(টপিক#১০৬০) [নাস্তিকদের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত :-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৪:সাবা পারা:২২ ১-৯ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬০)
[নাস্তিকদের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৪:সাবা
পারা:২২
১-৯ নং আয়াত:-
৩৪:১
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡ لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ وَ لَہُ الۡحَمۡدُ فِی الۡاٰخِرَۃِ ؕ وَ ہُوَ الۡحَکِیۡمُ الۡخَبِیۡرُ ﴿۱﴾
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিসের মালিক এবং আখেরাতে প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি বিজ্ঞ ও সর্বজ্ঞ।
৩৪:২
یَعۡلَمُ مَا یَلِجُ فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا یَخۡرُجُ مِنۡہَا وَ مَا یَنۡزِلُ مِنَ السَّمَآءِ وَ مَا یَعۡرُجُ فِیۡہَا ؕ وَ ہُوَ الرَّحِیۡمُ الۡغَفُوۡرُ ﴿۲﴾
যা কিছু যমীনে প্রবেশ করে, যা কিছু তা থেকে বের হয়, যা কিছু আকাশ থেকে নামে এবং যা কিছু তাতে উত্থিত হয় প্রত্যেকটি জিনিস তিনি জানেন। তিনি দয়াবান ও ক্ষমাশীল।
৩৪:৩
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَا تَاۡتِیۡنَا السَّاعَۃُ ؕ قُلۡ بَلٰی وَ رَبِّیۡ لَتَاۡتِیَنَّکُمۡ ۙ عٰلِمِ الۡغَیۡبِ ۚ لَا یَعۡزُبُ عَنۡہُ مِثۡقَالُ ذَرَّۃٍ فِی السَّمٰوٰتِ وَ لَا فِی الۡاَرۡضِ وَ لَاۤ اَصۡغَرُ مِنۡ ذٰلِکَ وَ لَاۤ اَکۡبَرُ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ ٭ۙ﴿۳﴾
কাফিররা বলে, ‘আমাদের কাছে কিয়ামত আসবে না।’ বলুন, অবশ্যই হ্যাঁ, শপথ আমার রবের, নিশ্চয় তোমাদের কাছে তা আসবে।’ তিনি গায়েব সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত; আসমানসমূহ ও যমীনে তাঁর অগোচরে নয় অণু পরিমাণ কিছু কিংবা তার চেয়ে ছোট বা বড় কিছু; এর প্রত্যেকটিই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।
৩৪:৪
لِّیَجۡزِیَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ ؕ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ ﴿۴﴾
যাতে তিনি প্রতিদান দেন তাদের, যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে। তাদেরই জন্য আছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিজিক।
৩৪:৫
وَ الَّذِیۡنَ سَعَوۡ فِیۡۤ اٰیٰتِنَا مُعٰجِزِیۡنَ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ مِّنۡ رِّجۡزٍ اَلِیۡمٌ ﴿۵﴾
যারা আমার বাক্যসমূহকে ব্যর্থ করার অপচেষ্টা করে তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে।
৩৪:৬
وَ یَرَی الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ ہُوَ الۡحَقَّ ۙ وَ یَہۡدِیۡۤ اِلٰی صِرَاطِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَمِیۡدِ ﴿۶﴾
যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তারা সুনিশ্চিতভাবে জানে যে, তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা সত্য; এবং তা মানুষকে পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর পথ নির্দেশ করে।
৩৪:৭
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ہَلۡ نَدُلُّکُمۡ عَلٰی رَجُلٍ یُّنَبِّئُکُمۡ اِذَا مُزِّقۡتُمۡ کُلَّ مُمَزَّقٍ ۙ اِنَّکُمۡ لَفِیۡ خَلۡقٍ جَدِیۡدٍ ۚ﴿۷﴾
কাফিররা বলে,’আমরা কি তোমাদেরকে এমন ব্যক্তির সন্ধান দেব যে তোমাদেরকে জানায় যে, ‘তোমাদের দেহ সম্পূর্ণ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লেও অবশ্যই তোমরা হবে নতুনভাবে সৃষ্ট !’
৩৪:৮
اَفۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا اَمۡ بِہٖ جِنَّۃٌ ؕ بَلِ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ فِی الۡعَذَابِ وَ الضَّلٰلِ الۡبَعِیۡدِ ﴿۸﴾
সে কি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, নাকি তার মধ্যে আছে উন্মাদনা ? বরং যারা আখিরাতের উপর ঈমান আনে না, তারা শাস্তি ও ঘোর বিভ্ৰান্তিতে রয়েছে।
৩৪:৯
اَفَلَمۡ یَرَوۡا اِلٰی مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مَا خَلۡفَہُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اِنۡ نَّشَاۡ نَخۡسِفۡ بِہِمُ الۡاَرۡضَ اَوۡ نُسۡقِطۡ عَلَیۡہِمۡ کِسَفًا مِّنَ السَّمَآءِ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لِّکُلِّ عَبۡدٍ مُّنِیۡبٍ ٪﴿۹﴾
তারা কি কখনো এ আকাশ ও পৃথিবী দেখেনি যা তাদেরকে সামনে ও পেছন থেকে ঘিরে রেখেছে? আমি চাইলে তাদেরকে যমীনে ধসিয়ে দিতে অথবা আকাশের কিছু অংশ তাদের ওপর নিক্ষেপ করতে পারি। আসলে তার মধ্যে রয়েছে একটি নির্দশন এমন প্রত্যেক বান্দার জন্য যে আল্লাহ‌ অভিমুখী হয়।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : ইসলামের প্রধান ও মৌলিক আকীদা আল্লাহর একত্ব, ওহীর সত্যতায় বিশ্বাস ও পরকালে বিশ্বাসই এই মাক্কী-সুরাটার আলােচ্য বিষয়। এর পাশাপাশি এতে উক্ত প্রধান আকীদাগুলাের সাথে সংশ্লিষ্ট আরাে কতিপয় মৌলিক তত্ত্বে সত্যায়ন করা হয়েছে। সেই সাথে বলা হয়েছে যে, ধন সম্পদ ও সন্তান সন্তুতি নয়, বরং ঈমান ও সৎকর্মই আল্লাহর কাছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রতিফল দানের ব্যাপারে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আর আল্লাহ তায়ালার ধরপাকড় থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কোন শক্তি কোথাও নেই এবং আল্লাহ তায়ালার অনুমতি ছাড়া কেউ তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে না। এ সূরায় যে বিষয়টার ওপর সবচেয়ে বেশী জোর দেয়া হয়েছে, তা হলাে পরকাল, কর্মফল এবং আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের সর্বব্যাপিতা, নির্ভুলতা ও সূক্ষ্মতা। এই দুটো পরস্পর সংশ্লিষ্ট বিষয়কে এ সূরায় বারবার বিভিন্ন ভংগীতে ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গােটা সূরার ওপর তার প্রভাব পড়েছে। যেমন পরকাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কাফেররা বলে আমাদের কাছে কেয়ামত আসবে না। তুমি বলাে, হ্যা, আমার প্রতিপালকের কসম, কেয়ামত তােমাদের কাছে অবশ্যই আসবে।’ কর্মফল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের যাতে তিনি কর্মফল প্রদান করতে পারেন…’ এর কাছাকাছি অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, যারা কুফরি করেছে, তারা বলে, তােমাদের কি এমন এক ব্যক্তির সন্ধান দেবাে, যে তােমাদের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, তােমরা সম্পূর্ণরূপে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর আবার নাকি তোমাদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করা হবে?…’ এ ছাড়া কেয়ামতের বিভিন্ন দৃশ্য। কেয়ামত অস্বীকারকারীদের প্রতি তিরষ্কার, যে আযাবকে তারা মিথ্যা মনে করতাে বা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতাে, তার বিভিন্ন রূপও এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন একটি দৃশ্য হলাে, ‘যদি তুমি দেখতে, যখন অত্যাচারীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে, তখন দুর্বলেরা অহংকারীদেরকে বলবে, ‘তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মােমেন হতাম। তাদেরকে তাদের কৃত কর্ম ছাড়া অন্য কিছুর প্রতিফল দেয়া হবে কি?'(আয়াত ৩১-৩৩) এ সব দৃশ্য এ সূরায় বারবার দেখানাে হয়েছে, সূরার বিভিন্ন জায়গায় তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং এ দিয়ে সূরায় সমাপ্তিও ঘটেছে, যেমন যদি তুমি দেখতে, যখন তারা আতংকিত হবে…’ (আয়াত ৫১-৫৪) আল্লাহ তায়ালার সর্বব্যাপী জ্ঞান সম্পর্কে সূরার শুরুতেই বলা হয়েছে, যা কিছু ভূগর্ভে প্রবেশ করে, ভূ-গর্ভ থেকে বের হয়, আকাশ থেকে নামে ও আকাশে ওঠে, সবই তিনি জানেন।’ কেয়ামতকে যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তাদের জবাবে বলা হয়েছে, ‘তুমি বলাে, হ্যা, আমার প্রতিপালকের শপথ, কেয়ামত তােমাদের কাছে অবশ্যই আসবে…'(আয়াত-৩) আর সূরার শেষ ভাগে বলা হয়েছে, বলাে, ‘নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক সত্যকে নিক্ষেপ করেন তিনি অদৃশ্য জান্তা।'(আয়াত-৪৮) তাওহীদ বিষয়ে সূরার শুরু করা হয়েছে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা দিয়ে, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য, যিনি আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সে সব কিছুর মালিক….’ আর মােশরেকদেরকে একাধিকবার চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে যে, ‘বল, তােমরা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর যাদের প্রভুত্বের দাবী কর, তারা আকাশ ও পৃথিবীতে কনামাত্র জিনিসেরও মালিক নয়!…’ এ আয়াতগুলােতে মােশরেকদের পক্ষ থেকে ফেরেশতা ও জ্বিনদের পূজা করার উল্লেখ রয়েছে এবং সেটা কেয়ামতের একটা দৃশ্য বর্ণনা প্রসংগে করা হয়েছে। যেমন, ‘যেদিন মহান আল্লাহ তাদের সকলকে একত্রিত করবেন অতপর ফেরেশতাদের বলবেন, এরা কি তােমাদের উপাসনা করতাে?…'(আয়াত ৪০-৪১) তারা ধারণা করতাে যে, ফেরেশতারা তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে সুপারিশ করবে। এ ধারণা খন্ডন করা হয়েছে ২৩ নং আয়াতে। যেহেতু তারা শয়তানের পূজা করতাে, তাই সেই প্রসংগে হযরত সােলায়মানের ঘটনা এবং জ্বীন জাতি কর্তৃক তার অনুগত করা ও তার মৃত্যু সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার ১৪ নং আয়াতে কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। ওহী ও রেসালাত সম্পর্কে ৩১, ৪৩, ২৮ ও ৬ নং আয়াতে বক্তব্য রাখা হয়েছে। আর মূল্যবােধ সংক্রান্ত বিষয়ে বক্তব্য এসেছে ৩৪ থেকে ৩৮ নং আয়াতে। এ সম্পর্কে ইতিহাস থেকে উদাহরণ পেশ করতে গিয়ে হযরত দাউদ(আ.)-এর কৃতজ্ঞ বংশধরের কাহিনী, সাবার দাম্ভিক ও কৃতঘ্নদের কাহিনী এবং উভয়ের পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। এতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রদত্ত সৎকর্মের পুরস্কার ও অসৎ কর্মের শাস্তির প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আলােচিত হয়েছে। অধিকাংশ মক্কী সূরাগুলােতে এই বিষয়গুলােই বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রত্যেক সূরায় মহাজাগতিক পরিবেশের বিবরণ দেয়ার মাধ্যমে এবং সেই সাথে বিভিন্ন হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য দ্বারা এ বিষয়গুলাে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। সূরা সাবাতেও একই পন্থায় মহাজাগতিক পরিবেশের বিবরণ দেয়ার মাধ্যমে আকীদাগত সত্যগুলাে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই পরিবেশের মধ্যে রয়েছে সুবিশাল আকাশ ও পৃথিবী, অজানা ও অদৃশ্য ভয়াল জগত, ত্রাস সৃষ্টিকারী কেয়ামতের ময়দান, হৃদয়ের গভীরতম ও সূক্ষ্ম জগত, ইতিহাসের জানা ও অজানা অধ্যায় এবং ইতিহাসের বিরল ও বিস্ময়কর দৃশ্যাবলী । এর প্রত্যেকটা জিনিসেই মানব মনকে প্রভাবিত ও উজ্জীবিতকারী, তাকে সচেতনকারী ও সক্রিয়কারী বক্তব্য রয়েছে। সূরার সূচনা থেকেই বিশাল মহাবিশ্বের, তাতে বিরাজমান আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনাবলীর ও তার সূক্ষ্ম ও সুপ্রশস্ত জ্ঞানের কথা আলােচিত হয়েছে। (আয়াত ২-৩) যারা আখেরাত অস্বীকার করে, তাদের এ সূরায় বিভিন্ন গুরুতর প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকি দেয়া হয়েছে। ৯ নং আয়াত দেখুন। যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে ফেরেশতাদের বা জ্বিনদের উপাসনা করে, তাদেরকে উচ্চতর ফেরেশতা জগতে অদৃশ্য সত্যের মুখােমুখী দাড় করানাে হয়েছে। যেমন ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে তার অনুমােদিত ব্যক্তি ছাড়া আর কারাে সুপারিশ সফল হবে না…'(আয়াত ২৩) আবার অন্যত্র কেয়ামতের মাঠে তাদেরকে ফেরেশতাদের মুখােমুখি দাঁড় করানাে হয়েছে, যেখানে কোনাে ঝগড়া বা বিতর্কে লিপ্ত হবার অবকাশ থাকবে না।(আয়াত ৪০) যারা রসূল(স.)-কে অস্বীকার করতাে তাঁকে মনগড়া ওহী তৈরী করার দায়ে অভিযুক্ত করতো কিংবা বলতাে যে, তার সাথে একটি জ্বিন থাকে। তাদেরকে দাঁড় করা হয়েছে তাদেরই মন ও বিবেকের সম্মুখে। যাবতীয় কৃত্রিম আড়াল ছিন্ন করে ও মনের ওপর কৃত্রিম প্রভাব সৃষ্টিকারী কথাবার্তা বাদ দিয়েই এটা করা হয়েছে। (৪৭ নং আয়াত লক্ষ্য করুন।) এভাবেই এ সূরাটা মানুষের উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলাের চারপাশে কেন্দ্রীভূত রাখে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে কেয়ামতের একটা ভয়াবহ দৃশ্যের মুখােমুখি এনে দাঁড় করায়। সূরাটার উপস্থাপনা ও ব্যাখ্যাকে সহজতর করার উদ্দেশ্যে তাকে পাঁচটা অধ্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে। তবে প্রকৃতপক্ষে এ অধ্যায়গুলোর মাঝে কোন সুক্ষ্ম পার্থক্য নেই। এটাই এই সূরার বৈশিষ্ট্য। সূরাটা শুরু হয়েছে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা দিয়ে, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর মালিক। যিনি আখেরাতে প্রশংসিত এবং যিনি মহাজ্ঞানী ও পরম কুশলী। তারপর আল্লাহ তায়ালার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও প্রশস্ততম জ্ঞানের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, যমীনে যা কিছু প্রবেশ করে, যা কিছু যমীনে থেকে বের হয়, যা কিছু আকাশ থেকে নামে ও আকাশে উঠে যায়, সব কিছু সম্পর্কেই তিনি জানেন। এরপর বলা হয়েছে যে, কাফেররা কেয়ামতকে অস্বীকার করে, আর আল্লাহ তায়ালা বারবার তাকে সত্য বলে সজোরে ঘােষণা করছেন। তার জ্ঞান এতাে সূক্ষ্ম ও নির্ভুল যে, আকাশ ও পৃথিবীতে একটা ক্ষুদ্র কণা এবং তারচেয়ে ছােটো বা বড় কোনাে জিনিসই তার অজানা নয়। তার জ্ঞান এতাে সূক্ষ্ম হওয়ায় তিনি মােমেনদের ও আল্লাহ তায়ালার আয়াতগুলাে নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্তদের যথােপযুক্ত প্রতিফল দিতে সক্ষম। সূরার অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, যারা প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী, তারা নবীর প্রতি নাযিল হওয়া ওহীকে সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। আর যারা পরকালকে অস্বীকার করে তাদের নির্বুদ্ধিতায় বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাদেরকে চরম বিপথগামী ও আযাবের উপযুক্ত বলে মন্তব্য করা হয়েছে। উপরন্তু তাদেরকে এই মর্মে হুমকি দেয়া হয়েছে যে, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি ধসিয়ে দিয়ে অথবা আকাশের ভাংগা টুকরাে তাদের মাথায় ফেলে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হতে পারে। এভাবে প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে হযরত দাউদ(আ.)-এর সেই সব বংশধরের কথা, যারা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের জন্য আল্লাহ তায়ালার যথাযথ শােকর আদায় করে থাকে। আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবীর বহু জিনিসকে হযরত দাউদ ও সােলায়মানের অনুগত ও বশীভূত করে দেয়া আল্লাহর এই নেয়ামত ও অনুগ্রহের অন্যতম নিদর্শন। এমন দুর্লভ নেয়ামত পেয়েও তারা কখনও দাম্ভিক বা অহংকারী হননি। এই সব অনুগত ও বশীভূত শক্তির মধ্যে জ্বিনও অন্তর্ভুক্ত। মােশরেকদের কেউ কেউ জ্বিনদের উপাসনা পর্যন্ত করে এবং তাদের কাছে অজানা ও অদৃশ্য খবর জানতে চায়। অথচ জ্বিনেরা অদৃশ্যের কোনাে খবরই জানে না । হযরত সােলায়মানের ইন্তেকালের পরও তারা তার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ও লাঞ্ছনাকর কাজ করেছে। কেননা তিনি যে মারা গেছেন, সে কথা তারা জানতেই পারেনি। কৃতজ্ঞতার এই ছিল দৃষ্টান্ত। যেমন সাবা সাম্রাজ্য ও তার রাণীর কাহিনী। আল্লাহ তায়ালার বিপুল নেয়ামত ও অনুগ্রহ ভােগ করেও তারা তার শােকর আদায় করেনি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, এর ফলে আমি তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছি।’ কেননা তারা শয়তানের আনুগত্য করেছিল। শয়তান তাদের ওপর কোনাে জোর খাটায়নি; বরং তারা স্বেচ্ছায় তাকে নিজেদের নেতা ও পথপ্রদর্শক বানিয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে সূচনা হয়েছে মােশরেকদেরকে এই মর্মে চ্যালেঞ্জ দেয়ার মাধ্যমে যে, ‘আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য যাদের তারা নিজেদের উপাস্য মনে করে, তাদের ডেকে আনুক ও তারা তাদের কতখানি সাহায্য করতে পারে দেখুক। আসলে তারা আকাশ ও পৃথিবীতে একটা কণার সমানও শক্তি রাখে না, আকাশ ও পৃথিবীতে কোথাও তাদের বিন্দুমাত্রও অংশীদারিত্ব নেই এবং তাদের মধ্যে কেউ আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ নেই। এই সব উপাস্য আল্লাহ তায়ালার কাছে তাদের জন্য একটু সুপারিশ করার ক্ষমতাও রাখে না, এমনকি তারা ফেরেশতা হলেও নয়। ফেরেশতারা সব সময় আল্লাহ তায়ালার আদেশের অনুগত এবং তারা তার সামনে টু শব্দটিও করার সাহস রাখে না। এ অধ্যায়ের এক জায়গায় প্রশ্ন করা হয়েছে যে, আকাশ ও পৃথিবী থেকে তাদের জীবিকা সরবরাহ করে কে? তারপর তার জবাব দেয়া হয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জীবিকা সরবরাহ করেন এবং তিনিই আকাশ ও পৃথিবীর মালিক। অতপর তাদের যাবতীয় বিরােধ আল্লাহ তায়ালার হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে এবং তিনিই তাদের সকল বিরােধ নিষ্পত্তি করবেন। এই অধ্যায়ের শুরুর মতাে শেষেও আবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে যে, যাদের তারা আল্লাহর শরীক বানায় তাদের দেখিয়ে দেয়া হােক। তারপর বলা হয়েছে, কখনাে দেখাতে পারবে না। বরং একমাত্র মা’বুদ হলেন আল্লাহ তায়ালা, যিনি মহাপরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞানী। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় একই সাথে ওহী ও রেসালাত, ওহী ও রেসালাতের সাথে কাফেরদের আচরণ, প্রত্যেক ইসলামী আন্দোলনের সাথে ইসলামের শত্রুদের আচরণ এবং তাদের জনশক্তি ও অর্থশক্তির গর্ব ও বড়াই নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে, হিসাব নিকাশ ও কর্মফল প্রকৃতপক্ষে যে জিনিসগুলাের ওপর নির্ভরশীল, তা হচ্ছে ঈমান ও সৎকাজ, জনবল ও ধনবল নয় । সেই সাথে কেয়ামতের একাধিক দৃশ্যে ঈমানদার ও বেঈমানদের পরিণাম তুলে ধরে দেখানাে হয়েছে কিভাবে বিভিন্ন দলমতের অনুসারীরা তাদের নেতৃবৃন্দকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। অনুরূপভাবে ফেরেশতারাও তাদের উপাসক বিভ্রান্ত মােশরেকদের প্রত্যাখ্যান ও নিজেদের নির্দোষিতা প্রমাণ করবে। এই সব দৃশ্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে তাদের আহ্বান জানানাে হয়েছে যে, তারা যেন তাদের আসল স্বভাব ও প্রকৃতিকে প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে পরিশুদ্ধ করে এবং রসূলকে প্রত্যাখ্যান না করে। যে রসূল তাদেরকে সুপথ প্রদর্শনের বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক চান না এবং যিনি মিথ্যুক নন, পাগলও নন, তাকে যেন অস্বীকার না করে। উভয় অধ্যায়ের সমাপ্তি টানা হয়েছে কেয়ামতের একটা দৃশ্য তুলে ধরার মাধ্যমে। আর সর্বশেষে সূরার সমাপ্তি ঘােষণা করা হয়েছে কয়েকটা গুরুগম্ভীর বক্তব্যের মাধ্যমে, তুমি বল, আমার প্রভু সত্য নিক্ষেপ করেন, তিনি যাবতীয় অদৃশ্য তত্ত্ব জানেন। বলো, সত্য এসে পড়েছে। অসত্য নতুন কিছু সৃষ্টিও করতে পারে না, পুনসৃষ্টিও করতে পারে না। বলাে, যদি আমি পথভ্রষ্টও হই, তবে তাে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে নিজেরই ক্ষতি সাধন করব, আর যদি আমি সৎপথের ওপর থাকি, তবে তা এ জন্য যে, আমার প্রভু আমার প্রতি ওহী প্রেরণ করেন। তিনি তাে সব শােনেন এবং অতি নিকটে অবস্থান করেন। অতপর কেয়ামতের একটা ভয়াল ও ক্ষুদ্র দৃশ্য তুলে ধরার মাধ্যমে সূরার সমাপ্তি টানা হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত আলােচনার পর এবার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আসছে।

‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য, আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছু যার মালিকানাধীন'(আয়াত ১ ও ২) আল্লাহ তায়ালার সাথে মােশরেকদের শিরক তাদের পক্ষ থেকে তাঁর রাসূল কে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করা, আখেরাতের প্রতি সন্দেহ পােষণ এবং পরকাল ও কেয়ামতকে অসম্ভব মনে করা-এই সব বিষয়ের পর্যালােচনায় পরিপূর্ণ এ সূরাটা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা দ্বারা সূচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা আর কোনাে মানুষ করুক বা না করুক, তিনি স্বতই প্রশংসিত। আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও গুণগানে নিয়ােজিত সমগ্র বিশ্ব জগতে তিনি প্রশংসিত এবং মানুষ ছাড়াও সমগ্র সৃষ্টিজগত কর্তৃক তিনি প্রশংসিত। প্রশংসার সাথে সাথে আকাশ ও পৃথিবীতে বিরাজিত যাবতীয় জিনিসের একচ্ছত্র মালিকানাও আল্লাহ তায়ালার বলে ঘােষিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার সাথে আর কারাে কোনো জিনিসের মালিকানা নেই। আকাশ ও পৃথিবীতে কোথাও কারাে কোন অংশীদারিত্ব নেই। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কিছু তার একচ্ছত্র মালিকানাধীন। এটাই ইসলামী আকাদীর প্রথম তত্ত্ব। এটা হলাে তাওহীদ। এই বিস্তৃত বিশ্বে সব কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। ‘তিনি ছাড়া আর কেউ কোনাে কিছুর মালিক নয়। আখেরাতে সকল প্রশংসা একমাত্র তারই।’ অর্থাৎ স্বতস্ফূর্ত প্রশংসা এবং বান্দাদের পক্ষ থেকে কৃত প্রশংসা উভয়ই। এমনকি পৃথিবীতে যারা আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করতাে, অথবা পথভ্রষ্ট হয়ে তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করতাে তারাও আখেরাতে প্রকৃত সত্য জানতে পারবে এবং একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করবে। আর তিনি মহাকুশলী সর্বজ্ঞ। তিনি এমন মহাকুশলী যে, যা কিছুই করেন, দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সাথে করেন, দুনিয়া ও আখেরাতকে সুকৌশলে পরিচালনা করেন এবং সমগ্র বিশ্ব জগতকে দক্ষতার সাথে পরিচালনা। করেন। তিনি সর্বদ। তাই সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন।  *আল্লাহর সীমাহীন জ্ঞান : এরপর আল্লাহ তায়ালা তার জ্ঞানের সুবিশাল ভান্ডারের একটা অংশ শুধু  দেখান-সমগ্র আকাশ ও পৃথিবী যার আওতাভুক্ত। পৃথিবীতে যা কিছু প্রবেশ করে, যা কিছু পৃথিবী থেকে বের হয়, যা কিছু আকাশ থেকে নামে এবং যা কিছু আকাশে ওঠে, তা তিনি জানেন।’ অল্প কয়েকটা শব্দে প্রকাশ করা এই অংশটা নিয়ে ভাবলেই মানুষ দেখতে পায় বিপুল সংখ্যক বস্তু, কর্ম, আকৃতি, রূপ, চিত্র, তত্ত্ব ও কাঠামাের এক বিশাল সমারােহ, যা কল্পনাও করা যায় না। এ আয়াতে যে সব জিনিসের দিকে ইংগিত করা হয়েছে, তার মধ্য থেকে যতগুলাে জিনিস এক মুহর্তে সংঘটিত হয়, সারা পৃথিবীর অধিবাসীরা জীবনভর গণনা করেও সেগুলাের সুনিশ্চিত সংখ্যা স্থির করতে পারবে না। এক মুহূর্তে পৃথিবীর অভ্যন্তরে কতগুলাে জিনিস প্রবেশ করে এবং কতকগুলাে জিনিস পৃথিবী থেকে বের হয়। এই এক মুহূর্তে কতগুলাে জিনিস আকাশ থেকে নামে এবং কতগুলাে জিনিস আকাশে উঠে যায়? পৃথিবীর ভূ-স্তুরগুলােতে কতগুলাে শস্য বীজ আত্মগােপন করে? কতগুলাে কীট পতংগ, পােকা মাকড়, সরীসৃপ পৃথিবীর বিভিন্ন দিক দিয়ে তার ভেতরে প্রবেশ করে? কতাে ফোটা পানি, কতাে বিন্দু গ্যাস ও কতাে ইউনিট বিদ্যুৎ পৃথিবীর বিস্তীর্ণ এলাকাগুলােতে প্রবেশ করে আল্লাহর সদা জাগ্রত চোখ তার সবকিছু দেখতে পায়! পৃথিবী থেকে কতাে জিনিসই বা বের হয়! কতো উদ্ভিদের চারা উদগত হয়! কতাে পানির ফোয়ারা বের হয়। কে আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণ ঘটে! কতাে গ্যাস আকাশে উঠে যায়! কতাে গুপ্ত জিনিস উদঘাটিত হয়! কতাে কীটপতংগ তার গুপ্ত বাসস্থান থেকে বের হয়! দৃশ্য ও অদৃশ্য এবং জানা ও অজানা কতাে জিনিস প্রবেশ করে ও বের হয়, কে তার ইয়ত্তা রাখে! কতাে জিনিসই বা আকাশ থেকে নামে! কতাে বৃষ্টির বিন্দু নামে! কতাে নক্ষত্র নামে! কতাে জ্বলন্ত রশ্মী এবং কতাে আলােকিত রশ্মী অবতীর্ণ হয়? কতাে স্থীরিকৃত সিদ্ধান্ত ও কতাে অদৃশ্যের ফায়সালা নামে? আল্লাহ তায়ালার কতাে অনুগ্রহ সমগ্র সৃষ্টিজগতের ওপর ব্যপ্ত হয় এবং কতাে রহমত বিশেষ বিশেষ বান্দার ওপর নামে? কতাে জীবিকা আল্লাহ তায়ালা তার কাংখিত বান্দাদের প্রতি বিস্তৃত করেন এবং কতাে জীবিকা থেকে তার বান্দাদেরকে বঞ্চিত করেন, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কে তার ইয়ত্তা রাখে? কতাে জিনিস আকাশে উঠে যায়? কতাে উদ্ভিদ, কতাে প্রাণী, কতাে মানুষ এবং মানুষের অজানা আরাে কতাে সৃষ্টি ওপরে উঠে যায়? আর আল্লাহ তায়ালার দিকে কতাে প্রকাশ্য বা গােপন আহ্বান উচ্চারিত হয়, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না। আমাদের জানা ও অজানা কতাে প্রাণ প্রতিনিয়ত আল্লাহ তায়ালার কাছে চলে যায়? কত ফেরেশতা আল্লাহর হুকুমে আকাশে উঠে যায়। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না, এমন কতাে আত্মা এই জগত থেকে উঠে যায়। কতাে বিন্দু পানি বাষ্প হয়ে আকাশে উঠে যায়? কত বিন্দু গ্যাস শরীর থেকে বের হয়? আল্লাহ ছাড়া আর কেইবা ইয়ত্তা রাখে যে, কি পরিমাণ জিনিস বের হয়? এক মুহূর্তে কতাে কী ঘটে যায়-সারা জীবন গণনা করেও মানুষ জানতে পারে না। আল্লাহ তায়ালার সর্বব্যাপী ও সূক্ষ্ম জ্ঞান সকল সময়ে ও সকল স্থানে সংঘটিত এই সব ঘটনার খবর জানেন। সকল প্রাণীর অন্তরে কী ধ্যানধারণা বিরাজ করে, কোন প্রাণী কী কী কাজ করে-সবই আল্লাহ তায়ালার চোখে উদ্ভাসিত। তিনি সব দেখেন ও সব জানেন। তবু সব কিছু গােপন করেন ও ক্ষমা করেন। তিনি দয়াশীল, ক্ষমাশীল।’ কোরআনের এই আয়াতটার মতাে একটা আয়াতই এ কথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, কোরআন মানব রচিত গ্রন্থ নয়। মহাবিশ্ব সংক্রান্ত এ ধরনের ধারণা ও কল্পনা স্বভাবতই মানুষের কল্পনা শক্তিতে আসতে পারে না। একমাত্র মহাবিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহর সৃষ্টিকর্মই এত ব্যাপকভাবে একটা মাত্র বাক্যে তুলে ধরা সম্ভব। এর সাথে কোনাে মানুষের সৃষ্টির তুলনা হতে পারে না।

# এ রকম ব্যাপক বিস্ময়কর পন্থায় এ তফাত্টা প্রকাশ করার পর পরবর্তী তিনটি আয়াতে অস্বীকারকারীদের অস্বীকৃতিমূলক উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে। অথচ এরা আগামীকাল কী ঘটবে তা জানে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ তায়ালা যাবতীয় অজানা ও অদৃশ্যের বিষয় অবগত। আকাশ ও পৃথিবীর কোন কিছু তার অগােচরে থাকে না। সৎ কর্মশীল ও অসৎকর্মশীলদের কৃতকর্মের। বিচারের জন্য কেয়ামত অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কাফেররা বলে, আমাদের কাছে কিয়ামত আসবে না। তুমি বলাে, হ্যা, আমার প্রভুর কসম, কেয়ামত অবশ্যই আসবে। তিনি অদৃশ্য জ্ঞাত।… ‘(আয়াত ৩, ৪ ও ৫) কাফেরদের আখেরাত অস্বীকার করার একমাত্র কারণ হলাে, তারা আল্লাহর সৃষ্টির মহৎ উদ্দেশ্য, সৃক্ষ্ম যুক্তি ও প্রজ্ঞা উপলব্ধি করে না। আল্লাহ তায়ালার এই মহৎ উদ্দেশ্য ও প্রজ্ঞা রয়েছে বলেই তিনি মানুষকে কর্মফলবিহীন ছেড়ে দেন না। যে ভালাে কাজ করে, সে তার ভালাে কাজের কোনাে ফল পাবে না এবং যে খারাপ কাজ করে, সে তার খারাপ কাজের কোন ফল পাবে না-এটা হতে পারে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলদের মুখ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি মানুষের সম্পূর্ণ অথবা আংশিক কর্মফল পরকালের জন্য রেখে দেন। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি জগতে তার যুক্তি ও প্রজ্ঞাকে যে ব্যক্তি উপলব্ধি করে, সে এ কথা অবশ্যই অনুধাবন করে যে, আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতি ও ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের জন্য আখেরাত অনিবার্য। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি কুফরি করে, তারা সেই যৌক্তিকতাকে উপলব্ধি করে না। এ জন্য তারা বলে থাকে যে, আমাদের কাছে কেয়ামত আসবে না। এ জন্যই তাদের কথার জবাব দেয়া হচ্ছে জোরালভাবে, ‘বলো, আমার প্রভুর কসম, কেয়ামত তােমাদের কাছে নিশ্চয়ই আসবে।’ বস্তুত আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল সত্য কথাই বলেছেন। তারা অদৃশ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না। তবুও যা জানে না, তা বড় গলায় বলে যে, কেয়ামত আসবেই। তিনি আলেমুল গায়ব’ অর্থাৎ তিনি অদৃশ্য জানেন। সুতরাং পরকালে কী হবে বা হবে না, সে সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য সুনিশ্চিত জ্ঞান ও প্রত্যয় ভিত্তিক এবং অকাট্য সত্য। এই জ্ঞানকে সূরার শুরুতে যেভাবে জাগতিক ও প্রাকৃতিক রূপ দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, এখানেও তেমনিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা এই মর্মে আরাে একটা সাক্ষ্য যে, এই কোরআন মানুষের রচনা হতে পারে না। কেননা মানুষের কল্পনায় কখনাে এ ধরনের রূপ ফুটে ওঠে না, ‘আকাশে ও পৃথিবীতে কণা পরিমাণ বস্তুও তার অগােচরে নেই, কিংবা কণার চেয়ে ছােট বা বড় নেই। আমি পুনরায় বলছি যে, এই ধারণা ও কল্পনার প্রকৃতি মনুষ্যসুলভ নয় এবং অতীতের কোনাে মানবীয় সাহিত্যে-গদ্যে বা পদ্যে-এর কোন নযীর নেই। মানুষ যখন জ্ঞানের সূক্ষ্মতা, ব্যাপকতা ও সর্বময়তার কথা বলে, তখন এ কথা তার কল্পনায়ও আসে না যে, এটাকে সে এরূপ বিস্ময়কর প্রাকৃতিক রূপ দিয়ে প্রকাশ করবে, ‘আকাশে ও পৃথিবীতে কণা পরিমাণ বস্তুও তার অগােচরে নেই ‘ সুক্ষ্ম ও সর্বব্যাপী জ্ঞানের জন্য মানবীয় সাহিত্যে এ ধরনের বর্ণনা দেয়ার কোনো দৃষ্টান্ত আছে বলে আমার জানা নেই। কেননা আল্লাহ তায়ালা নিজেকে ও নিজের জ্ঞানকে এমন সব বিশেষণে ভূষিত করেন, যা মানুষের কল্পনারও বাইরে। এভাবে কোরআন মানুষের ইলাহ’ সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণাকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করে। সর্বাবস্থায় তাকে সীমিত মানবীয় শক্তির আওতায় রাখে এবং তার গুণাবলী দ্বারা তাকে পরিচিত করে। ‘একটা প্রকাশ্য পুস্তকে সংরক্ষিত রয়েছে’ এ কথার সহজতর ব্যাখ্যা হলাে যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানই সকল জিনিসকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার অগোচরে এক কণা পরিমাণ কোনাে বস্তু আকাশে বা পৃথিবীতে নেই। ‘এই কণা পরিমাণ’ কথাটা নিয়ে একটু ভেবে দেখা দরকার। কণা বা অণুকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্তও সবচেয়ে ক্ষুদ্র বস্তু বলে মনে করা হতাে। কিন্তু অণুকে বিভক্ত করার পর মানব জাতি এখন জানতে পেরেছে যে, অণুর চেয়ে ক্ষুদ্র বস্তুও রয়েছে। এই ক্ষুদ্রতর বস্তু অণুরই অংশ। অথচ সেদিন পর্যন্তও এ কথা কারাে কল্পনায় আসেনি। মহান আল্লাহ কল্যাণময় হােন, যিনি তাঁর বান্দাদেরকে যতটুকু ইচ্ছা করেন, নিজের গুণাবলীর সৃক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তথ্য এবং নিজের সৃষ্টির অজানা রহস্য জানান। কেয়ামত যে অবশ্যই আসবে এবং কোন ছােট বা বড় বস্তু যে তার জ্ঞানের বাইরে নেই-এরূপ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য কী, তা বলা হয়েছে পরবর্তী দুটো আয়াতে, ‘যেন আল্লাহ তায়ালা ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করতে পারেন…'(আয়াত ৪ ও ৫) এ থেকে বুঝা গেল যে, প্রত্যেক সৃষ্টির পেছনে আল্লাহ তায়ালার মহৎ উদ্দেশ্য, সূক্ষ যুক্তি, প্রজ্ঞা ও পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে তিনি ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের জন্য এবং অসৎ কর্মশীল ও কাফেরদের যথােপযুক্ত কর্মফল দিতে পারেন। যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্মের মাধ্যমে ঈমানকে বাস্তবায়িত করেছে, তাদের ভুল ক্রুটি ক্ষমা করা হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে ‘সম্মানজনক জীবিকা।’ এই সূরায় জীবিকার প্রসংগ বহুবার এসেছে। তাই এখানে আখেরাতের নেয়ামতকে জীবিকা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বস্তুত আখেরাতের নেয়ামতও আল্লাহ তায়ালার এক ধরনের জীবিকা বটে। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ তায়ালার আয়াতগুলাে থেকে মানুষকে দূরে সরাতে চেষ্টা করে। তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক ও নিকৃষ্ট ধরনের শাস্তি। এটা বাতিলের পথে তাদের পরিচালিত অপতৎপরতার প্রতিফল। এভাবেই আল্লাহ তায়ালার হেকমত তথা সৃষ্টির যৌক্তিকতা ও মহৎ উদ্দেশ্য সফল হয়, সফল হয় অবধারিত কেয়ামতের উদ্দেশ্য, যা কখনাে আসবে না বলে তারা দাবী করে থাকে। কেয়ামত একটা অজানা ও অদৃশ্য গায়বী ঘটনা হওয়া সত্তেও তারা এই বলে আস্ফালন করে থাকে যে, ওটা কখনাে হবে না। অথচ অদৃশ্য জগতের মালিক আল্লাহ তায়ালা জোর দিয়ে বলছেন যে, কেয়ামত অবধারিত।

*কোরআন যেভাবে সঠিক পথের দিশা দেয় : ওদিকে আল্লাহ তায়ালার বাণী প্রচারের কাজে নিয়ােজিত রসূল(সঃ) বলেন যে, ‘যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, ……… এবং তা মানুষকে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসিত পথেই পরিচালিত করে'(আয়াত ৬) ‘যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে’ কথাটা দ্বারা আহলে কিতাব তথা ইহুদী ও খৃষ্টানদের বুঝানাে হয়েছে। কেননা তারা তাদের কিতাব থেকেই জানে যে, কোরআন সত্য ও সুপথ প্রদর্শক। তবে এ আয়াতের বক্তব্যের পরিধি ইহুদী খৃষ্টানদের মধ্যে সীমিত নয়-বরং তার চেয়েও ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী। যাদেরকে জ্ঞান জ্ঞান দেয়া হয়েছে। চাই তা যে কোন যুগের যে কোন স্থানের ও যে কোন প্রজন্মের লােকই হােক না কেন, তাদের জ্ঞান যখন বিশুদ্ধ ও পরিপক্ক হয়, তখন তারা উপলব্ধি করে যে, কোরআনের বক্তব্যই সঠিক। কোরআন অনাগত কালের সকল প্রজন্মের জন্য এক উন্মুক্ত কিতাব। নির্ভুল ও বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে এই কিতাব প্রকৃত সত্যকে উন্মোচন করে। বিশ্ব জগতের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সত্যকে এই কিতাব উদঘাটন করে। এই সৃষ্টি জগত ও তার ভেতরে যে প্রকৃত সত্য রয়েছে, কোরআন তার নিখুঁততম তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে। মহাপরাক্রান্ত ও মহা প্রশংসিত আল্লাহ তায়ালার পথে চালিত করে। মহা পরাক্রান্ত ও মহা প্রশংসিত আল্লাহ তায়ালার পথ বলতে আল্লাহর সেই জীবন বিধানকে বুঝায়, যা তিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য ও মানুষের জন্য মনােনীত করেছেন, যাতে সমগ্র সৃষ্টিজগতের কর্মকাণ্ডের সাথে মানুষের কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ঘটে। এই জীবন বিধান হচ্ছে সেই সব নিয়ম ও বিধান, এই গােটা সৃষ্টি জগতের ওপর কর্তৃত্ব করে। মানব জীবনও এই সৃষ্টি জগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উৎস, মূল, বিধিব্যবস্থা, ও কর্মকান্ড-কোনাে কিছুর দিক দিয়েই মানব জীবন অবশিষ্ট সৃষ্টি জগত থেকে এবং সৃষ্টি জগতের যাবতীয় প্রাণী ও বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কোরআন মহা পরাক্রান্ত ও মহা প্রশংসিত আল্লাহ তায়ালার পথে কিভাবে মানুষদের চালিত করে? মােমেনের চেতনায় সৃষ্টি জগত, তার সাথে সম্পর্ক ও মূল্যবােধ, সৃষ্টি জগতে মানুষের মর্যাদা ও ভূমিকা, মানুষের চার পাশে বিরাজমান বিভিন্ন সৃষ্টি কর্তৃক আল্লাহর ইচ্ছা ও তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পারস্পরিক সহযােগিতা এবং সকল সৃষ্টির কর্মকান্ডের সমন্বয় ও একাত্মতার মধ্য দিয়ে মহান স্রষ্টার আনুগত্য করার প্রেরণা উজ্জীবনের মাধ্যমে। চিন্তা পদ্ধতির সংশােধন, চিন্তা পদ্ধতি নির্ভুল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ব জগতের প্রাকৃতিক নিয়ম বিধির সাথে মানবীয় স্বভাব প্রকৃতির এমন সমন্বয় সাধন করে, যাতে এই প্রক্রিয়া মানবীয় চিন্তাধারাকে এই বিশ্ব জগতের স্বভাব প্রকৃতি, বৈশিষ্ট ও নিয়ম বিধি বুঝতে, তার সাহায্য নিতে ও তার সাথে কোন রকম সংঘাত, সংঘর্ষ ও জটিলতা ছাড়াই পরিপূর্ণ একাত্মতা গড়তে সাহায্য কতে পারে। কোরআনের সেই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে, যা ব্যক্তিকে সমাজের সাথে পরিপূর্ণ একাত্মতা, সংহতি ও সমন্বয়ের জন্য প্রস্তুত করে, সমাজকে ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয় পর্যায়ে সমগ্র বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টিকুলের সাথে সংহতি ও সমন্বয়ের জন্য প্রস্তুত করে, সর্বোপরি সকল সৃষ্টিকুলকে যে জগতে তারা অবস্থান করে, তার স্বভাব প্রকৃতির সাথে সমন্বয় ও একাত্মতার জন্য প্রস্তুত করে। আর এই সব কিছুই সে অত্যন্ত সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ উপায়েই সম্পন্ন করে। কোরআনের সেই সব আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে, যা মানবীয় স্বভাব প্রকৃতি, তার মৌলিক জীবন যাপন পদ্ধতি ও অর্থনীতির সাথে সংগতিপূর্ণ, যা মানুষ ছাড়া অন্য সকল প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণকারী বিধি-বিধানের সাথে ও অন্য সকল সৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ জন্য মানুষের আইন কানুন সৃষ্টি জগতের সাধারণ নিয়ম নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ও তার সাথে অসংগতিপূর্ণ হতে পারে না। কেননা মানুষ এ মহাবিশ্বের অসংখ্য সৃষ্টিকূলেরই একটা জাতি বা শ্রেণী মাত্র। এই মহাগ্রন্থ কোরআন আল্লাহ তায়ালার শাশ্বত, নির্ভুল, সরল ও সঠিক পথের দিকনির্দেশক। মানুষের ও এই পথের যিনি স্রষ্টা, তিনিই এই দিকনির্দেশক ও এই পথের সন্ধানদাতা ও রচয়িতা। উভয়ের স্বভাব প্রকৃতি সম্পর্কেও তিনি অবগত। আপনি যে সড়ক দিয়ে চলবেন, সেই সড়ক নির্মাণকারী প্রকৌশলীর নিজের রচিত একটা গাইড যদি আপনার কাছে থাকে, তাহলে আপনি অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে পথ চলতে পারবেন এবং হতে পারবেন একজন প্রাজ্ঞ যাত্রী। আর সড়ক নির্মাণকারী ইঞ্জিনিয়ার যদি খোদ যাত্রীরও নির্মাতা হয়ে থাকেন, তাহলে তা সােনায় সােহাগা!
*পরকালে অবিশ্বাসীদের জীবন : চেতনা উজ্জীবনকারী এই আয়াত কটার পর পুনরায় মােশরেকদের পরকাল সংক্রান্ত কথাবার্তা ও তাদের বিষয় নিয়ে আলােচনা শুরু হয়েছে। তারা কেয়ামত ও আখেরাতের বিষয়টাকে এতাে অসম্ভব মনে করে যে, জিন ভূতে আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ যেন এ সব কথা মুখেই আনতে পারে না। জ্বিন ভূতে আক্রান্ত মানুষ অনেক অসম্ভব কথা, মিথ্যে কথা ও বিস্ময়কর কথা বলে থাকে। ‘তারা বলে, তােমাদেরকে কি এমন এক ব্যক্তির সন্ধান দেব,’ (আয়াত ৭ ও ৮) পরকালের বিষয়টাকে তারা এতােই বিস্ময়কর ও অসম্ভব মনে করতাে যে, এ বিষয়ে যে কথা বলতাে, খুব ঢাক ঢােল পিটিয়ে তাকে দেখার জন্য জনতাকে কৌতূহলী করে তুলতো ও দেখার আহ্বান জানাতাে। ‘তারা বলতাে যে, তােমাদেরকে কি এমন এক ব্যক্তির সন্ধান দেব, যে তােমাদেরকে বলে যে, তােমরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তােমাদেরকে নাকি নতুন করে সৃষ্টি করা হবে?’ অর্থাৎ এমন এক আজব ও অদ্ভুত ব্যক্তিকে দেখতে চাও তাে এসাে যে, একটা উদ্ভট ও অসম্ভব রকমের কথা বলে। সে বলে কিনা, মরে পচে গলে ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তােমরা নাকি পুনরায় সৃষ্টি হবে এবং পুনরায় অস্তিত্ব ফিরে পাবে! তাদের এই বিষয়, এই ঢাক ঢােল ও হৈ হল্লোড় চলতেই থাকে। তারা বলে, সে কি আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলেছে, নাকি তার ঘাড়ে জ্বিন চেপেছে। তাদের ধারণামতে, একজন মিথ্যাবাদী ছাড়া আর কারাে পক্ষে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এমন মনগড়া কথা বলা সম্ভব নয় যা তিনি বলেননি, কিংবা একজন জ্বীনে ধরা লোকও এ ধরনের প্রলাপ বকতে বা আজব কথাবার্তা বলতে পারে! এতসব হৈ চৈ শুধু এ জন্য যে, রসূল(স.) তাদেরকে বলেন, তােমরা মৃত্যুর পর আবার পুনরুজ্জীবিত হবে। অথচ তাদেরকে যখন প্রথমে একবার সৃষ্টি করা হয়েছে, তখন পুনরায় সৃষ্টি করাতে বিস্ময়ের কী আছে। প্রথম সৃষ্টির এই বিস্ময়কর ঘটনার দিকে তাদের চোখ পড়ে না। অথচ প্রথম সৃষ্টিটাই বিষ্ময়। এটা যদি তারা ভেবে দেখতাে, তাহলে পুনরায় সৃষ্টির ব্যাপারে একটুও বিস্বয় প্রকাশ করতাে না। তাে আসলে তারা বিপথগামী। তাই কোরআন তাদের এই হৈ চৈ ও বিস্ময় সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেছে! ‘আসলে যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তারা আযাবে আছে এবং তারা দূরবর্তী গােমরাহীতে লিপ্ত।’ আযাবে আছে এ কথাটা দ্বারা আখেরাতের আযাবকে বুঝানাে হতে পারে এবং আযাব নিশ্চিত ও অবধারিত বলে এভাবে বলা হয়ে থাকতে পারে যেন, তারা এখনই আযাবে আছে। দূরবর্তী গােমরাহীতে লিপ্ত হওয়ার অর্থ এমন গোমরাহীতে লিপ্ত হওয়া, যার পর সুপথ প্রাপ্তির আশা করা যায় না। এর অন্য একটা অর্থও হতে পারে যে, যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তারা একই সাথে এই পৃথিবীতে আযাবে ও গােমরাহীতে লিপ্ত থাকে। এটা একটা সূক্ষ্ম বিষয়। যে ব্যক্তি আখেরাতে বিশ্বাস করে না, সে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণায় ভোগে । দুনিয়ার জীবনে সে যতাে দুঃখ কষ্ট ভােগ করে, তার কোনাে সুবিচার, প্রতিদান বা ক্ষতিপূরণ পাবে বলে তার আশা থাকে। পার্থিব জীবনে মানুষ মাত্রই কিছু না কিছু বিপদ মুসিবত ভােগ করতে বাধ্য হয়। অথচ সে আখেরাতে এর বিনিময়ে সওয়াব পাবে এবং তার ওপর যে যুলুম করেছে সে এর পরিণতি ভােগ করবে-এ বিশ্বাস না থাকলে তার কষ্টে ধৈর্য ধারণের মনােবল ও সাহস থাকে না। সে আখেরাতে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করবে এবং দুনিয়ার ছােটো বড় প্রতিটা কাজের ফল পাবে এই বিশ্বাস থাকলে তার পক্ষে সকল বিপদে ধৈর্য ধারণ করা সহজ হয়। পৃথিবীতে কেউ যদি একটা ক্ষুদ্র সরিষায় পরিণত হয়ে কোন পাহাড় পর্বতে, আকাশে বা পৃথিবীতে লুকিয়ে থাকে, তাহলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে খুঁজে বের করবেন। এই বিশ্বাসের জানালা যার খােলা থাকে না, সে নিসন্দেহে এই দুনিয়াতেই আযাব ও গােমরাহীতে লিপ্ত থাকে। তদুপরি আখেরাতের আযাবও তাকে ভােগ করতে হবে। পক্ষান্তরে আখেরাতে বিশ্বাস একটা রহমত ও নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালার বান্দাদের মধ্য থেকে যারা একনিষ্ঠ এবাদাত, সত্যের অনুসরণ, ও হেদায়াতের অন্বেষণে লিপ্ত থাকে। তাদেরকে তিনি এই নেয়ামত ও রহমত দিয়ে থাকেন। খুব সম্ভবত আয়াত দ্বারা এই শেষােক্ত অর্থটাই বুঝানাে হয়েছে। যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, মনস্তাত্ত্বিক আযাব ও গোমরাহী এই দুটো শাস্তিই তারা ভোগ করে থাকে। আখেরাতে অবিশ্বাসী এই লােকদেরকে এক ভয়ংকর পার্থিব শাস্তির হুমকি দেয়া হয়েছে। এই শাস্তি হলাে, মাটির নীচে ধসে যাওয়া অথবা আকাশ ভেংগে তাদের মাথায় পড়া। তবে কি তারা তাদের সামনে ও পেছনে যে আকাশ ও পৃথিবী রয়েছে, তা দেখে না?…'(আয়াত ৯) এটা একটা ভয়ংকর পার্থিব দৃশ্য। এ ধরনের ঘটনা কখনাে কখনাে তারা চাক্ষুস দেখে থাকে, কখনাে বা উপলব্ধি করে। পৃথিবীর ধসে যাওয়ার ঘটনা অহরহই ঘটে থকে এবং অনেকে তা দেখেও থাকে। অনেক গল্প উপন্যাসেও পঠিত হয়। আকাশের অংশ ভেংগে পড়ার অর্থ বজ্রপাত বা উল্কাপাত, তাও অনেক সময় ঘটে থাকে। এ সব ঘটনা মাঝে মাঝে লােকেরা দেখেছে বা শুনেছে। এ ধরনের ঘটনা অনেক উদাসীন লােককে সচকিত ও প্রকম্পিত করে। তারা কেয়ামতকে অসম্ভব মনে করে। অথচ আল্লাহ তায়ালা যদি কেয়ামতের আগেই এই পৃথিবীতে শাস্তি দিতে চান, তবে যে কোনাে সময় পেছনে তাদের ঘিরে রেখেছে, সেই আকাশ ও পৃথিবী থেকে আযাব আসতে পারে। এ আযাব অতি নিকটে রয়েছে। কেয়ামতের কতাে দেরী তাও আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। বস্তুত পাপীরা ছাড়া আল্লাহ তায়ালার আযাব থেকে কেউ নিশ্চিত থাকতে পারে না। ‘এতে প্রত্যেক বিনয়ী বান্দার জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবী থেকে যে কোন মুহর্তে মাটি ধস বা বজ্রপাত বা উল্কাপাতের মাধ্যমে আসার সম্ভাবনায় বিনয়ী হৃদয়ের জন্য শিক্ষা রয়েছে, ফলে সে গােমরাহীতে লিপ্ত হয়।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

(৩৪-সাবা) : নামকরণ:

১৫ আয়াতের বাক্য لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ থেকে গৃহীত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এটি এমন একটি সূরা যেখানে ‘সাবা’ –এর কথা বলা হয়েছে।।

(৩৪-সাবা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

কোন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত থেকে এর নাযিলের সঠিক সময়-কাল জানা যায় না। তবে বর্ণনাধারা থেকে অনুভূত হয়, সেটি ছিল মক্কার মাঝামাঝি যুগ অথবা প্রাথমিক যুগ। যদি মাঝামাঝি যুগ হয়ে থাকে তাহলে সম্ভবত সেটি ছিল তার একেবারে প্রথম দিককার সময়। তখনো পর্যন্ত জুলুম-নিপীড়নের তীব্রতা দেখা দেয়নি এবং তখনো কেবলমাত্র ঠাট্টা-তামাশা, বিদ্রূপ, গুজব ছড়ানো এবং মিথ্যা অপবাদ ও প্ররোচনা দেবার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনকে দমিত করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছিল।

(৩৪-সাবা) : কেন্দ্রীয় আলোচ্যবিষয় :

এ সূরায় কাফেরদের এমন সব আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে যা তারা নবীর (সা.) তাওহীদ ও আখেরাতের দাওয়াতের এবং তাঁর নবুওয়াতের বিরুদ্ধে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ ও অর্থহীন অপবাদের আকারে পেশ করতো। কোথাও এ আপত্তিগুলো উদ্ধৃত করে তার জবাব দেয়া হয়েছে আবার কোথাও সেগুলো কোন্ আপত্তির জবাব তা স্বতস্ফূর্তভাবে প্রকাশ হয়ে গেছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে জবাব গুলো দেয়া হয়েছে বুঝাবার পদ্ধতিতে এবং আলোচনার মাধ্যমে স্বরণ করিয়ে দেবার ও যুক্তি প্রদর্শনের কায়দায়। কিন্তু কোথাও কোথাও কাফেরদেরকে তাদের হঠকারিতার খারাপ পরিণতির ভয় দেখানো হয়েছে। এ প্রসংগে হযরত দাউদ (আ), হযরত সুলাইমান (আ) ও সাবা জাতির কাহিনী এ উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তোমাদের সামনে ইতিহাসের এ দু’টি দৃষ্টান্তই রয়েছে: একদিকে রয়েছে হযরত দাউদ (আ) ও হযরত সুলাইমান (আ) । আল্লাহ তাঁদেরকে দান করেছিলেন বিপুল শক্তি এবং এমন গৌরব দীপ্ত শান-শওকত, যা ইতিপূর্বে খুব কম লোককে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব কিছু পাওয়ার পরও তাঁরা অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত হননি। বরং নিজের রবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিবর্তে তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হন। অন্য দিকে ছিল সাবা জাতি। যখন আল্লাহ তাদেরকে নিয়ামত দান করলেন, তারা অহমিকায় স্ফীত হয়ে উঠলো এবং শেষে এমনভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো যে, এখন কেবল তাদের কাহিনীই দুনিয়ার বুকে রয়ে গেছে। এ দু’টি দৃষ্টান্ত সামনে রেখে স্বয়ং তোমাদেরকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, তাওহীদ ও আখেরাতে বিশ্বাস এবং নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রবণতার ভিত্তিতে যে জীবন গড়ে ওঠে তা বেশী ভালো, না সেই জীবন বেশী ভালো যা গড়ে ওঠে কুফর ও শির্ক এবং আখেরাত অস্বীকার ও বৈষয়িক স্বার্থ পূজার ভিত্তিতে।

# মূলে ‘হামদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এখানে এ দু’টি অর্থই প্রযুক্ত। আল্লাহ‌ যখন বিশ্ব-জাহান ও এর সমস্ত জিনিসের মালিক তখন অবশ্যই এ বিশ্ব-জাহানে সৌন্দর্য, পূর্ণতা, জ্ঞান, শক্তি, শিল্পকারিতা ও কারিগরির যে শোভা দৃষ্টিগোচর হয় এসবের জন্য একমাত্র তিনিই প্রশংসার অধিকারী। আর এ বিশ্ব-জাহানে বসবাসকারী যে কেউ যে কোন জিনিস থেকে লাভবান হচ্ছে বা আনন্দ ও স্বাদ উপভোগ করছে সেজন্য তার আল্লাহর প্রতিই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ। অন্য কেউ যখন এসব জিনিসের মালিকানায় শরীক নেই তখন প্রশংসা বা কৃতজ্ঞতা লাভ করার অধিকারও অন্য কারো নেই।
# যেভাবে এ দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত তিনিই দান করেছেন, ঠিক তেমনি আখেরাতেও মানুষ যা কিছু পাবে তা তাঁরই ভাণ্ডার থেকে এবং তাঁরই দান হিসেবেই পাবে। তাই সেখানেও একমাত্র তিনিই হবেন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা লাভের অধিকারী।
# তাঁর সমস্ত কাজই হয় পূর্ণজ্ঞান ও প্রজ্ঞা ভিত্তিক। তিনি যা করেন একদম ঠিকই করেন। নিজের প্রত্যেকটি সৃষ্টি কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে, তার প্রয়োজন কি, তার প্রয়োজনের জন্য কি উপযোগী, এ পর্যন্ত সে কি করেছে এবং সামনের দিকে আরো কি করবে –এসব সম্পর্কে তিনি পূর্ণজ্ঞান রাখেন। নিজের তৈরি দুনিয়া সম্পর্কে তিনি বেখবর নন এবং প্রতিটি অণু-পরমাণুর অবস্থাও তিনি পুরোপুরি জানেন।
# তাঁর রাজ্যে কোন ব্যক্তি বা দল তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সত্ত্বেও যদি পাকড়াও না হয়ে থাকে তাহলে এর কারণ এ নয় যে, এ দুনিয়ায় নৈরাজ্য চলছে এবং আল্লাহ‌ এখানকার ক্ষমতাহীন রাজা। বরং এর কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ‌ করুণাশীল এবং ক্ষমা করাই তাঁর অভ্যাস। পাপী ও অপরাধীকে অপরাধ অনুষ্ঠিত হবার সাথে সাথেই পাকড়াও করা, তার রিযিক বন্ধ করে দেয়া, তার শরীর অবশ করে দেয়া, মুহূর্তের মধ্যে তাকে মেরে ফেলা, সবকিছুই তাঁর ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে কিন্তু তিনি এমনটি করেন না। তাঁর করুণাগুণের দাবী অনুযায়ী তিনি এটি করেন। সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও তিনি নাফরমান বান্দাদেরকে ঢিল দিয়ে থাকেন। তাদেরকে আপন আচরণ শুধরে নেবার অবকাশ দেন এবং নাফরমানি থেকে বিরত হবার সাথে সাথেই মাফ করে দেন।
# ঠাট্টা-মস্করা করে চিবিয়ে চিবিয়ে তারা একথা বলে। তাদের একথা বলার অর্থ ছিল এই যে, বহুদিন থেকে এ পয়গম্বর সাহেব কিয়ামতের আগমনী সংবাদ দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু জানি না আসতে আসতে তা আবার থেমে গেলো কোথায়! আমরা তার প্রতি এতই মিথ্যা আরোপ করলাম, এত গোস্তাখী করলাম তা নিয়ে এত ঠাট্টা-বিদ্রূপ করলাম কিন্তু এরপরও সেই কিয়ামত কোনভাবেই আসছে না।
# পরওয়ারদিগারের কসম খেয়ে তাঁর জন্য “অদৃশ্য জ্ঞানী” বিশেষণ ব্যবহার করার দ্বারা স্বতস্ফূর্তভাবে এ দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কিয়ামতের আগমন তো অবধারিত কিন্তু তার আগমনের সময় অদৃশ্যজ্ঞানী আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ জানে না। এ বিষয়টিই কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সূরা আল আরাফ ১৮৭ , তা-হা ১৫ , লুকমান ৩৪ , আল আহযাব ৬৩ , আল মুলক ২৫-৩৬ এবং আন নাযি’আত ৪২-৪৪ আয়াত।
# আখেরাতের সম্ভাবনার সপক্ষে যেসব যুক্তি পেশ করা হয় এটি তার অন্যতম। যেমন সামনের দিকে ৭ আয়াতে আসছে। আখেরাত অস্বীকারকারীরা যেসব কারণে মৃত্যুর পরের জীবনকে যুক্তি বিরোধী মনে করতো তার মধ্যে একটি কথা ছিল এই যে, যখন সমস্ত মানুষ মরে মাটিতে মিশে যাবে এবং তাদের দেহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশগুলোও চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে তখন এ অসংখ্য অংশের আবার কিভাবে একত্র হওয়া সম্ভব হবে এবং এগুলোকে এক সাথে জুড়ে আবার কেমন করে তাদেরকে সেই একই দেহাবয়বে সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। একথা বলে এ সন্দেহ নিরসন করা হয়েছে যে, আল্লাহর দপ্তরে এসব লিখিত আছে এবং আল্লাহ‌ জানেন কোন্ জিনিসটি কোথায় গেছে। যখন তিনি পুনর্বার সৃষ্টি করার সংকল্প করবেন তখন তাঁর পক্ষে প্রতিটি ব্যক্তির দেহের অংশগুলো একত্র করা মোটেই কষ্টকর হবে না।
# ওপরে আখেরাতের সম্ভাবনার যুক্তি পেশ করা হয়েছিল এবং এখানে তার অপরিহার্যতার যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এমন একটি সময় অবশ্যই আসা উচিত যখন জালেমদেরকে তাদের জলুমের এবং সৎকর্মশীলদেরকে তাদের সৎকাজের প্রতিদান দেয়া হবে। যে সৎকাজ করবে সে পুরস্কার পাবে এবং যে খারাপ কাজ করবে সে শাস্তি পাবে, সাধারণ বিবেক-বৃদ্ধি এটা চায় এবং এটা ইনসাফেরও দাবী। এখন যদি তোমরা দেখো, বর্তমান জীবনে প্রত্যেকটি অসৎলোক তার অসৎকাজের পুরোপুরি সাজা পাচ্ছে না এবং প্রত্যেকটি সৎলোক তার সৎকাজের যথার্থ পুরস্কার লাভ করছে না বরং অনেক সময় অৎসকাজ ও সৎকাজের উল্টো ফলাফল পাওয়া যায়, তাহলে তোমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, যুক্তি, বিবেক-বুদ্ধি ও ইনসাফের এ অপরিহার্য দাবী একদিন অবশ্যই পূর্ণ হতে হবে। সেই দিনের নামই হচ্ছে কিয়ামত ও আখেরাত। তার আসা নয় বরং না আসাই বিবেক ও ইনসাফের বিরোধী।

এ প্রসঙ্গে ওপরের আয়াত থেকে আর একটি বিষয়ও সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এখানে বলা হয়েছে, ঈমান ও সৎকাজের ফল হচ্ছে গোনাহের মার্জনা ও সম্মানজনক রিযিক লাভ এবং যারা আল্লাহর দ্বীনকে হেয় করার জন্য বিদ্বিষ্ট ও শত্রুতামূলক প্রচেষ্টা চালাবে তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্টতম শাস্তি। এ থেকে আপনা আপনি একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সাচ্চা দিলে যে ব্যক্তি ঈমান আনবে তার কাজের মধ্যে যদি কিছু গলদও থাকে তাহলে সে সম্মানজনক রিযিক না পেয়ে থাকলেও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত হবে না। আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে কিন্তু আল্লাহর সত্য দ্বীনের মোকাবিলায় বিদ্বেষমূলক ও বৈরী নীতি অবলম্বন করবে না সে শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না ঠিকই কিন্তু নিকৃষ্টতম শাস্তি তার জন্য নয়।
# এ বিরোধীরা তোমার উপস্থাপিত সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যতই জোর দিক না কেন তাদের এসব প্রচেষ্টা ও কৌশল সফলকাম হতে পারবে না। কারণ এসব কথার মাধ্যমে তারা কেবলমাত্র মূর্খদেরকেই প্রতারিত করতে পারবে। জ্ঞানবানরা তাদের প্রতারণার জালে পা দেবে না।
# কুরাইশ সরদাররা একথা ভালোভাবে জানতো, মুহাম্মাদ ﷺ কে মিথ্যুক বলে মেনে নেয়া জনগণের জন্য ছিল বড়ই কঠিন। কারণ সমগ্রজাতি তাঁকে সত্যবাদী জানতো এবং সারা জীবনেও কখনো কেউ তাঁর মুখ থেকে একটি মিথ্যা কথা শোনেনি। তাই তারা লোকদের সামনে তাঁর প্রতি এভাবে দোষারোপ করতোঃ এ ব্যক্তি যখন মৃত্যু পরের জীবনের মতো অবাস্তব কথা মুখে উচ্চারণ করে চলেছে, তখন হয় সে (নাউযুবিল্লাহ) জেনে বুঝে একটি মিথ্যা কথা বলছে নয়তো সে পাগল। কিন্তু এ পাগল কথাটিও ছিল মিথ্যুক কথাটির মতই সমান ভিত্তিহীন ও উদ্ভট। কারণ একজন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে পাগল বলা কেবল একজন নিরেট মূর্খ ও নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। নয়তো চোখে দেখেইবা এক ব্যক্তি একটি জ্যান্ত মাছি গিলে খেয়ে নিতো কেমন করে। এ কারণেই আল্লাহ‌ এ ধরনের বাজে কথার জবাবে কোন প্রকার যুক্তি উপস্থাপনের প্রয়োজন অনুভব করেননি এবং তারা মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে যে বিস্ময় প্রকাশ করতো কেবলমাত্র তা নিয়েই কথা বলেছেন।
# এ হচ্ছে তাদের কথার প্রথম জবাব। এর অর্থ হচ্ছে, মূর্খের দল! তোমরা তো বিবেক বুদ্ধির মাথা খেয়ে বসেছ। যে ব্যক্তি তোমাদেরকে প্রকৃত অবস্থা জানাচ্ছে তাঁর কথা মেনে নিচ্ছো না এবং সোজা যে পথটি জাহান্নামের দিকে চলে গেছে সেদিকেই চোখ বন্ধ করে দৌঁড়ে চলে যাচ্ছো কিন্তু তারপরও তোমাদের নির্বুদ্ধিতার চূড়ান্ত হচ্ছে যে, যে ব্যক্তি তোমাদের কে বাঁচাবার চিন্তা করছে উল্টো তাঁকেই তোমরা পাগল আখ্যায়িত করছো।
# এটা তাদের কথার দ্বিতীয় জবাব। এ জবাবটি অনুধাবন করতে হলে এ সত্যটি দৃষ্টি সমক্ষে রাখতে হবে যে, কুরাইশ কাফেররা যেসব কারণে মৃত্যুপরের জীবনকে অস্বীকার করতো তার মধ্যে তিনটি জিনিস ছিল সবচেয়ে বেশী সুস্পষ্ট। এক, তারা আল্লাহর হিসেব নিকেশ এবং তাঁর কাছে জবাবদিহির ব্যাপারটি মেনে নিতে চাইতো না। কারণ এটা মেনে নিলে দুনিয়ায় তাদের ইচ্ছা মতো কাজ করার স্বাধীনতা থাকতো না। দুই, তারা কিয়ামত হওয়া, বিশ্ব ব্যবস্থায় ওলট পালট হয়ে যাওয়া এবং পুনরায় একটি নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটাকে অকল্পনীয় মনে করতো। তিন, যারা শত শত হাজার হাজার বছর আগে মরে গেছে এবং যাদের হাঁড়গুলোও গুঁড়ো হয়ে মাটিতে, বাতাসে ও পানিতে মিশে গেছে তাদের পুনর্বার প্রাণ নিয়ে সশরীরে বেঁচে ওঠা তাদের কাছে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার মনে হতো। ওপরের জবাবটি এ তিনটি দিককেই পরিবেষ্টন করেছে এবং এছাড়াও এর মধ্যে একটি কঠোর সতর্কবাণীও নিহিত রয়েছে। এ ছোট ছোট বাক্যগুলো মধ্যে যে বিষয়বস্তু লুকিয়ে রয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপঃ

একঃ যদি তোমরা কখনো চোখ মেলে এ পৃথিবী ও আকাশের দিকে তাকাতে তাহলে দেখতে পেতে এসব খেলনা নয় এবং এ ব্যবস্থা ঘটনাক্রমে সৃষ্টি হয়ে যায়নি। এ বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিস একথা প্রকাশ করছে যে, একটি সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন সত্তা পূর্ণ প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সহকারে তাকে তৈরি করেছেন। এ ধরনের একটি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার অধীনে এখানে কাউকে বুদ্ধি, বিবেক, বিচারশক্তি ও স্বাধীন ক্ষমতা দান করার পর তাকে অদায়িত্বশীল ও কারো কাছে কোন প্রকার জবাবদিহি না করে এমনি ছেড়ে দেয়া যেতে পারে বলে ধারণা করা একেবারেই অযৌত্তিক ও অর্থহীন কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।

দুইঃ গভীর দৃষ্টিতে এ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে কিয়ামতের আগমন যে মোটেই কোন কঠিন ব্যাপার নয়, সে কথা যে কোন ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারবে। পৃথিবী ও আকাশ যেসব নিয়মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সামান্য একটু হেরফের হলে কিয়ামত ঘটে যেতে পারে। আর এ ব্যবস্থাই আবার একথারও সাক্ষ্য দেয় যে, যিনি আজ এ দুনিয়া-জাহান তৈরি করে করেছেন তিনি আবার অন্য একটি দুনিয়াও তৈরি করতে পারেন। এ কাজ যদি তাঁর জন্য কঠিন হতো তাহলে এ দুনিয়াটিই বা কেমন করে অস্তিত্ব লাভ করতো।

তিনঃ তোমরা পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টাকে কী মনে করেছো? তাঁকে তোমরা মৃত মানব গোষ্ঠীকে পুর্নবার সৃষ্টি করতে অক্ষম বলে মনে করছো? যারা মরে যায় তাদের দেহ পচে খাসে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যতই দূরে ছড়িয়ে পড়ুক না কেন সেগুলো থাকে তো আকাশ ও পৃথিবীর সীমানার মধ্যেই। এর বাইরে তো চলে যায় না। তাহলে এ পৃথিবী ও আকাশ যে আল্লাহ‌র কর্তৃত্বাধীন রয়েছে তাঁর পক্ষে মাটি, পানি ও হাওয়ার মধ্যে সেখানে যে জিনিস প্রবেশ করে আছে সেখান থেকে তাকে টেনে বের করে আনা এমন আর কি কঠিন ব্যাপার। তোমাদের শরীরের মধ্যে এখন যা কিছু আছে, তাও তো তাঁরই একত্রিত করা এবং ঐ একই মাটি, পানি ও হাওয়া থেকে বের করে আনা হয়েছে। এ বিচ্ছিন্ন অংশগুলো সংগ্রহ করা যদি আজ সম্ভবপর হয়ে থাকে, তাহলে আগামীকাল কেন অবম্ভব হবে?

এ তিনটি যুক্তিসহ ও বক্তব্যের মধ্যে আরো যে সতর্কবাণী নিহিত রয়েছে, তা এই যে, তোমরা সব দিক থেকে আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বের আবেষ্টনীতে ঘেরাও হয়ে আছো। যেখানেই যাবে এ বিশ্ব-জাহান তোমাদের ঘিরে রাখবে। আল্লাহর মোকাবিলায় কোন আশ্রয়স্থল তোমরা পাবে না। অন্যদিকে আল্লাহর ক্ষমতা এতই অসীম যে, যখনই তিনি চান তোমাদের পায়ের তলদেশ বা মাথার ওপর থেকে যে কোন বিপদ আপদ তোমাদের প্রতি বর্ষণ করতে পারেন। যে ভুমিকে মায়ের কোলের মতো প্রশান্তির আধার হিসেবে পেয়ে তোমরা সেখানে গৃহ নির্মাণ করে থাকো, তার উপরিভাগের নীচে কেমন সব শক্তি কাজ করছে এবং কখন তিনি কোন্ ভূমিকম্পের মাধ্যেম এ ভূমিকে তোমাদের জন্য কবরে পরিণত করবেন তা তোমরা জানো না। যে আকাশের নিচে তোমরা এমন নিশ্চিন্তে চলাফেরা করছো যেন এটা তোমাদের নিজেদের ঘরের ছাদ, তোমরা জানো না এ আকাশ থেকে কখন কোন্ বিজলী নেমে আসবে অথবা কোন্ প্রলয়ংকর বর্ষার ঢল নামবে কিংবা কোন আকস্মিক বিপদ তোমাদের ওপর আপতিত হবে। এ অবস্থায় তোমাদের এ আল্লাহকে ভয় না করা, পরকালের ভাবনা থেকে এভাবে গাফেল হয়ে যাওয়া এবং একজন শুভাকাংখীর উপদেশের মোকাবিলায় এ মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়ার এছাড়া আর কি অর্থ হতে পারে যে, নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনছো।
# যে ব্যক্তি কোন ধরনের বিদ্বেষ ও অন্ধ স্বার্থপ্রীতি দুষ্ট নয়, যার মধ্যে কোন জিদ ও হঠকারিতা নেই বরং যে আন্তরিকতা সহকারে তার মহান প্রতিপালকের কাছে পথনিদের্শনার প্রত্যাশী হয়, সে তো আকাশ ও পৃথিবীর এ ব্যবস্থা দেখে বড় রকমের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু যার মন আল্লাহর প্রতি বিমুখ সে বিশ্ব-জাহানে সবকিছু দেখবে তবে প্রকৃত সত্যের প্রতি ইঙ্গিতকারী কোন নিদর্শন সে অনুভব করবে না।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ:

“সাবা” একটি জনবসতি বা দেশের নাম “যেখানকার রাজা ছিলেন বিলকীস” এ সূরাতে “সাবা”বাসীদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বিধায় একে সূরা “সাবা” বলে নামকরণ করা হয়েছে।

এ সূরাতে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ, কিয়ামতের ব্যাপারে কাফিরদের সংশয় নিরসন, দাঊদ (عليه السلام) ও তাঁর সন্তান সুলাইমান (عليه السلام) এবং তাদেরকে যে সকল মু‘জিযাহ দান করা হয়েছিল তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সাবাবাসী মুশরিকদের বাতিল মা‘বূদের অপারগতা ও তারা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কোন শাফায়াত করতে পারবে না সে সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে। দুনিয়ার সবল ও দুর্বলদের কথা কাটাকাটি, প্রত্যেক জাতির ধনাট্য ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা নাবীদের সাথে যে আচরণ করত এবং তাদের যে অবস্থান ছিল সে বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।

১-২ নং আয়াতের তাফসীর:

সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা নিজের সম্পর্কে অবগত করছেন যে, তিনি দুনিয়া ও আখিরাতের সকল প্রশংসার অধিকারী এবং আকাশমণ্ডলী ও জমিনের একমাত্র মালিক। তিনি ব্যতীত দ্বিতীয় আর কেউ নেই, এগুলোর ওপর তাঁর একচ্ছত্র মালিকানা রয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(تَبٰرَکَ اَلَّذِيْ لَه۫ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَّلَمْ يَكُنْ لَّه۫ شَرِيْكٌ فِي الْمُلْكِ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَه۫ تَقْدِيْرًا)‏

“যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী; তিনি কোন সন্ত‎ান গ্রহণ করেননি; সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি সমস্ত‎ কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে।” (সূরা ফুরকান ২৫:২)

সুতরাং আমরা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও গুণর্কীতণ করব। এরপর আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানের পরিব্যাপ্তির বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। তাঁর জ্ঞান সকল কিছু বেষ্টন করে আছে। এমনকি যা জমিনে প্রবেশ করে তাও তিনি জানেনন যেমন বৃষ্টি, প্রোথিত গুপ্তধন এবং খনিজ সম্পদ, বীজ ইত্যাদি এবং তিনি জানেন যা কিছু যমীন থেকে বের হয়। যেমন বিভিন্ন গাছ-গাছালি, উদ্ভিদ, তরুলতা ইত্যাদি এবং তিনি এও জানেন যা আকাশ হতে বর্ষিত হয় এবং যা কিছু যমীন হতে আকাশে উত্থিত হয়। তাঁর নিকট কোন কিছুই গোপন নেই।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ط وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَّرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِيْ ظُلُمٰتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَّلَا يَابِسٍ إِلَّا فِيْ كِتٰبٍ مُّبِيْنٍ)

“জলে ও স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত, তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে (লাওহে মাহফূজে) নেই।” (সূরা আনআম ৬:৫৯)

সুতরাং যমীনে ও আকাশে যা কিছুই হোক না কেন কোন বিষয় আল্লাহ তা‘আলার নিকট গোপন থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা সকল কিছু সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবগত আছেন। তাঁর দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়ার কোনই সুযোগ নেই। সেটি অন্ধকারে হোক আর আলোতে হোক, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই জানেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২. সর্বাবস্থায় সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য, অন্য কারো জন্য নয়।
৩. আল্লাহ তা‘আলা সকল বিষয়ে খবর রাখেন, মানুষ তা প্রকাশ্যে করুক বা গোপনে।

৩-৬ নং আয়াতের তাফসীর:

অত্র আয়াতে বস্তুবাদী নাস্তিকদের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করে তাদের বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাসন আমরা দুনিয়াতে আছি, মারা যাব, পরে আর কিছু হবে না। কিসের কিয়ামত কিসের হাশর-নাশর। তাই তাদের ভাষাটা যেন এমন যে, খাও-দাও ফূর্তি কর, গরীবদের ওপর জুলুম কর। এসব কঠিন বেঈমানদের কঠিন উত্তর দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর রবের শপথ করে বলতে বললেন বল: আমার রবের শপথ কিয়ামত অবশ্যই সংঘঠিত হবে। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার নিশ্চয়তার ব্যাপারে এরকম আরো দু’জায়গায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা তা’আলা তাঁর নিজ সত্ত্বার নামে শপথ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَيَسْتَنْۭبِئُوْنَكَ أَحَقٌّ هُوَ ط ل قُلْ إِيْ وَرَبِّيْٓ إِنَّه۫ لَحَقٌّ ط ل وَمَآ أَنْتُمْ بِمُعْجِزِيْنَ)‏

“তারা তোমার নিকট (কিয়ামতের আযাব সম্পর্কে) জানতে চায়, ‘তা কি সত্য?’ বল:‎ ‘হ্যাঁ, আমার প্রতিপালকের শপথ! তা অবশ্যই সত্য। এবং তোমরা এটা ব্যর্থ করতে পারবে না।’ (সূরা ইউনুস ১০:৫৩)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(زَعَمَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْآ أَنْ لَّنْ يُّبْعَثُوْا ط قُلْ بَلٰي وَ رَبِّيْ لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ ط وَذٰلِكَ عَلَي اللّٰهِ يَسِيْرٌ)‏

“কাফিররা ধারণা করে যে, তারা কখনো পুনরুত্থিত হবে না। বল: নিশ্চয়ই হবে, আমার প্রতিপালকের শপথ! তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমরা যা করতে তোমাদেরকে সে সম্বন্ধে অবশ্যই অবহিত করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ।” (সূরা তাগাবুন ৬৪:৭)

সুতরাং কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করার কিছুই নেই। এটা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আর তখন কেউই এটা প্রতিহত করতে পারবে না।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তিনি হলেন, আলিমুল গাইব। তিনি সমস্ত অদৃশ্যের খবর জানেন। আকাশে ও জমিনে ছোট-বড়, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এমন কোন জিনিস নেই যা তিনি জানেন না। তিনি প্রত্যেক জিনিসের যথাযথ খবর রাখেন। তাঁর দৃষ্টিকে ফাঁকি দিবে এমন কিছুই নেই।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার হিকমত বর্ণনা করছেন যে, দুনিয়াতে মানুষ ভাল কাজ করে কিন্তু সবাই তার যথার্থ মূল্যায়ন পায় না। আর অনেক অপরাধী অপরাধ করে, তাকে কেউ শাস্তি দিতে পারে না। তাই ভাল আমলকারীদের যথাযথ প্রতিদান ও অপরাধীদের জন্য উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার জন্য কিয়ামত বা বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যেন তিনি পুরস্কৃত করেন তাদেরকে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে।’

সুতরাং কিয়ামত সংঘটনের মাধ্যমে ভাল ও মন্দের বিচার করা হবে এবং তাদেরকে তাদের প্রতিদান দেয়া হবে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানী লোকদের মর্যাদা বর্ণনা করছেন যে, তারা তাদের সঠিক জ্ঞান ার্জনের দ্বারা সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলে বুঝতে পেরেছে এবং এ সঠিক জ্ঞানের কারণে তারা সৎ ‘আমাল করতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ওপর পূর্ণ বিশ্বাসী। ফলে তারা কিয়ামতের দিন বলবেন (هٰذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمٰنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُوْنَ)‏ “দয়াময় আল্লাহ তো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্যই বলেছিলেন।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৫২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তারা আরো বলবে,

(وَقَالَ الَّذِيْنَ أُوْتُوا الْعِلْمَ وَالْإِيْمَانَ لَقَدْ لَبِثْتُمْ فِيْ كِتٰبِ اللّٰهِ إِلٰي يَوْمِ الْبَعْثِ ز فَهٰذَا يَوْمُ الْبَعْثِ وَلٰكِنَّكُمْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ)‏

“কিন্তু যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান দেয়া হয়েছে তারা বলবে: তোমরা তো আল্লাহর নির্ধারিত দিবস অনুযায়ী অবস্থান করেছ; এটাই হল পুনরুত্থান দিবস, কিন্তু তোমরা জানতে না।” (সূরা রূম ৩০:৫৬)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে, তা অস্বীকার করার কোনই সুযোগ নেই।
২. কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার হিকমত সম্পর্কে জানতে পারলাম।
৩. সৎ লোকেরা জান্নাতে এবং অসৎ লোকেরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
৫. যারা কুরআন ও হাদীসের সঠিক জ্ঞান অর্জন করে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারলাম।

৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর:

মক্কার কাফির-মুশরিকরা যারা কিয়ামতকে অস্বীকার করত, পুনরুত্থানকে অস্বীকার করত এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে উন্মাদ, কবি ইত্যাদি কথা বলে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ ও উপহাস করত এখানে তাদেরই কথা বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা পরস্পর বলাবলি করত: আমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি রয়েছে যে কিনা বলে যে, আমরা যখন মরে, পঁচে, গলে শেষ হয়ে যাব তখন পুনরায় আমাদেরকে জীবিত করা হবে। এসকল কথা-বার্তা বলে তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তুচ্ছ করত এবং উপহাস করত। مُزِّقْتُمْ শব্দটি مزق থেকে উদ্ভূত, এর অর্থ খন্ড-বিখন্ড করা। كُلَّ مُمَزَّقٍ এর অর্থ মানবদেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা হয়ে যাবে।

(أَفْتَرٰي عَلَي اللّٰهِ كَذِبًا أَمْ بِه۪ جِنَّةٌ)

‘সে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে, নাকি সে পাগল’ অর্থাৎ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একত্রিত করা হবে এবং জীবিত করা হবে এরূপ কথা বলা আল্লাহ তা‘আলার নামে মিথ্যা কথা বলা ছাড়া কিছুই না, অথবা সে পাগল যার কথার কোন সঠিক ভিত্তি নেই।

তাদের এ সকল ভ্রান্ত ধারণার যথাযথ উত্তর দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তোমরা যতই উপহাস করো না কেন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ব্যাপারে তোমাদেরকে খবর দিয়েছেন তা-ই সত্য। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তাদের এ সন্দেহ দূর করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের উপমা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(أَفَلَمْ يَنْظُرُوْآ إِلَي السَّمَا۬ءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنٰهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِنْ فُرُوْجٍ -‏ وَالْأَرْضَ مَدَدْنٰهَا وَأَلْقَيْنَا فِيْهَا رَوَاسِيَ وَأَنْۭبَتْنَا فِيْهَا مِنْ كُلِّ زَوْجٍۭ بَهِيْجٍ لا تَبْصِرَةً وَّذِكْرٰي لِكُلِّ عَبْدٍ مُّنِيْبٍ)

“তারা কি কখনও তাদের ওপরের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না, কিভাবে আমি তা তৈরি করেছি ও তাকে সুশোভিত করেছি? আর তাতে কোন (সূক্ষ্মতম) ফাটলও নেই। আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি আর তাতে উদ্গত করেছি চোখ জুড়ানো সর্বপ্রকার উদ্ভিদ। প্রত্যেক আল্লাহ অভিমুখী ব্যক্তির জন্য জ্ঞান আহরণ ও উপদেশ স্বরূপ।” (সূরা কফ ৫০:৬-৮)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

(وَالسَّمَا۬ءَ بَنَيْنٰهَا بِأَيْدٍ وَّإِنَّا لَمُوْسِعُوْنَ – وَالْأَرْضَ فَرَشْنٰهَا فَنِعْمَ الْمٰهِدُوْنَ)

“আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার (নিজ) হাতে এবং আমি অবশ্যই মহা সম্প্রসারণকারী। এবং আমি পৃথিবীকে বিছিয়ে দিয়েছি, সুতরাং আমি কত সুন্দরভাবে বিছিয়েছি।” (সূরা যারিয়াত ৫১:৪৭-৪৮)

সুতরাং তোমাদের অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আমি আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলী ও জমিনসহ এত বড় বড় জিনিস যেহেতু সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি, তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি; অতএব তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতেও সক্ষম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(اَوَ لَیْسَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ بِقٰدِرٍ عَلٰٓی اَنْ یَّخْلُقَ مِثْلَھُمْﺛ بَلٰیﺠ وَھُوَ الْخَلّٰقُ الْعَلِیْمُ)‏

“আর যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি সক্ষম নন এদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে?” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৮১)

অতএব আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় সৃষ্টি করতেও সক্ষম। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রত্যেক মু’মিনের এটা অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. মানুষের পুনরুত্থান অবশ্যই হবে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।
২. ধর্মের ব্যাপারে হাসি-তামাশা করা যাবে না।
৩. দুনিয়ার বিভিন্ন সৃষ্টি বস্তুতে মানুষের জন্য উপদেশ রয়েছে, তা সঠিকভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

১-২ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় মহান সত্তা সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত নিয়ামত ও রহমত তাঁরই নিকট হতে আসে। সমস্ত হুকুমতের হাকিম তিনিই। সুতরাং সর্ব প্রকারের প্রশংসা ও গুণ-কীর্তনের হকদার একমাত্র তিনিই। তিনিই মাবুদ। তিনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কেউই নেই। তাঁরই জন্যে দুনিয়া ও আখিরাতের তারীফ ও প্রশংসা শোভনীয়। হুকুমত একমাত্র তাঁরই এবং তাঁরই নিকট সবকিছু প্রত্যাবর্তিত হবে। যমীনে ও আসমানে যা কিছু আছে সবই তাঁর অধীনস্থ। যত কিছু আছে সবাই তাঁর দাস ও অনুগত। আর সবই তাঁর আয়ত্তাধীন। সবারই উপর তাঁর আধিপত্য রয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমারই জন্যে আদি ও অন্ত।”(৯২:১৩) আখিরাতে তাঁরই প্রশংসা হবে। তাঁর কথা, তাঁর কাজ এবং তাঁর আহকাম তাঁরই হুকুমতে বিরাজিত। তিনি এতো সজাগ যে, তাঁর কাছে কোন কিছুই গোপন থাকে না। তাঁর কাছে একটি অণুও গোপন থাকবার নয়। তিনি স্বীয় আহকামের মধ্যে অতি বিজ্ঞ। তিনি স্বীয় সৃষ্টি সম্বন্ধে সচেতন। পানির যতগুলো ফোঁটা যমীনে যায়, যতগুলো বীজ যমীনে বপন করা হয়, কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। যমীন হতে যা কিছু বের হয় সেটাও তিনি জানেন। তাঁর সীমাহীন ও প্রশস্ত জ্ঞানের বাইরে কিছুই থাকতে পারে না। প্রত্যেক বস্তুর সংখ্যা, প্রকৃতি এবং গুণাগুণ তাঁর জানা আছে। মেঘ হতে যে বৃষ্টি বর্ষিত হয়, তাতে কতটা ফোঁটা আছে তা তাঁর অজানা থাকে না। যে খাদ্য সেখান হতে নাযিল হয় সেটা সম্পর্কেও তিনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। ভাল কাজ যা আকাশের উপর উঠে যায় সে খবরও তিনি রাখেন।

তিনি স্বীয় বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান। এ কারণেই তাদের পাপরাশি অবগত হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাড়াতাড়ি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন না। বরং তাদেরকে তাওবা করার সুযোগ দিয়ে থাকেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। একদিকে বান্দা তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে অনুনয়-বিনয় ও কান্নাকাটি করে, আর অপরদিকে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। তাওবাকারীকে তিনি ধমক দিয়ে সরিয়ে দেন না। তার উপর ভরসাকারীরা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

৩-৬ নং আয়াতের তাফসীর:

সম্পূর্ণ কুরআন কারীমে তিনটি আয়াত রয়েছে যেখানে কিয়ামত আগমনের উপর শপথ করা হয়েছে। একটি সূরায়ে ইউনুসের আয়াত। তা হলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা তোমার কাছে জানতে চায়ঃ এটা কি সত্য? তুমি বলঃ হ্যা, আমার প্রতিপালকের শপথ! এটা অবশ্যই সত্য এবং তোমরা এটা ব্যর্থ করতে পারবে না।”(১০:৫৩) দ্বিতীয় হলো এই সূরায়ে সাবার। (আরবী)-এই আয়াতটি। আর তৃতীয় হলো সূরায়ে তাগাবুনের নিম্নের আয়াতটিঃ (আরবী) অর্থাৎ “কাফিররা ধারণা করে যে, তারা কখনো পুনরুত্থিত হবে না। বলঃ নিশ্চয়ই হবে, আমার প্রতিপালকের শপথ! তোমরা নিশ্চয়ই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমরা যা করতে তোমাদেরকে সে সম্বন্ধে অবশ্যই অবহিত করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।”(৬৪:৭) এখানেও কাফিরদের কিয়ামতের অস্বীকৃতির উল্লেখ করে স্বীয় নবী (সঃ)-কে শপথমূলক উত্তর দিতে বলার পর আরো গুরুত্বের সাথে বলছেনঃ সেই আল্লাহ তিনি, যিনি আলেমুল গায়েব, যার অগোচর নয় আকাশ ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছু কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু। যে হাড়গুলো পচে সড়ে যায়, মানুষের শরীরের জোড়গুলো যে খুলে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, ওগুলো যায় কোথায় এবং ওগুলোর সংখ্যাই বা কত ইত্যাদি সবকিছুই আল্লাহ জ্ঞাত আছেন। তিনি এগুলো একত্রিত করতে সক্ষম, যেমন তিনি প্রথমে সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি সমস্ত কিছুই জানেন। সবকিছুই তাঁর কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।

অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ কিয়ামত আসার হিকমত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ এটা এই জন্যে যে, যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ তিনি তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। তাদেরই জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযক। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর আয়াত সমূহকে ব্যর্থ করবার চেষ্টা করে তাদের জন্যে রয়েছে ভয়ংকর মর্মন্তুদ শাস্তি। সৎকর্মশীল মুমিনরা পুরস্কৃত হবে এবং দুষ্ট ও পাপী কাফিররা হবে শাস্তিপ্রাপ্ত। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “জাহান্নামের অধিবাসী ও জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।”(৫৯:২০) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি কি ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদেরকে ভূ-পৃষ্ঠে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের মত করবো অথবা আমি কি সংযমী ও আল্লাহভীরুদেরকে করবো পাপাসক্তদের মত?”(৩৮:২৮)।

এরপর আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের আর একটি হিকমত বর্ণনায় বলেনঃ কিয়ামতের দিন ঈমানদার লোকেরা সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত হতে এবং পাপীদেরকে শাস্তিপ্রাপ্ত হতে দেখে নিশ্চিত জ্ঞান দ্বারা চাক্ষুষ প্রত্যয় লাভ করবে। ঐ সময় তারা বলে উঠবেঃ আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ সত্য আনয়ন করেছিলেন। আরো বলা হবেঃ (আরবী) অর্থাৎ “দয়াময় আল্লাহ্ তো এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন।”(৩৬:৫২) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ্ কিতাবে লিপিবদ্ধ ছিল যে, তোমরা পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবস্থান করবে, তাহলে পুনরুত্থান দিবস তো এটাই।”(৩০:৫৬)

আল্লাহ পরাক্রমশালী অর্থাৎ তিনি প্রবল পরাক্রান্ত, বড়ই মর্যাদা সম্পন্ন, মহাশক্তির অধিকারী, ক্ষমতাবান শাসক এবং পূর্ণ বিজয়ী। তার উপর কারো কোন আদেশ চলে না এবং কারো কোন জোরও খাটে না। প্রত্যেক বস্তুই তাঁর কাছে শক্তিহীন ও অপারগ। তাঁর কথা ও কাজ চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী। তাঁর সমুদয় সৃষ্টজীব তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর:

কাফির ও বিপথগামী, যারা কিয়ামত সংঘটিত হওয়াকে অস্বীকার করে এবং এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে উপহাস করে, এখানে তাদেরই খবর আল্লাহ তা’আলা দিচ্ছেন। তারা পরস্পর বলাবলি করতোঃ দেখো, আমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি রয়েছে যে বলে যে, যখন আমরা মরে মাটির সাথে মিশে যাবো ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবো, তার পরেও নাকি আমরা আবার জীবিত হয়ে উঠবো! এ লোকটা সম্পর্কে দুটো কথা বলা যায়। হয়তো সে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ। করছে, না হয় সে উন্মাদ।

আল্লাহ তাআলা তাদের এ কথার জবাবে বলেনঃ না, এ কথা নয়। বরং মুহাম্মাদ (সঃ) সত্যবাদী, সৎ, সুপথ প্রাপ্ত ও জ্ঞানী। সে যাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানে পরিপক্ক। সে বড়ই দূরদর্শী। কিন্তু এর কি ওষুধ আছে যে কাফিররা মূর্খতা এবং অজ্ঞতামূলক কাজ-কাম করতে রয়েছে? তারা চিন্তা-ভাবনা করে কোন কাজের গভীরতায় পৌঁছবার কোন চেষ্টাই করে না। তারা শুধু অস্বীকার করতেই জানে। তারা যে কোন কথায় যেখানে সেখানে শুধু অস্বীকার করেই থাকে। কেননা, সত্য কথা ও সঠিক পথ তারা ভুলে যায়। সেখান থেকে তারা বহু দূরে ছিটকে পড়ে।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা কি তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে, আসমানে ও যমীনে যা আছে তার প্রতি লক্ষ্য করে না? তিনি এতে ক্ষমতাবান যে, এতে আকাশ ও এমন বিস্তৃত যমীন সৃষ্টি করেছেন! না আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে, না যমীন ধ্বসে যাচ্ছে। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আকাশকে স্বহস্তে সৃষ্টি করেছি এবং আমি প্রশস্ততার অধিকারী। আর আমি যমীনকে বিছিয়ে দিয়েছি এবং আমি বিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কতই না উত্তম!”(৫১:৪৭-৪৮) তাদের উচিত সামনে ও পিছনে এবং আকাশ ও পৃথিবীর প্রতি লক্ষ্য করা। এগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলেই তারা অনুধাবন করতে পারবে যে, যিনি এত বড় সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা এবং ব্যাপক ও অসীম শক্তির অধিকারী, তিনি কি মানুষের ন্যায় ক্ষুদ্র সৃষ্টিকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন না? তিনি তো ইচ্ছা করলে তাদেরকেসহ ভূমি ধ্বসিয়ে দিতে পারেন অথবা তাদের উপর আকাশ খণ্ডের পতন ঘটিয়ে দিতে পারেন! এরূপ অবাধ্য বান্দা কিন্তু এরূপ শাস্তিরই যোগ্য। কিন্তু ক্ষমা করে দেয়া আল্লাহর অভ্যাস। তিনি মানুষকে অবকাশ দিচ্ছেন মাত্র। যার জ্ঞান-বুদ্ধি আছে, দূরদর্শিতা আছে, আছে চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা, যার মধ্যে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার যোগ্যতা আছে, যার অন্তর আছে এবং অন্তরে জ্যোতি আছে, সে এসব বিরাট বিরাট নিদর্শন দেখার পর মহাশক্তির অধিকারী ও সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর এ সৃষ্টিতে সন্দেহ পোষণ করতেই পারে না যে, মৃত্যুর পর মানুষ পুনরুজ্জীবিত হবে। আকাশের ন্যায় সামিয়ানা এবং পৃথিবীর ন্যায় বিছানা যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর জন্যে মানুষকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা তো মোটেই কঠিন কাজ নয়! যিনি প্রথমবার হাড়-গোশত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, সেগুলো সড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবার পর আবার ঐগুলোকে পুনর্বার সৃষ্টি করতে কেন তিনি সক্ষম হবেন না? যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সমর্থ নন? হ্যা, নিশ্চয়ই (তিনি সক্ষম)।”(৩৬:৮১) আর একটি আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি তো মানব সৃষ্টি অপেক্ষা বেশী কঠিন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না।” (৪০:৫৭)

Leave a Reply