أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৫)
[*আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার
পারা:২৪
৫৩- ৭৫ নং আয়াত:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৫৩-৫৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
প্রথমত আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন, তোমরা কখনো আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। কারণ কাফির ব্যতীত কেউ আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হয় না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরা গুনাহ। (দুররুল মানছুর ২/১৪৭, বাযযার হা. ১০৬, হাসান)
إسراف (ইসরাফ) অর্থ পাপের প্রাচুর্য।
(لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللہِ)
“আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না” অর্থ ঈমান আনার পূর্বে বা তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে যতই গুনাহ করে থাকে, মানুষ যেন এটা মনে না করে যে, আমি তো অনেক বড় পাপী, আমাকে আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে ক্ষমা করবেন? বরং পরিষ্কার হৃদয়ে যদি ঈমান আনে বা নিষ্ঠার সাথে যদি তাওবা করে, তবে আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত পাপকে মাফ করে দেবেন। এ আয়াতের শানে নুযূল হতেও এ অর্থই সাব্যস্ত হয়। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : কিছু কাফির ও মুশরিক এমন ছিল, যারা প্রচুর হত্যা ও ব্যভিচারে লিপ্ত ছিল। এরা নাবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল যে, আপনার দাওয়াত তো সঠিক, কিন্তু আমরা অনেক পাপকার্য করেছি। যদি আমরা ঈমান আনি, তবে এ সমস্ত গুনাহ মাফ হবে কি? এরই ভিত্তিতে এ আয়াত নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮১০) তাই আয়াতের বিষয়বস্তুর সারমর্ম এই যে, মৃত্যুর পূর্বে প্রত্যেক বড় গুনাহ এমনকি শির্ক ও কুফর থেকেও তাওবা করলে তাওবা কবূল করা হবে। সত্যিকার তাওবা দ্বারা সব রকম গুনাহই ক্ষমা করে দেয়া হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হওয়া উচিত নয়।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ তা‘আলার রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার আশায় খুব পাপ করে যাই। তাঁর যাবতীয় বিধি-বিধান ও ফরয কার্যাদির ব্যাপারে গাফিল হয়ে থাকি এবং আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত সীমা ও নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করি। এভাবে তাঁর ক্রোধ ও প্রতিশোধকে আহ্বান জানিয়ে তাঁর রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার আশা করা একেবারে বোকামি ও খামখেয়ালী ছাড়া কিছুই নয়। এটা হল নীম গাছের বীজ লাগিয়ে আঙ্গুর ফলের আশা করার মতই। এ ধরণের অবাধ্যদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা
عزيز ذو انتقام
অর্থাৎ কঠোর ও প্রতিশোধগ্রহণকারীও বটে। তাই তো কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উভয় দিককে এক সাথেই বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(نَبِّیْٔ عِبَادِیْٓ اَنِّیْٓ اَنَا الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُﮀﺫوَاَنَّ عَذَابِیْ ھُوَ الْعَذَابُ الْاَلِیْمُ)
“আমার বান্দাদেরকে বলে দাও যে, আমি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু, এবং আমার শাস্তি- সে অতি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি!” (সূরা হিজর ১৫ : ৪৯-৫০)
সম্ভবত এটাই কারণ যে, এখানে আয়াতের আরম্ভ يا عبادي (হে আমার বান্দাগণ!) দিয়ে হয়েছে। যার দ্বারা এটাই প্রমাণিত যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনে অথবা পরিষ্কার হৃদয়ে তাওবা করে প্রকৃত অর্থে সে তাঁর বান্দা হয়ে যাবে, তার পাপ যতই বেশি হোক না কেন, তবুও তা মাফ হয়ে যায়। তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য অবশ্যই ক্ষমাশীল ও দয়াবান। যেমন হাদীসে একশত মানুষের খুনীর তাওবার ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে, যাকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করেছিলেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে সৎ আমল করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কারণ সৎ আমল ছাড়া জান্নাতে যাওয়া যাবে না।
আর যারা সৎ আমল করবে না তারা শুধু পরকালে আফসোসই করবে, কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যে-সকল বাহ্যিক আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন : যেমন সালাত, সিয়াম, যাকাত, হাজ্জ, সাদাকা ও সর্ব প্রকার ইহসান এবং যে-সকল অভ্যন্তরীণ আমলের নির্দেশ দিয়েছেন যেমন আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসা, ভয় করা, ক্ষমার আশা করা, অপর ভাইয়ের জন্য কল্যাণ কামনা করা ও এর বিপরীত যা আছে তা বর্জন করা ইত্যাদি। সুতরাং যারা এসব বিধান অনুসরণ করবে তারাই আল্লাহ তা‘আলা অভিমুখী মুসলিম ।
তাই আমাদের উচিত, আযাব আসার পূর্বে তাওবা এবং নেক আমল করা। কেননা যখন আযাব আসবে, তখন আর কোন নিস্তার পাওয়া যাবে না। তাই যাতে আফসোস করতে না হয়, সে-জন্য পূর্ব থেকেই সৎ আমল করতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। কারণ এটা কাফিরদের অভ্যাস।
২. শাস্তি আসার পূর্বেই ভাল আমল করতে হবে।
৩. পরকালে আফসোস করে কোন লাভ হবে না।
৬০-৬১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা এখানে দু শ্রেণির মানুষের কথা বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ কিয়ামতের মাঠে দু শ্রেণির লোক হবে। এক শ্রেণির লোকের মুখ হবে কালো আর এক শ্রেণির লোকের চেহারা হবে উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(يَّوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوْهٌ وَّتَسْوَدُّ وُجُوْهٌ)
“সেদিন কিছু চেহারা হবে উজ্জ্বল এবং কিছু চেহারা হবে কালো।” (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১০৬)
যারা কাফির-মুশরিক তাদের চেহারা কালো হয়ে যাবে। আর যারা ঈমান এনেছে, কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী আমল করেছে তাদের চেহারা হবে উজ্জ্বল।
কালো হওয়ার কারণ, আযাবের ভয়াবহতা এবং আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধের প্রত্যক্ষ দর্শন। পক্ষান্তরে যাদের চেহারা উজ্জ্বল তারা মূলত আল্লাহ তা‘আলার একনিষ্ঠ বান্দা এবং তারা দুনিয়াতে তাঁরই ইবাদত করত। যার ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সাফল্যসহ উদ্ধার করবেন। অমঙ্গল তাদেরকে স্পর্শ করবে না এবং তারা দুঃখও পাবে না।
(بِمَفَازَتِهِمْ) অর্থাৎ অকল্যাণ থেকে বেঁচে যাওয়া এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্য লাভ করা।
তাই কিয়ামতের মাঠে উজ্জ্বল চেহারার অধিকারী হতে হলে আমাদেরকে সঠিক ঈমান ও সুন্নাতী তরীকায় আমল করতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামতের মাঠে দু’ শ্রেণির লোক হবে। এক শ্রেণি নাজাত পাবে, আরেক শ্রেণি বিপদগ্রস্ত হবে।
২. গর্ব-অহঙ্কার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নচেৎ জাহান্নামে যেতে হবে।
৬২-৬৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহত্ব ও বড়ত্বের সংবাদ দিয়ে বলছেন, তিনিই আকাশ-জমিন, মানুষ-জিন, ফেরেশতা, গাছ-পালাসহ সবকিছুর স্রষ্টা, এমনকি সবকিছুর পরিচালকও তিনি।
এ আয়াত থেকে অনেকে বলতে চায় আল্লাহ তা‘আলার কথা মাখলুক, কুরআন মাখলুক যা মু‘তাযিলাদের বিশ্বাস। এরূপ বিশ্বাস মূর্খতার পরিচয় বহন করে, কারণ কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম বা কথা, আল্লাহ তা‘আলার কালাম তাঁর একটি গুণ বা সিফাত। আর আল্লাহ তা‘আলার সিফাত কখনো মাখলূক হতে পারে না, বরং আল্লাহ তা‘আলার মতই চিরস্থায়ী অবিনশ্বর। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর সিফাত ছাড়া যা কিছু আছে সবকিছু মাখলূক তথা ধ্বংসশীল।
আকাশ ও জমিনের জ্ঞান-বিজ্ঞান, কল্যাণ-অকল্যাণসহ সবকিছুর চাবি-কাঠি তাঁরই হাতে। তিনি যা চান তাই হয়, আর যা চান না তা হয় না। সকল কিছুর ওপর তিনিই ক্ষমতাবান। যারা এতে বিশ্বাসী তারা পরকালে সফলকাম হবে, আর যারাই অস্বীকার করবে তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(مَا يَفْتَحِ اللّٰهُ لِلنَّاسِ مِنْ رَّحْمَةٍ فَلَا مُمْسِكَ لَهَا ج وَمَا يُمْسِكْ فَلَا مُرْسِلَ لَه۫ مِنْۭ بَعْدِه۪ ط وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ)
“আল্লাহ মানুষের জন্য যে রহমত উন্মুক্ত করে দেন তা কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না; আর যা তিনি বন্ধ করে দেন তা বন্ধ করার পরে কেউ উন্মুক্ত করতে পারে না। তিনি প্র্রতাপশালী ও মহাপ্রজ্ঞাময়।” (সূরা ফাতির ৩৫ : ২)
مَقَالِيْدُ হলো, مقلد এবং مقلاد-এর বহুবচন। কেউ এর অর্থ করেছেন চাবিসমূহ, আবার কেউ এর অর্থ করেছেন- ধন-ভাণ্ডার।
সুতরাং যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এসব কিছুর মালিক তাঁকে ব্যতীত আমরা কি অন্যের ইবাদত করব? না, কখনো নয়; সর্বদা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করব, জাহেলরা যতই অন্যের ইবাদতের দিকে আহ্বান করুক তারা মূলত ইবাদতের হকদার নয়। এমনকি তারা ইবাদতের কোন অংশেরও হকদার নয়, যদি কেউ তাদের জন্য ইবাদতের কিছু অংশও সম্পাদন করে তাহলে তারাও মুশরিক। যারা শির্ক করবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে সম্বোধন করে উম্মাতকে সতর্ক করে বলেন : তুমিও যদি কোন প্রকার শির্কে লিপ্ত হও আর তাওবা না করে শির্কের ওপরই মৃত্যু বরণ করো তাহলে তোমার সমস্ত আমল বাতিল হয়ে যাবে এবং তুমি হবে জাহান্নামী।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(ذٰلِكَ هُدَي اللّٰهِ يَهْدِيْ بِه۪ مَنْ يَّشَا۬ءُ مِنْ عِبَادِه۪ ط وَلَوْ أَشْرَكُوْا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ)
“এটা আল্লাহর হিদায়াত, স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি হিদায়াত দ্বারা সৎ পথে পরিচালিত করেন। তারা যদি শির্ক করত তবে তাদের কৃতকর্ম নিষ্ফল হত।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৮৮)
সুতরাং শির্ক ও এ জাতীয় আমল থেকে আমাদেরকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করা যাবে না।
২. শির্ক করলে পূর্ববর্তী সকল ভাল আমল নষ্ট হয়ে যায়।
৩. আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে। তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া যাবে না।
৬৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
কাফির-মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখে না তাই তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করে থাকে। মূলত আল্লাহ তা‘আলার চেয়ে বড় মর্যাদাবান, রাজত্বের অধিকারী এবং ক্ষমতাবান আর কেউ নেই। তাঁর ক্ষমতা এমন যে, কিয়ামতের মাঠে তিনি সমস্ত পৃথিবীকে তাঁর হাতের মুষ্টিতে নিয়ে নেবেন এবং আকাশসমূহকে ভাঁজ করে ডান হাতে নিয়ে নেবেন।
যেমন হাদীসে বলা হয়েছে ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইয়াহূদী পণ্ডিত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে বলল : হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমরা (কিতাবে) পাই যে, আল্লাহ তা‘আলা আকাশসমূহকে এক আঙ্গুলে, জমিনসমূহকে এক আঙ্গুলে, গাছ-পালাকে এক আঙ্গুলে, পানি ও স্থলকে এক আঙ্গুলে এবং অন্যান্য সমস্ত সৃষ্টিজীবকে এক আঙ্গুলে রাখবেন এবং বলবেন : আমিই বাদশা। তখন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কথার সত্যতা প্রমাণে মুচকি হাসলেন এবং এ আয়াতটি পাঠ করলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮১১, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৮৬)
অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন : আল্লাহ তা‘আলা জমিনকে কবজ করে নেবেন এবং আকাশসমূহকে ডান হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে বলবেন : আমিই বাদশা। জমিনের বাদশারা কোথায়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮১২, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৮৭) সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাবান। কাফির-মুশরিকরা তাঁর মর্যাদার ব্যাপারে কোনই জ্ঞান রাখে না, তাই তারা তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে। যদি তারা আল্লাহ তা‘আলার যথাযথ মর্যাদার কথা বুঝত তাহলে তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করত না। বরং তাঁকে যথাযথ মূল্যায়ন করত।
مَطْوِيّٰتٌ শব্দের অর্থ হলো পেঁচিয়ে, গুটিয়ে কোন জিনিসকে ভাঁজ করে নেয়া।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলাকে যথার্থ মর্যাদা দেয়া আবশ্যক ।
২. আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন আকাশ জমিনকে ভাঁজ করে হাতে নেবেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলার হাত আছে এটা জানা গেল, কিন্তু কেমন তা জানা যায়না তবে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, তাঁর জন্য মানানসই হাত রয়েছে।
৬৮-৭০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
( وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ….. يَّنْظُرُوْنَ)
‘এবং শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে’ কারো কারো মতে এখানে যে ফুঁৎকারের কথা বলা হয়েছে সেটা হবে দ্বিতীয় ফুঁক। অর্থাৎ এটা হবে বেহুঁশ হবার ফুঁক। যার ফলে সবাই মারা যাবে। আবার কারো মতে এটা হবে প্রথম ফুঁক। এর ফলেই প্রথমত সকলে কঠিন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে এবং পরে সবাই মৃত্যু মুখে পতিত হবে।
আবার কেউ এ ফুঁকগুলোকে এভাবে বর্ণনা করেছেন- প্রথম : نفخة الفناء তথা ধ্বংসের ফুঁক। দ্বিতীয় : نفخة البعث তথা পুনরুত্থানের ফুঁক। তৃতীয় : نفخة الصعق তথা বেহুঁশ হবার ফুঁক। চতুর্থ : نفخة القيام তথা বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার ফুঁক। (আইসারুত তাফাসীর)
আবার কারো মতে ফুঁক দু’টো হবে- نفخة الموت তথা মৃত্যুবরণ করার ফুঁক এবং نفخة البعث তথা পুনরুত্থানের ফুঁক। আবার কারো মতে, ফুঁক দেয়া হবে তিনটি।
এ ফুঁৎকারের ফলে, আকাশ ও জমিনে যা কিছু থাকবে সকলে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা করবেন সে ব্যতীত। এরপর যখন ফুঁৎকার দেয়া হবে তখন সকলে আল্লাহ তা‘আলার দিকে ছুটে আসবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(فَاِنَّمَا ھِیَ زَجْرَةٌ وَّاحِدَةٌﭜﺫ فَاِذَا ھُمْ بِالسَّاھِرَةِﭝ)
“এটা তো একটি ভয়ঙ্কর ধমক মাত্র। ফলে হঠাৎ প্রশস্ত ময়দানে তাদের আবির্ভাব হবে।” (সূরা না-যি‘আ-ত ৭৯ : ১৩-১৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(يَوْمَ يَدْعُوْكُمْ فَتَسْتَجِيْبُوْنَ بِحَمْدِه۪ وَتَظُنُّوْنَ إِنْ لَّبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيْلًا)
‘যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করবেন এবং তোমরা তাঁর প্রশংসার সাথে তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবে এবং তোমরা মনে করবে, তোমরা অল্প সময়ই (দুনিয়াতে) অবস্থান করেছিলে।’ (সূরা বানী ইসরা-ঈল ১৭ : ৫২)
হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : শেষ ফুঁক দেয়ার পর আমিই হব প্রথম ব্যক্তি, যে তার মাথা উঠাবে। আমি তখন দেখব যে, মূসা (আঃ) আরশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানি না সে-কি পূর্বে থেকেই (অর্থাৎ তাঁকে কি বেহুঁশ করা হয়নি) নাকি ফুঁক দেয়ার পর (তিনি উঠেছেন)। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮১৩, সহীহ মুসলিম হা. ২৩৭৩-৩২৭৬)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন- সেদিন অর্থাৎ কিয়ামতের দিন পৃথিবী তাঁর জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে, আমলনামা পেশ করা হবে, নাবীদেরকে ও সাক্ষীদেরকে উপস্থিত করা হবে এবং সেদিন সকলের মধ্যে ন্যায় বিচার করা হবে। কারো প্রতি কোন প্রকার জুলুম, অত্যাচার করা হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَنَضَعُ الْمَوَازِيْنَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيٰمَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا ط وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا ط وَكَفٰي بِنَا حٰسِبِيْنَ)
“এবং কিয়ামত দিবসে আমি স্থাপন করব ন্যায়বিচারের মানদণ্ড। সুতরাং কারও প্রতি কোন অবিচার করা হবে না এবং কর্ম যদি সরিষার দানা পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও সেটা আমি উপস্থিত করব; হিসেব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।” (সূরা আল আম্বিয়া- ২১ : ৪৭)
জুলুম তো করা হবেই না বরং যদি কারো কোন নেকী থাকে তাহলে তিনি ওটাকে আরো দ্বিগুণ করে দেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ اللّٰهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ ج وَإِنْ تَكُ حَسَنَةً يُّضٰعِفْهَا وَيُؤْتِ مِنْ لَّدُنْهُ أَجْرًا عَظِيْمًا)
“আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না। আর কোন পুণ্য কর্ম হলে আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ করেন এবং আল্লাহ তাঁর নিকট হতে মহাপুরস্কার প্রদান করেন।” (সূরা আন্ নিসা ৪ : ৪০)
তাই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, সেদিন প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَه۫ ط وَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَّرَه۫ )
“অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎ কর্ম করলে তা দেখতে পাবে, এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কর্ম করলে তা-ও দেখতে পাবে।” (সূরা আয্ যিলযা-ল ৯৯ : ৭-৮)
সাক্ষী দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে মতামত রয়েছে; কেউ বলেছেন, সাক্ষীরা হলেন- যে-সকল ফেরেশতাগণ বান্দাদের আমল লিখতেন তারা। যেমন সূরা ক্বাফের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। কেউ বলেছেন- সাক্ষী হলেন উম্মাতে মুহাম্মাদী, তারা পূর্ববর্তী উম্মতের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে। যেমন সূরা বাকারার ১৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। আবার বলা হয়- যারা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় শহীদ হয়েছেন তারা। তবে সঠিক কথা এই যে, এখানে সাক্ষী দ্বারা উদ্দেশ্য রাসূলগণ, যাদেরকে তাঁদের উম্মতের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইউনুসের ৪৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার নূর বা জ্যোতি রয়েছে। যা দ্বারা পৃথিবী একদিন উদ্ভাসিত হবে।
২. কিয়ামতের মাঠে মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার করা হবে, কারো প্রতি কোন জুলুম করা হবে না।
৭১-৭৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
কিয়ামতের মাঠে বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর কাফির-মুশরিকদেরকে হাঁকিয়ে হাঁকিয়ে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(يَوْمَ يُدَعُّوْنَ إِلٰي نَارِ جَهَنَّمَ دَعًّا)
“সেদিন তাদেরকে চরমভাবে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের অগ্নির দিকে” (সূরা আত্ তূর ৫২ : ১৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(وَّنَسُوْقُ الْمُجْرِمِيْنَ إِلٰي جَهَنَّمَ وِرْدًا)
“এবং অপরাধীদেরকে তৃষ্ণাতুর অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব।” (সূরা মারইয়াম ১৯ : ৮৫-৮৬)
অতঃপর যখন তারা জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হবে তখন তার দরজাসমূহ তাদের জন্য খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে : তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য হতে রাসূলগণ আসেননি যারা তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের আয়াত তেলাওয়াত করত এবং তোমাদেরকে এই দিনের সাক্ষাত সম্বন্ধে সতর্ক করত? তারা বলবে : অবশ্যই এসেছিল।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
( كُلَّمَآ أُلْقِيَ فِيْهَا فَوْجٌ سَأَلَهُمْ خَزَنَتُهَآ أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَذِيْرٌ – قَالُوْا بَلٰي قَدْ جَا۬ءَنَا نَذِيْرٌ ৫ لا فَكَذَّبْنَا وَقُلْنَا مَا نَزَّلَ اللّٰهُ مِنْ شَيْءٍ ﺊإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا فِيْ ضَلَالٍ كَبِيْرٍ - وَقَالُوْا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِيْٓ أَصْحٰبِ السَّعِيْرِ )
“যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তখনই তাদেরকে জাহান্নামের রক্ষীরা জিজ্ঞাসা করবে : তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা উত্তরে বলবে : হ্যাঁ আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, আমরা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলাম এবং বলেছিলাম : আল্লাহ কিছুই নাযিল করেননি, তোমরা তো মহা গুমরাহীতে রয়েছ। এবং তারা আরো বলবে : যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না।” (সূরা আল মুল্ক ৬৭ : ৮-১০) কারণ আল্লাহ তা‘আলা কোন জাতিকে সতর্ক করার পূর্বে শাস্তি দেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ حَتّٰي نَبْعَثَ رَسُوْلًا)
আমি রাসূল না পাঠান পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না। (সূরা ইসরা ১৭ : ১৫)
তখন তারা তাদের অপরাধের কথা স্বীকার করবে এবং লজ্জিত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(فَاعْتَرَفُوْا بِذَنْۭبِھِمْﺆ فَسُحْقًا لِّاَصْحٰبِ السَّعِیْرِ)
“অতঃপর তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে। সুতরাং অভিশাপ জাহান্নামবাসীদের জন্য!” (সূরা মুল্ক ৬৭ : ১১)
কিন্তু তথায় লজ্জিত হয়ে কোনই লাভ হবে না, তাদেরকে বলা হবে তোমরা আজ চিরস্থায়ী জাহান্নামে প্রবেশ করো। আর এটা কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থল।
পক্ষান্তরে যারা মুত্তাকী তাদেরকেও হাঁকিয়ে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জান্নাতের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হবে তখন তার প্রহরীরা জান্নাতীদেরকে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেবে এবং বলবে : তোমাদের প্রতি সালাম- শান্তি তোমরা সুখী হও এবং এ চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করো। তখন জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করে বলবে : প্রশংসা ঐ আল্লাহ তা‘আলার যিনি আমাদেরকে দেয়া ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির অধিকারী বানিয়েছেন। আমরা জান্নাতে যেখানে খুশি বসবাস করব। জান্নাতী ও জাহান্নামীদের এ সকল অবস্থা সূরা আ‘রাফ এর ৪৪-৫০ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর যখন জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে চলে যাবে তখন ফেরেশতারা আরশের চারপাশ ঘিরে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করবে। সকলেই সেদিন মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَنَزَعْنَا مَا فِيْ صُدُوْرِهِمْ مِّنْ غِلٍّ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهٰرُ ج وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ هَدٰنَا لِهٰذَا قف وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلَآ أَنْ هَدٰنَا اللّٰهُ ج لَقَدْ جَا۬ءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ ط وَنُوْدُوْآ أَنْ تِلْكُمُ الْجَنَّةُ أُوْرِثْتُمُوْهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ)
“আমি তাদের অন্তর হতে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দেব, তাদের পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদী এবং তারা বলবে, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাদেরকে এর পথ দেখিয়েছেন। ‘আল্লাহ আমাদেরকে পথ না দেখালে আমরা কখনও পথ পেতাম না। আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ তো সত্যবাণীই নিয়ে এসেছিল,’ এবং তাদেরকে আহ্বান করে বলা হবে, ‘তোমরা যা করতে তারই জন্য তোমাদেরকে এ জান্নাতের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে।’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৪৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামতের মাঠে জান্নাতী এবং জাহান্নামীদের কিরূপ অবস্থা হবে সে সম্পর্কে জানা গেল।
২. আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে এবং জাহান্নামে প্রহরী নিযুক্ত রেখেছেন।
৩. জান্নাতে এবং জাহান্নামে দরজা রয়েছে।
৪. জান্নাতীদেরকে সালাম সম্ভাষণের মাধ্যমে জান্নাতে স্থান দেয়া হবে।