أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১০৮)
[ * *মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আল্লাহর অনুপম ব্যবস্থাপনা : -]
www.motaher21.net
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ পারা:২৫
৯-১৪ নং আয়াত:-
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:৯
وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَہُمۡ مَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ لَیَقُوۡلُنَّ خَلَقَہُنَّ الۡعَزِیۡزُ الۡعَلِیۡمُ ﴿ۙ۹﴾
তুমি যদি ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর, ‘কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? ওরা অবশ্যই বলবে, এগুলিকে সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ (আল্লাহ)।’
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:১০
الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ مَہۡدًا وَّ جَعَلَ لَکُمۡ فِیۡہَا سُبُلًا لَّعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ ﴿ۚ۱۰﴾
তিনিই তো সৃষ্টি করেছেন যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য দোলনা বানিয়েছেন এবং সেখানে তোমাদের জন্য রাস্তা তৈরী করে দিয়েছেন। যাতে তোমাদের গন্তব্যস্থলের পথ খুঁজে পাও।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:১১
وَ الَّذِیۡ نَزَّلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءًۢ بِقَدَرٍ ۚ فَاَنۡشَرۡنَا بِہٖ بَلۡدَۃً مَّیۡتًا ۚ کَذٰلِکَ تُخۡرَجُوۡنَ ﴿۱۱﴾
আর যিনি আসমান থেকে বারি বর্ষণ করেন পরিমিতভাবে । অতঃপর তা দ্বারা আমরা সঞ্জীবিত করি নির্জীব জনপদকে। এভাবেই তোমাদেরকে বের করা হবে।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:১২
وَ الَّذِیۡ خَلَقَ الۡاَزۡوَاجَ کُلَّہَا وَ جَعَلَ لَکُمۡ مِّنَ الۡفُلۡکِ وَ الۡاَنۡعَامِ مَا تَرۡکَبُوۡنَ ﴿ۙ۱۲﴾
আর যিনি সকল প্রকারের জোড়া যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এমন নৌযান ও গৃহপালিত জন্তু যাতে তোমরা আরোহণ কর ;
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:১৩
لِتَسۡتَوٗا عَلٰی ظُہُوۡرِہٖ ثُمَّ تَذۡکُرُوۡا نِعۡمَۃَ رَبِّکُمۡ اِذَا اسۡتَوَیۡتُمۡ عَلَیۡہِ وَ تَقُوۡلُوۡا سُبۡحٰنَ الَّذِیۡ سَخَّرَ لَنَا ہٰذَا وَ مَا کُنَّا لَہٗ مُقۡرِنِیۡنَ ﴿ۙ۱۳﴾
যাতে তোমরা এর পিঠে স্থির হয়ে বসতে পার, তারপর তোমাদের রবের অনুগ্রহ স্মরণ করবে যখন তোমরা এর উপর স্থির হয়ে বসবে; এবং বলবে , ‘পবিত্ৰ-মহান তিনি, যিনি এগুলোকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন। আর আমরা সমর্থ ছিলাম না এদেরকে বশীভূত করতে।
সূরা:৪৩: সূরা:- আয-যুখরুফ:১৪
وَ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا لَمُنۡقَلِبُوۡنَ ﴿۱۴﴾
এক দিন আমাদের রবের কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে।’
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করে যে, আকাশ ও পৃথিবীকে কে সৃষ্টি করেছে…'(আয়াত ৯) এ কথা সত্য যে, আরবদের মধ্যে কিছু কিছু সুস্থ আকীদা বিশ্বাসও ছিলো। আমার মনে হয়, এগুলাে হযরত ইবরাহীমের রেখে যাওয়া তাওহীদী আকীদারই অবশিষ্টাংশ। তবে পরবর্তীকালে তার বিকৃতি ঘটে এবং তাতে মানুষের মনগড়া ধ্যান ধারণা ঢুকে পড়ে। কিন্তু মানুষের সহজাত বিবেক-বুদ্ধি যে কথাটা অস্বীকার করতে অপারগ, তা মােশরেকদের আকীদা বিশ্বাসেও টিকে রয়েছে। সেটা হলাে, বিশ্বজগতের একজন স্রষ্টা রয়েছেন ও স্বতম্বিদ্ধ সত্য যে, কোনাে স্রষ্টা ছাড়া এই মহাবিশ্ব আপনা আপনি সৃষ্টি হতে পারে না এবং এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ পারে না। কিন্তু এই অকাট্য সত্যকে স্বীকার করে এর বাহ্যিক রূপ পর্যন্তই তারা থেমে থাকতাে। এর পরে এর যে স্বাভাবিক দাবী রয়েছে, তা মানতাে না। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করাে, আকাশ ও পৃথিবীকে কে সৃষ্টি করলাে, তাহলে তারা বলবে, মহা প্রতাপশালী মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালাই ওগুলােকে সৃষ্টি করেছেন।’ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘আল-আযীয’ (মহা প্রতাপশালী) ও আল আলীম (মহাজ্ঞানী) এই দুটো শব্দ তাদের কথার অন্তর্ভুক্ত ছিলাে না। তারা এ কথা স্বীকার করতাে বটে যে, বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা। কিন্তু ইসলাম আল্লাহর যে গুণাবলী বর্ণনা করেছে, তা তারা স্বীকার করতাে না। ইসলামের প্রচারিত এ গুণগুলাে এমন ইতিবাচক যে, এর প্রভাবে আল্লাহর সত্ত্বার একটা কার্যকর প্রভাব মানুষের অন্তরে, বাস্তব জীবনে ও এই সৃষ্টি জগতের জীবনে না পড়ে পারে না। তারা আল্লাহকে বিশ্বজগতের ও তাদের স্রষ্টা হিসাবে চিনতাে। কিন্তু তারা তার সাথে শরীকও মানে কেননা আল্লাহর যে গুণাবলী শিরকের ধারণাকে খন্ডন করে এবং শিরককে অযৌক্তিক ও বাতিল বলে প্রমাণ করে, সেই গুণাবলী সহকারে চিনতাে না। কোরআন এখানে তাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, যে আল্লাহকে তারা আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা হিসাবে জানে, তিনি ‘আযীয’ ও ‘আলীম অর্থাৎ অসীম শক্তিধর ও মহাজ্ঞানী। কোরআন তাদের এই স্বীকৃতি থেকে তাদের পিছু নেয় এবং এই স্বীকৃতির পরবর্তী ধাপগুলােতেও তাকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
*মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আল্লাহর অনুপম ব্যবস্থাপনা : এরপর কোরআন আল্লাহকে তাদের সাথে তার গুণাবলীর মাধ্যমে পরিচিত করতে আরেক ধাপ অগ্রসর হয় এবং সৃষ্টির পর তিনি তাদের ওপর আর কী কী অনুগ্রহ করেছেন, তা বর্ণনা করে।‘যিনি তােমাদের জন্যে পৃথিবীকে বিছানা স্বরূপ বানিয়েছেন এবং পৃথিবীতে তােমাদের জন্যে যাতায়াতের পথ বানিয়ে দিয়েছেন।’(আয়াত ১০) এই পৃথিবীকে মানুষের জন্যে বিছানাস্বরূপ বানানাের তত্ত্বটা সব যুগের মানুষই কোনাে না কোনাে আকারে বুঝতে পারে। যারা কোরআনকে সর্বপ্রথম গ্রহণ করেছে, তারা সম্ভবত পৃথিবীকে পায়ের নীচে দেখে বুঝতে পারে যে, তা চলাচলের যােগ্য, সামনে দেখে তাকে চাষাবাদের যােগ্য এবং সামগ্রিকভাবে তা জীবন যাপন ও উৎপাদনের উপযােগী। আজকে আমরা এ তত্ত্বটাকে আরাে ব্যাপক ও গভীরভাবে বুঝতে পারি। আধুনিক বিজ্ঞান এই পৃথিবীর প্রকৃতি ও তার দূর ও নিকটের ইতিহাস সম্পর্কে যতােদূর জেনেছে, ততােদূর আমরা জানি। অবশ্য এ সম্পর্কে আমাদের মতবাদ ও আন্দাজ-অনুমান যদি সঠিক হয়, তবেই এ জ্ঞান স্বার্থক। আমাদের পরে যারা পৃথিবীতে আসবে, তারা আমাদের চেয়েও অনেক বেশী তত্ত্ব ও তথ্য জানবে, ফলে এ আয়াতের ব্যাখ্যায়ও আসবে অধিকতর ব্যাপকতা ও গভীরতা। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যতােবেশী অগ্রসর হবে, ততােই আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার প্রশস্ততর হবে এবং মানুষ অজানাকে জানবে। আজকে আমরা পৃথিবীর বিছানা হওয়া ও এতে চলাচলের রাস্তা হওয়া সম্পর্কে এতােদূর জেনেছি যে, পৃথিবী নামক এই গ্রহটার রূপান্তর ঘটেছে যুগ যুগ কাল ধরে এবং শেষ পর্যন্ত তা মানব জাতির বসবাসযােগ্য (বিছানা সদৃশ) হয়েছে। রূপান্তর চলাকালে এক সময় ভূপৃষ্ঠে শুকনাে পাথর থেকে উর্বর মাটিতে পরিণত হয়েছে। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মিলনে ভূপূষ্ঠে পানি জন্মেছে। সে নিজের কক্ষপথে নিজেরই চারপাশে আবর্তিত হতে হতে তার দিনরাতের উত্তাপ ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে তাকে জীবন ধারণের যোগ্য বানিয়েছে। তার গতিবেগ এমন হয়েছে যে, তার পিঠের ওপর বস্তু ও প্রাণীসমূহ স্থির থাকতে পারে এবং মহাশূন্যে ছিটকে না পড়ে। এ সত্য থেকে আমরা এটাও জানতে পারি যে, আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীকে মধ্যাকর্ষণ নামক এক শক্তি দিয়েছেন। ফলে সে নিজস্ব পদ্ধতিতে এমন একটা বায়ুস্তর সংরক্ষণ করেছে, যা জীবনের অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছে। এই গ্রহের চারপাশের বায়ুস্তরে যদি মধ্যাকর্ষণ না থাকতো তাহলে এর পিঠের ওপর জীবনের অস্তিত্ব থাকতাে না যেমন মধ্যাকর্ষণবিহীন অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহে জীবনের অস্তিত্ব থাকেনি, যেমন চাদ। মহান স্রষ্টা এই মধ্যাকর্ষণ শক্তিকেও আবার পৃথিবীর আবর্তন থেকে উদ্ভূত ক্ষেপণ ক্ষমতার সাথে সমন্বিত করেছেন, যাতে ভূপৃষ্ঠে অবস্থানরত প্রাণী ও বস্তুগুলাে বিক্ষিপ্ত হয়ে ও ছিটকে শূন্যে ছড়িয়ে না পড়ে, আবার সেই সাথে ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী চলাচলও করতে পারে। আকর্ষণ যদি প্রয়ােজনের চেয়ে বেশী হতে, তাহলে বস্তু ও প্রাণী পৃথিবীর সাথে এমনভাবে সেঁটে থাকতাে যে, তার নড়াচড়া ও চলাচল করা হয় অসম্ভব হতাে, কিংবা তা কঠিন হয়ে পড়তাে। অপরদিকে তাদের ওপর বায়ুর চাপও এতােবেশী হতে যে, এগুলোকে পৃথিবীর সাথে মিশিয়ে দিতাে কিংবা পিষে ধ্বংস করে ফেলতাে। আবার এই বায়ুর চাপ যদি অতিমাত্রায় হালকা হতো তাহলে আমাদের বুক ও নাড়িভুড়ি ফেটে বেরিয়ে পড়তাে। অনুরূপভাবে পৃথিবীকে বিছানা স্বরূপ বানানাে ও তার ওপর জীবন যাপনের সুযােগ সুবিধা সৃষ্টির তত্ত্ব থেকে আমরা আরাে একটা বিষয় জানতে পারি। সেটা হলাে মহান আল্লাহ এই পৃথিবীতে এমন কিছু সহায়ক উপাদান রেখে দিয়েছেন, যা মিলিত হয়ে মানুষের জীবন ধারণকে সম্ভব ও সহজসাধ্য করেছে। এই উপাদান গুলাের কোনাে একটারও যদি অভাব ঘটতাে, তাহলে এই জীবন ধারণ অসম্ভব অথবা দুঃসাধ্য হয়ে যেতাে। এসব অনুকূল উপাদানের মধ্যে কয়েকটার নাম ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। আরাে একটা উপাদান হলো, ভূপৃষ্ঠের ওপর সঞ্চিত পানির বড় বড় উৎসগুলাে। যথা সাগর, মহাসাগর ইত্যাদিকে আল্লাহ তায়ালা সেসব বিষাক্ত গ্যাস শুষে নেয়ার পর্যাপ্ত যােগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়েছেন, যা ভূপৃষ্ঠে নানা ধরনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়, আর এর আবহাওয়াকে এমন পর্যায়ে রেখেছেন যে, তা পৃথিবী জীবজগতের বাসােপযোগী রয়েছে। আরাে একটা উপাদান হলাে, জীবজগত জীবন ধারণের জন্যে যে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং তারা যে অক্সিজেন ত্যাগ করে- সেই উভয় অক্সিজেনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যে গাছপালার সৃষ্টি করেছেন। এই ভারসাম্য রক্ষা করা না হলে কিছুকাল পর সকল প্রাণী শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতাে। এভাবে পৃথিবীকে বিছানাস্বরূপ বানানাে ও তার ওপর রাস্তাঘাট তৈরী করার ব্যাপারটা থেকে আমরা প্রতিনিয়ত আরাে বহু তথ্যের সন্ধান পাই। কোরআনের প্রথম শ্রোতারা এ সম্পর্কে যা কিছু তথ্য জানতাে, তার সাথে আরাে বহু তথ্য সংযােজিত হয়েছে। এ সবই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা বিপুল জ্ঞান ও শক্তির অধিকারী। এ সব থেকে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে যে, যতাে দূর দৃষ্টি যায় এবং কল্পনা শক্তি যতাে দূর কল্পনা করতে পারে- সর্বত্র এক অসীম শক্তিধর ও বিচক্ষণ সত্ত্বা সদা সক্রিয় রয়েছেন। জানা যায় যে, মানুষকে অকারণে সৃষ্টি করা হয়নি এবং তাকে বিনা জবাবদিহীতে ছেড়ে দেয়াও হবে না। মহান আল্লাহর অদৃশ্য হাত তাকে জীবনের প্রতিটা মুহর্তে ও প্রতিটা পদক্ষেপ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন ও ধরে রেখেছেন। যেন তােমরা সঠিক পথে চালিত হও। অর্থাৎ এই সৃষ্টিজগত ও তার সুসমন্বিত বিধি ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা মানুষের মনকে জগত স্রষ্টার দিকে পরিচালিত করা ও তার সন্ধান দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। সৃষ্টির সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর রহস্যের মধ্যেই তার হেদায়াতের উপাদান সংরক্ষিত রয়েছে। পৃথিবীকে বিছানাস্বরূপ বানানাে ও তার ওপর রাস্তাঘাট তৈরী করে দেয়ার পর জীবন ও জগতের উন্মেষের দিকে পরবর্তী আয়াতে আরাে একধাপ এগিয়ে যাওয়া হয়েছে। ‘আর যিনি আকাশ থেকে পরিমিত মাত্রায় পানি নামিয়ে এনেছেন…'(আয়াত ১১) আকাশ থেকে যে পানি নামে, সব মানুষই তা দেখে। অথচ এই বিস্ময়কর ঘটনা দেখেও মানুষ কিছুমাত্র চিন্তা-ভাবনা করে না এবং তার অন্তরে একটুও আলােড়ন বা শিহরণের সৃষ্টি হয় না। কেননা এগুলাে সে সারা জীবন দেখে এসেছে এবং বারবার দেখছে। পক্ষান্তরে রসূল(স.)-এর প্রতিটা ফোটাকে গভীর আবেগ উদ্দীপনা ও তীব্র আবেদন সহকারে পর্যবেক্ষণ করতেন। কেননা প্রতিটা ফোটা বৃষ্টি মহান আল্লাহর কাছ থেকে নেমে আসছে। আর তার সজীব ও সতেজ অন্তর এই ফোটাগুলােতে মহান আল্লাহর প্রাণবন্ত সৃজনী কর্মের স্বাক্ষর হিসাবে প্রত্যক্ষ করতাে এবং তার শিল্পী হাতের উপস্থিতি দেখতে পেতাে। আল্লাহর সাথে ও মহাবিশ্বে সক্রিয় প্রাকৃতিক বিধানের সাথে যারা সম্পর্ক রাখে, তারাও এগুলােকে একইভাবে প্রত্যক্ষ করবে বলে আশা করা যায়। কেননা প্রতিটা ফোঁটা এই প্রাকৃতিক বিধানেরই সৃষ্টি, যা মহাবিশ্বে সদা সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটা ফোটার ওপর সর্বক্ষণ আল্লাহর চোখ ও আল্লাহর হাত কার্যকর রয়েছে। এ সত্য অনস্বীকার্য যে, আকাশ থেকে নেমে আসা এই পানির উৎস হলাে পৃথিবী থেকে উত্থিত সেই বাম্প, যা মহাশূন্যে ঘনীভূত হয়ে বিরাজ করে। তাহলে কে এই পৃথিবী সৃষ্টি করলাে, কেই বা তাতে পানি বর্ষালাে? আর কেই বা তার ওপর উত্তাপ ও উষ্ণতা ছড়িয়ে রেখেছে। আর উত্তাপ পেলেই বাশে পরিণত হবার স্বভাবটাই বা পানির মধ্য কে দিয়েছে? বান্পকেই বা কে ওপরের দিকে আরােহণ করা ও ঘনীভূত হয়ে বায়ুমন্ডলে অবস্থান করার স্বভাব কে দিলাে? প্রকৃতিকেই বা সেই সব বৈশিষ্ট্য কে দিলাে, যা সেই ঘনীভূত বাম্পকে বিদ্যুৎ দিয়ে ভরে দিলাে, যার কারণে বৃষ্টি হয়। আর এই বিদ্যুতই বা কী? সেই সব রহস্য ও বৈশিষ্ট্য কী কী, যা বৃষ্টি বর্ষণকে অনিবার্য করে তােলে? আমরা বিজ্ঞান থেকে আমাদের অনুভূতির ওপর এমন অনেক ভারী বােঝা পড়ে থাকা টের পাই, যা আমাদের কাছ থেকে এই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক জগতের সৃষ্টি রহস্যকে আড়াল করে রাখে। অথচ এই বিজ্ঞানের প্রভাবে আমাদের হৃদয় হওয়া উচিত ছিলাে আবেগাপ্লুত ও বিনয়াবনত। আর যিনি আকাশ থেকে পরিমিত মাত্রায় পানি বর্ষণ করেন অর্থাৎ এই বৃষ্টির পানি (সাধারণত) পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিত। এটা এতাে বেশী হয় না যে, পৃথিবী ডুবে যাবে। আবার এতাে কম হয় না যে, পৃথিবী শুকিয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। আমরা এই চমকপ্রদ আনুকূল্য দেখতে পাই। আজ আমরা বুঝতে পারি জীবনের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের জন্যে এর প্রয়ােজনীয়তা। তা দিয়ে আমি মৃত নগরকে পুনরুজ্জীবিত করি। অর্থাৎ পানি থেকেই জীবনের উদ্ভব ঘটাই। ‘এভাবেই তােমরা পুনরায় জীবিত হবে।’ অর্থাৎ যিনি জীবনের প্রথম স্রষ্টা, তিনিই পুনরায় তা সৃষ্টি করবেন। আর যিনি মৃত ভূমি থেকে প্রথম জীবনের উদ্ভব ঘটিয়েছেন, তিনিই কেয়ামতের দিন পুনরায় প্রাণীদেরকে জীবন দেবেন। জানা কথা যে, প্রথম আরম্ভ থেকে পুনরার সহজ। আর আল্লাহর কাছে কোনাে কিছুই কঠিন নয়। তার কাছে সবই সহজ। আর যেসব পশুর মধ্য থেকে তারা একাংশ আল্লাহর জন্যে ও একাংশ আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যদের জন্যে নির্ধারণ করে, আল্লাহ তায়ালা ওগুলােকে এ জন্যে সৃষ্টি করেননি। এগুলােকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের প্রতি তার অনুগ্রহ হিসাবে। তারা নৌকার মতাে এগুলােতেও আরােহণ করবে, এগুলােকে অনুগত করে দেয়ার জন্যে আল্লাহর শােকর আদায় করবে এবং নেয়ামতের উপযুক্ত বিনিময় দেবে। (আয়াত ১২-১৪) এ আয়াত থেকে ইংগিত পাওয়া যায় যে, জোড়া জোড়া হওয়াই জীবনের মূলনীতি। সকল প্রাণীরই জোড়া রয়েছে। এমনকি প্রথম একক জীবকোষের ভেতরেও পুরুষ ও নারীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বরঞ্চ এ কথা বলাও হয়তাে ভুল হবে না যে, জোড়া জোড়া হওয়া শুধু জীবনের নয় বরং গােটা সৃষ্টি জগতেরই বৈশিষ্ট্য। কেননা জগতের ভিত্তিই হলাে একটা নেতিবাচক ইলেকট্রন ও এ একটা ইতিবাচক প্রােটনের সমন্বয়ে গঠিত অণু । পদার্থ বিদ্যার গবেষণা থেকে এ যাবত এটাই জানা গেছে। জোড়া জোড়া হওয়া প্রাণী জগতে সুস্পষ্ট। আল্লাহ তায়ালাই মানুষ ও মানুষ ছাড়া সকল প্রাণীকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। ‘তিনি নৌকা ও পশুদের মধ্য থেকে তােমাদের ভারবাহী বানিয়েছেন।’ এই কথাটা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তাকে পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা মনােনীত করে তিনি তার ওপর কতাে বড় অনুগ্রহ করেছেন এবং কতাে প্রাকৃতিক শক্তিকে মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন। তারপর এই নেয়ামতের শােকর আদায়ের নির্দেশ দিচ্ছেন, যখন নেয়ামত চোখে পড়বে বা ভোগ করা হবে, তখনই নেয়ামতদাতার শােকর আদায় করতে বলছেন। যাতে হৃদয় প্রতিটা কাজের সময় আল্লাহর সাথে যুক্ত থাকে। (আয়াত ১৩) অর্থাৎ আমরা আল্লাহর নেয়ামতের বিনিময়ে অনুরূপ নেয়ামত দিতে সক্ষম নই। আমরা নেয়ামতের বিনিময়ে কেবল শােকরই করতে পারি। তারপর এ কথাও স্মরণ করতে বলছেন যে, পৃথিবীতে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের পর তাদেরকে পুনরায় আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে, যাতে এই খেলাফতের দায়িত্ব পালনকালে সম্পাদিত সকল কাজের প্রতিফল দেয়া হয় এবং প্রাকৃতিক শক্তিগুলােকে অনুগত করে দেয়ার বিনিময়ে শােকর আদায় করা হয়। ‘আর আমরা আমাদের প্রভুর কাছে অবশ্যই ফিরে যাবো।’ নেয়ামতদাতার প্রতি এটাই হলাে অপরিহার্য আদব। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই আদব প্রতিপালনের নির্দেশ দিচ্ছেন। যাতে প্রত্যেক নেয়ামত ভােগ করার সময় তাকে স্মরণ করা হয়। কেননা আমরা নেয়ামতে আপাদমস্তক ডুবে থেকেও আল্লাহকে ভুলে থাকি। এ ক্ষেত্রে ইসলামী আদব বা আচরণবিধি হৃদয়ের প্রশিক্ষণ ও বিবেকের পুনরুজ্জীবনের সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত। এটা নিছক সাময়িক কোনাে কাজ নয় যে, শুধু নৌকায় অথবা পশুর পিঠে আরােহণের সময়ই তা করতে হবে কিংবা নিছক কোনাে দোয়া কালাম নয় যে বিড়বিড়িয়ে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে দিলেই হবে। এটা সমগ্র মানবীয় চেতনা-অনুভূতিকে জাগিয়ে তােলার নাম, যেন তা সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহর উপস্থিতির বাস্তবতাকে, তাঁর সাথে বান্দার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বাস্তবতাকে, মানব সমাজের প্রতিটি বিষয়ে প্রতিক্ষণে আল্লাহর প্রত্যক্ষ হাত থাকার বাস্তবতাকে এবং আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিটা জিনিসকে ভােগ করার ওপর আল্লাহর হাত থাকাকে কার্যকরভাবে অনুভব করে। বস্তুত মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দেয়া প্রতিটা জিনিস হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহ, যার বিনিময়ে বান্দা কিছুই দেয়নি, দিতেও পারে না। আর আল্লাহর নেয়ামতের এই সার্বক্ষণিক স্মৃতি ও তার সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণাধীন থাকার অনুভূতি থাকাই কেবল যথেষ্ট নয়; বরং আল্লাহর মুখােমুখী হয়ে শেষ পর্যন্ত একদিন সারা জীবনের করা কর্মের হিসাব দিতে হবে- এই অনুভূতি থাকাও জরুরী। এসব চেতনা ও অনুভূতি থাকলে তা মানুষের মনকে সদা সচেতন রাখতে পারে। ফলে মানুষের মন কখনাে আল্লাহর তদারকী সম্পর্কে উদাসীন হতে পারে না এবং কখনাে তাকে ভুলে গিয়ে জড়তা ও স্থবিরতায় আক্রান্ত হতে পারে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# অন্যান্য স্থানে তো পৃথিবীকে বিছানা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এখানে তার পরিবর্তে দোলনা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ একটি শিশু যেভাবে তার দোলনার মধ্যে আরামে শুয়ে থাকে মহাশূন্যে ভাসমান এই বিশাল গ্রহকে তোমাদের জন্য তেমনি আরামের জায়গা বানিয়ে দিয়েছেন। এটি তার অক্ষের ওপর প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার মাইল গতিতে ঘুরছে এবং প্রতি ঘণ্টায় ৬৬, ৬০০ মাইল গতিতে ছুটে চলছে। এর অভ্যন্তরে রয়েছে এমন আগুন যা পাথরকেও গলিয়ে দেয় এবং আগ্নেয়গিরির আকারে লাভা উদগীরণ করে কখনো কখনো তোমাদেরও তার ভয়াবহতা টের পাইয়ে দেয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তোমাদের স্রষ্টা তাকে এতটা সুশান্ত বানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা আরামে তার ওপর ঘুমাও অথচ ঝাকুনি পর্যন্ত অনুভব করো না। তোমরা তার ওপরে বসবাস করো কিন্তু অনুভব পর্যন্ত করতে পার না এটি মহাশূন্যে ঝুলন্ত গ্রহ আর তোমরা তাতে পা ওপরে ও মাথা নীচের দিকে দিয়ে ঝুলছো। তোমরা এর পিঠের ওপরে আরামে ও নিরাপদে চলাফেরা করছো অথচ এ ধারণা পর্যন্ত তোমাদের নেই যে, তোমরা বন্দুকের গুলীর চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন গাড়ীতে সওয়ার হয়ে আছো। বিনা দ্বিধায় তাকে খনন করছো, তার বুক চিরছো এবং নানাভাবে তার পেট থেকে রিযিক হাসিল করছো অথচ কখনো কখনো ভূমিকম্পের আকারে তার অতি সাধারণ কম্পনও তোমাদের জানিয়ে দেয় এটা কত ভয়ংকর দৈত্য যাকে আল্লাহ তোমাদের জন্য অনুগত করে রেখেছেন (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখূন, তাফহীমুল কুরআন, আন নামল, টীকা ৭৪ – ৭৫ )
# ভূ-পৃষ্ঠে পাহাড়ের মাঝে গিরিপথ এবং পাহাড়ী ও সমতল ভূমি অঞ্চলে নদী হচ্ছে সেই সব প্রাকৃতিক পথ যা আল্লাহ তৈরী করেছেন। এসব পথ ধরেই মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। পর্বত শ্রেনীকে যদি কোন ফাঁক ছাড়া একেবারে নিশ্ছিদ্র প্রাচীরের মত করে দাঁড় করানো হতো এবং ভূ-পৃষ্ঠের কোথাও কোন সমুদ্র, নদী-নালা না থাকতো তাহলে মানুষ যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছিলো সেখানেই আবদ্ধ হয়ে পড়তো। আল্লাহ আরো অনুগ্রহ করেছেন এই যে, তিনি গোটা ভূ-ভাগকে একই রকম করে সৃষ্টি করেননি, বরং তাতে নানা রকমের এমন সব পার্থক্যসূচক চিহ্ন (Land marks) রেখে দিয়েছেন যার সাহায্যে মানুষ বিভিন্ন এলাকা চিনতে পারে এবং এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে। এটা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় যার সাহায্যে পৃথিবীতে মানুষের চলাচল সহজ সাধ্য হয়েছে। মানুষের যখন বিশাল কোন মরুভূমিতে যাওয়ার সুযোগ হয়, যেখানে মাইলের পর মাইল এলাকায় কোন পার্থক্যসূচক চিহ্ন থাকে না এবং মানুষ বুঝতে পারে না সে কোথা থেকে কোথায় এসে পৌঁছেছে এবং সামনে কোন্ দিকে যেতে হবে তখন সে এই নিয়ামতের মর্যাদা বুঝতে পারে।
# এ আয়াতাংশ একই সাথে দু’টি অর্থ প্রকাশ করছে। একটি হচ্ছে, এসব প্রাকৃতিক রাস্তা ও রাস্তার চিহ্নসমূহের সাহায্যে তোমরা তোমাদের পথ চিনে নিতে পার এবং যেখানে যেতে চাও সেখানে পৌঁছতে পার। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, মহিমান্বিত আল্লাহর এসব কারিগরি দেখে হিদায়াত লাভ করতে পার। প্রকৃত সত্য লাভ করতে পার এবং বুঝতে পার যে, পৃথিবীতে আপনা থেকেই এ ব্যবস্থা হয়ে যায়নি, বহু সংখ্যক খোদা মিলেও এ ব্যবস্থা করেনি, বরং মহাজ্ঞানী এক পালনকর্তা আছেন যিনি তার বান্দাদের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে পাহাড় ও সমতল ভূমিতে এসব রাস্তা বানিয়েছেন এবং পৃথিবীর একেকটি অঞ্চলকে অসংখ্য পন্থায় ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি দান করেছেন যার সাহায্যে মানুষ এক অঞ্চলকে আরেক অঞ্চল থেকে আলাদা করে চিনতে পারে।
# প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য বৃষ্টির একটা গড় পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন যা দীর্ঘকাল প্রতি বছর একই ভাবে চলতে থাকে। এক্ষেত্রে এমন কোন অনিয়ম নেই যে কখনো বছরে দুই ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হবে আবার কখনো দুইশ’ ইঞ্চি হবে। তাছাড়াও তিনি বিভিন্ন মওসুমের বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টিকে বিক্ষিপ্ত করে এমনভাবে বর্ষণ করেন সাধারণত তা ব্যাপক মাত্রায় ভূমির উৎপাদন ক্ষমতার জন্য উপকারী হয়। এটাও তাঁর জ্ঞান ও কৌশলেরই অংশ যে, তিনি ভূ-পৃষ্ঠের কিছু অংশকে প্রায় পুরোপুরিই বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করে পানি ও লতাগুল্ম শূন্য মরুভূমি বানিয়ে দিয়েছেন এবং অপর কিছু অঞ্চলে কখনো দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেন আবার কখনো ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যাতে ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, পৃথিবীর বিভিন্ন বসতি এলাকার জন্য বৃষ্টিপাত ও তা নিয়মিত হওয়া কত বড় নিয়ামত। তাছাড়া একথাও যেন তার স্মরণ থাকে যে, এই ব্যবস্থা অন্য কোন শক্তির নির্দেশনা মোতাবেক চলছে যার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন কিছুই কার্যকরী হয় না। একটি দেশে বৃষ্টিপাতের যে সাধারণ গড় তা পরিবর্তন কিংবা পৃথিবীর ব্যাপক এলাকায় তার বণ্টন হারে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করা, অথবা কোন আগমনোদ্যত তুফানকে রোধ করতে পারা বা কোন বিমুখ বৃষ্টিকে খাতির তোয়াজ করে নিজ দেশের দিকে টেনে আনা এবং বর্ষনে বাধ্য করার সাধ্য কারোর নেই। আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হিজর, আয়াত ১৯ থেকে ২২ টীকাসহ , আল মু’মিনূন, টীকা ১৭ , ১৮ )।
# এখানে পানির সাহায্যে ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা সৃষ্টিকে এক সাথে দু’টি জিনিসের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এক-এ কাজটি যিনি এক মাত্র আল্লাহ তাঁর জ্ঞান ও কুদরত দ্বারা হচ্ছে। আল্লাহর এই সার্বভৌম কর্তৃত্বে অন্য কেহ তাঁর শরীক নয়। দুই-মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবন হতে পারে এবং হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আন নাহল, টীকা ৫৩(ক) ; আল হাজ্জ, টীকা ৭৯ ; আন নামল টীকা ৭৩ ; আর রূম; টীকা ২৫ , ৩৪ ও ৩৫ ; সূরা ফাতের, টীকা ১৯ , সূরা ইয়াসীন, টীকা ২৯ )।
# জোড়া অর্থ শুধু মানবজাতির নারী ও পুরুষ এবং জীব-জন্তু ও উদ্ভিদরাজির নারী-পুরুষে জোড়াই বুঝানো হয়নি, বরং আল্লাহর সৃষ্ট আরো অসংখ্য জিনিসের জোড়া সৃষ্টির বিষয়ও বুঝানো হয়েছে যাদের পারস্পরিক সংমিশ্রনে পৃথিবীতে নতুন নতুন জিনিসের উৎপত্তি হয়। যেমনঃ উপাদানসমূহের মধ্যে কোনটি কোনটির সাথে খাপ খায় এবং কোনটি কোনটির সাথে খাপ খায় না। যেগুলো পরস্পর সংযোজন ও সংমিশ্রণ ঘটে সেগুলোর মিশ্রনে নানা রকম বস্তুর উদ্ভব ঘটছে। যেমন বিদ্যুৎ শক্তির মধ্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিদ্যুৎ একটি আরেকটির জোড়া। এ দু’টির পারস্পরিক আকর্ষণ পৃথিবীতে বিস্ময়কর ও অদ্ভূত সব ক্রিয়াকাণ্ডের কারণ হচ্ছে। এটি এবং এ ধরনের আরো অগণিত জোড়া যা আল্লাহ নানা ধরনের সৃষ্টির মধ্যে পয়দা করেছেন, এদের আকৃতি কাঠামো, এদের পারস্পরিক যোগ্যতা, এদের পারস্পরিক আচরণের বিচিত্র রূপ এবং এদের পারস্পারিক সংযুক্তি থেকে সৃষ্ট ফলাফল নিয়ে যদি মানুষ চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তার মন এ সাক্ষ্য না দিয়ে পারবে না যে, এ গোটা বিশ্ব কারখানা কোন একজন মহাপরাক্রমশালী মহাজ্ঞানবান কারিগরের তৈরী এবং তাঁরই ব্যবস্থাপনায় এটি চলছে। এর মধ্যে একাধিক খোদার অধিকার থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই।
# পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ শুধু মানুষ নৌকা ও জাহাজ চালনা এবং সওয়ারীর জন্য সওয়ারী জন্তু ব্যবহার করার ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু সে ক্ষমতা তিনি এজন্য দেননি যে, মানুষ খাদ্যের বস্তার মত এগুলোর পিঠে চেপে বসবে এবং যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন তিনি কে তা চিন্তা করবে না। অনুরূপ তিনি আমাদের জন্য বিশাল সমুদ্রে জাহাজ চালনা সম্ভব করেছেন এবং অসংখ্য রকমের জীব-জন্তুর মধ্যে এমন কিছু জীব-জন্তু সৃষ্টি করেছেন যেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের অধীন হয়ে থাকে। আমরা তাদের পিঠে আরোহণ করে যে দিকে ইচ্ছা নিয়ে যাই। তিনি আমাদের এ ক্ষমতা দান করেছেন তিনি কে তা একবারও ভেবে দেখবো না সেজন্য তিনি এসব দেননি। এসব নিয়ামত থেকে উপকৃত হওয়া কিন্তু নিয়ামতদাতাকে ভুলে যাওয়া মৃত হৃদয়-মন ও অনুভূতিহীন বিবেক বুদ্ধির আলামত। একটি জীবন্ত ও তীক্ষ্ণ অনুভূতি প্রবণ মন ও বিবেক সম্পন্ন মানুষ যখনই এসব সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করবে তখনই তার হৃদয়-মন নিয়ামতের উপলব্ধি ও কৃতজ্ঞতার আবেগে ভরে উঠবে। সে বলে উঠবে, পবিত্র সেই মহান সত্তা যিনি আমার জন্য এসব জিনিস অনুগত করে দিয়েছেন। পবিত্র এই অর্থে যে, তাঁর সত্তার গুণাবলী ও ক্ষমতা ইখতিয়ারে অন্য কেউ শরীক নয়। নিজের খোদায়ীর ক্রিয়াকাণ্ড চালাতে তিনি অক্ষম তাই অন্যান্য সাহায্যকারী খোদার প্রয়োজন পড়ে—এই দুর্বলতা থেকে তিনি মুক্ত। এসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করবো, এ অবস্থা থেকেও তিনি পবিত্র।
সওয়ারী পিঠে বসার সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের মুখ থেকে যেসব কথা উচ্চারিত হতো সেগুলোই এ আয়াতের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের সর্বোত্তম বাস্তব ব্যাখ্যা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, সফরে রওয়ানা হওয়ার সময় নবী (সা.) যখন সওয়ারীতে বসতেন তখন তিনবার আল্লাহু আকবর বলতেন। তারপর এই আয়াতটি পড়ার পর এই বলে দোয়া করতেনঃ اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ فِى سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى اللَّهُمَّ هَوِّنْ لَنا سَفَرَ اطْوِ لَنَا الْبُعْدَ اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِى السَّفَرِ وَالْخَلِيفَةُ فِى الأَهْلِ اللَّهُمَّ اصْحَبْنَا فِى سَفَرِنَا وَاخْلُفْنَا فِى أَهْلِنَا (مسند احمد , مسلم , ابو داود , نسائى , دارمى ترمذى) “হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার এই সফরে আমাকে নেকী, তাকওয়া এবং এমন কাজ করার তাওফীক দান করো যা তোমার পছন্দ। হে আল্লাহ, আমার জন্য সফরকে সহজ এবং দীর্ঘ পথকে সংকুচিত করে দাও। হে আল্লাহ তুমিই আমার সফরের সাথী ও আমার অবর্তমানে আমার পরিবার পরিজনের রক্ষক। হে আল্লাহ, সফরে আমাদের সঙ্গী হও এবং আমাদের অনুপস্থিতিতে পরিবার পরিজনের তত্বাবধান করো।”
হযরত আলী বলেনঃ একবার রসূলুল্লাহ ﷺ বিসমিল্লাহ বলে রিকাবে পা রাখলেন এবং সওয়ার হওয়ার পর বললেনঃ الحمد لله سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا……….তারপর তিনবার الحمد لله (আল্লাহু আকবার) বললেন ও তিনবার الله اكبر বললেন এবং তারপর বললেনঃ
سُبْحَانَكَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ قَدْ ظَلَمْتُ نَفْسِى فَاغْفِرْ لِى
“তুমি অতি পবিত্র। তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আমি নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।” এরপর তিনি হেসে ফেললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল, আপনি কি কারণে হাসলেন। তিনি বললেন, বান্দা رَبِّ اغْفِرْ لِى (হে রব আমাকে ক্ষমা করে দাও।) বললে আল্লাহর কাছে তা বড়ই পছন্দনীয় হয়। তিনি বলেনঃ আমার এই বান্দা জানে যে, আমি ছাড়া রক্ষাকারী আর কেউ নেই। (আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী প্রভৃতি।)
আবু মিজলায নামক এক ব্যক্তি বর্ণনা করেন, ‘একবার আমি সওয়ারী জন্তুর পিঠে উঠে سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَاআয়াতটি পড়লাম। হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ তোমাদের কি এরূপ করতে বলা হয়েছে। আমি বললামঃ তা হলে আমরা কি বলবো? তিনি বললেনঃ এভাবে বলোঃ সেই আল্লাহর শোকর যিনি আমাদের ইলামের হিদায়াত দান করেছেন। তাঁর শোকর যে, তিনি মুহাম্মাদ ﷺ পাঠিয়ে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তাঁর শোকর যে, তিনি তাঁর মাখলুকের জন্য সৃষ্ট সর্বোত্তম উম্মতের মধ্যে শামিল করেছেন। তারপর এ আয়াত পাঠ করো (ইবনে জাররি, আহকামূল কুরআন-জাসসাস)।
# প্রতিটি সফরে যাওয়ার সময় স্মরণ করো যে, সামনে আরো একটি বড় সফর আছে এবং সেটিই শেষ সফর। তাছাড়া প্রত্যেকটি সওয়ারী ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনাও যেহেতু থাকে যে, হয়তো বা কোন দুর্ঘটনা এ সফরকেই তার শেষ সফর বানিয়ে দেবে। তাই উত্তম হচ্ছে, প্রত্যেকবারই সে তার রবের কাছে ফিরে যাওয়ার বিষয়টিকে স্মরণ করে যাত্রা করবে। যাতে মরতে হলেও একেবারে অবচেতনার মৃত্যু যেন না হয়।
এখানে কিছুক্ষণ থেমে এই শিক্ষার নৈতিক ফলাফল ও কিছুটা অনুমান করুন। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে, ব্যক্তি কোন সওয়ারীতে আরোহণের সময় জেনে বুঝে পূর্ণ অনুভূতির সাথে এভাবে আল্লাহকে এবং তাঁর কাছে নিজের ফিরে যাওয়া ও জবাবদিহি করার কথা স্মরণ করে যাত্রা করে সে কি অগ্রসর হয়ে কোন পাপাচার অথবা জুলুম নির্যাতনে জড়িত হবে? কোন চরিত্রহীনার সাথে সাক্ষাতের জন্য, কিংবা কোন ক্লাবে মদ্য পান বা জুয়াখেলার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়ও কি কোন মানুষের মুখ থেকে একথা উচ্চারিত হতে পারে অথবা সে তা ভাবতে পারে? কোন শাসক কিংবা কোন সরকারী কর্মচারী অথবা ব্যবসায়ী যে মনে মনে এসব কথা ভেবে এবং মুখে উচ্চারণ করে বাড়ী থেকে বের হলো সেকি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে মানুষের হক নষ্ট করতে পারে? কোন সৈনিক নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত ঘটানো এবং দুর্বলদের স্বাধীনতা নস্যাত করার উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়ও কি তার বিমানে আরোহণ কিংবা ট্যাংকে পা রাখতে গিয়ে মুখে একথা উচ্চারণ করতে পারে? যদি না পারে, তাহলে এই একটি মাত্র জিনিস গোনাহর কাজের প্রতিটি তৎপরতায় বাঁধা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৯-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ তথা সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও মালিক একমাত্র আল্লাহ এ স্বীকারোক্তি মক্কার কুরাইশরাও দিত সে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এ সম্পর্কে যদি মক্কার কাফিরদেরকে জিজ্ঞাসা করা হত তাহলে তারা এ কথাই বলত যে, সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও মালিক আল্লাহ, যিনি জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন ইত্যাদি। শুধু তাই নয় বরং বিপদে পড়লে তারা একমাত্র আল্লাহকে ডাকত, কারণ তারা জানত এ বিপদ থেকে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। তারপরেও তারা মুসলিম হতে পারেনি, কারণ তারা তাওহীদে উলূহিয়্যাতে সরাসরি বিশ্বাস করত না এবং মানত না। কোন কিছুর প্রয়োজন পড়লে দেব-দেবীর কাছে যেত, তাদের নামে মানত করত, তাদের নামে কুরবানী করত।
তাই একজন ব্যক্তি আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও সবকিছুর মালিক ইত্যাদি অর্থাৎ তাওহীদে রুবুবিয়্যাতে ঈমান আনলেই মু’মিন হবে না যতক্ষণ না সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য সম্পাদন করে। এ সম্পর্কে আরো আলোচনা সূরা লুক্বমান-এর ২৫ নম্বর আয়াতে করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তিনি পৃথিবীকে মানুষের জন্য করেছেন শয্যাস্বরূপ, তা এমন শয্যা বা বিছানা যা স্থির ও স্থিতিশীল। তোমরা এর ওপর চলাফেরা করো, দণ্ডায়মান হও। নিদ্রা যাও এবং যেখানে ইচ্ছা যাতায়াত করো। তিনি এটাকে পর্বতমালা দ্বারা সুদৃঢ় করে দিয়েছেন, যাতে তা নড়াচড়া না করে এবং এতে চলার পথ তৈরী করে দিয়েছেন যাতে মানুষ সঠিক পথ লাভ করতে পারে। এ সম্পর্কে সূরা আন্ নাহ্ল-এর ১৫ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনিই আকাশ হতে পরিমিত বৃষ্টি বর্ষণ করেন যা দ্বারা মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। তার থেকে কমও নয় আবার বেশিও নয়। আর এ পানির দ্বারা তিনিই মৃত জমিনকে সঞ্জীবিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَا۬ٓءَ بِنَا۬ٓءً ص وَّأَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ٓءً فَأَخْرَجَ بِه۪ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَّكُمْ ج فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)
“যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য জীবিকাস্বরূপ ফল উৎপাদন করেন, অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।” (সূরা বাকারাহ ২ : ২২)
এ সম্পর্কেও সূরা আল হিজ্র, সূরা আন নাহ্ল সহ অন্যান্য জায়গাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত জীবকে জোড়া জোড়া তথা নর ও নারী করে সৃষ্টি করেছেন। যাবতীয় উদ্ভিদ, শস্য, ফল-মূল এবং জীব-জন্তু সবকিছুরই বিপরীত লিঙ্গ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(سُبْحٰنَ الَّذِیْ خَلَقَ الْاَزْوَاجَ کُلَّھَا مِمَّا تُنْۭبِتُ الْاَرْضُ وَمِنْ اَنْفُسِھِمْ وَمِمَّا لَا یَعْلَمُوْنَ)
“পবিত্র তিনি, যিনি জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে।” (সূরা ইয়া-সীন ৩৬ : ৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সওয়ারের জন্য নৌযান ও চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে সূরা আন্ নাহ্ল এ আলোচনা করা হয়েছে।
لِتَسْتَوُوْا -এর অর্থ, لتستقروا অথবা لتستعلوا স্থির হয়ে বসতে পার অথবা সওয়ার হতে পার।
ظُهُوْرِه۪ এখানে একবচনের যমীর (সর্বনাম) ব্যবহার করা হয়েছে ‘জিন্স’ (শ্রেণি)-এর দিকে লক্ষ্য করে। অর্থাৎ যাতে তোমরা নৌযান অথবা চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে স্থির হয়ে বসতে পার। তারপর আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের কথা স্মরণ করবে যে, তোমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা তা অনুগত করে দিয়েছেন।
مقرنين অর্থ- مطيعين অর্থাৎ- বশীভূত করে দেয়া, অনুগত করে দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সওয়ারে আরোহণের জন্য যে, দু‘আ পাঠ করতে হয় তা শিক্ষা দিয়েছেন। সেটা হলো,
(سُبْحَانَ الَّذِيْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَمَا كُنَّا لَه۫ مُقْرِنِيْنَ- وَإِنَّا إِلَي رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ)
পবিত্র ও মহান তিনি যিনি একে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সমর্থ ছিলাম না। আর আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব। সওয়ারীতে আরোহণ করার ব্যাপারে আরো সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায়।
‘আলী ইবনু রাবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি ‘আলী (রাঃ)-কে দেখলাম তিনি তার সওয়ারীর নিকট আসলেন, যখন সওয়ারীর ওপর পা রাখলেন তখন বললেন : بسم الله যখন সেটার ওপর বসলেন তখন বললেন : الحمد لله এবং এ দু‘আটি পাঠ করলেন :
(سُبْحَانَ الَّذِيْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَمَا كُنَّا لَه۫ مُقْرِنِيْنَ..)
অতঃপর তিনবার الحمد لله তিনবার الله اكبر এবং বললেন :
سبحانك لا اله الا انت قد ظلمت نفسي فاغفرلي
আপনি পবিত্র, আপনি ব্যতীত কোন সঠিক মা‘বূদ নেই। আমি আমার নিজের ওপর জুলুম করেছি সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। এটা মূলত সওয়ারীতে আরোহণ করার পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতেই সকল মুসলিমকে আরোহণ করা উচিত।
অতঃপর তিনি হাসলেন। আমি তাকে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুরূপ করতে দেখেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : বান্দা যখন বলে- হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা কর তখন আল্লাহ তা‘আলা আনন্দিত হন এবং বলেন : আমার বান্দা জানে যে, আমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না। (আবূ দাঊদ হা. ২৬০২, তিরমিযী হা. ৩৪৪৬, সহীহ)
অন্য বর্ণনায় এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁর বাহনে আরোহণ করতেন তখন তিনবার তাকবীর বলতেন, অতঃপর বলতেন :
(سُبْحَانَ الَّذِيْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَمَا كُنَّا لَه۫ مُقْرِنِيْنَ….)
তারপর বলতেন :
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ فِي سَفَرِي هَذَا مِنَ البِرِّ وَالتَّقْوَي، وَمِنَ العَمَلِ مَا تَرْضَي، اللّٰهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا المَسِيرَ، وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَ الأَرْضِ، اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِي السَّفَرِ، وَالخَلِيفَةُ فِي الأَهْلِ، اللَّهُمَّ اصْحَبْنَا فِي سَفَرِنَا، وَاخْلُفْنَا فِي أَهْلِنَا
হে আল্লাহ! আমি আমার এ সফরে কল্যাণ ও তাক্বওয়া কামনা করছি এবং এমন আমল কামনা করছি যা আপনি পছন্দ করেন।
হে আল্লাহ তা‘আলা! আমাদের জন্য সফর সহজ করে দাও, দূরকে নিকটবর্তী করে দাও। হে আল্লাহ তা‘আলা! তুমি সফরে সাথী, পরিবারের প্রতিনিধি। হে আল্লাহ তা‘আলা! আমাদের সফরে তুমি সাথী হও এবং আমাদের পরিবারের প্রতিনিধি হও। (সহীহ মুসলিম, তিরমিযী হা. ২৪৪৭, আবূ দাঊদ হা. ২৫৯৯)
সফর থেকে ফিরে এসে বলতেন :
آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ
আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, ইবাদতকারী ও আমাদের প্রভুর প্রশংসাকারী। (সহীহ বুখারী হা. ৫৯৬৮, সহীহ মুসলিম হা. ১৩৪২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : প্রত্যেক জন্তুর গজের ওপর শয়তান থাকে, যখন তার ওপর আরোহণ করবে তখন বিসমিল্লাহ বলবে যেমন তোমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে; তারপর সে জন্তু ব্যবহার কর। কারণ তারা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই বহন করে নিয়ে চলে। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ২২৭১)
সুতরাং একজন বুদ্ধিমান ও সচেতন মানুষের কর্তব্য হল সত্যিকার দাতা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত ব্যবহার করার সময় অমনযোগী ও উদাসীন না হওয়া। বরং নেয়ামতের কৃজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি জন্তুর অধিকারের দিকে খেয়াল রাখা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নয়। এ কথা মক্কার কুরাইশরাও স্বীকার করত।
২. আল্লাহ তা‘আলা সকল বস্তুকে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন।
৩. মানুষকে মৃত্যুর পর অবশ্যই পুনরায় জীবিত করা হবে। যেমনভাবে জীবিত করা হয় মৃত জমিনকে।
৪. সওয়ারীতে আরোহণ করার পদ্ধতি ও দু‘আ জানতে পারলাম।
৫. কোন ব্যক্তি যে-কোন প্রকার ইবাদত আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের জন্য সম্পাদন করলে মু’মিন থাকবে না, যদিও আল্লাহ তা‘আলাকে রিযিকদাতা, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৯-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি যদি এই মুশরিকদেরকে জিজ্ঞেস কর যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তবে অবশ্যই তারা উত্তরে বলবে যে, পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহই এগুলো সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তারা তাঁর একত্বকে স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও তার সাথে ইবাদতে অন্যদেরকেও শরীক করছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে শয্যা এবং ওতে করেছি তোমাদের চলার পথ যাতে তোমরা সঠিক পথে চলতে পার। অর্থাৎ যমীনকে আমি স্থির ও মযবুত বানিয়েছি, যাতে তোমরা এর উপর উঠা-বসা ও চলা-ফেরা করতে পার এবং শুতে ও জাগতে পার। অথচ স্বয়ং এ যমীন পানির উপর রয়েছে, কিন্তু মযবূত পর্বতমালা এতে স্থাপন করে দিয়ে একে হেলা-দোলা ও নড়াচড়া করা হতে মুক্ত রাখা হয়েছে। এতে রাস্তা বানিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে তোমরা এক শহর হতে অন্য শহরে এবং এক দেশ হতে অন্য দেশে গমনাগমন করতে পার। তিনি আকাশ হতে এমন পরিমিত পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষণ করেন যে, তা জমির জন্যে যথেষ্ট হয়। এর ফলে ভূমি শস্য-শ্যামল হয়ে ওঠে। এই পানি মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু পানও করে থাকে। এই বৃষ্টির দ্বারা মৃত ও শুষ্ক জমিকে সজীব করে তোলা হয়। শুষ্কতা সিক্ততায় পরিবর্তিত হয়। জঙ্গল ও মাঠ-ময়দান সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে এবং গাছপালা ফুলে ফলে পূর্ণ হয়ে যায়। বিভিন্ন প্রকারের সুন্দর ও সুস্বাদু ফল-মূল উৎপন্ন হয়। এটাকেই আল্লাহ তা’আলা মৃতকে পুনর্জীবিত করার দলীল হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেনঃ ‘এই ভাবেই তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে।’
মহান আল্লাহ বলেনঃ “তিনি যুগলসমূহের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেছেন। তিনি শস্য, ফলমূল, শাক-সবজী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের জিনিস সৃষ্টি করেছেন। মানুষের উপকারের জন্যে তিনি সৃষ্টি করেছেন নানা প্রকারের জীবজন্তু। সামুদ্রিক সফরের জন্যে তিনি নৌযানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং স্থল ভাগের সফরের জন্যে তিনি সরবরাহ করেছেন চতুষ্পদ জন্তু। এগুলোর মধ্যে মানুষ কতকগুলোর গোত ভক্ষণ করে থাকে এবং কতকগুলো তাদেরকে দুধ দিয়ে থাকে। আর কতকগুলো তাদের সওয়ারীর কাজে ব্যবহৃত হয়। তারা ঐগুলোর উপর তাদের বোঝা চাপিয়ে দেয় এবং নিজেরাও সওয়ার হয়। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের উচিত যে, সওয়ার হওয়ার পর আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে বলবেঃ পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এদেরকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা সমর্থ ছিলাম না এদেরকে বশীভূত করতে। আর আমরা (মৃত্যুর পর) আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করবো। এই আগমন ও প্রস্থান এবং এই সংক্ষিপ্ত সফরের মাধ্যমে আখিরাতের সফরকে স্মরণ কর।” যেমন দুনিয়ার পাথেয়ের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তা’আলা আখিরাতের পাথেয়ের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা পাথেয় গ্রহণ কর, তবে আখিরাতের পাথেয়ই হলো উত্তম পাথেয়।”(২:১৯৭) অনুরূপভাবে পার্থিব পোশাকের বর্ণনা দেয়ার পর পারলৌকিক পোশাকের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেনঃ “তাকওয়ার পোশাকই হলো উত্তম পোশাক।”
সওয়ারীর উপর সওয়ার হওয়ার সময় দু’আ পাঠের হাদীসসমূহঃ
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ)-এর হাদীসঃ
হযরত আলী ইবনে রাবীআহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে তাঁর সওয়ারীর উপর সওয়ার হওয়ার সময় পা-দানীতে পা রাখা অবস্থাতেই (আরবী) পড়তে শুনেছেন। যখন ঠিকভাবে সওয়ার হয়ে যান তখন পাঠ করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য, পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এটাকে আমাদের বশীভূত করেছেন, যদিও আমরা সমর্থ ছিলাম না একে বশীভূত করতে। আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করবো।” অতঃপর তিনি তিনবার (আরবী) এবং তিন বার (আরবী) বলেন। তারপর পাঠ করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, আপনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, আমি আমার উপর যুলুম করেছি, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করুন। তারপর তিনি হেসে উঠেন। হযরত আলী ইবনে রাবীআহ (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি হাসলেন কেন?” তিনি উত্তরে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এই প্রশ্নই করেছিলাম। তিনি জবাবে বলেছিলেন, আল্লাহ তা’আলা যখন স্বীয় বান্দার মুখে (আরবী) (হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করুন!) শুনতে পান তখন তিনি অত্যন্ত খুশী হন এবং বলেনঃ “আমার বান্দা জানে যে, আমি ছাড়া আর কেউ গুনাহ মাফ করতে পারে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবু দাঊদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে তাঁর সওয়ারীর পিছনে বসিয়ে নেন। ঠিকঠাকভাবে বসে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তিনবার তিনবার এবং তিনবার পাঠ করেন। অতঃপর একবার পড়েন। তারপর সওয়ারীর উপর চিত হয়ে শয়নের মত হন এবং এরপর হেসে ওঠেন। অতঃপর তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন জানোয়ারের উপর সওয়ার হয়ে আমি যেমন করলাম এরূপ করে, তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ তার প্রতি মনোযোগী হয়ে এই ভাবে হেসে ওঠেন যেভাবে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখনই স্বীয় সওয়ারীর উপর আরোহণ করতেন তখনই তিনি তিনবার তাকবীর পাঠ করে কুরআন কারীমের (আরবী) হতে (আরবী) পর্যন্ত আয়াত দু’টি পাঠ করতেন। অতঃপর বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি আমার এই সফরে আপনার নিকট কল্যাণ ও তাকওয়া প্রার্থনা করছি এবং ঐ আমল কামনা করছি যাতে আপনি সন্তুষ্ট। হে আল্লাহ! আমাদের উপর সফরকে হালকা করে দিন এবং আমাদের জন্যে দূরত্বকে জড়িয়ে নিন। হে আল্লাহ! আপনিই সফরে সাথী এবং পরিবার পরিজনের রক্ষক। হে আল্লাহ! আপনি সফরে আমাদের সাথী হয়ে যান এবং বাড়ীতে আমাদের পরিবার পরিজনের রক্ষক হয়ে যান। আর যখন তিনি সফর হতে বাড়ী অভিমুখে ফিরতেন তখন বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী ইনশাআল্লাহ প্রতিপালকের ইবাদতকারী, প্রশংসাকারী।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু লাস খুযায়ী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে সাদকার একটি উট দান করেন যেন আমরা ওর উপর সওয়ার হয়ে হজ্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) ! আমরা তো এটা দেখতে পারি না যে, আপনি আমাদেরকে এর উপর সওয়ার করিয়ে দিবেন! তিনি তখন বললেনঃ “জেনে রেখো যে, প্রত্যেক উটে উপর শয়তান থাকে। তোমরা যখন এর উপর সওয়ার হবে তখন আমি তোমাদেরকে যে নির্দেশ দিচ্ছি তাই করবে। প্রথমে আল্লাহর নাম স্মরণ করবে, তারপর একে নিজের খাদেম বানাবে। মনে রেখো যে, আল্লাহ তাআলাই সওয়ার করিয়ে থাকেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবূ লাস (রাঃ)-এর নাম মুহাম্মাদ ইবনে আসওয়াদ ইবনে খালফ (রাঃ) মুসনাদের অন্য একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক উটের পিঠের উপর শয়তান থাকে। সুতরাং যখন তোমরা ওর উপর সওয়ার হবে তখন আল্লাহর নাম নাও, অতঃপর প্রয়োজন সংক্ষেপ করো না বা প্রয়োজন পূরণে ত্রুটি করো না।”