أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৪৮/মুনাফিক কি?বই:-৩১)
[একজন লোক একই সঙ্গে মু’মিন ও মুনাফিক, সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী এবং সৎ ও অসৎ হতে পারে না:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৩:আহযাব
পারা:২১
৪- ৫ নং আয়াত:-
৩৩:৪
مَا جَعَلَ اللّٰہُ لِرَجُلٍ مِّنۡ قَلۡبَیۡنِ فِیۡ جَوۡفِہٖ ۚ وَ مَا جَعَلَ اَزۡوَاجَکُمُ الّٰٓیِٴۡ تُظٰہِرُوۡنَ مِنۡہُنَّ اُمَّہٰتِکُمۡ ۚ وَ مَا جَعَلَ اَدۡعِیَآءَکُمۡ اَبۡنَآءَکُمۡ ؕ ذٰلِکُمۡ قَوۡلُکُمۡ بِاَفۡوَاہِکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ یَقُوۡلُ الۡحَقَّ وَ ہُوَ یَہۡدِی السَّبِیۡلَ ﴿۴﴾
আল্লাহ কোন ব্যক্তির দেহাভ্যন্তরে দু’টি হৃদয় রাখেননি। তোমাদের যেসব স্ত্রীকে তোমরা “যিহার” করো তাদেরকে আল্লাহ তোমাদের জননীও করেননি এবং তোমাদের পালক পুত্রদেরকেও তোমাদের প্রকৃত পুত্র করেননি। এসব তো হচ্ছে এমন ধরনের কথা যা তোমরা স্বমুখে উচ্চারণ করো, কিন্তু আল্লাহ এমন কথা বলেন যা প্রকৃত সত্য এবং তিনিই সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।
৩৩:৫
اُدۡعُوۡہُمۡ لِاٰبَآئِہِمۡ ہُوَ اَقۡسَطُ عِنۡدَ اللّٰہِ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ تَعۡلَمُوۡۤا اٰبَآءَہُمۡ فَاِخۡوَانُکُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ مَوَالِیۡکُمۡ ؕ وَ لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ فِیۡمَاۤ اَخۡطَاۡتُمۡ بِہٖ ۙ وَ لٰکِنۡ مَّا تَعَمَّدَتۡ قُلُوۡبُکُمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۵﴾
ডাকো তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃ পরিচয়ে ; আল্লাহ্র নিকট এটাই বেশী ন্যায়সংগত। অতঃপর যদি তোমরা তাদের পিতৃ পরিচয় না জান, তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই এবং বন্ধু। আর এ ব্যাপারে তোমরা কোন অনিচ্ছাকৃত ভুল করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই; কিন্তু তোমাদের অন্তর যা স্বেচ্ছায় করেছে (তা অপরাধ), আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# একজন লোক একই সঙ্গে মু’মিন ও মুনাফিক, সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী এবং সৎ ও অসৎ হতে পারে না। তার বক্ষ দেশে দু’টি হৃদয় নেই যে, একটি হৃদয়ে থাকবে আন্তরিকতা এবং অন্যটিতে থাকবে আল্লাহর প্রতি বেপরোয়া ভাব। কাজেই একজন লোক এক সময় একটি মর্যাদারই অধিকারী হতে পারে। সে মু’মিন হবে অথবা হবে মুনাফিক। সে কাফের হবে অথবা হবে মুসলিম। এখন যদি তোমরা কোন মু’মিনকে মুনাফিক বলো অথবা মুনাফিককে মু’মিন, তাহলে তাতে প্রকৃত সত্যের কোন পরিবর্তন হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আসল মর্যাদা অবশ্যই একটিই থাকবে।
# “যিহার” আরবের একটি বিশেষ পরিভাষা। প্রাচীনকালে আরবের লোকেরা স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করতে করতে কখনো একথা বলে বসতো, “তোমার পিঠ আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতো।” একথা কারো মুখ থেকে একবার বের হয়ে গেলেই মনে করা হতো, এ মহিলা এখন তার জন্য হারাম হয়ে গেছে। কারণ সে তাকে তার মায়ের সাথে তুলনা করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, স্ত্রীকে মা বললে বা মায়ের সাথে তুলনা করলে সে মা হয়ে যায় না। মা তো গর্ভধারিনী জন্মদাত্রী। নিছক মুখে মা বলে দিলে প্রকৃত সত্য বদলে যায় না। এর ফলে যে স্ত্রী ছিল সে তোমাদের মুখের কথায় মা হয়ে যাবে না। (এখানে যিহার সম্পর্কিত শরীয়াতের বিধান বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়। যিহার সম্পর্কিত আইন বর্ণনা করা হয়েছে সূরা মুজাদিলার ২-৪ আয়াতে)
# সুরা: আল-মুজাদিলাহ
আয়াত নং :-২
اَلَّذِیْنَ یُظٰهِرُوْنَ مِنْكُمْ مِّنْ نِّسَآئِهِمْ مَّا هُنَّ اُمَّهٰتِهِمْ١ؕ اِنْ اُمَّهٰتُهُمْ اِلَّا الّٰٓئِیْ وَلَدْنَهُمْ١ؕ وَ اِنَّهُمْ لَیَقُوْلُوْنَ مُنْكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَ زُوْرًا١ؕ وَ اِنَّ اللّٰهَ لَعَفُوٌّ غَفُوْرٌ
তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে “যিহার” করে৩ তাদের স্ত্রীরা তাদের মা নয়। তাদের মা কেবল তারাই যারা তাদেরকে প্রসব করেছে। এসব লোক একটা অতি অপছন্দনীয় ও মিথ্যা কথাই বলে থাকে। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহ মাফ করেন, তিনি অতীব ক্ষমাশীল।
# আরবে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটতো যে, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হলে স্বামী ক্রোধান্বিত হয়ে বলতো
اَنْتَ عَلَى كَظَهْرِ اُمِّى
এর আভিধানিক অর্থ হলো, “তুমি আমার জন্য ঠিক আমার মায়ের পিঠের মত” কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, আমার তোমার সাথে সহবাস ঠিক আমার মায়ের সাথে সহবাস করার মত। এযুগেও বহু নির্বোধ মানুষ স্ত্রীর সাথে ঝগড়া বিবাদ করে তাদের মা, বোন ও মেয়ের মত বলে ফেলে। এর স্পষ্ট অর্থ দাঁড়ায় স্বামী এখন আর তাকে স্ত্রী মনে করে না, বরং যেসব স্ত্রীলোক তার জন্য হারাম তাদের মত মনে করে। এরূপ করাকেই “যিহার” বলা হয়। ظهر আরবী ভাষায় রূপক অর্থে বাহনকে বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ সওয়ারী জন্তুকে ظهر বলা হয়। কেননা, মানুষ তার পিঠে আরোহণ করে। মানুষ যেহেতু স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম করে নেয়ার উদ্দেশ্যে বলতো যে, ظهر বানানো আমার জন্য আমার মাকে ظهر বানানোর মতই হারাম। সুতরাং তাদের মুখ থেকে এসব কথা উচ্চারণ করাকেই তাদের ভাষায় “যিহার” বলা হতো। জাহেলী যুগে আরবদের কাছে এটা তালাক বা তার চেয়ে অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা বলে মনে করা হতো। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে এর অর্থ ছিল এই যে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্কই ছিন্ন করছে না, বরং তাকে নিজের মায়ের মত হারাম করে নিচ্ছে। এ কারণে আরবদের মতে তালাক দেয়ার পর তা প্রত্যাহার করা যেতো। কিন্তু “যিহার” প্রত্যাহার করার কোন সম্ভাবনাই অবশিষ্ট থাকতো না।
# এটা যিহার সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার প্রথম ফায়সালা। এর অর্থ হলো, কেউ যদি মুখ ফুটে স্ত্রীকে মায়ের মত বলে বসে তাহলে তার বলার কারণে স্ত্রী তার মা হতে পারে না। কোন মহিলার কারো মা হওয়া একটা সত্য ও বাস্তব প্রমাণ ব্যাপার। কারণ, সে তাকে প্রসব করেছে। এ কারণে সে স্থায়ীভাবে হারাম হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছে। কিন্তু যে নারী তাকে প্রসব করেনি, শুধু মৌখিক কথাতেই সে কিভাবে তার মা হয়ে যাবে? বুদ্ধি-বিবেক, নৈতিকতা এবং আইন-কানুন যে কোন বিচারেই হোক সে কিভাবে প্রকৃত প্রসবকারিনী মায়ের মত হারাম হবে? আল্লাহ তা’আলা এভাবে এ কথাটি ঘোষণা করে সেসব জাহেলী আইন-কানুনকে বাতিল করে দিয়েছেন যার ভিত্তিতে যিহারকারী স্বামীর সাথে তার স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেতো এবং স্ত্রীকে স্বামীর জন্য মায়ের মত অলংঘনীয় হারাম মনে করা হতো।
# স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করা প্রথমত এমন একটি অর্থহীন ও লজ্জাজনক কথা যা মুখে উচ্চারণ করা তো দূরের কথা কোন শরীফ মানুষের যার কল্পনাও করা উচিত নয়। দ্বিতীয়ত, এটি একটি মিথ্যা কথাও বটে। কারণ, যে এরূপ কথা বলছে সে যদি এর দ্বারা বুঝিয়ে থাকে যে, তার স্ত্রী এখন তার মা হয়ে গিয়েছে তাহলে সে মিথ্যা বলছে। আর সে যদি এ কথাটি তার সিদ্ধান্ত হিসেবে শুনিয়ে থাকে যে, আজ থেকে সে তার স্ত্রীকে মায়ের মর্যাদা দান করেছে তাহলেও তার এ দাবী মিথ্যা। কারণ, আল্লাহ তাকে অধিকার দেননি যে, যতদিন ইচ্ছা সে একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে রাখবে এবং যখন ইচ্ছা তাকে মায়ের মর্যাদা দান করবে। সে নিজে আইন রচয়িতা নয় বরং আইন রচয়িতা হলেন আল্লাহ। আল্লাহ তা’আলা প্রসবকারিনী মায়ের সাথে দাদী, নানী, শ্বাশুড়ী, দুধমা এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণকেও মাতৃত্বের মর্যাদা দান করেছেন। নিজের স্ত্রীকে তো দূরের কথা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোন নারীকেও এ মর্যাদার অন্তর্ভুক্ত করার অধিকার কারোই নেই। একথা থেকে আরো একটি আইনগত বিধান যা পাওয়া যায় তাহলো, ‘যিহার’ করা একটি গুরুতর গোনাহ এবং হারাম কাজ। যে এ কাজ করবে সে শাস্তির উপযুক্ত।
# এটি এমন একটি কাজ যেজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার মেহেরবাণী যে, তিনি প্রথমত যিহারের ব্যাপারে জাহেলী আইন-কানুন বাতিল করে তোমাদের পারিবারিক জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। দ্বিতীয়ত, এ অপরাধে অপরাধী ব্যক্তির জন্য সর্বাধিক লঘু শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় মেহেরবানী এই যে, জেল খাটা বা মারপিট আকারে এ অপরাধের শাস্তি বিধান করেননি। বরং এমন কিছু ইবাদাত ও নেকীর কাজকে এ অপরাধের শাস্তি নির্ধারিত করেছেন যা তোমাদের প্রবৃত্তির সংশোধন করে এবং সমাজে কল্যাণ ও সুকৃতির বিস্তার ঘটে। এক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বুঝা উচিত যে, কোন কোন অপরাধ ও গোনাহর জন্য যেসব ইবাদতকে কাফফারা নির্ধারণ করা হয়েছে তা ইবাদাতের চেতনাবিহীন নিরেট শাস্তি নয়। আবার নিছক এমন ইবাদতও নয় যে, তার মধ্যে শাস্তির কষ্টকর কোন দিক আদৌ নেই। এর মধ্যে ইবাদাত ও শাস্তি উভয়টিই একত্রিত করা হয়েছে, যাতে ব্যক্তি যুগপত কষ্টও ভোগ করে এবং সাথে সাথে একটি ইবাদাত ও নেকীর কাজ করে তার কৃত গোনাহরও প্রতিকার করে।
সুরা: আল-মুজাদিলাহ
আয়াত নং :-৩
وَ الَّذِیْنَ یُظٰهِرُوْنَ مِنْ نِّسَآئِهِمْ ثُمَّ یَعُوْدُوْنَ لِمَا قَالُوْا فَتَحْرِیْرُ رَقَبَةٍ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّتَمَآسَّا١ؕ ذٰلِكُمْ تُوْعَظُوْنَ بِهٖ١ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ
যারা৭ নিজের স্ত্রীর সাথে “যিহার” করে বসে এবং তারপর নিজের বলা সে কথা প্রত্যাহার করে এমতাবস্থায় তারা পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি ক্রীতদাসকে মুক্ত করতে হবে। এর দ্বারা তোমাদের উপদেশ দেয়া হচ্ছে। তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।
# এখান থেকে যিহারের আইনগত আদেশ নিষেধ শুরু হয়েছে। এসব বিধি-বিধান সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র যুগে যিহারের যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তা সামনে থাকা জরুরী। কেননা, যিহারের বিধি-বিধান সম্পর্কিত এসব আয়াত নাযিল হওয়ার পর সংঘটিত ঘটনাসমূহের ক্ষেত্রে নবী (সা.) যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তা থেকেই ইসলামে যিহার সম্পর্কিত বিস্তারিত বিধি-বিধান গৃহীত হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনা অনুসারে আওস ইবনে সামেত আনসারীর ঘটনাই ইসলামে যিহার সম্পর্কিত সর্ব প্রথম ঘটনা। তাঁর স্ত্রী খাওলার ফরিয়াদের জওয়াবে আল্লাহ তা’আলা এসব আয়াত নাযিল করেছেন। বিভিন্ন বর্ণনাকারীর নিকট থেকে মুহাদ্দিসগণ এ ঘটনার যে বিস্তারিত বিবরণ উদ্ধৃত করেছেন তাতে অনেক খুঁটি-নাটি মতভেদ আছে। তবে আইনগত গুরুত্ব বহন করে এরূপ উপাদান সম্পর্কে সবাই প্রায় একমত। এসব বর্ণনার সারকথা হলো, বৃদ্ধাবস্থায় হযরত আওস ইবনে সামেত কিছুটা খিটমিটে মেজাজের হয়ে গিয়েছিলেন। কোন কোন বর্ণনা অনুসারে তার মধ্যে কতকটা পাগলামী ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। এ বিষয়টি বুঝানোর জন্য বর্ণনাকারীগণ كان به لمم বাক্য ব্যবহার করেছেন। আরবী ভাষায় لمم শদ্ব দ্বারা পাগলামী বুঝানো হয় না, বরং এমন একটি অবস্থাকে বুঝানো হয় যাকে আমরা বাংলায়, “ক্রোধে পাগল হয়ে যাওয়া” কথাটি দ্বারা বুঝিয়ে থাকি। এ অবস্থায় তিনি পূর্বেও কয়েকবার স্ত্রীর সাথে যিহার করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর সাথে ঝগড়া বিবাদ করে তার দ্বারা পুনরায় এ ঘটনা সংঘটিত হওয়া ছিল ইসলামে সর্ব প্রথম ঘটনা। এ ঘটনার পর তার স্ত্রী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির হয় এবং পূরা ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন হে আল্লাহর রসূল, আমার এবং আমার সন্তানাদির জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার কোন অবকাশ আছে কি? নবী (সা.) এর জওয়াব দিয়েছিলেন বিভিন্ন বর্ণনাকারী তা বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে উদ্ধৃত করেছেন। কোন কোন বর্ণনার ভাষা হলো, “এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাকে কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি।” কোন কোন বর্ণনার ভাষা হলো, “আমার ধারণা তুমি তার জন্য হারাম হয়ে গিয়েছো।” আবার কোন কোন বর্ণনায় আছে, তিনি বললেন, “তুমি তার জন্য হারাম হয়ে গিয়েছো।” এ জবাব শুনে তিনি কাকুতি ও আহাজারী করতে শুরু করলেন। তিনি বারবার নবীকে ﷺ বললেনঃ সে তো তালাকের শব্দ বলেনি। আপনি এমন কোন পন্থা বলুন যার দ্বারা আমি আমার সন্তানাদি এবং বুড়ো স্বামীর জীবন ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু নবী (সা.) প্রতিবার তাকে একই জবাব দিচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে নবীর ﷺ ওপর অহী নাযিল হওয়ার অবস্থা দেখা দিল এবং এ আয়াতগুলো নাযিল হলো। এরপর তিনি তাকে বললেন, কোন কোন বর্ণনা অনুসারে তার স্বামীকে ডেকে বললেনঃ একটি ক্রীতদাসকে মুক্ত করতে হবে। সে এতে তার অক্ষমতা প্রকাশ করলে বললেনঃ লাগাতার দুইমাস রোযা রাখতে হবে। সে বললো তার অবস্থা এমন যে, দিনে তিনবার পানাহার না করলে তার দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণতর হতে থাকে। তিনি বললেনঃ তাহলে ৬০ জন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াতে হবে। সে বললো তার সে সামর্থ্য নেই। তবে আপনি যদি সাহায্য করেন তাহলে পারবো। তিনি তাকে ৬০ জন মিসকীনকে দু’বার খাওয়ানোর মত খাদ্য দিলেন। বিভিন্ন রেওয়ায়াতে প্রদত্ত এ খাদ্যের বিভিন্ন পরিমাণ বর্ণনা করা হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় আছে, নবী (সা.) যে পরিমাণ খাদ্য দিয়েছিলেন হযরত খাওলা নিজেও তার স্বামীকে সে পরিমাণ খাদ্য দিয়েছিলেন যাতে তিনি কাফফারা আদায় করতে পারেন (ইবনে জারীর, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে আবী হাতেম)।
যিহারের দ্বিতীয় ঘটনা ছিল সালামা ইবনে সাখার বায়দীর ঘটনা। তাঁর যৌন শক্তি ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু বেশী। রমযান মাস আসলে সে আশঙ্কায় রমযানের শেষ অবধি সময়ের জন্য স্ত্রীর সাথে যিহার করলো যাতে রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় অধৈর্যের কাজ করে না বসে। কিন্তু সে নিজের এ সংকল্প রক্ষা করতে পারেনি। এক রাতে সে স্ত্রীর কাছে চলে যায় এবং তারপর লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সব কিছু খুলে বলে। তিনি বললেন, একজন ক্রীতদাস মুক্ত করো। সে বললো, আমার কাছে আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই যাকে আমি মুক্ত করতে পারি। তিনি বললেন, একাধারে দুই মাস রোযা রাখো। সে বললো, রোযা অবস্থায় অধৈর্য হয়েই তো আমি এ মসিবতে জড়িয়ে পড়েছি। নবী (সা.) বললেন, তাহলে ৬০ জন মিসকীনকে খেতে দাও। সে বললো, আমি এত দরিদ্র যে, উপোস করে রাত কাটিয়েছি। তখন নবী (সা.) বনী যুরাইকের যাকাত আদায়কারীর নিকট থেকে তাকে একটা খাদ্য দিলেন যাতে সে তা ৬০ জন মিসকীনকে বণ্টন করে দিতে পারে এবং নিজের সন্তানাদির প্রয়োজন পূরণ করার জন্যও কিছু রাখতে পারে। (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী)।
নাম উল্লেখ না করে তৃতীয় ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে যে, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে যিহার করলো এবং কাফফারা আদায় করার পূর্বেই তার সাথে সহবাস করলো। পরে নবী (সা.) এর কাছে এ বিষয়ের সমাধান জানতে চাইলে তিনি তাকে নির্দেশ দিলেন কাফফারা আদায় না করা পর্যন্ত স্ত্রীর নিকট থেকে দূরে থাকো। (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)।
চতুর্থ ঘটনাটি হলো, রসূলুল্লাহ ﷺ শুনলেন এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বোন সম্বোধন করে ডাকছে। এতে তিনি রাগান্বিতভাবে বললেনঃ সে কি তোমার বোন? তবে এটিকে তিনি যিহার হিসেবে গণ্য করলেন না। (আবু দাউদ)
এ চারটি ঘটনার নির্ভরযোগ্য বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহে পাওয়া যায়। পরবর্তী আয়াতসমূহে কুরআন মজীদের ‘যিহার’ সম্পর্কিত যে নির্দেশ আছে এসব হাদীসের সাহায্যে তা ভালভাবে বুঝা যেতে পারে।
# মূল আয়াতাংশ হচ্ছে, ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا । একথাটির শাব্দিক অনুবাদ হবে, “তারা যা বলেছে যদি সেদিকে ফিরে যায়” কিন্তু আরবী ভাষা ও বাকরীতি অনুসারে এর অর্থ নিরূপণে বড় রকমের মতভেদ হয়েছে।
এর একটি অর্থ হতে পারে, যিহারের শব্দাবলী একবার মুখ থেকে বের হওয়ার পর পুনরায় তা বলবে। জাহেরিয়া, বুকাইর ইবনুল আশাজ্জ এবং ইয়াহইয়া ইবনে যিহাদ আল ফাররা এ অর্থের সমর্থক। আতা ইবনে আবী রাবাহর একটি মতও এর সমর্থন করে বলে বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের মতে একবার যিহার করলে তা ক্ষমার যোগ্য। তবে কেউ যদি বার বার তা করে তাহলে তাকে কাফফারা দিতে হবে। তবে দু’টি কারণে এ ব্যাখ্যা স্পষ্ট ভুল। একটি কারণ হলো, আল্লাহ তা’আলা যিহার অর্থহীন ও মিথ্যা কথা ঘোষণা করে তার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। এখন একথা কি কল্পনা করা যায় যে, কেউ একবার মিথ্যা এবং অর্থহীন কথা বললে তা মাফ হবে কিন্তু দ্বিতীয়বার বললে শাস্তির উপযুক্ত হবে? এটি ভুল হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হলো, রসূলুল্লাহ ﷺ যিহারকারী কোন লোককেই একথা জিজ্ঞেস করেননি যে, সে একবার যিহার করেছে না দুইবার।
এ আয়তাংশের দ্বিতীয় অর্থ হলো, জাহেলী যুগে যেসব লোক এ কাজ করতে অভ্যস্ত ছিল তারা যদি ইসলামের যুগেও তা করে তাহলে এটা হবে তাদের শাস্তি। এক্ষেত্রে এর অর্থ হবে যিহার করা মূলত একটা শাস্তিযোগ্য কাজ। যে ব্যক্তিই তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে মুখ থেকে যিহারের শব্দাবলী উচ্চারণ করবে সে পরে তার স্ত্রীকে তালাক দিক বা তার স্ত্রী মারা যাক কিংবা সে তার স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষা না করার সংকল্প করুক তাতে কিছু আসে যায় না। সর্বাবস্থায় তাকে কাফফারা দিতে হবে। ফকীহদের মধ্যে তাউস, মুহাজিদ, শা’বী যুহরী, সুফিয়ান সাওরী এবং কাতাদা এমত পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে যিহার করার পর স্ত্রী যদি মারা যায় তাহলে কাফফারা আদায় না করা পর্যন্ত স্বামী তার পরিত্যক্ত সম্পদের উত্তরাধীকারী হবে না।
এ আয়াতাংশের তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, যিহারের শব্দাবলী মুখ থেকে উচ্চারণের পর ব্যক্তি যা বলেছে তা প্রত্যাহার করে এবং যদি তার প্রতিকার করতে চায়। অন্য কথায় عَادَ لِمَا قَالَ অর্থ সে যদি তার কথা থেকে ফিরে যায়।
এর চতুর্থ অর্থ হলো, যিহার করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জন্য যে জিনিস হারাম করে নিয়েছিল তা যদি আবার নিজের জন্য হালাল করে নিতে চায়। অন্য কথায় عَادَ لِمَا قَالَ অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি হারাম করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখন সে পুনরায় তা হালাল করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অধিকাংশ ফিকাহবিদ শেষোক্ত দু’টি অর্থের মধ্যে যে কোন একটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
# অন্য কথায় তোমাদেরকে শিষ্ট ও ভদ্র আচরণ শিখানোর জন্য এ নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যাতে মুসলিম সমাজের মানুষ এ জাহেলী কু আচরণ পরিত্যাগ করে এবং তোমাদের মধ্য থেকে কেউই যেন এ অর্থহীন কাজ না করে। যদি স্ত্রীর সাথে বিবাদ না করে কোন উপায় না থাকে তাহলে সভ্য ও রুচিশীল মানুষের মত বিবাদ করো। যদি তালাকই দিতে হয় তাহলে সরাসরি তালাক দিয়ে দাও। স্ত্রীর সাথে বিবাদ হলে তাকে মা অথবা বোন বানিয়ে ছাড়তে হবে এটা কি ধরনের ভদ্রতা?
# কেউ যদি বাড়িতে স্ত্রীর সাথে চুপে চুপে যিহার করে বসে এবং পরে কাফফারা আদায় করা ছাড়াই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আগের মতই দাম্পত্য সম্পর্ক চলতে থাকে তাহলে সে সম্পর্কে দুনিয়াতে কেউ অবহিত থাক আর না থাক আল্লাহ সর্বাবস্থায়ই তা জানেন। তার জন্য আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়।
সুরা: আল-মুজাদিলাহ
আয়াত নং :-৪
فَمَنْ لَّمْ یَجِدْ فَصِیَامُ شَهْرَیْنِ مُتَتَابِعَیْنِ مِنْ قَبْلِ اَنْ یَّتَمَآسَّا١ۚ فَمَنْ لَّمْ یَسْتَطِعْ فَاِطْعَامُ سِتِّیْنَ مِسْكِیْنًا١ؕ ذٰلِكَ لِتُؤْمِنُوْا بِاللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ١ؕ وَ تِلْكَ حُدُوْدُ اللّٰهِ١ؕ وَ لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابٌ اَلِیْمٌ
যে মুক্ত করার জন্য কোন ক্রীতদাস পাবে না সে বিরতিহীনভাবে দুই মাস রোযা রাখবে- উভয়ে পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বেই। যে তাও পারবে না সে ষাট জন মিসকীনকে খাবার দেবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এজন্য যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান আনো। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত ‘হদ’। কাফেরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।
# এটি যিহার সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ। মুসলিম ফিকাহবিদগণ এ আয়াতের শব্দাবলী, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিদ্ধান্তসমূহ এবং ইসলামের সাধারণ নীতিমালা থেকে এ বিষয়ে যেসব আইন-কানুন রচনা করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপঃ
একঃ আবর জাহেলিয়াতের যেসব রসম-রেওয়াজ অনুসারে যিহার বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দিত এবং স্ত্রী স্বামীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যেতো যিহার সম্পর্কিত এসব ইসলামী আইন-কানুন তা বাতিল করে দেয়। অনুরূপভাবে যেসব আইনকানুন ও রসম-রেওয়াজ যিহারকে অর্থহীন ও প্রতিক্রিয়াহীন মনে করে এবং স্ত্রীকে মা কিংবা বিয়ে করা হারাম এমন মহিলাদের সাথে তুলনা করা সত্ত্বেও স্বামী তার সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখা বৈধ করে দেয় ইসলামী আইন-কানুন সে সবকেও বাতিল করে দেয়। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে মা এবং বিয়ে করা হারাম এমন অন্য সব মহিলার হারাম হওয়ার ব্যাপারটা মামুলি কোন বিষয় নয়। তাই স্ত্রী এবং তাদের মধ্য তুলনা করার বিষয়টা মুখে উচ্চারণ করা তো দূরের কথা তা কল্পনাও করা যায় না। এ ব্যাপারে দু’টি চরম পন্থার মধ্যে ইসলামী আইন যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে তা তিনটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রথম ভিত্তি হলো, যিহার দ্বারা বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়না। বরং মহিলা যথারীতি স্বামীর স্ত্রীই থাকে। দ্বিতীয় ভিত্তি হলো, যিহার দ্বারা স্ত্রী সাময়িকভাবে স্বামীর জন্য হারাম হয়ে যায়। তৃতীয় ভিত্তি হলো, স্বামী কাফফারা আদায় না করা পর্যন্ত এই ‘হুরমত’ অবশিষ্ট থাকে এবং শুধু কাফ্ফারাই এই ‘হুরমত’ রহিত করতে পারে।
দুইঃ যিহারকারী স্বামী সম্পর্কে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, যে স্বামী সুস্থ বুদ্ধি ও প্রাপ্ত বয়স্ক এবং সুস্থ ও সজ্ঞানে যিহারের শব্দাবলী মুখ থেকে উচ্চারণ করবে কেবল তার যিহার গ্রহণযোগ্য হবে। শিশু ও বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তির যিহার গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া যিহারের শব্দাবলী উচ্চারণের সময় যার বিবেক-বুদ্ধি ও মস্তিষ্ক সুস্থ নাই তার যিহারও গ্রহণযোগ্য হবে না। যেমন কেউ ঘুমন্ত অবস্থায় অস্ফুট স্বরে কিছু বললো অথবা কোন প্রকার সংজ্ঞানহীনতায় আক্রন্ত হলো। এগুলো ছাড়া নিম্ন বর্ণিত বিষয়সমূহে ফিকাহবিদদের মতভেদ আছেঃ
(ক) নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যিহারকারী সম্পর্কে চার ইমামসহ ফিকাহবিদদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মত হচ্ছে, কেউ যদি জেনে শুনে মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে তাহলে তালাকের মত তার যিহারও আইনত সঠিক বলে ধরে নেয়া হবে। কারণ সে নিজেই নিজের ওপর এ অবস্থা চাপিয়ে নিয়েছে। তবে কেউ যদি রোগের জন্য কোন ওষুধ ব্যবহার করে এবং তা দ্বারা নেশা ও মাদকতা সৃষ্টি হয়ে থাকে অথবা তীব্র পিপাসায় জীবন রক্ষার জন্য শরাব পান করতে বাধ্য হয়ে থাকে তবে এভাবে সৃষ্ট নেশার তার যিহার ও তালাক কার্যকর করা হবে না। হানাফী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীগণ এ মতটিই গ্রহণ করেছেন। সাধারণভাবে সাহাবা কিরামের মতও এটিই ছিল। পক্ষান্তরে হযরত উসমানের (রা.) মত হলো, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তালাক ও যিহার গ্রহণযোগ্য নয়। হানাফীদের মধ্য থেকে ইমাম তাহাবী (র) ও কারখী (র) এ মতটিকে অগ্রাধিকার দান করেন এবং ইমাম শাফেয়ীর (র) একটি মতও এর সমর্থন করে। মালেকীদের মতে ব্যক্তি যদি সম্পূর্ণরূপে বিচার বুদ্ধি খুইয়ে না বসে বরং সংলগ্ন ও সাজানো গোছানো কথাবার্তা বলতে থাকে এবং কি বলছে সে উপলব্ধি থাকে তাহলে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যিহারও গ্রহণযোগ্য হবে। (খ) ইমাম আবু হানিফা (র) ও ইমাম মালেকের (র) মতে কেবল মুসলমান স্বামীর যিহারই গ্রহণযোগ্য হবে। যিহার সম্পর্কিত এসব বিধি-নিষেধ যিম্মিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। কারণ কুরআন মজীদে الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْكُمْ বলে মুসলমানদের সম্বোধন করা হয়েছে। তাছাড়া কুরআন মজীদে যিহারের যে তিন প্রকার কাফফারার কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রোযাও অন্তর্ভুক্ত আছে। একথা সুস্পষ্ট যিম্মিদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমাদের মতে এসব আদেশ নিষেধ যিম্মী ও মুসলমান উভয়ের যিহারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। তবে যিম্মীদের রোযা রাখতে হবে না। তারা শুধু একজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করবে অথবা ৬০ জন মিসকীনকে খেতে দেবে।
(গ)পুরুষের মত নারীও কি যিহার করতে পারে? যেমনঃ সে যদি স্বামীকে বলে, তুমি আমার জন্য আমার বাপের মত অথবা আমি তোমার জন্য তোমার মায়ের মত তাহলে কি তা ‘যিহার’ বলে গণ্য হবে? চার ইমামের মতে এটা যিহার হবে না এবং এক্ষেত্রে যিহারের আইনগত বিধি-বিধান আদৌ প্রযোজ্য হবে না। কেননা, স্বামী যদি স্ত্রীর সাথে যিহার করে কেবল তখনই এই বিধি-বিধান প্রযোজ্য হবে বলে কুরআন মজীদ স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছে (وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْ نِسَائِهِمْ) এবং যিহার করার ইখতিয়ার কেবল তারই থাকবে যার তালাক দেয়ার অধিকার আছে। ইসলামী শরীয়াত স্বামীকে তালাক দেয়ার ইখতিয়ার যেমন স্ত্রীকে দেয়নি ঠিক তেমনি নিজেকে স্বামীর জন্য হারাম করে নেয়ার ইখতিয়ারও দেয়নি। সুফিয়ান সাওরী, ইসহাক ইবনে রাহবিয়া, আবু সাওর এবং লাইস ইবনে সাদ এমতটিই পোষণ করেছেন। তাদের মতে, স্ত্রীর এরূপ কথা অযথা ও অর্থহীন। ইমাম আবু ইউসূফ বলেন, এতে যিহার হবে না। তবে এর দ্বারা স্ত্রীর ওপর কসমের কাফফারা দেয়া অত্যাবশ্যকীয় হবে। কারণ স্ত্রীর একথা বলার অর্থ হচ্ছে সে তার স্বামীর সাথে সম্পর্ক না রাখার শপথ করেছে। ইবনে কুদামাহ উদ্ধৃত করেছেন যে, এটি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালের (র)ও মত। ইমাম আওযায়ী (র) বলেন, স্ত্রী যদি বিয়ে হওয়ার আগে একথা বলে থাকে যে, তার যদি অমুক ব্যক্তির সাথে বিয়ে হয় তাহলে সে তার জন্য তার বাপের মত তা যিহার বলে গণ্য হবে। আর যদি বিয়ের পর বলে থাকে তাহলে কসম বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে শুধু কসমের কাফফারা দিতে হবে। তবে কাফ্ফারা আদায়ের পূর্বে স্বামীকে কাছে আসতে বাঁধা দেয়ার কোন অধিকার নারীর থাকবে না। এর সমর্থনে ইবরাহীম নাখয়ী একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি হলো, তালহার (রা.) কণ্যা আয়েশাকে বিয়ে করার জন্য হযরত যুবায়েরের পুত্র মুসআব প্রস্তাব দিলে সে প্রত্যাখ্যান করে বলে; আমি যদি তাকে বিয়ে করি তাহলে هو على كظهر ابى সে আমার পিতার পিঠের মত। এর কিছুকাল পর সে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে সম্মত হয়। এব্যাপারে মদীনার উলামাদের নিকট থেকে ফতোয়া চাওয়া হলে বহু সংখ্যক ফকীহ ফতোয়া দিলেন যে, আয়েশাকে যিহারের কাফফারা দিতে হবে। এসব ফকিহদের মধ্যে কয়েকজন সাহাবীও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ ঘটনা বর্ণনা করার পর হযরত ইবরাহীম নাখয়ী মত প্রকাশ করেছেন যে, আয়েশা যদি বিয়ের পর একথা বলতেন তাহলে কাফফারা দিতে হতো না। কিন্তু তিনি এ কথা বলেছিলেন বিয়ের পূর্বে, যখন তাঁর বিয়ে করা বা না করার অধিকার ছিল তাই তার ওপর কাফফারা দেয়া ওয়াজিব।
তিনঃ সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ও প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি যদি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে যিহারের শব্দাবলী মুখ থেকে উচ্চারণ করে এবং পরে যুক্তি দেখিয়ে বলে যে, সে ক্রুদ্ধ হয়ে, হাসি-তামাসা করে অথবা আদর সোহাগ করে এরূপ বলেছে কিংবা তার যিহারের নিয়ত ছিল না তাহলে এ ওজর গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে যেসব শব্দ থেকে স্পষ্টভাবে যিহার বুঝায় না এবং যেসব শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থের অবকাশ আছে সেসব শব্দের ধরন ও প্রকৃতির ওপর তার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। যিহারের স্পষ্ট শব্দ কোন্গুলো এবং অস্পষ্ট শব্দ কোন্গুলো সে সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করবো।
চারঃ এটা সর্বসম্মত ব্যাপার যে, বিবাহিত স্ত্রীর সাথেই কেবল যিহার করা যায়। অতএব স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন নারীর সাথে যিহার করা যায় কিনা সে বিষয়ে মতভেদ আছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মত নিম্নরূপঃ
হানাফীদের মতে কেউ যদি অপর কোন নারীকে বলে, “আমি যদি তোমাকে বিয়ে করি তাহলে তুমি আমার জন্য ঠিক আমার মায়ের পিঠের মত।” এক্ষেত্রে সে যখনই তাকে বিয়ে করুক না কেন, কাফফারা আদায় করা ছাড়া তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এটি হযরত ‘উমরের (রা.)ও ফতোয়া। তাঁর খিলাফত যুগে এক ব্যক্তি এক মহিলাকে একথা বলেছিল এবং পরে তাকে বিয়ে করেছিল। হযরত উমর (রা.) বললেন, তাকে যিহারের কাফফারা দিতে হবে।
মালেকী এবং হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীগণও এ কথাই বলেন। এর সাথে তারা অতিরিক্ত এতটুকু সংযোজিত করেন যে, যদি নির্দিষ্ট করে কোন মহিলার কথা না বলে এভাবে বলে যে, সমস্ত নারীই আমার জন্য এরূপ, এমতাবস্থায় সে যে নারীকেই বিয়ে করুক না কেন তাকে স্পর্শ করার আগেই কাফফারা দিতে হবে। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব, উরওয়া ইবনে যুবায়ের, আতা ইবনে আবী রাবাহ, হাসান বাসরী এবং ইসহাক ইবনে রাহাবিয়া এমতটিই পোষণ করেছেন।
শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহদের মতে, বিয়ের পূর্বে যিহার অর্থহীন। ইবনে আব্বাস এবং কাতাদাও এ মতটিই পোষণ করেন।
পাঁচঃ যিহার কি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হতে পারে? হানাফী এবং শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহদের মতে, কেউ যদি নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে যিহার করে তাহলে সেই সময়ের মধ্যে স্ত্রীকে স্পর্শ করলে কাফফারা দিতে হবে। তবে সেই সময় অতিক্রম হলে যিহার অকার্যকর হয়ে পড়বে। এর প্রমাণ সালামা ইবনে সাখর বায়াদীর ঘটনা। তিনি তাঁর স্ত্রীর সাথে রমযান মাসের জন্য যিহার করেছিলেন কিন্তু নবী ﷺ তাকে বলেননি যে, সময় নির্দিষ্ট করা অর্থহীন। পক্ষান্তরে ইমাম মালেক এবং ইবনে আবী লায়লা বলেনঃ যিহার যখনই করা হোক না কেন তা সব সময়ের জন্য হবে। এক্ষেত্রে সময় নির্দিষ্ট করার কোন কার্যকারিতা থাকবে না। কারণ, যে ‘হুরমত, কার্যকর হয়েছে সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে তা আপনা থেকেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
ছয়ঃ শর্তযুক্ত যিহার করা হয়ে থাকলে যখনই শর্ত ভঙ্গ হবে কাফফারা দিতে হবে। যেমনঃ কেউ যদি স্ত্রীকে বলে, “আমি যদি ঘরে প্রবেশ করি তাহলে তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত” এমতাবস্থায় সে যখনই ঘরে প্রবেশ করবে কাফফারা আদায় করা ছাড়া সে স্ত্রীকে স্পর্শ করতে পারবে না।
সাতঃ একই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে কয়েকবার যিহারের শব্দাবলী বলা হয়ে থাকলে তা একই বৈঠকে বলা হয়ে থাক বা ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে বলা হয়ে থাক, সর্বাবস্থায়ই তা যতবার বলা হয়েছে ততবার কাফফারা দিতে হবে। তবে যিহারের শব্দাবলী ব্যবহারকারী যদি তা একবার ব্যবহার করার পর শুধু পূর্বের কথার ওপর জোর দেয়ার উদ্দেশ্যে তা বারবার বলে তাহলে ভিন্ন কথা। পক্ষান্তরে ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেনঃ কথাটি বারবার বলার নিয়তে বলা হোক কিংবা জোর দেয়ার জন্য বলা হোক, যতবারই বলা হোক না কেন সেজন্য একবারই কাফফারা দিতে হবে। শা’বী, তাউস, আতা ইবনে আবী রাবাহ, হাসান বাসরী এবং আওযায়ী রাহিমাহুমুল্লাহ এ মতেরই অনুসারী। এ বিষয়ে হযরত আলীর ফতোয়া হলো, কথাটি যদি একই বৈঠকে বার বার বলা হয়ে থাকে তাহলে সেজন্য একবার মাত্র কাফফারা দিতে হবে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে বলা হলে যত সংখ্যক বৈঠকে বলা হয়েছে ততবার কাফফারা দিতে হবে। এটি কাতাদা এবং আ’মর ইবনে দীনারেরও মত।
আটঃ দুই বা দু’য়ের অধিক সংখ্যক স্ত্রীর সাথে একসাথে যিহার করা হলে, যেমনঃ স্বামী তাদেরকে উদ্দেশ্যে করে বললো যে, তোমরা আমার জন্য ঠিক আমার মায়ের পিঠের মত, তাহলে হানাফী ও শাফেয়ীদের মতে, প্রত্যেককে হালাল করার জন্য আলাদা আলাদা কাফফারা দিতে হবে। এটি হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.), উরওয়া ইবনে যুবায়ের, তাউস, আতা, হাসান বাসরী, ইবরাহীম নাখয়ী, সুফিয়ান সাওরী এবং ইবনে শিহাব যুহরীর মত। ইমাম মালেক (র) এবং ইমাম আহমাদ (র) বলেন, এক্ষেত্রে সবার জন্য একবারই কাফফারা দিতে হবে। রাবীয়া, আওযায়ী, ইসহাক ইবনে রাহবিয়া এবং আবু সাওরও এমতের অনুসারী।
নয়ঃ কেউ যদি এক যিহারের কাফফারা দেয়ার পর পুনরায় যিহার করে বসে তাহলে পুনরায় কাফফারা দেয়া ছাড়া স্ত্রী তার জন্য হালাল হবে না।
দশঃ কেউ যদি কাফফারা দেয়ার আগেই স্ত্রীকে স্পর্শ করে বসে তাহলে চার ইমামের মতে, যদিও একাজ গোনাহ কিন্তু তাকে একটি কাফফারাই দিতে হবে। তবে তার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত এবং পুনরায় এ কাজ না করা উচিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যারা এরূপ করেছিল তিনি তাদের বলেছিলেন ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং যতক্ষণ কাফফারা না দিবে ততক্ষণ স্ত্রী থেকে আলাদ থাকো। কিন্তু এজন্য তিনি যিহারের কাফফারা ছাড়া আর কোন কাফফারা দিতে হবে বলে নির্দেশ দেননি। হযরত আমর ইবনুল আস, কাবিসা ইবনে যুয়াইব, সাঈদ, ইবনে জুবায়ের যুহরী এবং কাতাবা বলেন, তাকে দুইটি কাফফারা দিতে হবে এবং হাসান বাসরী ও ইবরাহীম নাখয়ীর মতে তিনটি কাফফারা দিতে হবে। এ বিষয়ে যেসব হাদীসে নবীর ﷺ ফায়সালা বর্ণিত হয়েছে উক্ত মনিষীদের কাছে সম্ভবত সে সব হাদীস পৌঁছেনি।
এগারঃ স্ত্রীকে কাদের সাথে তুলনা করলে যিহার হবে? এ বিষয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ আছেঃ
আমের শা’বী বলেন, কেবলমাত্র মায়ের সাথে তুলনা করলেই যিহার হবে। জাহেরিয়াগণ বলেনঃ মায়েরও শুধু পিঠের সাথে তুলনা করলে যিহার হবে। অন্য কোন কথার ওপর এ নির্দেশ প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু এ বিষয়ে ফিকাহবিদদের কোন গোষ্ঠিই তাঁর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেননি। কারণ মায়ের সাথে স্ত্রীর তুলনা করাকে কুরআন কর্তৃক গোনাহর কাজ বলার কারণ হলো, এটা একটা চরম অর্থহীন ও মিথ্যা কথা। এখন একথা সুস্পষ্ট যে, যেসব নারী মায়ের মতই হারাম, তাদের সাথে স্ত্রীকে তুলনা করা অর্থহীনতা ও মিথ্যাবাদীতার দিক থেকে এর চেয়ে কোন অংশ কম নয়। তাই মায়ের সাথে তুলনা করার ক্ষেত্রে বিধান প্রযোজ্য এক্ষেত্রেও সেই একই বিধান প্রযোজ্য না হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
হানাফীদের মতে যেসব নারী বংশ, দুগ্ধদান অথবা দাম্পত্য সম্পর্কের কারণে কারো জন্য চিরস্থায়ী হারাম তারা সবাই এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু যেসব নারী অস্থায়ীভাবে হারাম এবং যে কোন সময় হালাল হতে পারে তারা এর অন্তর্ভুক্ত না। যেমন স্ত্রীর বোন, খালা, ফুফু, অন্যান্য নারী যারা তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ নয়। চিরস্থায়ী হারাম মহিলাদের মধ্য থেকে কোন মহিলার যে অংগের প্রতি দৃষ্টিপাত করা কারো জন্য হালাল নয় তার সাথে তুলনা করাই যিহার বলে গণ্য হবে। তবে স্ত্রীর হাত, পা, মাথা, চুল, দাঁত ইত্যাদিকে চিরস্থায়ী হারাম নারীর পিঠের সাথে অথবা স্ত্রীকে তার মাথা, হাত ও পায়ের মত দৈহিক অংগ-প্রত্যংগের সাথে তুলনা করা যিহার বলে গণ্য হবে না। কারণ মা ও বোনের এসব অংগ-প্রত্যাংগের প্রতি তাকানো হারাম নয়। অনুরূপভাবে তোমার হাত আমার মায়ের হাতের মত অথবা তোমার পা আমার মায়ের পায়ের মত বলায় যিহার হবে না।
শাফেয়ীদের মতে, কেবল সেসব নারীই এ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে যারা চিরদিন হারাম ছিল এবং চিরদিন হারাম থাকবে। অর্থাৎ মা, বোন, মেয়ে ইত্যাদি। কিন্তু যেসব নারী কোন সময় হালাল ছিল যেমন দুধ মা, দুধ বোন, শাশুড়ী এবং পুত্রবধু অথবা যে সব নারী কোন সময় হালাল হতে পারে যেমন শ্যালিকা। এসব বিশেষ কারণে হারাম বা সাময়িক ও অস্থায়ী হারাম নারী ছাড়া স্থায়ী হারাম নারীদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দেখানো জন্য সাধারণত যে সব অংগের কথা উল্লেখ করা হয় না স্ত্রীকে যদি সেসব অংগের সাথে তূলনা করা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে তার যিহার বলে গণ্য হবে। তবে যেসব অংগ-প্রত্যাংগের উল্লেখ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য করা হয় তার সাথে তুলনা করা কেবল তখনই যিহার হবে যখন তা যিহারের নিয়তে বলা হবে। যেমন স্ত্রীকে একথা বলা তুমি আমার মায়ের চোখ অথবা জানের মত অথবা মার হাত অথবা পা অথবা পেটের মত, অথবা মায়ের পেট অথবা বক্ষস্থলের সাথে স্ত্রীর পেট অথবা বক্ষস্থলের সাথে তুলনা করা, অথবা স্ত্রীর মাথা, পিঠ অথবা হাতকে নিজের জন্য মায়ের হাতের মত মনে করা, অথবা স্ত্রীকে একথা বলা যে, তুমি আমার জন্য আমার মায়ের মত। এসব কথা যদি যিহারের নিয়তে বলা হয়ে থাকে তাহলে যিহার হবে, আর যদি সম্মান দেখানো নিয়তে বলা হয়ে থাকে তাহলে সম্মান প্রদর্শনই হবে।
মালেকীগণ বলেন, যেসব নারী পুরুষের জন্য হারাম তাদের সাথে স্ত্রীকে তুলনা করাই যিহার। এমন কি তাদের মতে, স্বামী যদি বলে, তুমি আমার জন্য অমুক পরনারীর পিঠের মত তাহলে তাও যিহারের সংজ্ঞায় পড়ে। তারা আরো বলেন, মা এবং চিরস্থায়ী হারাম মহিলাদের কোন অংগের সাথে স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রীর কোন অংগকে তুলনা করা যিহার। এক্ষেত্রে এমন কোন শর্ত নেই যে, সেসব অংগ এমন হতে হবে যার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হালাল নয়। কারণ স্ত্রীর প্রতি যেভাবে দৃষ্টিপাত করা হয় সেভাবে মায়ের কোন অংগের প্রতিই দৃষ্টিপাত করা হালাল নয়।
হাম্বলী মাযহাবের ফিকাহবিদগণ হারাম মহিলাদের সবাইকে এ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। তাই চাই স্থায়ী হারাম হোক অথবা ইতিপূর্বে কখনো হালাল ছিল এখন চিরদিনের জন্য হারাম হয়ে গিয়েছে। যেমনঃ শ্বাশুড়ী ও দুধমা। তবে যেসব মহিলা পরবর্তী কোন সময় হালাল হতে পারে যেমনঃ শ্যালিকা। তাদের ব্যাপারে ইমাম আহমাদের একটি মত হলো, তাদের সাথে যিহার হবে না। তাছাড়াও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীদের মতে স্ত্রীর কোন অংগকে হারাম মেয়েদের কোন অংগের সাথে তুলনা করা যিহারের সংজ্ঞায় পড়ে। তবে চুল, নখ ও দাঁতের মত শরীরের অস্থায়ী অংগসমূহ এ নির্দেশের বহির্ভূত।
বারঃ এ ব্যাপারে সমস্ত ফিকাহবিদগণ একমত যে, কেউ যদি তার স্ত্রীকে বলে, “তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত” তাহলে তা স্পষ্ট যিহার হবে। কারণ, আরবদের মধ্যে এটাই যিহারের নিয়ম হিসেবে প্রচলিত ছিল। আর এ বিষয়টি সম্পর্কেই কুরআনের নির্দেশ নাযিল হয়েছে। অন্য সব বাক্যের কোনটি দ্বারা স্পষ্ট যিহার হবে আর কোনটি দ্বারা যিহার হবে না বরং সেক্ষেত্রে যিহার হওয়া না হওয়ার সিদ্ধান্ত বক্তার নিয়ত অনুসারে করা হবে। এ ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে।
হানাফীদের মতে, যেসব বাক্য দ্বারা হালাল নারীকে (স্ত্রী) স্পষ্টভাবে হারাম নারীর (স্থায়ী হারাম নারীদের কোন একজন) সাথে তুলনা করা হয়েছে, অথবা যে অংগের দিকে দৃষ্টিপাত করা হালাল নয় এমন অংগের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেমন কেউ তার স্ত্রীকে বললোঃ তুমি আমার জন্য মা অথবা অমুক হারাম নারীর পেট অথবা উরুর মত। এছাড়া অন্য সব বাক্য সম্পর্কে মতভেদ করার অবকাশ আছে। কেউ যদি বলেঃ “তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত হারাম। ইমাম আবু হানিফার মতে এটা স্পষ্ট যিহার। কিন্তু ইমাম আবু ইউসূফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে এক্ষেত্রে যিহারের নিয়ত থাকলে যিহার হবে এবং তালাকের নিয়ত থাকলে তালাক হবে। যদি বলে, তুমি যেন আমার মা অথবা আমার মায়ের মত তাহলে এক্ষেত্রে সাধারণভাবে হানাফীদের ফতোয়া হলো, যিহারের নিয়তে একথা বলা হয়ে থাকলে যিহার হবে এবং তালাকের নিয়তে বলা হয়ে থাকলে বায়েন তালাক হবে এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে বলা হয়ে থাকলে অর্থহীন বাক্য হবে। কিন্তু ইমাম মুহাম্মাদের মতে এটা অকাট্যভাবে যিহার। কেউ যদি স্ত্রীকে মা অথবা বোন অথবা কন্যা বলে সম্বোধন করে তাহলে এটা চরম অর্থহীন ও বাজে কথা। এরূপ কথায় নবী ﷺ ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাকে যিহার বলে গণ্য করেননি। কেউ যদি বলে “তুমি আমার জন্য মায়ের মতই হারাম” যদি যিহারের নিয়তে বলে তাহলে যিহার হবে তালাকের নিয়তে বললে তালাক হবে। আর কোন নিয়ত না থাকলে যিহার হবে। যদি বলে “তুমি আমার জন্য মায়ের অনুরূপ অথবা মায়ের মত” তাহলে উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। যদি সম্মান ও মর্যাদা বুঝানোর জন্য বলে থাকে তাহলে সম্মান মর্যাদা দেখানো বলে গণ্য হবে। যিহারের নিয়তে বলা হয়ে থাকলে যিহার হবে। তালাকের নিয়তে বলে থাকলে তালাক হবে। কোন নিয়ত না থাকলে এবং এমনি বলে থাকলে ইমাম আবু হানিফার মতে অর্থহীন কথা হবে, ইমাম আবু ইউসূফের মতে তাকে যিহারের কাফফারা দিতে হবে না তবে কসমের কাফফারা দিতে হবে এবং ইমাম মুহাম্মাদের মতে যিহার হবে।
শাফেয়ী ফিকাহবিদদের মতে যিহারের স্পষ্ট বাক্য হলো, “তুমি আমার কাছে অথবা আমার সঙ্গে অথবা আমার জন্য মায়ের পিঠের মত, অথবা তুমি আমার মায়ের পিঠের মত। অথবা তোমার দেহ বা শরীর অথবা তোমার সত্তা আমার জন্য আমার মায়ের দেহ বা শরীর অথবা সত্তার মত। এছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত বাক্যের ব্যাপারে বাক্য প্রয়োগকারীর নিয়ম অনুসারে সিদ্ধান্ত হবে।
হাম্বলী ফিকাহবিদদের মতে, কেউ যদি তার স্ত্রীকে অথবা তার স্বতন্ত্র কোন অংগকে বিয়ে করা হারাম এমন কোন মহিলার সাথে অথবা তার দেহের স্বতন্ত্র কোন অংগের সাথে স্পষ্ট ভাষায় তুলনা করে তাহলে তা যিহারের স্পষ্ট বাক্য বলে গণ্য হবে। মালেকী মাযহাবের অনুসৃত মতও প্রায় অনুরূপ। তবে বিস্তারিত খুঁটিনাটিতে গিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে। যেমন কেউ যদি তার স্ত্রীকে বলে তুমি আমার জন্য আমার মায়ের তুল্য অথবা আমার মায়ের মত তাহলে মালেকীদের মতে যিহারের নিয়ত থাকলে যিহার হবে। তালাকের নিয়ম থাকলে তালাক হবে এবং কোন নিয়ত না থাকলে যিহার হবে। হাম্বলীদের মতে শুধু নিয়তের শর্তে যিহার বলে গণ্য করা যেতে পারে। কোন ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে বলে তুমি আমার মা। মালেকীদের মতে তা যিহার হবে। হাম্বলীদের মতে ঝগড়া বিবাদ বা ক্রুদ্ধাবস্থায় বলা হয়ে থাকলে যিহার হবে এবং আদর সোহাগপূর্ণ পরিবেশে বলা হয়ে থাকলে তা খুবই খারাপ কথা। কিন্তু তা যিহার হিসেবে গণ্য হবে না। কেউ যদি স্ত্রীকে বলেঃ তোমাকে তালাক, তুমি আমার মায়ের মত, তাহলে হাম্বলীদের মতে এতে তালাক হবে যিহার নয়। তবে যদি বলেঃ তুমি আমার মায়ের মত, তোমাকে তালাক তাহলে যিহার ও তালাক উভয়টিই হয়ে যাবে। আর যদি বলেঃ তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত হারাম তাহলে মালেকী ও হাম্বলী উভয় মাযহাবের ফিকাহবিদদের মতে এ বাক্য তালাকের নিয়তে বলা হোক বা আদৌ কোন নিয়ত না থাক এতে যিহার হবে। যিহারের বাক্য সম্পর্কিত এ আলোচনায় এ বিষয়টি ভালভাবে বুঝতে হবে যে, এ বিষয়ে ফিকাহবিদগণ যত আলোচনা করেছেন তা সবই আরবী ভাষার বাক্য ও বাকরীতি সম্পর্কে। একথা সবারই জানা যে, পৃথিবীর অন্য ভাষাভাষী লোকেরা যিহার করার সময় আরবী ভাষা ব্যবহার করবে না, কিংবা যিহার করার সময় আরবী বাক্য ও বাক্যাংশের হুবহু অনুবাদ উচ্চারণ করবে না। সুতরাং কোন শব্দ বা বাক্যাংশ যিহারের সংজ্ঞায় পড়ে কিনা সে বিষয়ে যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় তাহলে ফিকাহবিদদের বর্ণিত বাক্যসমূহের কোন্টির সঠিক অনুবাদ শুধু সেটিই বিচার বিবেচনা করা ঠিক হবে না বরং শুধু এ বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে যে, বক্তা বা শব্দ ব্যবহারকারী ব্যক্তি স্ত্রীকে যৌন (আরবী) সম্পর্কের দিক দিয়ে হারাম নারীদের কারো সাথে সুস্পষ্টভাবে তুলনা করেছে নাকি ঐসব বাক্যের অন্য কোন অর্থ হওয়ার অবকাশ আছে? আরবী ভাষার اَنْتَ عَلَى كَظَهْرِ اُمِّى তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত বাক্যটি এর সুস্পষ্ট উদাহরণ। ফিকাহবিদ এবং মুফাসসিরগণ এ বিষয়ে একমত যে, আরবে যিহার করার জন্য এ বাক্যটিই ব্যবহার করা হতো এবং এ বাক্যটি সম্পর্কেই কুরআন মজীদের নির্দেশ নাযিল হয়েছে। সম্ভবত দুনিয়ার কোন ভাষাতেই—উর্দু ভাষা সম্পর্কে তো আমরা অন্তত নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি—যিহারকারী কোন ব্যক্তি এমন বাক্য ব্যবহার করতে পারে না যা এই আরবী বাক্যটির হুবহু শাব্দিক অনুবাদ হতে পারে। তবে তারা নিজের ভাষার এমন সব বাক্য অবশ্যই ব্যবহার করতে পারে যার অর্থ অবিকল তাই যা একজন আরব এইটি দ্বারা প্রকাশ করতো। একথাটি বলার অর্থ ছিল, তোমার সাথে সহবাস করা আমার জন্য আমার মায়ের সাথে সহবাস করার মত। অথবা কোন কোন মূর্খ ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলে বসে যে, “আমি যদি তোমার কাছে যাই তাহলে আমার মায়ের কাছেই গেলাম।”
তেরঃ কুরআন মজীদের যে জিনিসকে কাফফারা আবশ্যিক হওয়ার কারণ বলা হয়েছে তা শুধু যিহার করা নয়, বরং যিহারের পরবর্তী عود । অর্থাৎ ব্যক্তি যদি শুধু যিহার করে এবং عود না করে তাহলে তাকে কাফফারা দিতে হবে না। এখন প্রশ্ন হলো عود কি যা কাফফারা দেয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়? এ ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মতামত নিম্বরূপঃ হানাফীদের মতে عود অর্থ সহবাস করার ইচ্ছা। তবে তার অর্থ এই নয় যে, শুধু ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা করলেই কাফফারা দেয়া জরুরী হবে। এমন কি ব্যক্তি যদি শুধু ইচ্ছা করেই থেমে থাকে এবং কার্যত কোন পদক্ষেপ না নেয় তাহলেও তাকে কাফফারা দিতে হবে ব্যাপার এমন নয়। বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি যিহার করার দ্বারা স্ত্রীর সাথে একান্ত দাম্পত্য সম্পর্কের ব্যাপারে যে ‘হুরমত’ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল প্রথমে কাফফারা তা দূর করে। কারণ এই ‘হুরমত’ বা নিষেধাজ্ঞা কাফফারা দেয়া ছাড়া দূরীভূত হতে পারে না।
এ বিষয়ে ইমাম মালেকের (র) তিনটি মত আছে। তবে এ ব্যাপারে ওপরে হানাফীদের যে মত বর্ণিত হয়েছে সেটিই মালেকীদের সর্বাধিক প্রসিদ্ধি ও বিশুদ্ধতম মত। তাঁদের মতে যিহার দ্বারা স্বামী নিজের জন্য যে জিনিসটি হারাম করে নিয়েছিল তা হচ্ছে স্ত্রীর সাথে সহবাসের সম্পর্ক। এরপর عود করা অর্থ পুনরায় তার সাথে সেই সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ফিরে যাওয়া।
এ বিষয়ে ওপরে দুই ইমামের যে মতামত বর্ণনা করা হয়েছে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের (রা.) মতও প্রায় অনুরূপ বলে ইবনুল কুদামা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেনঃ যিহার করার পর সহবাস হালাল হওয়ার জন্য কাফফারা দেয়া শর্ত। যিহারকারী যে ব্যক্তিই তা হালাল করতে চায় সে যেন হারাম করে নেয়া থেকে ফিরতে চায়। তাই তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, হালাল করে নেয়ার পূর্বে সে যেন কাফফারা আদায় করে। কোন ব্যক্তি কোন নারীকে নিজের জন্য হালাল করে নিতে চাইলে তাকে হালাল করার পূর্বে যেমন বিয়ে করতে বলা হবে এটা যেন ঠিক তাই।
ইমাম শাফেয়ীর (র) মত এ তিনটি মতামত থেকে ভিন্ন। তিনি বলেনঃ কারো নিজের স্ত্রীর সাথে যিহার করার পর তাকে পূর্বের মত স্ত্রী হিসেবে রাখা, কিংবা অন্য কথায় তাকে স্ত্রী হিসেবে কাছে রাখাটাই عود । কারণ, সে যে সময় যিহার করেছে সে সময় থেকেই যেন তাকে স্ত্রী হিসেবে রাখা হারাম করে নিয়েছে। সুতরাং সে যদি যিহার করার সাথে সাথেই তালাক না দিয়ে থাকে এবং তালাকের শব্দগুলো উচ্চারণ করার মত সময়টুকু পর্যন্ত তাকে স্ত্রী হিসেবে রাখে তাহলে সে عود করলো এবং তার ওপর কাফফারা দেয়া ওয়াজিব হয়ে গেল। এর অর্থ হচ্ছে, কেউ এক নিশ্বাসে যিহার করার পর পরবর্তী নিশ্বাসেই যদি তালাক না দেয় তাহলে কাফফারা ওয়াজিব হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে পরে তাকে স্ত্রী হিসেবে না রাখার এবং দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষা না করার সিদ্ধান্ত না হলেও কিছু এসে যায় না। এমনকি এরপর সে কয়েক মিনিট চিন্তা-ভাবনা করে যদি সে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ইমাম শাফেয়ীর (র) মতানুসারে তবুও তাকে কাফফারা দিতে হবে।
চৌদ্দঃ কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে, স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে مس স্পর্শ করার পূর্বেই যিহারকারীকে কাফফারা দিতে হবে। এ আয়াতের উল্লেখিত مس শব্দের অর্থ স্পর্শ করা। এ বিষয়ে চার ইমামই একমত। সুতরাং কাফ্ফারা দেয়ার পূর্বেই শুধু সহবাসই হারাম নয় বরং স্বামী কোনভাবেই স্ত্রীকে স্পর্শ করতে পারবে না। শাফেয়ী মাযহাবের ফিকাহবিদগণ বলেনঃ যৌন ইচ্ছাসহ স্পর্শ করা হারাম। হাম্বলী মাযহাবের ফিকাহবিদগণ সব রকম উপভোগকেই না জায়েজ বলেন। তাঁদের মতে এ অবস্থায় কেবল মুখমণ্ডল ও হাতের দিকে তাকানো যেতে পারে।
পনেরঃ যিহার করার পর স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাহলে ‘রিজয়ী’ তালাকের ক্ষেত্রে ‘রুজু’ করার পরও কাফ্ফারা দেয়া ছাড়া স্বামী স্ত্রীকে স্পর্শ করাতে পারবে না। বায়েন তালাক হওয়ার ক্ষেত্রে সে যদি তাকে পুনরায় বিয়ে করে তখনও স্পর্শ করার পূর্বে কাফ্ফারা দিতে হবে। এমনকি যদি তিন তালাকও দিয়ে থাকে এবং স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে বিবাহিতা হওয়ার পর বিধবা অথবা তালাক প্রাপ্তা হয় এবং তারপর যিহারকারী স্বামী তাকে নতুন করে বিয়ে করে, তাহলেও কাফ্ফারা ছাড়া সে তার জন্য হালাল হবে না। কেননা, মা বা অন্যান্য চিরনিষিদ্ধ মহিলাদের সাথে স্ত্রীর সাদৃশ্য বর্ণনা করে সে ইতিপূর্বে একবার তাকে নিজের ওপর হারাম বা নিষিদ্ধ করে নিয়েছে। কাফ্ফারা ছাড়া সেই হারাম বা নিষিদ্ধাবস্থার অবসান ঘটা সম্ভব নয়। চার ইমামের সকলেই এ ব্যাপারে একমত।
ষোলঃ যে স্বামী স্ত্রীর সাথে যিহার করেছে কাফ্ফারা না দেয়া পর্যন্ত তাকে তার শরীর স্পর্শ করতে না দেয়া স্ত্রীর কর্তব্য। যেহেতু দাম্পত্য সম্পর্ক চালু থাকা স্ত্রীর একটি অধিকার বিশেষ এবং তা থেকে স্বামী তাকে বঞ্চিত করেছে, তাই সে যদি কাফ্ফারা না দেয় তবে স্ত্রী আদালতের আশ্রয় নিতে পারে। আদালত তার স্বামীকে সে বাঁধা অপসারণে বাধ্য করবে। যা সে নিজের ও তার স্ত্রীর মাঝখানে দাঁড় করিয়েছে। আর যদি সে তা না মানে, তবে আদালত তাকে প্রহার বা কারাদণ্ড বা উভয় প্রকারের দণ্ড দিতে পারে। চার মাযহাবেই এ ব্যাপারে পূর্ণ মতৈক্য রয়েছে। তবে পার্থক্য শুধু এই যে, হানাফী মাযহাবের স্ত্রীর জন্য আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। আদালত যদি স্ত্রীকে এ সংকট থেকে উদ্ধার না করে তবে সে আজীবন ঝুলন্ত অবস্থায়ই থেকে যাবে। কেননা, হানাফী মাযহাব অনুসারে যিহার দ্বারা বিয়ে বাতিল হয় না, কেবল স্বামীর সঙ্গমের অধিকার রহিত হয়। মালেকী মাযহাবে স্বামী যদি স্ত্রীকে নির্যাতন করার জন্য যিহার করে ঝুলিয়ে রাখে। তাহলে সেক্ষেত্রে “ইলার” বিধান বলবত হবে। অর্থাৎ সে চার মাসের বেশী স্ত্রীকে আটকে রাখতে পারে না। (“ইলা”র বিধান তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারা ২৪৫ থেকে ২৪৭ টীকায় দ্রষ্টব্য)। আর শাফেয়ী মাযহাবে যদিও স্বামী কেবল নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য যিহার করলেই এবং সে মেয়াদ চার মাসের বেশী হলেই ইলার বিধান কার্যকর হবে। কিন্তু যেহেতু শাফেয়ী মাযহাবে স্বামী স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখলেই কাফ্ফারা দিতে হয়। তাই তার পক্ষে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্ত্রীকে ঝুলন্ত রাখা সম্ভব হয় না।
সতেরঃ কুরআন ও হাদীসে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, যিহারের প্রথম কাফ্ফারা হচ্ছে দাস মুক্ত করা। এটা করতে অসমর্থ হলেই দু’মাস ব্যাপী রোযা রাখা এবং তাতেও অসমর্থ হলে ৬০ জন দরিদ্র মানুষকে আহার কারানো যেতে পারে। কিন্তু কেউ যদি এ তিন ধরনের কাফ্ফারার কোনটিই দিতে সমর্থ না হয় তাহলে শরীয়াতের কাফ্ফারার অন্য কোন ব্যবস্থা না থাকা হেতু সে যতক্ষণ পর্যন্ত এ তিন ধরনের কাফ্ফারার কোন একটি দেয়ার সামর্থ লাভ না করে, ততক্ষন পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। তবে হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, এ ধরনের ব্যক্তি যাতে তৃতীয় কফ্ফারাটি দিতে পারে সেজন্য তাকে সাহায্য করা উচিত। যারা নিজেদের ভুলের কারণে এরূপ সমস্যার জালে আটকা পড়েছিল এবং এ তিন প্রকারের কাফ্ফারার কোনটিই দিতে সমর্থ ছিল না,তাদেরকে রসূল ﷺ বাইতুল মাল থেকে সাহায্য করেছিলেন।
আঠারঃ পবিত্র কুরআনে কাফ্ফারা হিসেবে যে কোন পরাধীন মানুষকে মুক্ত করার আদেশ দেয়া হয়েছে চাই সে দাস হোক অথবা দাসী হোক। এক্ষেত্রে দাস-দাসীর বয়সেরও কোন কড়াকড়ি নেই। দুধ খাওয়া শিশুও যদি গোলামীতে আবদ্ধ হয়ে থাকে তবে তার মুক্তির ব্যবস্থা করাও কাফ্ফারার জন্য যথেষ্ট। তবে মুসলিম ও অমুসলিম উভয় ধরনের দাস-দাসী মুক্ত করা চলবে, না শুধু মুসলিম দাস-দাসী মুক্ত করতে হবে, সে ব্যাপারে মুসলিম ফিকাহবিদগণের মতভেদ রয়েছে। হানাফী ও যাহেরী মাযহাবের মতানুসারে দাস-দাসী মুসলিম কিংবা অমুসলিম যাই হোক না কেন, তাকে মুক্ত করা যিহারের কাফফারার জন্য যথেষ্ট হবে। কেননা কোরআন শরীফে শর্তহীনভাবে কেবল পরাধীন মানুষকে মুক্ত করতে বলা হয়েছে। তাকে মুসলমানই হতে হবে, একথা বলা হয়নি। পক্ষান্তরে শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাব এ দাস-দাসীর মুসলমান হওয়ার শর্ত আরোপ করে। অন্য যেসব কাফফারায় কুরআন শরীফে শুধুমাত্র দাস-দাসীকে মুক্ত করতে বলা হয়েছে। আলোচ্য কাফফারাকেও এ তিন মাযহাবে সেসব কাফফারার সমপর্যায়ের বলে কিয়াস করা হয়েছে।
উনিশঃ দাস-দাসী মুক্ত করা সম্ভব না হলে কুরআনের বিধান হলো, স্বামী-স্ত্রী কর্তৃক পরস্পরকে স্পর্শ করার আগেই যিহারকারীকে এক নাগাড়ে দু’মাস রোযা রাখতে হবে। আল্লাহর এ আদেশ বাস্তবায়নের বিস্তারিত বিধিমালা বিভিন্ন মাযহাবে নিম্নরূপঃ
(ক) এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, মাস বলতে এখানে চন্দ্র মাস বুঝানো হয়েছে। চাঁদ ওঠা থেকে যদি রোযা রাখা শুরু করা হয়, তবে দু’টি চন্দ্র মাস পূর্ণ করতে হবে। আর যদি মাসের মধ্যবর্তী কোন তারিখ থেকে শুরু করা হয়, তাহলে হানাফী ও হাম্বলী মাযহাব অনুসারে ষাট দিন রোযা রাখতে হবে। শাফেয়ী মাযহাবের মত এই যে, প্রথম এবং তৃতীয় মাসে সর্বমোট ৩০ দিন রোযা রাখতে হবে। আর মাঝখানের চন্দ্র মাসটি ২৯ দিনের হোক বা ৩০ দিনের হোক—সে মাস রোযা রাখলেই চলবে।
(খ) হানাফী ও শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে রোযা এমন সময় শুরু করতে হবে, যাতে মাঝখানে রমযান, ঈদ কিংবা আইয়ামে তাশরীক না পড়ে। কেননা কাফফারার রোযা চলাকালে রমযানের রোযা রাখায় এবং ঈদ ও আইয়ামে তাশরীক রোযার বিরতি দেয়ায় দু’মাস রোযা রাখার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে এবং আবার নতুন করে রোযা রাখতে হবে। হাম্বলী মাযহাবের মত এই যে, রমযানের রোযা রাখা ও নিষিদ্ধ দিনের রোযায় বিরতি দেয়ায় ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয় না।
(গ) দু’মাস রোযা রাখার মাঝে যে কোন ওজরের কারণে অথবা বিনা ওজরে রোযা ভাংলেই হানাফী ও শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হবে এবং আবার গোড়া থেকে রোযা রাখা শুরু করতে হবে। ইমাম মুহাম্মাদ বাকের, ইবরাহীম নাখয়ী, সাঈদ বিন জুবায়ের এবং সুফিয়ান সাওরীর অভিমতও অনুরূপ। ইমাম মালেক এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মতে রোগ বা সফরের কারণে মাঝখানে রোযা বিরতি দেয়া চলে। এতে ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে না। তবে বিনা ওজরে রোযায় বিরতি দিলে ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়। শেষোক্ত ইমাম দ্বয়ের যুক্তি এই যে, কাফফারার রোযার গুরুত্ব রমযানের ফরয রোযার গুরুত্বের চেয়ে বেশী নয়। রমযানের রোযা যদি ওজর বশত ছাড়া যায়। তাহলে কাফফারার রোযায় বিরতি দেয়া যাবে না এমন কোন কারণ নেই। অন্য যারা এ অভিমত পোষণ করেন তাঁরা হচ্ছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হাসান বাসরী, আতা বিন আবী রাবাহ, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, আমর বিন দীনার, শা’বী, তাউস, মুজাহিদ, ইসহাক বিন রাহওয়াই, আবু উবাইদ এবং আবু সাওর।
(ঘ) দু’মাস ব্যাপী রোযা চলতে থাকাকালে যিহারকারী যদি তার যিহারকৃত স্ত্রীর সাথে সংগম করে বসে, তা সকল ইমামের সর্বসম্মত মত এই যে, এ দ্বারা ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাবে এবং নতুন করে রোযা রাখতে হবে। কেননা স্পর্শ করার আগেই দু’মাস রোযা রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে।
বিশঃ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তৃতীয় কাফফারাটি (৬০ জন দরিদ্র ব্যক্তিকে আহার করানো) শুধুমাত্র সে ব্যক্তিই দিতে যার দ্বিতীয়টি দেয়ার সামর্থ নেই। (অর্থাৎ দু’মাস ব্যাপী রোযা রাখা) । এ বিধিটি বাস্তবায়নের জন্য ফকীহগণ যে বিস্তারিত নিয়ম-পদ্ধতি রচনা করেছেণ তা নিম্নরূপঃ
(ক) চার ইমামের মতে রোযা রাখতে অসমর্থ হওয়ার অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হয় বার্ধক্যের কারণে, নচেত রোগব্যাধির কারণে অথবা এক নাগাড়ে দু’মাস যৌন সংগম থেকে সংযত থাকতে না পারা ও এ সময়ের মধ্যে ধৈর্য হারিয়ে বসার আশংকার কারণে অক্ষম হওয়া। এ তিনটি ওজরই সঠিক এবং শরীয়াতের গ্রহণযোগ্য, সে কথা হযরত আওস বিন সাবেত আনসারী এবং সালাম বিন সাখর বায়জীর বর্ণিত হাদীসসমূহ থেকে প্রমাণিত। তবে রোগ সম্পর্কে ফকীহগণের মধ্যে সামান্য কিছু মতভেদ রয়েছে। হানাফী ফকীহগণের মতে, যে রোগে আরোগ্য লাভের আশা নেই অথবা রোযার কারণে রোগ বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে কেবল সে রোগ ওজর হিসেবে গ্রহণযোগ্য। শাফেয়ী ফকীহগণ বলেন, রোযার কারণে যদি এত কঠিন শারীরিক পরিশ্রম হয় যে, দু’মাসের মাঝখানেই রোযার ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন হবার আশংকা থাকে, তাহলে সেটিও একটি সঠিক ওজর বলে বিবেচিত হতে পারে। মালেকী মাযহাবের ফকীহগণের মতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি নিজের সম্পর্কে প্রবলভাবে আস্থাশীল হয় যে ভবিষ্যতে রোযা রাখতে সক্ষম হবে তাহলে তার অপেক্ষা করা উচিত। আর যদি প্রবলতর ধারণা এটাই হয় যে, আর কখনো রোযা রাখার সামর্থ ফিরে পাবে না, তাহলে দরিদ্র লোকদেরকে আহার করিয়ে দেয়া উচিত। হাম্বলী মাযহাবের মতে রোযার কারণে রোগ বৃদ্ধির আশংকা ওজর হিসেবে যথেষ্ট।
(খ) শুধুমাত্র সেসব দরিদ্র ব্যক্তিকে আহার করানো যাবে, যাদের ভরণ-পোষণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দায়ভূক্ত নয়।
(গ) হানাফী ফকীহগণের মত এই যে, মুসলিম ও অমুসলিম উভয় ধরনের নাগরিককেই আহার করানো চলবে। তবে যুদ্ধরত ও আশ্রয় প্রার্থী অমুসলিমদেরকে আহার করানো যাবে না। মালেকী, শাফেয়ী, ও হাম্বলী মাযহাব অনুসারে শুধুমাত্র মুসলিম দরিদ্রদেরকেই আহার করানো যাবে।
(ঘ) আহার করানো দ্বারা যে দু’বার পেট ভরে খাওয়ানো বুঝায়, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। তবে কিভাবে খাওয়াতে হবে তা নিয়ে মতভেদ আছে। হানাফী মতে দু’বার পেট পুরে খাওয়ার মত খাদ্য শস্য দিয়ে দেয়া অথবা রান্না বান্না করে দু’বেলা খাইয়ে দেয়া দু’টোই শুদ্ধ। কেননা কোরআন শরীফে, “ইতয়া’ম” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর অর্থ খাবার দেয়া এবং খাওয়ানো দু’টোই। তবে মালেকী, শাফেয়ী, ও হাম্বালী মাযহাব রান্না করে খাওয়ানো শুদ্ধ মনে করে না বরং খাদ্য শস্য প্রদান করাই সঠিক মনে করে। খাদ্য শস্য দেয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সর্বসম্মত যে স্থানীয়ভাবে যেটি জনসাধারণের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত খাদ্য সেটিই দিতে হবে এবং সকল দরিদ্র ব্যক্তিকে সমপরিমান দিতে হবে।
(ঙ) হানাফী মতানুসারে একই দরিদ্র ব্যক্তিকে যদি ৬০ দিন ব্যাপী খাবার দেয়া হয় তবে তাও সঠিক হবে। তবে একই দিন তাকে ৬০ দিনের খোরাক দেয়া শুদ্ধ নয়। অন্য তিন মাযহাবে একই দরিদ্র ব্যক্তিকে খাবার দেয়া সঠিক মনে করা হয় না। তাদের মতে ৬০ জন দরিদ্র ব্যক্তিকেই দিতে হবে। ৬০ জন দরিদ্র ব্যক্তিকে এক বেলার খাবার এবং অন্য ৬০ জন দরিদ্র ব্যক্তিকে আর এক বেলা খাবার দেয়া সকল মাযহাবেই অবৈধ।
(চ) এটাও সকল মাযহাবের মতে অশুদ্ধ যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ৩০ দিনের রোযা রাখবে আর ৩০ জন দরিদ্র ব্যক্তিকে আহার করাবে। দু’রকমের কাফফারার সমাবেশ ঘটানো যাবে না। রোযা রাখতে হলে পুরো দু’মাস এক নাগাড়ে রাখা চাই। খাবার দিতে হলেও ৬০ জন দরিদ্র ব্যক্তিকে দিতে হবে।
(ছ) কাফফারা হিসেবে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে যদিও কুরআনে এরূপ শব্দ ব্যবহৃত হয়নি যে, এ কাফফারাও স্বামী স্ত্রীর পরস্পরকে স্পর্শ করার আগেই সমাধা হওয়া চাই, তথাপি বাক্যের অবস্থান ও প্রেক্ষাপট থেকে বুঝা যায় যে, এ কাফফারার ক্ষেত্রেও ঐ শর্তটি বলবত রয়েছে। তাই কাফফারার ভোজনপর্ব চলাকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্ত্রীর কাছে যাওয়া চার ইমামের কেউই বৈধ মনে করেন না। তবে এমন কাণ্ড কেউ যদি ঘটিয়েই বসে, তবে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। হাম্বলী মাযহাব মতে আবার খাওয়াতে হবে। কিন্তু হানাফী মাযহাবে তার প্রয়োজন নেই। কেননা, তাদের মতে এই তৃতীয় কাফফারায় সুস্পষ্টভাবে “পরস্পরকে স্পর্শ করার আগে” বলা হয়নি এবং এ কারণে এক্ষেত্রে কিছুটা উদারতার অবকাশ রয়েছে।
উল্লেখিত বিধিসমূহ নিম্নোক্ত ফিকাহ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাবলী থেকে গৃহীত হয়েছেঃ
হানাফী ফিকাহঃ হিদায়া, ফাতহুল কাদীর, বাদায়িউস-সানায়ে, এবং আহকামুল কুরআন (জাসসাস) ।
শাফেয়ী ফিকাহঃ আল মিনহাজ (নবাবী) তৎসহ মুগনীল মুহতাজ শীর্ষক টীকা। তাফসীরে কাবীর। মালেকী ফিকাহঃ শারহুল কাবীরের ওপর দাসুকীর টীকা, বিদায়াতুল মুজতাহিদ, আহকামুল কুরআন (ইবনুল আরাবী)
হাম্বালী ফীকাহঃ আল্ মুগনী (ইবনে কুদামা) ।
জাহেরী ফিকাহঃ আল্ মুহাল্লা (ইবনে হাযম) ।
# এখানে “ঈমান আনা” দ্বারা খাঁটি ও একনিষ্ঠ মু’মিন সুলভ আচরণকে বুঝানো হয়েছে। এ আয়াতের সম্বোধন যে, কাফের ও মুশরিকদের প্রতি নয় বরং আগে থেকেই ঈমান আনা মুসলমানদের প্রতি করা হয়েছে, তা সুস্পষ্ট। তাদেরকে শরীয়াতের একটি নির্দেশ প্রদানের পর একথা বলা যে, “তোমরা যাতে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনো, সেজন্য তোমাদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হচ্ছে” স্পষ্টতই এ তাৎপর্য বহন করে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর এ আদেশ শ্রবণের পরও প্রাচীন জাহেলী রসম রেওয়াজ মেনে চলতে থাকে, তার এ আচরণ ঈমানের পরিপন্থী। এটা কোন মু’মিনের কাজ নয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যখন তার জন্য জীবনের কোন ব্যাপারে কোন আইন নির্ধারন করে দেন, তখন সে তা বাদ দিয়ে দুনিয়ার অন্য কোন আইন মেনে চলবে কিংবা নিজের প্রবৃত্তির ইচ্ছা ও খায়েশ মোতাবেক কাজ করবে।
# এখানে কাফের অর্থ আল্লাহ ও রসূলকে অস্বীকারকারী নয়। এখানে কাফের শব্দটি দ্বারা সেই ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে আল্লাহ ও রসুলকে মান্য করার স্বীকৃতি ও ঘোষণা দেয়ার পরও একজন কাফেরের উপযোগী আচরণ করতে থাকে। অন্য কথায় এ উক্তির মর্ম এই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ শোনার পরও নিজের খেয়াল খুশীমত চলা অথবা জাহেলী রীতি প্রথা ও রসম রেওয়াজের অনুসরণ করতে থাকা আসলে কাফেরদের কাজ। সাচ্চা দিলে ঈমান এনেছে এমন কোন ব্যক্তি এ ধরনের আচরণ করতে পারে না। সূরা আলে ইমরানে যেখানে হজ্জ ফরয করার বিধান ঘোষণা করা হয়েছে সেখানেও ঐ ঘোষণাটির অব্যবহিত পর বলা হয়েছে যে,
وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
“আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে (অর্থাৎ এ আদেশে অমান্য করবে) তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ জগতবাসীর মোটেই মুখাপেক্ষী নন।”
এ উভয় জায়গায় “কুফর” শব্দটির অর্থ এটা নয় যে, যে ব্যক্তি যিহার করার পর কাফ্ফারা না দিয়ে স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, অথবা এরূপ মনে করে যে, যিহার দ্বারাই স্ত্রীর ওপর তালাক কার্যকর হয়ে গেছে অথবা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না, শরীয়াতের আদালত তাকে কাফের ও মুরতাদ ঘোষণা করবে এবং সকল মুসলমান তাকে ইসলাম বহির্ভূত মনে করবে। বরঞ্চ এর অর্থ এই যে, আল্লাহর নিকট এ ধরনের লোকেরা মু’মিন বলে গণ্য হবে না। যারা তার আদেশ নিষেধকে কথা বা কাজের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে এবং আল্লাহ মানুষের জন্য কি কি সীমা নির্ধারণ করেছেন, কোন্ কোন্ কাজকে ফরয করেছেন কোন্ কোন্ জিনিসকে হালাল এবং কোন্ কোন্ জিনিসকে হারাম করেছেন তার কোন ধার ধারে না।
# এটি হচ্ছে বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্য। ওপরের দু’টি বাক্যাংশ এ তৃতীয় বক্তব্যটি বুঝাবার যুক্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছে।
# এ হুকুমটি পালন করার জন্য সর্বপ্রথম যে সংশোধনমূলক কাজটি করা হয় সেটি হচ্ছে এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালক পুত্র হযরত যায়েদকে (রা.) যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলার পরিবর্তে তাঁর প্রকৃত পিতার সাথে সম্পর্কিত করে যায়েদ ইবনে হারেসাহ বলা শুরু করা হয়। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি ও নাসাঈ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, যায়েদ ইবনে হারেসাকে প্রথমে সবাই যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলতো। এ আয়াত নাযিল হবার পর তাঁকে যায়েদ ইবনে হারেসাহ বলা হতে থাকে। তাছাড়া এ আয়াতটি নাযিল হবার পর কোন ব্যক্তি নিজের আসল বাপ ছাড়া অন্য কারো সাথে পিতৃ সম্পর্ক স্থাপন করাকে হারাম গণ্য করা হয়। বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের (রা.) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, নবী করীম ﷺ বলেছেনঃ
مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ غَيْرُ أَبِيهِ فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ “যে ব্যক্তি নিজেকে আপন পিতা ছাড়া অন্য কারো পুত্র বলে দাবী করে, অথচ সে জানে ঐ ব্যক্তি তার পিতা নয়, তার জন্য জান্নাত হারাম।”
হাদীসে একই বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্যান্য রেওয়াতও পাওয়া যায়। সেগুলো এ কাজটিকে মারাত্মক পর্যায়ের গুনাহ গণ্য করা হয়েছে।
# এ অবস্থাতেও খামাখা কোন ব্যক্তির সাথে তার পিতৃ-সম্পর্ক জুড়ে দেয়া ঠিক হবে না।
# এর অর্থ হচ্ছে, কাউকে সস্নেহে পুত্র বলে ফেললে এতে কোন গুনাহ হবে না। অনুরূপভাবে মা, মেয়ে, বোন, ভাই ইত্যাদি শব্দাবলীও যদি কারো জন্য নিছক ভদ্রতার খাতিরে ব্যবহার করা হয় তাহলে তাতে কোন গুনাহ হবে না। কিন্তু যদি এরূপ নিয়ত সহকারে একথা বলা হয় যে, যাকে পুত্র ইত্যাদি বলা হবে তাকে যথার্থই এ সম্পর্কগুলোর যে প্রকৃত সেই মর্যাদায় অভিসিক্ত করতে হবে, এ ধরনের আত্মীয়দের যে অধিকার স্বীকৃত তা দান করতে হবে এবং তার সাথে ঠিক তেমনি সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে যেমন সেই পর্যায়ের আত্মীয়দের সাথে করা হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এটি হবে আপত্তিকর এবং এজন্য পাকড়াও করা হবে।
# এর একটি অর্থ হচ্ছে, ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে যেসব ভুল করা হয়েছে আল্লাহ সেগুলো মাফ করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাদেরকে আর কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, না জেনে কোন কাজ করার জন্য আল্লাহ পকড়াও করবেন না। যদি বিনা ইচ্ছায় এমন কোন কাজ করা হয় যার বাইরের চেহারা কোন নিষিদ্ধ কাজের মতো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে সেই নিষিদ্ধ কাজটি করার ইচ্ছা ছিল না। তাহলে নিছক কাজটির বাইরের কাঠামোর ভিত্তিতে আল্লাহ শাস্তি দেবেন না।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*যিহার অর্থাৎ স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করার কাফফারা : কোরআনের বিবরণ হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে আলােড়িত করে। এরপর আসল সমস্যার বিবরণ আসছে দ্বিতীয় আয়াতে, ‘তােমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে, তারা তাদের মা নয়। তাদের মা তাে তারাই, যারা তাদের প্রসব করেছে। তারা আসলে একটা নিকৃষ্ট কথা বলে ও মিথ্যা বলে। তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, মার্জনাকারী। এভাবে মূল সমস্যার গােড়ায় হাত দেয়া হয়েছে। বস্তুত যিহার জিনিসটা একটা অমূলক ও ভুয়া ব্যাপার। স্ত্রী কখনাে মা নয় যে, মায়ের মতাে সে হারাম হয়ে যাবে। মা তাে তিনি যিনি তাকে প্রসব করেছেন। মুখের একটা কথায় স্ত্রী মা হয়ে যেতে পারে না। ওটা একটা খারাপ কথা, যা বাস্তবকে অস্বীকার করে। একটা ভুয়া কথা, যা সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। জীবনের যাবতীয় ব্যাপার সত্য ও বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। একটা অন্যটার সাথে মিশে জগাখিচুড়ি হতে পারে না। তবে যা অতীতে হয়ে গেছে সে ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, দয়াশীল। এভাবে সুস্পষ্টভাবে ও স্বচ্ছতায় মূল বিষয়টা তুলে ধরার পর এর ব্যাপারে আইনগত ফায়সালা ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘তােমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীর সাথে যিহার করে অতপর তাদের উক্তি প্রত্যাহার করতে চায়, তাদের কর্তব্য একে অপরকে স্পর্শ করার আগে একজন দাস মুক্ত করা। এ নির্দেশ দিয়ে তােমাদের নসীহত করা হয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।’ আল্লাহ তায়ালা দাস মুক্তকরণের কাজটাকে বহ রকমের গুনাহর কাফফারা রূপে নির্ধারণ করেছেন। যারা যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে প্রথমে যুদ্ধবন্দী হয়ে পরে দাসত্বের ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য হতাে, কাফফারা তাদের স্বাধীনতা ও তাদের মুক্তির অন্যতম উপায় হয়ে ওঠেছিলাে। ‘অতঃপর তাদের উক্তি প্রত্যাহার করতে চায়’- এ কথাটার ব্যাখ্যায় অনেকগুলাে মতামত উদ্ধৃত হয়েছে। আমি সেসব মতামতের মধ্যে থেকে এই মতটাই অগ্রগণ্য মনে করেছি যে, এর অর্থ হচ্ছে, তারা তাদের সে উক্তি তথা যিহার দ্বারা নিজেদের ওপর যে স্ত্রী সহবাস হারাম করেছিলাে, সেটা পুনরায় বৈধ করার জন্যে সে উক্তি প্রত্যাহার করতে চায়। এই মতটাই আয়াতের বাহ্যিক বাচনিক রূপের সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নিকটতম। অর্থাৎ স্বামীর নিজের সৃষ্টি করা এই সমস্যার সমাধানের জন্যে একজন দাস মুক্ত করা অপরিহার্য। অতপর মন্তব্য করা হচ্ছে, ‘এ নির্দেশ দিয়ে তােমাদের নসীহত করা হচ্ছে।’ অর্থাৎ যে যেহারের কোনাে ন্যায়সংগত ভিত্তি নেই এবং কোনাে ভালাে কাজ বলে পরিচিতও নয়, তা যাতে তােমরা পুনরায় না করো, সে জন্যে এই কাফফারা একটা উপদেশবাণী ও স্মরণিকা হয়ে থাকবে। ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।’ অর্থাৎ তােমাদের কার্যকলাপের ধরন, তার সংগঠন ও তার পেছনে তােমাদের যে নিয়ত, মনােভাব ও উদ্দেশ্য সক্রিয় রয়েছে তা তার জানা আছে। এই মন্তব্য করা হয়েছে যিহারের বিধান পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করার পূর্বে, যাতে মােমেনদের মন সেই বিধান গ্রহণের জন্য জাগ্রত ও প্রস্তুত হয়, বিধানের আনুগত্য করার প্রশিক্ষণ যেন সে লাভ করে এবং এই মর্মে সতর্ক হয় যে, আল্লাহ তায়ালা যে ব্যাপারেই নির্দেশ দেন, তার সম্পর্কে তার পূর্ণ অভিজ্ঞতা এবং তার গােপন ও প্রকাশ্য সবকিছু অবহিত থাকার ভিত্তিতেই নির্দেশ দেন। এ কথা বলার পর কাফফারার অবশিষ্ট বিধান বর্ণনা করা হচ্ছে, ‘আর যে ব্যক্তি তা (দাসমুক্ত করতে) পারে না, সে যেন উভয়ের পক্ষ থেকে পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বে একনাগাড়ে দু’মাস রােযা রাখে, আর যে ব্যক্তি তাও না পারে, সে যেন ষাট জন অভাবী ব্যক্তিকে আহার করানো।’ এরপর অধিকতর বিশ্লেষণ ও মনােযােগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বলা হচ্ছে, ‘ নির্দেশদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেন তােমরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনাে।’ যাদের সম্বােধন করে এ কথা বলা হচ্ছে, তারা মােমেনই। তবুও এই বর্ণনা, এসব কাফফার এবং এর ভেতরে তাদের অবস্থা আল্লাহর নির্দেশ ও ফয়সালার সাথে যেভাবে সংযুক্ত ও সমন্বিত করা হয়েছে, তা ঈমানকে নিছক বিশ্বাস ও মানসিক প্রেরণা-উদ্দীপনার স্তর থেকে বাস্তবতার স্তরে উন্নীত করে। ঈমানের সাথে কর্মময় জীবনের সংযােগ সাধন করে এবং বাস্তব জীবনের জন্য ঈমানকে একটা লক্ষণীয় শক্তির উৎসরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। ‘আর এগুলাে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা।’ এই সীমারেখা তিনি এজন্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাতে মানুষ এই সীমারেখার কাছে এসে থেমে না যায় এবং তা অতিক্রম না করে। কেননা যে ব্যক্তি এই সীমারেখা মানে না এবং মাড়াতে দ্বিধাবােধ করে না, তার ওপর আল্লাহ তায়ালা রাগান্বিত হন।
*যেহারের কাফফারা ও নারী নির্যাতন : অতপর এই সবকটি নির্দেশের সমাপ্তি টানা হচ্ছে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণজনিত চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘােষণার মাধ্যমে, ‘আল্লাহ তায়ালা কোনাে ব্যক্তিকে তার অভ্যন্তরে দুটো মন দেননি…’ যেহেতু তার মন একটা, সুতরাং তার চলার পথও একটাই হবে। জীবন ও জগত সম্পর্কে তার দৃষ্টিভংগীও একই রকম হবে। যাবতীয় জিনিস, ঘটনাবলী ও ধ্যান ধারণার মূল্যায়নের জন্যে তার কাছে মানদন্ডও একটাও থাকবে। অন্যথায় সে হয়ে যাবে বিক্ষিপ্ত, বিশৃংখল, মানাফেক, ভন্ড, বাঁকা পথগামী এবং কোনাে দিকেই সে দৃঢ় পদক্ষেপে এগুতে পারবে না। কোনাে মানুষের পক্ষেই এটা সম্ভব নয় যে, সে তার স্বভাব চরিত্র ও আচার ব্যবহারের শিক্ষা গ্রহণ করবে এক উৎস থেকে, আইন কানুন গ্রহণ করবে আর এক উৎস থেকে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তৃতীয় কোনাে উৎস থেকে এবং সংস্কৃতি ও কৃষ্টির শিক্ষা গ্রহণ করবে চতুর্থ কোনাে উৎস থেকে। এমন জগাখিচুড়ি ও বহুমুখী জীবন ব্যবস্থা এমন কোনো সুসংহত মানুষ সৃষ্টি করে না, যার একটামাত্র হৃদয় রয়েছে। এ ধরনের জীবন ব্যবস্থা কেবল বহুধা বিচ্ছিন্ন মানব সত্ত্বারই উদ্ভব ঘটায়। সেই মানব সত্ত্বার কোনাে একীভূত চরিত্র ও স্থীতিশীল ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে না। কোনাে আকীদা বিশ্বাস বা আদর্শ ধারণ করে-এমন কোনাে ব্যক্তির পক্ষে এটা আদৌ সম্ভব নয় যে, তার একটা আদর্শ বা আকীদায় সত্যিই আস্থা থাকবে, অথচ সেই আকীদা বা আদর্শের দাবী, চাহিদা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট মূল্যবােধের প্রভাবমুক্ত হয়ে সে জীবনের কোনাে দিক ও বিভাগে কোনাে ছােটো বা বড়াে কাজ করবে। সে যে কোনাে কথাই বলুক, যে কোনাে কাজই করুক, যে কোনাে সংকল্প গ্রহণ করুক এবং যে কোনাে চিন্তাধারাই অবলম্বন করুক-তার অন্তঃকরণে যে আকীদা ও আদর্শ যথার্থই বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে, সে আদর্শের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব থেকে একেবারেই মুক্ত হয়ে সে সেই কথা বলতে, সেই কাজ করতে, সেই চিন্তা বা সংকল্প গ্রহণ করতে পারে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে একটামাত্র অন্তকরণই সৃষ্টি করেছেন, যা একটামাত্র বিধানের কাছেই নতি স্বীকার করতে সক্ষম। একটামাত্র চিন্তাধারাই গ্রহণ করতে সক্ষম এবং একটামাত্র মানদন্ডেই সবকিছু পরিমাপ ও মূল্যায়ন করতে সক্ষম। কোনাে আদর্শবাদী মুসলিম ব্যক্তি এ কথা বলতে পারে না যে, এই কাজটা আমি ব্যক্তিগতভাবে করলাম। আর এই কাজটা করলাম মুসলিম হিসাবে-যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবসায়ী, সমাজ বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানী ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ এ ধরনের কথাবার্তা আজকাল প্রায়ই বলে থাকেন। প্রত্যেক মানুষের একটা মাত্রই সত্তা ও ব্যক্তিত্ব থাকে, একটা মাত্রই মন ও বিবেক থাকে, একটাই আকীদা ও আদর্শ থাকে, জীবন সম্পর্কে একটামাত্রই ধারণা ও বিশ্বাস থাকে এবং জীবনের যাবতীয় কর্মকান্ড ও মূল্যবােধের জন্যে একটাই মানদন্ড থাকে। আর তার আকীদা বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত চিন্তাধারাই সকল অবস্থায় তার সমস্ত কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়। এই একটা মাত্র অন্তঃকরণ নিয়েই সে তার ব্যক্তিগত পারিবারিক, সামাজিক, রষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন অতিবাহিত করে। ওটা নিয়েই সে প্রকাশ্য ও গােপন জীবনযাপন করে, চাকুরী অথবা মনীবগিরি করে, শাসক অথবা শাসিতের জীবন উপভােগ করে। সুখে অথবা দুঃখে জীবন কাটায়। এ সবের কোনাে অবস্থাই তার মানদন্ড বদলায় না। মূল্যবােধ বদলায় না, চিন্তাধারায় হেরফের হয় না। কেননা আল্লাহ তায়ালা কোনাে মানুষের অভ্যন্তরে দুটো অন্তঃকরণ সৃষ্টি করেননি। সুতরাং মানুষের সামনে একটা মাত্রই পথই খােলা। তা হলো এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। একটামাত্র হৃদয়ের অধিকারী মানুষ দু’জন মাবুদের আনুগত্য করতে পারে না, দু’জন মনীবের সেবা করতে পারে না। দুটো পথে চলতে পারে না। দুটো জীবন বিধান মেনে চলতে পারে না। তা করতে গেলে তার স্বকীয়তা হয়ে যাবে লন্ডভন্ড এবং তার ব্যক্তিত্ব হয়ে যাবে খন্ড বিখন্ড। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে এই দ্ব্যর্থহীন ও আপােসহীন সিদ্ধান্ত ঘােষণা করার পর কোরআন যেহার ও পালকপুত্র গ্রহণের প্রথা বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যাতে করে সমাজ ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ সাবলীল, সুস্থ, স্বাভাবিক ও নির্মল পারিবারিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা যায়। ‘তােমাদের যেসব স্ত্রীকে তােমাদের নিজেদের মায়ের সাথে তুলনা করে(দৈহিক সাদৃশ্য দেখাও) সেসব স্ত্রীকে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের মা বানাননি এবং তােমাদের পালিত পুত্রকে তােমাদের পুত্র বানাননি'(আয়াত ৪-৫) জাহেলী যুগে এরূপ প্রথা প্রচলিত ছিলাে যে, স্বামী তার স্ত্রীকে বলতাে, তুমি আমার কাছে আমার মায়ের মতাে। অর্থাৎ আমার মা যেমন আমার জন্যে নিষিদ্ধ, তুমিও তেমনি নিষিদ্ধ ও হারাম। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই সেই স্ত্রীর সাথে সহবাস করা তার জন্যে অবৈধ গণ্য হতাে। তারপর সেই মহিলা ঝুলন্ত অবস্থায় থাকতাে। সে তালাকপ্রাপ্তা বলেও বিবেচিত হতাে না যে, অন্য কোনাে পুরুষকে বিয়ে করবে। বর্তমান স্বামীর স্ত্রী বলেও গণ্য হতাে না যে, সে তার জন্যে বৈধ হয়ে যাবে। এটা ছিলাে এক ধরনের নিষ্ঠুর নিপীড়ণ। জাহেলী যুগে নারীর প্রতি যে রকমারী যুলুম নির্যাতন ও অসদাচরণ করা হতাে, এটা ছিলাে তারই অংশ বিশেষ। ইসলাম যখন পারিবারিক অংগনে সংস্কারের কাজে হাত দিলাে, তখন পরিবারকে সে সমাজের প্রাথমিক একক বলে গণ্য করলাে। তাকে নতুন প্রজন্মের সূতিকাগার হিসাবে যথােপযুক্ত গুরুত্ব দিলাে। নারীর ওপর থেকে এই যুলুমের খড়গ দূরে নিক্ষেপ করলে এবং পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনগুলােকে একে একে ন্যায়বিচার ও মহানুভবতার বন্ধনে পরিণত করতে লাগলাে। এই সংস্কারকে সে আইনে পরিণত করলাে এই বলে যে, ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের সেইসব স্ত্রীকে মা বানাননি, যাদেরকে তােমরা মায়ের মতো বলেছো’ কেননা মুখের একটা কথা প্রকৃত সত্যকে ও বাস্তবতাকে বদলে দিতে পারে না। মা মাই থাকবে এবং স্ত্রী স্ত্রীই থাকবে। একটা কথার কারণেই সম্পর্কের প্রকৃতি পাল্টে যেতে পারে না। এ জন্যেই ইসলামী আইনে যেহার (স্ত্রীকে মায়ের মতাে বলা) দ্বারা স্ত্রী হুবহু মায়ের মতাে চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে যায় না- যেমনটি জাহেলী যুগে হতাে। এ কথাও বর্ণিত আছে যে, যেহার প্রথাকে আইনগতভাবে বিলুপ্ত করা হয় সূরা আল মুজাদালাহ নাযিল করার মাধ্যমে। হযরত আওস বিন সামেত তার স্ত্রী খাওলা বিনতে ছালাবার সাথে যেহার করলে খাওলা রসূল(স.)-এর কাছে এসে এভাবে অভিযােগ করেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমার স্বামী আমার সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করেছে, আমার যৌবনকে ধ্বংস করেছে এবং আমি আমার উদরকে তার জন্যে উৎসর্গ করেছি। অবশেষে যখন আমি বুড়ি হয়েছি এবং আমার সন্তান আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তখন সে আমার সাথে যেহার করেছে। রসূল(স.) বললেন, ‘আমার তাে মনে হচ্ছে তুমি ওর জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। খাওলা এরপরও তার অভিযােগ বারবার তুলে ধরতে লাগলাে। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সেই মহিলার বক্তব্য শুনেছেন যে তােমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত ছিলো নিজের স্বামী সম্পর্কে…'( মুজাদালাহ, আয়াত ১-৪) এভাবে যেহার দ্বারা সাময়িকভাবে স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ হয়ে যায়, স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হয় না। কিংবা তালাকও হয় না। এর প্রতিকার বা কাফফারা হিসাবে একটা দাস বা দাসী মুক্ত করে দিতে হয়। অথবা দু’মাস একনাগাড়ে রােযা রাখতে হয় অথবা ৬০ জন দরিদ্রকে খাওয়াতে হয়। এতেই স্ত্রী তার জন্যে পুনরায় হালাল হয়ে যায়। সাবেক দাম্পত্য জীবন পুনর্বহাল হয়। বাস্তবতা ও আসল সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় শরীয়তের বিধান। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ’তোমাদের যে স্ত্রীদেরকে তােমরা নিজেদের মায়ের সদৃশ্য বলেছো, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের মা বানাননি।’ এভাবে সেই জাহেলী প্রথার কারণে পরিবার ভেংগে খানখান হওয়া থেকে রক্ষা পায়। সেই প্রথাটা ছিলাে জাহেলী সমাজে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার অধীন সর্বব্যাপী নারী নির্যাতন, পারিবারিক জটিলতা অরাজকতা ও বিপর্যয় সৃষ্টির হাতিয়ার। [ইসলাম মানুষকে দায়িত্ব জ্ঞান উক্তি ও মন্তব্য করা থেকে দূরে রাখতে চায় বলেই যেহারের জন্যে কিছু শান্তির বিধান জারী করেছে। নিজ স্ত্রীকে নিজ মায়ের সাথে তুলনা করলে যদিও সে তার জন্মদায়িনী মা হয়ে যায় না, কিন্তু মায়ের জন্য রক্ষিত বিশেষ মর্যাদা দারুণভাৰে লংঘিত হয়। এ জন্যে যদি কোনােরকম শাস্তির বিধান না রাখা হয় তাহলে সে কখনাে দায়িত্ব জঞান সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না।-সম্পাদক]
Aaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaa ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*পালক প্রথা রহীতকরণ : এতাে গেলাে যেহারের প্রথা। এরপর রয়েছে পালকপুত্র গ্রহণের প্রথা। এ প্রথার মাধ্যমে ছেলেদের আসল পিতার পরিবর্তে অন্যান্য ব্যক্তি পিতা হিসাবে পরিচিত হতাে। পরিবার ও সমাজের স্বাভাবিক বন্ধন শিথিল হওয়ার কারণে এই উপসর্গটা জন্ম নিতে পেরেছিলাে। যদি আরব সমাজের সুপ্রসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, নারীর সতীত্ব ও অটুট বংশীয় ধারাবাহিকতার জন্যে তারা গৌরব করতাে। কিন্তু এই গৌরবের পাশাপাশি সেই সমাজের সুপ্রসিদ্ধ বংশীয় ধারার বাইরের কিছু পরিবারে এর ঠিক বিপরীত কিছু গ্লানিময় বৈশিষ্টও দেখা যেতাে। সমাজের কিছু ছেলেমেয়ে এরূপ দেখা যেত, যাদের পিতা কে তা কেউ জানতাে না। এ ধরনের ছেলে মেয়েদের মধ্য থেকে কোন একজন কারাে চোখে ভালাে লেগে গেলে সে তাকে নিজের সন্তান বানিয়ে নিতো এবং তাকে নিজের বংশধরের মধ্যেই গণ্য করতাে। তারপর তার সাথে তার উত্তরাধিকারের সম্পর্কও গড়ে উঠত অবিকল বংশােদ্ভূত সন্তানদের মতােই। সেই সমাজে কিছু অনাথ ছেলেমেয়ে এমনও ছিলাে, যাদের পিতৃ পরিচয় সবার জানা ছিলাে। কিন্তু সেইসব ছেলেমেয়ের মধ্য থেকে কোনােটা কারাে চোখে ভালাে লাগলে সে তাকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে যেতাে, নিজের সন্তানে পরিণত করতাে এবং নিজের বংশধরের অন্তর্ভুক্ত করে নিতো। এরপর থেকে যে ব্যক্তি তাকে নিজের সন্তান বানিয়েছে, তারই নামে সে সমাজে পরিচিত হতাে এবং তার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হতাে। এ ধরনের ঘটনা সাধারণত যুদ্ধবন্দী হিসাবে গৃহীত ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘটতাে। এ ধরনের শিশু কিশােরদের মধ্য থেকে যাকে কেউ নিজের বংশধরে পরিণত করতে চাইতাে, সে তাকে নিজের সন্তান বানিয়ে নিতাে, তার নামের সাথে নিজের নাম যুক্ত করত এবং সন্তানসুলভ সমুদয় অধিকার ও দায়দায়িত্ব তার সাথে যুক্ত হতাে। যায়েদ বিন হারেসা কালবীও ছিলেন এ ধরনের একজন। একটা আরব গােত্র বনী কালবের। বংশধর এই যায়দ জাহেলী যুগের একটা দুঃখজনক ঘটনায় বন্দী হয়ে শিশুকালেই মক্কায় আসেন। হাকীম বিন হিযাম তার ফুফু হযরত খাদীজা(রা.)-এর জন্যে তাকে কিনে আনেন। পরে রসূল(স.)-এর সাথে বিয়ে হওয়ার পর খাদীজা(রা.) এই ক্রীতদাসটা রসূল(স.)-কে উপহারস্বরূপ দেন। এরপর যখন যায়েদের পিতা মাতা তাকে ফেরত চায়, তখন রসূল(স.)- যায়েদকে তার পিতামাতার সাথে চলে যাওয়া অথবা তার কাছে থেকে যাওয়া-এই দুটোর যে কোনাে একটা বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেন। যায়েদ রসূল(স.)-এর কাছে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। রসূল(স.) তাকে প্রথমে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন, অতপর নিজের ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেন। সেই থেকে তাকে যায়েদ বিন মােহাম্মাদ বলে পরিচয় দেয়া হতাে। মুক্তি পাওয়া দাসদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ইসলাম যখন পারিবারিক বন্ধনগুলােকে তার স্বাভাবিক ভিত্তির ওপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, পারিবারিক সম্পর্ককে দৃঢ়তর করা এবং তাকে স্বচ্ছ, সুস্পষ্ট ও নির্ভেজাল করতে আরম্ভ করলাে, তখন এই দত্তক গ্রহণের প্রথা কে বাতিল করলাে এবং বংশীয় সম্পর্ককে তার প্রকৃত ভিত্তির ওপর দাঁড় করালাে। পিতা ও সন্তানের জন্যে রক্ত সম্পর্ক ও আসল পিতা বা সন্তান হিসাবে পরিচিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা পুনর্বহাল করলাে । ইসলাম ঘােষণা করলাে, ‘তােমাদের পালিত সন্তানদেরকে আল্লাহ প্রকৃত সন্তান বানাননি। ওটা তােমাদের মুখের কথা মাত্র।’ বস্তুত মুখের কথা বাস্তবতাকে বদলে দেয় না, রক্ত সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনাে সম্পর্ককে প্রকৃত সম্পর্কে পরিণত করে না, বীর্য থেকে সৃষ্ট বংশীয় সম্পর্ক বন্ধন ছাড়া অন্য কোনাে সম্পর্ক বন্ধন উত্তরাধিকারের যােগ্যতা সৃষ্টি করে না এবং সন্তান পিতার দেহের অংশ হলে যে স্বাভাবিক আবেগের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা কোনাে কৃত্রিম পিতা ও কৃত্রিম সন্তানের মধ্যে গড়ে ওঠে না। ‘আল্লাহ প্রকৃত সত্য কথা বলেন এবং তিনিই সঠিক পথের সন্ধান দেন।’ অর্থাৎ তিনিই সেই আসল সত্য কথা বলেন, যার সাথে বাতিলের কোনাে সংমিশ্রণ নেই । আর শুধু মুখের কথা নয়, বরং রক্ত ও মাংস থেকে সৃষ্ট আসল ও অকৃত্রিম বন্ধনের ওপর যাবতীয় সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করাও সত্যের অন্তর্ভুক্ত। ‘এবং তিনিই সঠিক পথের সন্ধান দেন।’ অর্থাৎ সরল, সােজা, নির্ভুল ও প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সংগতিপূর্ণ পথের সন্ধান দেন, মানুষের মুখের কথা ও অবাস্তব বক্তব্য দ্বারা যে পথ তৈরী হয়, তার ওপর আল্লাহ তায়ালা যে সত্য ও স্বাভাবিক কথা বলেন এবং যা দ্বারা সঠিক পথের সন্ধান দেন, তা বিজয়ী হয়ে থাকে। তাদেরকে তাদের পিতাসহ ডাকো। এটাই আল্লাহর কাছে অধিকতর ইনসাফপূর্ণ। বস্তুত সন্তানকে তার পিতৃ পরিচয় ধরে ডাকাই অধিকতর ন্যায়সংগত ও সুবিচার সম্মত। এটা সেই পিতার জন্যেও সুবিচার সম্মত, যার দেহের একটা জীবন্ত অংশ হিসেবেই এই সন্তানের জন্ম হয়েছে। আর সেই সন্তানের জন্যেও সুবিচারপূর্ণ যাকে তার পিতার পরিচয়ে পরিচিত করা হয় এবং উত্তরাধিকারের বিধি ব্যবস্থা প্রনয়ণ করা হয়। সে তার পিতার সাথে সহযােগিতা করে, তার সুপ্ত উত্তরাধিকারগুলাে তার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় এবং তার পিতা-পিতামহদের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে প্রতিফলিত হয় এটা সত্যের প্রতিও ইনসাফপূর্ণ। যা সবকিছুকে তার স্বাভাবিক অবস্থানে বহাল রাখে, প্রত্যেকটা সম্পর্ককে তার স্বাভাবিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে এবং পিতা বা সন্তানের কোনাে বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে না। এটা প্রকৃত পিতা ছাড়া আর কাউকে সন্তানের সুফল ভােগ করতে দেয় না এবং তাকে তার বৈশিষ্ট্যগুলােও দেয় না। প্রকৃত পিতাকে ছাড়া আর কাউকে সন্তানের সুফল ও কল্যাণ অর্জনের যোগ্য গণ্য করে না। এই ব্যবস্থা পরিবারকে ভারসাম্যপূর্ণ বানায় এবং বাস্তবভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। সেই সাথে সমাজকেও একটা শক্তিশালী ও বান্তব ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। কেননা এই ব্যবস্থায় সত্যের আনুকূল্য ও স্বাভাবিক সত্যের সাথে সংগতি রয়েছে। পরিবারের প্রকৃত ও স্বাভাবিক ভিত্তি যে ব্যবস্থায় অস্বীকার করা হয়, তা ব্যর্থ ও নিস্ফল ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা দুর্বল, তার ভিত্তি কৃত্রিম এবং তা টিকে থাকার অযোগ্য। [কমিউনিজম সমাজ গঠনে পারিবারিক ভিত্তিকে অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছিলাে। ফলে নিজেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং এখনাে হচ্ছে। সকল বজ্র আটুনীকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাশিয়ায় স্বাভাবিক পারিবারিক ভিত্তি বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে এবং ক্রমান্বয়ে তা সমাজকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে ফিরে আসছে] যেহেতু জাহেলী যুগে পারিবারিক বন্ধনগুলাে নৈরাজ্য কবলে পড়েছে এবং যৌন অরাজকতাও ব্যাপক হয়ে পড়েছে, আর সে কারণে বংশীয় ধারায় ভেজালের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং অনেক সময় শিশু-কিশােরের পিতৃ পরিচয় জানা যায় না, একারণেই ইসলাম ব্যাপারটাকে সহজ করে দিয়েছে এবং যাদের প্রকৃত পিতৃ পরিচয় পাওয়া যায় তাদেরকে ইসলামী সমাজে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামী বন্ধুত্বের ভিত্তিতে ঠাই করে দিয়েছে। কেননা পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনই তার মূল লক্ষ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি তাদের পিতার পরিচয় না জানাে, তাহলে তারা তােমাদের দ্বীনী ভাই ও বন্ধু।’ এটা হচ্ছে নিছক নৈতিক ও আন্তরিক সম্পর্ক। এ দ্বারা কোনাে আইনগত বাধ্যবাধকতা আরােপিত হয় না। যেমন উত্তরাধিকারের বাধ্যবাধকতা রক্তপণ পরিশােধের ব্যাপারে সামষ্টিক দায়-দায়িত্ব গ্রহণ, রক্ত সম্পর্কের ন্যায় বংশীয় বন্ধনের বাধ্যবাধকতা আরােপিত হয় না, যা দত্তক গ্রহণে আরােপিত হতাে। এ ব্যবস্থার লক্ষ্য হলাে যে, দত্তক প্রথা বিলুপ্তির পর এসব বেওয়ারিশ ও ভাসমান জনগােষ্ঠী যেন সমাজে ছিন্নমূল হয়ে না থাকে। ‘যদি তােমরা তাদের পিতৃ পরিচয় না জানাে’ এই উক্তিটা থেকে চিত্তপটে জাহেলী সমাজের একটা উচ্ছৃংখল ছবি এবং নারী পুরুষের সম্পর্কের অরাজকতার চিত্র ভেসে ওঠে। ইসলাম এই অরাজকতা ও অনিয়মতান্ত্রিকতার প্রতিকার করেছে পিতা শাসিত পরিবার প্রতিষ্ঠা এবং পবিত্র ও নির্মল পরিবার ভিত্তিক সমাজ গড়ার মাধ্যমে। [এ অবৈধ সন্তানের বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমা সভাতার কোলে লালিত মানুষগুলাে যে কি বিপদ-মুসীবতে আছে তা আজকের ইউরােপ আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাকালে সহজেই অনুভব করা যায়। এই বিষয়টি এতাে ব্যাপক যে, একটি ক্ষুদ্র টীকা দিয়ে এখান তা শেষ করা যাবে না। ইউরােপের সর্বশেষ জরীপ অনুযায়ী একমাত্র ইংল্যান্ডেই শতকরা ৩৪ ভাগ শিশু এমন আছে, যাদের হাসপাতালের নথিপত্রে ও স্কুলের খাতায় পিতার কোনাে পরিচয় নেই। ইদানীং সে সমাজের চিন্তা নায়করা অবৈধ প্রজন্মের এ বিশাল বাহিনী নিয়ে দারুণ চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। সোস্যাল সিকিউরিটি, শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ও হাসপাতালের বিভাগগুলো এ সমস্যাগুলাের গিয়ে দারুণভাবে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। মনে হয় গােটা সভ্যতার প্রাসাদ আজ ভেংগে খানখান হয়ে যাবে। প্রতিদিন এব্যাপারে আমাদের সামনে এতাে তথ্য আসছে যে, আমি কোনাে এক দুটো বইয়ের নাম লিখে বিষয়টিকে সংকুচিত করতে চাই না। উৎসাহী পাঠকরা এই বিষয়ের ওপর প্রয়ােজনীয় তথ্য পেতে চাইলে সহজেই তা পেয়ে যাবেন-সম্পাদক] সঠিক বংশ পরিচয় ও বংশীয় ধারাবাহিকতা পুন প্রতিষ্ঠার যথাসাধ্য চেষ্টা করার পর যেসব ক্ষেত্রে সঠিক বংশ পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয় না, সে সব ক্ষেত্রে মুসলমানদের ওপর কোনাে দায়িত্ব বর্তে না। ‘তোমরা যে ক্ষেত্রে ভুল করাে সে ক্ষেত্রে তােমাদেরকে কোনাে দোষারােপ করা হবে না তবে ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতার দায় থেকে রেহাই নেই।’ এই মহানুভবতার কারণ হলাে আল্লাহর দয়াশীলতা ও ক্ষমাশীলতা বর্ণনা করা। ‘তিনি মানুষকে তার সাধ্যের বাইরে কোনাে কাজ করতে বাধ্য করেন না, আল্লাহ তায়ালা দয়াশীল ও ক্ষমাশীল।’ জাহেলী সমাজের অনিয়মতান্ত্রিকতার প্রভাব ঝেড়ে মুঝে ফেলে সমাজ পুনর্গঠনের ওপর রসূল(স.) সর্বাত্মক গুরুত্ব আরােপ করেছেন এবং যারা প্রকৃত বংশীয় পরিচয় গােপন করে, তাদেরকে কুফরির পথ অবলম্বনকারী বলে তিরস্কার করেছেন। ইমাম ইবনে জারীর বর্ণনা করেন যে, হযরত আবু বকর(রা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা তাদেরকে তাদের পিতার পরিচয়ে ডাকো। এটাই আল্লাহর কাছে অধিকতর ইনসাফপূর্ণ। আর যদি তাদের পিতার পরিচয় না জানাে, তাহলে তারা তােমাদের ইসলামী ভাই ও বন্ধু… আমিও এমন এক ব্যক্তি, যার পিতা অজ্ঞাত। কাজেই আমি তােমাদের দ্বীনী ভাই। উয়াইনা বিন আবদুর রহমান বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি মনে করি, আবু বকর যদি জানতাে যে তার পিতা একটা গাধা ছিলাে, তবে সে তাকেই পিতা বলে মেনে নিতো। কারণ হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি জেনে-শুনে নিজের পিতা ছাড়া অন্য কাউকে পিতা বলে, সে কুফরি করে।’ পরিবারকে ও পারিবারিক সম্পর্ককে যাবতীয় সন্দেহ সংশয় থেকে রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা, ও দৃঢ়তার যাবতীয় উপকরণ দ্বারা তার প্রাচীরকে শক্তিশালী ও মযবুত করার ওপর ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে বলেই এ ব্যাপারে এতাে কঠোর বক্তব্য দিয়েছে। কেননা এই নিখুঁত ও নির্মল পরিবার দিয়েই সে পবিত্র ও সৎ সমাজ গড়তে সংকল্পবদ্ধ।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা একজন ব্যক্তিকে দুটি অন্তর দান করেননি। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি একই সাথে দুটি কাজ করবে বা দুধরনের চিন্তা করবে তা কখনো সম্ভব হবে না। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: এভাবে ব্যক্ত করার কারণ হল কতক মুনাফিক বলতন মুহাম্মাদের দুটি অন্তর রয়েছেন কেননা কখনো কোন বিষয়ে মগ্ন থাকলেও অন্য বিষয়ে ফিরে আসে, তারপর আবার সে ঐ বিষয়ে ফিরে যায়। আল্লাহ তা‘আলা একথা দ্বারা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলেন। এ ছাড়াও অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। (কুরতুবী) অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা যিহারের বিধান বর্ণনা করছেন ।
যিহারের পরিচয় ও বিধান:
ظهار এর শাব্দিক অর্থ: এটি আরবি শব্দ, অর্থ হল বিক্ষোভ প্রদর্শন করা, একে অপরকে সাহায্য বা সমর্থন করা, যিহার করা ইত্যাদি।
পরিভাষায় যিহার হল স্ত্রীকে বা স্ত্রীর কোন অঙ্গকে যাদের বিবাহ করা হারাম তাদের সাথে তুলনা করা। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ:৩/৩৬৯) স্ত্রীকে এরূপ বলা যে, তুমি আমার মায়ের পিঠের মত বা অমুক অঙ্গের মত ইত্যাদি। কেউ কেউ যিহারকে মায়ের পিঠের সাথে তুলনা করাকে সীমাবদ্ধ করেছেন।
যিহারের হুকুম হল যদি কেউ তার স্ত্রীর সাথে যিহার করে তাহলে স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলন করা তার জন্য হারাম হয়ে যাবে। তবে কাফফারা দেয়ার পর দৈহিক মিলন করতে পারবে। কিন্তু কাফফারা আদায় না করা পর্যন্ত স্ত্রী তার জন্য হারাম। যিহারের কাফফারা হল:
(১) একজন গোলাম আযাদ করতে হবে।
(২) যদি সক্ষম না হয় তাহলে ধারাবাহিকভাবে দু মাস সিয়াম পালন করতে হবে।
(৩) যদি তাতেও সক্ষম না হয় তাহলে ষাটজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ يُظَاهِرُوْنَ مِنْ نِّسَآئِهِمْ ثُمَّ يَعُوْدُوْنَ لِمَا قَالُوْا فَتَحْرِيْرُ رَقَبَةٍ مِّنْ قَبْلِ أَنْ يَّتَمَآسَّا ط ذٰلِكُمْ تُوْعَظُوْنَ بِه۪ ط وَاللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ – فَمَنْ لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَّتَمَآسَّا ط فَمَنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّيْنَ مِسْكِيْنًا ط ذٰلِكَ لِتُؤْمِنُوْا بِاللّٰهِ وَرَسُوْلِه۪ ط وَتِلْكَ حُدُوْدُ اللّٰهِ ط وَلِلْكٰفِرِيْنَ عَذَابٌ أَلِيْمٌ)
“আর যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে, পরে তারা পরিত্যাগ করে যা তারা বলেছে, তাহলে তারা একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি গোলাম মুক্ত করবে। এ আদেশ দিয়ে তোমাদেরকে নসীহত করা যাচ্ছে। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত। তবে যার এ সামর্থ্য নেই, সে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে ধারাবাহিকভাবে দু’মাস রোযা রাখবে। আর যে ব্যক্তি এতেও অসমর্থ, সে ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াবে। এ নির্দেশ এ জন্য যে, তোমরা যেন ঈমান আনয়ন কর আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি। আর এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা মুজাদালাহ ৫৮:৩-৪)
শুধু কাফফারা দিলেই হবে না সাথে সাথে মৌখিকভাবে উক্ত কথা প্রত্যাখ্যান করে নিতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলছেন
(ثُمَّ يَعُوْدُوْنَ لِمَا قَالُوْا)
‘পরে তারা ফিরে আসে যা তারা বলেছে’।
হাদীসে এসেছে,
ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে বলল: আমি আমার স্ত্রীর সাথে যিহার করেছি এবং কাফফারা দেয়ার পূর্বেই তার সাথে সহবাস করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমার ওপর রহম করুন। এ কাজ করতে তোমাকে কিসে উদ্বুদ্ধ করেছে? লোকটি বলল: আমি চাঁদনী রাতে তার পায়ের মলের (গহনার) সৌন্দর্য দেখে (তার সাথে সহবাস করে ফেলি)। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা না আদায় করা পর্যন্ত তুমি তার নিকটবর্তী হয়ো না। (আবূ দাঊদ হা: ২২২৩, তিরমিযী হা: ১১৯৯, সহীহ)
যিহারের পদ্ধতি:
স্ত্রীকে স্বামী বলবে: তুমি আমার মায়ের পিঠের মত বা মায়ের অমুক অঙ্গের মত। অথবা যাদের সাথে বিবাহ বন্ধন হারাম তাদের কারো কোন অঙ্গের সাথে তুলনা করবে। স্ত্রীকে মায়ের পিঠের মত বা অঙ্গের সাথে তুলনা করলেই স্ত্রী মা হয়ে যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلَّذِيْنَ يُظَاهِرُوْنَ مِنْكُمْ مِّنْ نِّسَآئِهِمْ مَّا هُنَّ أُمَّهٰتِهِمْ ط إِنْ أُمَّهٰتُهُمْ إِلَّا الّٰ۬ئِيْ وَلَدْنَهُمْ)
“তোমাদের মধ্যে যারা স্বীয় স্ত্রীদের সাথে যিহার করে (তারা জেনে রাখুক), তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মাতা তো কেবল তারাই যারা তাদেরকে জন্মদান করেছেন।” (সূরা মুযাদালাহ ৫৮:২) এ কথাই আল্লাহ তা‘আলা এখানে বলেছেন: এবং তোমাদের স্ত্রীদের মধ্য হতে যাদের সাথে তোমরা ‘যিহার’ কর তাদেরকে তোমাদের জননী করেননি।
أَدْعِيَا۬ءَ শব্দটি دعي এর বহুবচন। অর্থ হলো: পালক পুত্র, পাতানো ছেলে। অর্থাৎ পালক পুত্র প্রকৃত পক্ষে তোমাদের পুত্র নয়। সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা পালক পুত্রের আসল বাবার পরিচয়ে ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই পালক পুত্রের সাথে পর্দা ফরয এবং পালক পুত্রের স্ত্রীকে পালক বাবা বিবাহ করতে পারবে। জাহিলী ও ইসলামের প্রথম যুগে যদি কোন ব্যক্তি অপর কারো পুত্রকে পোষ্য পুত্ররূপে গ্রহণ করত তবে এ পোষ্যপুত্র তার প্রকৃত পুত্র বলে পরিচিত হত এবং তারই পুত্র বলে সম্বোধন করা হতো। এ পোষ্যপুত্র সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত পুত্রের মর্যাদাভুক্ত হতো। যথা তারা প্রকৃত সন্তানের ন্যায়ই মীরাসের অধিকারী হত এবং বংশ ও রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে যেসব নারীদেরকে বিবাহ করা হারাম তাদেরকে বিবাহ করতে পারত না। অনুরূপভাবে পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীও সেই পালক পিতার জন্য বিবাহ করা হারাম ছিল। এ প্রথা রহিত করে দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বিধান দিলেন পালক পুত্র তোমাদের প্রকৃত পুত্র নয় এবং পালক বাবা প্রকৃত বাবা নয়। সুতরাং যখন পালক পুত্রকে ডাকবে তখন তার প্রকৃত পিতার পরিচয় দিয়ে ডাকবে। আর পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য কোন দোষের কারণ নয়।
(اُدْعُوْهُمْ لِاٰبَآئِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ….) শানে নুযূল:
আবদুল্লাহ বিন উমার (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, যায়েদ বিন হারিসা (رضي الله عنه) ছিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পালক পুত্র। আমরা তাকে যায়েদ বিন মুহাম্মাদ বলেই ডাকতাম। তখন আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতটি নাযিল করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৮২, সহীহ মুসলিম হা: ২৪২৫)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা এখানে পালক পুত্রকে তাঁর পিতৃ পরিচয়ে ডাকার জন্যই নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর এটাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট অধিক ন্যায়সঙ্গত বিষয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَلٰكِنْ رَّسُوْلَ اللّٰهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ ط وَكَانَ اللّٰهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمًا)
“মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদের মধ্যকার কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নাবী। আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (সূরা আহযাব ৩৩:৪০)
আর যদি কারো পিতৃ পরিচয় না পাওয়া যায় তাহলে তারা তোমাদের দীনি ভাই এবং বন্ধু বলে গণ্য হবে। তবে কিছুতেই সন্তান বলে গণ্য হতে পারে না। হাদীসে এসেছে:
সাদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি অন্যকে পিতা বলে দাবী করবে অথচ সে জানে যে, এ ব্যক্তি তার পিতা নয় তার জন্য জান্নাত হারাম। (সহীহ বুখারী হা: ৬৭৬৬, সহীহ মুসলিম হা: ৬৩)
আবূ হুরাইরাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমরা তোমাদের পিতা (অর্থাৎ পিতার পরিচয় দেয়া) থেকে বিমুখ হয়ো না। যে ব্যক্তি তার পিতা থেকে বিমুখ হয়ে যায় সে কুফরী করল। (সহীহ বুখারী হা: ৬৭৬৮, সহীহ মুসলিম হা: ৬৯)
এরপর আল্লাহ দয়াদ্রতার কথা উল্লেখ করে বললেন, ইতোপূর্বে তোমরা যে সকল পাপ বা ভুল করেছ সেগুলোর জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করা হবে না। তবে যদি অন্তরে দৃঢ় সংল্পের সাথে করে থাক তাহলে সে কথা ভিন্ন অর্থাৎ এজন্য গুনাহগার হতে হবে আর এজন্য পাকড়াও করা হবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللّٰهُ بِاللَّغْوِ فِيْٓ أَيْمَانِكُمْ وَلٰكِنْ يُّؤَاخِذُكُمْ بِمَا كَسَبَتْ قُلُوْبُكُمْ ط وَاللّٰهُ غَفُوْرٌ حَلِيْمٌ)
“অনর্থক কসমের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, তবে তিনি তোমাদেরকে গ্রেফতার করবেন তোমাদের অন্তর যা অর্জন করে তার জন্য। আর আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, ধৈর্যশীল।” (সূরা বাকারাহ ২:২২৫)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. একজন ব্যক্তির একটাই অন্তর থাকে কখনো দুটো অন্তর থাকতে পারে না।
২. স্ত্রীর সাথে যিহার করলে কাফফারা দেয়ার পূর্বে ঐ স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলন করতে পারবে না।
৩. পোষ্য পুত্রদের স্ত্রীকে বিবাহ করা বৈধ। এদেরকে নিজের পুত্র মনে করা যাবে না।
৪. নিজের পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলে ডাকা যাবে না। যদি কেউ এমনটি করে তাহলে সে যেন কুফরী করল।
৫. পোষ্য পুত্রদের সম্মুখেও পর্দা করতে হবে। ছেলে মনে করে তাদের নিকট খোলা মেলা চলাফেরা করা ঠিক নয়।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪-৫ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা উদ্দেশ্য বর্ণনা করার পূর্বে ভূমিকা ও প্রমাণের দৃষ্টান্ত স্বরূপ দু’একটি ঐ কথা বলেছেন যা সবাই অনুভব করে থাকে। অতঃপর সেদিক থেকে চিন্তা ও খেয়াল ফিরিয়ে নিজের উদ্দেশ্যের দিকে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেনঃ কোন মানুষের হৃদয় বা অন্তর দু’টি হয় না। এভাবেই তুমি বুঝে নাও যে, তুমি যদি তোমার কোন স্ত্রীকে মা বলে দাও তবে সে সত্যিই তোমার মা হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে অপরের পুত্রকে তুমি পুত্র বানিয়ে নিলে সে সত্যিকারের পুত্র হবে না। কেউ যদি ক্রোধের সময় তার স্ত্রীকে বলে ফেলেঃ তুমি আমার কাছে এমনই যেমন আমার মায়ের পিঠ। এরূপ বললে সে সত্যি সত্যিই মা হয়ে যাবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তারা তাদের মা নয়, তাদের মা তো তারাই যাদেরকে তারা জন্ম দিয়েছে বা প্রসব করেছে।” (৫৮:২) এ দু’টি কথা বর্ণনা করার পর মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হচ্ছে যে, মানুষের পালক পুত্র তার প্রকৃত পুত্র হতে পারে না। এ আয়াতটি হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) নবুওয়াতের পূর্বে তাঁকে পোষ্যপুত্র করে রেখেছিলেন। তাঁকে যায়েদ (রাঃ) ইবনে মুহাম্মাদ (সঃ) বলা হতো। এ আয়াত দ্বারা এ সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়াই উদ্দেশ্য। যেমন এই সূরারই মধ্যে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “মুহাম্মাদ (সঃ) তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নয়, রবং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (৩৩:৪০) এখানে মহান আল্লাহ বলেনঃ এটা তো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। তোমরা কারো ছেলেকে অন্য কারো ছেলে বলবে এবং এভাবেই বাস্তব পরিবর্তন হয়ে যাবে এটা হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে তার পিতা সেই যার পিঠ হতে সে বের হয়েছে। একটি ছেলের দু’টি পিতা হওয়া অসম্ভব, যেমন একটি বক্ষে দু’টি অন্তর হওয়া অসম্ভব। আল্লাহ তা’আলা সত্য কথা বলে থাকেন ও সরল-সোজা পথ প্রদর্শন করে থাকেন।
এ আয়াতটি একটি কুরায়েশীর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যে প্রচার করে রেখেছিল যে, তার দুটি অন্তর আছে এবং দুটোই জ্ঞান ও বোধশক্তিতে পরিপূর্ণ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তার একথাকে খণ্ডন করে দেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা নামাযে দণ্ডায়মান ছিলেন, এমতাবস্থায় তিনি আতংকগ্রস্ত হলেন। তখন যেসব মুনাফিক তাঁর সাথে নামায পড়ছিল তারা পরস্পর বলাবলি করলো: “দেখো, তাঁর দু’টি অন্তর রয়েছে, একটি তোমাদের সাথে এবং অপরটি তাদের সাথে।” ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা (আরবি)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।
যুহরী (রঃ) বলেন যে, এটা শুধু দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা হয়েছে। অর্থাৎ যেমন কোন লোকের দু’টি অন্তর হয় না, তেমনই কোন ছেলের দু’টি পিতা হয় না। এ মুতাবেকই আমরাও এ আয়াতের তাফসীর করেছি। এসব ব্যাপারে মহামহিমান্বিত আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
পূর্বে তো এর অবকাশ ছিল যে, পালক পুত্রকে পালনকারীর দিকে সম্বন্ধ লাগিয়ে তার পুত্র বলে ডাকা যাবে। কিন্তু এখন ইসলাম এটাকে রহিত করে দিয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তাকে তার প্রকৃত পিতার দিকে সম্পর্ক লাগিয়ে ডাকতে হবে। ন্যায়, হক ও সত্য এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ “এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে আমরা হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে যায়েদ (রাঃ) ইবনে মুহাম্মাদ (সঃ) বলতাম। কিন্তু এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আমরা এটা বলা পরিত্যাগ করি। পূর্বে তো পালক পুত্রের ঐ সমুদয় হক থাকতো যা ঔরষজাত ছেলের থাকে।”
এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত সালেহ বিনতে সুহায়েল (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা সালিম (রাঃ)-কে মৌখিক পুত্র বানিয়ে রেখেছিলাম। এখন কুরআন তার ব্যাপারে ফায়সালা করে দিয়েছে। আমি এখন পর্যন্ত তার থেকে পর্দা করিনি। সে আসে এবং যায়। আমার স্বামী হযরত হুযাইফা (রাঃ) তার এভাবে যাতায়াতে কিছুটা অসন্তুষ্ট রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “তাহলে যাও, সালিম (রাঃ)-কে তোমার দুধ পান করিয়ে দাও। এতে তুমি তার উপর হারাম হয়ে যাবে (শেষ পর্যন্ত)।”
মোটকথা পূর্বের হুকুম রহিত হয়ে যায়। এখন পোষ্যপুত্রদের স্ত্রীদেরকে পোষ্যপুত্র রূপে গ্রহণকারীদের জন্যে বৈধ করে দেয়া হয়। অর্থাৎ তারা তাদের পোষ্যপুত্রদের স্ত্রীদেরকে বিয়ে করে নিতে পারে। হযরত যায়েদ (রাঃ) যখন তার স্ত্রী হযরত যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ)-কে তালাক দেন তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বিয়ে করে নেন এবং এভাবে মুসলমানরা একটি কঠিন সমস্যা হতে রক্ষা পেয়ে গেলেন। এর প্রতি লক্ষ্য রেখেই যেসব নারীকে বিয়ে করা হারাম তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এবং তোমাদের জন্যে অবৈধ বা নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরষজাত পুত্রদের স্ত্রীরা।” (৪:২৩) তবে এখানে দুগ্ধ সম্পৰ্কীয় ছেলেরাও ঔরষজাত ছেলেদের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হাদীস রয়েছে যে, দুধপানের কারণে ঐ সব আত্মীয় হারাম যা বংশের কারণে হারাম হয়ে থাকে। তবে কেউ যদি স্নেহ বশতঃ কাউকেও পুত্র বলে ডাকে তাহলে সেটা অন্য কথা, এতে কোন দোষ নেই।
মুসনাদে আহমাদ ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমাদের ন্যায় আবদুল মুত্তালিব বংশের ছোট বালকদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুযদালাফাহ হতে রাত্রেই জামরাতের দিকে বিদায় করে দেন এবং আমাদের উরুতে হাত বুলিয়ে বলেনঃ “হে আমার ছেলেরা!
সূর্যোদয়ের পূর্বে জামরাতের উপর কংকর মারবে না।” এটা দশম হিজরীর যিলহজ্ব মাসের ঘটনা। এটা প্রমাণ করছে যে, স্নেহের বাক্য ধর্তব্য নয়।
হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) যার ব্যাপারে এ হুকুম অবতীর্ণ হয়েছে, ৮ম হিজরীতে মূতার যুদ্ধে শহীদ হন। (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে ‘হে আমার প্রিয় পুত্র বলে সম্বোধন করতেন।”
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভ্রাতা ও বন্ধু।
উমরাতুল কাযার বছরে যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা হতে প্রত্যাবর্তন করেন তখন হযরত হামযা (রাঃ)-এর কন্যা তাকে চাচা বলে ডাকতে ডাকতে তার পিছনে পিছনে দৌড়তে শুরু করে। হযরত আলী (রাঃ) তখন তাকে ধরে হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেনঃ “এটা তোমার চাচাতো বোন, একে ভালভাবে রাখো।” তখন হযরত যায়েদ (রাঃ) ও হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাঃ) বলে উঠলেনঃ “এই শিশু কন্যার হকদার আমরাই। আমরাই একে লালন-পালন করবো।” হযরত আলী (রাঃ) প্রমাণ পেশ করলেন যে, সে তার চাচার মেয়ে। আর হযরত যায়েদ (রাঃ) বললেন যে, সে তার ভাই-এর কন্যা। হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাঃ) বললেন : “এটা আমার চাচার মেয়ে এবং তার চাচী আমার বাড়ীতেই আছে অর্থাৎ হযরত আসমা বিনতে উমায়েস (রাঃ)।” অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ ফায়সালা করলেন যে, এ কন্যা তার খালার কাছেই থাকবে, যেহেতু খালা মায়ের স্থলাভিষিক্তা। হযরত আলী (রাঃ)-কে তিনি বললেনঃ “তুমি আমার ও আমি তোমার।” হযরত জাফর (রাঃ)-কে বললেনঃ “তোমার আকৃতি ও চরিত্র তো আমার সাথেই সাদৃশ্যযুক্ত। হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে তিনি বললেনঃ “তুমি আমার ভাই ও আমার আযাদকৃত দাস।” এ হাদীসে বহু কিছু হুকুম রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ন্যায়ের হুকুম শুনিয়ে দিলেন, অথচ দাবীদারদেরকেও তিনি অসন্তুষ্ট করলেন না, বরং নম্র ভাষার মাধ্যমে তাঁদের অন্তর জয় করলেন। তিনি এ আয়াতের উপর আমল করতে গিয়ে হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে বললেনঃ “তুমি আমার ভাই ও বন্ধু।”
হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “এ আয়াত অনুযায়ী আমি তোমাদের দ্বীনী ভাই।” হযরত উবাই (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! যদি জানা যেতো যে, তার পিতা ছিল গাদা তবে অবশ্যই তার দিকে সে সম্পর্কিত হতো।”
হাদীসে এসেছে যে, যদি কোন লোক তার সম্পর্ক জেনে শুনে তার পিতা ছাড়া অন্যের দিকে জুড়ে দেয় তবে সে কুফরী করলো। এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, নিজেকে নিজের সঠিক ও প্রকৃত বংশ হতে সরিয়ে অন্য বংশের সাথে সম্পর্কিত করা খুব বড় পাপ।
এরপর বলা হচ্ছেঃ তোমরা যদি তোমাদের সাধ্যমত তাহকীক ও যাচাই করার পর কাউকেও কারো দিকে সম্পর্কিত কর এবং সেটা ভুল হয়ে যায় তবে এতে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না। কেননা, স্বয়ং আল্লাহ তাবারাক ওয়া। তাআলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা যেন বলিঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে অপরাধী করবেন না।” (২:২৮৬) সহীহ মুসলিমে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন বান্দা এ প্রার্থনা করে তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাই করলাম অর্থাৎ তোমাদের প্রার্থনা কবুল করে নিলাম।”
হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যদি বিচারক (বিচারের ব্যাপারে) ইজতেহাদ (সঠিকতায় পৌছার জন্যে চেষ্টা-তদবীর ও চিন্তা-ভাবনা করে এবং এতে সে সঠিকতায় পৌঁছে যায় তবে তার জন্যে দ্বিগুণ পুণ্য রয়েছে। আর যদি তার ইজতিহাদে ভুল হয়ে যায় তবে তার জন্যে রয়েছে একটি পুণ্য। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)
অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতের ভুল-চুক এবং যে কাজ তাদের দ্বারা জোরপূর্বক করিয়ে নেয়া হয় তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখানেও মহান আল্লাহ একথা বলার পর বলেনঃ কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে অপরাধ হবে।
কসম সম্পর্কেও ঐ একই কথা। উপরে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, নসব বা বংশ পরিবর্তনকারী কাফিরের পর্যায়ভুক্ত, সেখানেও বলা হয়েছে যে, এরূপ অপরাধ হবে জেনে শুনে করলে।
কুরআন কারীমের আয়াত, যার তিলাওয়াত বা পঠন এখন মানসূখ বা রহিত, তাতে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমাদের নিজেদের পিতাদের দিক হতে সম্পর্ক সরিয়ে নেয়া কুফরী।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তাঁর প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। তাতে রজমের আয়াত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজে রজম করেছেন অর্থাৎ ব্যভিচারের অপরাধে বিবাহিত পুরুষ ও বিবাহিতা নারীকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করেছেন। আমরাও তার পরে রজম করেছি।” অতঃপর তিনি বলেনঃ “আমরা পাঠ করতাম কুরআন কারীমের (আরবি)-এ আয়াতটি (যার পঠন এখন রহিত হয়ে গেছে)।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আমার প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ)-এর প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা হয়েছিল। আমি তো আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলবে।” একটি রিওয়াইয়াতে শুধু ইবনে মারইয়াম (আঃ) আছে। আর একটি হাদীসে আছে যে, মানুষের মধ্যে তিনটি কুফরী (স্বভাব) রয়েছে। এগুলো হচ্ছেঃ বংশকে ভৎর্সনা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, মৃতের উপর ক্রন্দন করা এবং তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1048/What is Munafiqn:-31)
[A person can’t be same time Muminin and Munafiq:-]
www.motaher21.net
Sura:33:Al-Ahzaab
Para:21
Ayat: – 4-5
33:4
مَا جَعَلَ اللّٰہُ لِرَجُلٍ مِّنۡ قَلۡبَیۡنِ فِیۡ جَوۡفِہٖ ۚ وَ مَا جَعَلَ اَزۡوَاجَکُمُ الّٰٓیِٴۡ تُظٰہِرُوۡنَ مِنۡہُنَّ اُمَّہٰتِکُمۡ ۚ وَ مَا جَعَلَ اَدۡعِیَآءَکُمۡ اَبۡنَآءَکُمۡ ؕ ذٰلِکُمۡ قَوۡلُکُمۡ بِاَفۡوَاہِکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ یَقُوۡلُ الۡحَقَّ وَ ہُوَ یَہۡدِی السَّبِیۡلَ ﴿۴﴾
Allah has not made for a man two hearts in his interior. And He has not made your wives whom you declare unlawful your mothers. And he has not made your adopted sons your [true] sons. That is [merely] your saying by your mouths, but Allah says the truth, and He guides to the [right] way.
Abolition of Adoption
Before Allah discusses ideas and theoretical matters, He gives tangible examples:one man cannot have two hearts in his body, and a man’s wife does not become his mother if he says the words of Zihar to her:”You are to me like the back of my mother.” By the same token, an adopted child does not become the son of the man who adopts him and calls him his son.
Allah says:
مَّا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ مِّن قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ وَمَا جَعَلَ أَزْوَاجَكُمُ اللَّايِي تُظَاهِرُونَ مِنْهُنَّ أُمَّهَاتِكُمْ
Allah has not made for any man two hearts inside his body. Neither has He made your wives whom you declare to be like your mothers’ backs, your real mothers…
This is like the Ayah:
مَّا هُنَّ أُمَّهَـتِهِمْ إِنْ أُمَّهَـتُهُمْ إِلاَّ اللَّيِى وَلَدْنَهُمْ
They cannot be their mothers. None can be their mothers except those who gave them birth. (58:2)
وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءكُمْ أَبْنَاءكُمْ
nor has He made your adopted sons your real sons.
This was revealed concerning Zayd bin Harithah, may Allah be pleased with him, the freed servant of the Prophet. The Prophet had adopted him before Prophethood, and he was known as Zayd bin Muhammad. Allah wanted to put an end to this naming and attribution, as He said:
وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءكُمْ أَبْنَاءكُمْ
nor has He made your adopted sons your real sons.
This is similar to the Ayah later in this Surah:
مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَأ أَحَدٍ مّن رِّجَالِكُمْ وَلَـكِن رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيماً
Muhammad is not the father of any of your men, but he is the Messenger of Allah and the last (end) of the Prophets. And Allah is Ever All-Aware of everything. (33:40)
And Allah says here:
ذَلِكُمْ قَوْلُكُم بِأَفْوَاهِكُمْ
That is but your saying with your mouths.
meaning, `your adoption of him is just words, and it does not mean that he is really your son,’ for he was created from the loins of another man, and a child cannot have two fathers just as a man cannot have two hearts in one body.
وَاللَّهُ يَقُولُ الْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِي السَّبِيلَ
But Allah says the truth, and He guides to the way.
Sa`id bin Jubayr said:
يَقُولُ الْحَقَّ
(But Allah says the truth) means, justice.
Qatadah said:
وَهُوَ يَهْدِي السَّبِيلَ
(and He guides to the way) means, the straight path.
Imam Ahmad said that Hasan told them that Zuhayr told them from Qabus, meaning Ibn Abi Zibyan, that his father told him:
“I said to Ibn Abbas, `Do you know the Ayah,
مَّا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ مِّن قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ
(Allah has not made for any man two hearts inside his body). What does this mean?’
He said that the Messenger of Allah stood up one day to pray, and he trembled. The hypocrites who were praying with him said,
`Do you not see that he has two hearts, one heart with you and another with them.’
Then Allah revealed the words:
مَّا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ مِّن قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ
(Allah has not made for any man two hearts inside his body).”
This was also narrated by At-Tirmidhi, who said, “It is a Hasan Hadith”.
It was also narrated by Ibn Jarir and Ibn Abi Hatim from the Hadith of Zuhayr.
An Adopted Child should be named after His Real Father
Allah commands;
33:5
اُدۡعُوۡہُمۡ لِاٰبَآئِہِمۡ ہُوَ اَقۡسَطُ عِنۡدَ اللّٰہِ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ تَعۡلَمُوۡۤا اٰبَآءَہُمۡ فَاِخۡوَانُکُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ مَوَالِیۡکُمۡ ؕ وَ لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ فِیۡمَاۤ اَخۡطَاۡتُمۡ بِہٖ ۙ وَ لٰکِنۡ مَّا تَعَمَّدَتۡ قُلُوۡبُکُمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۵﴾
Call them by [the names of] their fathers; it is more just in the sight of Allah . But if you do not know their fathers – then they are [still] your brothers in religion and those entrusted to you. And there is no blame upon you for that in which you have erred but [only for] what your hearts intended. And ever is Allah Forgiving and Merciful.
ادْعُوهُمْ لاِبَايِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ
Call them (adopted sons) by their fathers, that is more just with Allah.
This is a command which abrogates the state of affairs that existed at the beginning of Islam, when it was permitted to call adopted sons after the man who adopted them. Then Allah commanded that they should be given back the names of their real fathers, and states that this was more fair and just.
Al-Bukhari (may Allah have mercy on him) narrated that Abdullah bin Umar said:
“Zayd bin Harithah, may Allah be pleased with him, the freed servant of the Messenger of Allah, was always called Zayd bin Muhammad, until (the words of the) Qur’an were revealed:
ادْعُوهُمْ لاِبَايِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّه
(Call them (adopted sons) by (the names of) their fathers, that is more just with Allah).”
This was also narrated by Muslim, At-Tirmidhi and An-Nasa’i.
They used to deal with them as sons in every respect, including being alone with them as Mahrams and so on. Hence Sahlah bint Suhayl, the wife of Abu Hudhayfah, may Allah be pleased with them both, said:”O Messenger of Allah! We used to call Salim our son, but Allah has revealed what He has revealed. He used to enter upon me, but I feel that Abu Hudhayfah does not like that.
The Prophet said:
أَرْضِعِيهِ تَحْرُمِي عَلَيْه
Breastfeed him and he will become your Mahram.”
Hence when this ruling was abrogated, Allah made it permissible for a man to marry the ex-wife of his adopted son, and the Messenger of Allah married Zaynab bint Jahsh, the divorced wife of Zayd bin Harithah, may Allah be pleased with him,
Allah said:
لِكَىْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُوْمِنِينَ حَرَجٌ فِى أَزْوَاجِ أَدْعِيَأيِهِمْ إِذَا قَضَوْاْ مِنْهُنَّ وَطَراً
So that (in future) there may be no difficulty to the believers in respect of the wives of their adopted sons when the latter have no desire to keep them. (33:37)
And Allah says in Ayat At-Tahrim:
وَحَلَـيِلُ أَبْنَأيِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلَـبِكُمْ
The wives of your sons from your own loins. (4:23)
The wife of an adopted son is not included because he was not born from the man’s loins.
A “foster” son through breastfeeding is the same as a son born from one’s own loins, from the point of view of Shariah, because the Prophet said in the Two Sahihs:
حَرَّمُوا مِنَ الرَّضَاعَةِ مَا يُحَرَّمُ مِنَ النَّسَب
Suckling makes unlawful as lineage does.
As for calling a person “son” as an expression of honor and endearment, this is not what is forbidden in this Ayah, as is indicated by the report recorded by Imam Ahmad and the Sunan compilers — apart from At-Tirmidhi — from Ibn Abbas, may Allah be pleased with him, who said:
“We young boys of Banu Abd Al-Muttalib came to the Messenger of Allah at the Jamarat; he slapped us on the thigh and said,
أُبَيْنِيَّ لَاأ تَرْمُوا الْجَمْرَةَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْس
O my sons, do not stone the Jamarah until the sun has risen.
This was during the Farewell Pilgrimage in 10 AH.
ادْعُوهُمْ لاِبَايِهِمْ
(Call them by their fathers). This is concerning Zayd bin Harithah, may Allah be pleased with him. He was killed in 8 AH at the battle of Mu’tah.
In Sahih Muslim it is reported that Anas bin Malik, may Allah be pleased with him, said:
“The Messenger of Allah said:
يَابَنِي
O my son.”
It was also reported by Abu Dawud and At-Tirmidhi.
فَإِن لَّمْ تَعْلَمُوا ابَاءهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيكُمْ
But if you know not their father’s then they are your brothers in the religion and Mawalikum (your freed servants).
Here Allah commands that adopted sons should be given back their fathers’ names, if they are known; if they are not known, then they should be called brothers in faith or freed servants, to compensate for not knowing what their real lineage is.
When the Messenger of Allah left Makkah after performing his Umrat Al-Qada’, the daughter of Hamzah, may Allah be pleased with her, started following him, calling, “O uncle, O uncle!”
Ali took her and said to Fatima, may Allah be pleased with her, “Take care of your uncle’s daughter,” so she picked her up.
Ali, Zayd and Jafar — may Allah be pleased with them — disputed over of which of them was going to take care of her, and each of them gave his reasons.
Ali said, “I have more right, because she is the daughter of my paternal uncle.”
Zayd said, “She is the daughter of my brother.”
Jafar bin Abi Talib said:”She is the daughter of my paternal uncle and I am married to her maternal aunt — meaning Asma’ bint `Umays.”
The Prophet ruled that she should stay with her maternal aunt, and said:
الْخَالَةُ بِمَنْزِلَةِ الاُْم
The maternal aunt has the same status as the mother.
He said to Ali, may Allah be pleased with him,
أَنْتَ مِنِّي وَأَنَا مِنْك
You belong to me and I belong to you.
He said to Jafar, may Allah be pleased with him,
أَشْبَهْتَ خَلْقِي وَخُلُقِي
You resemble me both in your looks and in your attitude.
And he said to Zayd, may Allah be pleased with him,
أَنْتَ أَخُونَا وَمَوْلَانَا
You are our brother and our freed servant.
This Hadith contains a number of rulings, the most important of which is that the Prophet ruled according to the truth, and that he sought to appease all the disputing parties. His saying to Zayd, may Allah be pleased with him,
أَنْتَ أَخُونَا وَمَوْلَانَا
(You are our brother and our freed servant), is as Allah says in this Ayah:
فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيكُمْ
(your brothers in faith and your freed servants).
Then Allah says:
وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُم بِهِ
And there is no sin on you concerning that in which you made a mistake,
meaning, if you call one of them after someone who is not in fact his father, by mistake, after trying your best to find out his parentage, then Allah will not attach any sin to this mistake.
This is like the Ayah in which Allah commands His servants to say:
رَبَّنَا لَا تُوَاخِذْنَأ إِن نَّسِينَأ أَوْ أَخْطَأْنَا
Our Lord! Punish us not if we forget or fall into error. (2:286)
It was reported in Sahih Muslim that the Messenger of Allah said:
قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ فَعَلْت
Allah says, “Certainly I did (so).”
In Sahih Al-Bukhari, it was recorded that Amr bin Al-`As, may Allah be pleased with him, said:
“The Messenger of Allah said:
إِذَا اجْتَهَدَ الْحَاكِمُ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ
وَإِنِ اجْتَهَدَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْر
If the judge makes Ijtihad and reaches the right decision, he will have two rewards;
if he makes Ijtihad and reaches the wrong decision, he will have one reward.
In another Hadith:
إِنَّ اللهَ تَعَالى رَفَعَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأَ وَالنِّسْيَانَ وَمَا يُكْرَهُونَ عَلَيْه
Allah will forgive my Ummah for mistakes, forgetfulness and what they are forced to do.
And Allah says here:
وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُم بِهِ وَلَكِن مَّا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ
وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
And there is no sin on you concerning that in which you made a mistake, except in regard to what your hearts deliberately intend. And Allah is Ever Oft-Forgiving, Most Merciful.
meaning, the sin is on the person who deliberately does something wrong, as Allah says elsewhere:
لااَّ يُوَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِالَّلغْوِ فِى أَيْمَـنِكُمْ
Allah will not call you to account for that which is unintentional in your oaths. (2:225)
Imam Ahmad narrated from Ibn Abbas that Umar said:
“Allah sent Muhammad with the Truth and revealed to him the Book. One of the things that was revealed in it was the Ayah of stoning, so the Messenger of Allah stoned (adulterers) and we stoned (them) after he died.”
Then he said,
“We also used to recite, `Do not attribute yourselves to anyone other than your fathers, for this is disbelief, to attribute yourselves to anyone other than your fathers.”‘
The Messenger of Allah said:
لَاا تُطْرُونِي كَمَا أُطْرِيَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُاللهِ فَقُولُوا عَبْدُهُ وَرَسُولُه
Do not exaggerate in praising me as `Isa bin Maryam was praised upon him be peace and blessings. I am just a servant of Allah. Say, “He is His servant and Messenger.”
Or Ma`mar may have said:
كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَم
As the Christians praised the son of Maryam.
This was also narrated in another Hadith:
ثَلَثٌ فِي النَّاسِ كُفْرٌ
الطَّعْنُ فِي النَّسَبِ
وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ
وَالاْاسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُوم
Three things that people do are parts of disbelief:
slandering a person’s lineage,
wailing over the dead and
seeking rain by the stars.
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran