أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০১৮)
[ অহংকার করো না :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৮:ক্বাসাস
পারা:২০
৭৬-৮৮ নং আয়াত:-
২৮:৭৬
اِنَّ قَارُوۡنَ کَانَ مِنۡ قَوۡمِ مُوۡسٰی فَبَغٰی عَلَیۡہِمۡ ۪ وَ اٰتَیۡنٰہُ مِنَ الۡکُنُوۡزِ مَاۤ اِنَّ مَفَاتِحَہٗ لَتَنُوۡٓاُ بِالۡعُصۡبَۃِ اُولِی الۡقُوَّۃِ ٭ اِذۡ قَالَ لَہٗ قَوۡمُہٗ لَا تَفۡرَحۡ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ الۡفَرِحِیۡنَ ﴿۷۶﴾
নিশ্চয় কারূন ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত, কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল। আর আমরা তাকে দান করেছিলাম এমন ধনভাণ্ডার যার চাবিগুলো বহন করা একদল বলবান লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল। স্মরণ করুন, যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, ‘অহংকার করো না, নিশ্চয় আল্লাহ্ অহংকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
২৮:৭৭
وَ ابۡتَغِ فِیۡمَاۤ اٰتٰىکَ اللّٰہُ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ وَ لَا تَنۡسَ نَصِیۡبَکَ مِنَ الدُّنۡیَا وَ اَحۡسِنۡ کَمَاۤ اَحۡسَنَ اللّٰہُ اِلَیۡکَ وَ لَا تَبۡغِ الۡفَسَادَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ﴿۷۷﴾
আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা দিয়ে আখেরাতের ঘর তৈরি করার কথা চিন্তা করো এবং দুনিয়া থেকেও নিজের অংশ ভুলে যেয়ো না। অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করো না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”
২৮:৭৮
قَالَ اِنَّمَاۤ اُوۡتِیۡتُہٗ عَلٰی عِلۡمٍ عِنۡدِیۡ ؕ اَوَ لَمۡ یَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰہَ قَدۡ اَہۡلَکَ مِنۡ قَبۡلِہٖ مِنَ الۡقُرُوۡنِ مَنۡ ہُوَ اَشَدُّ مِنۡہُ قُوَّۃً وَّ اَکۡثَرُ جَمۡعًا ؕ وَ لَا یُسۡـَٔلُ عَنۡ ذُنُوۡبِہِمُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ ﴿۷۸﴾
এতে সে বললো, “এসব কিছু তো আমি যে জ্ঞান লাভ করেছি তার ভিত্তিতে আমাকে দেয়া হয়েছে।” –সে কি এ কথা জানতো না যে, আল্লাহ এর পূর্বে এমন বহু লোককে ধ্বংস করে দিয়েছেন যারা এর চেয়ে বেশী বাহুবল ও জনবলের অধিকারী ছিল? অপরাধীদেরকে তো তাদের গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় না।
২৮:৭৯
فَخَرَجَ عَلٰی قَوۡمِہٖ فِیۡ زِیۡنَتِہٖ ؕ قَالَ الَّذِیۡنَ یُرِیۡدُوۡنَ الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا یٰلَیۡتَ لَنَا مِثۡلَ مَاۤ اُوۡتِیَ قَارُوۡنُ ۙ اِنَّہٗ لَذُوۡ حَظٍّ عَظِیۡمٍ ﴿۷۹﴾
একদিন সে তার সম্প্রদায়ের সামনে বের হলো পূর্ণ জাঁকজমক সহকারে। যারা দুনিয়ার জীবনের ঐশ্বর্যের জন্য লালায়িত ছিল তারা তাকে দেখে বললো, “আহা! কারূণকে যা দেয়া হয়েছে তা যদি আমরাও পেতাম! সে তো বড়ই সৌভাগ্যবান।”
২৮:৮০
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ وَیۡلَکُمۡ ثَوَابُ اللّٰہِ خَیۡرٌ لِّمَنۡ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا ۚ وَ لَا یُلَقّٰہَاۤ اِلَّا الصّٰبِرُوۡنَ ﴿۸۰﴾
আর যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল তারা বলল, ‘ধিক তোমাদেরকে ! যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য আল্লাহ্র পুরস্কারই শ্রেষ্ঠ এবং ধৈর্যশীল ছাড়া তা কেউ পাবে না।
২৮:৮১
فَخَسَفۡنَا بِہٖ وَ بِدَارِہِ الۡاَرۡضَ ۟ فَمَا کَانَ لَہٗ مِنۡ فِئَۃٍ یَّنۡصُرُوۡنَہٗ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ٭ وَ مَا کَانَ مِنَ الۡمُنۡتَصِرِیۡنَ ﴿۸۱﴾
শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ও তার গৃহকে ভূগর্ভে পুতে ফেললাম। তখন আল্লাহর মোকাবিলায় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসার মতো সাহায্যকারীদের কোন দল ছিল না এবং সে নিজেও নিজেকে সাহায্য করতে পারলো না।
২৮:৮২
وَ اَصۡبَحَ الَّذِیۡنَ تَمَنَّوۡا مَکَانَہٗ بِالۡاَمۡسِ یَقُوۡلُوۡنَ وَیۡکَاَنَّ اللّٰہَ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِہٖ وَ یَقۡدِرُ ۚ لَوۡ لَاۤ اَنۡ مَّنَّ اللّٰہُ عَلَیۡنَا لَخَسَفَ بِنَا ؕ وَیۡکَاَنَّہٗ لَا یُفۡلِحُ الۡکٰفِرُوۡنَ ﴿٪۸۲﴾
যারা আগের দিন তার মতো মর্যাদা লাভের আকাংখা পোষণ করছিল তারা বলতে লাগলো, “আফসোস, আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার রিযিক প্রসারিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে সীমিত রিযিক দেন। যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করতেন, তাহলে আমাদেরও ভূগর্ভে পুতে ফেলতেন। আফসোস, আমাদের মনে ছিল না, কাফেররা সফলকাম হয় না”
২৮:৮৩
تِلۡکَ الدَّارُ الۡاٰخِرَۃُ نَجۡعَلُہَا لِلَّذِیۡنَ لَا یُرِیۡدُوۡنَ عُلُوًّا فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا فَسَادًا ؕ وَ الۡعَاقِبَۃُ لِلۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۸۳﴾
এ পরলোকের আবাস; যা আমি নির্ধারিত করি তাদেরই জন্য যারা এ পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। সাবধানীদের জন্য শুভ পরিণাম।
২৮:৮৪
مَنۡ جَآءَ بِالۡحَسَنَۃِ فَلَہٗ خَیۡرٌ مِّنۡہَا ۚ وَ مَنۡ جَآءَ بِالسَّیِّئَۃِ فَلَا یُجۡزَی الَّذِیۡنَ عَمِلُوا السَّیِّاٰتِ اِلَّا مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۸۴﴾
যে কেউ ভাল কাজ নিয়ে আসবে তার জন্য রয়েছে তার চেয়ে ভাল ফল এবং যে কেউ খারাপ কাজ নিয়ে আসে তার জানা উচিৎ যে, অসৎ কর্মশীলরা যেমন কাজ করতো ঠিক তেমনটিই প্রতিদান পাবে।
২৮:৮৫
اِنَّ الَّذِیۡ فَرَضَ عَلَیۡکَ الۡقُرۡاٰنَ لَرَآدُّکَ اِلٰی مَعَادٍ ؕ قُلۡ رَّبِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَنۡ جَآءَ بِالۡہُدٰی وَ مَنۡ ہُوَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۸۵﴾
যিনি আপনার জন্য কুরআনকে করেছেন বিধান, তিনি আপনাকে অবশ্যই ফিরিয়ে নেবেন প্রত্যাবর্তনস্থলে । বলুন, ‘আমার রব ভাল জানেন কে সৎপথের নির্দেশ এনেছে আর কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে।’
২৮:৮৬
وَ مَا کُنۡتَ تَرۡجُوۡۤا اَنۡ یُّلۡقٰۤی اِلَیۡکَ الۡکِتٰبُ اِلَّا رَحۡمَۃً مِّنۡ رَّبِّکَ فَلَا تَکُوۡنَنَّ ظَہِیۡرًا لِّلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۫۸۶﴾
আর আপনি আশা করেননি যে, আপনার প্রতি কিতাব নাযিল হবে। এ তো শুধু আপনার রব-এর অনুগ্রহ। কাজেই আপনি কখনো কাফেরদের সহায় হবেন না।
২৮:৮৭
وَ لَا یَصُدُّنَّکَ عَنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ بَعۡدَ اِذۡ اُنۡزِلَتۡ اِلَیۡکَ وَ ادۡعُ اِلٰی رَبِّکَ وَ لَا تَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ ﴿ۚ۸۷﴾
তোমার প্রতি আল্লাহর আয়াত অবতীর্ণ করার পর ওরা যেন তোমাকে কিছুতেই সেগুলি হতে বিমুখ না করে ফেলে।[১] তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে আহবান কর এবং কিছুতেই অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
২৮:৮৮
وَ لَا تَدۡعُ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ ۘ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۟ کُلُّ شَیۡءٍ ہَالِکٌ اِلَّا وَجۡہَہٗ ؕ لَہُ الۡحُکۡمُ وَ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿٪۸۸﴾
আর আপনি আল্লাহ্র সাথে অন্য ইলাহ্কে ডাকবেন না, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। আল্লাহ্র সত্তা ছাড়া সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল বিধান তাঁরই এবং তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সূরার প্রথমাংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিলাে মূসা(আ.) ও ফেরাউনের কাহিনী। রাষ্ট্রীয় শক্তি ও শাসন ক্ষমতা কতাে দাপট ও দোর্দন্ড প্রতাপের অধিকারী হয়ে থাকে এবং যুলুম, আগ্রাসন, আল্লাহর নাফরমানী, অকৃতজ্ঞতা ও আল্লাহর বিধান থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরিণামে এই প্রবল প্রতাপান্বিত রাষ্ট্র শক্তিও কিভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, সেটা এখানে আলােচনা করা হয়েছে। এবার আসছে কারূনের কিসসা। এ কিসসাতে দেখানাে হয়েছে ধন সম্পদ ও জ্ঞানের ক্ষমতা কতাে, আর জনগণের ওপর স্বৈরাচার, যুলুম ও অহংকার চাপিয়ে দেয়া এবং আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করার পরিণামে তা কিভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সাথে সাথে এতে প্রকৃত মূল্যবোধ কী, তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ঈমান ও সচ্চরিত্রের সামনে পার্থিব সহায় সম্পদ এবং জাকজমকের মূল্য খাটো করে দেখানাে হয়েছে। আর দুনিয়ার হালাল ও পবিত্র ধন সম্পদ ভােগ করতে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং পৃথিবীতে বড়াই না করা ও বিপর্যয় সৃষ্টি না করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। *ধনকুবের কারূনের ধ্বংসের ইতিহাস : এখান থেকে শুরু হয়েছে ধন সম্পদ পেয়ে অহংকারী হয়ে যাওয়া কারূনের কাহিনী, তবে এই কাহিনীর সময় ও স্থান সম্পর্কে কোরআন কোনাে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানায়নি। শুধু এতােটুকু বলেছে যে, কারূন মূসার গােত্রেরই একজন লােক ছিলাে এবং সে তার গােত্রের ওপর যুলুম নিগ্রহ চাপিয়ে দেয়। এই ঘটনা কি বনী ইসরাঈলের ও হযরত মূসার মিসরে থাকাকালে এবং তাদের নির্বাসনের আগেই ঘটেছিলাে, না তারপরে হযরত মূসার জীবদ্দশায় বা তার ইন্তেকালের পর ঘটেছিলাে? এ সম্পর্কে একাধিক বর্ণনা রয়েছে, কারও কারও মতে কারূন ছিলাে হযরত মূসার চাচাতাে ভাই এবং এ ঘটনা হযরত মূসার জীবদ্দশায় ঘটে। অন্যান্য বর্ণনায় আরাে বাড়তি তথ্য রয়েছে যে, কারূন হযরত মূসাকে উত্যক্ত করতাে এবং সে এক মহিলাকে ঘুষ দিয়ে এই মর্মে সম্মত করে যে, সে হযরত মূসার ওপর তার সাথে ব্যভিচার করার অপবাদ আরােপ করবে। আল্লাহ তায়ালা যথাসময়ে এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে হযরত মূসাকে অপবাদ থেকে নিষ্কৃতি দেন এবং কারূনকে মাটিতে ধসিয়ে দেয়া হয়। এসব বর্ণনার সব কটা আমাদের প্রয়ােজন নেই। কোথায় ও কবে এ ঘটনা ঘটেছিলাে, তাও জানা অনাবশ্যক। ঘটনাটা কোরআনে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, ঘটনার উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে তাই যথেষ্ট। যে মূল্যবােধ ও নীতিমালা বর্ণনা করার জন্যে এ ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলাের জন্যে এ ঘটনা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর স্থান, কাল ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খুঁটিনাটি বিষয় বর্ণনা করলে যদি এ কাহিনীর তাৎপর্য কিছু বাড়তাে, তাহলে কোরআন সেসব খুঁটিনাটির কিছুই উল্লেখ করতে বাদ দিতাে না। এবার দেখা যাক, ঘটনাটা কোরআনে কিভাবে এসেছে। অন্য সব বর্ণনার ব্যাপারে মাথা ঘামানাের দরকার নেই। ‘কারূন মূসার গোত্রের লােক ছিলাে। সে তাদের ওপর অত্যাচার চালালা…'(আয়াত ৭৬, ৭৭ ও ৭৮) এভাবেই কাহিনী শুরু হয়েছে। এর নায়ক কারূন। কারূনের গোত্র হযরত মূসারই গোত্র। গােত্রের লােকদের সাথে তার আচরণ ছিলাে অত্যাচার ও নিপীড়নমূলক। আর এই অত্যাচারের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কারণটা হলাে তার প্রাচূর্য। ‘আমি তাকে এতাে সম্পত্তি দিয়েছিলােম যে, তার চাবিগুলাে বহন করতে একটা শক্তিশালী দলও হিমশিম খেতাে।’ এরপর বর্ণনা করা হয়েছে পরবর্তী ঘটনাবলী, তদসংক্রান্ত কথাবার্তা ও মানসিক প্রতিক্রিয়াসমূহ। মূসার স্বগােত্রীয় এই কারূনকে আল্লাহ তায়ালা বিপুল ধন সম্পদ দান করেছিলেন। তার ধন সম্পদ এতাে বেশী ছিলাে যে, তার আধিক্য বুঝাতে সে ধন সম্পদকে ‘কুনুয’ বলা হয়েছে। কুনুয হচ্ছে ‘কান্-য’ শব্দের বহুবচন। ‘কান্-য’ বলা হয় সেই ধন-সম্পদকে, যা ভােগ, ব্যবহার ও লেনদেনে খাটানাে সম্পদের অতিরিক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে পুঁজি করে রাখা হয়। কারূনের ধন-সম্পদের বিপুলতা বুঝাতে আরাে একটা কথা বলা হয়েছে। সেটা এই যে, অত্যন্ত শক্তিশালী লােকদের একটা দলও তার চাবিগুলাে বহন করতে হিমশিম খেতাে। এ কারণে কারূন তার গােত্রের লোকদের ওপর আগ্রাসন চালাতাে। সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি সে কিভাবে আগ্রাসন চালাতে, যাতে করে বুঝা যায়, সে নানা উপায়ে এবং অজ্ঞাত সংখ্যক পন্থায় আগ্রাসন চালাতাে। হয়তাে বা সে তাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ চালাতাে এবং তাদের জমিজমা ও অন্যান্য সহায় সম্পদ দখল করার মাধ্যমে আগ্রাসন চালাতাে, যেমন বহু অত্যাচারী ধনীকরা চালিয়ে থাকে। আবার এমনও হতে পারে যে, তার সম্পদে জনগণের যে প্রাপ্য ছিলাে, তা থেকে তাদের বঞ্চিত করতাে। এটাও এক ধরনের আগ্রাসন। কেননা ধনীকদের সম্পদে গরীবদের অধিকার থাকে, যাতে সম্পদ কেবল ধনীকদের মধ্যেই ঘূর্ণায়মান না থাকে। চারদিকে যেখানে অভাবী ও বঞ্চিতদের ভীড়, সেখানে তাদের বঞ্চিত করে শুধু ধনীকরাই যদি ভােগ করতে থাকে, তাহলে জনমনে অসন্তোষ ধূমায়িত হবে এবং জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠবে। হয়তাে এই দুই পন্থায় কিংবা আরাে বহু পন্থায় সে অত্যাচার চালাত। যাই হােক, তার গােত্রের মধ্যে এমন ব্যক্তিরও অভাব ঘটেনি, যে কারূনকে এসব অত্যাচার থেকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছে এবং আল্লাহ তায়ালা যে পথে অর্থ ব্যয় করলে সন্তুষ্ট থাকেন, সেই পথে অর্থ ব্যয় করার উপদেশ দিয়েছে। এটা এমন একটা বিধান, ধনীকদের কাছ থেকে তাদের ধন কেড়ে নেয় না; বরং আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ মধ্যম ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে ভােগ করতে বাধ্য করে। আর তার আগে আল্লাহ তায়ালা যে তাদের ধন সম্পদ দান করেছেন তা চেনা এবং আখেরাতে এই ধন-সম্পদের হিসাব দিতে হবে এ কথা মনে রাখার নির্দেশ দেয়। ‘তার গােত্র তাকে বললাে, তুমি গর্বিত হয়াে না…'(আয়াত ৭৬-৭৭) এখানে ইসলামী বিধানের সেই অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবােধগুলাে একত্রিত করা হয়েছে, যা তাকে অন্য সকল মানব রচিত বিধান থেকে বিশিষ্টতা দান করেছে। ‘লা-তাফরাহু’ কথাটার শাব্দিক অর্থ হলাে ‘আনন্দিত হয়াে না।’ তবে এখানে সাধারণ আনন্দ বুঝানাে হয়নি। বিপুল পুঞ্জীভূত সম্পদের মালিক হওয়া ও ভােগবিলাসে মেতে ওঠার ফলে যে লাগামহীন আনন্দ উল্লাস জন্ম নেয়, যা এমন গর্ব অহংকারের রূপ ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করে যে, সম্পদের মালিক তার দাতা মহান আল্লাহকেই ভুলে যায়, তার প্রশংসা ও শােকর আদায় করার কথা ভুলে যায় এবং সম্পদকে আল্লাহর বান্দাদের ওপর প্রভু হিসেবে চেপে বসার হাতিয়ারে পরিণত করে, সেই আনন্দ বুঝানাে হয়েছে। ‘আল্লাহ তায়ালা ধন-গর্বিতদের ভালবাসেন না।’ এ কথা বলে গােত্রের লােকেরা কারূনকে আল্লাহর দিকে ফেরাতে চেয়েছিলাে এবং সম্পদের দম্ভে মানুষের ওপর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দাপট দেখানো থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলাে। ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন, তার একাংশ দিয়ে তুমি আখেরাতের শান্তি অর্জন করাে, আর তােমার দুনিয়ার প্রয়ােজনীয় অংশকে ভুলে যেও না।’ এই কথার ভেতর দিয়ে ইসলামী বিধানের ভারসাম্য ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এ বিধান সম্পদের মালিকের মনকে আখেরাতমুখী করে এবং তার দুনিয়ার অংশ থেকে তাকে বঞ্চিত করে না; বরং দুনিয়ার অংশ গ্রহণ করতে তাকে উদ্বুদ্ধ করে ও নির্দেশ দেয়, যাতে সে বৈরাগ্যবাদী হয়ে পার্থিব জীবনকে দুর্বল ও অর্থহীন না করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে বহু পবিত্র ও হালাল সম্পদ সৃষ্টি করেছেন যেন মানুষ তা ভােগ ব্যবহার করে এবং উপার্জন ও সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে কাজে লাগায়। এতে করে জীবন বিকশিত, উন্নত ও সমৃদ্ধশালী হবে এবং পৃথিবীতে মানব জাতির খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। কেননা তাদের পার্থিব সম্পদ অর্জন ও ভােগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আখেরাত। তাই আখেরাতের পথ থেকে তারা কখনাে বিপথগামী হয় না এবং পার্থিব সম্পদের ভােগ ব্যবহার করতে গিয়ে আখেরাত সংক্রান্ত দায় দায়িত্ব বিস্মৃত হয় না। এরূপ দায়িত্ব সচেতন অবস্থায় যেটুকু পার্থিব সম্পদ ভােগ করা হয়, সেটুকু আল্লাহর নেয়ামতের শােকার আদায়, তার নেয়ামত সাদরে গ্রহণ ও তা দ্বারা উপকৃত হওয়া বলে গণ্য হবে। সুতরাং এই ভােগ এক ধরনের এবাদাত, যার জন্যে আল্লাহ তায়ালা উত্তম পুরস্কার দেবেন। এভাবে ইসলাম মানব জীবনে ভারসাম্য ও ইনসাফ বাস্তবায়িত করে এবং মানুষকে তার স্বাভাবিক, ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের মধ্য দিয়ে তার আধ্যাত্মিক উন্নতি নিশ্চিত করে। এ জীবনে না আছে কোনাে বঞ্চনা, আর না আছে স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদা উপেক্ষা করার কোনাে অবকাশ। ‘আর আল্লাহ তায়ালা যেমন তােমার প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করেছেন, তেমনি তুমিও মহানুভবতা প্রদর্শন করাে।’ বস্তুত দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদ সম্পত্তি আল্লাহর দান। এই দানের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা যে মহত্ত্ব ও মহানুভবতা দেখিয়েছেন, তার বদলা ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মানুষেরও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি উদারতা মহানুভবতা দেখানাে উচিত। ‘পৃথিবীতে অরাজকতা ছড়িও না।’ যুলুম, অত্যাচার ও আগ্রাসন দ্বারা, আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতের চিন্তামুক্ত হয়ে লাগামহীনভাবে ভােগবিলাসে মত্ত হওয়া দ্বারা মানুষের মনে অপর মানুষের বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা পােষণ করা দ্বারা, অবৈধ বা অনুপযুক্ত খাতে অর্থের অপচয় অপব্যয় দ্বারা এবং উপযুক্ত খাতে অর্থ ব্যয়ে কার্পণ্য করা দ্বারা অরাজকতা ছড়ানাে হয়। ‘আল্লাহ তায়ালা অরাজকতাকারীদের ভালবাসেন না।’ যেমন তিনি অর্থগর্বে আত্মহারা লােকদের ভালবাসেন না। এ ছিলাে কারূনের প্রতি তার স্বগােত্রীয়দের উপদেশ। এর জবাবে সে একটামাত্র বাক্য উচ্চারণ করলাে, যার ভেতরে অরাজকতা ও বিকৃতির একাধিক উপকরণ নিহিত ছিলাে। সে বললাে, ‘এ সব সম্পদ তাে আমি নিজের জ্ঞানের বলেই উপার্জন করেছি।’ অর্থাৎ সম্পদ উপার্জন ও সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধকারী আমার বিদ্যাবুদ্ধি ও জ্ঞানই আমাকে এর যােগ্য করেছে। এখন এই। সম্পদ ব্যয়ে একটা নির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বনে তােমরা আমাকে আদেশ দিচ্ছাে কেন? কেনই বা তােমরা আমার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তির ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করছাে? অথচ আমি নিজের চেষ্টায়ই এ সম্পদ উপার্জন করেছি এবং নিজের জ্ঞানবলেই তার যােগ্যতা লাভ করেছি। এটা হচ্ছে অহংকারে মাথা বিগড়ে যাওয়া এমন এক ব্যক্তির বক্তব্য, যে তার বিত্ত বৈভবের উৎস কী তা ভুলে গেছে এবং, কী উদ্দেশ্যে তা দেয়া হয়, তাও ভুলে গেছে। প্রাচুর্য তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীতে এ ধরনের মানুষ বার বার এসে থাকে। অনেকেই মনে করে, তার জ্ঞান ও শ্রমই তার ধন সম্পদের একমাত্র কারণ। তাই সে তার সম্পদ কোথায় ব্যয় করবে এবং কোথায় করবে, তা দ্বারা সৎ কাজ করবে না অসৎ কাজ করবে, সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আল্লাহর কাছে কোনাে হিসাব তাকে দিতে হবে না এবং তার সন্তোষ বা অসন্তোষের কোনাে তােয়াককাও তার করতে হবে না। ইসলাম ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে। সম্পদ উপার্জনে যে ব্যক্তিগত চেষ্টা সাধনা ব্যয়িত হয়, তারও সে মূল্য দেয়। তবে তার নির্ধারিত হালাল পন্থাগুলােকেই সে মেনে নেয়। ব্যক্তিগত শ্রম সাধনা তার কাছে মূল্যহীন নয়। তবে সেই সাথে সে ব্যক্তি মালিকানার জন্যে একটা সুনির্দিষ্ট বিধান দেয়, যেমন সে সম্পদ অর্জন এবং তার উন্নয়নের জন্যেও বিধান দেয়। তার এ বিধান ইনসাফপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ। ব্যক্তিকে তার শ্রমের ফল থেকে ইসলাম বঞ্চিত করে না। তা দ্বারা অবাধ ভোগবিলাসেরও অনুমতি দেয় না এবং কার্পণ্যও করতে দেয় না। সমাজের জন্যে তাকে কিছু অধিকার নির্দিষ্ট করে দেয় এবং তা উপার্জন ও উন্নয়নের পন্থা নিয়ন্ত্রণ করে। সম্পদের খরচ ও ভােগ করার পন্থাও সে নিয়ন্ত্রণ করে। ইসলামের এ বিধান সুনির্দিষ্ট এবং এর বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ। কারূন তার গোত্রের লােকদের উপদেশে কর্ণপাত করলাে না এবং তার সম্পদ যে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত, সে কথাও সে উপলব্ধি করলাে না। এ জন্যে সে আল্লাহর বিধানের অনুগতও রইলাে না। চরম অহংকারের বশবর্তী হয়ে সে এ সব উপদেশ প্রত্যাখ্যান করলাে। তাই আয়াত শেষ হবার আগেই তার প্রতি হুমকি ও ধিক্কার এবং তার ঘৃণ্য উক্তির জবাব হুমকির আকারে দেয়া হয়েছে, ‘সে (কারূন) কি জানে না যে, আল্লাহ তায়ালা তার পূর্বে তার চেয়েও শক্তিশালী ও অধিকতর জনবলসম্পন্ন বহু জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আর অপরাধীদের ধ্বংস করার সময় তাদের কাছ থেকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তা করা হয় না।’ অর্থাৎ কারূন যদিও বিপুল শক্তির অধিকারী এবং ধন সম্পদের মালিক হয়ে থাকে, তবে তাতে কিছু আসে যায় না। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার পূর্বে তার চেয়েও অধিকতর শক্তিশালী এবং অধিকতর ধনবান বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। সে যখন জ্ঞানের এতােই গর্ব করে, তখন ইতিহাসের এই অকাট্য সত্যটাও তার জানা উচিত ছিলাে। কেননা এই জ্ঞান তাকে ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারতো। কারূনের একথাও জানা উচিত ছিলাে যে, তাকে ও তার মতাে অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার জন্যে আল্লাহর তাদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়ােজন হয় । কেননা তারা বিচারকও নয়, সাক্ষীও নয়। এটা ছিলাে কারূনের কাহিনী প্রথম দৃশ্য। কারূনের অহংকার ও আগ্রাসন, সদুপদেশ প্রত্যাখ্যান, নিজেকে সকল উপদেশের উর্ধে মনে করা, অন্যায় অত্যাচার ও অরাজকতা বিস্তারের কাজ অব্যাহত রাখা, সম্পদের প্রাচুর্যের বড়াই এবং এই বড়াই ও দম্ভের কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা ইত্যাকার অপরাধগুলাে এই দৃশ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এরপর আসছে দ্বিতীয় দৃশ্য। এই দৃশ্যে কারূন তার গােত্রের সামনে নিজের জাকজমক প্রদর্শন করে। এ সব দেখে তাদের একাংশের মনে আক্ষেপ জন্মে, হায়, এ রকম ধনৈশ্বর্য যদি তাদেরও হতাে। কারূন তাে অসাধারণ সৌভাগ্যশালী। আর বঞ্চিতরা তাকে দেখে কেবল আক্ষেপই করছে। অন্য একটা দলের মনে তখন ঈমানী প্রেরণা উজ্জীবিত হয় এবং তা দ্বারা তারা কারূনের ধনৈশ্বর্যের মােহ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়। যারা কারূনের ধনৈশ্বর্য ও জাকজমক দেখে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছিলাে, তাদের ঈমানদার ব্যক্তিরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে আল্লাহর প্রতিদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন, কারূন জাঁকজমক সহকারে তার গোত্রের লােকদের সামনে বেরুলাে। যারা দুনিয়ার মােহে আক্রান্ত ছিলাে, তারা বললাে, হায় আক্ষেপ! আমাদের যদি কারূনের মতাে ধনসম্পদ হতাে! সে তাে দারুণ ভাগ্যবান।’ আর যাদের সত্যের জ্ঞান দান করা হয়েছিলাে তারা বললাে, ‘ধিক তােমাদের, ঈমানদার ও সৎকৰ্মশীলদের জন্যে আল্লাহর দেয়া পুরস্কারই উত্তম। এটা কেবল ধৈর্যশীলরাই পেয়ে থাকে।’ এভাবে দুনিয়ার প্রলােভনের সামনে তাদের একটা দল পরাজিত হলাে। আর অপর দলটা ঈমানদারদের, আল্লাহর কাছে যে প্রতিদান পাওনা আছে তার আশা ও আখেরাতের সওয়াবের প্রত্যয়ের জোরে জয় লাভ করলাে। ঈমান ও ধন-সম্পদ এই দুটো জিনিসের কোটা বেশী মূল্যবান, তা একই দাড়িপাল্লায় মাপা হলাে, ‘যারা দুনিয়ার মােহে আক্রান্ত, তারা বললাে, হায়, আমাদের যদি কারূনের মতাে ধন-সম্পদ হতাে। সে তাে খুবই ভাগ্যবান!’ পার্থিব ধন সম্পদ জাকজমকের প্রলােভন সকল যুগে ও সকল দেশে কিছু লােককে প্রলুব্ধ করে থাকে। যারা দুনিয়া চায়, তারাই ওসব দ্বারা প্রলুব্ধ হয় এবং এর চেয়েও সম্মানজনক কোনাে প্রাপ্তি বা প্রতিদান থাকতে পারে কিনা, সে কথা ভেবে দেখে না। তারা জিজ্ঞেস করে না, বিত্তশালী ব্যক্তি কিসের বিনিময়ে বিত্ত-বৈভব পেলাে এবং পদমর্যাদাধারী কিসের সাহায্যে পদমর্যাদা লাভ করলাে। তাই মাছি যেমন মিষ্ট দ্রব্যের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে, তারাও তেমনি দুনিয়ার সম্পদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। ভাগ্যবান বিত্তশালীদের ধনৈশ্বর্য দেখে তাদের মুখ দিয়ে লালা পড়ে। কিন্তু কতাে মূল্যবান জিনিসের বিনিময়ে এবং কতাে নােংরা পন্থায় যে তারা তা অর্জন করেছে, সেটা উপলব্ধি করে না। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর অনুগত, তাদের কাছে রয়েছে জীবনের মূল্যায়নের ভিন্ন এক দাঁড়িপাল্লা। তাদের চোখে দুনিয়াবী সম্পদের চেয়ে অন্য জিনিস অধিক মূল্যবান। তারা দুনিয়াবী সম্পদের লােভে লালায়িত হয় না। তাদের হৃদয় এর চেয়ে অনেক উচ্চ ও বড়। আল্লাহর অনুগত হওয়ার কারণে তাদের মর্যাদা এতাে উচ্চে থাকে যে, তা তাদের আল্লাহর বান্দাদের সামনে নত হতে ও তাদের ঐশ্বর্য দেখে হীনমন্যতায় আক্রান্ত হতে দেয় না। তারাই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী। তাদের কাছে রয়েছে সেই নির্ভুল ওহীর জ্ঞান, যা দ্বারা জীবনকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারে, ‘যারা জ্ঞান লাভ করেছে, তারা বললাে, ধিক তােমাদের, আল্লাহর পুরস্কার ঈমানদার ও সত্ত্বশীলদের জন্যে উত্তম…’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যা দেবেন, এই ধনৈশ্বর্যের চেয়ে উত্তম। আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা কারূনের সম্পদের চেয়ে ভালাে। আর এই উচ্চাংগের অনুভূতি ও চেতনার অধিকারী হওয়া একমাত্র ধৈর্যশীল ব্যক্তিদের পক্ষেই সম্ভব। যারা মানুষের ধন সম্পদের মাপকাঠি ও মানদন্ড দ্বারা উত্তম অধম নিরূপণ করে না, যারা দুনিয়ার জীবনের সকল প্রলােভন জয় করতে পারে এবং যারা সকল বঞ্চনা সহ্য করতে পারে, তাদের পক্ষেই এরূপ চেতনা লাভ করা সম্ভব। আল্লাহ তায়ালা যখন তাদের মধ্যে এই মানের ধৈর্য দেখতে পান, তখন তাদের অনুরূপ উচ্চাংগের চেতনা ও অনুভূতি দান করেন। ফলে তারা পৃথিবীর সকল প্রলােভন উপেক্ষা করে একমাত্র আল্লাহর প্রতিদান লাভ করার জন্যে সর্বান্তকরণে সচেষ্ট হয়। যখন কারূনের জাকজমকের প্রভাবে সামাজিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করল এবং লােকেরা ব্যাপকভাবে তার প্রতি প্রলুব্ধ হতে লাগল, তখন আল্লাহ তায়ালা এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে হস্তক্ষেপ করলেন, দরিদ্র ও দুর্বল জনগণকে প্রলােভনের শিকার হওয়া থেকে অনুগ্রহপূর্বক রক্ষা করলেন এবং কারূনের দর্প অহংকার ভেংগে চুরমার করে দিলেন। কাহিনীর এই তৃতীয় দৃশ্য এভাবে একটা চূড়ান্ত ফয়সালার আকারে আবির্ভূত হল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি কারূন ও তার প্রাসাদকে ভূ-গর্ভে ধসিয়ে দিলাম। এখন আল্লাহর আযাব থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে এমন কোনাে দল তার ছিলাে না, আর সাহায্য গ্রহণ করতেও সে সক্ষম ছিলাে না।’ একটা ক্ষুদ্র বাক্যে জানিয়ে দেয়া হলাে এক নিমেষে ঘটে যাওয়া একটা ভয়ংকর ঘটনা, ‘আমি তাকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম।’ যে মাটির ওপর একদিন সে দোর্দন্ড প্রতাপ খাটাতাে, সদম্ভে হুংকার ছাড়তাে, সেই মাটির ভেতরেই সে জ্যান্ত প্রােথিত হয়ে গেলাে। যেমন কর্ম ঠিক তেমন ফলই সে পেলাে। একেবারেই দুর্বল অসহায় ও অক্ষম অবস্থায় সে ধরাপৃষ্ঠ থেকে পাততাড়ি গুটালাে। কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলাে না এবং নিজের অগাধ ধন সম্পদ ও পদমর্যাদা কাজে লাগিয়ে সে নিজেও নিজেকে রক্ষা করতে পারলাে না। এই সাথে অবসান ঘটলাে সেই ভয়ংকর ফেতনার, যা অনেককে বিপথগামী করতে শুরু করে দিয়েছিলাে। কারূনের ধ্বংসলীলা মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দিলাে এবং তাদের মন থেকে সকল বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা দূর করে দিলাে। এটাই ছিলাে কাহিনীটার শেষ দৃশ্য। ‘যারা গতকাল কারূনের মতাে হবার আকাংখা পােষণ করেছিলাে, তারা সকাল বেলা বলতে লাগলাে…’ অর্থাৎ আজ তারা আল্লাহকে এ জন্যে প্রশংসা করতে ও ধন্যবাদ দিতে লাগলাে যে, গতকাল তারা মনে মনে যে আশা পােষণ করছিলাে তা তিনি পূরণ করেননি এবং কারূনকে যেমন ধন-সম্পদ দিয়েছেন তা তাদের দেননি। কেননা তারা মাত্র একদিন ও এক রাতের মধ্যেই কারূনের শােচনীয় পরিণাম স্বচক্ষে দর্শন করেছে। তারা উপলব্ধি করেছে যে, প্রাচুর্য ও ধনৈশ্বর্য আল্লাহর সন্তুষ্টির আলামত নয়; বরং তিনি যাকে ইচ্ছা করেন, বিপুল সম্পদ দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছা করেন, তার ওপর অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত না হলেও অন্যান্য কারণে সম্পদ হ্রাস করেন। ধন ঐশ্বর্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষণ হতাে তাহলে কারূনকে এমন ভয়ংকরভাবে পাকড়াও করতেন না। এটা হলাে একটা পরীক্ষা। এ ধরনের পরীক্ষার পর আল্লাহ তায়ালা কখনও কখনও বিপদ-মসিবত দিয়ে থাকেন। সবাই জানে, কাফেররা সফলকাম হয় না। কারুন যদিও খােলাখুলিভাবে কুফরীসূচক কোনাে কথা বলেনি, কিন্তু ধন সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে দম্ভ করা ও তা তার নিজের জ্ঞানের কারণে হয়েছে বলে মনে করার দরুন জনগণ তাকে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। তার ধ্বংসীলালার ধরন দেখে তারা ধরে নিয়েছে, সে কাফের সুলভ মৃত্যুই বরণ করেছে।
* এখানে এসে এই দৃশ্যের যবনিকাপাত ঘটেছে। আল্লাহর সময়ােচিত আকস্মিক হস্তক্ষেপ এখানে মােমেনদের বিজয় সূচিত ও ঈমানের পাল্লা ভারী করেছে অতপর, ঘটনার সময়ােচিত পর্যালােচনা শুরু করা হয়েছে। ‘এটা হলাে আখেরাতের সেই বাসস্থান, যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক নয়, তাদের জন্যেই এটা নির্দিষ্ট করেছি। শুভ পরিণাম তাে আল্লাহভীরুদের জন্যেই।'(আয়াত ৮৩) অর্থাৎ কারূনের গােত্রের মধ্য থেকে ওহীর জ্ঞানপ্রাপ্ত মােমেনরা যে আখেরাতের কথা বলেছিলাে, এ হচ্ছে সেই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ও সুদূরপ্রসারী আখেরাত। সেই নির্ভুল ও সত্য জ্ঞানের ভিত্তিতেই তারা এর কথা বলেছিলাে, যে জ্ঞান যাবতীয় জিনিসের যথাযথ মূল্যায়ন করে থাকে। ‘যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না, আমি তাদের জন্যেই এটা নির্দিষ্ট করেছি।’ অর্থাৎ যারা নিছক নিজেদের উচ্চ ক্ষমতা ও মর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করে না, বরং আল্লাহর বিধান জীবনে বাস্তবায়িত করার জন্যে তৎপর থাকে, আখেরাতের কল্যাণ কেবল তাদেরই প্রাপ্য। তারা দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধার করতে চায় না এবং কোনাে ফাসাদেও জড়িত হতে চায় না। ‘শুভ পরিণাম তাে কেবল আল্লাহভীরুদের জন্যে।’ অর্থাৎ যারা আল্লাহর অসন্তোষকে এড়িয়ে চলে ও তার সন্তোষ কামনা করে তাদের জন্যে। সেই আখেরাতের বাসস্থানেই আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিশ্রুত প্রতিদান দেবেন। সে প্রতিদান হবে সৎকর্মের চেয়ে উত্তম ও বহুগুণ উৎকৃষ্ট। কিন্তু অসৎ কর্মের ফল দেয়া হবে শুধু এক গুণ। বান্দার দুর্বলতার প্রতি দয়া প্রদর্শন ও তার হিসাব সহজ করার জন্যেই এ ব্যবস্থা। ‘যে ব্যক্তি সৎ কাজ করবে সে তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান পাবে…'(আয়াত ৮৪) এখানে এ সূরার কাহিনীগুলাে শেষ হলাে। সেই সাথে এসব কাহিনীর ওপর প্রত্যক্ষ পর্যালােচনাও সমাপ্ত হলাে।
*মােহাজেরদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওয়াদা : এখন রসূল(স.)-কে এবং তাঁর মাধ্যমে সেদিন তার সাথে মক্কায় অবস্থানকারী সংখ্যালঘু মুসলমানদের সম্বােধন করা হচ্ছে। এ সময় রসূল(স.)-কে তার জন্মস্থান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলাে। তিনি মদীনায় রওনা হয়েছেন কিন্তু পৌছেননি। তিনি তখনাে মক্কার নিকটবর্তী জুহাতে ছিলেন। অর্থাৎ তখনও তিনি বিপদ মুক্ত নন। তার চোখ ও মন প্রিয় মাতৃভূমির সাথে লেগে রয়েছে। মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়া তার কাছে কষ্টকর লাগছে। তবে তার দাওয়াত অব্যাহত রাখা তার কাছে তার শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত মাতৃভূমির চেয়েও প্রিয় ছিলাে। তাই তিনি মদীনায় যাত্রা করেছেন। এই অবস্থায় তাকে সম্বােধন করে বলা হচ্ছে, ‘যিনি তােমার ওপর কোরআন সমর্পণ করেছেন তিনি তােমাকে অবশ্যই তােমার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন…’ কেননা তিনি তােমার ওপর কোরআনের দায়িত্ব ও ইসলামের দাওয়াত প্রচারের কাজ অর্পণ করেছেন। তিনি তােমাকে মােশরেকদের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন না, যারা তােমাকে তােমার প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে, তােমার ওপর ও তােমার আন্দোলনের ওপর দমন নীতি চালায় এবং তােমার সাথী মােমেনদের নির্যাতন করে। যে সময়ের ভেতরে তিনি তােমাকে বিজয়ী করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সে সময়ের ভেতরে তােমাকে বিজয়ী করবেন বলেই তিনি তােমাকে কোরআন দিয়েছেন। আজ তুমি মক্কা থেকে বহিষ্কার ও বিতাড়িত, কিন্তু ভবিষ্যতে তােমাকে সাহায্য করা হবে এবং তুমি ওখানে অবশ্যই ফিরে যাবে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা সেই কঠিন ও দুর্যোগময় মুহূর্তে তাঁর বান্দার ওপর এই নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি নাযিল করার প্রাজ্ঞ পদক্ষেপ নিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিলাে এই যে, তিনি যেন নির্দ্বিধায় ও পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে তার গন্তব্যের দিকে রওনা হয়ে যেতে পারেন। আল্লাহর ওয়াদা যে সত্য সে ব্যাপারে তার কণামাত্রও সন্দেহ ছিলাে না। আল্লাহর ওয়াদা সর্বকালে আল্লাহর পথের সকল পথিকের জন্যেই সমভাবে কার্যকর। আল্লাহর পথে যে কেউ নির্যাতন ভােগ করবে, ধৈর্যধারণ করবে ও সত্যের ওপর বিশ্বাসী থাকবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী করবেন। যখন সে সাধ্যমতাে সকল চেষ্টা সম্পন্ন করে এবং নিজের সকল দায়িত্ব পালন করে, তখন তার সংগ্রাম সাধনাকে সফল করার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করেন। হযরত মূসা(আ.)ও যে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে সেখানে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তারপর তাকে দিয়ে দুর্বল বনী ইসরাঈলীদের মুক্ত করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার দলবলকে ধ্বংস করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার দাওয়াত গ্রহণকারীরাই সফল হয়েছিলাে। সুতরাং তুমিও তােমার পথে চলতে থাকে এবং তােমার ও তােমার জাতির মধ্যে নিষ্পত্তির দায়িত্ব আল্লাহর ওপর অর্পণ করাে, যিনি তােমার ওপর কোরআনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। ‘তুমি বলাে, আমার মালিকই ভাল জানেন কে সুপথগামী এবং কে সুস্পষ্ট বিপথগামী।’ আর সুপথপ্রাপ্ত ও বিপথগামীদের কর্মফল দেয়ার কাজটা আল্লাহর ওপর অর্পণ করাে। *ইসলামবিরােধীদের সহযােগীতা না করার নির্দেশ : পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে যে, ‘তােমাকে কোরআনের দায়িত্ব অর্পণ করা আল্লাহর এক নেয়ামত ও রহমত ছাড়া আর কিছু নয়।’ এই গুরুদায়িত্ব তােমার ওপর অর্পিত হবে সে কথা তুমি ভাবতেও পারােনি। এটা এক মহান কাজ, যা তােমাকে করতে না বলা পর্যন্ত তুমি চেয়ে নিতে পারতে না! ‘তুমি আশা করতে পারতে না যে, তােমার ওপর কিতাব নাযিল হবে, তবে এটা একান্তই আল্লাহর রহমত হিসেবে নাযিল হয়েছে।’ এ আয়াত থেকে অকাট্যভাবে জানা গেলাে যে, রসূল(স.) কখনাে আবেদন করে রসূল হননি। এটা ছিলাে আল্লাহর নিয়ােগ। আল্লাহ তায়ালা যে কোনাে জিনিসের সৃষ্টি ও নিয়ােগে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আল্লাহর নিয়ােগ ও তার কাছ থেকে এর যােগ্যতা না পাওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে কোনাে মানুষ চিন্তাও করতে পারে না। আল্লাহর এই নিয়ােগ ও মনােনয়ন মানব জাতির ওপর এবং যাকে নিয়ােগ করেন তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ। রসূল বা নবী হিসেবে কাউকে নিয়ােগ দান করে আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে হেদায়াত করেন। এ অনুগ্রহ শুধু মনােনীত ব্যক্তিরাই পায়, যারা চায় তারা পায় না। আরবে ও বনী ইসরাঈলে অনেকেই শেষ যুগের প্রতিশ্রুত নবী হতে উদগ্রীব ছিলাে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকেই শেষ নবী বানালেন, যিনি তা চাননি, আশাও করেননি। যারা এর জন্যে লালায়িত ছিলাে ও প্রার্থী ছিলো, তাদের কাউকে রাসূল বানাননি। যার ভেতরে এর যোগ্যতা আছে বলে তিনি জানতেন তাকেই রাসূল করে পাঠিয়েছেন। এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন তিনি এই কিতাবের মতাে নেয়ামত লাভ করার পর কোনােক্রমেই কাফেরদের প্রতি নমনীয় না হন এবং সাবধান করে দিচ্ছেন যেন কাফেররা তাকে আল্লাহর নাযিল করা আয়াতগুলাের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকে বিরত রাখতে না পারে। তাকে আরাে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, ‘শিরক ও মুশরিকদের মােকাবেলায় তিনি যেন সব সময় নির্ভেজাল তাওহীদ প্রচার করেন'(আয়াত ৮৬-৮৭) এ হচ্ছে সূরার সর্বশেষ উক্তি। এ দ্বারা রসূল(স.)-এর পথ এবং কুফর-শিরকের পথ পৃথক করা হয়েছে। এ দ্বারা কেয়ামত পর্যন্ত রসূল(স.)-এর যত অনুসারী হবে, তাদেরও তাদের পথ দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। এ উক্তি তখনই ঘােষিত হচ্ছে, যখন রসূল(স.) হিজরত করে মদীনায় চলে যাচ্ছেন। এ হিজরত ছিলাে ইতিহাসের দুটো যুগের মধ্যবর্তী একটা যুগান্তকারী ঘটনা। ‘অতএব তুমি কাফেরদের সহযােগী হয়াে না।’ কেননা কাফেরদের ও মােমেনদের মধ্যে সহযোগিতার কোনাে অবকাশ নেই। উভয়ের পথ ভিন্ন। উভয়ের জীবন ব্যবস্থা আলাদা। মােমেনরা হলাে আল্লাহর দল আর কাফেররা শয়তানের দল। কাজেই তাদের মধ্যে সহযোগিতার প্রশ্নই ওঠে না। আল্লাহর আয়াতগুলাে তােমার ওপর নাযিল হবার পর কাফেররা যেন তােমাকে তা থেকে ফিরিয়ে না রাখতে পারে…’ কাফেরদের চিরাচরিত নীতি হলাে, যারা দাওয়াতের কাজে নিয়ােজিত তাদের দাওয়াত থেকে ফেরানাে, তা যে কোনাে পন্থায় ও যে কোনাে কৌশলেই হােক। আর মােমেনদের চিরাচরিত নীতি হলাে তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া। কোনাে শক্র তাদের তা থেকে ফেরাতে পারে না। কেননা তাদের কাছে আল্লাহর আয়াতসমূহ রয়েছে। ‘এগুলাে তাদের কাছে আমানত রাখা হয়েছে। এবং তােমার প্রভুর দিকে ডাকো।’ অর্থাৎ খালেসভাবে ও স্পষ্টভাব ডাকো। শুধু আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাও, কোনাে জাতীয়তা বা গােত্রপ্রীতির দিকে নয়, কোনাে ভূমি বা পতাকার দিকেও নয়, কোনাে আর্থিক স্বার্থের দিকেও নয়, কোনাে প্রবৃত্তির কামনা বাসনা চরিতার্থ করার দিকেও নয়। যে ব্যক্তি এই নির্ভেজাল দাওয়াতের অনুসারী হতে ইচ্ছুক, তার হওয়া উচিত, আর যে অন্য কিছু চায় তার জন্যে এ পথ নয়। ‘তুমি কোনােক্রমেই মােশরেক হয়াে না।’ শিরক ও আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহরূপে গ্রহণ করতে দুবার নিষেধ করা হলাে। কেননা এটাই ইসলামী আকীদার প্রধানতম মূলনীতি। এর ওপরই ইসলামের সমগ্র আকীদা শাস্ত্র, আইন বিধান ও নীতিমালার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত । এটাকে কেন্দ্র করেই সমগ্র ইসলামী আইন ও বিধান প্রণীত হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেক আইন প্রণয়নের আগে এই মূলনীতি উল্লেখ করা হয়ে থাকে। পুনরায় এই মূলনীতি ঘােষণা করা হচ্ছে, ‘তিনি ছাড়া আর কোনাে ইলাহ নেই। তিনি ছাড়া আর সব জিনিস ধ্বংসশীল। ফয়সালা করা একমাত্র তারই অধিকার, একমাত্র তার কাছেই তােমরা ফিরে যাবে।’ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে অনুগত্য চলে না, আর কারাে দাসত্ব চলে না, আর কেউ শক্তির উৎস নয়, আর কেউ আশ্রয়স্থল ও রক্ষক নয়। তিনি ছাড়া সব কিছুই ধ্বংসশীল। সব কিছুই মরণশীল। সব কিছুই ক্ষয়িষ্ণু। সম্পদ, পদ, ক্ষমতা, জীবন, জীবনােপকরণ, সব কিছুই ধ্বংসশীল। এই পৃথিবী ও এর সকল অধিবাসী, আকাশ ও আকাশের সব কিছু, মহাবিশ্ব ও মহাবিশ্বের যেখানে জানা অজানা যত কিছু আছে, সবই ধ্বংসশীল। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ স্থায়ী নয়। ফয়সালা একমাত্র তাঁরই অধিকার।’ তিনি যা খুশী ফয়সালা করেন, যেমন খুশী শাসন করেন। তার শাসনে কেউ শরীক হয় না। তার ফয়সালা কেউ নাকচ করে না, তার আদেশ কেউ বাধাগ্রস্ত করে না। তিনি যা চান শুধু তাই হয়, আর কিছু হয় না। একমাত্র তাঁর কাছেই তােমরা ফিরে যাবে। সুতরাং তাঁর শাসনের বাইরে যাওয়ার জায়গা নেই, তার ফয়সালা এড়িয়ে যাওয়ার এবং তার কাছে ছাড়া আর কোথাও আশ্রয় নেয়ার উপায় নেই। এখানে এই সূরাটা শেষ হচ্ছে। এ সূরায় আল্লাহর হাত সদা সক্রিয় দেখতে পাওয়া যায়। আল্লাহর দিকে দাওয়াতের আন্দোলনকে তিনি সব সময় প্রহরা দেন ও রক্ষা করেন এবং আল্লাহদ্রোহী স্বৈরাচারী শক্তিকে ধ্বংস ও নির্মূল করেন। সবার শেষে ইসলামের মূলনীতি আল্লাহর একত্বের ঘােষণার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তাঁকেই একমাত্র মাবুদ, চিরঞ্জীব মাবুদ, সার্বভৌম মনিব ও চূড়ান্ত ফয়সালাকারী প্রভু ঘােষণা করা হয়েছে। যাতে ইসলামের দাওয়াতদাতারা তাঁর ওপর সর্বাত্মকভাবে নির্ভরশীল হয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে, অবিচল নিষ্ঠা সহকারে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৭৬-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াতগুলোতে কারূনের গর্ব অহঙ্কার ও তার শেষ পরিণতির কথা বলা হয়েছে।
সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত মূসা (عليه السلام), ফির‘আউন ও ফির‘আউনের বংশধরদের সাথে মূসা (عليه السلام)-এর একক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এখানে তাঁরই সম্প্রদায়ভুক্ত বিশিষ্ট সম্পদশালী কারূনের অর্থ সম্পদের অহঙ্কার ও তার শেষ পরিণতি সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে। পূর্ববর্তী আয়াতসমূহের সাথে এর সম্পর্ক হলন পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছিল দুনিয়ার ধন-সম্পদ ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং দুনিয়ার সম্পদের মোহে পড়ে আখিরাতের কথা ভুলে যাওয়া যাবে না। কারূন এমনই করেছিল। দুনিয়ার সম্পদ পেয়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ভুলে গিয়েছিল, সম্পদের অহঙ্কার করত। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধ্বংস করে দেন। তাছাড়া আরো একটি সম্পর্ক হলন মুশরিকদেরকে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে যে, হে মুশরিকরা! তোমরা কারূন ও ফির‘আউনের চেয়ে অধিক সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান নও, তাদের অনেক সম্পদ ও ক্ষমতা ছিল কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার সাথে নাফরমানী করার কারণে তাদের এসব সম্পদ ও ক্ষমতা কোন কাজে আসেনি। সুতরাং তোমাদেরকে হুশিয়ার করছি, তোমরাও যদি তাদের মত আচরণ কর তাহলে তোমাদের পরিণতি তাদের মতই হবে।
কারূন ছিল মূসা (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ভুক্ত। কাতাদাহ বলেন: সে ছিল মূসা (عليه السلام)-এর চাচাত ভাই। এছাড়াও আরো অনেক উক্তি রয়েছে (কুরতুবী)।
(فَبَغٰي عَلَيْهِمْ) -بغي
কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ হল জুলুম করা, অত্যাচার করা। অর্থাৎ সে ধন-সম্পদের নেশায় মানুষের প্রতি জুলুম করত। সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব বলেন: কারূন ছিল বিত্তশালী। ফির‘আউন তাকে বানী ইসরাঈলের দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত করেছিল। এ পদে থাকা অবস্থায় সে বানী ইসরাঈলের ওপর জুলুম করত।
এর অপর একটি অর্থ অহঙ্কার করা। অনেকে এ অর্থ ধরে বলেছেন: কারূন ধন-দৌলতের নেশায় বিভোর হয়ে বানী ইসরাঈলদের কাছে অহঙ্কার করত। তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করত।
– (وَاٰتَيْنٰهُ مِنَ الْكُنُوْزِ) كنوز
শব্দটি كنز এর বহুবচন। এর অর্থ ভূগর্ভস্থ ধন-সম্পদ। শরীয়তের পরিভাষায় كنز বলা হল এমন সম্পদকে যার যাকাত দেয়া হয়নি।
(لَتَنُوْ۬ءُ بِالْعُصْبَةِ) ناء-
শব্দের অর্থ বোঝার ভারে ঝুঁকিয়ে দেয়া। عصبة শব্দের অর্থ দল, অর্থাৎ তার সম্পদ এত বেশি পরিমাণ ছিল যে, সম্পদের চাবি বহন করতে একটি শক্তিশালী দলের কষ্টসাধ্য হয়ে যেত
(لَا تَفْرَحْ) এর শাব্দির অর্থ আনন্দ, উল্লাস। কুরআনের অনেক আয়াত এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এখানে অহঙ্কার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তার এ গর্ব অহঙ্কার দেখে তার সম্প্রদায়ের সৎ লোকেরা বলেছিল, অহঙ্কার কর না। আল্লাহ তা‘আলা অহঙ্কারীকে ভালবাসেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ط إِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ)
“আর তুমি অহঙ্কারবশে মানুষকে অবহেলা কর না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে বিচরণ কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে ভালোবাসেন না।” (সূরা লুকমান ৩১:১৮)
বরং এ সব গর্ব অহঙ্কার ভুলে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে যা দান করেছেন তা দ্বারা আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর। এর মানে এটি নয় যে, তুমি দুনিয়াকে ভুলে যাও, সব কিছু আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করে দাও। বরং তুমি দুনিয়াতে ভাল নেয়ামত দ্বারা উপকৃত হও ও তোমার সম্পদ দ্বারা উপকৃত হও, তবে যেন তা দীনের ওপর প্রাধান্য না পায়। বরং দুনিয়া অর্জনের সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অন্বেষণ কর। আল্লাহ তা‘আলা যেমন তোমাকে ধন-সম্পদ দান করে তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন তেমনি তুমিও তার সৃষ্টি জীবের প্রতি অনুগ্রহ কর। আর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি কর না। তাদের এ সকল উপদেশ বাণী শুনে কারূন বলল,
(إِنَّمَآ أُوْتِيْتُه۫ عَلٰي عِلْمٍ عِنْدِيْ)
আমি এ সম্পদ আমার জ্ঞান দ্বারা প্রাপ্ত হয়েছি। এটা মূলত আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতকে অস্বীকার করা, সে স্বীকার করতে চায় না এগুলো আল্লাহ তা‘আলার দান, তার প্রতি অনুগ্রহ করা হয়েছে। বরং সে বলছে, আমার জ্ঞান দ্বারা তা উপার্জন করেছি। এরূপ বলা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের সাথে কুফরী করা। সুতরাং বলতে হবে এসবই আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ, তিনি আমাকে দান করেছেন। তিনি ইচ্ছা করলে তা নিয়ে নিতে পারেন। তাই আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায়ার্থে তার হক আদায় করতে হবে এবং উপযুক্ত অংশ ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ز ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنٰهُ نِعْمَةً مِّنَّا لا قَالَ إِنَّمَآ أُوْتِيْتُه۫ عَلٰي عِلْمٍ)
“মানুষকে দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করলে সে আমাকে ডাকে, অতঃপর যখন আমি তার প্রতি অনুগ্রহ প্রদান করি আমার পক্ষ থেকে তখন সে বলে: আমাকে এটা দেয়া হয়েছে আমার জ্ঞানের বিনিময়ে।” (সূরা যুমার ৩৯:৪৯)
(أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللّٰهَ)
অর্থাৎ কারূন ভুলে গিয়েছে যে, তার পূর্বে আরো বহু শক্তিশালী জনগোষ্ঠিকে তাদের এ সকল গর্ব অহঙ্কারের কারণে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে । তাই পূর্ববর্তীদের অবস্থার মত তারও অশুভ পরিণতি হল।
অতঃপর সে একদা গর্ব অহঙ্কারবশত জাঁকজমক পোশাক পরিধান করে তার সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট গিয়েছিল। তখন যারা দুনিয়া কামনা করত তারা বলল, যদি আমাদেরকে কারূনের মত ধন-সম্পদ দেয়া হত। আর যারা ছিল ঈমানদার তারা বলেছিল, তার নিকট যা আছে তা অপেক্ষা আল্লাহ তা‘আলার নিকট যা আছে তা অধিক উত্তম। আর তা প্রাপ্ত হবে যারা ঈমান আনে, সৎ আমল করে এবং ধৈর্য ধারণ করে তারাই। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আমি আমার বান্দাদের জন্য এমন কিছু প্রস্তুত করে রেখেছি যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান শ্রবণ করেনি এবং কোন মানুষের অন্তর কল্পনাও করেনি। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৭৯)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা কারূন ও তার প্রাসাদকে তার গর্ব অহঙ্কারের কারণে ভূগর্ভে প্রোথিত করে দিলেন। যা থেকে তাকে কেউ রক্ষা করতে পারেনি। তার এ অবস্থা দেখে গতকাল যারা তার মত হবার কামনা করেছিল তারা অনুতপ্ত হল।
সুতরাং আমাদের উচিত কারূনের মত না হয়ে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করা, তাঁর দেয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা এবং সম্পদের হক আদায় করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সম্পদ একটি নেয়ামত, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তাকেই তা দান করেন, তাই তার সদ্ব্যবহার করতে হবে।
২. কোন নেয়ামত পেয়ে গর্ব-অহঙ্কার করা যাবে না।
৩. পার্থিব সম্পদের প্রতি লোভ-লালসায় আখিরাত ভুলে যাওয়া যাবে না।
৪. মানুষের সাথে নম্র-ভদ্র ব্যবহার করতে হবে।
৫. ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা যাবে না।
৬. শুধু আখিরাতের আশায় দুনিয়ার প্রাপ্য বা অংশ গ্রহণ করা শরীয়তসম্মত।
৮৩-৮৪ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে বলা হচ্ছে, যারা দুনিয়াতে অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায় না বরং ঈমানের সাথে ভাল কাজ করে তাদের জন্য জান্নাত প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আর যারা এর ব্যতিক্রম করবে, সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে, অহঙ্কার করে বেড়াবে, ঈমান ও আমলের পরওয়া করবে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেন। কেউ একটি ভাল আমল করলে তাকে তার উপযুক্ত বিনিময়ের চেয়ে আরো উত্তম প্রতিদান দেবেন। কিন্তু খারাপ আমল করলে খারাপের যতটুকু পরিণাম ততটুকুই দেবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ جَا۬ءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَه۫ عَشْرُ أَمْثَالِهَا ج وَمَنْ جَا۬ءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجْزٰٓي إِلَّا مِثْلَهَا وَهُمْ لَا يُظْلَمُوْنَ)
“কেউ কোন সৎ কাজ করলে সে তার প্রতিদান দশ গুণ পাবে এবং কেউ কোন অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু তারই প্রতিফল দেয়া হবে, আর তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।” (সূরা আন‘আম ৬:১৬০)
অতএব আমাদের উচিত নম্র-ভদ্রভাবে মানুষের সাথে ব্যবহার করা এবং গর্ব-অহঙ্কার বর্জন করা। কেননা এগুলো বর্জন না করা হলে জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সৎ আমল জান্নাতে যাবার মাধ্যম আর অসৎ আমল জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।
২. বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার করুণা যে, তিনি সৎ আমলের প্রতিদান বহুগুণে বাড়িয়ে দেন।
৮৫-৮৮ নং আয়াতের তাফসীর:
(إِنَّ الَّذِيْ فَرَضَ عَلَيْكَ….)
উক্ত আয়াতে মূলত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা প্রদান করছেন এবং তাবলীগী কাজে অবিচল থাকার প্রতি জোর দিচ্ছেন। সূরার শুরুতে মূসা (عليه السلام) ও তাঁর শত্র“ ফির‘আউনের ঘটনা বিস্তারিত আলোচনা করার পর সূরার শেষে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে চাচ্ছেনন মূসা (عليه السلام)-কে ফির‘আউন ও তার বাহিনী হত্যা করতে চেয়েছিল, তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে এবং তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করে। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে ফির‘আউনের ওপর বিজয় দান করেন এবং নিজ দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। অনুরূপ হে রাসূল! মক্কার কাফিররা তোমাকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে, তোমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে এবং অমানবিক নির্যাতন করেছে। আল্লাহ তাঁর রীতি অনুযায়ী তোমাকেও বিজয় দান করবেন এবং মক্কায় তোমার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন।
(إِنَّ الَّذِيْ فَرَضَ عَلَيْكَ الْقُرْاٰنَ)
অর্থাৎ যে পবিত্র সত্তা তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করে বিধি-বিধান দিয়েছেন সে সত্তা তোমাকে ‘মাআদে’ ফিরিয়ে আনবেন। ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন:
(لَرَآدُّكَ إِلٰي مَعَادٍ)
অর্থাৎ মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৭৩) অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এ কথাই বলেছেন। (তাফসীর কুরতুবী, মুয়াসসার) তবে আল্লামা সাদী বলেন: যে আল্লাহ তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করে বিধি-বিধান দিয়েছেন। যথা হালাল-হারাম বর্ণনা করে দিয়েছেন ও তোমাকে দাওয়াতী কাজের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর হিকমতের শানে এটা উপযোগী নয় যে, ভাল-মন্দ কর্মের প্রতিদান না দিয়ে দুনিয়ার জীবনের মাঝেই সব শেষ করে দেবেন। বরং অবশ্যই তোমাকে আখিরাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তথায় ভাল কাজের উত্তম প্রতিদান দেবেন আর মন্দ কর্মের উপযুক্ত শাস্তি দেবেন। (তাফসীর সাদী)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি তাঁর অন্যতম একটি বড় অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কয়েকটি নির্দেশ প্রদান করছেন। অনুগ্রহ হলন তিনি তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করেছেন, অথচ তুমি জানতেও না যেন তুমি একজন নাবী হবে, তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করে সম্মানিত করা হবে। এটা মূলত তোমার প্রতি মহান আল্লাহ তা‘আলার একটা বড় অনুগ্রহ। সুতরাং যে আল্লাহ তা‘আলা তোমার প্রতি এত বড় নেয়ামত দান করেছেন তাঁর নির্দেশ হল-কখনো কাফিরদের সাহায্য করবে না। কুরআন নাযিল হওয়ার পর কারো কোন কথা বা মন্তব্য, মোট কথা কোন কিছুই যেন আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ থেকে তোমাকে বিরত না রাখতে পারে। আল্লাহ তা‘আলার দিকে মানুষকে আহ্বান কর, আর কখনো শির্কী কাজ করে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
(كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَه)
‘তাঁর চেহারা ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল।’ وجه শব্দের অর্থ চেহারা, যা আমাদের কাছে পরিচিত। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার চেহারা কেমন তা আমাদের জানা নেই, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সংবাদ দেননি, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসেও বলেননি। সুতরাং আমরা অন্যান্য সিফাতের ন্যায় বিশ্বাস করব আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত চেহারা রয়েছে, যেমন তাঁর সত্তার সাথে উপযোগী। কোন মাখলূকের চেহারার সাথে সাদৃশ্য দিতে যাব না, আর অস্বীকারও করব না। হাদীসে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لَأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَي إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ
আল্লাহ তা‘আলার পর্দা হল নূর, যদি তা উন্মোচন করেন তাহলে তাঁর চেহারার উজ্জ্বলতা ও নূর ঐ পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলবে সৃষ্টির যে পর্যন্ত তাঁর দৃষ্টি পৌঁছবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭৯)।
অনেকে বলতে পারেন তাহলে আল্লাহ তা‘আলার চেহারা ব্যতীত সব ধ্বংস হয়ে যাবে? উত্তর: আপনি যদি বলতে চান, এখানে চেহারা দ্বারা উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তা‘আলার সম্পূর্ণ সত্তা, তাহলেও কোন সমস্যা নেই। এখানে وجه দ্বারা এমন সত্তার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে যার চেহারা রয়েছে। যদি চেহারা না থাকত তাহলে এ শব্দ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সত্তাকে ব্যক্ত করতে পারতেন না। সুতরাং যারা وجه দ্বারা তাফসীর করে থাকে এমন আমল যা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য করা হয় বা রূপক অর্থে এ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলার কোন চেহারা নেই, যদি বলি আল্লাহ তা‘আলার চেহারা আছে তাহলে আল্লাহ তা‘আলার আকার সাব্যস্ত করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি তাদের তাফসীর ভুল ও বিকৃত।
তাই প্রত্যেক মু’মিনের বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যে সকল গুণ নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সহীহ হাদীসে উল্লেখ করেছেন তা আল্লাহ তা‘আলার শানে যেমন উপযুক্ত তেমনি, আমাদেরকে যতটুকু জানানো হয়েছে ততটুকুর প্রতি ঈমান আনব। কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও অপব্যাখ্যা করা যাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার চেহারা রয়েছে যেমন তাঁর সত্তার জন্য উপয্ক্তু।
২. আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না।
৩. সকলকে একদিন আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে যেতে হবে।
৪. কুরআনের মাধ্যমে এক জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা উত্থান করেন অপর জাতির পতন ঘটান।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# সাতান্ন আয়াত থেকে মক্কার কাফেরদের যে আপত্তি সম্পর্কে লাগাতার ভাষণ চলছে এ ঘটনাটিও তারই জবাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একথাটিও মনে রাখতে হবে যে, যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের কারণে জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবার ভয় প্রকাশ করেছিল তারা আসলে ছিল মক্কার বড় বড় শেঠ, মহাজন ও পুঁজিপতি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সূদী কারবার তাদেরকে সমকালীন কারূণে পরিণত করেছিলো। তারাই মনে করছিল বেশি বেশি করে ধন সম্পদ আহরণ করাই হচ্ছে আসল সত্য। এ উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে গিয়ে যে জিনিস থেকেই কিছু ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে তা সরাসরি বাতিল করতে হবে। কোন অবস্থাতেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ধন-সম্পদের এ উঁচু স্তম্ভগুলোকে আকাংখার দৃষ্টিতে দেখতো এবং তাদের চূড়ান্ত কামনা হতো, যে উচ্চতায় এরা পৌঁছেছে হায়। যদি আমাদের সেখানে পৌঁছুবার সৌভাগ্য হতো! চলমান অর্থ গৃধনুতার পরিবেশে এ যুক্তি বড়ই শক্তিশালী মনে করা হচ্ছিল যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে তাওহীদ, আখেরাত ও নৈতিক বিধি-বন্ধনের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন তা মেনে নেয়া হলে কুরাইশদের উচ্চ মর্যাদার গগণচুম্বী প্রাসাদ ধূলোয় লুটিয়ে পড়বে এবং এক্ষেত্রে ব্যবসা বাণিজ্য তো দূরের কথা জীবন ধারণই কঠিন হয়ে পড়বে।
# বাইবেল ও তালমূদে কারূনকে কোরহ (Korah) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে ছিল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের চাচতো ভাই। বাইবেলের যাত্রাপুস্তকে (৬ অধ্যায় ১৮-২১ শ্লোক) যে বংশধারা বর্ণনা করা হয়েছে, তার দৃষ্টিতে বলা যায় হযরত মূসা ও কারূনের পিতা উভয়ই ছিল পরস্পর সহোদর ভাই। কুরআন মজীদের অন্য স্থানে বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি বনী ইসরাঈলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ফেরাউনের সাথে হাত মিলিয়েছিল এবং তার নৈকট্য লাভ করে এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, মূসা আলাইহিস সালামের দাওয়াতের মোকাবিলায় ফেরাউনের পরে বিরোধিতার ক্ষেত্রে যে দু’জন প্রধান দলপতি বেশি অগ্রসর ছিল তাদের একজন ছিল এ কারূনঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآيَاتِنَا وَسُلْطَانٍ مُبِينٍ – إِلَى فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَقَارُونَ فَقَالُوا سَاحِرٌ كَذَّابٌ
“আমি মূসাকে আমার নিদর্শনসমূহ এবং সুস্পষ্ট যুক্তি সহকারে ফেরাউন, হামান ও কারূনের কাছে পাঠালাম। কিন্তু তারা বলল, এ একজন যাদুকর ডাহা মিথ্যুক।” (আল-মু’মিনঃ ২৩-২৪) এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, কারূন নিজের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে এমন শত্রু শক্তির ধামাধরায় পরিণত হয়েছিল, যে বনী ইসরাঈলকে শিকড় শুদ্ধ উপড়ে ফেলার সর্বাত্নক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। আর এ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার বদৌলতে ফেরাউনের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সে এমন গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছিল যে, হযরত মূসা ফেরাউন ছাড়া আর যে দু’জন বড় বড় সত্ত্বার কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের দু’জনের একজন ছিল ফেরাউনের মন্ত্রী হামান এবং অন্যজন এ ইসরাঈলী শেঠ। বাকি রাষ্ট্রের অন্য সভাসদ ও কর্মকর্তারা ছিল অপেক্ষাকৃত নিম্ন পর্যায়ের। কাজেই তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল না। কারূনের এ মর্যাদাটিই সূরা আন কাবূতের ৩৯ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
# বাইবেলে (গণনা পুস্তকের ১৬ অধ্যায়) তার যে কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে এ ব্যক্তির ধন-দৌলতের কোন কথা বলা হয়নি। কিন্তু ইহুদী বর্ণনাসমূহ থেকে জানা যায়, এ ব্যক্তি অগাধ ধন-সম্পদের মালিক ছিল, এমনকি তার ধনাগারের চাবিগুলো বহন করার জন্য তিনশো খচ্চরের প্রয়োজন হতো। (জুয়িশ ইনসাইক্লোপিডিয়া, ৭ খণ্ড, ৫৫৬ পৃষ্ঠা) এ বর্ণনাটি যদিও অনেক বেশি অতিরঞ্জিত তবুও এ থেকে এতটুকু জানা যায় যে, ইসরাঈলী বর্ণনাবলীর দৃষ্টিতেও কারূন ছিল তৎকালের সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তি।
# আসল শব্দগুলো হচ্ছে إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, আমি যা কিছু পেয়েছি নিজের যোগ্যতার বলে পেয়েছি। এটা কোন অনুগ্রহ নয়। অধিকার ছাড়াই নিছক দয়া করে কেউ আমাকে এটা দান করেনি। তাই আমাকে এখন এজন্য এভাবে কারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই যে, যেসব অযোগ্য লোককে কিছুই দেয়া হয়নি তাদেরকে দয়া ও অনুগ্রহ হিসেবে আমি এর মধ্য থেকে কিছু দেবো অথবা আমার কাছ থেকে এ সম্পদ যাতে ছিনিয়ে নিয়ে না নেয়া হয় সেজন্য কিছু দান খয়রাত করে দেবো। এর দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, আমার মতে আল্লাহ এই যে সম্পদরাজি আমাকে দিয়েছেন এটি তিনি আমার গুণাবলী সম্পর্কে জেনেই দিয়েছেন। যদি তাঁর দৃষ্টিতে আমি একজন পছন্দনীয় মানুষ না হতাম, তাহলে তিনি এসব আমাকে কেন দিলেন? আমার প্রতি তাঁর নিয়ামত বর্ষিত হওয়াটাই প্রমাণ করে আমি তাঁর প্রিয় পাত্র এবং আমার নীতিপদ্ধতি তিনি পছন্দ করেন।
# এ ব্যক্তি যে নিজেকে বড় পণ্ডিত, জ্ঞানী, গুণী ও চতুর বলে দাবী করে বেড়াচ্ছে এবং নিজের যোগ্যতার অহংকারে মাটিতে পা ফেলছে না, সে কি জানে না যে, তার চাইতেও বেশী অর্থ, মর্যাদা, প্রতিপত্তি, শক্তি ও শান-শওকতের অধিকারী লোক ইতিপূর্বে দুনিয়ায় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং আল্লাহ শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন? যোগ্যতা ও নৈপূণ্যই যদি পার্থিব উন্নতির রক্ষাকবচ হয়ে থাকে তাহলে যখন তারা ধ্বংস হয়েছিল তখন তাদের এ যোগ্যতাগুলো কোথায় গিয়েছিল? আর যদি কারো পার্থিব উন্নতি লাভ অনিবার্যভাবে একথাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তার কর্ম ও গুণাবলী পছন্দ করেন তাহলে সর্বনাশ হলো কেন?
# অপরাধীরা তো এ দাবীই করে থাকে যে, তারা বড়ই ভালো লোক। তাদের কোন দোষ আছে এ কথা তারা কবেই বা স্বীকার করে। কিন্তু তাদের শাস্তি তাদের স্বীকারোক্তির উপর নির্ভর করে না। তাদেরকে যখন পাকড়াও করা হয় একথা জিজ্ঞেস করে পাকড়াও করা হয় না যে, তোমরা কি কি অপরাধ করেছ!
# এ চরিত্র, চিন্তা পদ্ধতি এবং আল্লাহর পুরস্কার দান কেবলমাত্র এমন লোকদের মধ্যে নির্ধারিত যাদের মধ্যে এতটা ধৈর্য ও দৃঢ়তা থাকে যার ফলে তারা হালাল পথে অর্থোপার্জন করার জন্য অবিচল সংকল্পবদ্ধ হয়। চাই তাতে তাদের ভাগ্য শুধুমাত্র নুনভাতই জুটুক, কিংবা তারা কোটিপতি হয়ে যাবার সৌভাগ্য লাভ করুক। সারা দুনিয়ার সুখ ও সুবিধা অর্জিত হবার সুযোগ দেখা দিলেও তারা হারাম পথের দিকে একটুও ঝুঁকে পড়ে না। এ আয়াতে আল্লাহর পুরস্কার বলতে এমন মর্যাদা সম্পন্ন রিয্ক বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করে প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে অর্জন করে। আর সবর অর্থ হচ্ছে, নিজের আবেগ-অনুভূতি ও কামনা-বাসনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। লোভ-লালসার মোকাবিলায় ঈমানদারী ও বিশ্বস্ততার ওপর অবিচল থাকা। সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার ফলে যে ক্ষতি হয় অথবা যে লাভ হাত ছাড়া হয়ে যায় তা বরদাশ্ত করে নেয়া। অবৈধভাবে তদবীর-তাগাদা করে যে লাভ হতে পারে তা প্রত্যাখ্যান করা। হালাল রোজগার তা যত সামান্যই হোক না কেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। হারামখোরদের জাকজমক দেখে মনের মধ্যে ঈর্ষা ও কামনা-বাসনার জ্বালায় অস্থির হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্র না করা এবং ঠাণ্ডা মাথায় একথা অনুধাবন করা যে, ঈমানদারের জন্য এ চাকচিক্যময় আবর্জনার তুলনায় এমন নিরাভরণ পবিত্রতাই ভালো যা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাকে দান করেছেন। “সবরকারীরা ছাড়া আর কেউ এ সম্পদ লাভ করে না” উক্তিতে উল্লেখিত সম্পদ অর্থ আল্লাহর সওয়াবও হতে পারে এবং এমন পবিত্র-পরিচ্ছন্ন মানসিকতাও হতে পারে যার ভিত্তিতে মানুষ ঈমান ও সৎকর্ম সহকারে অনাহার ও অভূক্ত থাকাকে বেঈমানীর পথ অবলম্বন করে কোটিপতি হয়ে যাওয়ার চাইতে ভাল মনে করে।
# আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক প্রসারিত বা সংকুচিত করা যেটাই ঘটুক না কেন তা ঘটে তাঁর ইচ্ছাক্রমেই। এ ইচ্ছার মধ্যে তাঁর ভিন্নতর উদ্দেশ্য সক্রিয় থাকে। কাউকে বেশী রিযিক দেবার অর্থ নিশ্চিতভাবে এ নয় যে, আল্লাহ তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট তাই তাকে পুরস্কার দিচ্ছেন। অনেক সময় কোন ব্যক্তি হয় আল্লাহর কাছে বড়ই ঘৃণিত ও অভিশপ্ত কিন্তু তিনি তাকে বিপুল পরিমাণ ধন-দৌলত দিয়ে যেতে থাকেন। এমনকি এ ধন শেষ পর্যন্ত তার ওপর আল্লাহর কঠিন আযাব নিয়ে আসে। পক্ষান্তরে যদি কারো রিযিক সংকুচিত হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে তার এ অর্থ হয় না যে, আল্লাহ তার প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তাকে শাস্তি দিচ্ছেন। অধিকাংশ সৎলোক আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় এ অভাব অনটন তাদের জন্য আল্লাহর রহমতে পরিণত হয়েছে। এ সত্যটি না বোঝার ফলে যারা আসলে আল্লাহর গযবের অধিকারী হয় তাদের সমৃদ্ধিকে মানুষ ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখে।
# আমাদের এ ভুল ধারণা ছিল যে, পার্থিব সমৃদ্ধি ও ধনাঢ্যতাই সফলতা। এ কারণে আমরা মনে করে বসেছিলাম কারূন বড়ই সাফল্য অর্জন করে চলছে। কিন্তু এখন বুঝলাম, আসল সাফল্য অন্য কোন জিনিসের নাম এবং তা কাফেরদের ভাগ্যে জোটে না। কারূনের ঘটনার এ শিক্ষণীয় দিকটি কেবলমাত্র কুরআনেই বর্ণিত হয়েছে। বাইবেল ও তালমূদে এর কোন উল্লেখ নেই। তবে এ দু’টি কিতাবে যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে তা থেকে জানা যায়, বনী ইসরাঈল যখন মিসর থেকে বের হয় তখন এ ব্যক্তিও নিজের দলবলসহ তাদের সাথে বের হয়। তারপর সে হযরত মূসা ও হারূনের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র করে। আড়াইশ’ লোক এ ষড়যন্ত্রে তার সাথে শরীক ছিল। শেষ পর্যন্ত তার ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হয় এবং সে নিজ গৃহ ও ধন-সম্পদসহ মাটির মধ্যে প্রোথিত হয়ে যায়।
# এখানে জান্নাতের কথা বলা হয়েছে, যা প্রকৃত সাফল্যের স্থান হিসেবে চিহ্নিত।
# যারা আল্লাহর যমীনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশী নয়। যারা বিদ্রোহী, স্বৈরাচারী ও দাম্ভিক হয়ে নয় বরং বান্দা হয়ে থাকে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজেদের বান্দা করে রাখার চেষ্টা করে না।
# ‘ফাসাদ’ বা বিপর্যয় হচ্ছে মানব জীবন ব্যবস্থার এমন একটি বিকৃতি যা সত্য বিচ্যূত হবার ফলে অনিবার্যভাবে দেখা দেয়। আল্লাহর বন্দেগী এবং তাঁর আইন-কানুনের আনুগত্যের সীমানা অতিক্রম করে মানুষ যা কিছুই করে সবই হয় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তই বিপর্যয়। এর একটি অংশ হচ্ছে এমন ধরণের বিপর্যয়, যা হারাম পথে ধন আহরণ এবং হারাম পথে তা ব্যয় করার ফলে সৃষ্টি হয়।
# তাদের জন্য যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকে।
# এই কুরআনকে আল্লাহর বান্দাদের কাছে পৌঁছাবার, তাদেরকে এর শিক্ষা দান করার এবং এর পথনির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ব সংস্কার করার দায়িত্ব তোমার প্রতি অর্পণ করেছেন।
# আসল শব্দ لَرَادُّكَ إِلَى مَعَادٍ অর্থাৎ তোমাকে একটি মা’আদের দিকে পৌঁছিয়ে দেবেন। মা’আদ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে এমন স্থান যেদিকে মানুষকে ফিরে যেতে হবে। এ শব্দটিকে অনির্দিষ্টবাচক হিসেবে ব্যবহার করার কারণে এর দ্বারা আপনা আপনি এ অর্থ বুঝানো হয় যে, এ স্থানটি বড়ই মহিমান্বিত ও মর্যাদা সম্পন্ন। কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ করেছেন জান্নাত। কিন্তু একে শুধুমাত্র জান্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আল্লাহ শব্দটিকে যেমন ব্যাপক অর্থে বর্ণনা করেছেন তেমনি ব্যাপক অর্থে একে ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়। এর ফলে এ প্রতিশ্রুতি দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাবে। আয়াতের পূর্ববর্তী আলোচনাও এ কথাই দাবী করে যে, একে কেবলমাত্র আখেরাতেই নয় বরং দুনিয়াতেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিরাট শান-শওকত এবং মাহাত্ন্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করার প্রতিশ্রুতি মনে করা হোক। মক্কার কাফেরদের যে উক্তি নিয়ে ৫৭ আয়াত থেকে এ পর্যন্ত লাগাতার আলোচনা চলছে তাতে তারা বলেছিল, হে মুহাম্মাদ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তুমি নিজের সাথে আমাদেরকেও নিয়ে ডুবাতে চাও। যদি আমরা তোমার সাথে সহযোগিতা করি এবং এ ধর্ম গ্রহণ করে নিই, তাহলে আরবের সরযমীনে আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। এর জবাবে আল্লাহ তাঁর নবীকে বললেন, হে নবী! যে আল্লাহ এ কুরআনের পতাকা বহন করার দায়িত্ব তোমার ওপর অর্পণ করেছেন তিনি তোমাকে ধ্বংস করে দেবেন না। বরং তিনি তোমাকে এমন উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে চান যার কল্পনাও আজ এরা করতে পারে না। আর প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মাত্র কয়েক বছর পর নবী করীম ﷺ কে এ দুনিয়ায় এদেরই চোখের সামনে সমগ্র আরব দেশে এমন নিরংকুশ কর্তৃত্ব দান করলেন যে, তাঁকে বাঁধাদানকারী কোন শক্তিই সেখানে টিকতে পারলো না এবং তাঁর দ্বীন ছাড়া অন্য কোন দ্বীনের জন্য সেখানে কোন অবকাশই থাকলো না। আরবের ইতিহাসে এর আগে সমগ্র আরব উপদ্বীপে কোন এক ব্যক্তির একচ্ছত্র আধিপত্যের এ ধরণের কোন নজীর সৃষ্টি হয়নি, যার ফলে সারা দেশে তার কোন প্রতিদ্বন্দী থাকেনি, তার হুকুমের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার ক্ষমতা কেউ রাখেনি এবং লোকেরা কেবল রাজনৈতিকভাবেই তার দলভূক্ত হয়নি বরং সমস্ত দ্বীনকে বিলুপ্ত করে দিয়ে সেই এক ব্যক্তি সবাইকে তার দ্বীনের অনুসারীও করে নিয়েছে।
কোন কোন মুফাসসির এ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সূরা কাসাসের এ আয়াতটি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করার সময় পথে নাযিল হয়েছিল। তাঁদের মতে এতে আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি আবার তাঁকে মক্কায় ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু প্রথমত এর শব্দাবলীর মধ্যে “মা’আদ” কে “মক্কা” অর্থে গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, বিষয়বস্তু ও আভ্যন্তরীন সাক্ষ্য-প্রমাণের দিক দিয়ে বিচার করলে এ সূরাটি হচ্ছে হাব্শায় হিজরাতের নিকটবর্তী সময়ের এবং এ কথা বুঝা যাচ্ছে না যে, কয়েক বছর পর মদীনায় হিজরাতের সময় পথে যদি এ আয়াতটি নাযিল হয়ে থাকে তাহলে কোন্ সম্পর্কের ভিত্তিতে এখানে এ ধারাবাহিক আলোচনার মধ্যে একে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, এ প্রেক্ষাপটে মক্কার দিকে নবী করীমের ﷺ ফিরে যাবার আলোচনা একেবারেই বেমানান ঠেকে। আয়াতের এ অর্থ গ্রহণ করা হলে এটা মক্কার কাফেরদের কথার জবাব হবে না বরং তাদের ওজরকে শক্তিশালী করা হবে। এর অর্থ হবে, অবশ্যই হে মক্কাবাসীরা! তোমরা ঠিকই বলছো, মুহাম্মাদ ﷺ কে এ শহর থেকে বের করে দেয়া হবে কিন্তু তিনি স্থায়ীভাবে নির্বাসিত হবেন না বরং শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে আবার এখানে ফিরিয়ে আনবো। এ হাদীসটি যদিও বুখারী, নাসাঈ, ইবনে জারীর ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন কিন্তু আসলে এটি ইবনে আব্বাসের নিজস্ব অভিমত। এটি সরাসরি রসূল ﷺ এর বক্তব্য সম্বলিত কোন মারফূ হাদীস নয় যে, একে মেনে নিতেই হবে।
# একথাটি মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা হচ্ছে। মূসা আলাইহিস সালাম এ কথা মোটেই জানতেন না যে, তাঁকে নবী করা হচ্ছে এবং বিরাট দায়িত্ব সম্পাদনে নিযুক্ত করা হচ্ছে। তিনি কখনো কল্পনায়ও এ ইচ্ছা বা আশা পোষণ করা তো দূরের কথা কখনো এ বিষয়টি কামনাও করেননি। হঠাৎ পথ চলার সময় তাঁকে ডেকে নেয়া হয় এবং নবীর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে তাঁর থেকে বিস্ময়কর কাজ নেয়া হয়, যার সাথে তার পূর্ববর্তী জীবনের কাজের কোন সাদৃশ্যই ছিল না। ঠিক একই ঘটনা ঘটে মুহাম্মাদ সল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথেও। মক্কার লোকেরা নিজেরাই জানতো, হেরা গিরিগুহা থেকে যেদিন তিনি নবুওয়াতের পয়গাম নিয়ে নেমে আসেন তার মাত্র একদিন আগে পর্যন্ত তাঁর জীবন কি ছিল, তিনি কি কাজ করতেন, কেমন কথাবার্তা বলতেন, তাঁর কথাবার্তার বিষয়বস্তু কি হতো, কোন্ বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল এবং তাঁর তৎপরতা ছিলো কোন্ ধরণের। তাঁর এ সমগ্র জীবন অবশ্যই সত্যতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ও পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতায় পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে পরিপূর্ণ ভদ্রতা, শালীনতা, শান্তিপ্রিয়তা, প্রতিশ্রুতি পালন, অধিকার প্রদান ও জনসেবার ভাবধারা অসাধারণ উজ্জ্বল্যে দেদীপ্যমান ছিল। কিন্তু সেখানে এমন কোন জিনিস ছিল না যার ভিত্তিতে কেউ এ কথা কল্পনাও করতে পারে যে, এ সদাচারী লোকটি আগামীকাল নবুওয়াতের দাবী নিয়ে এগিয়ে আসবেন। তাঁর সাথে যারা নিকটতম সম্পর্ক রাখতো এবং তাঁর আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে একজনও একথা বলতে পারেনি যে, তিনি পূর্ব থেকেই নবী হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হেরা গিরিগূহার সেই বৈপ্লবিক মূহুর্তের পরে অকস্মাৎ যেসব বিষয়বস্তু, সমস্যাবলী ও প্রসঙ্গ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য বিবৃতি ও ভাষণ দান শুরু হয়ে যায় ইতিপূর্বে কেউ তাঁর কন্ঠ থেকে কখনো তার একটি বর্ণও শোনেনি। কুরআনের আকারে অকস্মাৎ তাঁর মুখ থেকে যে বিশেষ ভাষা, শব্দ ও পরিভাষা লোকেরা শুনতে থাকে ইতিপূর্বে কখনো তারা তা শোনেনি। ইতিপূর্বে কখনো তিনি কোথাও বক্তৃতা ও ওয়াজ-নসিহত করতে দাঁড়াননি। কখনো দাওয়াত দিতে ও আন্দোলনের বাণী নিয়ে এগিয়ে আসেননি। বরং কখনো তাঁর কোন কর্মতৎপরতা থেকে এ ধারণাই জন্মাতে পারেনি যে, তিনি সামাজিক সমস্যা সমাধান অথবা ধর্মীয় সংশোধন কিংবা নৈতিক ও চারিত্রিক সংস্কার সাধনের জন্য কোন কাজ শুরু করার চিন্তা-ভাবনা করছেন। এ বৈপ্লবিক মুহূর্ত সমাগত হবার একদিন আগেও তাঁর জীবন ছিল একজন ব্যবসায়ীর জীবন। সাদামাটা ও বৈধ পথে রুজি-রোজগার করা, নিজের সন্তান-পরিজনদের সাথে হাসিখুশির জীবন-যাপন করা, অতিথি আপ্যায়ন করা, দুঃখী-দরিদ্রদের সাহায্য সেবা করা এবং আত্নীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার আর কখনো কখনো ইবাদাত করার জন্য একান্তে বসে যাওয়া— এই ছিল তাঁর স্বাভাবিক জীবন। এ ধরণের একজন লোকের হঠাৎ একদিন বিশ্ব কাঁপানো বাগ্মীতা নিয়ে ময়দানে নেমে আসা, একটি বিপ্লবাত্মক দাওয়াতের কাজ শুরু করে দেয়া, একটি অভিনব সাহিত্য সৃষ্টি করা এবং একটি স্বতন্ত্র জীবন দর্শন, চিন্তাধারা, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিধান নিয়ে সামনে এগিয়ে আসা, এতবড় একটি পরিবর্তন, যা মানবিক মনস্তত্বের দৃষ্টিতে কোন প্রকার কৃত্রিমতা, প্রস্তুতি ও ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কখনোই আত্নপ্রকাশ করতে পারে না। কারণ এ ধরণের প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি অবশ্যই পর্যায়ক্রমিক ক্রমোন্নতির স্তর অতিক্রম করে এবং যাদের মধ্যে মানুষ রাত্রি-দিন জীবন-যাপন করে এ পর্যায় ও স্তর কখনো তাদের চোখের আড়ালে থাকতে পারে না। নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন যদি এ পর্যায়গুলো অতিক্রম করে থাকতো তাহলে মক্কার হাজার হাজার লোক বলতো, আমরা না আগেই বলেছিলাম এ ব্যক্তি একদিন কোন বড় আকারের দাবী করে বসবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মক্কার কাফেররা তাঁর বিরুদ্ধে সব ধরণের অভিযোগ আনলেও এ অভিযোগটি তাদের একজনও উত্থাপন করেননি। তারপর তিনি নিজেও নবুওয়াতের প্রত্যাশী ছিলেন না। অথবা তা কামনা করতেন না এবং সেজন্য অপেক্ষাও করছিলেন না। বরং সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে অকস্মাত তিনি এ বিষয়টির মুখোমুখি হলেন। বিভিন্ন হাদীসে অহীর সূত্রপাতের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে যে ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। জিব্রীলের সাথে প্রথম সাক্ষাত এবং সূরা আলাকের প্রাথমিক আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর তিনি হেরা গূহা থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গৃহে পৌঁছেছিলেন। গৃহের লোকদের বলেছিলেন, “আমাকে ঢেকে দাও, আমাকে ঢেকে দাও।” কিছুক্ষণ পরে ভীতির অবস্থা কিছুটা দূর হয়ে গেলে নিজের জীবন সঙ্গীনিকে সব অবস্থা খুলে বললেন। এ প্রসঙ্গে তাঁকে বললেন, “আমি নিজের প্রাণের ভয় করছি।” স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন, “মোটেই না, আল্লাহ আপনাকে কখনো কষ্ট দেবেন না। আপনি আত্নীয়দের হক আদায় করেন। অসহায়কে সাহায্য করেন। অভাবী দরিদ্রকে সহায়তা দেন। অতিথি আপ্যায়ন করেন। প্রত্যেক ভালো কাজে সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকেন।” তারপর তিনি তাঁকে নিয়ে নিজের চাচাতো ভাই ও আহলে কিতাবদের একজন অভিজ্ঞ আলেম ও সদাচারী ব্যক্তি ওয়ারাকাহ ইবনে নওফালের কাছে গেলেন। তাঁর কাছ থেকে পুরো ঘটনা শোনার পর ওয়ারাকাহ বললেন, “আপনার কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি ছিলেন সেই একই আসমানী দূত বা নামূস (বিশেষ কাজে নিযুক্ত নির্দিষ্ট ফেরেশতা) যিনি মূসার (আ) কাছে এসেছিলেন। হায়! যদি আমি যুবক হতাম এবং সে সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতাম যখন আপনার সম্প্রদায় আপনাকে বহিস্কার করবে।” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কি আমাকে বের করে দেবে?” জবাব দিলেন, “হ্যাঁ আজ পর্যন্ত এক ব্যক্তিও এমন অতিক্রান্ত হননি, যিনি এ ধরণের বাণী বহন করে এনেছেন এবং লোকেরা তাঁর দুশমনে পরিণত হয়নি।
এ সমগ্র ঘটনাটি এমন একটি অবস্থার ছবি তুলে ধরে, যা একজন সরল মানুষ একটি অপ্রত্যাশিত ও চরম অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে তার জীবনে দেখা দিতে পারে। যদি নবী ﷺ প্রথম থেকেই নবী হবার চিন্তা করতেন, নিজের সম্পর্কে চিন্তা করতেন যে, তাঁর মতো মানুষের নবী হওয়া উচিত এবং কবে কোন ফেরেশতা তাঁর কাছে পয়গাম নিয়ে আসবে তারই প্রতীক্ষায় ধ্যান সাধনা করে নিজের মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেন, তাহলে হেরা গূহার ঘটনাটি সংঘটিত হবার সাথে সাথেই তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন এবং বলিষ্ঠ মনোবল নিয়ে বিরাট দাবী সহকারে পাহাড় থেকে নামতেন, তারপর সোজা নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে পৌঁছে নিজের নবুওয়াতের ঘোষণা দিতেন। কিন্তু এখানে এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা পরিদৃষ্ট হয়। তিনি যা কিছু দেখেন তাতে বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে পৌঁছেন। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। মনটা একটু শান্ত হলে চুপি চুপি স্ত্রীকে বলেন, আজ গুহার নিসঙ্গতায় এ ধরণের একটি ঘটনা ঘটে গেছে। জানি না কি হবে। আমার প্রাণ নিরাপদ নয় মনে হচ্ছে। নবুওয়াত প্রার্থীর অবস্থা থেকে এ অবস্থা কত ভিন্নতর।
তারপর স্বামীর জীবন, তাঁর অবস্থা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে স্ত্রীর চেয়ে বেশি আর কে জানতে পারে? যদি তিনি পূর্বাহ্ণেই এ অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকতেন যে, তাঁর স্বামী হচ্ছেন নবুওয়াতের প্রার্থী, তিনি সর্বক্ষণ ফেরেশতাদের আগমনের প্রতীক্ষা করছেন, তাহলে তার জবাব কখনো হযরত খাদিজার (রা.) জবাবের অনুরূপ হতো না। বরং তিনি বলতেনঃ হে স্বামী! ভয় পাও কেন? দীর্ঘদিন থেকে যে জিনিসের প্রত্যাশী ছিলে তা পেয়ে গেছো। চলো, এবার পীর গিরির দোকান পাঠ সাজাও। আমি মানত, নাজরানা ইত্যাদি সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু পনের বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি স্বামীর জীবনের যে চেহারা দেখেছিলেন তার ভিত্তিতে একথা বুঝতে তার এক মুহূর্তও দেরী হয়নি যে, এমন সৎ, ত্যাগী ও নির্লোভ ব্যক্তির কাছে শয়তান আসতে পারে না, আল্লাহ তাঁকে কোন বড় পরীক্ষার সম্মুখীনও করতে পারেন না বরং তিনি যা কিছু দেখেছেন তা নির্জলা সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওয়ারকাহ ইবনে নওফালের ব্যাপারেও একই কথা। তিনি কোন বাইরের লোক ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন নবী করীম ﷺ এর ভ্রাতৃসমাজের অন্তর্ভুক্ত এবং নিকটতম আত্মীয়তার প্রেক্ষিতে তাঁর শ্যালক। তারপর একজন ঈসায়ী আলেম হবার ফলে নবুওয়াত, কিতাব ও অহীকে কৃত্রিমতা ও বানোয়াট থেকে বাছাই করার ক্ষমতা রাখতেন। বয়সে অনেক বড় হবার কারণে নবীর ﷺ শৈশব থেকে সে সময় পর্যন্ত সমগ্র জীবন তার সামনে ছিল। তিনিও তাঁর মুখ থেকে হেরা গূহার সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক শোনার পর সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠেন, এ আগমনকারী নিশ্চিতভাবেই সেই একই ফেরেশতা হবেন যিনি হযরত মূসার (আ) কাছে অহী নিয়ে আসতেন। কারণ হযরত মুসা (আ) সাথে যা ঘটেছিল এখানেও সেই একই ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ একজন অত্যন্ত পবিত্র-পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী সহজ-সরল মানুষ, মাথায় কোন প্রকার পূর্ব চিন্তা বা পরিকল্পনা নেই, নবুওয়াতের চিন্তায় ডুবে থাকা তো দূরের কথা তা অর্জন করার কল্পনাও কোনদিন তাঁর মনে জাগেনি এবং অকস্মাৎ তিনি পূর্ণ সচেতন অবস্থায় প্রকাশ্যে এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। এ জিনিসটি তাঁকে দুই আর দু’ইয়ে চারের মতো নির্দ্ধিধায় নিশ্চতভাবেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়ে দেয় যে, এখানে কোন প্রবৃত্তির প্ররোচনা বা শয়তানী ছল চাতুরী নেই। বরং এ সত্যাশ্রয়ী মানুষটি নিজের কোন প্রকার ইচ্ছা-আকাংখা ছাড়াই যা কিছু দেখেছেন তা আসলে প্রকৃত সত্যদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।
এটি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের এমন একটি সুস্পষ্ট ও জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ যে, একজন সত্যপ্রিয় মানুষের পক্ষে তা প্রমাণ করা কঠিন। তাই কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় এ জিনিসটিকে নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। যেমন সূরা ইউনূসে বলা হয়েছেঃ
قُلْ لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلَا أَدْرَاكُمْ بِهِ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِنْ قَبْلِهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
“হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, যদি আল্লাহ এটা না চাইতেন, তাহলে আমি কখনো এ কুরআন তোমাদের শুনাতাম না বরং এর খবরও তোমাদের দিতাম না। ইতিপূর্বে আমি তোমাদের মধ্যে আমার জীবনের দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছি, তোমরা কি এতটুকু কথাও বোঝো না?” (ইউনূসঃ ১৬ আয়াত) আর সূরা আশ্-শূরায় বলা হয়েছে,
مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا
“হে নবী! তুমি তো জানতেও না কিতাব কি এবং ঈমান কি। কিন্তু আমি এ অহীকে একটি আলোয় পরিণত করে দিয়েছি। যার সাহায্যে আমি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চাই তাকে পথ দেখাই।” (আশ্-শূরাঃ ৫২ আয়াত)
আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা ইউনূস ২১ , আনকাবুত ৮৮-৯২ এবং শূরা ৮৪ টীকা।
# আল্লাহ যখন না চাইতেই তোমাদের এ নিয়ামত দান করেছেন তখন তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে, তোমাদের সমস্ত শক্তি ও শ্রম এর পতাকা বহন করার এবং এর প্রচার ও প্রসারের কাজে ব্যয় করবে, এ কাজে ত্রুটি ও গাফলতি করার মানে হবে তোমরা সত্যের পরিবর্তে সত্য অস্বীকারকারীদেরকে সাহায্য করেছো। এর অর্থ এ নয়, নাউযুবিল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ধরণের কোন ভুলের আশঙ্কা ছিল। বরং এভাবে আল্লাহ কাফেরদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিজের নবীকে এ হিদায়াত দান করছেন যে, এদের শোরগোল ও বিরোধিতা সত্ত্বেও তুমি নিজের কাজ করে যাও এবং তোমার এ দাওয়াতের ফলে সত্যের দুশমনরা তাদের জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবার যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করে তার পরোয়া করার কোন প্রয়োজন নেই।
# সেগুলোর প্রচার ও প্রসার থেকে এবং সে অনুযায়ী কাজ করা থেকে।
# এ অর্থও হতে পারে, শাসন কর্তৃত্ব তাঁরই জন্য অর্থাৎ একমাত্র তিনিই তার অধিকার রাখেন।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৭৬-৭৭ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কারূন ছিল হযরত মূসা (আঃ)-এর চাচাতো ভাই। ইবনে জুরায়েজ (রঃ) বলেন যে, তার নসবনামা (বংশ তালিকা) হলো: কারূন ইবনে ইয়াসহাব ইবনে কাহিস। ইবনে ইসহাক (রঃ)-এর মতে কারূন ছিল হযরত মূসা ইবনে ইমরান (আঃ)-এর চাচা। কিন্তু অধিকাংশ আলেম তাকে তার চাচাতো ভাই বলে থাকেন। কারূনের গলার স্বর ছিল খুবই সুমিষ্ট। সুমিষ্ট সুরে তাওরাত পাঠ করতো। কিন্তু সামেরী যেমন মুনাফিক ছিল, অনুরূপভাবে আল্লাহর এই শত্রুও মুনাফিক হয়ে গিয়েছিল। সে বড় সম্পদশালী ছিল বলে সম্পদের গর্বে গর্বিত হয়েছিল এবং আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল। তার কওমের মধ্যে সাধারণভাবে যে পোশাক প্রচলিত ছিল, সে ওর চেয়ে অর্ধহাত নীচু করে বানিয়েছিল, যাতে তার গর্ব ও ঐশ্বর্য প্রকাশ পায়। তার এতো বেশী ধন-সম্পদ ছিল যে, তার কোষাগারের চাবিগুলো উঠাবার জন্যে শক্তিশালী লোকদের একটি দল নিযুক্ত ছিল। তার অনেকগুলো কোষাগার ছিল এবং প্রত্যেক কোষাগারের চাবি ছিল পৃথক পৃথক, যা ছিল অর্ধহাত করে লম্বা। যখন ঐ চাবিগুলো তার সওয়ারীর সাথে খচ্চরগুলোর উপর বোঝাই করা হতো তখন এর জন্যে কপাল ও চারটি পা সাদা চিহ্নযুক্ত ষাটটি খচ্চর নির্ধারিত থাকতো। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। তার কওমের সম্মানিত, সৎ ও আলেম লোকেরা যখন তার দম্ভ এবং ঔদ্ধত্য চরম সীমায় পৌঁছতে দেখলেন তখন তারা তাকে উপদেশ দিলেনঃ “এতো দাম্ভিকতা প্রকাশ করো না, আল্লাহর অকৃতজ্ঞ বান্দা হয়ো না, অন্যথায় তুমি তার কোপানলে পতিত হবে। জেনে রেখো যে, আল্লাহ দাম্ভিকদেরকে পছন্দ করেন না।” উপদেশদাতাগণ তাকে আরো বলতেনঃ “আল্লাহর দেয়া নিয়ামত যে তোমার নিকট রয়েছে। তদৃদ্বারা তার সন্তুষ্টি অনুসন্ধান কর এবং তার পথে ওগুলো হতে কিছু কিছু খরচ কর যাতে তুমি আখিরাতের অংশও লাভ করতে পার। আমরা একথা বলছি না যে, দুনিয়ায় তুমি সুখ ভোগ মোটেই করবে না। বরং আমরা বলি যে, তুমি দুনিয়াতেও ভাল খাও, ভাল পান কর, ভাল পোশাক পরিধান কর, বৈধ নিয়ামত দ্বারা উপকৃত হও এবং ভাল বিবাহ দ্বারা যৌন ক্ষুধা নিবারণ কর। কিন্তু নিজের চাহিদা পূরণ করার সাথে সাথে তুমি আল্লাহর হক ভুলে যেয়ো না। তিনি যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন তেমনি তুমি তাঁর সৃষ্টজীবের প্রতি অনুগ্রহ করো। জেনে রেখো যে, তোমার সম্পদে দরিদ্রদেরও হক রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক হকদারের হক তুমি আদায় করতে থাকো। আর তুমি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। মানুষকে কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকো এবং জেনে রেখো যে, যারা আল্লাহর মাখলুককে কষ্ট দেয় এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে তাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন না।”
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# কওমের আলেমদের উপদেশবাণী শুনে কারূন যে জবাব দিয়েছিল তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, সে বলেছিলঃ “তোমাদের উপদেশ তোমরা রেখে দাও। আমি খুব ভাল জানি যে, আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন আমি তার যথাযোগ্য হকদার। আর আল্লাহ এটা জানেন বলেই আমাকে এই সব দান করেছেন।” যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেছেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যখন মানুষকে কোন কষ্ট পৌঁছে তখন বড়ই বিনয়ের সাথে আমাকে ডাকতে থাকে, অতঃপর যখন আমি কোন নিয়ামত ও শান্তি তাকে প্রদান করি তখন সে বলে ফেলেঃ এটা আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি।” (৩৯:৪৯) তিনি আরো বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কষ্ট ও বিপদের পর যদি আমি তাকে আমার করুণার স্বাদ গ্রহণ করাই তখন সে অবশ্যই বলে ওঠে- এটা আমার জন্যেই অর্থাৎ আমি এর হকদার ছিলাম।” (৪১:৫০)
কেউ কেউ বলেন যে, কারূন কিমিয়া শাস্ত্রবিদ ছিল। যে লোহা, পিতল ইত্যাদিকে স্বর্ণে পরিণত করার কৌশল জানে। কিন্তু এটা খুবই দুর্বল উক্তি। কিমিয়ার জ্ঞান আসলে কারো নেই। কেননা, কোন জিনিসের মূলকে বদলিয়ে দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। এর ক্ষমতা আর কেউই রাখে না। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে লোক সকল! একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হচ্ছে, তোমরা মনোেযোগ দিয়ে শ্রবণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা ডাকছো তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা তার জন্যে একত্রিত হয়।” (২২:৭৩)
সহীহ হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন যে, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বড় অত্যাচারী আর কে আছে যে আমার সৃষ্টির মত সৃষ্টি করার চেষ্টা করে? তাহলে সে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু বা একটি জব সৃষ্টি করুক তো দেখি?” এই হাদীসটি ঐ লোকদের ব্যাপারে প্রযোজ্য যারা ফটো বা ছবি উঠায় এবং শুধু বাহ্যিক আকৃতি নকল করে থাকে। এরপরেও যে ব্যক্তি দাবী করে যে, সে কিমিয়ার জ্ঞান রাখে, একটি জিনিসকে অপর জিনিসে রূপান্তরিত করতে পারে, যেমন লোহাকে সোনায় পরিণত করা ইত্যাদি, সে মিথ্যাবাদী ছাড়া কিছুই নয়। তবে রঙ ইত্যাদিকে বদলিয়ে দিয়ে ধোকাবাজী করা অন্য কথা। কিন্তু প্রকৃতভাবে এটা অসম্ভব। যারা এই কিমিয়ার দাবী করে তারা শুধু মিথ্যাবাদী, অজ্ঞ, ফাসেক ও অপবাদদাতা। এরূপ দাবী করে তারা শুধু মানুষকে প্রতারিত করে থাকে। হ্যাঁ, তবে আল্লাহ তাআলার কোন কোন ওলী হতে যে কোন কোন কারামত প্রকাশ পায় এবং কোন কোন জিনিস পরিবর্তিত হয়ে থাকে আমরা তা অস্বীকার করি না। এটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের উপর বিশেষ অনুগ্রহ। এটা তাদের নিজেদের কোন ক্ষমতার কাজ নয়। এটা আল্লাহর হুকুমের ফল ছাড়া কিছুই নয়। এটা আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৎ বান্দাদের মাধ্যমে স্বীয় মাখলুককে প্রদর্শন করে থাকেন। বর্ণিত আছে যে, হযরত হায়ওয়াহ্ ইবনে শুরাইহ মিসরী (রঃ)-এর নিকট একদা একজন ভিক্ষুক এসে কিছু ভিক্ষা চায়। ঘটনাক্রমে ঐ সময় তাঁর কাছে দেয়ার মত কিছুই ছিল না। তার দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি ব্যথিত হন। তিনি মাটি হতে একটি কংকর উঠিয়ে নেন এবং হাতে নাড়াচাড়া করে ঐ ভিক্ষুকের ঝুলিতে ফেলে দেন। সাথে সাথে ঐ কংকরটি লাল স্বর্ণে পরিণত হয়। হাদীস ও আসারে মু’জিযা ও কারামাতের আরো বহু ঘটনা রয়েছে, এখানে ওগুলো বর্ণনা করলে এ কিতাবের কলেবর বৃদ্ধি পাবে বিধায় বর্ণনা করা সম্ভব হলো না।কারো কারো উক্তি এই যে, কারূন ইসমে আযম জানতো, যা পাঠ করে সে দু’আ করেছিল। ফলে সে এতো বড় ধনী হয়েছিল।
কারূনের এ উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ কারূনের এটা ভুল কথা। আল্লাহ তা’আলা যার প্রতি সদয় হন তাকেই তিনি সম্পদশালী করে থাকেন এটা মোটেই ঠিক নয়। তার পূর্বে তিনি তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী ও প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাহলে বুঝা গেল যে, মানুষের সম্পদশালী হওয়া তার প্রতি আল্লাহর ভালবাসার নিদর্শন নয়। যে আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয় এবং কুফরীর উপর অটল থাকে তার পরিণাম মন্দ হয়ে থাকে। পাপীদেরকে তাদের পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার কোন প্রয়োজন হবে না। তার আমলনামাই তার হিসাব গ্রহণের জন্যে যথেষ্ট হবে। কারূনের ধারণা ছিল যে, তার মধ্যে মঙ্গল ও সততা রয়েছে বলেই আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তার বিশ্বাস ছিল যে, সে ধনী হওয়ার যোগ্য। তার মতে তাকে আল্লাহ তাআলা ভাল না বাসলে এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট না থাকলে তাকে এ নিয়ামত প্রদান করতেন না।
৭৯-৮০ নং আয়াতের তাফসীর
একদা কারূন অতি মূল্যবান পোশাক পরিহিত হয়ে, অত্যন্ত জাঁকজমক সহকারে উত্তম সওয়ারীতে আরোহণ করে, স্বীয় গোলামদের মূল্যবান পোশাক পরিয়ে সামনে ও পিছনে নিয়ে দাম্ভিকতার সাথে বের হলো। তার এই জাকজমক ও শান-শওকত দেখে দুনিয়াদারদের মুখ পানিতে ভরে গেল এবং তারা বলতে লাগলো: আহা! কারূনকে যেরূপ দেয়া হয়েছে আমাদেরকে যদি তা দেয়া হতো! প্রকৃতই সে মহাভাগ্যবান। আলেমরা তাদের মুখে একথা শুনে তাদেরকে এই ধারণা হতে বিরত রাখতে চাইলেন এবং বুঝাতে লাগলেনঃ “দেখো, আল্লাহ। তা’আলা তাঁর সৎ ও মুমিন বান্দাদের জন্যে নিজের কাছে যা কিছু তৈরী করে রেখেছেন তা এর চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ এবং ধৈর্যশীলগণ ছাড়া কেউ এটা লাভ করতে পারে না।” ভাবার্থ এটাও যে, এরূপ পবিত্র কথা ধৈর্যশীলদের মুখ দিয়েই বের হয়। যারা দুনিয়ার আকর্ষণ হতে দূরে থাকে এবং পরকালের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই অবস্থায় খুব সম্ভব এই কথা ঐ আলেমদের নয়, বরং তাদের প্রশংসায় এই পরবর্তী কথা আল্লাহর পক্ষ হতেই এসে থাকবে।
# ৮১-৮২ নং আয়াতের তাফসীর
উপরে কারূনের ঔদ্ধত্য ও বেঈমানীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এখানে তার পরিণামের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে।
হযরত সালিম (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “একটি লোক তার লুঙ্গী লটকিয়ে গর্বভরে চলছিল, এমতাবস্থায় তাকে ভূ-গর্ভে প্রোথিত করা হয়। কিয়ামত পর্যন্ত সে প্রোথিত হতেই থাকবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের পূর্বে একটি লোক দু’টি সবুজ চাদরে নিজেকে আবৃত করে দম্ভভরে চলছিল, এমতাবস্থায় আল্লাহ তা’আলা যমীনকে নির্দেশ দিলেনঃ তাকে গিলে ফেল।” (এ রিওয়াইয়াতটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হাফিয মুহাম্মাদ ইবনে মুনযির (রঃ) তাঁর কিতাবুল আজায়েবে বর্ণনা করেছেন যে, নওফল ইবনে মাসাহিক (রঃ) বলেন, নাজরানের মসজিদে আমি এক যুবককে দেখতে পাই। আমি তার দিকে চেয়ে থাকি এবং তার দেহের দৈর্ঘ্য, পূর্ণতা এবং সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেঃ “আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন?” আমি উত্তরে বলিঃ তোমার সৌন্দর্য ও পূর্ণতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। সে তখন বলেঃ “স্বয়ং আল্লাহও আমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। তার মুখের কথা মুখেই আছে, হঠাৎ সে ছোট হতে শুরু করে এবং ছোট ও খাটো হতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত সে কনিষ্ঠাঙ্গুলী বরাবর হয়ে যায়। তখন তার একজন আত্মীয় তাকে ধরে তার জামার আস্তীনে ভরে নিয়ে চলে যায়।”
এটাও বর্ণিত আছে যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর বদ দু’আর কারণেই কারূন ধ্বংস হয়েছিল। তার ধ্বংসের কারণের ব্যাপারে বহু মতভেদ রয়েছে।
একটি কারণ এরূপ বর্ণিত আছে যে, অভিশপ্ত কারূন এক ব্যভিচারিণী নারীকে বহু মালধন দিয়ে এই কাজে উত্তেজিত করে যে, যখন মূসা (আঃ) বানী ইসরাঈলের জামাআতে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তা’আলার কিতাব পাঠ করতে শুরু করবেন ঠিক ঐ সময়ে যেন সে জনসম্মুখে বলেঃ “হে মূসা (আঃ)! তুমি আমার সাথে এরূপ এরূপ করেছো।” কারূনের এই কথামত ঐ স্ত্রীলোকটি তা-ই করে। অর্থাৎ কারূনের শিখানো কথাই বলে। তার একথা শুনে হযরত মূসা (আঃ) কেঁপে উঠেন এবং তৎক্ষণাৎ দু’রাকআত নামায আদায় করে ঐ স্ত্রীলোকটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেনঃ “আমি তোমাকে ঐ আল্লাহর কসম দিচ্ছি যিনি সমুদ্রের মধ্যে রাস্তা করে দিয়েছিলেন, তোমার কওমকে ফিরাউনের অত্যাচার হতে রক্ষা করেছেন এবং আরো বহু অনুগ্রহ করেছেন, সত্য ঘটনা যা কিছু রয়েছে সবই তুমি খুলে বল।” স্ত্রীলোকটি তখন বললো: “হে মূসা (আঃ)! আপনি যখন আমাকে আল্লাহর কসমই দিলেন তখন আমি সত্য কথাই বলছি। কারূন আমাকে বহু টাকা-পয়সা দিয়েছে এই শর্তে যে, আমি যেন বলি আপনি আমার সাথে এরূপ এরূপ কাজ করেছেন। আমি আপনাকে তা-ই বলেছি। এজন্যে আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তার কাছে তাওবা করছি।” তার এ কথা শুনে হযরত মূসা (আঃ) পুনরায় সিজদায় পড়ে যান এবং কারূনের শাস্তি প্রার্থনা করেন। তখন আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাঁর নিকট অহী আসেঃ “আমি যমীনকে তোমার বাধ্য করে দিলাম।” হযরত মূসা (আঃ) তখন সিজদা হতে মাথা উঠিয়ে যীমনকে বলেনঃ “তুমি কারূন ও তার প্রাসাদকে গিলে ফেল।” যমীন তা-ই করে।। কারূনের ধ্বংসের এ কারণটি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত সুদ্দী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
দ্বিতীয় কারণ এই বলা হয়েছে যে, একদা কারূনের সওয়ারী অতি জাঁকজমকের সাথে চলতে শুরু করে। সে অত্যন্ত মূল্যবান পোশাক পরিহিত হয়ে একটি অতি মূল্যবান সাদা খচ্চরের উপর আরোহণ করে চলছিল। তার সাথে তার গোলামগুলোও ছিল, যারা সবাই রেশমী পোশাক পরিহিত ছিল। এইভাবে সে চলতেছিল। আর ওদিকে হযরত মূসা (আঃ) বানী ইসরাঈলের সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। যখন কারূন তার দলবলসহ ঐ জনসমাবেশের পার্শ্ব দিয়ে গমন করে তখন হযরত মূসা (আঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে কারূন! আজ এমন শান-শওকতের সাথে গমনের কারণ কি?” সে উত্তরে বলেঃ “ব্যাপার এই যে, আল্লাহ তোমাকে একটি ফযীলত দান করেছেন এবং আমাকেও তিনি একটি ফযীলত দান করেছেন। যদি তিনি তোমাকে নবুওয়াত দান করে থাকেন তবে আমাকে তিনি দান করেছেন ধন-দৌলত ও মান-মর্যাদা। যদি আমার মর্যাদা সম্পর্কে তুমি সন্দেহ পোষণ করে থাকো তবে আমি প্রস্তুত আছি যে, চল, আমরা দু’জন আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, দেখা যাক আল্লাহ কার দু’আ কবুল করেন?” হযরত মূসা (আঃ) কারূনের এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে যান এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হন। অতঃপর তিনি তাকে বলেনঃ “হে কারূন! আমি প্রথমে প্রার্থনা করবো, না তুমি প্রথমে করবে?” সে জবাবে বলেঃ “আমিই প্রথমে দুআ করবো।” একথা বলে সে দু’আ করতে শুরু করে এবং শেষও করে দেয়। কিন্তু তার দু’আ কবূল হলো না। হযরত মূসা (আঃ) তখন তাকে বললেনঃ “তাহলে আমি এখন দু’আ করি?” সে উত্তরে বলেঃ “হ্যা, কর।” অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ তা’আলার নিকট দু’আ করেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি যমীনকে নির্দেশ দিন যে, আমি তাকে যে হুকুম করবো তাই যেন সে পালন করে।” আল্লাহ তা’আলা তাঁর দু’আ কবুল করেন এবং তাঁর নিকট অহী অবতীর্ণ করেনঃ “হে মূসা (আঃ)! যমীনকে আমি তোমার হুকুম পালনের নির্দেশ দিলাম।” হযরত মূসা (আঃ) তখন যমীনকে বললেনঃ “হে যমীন! তুমি কারূন ও তার লোকদেরকে ধরে ফেল।” তাঁর একথা বলা মাত্রই তাদের পাগুলো যমীনে প্রোথিত হয়। তিনি আবার বলেনঃ “আরো ধরো।” তখন তাদের হাঁটু পর্যন্ত প্রোথিত হয়ে যায়। পুনরায় তিনি বলেনঃ “আরো পাকড়াও কর।” ফলে তাদের কাঁধ পর্যন্ত প্রোথিত হয়। তারপর তিনি যমীনকে বলেনঃ “তার মাল ও তার কোষাগারও পুঁতে ফেলো।” তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত ধন-ভাণ্ডার ও সম্পদ এসে গেল। কারূন সবগুলোই স্বচক্ষে দেখে নিলো। অতঃপর তিনি যমীনকে ইঙ্গিত করলেনঃ “এগুলোসহ তাদেরকে তোমার ভিতরে করে নাও।” সাথে সাথে কারূন তার দলবল, প্রাসাদ, ধন-দৌলত এবং কোষাগারসহ যমীনে প্রোথিত হয়ে গেল। এভাবে তার ধ্বংস সাধিত হলো। যমীন যেমন ছিল তেমনই হয়ে গেল।
বর্ণিত আছে যে, সপ্ত যমীন পর্যন্ত তারা প্রোথিত হয়। একটি বর্ণনা এও আছে। যে, প্রত্যহ তারা এক মানুষ বরাবর নীচের দিকে প্রোথিত হতে রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তারা এই শাস্তির মধ্যেই থাকবে। এখানে বানী ইসরাঈলের আরো বহু রিওয়াইয়াত রয়েছে। কিন্তু আমরা ওগুলো ছেড়ে দিলাম। কারূনের স্বপক্ষে এমন কোন দল ছিল না যে আল্লাহর শাস্তি হতে তাকে সাহায্য করতে পারতো এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না। সে ধ্বংস হয়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং তার মূলোৎপাটন করা হয়। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ পূর্বদিন যারা তার মত হবার কামনা করেছিল তারা তার শোচনীয় অবস্থা দেখে বলতে লাগলো: আমরা ভুল বুঝেছিলাম। সত্যি ধন-দৌলত আল্লাহর সন্তুষ্টির নিদর্শন নয়। এটা তো আল্লাহর হিকমত বা নৈপুণ্য, তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্যে ইচ্ছা তার রিযক বর্ধিত করেন এবং যার জন্যে ইচ্ছা হ্রাস করেন। তাঁর হিকমত তিনিই জানেন। যেমন হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের মধ্যে চরিত্রকে ঐভাবে বন্টন করেছেন, যেমনিভাবে তোমাদের মধ্যে। রিযক বন্টন করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ভালবাসেন তাকেও দুনিয়া (অর্থাৎ ধন-দৌলত) দান করেন এবং যাকে ভালবাসেন না তাকেও দান করেন। আর দ্বীন একমাত্র ঐ ব্যক্তিকে দান করেন যাকে তিনি ভালবাসেন।”
কারূনের মত হওয়ার বাসনাকারীরা আরো বললো: যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি সদয় না হতেন তবে আমাদেরও তিনি ভূ-গর্ভে প্রোথিত করতেন। সত্যি, কাফিররা কখনো সফলকাম হয় না। না তারা দুনিয়ায় কৃতকার্য হয়, না আখিরাতে তারা পরিত্রাণ পাবে।
(আরবি)-এর অর্থ নিয়ে আরবী ব্যাকরণবিদদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, এটা (আরবি)-এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এটাকে(আরবি) বা হালকা করে (আরবি) রয়ে গেছে এবং (আরবি)-এর যবরটি শব্দ। বা উহ্য থাকার প্রতি ইঙ্গিত বহন করছে। কিন্তু এই উক্তিটিকে ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) দুর্বল বলেছেন। কিন্তু আমি বলি যে, এটাকে দুর্বল বলা ঠিক নয়। কুরআন কারীমে এর লিখন এক সাথে হওয়া ওর দুর্বল হওয়ার কারণ হতে পারে না। কেননা, (আরবি)বা লিখনের পদ্ধতি তো পারিভাষিক আদেশ। যা প্রচলিত হয় তাই ধর্তব্য হয়ে থাকে। এর দ্বারা অর্থের উপর কোন ক্রিয়া হয় না। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
অন্য উক্তি এই যে, এটা (আরবি)-এর অর্থে ব্যবহৃত। আর একটি বর্ণনা এও আছে যে, এখানে দুটি শব্দ রয়েছে অর্থাৎ (আরবি) এবং (আরবি) শব্দটি বিস্ময় প্রকাশের জন্যে অথবা সতর্কতা প্রকাশের জন্যে। আর (আরবি) শব্দটি (আরবি) (আমি ধারণা করি)-এর অর্থে ব্যবহৃত। এসব উক্তির মধ্যে সবল উক্তি হলো এটাই যে, (আরবি) এর অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ তুমি কি দেখনি? যেমন এটা হযরত কাতাদা (রঃ)-এর উক্তি। আরবী কবিতাতেও এই অর্থই নেয়া হয়েছে।
৮৩-৮৪ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, জান্নাত ও আখিরাতের নিয়ামত শুধু তারাই লাভ করবে যাদের অন্তর সদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে এবং যারা পার্থিব জীবন বিনয়, নম্রতা ও উত্তম চরিত্রের সাথে অতিবাহিত করে এবং নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় ও উচ্চ মনে করে না। যারা ভূ-পৃষ্ঠে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টি করে না। যারা কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে না এবং পৃথিবীতে আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করে না।
হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি এটা পছন্দ করে যে, তার জুতার চামড়া তার সঙ্গীর জুতার চামড়া অপেক্ষা ভালো হোক সে-ই এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এর দ্বারা উদ্দেশ্যে এই যে, যখন সে গর্ব ও অহংকার করবে। আর যদি উদ্দেশ্য শুধু সৌন্দর্য প্রকাশ হয় তবে তাতে কোন দোষ নেই। যেমন সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, একটি লোক বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি তো এতে সন্তুষ্ট থাকি যে, আমার চাদর ভাল হালে, আমার জুতা সুন্দর হালে, এটাও কি অহংকার হিসেবে গণ্য হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “না, না। এটা তো সৌন্দর্য। আর আল্লাহ তাআলা সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করে থাকেন।
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ যে কেউ সৎ কর্ম করে সে তার কর্ম অপেক্ষা উত্তম ফল পাবে। পক্ষান্তরে যে মন্দ কর্ম করে সে শাস্তি পাবে শুধু তার কর্ম অনুপাতে। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যে মন্দ কাজ করবে তাকে উল্টোমুখে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।” (২৭:৯০) এরপরে বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হবে যা তোমরা আমল করতে।” (২৭:৯০) আর এটা হলো অতিরিক্ত প্রদান ও ন্যায় বিচারের স্থান।
৮৫-৮৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহর তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ হে রাসূল (সঃ)! তুমি তোমার রিসালাতের তাবলীগ করতে থাকো, মানুষকে আল্লাহর কালাম শুনিয়ে যাও, আর জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাকে কিয়ামতের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। অতঃপর সেখানে তোমাকে নবুওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “অবশ্যই আমি জিজ্ঞাসাবাদ করবো যাদের নিকট রাসূল পাঠানো হয়েছিল তাদেরকে এবং অবশ্যই আমি প্রশ্ন করবো রাসূলদেরকে।” (৭:৬) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “ঐদিন রাসূলদেরকে একত্রিত করে জিজ্ঞেস করা হবে তোমাদেরকে কি জবাব দেয়া হয়েছিল?” (৫:১০৯) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আনয়ন করা হবে নবীগণকে এবং সাক্ষীদেরকে।”
সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, (আরবি) দ্বারা জান্নাতও উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার মৃত্যুও হতে পারে এবং পুনরুত্থানও অর্থ হতে পারে। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার জীবিত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, (আরবি) দ্বারা মক্কাকে বুঝানো হয়েছে। মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মক্কা যা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্মভূমি ছিল।
যহাক (রঃ) বলেন যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা হতে বের হন এবং জুহফাহ্ নামক স্থানে পৌঁছেন তখন মক্কার আকাঙ্ক্ষা তাঁর অন্তরে জেগে ওঠে, ঐ সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। তার সাথে ওয়াদা করা হয় যে, তাঁকে মক্কায় ফিরিয়ে দেয়া হবে। এর দ্বারা এটাও বের হচ্ছে যে, এটা মাদানী আয়াত। অথচ পুরো সূরাটি মক্কী। এও বলা হয়েছে যে, (আরবি) দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাসকে বুঝানো হয়েছে। যিনি এই মত পোষণ করেছেন, সম্ভবতঃ কিয়ামতই তার উদ্দেশ্য। কেননা, বায়তুল মুকাদ্দাসই হাশরের ময়দান হবে। এই সমুদয় উক্তিকে একত্রিত করার উপায় এই যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কখনো তাফসীর করেছেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মক্কায় ফিরে যাওয়ার দ্বারা, যা মক্কা বিজয় দ্বারা পূর্ণ হয়। আর এটা রাসূলল্লাহ (সঃ)-এর বয়স পূর্ণ হয়ে যাওয়ার একটি বড় নিদর্শন ছিল। যেমন তিনি সূরায়ে (আরবি) এর তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। হযরত উমার (রাঃ) তার অনুকূলেই মত দিয়েছিলেন। তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলেছিলেনঃ “এ ব্যাপারে আপনি যা জানেন, আমিও তাই জানি।” এটা একই কারণ যে, তার থেকেই এই আয়াত দ্বারা যেখানে মক্কা’ বর্ণিত আছে সেখানেই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তেকাল’ও বর্ণিত আছে। আবার তিনি কখনো জান্নাত’ তাফসীর করেছেন, যেটা তাঁর আবাসস্থল এবং তাঁর তাবলীগে রিসালাতের প্রতিদান যে, তিনি দানব ও মানবকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহ্বান করেছেন। আর তিনি ছিলেন সমস্ত মাখলুকের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বাকপটু ও উত্তম।
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ তুমি তোমার বিরুদ্ধাচারীদেরকে ও তোমাকে অবিশ্বাসকারীদেরকে বলে দাও- কে সৎ পথের নির্দেশ এনেছে এবং কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে তা আমার প্রতিপালক খুব ভাল জানেন।
আল্লাহ তা’আলা তাঁর আর একটি বড় নিয়ামতের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অহী অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি আশা করেননি যে, তার উপর আল্লাহর কিতাব অবতীর্ণ হবে। এটা তো শুধু তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের অনুগ্রহ। সুতরাং কাফিরদের সহায়ক হওয়া তাঁর জন্যে মোটেই সমীচীন নয়। তাদের থেকে পৃথক থাকাই তার উচিত। তাঁর এই ঘোষণা দেয়া উচিত যে, তিনি কাফিরদের বিরুদ্ধাচরণকারী ।
অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার প্রতি আল্লাহর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর এই কাফিররা যেন তোমাকে কিছুতেই সেগুলো থেকে বিমুখ না করে। অর্থাৎ এই লোকগুলো যে তোমার ও দ্বীনের বিরুদ্ধাচরণ করছে এবং তোমার অনুসরণ হতে জনগণকে ফিরিয়ে রাখছে এতে তুমি যেন মনঃক্ষুন্ন হয়ে তোমার কাজ থেকে বিরত না হও। বরং তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। আল্লাহ তোমার কালেমাকে পুরোকারী, তোমার দ্বীনের পৃষ্ঠপোষকতাকারী, তোমার রিসালাতকে জয়যুক্তকারী এবং তোমার দ্বীনকে সমস্ত দ্বীনের উপর বুলন্দকারী। সুতরাং তুমি জনগণকে তোমার প্রতিপালকের ইবাদতের দিকে আহ্বান করতে থাকো, যিনি এক ও শরীকবিহীন। তোমার জন্যে এটা উচিত নয় যে, তুমি কাফিরদের সহায়তা করবে। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকেও আহ্বান করো না। ইবাদতের যোগ্য একমাত্র তিনিই। উলুহিয়্যাতের যোগ্য একমাত্র তাঁরই বিরাট সত্তা। তিনিই চিরস্থায়ী ও সদা বিরাজমান। সমস্ত সৃষ্টজীব মৃত্যুবরণ করবে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু নেই। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “ভূ-পৃষ্ঠে যত কিছু আছে সবই নশ্বর, অবিনশ্বর শুধু তোমার প্রতিপালকের সত্তা, যিনি মহিমময়, মহানুভব।” (৫৫:২৬-২৭) দ্বারা আল্লাহর সত্তাকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “কবি লাবীদ একটি চরম সত্য কথা বলেছে। সে বলেছেঃ (আরবি) অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই বাতিল বা অসার।” মুজাহিদ (রঃ) এবং সাওরী (রঃ) বনে যে,
(আরবি)-এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ সবকিছুই ধ্বংসশীল, কিন্তু শুধু ঐ কাজ যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়। কবিদের কবিতাতেও শব্দটি এই ভাবার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন কোন কবি বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যে আল্লাহ সমস্ত বান্দার প্রতিপালক, যার দিকে মনোযোগ ও বাসনা, যার জন্যে আমল, তার নিকট আমি আমার এমন পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি যা আমি গণনা করে শেষ করতে পারবো না।” এই উক্তি পূর্বের উক্তির বিপরীত নয়। এটাও নিজের জায়গায় ঠিক আছে যে, মানুষের সব কাজই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, শুধুমাত্র ঐ কাজের পুণ্য সে লাভ করবে যা একমাত্র তারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সে করেছে। আর প্রথম উক্তিটির ভাবার্থও সম্পূর্ণরূপে সঠিক যে, সমস্ত প্রাণী ধ্বংস ও নষ্ট হয়ে যাবে, শুধুমাত্র আল্লাহর সত্তা বাকী থাকবে যা ধ্বংস ও নষ্ট হওয়া থেকে বহু ঊর্ধ্বে। তিনিই প্রথম, তিনিই। শেষ। সবকিছুর পূর্বেও তিনি ছিলেন এবং সবকিছুর পরেও তিনি থাকবেন।
বর্ণিত আছে যে, যখন হযরত ইবনে উমার (রাঃ) নিজের অন্তরকে দৃঢ় করতে চাইতেন তখন তিনি জঙ্গলে চলে যেতেন এবং কোন ভগ্নাবশেষের সামনে দাড়িয়ে ব্যথিত সুরে বলতেনঃ “তোমার পরিবারবর্গ কোথায়?” অতঃপর স্বয়ং এর উত্তরে তিনি। (আরবি)এই আয়াতটিই পাঠ করতেন।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ বিধান তাঁরই এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। তিনি প্রত্যেককেই পুণ্য ও পাপের প্রতিদান প্রদান করবেন। তিনি পুণ্যের পুরস্কার ও পাপের শাস্তি দিবেন।