أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০১১)
[দলীল-প্রমাণ বাদ দিয়ে অনুসরণ করা যাবে না।]
www.motaher21.net
সূরা:- আন-নমল।
পারা:১৯
৪৫- ৫৮ নং আয়াত:-
২৭:৪৫
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلٰی ثَمُوۡدَ اَخَاہُمۡ صٰلِحًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ فَاِذَا ہُمۡ فَرِیۡقٰنِ یَخۡتَصِمُوۡنَ ﴿۴۵﴾
আর অবশ্যই আমরা সামূদ সম্প্রদায়ের কাছে তাদের ভাই সালেহকে পাঠিয়েছিলাম এ আদেশসহ যে, ‘তোমরা আল্লাহ্র ‘ইবাদাত কর ,’ এতে তারা দু’দলে বিভক্ত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হল।
২৭:৪৬
قَالَ یٰقَوۡمِ لِمَ تَسۡتَعۡجِلُوۡنَ بِالسَّیِّئَۃِ قَبۡلَ الۡحَسَنَۃِ ۚ لَوۡ لَا تَسۡتَغۡفِرُوۡنَ اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ﴿۴۶﴾
তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায় ! তোমরা কেন কল্যাণের আগে অকল্যাণ ত্বরান্বিত করতে চাচ্ছ ? কেন তোমরা আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছ না, যাতে তোমরা রহমত পেতে পার?’
২৭:৪৭
قَالُوا اطَّیَّرۡنَا بِکَ وَ بِمَنۡ مَّعَکَ ؕ قَالَ طٰٓئِرُکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ بَلۡ اَنۡتُمۡ قَوۡمٌ تُفۡتَنُوۡنَ ﴿۴۷﴾
ওরা বলল, ‘তোমাকে ও তোমার সঙ্গে যারা আছে, তাদেরকে আমরা অমঙ্গলের কারণ মনে করি।’[১] (সালেহ) বলল, ‘তোমাদের শুভাশুভ আল্লাহর এখতিয়ারে, বস্তুতঃ তোমরা এমন এক সম্প্রদায় যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
২৭:৪৮
وَ کَانَ فِی الۡمَدِیۡنَۃِ تِسۡعَۃُ رَہۡطٍ یُّفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا یُصۡلِحُوۡنَ ﴿۴۸﴾
সে শহরে ছিল ন’জন দল নায়ক যারা দেশের বিপর্যয় সৃষ্টি করতো এবং কোন গঠনমূলক কাজ করতো না।
২৭:৪৯
قَالُوۡا تَقَاسَمُوۡا بِاللّٰہِ لَنُبَیِّتَنَّہٗ وَ اَہۡلَہٗ ثُمَّ لَنَقُوۡلَنَّ لِوَلِیِّہٖ مَا شَہِدۡنَا مَہۡلِکَ اَہۡلِہٖ وَ اِنَّا لَصٰدِقُوۡنَ ﴿۴۹﴾
তারা বলল, ‘তোমরা পরস্পর আল্লহর নামে শপথ গ্রহণ কর, ‘আমরা রাতেই শেষ করে দেব তাকে ও তার পরিবার-পরিজনকে; তারপর তার অভিভাবককে নিশ্চিত করে বলব যে, ‘তার পরিবার-পরিজন হত্যা আমরা প্রত্যক্ষ করিনি; আর আমরা অবশ্যই সত্যবাদী ।
২৭:৫০
وَ مَکَرُوۡا مَکۡرًا وَّ مَکَرۡنَا مَکۡرًا وَّ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۵۰﴾
এ চক্রান্ত তো তারা করলো এবং তারপর আমি একটি কৌশল অবলম্বন করলাম, যার কোন খবর তারা রাখতো না।
২৭:৫১
فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ مَکۡرِہِمۡ ۙ اَنَّا دَمَّرۡنٰہُمۡ وَ قَوۡمَہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿۵۱﴾
অবশেষে তাদের চক্রান্তের পরিণাম কি হলো দেখে নাও। আমি তাদেরকে এবং তাদের সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে দিলাম।
২৭:৫২
فَتِلۡکَ بُیُوۡتُہُمۡ خَاوِیَۃًۢ بِمَا ظَلَمُوۡا ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لِّقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ ﴿۵۲﴾
এই তো তাদের বাড়ী-ঘর; তাদের সীমালংঘন হেতু তা জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। এতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।
২৭:৫৩
وَ اَنۡجَیۡنَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ ﴿۵۳﴾
আর আমরা উদ্ধার করেছিলাম তাদেরকে, যারা ঈমান এনেছিল। আর তারা তাকওয়া অবলম্বন করত।
২৭:৫৪
وَ لُوۡطًا اِذۡ قَالَ لِقَوۡمِہٖۤ اَتَاۡتُوۡنَ الۡفَاحِشَۃَ وَ اَنۡتُمۡ تُبۡصِرُوۡنَ ﴿۵۴﴾
আর স্মরণ করুন লূতের কথা , তিনি তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, ‘তোমরা জেনে-দেখে কেন অশ্লীল কাজ করছ?
২৭:৫৫
اَئِنَّکُمۡ لَتَاۡتُوۡنَ الرِّجَالَ شَہۡوَۃً مِّنۡ دُوۡنِ النِّسَآءِ ؕ بَلۡ اَنۡتُمۡ قَوۡمٌ تَجۡہَلُوۡنَ ﴿۵۵﴾
তোমাদের কি এটাই রীতি, কাম-তৃপ্তির জন্য তোমরা মেয়েদের বাদ দিয়ে পুরুষদের কাছে যাও? আসলে তোমরা ভয়ানক মূর্খতায় লিপ্ত হয়েছো।”
২৭:৫৬
فَمَا کَانَ جَوَابَ قَوۡمِہٖۤ اِلَّاۤ اَنۡ قَالُوۡۤا اَخۡرِجُوۡۤا اٰلَ لُوۡطٍ مِّنۡ قَرۡیَتِکُمۡ ۚ اِنَّہُمۡ اُنَاسٌ یَّتَطَہَّرُوۡنَ ﴿۵۶﴾
উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বলল, ‘লূত-পরিবারকে তোমাদের জনপদ হতে বহিষ্কার কর, এরা তো এমন লোক যারা পবিত্র সাজতে চায়।’
২৭:৫৭
فَاَنۡجَیۡنٰہُ وَ اَہۡلَہٗۤ اِلَّا امۡرَاَتَہٗ ۫ قَدَّرۡنٰہَا مِنَ الۡغٰبِرِیۡنَ ﴿۵۷﴾
শেষ পর্যন্ত আমরা তাঁকে এবং তাঁর পরিবারবর্গকে বাঁচিয়ে নিলাম তবে তাঁর স্ত্রীকে নয়। কারণ তার পেছনে থেকে যাওয়াটাই আমি স্থির করে দিয়েছিলাম।
২৭:৫৮
وَ اَمۡطَرۡنَا عَلَیۡہِمۡ مَّطَرًا ۚ فَسَآءَ مَطَرُ الۡمُنۡذَرِیۡنَ ﴿٪۵۸﴾
তাদের উপর বিশেষ ধরনের বৃষ্টি বর্ষণ করলাম; যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল, তাদের জন্য এই বর্ষণ ছিল কত মারাত্মক!
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪৫-৫৩ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা সালেহ (عليه السلام) ও তাঁর সামূদ জাতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আ‘দ জাতির ধ্বংসের প্রায় ৫০০ বছর পরে সালেহ (عليه السلام) সামূদ জাতির প্রতি নাবী হিসেবে প্রেরিত হন। (তারীখুল আম্বিয়া ১/৪৯) আ‘দ ও সামূদ জাতি একই দাদা ‘ইরাম’ এর দুটি বংশধারার নাম। সামূদ জাতি আরবের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় বসবাস করত। তাদের প্রধান শহরের নাম ছিল ‘হিজর’ যা সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে একে সাধারণভাবে ‘মাদায়েনে সালেহ’ বলা হয়। আ‘দ জাতির ধ্বংসের পর সামূদ জাতি তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়।
(فَاِذَا ھُمْ فَرِیْقٰنِ)
অর্থাৎ সালেহ (عليه السلام) তাওহীদের দাওয়াত দেয়া শুরু করলে জাতির লোকেরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল ঈমান আনে, তবে এরা ছিল সমাজের দুর্বল ও সাধারণ মানুষ। সাধারণত নাবীদের অনুসারী এমনই হয়ে থাকে যেমন হিরাকলের হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৭)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَالَ الْمَلَاُ الَّذِیْنَ اسْتَکْبَرُوْا مِنْ قَوْمِھ۪ لِلَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا لِمَنْ اٰمَنَ مِنْھُمْ اَتَعْلَمُوْنَ اَنَّ صٰلِحًا مُّرْسَلٌ مِّنْ رَّبِّھ۪ﺚ قَالُوْٓا اِنَّا بِمَآ اُرْسِلَ بِھ۪ مُؤْمِنُوْنَﮚقَالَ الَّذِیْنَ اسْتَکْبَرُوْٓا اِنَّا بِالَّذِیْٓ اٰمَنْتُمْ بِھ۪ کٰفِرُوْنَ)
“তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানেরা সে সম্প্রদায়ের ঈমানদার যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তাদেরকে বলল: ‘তোমরা কি জান যে, সালেহ ‘আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রেরিত?’ তারা বলল: ‘তার প্রতি যে বাণী প্রেরিত হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাসী।’ তখন অহংকারীরা বললো তোমরা যা বিশ্বাস কর আমরা তা অবিশ্বাস করি।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৭৫-৭৬)
সামূদ জাতির নিকট সালেহ (عليه السلام)-এর দাওয়াত:
পথভোলা এ জাতিকে অন্যান্য নাবীদের মত সালেহ (عليه السلام) প্রথমেই তাওহীদের দাওয়াত দিলেন। তিনি তাদেরকে পূর্তিপূজাসহ যাবতীয় শির্ক ও কুসংস্কার ত্যাগ করে আল্লাহকে ভয়, এক আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর প্রেরিত রাসূলের আনুগত্য করার প্রতি আহবান জানান। যেমন সূরা আ‘রাফের ৭৩ ও সূরা হূদের ৬১ নং আয়াতে বলা হয়েছে। তাওহীদের এ দাওয়াতের সাথে সাথে তাদের ওপর আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ বলেন: ‘আদ জাতির পর তিনি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন, তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, তোমরা সমতল ভূমিতে প্রাসাদ নির্মাণ ও পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করেছ। সুতরাং তোমরা ‘আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।’ অন্যান্য নাবীদের মত এ কথাও বললেন, আমি এ কাজের জন্য তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না।
সালেহ (عليه السلام)-এর দাওয়াতের ফলশ্রতি:
সালেহ (عليه السلام) তাওহীদের দাওয়াত দেয়া শুরু করলে লোকেরা তাঁকে বলল:
(یٰصٰلِحُ قَدْ کُنْتَ فِیْنَا مَرْجُوًّا قَبْلَ ھٰذَآ اَتَنْھٰٿنَآ اَنْ نَّعْبُدَ مَا یَعْبُدُ اٰبَا۬ؤُنَا وَاِنَّنَا لَفِیْ شَکٍّ مِّمَّا تَدْعُوْنَآ اِلَیْھِ مُرِیْبٍ)
‘হে সালেহ্! এর পূর্বে তুমি ছিলে আমাদের আশা ভরসার পাত্র। তুমি কি আমাদেরকে নিষেধ করছ ‘ইবাদত করতে তাদের, যাদের ‘ইবাদত করত আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা? আমরা অবশ্যই বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছি সে বিষয়ে, যার প্রতি তুমি আমাদেরকে আহ্বান করছ।’ (সূরা হূদ ১১:৬২) এমনকি তারা উদ্ধত্য প্রকাশ করে আরো বলল,
(اَبَشَرًا مِّنَّا وَاحِدًا نَّتَّبِعُھ۫ٓﺫ اِنَّآ اِذًا لَّفِیْ ضَلٰلٍ وَّسُعُرٍﭧءَاُلْقِیَ الذِّکْرُ عَلَیْھِ مِنْۭ بَیْنِنَا بَلْ ھُوَ کَذَّابٌ اَشِرٌ)
“আমরা কি আমাদেরই এক ব্যক্তির অনুসরণ করব? তবে তো আমরা বিপথগামী এবং বিবেকহীনরূপে গণ্য হব। আমাদের মধ্যে কি তারই প্রতি ওয়াহী করা হয়েছে? বরং সে তো একজন মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক।” (সূরা কামার ৫৪:২৪-২৫) তারা আরো বলল: ‘তোমাকে ও তোমার সঙ্গে যারা আছে তাদেরকে আমরা অমঙ্গলের কারণ মনে করি।’ (সূরা নামল ২৭:৪৭)
এভাবে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণি সালেহ (عليه السلام)-কে অমান্য করল এবং মূর্তিপূজাসহ শির্ক ও আল্লাহদ্রোহী কাজে লিপ্ত রইল। আল্লাহ তা‘আলার ভাষায়,
(وَاَمَّا ثَمُوْدُ فَھَدَیْنٰھُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمٰی عَلَی الْھُدٰی فَاَخَذَتْھُمْ صٰعِقَةُ الْعَذَابِ الْھُوْنِ بِمَا کَانُوْا یَکْسِبُوْنَ)
“আর সামূদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, আমি তাদেরকে পথ নির্দেশ করেছিলাম; কিন্তু তারা সৎপথের পরিবর্তে অন্ধত্ব (ভ্রান্ত পথ) অবলম্বন করেছিল। অতঃপর তাদের কৃতকর্মের পরিণামস্বরূপ লাঞ্ছনাদায়ক বজ্র শাস্তি আঘাত হানল।” (সূরা ফুসসিলাত ৪১:১৭)
সামূদ জাতির ওপর আপতিত গযবের বিবরণ:
জাতির অবাধ্য লোকেরা সালেহ (عليه السلام)-এর কাছে দাবী করল, আপনি যদি সত্যি নাবী হন তাহলে পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি দশ মাসের গর্ভবতী সবল ও স্বাস্থ্যবতী উষ্ট্রী বের করে এনে দেখান। সালেহ (عليه السلام) তাদের দাবী শুনে অঙ্গীকার নিলেন যে, তোমাদের দাবী পূরণ করা হলে তোমরা ঈমান আনবে। তবে দাবী পূরণ করার পরেও ঈমান না আনলে আল্লাহ তা‘আলার গযবে তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। এতে সবাই স্বীকৃতি দিল এবং সে মর্মে অঙ্গীকার করল। তখন সালেহ (عليه السلام) দু‘আ করলে আল্লাহ তার দু‘আ কবূল করে নিলেন এবং বললেন:
( اِنَّا مُرْسِلُوا النَّاقَةِ فِتْنَةً لَّھُمْ فَارْتَقِبْھُمْ وَاصْطَبِرْ)
“নিশ্চয়ই আমি তাদের পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি এক উষ্ট্রী; অতএব তুমি (হে সালেহ!) তাদের আচরণ লক্ষ্য কর এবং ধৈর্যশীল হও।” (সূরা কামার ৫৪:২৭) উক্ত উষ্ট্রীর জন্য পানি পান করার নির্দিষ্ট দিন নির্ধারণ করা ছিল আর বলে দেয়া ছিল সেদিন যেন কেউ পানি সংগ্রহ না করে। (সূরা কামার ৫৪:২৮)
সামূদ জাতির লোকেরা যে কূপ থেকে পানি পান করত ও তাদের গবাদি পশুদের পানি পান করাত, এ উষ্ট্রীও সেই কূপ থেকে পানি পান করত। যেদিন উষ্ট্রী পানি পান করত সেদিন পানি শেষ হয়ে যেত। অবশ্য সেদিন লোকেরা উষ্ট্রীর দুধ পান করত এবং বাকী দুধ দ্বারা তাদের সব পাত্র ভরে নিত। কিন্তু এ হতভাগাদের কপালে এত সুখ সহ্য হল না। তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করল। আল্লাহ তা‘আলার গযবের পরওয়া করল না, অবশেষে শয়তান তাদেরকে সর্ববৃহৎ কুমন্ত্রণা দিলো। আর তা হল নারীর প্রলোভন। সামূদ গোত্রের দুজন পরমা সুন্দরী মহিলা, যারা সালেহ (عليه السلام)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষী ছিল তারা তাদের রূপ-যৌবন দেখিয়ে দুজন যুবককে উষ্ট্রী হত্যায় রাযী করাল। অতঃপর তারা তীর ও তরবারির আঘাতে উষ্ট্রীকে পা কেটে হত্যা করে ফেলল। হত্যাকারী যুবকদ্বয়ের প্রধানকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেন:
(اِذِ انْۭبَعَثَ اَشْقٰٿھَا)
“যখন তাদের সর্বাধিক হতভাগ্য ব্যক্তি তৎপর হয়ে উঠেছিল।” (সূরা শামস ৯১:১২) কেননা তার কারণেই গোটা সামূদ জাতি গযবে পতিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘‘অতঃপর তারা তাদের এক সঙ্গীকে আহ্বান করল, সে ওটাকে (উষ্ট্রীকে) ধরে হত্যা করল। কি কঠোর ছিল আমার আযাব ও সতর্কবাণী! আমি তাদের উপর পাঠিয়েছি এক বিকট আওয়াজ; ফলে তারা হয়ে গেল খোয়াড় মালিকদের বিখন্ডিত ভূষির ন্যায়।“ (সূরা কামার ৫৪: ২৯-৩১)
এ উষ্ট্রী হত্যার পর সালেহ (عليه السلام) জাতিকে আল্লাহ তা‘আলার গযবের কথা জানিয়ে দিলেন যে,
(تَمَتَّعُوْا فِیْ دَارِکُمْ ثَلٰثَةَ اَیَّامٍﺚ ذٰلِکَ وَعْدٌ غَیْرُ مَکْذُوْبٍ)
‘‘তোমরা তোমাদের গৃহে তিন দিন জীবন উপভোগ করে নাও। এটা একটি প্রতিশ্র“তি যা মিথ্যা হবার নয়।’’ (সূরা হূদ ১১:৬৫) কিন্তু তারা এরূপ কঠোর হুশিয়ারীকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাচ্ছিল্যভরে বলল, “হে সালেহ! তুমি সত্য রাসূল হয়ে থাকলে আমাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন কর।”
(تِسْعَةُ رَھْطٍ) অর্থাৎ সালেহ (عليه السلام)-এর যুগে যে নয় জন বড় বড় নেতা ঐ শহরে বসবাস করত তাদের কথা বলা হচ্ছে। رهط শব্দের অর্থ দল। এখানে নয় ব্যক্তির মধ্য থেকে প্রত্যেককেই رهط বলার কারণ সম্ভবতঃ এই যে, তারা তাদের অর্থ-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে সম্প্রদায়ের প্রধানরূপে গণ্য হত এবং প্রত্যেকের সাথে ভিন্ন ভিন্ন দল ছিল। কাজেই এই নয় ব্যক্তিকে নয় দল বলা হয়েছে। তারা ছিল হিজর জনপদের প্রধান। তারা ছিল এমন নয়জন যারা সর্বদা ঐ সময় জমিনে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়াত। তারা কোন কিছু না বুঝেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত, কখনো সংশোধন হবার চেষ্টা করত না। একদা তারা আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলেছিল, তারা সালেহ (عليه السلام) ও তাঁর পরিবার পরিজনকে রাত্রিকালে হত্যা করবে এবং তারা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে তা অস্বীকার করবে। কেননা এর নবুওয়াতকে অস্বীকার করার কারণেই গযব আসবে। সুতরাং সেই গযবের জন্য দায়ী। আর যদি গযব না আসে তাহলে মিথ্যার দণ্ড ভোগ করুক। জাতির নয়জন নেতা এ নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দেয়। তাদের সিদ্ধান্ত মতে নয়জন নেতা তাদের প্রধান কাদার বিন সালেফ এর নেতৃত্বে রাতের বেলা সালেহ (عليه السلام)-কে হত্যা করার জন্য তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পথিমধ্যেই প্রস্তর বর্ষণে ধ্বংস করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَکَرُوْا مَکْرًا وَّمَکَرْنَا مَکْرًا وَّھُمْ لَا یَشْعُرُوْنَﮁفَانْظُرْ کَیْفَ کَانَ عَاقِبَةُ مَکْرِھِمْﺫ اَنَّا دَمَّرْنٰھُمْ وَقَوْمَھُمْ اَجْمَعِیْنَ)
“তারা এক চক্রান্ত করেছিল এবং আমিও এক কৌশল অবলম্বন করলাম, কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি। অতএব দেখ, তাদের চক্রান্তের পরিণাম কী হয়েছেন আমি অবশ্যই তাদেরকে ও তাদের সম্প্রদায়ের সকলকে ধ্বংস করেছি।” (সূরা নামল ২৭:৫০-৫১) যাই হোক নির্ধারিত দিনে গযব আসার প্রাক্কালেই আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে সালেহ (عليه السلام) স্বীয় ঈমানদার সাথীদেরকে নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন।
ভীষণ ভূমিকম্প শুরু হল এবং ওপর থেকে বিকট ও ভয়াবহ এক গর্জন শোনা গেল। ফলে সবাই যার যার স্থানে একযোগে অধোমুখী হয়ে ভূতলশায়ী হল (সূরা আ‘রাফ ৭৮, হূদ ৬৭-৬৮) এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হল এমনভাবে, যেন তারা কোনদিন সেখানে বসবাস করেনি। অন্য আয়াতে এসেছে যে, ‘আমি তাদের উপর পাঠিয়েছি এক বিকট আওয়াজ; ফলে তারা হয়ে গেল খোয়াড় মালিকদের বিখন্ডিত ভূষির ন্যায়।’ (সূরা কামার ৫৪:৩১)
৯ম হিজরীতে তাবূক যুদ্ধে যাওয়ার পথে মুসলিম বাহিনী হিজরে অবতরণ করলে রাসূলুল্লাহ তাদেরকে সেখানে প্রবেশ করতে নিষেধ করে বলেন,
لَا تَدْخُلُوا مَسَاكِنَ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ إِلَّا أَنْ تَكُونُوا بَاكِينَ أَنْ يُصِيبَكُمْ مَا أَصَابَهُمْ ثُمَّ تَقَنَّعَ بِرِدَائِهِ
তোমরা ঐসব অভিশপ্তদের এলাকায় প্রবেশ করো না ক্রন্দনরত অবস্থায় ব্যতীত। যদি ক্রন্দন করতে না পার তাহলে প্রবেশ করো না। তাহলে তোমাদের ওপর ঐ গযব আসতে পারে, যা তাদের ওপর এসেছিল। এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথা ঢেকে ফেললেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৩৩)
পার্থিব ক্ষমতা ও ধনৈশ্বর্য অধিকাংশ মানুষকে অশুভ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। বিত্তশালীরা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভুলে গিয়ে ভ্রান্ত পথে পা বাড়ায়। সামূদ জাতির বেলায়ও তাই হয়েছিল। অথচ নূহ (عليه السلام)-এর জাতির কঠিন শাস্তির ঘটনাবলী তখনও লোকমুখে আলোচিত হত। আর আ‘দ জাতির নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনা তো তাদের কাছে একপ্রকার টাটকা ঘটনাই ছিল। অথচ তাদের ভাইদের ধ্বংসস্তুপের ওপরে বড় বড় বিলাসবহুল অট্টালিকা নির্মাণ করে ও বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে তারা পেছনের কথা ভুলে গেল। এমনকি তারা আ‘দ জাতির মত অহংকারী কার্যকলাপ শুরু করে দিল। ফলে আল্লাহর গযব অনিবার্য হয়ে গেল। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৭৩-৭৯ নং আয়াতের আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধে কারো কোন কৌশল কাজে আসবে না।
২. সমাজের প্রধান হলেই কেউ সঠিক পথের অনুসারী এমনটি মনে করা যাবে না।
৩. দলীল-প্রমাণ বাদ দিয়ে নেতা হলেই কারো অনুসরণ করা যাবে না।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
পবিত্র কোরআনে অধিকাংশ জায়গায় হযরত সালেহ ও তার জাতি সামুদ এর কাহিনী, হযরত নুহ, হুদ, লুত ও শোয়ায়ব সংক্রান্ত সাধারণ কিসসা-কাহিনীর ধারাবাহিকতায় বর্ণিত হয়ে থাকে। এই ধারাবাহিকতায় কখনাে কখনাে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কাহিনীও বর্ণিত হয়, আবার কখনাে হয় না। বর্তমান সূরায় যেখানে বনী ইসরাঈলের কাহিনীই কেন্দ্রীয় আলােচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেখানে হযরত মূসা, দাউদ ও সোলায়মান কাহিনী অপেক্ষাকৃতভাবে এবং হযরত হুদ ও শােয়বের কাহিনী সংক্ষেপে আলােচিত হয়েছে, কিন্তু হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর প্রসংগ এখানে একেবারেই আসেনি। হযরত সালেহ(আ.)-এর কাহিনীর ক্ষেত্রে স্ত্রীর ব্যাপারটা আসেনি- এসেছে শুধু হযরত সালেহ(আ.) ও তার আপনজনদের বিরুদ্ধে নয় ব্যক্তির যড়যন্ত্র পাকানাের কাহিনী। এই ষড়যন্ত্র যেমন হযরত সালেহ এর অজান্তে পাকানাে হয়েছিলাে, তেমনি আল্লাহ তায়ালাও তাদের অজ্ঞাতসারেই তাদের বিরুদ্ধে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সমগ্র সামূদ জাতিকে তিনি ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। যারা আল্লাহ তায়ালা ও তার নবী হযরত সালেহের ওপর ঈমান এনে আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করতাে, তাদের আল্লাহ আযাব থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন এবং বিদ্রোহী সামূদ জাতির বিধ্বস্ত জনপদের কাছ দিয়ে মক্কার মােশরেকরা চলাফেরা করতাে। অথচ তারা শিক্ষা গ্রহণ করতাে না। সালেহ(আ.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র ‘আমি সামূদ জাতির কাছে তাদের ভাই সালেহকে এই বাণী দিয়ে পাঠিয়েছিলাম যে, তােমরা একমাত্র আল্লাহর এবাদাত করো। এর ফলে তৎক্ষণাৎ তারা দুটো বিবদমান দলে বিভক্ত হয়ে পড়লাে। একটা মাত্র কথার মধ্য দিয়ে হযরত সালেহ এর রেসালাতের মর্মবাণী তুলে ধরা হয়েছে। সেই মর্মবাণী হলাে! একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো। আসলে এটাই ছিলাে সকল নবীর দাওয়াতের মূলকথা। যদিও এ বিশ্বজগতে মানব জাতির চারপাশে যা কিছুই বিদ্যমান, তার প্রতিটি বস্তুই এ দাওয়াত গ্রহণ করার আহ্বান জানায়, কিন্তু মানব জাতি কতাে প্রজন্ম ও কতাে যুগ যে সে সত্যকে অস্বীকার করে কাটিয়ে দিয়েছে, তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কউ জানে না। আজও মানব জাতির একটা অংশ এই শাশ্বত সত্য অস্বীকার করে আল্লাহর একমাত্র সহজ সরল সত্য পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে হযরত সালেহ সামূদ জাতিকে তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার পর এবং সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা চালানাের পর তাদের যে অবস্থা দাড়িয়েছিলাে, কোরআন তার বর্ণনা দিয়েছে যে, তারা দুটো দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলাে। একটা দল হযরত সালেহের দাওয়াত গ্রহণ করে, আর অপর দল করে তার বিরােধিতা। কোরআনের অন্যান্য সূরা থেকে আমরা জানতে পারি যে, বিরােধী দলই ছিলাে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই পর্যায়ে এসে কোরআন নীরবতা অবলম্বন করে এবং এ দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, যারা হযরত সালেহ এর দাওয়াত মিথ্যা সাব্যস্ত ও প্রত্যাখ্যান করেছিলাে, তারা হযরত সালেহকে এই বলে তাড়া দিচ্ছিল যে, তুমি যে আযাবের ভয় দেখাও তা দ্রুত নিয়ে এসাে। তারা কোথায় আল্লাহর হেদায়াত ও রহমত কামনা করবে, তা না করে আযাব চেয়ে বসলাে। কোরায়শরাও রসূল(স.)-এর সাথে অনুরূপ আচরণই করছিলাে। যা হােক, হযরত সালেহ সামূদ জাতির এ আচরণে ভীষণ ক্ষোভ প্রকাশ করলেন যে, তারা হেদায়াত না চেয়ে দ্রুত আযাব নাযিল করার আবদার ধরলাে। তিনি তাদের আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে উপদেশ দিলেন এবং বললেন, এভাবে হয়তাে তােমাদের ওপর আল্লাহর রহমত নেমে আসবে, ‘সালেহ বললাে, হে আমার জাতি, তােমরা কল্যাণের আগে অকল্যাণ চাইছে কেন? তােমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও না কেন? হয়তাে তােমাদের ওপর রহমত হবে।'(আয়াত ৪৭) অবিশ্বাসী কুরাইশদের মনের বক্রতা এতােদূর গড়িয়েছিলাে যে, তারা বলতাে, ‘হে আল্লাহ, এই দাওয়াত যদি তোমার পক্ষ থেকে আগত সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের ওপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করাে, অথবা কোনাে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এনে দাও।’ অথচ এর পরিবর্তে তারা এ কথাও বলতে পারতাে, ‘হে আল্লাহ, এই দাওয়াত যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের এর ওপর ঈমান আনার ও একে সত্য বলে মেনে নেয়ার পথে চালিত করাে।’ হযরত সালেহ এর জাতিও এ ধরনের কথা বলতাে। তাদের রাসূল তাদেরকে তাওবা, এসতেগফার ও রহমত কামনা করে দোয়া করার যে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তার প্রতি তারা কর্ণপাতও করতাে না। উপরন্তু তারা এই বলে অজুহাত খাড়া করতাে যে, তারা তাকে ও তার সাথীদেরকে তাদের জন্যে অমঙ্গলজনক মনে করে এবং তাদের দ্বারা তাদের ক্ষতি হবে বলে শংকিত। তারা বললাে, আমরা তােমাকে ও তােমার সাথীদেরকে অমংগল ও অশুভ মনে করি।…’ ‘তাতাইয়ুর’ শব্দের অর্থ কোনাে জিনিসকে অমংগল, অকল্যাণ বা অশুভ মনে করা। অজ্ঞ ও মূর্খ লােকেরা নিজেদের কল্পনাপ্রসূত ভিত্তিহীন ধ্যান-ধারণার অনুসরণ করতাে। এর ফলে তারা তা থেকে সত্যিকার ঈমানের পথে ধাবিত হতে সক্ষম হতে না। কখনাে কখনাে তাদের কেউ কেউ কোনাে কাজ করার ইচ্ছা করলে কোনাে একটা পাখীর আশ্রয় নিতাে। সে পাখীটাকে তাড়া দিতাে। এতে পাখীটা যদি তার ডান দিক থেকে উড়ে বাম দিকে চলে যেতাে, তাহলে সে খুশী হতাে এবং যে কাজের উদ্যোগ নিয়েছে তা মংগলজনক হবে ভেবে এগিয়ে যেতাে। আর যদি পাখীটা তার বাম থেকে ডান দিকে যেতাে, তাহলে এটাকে অশুভ সংকেত মনে করতাে এবং ক্ষতির আশংকায় সে ইচ্ছা পরিত্যাগ করতাে। অথচ পাখী গায়েব জানে না এবং তার স্বতস্ফূর্ত কার্যকলাপ কোনাে বিষয়ের দিকনির্দেশক হয় না, কিন্তু মানুষের মন স্বভাবতই এমন কোনাে অজানা অদৃশ্য সত্তার ওপর বিশ্বাস না করে থাকতে পারে না, যার কাছে সে তার সমস্ত অজানা ও ক্ষমতা বহির্ভূত বিষয় সােপর্দ করে দিয়ে চিন্তা মুক্ত হতে পারে। অজানা অদৃশ্য সত্ত্বার ওপর বিশ্বাসের এই স্বতস্ফূর্ত তাগিদ তাকে যদি সমুদয় অদৃশ্য জ্ঞানের একচ্ছত্র অধিপতি মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ না করে, তাহলে তা তাকে এই জাতীয় কল্পনাপ্রসূত ধ্যান ধারণা ও কুসংস্কারের দিকে টেনে নিয়ে যায়, যার কোনাে শেষ সীমা নেই, যা কোনাে যুক্তির ধার ধারে না এবং যার কোনাে কিছুতেই তৃপ্তি ও বিশ্বাস আসে না। এমনকি আজকের যুগেও আমরা দেখতে পাই, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে ইচ্ছুক নয়, অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস করার আহ্বান শুনলে নাক সিটকায় এবং মনে করে করে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতাে উচ্চন্তরে পৌছে গেছে যে, এখন ধর্মের ন্যায় কুসংস্কারে (!) বিশ্বাস করা তাদের পক্ষে বেমানান, তারা কিন্তু অত্যধিক গুরুত্বের সাথে ১৩ কে অশুভ সংখ্যা, সামনে দিয়ে কালাে বিড়ালের রাস্তা পার হওয়াকে কুযাত্রার লক্ষণ এবং দিয়াশলাইর একটা কাঠি দিয়ে দুটোর বেশী খাম জ্বালানােকে ঘােরতর অমংগলজনক মনে করে থাকে। এ ছাড়া এ ধরনের বহু হাস্যকর ও তুচ্ছ বিষয়কে তারা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর কারণ এই যে, তারা তাদের নিজেদের জন্মগত স্বভাব-প্রকৃতির সাথে বৈরী আচরণে লিপ্ত। অথচ সত্য বিশ্বাসের প্রতি প্রত্যেক মানুষের স্বভাবগত দুর্নিবার আকর্ষণ ও ঝোঁক রয়েছে।[ পশ্চিমী দুনিয়ার আধুনিক জাহেলরা এখন ১৩ সখ্যাটিকে এতােই অশুভ মনে করে যে, তাদের অনেকেই এই সংখ্যাটা মুখেই আনতে চায় না। এসব দেশে কোনাে লােকের ঘর, হােটেল কক্ষের নাম্বার, গার্লফ্রেন্ড ও বয়ফ্রেন্ডের জন্ম তারিখ, বিয়ে বার্ষিকী ইত্যাদি যদি কখনাে এই তারিখে পড়ে, তাহলে তারা থার্টিন না বলে টুয়েলভ প্লাস শব্দ ব্যবহার করে। আবার যদি এই ১৩ তারিখ শুক্রবার হয়ে পড়ে তাহলে তাে কোনাে কথাই নেই। বছর দুয়েক আগে এমনি একটি কো-ইন্সিডেন্স-এর পর প্যারিসে তাে রীতিমতাে লঙ্কাকান্ড ঘটে যাওয়ার উপক্রম হয়। লন্ডনের দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা এদিনে আধুনিক জাহেলদের কর্মকান্ডের ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সন্ধবত এই একই দৈনিকে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে।-সম্পাদক] বিশ্বজগতে এমন বহু সত্য রয়েছে, যা এখনাে মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের নাগালের বাইরে। সেসব সত্যের ব্যাখ্যা দিতে মানুষ বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল হয়। কোনাে কোনাে সত্য এমনও রয়েছে, যা কম্মিনকালেও বিজ্ঞানের আওতার ভেতরে আসবে না। কেননা সেগুলাে মানবীয় ক্ষমতার চেয়েও অনেক বড়, মানুষের দায়িত্ব ও কর্মের সীমার বাইরে অবস্থিত এবং পৃথিবীতে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের সেসব প্রয়ােজনীয় ক্ষমতা ও প্রতিভার অতিরিক্ত, যা মানুষকে ওই দায়িত্বের প্রয়ােজন অনুপাতেই দেয়া হয়েছে। এসব সত্যকে জয় করার একমাত্র উপকরণ হচ্ছে বিশ্বাস, প্রত্যয় বা ঈমান। সামূদ জাতি যখন এহেন চরম নির্বোধ-সুলভ কথা হযরত সালেহকে বললাে, তখন হযরত সালেহ তাদের ঈমানের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে পুনরায় বললেন, ‘তােমাদের অমংগল আল্লাহর কাছে রয়েছে…’ অর্থাৎ তােমাদের ভাগ্য, ভবিষ্যৎ ও পরিণতি আল্লাহর হাতে। আল্লাহর কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। তিনি মানুষকেও কিছু বিধি-বিধান দিয়েছেন এবং কোনটা সঠিক পথ তা দেখিয়ে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সেই বিধান মেনে চলবে, সে নির্ঘাত কল্যাণের অধিকারী হবে। তার আর কোনাে ভাগ্য নির্ণয়ের কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে না, আর যে ব্যক্তি সেই বিধান অমান্য করবে, সে অকল্যাণ অমংগলের শিকার হবেই। ভাগ্য নির্ণয়ের কোনাে কৌশল এতে সুফল দেবে না। ‘বরঞ্চ তােমরা পরীক্ষার সম্মুখীন একটা জাতি।’ অর্থাৎ তােমাদের কখনাে আল্লাহর নেয়ামত দিয়ে, কখনাে সুখ শান্তি দিয়ে আবার কখনাে দুঃখ-দুর্দশা দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। সুতরাং প্রত্যেক ঘটনা প্রত্যেক অবস্থা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা এবং তার পেছনে যে পরীক্ষা নিহিত রয়েছে, তার ব্যাপারে সজাগ থাকাই চূড়ান্ত পর্যায়ে কল্যাণ ও মংগল বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেয়। মানুষ, পাখী কিংবা আল্লাহর অন্য কোনাে সৃষ্টিকে শুভ লক্ষণ বা অশুভ লক্ষণ মনে করা দ্বারা কোনাে লাভ হয় না বা কোনাে কল্যাণই নিশ্চিত হয় না। এভাবে বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস মানুষকে দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ের সঠিক ও স্বচ্ছ মূল্যায়নে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের ওপর বা তাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে, সে সম্পর্কে তাদের মনকে সচকিত ও চিন্তাভাবনায় অনুপ্রাণিত করে। সঠিক আকীদা বিশ্বাস মানুষকে এই উপলব্ধি দান করে যে, সব কিছুর পেছনেই আল্লাহর হাত রয়েছে, কোনাে কিছুই অকারণে বা কাকতালীয়ভাবে ঘটে না; বরং আল্লাহ যা কিছুই ঘটান, কল্যাণ ও মংগলের জন্যেই ঘটান। একমাত্র এরূপ উপলব্ধি এবং বিশ্বাসের দ্বারাই জীবনের মূল্য ও মানুষের মর্যাদা বাড়ে। এর কারণেই এই গ্রহে জীবন যাপন করার সময় চারপাশের সৃষ্টিজগত, তার স্রষ্টা ও যে সকল ফেরেশতা এবং প্রাকৃতিক নিয়ম মহান স্রষ্টার আদেশে এই মহাবিশ্বের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে, তার সাথে মানুষের সম্পর্ক অক্ষুন্ন থাকে। কিন্তু এই সুষ্ঠু ও বিশুদ্ধ যুক্তি কেবল তাদের কাছেই গ্রহণযােগ্য হয়ে থাকে, যাদের মন মগয বিকৃত হয়নি এবং এতােটা বিপথগামী হয়নি যা সংশােধনের অযােগ্য। হযরত সালেহের জাতির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে নয় জন এমন ছিলা, যাদের বিবেক সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে গিয়েছিলাে এবং তাদের অস্তরে সত্য ও ন্যায়ের জন্যে বিন্দুমাত্রও স্থান অবশিষ্ট ছিলাে না। তারা হযরত সালেহ ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাতে শুরু করে দিলাে।
শহরে এমন নয় ব্যক্তি ছিলাে, যারা দেশে অরাজকতা ও বিশৃংখলা ছড়াতাে…'(আয়াত ৪৮,৪৯) সর্বক্ষণ কুচিন্তা ও কুকর্মে বিভাের এই নয় ব্যক্তির অন্তরে সততা ও সদাচার বরদাশত করার মত এক বিন্দু পরিমাণ উদারতা নমনীয়তাও ছিলাে না। ফলে হযরত সালেহের দাওয়াত ও যুক্তিতর্কের প্রতি তারা একেবারেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠলাে এবং তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত আঁটতে শুরু করে দিলাে। আরাে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, আল্লাহর এবাদাতের দাওয়াত দেয়ার অপরাধে হযরত সালেহ ও তার স্বজনদের হত্যা করার এই জঘন্য চক্রান্তের জন্যে মহান আল্লাহর নামে কসম খেতেও তাদের বিবেকে বাধেনি। এটাও কৌতুকপ্রদ ব্যাপার যে, তারা পরস্পরকে বললাে, ‘তােমরা আল্লাহর নামে শপথপূর্বক অংগীকার করো যে, তাকে ও তার পরিজনবর্গকে হত্যা করবাে এবং তারপর তার অভিভাবককে বলবাে, আমরা তার হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ করিনি।’ অর্থাৎ আমরা তার হত্যাকান্ডের সময় উপস্থিত ছিলাম না। ‘আর আমরা অবশ্যই সত্যবাদী।’ অর্থাৎ আমরা বলবাে যে, আমরা সম্পূর্ণ সত্য কথা বলছি। কেননা যারা তাকে হত্যা করেছে তারা রাতের অন্ধকারে হত্যা করেছে, তাই অন্ধকারের জন্যে দেখা যায়নি। এটা আসলে একটা খোড়া যুক্তি ছিলাে। কিন্তু এ দ্বারা তারা নিজেদের মনকে বুঝ দিচ্ছিলাে এবং হযরত সালেহ ও তার পরিবার পরিজনকে হত্যার পরিকল্পনা করার পর তার উত্তরাধিকারীদের প্রতিশােধ থেকে বাঁচার জন্যে মিথ্যা অজুহাত তৈরী করছিলো। এ ধরনের লােকেরাও যে নিজেদের সত্যবাদী সাব্যস্ত করতে চায়, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর বটে। তবে মানুষের মন নানা রকমের জটিলতা ও বিচ্যুতিতে পরিপূর্ণ থাকে, বিশেষত যখন সে ঈমানের আলাে থেকে বঞ্চিত থাকে। কেননা এই আলােই তাকে সরল সঠিক পথ দেখিয়ে থাকে। এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকলাে, কিন্তু মহান আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ ছিলেন, অথচ তারা তা বুঝতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘তারা একটা ষড়যন্ত্র পাকালাে। আমিও একটা একটা কৌশল অবলম্বন করলাম, অথচ তারা কিছুই টের পেলাে না।'(আয়াত ৫০) স্বৈরাচারীরা অনেক সময় হিসাবে ভুল করে থাকে। নিজেদের ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ ধারণা পােষণ করে আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার হয়। সর্বদ্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা যে তাদের ওপর আকস্মিকভাবে আক্রমণ করতে পারেন, সে কথা ভুলে যায়, ‘অতএব, লক্ষ্য করাে, তাদের ষড়যন্ত্রের পরিণতি কেমন হয়েছিলাে…'(আয়াত ৫১-৫২) এক নিমেষেই সব কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলাে এবং ঘরবাড়ী জনমানবশূন্য হয়ে গিয়েছিলাে। অথচ এক মুহূর্ত আগেও তারা ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল এবং সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তারা নিজেদের পুরােপুরি সক্ষম মনে করছিলাে। আয়াতে আল্লাহর শাস্তির এই দ্রুততা ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, যাতে আযাবের আকস্মিকতা স্পষ্ট হয়ে যায় এবং মহান আল্লাহ যে সেসব আত্মপ্রবঞ্চিত ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে পর্যদস্তু হবার পাত্র নন, তাতে কোনােই সন্দেহ অবশিষ্ট না থাকে। ‘নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে।’ এই সূরায় এবং এর ঘটনাবলীর পর্যালােচনায় জ্ঞানকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আলােচ্য উক্তিতে আরেকবার তারই অভিব্যক্তি ঘটেছে। এই আকস্মিক আযাবের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহভীরু মােমেনদের নিষ্কৃতি দেয়ার কথা জানানাে হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি সমস্ত ঈমানদার ও আল্লাহভীরু লােকদের নিষ্কৃতি দিলাম।'(আয়াত ৫৩) কেননা এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তায়ালা ঘােষণা করেছেন, যারা আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্য সমস্ত ভয় থেকে রক্ষা করবেন এবং দুরকম ভয় (অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও বান্দার ভয়) একত্রিত করবেন না।
হযরত লূতের(আ.) কাহিনীর এই ক্ষুদ্র ও সংক্ষিপ্ত অংশটুকুতে দেখানাে হয়েছে কিভাবে হযরত লূতের জাতি তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেছে। এর কারণ একটাই । তিনি তাদের সেই জঘন্য কুৎসিত ও অশ্লীল কাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, যার ব্যাপারে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিলাে এবং যা তারা প্রকাশ্যে করতাে। শুধু মানব জাতির ভেতরে নয় বরং সমগ্র প্রাণী জগতের ভেতরেও যা বিরল এবং যা মহান আল্লাহর সৃষ্টিগত রীতির পরিপন্থী। সেই ঘৃণ্যতম অপরাধ সমকামে তারা আক্রান্ত ছিলাে। *কওমে লূতের বিকৃত রুচী : মানব জাতির ইতিহাসে এটা একটা বিরল অপরাধ। কোনাে মানসিক বা দৈহিক অস্বাভাবিকতার কারণে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি এ অপরাধে জড়িত হয়ে যেতে পারে সাময়িকভাবে। পুরুষে পুরুষে সমকামের ঘটনা সবচেয়ে বেশী ঘটে সামরিক ব্যারাকগুলােতে, যেখানে নারীর কোনাে অস্তিত্ব থাকে না। কারাগারেও দীর্ঘমেয়াদী কয়েদীদের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা দিতে পারে নারী সংসর্গ থেকে বঞ্চিত থাকার ফলে অদম্য কাম বাসনার চাপে। তবে কোনাে সাধারণ জনপদে, যেখানে নারী সহজলভ্য এবং বিয়ে শাদীও সহজ সাধ্য, সেখানে এটা একটা প্রথায় পরিণত হওয়া সত্যিই মানবেতিহাসের বিরলতম ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা মানুষের এক লিংগের অপর লিংগের প্রতি জন্মগতভাবে আকর্ষণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কেননা তিনি গােটা প্রাণী জগতকেই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর পবিত্রতা ঘােষণা করাে, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ ও তাদের অজানা আরাে বহু সৃষ্টিকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। বন্তুত তিনি প্রাণী মাত্রকেই জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন, চাই তা উদ্ভিদ হােক, পশু, পাখী, সরীসৃপ, পােকামাকড় বা অন্য কোনাে অজানা সৃষ্টি হােক। জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্ট শুধু প্রাণীই নয়, জীব জড় নির্বিশেষে সকল সৃষ্টিরই মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে মনে হয়। এমনকি অণু বা এ্যাটমও একটা পজেটিভ ও একটা নেগেটিভ ইলেকট্রোনের সমষ্টি। এই অণু হচ্ছে সমগ্র বিশ্বজগতের মূল একক। মােট কথা, অকাট্য সত্য এই যে, সমগ্র প্রাণী জগতই জোড়ায় জোড়া সৃজিত। এমনকি যে প্রাণীর স্বজাতির মধ্য থেকে কোনাে নর ও নারী নেই, তার প্রতিটির ভেতরে নরকোষ ও নারী কোষ রয়েছে এবং এই দু’ধরনের কোষের মিলনের কারণেই সে প্রাণীর বংশ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যেহেতু সৃষ্টিজগতের নিয়ম বিধিতে জোড়ায় জোড়ায় জন্মানােই জীবনের ভিত্তি, অন্য কথায়, জোড়া জোড়া হওয়া ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব ও বিকাশ সম্ভব নয়। সেহেতু আল্লাহ তায়ালা নর ও নারীর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণকে জন্মগত বৈশিষ্ট্যে পরিণত করেছেন। এ আকর্ষণ শিখিয়ে দেয়ার বা উদ্বুদ্ধ করার অপেক্ষা রাখে না। এরূপ ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্য, স্বতস্ফূর্ত জন্মগত তাড়নার ভিত্তিতেই যেন জীবনের বিকাশ ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। প্রত্যেক প্রাণী তার এই জন্মগত তাড়না চরিতার্থ করায় আনন্দ পায়। প্রাণীদের দেহাভ্যন্তরে সংরক্ষিত এই স্বাদ ও আনন্দের ভেতর দিয়ে মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা আপন ইচ্ছা এমনভাবে বাস্তবায়িত করেন যে, তারা নিজেরাও তা টের পায় না। আর অন্য কেউও সে সম্পর্কে তাকে কোনাে দিকনির্দেশনা দিতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষের অংগ প্রত্যংগ এমন সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গঠন করেছেন উভয়ের মিলন স্বাভাবিক আনন্দ বাস্তবায়িত করে। এই সময় তিনি একই লিংগের দুই ব্যক্তির অংগ প্রত্যংগের মধ্যে সৃষ্টি করেননি। তাই এই জন্মগত বৈশিষ্ট্যের যেরূপ সর্বব্যাপী বিকৃতি হযরত লুতের জাতির ভেতরে সংঘটিত হয়েছিলাে, সেটা যথার্থই বিস্ময়কর। বিশেষত স্বাভাবিক নিয়মের বিপরীত পথে চলার জন্যে যেখানে কোনাে অনিবার্য প্রয়ােজন দেখা দেয়নি। এ কারণেই হযরত লুত তার জাতির এই অপকর্মের প্রতিবাদে এমন বিস্ময়জড়িত ক্ষোভ প্রকাশ করেন, ‘লূতের কথা স্মরণ করাে, যখন সে তার জাতিকে বললাে, তােমরা এমন অশ্লীল কাজ করো, অথচ তােমরা সব কিছুই দেখছাে…'(আয়াত ৫৪-৫৫) প্রথম আয়াতটাতে তিনি এ জন্যে বিশ্ময় প্রকাশ করছেন যে, তারা যখন সমগ্র জীবন ও জগতকে স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দেখছে, তখন কিভাবে এমন অস্বাভাবিক অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে পারছো? এভাবে তো তারা নিজেদেরকেই সমগ্র প্রাণী জগতের মধ্যে একমাত্র স্বভাবভ্রষ্ট বিরল প্রজাতির প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করছে। আর দ্বিতীয় আয়াতে তার যে উক্তি স্থান পেয়েছে, তাতে তিনি সে অশ্লীল কাজের পরিচয় দিয়েছেন। কেবল কাজটার পরিচয় দ্বারাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সে কাজটা শুধু মানুষের নয়, বরং গােটা সৃষ্টি জগতেরই চির পরিচিত স্বাভাবিক রীতি-নীতির পরিপন্থী। এরপর একে জাহেলী তথা অজ্ঞতা ও মূর্খতার ফল বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। ‘জাহল’ শব্দের দুটো অর্থ, প্রথম, জ্ঞানহীনতা, দ্বিতীয়, নির্বুদ্ধিতা ও গােয়ার্তুমি। উভয় অর্থেই জাহেলী প্রতিফলিত হয়েছে এই ঘৃণ্য বিকৃতির মধ্য দিয়ে। কেননা প্রকৃতির রীতি যে জান না, সে কোনাে কিছুই জানে না। সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও অকাট্য মূর্খ। আর যে ব্যক্তি স্বাভাবিক নিয়ম রীতি থেকে এতটা বিকারগ্রস্ত ও ভ্রষ্ট হয়, সে এমন একজন নির্বোধ, বােকা ও গোয়ার, যার পক্ষে অন্যদের অধিকার হরণ ও গ্রাস করা সম্পূর্ণ সম্ভব। তাদের বিকৃতির এই প্রতিবাদের জবাবে হযরত লূত(আ.)-এর জাতি সংক্ষেপে একটা কথাই বলেছিলাে যে, লূত ও তার অনুসারীরা খুব সৎ ও পবিত্র মানুষ। ওদের স্থান এখানে নেই। ওদের এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। হযরত লূতের অনুসারীরা তার পরিবার-পরিজনের মধ্যেই সীমিত ছিলাে, কেবল তার স্ত্রী ব্যতীত। ‘তার জাতির একমাত্র জবাব ছিলাে এই যে, লূতের অনুসারীদের তােমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। ওরা খুবই পবিত্র মানুষ।'(আয়াত ৫৬) তাদের এ উক্তির অর্থ এও হতে পারে যে, তারা এই নােংরা ঘৃণ্য কাজ থেকে পবিত্র থাকাকে সরাসরি ব্যাংগ করছে। আবার এর অর্থ এও হতে পারে যে, তারা এই যৌন বিকৃতিতে এতাে বেশী ডুবে গিয়েছিলাে যে, এই বিকৃত রুচিবােধে কোনাে নােংরামি বা অশ্লীলতা থাকতে পারে, এটা তারা অনুভবই করতাে না। তাই এ কাজ থেকে বিরত থাকাকে পবিত্রতা আখ্যায়িত করাতেই তারা অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছিলাে। আবার এই কাজ ত্যাগ করাকে পবিত্রতা আখ্যায়িত করায় এ উক্তির মাধ্যমে তারা বিরক্তিও প্রকাশ করে থাকতে পারে। ঘটনা যাই হােক, তারা হযরত লুতের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত ঘােষণাই করে দিয়েছিলাে। অপর দিকে আল্লাহ তায়ালাও তার বিপরীত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন, ‘অতপর আমি তাকে ও তার পরিবার পরিজনকে আযাব থেকে রক্ষা করেছিলাম, কেবল তার স্ত্রী ছাড়া(১)…'(আয়াত ৫৭-৫৮) এখানে এই বৃষ্টির বিশদ বিবরণ দেয়া হয়নি। তবে অন্যান্য সূরায় তা দেয়া হয়েছে। আমিও এখানে এর চেয়ে বেশী বিবরণ দিতে চাই না। তবে লূতের জাতিকে বৃষ্টি দিয়ে ধ্বংস করার ভেতরে আমি বিশেষ একটা ইংগিত দেখতে পাই। বৃষ্টির মাধ্যমে যে পানি বর্ষিত হয়, তা জীবনদায়ক ও মাটিতে উদ্ভিদ উৎপাদক। অথচ এই পানি দিয়ে আল্লাহ একটা জাতিকে ধ্বংস করলেন। তারা যেমন তাদের বীর্যরূপী পানিকে তার উপযুক্ত কাজে- তথা মানবশিশু জন্মানাের কাজে ব্যবহার করেনি, তেমনি আল্লাহ তায়ালাও তার প্রাণবাহী পানি দিয়ে প্রাণ সংহার করে তার উপযুক্ত প্রতিশােধ নিলেন। তবে আল্লাহ তায়ালাই এর প্রকৃত তাৎপর্য, রীতিনীতি এবং কর্ম কৌশল সম্পর্কে অধিক অবহিত। এই ঘটনায় আল্লাহর গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত মাত্র।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য সূরা আল আ’রাফের ৭৩ থেকে ৭৯ , হূদের ৬১ থেকে ৬৮ , আশ্ শু’আরার ৪১ থেকে ৫৯ , আল কামারের ২৩ থেকে ৩২ এবং আশ্ শামসের ১১ থেকে ১৫ আয়াত পড়ুন।
# সালেহ আলাইহিস সালামের দাওয়াত শুরু হবার সাথে সাথেই তাঁর জাতি দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে গেলো। একটি দল মু’মিনদের এবং অন্যটি অস্বীকারকারীদের। এ বিভক্তির সাথে সাথেই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতও শুরু হয়ে গেলো। যেমন কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِمَنْ آمَنَ مِنْهُمْ أَتَعْلَمُونَ أَنَّ صَالِحًا مُرْسَلٌ مِنْ رَبِّهِ قَالُوا إِنَّا بِمَا أُرْسِلَ بِهِ مُؤْمِنُونَ – قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا بِالَّذِي آمَنْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ “তার জাতির শ্রেষ্ঠত্বের গর্বে গর্বিত সরদাররা দলিত ও নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে বললো, সত্যই কি তোমরা জানো, সালেহ তাঁর রবের পক্ষ থেকে পাঠানো একজন নবী? তারা জবাব দিল, তাঁকে যে জিনিস সহকারে পাঠানো হয়েছে আমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান রাখি। এ অহংকারীরা বললো, তোমরা যে জিনিসের প্রতি ঈমান এনেছো আমরা তা মানি না।” (আ’রাফ ৭৫-৭৬ আয়াত) মনে রাখতে হবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের সাথে সাথে মক্কায়ও এ একই ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তখনও জাতি দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছিল এবং সাথে সাথেই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই যে অবস্থার প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়েছিল তার সাথে এ কাহিনী আপনা থেকেই খাপ খেয়ে যাচ্ছিল।
# আল্লাহর কাছে কল্যাণ চাওয়ার পরিবর্তে অকল্যাণ চাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করছো কেন? অন্য জায়গায় সালেহের জাতির সরদারদের এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ يَا صَالِحُ ائْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الْمُرْسَلِينَ “হে সালেহ! আনো সেই আযাব আমাদের ওপর, যার হুমকি তুমি আমাদের দিয়ে থাকো, যদি সত্যি তুমি রসূল হয়ে থাকো।” (আল আ’রাফঃ ৭৭)
# তাদের উক্তির একটি অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমার এ আন্দোলন আমাদের জন্য বড়ই অমঙ্গলজনক প্রমাণিত হয়েছে। যখন থেকে তুমি ও তোমার সাথীরা পূর্বপুরুষদের ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছো তখন থেকেই নিত্যদিন আমাদের উপর কোন না কেন বিপদ আসছে। কারণ আমাদের উপাস্যরা আমাদের প্রতি নারাজ হয়ে গেছে। এ অর্থের দিক দিয়ে আলোচ্য উক্তিটি সেই সব মুশরিক জাতির উক্তির সাথে সামঞ্জস্যশীল, যারা নিজেদের নবীদেরকে অপয়া গণ্য করতো। সূরা ইয়াসীনে একটি জাতির কথা বলা হয়েছে। তারা তাদের নবীদেরকে বললোঃ إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ “আমরা তোমাদের অপয়া পেয়েছি” (১৮ আয়াত) হযরত মূসা সম্পর্কে ফেরাউনের জাতি এ কথাই বলতোঃ فَإِذَا جَاءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوا لَنَا هَذِهِ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوا بِمُوسَى وَمَنْ مَعَهُ “যখন তাদের সুসময় আসতো, তারা বলতো আমাদের এটাই প্রাপ্য এবং কোন বিপদ আসতো তখন মূসা ও তার সাথীদের কুলক্ষুণে হওয়াটাকে এজন্য দায়ী মনে করতো।” (আল আ’রাফঃ ১৩১ আয়াত) প্রায় একই ধরনের কথা মক্কায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পর্কেও বলা হতো। এ উক্তিটির দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমার আসার সাথে সাথেই আমাদের জাতির মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে। পূর্বে আমরা ছিলাম এক জাতি। এক ধর্মের ভিত্তিতে আমরা সবাই একত্রে সংঘবদ্ধ ছিলাম। তুমি এমন অপয়া ব্যক্তি এলে যে, তোমার আসার সাথে সাথেই ভাই-ভাইয়ের দুশমন হয়ে গেছে এবং পুত্র-পিতা থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এভাবে জাতির মধ্যে আর একটি নতুন জাতির উত্থানের পরিণাম আমাদের চোখে ভালো ঠেকছে না। এ অভিযোগটিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে বারবার পেশ করতো। তাঁর দাওয়াতের সূচনাতেই কুরাইশ সরদারদের যে প্রতিনিধি দলটি আবু তালেবের নিকট এসেছিল তারা এ কথাই বলেছিলঃ “আপনার এ ভাতিজাকে আমাদের হাতে সোপর্দ করে দিন। সে আপনার ও আপনার বাপ-দাদার ধর্মের বিরোধিতা করছে, আপনার জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছে এবং সমগ্র জাতিকে বেকুব গণ্য করেছে।” (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, ২৮৫ পৃষ্ঠা) হজ্জের সময় মক্কার কাফেরদের যখন আশঙ্কা হলো যে, বাইরের যিয়ারতকারীরা এসে যেন আবার মুহাম্মাদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে যেতে পারে। তখন তারা পরস্পর পরামর্শ করার পর আরব গোত্রগুলোকে একথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়ঃ “এ ব্যক্তি একজন যাদুকর। এর যাদুর প্রভাবে পুত্র-পিতা থেকে, ভাই-ভাই থেকে, স্ত্রী-স্বামী থেকে এবং মানুষ তার সমগ্র পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে।” (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড ২৮৯ পৃষ্ঠা) (ইবনে হিশাম ডাউনলোড লিংক)
# তোমরা যা মনে করছো আসল ব্যাপার তা নয়। আসল ব্যাপারটি তোমার এখনো বুঝতে পারোনি। সেটি হচ্ছে, আমার আসার ফলে তোমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। যতদিন আমি আসিনি ততদিন তোমরা নিজেদের মূর্খতার পথে চলছিলে। তোমাদের সামনে হক ও বাতিলের কোন সুস্পষ্ট পার্থক্য-রেখা ছিল না। ভেজাল ও নির্ভেজাল যাচাই করার কোন মানদণ্ড ছিল না। অত্যধিক নিকৃষ্ট লোকেরা উঁচুতে উঠে যাচ্ছিল এবং সবচেয়ে ভালো যোগ্যতা সম্পন্ন লোকেরা মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন একটি মানদণ্ড এসে গেছে। তোমাদের সবাইকে এখানে যাচাই ও পরখ করা হবে। এখন মাঠের মাঝখানে একটি তুলাদণ্ড রেখে দেয়া হয়েছে। এ তুলাদণ্ড প্রত্যেককে তার ওজন অনুযায়ী পরিমাপ করবে। এখন হক ও বাতিল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যে হককে গ্রহণ করবে সে ওজনে ভারী হয়ে যাবে, চাই এ যাবত তার মূল্য কানাকড়িও না থেকে থাকুক। আর যে বাতিলের উপর অবিচল থাকবে তার ওজন এক রত্তিও হবে না। চাই এ যাবত সে সর্বোচ্চ নেতার পদেই অধিষ্ঠিত থেকে থাকুক না কেন। কে কোন্ পরিবারের লোক, কার সহায়-সম্পদ কি পরিমাণ আছে এবং কে কতটা শক্তির অধিকারী তার ভিত্তিতে এখন আর কোন ফায়সালা হবে না। বরং কে সোজাভাবে সত্যকে গ্রহণ করে এবং কে মিথ্যার সাথে নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে দেয় এরই ভিত্তিতে ফায়সালা হবে।
# ন’জন উপজাতীয় সরদার। তাদের প্রত্যেকের সাথে ছিল একটি বিরাট দল।
# সালেহ আলাইহিস সালামের গোত্রের সরদারকে। প্রাচীন গোত্রীয় রেওয়াজ অনুযায়ী তাঁকে হত্যা করার বিরুদ্ধে তাঁর গোত্রীয় সরদারেরই রক্তের দাবী পেশ করার অধিকার ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামানায় তাঁর চাচা আবু তালেবেরও এ একই অধিকার ছিল। কুরাইশ বংশীয় কাফেররাও এ আশঙ্কায় পিছিয়ে আসতো যে, যদি তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করে ফেলে তাহলে বনু হাশেমের সরদার আবু তালেব নিজের গোত্রের পক্ষ থেকে তাঁর খুনের বদলা নেবার দাবী নিয়ে এগিয়ে আসবে।
# হুবহু এ একই ধরনের চক্রান্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে করার জন্য মক্কার গোত্রীয় সরদাররা চিন্তা করতো। অবশেষে হিজরতের সময় তারা নবীকে ﷺ হত্যা করার জন্য এ চক্রান্ত করলো। অর্থাৎ তারা সব গোত্রের লোক একত্র হয়ে তাঁর উপর হামলা করবে। এর ফলে বনু হাশেম কোন একটি বিশেষ গোত্রকে অপরাধী গণ্য করতে পারবে না এবং সকল গোত্রের সাথে একই সঙ্গে লড়াই করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
# তারা নিজেদের স্থিরীকৃত সময়ে হযরত সালেহের ওপর নৈশ আক্রমণ করার পূর্বেই আল্লাহ তাঁর আযাব নাযিল করলেন এবং এর ফলে কেবলমাত্র তারা নিজেরাই নয় বরং তাদের সমগ্র সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে গেলো। মনে হয়, উটনীর পায়ের রগ কেটে ফেলার পর তারা এ চক্রান্তটি করেছিল। সূরা হূদে বলা হয়েছে, যখন তারা উটনীকে মেরে ফেললো তখন হযরত সালেহ তাদেরকে নোটিশ দিলেন। তাদেরকে বললেন, ব্যস আর মাত্র তিন দিন ফূর্তি করে নাও তারপর তোমাদের ওপর আযাব এসে যাবে (فَقَالَ تَمَتَّعُوا فِي دَارِكُمْ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ ذَلِكَ وَعْدٌ غَيْرُ مَكْذُوبٍ) একথায় সম্ভবত তারা চিন্তা করেছিল, সালেহের (আ) কথিত আযাব আসুক বা না আসুক আমরা উটনীর সাথে তারও বা দফা রফা করে দিই না কেন। কাজেই খুব সম্ভবত নৈশ আক্রমণ করার জন্য তারা সেই রাতটিই বেছে নেয়, যে রাতে আযাব আসার কথা ছিল এবং সালেহের গায়ে হাত দেবার আগেই আল্লাহর জবরদস্ত হাত তাদেরকে পাকড়াও করে ফেললো।
# মূর্খদের ব্যাপার আলাদা। তারা তো বলবে, সামূদ জাতি যে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয় তার সাথে হযরত সালেহ ও তাঁর উটনীর কোন সম্পর্ক নেই। এসব তো প্রাকৃতিক কারণে হয়ে থাকে। এ এলাকায় কে সৎকাজ করতো এবং কে অসৎকাজ করতো আর কে কার ওপর জুলুম করেছিল এবং কে করেছিল অনুগ্রহ, ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার ওপর এসব বিষয়ের কোন দখল নেই। অমুক শহর বা অমুক এলাকা ফাসেকী ও অশ্লীল কার্যকলাপে ভরে গিয়েছিল তাই সেখানে বন্যা এসেছিল বা ভূমিকম্প দ্বারা সে এলাকাটিকে উলট পালট করে দেয়া হয়েছিল। কিংবা কোন আকস্মিক মহাপ্রলয় তাকে বিধ্বস্ত করেছিল, এসব নিছক ওয়াজ নসিহতকারীদের গালভরা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু চিন্তাশীল ও জ্ঞানবান লোক মাত্রই জানেন, কোন অন্ধ ও বধির আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহানের ওপর রাজত্ব করছেন না বরং এক সর্বজ্ঞ ও পরম বিজ্ঞ সত্তা এখানে সকলের ভাগ্যের নিষ্পত্তি করছেন। তাঁর সিদ্ধান্তসমূহ প্রাকৃতিক কার্যকারণের অধীন নয় বরং প্রাকৃতিক কার্যকারণসমূহ তাঁর ইচ্ছার অধীন। তিনি চোখ বন্ধ করে জাতিসমূহের উত্থান-পতনের ফায়সালা করেন না বরং বিজ্ঞতা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে করেন। একটি প্রতিদান ও প্রতিশোধের আইনও তাঁর আইনগ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। এ আইনের দৃষ্টিতে নৈতিক ভিত্তিতে এ দুনিয়াতেও জালেমকে শাস্তি দেয়া হয়। এ সত্যগুলো সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিরা কখনো ঐ ভূমিকম্পকে প্রাকৃতিক কারণ প্রসূত বলে এড়িয়ে যেতে চাইবে না। তারা তাকে নিজেদের জন্য সতর্কীকরণ মূলক বেত্রাঘাত মনে করবে। তা থেকে তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে। স্রষ্টার যেসব নৈতিক কারণের ভিত্তিতে নিজের সৃষ্ট একটি সমৃদ্ধ বিকাশমান জাতিকে ধ্বংস করে দেন তারা তাঁর নৈতিক কারণসমূহ অনুধাবন করার চেষ্টা করবে। তারা নিজেদের কর্মনীতিকে এমন পথ থেকে সরিয়ে আনবে যে পথে আল্লাহর গযব আসে এবং এমন পথে তাকে পরিচালিত করবে যে পথে তাঁর রহমত নাযিল হয়।
# তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন সূরা আল আ’রাফ ৮০-৮৪ , হূদ ৭৪-৮৩ , আল হিজর ৫৭-৭৭ , আল আম্বিয়া ৭১-৭৫ ,আশ্ শু’আরা ১৬০ থেকে ১৭৪ , আন নামল ৫৪-৫৮ , আল আনকাবুত ২৮-৩৫ , আস্ সাফফাত ১৩৩-১৩৮ এবং আল কামার ৩৩-৩৯ আয়াত।
# এ উক্তির কয়েকটি অর্থ হতে পারে। সম্ভবত এ সবগুলো অর্থই এখানে প্রযোজ্য। এক, এ কাজটি যে অশ্লীল ও খারাপ তা তোমরা জানো না এমন নয়। বরং জেনে বুঝে তোমরা এ কাজ করো। দুই, একথাটিও তোমাদের অজানা নেই যে, পুরুষের কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য পুরুষকে সৃষ্টি করা হয়নি বরং এজন্য নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পুরুষ ও নারীর পার্থক্য এমন নয় যে, তা তোমাদের চোখে ধরা পড়েনা বরং তোমরা চোখে দেখেই এ জ্বলজ্যান্ত মাছি গিলে ফেলছো। তিন, তোমরা প্রকাশ্যে এ অশ্লীল কাজ করে যাচ্ছো। অন্যদিকে চক্ষুষ্মান লোকেরা তোমাদের কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করছে, যেমন সামনের দিকে সূরা আনকাবুতে বলা হয়েছেঃ وَتَأْتُونَ فِي نَادِيكُمُ الْمُنْكَرَ “আর তোমরা নিজেদের মজলিসে বদকাম করে থাকো।” (২৯ আয়াত)
# পূর্বেই হযরত লূতকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তিনি যেন এ মহিলাকে নিজের সহযোগী না করেন। কারণ তার নিজের জাতির সাথেই তাকে ধ্বংস হতে হবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪৫-৪৭ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, যখন হযরত সালেহ (আঃ) তাঁর কওমের কাছে আসলেন এবং আল্লাহর রিসালাত আদায় করতে গিয়ে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন তখন তাদের মধ্যে দু’টি দল হয়ে যায়। একটি মুমিনদের দল এবং অপরটি কাফিরদের দল। এ দু’টি দল পরস্পরের মধ্যে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানরা সেই সম্প্রদায়ের ঈমানদার যাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো তাদেরকে বললো, তোমরা কি জান যে, সালেহ (আঃ) আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত? তারা বললো, তার প্রতি যে বাণী প্রেরিত হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাসী। দাম্ভিকরা বললো, তোমরা যা বিশ্বাস কর আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।” (৭: ৭৫-৭৬)
হযরত সালেহ (আঃ) তাঁর কওমকে বলেনঃ “হে আমার কওম! তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা রহমত চাওয়ার পরিবর্তে শাস্তি চাচ্ছ? কেন তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছে না, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে তারা উত্তরে বললোঃ “তোমাকে ও তোমার সঙ্গে যারা আছে তাদেরকে আমরা অমঙ্গলের কারণ মনে করি।’ এ কথাই ফিরাউন ও তার লোকেরা হযরত মূসা (আঃ)-এর ব্যাপারে বলেছিল। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “যখন তারা কল্যাণ লাভ করে তখন বলে-আমরা তো এরই উপযুক্ত, আর যখন তাদেরকে অকল্যাণ পৌছে তখন তারা এ জন্যে মূসা (আঃ) ও তার সঙ্গীদেরকে দায়ী করে।” অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যদি তাদেরকে কল্যাণ পৌছে তবে তারা বলে-এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, আর যদি তাদেরকে অকল্যাণ পৌছে তবে তারা বলে- এটা তোমার পক্ষ হতে এসেছে; তুমি বল, সবই আল্লাহর পক্ষ হতে এসে থাকে।” (৪:৭৮)
আল্লাহ তা’আলা জনপদের অধিবাসীদের সম্পর্কে খবর দিয়ে বলেন, যখন তাদের নিকট রাসূলগণ এসেছিলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তারা বললোঃ আমরা তোমাদেরকে অকল্যাণের কারণ মনে করি, যদি তোমরা বিরত না হও তবে অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবো এবং আমাদের পক্ষ হতে তোমাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবশ্যই আপতিত হবে। তারা বললোঃ তোমাদের অমঙ্গল তোমাদেরই সাথে।” (৩৬: ১৮-১৯)
এখানে রয়েছে যে, হযরত সালেহ (আঃ) বললেনঃ তোমাদের শুভাশুভ আল্লাহর ইখতিয়ারে, বস্তুতঃ তোমরা এমন এক সম্প্রদায় যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ পরীক্ষা করা হচ্ছে তিরস্কার দ্বারাও এবং বিপদ-আপদ দ্বারাও। তবে এখানে তোমাদেরকে অবকাশ দেয়া হচ্ছে। এ অবকাশ আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে, এর পরে পাকড়াও করা হবে।
৪৮-৫৩ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, সামূদ সম্প্রদায়ের শহরে নয়জন ঝগড়াটে ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী লোক ছিল। তাদের স্বভাব বা প্রকৃতিতে সংস্কার বা শুদ্ধকরণের মূল জিনিস কিছুই ছিল না। তারাই ছিল সামূদ সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় লোক। তাদেরই পরামর্শক্রমে উন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনামতে তাদের নামগুলো হলোঃ দামী, দায়ীম, হারাম, হারীম, দা’ব, সওয়াব, রিবাব, মিসতা এবং কিদার ইবনে সালিফ (আল্লাহ তাদের অবস্থা মন্দ করুন ও তাদের উপর লা’নত বর্ষণ করুন!)। এদের শেষোক্ত ব্যক্তিটিই নিজের হাতে হযরত সালেহ (আঃ)-এর উষ্ট্রীটির পা কেটে ফেলেছিল। যার বর্ণনা নিম্নের আয়াতগুলোতে রয়েছে।
(আরবি) অর্থাৎ “অতঃপর তারা তাদের এক সঙ্গীকে আহ্বান করলো, সে ওকে ধরে হত্যা করলো। (৫৪: ২৯) (আরবি) অর্থাৎ “তাদের মধ্যে যে সর্বাধিক হতভাগ্য সে যখন তৎপর হয়ে উঠলো।” (৯১: ১২)
এরা ছিল ঐ সব লোক যারা দিরহামের হুঁচকে কিছুটা কেটে দিতে এবং ওটাকেই চালিয়ে দিতো। ছাঁচকে কেটে দেয়াও এক প্রকারের বিপর্যয় সৃষ্টি। যেমন সুনানে আবি দাউদ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে রয়েছে যে, যে মুদ্রা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে ওকে বিনা প্রয়োজনে কাটতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিষেধ করেছেন। মোটকথা, তারা এ ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টিও করতো এবং আরো নানা প্রকারের ফাসাদ সৃষ্টি করতো। ঐ অপবিত্র দল একত্রিত হয়ে পরামর্শ গ্রহণ করলোঃ “আজ রাত্রে সালেহ (আঃ)-কে এবং তার পরিবারবর্গকে হত্যা করে ফেলো। এতে তারা সবাই একমত হয়ে দৃঢ়ভাবে শপথ ও প্রতিজ্ঞা করলো। কিন্তু তারা হযরত সালেহ (আঃ)-এর নিকট পৌছার পূর্বেই আল্লাহ তাআলার শাস্তি তাদের উপর আপতিত হলো এবং তারা সমূলে ধ্বংস হয়ে গেল। উপর থেকে একটি পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে আসলো। ঐসব নেতার মাথা ফুটে গেল। একই সাথে সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। তাদের সাহস খুবই বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে যখন তারা হযরত সালেহ (আঃ)-এর উস্ত্রীকে হত্যা করলো এবং দেখলো যে, কোন শাস্তি এলো না তখন তারা আল্লাহর নবী হযরত সালেহ (আঃ)-কে হত্যা করতে উদ্যত হলো। তারা পরস্পর পরামর্শ করলোঃ “তোমরা গোপনে তাকে ও তার ছেলেমেয়েদেরকে হঠাৎ হত্যা করে ফেলে এবং তার আত্মীয়-স্বজন ও কওমের লোকদেরকে বলো-তাদের খবর আমরা কি জানি? আমরা তাদের কোন খবরই রাখি না।”
তখন আল্লাহ তাদের সকলকেই ধ্বংস করে দেন। তারা আরো বলেছিলঃ “যদি সালেহ (আঃ) সত্যই নবী হয় তবে তাকে আমরা হাতে পাবো না। আর যদি সে মিথ্যাবাদী হয় তবে তার উস্ত্রীর সাথে তাকেও আমরা সেলাই করে দেবো।” এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা বের হয়ে পড়লো। তারা পথেই ছিল এমতাবস্থায় ফেরেশতা তাদের সবারই মস্তিষ্ক টুকরো টুকরো করে ফেলেন। তাদের পরামর্শে অন্য যেসব দল শরীক ছিল তারা যখন দেখলো যে, অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে অথচ তারা ফিরে আসছে না তখন তারা তাদের খবর নিতে এসে দেখে যে, তাদের সবারই মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে গেছে এবং সবাই মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তখন তারা হযরত সালেহ (আঃ)-কে তাদের হত্যাকারী বলে অপবাদ দেয় এবং তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। কিন্তু তাঁর কওমের লোকেরা ইতিমধ্যে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এসে পড়ে এবং তাদেরকে বলে- “দেখো, সালেহ (আঃ) তো তোমাদেরকে বলেছেন যে, তিন দিনের মধ্যে তোমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়বে। তাহলে যদি তিনি তার কথায় সত্যবাদী হন তবে তাঁকে হত্যা করলে আল্লাহ তোমাদের প্রতি আরো অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হবেন এবং তোমাদের উপর আরো কঠিন শাস্তি আপতিত হবে। আর যদি তিনি মিথ্যাবাদী হন তবে তিনি তোমাদের হাত হতে যাবেন কোথায়?” তাঁর কওমের এ কথা শুনে ঐ দুষ্ট লোকেরা ফিরে যায়। সত্যিই হযরত সালেহ (আঃ) ঐ লোকদের পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেনঃ “যদি তোমরা আল্লাহর উন্ত্রীকে হত্যা করে ফেলো তবে তিন দিন পর্যন্ত তোমরা মজা উড়িয়ে নাও। অতঃপর আল্লাহর সত্য ওয়াদা প্রকাশিত হবেই।”
হযরত সালেহ (আঃ)-এর মুখে এ কথা শুনে ঐ উদ্ধত লোকগুলো পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করলোঃ “এ লোকটি তো বহুদিন হতেই এ কথা বলে আসছে। এসো, আজই এর ফায়সালা হয়ে যাক।” যে পাহাড়ের মধ্য হতে উষ্ট্ৰীটি বের হয়েছিল ঐ পাহাড়েই হযরত সালেহ (আঃ)-এর একটি মসজিদ ছিল, যেখানে তিনি নামায পড়তেন। তারা পরামর্শ করলো যে, যখন তিনি নামাযের উদ্দেশ্যে বের হবেন তখন পথেই তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে। এই উদ্দেশ্যে যখন তারা পাহাড়ের উপর উঠতে শুরু করলো তখন তারা লক্ষ্য করলো যে, উপর হতে একটি বিরাট পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। ওটা থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা একটি গুহার মধ্যে প্রবেশ করলো। পাথরটি এসে গুহাটির মুখে এমনভাবে থেমে গেল যে, ওর মুখ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল। ফলে তারা সবাই ধ্বংস হয়ে গেল। কারো কোন খবর রইলো না যে, এ লোকগুলো কোথায় গেল। এখানে তো এরা এভাবে ধ্বংস হলো আর ওদিকে বাকী লোকেরা তাদের জায়গাতেই ধ্বংস হয়ে গেল। না এদের খবর ওরা পেলো এবং না ওদের খবর এরা পেলো। হযরত সালেহ (আঃ) এবং তাঁর অনুসারী মুমিনদের তারা কোনই ক্ষতি করতে পারলো না। বরং তারা নিজেদেরই জীবন আল্লাহর শাস্তিতে নষ্ট করে ফেললো।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা এক চক্রান্ত করেছিল এবং আমিও তাদেরকে তাদের চক্রান্তের মজা চাখিয়ে দিলাম। তারা এমনভাবে ধ্বংস হয়ে গেল যে, ক্ষণেক পূর্বেও তারা এটা বুঝতে পারেনি। ঐ চক্রান্তকারীদের পরিণাম এই হলো যে, তারা সবাই ধ্বংস হয়ে গেল।
মহান আল্লাহ বলেনঃ এই তো তাদের ঘরবাড়ী, তাদের সীমালংঘন হেতু জনশূন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তাদের যুলুম ও বাড়াবাড়ির কারণে তাদের জাঁকজমকপূর্ণ শহর ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়েছে। এর দ্বারা জ্ঞানী লোকেরা অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। যারা মুমিন ও মুত্তাকী ছিল তাদেরকে আমি উদ্ধার করেছি।
৫৪-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দা ও রাসূল হযরত লূত (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণনা করছেন যে, তিনি তাঁর উম্মত অর্থাৎ তার কওমকে তাদের এমন জঘন্যতম কাজের জন্যে ভীতি প্রদর্শন করেন যে কাজ তাদের পূর্বে কেউই করেনি অর্থাৎ কাম-তৃপ্তির জন্যে নারীকে ছেড়ে পুরুষে উপগত হওয়া। সমস্ত কওমের অবস্থা এই ছিল যে, পুরুষ লোকেরা পুরুষ লোকেদের দ্বারা এবং স্ত্রীলোকেরা স্ত্রীলোকদের দ্বারা তাদের কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতো। সাথে সাথে তারা এতো বেহায়া হয়ে গিয়েছিল যে, ঐ জঘন্য কাজ গোপনে করাও প্রয়োজন মনে করতো না। প্রকাশ্যে তারা এই বেহায়াপূর্ণ কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়তো। স্ত্রীলোকদেরকে ছেড়ে তারা পুরুষ লোকদের কাছে আসতো। এ জন্যেই হযরত লূত (আঃ) তাদেরকে বলেনঃ “তোমরা তোমাদের অজ্ঞতাপূর্ণ কাজ হতে ফিরে এসো। তোমরা এমনই মূর্খ হয়ে গেছে যে, শরীয়তের পবিত্রতার সাথে সাথে তোমাদের স্বাভাবিক পবিত্রতাও বিদায় নিতে শুরু করেছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমরা বিশ্ব জগতের পুরুষদের নিকট আসছে এবং তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে যে জোড়াসমূহ সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে ছেড়ে দিচ্ছ? বরং তোমরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়।” (২৬:১৬৫-১৬৬)
মহান আল্লাহ বলেন যে, তারা উত্তরে বলেছিলঃ “তোমরা পূত-পরিবারকে তোমাদের জনপদ হতে বহিস্কৃত কর, তারা তো এমন লোক যারা পবিত্র সাজতে চায়।”
যখন কাফিররা হযরত লূত (আঃ) ও তাঁর পরিবারকে দেশান্তর করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সবাই একমত হয়ে যায় তখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন এবং হযরত লূত (আঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গকে তাদের হতে এবং যে শাস্তি তাদের উপর আপতিত হয়েছিল তা হতে রক্ষা করেন। হ্যাঁ, তবে তাঁর স্ত্রী, যে তাঁর কওমের সাথেই ছিল এবং ঐ ধ্বংসপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রথম হতেই তার নাম লিপিবদ্ধ হয়েছিল, সে এখানে বাকী রয়ে যায় এবং শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। কেননা, সে ঐ ধ্বংসপ্রাপ্তদেরকে তাদের দ্বীন ও রীতি নীতিতে সাহায্য করতো। সে তাদের দুষ্কর্মকে পছন্দ করতো। সে-ই হযরত নূত (আঃ)-এর অতিথিদের খবর তাঁর কওমের নিকট পৌছিয়ে দিয়েছিল। তবে এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, সে তাদের অশ্লীল কাজে শরীক ছিল না। আল্লাহর নবীর স্ত্রী বদকার হবে এটা নবীর মর্যাদার পরিপন্থী।
ঐ কওমের উপর আকাশ হতে পাথর বর্ষিত হয়, যে পাথরগুলোর উপর তাদের নাম অংকিত ছিল। প্রত্যেকের উপর তার নামেরই পাথর পড়েছিল এবং তাদের একজনও বাঁচেনি। অত্যাচারীদের হতে আল্লাহর শাস্তি দূর হয় না। তাদের উপর আল্লাহর হুজ্জত কায়েম হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে সতর্ক ও ভয় প্রদর্শন করা হয়েছিল এবং তাদের উপর রিসালাতের তাবলীগ যথেষ্ট পরিমাণে হয়েছিল। কিন্তু তারা বিরোধিতাকরণ, অবিশ্বাসকরণ ও বেঈমানীর উপর অটল ছিল। তারা আল্লাহর নবী হযরত লূত (আঃ)-কে কষ্ট দিয়েছিল, এমনকি তাঁকে দেশ হতে বহিস্কৃত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। তৎক্ষণাৎ ঐ মন্দ প্রস্তর-বৃষ্টি তাদের উপর বর্ষিত হয় এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1011)
[ Can’t follow without evidence.]
www.motaher21.net
Sura:27
Para:19
Sura: An-Noml
Ayat: 45-58
27:45
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلٰی ثَمُوۡدَ اَخَاہُمۡ صٰلِحًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ فَاِذَا ہُمۡ فَرِیۡقٰنِ یَخۡتَصِمُوۡنَ ﴿۴۵﴾
And We had certainly sent to Thamud their brother Salih, [saying], “Worship Allah,” and at once they were two parties conflicting.
Salih and Thamud
Allah tells:
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ
And indeed We sent to Thamud their brother Salih, (saying):”Worship Allah.”
Allah tells us about Thamud and how they responded to their Prophet Salih, when Allah sent him to call them to worship Allah alone, with no partner or associate.
فَإِذَا هُمْ فَرِيقَانِ يَخْتَصِمُونَ
Then look! They became two parties quarreling with each other.
Mujahid said,
“These were believers and disbelievers.”
This is like the Ayah,
قَالَ الْمَلَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُواْ مِن قَوْمِهِ لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُواْ لِمَنْ ءامَنَ مِنْهُمْ أَتَعْلَمُونَ أَنَّ صَـلِحاً مُّرْسَلٌ مّن رَّبّهِ قَالُواْ إِنَّا بِمَأ أُرْسِلَ بِهِ مُوْمِنُونَ
قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُواْ إِنَّا بِالَّذِى ءامَنتُمْ بِهِ كَـفِرُونَ
The leaders of those who were arrogant among his people said to those who were counted weak — to such of them as believed:”Know you that Salih is one sent from his Lord.”
They said:”We indeed believe in that with which he has been sent.”
Those who were arrogant said:”Verily, we disbelieve in that which you believe in.” (7:75-76)
27:46
قَالَ یٰقَوۡمِ لِمَ تَسۡتَعۡجِلُوۡنَ بِالسَّیِّئَۃِ قَبۡلَ الۡحَسَنَۃِ ۚ لَوۡ لَا تَسۡتَغۡفِرُوۡنَ اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ﴿۴۶﴾
He said, “O my people, why are you impatient for evil instead of good? Why do you not seek forgiveness of Allah that you may receive mercy?”
قَالَ يَا قَوْمِ لِمَ تَسْتَعْجِلُونَ بِالسَّيِّيَةِ قَبْلَ الْحَسَنَةِ
He said:”O my people! Why do you seek to hasten the evil before the good!”
meaning, `why are you praying for the punishment to come, and not asking Allah for His mercy!’
Then he said:
لَوْلَا تَسْتَغْفِرُونَ اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
27:47
قَالُوا اطَّیَّرۡنَا بِکَ وَ بِمَنۡ مَّعَکَ ؕ قَالَ طٰٓئِرُکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ بَلۡ اَنۡتُمۡ قَوۡمٌ تُفۡتَنُوۡنَ ﴿۴۷﴾
They said, “We consider you a bad omen, you and those with you.” He said, “Your omen is with Allah . Rather, you are a people being tested.”
قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ
“Why seek you not the forgiveness of Allah, that you may receive mercy!”
They said:”We augur an omen from you and those with you.”
This means:”We do not see any good in your face and the faces of those who are following you.”
Since they were doomed, whenever anything bad happened to any of them they would say, “This is because of Salih and his companions.”
Mujahid said,
“They regarded them as bad omens.”
This is similar to what Allah said about the people of Fir`awn:
فَإِذَا جَأءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُواْ لَنَا هَـذِهِ وَإِن تُصِبْهُمْ سَيِّيَةٌ يَطَّيَّرُواْ بِمُوسَى وَمَن مَّعَهُ
But whenever good came to them, they said:”Ours is this.” And if evil afflicted them, they saw it as an omen about Musa and those with him. (7:131)
And Allah says:
وَإِن تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ يَقُولُواْ هَـذِهِ مِنْ عِندِ اللَّهِ وَإِن تُصِبْهُمْ سَيِّيَةٌ يَقُولُواْ هَـذِهِ مِنْ عِندِكَ قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِندِ اللَّهِ
And if some good reaches them, they say, “This is from Allah,” but if some evil befalls them, they say, “This is from you.”
Say:”All things are from Allah.” (4:78)
i.e., by virtue of His will and decree.
And Allah tells us about the dwellers of the town, when the Messengers came to them:
قَالُواْ إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَيِن لَّمْ تَنتَهُواْ لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُمْ مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ
قَالُواْ طَـيِرُكُم مَّعَكُمْ
They (people) said:”For us, we see an omen from you; if you cease not, we will surely stone you, and a painful torment will touch you from us.”
They (Messengers) said:”Your omens are with yourselves! (36:18)
And these people (Thamud) said:
اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ قَالَ طَايِرُكُمْ عِندَ اللَّهِ
“We augur an omen from you and those with you.”
He said:”Your omen is of Allah;
meaning, Allah will punish you for that.
بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ تُفْتَنُونَ
nay, but you are a people that are being tested.
Qatadah said:
“You are being tested to see whether you will obey or disobey.”
The apparent meaning of the phrase
تُفْتَنُونَ
(are being tested) is:
you will be left to get carried away in your state of misguidance
27:48
وَ کَانَ فِی الۡمَدِیۡنَۃِ تِسۡعَۃُ رَہۡطٍ یُّفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا یُصۡلِحُوۡنَ ﴿۴۸﴾
And there were in the city nine family heads causing corruption in the land and not amending [its affairs].
The Plot of the Mischief-Makers and the End of the People of Thamud
Allah tells us about the evildoers of Thamud and their leaders who used to call their people to misguidance and disbelief, and to deny Salih. Eventually they killed the she-camel and were about to kill Salih too. They plotted to let him sleep with his family at night, then they would assassinate him and tell his relatives that they knew nothing about what happened to him, and that they were telling the truth because none of them had seen anything.
Allah says:
وَكَانَ فِي الْمَدِينَةِ
And there were in the city,
meaning, in the city of Thamud,
تِسْعَةُ رَهْطٍ
nine Raht,
meaning, nine people,
يُفْسِدُونَ فِي الاَْرْضِ وَلَا يُصْلِحُونَ
who made mischief in the land, and would not reform.
They forced their opinions on the people of Thamud, because they were the leaders and chiefs.
Al-`Awfi reported that Ibn Abbas said:
“These were the people who killed the she-camel,”
Meaning, that happened upon their instigation, may Allah curse them.
Allah says:
فَنَادَوْاْ صَـحِبَهُمْ فَتَعَاطَى فَعَقَرَ
But they called their comrade and he took (a sword) and killed (the she-camel). (54:29)
إِذِ انبَعَثَ أَشْقَـهَا
When the most wicked man among them went forth (to kill the she-camel). (91:12)
Abdur-Razzaq said that Yahya bin Rabi`ah As-San`ani told them,
“I heard `Ata’ — i.e. Ibn Abi Rabah — say:
وَكَانَ فِي الْمَدِينَةِ
تِسْعَةُ رَهْطٍ يُفْسِدُونَ فِي الاَْرْضِ وَلَا يُصْلِحُونَ
(And there were in the city nine Raht, who made mischief in the land, and would not reform),
`They used to break silver coins.”‘
They would break off pieces from them, as if they used to trade with them in terms of numbers (as opposed to weight), as the Arabs used to do.
Imam Malik narrated from Yahya bin Sa`id that Sa`id bin Al-Musayyib said:
“Cutting gold and silver (coins) is part of spreading corruption on earth.”
What is meant is that the nature of these evil disbelievers was to spread corruption on earth by every means possible, one of which was that mentioned by these Imams
27:49
قَالُوۡا تَقَاسَمُوۡا بِاللّٰہِ لَنُبَیِّتَنَّہٗ وَ اَہۡلَہٗ ثُمَّ لَنَقُوۡلَنَّ لِوَلِیِّہٖ مَا شَہِدۡنَا مَہۡلِکَ اَہۡلِہٖ وَ اِنَّا لَصٰدِقُوۡنَ ﴿۴۹﴾
They said, “Take a mutual oath by Allah that we will kill him by night, he and his family. Then we will say to his executor, ‘We did not witness the destruction of his family, and indeed, we are truthful.’ ”
قَالُوا تَقَاسَمُوا بِاللَّهِ لَنُبَيِّتَنَّهُ وَأَهْلَهُ
They said:”Swear one to another by Allah that we shall make a secret night attack on him and his household…”
They took a mutual oath, pledging that during the night, whoever met the Allah’s Prophet Salih, peace be upon him, he would assassinate him.
ثُمَّ لَنَقُولَنَّ لِوَلِيِّهِ مَا شَهِدْنَا مَهْلِكَ أَهْلِهِ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ
and thereafter we will surely say to his near relatives:`We witnessed not the destruction of his household, and verily, we are telling the truth.”‘
But Allah planned against them and caused their plot to backfire.
Mujahid said,
“They took a mutual oath pledging to kill him, but before they could reach him, they and their people were all destroyed.”
Abdur-Rahman bin Abi Hatim said:
“When they killed the she-camel, Salih said to them:
تَمَتَّعُواْ فِى دَارِكُمْ ثَلَـثَةَ أَيَّامٍ ذلِكَ وَعْدٌ غَيْرُ مَكْذُوبٍ
“Enjoy yourselves in your homes for three days. This is a promise (i.e., a threat) that will not be belied.” (11:65)
They said:`Salih claims that he will finish with us in three days, but we will finish him and his family before the three days are over.’
Salih had a place of worship in a rocky tract in a valley, where he used to pray. So they set out to go to a cave there one night, and said, `When he comes to pray, we will kill him, then we will return. When we have finished him off, we will go to his family and finish them off too.’
Then Allah sent down a rock upon them from the mountains round about; they feared that it would crush them, so they ran into the cave and the rock covered the mouth of the cave while they were inside.
Their people did not know where they were or what had happened to them. So Allah punished some of them here, and some of them there, and He saved Salih and the people who were with him.
Then he recited:
وَمَكَرُوا مَكْرًا وَمَكَرْنَا مَكْرًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ
27:50
وَ مَکَرُوۡا مَکۡرًا وَّ مَکَرۡنَا مَکۡرًا وَّ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۵۰﴾
And they planned a plan, and We planned a plan, while they perceived not.
فَانظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ مَكْرِهِمْ أَنَّا دَمَّرْنَاهُمْ وَقَوْمَهُمْ أَجْمَعِينَ
27:51
فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ مَکۡرِہِمۡ ۙ اَنَّا دَمَّرۡنٰہُمۡ وَ قَوۡمَہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿۵۱﴾
Then look how was the outcome of their plan – that We destroyed them and their people, all.
27:52
فَتِلۡکَ بُیُوۡتُہُمۡ خَاوِیَۃًۢ بِمَا ظَلَمُوۡا ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لِّقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ ﴿۵۲﴾
So those are their houses, desolate because of the wrong they had done. Indeed in that is a sign for people who know.
فَتِلْكَ بُيُوتُهُمْ خَاوِيَةً
So, they plotted a plot, and We planned a plan, while they perceived not. Then see how was the end of their plot! Verily, We destroyed them and their nation, all together. These are their houses in utter ruin,
i.e., deserted.”
بِمَا ظَلَمُوا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَايَةً لِّقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
وَأَنجَيْنَا الَّذِينَ امَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ
27:53
وَ اَنۡجَیۡنَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ ﴿۵۳﴾
And We saved those who believed and used to fear Allah .
for they did wrong. Verily, in this is indeed an Ayah for people who know. And We saved those who believed, and had Taqwa of Allah
27:54
وَ لُوۡطًا اِذۡ قَالَ لِقَوۡمِہٖۤ اَتَاۡتُوۡنَ الۡفَاحِشَۃَ وَ اَنۡتُمۡ تُبۡصِرُوۡنَ ﴿۵۴﴾
And [mention] Lot, when he said to his people, “Do you commit immorality while you are seeing?
Lut and His People
Allah tells:
وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ
And (remember) Lut! When he said to his people:
Allah tells us about His servant and Messenger Lut, peace be upon him, and how he warned his people of Allah’s punishment for committing an act of immorality which no human ever committed before them — intercourse with males instead of females. This is a major sin, whereby men are satisfied with men and women are with women (i.e., homosexuality).
Lut said:
أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ وَأَنتُمْ تُبْصِرُونَ
Do you commit immoral sins while you see!
meaning, `while you see one another, and you practice every kind of evil in your meetings.’
أَيِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِّن دُونِ النِّسَاء بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ
27:55
اَئِنَّکُمۡ لَتَاۡتُوۡنَ الرِّجَالَ شَہۡوَۃً مِّنۡ دُوۡنِ النِّسَآءِ ؕ بَلۡ اَنۡتُمۡ قَوۡمٌ تَجۡہَلُوۡنَ ﴿۵۵﴾
Do you indeed approach men with desire instead of women? Rather, you are a people behaving ignorantly.”
Do you practice your lusts on men instead of women!
Nay, but you are a people who behave senselessly.
means, `you do not know anything of what is natural or what is prescribed by Allah.’
This is like the Ayah:
أَتَأْتُونَ الذُّكْرَانَ مِنَ الْعَـلَمِينَ
وَتَذَرُونَ مَا خَلَقَ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِّنْ أَزْوَجِكُمْ بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ عَادُونَ
Go you in unto the males of mankind, and leave those whom Allah has created for you to be your wives.
Nay, you are a trespassing people! (26:165-166)
فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلاَّ أَن قَالُوا أَخْرِجُوا الَ لُوطٍ مِّن قَرْيَتِكُمْ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَتَطَهَّرُونَ
27:56
فَمَا کَانَ جَوَابَ قَوۡمِہٖۤ اِلَّاۤ اَنۡ قَالُوۡۤا اَخۡرِجُوۡۤا اٰلَ لُوۡطٍ مِّنۡ قَرۡیَتِکُمۡ ۚ اِنَّہُمۡ اُنَاسٌ یَّتَطَہَّرُوۡنَ ﴿۵۶﴾
But the answer of his people was not except that they said, “Expel the family of Lot from your city. Indeed, they are people who keep themselves pure.”
There was no other answer given by his people except that they said:”Drive out the family of Lut from your city. Verily, these are men who want to be clean and pure!”
means, `they feel embarrassed because of the deeds you are doing, and because you approve of your actions, so expel them from among yourselves, for they are not fit to live among you in your city.’
So, the people resolved to do that, and Allah destroyed them, and a similar end awaits the disbelievers.
Allah says:
فَأَنجَيْنَاهُ وَأَهْلَهُ إِلاَّ امْرَأَتَهُ قَدَّرْنَاهَا مِنَ الْغَابِرِينَ
27:57
فَاَنۡجَیۡنٰہُ وَ اَہۡلَہٗۤ اِلَّا امۡرَاَتَہٗ ۫ قَدَّرۡنٰہَا مِنَ الۡغٰبِرِیۡنَ ﴿۵۷﴾
So We saved him and his family, except for his wife; We destined her to be of those who remained behind.
So, We saved him and his family, except his wife. We destined her to be of those who remained behind.
meaning, she was one of those who were destroyed, with her people, because she was a helper to what they did and she approved of their evil deeds.
She told them about the guests of Lut so that they could come to them. She did not do the evil deeds herself, which was because of the honor of the Lut and not because of any honor on her part
27:58
وَ اَمۡطَرۡنَا عَلَیۡہِمۡ مَّطَرًا ۚ فَسَآءَ مَطَرُ الۡمُنۡذَرِیۡنَ ﴿٪۵۸﴾
And We rained upon them a rain [of stones], and evil was the rain of those who were warned.
وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِم مَّطَرًا
And We rained down on them a rain.
means; stones of Sijjil, in a well-arranged manner one after another. Marked from your Lord; and they are not ever far from the evildoers.
Allah said:
فَسَاء مَطَرُ الْمُنذَرِينَ
So, evil was the rain of those who were warned.
meaning, those against whom proof was established and whom the warning reached, but they went against the Messenger and denied him, and resolved to drive him out from among them
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran