أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৪৯)
[নিঃসন্দেহে নবী ঈমানদারদের কাছে তাদের নিজেদের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক প্রিয়:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৩:আহযাব
পারা:২১
৬-৮ নং আয়াত:-
৩৩:৬
اَلنَّبِیُّ اَوۡلٰی بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ مِنۡ اَنۡفُسِہِمۡ وَ اَزۡوَاجُہٗۤ اُمَّہٰتُہُمۡ ؕ وَ اُولُوا الۡاَرۡحَامِ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلٰی بِبَعۡضٍ فِیۡ کِتٰبِ اللّٰہِ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُہٰجِرِیۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ تَفۡعَلُوۡۤا اِلٰۤی اَوۡلِیٰٓئِکُمۡ مَّعۡرُوۡفًا ؕ کَانَ ذٰلِکَ فِی الۡکِتٰبِ مَسۡطُوۡرًا ﴿۶﴾
নিঃসন্দেহে নবী ঈমানদারদের কাছে তাদের নিজেদের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক প্রিয়।আর নবীদের স্ত্রীগণ তাদের মা।১৩ কিন্তু আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে সাধারণ মু’মিন ও মুহাজিরদের তুলনায় আত্মীয়রা পরস্পরের বেশি হকদার। তবে নিজেদের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কোন সদ্ব্যবহার তোমরা করতে পারো। আল্লাহর কিতাবে এ বিধান লেখা আছে।
৩৩:৭
وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِنَ النَّبِیّٖنَ مِیۡثَاقَہُمۡ وَ مِنۡکَ وَ مِنۡ نُّوۡحٍ وَّ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسَی ابۡنِ مَرۡیَمَ ۪ وَ اَخَذۡنَا مِنۡہُمۡ مِّیۡثَاقًا غَلِیۡظًا ۙ﴿۷﴾
আর হে নবী! স্মরণ করো সেই অঙ্গীকারের কথা যা আমি নিয়েছি সকল নবীর কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারয়াম পুত্র ঈসার কাছ থেকেও। সবার কাছ থেকে আমি নিয়েছি পাকাপোক্ত অলংঘনীয় অঙ্গীকার।
৩৩:৮
لِّیَسۡـَٔلَ الصّٰدِقِیۡنَ عَنۡ صِدۡقِہِمۡ ۚ وَ اَعَدَّ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابًا اَلِیۡمًا ٪﴿۸﴾
সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করার জন্য। আর তিনি কাফিরদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা দিচ্ছেন যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মু’মিনদের নিজেদের অপেক্ষা তাদের নিকট অধিক ঘনিষ্ঠতর। তাদের নিজেদের চেয়ে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের জন্য অধিক কল্যাণকামী, এবং তাদের প্রতি স্নেহপরায়ণ। মানুষ নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমার ও আমার উম্মাতের দৃষ্টান্ত হল ঐ ব্যক্তির ন্যায়-যে আগুন প্রজ্জ্বলিত করল, ফলে কীট-পতঙ্গ তাতে এসে পড়তে লাগল, তোমরাও আগুনে পড়তেছিলে, আর আমি তোমাদেরকে বাধা দিচ্ছিলাম। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪২৭, সহীহ মুসলিম হা: ২২৮৪) সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন বিষয়ে তাদেরকে যে সিদ্ধান্ত দেবেন তাই তাদেরকে মনে নিতে হবে। কোন প্রকার দ্বিমত পোষণ করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُوْنَ حَتّٰي يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوْا فِيْٓ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا)
“কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মু’মিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের মধ্যে বিবদমান বিষয়ের বিচারভার তোমার ওপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা থাকে এবং সম্পূর্ণরূপে তা মেনে না নেয়।” (সূরা নিসা ৪:৬৫)
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে। তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার নিকট তার নিজের থেকে, তার সম্পদ থেকে, তার সন্তান-সন্ততি থেকে এবং সমস্ত জিনিস থেকে অধিক প্রিয় না হই। (সহীহ বুখারী হা: ১৫)
উমার (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: হে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহ তা‘আলার শপথ আপনি আমার নিকট সকল জিনিস থেকে বেশি প্রিয়। কিন্তু নিজের জীবনের চেয়ে বেশি নন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: হে উমার! তোমরা জীবন থেকেও আমাকে বেশি না ভালবাসা পর্যন্ত তুমি মু’মিন হতে পারবে ন। তখন উমার (রাঃ) বললেন: হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি আমার নিকট সকল জিনিস থেকে প্রিয় এমনকি নিজের জীবন থেকেও। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: এখন তুমি মু’মিন হয়েছো। (সহীহ বুখারী হা: ৬৬৩২)
ইমাম বুখারী (رحمه الله) এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন: আবূ হুরাইরাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: দুনিয়া ও পরকালে সমস্ত মানুষের চেয়ে মু’মিনের জন্য আমিই ঘনিষ্ঠতম। তোমরা ইচ্ছা করলে:
(اَلنَّبِيُّ أَوْلٰي بِالْمُؤْمِنِيْنَ) এ আয়াতটি পড়তে পার। সুতরাং কোন মু’মিন ব্যক্তি যদি সম্পদ রেখে মৃত্যু বরণ করে তাহলে তার হকদার হবে তার উত্তরাধিকারীরা। আর যদি কোন মু’মিন ব্যক্তি ঋণ অথবা অসহায় সন্তানাদি রেখে মারা যায় তাহলে সে যেন আমার কাছেই আসে, আমি তার অভিভাবক। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৮১, সহীহ মুসলিম হা: ১৬১৯)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদের বিধান দিয়ে বলেন, নাবীপত্মীগণ মু’মিনদের মাতৃতুল্য। আর এ মাতৃতুল্য হল হুরমাত ও সম্মানের ক্ষেত্রে; জন্মদাতা মাতা হিসেবে নয়, তাদেরকে বিবাহ করা হারাম এবং তাদের সাথে পর্দা করা ওয়াজিব যেমন অত্র সূরার ৫৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যেতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মু’মিনদের পিতৃতুল্য। যেমন হাদীসে এসেছে: আবূ হুরাইরাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমি তোমাদের জন্য তোমাদের পিতাদের স্থলাভিষিক্ত আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছি যে, তোমাদের কেউ পায়খানায় গেলে কিবলার দিকে যেন মুখ এবং পিঠ না করে বসে। ডান হাতে যেন ঢিলা ব্যবহার না করে এবং ডান হাতে যেন ইসতিনজাও না করে। (আবূ দাঊদ হা: ৮, নাসায়ী হা: ৪০, ইবনু মাযাহ হা: ৩১৩, সহীহ)
তবে এ পিতা ধর্মীয় দিক দিয়ে পিতা, জন্মদাতা হিসেবে নয়। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন পুরুষের পিতা নন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَلٰكِنْ رَّسُوْلَ اللّٰهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ ط وَكَانَ اللّٰهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمًا)
“মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদের মধ্যকার কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং তিনি আল্লহর রাসূল এবং সর্বশেষ নাবী। আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (সূরা আহযাব ৩৩:৪০)
সুতরাং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধর্মীয় দিক দিয়ে মু’মিনদের পিতা এবং তাঁর স্ত্রীগণ হলেন মাতা। তারা প্রকৃত জন্মদাতা পিতা-মাতা নন। তাই তাদের কন্যাদেরকে বিবাহ করা বৈধ।
(وَأُولُوا الْأَرْحَامِ)
এখানে মূলত ইসলামের প্রথম যুগে যে বিধান কার্যকর ছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, মুহাজিরগণ কোন প্রকার বংশীয় সম্পর্ক ব্যতিরেকেই আনসারদের মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তির ওয়ারিশ হত। আর এদিক দিয়ে তারা ছিল একে অপরের খুবই নিকটাত্মীয়। কিন্তু পরবর্তীতে মিরাসের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর এ বিধান বাতিল হয়ে যায়। তবে একটি পথ খোলা থাকে, তা হল কেউ যদি কাউকে সাহায্য, অনুগ্রহ বা সহযোগিতা, সদাচরণবশত কিছু দিতে চায় তাহলে অসিয়তের মাধ্যমে দিতে পারবে। এ সম্পর্কে সূরা আনফালের শেষ আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল জিনিস থেকে এমনকি নিজের জীবন থেকেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বেশি ভালবাসতে হবে। অন্যথায় মু’মিন হওয়া যাবে না। আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হলো তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ করা।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদেরকে মায়ের মত সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।
৪. কেউ যদি কাউকে সাহায্য করণার্থে তার সম্পত্তি থেকে কিছু দিতে চায় তাহলে সেক্ষেত্রে ওয়ারিশ ব্যতীত অন্যদের ক্ষেত্রে অসিয়ত করতে পারবে। কিন্তু ওয়ারীশদের ক্ষেত্রে অসিয়ত গ্রহণ যোগ্য হবে না।
৫. একজন মু’মিন ব্যক্তি অন্য মু’মিনকে নিজের নিকটাত্মীয়দের মত এমনকি নিজের ভাইয়ের মত মনে করতে হবে।
৭-৮ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সকল নাবীদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন, বিশেষ করে পাঁচজন “উলূল আযম” রাসূলদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। নাবীদের থেকে নেয়া অঙ্গীকার সাধারণ মানুষ থেকে নেয়া অঙ্গীকার থেকে ভিন্ন। নাবীদের থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল তারা একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে, সত্যায়িত করবে ও দীন প্রতিষ্ঠা করবে এবং তাতে বিভক্ত হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِذْ أَخَذَ اللّٰهُ مِيْثَاقَ النَّبِيِّيْنَ لَمَآ اٰتَيْتُكُمْ مِّنْ كِتٰبٍ وَّحِكْمَةٍ ثُمَّ جَا۬ءَكُمْ رَسُوْلٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِه۪ وَلَتَنْصُرُنَّه۫ ط قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلٰي ذٰلِكُمْ إِصْرِيْ ط قَالُوْآ أَقْرَرْنَا ط قَالَ فَاشْهَدُوْا وَأَنَا مَعَكُمْ مِّنَ الشّٰهِدِيْنَ)
“আর স্মরণ কর যখন আল্লাহ নাবীদের কাছ থেকে এ ওয়াদা নিয়েছেন যে, আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হেকমত দান করেছি অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যায়নকারীরূপে কোন রাসূল আগমন করবে তখন তোমরা তার ওপর অবশ্যই ঈমান আনবে ও সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ) বললেন: তোমরা কি স্বীকার করেছ? এবং এ বিষয়ে আমার ওয়াদা গ্রহণ করেছ? তারা (নাবীরা) উত্তরে বললেন: আমরা স্বীকার করলাম। আল্লাহ বললেন: তাহলে তোমরা সাক্ষী থাক আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষ্যদানকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আলি ইমরান ৩:৮১)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصّٰي بِه۪ نُوْحًا وَّالَّذِيْٓ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِه۪ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسٰي وَعِيْسٰيٓ أَنْ أَقِيْمُوا الدِّيْنَ وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ)
“তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন দীন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে আর যা আমি ওয়াহী করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে, এই বলে যে, তোমরা এই দীনকে (তাওহীদকে) প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে মতভেদ কর না।” (সূরা শুরা ৪২:১৩)
উক্ত অঙ্গীকার যদিও সকল আম্বিয়াগণের থেকে নিয়েছেন কিন্তু এখানে বিশেষভাবে পাঁচজন আম্বিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে তাদের গুরুত্ব ও মর্যাদা সুস্পষ্ট হয়। পরন্তু এতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উল্লেখ সর্বপ্রথম করা হয়েছে অথচ নবুওয়াত প্রাপ্তির দিক দিয়ে তিনি সর্বশেষ নাবী। সুতরাং এতে যে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মহত্ত্ব ও মর্যাদা সবার চেয়ে অধিকরূপে প্রকাশ পাচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
আর আল্লাহ তা‘আলা সর্বসাধারণের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, তারা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করবে। আর তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। এ অঙ্গীকর যারা পূর্ণ করবে তাদের জন্য জান্নাত আর যারা ভঙ্গ করবে তাদের জন্যই জাহান্নাম। এ অঙ্গীকার সংক্রান্ত আলোচনা সূরা আলি ইমরানের ৮১-৮২ নং আয়াতে করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পাঁচজন মর্যাদাসম্পন্ন নাবী সম্পর্কে জানতে পারলাম।
২. মানব জাতি আল্লাহ তা‘আলার নিকট অঙ্গীকারাবদ্ধ যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না।
৩. নাবীদেরকে পরকালে জিজ্ঞেস করা হবে যে, তাদের উম্মাতেরা তাদের দাওয়াতের কী উত্তর দিয়েছিল।
৪. পর্যায়ক্রমে নাবী প্রেরণ করা হয়েছে একজন দ্বারা অন্যজনের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মুসলমানদের এবং মুসলমানদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সম্পর্ক তা অন্যান্য সমস্ত মানবিক সম্পর্কের উর্ধ্বে এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক। নবী ও মু’মিনদের মধ্যে যে সম্পর্ক বিরাজিত, অন্য কোন আত্মীয়তা ও সম্পর্ক তার সাথে কোন দিক দিয়ে সামান্যতমও তুলনীয় নয়। নবী ﷺ মুসলমানদের জন্য তাদের বাপ-মায়ের, চাইতেও বেশী স্নেহশীল ও দয়াদ্র হৃদয় এবং তাদের নিজেদের চাইতেও কল্যাণকামী। তাদের বাপ-মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা তাদের ক্ষতি করতে পারে, তাদের সাথে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করতে পারে, তাদেরকে বিপথে পরিচালিত করতে পারে, তাদেরকে দিয়ে অন্যায় কাজ করাতে পারে, তাদেরকে জাহান্নামে ঠেলে দিতে পারে, কিন্তু নবী ﷺ তাদের পক্ষে কেবলমাত্র এমন কাজই করতে পারেন যাতে তাদের সত্যিকারের সাফল্য অর্জিত হয়। তারা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে পারে, বোকামি করে নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করতে পারে কিন্তু নবী ﷺ তাদের জন্য তাই করবেন যা তাদের জন্য লাভজনক হয়। আসল ব্যাপার যখন এই তখন মুসলমানদের ওপরও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ অধিকার আছে যে, তারা তাঁকে নিজেদের বাপ-মা ও সন্তানদের এবং নিজেদের প্রাণের চেয়েও বেশী প্রিয় মনে করবে। দুনিয়ার সকল জিনিসের চেয়ে তাঁকে বেশী ভালোবাসবে। নিজেদের মতামতের ওপর তাঁর মতামতকে এবং নিজেদের ফায়সালার ওপর তাঁর ফায়সালাকে প্রাধান্য দেবে। তাঁর প্রত্যেকটি হুকুমের সামনে মাথা নত করে দেবে। বুখারী ও মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ তাদের হাদীস গ্রন্থে সামান্য শাব্দিক পরিবর্তন সহকারে এ বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছেঃ
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
“তোমাদের কোন ব্যক্তি মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষের চাইতে বেশী প্রিয় হই।”
# ওপরে বর্ণিত এ একই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, মুসলমানদের নিজেদের পালক মাতা কখনো কোন অর্থেই তাদের মা নয় কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ ঠিক তেমনিভাবে তাদের জন্য হারাম যেমন তাদের আসল মা তাদের জন্য হারাম। এ বিশেষ বিধানটি নবী ﷺ ছাড়া দুনিয়ার আর কোন মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে এ কথাও জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ শুধু মাত্র এ অর্থে মু’মিনদের মাতা যে, তাঁদেরকে সম্মান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব এবং তাঁদের সাথে কোন মুসলমানের বিয়ে হতে পারে না। বাদবাকি অন্যান্য বিষয়ে তাঁরা মায়ের মতো নন। যেমন তাদের প্রকৃত আত্মীয়গণ ছাড়া বাকি সমস্ত মুসলমান তাদের জন্য গায়ের মাহরাম ছিল এবং তাঁদের থেকে পর্দা করা ছিল ওয়াজিব। তাঁদের মেয়েরা মুসলমানদের জন্য বৈপিত্রেয় বোন ছিলেন না, যার ফলে তাদের সাথে মুসলমানদের বিয়ে নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাঁদের ভাই ও বোনেরা মুসলমানদের জন্য মামা ও খালার পর্যায়ভুক্ত ছিলেন না। কোন ব্যক্তি নিজের মায়ের তরফ থেকে যে মীরাস লাভ করে তাঁদের তরফ থেকে কোন অনাত্মীয় মুসলমান সে ধরনের কোন মীরাস লাভ করে না।
এখানে আর একটি কথাও উল্লেখযোগ্য। কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সকল স্ত্রীই এই মর্যাদার অধিকারী। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাও এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু একটি দল যখন হযরত আলী ও ফাতেমা রাদিয়াল্লাহ আনহা এবং তাঁর সন্তানদেরকে দ্বীনের কেন্দ্রে পরিণত করে সমগ্র ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে তাঁদের চারপাশে ঘোরাতে থাকে এবং এরই ভিত্তিতে অন্যান্য বহু সাহাবার সাথে হযরত আয়েশাকেও নিন্দাবাদ ও গালাগালির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তখন কুরআন মজীদের এ আয়াত তাদের পথে প্রতিরোধ দাঁড় করায়। কারণ এ আয়াতের প্রেক্ষিতে যে ব্যক্তিই ঈমানের দাবীদার হবে সে-ই তাঁকে মা বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য। শেষমেষ এ সংকট থেকে রেহাই পাওয়ার উদ্দেশ্যে এ অদ্ভুত দাবী করা হয়েছে যে, নবী করীম ﷺ হযরত আলীকে এ ইখতিয়ার দিয়েছিলেন যে, তাঁর ইন্তিকালের পর তিনি তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের মধ্য থেকে যাঁকে চান তাঁর স্ত্রীর মর্যাদায় টিকিয়ে রাখতে পারেন এবং যাঁকে চান তাঁর পক্ষ থেকে তালাক দিতে পারেন। আবু মনসুর আহমাদ ইবনে আবু তালেব তাবরাসী কিতাবুল ইহ্তিজাজে যে কথা লিখেছেন এবং সুলাইমান ইবনে আবদুল্লাহ আলজিরানী যা উদ্ধৃত করেছেন তা হচ্ছে এই যে, নবী ﷺ হযরত আলীকে বলেনঃ
يا ابا الحسن ان هذا الشرف باق مادمنا على طاعة الله تعالى فايتهن عصت الله تعالى بعدى بالخروج عليك فطلقها من الازواج واسقطها من شرف امهات الؤمنين- “হে আবুল হাসান! এ মর্যাদা ততক্ষণ অক্ষুণ্ন থাকবে যতক্ষণ আমরা আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবো। কাজেই আমার স্ত্রীদের মধ্য থেকে যে কেউ আমার পরে তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আল্লাহর নাফরমানি করবে তাকে তুমি তালাক দিয়ে দেবে এবং তাদেরকে মু’মিনদের মায়ের মর্যাদা থেকে বহিস্কার করবে।”
হাদীস বর্ণনার রীতি ও মূলনীতির দিক দিয়ে তো এ রেওয়ায়াতটি সম্পুর্ন ভিত্তিহীন। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি এ সূরার ২৮-২৯ এবং ৫১ ও ৫২ আয়াত ৪টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে তিনি জানতে পারবেন যে, এ রেওয়ায়াতটি কুরআনেরও বিরোধী। কারণ ইখ্তিয়ার সম্পর্কিত আয়াতের পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সকল স্ত্রী সর্বাবস্থায় তাঁর সাথে থাকা পছন্দ করেছিলেন তাঁদেরকে তালাক দেবার ইখ্তিয়ার আর রসুলের ﷺ হাতে ছিল না। সামনের দিকে ৪২ ও ৯৩ টীকায় এ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা আসছে।
এছাড়াও একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিই ব্যবহার করে এ রেওয়ায়াতটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলেও তিনি পরিষ্কার দেখতে পাবেন এটি একটি চরম ভিত্তিহীন এবং রসূলে পাকের বিরুদ্ধে অত্যন্ত অবমাননাকর মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। রসূল তো অতি উন্নত ও শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার অধিকারী, তাঁর কথাই আলাদা, এমন কি একজন সাধারণ ভদ্রলোকের কাছেও এ আশা করা যেতে পারে না যে, তিনি মারা যাবার পর তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেবার কথা চিন্তা করবেন এবং দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার সময় নিজের জামাতাকে এই ইখ্তিয়ার দিয়ে যাবেন যে, যদি কখনো তার সাথে তোমার ঝগড়া হয় তাহলে তুমি আমার পক্ষ থেকে তাকে তালাক দিয়ে দেবে। এ থেকে জানা যায়, যারা আহ্লে বায়তের প্রেমের দাবীদার তারা গৃহস্বামীর (সাহেবে বায়েত) ইজ্জত ও আবরুর কতোটা পরোয়া করেন। আর এরপর তারা মহান আল্লাহর বাণীর প্রতিও কতটুকু মর্যাদা প্রদর্শন করেন সেটিও দেখার বিষয়।
# এ আয়াতে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তো মুসলমানদের সম্পর্কের ধরন ছিল সবকিছু থেকে আলাদা। কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এমন নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে যার ফলে আত্মীয়দের অধিকার পরস্পরের ওপর সাধারণ লোকদের তুলনায় অগ্রগণ্য হয়। নিজের মা-বাপ, সন্তান-সন্ততি ও ভাইবোনদের প্রয়োজন পূর্ণ না করে বাইরে দান-খয়রাত করে বেড়ালে তা সঠিক গণ্য হবে না। যাকাতের মাধ্যমে প্রথমে নিজের গরীব আত্বীয় স্বজনদেরকে সাহায্য করতে হবে এবং তারপর অন্যান্য হকদারকে দিতে হবে। মীরাস অপরিহার্যভাবে তারাই লাভ করবে যারা হবে মৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়। অন্যদেরকে সে চাইলে (জীবিতাবস্থায়) হেবা, ওয়াকফ বা অসিয়াতের মাধ্যমে নিজের সম্পদ দান করতে পারে। কিন্তু এও ওয়ারিসদেরকে বঞ্চিত করে সে সবকিছু অন্যদেরকে দিয়ে যেতে পারে না। হিজরাতের পর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছিল, যার প্রেক্ষিতে নিছক দ্বীনী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের ভিত্তিতে মুহাজির ও আনসারগণ পরস্পরের ওয়ারিস হতেন, এ হুকুমের মাধ্যমে তাও রহিত হয়ে যায়। আল্লাহ পরিষ্কার বলে দেন, মীরাস বণ্টন হবে আত্মীয়তার ভিত্তিতে। তবে হ্যাঁ কোন ব্যক্তি চাইলে হাদীয়া, তোহ্ফা, উপঢৌকন বা অসিয়াতের মাধ্যমে নিজের কোন দ্বীনী ভাইকে সাহায্য করতে পারেন।
# এ আয়াতে আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, সকল নবীদের ন্যায় আপনার থেকেও আল্লাহ পাকাপোক্ত অঙ্গীকার নিয়েছেন সে অঙ্গীকার আপনার কঠোরভাবে পালন করা উচিত। এ অঙ্গীকার বলতে কোন্ অঙ্গীকার বুঝানো হয়েছে? ওপর থেকে যে আলোচনা চলে আসছে সে সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এখানে যে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছেঃ নবী নিজে আল্লাহর প্রত্যেকটি হুকুম মেনে চলবেন এবং অন্যদের তা মেনে চলার ব্যবস্থা করবেন। আল্লাহর প্রত্যেকটি কথা হুবহু অন্যদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবেন এবং তাকে কার্যত প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা ও সংগ্রামে কোন প্রকার গাফলতি করবেন না। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। যেমনঃ
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
“আল্লাহ তোমাদের জন্য এমন দ্বীন নির্ধারিত করে দিয়েছেন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে এবং যা অহির মাধ্যমে দান করা হয়েছে (হে মুহাম্মাদ) তোমাকে। আর নির্দেশ দেয়া হয়েছে ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এ তাগিদ সহকারে যে, তোমরা প্রতিষ্ঠিত করবে এ দ্বীনকে এবং এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে না।”(আশ শূরা, ১৩)
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ
“আর স্মরণ করো, আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন তাদের থেকে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল এজন্য যে, তোমরা তার শিক্ষা বর্ণনা করবে এবং তা লুকাবে না।” (আলে ইমরান, ১৮৭)
وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ
“আর স্মরণ করো, আমি বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না।” (আল বাকারাহ, ৮৩)
أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِمْ مِيثَاقُ الْكِتَابِ…………………………………. خُذُوا مَا آتَيْنَاكُمْ بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ “তাদের থেকে কি কিতাবের অঙ্গীকার নেয়া হয়নি?——সেটিকে মজবুতভাবে ধরো যা আমি তোমাদের দিয়েছি এবং সেই নির্দেশ মনে রাখো যা তার মধ্যে রয়েছে। আশা করা যায়, তোমরা আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাকবে।” (আল আরাফ, ১৬৯-১৭১)
وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمِيثَاقَهُ الَّذِي وَاثَقَكُمْ بِهِ إِذْ قُلْتُمْ سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا “আর হে মুসলমানরা! মনে রেখো আল্লাহর অনুগ্রহকে, যা তিনি তোমাদের প্রতি করেছেন এবং সেই অঙ্গীকারকে যা তিনি তোমাদের থেকে নিয়েছেন যখন তোমরা বলেছিলে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম।” (আল মা-য়েদাহ, ৭)
নবী ﷺ শত্রুদের সমালোচনার আশঙ্কায় পালক সন্তানের আত্মীয়তা সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের নিয়ম ভাংতে ইতস্তত করছিলেন বলেই মহান আল্লাহ এ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। যেহেতু ব্যাপারটা একটি মহিলাকে বিয়ে করার, তাই তিনি বারবার লজ্জা অনুভব করছিলেন। তিনি মনে করছিলেন, আমি যতই সৎ সংকল্প নিয়ে নিছক সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যেই কাজ করি না কেন শত্রু একথাই বলবে, প্রবৃত্তির তাড়নায় এ কাজ করা হয়েছে এবং এ ব্যক্তি নিছক ধোঁকা দেবার জন্য সংস্কারকের খোলস নিয়ে আছে। এ কারণেই আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলছেন, তুমি আমার নিযুক্ত পয়গম্বর, সকল পয়গম্বরদের মতো তোমার সাথেও আমার এ মর্মে অলংঘনীয় চুক্তি রয়েছে যে, আমি যা কিছু হুকুম করবো তাই তুমি পালন করবে এবং অন্যদেরকেও তা পালন করার হুকুম দেবে। কাজেই কারো তিরস্কার সমালোচনার পরোয়া করো না, কাউকে লজ্জা ও ভয় করো না এবং তোমাকে দিয়ে আমি যে কাজ করাতে চাই নির্দ্বিধায় তা সম্পাদন করো।
একটি দল এ অঙ্গীকারকে একটি বিশেষ অঙ্গীকার অর্থে গ্রহণ করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বের সকল নবীর কাছ থেকে এ অঙ্গীকারটি নেয়া হয়। সেটি ছিল এই যে, তাঁরা পরবর্তীকালে আগমনকারী নবীর প্রতি ঈমান আনবেন এবং তাঁর সাথে সহযোগিতা করবেন। এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এ দলের দাবী হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরেও নবুওয়াতের দরজা খোলা আছে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকেও এ অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে যে, তাঁর পরেও যে নবী আসবে তাঁর উম্মাত তার প্রতি ঈমান আনবে। কিন্তু আয়াতের পূর্বাপর বক্তব্য পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভুল। যে বক্তব্য পরম্পরায় এ আয়াতটি এসেছে সেখানে তাঁর পরও নবী আসবে এবং তাঁর উম্মাতের তার প্রতি ঈমান আনা উচিত, একথা বলার কোন অবকাশই নেই। এর এ অর্থ গ্রহণ করলে এ আয়াতটি এখানে একেবারেই সর্ম্পকহীন ও খাপছাড়া হয়ে যায়। তাছাড়া এ আয়াতের শব্দগুলোয় এমন কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই যা থেকে এখানে অঙ্গীকার শব্দটির সাহায্যে কোন্ ধরনের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে তা বুঝা যেতে পারে। অবশ্যই এর ধরন জানার জন্য আমাদের কুরআন মজীদের যেসব জায়গায় নবীদের থেকে গৃহীত অঙ্গীকারসমূহের কথা বলা হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি ফিরাতে হবে। এখন যদি সমগ্র কুরআন মজীদে শুধুমাত্র একটি অঙ্গীকারের কথা বলা হতো এবং তা হতো পরবর্তীকালে আগমনকারী নবীদের প্রতি ঈমান আনার সাথে সম্পর্কিত তাহলে এখানেও ঐ একই অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে একথা দাবী করা যথার্থ হতো। কিন্তু যে ব্যক্তিই সচেতনভাবে কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করে সে জানে এ কিতাবে নবীগণ এবং তাঁদের উম্মাতদের থেকে গৃহীত বহু অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। কাজেই এসব বিভিন্ন ধরনের অঙ্গীকারের মধ্যে থেকে যে অঙ্গীকারটি এখানকার পূর্বাপর বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখে একমাত্র সেটির কথা এখানে বলা হয়েছে বলে মনে করা সঠিক হবে। এখানে যে অঙ্গীকারের উল্লেখের কোন সুযোগই নেই তার কথা এখানে বলা হয়েছে বলে মনে করা কখনই সঠিক নয়। এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কিছু লোক কুরআন থেকে হিদায়াত গ্রহণ করার নয় বরং কুরআনকে হিদায়াত করার কাজে ব্যাপৃত হয়।
# আল্লাহ কেবলমাত্র অঙ্গীকার নিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং এ অঙ্গীকার কতটুকু পালন করা হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি প্রশ্ন করবেন। তারপর যারা নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহর সাথে করা অঙ্গীকার পালন করে থাকবে তারাই অঙ্গীকার পালনকারী গণ্য হবে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মােহাজের ও আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন : এরপর ইসলাম দত্তক গ্রহণের প্রথার ন্যায় আনসার ও মােহাজেরদের ভাই ভাই বানানাের প্রথাও বাতিল করে। এই ভাই ভাই প্রথাটা জাহেলী প্রথা ছিলাে না, বরং হিজরতের পর ইসলামই এটা প্রবর্তন করেছিলাে। যে সমস্ত মােহাজের তাদের সহায়-সম্পদ ও আপনজনদেরকে মক্কায় রেখে এসেছিলাে এবং যে সকল মদীনাবাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে নিজ নিজ পরিবারের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাে, তাদেরকে উদ্ভুত পরিস্থিতি মােকাবেলায় সাহায্য করাই ছিলাে এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। অবশ্য এর পাশাপাশি রসূল(স.)-কে সকল মুসলমানের সাধারণ অভিভাবক হিসাবে বহাল রাখা, তার অভিভাবকত্বকে যাবতীয় বংশীয় সম্পর্কের চেয়ে অগ্রগণ্য নির্ধারণ করা এবং তার স্ত্রীদেরকে সমগ্র মুসলিম জাতির মা বলে ঘােষণা করা হয়েছিলাে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নবী(স.) মােমেনদের জন্যে তাদের নিজেদের চেয়ে অধিকতর অভিভাকত্বের অধিকারী। আর তার স্ত্রীরা তাদের মা'(আয়াত ৬) মোহাজের যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন, তখন তারা তাদের যাবতীয় সহায়-সম্পদ সেখানে পরিত্যাগ করে চলে যান। একমাত্র প্রাণপ্রিয় দ্বীন ইসলামকে সম্বল করে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তারা তাদের যাবতীয় আত্মীয়তার বন্ধন, ধন সম্পদ, জীবন-যাপনের উপকরণ, জন্মভূমিতে শৈশব বাল্যকালের এবং বন্ধু ও প্রিয়জনদের প্রীতি ও ভালবাসাকে বিসর্জন দিয়ে একমাত্র আকীদা ও আদর্শকে সাথে নিয়ে এবং আকীদা ও আদর্শ ছাড়া অন্য সবকিছু ত্যাগ করে প্রাণ নিয়ে পলায়ন করেন। এ ধরনের হিজরতের মাধ্যমে এবং স্বামী-স্ত্রী সন্তানসহ সকল প্রিয়জনকে ত্যাগ করে এভাবে দেশান্তরী হওয়ার মাধ্যমে তারা পৃথিবীতে নিজেদের আকীদা ও আদর্শের পূর্ণাংগ বাস্তবায়ন, তাদের অন্তরে এই আদর্শের সর্বাত্মক আধিপত্য ও সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মানব সত্ত্বা ও মানব জীবনের অখন্ড একত্ব প্রতিষ্ঠার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তারা প্রমাণ করলেন যে, তাদের অন্তকরণে ইসলাম ছাড়া আর কোনাে কিছুর বিন্দুমাত্রও স্থান নেই এবং আল্লাহর এই কথা অকাট্যভাবে সত্য প্রমাণিত হলাে যে, আল্লাহ তায়ালা কোনাে মানুষের অভ্যন্তরে দুটো অন্তকরণ সৃষ্টি করেননি। মদীনাতেও একটু ভিন্ন আকারে একই ধরনের ঘটনা ঘটলাে, বিভিন্ন পরিবারের কিছু সদস্য এককভাবে ইসলাম গ্রহণ করলাে এবং অন্যান্য সদস্যরা শিরকের ওপর বহাল রইলাে। ফলে মুসলিম সদস্যদের সাথে অমুসলিম সদস্যদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। সামগ্রিকভাবে পারিবারিক বন্ধনে একটা চিড় ধরলাে। আর সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা দিলাে আরাে বড়াে রকমের ফাটল। এ সময় ইসলামী সমাজ ছিলাে একটা সদ্যজাত সমাজ। আর নবীন ইসলামী রাষ্ট্র যতােটা ছিলাে পরিস্থিতি নির্ভর একটা শাসন ব্যবস্থা, মদীনাবাসীর মনে তার চেয়ে তার আদর্শিক ভাবমূর্তি অনেক বেশী জোরালাে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছিলাে। এ কারণে এই নতুন মতাদর্শের পক্ষে একটা তীব্র ভাবাবেগের জোয়ার বইতে শুরু করলো। সে জোয়ার অন্য সমস্ত আবেগ অনুভূতি, ঐতিহ্য ও সমাজরীতি এবং সম্পর্ক ও বন্ধনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলাে। এর ফল দাঁড়ালাে এই যে, এই নতুন মতাদর্শই হয়ে দাঁড়ালাে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে আত্মীয়তা ও অন্তরংগতা সৃষ্টির একমাত্র উৎস। একই সাথে যাদের ইসলাম গ্রহণের কারণে নিজ নিজ গােত্র ও পরিবারের সাথে তাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাে, তাদের পরস্পরের মধ্যে ইসলামই রচনা করলাে একমাত্র আত্মীয়তার বন্ধন। ইসলামী বন্ধন তাদের মধ্যে রক্ত, বংশ, স্বার্থ, বন্ধুত্ব, স্বজাত্য ও ভাষাগত বন্ধনের স্থলাভিষিক্ত হলাে। ইসলাম গ্রহণকারী এসব বিচ্ছিন্ন সদস্যকে ইসলাম ঐক্যবদ্ধ করলাে এবং এমন একটা দলে পরিণত করলাে, যার সদস্যরা সত্যিকার অর্থে পরস্পরের সহযোগী, পরস্পরের প্রতি ঘনিষ্ঠ, পরস্পরের প্রতি একাত্ম ও পরস্পরের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানকারী। এ কাজটা সে সম্পন্ন করলাে কোনাে আইন জারী করে নয়, কিংবা কোনাে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক আদেশ বলেও নয়, একটা আভ্যন্তরীণ প্রেরণা ও আবেগ উদ্দীপনার জোয়ার সৃষ্টি করার মাধ্যমে। মানুষ স্বাভাবিকভাবে যে ধরনের আবেগ উদ্দীপনার সাথে পরিচিত, এ উদ্দীপনা ছিলাে তার চেয়ে অনেক বেশী তীব্র, প্রবল ও অপ্রতিরােধ্য। এই ভিত্তির ওপরই ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলো। অথচ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এ কাজ করা ও বিরাজমান সমাজ ব্যবস্থার ওপর শক্তি প্রয়ােগে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মতাে ক্ষমতা তখনাে তাদের আয়ত্তে আসেনি। মক্কার মােহাজেররা মদীনার আনসারদের অতিথি হলেন। আনসাররা তার আগে থেকেই মদীনার অধিবাসী ছিলেন। তারা ঈমান এনেছিলেন তাদের আগমনের আগেই। তারা মােহাজেরদেরকে শুধু তাদের বাড়ী ঘরেই ঠাই দিলেন তা নয়, বরং অন্তরের অন্তস্থলে স্থান দিলেন এবং তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি থেকেও তাদেরকে অংশ দিলেন। কে কাকে নিজের ঘরে তুলবে তা নিয়ে এতাে প্রতিযােগিতা হলাে যে, লটারী ছাড়া কোনাে মােহাজের কোনাে আনসারের বাড়ীতে উঠতেই পারেননি। কারণ আশ্রয় দিতে আগ্রহী আনসারদের তুলনায় মােহাজেরদের সংখ্যা ছিলাে কম। তারা স্বেচ্ছায়, সানন্দে ও স্বতস্ফুর্তভাবে এবং স্বভাবগত ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অহংকার ও লােক দেখানাের প্রবণতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকেই এই মহৎ কাজে অংশগ্রহণ করেন। রসূল(স.) কিছুসংখ্যক মােহাজের ও আনসারের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করলেন। পৃথিবীর আর কোনাে ধর্ম বা মতাদর্শের অনুসারীদের মধ্যে কখনাে এ ধরনের সর্বাত্মক সহযােগিতা ও সমমর্মিতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন নযীর ইতিহাসে নেই। এ ভ্রাতৃত্ব অবিকল রক্ত সম্পৰ্কীয় ভ্রাতৃত্বের সমপর্যায়ের ছিলাে। কেননা বংশীয় সম্পর্কের কারণে উত্তরাধিকার ও রক্তপণসহ যেসব দায়-দায়িত্ব ও অধিকার জন্ম নিয়ে থাকে, তার সবই এর আওতাভুক্ত ছিলাে। এ ক্ষেত্রে আবেগের প্রাবল্য সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়। মুসলমানরা এই নতুন সম্পর্ককে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে। ইসলাম এ ব্যাপারে যা কিছু নীতি ও নির্দেশনা দিয়েছে, তার সবই তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। ইসলামী সমাজ ও তার নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণে এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রীয়, আইনগত ও সামাজিক বন্ধনে পর্যবসিত হয় বরং এর শক্তি ছিলাে আরাে বেশী। যে ব্যতিক্রমধর্মী জটিল পরিস্থিতিতে এই ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে পরিস্থিতিতে এই নবগঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সংহতি নিশ্চিত করার জন্যে এটা ছিলাে অপরিহার্য। যখনই কোনাে মুসলিম জনগােষ্ঠী এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হবে, তখনই এ ধরনের চেতনা ও ভাবাবেগের জোয়ার সৃষ্টি করা জরুরী হয়ে পড়বে এবং তাদের স্বাধীন ও স্নির্ভর স্থায়ী ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী সমাজ ও ইসলামী আইন-কানুন চালু না হওয়া পর্যন্ত এই জোয়ার অব্যাহত রাখতে হবে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত উক্ত জনগােষ্ঠীর রক্ষণাবেক্ষণ ও অগ্রগতির জন্যে রাষ্ট্রীয় ও আইনগতভাবে বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ইসলাম যদিও এ ধরনের আবেগ-উদ্দীপনার জোয়ার সৃষ্টি এবং মুসলমানদের অন্তরে এর উৎসগুলাের স্থায়িত্ব ও সার্বক্ষণিক সক্রিয়তা বহাল রাখতে উদগ্রীব, কিন্তু সে এর ভিত্তিকে জনগণের স্বাভাবিক শক্তি ও মনোবলের ওপর দাঁড় করাতেও ইচ্ছুক। সাময়িক আবেগ উত্তেজনার কার্যকারিতাও ক্ষণস্থায়ী ও নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। সেই বিশেষ জরুরী সময় অতিবাহিত হওয়ার পর উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে স্থির হয়ে যায় এবং শান্ত অবস্থা ফিরে আসে। এ জন্যেই বদর যুদ্ধের পর যখনই মদীনার পরিস্থিতি শান্ত, স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল হলে, সার্বিক পরিস্থিতি ইসলামী রাষ্ট্রের অনুকূলে এসে গেলাে এবং আংশিকভাবে হলেও সামাজিক স্থিতাবস্থা বহাল হলাে, যুক্তিসংগত ছােট খাট সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে এতােটা সম্পদ অর্জিত হলাে যে, মুসলমানরা সকলেই মােটামুটি স্বনির্ভর হয়ে উঠলেন, বিশেষত ইহুদী গােত্র বনু কাইনুকার নির্বাসনের পর মুসলমানরা যখন বেশ সচ্ছল হয়ে উঠলেন, তখন এতটুকু নিরাপদ পরিস্থিতি পুনর্বহাল হওয়া মাত্রই কোরআন ভ্রাতৃত্ব ব্যবস্থার রক্ত সম্পর্কীয় ও বংশীয় পর্যায়ের দায় দায়িত্বের আইনগত বাধ্যবাধকতা বাতিল করে দিলাে। তবে নৈতিক ও চেতনাগত পর্যায়ে তা বহাল রাখে, যাতে প্রয়ােজন দেখা দিলে পুনরায় তা কার্যকর হতে পারে। মুসলিম সমাজের উত্তরাধিকার ও রক্তপণের দায়-দায়িত্বকে রক্তের ও বংশীয় সম্পর্কের কর্তৃত্ব ন্যস্ত করাসহ যাবতীয় বিষয়কে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনলাে, ঠিক যেমনটি তা আল্লাহর আদি গ্রন্থে ও তার প্রাকৃতিক বিধানে মৌলিকভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রা আল্লাহর বিধানে অভিভাবকত্বে মুমিন ও মােহাজেরদের চেয়ে অধিকতর যােগ্য। কিতাবে এটাই লিখিত ছিলাে। *নবীর প্রতি সর্বোচ্চ ভালােবাসা ঈমানের শর্ত : তবে এই সাথে সাধারণ অভিভাবকত্ব রসূল(স.)-এর জন্যে বহাল রাখা হয়। এ অভিভাবকত্ব রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার চেয়েও অগ্রগণ্য। এমনকি প্রত্যেক মুসলমানের নিজের চেয়েও অগ্রগণ্য। নবী মােমেনদের জন্যে তাদের নিজেদের চেয়েও উত্তম অভিভাবক এই কথাটার মধ্য দিয়ে এই বক্তব্যই ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া রসূল(স.)-এর স্ত্রীদেরকেও সকল মুসলমানের মায়ের আসনে বসানাে হয়েছে সচেতনভাবে। বলা হয়েছে, ‘তার স্ত্রীরা হচ্ছেন তাদের মা।’ রসূল(স.)-এর অভিভাবক হচ্ছে সর্বাত্মক ও সার্বজনীন অভিভাকত্ব। মানুষের সমগ্র জীবন, তার সকল দিক ও বিভাগসহ এর আওতাভুক্ত। ফলে মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চুড়ান্ত ক্ষমতা একমাত্র রসূল(স.)-এর কাছে ন্যস্ত। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ওহীর আলােকে যে সিদ্ধান্ত দেবেন। সেটাই তাদেরকে শর্তহীনভাবে মাথা পেতে নিতে হবে, নিজেরা স্বাধীনভাবে কোনাে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। রাসূল (স.) বলেছেন, ‘তােমাদের কেউ ততােক্ষণ মােমেন হতে পারবে না, যতক্ষণ তার আবেগ-অনুভূতি আমার আনীত বিধানের অনুসারী না হবে।’ রসূল(স.)-এর অভিভাবকত্বের আওতাধীন মুসলমানদের আবেগ অনুভূতি। তাই তাঁর ব্যক্তিত্ব তাদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও প্রিয়। তাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব, অন্য কারাে ব্যক্তিত্ব বা অন্য কোনাে জিনিস কোনাে অবস্থাতেই তাদের কাছে রসূল (স.)-এর ব্যক্তিত্বের চেয়ে অগ্রাধিকার পেতে পারে না। সহীহ বােখারীতে বর্ণীত হয়েছে যে, রসূল(স.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, তােমরা ততােক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতােক্ষণ আমি তােমাদের কাছে তােমাদের নিজেদের চেয়ে, সহায় সম্পদের চেয়ে, সন্তান সন্ততির চেয়ে এবং সকল মানুষের চেয়ে প্রিয় না হবো।’ সহীহ বোখারীর আরাে একটা হাদীসে আছে যে, হযরত ওমর(রা.) বলেছিলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম, আপনি আমার কাছে সব কিছুর চেয়ে প্রিয়, তবে আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় নন। রসূল(স.) বললেন, না, হে ওমর, আমি যতােক্ষণ তােমার কাছে তােমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় না হবাে, ততােক্ষণ তুমি মােমেন হতে পারবে না। হযরত ওমর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আপনি আমার কাছে সব কিছুর চেয়ে প্রিয়, এমনকি আমার প্রাণের চেয়েও।’ রসূল(স.) বললেন, এবার ঠিক আছে, হে ওমর। এটা শুধু কথার কথা নয়। এটা হচ্ছে সেই সুউচ্চ স্তর, যেখানে মহান আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া পৌছা সম্ভব নয়। এই প্রত্যক্ষ সাহায্যই তাকে এতাে উচ্চ ও উজ্জ্বল শীর্ষবিন্দুতে পৌছাতে পারে। এখানে সে যাবতীয় ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও দুনিয়ার আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। বন্তুত মানুষ নিজ সত্ত্বা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় জিনিসকে এতাে ভালােবাসে, যা কল্পনা ও উপলব্ধিরও উর্ধে, অনেক সময় তার মনে হয়, সে তার আবেগকে সংযত করেছে, মনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং নিজেকে ভালােবাসার ক্ষেত্রে যে বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে, তা সে কমিয়ে ফেলেছে। কিন্তু যখনই তার আত্মসম্মানে সামান্যতম আঘাত আসে, অমনি সে এমনভাবে ঘাবড়ে যায় যেন তাকে সাপে কামড় দিয়েছে। এই আঘাতে সে এতাে যন্ত্রণা ও অপমান অনুভব করে, যে তার কোনাে প্রতিক্রিয়া সে ব্যক্তই করতে পারে না। প্রতিক্রিয়া যেটুকু হয়, তা তার অনুভূতিতেই সুপ্ত থাকে এবং হৃদয়ের গভীরতম প্রকোষ্ঠে নিমজ্জিত থাকে। কখনাে কখনাে সে তার গােটা জীবনকেই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়, অথচ তার ব্যক্তিত্বে এমন সামান্যতম স্পর্শও সে সহ্য করতে পারে না, যা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে বলে তার কাছে মনে হয়, কিংবা তার কোনাে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি নিন্দা-ধিক্কার দেয় বলে মনে হয়, অথবা তার কোনাে আচার-আচরণের সমালােচনা করে বলে মনে হয়। এ ধরনের কোনাে নিন্দা সমালােচনায় তার কিছুই এসে যায় না বলে দাবী করা সত্তেও এই অসুহিষ্ণুতার ভার তার মধ্যে যথারীতি অক্ষুণ্ন থাকে। এমন গভীর আত্মপ্রেমকে নিয়ন্ত্রণ করা শুধু কথার কথা নয়, বরং একটা অতি উচ্চ ও উন্নত স্তর, যেখানে আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া কেউ পৌছতে পারে না। আর আল্লাহর এই সাহায্য দীর্ঘ ও নিরন্তর চেষ্টা সাধনা, অব্যাহত সচেতনতা ও আন্তরিক আগ্রহের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। এই চেষ্টা সাধনাকে রাসূল(স.) সবচেয়ে বড় জেহাদ নামে আখ্যায়িত করেছেন। হযরত ওমরের(রা.) ন্যায় ব্যক্তিরও এই জেহাদে রসূল(স.)-এর পথ নির্দেশনার প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিলাে এবং এই পথনির্দেশনাই তার নির্মল অন্তকরণকে অর্গলমুক্ত করেছিলাে। মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও এই সার্বজনীন অভিভাবকত্বের আওতায় পড়ে। সহীহ বােখারীর এক হাদীসে রাসূল(স.) বলেন, দুনিয়া ও আখেরাতে প্রত্যেক মুমিনের জন্যে আমিই সর্বোত্তম অভিভাবক। ইচ্ছা হলে তােমরা সূরা সেজদার এই আয়াতটা পড়ে দেখতে পারাে, নবী হচ্ছেন মােমেনদের জন্যে তাদের নিজেদের চেয়েও উত্তম অভিভাবক।’ সুতরাং কোনাে মােমেন যদি কিছু ধন সম্পত্তি রেখে মারা যায়, তবে তার জীবিত রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রাই তার উত্তরাধিকারী হবে। আর যদি ঋণ অথবা ক্ষয়ক্ষতি রেখে যায়, তবে তার উত্তরাধিকারী যেন আমার কাছে আসে। কেননা আমিই তার অভিভাবক। অর্থাৎ সে যদি ঋণ পরিশােধ করার উপযুক্ত কোনাে ধন সম্পদ রেখে না যায়। তবে তিনিই তা পরিশােধ করবেন এবং তার রেখে যাওয়া অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের ভরণ-পােষণও করবেন। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সামষ্টিক জীবন স্বাভাবিকভাবেই চলবে, কোনাে আবেগ উদ্দীপ্ত আন্দোলনের বা অস্বাভাবিক কোনাে গণবিস্ফোরণের প্রয়ােজন দেখা দেবে না। ভ্রাতৃত্ব চুক্তি বাতিলের পর মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও মমত্ব বহাল থাকবে। তাই যে কোনাে অভিভাবক তার পালিতকে নিজের মৃত্যুর পরে দান করার জন্যে ওসিয়ত করতে পারে কিংবা জীবদ্দশায় কোনাে সম্মতি প্রদান করতে পারে। এতে শরীয়তে কোনাে বাধা নেই। এ কথাই আয়াতের একাংশে এভাবে বলা হয়েছে, ‘তবে তােমাদের পালিতকে যদি কিছু সৌজন্য প্রদর্শন করতে চাও, তবে সেটা ভিন্ন কথা।’ আর এই সমুদয় ব্যবস্থাকে প্রথমােক্ত মূলনীতির সাথে যুক্ত করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে যে, ‘এটা আল্লাহর আদি পুস্তকে লিখিতভাবে বিদ্যমান সিদ্ধান্ত। ‘এটা কিতাবে লিখিত ছিল। এভাবে মুসলমানদের মনকে শান্ত ও তৃপ্ত করা হচ্ছে এবং সেই মহান ঐশী মূলনীতিকে ধারণ করা হচ্ছে, যার আওতায় সব আইন প্রণয়ন ও সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বস্তুত এভাবেই মানব জীবনকে তার স্বাভাবিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তা সহজ সরল ও প্রশান্ত গতিতে চলতে থাকে। সীমিত ও ব্যতিক্রমী কোনাে কোনাে অবস্থায় ছাড়া ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক জীবনের কোথাও কোনাে অচলাবস্থা বা অরাজকতার সৃষ্টি হয় না।
*নবীদের কাছ থেকে আনুগত্যের অঙ্গীকার গ্রহণ : অতপর যদি কখনাে মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনে কোনাে গণচেতনা বা গণঅভূত্থানের জরুরী প্রয়ােজন দেখা দেয়, তবে ইসলাম তার সেই শক্তিশালী উৎসটাকেও সে জন্যে খােলা রেখে দেয়। আল্লাহর কিতাবে তাঁর যে আদি ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত লিখিত রয়েছে এবং যা পরবর্তীতে বিশ্ব প্রকৃতিতে কার্যকর চিরস্থায়ী নিয়ম ও বিধানে পরিণত হয়েছে, সেই ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে পরবর্তী আয়াতে সাধারণ ও বিশিষ্ট নবীদের কাছ থেকে আল্লাহর গৃহীত অংগীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে এই মর্মে অংগীকার নেয়া হয়েছিলাে যে, তারা আল্লাহর জারীকৃত এই বিধানকে নিজ নিজ জাতির কাছে প্রচার ও বাস্তবায়ন করবেন ও তাতে দৃঢ়চেতা ও আপােষহীন থাকবেন, যাতে মানুষকে তাদের হেদায়াত লাভ অথবা ভ্ৰষ্টতা এবং ঈমান আনয়ন কিংবা কুফরি অবলম্বনের ব্যাপারে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে যায়। কেননা নবীরা ইতিপূর্বেই তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌছে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি নবীদের কাছ থেকে অংগীকার নিয়েছিলােম…'(আয়াত ৭-৮) আসলে এটা হযরত নূহ(আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী মােহাম্মদ(স.) পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চালু থাকা একই অংগীকার, একই বিধান এবং একই আমানত-যা প্রত্যেক নবী নিজে গ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তী নবীর কাছে হস্তান্তর করে গেছেন। আয়াতের প্রথমাংশে প্রথমে সাধারণভাবে সকল নবীর কথা বলা হয়েছে যে, আমি নবীদের কাছ থেকে অংগীকার নিয়েছিলাম। দাওয়াত পৌছানাের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহানবীর কথা বলা হয়েছে, ‘এবং তােমার কাছ থেকে, অতপর শেষ নবীর পূর্ববর্তী প্রধান প্রধান নবীর উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, ‘এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসার কাছ থেকে।’ যাঁদের কাছ থেকে অংগীকার গ্রহণ করা হয়েছে তাদের বিবরণ দেয়ার পর কেমন অংগীকার নেয়া হয়েছে, তার বিবরণ দিয়ে বলা হচ্ছে, আমি তাদের কাছ থেকে জোরদার অংগীকার নিয়েছি।’ মীসাক’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলাে ‘পাকানাে দড়ি বা রশী। শব্দটার রূপক প্রয়ােগ হয়েছে অংগীকার ও প্রতিশ্রুতি অর্থে। অন্যদিক দিয়ে এতে আধ্যাত্মিক তাৎপর্যও এমনভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, শ্রোতার উদ্দীপনা ও আবেগকে শাণিত করে তােলে। অর্থাৎ এটা সেই মজবুত চুক্তি, যা আল্লাহ তায়ালা ও তার মনােনীত প্রিয় বান্দাদের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে, যেন তারা তার ওহী পাওয়ার পর অন্যদের কাছে পৌছানাে এবং বিশ্বস্ততা ও দৃঢ়তার সাথে তা বাস্তবায়িতও করেন। যেন সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে পারেন এই সত্যবাদী অর্থ ঈমানদাররা। তারা সত্য কথা বলেছে এবং সত্য আকীদাকে গ্রহণ করেছে। তারা ছাড়া আর সবাই মিথ্যাবাদী। কেননা তারা বাতিল কথা বলে ও বাতিল মতবাদে বিশ্বাস করে। তাই এরই সত্যবাদী বিশেষণটা তাৎপর্যপূর্ণ। কেয়ামতের দিন এই সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা শিক্ষক কর্তৃক কৃতকার্য ও উত্তীর্ণ ছাত্রকে তার সেই উত্তর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার সাথে তুলনীয়, যে উত্তর দিয়ে সে গৌরবময় কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছে। এ প্রশ্ন করা হবে কেয়ামতের মাঠে সমবেত সকলের সামনে তাদের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্যে। পক্ষান্তরে যারা মিথ্যুক ও বাতিলপন্থী, যারা আকীদার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলেছে। ‘তাদের কর্মফল সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং সে কর্মফল তাদের অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের জন্যে যন্ত্রণাদায়ক আযাব রয়েছে।’
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
আল্লাহ তা’আলা জানেন যে, তাঁর রাসূল (সঃ) নিজের জীবন অপেক্ষা নিজের উম্মতের উপর অধিকতর দয়ালু, এজন্যে তিনি তাঁর রাসূল (সঃ)-কে তাদের উপর তাদের জীবনের চেয়েও বেশী অধিকার দিয়েছেন। তারা নিজেদের জন্যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না, বরং রাসূল (সঃ)-এর প্রত্যেক হুকুমকে জান-প্রাণ দিয়ে তাদেরকে কবুল করতে হবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ বিসম্বাদের বিচারের ভার তোমার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে ওটা মেনে না নেয়।” (৪:৬৫) সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! ততামাদের মধ্যে কেউ মুমিন হতে পারে না যে পর্যন্ত না আমি তার কাছে প্রিয়। হই তার নিজের জান, মাল, সন্তান এবং সমস্ত লোক অপেক্ষা।” সহীহ হাদীসে আরো বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই আপনি আমার নিকট আমার প্রাণ ছাড়া সবকিছু হতেই প্রিয়।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে উমার (রাঃ)! না (এতেও তুমি মুমিন হতে পার না), বরং আমি যেন তোমার কাছে তোমার জীবন অপেক্ষাও প্রিয় হই।” তখন তিনি বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহর শপথ! (এখন হতে) আপনি আমার নিকট সব কিছু হতেই প্রিয় হয়ে গেলেন। এমনকি আমার নিজের জীবন হতেও।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “হে উমার (রাঃ)! এখন (তুমি পূর্ণ মুমিন হলে)।” এ জন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, নবী (সঃ) মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর।
এ আয়াতের তাফসীরে সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়া ও আখিরাতে সমস্ত মুমিনের সবচেয়ে বেশী হকদার আমিই, এমনকি তাদের নিজেদের জীবনের চেয়েও। তোমরা ইচ্ছা করলে। (আরবি)-এই আয়াতটি পড়ে নাও। জেনে রেখো যে, যদি কোন মুসলমান মাল-ধন রেখে মারা যায় তবে সেই মালের হকদার হবে তার উত্তরাধিকারীরা। আর যদি কোন মুসলমান তার কাঁধে ঋণের বোঝা রেখে মারা যায় অথবা ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রেখে মারা যায় তবে তার ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার এবং তার ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের লালন-পালনের দায়িত্ব ভারও আমারই উপর ন্যাস্ত।”
এরপর ঘোষিত হচ্ছেঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পত্নীগণ মুমিনদের মাতাতুল্য। তারা তাদের সম্মানের পাত্রী। সম্মান, বুযর্গী ইত্যাদির দিক দিয়ে তাঁরা যেন তাদের মা। হ্যা, তবে মায়ের সাথে অন্যান্য আহকাম যেমন নির্জনতা ইত্যাদিতে পার্থক্য আছে। তাঁদের গর্ভজাত কন্যাদের সাথে এবং বোনদের সাথে বিয়ে হারাম হওয়ার কথা এখানে বলা হয়নি। কোন কোন আলেম তাদের কন্যাদেরও মুসলমানদের বোন বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইমাম শাফেয়ী (রঃ) মুখতাসার গ্রন্থে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা ইবারতের প্রয়োগ, হুকুম সাব্যস্ত করা নয়। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) প্রমুখ কোন না কোন উম্মুল মুমিনীনের ভাই ছিলেন। তাঁকে মামা বলা যাবে কি না এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন যে, বলা যেতে পারে। বাকী রইলো এখন এই কথা যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আবুল মুমিনীন (মুমিনদের পিতা) বলা যাবে কি-না? এটাও খেয়াল করা প্রয়োজন যে, আবুল মুমিনীন বললে স্ত্রীলোকেরাও এসে যায়।
এর মধ্যে আধিক্য হিসেবে স্ত্রী লিঙ্গও রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, আবুল মুমিনীন বলা যাবে না। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) (আরবি)-এর দু’টি উক্তির মধ্যেও অধিকতর সঠিক উক্তি এটাই। হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)(আরবি)-এর কিরআতে -এর পরে।
(এবং তিনি তাদের পিতা) এরূপও রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রঃ)-এর মাযহাবেও একটি উক্তি এটাই এবং নিম্নের হাদীসটিও এ উক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করেঃ (আরবি) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের পিতাদের স্থলাভিষিক্ত। আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছি যে, তোমাদের কেউ পায়খানায় গেলে কিবলার দিকে যেন মুখ না করে এবং পিঠও যেন না করে, ডান হাতে যেন ঢিলা ব্যবহার না করে এবং ডান হাতে যেন ইসতিজাও না করে।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) তিনি ইসতিজার জন্যে তিনটি ঢিলা নিতে বলেছেন। গোবর ও হাড় দ্বারা ইসতিজা করতে তিনি নিষেধ করেছেন।
দ্বিতীয় উক্তি এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে পিতা বলা যাবে না। কেননা কুরআন কারীমে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “মুহাম্মাদ (সঃ) তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন।” (৩৩:৪০)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহর বিধান অনুসারে মুমিনও মুহাজিরগণ অপেক্ষা যারা আত্মীয়, তারা পরস্পরের নিকটতর। ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিলেন ঐ দিক দিয়েই তারা একে অপরের উত্তরাধিকারী হতেন। শপথ করে যারা সম্বন্ধ জুড়ে দিতেন তারাও তাঁদের সম্পত্তির হকদার হয়ে যেতেন। এ আয়াত দ্বারা এগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
পূর্বে কোন আনসার মারা গেলে তাঁর নিকটাত্মীয়রা ওয়ারিস হতো না, বরং মুহাজিররা ওয়ারিস হতেন, যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করেছিলেন। হযরত যুহায়ের ইবনে আওয়াম (রাঃ) বলেনঃ “এই হুকুম বিশেষভাবে আমাদের আনসার ও মুহাজিরদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় আগমন করি তখন আমাদের কাছে কিছুই ছিল না। এখানে (মদীনায়) এসে আমরা আনসারদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। তারা আমাদের উত্তম ভাই সাব্যস্ত হন। এমনকি তাদের মৃত্যুর পর আমরা তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতাম। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল হযরত খারেজা ইবনে যায়েদ (রাঃ)-এর সাথে। হযরত উমার (রাঃ)-এর হয়েছিল অমুকের সাথে। হযরত উসমান (রাঃ) ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন একজন যারকী ব্যক্তির সাথে। আর স্বয়ং আমার ভাই হয়েছিলেন হযরত কা’ব ইবনে মালিক (রাঃ)। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হলেন। ঐ সময় তার ইন্তেকাল হলে আমিও তার ওয়ারিস হয়ে যেতাম। অতঃপর এ আয়াত অবতীর্ণ হলো এবং মীরাসের সাধারণ হুকুম আমাদের জন্যেও প্রযোজ্য হয়ে গেল ।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তবে তোমরা যদি তোমাদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করতে চাও তবে তা করতে পার। তুমি তার জন্যে অসিয়ত করে যেতে পার।
অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহর এই হুকুম প্রথম হতেই এই কিতাবে লিপিবদ্ধ ছিল। তাতে কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা হয়নি। মধ্যখানে পাতানো ভাই-এর উপর যে ওয়ারিসী স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এটা শুধু একটা বিশেষ যুক্তিসঙ্গতার ভিত্তিতে হয়েছিল একটা বিশেষ ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এরপর এটা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন মূল হুকুম জারী হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৭-৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি এই পাঁচজন স্থিরপ্রতিজ্ঞ নবীর নিকট হতে এবং সাধারণ সমস্ত নবীর নিকট হতে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তারা আমার দ্বীনের প্রচার করবেন ও তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। তারা পরস্পরে একে অপরকে সাহায্য করবেন এবং একে অপরকে সমর্থন করবেন। তারা পরস্পরের মধ্যে ইত্তেহাদ ও ইত্তেফাক কায়েম রাখবেন। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেনঃ তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি তার শপথ! যখন একজন রাসূল আসবে তখন নিশ্চয়ই তোমরা তাকে বিশ্বাস করবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেনঃ তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এই সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বললো: আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেনঃ তবে তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম।” (৩:৮১) এখানে সাধারণ নবীদের বর্ণনা দেয়ার পর বিশিষ্ট মর্যাদা সম্পন্ন নবীদের নামও উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে তাদের নাম নিম্নের আয়াতেও রয়েছেঃ (আরবি)
এখানে হযরত নূহ (আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে যিনি ভূ-পৃষ্ঠে আল্লাহ তাআলার সর্বপ্রথম নবী ছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে যিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী এবং হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ)-এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে যারা ছিলেন মধ্যবর্তী নবী। এতে সূক্ষ্মদর্শিতা এই রয়েছে যে, প্রথম নবী হযরত আদম (আঃ)-এর পরবর্তী নবী হযরত নূহ (আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর পূর্ববর্তী নবী হযরত ঈসা (আঃ)-এর নাম উল্লেখ রয়েছে। আর মধ্যবর্তী নবীদের মধ্যে হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেও তো এই ক্রমপর্যায় রয়েছে যে, প্রথম ও শেষের নাম উল্লেখ করার পর মধ্যবর্তী নবীদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আর এ আয়াতে সর্বপ্রথম সর্বশেষ নবী (সঃ)-এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কারণ তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা অধিক মর্যাদা সম্পন্ন নবী। অতঃপর একের পর এক ক্রমানুযায়ী অন্যান্য নবীদের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সমস্ত নবীর উপর দরূদ ও সালাম নাযিল করুন! এই আয়াতের তাফসীরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি সমস্ত নবীর পূর্বে সৃষ্ট হয়েছি এবং দুনিয়ায় সর্বশেষে আগমন করেছি। তাই আমা হতেই শুরু করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) কিন্তু এর একজন বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনে বাশীর দুর্বল এবং সনদ হিসেবে এটা মুরসাল রূপে বর্ণিত হয়েছে। এটাই বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেউ কেউ এটাকে মাওকুফ রূপে বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্যে পাঁচজন নবী আল্লাহ তা’আলার নিকট খুইব পছন্দনীয়। তাঁরা হলেনঃ হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সঃ)। এর একজন বর্ণনাকারী হামযাহ দুর্বল। এও বলা হয়েছে যে, এই আয়াতে যে অঙ্গীকারের বর্ণনা রয়েছে তা হলো ওটাই যা আল্লাহ তা’আলা রোযে আযলে হযরত আদম (আঃ)-এর পিঠ হতে সমস্ত মানুষকে বের করে গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আদম (আঃ)-কে উচ্চে তুলে ধরা হয়। তিনি তাঁর সন্তানদের দেখেন। তাদের মধ্যে তিনি ধনী, নির্ধন, সুন্দর, কুৎসিত সর্বপ্রকারের লোককেই দেখতে পান। তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহ! যদি আপনি এদের সবাইকে সমান করতেন তবে কতই না ভাল হতো!” মহামহিমান্বিত আল্লাহ জবাবে বলেনঃ “এটা এজন্যেই করা হয়েছে যে, যেন আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। তাদের মধ্যে যারা নবী ছিলেন। তিনি তাদেরকেও দেখেন। তাঁরা জ্যোতির্ময় রূপে প্রকাশিত ছিলেন। তাঁদের উপর নূর বর্ষিত হচ্ছিল। তাদের নিকট হতেও নবুওয়াত ও রিসালাতের একটি বিশেষ অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল। যার বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে।
ঘোষিত হচ্ছেঃ সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদীতা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করবার জন্যে, অর্থাৎ তাদেরকে রাসূল (সঃ)-এর হাদীসগুলো পৌঁছিয়ে দিতো। আর আল্লাহ তা’আলা অমান্যকারীদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন বেদনাদায়ক শাস্তি।
সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করছি যে, আপনার রাসূলগণ আপনার বান্দাদের কাছে আপনার বাণী কমবেশী ছাড়াই পৌছিয়ে দিয়েছেন। তারা পূর্ণভাবে মঙ্গল কামনা করেছে এবং সত্যকে পরিষ্কারভাবে উজ্জ্বল পন্থায় জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। যাতে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই, যদিও হতভাগ্য ও হঠকারীরা তাদেরকে মানেনি। আমাদের বিশ্বাস আছে যে, আপনার রাসূলদের সমস্ত কথা ন্যায় ও সত্য। যারা তাঁদের পথ অনুসরণ করেনি তারা বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট। তারা বাতিলের উপর রয়েছে।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1049)
[The Prophet is more dearer to the believers than themselves:-]
www.motaher21.net
Sura:33:Al-Ahzaab
Para:21
Ayat: – 6-8
33:6
اَلنَّبِیُّ اَوۡلٰی بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ مِنۡ اَنۡفُسِہِمۡ وَ اَزۡوَاجُہٗۤ اُمَّہٰتُہُمۡ ؕ وَ اُولُوا الۡاَرۡحَامِ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلٰی بِبَعۡضٍ فِیۡ کِتٰبِ اللّٰہِ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُہٰجِرِیۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ تَفۡعَلُوۡۤا اِلٰۤی اَوۡلِیٰٓئِکُمۡ مَّعۡرُوۡفًا ؕ کَانَ ذٰلِکَ فِی الۡکِتٰبِ مَسۡطُوۡرًا ﴿۶﴾
The Prophet is more worthy of the believers than themselves, and his wives are [in the position of] their mothers. And those of [blood] relationship are more entitled [to inheritance] in the decree of Allah than the [other] believers and the emigrants, except that you may do to your close associates a kindness [through bequest]. That was in the Book inscribed.
Loyalty to the Prophet ; and his wives are Mothers of the Believers
Allah tells us how His Messenger is merciful and sincere towards his Ummah, and how he is closer to them than they are to themselves. His judgement or ruling takes precedence over their own choices for themselves, as Allah says:
فَلَ وَرَبِّكَ لَا يُوْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِى أَنفُسِهِمْ حَرَجاً مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيماً
But no, by your Lord, they can have no faith, until they make you judge in all disputes between them, and find in themselves no resistance against your decisions, and accept with full submission. (4:65)
In the Sahih it says:
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَاا يُوْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ نَفْسِهِ وَمَالِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِين
By the One in Whose Hand is my soul, none of you truly believes until I am dearer to him than his own self, his wealth, his children and all the people.
It was also reported in the Sahih that Umar, may Allah be pleased with him, said:
“O Messenger of Allah, by Allah, you are dearer to me than everything except myself.”
He said,
لَاا يَا عُمَرُ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِك
No, O Umar, not until I am dearer to you than yourself.
Umar said:”O Messenger of Allah, by Allah, now you are dearer to me than everything, even myself.”
He said,
الاْنَ يَاعُمَر
Now, O Umar (you have got it right).
Allah says in this Ayah:
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُوْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ
The Prophet is closer to the believers than themselves,
Concerning this Ayah, Al-Bukhari narrated from Abu Hurayrah, may Allah be pleased with him, that the Prophet said:
مَا مِنْ مُوْمِنٍ إِلاَّ وَأَنَا أَوْلَى النَّاسِ بِهِ فِي الدُّنْيَا وَالاْاخِرَةِ اقْرَوُوا إِنْ شِيْتُمْ
There is no believer except I am the closest of all people to him in this world and in the Hereafter. Recite, if you wish:
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُوْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ
(The Prophet is closer to the believers than themselves).
فَأَيُّمَا مُوْمِنٍ تَرَكَ مَالاًأ فَلْيَرِثْهُ عُصْبَتُهُ مَنْ كَانُوا وَإِنْ تَرَكَ دَيْنًا أَوْ ضِيَاعًا فَلْيَأْتِنِي فَأَنَا مَوْلَاأه
If any believer leaves behind any wealth, let his own relatives inherit it, but if he leaves behind any debt or orphans, bring them to me and I will take care of them.
This was recorded only by Al-Bukhari, and he also recorded it in the Book of Loans.
وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ
and his wives are their mothers.
means, they are unlawful for marriage.
In terms of honor, respect and veneration, it is not permissible for them to be alone with them, and the prohibition of marriage to them does not extend to their daughters and sisters, according to scholarly consensus.
وَأُوْلُو الاْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ مِنَ الْمُوْمِنِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ
And blood relations among each other have closer personal ties in the decree of Allah than the believers and the Muhajirin,
This is an abrogation of the rule that existed previously, whereby they could inherit from one another by virtue of the oath of brotherhood among them.
Ibn Abbas and others said:
“A Muhajir would inherit from an Ansari even though they were not related by blood, because of the brotherhood established between them by the Messenger of Allah.”
This was also stated by Sa`id bin Jubayr and others among scholars of the earlier and later generations.
إِلاَّ أَن تَفْعَلُوا إِلَى أَوْلِيَايِكُم مَّعْرُوفًا
except that you do kindness to those brothers.
means, the idea of inheriting from one another has gone, but there remains the duty to offer support and kindness, to uphold ties of brotherhood and to offer good advice.
كَانَ ذَلِكَ فِي الْكِتَابِ مَسْطُورًا
This has been written in the Book.
This ruling, which is that those who are blood relatives have closer personal ties to one another, is a ruling which Allah has decreed and which is written in the First Book which cannot be altered or changed.
This is the view of Mujahid and others.
(This is the case) even though Allah legislated something different at certain times, and there is wisdom behind this, for He knew that this would be abrogated and the original ruling that was instituted an eternity ago would prevail, and this is His universal and legislative decree.
And Allah knows best.
33:7
وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِنَ النَّبِیّٖنَ مِیۡثَاقَہُمۡ وَ مِنۡکَ وَ مِنۡ نُّوۡحٍ وَّ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسَی ابۡنِ مَرۡیَمَ ۪ وَ اَخَذۡنَا مِنۡہُمۡ مِّیۡثَاقًا غَلِیۡظًا ۙ﴿۷﴾
And [mention, O Muhammad], when We took from the prophets their covenant and from you and from Noah and Abraham and Moses and Jesus, the son of Mary; and We took from them a solemn covenant.
The Covenant of the Prophets
Allah tells us about the five Mighty Messengers with strong resolve and the other Prophets, how He took a covenant from them to establish the religion of Allah and convey His Message, and to cooperate and support one another, as Allah says:
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَـقَ النَّبِيِّيْنَ لَمَأ ءَاتَيْتُكُم مِّن كِتَـبٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَأءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُوْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ قَالَ ءَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذلِكُمْ إِصْرِى قَالُواْ أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُواْ وَأَنَاْ مَعَكُمْ مِّنَ الشَّـهِدِينَ
And when Allah took the covenant of the Prophets, saying:
“Take whatever I gave you from the Book and Hikmah, and afterwards there will come to you a Messenger confirming what is with you; you must, then, believe in him and help him.”
Allah said:”Do you agree, and will you take up My covenant!”
They said:”We agree.”
He said:”Then bear witness; and I am with you among the witnesses.” (3:81)
This covenant was taken from them after their missions started.
Elsewhere in the Qur’an, Allah mentions five by name, and these are the Mighty Messengers with strong resolve. They are also mentioned by name in this Ayah and in the Ayah:
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الِدِينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِى أَوْحَيْنَأ إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُواْ الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِ
He (Allah) has ordained for you the same religion which He ordained for Nuh, and that which We have revealed to you, and that which We ordained for Ibrahim, Musa and `Isa saying you should establish religion and make no divisions in it. (42:13)
This is the covenant which Allah took from them, as He says:
وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ
And when We took from the Prophets their covenant, and from you, and from Nuh, Ibrahim, Musa, and `Isa son of Maryam.
This Ayah begins with the last Prophet, as a token of respect, may the blessings of Allah be upon him, then the names of the other Prophets are given in order, may the blessings of Allah be upon them.
وَأَخَذْنَا مِنْهُم مِّيثَاقًا غَلِيظًا
We took from them a strong covenant.
Ibn Abbas said:
“The strong covenant is Al-`Ahd (the covenant)
33:8
لِّیَسۡـَٔلَ الصّٰدِقِیۡنَ عَنۡ صِدۡقِہِمۡ ۚ وَ اَعَدَّ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابًا اَلِیۡمًا ٪﴿۸﴾
That He may question the truthful about their truth. And He has prepared for the disbelievers a painful punishment.
لِيَسْأَلَ الصَّادِقِينَ عَن صِدْقِهِمْ
That He may ask the truthful about their truth.
Mujahid said:
“This refers to, those who convey the Message from the Messengers.”
وَأَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ
And He has prepared for the disbelievers. i.e., among their nations,
عَذَابًا أَلِيمًا
a painful torment.
i.e., agonizing.
We bear witness that the Messengers did indeed convey the Message of their Lord and advised their nations, and that they clearly showed them the truth in which there is no confusion, doubt or ambiguity, even though they were rejected by the ignorant, stubborn and rebellious wrongdoers. What the Messengers brought is the truth, and whoever opposes them is misguided. As the people of Paradise will say:
لَقَدْ جَأءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ
Indeed, the Messengers of our Lord did come with the truth. (7:43
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran