أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৫৮)
[পর্দার বিধান ও সামাজিক সভ্যতা :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৩:আহযাব
পারা:২২
৫৩- ৫৯ নং আয়াত:-
৩৩: ৫৩
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَدۡخُلُوۡا بُیُوۡتَ النَّبِیِّ اِلَّاۤ اَنۡ یُّؤۡذَنَ لَکُمۡ اِلٰی طَعَامٍ غَیۡرَ نٰظِرِیۡنَ اِنٰىہُ ۙ وَ لٰکِنۡ اِذَا دُعِیۡتُمۡ فَادۡخُلُوۡا فَاِذَا طَعِمۡتُمۡ فَانۡتَشِرُوۡا وَ لَا مُسۡتَاۡنِسِیۡنَ لِحَدِیۡثٍ ؕ اِنَّ ذٰلِکُمۡ کَانَ یُؤۡذِی النَّبِیَّ فَیَسۡتَحۡیٖ مِنۡکُمۡ ۫ وَ اللّٰہُ لَا یَسۡتَحۡیٖ مِنَ الۡحَقِّ ؕ وَ اِذَا سَاَلۡتُمُوۡہُنَّ مَتَاعًا فَسۡـَٔلُوۡہُنَّ مِنۡ وَّرَآءِ حِجَابٍ ؕ ذٰلِکُمۡ اَطۡہَرُ لِقُلُوۡبِکُمۡ وَ قُلُوۡبِہِنَّ ؕ وَ مَا کَانَ لَکُمۡ اَنۡ تُؤۡذُوۡا رَسُوۡلَ اللّٰہِ وَ لَاۤ اَنۡ تَنۡکِحُوۡۤا اَزۡوَاجَہٗ مِنۡۢ بَعۡدِہٖۤ اَبَدًا ؕ اِنَّ ذٰلِکُمۡ کَانَ عِنۡدَ اللّٰہِ عَظِیۡمًا ﴿۵۳﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া না হলে তোমরা খাবার- দাবার তৈরীর জন্য অপেক্ষা না করে খাওয়ার জন্য নবীর ঘরে প্রবেশ করো না। তবে তোমাদেরকে ডাকা হলে তোমরা প্ৰবেশ করো তারপর খাওয়া শেষে তোমরা চলে যেও; তোমরা কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। নিশ্চয় তোমাদের এ আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়, কারণ তিনি তোমাদের ব্যাপারে (উঠিয়ে দিতে) সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে সংকোচ বোধ করেন না । তোমরা তার পত্নীদের কাছ থেকে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য বেশী পবিত্ৰ । আর তোমাদের কারো পক্ষে আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া সংগত নয় এবং তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদেরকে বিয়ে করাও তোমাদের জন্য কখনো বৈধ নয়। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে এটা গুরুতর অপরাধ।
৩৩:৫৪
اِنۡ تُبۡدُوۡا شَیۡئًا اَوۡ تُخۡفُوۡہُ فَاِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمًا ﴿۵۴﴾
তোমরা কোন বিষয় প্রকাশই কর অথবা গোপনই রাখ –আল্লাহ অবশ্যই সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।
৩৩:৫৫
لَا جُنَاحَ عَلَیۡہِنَّ فِیۡۤ اٰبَآئِہِنَّ وَ لَاۤ اَبۡنَآئِہِنَّ وَ لَاۤ اِخۡوَانِہِنَّ وَ لَاۤ اَبۡنَآءِ اِخۡوَانِہِنَّ وَ لَاۤ اَبۡنَآءِ اَخَوٰتِہِنَّ وَ لَا نِسَآئِہِنَّ وَ لَا مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُہُنَّ ۚ وَ اتَّقِیۡنَ اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَہِیۡدًا ﴿۵۵﴾
নবী-স্ত্রীদের জন্য তাদের পিতাগণ, পুত্ৰগণ, ভাইগণ, ভাইয়ের ছেলেরা, বোনের ছেলেরা, আপন নারীগণ এবং তাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীগণের ব্যাপারে তা পালন না করা অপরাধ নয়। আর হে নবী-স্ত্রীগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ সবকিছুর উপর সম্যক প্রত্যক্ষদর্শী।
৩৩:৫৬
اِنَّ اللّٰہَ وَ مَلٰٓئِکَتَہٗ یُصَلُّوۡنَ عَلَی النَّبِیِّ ؕ یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا صَلُّوۡا عَلَیۡہِ وَ سَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا ﴿۵۶﴾
আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠান। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠাও।(দরূদ ও সালাম পেশ কর।)
(এই আয়াতটি পড়ে দরূদ পড়া ওয়াজিব
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ )
৩৩:৫৭
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُؤۡذُوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ لَعَنَہُمُ اللّٰہُ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ وَ اَعَدَّ لَہُمۡ عَذَابًا مُّہِیۡنًا ﴿۵۷﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয় তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়ায় ও আখেরাতে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক আযাবের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
৩৩:৫৮
وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡذُوۡنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ بِغَیۡرِ مَا اکۡتَسَبُوۡا فَقَدِ احۡتَمَلُوۡا بُہۡتَانًا وَّ اِثۡمًا مُّبِیۡنًا ﴿٪۵۸﴾
যারা মু’মিন পুরুষ ও মহিলাদেরকে কোন অপরাধ ছাড়াই কষ্ট দেয় তারা একটি বড় অপবাদ ও সুস্পষ্ট গোনাহর বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছে।
৩৩:৫৯
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ وَ بَنٰتِکَ وَ نِسَآءِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡہِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِہِنَّ ؕ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَنۡ یُّعۡرَفۡنَ فَلَا یُؤۡذَیۡنَ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۵۹﴾
হে নবী! তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মু’মিনদের নারীদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের প্রান্ত তাদের ওপর টেনে নেয়। এটি অধিকতর উপযোগী পদ্ধতি, যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং কষ্ট না দেয়া হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
পর্দার বিধান ও সামাজিক সভ্যতা : এরপর কোরআন নবী গৃহের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অনুরূপভাবে তাঁর স্ত্রী তথা উম্মুল মােমেনীনদের সাথেও তাদের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করেছে। এভাবে কোরআন একটা বাস্তব সমস্যার সমাধান করেছে। কেননা সে সময়ে মােনাফেকরা ও বিকারগ্রস্ত লােকেরা রাসূল (স.)-কে তার বাড়ীতে ও তার স্ত্রীর সামনে নানাভাবে উত্যক্ত ও বিব্ৰত করতাে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। (আয়াত ৫৩ ও ৫৪)। বােখারী শরীফে হযরত আনাস ইবনে মালেক(রা.) থেকে বর্ণিত একটা হাদীসে বলা হয়েছে যে, রসূল(স.) গােশত ও রুটির ভােজের আয়ােজন করে আমাকে অন্যান্যদের দাওয়াত দেয়ার জন্য আমাকে দাওয়াতকারী নিয়ােগ করেন। খাওয়া দাওয়া শুরু হলে একটা দল আসে, খাওয়া দাওয়া করে ও চলে যায় । তারপর আবার অন্য একটা দল আসে, খায়-দায় ও চলে যায়। এরপর ডাকার মতাে কাউকে পেলাম না। আমি রসূল(স.)-কে বললাম! ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি এখন আর দাওয়াত দেয়ার মতাে কাউকে পাচ্ছি না। রসূল (স.) বললেন, ‘তােমরা তােমাদের খাবার তুলে রাখো। এরপর তিন ব্যক্তি নবীগৃহে বসে গল্পগুজব করতে লাগলাে। রাসূল(স.) ঘর থেকে বেরিয়ে হযরত আয়েশার কক্ষে গেলেন এবং বললেন, হে গৃহবাসী, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহে ওয়াবারাকাতুহ। হযরত আয়েশা বললেন, ওয়ালাইকুমুস সালামু ওয়া রহমাতুল্লাহ। ইয়া রসূলাল্লাহ নতুন স্ত্রীকে আপনার কেমন লাগলাে? আল্লাহ তায়ালা আপনার কল্যাণ করুণ। এভাবে তার প্রত্যেক স্ত্রীর কক্ষে দরজায় করাঘাত করলেন, হযরত আয়েশাকে যা বলেছিলেন, প্রত্যেক স্ত্রীকে সে রূপ জবাব দিতে লাগলেন। এরপর রসূল(স.) নিজ গৃহে ফিরে এসে দেখলেন, তখনাে সেই তিন ব্যক্তি গল্প-গুজবে মশগুল। রসূল(স.) ছিলেন অতিশয় লাজুক। তিনি আবার হযরত আয়েশার কক্ষে চলে গেলেন। এরপর আমি জানি না হযরত আয়েশা না অন্য কেউ তাকে জানালাে যে, যারা আহার সেরে গল্প-গুজবে মশগুল ছিলাে তারা চলে গেছে। অতপর রসূল(স.) স্বগৃহে ফিরে এলেন। তিনি যখন তার এক পা দরজার ভেতরে রেখেছেন এবং অপর পা বাইরে-তখনই আমার ও তার মধ্যে পর্দা টেনে দিলেন। আর তৎক্ষণাত পর্দার বিধান সম্বলিত আয়াত নাযিল হলো। এ আয়াতে অন্যের বাড়ীতে প্রবেশ সংক্রান্ত এমন কিছু নিয়ম-বিধি বর্ণিত হয়েছে, যা জাহেলী যুগের মানুষ জানতাে না। এমনকি রাসূল(স.)-এর গৃহে প্রবেশেও কোনাে নিয়ম-নীতির তােয়াক্কা করা হতাে না। মালিকের অনুমতি ছাড়াই অন্যের বাড়ীতে প্রবেশ করতে লােকেরা অভ্যস্ত ছিলাে। অনুমতি গ্রহণপূর্বক গৃহে প্রবেশ সংক্রান্ত সূরা নূরের আয়াতের ব্যাখ্যায় এ সম্পর্ক বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু রাসূল(স.)-এর বাড়ী ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিলাে, সেহেতু এই অননুমােদিত প্রবেশ নবীগৃহেই বেশী সংঘটিত হতাে। ব্যাপারটা শুধু অনুমতি ছাড়া প্রবেশেই সীমিত থাকতাে না, বরং কেউ নবীগৃহে প্রবেশের পর যখন দেখতাে যে, কোনাে খাবার দাবারের আয়ােজন চলছে তখন রান্না সম্পন্ন হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকতাে, যাতে বিনা দাওয়াতেই ভােজন করা যায়। এভাবে দাওয়াতেই অথবা বিনা দাওয়াতে-খাওয়া দাওয়া সেরেও কেউ কেউ ঠায় বসে থাকতাে এবং গল্প গুজবে মশগুল হয়ে যেতাে। এতে রসূল(স.) ও তাঁর পরিবার পরিজনের যে অসুবিধা হচ্ছে, সেটা সে একটুও অনুভব করতাে না। কোনাে কোনাে বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সেই তিন ব্যক্তি যখন খাওয়া-দাওয়ার পর বসে গল্প গুজব করছিলাে, তখন রসূল(স.)-এর নব পরিণীতা বধু হযরত যয়নব বিনতে জাহশ দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিলেন। অথচ রাসূল(স.) লজ্জায় তাদেরকে বলতে পারছিলেন না যে, তাদের উপস্থিতি তার জন্যে বিব্রতকর হয়ে উঠেছে। তার সাক্ষাতপ্রার্থীরা অপমানবােধ করে এমন কোনাে কথা বলতে তিনি কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তার পক্ষ থেকে সত্য কথা বললেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা সত্য বলতে লজ্জা বোধ করেন না। বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর(রা.) স্বীয় স্পর্শকাতর অনুভূতির কারণে রসূল(স.)-কে পর্দার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরামর্শ দিতেন এবং মনে মনে আকাংখা করতেন যে, আল্লাহ তায়ালা পর্দার বিধান নাযিল করলে ভালাে হতাে। অবশেষে তার এ মানসিকতা ও স্পর্শকাতরতার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা পর্দার বিধান সম্বলিত আয়াত নাযিল করলেন। বুখারীর বর্ণনা মতে হযরত আনাস ইবনে মালেক জানান যে, হযরত ওমর(রা.) রসূল(স.)-কে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনার কাছে সৎ ও অসৎ উভয় প্রকারের লােক এসে থাকে। সুতরাং আপনি যদি উদ্মুল মােমেনীনদেরকে পর্দা পালন করার আদেশ দিতেন, তবে ভালাে হতো, এর অব্যবহিত পরই পর্দার আয়াত নাযিল হয়। আলােচ্য (৫৩) আয়াতটা মানুষকে শিক্ষা দিতে এসেছে যে, তারা যেন বিনা অনুমতিতে রসূল(স.)-এর বাড়ীতে প্রবেশ না করে। তাদেরকে যদি খাওয়া দাওয়ার দাওয়াত দেয়া হয়, তবে তারা প্রবেশ করবে। দাওয়াত না দেয়া হলে সেখানে প্রবেশ করে রান্না শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকা উচিত নয়। আর খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেলেই বিদায় হওয়া উচিত। খাওয়ার পর গল্প গুজব করার জন্যে বসে থাকা অনুচিত। আজকের যুগে এ সব নিয়ম-কানুন মেনে চলা মুসলমানদের জন্যে অত্যন্ত জরুরী। আজকাল তারা এসব নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না। ভােজনের দাওয়াতে এসে ভোজন পর্ব শেষ করেও অনেকে বসে গল্প-গুজব ও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে। বাড়ীর লােকেরা যারা কিছু পর্দার বিধান মেনে চলতে চায়, তারা এ অবস্থায় খুবই বিব্রিত বােধ করে। অথচ অতিথিরা সেটা অনুভব করে না। ইসলামী সংস্কৃতিতে সব অবস্থার জন্যে প্রয়ােজনীয় আচরণ পদ্ধতি শেখানাে হয়েছে। আল্লাহর রচিত এই আচরণবিধি মেনে চললে আমরা ঘরে-বাইরে। সব রকমের শান্তি লাভ করতে পারি। আয়াতের আরেকটা বাক্যে রাসূল(স.)-এর স্ত্রীরা ও মুসলিম পুরুষদের মাঝে পর্দা মেনে চলার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যখন তােমরা মহিলাদের কাছে কোনাে জিনিস চাইবে, তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে।’ পরে এ কথাও বলা হয়েছে যে, এই পর্দার বিধানটা নারী পুরুষ সবার জন্যেই অপেক্ষাকৃত পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা। ‘এ ব্যবস্থাটা তােমাদের মন ও তাদের মনের জন্যে অপেক্ষাকৃত পবিত্র।’ সুতরাং আল্লাহ তায়ালা যা বলেছেন, তার উল্টোটা কারাে বলা উচিত নয়, কিছু আধুনিক মানুষের মতাে কারাে বলা উচিত নয় যে, অবাধ মেলামেশা, পর্দা তুলে দেয়া এবং নারী পুরুষের মধ্যে বাক্য বিনিময়, সাক্ষাত বিনিময়, এক সাথে ওঠাবসা ও চলাফেরা করায় মন অপেক্ষাকৃত পবিত্র থাকে, চেপে রাখা যৌন আবেগকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা সহজতর হয় এবং নারী ও পুরুষ উভয়কে তাদের আবেগ-অনুভূতি হালকা করা ও চাল চলন পরিচ্ছন্ন রাখা সহজতর হয়। একশ্রেণীর অজ্ঞ মূর্খরা এ ধরনের আরাে অনেক কথা বলে থাকে। এ ধরনের কোনাে কথাই কারাে বলা উচিত নয়। আল্লাহ তায়ালা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘যখন তােমরা মহিলাদের কাছে কোনাে জিনিস চাইবে। তখন পর্দার আড়াল থেকে চাও। এটা তােমাদের মন ও তাদের মনের জন্যে অধিকতর পবিত্র ব্যবস্থা।’ এ কথাটা আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-এর পবিত্র স্ত্রীর তথা উম্মুল মােমেনীনদের সম্পর্কে বলেছেন। আর বলেছেন প্রথম যুগের সাহাবীদের সম্পর্কে, যাদের বিরুদ্ধে কোনাে অশােডন কথা বলার ধৃষ্টতা কেউ দেখাতে পারে না। যখন আল্লাহ তায়ালা এক কথা বলেন এবং আল্লাহর কোনাে বান্দা অন্য কথা বলে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর কথাই গ্রহণযােগ্য হবে এবং অন্যসব কথা বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত হবে। আল্লাহর কথার ওপর দিয়ে সেই সব বান্দার কথা বড় করে তুলে ধরার ধৃষ্টতা কেবল তারাই দেখাতে পারে, যারা বলতে পারে যে, মরণশীল বান্দারা মানুষের মন সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহর চেয়েও বেশী জ্ঞান রাখে, অথচ তিনি হচ্ছেন সেই চিরঞ্জীব স্রষ্টা। যিনি তার সকল বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন। *উম্মতের জন্যে নবী ফজরের হারাম ঘোষণা করা : বাস্তব ঘটনা আল্লাহর বক্তব্যকেই অকাট্য সত্য বলে প্রমাণ করছে এবং আল্লাহর বক্তব্যের বিপরীত যারা দাবী করে তাদের মিথ্যুক সাব্যন্ত করছে। এ যুগের এবং এ দুনিয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা যা বলছি, সেটাকেই মিথ্যা প্রমাণ করে। বিশেষত যেসব দেশে অবাধ মেলামেশা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, সেখানকার অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে অকাট্য কিছু প্রমাণ বহন করে। (আমার লেখা ‘ইসলাম ও বিশ্বশান্তি’ ‘পারিবারিক শান্তি’ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা দেখুন) আয়াতে বলা হয়েছে যে, বিনা দাওয়াতে তাদের আগমন, খাদ্য তৈরী হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকা এবং খাওয়ার পর গল্প গুজবে মত্ত হওয়া রসূল(স.)-এর জন্যে কষ্টদায়ক ও তিক্তকর। অথচ তিনি তাদেরকে সেখান থেকে চলে যেতে বলতেও লজ্জা পান। আয়াতের শেষভাগে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয়ার কোনাে অধিকার মুসলমানদের নেই, অনুরূপভাবে তার ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীদেরকে বিয়ে করার অধিকারও কারাে নেই। কেননা তারা তাদের মায়ের সমান। রসূল(স.)-এর কাছে তাদের বিশেষ মর্যাদার কারণে এবং তার পরিবারের বিশেষ সম্মানের কারণে রসূল(স.)-এর ইন্তেকালের পর তাদেরকে বিয়ে করা চিরতরে হারাম করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয়া এবং তার স্ত্রীকে তার পরে বিয়ে করার কোনাে অধিকার তােমাদের নেই।’ কথিত আছে যে, কোনাে কোনাে মােনাফেক নাকি হযরত আয়েশাকে বিয়ে করার অপেক্ষায় ছিলাে, ‘নিশ্চয় এটা আল্লাহর তায়ালার কাছে একটা গুরুতর ব্যাপার।’ বন্তুত আল্লাহর কাছে যা গুরুতর, তার চেয়ে ভয়ংকর জিনিস আর কি হতে পারে না। আয়াতে শুধু এই হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত থাকা হয়নি বরং আরাে একটা কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে, ‘তােমরা যদি তা গােপন করাে বা প্রকাশ করো, তবে আল্লাহ তায়ালা সবকিছুই জানেন।’ বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই সবকিছুর নিয়ন্তা। গােপন ও প্রকাশ্য সবকিছুর খবর তিনি জানেন সকল চিন্তা ও কর্ম সম্পর্কেই তিনি অবগত। রসূল(স.)-কে কষ্ট দেয়ার ব্যাপারটা তার কাছে অবশ্যই গুরুতর। যদি কেউ এরপরও কষ্ট দিতে চায় তবে দিক, সে আল্লাহর ভয়াবহ ও সর্বনাশা আযাব ভােগ করতে বাধ্য হবে। এই হুমকি ও হুঁশিয়ারীর পর সেই সব বিবাহ-নিষিদ্ধ পুরুষের বিবরণ দেয়া হচ্ছে, যাদের সামনে পর্দা করা রসুলের (স.) স্ত্রীদের জন্যে জরুরী নয়।
৫৫ নং আয়াতে বর্ণিত এইসব পুরুষের সাথে বিয়ে চিরতরে নিষিদ্ধ বিধায় তাদের সামনে বের হওয়া সাধারণভাবে সকল মুসলমান নারীর জন্যে বৈধ। এ ব্যাপারে কোরআনে দুটো আয়াত রয়েছে। একটা এখানে এবং তা বিশেষভাবে রসুলের(স.) স্ত্রীদের জন্যে। অপরটা সূরা নূর’-এ এবং সেটা সকল মুসলিম নারীর জন্যে। এই দুটো আয়াতের কোনটা প্রথমে নাযিল হয়েছে আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। তবে ব্যাপারটা যে প্রথমে রসূলের স্ত্রীদের জন্যেই নির্দিষ্ট ছিলাে এবং পরে সকল মুসলিম নারীর ওপর প্রযােজ্য হয়েছে, সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কেননা শরীয়তের কোনাে বিধান প্রবর্তন বা প্রচলনে এটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিসংগত ব্যবস্থা। আয়াতের শেষাংশে আল্লাহকে ভয় করার আদেশ ও আল্লাহ তায়ালা সর্ব বিষয়ে অবগত আছেন বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। কেননা এ ধরনের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা ও আল্লাহর উপস্থিতির কথা স্মরণ রাখা অত্যন্ত জরুরী। কারণ আল্লাহর ভয়ই সবকিছুর ব্যাপারে প্রথম ও শেষ গ্যারান্টি এবং এটাই মানুষের মনের ওপর একমাত্র সদাজাগ্রত প্রহরী। যারা রসূল(স.) ও তার পরিবার-পরিজনকে নানাভাবে কষ্ট দেয় ও উত্যক্ত করে, তাদেরকে পরবর্তী দুটো আয়াতেও সতর্ক করা তাদের এই নিন্দনীয় কাজকে একটা ভয়ংকর কাজ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। এ জন্যে প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ও তার উচ্চতর পারিষদবর্গের সামনে রসূল(স.) এর জন্যে অত্যন্ত উচ্চমর্যাদা ও সম্মানিত স্থান রয়েছে বলে ঘােষণা করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর রসূলকে উত্যক্ত করা স্বয়ং আল্লাহকে উত্যক্ত করার শামিল এবং আল্লাহর কাছে তার শাস্তি হলাে দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং লাঞ্জনাকর আযাব। ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক রসূল (স.)-এর ওপর দরদ পাঠের উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ হলাে তার উচ্চতর পারিষদবর্গের সামনে তিনি তার প্রশংসা করেন। আর তার ফেরেশতাদের দরূদ পাঠ করার যে উল্লেখ করা হয়েছে তার অর্থ হলাে, তারা তার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। ভাবতে অবাক লাগে, রসূল(স.)-এর মর্যাদা কত উচু যে, স্বয়ং মহান আল্লাহ তার নবীর যে প্রশংসা করেন, তা-ই সমগ্র সৃষ্টিজগত কর্তৃক প্রতিধ্বনিত হয় এবং তা সমগ্র সৃষ্টিজগতে চিরদিনের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এর পর সম্মান ও অনুগ্রহের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এরপর মানুষ যা কিছু দরূদ ও সালাম পাঠায়, তা আল্লাহ তায়ালা ও ফেরেশতাদের দরূদ ও সালামের পর নিতান্তই গৌণ হয়ে যায়। এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা এটাই চান যে, মােমেনরা তাদের দরূদ ও সালামকে আল্লাহর দরূদ ও সালামের সাথে যুক্ত করে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করুক এবং এভাবে তারা মহান আল্লাহর শাশ্বত, চিরন্তন ও উচ্চ মার্গের সাথে যুক্ত হােক। স্বয়ং মহান আল্লাহ যখন জাঁকজমকের সাথে রসূল(স.)-এর প্রশংসা করেন, তখন একশ্রেণীর মানুষের পক্ষ থেকে রসূল(স.)-কে কষ্ট দেয়া ও উত্যক্ত করা যে কত ঘৃণ্য, ধিক্কারযােগ্য, নিন্দনীয় ও অভিশাপযােগ্য কাজ তা বর্ণনা করা হয়েছে ৫৭ নং আয়াতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তার রসূলকে উত্যক্ত করে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় ও আখেরাতে অভিসম্পাত দেবেন…’ রাসূলকে(স.) উত্যক্ত করার কাজটা আরাে বেশী ঘৃণিত ও ধিকৃত হয় এ জন্যে যে, তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাকেই তার বান্দা ও সৃষ্টির পক্ষ থেকে উত্যক্ত করার শামিল। মানুষ যদিও আল্লাহ তায়ালাকে উত্যক্ত করতে সক্ষম হয় না, কিন্তু এ কথা দ্বারা রসূলকে উত্যক্তকরণ কতাে স্পর্শকাতর, সেটাই ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, যেন এটা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাকেই উত্যক্ত করার শামিল। তাহলে ভেবে দেখা দরকার যে, কাজটা কত ভয়াবহ, কত জঘন্য ও কত নিকৃষ্ট! এরপর সাধারণভাবে মুসলিম নর-নারীকে উত্যক্তকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে মিথ্যা অপবাদ আরােপ করে তাদেরকে এমন দোষের জন্যে দায়ী করা হয়, যা তারা করে না। ৫৮ নং আয়াত দেখুন। এই কঠোর সমালােচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালে মদীনায় একশ্রেণীর লােক মুসলিম নর নারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতাে। তাদের সম্পর্কে কুৎসা ও অপবাদ রটাতো এবং নানা রকম ফন্দি আঁটতাে। এ ব্যাপারটা সকল যুগে ও সকল স্থানেই ঘটে থাকে। বিকৃত ও গর্হিত রুচি সম্পন্ন মােনাফেক ও দুস্কৃতকারীদের এসব দুরভিসন্ধীর কবলে পড়ে মুসলিম নর-নারী সর্বত্রই হেস্তনেস্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা তাদের দুরভিসন্ধীর জবাব দেন এবং তাদের অপবাদ খন্ডন করেন। বন্তুত তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী।
*সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারীদের পরিচয় : এরপর আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তার স্ত্রী-কন্যাদেরকে প্রয়ােজনীয় কাজে বাইরে যাওয়ার সময় সমস্ত শরীর, মাথা ও বুকের খােলা অংশ আচ্ছাদিত করার আদেশ দেন। সর্বাংগ আচ্ছাদনকারী একটা জিলবাব বা চাদর দ্বারা শরীরটাকে ঢেকে নিতে হবে। এ পােশাক তাদেরকে অন্যান্য নারীদের মধ্য থেকে আলাদা বৈশিষ্ট এনে দেবে এবং দুষ্কৃতকারী ও বখাটে লােকদের উত্যক্ত থেকে রক্ষা করবে। কোনাে মহিলাদেরকে উত্যক্তকারী বখাটেরা আপাদমস্তক আবৃত মহিলাদেরকে দেখে তাদেরকে আল্লাহভীরু নারী হিসাবে চিনতে পেরে লজ্জা ও সংকোচ বােধ করে ও সংযত আচরণ করে। ৫৯ নং আয়াতে জিলবাব পরিধানের এ আদেশটা লক্ষণীয়। এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে সুদ্দী বলেছেন, মদীনার কিছু পাপাচারী বখাটে লােক রাতের আঁধার নেমে এলেই মদীনার অলি গলিতে বেরিয়ে পড়তো এবং মেয়েদের খোঁজ করতাে। মদীনা ছিলাে ঘন বসতিপূর্ণ। তাই রাত হলে মহিলারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে বেরুতো। আর পাপাচারী বখাটেরা এই সুযােগেরই অপেক্ষায় থাকতাে। তবে কোনাে মহিলাকে চাদর দ্বারা আপাদমস্তক আবৃত দেখলে তারা বলতাে যে, এত ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা। কাজেই তার ব্যাপারে সংযত থাকতাে। আর যখন দেখতাে কেউ চাদর দিয়ে শরীর না ঢেকেই বেরিয়েছে, তখন তারা বলতাে যে, ‘এতাে দাসী বাদী বা নিম্নস্তরের মহিলা।’ এই বলেই তার ওপর আক্রমণ চালাতাে। মােজাহেদ বলেছেন, জিলবাব বা চাদর পরিধানের আদেশ দেয়া হয়েছে এ জন্যে যেন বুঝা যায় তারা স্বাধীন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। ফলে কোনাে অপরাধপ্রবণ লােক তাদের কোনােভাবে উত্যক্ত করতে চেষ্টা করবে না। ‘আর আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়ালু’ এ কথার অর্থ হলাে, অজ্ঞতাবশত জাহেলী যুগে যেসব অন্যায় কাজ করা হয়েছে, তা আল্লাহ ক্ষমা করবেন। এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আরবের সামাজিক পরিবেশকে পবিত্র করার জন্যে যে অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিলাে, ফেতনা ফাসাদ ও নৈরাজ্য দূর করার জন্যে যে ক্রমাগত বিধি-নিষেধ জারী করা হচ্ছিলাে এবং যাবতীয় বিশৃংখলা ও দুর্নীতিকে সংকীর্ণতম গন্ডীতে সীমিত করার জন্যে যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানাে হচ্ছিলাে, এ সবকিছুর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলাে গােটা মুসলিম সমাজের ওপর ইসলামী নিয়ম বিধি ও ঐতিহ্যের নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আলােচনার শেষ পর্যায়ে মােনাফেক, মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ও বিকৃত রুচিসম্পন্ন সেইসব লােকের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে, যারা মুসলিম সমাজে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নানারকম গুজব রটাতাে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুমকি দেয়া হয়েছে যে, তারা যদি তাদের যাবতীয় অপতৎপরতা থেকে এবং মুসলিম নরনারীকে ও সমগ্র মুসলিম সমাজকে উৎপীড়ন ও উত্যক্ত করা থেকে বিরত না হয়, তা হলে ইহুদীদের মতাে তাদেরকেও মদীনা থেকে উচ্ছেদ করা হবে এবং তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, হত্যা করা হবে। কেননা ইতিপূর্বে রসূল(স.)-এর হাতে ইহুদীদেরকে এবং পূর্ববর্তীকালে অন্যান্য অপরাধী ও দুষ্কৃতকারীদেরকে সমাজ থেকে উৎখাত করা আল্লাহর স্থায়ী রীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# প্রায় এক বছর পরে সূরা নূরে যে সাধারণ হুকুম দেয়া হয় এটা তার ভূমিকা স্বরূপ। প্রাচীন যুগে আরবের লোকেরা নিসংকোচে একজন অন্যজনের ঘরে ঢুকে পড়তো। কেউ যদি কারো সাথে দেখা করতে চাইতো তাহলে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকার বা অনুমতি নিয়ে ভেতরে যাবার নিয়ম ছিল না। বরং ভেতরে গিয়ে গৃহকর্তা গৃহে আছে কি নেই স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কাছে জিজ্ঞেস করে তা জানতে চাইতো। এ জাহেলী পদ্ধতি বহু ক্ষতির কারণ হয়ে পড়েছিল। অনেক সময় বহু নৈতিক অপকর্মেরও সূচনা এখান থেকে হতো। তাই প্রথমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গৃহে এ নিয়ম জারী করা হয় যে, কোন নিকটতম বন্ধু বা দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজন হলেও বিনা অনুমতিতে তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে পারবে না। তারপর সূরা নূরে এ নিয়মটি সমস্ত মুসলমানের গৃহে জারী করার সাধারণ হুকুম দিয়ে দেয়া হয়।
# এ প্রসঙ্গে এটা দ্বিতীয় হুকুম। আরববাসীদের মধ্যে যেসব সভ্যতা বিবর্জিত আচরণের প্রচলন ছিল তার মধ্যে একটি এও ছিল যে, কোন বন্ধু বা পরিচিত লোকের গৃহে তারা পৌঁছে যেতো ঠিক খাবার সময় তাক করে। অথবা তার গৃহে এসে বসে থাকতো এমনকি খাবার সময় এসে যেতো। এহেন আচরণে গৃহকর্তা অধিকাংশ সময় বেকায়দায় পড়ে যেতো। মুখ ফুটে যদি বলে এখন আমার খাবার সময় মেহেরবানী করে চলে যান, তাহলে বড়ই অসভ্যতা ও রুঢ়তার প্রকাশ হয়। আর যদি খাওয়ায়, তাহলে হঠাৎ আগত কতজনকে খাওয়াবে। যখনই যতজন লোকই আসুক সবসময় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করার মতো সামর্থ্য সবাই রাখে না। আল্লাহ এ অভদ্র আচরণ করতে তাদেরকে নিষেধ করেন এবং হুকুম দেন, কোন ব্যক্তির গৃহে খাওয়ার জন্য তখনই যেতে হবে যখন গৃহকর্তা খাওয়ার দাওয়াত দেবে। এ হুকুম শুধুমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য নির্দিষ্ট ছিল না বরং সেই আদর্শগৃহে এ নিয়ম এজন্যই জারী করা হয়েছিল যেন তা মুসলমানদের সাধারণ সাংস্কৃতিক জীবনের নিয়মে ও বিধানে পরিণত হয়ে যায়।
# এটি আরো একটি অসভ্য আচরণ সংশোধনের ব্যবস্থা। কোন কোন লোক খাওয়ার দাওয়াতে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে এমনভাবে ধরণা দিয়ে বসে চুটিয়ে আলাপ জুড়ে দেয় যেন আর উঠবার নামটি নেই, মনে হয় এ আলাপ আর শেষ হবে না। গৃহকর্তা ও গৃহবাসীদের এতে কি অসুবিধা হচ্ছে তার কোন পরোয়াই তারা করে না। ভদ্রতা জ্ঞান বিবর্জিত লোকেরা তাদের এ আচরণের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও কষ্ট দিতে থাকতো এবং তিনি নিজের ভদ্র ও উদার স্বভাবের কারণে এসব বরদাশত করতেন। শেষে হযরত যয়নবের ওলিমার দিন এ কষ্টদায়ক আচরণ সীমা ছাড়িয়ে যায়। নবী করীমের ﷺ বিশেষ খাদেম হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেনঃ রাতের বেলা ছিল ওলিমার দাওয়াত। সাধারণ লোকেরা খাওয়া শেষ করে বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু দু’তিন জন লোক বসে কথাবার্তায় মশগুল হয়ে গিয়েছিলন। নবী ﷺ বিরক্ত হয়ে উঠলেন এবং পবিত্র স্ত্রীদের ওখান থেকে এক চক্কর দিয়ে এলেন। ফিরে এসে দেখলেন তারা যথারীতি বসেই আছেন। তিনি আবার উঠে গেলেন এবং হযরত আয়েশার কামরায় বসলেন। অনেকটা রাত অতিবাহিত হয়ে যাবার পর যখন তিনি জানলেন তারা চলে গেছেন তখন তিনি হযরত যয়নবের (রা.) কক্ষে গেলেন। এরপর এ বদ অভ্যাসগুলো সম্পর্কে লোকদেরকে সতর্ক করে দেয়া স্বয়ং আল্লাহর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়লো। হযরত আনাসের (রা.) রেওয়ায়াত অনুযায়ী এ আয়াত সে সময়ই নাযিল হয়। (মুসলিম, নাসাঈ ও ইবনে জারীর)
# এ আয়াতকেই হিজাব বা পর্দার আয়াত বলা হয়। বুখারীতে হযরত আনাস ইবনে মালেকের (রা.) উদ্ধৃত হয়েছে উমর (রা.) এ আয়াতটি নাযিল হবার পূর্বে নবী করীমের ﷺ কাছে নিবেদন করেছিলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর রসূল! আপনার এখানে ভালোমন্দ সবরকম লোক আসে। আহা, যদি আপনি আপনার পবিত্র স্ত্রীদেরকে পর্দা করার হুকুম দিতেন। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, একবার হযরত উমর (রা.) নবী করীমের ﷺ স্ত্রীদের বলেনঃ “যদি আপনাদের ব্যাপারে আমার কথা মেনে নেয়া হয় তাহলে আমার চোখ কখনোই আপনাদের দেখবে না।” কিন্তু রসূলুল্লাহ ﷺ যেহেতু আইন রচনার ক্ষেত্রে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না, তাই তিনি আল্লাহর ইশারার অপেক্ষায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এ হুকুম এসে গেলো যে, মাহরাম পুরুষরা ছাড়া (যেমন সামনের দিকে ৫৫ আয়াতে আসছে) অন্য কোন পুরুষ নবী করীমের ﷺ গৃহে প্রবেশ করবে না। আর সেখানে মহিলাদের কাছে যারই কিছু কাজের প্রয়োজন হবে তাকে পর্দার পেছনে থেকেই কথা বলতে হবে। এ হুকুমের পরে পবিত্র স্ত্রীদের গৃহে দরজার ওপর পর্দা লটকে দেয়া হয় এবং যেহেতু নবী করীমের ﷺ গৃহ সকল মুসলমানের জন্য আদর্শগৃহ ছিল তাই সকল মুসলমানের গৃহের দরজায়ও পর্দা ঝোলানো হয়। আয়াতের শেষ অংশ নিজেই এদিকে ইঙ্গিত করছে যে, যারাই পুরুষ ও নারীদের মন পাক পবিত্র রাখতে চায় তাদেরকে অবশ্যই এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
এখন যে ব্যক্তিকেই আল্লাহ দৃষ্টিশক্তি দান করেছেন সে নিজেই দেখতে পারে, যে কিতাবটি নারী পুরুষকে সামনা সামনি কথা বলতে বাঁধা দেয় এবং পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলার কারণ স্বরূপ একথা বলে যে, “তোমাদের ও তাদের অন্তরের পবিত্রতার জন্য এ পদ্ধতিটি বেশী উপযোগী”, তার মধ্যে কেমন করে এ অভিনব প্রাণপ্রবাহ সঞ্চার করা যেতে পারে, যার ফলে নারী পুরুষের মিশ্র সভা-সমিতি ও সহশিক্ষা এবং গণপ্রতিষ্ঠান ও অফিসসমূহে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা একেবারেই বৈধ হয়ে যাবে এবং এর ফলে মনের পবিত্রতা মোটেই প্রভাবিত হবে না? কেউ যদি কুরআনের বিধান অনুসরণ করতে না চায়, তাহলে সে তার বিরুদ্ধাচরণ করুক এবং পরিষ্কার বলে দিক আমি এর অনুসরণ করতে চাই না, এটিই তার জন্য অধিক যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি। কিন্তু কুরআনের সুস্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং তারপর আবার বেহায়ার মতো বুক ফুলিয়ে বলবে, এটি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা যা আমি উদ্ভাবন করে নিয়ে এসেছি-এটি বড়ই হীন আচরণ। কুরআন ও সুন্নাহর বাইরে কোন্ জায়গা থেকে তারা ইসলামের এ তথাকথিত শিক্ষা খুঁজে পেলেন?
# সে সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে যেসব অপবাদ ছড়ানো হচ্ছিল এবং কাফের ও মুনাফেকদের সাথে সাথে অনেক দুর্বল ঈমানদার মুসলমানও তাতে অংশ গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন, এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
# সূরার শুরুতে “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ হচ্ছেন মু’মিনগণের মা” বলে যে বক্তব্য উপস্থাপন হয়েছে এ হচ্ছে তার ব্যাখ্যা।
# নবী করীমের ﷺ বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তি যদি অন্তরেও কোন খারাপ ধারণা পোষণ করে অথবা তাঁর স্ত্রীদের সম্পর্কে কারো নিয়তের মধ্যে কোন অসততা প্রচ্ছন্ন থাকে, তাহলে আল্লাহর কাছে তা গোপন থাকবে না এবং এজন্য সে শাস্তি পাবে।
# ব্যাখ্যার জন্য সূরা নূরের তাফসীরের ৩৮ থেকে ৪২ পর্যন্ত টীকা দেখুন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসীর এ ব্যাখ্যাও উল্লেখযোগ্য যে, ভাই, ভাতিজা ও ভাগনাদের বিধানের মধ্যে এমন সব আত্মীয়রাও এসে যায় যারা একজন মহিলার জন্য হারাম-তারা রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় বা দুধ সম্পর্কিত যাই হোক না কেন। এ তালিকায় চাচা ও মামার উল্লেখ করা হয়নি। কারণ তারা নারীর জন্য পিতার সমান। অথবা তাদের উল্লেখ না করার কারণ হচ্ছে এই যে, ভাতিজা ও ভাগনার কথা এসে যাবার পর তাদের কথা বলার প্রয়োজন নেই। কেননা ভাতিজা ও ভাগনাকে পর্দা না করার পেছনে যে কারণ রয়েছে চাচা ও মামাকে পর্দা না করার কারণও তাই। (রুহুল মা’আনী)
# একথার অর্থ হচ্ছে, এ চূড়ান্ত হুকুম এসে যাবার পর ভবিষ্যতে এমন কোন ব্যক্তিকে বেপর্দা অবস্থায় গৃহে প্রবেশের অনুমতি দেয়া যাবে না যে ঐ ব্যতিক্রমী আত্মীয়দের গণ্ডীর বাইরে অবস্থান করে। দ্বিতীয় অর্থ এও হয় যে, স্ত্রীদের কখনো এমন নীতি অবলম্বন করা উচিত নয় যার ফলে স্বামীর উপস্থিতিতে তারা পর্দার নিয়ন্ত্রণ মেনে চলবে এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে গায়ের মাহরাম পুরুষদের সামনে পর্দা উঠিয়ে দেবে। তাদের এ কর্ম স্বামীর দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে না।
# আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীর প্রতি দরূদের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ নবীর প্রতি সীমাহীন করুণার অধিকারী। তিনি তাঁর প্রশংসা করেন। তাঁর কাজে বরকত দেন। তাঁর নাম বুলন্দ করেন। তাঁর প্রতি নিজের রহমতের বারি বর্ষণ করেন। ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি দরূদের অর্থ হচ্ছে, তাঁরা তাঁকে চরমভাবে ভালোবাসেন এবং তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আল্লাহ যেন তাঁকে সর্বাধিক উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তাঁর শরীয়াতকে প্রসার ও বিস্তৃতি দান করেন এবং তাঁকে একমাত্র মাহমুদ তথা সবোর্চ্চ প্রশংসিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেন। পূর্বাপর বিষয়বস্তুর প্রতি দৃষ্টি দিলে এ বর্ণনা পরম্পরায় একথা কেন বলা হয়েছ তা পরিষ্কার অনুভব করা যায়। তখন এমন একটি সময় ছিল যখন ইসলামের দুশমনরা এ সুস্পষ্ট জীবন ব্যবস্থার বিস্তার ও সম্প্রসারণের ফলে নিজেদের মনের আক্রোশ প্রকাশের জন্য নবী করীমের ﷺ বিরুদ্ধে একের পর এক অপবাদ দিয়ে চলছিল এবং তারা নিজেরা একথা মনে করছিল যে, এভাবে কাঁদা ছিটিয়ে তারা তাঁর নৈতিক প্রভাব নির্মূল করে দেবে। অথচ এ নৈতিক প্রভাবের ফলে ইসলাম ও মুসলমানরা দিনের পর দিন এগিয়ে চলছিল। এ অবস্থায় আলোচ্য আয়াত নাযিল করে আল্লাহ দুনিয়াকে একথা জানিয়ে দেন যে, কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকরা আমার নবীর দুর্নাম রটাবার এবং তাঁকে অপদস্ত করার যতই প্রচেষ্টা চালাক না কেন শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হবে। কারণ আমি তাঁর প্রতি মেহেরবান এবং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের আইন ও শৃংখলা ব্যবস্থা যেসব ফেরেশতার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে তারা সবাই তাঁর সহায়ক ও প্রশংসাকারী। আমি যেখানে তাঁর নাম বুলন্দ করছি এবং আমার ফেরেশতারা তার প্রশংসাবলীর আলোচনা করছে সেখানে তাঁর নিন্দাবাদ করে তারা কি লাভ করতে পারে? আমার রহমত ও বরকত তাঁর সহযোগী এবং আমার ফেরেশতারা দিনরাত দোয়া করছে, হে রব্বুল আলামীন! মুহাম্মাদের ﷺ মর্যাদা আরো বেশী উঁচু করে দাও এবং তাঁর দ্বীনকে আরো বেশী প্রসারিত ও বিকশিত করো। এ অবস্থায় তারা বাজে অস্ত্রের সাহায্যে তাঁর কি ক্ষতি করতে পারে?
# অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে, হে লোকেরা! মুহাম্মাদ রসূলুল্লাহর বদৌলতে তোমরা যারা সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছো তারা তাঁর মর্যাদা অনুধাবন করো এবং তাঁর মহা অনুগ্রহের হক আদায় করো। তোমরা মূর্খতার অন্ধকারে পথ ভুলে বিপথে চলছিলে, এ ব্যক্তি তোমাদের জ্ঞানের আলোক বর্তিকা দান করেছেন। তোমরা নৈতিক অধঃপতনের মধ্যে ডুবেছিলে, এ ব্যক্তি তোমাদের সেখান থেকে উঠিয়েছেন এবং তোমাদের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যার ফলে আজ মানুষ তোমাদেরকে ঈর্ষা করে। তোমরা বর্বর ও পাশবিক জীবন যাপন করছিলে, এ ব্যক্তি তোমাদের সর্বোত্তম মানবিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাজে সুসজ্জিত করেছেন। তিনি তোমাদের ওপর এসব অনুগ্রহ করেছেন বলেই দুনিয়ার কাফের ও মুশরিকরা এ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়ছে। নয়তো দেখো, তিনি কারো সাথে ব্যক্তিগতভাবে কোন দুর্ব্যবহার করেননি। তাই এখনি তোমাদের কৃতজ্ঞতার অনিবার্য দাবী হচ্ছে এই যে, তারা এ আপাদমস্তক কল্যাণ ব্রতী ব্যক্তিত্বের প্রতি যে পরিমাণ হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করে ঠিক একই পরিমাণ বরং তার চেয়ে বেশী ভালোবাসা তোমরা তাঁর প্রতি পোষণ করো। তারা তাঁকে যে পরিমাণ ঘৃণা করে ঠিক ততটাই বরং তার চেয়ে বেশীই তোমরা তাঁর প্রতি অনুরক্ত হবে। তারা তাঁর যতটা নিন্দা করে ঠিক ততটাই বরং তার চেয়ে বেশী তোমরা তাঁর প্রশংসা করো। তারা তাঁর যতটা অশুভাকাংখী হয় তোমরা তার ঠিক ততটাই বরং তার চেয়ে বেশী শুভাকাংখী হয়ে যাও এবং তাঁর পক্ষে সেই একই দোয়া করো যা আল্লাহর ফেরেশতারা দিনরাত তাঁর জন্য করে যাচ্ছে, হে দোজাহানের রব! তোমার নবী যেমন আমাদের প্রতি বিপুল অনুগ্রহ করেছেন তেমনি তুমিও তাঁর প্রতি অসীম ও অগণিত রহমত বর্ষণ করো, তাঁর মর্যাদা দুনিয়াতেও সবচেয়ে বেশী উন্নত করো এবং আখেরাতেও তাঁকে সকল নৈকট্য লাভকারীদের চাইতেও বেশী নৈকট্য দান করো।
এ আয়াতে মুসলমানদেরকে দু’টো জিনিসের হুকুম দেয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে, “সাল্লু আলাইহে অর্থাৎ তাঁর প্রতি দরূদ পড়ো। অন্যটি হচ্ছে, “ওয়া সাল্লিমূ তাসলীমা” অর্থাৎ তাঁর প্রতি সালাম ও প্রশান্তি পাঠাও।
“সালাত” শব্দটি যখন “আলা” অব্যয় সহকারে বলা হয় তখন এর তিনটি অর্থ হয়ঃ এক, কারো অনুরক্ত হয়ে পড়া। দুই, কারো প্রশংসা করা। তিন, কারো পক্ষে দোয়া করা। এ শব্দটি যখন আল্লাহর জন্য বলা হবে তখন একথা সুস্পষ্ট যে, তৃতীয় অর্থটির জন্য এটি বলা হবে না। কারণ আল্লাহর অন্য কারো কাছে দোয়া করার ব্যাপারটি একেবারেই অকল্পনীয়। তাই সেখানে অবশ্যই তা হবে শুধুমাত্র প্রথম দু’টি অর্থের জন্য। কিন্তু যখন এ শব্দ বান্দাদের তথা মানুষ ও ফেরেশতাদের জন্য বলা হবে তখন তা তিনটি অর্থেই বলা হবে। তার মধ্যে ভালোবাসার অর্থও থাকবে, প্রশংসার অর্থও থাকবে এবং দোয়া ও রহমতের অর্থও থাকবে। কাজেই মু’মিনদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে “সাল্লু আলাইহে”-এর হুকুম দেয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমরা তাঁর ভক্ত-অনুরক্ত হয়ে যাও তাঁর প্রশংসা করো এবং তাঁর জন্য দোয়া করো।
“সালাত” শব্দেরও দু’টি অর্থ হয়। এক সবরকমের আপদ-বিপদ ও অভাব অনটন মুক্ত থাকা। এর প্রতিশব্দ হিসেবে আমাদের এখানে সালামতি বা নিরাপত্তা শব্দের ব্যবহার আছে, দুই, শান্তি, সন্ধি ও অবিরোধিতা। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে “সাল্লিমূ তাসলিমা” বলার একটি অর্থ হচ্ছে, তোমরা তাঁর জন্য পূর্ণ নিরাপত্তার দোয়া করো। আর এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমরা পুরোপুরি মনে প্রাণে তাঁর সাথে সহযোগিতা করো, তাঁর বিরোধিতা করা থেকে দূরে থাকো এবং তাঁর যথার্থ আদেশ পালনকারীতে পরিণত হও।
এ হুকুমটি নাযিল হবার পর বহু সাহাবী রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, হে আল্লাহর রসূল! সালামের পদ্ধতি তো আপনি আমাদের বলে দিয়েছেন। (অর্থাৎ নামাযে “আসসালামু আলাইকা আইয়ূহান নাবীয্যু ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ” এবং দেখা সাক্ষাত হলে “আসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলুল্লাহ” বলা।) কিন্তু আপনার প্রতি সালাত পাঠাবার পদ্ধতিটা কি? এর জবাবে নবী করীম ﷺ বিভিন্ন লোককে বিভিন্ন সময় যেসব দরূদ শিখিয়েছেন তা আমি নিচে উদ্ধৃত করছিঃ কা’ব ইবনে ‘উজরাহ (রা.) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
এ দরূদটি সামান্য শাব্দিক বিভিন্নতা সহকারে হযরত কা’ব ইবনে উজ্ রাহ (রাঃ) থেকে বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে ইমাম আহমাদ, ইবনে আবী শাইবাহ, আবদুর রাজ্জাক, ইবনে আবী হাতেম ও ইবনে জারীরে উদ্ধৃত হয়েছে।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেঃ তাঁর থেকেও হালকা পার্থক্য সহকারে ওপরে বর্ণিত একই দরূদ উদ্ধৃত হয়েছে। (ইবনে জারীর) আবু হুমাইদ সায়েদী (রাঃ ) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ (মুআত্তা ইমাম মালেক, মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)
আবু মাসউদ বদরী (রাঃ) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ فَى الْعَالَمِينَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ (মালেক, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, আহমদ, ইবনে জারীর, ইবনে হাব্বান ও হাকেম)
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকেঃ اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُولِكَ ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ- (আহমাদ, বুখারী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)
বুরাইদাতাল খুযাঈ থেকেঃ
اللَّهُمَّ اجْعَلْ صَلَوَاتِكَ وَرَحْمَتَكَ وَبَرَكَاتِكَ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا جَعَلْتَهَا عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ- (আহমাদ, আবদ ইবনে হুমাইদ ও ইবনে মারদুইয়া)
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ ) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ آلِ إِبْرَاهِيمَ فِى الْعَالَمِينَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ- (নাসাঈ)
হযরত তালহা (রাঃ) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ (ইবনে জারীর)
এ দরূদগুলো শব্দের পার্থক্য সত্ত্বেও অর্থ সবগুলোর একই। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এ বিষয়গুলো ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে।
প্রথমত, এসবগুলোতে নবী করীম ﷺ মুসলমানদেরকে বলেছেন, আমার ওপর দরূদ পাঠ করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, তোমরা আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করো, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের ﷺ ওপর দরূদ পাঠাও। অজ্ঞ লোকেরা, যাদের অর্থজ্ঞান নেই, তারা সঙ্গে সঙ্গেই আপত্তি করে বসে যে, এতো বড়ই অদ্ভূত ব্যাপার যে, আল্লাহ তো আমাদের বলছেন তোমরা আমার নবীর ওপর দরূদ পাঠ করো কিন্তু অপর দিকে আমরা আল্লাহকে বলছি তুমি দরূদ পাঠাও। অথচ এভাবে নবী ﷺ লোকদেরকে একথা বলেছেন যে, তোমরা আমার প্রতি “সালাতের” হক আদায় করতে চাইলেও করতে পারো না, তাই আল্লাহরই কাছে দোয়া চাও যেন তিনি আমার প্রতি দরূদ পাঠান। একথা বলা নিষ্প্রয়োজন, আমরা নবী করীমের ﷺ মর্যাদা বুলন্দ করতে পারি না। আল্লাহই বুলন্দ করতে পারেন। আমরা নবী করীমের ﷺ অনুগ্রহের প্রতিদান দিতে পারি না। আল্লাহই তার প্রতিদান দিতে পারেন। আমরা নবী করীমের ﷺ কথা আলোচনাকে উচ্চমাপে পৌঁছাবার এবং তাঁর দ্বীনকে সম্প্রসারিত করার জন্য যতই প্রচেষ্টা চালাই না কেন আল্লাহর মেহেরবানী এবং তাঁর সুযোগ ও সহায়তা দান ছাড়া তাতে কোন প্রকার সাফল্য অর্জন করতে পারি না। এমন কি নবী করীমের ﷺ প্রতি ভক্তি ভালোবাসাও আমাদের অন্তরে আল্লাহরই সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অন্যথায় শয়তান নাজানি কত রকম প্ররোচনা দিয়ে আমাদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তুলতে পারে। اعاذنا الله من ذلك- —আল্লাহ আমাদের তা থেকে বাঁচান। কাজেই নবী করীমের ﷺ ওপর দরূদের হক আদায় করার জন্য আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতি সালাত বা দরূদের দোয়া করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। যে ব্যক্তি “আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদিন” বলে সে যেন আল্লাহ সমীপে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করতে গিয়ে বলে, হে আল্লাহ! তোমার নবীর ওপর সালাত বা দরূদ পাঠানোর যে কর্তব্য আমার ওপর চাপানো আছে তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করার সামর্থ্য আমার নেই, আমার পক্ষ থেকে তুমিই তা সম্পন্ন করে দাও এবং তা করার জন্য আমাকে যেভাবে কাজে নিয়োগ করতে হয় তা তুমি নিয়োগ করো।
দ্বিতীয়ত, নবী করীমের ﷺ ভদ্রতা ও মহানুভবতার ফলে তিনি কেবল নিজেকেই এ দোয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে নেননি। বরং নিজের সাথে তিনি নিজের পরিজন স্ত্রী ও পরিবারকেও শামিল করে নিয়েছেন। স্ত্রী ও পরিবার অর্থ সুস্পষ্ট আর পরিজন শব্দটি নিছক নবী করীমের ﷺ পরিবারের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং এর মধ্যে এমনসব লোকও এসে যায় যারা তাঁর অনুসারী এবং তাঁর পথে চলেন। পরিজন অর্থে মূলে “আল” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষার দৃষ্টিতে “আল” ও “আহল” –এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তির “আল” হচ্ছে এমন সব লোক যারা হয় তার সাথী, সাহায্যকারী ও অনুসারী, তারা তার আত্মীয় বা অনাত্মীয় হোক বা না হোক অবশ্যই তার আত্মীয়। কুরআন মজীদের ১৪টি স্থানে “আলে ফেরাউন” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে কোন জায়গায়ও “আহল” মানে ফেরাউনের পরিবারের লোকেরা নয়। বরং এমন সমস্ত লোক যারা হযরত মূসার মোকাবিলায় ফেরাউনের সমর্থক ও সহযোগী ছিল। (দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখুন সূরা বাকারার ৪৯-৫০, আলে ইমরানের ১১, আল আ’রাফের ১৩০ ও আল মু’মিনূনের ৪৬ আয়াতসমুহ) কাজেই এমন সমস্ত লোকই “আলে” মুহাম্মাদ ﷺ এর বহির্ভূত হয়ে যায় যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের অনুসারী নয়। চাই, তারা নবীর পরিবারের লোকই হোক না কেন। পক্ষান্তরে এমন সমস্ত লোক ও এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যারা নবী করীমের ﷺ পদাংক অনুসরণ করে চলে, চাই তারা নবী করীমের ﷺ কোন দূরবর্তী রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় নাই হোক। তবে নবী পরিবারের এমন প্রত্যেকটি লোক সর্বতোভাবেই “আলে” মুহাম্মাদের ﷺ অন্তর্ভুক্ত হবে যারা তাঁর সাথে রক্ত সম্পর্কও রাখে আবার তাঁর অনুসারীও।
তৃতীয়, তিনি যেসব দরূদ শিখিয়েছেন তার প্রত্যেকটিতেই অবশ্যই একথা রয়েছে যে, তাঁর প্রতি এমন অনুগ্রহ করা হোক যা ইবরাহীম ও ইবরাহীমের পরিজনদের ওপর করা হয়েছিল। এ বিষয়টি বুঝতে লোকদের বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আলেমগণ এর বিভিন্ন জটিল ব্যাখ্যা (তাবীল) করেছেন। কিন্তু কোন একটি ব্যাখ্যাও ঠিকমতো গ্রহণীয় নয়। আমার মতে এর সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, (অবশ্য আল্লাহই সঠিক জানেন) আল্লাহ হযরত ইবরাহীমের প্রতি একটি বিশেষ করুণা করেন। আজ পর্যন্ত কারো প্রতি এ ধরনের করুণা প্রদর্শন করেননি। আর তা হচ্ছে এই যে, যারা নবুওয়াত, অহী ও কিতাবকে হিদায়াতের উৎস বলে মেনে নেয় তারা সবাই হযরত ইবরাহীমের (আ) নেতৃত্বের প্রশ্নে একমত। এ ব্যাপারে মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদির মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে এই যে, যেভাবে হযরত ইবরাহীমকে মহান আল্লাহ সমস্ত নবীর অনুসারীদের নেতায় পরিণত করেছেন। অনুরূপভাবে আমাকেও পরিণত করুন। এমন কোন ব্যক্তি যে নবুওয়াত মেনে নিয়েছে সে যেন আমার নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনা থেকে বঞ্চিত না হয়।
নবী করীমের ﷺ প্রতি দরূদ পড়া ইসলামের সুন্নাত। তাঁর নাম উচ্চারিত হলে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব। বিশেষ করে নামাযে দরূদ পড়া সুন্নাত। এ বিষয়ে সমগ্র আলেম সমাজ একমত। সমগ্র জীবনে নবী (সা.) এর প্রতি একবার দরূদ পড়া ফরয, এ ব্যাপারে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারণ আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু এরপর দরূদের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মত দেখা দিয়েছে।
ইমাম শায়েঈ (র.) বলেন, নামাযে একজন মুসল্লী যখন শেষ বার তাশাহ্হুদ পড়ে তখন সেখানে সালাতুন আলান নবী (صلوة على النبى) পড়া ফরয। কোন ব্যক্তি এভাবে না পড়লে তার নামায হবে না। সাহাবীগণের মধ্য থেকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আবু মাসউদ আনসারী (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ও হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), তাবেঈদের মধ্য থেকে শা’বী, ইমাম মুহাম্মাদ বাকের, মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরযী ও মুকাতিল ইবনে হাউয়ান এবং ফকীহগণের মধ্য থেকে ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহও এ মতের প্রবক্তা ছিলেন। শেষের দিকে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালও মত অবলম্বন করেন।
ইমাম আবু হানীফা (র), ইমাম মালেক (র) ও অধিকাংশ উলামা এ মত পোষণ করেন যে, দরূদ সারা জীবনে শুধুমাত্র একবার পড়া ফরয। এটি কালেমায়ে শাহাদাতের মতো। যে ব্যক্তি একবার আল্লাহকে ইলাহ বলে মেনে নিয়েছে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের স্বীকৃতি দিয়েছে সে ফরয আদায় করে দিয়েছে। অনুরূপভাবে যে একবার দরূদ পড়ে নিয়েছে সে নবীর ওপর সালাত পাঠ করার ফরয আদায়ের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে গেছে। এরপর তার ওপর আর কালেমা পড়া ফরয নয় এবং দরূদ পড়াও ফরয নয়।
একটি দল নামাযে দরূদ পড়াকে সকল অবস্থায় ওয়াজিব গণ্য করেন। কিন্তু তারা তাশাহহুদের সাথে তাকে শৃংখলিত করেন না। অন্য একটি দলের মতে প্রত্যেক দোয়ায় দরূদ পড়া ওয়াজিব। আরো কিছু লোক নবী করীমের ﷺ নাম এলে দরূদ পড়া ওয়াজিব বলে অভিমত পোষণ করেন। অন্য একটি দলের মতে এক মজলিসে নবী করীমের ﷺ নাম যতবারই আসুক না কেন দরূদ পড়া কেবলমাত্র একবারই ওয়াজিব।
কেবলমাত্র ওয়াজিব হবার ব্যাপারে এ মতবিরোধ। তবে দরূদের ফযীলত, তা পাঠ করলে প্রতিদান ও সওয়াব পাওয়া এবং তার একটি অনেক বড় সৎকাজ হবার ব্যাপারে তো সমস্ত মুসলিম উম্মাত একমত। যে ব্যক্তি ঈমানের সামান্যতম স্পর্শও লাভ করেছে তার এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। এমন প্রত্যেকটি মুসলমানের অন্তর থেকেই তো স্বাভাবিকভাবে দরূদ বের হবে যার মধ্যে এ অনুভূতি থাকবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পরে আমাদের প্রতি সবচেয়ে বড় অনুগ্রহকারী। মানুষের দিলে ঈমান ও ইসলামের মর্যাদা যত বেশী হবে তত বেশী মর্যাদা হবে তার দিলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগ্রহেরও। আর মানুষ যত বেশী এ অনুগ্রহের কদর করতে শিখবে তত বেশীই সে নবী করীমের ﷺ ওপর দরূদ পাঠ করবে। কাজেই বেশী বেশী দরূদ পড়া হচ্ছে একটি মাপকাঠি। এটি পরিমাপ করে জানিয়ে দেয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা গভীর এবং ঈমানের নিয়ামতের কতটা কদর তার অন্তরে আছে। এ কারণেই নবী ﷺ বলেছেনঃ
مَنْ صَلَّى عَلَىَّ صَلاَةً لَمْ تَزَلِ الْمَلاَئِكَةُ تُصَلِّى عَلَيْهِ مَا صَلَّى عَلَىَّ
“যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে ফেরেশতারা তার প্রতি দরূদ পাঠ করে যতক্ষণ সে দরূদ পাঠ করতে থাকে।” (আহমাদ ও ইবনে মাজাহ)
مَنْ صَلَّى عَلَىَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرًا
“যে আমার ওপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ তার ওপর দশবার দরূদ পড়েন।” (মুসলিম) أَوْلَى النَّاسِ بِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَىَّ صَلاَةً(ترمذى)
“কিয়ামতের দিন আমার সাথে থাকার সবচেয়ে বেশী হকদার হবে সেই ব্যক্তি যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশী দরূদ পড়বে।” (তিরযিমী) الْبَخِيلُ الَّذِى مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَىَّ(ترمذى)
“আমার কথা যে ব্যক্তির সামনে আলোচনা করা হয় এবং সে আমার ওপর দরূদ পাঠ করে না সে কৃপণ।” (তিরযিমী)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ছাড়া অন্যের জন্য اللهم صل على فلان অথবা صلى الله عليه وسلم কিংবা এ ধরনের অন্য শব্দ সহকারে ‘সালাত’ পেশ করা জায়েয কিনা, এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। একটি দল, কাযী ঈয়াযের নাম এ দলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, একে সাধারণভাবে জায়েয মনে করে। এদের যুক্তি হচ্ছে, কুরআনে আল্লাহ নিজেই অ-নবীদের ওপর একাধিক জায়গায় সালাতের কথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। যেমন
أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ (البقرة-157) خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ (التوبة-103) هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ (الاحزاب-43)
এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাও একাধিকবার অ-নবীদের জন্য সালাত শব্দ সহকারে দোয়া করেন। যেমন একজন সাহাবীর জন্য তিনি দোয়া করেন الهم صل على ال ابى اوفى (যে আল্লাহ! আবু আওফার পরিজনদের ওপর সালাত পাঠাও) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর (রা.) স্ত্রীর আবেদনের জবাবে বলেন, صلى الله عليك وعلى زوجك (আল্লাহ তোমার ও তোমার স্বামীর ওপর সালাত পাঠান)। যারা যাকাত নিয়ে আসতেন তাদের পক্ষে তিনি বলতেন, الهم صل عليهم (হে আল্লাহ! ওদের ওপর সালাত পাঠাও)। হযরত সা’দ ইবনে উবাদার পক্ষে তিনি বলেন, الهم اجعل صلوتك ورحمتك على ال سعدبن عباده (হে আল্লাহ! সা’দ ইবনে উবাদার (রা.) পরিজনদের ওপর তোমার সালাত ও রহমত পাঠাও)। আবার মু’মিনের রূহ সম্পর্কে নবী করীম ﷺ খবর দিয়েছেন যে, ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করেঃ صلى الله عليك وعلى جسدك কিন্তু মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশের মতে এমনটি করা আল্লাহ ও তাঁর রসূলে জন্য তো সঠিক ছিল কিন্তু আমাদের জন্য সঠিক নয়। তারা বলেন, সালাত ও সালামকে মুসলমানরা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এটি বর্তমানে তাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তাই নবীদের ছাড়া অন্যদের জন্য এগুলো ব্যবহার না করা উচিত। এজন্যই হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয একবার নিজের একজন শাসন কর্তাকে লিখেছিলেন, “আমি শুনেছি কিছু বক্তা এ নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করেছেন যে, ‘তারা সালাতু আলান নাবী’ –এর মতো নিজেদের পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্য কারীদের জন্যও “সালাত” শব্দ ব্যবহার করছেন। আমার এ পত্র পৌঁছে যাবার পরপরই তাদেরকে এ কাজ থেকে নিরস্ত করো এবং সালাতকে একমাত্র নবীদের জন্য নির্দিষ্ট করে অন্য মুসলমানদের জন্য দোয়া করেই ক্ষান্ত হবার নিদের্শ দাও।” (রুহুল মা’আনী) অধিকাংশ আলেম এ মতও পোষণ করেন যে, নবী করীম ﷺ ছাড়া অন্য কোন নবীর জন্যও “সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” ব্যবহার করা সঠিক নয়।
# আল্লাহকে কষ্ট দেবার অর্থ হয় দু’টি জিনিস। এক, তাঁর নাফরমানি করা। তাঁর মোকাবিলায় কুফরী, শিরক ও নাস্তিক্যবাদের পথ অবলম্বন করা। তিনি যা হারাম করেছেন তাকে হালাল করা। দুই, তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়া কারণ রসূলের আনুগত্য যেমন আল্লাহর আনুগত্য ঠিক তেমনি রসূলের নিন্দাবাদ আল্লাহর নিন্দাবাদের শামিল। রসূলের বিরোধিতা আল্লাহর বিরোধিতার সমার্থক। রসূলের নাফরমানি আল্লাহরই নাফরমানি।
# এ আয়াতটি অপবাদের সংজ্ঞা নিরূপণ করে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যে দোষ নেই অথবা যে অপরাধ মানুষ করেনি তা তার ওপর আরোপ করা। নবী ﷺ ও এটি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। আবু দাউদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়, গীবত কি? জবাবে বলেনঃ ذكرك اخاك بما يكره “তোমার নিজের ভাইয়ের আলোচনা এমনভাবে কর যা সে অপছন্দ করে।” জিজ্ঞেস করা হয়, যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সেই দোষ সত্যিই থেকে থাকে? জবাব দেনঃ
ان كان فيه ما تقول فقد اغتبته وان لم يكن فيه ماتقوم فقد بهته
“তুমি যে দোষের কথা বলছো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলে তুমি তার গীবত করলে আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তাহলে তার ওপর অপবাদ দিলে।” এ কাজটি কেবলমাত্র একটি নৈতিক গোনাহই নয়, আখেরাতে যার শাস্তি পাওয়া যাবে বরং এ আয়াতের দাবী হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের আইনেও মিথ্যা অপবাদ দান করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করতে হবে।
# মূল শব্দগুলো হচ্ছে, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ আরবী ভাষায় ‘জিলবাব’ বলা হয় বড় চাদরকে। আর ‘ইদন’ (ادناء) শব্দের আসল মানে হচ্ছে নিকটবর্তী করা ও ঢেকে নেয়া। কিন্তু যখন তার সাথে ‘আলা’ অব্যয় (Preposition) বসে তখন তার মধ্যে ইরখা (ارخاء) অর্থাৎ ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়ার অর্থ সৃষ্টি হয়। বর্তমান যুগের কোন কোন অনুবাদক ও তাফসীরকার পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে এ শব্দের অনুবাদ করেন শুধুমাত্র “জড়িয়ে নেয়া” যাতে চেহারা কোনভাবে ঢেকে রাখার হুকুমের বাইরে থেকে যায়। কিন্তু যা বর্ণনা করছেন আল্লাহর উদ্দেশ্য যদি তাই হতো, তাহলে তিনি يدنين اليهن বলতেন। যে ব্যক্তিই আরবী ভাষা জানেন তিনি কখনো একথা মেনে নিতে পারেন না যে, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ মানে কেবলমাত্র জড়িয়ে নেয়া হতে পারে। তাছাড়া مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ শব্দ দু’টি এ অর্থ গ্রহণ করার পথে আরো বেশী বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। একথা সুস্পষ্ট যে, এখানে মিন (من) শব্দটি ‘কিছু’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ চাদরের এক অংশ। আর এটাও সুস্পষ্ট যে, জড়িয়ে নিতে হলে পুরো চাদর জড়াতে হবে, নিছক তার একটা অংশ নয়। তাই আয়াতের পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, নারীরা যেন নিজেদের চাদর ভালোভাবে জড়িয়ে ঢেকে নিয়ে তার একটি অংশ বা একটি পাল্লা নিজেদের ওপর লটকিয়ে দেয়, সাধারণভাবে যাকে বলা হয় ঘোমটা।
নবুওয়াত যুগের নিকটবর্তী কালের প্রধান মুফাসসিরগণ এর এ অর্থই বর্ণনা করেন। ইবনে জারীর ও ইবনুল মুনযিরের বর্ণনা মতে মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন (রা.) হযরত উবাইদাতুস সালমানীর কাছে এ আয়াতটির অর্থ জিজ্ঞেস করেন। (এই হযরত উবাইদাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মুসলমান হন কিন্তু তাঁর খিদমতে হাযির হতে পারেননি। হযরত উমরের (রা.) আমলে তিনি মদীনা আসেন এবং সেখানেই থেকে যান। তাঁকে ফিকহ ও বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে কাযী শুরাইহ-এর সমকক্ষ মনে করা হতো।) তিনি জবাবে কিছু বলার পরিবর্তে নিজের চাদর তুলে নেন এবং তা দিয়ে এমনভাবে মাথা ও শরীর ঢেকে নেন যে তার ফলে পুরো মাথা ও কপাল এবং পুরো চেহারা ঢাকা পড়ে যায়, কেবলমাত্র একটি চোখ খোলা থাকে। ইবনে আব্বাসও প্রায় এই একই ব্যাখ্যা করেন। তাঁর যেসব উক্তি ইবনে জারীর, ইবনে আবি হাতেম ও ইবনে মারদুইয়া উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে তাঁর যে বক্তব্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, “আল্লাহ মহিলাদেরকে হুকুম দিয়েছেন যে, যখন তারা কোন কাজে ঘরের বাইরে বের হবে তখন নিজেদের চাদরের পাল্লা ওপর দিয়ে লটকে দিয়ে যেন নিজেদের মুখ ঢেকে নেয় এবং শুধুমাত্র চোখ খোলা রাখে।” কাতাদাহ ও সুদ্দীও এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন। সাহাবা ও তাবে’ঈদের যুগের পর ইসলামের ইতিহাসে যত বড় বড় মুফাসসির অতিক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা সবাই একযোগে এ আয়াতের এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে জারীর তাবারী বলেনঃ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ অর্থাৎ ভদ্র ঘরের মেয়েরা যেন নিজেদের পোশাক আশাকে বাঁদীদের মতো সেজে ঘর থেকে বের না হয়। তাদের চেহারা ও কেশদাম যেন খোলা না থাকে। বরং তাদের নিজেদের ওপর চাদরের একটি অংশ লটকে দেয়া উচিত। ফলে কোন ফাসেক তাদেরকে উত্যক্ত করার দুঃসাহস করবে না। (জামেউল বায়ান ২২ খন্ড, ৩৩ পৃষ্ঠা)।
আল্লামা আবু বকর জাসসাস বলেন, “এ আয়াতটি প্রমাণ করে, যবুতী মেয়েদের চেহারা অপরিচিত পুরুষদের থেকে লুকিয়ে রাখার হুকুম দেয়া হয়েছে। এই সাথে ঘর থেকে বের হবার সময় তাদের সতর ও পবিত্রতা সম্পন্না হবার কথা প্রকাশ করা উচিত। এর ফলে সন্দেহযুক্ত চরিত্র ও কর্মের অধিকারী লোকেরা তাদেরকে দেখে কোন প্রকার লোভ ও লালসার শিকার হবে না।” (আহকামুল কুরআন, ৩ খন্ড, ৪৫৮ পৃষ্ঠা) আল্লামা যামাখশারী বলেন, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ অর্থাৎ তারা যেন নিজেদের চাদরের একটি অংশ লটকে নেয় এবং তার সাহায্যে নিজেদের চেহারা ও প্রান্তভাগগুলো ভালোভাবে ঢেকে নেয়।” (আল কাশশাফ, ২ খন্ড, ২২ পৃষ্ঠা) আল্লামা নিযামুদ্দীন নিশাপুরী বলেন, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ অর্থাৎ নিজেদের ওপর চাদরের একটি অংশ লটকে দেয়। এভাবে মেয়েদেরকে মাথা ও চেহারা ঢাকার হুকুম দেয়া হয়েছে। (গারায়েবুল কুরআন ২২, খন্ড ৩২ পৃষ্ঠা) ইমাম রাযী বলেনঃ “এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা যেন জানতে পারে এরা দুশ্চরিত্রা মেয়ে নয়। কারণ যে মেয়েটি নিজের চেহারা ঢাকবে, অথচ চেহারা সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কাছে কেউ আশা করতে পারে না যে, সে নিজের ‘সতর’ অন্যের সামনে খুলতে রাজী হবে। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে, এ মেয়েটি পর্দানশীল, একে যিনার কাজে লিপ্ত করার আশা করা যেতে পারে না।” (তাফসীরে কবীর, ২ খন্ড, ৫৯১ পৃষ্ঠা)
এ আয়াত থেকে পরোক্ষভাবে আর একটি বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ এখান থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কয়েকটি কন্যা থাকার কথা প্রমাণিত হয়। কারণ, আল্লাহ বলছেন, “হে নবী! তোমার স্ত্রীদের ও কন্যাদেরকে বলো।” এ শব্দাবলী এমনসব লোকদের উক্তি চূড়ান্তভাবে খন্ডন করে যারা আল্লাহর ভয়শূন্য হয়ে নিসংকোচে এ দাবী করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেবলমাত্র একটি কন্যা ছিল এবং তিনি ছিলেন, হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। বাদবাকি অন্য কন্যারা তাঁর ঔরসজাত ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন তাঁর স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত এবং তাঁর কাছে প্রতিপালিত। এ লোকেরা বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে একথাও চিন্তা করেন না যে, নবী সন্তানদেরকে তাঁর ঔরসজাত হবার ব্যাপারটি অস্বীকার করে তারা কতবড় অপরাধ করছেন এবং আখেরাতে এজন্য তাদেরকে কেমন কঠিন জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। সমস্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস এ ব্যাপারে ঐকমত্য ব্যক্ত করেছে যে, হযরত খাদীজার (রা.) গর্ভে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেবলমাত্র একটি সন্তান হযরত ফাতেমা (রা.) জন্ম গ্রহণ করেননি বরং আরো তিন কন্যাও জন্মলাভ করে। নবী করীমের ﷺ সবচেয়ে প্রাচীন সীরাত লেখক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক হযরত খাদীজার সাথে নবী করীমের ﷺ বিয়ের ঘটনা উল্লেখ করার পর বলেনঃ “ইবরাহীম ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত ছেলে মেয়ে তাঁরই গর্ভে জন্ম নেয়। তাদের নাম হচ্ছেঃ কামেস, তাহের ও তাইয়েব এবং যয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ খন্ড, ২০২ পৃষ্ঠা) প্রখ্যাত বংশতালিকা বিশেষজ্ঞ হিশাম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনুস সায়েব কালবির বর্ণনা হচ্ছেঃ “নবুওয়াত লাভের পূর্বে মক্কায় জন্ম গ্রহণকারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম সন্তান হলো কাসেম। তারপর জন্ম লাভ করে যয়নব, তারপর রুকাইয়া, তারপর উম্মে কুলসুম।” (তাবকাতে ইবনে সা’দ, ১খন্ড, ১৩৩ পৃষ্ঠা) ইবনে হাযম জাওয়ামেউস সিয়ারে লিখেছেন, হযরত খাদীজার (রা.) গর্ভে নবী করীমের ﷺ চারটি কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন হযরত যয়নব (রা.), তাঁর ছোট ছিলেন হযরত রুকাইয়া (রা.), তাঁর ছোট ছিলেন হযরত ফাতেমা (রা.) এবং তাঁর ছোট ছিলেন উম্মে কুলসুম (রা.) (পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯) তাবারী, ইবনে সা’দ আল মুহাব্বার গ্রন্থ প্রণেতা আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে হাবীব এবং আল ইসতি’আব গ্রন্থ প্রণেতা ইবনে আবদুল বার নির্ভরযোগ্য বরাতের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে হযরত খাদীজার (রা.) আরো দু’জন স্বামী অতিক্রান্ত হয়েছিল। একজন ছিলেন আবু হালাহ তামিমী, তাঁর ঔরসে জন্ম নেয় হিন্দ ইবনে আবু হালাহ। দ্বিতীয় জন ছিলেন আতীক ইবনে আয়েদ মাখযূমী। তাঁর ঔরসে হিন্দ নামে এক মেয়ের জন্ম হয়। তারপর তাঁর বিয়ে হয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে। সকল বংশ তালিকা বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একমত যে তাঁর ঔরসে হযরত খাদীজার (রা.) গর্ভে ওপরে উল্লেখিত চার কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। (দেখুন তাবারী, ২ খন্ড, ৪১১ পৃষ্ঠা তাবকাত ইবনে সা’দ, ৮ খন্ড, ১৪-১৬ পৃষ্ঠা, কিতাবুল মুহাব্বার, ৭৮, ৭৯ ও ৪৫২ পৃষ্ঠা এবং আল ইসতি’আব, ২খন্ড, ৭১৮ পৃষ্ঠা।) এ সমস্ত বর্ণনা নবী করীমের ﷺ একটি নয় বরং কয়েকটি মেয়ে ছিল, কুরআন মজীদের এ বর্ণনাকে অকাট্য প্রমাণ করে।
# “চিনে নেয়া যায়” এর অর্থ হচ্ছে, তাদেরকে এ ধরনের অনাড়ম্বর লজ্জা নিবারণকারী পোশাকে সজ্জিত দেখে প্রত্যেক প্রত্যক্ষকারী জানবে তারা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের পূত-পবিত্র মেয়ে, এমন ভবঘুরে অসতী ও পেশাদার মেয়ে নয়, কোন অসদাচারী মানুষ যার কাছে নিজের কামনা পূর্ণ করার আশা করতে পারে। “না কষ্ট দেয়া হয়” এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তাদেরকে যেন উত্যক্ত ও জ্বালাতন না করা হয়।
এখানে কিছুক্ষণ থেমে একবার একথাটি অনুবাধন করার চেষ্টা করুন যে, কুরআনের এ হুকুম এবং এ হুকুমের যে উদ্দেশ্য আল্লাহ নিজেই বর্ণনা করেছেন তা ইসলামী সমাজ বিধানের কোন্ ধরনের প্রাণ শত্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ইতিপূর্বে সূরা নূরের ৩১ আয়াতে এ নির্দেশ আলোচিত হয়েছে যে, মহিলারা তাদের সাজসজ্জা অমুক অমুক ধরনের পুরুষ ও নারীদের ছাড়া আর কারো সামনে প্রকাশ করবে না। “আর মাটির ওপর পা দাপিয়ে চলবে না, যাতে যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে লোকেরা যেন তা জেনে না ফেলে।” এ হুকুমের সাথে যদি সূরা আহযাবের এ আয়াতটি মিলিয়ে পড়া হয় তাহলে পরিষ্কার জানা যায় যে, এখানে চাদর দিয়ে ঢাকার যে হুকুম এসেছে অপরিচিতদের থেকে সৌন্দর্য লুকানোই হচ্ছে তার উদ্দেশ্য। আর একথা সুস্পষ্ট যে, এ উদ্দেশ্য তখনই পূর্ণ হতে পারে যখন চাদরটি হবে সাদামাটা। নয়তো একটি উন্নত নকশাদার ও দৃষ্টিনন্দন কাপড় জড়িয়ে নিলে তো উল্টো এ উদ্দেশ্য আরো খতম হয়ে যাবে। তাছাড়া আল্লাহ কেবল চাদর জড়িয়ে সৌন্দর্য ঢেকে রাখার হুকুম দিচ্ছেন না বরং একথাও বলছেন যে, মহিলারা যেন চাদরের একটি অংশ নিজেদের ওপর লটকে দেয়। কোন বিচক্ষণ বিবেকবান ব্যক্তি এ উক্তিটির এছাড়া দ্বিতীয় কোন অর্থ করতে পারেন না যে, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ঘোমটা দেয়া যাতে শরীর ও পোশাকের সৌন্দর্য ঢাকার সাথে সাথে চেহারাও ঢাকা পড়বে। তারপর আল্লাহ নিজেই এ হুকুমটির ‘ইল্লাত’ (কার্যকারণ) এ বর্ণনা করেছেন যে, এটি এমন একটি সর্বাধিক উপযোগী পদ্ধতি যা থেকে মুসলমান মহিলাদেরকে চিনে নেয়া যাবে এবং তারা উত্যক্ত হবার হাত থেকেও বেঁচে যাবে। এ থেকে আপনা-আপনিই একথা প্রকাশ হয়ে যায় যে, এ নিদের্শ এমন সব মহিলাকে দেয়া হচ্ছে যারা পুরুষদের হাতে উত্যক্ত হবার এবং তাদের দৃষ্টিতে পড়ার ও তাদের কামনা-লালসার বস্তুতে পরিণত হবার ফলে আনন্দ অনুভব করার পরিবর্তে একে নিজেদের জন্য কষ্টদায়ক লাঞ্ছনাকর মনে করে, যারা সমাজে নিজেদেরকে বে-আবরু মক্ষিরাণী ধরনের মহিলাদের মধ্যে গণ্য করাতে চায় না। বরং সতী-সাধ্বী গৃহ প্রদীপ হিসেবে পরিচিত হতে চায়। এ ধরনের শরীফ ও পূত চরিত্রের অধিকারিনী সৎকর্মশীলা মহিলাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, যদি সত্যিই তোমরা এভাবে নিজেদেরকে পরিচিত করাতে চাও এবং পুরুষদের যৌন লালসার দৃষ্টি সত্যিই তোমাদের জন্য আনন্দাদায়ক না হয়ে কষ্টকর হয়ে থাকে, তাহলে এজন্য তোমরা খুব ভালোভাবে সাজসজ্জা করে বাসর রাতের কনে সেজে ঘর থেকে বের হয়ো না এবং দর্শকদের লালসার দৃষ্টির সামনে নিজেদের সৌন্দর্যকে উজ্জল করে তুলে ধরো না। কেননা এটা এর উপযোগী পদ্ধতি নয়। বরং এজন্য সর্বাধিক উপযোগী পদ্ধতি এই হতে পারে যে, তোমরা একটি সাদামাটা চাদরে নিজেদের সমস্ত সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা ঢেকে বের হবে, চেহারা ঘোমটার আড়ালে রাখবে এবং এমনভাবে চলবে যাতে অলংকারের রিনিঝিনি আওয়াজ লোকদেরকে তোমাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে না। বাইরে বের হবার আগে যেসব মেয়ে সাজগোজ করে নিজেদেরকে তৈরী করে এবং ততক্ষণ ঘরের বাইরে পা রাখে না যতক্ষন অপরূপ সাজে নিজেদেরকে সজ্জিতা না করে নেয়, তাদের এর উদ্দেশ্য এছাড়া আর কি হতে পারে যে, তারা সারা দুনিয়ার পুরুষদের জন্য নিজেদেরকে দৃষ্টিনন্দন করতে চায় এবং তাদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করতে চায়। এরপর যদি তারা বলে, দর্শকদের ভ্রূভংগী তাদেরকে কষ্ট দেয়, এরপর যদি তাদের দাবী হয় তারা “সমাজের মক্ষিরানী” এবং “সর্বজনপ্রিয় মহিলা” হিসেবে নিজেদেরকে চিত্রিত করতে চায় না বরং পূত-পবিত্রা গৃহিনী হয়েই থাকতে চায়, তাহলে এটা একটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের কথা তার নিয়ত নির্ধারণ করে না বরং কাজেই তার আসল নিয়ত প্রকাশ করে। কাজেই যে নারী আকর্ষণীয়া হয়ে পর পুরুষের সামনে যায়, তার এ কাজটির পেছনে কোন্ ধরনের উদ্দেশ্য কাজ করছে সেটা ঐ কাজ দ্বারাই প্রকাশ পায়। কাজেই এসব মহিলাদের থেকে যা আশা করা যেতে পারে ফিতনাবাজ লোকেরা তাদের থেকে তাই আশা করে থাকে। কুরআন মহিলাদেরকে বলে, তোমরা একই সঙ্গে “গৃহপ্রদীপ” ও “সমাজের মক্ষিরাণী” হতে পারো না। গৃহপ্রদীপ হতে চাইলে সমাজের মক্ষিরাণী হবার জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় তা পরিহার করো এবং এমন জীবনধারা অবলম্বন করো যা গৃহপ্রদীপ হতে সাহায্য করতে পারে। কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত মত কুরআনের অনুকূল হোক বা তার প্রতিকূল এবং তিনি কুরআনের পথনিদের্শককে নিজের কর্মনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে চান বা না চান, মোটকথা তিনি যদি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জাল-জুয়াচুরির পথ অবলম্বন করতে না চান, তাহলে কুরআনের অর্থ বুঝতে তিনি ভুল করতে পারেন না। তিনি যদি মুনাফিক না হয়ে থাকেন, তাহলে পরিষ্কারভাবে একথা মেনে নেবেন যে, ওপরে যা বর্ণনা করা হয়েছে তাই হচ্ছে কুরআনের উদ্দেশ্য। এরপর তিনি যে বিরুদ্ধাচরণই করবেন একথা মেনে নিয়েই করবেন যে, তিনি কুরআন বিরোধী কাজ করছেন অথবা কুরআনের নিদের্শনাকে ভুল মনে করছেন।
# ইতিপূর্বে জাহেলী জীবন যাপন করার সময় যেসব ভুল করা হয় আল্লাহ নিজ মেহেরবানীতে তা ক্ষমা করে দেবেন তবে এজন্য শর্ত হচ্ছে, এখন পরিষ্কার পথ নিদের্শ লাভ করার পর তোমরা নিজেদের কর্মধারা সংশোধন করে নেবে এবং জেনে বুঝে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৫৩-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:
(أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا……) শানে নুযূল:
আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যয়নব বিনতে জাহাশ (رضي الله عنها)-কে বিবাহ করলেন তখন লোকদেরকে দাওয়াত করলেন। তারা খাওয়া-দাওয়া শেষে বসে আলোচনা করছিল বা কথাবার্তা বলছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উঠার জন্য তৈরী হলেন কিন্তু তখনো তারা উঠল না। তা দেখে তিনি উঠে গেলেন এবং কিছু লোক তাঁর সাথে উঠে চলে গেল। কিন্তু এরপরেও তিনজন লোক বসে থাকল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়িতে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে আসলেন। তখনো তারা বসেছিল। এরপর তারা উঠে চলে গেল। আনাস বলেন: আমি আসলাম এবং নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সংবাদ দিলাম যে, তারা চলে গেছে। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি তাঁর সাথে প্রবেশ করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি আমার ও তাঁর মধ্যে পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৯১ন৯৪, সহীহ মুসলিম হা: ৮৬, ১৪২৮)
এ আয়াতে কিছু সামাজিক বিধি-বিধান উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে:
১. আয়াতের প্রথমাংশে দাওয়াত ও আপ্যায়ন সম্পর্কিত তিনটি রীতি-নীতি বর্ণিত হয়েছে। এগুলো সকল মুসলিমদের জন্য ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু যে ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে তা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গৃহে সংঘটিত হয়েছে, তাই শিরোনামে بُيُوْتَ النَّبِيِّ উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথম রীতি হল-
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গৃহসহ অন্য যেকোন মু’মিন ব্যক্তির গৃহে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ না করা। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتّٰي تَسْتَأْنِسُوْا وَتُسَلِّمُوْا عَلٰٓي أَهْلِهَا ط ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ)
“হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য কারও গৃহে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদেরকে সালাম না করে প্রবেশ কর না। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, সম্ভবত তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।” (সূরা নূর ২৪:২৭)
দ্বিতীয় রীতি হলন প্রবেশের অনুমতি এমনকি খাওয়ার দাওয়াত হলেও সময়ের পূর্বে উপস্থিত হয়ে আহার্য প্রস্তুতির অপেক্ষায় বসে থেকো না।
(غَيْرَ نٰظِرِيْنَ إِنٰهُ)-ناظر
-শব্দের অর্থ এখানে অপেক্ষাকারী এবং انا শব্দের অর্থ খাদ্য রান্না করা। আয়াতে لَا تَدْخُلُوْا নিষেধাজ্ঞা থেকে দুটি ব্যতিক্রম প্রকাশ করা হয়েছে। একটি
(إِلَّآ أَنْ يُّؤْذَنَ لَكُمْ)
এর إِلَّآ শব্দ দ্বারা অপরটি غَيْرَ শব্দ দ্বারা। এর অর্থ এই যে, বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করো না এবং সময়ের পূর্বে এসে খাদ্য রান্নার অপেক্ষায় বসে থেকো না বরং যথাসময়ে আহ্বান করা হলে গৃহে প্রবেশ করবে। তাই বলা হয়েছে:
(وَلٰكِنْ إِذَا دُعِيْتُمْ فَادْخُلُوْا)
‘তবে তোমাদেরকে ডাকা হলে তোমরা প্রবেশ কর’
তৃতীয় রীতি হলন খাওয়া শেষে নিজ নিজ কাজে ছড়িয়ে পড়। পরস্পর কথাবার্তা বলার জন্য গৃহে অনড় হয়ে বসে থেকো না। তাই বলা হয়েছে:
(فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوْا وَلَا مُسْتَأْنِسِيْنَ لِحَدِيْثٍ)
‘এবং খাওয়া শেষ হলে নিজেরাই চলে যাও, কথাবার্তায় মাশগুল হয়ে পড় না।’
তবে এ রীতি সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেখানে খাওয়ার পর দাওয়াত প্রাপ্তদের বেশিক্ষণ বসে থাকা দাওয়াতকারীর জন্য কষ্টের কারণ হয়। যেমন সে এ কাজ সেরে অন্য কোন কাজে জড়িত হতে চায় কিংবা তাদেরকে বিদায় দিয়ে অন্য মেহমানদেরকে খাওয়াতে চায়। উভয় অবস্থায় দাওয়াত প্রাপ্তদের বসে থাকা তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানে যদি পরিবেশ পরিস্থিতি এমন না হয় বরং বসে থাকার সুযোগ রাখা হয়েছে তাহলে ইচ্ছা করলে থাকতে পারবে যেমন এখনকার অধিকাংশ দাওয়াতী আয়োজনে ব্যবস্থা করা হয়।
(إِنَّ ذٰلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ)
অর্থাৎ দাওয়াত খাওয়ার পরেও অনর্থক বসে খোশগল্প করায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কষ্ট দেয়া হয়, কারণ তোমরা উঠে চলে যাও এ কথা বলতেও তিনি লজ্জা পান। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা সত্য প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন না, তাই তিনি আয়াত নাযিল করে জানিয়ে দিলেন।
তাই মু’মিনদের উচিত বিনা অনুমতিতে কারো গৃহে প্রবেশ না করা এবং যদি অনুমতি দেয়া হয় তাহলে প্রয়োজন সেরে তৎক্ষণাৎ চলে যাওয়া।
ইবনে উমার (رضي الله عنهما) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের কেউ যদি তার ভাইকে দাওয়াত করে তাহলে সে যেন তার ভাইয়ের ডাকে সাড়া দেয়। সেটি বিবাহের ওলিমা হোক বা অন্য কিছু হোক। (সহীহ মুসলিম হা: ১০৫৩)
অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যদি আমাকে একটি হাড়ের জন্যও দাওয়াত করা হত আমি তার ডাকে সাড়া দিতাম। আমাকে যদি একটি খুরও হাদিয়া দেয়া হত আমি কবূল করতাম। যখন তোমাদের কাউকে দাওয়াত করা হয় তখন সে যেন খাবার শেষে সেখান থেকে সরে পড়ে। (সহীহ বুখারী হা: ৫১৭৮) অনুমতি চাওয়া সম্পর্কেও সূরা নূরে আলোচনা করা হয়েছে।
২. (وَإِذَا سَأَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَسْئَلُوْهُنَّ مِنْ وَّرَا۬ءِ حِجَابٍ)
‘তোমরা যখন তাঁর স্ত্রীদের কাছ থেকে কোন কিছু চাও, তখন পর্দার আড়াল থেকে চাও’ অত্র আয়াতে যদিও নাবী পত্নীদের কথা বলা হয়েছে যে, তোমরা যখন তাদের নিকট কোন কিছু চাও তখন পর্দার আড়াল থেকে চাও, কিন্তু এর দ্বারা সকল মু’মিনা নারীদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আর এ বিধান উমার (رضي الله عنه)-এর বাসনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়। তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরজ করলেন যে, হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার নিকট সৎ অসৎ বিভিন্ন ধরণের লোক আসা যাওয়া করে। আপনি আপনার স্ত্রীগণকে পর্দা করার আদেশ দিলে খুবই ভাল হত। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৯০১) এ পর্দার বিধান সম্পর্কে সূরা নূরে আলোচনা করা হয়েছে।
(لِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوْبِكُمْ وَقُلُوْبِهِنَّ)
‘এটা তোমাদের অন্তরের জন্য এবং তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্র উপায়’ অর্থাৎ পুরুষের মনে নারীর প্রতি যে আসক্তি আর নারীর মনে পুরুষের প্রতি যে আসক্তি তা থেকে পবিত্র থাকতে পারবে। ফলে উভয়ের মন পরিস্কার থাকবে কারো প্রতি কোন খারাপ ধারণা সৃষ্টি হবে না।
৩. তৃতীয় আরেকটি বিধান হল এই যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীগণকে কারো জন্য বিবাহ করা হালাল নয়। কেননা তারা হল মু’মিনদের জন্য মাতৃতুল্য। তবে পর্দা করা জরুরী। এটা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর স্ত্রীদের সম্মান।
এরপর বলেন যে, মানুষ যা কিছুই করুক না কেন। তা প্রকাশ্যে করুক অথবা অপ্রকাশ্যে করুক আল্লাহ তা‘আলা তা অবহিত আছেন।
সুতরাং গোপনে অপরাধ করে মনে করা যাবে না যে, কেউ জানে না। বরং আল্লাহ তা‘আলা সকল কিছুই জানেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অনুমতি ব্যতীত কারো গৃহে প্রবেশ করা যাবে না।
২. কেউ কাউকে দাওয়াত দিলে তা কবূল করতে হবে।
৩. মহিলাদের সাথে তেমন জরুরী প্রয়োজন থাকলে পর্দার আড়াল থেকে প্রয়োজন মেটাতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা সকল বিষয়ের ওপর খবর রাখেন, তা প্রকাশ্যে হোক বা অপ্রকাশ্যে হোক।
৫. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণ মু’মিনদের জন্য মাতৃতুল্য, তাই তাদেরকে বিবাহ করা হারাম।
৬. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কষ্ট পান এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বে পর্দার বিধান আলোচনা করার পর এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঐ সকল লোকদের বর্ণনা দিচ্ছেন যাদের সাথে দেখা করা শরীয়তসম্মত।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর মু’মিন নারীদেরকে বল: তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী (সংযত) করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে; তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তাদের ঘাড় ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে, তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা মুক্ত নিষ্কাম পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারও নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদ না ফেলে। হে মু’মিগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সূরা নূর ২৪:৩১)
যখন পর্দার আয়াত নাযিল হয় তখন বাবা, সন্তান ও নিকটাত্মীয়গণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন আমাদেরও কি পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতে হবে? তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (কুরতুবী)
আয়াতে যে সকল পুরুষদের সাথে দেখা করা বৈধ তাদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে চাচা ও খালুর কথা উল্লেখ করা হয়নি। উত্তর হল চাচা ও খালুর বিধান পিতার মতই, তাই উল্লেখ করা হয়নি। এ সম্পর্কে সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
# ৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঐ সম্মান ও মর্যাদার কথা বর্ণনা করা হয়েছে যা আসমানে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাদের নিকট বিদ্যমান। তা এই যে, আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের নিকট নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মান ও প্রশংসা করেন এবং তাঁর ওপর রহমত বর্ষণ করেন। আর ফেরেশতাগণও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মর্যাদার জন্য দু‘আ করেন। তার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ববাসীকে আদেশ করছেন তারাও যেন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠ করে। যাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রশংসায় ঊর্ধ্ব ও নিম্ন উভয় জগৎ একত্রিত হয়ে যায়। আবুল আলিয়া বলেন: (নাবীর প্রতি) আল্লাহ তা‘আলার সালাত হলো: ফেরেশতাদের কাছে তাঁর প্রশংসা করা। আর ফেরেশতাদের সালাত হলো: নাবীর জন্য দু’আ করা। (সহীহ বূখারী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পড়ার জন্য উম্মাতের প্রতি তাঁর নির্দেশ ও পদ্ধতি:
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মাতকে দরূদ পড়ার ব্যাপারে অনেক জায়গায় নির্দেশ প্রদান করেছেন। এ ব্যাপারে মুতাওতির হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো কা‘ব বিন উজরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: বলা হলো হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল! আপনাকে কিভাবে সালাম দেব তা জানতে পারলাম। কিন্তু সালাত কিভাবে পড়ব? তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরূদে ইবরাহীমের কথা বললেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৯৭)
এছাড়াও বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাতে শব্দের একটু ভিন্নতা পাওয়া যায়। তবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করার উত্তম শব্দ ও দরূদ হলো দরূদে ইবরাহীম। তবে আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু কিছু দরূদ পাওয়া যায় যেমন
’’يا نبي سلام عليك يا حبيب سلام عليك‘‘
এগুলোর কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা নেই। এগুলো একশ্রেণির নামধারী তথাকথিত আলেম নামক ধর্মব্যবসায়ীদের তৈরি করা কথা। তাই চার রাকাতবিশিষ্ট সালাতের উভয় বৈঠকে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। আবার কেউ সুন্নাত বলেছেন। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
তাছাড়া আযান শেষে, মসজিদে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার পূর্বে, জানাযার সালাতে, ঈদের সালাতে, আল্লাহ তা‘আলার কাছে কিছু চেয়ে দু‘আ করার শেষে ও কবর যিয়ারতের সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করার পদ্ধতি:
পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা যায় এবং সে দরূদ আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের মাধ্যমে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে পৌঁছে দেন। যেমন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন ; তোমরা আমার কবরকে অনুষ্ঠানের জায়গা বানিয়ে নিও না এবং তোমাদের বাড়ি ঘরকে কবর বানিয়ে নিও না, আর তোমরা আমার প্রতি দরূদ প্রেরণ কর। তোমরা যেখান থেকেই আমার প্রতি দরূদ পাঠ কর তা আমার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। (আবূ দাঊদ হা: ২০৪২, সনদ সহীহ)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: জমিনে আল্লাহ তা‘আলার কতগুলো ভ্রাম্যমান ফেরেশতা রয়েছে, তারা আমার উম্মাতের সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেয়। (আহমাদ ১/৪৪১, নাসায়ী হা: ১২৮১, সনদ সহীহ) অতএব নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম ও তাঁর প্রতি দরূদ প্রেরণের জন্য পাখি হয়ে মদীনাতে যেতে হবে না এবং কোন হাজী সাহেবকেও বলে দিতে হবে না যে, আমার সালাম নাবীর রওজায় পৌঁছে দেবেন। বরং পৃথিবীর যেখান থেকেই দরূদ পাঠ করা হোক না কেন তা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে পৌঁছে যাবে।
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করার ফযীলত ও না পাঠ করলে অপরাধ:
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। (সহীহ মুসলিম ১/৩০৬, আবূ দাঊদ হা: ১৫৩০)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন: ঐ ব্যক্তির নাক ধূলোয় ধূসরিত হোক, যে ব্যক্তির নিকট আমার নাম উচ্চারণ করা হলো কিন্তু আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
الْبَخِيلُ مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ، ثُمَّ لَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ
সে ব্যক্তি কৃপণ যার কাছে আমার নাম উচ্চারণ করা হলে দরূদ পাঠ করে না। (মুসনাদ আহমাদ হা: ১৭৩৬, সহীহ)
সুতরাং যে কোন আমল সুন্নাতী তরীকায় আদায় করলে তার নেকীর আশা করা যায়, অন্যথায় তার কোন নেকী পাওয়ার আশা করা যায় না বরং পাপের ভাগী হতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর দরূদ পাঠ করার ফযীলত সম্পর্কে জানা গেল।
২. স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা এবং ফেরেশতারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর দরূদ পাঠ করেন।
৩. যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর দরূদ পাঠ করে না সে হল বড় কৃপণ।
৪. সুন্নাতী দরূদ পাঠ করতে হবে, কোন প্রকার বিদ‘আতী দরূপ পাঠ করা যাবে না।