছেন, তিনি যার কাছে ইচ্ছা তার কাছে এসব বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে ওহী পাঠান। আমার নিজের মানসিক অবস্থা হচ্ছে এই যে, আমি যখনই এমন কোনাে আয়াত দেখেছি, যার মধ্যে ওহী অথবা এসব হাদীস সম্পর্কে আলােচনা এসেছে, তখনই ফেরেশতা জিবরাইল(আ.) এর সাথে সেই মিলনের প্রসংগটি আমার মধ্যে এক ভীষণ কম্পন সৃষ্টি করেছে। আমার প্রত্যেকটি অংগ প্রত্যংগ থরথর করে কাঁপতে থেকেছে… তারপর চিন্তা এসেছে, কেমন করে ও কিভাবে মহান সেই সত্ত্বার সাথে আমাদের মিলন সংঘটিত হবে- যার নেই কোনাে আদি, নেই কোনাে অন্ত। যিনি আছেন চিরদিন এবং থাকবেন চিরদিন, যার ক্ষমতার কোনাে সীমা-শেষ নেই, যাকে কোনাে স্থান, কোনাে সীমা বা সময়ের সাথে কল্পনা করা যায় না, যিনি জানেন সব কিছু এবং যার ক্ষমতার আওতার মধ্যেই সব কিছু চলছে। যাঁর মতাে কেউ নেই, কিছু নেই। একদিন অবশ্যই আসবে, যখন তার সাথে আমাদের মিলন হবে, কিন্তু মহান রব্বুল আলামীন-এর সাথে আমাদের মিলন কিভাবে হবে? আমরা তো সীমাবদ্ধ জীব, সময়, স্থান ও স্থুলতার গন্ডীতে আমরা আবদ্ধ। কিভাবে আমরা পৌছুবাে তার কাছে আমরা তাে ধ্বংসশীল, এই নশ্বর দেহ কিভাবে তার কাছে গিয়ে দাড়াবে। সেই মহা জ্যোতির্ময় রবের সামনে আমাদের অস্তিত্ব কিভাবে স্থির থাকবে? এরপর, সেই মহা মিলনের কথা কিভাবে বুঝবাে, কিভাবে বুঝাবাে? কোনাে ভাষা দিয়ে এ কথা প্রকাশ করবাে। এই অনুভূতির সাথে এসে জড় হয় সেই চিন্তা, কেমন করে এই নশ্বর দেহের মানুষের কাছে পৌছুবে সেই অবিনশ্বর, চিরন্তন ও সর্বশক্তিমান মাবুদের কথা? পৌছুবে তাঁর কথা, যার কোনাে সীমা নেই। নেই কোনাে শেষ এবং নেই এমন কোনাে রূপ বর্ণ বা আকার আকৃতি, যা আমরা বুঝতে পারি? কেমন করে তা হবে? কিভাবে হবে? একের পর এক এসব প্রশ্ন মনে আসতে থাকে, কিন্তু এর কিছুই আমরা বুঝতে পারি না কেননা আমরা তুচ্ছ সীমাবদ্ধ বোধ ও অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু এরপরও আমি এ প্রসংগে আবারও ফিরে আসবো এবং নিজেকে বলবাে, এ কী হলাে তােমার, কেন জিজ্ঞাসা করছাে এসব কথা? কিভাবে হবে, কেমনে হবে? তুমি জিজ্ঞাসা করছো, অথচ তােমাকে তো চিন্তা করতে হবে তােমার নিজের সীমাবদ্ধতার কথা খেয়াল রাখতে হবে তােমার সীমাবদ্ধতা, তােমার অক্ষমতা, তােমার বস্তুনির্ভরতা, তােমার মানবনির্ভশীলতা ইত্যাদির গন্ডীর মধ্যে চিন্তা করা ছাড়া তােমার তাে কোনােই গত্যন্তর নেই। হাঁ, অবশ্যই মানতে হবে যে, এ সত্য কথাটা ওপরের বর্ণনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এ সত্যটা জীবন্ত ছবির মতাে ফুটে উঠেছে। প্রকৃতির সব কিছুর মধ্যে যেসব লক্ষণ ছড়িয়ে রয়েছে তাতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা আছেন এবং সৃষ্টির সব কিছুই তার অস্তিত্বের সাথে জড়িত রয়েছে। এ সত্যটি বুঝা সত্তেও তার সম্পর্কে ভয় এবং কম্পন আমার যথারীতিই রয়ে গেছে। আর প্রকৃতপক্ষে এ ভয়টা থাকাও দরকার। অবশ্য নবুওত এক বিরাট নেয়ামত এবং ফেরেশতার সাথে সাক্ষাত এটাও অবশ্যই এক বিরাট রহস্যপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে গােটা মানব মন্ডলীকে সঠিক পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই এ নেয়ামত দেয়া হয়েছে। এ মহান নেয়ামতের মাধ্যমে যেমন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইয়হে ওয়া সাল্লাম মানুষের কাছে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত পৌছে দিয়েছেন, তেমনি করে যারা এ সুমহান কিতাব পাঠ করে, তারাও এ কিতাবের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববােধ পয়দা করে। আমার প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আপনিও কি আমার সাথে এখন এই চিন্তাই করছেন এবং ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আল কোরআনের অবদান সম্পর্কে আপনি কি আমার সাথে একমত? এ কিতাব তাে সেই ওহীরই প্রতিধ্বনি করে, যা সেই মহান পরওয়ারদেগারের কাছ থেকে এসেছে! হাঁ, তাহলে আপনি কি আমার সাথে এই একইভাবে চিন্তা করবেন যা আমি করছি! এ কিতাব ওখান থেকেই এসেছে, আমি কি এ কথাটি বলবাে? বলাটা কি আমার ঠিক হবে না, কিছুতেই না (যদিও আমরা কথায় কথায় অনেক সময় এভাবে বলে ফেলি) প্রকৃতপক্ষে ওখান থেকে এ কিতাব আসেনি, আসেনি কোনাে বিশেষ স্থান থেকে। কোনাে বিশেষ যামানার কোনাে বিশেষ ক্ষেত্র থেকে, কোনাে বিশেষ দিক থেকে, কোনাে বিশেষ ব্যক্তি বা পাত্র থেকে অথবা কোনাে সীমাবদ্ধতা থেকে আসেনি। এসেছে সকল সত্ত্বার চূড়ান্ত সত্ত্বা থেকে, সে মহান সত্ত্বা চিরদিন আছেন, চিরদিন থাকবেন। এসেছে সকল ক্ষমতা ও শক্তির আধার সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছ থেকে মানুষের কাছে। এই মানুষকেই নবী রসূল বানানাে হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, সেই অসীম সত্ত্বার অমর অক্ষয় বাণীসম্বলিত এ কিতাবটি এলাে, সসীম ও ক্ষীণ আয়ু সম্বলিত এই দুর্বল মানুষের কাছে, অসীমের সাথে সসীমের এ সম্পর্ক তার বার্তার মাধ্যমে সম্পন্ন হলো-এটা সত্যিই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। কারণ, এতাে এমন এক অলৌকিক কালাম, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ রচনা করতে পারে না, সেই অমর অক্ষয় বাণীকে মরণশীল এই মানুষের কাছে পৌছে দেয়াটা কী আজব ব্যাপার তা একটু চিন্তা করলেই আঁচ করা হয়তাে সম্ভব হবে। তবে যে উপায়ে এ বাণী পাঠানাের ব্যবস্থা হয়েছে তা কতাে রহস্য ভরা এবং তা কিভাবে সম্পন্ন হয়েছে তা একমাত্র তিনিই জানেন। তিনিই এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। আর যে ব্যক্তিই এ কথাগুলাে পড়ে, সেই অশান্ত ও উচ্ছংখল মানব গােষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। আমার ভাই বােনেরা, সেই সব বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলাে সম্পর্কে, আপনারাও কি সেইভাবে অনুভব করেন যেভাবে আমি অনুভব করছি যা উল্লেখ করতে গিয়ে আমি ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠি, যা লিখতে গিয়ে আমার গােটা অস্তিত্ব মুহর্মুহু প্রকম্পিত হচ্ছে আমি যখন কল্পনা করছি, এ পাক কালামের অবতীর্ণ হওয়ার সেই মহাশ্চর্য মুহূর্ত সম্পর্কে তখন কেন যেন আমার ভয় লাগছে এবং কেন যেন আমি ভীষণভাবে প্রকম্পিত হচ্ছি তা আমি বলতে পারবাে না। এ বিষয়ে আমি কী বলবাে তাও বুঝতে পারছি না, যেহেতু এ ঘটনাটাই অসাধারণ এবং এক অলৌকিক প্রকৃতির। এর দৃশ্যও অস্বাভাবিক, অথচ এই বাণী বারবার পৃথিবীর বুকে নাযিল হয়েছে। আর এ বাণীর অলৌকিক এবং অত্যাশ্চার্য ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ রসূল(স.)-এর যামানার লােকেরা বহুবার অনুভব করেছে, তারা নিজেদের চোখেই দেখেছে এ মর্যাদাপূর্ণ কালামের শক্তি। খােদ আয়েশা(রা.) (যিনি ছিলেন রাসূল(স.)-এর সব থেকে ঘনিষ্ঠ জীবন সাথী), মানবেতিহাসে এ মহান কালামের শক্তির যে নিদর্শন অবলােকন করেছেন সেগুলাের মধ্য থেকে একটি ঘটনা তিনি পেশ করছেন। বলছেন, রসূল(স.) বললেন, ‘ওহে আয়েশা, এই যে জিবরাঈল(আ.) এসেছেন, তিনি তোমাকে সালাম জানাচ্ছেন। বললাম, তার ওপরও সালাম ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হােক। এরপর তিনি বললেন, “তিনি দেখছেন, যা আমরা দেখি না।(হাদীসটি বুখারী শরীফে এসেছে) যায়েদ ইবনে সাবেত(রা.) নিজে এমন একটি মুহর্তের সাক্ষ্য দিচ্ছেন। বলছেন, এ সময় রসূল(স.)-এর উরু(র কিয়দাংশ) তার উরুর ওপর রেখে বসে আছেন এমন সময় ওহী এসে গেলাে, তখন রসূল(স.)-এর উরু এত ভারী হয়ে গেলাে যে মনে হতে লাগলাে যে তার (যায়েদের) উরু ভেংগে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। রসূল(স.)-এর আরও বহু সাহাবী এ ঘটনা দেখেছেন এবং ওহীর এ কঠিন চাপ রসূল(স.)-এর চেহারা দেখে তারা অনুভব করেছেন, অতপর তারা সেই অবস্থায় রসূলকে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করেছেন। অবশেষে ওহী আসা শেষ হয়েছে এবং তিনি হালকা হয়ে গেছেন। তখন তিনি উপস্থিত সাহাবীদের দিকে মনােযােগী হলেন এবং তারাও তার কাছে এগিয়ে এলেন। আরাে চিন্তার বিষয় এই যে ওহী, এর প্রকৃতি কী? যে মহান ও মর্যাদাপূর্ণ ফেরেশতা ওহী নাযিল করার উদ্দেশ্যে এসে তার সাথে মিলিত হচ্ছেন তার প্রকৃতিই বা কী? রূহ রাজ্যের কোন ধাতু দিয়ে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে যে তিনি আল্লাহ রব্বুল ইযযতের কাছ থেকে এ ওহী বহন করে এলেন মাটির সৃষ্টি মানুষ নবীর কাছে পৌছাতে পারছেন, তার সাথে মােলাকাত করছেন এবং তাঁর অনুভূতিকে স্পর্শ করছেন? এ রহস্য এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। এটা একটা বাস্তব সত্য যে এর থেকেও আরও গভীর রহস্য ফুটে উঠেছে, যেখানে দূর থেকে উক্ত ফেরেশতাকে তিনি গােটা দিগন্ত বলয়ে অবস্থানরত অবস্থায় দেখেছেন। এ অবস্থাটা বুঝা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এসব অত্যাশ্চার্য ঘটনাবলীর সংস্পর্শে যিনি আসছেন তিনি স্বয়ং নবী মোহাম্মদ(স.), তাঁর হৃদয় তাে এ নশ্বর দেহধারী মানবীয় হৃদয়। কি করে তিনি মাটির মানুষ হয়ে এই অকল্পনীয় ও অভাবনীয় বিষয়গুলাে অনুভব করছেন? কিভাবেই বা গড়ে উঠছে সেই আলােকময় ফেরেশতার। সাথে তার এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর কিভাবেই বা তিনি সেই ফেরেশতার সাথে মােলাকাত করছেন? কি করে তার হৃদয় গ্রন্থগুলাে সেই মােলাকাতের জন্যে খুলে গেলাে, আর কিভাবেই বা তার মধ্যে সেই শক্তির যােগান দেয়া হচ্ছে যার ফলে তার মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভূত হচ্ছে এবং তার গােটা সত্ত্বা আল্লাহর কথায় সাড়া দিচ্ছে। কোন সে পরিচালনা, কোন সে রহমত এবং কোন সে মর্যাদা নিহিত রয়েছে এসব কিছু বানানাের উদ্দেশ্যের মধ্যে। এরপর মহান আল্লাহ তায়ালা দয়া বর্ষণ করছেন এবং চাইছেন মানুষ নামক এই দুর্বল ও তুচ্ছ মানুষের কাছে তার উপদেশ বাণী পাঠিয়ে তাদেরকে সঠিক পথে চলার ব্যাপারে সাহায্য করতে। এভাবে তাদের জীবনকে শােধরানাের জন্যে এবং তার পথ তাদের সামনে সমুজ্জ্বল করে তুলে ধরার জন্যে তাদের কাছে তিনি তার ওহী পাঠাচ্ছেন, এভাবে তিনি চাইছেন যে তারা সত্য পথ থেকে দূরে সরে যায়। আর মানুষের পক্ষে একটি মশা তাড়ানাের কাজ থেকেও আল্লাহ তায়ালার কাছে এ কাজ অতি সহজ। তার সুবিশাল সাম্রাজ্যের দিকে গভীর দৃষ্টিতে যখন তাকানাে হবে তখন এটা বুঝা যাবে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পরিচালনা, হাঁ এটা এক জ্বলন্ত বাস্তবতা, বরং যদি মানুষ সুদূর সমুজ্জ্বল দিগন্তের দিকে স্থির দৃষ্টিতে একবার তাকায় তাহলে তারা বুঝতে পারবে, তারা যা কিছু অনুমান করে থাকে তার থেকে আল্লাহ তায়ালা বহু বহু উর্ধে।
*ওহীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : এরশাদ হচ্ছে, ‘আর এমনি করে আমি, মহান আল্লাহ, তােমার কাছে… শােনাে সকল কাজ (অবশেষে) তার কাছেই ফিরে যাবে।’(আয়াত ৫২-৫৩) ‘ওয়া কাযালিকা’- এ শব্দটি দ্বারা বুঝায় এই নিয়মে এবং এই সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে, ‘আমি পাঠাই তােমার কাছে’ অতপর আল্লাহর ওয়াদা অনুযায়ী ওহী আসার কাজ ও সময় শেষ হয়ে গেছে। ‘আমি তােমার কাছে পাঠিয়েছি, প্রচন্ড শক্তিমান রূহকে আমার আদেশে।’ এ মােবারক রূহের মধ্যে যে জীবন প্রবাহ রয়েছে, তা তার প্রখর তেজকে প্রচন্ডভাবে ছড়িয়ে দেয় যা সর্বত্র সকল বিরােধিতাকে প্রতিহত করে, এরপর যা অন্তরের মধ্যে এবং প্রকাশ্য কর্মক্ষেত্রে, বাস্তব কাজের মাধ্যমে তা বৃদ্ধি করে। এ ঈমানী চেতনাই তােমাকে সঠিক পথে রেখেছে। এমন সময় যখন তুমি জানতে না ঈমান কি এবং কিতাবই বা কি। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-এর জীবনের চিত্র একেছেন, অথচ এই ওহী দান করার পূর্ব থেকে তাঁকে বা তার সম্পর্কে তিনি ভালাে করেই জানেন। রসূল (রসূল হওয়ার পূর্বেই) আসমানী কিতাব ও ঈমান সম্পর্কিত কথা শুনেছিলেন। যেহেতু আরব দেশে আরবদের মধ্যে অনেক আহলে কিতাব (ইহুদী খৃষ্টান) বাস করতাে এবং তাদের কিছু আকীদা ছিলাে, কিন্তু সে আকীদার কথা বলা এখানে উদ্দেশ্য নয়। এখানে আলােচ্য বিষয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কিতাব ও এর মধ্যে উপস্থাপিত ঈমানের প্রতি দাওয়াতের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তাদের অন্তরের মধ্যে এ কিতাবের তাৎপর্য অনুধাবন করানাে এবং এ কিতাব সম্পর্কে চেতনা পয়দা করা, কিন্তু বিবেকের মধ্যে এসব কিছুর তাৎপর্য তখনই গভীরভাবে অনুভূত হবে যখন বুঝা যাবে যে, এই রূহ জিবরাঈল(আ.)] মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই নাযিল হয়েছে। যিনি মােহাম্মদ(স.)-কে চূড়ান্তভাবে দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর বান্দাদের কাছে তার বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্যে। তিনি বলছেন, ‘বরং আমি, (ঈমানকে) এক নূর হিসেবে বানিয়েছি, যার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা তাকে হেদায়াত করি।’ এইটিই হচ্ছে ঈমানের খাটি প্রকৃতি, এইটিই এই ওহীর প্রকৃতি। এই রূহ এবং আল কিতাব [{বারবার এ মহান কিতাবে, আল কিতাব শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে। এর দ্বারা সেই কিতাবকে বুঝানাে হয়েছে যা আরশে মােয়াল্লাতে লিখিত রয়েছে। যার শিক্ষা দুনিয়াতে অসংখ্য নবীর মাধ্যমে বারবার এসেছে। এই জন্যেই দেখা যায়, পরিবর্তিত হয়ে গেলেও, সমস্ত আসমানী কিতাবের মূল সুর একই। এমনকি যারা নবী রসূলের কথা বলে না, তারাও পরকালের কথা বলে এবং মানব কণ্যাণ সম্পর্কে একই শিক্ষা দেয়। সেই মূল কিতাব, তার আরবী ভাষায় উচ্চারিত শব্দাবলীসহ পরিপূর্ণভাবে শেষ নবী(স.) এর ওপর নাযিল হয়েছে এবং এ জনােই এই সেই কিতাব- আল কোরআনকে হেফাযত করার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন এবং তার নাম দিয়েছেন আল কোরআন। অর্থাৎ সর্বাধিক এবং সর্বক্ষণ পঠিতব্য, আর বাস্তবেও এ কিতাব সদা সর্বদা পঠিত হচ্ছে কিনা এবং একে হেফাযত করার জন্যে আল্লাহ তায়ালার দেয়া ওয়াদা তিনি পালন করছেন কিনা? তা লক্ষ্য করার বিষয় এই কিতাবকে এবং এর বাহক জিবরাঈল(আ.)-কে আল্লাহ তায়ালা নূর বলে অভিহিত করেছেন। মহব্বতের সাথে যে কেউ এ কিতাব পড়ে, বুঝে, চর্চা করে, সেও এ নূরের আলােকে নূরাণী হয়ে যায়}] অবশ্যই এ গুলাে এক মহা দেদীপ্যমান আলাে। এ নূর নিয়ে যে চলে, যে ব্যক্তি এ নূরের আলােতে আলােকিত হতে চায়, যে কেউ এ কিতাব অধ্যয়ন করে এবং নির্বোধ না হয়ে এর শিক্ষা অনুসারে জীবনকে গড়ে তােলে। তার জন্যে এ নূর বয়ে আনে শান্তি তার হৃদয়কে এ নূর হাসি খুশীতে ভরে দেয়। তবে তাকেই এ নূর আলােকিত করে, যাকে আল্লাহ তায়ালা তার আলােতে চলার তাওফিক দেন, যাকে এর তাৎপর্য বুঝার যােগ্যতা দান করেন, আর এ নূরের সাথে সাক্ষাত করার কাজটিই হৃদয়সমূহকে আলােকিত করে। এ নূর হচ্ছে হেদায়াতের পথে এক দিগ্বিজয়ী আলোকবর্তিকা। এর সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, ‘(হে রসূল) তাদের অবশ্যই তুমি সঠিক পথ দেখাও, মানুষকে সরল সঠিক ও মজবুত পথের দিকে (এই নূর এর দ্বারাই) তাদের এগিয়ে দাও।’ এখানে এই পথ দেখানাের বিষয়ের ওপরই প্রধানত গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। কিন্তু এ হেদায়াতপ্রাপ্তি তাে আল্লাহর ইচ্ছাতে সম্ভব হয়, অর্থাৎ সকল কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যে ব্যক্তি আল কোরআনের কাছে সম্পর্ক ও তার প্রতি মহব্বত যে কোনাে ব্যক্তিকে এ মহান কিতাবের খাস এলম (জ্ঞান) লাভ করার আকাংখী হওয়ার তাওফীক যােগাবে। আল কোরআনের সাথে গভীর মহব্বত ছাড়া এ মহান নেয়ামত কেউ পেতে পারে না। অপর দিকে রসূলুল্লাহ(স.) হচ্ছেন আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সন্তুষ্ট লাভ করার একমাত্র মাধ্যম। এ কথা মনে রাখতে হবে, কোনাে হৃদয় ততােক্ষণ হেদায়াতের আলাে লাভ করবে না, যতােক্ষণ পর্যন্ত না রেসালাতের কাছে সে না পৌছুবে। কারণ রেসালাতের মাধ্যমেই আল্লাহর মর্জি বাস্তবায়িত হবে!’ তুমি সরল সঠিক অবিচল পথ দেখাবে, সে পথ আল্লাহর যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মালিক। এটাই হচ্ছে আল্লাহর পথে পৌছুনাের সঠিক দিকনির্দেশনা। এ হচ্ছে সেই পথ যেখানে এসে অন্যান্য সকল পথের মিলন ঘটেছে। যেহেতু এই পথটিই বিশ্বের মালিকের কাছে পৌছেছে। মালিক তিনি যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সে সব কিছুর মালিক। অতএব, যে তার পথে চলবে, সে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন যে নিয়ম দিয়েছেন সেই নিয়মের ওপরই চলবে এবং চলবে সেই শক্তি ও তার দেয়া মেহেরবানীর ওপর যা ছড়িয়ে রয়েছে সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী জুড়ে সেই হেদায়াত পাবে। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এদের মহা মহিমান্বিত মালিকের ওপর সদা সর্বদা মুখাপেক্ষী। তিনি তাে সেই মহাসত্ত্বা যার কাছে সবাই মুখাপেক্ষী। যার কাছে সবাইকেই ফিরে যেতে হবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘শােনো, আল্লাহর কাছেই সব কিছু ফিরে যাবে।’ অর্থাৎ সব কিছু শেষ হয়ে যাবে তাঁর কাছে গিয়ে, তাঁর কাছে গিয়েই সবাই পরস্পর মিলিত হবে এবং তিনিই তার নিজ হুকুম বলে সব কিছুর ফয়সালা করে দেবেন। ঈমানরূপী এই নূর, তাঁর সেই পথ যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্যে পছন্দ করেছেন, যাতে করে তারা অবশেষে খুশী মনে ও আনুগত্য সহকারে সেই পথ দিয়ে চলে। এভাবেই শেষ হচ্ছে আলােচ্য সূরাটি। ওহী সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে যার আলােচনা শুরু হয়েছিলাে, আর ওহীই হচ্ছে সেই প্রধান কেন্দ্রবিন্দু বা মাঝের খুঁটা, যাকে কেন্দ্র করে সকল সমাধান আবর্তিত হয়, অর্থাৎ মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান দিয়েছেন যিনি, তিনি জানিয়েছেন যে, একেবারে প্রথম যুগ থেকে তিনি তাঁর প্রেরিত বার্তা পৌছানাের মাধ্যমে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। তিনি ফেরেশতা জিবরাঈলের মাধ্যমে সব কিছু পাঠিয়েছেন, যাতে করে মানুষ একমাত্র তাঁরই পথ গ্রহণ করে, শুধু তারই মত কবুল করে এবং তারই বিধান মেনে চলে। মােহাম্মদ(স.)-কে পাঠিয়েছেন যেন তার রেসালাতের আদর্শ অনুযায়ী মানবমন্ডলীর জন্যে নতুন নেতৃত্বের ঘােষণা দেয়া যায়, যেন মােমেন জামায়াতের মধ্যে আল্লাহর দ্বীন এবং সীরাতুল মুস্তাকীম পর্যন্ত তাদের পৌছে দেয়ার জন্যে নেতৃত্বের দায়িত্ব সম্পন্ন করা যায়। এই হলাে ‘সীরাতুল মুস্তাকীম বা সহজ সরল ও মযবুত পথ। এ তাে হচ্ছে তাঁরই পথ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে তার সব কিছুর মালিক। আল্লাহ রব্বুল আলামীন নবীর নেতৃত্বে পরিচালিত এই মুসলিম জামায়াতের বৈশিষ্ট্যগুলােও সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন এবং তাদের কথাও বলেছেন যারা এই বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জামায়াতের অনুসারী হবে। এই জামায়াতই দুনিয়ায় সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে এবং জামায়াতই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দেয়া আমানতকে বহন করবে, এ হচ্ছে সেই আমানত যা পৃথিবীর বুকে সুদূর আসমান থেকে নাযিল হয়েছে। এমন মহা আশ্চর্যজনক উপায়ে যার বর্ণনা আমরা ওপরে বিস্তারিতভাবে দেখতে পেয়েছি।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন #:-
যারা কুফর ও শিরকের নির্বুদ্ধিতায় ডুবে আছে তারা যদি বুঝানোর পরও না মানতে চায় না মানুক, সত্য যথা স্থানে সত্যই। যমীন ও আসমানের বাদশাহী দুনিয়ার তথাকথিত বাদশাহ, স্বৈরাচারী ও নেতাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি। কোন নবী, অলী, দেবী বা দেবতার তাতে কোন অংশ নেই, আল্লাহ একাই তার মালিক। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী না নিজের শক্তিতে বিজয়ী হতে পারে, না সেই সব সত্তার কেউ এসে তাকে রক্ষা করতে পারে যাদেরকে মানুষ নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে খোদায়ী ক্ষমতা ও এখতিয়ারসমূহের মালিক মনে করে বসে আছে।
# এটা আল্লাহর বাদশাহীর নিরংকুশ (Absolute) হওয়ার একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ। কোন মানুষ, সে পার্থিব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যত বড় অধিকর্তাই সাজুক না কেন, কিংবা তাকে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যত বড় মালিকই মনে করা হোক না কেন, অন্যদের সন্তান দেওয়ানো তো দূরের কথা নিজের জন্য নিজের ইচ্ছানুসারে সন্তান জন্ম দানেও সে কখনো সক্ষম হয়নি। আল্লাহ যাকে বন্ধ্যা করে দিয়েছেন সে কোন ওষুধ, কোন চিকিৎসা এবং কোন তাবীজ কবজ দ্বারা সন্তান ওয়ালা হতে পারেনি। আল্লাহ যাকে শুধু কন্যা সন্তান দান করেছেন সে কোনভাবেই একটি পুত্র সন্তান লাভ করতে পারেনি এবং আল্লাহ যাকে শুধু পুত্র সন্তানই দিয়েছেন সে কোনভাবেই একটি কন্যা সন্তান লাভ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে সবাই নিদারুণ অসহায় এমনকি সন্তান জন্মের পূর্বে কেউ এতটুকু পর্যন্ত জানতে পারেনি যে মায়ের গর্ভে পুত্র সন্তান বেড়ে উঠছে না কন্যা সন্তান। এসব দেখে শুনেও যদি কেউ খোদার খোদায়ীতে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী সেজে বসে, কিংবা অন্য কাউকে ক্ষমতা ও ইখতিয়ারে অংশীদার মনে করে তাহলে সেটা তার নিজের অদূরদর্শিতা যার পরিণাম সে নিজেই ভোগ করবে। কেউ নিজে নিজেই কোন কিছু বিশ্বাস করে বসলে তাতে প্রকৃত সত্যের সামান্য কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না।
# বক্তব্যের সূচনা পর্বে যা বলা হয়েছিলো সমাপ্তি পর্যায়েও সেই বিষয়টিই বলা হচ্ছে। কথাটা পুরোপুরি বুঝতে হলে এই সূরার প্রথম আয়াত এবং তার টীকা পুনরায় দেখে নিন।
#.এখানে অহী অর্থ ‘ইলকা’, ইলহাম, মনের মধ্যে কোন কথা সৃষ্টি করে দেয়া কিংবা স্বপ্নে কিছু দেখিয়ে দেয়া, যেমন হযরত ইবরাহীম ও ইউসুফকে দেখানো হয়েছিলো (ইউসুফ, আয়াত ৪ ও ১০০ এবং আস সাফফাত, ১০২ )
# এর সারমর্ম হচ্ছে, বান্দা শব্দ শুনতে পায় কিন্তু শব্দদাতাকে দেখতে পায় না, যেমন হযরত মূসার ক্ষেত্রে ঘটেছিলো। তূর পাহাড়ের পাদদেশে একটি বৃক্ষ থেকে হঠাৎ আওয়াজ আসতে শুরু হলো। কিন্তু যিনি কথা বললেন তিনি তাঁর দৃষ্টির আড়ালেই থাকলেন (ত্বাহা আয়াত ১১ থেকে ৪৮ ; আন নামল, আয়াত ৮ থেকে ১২ ; আল কাসাস, আয়াত ৩০ থেকে ৩৫ )
# যে পদ্ধতিতে নবী-রসূলদের কাছে সমস্ত আসমানী কিতাব এসেছে এটা অহী আসার সেই পদ্ধতি। কেউ কেউ এ আয়াতাংশের ভুল ব্যাখ্যা করে এর অর্থ করেছেনঃ আল্লাহ রসূল প্রেরণ করেন যিনি তাঁর নির্দেশে সাধারণ লোকদের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছিয়ে দেন।” কিন্তু কুরআনের ভাষাفَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ (তারপর সে তাঁর নির্দেশে তিনি যা চান তাই অহী হিসেবে দেয়) তাদের এই ব্যাখ্যার ভ্রান্তি সম্পূর্ণ স্পষ্ট করে দেয়। সাধারণ মানুষের সামনে নবীদের তাবলীগী কাজকর্মকে “অহী প্রদান” অর্থে না কুরআনের কোথাও আখ্যায়িত করা হয়েছে, না আরবী ভাষায় মানুষের সাথে মানুষের কথাবার্তাকে ‘অহী’ শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ আছে। অহীর আভিধানিক অর্থই হচ্ছে গোপন এবং ত্বরিত ইঙ্গিত। নবী-রসূলদের তাবলীগী কাজকর্ম বুঝাতে এই শব্দটির ব্যবহার শুধু এমন ব্যক্তিই করতে পারে যে আরবী ভাষায় একেবারেই অজ্ঞ।
# তিনি কোন মানুষের সাথে সামনা-সামনি কথাবার্তা বলার বহু ঊর্ধ্বে। নিজের কোন বান্দার কাছে নির্দেশনা পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য সামনা-সামনি বাক্যালাপ করা ছাড়া আর কোন কৌশল উদ্ভাবন করতে তাঁর জ্ঞান অক্ষম নয়।
# “এভাবেই” অর্থ শুধু শেষ পদ্ধতি নয়, বরং ওপরের আয়াতে যে তিনটি পদ্ধতি উল্লেখিত হয়েছে তার সব ক’টি। আর ‘রূহ’ অর্থ অহী অথবা অহীর মাধ্যমে নবীকে ﷺ যে শিক্ষা দান করা হয়েছে সেই শিক্ষা। কুরআন ও হাদীস থেকেই একথা প্রমাণিত যে, এই তিনটি পদ্ধতিতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হিদায়াত দান করা হয়েছেঃ একঃ হাদীস শরীফে হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অহী আসার সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের আকারে (বুখারী ও মুসলিম)। এই ধারা পরবর্তী সময় পর্যন্ত জারি ছিল। তাই হাদীসে তাঁর বহু সংখ্যক স্বপ্নের উল্লেখ দেখা যায়। যার মাধ্যমে হয় তাঁকে কোন শিক্ষা দেয়া হয়েছে কিংবা কোন বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তাছাড়া কুরআন মজীদে নবীর ﷺ একটি স্বপ্নের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে (আল ফাতহু, আয়াত ২৭)। তাছাড়া কতিপয় হাদীসে একথারও উল্লেখ আছে যে, নবী (সা.) বলেছেন, আমার মনে অমুক বিষয়টি সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে, কিংবা আমাকে একথাটি বলা হয়েছে বা আমাকে এই নির্দেশ দান করা হয়েছে অথবা আমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের সব কিছু অহীর প্রথমোক্ত শ্রেণীর সাথে সম্পর্কিত। বেশীর ভাগ হাদীসে কুদসী এই শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত। দুইঃ মে’রাজে নবীকে ﷺ দ্বিতীয় প্রকার অহী দ্বারা সম্মানতি করা হয়েছে। কতিপয় হাদীসে নবীকে ﷺ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশ দেয়া এবং তা নিয়ে তাঁর বার বার দরখাস্ত পেশ করার কথা যেভাবে উল্লেখিত হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, সে সময় আল্লাহ এবং তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে ঠিক তেমনি কথাবার্তা হয়েছিলো যেমনটি তূর পাহাড়ের পাদদেশে মূসা (আ) ও আল্লাহর মধ্যে হয়েছিলো। তিনঃ এরপর থাকে অহীর তৃতীয় শ্রেণী। এ ব্যাপারে কুরআন নিজেই সাক্ষ্য দান করে যে, কুরআনকে জিবরাঈল আমীনের মাধ্যমে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছানো হয়েছে (আল বাকারা ৯৭ , আশ শু’আরা ১৯২ থেকে ১৯৫ আয়াত)।
# নবুওয়াতের মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার আগে নবীর ﷺ মগজে এ ধারণা পর্যন্তও কোন দিন আসেনি যে, তিনি কোন কিতাব লাভ করতে যাচ্ছেন বা তাঁর লাভ করা উচিত। বরং তিনি আসমানী কিতাব এবং তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আদৌ কিছু জানতেন না। অনুরূপ আল্লাহর প্রতি তাঁর ঈমান অবশ্যই ছিল। কিন্তু মানুষকে আল্লাহ সম্পর্কে কি কি বিষয় মানতে হবে সচেতনভাবে তিনি তার বিস্তারিত কিছুই জানতেন না। একথাও তাঁর জানা ছিল না যে, এর সাথে ফেরেশতা, নবুওয়াত, আল্লাহর কিতাবসমূহ এবং আখেরাত সম্পর্কে অনেক কিছুই মানা আবশ্যক। এ দু’টি ছিল এমনই বিষয় যা মক্কার কাফেরদের কাছেও গোপন ছিল না। মক্কার কোন মানুষই এ প্রমাণ দিতে সক্ষম ছিল না যে, হঠাৎ নবুওয়াত ঘোষণার পূর্বে সে কখনো নবীর ﷺ মুখে আল্লাহর কিতাবের কথা শুনেছে কিংবা মানুষদের অমুক অমুক বিষয়ের প্রতি ঈমান আনতে হবে এমন কোন কথা শুনেছে। একথা সুস্পষ্ট যদি কোন ব্যক্তি পূর্ব থেকেই নবী হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে তাহলে চল্লিশ বছর পর্যন্ত রাত দিন তাঁর সাথে উঠাবসা করেও কেউ তাঁর মুখ থেকে কিতাব ও ঈমান শব্দ পর্যন্ত শুনবে না। অথচ চল্লিশ বছর পর সে ঐ সব বিষয়েই হঠাৎ জোরালো বক্তব্য পেশ করতে শুরু করবে তা কখনো হতে পারে না।
# এটা কাফেরদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত শেষ সতর্কবাণী। এর তাৎপর্য হলো, নবী (সা.) বললেন আর তোমরা তা শুনে প্রত্যাখ্যান করলে কথা এখানেই শেষ হয়ে যাবে না। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে তার সবই আল্লাহর সামনে পেশ করা হবে এবং সবশেষে কার কি পরিণাম হবে সে চূড়ান্ত ফায়সালা তাঁর দরবার থেকেই হবে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন#:-
৪৯-৫০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
অত্র আয়াতদ্বয়ে বলা হচ্ছে যে, সকল ক্ষমতার উৎস ও অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তাঁর জন্যই আকাশ ও জমিনের রাজত্ব। তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু করেন। তিনি যা কিছু চান তাই হয় আর যা চান না তা হয় না। তাঁর ইচ্ছার ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
(يَخْلُقُ مَا يَشَا۬ءُ)
তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি ইচ্ছা করলে কাউকে শুধু পুত্র সন্তান দান করেন, আবার ইচ্ছা করলে কাউকে শুধু কন্যা সন্তান দান করেন। কাউকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন আবার কাউকে বন্ধ্যা অবস্থায় রেখে দেন। এগুলো মূলত আল্লাহ তা‘আলার মহাশক্তির নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই এ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ব্যতীত আর কেউ নেই, যে মানুষকে সন্তান দান করতে পারে। যারা মনে করে যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোন পীর-ফকির সন্তান দান করতে পারে তাদের এ দাবী মিথ্যা, তারা সন্তান দেয়ার নামে শরীয়ত গর্হিত কাজ করে থাকে। কোন মানুষের পক্ষে এটা কক্ষনো সম্ভব নয়। যারা এরূপ বিশ্বাস করবে তারা মূলত মুশরিক। এখানে আল্লাহ তা‘আলা চার শ্রেণির মানুষের কথা বর্ণনা করেছেন- (১) যারা কেবল পুত্র সন্তান লাভ করে, (২) যারা কেবল কন্যা সন্তান লাভ করে, (৩) যারা পুত্র ও কন্যা উভয় সন্তান লাভ করে, (৪) বন্ধ্যা : যারা কোন প্রকার সন্তান লাভ করে না। এ শ্রেণী বিভাগ হলো জাতকের দিক দিয়ে। জনকের দিক দিয়েও মানুষ চার প্রকার : (১) আদম (আঃ)-কে কেবল মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, (২) হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) থেকে অর্থাৎ শুধু পরুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন, ৩. ‘ঈসা (আঃ)-কে কেবল নারী থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, (৪) অবশিষ্ট সকল মানুষকে নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটি সৃষ্টিই আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ক্ষমতার ওপর প্রমাণ বহন করে। অতএব সন্তান চাওয়ার জন্য কোন মাযার, কোন পীর বা ফকিরের কাছে যাওয়া যাবে না, বরং আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাইতে হবে। তিনি ইচ্ছা করলে সবই সম্ভব।
এসব আয়াতে সন্তানের প্রকার বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কন্যা-সন্তানের কথা উল্লেখ করলেন, আর পুত্র-সন্তানের কথা উল্লেখ করলেন পরে। এ ইঙ্গিতদৃষ্টে ওয়াছেলা ইবনু আসকা বলেন : যে নারীর গর্ভ থেকে প্রথমে কন্যা-সন্তান হবে সে পুণ্যময়ী (কুরতুবী)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সন্তান দান করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার হাতে।
২. আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে চার শ্রেণির মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কারো কাছে এমন কিছু যাওয়া যাবে না, যা দেয়ার মালিক আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ না।
৫১-৫৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আলোচ্য আয়াতসমূহের প্রথম আয়াত ইয়াহুদীদের এক হঠকারিতামূলক দাবীর জবাবে অবতীর্ণ হয়েছে। ইমাম বাগভী ও কুরতুবী (রহঃ) বলেন : ইয়াহুদীরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলল, আপনি যদি নাবী হন তাহলে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কথা বলেন না কেন, তাঁকে দেখেন না কেন, যেমন মুসা (আঃ) কথা বলেছেন এবং দেখেছেন? আপনি এরূপ না করা পর্যন্ত আমরা ঈমান আনব না। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : মূসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেননি। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (কুরতুবী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াতগুলোতে কোন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তা‘আলার কথা বলার মাধ্যমগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সাথে তিনটি পদ্ধতিতে কথা বলেন :
(১) وَحْيًا ওয়াহী তথা কোন ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়াই রাসূলের অন্তরে ওয়াহী ছুড়ে দেন। এরূপ পদ্ধতিকেنفث বলা হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : জিবরীল (আঃ) আমার অন্তরে ছুড়ে দিয়েছে যে, কোন আত্মা তার রিযিক ও আয়ু পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মারা যায় না। আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর ও উত্তম রিযিক তালাশ কর। যা হালাল তা গ্রহণ কর আর যা হারাম তা বর্জন কর। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ২৮৬৬)
(২) জাগ্রত অবস্থায় পর্দার আড়াল থেকে সরাসরি কথা বলা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-এর সাথে তূর পাহাড়ে কথা বলেছিলেন।
(৩) ফেরেশতার মাধ্যমে স্বীয় ওয়াহী প্রেরণ করা। যেমন জিবরীল (আঃ) ওয়াহী নিয়ে আগমন করতেন এবং নাবীদেরকে শুনাতেন।
সুতরাং দুনিয়াতে কোন মানুষ আল্লাহ তা‘আলার সাথে সামনা-সামনি কথা বলতে পারে না।
روح ‘ রূহ’ বলতে এখানে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেভাবে আমি তোমার পূর্বে অন্যান্য নাবীর প্রতি ওয়াহী প্রেরণ করেছিলাম, অনুরূপ তোমার প্রতি কুরআন ওয়াহী করেছি। কুরআনকে “রূহ্” বলে এ জন্য আখ্যায়িত করা হয়েছে যে, কুরআন দ্বারা অন্তঃকরণের জীবন লাভ হয়।
(مَا كُنْتَ تَدْرِيْ مَا الْكِتٰبُ وَلَا الْإِيْمَانُ)
‘তুমি তো জানতে না কিতাব কী ও ঈমান কী’ “কিতাব” দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য। অর্থাৎ নবুওয়াতের পূর্বে কুরআনের কোন জ্ঞান তোমার ছিল না। অনুরূপ ঈমান তথা ইসলামী শরীয়তের বিস্তারিত বিষয় সম্পর্কেও তোমার কোন জ্ঞান ছিল না। এগুলো ওয়াহী দ্বারা তোমাকে জানানো হয়েছে। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আমি এ কুরআনকে করেছি নূর বা জ্যোতি। এর দ্বারা আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে চাই হিদায়াত দান করি। অর্থাৎ কুরআন দ্বারা হিদায়াত কেবল তারাই পায় যাদের মধ্যে ঈমানের অনুসন্ধান ও তা গ্রহণের প্রতি তীব্র আগ্রহ থাকে, তারা এটাকে হিদায়াত লাভের নিয়্যাতে পড়ে থাকে। তাই আল্লাহ তা‘আলা এদের সাহায্য করেন এবং এদের জন্য হিদায়াতের পথ সুগম করে দেন। এ পথের ওপরই এরা চলতে থাকে। কিন্তু যারা নিজের চোখ বন্ধ করে নেয় ও কানে ছিপি লাগিয়ে নেয় এবং জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগায় না, তারা হিদায়াত কিভাবে পেতে পারে?
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَوْ جَعَلْنٰھُ قُرْاٰنًا اَعْجَمِیًّا لَّقَالُوْا لَوْلَا فُصِّلَتْ اٰیٰتُھ۫ﺛ ءَاَعْجَمِیٌّ وَّعَرَبِیٌّﺚ قُلْ ھُوَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا ھُدًی وَّشِفَا۬ئٌﺚ وَالَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ فِیْٓ اٰذَانِھِمْ وَقْرٌ وَّھُوَ عَلَیْھِمْ عَمًیﺚ اُولٰ۬ئِکَ یُنَادَوْنَ مِنْ مَّکَانٍۭ بَعِیْدٍ)
“আমি যদি আজমী (অনারবীয়) ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করতাম তবে তারা অবশ্যই বলত : এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি কেন? কী আশ্চর্য যে, এর ভাষা আজমী (অনারবীয়), অথচ রাসূল আরবীয়। বল : মু’মিনদের জন্য এটা পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার; কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব। তারা এমন যে, যেন তাদেরকে আহ্বান করা হয় বহু দূর হতে।” (সূরা হা-মীম আস্ সাজদাহ্ ৪১ : ৪৪)
(وَإِنَّكَ لَتَهْدِيْٓ إِلٰي صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ)
‘তুমি অবশ্যই প্রদর্শন কর সরল পথ’ অর্থাৎ তুমি মানুষকে সিরাতুল মুসতাকিমের পথ দেখাও। এটাকে
(هداية الارشاد والدلالة)
বা পথ প্রদর্শন ও নির্দেশনামূলক হিদায়াত বলা হয়। নাবী-রাসূলসহ সকল মানুষ এ প্রকার হিদায়াত বা পথপ্রদর্শন করতে পারে। কিন্তু প্রথম হিদায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য (هداية التوفيق) হিদায়াতুত তাওফীক : সরল সঠিক পথের দিশা দান করতঃ তার ওপর মজবুত ও অটুট থাকার তাওফীক দান করা। এ প্রকার হিদায়াত শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার হাতে।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার কাছে সঠিক পথের হিদায়াত চাইতে হবে এবং তার ওপর বহাল থাকার জন্য বেশি বেশি এ দু‘আ করতে হবে-
يَا مُقَلِّبَ القُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَي دِينِكَ
হে অন্তরের পরিবর্তনকারী, আমার অন্তরকে দীনের ওপর অটল রাখ। স্বয়ং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ দু‘আ বেশি বেশি পাঠ করতেন। কারণ কোন পীর, মুরশিদ ও বাবা হিদায়াতের মালিক নয়, যদি আল্লাহ তা‘আলা হিদায়াত না দেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মানুষের সাথে আল্লাহ তা‘আলার কথা বলার তিনটি পদ্ধতি জানতে পারলাম। এ তিনটি পদ্ধতির বাইরে কোন ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সাথে কথা বলার দাবী করলে সে মিথ্যাবাদী।
২. কুরআন মু’মিনের জন্য হিদায়াতস্বরূপ।
৩. আল্লাহ তা‘আলার কাছে হিদায়াত কামনা করব এবং তার ওপর অটল থাকার জন্য বেশি বেশি দু’আ করব।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন #:-
৪৯-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, সৃষ্টিকর্তা, অধিকর্তা এবং আকাশ ও পৃথিবীর ব্যবস্থাপক একমাত্র আল্লাহ্। তিনি যা চান তা হয় এবং যা চান না তা হয় না। তিনি যাকে ইচ্ছা দেন, যাকে ইচ্ছা দেন না। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা শুধু কন্যা সন্তানই দান করেন, যেমন হযরত নূত (আঃ)। আর যাকে চান তাকে শুধু পুত্র সন্তান দান করেন, যেমন হযরত ইবরাহীম (আঃ)। আবার যাকে ইচ্ছা তিনি পুত্র ও কন্যা উভয় সন্তানই দান করেন, যেমন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সঃ)। আর তিনি যাকে ইচ্ছা সন্তানহীন করেন, যেমন হযরত ইয়াহ্ইয়া (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ)। সুতরাং চারটি শ্ৰেণী হলোঃ শুধু কন্যা সন্তানের অধিকারী, শুধু পুত্র সন্তানের অধিকারী, উভয় সন্তানেরই অধিকারী এবং সন্তানহীন।
তিনি সর্বজ্ঞ, প্রত্যেক হকদার সম্পর্কে তিনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি ইচ্ছামত বিভিন্নতা ও তারতম্য রাখেন।
সুতরাং এটা আল্লাহ পাকের ঐ ফরমানের মতই যা হযরত ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে রয়েছে। তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এটাকে যেন আমি লোকদের জন্যে নিদর্শন করি।”(১৯:২১) অর্থাৎ এটাকে আমি আমার শক্তির প্রমাণ বানাতে চাই এবং দেখাতে চাই যে, আমি মানুষকে চার প্রকারে সৃষ্টি করেছি। হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছি শুধু মাটি দ্বারা, তার পিতাও ছিল। না, মাতাও ছিল না। হযরত হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছি শুধু পুরুষের মাধ্যমে। আর হযরত ঈসা (আঃ) ছাড়া অন্যান্য সমস্ত মানুষকে আমি সৃষ্টি করেছি পুরুষ ও নারীর মাধ্যমে এবং ঈসা (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছি পুরুষ ছাড়াই, শুধু নারীর মাধ্যমে। সুতরাং হযরত ঈসা (আঃ)-কে সৃষ্টির করে মহাপ্রতাপান্বিত ও মহান শক্তিশালী আল্লাহ তার সৃষ্টির এই চার প্রকার পূর্ণ করেছেন। ঐ স্থানটি ছিল মাতা-পিতা সম্পর্কে এবং এই স্থানটি হলো সন্তানদের সম্পর্কে। ওটাও চার প্রকার এবং এটাও চার প্রকার। সুবহানাল্লাহ! এটাই হলো আল্লাহ তা’আলার জ্ঞান ও ক্ষমতার নিদর্শন।
৫১-৫৩ নং আয়াতের তাফসীর:
অহীর স্থান, স্তর ও অবস্থার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, ওটা কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অন্তরে ঢেলে দেয়া, যেটা আল্লাহর অহী হওয়া সম্পর্কে তাঁর মনে কোন সংশয় ও সন্দেহ থাকে না। যেমন ইবনে হিব্বানের (রঃ) সহীহ গ্রন্থে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “রূহুল কুদুস (আঃ) আমার অন্তরে এটা ফুকে দিয়েছেন যে, কোন ব্যক্তিই মৃত্যুবরণ করে না যে পর্যন্ত না তার রিযক ও সময় পূর্ণ হয়। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তমরূপে রুযী অনুসন্ধান কর।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘অথবা পর্দার অন্তরাল হতে তিনি কথা বলেন। যেমন তিনি হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেছিলেন। কেননা, তিনি কথা শুনার পর আল্লাহ তাআলাকে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলা ছিলেন পর্দার মধ্যে।
সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ)-কে বলেনঃ “আল্লাহ পর্দার অন্তরাল ছাড়া কারো সাথে কথা বলেননি, কিন্তু তোমার পিতার সাথে তিনি সামনা সামনি হয়ে কথা বলেছেন। তিনি উহুদের যুদ্ধে কাফিরদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, এটা ছিল আলমে বারযাখের কথা আর এই আয়াতে যে কালামের কথা বলা হয়েছে তা হলো ভূ-পৃষ্ঠের উপরের কালাম।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ‘অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে, যেই দূত তার অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করে। যেমন হযরত জিবরাঈল (আঃ) প্রমুখ ফেরেশতা নবীদের (আঃ) নিকট আসতেন। তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়।
এখানে রূহ দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি এই কুরআনকে অহীর মাধ্যমে তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি। তুমি তো জানতে না কিতাব কি ও ঈমান কি! কিন্তু আমি এই কুরআনকে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করি।” যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি বলে দাও- এটা ঈমানদারদের জন্যে হিদায়াত ও আরোগ্য, আর যারা ঈমানদার নয় তাদের কানে আছে বধিরতা এবং চোখে আছে অন্ধত্ব।” (৪১:৪৪)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তুমি তো প্রদর্শন কর শুধু সরল পথ- সেই আল্লাহর পথ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার মালিক। প্রতিপালক তিনিই। সবকিছুর মধ্যে ব্যবস্থাপক ও হুকুমদাতা তিনিই। কেউই তাঁর কোন হুকুম অমান্য করতে পারে না। সকল বিষয়ের পরিণাম আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তিনিই সব কাজের ফায়সালা করে থাকেন। তিনি পবিত্র ও মুক্ত ঐ সব দোষ হতে যা যালিমরা তার উপর আরোপ করে থাকে। তিনি সমুচ্চ, সমুন্নত ও মহান।