(বই#১০১৭)   [  *সার্বভৌমত্বের মিথ্যা দাবীদারদের করুণ পরিণতি :-] www.motaher21.net সূরা:- ২৮:ক্বাসাস পারা:২০ ৬২-৭৫ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০১৭)
[  *সার্বভৌমত্বের মিথ্যা দাবীদারদের করুণ পরিণতি :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৮:ক্বাসাস
পারা:২০
৬২-৭৫ নং আয়াত:-
২৮:৬২
وَ یَوۡمَ یُنَادِیۡہِمۡ فَیَقُوۡلُ اَیۡنَ شُرَکَآءِیَ الَّذِیۡنَ کُنۡتُمۡ تَزۡعُمُوۡنَ ﴿۶۲﴾
সে দিনটি যখন তিনি তাদেরকে ডাকবেন এবং জিজ্ঞেস করবেন, “কোথায় তারা যাদেরকে তোমরা আমার শরীক বলে মনে করতে?”
২৮:৬৩
قَالَ الَّذِیۡنَ حَقَّ عَلَیۡہِمُ الۡقَوۡلُ رَبَّنَا ہٰۤؤُلَآءِ الَّذِیۡنَ اَغۡوَیۡنَا ۚ اَغۡوَیۡنٰہُمۡ کَمَا غَوَیۡنَا ۚ تَبَرَّاۡنَاۤ اِلَیۡکَ ۫ مَا کَانُوۡۤا اِیَّانَا یَعۡبُدُوۡنَ ﴿۶۳﴾
যাদের জন্য শাস্তির বাণী অবধারিত হয়েছে, তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব ! এরা তো তারা যাদেরকে আমরা বিভ্রান্ত করেছিলাম; আমরা এদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলাম যেমন আমরা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম; আপনার সমীপে আমরা তাদের ব্যাপারে দায়মুক্ততা ঘোষণা করছি । এরা তো আমাদের ‘ইবাদাত করত না।’
২৮:৬৪
وَ قِیۡلَ ادۡعُوۡا شُرَکَآءَکُمۡ فَدَعَوۡہُمۡ فَلَمۡ یَسۡتَجِیۡبُوۡا لَہُمۡ وَ رَاَوُا الۡعَذَابَ ۚ لَوۡ اَنَّہُمۡ کَانُوۡا یَہۡتَدُوۡنَ ﴿۶۴﴾
ওদেরকে বলা হবে, ‘তোমাদের দেবতাগুলিকে আহবান কর।’ তখন ওরা ওদেরকে আহবান করবে; কিন্তু ওরা ওদের আহবানে সাড়া দেবে না। ওরা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।হায়, ওরা যদি সৎপথ অনুসরণ করত ।
২৮:৬৫
وَ یَوۡمَ یُنَادِیۡہِمۡ فَیَقُوۡلُ مَاذَاۤ اَجَبۡتُمُ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۶۵﴾
সেদিন আল্লাহ ওদেরকে ডেকে বলবেন, ‘তোমরা রসূলগণকে কি জবাব দিয়েছিলে?’
২৮:৬৬
فَعَمِیَتۡ عَلَیۡہِمُ الۡاَنۡۢبَآءُ یَوۡمَئِذٍ فَہُمۡ لَا یَتَسَآءَلُوۡنَ ﴿۶۶﴾
সেদিন তাদের কোন জবাব থাকবে না, তারা নিজেদের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে না।
২৮:৬৭
فَاَمَّا مَنۡ تَابَ وَ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا فَعَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنَ مِنَ الۡمُفۡلِحِیۡنَ ﴿۶۷﴾
তবে যে ব্যাক্তি তাওবা করেছিল এবং ঈমান এনেছিল ও সৎকাজ করেছিল, আশা করা যায় সে সাফল্য অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
২৮:৬৮
وَ رَبُّکَ یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ وَ یَخۡتَارُ ؕ مَا کَانَ لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ ؕ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۶۸﴾
তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন, এতে ওদের কোন এখতিয়ার নেই। আল্লাহ পবিত্র, মহান এবং ওরা যাকে অংশী করে তা হতে তিনি ঊর্ধ্বে।
২৮:৬৯
وَ رَبُّکَ یَعۡلَمُ مَا تُکِنُّ صُدُوۡرُہُمۡ وَ مَا یُعۡلِنُوۡنَ ﴿۶۹﴾
ওদের অন্তর যা গোপন করে এবং ওরা যা ব্যক্ত করে, তোমার প্রতিপালক তা জানেন।
২৮:৭০
وَ ہُوَ اللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ؕ لَہُ الۡحَمۡدُ فِی الۡاُوۡلٰی وَ الۡاٰخِرَۃِ ۫ وَ لَہُ الۡحُکۡمُ وَ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۷۰﴾
তিনিই এক আল্লাহ‌ যিনি ছাড়া ইবাদাতের আর কোন হকদার নেই। তাঁরই জন্য প্রশংসা দুনিয়ায়ও, আখেরাতেও। শাসন কর্তৃত্ব তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে।
২৮:৭১
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ جَعَلَ اللّٰہُ عَلَیۡکُمُ الَّیۡلَ سَرۡمَدًا اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ مَنۡ اِلٰہٌ غَیۡرُ اللّٰہِ یَاۡتِیۡکُمۡ بِضِیَآءٍ ؕ اَفَلَا تَسۡمَعُوۡنَ ﴿۷۱﴾
বল, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ যদি রাত্রির অন্ধকারকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তাহলে আল্লাহ ছাড়া এমন কোন উপাস্য আছে কি, যে তোমাদের দিবালোক দান করতে পারে? তবুও কি তোমরা কর্ণপাত করবে না?’
২৮:৭২
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ جَعَلَ اللّٰہُ عَلَیۡکُمُ النَّہَارَ سَرۡمَدًا اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ مَنۡ اِلٰہٌ غَیۡرُ اللّٰہِ یَاۡتِیۡکُمۡ بِلَیۡلٍ تَسۡکُنُوۡنَ فِیۡہِ ؕ اَفَلَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿۷۲﴾
বল, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ যদি দিনকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তাহলে আল্লাহ ছাড়া এমন উপাস্য আছে কি, যে তোমাদের জন্য রাত্রির আবির্ভাব ঘটাবে; যাতে তোমরা বিশ্রাম করতে পার। তবুও কি তোমরা ভেবে দেখবে না?’
২৮:৬৩
وَ مِنۡ رَّحۡمَتِہٖ جَعَلَ لَکُمُ الَّیۡلَ وَ النَّہَارَ لِتَسۡکُنُوۡا فِیۡہِ وَ لِتَبۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِہٖ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۷۳﴾
তিনিই নিজ করুণায় তোমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন; যাতে রাতে তোমরা বিশ্রাম করতে পার এবং দিনে তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
২৮:৭৪
وَ یَوۡمَ یُنَادِیۡہِمۡ فَیَقُوۡلُ اَیۡنَ شُرَکَآءِیَ الَّذِیۡنَ کُنۡتُمۡ تَزۡعُمُوۡنَ ﴿۷۴﴾
সেদিন ওদেরকে আহবান করে বলা হবে, ‘তোমরা যাদেরকে আমার অংশী মনে করতে তারা কোথায়?’
২৮:৭৫
وَ نَزَعۡنَا مِنۡ کُلِّ اُمَّۃٍ شَہِیۡدًا فَقُلۡنَا ہَاتُوۡا بُرۡہَانَکُمۡ فَعَلِمُوۡۤا اَنَّ الۡحَقَّ لِلّٰہِ وَ ضَلَّ عَنۡہُمۡ مَّا کَانُوۡا یَفۡتَرُوۡنَ ﴿٪۷۵﴾
আর আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে একজন সাক্ষী বের করে আনবো তারপর বলবো, “আনো এবার তোমাদের প্রমাণগুলো।” সে সময় তারা জানবে, সত্য রয়েছে আল্লাহর কাছে এবং তারা যা কিছু মিথ্যা বানিয়ে রেখেছিল তা সবই উধাও হয়ে যাবে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*সার্বভৌমত্বের মিথ্যা দাবীদারদের করুণ পরিণতি : পরবর্তী পর্বে কেয়ামতের একটা দৃশ্য দেখিয়ে মােশরেকদের শিরক ও গােমরাহীর শােচনীয় পরিণতি তুলে ধরা হচ্ছে, ‘যেদিন আল্লাহ তাদের ডেকে বলবেন, তােমরা যাদের আমার শরীক মনে করতে, তারা কোথায়?…'(আয়াত ৬২-৬৬) এখানে প্রথম প্রশ্নটাতে হুমকি ও ধমকের সুর ফুটে ওঠেছে, ‘তােমরা যাদের আমার শরীক মনে করতে, তারা (আজ) কোথায়?’ আল্লাহ তায়ালা ভালাে করেই জানেন, আজকের এই কেয়ামতের দিন সেসব শরীকের কোনাে অস্তিত্বই নেই, তার অনুসারীরা তাদের সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং তাদের কোনাে সন্ধানও তাদের জানা নেই। কেবল তাদের জনসমক্ষে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করার উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন করা হয়েছে, তারা এখন কোথায়? এ জন্যেই যাদের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছে, তারা কোন জবাব দিচ্ছে না। এখানে তাদের জবাব পাওয়া উদ্দেশ্যও নয়। তারা শুধু পরবর্তী প্রজন্মকে বিপথগামী করার এবং আল্লাহর হেদায়াতের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখার অপরাধের দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করছে। কোরায়শ নেতারাও তাদের অনুসারীদের একই পন্থায় বিপথগামী করতাে। এসব কাফের ও মােশরেক কেয়ামতের দিন বলবে, হে আমাদের মালিক, এই যে সেসব লােক, যাদের আমরা বিপথগামী করেছিলাম। আমরা নিজেরা যেমন বিপথগামী হয়েছিলাম, তেমনি ওদের বিপথগামী করেছিলাম। আমরা তােমার কাছে নিজেদের নির্দোষিতা জানাচ্ছি, ওরা আমাদের উপাসনা করতাে না। অর্থাৎ হে আমাদের মালিক, আমরা ওদের জোরপূর্বক বিপথগামী করিনি। কেননা তাদের মনের ওপর আমাদের কোন জোর খাটাতাে না। তারা নিজেরাই স্বেচ্ছায় বিপথে চালিত হয়েছে, যেমন আমরাও স্বেচ্ছায় বিপথে চালিত হয়েছি। আমরা তােমার কাছে নিজেদের নির্দোষিতা ব্যক্ত করতাে না।’ ওরা মূর্তি ও তােমার রকমারি সৃষ্টির উপাসনা করতাে। আমরা নিজেদের তাদের মাবুদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করিনি এবং তারাও আমাদের উপাসনা করেনি। এই পর্যায়ে এসে তারা যাদের আল্লাহর সাথে শরীক করতাে, তাদের প্রসংগে বক্তব্য রেখে অপমান করা হয়েছে। ‘আর বলা হবে, তােমাদের শরীকদের ডাকো…’ অর্থাৎ তাদের চরিত্র উদঘাটন না করে পালিও না। তাদের ডাকো। তারা তােমাদের উদ্ধার করুক। কেননা আজ তাদেরই দিন এবং তাদের কাছ থেকেই উপকার গ্রহণের দিন। সেদিন দুর্গত লােকেরা জানবে যে, ওদের ডেকে কোনাে লাভ নেই, কিন্তু তারা বাধ্য হয়ে এই আদেশ মান্য করবে এবং ডাকবে, ‘অতপর তারা তাদের ডাকবে। কিন্তু তারা সেই ডাকে কোনই সাড়া দেবে না।’ সাড়া যে দেবে না তা জানাই থাকবে। কেবল তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করার জন্যেই এই আদেশ দেয়া হবে। আর তারা আযাব দেখবে। অর্থাৎ এই সংলাপের মধ্যে আযাব দেখতে পাবে। এই সংলাপের পর আযাব ছাড়া আর কিছু থাকবে না। এই চরম মুহূর্তে ইতিপূর্বে তারা যে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিলাে, তাদের কাছে তা পেশ করা হবে, কিন্তু তখন সেটা হবে নিতান্তই অনুশােচনার ব্যাপার। তখন তা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের কোনােই অবকাশ থাকবে না। অথচ দুনিয়ার জীবনে তা গ্রহণ করার অবকাশ ছিলাে। তারা আক্ষেপ করবে যদি তারা হেদায়াত গ্রহণ করো তবে ভালাে হতাে। এরপর পুনরায় তাদের সেই আতংকজনক দৃশ্যপটে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে, ‘সেদিন আল্লাহ তাদের ডাকবেন এবং বলবেন, তােমরা রসূলদের কী জবাব দিয়েছিলো। তারা কী জবাব দিয়েছিলাে সেটা আল্লাহর জানাই আছে। তথাপি এ প্রশ্নটা করা হয়েছে ধমক দেয়া ও অপমান করার উদ্দেশ্যে। কাফেররা এ প্রশ্নের জবাবে নীরব থাকবে। কেননা তারা থাকবে বিপন্ন এবং এর জবাব দেয়ার সাধ্যই তাদের থাকবে না। ‘সেদিন তাদের কাছ থেকে সকল তথ্য অন্ধে (উধাও) হয়ে যাবে। ফলে তারা পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে না।’ এখানে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে গােটা দৃশ্যপট ও তার কর্মকান্ডের ওপর অন্ধত্বের ভাব ফুটে ওঠেছে, যেন তথ্যগুলােই অন্ধ। তাই তাদের কাছে পৌছতে পারে না। আর তারা কোনাে কিছুই জানতে পারে না এবং পরস্পরের সাথে প্রশ্নোত্তরের আদান প্রদান করতে পারে । এ জন্যে তারা দিশেহারা ও নিশ্চুপ। ‘তবে যারা তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে, তারা অচিরেই সফলকাম হবে।’ এ হচ্ছে বিপরীত দৃশ্য। একদিকে মােশরেকদের দুর্দশা যখন চরম, তখন তাওবাকারী, ঈমান আনয়নকারী ও সৎকর্মশীলদের সাফল্য সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। আর এ পথ অবলম্বনে সকলেরই স্বাধীনতা রয়েছে।

*আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা : পরবর্তী ক’টা আয়াতে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর সব কিছুর নির্ভরশীলতা বর্ণনা করা হয়েছে । কেননা তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেন। তিনিই সব কিছু জানেন। দুনিয়া আখেরাতে সব কিছুরই চূড়ান্ত পরিণতি তার হাতে নিবদ্ধ। আদি অন্তে সমস্ত প্রশংসা তারই প্রাপ্য। পৃথিবীতে তারই সার্বভৌমত্ব এবং তাঁরই সর্বময় কর্তৃত্ব বিরাজ করে, তার কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে। আল্লাহর বান্দাদের কোনই ক্ষমতা ও অধিকার নেই নিজেদের এবং অন্যদের জন্যে কোনাে কিছু নির্ধারণ করার। এ ক্ষমতা শুধু আল্লাহর। ৬৮ থেকে ৭০ পর্যন্ত আয়াতগুলাে দ্রষ্টব্য। কাফেরদের ‘তােমার আনীত হেদায়াতের বাণীর অনুসরণ করলে আমরা আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে যাবাে,’ এই উক্তি উদ্ধৃত করার পর এবং কেয়ামতের দিন তাদের শিরক ও বিপথগামিতার যে পরিণতি হবে, তা পর্যালােচনার পর এ আয়াতগুলােতে এই কথাগুলাে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তারা নিজেদের জন্যে কোনাে নির্বাচনের ক্ষমতাই রাখে না যে, ভীতি কিংবা নিরাপত্তা নির্বাচন করবে। এতে আরাে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা এক এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ‘তােমার প্রভু যা কিছু চান সৃষ্টি করেন এবং নির্বাচন করেন। তাদের কোনাে নির্বাচনের ক্ষমতাই নেই।’ এটা এমন এক বাস্তব সত্য, যা অনেকেই সম্পূর্ণরূপে অথবা আংশিকভাবে ভুলে যায় । আল্লাহতায়ালা যা কিছু ইচ্ছা করেন স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করেন, কেউ তাকে পরামর্শ বা প্রস্তাব দিতে পারে না, কেউ তার সৃষ্টিতে কম বেশী করতে কিংবা পরিবর্তন ও সংশােধন করতে পারে না। তার সৃষ্টির মধ্য থেকে তিনি যাকে ইচ্ছা করেন যে কোনাে কাজ বা পদমর্যাদার জন্যে মনােনীত করেন। কেউ তাঁর কাছে কোনাে ব্যক্তির পক্ষে বা কোনাে বিশেষ ঘটনা ঘটানাের জন্যে কথা বা কাজের মাধ্যমে সুপারিশ করতে পারে না। ‘তাদের কোনােই নির্বাচনী ক্ষমতা নেই।’ অর্থাৎ নিজের ব্যাপারেও নয়, অন্যের ব্যাপারেও নয়, ছােট বড় সকল ব্যাপারেই আল্লাহ তায়ালাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এই বাস্তব সত্য যদি মানুষের মনে বদ্ধমূল থাকে, তাহলে মানুষ তার কোন বিপদ মুসিবতেই উদ্বিগ্ন হতে পারে না, কোনাে সুখকেই সে বড়াে কিছু মনে করতে পারে না, কোন কাংখিত জিনিস হারিয়ে সে দুঃখিত হতে পারে না। কেননা এ সব জিনিস নির্ধারণের ব্যাপারে তাদের কোনাে হাত নেই, হাত শুধু আল্লাহর। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে, মানুষ তার বিবেক বুদ্ধির চর্চা, ইচ্ছাশক্তির প্রয়ােগ ও চেষ্টা সাধনা বন্ধ করে দেবে। এর অর্থ এই যে, মানুষ তার সাধ্যমতাে চিন্তা গবেষণা, পরিকল্পনা, চেষ্টা-সাধনা ও সিদ্ধান্ত প্রয়ােগ করার পর তার ভাগ্যে যা ঘটবে, তা সর্বান্তকরণে মেনে নেবে। কেননা মানুষের হাতে শুধু চেষ্টা-সাধনার ক্ষমতাই রয়েছে। এরপর সব কিছু আল্লাহর হাতে। মােশরেকরা তাদের কল্পিত দেবদেবীকে আল্লাহর সাথে শরীক করতাে। অথচ আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র স্রষ্টা ও সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তার সৃষ্টিতে ও ক্ষমতায় কেউ তার শরীক নেই। আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল শিরকের ঊর্ধ্বে ও তা থেকে পবিত্র।’ ‘আর তােমার প্রভু তাদের ভেতরে লুকানাে বা প্রকাশিত সব কিছুই জানেন। তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি যা জানেন সে অনুসারে তাদের কর্মফল দেবেন। তারা যে জিনিসের যােগ্য, তা-ই তিনি তাদের জন্যে মনােনীত করবেন। গােমরাহীর যােগ্য হলে গােমরাহী এবং সৎপথের যোগ্য হলে সৎপথ দেখাবেন। ‘তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা যিনি ছাড়া আর কোনাে ইলাহ নেই।’ সুতরাং তার সৃষ্টিতে ও মনােনয়নে তার কোনাে শরীক নেই। আদি ও অন্তে একমাত্র তাঁরই জন্য সকল প্রশংসা। তার নির্বাচন ও মনােনয়ন, তার নেয়ামত, তার দক্ষতা ও নৈপুণ্য এবং তার সুবিচার ও দয়ার জন্যে তার সমস্ত প্রশংসা। একমাত্র তিনিই প্রশংসার যােগ্য। একমাত্র তিনিই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। তার বান্দাদের ব্যাপারে তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কেউ তা রদও করতে পারে না, বদলাতেও পারে না। এবং তার কাছেই তােমরা ফিরে যাবে।’ তখন তিনিই তােমাদের মধ্যে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করবেন।’ এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সৃষ্টিজগতের ওপর তার সর্বময় ক্ষমতা, একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ইচ্ছা করার ক্ষমতা এবং গােপন ও প্রকাশ্য সব ব্যাপারে অবগত থাকার অনুভূতি ও চেতনা দান করেন। বান্দাদের কোনাে কিছুই তার অজানা থাকে না। তার কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে, কেউ পালাতে পারবে না। সুতরাং তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যখন কেউ যেতে পারে না তখন তার সাথে অন্যকে শরীক করার কী যুক্তি থাকতে পারে।

*প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন : এরপর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে প্রকৃতির বিভিন্ন দৃশ্য অবলােকন করান। এই প্রকৃতিতেই তারা বাস করে। অথচ এখানে আল্লাহ তায়ালা কিভাবে তাদের জন্যে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা করে চলেছেন এবং তাদের জীবন যাপন ও আয় উপার্জনের জন্যে বিভিন্ন পন্থা নির্বাচন করছেন, সে সম্পর্কে একেবারেই তারা উদাসীন। বিশেষত দুটো বড় বড় প্রাকৃতিক ঘটনা- রাত ও দিনের অন্তরালে আল্লাহর একত্বের যে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, সে সম্পর্কে তাদের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছেন। ‘বলাে, তােমরা কি ভেবে দেখেছাে আল্লাহ তায়ালা যদি রাতকে তােমাদের ওপর কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করতেন…'(আয়াত ৭১-৭৩) মানুষ যেহেতু দিন ও রাতের আগমন দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই দিন রাতের এই পুন পুন আবির্ভাব ও তিরােভাব সে ভুলে যায়। সূর্যের উদয়াস্তের দৃশ্য তাকে তেমন বিস্মিত করে না। রাতের বিদায় ও দিনের আগমন তাকে রােমাঞ্চিতও করে না। এভাবে আবহমানকাল ধরে দিন ও রাতের আবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি যে আল্লাহর কতাে দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষিত হচ্ছে এবং ক্ষয়, ধ্বংস, নিদ্রিয়তা, জড়তা ও স্থবিরতা প্রতিহত করা হচ্ছে, তা সে ভেবে দেখে না। কোরআন মানুষকে একটা ভিন্নতর অবস্থার কথা কল্পনা করার আহ্বান জানায়। যদি রাত চিরস্থায়ী হতাে অথবা দিন চিরস্থায়ী হতাে, তা হলে কেমন হতাে ভেবে দেখার আহ্বান জানায়। কল্পিত এই উভয় অবস্থার ফলাফল সম্পর্কে তাকে আতংকিত করে তােলে। এভাবে সে তার দিনরাতের আবর্তনের চিরাচরিত দৃশ্য দর্শনে অভ্যস্ততাজনিত একঘেঁয়েমি ও জড়তা দূর করে। চার পাশের প্রকৃতি ও তার গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যসমূহের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ জন্যেই সে এই কল্পনার আশ্রয় নেয়। কারণ মানুষ কোনাে জিনিস না হারানাে পর্যন্ত অথবা হারানাের আশংকা বােধ না করা পর্যন্ত তার মূল্য বােঝে না। বলা হয়েছে, ‘বলাে, তােমরা কি ভেবে দেখেছো, আল্লাহ তায়ালা যদি রাতকে তােমাদের ওপর কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করেন তাহলে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোন মাবুদ তােমাদের আলাে এনে দেবে? তােমরা কি শুনতে পাও না?’ শীতকালে রাত সামান্য একটু লম্বা হয়ে যায়। তাতেই মানুষ প্রভাত দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ক্ষণিকের জন্যে সূর্য মেঘে ঢাকা পড়লে মানুষ অস্থির হয়ে ভাবতে থাকে, কখন সূর্যের কিরণ আবার বেরিয়ে আসবে। আর এই কিরণ যদি চিরতরেই চলে যায় এবং কেয়ামত পর্যন্ত রাত স্থায়ী হয়, তাহলে উপায়? এ প্রশ্ন তাে রাখা হয়েছে সকল মানুষ কেয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকবে ধরে নিয়ে । নচেত দিন যদি একেবারেই না আসে, তাহলে তাে এ পৃথিবীতে কোনাে জীবের বেঁচে থাকাই আদৌ সম্ভব নয়। পুনরায় বলা হয়েছে, ‘বলাে, আল্লাহ তায়ালা যদি দিনকে তােমাদের ওপর কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তাহলে তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ তােমাদের বিশ্রামের জন্যে রাত নিয়ে আসবে। তােমরা কি দেখতে পাও না?'[ যখন রাতের চিরস্থায়ী হওয়ার কথা বলেছেন তখন বলেছেন, ‘তোমরা কি শুনতে পাও না?’ আর যখন দিনের চিরস্থায়ী হওয়ার উল্লেখ করেছেন তখন বলেছেন, ‘তোমরা কি দেখতে পাও না?’ এর কারণ এই যে, রাতের বেলা শ্রবণেনিন্দ্রয়ের কাজই প্রধান। আর দিনের বেলা দর্শনেন্দ্রিয়ের কাজ প্রধান। এটা কোরআনের ভাষাগত শৈল্পিক নৈপুণ্যের একটা উল্লেখযােগ্য দিক ] দিনের বেলায় যখন দুপুরের খরতাপ অতিরিক্ত কয়েক ঘন্টা দীর্ঘ হয়, তখন মানুষ ছায়ার জন্যে কেমন উদগ্রীব হয়ে ওঠে এবং গ্রীষ্মের সময় যখন দিন কয়েক ঘন্টা লম্বা হয়, তখন মানুষ রাতের জন্যে কেমন অস্থির হয়ে ওঠে, তা আমাদের সবার জানা আছে। এ সময় রাতের আধার ও নিস্তব্ধতাই হয়ে ওঠে বিশ্রাম এবং আশ্রয়ের প্রধান অবলম্বন। আসলে শুধু মানুষের নয়, বরং প্রাণী মাত্রেরই রাতের বিশ্রামের প্রয়ােজন। দিনের বেলার পরিশ্রমে যে শক্তি ক্ষয় হয় রাতের বিশ্রামে সেই শক্তি পুনর্বহাল হয়। মানুষকে যদি কেয়ামত পর্যন্ত জীবিত ধরে নেয়া হয় এবং দিন যদি কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হয়, তাহলে সে কিভাবে বিশ্রাম নেবে ও হারানাে শক্তি পুনরুদ্ধার করবে। প্রকৃতপক্ষে দিন যদি কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হয়, তাহলে এই জীবজগত সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য। আসলে প্রতিটা বস্তু সুপরিকল্পিত এবং মহাবিশ্বের ছােট বড় সকল জিনিসই নিয়ন্ত্রিত। সকল জিনিসেরই একটা নির্দিষ্ট মাত্রা ও পরিমাণ আল্লাহ তায়ালা ধার্য করে রেখেছেন। ‘এটা আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তােমাদের বিশ্রামের জন্যে রাত এবং আল্লাহর রবাদ্দকৃত অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করার জন্যে দিন সৃষ্টি করেছেন। যাতে তােমরা কৃতজ্ঞ হও।’ বস্তুত রাত বিশ্রাম ও আরামের সময় আর দিন কাজের এবং আল্লাহর অনুগ্রহ খোজার সময়। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যা কিছুই দেন তা তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছু নয়। ‘যাতে তােমরা কৃতজ্ঞ হও।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যে রহমত ও নেয়ামত দিয়ে তােমাদের খুশি করেন, রাত দিনের আবর্তনের ব্যবস্থা করে এবং জীবনের অন্য সকল উপকরণ সরবরাহ করে যে অনুগ্রহ করেন তার জন্যে কৃতজ্ঞ হও। এসব উপকরণ তােমরা সংগ্রহ করতে পারোনি। আল্লাহ তায়ালা নিজেই তার অনুগ্রহ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা এগুলাে সরবরাহ করেছেন। অথচ তােমরা এগুলাে ক্রমাগত দেখতে দেখতে ও ভােগ করতে করতে তাঁর সেই অনুগ্রহ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা ভুলে যাও, উদাসীন হয়ে যাও। আল্লাহ তায়ালা এই অধ্যায়ের সমাপ্তি টানছেন অতি সংক্ষেপে কেয়ামতের একটা দৃশ্য তুলে ধরে, তাদের কল্পিত শরীকদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে এবং তাদেরকে তাদের ভিত্তিহীন দাবী দাওয়ার মুখােমুখি করে এ বক্তব্য সমাপ্ত করছেন। কেয়ামতের সেই কঠিন দিনে তাদের কল্পিত সেসব শরীক তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে যাবে। ‘যেদিন আল্লাহ তায়ালা মােশরেকদের সম্বােধন করবেন এবং বলবেন, তােমাদের কল্পিত আমার সেই শরীকরা আজ কোথায়? আজ আমি প্রত্যেক জাতির মধ্য থেকে একজন সাক্ষী হাযির করবাে তারপর বলবাে, তােমাদের প্রমাণ নিয়ে এসাে। তাদের কল্পিত মিথ্যা শরীকরা (তখন) উধাও হয়ে যাবে।’ কেয়ামতের দিনের এই সম্বােধন ও শরীক সংক্রান্ত প্রশ্নের বিবরণ পূর্ববর্তী একটা সূরায় এসেছে। এখানে একটা নতুন দৃশ্য তুলে ধরার কারণে সে বিবরণের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এখানকার এই নতুন দৃশ্য হল প্রত্যেক জাতির মধ্য থেকে একজন সাক্ষী হাযির করা সম্বলিত। এই সাক্ষী তাদের নবী, সে জাতি তার দাওয়াতে কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলাে সে সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবেন। ‘আন্-নাযয়ু’ শব্দের অর্থ হলাে প্রচন্ড জোরে কোনাে কিছুকে নাড়ানাে। এখানে এ শব্দটা দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, তাদের নবীকে তাদের মধ্য থেকে বের করে এনে খুবই লক্ষণীয় করে দাঁড় করানাে হবে- যাতে তার জাতি সম্পর্কে তিনি এবং তার সম্পর্কে তার জাতি সাক্ষ্য দিতে পারে। আর এই সাক্ষীর সামনেই তাদের কাছ থেকে তাদের আকীদা ও কর্ম সম্পর্কে প্রমাণ এবং সনদ চাওয়া হবে, কিন্তু তারা কোনাে সনদ দেখাতে পারবে না। সেদিন সনদ ছাড়া গলাবাজি করারও কোনাে সুযােগ থাকবে না, ‘অতপর তারা জানবে যে, সত্য কেবল আল্লাহর জন্যে’ অর্থাৎ সমস্ত সত্য নির্ভেজালভাবে আল্লাহর জন্যে এতে কোনাে সন্দেহ নেই। ‘তাদের কল্পিত মিথ্যে শরীকরা সব তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে যাবে’ অর্থাৎ প্রয়ােজনের সময় তারাও তার কাজে লাগবে না। আর তিনিও তাদের কোনাে উপকার করতে পারবেন না। এখানে ফেরাউন ও হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনীর পর্যালােচনা শেষ হচ্ছে, এ পর্যালােচনা শ্রোতার মন ও বিবেককে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী, দৃশ্যাবলী এবং সংশ্লিষ্ট জগতগুলােতে টেনে নিয়ে যায়, দুনিয়া থেকে আখেরাতে ও আখেরাত থেকে দুনিয়ায় ফিরিয়ে নেয়। এ পর্যালােচনা মানুষকে প্রকৃতির বিভিন্ন দিক, মানব সত্ত্বার অন্তর্নিহিত অংশ, অতীত জাতিগুলাের ধ্বংস বৃত্তান্ত এবং জীবন ও জগতের বিধি বিধান সম্পর্কে বহু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্য অবহিত করে। সেই সাথে সে সূরার মূল আলােচ্য বিষয়ের সাথে এগুলাের সমন্বয় ঘটায়। সমন্বয় ঘটায় সূরার প্রধান দুটো কাহিনীর সাথেও। একটা হলাে হযরত মূসার কাহিনী এবং অপরটা কারুনের কাহিনী। প্রথমটা তাে অলৌকিকভাবে সংঘটিত হয়েছে। এবার আমরা দ্বিতীয়টা নিয়ে আলােচনা করতে যাচ্ছি।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৬২-৬৭ নং আয়াতের তাফসীর:

আয়াতগুলোতে মূলত কাফির-মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলাকে ব্যতীত তাঁর সাথে অন্যান্য যেসকল উপাস্যদেরকে আহ্বান করত, আর এ কারণে কাল কিয়ামতের মাঠে তারা কি পরিমাণ লাঞ্ছিত ও হেয় প্রতিপন্ন হবে সে কথাই বলা হচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা ঐ সমস্ত লোকদেরকে তিরস্কারের সাথে জিজ্ঞাসা করবেন, তোমাদের ঐ সকল মা‘বূদ কোথায়? যাদেরকে তোমরা আমার পরিবর্তে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিলে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَا نَرٰي مَعَكُمْ شُفَعَا۬ءَكُمُ الَّذِيْنَ زَعَمْتُمْ أَنَّهُمْ فِيْكُمْ شُرَكٰٓؤُا ط لَقَدْ تَّقَطَّعَ بَيْنَكُمْ وَضَلَّ عَنْكُمْ مَّا كُنْتُمْ تَزْعُمُوْنَ)

“তোমরা যাদেরকে তোমাদের ব্যাপারে শরীক মনে করতে তোমাদের সেই সুপারিশকারিগণকেও তোমাদের সাথে দেখছি না; তোমাদের মাঝে সম্পর্ক অবশ্যই ছিন্ন হয়েছে এবং তোমরা যা ধারণা করেছিলে তাও নিষ্ফল হয়েছে।” (সূরা আন‘আম ৬:৯৪)

এমনকি তাদেরকে বলা হবে, তারা যেন তাদের ঐ সকল ভ্রান্ত মা‘বূদদেরকে ডেকে নিয়ে আসে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَيَوْمَ يَقُوْلُ نَادُوْا شُرَكَا۬ئِيَ الَّذِيْنَ زَعَمْتُمْ فَدَعَوْهُمْ فَلَمْ يَسْتَجِيْبُوْا لَهُمْ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمْ مَّوْبِقًا – وَرَأَي الْمُجْرِمُوْنَ النَّارَ فَظَنُّوْآ أَنَّهُمْ مُّوَاقِعُوْهَا وَلَمْ يَجِدُوْا عَنْهَا مَصْرِفًا)‏

“এবং সেদিনের কথা স্মরণ কর‎, যেদিন তিনি বলবেন, ‘তোমরা যাদেরকে আমার শরীক মনে করতে তাদেরকে আহ্বান কর‎।’ তারা তখন তাদেরকে আহ্বান করবে কিন্তু তারা তাদের আহ্বানে সাড়া দিবে না এবং তাদের উভয়ের মধ্যস্থলে রেখে দিব এক ধ্বংস-গহ্বর। অপরাধীরা আগুন দেখে বুঝবে যে, তারা তথায় পতিত হবে এবং তারা সেখান হতে কোন পরিত্রাণস্থল পাবে না।” (সূরা কাহ্ফ ১৮:৫২-৫৩)

কিন্তু ঐ সকল বাতিল মা‘বূদগুলো তাদের ভক্তদের কথা কিয়ামতের মাঠে অস্বীকার করবে। এমনকি তারা একে অপরের শত্র“তে পরিণত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَاتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ اٰلِهَةً لِّيَكُوْنُوْا لَهُمْ عِزًّا لا- كَلَّا ط سَيَكْفُرُوْنَ بِعِبَادَتِهِمْ وَيَكُوْنُوْنَ عَلَيْهِمْ ضِدًّا)

“তারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য অনেক ইলাহ্ গ্রহণ করেছে এজন্য যাতে তারা তাদের সহায় হয়; কখনই নয়; তারা অচিরেই তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে এবং তাদের বিরোধী হয়ে যাবে।” (সূরা মারইয়াম ১৯:৮১-৮২)

অতএব দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলাকে ছেড়ে যাদেরই ইবাদত করা হোক না কেন তারা আখিরাতে কারো কোন উপকার করতে পারবে না। বরং একে অপরের শত্র“তে পরিণত হবে।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর একত্বের কথা বর্ণনা করার পর রাসূলের নবুওয়াতের কথা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা আমার রাসূলগণের ডাকে কি সাড়া দিয়েছিলে? তাঁকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলে, না মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলে? তখন তারা কোন উত্তরই দিতে পারবে না। তবে যারা ঈমান আনবে তাদের কথা ভিন্ন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না।
২. যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ছাড়া অন্যদের ইবাদত করত তারা কোন উপকার করতে পারবে না।
৩. যাদের ইবাদত করা হত এবং যারা ইবাদত করত তারা পরস্পরে শত্র“তে পরিণত হবে।
৪. মু’মিনগণ আখিরাতে সফলকাম হবে।
৬৮-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:

প্রথম আয়াতে বর্ণনা করা হচ্ছে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টিকর্তা। তিনি ব্যতীত অন্য আর কেউ সৃষ্টিকর্তা নেই এবং সমস্ত আধিপত্যও তাঁরই। কারো কোন অধিকার নেই। তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সুতরাং তিনি যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন তাই সৃষ্টি করে থাকেন, তিনি যাকে ইচ্ছা নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করেন। মক্কার মুশরিকরা বলে, মুহাম্মাদ ছাড়া অন্য কাউকে রিসালাত দেয়া হল না কেন? আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَقَالُوْا لَوْلَا نُزِّلَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ عَلٰي رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيْمٍ)‏

“এবং তারা বলে: এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হল না দুই জনপদের কোন প্রভাবশীল ব্যক্তির ওপর?” (সূরা যুখরূফ ৪৩:৩১)

অতএব আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তাকেই নবুওয়াত দিয়ে থাকেন, এখানে কারো কোন হাত নেই।

(وَرَبُّكَ يَعْلَمُ مَا تُكِنُّ صُدُوْرُهُمْ وَمَا يُعْلِنُوْنَ)

আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সকল বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন। এমনকি তারা যা কিছু গোপন করে তাও। এ সম্পর্কে সূরা নামলের ৭৪-৭৫ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন, তিনিই একমাত্র মা‘বূদ, তিনি ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই। তাই একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে হবে। আর দুনিয়া ও আখিরাতে সর্বাবস্থায় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার এবং বিধানও চলবে একমাত্র তাঁর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلّٰهِ)

“বিধান দেয়ার কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহরই।” (সূরা আন‘আম ৬:৫৭)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কোন সৃষ্টিকর্তা ও উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র ইবাদতের যোগ্য, অন্য কেউ নয়।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের গোপন ও প্রকাশ্য সকল বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন।
৩. সর্বাবস্থায় কেবল আল্লাহ তা‘আলারই প্রশংসা করতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কারো কোন বিধান চলবে না। আর পরিশেষে মানুষকে তাঁর দিকেই ফিরে যেতে হবে।
৭১-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর:

উক্ত আয়াতগুলোতে মূলত আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা ও মানব জাতির প্রতি তাঁর দয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি দিন ও রাতকে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন, চাইলে তা না করে কিয়ামত পর্যন্ত শুধু দিনকেই স্থায়ী করে রাখতে পারতেন। কিংবা রাতকে স্থায়ী করে রাখতে পারতেন। শুধু দিনকে স্থায়ী করলে মানুষের জীবন ক্লান্ত, শ্রান্ত ও দুঃখময় হয়ে পড়ত। আবার শুধু রাতকে স্থায়ী করলে মানুষের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যেত। তাই এরূপ যাতে না হয় সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা দিন ও রাত উভয়কেই পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং দিন-রাত্রির আবর্তন মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার একটি অনুগ্রহ। যাতে করে তারা আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَهُوَ الَّذِيْ جَعَلَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ خِلْفَةً لِّمَنْ أَرَادَ أَنْ يَّذَّكَّرَ أَوْ أَرَادَ شُكُوْرًا)‏

“তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত এবং দিনকে পরস্পরের অনুগামীরূপে তার জন্যন যে উপদেশ গ্রহণ করতে ও কৃতজ্ঞ হতে চায়।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬২)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য দ্বিতীয় কোন মা‘বূদ নেই যার উপাসনা করা যায়।
২. সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করতে হবে।
৩. আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা সম্পর্কে জানা গেল।

৭৪-৭৫ নং আয়াতের তাফসীর:

দুনিয়াতে যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশীদার স্থাপন করতঃ অন্যান্য মাবুদের কাছে সাহায্য কামনা করে প্রার্থনা করত, ইবাদত করতন তাদেরকে আখিরাতে আল্লাহ তা‘আলা ডেকে বলবেন, তোমরা যাদের ইবাদত করতে, যাদের কাছে সাহায্য চাইতে তারা আজ কোথায়? অর্থাৎ সেদিন তারা উধাও হয়ে যাবে, ক্ষতি ছাড়া কোন উপকার করতে পারবে না।

অর্থাৎ যখন সকল যুগের মুশরিক ও তাদের মা‘বূদ উপস্থিত হবে তখন প্রত্যেক মিথ্যুক ও মুশরিক জাতি থেকে তাদের একজন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা ডেকে নিয়ে আসবেন। দুনিয়াতে তারা যে শির্ক ও ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ করত সে সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: শির্কী কাজ করা সঠিক তোমাদের এ কথার স্বপক্ষে দলীল নিয়ে এসো, আমি কি তোমাদেরকে এরূপ নির্দেশ দিয়েছিলাম? রাসূলগণ কি তোমাদেরকে এরূপ নির্দেশ দিয়েছিল? আমার নাযিল করা কোন কিতাবে তা পেয়েছো? তখন তারা বুঝতে পারবে তাদের কাজকর্ম সব বাতিল ছিল, আল্লাহ তা‘আলা যা বলেছিলেন, তাই সত্য। সুতরাং সেদিন তাদের থেকে তাদের বানানো মা‘বূদেরা উধাও হয়ে যাবে। কোন উপকার করতে পারবে না। এ সম্পর্কে অত্র সূরার ৬২-৬৪নং আয়াতসহ পূর্বে অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, কোন্ প্রমাণের ভিত্তিতে তারা শির্ক করেছে।
২. আল্লাহ তা‘আলা, নাবী-রাসূলগণ ও কোন আসমানী কিতাব মানুষ জাতিকে শির্কের নির্দেশ দেয়নি। বরং সবাই এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের কথা বলেছেন।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ ভাষণটিও চতুর্থ জবাবের সাথেই সংশ্লিষ্ট। উপরের আয়াতের শেষ অংশের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, নিছক নিজেদের পার্থিব স্বার্থের খাতিরে শিরক, মূর্তিপূজা ও নবুওয়াত অস্বীকারের যে গোমরাহীর ওপর তারা জোর দিচ্ছে, তার জন্য আখেরাতের চিরন্তন জীবনে তাদের কেমন অশুভ পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে। যে অনুভূতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে একথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, মনে করো, দুনিয়ায় তোমাদের কোন বিপদের সম্মুখীন হতে না হলেও এবং এখানকার সংক্ষিপ্ত জীবনকালে তোমরা দুনিয়ার জীবনের সম্পদ ও সৌন্দর্য খুব বেশি উপভোগ করলেও যদি আখেরাতে এর পরিণাম খারাপ হওয়াই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে নিজেই ভেবে দেখো তোমরা যা কিছু করছো তা লাভজনক ব্যবসায় না ক্ষতির ব্যবসায়?
# এখানে জিন ও মানবজাতির শয়তানদের কথা বলা হয়েছে, যাদেরকে দুনিয়ায় আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়েছিল, যাদের কথার মোকাবিলায় আল্লাহও রসূলের কথা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল এবং যাদের ওপর ভরসা করে সরল সঠিক পথ পরিত্যাগ করে জীবনের ভুল পথ অবলম্বন করা হয়েছিল। এ ধরণের লোকদের কেউ ইলাহ ও রব বলুক বা না বলুক মোট কথা যখন তাদের আনুগত্য এমনভাবে করা হয়েছে যেমন আল্লাহর আনুগত্য হওয়া উচিত। তখন অবশ্যই তাদেরকে আল্লাহর সার্বভৌম কতৃর্ত্বে শরীক করা হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আল কাহ্‌ফ ৫০ টীকা)
# আমরা জোর করে এদেরকে গোমরাহ করিনি। আমরা এদের দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তি ছিনিয়ে নিইনি। এদের চিন্তা ও অনুধাবন শক্তিও কেড়ে নিইনি এবং এমন অবস্থারও সৃষ্টি করিনি যে, এরা সঠিক পথের দিকে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু আমরা হাত ধরে টেনে জোর করে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিলাম। বরং আমরা যেমন স্বেচ্ছায় ভুল পথ অবলম্বন করেছিলাম, তেমনি এদের সামনেও আমরা ভুল পথ পেশ করেছিলাম এবং এরা স্বেচ্ছয় তা গ্রহণ করেছিল। কাজেই আমরা এদের দায়িত্ব গ্রহণ করছি না। আমরা নিজেদের কাজের জন্য দায়ী এবং এরা এদের নিজেদের কাজের জন্য দায়ী।

এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় প্রণিধানযোগ্য। সেটি হচ্ছে আল্লাহ‌ যদিও প্রশ্ন করবেন যারা শরীক করতো তাদেরকে। কিন্তু তারা কিছু বলার আগেই জবাব দিতে আরম্ভ করবে তাদের সেই উপাসিতরা যাদেরকে শরীক করা হয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে, যখন সাধারণ মুশরিকদেরকে এ প্রশ্ন করা হবে তখন তাদের নেতৃবর্গ অনুভব করবে, এবার আমাদের সর্বনাশের পালা এসে গেছে এবং আমাদের সাবেক অনুসারীরা নিশ্চয়ই এবার বলতে শুরু করবে এরাই আমাদের পথভ্রষ্টতার জন্য মূলত দায়ী। তাই অনুসারীদের বলার আগেই তারা নিজেরাই এগিয়ে গিয়ে নিজেদের সাফাই পেশ করতে থাকবে।
# এরা আমাদের নয় বরং এদের নিজেদেরই প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে গিয়েছিল।
# তাদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকো, দুনিয়ায় তোমরা তাদের প্রতি নির্ভর করে আমার কথা রদ করে দিয়েছিলে। এখন এখানে তাদেরকে আসতে, তোমাদের সাহায্য করতে বলো এবং তোমাদেরকে আযাব থেকে বাঁচাতে বলো।
# আসলে শিরককে খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে এ উক্তি করা হয়েছে। মুশরিকরা আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টিকে তাদের উপাস্য পরিণত করেছে। নিজেদের পক্ষ থেকে তাদেরকে বিভিন্ন মর্যাদা, পদ ও গুণাবলী দান করা করেছে। এর প্রতিবাদ করে আল্লাহ‌ বলছেন, আমার সৃষ্ট মানুষ, ফেরেশতা, জিন ও অন্যান্য বান্দাদের মধ্য থেকে আমি নিজেই যাকে যেমন চেয়েছি গুণাবলী, যোগ্যতা ও শক্তি দান করেছি এবং যার মাধ্যমে যে কাজ নিতে চাই নিয়ে থাকি। কাজেই আমার বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে নিজেদের ইচ্ছা মতো বিপদ থেকে উদ্ধারকারী, অন্নদাতা ও ফরিয়াদ শ্রবণকারী ইত্যাদি মনে করার অধিকার মুশরিকরা কেমন করে ও কোথা থেকে লাভ করলো? কিভাবে তারা যাকে ইচ্ছা তাকে বৃষ্টি বর্ষণ, রুজি-রোজগার ও সন্তান দান এবং রোগ ও রোগ নিরাময় করার ক্ষমতা অর্পণ করে? কেমন করে তারা যাকে ইচ্ছা তাকে আমার সার্বভৌম কর্তৃত্বাধীন এলাকার একটি অংশের শাসনকর্তা নিয়োগ করে? আমার ক্ষমতার মধ্য থেকে যা কিছু যাকে চায় তাকে তারা কেমন করে সোপর্দ করে? কেউ ফেরেশতা, জিন, নবী বা অলী যাই কিছু থাক আমার সৃষ্টির কারণেই আছে। যে গুণাবলীই যে কেউ লাভ করেছে তা আমারই দান। যাকে আমি যে কাজে লাগাতে চেয়েছি লাগিয়ে দিয়েছি। তাদেরকে বিভিন্ন কাজের জন্য এভাবে নির্বাচিত করার এ অর্থ কেমন করে হয়ে গেলো যে, এ বান্দাদেরকে বন্দেগীর স্থান থেকে উঠিয়ে খোদায়ী মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে হবে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিতে হবে, তাদেরকে সাহায্য দান করার জন্য ডাকতে হবে, অভাব পূরণ করার জন্য তাদের কাছে আবেদন জানাতে হবে, তাদেরকে ভাগ্য ভাঙা-গড়ার মালিক এবং আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতার অধিকারী আখ্যায়িত করতে হবে?
# চলমান ভাষণের মধ্যে যে উদ্দেশ্যে একথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, কোন ব্যক্তি বা দল দুনিয়ার মানুষের সামনে এ দাবী করতে পারে যে, সে যে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তার ভ্রান্তিহীনতার ব্যাপারে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণে সে নিশ্চিন্ত এবং তার বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি প্রমাণ পেশ করা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে সে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আর এ গোমরাহীকে সে কোন অসৎ উদ্দেশ্যে নয় বরং পুরোপুরি সৎ উদ্দেশ্যে অবলম্বন করেছে এবং তার সামনে কখনো এমন কোন জিনিস আসেনি যার সাহায্যে তার ভুল তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু আল্লাহর সামনে তার এ দাবী চলতে পারে না। তিনি কেবল বাইরেরটা দেখেন না। তাঁর সামনে তো মানুষের মন ও মস্তিস্কের এক একটি অংশ উন্মুক্ত হয়ে আছে। তিনি তাঁর জ্ঞান, অনুভূতি, আবেগ, আকাংখা, সংকল্প, বিবেক তথা প্রত্যেকটি জিনিস সরাসরি জানেন। তিনি জানেন, কোন্‌ ব্যক্তিকে কোন্‌ কোন্‌ সময় কোন্‌ কোন্‌ পন্থায় সতর্ক করা হয়েছে, কোন্‌ কোন্‌ পথে তার কাছে সত্য পৌঁছেছে এবং কোন্‌ কোন্‌ পথে বাতিলের বাতিল হওয়ার বিষয়টি তার কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে মূল কারণগুলোর ভিত্তিতে সে হক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের গোমরাহীকে প্রাধান্য দিয়েছিল সেগুলো কি ছিল তাও তিনি জানেন।
# নবী, যিনি সংশ্লিষ্ট উম্মতকে সতর্ক করেছিলেন। অথবা নবীদের অনুসারীদের মধ্য থেকে এমন কোন হিদায়াত প্রাপ্ত ব্যক্তি যিনি সংশ্লিষ্ট উম্মতের মধ্যে সত্য প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিংবা কোন প্রচার মাধ্যম যার সাহায্যে সংশ্লিষ্ট উম্মতের কাছে সত্যের পয়গাম পৌঁছেছিল।
# নিজেদের সাফাইয়ের মধ্যে এমন কোন প্রমাণ পেশ করো যার ভিত্তিতে তোমাদের মাফ করে দেয়া যেতে পারে। অথবা তোমরা যে শির্‌ক এবং যে আখেরাত ও নবুওয়াত অস্বীকারের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলে তা সঠিক ছিল এবং তোমরা যুক্তিসঙ্গত কারণে এ পথ অবলম্বন করেছিলে একথা প্রমাণ করো। কিংবা এ না হলেও কমপক্ষে একথাই প্রমাণ করো যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে এ ভুলের জন্য সতর্ক করে দেবার এবং তোমাদের কাছে সঠিক কথা পৌঁছাবার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৬২-৬৭ নং আয়াতের তাফসীর

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা মুশরিকদেরকে ডেকে সামনে দাঁড় করাবেন এবং বলবেনঃ “আমি ছাড়া যেসব প্রতিমা ও পাথরের তোমরা পূজা করতে সেগুলো আজ কোথায়? তাদেরকে আজ ডাকো এবং দেখো যে, তারা তোমাদের কোন সাহায্য করতে বা তাদের নিজেদেরই কোন সাহায্য করতে পারে কি না?” এ কথা তাদেরকে শুধু ধমক হিসেবেই বলা হবে। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “অবশ্যই তোমরা আমার কাছে এককভাবে এসেছে যেমন আমি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম। আর যা কিছু আমি তোমাদেরকে। দিয়েছিলাম সেগুলোর সবই তোমরা পিছনে ছেড়ে এসেছো। আজ তো আমি তোমাদের সাথে কোন সুপারিশকারীকে দেখছি না যাদেরকে তোমরা আল্লাহর অংশীদার মনে করতে? তাদের সাথে আজ তোমাদের কোনই সম্পর্ক নেই, তোমরা যা ধারণা করতে তার সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তারা আজ সবাই তোমাদের থেকে দূরে সরে পড়েছে।” (৬:৯৪)

মহান আল্লাহর উক্তিঃ যাদের জন্যে শাস্তি অবধারিত হয়েছে তারা বলবে অর্থাৎ শয়তান, উদ্ধত এবং শিক্ ও কুফরীর দিকে আহ্বানকারীরা সেদিন বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম এবং তারা আমাদের। শুনেছিল ও মেনে নিয়েছিল। আমরা নিজেরাও ছিলাম পথভ্রষ্ট এবং তাদেরকেও করেছিলাম পথভ্রষ্ট। আজ আমরা আপনার সামনে তাদের ইবাদতের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য মা’বুদ গ্রহণ করে এই জন্যে যে, যাতে তারা তাদের সহায় হয়। কখনই নয়, তারা তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে এবং তাদের বিরোধী হয়ে যাবে।” (১৯:৮১-৮২) আল্লাহ তা’আলা আর এক আয়াতে বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে যে আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকে আহ্বান করে যারা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারবে না এবং তারা তাদের ডাক হতে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন?” (৪৬:৫) তিনি আরো বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “(কিয়ামতের দিন) যখন লোকেরা একত্রিত হবে তখন তারা (উপাস্যরা) তাদের (উপাসকদের) শত্রু হয়ে যাবে এবং তাদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে।” (৪৬:৬)

হ্যরত (ইবরাহীম) খলীলুল্লাহ (আঃ) স্বীয় কওমকে বলেছিলেনঃ “তোমরা যে প্রতিমাগুলোর উপাসনা করছে তাদের সাথে তোমাদের শুধু দুনিয়াতেই বন্ধুত্ব থাকছে, কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং একে অপরের প্রতি লা’নত বর্ষণ করবে।” মহান আল্লাহ অন্য এক আয়াতে বলেনঃ “যখন অনুসৃতরা অনুসারীদের থেকে নিজেদেরকে দায়িত্বমুক্ত বলে ঘোষণা করবে এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয়ে যাবে…. তারা (জাহান্নামের) আগুন হতে বের হতে পারবে না। তাদেরকে বলা হবেঃ “দুনিয়ায় যাদের তোমরা পূজা-অর্চনা করতে এখন তাদেরকে ডাকছো না কেন?” তখন তারা ডাকতে শুরু করবে, কিন্তু কোন জবাব তারা পাবে না। তখন তাদের বিশ্বাস হয়ে যাবে যে, তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে যেতেই হবে। ঐ সময় তারা আকাঙ্ক্ষা করবে যে, হায়! তারা যদি সৎপথ অনুসরণ করতো! যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আর সেই দিনের কথা স্মরণ কর, যেদিন তিনি বলবেনঃ তোমরা যাদেরকে আমার শরীক মনে করতে তাদেরকে আহ্বান কর। তারা তখন তাদেরকে আহ্বান করবে কিন্তু তারা তাদের আহ্বানে সাড়া দেবে না এবং তাদের উভয়ের মধ্যস্থলে রেখে দেবো এক ধ্বংস গহ্বর। অপরাধীরা আগুন দেখে বুঝবে যে, তারা তথায় পতিত হচ্ছে এবং তারা এটা হতে কোন পরিত্রাণস্থল। পাবে না।” (১৮:৫২-৫৩)

এই কিয়ামতের দিনেই তাদের সবকে শুনিয়ে একটা প্রশ্ন এও করা হবেঃ “তোমরা নবীদেরকে কি জবাব দিয়েছিলে এবং তাদেরকে কতদূর সাহায্য সহযোগিতা করেছিলে?” প্রথমে তাওহীদ সম্পর্কে প্রশ্ন ও বিচার-বিশ্লেষণের আলোচনা ছিল। এখন রিসালাত সম্পর্কে সওয়াল-জবাবের আলোচনা হচ্ছে। অনুরূপভাবে কবরেও প্রশ্ন হয়ঃ “তোমার প্রতিপালক কে? তোমার নবী কে? এবং তোমার দ্বীন কি?” মুমিন উত্তর দেয়ঃ “আমার প্রতিপালক ও মাবুদ আল্লাহ, আমার রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ), যিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল ছিলেন এবং আমার দ্বীন হলো ইসলাম।” তবে কাফির কোন উত্তর দিতে পারে না। ভীত-সন্ত্রস্ত ও হতভম্ব হয়ে বলেঃ “আমি এসব জানি না।” সে অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “যে এই দুনিয়ায় অন্ধ সে পরকালেও অন্ধ এবং সে চরম পথভ্রষ্ট।” (১৭:৭২) সমস্ত দলীল প্রমাণ তার দৃষ্টি হতে সরে যাবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয়ে যাবে। বংশ তালিকার কোন প্রশ্ন করা হবে না। তবে যে ব্যক্তি তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকার্যাবলী সম্পাদন করে সে অবশ্যই সাফল্য অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এখানে (আরবি) শব্দটি (আরবি) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ মুমিন অবশ্যই কৃতকার্য ও সফলকাম হবে।

৬৮-৭০ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, একমাত্র তিনিই সৃষ্টিকর্তা এবং সমস্ত আধিপত্য তাঁরই। না তার সাথে কেউ বিতর্কে লিপ্ত হতে পারে, না কেউ তাঁর শরীক হতে পারে। তিনি যা চান তাই সৃষ্টি করে থাকেন এবং যাকে চান নিজের বিশিষ্ট বান্দা বানিয়ে নেন। তিনি যা চান তা হয় এবং যা চান না তা হয় না। ভাল ও মন্দ সবই তাঁরই হাতে। সবকেই তারই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। কারো কোন অধিকার নেই। শব্দের অর্থ এটাই। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিনা নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না।” (৩৩:৩৬)

সঠিক দু’টি উক্তিতেই (আরবি) শব্দটি (আরবি) বা নেতিবাচক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ইবনে জারীর (রঃ) বলেছেন যে, (আরবি) এখানে ব্যবহৃত হয়েছে (আরবি) অর্থে। অর্থাৎ আল্লাহ ওটাই পছন্দ করেন যাতে তাদের মঙ্গল রয়েছে। কিন্তু সঠিক কথা এটাই যে, এখানে (আরবি) ব্যবহৃত হয়েছে (আরবি) অর্থে। যেমন এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন হতে বর্ণিত হয়েছে। এ আয়াতটি এই বর্ণনাতেই রয়েছে যে, মাখলুককে সৃষ্টি করা, তকদীর নির্ধারণ করা ইত্যাদি সবকিছুর অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তিনি অতুলনীয়। এজন্যেই এ আয়াতের শেষে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ তারা যাকে শরীক করে তা হতে তিনি ঊর্ধ্বে।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার প্রতিপালক জানেন তাদের অন্তরে যা গোপন রয়েছে এবং তারা যা প্রকাশ করে। হে মানুষ! তোমরা যা গোপন কর বা প্রকাশ কর, সবকিছুই তাঁর কাছে প্রকাশমান, তিনি সবই জানেন। দিবসে ও রজনীতে যা কিছু ঘটছে, কিছুই তার কাছে গোপন থাকে না। মা’বুদ হওয়ার ব্যাপারেও তিনি একক। দুনিয়া ও আখিরাতে প্রশংসা তাঁরই, বিধান তাঁরই, তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। তার হুকুম কেউই রদ করতে পারে না। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করতে পারেন। এমন কেউ নেই যে তার ইচ্ছা থেকে তাঁকে ফিরাতে পারে। হিকমত ও রহমত তারই পবিত্র সত্তায় রয়েছে। কিয়ামতের দিন তোমরা তারই নিকট ফিরে যাবে। তিনি। তোমাদের সকলকেই তোমাদের আমলের প্রতিদান প্রদান করবেন। তার কাছে তোমাদের কোন কাজই গোপন নেই। তিনি সেই দিন সৎ লোকদেরকে পুরস্কার ও অসৎ লোলেদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন। ঐ দিন তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে পূর্ণ ফায়সালা করে দিবেন।

৭১-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহের কথা একটু চিন্তা করে দেখো তো, তিনি তোমাদের কোন চেষ্টা তদবীর ছাড়াই বরাবরই দিবস ও রজনীকে আনয়ন করতে রয়েছেন। যদি শুধু রাত্রিই থেকে যায় তবে তোমরা। কঠিন অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাবে, তোমাদের কাজ-কর্ম হয়ে যাবে বন্ধ এবং তোমাদের জীবন যাপন করা অত্যন্ত কষ্টকর হবে। এমতাবস্থায় তোমরা এমন কাউকেও পাবে কি, যে তোমাদের জন্যে দিন আনয়ন করতে পারে? যার ফলে তোমরা আলোকের মধ্যে চলতে পার? অতঃপর নিজেদের কাজ-কর্মে লেগে যেতে পার? বড়ই দুঃখের বিষয় এই যে, তোমরা আল্লাহর কথায় মোটেই কর্ণপাত কর না। অনুরূপভাবে মহামহিমান্বিত আল্লাহ যদি শুধু দিনই রেখে দেন তাহলেও তোমাদের জীবন তিক্ত ও দুঃখময় হয়ে যাবে। তোমরা হয়ে পড়বে ক্লান্ত, শ্রান্ত। বিশ্রামের কোন সুযোগ তোমরা পাবে না। এমতাবস্থায় এমন কেউ আছে কি, যে তোমাদেরকে রাত্রি এনে দিতে পারে? যাতে তোমরা বিশ্রাম করতে পার? কিন্তু তোমাদের চক্ষু থাকা সত্ত্বেও তোমরা আল্লাহর নিদর্শনাবলী ও তাঁর দয়াপূর্ণ কাজগুলো দেখে কিছুই চিন্তা ভাবনা কর না, এটা বড়ই দুঃখপূর্ণ ব্যাপারই বটে।

এটা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই মেহেরবানী যে, তিনি তোমাদের জন্যে। দিবস ও রজনী দু’টোরই ব্যবস্থা রেখেছেন, যাতে তোমরা রাত্রে বিশ্রাম করতে পার এবং দিনে কাজ-কর্মে ও ব্যবসা বাণিজ্যে লিপ্ত থাকতে পার। আর যিনি তোমাদের প্রকৃত মালিক, যিনি ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী তার অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
৭৪-৭৫ নং আয়াতের তাফসীর

মুশরিকদেরকে দ্বিতীয়বার ধমক দিয়ে বলা হবেঃ দুনিয়ায় যাদেরকে তোমরা আমার শরীক বলে গণ্য করতে তারা আজ কোথায়? প্রত্যেক উম্মতের মধ্য হতে একজন সাক্ষী অর্থাৎ ঐ উম্মতের পয়গম্বর মনোনীত করা হবে এবং মুশরিকদেরকে বলা হবেঃ তোমাদের শিক্মকের কোন দলীল তোমরা পেশ কর এবং ঐ সময় তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যাবে যে, প্রকৃতপক্ষেই ইবাদতের যোগ্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউই নয়। সুতরাং তারা কোন জবাব দিতে পারবে না। তাই তারা খুবই বিচলিত হয়ে পড়বে এবং তারা আল্লাহ তা’আলার উপর যা কিছু মিথ্যা আরোপ করেছিল সবই ভুলে যাবে।

Leave a Reply