[* আনুগত্য, উৎসর্গ, কোরবানি , আত্মসমর্পণের ও হিকমত এর দৃষ্টান্ত :-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৭:সাফফাত পারা:২৩ ৭৫-১১৩ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭৫)
[* আনুগত্য, উৎসর্গ, কোরবানি , আত্মসমর্পণের ও হিকমত এর দৃষ্টান্ত :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৭:সাফফাত
পারা:২৩
৭৫-১১৩ নং আয়াত:-

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন :-
# এ বিষয়বস্তুটির সম্পর্ক রয়েছে পেছনের রুকূ’র শেষ বাক্যগুলোর সাথে। সেগুলোর ওপর চিন্তা-ভাবনা করলে এ কাহিনীটি এখানে কেন শুনানো হচ্ছে তা বুঝা যায়।
# এখানে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের ফরিয়াদের কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘকাল নিজের কওমকে সত্য দ্বীনের দাওয়াত দেবার পর শেষে হতাশ হয়ে তিনি মহান আল্লাহর কাছে এ ফরিয়াদ করেছিলেন। সূরা কামারে এ ফরিয়াদের শব্দগুলো নিম্নোক্তভাবে এসেছে فَدَعَا رَبَّهُ أَنِّي مَغْلُوبٌ فَانْتَصِرْ “সে তার রবকে ডেকে বললো, আমি পরাজিত হয়ে গেছি, তুমি আমাকে সাহায্য করো।” (আল কামার, ১০ আয়াত)
# একটি চরিত্রহীন ও জালেম জাতির ক্রমাগত বিরোধিতার কারণে তিনিই যে ভয়াবহ যন্ত্রণা, ক্লেশ ও কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। এর মধ্যে এ বিষয়টির প্রতিও একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রযেছে যে, নূহ আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাথিদেরকে যেভাবে সেই মহাক্লেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, ঠিক তেমনি শেষ পর্যন্ত আমি মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদেরকেও মক্কাবাসীরা যে মহাক্লেশের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে তা থেকে উদ্ধার করবো।
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, যারা হযরত নূহের বিরোধিতা করেছিল তাদের বংশধারা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে এবং হযরত নূহেরই বংশধারাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। দুই, সমস্ত মানব বংশধারাকে খতম করে দেয়া হয়েছে এবং সামনের দিকে কেবলমাত্র নূহ আলাইহিস সালামের সন্তানদের মাধ্যমে এ দুনিয়ার জনবসতিকে বিস্তৃতি দান করা হয়েছে। সাধারণভাবে মুফসসিরগণ এ দ্বিতীয় অর্থটিই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কুরআন মজীদের শব্দবলী এ অর্থটির ব্যাপারে সুস্পষ্ট নয়। আসল ব্যাপারটা কি তা আল্লাহ‌ ছাড়া কেউ জানে না।
# আজ সারা দুনিয়ায় হযরত নূহের দুর্নাম করার কেউ নেই। নূহের প্লাবনের পর থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার বছর ধরে দুনিয়াবাসীরা তাঁর সুনামই করে চলেছে।
# রবের সামনে হাজির হওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাঁর দিকে রুজু হওয়া এবং সবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একমাত্র তাঁর দিকে মুখ করা। আর বিশুদ্ধ চিত্ত (قلب السليم) মানে হচ্ছে “সঠিক ও নিষ্কলূষ অন্তকরণ।” অর্থাৎ সব রকমের বিশ্বাসগত ও নৈতিক ত্রুটিমুক্ত অন্তর। যেখানে কুফরী ও শিরক এবং সন্দেহ-সংশয়ের লেশ মাত্রও নেই। যার মধ্যে নাফরমানী ও বিদ্রোহের কোন সামান্যতম অনুভূতিও পাওয়া যায় না। যার মধ্যে কোন প্রকান প্যাঁচ ও জটিলতা নেই। যা সব ধরনের অসৎ প্রবণতা ও অপবিত্র কামনা-বাসনার সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত। যার মধ্যে কারো বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ ও অকল্যাণ কামনা পাওয়া যায় না এবং যার নিয়তে কোনপ্রকার ত্রুটি ও কৃত্রিমতা নেই।
# হযরত ইবরাহীমের (আ) এ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আন’আম, ৫০-৫৫, মারয়াম, ২৬-২৭ ; আল আম্বিয়া, ৫৩-৬৬ ; আশ শূ’আরা, ৫১-৬৪ এবং আল আনকাবূত, ২৪-৪৮ টীকা।
# আল্লাহকে তোমরা কী মনে করেছো? তোমরা কি মনে করো, এসব কাঠ-পাথরের তৈরি দেবতারা তাঁর সমজাতীয় হতে পারে? অথবা এরা তাঁর গুণাবলী ও ক্ষমতায় শরীক হতে পারে? আর তোমরা কি এ বিভ্রান্ত চিন্তারও শিকার হয়েছো যে, তাঁর সাথে এত বড় গোস্তাখী করার পর তোমরা তাঁর পাকড়াও থেকে রেহাই পেয়ে যাবে?
# এখন একটি বিশেষ ঘটনার কথা বলা হচ্ছে। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা এসেছে সূরা আল আম্বিয়া, ৫১-৭৩ এবং আল ’আনকাবূতে, ১৬-২৭ আয়াতে।
# ইবনে আবি হাতেম প্রসিদ্ধ তাবে’ঈ মুফাসসির কাতাদাহর এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, আরবরা نَظَرَ فِى النَّجُوْمِ (সে তারকাদের দিকে তাকালো) শব্দাবলী প্রবাদ বাক্য হিসেবে ব্যবহার করে তার যে অর্থ গ্রহণ করে তা হচ্ছে এই যে, সে ভাবনা-চিন্তা করলো অথবা সে চিন্তা করতে লাগলো। আল্লামা ইবনে কাসীর এ উক্তিটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এমনিতেও প্রায়ই দেখা যায়, যখন কোন ব্যক্তির সামনে চিন্তার কোন বিষয় আসে তখন সে আকাশের দিকে অথবা ওপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারপর ভেবে-চিন্তে জবাব দেয়।
# হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর জীবনে তিনটে মিথ্যা বলেছিলেন বলে যে কথা বলা হয়ে থাকে এটি তার একটি। অথচ একথাটিকে মিথ্যা বা বাস্তব বিরোধী বলার জন্য প্রথমে কোন উপায়ে একথা জানা উচিত যে, সে সময় হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কোন প্রকারের কোন কষ্ট ও অসুস্থতা ছিল না এবং তিনি নিছক বাহানা করে একথা বলেছিলেন। যদি এর কোন প্রমাণ না থেকে থাকে, তাহলে অযথা কিসের ভিত্তিতে একে মিথ্যা গণ্য করা হবে। এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আমি তাফহীমুল কুরআন সূরা আল আম্বিয়া, ৬০ টীকায় করেছি এবং আরো কিছু আলোচনা রাসায়েল ও মাসায়েল ২ খণ্ডের ২০-২৪ পৃষ্ঠার এসে গেছে।
# আসল ব্যাপার কি ছিল তা এ বাক্য নিজেই প্রকাশ করছে। মনে হচ্ছে সম্প্রদায়ের লোকেরা কোন জাতীয় মেলায় যাচ্ছিল। হযরত ইবরাহীমের পরিবারের লোকেরা তাঁকেও সঙ্গে যেতে অনুরোধ করে থাকবে। তিনি আমার শরীর খারাপ, আমি যেতে পারবো না, বলে ওযর পেশ করে দিয়ে থাকবেন। এখন যদি একথাটা একেবারে অসত্য বা বাস্তব বিরোধী হতো, তাহলে ঘরের লোকেরা তাঁকে বলতো, শরীর-স্বাস্থ্য তো ভালোই আছে দেখতে পাচ্ছি তাহলে আবার খামখা বাহানা করছো কেন? কিন্তু যখন তারা এ ওজর গ্রহণ করে তাঁকে পেছনে রেখে চলে গেলো তখন এ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একথা প্রকাশ পায় যে, নিশ্চয়ই হযরত ইবরাহীম সে সময় সর্দি, কাশি অথবা এ ধরনের কোন সাধারণ রোগে ভুগছিলেন, যার ফলে পরিবারের লোকেরা তাঁকে রেখে চলে যেতে রাজি হয়ে যায়।
# এ থেকে পরিস্কর জানা যায়, মন্দিরে মূর্তিদের সামনে বিভিন্ন প্রকার খাবার জিনিস রাখা হয়েছিল।
# এখানে ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। সূরা আল আম্বিয়ায় এর যে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে তাতে বলা হয়েছে, যখন তারা ফিরে এসে তাদের মন্দিরে সমস্ত মূর্তি ভেঙে পড়ে আছে দেখলো তখন চারদিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। কিছু লোক বললো, ইবরাহীম নামের এক যুবক মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে নানান কথা বলে বেড়ায়। একথায় জমায়াতের লোকেরা বললো তাকে ধরে আনো। সে অনুসারে একটি দল দৌড়ে তাঁর কাছে এলো এবং তাঁকে সমবেত জনতার সামনে হাজির করলো।
# সূরা আল আম্বিয়ার ৬৯ আয়াতের শব্দাবলী হচ্ছেঃ

قُلْنَا يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ

“আমি বললাম, হে আগুন! শীতল হয়ে যাও এবং নিরাপদ হয়ে যাও ইবরাহীমের জন্য।” সূরা আল আনকাবূতের ২৪ আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَأَنْجَاهُ اللَّهُ مِنَ النَّارِ (তারপর আল্লাহ‌ তাঁকে আগুন থেকে উদ্ধার করলেন) এ থেকে প্রমাণ হয়, তারা হযরত ইবরাহীমকে (আ) আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন এবং তারপর আল্লাহ‌ তাঁকে তা থেকে সম্পূর্ণ সূস্থ ও অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন। “তারা তাঁর বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছিল কিন্তু আমি তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করেছি” আয়াতের এ শব্দগুলোকে এ অর্থে গ্রহণ করা যেতে পারে না যে, তারা হযরত ইবরাহীমকে আগুনে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বরং ওপরে উল্লেখিত আয়াতের সাথে মিলিয়ে দেখলে তার এ অর্থটিই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, তারা তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করে মেরে ফেলতে চাচ্ছিল কিন্তু তা করতে পারেনি। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাবার ফলে হযরত ইবরাহীমের (আ) শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয়ে গেলো এবং মুশরিকদেরকে আল্লাহ‌ হেয় প্রতিপন্ন করলেন। এ ঘটনাটি বর্ণনা করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরাইশদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া যে, তোমরা যে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তান হবার গর্ব করে থাকো তাঁর নীতি তা ছিল না যা তোমরা অবলম্বন করেছো বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম যে নীতি অবলম্বন করেছেন সেটিই ছিল তাঁর নীতি। এখন যদি তোমরা তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এমন ধরনের চক্রান্ত করো যা হযরত ইবরাহীমের জাতি তাঁর বিরুদ্ধে করেছিল, তাহলে শেষ পর্যন্ত তোমরাই হেয়প্রতিপন্ন হবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেয়প্রতিপন্ন করার ক্ষমতা তোমাদের নেই।
# আগুন থেকে সুস্থ শরীরে স্বাচ্ছন্দে বেরিয়ে আসার পর যখন হযরত ইবরাহীম (আ) দেশ থেকে বের হয়ে যাবার ফায়সালা করলেন তখন চলার সময় একথাগুলো বলেন।
# আগুন থেকে সুস্থ শরীরে স্বাচ্ছন্দে বেরিয়ে আসার পর যখন হযরত ইবরাহীম (আ) দেশ থেকে বের হয়ে যাবার ফায়সালা করলেন তখন চলার সময় একথাগুলো বলেন।
# এর অর্থ হচ্ছে, আমি আল্লাহর জন্য বের হয়ে পড়ছি। কারণ আমি আল্লাহর হয়ে গেছি, তাই আমার জাতি আমার শত্রু হয়ে গেছে। নয়তো আমার ও তার মধ্যে কোন দুনিয়াবী ঝগড়া ছিল না এবং এর ভিত্তিতে আমাকে স্বদেশ ত্যাগ করতে হচ্ছে না। তাছাড়া দুনিয়ায় আমার যাবার মতো কোন ঠিকানা নেই। সমগ্র দেহ-প্রাণকে তাকদীরের হাতে ছেড়ে দিয়ে একমাত্র আল্লাহর ভরসায় বের হয়ে পড়ছি। যেদিকে তিনি নিয়ে যাবেন সেদিকেই চলে যাবো।
# এ দোয়া থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একথা জানা যায় যে, হযরত ইবরাহীম সে সময় সন্তানহীন ছিলেন। কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে জানা যায়, তিনি কেবলমাত্র নিজের এক স্ত্রী ও এক ভাতিজাকে (হযরত লূত) সাথে নিয়ে দেশ থেকে বের হয়ে পড়েছিলেন। সে সময় স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মনে এ কামনার উদ্ভব হয়ে থাকবে যে, আল্লাহ‌ যেন তাঁকে একটি সৎকর্মশীল সন্তান দান করেন, যে এ প্রবাস জীবনে তাঁর দুঃখ লাঘব করতে সাহায্য করবে।
# দোয়া করতে করতেই সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, এ থেকে একথা মঅন্যস্থানে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছেঃ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ “আল্লাহর শোকর, তিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাইল ও ইসহাক দান করেছেন। (ইবরাহীম, ৩৯) এ থেকে প্রমাণ হয়, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দেয়া এবং এ সুসংবাদের মধ্যে বহু বছরের ব্যবধান ছিল। বাইবেল বর্ণনা করছে, হযরত ইসমাঈলের (আ) জন্মের সময় হযরত ইবরাহীমের (আ) বয়স ছিল ৮৬ বছর। ( আদি পুস্তক ১৬: ১৬ ) অন্যদিকে হযরত ইসহাকের জন্মের সময় তাঁর বয়সনে করার কোন কারণ নেই। কুরআন মজীদেরই ছিল একশত বছর ( ৫: ২১ )
# একথা মনে রাখতে হবে, হযরত ইবরাহীম (আ) স্বপ্ন দেখেননি যে, তিনি পুত্রকে যবেহ করে ফেলেছেন। বরং তিনি দেখেছিলেন, তিনি তাকে যবেহ করছেন। যদিও তিনি তখন স্বপ্নের এ অর্থই নিয়েছিলেন যে, তিনি পুত্রকে যবেহ করবেন। এ কারণে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় পুত্রকে কুরবানী করে দেবার জন্য একেবারেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখাবার মধ্যে মহান আল্লাহ‌ যে সূক্ষ্ম বিষয় সামনে রেখেছিলেন তা সামনের ১০৫ আয়াতে তিনি নিজেই সুস্পষ্ট করে দিয়েছিল।
# পুত্রকে একথা জিজ্ঞেস করার এ অর্থ ছিল না যে, তুমি রাজি হয়ে গেলে আল্লাহর হুকুম তামিল করবো অন্যথায় করবো না। বরং হযরত ইবরাহীম আসলে দেখতে চাচ্ছিলেন, তিনি যে সৎ সন্তানের জন্য দোয়া করেছিলেন সে যথার্থই কতটুকু সৎ। যদি সে নিজে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে এর অর্থ হয় দোয়া পুরোপুরি কবুল হয়েছে এবং পুত্র নিছক শারীরিক দিক দিয়েই তাঁর সন্তান নয় বরং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়েও তাঁর সুসন্তান।
# এ শব্দগুলো পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, নবী-পিতার স্বপ্নকে পুত্র নিছক স্বপ্ন নয় বরং আল্লাহর হুকুম মনে করেছিলেন। এখন যদি যথার্থই এটি আল্লাহর হুকুম না হতো তাহলে অবশ্যই আল্লাহ‌ পরিষ্কারভাবে বা ইঙ্গিতের মাধ্যমে বলে দিতেন যে, ইবরাহীম পুত্র ভুলে একে হুকুম মনে করে নিয়েছে। কিন্তু পূর্বাপর আলোচনায় এর কোন ইঙ্গিত নেই। এ কারণে নবীদের স্বপ্ন নিছক স্বপ্ন নয় বরং তাও হয় এক ধরনের অহী, মুসলমানরা এ বিশ্বাস পোষণ করে। একথা সুস্পষ্ট, যে কথার মাধ্যমে এতবড় একটি নিয়ম আল্লাহর শরীয়াতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তা যদি সত্য ভিত্তিক না হতো বরং নিছক একটি বিভ্রান্তি হতো তাহলে আল্লাহ‌ তার প্রতিবাদ করতেন না, এটা হতো একটি অসম্ভব ব্যাপার। কুরআনকে যারা আল্লাহর কালাম বলে মানে তাদের পক্ষে আল্লাহর এ ধরনের ভুল হয়ে যেতে পারে একথা মেনে নেয়া একেবারেই অসম্ভব।
#‌ হযরত ইবরাহীম (আ) যবেহ করার জন্য পুত্রকে চিৎ করে শোয়াননি বরং উপুড় করে শুইয়ে দিয়েছেন, যাতে যবেহ করার সময় পুত্রের মুখ দেখে কোন প্রকার স্নেহ-মমতার বসে তাঁর হাত কেঁপে না যায়। তাই তিনি নিচের দিক থেকে হাত রেখে ছুরি চালাতে চাচ্ছিলেন।
# ব্যাকরণবিদদের একটি দল বলেন, এখানে “এবং” শব্দটি “তখন” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ বাক্যটি হবে—“যখন এরা দু’জনে আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল তখন আমি আওয়াজ দিলাম।” কিন্তু অন্য একটি দল বলেন, এখানে “যখন” শব্দটির জওয়াব উহ্য রয়ে গেছে এবং তাকে শ্রোতার মনের কল্পনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কারণ কথা এত বড় ছিল যে, তাকে শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করার পরিবর্তে কল্পনারই জন্য ছেড়ে দেয়া বেশী সঙ্গত ছিল। আল্লাহ‌ যখন দেখে থাকবেন বুড়ো বাপ তার বুড়ো বয়সের আকাংখায় চেয়ে পাওয়া পুত্রকে নিছক তাঁর সন্তুষ্টিলাভের জন্য কুরবানী করে দিতে প্রস্তুত হয়ে গেছেন এবং পুত্রও নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছে, তখন এ দৃশ্য দেখে রহমতের দরিয়া কেমন নাজানি উথলে উঠে থাকবে এবং দুই পিতা-পুত্রের প্রতি মালিকের প্রেম কেমন নাজানি বাঁধনহারা হয়ে গিয়ে থাকবে, তা কেবল কল্পনাই করা যেতে পারে। কথায় তার অবস্থা যতই বর্ণনা করা হোক না কেন তা ব্যক্ত করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। বরং বর্ণনায় তার আসল দৃশ্যের অতি অল্পই ফুটে উঠবে।
# তুমি পুত্রকে যবেহ করে দিয়েছো এবং তার প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে, এটা তো আমি তোমাকে দেখাইনি। বরং আমি দেখিয়েছিলাম, তুমি যবেহ করছো। তুমি সে স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিলে। কাজেই এখন তোমার সন্তানের প্রাণবায়ু বের করে নেয়া আমার লক্ষ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য যা কিছু তা তোমার সংকল্প, উদ্যোগ ও প্রস্তুতিতেই সফল হয়ে গেছে।
# যারা সংকর্মের পথ অবলম্বন করে তাদেরকে আমি খামখা কষ্টের মধ্যে ফেলে দেবার এবং দুঃখ ও ক্লেশের মুখোমুখি করার জন্য পরীক্ষার সম্মুখীন করি না। বরং তাদের উন্নত গুণাবলী বিকশিত করার এবং তাদেরক উচ্চ মর্যাদা দান করার জন্যই তাদেরকে পরীক্ষার মুখোমুখি করি। তারপর পরীক্ষার খাতিরে তাদেরকে যে সংকট সাগরে নিক্ষেপ করি তা থেকে নিরাপদে উদ্ধারও করি। তাই দেখো, পুত্রের কুরবানীর জন্য তোমার উদ্যোগ প্রবণতা ও প্রস্তুতিই এমন মর্যাদা দানের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেছে, যা আমার সন্তুষ্টিলাভের জন্য যথার্থই পুত্র উৎসর্গকারী লাভ করতে পারতো। এভাবে আমি তোমার পুত্রের প্রাণও রক্ষা করলাম এবং তোমাকের এ উচ্চ মর্যাদাও দান করলাম।
# তোমার হাতে তোমার পুত্রকে যবেহ করা উদ্দেশ্য ছিল না। বরং দুনিয়ার কোন জিনিসকে তুমি আমার মোকাবিলায় বেশী প্রিয় মনে করো কিনা, সে পরীক্ষা নেয়াই ছিল আসল উদ্দেশ্য।
# “বড় কুরবানী” বলতে বাইবেল ও ইসলামী বর্ণনা অনুসারে একটি ভেড়া। সে সময় আল্লাহর ফেরেশতা হযরত ইবরাহীমের সামনে এটি পেশ করেন পুত্রের পরিবর্তে একে যবেহ করার জন্য। একে “বড় কুরবানী” বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এটি ইবরাহীমের ন্যায় আল্লাহর বিশ্বস্ত বান্দার জন্য ইবরাহীম পুত্রের ন্যায় ধৈর্যশীল ও প্রাণ উৎসর্গকারী পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে ছিল এবং আল্লাহ‌ একে একটি নজীর বিহীন কুরবানীর নিয়ত পুরা করার অসিলায় পরিণত করেছিলেন। এছাড়াও একে “বড় কুরবানী” গণ্য করার আর একটি বড় কারণ দিয়েছেন যে, এ তারিখে সারা দুনিয়ায় সমস্ত মু’মিন পশু কুরবানী করবে এবং বিশ্বস্ততা ও প্রাণ উসৎর্গকারী এ মহান ঘটনার স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করতে থাকবে।
# এখানে এসে আমাদের সামনে এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর যে পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন এবং যিনি স্বতস্ফূর্তভাবে নিজেকে এ কুরবানীর জন্য পেশ করে দিয়েছিলেন তিনি কে ছিলেন? সর্বপ্রথম এ প্রশ্নের জবাব আমাদের সামনে আসছে বাইবেল থেকেঃ “ঈশ্বর আব্রাহামের পরীক্ষা করিলেন। তিনি তাঁহাকে কহিলেন, হে আব্রাহাম ……………….. তুমি আপন পুত্রকে, তোমার অদ্বিতীয় পুত্রকে, যাহাকে তুমি ভালবাস, সেই ইসহাককে লইয়া মোরিয়া দেশে যাও এবং তথাকার যে এক পর্বতের কথা আমি তোমাকে বলিব, তাহার উপর তাহাকে হোমার্থে বলিদান কর।” ( আদিপুস্তক ২২: ১-২ ) এ বর্ণনায় একদিকে বলা হচ্ছে, আল্লাহ‌ হযরত ইসহাকের কুরবানী চেয়েছিলেন আবার অন্যদিকে একথা বলা হচ্ছে, তিনি একমাত্র পুত্র ছিলেন। অথচ বাইবেলের নিজেরই অন্যান্য বর্ণনা থেকে চূড়ান্তভাবে প্রমাণ হয় যে, হযরত ইসহাক একমাত্র পুত্র ছিলেন না। তাই বাইবেলের নিম্নোক্ত বিস্তারিত বক্তব্যটি একবার দেখুনঃ “আব্রাহামের স্ত্রী সারী নিঃসন্তান ছিলেন এবং হাগার নামে তার এক মিস্রীয় দাসী ছিল। তাহাতে সারী আব্রাহামকে কহিলেন দেখ সদাপ্রভু আমাকে সন্ধ্যা করিয়াছেন, বিনয় করি, তুমি আমার দাসীর কাছে গমন কর, কি জানি ইহা দ্বারা আমি পুত্রবতী হইতে পারিব। তখন আব্রাহাম সারীর বাক্যে সম্মত হইলেন। এইরূপে কানান দেশে আব্রাহাম দশ বৎসর বাস করিলে পর আব্রাহামের স্ত্রী সারী আপন দাসী মিস্রীয়া হাগারকে লইয়া আপন স্বামী আব্রাহামের সহিত বিবাহ দিলেন। পরে আব্রাহাম হাগারের কাছে গমন করিলে সে গর্ভবতী হইল।” (আদিপুস্তক ১৬: ১-৪) “সদাপ্রভূর দূত তাহাকে আরও কহিলেন, দেখ, তোমার গর্ভ হইয়াছে, তুমি পুত্র প্রসব করিবে ও তাহার নাম ইশ্মায়েল ঈশ্বর শুনেন রাখিবে।” (আদিপুস্তক ১৬: ১১) “আব্রাহামের ছেয়াশী বৎসর বয়সে হাগার আব্রাহামের নিমিত্তে ইশ্মায়েলকে প্রসব করিল।”(১৬: ১৬) “আর ঈশ্বর আব্রাহামকে কহিলেন, তুমি তোমার স্ত্রী সারীকে আর সারী বলিয়া ডাকিওনা, তাহার নাম সারা রানী হইল ………….. তাহা হইতে এক পুত্রও তোমাকে দিব ; ………….. তুমি তাহার নাম ইস্‌হাক হাস্য রাখিবে, ………… আগামী বৎসরের এই ঋতুতে সারা তোমার নিমিত্তে যাহাকে প্রসব করিবে, ……….. পরে আব্রাহাম আপনপুত্র ইশ্মায়েলকে ও …………… গৃহে যত পুরুষ ছিল, সেই সকলকে লইয়া ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারে সেই তাহাদের লিঙ্গাগ্রচর্ম ছেদন করিলেন। আব্রাহামের লিঙ্গাগ্রের ত্বক ছেদন কালে তাঁহার বয়স নিরানব্বই বৎসর। আর তাঁহার পুত্র ইশ্মায়েলের লিঙ্গাগ্রের ত্বক ছেদন কালে তাহার বয়স তের বৎসর।” “(আদি পুস্তক ১৭: ১৫-২৫) “আব্রাহামের একশত বৎসর বয়সে তাঁহার পুত্র ইসহাকের জন্ম হয়।” (আদি পুস্তক ২১: ৫) ( আদিপুস্তক : সবগুলো লিংক )

এ থেকে বাইবেলের বর্ণনার বৈপরীত্য পরিষ্কার সামনে এসে যায়। একথা সুস্পষ্ট, ১৪ বছর পর্যন্ত হযরত ইসমাঈল (আ) হযরত ইবরাহীমের (আ) একমাত্র সন্তান ছিলেন। এখন যদি একমাত্র পুত্রের কুরবানী চাওয়া হয়ে থাকে তাহলে তা হযরত ইসহাকের নয় বরং ইসমাঈলের কুরবানী ছিল। কারণ তিনিই ছিলেন একমাত্র সন্তান। আর যদি হযরত ইসহাকের কুরবানী চাওয়া হয়ে থাকে তাহলে আবার একথা বলা ঠিক নয় যে, একমাত্র সন্তানের কুরবানী চাওয়া হয়েছিল।

এরপর আমরা ইসলামী বর্ণনাগুলোর প্রসঙ্গে আসতে পারি। সেখানে দেখি ভীষণ মতবিরোধ। মুফাসসিরগণ সাহাবা ও তাবেঈগণের যে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন তাতে একটি দলের উক্তি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীমের পুত্র হযরত ইসহাক। এ দলে রয়েছেন মনীষীগণঃ

হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.), কতাদাহ, ইকরামাহ, হাসান বাসরী, সাঈদ ইবনে জুবাইর, মুজাহিদ, শা’বী, মাসরূক মাকহূল, যুহরী, আতা, মুকাতিল, সুদ্দী, কা’ব আহবার, যায়েদ ইবনে আসলাম এবং আরো অনেকে।

দ্বিতীয় দলটি বলেন, তিনি ছিলেন হযরত ইসমাঈল। এ দলে রয়েছেন নিম্নোক্ত মনীষীগণঃ

হযরত আবু বকর (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.), হযরত মু’আবীয়াহ (রা.) ইকরামাহ, মুজাহিদ, ইউসুফ ইবনে মেহরান, হাসান বাসরী, মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল কুরযী, শা’বী, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব, দ্বাহহাক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন (মুহাম্মাদ আল বাকের), রাবী’ ইবনে আনাস, আহমাদ ইবনে হামবল এবং আরো অনেকে।

এ দু’টি তালিকা পর্যলোচনা করলে দেখা যাবে এর মধ্যে অনেকগুলো নাম উভয় তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ একজন মনীষী বিভিন্ন সময় দু’টি ভিন্ন উক্তি করেছেন। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে ইকরামাহ এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীমের পুত্র হযরত ইসহাক। কিন্তু তাঁরই থেকে আতা ইবনে আবী রাবাহ একথা উদ্ধৃত করেছেনঃ زعمت اليهود انه اسحق وكذبت اليهود (ইহুদীদের দাবী হচ্ছে, তিনি ছিলেন হযরত ইসহাক কিন্তু ইহুদীরা মিথ্যা বলেছে) অনুরূপভাবে হযরত হাসান বাসরী থেকে একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি হযরত ইসহাকের কুরবানীর প্রবক্তা ছিলেন কিন্তু আমর ইবনে উবাইদ বলেন, হাসান বাসরীর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল না যে, হযরত ইবরাহীমের (আ) যে পুত্রকে যবেহ করার হুকুম হয়েছিল তিনি ছিলেন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম।

এ বর্ণনার বিভিন্নতার ফলে মুসলিম আলেমণের একটি দল পূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে হযরত ইসহাকের পক্ষে রায় দিয়েছেন। যেমন ইবনে জারীর ও কাযী ঈয়ায। অনেকে চূড়ান্তভাবে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, হযরত ইসমাঈলকেই যবেহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেমন ইবনে কাসীর। আবার কেউ কেউ সংশয়াপন্ন। যেমন জালালুদ্দীন সুয়ূতী। কিন্তু গবেষণা ও অনুসন্ধানের দৃষ্টিতে বিচার করলে একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইসমাঈলকেই যবেহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর সপক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তি রয়েছেঃ

একঃ ওপরে কুরআন মজীদের এ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে যে, স্বদেশ থেকে হিজরাত করার সময় হযরত ইবরাহীম (আ) একটি সৎকমশীল পুত্রের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। এর জবাবে আল্লাহ‌ তাঁর একটি ধৈর্যশীল সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ পরিষ্কার একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, এ দোয়া ঠিক তখন করা হয়েছিল যখন তিনি ছিলেন সন্তানহীন। আর যে সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল সেটি ছিল তাঁর প্রথম সন্তান। তারপর কুরআনের বক্তব্যের ধারাবহিক বর্ণনা থেকে একথাও প্রকাশ হয় যে, সে শিশুটিই যখন পিতার সাথে দৌড় ঝাঁপ করার যোগ্য হয়ে গেলো তখন তাকে যবেহ করার ইশারা করা হলো। এখন একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত যে, হযরত ইবরাহীমের (আ) প্রথম সন্তান ছিলেন হযরত ইসমাঈল। হযরত ইসহাক প্রথম সন্তান ছিলেন না কুরআনে হযরত ইবরাহীমের সন্তানের ধারাবাহিকতার বর্ণনা এভাবে দেয়া হয়েছেঃ

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ (ابراهيم: 39)

দুইঃ কুরআন মজীদে যেখানে হযরত ইসহাকের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে সেখানে তাঁর জন্য “গোলামুন আলীমন” (জ্ঞানবান বালক) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছেঃ وَبَشَّرُوهُ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ (الذاريات: 28) এবং لَا تَوْجَلْ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ (الحجر: 53) কিন্তু এখানে যে সন্তানটির সুসংবাদ দেয়া হয়েছে তাঁর জন্য “গোলামুন হালীমুন” (ধৈর্যশীল বালক) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, দুই পুত্রের দু’টি পৃথক বৈশিষ্ট্য ছিল এবং যবেহ করার হুকুমটি জ্ঞানবান সন্তানের জন্য ছিল না, ছিল ধৈর্যশীল সন্তানের জন্য।

তিনঃ কুরআন মজীদে হযরত ইসহাকের সুসংবাদ দেবার সাথে সাথেই এ সুসংবাদও দেয়া হয়েছিল যে, তাঁর গৃহে ইয়াকুবের মতো পুত্র সন্তান জন্ম নেবেঃ فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ (هود : 71) এখন একথা পরিষ্কার যে, সন্তান জন্মের খবর দেবার সাথে সাথেই তাঁর ওখানে একটি সুযোগ্য পুত্র সন্তান জন্মেরও খবর দেয়া হয়ে গিয়ে থাকে, তার ব্যাপারে যদি হযরত ইবরাহীমকে এ স্বপ্ন দেখানো হয় যে, তিনি তাকে যবেহ করছেন, তাহলে হযরত ইবরাহীম কখনো একথা বুঝতে পারতেন না যে, তাঁর এ পুত্রকে কুরবানী করে দেবার ইঙ্গিত করা হচ্ছে। আল্লামা ইবনে জারীর এ যুক্তিটির জবাবে বলেন, সম্ভবত এ স্বপ্নটি হযরত ইবরাহীমকে এমন এক সময় দেখানো হয় যখন হযরত ইসহাকের গৃহে হযরত ইয়াকুবের জন্ম হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে এটি ঐ যুক্তির একটি অত্যন্ত দুর্বল জবাব। কুরআন মজীদের শব্দ হচ্ছেঃ “যখন ছেলেটি বাপের সাথে দৌড় ঝাঁপ করার যোগ্য হয়ে গেলো” ঠিক এ সময়ই এ স্বপ্নটি দেখানো হয়েছিল। যে ব্যক্তি মুক্ত মনে এ শব্দগুলো পড়বে তার সামনে ভেসে উঠবে আট দশ বছরের একটি ছেলের ছবি। কোন জোয়ান ব্যক্তি যিনি সন্তানের পিতা তাঁর সম্পর্কে একথা বলা হয়েছে বলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।

চারঃ কুরআনে আল্লাহ‌ সমস্ত কাহিনী বর্ণণা করার পর শেষে বলছেন, “আমি তাঁকে ইসহাকের সুসংবাদ দিয়েছি, সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে একজন নবী।” এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, যে পুত্রকে যবেহ করার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল, এটি সে পুত্র নয়। বরং পূর্বে অন্য কোন পুত্রের সুসংবাদ দেয়া হয়। তারপর যখন সে পিতার সাথে দৌড়াদৌড়ি ও চলাফেরা করার যোগ্যতা অর্জন করে তখনই তাকে যবেহ করার হুকুম হয়। তারপর যখন হযরত ইবরাহীম এ পরীক্ষায় সফলকাম হয়ে যান তখন তাঁকে আর এক সন্তান অর্থাৎ ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের সুসংবাদ দেয়া হয়। ঘটনার এ বিন্যাস চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দান করে যে, যে পুত্রটিকে যবেহ করার হুকুম হয়েছিল তিনি হযরত ইসহাক ছিলেন না। বরং তাঁর কয়েক বছর আগে সে পুত্রের জন্ম হয়েছিল। আল্লামা ইবনে জারীর এ সুস্পষ্ট যুক্তিটি এ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, প্রথমে কেবলমাত্র হযরত ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল, তারপর যখন তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন তখন তাঁর নবী হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হলো কিন্তু এটি তাঁর প্রথম জবাবটি থেকেও দুর্বলতর। সত্যই যদি ব্যাপার এটাই হতো, তাহলে আল্লাহ‌ এভাবে বলতেন নাঃ “আমি তাঁকে ইসহাকের সুসংবাদ দেই, সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে একজন নবী।” বরং তিনি বলতেন, আমি তাকে এ সুসংবাদ দেই যে, তোমার এ পুত্র একজন নবী হবেন সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে।

পাঁচঃ নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে প্রমাণিত যে, হযরত ইসমাঈলের বিনিময়ে যে ভেড়াটি যবেহ করা হয়েছিল তার শিং কা’বা ঘরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরের (রা.) যামানা পর্যন্ত সংরক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ যখন হরম শরীফে ইবনে যুবাইরকে (রা.) অবরোধ করে এবং কা’বা ঘর ভেঙে ফেলে তখন এ শিংও নষ্ট হয়ে যায়। ইবনে আব্বাস ও আমের শা’বী উভয়ই এ মর্মে সাক্ষ্য দেন যে, তারা নিজেরা কা’বা ঘরে এ শিং দেখেছিলেন (ইবনে কাসীর), এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরবানীর এ ঘটনা সিরিয়ায় নয়, মক্কা মু’আযযমায় সংঘটিত হয়েছিল এবং হযরত ইসমাঈলের সাথেই ঘটেছিল। তাইতো হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের নির্মিত কা’বা ঘরে তার স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল।

ছয়ঃ শত শত বছর থেকে আরবীয় বর্ণনাসমূহে ও কিংবদন্তীতে একথা সংরক্ষিত ছিল যে, কুরবানীর এ ঘটনা ঘটেছিল মিনায়। আর এটা শুধুমাত্র কিংবদন্তীই ছিল না বরং সে সময় থেকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানা পর্যন্ত হজ্জের কর্মকাণ্ডের মধ্যে এ কাজটিও নিয়মিতভাবে শামিল হয়ে আসছিল যে, এ মিনা নামক স্থানে যেখানে হযরত ইবরাহীম কুরবানী করেছিলেন প্রত্যেক ব্যক্তি সেখানে গিয়ে পশু কুরবানী করতো। তারপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন হলো তখন তিনিও এ পদ্ধতি অব্যাহত রাখেন। এমন কি আজো হজ্জের সময় যিলহজ্জের দশ তারিখে মিনায় কুরবানী করা হয়। সাড়ে চার হাজার বছরের এ অবিচ্ছিন্ন কার্যক্রম একথার অনস্বীকার্য প্রমাণ পেশ করে যে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এ কুরবানীর উত্তরাধিকারী ছিল বনী ইসমাঈল, বনী ইসহাক নয়। হযরত ইসহাকের বংশে এ ধরনের কোন রেওয়াজ কোন দিন জারি থাকেনি, যাতে সমস্ত জাতির একসাথে কুরবানী করতো এবং তাকে হযরত ইবরাহীমের কুরবানীর স্মৃতি বলা হতো।

এগুলো এমন ধরনের যুক্তি যেগুলো সামনে রাখার পর একথা বিস্ময়কর মনে হচ্ছে যে, স্বয়ং উম্মতে মুসলিমার মধ্যে হযরত ইসহাকের আল্লাহর জন্য কুরবানী হবার ধারণা কেমন করে বিস্তার লাভ করলো। ইহুদীরা যদি হযরত ইসমাঈলকে এ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে তাদের দাদা হযরত ইসহাকের সাথে একে সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টা করে, তাহলে এটি একটি বোধগম্য বিষয় হয় কিন্তু মুসলমানদের একটি বিরাট দল তাদের এ প্রতারণা গ্রহন করলো কেমন করে? এ প্রশ্নের অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী জবাব দিয়েছেন আল্লামা ইবনে কাসীর তাঁর তাফসীর গ্রন্থে। তিনি বলেনঃ “প্রকৃত ব্যাপার তো আল্লাহই জানেন। তবে বাহ্যত মনে হয়, এ সমস্ত উক্তি (হযরত ইসহাকের আল্লাহর জন্য কুরবানী হবার পক্ষে যেগুলো বলা হয়েছে) কা’ব আহবার থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি যখন হযরত উমরের (রা.) আমলে মুসলমান হন তখন মাঝে মধ্যে ইহুদী ও খৃস্টানদের প্রাচীন কিতাবসমূহের বাণী তাঁদেরকে পড়ে শুনাতেন এবং হযরত উমর (রা.) সেসব শুনতেন। এ কারণে অন্য লোকেরাও তাঁর কথা শুনতে শুরু করে এবং তিনি যেসব ভালো-মন্দ বর্ণনা করতেন সেগুলো তারা বর্ণনা করতে শুরু করে। অথচ এ উম্মতের জন্য তাঁর এ তথ্য সম্ভারের মধ্য থেকে কোন জিনিসেরই প্রয়োজন ছিল না।”

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরাযীর একটি রেওয়ায়াত এ প্রশ্নটির ওপর আরো কিছুটা আলোকপাত করে। তিনি বর্ণনা করেন, একবার আমার উপস্থিতিতে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের (র) সামনে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, আল্লাহর জন্য যবেহ করা হয়েছিল কাকে, হযরত ইসহাককে না হযরত ইসমাঈলকে? সে সময় এমন এক ব্যক্তিও মজলিসে হাজির ছিলেন যিনি পূর্বে ইহুদী আলেমদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং পরে সাচ্চা দিলে মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি বলেন, “হে আমীরুল মু’মেনীন! আল্লাহর কসম, তিনি ইসমাঈল ছিলেন। ইহুদীরা একথা জানে কিন্তু আরবদের প্রতি হিংসাবশত তারা দাবী করে যে, হযরত ইসহাককে আল্লাহর জন্য যবেহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। (ইবনে জারীর) এ দু’টি কথাকে মিলিয়ে দেখলে জানা যায়, আসলে এটা ছিল ইহুদী প্রচারণার প্রভাব এবং মুসলমানদের মধ্যে এ প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। আর মুসলমানরা যেহেতু তাত্বিক বিষয়ে সবসময় বিদ্বেষ ও স্বার্থপ্রীতি মুক্ত থেকেছে তাই তাদের অনেকেই প্রাচীন সহীফাগুলোর বরাত দিয়ে ঐতিহাসিক বর্ণনার ছদ্মবরণে ইহুদীরা যেসব বর্ণনা পেশ করতো সেগুলোকে নিছক একটি তাত্বিক সত্য মনে করে গ্রহণ করে নেয় এবং একথা চিন্তা করেনি যে, এর মধ্যে তত্বের পরিবর্তে বিদ্বেষ ও স্বার্থপ্রীতি সক্রিয় রয়েছে।
# যে উদ্দেশ্যে হযরত ইবরাহীমের কুরবনীর কাহিনী এখানে বর্ণনা করা হয়েছে এ বাক্যটি তার সমগ্র অবয়বের ওপর আলোকপাত করে। হযরত ইবরাহীমের দুই পুত্রের বংশ থেকে দু’টি সুবিশাল জাতির সৃষ্টির হয়। একটি বনী ইসরাঈল জাতি। তাদের মধ্যে জন্ম হয় দুনিয়ার দু’টি বড় ধর্মমত (ইহুদীবাদ ও খৃস্টবাদ)। তারা পৃথিবীর অনেক বড় ও বিস্তৃত অংশকে নিজেদের অনুসারী করে। দ্বিতীয়টি বনী ইসমাঈল জাতি। কুরআন নাযিলের সময় তারা ছিল সমগ্র আরববাসীর নেতা ও অনুসরণযোগ্য। সে সময় মক্কা মু’আযযমার কুরাইশ গোত্র তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী ছিল। ইবরাহীমী বংশধারার এ দু’টি শাখা যে উন্নতি, বিস্তৃতি ও খ্যাতি অর্জন করে তা সম্ভব হয় হযরত ইবরাহীম ও তাঁর দুই মহান মর্যাদা সম্পন্ন পুত্রের সাথে তাদের রক্ত সম্পর্কের কারণে। নয়তো দেখা যায়, দুনিয়ায় এমন কত শত পরিবারের উদ্ভব হয়েছে এবং কালক্রমে অপরিচিতর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন মহান আল্লাহ‌ এ পরিবারের ইতিহাসের সবচেয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল কর্মকাণ্ড বর্ণনা করার পর এ উভয় দলকে এ অনুভূতি দান করেছেন যে, তোমরা দুনিয়ায় যা কিছু মর্যাদা লাভ করেছো, এসবের মূলে রয়েছে তোমাদের বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক আলাইহিমুস সালাম প্রতিষ্ঠিত আল্লাহর আনুগত্য, নিঃস্বার্থ আন্তরিকতা ও আল্লাহর হুকুমের জন্য উৎসর্গিত প্রাণের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। তিনি তাদেরকে বলেন, আমি তাদেরকে যে বরকত ও সমৃদ্ধি দান করেছিলাম এবং নিজের দয়া ও অনুগ্রহের যে বারিধারা তাদের প্রতি বর্ষণ করেছিলাম তা চোখ বন্ধ করে বর্ষণ করিনি। আমি সহসাই কোন কারণ ছাড়াই এক ব্যক্তি ও তাঁর দুই পুত্রকে বাছাই করে তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও দাক্ষিণ্যের ঝরণাধারা প্রবাহিত করিনি। বরং তাঁরা নিজেদের প্রকৃত মালিক ও প্রভুর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার কিছু প্রমাণ পেশ করেছিলেন এবং তারই ভিত্তিতে এসব অনুগ্রহের হকদার হয়েছিলেন। এখন তোমরা নিছক তাদের আওলাদ ও অহংকারের ভিত্তিতে সেসব অনুগ্রহ ও নিয়ামতের হকদার হতে পারো না। আমি তো অবশ্যই দেখবো, তোমাদের মধ্যে কে সৎকর্মশীল এবং কে জালেম ও পাপাচারী। তারপর যে যেমনটি হবে তার সাথে ঠিক তেমনি ধরনেরই ব্যবহার করা হবে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৭৫-৮২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আঃ)-কে সাড়ে নয়শত বছর বয়স দিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রথম রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন। তিনি এক পুরুষের পর দ্বিতীয় পুরুষকে অতঃপর তৃতীয় পুরুষকে শুধু এই আশায় দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন যে, তারা ঈমান আনবে। কিন্তু শতাব্দির পর শতাব্দি অক্লান্তভাবে দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও তারা ঈমান আনেনি। মূলত এ সময় নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় জনবল ও অর্থবলে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সংখ্যাধিক্যের কারণে ইরাকের ভূখণ্ড ও পাহাড়েও তাদের আবাস সংকুলান হচ্ছিল না। তারা নূহ (আঃ)-এর দাওয়াতকে তাচ্ছিল্য ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। নূহ (আঃ) তাদেরকে দিবারাত্রি দাওয়াত দেন। কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে অর্থাৎ সকল পন্থা অবলম্বন করে তিনি নিজ কওমকে দীনের পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এই সুদীর্ঘ দাওয়াতী যিন্দেগীতে তিনি যেমন কখনো চেষ্টায় ক্ষান্ত হননি, তেমনি কখনো নিরাশও হননি। সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানাবিধ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েও তিনি সবর করেছেন। অবশেষে কওমের লোকেরা যখন তাকে সাধারণ মানুষ, হীন ও কম বুদ্ধির লোক, পদ লোভী ও বাপ-দাদার রীতি বিরোধী ইত্যাদি বলে প্রত্যাখ্যান করল তখন নূহ (আঃ) আল্লাহ তা‘আলাকে আহ্বান করলে আল্লাহ তা‘আলা তার আহবানে সাড়া দেন এবং কওমের অপরাধের কারণে সর্বগ্রাসী মহাপ্লাবনের গযবে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেন। নূহ (আঃ) ও যারা তার প্রতি ঈমান এনেছিল তাদেরকে গযব থেকে রক্ষা করেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত সূরা হূদের ২৫-৪৭ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মু’মিন ব্যক্তিদের মর্যাদা ও কাফিরদের কঠোর শাস্তির কথা জানতে পারলাম।
২. সৎ কর্মের প্রতিদান সর্বদা ভাল আর মন্দ কর্মের প্রতিদান সর্বদা মন্দই হয়ে থাকে।
৩. যারা আল্লাহর পথে অবিচল ও অটল থাকে তাদেরকে আল্লাহ বিপদ থেকে নাজাত দেন।
৮৩-৯৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় বান্দা ও বন্ধু ইব্রাহীম (আঃ) কর্তৃক তাঁর পিতা ও সম্প্রদায়ের কাছে দা‘ওয়াত এবং তাদের প্রতিমাগুলোকে ভাঙ্গার ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর পিতাকে যেভাবে দা‘ওয়াত দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে সূরা মারইয়াম-সহ অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।

شِيْعَة এর অর্থ দল, স্বমতাবলম্বী ও অনুসরণকারী। অর্থাৎ ইবরাহীম (আঃ) দীনদার ও তাওহীদবাদীদের সে দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা নূহ (আঃ)-এর মতই আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের বিশেষ তাওফীক পেয়েছিলেন।

ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পিতা ও জাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন; তোমরা কিসের ইবাদত করছ? নিজেরা মূর্তি তৈরি করে তাকেই মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছ? এরা তো প্রকৃতপক্ষে ইবাদতের যোগ্য নয়। তোমরা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে কী ধারণা কর? তিনি কি কোন অংশীর মুখাপেক্ষী, যে তার জন্য তোমরা তাঁর অংশী স্থাপন করছ। এরপর ইবরাহীম (আঃ) একটা সুযোগ খুঁজছিলেন- কিভাবে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে, তারা যাদের ইবাদত করছে আসলে তাদের কোনই ক্ষমতা নেই। এমতাবস্থায় যখন তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের জাতীয় উৎসব ও খুশির দিনে তাঁকে (মেলায়) নিয়ে যাবার কথা বলেছিল তখন তিনি তাদের সাথে বের হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন- আমি অসুস্থ। আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন চিন্তা-ভাবনা করার জন্য অথবা তারা তারকারাজির পরিভ্রমণকে প্রভাবশালী মনে করত, তাদেরকে ভুল ধারণা দেয়ার জন্য। এখানে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ না থাকলেও মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। যার ফলে তিনি এ কথা বলেছেন। মূলত এটা মিথ্যা ছিল না। তিনি এখানে অসুস্থ বলে অন্যটি উদ্দেশ্য নিয়েছেন। অবশেষে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁকে রেখে মেলায় চলে গেল। এ সুযোগে তিনি তাদের দেব-দেবীর ঘরে প্রবেশ করে তাদের মূর্তিগুলোকে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন। এ সম্পর্কে সূরা ‘আম্বিয়া-’র ৫১-৭০ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ইসলামের দিকে মানুষকে সুন্দরভাবে হিকমতের সাথে আহ্বান করা উচিত। যেমন ইবরাহীম (আঃ) তার পিতা ও জাতিকে আহ্বান করেছিলেন।
৯৯-১১৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ইব্রাহীম (আঃ)-এর হিজরত ও তাকে সৎ সন্তান ইসমা‘ঈল (আঃ)-কে দেয়ার পর যে পরীক্ষা করেছিলেন সে-কথা ব্যক্ত করেছেন। ইব্রাহীম (আঃ) যখন দেখলেন যে, তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা সত্য গ্রহণ করছে না বিধায় তিনি সেখান থেকে হিজরত করলেন।

তখন ইবরাহীম (আঃ)-এর বয়স ৮৬ বছর, স্ত্রী হাজেরার বয়স ৭৬ বছর। (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/১৭৯) বৈবাহিক জীবনে তখনো কোন সন্তান হয়নি। নিঃসন্তান ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করলেন, হে আল্লাহ আমাকে সৎ কর্মশীল সন্তান দান করুন। আল্লাহ তাঁর দু‘আ কবূল করে একজন ধৈর্যশীল সন্তান দান করলেন। এ ধৈর্যশীল সন্তানই ছিলেন ইসমাঈল (আঃ), এতে কোন মতভেদ নেই। কেননা এ ধৈর্যশীল সন্তানের সাথে ইবরাহীম (আঃ)-এর কুরবানীর ঘটনা বর্ণনার পরে ১১২ নম্বর আয়াতে ইসহাক (আঃ)-এর সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। উক্ত আয়াতগুলোর বর্ণনা পরম্পরায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, প্রথম সুসংবাদপ্রাপ্ত সন্তানটি ছিলেন ইসমাঈল, যাকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। অতঃপর সুসংবাদপ্রাপ্ত দ্বিতীয় সন্তানটি ছিলেন ইসহাক। যেমন ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দু‘আ করেন,

(اَلْحَمْدُ لِلہِ الَّذِیْ وَھَبَ لِیْ عَلَی الْکِبَرِ اِسْمٰعِیْلَ وَاِسْحٰقَﺚ اِنَّ رَبِّیْ لَسَمِیْعُ الدُّعَا۬ئِ)

“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইস্মা‘ঈল ও ইস্হাককে দান করেছেন। আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনে থাকেন।” (সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৩৯) অত্র আয়াতে ইসমাঈলের পরে ইসহাকের কথা উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া সূরা বাকারার ১৩৩, ৩৬, ৪০; সূরা আলি ইমরানের ৮৪, নিসার ১৬৩, ইবরাহীমের ৩৯ আয়াতগুলোতে সর্বত্র ইসমাঈলের পরেই ইসহাকের আলোচনা এসেছে। উপরোক্ত আলোচনায় একথা স্পষ্ট হয় যে, ইসমাঈল (আঃ) ইসহাক থেকে বয়সে বড় এবং তাঁকে জবাই করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল।

জাবীহ (যাকে জবেহ করতে যাওয়া হয়েছিল তিনি) কে ছিলেন- ইসমাঈল (আঃ)-না ইসহাক (আঃ)? এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতভেদ থাকলেও সঠিক কথা হল ইসমাঈল (আঃ)-কে জবেহ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

(فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ)

অর্থাৎ যখন চলাফেরা করার মত বয়স হল যেমন তের বা চৌদ্দ বছর বা কাছাকাছি তখন আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্নের মাধ্যমে ইবরাহীম (আঃ)-কে জানিয়ে দিলেন যে, তুমি তোমার সন্তানকে কুরবানী কর। বৃদ্ধ বয়সে একটি সন্তান পেলেন তাও কুরবানী করার আদেশ চলে এসেছে। নাবীদের স্বপ্ন ওয়াহী, তাই পালন করতেই হবে। সে জন্য তিনি সন্তানের কাছে তাঁর স্বপ্নের কথা তুলে ধরে বলেন : আমি স্বপ্নে দেখলাম তোমাকে জবাই করছি, তোমার মতামত কী? পুত্র অত্যন্ত ধৈর্যশীল, তাই বাবার মত ছেলে জবাব দিয়ে বলল : আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা পালন করুন, ইনশা আল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।

(وَتَلَّه۫ لِلْجَبِيْنِ) মানুষের মুখমন্ডলের ডানে ও বামে দুই পার্শ্ব থাকে এবং মাঝে থাকে جبهة বা কপাল। অতএব আয়াতের সঠিক অর্থ হবে; কাত করে শায়িত করল, অর্থাৎ এমনভাবে কাত করে শুইয়ে দিলেন যেমন পশুকে জবেহ করার সময় কিবলামুখী করে কাত করা হয়। বলা হয় এভাবে শোয়ানোর কারণ হল ইসমাঈল (আঃ) নিজেই কাত করে শোয়ানোর জন্য বলেছিলেন। যাতে তাঁর মুখমন্ডল পিতার সামনে না থাকে এবং পিতৃস্নেহ আল্লাহ তা‘আলার আদেশের ওপর প্রাধান্য পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। এসব কথা ভিত্তিহীন, কারণ নবীদের জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালনে অন্য কোন বিষয় প্রাধান্য পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

(قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيا)

অর্থাৎ হে ইবরাহীম! মনের পরিপূর্ণ ইচ্ছার সাথে সন্তানকে জবেহ করার উদ্দেশ্যে মাটির ওপর শুইয়ে দেয়াতেই তুমি নিজ স্বপ্নকে বাস্তব করে দেখালে, আর স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহ তা‘আলার আদেশের তুলনায় তোমার নিকট কোন বস্তুই প্রিয় নয় এমনকি নিজের একটি মাত্র পুত্র সন্তানও নয়।

(إِنَّ هٰذَا) অর্থাৎ স্নেহভাজন একমাত্র সন্তানকে জবেহ করার আদেশ পালন করা একটি বড় পরীক্ষা ছিল, যাতে তুমি সফল হয়েছ।

(بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ) জবেহযোগ্য মহান বস্তু একটি দুম্বা ছিল, যা আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত থেকে জিবরীল (আঃ) মারফত পাঠিয়েছিলেন। (ইবনু কাসীর) ইসমাঈল (আঃ)-এর পরিবর্তে সেই দুম্বাটি জবেহ করা হয়েছিল।

(وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْا۬خِرِيْنَ)

অর্থাৎ ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্ত সুন্নতকে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের পথ ও ঈদুল আযহার দিনে সব থেকে পছন্দনীয় আমল বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

(وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا) অর্থাৎ তাদের উভয়ের বংশ বিস্তার করেছিলাম। অধিকাংশ নাবী ও রাসূলদের আগমন তাঁদের বংশেই হয়েছে। ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ছিলেন ইয়া‘কূক (আঃ), যার বারটি সন্তান থেকে বানী ইসরাঈলের বারটি গোত্র সৃষ্টি হয়েছিল, তাদের বংশ থেকেই বানী ইসরাঈল জাতি বিস্তার লাভ করে এবং অধিকাংশ নাবী তাদের মধ্য থেকেই আগমন করেন। ইসমাঈল (আঃ) থেকে আরবদের বংশ বিস্তার হয় এবং তাদের মধ্য হতে শেষ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমন ঘটে।

(وَّظٰلِمٌ لِّنَفْسِه۪ مُبِيْنٌ)

অর্থাৎ তারা শির্ক, পাপাচার অন্যায়-অবিচার ও বেহায়পনায় লিপ্ত ছিল। ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরে বরকত থাকা সত্ত্বেও এখানে তাদের মধ্যে সৎ কর্মপরায়ণ ও অত্যাচারী বলে ইঙ্গিত করেছেন যে, মর্যাদাসম্পন্ন বাপদাদা ও বংশের সম্পর্কের আল্লাহর কাছে কোন মূল্য নেই, যদি ঈমান ও নেক আমল না থাকে। ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানরা যদিও ইসহাক (আঃ)-এর সন্তান, অনুরূপ আরবের মুশরিকরা ইসমাঈল (আঃ)-এর সন্তান, কিন্তু তাদের আমল যেহেতু স্পষ্ট ভ্রষ্টতা বা শির্ক ও অবাধ্যতার ওপর ছিল সেহেতু উচ্চ বংশ-মর্যাদা তাদের আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত করতে পারবে না।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ

যার আমল তাকে পিছে ফেলে দিয়েছে বংশনামা তাকে আগে নিয়ে যেতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম হা. ৭০১৮)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সন্তান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তাই তাঁর কাছেই সন্তান প্রার্থনা করতে হবে এবং সৎ-সন্তান কামনা করতে করতে।
২. আল্লাহ তা‘আলার রহমত হতে নিরাশ হওয়া উচিত নয়, তিনি বৃদ্ধ বয়সে ও বন্ধ্যা নারীকেও সন্তান দানে সক্ষম যেমন ইবরাহীম (আঃ)-কে দিয়েছেন।
৩. পিতা-মাতা যেমন হবেন সন্তান তেমন হবে, এটা স্বাভাবিক কথা, তবে ব্যতিক্রমও হতে পারে। তাই পিতা-মাতার দীনদার ও পরহেযগার হওয়া উচিত।
৪. কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তা‘আলার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা এমনকি যদিও নিজের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু দান করেও হয়।
৫. ইবরাহীম (আঃ) কুরবানী করার জন্য ইসমাঈল (আঃ)-কে প্রস্তুত করেছিলেন, ইসহাক (আঃ)-কে নয়।
৬. মর্যাদা ও প্রশংসার মাপকাঠি হল ঈমান ও সৎ আমল, কোন উচ্চ বংশ বা ক্ষমতা নয়।
৭. আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল বান্দারা তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করে থাকেন যেমন ইবরাহীম (আঃ) করেছিলেন।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৭৫-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:

পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে পূর্বযুগের মানুষের পথভ্রষ্টতার কথা সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয়েছে। এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা’আলা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করছেন। হযরত নূহ (আঃ) সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তিনি স্বীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সুদীর্ঘ নয় শত পঞ্চাশ বছর অবস্থান করেছিলেন। তিনি স্বীয় সম্প্রদায়ের লোককে সদা-সর্বদা উপদেশ দিতেন ও বুঝাতেন। এতদসত্ত্বেও তারা পথভ্রষ্টতার মধ্যেই ডুবে ছিল। শুধুমাত্র গুটিকতক লোক তার উপর ঈমান এনেছিল। জাতির যখন এহেন অবস্থা চলতে থাকলো এবং নবী (আঃ)-এর উপর মিথ্যা আরোপ করতে লাগলো তখন হযরত নূহ (আঃ) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা জানালেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমি তো অসহায়, অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন।” তখন আল্লাহর ক্রোধ তাদের উপর পতিত হলো। সমস্ত কাফির পানিতে ডুবে মরলো। এজন্যেই মহান আল্লাহ বলেনঃ নূহ (আঃ) আমাকে আহ্বান করেছিল, আর আমি কত উত্তম সাড়াদানকারী।’ অর্থাৎ আমি তার আহ্বানে উত্তমরূপে সাড়া দিয়েছিলাম। তাকে ও তার পরিবার পরিজনকে বিপদ থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলাম। আর তার বংশধরদেরকেই আমি বিদ্যমান রেখেছি বংশ পরম্পরায়। কেননা, তারাই তো শুধু অবশিষ্ট ছিল। হযরত আলী ইবনে আবি তালহা (রাঃ) বলেন যে, হযরত নূহ (আঃ)-এর সন্তানরা ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ট ছিল না। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, সমগ্র মানব জাতি হযরত নূহ (আঃ)-এর সন্তানদের থেকেই হয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, সাম, হাম ও ইয়াফাসের সন্তানরা দুনিয়াতে বিস্তার লাভ করে ও অবশিষ্ট থাকে। ইমাম আহমাদ (রঃ) তাঁর মুসনাদে বর্ণনা করেছেন যে, সাম সমগ্র আরব জাতির পিতা, হাম সমগ্র হাবশের পিতা এবং ইয়াফাস সমগ্র রোমের পিতা। এই হাদীসে রোম দ্বারা প্রথম রোম অর্থাৎ ইউনানকে বুঝানো হয়েছে যা রোমী লায়তী ইবনে ইউনান ইবনে ইয়াফাস ইবনে নূহ (আঃ)-এর দিকে সমন্ধযুক্ত। হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রঃ) বলেন যে, হযরত নূহ (আঃ)-এর এক পুত্র সামের সন্তান হলো আরব, ফারেস ও রোমীরা। ইয়াফাসের সস্তান হলো তুর্কী, সাকালিয়া এবং ইয়াজুজ ও মাজুজ। আর হামের সন্তান হচ্ছে কিবতী, সুদানী ও বার্বারীরা। হযরত নূহ (আঃ)-এর সততা এবং তাঁর উত্তম স্বরণ আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাঁর পরবর্তী লোকদের মধ্যে অবশিষ্ট থাকে। সমস্ত নবী (আঃ)-এর সত্যবাদিতার ফল এটাই হয় যে, জনগণ সদা-সর্বদা তাদের উপর সালাম পাঠিয়ে থাকেন এবং তাঁদের প্রশংসা করে থাকেন।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “সমগ্র বিশ্বের মধ্যে নূহ (আঃ)-এর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক!’ এটা যেন পূর্ববর্তী বাক্যেরই ব্যাখ্যা। অর্থাৎ তার যিকর উত্তমরূপে অবশিষ্ট থাকার অর্থ এই যে, প্রত্যেক উম্মত তার উপর সালাম বর্ষণ করতে থাকবে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমার নীতি এই যে, যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে আমার ইবাদত ও আনুগত্যে লেগে থাকে, তাকে এই ভাবেই আমি পুরস্কৃত করে থাকি। অর্থাৎ পরবর্তীদের মধ্যে তার উত্তম যিকর সদা-সর্বদার জন্যে বাকী রেখে থাকি।’

আল্লাহ তা’আলার উক্তি:নূহ (আঃ) ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন বিশ্বাসী ও তাওহীদের উপর অটল। তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের পরিণাম ভাল হয়েছিল এবং বিরুদ্ধবাদীদেরকে ধ্বংস ও নিমজ্জিত করে দেয়া হয়েছিল। চোখের পলক ফেলে এমনও একজন তাদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না। এমনকি তাদের কোন চিহ্ন পর্যন্ত বাকী ছিল না। হ্যা, তবে তাদের কলংকময় কার্যকলাপ মানুষের মাঝে প্রাচীন ঘটনা হিসেবে আলোচিত হতে থাকলো।
৮৩-৮৭ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত ইবরাহীম (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর ধর্মমতের উপরই ছিলেন। তিনি তাঁরই রীতি-নীতি ও চাল-চলনের উপর ছিলেন। তিনি তার প্রতিপালকের নিকট হাযির হয়েছিলেন বিশুদ্ধ চিত্তে। অর্থাৎ তিনি একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি আল্লাহকে সত্য বলে বিশ্বাস করতেন। কিয়ামত যে একদিন সংঘটিত হবে তা তিনি স্বীকার করতেন। মৃতকে যে পুনরুজ্জীবিত করা হবে সেটাও তিনি বিশ্বাস করতেন। শিরক ও কুফরীর তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি অপরকে তিরস্কারকারী ছিলেন না।

মহান আল্লাহ বলেন, যখন সে তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে জিজ্ঞেস করেছিলঃ “তোমরা কিসের পূজা করছো?” অর্থাৎ তিনি মূর্তিপূজা ও অন্যান্য দেবদেবীর পূজার বিরোধিতা করলেন এবং সব কিছুকেই ঘৃণার চোখে দেখলেন। এজন্যেই মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা কি তাহলে আল্লাহর পরিবর্তে অসত্য উপাস্য কামনা করছো, অতঃপর বিশ্বপ্রতিপালকের সম্বন্ধে তোমরা কিরূপ ধারণা পোষণ করছো?” অর্থাৎ তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্যদের উপাসনা পরিত্যাগ কর এবং নিজেদের মিথ্যা ও অলীক মা’ৰূদদের ইচ্ছার কথা ছেড়ে দাও। অন্যথায় জেনে রেখো যে, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন।
৮৮-৯৮ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়কে এই কথা এ জন্যেই বললেন যে, যখন তারা তাদের মেলায় বের হয়ে যাবে তখন তিনি যেন শহরে একাই থেকে যেতে পারেন এবং তাদের মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করার সুযোগ পান। এই জন্যে তিনি এমন কথা বললেন যা প্রকৃত প্রস্তাবে সত্য ছিল। তারা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে অসুস্থ ভেবেছিল। তাই তাকে রেখেই তারা বের হয়েছিল। আর এরই মাঝে তিনি দ্বীনী খিদমত করেছিলেন। কাতাদাও (রঃ) বলেন যে, যখন কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তখন আরবীয়রা বলেঃ “তিনি নক্ষত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন।” অর্থ হচ্ছে এই যে, চিন্তিতভাবে নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা এবং অনুধাবন করা যে, কিভাবে ওর প্রভাবমুক্ত হওয়া যাবে?

হযরত ইবরাহীম (আঃ) চিন্তা-ভাবনা করে বললেন যে, তিনি পীড়িত অর্থাৎ দুর্বল। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইবরহীম (আঃ) তিনটি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। এর মধ্যে দু’বার আল্লাহর দ্বীনের জন্যে মিথ্যা বলেছিলেন। যথা (আরবী) (আমি অসুস্থ)। অপর স্থানে বলেছিলেনঃ (আরবী) (২১:৬৩) (বরং তাদের এই বড় প্রতিমাটি এ কাজ করেছে অর্থাৎ মূর্তিগুলো ভেঙ্গেছে)। আর একবার তিনি স্বীয় স্ত্রী হযরত সারাকে তার বোন বলেছিলেন। একথা স্মরণযোগ্য যে, এগুলোর একটিও আসল বা প্রকৃত মিথ্যা ছিল না। এখানে রূপক অর্থে মিথ্যা বলা হয়েছে। সুতরাং তাকে তিরস্কার করা চলবে না। কথার মাঝে কোন শরয়ী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এরূপ বাহানা করা মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত নয়।

হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ঐ তিনটি কথার মধ্যে একটিও এমন ছিল না যার কর্ম-কৌশলের সাথে আল্লাহর দ্বীনের কল্যাণ সাধন উদ্দেশ্য ছিল না।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সুফিয়ান (রঃ) বলেন যে, “আমি অসুস্থ” এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ “আমি প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়েছি।” আর ঐ লোকগুলো এরূপ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি হতে পালিয়ে যেতো। হযরত সাঈদ (রঃ) বলেন যে, আল্লাহর দ্বীন প্রচার এবং তাদের মিথ্যা উপাস্যদের অসারতা প্রমাণের জন্যেই হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর এটা একটি কর্মকৌশল ছিল যে, তিনি নক্ষত্র উদিত হতে দেখে বলেছিলেনঃ “আমি অসুস্থ।” এ কথাও বলা হয়েছে যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ “আমি রোগাক্রান্ত হবো” অর্থাৎ একবার মৃত্যুর রোগ আসবেই। একটা উক্তি এও রয়েছে যে, তার এ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য ছিলঃ “আমার হৃদয় তোমাদের দেব-দেবীর উপাসনা করাতে অসুস্থ।”

হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায় মেলাতে যাচ্ছিল তখন তাকেও তারা তাদের সাথে যেতে বাধ্য করছিল। তখন তিনি “আমি অসুস্থ” একথা বলে সরে পড়েন এবং একটি নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। যখন তারা সবাই মেলায় চলে যায় তখন তিনি অতি সন্তর্পণে তাদের দেবতাগুলোর নিকট গমন করেন এবং বলেনঃ “তোমরা খাদ্য গ্রহণ করছো না কেন?” হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাদের মন্দিরে গিয়ে দেখেন যে, তারা তাদের দেবতাগুলোর সামনে যে নৈবেদ্য বা প্রসাদ রেখেছিল সেগুলো সবই পড়ে রয়েছে। তারা বরকতের আশায় যেসব উৎসর্গ রেখেছিল সেগুলো হতে তাদের দেবতাগুলো কিছুই খায়নি। মন্দিরটি ছিল অত্যন্ত প্রশস্ত ও কারুকার্য খচিত। দরযার নিকটেই এক প্রকাণ্ড মূর্তি ছিল। তার পাশে ছিল অনেকগুলো ছোট ছোট মূর্তি। মন্দিরটি মূর্তিতে পরিপূর্ণ ছিল। তাদের সামনে নানা জাতের উপাদেয় খাদ্য রাখা ছিল। তাদের এ বিশ্বাস ছিল যে, খাদ্যগুলো বরকতময় হবে এবং তারা মেলা হতে ফিরে এসে ওগুলো ভক্ষণ করবে।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) মূর্তিগুলোর মুখ হতে তার কথার কোন জবাব না পেয়ে আবার বললেনঃ “তোমাদের হয়েছে কি, কথা বলছো না কেন?” অতঃপর তিনি তাদের নিকটবর্তী হয়ে ডান হাত দ্বারা তাদেরকে আঘাত করেন। কাতাদা (রঃ) ও জওহারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) তখন মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে ফেলার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন এবং ডান হাত দ্বারা আঘাত করতে শুরু করলেন। কেননা ঐগুলো ছিল খুব শক্ত। তিনি সবগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় মূর্তিটিকে তিনি বহাল রেখে দিলেন, ভেঙ্গে ফেললেন না। যাতে ওর উপরই মন্দ ধারণা জন্মে, যেমন সূরায়ে আম্বিয়ায় বর্ণিত হয়েছে এবং সেখানে এর পূর্ণ তাফসীরও বর্ণনা করা হয়েছে।

মূর্তিপূজকরা মেলা হতে ফিরে এসে যখন তাদের মন্দিরে প্রবেশ করলো তখন দেখলো যে, মূর্তিগুলো ভাঙ্গা অবস্থায় বিশৃংখলভাবে পড়ে রয়েছে। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো মাথা এবং কারো কারো পূর্ণ দেহটিই নেই। তারা বিস্মিত হলো যে, ব্যাপার কি!

মহান আল্লাহর উক্তিঃ “তখন ঐ লোকগুলো তার দিকে ছুটে আসলো।” অর্থাৎ বহু চিন্তা-ভাবনা করে, আলাপ আলোচনা করে তারা বুঝলো যে, হয় না হয় এটা ইবরাহীমেরই (আঃ) কাজ। তাই তারা দ্রুতগতিতে তাঁর দিকে ধাবিত হয়েছিল। এখানে ঘটনাটি সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। সূরায়ে আম্বিয়ায় এটা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাদের সকলকে এক সাথে পেয়ে তাবলীগ করার বড় সুযোগ লাভ করলেন। তিনি তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা নিজেরা যাদেরকে খোদাই করে নির্মাণ কর তাদেরই কি তোমরা পূজা করে থাকো? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমরা যা তৈরী কর সেগুলোকেও।” এই আয়াতে (আরবী) অক্ষরটি সম্ভবতঃ (আরবী) হিসেবে এসেছে এবং এও হতে পারে যে, এটা (আরবী)-এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে প্রথমটিই বেশী সুস্পষ্ট।

হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে মারফু রূপে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ প্রত্যেক শিল্পী ও তার শিল্পকে সৃষ্টি করেন। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) কিতাবু আফআলিল ইবাদ’ এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন) কেউ কেউ এ আয়াতটি (আরবী) এরূপ পড়েছেন।

যেহেতু এমন সুস্পষ্ট উক্তির উত্তর তাদের নিকট ছিল না সেই হেতু তারা নবী (আঃ)-এর শত্রুতায় উঠে পড়ে লেগে গেল। তারা বললোঃ “তার জন্যে একটি ইমারত (চতুর্দিকে পাকা প্রাচীরযুক্ত ইমারত যাতে অগ্নি প্রজ্বলিত করা হয়েছিল) তৈরী কর, অতঃপর তাকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ কর।” মহান আল্লাহ স্বীয় বন্ধুকে এই জ্বলন্ত অগ্নি হতে রক্ষা করেন। তাঁকেই তিনি বিজয় মাল্যে ভূষিত করেন ও সাহায্য দান করেন। আর তাদেরকে করেন অতিশয় হেয় ও অপমানিত। এর পূর্ণ বর্ণনা ও পুরোপুরি তাফসীর সূরায়ে আম্বিয়ায় গত হয়েছে। এ জন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদেরকে অতিশয় হেয় করে দিলাম।”
৯৯-১১৩ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা সংবাদ প্রদান করছেন যে, যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়ের ঈমান আনয়ন হতে নিরাশ হয়ে গেলেন, কারণ তারা আল্লাহর ক্ষমতা প্রকাশক বহু নিদর্শন দেখার পরও ঈমান আনলো না, তখন তিনি সেখান থেকে হিজরত করে অন্যত্র চলে যেতে ইচ্ছা করে প্রকাশ্যভাবে তাদেরকে বললেনঃ “আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চললাম। তিনি অবশ্যই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন। আর তিনি প্রার্থনা করলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন!” অর্থাৎ ঐ সন্তান যেন একত্ববাদে তাঁর সঙ্গী হয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।” ইনিই ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রথম সন্তান। বিশ্ব মুসলিম এর ঐকমত্যে তিনি হযরত ইসহাক (আঃ)-এর বড় ছিলেন। একথা আহলে কিতাবও মেনে থাকে। এমনকি তাদের কিতাবেও লিখিত আছে যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর জন্মের সময়। হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বয়স ছিল ছিয়াশি বছর। আর হযরত ইসহাক (আঃ)-এর যখন জন্ম হয় তখন হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বয়স নিরানব্বই বছরে পৌঁছেছিল। তাদেরই গ্রন্থে একথাও লিখিত রয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে তার একমাত্র সন্তানকে কুরবানী করার হুকুম হয়েছিল। কিন্তু ইয়াহুদীরা হযরত ইসহাক (আঃ)-এর বংশধর এবং আরবরা হলো হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর, শুধু এই কারণেই তারা কুরবানীর মর্যাদা হযরত ইসমাঈল (আঃ) হতে সরিয়ে হযরত ইসহাক (আঃ)-কে প্রদান করেছে। আর অনর্থক ব্যাখ্যা করে আল্লাহর বাণীর পরিবর্তন সাধন করেছে। তারা একথাও বলেছেঃ “আমাদের কিতাবে (আরবী) শব্দ রয়েছে, যার অর্থ একমাত্র সন্তান নয়, বরং এর অর্থ হলোঃ “যে তোমার নিকট বর্তমানে একাকী রয়েছে। এটা এজন্যেই যে, ঐ সময় হযরত ইসমাঈল (আঃ) মক্কায় তাঁর মায়ের কাছে ছিলেন এবং হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট শুধুমাত্র হযরত ইসহাক (আঃ) ছিলেন।

কিন্তু এটা সম্পূর্ণরূপে ভুল কথা। কেননা, ওকেই বলে যে একমাত্র সন্তান, যার আর কোন ভাই নেই। আর একথাও সত্য যে, যার একটি মাত্র সন্তান, আর তার পরে কোন সন্তান নেই তার প্রতি স্বাভাবিকভাবে মমতা বেশীই হয়ে থাকে। এজন্যে তাকে কুরবানী করার আদেশ দান পরীক্ষা করার একটি বিরাট হাতিয়ার। পূর্বযুগীয় কতক গুরুজন এমনকি কতক সাহাবীও (রাঃ) যে এ মত পোষণ করতেন যে, যাবীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসহাক (আঃ), এটা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু এটা আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সঃ)-এর সুন্নাত সম্মত নয়। বরং এরূপ ধারণা করা যায় যে, তাঁরা বানী ইসরাঈলের কথাকে বিনা প্রমাণেই মেনে নিয়েছেন, এর পিছনে কোন যুক্তি তাঁরা অন্বেষণ করেননি। আমরা আল্লাহর কালাম দ্বারাই প্রমাণ করবো যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন যাবীহুল্লাহ। সুসংবাদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী) অর্থাৎ সহনশীল সন্তান। অতঃপর কুরবানীর উল্লেখ রয়েছে। এসব বর্ণনা সমাপ্ত করার পর সৎ নবী হযরত ইসহাক (আঃ)-এর জন্মের সুসংবাদ রয়েছে এবং তাঁর সম্পর্কে ফেরেশতারা (আরবী) বা বিজ্ঞ সন্তান বলেছেন। তারপর তার সুসংবাদের সাথে ইরশাদ হয়েছেঃ (আরবী) (১১:৭১) অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জীবদ্দশাতেই হযরত ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র হযরত ইয়াকূব (আঃ) জন্মগ্রহণ করবেন। আর এভাবেই তাঁর বংশ বৃদ্ধির সংবাদ প্রথমেই জানানো হয়। তাহলে তাঁকে যবেহ করার আদেশ কি প্রকারে সম্ভব হতে পারে? এটা আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। অবশ্য এখানে হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে ধৈর্যশীল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং তা যবেহ করার কাজের সাথে অতি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এখন হযরত ইসমাঈল (আঃ) বড় হলেন। এখন তিনি পিতার সাথে চলাফেরা করতে পারেন। ঐ সময় তিনি তাঁর মাতার সাথে ফারান নামক এলাকায় থাকতেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রায়ই সেখানে যাতায়াত করতেন। এ কথাও বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) তথায় বুরাক নামক যানে যাওয়া আসা করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলৈনঃ এই বাক্যের অর্থ এও হতে পারে যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) ঐ সময় প্রায় যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন এবং পিতার ন্যায় চলাফেরা করা ও কাজকর্ম করার যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। তখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি তাঁর প্রিয় সন্তানকে কুরবানী করছেন। হযরত উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রাঃ) বলেন যে, নবীদের স্বপ্ন হলো অহী। অতঃপর তিনি। (আরবী)-এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। একটি মার’ হাদীসেও এটা রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঘুমে নবীদের (আঃ) স্বপ্ন হলো অহী।” (এহানসটি মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে)

আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় সন্তানের পরীক্ষার জন্যে এবং এজন্যেও যে, হঠাৎ কুরবানীর কথা শুনে তিনি যেন হতবুদ্ধি না হয়ে পড়েন, নিজের মত ও সত্য স্বপ্ন তার সামনে প্রকাশ করলেন। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান উত্তর দিলেনঃ “পিতঃ! বিলম্ব করছেন কেন? একথা কি জিজ্ঞেস করতে হয়? যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন তা সত্বর করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আমি ধৈর্যধারণের মাধ্যমে আপনার বাসনা চরিতার্থ করবো।” তিনি যা বললেন তাই করে দেখালেন এবং তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী রূপে প্রমাণিত হলেন। এজন্যেই আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “স্মরণ কর এই কিতাবে উল্লিখিত ইসমাঈল (আঃ)-এর কথা, সে ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী, এবং সে ছিল রাসূল, নবী। সে তার পরিজনবর্গকে নামায ও যাকাতের নির্দেশ দিতো এবং সে ছিল তার প্রতিপালকের সন্তোষজন।”(১৯:৫৪-৫৫)

পিতা-পুত্র উভয়ে যখন একমত হলেন তখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে মাটিতে কাত করে শায়িত করলেন বা অধোমুখে মাটিতে ফেলে দিলেন, যাতে যবেহ করার সময় প্রাণপ্রিয় সন্তানের মুখমণ্ডল দেখে মায়ার উদ্রেক না হয়। মুসনাদে আহমাদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে একট বর্ণনা রয়েছে যে, যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় সন্তানকে যবেহ করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন শয়তান সামনে এসে হাযির হলো। কিন্তু তিনি শয়তানকে পিছনে ফেলে অগ্রসর হলেন। অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) সহ, জামরায়ে অকাবায় উপস্থিত হলেন। এখানেও শয়তান সামনে আসলে তার দিকে তিনি সাতটি কংকর নিক্ষেপ করলেন। তারপর তিনি জামরায়ে উসতার নিকট এসে পুনরায় শয়তানের দিকে সাতটি কংকর ছুঁড়লেন। অতঃপর সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে ছেলেকে মাটিতে শায়িত করলেন। ঐ সময় ছেলের গায়ে সাদা রঙ-এর চাদর ছিল। তিনি পিতাকে চাদরটি খুলে নিতে বললেন, যাতে ঐ চাদর দ্বারা তাঁর কাফনের কাজ হয়। এহেন অবস্থায় পিতা হয়ে পুত্রের দেহ অনাবৃত করা অতি বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে। এমন সময় শব্দ এলোঃ “হে ইবরাহীম (আঃ)! তুমি তো স্বপ্নদেশ সত্যিই পালন করলে। তখন তিনি পিছনে ফিরে একটি দুম্বা দেখতে পেলেন, যার শিং ছিল বড় বড় এবং চক্ষুদ্বয় ছিল অতি সুন্দর।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “এ জন্যেই আমরা কুরবানীর জন্যে এই প্রকারের দুম্বা মনোনীত করে থাকি।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর অপর এক বর্ণনায় হযরত ইসহাক (আঃ)-এর নাম উল্লিখিত রয়েছে। ফলে তাঁর বর্ণনায় দু’জনের নাম পাওয়া যায়। সুতরাং প্রথমটিই গ্রহণযোগ্য। ইনশাআল্লাহ এর প্রমাণ পেশ করা হবে।

আল্লাহ তা’আলা কুরবানীর জন্যে একটি দুম্বা দান করলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ওটা জান্নাতের দুম্বা ছিল। চল্লিশ বছর ধরে সেখানে পালিত হয়েছিল। এটা দেখে হযরত ইবরহীম (আঃ) পুত্রকে ছেড়ে দিয়ে সেই দিকে অগ্রসর হলেন। প্রথম জামরায় এসে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করলেন। শয়তান সেখান থেকে পালিয়ে জামরায়ে উসতায় আসলো। সেখানেও তিনি সাতটি কংকর হুঁড়লেন। আবার প্রথম জামরায় এসে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করলেন। সেখান হতে যবেহের স্থানে এসে দুষাটি কুরবানী করলেন। এটার মাথাসহ শিং কা’বার দেয়ালে লটকানো ছিল। পরে ওটা শুকিয়ে যায় এবং ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত সেখানেই বিদ্যমান ছিল।

বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) ও হযরত কা’ব (রাঃ) একত্রিত হন। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) নবী (সঃ) হতে হাদীস বর্ণনা করছিলেন এবং হযরত কা’ব (রাঃ) আল্লাহর কিতাব হতে ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক নবী (আঃ)-এর জন্যে একটি ককূলকৃত দুআ রয়েছে। আমার এই কবুলকৃত দু’আ আমি আমার উম্মতের শাফাআতের জন্যে গোপন রেখেছি যা কিয়ামতের দিন হবে।” হযরত কা’ব (রাঃ) তখন হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ)-কে বলেনঃ “তুমি কি স্বয়ং এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনেছো?” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “হ্যা, আমি নিজেই শুনেছি।” তখন হযরত কা’ব (রাঃ) খুব খুশী হন এবং বলেনঃ “তোমার উপর আমার পিতা-মাতা উৎসর্গকৃত হোক অথবা নবী (সঃ)-এর উপর আমার পিতা-মাতা উৎসর্গকৃত হোক।” অতঃপর হযরত কা’ব (রাঃ) হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ঘটনা শুনালেন। তিনি বর্ণনা করলেন যে, যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) হযরত ইসহাক (আঃ)-কে যবেহ করার জন্যে প্রস্তুত হলেন তখন শয়তান (মনে মনে) বললোঃ “আমি যদি এ সময়ে এ কাজ থেকে তাঁকে টলাতে না পারি তবে আমাকে এ জন্যে সারা জীবন নিরাশ থাকতে হবে। প্রথমে সে হযরত সারার নিকট গেল এবং তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ “তোমার স্বামী তোমার পুত্রকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তা জান কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “হয়তো নিজের কোন কাজের জন্যে। নিয়ে যাচ্ছেন।” সে বললোঃ “না, না, বরং তাকে যবেহ করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছেন।” হযরত সারা বললেন:“তিনি নিজের পুত্রকে যবেহ করবেন এটা কি সম্ভব?” অভিশপ্ত শয়তান জবাব দিলোঃ “তোমার স্বামী বলেন কি জান? তাঁকে নাকি আল্লাহ এই নির্দেশ দিয়েছেন!” হযরত সারা তখন বললেনঃ “তাকে যদি আল্লাহ নির্দেশ দিয়ে থাকেন তবে তিনি ঠিকই করছেন। আল্লাহর হুকুম পালন করে তিনি ফিরে আসবেন।” সে এখানে ব্যর্থ হয়ে হযরত ইসহাক (আঃ)-এর নিকট গেল এবং তাকে বললোঃ “তোমাকে তোমার আব্বা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তা জান কি?” তিনি উত্তর দিলেনঃ “হয়তো কোন কাজের জন্যে কোন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন।” শয়তান বললোঃ “না, বরং তোমাকে যবেহ করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছেন।” হযরত ইসহাক (আঃ) বললেনঃ “এটা কি করে সম্ভব?” শয়তান। বললোঃ “তোমাকে যবেহ করতে নাকি আল্লাহ তাকে আদেশ করেছেন।” তখন হযরত ইসহাক (আঃ) বললেনঃ “আল্লাহর কসম! যদি সত্যি আল্লাহ আমাকে যবেহ করতে তাঁকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন তবে তো তাড়াতাড়ি তার এ কাজ করা উচিত।”

শয়তান এখানেও নিরাশ হয়ে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট গিয়ে বললোঃ “ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “প্রয়োজনীয় কাজে যাচ্ছি।” শয়তান বললোঃ “না, তা নয়। বরং তাকে যবেহ করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে।” হযরত ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ “তাকে আমি কেন যবেহ করবো?” শয়তান জবাব দিলোঃ “হয়তো আপনার প্রতিপালক আপনাকে এ কাজে আদেশ করেছেন। তিনি তখন বললেনঃ “আমার প্রতিপালক যদি আমাকে আদেশ করেই থাকেন তবে আমি তা করবোই।” ফলে শয়তান এখানেও নিরাশ হয়ে গেল।

অপর এক বর্ণনায় বলা হয় যে, এই সব ঘটনার পর মহান আল্লাহ হযরত ইসহাক (আঃ)-কে বললেনঃ “তুমি আমার নিকট যে দু’আ করবে আমি তা ককূল করবো।” হযরত ইসহাক (আঃ) তখন দু’আ করলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! যারা আপনার সাথে কোন শরীক স্থাপন করবে না তাদেরকে আপনি জান্নাত দান করুন!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বর্ণনা করেনঃ “দু’টি বিষয় আমার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। একটি হলো এই যে, আমার অর্ধেক উম্মতকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর দ্বিতীয় হলো এই যে, আমাকে শাফাআত করার অধিকার দেয়া হবে। অমি শাফাআত করাকেই প্রাধান্য দিলাম, এই আশায় যে, ওটা সাধারণ হবে। হ্যা, তবে একটি দু’আ ছিল যে, আমি ওটাই করতাম। কিন্তু আমার পূর্বেই আল্লাহর এক সৎ বান্দা তা করে ফেলেছেন। ঘটনা এই যে, যখন হযরত ইসহাক (আঃ) যবেহ-এর বিপদ হতে মুক্তি পেলেন তখন তাঁকে বলা হলোঃ “আমার নিকট চাও, যা চাইবে তাই আমি দিবো।” তখন হযরত ইসহাক (আঃ) বললেনঃ “আল্লাহর শপথ! শয়তান ধোকা দেয়ার পূর্বেই আমি তা চাইবো। হে আল্লাহ! যে আপনার সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করবে তাকে আপনি জান্নাতে প্রবিষ্ট করুন!” (এ হাদীসটি মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। এর সনদ গারীব ও মুনকার। আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম নামক এর একজন বর্ণনাকারী দুর্বল। আর আমার তো এই ভয়ও হয় যে, “যখন আল্লাহ হযরত ইসহাক (আঃ)-কে বললেন … শেষ পর্যন্ত এ কথাগুলো তার নিজের কথা, যেগুলো তিনি হাদীসের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যাবীহুল্লাহ তো ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ) এবং যবেহ-এর স্থান তো মিনা, যা মক্কায় অবস্থিত এবং হযরত ইসমাঈল (আঃ) মক্কাতেই ছিলেন, হযরত ইসহাক (আঃ) নন, তিনি তো ছিলেন সিরিয়ার কিন’আন শহরে)

মহান আল্লাহ বলেনঃ “যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পুত্র (ইসমাঈল আঃ)-কে কাত করে শায়িত করলেন তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললামঃ হে ইবরাহীম (আঃ)! তুমি তো স্বপ্নদেশ সত্যিই পালন করলে!” হযরত সুদ্দী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর গলায় ছুরি চালাতে শুরু করলেন তখন গলা তামা হয়ে গেল, ফলে ছুরি চললো না ও গলা কাটলো না। ঐ সময় (আরবী) এই শব্দ আসলো।

আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ “এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। অর্থাৎ তাদেরকে কঠিন বিপদ থেকে উদ্ধার করে থাকি। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার পরিত্রাণের উপায় বের করে দেন এবং তাকে এমনভাবে রিযক দান করে থাকেন যে, ওটা তার ধারণা বা কল্পনাও থাকে না। আল্লাহর উপর ভরসাকারীর জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পুরো করেই থাকেন এবং প্রত্যেক জিনিসেরই তিনি পরিমাপ নির্ধারণ করে রেখেছেন।”(৬৫:২-৩)

এই আয়াত দ্বারা আলেমগণ দলীল গ্রহণ করেছেন যে, কাজের উপর ক্ষমতা লাভের পূর্বেই হুকুম রহিত হয়ে যায়। অবশ্য মু’তাযিলা সম্প্রদায় এটা মানে না। দলীল গ্রহণের কারণ প্রকাশমান। কেননা, হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তিনি যেন তার পুত্রকে কুরবানী করেন। অতঃপর যবেহ করার। পূর্বেই ফিদিয়ার মাধ্যমে এ হুকুম রহিত করে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল এটাই যে, তাকে ধৈর্য ও আদিষ্ট কাজ প্রতিপালনে সদা প্রস্তুত থাকার উপর বিনিময় প্রদান করা হবে। এজন্যেই ইরশাদ হয়েছেঃ “নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। একদিকে হুকুম এবং অপরদিকে তা প্রতিপালন। এজন্যেই মহান আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রশংসায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ ইবরাহীম (আঃ), যে পালন করেছিল তার দায়িত্ব।”(৫৩:৩৭)

হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) বলেন যে, যে ফিদিয়া দান করা হয়েছিল তার রঙ ছিল সাদা, চক্ষু বড় এবং বড় শিং বিশিষ্ট উৎকৃষ্ট খাদ্যে প্রতিপালিত ভেড়া। যা সাবীর’ নামক স্থানে বাবুল বৃক্ষে বাঁধা ছিল। ওটা জান্নাতে চল্লিশ বছর ধরে ছিল। মিনাতে সাবীরের নিকট ওটাকে যবেহ করা হয়। এটা সেই ভেড়া যাকে হাবীল কুরবানী করেছিলেন। হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, ঐ ভেড়াটির নাম ছিল জারীর। ইবনে জুরায়েজ (রঃ) বলেন যে, ওটাকে মাকামে ইবরাহীমে যবেহ করা হয়। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, ওটাকে মিনার নহরের স্থানে যবেহ করা হয়।

বর্ণিত আছে যে, একটি লোক নিজেকে কুরবানী করার মানত মানে এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে তাঁর কাছে ফতওয়া জিজ্ঞেস করে। তিনি তাকে একশটি উট কুরবানী করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি বলতেনঃ “তাকে যদি আমি একটি মাত্র ভেড়া কুরবানী করতে বলতাম তাহলেও যথেষ্ট হতো। কেননা কুরআন কারীমে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইসমাঈল যাবীহুল্লাহ (আঃ)-এর ফিদিয়া ওটা দ্বারাই দেয়া হয়েছিল।”

কেউ কেউ বলেন যে, ওটা পাহাড়ী ছাগল ছিল। কারো কারো মতে ওটা ছিল হরিণ।

মুনসাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উসমান ইবনে তালহা (রাঃ)-কে ডেকে বলেনঃ “কা’বা ঘরে প্রবেশ করে আমি ভেড়ার শিং দেখেছি। কিন্তু ওটা তোমাকে ঢেকে রাখতে বলার কথা আমি ভুলে গেছি। যাও, ওটা ঢেকে দাও। কাবা ঘরে এমন কোন জিনিস থাকা ঠিক নয় যাতে নামাযীর নামাযে অসুবিধা সৃষ্টি হয়।”

সুফিয়ান সাওরী (রঃ) বলেন যে, ওটা কা’বা ঘরেই ছিল। পরবর্তীকালে কা’বা ঘরে আগুন লাগায় ওটা পুড়ে যায়। এর দ্বারাও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর কুরবানী হওয়ার প্রমাণ মিলে। কেননা, উক্ত শিং তখন থেকে নিয়ে ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত কুরায়েশদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে রক্ষিত ছিল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

অধ্যায়: প্রকৃত যাবীহ কে ছিলেন সে সম্পর্কে পূর্বযুগীয় গুরুজন হতে যেসব ‘আসার’ এসেছে সেগুলোর বর্ণনাঃ

যারা দাবী করেন যে, যাবীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসহাক (আঃ), তাঁদের যুক্তি, যথাঃ হযরত আবু মায়সারা (রঃ) বলেন যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) মিসরের বাদশাহকে বলেনঃ “আপনি কি আমার সাথে খেতে চান? আমি হলাম ইউসুফ ইবনে ইয়াকূব ইবনে ইসহাক যাবীহুল্লাহ ইবনে ইবরাহীম খালীলুল্লাহ (আঃ)।”

হযরত উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মূসা (আঃ) বলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! মানুষরা মুখে মুখে হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত ইসহাক (আঃ) এবং হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর মা’রূদের শপথ করে থাকে। এর কারণ কি?” উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “কারণ এই যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রত্যেকটি বিষয়ে আমাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ইসহাক (আঃ) আমার পথে কুরবানী হওয়ার জন্যে নিজেকে আমার হাতে সমর্পণ করে। আর ইয়াকূব (আঃ)-কে আমি যতই বিপদাপদে নিপতিত করি, তার শুভ ধারণা ততই বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।”

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর সামনে একদা এক ব্যক্তি তার পূর্বপুরুষের গৌরবের কথা বলাবলি করছিল। তিনি তাকে বললেনঃ “প্রকৃত গৌরবের অধিকারী হওয়ার যোগ্য হযরত ইউসুফ (আঃ)। কেননা, তিনি হচ্ছেন ইয়াকূব (আঃ) ইবনে ইসহাক যাবীহুল্লাহ (আঃ) ইবনে ইবরাহীম খালীলুল্লাহ (আঃ)-এর বংশধর।”

ইকরামা (রঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ), আব্বাস (রাঃ), আলী (রাঃ), যায়েদ ইবনে জুবায়ের (রঃ), মুজাহিদ (রঃ), শাবী (রঃ), উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রঃ), যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ), আবদুল্লাহ ইবনে শাকীক (রঃ), কাসিম ইবনে আবি বুরযা (রঃ), মাকহুল (রঃ), উসমান ইবনে আবি হাযির (রঃ), সুদ্দী (রঃ), হাসান (রঃ), কাতাদা (রঃ), আবূ হুয়েল (রঃ), ইবনে সাবিত (রঃ), কাবুল আহবার (রঃ) প্রমুখ গুরুজন এই মত পোষণ করেন যে, যাবীহুল্লাহ হযরত ইসহাকই (আঃ) ছিলেন। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এই মত গ্রহণ করেছেন। সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই আছে। তবে বাহ্যতঃ এটা জানা যায় যে, উক্ত মনীষীবৃন্দের উস্তাদ ছিলেন হযরত কা’বুল আহবার (রঃ)। তিনি হযরত উমার ফারূক (রাঃ)-এর খিলাফতের যুগে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি হযরত উমার (রাঃ)-কে প্রাচীন কিতাবগুলোর ঘটনা শুনাতেন। জনগণের মধ্যেও তিনি ঐ সব কথা বলতেন। তখন শুদ্ধ ও অশুদ্ধের পার্থক্য উঠে যায়। সঠিক কথা তো এই যে, এই জাতির জন্যে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের একটি কথারও প্রয়োজন নেই। ইমাম বাগাবী (রঃ) আরো কিছু সাহাবী ও তাবেয়ীর নাম সংযোজন করেছেন যাঁরা সবাই হযরত ইসহাক (আঃ)-কে যাবীহুল্লাহ বলতেন। একটি মারফু হাদীসেও এরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু হাদীসটি সহীহ হলে তো বিবাদের মীমাংসা হয়েই যেতো। আসলে হাদীসটি সহীহ নয়। কেননা, এর সনদে দুজন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। হাসান ইবনে দীনার পরিত্যক্ত এবং আলী ইবনে যায়েদ মুনকারুল হাদীস। আর সৰ্বাধিক সঠিক কথা এই যে, হাদীসটি মাওকুফ। কেননা, অন্য এক সনদে একথা হযরত আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে এবং এটাই বেশী সঠিক কথা। তবে সব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

এখন ঐ সব ‘আসার’ বর্ণনা করা হচ্ছে যেগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যাবীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ)। আর এটাই অকাট্যরূপে সত্য।

হযরত ইবনে আব্বাস বলেন যে, যাবীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ)। ইয়াহূদীরা যে হযরত ইসহাক (আঃ)-কে যাবীহুল্লাহ বলেছে তা তারা ভুল বলেছে। হযরত ইবনে উমার (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), শা’বী (রঃ), হাসান বসরী (রঃ), মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কারাযী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন মত প্রকাশ করেন যে, যাবীহুল্লাহ হযরত ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন। হযরত শাবী (রঃ) বলেনঃ ‘যাবীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ) এবং আমি কা’বা গৃহে ভেড়ার শিং দেখেছি।”

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব (রঃ) বলেন যে, মহান আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে কুরবানী করার নির্দেশ দেন। উক্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর আল্লাহ পাক ইরশাদ করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাকে সুসংবাদ দিয়েছিলাম ইসহাক (আঃ)-এর, সে ছিল এক নবী, সৎকর্মশীলদের অন্যতম।” হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর জন্ম হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে আরো বলা হয়েছে। যে, হযরত ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র হযরত ইয়াকূব (আঃ) জন্ম লাভ করবেন। সুতরাং হযরত ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর জন্মগ্রহণের পূর্বে তাঁকে কুরবানী করার হুকুম দেয়া কি করে সম্ভব? কেননা, এটা আল্লাহ তাআলার ওয়াদা যে, হযরত ইসহাক (আঃ)-এর ঔরষে হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর জন্ম হবে। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কেই কুরবানী দেয়ার হুকুম হয়েছিল, হযরত ইসহাক (আঃ)-কে নয়।

হযরত ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেনঃ একথা আমি বহু লোককে বলতে শুনেছি। এ প্রসঙ্গে হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) বর্ণনা করেনঃ “এটা অতি পরিষ্কার প্রমাণ। আমিও জানতাম যে, যাবীহুল্লাহ হযরত ইসমাঈলই (আঃ) ছিলেন। অতঃপর তিনি সিরিয়ার একজন ইয়াহূদী আলেমকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন যিনি মুসলমান হয়েছিলেন। উত্তরে ঐ আলেম বলেছিলেনঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! সত্য কথা এটাই যে, যাকে কুরবানী করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তিনি ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ)। কিন্তু যেহেতু আরবরা ছিল তাঁর বংশধর, তাই এই মর্যাদা তাদের দিকেই, প্রত্যাবর্তিত হয়। এতে ইয়াহূদীরা হিংসায় জ্বলে ওঠে এবং হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর নাম পরিবর্তন করে হযরত ইসহাক (আঃ)-এর নাম প্রবিষ্ট করে। এ ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। আমাদের ঈমান রয়েছে যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) ও হযরত ইসহাক (আঃ) উভয়েই ছিলেন সৎ, পবিত্র ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী এবং আল্লাহর খাটি অনুগত বান্দা।

কিতাবুয যুহদে বর্ণিত আছে যে, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ)-কে তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ্ (রঃ) এই মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “যাবীহ ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ)।” হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে উমার (রাঃ), আবু তোফায়েল (রঃ), সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রঃ), সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ), হাসান (রঃ), মুজাহিদ (রঃ), শা’বী (রঃ), মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব (রঃ), মুহাম্মাদ ইবনে আলী (রঃ), আবূ সালেহ (রঃ) প্রমুখ মনীষীবৃন্দ হতেও এটাই বর্ণিত আছে। ইমাম বাগাবী (রঃ) আরো কিছু সাহাবী ও তাবেয়ীর নাম উল্লেখ করেছেন। এর স্বপক্ষে একটি গারীব বা দুর্বল হাদীসও রয়েছে। তাতে রয়েছে যে, সিরিয়ায় আমীর মু’আবিয়া (রাঃ)-এর সামনে যাবীহুল্লাহ কে ছিলেন এ প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তিনি জবাবে বলেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি এটা অবগত আছি। শুনুন, আমি একদা নবী (সঃ)-এর নিকটে ছিলাম এমন সময় একজন লোক এসে বলতে শুরু করলোঃ “হে আল্লাহর পথে উৎসর্গীকৃত দুই ব্যক্তির বংশের রাসূল (সঃ)! আমাকেও গানীমাতের মাল হতে কিছু প্রদান করুন!” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুচকি হাসলেন। হযরত মু’আবিয়া (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! ঐ যাবীহদ্বয় কারা?” তিনি জবাবে বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব যখন যমযম কূপ খনন করেন তখন তিনি নযর মেনেছিলেন যে, যদি কাজটি সহজভাবে সমাপ্ত হয় তবে তিনি তাঁর একটি ছেলেকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করবেন। কাজটি সহজভাবে সমাপ্ত হলো। তখন কোন ছেলেকে কুরবানী করা যায় এটা নির্ণয় করার জন্যে তিনি লটারী করেন। লটারীতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিতা আবদুল্লাহর নাম উঠে। এ দেখে তাঁর নানারা এ কাজ করতে তাঁকে নিষেধ করলো এবং বললোঃ “তার বিনিময়ে একশটি উট কুরবানী করে দাও।” তিনি তাই করলেন। আর দ্বিতীয় যাবীহ হলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ), যা সর্বজন বিদিত।” তাফসীরে ইবনে জারীর ও মাগাযী উমুবীতে এ রিওয়াইয়াতটি বিদ্যমান রয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) হযরত ইসহাক (আঃ) যাবীহুল্লাহ হওয়ার একটি দলীল এই পেশ করেছেন যে, যে (আরবী) বা সহনশীল ছেলের সুসংবাদের উল্লেখ রয়েছে তার দ্বারা হযরত ইসহাককেই (আঃ) বুঝানো হয়েছে। কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় (আরবী) অর্থাৎ “তারা তাকে এক জ্ঞানী ও বিজ্ঞ সন্তানের সুসংবাদ দিলো।”(৫১:২৮) আর হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর সুসংবাদের জবাব এই দিয়েছেন যে, তিনি তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর সম্ভবতঃ হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর সাথেই আরো সন্তানও থেকে থাকবে। কা’বা ঘরে শিং থাকার ব্যাপারে বলেছেন। যে, ওটা কিনআন শহর হতে এনে এখানে রেখে দেয়া হয়েছে। কোন কোন লোক হযরত ইসহাক (আঃ)-এর কথা খোলাখুলিভাবেই বলেছেন। কিন্তু এসব কথা বাস্তবতা শূন্য। অবশ্য হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর যাবীহুল্লাহ হওয়ার ব্যাপারে মুহাম্মাদ ইবনে কাব কারাযীর (রঃ) প্রমাণ খুব স্পষ্ট ও সবল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

প্রথমে যাবীহুল্লাহ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর জন্ম লাভের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল এবং এরপর তাঁর ভাই হযরত ইসহাক (আঃ)-এর জন্মের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। সূরায়ে হৃদ ও সূরায়ে হিজরে এর বর্ণনা গত হয়েছে।

(আরবী) শব্দটি হয়েছে, অর্থাৎ তিনি নবী হবেন সৎ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যাবীহ ছিলেন হযরত ইসহাক (আঃ) এবং এখানে নবুওয়াত হলো হযরত ইসহাক (আঃ)-এর সুসংবাদ। যেমন হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভ্রাতা হারূন (আঃ)-কে নবীরূপে।”(১৯:৫৩) প্রকৃতপক্ষে হযরত হারূন (আঃ) হযরত মূসা (আঃ)-এর চেয়ে বড় ছিলেন। এখানে তাঁর নবুওয়াতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। সুতরাং এখানেও সুসংবাদ ঐ সময় দেয়া হয় যখন তিনি যবেহ-এর পরীক্ষায় ধৈর্যশীল প্রমাণিত হয়েছিলেন। এটাও বর্ণিত হয়েছে যে, এ সুসংবাদ দুইবার প্রদান করা হয়েছে। প্রথমবার জন্মের পূর্বে এবং দ্বিতীয়বার নবুওয়াতের কিছু পূর্বে। এটা হযরত কাতাদা (রঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাকে বরকত দান করেছিলাম এবং ইসহাককেও (আঃ), তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মপরায়ণ এবং কতক নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “বলা হলো- হে নূহ (আঃ)! অবতরণ কর আমার দেয়া শান্তিসহ এবং তোমার প্রতি ও যেসব সম্প্রদায় তোমার সাথে আছে তাদের প্রতি কল্যাণসহ; অপর সম্প্রদায়সমূহকে জীবন উপভোগ করতে দিবো, পরে আমা হতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে স্পর্শ করবে।”(১১:৪৮)

Leave a Reply