أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৫১/মুনাফিক কি? বই নং ৩৩:-)
[‘তােমাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’]
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪) তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
www.motaher21.net
সুরা:-(৩৩) আহযাব
পারা:- ২১
আয়াত:-২১-৩১
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا ﴿ؕ۲۱﴾
অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মধ্যে উত্তম আর্দশ , তার জন্য যে আসা রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের এবং আল্লাহ্কে বেশী স্মরণ করা।
৩৩:২২
وَ لَمَّا رَاَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الۡاَحۡزَابَ ۙ قَالُوۡا ہٰذَا مَا وَعَدَنَا اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗ وَ صَدَقَ اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗ ۫ وَ مَا زَادَہُمۡ اِلَّاۤ اِیۡمَانًا وَّ تَسۡلِیۡمًا ﴿ؕ۲۲﴾
মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল, তারা বলে উঠল, ’এটা তো তাই, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন। ‘ আর এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেল।
৩৩:২৩
مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ رِجَالٌ صَدَقُوۡا مَا عَاہَدُوا اللّٰہَ عَلَیۡہِ ۚ فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ قَضٰی نَحۡبَہٗ وَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّنۡتَظِرُ ۫ۖ وَ مَا بَدَّلُوۡا تَبۡدِیۡلًا ﴿ۙ۲۳﴾
ঈমানদারদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেখালো। তাদের কেউ নিজের নজরানা পূর্ণ করেছে এবং কেউ সময় আসার প্রতীক্ষায় আছে। তারা তাদের নীতি পরিবর্তন করেনি।
৩৩:২৪
لِّیَجۡزِیَ اللّٰہُ الصّٰدِقِیۡنَ بِصِدۡقِہِمۡ وَ یُعَذِّبَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ اِنۡ شَآءَ اَوۡ یَتُوۡبَ عَلَیۡہِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿ۚ۲۴﴾
যাতে আল্লাহ্ পুরস্কৃত করেন সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদীতার জন্য এবং শাস্তি দেন মুনাফিকদেরকে যদি তিনি চান অথবা তাদের ক্ষমা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
৩৩:২৫
وَ رَدَّ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِغَیۡظِہِمۡ لَمۡ یَنَالُوۡا خَیۡرًا ؕ وَ کَفَی اللّٰہُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الۡقِتَالَ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ قَوِیًّا عَزِیۡزًا ﴿ۚ۲۵﴾
আল্লাহ্ কাফিরদেরকে ত্রুদ্ধাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন, তারা কোন কল্যাণ লাভ করেনি। আর যুদ্ধে মুমিনদের জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট ; এবং আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান, প্রবল পরাক্রমশালী।
৩৩:২৬
وَ اَنۡزَلَ الَّذِیۡنَ ظَاہَرُوۡہُمۡ مِّنۡ اَہۡلِ الۡکِتٰبِ مِنۡ صَیَاصِیۡہِمۡ وَ قَذَفَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمُ الرُّعۡبَ فَرِیۡقًا تَقۡتُلُوۡنَ وَ تَاۡسِرُوۡنَ فَرِیۡقًا ﴿ۚ۲۶﴾
কিতাবীদের মধ্যে যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ হতে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন ; তোমরা তাদের কিছু সংখ্যককে হত্যা করছ এবং কিছু সংখ্যককে করছ বন্দী ।
৩৩:২৭
وَ اَوۡرَثَکُمۡ اَرۡضَہُمۡ وَ دِیَارَہُمۡ وَ اَمۡوَالَہُمۡ وَ اَرۡضًا لَّمۡ تَطَـُٔوۡہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرًا ﴿٪۲۷﴾
তিনি তোমাদেরকে তাদের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদের ওয়ারিস করে দিয়েছেন এবং এমন এলাকা তোমাদের দিয়েছেন যাকে তোমরা কখনো পদানত করোনি। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন।
৩৩:২৮
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ اِنۡ کُنۡـتُنَّ تُرِدۡنَ الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا وَ زِیۡنَتَہَا فَتَعَالَیۡنَ اُمَتِّعۡکُنَّ وَ اُسَرِّحۡکُنَّ سَرَاحًا جَمِیۡلًا ﴿۲۸﴾
হে নবী! তোমার স্ত্রীদেরকে বলো, যদি তোমরা দুনিয়া এবং তার ভূষণ চাও, তাহলে এসো আমি তোমাদের কিছু দিয়ে ভালোভাবে বিদায় করে দিই।
৩৩:২৯
وَ اِنۡ کُنۡـتُنَّ تُرِدۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ فَاِنَّ اللّٰہَ اَعَدَّ لِلۡمُحۡسِنٰتِ مِنۡکُنَّ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿۲۹﴾
পক্ষান্তরে তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং পরকাল কামনা করলে, তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীলা আল্লাহ তাদের জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’
৩৩:৩০
یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ مَنۡ یَّاۡتِ مِنۡکُنَّ بِفَاحِشَۃٍ مُّبَیِّنَۃٍ یُّضٰعَفۡ لَہَا الۡعَذَابُ ضِعۡفَیۡنِ ؕ وَ کَانَ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرًا ﴿۳۰﴾
হে নবী-পত্নীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ কোন প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়া হবে। আর আল্লাহর জন্য তা সহজ।
৩৩:৩১
وَ مَنۡ یَّقۡنُتۡ مِنۡکُنَّ لِلّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ تَعۡمَلۡ صَالِحًا نُّؤۡتِہَاۤ اَجۡرَہَا مَرَّتَیۡنِ ۙ وَ اَعۡتَدۡنَا لَہَا رِزۡقًا کَرِیۡمًا ﴿۳۱﴾
তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের প্রতি অনুগতা হবে ও সৎকাজ করবে, তাকে আমি দ্বিগুণ পুরস্কার দান করব। আর তার জন্য আমি সম্মানজনক জীবিকা প্রস্তুত রেখেছি।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২১-২৭ নং আয়াতের তাফসীর:
মুসলিমদের উত্তম আদর্শের প্রতীক একমাত্র নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তাই তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে প্রত্যেক মুসলিম জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সর্বক্ষেত্রে আদর্শ গ্রহণ করবে। আজ বিভিন্ন দল, তরীকা ও সম্প্রদায়ের অনুসারীরা তাদের নেতা ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির আদর্শের দিকে আহ্বান করে থাকে। কখনো একজন মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ বর্জন করে অন্য কোন ব্যক্তির আদর্শ গ্রহণ করতে পারে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনাদর্শে রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি। পৃথিবীতে এমন কোন ব্যক্তি নেই যার সকল কথা ও কাজ পালনীয় ও অনুসরণীয়, কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যতীত। একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সমস্ত কথা, কাজ ও অবস্থা আনুগত্য ও অনুসরণযোগ্য। প্রতিটি স্থান, কাল ও পাত্রে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ অনুসরণ করলে মুসলিমরা আবার সে স্বর্ণ যুগে ফিরে যেতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেভাবে কথা বলেছেন, কাজ করেছেন, এমনকি যুদ্ধে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ধৈর্য, সহনশীলতা ও বীরত্বের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অবশ্যই অনুসরণীয়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিপদে কখনো বিচলিত হননি। বরং সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ ط مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَآءُ وَالضَّرَّآءُ وَزُلْزِلُوْا حَتّٰي يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مَعَهُ مَتٰي نَصْرُ اللّٰهِ ط أَلَآ إِنَّ نَصْرَ اللّٰهِ قَرِيْبٌ)
“তোমরা কি ধারণা করেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত সংকটময় অবস্থা এখনো তোমাদের ওপর আসেনি। তাদেরকে বিপদ ও দুঃখ স্পর্শ করেছিল এবং তাদেরকে কাঁপিয়ে তুলা হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথে ঈমান আনয়নকারীরা শেষপর্যন্ত বলেছিল, কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।” (সূরা বাকারাহ ২:২১৪)
নাফি‘(رحمه الله) হতে বর্ণিত যে, ইবনু উমার (رضي الله عنه) তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ এর নিকট গেলেন যখন তাঁর (হাজ্জ যাত্রার) বাহন প্রস্তুত, তখন তাঁর ছেলে বললেন: আমার আশংকা হয় এ বছর মানুষের মধ্যে লড়াই হবে, তারা আপনাকে কাবায় যেতে বাধা দেবে। কাজেই এবার নিবৃত্ত হওয়াটাই উত্তম। তখন ইবনু উমার (رضي الله عنه) বললেন: আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা রওনা হয়েছিলেন, কুরাইশ কাফিররা তাঁকে বাইতুল্লাহ যেতে বাধা দিয়েছিল। আমাকেও যদি বাইতুল্লাহ যেতে বাধা দেয়া হয়, তবে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা করেছিলেন আমিও তাই করব। কেননা “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ” (সূরা আহযাব ২১)। এরপর তিনি বললেন: তোমরা সাক্ষী থেকো, আমি উমরাহর সাথে হাজ্জ এর নিয়ত করলাম। নাফি‘ বলেন: তিনি মক্কায় উপনীত হয়ে উভয়টির জন্য মাত্র একটি তাওয়াফ করলেন। (সহীহ বুখারী হা: ১৬৩৯)
সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ তারাই মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিতে পারবে যারা পরকালের সফলতা কামনা করে। তাই আমাদের উচিত হবে যদি আমরা পরকালীন কল্যাণ ও সফলতা চাই তাহলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ অনুরসণ করব। কোন কাজ করার পূর্বে ভেবে দেখব, এ কাজ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করেছেন কিনা। আর করে থাকলে তিনি তা কিভাবে করেছেন সেভাবেই করতে হবে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে যখন মুসলিম বাহিনীকে তাঁর সাহায্য পাঠিয়ে বিজয়ী করলেন, যারা প্রকৃত মু’মিন ছিল তারা বুঝতে পারলেন এটা আল্লাহ তা‘আলার ও তাঁর রাসূলের ওয়াদার বাস্তবরূপ। ফলে তাদের ঈমান বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। এখানে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন ও সাহায্য পেলে ঈমান বৃদ্ধি পায়। এ সম্পর্কে সূরা ফাতহ-এর ৪ ও সূরা তাওবার ১২৪ নং আয়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
(مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ رِجَالٌ…..) শানে নুযূল:
আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমার চাচা আনাস বিন নযর বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন: হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি মুশরিকদের সাথে প্রথম যে যুদ্ধ করেছেন আমি তাতে অনুপস্থিত ছিলাম। আল্লাহ তা‘আলা যদি আমাকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করার সুযোগ দেন তাহলে দেখিয়ে দেব যে, আমি কী করছি। অতঃপর যখন উহুদ যুদ্ধের সময় আসল তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, সা‘দ বিন মুআয (رضي الله عنه) পেছনে ফিরে আসছেন। তখন তিনি তাকে বললেন: হে সা‘দ বিন মুআয! আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমি এ দিক থেকে জান্নাতের সুগন্ধ পাচ্ছি। তখন সে সামনের দিকে অগ্রসর হল এবং জিহাদ করতে করতে শহীদ হয়ে গেল। তখন তাঁর গায়ে আশিটিরও বেশি যখমের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। কোনটা বর্শার আবার কোনটা তরবারীর। তাঁর ব্যাপারেই এ আয়াতটি নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী হা: ২৮০৫, সহীহ মুসলিম হা: ১৯০৩)
আয়িশাহ (رضي الله عنها) অত্র আয়াতের তাফসীরে বলেন: এদের অন্তর্ভুক্ত হলেন তালহা বিন উবাইদুল্লাহ যিনি উহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছিলেন এমনকি ৭০ এর অধিক তীরবিদ্ধ হয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন: তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে। (সিলসিলা সহীহাহ হা: ৯৪৫)
জনৈক সাহাবী অজ্ঞ গ্রাম্য ব্যক্তিকে বললেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করুন ‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে’ তারা কারা? সাহাবীরা সহজে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রশ্ন করার সাহস পেত না। সে গ্রাম্য ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখ ফিরিয়ে নেন, এভাবে দুবার হয়। সে সাহাবী বলছেন: আমি মাসজিদের দরজা দিয়ে আসছি তখন আমার গায়ে সবুজ কাপড় ছিল, যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে দেখলেন তখন বললেন: প্রশ্নকারী কোথায়? সেই গ্রাম্য ব্যক্তি বলল: আমি হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: এ হল সেই ব্যক্তিদের একজন। (তিরমিযী হা: ৩২০৩, সিলসিলা সহীহাহ হা: ১২৬)
(فَمِنْهُمْ مَّنْ قَضٰي نَحْبَه)- نَحْبَه অর্থ ارادته ومطلوبه
অর্থাৎ তাদের অনেকে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে এবং তাদের ওপর যে হক ছিল তা আদায় করে আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় শাহাদাত বরণ করেছে। আর কেউ কেউ দুটি প্রতিদানের একটির অপেক্ষায় রয়েছে। দুটি প্রতিদান হলন এক. সাহায্য-সহযোগিতা, দুই. আল্লাহ তা‘আলার পথে শাহাদাত বরণ। (তাফসীর মুয়াসসার)
আল্লাহ তা‘আলা যুদ্ধ-জিহাদ শরীয়ত সিদ্ধ করে দিয়েছেন যাতে সত্যবাদীদেরকে তাদের ওয়াদা সত্যে পরিণত করার প্রতিদান দিতে পারেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَالَ اللّٰهُ هٰذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصّٰدِقِيْنَ صِدْقُهُمْ ط لَهُمْ جَنّٰتٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ خٰلِدِيْنَ فِيْهَآ أَبَدًا ط رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ ط ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ)
“আল্লাহ বলবেন, ‘এ সেদিন যেদিন সত্যবাদীগণ তাদের সত্যতার জন্য উপকৃত হবে, তাদের জন্য আছে জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট; এটা মহাসফলতা।’ (সূরা মায়িদা ৫:১১৯) আর আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে মুনাফিকদেরকে তাদের কর্মের কারণে শাস্তি দেবেন অথবা তাওবা করার সুযোগ দিলে তাওবা করতে পারবে ফলে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দেবেন।
(وَرَدَّ اللّٰهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِغَيْظِهِمْ)
‘আল্লাহ কাফিরদেরকে তাদের ক্রোধ সহকারে ফিরিয়ে দিয়েছেন’ অর্থাৎ কাফিররা খুব আশা নিয়ে এসেছিল তারা যুদ্ধে বিজয়ী হবে, কিন্তু মু’মিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করেছিলেন বিধায় কাফিররা বিজয়ী হতে পারেনি। সে কথাই বলা হচ্ছে: আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদেরকে তাদের ক্রোধসহ ফিরিয়ে দিলেন, তারা কোন কল্যাণ তথা বিজয় অর্জন করতে পারেনি। আয়িশাহ বলেন: এখানে কাফির দ্বারা উদ্দেশ্য হল আবূ সুফিয়ান ও উআইনা বিন বদর। আবূ সুফিয়ান ফিরে এসেছিল তুহামাহ এলাকায়, আর উআইনা ফিরে এসেছিল নাজদে। (কুরতুবী)
(وَأَوْرَثَكُمْ أَرْضَهُمْ وَدِيٰرَهُمْ…..)
‘আর তিনি তোমাদেরকে উত্তরাধিকারী করে দিলেন তাদের জমিনের’ এ আয়াত দ্বারা বানী কুরাইযার যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছে:
আয়িশাহ (رضي الله عنها) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে অস্ত্র সরঞ্জামাদী রাখলেন এবং গোসল শেষ করলেন। এমতাবস্থায় তাঁর নিকট জিবরীল (عليه السلام) এসে বললেন, আপনি অস্ত্র সরঞ্জামাদী রেখে দিয়েছেন? আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আমরা (ফেরেশতারা) এখনো অস্ত্র সরঞ্জামাদী রাখিনি। আপনি বানী কুরাইযার সাথে যুদ্ধ করার জন্য বের হন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের সাথে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪১১৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৭৬৯)
এ যুদ্ধের মাধ্যমেই মুসলিম বাহিনীকে ইয়াহূদীদের ঘর-বাড়ি, ভূমি ও ধন-সম্পদের মালিক বানিয়ে দেয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জীবনের সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কর্মপদ্ধতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির অনুসরণ করতে হবে। কেননা তিনি হলেন মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ এবং অনুসরণীয় ব্যক্তি।
২. বিপদে বিচলিত হওয়া যাবে না বরং বিপদ যত বড়ই হোক না কেন আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করতে হবে।
৩. ঈমান বৃদ্ধি পায় আবার কমেও যায়।
৪. অঙ্গীকার করার পর তা অবশ্যই পূর্ণ করতে হবে, ভঙ্গ করা যাবে না।
৫. বাতিলকে কখনো কোন প্রকার সাহায্য সহযোগীতা করা যাবে না।
২৮-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
জাবের (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আবূ বাকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আসলেন এবং অনুমতি প্রার্থনা করলেন কিন্তু তিনি তাকে অনুমতি দেননি। অতঃপর উমার (رضي الله عنه) আসলে তিনি তাকেও অনুমতি দেননি। পরে তিনি উভকেই অনুমতি দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট প্রবেশ করল। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বসে ছিলেন এবং তাঁর পাশে তাঁর স্ত্রীগণ। আর তিনি নিরব ছিলেন। তখন উমার (رضي الله عنه) বললেন: আমি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এমন একটি কথা বলব যা শুনে তিনি হাসবেন। তিনি বললেন: হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি যদি দেখতেন যে, যায়েদের কন্যা উমারের স্ত্রী সে এইমাত্র আমার কাছে তার খরচ ভার চেয়েছে। তখন আমি তার গলা ধরে ধাক্কা দিয়েছি। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেসে দিলেন এবং বললেন: যারা আমার পাশে তারাও তো আমার নিকট খরচ দাবী করে। তখন আবূ বাকর আয়িশাহকে এবং উমার হাফসাকে মারার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। তারা উভয়েই তাদেরকে বললেন, তোমরা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট খরচ চাও যা তাঁর নিকট নেই? তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদের স্বাধীনতা নিয়ে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৮৫-৮৬, সহীহ মুসলিম হা: ১৪৭৮)
এখানে আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ প্রদান করেছেন যে, তিনি যেন তার স্ত্রীদেরকে দুটি জিনিসের মধ্য থেকে একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা প্রদান করেন। যদি তারা পার্থিব জগতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সৌন্দর্য ও চাকচিক্য পছন্দ করে তবে তিনি যেন তাদেরকে তাঁর বিবাহ সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। আর যদি দুনিয়ার অভাব-অনটনে ধৈর্যধারণ করত আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সন্তুষ্টি এবং আখিরাতের সুখ-শান্তি কামনা করে তবে যেন তারা তাঁর সাথে ধৈর্যধারণ করে জীবন অতিবাহিত করে। আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত নেয়ামত দ্বারা তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখবেন। তখন নাবী পত্নীগণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে থেকে বিপদে ধৈর্যধারণ করাই পছন্দ করলেন।
আয়িশাহ (رضي الله عنها) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদেরকে স্বাধীনতা প্রদান করলেন। প্রথমেই আমাকে বললেন: হে আয়িশাহ! আমি তোমাকে একটি কথা বলব, তার উত্তর তাড়াতাড়ি দেবার প্রয়োজন নেই, বরং তোমার পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করে তারপর বলবে। আয়িশাহ (رضي الله عنها) বলেন: আমার পিতা-মাতা সম্পর্কে ভালো করে জানেন, তারা কখনো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বর্জন করার পরামর্শ দেবেন না। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আয়িশাহ (رضي الله عنها) বলেন: এ বিষয়ে পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করব? আমি আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল এবং পরকাল চাই। আয়িশাহ (رضي الله عنها) যা করলেন অন্যান্য স্ত্রীরাও তাই করলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৮৬, সহীহ মুসলিম হা: ১৪৭৫)
সুতরাং মু’মিন নারীদের জন্য এখানে শিক্ষা রয়েছে, তার স্বামী যা দিতে অক্ষম এমন কিছু তার কাছে দাবী করা উচিত নয়, বরং স্বামী তার সাধ্যমত যতটুকু ভরণপোষণ দেয় তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা দুনিয়া চায় তাদেরকে দুনিয়ায় দেয়া হবে। কিন্তু পরকালে তাদের জাহান্নাম ব্যতীত আর কিছুই থাকবে না।
২. যারা মুত্তাকী ও মু’মিন দুনিয়াতে তাদের অনেক দুঃখ, কষ্ট আসতে পারে এটাই স্বাভাবিক।
৩. যারা দুনিয়া প্রিয় তাদের সাথে সংসার করার চেয়ে না করাটাই উত্তম। কারণ তাতে আল্লাহ তা‘আলার কোন রহমত থাকে না।
৩০-৩১ নং আয়াতের তাফসীর:
মানুষ যে যত বড় তার কথা ও কাজ কর্মের ওজনও তত বড়। তারা যেমন ভাল কর্মের জন্য বড় প্রতিদান পায় তেমনি তাদেরকে ছোট ভুলের জন্য বড় মাশুল দিতে হয়। অনুরূপভাবে নাবী পতœীগণ মর্যাদার দিক দিয়ে সাধারণ নারীদের থেকে উত্তম। সুতরাং তারা ভাল কাজ করলে যেমন দ্বিগুণ প্রতিদান পাবে, অনুরূপভাবে কোন অবৈধ বা অশ্ল¬ীল কাজে লিপ্ত হলে শাস্তিও দ্বিগুণ হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
(مَنْ جَا۬ءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَه۫ خَيْرٌ مِّنْهَا ج وَهُمْ مِّنْ فَزَعٍ يَّوْمَئِذٍ اٰمِنُوْنَ - وَمَنْ جَا۬ءَ بِالسَّيِّئَةِ فَكُبَّتْ وُجُوْهُهُمْ فِي النَّارِ ط هَلْ تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ)
“যে কেউ সৎ কর্ম নিয়ে আসবে, সে তা হতে উত্তম প্রতিফল পাবে এবং সেদিন তারা ভয় হতে নিরাপদ থাকবে। যে কেউ অসৎ কর্ম নিয়ে আসবে, তাকে অধোমুখে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে (এবং তাদেরকে বলা হবে) ‘তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল তোমাদেরকে দেয়া হচ্ছে।” (সূলা নামল ২৭:৮৯-৯০)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يُّضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيْه۪ مُهَانًا)
“কিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়; (সূরা ফুরকান ২৫:৬৯) এখানে فَاحِشَةٍ বা অশ্লীল কাজ দ্বারা উদ্দেশ্য অসভ্য ও অশোভনীয় আচরণ। তবে কুরআনে যখন আলিফ-লাম নিয়ে الفاحشة শব্দটি এসেছে তখন তার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ব্যভিচার।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পরকালে মানুষের মর্যাদা অনুপাতে তাদের বিচারকার্য সম্পাদন করা হবে।
২. মর্যাদায় যত বেশি বড় হবে অন্যায় কাজে লিপ্ত হলে শাস্তিও তদ্রƒপ বড় হবে।
৩. আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুগত থাকতে হবে, তাদের নির্দেশের অবাধ্য হওয়া যাবে না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২১-২২ নং আয়াতের তাফসীর
এ আয়াত ঐ বিষয়ের উপর বড় দলীল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সমস্ত কথা, কাজ ও অবস্থা আনুগত্য ও অনুসরণের যোগ্য। আহযাবের যুদ্ধে তিনি যে ধৈর্য, সহনশীলতা ও বীরত্বের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যেমন আল্লাহর পথের প্রস্তুতি, জিহাদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ এবং কাঠিন্যের সময়ও আসমানী সাহায্যের আশা যে তিনি করেছিলেন, এগুলো নিঃসন্দেহে এ যোগ্যতা রাখে যে, মুসলমানরা এগুলোকে জীবনের বিরাট অংশ বানিয়ে নেয়। আর যেন আল্লাহর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে নিজেদের জন্যে উত্তম নমুনা বানিয়ে নেয় এবং তার গুণাবলী যেন নিজেদের মধ্যে আনয়ন করে। এই কারণেই ভয় ও উদ্বেগ প্রকাশকারী লোকদের জন্যে আল্লাহ পাক কুরআন কারীমে ঘোষণা দেনঃ তোমরা আমার নবী (সঃ)-এর অনুসরণ কর না কেন? আমার রাসূল (সঃ) তো তোমাদের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছেন। তার নমুনা তোমাদের সামনে বিদ্যমান ছিল। তোমাদেরকে তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতা অবলম্বনের কথা শুধু শিক্ষাই দিচ্ছেন না বরং কার্যে অটলতা, ধৈর্য এবং দৃঢ়তা তিনি নিজের জীবনেও ফুটিয়ে তুলেছেন। তোমরা যখন আল্লাহর উপর ও কিয়ামতের উপর বিশ্বাসের দাবী করছো তখন তাকে নমুনা বানাতে আপত্তি কিসের?
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর সেনাবাহিনী, খাঁটি মুসলমান এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সত্য সঙ্গীদের পাকা ঈমানের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, মুমিনরা যখন শত্রুপক্ষীয় ভীরু ও কাপুরুষ সম্মিলিত বাহিনীকে দেখলো তখন তারা বলে উঠলো: এটা তো তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) সত্যই বলেছিলেন। আর এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেলো।
খুব সম্ভব আল্লাহর যে ওয়াদার দিকে এতে ইঙ্গিত রয়েছে তা সূরায়ে বাকারার নিম্নের আয়াতটিঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনো তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি? অর্থ সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিল।
এমনকি রাসূল এবং তার সাথে ঈমান আনয়নকারীরা বলে উঠেছিলঃ আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? হ্যা, হ্যা, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।” (২:২১৪) অর্থাৎ এটা তো পরীক্ষা মাত্র। এদিকে তোমরা যুদ্ধে অটল থেকেছো, আর ওদিকে আল্লাহর সাহায্য এসেছে। এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আল্লাহ এবং তার রাসূল (সঃ) সত্য বলেছেন এবং এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেলো। অর্থাৎ তাদের ঈমান পূর্ণ হয়ে গেল এবং আনুগত্য আরো বৃদ্ধি পেলো। ঈমান বেশী হওয়ার একটি দলীল এই আয়াতটি এবং অন্যদের তুলনায় তাঁদের ঈমান বেশী হওয়ারও দলীল। জমহুর ইমামগণও একথাই বলেন যে, ঈমান বাড়ে ও কমে। আমরাও সহীহ বুখারীর শরাহের শুরুতে এটা বর্ণনা করেছি। সুতরাং আল্লাহ তা’আলার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা।
মহান আল্লাহ তাই বলেনঃ তাদের ঈমান যা ছিল, কঠিন বিপদের সময় তা আরো বৃদ্ধি পেয়ে গেল।
২৩-২৪ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে মুমিন ও মুনাফিকদের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, সময় আসার পূর্বে মুনাফিকরা বড় বড় বুলি আওড়িয়ে থাকে কিন্তু যখন সময় এসে যায় তখন। অত্যন্ত ভীরুতা ও কাপুরুষতা প্রদর্শন করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর সাথে কৃত ওয়াদা সব ভুলে যায়। সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করার পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে মুমিনরা তাদের ওয়াদা পূর্ণভাবে পালন করে। কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করে এবং কেউ কেউ শাহাদাতের প্রতীক্ষায় থাকে।
হযরত সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “যখন আমি কুরআন মাজীদ লিখতে শুরু করি তখন একটি আয়াত আমি পাচ্ছিলাম না। অথচ সূরায়ে আহযাবে আমি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে তা শুনেছিলাম। অবশেষে হযরত খুযাইমা ইবনে সাবিত আনসারী (রঃ)-এর নিকট আয়াতটি পাওয়া গেল। ইনি ঐ সাহাবী, যাঁর একার সাক্ষ্যকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) দু’জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের সমান করে দিয়েছিলেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, (আরবি)-এ আয়াতটি হযরত আনাস ইবনে মাযার (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। ঘটনাটি এই যে, তিনি বদরের যুদ্ধে যোগদান করতে পারেননি বলে মনে অত্যন্ত দুঃখ ও ব্যথা অনুভব করেছিলেন। তার দুঃখের কারণ ছিল এই যে, যে যুদ্ধে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সেই যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করতে পারলেন না। সুতরাং তার মত। হতভাগ্য আর কে আছে? তাই তিনি অঙ্গীকার করে বলেনঃ “আবার যদি জিহাদের সুযোগ এসে যায় তবে অবশ্যই আমি আল্লাহ তাআলাকে আমার সত্যবাদিতা ও সৎ সাহসিকতা প্রদর্শন করবো আর এও দেখিয়ে দেবো যে, আমি কি করছি!” অতঃপর যখন উহুদ যুদ্ধের সুযোগ আসলো তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, সামনের দিক হতে হযরত সা’দ ইবনে মুআয (রাঃ) ফিরে আসছেন। তাকে এভাবে ফিরে আসতে দেখে তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আবু আমর (রাঃ)! কোথায় যাচ্ছেন? আল্লাহর শপথ! উহুদ পাহাড়ের এই দিক হতে আমি জান্নাতের সুগন্ধ পাচ্ছি।” এ কথা বলেই তিনি সামনের দিকে অগ্রসর হন এবং মুশরিকদের মধ্যে প্রবেশ করে বহুক্ষণ ধরে তরবারী চালনা করেন। কিন্তু মুসলমানরা সবাই ফিরে গিয়েছিলেন বলে তিনি একা হয়ে গেলেন। তাঁর এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে মুশরিকরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং তাঁকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললো। অতঃপর তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। তার দেহে আশিটিরও বেশী যখম হয়েছিল। কোনটি ছিল বর্শার যখম এবং কোনটি ছিল তরবারীর যখম। শাহাদাতের পর তাঁকে কেউ চিনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তাঁর ভগ্নী তাঁকে তাঁর হাতের অঙ্গুলীগুলোর অগ্রভাগ দেখে চিনতে পারেন। তার ব্যাপারেই (আরবি) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, যখন মুসলমানরা যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করে তখন তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহ! এরা মুসলমানরা) যা করলো এজন্যে আমি আপনার নিকট ওযর প্রকাশ করছি এবং মুশরিকরা যা করেছে সে জন্যে আমি আপনার নিকট অসন্তোষ প্রকাশ করছি।” তাতে এও রয়েছে যে, হযরত সা’দ (রাঃ) তাকে বলেনঃ “আমি আপনার সাথেই রয়েছি। আমি তার সাথে চলছিলামও বটে। কিন্তু তিনি যা করছিলেন। তা আমার সাধ্যের অতিরিক্ত ছিল।”
হযরত তালহা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ উহুদের যুদ্ধ হতে মদীনায় ফিরে এসে মিম্বরের উপর আরোহণ করেন এবং আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর মুসলমানদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। যারা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের মর্যাদার বর্ণনা দেন। অতঃপর তিনি (আরবি) এ আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন। একজন মুসলমান দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ আয়াতে যাদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাঁরা কারা?” ঐ সময় আমি সামনের দিক হতে আসছিলাম এবং হারামী ও সবুজ রঙ-এর দু’টি কাপড় পরিহিত ছিলাম। আমার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেনঃ “হে প্রশ্নকারী ব্যক্তি! এই লোকটিও তাদের মধ্যে একজন।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
বর্ণিত আছে যে, হযরত মূসা ইবনে তালহা (রাঃ) হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর দরবারে গমন করেন। যখন তিনি তার দরবার হতে ফিরে আসতে উদ্যত হন তখন তিনি তাকে ডেকে বলেনঃ “হে মূসা (রাঃ)! এসো, আমার নিকট হতে একটি হাদীস শুনে যাও। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি। যে, (আরবি)-এই আয়াতে যেসব লোকের বর্ণনা রয়েছে তাদের মধ্যে তোমার পিতা হযরত তালহা (রাঃ) একজন।”এটাও মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে।
এঁদের বর্ণনা দেয়ার পর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আর কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে যে, আবার যুদ্ধের সুযোগ আসলে তারা তাদের কাজ আল্লাহকে প্রদর্শন করবে এবং শাহাদাতের পেয়ালা পান করবে। তারা তাদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি।
এই ভীতি এবং এই সন্ত্রাস এই কারণেই ছিল যে, আল্লাহ সত্যবাদীদেরকে পুরস্কৃত করেন তাদের সত্যবাদিতার জন্যে এবং তাঁর ইচ্ছা হলে মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন অথবা তাদেরকে ক্ষমা করেন। আল্লাহ তা’আলা হলেন আলেমুল গায়েব। তার কাছে প্রকাশ্য ও গোপনীয় সবই সমান। যা হয়নি তা তিনি তেমনি জানেন যেমন জানেন যা হয়ে গেছে। কিন্তু তার অভ্যাস এই যে, বান্দা কোন কাজ যে পর্যন্ত না করে বসে সে পর্যন্ত তাকে শুধু নিজের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে শাস্তি প্রদান করেন না। যেমন তিনি বলেনঃ (আারবি)
অর্থাৎ “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো, যতক্ষণ না আমি জেনে নিই তোমাদের মধ্যে জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদের এবং আমি তোমাদের ব্যাপারে পরীক্ষা করি।” (৪৭:৩১) সুতরাং অস্তিত্বের পূর্বের জ্ঞান, তারপর অস্তিত্ব লাভের পরের জ্ঞান উভয়ই আল্লাহ তা’আলার রয়েছে। আর অস্তিত্বে আসার পর হবে পুরস্কার অথবা শাস্তি। যেমন মহান আল্লাহ অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আারবি)
অর্থাৎ “অসৎকে সৎ হতে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছে। আল্লাহ মুমিনদেরকে সেই অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না। অদৃশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদেরকে অবহিত করবার নন।” (৩:১৭৯) সুতরাং আল্লাহ তা’আলা এখানে বলেনঃ তার ইচ্ছা হলে তিনি মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন অথবা তাদেরকে ক্ষমা করেন। অর্থাৎ তাদেরকে তিনি খাটি অন্তরে তাওবা করার তাওফীক দেন। ফলে তারা তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে। আল্লাহ তা’আলা তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তাঁর করুণা ও রহমত তার গযব ও ক্রোধের উপর বিজয়ী।
# আল্লাহ তা’আলা নিজের ইহসান বা অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি ঝড়-তুফান ও অদৃশ্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করে কাফিরদের শক্তি-সাহস সবকিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। তারা কঠিন নৈরাশ্যের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অকৃতকার্য অবস্থায় তারা অবরোধ উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। যদি তারা বিশ্ব শান্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উম্মতের মধ্যে না থাকতো তবে এ ঝড়-তুফান তাদের সাথে ঐ ব্যবহারই করতো যেমন ব্যবহার করেছিল আ’দ জাতির সাথে। যেহেতু বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেছেনঃ যতদিন তুমি তাদের মধ্যে অবস্থান করবে ততদিন আল্লাহ তাদের উপর সাধারণ আযাব নাযিল করবেন না, সেহেতু তিনি তাদেরকে তাদের দুষ্টামির স্বাদ গ্রহণ করালেন তাদের একতাকে ভেঙ্গে দিয়ে, তাদেরকে তিনি ছিন্ন ভিন্ন করে দিলেন এবং নিজের আযাব সরিয়ে নিলেন। তাদের একতাবদ্ধতা তাদের প্রবৃত্তি প্রসূত ছিল বলে ঝড়-তুফানই তাদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলো। যারা চিন্তা-ভাবনা করে এসেছিল তারাও সবাই মাটির সাথে মিশে গেল। কোথায় গেল তাদের গনীমতের মাল এবং কোথায় গেল তাদের বিজয়! তাদের জীবনের উপর মরিচা পড়ে গেল। তারা হাতে হাত মলতে লাগলো; দাঁতে দাঁত পিষতে লাগলো। ঘুরানো চক্রে আপতিত হয়ে অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে উদ্দেশ্য সাধন ছাড়াই অকৃতকার্য হয়ে তারা ফিরে গেল। দুনিয়ার ক্ষতি তাদের পৃথকভাবে হলো এবং আখিরাতের শাস্তি তো পৃথকভাবে আছেই। কেননা, কেউ যদি কোন কাজ করার নিয়ত করে এবং তা কার্যে পরিণত করে, তবে সে তাতে কৃতকার্য হালে আর নাই হালে, পাপ তার হবেই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হত্যা ও তার দ্বীনকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা ইত্যাদি সব কিছুই তারা করেছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা উভয় জগতের বিপদ তাদের উপর আপতিত করে তাদের অন্তর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেন এবং তাদেরকে ব্যর্থ মনোরথ করে ফিরিয়ে দেন। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের পক্ষ থেকে তাদের মুকাবিলা করেন। মুসলমানরা না তাদের সাথে লড়েছে, না তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছে। বরং মুসলমানরা তাদের জায়গাতেই অবস্থান করেছে। আর কাফির ও মুশরিকরা এমনিতেই পলায়ন করেছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষা করলেন, নিজের বান্দাদের তিনি সাহায্য করলেন এবং নিজেই তিনি যথেষ্ট হয়ে গেলেন। এজন্যেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, তিনি এক, তাঁর ওয়াদা সত্য, তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, তার সেনাবাহিনীর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন, সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হলো এবং এরপরে আর কিছুই নেই। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে তাখরীজ করেছেন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আহযাবের যুদ্ধে দু’আ করেছিলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! হে কিতাব অবতীর্ণকারী, হে তাড়াতাড়ি হিসাব গ্রহণকারী! সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করুন এবং তাদেরকে আন্দোলিত ও প্রকম্পিত করুন।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
মহান আল্লাহ বলেনঃ “যুদ্ধে মুমিনদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। এতে একটি অতি সূক্ষ্ম কথা এই আছে যে, মুসলমানরা শুধু এই যুদ্ধ হতেই মুক্ত হননি, বরং আগামীতে সদা-সর্বদার জন্যে সাহাবীগণ (রাঃ) যুদ্ধ হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন। মুশরিকরা আর তাঁদের উপর আক্রমণ করার সাহস কখনো করেনি। ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, আহযাবের যুদ্ধের পর কাফিরদের এ সাহস হয়নি যে, তারা মদীনার উপর অথবা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর কোন স্থান হতে আক্রমণ করে। তাদের এ অপবিত্র পদক্ষেপ হতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে এবং তার বাসস্থান ও আরামের জায়গাকে সুরক্ষিত রেখেছেন। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে। বরং অপরপক্ষে মুসলমানরা তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। এমনকি আল্লাহ তা’আলা আরব উপমহাদেশ হতে শিরক ও কফরী সমলে উৎপাটিত করেছেন। যখন কাফিররা এ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন করে। তখনই রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে বলেছিলেনঃ “এ বছরের পর কুরায়েশরা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে না। বরং তোমরাই তাদের সাথে যুদ্ধ করবে।” তাই হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মক্কা বিজিত হলো। আল্লাহর শক্তির মুকাবেলা করা বান্দার সাধ্যাতীত। আল্লাহকে কেউই পরাজিত করতে পারে না। তিনিই স্বীয় শক্তি ও সাহায্যবলে ঐ সম্মিলিত বাহিনীকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলেন। তাদের নাম নেয়ার মত কেউই থাকলো না। তিনি ইসলাম ও মুসলমানদেরকে বিজয় দান করলেন এবং স্বীয় ওয়াদাকে সত্য করে দেখালেন। তিনি স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে সাহায্য করলেন। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই জন্যে।
২৬-২৭ নং আয়াতের তাফসীর
ইতিপূর্বে আমরা বর্ণনা করেছি যে, যখন মুশরিক ও ইয়াহূদীদের সেনাবাহিনী মদীনায় আসে ও অবরোধ সৃষ্টি করে তখন বানু কুরাইযা গোত্রের ইয়াহুদীরা যারা মদীনার অধিবাসী ছিল এবং যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চুক্তি হয়েছিল, তারাও ঠিক এই সময় বিশ্বাসঘাতকতা করলো এবং সন্ধি ভেঙ্গে দিলো। তারা চোখ রাঙাতে শুরু করলো। তাদের সরদার কাব ইবনে আসাদ আলাপ আলোচনার জন্য আসলো। ম্লেচ্ছ হুয়াই ইবনে আখতাব ঐ সরদারকে সন্ধি ভঙ্গ করতে উদ্বুদ্ধ করলো। প্রথমে সে সন্ধি ভঙ্গ করতে সম্মত হলো না। সে এ সন্ধির উপর দৃঢ় থাকতে চাইলো। হুয়াই বললো: “এটা কেমন কথা হলো? আমি তোমাকে সম্মানের উচ্চাসনে বসিয়ে তোমার মস্তকে রাজ মুকুট পরাতে চাচ্ছি, অথচ তুমি তা মানছো না? কুরায়েশরা ও তাদের অন্যান্য সঙ্গীসহ আমরা সবাই এক সাথে আছি। আমরা শপথ করেছি যে, যে পর্যন্ত না আমরা এক একজন মুসলমানের মাংস ছেদন করবো সে পর্যন্ত এখান হতে সরবো না।” কা’বের দুনিয়ার অভিজ্ঞতা ভাল ছিল বলে সে উত্তর দিলো: “এটা ভুল কথা। এটা তোমাদের ক্ষমতার বাইরে। তোমরা আমাকে লাঞ্ছনার বেড়ী পরাতে এসেছে। তুমি একটা কুলক্ষণে লোক। সুতরাং তুমি আমার নিকট হতে সরে যাও। আমাকে তোমার ধোকাবাজীর শিকারে পরিণত করো না।” হুয়াই কিন্তু তখনো তার পিছন ছাড়লো না। সে তাকে বারবার বুঝাতে থাকলো। অবশেষে সে বললো: “মনে কর যে, কুরায়েশ ও গাতফান গোত্র পালিয়ে গেল, তাহলে আমরা দলবলসহ তোমার গর্তে গিয়ে পড়বো। তোমার ও তোমার গোত্রের যে দশা হবে, আমার ও আমার গোত্রেরও সেই দশাই হবে।”
অবশেষে কাবের উপর হুয়াই-এর যাদু ক্রিয়াশীল হলো। বানু কুরাইযা সন্ধি ভঙ্গ করলো। এতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও সাহাবীগণ (রাঃ) অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং এটা তাঁদের কাছে খুবই কঠিন ঠেকলো। আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদের সাহায্য করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীগণ সমভিব্যাহারে বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। সাহাবীগণ (রাঃ) অস্ত্র-শস্ত্র খুলে ফেললেন এবং রাসূলুল্লাহও (সঃ) অস্ত্র-শস্ত্র খুলে ফেলে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)-এর গৃহে ধূলো-ধূসরিত অবস্থায় হাযির হলেন এবং পাক সাফ হওয়ার জন্যে গোসল করতে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিবরাঈল (আঃ) আবির্ভূত হন। তাঁর মস্তকোপরি রেশমী পাগড়ী ছিল। তিনি খচ্চরের উপর উপবিষ্ট ছিলেন। ওর পিঠে রেশমী গদি ছিল। তিনি বলতে লাগলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি কি অস্ত্র-শস্ত্র খুলে ফেলেছেন?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা।” হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “ফেরেশতারা কিন্তু এখনো অস্ত্র-শস্ত্র হতে পৃথক হয়নি। আমি কাফিরদের পশ্চাদ্ধাবন হতে এইমাত্র ফিরে এলাম। জেনে রাখুন! আল্লাহর নির্দেশ, বানু কুরাইযার দিকে চলুন! তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দান করুন! আমার প্রতিও মহান আল্লাহর এ নির্দেশ রয়েছে যে, আমি যেন তাদেরকে প্রকম্পিত করি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে যান। নিজে প্রস্তুতি গ্রহণ করে সাহাবীদেরকেও প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা সবাই বানু কুরাইযার ওখানেই আসরের নামায আদায় করবে। যুহরের নামাযের পর এ হুকুম দেয়া হলো। বানু কুরাইযার দুর্গ মদীনা হতে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। পথেই নামাযের সময় হয়ে গেল। তাদের কেউ কেউ নামায আদায় করে নিলেন। তাঁরা বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল যে, তারা যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে আসেন।” আবার কেউ কেউ বললেনঃ “আমরা সেখানে না পৌঁছে নামায পড়বো না।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ খবর জানতে পেরে দু’দলের কাউকেই তিনি ভৎসনা বা তিরস্কার করলেন না। তিনি ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ)-কে মদীনার খলীফা নিযুক্ত করলেন। সেনাবাহিনীর পতাকা হযরত আলী (রাঃ)-এর হাতে প্রদান করলেন। তিনি নিজেও সৈন্যদের পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন। সেখানে গিয়েই তিনি তাদের দুর্গ অবরোধ করে ফেললেন। পঁচিশ দিন পর্যন্ত অবরোধ স্থায়ী হলো। যখন ইয়াহূদীদের দম নাকে এসে গেল তখন তাদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠলো। তারা হযরত সা’দ ইবনে মুআয (রাঃ)-কে নিজেদের সালিশ বা মীমাংসাকারী নির্ধারণ করলো। কারণ তিনি আউস গোত্রের সরদার ছিলেন। বানু কুরাইযা ও আউস গোত্রের মধ্যে যুগ-যুগ ধরে বন্ধুত্ব ও মিত্রতা চলে আসছিল। তারা একে অপরের সাহায্য করতো। তাদের ধারণা ছিল যে, হযরত সা’দ (রাঃ) তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করবেন। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সাল্ল বানু কাইনুকা গোত্রকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল। এদিকে হযরত সা’দ (রাঃ)-এর দেহে একটি তীর বিদ্ধ হয়েছিল, যার কারণে সেখান হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার ক্ষতস্থানে দাগ লাগিয়েছিলেন এবং মসজিদের তাঁবুতে তাঁর স্থান করেছিলেন। যাতে তাঁকে দেখতে যাওয়ার সুবিধা হয়। হযরত সা’দ (রাঃ) যে দু’আ করেছিলেন তন্মধ্যে একটি দু’আ এও ছিলঃ “হে আমার প্রতিপালক। যদি আরো কোন যুদ্ধ আপনার নবী (সঃ)-এর উপর থেকে থাকে যেমন কাফির মুশরিকরা আপনার নবী (সঃ)-এর উপর আক্রমণ চালিয়েছে, তবে আমাকে জীবিত রাখুন, যেন আমি তার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারি। আর যদি কোন যুদ্ধ অবশিষ্ট না থেকে থাকে তবে আমার ক্ষতস্থান হতে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকুক। কিন্তু হে আমার প্রতিপালক! যে পর্যন্ত না আমি বানু কুরাইযা গোত্রের বিদ্রোহের পূর্ণ শাস্তি দেখে আমার চক্ষুদ্বয় ঠাণ্ডা করতে পারি সে পর্যন্ত আমার মৃত্যুকে বিলম্বিত করুন। হযরত সা’দ (রাঃ)-এর প্রার্থনা কবুল হওয়ার দৃশ দেখে বিস্মিত হতে হয়। তিনি এদিকে প্রার্থনা করছেন, আর ওদিকে বানু কুরাইযা গোত্র স্বীকার করে নিয়েছে যে, হযরত সা’দ (রাঃ) তাদের যে মীমাংসা করবেন তা তারা মেনে নেবে এবং তাদের দুর্গ মুসলমানদের হাতে সমর্পণ করবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত সা’দ (রাঃ)-এর নিকট সংবাদ পাঠালেন যে, তিনি যেন এসে তাদেরকে তার ফায়সালা শুনিয়ে দেন।
হযরত সা’দ (রাঃ)-কে গাধার উপর সওয়ার করিয়ে নিয়ে আসা হলো। আউস গোত্রের সমস্ত লোক তাকে জড়িয়ে ধরে বললো: “দেখুন, বানু কুরাইযা গোত্র আপনারই লোক। তারা আপনার উপর ভরসা করেছে। তারা আপনার কওমের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সুতরাং আপনি তাদের উপর দয়া করুন এবং তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করুন!” হযরত সা’দ (রাঃ) নীরব ছিলেন। তাদের কথার কোন জবাব তিনি দিচ্ছিলেন না। তারা তাকে উত্তর দেয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো এবং তার পিছন ছাড়লো না। অবশেষে তিনি বললেনঃ “ঐ সময় এসে গেছে, হযরত সা’দ এটা প্রমাণ করতে চান যে, আল্লাহর পথে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারের তিনি কোন পরওয়া করবেন না। তাঁর এ কথা শোনা মাত্রই ঐ লোকগুলো হতাশ হয়ে পড়লো যে, বানু কুরাইযা গোত্রের কোন রেহাই নেই। যখন হযরত সা’দ (রাঃ)-এর সওয়ারী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর তাঁবুর নিকট আসলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তোমরা তোমাদের সরদারের অভ্যর্থনার জন্যে দাঁড়িয়ে যাও।” তখন মুসলমানরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাকে সওয়ারী হতে নামানো হলো। এরূপ করার কারণ ছিল এই যে, ঐ সময় তিনি ফায়সালাকারীর মর্যাদা লাভ করেছিলেন। ঐ সময় তার ফায়সালাই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে। তিনি উপবেশন করা মাত্রই রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “বানু কুরাইযা গোত্র তোমার ফায়সালা মেনে নিতে সম্মত হয়েছে এবং দুর্গ আমাদের হাতে সমর্পণ করেছে। সুতরাং তুমি এখন তাদের ব্যাপারে ফায়সালা দিয়ে দাও।” হযরত সা’দ (রাঃ) বললেনঃ “তাদের ব্যাপারে আমি যা ফায়সালা করবো তাই কি পূর্ণ করা হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “নিশ্চয়ই।” তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেনঃ “এই তাঁবুবাসীদের জন্যেও কি আমার ফায়সালা মেনে নেয়া জরুরী হবে?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই।” আবার তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “এই দিকের লোকদের জন্যেও কি?” ঐ সময় তিনি ঐ দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন যেই দিকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইজ্জত ও বুযর্গীর খাতিরে তিনি তাঁর দিকে তাকালেন না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “হ্যা, এই দিকের লোলেদের জন্যেও এটা মেনে নেয়া জরুরী হবে।” তখন হযরত সা’দ (রাঃ) বললেনঃ “তাহলে এখন আমার ফায়সালা শুনুন! বানু কুরাইযার মধ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মত যত লোক রয়েছে তাদের সবাইকেই হত্যা করে দেয়া হবে। তাদের শিশু সন্তানদেরকে বন্দী করা হবে এবং তাদের ধন-সম্পদ মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হবে।” তাঁর এই ফায়সালা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে সা’দ (রাঃ)! তুমি এ ব্যাপারে ঐ ফায়সালাই করেছে যা আল্লাহ তা’আলা সপ্তম আকাশের উপর ফায়সালা করেছেন। অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে সা’দ (রাঃ)! প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহর যে ফায়সালা সেই ফায়সালাই তুমি শুনিয়েছো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশক্রমে গর্ত খনন করা হয় এবং বানু কুরাইযা গোত্রের লোকদেরকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় হত্যা করে তাতে নিক্ষেপ করা হয়। তাদের সংখ্যা ছিল সাতশ’ বা আটশ’। তাদের নারীদেরকে ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদেরকে এবং তাদের সমস্ত মালধন হস্তগত করা হয়। আমি এসব ঘটনা আমার ‘কিতাবুস সিয়ার’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলারই জন্যে।
তাই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ কিতাবীদের মধ্যে যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দুর্গ হতে অবতরণে বাধ্য করলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন। এখন তোমরা তাদের কতককে হত্যা করছে এবং কতককে করছো বন্দী।
এই বানু কুরাইযা গোত্রের বড় নেতা, যার দ্বারা এই বংশ চালু হয়েছিল, পূর্ব যুগে এ আশায় সে হিজাযে এসে বসতি স্থাপন করেছিল যে, যে শেষ নবী (সঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী তাদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, তিনি যেহেতু হিজায প্রদেশে আবির্ভূত হবেন, সেহেতু তারা যেন সর্বপ্রথম তাঁর আনুগত্যের মর্যাদা লাভ করতে পারে। কিন্তু শেষ নবী (সঃ)-এর যখন আগমন ঘটলো তখন তার অযোগ্য উত্তরসূরীরা তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। যার ফলে তাদের উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হলো।
(আরবি) দ্বারা দুর্গকে বুঝানো হয়েছে। এই কারণে জন্তুর মাথার শিংকেও (আরবি) বলা হয়। কেননা, জন্তুদের দেহের সবচেয়ে উপরে শিংই থাকে। আল্লাহ তা’আলা তাদের অন্তরে প্রভাব সৃষ্টি করে দিলেন। তারাই মুশরিকদেরকে উত্তেজিত করে তুলেছিল এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। শিক্ষিত ও মূর্খ কখনো সমান হয় না। তারাই মুসলমানদেরকে সমূলে উৎপাটিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘটনা তার বিপরীত হয়ে গেল। শক্তি দুর্বলতায় এবং সফলতা বিফলতায় পরিবর্তিত হলো। চিত্র নষ্ট হয়ে গেল। মিত্ররা পলায়ন করলো এবং তারা একেবারে অসহায় হয়ে পড়লো। সম্মানের জায়গা অসম্মান দখল করে নিলো। মুসলমানদেরকে দুনিয়া হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আনন্দ তাদের নিজেদেরকেই নিশ্চিহ্ন করে দিলো। এরপর আখিরাতের পালা তো আছেই। তাদের কিছু সংখ্যককে হত্যা করে দেয়া হলো। আতিয়্যা কারামী বর্ণনা করেছে, যখন আমাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে হাযির করা হলো তখন তিনি বললেনঃ “দেখো, যদি এর নাভীর নীচে চুল গজিয়ে থাকে তবে একে হত্যা করে দেবে। অন্যথায় একে বন্দীদের অন্তর্ভুক্ত করবে।” দেখা গেল যে, তখনো আমার শৈশবকাল কাটেনি। সুতরাং জীবিত ছেড়ে দেয়া হলো।
মুসলমানদেরকে তাদের ভূমি, ঘরবাড়ী ও ধন-সম্পদের অধিকারী করে দেয়া হলো। এমনকি তাদেরকে ঐ ভূমির মালিক করে দেয়া হলো যা তখনো পদানত হয়নি। অর্থাৎ খাইবারের ভূমি অথবা মক্কা শরীফের ভূমি কিংবা পারস্য অথবা রোমের ভূমি। কিংবা হতে পারে যে, সব জায়গারই ভূমি। অর্থাৎ সব জমিই বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “খন্দকের যুদ্ধের দিন আমি বের হলাম, আমার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবস্থা অবহিত হওয়া। এমন সময় আমার পিছন দিক থেকে কারো সবেগে আগমনের আভাষ পেলাম। তার অস্ত্রের ঝনঝনানীর শব্দও আমার কানে এলো। আমি তখন রাস্তা হতে সরে গিয়ে এক জায়গায় বসে পড়লাম। দেখলাম যে, হযরত সা’দ (রাঃ) সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হতে যাচ্ছেন। তার সাথে তাঁর ভাই হারিস ইবনে আউস (রাঃ)-ও ছিলেন। তাঁর হাতে ঢাল ছিল। হযরত সা’দ (রাঃ) লৌহবর্ম পরিহিত ছিলেন। তিনি খুবই লম্বা দেহ বিশিষ্ট লোক ছিলেন বলে তাঁর দেহ বর্মে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত হয়নি। তাঁর হাত খোলা ছিল। যুদ্ধের কবিতা পাঠ করতে করতে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি সেখান হতে আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। একটি বাগানে আমি প্রবেশ করলাম। সেখানে কিছু মুসলমান উপস্থিত ছিলেন। একটি লোক লৌহ-শিরস্ত্রাণ পরিহিত ছিলেন। ঐ লোকদের মধ্যে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-ও বিদ্যমান ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে ফেলেছিলেন এবং এ কারণে তিনি আমার উপর অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। তিনি বলতে লাগলেনঃ “হে বীরাঙ্গনা! আপনি কি জানেন না যে, যুদ্ধ চলছে? আল্লাহ তাআলাই জানেন পরিণতি কি হবে! আপনি কি করে এখানে আসতে পারলেন? ইত্যাদি অনেক কিছু বলে তিনি আমাকে ভৎসনা করলেন। তিনি আমাকে এতো বেশী তিরস্কার করলেন যে, যদি যমীন ফেটে যেতো তবে আমি তাতে ঢুকে পড়তাম। যে লোকটি মুখ ঢেকে ছিলেন তিনি হযরত উমারের এসব কথা শুনে মাথা হতে লোহার টুপি নামিয়ে ফেললেন। তখন আমি তাকে দেখে চিনতে পারলাম। তিনি ছিলেন হযরত তালাহা ইবনে উবাইদিল্লাহ (রাঃ)। তিনি হযরত উমার (রাঃ)-কে নীরব করিয়ে দিয়ে বললেনঃ “কি ভৎসনা করছেন? পরিণামের জন্যে কি ভয়? আপনি এতো ভয় করছেন কেন? কেউ যদি পালিয়ে যায় তবে সে যাবে কোথায়? সবকিছুই আল্লাহর হাতে।” একজন কুরায়েশী হযরত সা’দ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে তীর মেরে দিলো এবং বললো: “আমি হলাম ইবনে আরকা।” হযরত সা’দ (রাঃ)-এর রক্তবাহী শিরায় তীরটি বিদ্ধ হয়ে গেল এবং রক্তের ফোয়ারা ছুটলো। ঐ সময় তিনি দু’আ করলেনঃ “হে আল্লাহ! আমার মৃত্যু ঘটাবেন না যে পর্যন্ত না আমি বানু কুরাইযা গোত্রের ধ্বংস স্বচক্ষে দেখে যেতে পারি।” আল্লাহ তাআলার কি মাহাত্ম্য যে, তৎক্ষণাৎ তার ক্ষতস্থানের রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। ঝড়-তুফান মুশরিকদেরকে তাড়িয়ে দিলো। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উপর সদয় হলেন। আবু সুফিয়ান এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তেহামায় পালিয়ে গেল। উয়াইনা ইবনে বদর এবং তার সঙ্গীরা পালিয়ে গেল নজদের দিকে। বানু কুরাইযা গোত্র তাদের দুর্গে আশ্রয় নিলো। যুদ্ধক্ষেত্র শূন্য দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মদীনায় ফিরে গেলেন। হযরত সা’দ (রাঃ)-এর জন্যে মসজিদে নববীতেই একটা তাঁবুর ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। ঐ সময়েই হযরত জিবরাঈল (আঃ) আসলেন। তার চেহারা ধূলিময় ছিল। তিনি বলতে লাগলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি অস্ত্র-শস্ত্র রেখে দিয়েছেন? ফেরেশতারা কিন্তু এখনো অস্ত্র-শস্ত্র খুলে ফেলেননি। চলুন, বানু কুরাইযার ব্যাপারেও একটা ফায়সালা করে নেয়া হালে। তাদের উপর আক্রমণ চালানো হালে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তৎক্ষণাৎ অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হলেন এবং সাহাবীদেরকেও যুদ্ধযাত্রার নির্দেশ প্রদান করলেন। বানু তামীম গোত্রের ঘরবাড়ী মসজিদে নববী সংলগ্ন ছিল। পথে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আচ্ছা ভাই! এখান দিয়ে কাউকেও যেতে দেখেছো কি?” তারা উত্তরে বললো: “এখনই হযরত দাহইয়া কালবী (রাঃ) গেলেন।” অথচ উনিই তো ছিলেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ)। তাঁর দাড়ী এবং চেহারা সম্পূর্ণরূপে হযরত দাহইয়া কালবী (রাঃ)-এর সাথে সাদৃশ্যযুক্ত ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) গিয়ে বানু কুরাইযার দুর্গ অবরোধ করে বসলেন। পঁচিশ দিন পর্যন্ত এই অবরোধ স্থায়ী হলো। যখন তারা অত্যন্ত সংকটময় অবস্থায় পতিত হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “দুর্গ আমাদের হাতে ছেড়ে দাও এবং তোমরা নিজেরাও আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর। আমি তোমাদের ব্যাপারে যা ইচ্ছা ফায়সালা করবো।” তারা আবু লুবাবা আব্দুল মুনযিরের সাথে পরামর্শ করলো। সে ইঙ্গিতে বললো: “এ অবস্থায় তোমরা জীবনের আশা পরিত্যাগ কর।” তারা এটা জানতে পেরে এতে অসম্মতি জানালো। তারা বললো: “আমরা আমাদের দুর্গ শূন্য করে দিচ্ছি এবং এটা আপনার সেনাবাহিনীর হাতে সমর্পণ করছি। আমাদের ব্যাপারে আমরা হযরত সা’দ (রাঃ)-কে আমাদের ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে নিচ্ছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেলেন। তিনি হযরত সা’দ (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। তিনি গাধার উপর সওয়ার হয়ে আসছিলেন যার উপর খেজুর গাছের বাকলের গদি ছিল। তাঁকে অতি কষ্টে ওর উপর সওয়ার করে দেয়া হয়। তাঁর কওম তাকে ঘিরে ফেলেছিল। তারা তাকে বুঝাচ্ছিলঃ “দেখুন, বানু কুরাইযা আমাদের মিত্র। তারা আমাদের বন্ধু। সুখে-দুঃখে তারা আমাদের সাথী। তাদের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে তা আপনার অজানা নয়।” হযরত সা’দ (রাঃ) নীরবে তাদের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। যখন তিনি তাদের মহল্লায় পৌছেন তখন ঐদিকে দৃষ্টিপাত করে বলেনঃ “এখন এমন সময় এসে গেছে যখন আমি আল্লাহর পথে কোন ভৎসনাকারীর ভৎসনাকে মোটেই পরওয়া করবো না।” যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর তাঁবুর নিকট হযরত সা’দ (রাঃ)-এর সওয়ারী পৌছলো তখন তিনি স্বীয় সাহাবীদেরকে বললেনঃ “তোমাদের সাইয়্যেদের জন্যে উঠে দাঁড়াও এবং তাঁকে নামিয়ে নাও।” এ কথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “আমাদের সাইয়্যেদ তো স্বয়ং আল্লাহ।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তাঁকে নামিয়ে নাও।” সবাই তখন মিলে জুলে তাঁকে সওয়ারী হতে নামিয়ে নিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “হে সা’দ (রাঃ)! তাদের ব্যাপারে তুমি যে ফায়সালা করতে চাও, কর।” তিনি তখন বললেনঃ “তাদের বড়দেরকে হত্যা করা হালে, ছোটদেরকে গোলাম বানিয়ে নেয়া হালে এবং তাদের মালধন বন্টন করে নেয়া হালে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার এ ফায়সালা শুনে বললেনঃ “হে সা’দ (রাঃ)! এই ফায়সালায় তুমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুকূল্য করেছো।” অতঃপর হযরত সা’দ (রাঃ) প্রার্থনা করেনঃ “হে আল্লাহ! যদি আপনার নবী (সঃ)-এর উপর কুরায়েশদের আর কোন আক্রমণ বাকী থেকে থাকে তবে তাতে অংশগ্রহণের জন্যে আমাকে জীবিত রাখুন। অন্যথায় আমাকে আপনার নিকট উঠিয়ে নিন।” তৎক্ষণাৎ তাঁর ক্ষতস্থান হতে রক্তের ফোয়ারা ছুটতে শুরু করলো। অথচ ওটা সম্পূর্ণরূপে ভাল হয়েই গিয়েছিল। সামান্য কিছু বাকী ছিল। সুতরাং তাকে তার তাঁবুতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং সেখানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ), হযরত
আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ) প্রমুখ মহান ব্যক্তিগণও আসলেন। তাঁরা সবাই কাঁদছিলেন। আমি হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমার (রাঃ)-এর ক্রন্দনের শব্দ পৃথক পৃথকভাবে বুঝতে পারছিলাম। আমি ঐ সময় আমার কক্ষে ছিলাম। সত্যিই তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহচরই ছিলেন। যেমন মহান আল্লাহ তাঁদের সম্পর্কে বলেনঃ (আারবি) অর্থাৎ “তারা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।” (৪৮:২৯)
হযরত আলকামা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে উম্মুল মুমিনীন! রাসূলুল্লাহ (সঃ) কিভাবে কাঁদতেন তা বলুন তো?” উত্তরে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ “কারো জন্যে তাঁর চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরতো না। তবে, দুঃখ ও বেদনার সময় তিনি স্বীয় দাড়ি মুবারক স্বীয় মুষ্টির মধ্যে নিয়ে নিতেন।”
২৮-২৯ নং আয়াতের তাফসীর
এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন তাঁর সহধর্মিণীদেরকে দুটি জিনিসের একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা প্রদান করেন। যদি তারা পার্থিব জগতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সৌন্দর্য ও আঁক-জমক পছন্দ করে তবে তিনি যেন তাদেরকে তাঁর বিবাহ-সম্পর্ক হতে বিচ্ছিন্ন করে দেন। আর যদি দুনিয়ার অভাব অনটনে ধৈর্য ধারণ করতঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর সন্তুষ্টি এবং আখিরাতের সুখ-শান্তি কামনা করে তবে যেন তারা তাঁর সাথে ধৈর্য অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করে। আল্লাহ তা’আলা সমস্ত নিয়ামত দ্বারা তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখবেন। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের মাতা নবী (সঃ)-এর সমস্ত সহধর্মিণীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। তাঁরা সবাই আল্লাহকে, তাঁর রাসূল (সঃ)-কে এবং আখিরাতকেই পছন্দ করে নেন। ফলে মহান আল্লাহ তাদের সবারই উপর খুশী হন। অতঃপর তিনি তাদেরকে আখিরাতের সাথে সাথে দুনিয়ার আনন্দ ও সুখ-শান্তিও দান করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহধর্মিণী হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নবী (সঃ) তাঁর নিকট আগমন করেন এবং বলেনঃ “আমি তোমাকে একটি কথা বলতে চাই। তুমি তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করো না। বরং পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করে উত্তর দাও।” তিনি বলেনঃ “তিনি তো অবশ্যই জানেন যে, আমার পিতা-মাতা যে তার বিবাহ বন্ধন হতে বিচ্ছিন্ন হবার পরামর্শ আমাকে দেবেন এটা অসম্ভব। অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করে আমাকে শুনিয়ে দেন। আমি উত্তরে তাকে বললাম, এ ব্যাপারে আমার পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করার কিছুই নেই। আমার আল্লাহ কাম্য, তাঁর রাসূল (সঃ) কাম্য এবং আখিরাতের সুখ-শান্তিই কাম্য। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অন্যান্য সমস্ত স্ত্রী আমার মতই কথা বলেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, তিনবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে বলেনঃ “দেখো, তোমার পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করা ছাড়া তুমি নিজেই কোন ফায়সালা করে ফেললা না।” অতঃপর আমার জবাব শুনে তিনি অত্যন্ত খুশী হয়ে যান এবং হেসে ওঠেন। তারপর তিনি তাঁর অন্যান্য স্ত্রীদের কাছে যান এবং তাদেরকে পূর্বেই বলেছেন যে, আয়েশা (রাঃ) এ কথা বলেছে। তারা তখন বলেন যে, তাদেরও জবাব এটাই।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “এই ইখতিয়ার প্রদানের পর আমরা যে তাঁকেই গ্রহণ করলাম, সুতরাং এটা তালাকের মধ্যে গণ্য হলো না।”
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। জনগণ তাঁর দরযার উপর উপবিষ্ট ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভিতরে অবস্থান করছিলেন। তিনি প্রবেশের অনুমতি পাননি এমতাবস্থায় হযরত উমার (রাঃ) এসে পড়েন।
তিনিও অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু অনুমতি পেলেন না। কিছুক্ষণ পর দু’জনকেই অনুমতি দেয়া হলো। তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পান যে, তার স্ত্রীরা তার পার্শ্বে বসে আছে এবং তিনি নীরব হয়ে আছেন। হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “দেখো, আমি আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে হাসিয়ে দিচ্ছি।” অতঃপর তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আপনি দেখতেন যে, আজ আমার স্ত্রী আমার কাছে টাকা-পয়সা চাইলো। আমার কাছে টাকা-পয়সা ছিল না। যখন কঠিন জিদ করতে লাগলো তখন আমি উঠে গিয়ে গর্দান মাপলাম।” এ কথা শুনেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেসে উঠলেন এবং বলতে লাগলেনঃ “এখানেও এ ব্যাপারই ঘটেছে। দেখুন, এরা সবাই আমার কাছে ধন-মাল চাইতে শুরু করেছে!” এ কথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর দিকে এবং হযরত উমার (রাঃ) হযরত হাফসা (রাঃ)-এর দিকে ধাবিত হলেন এবং বললেনঃ “বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে এমন কিছু চাচ্ছ যা তাঁর কাছে নেই?””ভাগ্য ভাল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের দু’জনকে থামিয়ে দিলেন। নতুবা তাঁরা যে নিজ নিজ কন্যাকে প্রহার করতেন এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। তখন তার সব স্ত্রীই বলতে লাগলেনঃ “আমাদের অপরাধ হয়েছে। আর কখনো আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এমনভাবে বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলবো না।” অতঃপর এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হলো। সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর নিকট গমন করলেন। তিনি আখিরাতকেই পছন্দ করলেন যেমন উপরে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হলো। সাথে সাথে হযরত আয়েশা (রাঃ) আবেদন জানালেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি যে আপনাকে গ্রহণ করলাম এ কথাটি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীকে বলবেন না।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আল্লাহ আমাকে গোপনকারী রূপে প্রেরণ করেননি। বরং আমাকে শিক্ষাদাতা ও সহজকারী রূপে প্রেরণ করা হয়েছে। আমাকে যে যা বলবে, আমি তাকে সঠিক ও পরিষ্কারভাবেই উত্তর দেবো।
হযরত আলী (রাঃ) বলেন, তালাক গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। বরং দুনিয়া বা আখিরাতকে প্রাধান্য দেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর সনদেও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে এবং এটা প্রকাশ্য আয়াতের বিপরীতও বটে। কেননা, প্রথম আয়াতের শেষে স্পষ্টভাবে রয়েছেঃ ‘এসো, আমি তোমাদের ভোগ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদেরকে বিদায় দিই।”
এতে উলামায়ে কিরামের মতভেদ রয়েছে যে, যদি তিনি স্বীয় স্ত্রীদেরকে তালাক প্রদান করেন তবে তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা জায়েয হবে কি কিন্তু সঠিক কথা এই যে, এটা জায়েয হবে, যাতে এই তালাকের ফল তারা পেয়ে যায় অর্থাৎ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ ও সৌন্দর্য কামনা এবং দুনিয়ার সুখ-শান্তি লাভ। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ হুকুম স্বীয় সহধর্মিণীদেরকে শুনিয়ে দেন তখন তার নয়জন স্ত্রী ছিলেন। পাঁচজন ছিলেন কুরায়েশ বংশের। তাঁরা হলেনঃ হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত হাফসা (রাঃ), হযরত উম্মে হাবীবাহ (রাঃ), হযরত সাওদাহ (রাঃ) এবং হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)। আর বাকী চারজন হলেনঃ হযরত সাফিয়া বিনতে হুওয়াই (রাঃ), তিনি ছিলেন নাযার গোত্রের নারী। হযরত মাইমূনা বিনতে হারিস (রাঃ), তিনি ছিলেন হালালিয়্যাহ গোত্রের নারী। হযরত যয়নব বিনতে জহশ (রাঃ), তিনি ছিলেন আসাদিয়্যাহ গোত্রের নারী। যুওয়াইরিয়্যাহ বিনতে হারিস (রাঃ), তিনি ছিলেন মুসতালিক গোত্রের নারী।
# রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্ত্রীরা অর্থাৎ মুমিনদের মাতারা যখন আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সঃ) এবং আখিরাতকে পছন্দ করলেন তখন মহান আল্লাহ এই আয়াতে তাঁদেরকে উপদেশ দিচ্ছেনঃ হে নবী-সহধর্মিণীরা! তোমাদের কাজ কারবার সাধারণ নারীদের মত নয়। মনে কর, যদি তোমরা নবী (সঃ)-এর অবাধ্যাচরণ কর কিংবা তোমাদের দ্বারা কোন নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ সংঘটিত হয়ে যায় তবে জেনে রেখো যে, দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের শাস্তি দ্বিগুণ হবে। কেননা, মর্যাদার দিক দিয়ে তোমরা সাধারণ নারীদের হতে বহু উর্ধে। সুতরাং পাপকার্য হতে তোমাদের সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা উচিত। অন্যথায় মর্যাদা অনুপাতে তোমাদের শাস্তিও বহুগুণে বেশী হবে। আল্লাহ তা’আলার কাছে সবকিছুই সহজ।
এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, এ কথাগুলো শর্তের উপর বলা হয়েছে এবং শর্ত হয়ে যাওয়া জরুরী নয়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! যদি তুমি শিরক কর তবে অবশ্যই তোমার আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে।” (৩১:৬৫) অন্য এক জায়গায় নবীদের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যদি তারা শিরক করে তবে তাদের আমলগুলো অবশ্যই বিনষ্ট হয়ে যাবে।” (৬:৮৯) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যদি রহমানের (আল্লাহর) সন্তান হতো তবে আমিই হতাম সর্বপ্রথম ইবাদতকারী।” (৩৯:৮১) আর একটি আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যদি আল্লাহ সন্তান গ্রহণের ইচ্ছা করতেন তবে তিনি স্বীয় সৃষ্টজীবের মধ্য হতে যাকে পছন্দ করতেন সন্তান বানিয়ে নিতেন। তিনি তো পবিত্র, একক, বিজয়ী এবং সবারই উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।” (৩৯:৮) সুতরাং এ পাঁচটি আয়াতে শর্তের সাথে বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এরূপ হয়নি। না নবীদের দ্বারা শিরকের কাজ হয়েছে, না নবীদের নেতা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দ্বারা শিরকের কাজ সম্ভব, না আল্লাহ তা’আলার সন্তান গ্রহণ সম্ভব। অনুরূপভাবে নবী-সহধর্মিণী ও মুমিনদের মাতাদের সম্পর্কে যে বলা হয়েছেঃ যদি তোমাদের মধ্যে কেউ অশ্লীল কাজ করে বসে তবে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে, এর দ্বারা এটা মনে করা যাবে না যে, তাঁদের মধ্যে কেউ কখনো এরূপ কোন বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ করেছেন। নাঊযুবিল্লাহ!
# এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় ন্যায়পরায়ণতা ও অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ তোমাদেরকে তোমাদের অনুগত ও সকার্যের জন্যে দ্বিগুণ পুরস্কার প্রদান করা হবে। তোমাদের জন্যে জান্নাতে সম্মান জনক আহার্য প্রস্তুত রয়েছে। কেননা, তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে তাঁর বাসস্থানে অবস্থান করবে। আর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বাসস্থান ইল্লীঈনের উচ্চতম স্থানে অবস্থিত রয়েছে। এটা সমস্ত মানুষের বাসস্থান হতে উঁচুতে রয়েছে। এরই নাম ওয়াসিলা। এটা জান্নাতের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মনযিল যার ছাদ হলো আল্লাহর আরশ।