أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৪৪)
[যে ব্যক্তি মােমেন, সে কি সেই ব্যক্তির মতাে যে ফাসেক?]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩২:আস-সাজদাহ
পারা:২১
১২-২২ নং আয়াত:-
৩২:১২
وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذِ الۡمُجۡرِمُوۡنَ نَاکِسُوۡا رُءُوۡسِہِمۡ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ ؕ رَبَّنَاۤ اَبۡصَرۡنَا وَ سَمِعۡنَا فَارۡجِعۡنَا نَعۡمَلۡ صَالِحًا اِنَّا مُوۡقِنُوۡنَ ﴿۱۲﴾
হায়, যদি তুমি দেখতে সে সময় যখন এ অপরাধীরা মাথা নিচু করে তাদের রবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। (তখন তারা বলতে থাকবে) “হে আমাদের রব! আমরা ভালোভাবেই দেখে নিয়েছি ও শুনেছি, এখন আমাদের ফেরত পাঠিয়ে দাও, আমরা সৎকাজ করবো, এবার আমাদের বিশ্বাস হয়ে গেছে।”
৩২:১৩
وَ لَوۡ شِئۡنَا لَاٰتَیۡنَا کُلَّ نَفۡسٍ ہُدٰىہَا وَ لٰکِنۡ حَقَّ الۡقَوۡلُ مِنِّیۡ لَاَمۡلَـَٔنَّ جَہَنَّمَ مِنَ الۡجِنَّۃِ وَ النَّاسِ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿۱۳﴾
আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতাম। কিন্তু আমার এ কথা যথার্থ সত্য যে, আমি নিশ্চয়ই মানব ও দানব উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করব।
৩২:১৪
فَذُوۡقُوۡا بِمَا نَسِیۡتُمۡ لِقَآءَ یَوۡمِکُمۡ ہٰذَا ۚ اِنَّا نَسِیۡنٰکُمۡ وَ ذُوۡقُوۡا عَذَابَ الۡخُلۡدِ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۴﴾
কাজেই আজকের দিনের এ সাক্ষাতকারের কথা ভুলে গিয়ে তোমরা যে কাজ করেছো এখন তার মজা ভোগ কর। আমিও এখন তোমাদের ভুলে গিয়েছি, নিজেদের কর্মফল হিসেবে চিরন্তন আযাবের স্বাদ আস্বাদন করতে থাকো।”
৩২:১৫
اِنَّمَا یُؤۡمِنُ بِاٰیٰتِنَا الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِّرُوۡا بِہَا خَرُّوۡا سُجَّدًا وَّ سَبَّحُوۡا بِحَمۡدِ رَبِّہِمۡ وَ ہُمۡ لَا یَسۡتَکۡبِرُوۡنَ ﴿ٛ۱۵﴾
শুধু তারাই আমাদের আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, যারা সেটার দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হলে সিজ্দায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, আর তারা অহংকার করে না।
৩২:১৬
تَتَجَافٰی جُنُوۡبُہُمۡ عَنِ الۡمَضَاجِعِ یَدۡعُوۡنَ رَبَّہُمۡ خَوۡفًا وَّ طَمَعًا ۫ وَّ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ﴿۱۶﴾
তাদের পিঠ থাকে বিছানা থেকে আলাদা, নিজেদের রবকে ডাকে আশঙ্কা ও আকাংখা সহকারে এবং যা কিছু রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।
৩২:১৭
فَلَا تَعۡلَمُ نَفۡسٌ مَّاۤ اُخۡفِیَ لَہُمۡ مِّنۡ قُرَّۃِ اَعۡیُنٍ ۚ جَزَآءًۢ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۷﴾
কেউই জানে না তার জন্য তার কৃতকর্মের বিনিময় স্বরূপ নয়ন-প্রীতিকর কি (পুরস্কার) লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
৩২:১৮
اَفَمَنۡ کَانَ مُؤۡمِنًا کَمَنۡ کَانَ فَاسِقًا ؕؔ لَا یَسۡتَوٗنَ ﴿۱۸﴾
এটা কি কখনো হতে পারে, যে ব্যক্তি মু’মিন সে ফাসেকের মতো হয়ে যাবে? এ দু’পক্ষ সমান হতে পারে না।
৩২:১৯
اَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَلَہُمۡ جَنّٰتُ الۡمَاۡوٰی ۫ نُزُلًۢا بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۹﴾
যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, তাদের কৃতকর্মের ফলসরূপ তাদের আপ্যায়নের জন্য রয়েছে জান্নাতের বাসস্থান।
৩২:২০
وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ فَسَقُوۡا فَمَاۡوٰىہُمُ النَّارُ ؕ کُلَّمَاۤ اَرَادُوۡۤا اَنۡ یَّخۡرُجُوۡا مِنۡہَاۤ اُعِیۡدُوۡا فِیۡہَا وَ قِیۡلَ لَہُمۡ ذُوۡقُوۡا عَذَابَ النَّارِ الَّذِیۡ کُنۡتُمۡ بِہٖ تُکَذِّبُوۡنَ ﴿۲۰﴾
আর যারা ফাসেকীর পথ অবলম্বন করেছে তাদের আবাস হচ্ছে জাহান্নাম। যখনই তারা তা থেকে বের হতে চাইবে তার মধ্যেই ঠেলে দেয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে, আস্বাদন করো এখন সেই আগুনের শাস্তির স্বাদ যাকে তোমরা মিথ্যা বলতে।
৩২:২১
وَ لَنُذِیۡقَنَّہُمۡ مِّنَ الۡعَذَابِ الۡاَدۡنٰی دُوۡنَ الۡعَذَابِ الۡاَکۡبَرِ لَعَلَّہُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۲۱﴾
আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে মহা শাস্তির পূর্বে কিছু লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব , যাতে তারা ফিরে আসে।
৩২:২২
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ ذُکِّرَ بِاٰیٰتِ رَبِّہٖ ثُمَّ اَعۡرَضَ عَنۡہَا ؕ اِنَّا مِنَ الۡمُجۡرِمِیۡنَ مُنۡتَقِمُوۡنَ ﴿٪۲۲﴾
আর তার চেয়ে বড় জালেম কে হবে যাকে তার রবের আয়াতের সাহায্যে উপদেশ দেয়া হয় এবং সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? এ ধরনেরঅপরাধীদের থেকে তো আমি প্রতিশোধ নেবোই।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*কেয়ামতের ময়দানে পাপিষ্ঠদের চিত্র : আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্জন্ম লাভের ব্যাপারে তারা যে সন্দেহ পােষণ করে, সেই সন্দেহ অপনােদনের লক্ষ্যে কেয়ামতের এমন একটা দৃশ্য তাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে, যা এক একটা জীবন্ত ও প্রাণবন্ত দৃশ্য, যা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, প্রেরণা ও সংলাপে ভরপুর। ‘যদি তুমি দেখতে অপরাধীরা যখন মাথা নীচু করে থাকবে এবং বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা এখন সব কিছু দেখলাম ও শুনলাম, অতএব আমাদেরকে পুনরায় দুনিয়ায় ফেরত পাঠাও, সৎকাজ করবাে'(আয়াত ১২-১৪) ১২ নং আয়াতে যে দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা লাঞ্ছনা, অপমান, শুনাহের স্বীকারােক্তি, প্রত্যাখ্যাত সত্যকে মেনে নেয়া, যে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে তার প্রতি বিশ্বাস ও প্রত্যয় ঘোষণা করা এবং অপমান ও লাঞ্ছনার ভারে মাথা নােয়ানাে অবস্থায় দুনিয়ার জীবনে যে ভুল করে আসা হয়েছে তা শোধরানাের জন্য পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার সুযােগ প্রার্থনার দৃশ্য। কিন্তু এসব কিছুই হবে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পরে, যখন কোনাে স্বীকারােক্তি ও ঘোষণায় কোনাে লাভ হবে না। অবিশ্বাসীদের এই অবমাননাকর প্রার্থনার জবাব দেয়ার আগে ১৩ নং আয়াতে সেই প্রকৃত সত্যটা তুলে ধরা হয়েছে, যা এ সম্পর্কে নীতি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে এবং যা মানব জাতির জীবনে ও ভাগ্য নির্ধারণেও চূড়ান্ত অবদান রাখে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি যদি ইচ্ছা করতাম, তবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে হেদায়াত দান করতাম’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে সকল মানুষের জন্য একই পথ-সততা ও ন্যায়ের পথ তৈরী করে দিতেন। যেমন করে দিয়েছেন মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব জন্তুর জন্য, যারা জন্মগতভাবেই প্রচ্ছন্ন ঐশী নির্দেশ মােতাবেক চলে, অথবা ফেরেশতাদের জন্য, যারা হুকুম পালন করা ছাড়া আর কিছু জানে না। আসলে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্তই ছিলাে যে, তার স্বভাব প্রকৃতি হবে স্বতন্ত্র ধরনের। সে সুপথেও চলতে পারবে, কূপথেও চলতে পারবে। সে স্বাধীনভাবে সুপথ বা কূপথ বেছে নেবে এবং এ বিশ্বের সে এই বিশেষ ধরনের স্বভাব প্রকৃতির ভিত্তিতেই নিজস্ব ভূমিকা পালন করবে। কেননা এ বিশ্ব জগতকে সৃষ্টি করার পেছনে আল্লাহ তায়ালার যে মহৎ উদ্দেশ্য ও প্রজ্ঞা সক্রিয় ছিলাে, তারই ভিত্তিতে তিনি মানুষকে এই বিশেষ ধরনের স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। এ জন্যই তিনি তার ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন এভাবে যে, যে সব জ্বিন ও মানুষ গােমরাহী ও অসৎ পথ বেছে নেবে এবং জাহান্নামের পথে চলবে, তাদেরকে দিয়ে জাহান্নামকে পূর্ণ করবেন। এরাই সেই সব অপরাধী, যারা কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার সামনে অবনত মস্তকে দাঁড়াবে এবং যাদের ওপর জাহান্নামের ফায়সালা প্রযােজ্য হবে। এ জন্য তাদেরকে বলা হবে, ‘অতএব, যেহেতু তােমরা আজকের এই দিনের সম্মুখীন হওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল। তাই স্বাদ গ্রহণ কর।’ অর্থাৎ সময় থাকতে এই দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ না করার কারণে ভােগ কর। ‘আমি তােমাদেরকে ভুলে গিয়েছি।’ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা কাউকে ভুলে যান না। তবে অবহেলিত ও বিস্মৃত মানুষের ন্যায় আচরণ করেন। সে আচরণে রয়েছে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অবজ্ঞা-অবহেলা ও গ্লানী । এবং তােমাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ চিরস্থায়ী আযাব ভােগ কর। এখানে এসেই কেয়ামতের দৃশ্যটার ওপর যবনিকাপাত হচ্ছে। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইতিপূর্বেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরাধীদেরকে গ্লানীকর পরিণতি ভােগ করার জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। কোরআনের পাঠক এ আয়াত কটা পড়ার পর অনুভব করে যেন সে কাফেরদের এই অবস্থায় রেখে যাচ্ছে। আর তারা যেন সেই অবস্থায় ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। প্রেরণা ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী এ ধরনের জ্বলজ্যান্ত দৃশ্য তুলে ধরা কোরআনের অন্যতম শিল্পগত বৈশিষ্ট।
*মােমেনদের সফলতা ও পাপিষ্ঠদের পরিণতি : উপরােক্ত দৃশ্যটার ওপর এখন যবনিকাপাত ঘটছে অপর এক পরিবেশে অপর এক দৃশ্য তুলে ধরার জন্য। সে দৃশ্যটা অন্তরাত্মাকে সঞ্জীবিত ও উদ্দীপিত করে এবং হৃদয়ে প্রেরণার সৃষ্টি করে। এটা মােমেনদের দৃশ্য। তারা একাগ্রচিত্তে যে এবাদাত ও দোয়া করে তার দৃশ্য। আল্লাহ তায়ালার ভয় ও তার অনুগ্রহের আশা পোষণের দৃশ্য। তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা যে পুরস্কার সঞ্চিত করে রেখেছেন তা অকল্পনীয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার আয়াতগুলােতে কেবল তারাই বিশ্বাস রাখে, যাদেরকে আয়াতগুলাে স্বরণ করিয়ে দিলেই সেজদায় পতিত হয়'(আয়াত ১৫-১৭) এ আয়াত কটাতে মােমেন বান্দাদের যে ছবি চিত্রিত করা হয়েছে তা খুবই আলােকোজ্জ্বল ছবি। এ ছবি স্বচ্ছ, তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন, আল্লাহর ভয়ে কম্পিত, আল্লাহর করুণা লাভের আশায় আশান্বিত, তাঁর অনুগত ও বিনয়ী বান্দাদের ছবি। এ সব বান্দাই আল্লাহর আয়াতে বিশ্বাস রাখে। জাগ্রত হৃদয়, প্রদীপ্ত বিবেক ও উদ্দীপিত অনুভূতি নিয়ে তারা আল্লাহ তায়ালার বাণীকে গ্রহণ করে। ‘তাদেরকে যখন আল্লাহ তায়ালার আয়াত বা নিদর্শনাবলীকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, তখন তারা সেজদায় পড়ে যায়।’ স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রতিক্রিয়াস্বরূপই তারা সেজদায় পড়ে। মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের তাগিদেও তারা সেজদা করে। কেননা তার নিদর্শনাবলীর স্মৃতি জাগরুক হওয়ার কারণেই এই সেজদার প্রেরণা আসে। তারা অনুভব করে যে আল্লাহ তায়ালার মহত্ব ও মহিমার যথার্থ কদর একমাত্র সেজদা দিয়েই করা সম্ভব। মাটির সাথে কপাল ঘষা ছাড়া এ অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না। ‘আর তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসা সহকারে তাসবীহ পাঠ করে।’ অর্থাৎ শরীর দ্বারা সেজদা ও জিহ্বা দ্বারা প্রশংসা ও তাসবীহ এক সাথেই বলে। ‘এবং তারা অহংকার করে না।’ কেননা এ সেজদা হচ্ছে সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহান আল্লাহর মহিমার সামনে একান্ত অনুগত বান্দার আকুতি। এরপর আবার তুলে ধরা হচ্ছে একই সাথে তাদের শারীরিক তৎপরতা ও মানসিক আবেগ অনুভূতির চিত্র, ‘ভয়ে ও আশায় আল্লাহ তায়ালাকে ডাকার সাথে সাথে তাদের পিঠ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায়।’ মােমেন বান্দারা রাতের বেলায় এশা ও বেতের নামাজ তো পড়েই। তদুপরি শেষ রাতেও তাহাজুদের নামায পড়ে ও দোয়া করে। কিন্তু কোরআনের বর্ণনাভংগীটা এই নামায ও দোয়াকে ভিন্নভাবে চিত্রিত করে। এতে দেখানাে হয়েছে যে, রাতের বিছানাগুলাে যেন তাদের পিঠগুলােকে শোয়া, আরাম করা ও মজা করে ঘুমানাের জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকে, কিন্তু তাদের পিঠ সে ডাকে সাড়া দেয় না, বরং সেই লােভনীয় বিছানাগুলাের আহ্বানকে প্রতিরােধ ও প্রত্যাখ্যানের চেষ্টা সাধনা করে। কেননা তারা নরম বিছানা ও মজাদার ঘুমের প্রতি আগ্রহী নয়। তারা আগ্রহী তাদের প্রতিপালকের সামনে হাযিরা দিতে এবং আষাব, গযব ও নাফরমানীর ভয় ও তার দয়া, সন্তুষ্টি ও সৎ কাজের প্রেরণা লাভের আশায় তার কাছে ধর্ণা দিতে। ‘তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় ও আশার সাথে ডাকে’ এই ক্ষুদ্র বাক্যটার ভেতর দিয়ে অন্তরে একই সাথে এই শিহরিত অনুভূতিগুলাের অনুরণন চিত্রিত করা হয়। আয়াতের শেষাংশে বলা হচ্ছে যে, তাদের এই অন্তরংগ অনুভূতি, একাগ্রচিত্ত নামায এবং আবেগোদ্বেলিত দোয়ার পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও নিজেদের পরিশুদ্ধির প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে মুসলিম সমাজের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালনেও ব্রতী হয়। কথাটা বলা হয়েছে এভাবে, ‘আর আমি তাদেরকে যে জীবিকা দান করেছি তা থেকে তারা ব্যয়ও করে।’ আল্লাহ তায়ালার প্রতি আনুগত্য ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের এই উজ্জ্বল চিত্রের সাথে সাথেই রয়েছে তুলনাহীন গৌরবময় প্রতিদানের চিত্রও। সে প্রতিদানের ভেতর দিয়ে এই বান্দাদের প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ তদারকী ও অভিভাবকত্ব, বিশেষ আদর, সম্মান ও আন্তরিকতারই অভিব্যক্তি ঘটেছে। এই প্রতিদানের কথা ঘােষিত হয়েছে পরবর্তী আয়াতে। ‘কেউ জানে না তাদের কাজগুলাের বিনিময়ে তাদের জন্য কেমন চোখ জুড়ানাে প্রতিদান লুকিয়ে রাখা হয়েছে।'(আয়াত ১৭) এ আয়াতে মােমেনদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার আতিথেয়তা এবং তার নিজ তদারকীতে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা চোখ জুড়ানাে সম্মান ও আদর আপ্যায়নের চমকপ্রদ অভিব্যক্তি ঘটেছে। তাদের জন্য সঞ্চিত এই পুরস্কারের বিষয়ে একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। এ পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার কাছে গুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। যারা এর প্রাপক, একমাত্র তারাই আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাতের সময় তা দেখতে পাবে। মহান আল্লাহর সাথে এই গৌরবোজ্জ্বল ও প্রাণপ্রিয় সাক্ষাতকারের এ এক উজ্বল ছবিই বটে! ভেবে স্তম্ভিত হতে হয় যে, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর কতাে অনুগ্রহ ও মহানুভবতা প্রদর্শন করেন। তার বান্দারা যতই সৎকর্মশীল, যতই এবাদতকারী, আনুগত্যকারী ও একনিষ্ঠ হােক না কেন, তিনি যদি তাদের প্রতি অনুকম্পাশীল ও দয়ালু না হতেন, তাহলে তাদের প্রতিদানকে এত যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে রাখতেন না। একদিকে অপরাধীদের শােচনীয় ও লাঞ্ছনাকর পরিণতি এবং অপর দিকে ঈমানদারদের সুখকর পরিণতির দৃশ্য তুলে ধরার পর আল্লাহ তায়ালা তার কর্মফল প্রদানের সুবিচারমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতির সংক্ষিপ্ত সার তুলে ধরে এ আলােচনার উপসংহার টানছেন। তার এই ন্যায়সংগত নীতিই দুনিয়া ও আখেরাতে সৎকর্মশীল ও দুষ্কৃতকারীদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে এবং সূক্ষ্ম ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে কর্ম অনুসারেই তার কর্মফল নির্ণয় করে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি মােমেন, সে কি সেই ব্যক্তির মতাে যে ফাসেক। এরা সমান নয়'(আয়াত ১৮-২২) বস্তুত মােমেনরা ও ফাসেকরা স্বভাবে, চরিত্রে, কর্মে ও আবেগ অনুভূতিতে কখনাে একরকম হয় না যে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের কর্মফল বা প্রতিদান একরকম হবে। যারা ঈমানদার তাদের স্বভাব-চরিত্র ও মেজাজ ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে থাকে, তারা আল্লাহমুখী হয়ে থাকে এবং তার নিখুঁত ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধান অনুসারে কাজ করে। আর যারা ফাসেক অসৎ ও পাপাচারী, তারা পথভ্রষ্ট ও সমাজে অশান্তি নৈরাজ্য ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়ে থাকে। তারা আল্লাহ তায়ালার দেয়া জীবন বিধান ও তার মৌল আইনের সাথে সংগতিশীল পথে চলে না। তাই পরকালেও মোমেন ও ফাসেকদের পরিণতি যে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হবে এবং উভয়ে নিজ নিজ কৃতকর্ম অনুসারেই ফল পাবে সেটা মােটেই বিচিত্র নয়। যারা ঈমানদার ও সৎকৰ্মশীল, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া যা তাদেরকে আশ্রয় দেবে এবং তারা সেখানে অবস্থান করবে। আর এটা হবে তাদেরই কর্মফল।’ আর যারা পাপাচারী ও ফাসেক, তাদের আশ্রয়স্থল হবে আগুন, সেখানে তারা আশ্রয় নেবে। আর এটা এমন খারাপ আশ্রয়স্থল যে তার অধিবাসী হওয়ার চেয়ে আশ্রয়হীন হওয়াও ভালো। ‘যখনই তারা সেখান থেকে বের হতে চাইবে, তখনই আবার তাদেরকে সেখানে ফেরত পাঠানাে হবে।’ এ বাক্যটাতে দোযখ থেকে পালানাে ও আত্মরক্ষা করার চেষ্টার দৃশ্য প্রতিফলিত হয়েছে। আর তাদেরকে বলা হবে, তােমরা যে দোযখের আযাবকে মিথ্যা বলতে, সেই আযাব এখন ভোগ কর। এটা তাদের আযাবের ওপর বাড়তি আযাবের শামিল। ওটা ছিলাে ফাসেকদের পরকালের শাস্তির বিবরণ। তাই বলে তাদেরকে সেই সময় পর্যন্ত অব্যাহতি দেয়া হয়নি। আখেরাতের আগে তাদেরকে দুনিয়াতেও শাস্তি দেয়া হবে বলে আল্লাহ তায়ালা হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি তাদেরকে বৃহত্তর আযাবের আগে ক্ষুদ্রতর আযাব ভােগ করাবােই।’ তবে এই ক্ষুদ্রতর আযাবের পথে আল্লাহর তায়ালার রহমতের ছায়া বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে ততােক্ষণ পর্যন্ত শাস্তি দেয়া পছন্দ করেন না যতক্ষণ তারা নিজেদের কর্মদোষে শাস্তির উপযুক্ত না হয় এবং যে সব গুনাহর কারণে আযাব অনিবার্য হয়ে ওঠে, সেসব গুনাহ অব্যাহত না রাখে। ‘তিনি কেবল ইহকালে শাস্তি দেয়ার ভয় দেখান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ অর্থাৎ যাতে তাদের বিবেক সচেতন হয় এবং আযাবের কষ্ট তাদেরকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনে। এতে যদি তারা ফিরে আসতাে তাহলে ফাসেকদের সেই পরিণতির সম্মুখীন হতাে না, যা তাদের যন্ত্রণাদায়ক আযাবের বর্ণনায় আমরা দেখে এসেছি। কিন্তু তাদেরকে যখন আল্লাহ তায়ালার আয়াতগুলাের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া সত্তেও তারা উপেক্ষা করেছে, তাদের ওপর পার্থিব আয়াত এসে গেছে এবং এরপরও আত্মশুদ্ধি করেনি এবং শিক্ষা গ্রহণ করে অন্যায় পথ থেকে ফিরে আসেনি, তখন তারা অবশ্যই যালেম তথা অপরাধী সাব্যস্ত হবে। ‘আর সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় যালেম আর কে আছে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতগুলাে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, তারপরও সে তাকে উপেক্ষা করেছে?’ এ ধরনের লােকেরা অবশ্যই দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তায়ালার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার শিকার হবার যােগ্য। ‘আমি অপরাধীদের কাছ থেকে প্রতিশােধ গ্রহণ করবো’ এ কথা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে যে, এটা কতাে বড় ভয়ংকর হুমকি, কী সাংঘাতিক শাসানি কেননা স্বয়ং মহাপরাক্রমশালী ও মহা ক্ষমতাদর্পী আল্লাহ তায়ালাই এসব দুর্বল ও অসহায় লােককে এই ভয়াল হুমকি দিয়েছেন। ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লােকদের শুভ প্রতিদান এবং ফাসেক ও অসৎ লােকদের অশুভ পরিণামের বিবরণের মধ্য দিয়ে এ অধ্যায়টা শেষ হচ্ছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এবার মানুষের এ “অহম” যখন তার রবের কাছে ফিরে গিয়ে নিজের হিসেব দেবার জন্য তার সামনে দাঁড়াবে তখনকার অবস্থার চিত্র অংকন করা হচ্ছে।
# এভাবে সত্যের সাথে সাক্ষাত ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যদি লোকদেরকে পথ দেখানো আমার লক্ষ্য হতো তাহলে দুনিয়ার জীবনে এত বড় পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তোমাদের এখানে আনার কি দরকার ছিল? এ ধরনের পথের দিশা তো আমি তোমাদের কে আগেও দিতে পারতাম্ কিন্তু শুরু থেকেই তো তোমাদের জন্য আমার এ পরিকল্পনা ছিল না। আমি তো প্রকৃত সত্যকে দৃষ্টির অন্তরালে এবং ইন্দ্রিয়ের স্পর্শ ও অনুভবের বাইরে রেখে তোমাদের পরীক্ষা নিতে চাচ্ছিলাম। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম, তোমরা সরাসরি তাকে আবরণমুক্ত দেখার পরিবর্তে বিশ্ব-জাহানে এবং স্বয়ং তোমাদের নিজেদের মধ্যে তার আলামতগুলো দেখে নিজের বুদ্ধির সাহায্যে তাকে চিনতে পারো কিনা, আমি নিজের নবীদের ও কিতাবসমূহের সাহায্যে এ সত্যকে চিনে নেবার ব্যাপারে তোমাদের যে সাহায্য করতে চাচ্ছি তা থেকে তোমরা ফায়দা হাসিল করছো কি না এবং সত্যকে জেনে নেবার পর নিজের প্রবৃত্তিকে এতটা নিয়ন্ত্রিত করতে পারো কিনা যার ফলে কামনা ও বাসনার দাসত্ব মুক্ত হয়ে তোমরা এ সত্যকে মেনে নেবে এবং এ অনুযায়ী নিজের জীবন ধারার সংস্কার সাধন করবে। এ পরীক্ষার সিলসিলা শুরু করায় লাভ কি? দ্বিতীয় পরীক্ষাটি যদি এমনভাবে নেয়া হয় যে, তোমরা এখানে যা কিছু শুনেছো ও দেখেছো তা যদি সব মনেই থেকে যায়, তাহলে আদতে সেটা কোন পরীক্ষাই হবে না। আর যদি আগের মতো সকল চিন্তা-ভাবনা মুক্ত করে এবং সত্যকে দৃষ্টির অগোচরে রেখে তোমাদের আবার দুনিয়ায় সৃষ্টি করা যায় এবং প্রথমবারে যেমন নেয়া হয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে একেবারে নতুন করে তোমাদের পরীক্ষা নেয়া হয়, তাহলে বিগত পরীক্ষার তুলনায় ফলাফল কিছুই ভিন্নতর হবে না। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারাহ, ২২৮ ; আল আন’আম, ৬ ও ১৪১ ; ইউনুস, ২৬ এবং আল মু’মিনুন, ৯১ টীকা। )
# মহান আল্লাহ আদম সৃষ্টির সময় ইবলিসকে সম্বোধন করে যে উক্তি করেছিলেন সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা সাদের শেষ রুকুতে সে সময়ের পুরো ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ইবলিস আদমকে সিজদাহ করতে অস্বীকার করে এবং আদমের বংশধরদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের অবকাশ চায়। জবাবে আল্লাহ বলেনঃ
قَالَ فَالْحَقُّ وَالْحَقَّ أَقُولُ – لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ
“কাজেই এ হচ্ছে সত্য এবং আমি সত্যই বলি যে, আমি জাহান্নাম ভরে দেবো তোমার এবং মানুষদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের দ্বারা।”
أَجْمَعِينَ শব্দটি এখানে এ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি যে, সকল জ্বীন ও সমস্ত মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, শয়তানরা এবং শয়তানদের অনুসারী মানুষরা সবাই এক সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
# একদিন যে নিজের রবের সামনে যেতে হবে একথা দুনিয়ায় আয়েশ-আরামে মত্ত হয়ে একদম ভুলে গেছো।
# অন্য কথায় তারা নিজেদের বিভ্রান্ত চিন্তা পরিহার করে আল্লাহর কথা মেনে নেয়া এবং আল্লাহর বন্দেগী অবলম্বন করে তার ইবাদাত করাকে নিজেদের জন্য সম্মানহানিকর মনে করে না। আত্মম্ভরিতা তাদেরকে সত্যগ্রহণ ও রবের আনুগত্য করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।
# আয়েশ-আরাম করে রাত কাটাবার পরিবর্তে তারা নিজেদের রবের ইবাদাত করে। তাদের অবস্থা এমনসব দুনিয়াপূজারীদের মতো নয় যাদের দিনের পরিশ্রমের কষ্ট দূর করার জন্য রাতে নাচ-গান, শরাব পান ও খেলা তামাশার মতো আমোদ প্রমোদের প্রয়োজন হয়। এর পরিবর্তে তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, সারা দিন নিজেদের দায়িত্ব পালন করে কাজ শেষে এসে দাঁড়ায় তারা নিজেদের রবের সামনে। তাকে স্মরণ করে রাত কাটিয়ে দেয়। তার ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং তার কাছেই নিজেদের সমস্ত আশা-আকাংখা সমর্পণ করে।
বিছানা থেকে পিঠ আলাদা রাখার মানে এ নয় যে, তারা রাতে শয়ন করে না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, তারা রাতের একটি অংশ কাটায় আল্লাহর ইবাদাতের মধ্য দিয়ে।
# রিযিক বলতে বুঝায় হালাল রিযিক। হারাম ধন-সম্পদকে আল্লাহ তার প্রদত্ত সম্পদ হিসেবে বর্ণনা করেন না। কাজেই এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যা সামান্য কিছু পবিত্র রিযিক আমি দিয়েছি তা থেকেই খরচ করে। তার সীমা অতিক্রম করে নিজের খরচপাতি পুরা করার জন্য হারাম সম্পদে হাত দেয় না।
# বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও মুসনাদে আহমাদে বিভিন্ন সূত্রে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত এই হাদীসে কুদসীটি উদ্ধৃত হয়েছে যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ
قُال اللَّهُ تعالى أَعْدَدْتُ لِعِبَادِىَ الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ
“আল্লাহ বলেন, আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য আমি এমনসব জিনিস সংগ্রহ করে রেখেছি যা কখনো কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোন মানুষ কোনদিন তা কল্পনাও করতে পারে না।”
এ বিষয়বস্তু সামান্য শাব্দিক হেরফের করে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.), হযরত মুগীরাহ ইবনে শু’বা (রা.) এবং হযরত সাহল ইবনে সা’আদ সায়েদী নবী করীম ﷺ থেকে রেওয়াযাত করেছেন এবং মুসলিম, আহমাদ, ইবনে জারীর ও তিরমিযী সহীহ সনদ সহকারে তা উদ্ধৃত করেছেন।
# এখানে মু’মিন ও ফাসেকের দু’টি বিপরীতমুখী পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। মু’মিন বলতে এমন লোক বুঝানো হয়েছে, যে আল্লাহকে নিজের রব ও একমাত্র উপাস্য মেনে নিয়ে আল্লাহ তার পয়গম্বরদের মাধ্যমে যে আইন-কানুন পাঠিয়েছেন তার আনুগত্য করে। পক্ষান্তরে ফাসেক হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে ফাসেকী আনুগত্য থেকে বের হয়ে আসা বা অন্যকথায় বিদ্রোহ, বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারী মনোবৃত্তি ও আল্লাহ ছাড়া অন্য সত্তার আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করে।
# দুনিয়ায় তাদের চিন্তাধারা ও জীবন পদ্ধতি এক হতে পারে না এবং আখেরাতেও তাদের সাথে আল্লাহর আচরণ এক হওয়া সম্ভব নয়।
# সেই জান্নাতগুলো নিছক তাদের প্রমোদ উদ্যান হবে না বরং সেখানেই হবে তাদের আবাস। চিরকাল তারা সেখানে বসবাস করবে।
# “বড় শাস্তি” বলতে আখেরাতের শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। কুফরী ও ফাসেকীর অপরাধে এ শাস্তি দেয়া হবে। এর মোকাবিলায় “ছোট শাস্তি” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে এ দুনিয়ায় মানুষ যেসব কষ্ট পায় সেগুলো। যেমন ব্যক্তিগত জীবনে কঠিন রোগ, নিজের প্রিয়তম লোকদের মৃত্যু, ভয়াবহ দুর্ঘটনা, মারাত্মক ক্ষতি, ব্যর্থতা ইত্যাদি। সামাজিক জীবনে ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প, বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, যুদ্ধ এবং আরো বহু আপদ-বিপদ, যা লাখো লাখো কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে। এসব বিপদ অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন ও কল্যাণকর দিক বর্ণনা করে বলা হয়েছে, এর ফলে বড় শাস্তি ভোগ করার আগেই যেন মানুষ সচেতন হয়ে যায় এবং এমন চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি ত্যাগ করে যার পরিণামে তাদেরকে এ বড় শাস্তি ভোগ করতে হবে। অন্যকথায় এর অর্থ হবে, দুনিয়ায় আল্লাহ মানুষকে একেবারেই পরমানন্দে রাখেননি। নিশ্চিন্তে ও আরামে জীবনের গাড়ি চলতে থাকলে মানুষ এ ভুল ধারণায় লিপ্ত হয়ে পড়বে যে, তার চেয়ে বড় আর কোন শক্তি নেই যে, তার কোন ক্ষতি করতে পারে। বরং আল্লাহ এমন ব্যবস্থা করে রেখেছেন যার ফলে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি, জাতি ও দেশের ওপর এমন সব বিপদ-আপদ পাঠাতে থাকেন, যা তাদেরকে একদিকে নিজেদের অসহায়তা এবং অন্যদিকে নিজেদের চেয়ে বড় ও উর্ধ্বে একটি মহাপরাক্রমশালী সর্বব্যাপী শাসন ব্যবস্থার অনুভূতি দান করে। এ বিপদ প্রত্যেকটি ব্যক্তি, দল ও জাতিকে একথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তোমাদের ভাগ্য ওপরে অন্য একজন নিয়ন্ত্রণ করছেন। সবকিছু তোমাদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়নি। আসল ক্ষমতা রয়েছে তার হাতে যিনি কর্তৃত্ব সহকারে এসব কিছু করে চলছেন। তার পক্ষ থেকে যখনই কোন বিপদ তোমাদের ওপর আসে, তার বিরূদ্ধে কোন প্রতিরোধ তোমরা গড়ে তুলতে পারো না এবং কোন জ্বিন, রূহ, দেব-দেবী, নবী বা অলীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেও তার পথ রোধ করতে সক্ষম হও না।
এদিক দিয়ে বিচার করলে এ বিপদ নিছক বিপদ নয় বরং আল্লাহর সতর্ক সংকেত। মানুষকে সত্য জানাবার এবং তার বিভ্রান্তি দূর করার জন্য একে পাঠানো হয়। এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যদি মানুষ দুনিয়াতেই নিজের বিশ্বাস ও কর্ম শুধরে নেয় তাহলে আখেরাতে আল্লাহর বড় শাস্তির মুখোমুখি হবার তার কোন প্রয়োজনই দেখা দেবে না।
# “রবের আয়াত” অর্থাৎ তার নিদর্শনাবলী, এ শব্দগুলো বড়ই ব্যাপক অর্থবোধক। সব ধরনের নিদর্শন এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কুরআন মজীদের সমস্ত বর্ণনা দৃষ্টি সম্মুখে রাখলে জানা যায়, এ নিদর্শনাবলী নিম্নোক্ত ছয় প্রকারেরঃ
একঃ যে নিদর্শনাবলী পৃথিবী থেকে নিয়ে আকাশ পর্যন্ত প্রত্যেকটি জিনিসের এবং বিশ্ব-জাহানের সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে পাওয়া যায়।
দুইঃ যে নিদর্শনগুলো মানুষের নিজের জন্ম এবং তার গঠনাকৃতি ও অস্তিত্বের মধ্যে পাওয়া যায়।
তিনঃ যে নিদর্শনাবলী মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অনুভূতিতে, তার অচেতন ও অবচেতন মনে এবং তার নৈতিক চিন্তাধারায় পাওয়া যায়।
চারঃ যে নিদর্শনাবলী পাওয়া যায় মানুষের ইতিহাসের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায়।
পাঁচঃ যে নিদর্শনাবলী মানুষের প্রতি অবতীর্ণ পার্থিব আপদ-বিপদ ও আসমানী বালা-মুসিবতের মধ্যে পাওয়া যায়।
ছয়ঃ আর এসবের পরে আল্লাহ তাঁর নবীগণের মাধ্যমে যেসব আয়াত পাঠান ওপরে বর্ণিত নিদর্শনগুলো যেসব সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছে এ আয়াতগুলোর সাহায্যে যুক্তি-সঙ্গত পদ্ধতিতে মানুষকে সেসব সত্যের জ্ঞান দান করাই কাম্য।
এ সমস্ত নিদর্শন পূর্ণ একাত্মতা সহকারে সোচ্চার কণ্ঠে মানুষকে একথা বলে যাচ্ছে যে, তুমি আল্লাহ নও এবং বহু সংখ্যক আল্লাহর বান্দা নও বরং তোমার আল্লাহ মাত্র একজন। তার ইবাদাত ও আনুগত্য ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোন পথ নেই। তোমাকে এ জগতে স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী ও দায়িত্বহীন করে পাঠানো হয়নি। বরং নিজের জীবনের সমস্ত কাজ শেষ করার পর তোমাকে তোমার আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে জবাবদিহি করতে এবং নিজের কাজের প্রেক্ষিতে পুরস্কার ও শাস্তি পেতে হবে। কাজেই তোমার আল্লাহ তোমাকে সঠিক পথ দেখাবার জন্য নিজের নবী ও কিতাবসমূহের মাধ্যমে যে পথ-নির্দেশনা পাঠিয়েছেন তা মেনে চলো এবং স্বেচ্ছাচারী নীতি অবলম্বন করা থেকে বিরত থাকো। এখন একথা সুস্পষ্ট, যে মানুষকে এত বিভিন্নভাবে বুঝানো হয়েছে, যাকে উপদেশ দেবার ও পরিচালনা করার জন্য এমন অগণিত নিদর্শনাবলীর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে এবং যাকে দেখার জন্য চোখ, শোনার জন্য কান এবং চিন্তা করার জন্য অন্তরের নিয়ামত দান করা হয়েছে, সে যদি সমস্ত নিদর্শনাবলীর দিক থেকে চোখ বন্ধ করে নেয়, যারা বুঝাচ্ছে তাদের কথা ও উপদেশের জন্যও নিজের কানের ছিদ্র বন্ধ করে নেয় এবং নিজের মন-মস্তিষ্ক দিয়েও উল্টা দর্শনই তৈরি করার কাজে আত্ননিয়োগ করে, তাহলে তার চেয়ে বড় জালেম আর কেউ হতে পারে না। এরপর সে দুনিয়ায় নিজের পরীক্ষার মেয়াদ খতম করার পর যখন তার আল্লাহর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে তখন বিদ্রোহের পূর্ণ শাস্তি লাভ করার যোগ্যই হবে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১২-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতগুলোতে পুনরুত্থানকে অস্বীকারকারী কাফির-মুশরিকদের কিয়ামতের দিন যে লাঞ্ছনা ও অপমানকর অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার সামনে দন্ডায়মান করা হবে এবং স্বচক্ষে তা দেখে দুনিয়াতে আগমনের কামনা করবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তারা যখন পুনরুত্থিত হবে তখন লজ্জায় তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে মাথা নত করে হীন ও লাঞ্ছিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকবে এবং বলবে হে আল্লাহ তা‘আলা! দুনিয়াতে না দেখে বিশ্বাস করিনি। এখন তো সব দেখছি ও শুনছি, অতএব আমাদেরকে দুনিয়াতে আসার সুযোগ দেন, আমরা ভাল আমল করে সৎ বান্দাদের মধ্যে শামিল হয়ে আসি। কিন্তু তাদের প্রার্থনা কবূল করা হবে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَلَوْ تَرٰٓي إِذْ وُقِفُوْا عَلَي النَّارِ فَقَالُوْا يٰلَيْتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِاٰيٰتِ رَبِّنَا وَنَكُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ – بَلْ بَدَأَ لَهُمْ مَّا كَانُوْا يُخْفُوْنَ مِنْ قَبْلُ ط وَلَوْ رُدُّوْا لَعَادُوْا لِمَا نُهُوْا عَنْهُ وَإِنَّهُمْ لَكٰذِبُوْنَ – وَقَالُوْآ إِنْ هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا وَمَا نَحْنُ بِمَبْعُوْثِيْنَ)
“তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদেরকে অগ্নির পার্শ্বে দাঁড় করান হবে এবং তারা বলবে, ‘হায়! যদি আমাদেরকে (পৃথিবীতে) আবার ফিরিয়ে দেয়া হত তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। (বিষয়টি এমন নয়) বরং পূর্বে তারা যা গোপন করেছে তা এখন তাদের নিকট প্রকাশ পেয়েছে এবং তারা প্রত্যাবর্তিত হলেও যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল পুনরায় তারা তাই করত এবং নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী। তারা বলে, ‘আমাদের পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন এবং আমরা পুনরুত্থিতও হব না।’ (সূরা আন‘আম ৬:২৭-২৯) তাদেরকে আর দুনিয়াতে পাঠানো হবে না। তারা তথায় আফসোস করে বলবে।
(وَقَالُوْا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِيْٓ أَصْحٰبِ السَّعِيْرِ)
“এবং তারা আরো বলবে: যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না।” (সূরা মুলক ৬৭:১০)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, যদি আমি ইচ্ছা করতাম তাহলে সকলকে হিদায়াত দান করতে পারতাম। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَلَوْ شَا۬ءَ رَبُّكَ لَاٰمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيْعًا ط أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتّٰي يَكُوْنُوْا مُؤْمِنِيْنَ)
“তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনত; তবে কি তুমি মু’মিন হবার জন্য মানুষের ওপর জবরদস্তি করবে?” (সূরা ইউনুস ১০:৯৯) কিন্তু সকলে হিদায়াত পায়নি কারণ পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলার বাণী নির্ধারিত হয়ে গেছে যে, এক শ্রেণির মানুষ ও জিন দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করা হবে। এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করে জাহান্নামে দেবেন, বরং তারা জাহান্নামে যাওয়ার আমল করবে তাই তারা জাহান্নামে যাবে। এ সম্পর্কে সূরা ইউনুসেও আলোচনা করা হয়েছে।
সুতরাং জাহান্নামে যারা যাবে তারা নিজেদের অপরাধের কারণেই যাবে। আল্লাহ তা‘আলা হিদায়াতের বাণী দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। তারা যেমন দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলার বানী ভুলে দূরে থাকত আল্লাহ তা‘আলাও কিয়ামতের দিন তাদেরকে ভূলে যাবেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَقِيْلَ الْيَوْمَ نَنْسٰكُمْ كَمَا نَسِيْتُمْ لِقَا۬ءَ يَوْمِكُمْ هٰذَا وَمَأْوَاكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِّنْ نّٰصِرِيْنَ)
“আর বলা হবে, আজ আমি তোমাদেরকে ভুলে যাব যেমন তোমরা এই দিবসের সাক্ষাতকে ভুলে গিয়েছিলে। তোমাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।” (সূরা জাসিয়া ৪৫:৩৪)
সুতরাং সময় থাকতে আমাদের হুশিয়ার হওয়া উচিত, কোনক্রমেই যেন আল্লাহ তা‘আলার সাথে নাফরমানী না করি। কারণ তা নিজের বিপদ ডেকে নিয়ে আসবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. হিদায়াতের মলিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা অন্য কেউ নয়।
২. জাহান্নাম জিন ও মানুষ জাতি দিয়েই পূর্ণ করা হবে।
১৫-১৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: প্রকৃত ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হল, তারা আন্তরিকতার সাথে কান লাগিয়ে আমার কথা শ্রবণ করে থাকে। আমার নির্দেশানুযায়ী তারা আমল করে। মুখে তারা এগুলো স্বীকার করে ও সত্য বলে মেনে নেয়, আর অন্তরেও তারা এগুলোকে সত্য বলেই জানে। আর যখন তাদের সামনে আমার আয়াত তেলাওয়াত করা হয় তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং প্রশংসার সাথে আমার তাসবীহ পাঠ করে। তারা কোন প্রকার গর্ব অহঙ্কার করে না। কারণ তারা জানে যে, যারা গর্ব অহঙ্কার করে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِيْٓ أَسْتَجِبْ لَكُمْ ط إِنَّ الَّذِيْنَ يَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِيْ سَيَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِيْنَ)
“তোমাদের প্রতিপালক বলেনঃ তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। যারা অহংকারে আমার ইবাদত বিমুখ, তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।” (সূরা মু’মিন ৪০:৬০)
প্রকৃত মুত্তাকী ও ঈমানদারদের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হল যে, তারা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার জন্য রাত্রে বিছানা ত্যাগ করে এবং তাদের প্রতিপালককে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের আশা নিয়ে আহ্বান করে। আর তাদেরকে যে রিযিক দেয়া হয়েছে তা হতে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে।
ইবনু মাসঊদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা দু ব্যক্তির ওপর খুবই খুশি হন। এক ব্যক্তি, যে শান্তি ও আরামের নিদ্রায় বিভোর থাকে, কিন্তু হঠাৎ তার আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত ও শাস্তির কথা স্মরণ হয়ে যায় এবং তখনই সে বিছানা ত্যাগ করে উঠে পড়ে এবং আল্লাহ তা‘আলার সামনে দাঁড়িয়ে সালাত শুরু করে দেয়। (মুসনাদ আহমাদ হা: ৩৯৪৭)
অন্য হাদীসে রয়েছে: মুআয বিন জাবাল (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি এক সফরে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে ছিলাম। সকালের দিকে আমি তাঁর খুব নিকটবর্তী হয়ে চলছিলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম: হে আল্লাহ তা‘আলার নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে ও জাহান্নাম হতে দূরে রাখবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “তুমি খুব বড় প্রশ্ন করেছ। তবে আল্লাহ তা‘আলা যার জন্য তা সহজ করে দেন তার জন্য তা সহজ হয়ে যায়। তাহলে শোন, তুমি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবে না। সালাত কায়িম করবে, যাকাত দিবে, রমাযানের রোযা রাখবে ও বায়তুল্লাহর হাজ্জ করবে। অতঃপর তিনি বলেন: আমি তোমাকে কল্যাণের দরজাসমূহের কথা কি বলে দিব না? তা হল রোযা ঢালস্বরূপ, দান-খয়রাত পাপ ও অপরাধসমূহ মুছে ফেলে এবং মধ্য রাতে মানুষের সালাত। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্র আয়াতটি পাঠ করেন। (তিরমিযী হা: ২৬১৬, সহীহ)
এ ছাড়াও তাহাজ্জুদ সালাতের ফযীলত সম্পর্কে অসংখ্য সহীহ হাদীস রয়েছে। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। তাই তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল বান্দাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: কোন মানুষই জানে না যে, তার জন্য কী প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ জান্নাতে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের জন্য কী প্রস্তুত করে রেখেছেন তা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কেউ জানে না।
হাদীসে এসেছে যে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
أَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَي قَلْبِ بَشَرٍ، فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ
আমি আমার সৎ বান্দাদের জন্য এমন (রহমত ও নেয়ামত) কিছু প্রস্তুত করে রেখেছি যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কর্ণ শোনেনি এবং কোন অন্তর কল্পনাও করতে পারেনি, তোমরা ইচ্ছা করলে এ আয়াত তেলাওয়াত করতে পার
(فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ)
(সহীহ বুখারী হা: ৩২৪৪)
অন্য এক বর্ণনাতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে তাকে যে নেয়ামত দেয়া হবে তা কখনো শেষ হবে না। তার কাপড় পুরাতন হবে না, তার যৌবনে ভাটা পড়বে না। তার জন্য জান্নাতে এমন নেয়ামত রয়েছে যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কর্ন শোনেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে কল্পনাও জাগেনি। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৮০, সহীহ মুসলিম ৪:২১৭৫)
এ সম্পর্কে আরো অনেক নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় ।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৎ বান্দাদের জন্য এমন নেয়ামত তৈরি করে রেখেছেন যা বর্ণনাতীত। তাই আমাদের উচিত হবে সেসব নেয়ামত পাওয়ার জন্য যথোচিত সৎ আমল করা এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা, হে আল্লাহ! তোমার কাছে জান্নাতুল ফিরদাউস কামনা করছি।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিন বান্দাদের জন্য বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার আয়াত শুনে সিজদায় লুটে পড়ে এবং কোন প্রকার অহঙ্কার করে না।
২. তাহাজ্জুদ সালাতের ফযীলত সম্পর্কে জানলাম।
৩. দান করলে পাপসমূহ মোচন হয়ে যায়।
৪. সৎ বান্দাদের জন্য এমন জান্নাত তৈরি করে রাখা হয়েছে যা কোন মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।
১৮-২২ নং আয়াতের তাফসীর:
মু’মিন আর বে-ঈমান কখনো সমান হতে পারে না, বরং তাদের মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ اجْتَرَحُوا السَّيِّاٰتِ أَنْ نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لا سَوَا۬ءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ ط سَا۬ءَ مَا يَحْكُمُوْنَ)
“যারা খারাপ কাজ করে তারা কি মনে করে যে, আমি জীবন ও মৃত্যুর দিক দিয়ে তাদেরকে সেসব ব্যক্তিদের সমান গণ্য করব যারা ঈমান আনে ও আমল করে? তাদের সিদ্ধান্ত কতই না মন্দ।” (সূরা জাসিয়া ৪৫:২১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(أَمْ نَجْعَلُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ كَالْمُفْسِدِيْنَ فِي الْأَرْضِ ز أَمْ نَجْعَلُ الْمُتَّقِيْنَ كَالْفُجَّارِ)
“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে আমি কি তাদেরকে ঐসব লোকের সমান করে দেব, যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়? অথবা আমি কি মুত্তাক্বীদেরকে গুনাহগারদের সমান করে দেব?” (সূরা সোয়াদ ৩৮:২৮)
মু’মিনরা থাকবে জান্নাতুল মাওয়াতে, যা তাদের আমলের প্রতিদানে আপ্যায়নস্বরূপ প্রদান করা হবে। পক্ষান্তরে যারা পাপী তারা থাকবে জাহান্নামে, তারা সেখান থেকে বের হতে পারবে না এবং সেখান থেকে পরিত্রাণও পাবে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(كُلَّمَآ أَرَادُوْآ أَنْ يَّخْرُجُوْا مِنْهَا مِنْ غَمٍّ أُعِيْدُوْا فِيْهَا ق وَذُوْقُوْا عَذَابَ الْحَرِيْقِ)
“যখনই তারা যন্ত্রণাকাতর হয়ে জাাহান্নাম হতে বের হতে চাইবে তখন তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হবে তাতে; (তাদেরকে বলা হবে) ‘আস্বাদ কর দহন-যন্ত্রণা।’’ (সূরা হজ্জ ২২:২২)
(الْعَذَابِ الْأَدْنٰي) দ্বারা ইহলৌকিক শাস্তি বা বিপদ-আপদ ও রোগ-ব্যাধিকে বুঝানো হয়েছে। (الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ) দ্বারা পারলৌকিক শাস্তি অর্থাৎ জাহান্নামের শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে।
এরপর আল্লাহ সর্বাধিক বড় জালিমের পরিচয় বর্ণনা করে বলছেন: যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলার আয়াত স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরেও সে আয়াত থেকে বিমুখ হয় সেই হচ্ছে সবচেয়ে বড় জালিম।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিনদের শেষ পরিণতি জান্নাত ও কাফিরদের জাহান্নাম।
২. আল্লাহর দীন সম্পর্কে জানার পরেও যে তা পালনে বিরত থাকবে সে-ই বড় জালিম এবং তার শাস্তিও হবে বড়।
৩. কাফির জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে কিন্তু তারা সেখান থেকে বের হতে পারবে না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১২-১৪ নং আয়াতের তাফসীর
তোমাদেরকে বিস্মৃত হয়েছি, তোমরা যা করতে তজ্জন্যে তোমরা স্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে থাকো।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এ পাপীরা যখন নিজেদের পুনর্জীবন স্বচক্ষে দেখবে তখন অত্যন্ত লজ্জিত অবস্থায় মাথা নীচু করে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবে। তখন তারা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের চোখ এখন উজ্জ্বল হয়েছে এবং আমাদের কানগুলো খাড়া হয়েছে। এখন আমরা বুঝতে ও জানতে পেরেছি। এখন আমরা বুঝে সুঝে কাজ করবো। আমাদের অন্ধত্ব ও বধিরতা দূর হয়ে গেছে। সুতরাং আমাদেরকে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরিয়ে দিন। আমরা সকর্ম করবো, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী। ঐ সময় কাফিররা নিজেদের তিরস্কার করতে থাকবে। জাহান্নামে প্রবেশের সময় তারা আক্ষেপ করে বলবেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “(তারা আরো বলবেঃ) যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম, তাহলে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না।” (৬৭:১০) অনুরূপভাবে এরা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম, এখন আপনি আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ করুন (পার্থিব জগতে)। তাহলে আমরা সকর্ম করবো, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ আমাদের এখন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য এবং আপনার সাক্ষাৎকার সত্য। আর আল্লাহ তাআলাও জানেন যে, যদি তিনি তাদেরকে পার্থিব জগতে ফিরিয়ে দেন তবে তারা পূর্বের মতই কাফির হয়ে যাবে এবং তাঁর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করবে ও তার রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তুমি যদি দেখতে যে, যখন তাদেরকে জাহান্নামের উপর দাঁড় করানো হবে তখন তারা বলবেঃ হায়! যদি আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হতো তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করতাম না।” (৬:২৭)
এজন্যেই আল্লাহ তাআলা এখানে বলেনঃ আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন তবে ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানকারী সবাই অবশ্যই ঈমান আনতো।” (১০:৯৯) কিন্তু আমার এ কথা অবশ্যই সত্য যে, আমি নিশ্চয়ই দানব ও মানব উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবো। এটা আল্লাহর অটল ফায়সালা। আমরা তাঁর সত্তায় পূর্ণ বিশ্বাস করি এবং তাঁর সমুদয় কথা হতে ও তার শাস্তি হতে তাঁর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
ঐদিন জাহান্নামীদেরকে বলা হবেঃ তবে শাস্তি আস্বাদন কর, কারণ আজকের এই সাক্ষাৎকারের কথা তোমরা বিস্মৃত হয়েছিলে। একে তোমরা অসম্ভব মনে করতে। আজ আমিও তোমাদেরকে বিস্তৃত হয়েছি। আল্লাহ তা’আলার পবিত্র সত্তা ভুল-ভ্রান্তি হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। এটা শুধু বদল বা বিনিময় হিসেবে বলা হয়েছে। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আজ আমি তোমাদেরকে ভুলে গেলাম যেমন তোমরা তোমাদের এদিনের সাক্ষাৎকারকে ভুলে গিয়েছিলে।” (৪৫:৩৪)।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমরা যা করতে তজ্জন্যে তোমরা স্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে থাকো। অর্থাৎ তোমাদের কুফরী ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে স্থায়ী শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করতে থাকো। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সেথায় তারা আস্বাদন করবে না শৈত্য, না কোন পানীয়- ফুটন্ত পানি ও পূজ ব্যতীত… আমি তো তোমাদের শাস্তিই শুধু বৃদ্ধি করবো।” (৭৮:২৪-৩০)
১৫-১৭ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ সত্যিকারের ঈমানদারদের লক্ষণ এই যে, তারা আন্তরিকতার সাথে কান লাগিয়ে আমার কথা শ্রবণ করে থাকে। আর ঐ। অনুযায়ী তারা আমল করে। মুখে তারা এগুলো স্বীকার করে ও সত্য বলে মেনে নেয়। আর অন্তরেও তারা এগুলোকে সত্য বলেই জানে। তারা সিজদায় পড়ে তাদের প্রতিপালকের তসবীহ পাঠ করে ও প্রশংসা কীর্তন করে। সত্যের অনুসরণে তারা মোটেই পিছ পা হয় না। তারা হঠকারিতা করে না। এ বিদআতগুলো কাফিররা করে থাকে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যারা আমার উপাসনায় অহংকার করে, সত্বরই তারা লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (৪০:৬০)
এই খাঁটি ঈমানদারদের একটি লক্ষণ এটাও যে, রাত্রে তারা বিছানা ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ে এবং তাহাজ্জুদের নামায আদায় করে থাকে। কেউ কেউ মাগরিব ও এশার নামাযের মধ্যবর্তী নামাযকে বুঝিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে এশার নামাযের জন্যে অপেক্ষা করা। আবার কারো কারো মত এই যে, এর দ্বারা এশা ও ফজরের নামায জামাআতের সাথে আদায় করাকে বুঝানো হয়েছে। এই মুমিনরা আল্লাহর আযাব হতে পরিত্রাণ পাওয়া ও তার নিয়ামত লাভ করার জন্যে তাঁর নিকট প্রার্থনা করে থাকে। সাথে সাথে তারা দান খায়রাতও করে থাকে। নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী তারা আল্লাহর পথে খরচ করে। তারা এমন পুণ্যের কাজও করে যার সম্পর্ক তাদের নিজেদের সাথে। আবার এমন পুণ্যের কাজগুলোও করে যেগুলোর সম্পর্ক থাকে অন্যদের সাথে। এসব পুণ্যের কাজে তিনি সর্বাপেক্ষা অগ্রগামী, যার মর্যাদা সবচেয়ে বেশী। অর্থাৎ আদম-সন্তানদের নেতা ও দোজাহানের গৌরব হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)। এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) তাঁর নিম্নের কবিতার মধ্যে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (সঃ) রয়েছেন যিনি সকাল হওয়া মাত্রই আল্লাহর পবিত্র কিতাব পাঠ করে থাকেন। তিনি আমাদেরকে অন্ধত্বের পর পথ প্রদর্শন করেছেন, আমাদের অন্তর এ দৃঢ় বিশ্বাস রাখে যে, তিনি যা বলেছেন তা সংঘটিত হবেই। রাত্রে যখন মুশরিকরা গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন থাকে তখন তার পার্শ্বদেশ শয্যা হতে পৃথক হয়ে যায় (অর্থাৎ তিনি শয্যা ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়েন)।”
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা দুই ব্যক্তির উপর খুবই খুশী হন। এক হলো ঐ ব্যক্তি যে শান্তি ও আরামের নিদ্রায় বিভোর থাকে, কিন্তু হঠাৎ তার আল্লাহর নিয়ামত ও শাস্তির কথা স্মরণ হয়ে যায় এবং তখনই সে বিছানা ত্যাগ করে উঠে পড়ে এবং আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে নামায শুরু করে দেয়। দ্বিতীয় হলো ঐ ব্যক্তি যে জিহাদে লিপ্ত রয়েছে, কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে অনুভব করে যে, মুসলমানরা পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। তখন সে এ চিন্তা করে যে, যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে গেলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন এবং সামনে অগ্রসর হলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন। সুতরাং সে সম্মুখে অগ্রস হওয়াই পছন্দ করলো এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্তই থাকলো। শেষ পর্যন্ত সে স্বীয় গর্দান আল্লাহর পথে লুটিয়ে দিলো। আল্লাহ তাআলা গর্বভরে ফেরেশতাদেরকে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করতে বলেন এবং তার প্রশংসা করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক সফরে নবী (সঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। সকালের দিকে আমি তার খুব নিকটবর্তী হয়ে চলছিলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর নবী (সঃ)! আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে ও জাহান্নাম হতে দূরে রাখবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তুমি খুব বড় প্রশ্ন করেছে। তবে আল্লাহ যার জন্যে তা সহজ করে দেন তার জন্যে তা সহজ হয়ে যায়। তাহলে শুনো, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবে না, নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমযানের রোযা রাখবে ও বায়তুল্লাহর হজ্ব করবে।” তারপর তিনি বলেনঃ “আমি তোমাকে কল্যাণের দরজাসমূহের কথা কি বলে দিবো না? তাহলো: রোযা ঢাল স্বরূপ, দান-খয়রাত পাপ ও অপরাধ মুছে ফেলে এবং মধ্য রাত্রে মানুষের নামায।” অতঃপর তিনি (আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করেন এবং (আরবি) পর্যন্ত পৌঁছে যান। এরপর তিনি বলেনঃ “আমি কি তোমাকে এই বিষয়ের (আমরে দ্বীনের) মাথা, স্তম্ভ এবং চূড়া ও উচ্চতার কথা বলবো না? জেনে রেখো যে, এই আমরের (দ্বীনের) মাথা ইসলাম, এর স্তম্ভ নামায এবং এর চূড়া ও উচ্চতা হচ্ছে আল্লাহর পথে জিহাদ।” তারপর তিনি বলেনঃ “আমি কি তোমাকে এসব কাজের নেতার খবর দিবো না?” অতঃপর তিনি স্বীয় জিহ্বা ধরে বললেনঃ “এটাকে সংযত রাখবে।” আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা যে কথা বলছি একারণেও কি আমাদেরকে পাকাড়ও করা হবে? তিনি উত্তরে বললেনঃ “ওরে নির্বোধ মুআয (রাঃ)! তোমার কি এটুকুও জানা নেই যে, মানুষকে মুখের ভরে (অথবা নাকের ভরে) জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে শুধু তার জিহ্বার ধারের কারণে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
এ হাদীসই কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। একটি সনদে এও আছে যে, (আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বান্দার রাত্রের নামায পড়া।” অন্য রিওয়াইয়াতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ উক্তিও বর্ণিত আছে যে, মানুষের অর্ধরাত্রে নামাযে দাঁড়ানোকে বুঝানো হয়েছে। তারপর তার উপরোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করাও বর্ণিত আছে।
হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তাআলা প্রথম ও শেষের সমস্ত লোককে একত্রিত করবেন। তখন একজন ঘোষণাকারী (ফেরেশতা) উচ্চ স্বরে ঘোষণা করবেন যার ঘোষণা সমস্ত সৃষ্টজীব শুনতে পাবে। তিনি ঘোষণা করবেনঃ “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত কে তা আজ সবাই জানতে পারবে।” আবার তিনি ঘোষণা করবেনঃ “যাদের পার্শ্বদেশ শয্যা হতে পৃথক থাকতো (অর্থাৎ যারা তাহাজ্জুদ পড়তে) তারা যেন দাঁড়িয়ে যায়। তখন তারা দাড়িয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সংখ্যা হবে খুবই কম। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আসলাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত বিলাল (রাঃ) বলেনঃ ‘যখন (আরবি)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন আমরা মজলিসে বসেছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীদের (রাঃ) কেউ কেউ মাগরেবের পর এশা পর্যন্ত নামাযের মধ্যে ছিলেন, এমন সময় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (এটা বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসের এই একটি মাত্র সনদ)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ কেউই জানে না তাদের জন্যে নয়নপ্রীতিকর কি লুক্কায়িত রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ। যেহেতু তারা গোপনে ইবাদত করতো সেহেতু আমিও গোপনে তাদের জন্যে তাদের নয়নপ্রীতিকর নিয়ামতরাজি মওজুদ করে রেখেছি যা কেউ না চোখে দেখেছে, না কানে শুনেছে, কল্পনা করেছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি আমার সৎ বান্দাদের জন্যে এমন রহমত ও নিয়ামত প্রস্তুত রেখেছি যা কেউ চোখে দেখেনি, কানে শুনেনি এবং অন্তরে কল্পনাও করেনি।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এ হাদীসটি বর্ণনা করার পর হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, কুরআন কারীমের নিম্নের আয়াতটি পাঠ করতে পারঃ (আরবি) অর্থাৎ “কেউই জানে না তাদের জন্যে নয়নপ্রীতিকর কি লুক্কায়িত রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ।”
এই রিওয়াইয়াতে (আরবি)-এর স্থলে (আরবি) পড়াও বর্ণিত আছে।
আর একটি রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে তাকে যে নিয়ামত দেয়া হবে তা কখনো শেষ হবে না। তার কাপড় পুরাতন হবে না, তার যৌবনে ভাটা পড়বে না। তার জন্যে জান্নাতে এমন নিয়ামত রয়েছে যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কর্ণ শুনেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে কল্পনাও জাগেনি।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাহল ইবনে সা’দ আস সাইদী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এক মজলিসে উপস্থিত ছিলাম, তিনি জান্নাতের গুণাবলী বর্ণনা করেন। হাদীসের শেষ ভাগে তিনি বলেনঃ “তাতে এমন নিয়ামত রয়েছে যা চক্ষু দেখেনি, কর্ণ শুনেনি এবং মানুষের অন্তরে কল্পনাও জাগেনি।” অতঃপর তিনি (আরবি) পর্যন্ত আয়াতগুলো পাঠ করেন।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি আমার সৎ বান্দাদের জন্যে এমন নিয়ামত প্রস্তুত রেখেছি যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শুনেনি এবং মানুষের অন্তর কল্পনাও করতে পারেনি।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত মুগীরা ইবনে শুবা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ হযরত মূসা (আঃ) তার মহিমান্বিত প্রতিপালককে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! সর্বনিম্ন পর্যায়ের জান্নাতীদের মর্যাদা কি?” উত্তরে মহান আল্লাহ বলেনঃ “সর্বনিম্ন পর্যায়ের জান্নাতী হলো ঐ ব্যক্তি যে সমস্ত জান্নাতীর জান্নাতে চলে যাওয়ার পরে আসবে। তাকে বলা হবেঃ “জান্নাতে প্রবেশ কর।” সে বলবেঃ “হে আল্লাহ! কোথায় যাবো? সবাই তো নিজ নিজ স্থান দখল করে নিয়েছে এবং নিজ নিজ জিনিস সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে?” তাকে বলা হবেঃ “তুমি কি এতে সন্তুষ্ট হবে যে, তোমাকে এতোটা দেয়া হবে যতোটা দুনিয়ার কোন বাদশাহর ছিল?” সে উত্তরে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! হ্যাঁ, আমি এতেই সন্তুষ্ট হবো।” তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “যাও, তোমাকে ততটাই দেয়া হলো এবং আরো ততোটা, আরো ততোটা, আরো ততোটা ও আরো ততোটা।” সে তখন বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! যথেষ্ট হয়েছে। আমি এতে সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম।” আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “যাও, আমি তোমাকে এগুলো সবই দিলাম। এবং আরো দশগুণ দিলাম। তোমার জন্যে আরো রয়েছে যা তোমার মন চাইবে এবং তোমার চক্ষু ঠাণ্ডা হবে।” সে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমার তো আশা পূর্ণ হয়ে গেছে এবং আমি খুশী হয়েছি।” হযরত মূসা (আঃ) তখন বললেনঃ “হে আল্লাহ! তাহলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জান্নাতীদের অবস্থা কি?” উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “এরা ঐ সব লোক যাদের কারামত আমি স্বহস্তে বপন করেছি এবং ওর উপর আমার মোহর লাগিয়েছি। সুতরাং তা কেউ না দেখতে পেয়েছে, না শুনতে পেয়েছে, না কেউ অন্তরে ধারণা করতে পেরেছে। এর স্বরূপ মহামহিমান্বিত আল্লাহর কিতাবের (আরবি) আয়াতটি।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আমির ইবনে আবদিল ওয়াহেদ (রঃ) বলেন যে, তাঁর কাছে খবর পৌঁছেছেঃ একজন জান্নাতী স্বীয় হুরের ভালবাসা ও প্রেমালাপে সত্তর বছর পর্যন্ত মশগুল থাকবে। অন্য কোন দিকে সে লক্ষ্যই করবে না। তারপর যখন সে অন্য দিকে লক্ষ্য করবে তখন দেখবে যে, প্রথমটির চেয়ে অধিকতর সুন্দরী ও নূরানী চেহারার হুর পাশেই বসে আছে। এ হুরটি তাকে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখে বলবেঃ “এবার আমার বাসনা পূর্ণ হবে।” লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করবেঃ “তুমি কে?” সে উত্তরে বলবেঃ “আমি অতিরিক্তদের মধ্যে একজন।” তখন সে সম্পূর্ণরূপে তারই প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। পুনরায় তার সাথে সত্তর বছরকাল প্রেমালাপে ও আমোদ আহ্লাদে সে কাটিয়ে দেবে। এরপর অন্য দিকে যখন তার দৃষ্টি ফিরবে তখন দেখবে যে, এর চেয়েও বেশী সুন্দরী হুর পাশেই অবস্থান করছে। এ হুরটি বলবেঃ “এখন তো সময় হয়েছে, এবার তো আমার পালা।” জান্নাতী লোকটি তাকে প্রশ্ন করবেঃ “তুমি কে?” হুরটি উত্তর দেবেঃ “আমি তাদেরই একজন যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ “কেউই জানে না তাদের জন্যে নয়নপ্রীতিকর কি লুক্কায়িত রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন যে, ফেরেশতারা দুনিয়ার দিনের পরিমাপে প্রতিদিন তিনবার করে জান্নাতীদের কাছে আসবেন জান্নাতে আদন হতে আল্লাহ প্রদত্ত উপঢৌকন নিয়ে যা তাদের জান্নাতে থাকবে না। এ আয়াতে তারই বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ঐ ফেরেশতারা তাদেরকে বলবেনঃ “আল্লাহ তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট।”
আবুল ইয়ামানী আল হাওযানী হতে অথবা অন্য কেউ হতে বর্ণিত আছে যে, জান্নাতের একশ’টি শ্রেণী বা স্তর রয়েছে। প্রথমটি চাদির তৈরী। ওর যমীনও চাদির এবং বাসভবনগুলোও চাদির। ওর মাটি হলো মৃগনাভি। দ্বিতীয়টি সোনার তৈরী, যমীনও সোনার, ঘরবাড়ীও সোনার, পানপাত্রও সোনার এবং মাটি হলো মৃগনাভি। তৃতীয়টি মণি-মুক্তার তৈরী, যমীনও মণি-মুক্তার, বাড়ী-ঘরও মণি-মুক্তার, পানপাত্রগুলোও মণি-মুক্তার এবং মাটি হলো মৃগনাভি। বাকী সাতানব্বইটি তো হলো এমনই যেগুলো না কোন চক্ষু দেখেছে, না কোন কর্ণ শুনেছে এবং না কোন অন্তরে কল্পনা জেগেছে। অতঃপর তিনি (আরবি)-এ আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) হযরত রূহুল আমীন (হ্যরত জিবরাঈল আঃ) হতে বর্ণনা করেছেনঃ “মানুষের পাপ ও পুণ্য আনয়ন করা হবে। একটি অপরটি হতে কম করা হবে। অতঃপর যদি একটি পুণ্যও বেঁচে যায় তবে আল্লাহ তা’আলা ওটাকে বৃদ্ধি করে দিবেন এবং জান্নাতের প্রশস্ততা দান করবেন।” বর্ণনাকারী ইয়াযদারদকে জিজ্ঞেস করেনঃ “পুণ্য কোথায় গেল?” উত্তরে তিনি নিম্নের আয়াতটি তিলাওয়াত করেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এরা ওরাই যাদের ভাল কাজগুলো আমি কবুল করে নিয়েছি এবং পাপগুলোকে ক্ষমা করে দিয়েছি।” (৪৬:১৬) বর্ণনাকারী বলেনঃ “তাহলে (আরবি)-এ আয়াতের অর্থ কি?” জবাবে তিনি বলেনঃ “বান্দা যখন পুণ্যের কাজ গোপনে করে তখন আল্লাহ তা’আলাও কিয়ামতের দিন তার শান্তির জন্যে নয়নপ্রীতিকর যা গোপন করে রেখেছিলেন তা তাকে প্রদান করবেন। (এটাও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১৮-২২ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলার আদল, ইনসাফ ও করুণার কথা এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে। তিনি সকর্মশীল ও পাপাচারীকে সমান চোখে দেখেন না। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যারা মন্দ কাজে লিপ্ত আছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে ঈমানদার ও সঙ্কৰ্মশীলদের মত করবো? তাদের জীবন ও মরণ সমান। তাদের অভিসন্ধি কতই জঘন্য!” (৪৫:২১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যারা ঈমান আনে ও সঙ্কর্ম করে তাদেরকে কি আমি ঐ লোকদের মত করবো যারা ভূপৃষ্ঠে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে? অথবা আমি কি আল্লাহভীরুদেরকে পাপাচারীদের মত করবো?” (৩৮:২৮) অন্য এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ ‘জাহান্নামের অধিবাসী ও জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়।’ (৫৯:২০)
এখানেও বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন মুমিন ও কাফির এক মর্যাদার লোক হবে না। বলা হয়েছে যে, এ আয়াত হযরত আলী (রাঃ) এবং উকবাহ ইবনে আবি মুঈতের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এই দুই প্রকারের লোকের বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছেন যে, যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কালামের সত্যতা স্বীকার করে ও ওটা অনুযায়ী আমল করে তাকে এমন জান্নাত দেয়া হবে যেখানে বাড়ী ঘর রয়েছে, অট্টালিকা রয়েছে, উঁচু উঁচু প্রাসাদ রয়েছে এবং শান্তিতে বসবাসের উপযোগী সমস্ত উপকরণ রয়েছে। এটা হবে তার ভাল কাজের বিনিময়ে আপ্যায়ন। পক্ষান্তরে যারা আনুগত্য ছেড়ে দিয়েছে তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম, যেখান হতে তারা বের হতে পারবে না। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যখনই তারা তথাকার (জাহান্নামের) দুঃখ-কষ্ট হতে বের হতে চাইবে তখনই তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হবে।” (২২:২২)।
হযরত ফুয়েল ইবনে আইয়ায (রঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! তাদের হাত-পা বাঁধা থাকবে। অগ্নিশিখা তাদেরকে নিয়ে উপরে-নীচে যাওয়া-আসা করবে। ফেরেশতারা তাদেরকে শাস্তি দিতে থাকবেন।”
তাদেরকে ধমক দিয়ে বলা হবেঃ যে অগ্নির শাস্তিকে তোমরা মিথ্যা বলতে তা আস্বাদন কর। (আরবি) বা লঘু শাস্তি দ্বারা পার্থিব বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, রোগ-শোক ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। এগুলো এ জন্যেই দেয়া হয় যে, যেন মানুষ সতর্ক হয়ে যায় ও আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং পারলৌকিক ভীষণ শাস্তি হতে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে। একটি উক্তি এও আছে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো পাপসমূহের ঐ নির্ধারিত শাস্তি যা দুনিয়ায় দেয়া হয়ে থাকে, যাকে শরীয়তের পরিভাষায় হুদূদ বলা হয়। এও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা কবরের শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। সুনানে নাসাঈতে রয়েছে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো দুর্ভিক্ষ। হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া, ধূম্র বহির্গত হওয়া, ধর-পাকড় হওয়া, ধ্বংসাত্মক শাস্তি হওয়া, বদরের যুদ্ধে কাফিরদের বন্দী ও নিহত হওয়া। কেননা, বদর-যুদ্ধের এ পরাজয়ের কারণে মক্কার ঘরে ঘরে শোলে ও বিলাপের ছায়া পড়ে গিয়েছিল। এই আয়াতে এই আযাবের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী দ্বারা উপদিষ্ট হয়ে তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে আছে?
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর যিকর হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। যারা এরূপ করে তারা মর্যাদাহীন, নীতি বিহীন ও বড় পাপী।
এখানেও মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ ঘোষণা করেনঃ আমি অবশ্যই অপরাধীদেরকে শাস্তি প্রদান করে থাকি।
হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ তিনটি কাজ যে করে সে পাপী হয়ে যায়। যে অন্যায়ভাবে পতাকা বাঁধে অথবা পিতা-মাতার অবাধ্যাচরণ করে কিংবা যালিমের সাহায্যার্থে তার সাথে গমন করে, সে পাপী হয়ে থাকে। আর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ অবশ্যই আমি অপরাধী ও পাপীদের হতে প্রতিশোধ গ্রহণকারী। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইবনে আবি হাতিমও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা খুবই গরীব বা দুর্বল হাদীস)