من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১০৩/মুনাফিক কী-৩৯ নং) [*  তিনিই তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন ** মুনাফিক ত্যাগ করে তাওবা করো, আন্তরিক তাওবা:-] www.motaher21.net সূরা:৪২:আশ-শূরা পারা:২৫ ২৫-২৮ নং আয়াত:- সুরা: ৬৬:তাহরীম:৮-৯ পারা:২৮

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১০৩/মুনাফিক কী-৩৯ নং)
[*  তিনিই তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন
** মুনাফিক ত্যাগ করে তাওবা করো, আন্তরিক তাওবা:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪২:আশ-শূরা
পারা:২৫
২৫-২৮ নং আয়াত:-
সুরা: ৬৬:তাহরীম:৮-৯
পারা:২৮
সূরা:৪২:আশ-শূরা-২৫
وَ ہُوَ الَّذِیۡ یَقۡبَلُ التَّوۡبَۃَ عَنۡ عِبَادِہٖ وَ یَعۡفُوۡا عَنِ السَّیِّاٰتِ وَ یَعۡلَمُ مَا تَفۡعَلُوۡنَ ﴿ۙ۲۵﴾
আর তিনিই তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন ও পাপসমূহ মোচন করেন এবং তোমরা যা কর তিনি তা জানেন।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-২৬
وَ یَسۡتَجِیۡبُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ یَزِیۡدُہُمۡ مِّنۡ فَضۡلِہٖ ؕ وَ الۡکٰفِرُوۡنَ لَہُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ﴿۲۶﴾
যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তিনি তাদের ডাকে সাড়া দেন এবং তাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বাড়িয়ে দেন; আর কাফিররা, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-২৭
وَ لَوۡ بَسَطَ اللّٰہُ الرِّزۡقَ لِعِبَادِہٖ لَبَغَوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنۡ یُّنَزِّلُ بِقَدَرٍ مَّا یَشَآءُ ؕ اِنَّہٗ بِعِبَادِہٖ خَبِیۡرٌۢ بَصِیۡرٌ ﴿۲۷﴾
আল্লাহ যদি তাঁর সব বান্দাদেরকে অঢেল রিযিক দান করতেন তাহলে তারা পৃথিবীতে বিদ্রোহের তুফান সৃষ্টি করতো। কিন্তু তিনি একটি হিসাব অনুসারে যতটা ইচ্ছা নাযিল করেন। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে অবহিত এবং তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-২৮
وَ ہُوَ الَّذِیۡ یُنَزِّلُ الۡغَیۡثَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا قَنَطُوۡا وَ یَنۡشُرُ رَحۡمَتَہٗ ؕ وَ ہُوَ الۡوَلِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿۲۸﴾
তিনিই সে মহান সত্তা নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং রহমত বিস্তার করে দেন। তিনি প্রশংসার যোগ্য অভিভাবক।

সুরা: ৬৬:তাহরীম:০৮
পারা:২৮
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ تَوۡبَۃً نَّصُوۡحًا ؕ عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یُّکَفِّرَ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ یُدۡخِلَکُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ۙ یَوۡمَ لَا یُخۡزِی اللّٰہُ النَّبِیَّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَہٗ ۚ نُوۡرُہُمۡ یَسۡعٰی بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ بِاَیۡمَانِہِمۡ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَتۡمِمۡ لَنَا نُوۡرَنَا وَ اغۡفِرۡ لَنَا ۚ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۸﴾
হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কার—বিশুদ্ধ তাওবা ; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না নবীকে এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।’
সুরা: ৬৬:তাহরীম:০৯
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ جَاہِدِ الۡکُفَّارَ وَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ وَ اغۡلُظۡ عَلَیۡہِمۡ ؕ وَ مَاۡوٰىہُمۡ جَہَنَّمُ ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ ﴿۹﴾
হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হোন। আর তাদের আশ্ৰয়স্থল জাহান্নাম এবং তা কত নিকৃষ্ট ফিরে যাওয়ার স্থান!
পারা:২৮
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২৫-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় অনুগ্রহ এবং দয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, বান্দা যত বড়ই পাপী হোক না কেন, যখন সে তার অসৎ ও পাপ কার্য হতে বিরত থাকে এবং আন্তরিকতার সাথে তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে ও বিশুদ্ধ অন্তরে তাওবা করে তখন তিনি স্বীয় দয়া ও করুণা দ্বারা তাকে ঢেকে নেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন ও স্বীয় অনুগ্রহ তার অবস্থার অনুরূপ করে দেন। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে ব্যক্তি মন্দকর্ম করে অথবা নিজের উপর যুলুম করে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, দয়ালু পায়।”(৪:১১০)

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দার তাওবায় ঐ ব্যক্তির চেয়েও বেশী খুশী হন যার উষ্ট্ৰীটি মরু প্রান্তরে হারিয়ে গেছে, যার উপর তার পানাহারের জিনিসও রয়েছে। লোকটি উস্ত্রীর খোঁজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একটি গাছের নীচে বসে পড়লো এবং নিজের জীবনের আশাও ত্যাগ করলো। উস্ত্রী হতে সে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে পড়লো। এমতাবস্থায় হঠাৎ সে দেখে যে, উষ্ট্ৰীটি তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো এবং ওর লাগাম ধরে নিলো এবং সে এতো বেশী খুশী হলো যে, আত্মভোলা হয়ে বলে ফেললোঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমার বান্দা এবং আমি আপনার প্রতিপালক। অত্যাধিক খুশীর কারণেই সে এরূপ ভুল করলো।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “বান্দা তাওবা করলে আল্লাহ এতো বেশী খুশী হন যে, ঐ লোকটিও এরূপ খুশী হয় না যে এমন জায়গায় তার হারানো জন্তুটি পেয়েছে যেখানে পানির অভাবে) পিপাসায় তার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবার সে আশংকা করছিল।”

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “যদি কোন লোক কোন নারীর সাথে অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে সে তাকে বিয়ে করতে পারে কি?উত্তরে তিনি বলেনঃ “এতে কোন দোষ নেই (অর্থাৎ সে তাকে বিয়ে করতে পারে)।” অতঃপর তিনি … (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মহান আল্লাহ বলেনঃ “তিনি পাপ মোচন করেন।” অর্থাৎ তিনি ভবিষ্যতের জন্য তাওবা কবুল করেন এবং অতীতের পাপরাশি ক্ষমা করে দেন।

আল্লাহ তাআলার উক্তিঃ “তোমরা যা কর তা তিনি জানেন।’ অর্থাৎ তিনি তোমাদের কথা ও কাজ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তথাপি যে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে তার তাওবা তিনি কবুল করে থাকেন।

আল্লাহ পাক বলেনঃ “তিনি মুমিন ও সৎকর্মশীলদের আহ্বানে সাড়া দেন। অর্থাৎ তারা নিজেদের জন্যে আহ্বান করুক অথবা অন্যদের জন্যে প্রার্থনা করুক, তিনি তাদের প্রার্থনা কবুল করে থাকেন।

বর্ণিত আছে যে, হযরত মুআয (রাঃ) সিরিয়ায় অবস্থানরত তার মুজাহিদ সঙ্গীদের মধ্যে ভাষণ দেনঃ “তোমরা ঈমানদার, সুতরাং তোমরা জান্নাতী। তোমরা যে এই রোমক ও পারসিকদেরকে বন্দী করে রেখেছো, এরাও যে জান্নাতে চলে যেতে পারে এতেও বিস্ময়ের কিছুই নেই। কেননা, যখন তাদের মধ্যে কেউ তোমাদের কোন কাজ করে দেয় তখন তোমরা বলে থাকোঃ “আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করুন! তুমি খুব ভাল কাজ করেছে। আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন, সত্যি তুমি খুব কল্যাণকর কাজ করেছে। আর আল্লাহ তা’আলা তো বলেছেনঃ “তিনি মুমিন ও সৎকর্মশীলদের আহ্বানে সাড়া দেন এবং তাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বর্ধিত করেন। ভাবার্থ এই যে, আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের দু’আ কবূল করে থাকেন।

(আরবী)-এই আয়াতের তাফসীর করা হয়েছেঃ যারা কথা মেনে নেয় ও ওর অনুসরণ করে। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা শুনে, মানে ও অনুসরণ করে তাদের প্রার্থনা আল্লাহ কবূল করেন। এবং মৃতদেরকে তিনি পুনরুত্থিত করবেন।”(৬:৩৬)

হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ (আরবী) আল্লাহ পাকের এই উক্তির তাৎপর্য হচ্ছেঃ তাদের এমন ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ কবুল করে নেয়া যার উপর জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে। যে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করেছে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবরাহীম নখঈ (রঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ তারা তাদের ভাইদের জন্যে সুপারিশ করবে। আর তারা আরো বেশী অনুগ্রহ লাভ করবে’ এর তাফসীর হলোঃ তাদের ভাইদের ভাইদের জন্যেও তাদেরকে সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে।

মুমিনদের এই মর্যাদার বর্ণনা দেয়ার পর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ কাফিরদের দুরবস্থার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জীবনোপকরণে প্রাচুর্য দিলে তারা পৃথিবীতে অবশ্যই বিপর্যয় সৃষ্টি করতো। অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহ তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জীবনোপকরণ দান করলে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসতো এবং ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতা প্রকাশ করতে শুরু করে দিতো এবং ভূ-পৃষ্ঠে বিশৃংখলা, অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি করতো। এজন্যেই হযরত কাতাদা (রঃ)-এর দর্শনপূর্ণ উক্তি হলোঃ “জীবনোপকরণ এটুকুই উত্তম যাতে ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতা প্রকাশ না পায়। এই বিষয়ের পূর্ণ হাদীস যে, “আমি তোমাদের উপর পার্থিব জগতের সুদৃশ্য ও বাহ্যড়ম্বরকেই ভয় করি” পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

মহান আল্লাহর উক্তিঃ কিন্তু তিনি তাঁর ইচ্ছামত পরিমাণেই (জীবনোপকরণ) দিয়ে থাকেন। তিনি তাঁর বান্দাদেরকে সম্যক জানেন ও দেখেন। অর্থাৎ তিনি বান্দাকে ঐ পরিমাণ রিযক দিয়ে থাকেন যা গ্রহণের তার মধ্যে যোগ্যতা রয়েছে। কে ধনী হওয়ার উপযুক্ত এবং কে দরিদ্র হওয়ার যোগ্য এ জ্ঞান তারই আছে। যেমন হাদীসে কুদসীতে রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমার এমন বান্দাও রয়েছে যে, তার মধ্যে ধনশ্বৈর্যের যোগ্যতা রয়েছে, যদি আমি তাকে দরিদ্র বানিয়ে দিই তবে তার দ্বীনও নষ্ট হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে, আমার এমন বান্দাও রয়েছে যে, সে দরিদ্র হওয়ারই যোগ্য। তাকে যদি আমি ধনী করে দিই তবে তার দ্বীন যেন আমি নষ্ট করে দিলাম।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “তারা যখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখনই তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন ও তাঁর করুণা বিস্তার করেন। অর্থাৎ মানুষ যখন রহমতের বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে শেষে নিরাশ হয়ে পড়ে এরূপ পূর্ণ প্রয়োজন এবং কঠিন বিপদের সময় আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকেন। ফলে তাদের নৈরাশ্যও দূর হয়ে যায় এবং অনাবৃষ্টির বিপদ হতে তারা মুক্ত হয়। সাধারণভাবে আল্লাহর রহমত ছড়িয়ে পড়ে।

একটি লোক হযরত উমার ইবনে খাত্তাবা (রাঃ)-কে বলেঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! বৃষ্টি-বর্ষণ বন্ধ হয়েছে এবং জনগণ নিরাশ হয়ে পড়েছে (এখন উপায় কিঃ)” উত্তরে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “যাও, ইনশাআল্লাহ বৃষ্টি অবশ্যই বর্ষিত হবে।” অতঃপর তিনি …(আরবী)-এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।

মহান আল্লাহর উক্তিঃ “তিনিই তো অভিভাবক, প্রশংসাৰ্হ।’ অর্থাৎ সৃষ্টজীবের ব্যবস্থাপনা তাঁরই হাতে। তাঁর সমুদয় কাজ প্রশংসার যোগ্য। মানুষের কিসে মঙ্গল আছে তা তিনি ভালই জানেন। তাঁর কাজ কল্যাণ ও উপকার শূন্য নয়।
৬-৮ নং আয়াতের তাফসীর

হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ তোমরা তোমাদের পরিবারের লোকদেরকে ইলম ও আদব শিক্ষা দাও।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ তোমরা আল্লাহর আদেশ মেনে চল এবং অবাধ্যাচরণ করো না। পরিবারের লোকদেরকে আল্লাহর যিকরের তাগীদ কর, যাতে আল্লাহ তোমাদেরকে জাহান্নাম হতে রক্ষা করেন।

মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরিবারের লোকদেরকেও ভয় করতে বল।

কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, অর্থ হলোঃ তাদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের হুকুম কর এবং অবাধ্যাচরণ হতে নিষেধ কর। তাদের উপর আল্লাহর হুকুম কায়েম রাখো এবং তাদেরকে আল্লাহর আহকাম পালন করার তাগীদ করতে থাকো। সৎ কাজে তাদেরকে সাহায্য কর এবং অসৎ কাজে তাদেরকে শাসন-গর্জন কর।

মুকাতিল (রঃ) বলেনঃ প্রত্যেক মুসলমানের উপর নিজের পরিবারভুক্ত লোকদেরকে এবং দাস-দাসীদেরকে আল্লাহর হুকুম পালন করার ও তাঁর নাফরমানী হতে বিরত থাকার শিক্ষা ও উপদেশ দান করতে থাকা ফরয।

আবদুল মালিক ইবনে রাবী’ ইবনে সিববাহ (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা তোমাদের শিশুদেরকে নামাযের হুকুম কর যখন তাদের বয়স সাত বছর হয়। আর যখন তারা দশ বছর বয়সে পদার্পণ করে তখন তাদেরকে নামাযে অবহেলার কারণে প্রহার কর।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবূ দাউদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ফকীহদের ফরমান এই যে, অনুরূপভাবে শিশুদেরকে এই বয়স হতেই রোযার জন্যেও তাগীদ করা উচিত। যাতে প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছা পর্যন্ত তারা নামায রোযায় পূর্ণমাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। যাতে তাদের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য করার এবং তাঁদের নাফরমানী হতে বিরত থাকার অভ্যাস পয়দা হয়।

মুমিনরা এ কাজ করলে তারাও তাদের পরিবার পরিজন জাহান্নামের অগ্নি হতে রক্ষা পাবে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর। এদের দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত করা হবে। তাহলে আগুন কত কঠিন তেজ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

প্রস্তর দ্বারা হয়তো ঐ প্রস্তর উদ্দেশ্য হতে পারে দুনিয়ায় যেগুলোর পূজা করা হয়। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “নিশ্চয়ই তোমরা এবং তোমাদের মা’বূদরা জাহান্নামের ইন্ধন হবে।”(২১:৯৮) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), আবূ জা’ফর আল বাকির (রঃ) এবং সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, ওটা হবে গন্ধকের পাথর যা হবে অত্যন্ত দুর্গন্ধময়।

একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবি)-এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। ঐ সময় তাঁর খিদমতে কয়েকজন সাহাবী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ লোক জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জাহান্নামের পাথরটি দুনিয়ার পাথরের মত?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যাঁর অধিকারে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! জাহান্নামের একটি পাথর দুনিয়ার সমস্ত পাথর হতে বড়।” একথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর বক্ষে হাত রেখে বুঝতে পারলেন যে, তিনি জীবিত আছেন। সুতরাং তিনি তাঁকে ডাক দিয়ে বললেনঃ “হে বৃদ্ধ! বলঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।” বৃদ্ধ তা পাঠ করলেন। তারপর তিনি ঐ বৃদ্ধ লোকটিকে জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। সাহাবীগণ তখন বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের মধ্য হতে শুধু তাঁকেই এ সুসংবাদ দান করলেন?” তিনি উত্তরে বললেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “ওটা ঐ ব্যক্তির জন্যে, যে আমার সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং ভয় করে আমার শাস্তিকে।” (১৪:১৪)।

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ এতে (এই শাস্তি দেয়ার কাজে) নিয়োজিত রয়েছে নির্মম হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতাগণ। অর্থাৎ তাদের স্বভাব বা প্রকৃতি কঠোর। কাফেরদের জন্যে তাদের অন্তরে কোন করুণা রাখা হয়নি। তারা নিকৃষ্ট পন্থায় কঠিন শাস্তি দিয়ে থাকে। তাদেরকে দেখা মাত্রই অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।

হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, জাহান্নামীদের প্রথম দলটি যখন জাহান্নামের দিকে এগিয়ে চলবে তখন দেখবে যে, দরজার উপর চার লক্ষ ফেরেশতা শাস্তি দেয়ার জন্যে প্রস্তুত রয়েছেন, যাঁদের চেহারা অত্যন্ত ভয়াবহ, রঙ অত্যন্ত কালে। দাঁতগুলো বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে। তাঁরা অত্যন্ত নির্দয় ও কঠোর হৃদয়। তাঁদের অন্তরে অণুপরিমাণও দয়া রাখা হয়নি। তাঁরা এতো মোটা ও চওড়া যে, যদি পাখী তাদের এক স্কন্ধ হতে উড়তে শুরু করে তবে অন্য স্কন্ধে পৌঁছতে তার দুই মাস সময় লাগবে। তারপর তারা (জাহান্নামীরা) দ্বিতীয় দরজার উপর ঊনিশ জন ফেরেশতা দেখতে পাবে, যাদের বক্ষ এতো প্রশস্ত যে, তা সত্তর বছরের পথ।

অতঃপর তাদেরকে এক দরজা হতে অন্য দরজার দিকে ধাক্কা দেয়া হবে। পাঁচ শত বছর পড়তে থাকার পর অন্য দরজার কাছে তারা তা দেখতে পাবে। এই ভাবে প্রতিটি দরজার উপর এই ফেরেশতামণ্ডলী আল্লাহ তা’আলার আজ্ঞাধীন রয়েছেন। একদিকে আদেশ এবং অন্যদিকে তা প্রতিপালন। তাঁদেরকে যাবানিয়্যাহ বলা হয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে তাঁদের হাত হতে মুক্তি দান করুন!

এরপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে কাফিরগণ! আজ তোমরা দোষ স্খালনের চেষ্টা করো না। তোমরা যা করতে তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হবে। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন কাফিরদেরকে বলা হবেঃ আজকে তোমরা কোন ওযর পেশ করো না, কারণ আজ তোমাদের কোন ওযর কবূল করা হবে না। তোমাদেরকে আজকে তোমাদের কৃতকর্মেরই শুধু প্রতিফল দেয়া হবে।

অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর, বিশুদ্ধ তাওবা। অর্থাৎ সত্য ও খাঁটি তাওবা কর যার ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী পাপরাশি মার্জনা করা হবে। আর তোমাদের মন্দ স্বভাব দূর হয়ে যাবে।

হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে খুৎবায় বলতে শুনেনঃ “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট এমন বিশুদ্ধ তাওবা কর যে, তোমার দ্বারা ঐ পাপকার্যের আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।” (এটা ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য রিওয়াইয়াতে রয়েছেঃ “অতঃপর ঐ পাপকার্য করার ইচ্ছাও করবে না।” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতেও প্রায় এরূপই বর্ণিত আছে। একটি মারফূ’ হাদীসে এরূপই এসেছে যা দুর্বল এবং সঠিক কথা এটাই যে, এ হাদীসটিও মাওকুফ। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

পূর্বযুগীয় আলেমগণ বলেনঃ খাঁটি ও বিশুদ্ধ তাওবা এই যে, গুনাহ হয়ে যাওয়ার পরই তাওবা করবে ও লজ্জিত হবে এবং আগামীতে ঐ পাপকার্য আর না করার দৃঢ় সংকল্প করবে। আর যদি গুনাহতে কারো হক থাকে তবে চতুর্থ শর্ত এই যে, ঐ হক নিয়মিতভাবে আদায় করবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “লজ্জিত হওয়াও হলো তাওবা করা।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) বলেনঃ “কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সময় এই উম্মতের শেষের লোকেরা কি কাজ করবে তা আমাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে। একটি এই যে, মানুষ তার স্ত্রী বা দাসীর গৃহ্যদ্বারে সঙ্গম করবে। অথচ এটা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল হারাম করেছেন। আর এ কাজে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ) অসন্তুষ্ট হন। অনুরূপভাবে পুরুষের সাথে পুরুষ কুকাজে লিপ্ত হবে। যা হারাম এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর অসন্তুষ্টির কারণ। এ লোকদের নামাযও আল্লাহর নিকট কবূল হয় না। যে পর্যন্ত না তারা তাওবা করে বিশুদ্ধ তাওবা।”

তখন হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “বিশুদ্ধ তাওবা কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এই প্রশ্নই করেছিলাম। তিনি জবাবে বলেছিলেনঃ “ভুলক্রমে গুনাহ হয়ে গেছে, অতঃপর ওর উপর লজ্জিত হওয়া, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, তারপর ঐ গুনাহর দিকে আর ঝুঁকে না পড়া।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত হাসান (রঃ) বলেনঃ বিশুদ্ধ তাওবা হলো এই যে, যেমন গুনাহর প্রতি ভালবাসা ও আকর্ষণ ছিল ঐ রকমই ওর প্রতি অন্তরে ঘৃণা জন্মে যাওয়া। যখন ঐ গুনাহর কথা স্মরণ হয় তখন ক্ষমা প্রার্থনা করা। যখন কোন বান্দা তাওবা করার জন্যে দঢ় সংকল্প করে নেয় এবং তাওবার উপর অটল থাকে তখন আল্লাহ তা’আলা তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।

সহীহ্ হাদীসে এসেছে যে, ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম-পূর্ব যুগের সমস্ত গুনাহ্ ইসলাম মিটিয়ে দেয়। এখন থাকলো এই কথা যে, বিশুদ্ধ তাওবায় শর্ত হলো, তাওবাকারী মৃত্যু পর্যন্ত আর ঐ গুনাহর কাজ কখনো করবে না। যেমন হাদীস ও আসার এখনই বর্ণিত হলো যে, আর কখনো ঐ পাপের কাজে হাত দিবে না। অথবা শুধু এই দৃঢ় সংকল্প যথেষ্ট হবে যে, ঐ পাপকার্য আর কখনো করবে না, তারপর হয় তো মানবিক চাহিদা হিসেবে আবার পদস্খলন ঘটে যাবে। যেমন এখনই হাদীস গত হলো যে, তাওবা পূর্বের সমস্ত গুনাহকে মিটিয়ে দেয়। তাহলে শুধু কি তাওবার দ্বারাই গুনাহ্ মাফ হয়ে যাবে, না মৃত্যু পর্যন্ত ঐ গুনাহর কাজ আর না করা শর্ত? প্রথমটির দলীল তো এই সহীহ্ হাদীসটি যে, যে ব্যক্তি ইসলামে সৎ কাজ করবে, সে তার অজ্ঞতার যুগের অসৎ কাজের কারণে গ্রেফতার হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পরেও অসৎ কাজে জড়িয়ে পড়বে তাকে তার ইসলাম ও জাহেলিয়াত উভয় যুগের অসৎ কাজের জন্যে পাকড়াও করা হবে। সুতরাং ইসলাম, যা পাপরাশিকে দূর করে দেয়ার ব্যাপারে তাওবার অপেক্ষাও অগ্রগণ্য, এর পরেও যখন তার অসত্ত্বার্যের কারণে পাকড়াও করা হচ্ছে, তখন তাওবার পরেও অসৎ কাজ পুনরায় করলে তো আরো বেশী তাকে পাকড়াও করা উচিত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ আল্লাহ নবী (সঃ) ও তার মুমিন সঙ্গীদেরকে অপদস্থ করবেন না। তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে যে জ্যোতি দান করা হবে তা তাদের সামনে ও দক্ষিণ পার্শ্বে ধাবিত হবে। আর অন্যেরা সবাই অন্ধকারের মধ্যে থাকবে। যেমন ইতিপূর্বে এটা সূরায়ে হাদীদের তাফসীরে গত হয়েছে। যখন মুমিনগণ দেখবে যে, মুনাফিকরা যে জ্যোতি লাভ করেছিল, ঠিক প্রয়োজনের সময় তা তাদের হতে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তারা অন্ধকারের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন তারা (মুমিনরা) দুআ করবেনঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জ্যোতিতে আপনি পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদেরকে রক্ষা করুন! আপনি তো সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

বানু কিনানাহ্ গোত্রের একজন লোক বলেনঃ “মক্কা বিজয়ের দিন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছনে নামায পড়েছিলাম। আমি তাঁকে দু’আয় বলতে শুনেছিলামঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! কিয়ামতের দিন আপনি আমাকে অপদস্ত করবেন না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবূ যার (রাঃ) ও হযরত আবূ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আমাকে সিজদার অনুমতি দেয়া হবে। অনুরূপভাবে সর্বপ্রথম আমাকেই সিজদা হতে মস্তক উত্তোলনেরও অনুমতি দেয়া হবে। আমি আমার সামনে এবং ডানে ও বামে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমার উম্মতকে চিনে নিবো।” একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাদেরকে আপনি কি করে চিনতে পারবেন? বহু উম্মত তো মিশ্রিতভাবে থাকবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমার উম্মতের লোকদের একটি চিহ্ন তো এই যে, তাদের অযুর অঙ্গগুলো উজ্জ্বল হবে ও চমকিতে থাকবে। অন্য কোন উম্মতের লোকদের এরূপ হবে না। দ্বিতীয় পরিচয় এই যে, তাদের আমলনামা তাদের ডান হাতে থাকবে। তৃতীয় নিদর্শন এই যে, তাদের ললাটে সিজদার চিহ্ন থাকবে। চতুর্থ চিহ্ন এই যে, তাদের জ্যোতি তাদের আগে আগে থাকবে।” (এ হাদীসটি মুহাম্মাদ ইবনে নাসরুল মুরূযী (রঃ) বর্ণনা করেছন)

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# পূর্ববর্তী আয়াতের পর পরই তাওবার প্রতি উৎসাহ দান থেকে স্বতই এ বিষয়টি প্রতিভাত হয় যে, হে জালেমরা সত্য নবীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে নিজেরাই নিজেদেরকে কেন আরো বেশী আল্লাহর আযাবের উপযুক্ত বানিয়ে নিচ্ছো? এখনো যদি নিজেদের এই আচরণ থেকে বিরত থাকো এবং তাওবা করো তাহলে আল্লাহ‌ ক্ষমা করে দেবেন। তাওবার অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে, যে অপরাধ করেছে বা করে এসেছে তা থেকে বিরত হবে এবং ভবিষ্যতে আর তা করবে না। তাছাড়া সত্যিকার তাওবার অনিবার্য দাবী হচ্ছে কোন ব্যক্তি পূর্বে যে অন্যায় করেছে নিজের সাধ্যমত তার ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করবে। যেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের কোন উপায় বের করা সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং নিজের ওপর যে কলঙ্ক লেপন করেছে তা পরিষ্কার করতে থাকবে। তবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য না থাকলে কোন তাওবাই সত্যিকার তাওবা নয়। অন্য কোন কারণে বা উদ্দেশ্যে কোন খারাপ কাজ পরিত্যাগ করা আদৌ তাওবার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না।
# যে প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে তা সামনে রাখলে স্পষ্ট বুঝা যায়, মক্কার কাফেরেদের বিদ্রোহের পেছনে যে কার্যকারণ কাজ করছিলো আল্লাহ‌ এখানে মূলত সেদিকেই ইঙ্গিত করছেন। যদিও রোম ও ইরানের তুলনায় তাদের কোন মর্যাদাশীল অস্তিত্বই ছিল না এবং আশেপাশের জাতিসমূহের মধ্যে তারা একটি পশ্চাদপদ জাতির একটি ব্যবসায়জীবী গোষ্ঠী বা অন্য কথায় ফেরিওয়ালার চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী ছিল না। কিন্তু নিজেদের এই ক্ষুদ্র জগতের মধ্যে অন্য আরবদের তুলনায় তারা যে সচ্ছলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিলো তা তাদেরকে এতটাই অহংকারী করে তুলেছিল যে, তারা আল্লাহর নবীর কথা শুনতে কোনভাবে প্রস্তুত ছিল না এবং মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের নেতা হবে আর তারা তাঁকে অনুসরণ করবে তাদের গোত্রাধিপতিগণ একে তাদের মার্যাদার পরিপন্থী মনে করতো। এ কারণে বলা হচ্ছে, আমি যদি এসব সংকীর্ণমনা লোকদের জন্য সত্যিই রিযিকের দরজা খুলে দিতাম তাহলে তারা পুরোপুরি গর্বে ফেটে পড়তো। কিন্তু আমি তাদেরকে আমার পর্যবেক্ষণে রেখেছি এবং বুঝে শুনে ঠিক ততটাই দিচ্ছি যতটা তাদের গর্বে স্ফীত হতে দেবে না। এ অর্থ অনুসারে এ আয়াত ঠিক সেই অর্থ প্রকাশ করছে যা সূরা তাওবার ৬৮ ও ৭০ আয়াত , আল কাহাফের ৩২ ও ৪২ আয়াত, আল কাসাসের ৭৫ ও ৮২ আয়াত, আর রূম ৯ আয়াত, সাবা ৩৪ ও ৩৬ আয়াত এবং আল মু’মিনের ৮২ ও ৮৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

# এখানে অলী অর্থ এমন সত্তা যিনি তাঁর নিজের তৈরী সমস্ত সৃষ্টির সব ব্যাপারের তত্বাবধায়ক, যিনি বান্দাদের সমস্ত অভাব ও প্রয়োজন পূরণের সব দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

# মূল আয়াতে تَوْبَةً نَصُوحًا শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় نصح শব্দের অর্থ নিষ্কলুষতা ও কল্যাণকামিতা। খাঁটি মধু যা মোম ও অন্যান্য আবর্জনা থেকে মুক্ত করা হয়েছে তাকে আরবীতে عسل ناصح বলা হয়। ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে দেয়া এবং ফাঁটা ফাঁটা কাপড় ঠিক করে দেয়া বুঝাতে আরবী يصاحة الثوب শব্দ ব্যবহার করা হয়। অতএব, তাওবা শব্দের সাথে يصوح বিশেষণ যুক্ত করলে হয় তার আভিধানিক অর্থ হবে এমন তাওবা যার মধ্যে প্রদর্শনী বা মুনাফিকীর লেশমাত্র নেই। অথবা তার অর্থ হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের কল্যাণ কামনা করবে এবং গোনাহ থেকে তাওবা করে নিজেকে মন্দ পরিণাম থেকে রক্ষা করবে। অথবা তার অর্থ হবে গোনাহর কারণে তার দ্বীনদারীর মধ্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তাওবা দ্বারা তা সংশোধন করবে। অথবা সে তাওবা করে নিজের জীবনকে এমন সুন্দর করে গড়ে তুলবে যে, অন্যের জন্য সে উপদেশ গ্রহণের কারণ হবে এবং তাকে দেখে অন্যরাও তার মত নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবে। ‘তাওবায়ে নাসূহ’ –এর আভিধানিক অর্থ থেকে এ অর্থসমূহই প্রতিভাত হয়। এরপর অবশিষ্ট থাকে তাওবায়ে নাসূহ এর শরয়ী অর্থ। আমরা এর শরয়ী অর্থের ব্যাখ্যা পাই যির ইবনে হুবাইশের মাধ্যমে ইবনে আবী হাতেম কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে। যির ইবনে হুবাইশ বলেনঃ আমি উবাই ইবনে কা’বের (রাঃ) কাছে ‘তাওবায়ে নাসূহ’ —এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একই প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বললেনঃ এর অর্থ হচ্ছে, কখনো তোমার দ্বারা কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তুমি নিজের গোনাহর জন্য লজ্জিত হবে। তারপর লজ্জিত হয়ে সেজন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং ভবিষ্যতে আর কখনো ঐ কাজ করো না। হযরত উমর (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেও এ অর্থই উদ্ধৃত হয়েছে। অন্য একটি বর্ণনা অনুসারে হযরত উমর (রাঃ) ‘তাওবায়ে নাসূহ’র সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবেঃ তাওবার পরে পুনরায় গোনাহ করা তো দূরের কথা তা করার আকাঙ্ক্ষা পর্যন্ত করবে না। (ইবনে জারীর)। হযরত আলী (রাঃ) একবার এক বেদুঈনকে মুখ থেকে ঝটপট করে তাওবা ও ইসতিগফারের শব্দ উচ্চারণ করতে দেখে বললেন, এতো মিথ্যাবাদীদের তাওবা। সে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে সত্যিকার তাওবা কি? তিনি বললেন সত্যিকার তাওবার সাথে ছয়টি জিনিস থাকতে হবে

(১) যা কিছু ঘটেছে তার জন্য লজ্জিত হও।

(২) নিজের যে কর্তব্য ও করণীয় সম্পর্কে গাফলতি করছো তা সম্পাদন কর।

(৩) যার হক নষ্ট করেছ তা ফিরিয়ে দাও।

(৪) যাকে কষ্ট দিয়েছ তার কাছে মাফ চাও।

(৫) প্রতিজ্ঞা করো ভবিষ্যতে এ গোনাহ আর করবে না এবং

(৬) নফসকে এতদিন পর্যন্ত যেভাবে গোনাহর কাজে অভ্যস্ত করেছ ঠিক তেমনি ভাবে আনুগত্যে নিয়োজিত করো। এতদিন পর্যন্ত নফসকে যেভাবে আল্লাহর অবাধ্যতার মজায় নিয়োজিত রেখেছিলে এখন তাকে তেমনি আল্লাহর আনুগত্যের তিক্ততা আস্বাদন করাও (কাশ্শাফ)। তাওবা সম্পর্কিত বিষয়ে আরো কয়েকটি জিনিস ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার।

প্রথমত, প্রকৃতপক্ষে তাওবা হচ্ছে কোন গোনাহের কারণে এজন্য লজ্জিত হওয়া যে, তা আল্লাহর নাফরমানী। কোন গোনাহর কাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বদনামের কারণ অথবা আর্থিক ক্ষতির কারণ হওয়ায় তা থেকে বিরত থাকার সংকল্প করা তাওবার সংজ্ঞায় পড়ে না।

দ্বিতীয়ত, যখনই কেউ বুঝতে পারবে যে, তার দ্বারা আল্লাহর নাফরমানী হয়েছে, তার উচিত তৎক্ষনাৎ তাওবা করা এবং যেভাবেই হোক অবিলম্বে তার ক্ষতিপূরণ করা কর্তব্য, তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।

তৃতীয়ত, তাওবা করে বারবার তা ভঙ্গ করা, তাওবাকে খেলার বস্তু বানিয়ে নেয়া এবং যে গোনাহ থেকে তাওবা করা হয়েছে বার বার তা করতে থাকা তাওবা মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ। কেননা, তাওবার প্রাণ সত্তা হচ্ছে, কৃত গোনাহ সম্পর্কে লজ্জিত হওয়া। কিন্তু বার বার তাওবা ভঙ্গ করা প্রমাণ করে যে, তার মধ্যে লজ্জার অনুভূতি নেই।

চতুর্থত, যে ব্যক্তি সরল মনে তাওবা করে পুনরায় ঐ গোনাহ না করার সংকল্প করেছে মানবিক দুর্বলতার কারণে যদি পুনরায় তার দ্বারা সেই গোনাহর পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে এক্ষেত্রে পূর্বের গোনাহ পুনরুজ্জীবিত হবে না তবে পরবর্তী গোনাহর জন্য তার পুনরায় তাওবা করা উচিত।

পঞ্চমত, যখনই গোনাহর কথা মনে পড়বে তখনই নতুন করে তাওবা করা আবশ্যক নয়। কিন্তু তার প্রবৃত্তি যদি পূর্বের পাপময় জীবনের স্মৃতিচারণ করে আনন্দ পায় তাহলে গোনাহর স্মৃতিচারণ তাকে আনন্দ দেয়ার পরিবর্তে লজ্জাবোধ সৃষ্টির কারণ না হওয়া পর্যন্ত তার বার বার তাওবা করা উচিত। কারণ, যে ব্যক্তি সত্যিই আল্লাহর ভয়ে গোনাহ থেকে তাওবা করেছে সে অতীতে আল্লাহর নাফরমানী করেছে এই চিন্তা করে কখনো আনন্দ অনুভব করতে পারে না। তা থেকে মজা পাওয়া ও আনন্দ অনুভব করা প্রমাণ করে যে, তার মনে আল্লাহর ভয় শিকড় গাড়তে পারেনি।
# এ আয়াতের কথাটি ভেবে দেখার মত। এখানে এ কথা বলা হয়নি যে, তাওবা করলে তোমাদের অবশ্যই মাফ করে দেয়া হবে এবং তোমাদেরকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। বরং তাদের এই প্রত্যাশা দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা সরল মনে তাওবা করো তাহলে অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ‌ তোমাদের সাথে এই আচরণ করবেন। এর অর্থ হলো, গোনাহগার বান্দার তাওবা কবুল করা এবং তাকে শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে জান্নাত দান করা আল্লাহর জন্য ওয়াজিব নয়। বরং তিনি যদি মাফ করে দেন এবং পুরস্কারও দেন তাহলে তা হবে সরাসরি তাঁর দয়া ও মেহেরবানী। বান্দার তাঁর ক্ষমালাভের আশা অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু তাওবা করলে ক্ষমা পাওয়া যাবে এই ভরসায় গোনাহ করা উচিত নয়।
# তার উত্তম কার্যাবলীর পুরস্কার নষ্ট করবেন না। কাফের মুনাফিকদের এ কথা বলার সুযোগ মোটেই দেবেন না যে, আল্লাহর বন্দেগী করে এসব লোক কি প্রতিদান লাভ করেছে? লাঞ্ছনা ও অপমান পড়বে বিদ্রোহী ও নাফরমানদের ভাগে, বিশ্বাসী ও অনুগতদের ভাগে তা পড়বে না।

# এ আয়াতটি সূরা হাদীদের ১২ ও ১৩ নং আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়লে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, ঈমানদারগণ যখন হাশরের ময়দান থেকে জান্নাতের দিকে যেতে থাকবেন তখনই তাদের আগে আগে ‘নূর’ অগ্রসর হওয়ার এই ঘটনা ঘটবে। সেখানে চারদিকে থাকবে নিকষ কালো অন্ধকার। যাদের জন্য দোযখের ফায়সালা হবে তারাই কেবল সেখানে অন্ধকারে ঠোকর খেতে থাকবে। আলো কেবল ঈমানদারদের সাথেই থাকবে। সেই আলোর সাহায্যে তারা পথ অতিক্রম করতে থাকবে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়ানো লোকদের আর্তনাদ ও বিলাপ শুনে শুনে ঈমানদারদের ওপর হয়তো ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে থাকবে এবং নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা স্মরণ করে তারাও আশঙ্কা করতে থাকবে যে, তাদের ‘নূর’ আবার ছিনিয়ে নেয়া না হয় এবং দুর্ভাগাদের মত তাদেরকেও অন্ধকারে হাতড়িয়ে মরতে না হয়। তাই তারা দোয়া করতে থাকবে, হে আমাদের রব, আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দাও এবং জান্নাতে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাদের ‘নূর’ কে অবশিষ্ট রাখ। ইবনে জারীর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, رَبَّنَا اَتْمِمَ لَنَا نُوْرَنَا এর অর্থ হচ্ছে, যতক্ষণ তারা সহী সালামতে পুলসেরাত অতিক্রম করে না যায় ততক্ষণ যেন তাদের নূর অবশিষ্ট থাকে এবং নিভে না যায়। হযরত হাসান বসরী, মুজাহিদ এবং দাহহাকের তাফসীরও প্রায় অনুরূপ। ইবনে কাসীর তাদের এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, ঈমানদারগণ যখন দেখবেন মুনাফিকরা ‘নূর’ থেকে বঞ্চিত হয়ে গিয়েছে তখন তারা নিজেদের ‘নূরের’ পূর্ণতার জন্য দোয়া করতে থাকবে (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হাদীদ, টীকা ১৭)।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

২৫-২৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করেছেন যে, বান্দা যত বড় পাপীই হোক না কেন, যখন সে অসৎ ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকে এবং আন্তরিকতার সাথে তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে ও বিশুদ্ধ অন্তরে তাওবা করে তখন তিনি স্বীয় দয়া ও করুণা দ্বারা তাকে ঢেকে নেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।

আয়াতে তাওবা করার অর্থ হলো, পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং আগামীতে তা আর না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। কেবল মুখে মুখে তাওবা-তাওবা করলেই তাওবা হয় না। বরং ঐ কাজকে পরিত্যাগ করতে হবে, নিজে অপরাধের জন্য লজ্জিত হতে হবে। তাহলেই আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবা কবূল করবেন। তাওবা কবুলের শর্ত সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী-

(وَمَنْ يَّعْمَلْ سُوْ۬ءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَه۫ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللّٰهَ يَجِدِ اللّٰهَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا)‏

“যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজ করে অথবা নিজের প্রতি জুলুম করে পরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে আল্লাহকে সে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু পাবে।” (সূরা নিসা ৪ : ১১০)

শুধু আল্লাহ তা‘আলা তাওবা কবূলই করেন না বরং কোন ব্যক্তি যদি তাওবা করে তবে আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবাতে মহা খুশি হন। হাদীসে এসেছে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যখন কোন বান্দা তাওবা করে তখন আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন যার উষ্ট্রীটি মরুপ্রান্তরে হারিয়ে গেছে। যার ওপর তার পানাহারের জিনিসও রয়েছে, সে নিরাশ হয়ে গেল তার সওয়ারী ফিরে পাওয়া থেকে তখন সে একটি গাছের ছায়ায় এসে বসল, এমতাবস্থায় সে দেখে যে, সওয়ারীটি তার পাশেই রয়েছে। তখন সে তার (সওয়ারী) লাগাম ধরে অধিক খুশির কারণে বলে- হে আল্লাহ তা‘আলা! তুমি আমার বান্দা আর আমি তোমার রব। (সহীহ মুসলিম হা. ২৭৪৭)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, যদি তিনি প্রত্যেককে সমান পরিমাণে রিযিক দান করতেন তবে তার ফলাফল এরূপ হত যে, কেউ কারো পরাধীনতা স্বীকার করত না। সবার অর্থ, সম্পদ সব কিছু সমান, কে কার কথা শুনবে, কে কার আনুগত্য করবে? ফলে জমিনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হবে। তাই তিনি মানুষকে পরিমিতভাবে রিযিক দান করে থাকেন। যাতে করে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(أَهُمْ يَقْسِمُوْنَ رَحْمَتَ رَبِّكَ ط نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَّعِيْشَتَهُمْ فِي الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجٰتٍ لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا ط وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ)

“তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত বন্টন করে? আমিই তাদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরের দ্বারা খেদমত লাভ করতে পারে এবং তারা যা জমা করে তা হতে তোমার প্রতিপালকের রহমত উৎকৃষ্টতর।” (সূরা যুখরুফ ৪৩ : ৩২)

অতঃপর বলা হচ্ছে যে, বৃষ্টির ব্যাপারে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বৃষ্টি দান করেন। কেননা যখন হতাশ হয়ে যাবার পর এ বৃষ্টি দান করা হয়, তখনই এ নেয়ামতের প্রতি সঠিক অনুভূতি সৃষ্টি হয়। আর মহান আল্লাহর এরূপ করার কৌশলও হলো এটাই, যাতে বান্দা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের মর্যাদা বুঝতে পারে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. একনিষ্ঠ নিয়্যাতে তাওবা করা হলে আল্লাহ তা‘আলা তা অবশ্যই কবূল করেন।
২. আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন ব্যক্তির ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেন।
৩. রিযিকদাতা, বৃষ্টিদাতা, এমনভাবে সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
৬-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের প্রতি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব অর্পণ করছেন। তা হল : একজন মু’মিন যেমন আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে জান্নাতের আশায় জাহান্নামের ভয়ে নিজে সৎআমল করবে এবং অসৎআমল বর্জন করে নিজেকে সংশোধন করে নেবে ঠিক তেমনিভাবে তার পরিবারকেও ইসলামী শিক্ষা প্রদান এবং শরীয়তের বিধি-বিধান পালন ও বিধি-নিষেধ থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে জাহান্নামের হাত থেকে রক্ষা করবে। এজন্যই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

(مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ)

তোমাদের সন্তানরা যখন সাত বছরে পদার্পন করে তখন তাদেরকে সালাত আদায় করার নির্দেশ দাও, আর যখন দশ বছরে পদার্পণ করবে তখন (সালাত আদায় না করলে) প্রহার কর এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও। (আবূ দাঊদ হা. ৪৯৪, তিরমিযী হা. ৪০৭, সহীহ)।

এভাবে প্রত্যেক মু’মিন যদি পরিবারসহ নিজে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে আপ্রাণ চেষ্টা করে তাহলে আখিরাতে যেমন সফলকাম হবে দুনিয়াতেও একটি আদর্শ সমাজে পরিণত হবে। যেখানে থাকবে না কোন ফেতনা-ফাসাদ, অশ্লীলতা বেপর্দা ইত্যাদি। কারণ যারাই ফেতনা-ফাসাদ করছে, অশ্লীল ও বেপর্দায় চলা ফেরা করছে তারা কারো না কারো পরিবারভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পরিবারের অভিভাবক তার পরিবারের দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৮৯৩, সহীহ মুসলিম হা. ১৮২৯)

(قُوْآ أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَارًا)

‘তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর ঐ অগ্নি হতে’ মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : তোমাদের নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের আল্লাহ তা‘আলার ভয়ের অসিয়ত কর এবং তাদেরকে আদব শিক্ষা দাও। (সহীহ বুখারী)।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য কর ও তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাক এবং তোমাদের পরিবারকে আল্লাহ তা‘আলার স্মরণের নির্দেশ দাও। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তা দ্বারা জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন। (ইবনু কাসীর)

وَّقُوْدُ অর্থ : কাঠ, জ্বালানী। অর্থাৎ জাহান্নামের জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর। কেউ বলেছেন : পাথর দ্বারা উদ্দেশ্য হল সে সকল পাথর যার ইবাদত করা হত, যাতে পাথরের ইবাদতকারীরা বুঝতে পারে পাথর ইবাদত পাওয়ার যোগ্য ছিল না এবং তারা আজ তাদের কোন উপকার করতে পারছে না বরং নিজেরাই জাহান্নামে যাচ্ছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ ط أَنْتُمْ لَهَا وَارِدُوْن)‏

“তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদত কর‎ সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে।” (সূরা আম্বিয়া ২১ : ৯৮)

(غِلَاظٌ شِدَادٌ)

অর্থাৎ জাহান্নামের প্রহরী ফেরেশতাগণ নির্মম হৃদয়বিশিষ্ট ও কঠোর স্বভাবের। তারা সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করে, তাদের যা আদেশ করা হয় তারা তার বিরোধিতা করে না।

(لَا تَعْتَذِرُوا الْيَوْمَ)

‘আজ তোমরা কোন প্রকার অজুহাত পেশ কর না’ অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামীদেরকে তিরস্কার করে এ কথা বলবেন। সেদিন ওজর পেশ করার কোন অবকাশ থাকবে না। কারণ তারা দুনিয়াতে যা কিছু আমল করেছে কেবল তারই প্রতিদান প্রদান করা হবে।

(تَوْبَةً نَّصُوْحًا)

‘একান্ত বিশুদ্ধ তাওবা’ উমার (রাঃ) বলেছেন : তা হল গুনাহ করার পর তাতে পুনরায় লিপ্ত না হওয়া। (ইবনু জারীর)

আল্লামা ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন :

توبة صادقة جازمة বা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাওবা।

এরূপ তাওবার পাঁচটি শর্ত;

১. একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই তাওবা করবে, অন্য কোন লোক দেখানোর জন্য নয়।
২. কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।
৩. কৃত অপরাধ থেকে ফিরে আসা। যদি মানুষের হক থাকে তাহলে তা ফেরত দেওয়া।
৪. এ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা যে, ভবিষ্যতে কখনো এরূপ কাজে জড়িত হবে না।
৫. সময়ের আগে তাওবা করতে হবে। অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বেই এবং পশ্চিমাকাশে সূর্য উদয় হওয়ার পূর্বেই তাওবা করতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন ;

( وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّاٰتِ ج حَتٰـّٰـيٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّيْ تُبْتُ الْئٰنَ )‏

“আর তাদের জন্য কোন তাওবা কবূল করা হয় না যারা পাপ কাজ করতেই থাকে এমনকি তাদের নিকট যখন মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সে বলে আমি এখন তাওবা করছি।” (সূরা নিস্ া৩ : ১৮, শরহু আকিদাহ ওয়াসিতিয়াহ)

(نُوْرُهُمْ يَسْعٰي بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ)

এ সম্পর্কে সূরা হাদীদের ১২ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

(يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَآ أَتْمِمْ لَنَا نُوْرَنَا)

অর্থাৎ মুনাফিকদের থেকে যখন নূর ছিনিয়ে নেয়া হবে তখন মু’মিনরা এ দু‘আ করবে, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের দু‘আ কবুল করবেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মু’মিনরা যেমন নিজে জাহান্নাম থেকে বাঁচবে তেমন পরিবারকেও বাঁচাবে।
২. আখিরাতে আল্লাহ তা‘আলা কেবল কৃতকর্মের প্রতিদান দেবেন।
৩. তাওবার শর্তসমূহ জানলাম।
৪. মু’মিনের চারপাশে কিয়ামতের দিন নূর থাকবে।
৫. খালেস তাওবার ফলাফল জানতে পারলাম।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

আলােচ্য সূরার এই দ্বিতীয় পর্বে জীবন ও জগতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঈমানের অসংখ্য প্রমাণাদি সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। জীবন ও জগতকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন ও জীবিকাকে কেন্দ্র করে যেসব বিষয় রয়েছে তার ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব ক্ষমতার বিষয়ে আলােচনা করা হয়েছে। তাছাড়া মােমেনদের কিছু গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করা হয়েছে যা তাদেরকে অপরাপর দল ও গােষ্ঠী থেকে পৃথক করে। উল্লেখ্য যে, সূরার প্রথম পর্বে ওহী এবং রেসালাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। সূরার শেষাংশে ওহীর প্রকৃতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, ওহী ও রেসালাত এই দুটো বিষয়ই পরস্পরের সাথে জড়িত। কারণ দুটো পথই মানব হৃদয়ে গিয়ে মিশে যায়।  *প্রয়ােজনমতাে মানুষের রিযিক সরবরাহ : আলােচ্য পর্বের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিই নিজ বান্দাদের তওবা কবুল করেন, পাপগুলাে মিটিয়ে দেন…'(আয়াত ২৭) এই মর্মস্পর্শী বক্তব্যটি আসছে পূর্ব বর্ণিত সেই দৃশ্যের পর যেখানে পাপী ও অত্যাচারীদেরকে নিজ নিজ কৃতকর্মের সামনে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় দেখানাে হয়েছে এবং মােমেন বান্দাদেরকে দেখানাে হয়েছে জান্নাতের উদ্যানে। সাথে সাথে যেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূলের পৌঁছানাে বাণী সম্পর্কে সব ধরনের সংশয় সন্দেহের অবসান ঘটানাে হয়েছে এবং এই সত্যটিও প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা অন্তরের সকল ভেদ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেফহাল। এই মর্মস্প্শী বক্তব্য এসেছে সেইসব লােকদের জন্যে যারা তওবা করতে চায়, যারা ভুল পথ থেকে ফিরে সঠিক পথে আসতে চায় এবং আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালার আগেই সংশােধিত হতে চায়। তাদের জন্যে তওবার দরজা খােলা আছে। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাদের তাওবা কবুল করার জন্যে প্রস্তুত আছেন, তাদের পাপ মােচন করার জন্যে রাজী আছেন। কাজেই পাপের বােঝা ভারী হওয়ার কারণে হতাশার কিছু নেই, ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহ তায়ালা মানুষের কার্যকলাপ সম্পর্কে সব কিছুই জানেন। তিনি আরও জানেন কারা সত্যিকার অর্থে তাওবা করে। যারা সত্যিকার অর্থে তাওবা করে, তিনি তাদের তাওবা কবুল করেন, তেমনিভাবে তিনি মানুষের অতীতের পাপগুলাে সম্পর্কেও জানেন, তাই সেগুলো মিটিয়ে দেন। এই হৃদয়গ্রাহী বর্ণনার মাঝখানেই মােমেন ও কাফেরদের প্রাপ্য প্রতিদান সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যারা মােমেন ও সৎকর্মশীল তারা তাদের প্রভুর ডাকে সাড়া দেয়। আর প্রভু তাদের প্রতি অধিক দয়া ও করুণা প্রদর্শন করেন। অপরদিকে যারা কাফের, তাদের জন্যে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। এই কঠিন শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তাওবার দরজা সবার জন্যে খােলা আছে। তবে আল্লাহর অধিক অনুগ্রহ ও বিশেষ দয়া কেবল তাদের ভাগ্যেই জুটবে যারা স্বতস্ফূর্তভাবে তার ডাকে সাড়া দেবে। পরকালে আল্লাহর দয়া ও করুণার কোনাে সীমা থাকবে না, কোনাে হিসাবও থাকবে না। কিন্তু পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের জীবিকা নির্ধারিত পরিমাণে দিয়ে থাকেন। কারণ তিনি ভালাে করেই জানেন, পৃথিবীতে বসবাসকারী এই দুর্বলচিত্তের বান্দাদের জন্যে তার দয়ার ভান্ডার পুরােপুরি খুলে দিলে তাদের পক্ষে সেই চাপ সহ্য করা সম্ভবপর হবে না। তাই বলা হচ্ছে, ‘যদি আল্লাহ তায়ালা তার সকল বান্দাকে প্রচুর রিযিক দিতেন, তবে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে…’(আয়াত ২৭) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ভালাে করেই জানেন যে, তাঁর বান্দারা সীমিত সচ্ছলতারই উপযুক্ত। তাদের ধারণ ক্ষমতার জন্যে এটা যথার্থ। কারণ, পরকালে তাদেরকে যে অঢেল পরিমাণে দেয়া হবে, সে পরিমাণে তাদেরকে যদি দুনিয়াতেও দেয়া হয় তাহলে তারা সীমালংঘন করবে, বিপর্যয় ঘটাবে। এ সকল বান্দা তো দুর্বল, তাই ভারসাম্য রক্ষা করে চলা তাদের পক্ষে সব ক্ষেত্রে সম্ভব নয়, তাদের ধারণ ক্ষমতা সীমিত সম্পদের জন্যেই উপযুক্ত। এ সত্যটুকু আল্লাহর জানা আছে। কারণ তিনি বান্দাদের সব কিছু জানেন ও দেখেন। আর সেই কারণেই তিনি এই পার্থিব জীবনে তাদেরকে সীমিত ও নির্ধারিত পরিমাণে এবং তাদের ধারণ ক্ষমতা অনুসারে সম্পদ দান করেন। তবে যারা দুনিয়ার পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হবে এবং সহি সালামতে পরকালীন জীবনে প্রবেশ করবে, তাদের জন্যে সীমাহীন প্রাচুর্য ও সুখ সাচ্ছন্দ থাকবে। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষ নিরাশ হয়ে যাওয়ার পরে তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং স্বীয় রহমত ছড়িয়ে দেন’ (আয়াত ২৮) এই আয়াতে বান্দার প্রতি আল্লাহ তায়ালার আর এক অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে যখন মানুষ জীবনের প্রথম উপাদান পানির জন্যে হাহাকার করতে থাকে এবং হতাশা নিরাশা যখন তাদেরকে গ্রাস করে ফেলে তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন, ফলে খরতাপে ঝলসে যাওয়া ভূমি জীবিত হয়ে ওঠে, পতিত জমি শস্যশ্যামল হয়ে উঠে, বীজ অংকুরিত হয়, চারাগুলাে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, আবহাওয়া কোমল ও স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে, জীবন চাঞ্চল্য ফিরে আসে, মানুষের মাঝে কর্মস্পৃহা জেগে উঠে, মাঠে ঘাটে আনন্দের বার্তা বয়ে যায়, হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার খুলে যায়, মনে আশার সঞ্চার হয়। হতাশা এবং আল্লাহর রহমতের মাঝে ক্ষণিকের ব্যবধান ছিলাে। এ ব্যবধান কেটে যাওয়ার সাথে সাথে রহমতের সকল দুয়ার খুলে যায়, আকাশের দুয়ার খুলে যায় এবং রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হয়। ‘তিনিই কার্যনির্বাহী প্রশংসিত….’ অর্থাৎ তিনি সাহায্যকারী, তিনি পালনকর্তা। তার সত্ত্বাও প্রশংসিত এবং তার গুণাবলীও প্রশংসিত। আলােচ্য আয়াতে বৃষ্টিকে ‘গায়ছু’ বলা হয়েছে। ‘গায়ছু’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ত্রাণ ও উদ্ধার। অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত বা দুর্যোগ কবলিত কাউকে রক্ষা করা, উদ্ধার করা। অপরদিকে বৃষ্টির প্রভাবকে রহমত ছড়িয়ে দেয়া’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই রহমত শব্দের মাঝে আমরা সজীবতা, শ্যামলতা, আশা ও উৎফুল্লতার ব্যঞ্জনা পাই। কারণ, বৃষ্টি ধারায় সিঞ্চিত হয়ে শুদ্ক ভূমি যখন ফলে ফুলে ভরে ওঠে, তখন সত্য সত্যই মানুষের মনে সজীবতা আসে, উৎফুল্লতা আসে এবং আশার সঞ্চার হয়। গ্রীষ্মের খরতাপের পর বৃষ্টির দৃশ্যে মানুষের হৃদয় মন ও স্নায়ু যতােটুকু স্বস্তি ও আনন্দ অনুভব করে ততােটুকু আর কিছুতে হয় না। তেমনিভাবে বৃষ্টিপাতের পর শুষ্ক ভূমি শস্য শ্যামল হয়ে ওঠার পর যে দৃশ্যের সৃষ্টি তা দেখে মানুষের চোখ যতােটুকু জুড়ায় ততােটুকু আর কিছুতে জুড়ায় না।

** মুনাফিক ত্যাগ করে তাওবা করো, আন্তরিক তাওবা:-

মােমেনদের কী হবে? তারা কিভাবে দোযখের আগুন থেকে নিজেদের ও নিজেদের আপনজনদের বাঁচাবে? আল্লাহ তায়ালা তাদের এর পথ বাতলে দিচ্ছেন এবং তাদের জন্যে আশার প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন এই বলে, ‘হে মােমেনরা, আল্লাহর কাছে খাঁটিভাবে তাওবা করাে। অচিরেই তােমাদের প্রতিপালক তােমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন…’ এই হচ্ছে বাঁচার পথ। খাঁটি তাওবা, যা হৃদয়কে খাঁটি ও খালেস বানায়, অতপর তা তাকে আর ধােকা দেয় না ও প্রবঞ্চিত করে না। তাওবা হচ্ছে খারাপ কাজ থেকে ফিরে আসা ও বিরত থাকার নাম। এর শুরু হয় অনুশােচনা দিয়ে এবং শেষ হয় সৎ কাজ ও আনুগত্যের মাধ্যমে। এই পরিপূর্ণ তাওবার মধ্য দিয়েই হৃদয় গুনাহের কলুষমুক্ত হয় এবং মানুষকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে। এটাই হচ্ছে তাওবাতুন নাসূহা তথা খাটি তাওবা, যা হৃদয়কে ক্রমাগত সতর্ক করে এবং কখনাে আর গুনাহের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে দেয় না। তাওবা যখন এমনই (পাপ থেকে পুরােপুরি নিবৃত্ত হওয়া, আর কখনাে পাপের ধারে-কাছেও না যাওয়া), তখন আশা করা যায় যে, আল্লাহ তা দ্বারা সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং তাওবাকারীদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যেদিন মােমেনদের গুনাহ মাফ করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, সেদিন কাফেরদের এমনভাবে লাঞ্চিত ও অপমানিত করবেন যে, তাদের কোনাে প্রকার ওযর-বাহানা করার সুযােগ পর্যন্ত দেবেন না বলে কিছু আগেই বলা হয়েছে। সেদিন আল্লাহ তার নবী ও মােমেনদেরকে লাঞ্ছিত করবেন না। ‘আল্লাহ তায়ালা নবী ও মােমেনদেরকে অপমানিত করবেন না’- এ কথাটা মােমেনদের বিশেষভাবে সম্মানিত ও আশান্বিত করেছে সেই অপমানের দিন যারা সম্মানিত হবে তাদের মধ্যে নবী(স.)-এর সাথে মােমেনদের একত্রিত করে এই বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মােমেনদের জন্যে সেদিন এমন এক আলাে প্রস্তুত রাখা হবে, যা তাদের সামনে ও ডানে চলতে থাকবে। সেই ভয়ংকর দুর্যোগময় দিনে এই আলাে দ্বারা তাদের চেনা যাবে, প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে এ আলাে দ্বারা তারা পথের সন্ধান পাবে এবং পরিশেষে এ আলাে তাদের সামনে ও ডানে চলতে চলতে জান্নাতে গিয়ে পৌঁছবে। সেদিন সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তারা আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের আলােকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদের তুমি রক্ষা করাে। নিশ্চয় তুমি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান।’ সেই কঠিন দিনে যখন মুখ নির্বাক ও অন্তর নিস্তব্ধ হয়ে যাবে, তখন তাদের এই দোয়া শেখানাে প্রকৃতপক্ষে দোয়াটি কবুল হওয়ারই আলামত। আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের এ দোয়া শেখাবেন এই জন্যে যে, তিনি এ দোয়া কবুল করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। সারকথা এই যে, আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের যে সম্মান ও আলা দান করবেন, তার ওপর এই দোয়া তার একটি বাড়তি নেয়ামত ও অনুগ্রহ। যে মােমেন এতাে সব নেয়ামত ও অনুগ্রহে সিক্ত হবে, তার আবার মানুষ ও পাথরের জ্বালানি দ্বারা প্রজ্বলিত দোযখের সাথে কিসের সম্পর্ক যে পুরস্কার ও শাস্তির উল্লেখ করা হলাে, তার উভয়টিই আগুন থেকে নিজেকে ও পরিবার পরিজনকে রক্ষা করার ব্যাপারে মােমেনের দায়িত্ব কতখানি, তা স্পষ্ট করে বলে দেয়। তাকে বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত লাভের যােগ্য করতেই বা এ দুটির ভূমিকা কী, তাও জানিয়ে দেয়। রসূল(স.)-এর পরিবারে সংঘটিত ঘটনার পটভূমিতে চিন্তা করলে আমরা আলােচ্য আয়াতগুলাের প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারি। নিজেকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করা এবং নিজের অন্তরকে সংশােধন করার ন্যায় নিজের পরিবার-পরিজনকে সঠিক পথে পরিচালিত করাও মােমেনের দায়িত্ব। সূরা তালাকে যেমন আমি বলেছি, ইসলাম শুধু ব্যক্তির নয়, পরিবারেরও জীবন বিধান। তাই পরিবারের প্রতি মােমেনের দায়িত্ব কী, তাও সে নির্ধারণ করে। মুসলিম পরিবার আসলে মুসলিম দল বা সংগঠনের ভিত্তি। এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ছােট বড় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত হয় জীবন্ত ইসলামী সমাজ। এক একটি মুসলিম পরিবার ইসলামের এক একটি দুর্গস্বরূপ। এই দুর্গ ভেতর থেকে অত্যন্ত মযবুত ও দুর্ভেদ্য থাকা চাই। তাতে কোথাও যদি ফাঁক বা ফাটল থেকে থাকে, তবে সে রকম প্রতিটি ফাটলে একজন মুসলমান পাহারাদার থাকা চাই, যাতে কেউ তা ভেদ করতে না পারে। অনুরূপভাবে ভেতর থেকেও যেন কেউ দুর্গের দেয়াল ভাংতে না পারে, তার ব্যবস্থা থাকা চাই। মােমেনের দায়িত্ব ও কর্তব্য এই যে, যেন ইসলামের দাওয়াত সর্বপ্রথম তার পরিবারের কাছে পৌছায় এবং এভাবে ইসলামের এই দুর্গটিকে নিরাপদ করে ও তার ফাটলগুলাে বন্ধ করে। এ কাজটি সম্পন্ন করার আগে দূরের কারাে কাছে দাওয়াত পৌছানাে তার দায়িত্ব নয়। পরিবার নামক এই দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণে মুসলিম মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা প্রয়ােজন। শুধু মুসলিম মাতাই এই দুর্গের নিরাপত্তা বিধানে যথেষ্ট নয়। ছেলেমেয়েদের গঠন করতে পিতা ও মাতা উভয়েরই প্রয়ােজন। শুধুমাত্র একদল পুরুষ দ্বারা ইসলামী সমাজ গঠনের চেষ্টা বৃথা। এ সমাজে মুসলিম মহিলাদেরও প্রয়োজন রয়েছে। তারাই নতুন প্রজন্মের রক্ষণাবেক্ষণকারিণী। আর এই নতুন প্রজন্ম হচ্ছে ভবিষ্যতের বীজ ও ফল দুটোই। এ জন্যে কোরআন পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যেই নাযিল হতাে। কোরআন পরিবার গঠন ও ইসলামী বিধানের আলােকে প্রতিষ্ঠিত করতাে, আর এ কারণেই মোমেনদের একদিকে যেমন নিজেদের দায়িত্ব অর্পণ করতাে, অপর দিকে তেমনি অর্পণ করতাে তাদের পরিবারের দায়িত্বও। এ দায়িত্বই অর্পণ করা হয়েছে ‘হে মােমেনরা তােমরা নিজেদেরকে ও তােমাদের পরিবার পরিজনকে আগুন থেকে বাচাও’- এই কথাটা বলার মধ্য দিয়ে।  *মুসলিম স্ত্রীদের অপরিহার্য আদর্শ : যারা মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকেন, এ বিষয়টি তাদের খুব ভালােভাবে হৃদয়ংগম করা দরকার। এ ব্যাপারে প্রথম চেষ্টা নিয়ােজিত করতে হবে নিজ গৃহের প্রতি তথা নিজের স্ত্রী, মাতা পিতা, সন্তান সন্ততি ও সকল আত্মীয়-স্বজনের প্রতি। মুসলিম নারীকে মুসলিম পরিবার গঠনের সর্বাত্মক সুযােগ দিতে হবে। আর যে ব্যক্তি মুসলিম পরিবার গঠন করতে চাইবে, তাকে সর্বপ্রথম নিজের জন্যে খাঁটি মুসলমান স্ত্রী খুঁজতে হবে। নচেৎ মুসলিম সমাজ গঠনের কাজ অনেক বেশী বিলম্বিত হয়ে যাবে এবং মুসলিম সমাজরূপী দুর্গের প্রাচীরে প্রচুর ফাটলের সৃষ্টি হবে। ইসলামের সূচনাকালে ইসলামী পরিবার গঠন করার কাজটি এ যুগের চেয়ে অনেক বেশী সহজ ছিলাে। কেননা, মদীনায় একটা ইসলামী সমাজ বিদ্যমান ছিলাে এবং সে সমাজের ওপর ইসলামের নিরংকুশ কর্তৃত্ব বিরাজ করতাে। মানব জীবন সম্পর্কে ইসলামের যে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন চিন্তাধারা রয়েছে এবং সেই চিন্তাধারা থেকে যে আইন কানুন ও বিধিবিধান রচিত হয়, তার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলাে গােটা সমাজ ব্যবস্থা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে গােটা জাতির কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল এবং আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের নির্দেশ। ওহীর মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত নাযিল হতাে, সেটাই হতাে সর্বশেষ, চূড়ান্ত ও অকাট্য সিদ্ধান্ত। এই সমাজ বিদ্যমান থাকা এবং তার চিন্তাধারা ও মতাদর্শ মানব জীবনে প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত থাকার কারণে নারীর পক্ষে ইসলামের বিধান অনুসারে নিজের জীবন গড়া সহজ ছিলাে। পুরুষের পক্ষেও স্ত্রী ও সন্তানদের ইসলামের বিধান অনুসারে পরিচালিত করা এবং তদনুসারে জীবন যাপন করার উপদেশ দেয়া সহজ ছিলাে। আজকে আমরা এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবস্থান করছি, এক সর্বব্যাপী জাহেলী সভ্যতার অধীনে জীবন যাপন করছি। এ সভ্যতার অধীন সমাজ, সংস্কৃতি, আইন, নৈতিকতা, চালচলন, আচার আচরণ সব কিছুই জাহেলিয়াত থেকে উদ্ভূত। এই জাহেলী সমাজের সাথেই তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে আজকের নারী সমাজকে। যখনই কোনাে নারী ইসলামী নীতি ও আদর্শের অনুসরণ করতে চায়, তখন সে এই জাহেলী সমাজের পক্ষ থেকে দুঃসহ চাপের সম্মুখীন হয়। চাই সে স্বতস্ফূর্তভাবে ইসলামের প্রেরণায় উজ্জীবিত হােক, অথবা তার স্বামী, ভাই বা পিতা তাকে ইসলামের দিকে পথনির্দেশ করে থাকুক। সেকালে নারী পুরুষ নির্বিশেষে গােটা সমাজ ইসলামের অনুসারী ছিলাে। আর আজকের যুগে পুরুষরা এমন এক আদর্শের অনুসরণ করে, যার কোনাে অস্তিত্ব বাস্তব জগতে নেই (অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের আকারে যে ইসলামের অস্তিত্ব নেই তার অনুসরণ করে)। আর এই আদর্শের কট্টর বিরােধী সমাজের চাপের মুখে নারী সমাজ দিশাহারা। বস্তুত সমাজ ও তার প্রচলিত কৃষ্টির চাপ পুরুষের কাছে যত প্রবল ও তীব্রভাবে অনুভূত হয়, নারীর কাছে অনুভূত হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশী। এ কারণে এ সমাজ পুরুষের দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রথমত তার দায়িত্ব দোযখ থেকে নিজেকে বাঁচানাে, অতপর তার পরিবার পরিজনকে বাচানো। তাই তাকে এই দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। তাহলে প্রথম মুসলিম সমাজে একজন পুরুষ এই দায়িত্ব পালন করার জন্যে যতোটা চেষ্টা সাধনা করতাে, সে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী চেষ্টা সাধনা করবে, আর ঠিক তখনই যে ব্যক্তি ইসলামী পরিবার গঠনে ইচ্ছুক, তার কর্তব্য হবে সর্ব প্রথমে এই দুর্গের প্রহরী হিসাবে এমন একজন উপযুক্ত মহিলাকে খুঁজে বের করা, যার চিন্তাধারা ইসলামেরই হুবহু অনুসারী। আর এটা করতে গেলে তাকে অনেক ত্যাগ ও কোরবানী দিতে হবে। তাকে সমাজের চোখ ধাঁধানো সংস্কৃতি এবং আধুনিকা নারীর মিথ্যা ছলনা বিসর্জন দিয়ে ধর্মপ্রাণ নারীর সন্ধান করতে হবে, যে তাকে ইসলামী পরিবার গঠনে ও ইসলামের দুর্গ নির্মাণে সাহায্য করবে। আর মুসলিম পিতারা যদি ইসলামের পুনরুজ্জীবন চান, তবে তাদের কর্তব্য হবে নব প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের ইসলামের ছাঁচে গড়ে তােলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারদান এবং নিজেকে ও পরিবারকে দোযখ থেকে বাঁচানাের জন্যে আল্লাহ তায়ালা যে আহবান জানিয়েছেন তাতে সাড়া দান। এই প্রসংগে একটি কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইসলামের স্বাভাবিক দাবী হলাে এমন একটি দল বা সমাজ গঠন করা, যা হুবহু ইসলামের অনুগত হবে এবং যে সমাজে ইসলামের বাস্তব অস্তিত্ব প্রচলিত ও প্রতিফলিত হবে। ইসলাম রচিতই হয়েছে এই উদ্দেশ্যে যে, একটি দল বা সমাজ এমন প্রতিষ্ঠিত হবে, যার আকীদা, মতবাদ ও মতাদর্শ, আইন ও বিধান এক কথায়, তার গােটা জীবনের বিধানই হবে ইসলাম আর এমন একটি সমাজই ইসলামী আদর্শকে ইসলাম বিরােধী সমাজের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। (সূরা সফের তাফসীর দ্রষ্টব্য) ইসলামী সমাজের গুরুত্ব কতখানি, উপরােক্ত বক্তব্যের আলােকে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এই সমাজেই মুসলিম নারী ও মুসলমান তরুণী বসবাস করে। ইসলামের নিরাপত্তা বেষ্টনীর কল্যাণেই সে বিদ্যমান জাহেলী সমাজের চাপ থেকে রক্ষা পায়। ইসলামী মতাদর্শের দাবী এবং প্রতিষ্ঠিত জাহেলী সমাজের রীতিনীতির টানাপড়েনে তার আবেগ-উদ্দীপনা হারিয়ে যায় না। তাকে জীবনসংগিনী হিসাবে পেয়ে মুসলিম যুবক ইসলামের দুর্গ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় এবং সেই দুর্গের ভিত্তিতে গঠন করে ইসলামী শিবির। বস্তুত এমন একটি ইসলামী সমাজ বা সংগঠন সৃষ্টি হওয়া অত্যন্ত জরুরী, যার সদস্যরা ইসলামের আনুগত্যের জন্যে পরস্পরকে উপদেশ দিতে ও সাবধান করতে থাকে, যে সমাজ ও সংগঠন ইসলামের চিন্তা চেতনা, নীতি ও চরিত্র, ধ্যান ধারণা ও চালচলনের লালন, বিকাশ সাধন ও সংরক্ষণ করে এবং তার দিকে বিভ্রান্ত জাহেলী সমাজকে ইসলামের বাস্তব নমুনা দেখিয়ে আহবান জানায়, যাতে সে অন্ধকার থেকে ইসলামের আলােতে আসার প্রেরণা পায় এবং শেষ পর্যন্ত একদিন আল্লাহর ইচ্ছায় ইসলামের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তী বংশধর জাহেলিয়াত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ইসলামের ছায়ার নিচে আশ্রয় নেয়। প্রথমে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করার স্বার্থেই রসূল(স.)-কে ইসলামের ও মুসলমানদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে। বলা হচ্ছে, হে নবী, কাফের ও মােনাফেকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাে এবং তাদের ওপর কঠোরতা প্রয়ােগ করাে। তাদের বাসস্থান হচ্ছে জাহান্নাম এবং তা নিকৃষ্ট ঠিকানা। ইতিপূর্বে মােমেনদেরকে যে নিজেদের ও তাদের পরিবার পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার আলােকে বিবেচনা করলে এ আয়াতটিতে প্রদত্ত মােনাফেক ও কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নির্দেশ তাৎপর্যবহ। পূর্বের আয়াতে যে খাঁটি তাওবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা তাদের গুনাহ মাফ করাতে ও জান্নাতে প্রবেশ করাতে সক্ষম, তার পরিপ্রেক্ষিতেও এ আদেশ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যে সমাজে দোযখের আগুন থেকে বাঁচা ও বাঁচানাের সাধনা চলে, সে সমাজকে বাইরে থেকে আগ্রাসী কাফেররা ও ভেতর থেকে গৃহ শত্রু বিভীষণ মােনাফেকরা অন্যায়ভাবে ধ্বংস করে দেবে, সেটা হতে দেয়া যায় না। এ সমাজকে তাই অত্যাচারী ও নৈরাজ্যবাদীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা অপরিহার্য। লক্ষণীয় যে, আয়াতে কাফের ও মোনাফেকদের একই সমতলে সমবেত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ও কঠোরতা প্রয়ােগ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, ইসলামী শিবিরকে হুমকি দেয়া, ধ্বংস করা ও ছিন্নভিন্ন করার ব্যাপারে তারা একই রকম ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা দোযখের আগুন থেকে বাঁচার সংগ্রামেরই পর্যায়ভুক্ত এবং রাসূল(স.) ও মােমেনদের পক্ষ থেকে দুনিয়ার জীবনে নিষ্ঠুর কঠোর আচরণ পাওয়া তাদের প্রাপ্য নগদ শাস্তি, আর আখেরাতে তাদের শাস্তি হলাে জাহান্নাম। এভাবে সূরার এ অংশটির আয়াতগুলাে যেমন পরস্পরের সাথে সুসমন্বিত, তেমনি তা পূর্ববর্তী অংশের সাথেও সার্বিকভাবে সমন্বিত।

Leave a Reply