أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০০১)
[নিষ্প্রয়ােজন স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করছো!]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৬:শুআরা
পারা:১৯
১২৩-১৪০ নং আয়াত:-
২৬:১২৩
کَذَّبَتۡ عَادُۨ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۲۳﴾ۚۖ
‘আদ সম্প্রদায় রাসূলদের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল।
২৬:১২৪
اِذۡ قَالَ لَہُمۡ اَخُوۡہُمۡ ہُوۡدٌ اَلَا تَتَّقُوۡنَ ﴿۱۲۴﴾ۚ
যখন তাদের ভাই হূদ তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না?
২৬:১২৫
اِنِّیۡ لَکُمۡ رَسُوۡلٌ اَمِیۡنٌ ﴿۱۲۵﴾ۙ
আমি তোমাদের জন্য একজন আমানতদার রসূল।
২৬:১২৬
فَاتَّقُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوۡنِ ﴿۱۲۶﴾ۚ
কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।
২৬:১২৭
وَ مَاۤ اَسۡـَٔلُکُمۡ عَلَیۡہِ مِنۡ اَجۡرٍ ۚ اِنۡ اَجۡرِیَ اِلَّا عَلٰی رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۲۷﴾ؕ
আমি এ কাজে তোমাদের কাছ থেকে কোন প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান দেবার দায়িত্ব তো রব্বুল আলামীনের।
২৬:১২৮
اَتَبۡنُوۡنَ بِکُلِّ رِیۡعٍ اٰیَۃً تَعۡبَثُوۡنَ ﴿۱۲۸﴾
‘তোমরা কি প্রতিটি উচ্চ স্থানে
নিষ্প্রয়ােজন স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করছো?
২৬:১২৯
وَ تَتَّخِذُوۡنَ مَصَانِعَ لَعَلَّکُمۡ تَخۡلُدُوۡنَ ﴿۱۲۹﴾ۚ
এবং বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করছো, যেন তোমরা চিরকাল থাকবে?
২৬:১৩০
وَ اِذَا بَطَشۡتُمۡ بَطَشۡتُمۡ جَبَّارِیۡنَ ﴿۱۳۰﴾ۚ
আর যখন তোমরা আঘাত হানো, তখন নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হেনে থাক।
২৬:১৩১
فَاتَّقُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوۡنِ ﴿۱۳۱﴾ۚ
কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।
২৬:১৩২
وَ اتَّقُوا الَّذِیۡۤ اَمَدَّکُمۡ بِمَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۳۲﴾ۚ
ভয় কর তাঁকে, যিনি তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন সে সকল সম্পদ দিয়ে, যা তোমরা জান;
২৬:১৩৩
اَمَدَّکُمۡ بِاَنۡعَامٍ وَّ بَنِیۡنَ ﴿۱۳۳﴾ۚۙ
তোমাদের দিয়েছেন পশু, সন্তান-সন্ততি,
২৬:১৩৪
وَ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوۡنٍ ﴿۱۳۴﴾ۚ
উদ্যানরাজি ও বহু প্রস্রবণ;
২৬:১৩৫
اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۱۳۵﴾ؕ
নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উপর মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করি।’
২৬:১৩৬
قَالُوۡا سَوَآءٌ عَلَیۡنَاۤ اَوَ عَظۡتَ اَمۡ لَمۡ تَکُنۡ مِّنَ الۡوٰعِظِیۡنَ ﴿۱۳۶﴾ۙ
ওরা বলল, ‘তুমি উপদেশ দাও অথবা না-ই দাও উভয়ই আমাদের নিকট সমান।
২৬:১৩৭
اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا خُلُقُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۱۳۷﴾ۙ
এ তো পূর্বপুরুষদেরই রীতিনীতি মাত্র।
২৬:১৩৮
وَ مَا نَحۡنُ بِمُعَذَّبِیۡنَ ﴿۱۳۸﴾ۚ
‘আমরা মোটেই শাস্তিপ্রাপ্ত হবো না।’
২৬:১৩৯
فَکَذَّبُوۡہُ فَاَہۡلَکۡنٰہُمۡ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً ؕ وَ مَا کَانَ اَکۡثَرُہُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۳۹﴾
সুতরাং তারা তার প্রতি মিথ্যারোপ করল ফলে আমরা তাদেরকে ধ্বংস করলাম। এতে তো অবশ্যই আছে নিদর্শন; কিন্তু তাদের অধিকাংশই মুমিন নয়।
২৬:১৪০
وَ اِنَّ رَبَّکَ لَہُوَ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ﴿۱۴۰﴾٪
আর প্রকৃতপক্ষে তোমার রব যেমন পরাক্রমশালী তেমন করুণাময়ও।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
হযরত হুদ জাতি ইয়ামানের সীমান্তবর্তী বালুকাময় পাবর্ত্য অঞ্চল আহকাফে বাস করতাে। হযরত নূহ(আ.)-এর প্লাবনের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবী থেকে পাপীদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কিছুকাল পর যেসব লােক পুনরায় বিপথগামী হয়, হযরত হুদের জাতি আদ তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আদ জাতির কিসসা সূরা আরাফে ও হুদে কিছুটা বিশদভাবে এবং সূরা মােমেনূনে আদ ও হযরত হুদের নামােল্লেখ ছাড়াই বর্ণিত হয়েছে। আর এ সূরায় বর্ণিত হয়েছে সংক্ষেপে। এখানে শুধু হযরত হুদ(আ.)-এর দাওয়াত ও আদ জাতির মধ্য থেকে যারা তাকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের ধ্বংসের কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে। কাহিনীর সূচনাটা অবিকল হযরত নূহ(আ.)-এর কাহিনীর মতােই। শিল্পোন্নত আদ জাতির ধ্বংসের ইতিবৃত্ত আদ জাতি রসূলদেরকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করেছেন।(আয়াত ১২৩-১২৮) হযরত হুদ যে দাওয়াত তার জাতিকে দিয়েছিলেন। প্রত্যেক নবী ও রসূলের দাওয়াতই তদ্রুপ ছিলাে। আল্লাহকে ভয় করা ও রসূলের আনুগত্য করার দাওয়াত, যাদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় তাদের কাছে কোনাে পার্থিব সম্পদ বা পারিশ্রমিক পাওয়ার আশা না করার ঘােষণা, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জিনিসের মােহ পরিত্যাগ ও আল্লাহর কাছে থেকে চিরস্থায়ী পুরস্কার প্রাপ্তির আশাবাদ প্রত্যেক নবীর দাওয়াত ভাষণের অংগীভূত থাকতাে। এরপর হযরত হুদ(আ.) তার জাতির বিশেষ অবস্থা ও চরিত্র সম্পর্কেও বক্তব্য রাখেন। নিছক শক্তির দম্ভ প্রকাশার্থে এবং ধন সম্পদের প্রাচুর্য ও স্থাপত্য শিল্পের বড়াই প্রদর্শনার্থে তারা বিলাসবহুল ও কারুকার্য খচিত দালান কোঠা নির্মাণ করতে, পৃথিবীর নানা রকম সম্পদ ও শক্তির অধিকারী হয়ে তারা অহংকারে ধরাকে সরা মনে করতাে এবং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর সার্বক্ষণিক তদারকী সম্পর্কে উদাসীন থাকতাে। হযরত হুদ(আ.) আদ জাতির এসব চারিত্রিক দোষ ত্রুটির সমালােচনা ও নিন্দা করতেন। যেমন, তোমরা কি প্রত্যেক উচ্চ স্থানে নিষ্প্রয়ােজন স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করছে এবং বিরাট বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করছে, যেন চিরকাল বেঁচে থাকবে।'(আয়াত ১২৮-১২৯) রী শব্দটার অর্থ হলাে উচ্চ স্থান। ১২৮ নং আয়াতের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা তাদের এলাকায় যেখানেই কোনাে উঁচু জায়গা পেতে, সেখানেই একটা সৌধ বা ভবন নির্মাণ করতাে, যা পরবর্তীকালে দর্শকদের কাছে নিছক একটা স্মৃতি চিহ্ন বলেই মনে হতাে। নিছক নিজেদের শক্তি সামর্থ, আর্থিক প্রাচুর্য ও কারিগরি নৈপুণ্য প্রদর্শন করা ছাড়া এর আর কোনাে উদ্দেশ্য থাকতাে না। এ জন্যে একে ‘আবাছ’ বা নিম্প্রয়ােজন বলা হয়েছে। এসব সৌধ যদি পথিকের পথ নির্দেশনা বা সেবার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হতাে, তাহলে ‘নিষ্প্রয়ােজন’ কথাটা বলা হতো না। এ থেকে বুঝানাে হয়েছে যে, শারীরিক শ্রম, কারিগরি নৈপুণ্য ও অর্থ সম্পদ কেবলমাত্র প্রয়ােজনীয় ও লাভজনক কাজেই ব্যয় করা উচিত নিছক বিলাসিতা, সাজ সজ্জা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং নিছক কারিগরি নৈপুণ্য ও কুশলতা প্রদর্শনের জন্যে নয়। অনুরূপ, ১২৯ নং আয়াত থেকে বুঝা যায়, আদ জাতি স্থাপত্য শিল্পে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছিলাে। এমনকি তারা পাহাড় কেটে কেটে প্রাসাদ নির্মাণ, পাহাড়ের গায়ে রকমারি কারুকার্য এবং উচ্চতর স্থানগুলােত অত্যাধুনিক প্রাসাদ নির্মাণ করতাে। এ সব ভবন ও প্রাসাদ দেখে সে জাতির মনে হতাে যে, এগুলাে তাদেরকে মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট। এরপর হযরত হুদ তার জাতির চারিত্রিক ত্রুটিগুলাের সমালােচনা অব্যাহত রাখেন, আর যখন তােমরা আঘাত করাে, তখন চরম স্বেচ্ছাচারীর মতাে আঘাত করাে। অর্থাৎ তারা এতাে স্বেচ্ছাচারী ও অহংকারী ছিলাে যে, কারাে ওপর আক্রমণ চালালে নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতার সকল সীমা ছাড়িয়ে যেতে। এই পর্যায়ে তাদেরকে পুনরায় আল্লাহর ভয় ও রসূলের আনুগত্যের তাগিদ দেয়া হয়, যাতে তারা নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতা থেকে বিরত থাকে, ‘অতএব তােমরা আল্লাহকে ভয় করাে এবং আমার আনুগত্য করাে।’ অতপর তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কতাে নেয়ামত দান করেছেন, যার ওপর ভর করে তারা এতাে স্বেচ্ছাচার ও এতাে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছে। অথচ সেই সব নেয়ামতের কথা স্মরণ করে তাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত ছিলাে, যিনি এসব সম্পদ ঐশ্বর্য দিতে পেরেছেন তিনি যে কোনাে সময় তা ছিনিয়েও নিতে পারেন এবং নিছক বিলাসিতা ও দাম্ভিকতার বশে তারা যে অপচয় ও অপব্যয় করে, তার জন্যে তিনি ভয়াবহ শাস্তি দিতে পারেন এ কথা মনে করে সংযত ও বিনয়ী হওয়া উচিত ছিলাে। ‘তােমরা সেই আল্লাহকে ভয় করাে, যিনি তােমাদেরকে তােমাদের সুপরিচিত সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছেন, সাহায্য করেছেন চতুষ্পদ জন্তু ও সন্তান-সন্তুতি দিয়ে।'(আয়াত ১৩২-১৩৫) এভাবে প্রথমে নেয়ামতদাতা ও নেয়ামতের কথা সংক্ষেপে স্মরণ করিয়েছেন। সুপরিচিত সামগ্রী বলতে সেই সব সামগ্রীকে বুঝানাে হচ্ছে, যা তাদের সামনে উপস্থিত, যেগুলােকে তারা জানে ও চেনে এবং যেগুলাের ভেতরে তারা জীবন যাপন করে। তারপর কিছুটা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন যে, চতুষ্পদ জন্তু, সন্তান-সন্ততি, বাগান ও নদনদী দিয়ে সাহায্য করেছেন। তৎকালে এগুলােই ছিলাে সুপরিচিত সম্পদ। এগুলাে শুধু তৎকালেই নয়, সর্বকালেই সুপরিচিত সম্পদ। অতপর তাদেরকে কেয়ামতের আযাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন এবং সতর্ক করে দিচ্ছেন এভাবে যেন তিনি নিজেই তাদের আযাবের ভয় পাচ্ছেন। কেননা তিনি তাে তাদের ভাই এবং তাদেরই একজন। তাই তারা কেয়ামতের আযাবে আক্রান্ত না হােক এটাই তার কাম্য। কিন্তু এই স্মরণ করানাে ও সতর্ক করানাে, তাদের বদ্ধ হৃদয়ে কোনাে শুভ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারেনি। তারা চরম হঠকারিতা, গােয়ার্তুমি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় জবাব দেয়, ‘তারা বললাে, তুমি আমাদেরকে উপদেশ দাও বা না দাও উভয়ই সমান।’ অর্থাৎ তুমি আমাদেরকে উপদেশ দাও বা না দাও, তাতে আমাদের কিছুই আসে যায় না। এ কথার ভেতরে এক ধরনের অবজ্ঞা, ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্য ফুটে উঠেছে। এর অনিবার্য ফল হলাে বুদ্ধির স্থবিরতা, একগুয়েমি ও অন্ধ অনুকরণ। এ সব কেবল প্রাচীনকালের লােকদের ঐতিহ্য। ‘আমাদেরকে কোনাে শাস্তিই দেয়া হবে না।’ অর্থাৎ কিনা, তাদের চালচলন ও আদত-অভ্যাস, যার জন্যে হুদ(আ.) এতাে সমালােচনা করে থাকেন, তা প্রাচীনকালের লােকদের ঐতিহ্য ও আদত অভ্যাস। তারা সেই প্রাচীন ঐতিহ্যেরই অনুসারী! আর প্রাচীনকালের লােকদের ঐতিহ্য অনুসরণের জন্যে কোনােরকম আযাবের সম্ভাবনাকে তারা অস্বীকার করছে। এরপর তাদের ও তাদের রসূলের মাঝে যে বাক বিতন্ডা হয়েছে, এখানে তার আর কোনাে বিবরণ দেয়া হয়নি। এখানে শুধু শেষ অবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অতঃপর তারা তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে। ফলে আমি তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম।’ মাত্র দুটো বাক্যে কাহিনীর সমাপ্তি টানা হলাে, শিল্পোন্নতি, অহংকারী, প্রতাপান্বিত আদ জাতি ধ্বংস হয়ে গেলাে। তাদের বিশাল বিশাল স্থাপত্য কর্ম ধুলিস্মাত হয়ে গেলাে। তাদের যাবতীয় ধন সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি, চতুস্পদ জন্তু, বাগান ও নদনদী সবই ধরাপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলাে। আদ জাতি ছাড়াও বহু জাতি এভাবে চিন্তা করে থাকে, এভাবে ঔদ্ধত্য ও অহংকার প্রদর্শন করে থাকে, আল্লাহ তায়ালা থেকে দূরে সরে যায় এবং মনে করে যে, মানুষের জীবনে আল্লাহর কোনাে প্রয়ােজন নেই। কোনাে জাতি সভ্যতায় উন্নতি সাধন করলেই তাদের মধ্যে এ ধরনের চিন্তা দানা বাঁধে। তারা নিজেদেরকে শত্রু থেকে রক্ষা করা ও অন্যদেরকে ধ্বংস করার উপকরণাদি তৈরী করে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে জীবন যাপন করতে থাকে। সহসা একদিন ওপর থেকে ও নীচ থেকে যে কোনােভাবে আযাবের শিকার হয়। এ কাহিনীতে নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ঈমান আনেনি। আর তােমার প্রতিপালক মহাপরাক্রমশালী, করুণাময়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন আল আ’রাফ ৬৫-৭২ ও হূদ ৫০-৬০ আয়াত। এছাড়া এ কাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত স্থানগুলো পড়ুনঃ হা-মীম আস্ সাজদাহ ১৩-১৬ , আল আহকাফ ২১-২৬ , আয্ যারিয়াত ৪১-৪৫ , আল কামার ১৮-২২ , আল হাক্কাহ ৪-৮ এবং আল ফজর ৬-৮ আয়াত।
# হযরত হূদের এ ভাষণটি অনুধাবন করার জন্য এ জাতিটি সম্পর্কিত তথ্যাবলী আমাদের সামনে থাকা প্রয়োজন। কুরআন মজীদ বিভিন্ন স্থানে আমাদের কাছে এ তথ্য পরিবেশন করেছে। এতে বলা হয়েছে, নূহের জাতির ধ্বংসের পর দুনিয়ায় যে জাতির উত্থান ঘটানো হয়েছিল তারা ছিল এই আদ জাতিঃ
وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ قَوْمِ نُوحٍ
“স্মরণ করো (আল্লাহর অনুগ্রহ ও দানের কথা) তিনি নূহের জাতির পরে তোমাদেরকে খলীফা তথা প্রতিনিধি নিয়োগ করেন।” (সূরা আল আ’রাফ ৬৯ আয়াত) শারীরিক দিক দিয়ে তারা ছিল অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান ও বলিষ্ঠ জাতি।
وَزَادَكُمْ فِي الْخَلْقِ بَسْطَةً
“আর শারীরিক গঠন শৈলীতে তোমাদেরকে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করি।” (আল আ’রাফ ৬৯ আয়াত)
সেকালে তারা ছিল নজিরবিহীন জাতি। তাদের সমকক্ষ অন্য কোন জাতিই ছিল নাঃ الَّتِي لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ
“তাদের সমকক্ষ কোন জাতি দেশে সৃষ্টি করা হয়নি।” (আল ফজর, ৮ আয়াত)
তাদের সভ্যতা ছিল বড়ই উন্নত ও গৌরবোজ্জ্বল। সুউচ্চ ইমারত নির্মাণ করা ছিল তাদের বৈশিষ্ট্য এবং এজন্য তদানীন্তন বিশ্বে তারা প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলঃ
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ – إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ “তুমি কি দেখোনি তোমাদের রব কি করেছেন সুউচ্চ স্তম্ভের অধিকারী ইরমের আদদের সাথে?” (আল ফজরঃ ৬-৭ আয়াত)
এ বস্তুগত উন্নতি ও শারীরিক শক্তি তাদেরকে অহংকারী করে দিয়েছিল এবং নিজেদের শক্তির গর্বে তারা মত্ত হয়ে উঠেছিলঃ فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً
“আর আদ জাতি, তারা তো পৃথিবীতে সত্যের পথ থেকে সরে গিয়ে অহংকার করতে থাকে এবং বলতে থাকে, কে আছে আমাদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী?” (হা-মীম আস্ সাজদাহ ১৫ আয়াত)
তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল কয়েকজন বড় বড় জালেম একনায়কের হাতে। তাদের সামনে কেউ ‘টু’ শব্দটিও পর্যন্ত করতে পারতো নাঃ
وَاتَّبَعُوا أَمْرَ كُلِّ جَبَّارٍ عَنِيدٍ
“আর তারা প্রত্যেক সত্যের দুশমন জালেম একনায়কের হুকুম পালন করে।” (হূদ, ৫৯ আয়াত)
ধর্মীয় দিক থেকে তারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতো না বরং শিরকে লিপ্ত ছিল। বন্দেগী একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত হওয়া উচিত, একথা তারা অস্বীকার করতোঃ
قَالُوا أَجِئْتَنَا لِنَعْبُدَ اللَّهَ وَحْدَهُ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا
“তারা (হূদ আলাইহিস সালামকে) বললো, তুমি কি আমাদের কাছে এজন্য এসেছো যে, আমরা একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করবো এবং আমাদের বাপ-দাদারা যাদের ইবাদাত করতো তাদেরকে বাদ দেবো?” (আল আ’রাফ, ৭০ আয়াত) এ বৈশিষ্ট্যগুলো সামনে রাখলে হযরত হূদের দাওয়াতের এ ভাষণ ভালোভাবে অনুধাবন করা যেতে পারে।
# নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও সমৃদ্ধির প্রদর্শনী করার উদ্দেশ্যে এমনসব বিশাল সুরম্য অট্টলিকা নির্মাণ করছো; যেগুলোর কোন প্রয়োগ ক্ষেত্র ও প্রয়োজনীয়তা নেই এবং নিছক তোমাদের সম্পদশালীতা ও শানশওকতের প্রদর্শনীর নিদর্শন হিসেবে এগুলো টিকে থাকবে, এছাড়া যেগুলোর কোন উপযোগিতাও নেই।
# তোমাদের অন্যান্য ইমারতগুলো ব্যবহারের জন্য নির্মিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেগুলোকে সুরম্য, কারুকার্যময় ও সুদৃঢ় করার ব্যাপারে তোমরা এতবেশী অর্থ, শ্রম ও যোগ্যতা নিয়োগ করছো যেন তোমরা এ দুনিয়ায় চিরকাল বসবাস করার ব্যবস্থা করছো, যেন শুধুমাত্র এখানকার আয়েশ-আরামের ব্যবস্থা করাই তোমাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং এছাড়া আর কোন কথাই চিন্তা করার নেই। এ প্রসঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, অপ্রয়োজনে বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করা এমন কোন বিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড নয়, যার প্রকাশ কোন জাতির মধ্যে এভাবে পারে যে, তার অন্য সমস্ত কাজ কারবার তো ভালোই শুধুমাত্র এ একটি খারাপ ও ভুল কাজ সে করেছে। এ অবস্থা একটি জাতির মধ্যে সৃষ্টিই হয় এমন এক সময় যখন একদিকে তার মধ্যে দেখা দেয় সম্পদের প্রাচুর্য এবং অন্যদিকে প্রবৃত্তি পূজা ও বৈষয়িক স্বার্থপরতা প্রবল হতে হতে উন্মত্ততার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। যখন কোন জাতির মধ্যে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায় তখন তার সভ্যতা-সংস্কৃতির সমগ্র ব্যবস্থাটিই পচে দুর্গন্ধময় হয়ে পড়ে। হূদ (আ) তাঁর জাতির ইমারত নির্মাণের যে সমালোচনা করেন তার উদ্দেশ্য এ ছিল না যে, তিনি শুধুমাত্র তাদের এ ইমারত নির্মাণকেই আপত্তিকর মনে করতেন বরং তিনি সামগ্রিকভাবে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকৃতির সমালোচনা করছিলেন এবং এ ইমারতগুলোর কথা তিনি এমন ভাবে উচ্চারণ করেছিলেন যেন সারা দেশে সর্বত্র এ বড় বড় ফোড়াগুলো সেই বিকৃতির সবচেয়ে সুস্পষ্ট আলামত হিসেবে পরিদৃষ্ট হচ্ছে।
# নিজেদের জীবন যাত্রার মান উন্নত করার ক্ষেত্রে তোমরা এত বেশী সীমালঙ্ঘন করে গেছো যার ফলে মনে হয়েছে তোমাদের বাসগৃহ নয়, সুদৃশ্য মহল ও প্রাসাদের প্রয়োজন। আর এতেও পরিতৃপ্ত না হয়ে তোমরা অপ্রয়োজনে সুউচ্চ নয়নাভিরাম ইমারতসমূহ নির্মাণ করছো। শক্তি ও সম্পদের প্রদর্শনী ছাড়া এগুলোর আর কোন সার্থকতা নেই। কিন্তু তোমাদের মনুষ্যত্বের মানদণ্ড এত নিচে নেমে গেছে, যার ফলে দুর্বলদের জন্য তোমাদের অন্তরে একটুও দয়া মায়া নেই। গরীবদের জন্য তোমাদের দেশে কোন ইনসাফ নেই। আশপাশের দুর্বল জাতিগুলো হোক বা তোমাদের নিজেদের দেশের পশ্চাতপদ শ্রেণীগুলো, সবাই তোমাদের জুলুম-নিপীড়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে এবং তোমাদের নির্মম নির্যাতনের হাত থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না।
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক. যা কিছু আমরা করছি এগুলো কোন নতুন জিনিস নয়, শত শত বছর থেকে আমাদের বাপ-দাদারা এসব করে আসছে। এসবই ছিল তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, চরিত্রনীতি ও ব্যবহারিক জীবনধারা। তাদের ওপর এমন কি বিপদ নেমে এসেছিল যে, আজ আমাদের ওপর তা নেমে আসার আশঙ্কা করবো? এ জীবন ধারায় যদি কোন অন্যায় ও দুষ্কৃতির অংশ থাকতো, তাহলে তুমি যে আযাবের ভয় দেখাচ্ছো তা আগেই নেমে আসতো। দুই, তুমি যেসব কথা বলছো এমনি ধারার কথা ইতিপূর্বেও বহু ধর্মীয় উম্মাদ এবং যারা নৈতিকতার বুলি আওড়ায় তারা আওড়িয়ে এসেছে। কিন্তু দুনিয়ার রীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তোমাদের মত লোকদের কথা না মানার ফলে কখনো এক ধাক্কায় এ রীতির মধ্যে ওলট-পালট হয়ে যায়নি।
# এ জাতির ধ্বংসের যে বিস্তারিত বিবরণ কুরআন মজীদে এসেছে তা হচ্ছে এই, হঠাৎ প্রবল ঘূর্ণিঝড় উঠে। লোকেরা দূর থেকে নিজেদের উপত্যকার দিকে এ ঘূর্ণিঝড় আসতে দেখে মনে করে মেঘ ছেয়ে যাচ্ছে। তারা আনন্দে উতলা হয়ে উঠে। কারণ জোর বৃষ্টিপাত হবে। কিন্তু তা ছিল আল্লাহর আযাব। আট দিন ও সাত রাত পর্যন্ত এমন ঝড়ো হাওয়া অনবরত বইতে থাকে যার ফলে প্রত্যেকটি জিনিসই ধ্বংস হয়ে যায়। হাওয়া প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়ে মানুষ জনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে চতুর্দিকে নিক্ষেপ করতে থাকে। বাতাসে বেশী গরম ও শুকনা ছিল যে, যার উপর দিয়ে তা একবার প্রবাহিত হয় তাকে নড়বড়ে ও অকেজো করে দিয়ে যায়। এ জালেম জাতির প্রত্যেকটি লোক খতম না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এ ঝড় থামেনি। তাদের জনপদের ধ্বংসাবশেষগুলোই শুধু তাদের পরিণামের কাহিনী শুনাবার জন্য টিকে আছে। আর আজ এ ধ্বংসাবশেষও নেই। আহকাফের সমগ্র এলাকা একটি ভয়াবহ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আহকাফ ২৫ টীকা।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১২৩-১৩৫ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে হযরত হূদ (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে যে, তিনি তাঁর সম্প্রদায় আ’দ জাতিকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। তারা ছিল আকাফের অধিবাসী। আহকাফ হলো ইয়ামন দেশের হাযূরা মাউতের পার্শ্ববর্তী একটি পার্বত্য অঞ্চল। হব্রত হূদ (আঃ)-এর যুগটি ছিল হযরত নূহ (আঃ)-এর পরবর্তী যুগ। সূরায়ে আব্রাফেও তাঁর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আ’দ সম্প্রদায়কে হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের স্থলাভিষিক্ত করা হয় এবং তাদেরকে বেশ স্বচ্ছলতা প্রদান করা হয়। তারা ছিল সবল ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তাদের ছিল প্রচুর ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি। জমি-জমা, বাগ্-বাগীচা, ফলমূল, নদী-প্রস্রবণ ইত্যাদির প্রাচুর্য তাদের ছিল। মোটকথা, সুখের সামগ্রী তাদের সবই ছিল। কিন্তু তারা মহান আল্লাহর নিয়ামতরাশির জন্যে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি এবং তার সাথে শরীক স্থাপন করেছিল। নবী (আঃ)-কে তারা আবিশ্বাস করেছিল। নবী তো ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি তাদেরকে বুঝিয়েছিলেন এবং আল্লাহর ভয় প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি তাদেরকে তাঁর রাসূল হওয়ার কথা বলার পর তাঁর আনুগত্য করার এবং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করার দাওয়াত দেন, যেমন হযরত নূহ (আঃ) দাওয়াত দিয়েছিলেন।
তারা তাদের শক্তি ও ধনৈশ্বর্যের নিদর্শন রূপে উঁচু উঁচু প্রসিদ্ধ পাহাড়ের উপর উঁচু উঁচু প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল। হযরত হূদ (আঃ) তাদেরকে এভাবে মাল অপচয় করতে নিষেধ করেছিলেন। কেননা, ওটা শুধু মাল অপচয় করা, সময় নষ্ট করা এবং কষ্ট উঠানো ছাড়া কিছুই ছিল না। ওতে না ছিল দ্বীনের কোন উপকার এবং না ছিল কোন উপকার দুনিয়ার। তাদের নবী হযরত হূদ (আঃ) তাই তাদেরকে বলেছিলেন, তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে নিরর্থক স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করছো? তোমরা কি মনে করেছে যে, এখানে তোমরা চিরস্থায়ী হবে? দুনিয়া তোমাদেরকে আখিরাতের কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। জেনে রাখো যে, তোমাদের এ মনোবাসনা নিরর্থক। দুনিয়া তো নশ্বর। তোমরা নিজেরাও ধ্বংস হয়ে যাবে। একটি কিরআতে (আরবি) রয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উত্মা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন মুসলমানরা গৃতায় বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করে ও সুন্দর সুন্দর বাগান তৈরী করে তখন হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) এসব দেখে মসজিদে দাঁড়িয়ে যান এবং উচ্চ স্বরে বলেনঃ “হে দামেস্কের অধিবাসী! তোমরা আমার কথা শুনো!” জনগণ সব একত্রিত হলে তিনি হামদ ও সানার পর বলেনঃ “তোমাদের কি লজ্জা হয় না, তোমরা কি এটা খেয়াল করছে না যে, তোমরা যা জমা করতে শুরু করেছে তা তোমরা খেতে পার না? তোমরা এমন ঘরবাড়ী তৈরী করতে শুরু করে দিয়েছো যেগুলো তোমাদের বসবাসের কাজে লাগবে না। তোমরা এমন দূরের আশা করতে শুরু করেছে যা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। তোমরা ভুলে গেছো যে, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরাও বহু কিছু জমা করেছিল, বড় বড় ও উঁচু উঁচু প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল, বড় রকমের আশা তারা পোষণ করেছিল, কিন্তু ফল এই দাঁড়িয়েছিল যে, তারা প্রতারিত হয়েছিল, তাদের সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাদের ঘরবাড়ী, দালান-কোঠা মূলোৎপাটিত হয়েছিল। আ’দ সম্প্রদায়কে দেখো, আদৃন হতে আম্মান পর্যন্ত তাদের ঘোড়া ও উট ছিল। কিন্তু তারা আজ কোথায়? এমন কোন নির্বোধ আছে কি যে আ’দ সম্প্রদায়ের মীরাসকে মাত্র দুই দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করবে?
আল্লাহ তা’আলা আ’দ সম্প্রদায়ের ধন-দৌলত ও ঘরবাড়ীর বর্ণনা দেয়ার পর তাদের বল ও শক্তির বর্ণনা দিয়েছেন যে, তারা বড়ই উদ্ধত, অহংকারী ও পাষাণ হৃদয় ছিল। আল্লাহর নবী হযরত হূদ (আঃ) তাদেরকে আল্লাহর ভয় দেখালেন এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে বললেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে ঐ সব নিয়ামতের কথা স্মরণ করালেন যেগুলো মহান আল্লাহ তাদেরকে দান করেছিলেন। যেমন চতুষ্পদ জন্তু, সন্তান-সন্ততি, উদ্যান এবং প্রস্রবণ। তারপর তিনি তাদেরকে বললেন যে, তিনি তাদের জন্যে মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করেন। তিনি তাদেরকে জান্নাতের লোভ দেখান এবং জাহান্নাম হতে ভীতি প্রদর্শন করেন। কিন্তু সবই বিফলে যায়।
১৩৬-১৪০ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত হূদ (আঃ)-এর হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা এবং উৎসাহ প্রদান ও ভয় প্রদর্শনযুক্ত ভাষণ তাঁর কওমের উপর মোটেই ক্রিয়াশীল হলো না। তারা পরিষ্কারভাবে বলে দিলোঃ “(হে হৃদ আঃ)! তুমি আমাদেরকে উপদেশ দাও আর না-ই দাও, উভয়ই আমাদের জন্যে সমান। আমরা তোমার কথা মেনে নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের রীতি-নীতি পরিত্যাগ করতে পারি না। আমাদের ঈমান আনয়নের ব্যাপারে তোমাদের নিরাশ হয়ে যাওয়া উচিত আমরা তোমার উপর ঈমান আনবো না।” প্রকৃতপক্ষে কাফিরদের অবস্থা এটাই। তাদেরকে বুঝানো ও উপদেশ দান বৃথা।
শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে আল্লাহ তা’আলা একথাই বলেছিলেনঃ ‘যারা কাফির হয়েছে তাদেরকে তুমি ভয় প্রদর্শন কর বা না-ই কর, উভয়ই তাদের জন্যে সমান, তারা ঈমান আনবে না।” আর এক জায়গায় রয়েছেঃ “নিশ্চয়ই যাদের উপর তোমার প্রতিপালকের কথা বাস্তবায়িত হয়েছে তারা ঈমান আনয়ন করবে না।”
(আরবি)-এর দ্বিতীয় কিরআত (আরবি) ও রয়েছে। অর্থাৎ হে হৃদ (আঃ)! তুমি.যে কথা আমাদেরকে বলছো এটা তো পূর্ববর্তীদের কথিত কথা।’ যেমন কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেছিলঃ “এগুলো তো পূর্ববর্তীদের কাহিনী, যেগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তোমার সামনে পাঠ করা হয়। আর এক জায়গায় রয়েছেঃ “এটা একটা মিথ্যা অপবাদ যা তুমি নিজেই গড়িয়ে নিয়েছো এবং কিছু লোককে নিজের পক্ষে করে নিয়েছো।” প্রসিদ্ধ কিরআত হিসেবে অর্থ হবেঃ “যার উপর আমরা রয়েছি ওটাই আমাদের পূর্বপুরুষদের মাযহাব। আমরা তো তাদের পথেই চলবো এবং তাদের রীতি-নীতিরই অনুসরণ করবো। আর এর উপরই আমরা মৃত্যু বরণ করবো। তুমি যা বলছে তা বাজে কথা। মৃত্যুর পরে আমাদেরকে পুনরায় জীবিত করা হবে এটা ঠিক নয়। আমাদেরকে শাস্তিও দেয়া হবে না। শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধাচরণ ও অবিশ্বাস করার কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। প্রচণ্ড বায়ু প্রেরণ করে তাদেরকে মূলোৎপাটিত করা হয়। এরাই ছিল প্রথম আ’দ। এদেরকেই ইরামাযাতিল ইমাদ বলা হয়েছে। এরা ইরাম ইবনে সাম ইবনে নূহ (আঃ)-এর বংশধর ছিল। তারা সুউচ্চ প্রাসাদে বাস করতো। ইরাম ছিল হযরত নূহ (আঃ)-এর পৌত্রের নাম। ইরাম কোন শহরের নাম ছিল না। কেউ কেউ ইরামকে শহরের নামও বলেছেন বটে, কিন্তু এটা বানী ইসরাঈলের উক্তি। তাদের মুখ থেকে শুনে অন্যেরাও একথা বলে দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এর কোন ম্যুবৃত দলীল নেই। এ কারণেই কুরআন কারীমে ইরামের উল্লেখের পরেই বলা হয়েছেঃ (আরবি)
(আরবি) অর্থাৎ “যার সমতুল্য কোন শহরে সৃষ্টি করা হয়নি।” (৮৯: ৮) যদি ইরাম দ্বারা শহর উদ্দেশ্য হতো তবে বলা হতো।
অর্থাৎ “কোন দেশ যার মত শহর নির্মাণ করা হয়নি।” কুরআন কারীমের অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আ’দ সম্প্রদায় অন্যায়ভাবে ভূ-পৃষ্ঠে অহংকার করে এবং বলে-আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? তারা কি দেখেনি যে, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী? তারা তার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করতো।” (৪১:১৫)
এটা আমরা পূর্বেই বর্ণনা করেছি যে, তাদের উপর শুধু বলদের নাক পরিমাণ বায়ু পাঠিয়েছিলেন। ঐ বায়ুই তাদের শহরগুলো এবং তাদের ঘরবাড়ীগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়। যেখান দিয়েই ঐ বায়ু প্রবাহিত হয় সব সাফ করে দেয়। কওমের সবারই মাথা দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আল্লাহর শাস্তিকে তারা বাতাসের আকারে দেখে দূর্গে, প্রাসাদে এবং সুরক্ষিত ঘরে আশ্রয় নেয়। মাটিতে গর্ত খনন করে তারা তাদের অর্ধেক দেহকে তাতে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আল্লাহর শাস্তিকে কোন কিছু বাধা দিতে পারে কি? এ শাস্তি এক মিনিটের জন্যেও কাউকেও অবকাশ দেয় না। মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাদের এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ “আ’দ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝঞাবায়ু দ্বারা, যা তিনি তাদের উপর প্রবাহিত করেছিলেন সপ্তরাত্রি ও অষ্টদিবস বিরামহীনভাবে; তখন তুমি উক্ত সম্প্রদায়কে দেখতে তারা সেখানে লুটিয়ে পড়ে আছে সারশূন্য বিক্ষিপ্ত খর্জুর কাণ্ডের ন্যায়।” মহান আল্লাহ বলেনঃ এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই ঈমানদার নয়। আল্লাহ হলেন মহাপরাক্রমশালী ও পরম দয়ালু।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1001)
[Do you build on every Ri` an Ayah for your amusement!]
www.motaher21.net
Sura:26
Para:19
Sura: Ash-Shu’araa
Ayat: 123-140