أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৫৯/মুনাফিক কি? বই নং ৩৬:-)
[ *মুনাফিকের কথায় বিভ্রান্ত না হওয়ার নির্দেশ : -]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৩:আহযাব
পারা:২২
৬০-৭৩ নং আয়াত:-
৩৩: ৬০
لَئِنۡ لَّمۡ یَنۡتَہِ الۡمُنٰفِقُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ وَّ الۡمُرۡجِفُوۡنَ فِی الۡمَدِیۡنَۃِ لَنُغۡرِیَنَّکَ بِہِمۡ ثُمَّ لَا یُجَاوِرُوۡنَکَ فِیۡہَاۤ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿ۖۛۚ۶۰﴾
মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে আর যারা নগরে গুজব রটনা করে, তারা বিরত না হলে আমরা অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আপনাকে প্ৰবল করব; এরপর এ নগরীতে আপনার প্রতিবেশীরূপে তারা স্বল্প সময়ই থাকবে—
৩৩:৬১
مَّلۡعُوۡنِیۡنَ ۚۛ اَیۡنَمَا ثُقِفُوۡۤا اُخِذُوۡا وَ قُتِّلُوۡا تَقۡتِیۡلًا ﴿۶۱﴾
তাদের ওপর লানত বর্ষিত হবে চারদিক থেকে, যেখানেই পাওয়া যাবে তাদেরকে পাকড়াও করা হবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে।
৩৩:৬২
سُنَّۃَ اللّٰہِ فِی الَّذِیۡنَ خَلَوۡا مِنۡ قَبۡلُ ۚ وَ لَنۡ تَجِدَ لِسُنَّۃِ اللّٰہِ تَبۡدِیۡلًا ﴿۶۲﴾
এটিই আল্লাহর সুন্নাত, এ ধরনের লোকদের ব্যাপারে পূর্ব থেকে এটিই চলে আসছে এবং তুমি আল্লাহর সুন্নাতে কোন পরিবর্তন পাবে না।
৩৩:৬৩
یَسۡـَٔلُکَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَۃِ ؕ قُلۡ اِنَّمَا عِلۡمُہَا عِنۡدَ اللّٰہِ ؕ وَ مَا یُدۡرِیۡکَ لَعَلَّ السَّاعَۃَ تَکُوۡنُ قَرِیۡبًا ﴿۶۳﴾
লোকে তোমাকে কিয়ামত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বল, ‘এর জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে।’ আর তোমাকে কিসে জানাবে? সম্ভবতঃ কিয়ামত শীঘ্রই হয়ে যেতে পারে।
৩৩:৬৪
اِنَّ اللّٰہَ لَعَنَ الۡکٰفِرِیۡنَ وَ اَعَدَّ لَہُمۡ سَعِیۡرًا ﴿ۙ۶۴﴾
নিশ্চয় আল্লাহ্ কাফিরদেরকে করেছেন অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য প্ৰস্তুত রেখেছেন জ্বলন্ত আগুন;
৩৩:৬৫
خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ۚ لَا یَجِدُوۡنَ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیۡرًا ﴿ۚ۶۵﴾
যেখানে ওরা চিরকালের জন্য স্থায়ী হবে। ওরা কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।
৩৩:৬৬
یَوۡمَ تُقَلَّبُ وُجُوۡہُہُمۡ فِی النَّارِ یَقُوۡلُوۡنَ یٰلَیۡتَنَاۤ اَطَعۡنَا اللّٰہَ وَ اَطَعۡنَا الرَّسُوۡلَا ﴿۶۶﴾
যেদিন তাদের চেহারা আগুনে ওলট পালট করা হবে তখন তারা বলবে “হায়! যদি আমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করতাম।”
৩৩:৬৭
وَ قَالُوۡا رَبَّنَاۤ اِنَّاۤ اَطَعۡنَا سَادَتَنَا وَ کُبَرَآءَنَا فَاَضَلُّوۡنَا السَّبِیۡلَا ﴿۶۷﴾
তারা আরো বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় বড় লোক (বুযুর্গ)দের আনুগত্য করেছিলাম, সুতরাং ওরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল।
৩৩:৬৮
رَبَّنَاۤ اٰتِہِمۡ ضِعۡفَیۡنِ مِنَ الۡعَذَابِ وَ الۡعَنۡہُمۡ لَعۡنًا کَبِیۡرًا ﴿٪۶۸﴾
হে আমাদের রব! তাদেরকে দ্বিগুণ আযাব দাও এবং তাদের প্রতি কঠোর লানত বর্ষণ করো।”
৩৩:৬৯
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ اٰذَوۡا مُوۡسٰی فَبَرَّاَہُ اللّٰہُ مِمَّا قَالُوۡا ؕ وَ کَانَ عِنۡدَ اللّٰہِ وَجِیۡہًا ﴿ؕ۶۹﴾
হে ঈমানদারগণ! মূসাকে যারা কষ্ট দিয়েছে তোমরা তাদের মত হয়ো না; অতঃপর তারা যা রটনা করেছিল আল্লাহ তা থেকে তাকে নির্দোষ প্রমাণিত করেন ; আর তিনি ছিলেন আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান।
৩৩:৭০
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَ قُوۡلُوۡا قَوۡلًا سَدِیۡدًا ﴿ۙ۷۰﴾
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।
৩৩:৭১
یُّصۡلِحۡ لَکُمۡ اَعۡمَالَکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ فَقَدۡ فَازَ فَوۡزًا عَظِیۡمًا ﴿۷۱﴾
তাহলে তিনি তোমাদের কর্মকে ক্রটিমুক্ত করবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, তারা অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে।
৩৩:৭২
اِنَّا عَرَضۡنَا الۡاَمَانَۃَ عَلَی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ الۡجِبَالِ فَاَبَیۡنَ اَنۡ یَّحۡمِلۡنَہَا وَ اَشۡفَقۡنَ مِنۡہَا وَ حَمَلَہَا الۡاِنۡسَانُ ؕ اِنَّہٗ کَانَ ظَلُوۡمًا جَہُوۡلًا ﴿ۙ۷۲﴾
আমি এ আমানতকে আকাশসমূহ, পৃথিবী ও পর্বতরাজির ওপর পেশ করি, তারা একে বহন করতে রাজি হয়নি এবং তা থেকে ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষ একে বহন করেছে, নিঃসন্দেহে সে বড় জালেম ও অজ্ঞ।
৩৩:৭৩
لِّیُعَذِّبَ اللّٰہُ الۡمُنٰفِقِیۡنَ وَ الۡمُنٰفِقٰتِ وَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ وَ الۡمُشۡرِکٰتِ وَ یَتُوۡبَ اللّٰہُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿٪۷۳﴾
যাতে আল্লাহ্ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীকে শাস্তি দেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে ক্ষমা করেন। আর আল্লাহ্ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলোচনা (৬৩-৭৩) : সূরার এই সর্বশেষ অধ্যায়টাতে যে বিষয়গুলাে আলােচিত হয়েছে, তার ভেতরে রয়েছে একশ্রেণীর লােকের কেয়ামত কবে হবে এই প্রশ্ন, কেয়ামতকে তাড়াতাড়ি সংঘটিত করার আবদার এবং কেয়ামত আদৌ হবে কিনা, সে ব্যাপারে তাদের সংশয় প্রকাশ। এসব প্রশ্নের জবাব এখানে আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ ধরনের প্রশ্ন তােলা থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে এবং যে কোনাে সময় আকস্মিকভাবে কেয়ামতের আগমন ঘটতে পারে বলে সাবধান করা হয়েছে। এরপর কেয়ামতের কিছু কিছু দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। কেয়ামতের জন্যে যারা তাড়াহুড়া করে, তাদের জন্যে এ দৃশ্য আনন্দদায়ক নয়। সেদিন তাদের মুখ দোযখের ভেতরে উল্টে দেয়া হবে। সেদিন তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য না করার জন্যে অনুশােচনা করবে। সেদিন তারা তাদের নেতা ও মুরব্বীদের জন্য দ্বিগুণ আযাবের দাবী জানাবে। এসব দৃশ্য আতংক ও ত্রাস সৃষ্টি করে। এ সব দৃশ্য দেখার পর কেউ কেয়ামতের জন্যে তাড়াহড়াে করতে পারে না। আখেরাতের এই দৃশ্য বর্ণনার পর পুনরায় দুনিয়ার দৃশ্য বর্ণনা করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য এই যে, মুসলমানরা যেন হযরত মূসার জাতির মতাে না হয়, যারা তার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করেছিলাে। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদের অপবাদ খন্ডন করলেন। মনে হয়, এটা একটা বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছিলাে। সম্ভবত, আরবের প্রচলিত প্রথার বিরােধিতা করে রাসূল(স.) কর্তৃক যয়নবকে বিয়ে করা নিয়ে কিছু কিছু লােক কানাঘুষা করেছিলাে। সেই কানাঘুষা প্রত্যাখ্যান করে মুসলমানদের কোনাে অপবাদ ও অপপ্রচারে লিপ্ত না হয়ে সহজ সরল ও সাদাসিধে কথা বলার আদেশ দেয়া হয়েছে। এর বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাদের সৎ কাজগুলােকে পরিশুদ্ধ করে কবুল করে নেবেন, তাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের হুকুম পালনকে তাদের কাছে প্রিয় করে দেবেন এবং সে জন্য তাদেরকে বিপুল সাফল্য দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতপর একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে সূরার উপসংহার টানা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মানুষ এমন একটা আমানত বহন করেছে, যা বহন করতে আকাশ পৃথিবী ও পাহাড় পর্বত সাহস পায়নি। এটা একটা বিরাট, ভয়াবহ ও ঝুঁকিপূর্ণ আমানত। এর উদ্দেশ্য ছিলাে যে, কর্ম অনুযায়ী কর্মফল দানে এবং মানুষ নিজের জন্যে স্বেচ্ছায় যা গ্রহণ করে, সে অনুসারে তার হিসাব গ্রহণে আল্লাহ তায়ালা বিধিব্যবস্থা যেন কার্যকরী হয়। (আয়াত ৭৩) *তাফসীর : ৬৩-৬৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ৬৮ নং আয়াতে পড়ুন।
# ৬০-৬২ নং আয়াতে এ বিষয়টি আলােচিত হয়েছে। এ তিনটি আয়াতের কঠোর হুমকি থেকে আমরা বুঝতে পারি, বনু কোরায়যার উচ্ছেদের পর মদীনায় মুসলিম শক্তি কতাে জোরদার এবং ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কতাে প্রবল হয়ে উঠেছিলাে। এ থেকে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে, গােপন ষড়যন্ত্র করা ছাড়া মােনাফেকদের আর কোন কার্যকর ক্ষমতা ছিলাে না। তারা নিতান্ত ভীরু ও কাপুরুষের মতাে প্রকাশ্যে মুসলমানদের সামনেও আসতে সাহস পেতাে না।
*কাফেরদের ধৃষ্টতা ও তাদের অনুসরণের পরিণতি : ‘লােকেরা তােমাকে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে…’ (আয়াত ৬৩) কিয়ামত সম্পর্কে রাসূল(স.) মােশরেকদের অনেক আগেই বিশদভাবে জানিয়েছেন, তাদেরকে অনেক সতর্ক করেছেন এবং কোরআনে তার বিভিন্ন দৃশ্য এমনভাবে বর্ণনা করেছে যে, তার পাঠকদের কাছে মনে হয় যেন তারা তাকে চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছে। তাই মােশরেকরা কেয়ামত সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করতাে না। জিজ্ঞেস করতাে কেয়ামত কবে হবে এবং আবদার করতাে যে সেটা তাড়াতাড়ি ঘটানাে হােক। এই তাড়াতাড়ি ঘটানাের আবদার থেকে তারা প্রকারান্তরে বুঝাতাে, তারা কেয়ামত নিয়ে সন্দেহ পােষণ করে,তা অবিশ্বাস করে অথবা তা নিয়ে উপহাস করে। যারা প্রশ্ন করতাে, তাদের ঈমান থেকে দূরত্ব, বা নৈকট্যের অনুপাত অনুসারেই এগুলাে হতো। কেয়ামত আসলে একটা অদৃশ্য বা গায়েবী বিষয়, যার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহই রাখেন। এ সংক্রান্ত জ্ঞান তিনি তার সৃষ্টি জগতের কাউকেই দিতে চাননি। এমনকি নবী রসূল ও ঘনিষ্ঠতম ফেরেশতাদেরকেও নয়। ঈমান ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ সম্পর্কে এক হাদীসে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব বলেন, এবার আমরা রসূল(স.)-এর কাছে বসেছিলাম । সহসা আমাদের কাছে এক ব্যক্তি আবির্ভূত হলাে। তার পােশাক একেবারে ধবধবে সাদা এবং তার চুল কুচকুচে কালাে। তার ভেতরে সফরের কোনাে লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলাে না। অথচ আমাদের কেউ তাকে চিনেও না। লােকটি রসূল(স.)-এর কাছে এসে বসলাে। রসূল(স.)-এর হাঁটুর সাথে হাঁটু লাগিয়ে এবং নিজের দুই উরুর ওপর হাত রেখে সে বসলাে। তারপর বললাে, হে মােহাম্মদ! আমাকে বলুন, ইসলাম কী? রসূল(স.) বললেন, ইসলাম হচ্ছে এই মর্মে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ(স.) আল্লাহর রসূল, আর নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দেয়া, রমযানের রােযা রাখা ও হজ্জের পথ খরচ সংকুলান হলে হজ্জ করা। আগন্তুক বললাে, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা অবাক হলাম যে, আগন্তুক তাকে জিজ্ঞেসও করছে, আবার তার কথার বিশুদ্ধতারও সাক্ষ্য দিচ্ছে। সে বললাে, বেশ, এবার আমাকে বলুন, ঈমান কাকে বলে? রসূল (স.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা, তাঁর ফেরশতাকুলের, তাঁর কিতাব সমূহ, তার সকল রাসূল, আখেরাত এবং ভাগ্য ভালাে মন্দ যাই হােক-এগুলােতে বিশ্বাস স্থাপন করা। আগন্তুক বললাে, আপনি ঠিক বলেছেন। তারপর বললাে, এখন আমাকে বলুন, এহসান কী? রসূল(স.) বললেন, এমনভাবে আল্লাহর এবাদত করা যেন এবাদতকারী তাকে দেখতে পাচ্ছে। আর যদি সে তাকে দেখতে নাও পায়, তবে অন্তত এতােটুকু অনুভব করা যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই দেখতে পান। সে বললাে, তাহলে আমাকে কেয়ামত সম্পর্কে অবহিত করুন। রসূল(স.) বললেন, এ কথা যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, সে প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশী জানে না…’ এরপর রসূল(স.) বললেন, এই ব্যক্তি ছিলাে জিবরাঈল। তােমাদেরকে ইসলামের শিক্ষা দিতে এসেছিলেন।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি ও নাসায়ী) এখানে প্রশ্নকারী জিবরাঈল(আ.)-এবং যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তিনি রসূল(স.)। দু’জনের কেউই কেয়ামত কবে হবে তা জানেন না। ‘তুমি বলাে, তার জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছেই আছে।’ অর্থাৎ আল্লাহর কোনাে বান্দাই এ সম্পর্কে অবহিত নয়। যে মহৎ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা এই ব্যবস্থা করেছেন তা শুধু তিনিই জানেন। আমরা কেবল এর অংশ বিশেষ অনুমান করতে পারি। যেমন, মানুষকে সব সময় কেয়ামত সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত ও সতর্ক রাখা এবং যে কোনাে সময় তা ঘটে যেতে পারে ভেবে সে যাতে তার জন্যে প্রস্তুত থাকে, তার পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা। অবশ্য মহান আল্লাহ যার মংগল কামনা করেন এবং যার অন্তরে আল্লাহভীতি সঞ্চিত রেখেছেন, একমাত্র তারাই এ ব্যবস্থা দ্বারা উপকৃত হতে পারে। পক্ষান্তরে যারা কেয়ামত ও আখেরাত সম্পর্কে উদাসীন থাকে এবং প্রতি মুহূর্তে কেয়ামতের মুখােমুখী হবার জন্যে প্রস্তুত থাকে না, তারা নিজেদের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে না। অথচ আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কেয়ামত সম্পর্কে অবহিত ও সতর্ক করেছেন এবং কেয়ামতকে এমন একটা অজানা ঘটনা হিসেবে সংরক্ষণ করেছেন, যা দিন ও রাতের যে কোনাে মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা এ জন্যে বলেছেন, ’তুমি জানাে না যে, কেয়ামত হয়তাে নিকটবর্তী এসে গেছে।'(আয়াত ৬৩) নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের ওপর অভিসম্পাত দিয়েছেন এবং তাদের জন্যে জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত করে রেখেছেন…'(আয়াত ৬৪-৬৮) কাফেররা কেয়ামত সম্পর্কে যে বিবিধ প্রশ্ন করে, তার জবাবে বলা হচ্ছে যে, কেয়ামতের কিছু কিছু দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা কাফেরদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছেন এবং তাদের জন্যে জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা কাফেরদেরকে তার রহমত থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং তাদের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছেন জ্বলন্ত দাউ দাউ করা আগুন। সেই জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত ও উপস্থিত রাখা হয়েছে। ‘ওরা সেখানে চিরদিন থাকবে’ অর্থাৎ দীর্ঘকাল অবস্থান করবে। কতাে দীর্ঘ, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। তার শেষ কোথায় তা শুধু আল্লাহ তায়ালাই জানেন এবং তার ইচ্ছা দ্বারাই তা নিয়ন্ত্রিত। তারা সকল সাহায্য ও সাহায্যকারী থেকে বঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন। কাজেই এই জ্বলন্ত আগুন থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোনাে আশা নেই। বলা হয়েছে, ‘তারা কোনাে অভিভাবক বা সাহায্যকারী পাবে না।’ এরপর আসছে সেই জ্বলন্ত আগুনে কিভাবে আযাব দেয়া হবে তার মর্মান্তিক বিবরণ, ‘যেদিন আগুনের মধ্যে তাদের মুখ উল্টো করে রাখা হবে।’ অর্থাৎ আগুন তাকে সর্বদিক থেকে ঘিরে ধরবে, এই বাচনভংগী দ্বারা আগুনের ভেতরে আযাবের পন্থা ও প্রক্রিয়ার ছবি অংকন করা হয়েছে। দেখানাে হয়েছে যে, তাদের শাস্তি বৃদ্ধি করার জন্যে আগুন যেনাে তাদের মুখমন্ডলের সকল পাশ দিয়ে দগ্ধীভূত করতে চাইবে। ‘তারা তখন বলতে থাকবে, হায় আক্ষেপ, আমরা যদি দুনিয়ায় আল্লাহর আনুগত্য ও রসূলের আনুগত্য করতাম।’ এটা অবশ্য ব্যর্থ অনুশােচনা! তখন এর আর কোনাে অর্থ থাকবে না এবং কেউ তা গ্রহণও করবে না। কেননা অনুশােচনার সময় ফুরিয়ে গেছে। এটা হবে শুধু অতীত নিয়ে আক্ষেপ মাত্র! এরপর তাদের ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটবে তাদের নেতাদের ও সমাজপতিদের ওপর যারা তাদেরকে বিপথগামী করেছে, তখন তারা আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট হবে। কিন্তু তাতে কোনাে লাভ হবে না। ‘তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা তাে আমাদের নেতা ও সমাজপতিদের আনুগত্য করতাম, তারা আমাদেরকে বিপথগামী করেছে। হে আমাদের প্রতিপালক! ওদেরকে দ্বিগুন আযাব দাও এবং তাদের ওপর মহা অভিশাপ বর্ষণ করাে।’ এই হচ্ছে কেয়ামত। এটা নিয়ে কিসের এতাে প্রশ্ন। সেখানে এ ধরনের অভিশপ্ত পরিণতি থেকে কিভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে সেটা নিয়েই ভাবা উচিত। হাঁ, এই উদ্ধার পাওয়া যাবে একমাত্র সৎ কাজ দ্বারা। যদিও যায়নব বিনতে জাহশের সাথে রসূল(স.)-এর বিয়ে করা দ্বারা ইসলাম জাহেলী যুগের প্রচলিত প্রথাকে বাতিল করতে চেয়েছিলাে, কিন্তু মনে হয় এই বিয়েটা সে সমাজে সহজে মেনে নেয়া হয়নি। বহু সংখ্যক মােনাফেক, মনােব্যাপ্তি ও নড়চড়ে ঈমানধারী যাদের কাছে ইসলামের সহজ সরল আইনগত বিধান স্বচ্ছ ও বােধগম্য ছিলাে না, তারা নানারকম গােপন ও প্রকাশ্য অপপ্রচার, বাদ-প্রতিবাদ, কানাঘুষা ও জঘন্য ধরনের অপবাদ রটানাের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলাে।
*মুনাফিকের কথায় বিভ্রান্ত না হওয়ার নির্দেশ : মুনাফিক ও সুযােগ সন্ধানীরা কখনো চুপ থাকতাে না। তারা তাদের বিষাক্ত অপপ্রচারের বিস্তার ঘটানাের কোনাে সুযােগই হাতছাড়া করতাে না। খন্দকের যুদ্ধে, হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনায়, দখলীকৃত ভূ-সম্পত্তি বন্টনে এবং অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, তারা রসূল(স.)-কে কষ্ট দেয়া ও উত্যক্ত করার প্রতিটা সুযােগই গ্রহণ করেছে। এ সময় বনু কোরায়যাসহ সমুদয় ইহুদী গােষ্ঠীকে মদীনা থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। তাই মদীনায় এমন কেউ অবশিষ্ট ছিল না যে, প্রকাশ্যে কুফরিতে লিপ্ত ছিলাে। মদীনার সকল অধিবাসীই তখন মুসলমান হয়ে গেছে। কেউবা একনিষ্ঠ মুসলিম, কেউবা বর্ণচোরা ও ভন্ড মুসলমান তথা মুনাফিক। মুনাফিকদের গুজব রটাতাে ও মিথ্যে প্রচারণায় লিপ্ত হতাে। কিন্তু কোনাে কোনাে মুসলমান তাদের চাতুর্যপূর্ণ অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে তাদের গুজবে বিশ্বাস করতাে। কোরআন তাদেরকে সতর্ক করে বললাে যে, বনী ইসরাঈল যেমন তাদের নবী হযরত মূসাকে উত্যক্ত করতাে, তােমরা তেমনি রসূল(স.)-কে উত্যক্ত করলে না। বরং সহজ সরল ও সত্য কথা বলে এবং কোনােরকম অপবাদ আরোপ করাে না। সব সময় আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করতে থাক, এতেই চুড়ান্ত সাফল্য নিহিত রয়েছে।(আয়াত ৬৯-৭১) হযরত মূসাকে উত্যক্ত করার ধরণ কী ছিলাে, সেটা কুরআন ব্যাখ্যা করেনি। এ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে কোরআন যে বিষয় সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছে, আমি তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার প্রয়ােজন আছে বলে মনে করি না। আল্লাহ তায়ালা যা বুঝাতে চেয়েছেন তা শুধু এতটুকুই যে, রসূল(স.) যেসব ব্যবহারে কষ্ট পান, তার সবকিছু থেকেই যেনাে মুসলমানরা দূরে থাকে ও সাবধান থাকে। কোরআনের বহু জায়গায় আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈল জাতির বিপথগামিতা ও বিকৃতিকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করেছেন। কাজেই তাদের নবীদেরকে তারা যে উত্যক্ত করেছে, সে ব্যাপারে শুধু ইশারা দেয়া এবং তাদের অনুকরণ থেকে মুসলমানদের সতর্ক করাই যথেষ্ট। এতেই প্রত্যেক মুসলমানের চেতনা ও অনুভূতিতে এই পথভ্রষ্টদের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করে দেয়া সম্ভব, যাদেরকে কোরআন বিভ্রান্তি ও বিকৃতির উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। হযরত মূসার বিরুদ্ধে তার জাতি যে অপবাদ রটিয়েছিলাে, তা থেকে আল্লাহ তায়ালা তাকে মুক্ত করেছিলেন। ‘তিনি আল্লাহর কাছে সম্মানিত ছিলেন।’ আল্লাহ তায়ালা তার সকল নবীকেই মিথ্যা অপবাদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে থাকেন। আর মুহাম্মদ(স.) তো শ্রেষ্ঠ রাসূল। কাজেই তাকে যে আল্লাহ তায়ালা অপবাদ থেকে অব্যাহতি দেবেন, এটা অবধারিত। কোরআন মুসলমানদেরকে সহজ সরল, ভালাে ও সঠিক কথা বলা এবং কথার উদ্দেশ্য লক্ষ্য ও তাৎপর্য বুঝার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে তারা মােনাফেক ও পথভ্রষ্টদের ছড়ানাে গুজবে কান দিয়ে আপন নবী, পথ প্রদর্শক ও নেতা সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝিতে লিপ্ত না হয়। কোরআন তাদেরকে ভালাে কথা বলার নির্দেশ দিয়েছে, যা ভালাে কাজের দিকে চালিত করে। কেননা যারা ভালাে ও সত্য কথা বলে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং তাদের কার্যকলাপকে সংশােধন করে তার প্রতিদান দেন। আর যারা ভালাে কথা বলে ও ভালাে কাজ করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সেই সব গুনাহ মাফ করে দেন, যা থেকে সাধারণভাবে কোনাে মানুষই রক্ষা পায় এবং একমাত্র ক্ষমা ছাড়া তা থেকে রেহাই পায় না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, সে বিরাট সাফল্য লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য মূলত একটা বিরাট সাফল্য। কেননা আল্লাহর বিধান মেনে চলার ওপর দৃঢ়তা দেখানাের নামই আনুগত্য। এই দৃঢ়তা হৃদয়ে শান্তি ও পরিতৃপ্তি আনে। আল্লাহর সােজা ও সঠিক পথে চলা মূলতই একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার, এর জন্যে কোনাে পুরস্কার বা প্রতিদান পাওয়া যাক বা না যাক। যে ব্যক্তি আল্লাহর সরল সঠিক ও আলােকিত পথে চলে, তার আশপাশে বিরাজমান আল্লাহর সকল সৃষ্টি তার সাথে সহযােগিতা করে। আর যে ব্যক্তি বক্রপথে ও অন্ধকার পথে চলে, তার চারপাশে বিরাজমান সকল সৃষ্টি তার শত্ৰু হয়ে যায়, তার সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয় ও তার বিরােধিতা করে। সুতরাং এ দুটো সমান নয়। তাই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য নিজেই নিজের পুরস্কার। তাই কেয়ামতের পূর্বে ও বেহেশতের নেয়ামত লাভের আগে এটাই একটা বিরাট সাফল্য। আখেরাতের পুরস্কার হচ্ছে আনুগত্যের একটা বাড়তি প্রতিদান। ওটা আল্লাহর এক পরম দান, যা কোনাে কিছুর বিনিময়ে দেয়া হয় না। আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন বিনা হিসাবে দান করেন।
*মানুষ যে মহান দায়িত্ব সেচ্ছায় কাঁধে নিয়েছে : সম্ভবত মানুষের সহজাত দুর্বলতা, তদুপরি তার সেই গুরুদায়িত্ব, যা বহন করতে আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বত পর্যন্ত সাহস করেনি, সে নিজের হাজারাে রকমের আবেগ, অনুভূতি, রিপু ও প্রবৃত্তির তাড়না, জ্ঞানের স্বল্পতা, আয়ুষ্কালের স্বল্পতা, স্থানগত ও কালগত বাধা-বিপত্তি এবং এই সব বাধা-বিপত্তির ওপারে কী আছে, তা সম্পূর্ণরূপে না জেনেই নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছে। এসব দেখেই আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি এতােবড় অনুগ্রহ করেছেন ও এতােবড় সাফল্য দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বতের সামনে আমানত বা গুরুদায়িত্ব রেখেছিলাম। তারা সবাই এ গুরুদায়িত্ব বহন করতে অস্বীকার করেছে এবং মানুষ তা বহন করেছে…'(আয়াত ৭১) আল কোরআন অন্যান্য সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বত এই কটা সৃষ্টিকে বাছাই করার কথা উল্লেখ করেছে। কারণ এগুলাে এতাে বড়ো যে, মানুষ এগুলোর ভেতরে বা আশেপাশে বাস করে এবং এ গুলাের তুলনায় মানুষকে খুবই ছােট ও নগণ্য মনে হয়। এসব বড়াে বড়াে সৃষ্টি তাদের স্রষ্টাকে বিনা চেষ্টাতেই চেনে এবং তার সেই সব নিয়ম-কানুনের আনুগত্য করে, যা তার ওপর সৃষ্টিগত প্রক্রিয়াতেই চালু হয়, এরা মহান স্রষ্টার নিয়ম-কানুন ও প্রাকৃতিক বিধিকে সরাসরি ও কোনাে চিন্তা পরিকল্পনা বা মাধ্যম ছাড়াই মেনে চলে। এই নিয়ম কানুন-অনুসারে তারা নিজ কর্তব্য পালন করে এবং এক মুহূর্তের জন্যে তার বিরুদ্ধাচরণ করে না বা শৈথিল্য দেখায় না। তারা কোনাে ইচ্ছা বা অনুভূতি ছাড়াই তাদের হভাব প্রকৃতি অনুসারেই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। সূর্য তার জন্যে নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিয়মিত আবর্তন সম্পন্ন করে এবং তাতে কখনাে ত্রুটি করে না। আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে যে দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন, সে অনুসারে সে তার উত্তাপ বিকিরণ করে এবং তার গ্রহ-উপগ্রহগুলােকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে রাখে। এভাবে সে তার মহাজাগতিক দায়িত্ব পূর্ণভাবে পালন করে। পৃথিবী তার কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে, ফসল ফলায়, তার অধিবাসীদের খাদ্য যােগায়, মৃতদের লাশ নিজের বুকে ধারণ করে এবং নদ-নদী ও জলাশয়গুলোর জন্ম দেয়। এসব দায়িত্ব পালনে তার ইচ্ছার কোনাে ভূমিকা নেই, আল্লাহর বিধান অনুসারেই সে এসব কাজ করে। চাঁদ-তারা ও গ্রহ-উপগ্রহ, বাতাস, মেঘ, জলবায়ু, পানি, পাহাড়-পর্বত, আর্দ্রতা- এই সবকিছুই মহান আল্লাহর হুকুমে নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে। তারা তাদের স্রষ্টাকে চেনে এবং তার ইচ্ছামতাে চলে। অথচ এ জন্যে তার কোনাে চেষ্টা বা কষ্ট করতে হয় না। কিন্তু তারা একটা বিশেষ দায়িত্ব বহনে ভয় পেয়ে গেলাে। সে দায়িত্বটা হলাে ইচ্ছা শক্তি প্রয়ােগের দায়িত্ব, ব্যক্তিগত জ্ঞান অর্জনের দায়িত্ব এবং ব্যক্তিগত চেষ্টা সাধনার দায়িত্ব। মানুষ সে দায়িত্ব বহন করে। মানুষ সচেতনভাবে আল্লাহ তায়ালাকে চেনে ও জানে। সে তার নিয়ম কানুনের আনুগত্য করে আপন প্রজ্ঞা, অন্তর্দৃষ্টি ও বােধশক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে। আর এই নিয়মবিধি অনুসারে সে কাজ করে নিজস্ব চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমে। নিজ ইচ্ছা অনুসারে, নিজ প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে, বিপথগামিতার প্রবণতা প্রতিরােধের মাধ্যমে এবং প্রবৃত্তির খেয়াল খুশী নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের মাধ্যমে সে আল্লাহর আনুগত্য করে। এই সব পদক্ষেপে সে নিজের ইচ্ছাকে কাজে লাগায়, নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে প্রয়ােগ করে এবং কোনাে পথ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা জেনে বুঝেই একটা পথ অনুসর করে। এটা একটা বিরাট গুরুদায়িত্ব, যা এই ক্ষুদ্র, সীমিত শক্তিসম্পন্ন সীমিত আয়ুষ্কালসম্পন্ন এবং রকমারি লােভ-লালসা, প্রবণতা ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার সাথে যুদ্ধরত জীব-মানুষ গ্রহণ করেছে। সে ভারী বােঝা নিজের কাঁধে চড়িয়ে এক দুঃসাহসিক কাজ করেছে। এজন্যে বলা হয়েছে যে, ‘সে যালেম ও অজ্ঞ।’ অর্থাৎ সে নিজের ওপর যুলুম করেছে এবং নিজের শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ। তার দায়িত্বের বিরাটত্বের বিবেচনায় এ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সে যখন তার দায়িত্ব পালনে উদ্যোগেী হয়, আপন স্রষ্টার পরিচয় লাভ করে, তার নিয়ম-বিধির প্রত্যক্ষ আনুগত্য করে, তার প্রতিপালকের ইচ্ছা অনুসারে পুরােপুরিভাবে চলে, তখন সে নিশ্চিতভাবে এমন এক স্তরে উন্নীত হয়, যেখানে সে পরম সম্মানের মর্যাদা লাভ করে এবং আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে একটা অনন্য স্থানে পৌছে যায়। কারণ সে আল্লাহর সেই পরিচয় লাভ করে ও সেই আনুগত্য যা আকাশ পৃথিবী ও পাহাড়ের আনুগত্যের ন্যায় সহজ, পূর্ণাংগ ও সর্বাত্মক। এ সব সৃষ্টি প্রত্যক্ষভাবে ও স্বতস্ফূর্তভাবে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে, প্রত্যক্ষ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর সন্ধান লাভ করে। প্রত্যক্ষ ও স্বতস্ফূর্তভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে। তাদের মাঝে ও তাদের স্রষ্টার মাঝে এবং স্রষ্টার ইচ্ছা ও হুকুমের মাঝে কোনাে অন্তরায় থাকে না। তাদেরকে আনুগত্য থেকে ও কর্তব্য পালন থেকে কেউ বিরত রাখতে বা উদাসীন করতে পারে না। মূলত এই উপলব্ধি, ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা সাধনা এবং দায়িত্ব ও কর্মফলের চেতনাই হলাে আল্লাহর অন্যান্য বহ সৃষ্টির সাথে মানুষের পার্থক্য ও বৈশিষ্ট। এ জিনিসগুলােই তাকে সেই সম্মানের যােগ্য বানায়, যা আল্লাহ তায়ালা আদমকে সেজদা করতে ফেরেশতাদের বাধ্য করার সময় ঘােষণা করেছিলেন। এ কথা আল্লাহ তায়ালা কোরআনেও সংরক্ষণ করেছেন, ‘আমি আদমের বংশধর সম্মানিত করেছি।’ অতপর মানুষের জানা উচিত কিসের জন্যে সে আল্লাহর কাছে এতো সম্মানিত। তার সেচ্ছায় গ্রহণ করা সেই আমানত তথা গুরুদায়িত্ব তার পালন করা উচিত, যা আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বত গ্রহণ করার সাহস পায়নি। এর উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ তায়ালা মুনাফিক পুরুষ ও মহিলাদেরকে এবং মােশরেক পুরুষ ও মহিলাদেরকে শাস্তি দেবেন এবং মােমেন নারী ও পুরুষকে ক্ষমা করবেন, আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়ালু। বস্তুত একমাত্র মানুষকে আল্লাহর আমানত গ্রহণের জন্যে বাছাই করা এবং নিজেকে চেনা, নিজেরই সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া, নিজেই কাজ করা ও নিজেকে গন্তব্যে পৌছানাের দায়িত্ব নিজের কাঁধে চাপানাের উদ্দেশ্য শুধু এই যে, সে যেন নিজের স্বেচ্ছাকৃত দায়িত্বের ফলাফল বহন করে এবং তার শাস্তি বা পুরস্কার যেন তার নিজের কাজ অনুসারেই হয়। তারপর মােনাফেক ও মােশরেক নারী-পুরুষের ওপর তার আযাব নেমে আসে এবং আল্লাহর সাহায্য তার মােমেন বান্দাদের ওপর বর্ষিত হয়। ফলে বিভিন্ন অক্ষমতা ও দুর্বলতার চাপে, বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির কারণে এবং বিভিন্ন আকর্ষণ ও বােঝার কারণে যেসব ভুলত্রুটি তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়, তা আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেবেন। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের প্রতি নিজের ক্ষমা ও দয়া নিয়ে অধিকতর অগ্রসর। আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ এই গুরু গন্ভীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সূরাটা শেষ হচ্ছে। এই সূরা শুরু হয়েছিলাে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রসূলকে তার আনুগত্য করা, কাফের ও মােনাফেকদের আনুগত্য না করা, আল্লাহর ওহীর অনুসরণ করা এবং একমাত্র তার ওপর তাওয়াক্কুল করার নির্দেশের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে এ সূরায় ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের অতীব প্রয়ােজনীয় আইন-কানুন ও নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং একাগ্র চিত্তে এগুলাে অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে মানুষের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বা আমানতের গুরুত্ব ও বিরাটত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর মানুষের আল্লাহর সঠিক পরিচয় লাভ, তার বিধি-বিধান ও তার ইচ্ছা অনুসরণের মধ্যেই এই আমানতের বিরাটত্বকে সীমিত করা হয়েছে। অন্যকথায়, আল্লাহর বিধান অনুসরণই মানুষের ওপর অর্পিত সেই আমানত বা গুরুদায়িত্ব। এই গুরুগম্ভীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সূরাটা এবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। সূরার শুরু ও শেষের বিষয়বস্তু ও বক্তব্যের মধ্যে চমৎকার একটা সমন্বয় বিদ্যমান। এই অলৌকিক সমন্বয়ই এই মহাগ্ৰন্থের উৎসের সন্ধান দেয়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# “মনের গলদ” বলতে এখানে দু’ধরনের গলদের কথা বলা হয়েছে। এক, মানুষ নিজেকে মুসলমানদের মধ্যে গণ্য করা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলমানদের অশুভাকাংখী হয়। দুই, মানুষ অসৎ সংকল্প, লাস্পট্য ও অপরাধী মানসিকতার আশ্রয় নেয় এবং তার পূতিগন্ধময় প্রবণতাগুলো তার উদ্যোগ, আচরণ ও কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে।
# এখানে এমন সব লোকের কথা বলা হয়েছে যারা মুসলমানদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়াবার এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য সেসময় প্রতি দিন মদীনায় এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে বেড়াতো যে, অমুক জায়গায় মুসলমানরা খুব বেশী মার খেয়ে গেছে, অমুক জাগয়ায় মুলসমানদের বিরুদ্ধে বিপুল শক্তিশালী সমাবেশ ঘটছে এবং শিগগির মদীনার ওপর অতর্কিত হামলা হবে। এই সঙ্গে তাদের আর একটি কাজ এও ছিল যে, তারা নবীর পরিবার ও শরীফ মুসলমানদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার অলীক গল্প তৈরি করে সেগুলো ছড়াতে থাকতো, যাতে এর ফলে জনগণের মধ্যে কুধারণা সৃষ্টি হয় এবং মুসলমানদের নৈতিক প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
# আল্লাহর শরীয়াতের একটি স্বতন্ত্র বিধান আছে। সে বিধান হচ্ছে, একটি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রে এ ধরনের ফাসাদীদেরকে কখনো সমৃদ্ধি ও বিকাশ লাভের সুযোগ দেয়া হয় না। যখনই কোন সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থা আল্লাহর শরীয়াতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানে এ ধরনের লোকদেরকে পূর্বেই সতর্ক করে দেয়া হবে, যাতে তারা নিজেদের নীতি পরিবর্তন করে নেয় এবং তারপর তারা বিরত না হলে কঠোরভাবে তাদেরকে দমন করা হবে।
# সাধারণত কাফের ও মুনাফিকরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ধরনের প্রশ্ন করতো। এর মাধ্যমে জ্ঞানলাভ করা তাদের উদ্দেশ্য হতো না। বরং তারা ঠাট্টা-মস্করা ও তামাশা-বিদ্রূপ করার জন্য একথা জিজ্ঞেস করতো। আসলে তারা আখেরাতে বিশ্বাস করতো না। কিয়ামতের ধারণাকে তারা নিছক একটি অন্তসারশূন্য হুমকি মনে করতো। কিয়ামত আসার আগে তারা নিজেদের যাবতীয় বিষয় ঠিকঠাক করে নেবার ইচ্ছা রাখে বলেই যে তারা তার আসার তারিখ জিজ্ঞেস করতো তা নয়। বরং তাদের আসল উদ্দেশ্য এই হতো, “হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা তোমাকে ছোট করার জন্য এসব করেছি এবং আজ পর্যন্ত তুমি আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারোনি। এখন তাহলে তুমি আমাদের বলো, সেই কিয়ামত কবে হবে যখন আমাদের শাস্তি দেয়া হবে।”
# এ বিষয়বস্তুটি কুরআন মজীদের বহুস্থানে বর্ণনা করা হয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিম্নলিখিত স্থানগুলো দেখুনঃ আল আ’রাফ ১৮৭ , আন নাযি’আত ৪২ ও ৪৬ , সাবা ৩ ও ৫ , আল মুলক ২৪ ও ২৭ , আল মুতাফফিফীন ১০ ও ১৭ আল হিজর ০২ ও ০৩ , আল ফুরকান ২৭ ও ২৯ এবং হা-মীম আস সাজদাহ ২৬ ও ২৯ আয়াত।
# মনে রাখতে হবে, কুরআন মজীদে “যে ঈমানদারগণ।” শব্দাবলীর মাধ্যমে কোথাও তো সাচ্চা মু’মিনদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে আবার কোথাও মুসলমানদের দলকে সামগ্রীকভাবে সম্বোধন করা হয়েছে, যার মধ্যে মু’মিন মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার সবাই শামিল আছে। আবার কোথাও মুনাফিকদের দিকে কথার মোড় ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদারদেরকে যখনই الَّذِينَ آمَنُوا বলে সম্বোধন করা হয় তখন এর উদ্দেশ্য তাদেরকে লজ্জা দেয়া এই মর্ম যে, তোমরা তো ঈমান আনার দাবী করে থাকো আর এই হচ্ছে তোমাদের কাজ। আগের পিছের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে প্রত্যেক জায়গায় الَّذِينَ آمَنُوا বলে কোন্ জায়গায় কার কথা বলা হয়েছে তা সহজেই জানা যায়। এখানে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা পরিষ্কার জানাচ্ছে যে, এখানে সাধারণ মুসলমানদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে।
# অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে, “হে মুসলমানরা! তোমরা ইহুদিদের মতো করো না। মূসা আলাইহিস সালামের সাথে বনী ইসরাঈল যে আচরণ করে তোমাদের নবীর সাথে তোমাদের তেমনি ধরনের আচরণ করা উচিত নয়।” বনী ইসরাঈল নিজেরাই একথা স্বীকার করে যে, হযরত মূসা ছিলেন তাদের সবচেয়ে বড় অনুগ্রাহক ও উপকারী। এ জাতির যা কিছু উন্নতি অগ্রগতি সব তাঁরই বদৌলতে। নয়তো মিসরে তাদের পরিণতি ভারতের শূদ্রদের চাইতেও খারাপ হতো। কিন্তু নিজেদের এ মহান হিতকারীর সাথে এ জাতির যে আচরণ ছিল তা অনুমান করার জন্য বাইবেলের নিম্নোক্ত স্থানগুলোর ওপর একবার নজর বুলিয়ে নেয়া যথেষ্ট হবেঃ যাত্রাপুস্তক ৫:২০-২১, ১৪: ১১-১২, ১৬: ২-৩, ১৭: ৩-৪; গণনা পুস্তক ১১: ১-১৫, ১৪: ১-১০, ১৬: সম্পূর্ণ ২০: ১-৫।
এত বড় হিতকারী ব্যক্তিত্বের সাথে বনী ইসরাঈল যে বৈরী নীতি অবলম্বন করেছিল। তার প্রতি ইঙ্গিত করে কুরআন মজিদ মুসলমানদেরকে এই বলে সতর্ক করে দিচ্ছে যে, তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এ ধরনের আচরণ করো না। অন্যথায় ইহুদিরা যে পরিণাম ভোগ করেছে ও করছে, তোমরা নিজেরাও সেই পরিণামের জন্য তৈরি হয়ে যাও।
একথাটিই বিভিন্ন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বলেছেন। একবারের ঘটনা, নবী (সা.) মুসলমানদের মধ্যে কিছু সম্পদ বিতরণ করছিলেন। এ মজলিস থেকে লোকেরা বাইরে বের হলে এক ব্যক্তি বললো, “মুহাম্মাদ এই বিতরণের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি একটুও নজর রাখেননি।” একথা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) শুনতে পান। তিনি নবী করীমের কাছে গিয়ে বলেন, আজ আপনার সম্পর্কে এ ধরনের কথা তৈরি করা হয়। তিনি জবাবে বলেনঃ
رَحْمَةُ اللَّهِ عَلَى مُوسَى فانه أُوذِىَ بِأَكْثَرَ مِنْ هَذَا فَصَبَرَ “মূসার প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তাঁকে এর চেয়েও বেশী পীড়া ও যন্ত্রণা দেয়া হয় এবং তিনি সবর করেন। (মুসনাদে আহমাদ, তিরযিমী ও আবু দাউদ)
# বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে আল্লাহ মানুষকে এ চেতনা দান করতে চান যে, দুনিয়ায় সে কোন্ ধরনের মর্যাদার অধিকারী এবং এ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থেকে যদি সে দুনিয়ার জীবনকে নিছক একটি খেলা মনে করে নিশ্চিন্তে ভুল নীতি অবলম্বন করে, তাহলে কিভাবে স্বহস্তে নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করে।
এ স্থানে “আমানত” অর্থ সেই “খিলাফতই” যা কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে মানুষকে দুনিয়ায় দান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে আনুগত্য ও অবাধ্যতার যে স্বাধীনতা দান করেছেন এবং এ স্বাধীনতা ব্যবহার করার জন্য তাকে অসংখ্য সৃষ্টির ওপর যে কর্তৃত্ব ক্ষমতা দিয়েছেন। তার অনিবার্য ফল স্বরূপ মানুষ নিজেই নিজের স্বেচ্ছাকৃত কাজের জন্য দায়ী গণ্য হবে এবং নিজের সঠিক কর্মধারার বিনিময়ে পুরস্কার এবং অন্যায় কাজের বিনিময়ে শাস্তির অধিকারী হবে। এসব ক্ষমতা যেহেতু মানুষ নিজেই অর্জন করেনি বরং আল্লাহ তাকে দিয়েছেন এবং এগুলোর সঠিক ও অন্যায় ব্যবহারের দরুন তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে, তাই কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে এগুলোকে খিলাফত শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে এবং এখানে এগুলোর জন্য আমানত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
এ আমানত কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্বল সে ধারণা দেবার জন্য আল্লাহ বলেন, আকাশ ও পৃথিবী তাদের সমস্ত শ্রেষ্ঠত্ব এবং পাহাড় তার বিশাল ও বিপুলায়তন দেহাবয়ব ও গম্ভীরতা সত্ত্বেও তা বহন করার শক্তি ও হিম্মত রাখতো না কিন্তু দূর্বল দেহাবয়বের অধিকারী মানুষ নিজের ক্ষুদ্রতম প্রাণের ওপর এ ভারী বোঝা উঠিয়ে নিয়েছে।
পৃথিবী ও আকাশের সামনে আমানতের বোঝা পেশ করা এবং তাদের তা উঠাতে অস্বীকার করা এবং ভীত হওয়ার ব্যাপারটি হতে পারে শাব্দিক অর্থেই সংঘটিত হয়েছে। আবার এও হতে পারে যে, একথাটি রূপকের ভাষায় বলা হয়েছে। নিজের সৃষ্টির সাথে আল্লাহর যে সম্পর্ক রয়েছে তা আমরা জানতেও পারি না এবং বুঝতেও পারি না। পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য ও পাহাড় যেভাবে আমাদের কাছে বোবা, কালা ও প্রাণহীন, আল্লাহর কাছেও যে তারা ঠিক তেমনি হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আল্লাহ নিজের প্রত্যেক সৃষ্টির সাথে কথা বলতে পারেন এবং সে তার জবাব দিতে পারে। এর প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করার ক্ষমতা আমাদের বুদ্ধি ও বোশক্তির নেই। তাই এটা পুরোপুরিই সম্ভব যে, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ নিজেই এ বিরাট বোঝা তাদের সামনে পেশ করে থাকবেন এবং তারা তা দেখে কেঁপে উঠে থাকবে আর তারা তাদের প্রভু ও স্রষ্টার কাছে এ নিবেদন পেশ করে থাকবে যে, আমরা তো আপনারই ক্ষমতাহীন সেবক হয়ে থাকার মধ্যেই নিজেদের মঙ্গল দেখতে পাই। নাফরমানী করার স্বাধীনতা নিয়ে তার হক আদায় করা এবং হক আদায় না করতে পারলে তার শাস্তি বরদাশত করার সাহস আমাদের নেই। অনুরূপভাবে এটাও সম্ভব, আমাদের বর্তমান জীবনের পূর্বে আল্লাহ সমগ্র মানবজাতিকে অন্য কোন ধরনের একটি অস্তিত্ব দান করে নিজের সামনে হাজির করে থাকবেন এবং তারা নিজেরাই এ দায়িত্ব বহন করার আগ্রহ প্রকাশ করে থাকবেন। একথাকে অসম্ভব গণ্য করার জন্য কোন যুক্তি আমাদের কাছে নেই। একে সম্ভাবনার গণ্ডীর বাইরে রাখার ফায়সালা সেই ব্যক্তিই করতে পারে যে নিজের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছে।
তবে এ বিষয়টাও সমান সম্ভবপর যে, নিছক রূপকের আকারে আল্লাহ এ বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন এবং অবস্থার অস্বাভাবিক গুরুত্বের ধারণা দেবার জন্য এমনভাবে তার নকশা পেশ করা হয়েছে যেন একদিকে পৃথিবী ও আকাশ এবং হিমালয়ের মতো গগণচুম্বী পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে আর অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আছে ৫/৬ ফুট লম্বা একজন মানুষ। আল্লাহ জিজ্ঞেস করছেনঃ
“আমি আমার সমগ্র সৃষ্টিকূলের মধ্যে কোন একজনকে এমন শক্তি দান করতে চাই যার ফলে আমার সার্বভৌম কর্তৃত্বের মধ্যে অবস্থান করে সে নিজেই স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে আমার প্রাধান্যের স্বীকৃতি এবং আমার হুকুমের আনুগত্য করতে চাইলে করবে অন্যথায় সে আমাকে অস্কীকার করতেও পারবে আর আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা নিয়েও উঠতে পারবে। এ স্বাধীনতা দিয়ে আমি তার কাছ থেকে এমনভাবে আত্মগোপন করে থাকবো যেন আমি কোথাও নেই। এ স্বাধীনতাকে কার্যকর করার জন্য আমি তাকে ব্যাপক ক্ষমতা দান করবো, বিপুল যোগ্যতার অধিকারী করবো এবং নিজের অসংখ্য সৃষ্টির ওপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করবো। এর ফলে বিশ্ব-জাহানে সে যা কিছু ভাঙা-গড়া করতে চায় করতে পারবে। এরপর একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমি তার কাজের হিসেব নেবো। যে আমার প্রদত্ত স্বাধীনতাকে ভুল পথে ব্যবহার করবে তাকে এমন শাস্তি দেবো যা কখনো আমার কোন সৃষ্টিকে আমি দেইনি। আর যে নাফরমানীর সমস্ত সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আমার আনুগত্যের পথই অবলম্বন করে থাকবে তাকে এমন উচ্চ মর্যাদা দান করবো যা আমার কোন সৃষ্টি লাভ করেনি। এখন বলো তোমাদের মধ্য থেকে কে এ পরীক্ষাগৃহে প্রবেশ করতে প্রস্তুত আছে?
এ ভাষণ শুনে প্রথমে তো বিশ্ব-জগত নিরব নিথর দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একের পর এক এগিয়ে আসে। সকল প্রকাণ্ড অবয়ব ও শক্তির অধিকারী সৃষ্টি এবং তারা হাঁটু গেড়ে বসে কান্নাজড়িত স্বরে সানুনয় নিবেদন করে যেতে থাকে তাদেরকে যেন এ কঠিন পরীক্ষা থেকে মুক্ত রাখা হয়। সবশেষে এ একমুঠো মাটির তৈরি মানুষ ওঠে। সে বলে, হে আমার পওয়ারদিগার! আমি এ পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত। এ পরীক্ষায় সফলকাম হয়ে তোমার সালতানাতের সবচেয়ে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হবার যে আশা আছে সে কারণে আমি এ স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারের মধ্যে যেসব আশঙ্কা ও বিপদাপদ রয়েছে সেগুলো অতিক্রম করে যাবো।
নিজের কল্পনাদৃষ্টির সামনে এ চিত্র তুলে ধরেই মানুষ এই বিশ্ব-জাহানে কেমন নাজুক স্থানে অবস্থান করছে তা ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারে। এখন এ পরীক্ষাগৃহে যে ব্যক্তি নিশ্চিন্তে বসে থাকে এবং কতবড় দায়িত্বের বোঝা যে সে মাথায় তুলে নিয়েছে, আর দুনিয়ার জীবনে নিজের জন্য কোন নীতি নির্বাচন করার সময় যে ফায়সালা সে করে তার সঠিক বা ভুল হবার ফল কি দাঁড়ায় তার কোন অনুভূতিই যার থাকে না তাকেই আল্লাহ এ আয়াতে জালেম ও অজ্ঞ বলে অভিহিত করছেন। সে অজ্ঞ, কারণ সেই বোকা নিজেই নিজেকে অদায়িত্বশীল মনে করে নিয়েছে। আবার সে জালেম, কারণ সে নিজেই নিজের ধ্বংসের ব্যবস্থা করছে এবং নাজানি নিজের সাথে সে আরো কতজনকে নিয়ে ডুবতে চায়।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
# (لَئِنْ لَّمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُوْنَ)
‘যদি বিরত না হয় মুনাফিকরা’ আয়াতের উল্লিখিত
(وَالَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ)
যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা
(وَّالْمُرْجِفُوْنَ فِي الْمَدِيْنَةِ)
এবং মদীনায় গুজব রটনাকারীরা এসবগুলোই মুনাফিকদের খারাপ বৈশিষ্ট্য, তাদেরকে অধিক নিন্দাকরণার্থে ও তাদের এ সমস্যাগুলো তুলে ধরার জন্য আলাদা আলাদাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। مَّرَضٌ বা ইসলাম সম্পর্কে সংশয় বা কৃপ্রবৃত্তির ব্যাধি, আর الْمُرْجِفُوْنَ অর্থ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ফিতনা সৃষ্টি করা, মিথ্যা ও বাতিল কথা রটিয়ে বেড়ানো। অর্থাৎ এসব মুনাফিকরা যদি মু’মিনদেরকে কষ্ট দেয়া ও ওপরোল্লিখিত কাজসহ তাদের থেকে যে সব ঘৃণিত চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা থেকে বিরত না হয় তাহলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া ও হত্যা করার জন্য তোমাকে নির্দেশ দেব।
ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: তারা যদি মু’মিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত না থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেবেন। ফলে তারা মদীনাতে তোমার প্রতিবেশী হিসেবে কয়েকদিন ছাড়া থাকতে পারবে না। হয় তাদেরকে হত্যা করে ফেলবে অথবা তাদেরকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেবে। এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে যারা মুসলিমদের মাঝে অনিষ্ট সৃষ্টি করে তাদেরকে হত্যা করা অথবা এলাকা থেকে বের করে দেয়া যাবে। (তাফসীর সাদী)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এ বিধি-বিধান শুধু বর্তমানেই নয়। বরং অতীতে যারা ছিল সকলের জন্যই আল্লাহ তা‘আলার একই বিধান কার্যকর ছিল। আল্লাহ তা‘আলার বিধানে কোন প্রকার পরিবর্তন নেই। যারা অপরাধ করবে তাদেরকেই তিনি এভাবে শাস্তি প্রদান করে থাকেন। কাউকে কোন প্রকার ছাড় দেন না।
# মুসলিম সমাজে যারা বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে তাদেরকে হত্যা করা বা দেশান্তর করে দেয়া বৈধ।
৬৩-৬৮ নং আয়াতের তাফসীর:
(يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ……..)
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কষ্টদানকারী এসব ব্যক্তিরা কিয়ামতকে অসম্ভব ও মিথ্যা মনে করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করে যে, তা কখন হবে। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে উত্তর শিখিয়ে দিচ্ছেন যে, বলে দাও এর সঠিক জ্ঞান তো একমাত্র মহান আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কেউই রাখে না। এ সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ৫৯ নং এবং সূরা লুকমানের ৩৪ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের কঠিন দিনে কাফির-মুশরিকদের কী অবস্থা হবে সে কথা বর্ণনা করেছেন। তারা হল অভিশপ্ত জাতি, তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং তথায় তারা চিরকাল বসবাস করবে। সেখানে তাদের কোন বন্ধু থাকবে না এবং থাকবে না কোন সাহায্যকারী। সেখানে তাদের চেহারাকে জাহান্নামের মধ্যে ওলট-পালট করা হবে এবং তারা তখন বলবে, হায়! যদি আমরা আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰي يَدَيْهِ يَقُوْلُ يٰلَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلًا - يٰوَيْلَتٰي لَيْتَنِيْ لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيْلًا - لَقَدْ أَضَلَّنِيْ عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَا۬ءَنِيْ ط وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُوْلًا)
“জালিম ব্যক্তি সেদিন নিজ দুহাত দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! ‘হায়! দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! ‘আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল কুরআন থেকে আমার নিকট তা পৌঁছার পর।’ শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।” (সূরা ফুরকান ২৫:২৭-২৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْ كَانُوْا مُسْلِمِيْنَ)
“কখনও কখনও কাফিররা আকাক্সক্ষা করবে যে, তারা যদি মুসলিম হত!” (সূরা হিজর ১৫:২)
এরপর ঐ সকল কাফিররা বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতাগণ ও বড় বড় লোকদের আনুগত্য করেছি, যার ফলে তারা আমাদেরকে গোমরাহ করেছে। সুতরাং আজ তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন। কিন্তু তাদের ওজর কোনই কাজে আসবে না। তথায় তাদের সকলকেই শাস্তি দেয়া হবে। কারো প্রতি কোন প্রকার অনুগ্রহ করা হবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কারো নেই।
২. বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে ধর্ম মানা যাবে না।
৩. বড় বড় নেতা হলেই যে তারা সৎ পন্থী, এমনটি মনে করা যাবে না।
৬৯ নং আয়াতের তাফসীর:
কাফির-মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনদেরকে যেভাবে কষ্ট দিত আল্লাহ তা‘আলা মুু‘মিনদেরকে নিষেধ করছেন তারাও যেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কষ্ট না দেয়। তারা মূসা (عليه السلام)-কে কষ্ট দিয়েছিল, তোমরাও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কষ্ট দিওনা। মূসা (عليه السلام)-এর উম্মাতেরা যেভাবে তাকে কষ্ট দিয়েছিল তার বর্ণনা হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: মূসা (عليه السلام) ছিলেন একজন লজ্জাশীল লোক। তাঁর লজ্জার কারণে তাঁর শরীরের কোন অংশ কারো সামনে খুলতেন না। ফলে বানী ইসরাঈলের লোকেরা তাকে কষ্ট দিতে লাগল। তারা বলল: সম্ভবত তাঁর শরীরে ধবল রোগ বা ঐ ধরনের কোন খুঁত আছে, তাঁর অন্ডকোষদ্বয় বড় ইত্যাদি। তখন আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলেন তাঁকে এ সকল দোষ থেকে মুক্ত করবেন যা তারা মূসার ব্যাপারে বলছিল। একদা মূসা (عليه السلام) নির্জনে কাপড় খুলে পাথরের ওপর রেখে একাকী গোসল করতে লাগলেন। গোসল শেষে মূসা কাপড় নেয়ার জন্য আসলেন, এদিকে পাথর তাঁর কাপড় নিয়ে পালাতে লাগল। তখন মূসা তাঁর লাঠি নিয়ে পাথরের পিছন পিছন ছুটলেন এবং তিনি কাপড় কাপড় বলে পাথরকে ডাকতে লাগলেন। অবশেষে পাথর বানী ইসরাঈলের এক জনসভায় এসে থামল। তারা মূসা (عليه السلام)-কে উলঙ্গ অবস্থায় দেখল এবং তারা যে সন্দেহ করেছিল তা হতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মুক্ত করে দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৬)
৭০-৭১ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বে কাফির-মুশরিকদের কথা বর্ণনা করার পর অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদারদের কথা বর্ণনা করেছেন। তাদেরকে নির্দেশ প্রদান করছেন তারা যেন আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং সঠিক কথা বলে। অর্থাৎ এমন কথা বলে যাতে কোন প্রকার বক্রতা নেই, ধোঁকা নেই। এরূপ কথাবার্তা বললে ও সঠিক কার্যকলাপ করলে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিদানস্বরূপ তাদের কর্মকে ত্র“টিমুক্ত করবেন এবং পাপ ক্ষমা করে দেবেন। আর তারাই সফলতা লাভ করবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করতে হবে এবং সত্য কথা বলতে হবে। কোন প্রতারণা মূলক ক্রিয়া কলাপ বা কথাবার্তা বলা যাবে না।
২. আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য করতে হবে।
৩. আল্লাহ তা‘আলা চাইলে বান্দার সকল অপরাধ ক্ষমা করতে পারেন।
৭২-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর:
“أمانة” আমানত বলতে ঐ সকল শরয়ী আদেশ, ফরয ও ওয়াজীব কর্মসমূহকে বুঝানো হয়েছে যা পালন করলে নেকী ও সওয়াব লাভ হয় এবং তা হতে বিমুখ হলে বা তা অস্বীকার করলে গুনাহ হয় এবং এর জন্য শাস্তির অধিকারী হতে হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, এ শরীয়তের আমানত প্রথমে আকাশ-জমিন ও পর্বতমালার নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকার করেছে এভাবে যে, যদি তা যথাযথভাবে বহন করতে না পারে তাহলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। অবশেষে মানুষ জাতি এ দায়িত্ব বহণ করতে স্বীকৃতি জানাল এবং এ দায়িত্ব গ্রহণ করল। কারণ মানুষ জাতি একটু ত্বরাপ্রবণ, তাই তারা শাস্তির দিকটা না ভেবে প্রতিদান ও পুরস্কার লাভের লোভে উক্ত আমানত কবূল করে নিল।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা এর কারণ বর্ণনা করেছেন যে, এর মাধ্যমে মুনাফিক, মুশরিক ও মু’মিন চিহ্নিত হয়ে যাবে। চিহ্নিত হয়ে যাবে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী। ফলে তিনি সত্যবাদীদেরকে পুরস্কার দান করবেন এবং মিথ্যাবাদীদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যদি মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে ও যারা নগরে গুজব রটনা করে বেড়ায়, তারা বিরত না হয় তবে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রবল করবো এবং তাদের উপর তোমার আধিপত্য বিস্তার করবো। এরপর তারা খুব কম সময়ই মদীনায় অবস্থান করতে পারবে। অতি সত্বরই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যে কয়েক দিন তারা মদীনায় অবস্থান করবে সে কয়েকদিনও তারা কাটাবে অভিশপ্ত অবস্থায়। চারদিক থেকে তাদেরকে ধিক্কার দেয়া হবে। তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই ধরা হবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে।
আল্লাহ তা’আলা এরপর বলেনঃ পূর্বে যারা গত হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর বিধান। হে নবী (সঃ)! তুমি কখনো আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন পাবে না।
৬৩-৬৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে সংবাদ দিচ্ছেন যে, লোকেরা তাঁকে। কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও তার সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। এর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই রয়েছে। সূরায়ে আরাফেও এই বর্ণনা আছে এবং এই সূরায়ও রয়েছে। সূরায়ে আ’রাফ মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছিল এবং এই সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে মদীনায়। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত কিয়ামতের সঠিক জ্ঞান রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ছিল না। তবে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দাদেরকে এটুকু জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কিয়ামত অতি নিকটবর্তী। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “কিয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে।” (৫৪:১) আরো বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।” (২১:১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহর আদেশ আসবেই, সুতরাং ওটা ত্বরান্বিত করতে চেয়ো না।” (১৬:১)
মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ কাফিরদেরকে অভিশপ্ত করেছেন অর্থাৎ তাদেরকে স্বীয় রহমত হতে দূর করে দিয়েছেন। আর তাদের জন্যে (পরকালে) প্রস্তুত রেখেছেন জ্বলন্ত অগ্নি।
তারা তথায় চিরকাল অবস্থান করবে। অর্থাৎ সেখান হতে তারা বের হতেও পারবে না এবং নিষ্কৃতিও লাভ করবে না। সেখানে তাদের অভিযোগ শুনবার মত কেউ থাকবে না। সেখানে তাদের জন্যে এমন কোন বন্ধু-বান্ধব থাকবে না যারা তাদেরকে কিছুমাত্র সাহায্য করতে পারে বা ঐ কঠিন বিপদ হতে তাদেরকে ছাড়িয়ে নিতে পারে। তাদেরকে উল্টোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারা সেদিন আফসোস করে বলবেঃ হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও তাঁর রাসূল (সঃ)-কে মানতাম! যেমন আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে খবর দিয়েছেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যালিম ব্যক্তি সেই দিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবেঃ হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধু রূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে সে তো বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট উপদেশ পৌছবার পর। শয়তান তো মানুষের জন্যে মহা প্রতারক।” (২৫:২৭-২৯) মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “কখনো কখনো কাফিররা আকাঙ্ক্ষা করবে যে, তারা যদি মুসলিম হতো!” (১৫:২)
অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানে ঐ কাফিরদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। আমরা ভেবেছিলাম যে, আমাদের নেতারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তাদের কাছে হক ও সত্য আছে। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারছি যে, তারা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যার উপর ছিল। তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। সুতরাং হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে আপনি দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন। একতো এই কারণে যে, তারা নিজেরা কুফরী করেছে। আর দ্বিতীয় কারণ এই যে, তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে আমাদের সর্বনাশ সাধন করেছে। আর তাদেরকে মহা অভিসম্পাত দিন!
একটি কিরআতে (আরবি) এর স্থলে (আরবি) শব্দ রয়েছে। দুটোরই ভাবার্থ একই। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে একটি দু’আ শিখিয়ে দিন যা আমি আমার নামাযে পাঠ করবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তুমি নিম্নের দু’আটি পড়বেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আমার নফসের উপর বহু যুলুম করেছি। এবং আপনি ছাড়া কেউ গুনাহ মাফ করতে পারে না। সুতরাং আপনার পক্ষ হতে আমাকে ক্ষমা করে দিন এবং আমার উপর দয়া করুন, নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাখরীজ করেছেন) কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, দু’আয় (আরবি) ও (আরবি) এই দু’টি শব্দই মিলিয়ে নেয়া উচিত। কিন্তু এটা ঠিক নয়। বরং সঠিক কথা এটাই যে, কোন সময় বলতে (আরবি) হবে এবং কোন সময় (আরবি) বলতে হবে। যেটা ইচ্ছা সেটাই বলা যাবে কিন্তু দুটোকেই এক সাথে জমা করা যাবে না। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
# সহীহ বুখারীতে এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত মূসা (আঃ) একজন বড় লজ্জাবান লোক ছিলেন।” ইমাম বুখারীও তাঁর সহীহ গ্রন্থের ‘কিতাবুত তাফসীর’-এ কুরআন কারীমের এই আয়াতের ভাবার্থ এভাবেই সংক্ষেপে আনয়ন করেছেন। কিন্তু নবীদের হাদীসগুলোর বর্ণনায় এটাকে দীর্ঘভাবে এনেছেন। তাতে এও রয়েছে যে, তিনি অত্যধিক লজ্জার কারণে নিজের দেহের কোন অংশ কারো সামনে উলঙ্গ করতেন না। বানী ইসরাঈল তাকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছা করলো। তারা গুজব রটিয়ে দিলো যে, তাঁর দেহে শ্বেত-কুষ্টের দাগ রয়েছে অথবা এক শিরার কারণে একটি অণ্ডকোষ বড় হয়ে গেছে বা অন্য কোন রোগ রয়েছে, যার কারণে তিনি এভাবে তার দেহকে ঢেকে রাখেন।
আল্লাহ তাআলা তার উপর থেকে এই বদধারণা দূর করে দেয়ার ইচ্ছা করলেন। একদা তিনি নির্জনে উলঙ্গ অবস্থায় গোসল করছিলেন। একটি পাথরের উপর তার পরনের কাপড় রেখে দিয়েছিলেন। গোসল শেষ করে তিনি কাপড় নিতে যাবেন এমতাবস্থায় পাথরটি দূরে সরে গেল। তিনি তাঁর লাঠিটি নিয়ে পাথরের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু পাথরটি দৌড়াতেই থাকলো। তিনিও হে পাথর! আমার কাপড়, আমার কাপড় বলে চীৎকার করতে করতে পাথরের পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করলেন। বানী ইসরাঈলের একটি দল এক জায়গায় বসেছিল। যখন তিনি লোকগুলোর কাছে পৌঁছে গেলেন তখন আল্লাহ তা’আলার নির্দেশক্রমে পাথরটি সেখানে থেমে গেল। তিনি তাঁর কাপড় নিয়ে পরে নিলেন। বানী ইসরাঈল তার সমস্ত শরীর দেখে নিলো। যে গুজব তারা শুনেছিল তা থেকে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (আঃ)-কে মুক্ত করে দিলেন। রাগে হযরত মূসা (আঃ) পাথরের উপর তার লাঠি দ্বারা তিন বার বা চার বার অথবা পাঁচ বার আঘাত করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! ঐ পাথরের উপর তাঁর লাঠির দাগ পড়ে গিয়েছিল।” (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়নি। এই রিওয়াইয়াত বহু সনদে বহু কিতাবে বর্ণিত আছে। কিছু কিছু মাওকুফ রিওয়াইয়াতও রয়েছে)
এই (আরবি) বা মুক্ত করার কথাই এই আয়াতে বলা হয়েছে (আরবি) আল্লাহ পাকের এই উক্তি সম্পর্কে হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারূন (আঃ) পাহাড়ের উপর গিয়েছিলেন যেখানে হযরত হারূন (আঃ) ইন্তেকাল করেন। জনগণ হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর অহেতুক সন্দেহ পোষণ করতে লাগলো এবং তাকে শাসাতে ও ধমকাতে শুরু করলো। মহামহিমান্বিত আল্লাহ তা’আলার নির্দেশক্রমে ফেরেশতারা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে বানী ইসরাঈলের একটি মজলিসের পার্শ্ব দিয়ে চলতে থাকলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে বাকশক্তি দান করলেন। তিনি প্রকাশ করলেন যে, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তার কবরের সঠিক চিহ্ন জানা যায় না। শুধু ঐ পাহাড়টিই তার কবরের স্থানটির কথা জানে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা ওকে বাকশক্তিহীন করেছেন। তাহলে হতে পারে যে, (আরবি) বা কষ্ট দেয়া এটাই অথবা হতে পারে যে, (আরবি) দ্বারা ঐ কষ্টকে বুঝাননা হয়েছে যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমি বলি যে, এটা এবং ওটা দুটোই উদ্দেশ্য হতে পারে বা এ দু’টো ছাড়া অন্য কষ্টও উদ্দেশ্য হতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) লোকদের মধ্যে কিছু বন্টন করেন। একটি লোক বলেঃ “এই বন্টনে আল্লাহর সন্তুষ্টির ইচ্ছা করা হয়নি।” এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ “ওরে আল্লাহর শত্রু!
আমি অবশ্যই তোমার এ কথা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জানিয়ে দিবো।” সুতরাং তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এটা জানিয়ে দিলেন। এটা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চেহারা মুবারক রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। অতঃপর তিনি বলেনঃ “আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর সদয় হোন! তাকে এর চেয়েও বেশী কষ্ট দেয়া হয়েছিল। তথাপি তিনি ধৈর্য ধারণ করেছিলেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সাহাবীদেরকে বলেনঃ “আমার সাহাবীদের কেউ যেন কারো কথা আমার কাছে পৌঁছিয়ে না দেয়। কেননা, আমি পছন্দ করি যে, কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোেগ নেই এমতাবস্থায় যেন আমি তোমাদের মধ্যে বের হয়ে আসি।” অতঃপর একবার তাঁর কাছে কিছু মাল আসে। তিনি তা বন্টন করে দেন। বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি দু’টি লোকের পার্শ্ব দিয়ে গমন করি। তাদের একজন অপরজনকে বলছেঃ “আল্লাহর কসম! এ বন্টনে মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের ঘর কামনা করেননি।” এ কথা শুনে আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি বলেছেন যে, কেউ যেন কারো কোন কথা আপনার নিকট পৌঁছিয়ে না দেয়। কিন্তু আমি অমুক অমুক দুটি লোকের পার্শ্ব দিয়ে গমন করেছিলাম। তাদের একজন অপরজনকে এরূপ এরূপ কথা বলেছিল।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চেহারা মুবারক লাল হয়ে যায় এবং এটা তাঁর নিকট খুবই কঠিন বোধ হয়। অতঃপর তিনি বলেনঃ “ছেড়ে দাও, হযরত মূসা (আঃ)-কে এর চেয়ে বেশী কষ্ট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণ করেছিলেন।” (হাদীসটি এই ধারায় ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ঘোষিত হচ্ছেঃ মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান ছিল। তাঁর দুআ মহান আল্লাহর নিকট গৃহীত হতো। হ্যাঁ, তবে তিনি আল্লাহকে দর্শনের দু’আ করেছিলেন, তা গৃহীত হয়নি। কেননা, ওটা ছিল মানবীয় শক্তি বহির্ভূত। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, তিনি তাঁর ভাই-এর নবুওয়াতের জন্যে দু’আ করেছিলেন, সেটাও আল্লাহ তা’আলার নিকট গৃহীত হয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভ্রাতা হারূন (আঃ)-কে নবীরূপে।” (১৯:৫৩)
৭০-৭১ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দাদেরকে তাঁকে ভয় করার হিদায়াত করছেন। তিনি তাদেরকে বলছেন যে, তারা যেন তার ইবাদত এমনভাবে করে যেন তারা তাকে দেখছে এবং তারা সত্য ও সঠিক কথা বলে। তাদের কথায় কোন বক্রতা ও পাঁচ না থাকে। যখন তারা অন্তরে তাকওয়া পোষণ করে এবং মুখে সত্য কথা বলে তখন এর বদৌলতে আল্লাহ তাদেরকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করেন। তাদের সমস্ত গুনাহ তিনি মাফ করে দেন। আর ভবিষ্যতেও ক্ষমার সুযোগ দান করেন, যেন গুনাহ বাকী রয়ে না যায়। আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যই হলো সত্যিকারের সফলতা। এর মাধ্যমেই মানুষ জাহান্নাম হতে দূরে থাকে এবং জান্নাতের নিকটবর্তী হয়।
হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমাদেরকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যোহরের নামায পড়েন। সালাম ফিরানোর পর তিনি আমাদের প্রতি বসার ইঙ্গিত করেন। সুতরাং আমরা বসে পড়ি। অতঃপর তিনি বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা আমাকে হুকুম করেছেন যে, আমি যেন তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার ও সঠিক কথা বলার নির্দেশ দিই।” তারপর তিনি মহিলাদের নিকট আসেন এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন যে, আমি যেন তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার এবং সত্য ও সঠিক কথা বলার নির্দেশ দিই।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরে দাঁড়ালেই আমি তাঁকে বলতে শুনতামঃ “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।” (এ হাদীসটি ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) কিতাবুত তাকওয়ায় বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা খুবই গারীব বা দুর্বল হাদীস)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ যে এতে আনন্দ পায় যে, লোকে তার সম্মান করুক সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।”
হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, (আরবি) হলো (আরবি) বা সঠিক কথা। অন্য কেউ বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ হলো সত্যবাদিতা। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) হলো সোজা ও সঠিক কথা। এ সবই (আরবি) এর অন্তর্ভুক্ত।
৭২-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এখানে (আরবি) অর্থ হলো (আরবি) বা আনুগত্য। এটা হযরত আদম (আঃ)-এর উপর পেশ করার পূর্বে যমীন, আসমান ও পাহাড়ের উপর পেশ করা হয়। তারা সবাই কিন্তু এই বিরাট দয়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে। তখন মহা মহিমান্বিত আল্লাহ ওটা হযরত আদম (আঃ)-এর সামনে পেশ করেন এবং বলেনঃ “ওরা সবাই তো অস্বীকার করলো, এখন তুমি কি বলছো, বল।” হযরত আদম (আঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “ব্যাপার কি?” আল্লাহ্ তা’আলা উত্তরে বললেনঃ “এতে যা রয়েছে তা যদি তুমি মেনে চল তবে তুমি পুণ্য লাভ করবে ও ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। আর যদি অমান্য কর তবে শাস্তি পাবে।” তখন হযরত আদম (আঃ) বললেনঃ “আমি এ দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত আছি।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে আরো বর্ণিত আছে যে, এখানে আমানত দ্বারা ফারায়েয উদ্দেশ্য। অন্যান্যদের কাছে যে এটা পেশ করা হয়েছিল তা আদেশ পর্যায়ে ছিল না, বরং শুধু তাদের মনোভাব জেনে নেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। তাদের অস্বীকৃতি ও অক্ষমতা প্রকাশের কারণে তাদের কোন গুনাহ ছিল না। বরং ওটা তাদের এক ধরনের তা’যীম ছিল। পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের ব্যাপারেই তারা কেঁপে উঠেছিল। তারা ভয় করেছিল যে, পূর্ণভাবে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কিন্তু মানুষ অজ্ঞতা ও দুর্বলতার কারণে সন্তুষ্ট চিত্তে ঐ আমানত উঠিয়ে নিয়েছিল।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেই এটাও বর্ণিত আছে যে, প্রায় আসরের সময় মানুষ এই আমানত উঠিয়ে নিয়েছিল এবং মাগরিবের পূর্বেই ভুল প্রকাশ পেয়েছিল।
হযরত উবাই (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নারীদের সতীত্ব রক্ষাও একটা আমানত। হযরত কাতাদা (রঃ)-এর উক্তি আছে যে, ফারায়েয, হুদুদ ইত্যাদি সবই আল্লাহর আমানত। কারো কারো উক্তিমতে অপবিত্রতার গোসলও আমানত। যায়েদ ইবনে আসলাম বলেন যে, তিনটি জিনিস হলো আল্লাহর আমানত। ওগুলো হলো: অপবিত্রতার গোসল, রোযা এবং নাযায। ভাবার্থ এই যে, এগুলো সবই আল্লাহর আমানতের অন্তর্ভুক্ত। সমস্ত আদেশ পালন এবং সমস্ত নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকা মানুষের দায়িত্ব। যে ঐ দায়িত্ব পালন করবে সে সওয়াব পাবে এবং যে পালন করবে না সে পাপী হবে এবং শাস্তি পাবে।
হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেছেনঃ চিন্তা করে দেখো, আসমান নিরাপদ, সুন্দর এবং সৎ ও নিস্পাপ ফেরেশতাদের বাসস্থান হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর আমানত উঠাতে সাহস করেনি। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল যে, ঐ আমানত রক্ষায় অপারগ হলে সে শাস্তির যোগ্য হয়ে যাবে। যমীন অত্যন্ত শক্ত, দীর্ঘ ও প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও ঐ আমানত বহনের ব্যাপারে ভীত হয়ে গেল এবং বিনীতভাবে নিজের অক্ষমতা ও অপাগরতার কথা জানিয়ে দিলো। পাহাড় স্বীয় উচ্চতা, দৃঢ়তা ও কাঠিন্য সত্ত্বেও আমানতের ব্যাপারে কেঁপে উঠলো এবং নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করলো।
মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, আসমানসমূহ উত্তরে বলেছিলঃ “আমরা তো। এমনিতেই আপনার বাধ্য। কিন্তু এটা বহনের শক্তি আমাদের নেই। কেননা এতে অকৃতকার্য হলে বড় রকম বিপদের আশংকা রয়েছে। তারপর মহান আল্লাহ যমীনকে বললেনঃ “তুমি যদি এটা পূর্ণভাবে প্রতিপালন করতে পার তবে আমি তোমাকে দয়া, অনুগ্রহ ও দানে ভূষিত করবো।” সে উত্তর দিয়েছিলঃ “আমি তো সবকিছুতেই আপনার অনুগত। আপনি যে আদেশই আমাকে করেন আমি তা পালন করে থাকি। কিন্তু এটা আমার সাধ্যের অতিরিক্ত।” অতঃপর পাহাড়কে বলা হলে সেও উত্তরে বলেঃ “আমি তো আপনার অবাধ্য নই। কথা হলো এই যে, যদি আমানত আমার উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তবে তা আমি অবশ্যই উঠিয়ে নিবো, কিন্তু আসলে এটা বহনের ক্ষমতা আমার নেই। সুতরাং এটা হতে আমাকে অব্যাহতি দান করা হালে।” অতঃপর হযরত আদম (আঃ)-কে বলা হলো তিনি উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ! যদি আমি এটা পূর্ণভাবে প্রতিপালন করতে পারি তবে কি পাবো?” উত্তরে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “তাহলে তুমি অতি সম্মানের স্থান জান্নাত লাভ করবে। তুমি দয়া ও অনুগ্রহে ভূষিত হবে। আর যদি তুমি অবাধ্য হও তবে এই অবাধ্যতার কারণে তোমাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তোমাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হবে। তিনি তখন বললেনঃ “হে আল্লাহ! আমি এটা গ্রহণ করে নিলাম।”
মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আসমান উত্তরে বলেছিলঃ “হে আল্লাহ! আমি তারকামণ্ডলীকে স্থান এবং ফেরেশতাদেরকে জায়গা দিয়েছি, কিন্তু আমি এ দায়িত্ব পালন করতে পারবো না। এতো ফরযসমূহের ভার। এটা বহনের শক্তিই তো আমার নেই।যমীন বলেছিলঃ “হে আল্লাহ! আমার উপর আপনি গাছপালা লাগিয়েছেন, সাগর জারি করেছেন, মানুষকে স্থান দিয়েছেন। এগুলো আমি বহন করেই চলেছি। কিন্তু এখন যে আমানতের দায়িত্বভার আমার উপর অর্পণ করতে চাচ্ছেন, এটা বহন করা আমার সাধ্যের অতীত। আমি সওয়াবের আশায় আযাবের সম্ভাবনা কাঁধে নিতে পারবো না।” পাহাড়ও এ ধরনেরই জবাব দিলো। কিন্তু মানুষ ঐ দায়িত্বভার গ্রহণ করে নিলো।
কোন কোন রিওয়াইয়াতে আছে যে, তারা তিন দিন পর্যন্ত কাঁদতে থাকে ও নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু মানুষ ওটাকে কাঁধে উঠিয়ে নেয়। অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ মানুষকে সম্বোধন করে বলেনঃ “শুনো, যদি তোমার নিয়ত ভাল হয় তবে আমার সাহায্য সদা তোমার উপর থাকবে। তোমার চোখের দু’টি পলক করে দিবো। আমার অসন্তুষ্টির জিনিস হতে তোমার চোখ দুটি হেফাজত করবে। তোমার মুখে আমি দুটি ঠোট বানিয়ে দিচ্ছি। সে আমার মর্জির বিপরীত কিছু বলতে চাইলে ওকে বন্ধ করে দিবে। তোমার লজ্জাস্থানের হিফাজতের জন্যে আমি পোশাকের ব্যবস্থা করছি। আমার মর্জির বিপরীত তুমি ওটা খুলবে না।”
যমীন ও আসমান সওয়াব ও আযাবকে প্রত্যাখ্যান করলো এবং আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লেগে থাকলো। কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করে নিলো।
একটি খুবই গরীব বা দুর্বল মারফু হাদীসে আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আমানত ও অফা মানুষের উপর নবীদের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহর কালাম নবীদের মুখ হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছেছে। নবীদের ভাষার মাধ্যমে তারা ভাল-মন্দ সবকিছু জানতে পেরেছে। প্রত্যেকই পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। জেনে রেখো যে, আমানতই হলো সর্বপ্রথম জিনিস যা উঠানো হয় এবং মানুষের অন্তরে এর লক্ষণ বাকী রয়েছে। তারপর উঠানো হয় অফা, আহাদ বা অঙ্গীকার ও যিম্মাদারী। কিতাবসমূহ তাদের হাতে রয়েছে। আলেমরা আমল করছে। আর অজ্ঞরা জানছে, কিন্তু না জানার ভান করছে। এখন এই আমানত এবং অফা আমি পর্যন্ত ও আমার উম্মত পর্যন্ত পৌঁছেছে। জেনে রেখো যে, আল্লাহ তাকেই ধ্বংস করেন যে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে। তারা উদাসীনতায় লিপ্ত থাকে। হে লোক সকল! তোমরা সাবধান হয়ে যাও, ভাল হয়ে চল, শয়তানের প্রতারণায় প্রতারিত হয়ো না। আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করছেন যে, তোমাদের মধ্যে ভাল আমলকারী কে?”
হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন ঈমানসহ পাঁচটি জিনিস যে নিয়ে আসবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের হিফাজত করবে, ওগুলোর অ্যু, রুকূ’, সিজদা ও সময়সহ আদায় করবে আর খুশী মনে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের মালের যাকাত দিবে, অতঃপর তিনি বললেনঃ আল্লাহর কসম! মুমিন ছাড়া এটা কেউ করতে পারে না এবং আমানত আদায় করে।” জনগণ প্রশ্ন করলেনঃ “হে আবু দারদা (রাঃ)! আমানত আদায় করা কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “অপবিত্রতার গোসল। কেননা, আল্লাহ তাআলা স্বীয় দ্বীনকে রক্ষার ব্যাপারে আদম সন্তানকে এর চেয়ে বড় আমানত আর কিছু দেননি।”
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেন, আল্লাহর পথে জীবন দান সমস্ত পাপ মুছে ফেলে। কিন্তু আমানতের খিয়ানতকারীকে ক্ষমা করা হয় না। খিয়ানতকারীকে কিয়ামতের দিন আনয়ন করা হবে। অতঃপর তাকে বলা হবেঃ “তোমার আমানত আদায় কর।” সে উত্তর দিবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! কোথা হতে এবং কি করে আদায় করবো, দুনিয়া তো শেষ হয়ে গেছে।” তিনবার তাকে এ কথা বলা হবে এবং তিনবারই সে এই ব্রনের উত্তর দিবে। অতঃপর আদেশ করা হবেঃ “একে হাবিয়া জাহান্নামে নিয়ে যাও।” ফেরেশতারা তখন তাকে ধাক্কা দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। সে একেবারে তলদেশে পৌঁছে যাবে। অতঃপর সেখানে ঐ আমানতের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত আগুনের জিনিস তার দৃষ্টিগোচর হবে। ওটাকে সে উপরের দিকে উঠাতে থাকবে। যখন জাহান্নামের ধারে পৌছবে তখন তার পা পিছলে যাবে এবং আবার নীচে পড়ে যাবে। আবার জাহান্নামের তলদেশে চলে যাবে। পুনরায় উঠবে এবং পুনরায় পড়বে। চিরকাল সে ঐ শাস্তিই ভোগ করতে থাকবে।
অযু এবং নামাযেও আমানত আছে। কথা-বার্তার মধ্যেও আছে আমানত। সবচেয়ে বড় আমানত ঐ জিনিসগুলোতে রয়েছে যেগুলো আমানত হিসেবে কারো কাছে রাখা হয়। হযরত বারা (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হলো: “আপনার ভাই আবদুল্লাহ (রাঃ) কি হাদীস বর্ণনা করলেন তা কি আপনি শুনলেন না?” তিনি উত্তরে বললেন যে, তিনি সত্য বলেছেন।
হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের কাছে দু’টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। একটি তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি এবং দ্বিতীয়টির জন্যে অপেক্ষা করছি। প্রথম এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমানত মানুষের প্রকৃতির মধ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে। কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং হাদীসসমূহ বর্ণিত হয়েছে।” অতঃপর তিনি আমানত উঠে যাওয়া সম্পর্কে বলেনঃ “মানুষ শয়ন করবে এমতাবস্থায় তার অন্তর হতে আমানত উঠে যাবে। এমন একটি দাগ থেকে যাবে যা দেখে মনে হবে যেন কোন জ্বলন্ত কাঠ তার পায়ে লেগে আছে এবং এর ফলে তার পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। আর ওটা বেশ উঁচু হয়ে আছে। কিন্তু তার ভিতরে কিছুই থাকবে না।” অতঃপর তিনি একটি কংকর নিয়ে নিজ পায়ে চেপে দিয়ে লোকদেরকে তা দেখিয়ে দিলেন যে, এইভাবে জনগণ লেন-দেন ও ক্রয়-বিক্রয় করতে থাকবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও ঈমানদার থাকবে না। এমন কি এটা মশহুর হয়ে পড়বে যে, অমুক গোত্রের মধ্যে একজন আমানতদার লোক রয়েছে এবং এতদূর পর্যন্ত বলা হবে যে, এ লোকটি কতই না জ্ঞানী, বিজ্ঞ, বিদ্বান ও বিচক্ষণ! অথচ তার মধ্যে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান থাকবে না। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ “দেখো, ইতিপূর্বে তো আমি অনেককেই ধার কর্জ দিতাম এবং অনেকের নিকট হতে ধার নিতাম। কেননা, সে মুসলমান হলে তো আমার প্রাপ্য আমাকে দিয়ে যাবে। আর সে ইয়াহূদী বা খৃষ্টান হলে ইসলামী শাসন তার নিকট হতে আমাকে আমার প্রাপ্য আদায় করিয়ে দিবে। কিন্তু বর্তমানে আমি শুধু অমুক অমকুকে ধার কর্জ দিয়ে থাকি এবং বাকী সবাইকে ধার দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। (এটা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাঁদের সহীহ গ্রন্থে তাখরীজ করেছেন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন চারটি জিনিস তোমার মধ্যে থাকবে তখন সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও তোমার কোন ক্ষতি নেই। সেগুলো হলো : আমানত রক্ষা করা, সত্য কথা বলা, চরিত্র ভাল হওয়া এবং খাদ্য পবিত্র ও হালাল হওয়া।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রঃ) কিতাবুয যুহদে বলেছেন যে, একদা খাননাস ইবনে সাহীম অথবা জিবিল্লাহ ইবনে সাহীম (রঃ) যিয়াদ ইবনে হাদীর (রঃ)-এর সাথে ছিলেন। ঘটনাক্রমে তার মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়ঃ “আমানতের কসম!”এ কথা শুনে হযরত যিয়াদ (রঃ) কাঁদতে শুরু করেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে তিনি কাঁদতে থাকেন। তখন ইবনে সাহীম (রঃ) ভয় পেলেন যে, তার মুখ দিয়ে খুব কঠিন কথা বের হলো না কি! তাই তিনি বলেনঃ “তিনি কি ওটাকে মন্দ জানতেন? উত্তরে হযরত যিয়াদ (রঃ) বললেনঃ “হ্যা, হযরত উমার (রাঃ) এটাকে খুবই মন্দ জানতেন এবং এটা হতে নিষেধ করতেন।”
হযরত বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে আমানতের কসম খায় সে আমাদের মধ্যে নয়। (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাঊদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ হযরত আদম (আঃ) যা করলেন এবং পরিণামে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারী অর্থাৎ যারা বাহ্যিক মুসলমান এবং ভিতরে কাফির ছিল, আর যারা বাইরে ও ভিতরে উভয় ক্ষেত্রেই কাফির ছিল, তাদেরকে শাস্তি দিবেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর উপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হবে। যারা আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে এবং তাঁর রাসূলদেরকে মেনে চলতো এবং তার আনুগত্য করতো সঠিকভাবে। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।