আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ কাউকে সম্মান দান করতে পারে না।

আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ কাউকে সম্মান দান করতে পারে না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
আয়াত:- ১০-১১

মহা প্রতাপান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ “কেউ ক্ষমতা চাইলে সে জেনে রাখুক যে, সব ক্ষমতা তো আল্লাহরই। অর্থাৎ যারা দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত থাকতে চায় তাকে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে চলতে হবে। তিনিই তার এ উদ্দেশ্যকে সফলতা দান করবেন। দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহই একমাত্র সত্তা যার হাতে সমস্ত ক্ষমতা, ইযযত ও সম্মান বিদ্যমান রয়েছে।

অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে মুমিনদেরকে ছেড়ে, তারা কি তাদের কাছে ইয্যত তালাশ করে? তাদের জেনে রাখা উচিত যে, সমস্ত ইয্যত তো আল্লাহর হাতে।”(৪:১৩৯)

আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের কথা যেন তোমাকে চিন্তিত ও দুঃখিত না করে, নিশ্চয়ই। সমস্ত ইয্যত তো আল্লাহরই জন্যে।” (১০:৬৫)

মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ইয্যত তো আল্লাহরই, আর তাঁর রাসূল (সঃ) ও মুমিনদের। কিন্তু মুনাফিকরা এটা জানে না।” (৬৩:৮)। | মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, প্রতিমা পূজায় ইয্যত নেই, ইতের অধিকারী তো একমাত্র আল্লাহ্। ভাবার্থ এই যে, ইযষত অনুসন্ধানকারীর আল্লাহর হুকুম মেনে চলার কাজে লিপ্ত থাকা উচিত। আর এটাও বলা হয়েছে যে, কার জন্যে ইয্যত তা যে জানতে চায় সে যেন জেনে নেয় যে, সমস্ত ইযত আল্লাহরই জন্যে।

যিকর, তিলাওয়াত, দু’আ ইত্যাদি সবই আল্লাহ্ তা’আলার নিকট পৌছে থাকে। এগুলো সবই পাক কালেমা।

মুখারিক ইবনে সালীম (রঃ) বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আমাদেরকে বলেনঃ “আমি তোমাদের কাছে যতগুলো হাদীস বর্ণনা করি সবগুলোরই সত্যতা আল্লাহর কিতাব হতে পেশ করতে পারি। জেনে রেখো যে, মুসলমান বান্দা যখন (আরবী) এই কালেমাগুলো পাঠ করে তখন ফেরেশতারা এগুলো তাদের ডানার নীচে নিয়ে আসমানের উপরে উঠে যান। এগুলো নিয়ে তাঁরা ফেরেশতাদের যে দলের পার্শ্ব দিয়ে গমন করেন তখন ঐ দলটি এই কালেমাগুলো পাঠকারীদের জন্যে আল্লাহ তা’আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। শেষ পর্যন্ত জগতসমূহের প্রতিপালক মহামহিমান্বিত আল্লাহর সামনে এই কালেমাগুলো পেশ করা হয়।” অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) (আরবী)-এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত কা’ব আহ্বার (রঃ) বলেন যে, (আরবী)-এই কালেমাগুলো আরশের চতুপার্শ্বে মৌমাছির ভন্ ভন্ শব্দের মত বের হয় এবং যারা এগুলো পাঠ করে তাদের কথা আল্লাহর সামনে আলোচিত হয় এবং সৎ কার্যাবলী খানা খানায় সংরক্ষিত থাকে।

হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “যারা আল্লাহর বুযর্গী, তার তাসবীহ, তাঁর হাদ, তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার একত্বের যিক্র করে, তাদের জন্যে এই কালেমাগুলো আরশের আশে-পাশে আল্লাহর সামনে তাদের কথা আলোচনা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে, সদা-সর্বদা তোমাদের যি আল্লাহর সামনে হতে থাকুক?” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, পাক কালাম দ্বারা উদ্দেশ্য আল্লাহর যিকর এবং সকর্ম দ্বারা উদ্দেশ্য ফরয কাজসমূহ আদায় করা। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকর ও ফরযসমূহ আদায় করে তার আমল তার যিকরকে আল্লাহর নিকট উঠিয়ে দেয়। কিন্তু যে আল্লাহর যিক্র করে কিন্তু ফরযসমূহ আদায় করে না, তার কালাম তার আমলের উপর ফিরিয়ে দেয়া হয়।

অনুরূপভাবে হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, কালেমায়ে তায়্যিবকে আমলে সালেহ্ নিয়ে যায়। অন্যান্য গুরুজন হতেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। এমনকি কাযী আইয়াস ইবনে মুআবিয়া (রঃ) বলেন যে, আমলে সালেহ্ বা ভাল আমল না থাকলে কালেমায়ে তায়্যিব বা উত্তম কথা উপরে উঠে না। হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, আমল ছাড়া কথা প্রত্যাখ্যাত হয়।

যারা মন্দ কর্মের ফন্দি আঁটে তারা হলো ঐসব লোক যারা ফাঁকিবাজি ও রিয়াকারী বা লোক দেখানো কাজ করে থাকে। বাহ্যিকভাবে যদিও এটা লোকদের কাছে প্রকাশিত হয় যে, তারা আল্লাহর আদেশ মেনে চলছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট। তারা ভাল কাজ যা কিছু করে সবই লোক দেখানো করে। তারা আল্লাহর যিক্র খুব কমই করে। আব্দুর রহমান (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা মুশরিককে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু সঠিক কথা এই যে, আয়াতটি সাধারণ। মুশরিকরা যে বেশী এর অন্তর্ভুক্ত এটা বলাই বাহুল্য।

মহা-প্রতাপান্বিত আল্লাহ্ বলেন যে, তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি। তাদের ফন্দি ও চক্রান্ত ব্যর্থ হবেই। তাদের মিথ্যাবাদিতা আজ না হলেও কাল প্রকাশ পাবেই। জ্ঞানীরা তাদের চক্রান্ত ধরে ফেলবে। কোন লোক যে কাজ করে তার লক্ষণ তার চেহারায় প্রকাশিত হয়ে থাকে। তার ভাষা ও কথা ঐ রঙেই রঞ্জিত হয়ে থাকে। ভিতর যেমন হয় তেমনিভাবে তার প্রতিচ্ছায়া বাইরেও প্রকাশ পায়। রিয়াকারীর বে-ঈমানী বেশীদিন গোপন থাকে না। নির্বোধরা তাদের চক্রান্তের জালে আবদ্ধ হয়ে থাকে সেটা অন্য কথা। মুমিন ব্যক্তি পুরোমাত্রায় জ্ঞানী ও বিবেকবান হয়ে থাকে। তারা তাদের ধোকাবাজি হতে বেশ সতর্ক থাকে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ্ তোমাদের আদম (আঃ)-কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর বংশকে এক ফোঁটা নিকৃষ্ট পানির (শুক্র বিন্দুর) মাধ্যমে জারী রেখেছেন। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জোড়া জোড়া বানিয়েছেন অর্থাৎ নর ও নারী। এটাও আল্লাহর এক বড় দয়া ও মেহেরবানী যে, তিনি নরদের জন্যে নারী বানিয়েছেন, যারা তাদের শান্তি ও আরামের উপকরণ। আল্লাহর অজ্ঞাতসারে কোন নারী গর্ভধারণ করে না এবং সন্তান প্রসব করে না। অর্থাৎ এসব খবর তিনি রাখেন। এমনকি প্রত্যেক ঝরে পড়া পাতা, অন্ধকারে পড়ে থাকা বীজ এবং প্রত্যেক সিক্ত ও শুষ্কের খবরও তিনি রাখেন। তাঁর কিতাবে এসব লিপিবদ্ধ রয়েছে।

নিম্নের আয়াতগুলোও এ আয়াতের অনুরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং জরায়ুতে যা কিছু কমে ও বাড়ে আল্লাহ্ তা জানেন এবং তাঁর বিধানে প্রত্যেক বস্তুরই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে। যা অদৃশ্য ও যা দৃশ্যমান তিনি তা অবগত। তিনি মহান, সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।” (১৩:৮-৯) এর পূর্ণ তাফসীর সেখানে বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ কোন দীর্ঘায়ু ব্যক্তির আয়ু বৃদ্ধি করা হয় না অথবা তার আয়ু হ্রাস করা হয় না, কিন্তু তা তো রয়েছে কিতাবে।

(আরবী) তে (আরবী) সর্বনামটির ফিরবার স্থান (আরবী) অর্থাৎ মানব। কেননা, দীর্ঘায়ু কিতাবে রয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার জ্ঞানে তার আয়ু হতে কম করা হয় না। (আরবী) -এর দিকেও সর্বনাম ফিরে থাকে। যেমন আরবে বলা হয়ঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার কাছে একটি কাপড় আছে এবং অন্য কাপড়ের অর্ধেক আছে।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা যে ব্যক্তির জন্যে দীর্ঘায়ু নির্ধারণ করে রেখেছেন সে তা পুরো করবেই। কিন্তু ঐ দীর্ঘায়ু তাঁর কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সে ঐ পর্যন্ত পৌছবে। আর যার জন্যে তিনি স্বল্পায় নির্ধারণ করেছেন তার জীবন ঐ পর্যন্তই পৌছবে। এ সবকিছু আল্লাহর কিতাবে পূর্ব হতেই লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর এটা আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই সহজ। আয়ু কম হওয়ার একটি ভাবার্থ এও হতে পারে যে, যে শুক্র পূর্ণতাপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই পড়ে যায় সেটাও আল্লাহর অবগতিতে রয়েছে। কোন কোন মানুষ শত শত বছর বেঁচে থাকে। আবার কেউ কেউ ভূমিষ্ট হওয়ার পরেই মারা যায়। ষাট বছরের কমে মৃত্যুবরণকারীও স্বল্পায়ু বিশিষ্ট।

এ কথা বলা হয়েছে যে, মায়ের পেটে দীর্ঘায়ু বা স্বল্পায় লিখে নেয়া হয়। সারা সৃষ্টজীবের আয়ু সমান হয় না। কারো আয়ু দীর্ঘ হয় কারো স্বল্প হয়। এগুলো আল্লাহ্ তা’আলার কাছে লিখিত রয়েছে। আর ওটা অনুযায়ীই প্রকাশ হতে রয়েছে।

কেউ কেউ বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছেঃ যে নির্ধারিত কাল লিখিত হয়েছে এবং ওর মধ্য হতে যা কিছু অতিবাহিত হয়েছে, সবই আল্লাহর অবগতিতে আছে এবং তাঁর কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে চায় যে, তার রিযক ও বয়স বেড়ে যাক সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখে।”

মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “কারো নির্ধারিত সময় এসে যাওয়ার পর তাকে অবকাশ দেয়া হয় না।”

বয়স বৃদ্ধি পাওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সৎ সন্তান জন্মগ্রহণ করা, যার দু’আ তার মৃত্যুর পর তার কবরে পৌঁছতে থাকে। বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ এটাই। এটা আল্লাহর নিকট খুবই সহজ। এটা তাঁর অবগতিতে রয়েছে। তাঁর জ্ঞনি সমস্ত সৃষ্টজীবকে পরিবেষ্টন করে আছে। তিনি সব কিছুই জানেন। কিছুই তাঁর কাছে গোপন নেই।

# বিভিন্ন প্রকার জিনিস সৃষ্টির বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তা’আলা নিজের অসীম ও ব্যাপক ক্ষমতা সাব্যস্ত করছেন। তিনি দুই প্রকারের সাগর সৃষ্টি করেছেন। একটার পানি স্বচ্ছ, সুমিষ্ট ও সুপেয়। এই প্রকারের পানি হাটে, মাঠে, জঙ্গলে, বাগানে বরাবর জারি হয়ে থাকে। অন্যটির পানি লবণাক্ত ও তিক্ত, যার উপর দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করে। এ দুই প্রকারের সাগর থেকে মানুষ মাছ ধরে থাকে এবং তাজা গোশত খেয়ে থাকে। আবার ওর মধ্য হতে অলংকার-পত্র বের করে। অর্থাৎ মণি-মুক্তা ইত্যাদি। এই জাহাজগুলো পানি কেটে চলাফেরা করে। বাতাসের মুকাবিলা করে চলতে থাকে। যেন মানুষ তার সাহায্যে আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পারে। যেন তারা এক দেশ হতে অন্য দেশে পৌঁছতে পারে। তার জন্যে যেন তারা বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। তিনি এগুলোকে মানুষের অনুগত করেছেন। মানুষ সাগর, দরিয়া ও নদী হতে জাহাজ দ্বারা লাভালাভ হাসিল করতে পারে। সেই মহাশক্তিশালী আল্লাহ আসমান ও যমীনকে মানুষের অনুগত করেছেন। এগুলো সবই তার ফযল ও করম!
# ১৩-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় পূর্ণ শক্তির বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি রাত্রিকে অন্ধকারময় এবং দিনকে জ্যোতির্ময় করে সৃষ্টি করেছেন। কখনো তিনি রাতকে বড় করেছেন আবার কখনো দিনকে বড় করেছেন। আবার কখনো রাত দিনকে সমান করেছেন। কখনো হয় শীতকাল, আবার কখনো হয় গ্রীষ্মকাল। তিনি সূর্য, চন্দ্র এবং স্থির ও চলমান তারকারাজিকে বাধ্য ও অনুগত করে রেখেছেন। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত সময়ের উপর চলতে রয়েছে। পূর্ণ জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ এই ব্যবস্থা কায়েম রেখেছেন যা বরাবর চলতে রয়েছে। আর নির্ধারিত সময় অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত এভাবে চলতেই থাকবে। যে আল্লাহ এ সবকিছু করেছেন তিনিই প্রকৃতপক্ষে মা’ৰূদ হবার যোগ্য। তিনি সবারই পালনকর্তা। তিনি ছাড়া কেউই মা’রূদ হওয়ার যোগ্য নয়। আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা আহ্বান করছে, তারা ফেরেশতাই হোক না কেন, সবাই তারা তাঁর সামনে উপায়হীন ও ক্ষমতাহীন। খেজুরের আঁটির আবরণেরও তারা অধিকারী নয়। আকাশ ও পৃথিবীর অতি নগণ্য জিনিসেরও তারা মালিক নয়। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাকো তারা তোমাদের ডাক শুনেই না। তোমাদের এই প্রতিমাগুলো তো প্রাণহীন জিনিস। তাদের কান নেই যে, তারা শুনতে পাবে। যাদের প্রাণ নেই তারা শুনবে কিরূপে? আর যদি মনে করা হয় যে, তারা তোমাদের ডাক শুনতে পায়, তাহলেও কিন্তু তারা তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। কেননা, তারা তো কোন কিছুরই মালিক নয়। সুতরাং তারা তোমাদের কোন প্রয়োজন পুরো করতে পারে না। কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরককে অস্বীকার করবে এবং তোমাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের চেয়ে বড় বিভ্রান্ত আর কে হবে যারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডাকে যারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারবে না এবং তারা তাদের ডাক হতে উদাসীন। আর যখন লোকদেরকে একত্রিত করা হবে তখন তারা তাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তাদের ইবাদতকে তারা অস্বীকার করবে।” (৪৬:৫-৬) আল্লাহ তা’আলা আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য মা’বুদ গ্রহণ করে যাতে তারা তাদের সহায় হয়। কখনই নয়; তারা তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে এবং তাদের বিরোধী হয়ে যাবে।” (১৯:৮১-৮২)

আল্লাহ তা’আলার ন্যায় সত্য সংবাদ আর কে দিতে পারে? তিনি যা কিছু বলেছেন তা অবশ্য অবশ্যই হবে। যা কিছু হচ্ছে বা হবে তিনি সে সম্পর্কে পূর্ণ। ওয়াকিফহাল। তার মত খবর আর কেউই দিতে পারে না।
১৫-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনি মাখলুক হতে অভাবশূন্য, আর সমস্ত যাক তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি অভাবমুক্ত এবং সবাই অভাবী। তিনি বেপরোয়া এবং সমস্ত সৃষ্টজীবই তাঁর মুখাপেক্ষী। সবাই তার সামনে হেয় ও তুচ্ছ এবং তিনি মহা প্রতাপশালী ও বিজয়ী। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কারো নড়াচড়ার বা থেমে থাকারও ক্ষমতা নেই। এমনকি তার বিনা হুকুমে শ্বাস-প্রশ্বাসেরও কারো অধিকার নেই। সৃষ্টি জগতের সবাই অসহায় ও নিরুপায়। বেপরোয়া, অমুখাপেক্ষী ও অভাবমুক্ত একমাত্র আল্লাহ। তিনি যা চান তাই করতে পারেন। তিনি যা করেন সবকিছুতেই তিনি প্রশংসনীয়। তাঁর কোন কাজই হিকমত ও প্রশংসাশূন্য নয়। নিজ কথা ও কাজে, নিজ বিধানে, তাকদীর নির্ধারণে, মোটকথা তার সব কাজই প্রশংসার যোগ্য।

মহান আল্লাহ বলেনঃ হে লোক সকল! আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে তোমাদের স্থলে অন্য সৃষ্টি আনয়ন করতে পারেন। এটা তার কাছে খুবই সহজ।

কিয়ামতের দিন কেউ তার বোঝা অন্যের উপর চাপাতে চাইলে তা পূর্ণ হবে না। এমন কেউ সেখানে থাকবে না যে তার বোঝা বহন করবে। বন্ধু-বান্ধব ও নিকটতম আত্মীয়রা সবাই সেদিন মুখ ফিরিয়ে নিবে। হে লোকেরা! জেনে রেখো যে, পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে। সেদিন সবারই উপর একই রকম বিপদ আসবে।

হযরত ইকরামা (রঃ) বলেছেন যে, প্রতিবেশী প্রতিবেশীর পিছনে লেগে যাবে। সে আল্লাহ তা’আলার কাছে আরয করবেঃ “হে আল্লাহ! আপনি তাকে জিজ্ঞেস করুন, কেন সে আমা হতে তার দরযা বন্ধ করে দিয়েছিল?” কাফির মুমিনের পিছনে লেগে যাবে এবং যে ইহসান সে দুনিয়ায় তার উপর করেছিল তা সে তাকে স্মরণ করিয়ে দিবে এবং বলবেঃ “আজ আমি তোমার মুখাপেক্ষী।” মুমিনও তার জন্যে সুপারিশ করবে এবং হতে পারে যে তার শাস্তিও কিছু কম হবে, যদিও জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভ অসম্ভব। পিতা পুত্রকে তার প্রতি তার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলবেঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! সরিষা পরিমাণ পুণ্য আজ তুমি আমাকে দাও।” পুত্র বলবেঃ “আব্বা! আপনি জিনিস তো অল্পই চাচ্ছেন। কিন্তু যে ভয়ে আপনি ভীত রয়েছেন সেই ভয়ে আমিও ভীত রয়েছি। সুতরাং আজ তো আমি আপনাকে কিছুই দিতে পারছি না।” তখন সে তার স্ত্রীর কাছে যাবে এবং বলবেঃ “দুনিয়ায় আমি তোমার প্রতি যে সদ্ব্যবহার করেছিলাম তা তো অজানা নেই?” উত্তরে স্ত্রী বলবেঃ “আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু এখন আপনার কথা কি?” সে বলবেঃ “আজ আমি তোমার মুখাপেক্ষী। আমাকে একটি নেকী দিয়ে দাও যাতে আমি আজ এই কঠিন আযাব হতে মুক্তি পেতে পারি।” স্ত্রী জবাবে বলবেঃ “আপনার আবেদন ও চাহিদা তো খুবই হালকা বটে, কিন্তু যে ভয়ে আপনি রয়েছেন সে ভয় আমারও কোন অংশে কম নয়। সুতরাং আজ তো আমি আপনার কোন উপকার করতে পারবো না।” কুরআন কারীমের অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “না পিতা পুত্রের কোন উপকারে আসবে এবং না পুত্র পিতার কোন উপকারে লাগবে।” (৩১:৩৩) মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই দিন মানুষ পলায়ন করবে তার ভ্রাতা হতে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তান হতে। সেই দিন তাদের প্রত্যেকের হবে এমন গুরুতর অবস্থা যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে।”(৮০:৩৪-৩৭)

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি শুধু তাদেরকেই সতর্ক করতে পার যারা তাদের প্রতিপালককে না দেখে ভয় করে এবং নামায কায়েম করে।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যে কেউ নিজেকে পরিশোধন করে সে তো পরিশোধন করে নিজেরই কল্যাণের জন্যে। ফিরে তো আল্লাহর কাছেই যেতে হবে। তার কাছে হাযির হয়ে হিসাব দিতে হবে। তিনি স্বয়ং আমলের বিনিময় প্রদান করবেন।
১৯-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা বলছেন যে, মুমিন ও কাফির সমান হয় না, যেমন সমান হয় অন্ধ ও চক্ষুষ্মন, অন্ধকার ও আলো, ছায়া ও রৌদ্র এবং জীবিত ও মৃত। যেমন এগুলোর মাঝে আকাশ পাতালের পার্থক্য রয়েছে, ঠিক তেমনই ঈমানদার ও কাফিরদের মাঝে সীমাহীন পার্থক্য বিরাজমান। মুমিন কাফিরের সম্পূর্ণ বিপরীত। কাফির হচ্ছে অন্ধ, অন্ধকার ও গরম লু হাওয়ার মত। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা মৃত ছিল তাদেরকে আমি জীবিত করে দিয়েছি, তাদেরকে নূর বা আলো দিয়েছি, সেগুলো নিয়ে তারা লোকদের মাঝে চলাফেরা করে, তারা কি তাদের মত যারা অন্ধকারে চলাফেরা করে?(৬:১২২) আর এক আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “দু’টি দলের দৃষ্টান্ত অন্ধ ও বধির এবং চক্ষুষ্মন ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন লোকের মত, এ দু’দলের দৃষ্টান্ত কি সমান?”(১১:২৪) মুমিনের তো চোখ আছে ও কান আছে। সে আলোক প্রাপ্ত। সে সরল সঠিক পথে রয়েছে। সে ছায়া ও নহর বিশিষ্ট জান্নাতে প্রবেশ করবে। অপরপক্ষে, কাফির অন্ধ ও বধির। সে দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না। অন্ধকারে সে জড়িয়ে পড়েছে। অন্ধকার হতে বের হতে পারে না। সে জাহান্নামে পৌঁছে যাবে যা অত্যন্ত গরম ও কঠিন তাপবিশিষ্ট এবং দাহনকারী আগুনের ভাণ্ডার।

আল্লাহ যাকে চাইবেন শুনিয়ে দিবেন অর্থাৎ এমনভাবে শুনবার তাওফীক দিবেন যে, সে শুনে কবূলও করে নিবে।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যারা কবরে আছে তাকে তুমি (হযরত মুহাম্মাদ সঃ) শুনাতে সমর্থ হবে না। অর্থাৎ কেউ যখন মরে যায় এবং তাকে সমাধিস্থ করা হয় তখন তাকে ডাকা যেমন বৃথা, তেমনই কাফিররাও যে, তাদেরকে হিদায়াতের দাওয়াত দেয়া বৃথা। অনুরূপভাবে মুশরিকদের উপরেও দুর্ভাগ্য ছেয়ে গেছে। সুতরাং তাদের হিদায়াত লাভের কোন আশা নেই। হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে কখনো হিদায়াতের উপর আনতে পার না। তুমি তো একজন সতর্ককারী মাত্র। তোমার কাজ শুধু আমার বাণী মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া। হিদায়াত করা ও পথভ্রষ্ট করার মালিক আল্লাহ।

হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল আসতে থেকেছেন যাতে তাদের কোন ওযর বাকী না থাকে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক কওমের জন্যেই একজন হিদায়াতকারী রয়েছে।” (১৩:৭) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই আমি রাসূল পাঠিয়েছিলাম।” (১৬:৩৬) কাজেই এদের এই নবী (সঃ)-কে অবিশ্বাস ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা কোন নতুন কথা নয়। এদের পূর্বের লোকেরাও তাদের রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছিল। তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শন, গ্রন্থাদি ও দীপ্তিমান কিতাবসহ এসেছিল। তবুও তারা তাদেরকে বিশ্বাস করেনি। তাদের অবিশ্বাস করার পরিণাম এই হয়েছিল যে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে তার শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করেছিলেন এবং তাঁর শাস্তি ছিল কতই না ভয়ংকর।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১০-১১ নং আয়াতের তাফসীর:

(مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعِزَّةَ فَلِلهِ الْعِزَّةُ جَمِيْعًا)

‘যে ব্যক্তি সম্মান লাভ করতে চায় (সে জেনে রাখুক!), সকল সম্মান আল্লাহরই জন্য’ অত্র আয়াতে বলা হচ্ছে যে, সমস্ত সম্মান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আর তাঁর থেকে সম্মান নিতে হলে তাঁর আনুগত্য করতে হবে এবং তাঁর ইবাদত করতে হবে। যে তাঁর আনুগত্য করে তিনি তাকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সম্মানীত করবেন। পক্ষান্তরে যারা তাঁকে ব্যতীত অন্যের ইবাদত করার মাধ্যমে সম্মান অর্জন করতে চায়, কাফির-মুশরিকদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে সম্মান অর্জন করতে চায়, মু’মিনদেরকে অপছন্দ করে তারা কোন দিন সম্মান খুঁজে পাবে না। কেননা তারা উদ্দিষ্ট জায়গা ব্যতীত অন্য জায়গায় সম্মান অন্বেষণ করে। অথচ সম্মান মূলত আল্লাহ তা‘আলার নিকট। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(الَّذِيْنَ يَتَّخِذُوْنَ الْكٰفِرِيْنَ أَوْلِيَا۬ءَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِيْنَ ط أَيَبْتَغُوْنَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلّٰهِ جَمِيْعًا) ‏

“মু’মিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি তাদের নিকট ইযযত চায়? বরং সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই।” (সূরা নিসা ৪:১৩৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(وَلِلّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُوْلِه۪ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَلٰكِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ)

“মান-সম্মান তো আল্লাহরই, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদের; কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।” (সূরা মুনাফিকূন ৬৩:৮)

সুতরাং কেউ যদি দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান অর্জন করতে চায় তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার মাধ্যমে তাঁর নিকটই সম্মান অন্বেষণ করতে হবে। কাফির-মুশরিকদের আনুগত্য করে, তাদের ক্ষমতাকে ভয় করে ও তাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে সম্মান পাওয়া যাবে না।

(إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ)

-অর্থাৎ পবিত্র বাণীসমূহ তাঁরই দিকে আরোহন করে। এখানে পবিত্র বাণী দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ-তাহমীদ, যিকির-আযকার ও তেলাওয়াতসহ সকল ভাল কথা। অনুরূপভাবে সকল “সৎ আমল” চাই সে আমল অন্তরের হোক আর অঙ্গ-প্রতঙ্গের হোক সবই তাঁর দিকে আরোহন করে। আরোহন করার অর্থ হলো এ সকল ভাল কথা ও কাজ ফেরেশ্তারা ঊর্ধ্বাকাশে আল্লাহ তা‘আলার কাছে নিয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা তা কবুল করতঃ সওয়াব প্রদান করেন। পক্ষান্তরে অসৎ আমল সৎ আমলের বিপরীত। তাছাড়া এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহ তা‘আলা ওপরে রয়েছেন। তিনি সর্বত্র বিরাজমান হলে এসকল উত্তম কথা ও সৎআমল ওপরে আরোহন করে নিয়ে যাওয়ার কোন অর্থই হয় না। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান নয়, বরং তিনি ওপরে রয়েছেন।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা অসৎ কর্ম করার চক্রান্ত করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আর তাদের এ চক্রান্ত কখনো সফল হবে না, বরং তা ব্যর্থ হবেই।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ مَكْرِهِمْ أَنَّا دَمَّرْنٰهُمْ وَقَوْمَهُمْ أَجْمَعِيْنَ) ‏

“অতএব দেখ, তাদের চক্রান্তে‎র পরিণাম কী হয়েছেন আমি অবশ্যই তাদেরকে ও তাদের সম্প্রদায়ের সকলকে ধ্বংস করেছি।” (সূরা নামল ২৭:৫১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(وَقَدْ مَكَرُوْا مَكْرَهُمْ وَعِنْدَ اللّٰهِ مَكْرُهُمْ ط وَإِنْ كَانَ مَكْرُهُمْ لِتَزُوْلَ مِنْهُ الْجِبَالُ)‏

“তারা ভীষণ চক্রান্ত‎ করেছিল, কিন্তু তাদের চক্রান্ত‎ আল্লাহর সামনেই ছিল যদিও তাদের চক্রান্ত‎ এমন ছিল, যাতে পর্বত টলে যেত।” (সূরা ইবরাহীম ১৩:৪৬)

শাহর বিন হাওশাব এ আয়াতের তাফসীরে বলেন: এসব লোকেরা হল তারা যারা মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করে। ইবনু আব্বাসসহ প্রমুখ বলেন: যারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হত্যা করার জন্য দারুন নাদওয়াতে একত্রিত হয়েছিল (কুরতুবী)। তবে সঠিক কথা হচ্ছেন এখানে খারাপ কাজের চক্রান্ত করার অর্থ হল- আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করা এবং স্বীয় অনুসারীদেরকে তা করার নির্দেশ দেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَقَالَ الَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا لِلَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا بَلْ مَكْرُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ إِذْ تَأْمُرُوْنَنَآ أَنْ نَّكْفُرَ بِاللّٰهِ وَنَجْعَلَ لَه۫ٓ أَنْدَادًا)

“যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তারা অহঙ্কারীদেরকে বলবে: প্রকৃতপক্ষে তোমরাই তো দিবা-রাত্র চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহকে অমান্য করি এবং তাঁর শরীক স্থাপন করি।” (সূরা সাবা ৩৪:৩৩, আযওয়াউল বায়ান)

(وَاللّٰهُ خَلَقَكُمْ…. أَزْوَاجًا)

‘আর আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে, তারপর তোমাদেরকে করেছেন জোড়া জোড়া।’ এ সম্পর্কে সূরা আল হাজ্জ-এর ৫ নং আয়াতসহ অন্যান্য স্থানেও আলোচনা করা হয়েছে।

(وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنْثٰي وَلَا تَضَعُ إِلَّا بِعِلْمِه)

অর্থাৎ কোন মহিলা কী গর্ভধারণ করে এবং কখন তা প্রসব করে তা আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানায়াত্ত্ব। তিনি সে সম্পর্কে অবগত আছেন অর্থাৎ সৃষ্টিকূলের মধ্যে যা কিছু হয় সবই আল্লাহ তা‘আলা দেখেন, শুনেন এবং সবই তাঁর জ্ঞানায়ত্ত্বে। এ বিষয়ে সূরা র্আ রা‘দ-এর ৮ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কোন ব্যক্তির আয়ু বৃদ্ধি করা হোক অথবা হ্রাস করা হোক তা মূলত পূর্ব থেকেই লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তবে সৎ আমলের মাধ্যমে আয়ু বৃদ্ধি পায়, যেমন আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি “যে ব্যক্তি চায় তার রিযিক বৃদ্ধি করা হোক এবং তার আয়ু বৃদ্ধি করা হোক সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।” (সহীহ বুখারী হা: ২০৬৮, সহীহ মুসলিম হা: ২৫৫৭)

আর আয়ু কমে যাওয়ার একটি কারণ হলো বেশি বেশি পাপ কাজ করা। তবে এ হ্রাস-বৃদ্ধিও লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

( يَمْحُوا اللّٰهُ مَا يَشَا۬ءُ وَيُثْبِتُ ﺸ وَعِنْدَه۫ٓ أُمُّ الْكِتٰبِ)

“আল্লাহ যা ইচ্ছা তা নিশ্চিহ্ন করেন এবং যা ইচ্ছা তা প্রতিষ্ঠিত রাখেন এবং তাঁরই নিকট আছে উম্মুল কিতাব (লাওহে মাহফূজ)।” (সূরা রাদ ১৩:৩৯)

সৎ আমলের মাধ্যমে আয়ু বৃদ্ধি পাওয়া আর অসৎ আমলের মাধ্যমে আয়ু কমে যাওয়া উভয়টাই লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি চায় তার আয়ু ও রিযিক বৃদ্ধি পাক সে যেন ভাল আমল করে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. পুনরুত্থান দিবস অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। এতে কোনই সন্দেহ নেই।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ কাউকে সম্মান দান করতে পারে না।
৩. ভাল কথা ও সৎ আমলসমূহ আল্লাহ তা‘আলার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
৪. প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর জ্ঞানায়ত্বে। তিনি জানেন না এমন কোন কাজ সংঘটিত হয় না।
৫. আত্মীয়তার সম্পর্কের মাধ্যমে আয়ু বৃদ্ধি পায় আর পাপাচারের কারণে আয়ু কমে যায়।
৬. আল্লাহ তা‘আলা ঊর্ধ্বে আছেন, তাই ফেরেশতারা সৎ আমলসমূহকে ওপরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে নিয়ে যায়।
১২-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:

(وَمَا یَسْتَوِی الْبَحْرٰنِ… وَلَعَلَّکُمْ تَشْکُرُوْنَﭛ)

আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা ও বড়ত্বে অনেকটা প্রমাণ পাওয়া যায় এ আয়াতে। আল্লাহ তা‘আলা দু’টি নদী পাশাপাশি প্রবাহিত করছেন, একটির পানি মিষ্টি ও সুপেয় আর অপরটির পানি লবণাক্ত যা পান করা যায় না, একটির পানি অপটির সাথে সংমিশ্রণ হয় না অথচ মাঝখানে বাহ্যিক কোন পার্টিশন নেই। নিশ্চয়ই এটা মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও বড়ত্বের বহিঃপ্রকাশ। এ সম্পর্কে সূরা আল ফুরক্বা-ন-এর ৫৩ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

( وَمِنْ كُلٍّ تَأْكُلُوْنَ….)

‘তোমরা প্রত্যেকটি থেকেই টাটকা গোশত খাও….’ অর্থাৎ মিষ্টি ও নোনা উভয় পানি হতে মাছ পাওয়া যায়। لحم দ্বারা উদ্দেশ্য হল মাছ, যা তরতাজা ধরা হয়। তাই طري বা টাটকা বলা হয়েছে এবং সমুদ্রে পরিধেয় অলংকার ও রতœাবলী পাওয়া যায়।

এ ছাড়াও সমুদ্রে যেসব নৌযান চলাচল করে সে কথাও বলা হয়েছে এ আয়াতে। এ সম্পর্কে সূরা নাহল-এর ১৪ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

(يُوْلِجُ اللَّيْلَ….. وَلَا یُنَبِّئُکَ مِثْلُ خَبِیْرٍﭝﺟ)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিছু নিদর্শন ও ক্ষমতার কথা ব্যক্ত করেছেন। এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা লুক্বমান-এর ২৯-৩০ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। قِطْمِيْرٍ বলা হয় পাতলা সাদা ছাল যা খেজুরের আঁটির ওপরে থাকে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সমস্যা নিরসনে এবং কল্যাণ লাভের জন্য যারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যকে আহ্বান করে তারা আহ্বানকারীর ডাক শুনে না। আর যদি শুনেও তবে তারা ডাকে সাড়া দিতে পারবে না। এমনকি কিয়ামত দিবসে তারা তাদের আহ্বানকারীদেরকে অস্বীকার করবে এবং তারা তাদের শত্র“ হয়ে যাবে।

আল্লাহ বলেন,

(وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَّدْعُوْا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ مَنْ لَّا يَسْتَجِيْبُ لَه۫ٓ إِلٰي يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَآئِهِمْ غٰفِلُوْنَ -‏ وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوْا لَهُمْ أَعْدَا۬ءً وَّكَانُوْا بِعِبَادَتِهِمْ كٰفِرِيْنَ)

“সে ব্যক্তির চেয়ে বেশি গোমরাহ আর কে হতে পারে, যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত র্পযন্তও সাড়া দেবে না। বরং তারা তাদের আহ্বান সম্পর্কে গাফেল। (হাশরের ময়দানে ) যখন সব মানুষকে একত্রিত করা হবে তখন যারা তাদেরকে ডাকত তারা তাদের দুশমন হয়ে যাবে এবং তাদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে।” (সূরা আহকাফ ৪৬:৫-৬)

সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত এমন কেউ নেই যে, তার ইবাদত করলে সে তার ইবাদতকারীর কোন উপকার করতে পারবে। বরং তাদের ইবাদত করার কারণে আরো ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে এবং এ কারণে শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই সকল প্রকার সমস্যা নিরসনে এবং যাবতীয় কল্যাণ লাভের জন্য কেবল আল্লাহকেই আহ্বান করতে হবে। কেননা তিনি কল্যাণ দিতে পারেন, সকল সমস্যাও নিসরন করতে পারেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. প্রত্যেকের জন্যই একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে, সে নির্ধারিত সময় চলে আসলে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কারো ইবাদত করা যাবে না। কারণ তিনি ব্যতীত কেউ বিন্দু পরিমাণ জিনিসেরও মালিক নয়।
১৫-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:

প্রথমত আল্লাহ তা‘আলা তা’আলা নিজের পরিপূর্ণতার বর্ণনা দিয়ে বলছেন, সকল মানুষ আল্লাহ তা‘আলার মুখাপেক্ষী, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কারো মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

(وَاللّٰهُ الْغَنِيُّ وَأَنْتُمُ الْفُقَرَا۬ءُ ج وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ لا ثُمَّ لَا يَكُوْنُوْآ أَمْثَالَكُمْ)‏

“আল্লাহ অভাবমুক্ত, তোমরাই অভাবগ্রস্ত। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে রাখ তাহলে আল্লাহ তোমাদের বদলে অন্য কাওমকে নিয়ে আসবেন। আর তারা তোমাদের মত হবে না।” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩৮)

হাদীসে কুদসীতে এসেছে:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে আমার বান্দা, তোমাদের পূর্বাপর সকল মানুষ ও জিন জাতি, তোমাদের জীবিত ও মৃত সবাই যদি ভাল হয়ে একজন সৎ লোকের আত্মার মত হয়ে যাও তাহলে আমার রাজত্বের কিছুই বৃদ্ধি পাবে না। আবার তোমাদের পূর্বাপর সকল মানুষ ও জিন জাতি, তোমাদের জীবিত ও মৃত সবাই যদি খারাপ হয়ে একজন খারাপ লোকের আত্মার মত হয়ে যাও তাহলে আমার রাজত্বের কোন কিছুই কমবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২৫৭৭)

(إِنْ يَّشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيْدٍ)

‘যদি তিনি ইচ্ছা করেন তবে তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেবেন এবং এক নতুন সৃষ্টি আনবেন।’ এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা নিসা’র ১৩৩ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

(وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ أُخْرٰي)

কোন ব্যক্তি অন্যজনের পাপের ভার বহন করবে না। প্রত্যেকে নিজেই তার পাপের ভার বহন করবে। ইকরিমা (عليه السلام) অত্র আয়াতের তাফসীরে বলেন: সে দিন এক পিতা তার পুত্রকে বলবে, তুমি জান যে, আমি তোমার প্রতি কেমন স্নেহশীল ও সদয় পিতা ছিলাম। পুত্র স্বীকার করে বলবে: নিশ্চয়ই আপনার ঋণ অসংখ্য। আমার জন্য পৃথিবীতে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। অতঃপর পিতা বলবে: হে বৎস, আজ আমি তোমার মুখাপেক্ষী। তোমার পুণ্যসমূহের মধ্য থেকে আমাকে যৎসামন্য দিয়ে দাও, এতে আমার মুক্তি হয়ে যাবে। পুত্র বলবে: বাবা আপনি সামান্য বস্তুই চেয়েছেন কিন্তু আমি কী করব, যদি আমি তা আপনাকে দিয়ে দেই, তবে আমারও তো সে অবস্থা হবে। অতএব আমি আপনাকে যৎসামান্য পুণ্য দিতে অক্ষম। অতঃপর সে তার সহধর্মিণীকেও এ কথা বলবে যে, দুনিয়াতে আমি তোমার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি। আজ তোমার কাছে সামান্য পুণ্য চাচ্ছি, তুমি তা দিয়ে দাও। সহধর্মিণীও পুত্রের অনুরূপ জওয়াব দেবে।
ইকরিমা বলেন:

(وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ أُخْرٰي)

বাক্যের অর্থও তাই। এ সম্পর্কে আলোচনা সূরা বানী ইসরাঈল-এর ১৫ নং আয়াতেও করা হয়েছে।

مُثْقَلَةٌ বলা হয় সে ব্যক্তিকে যে পাপের বোঝা বহন করবে, সে তার পাপের বোঝা বহন করার জন্য নিজের আত্মীয়দেরকে ডাকবে, কিন্তু কেউ তার আহ্বানে সাড়া দিবে না।

( إِنَّمَا تُنْذِرُ الَّذِيْنَ….. الصَّلٰوةَ)

‘তুমি কেবল তাদেরকে সতর্ক করতে পারো, যারা তাদের প্রতিপালককে না দেখে ভয় করে’ এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সতর্ক করাটা সীমাবদ্ধ করেছেন ঐ সকল লোকদের জন্য যারা আল্লাহ তা‘আলাকে না দেখেও ভয় করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে। এখানে মু’মিনদের সাথে নির্দিষ্ট করার কারণ এই যে, যেহেতু তারাই এ সতর্কবাণী দ্বারা উপকৃত হয় তাই বস্তুত সকলকেই সতর্ক করা হয় কিন্তু যারা কাফির-মুশরিক তারা এর দ্বারা উপকৃত হয় না।

আল্লাহর বাণী,

(وَسَوَا۬ءٌ عَلَيْهِمْ أَأَنْذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنْذِرْهُمْ لَا يُؤْمِنُوْنَ ‏ إِنَّمَا تُنْذِرُ مَنِ اتَّبَعَ الذِّكْرَ وَخَشِيَ الرَّحْمٰنَ بِالْغَيْبِ ج فَبَشِّرْهُ بِمَغْفِرَةٍ وَّأَجْرٍ كَرِيْمٍ)‏

“তুমি তাদেরকে সতর্ক কর কিংবা না কর, তাদের পক্ষে উভয়ই সমান, তারা ঈমান আনবে না। তুমি কেবল তাকেই সতর্ক কর, যে উপদেশ মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে। অতএব তুমি তাকে সুসংবাদ শুনিয়ে দাও ক্ষমা ও উত্তম পুরস্কারের।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:১০-১১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(إِنَّمَآ أَنْتَ مُنْذِرُ مَنْ يَّخْشَاهَا)

“যে তার ভয় করে তুমি কেবল তারই সতর্ককারী।” (সূরা নাযিআত ৭৯:৪৫)

মূলত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলের জন্যই সতর্ককারী। আর বিশ্বাসীগণই যেহেতু এ সতর্কবাণী দ্বারা সতর্ক হয় তাই বিশেষ করে তাদের কথাই বলা হয়েছে।

অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, কেউ নিজেকে সংশোধন করে নিলে সে তা নিজের কল্যাণার্থেই করল। এর দ্বারা অন্য কারো কল্যাণ হবে না, বরং তারই উপকার হবে। আর যদি সংশোধন না করে নেয় তাহলে তার নিজেরই ক্ষতি হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন বরং বান্দা প্রতিটি কাজে আল্লাহ তা‘আলার মুখাপেক্ষী।
২. প্রত্যেককে তার নিজের পাপভার নিজেকেই বহন করতে হবে, কেউ কারো পাপভার বহন করবে না। যদিও নিকটাত্মীয় হয়।
৩. মানুষ যা কিছু করে তা মূলত তারই কল্যাণ বা অকল্যাণে আসবে, অন্য কারো নয়।
১৯-২৬ নং আয়াতের তাফসীর

(وَمَا يَسْتَوِي الْأَعْمٰي وَالْبَصِيْرُ)

‘আর সমান নয় অন্ধ ও দৃষ্টিমান ব্যক্তি’ এখানে অন্ধ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন লোকের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে যে, অন্ধ অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলার দীনের ব্যাপারে অন্ধ তারা এবং যারা আল্লাহ তা‘আলার দীনের ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান রাখে ও অনুসরণ করে তারা কখনো সমান হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

(مَثَلُ الْفَرِيْقَيْنِ كَالْأَعْمٰي وَالْأَصَمِّ وَالْبَصِيْرِ وَالسَّمِيْعِ ط هَلْ يَسْتَوِيٰنِ مَثَلًا ط أَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ)

“দু শ্রেণির লোকের উপমা যেমন একজন অন্ধ ও বধির এবং অপরজন চুক্ষুস্মান ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন তুলনায় এ দু’টি কি সমান?” (সূরা হূদ ১১:২৪)

উক্ত আয়াতে অন্ধ দ্বারা কুফর এবং চাক্ষুমান দ্বারা ঈমান বুঝানো হয়েছে। সুতরাং কুফর ও ঈমান কখনো সমান হতে পারে না।

الظُّلُمٰتُ বা অন্ধকার দ্বারা উদ্দেশ্য হলোন কুফরীর অন্ধকার, অর্থাৎ যারা পথভ্রষ্ট তারা।

النُّوْرُ বা আলো দ্বারা উদ্দেশ্য হলোন ঈমানের আলো, অর্থাৎ যারা হিদায়াতপ্রাপ্ত তারা।

الظِّلُّ বা ছায়া, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জান্নাত।

الْحَرُوْرُ বা গরম, উত্তপ্তন এর দ্বারা মূলত জাহান্নামকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে।

الْأَحْيَا۬ءُ বা জীবিত, এর দ্বারা মু’মিনদেরকে বুঝানো হয়েছে কিংবা ‘আলিম বা জ্ঞানী লোকে।

الْأَمْوَاتُ বা মৃত, এর দ্বারা কাফিরদেরকে বুঝানো হয়েছে অথবা মুর্খ লোককে। যেমন সূরা আন‘আমের ১২২ নং আয়াতে ও সূরা ইয়াসিনের ৭০ নং আয়াতেও বলা হয়েছে। সুতরাং যারা ঈমানদার ও সঠিক পথের অনুসারী তারা, আর যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করে ও অন্ধকার পথের পথিক তারা কখনো সমান নয়। বরং ঈমানদাররাই সফলকাম।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(لَا يَسْتَوِيْٓ أَصْحٰبُ النَّارِ وَأَصْحٰبُ الْجَنَّةِ ط أَصْحٰبُ الْجَنَّةِ هُمُ الْفَآئِزُوْنَ)‏

“জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়। জান্নাতবাসীরাই সফলকাম।” (সূরা হাশর ৫৯:২০)

(وَمَآ أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَّنْ فِي الْقُبُوْرِ)

‘যারা কবরে আছে তুমি তাদেরকে শুনাতে পারবে না’ অর্থাৎ যেমনিভাবে কবরে মৃত আত্মাকে তুমি শুনাতে পারবে না, যতই তাদেরকে ডাক যারা আল্লাহ তা‘আলার দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এমন জীবিত ব্যক্তিদেরকেও তুমি বোঝাতে পারবে না। তাদেরকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করো না কেন তারা বুঝতে চাইবে না। এ সম্পর্কে সূরা নাম্ল-এর ৮০ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকটই তিনি পথ প্রদর্শনকারী রাসূল প্রেরণ করেছেন। এমন কোনই সম্প্রদায় নেই যাদের প্রতি কোন সতর্ককারী পাঠানো হয়নি। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

(وَّلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ)‏

“এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আছে পথ প্রদর্শক।” (সূরা রাদ ১৩:৭)

সুতরাং কিয়ামত দিবসে কারো আপত্তি পেশ করার কোনই সুযোগ থাকবে না যে, আমাদের নিকট সত্য নিয়ে কোন লোক আগমন করেনি। সকলের নিকটই সতর্ককারী পাঠানো হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. মু’মিন আর কাফির কখনো সমান হতে পারে না, বরং মু’মিনরাই সফলকাম।
২. প্রত্যেক জাতির নিকট সৎ ব্যক্তিদের জন্য সুসংবাদ আর অবাধ্যদের জন্য সতর্ককারীরূপে রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে।
৩. যারা আল্লাহ তা‘আলার দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের পরিণতি খুব ভয়াবহ।

Leave a Reply