(টপিক#১০৫০/মুনাফিকরা বলেছিল , বই নং:-৩২) [মুনাফিক কি? কুরআন ও হাদীসের আলোকে:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৩:আহযাব পারা:২১ ৯-২০ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৫০/মুনাফিকরা বলেছিল , বই নং:-৩২)
[মুনাফিক কি? কুরআন ও হাদীসের আলোকে:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৩:আহযাব
পারা:২১
৯-২০ নং আয়াত:-
৩৩:৯
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ جَآءَتۡکُمۡ جُنُوۡدٌ فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ رِیۡحًا وَّ جُنُوۡدًا لَّمۡ تَرَوۡہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرًا ۚ﴿۹﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল অতঃপর আমরা তাদের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম ঘূর্ণিবায়ু এবং এমন বাহিনী যা তোমরা দেখনি । আর তোমরা যা কর আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা।
৩৩:১০
اِذۡ جَآءُوۡکُمۡ مِّنۡ فَوۡقِکُمۡ وَ مِنۡ اَسۡفَلَ مِنۡکُمۡ وَ اِذۡ زَاغَتِ الۡاَبۡصَارُ وَ بَلَغَتِ الۡقُلُوۡبُ الۡحَنَاجِرَ وَ تَظُنُّوۡنَ بِاللّٰہِ الظُّنُوۡنَا ﴿۱۰﴾
যখন তারা ওপর ও নিচে থেকে তোমাদের ওপর চড়াও হলো, যখন ভয়ে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল, প্রাণ হয়ে পড়েছিল ওষ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা প্রকার ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিলে।
৩৩:১১
ہُنَالِکَ ابۡتُلِیَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ زُلۡزِلُوۡا زِلۡزَالًا شَدِیۡدًا ﴿۱۱﴾
তখন মু’মিনদেরকে নিদারুণ পরীক্ষা করা হলো এবং ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়া হলো।
৩৩:১২
وَ اِذۡ یَقُوۡلُ الۡمُنٰفِقُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ مَّا وَعَدَنَا اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗۤ اِلَّا غُرُوۡرًا ﴿۱۲﴾
স্মরণ করো যখন মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ ছিল তারা পরিষ্কার বলছিল, আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূল আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
৩৩:১৩
وَ اِذۡ قَالَتۡ طَّآئِفَۃٌ مِّنۡہُمۡ یٰۤاَہۡلَ یَثۡرِبَ لَا مُقَامَ لَکُمۡ فَارۡجِعُوۡا ۚ وَ یَسۡتَاۡذِنُ فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمُ النَّبِیَّ یَقُوۡلُوۡنَ اِنَّ بُیُوۡتَنَا عَوۡرَۃٌ ؕۛ وَ مَا ہِیَ بِعَوۡرَۃٍ ۚۛ اِنۡ یُّرِیۡدُوۡنَ اِلَّا فِرَارًا ﴿۱۳﴾
যখন তাদের মধ্য থেকে একটি দল বললো, “হে ইয়াসরিববাসীরা! তোমাদের জন্য এখন অবস্থান করার কোন সুযোগ নেই, ফিরে চলো।” যখন তাদের একপক্ষ নবীর কাছে এই বলে ছুটি চাচ্ছিল যে, “আমাদের গৃহ বিপদাপন্ন,” অথচ তা বিপদাপন্ন ছিল না আসলে তারা (যুদ্ধক্ষেত্র থেকে) পালাতে চাচ্ছিল।
৩৩:১৪
وَ لَوۡ دُخِلَتۡ عَلَیۡہِمۡ مِّنۡ اَقۡطَارِہَا ثُمَّ سُئِلُوا الۡفِتۡنَۃَ لَاٰتَوۡہَا وَ مَا تَلَبَّثُوۡا بِہَاۤ اِلَّا یَسِیۡرًا ﴿۱۴﴾
যদি শহরের বিভিন্ন দিক থেকে শত্রুরা ঢুকে পড়তো এবং সেসময় তাদেরকে ফিতনা সৃষ্টি করার জন্য আহবান জানানো হতো, তাহলে তারা তাতেই লিপ্ত হয়ে যেতো এবং ফিতনায় শরীক হবার ব্যাপারে তারা খুব কমই ইতস্তত করতো।
৩৩:১৫
وَ لَقَدۡ کَانُوۡا عَاہَدُوا اللّٰہَ مِنۡ قَبۡلُ لَا یُوَلُّوۡنَ الۡاَدۡبَارَ ؕ وَ کَانَ عَہۡدُ اللّٰہِ مَسۡـُٔوۡلًا ﴿۱۵﴾
তারা ইতিপূর্বে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্টপ্রদর্শন করবে না এবং আল্লাহর সাথে করা অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা তো হবেই।
৩৩:১৬
قُلۡ لَّنۡ یَّنۡفَعَکُمُ الۡفِرَارُ اِنۡ فَرَرۡتُمۡ مِّنَ الۡمَوۡتِ اَوِ الۡقَتۡلِ وَ اِذًا لَّا تُمَتَّعُوۡنَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿۱۶﴾
বলুন, ‘তোমাদের কোন লাভই হবে না পালিয়ে বেড়ানো, যদি তোমরা মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে পালিয়ে যাও, তবে সে ক্ষেত্রে তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে।’
৩৩:১৭
قُلۡ مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَعۡصِمُکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ اِنۡ اَرَادَ بِکُمۡ سُوۡٓءًا اَوۡ اَرَادَ بِکُمۡ رَحۡمَۃً ؕ وَ لَا یَجِدُوۡنَ لَہُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیۡرًا ﴿۱۷﴾
বলুন ‘কে তোমাদেকে আল্লাহ্ থেকে বাধা দান করবে, যদি তিনি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছে করেন অথবা তিনি তোমাদেরকে অনুগ্রহ করতে ইচ্ছে করেন?’ আর তারা আল্লাহ্ ছাড়া নিজেদের জন্য কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।
৩৩:১৮
قَدۡ یَعۡلَمُ اللّٰہُ الۡمُعَوِّقِیۡنَ مِنۡکُمۡ وَ الۡقَآئِلِیۡنَ لِاِخۡوَانِہِمۡ ہَلُمَّ اِلَیۡنَا ۚ وَ لَا یَاۡتُوۡنَ الۡبَاۡسَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿ۙ۱۸﴾
আল্লাহ্ অবশ্যই জানেন তোমাদের মধ্যে কারা বাধাদানকারী এবং কারা তাদের ভাইদেরকে বলে, আমাদের দিকে চলে এসো। ‘ তারা অল্পই যুদ্ধে যোগদান করে —-
৩৩:১৯
اَشِحَّۃً عَلَیۡکُمۡ ۚۖ فَاِذَا جَآءَ الۡخَوۡفُ رَاَیۡتَہُمۡ یَنۡظُرُوۡنَ اِلَیۡکَ تَدُوۡرُ اَعۡیُنُہُمۡ کَالَّذِیۡ یُغۡشٰی عَلَیۡہِ مِنَ الۡمَوۡتِ ۚ فَاِذَا ذَہَبَ الۡخَوۡفُ سَلَقُوۡکُمۡ بِاَلۡسِنَۃٍ حِدَادٍ اَشِحَّۃً عَلَی الۡخَیۡرِ ؕ اُولٰٓئِکَ لَمۡ یُؤۡمِنُوۡا فَاَحۡبَطَ اللّٰہُ اَعۡمَالَہُمۡ ؕ وَ کَانَ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرًا ﴿۱۹﴾
পক্ষান্তরে তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং পরকাল কামনা করলে, তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীলা আল্লাহ তাদের জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’
৩৩:২০
یَحۡسَبُوۡنَ الۡاَحۡزَابَ لَمۡ یَذۡہَبُوۡا ۚ وَ اِنۡ یَّاۡتِ الۡاَحۡزَابُ یَوَدُّوۡا لَوۡ اَنَّہُمۡ بَادُوۡنَ فِی الۡاَعۡرَابِ یَسۡاَلُوۡنَ عَنۡ اَنۡۢبَآئِکُمۡ ؕ وَ لَوۡ کَانُوۡا فِیۡکُمۡ مَّا قٰتَلُوۡۤا اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿٪۲۰﴾
তারা মনে করছে আক্রমণকারী দল এখনো চলে যায়নি। আর যদি আক্রমণকারীরা আবার এসে যায়, তাহলে তাদের মন চায় এ সময় তারা কোথাও মরুভূমিতে বেদুইনের মধ্যে গিয়ে বসতো এবং সেখান থেকে তোমাদের খবরাখবর নিতো। তবুও যদি তারা তোমাদের মধ্যে থাকেও তাহলে যুদ্ধে খুব কমই অংশ নেবে।

আলোচিত আয়াতে গুলোতে অনুধাবন করতে নিম্ন বর্ণিত আয়াত গুলো পড়লে ভালো হয়।

১) Al-Munafiqun 63:2

ٱتَّخَذُوٓا۟ أَيْمَٰنَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا۟ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ إِنَّهُمْ سَآءَ مَا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ
তারা তাদের শপথগুলোকে ঢালরূপে ব্যবহার করে, ফলে তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করে। তারা যা করে, নিশ্চয় তা কতই না মন্দ !

They have taken their oaths as a cover, so they averted [people] from the way of Allāh. Indeed, it was evil that they were doing.

২) At-Taubah 9:67

ٱلْمُنَٰفِقُونَ وَٱلْمُنَٰفِقَٰتُ بَعْضُهُم مِّنۢ بَعْضٍۚ يَأْمُرُونَ بِٱلْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ ٱلْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْۚ نَسُوا۟ ٱللَّهَ فَنَسِيَهُمْۗ إِنَّ ٱلْمُنَٰفِقِينَ هُمُ ٱلْفَٰسِقُونَ
মুনাফেক পুরুষ ও মুনাফেক নারী একে অপরের অংশ, তারা অসৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং সৎকাজে নিষেধ করে, তারা তাদের হাত গুটিয়ে রাখে, তারা আল্লাহ্‌ কে ভুলে গিয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন; মুনাফেকরা তো ফাসিক।

The hypocrite men and hypocrite women are of one another. They enjoin what is wrong and forbid what is right and close their hands.[1] They have forgotten Allāh, so He has forgotten them [accordingly]. Indeed, the hypocrites – it is they who are the defiantly disobedient.

৩) At-Taubah 9:75

وَمِنْهُم مَّنْ عَٰهَدَ ٱللَّهَ لَئِنْ ءَاتَىٰنَا مِن فَضْلِهِۦ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ
তাদের মধ্যে এমন কতিপয় লোক রয়েছে, যারা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল, আল্লাহ যদি আমাদেরকে নিজ অনুগ্রহ হতে দান করেন, তাহলে অবশ্যই আমরা দান-খয়রাত করব এবং সৎলোকদের অন্তর্ভুক্ত হবো।

And among them are those who made a covenant with Allāh, [saying], “If He should give us from His bounty, we will surely spend in charity, and we will surely be among the righteous.”

৪) At-Taubah 9:76

فَلَمَّآ ءَاتَىٰهُم مِّن فَضْلِهِۦ بَخِلُوا۟ بِهِۦ وَتَوَلَّوا۟ وَّهُم مُّعْرِضُونَ

অতঃপর যখন আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহ দান করলেন, তখন তারা তাতে কার্পণ্য করতে লাগল এবং বিমুখ হয়ে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল।

But when He gave them from His bounty, they were stingy with it and turned away while they refused.

৫) At-Taubah 9:77

فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًا فِى قُلُوبِهِمْ إِلَىٰ يَوْمِ يَلْقَوْنَهُۥ بِمَآ أَخْلَفُوا۟ ٱللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا۟ يَكْذِبُونَ
পরিণামে আল্লাহ তাদের শাস্তিস্বরূপ তাদের অন্তরসমূহে মুনাফিক্বী (কপটতা) স্থায়ী করে দিলেন তাঁর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হওয়ার দিন পর্যন্ত। যেহেতু তারা আল্লাহর সাথে নিজেদের কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিল এবং তারা মিথ্যা বলত।

So He penalized them with hypocrisy in their hearts until the Day they will meet Him – because they failed Allāh in what they promised Him and because they [habitually] used to lie.

৬) An-Nisa’ 4:142

إِنَّ ٱلْمُنَٰفِقِينَ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَهُوَ خَٰدِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوٓا۟ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُوا۟ كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا
নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুতঃ তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন । আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।

Indeed, the hypocrites [think to] deceive Allāh, but He is deceiving them. And when they stand for prayer, they stand lazily, showing [themselves to] the people and not remembering Allāh except a little,

৭) Muhammad 47:9

ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا۟ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَٰلَهُمْ
এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করেছে। কাজেই তিনি তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল করে দিয়েছেন।

That is because they disliked what Allāh revealed, so He rendered worthless their deeds.

৮) At-Taubah 9:67

ٱلْمُنَٰفِقُونَ وَٱلْمُنَٰفِقَٰتُ بَعْضُهُم مِّنۢ بَعْضٍۚ يَأْمُرُونَ بِٱلْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ ٱلْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْۚ نَسُوا۟ ٱللَّهَ فَنَسِيَهُمْۗ إِنَّ ٱلْمُنَٰفِقِينَ هُمُ ٱلْفَٰسِقُونَ
মুনাফেক পুরুষ ও মুনাফেক নারী একে অপরের অংশ, তারা অসৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং সৎকাজে নিষেধ করে, তারা তাদের হাত গুটিয়ে রাখে, তারা আল্লাহ্‌ কে ভুলে গিয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন; মুনাফেকরা তো ফাসিক।

The hypocrite men and hypocrite women are of one another. They enjoin what is wrong and forbid what is right and close their hands.[1] They have forgotten Allāh, so He has forgotten them [accordingly]. Indeed, the hypocrites – it is they who are the defiantly disobedient.

৯) Aal-e-Imran 3:120

إِن تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِن تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا۟ بِهَاۖ وَإِن تَصْبِرُوا۟ وَتَتَّقُوا۟ لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْـًٔاۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ
তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়। তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকী হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না । তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।

If good touches you, it distresses them; but if harm strikes you, they rejoice at it. And if you are patient and fear Allāh, their plot will not harm you at all. Indeed, Allāh is encompassing of what they do.

১০) An-Nisa’ 4:60

أَلَمْ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ ءَامَنُوا۟ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوٓا۟ إِلَى ٱلطَّٰغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوٓا۟ أَن يَكْفُرُوا۟ بِهِۦ وَيُرِيدُ ٱلشَّيْطَٰنُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلَٰلًۢا بَعِيدًا
তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা ধারণা (ও দাবী) করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে তারা বিশ্বাস করে? অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়; যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।

Have you not seen those who claim to have believed in what was revealed to you, [O Muḥammad], and what was revealed before you? They wish to refer legislation to ṭāghūt,[1] while they were commanded to reject it; and Satan wishes to lead them far astray.

১১) An-Nisa’ 4:61

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا۟ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَإِلَى ٱلرَّسُولِ رَأَيْتَ ٱلْمُنَٰفِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودًا
তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার দিকে এবং রসূলের দিকে এস।’ তখন তুমি মুনাফিক (কপট)দেরকে তোমার নিকট থেকে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে।

And when it is said to them, “Come to what Allāh has revealed and to the Messenger,” you see the hypocrites turning away from you in aversion.

১২) Al-Baqarah 2:11

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ قَالُوٓا۟ إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না’, তারা বলে, ‘আমরা তো শান্তি স্থাপনকারীই।’
And when it is said to them, “Do not cause corruption on the earth,” they say, “We are but reformers.”

১৩) Al-Baqarah 2:16

أُو۟لَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشْتَرَوُا۟ ٱلضَّلَٰلَةَ بِٱلْهُدَىٰ فَمَا رَبِحَت تِّجَٰرَتُهُمْ وَمَا كَانُوا۟ مُهْتَدِينَ
যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘ তোমরা ঈমান আন যেমন লোকেরা ঈমান এনেছে’ , তারা বলে, ; নির্বোধ লোকেরা যেরুপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরুপ ঈমান আনবো ?’ সাবধান ! নিশ্চয় এরা নির্বোধ, কিন্তু তারা তা জানে না।
Those are the ones who have purchased error [in exchange] for guidance, so their transaction has brought no profit, nor were they guided.

. ১৪) Al-Ma’idah 5:61

وَإِذَا جَآءُوكُمْ قَالُوٓا۟ ءَامَنَّا وَقَد دَّخَلُوا۟ بِٱلْكُفْرِ وَهُمْ قَدْ خَرَجُوا۟ بِهِۦۚ وَٱللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا كَانُوا۟ يَكْتُمُونَ
তারা যখন তোমাদের কাছে আসে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’, অথচ তারা কুফর নিয়েই প্রবেশ করেছে এবং তারা তা নিয়েই বেরিয়ে গেছে। আর তারা যা গোপন করে, আল্লাহ তা ভালভাবেই জানেন।

And when they come to you, they say, “We believe.” But they have entered with disbelief [in their hearts], and they have certainly left with it. And Allāh is most knowing of what they were concealing.

হাদীসে‌ বলা হয়েছে:-

1. Hadith

حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، قَالَ حَدَّثَنَا سَلاَّمُ بْنُ مِسْكِينٍ، عَنْ شَيْخٍ، شَهِدَ أَبَا وَائِلٍ فِي وَلِيمَةٍ فَجَعَلُوا يَلْعَبُونَ يَتَلَعَّبُونَ يُغَنُّونَ فَحَلَّ أَبُو وَائِلٍ حَبْوَتَهُ وَقَالَ سَمِعْتُ عَبْدَ اللَّهِ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏”‏ الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِي الْقَلْبِ ‏”‏ ‏.‏

আবূ ওয়াইল(রহঃ)-এর সঙ্গে এক বৌ-ভাত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।তখন লোকেরা খেলাধূলা ও আনন্দ আর সঙ্গীতে মত্ত হল।আবূ ওয়াইল (রহঃ) হাত দিয়ে নিজ হাঁটুদ্বয় পেঁচিয়ে ধরে বললেন, আমি ‘আবদুল্লাহ(রাঃ)-কে বলতে শুনেছি,আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ নিশ্চয়ই সঙ্গীত অন্তরে কপটতা সৃষ্টি করে।

Salam ibn Miskin, quoting an old man who witnessed AbuWa’il in a wedding feast, said:
They began to play, amuse and sing. He united the support of his hand round his knees that were drawn up, and said: I heard Abdullah (ibn Mas’ud) say: I heard the apostle of Allah (ﷺ) say: Singing produces hypocrisy in the heart.

Da’if (Al-Albani)

Sunan Abi Dawud, 4927
In-Book Reference: Book 43, Hadith 155
English Reference: Book 42, Hadith 4909
২) Hadith

حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ مَنِيعٍ، حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، عَنْ أَبِي غَسَّانَ، مُحَمَّدِ بْنِ مُطَرِّفٍ عَنْ حَسَّانَ بْنِ عَطِيَّةَ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ الْحَيَاءُ وَالْعِيُّ شُعْبَتَانِ مِنَ الإِيمَانِ وَالْبَذَاءُ وَالْبَيَانُ شُعْبَتَانِ مِنَ النِّفَاقِ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ إِنَّمَا نَعْرِفُهُ مِنْ حَدِيثِ أَبِي غَسَّانَ مُحَمَّدِ بْنِ مُطَرِّفٍ ‏.‏ قَالَ وَالْعِيُّ قِلَّةُ الْكَلاَمِ وَالْبَذَاءُ هُوَ الْفُحْشُ فِي الْكَلاَمِ وَالْبَيَانُ هُوَ كَثْرَةُ الْكَلاَمِ مِثْلُ هَؤُلاَءِ الْخُطَبَاءِ الَّذِينَ يَخْطُبُونَ فَيُوَسِّعُونَ فِي الْكَلاَمِ وَيَتَفَصَّحُونَ فِيهِ مِنْ مَدْحِ النَّاسِ فِيمَا لاَ يُرْضِي اللَّهَ ‏.‏
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ লজ্জা-সম্ভ্রম ও অল্প কথা বলা ঈমানের দুইটি শাখা। অশ্লীলতা ও বাকপটুতা (বাচালতা) নিফাকের (মুনাফিকীর) দুইটি শাখা।

সহীহ, ঈমান ইবনে আবী শাইবা (১১৮) , মিশকাত তাহকীক ছানী (৪৭৯৬)

Abu Umamah narrated that the Messenger of Allah (s.A.W) said:
“Al-Haya’ and Al-‘Iy are two branches of faith, and Al-Badha and Al-Bayan are two branches of Hypocrisy.”

Sahih (Darussalam)

Jami` at-Tirmidhi, 2027
In-Book Reference: Book 27, Hadith 133
English Reference: Vol. 4, Book 1, Hadith 2027

3) Hadith

حَدَّثَنَا ابْنُ سَلاَمٍ، حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ أَبِي سُهَيْلٍ، نَافِعِ بْنِ مَالِكِ بْنِ أَبِي عَامِرٍ عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ ‏”‏‏.‏
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মুনাফিকের চিহ্ন তিনটিঃ যখন সে কথা বলে, তখন মিথ্যা বলে, যখন সে ওয়াদা করে, তখন তা ভঙ্গ করে, আর যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় সে তাতে খিয়ানাত করে।(আধুনিক প্রকাশনী- ৫৬৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫৫২)

Narrated Abu Huraira:
Allah’s Messenger (ﷺ) said, “The signs of a hypocrite are three: Whenever he speaks, he tells a lie; and whenever he promises, he breaks his promise; and whenever he is entrusted, he betrays (proves to be dishonest)”.

Sahih

Sahih al-Bukhari, 6095
In-Book Reference: Book 78, Hadith 122
USC-MSA web (English) reference: Vol. 8, Book 73, Hadith 117 (deprecated numbering scheme)

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলোচনা(৯-২৭) : সেকালে যুদ্ধ বিগ্রহ ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ইসলামী ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিলো। দিনের পর দিন ক্রমাগত যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটতে থাকায় এই ব্যক্তিত্ব অধিকতর পরিপক্কতা অর্জন করতাে, উৎকর্ষ লাভ করতাে এবং উত্তম গুণাবলী বিকশিত হতাে। এই পরিপক্ক ও গুণধর ব্যক্তিত্বগুলাের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী সমাজ নিজের স্বতন্ত্র গুণ বৈশিষ্ট্য, স্বতন্ত্র মূল্যবােধ এবং স্বতন্ত্র চরিত্র ও কৃষ্টি নিয়ে মানব সমাজে আবির্ভূত হয়েছিলাে। সদ্য গঠিত ইসলামী সমাজের জন্যে এসব যুদ্ধ-বিগ্রহ এতাে কষ্টকর হয়ে দেখা দিতাে যে, কখনাে কখনাে তা কঠিন অগ্নি পরীক্ষার রূপ নিতাে। স্বর্ণকে যেমন আগুনে পুড়িয়ে আসল ও খাদ বাছাই করা হয়, ঠিক তেমনি এইসব যুদ্ধ-বিগ্রহ দ্বারা মুসলমানদের নৈতিক মান যাচাই হয়ে যেতাে। এরপর আর ভালােমন্দ মিলে-মিশে একাকার হয়ে থাকতে পারতাে না এবং কার কেমন চরিত্র, তা অজানা থাকতাে না। এইসব অগ্নি পরীক্ষার মাঝে অথবা শেষে একটু একটু করে কোরআন নাযিল হয়ে ঘটনার প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরতো, এর বিভিন্ন দিকের ওপর আলােকপাত করতাে এবং ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মতামত, আবেগ অনুভূতি, উদ্দেশ্য ও মনােভাব উন্মোচন করে দিতাে। সকলের অন্তকরণ যখন আলােয় উদ্ভাসিত এবং সবরকমের আড়াল ও আবরণ থেকে মুক্ত, তখন সেই অন্তরগুলােকে কোরআন সম্বােধন করতাে, অন্তরের সেই কোমল স্থানগুলােকে খুঁজে খুঁজে বের করতাে যার মধ্যে গ্রহণ করা ও প্রভাবিত হওয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা রয়েছে। এরূপ অন্তরগুলােকে সে দিনের পর দিন প্রতিটা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে লালন করে অধিকতর যােগ্য করে গড়ে তুলতো এবং তার মনােনীত আদর্শে দীক্ষিত করতাে। কোরআন একই সাথে সমুদয় আদেশ নিষেধ এবং সমুদয় আইনগত বিধি বিধান ও নৈতিক নির্দেশাবলী নিয়ে নাযিল হবে এ জন্যে মুসলমানদেরকে প্রস্তুত করা হয়নি। বরঞ্চ আল্লাহ তায়ালা ক্ৰমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদেরকে গড়ে তুলেছেন। তিনি জানতেন যে, মানুষকে এ ধরনের বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়া সঠিকভাবে প্রস্তুত করা ও পরিপক্কতা দান করা সম্ভব নয় । এরূপ প্রশিক্ষণ তার অন্তরের অন্তস্থলে বদ্ধমূল করা এবং মেরুমজ্জায় খােদাই করে দেয়া সম্ভব। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্য দিয়ে এ প্রশিক্ষণ বিভিন্ন ব্যক্তিকে যতােটা কার্যকরভাবে দেয়া যায় ততােটা আর কোনােভাবে দেয়া যায় না। কোরআন তার শ্রোতাদের সামনে ঘটনার প্রকৃত স্বরূপ ও তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে। পরীক্ষার আগুনে উত্তপ্ত, বিগলিত, ও বশীভূত এই অন্তরে সে বিভিন্ন নির্দেশিকা সফলতার সাথে উৎকীর্ণ করে ও তাকে আপন রংগে রঞ্জিত করে। রাসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় মুসলমানরা যে সময় অতিবাহিত করেছেন, সেটা ছিলাে যথার্থই একটা চমকপ্রদ সময়। এ সময়টাতেই মহান আল্লাহ ও বিশ্ব মানবের মধ্য প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্য সংযোগ স্থাপিত হয়। বিভিন্ন ঘটনা ও উক্তির মধ্য দিয়ে এ সংযােগ ও মিলনের প্রতিফলন ঘটেছে। এ সময় প্রত্যেক মুসলমান গভীর রাতে নির্জনে নিভৃতে অবস্থানকালেও অনুভব করতাে যে, আল্লাহর চোখ তার ওপর নিবদ্ধ রয়েছে এবং তিনি তার প্রতিটা কাজ দেখতে পাচ্ছেন, আর তার কান সর্বক্ষণ পাতা রয়েছে এবং তিনি সব কিছু শুনতে পাচ্ছেন। সে আরাে অনুভব করে যে, তারা যে কোনাে কথা, কাজ, এমনকি অন্তরের সামান্যতম ইচ্ছা বা অভিলাষ যে কোনাে মুহর্তে কোরআনের কোনাে আয়াত নাযিল হওয়ার মধ্য দিয়ে ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এই সময়টাতেই প্রত্যেক মুসলমান নিজের ও তার প্রতিপালকের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংযােগ অনুভব করতাে। এ জন্যে যখনই সে কোনাে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতাে, আল্লাহর পক্ষ থেকে সে সমস্যার একটা সমাধান আসবে বলে বিশ্বাস করতাে এবং সে জন্যে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতাে। এই সময়ে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাকে বলতেন, ওহে অমুক, তুমি তাে এই কথা বলেছিলে, এই কাজ করেছিলে, এই কথা মনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রেখেছিলে, এই কথা প্রকাশ করেছিলে, তুমি এরূপ হও এবং এরূপ হয়ো না ইত্যাদি ইত্যাদি। কী বিস্ময়কর ব্যাপার যে, মহান আল্লাহ একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সম্বােধন করেন। অথচ এই পৃথিবীর অধিবাসীরা সকলে মিলিত হয়েও এবং এই গােটা পৃথিবীটাও আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্যে একটা ক্ষুদ্র কণার চেয়ে বেশী নয়। বস্তুত সেটা একটা বিস্ময়কর সময়ই ছিলাে বটে । আজকের মানুষ সে অবস্থাটা কেবল কল্পনাই করতে পারে। কিন্তু বুঝতে পারে না যে, এমন অবস্থার উদ্ভব কেমন করে হয়েছিলাে। | কিন্তু মহান আল্লাহ মুসলমানদের নিছক এসব আবেগ-অনুভূতির কাছে সােপর্দ করেই ক্ষ্যান্ত থাকেননি। তিনি চাননি যে, মহান আল্লাহর সাথে বান্দার প্রত্যক্ষ সংযােগের অনুভূতি এবং কোরআন নাযিল হওয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তাদের মনের কথা প্রকাশিত হওয়ার দ্বারাই তাদের ইসলামী ব্যক্তিত্বের বিকাশ বৃদ্ধি ও পরিপক্কতা অর্জিত হতে থাকুক। বরঞ্চ তিনি তাদেরকে বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছেন এবং এমন পরীক্ষার মুখােমুখী করেছেন, যা তাদেরকে কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেও বাধ্য করেছে। আবার বেশ কিছু শিক্ষাও দিয়েছে। এ সব পরীক্ষার পেছনে ছিলাে আল্লাহর সুগভীর প্রজ্ঞা ও মহৎ উদ্দেশ্য যা একমাত্র তিনিই জানেন। তার সৃষ্টি সম্পর্কে তার জ্ঞানই সবচেয়ে বেশী, সবচেয়ে সুক্ষ্ম ও নির্ভুল। তিনি সর্ববিষয়ে সূক্ষ্ম জ্ঞানী ও ব্যাপকতর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। মহান আল্লাহর এই সুক্ষ্ম ও নির্ভুল জ্ঞান এবং এই মহৎ উদ্দেশ্য উপলদ্ধি করার জন্যে আমাদের কিছু চিন্তা গবেষণা করা প্রয়ােজন এই চিন্তা গবেষণা ও তা দ্বারা অর্জিত উপলব্ধির আলােকেই আমাদের বিবেচনা করতে হবে দুনিয়ার যাবতীয় ঘটনাবলী ও পরীক্ষা নিরীক্ষাকে।  *ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধ : সূরা আল আহযাবের এই অংশটুকুতে ইসলামী আন্দোলন ও মুসলিম জাতির ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং মুসলমানদের ওপর আপতিত কঠিন পরীক্ষার একটা পর্ব আলােচিত হয়েছে। সেই ঘটনা হলাে আহযাব যুদ্ধ। এটা সংঘটিত হয় হিজরী চতুর্থ বা পঞ্চম সনে। এটা ছিলাে মদীনার সদ্য প্রসূত মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের চিন্তাধারা, মূল্যবােধ ও চরিত্রের দৃঢ়তা ও পরিপক্কতার পরীক্ষা। কোরআনের এই অংশের আয়াতগুলাে ঘটনা বর্ণনায় যে ধরনের বাচনভংগী প্রয়ােগ করেছে এর বিভিন্ন দৃশ্য, মন্তব্য, তৎপরতা ও মানসিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা এবং এ সংক্রান্ত আল্লাহর বিধান ও মূল্যবােধ বিশ্লেষণের যে রীতি অবলম্বন করেছে, তা থেকে আমরা বুঝতে পারি মহান আল্লাহ একই সাথে কোরআন দ্বারা ও ঘটনাবলীর ঘাত-প্রতিঘাত দ্বারা মুসলিম উম্মাহকে কিভাবে শিক্ষা দিতেন। ঘটনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে কোরআনের গৃহীত পদ্ধতি বুঝবার উদ্দেশ্যে আমি প্রথমে সীরাত গ্রন্থসমূহে বর্ণিত এই ঘটনার বিবরণ কিছুটা সংক্ষেপে তুলে ধরছি এবং তারপর সুরার তাফসীরে আত্ম নিয়ােগ করবাে। এতে কোনাে ঘটনা সম্পর্কে মানুষের বর্ণনায় ও আল্লাহর বর্ণনায় পার্থক্য বুঝা যাবে। মােহাম্মদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, খন্দকের যুদ্ধ সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া গেছে তা হলাে যে, বনু নযীর গােত্রের হুয়াই বিন আখতার, কেনানা বিন আবিল হাকীক, সালাম বিন আবিল হাকীক, বনু ওয়ায়েশ গােত্রের হাওদা বিন কায়েস ও আবু আম্মার প্রমুখসহ বনু নযীর ও বনু ওয়ায়েলের একদল ইহুদী নেতা, যারা খন্দক যুদ্ধের উদ্যোক্তা ছিলাে এবং আরবের বেশীর ভাগ গােত্রকে রাসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে সমবেত করেছিলাে, মক্কার কুরাইশদের কাছে উপনীত হয়ে তাদেরকে রাসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্ররােচনা দিতে লাগলাে। তারা বললাে, আমরা মুহাম্মদ(স.)-কে সমূলে উৎখাত করার জন্যে তােমাদের সাথে থাকবাে। কোরায়শরা তাদেরকে বললাে, শুনো ইহুদী নেতৃবর্গ, তােমরা তাে প্রথম কিতাবের অধিকারী ছিলে, আর আমরা ও মােহাম্মদ(স.) যে বিষয়ে মতভেদে লিপ্ত আছি, সে সম্পর্কেও তােমরা নিশ্চয়ই অবগত আছ। এখন বলো, আমাদের ধর্ম ভালাে, না মোহাম্মদের ধর্ম ভালো! তারা বললাে, বরঞ্চ তার ধর্মের চেয়ে তােমাদের ধর্মই ভালাে এবং তােমরা অধিকারের ক্ষেত্র তার চেয়ে অগ্রেগণ্য। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ৫১ থেকে ৫৬ নং আয়াত নাযিল করেন। ইহুদী নেতাদের মুখ থেকে এ কথাগুলাে শুনে কোরায়েশ নেতারা আনন্দিত হলাে এবং রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালনার জন্যে তারা যে আহ্বান জানালাে, তা বাস্তবায়নে তারা পুরোমাত্রায় প্রস্তুত হয়ে গেলাে। এরপর সেই ইহুদী নেতৃবর্গ বনু গাতফানের কাছে গেলাে। তারা তাদেরকেও রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্ররােচিত করলাে। তারা তাদেরকে জানালাে যে, ইহুদীরা এ ক্ষেত্রে তাদেরকে পূর্ণ সহযােগিতা করবে এবং কোরায়শরাও তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। এ কথা শুনে গাতফানীরাও প্রস্তুত হয়ে গেলাে এবং যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হলাে। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশ, উযায়না ইবনে হাসনের নেতৃত্বে বনু গাতফান, হারেস ইবনে আওফের নেতৃত্বে বনু মুরাহ এবং মাশয়ার বিন রাখালের নেতৃত্বে বনু আশজা মদীনা আক্রমণ করার জন্যে অভিযানে বেরিয়ে পড়লাে। রাসূল(স.) আগ্রাসনের খবর শুনে মদীনার চারপাশে খন্দক বা পরিখা খনন করলেন। এই খননকার্যে সাধারণ মুসলমানদের সাথে সাথে স্বয়ং রাসূল(স.) ও অংশগ্রহণ করলেন। সকলেই অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন। কিন্তু কিছুসংখ্যক মুনাফিক সাধারণ মুসলমানদের সাথে ও রসূল(স.)-এর সাথে পরিখা খনন থেকে নানা ওযুহাতে পিছিয়ে থাকলাে। কেউ কেউ রসূল(স.)-এর কাছ থেকে কোনাে অনুমতি না নিয়ে এবং তাকে কিছু না জানিয়ে গােপনে নিজ নিজ পরিবার-পরিজনের কাছে যেতে লাগলাে। ওদিকে মুসলমানদের মধ্য থেকে কারাে কোনাে জরুরী প্রয়ােজন দেখা দিলে সে রসূল(স.)-কে তা জানিয়ে ও অনুমতি নিয়ে যেতাে এবং জরুরী কাজ সেরে ফিরে এসে আবার নিজ কাজে আত্মনিয়ােগ করতাে। কেননা তারা সৎ কাজে অতিশয় আগ্রহী ও নিষ্ঠাবান ছিলাে। এসব নিষ্ঠাবান মােমেনদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা নূরের ৬১ নং আয়াত নাযিল করেন। অতপর কাজে ফাঁকি দিয়ে গােপনে বিনা অনুমতিতে বাড়ীতে যাওয়ার জন্যে মােনাফেকদেরকে ভৎর্সনা করে ৬২ নং আয়াত নাযিল করেন। রসূল(স.)-এর পরিখা খননের কাজ সমাপ্ত হবার পর কোরায়শরা তাদের অনুগত নিগ্রো দাস, বনু কিনানা ও তেহামাবাসীদের সমন্বয়ে গঠিত দশ হাজারের বিশাল বাহিনী নিয়ে হাযির হলাে। তাদের সাথে আরাে যােগ দিল বনু গাতফান ও অনুগত নাজদবাসীও। তারা ওহুদ পাহাড়ের পাশে সমবেত হলাে। এদিকে রসূল(স.) তিন হাজার মুসলমানের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে পরিখা নিজেদের ও শত্রুদের মাঝখানে রেখে অবস্থান নিলেন। মুসলমানদের সন্তান-সন্তুতি ও স্ত্রীদেরকে দুর্গের অভ্যন্তরে রেখে আসার নির্দেশ দিলেন। আল্লাহর দুশমন হুয়াই ইবনে আখতার বনু কোরায়যার নেতা কা’ব বিন আসাদের কাছে গেলাে। রাসূল(স.) কাবের সাথে ইতিপূর্বে উভয় পক্ষের বেসামরিক লােকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু হুয়াই আসাদকে এই চুক্তি ভংগ করতে প্ররােচিত করতে লাগলো। সে কা’বকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিলাে যে, কোরায়শ ও গাতফান যদি মােহাম্মদ(স.)-কে অক্ষত অবস্থায় রেখে চলে যায়, তাহলে আমি তােমার সাথে তােমার দুর্গে অবস্থান করবাে এবং তােমার যে পরিণাম হবে, আমারও তাই হবে। হুযাইয়ের এই প্ররােচণায় কা’ব তার সাথে রাসূল(স.)-এর যে চুক্তি ছিলাে, তা ভংগ করলাে। এই পর্যায়ে মুসলমানদের বিপদ ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো এবং তাদের ভয়ভীতি ও শংকা নিদারুণভাবে বেড়ে গেলাে। তাদের শত্রুরা সর্বদিক থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বসলাে। এ সময় কোনাে কোনাে দুর্বল ঈমানধারী মুসলমান আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কেও বিরূপ ধারণা পােষণ করতে লাগলাে। মােনাফেকদের মােনাফেকী তীব্রতর হয়ে উঠলাে। বনু আমরের মােয়াত্তাব বিন কুশায়ের বলে উঠলাে, মুহাম্মদ(স.) আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাে যে, রােম ও পারস্যের সম্রাটদের সম্পত্তি আমাদের হস্তগত হবে। অথচ আজ আমাদের অনেকে পেশাব পায়খানা করতে গিয়েও নিজের জীবন নিয়ে শংকিত থাকে। বনু হারেসা গােত্রের আওস বিন কায়সী বললাে, ‘হে রসূল, আমাদের বাড়ী-ঘর শত্রুদের নাগালের ভেতরে রয়েছে। কাজেই মদীনার বাইরে অবস্থিত আমাদের পরিবার-পরিজনের কাছে যাওয়ার অনুমতি দিন।’ এভাবে রসূল(স.) ও মােশরেকদের অবরােধসূচক অবস্থান প্রায় একমাসের কাছাকাছি বহাল থাকলাে। পরস্পরে কিছু পাথর ছোড়াছুড়ি ও তীর বিনিময় করা ছাড়া আর কোনাে যুদ্ধ হয়নি। মুসলমানদের জন্যে পরিস্থিতি যখন অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করলাে, তখন রসূল(স.) বনু গাতফানের দুই নেতা উয়াইনা ইবন হাসন ও হারেস বিন আওফের কাছে এই মর্মে সন্ধি প্রস্তাব পাঠালেন যে, তারা তাদের দলবলসহ মদীনা ত্যাগ করতে রাজী হলে তিনি তাদেরকে মদিনায় উৎপন্ন শস্যের এক তৃতীয়াংশ দিবেন।[ওদিকে ইহুদীরা তাদেরকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাে, তারা তাদেরকে সাহায্য করলে তাদেরকে খয়বরে এক বছরের ফসল দেবে। (মিকরীনী)] এই দুই গাতফানী নেতার সাথে রাসূল(স.)-এর এই সন্ধি চুক্তির আলােচনা এবং লেখার কাজ সম্পন্ন হলাে। কেবল সাক্ষীর সাক্ষ্য ও উভয় পক্ষের স্বাক্ষর দান বাকী ছিলাে। এ ব্যাপারে উভয়পক্ষের পারস্পরিক সম্মতি আদায়ের জন্যে চেষ্টা ও দর কষাকষি চলছিলাে। রাসূল(স.) চুক্তি চূড়ান্ত করার আগে আওস নেতা হযরত সাদ ইবনে মােয়ায ও খাজরায নেতা সাদ বিন ওবাদাকে জানালেন এবং তাদের উভয়ের মতামত ও পরামর্শ চাইলেন। তাঁরা উভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! এটা কি আপনার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়, যা আমাদের করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? অথবা আল্লাহ তায়ালা আপনাকে এ কাজ করতে আদেশ দিয়েছেন, যা আমাদের অবশ্য করণীয়? নাকি, এটা আপনি নিজস্ব বিবেচনায় আমাদের কল্যাণার্থে করতে চাইছেন? রাসূল(স.) বললেন, তােমাদের উপকারার্থে আমি নিজস্ব বিবেচনায় এ কাজটা করতে চাই, আল্লাহর কসম, আমি এ কাজটা শুধু এ জন্যেই করতে চেয়েছি যে, আমি দেখেছি, সমগ্র আরবজাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তােমাদেরকে একই তীরে বিদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছে এবং তােমাদের ওপর চতুর্দিক থেকে আগ্রাসন চালিয়েছে। এমতাবস্থায় তােমাদের ওপর থেকে তাদের দাপট যতােটুকু সম্ভব খর্ব করতে চেয়েছি।’ সা’দ ইবনে মােয়ায বলেন, হে রসূলাল্লাহ, এক সময় আমরা ও এই লােকেরা একই সাথে আল্লাহর সাথে শিরক ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিলাম। তখন আল্লাহর এবাদতও করতাম না, আল্লাহ তায়ালাকে চিনতামও না। অথচ সে সময়ও তারা নেহাৎ অতিথিসুলভ আপ্যায়ন অথবা কিনে খাওয়া ছাড়া আমাদের উৎপন্ন ফসল থেকে একটা দানাও খেতে পারেনি। আর আজ যখন আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ইসলামের ন্যায় অমূল্য সম্পদ দিয়ে সম্মানিত করেছেন, ইসলামের দিকে পথ প্রদর্শন করেছেন এবং আপনাকে ও ইসলামকে দিয়ে আমাদেরকে গৌরবান্বিত করেছেন, তখন তাদেরকে আমাদের সম্পদ দেবাে? আল্লাহর কসম, আমাদের এর কোনাে প্রয়ােজন নেই। আল্লাহর কসম, আমরা তাদেরকে তরবারী ছাড়া আর কিছুই দেবাে না, যতােক্ষণ না তাদের ও আমাদের মাঝে আল্লাহ তায়ালা কোনাে চূড়ান্ত ফায়সালা না করে দেন। রসূল(স.) বললেন, ঠিক আছে। ব্যাপারটা এখন তােমার হাতেই ন্যস্ত করলাম। এরপর সা’দ চুক্তির খসড়াটা হাতে নিলেন এবং যা কিছু লেখা হয়েছিলাে, সব নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘ওরা আমাদের যা করতে পারে করুক। রাসূল(স.) ও তার সাহাবীরা তীব্র ভীতি ও সন্ত্রাসের পরিবেশে অবস্থান করতে লাগলেন। এ সময় চতুর্দিক থেকে শত্রু সেনাদের আনাগােনা ও তাদের আগ্রাসী হামলা অব্যাহত ছিলাে। [হযরত উম্মে সালমা(রা.) বলেন, আমি রসূল(স.)-এর সাথে এমন অনেকগুলাে রণাংগনে উপস্থিত থেকেছি যেখানে তুমুল যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করছিলাে, যেমন মুরাইসী, খয়বর ও হুনায়ন। এ ছাড়া মক্কা বিজয় এবং হােদাইবিয়ার ঘটনাস্থলেও আমি ছিলাম । কিন্তু এ সবের কোনােটাই রসূল (স.)-এর জন্য খন্দকের চেয়ে পীড়াদায়ক এবং আমাদের জন্য ত্রাসোদ্দীপক ছিলাে না। কেননা খন্দক যুদ্ধের সময় মুসলমানরা পুরােপুরি অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলো এবং ইহুদী গােত্র বনু কোরায়যার দিক থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েরা নিরাপদ ছিলাে না। মদীনাকে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সারারাত পাহারা দেয়া হতো এবং সারারাত মুসলিম জনতার আল্লাহ আকবর ধ্বনি শুনতে শুনতে ভীতি ও শংকার মধ্য দিয়েই আমাদের সকাল হতো। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা শত্রুদেরকে বিন্দুমাত্র সাফল্য ছাড়াই ফিরে যেতে বাধ্য করলেন] অবশেষে এক সময় বনু গিফানের নঈম ইবনে মাসউদ ইবনে আমের রসূলুল্লাহ(স)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। তবে আমার গােত্র আমার ইসলাম গ্রহণের কথা জানে না। এখন আপনি আমাকে যা ইচ্ছে আদেশ দিতে পারেন। রসূল(স.) বললেন, ‘তুমিই আমাদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি, যে কিছু কার্যকর অবদান রাখতে পারাে। কাজেই যদি পারাে, কোনাে কৌশল অবলম্বন করে আমাদের ওপর থেকে এই সংকট দূর করো। মনে রেখ, যুদ্ধ কৌশলেরই আর এক নাম। (অতপর সত্যিই নঈম ইবনে মাসউদ এক যুগান্তকারী কৌশল অবলম্বন করে হানাদার বাহিনীগুলাে ও বনু কোরায়যার মধ্যে পারস্পরিক অনাস্থার সৃষ্টি করে দিলেন। এ কৌশলের বিস্তারিত বিবরণ সীরাত গ্রন্থাবলীতে রয়েছে। দীর্ঘসুত্রিতার আশংকায় এখানে সেই বিবরণ উদ্ধৃত করা থেকে বিরত রইলাম) আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পর্যদুস্ত করে দিলেন। একে তাে প্রচন্ড শীতের রাত, তদুপরি তাদের ওপর এমন ঝড়াে হাওয়া চালিয়ে দিলেন, যা তাদের ডেগচিগুলােকে উপুড় করে ও তাঁবুগুলােকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলে। আগ্রাসী বাহিনীগুলাের মধ্যে মতভেদ ও বিশৃংখলার খবর জানতে পেরে রাসূল(স.) হযরত হােযায়ফা ইবনুল ইয়ামানকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলে তাঁকে রাতের বেলায় আগ্রাসী বাহিনীগুলাের অবস্থা ও তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করতে পাঠিয়ে দিলেন। এ সম্পর্কে মােহাম্মদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা নিম্নরূপ, জনৈক কুফাবাসী হযরত হােযায়ফা ইবনুল ইয়ামানকে জিজ্ঞেস করলাে, আপনি কি রসূল(স.)-কে স্বচক্ষে দেখেছেন এবং তার সাথে কখনাে অবস্থান করেছেন? হােযায়ফা বললেন, হ্যা। সে আবার জিজ্ঞেস করলাে, আপনারা তার সাথে কেমন ব্যবহার করতেন? হােযায়ফা বললেন, আমরা তাঁর আদেশ পালনের জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। সে বললাে, আল্লাহর কসম, আমরা যদি তাকে পেতাম, তবে তাকে মাটির ওপর দিয়ে হাঁটতে দিতাম না বরং তাকে ঘাড়ে করে রাখতাম। হােযায়ফা বললেন, শােনাে, আমরা খন্দকের মধ্যে রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে ছিলাম। রাতের একটা অংশ তিনি নামায পড়ে কাটিয়ে দিলেন। তারপর আমাদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, তােমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, উঠে গিয়ে শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারে? কিন্তু তীব্র ভীতি, প্রচন্ড ক্ষুধা ও ভয়ংকর ঠান্ডার কারণে কেউ উঠে দাঁড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করলাে না। কেউ যখন দাঁড়ালাে না, তখন রাসূল(স.) আমাকে ডাকলেন। আমাকে যখন ডাকলেন, তখন আমার না দাঁড়িয়ে গত্যন্তর ছিলাে না। অতপর তিনি আমাকে বললেন, হুযায়ফা, তুমি যাও, শত্রুদের ভেতরে ঢুকে পড়াে এবং দেখাে তারা কী করে। আমার কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত কোনাে ঘটনা ঘটিও না। হােযায়ফা বলেন, এরপর আমি গেলাম এবং ওদের শিবিরের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তাদের হাড়িকুড়ি, চুলার আগুন, তাবু ও অন্যান্য স্থাপনা-সবই তছনছ হয়ে যাচ্ছিলাে। এই সময় আবু সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালাে এবং বললাে, হে কোরায়শী বাহিনী, তােমাদের প্রত্যেকের নিজের পাশে কে বসে আছে এবং কী করছে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।’ হােযায়ফা বলেন, আমি তৎক্ষণাত আমার পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিকে ধরে বললাম, তুমি কে? সে বললাে, অমুকের ছেলে অমুক। আবু সুফিয়ান আবার বললাে, হে কোরায়শী বাহিনী, আল্লাহর কসম, আমরা এমন জায়গায় অবস্থান করছি, যা অবস্থানের যােগ্য নয়। আমাদের উট ঘােড়া সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। বনু কোৱায় আমাদেরকে ফেলে চলে গেছে। তাদের সম্পর্কে যে খবর পেয়েছি, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। তাছাড়া তােমরা দেখতেই পাচ্ছো আমরা কী সাংঘাতিক ঝড়ের কবলে পড়েছি। আমাদের একটা ডেগচিও স্থির থাকছে না, আগুন নিভে গেছে, তাবু ও অন্যসব স্থাপনা তছনছ হয়ে গেছে। তাই সবাই রওনা হও। আমিও রওনা হচ্ছি।’ তারপর সে তার রজ্জুবদ্ধ উটের দিকে এগিয়ে গেলাে এবং তার পিঠে চড়ে বসলাে। তিনবার আঘাত করার পর উটটা তাকে নিয়ে লফঝম্প করতে করতে যাত্রা শুরু করলাে। আল্লাহর কসম, বন্ধন খুলে দেয়ার পরও উটটা ঠায় দাড়িয়ে ছিলাে। রসূল(স.) যদি আমাকে পূর্বাহ্নে আদেশ না দিতেন যে, আমার কাছে ফিরে না এসে কোনাে ঘটনা ঘটিও না, তাহলে আমি চাইলেই তাকে বর্শা মেরে হত্যা করতে পারতাম। হােযায়ফা বলেন, এরপর আমি রাসূল(স.)-এর কাছে ফিরে এলাম। তিনি তখনাে তার কোনাে স্ত্রীর ইয়ামানী কম্বলে আবৃত হয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে তিনি তার পায়ের কাছে আমাকে বসতে দিলেন এবং কম্বলের এক প্রান্ত আমার গায়ের ওপর ফেলে দিলেন। তারপর তিনি যখন রুকু ও সিজদা দিলেন তখনাে আমি সেই কম্বলের ভেতরে । তিনি যখন সালাম ফেরালেন, আমি তাকে সব খবর জানালাম। ওদিকে কুরাইশরা কী করেছে, সেটা যখন গাতফানীরা শুনলো, তখন তারাও উঠি পড়ি করে স্বদেশের পথে পাড়ি জমালাে।   *আল কোরআনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য : পবিত্র কোরআনের বক্তব্যে সাধারণত নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করা হয় না। তার লক্ষ্য থাকে শুধু মানুষের ও তার স্বভাব প্রকৃতির নমুনা তুলে ধরা। কোরআনে ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ ও খুঁটিনাটি বর্ণনা দেয়া হয় না। কেবল স্থায়ী ধ্যান ধারণা এবং প্রচলিত রীতিনীতি ও মূল্যবােধ বর্ণনা করা হয়। এ জিনিসগুলা ঘটনার সমাপ্তির সাথে সাথে সমাপ্ত হয় না এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ধানের সাথে সাথে অন্তর্হিত হয় না। এজন্যে এগুলাে প্রত্যেক যুগ ও প্রজন্মের জন্যে স্থায়ী দৃষ্টান্ত ও মূলনীতি হিসেবে বহাল থেকে যায়। কোরআন সংশ্লিষ্ট ঘটনার মহান আল্লাহর শক্তি ও পরিকল্পনার সংযােগ প্রতিষ্ঠিত করে, যিনি যাবতীয় ঘটনা, ব্যক্তি ও বস্তুর ওপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, এসব জিনিসের ভেতর দিয়ে সে মহান আল্লাহর দোর্দন্ড ক্ষমতা ও প্রতাপ এবং তাঁর সূক্ষ্ম ও সুনিপুণ কৌশলকে প্রতিফলিত করে। আর দ্বন্দ্ব সংঘাতের প্রতিটি পর্যায়ে সে নির্দেশ দান, পর্যালােচনা ও প্রধানতম মূলনীতির সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়ােজিত থাকে। যদিও কোরআন তার প্রত্যক্ষ শ্রোতাদের কাছেও কিসসা কাহিনী ও ঘটনাবলী বর্ণনা করতাে, কিন্তু এ দ্বারা সে তাদেরকে একটা বাড়তি তথ্য ও পরিবেশন করতাে এবং তা থেকে এমন সব আনুসংগিক তত্ত্ব ও তাদের কাছে উদঘাটন করতাে, যা তারা কুরআন নাযিল হওয়ার সমসাময়িক হয়েও বুঝতে পারেনি। কোরআন তাদের অন্তরের অন্তস্থলে লুকানাে যাবতীয় বক্রতা ও খটকা প্রকাশ করে দিতাে। সেই সাথে কোরআনের দৃশ্য চিত্রায়নে যে অপরূপ সৌন্দর্য, শক্তিমত্তা ও তেজস্বীতা ফুটিয়ে তুলেছে, কাপুরুষতা, ভীরুতা, ভন্ডামী ও বক্রতার প্রতি যে বিদ্রুপ ও শ্লেষের বাণ নিক্ষেপ করেছে, এবং ঈমানদারদের ঈমানী বীরত্ব, সাহসিকতা, ধৈর্য, সহনশীলতা ও প্রত্যয়ের দৃঢ়তার যে উদ্দীপনাময় চিত্র তুলে ধরেছে, তা প্রত্যেক পাঠককেই অভিভূত করে। বস্তুত কোরআন শুধু তার সমকালীন মানব গোষ্ঠীর জন্যেই নয়, বরং সর্বকালের মানুষের জন্যেই কর্ম প্রেরণার উৎস। বিশেষত যে মানবগােষ্ঠী তার সমকালীন মানবগােষ্ঠীর মতােই পরিস্থিতি ও পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হয়। তার মন মগযে সে ঠিক ততোখানি জোরালােভাবেই কর্মোদ্দীপনা সৃষ্টি করে, যতােখানি জোরালোভাবে প্রথম মুসলিম সমাজের মন মগজে সৃষ্টি করেছিলাে। সত্য বলতে কি, কোরআন নাযিল হওয়ার সময় সে যে ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাে। ঠিক সেই পরিস্থিতিরই সম্মুখীন না হয়ে কেউ কোরআনের বক্তব্যের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না। সেই ধরনের পরিস্থিতির মুখেই কোরআন তার সঞ্চিত ভান্ডার উজাড় করে দেয় এবং তার পাঠকদের মন মগজ তার সমুদয় আলােচ্য বিষয় উপলব্ধির জন্যে উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর এহেন পরিস্থিতি ও পরিবেশে তার সেই সব লিখিত বক্তব্য থাকে না বরং তা অদম্য শক্তি এবং অমিত তেজে রূপান্তরিত হয়। সেখানে যে সমস্ত ঘটনা প্রবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা যেন এক জীবন্ত, জাগ্রত, তেজোদ্দীপ্ত, প্রেরণাময় ও তরতাজা এক দল প্রাণীর রূপ ধারণ করে। এবং তারা যেন জীবনের কর্মময় অংগনে ও মন মগযে আলােড়ন তােলে। মনে রাখতে হবে, কোরআন এমন কোনাে পুস্তক নয়, যা কেবল সুরেলা আবৃত্তি ও সুললিত পাঠই যথেষ্ট হতে পারে। কোরআন তাে হচ্ছে কর্মোদ্দীপক, প্রাণ শক্তির ভান্ডার এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রে ও প্রত্যেক ঘটনায় প্রতিনিয়ত কর্মস্পৃহা যােগানোর উৎস। যদি তার মন মস্তিষ্ক কোরআনের আদর্শে উজ্জীবিত হয় এবং বিরাজমান পরিবেশে কোরআনের হতবুদ্ধিকর ও তাৎপর্যময় আয়াতগুলাের ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে থাকা প্রাণশক্তির ছোঁয়া লাগে তাহলে এর প্রতিটি বক্তব্য প্রতি মুহূর্তে মানুষকে কর্মচঞ্চল থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষ অনেক সময় কোরআনের কোনাে আয়াতকে শতবার পড়েও তার তেমন কোনাে তাৎপর্য খুঁজে পায় না। কিন্তু যখন বিশেষ কোনাে পরিস্থিতিতে বা বিশেষ কোনাে দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে পড়ে সেই আয়াতটা পড়ে, তখনই তার কাছে মনে হয়, আয়াতটা যেন নতুন, আগে যেন কখনাে সে তা আর পড়েনি। সে এখন যে তাৎপর্য ও প্রেরণার সন্ধান তাতে পেয়েছে, আগে যেন কখনাে তা পায়নি। এখন তা থেকে যে কঠিন প্রশ্নের জবাব, যে জটিল সমস্যার সমাধান, যে অজানা পথের ও যে নির্ভুল গন্তব্যের সন্ধান এ ইস্পিত বিষয়ে যে অটুট প্রত্যয় ও গভীর তৃপ্তির স্বাদ সে পেয়েছে, তাও যেন আগে কখনাে পায়নি। কোরআন ছাড়া প্রাচীন বা আধুনিক আর কোনাে গ্রন্থই এ বৈশিষ্টের অধিকারী নয় ।
*খন্দক যুদ্ধের ধারা পর্যালোচনা : পরবর্তী আয়াত থেকে শুরু হয়েছে আহযাব যুদ্ধের পর্যালোচনা। এ পর্যালােচনার সূচনায় মােমেন বান্দাদেরকে আল্লাহর এই অকল্পনীয় অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যে হানাদার শত্রু বাহিনী তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্যে আগ্রাসী আক্রমণ চালিয়েছিলাে, তাদেরকে তিনি হটিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর সূক্ষ্ম কৌশল ও সহৃদয় সাহায্য যদি না থাকতাে, তাহলে ওরা মদীনার মুষ্টিমেয়সংখ্যক মুসলমানকে একেবারেই নাস্তানাবুদ করে দিয়ে চলে যেতাে। এ জন্যে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার আগে প্রথম আয়াতেই তার ধরণ ও প্রকৃতি এবং আরম্ভ ও সমাপ্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তার অনুগ্রহের বিশালতার চিত্র তুলে ধরেছেন এবং তা স্মরণ করতে বলেছেন। এই সাথে এ কথাও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ। তায়ালা মােমেনদেরকে শুধু তার ওহীর অনুসরণ, একমাত্র তার ওপর নির্ভর করা এবং কাফের ও মােনাফেকদের আনুগত্য না করার আদেশ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন না, বরং সেই সাথে তিনি তার দ্বীনের দাওয়াতের কাজে নিয়ােজিতদেরকে কাফের ও মােনাফেকদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তােমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করাে, যখন তােমাদের ওপর সেনাদলগুলাে আক্রমণ করেছিলাে, তখন আমি তাদের ওপর প্রবল বাতাস ও এমন সৈন্যদেরকে পাঠিয়েছিলাম যাদের তােমরা দেখতে পাওনি। আল্লাহ তায়ালা অতিশয় সুক্ষ্মদ্শী'(আয়াত ৯) এভাবে এই সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক বক্তব্যে যুদ্ধের আরম্ভ ও সমাপ্তি এবং যুদ্ধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী ঘটনাবলী যেমন শত্রু সেনাদের আক্রমণ, আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক ঝড় ও তার এমন (ফেরেশতা) সেনাদল প্রেরণ, যাদেরকে মুসলমানরা কখনাে দেখেনি এবং আল্লাহর গভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুক্ষদর্শিতামূলক সাহায্যের উল্লেখ করা হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনার পরই পরবর্তী আয়াত থেকে শুরু হয়েছে এর বিশদ বিবরণ, ‘যখন তারা তােমাদের ওপর থেকেও এলাে, নীচ থেকেও এলাে…'(আয়াত ১০-১৩) এ হচ্ছে সেই প্রলয়ংকরী আগ্রাসী হামলার চিত্র, যা সমগ্র মদীনায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলাে এবং এমন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছিলাে, যা থেকে কোনাে একজন অধিবাসীও রেহাই পাচ্ছিল না। কোরায়শী ও গাতফানী মােশরেকরা ও বনু কোরায়যার ইহুদীরা মদীনার ওপর ও নীচ-সর্বদিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছে। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অনুভূতিতে মদীনাবাসীদের কেউ কারাে থেকে পিছিয়ে ছিলাে না। কেবল একটা বিষয়ে পার্থক্য ছিলাে। সেটা হলাে, এই আগ্রাসনে মদীনাবাসীর মানসিক প্রতিক্রিয়া, আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের ধারণা, বিপদাপদে তাদের আচরণ এবং ঘটনার কারণ ও ফলাফলের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ। এ জন্যে পরীক্ষাটা ছিলাে সর্বাত্মক ও সূক্ষ। আর মােমেন ও মােনাফেকদের ছাঁটাই বাছাইটাও ছিলাে চূড়ান্ত ও বেপরােয়া। ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই, সেই খন্দক যুদ্ধ তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত। এই ক্ষুদ্র আয়াতটার মধ্য দিয়ে আমরা যেন তার একটা চিত্র দেখতে পাই। ঘটনার বাহ্যিক রূপটা দেখতে পাই এ রকম, ‘যখন তারা তােমাদের ওপর থেকেও এলাে, নীচ থেকেও এলাে…’ পুনরায় দৃষ্টি দিলে মনের ওপর এর প্রতিক্রিয়াটা দেখতে পাই এরকম। ‘আর যখন তোমাদের চোখগুলাে ভয়ে বিস্ফারিত এবং প্রাণগুলাে ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিলাে’ এটা আসলে সেই ভয়াল, উদ্বেগজনক ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির চিত্র, যাতে মুখমন্ডলের আলামত ও মনের ভাবান্তর দ্বারা অংকন করা হয়েছে। ‘এবং তােমরা আল্লাহ সম্পর্কে রকমারি ধারণা পােষণ করছিলে।’ ধারণাগুলাে কিরকম ছিলো, তার বিবরণ দেয়া হচ্ছে না, বরং এমন সংক্ষিপ্ত রেখে দেয়া হচ্ছে, যাতে সেই সংকটকালের মানসিক অস্থিরতা, কল্পনার বিক্ষিপ্ততা এবং এক একজনের মনে এক একরকম ভাবনার উদ্রেকের চিত্র ফুটে ওঠে। এরপর পুনরায় যুদ্ধাবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলােকে আরাে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং আতংকজনক দৃশ্যগুলােকে আরাে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘সেখানে ঈমানদারদের পরীক্ষা নেয়া হয় এবং তাদেরকে প্রচন্ডভাবে কাপিয়ে দেয়া হয়।’ যে আতংক মুসলমানদের কাপিয়ে দেয়, তা খুবই ভয়ংকর ধরনের হওয়ারই কথা। মােহাম্মদ বিন মুসলিম প্রমুখ বর্ণনা করেন, আহযাব যুদ্ধ উপলক্ষে তৈরী খন্দক বা পরীখাগুলাের ভেতরে আমাদের রাত ছিলাে দিনের মতাে স্বচ্ছ। মােশরেক নেতারা পালাক্রমে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতাে। একদিন আবু সুফিয়ান, একদিন খালেদ ইবনুল ওলীদ, একদিন আমর ইবনুল আস, একদিন বাইবা ইবনে আবি ওহাব একদিন ইকরামা ইবনে আবি জাহল, একদিন যেরার ইবনুল খাত্তাব সেনাপতিরূপে আবির্ভূত হতাে। ফলে সংকট ঘনীভূত হতে থাকে এবং জনগণের মধ্যে ক্রমেই আতংক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মিকরিযী মুসলমানদের অবস্থার যে বিবরণ দিয়েছেন তা নিম্নরূপ, ‘মােশরেকরা ভাের রাতে এসে পৌঁছলাে। রসূল(স.) তার সাহাবীদেরকে সংঘবদ্ধ করলেন এবং তারা সারাদিন রাত পর্যন্ত যুদ্ধ করলাে। যুদ্ধের তীব্রতায় রসূল(স.) স্বয়ং এবং অন্য কোন মুসলমান নিজ নিজ জায়গা থেকে একটুও নড়তে পারলেন না। এমনকি, রসূল(স.) জোহর, আছর, মাগরিব ও এশার নামায পর্যন্ত পড়তে পারেননি। সাহাবীরা বলতে লাগলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমরা তাে নামায পড়লাম না। রসূল(স.) বললেন, আল্লাহর কসম, আমিও নামায পড়িনি। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা মােশরেকদেরকে হটিয়ে দিলেন এবং উভয় পক্ষ নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গেলাে। উসায়দ ইবনুল হুযায়র দুইশ মুসলিম সেনাকে সাথে নিয়ে খন্দকের কিনারে রুখে দাঁড়ালেন। এটা দেখে খালেদ বিন ওলীদের নেতৃত্বে একদল মােশরেক তাদেরকে আক্রমণ করার জন্যে রুখে দাঁড়ালাে। উসায়দের বাহিনী কিছুক্ষণ তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেন। এই সংঘর্ষকালে ওহুদ যুদ্ধে হযরত হামযাকে হত্যাকারী ওয়াহশী হযরত তােফায়েল ইবনুন নুমান ইবনু আনসা আল আনসারীকে বল্লম মেরে হত্যা করলাে। এই দিন রসূল(স.) বললেন, মােশরেকরা আমাদেরকে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে আসরের নামায পড়তে দেয়নি। আল্লাহ তায়ালা যেন ওদের পেট ও হৃদয় আগুন দিয়ে ভরে দেন। [হযরত জাবের বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায় যে, রসূল(স.)-এর সেদিন শধু আসরের নামায কাযা হয়েছিলাে। তবে মনে হয়, এ ধরনের ঘটনা একাধিকবার ঘটেছিলাে। একবার শুধু আসর এবং আর একবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই কাযা হয়েছিলাে] গভীর রাতে মুসলমানদের দুটো সেনাদল বাইরে গিয়ে পরস্পরকে চিনতে না পেরে এবং উভয়ে উভয়কে শত্রুপক্ষীয় মনে করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং কয়েকজন আহত ও নিহত হয়। এরপর তারা ইসলামী ধ্বনি দেন, ‘হুম্মা, লা ইউনসারূন’ অর্থাৎ ‘অবধারিত হয়ে গেছে, ওরা জয় লাভ করবে না।’ এরপর তারা সংঘর্ষ থেকে বিরত হয়। রসূল(স.) এ খবর শুনে বলেন, ‘তােমাদের মধ্যে যারা আহত হয়েছে, তারা আল্লাহর পথে আহত এবং যারা নিহত হয়েছে তারা শহীদ গণ্য হবে।’ মুসলমানরা মােশরেকদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে যখন পরিখার পাশে অবস্থান করছিলাে, তখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় কাটাচ্ছিলেন। কেননা ওখানে বসে তারা খবর পাচ্ছিলেন যে, ইহুদী গােত্র বনু কোরায়যা মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভংগ করেছে। এ কারণে তারা একমুহুর্তের জন্যেও নিশ্চিত হতে পারছিলাে না যে, মােশরেক ও ইহুদীরা একযােগে তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে না। অথচ এ দুই গােষ্ঠী তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই এসেছিলাে এবং এদের সম্মিলিত জনশক্তির মােকাবেলায় মুসলমানরা ছিলাে নগন্য সংখ্যালঘু। এছাড়া মােনাফেক ও গুজব রটনাকারীদের একটা বর্ণচোরা গােষ্ঠী শুধু মদীনায় নয়, বরং খন্দকের রণাংগনে মুসলিম সেনাদলের অভ্যন্তরেও তৎপর ছিলাে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মোনাফেকরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিলাে তারা বলছিলাে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা ভাওতা ছাড়া আর কিছু নয়।’ (আয়াত ১২) বস্তুত সেই লােমহর্ষক ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে এই লােকগুলাে নিজেদের মনের গােপন কূ মতলবগুলাে প্রকাশ করার অবাধ সুযােগ পেয়ে গিয়েছিলাে। তারা এ ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলাে যে, তাদেরকে কেউ তিরঙ্কার করবে না বা ধিক্কার দেবে না। তারা মুসলমানদেরকে অপমানিত করা ও বেকায়দায় ফেলা এবং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের প্রতিশ্রুতির সত্যতা সম্পর্কে সংশয় ছড়িয়ে দেয়ারও মােক্ষম সুযােগ পেয়ে গিয়েছিলাে। আর এ কাজের জন্যে কেউ তাদেরকে পাকড়াও করবে এমন আশংকাও তাদের ছিলাে না। বরং মুসলমানদেরকে অপমানিত করা ও সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার অপতৎপরতায় বাস্তব পরিস্থিতি তাদের সহায়ক ও সমর্থক ছিলাে। তা সত্তেও তারা নিজেদের সাথে ও নিজেদের আবেগ অনুভূতির সাথে যুক্তিসংগত আচরণ করে যাচ্ছিল। আতংক ও ভাতির আতিশয্যে তারা আর কোনাে রাখঢাক করার এবং তাদের কৃত্রিম। ঈমানের তােয়াক্কা করারও প্রয়ােজন অনুভব করছিলাে না। তাই তারা সমস্ত দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে যা বুঝেছি, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিলাে। এ ধরনের মুনাফিক ও বর্ণচোরা লোক সকল সমাজে ও সকল দলেই থাকে। বিপদাপদে তারা তাদের এই ধরনের লােকদের মতই ভূমিকা পালন করে। সকল দলে ও সকল প্রজন্মে যুগে যুগে বারবার তাদের আবির্ভাব ঘটে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন তাদের একটা দল বললাে, ‘হে ইয়াসরিববাসী, এখানে তােমাদের টিকে থাকার অবকাশ নেই। কাজেই তােমরা ফিরে যাও।'(আয়াত ১৩) তারা স্পষ্টতই মদীনাবাসীকে রণাংগন ছেড়ে চলে যেতে উদ্বুদ্ধ করলাে এবং বাড়ী ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানালাে। তাদের যুক্তি ছিল যে, পরিখার সামনে তাদের এরূপ সংঘবদ্ধভাবে অবস্থানের কোনাে অবকাশ নেই, বিশেষত তাদের বাড়ীঘর যখন নিরাপদ নয়। আসলে এটা একটা ন্যক্কারজনক আহ্বান, যা স্ত্রী ও সন্তানদের নিরাপত্তাহীনতার ওজুহাতে করা হতে থাকে। অথচ এ আশঙ্কা নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত যার কোনাে স্থায়িত্ব নেই। তাদের একটা দল নবীর কাছ থেকে এই বলে ছুটি চায় যে, আমাদের ঘরবাড়ী অরক্ষিত। অর্থাৎ শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ নয়, এই ওজুহাতে তারা পরিবারের কাছে যাওয়ার অনুমতি চায়। অথচ তা মােটেই অরক্ষিত নয় তারা নিছক মিথ্যাচার, প্রতারণা, কাপুরুষতা ও পলায়নী মানসিকতায় আক্রান্ত।’ তারা পালানাে ছাড়া আর কিছু চায় না।’ বর্ণিত আছে যে, বনু হারেসা গােত্র আওস বিন কায়সীর মারফত রসূল(স.)-এর কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছিলাে যে, আমাদের ঘরবাড়ী অরক্ষিত। আনসারদের কারাে বাড়ীই আমাদের বাড়ীর মতাে বিপজ্জনক অবস্থানে নেই। আমাদের ও গাতফানের মাঝে এমন কেউ নেই, যে তাদের আক্রমণ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে। কাজেই আমাদের অনুমতি দিন, আমরা বাড়ীঘরে গিয়ে ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। রসূল(স.) তাদেরকে অনুমতি দিলেন। সাদ ইবনে মােয়ায এ খবর শুনে রসূল(স.)-কে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ওদেরকে অনুমতি দেবেন না। কারণ আমরা ও ওরা যখন কোনাে বিপদে পড়ি, তখনই ওরা এ ধরনের অজুহাত খাড়া করে থাকে। তখন রসূল(স.) তাদের অনুমতি বাতিল করলেন। কোরআন যাদের সম্পর্কে বলেছে যে, তারা পালানাে ছাড়া আর কিছু চায় না এই হচ্ছে তাদের পরিচিতি। ঘােরতর অরাজকতা, আতংক ও পলায়নপরতার পরিবেশের চিত্র অংকনকারী এই চমকপ্রদ শৈল্পিক বিবরণ দিয়েই এখানে যুদ্ধ ও যুদ্ধের ময়দানের বর্ণনা শেষ হয়েছে।

*মুনাফিকের চরিত্র বিশ্লেষণ : এরপর মােনাফেক ও মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত লােকদের ঈমানের দুর্বলতা, কাপুরুষতা এবং বিপথগামী হবার সম্ভাবনাসহ তাদের মানসিক অবস্থার একটা সঠিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ১৪ নং আয়াতে, ‘আর যদি শত্রুরা নগরীর চতুর্দিক থেকে প্রবেশ করে বিদ্রোহের জন্যে তাদেরকে প্ররােচিত করতাে, তবে তারা তৎক্ষণাত তাই করতাে…’ এই ছিলাে তখন পর্যন্ত তাদের ও শত্রদের অবস্থা। শত্রুরা তখনাে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়নি। ভিত্তি ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা যতােই থাক, কল্পিত বিপদাশংকা ও বাস্তব বিপদ এক কথা নয়। যদি সেই বিপদ সত্যিই দেখা দিতাে, তারা যদি চতুর্দিক থেকে মদীনায় ঢুকে পড়তাে এবং তাদেরকে বিদ্রোহ করার অর্থাৎ ইসলাম ত্যাগ করার প্ররােচণা দিতাে, তাহলে তারা কোনাে দ্বিধা সংকোচ না করেই তাই করতাে। ‘অল্প কিছু ব্যতীত’ অর্থাৎ অল্পকিছু সময় ভেবে দেখা ব্যতীত বা অল্প কিছু লােক ব্যতীত-যারা কুফরিতে ফিরে যাওয়ার আগে একটু চিন্তাভাবনা করতাে। বস্তুত তাদের ঈমান ছিলাে দুর্বল ও অস্থিতিশীল। আর এ ধরনের দুর্বল ঈমান প্রচ্ছন্ন কাপুরুষতার শামিল, যা কুফরির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়তে পারে না। এভাবে কোরআন তাদের মুখােশ খুলে দিয়েছে। তাদের ওপর থেকে সকল আবরণ সরিয়ে দিয়েছে। তারপর তাদের আরাে একটা চারিত্রিক বিকৃতিও তুলে ধরেছে, সেটা হচ্ছে ওয়াদা খেলাপী। আর সেটা কার সাথে স্বয়ং আল্লাহর সাথে। তারা ইতিপূর্বেও তার সাথে আরাে বহু ব্যাপারে ওয়াদা করেছে। কিন্তু সে ওয়াদা রক্ষা করেনি। ১৫ নং আয়াত দ্রষ্টব্য। ইবনে হিশাম বলেন, এ আয়াতে বনু হারেসা গােত্রের কথা বলা হয়েছে, যারা ওহুদ যুদ্ধের দিন ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ার উপক্রম করেছিলো। তাদের সাথে বনু সালামাও ছিলাে এবং উভয় গােত্রই সেদিন ওয়াদা ভংগ করতে উদ্যত হয়েছিলাে। তারপর তারা আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করে যে, আর কখনাে যুদ্ধ থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না বা পালাবে না। এখানে তাদের সেই প্রতিজ্ঞার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওহুদের দিনে তাে আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর রহমত করেছেন এবং তাদের ব্যর্থতার কুফল থেকে বাঁচিয়েছেন। এটা ছিলাে জেহাদের আদেশ আসার পরবর্তী সময়কার একটা প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। কিন্তু আজ এতাে দীর্ঘকাল পরে এবং পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের পরে কোরআন আর কোনাে নমনীয়তা দেখাতে প্রস্তুত নয়। সে এ ধরনের আচরণকে অত্যন্ত কঠোরভাবে মােকাবেলা করে। এই পর্যায়ে, যখন বিপদাশংকা থেকে মুক্তি ও ভীতি থেকে নিরাপত্তা লাভের আশায় প্রতিশ্রুতি ভংগ করা হয়েছে, তখন কোরআন তার অবশিষ্ট শিক্ষাগুলাে এক একটাকে কঠোরভাবে মেনে চলার ওপর গুরুত্ব আরােপ করছে। যে ভ্রান্ত চিন্তাধারা তাদেরকে প্রতিশ্রুতি ভংগ করার ও রণাংগন থেকে পালানাের প্ররােচণা দেয় তা সংশােধন করছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলাে, তােমরা যদি মৃত্যু বা হত্যা থেকে পালাও, তবে সেই পলায়নে কোনাে লাভ হবে না… ‘(আয়াত ১৬-১৭) আল্লাহ তায়ালা যে ভাগ্য নির্ধারণ করেন, সেটাই সকল ঘটনা ও তার পরিণামকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা ঘটনাবলীকে আল্লাহর পরিকল্পিত পথে ঠেলে দেয় এবং তার স্থীরিকৃত পরিণতিতে পৌছে দেয়। আর মৃত্যু বা হত্যা নির্ধারিত সময়ে ঘটা অবধারিত। তা থেকে রেহাই পাওয়া বা এক মুহুর্ত আগ পাছ হওয়া সম্ভব নয় । পলায়নকারী পালিয়ে তার অনিবার্য পরিণাম থেকে রক্ষা পায় না। পালানাে সত্তেও নির্ধারিত ভাগ্য তাকে নির্দিষ্ট সময়ে বরণ করতেই হয়। আল্লাহর ইচ্ছা কেউ রােধ করতে পারে না, তা তিনি ভালাে ইচ্ছা করেন বা মন্দ ইচ্ছা করেন। আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত মানুষের আর কোনাে রক্ষক বা সাহায্যকারী নেই। আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য কেউ ফিরিয়ে দিতে পারে না। সুতরাং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। তার হুকুমের আনুগত্য করতেই হবে। তার সাথে করা ওয়াদা সুখ-দুখ সর্বাবস্থায় পালন করতে হবে। সব ব্যাপারে তার ওপর ভরসা করতে হবে, সব কিছুর বিচার বিবেচনা তার হাতে ন্যস্ত করতে হবে। তারপর তিনি যা খুশী তাই করবেন। এরপর বলা হয়েছে যে, জেহাদ থেকে পলায়নপর ও নিষ্ক্রিয় সেসব লােক সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অবগত আছেন, যারা অন্যদেরকেও রণাংগনে যেতে দেয় না। তারা তাদেরকে বলে, ‘তােমাদের অবস্থানের অবকাশ নেই কাজেই ফিরে যাও।’ এখানে তাদের এমন এক মানসিক অবস্থা চিত্রিত করা হয়েছে, যা খুবই অদ্ভুত। এই চিত্র অভ্রান্ত ও অকাট্য সত্য। তবে তা এ ধরনের মানুষ সম্পর্কে হাসির উদ্রেক করে। এ ধরনের মানুষ যুগে যুগে বারবার আবির্ভূত হয়। একটু ভীতিজনক ও বিপদজনক অবস্থা দেখা দিলেই তারা কাপুরুষতা প্রদর্শন করে। আর যখন ভালাে অবস্থা থাকে, তখন তাদের মুখ হয়ে ওঠে অতিশয় বাকপটু। ভালাে কাজ ও কল্যাণমূলক কাজ করতে তারা মানুষকে নিরুৎসাহিত করে। আর অনেক দূর থেকেও বিপদের আশংকা দেখা দিলে তারা ঘাবড়ে যায় ও অস্থির হয়ে পড়ে। কোরআনের ভাষায় এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে এমন চমৎকার রূপ দেয়া হয়েছে, যার তুলনা অন্য কোথাও নেই। ‘তােমাদের মধ্যে কারা যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধা দেয় এবং কারা তাদের ভাইদেরকে বলে আমাদের কাছে এসাে তা আল্লাহ তায়ালা ভালাে করেই জানেন।'(আয়াত ১৮-২০) আয়াতের সূচনাতেই বলা হয়েছে যে, যারা মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং তাদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধা দেয় তাদের আল্লাহ ভালাে করেই চিনেন ও জানেন। তারা জেহাদে খুব কমই অংশ নেয়। তারা আল্লাহর কাছে খুবই পরিচিত এবং তাদের প্রতারণা কারাে অজানা নেই। ‘তােমাদের প্রতি বিরক্তি সহকারে।’ অর্থাৎ তাদের মন মুসলমানদের প্রতি বিরক্ত ও বিদ্বিষ্ট। এই বিরক্তি ও বিদ্বেষ তাদের চেষ্টা সাধনায়, অর্থ সম্পদে ও আবেগ অনুভূতিতে সমভাবেই প্রতিফলিত হয়ে থাকে । তারপর যখন বিপদ এসে পড়ে, তখন তাদেরকে দেখতে পাও, মৃত্যুর ভয়ে বেহুশ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির ন্যায় তােমার দিকে চোখ উল্টিয়ে তাকাচ্ছে।’ এটা মােনাফেকদের একটা স্বচ্ছ, সুস্পষ্ট ও চলমান চিত্র। সেই সাথে এটা তাদের একটা হস্যোদ্দীপক ও বিদ্রূপাত্মক ও কাপুরুষোচিত চিত্রও। এতে দেখা যায় যে, তাদের প্রতিটা অংগ-প্রত্যংগ যেন বিপদের মুহূর্তে ভয়ে ঠক ঠক করে কাপছে ও কাপার মাধ্যমে নিজের কাপুরুষতা ব্যক্ত করছে। তাদের আরাে হাস্যোদ্দীপক চিত্র ফুটে ওঠে তখন, যখন বিপদ দূর হয়ে শান্তি ফিরে আসে। ‘যখন বিপদ দূর হয়ে যাবে, তখন তারা লম্বা লম্বা বুলি আওড়িয়ে তােমাদের সাথে সাক্ষাত করবে।’ তারা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের কাঁপুনি থেমে যাবে এবং তারা উচ্চস্বরে কথা বলবে। গর্বে ও অহংকারে তারা মত্ত হয়ে যাবে। সমস্ত লজ্জা ও সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তারা যুদ্ধে বড়াে বড়াে বীরত্ব ও কৃতিত্বের দাবী করবে। এসবই করবে তারা বিজয়ের সুফল ভোগ করার লােভে, কল্যাণের লােভে অথচ এতােসব বড়ো বড়াে দাবী করা সত্তেও তারা এই কল্যাণ লাভের জন্যে নিজেদের বিন্দুমাত্রও শ্রম, শক্তি ও অর্থ ব্যয় করে না। এ ধরনের মানুষ কোনাে কালেও কোনাে প্রজন্মে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। সব সময়ই তার সমাজে বিদ্যমান থাকে। দেশে যখন সুখ শান্তি বিরাজ করে, তখন তারা ভয়ংকর বীরদর্পে বিচরণ করে, সবকিছুতে অগ্রণী থাকে এবং উচু গলায় কথা বলে। কিন্তু যেখানেই ভয়ভীতি ও বিপদাশংকা বিরাজ করে, সেখানে তারা অতিমাত্রায় ভীরু, কাপুরুষ ও নীরব। সৎকাজ ও সৎকর্মশীলদের বেলায় তারা অত্যধিক কৃপণ। লম্বা লম্বা বুলি কপচানাে ছাড়া তারা আর কিছুই ব্যয় করে না। ‘তারা আদৌ ঈমান আনেনি, ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদের যাবতীয় সৎ কাজ বাতিল করে দিয়েছেন।’ এটা হচ্ছে প্রথম কারণ। তাদের হৃদয়ে ঈমানের নামগন্ধও ঢােকেনি, ঈমানের আলােয় তা আলােকিত হয়নি এবং ঈমানের পথে চালিতও হয়নি। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের সৎ কাজগুলাে বাতিল করে দিয়েছেন। সৎ কাজগুলাে বৃথা গেছে। কেননা ওগুলাের সফলতার ভিত্তি হচ্ছে ঈমান এবং সেই ভিত্তিই সেখানে অনুপস্থিত। এটা আল্লাহর কাছে নিতান্ত সহজ। বস্তুত আল্লাহর কাছে কঠিন বা জটিল বলতে কিছু নেই। আল্লাহ যা করতে চান, তা অনায়াসেই করে ফেলেন। এরপর খন্দক যুদ্ধে মােনাফেকদের হাস্যকর ভূমিকার আরাে বিবরণ আসছে পরবর্তী আয়াতে, ‘তারা মনে করে যে, হানাদার দলগুলাে এখনাে যায়নি।’ অর্থাৎ তাদের কাপুনি, ভীরুতা ও ভীতি ছড়ানাের তৎপরতা এখনাে চলছে। তারা এখনাে স্বীকার করতে প্রস্তুত নয় যে, হানাদাররা চলে গেছে। ভয়ভীতি কেটে গেছে এবং শান্তি ফিরে এসেছে। আর হানাদার বাহিনীগুলাে যদি ফিরে আসে, তাহলে তারা প্রত্যাশা করে যে, তারা যদি মরুবাসী বেদুঈন হয়ে তােমাদের খবরাখবর জিজ্ঞেস করে বেড়াতে পারতাে তাহলেই ভালাে হতে। কী হাস্যকর ও ন্যক্কারজনক চিত্র! হানাদার বাহিনীগুলাে এলে এই কাপুরুষরা মনে করে, আহা, আমরা যদি মদীনাবাসী না হয়ে মরুচারী বেদুঈন হতাম। মদীনাবাসীর জীবন ও ভাগ্যের অংশীদার না হতাম, তাদের কী হচ্ছে তা না জানতাম এবং এতে নিরাপদ দূরত্বে থাকতাম যে, তাদের সম্পর্কে একজন প্রবাসী যেমন আরেক জন প্রবাসীকে জিজ্ঞেস করে, তেমনি জিজ্ঞেস করে জেনে নিতাম, তাহলেই ভালাে হতাে। এরকমই ছিলাে তাদের হাস্যোদ্দীপক বাসনা। অথচ তারা ছিলাে নিস্ক্রীয়, যুদ্ধ বিমুখ এবং যুদ্ধের সাথে তাদের কোনাে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলাে না। দূর থেকেই তারা ভয়ে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যদি তারা তােমাদের মধ্যে থাকতাে, তবে খুব কমই যুদ্ধ করতাে।’ এ পর্যন্তই শেষ হয়ে যাচ্ছে মদীনার নবীর ইসলামী সমাজে জীবন যাপনকারী এই বর্ণচোৱা ভন্ড মুসলমানদের চরিত্র চিত্রণ। এ ধরনের ভন্ডদের আবির্ভাৰ প্রত্যেক প্রজন্মেই বারবার ঘটে থাকে এবং ঘটবে। চিরদিনই তাদের একই ধরনের স্বভাব এবং একই ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই শ্রেণীটির প্রতি ঘৃণা, ধিক্কার, বিদ্রুপ, আল্লাহ তায়ালা ও জনগণের কাছে এদের মর্যাদাহীনতা এবং এদের কাছ থেকে দূরে থাকার শিক্ষাই এই আলােচনার সার কথা।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এখান থেকে ৩ রুকুর শেষ পর্যন্তকার আয়াতগুলো নাযিল হয় নবী ﷺ বনী কুরাইযার যুদ্ধ শেষ করার পর। এ দু’টি রুকুতে আহযাব ও বনী কুরাইযার ঘটনাবলী সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে। এগুলো পড়ার সময় আমি ভূমিকায় এ দু’টি যুদ্ধের যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছি তা যেন দৃষ্টি সম্মুখে থাকে।
# শত্রুসেনারা যখন মদীনার ওপর চড়াও হয়েছিল ঠিক তখনই এ ধূলিঝড় আসেনি। বরং অবরোধের এক মাস হয়ে যাওয়ার পর এ ধূলিঝড় আসে। অদৃশ্য ‌“সেনাবাহিনী” বলতে এমন সব গোপন শক্তিকে বুঝানো হয়েছে যা মানুষের বিভিন্ন বিষয়াবলীতে আল্লাহর ইশারায় কাজ করতে থাকে এবং মানুষ তার খবরই রাখে না। ঘটনাবলী ও কার্যকলাপকে মানুষ শুধুমাত্র তাদের বাহ্যিক কার্যকারণের দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অননুভূত পদ্ধতিতে যেসব শক্তি কাজ করে যায় সেগুলো থাকে তার হিসেবের বাইরে। অথচ অধিকাংশ সময় এসব গোপন শক্তির কার্যকারিতা চূড়ান্ত প্রমাণিত হয়। এসব শক্তি যেহেতু আল্লাহর ফেরেশতাদের অধীনে কাজ করে তাই “সেনাবাহিনী” অর্থে ফেরেশতাও ধরা যেতে পারে, যদিও এখানে ফেরেশতাদের সৈন্য পাঠাবার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি।
# এর একটি অর্থ হতে পারে, সবদিক থেকে চড়াও হয়ে এলো। দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, নজদ ও খয়বরের দিক থেকে আক্রমণকারীরা ওপরের দিক থেকে এবং মক্কা মো’আযযমার দিক থেকে আক্রমণকারীরা নিচের দিক থেকে আক্রমণ করলো।
# এখানে মু’মিন তাদেরকে বলা হয়েছে যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসূল বলে মেনে নিয়ে নিজেকে তাঁর অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এদের মধ্যে সাচ্চা ঈমানদার ও মুনাফিক উভয়ই ছিল। এ প্যারাগ্রাফে মুসলমানদের দলের উল্লেখ করেছেন সামগ্রিকভাবে, এরপরের তিনটি প্যারাগ্রাফে মুনাফিকদের নীতির ওপর মন্তব্য করা হয়েছে। তারপর শেষ দু’টি প্যারাগ্রাফে রসূলুল্লাহ ﷺ ও সাচ্চা মু’মিনদের সম্পর্কে বলা হয়েছে।
# এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি যে, ঈমানদাররা আল্লাহর সাহায্য-সমর্থন লাভ করবে এবং তাদেরকে চূড়ান্ত বিজয় দান করা হবে।
# এ বাক্যটি দু’টি অর্থে বলা হয়েছে। এর বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, খন্দকের সামনে কাফেরদের মোকাবিলায় অবস্থান করার কোন অবকাশ নেই। শহরের দিকে চলো। আর এর গূঢ় অর্থ হচ্ছে, ইসলামের ওপর অবস্থান করার কোন অবকাশ নেই। এখন নিজেদের পৈতৃক ধর্মে ফিরে যাওয়া উচিত। এর ফলে সমস্ত আরব জাতির শত্রুতার মুখে আমরা যেভাবে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছি তা থেকে রক্ষা পেয়ে যাবো। মুনাফিকরা নিজ মুখে এসব কথা এজন্য বলতো যে, তাদের ফাঁদে যে পা দেবে তাকে নিজেদের গূঢ় উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দেবে এবং যে তাদের কথা শুনে সতর্ক হয়ে যাবে এবং তাদেরকে পাকড়াও করবে নিজেদের শব্দের বাহ্যিক আবরণের আড়ালে গিয়ে তাদের পাকড়াও থেকে বেঁচে যাবে।
# যখন বনু কুরাইযাও হানাদারদের সাথে হাত মিলালো তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেনাদল থেকে কেটে পড়ার জন্য মুনাফিকরা একটি চমৎকার বাহানা পেয়ে গেলো এবং তারা এই বলে ছুটি চাইতে লাগলো যে, এখন তো আমাদের ঘরই বিপদের মুখে পড়ে গিয়েছে, কাজেই ঘরে ফিরে গিয়ে আমাদের নিজেদের পরিবার ও সন্তানদের হেফাজত করার সুযোগ দেয়া উচিত। অথচ সেসময় সমগ্র মদীনাবাসীদের হেফাজতের দায়িত্ব ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর। বনী কুরাইযার চুক্তি ভঙ্গের ফলে যে বিপদ দেখা দিয়েছিল তার হাত থেকে শহর ও শহরবাসীদেরকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা ছিল রসূলের ﷺ কাজ, পৃথক পৃথকভাবে একেকজন সৈনিকের কাজ ছিল না।
# নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই তো এ বিপদ থেকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ব্যবস্থাপনাও তাঁর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল এবং সেনাপতি হিসেবে তিনি এ ব্যবস্থা কার্যকর করার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। কাজেই সেসময় কোন তাৎক্ষণিক বিপদ দেখা দেয়নি। এ কারণে তাদের এ ধরনের ওজর পেশ করা কোন পর্যায়েও যুক্তিসঙ্গত ছিল না।
# যদি নগরে প্রবেশ করে কাফেররা বিজয়ীর বেশে এ মুনাফিকদেরকে এই বলে আহবান জানাতো, এসো আমাদের সাথে মিলে মুসলমানদেরকে খতম করো।
# ওহোদ যুদ্ধের সময় তারা যে দুর্বলতা দেখিয়েছিল তারপর লজ্জা ও অনুতাপ প্রকাশ করে তারা আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছিল যে, এবার যদি পরীক্ষার কোন সুযোগ আসে তাহলে তারা নিজেদের এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে। কিন্তু আল্লাহকে নিছক কথা দিয়ে প্রতারণা করা যেতে পারে না। যে ব্যক্তিই তাঁর সাথে কোন অঙ্গীকার করে তাঁর সামনে তিনি পরীক্ষার কোন না কোন সুযোগ এনে দেন। এর মাধ্যমে তার সত্য ও মিথ্যা যাচাই হয়ে যায়। তাই ওহোদ যুদ্ধের মাত্র দু’বছর পরেই তিনি তার চাইতেও বেশী বড় বিপদ সামনে নিয়ে এলেন এবং এভাবে তারা তাঁর সাথে কেমন ও কতটুকু সাচ্চা অঙ্গীকার করেছিল তা যাচাই করে নিলেন।
# এভাবে পলায়ন করার ফলে তোমাদের আয়ু বেড়ে যাবে না। এর ফলে কখনোই তোমরা কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে এবং সারা দুনিয়া জাহানের ধন-দৌলত হস্তগত করতে পারবে না। পালিয়ে বাঁচলে বড় জোর কয়েক বছরই বাঁচবে এবং তোমাদের জন্য যতটুকু নির্ধারিত হয়ে আছে ততটুকুই জীবনের আয়েশ-আরাম ভোগ করতে পারবে।
# এ নবীর দল ত্যাগ করো। কেন তোমরা দ্বীন, ঈমান, সত্য ও সততার চক্করে পড়ে আছো? নিজেদেরকে বিপদ-আপদ, ভীতি ও আশঙ্কার মধ্যে নিক্ষেপ করার পরিবর্তে আমাদের মতো নিরাপদে অবস্থান করার নীতি অবলম্বন করো।
# সাচ্চা মু’মিনরা যে পথে তাদের সবকিছু উৎসর্গ করে দিচ্ছে সেপথে তারা নিজেদের শ্রম, সময়, চিন্তা ও সহায়-সম্পদ স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ব্যয় করতে প্রস্তুত নয়। প্রাণপাত করা ও বিপদ মাথা পেতে নেয়া তো দূরের কথা কোন কাজেও তারা নির্দ্বধায় মু’মিনদের সাথে সহযোগিতা করতে চায় না।
# আভিধানিক দিক দিয়ে আয়াতটির দু’টি অর্থ হয়। এক, যুদ্ধের ময়দান থেকে সাফল্য লাভ করে যখন তোমরা ফিরে আসো তখন তারা বড়ই হৃদ্যতা সহকারে ও সাড়ম্বরে তোমাদেরকে স্বাগত জানায় এবং বড় বড় বুলি আউড়িয়ে এই বলে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে যে, আমরাও পাক্কা মু’মিন এবং এ কাজ সম্প্রসারণে আমরাও অংশ নিয়েছি কাজেই আমরাও গনীমাতের মালের হকদার। দুই, বিজয় অর্জিত হলে গনীমাতের মাল ভাগ করার সময় তাদের কন্ঠ বড়ই তীক্ষ্ণ ও ধারাল হয়ে যায় এবং তারা অগ্রবর্তী হয়ে দাবী করতে থাকে, আমাদের ভাগ দাও, আমরাও কাজ করেছি, সবকিছু তোমরাই লুটে নিয়ে যেয়ো না।
# ইসলাম গ্রহণ করার পর তারা যেসব নামায পড়েছে, রোযা রেখেছে, যাকাত দিয়েছে এবং বাহ্যত যেসব সৎকাজ করেছে সবকিছুকে মহান আল্লাহ‌ নাকচ করে দেবেন এবং সেগুলোর কোন প্রতিদান তাদেরকে দেবেন না। কারণ আল্লাহর দরবারে কাজের বাহ্যিক চেহারার ভিত্তিতে ফায়সালা করা হয় না বরং এ বাহ্য চেহারার গভীরতম প্রদেশে বিশ্বাস ও আন্তরিকতা আছে কিনা তার ভিত্তিতে ফায়সালা করা হয়। যখন এ জিনিস আদতে তাদের মধ্যে নেই তখন এ লোক দেখানো কাজ একেবারেই অর্থহীন। এখানে এ বিষয়টি গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, যেসব লোক আল্লাহ‌ ও রসূলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, নামায পড়ছিল, রোযা রাখছিল, যাকাতও দিচ্ছিল এবং মুসলমানদের সাথে তাদের অন্যান্য সৎকাজে শামিলও হচ্ছিল, তাদের সম্পর্কে পরিষ্কার ফায়সালা শুনিয়ে দেয়া হলো যে, তারা আদতে ঈমানই আনেনি। আর এ ফায়সালা কেবলমাত্র এরই ভিত্তিতে করা হলো যে, কুফর ও ইসলামের দ্বন্দ্বে যখন কঠিন পরীক্ষার সময় এলো তখন তারা দো-মনা হবার প্রমাণ দিল, দ্বীনের স্বার্থের ওপর নিজের স্বার্থের প্রার্ধন্য প্রতিষ্ঠিত করলো এবং ইসলামের হেফাজতের জন্য নিজের প্রাণ, ধন-সম্পদ ও শ্রম নিয়োজিত করতে অস্বীকৃতি জানালো। এ থেকে জানা গেলো, ফায়সালার আসল ভিত্তি এসব বাহ্যিক কাজ-কর্ম নয়। বরং মানুষের বিশ্বস্ততা কার সাথে সম্পর্কিত তারই ভিত্তিতে এর ফায়সালা সূচিত হয়। যেখানে আল্লাহ‌ ও তাঁর দ্বীনের প্রতি বিশ্বস্ততা নেই সেখানে ঈমানের স্বীকৃতি এবং ইবাদাত ও অন্যান্য সৎকাজের কোন মূল্য নেই।
# তাদের কার্যাবলীর কোন গুরুত্ব ও মূল্য নেই। ফলে সেগুলো নষ্ট করে দেয়া আল্লাহর কাছে মোটেই কষ্টকর হবে না। তাছাড়া তারা এমন কোন শক্তিই রাখে না যার ফলে তাদের কার্যাবলী ধ্বংস করে দেয়া তাঁর জন্য কঠিন হতে পারে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৯-১১ নং আয়াতের তাফসীর:

৫ম হিজরীতে মুসলিম ও মক্কার কুরাইশসহ মদীনার ইয়াহুদী আর আশপাশের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে আহযাব অর্থাৎ খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তাদের মুকাবেলা করা ছিল খুবই কঠিন। এ কঠিন মুহূর্তে মুসলিম বাহিনীকে আল্লাহ তা‘আলা যে গায়েবী মদদ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন সে নেয়ামতের কথা স্মরণ করার জন্য মু’মিনদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। আয়াতে প্রথমত ‘جنود’ বলতে শত্র“বাহনীদেরকে বুঝানো হয়েছে। যখন শত্র“বাহিনী মুসলিম বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার উপক্রম হয়েছিল তখনই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর গায়েবী মদদ দ্বারা মুসলিম বাহিনীকে রক্ষা করলেন। আল্লাহ তা‘আলার সে সময় যে নেয়ামতসমূহ দিয়েছিলেন তা হলন

১. বাতাস বা ঝড়। এর দ্বারা ঐ প্রবল হওয়াকে বুঝানো হয়েছে, যা তুফানরূপে এসে শত্র“দের তাঁবু উড়িয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল, পশুর দল রশি ছিঁড়ে পালিয়েছিল, হাড়ি-পাতিল উল্টে গিয়েছিল এবং তারা সকলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এ ঝড় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমাকে পূবালী হাওয়া দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে এবং আ‘দ জাতিকে পশ্চিমা হওয়া দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ১০৩৫, সহীহ মুসলিম হা: ৯০০)

২. দ্বিতীয় ‘جنود’ বা সৈন্য দ্বারা ফেরেশতাদের বাহিনীকে বুঝানো হয়েছে। তারা শত্র“দের মনে এমন ভয় ও ত্রাস সঞ্চার করে দিয়েছে যে, তারা (শত্র“ বাহিনী) সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়াটাই নিজেদের জন্য কল্যাণকর মনে করেছিল।

‘من فوقكم’ দ্বারা উচ্চাঞ্চল অর্থাৎ গাতফান, হওয়াযিন এবং নাজদের অন্যান্য মুশরিক বাহিনীরা উদ্দেশ্য, তারাও মুসলিমদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য এসেছিল।

من أسفل منكم এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল কুরাইশ এবং তাদের সাহায্যকারীরা।

আহযাব যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ঘটনা:

ইয়াহূদী গোত্র বানু নাযীর; যাদেরকে বার বার অঙ্গীকার ভঙ্গ করার ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তারা খায়বারে গিয়ে বসবাস শুরু করে। তারা মক্কার কাফিরদেরকে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করার জন্য তৈরী করল। অনুরূপ গাতফান, নাজদের গোত্রসহ অন্যান্য গোত্রগুলোকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে লড়াইয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করল। সুতরাং ইয়াহূদীরা অনায়াসে ইসলাম ও মুসলিমদের সকল শত্র“দেরকে একত্রিত করে মদীনায় আক্রমণ করতে সাহস পেল।

মক্কার মুশরিকদের কমান্ডার ছিল আবূ সফিয়ান। সে উহূদ পর্বতের আশেপাশে শিবির স্থাপন করে প্রায় পুরো মদীনা পরিবেষ্টন করে নিল। তাদের সম্মিলিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। আর মুসলিমগণ ছিলেন মাত্র তিন হাজার। এ ছাড়াও মদীনার দক্ষিণ দিকে ইয়াহূদীদের তৃতীয় গোত্র বানু কুরাইযা বাস করত; যাদের সাথে তখনও মুসলিদের চুক্তি ছিল এবং তারা মুসলিমদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বানু নাযীরের ইয়াহূদী সর্দার হুয়াই বিন আখত্বাব মুসলিমদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরকে ফুসলিয়ে নিজেদের সাথে করে নিল। এদিকে মুসলিম বাহিনী সর্বদিক দিয়ে শত্র“ বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ল।

সেই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় সালমান ফারসীর (রাঃ) পরামর্শে পরিখা খনন করা হল। যার ফলে শত্র“ বাহিনী মদীনার ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হল না। বরং মদীনার বাইরেই থাকতে বাধ্য হল। তখন মুসলিম বাহিনী তাদের এ পরিবেষ্টনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এমনকি তাদের চক্ষু স্থির হয়ে গিয়েছিল। প্রাণ কণ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল এবং তারা এ বিপদের সম্মুখীন হয়ে আল্লাহ তা‘আলা সম্বন্ধে নানাবিধ কু-ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিল। ঠিক ঐ মুর্হূতেই মহান আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম বাহিনীকে গায়েবী সাহায্যস্বরূপ বাতাস ও সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন।

আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন খন্দকের দিকে আগমন করলেন তখন প্রত্যক্ষ করলেন যে, শীতের সকালে আনসার ও মুহাজিরগণ পরিখা খনন করছেন। তাদের নিকট এমন কোন দাস নেই যে, তাদের পরিবর্তে দাসগণ ঐ কাজ করবে। তাদের কষ্ট এবং ক্ষুধার ভাব দেখে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:

اللَّهُمَّ إِنَّ العَيْشَ عَيْشُ الآخِرَهْ، فَاغْفِرْ لِلْأَنْصَارِ وَالمُهَاجِرَهْ

হে আল্লাহ তা‘আলা! পরকালের জীবনই তো প্রকৃত জীবন, অতএব আনসার ও মুহাজিরদেরকে ক্ষমা করে দাও। আনসার ও মুহাজিররা প্রত্যুত্তরে বললেন:

نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدَا … عَلَي الجِهَادِ مَا بَقِينَا أَبَدَا

আমরা সেই ব্যক্তি যারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হস্তে বাইয়াত করেছি যে, যতদিন জীবিত থাকব ততদিন জিহাদ করব। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৩৪)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মু’মিন বান্দাদেরকে বিপদ-আপদের মাধ্যমে ঈমান পরীক্ষা করেন ।
২. মু’মিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য করা কর্তব্য।
৩. সংখ্যা বেশি হলেই যে বিজয়ী হওয়া যাবে এমনটি মনে করা ঠিক নয়।
৪. পূবালী বাতাস রহমতস্বরূপ আর পশ্চিমা বাতাস হল আযাবস্বরূপ।

১২-২০ নং আয়াতের তাফসীর:

এ আয়াতগুলোতে আহযাব অর্থাৎ খন্দকের যুদ্ধের কঠিন মুর্হূতে মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ ছিল তারা আল্লাহ তা‘আলার এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেয়া সাহায্যের প্রতিশ্র“তিকে মিথ্যা মনে করেছিল এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন টাল-বাহানা, ওজর পেশ করেছিল সে কথাই আলোচনা করা হয়েছে। এটা ছিল তাদের অভ্যন্তরীণ কুফরীর বহিঃপ্রকাশ। পরবর্তী পর্যায়ে যেসব মুনাফিক কার্যতঃ বাহ্যিকভাবে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে শরীক ছিল তারা দুশ্রেণির; প্রথম শ্রেণিন যারা কিছু না বলেই পালাতে লাগল এবং বলতে লাগল

(وَإِذْ قَالَتْ طَّآئِفَةٌ مِّنْهُمْ يٰٓأَهْلَ يَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوْا)

“তাদের মধ্য থেকে এক দল বলেছিল: হে ইয়াস্রিববাসী! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, অতএব তোমরা ফিরে যাও”। আরেক শ্রেণিন যারা ছল-চাতুরী করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আবেদন করল। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَيَسْتَأْذِنُ فَرِيْقٌ مِّنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُوْلُوْنَ إِنَّ بُيُوْتَنَا عَوْرَةٌ)

“আর তাদের মধ্যে এক দল নাবীর কাছে অব্যাহতি চেয়ে বলেছিল: আমাদের বাড়ি-ঘর অরক্ষিত।” আল্লাহ তা‘আলা তাদের এসব ছল-চাতুরীর স্বরূপ উদঘাটন করে দিয়েছেন যে, এসব মিথ্যা। আসলে এরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যেতে চায় । পরবর্তী কয়েক আয়াতে তাদের কুকর্ম ও মুসলিমদের সাথে শত্র“তা অতঃপর এদের করুণ ও মর্মন্তুদ পরিণতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

“يثرب” দ্বারা মদীনাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মদীনার পূর্ব নাম ছিল ইয়াসরিব। হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন “স্বপ্নে আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে। তা দুটি কঙ্করময় ভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত। আমার মনে হয়েছিল যে, ওটা হিজর হবে। কিন্তু না তা ইয়াসরিব। (সহীহ বুখারী হা: ৭/২৬৭, সহীহ মুসলিম হা: ৪/২০/১৭৭৯)

“الفتنة” দ্বারা দুটো অর্থ হতে পারে:

১. শির্ক:

অর্থাৎ মদীনা বা ওদের ঘরে যদি চারদিক থেকে শত্র“বাহিনী প্রবেশ করত এবং তাদের নিকট (মুনাফিকী) প্রস্তাব রাখত যে, তোমরা পুনরায় কুফরী ও শির্কের দিকে ফিরে এসো, তাহলে ওরা সামান্যও দেরী করত না এবং সে সময় ঘর অরক্ষিত হওয়ার কোন ওজর দেখাত না। বরং অবিলম্বে শির্কের প্রস্তাবকে গ্রহণ করত। উদ্দেশ্য এই যে, কুফর ও শির্কের প্রতি ওরা বড় আসক্ত এবং তার দিকে ওরা দ্রুত ধাবিত হয়।

২. বিদ্রোহ ও অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করে যুদ্ধ:

অর্থাৎ শত্র“বাহিনী প্রবেশ করে ওদের সাথে মিলিত হয়ে ওদেরকে বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত করত, তাহলে ওরা অবশ্যই বিদ্রোহ করে বসত।

তবে এখানে ফিতনা অর্থ শির্ক এটাই অধিক গ্রহণযোগ্য।

(وَلَقَدْ كَانُوْا عَاهَدُوا اللّٰهَ مِنْ قَبْلُ)

‘অথচ এরাই পূর্বে আল্লাহ্র সাথে শপথ করেছিল’ এ আয়াতে যে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে তা হল, মুসলিম বাহিনী যখন বদর প্রান্তরে বিজয়ী হয়েছিল এবং প্রচুর গনীমত লাভ করেছিল। তখন এ মুনাফিকরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিল যে, তারা আর কখনো যুদ্ধ থেকে পিছপা হবে না। কিন্তু খন্দকের যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে সে ওয়াদা ঠিক রাখতে পারেনি। মুনাফিকরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঐ সকল পলায়নকারী মুনাফিকদেরকে তিরস্কারের সাথে বলতে বলছেন যে, বলে দাও; তোমরা নিহত হবে বা মারা যাবে এ ভয়ে পলায়ন করলেও কোন উপকার হবে না, হয়তো দুনিয়াতে বেশ কয়েকদিন বেঁচে থাকতে পারবে কিন্তু তারপরও মৃত্যু বরণ করতে হবে, তখন বুঝতে পারবে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা ও ওয়াদা দিয়ে তা ভঙ্গ করার পরিণাম কী।

তারপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরো জানিয়ে দিতে বলছেন: যদি আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কোন ক্ষতি চান বা কোন কল্যাণ চান তাহলে কেউ কি আছে, যে তা হতে রক্ষা করতে পারবে বা তা ঠেকাতে পারবে? না কক্ষনো নয়। সুতরাং কেন তোমরা মৃত্যুর ভয়ে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করছ?

(قَدْ يَعْلَمُ اللّٰهُ الْمُعَوِّقِيْنَ مِنْكُمْ)

‘আল্লাহ খুব ভাল করেই জানেন তোমাদের মধ্যে কারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়’ الْمُعَوِّقِيْنَ অর্থ বাধাদানকারী, প্রতিহতকারী। অর্থাৎ যে সকল মুনাফিকরা মানুষকে যুদ্ধে যেতে বাধা দেয় আর যারা তাদের ভাইদেরকে যুুদ্ধের ময়দান থেকে চলে আসতে বলে তাও আল্লাহ তা‘আলা জানেন। মুকাতিল বলেন: তারা হল মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সাথীরা।

এতে তিনটি বর্ণনা রয়েছে:

(১) এরা হল মুনাফিক, মু’মিনদেরকে তারা বলেছিল: মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যাবে, অতএব আমাদের দলে চলে আসো।

(২) এরা হল বানু কুরাইযার ইয়াহূদী, তাদের মুনাফিক ভাইদেরকে বলেছিল: মুহাম্মাদকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসো, কেননা সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আবূ সুফিয়ান জয়ী হলে তোমাদের কাউকে জীবিত রাখবে না।

(৩) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জনৈক সাহাবী যিনি যুদ্ধের ময়দানে তরবারী ও তিরন্দাজদের মাঝে ছিলেন তাকে তার সহোদর ভাই বলল: আমার কাছে চলে আসো, চারদিক থেকে তোমাদেরকে শত্র“রা বেষ্টন করে নিয়েছে। সে সাহাবী বলছিলেন: তুমি মিথ্যা বলেছ, আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমি এ কথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানিয়ে দেব। সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানিয়ে দিতে গিয়ে দেখে ওয়াহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। (কুরতুবী)

“اَشِحَّةٌ” শব্দের অর্থ হল কৃপণ। অর্থাৎ তারা ছিল নফসের দিক দিয়ে, চেষ্টার দিক দিয়ে, ভালবাসার দিক দিয়ে এবং মু’মিনদেরকে সাহায্য করার দিক দিয়ে কৃপণ। আর তারা ছিল দুনিয়া প্রিয় ও মৃত্যুকে অপছন্দকারী।

(يَحْسَبُوْنَ الْأَحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوْا)

‘তারা ধারণা করে যে, এখনও সম্মিলিত শত্র“বাহিনী চলে যায়নি’ অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের কাপুরুষতার কারণে ধারণা করেছিল যে, শত্র“ বাহিনী এখনো চলে যায়নি। কিন্তু তারা চলে গিয়েছিল তবে বেশি দূর যায়নি। তারা মনে মনে কামনা করছিল যদি আবার আসে তাহলে তারা মারামারি থেকে বাঁচার জন্য পল্লী এলাকায় চলে যাবে। ফলে নিরাপদে থেকে যাবে, কোন সমস্যা হবে না, সেখানে বসে বসে পরিবেশ-পরিস্থিতির খবর নেবে ।

ওপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মুনাফিকরা ইসলামের জন্য যত ক্ষতিকর, কাফিরাও তত ক্ষতিকর নয়। তাই তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে, কারণ মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ ক্ষতি করার জন্য তারাই যথেষ্ট।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. যত বড় বিপদই আসুক না কেন ঈমানের ওপর ধৈর্যধারণ করে অটল থাকতে হবে। ঈমান হারা হওয়া যাবে না।
২. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা যাবে না এবং এর জন্য কোন ওজর পেশ করা যাবে না।
২. কেবল মুনাফিকরাই জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করে থাকে।
৩. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মুনাফিকের আলামত।
৪. মানুষকে একদিন না একদিন অবশ্যই মৃত্যু বরণ করতে হবে। কোন প্রাণীই চিরস্থায়ী নয়।
৬. সর্বপ্রকার কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৭. মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ শত্র“, এরা কাফিরদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৯-১০ নং আয়াতের তাফসীর

পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে। আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের উপর যে দয়া ও অনুগ্রহ করেছিলেন এখানে তিনি তারই বর্ণনা দিচ্ছেন। যখন মুশরিকরা মুসলমানদেরকে দুনিয়া হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্যে পূর্ণ শক্তিসহ বিরাট বাহিনী নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করেছিল। কেউ কেউ বলেন যে, খন্দকের যুদ্ধ চতুর্থ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের ঘটনা এই যে, বানু নাযীরের ইয়াহুদী নেতৃবর্গ, যাদের মধ্যে সালাম ইবনে আবি হাকীক, সালাম ইবনে মুশকাম, কিনানাহ, ইবনে রাবী প্রমুখ ছিল, মক্কায় এসে পূর্ব হতেই প্রস্তুত কুরায়েশদেরকে যুদ্ধের জন্যে উত্তেজিত করলো এবং তাদের সাথে অঙ্গীকার করলো যে, তারা তাদের অধীনস্থ লোকদেরকে সাথে নিয়ে তাদের দলে যোগদান করবে। সেখানে তাদের সাথে কথা শেষ করে তারা গাতফান গোত্রের লোকদের নিকট গমন করলো এবং তাদের সাথে কথাবার্তা বলে তাদেরকেও তাদের সাথে মিলিত করলো। কুরায়েশরাও এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে সারা আরবে আলোড়ন সৃষ্টি করলো এবং আরো কিছু লোক যোগাড় করে নিলো। এসবের সরদার নির্বাচিত হলেন আবু সুফিয়ান সাখর ইবনে হারব এবং গাতফান গোত্রের নেতা নির্বাচিত হলো উয়াইনা ইবনে হাসান ইবনে বদর। এভাবে চেষ্টা তদবীর চালিয়ে তারা দশ হাজার যোদ্ধা একত্রিত করলো এবং মদীনার দিকে ধাওয়া করলো। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ সংবাদ পেয়ে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)-এর পরামর্শক্রমে, মদীনার পূর্ব দিকে খন্দক খনন করতে শুরু করলেন। সমস্ত মুহাজির ও আনসার এ খনন কার্যে অংশগ্রহণ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেও একাজে অংশ নিলেন। স্বয়ং তিনি কাদা-মাটি বহন করতে লাগলেন। মুশরিকদের সেনাবাহিনী বিনা বাধায় মদীনা পর্যন্ত পৌঁছে গেল এবং মদীনার পূর্বাংশে উহুদ পাহাড় সংলগ্ন স্থানে নিজেদের শিবির স্থাপন করলো। এটা ছিল মদীনার নিম্নাংশ। মদীনার উপরাংশে তারা এক বিরাট সৈন্য দল পাঠিয়ে দিলো যারা মদীনার উঁচু অংশে শিবির স্থাপন করলো এবং নীচে ও উপরের দিক থেকে মুলমানদেরকে অবরোধ করে ফেললো। মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা তিন হাজারেরও কম ছিল। কোন কোন রিওয়াইয়াতে শুধু সাতশ’ বলা হয়েছে। এই অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুকাবিলার জন্যে আসলেন। তিনি সালা পাহাড়কে পিছনের দিকে করলেন। শত্রুদের দিকে মুখ করে তিনি সৈন্য সমাবেশ করলেন। যে খন্দক তিনি খনন করেছিলেন তাতে পানি ইত্যাদি ছিল না। তা শুধু একটি গর্ত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) শিশু ও মহিলাদেরকে মদীনার একটি মহল্লায় একত্রিত করে রেখে দেন। মদীনায় বানু কুরায়যা নামক ইয়াহুদীদের একটি গোত্র বসবাস করতো। তাদের মহল্লা ছিল মদীনার পূর্ব দিকে। নবী (সঃ)-এর সাথে তাদের দৃঢ় সন্ধিচুক্তি ছিল। তাদেরও বিরাট দল ছিল। প্রায় আটশ’ জন বীর যোদ্ধা তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। মুশরিক ও ইয়াহূদীরা তাদের কাছে হুয়াই ইবনে আখতাব নারীকে পাঠিয়ে দিলো। সে তাদেরকে নানা প্রকারের লোভ-লালসা দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে করে নিলো। তারাও ঠিক সময়ে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো এবং প্রকাশ্যভাবে সন্ধি ভেঙ্গে দিলো। বাইরে দশহাজার শত্রু সৈন্য ছাউনি ফেলে বসে আছে। এদিকে ইয়াহূদীদের এই বিশ্বাসঘাতকতা যেন বগলে ফোড়া বের হওয়া। বত্রিশ দাঁতের মধ্যে জিহ্বা অথবা আটার মধ্যে লবণের মত মুসলমানদের অবস্থা হয়ে গেল। এ সাতশ জন লোক কি-ই বা করতে পারে? এটা ছিল ঐ সময় যার চিত্র কুরআন কারীম অংকন করেছে যে, তখন মুমিনরা পরীক্ষিত হয়েছিল এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল। শত্রুরা একমাস ধরে অবরোধ অব্যাহত রাখলো। যদিও মুশরিকরা খন্দক অতিক্রম করতে মক্ষম হলো না। তবে তারা মাসাধিককাল ধরে মুসলমাদেরকে ঘিরে বসে থাকলো। এতে মুসলমানরা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো। আমর ইবনে আবদে অদ্দ, যে ছিল আরবের বিখ্যাত বীর পুরুষ, সেনাপতিত্ব বিষয়ে যে ছিল অদ্বিতীয়, একবার সে নিজের সাথে কয়েকজন দুঃসাহসী বীরপুরুষকে নিয়ে সাহস করে অশ্বচালনা করলো এবং খন্দক পার হয়ে গেল। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় অশ্বারোহীদের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। কিন্তু বলা হয় যে, তাদেরকে তিনি প্রস্তুত না পেয়ে হযরত আলী (রাঃ)-কে তাদের মুকাবিলা করার নির্দেশ দিলেন। অল্পক্ষণ ধরে উভয় পক্ষের বীরপুরুষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলতে থাকলো। অবশেষে আল্লাহর সিংহ হযরত আলী (রাঃ) শত্রুদেরকে তরবারীর আঘাতে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। এতে মুসলমানরা খুবই খুশী হলেন এবং তাঁদের সাহস ও উৎসাহ বেড়ে গেল। তারা বুঝে নিলেন যে, তাদের জয় সুনিশ্চিত। অতঃপর আল্লাহ তা’আলার নির্দেশক্রমে ভীষণ বেগে ঝড় তুফান ও ঘূর্ণিবার্তা প্রবাহিত হতে শুরু করলো। এর ফলে কাফিরদের সমস্ত তাঁবু মূলোৎপাটিত হলো। কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। অগ্নি জ্বালানো কঠিন হয়ে গেল। কোন আশ্রয়স্থল তাদের দৃষ্টিগোচর হলো না। পরিশেষে তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গেল। এরই বর্ণনা কুরআন কারীমে দেয়া হয়েছে এবং আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম ঝঞাবায়ু। এ আয়াতে যে বায়ুর কথা বলা হয়েছে হযরত মুজাহিদ (রঃ)-এর মতে ওটা ছিল পূবালী হাওয়া। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিম্নের উক্তিও এর পৃষ্ঠপোষকতা করে। তিনি বলেনঃ “পূবালী বায়ু দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে এবং আ’দ সম্প্রদায়কে দাৰূর’ দ্বারা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।”

ইকরামা (রাঃ) বলেন যে, দক্ষিণা হাওয়া উত্তরা হাওয়াকে আহযাবের যুদ্ধের সময় বলেঃ “চল, আমরা উভয়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সাহায্য করি।” তখন উত্তরা হাওয়া জবাবে বলেঃ “রাত্রে গরম বা প্রখরতা চলে না।” অতঃপর পূবালী হাওয়া প্রবাহিত হলো। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ “আমার মামা হযরত উসমান ইবনে মাযউন (রাঃ) খন্দকের যুদ্ধের রাত্রে কঠিন শীত ও প্রচণ্ড বাতাসের সময় খাদ্য ও লেপ আনার জন্যে আমাকে মদীনায় প্রেরণ করেন। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি আমাকে অনুমতি প্রদান করেন। তিনি আমাকে বলেনঃ “আমার কোন সাহাবীর সাথে তোমার দেখা হলে তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে।” আমি চললাম। ভীষণ জোরে বাতাস বইতে ছিল। যে সাহাবীর সাথে আমার সাক্ষাৎ হচ্ছিল আমি তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পয়গাম পৌছিয়ে দিচ্ছিলাম। যিনি পয়গাম শুনছিলেন তিনিই তৎক্ষণাৎ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দিকে চলে আসছিলেন। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ পিছন ফিরেও দেখছিলো না। বাতাস আমার ঢালে ধাক্কা দিচ্ছিল এবং আমি তাতে আঘাত পাচ্ছিলাম। এমনকি ওর লোহা আমার পায়ে পড়ে গেল। আমি ওটাকে নীচে ফেলে দিলাম। (এটাও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি এমন এক বাহিনী প্রেরণ করেছিলাম যা তোমরা দেখোনি।” তাঁরা ছিলেন ফেরেশতা। তাঁরা মুশরিকদের অন্তর ও বক্ষ ভয়, সন্ত্রাস এবং প্রভাব দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাদের সমস্ত নেতা তাদের অধীনস্থ সৈন্যদেরকে কাছে ডেকে ডেকে বলেছিলঃ “তোমরা মুক্তির পথ অন্বেষণ কর, বাঁচার পথ বের করে নাও।” এটা ছিল ফেরেশতাদের নিক্ষিপ্ত ভয় ও প্রভাব এবং তারাই ছিলেন ঐ সেনাবাহিনী যার বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে।

কুফার অধিবাসী একজন নব্যযুবক হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রাঃ)-কে বলেনঃ “হে আবু আবদিল্লাহ (রাঃ)! আপনি বড়ই ভাগ্যবান যে, আপনি আল্লাহর নবী (সঃ)-কে স্বচক্ষে দেখেছেন এবং তাঁর মজলিসে বসেছেন। বলুন তো, তখন আপনি কি করতেন?” হযরত হুযাইফা (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহর কসম! আমি তখন জীবন দানে প্রস্তুত থাকতাম।”এ কথা শুনে যুবকটি বলেনঃ “শুনুন চাচা! যদি আমরা নবী (সঃ)-এর যামানা পেতাম তবে আল্লাহর শপথ! আমরা তাঁর পা মাটিতে পড়তে দিতাম না। তাঁকে আমরা নিজেদের ঘাড়ে উঠিয়ে নিয়ে ফিরতাম।” তিনি তখন বললেনঃ “হে আমার প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্র! তাহলে একটি ঘটনা বলি, শুননা। খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) গভীর রাত্রি পর্যন্ত নামায পড়ছিলেন। নামায শেষ করে তিনি বললেনঃ “কাফিরদের খবরাখবর আনতে পারে এমন কেউ তোমাদের মধ্যে আছে কি? আল্লাহর নবী (সঃ) তার সাথে শৰ্ত করছেন যে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” তাঁর এ কথায় কেউই দাঁড়ালো না। কেননা সবারই ভয়, ক্ষুধা ও ঠাণ্ডা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আবার তিনি অনেকক্ষণ ধরে নামায পড়লেন। তারপর পুনরায় বললেনঃ “যে। ব্যক্তি বিপক্ষ দলের খবর নিয়ে আসবে, আমি তাকে অভয় দিচ্ছি যে, সে অবশ্যই (অক্ষত ও নিরাপদ অবস্থায়) ফিরে আসবে। আমি দু’আ করি যে, তাকে যেন আল্লাহ জান্নাতে আমার বন্ধু হিসেবে স্থান দেন।” এবারও কেউ দাঁড়ালো না। আর দাঁড়াবেই বা কি করে? ক্ষুধার জ্বালায় তাদের পেট কোমরের সাথে লেগে গিয়েছিল এবং ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁতে বাজতে শুরু করেছিল। ভয়ে তাদের রক্ত পানি হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নাম ধরে ডাক দিলেন। আমার তো তখন আর তার ডাকে সাড়া দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকলো না। তিনি বললেনঃ “হুযাইফা (রাঃ) তুমি যাও এবং দেখে এসো তারা কি করছে। দেখো, তুমি যে পর্যন্ত আমার কাছে ফিরে না আসো সে পর্যন্ত নতুন কোন কাজ করে বসো না।” আমি খুব আচ্ছা’ বলে আমার পথ ধরলাম। সাহস করে আমি শত্রুর মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সেখানে গিয়ে বিস্ময়কর অবস্থা দেখলাম। তা এই যে, আল্লাহ তা’আলার অদৃশ্য সৈন্যরা আনন্দের সাথে নিজেদের কাজ করতে রয়েছে। বাতাস চুলার উপর হতে ডেকচিগুলোকে উল্টিয়ে ফেলেছে। তাঁবুর খুঁটি উৎপাটিত হয়েছে। তারা আগুন জ্বালাতে পারছে না। কোন কিছুই সজ্জিত অবস্থায় নেই। ঐ সময় আবু সুফিয়ান দাড়িয়ে উচ্চ স্বরে সকলকে সম্বোধন করে বললেনঃ “হে কুরায়েশরা! তোমরা নিজ নিজ সঙ্গী হতে সতর্ক হয়ে যাও। নিজ সাথীদের দেখা শোনা কর। এমন যেন না হয় যে, অন্য কেউ তোমাদের পাশে দাড়িয়ে তোমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে।” আমি কথাগুলো শুনার সাথে সাথে আমার পাশে যে কুরায়েশী দাঁড়িয়েছিল তার হাত ধরে ফেললাম এবং তাকে। বললামঃ কে তুমি? সে উত্তরে বললো: “আমি অমুকের পুত্র অমুক।” আমি বললামঃ এখন থেকে সতর্ক থাকবে। আবু সুফিয়ান বললেনঃ “হে কুরায়েশের দল! আল্লাহর কসম, আমাদের আর কোথাও দাঁড়াবার স্থান নেই। আমাদের গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুগুলো এবং আমাদের উটগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। বানু কুরাইযা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা আমাদেরকে খুব কষ্ট দিয়েছে। অতঃপর এই ঝড়ো হাওয়া আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। আমরা রান্না করে খেতে পারছি না। তবু ও থাকার স্থান আমরা ঠিক রাখতে পারছি না। তোমরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আমি তো ফিরে যাবার কথা চিন্তা করছি। আমি তোমাদের সকলকেই ফিরে যাবার নির্দেশ দিচ্ছি।” এ কথা বলেই পাশে যে উটটি বসিয়ে রাখা হয়েছিল তার উপর তিনি উঠে বসলেন। উটকে মার দিতেই সে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। সে সময় আমার এমন সুযোগ হয়েছিল যে, আমি ইচ্ছা করলে আবু সুফিয়ান (রাঃ)-কে একটি তীরের আঘাতেই খতম করে দিতে পারতাম। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশ ছিল যে, আমি যেন নতুন কোন কাজ না করে বসি। তাই আমি এ কাজ হতে বিরত থাকলাম। এখন আমি ফিরে চললাম এবং আমার সৈন্যদলের মধ্যে পৌছে গেলাম। আমি যখন পৌঁছি তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি চাদর গায়ে দিয়ে নামায পড়ছিলেন। চাদরটি ছিল তাঁর কোন এক পত্নীর। আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি আমাকে তাঁর দুই পায়ের মাঝে বসিয়ে নিলেন এবং তাঁর ঐ চাদর দ্বারা আমাকে আবৃত করলেন। অতঃপর তিনি রুকু সিজদা করলেন। আর আমি সেখানেই চাদরমুড়ি দিয়ে বসে থাকলাম। তাঁর নামায পড়া শেষ হলে আমি তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। গাতফান গোত্র যখন কুরায়েশদের ফিরে যাবার কথা শুনলো তখন তারাও নিজেদের তলপি-তলপা বেঁধে নিয়ে ফিরে চললো।”

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর কসম! ককনে শীত সত্ত্বেও আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি যেন কোন গরম হাম্মাম খানায় রয়েছি। ঐ সময় আবু সুফিয়ান (রাঃ) আগুন জ্বেলে তাপ গ্রহণ করছিল। আমি তাকে দেখে চিনে ফেললাম। সাথে সাথে আমি কামানে তীর যোজন করলাম। মনে করলাম যে, তীর ছুঁড়ে দিই। তিনি আমার তীরের আওতার মধ্যেই ছিলেন। আমার লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার কোন কারণই ছিল না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কথা আমার স্মরণ হয়ে গেল যে, আমি যেন এমন কোন নতুন কাজ করে না বসি যার ফলে শত্রুরা সতর্ক হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমি আমার বাসনা পরিত্যাগ করলাম। যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ফিরে আসলাম তার পূর্ব পর্যন্ত আমি কোন ঠাণ্ডা অনুভব করিনি। আমার মনে হচ্ছিল যে, যেন আমি গরম হাম্মাম খানায় আছি। তবে যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পৌছলাম তখন খুবই ঠাণ্ডা অনুভূত হতে লাগলো। আমি ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে দিলেন। আমি সকাল পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমালাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে এ বলে জাগালেনঃ “হে নিদিত ব্যক্তি! জেগে ওঠো।

অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, যখন ঐ তাবেয়ী বলেনঃ “হায়! যদি আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দেখতাম এবং তাঁর যুগটা পেতাম।” তখন হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ “হায়! যদি তোমার মত আমার ঈমান হতো। তাকে না দেখেই তুমি তাঁর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছো! তবে হে আমার প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্র! তুমি যে আকাক্ষা করছে তা শুধু আকাঙ্ক্ষাই মাত্র। সেই সময় থাকলে তুমি কি করতে তা তুমি জানো না। আমাদের উপর দিয়ে কত কঠিন সময় গত হয়েছে!” অতঃপর তিনি তাঁর সামনে উপরোল্লিখিত ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তাতে তিনি একথাও বললেনঃ “ঝড় তুফানের সাথে সাথে বৃষ্টিও বর্ষিত হচ্ছিল।”

আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথের ঘটনাটি বর্ণনা করছিলেন তখন মজলিসে যারা উপস্থিত ছিলেন। তারা বললেনঃ “আমরা যদি সে সময় উপস্থিত থাকতাম তবে এই করতাম, ঐ করতাম।” তাঁদের একথা শুনে হযরত হুযাইফা (রাঃ) ঘটনাটি বর্ণনা করেনঃ ‘বাহির হতে তো দশ হাজার সৈন্য আমাদেরকে ঘিরে বসে আছে, আর ভিতর হতে বানু কুরাইযার আটশ’ জন ইয়াহূদী বিদ্রোহী হয়ে গেছে এবং শিশুরা ও নারীরা মদীনায় পড়ে আছে। এভাবে সবদিক দিয়েই বিপদ লেগে আছে। যদি বানু কুরাইযা গোত্র এদিকে লক্ষ্য করে তাহলে ক্ষণেকের মধ্যে শিশু ও নারীদের ফায়সালা করে দিবে। আল্লাহর শপথ! এ রাত্রের মত ভীতি-বিহ্বল অবস্থা আমার আর কখনো হয়নি। এর উপর ঝড় বইছে, তুফান সমানভাবে চলতেই আছে, চতুর্দিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, মেঘ গর্জন করছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সবই মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহর ইচ্ছেতেই হচ্ছে। সাথীদেরকে কোথায় দেখা যাবে? নিজের হাতের অঙ্গুলীও দেখা যায় না। মুনাফিকরা বাহানা করতে শুরু করে দিয়েছে যে, তাদের ছেলে মেয়ে, স্ত্রী পরিবারকে দেখবার কেউ নেই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) যেন তাদেরকে ফিরে যাবার অনুমতি প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাউকেও ফিরে যেতে বাধা দিলেন না। যেই অনুমিত চায় তাকেই তিনি বলেনঃ “যাও, আগ্রহের সাথেই যাও।” সুতরাং তারা এক এক করে সরে পড়ে। আমরা শুধু প্রায় তিনশর মত রয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এসে আমাদেরকে এক এক করে দেখলেন। আমার অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। আমার কাছে শত্রুর হাত হতে রক্ষা পাওয়ার না ছিল কোন অস্ত্র এবং ঠাণ্ডা হতে বাঁচবার না ছিল কোন ব্যবস্থা। শুধু আমার স্ত্রীর ছোট একটি চাদর ছিল যা আমার হাঁটু পর্যন্ত পৌছেনি। যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নিকট আসলেন তখন আমি আমার হাঁটুতে মাথা লাগিয়ে কাঁপছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “এটা কে?” আমি উত্তরে বললামঃ আমি হুযাইফা। তিনি তখন বললেনঃ “হে হুযাইফা (রাঃ)! শুন।” তাঁর একথা শুনে আল্লাহর কসম! পৃথিবী আমার উপর সংকুচিত হয়ে গেল যে, না জানি হয়তো তিনি আমাকে দাঁড়াতে বলবেন। আর দাঁড়ালে তো আমার দুর্গতির কোন সীমা থাকবে না। কিন্তু করি কি? আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর নির্দেশ তো? বাধ্য হয়ে বললামঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আপনার আদেশ পালন করতে প্রস্তুত আছি।” তিনি বললেনঃ “শত্রুদের মধ্যে এক নতুন ব্যাপার শুরু হয়ে গেছে। যাও, এর খবর নাও।” আল্লাহর কসম! ঐ সময় আমার চেয়ে অধিক না কারো ভয়-ভীতি ছিল, না আমার চেয়ে বেশী কাউকেও ঠাণ্ডা লাগছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আদেশ শোনা মাত্রই আমি রওয়ানা হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার জন্যে দু’আ করছেন। এটা আমার কানে আসলো। তিনি দু’আ করছিলেনঃ “হে আল্লাহ! তার সামনে হতে, পিছন হতে, ডান দিক হতে, বাম দিক হতে, উপর হতে এবং নীচ হতে তাকে হিফাযত করুন।” তার দু’আর সাথে সাথে আমার অন্তর হতে ভয়-ভীতি দূর হয়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে ডেকে বললেনঃ “শুন হে হুযাইফা (রাঃ)! সেখান হতে আমার নিকট ফিরে না আসা পর্যন্ত নতুন কিছু করে বসো না।”

এ রিওয়াইয়াতে এও আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ “ইতিপূর্বে আমি আবু সুফিয়ান (রাঃ)-কে চিনতাম না। ওখানে গিয়ে আমি এ শব্দই শুনতে পেলামঃ “চল, ফিরে চল।” একটি আশ্চর্য ব্যাপার এও দেখলাম যে, ঐ ভয়াবহ বাতাস যা ডেকচিগুলোকে উল্টিয়ে দিচ্ছিল তা শুধু তাদের সেনাবাহিনীর অবস্থানস্থল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। আল্লাহর শপথ! তা থেকে অর্ধ হাতও বাইরে যায়নি। আমি দেখলাম যে, পাথর উড়ে উড়ে তাদের উপর পড়ছিল। যখন আমি ফিরে আসলাম তখন দেখলাম যে, পাগড়ি পরিহিত প্রায় ২০ জন অশ্বারোহী রয়েছেন যারা আমাকে বললেনঃ “যাও, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সংবাদ দাও যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর জন্যে যথেষ্ট হয়েছেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে তিনি পরাজিত ও লাঞ্ছিত করেছেন।” এই বর্ণনায় এও উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অভ্যাস ছিল, যখন তিনি কোন বিপদের সম্মুখীন হতেন তখন নামায পড়া শুরু করে দিতেন। এতে আরো রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ খবর পৌছানো হয় তখনই এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। সুতরাং এ আয়াতে নিম্ন অঞ্চল হতে আগমনকারী দ্বারা বানু কুরাইযাকে বুঝানো হয়েছে।

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমাদের চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল কণ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে নানাবিধ ধারণা পোষণ করছিলে। এমনকি কোন কোন মুনাফিক তো এটা মনে করে নিয়েছিল যে, এ যুদ্ধে কাফিররাই জয়যুক্ত হবে। সাধারণ মুনাফিকদের কথা তো দূরে থাক, এমনকি মুতাব ইবনে কুশায়ের বলতে শুরু করলো: “রাসূলুল্লাহ (সঃ) তো আমাদেরকে বলেছিলেন যে, আমরা নাকি কাইসার ও কিসরার ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যাবো, অথচ এখানকার অবস্থা এই যে, পায়খানায় যাওয়াও আমাদের জন্যে কষ্টকর হয়ে পড়েছে।” এ রকম বিভিন্ন লোকের ধারণা বিভিন্ন ছিল। তবে মুসলমানদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাঁদের জয় সুনিশ্চিত।

হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “খন্দকের যুদ্ধের দিন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের প্রাণ তো হয়েছে কণ্ঠাগত, এখন আমাদের বলার কিছু আছে কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, তোমরা বলো (আরবি)

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মর্যাদা রক্ষা করুন এবং আমাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করুন।” এদিকে মুসলমানদের এ দু’আ উচ্চারিত হচ্ছিল, আর ঐ দিকে আল্লাহর সৈন্য বাতাসের রূপ ধারণ করে এসে পড়ে এবং কাফিরদের দুর্গতি চরম সীমায় পৌঁছিয়ে দেয়। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) ও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১১-১৩ নং আয়াতের তাফসীর

আহযাবের যুদ্ধে মুসলমানরা যে ভীতি-বিহ্বলতা ও উদ্বেগপূর্ণ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল এখানে তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। বাহির হতে আগত শত্রুরা পূর্ণ শক্তি ও বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর ভিতরে শহরের মধ্যে বিদ্রোহের অগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। ইয়াহূদীরা হঠাৎ করে সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছে। মুসলমানরা খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে পতিত হয়েছে। মুনাফিকরা প্রকাশ্যভাবে পৃথক হয়ে গেছে। দুর্বল মনের লোকেরা বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে শুরু করেছে। তারা একে অপরকে বলছেঃ “পাগল হয়েছো না কি? দেখতে পাচ্ছ না যে, অতি অল্পক্ষণের মধ্যে পট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে? চলো, পালিয়ে যাই।”

ইয়াসরিব দ্বারা মদীনাকে বুঝানো হয়েছে। যেমন সহীহ হাদীসে এসেছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “স্বপ্নে আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে। তা দু’টি কংকরময় ভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত। প্রথম আমার ধারণা হয়েছিল যে, ওটা বোধহয় হিজর হবে। কিন্তু না, তা ইয়াসরিব।” আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, ঐ স্থানটি হলো মদীনা। অবশ্য একটি দুর্বল রিওয়াইয়াতে আছে যে, যে ব্যক্তি মদীনাকে ইয়াসরিব বলে সে যেন তা হতে তাওবা করে। মদীনা তো হলো তাবা, ওটা তাবা। (এ হাদীসটি শুধু মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে। এর ইসনাদে দুর্বলতা রয়েছে)

বর্ণিত আছে যে, আমালীকের মধ্যে যে লোকটি এখানে এসে অবস্থান করেছিল তার নাম ছিল ইয়াসরিব ইবনে আবীদ ইবনে মাহবীল ইবনে আউস ইবনে আমলাক ইবনে লাআয ইবনে ইরাম ইবনে সাম ইবনে নূহ (আঃ)। তার নামানুসারেই এ শহরটিও ইয়াসরিব নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

একটি উক্তি এও আছে যে, তাওরাত শরীফে এর এগারোটি নাম রয়েছে। ওগুলো হলো: মদীনা, তাবা, তায়্যেবাহ্, সাকীনা, জাবিরাহ, মুহিব্বাহ, মাহবুবাহ, কাসিমাহ, মাজরূরাহ, আযরা এবং মারহ্মাহ্।

কা’ব আহ্বার (রঃ) বলেন, আমরা তাওরাতে একথাগুলো পেয়েছি যে, আল্লাহ তা’আলা মদীনা শরীফকে বলেনঃ “হে তাইয়্যেবা, হে তাবা এবং হে মাসকীনা! ধন-ভাণ্ডারে জড়িত হয়ে পড়ো না। সমস্ত জনপদের মধ্যে তোমার মর্যাদা সমুন্নত হবে। কিছু লোক খন্দকের যুদ্ধের সময় বলেছিলঃ “হে ইয়াসরিববাসী! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোমরা ফিরে চল।’ বানু হারিসা গোত্র বলতে শুরু করেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের বাড়ীতে চুরি হওয়ার আশংকা রয়েছে। ওগুলো জনহীন অবস্থায় পড়ে আছে। সুতরাং আমাদেরকে বাড়ী ফিরে যাবার অনুমতি দিন।” আউস ইবনে কায়সী বলেছিলঃ “আমাদের বাড়ীতে শত্রুদের ঢুকে পড়ার ভয় রয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে বাড়ী ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হালে।” আল্লাহ তা’আলা তাদের অন্তরের কথা বলে দিলেন যে, আসলে পলায়ন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য, তাদের ঘরবাড়ী অরক্ষিত ছিল না।
১৪-১৭ নং আয়াতের তাফসীর

যারা ওযর করে জিহাদ হতে পালিয়ে যাচ্ছিল যে, তাদের ঘরবাড়ী অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, যার বর্ণনা উপরে দেয়া হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যদি শত্রুরা নগরীর বিভিন্ন দিক হতে প্রবেশ করে তাদেরকে কুফরীর মধ্যে প্রবেশের জন্যে প্ররোচিত করতো তবে তারা অবশ্যই কোন চিন্তা-ভাবনা না করে কুফরীকে ককূল করে নিতো। তারা সামান্য ভয়-ভীতির কারণে ঈমানের কোন হিফাযত করতো না ও ঈমানকে আঁকড়ে ধরে থাকতো না। এভাবে মহান আল্লাহ তাদের নিন্দে করেছেন।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এরা তো পূর্বেই আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করবে না। তারা জানে না যে, আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সম্বন্ধে অবশ্যই তারা জিজ্ঞাসিত হবে।

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এভাবে মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করে কোন লাভ হবে না, এতে তোমাদের প্রাণ রক্ষা পেতে পারে না। বরং হতে পারে যে, এর কারণে অকস্মাৎ আল্লাহর পাকড়াও এসে যাবে এবং

দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে। দুনিয়া তো চিরস্থায়ী আখিরাতের তুলনায় অতি নগণ্য ও তুচ্ছ জিনিস।।

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ আল্লাহ তা’আলা যদি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছা করেন। তবে এমন কেউ নেই যে তোমাদেরকে আল্লাহ হতে রক্ষা করতে পারে। পক্ষান্তরে, তিনি যদি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করার ইচ্ছা করেন তবে এমন কেউ নেই যে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে। তোমরা আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।
১৮-১৯ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনি তার ব্যাপক ও প্রশস্ত জ্ঞানের দ্বারা ঐ লোকদের ভালরূপেই অবগত আছেন যারা অন্যদেরকেও জিহাদে গমন হতে বাধা দেয় এবং নিজেদের সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে এবং আত্মীয়-স্বজনকে বলেঃ “তোমরাও আমাদের সঙ্গেই থাকো এবং নিজেদের ঘরবাড়ী, আরাম-আয়েশ, জমি-জমা ও পরিবারবর্গকে পরিত্যাগ করে জিহাদে যোগদান করো না। তারা নিজেরাও জিহাদে অংশগ্রহণ করে না। কোন কোন সময় তারা মুখ দেখিয়ে যায় এবং নাম লিখিয়ে দেয় সেটা অন্যকথা।

মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ) ও মুমিনদেরকে বলেনঃ এরা অত্যন্ত কৃপণ। তাদের নিকট থেকে তোমরা কোন আর্থিক সাহায্য পাবে না এবং তোমাদের প্রতি তাদের অন্তরে কোন সহানুভূতিও নেই। তোমরা যখন গনীমতের মাল প্রাপ্ত হও তখন তারা অসন্তুষ্ট হয়। যখন বিপদ আসে তখন তোমরা দেখতে পাও যে, মৃত্যু ভয়ে মুচ্ছাতুর ব্যক্তির মত চক্ষু উল্টিয়ে তারা তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যখন বিপদ দূর হয়ে যায় তখন তারা ধনের লোভে তোমাদেরকে তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। তারা নবী (সঃ)-কে বলেঃ আমরা তো আপনারই সঙ্গী। আমরা আপনার সঙ্গে থেকে রীতিমত যুদ্ধ করেছি। সুতরাং গনীমতের মালে আমাদেরও অংশ রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের সময় তারা মুখও দেখায় না। তারা পলাতকদের আগে এবং যোদ্ধাদের পিছনে থাকে। মালের দিকে তারা মাছির মত লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায়। মিথ্যা ও কাপুরুষতা এ দুটো দোষই তাদের মধ্যে বিদ্যমান। এ দুটো দোষে যারা দোষী হয় তাদের কাছে কল্যাণের কোন আশা করা যায় কি? শান্তির সময় প্রতারণা, দুশ্চরিত্রতা এবং রূঢ়তা, আর যুদ্ধের সময় ভীরুতা ও নারীত্বপনা! যুদ্ধের সময় ঋতুবতী নারীর ন্যায় পৃথক হয়ে যাওয়া, আর মাল নেয়ার সময় গাধার মত লোভনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করাই তাদের কাজ।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তারা ঈমান আনেনি, এজন্যে আল্লাহ তাদের কার্যাবলী নিষ্ফল করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষে এটা সহজ।
# এই মুনাফিকদের কাপুরুষতা ও ভীতি-বিহ্বলতার অবস্থা এই যে, কাফির সৈন্যরা যে ফিরে গেছে এ বিশ্বাসই তাদের হয়নি। তাদের মনে এ ভয় রয়েই গেছে যে, না জানি হয়তো তারা আবার ফিরে আসবে। মুশরিকদের সৈন্যদেরকে দেখেই তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। তারা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যে, যদি তারা মুসলমানদের সাথে ঐ শহরেই না থাকতো তবে কতই না ভাল হতো! বরং তারা যদি অশিক্ষিত ও অজ্ঞদের সাথে কোন জনমানবহীন গ্রামে অথবা কোন বন জঙ্গলে অবস্থান করতো এবং কোন পথিককে যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতো তবে কতই না ভাল হতো! মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা তোমাদের সাথে অবস্থান করলেও যুদ্ধ অল্পই করতো। তাদের মন তো মরে গেছে। কাপুরুষতার ঘুণ তাদেরকে ধরে বসেছে। তারা যুদ্ধ করবে কি, কী বীরত্বপনা তারা দেখাবে?

 

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1050/What is Munafiq?Book :- 32)
[What Is Munafiq? As described on the Quran & Hadis:-]
www.motaher21.net
Sura:33:Al-Ahzaab
Para:21
Ayat: – 9
33:9

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ جَآءَتۡکُمۡ جُنُوۡدٌ فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ رِیۡحًا وَّ جُنُوۡدًا لَّمۡ تَرَوۡہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرًا ۚ﴿۹﴾

O you who have believed, remember the favor of Allah upon you when armies came to [attack] you and We sent upon them a wind and armies [of angels] you did not see. And ever is Allah, of what you do, Seeing.

 

The Campaign of the Confederates (Al-Ahzab)

Allah tells us of the blessings and favors He bestowed upon His believing servants when He diverted their enemies and defeated them in the year when they gathered together and plotted. That was the year of Al-Khandaq, in Shawwal of the year 5 AH according to the well-known correct view.

Musa bin Uqbah and others said that it was in the year 4 AH.

The reason why the Confederates came was that a group of the leaders of the Jews of Banu Nadir, whom the Messenger of Allah had expelled from Al-Madinah to Khyber, including Sallam bin Abu Al-Huqayq, Sallam bin Mishkam and Kinanah bin Ar-Rabi, went to Makkah where they met with the leaders of Quraysh and incited them to make war against the Prophet.

They promised that they would give them help and support, and Quraysh agreed to that. Then they went to the Ghatafan tribe with the same call, and they responded too. The Quraysh came out with their company of men from various tribes and their followers, under the leadership of Abu Sufyan Sakhr bin Harb. The Ghatafan were led by Uyaynah bin Hisn bin Badr. In all they numbered nearly ten thousand.

When the Messenger of Allah heard that they had set out, he commanded the Muslims to dig a ditch (Khandaq) around Al-Madinah from the east. This was on the advice of Salman Al-Farisi, may Allah be pleased with him.

So the Muslims did this, working hard, and the Messenger of Allah worked with them, carrying earth away and digging, in the process of which there occurred many miracles and clear signs.

The idolators came and made camp to the north of Al-Madinah, near Uhud, and some of them camped on the high ground overlooking Al-Madinah, as Allah says:
إِذْ جَاوُوكُم مِّن فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنكُمْ
(When they came upon you from above you and from below you),

The Messenger of Allah came out with the believers, who numbered nearly three thousand, or it was said that they numbered seven hundred. They had their backs towards (the mountain of) Sal` and were facing the enemy, and the ditch, in which there was no water, was between the two groups, preventing the cavalry and infantry from reaching them. The women and children were in the strongholds of Al-Madinah.

Banu Qurayzah, who were a group among the Jews, had a fortress in the south-east of Al-Madinah, and they had made a treaty with the Prophet and were under his protection. They numbered nearly eight hundred fighters. Huyay bin Akhtab An-Nadari went to them and kept trying to persuade them until they broke the treaty and went over to the side of the Confederates against the Messenger of Allah. The crisis deepened and things got worse, as Allah says:
هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُوْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا زِلْزَالاً شَدِيدًا
(There, the believers were tried and shaken with a mighty shaking). (33:11)

They besieged the Prophet and his Companions for almost a month, but they did not reach them and there was no fighting between them, except for when `Amr bin Abd Wadd Al-Amiri, who was one of the most famous and bravest horsemen of the Jahiliyyah, came with some other horsemen, and crossed the ditch to the Muslim side.

The Messenger of Allah called for the Muslim cavalry, and it was said that no one came forward. Then he called Ali, may Allah be pleased with him, who came forward and they fought in single combat until Ali, may Allah be pleased with him, killed him, and this was a sign of imminent victory.

Then Allah sent an intensely cold wind with strong gusts against the Confederates, and they were left with no tents or anything else; they could not light any fires or do anything, and so they departed, disappointed and defeated, as Allah says:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَاءتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا

O you who believe! Remember Allah’s favor to you, when there came against you hosts, and We sent against them a wind and forces.

Mujahid said:”This was the easterly wind.”

This view is supported by another Hadith:

نُصِرْتُ بِالصَّبَا وَأُهْلِكَتْ عَادٌ بِالدَّبُور

I was given victory by the easterly wind, and `Ad were destroyed by the westerly wind.

وَجُنُودًا

لَّمْ تَرَوْهَا

and forces that you saw not.

This refers to the angels who shook them and cast fear and terror into their hearts.

The chief of each tribe said, “O Banu so-and-so, to me!” So they gathered around him, and he said, “Let us save ourselves,” when Allah cast fear and terror into their hearts.

In his Sahih, Muslim recorded that Ibrahim At-Taymi said that his father said:

“We were with Hudhayfah bin Al-Yaman, may Allah be pleased with him, and a man said to him:`If I had met the Messenger of Allah I would have fought alongside him and I would have striven my utmost.’

Hudhayfah said to him:`Would you really have done that?

I was present with the Messenger of Allah during (the campaign) against the Confederates on a very cold and windy night, and the Messenger of Allah said:
أَلَا رَجُلٌ يَأْتِي بِخَبَرِ الْقَوْمِ يَكُونُ مَعِي يَوْمَ الْقِيَامَة
(Is there any man who will bring me news of the people; He will be with me on the Day of Resurrection).

None of us answered him, and he repeated it a second and a third time. Then he said:
يَاحُذَيْفَةُ قُمْ فَأْتِنَا بِخَبَرٍ مِنَ الْقَوْم
(O Hudhayfah, get up and bring us news of the people).

When he called me by name, I had no choice but to get up. He said,
ايْتِنِي بِخَبَرِ الْقَوْمِ وَلَاتَذْعَرْهُمْ عَلَي
(Bring us news of the people, but do not alarm them).

So I went, walking as if I were walking among pigeons, until I came to them. I saw Abu Sufyan warming his back by the fire, and I put an arrow in my bow, wanting to shoot it at him, then I remembered what the Messenger of Allah said,
وَلَاتَذْعَرْهُمْ عَلَي
(Do not alarm them).

If I shot the arrow, I would have hit him. So I came back, again walking as if I were walking among pigeons, and I came to the Messenger of Allah. After my returning I began to feel very cold. I told the Messenger of Allah and he gave me to wear a spare cloak of his which he used to pray in. I slept until morning came, and when morning came, the Messenger of Allah said,
قُمْ يَانَوْمَان
(Get up, O sleepy one!)”‘

And Allah says,

وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا

And Allah is Ever All-Seer of what you do.

Then Allah says

33:10

اِذۡ جَآءُوۡکُمۡ مِّنۡ فَوۡقِکُمۡ وَ مِنۡ اَسۡفَلَ مِنۡکُمۡ وَ اِذۡ زَاغَتِ الۡاَبۡصَارُ وَ بَلَغَتِ الۡقُلُوۡبُ الۡحَنَاجِرَ وَ تَظُنُّوۡنَ بِاللّٰہِ الظُّنُوۡنَا ﴿۱۰﴾

[Remember] when they came at you from above you and from below you, and when eyes shifted [in fear], and hearts reached the throats and you assumed about Allah [various] assumptions.

 

إِذْ جَاوُوكُم مِّن فَوْقِكُمْ

When they came upon you from above you,

refers to the Confederates,

وَمِنْ أَسْفَلَ مِنكُمْ

and from below you.

We have already noted the report from Abu Hudhayfah that these were Banu Qurayzah.

وَإِذْ زَاغَتْ الاْإَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ

and when the eyes grew wild and the hearts reached to the throats,

means, from intense fear and terror.

وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا

and you were harboring doubts about Allah.

Ibn Jarir said:

“Some of those who were with the Messenger of Allah, had doubts and thought that the outcome would be against the believers, and that Allah would allow that to happen.”

Muhammad bin Ishaq said concerning the Ayah:
وَإِذْ زَاغَتْ الاْإَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا
(when the eyes grew wild and the hearts reached to the throats, and you were harboring doubts about Allah),

“The believers had all kinds of doubts, and hypocrisy emerged to such an extent that Mu`attib bin Qushayr, the brother of Banu `Amr bin `Awf said:`Muhammad was promising us that we would win the treasure of Chosroes and Caesar, but one of us cannot even go and relieve himself.”‘

Al-Hasan said concerning the Ayah:
وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا
(and you were harboring doubts about Allah),

“There were different kinds of thoughts; the hypocrites thought that Muhammad and his Companions would be eliminated, while the believers were certain that what Allah and His Messenger promised was true, and that He would cause the religion to prevail even if the idolators hated it.”

Ibn Abi Hatim recorded that Abu Sa`id, may Allah be pleased with him, said:

“On the day of Al-Khandaq, we said:`O Messenger of Allah, is there anything we should say, for our hearts have reached our throats.’

He said:

نَعَمْ قُولُوا

اللَّهُمَّ اسْتُرْ عَوْرَاتِنَا وَامِنْ رَوْعَاتِنَا

Yes, say:

O Allah, cover our weak points and calm our fears.

Then (Allah) struck the faces of the enemy with the wind, and defeated them with the wind.

This was also recorded by Imam Ahmad bin Hanbal from Abu `Amir Al-`Aqadi

33:11

ہُنَالِکَ ابۡتُلِیَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ زُلۡزِلُوۡا زِلۡزَالًا شَدِیۡدًا ﴿۱۱﴾

There the believers were tested and shaken with a severe shaking.

 

How the Believers were tested, and the Position of the Hypocrites during the Battle of Al-Khandaq

Allah tells,

هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُوْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا زِلْزَالاً شَدِيدًا

There, the believers were tried and shaken with a mighty shaking.

Allah tells us what happened when the Confederates surrounded Al-Madinah and the Muslims were besieged and found themselves in straitened circumstances, with the Messenger of Allah in their midst. They were tried and tested, and were shaken with a mighty shaking. At this time hypocrisy emerged, and those in whose hearts was a disease spoke about what they really felt.

وَإِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ مَّا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ إِلاَّ غُرُورًا

33:12

وَ اِذۡ یَقُوۡلُ الۡمُنٰفِقُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ مَّا وَعَدَنَا اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗۤ اِلَّا غُرُوۡرًا ﴿۱۲﴾

And [remember] when the hypocrites and those in whose hearts is disease said, ” Allah and His Messenger did not promise us except delusion,”

 

And when the hypocrites and those in whose hearts is a disease said:”Allah and His Messenger promised us nothing but delusion!”

Their hypocrisy became apparent, while the one in whose heart was doubt became weak, and he expressed the ideas that were in his heart because of the weakness of his faith and the difficulty of the situation. And other people said, as Allah tells us

33:13

وَ اِذۡ قَالَتۡ طَّآئِفَۃٌ مِّنۡہُمۡ یٰۤاَہۡلَ یَثۡرِبَ لَا مُقَامَ لَکُمۡ فَارۡجِعُوۡا ۚ وَ یَسۡتَاۡذِنُ فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمُ النَّبِیَّ یَقُوۡلُوۡنَ اِنَّ بُیُوۡتَنَا عَوۡرَۃٌ ؕۛ وَ مَا ہِیَ بِعَوۡرَۃٍ ۚۛ اِنۡ یُّرِیۡدُوۡنَ اِلَّا فِرَارًا ﴿۱۳﴾

And when a faction of them said, “O people of Yathrib, there is no stability for you [here], so return [home].” And a party of them asked permission of the Prophet, saying, “Indeed, our houses are unprotected,” while they were not exposed. They did not intend except to flee.

 

وَإِذْ قَالَت طَّايِفَةٌ مِّنْهُمْ يَا أَهْلَ يَثْرِبَ

And when a party of them said:”O people of Yathrib…”

meaning Al-Madinah, as it was reported in the Sahih:

أُرِيتُ فِي الْمَنَامِ دَارَ هِجْرَتِكُمْ أَرْضٌ بَيْنَ حَرَّتَيْنِ فَذَهَبَ وَهَلِي أَنَّهَا هَجَرُ فَإِذَا هِيَ يَثْرِب

I was shown in a dream the place to which you will migrate, a land between two lava fields. At first I thought it was Hajar, but it turned out to be Yathrib.

According to another narration:
الْمَدِينَة
(Al-Madinah).

It was said that the origin of its name Yathrib was that a man settled there from (the people of) Al-Amaliq whose name was Yathrib bin Ubayd bin Mahlayil bin `Aws bin Amlaq bin Lawudh bin Iram bin Sam bin Nuh.

This was the view of As-Suhayli.

He said:

“And it was narrated from some of them that he said, `It is given eleven names in the Tawrah:Al-Madinah, Tabah, Tayyibah, Al-Miskinah, Al-Jabirah, Al-Muhibbah, Al-Mahbubah, Al-Qasimah, Al-Majburah, Al-`Adhra’ and Al-Marhumah.”‘

لَاا مُقَامَ لَكُمْ

There is no position for you.

means, `here, with the Prophet , you cannot stand guard,’

فَارْجِعُوا

Therefore go back,

means, `to your houses and dwellings’.

وَيَسْتَأْذِنُ فَرِيقٌ مِّنْهُمُ النَّبِيَّ

And a band of them ask for permission of the Prophet,

Al-`Awfi reported that Ibn Abbas, may Allah be pleased with him said,

“These were Banu Harithah, who said, `We fear for our homes, that they may be robbed.”‘

This was also stated by others.

Ibn Ishaq mentioned that the one who said this was `Aws bin Qayzi.

يَقُولُونَ إِنَّ بُيُوتَنَا عَوْرَةٌ

saying:”Truly, our homes lie open.”

They were using as an excuse to go back to their houses the claim that they were lying open and had nothing to protect them from the enemy, so they were afraid for their homes. But Allah said:

وَمَا هِيَ بِعَوْرَةٍ

And they lay not open.

meaning, it is not as they claim.

إِن يُرِيدُونَ إِلاَّ فِرَارًا

They but wished to flee.

means, they wanted to run away from the battlefield

33:14

وَ لَوۡ دُخِلَتۡ عَلَیۡہِمۡ مِّنۡ اَقۡطَارِہَا ثُمَّ سُئِلُوا الۡفِتۡنَۃَ لَاٰتَوۡہَا وَ مَا تَلَبَّثُوۡا بِہَاۤ اِلَّا یَسِیۡرًا ﴿۱۴﴾

And if they had been entered upon from all its [surrounding] regions and fitnah had been demanded of them, they would have done it and not hesitated over it except briefly.

 

Allah tells us about those who said:

وَلَوْ دُخِلَتْ عَلَيْهِم مِّنْ أَقْطَارِهَا ثُمَّ سُيِلُوا الْفِتْنَةَ لَاتَوْهَا وَمَا تَلَبَّثُوا بِهَا إِلاَّ يَسِيرًا
33:15

وَ لَقَدۡ کَانُوۡا عَاہَدُوا اللّٰہَ مِنۡ قَبۡلُ لَا یُوَلُّوۡنَ الۡاَدۡبَارَ ؕ وَ کَانَ عَہۡدُ اللّٰہِ مَسۡـُٔوۡلًا ﴿۱۵﴾

And they had already promised Allah before not to turn their backs and flee. And ever is the promise to Allah [that about which one will be] questioned.

 

وَلَقَدْ كَانُوا عَاهَدُوا اللَّهَ مِن قَبْلُ لَا يُوَلُّونَ الاَْدْبَارَ

And if the enemy had entered from all sides, and they had been exhorted to Al-Fitnah, they would surely have committed it and would have hesitated thereupon but little.

And indeed they had already made a covenant with Allah not to turn their backs,

Allah tells us about those who said:
يَقُولُونَ إِنَّ بُيُوتَنَا عَوْرَةٌ وَمَا هِيَ بِعَوْرَةٍ إِن يُرِيدُونَ إِلاَّ فِرَارًا
(“Truly, our homes lie open.” And they lay not open. They but wished to flee).

If the enemy had entered upon them from every side of Al-Madinah and from every direction, then demanded that they become disbelievers, they would have promptly done so. They would not have adhered to their faith or remained steadfast in it if they were faced with the slightest fear.

This is how it was interpreted by Qatadah, Abdur-Rahman bin Zayd and Ibn Jarir.

This is a condemnation of them in the clearest terms. Then Allah reminds them of the promise they had made to Him before this fear struck them, that they would not turn their backs or flee from the battlefield.

وَكَانَ عَهْدُ اللَّهِ مَسْوُولاً

and a covenant with Allah must be answered for.

means, Allah will inevitably ask them about that covenant

33:16

قُلۡ لَّنۡ یَّنۡفَعَکُمُ الۡفِرَارُ اِنۡ فَرَرۡتُمۡ مِّنَ الۡمَوۡتِ اَوِ الۡقَتۡلِ وَ اِذًا لَّا تُمَتَّعُوۡنَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿۱۶﴾

Say, [O Muhammad], “Never will fleeing benefit you if you should flee from death or killing; and then [if you did], you would not be given enjoyment [of life] except for a little.”

 

قُل لَّن يَنفَعَكُمُ الْفِرَارُ إِن فَرَرْتُم مِّنَ الْمَوْتِ أَوِ الْقَتْلِ

Say:”Flight will not avail you if you flee from death or killing,

Then Allah tells them that fleeing from battle will not delay their appointed demise or make their lives any longer; on the contrary, it may be the cause of their being taken sooner, and in a sudden manner.

Allah says:

وَإِذًا لاَّ تُمَتَّعُونَ إِلاَّ قَلِيلًإ

and then you will enjoy no more than a little while!

meaning, `after you run away and flee from battle.’

قُلْ مَتَـعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالاٌّخِرَةُ خَيْرٌ لِّمَنِ اتَّقَى

Say:”Short is the enjoyment of this world. The Hereafter is better for him who have Taqwa!” (4:77)

Then Allah says:

قُلْ مَن ذَا الَّذِي يَعْصِمُكُم مِّنَ اللَّهِ إِنْ أَرَادَ بِكُمْ سُوءًا أَوْ أَرَادَ بِكُمْ رَحْمَةً وَلَا يَجِدُونَ لَهُم مِّن دُونِ اللَّهِ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا
33:17

قُلۡ مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَعۡصِمُکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ اِنۡ اَرَادَ بِکُمۡ سُوۡٓءًا اَوۡ اَرَادَ بِکُمۡ رَحۡمَۃً ؕ وَ لَا یَجِدُوۡنَ لَہُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیۡرًا ﴿۱۷﴾

Say, “Who is it that can protect you from Allah if He intends for you an ill or intends for you a mercy?” And they will not find for themselves besides Allah any protector or any helper.

 

Say:

“Who is he who can protect you from Allah if He intends to harm you, or intends mercy on you!”

And they will not find, besides Allah, for themselves any protector or any helper.

meaning, they have no one else except Allah to respond to their cries

33:18

قَدۡ یَعۡلَمُ اللّٰہُ الۡمُعَوِّقِیۡنَ مِنۡکُمۡ وَ الۡقَآئِلِیۡنَ لِاِخۡوَانِہِمۡ ہَلُمَّ اِلَیۡنَا ۚ وَ لَا یَاۡتُوۡنَ الۡبَاۡسَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿ۙ۱۸﴾

Already Allah knows the hinderers among you and those [hypocrites] who say to their brothers, “Come to us,” and do not go to battle, except for a few,

 

Allah tells,

قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الْمُعَوِّقِينَ مِنكُمْ وَالْقَايِلِينَ لاِِخْوَانِهِمْ

Allah already knows those among you who keep back (men) from fighting (in Allah’s cause), and those who say to their brethren,

Allah tells us that His knowledge encompasses those who sought to tell others not to go out and who said to their brethren, meaning their companions, friend and acquaintances,


هَلُمَّ إِلَيْنَا

Come here towards us,

meaning, come to where we are in the shade and enjoying fruits. But in spite of that,


وَلَا يَأْتُونَ الْبَأْسَ إِلاَّ قَلِيلً

33:19

اَشِحَّۃً عَلَیۡکُمۡ ۚۖ فَاِذَا جَآءَ الۡخَوۡفُ رَاَیۡتَہُمۡ یَنۡظُرُوۡنَ اِلَیۡکَ تَدُوۡرُ اَعۡیُنُہُمۡ کَالَّذِیۡ یُغۡشٰی عَلَیۡہِ مِنَ الۡمَوۡتِ ۚ فَاِذَا ذَہَبَ الۡخَوۡفُ سَلَقُوۡکُمۡ بِاَلۡسِنَۃٍ حِدَادٍ اَشِحَّۃً عَلَی الۡخَیۡرِ ؕ اُولٰٓئِکَ لَمۡ یُؤۡمِنُوۡا فَاَحۡبَطَ اللّٰہُ اَعۡمَالَہُمۡ ؕ وَ کَانَ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرًا ﴿۱۹﴾

Indisposed toward you. And when fear comes, you see them looking at you, their eyes revolving like one being overcome by death. But when fear departs, they lash you with sharp tongues, indisposed toward [any] good. Those have not believed, so Allah has rendered their deeds worthless, and ever is that, for Allah, easy.

 

أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ

they come not to the battle except a little, being miserly towards you.

i.e., `they are mean and have no love or mercy towards you.’

As-Suddi said:

أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ
(Being miserly towards you). means, with the booty.

فَإِذَا جَاء الْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنظُرُونَ إِلَيْكَ تَدُورُ أَعْيُنُهُمْ كَالَّذِي يُغْشَى عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ

Then when fear comes, you will see them looking to you, their eyes revolving like one over whom hovers death;

means, because of the intensity of their fear and terror; this is how afraid these cowards are of fighting.

فَإِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوكُم بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ

but when the fear departs, they will smite you with sharp tongues,

means, when security is restored, they will speak eloquently and nicely, claiming that they were the bravest and most chivalrous of men, but they are lying.

Ibn Abbas, may Allah be pleased with him, said:
سَلَقُوكُم
(they will smite you) means,

“they will start to talk about you.”

Qatadah said:

“But when it comes to the booty, the most miserly of people and the worst to have to share the booty with are those who say, `Give us, give us, we were there with you,’ but during battle they were the most cowardly and the most likely to fail to support the truth.”

أَشِحَّةً عَلَى الْخَيْرِ

are miserly towards good,

meaning that there is no goodness in them, for they have combined cowardice with lies and little good.

Allah says:

أُوْلَيِكَ لَمْ يُوْمِنُوا فَأَحْبَطَ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا

Such have not believed. Therefore Allah makes their deeds fruitless and that is ever easy for Allah

33:20

یَحۡسَبُوۡنَ الۡاَحۡزَابَ لَمۡ یَذۡہَبُوۡا ۚ وَ اِنۡ یَّاۡتِ الۡاَحۡزَابُ یَوَدُّوۡا لَوۡ اَنَّہُمۡ بَادُوۡنَ فِی الۡاَعۡرَابِ یَسۡاَلُوۡنَ عَنۡ اَنۡۢبَآئِکُمۡ ؕ وَ لَوۡ کَانُوۡا فِیۡکُمۡ مَّا قٰتَلُوۡۤا اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿٪۲۰﴾

They think the companies have not [yet] withdrawn. And if the companies should come [again], they would wish they were in the desert among the bedouins, inquiring [from afar] about your news. And if they should be among you, they would not fight except for a little.

 

Another aspect of their abhorrent attribute of cowardice and fear:

Allah tells;

يَحْسَبُونَ الاَْحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوا

They think that the Confederates have not yet withdrawn;

and that they are still close by and will return.

وَإِن يَأْتِ الاْإَحْزَابُ يَوَدُّوا لَوْ أَنَّهُم بَادُونَ فِي الاْإَعْرَابِ يَسْأَلُونَ عَنْ أَنبَايِكُمْ

and if the Confederates should come, they would wish they were in the deserts among the Bedouins, seeking news about you;

means, `if the Confederates should come back, they hope that they will not be present with you in Al-Madinah, but that they will be in the desert, asking about news of you and what happened to you with your enemy.’

وَلَوْ كَانُوا فِيكُم مَّا قَاتَلُوا إِلاَّ قَلِيلً

and if they were to be among you, they would not fight but little. means,

`if they are among you, they will not fight alongside you very much,’ because they are so cowardly and weak, and have so little faith, but Allah knows best about them

For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran

Leave a Reply