(বই#১০২০) [ পরীক্ষার কতিপয় বাস্তব নমুনা:-] www.motaher21.net সূরা:- ২৯:আল-আনকাবুত পারা:২০ ১৪-২৭ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০২০)
[ পরীক্ষার কতিপয় বাস্তব নমুনা:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৯:আল-আনকাবুত
পারা:২০
১৪-২৭ নং আয়াত:-
২৯:১৪
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰی قَوۡمِہٖ فَلَبِثَ فِیۡہِمۡ اَلۡفَ سَنَۃٍ اِلَّا خَمۡسِیۡنَ عَامًا ؕ فَاَخَذَہُمُ الطُّوۡفَانُ وَ ہُمۡ ظٰلِمُوۡنَ ﴿۱۴﴾
আমি অবশ্যই নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম; সে ওদের মধ্যে অবস্থান করেছিল সাড়ে ন’শ বছর। অতঃপর বন্যা ওদেরকে গ্রাস করল; কারণ ওরা ছিল সীমালংঘনকারী।
২৯:১৫
فَاَنۡجَیۡنٰہُ وَ اَصۡحٰبَ السَّفِیۡنَۃِ وَ جَعَلۡنٰہَاۤ اٰیَۃً لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۵﴾
অতঃপর আমি তাকে এবং পানি-জাহাজের আরোহীদেরকে রক্ষা করলাম এবং বিশ্ব-জগতের জন্য একে করলাম একটি নিদর্শন।
২৯:১৬
وَ اِبۡرٰہِیۡمَ اِذۡ قَالَ لِقَوۡمِہِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَ اتَّقُوۡہُ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۶﴾
স্মরণ কর ইব্রাহীমের কথা, যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর এবং তাঁকে ভয় কর; তোমাদের জন্য এটিই শ্রেয় যদি তোমরা জানতে।
২৯:১৭
اِنَّمَا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَوۡثَانًا وَّ تَخۡلُقُوۡنَ اِفۡکًا ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ لَا یَمۡلِکُوۡنَ لَکُمۡ رِزۡقًا فَابۡتَغُوۡا عِنۡدَ اللّٰہِ الرِّزۡقَ وَ اعۡبُدُوۡہُ وَ اشۡکُرُوۡا لَہٗ ؕ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۱۷﴾
তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে পূজা করছো তারা তো নিছক মূর্তি আর তোমরা একটি মিথ্যা তৈরি করছো। আসলে আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তোমরা পূজা করো তারা তোমাদের কোন রিযিকও দেবার ক্ষমতা রাখে না, আল্লাহর কাছে রিযিক চাও, তাঁরই বন্দেগী করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তারই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে।
২৯:১৮
وَ اِنۡ تُکَذِّبُوۡا فَقَدۡ کَذَّبَ اُمَمٌ مِّنۡ قَبۡلِکُمۡ ؕ وَ مَا عَلَی الرَّسُوۡلِ اِلَّا الۡبَلٰغُ الۡمُبِیۡنُ ﴿۱۸﴾
‘আর যদি তোমরা মিথ্যারোপ কর তবে তো তোমাদের পূর্ববর্তীরাও মিথ্যারোপ করেছিল। সুস্পষ্টভাবে প্রচার করা ছাড়া রাসূলের আর কোন দায়িত্ব নেই।
২৯:১৯
اَوَ لَمۡ یَرَوۡا کَیۡفَ یُبۡدِئُ اللّٰہُ الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُہٗ ؕ اِنَّ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرٌ ﴿۱۹﴾
ওরা কি লক্ষ্য করে না যে, কিভাবে আল্লাহ সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করেন, অতঃপর তা পুনরায় সৃষ্টি করবেন? নিশ্চয়ই এ আল্লাহর জন্য অতি সহজ।
২৯:২০
قُلۡ سِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَانۡظُرُوۡا کَیۡفَ بَدَاَ الۡخَلۡقَ ثُمَّ اللّٰہُ یُنۡشِیٴُ النَّشۡاَۃَ الۡاٰخِرَۃَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿ۚ۲۰﴾
এদেরকে বলো, পৃথিবীর বুকে চলাফেরা করো এবং দেখো তিনি কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর আল্লাহ‌ দ্বিতীয়বারও জীবন দান করবেন। অবশ্যই আল্লাহ‌ সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।
২৯:২১
یُعَذِّبُ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَرۡحَمُ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ اِلَیۡہِ تُقۡلَبُوۡنَ ﴿۲۱﴾
তিনি যাকে ইচ্ছে শাস্তি দেন এবং যার প্রতি ইচ্ছে অনুগ্রহ করেন। আর তোমরা তাঁরই কাছে প্ৰত্যাবর্তিত হবে।
২৯:২২
وَ مَاۤ اَنۡتُمۡ بِمُعۡجِزِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا فِی السَّمَآءِ ۫ وَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ ﴿٪۲۲﴾
তোমরা আল্লাহকে ব্যর্থ করতে পারবে না পৃথিবীতে অথবা আকাশে এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নেই, সাহায্যকারীও নেই।
২৯:২৩
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ لِقَآئِہٖۤ اُولٰٓئِکَ یَئِسُوۡا مِنۡ رَّحۡمَتِیۡ وَ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۲۳﴾
যারা আল্লাহর আয়াত এবং তার সাথে সাক্ষাত অস্বীকার করে, তারা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে গেছে এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
২৯:২৪
فَمَا کَانَ جَوَابَ قَوۡمِہٖۤ اِلَّاۤ اَنۡ قَالُوا اقۡتُلُوۡہُ اَوۡ حَرِّقُوۡہُ فَاَنۡجٰىہُ اللّٰہُ مِنَ النَّارِ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ ﴿۲۴﴾
উত্তরে ইবরাহীমের সম্প্রদায় শুধু এটাই বলল, ‘একে হত্যা কর অথবা অগ্নিদগ্ধ কর ।’ অতঃপর আল্লাহ্‌ তাঁকে আগুন থেকে রক্ষা করলেন। নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে, এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা ঈমান আনে ।
২৯:২৫
وَ قَالَ اِنَّمَا اتَّخَذۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَوۡثَانًا ۙ مَّوَدَّۃَ بَیۡنِکُمۡ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ ثُمَّ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ یَکۡفُرُ بَعۡضُکُمۡ بِبَعۡضٍ وَّ یَلۡعَنُ بَعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ۫ وَّ مَاۡوٰىکُمُ النَّارُ وَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ نّٰصِرِیۡنَ ﴿٭ۙ۲۵﴾
(ইবরাহীম) বলল, ‘পার্থিব জীবনে তোমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে প্রতিমাগুলিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছ; কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং একে অপরকে অভিশাপ দেবে। আর তোমাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।’
২৯:২৬
فَاٰمَنَ لَہٗ لُوۡطٌ ۘ وَ قَالَ اِنِّیۡ مُہَاجِرٌ اِلٰی رَبِّیۡ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۲۶﴾
সে সময় লূত তাকে মেনে নেয়৪৪ এবং ইবরাহীমকে বলে, আমি আমার রবের দিকে হিজরত করছি, তিনি পরাক্রমশালীও জ্ঞানী।
২৯:২৭
وَ وَہَبۡنَا لَہٗۤ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ وَ جَعَلۡنَا فِیۡ ذُرِّیَّتِہِ النُّبُوَّۃَ وَ الۡکِتٰبَ وَ اٰتَیۡنٰہُ اَجۡرَہٗ فِی الدُّنۡیَا ۚ وَ اِنَّہٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ لَمِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۲۷﴾
আমি ইব্রাহীমকে দান করলাম ইসহাক ও ইয়াকুব এবং তার বংশধরদের জন্য স্থির করলাম নবুঅত ও গ্রন্থ এবং আমি তাকে পৃথিবীতে পুরস্কৃত করলাম; পরকালেও সে নিশ্চয়ই সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম হবে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

এখন যে পর্ব শুরু হলাে, এতে পরীক্ষার কতিপয় বাস্তব নমুনা তুলে ধরা হয়েছে। হযরত নূহ(আ.) থেকে শুরু করে সুদীর্ঘ মানবেতিহাস জুড়ে যে ইসলামী আন্দোলন চলেছে, সেই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এসব পরীক্ষা সংঘটিত হয়েছে। এ সব পরীক্ষা ইসলামী দাওয়াতের পথিকৃত নবীদের ওপরও সংঘটিত হয়েছে। এখানে হযরত ইবরাহীম ও হযরত লূতের ওপর সংঘটিত পরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ আর অন্য নবীদের ওপর সংঘটিত পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে । এসব কাহিনীতে ইসলামের প্রচার ও দাওয়াতের পথে বিভিন্ন বাধা বিঘ্ন এবং যুলুম নির্যাতনের বিবরণ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে হযরত নূহ(আ.)-এর কাহিনীতে দেখানাে হয়েছে কত বড় ও দীর্ঘস্থায়ী চেষ্টা সাধনা চালিয়ে তিনি কতাে সামান্য ও নগণ্য সুফল পেয়েছেন। তিনি নয়শ’ পঞ্চাশ বছর তার জাতির সাথে বসবাস করেছেন এবং দাওয়াতী কাজ চালিয়েছেন, কিন্তু খুব অল্পসংখ্যক লােকই ঈমান এনেছিলাে। ‘অতঃপর সেই পাপাচারী জাতি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।’ হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনায়ও তার জাতির নিদারুণ গােমরাহী ও তার দাওয়াতের (বাহ্যিক) শােচনীয় অসাফল্য প্রতিফলিত হয়েছে। তার দাওয়াতের জবাবে তার জাতি শুধু এ কথাই বললাে যে, ইবরাহীমকে হয় হত্যা করাে, নচেত পুড়িয়ে দাও। হযরত লুত(আ.)-এর ঘটনায় ফুটে ওঠেছে জঘন্য নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতার প্রকাশ্য ঔদ্ধত্য। এ ঘটনায় মানবতা কিভাবে বিপথগামিতার সর্বনিম্নস্তরে পৌছে যায় এবং আল্লাহর নবীর সতর্কবাণী পর্যন্ত কিভাবে অবজ্ঞা করা হয়, তা দেখানাে হয়েছে। হযরত শােয়ায়বের কাহিনীতে ব্যবসায়ে দুর্নীতি ও কারচুপি এবং সত্য ও ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দৃষ্টান্ত সুস্পষ্ট। আদ ও সামুদ জাতির সংক্ষিপ্ত আলােচনায় তাদের শক্তির দম্ভ ও সম্পদের প্রাচুর্যজনিত দর্প প্রকাশ পেয়েছে। অনুরূপভাবে কারূন, ফেরাউন ও হামানের ধন ঐশ্বর্যের অহংকার, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে স্বৈরাচার ও আল্লাহর সাথে মােনাফেকীজনিত বিদ্রোহের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এসব কাহিনী পর্যালােচনা প্রসংগে একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে ইসলামী দাওয়াত ও তাবলীগের পথে বাধা সৃষ্টিকারী শক্তিগুলাে যতােই হুংকার ছাড়ুক ও আস্ফালন করুক, তারা যে আসলে মাকড়সার মতােই দুর্বল, সে কথা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এই পর্বের শেষে রসূল(স.)-কে কোরআন পড়ে শােনাতে, নামায কায়েম করতে এবং এরপর সব কিছু আল্লাহর হাতে সমর্পণ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে।  *হযরত নূহ ও ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনা : ‘আমি নূহকে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম… ‘(আয়াত ১৪-১৫) সর্বাধিক অগ্রগণ্য মত এই যে, হযরত নূহের নবুওতের মেয়াদ ৯৫০ বছর। এই পুরাে মেয়াদ জুড়ে তিনি তার জাতিকে দ্বীনের দাওয়াত দেন। নবুওতলাভের আগেও তার একটা সময় কেটে গেছে এবং বন্যার পরও তার জীবনের একটা অংশ অতিবাহিত হয়েছে। এই অংশ কতাে বছরের, তা অজ্ঞাত। মােট কথা, তিনি যে একটা সুদীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। এতাে দীর্ঘ জীবন আমাদের কাছে অস্বাভাবিক ও অসাধারণ মনে হয়। তবে এ তথ্যটা আমরা বিশ্বজগতের সবচেয়ে নির্ভুল ও সত্য উৎস থেকে পেয়েছি। এটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত করে যে, এ তথ্য সম্পূর্ণ সত্য। তবে এতাে দীর্ঘ আয়ুষ্কাল লাভ করা কিভাবে সম্ভব, তার ব্যাখ্যা দিতে গেলে বলা যায়, তৎকালে মানুষের সংখ্যা ছিলাে খুবই কম ও সীমাবদ্ধ। কাজেই এটা বিচিত্র নয় যে, সে কালের প্রজন্মগুলাে সংখ্যা স্বল্পতার কারণে পৃথিবীতে আবাদ ও বংশ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে যে ক্ষতির সম্মুখীন ছিলাে, তা পূরণের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাদের আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে যখন মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলাে এবং পৃথিবী আবাদ হয়ে গেলাে, তখন আর আয়ুষ্কাল দীর্ঘ করার কোনাে প্রয়ােজন রইলাে না। জীবজগতের বহু প্রাণীর আয়ুষ্কাল কম বা বেশী হবার পেছনে এই রহস্যটা সক্রিয় রয়েছে। প্রজাতির সংখ্যা যেখানেই কম, সেখানেই আয়ুষ্কাল বেশী হতে দেখা যায়- যেমন শকুন ও কচ্ছপের ক্ষেত্রে এটা লক্ষণীয়। এদের কোনাে কোনােটা কয়েকশ’ বছরও বেঁচে থাকে। পক্ষান্তরে মাছি, যার সংখ্যা কোটি কোটি, দু’সপ্তাহের বেশী বাঁচে না। এ সম্পর্কে জনৈক আরব কবি বলেন, দুর্বল ও নগ্ন পাখীকুল অনেক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে পক্ষান্তরে বাজপাখীর সন্তান খুবই কম জন্মে। এজন্যে বাজপাখী দীর্ঘজীবী আর ছােট ছােট পাখী স্বল্পজীবী হয়ে থাকে। এসব কিছুর পেছনেই আল্লাহর মহান উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। আর তিনি সব কিছুরই পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়ে থাকেন। হযরত নূহ(আ.)-এর সাড়ে নয়শাে বছরব্যাপী দাওয়াতী কাজ মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির ঈমান আনা ছাড়া আর কোনাে সুফল বয়ে আনেনি। এই দীর্ঘকালব্যাপী পরিচালিত দাওয়াত ও তাবলীগকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা, প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাস করার মাধ্যমে নিজেদের ওপর অত্যাচারকারী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা বন্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঈমান আনয়নকারী স্বল্পসংখ্যক মানুষ- যারা নৌকায় স্থান পেয়েছিলাে, তারাই বন্যা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলাে। এভাবে হযরত নূহ(আ.)-এর বন্যা ও নৌকার কাহিনী সমগ্র বিশ্ববাসীর স্মৃতিতে চিরন্তন শিক্ষার উৎস হয়ে টিকে রইল । যুগ যুগকাল ধরে এ কাহিনী কুফুর ও যুলুমের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করতে থাকবে। হযরত নূহ(আ.)-এর কাহিনীর পর সূরার পরবর্তী আয়াতগুলােতে সংক্ষেপে শত শত বছরের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত প্রাচীনকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত ইবরাহীমের ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হয়েছে, ‘আর ইবরাহীমের কথা স্মরণ করাে, যখন সে তার জাতিকে বললাে, তােমরা আল্লাহর আনুগত্য করাে ও আল্লাহকে ভয় করাে…'(আয়াত ১৬-১৮) হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর দাওয়াত ছিলাে খুবই স্বচ্ছ, স্পষ্ট, সহজ সরল । এতে ছিলাে না কোনাে জটিলতা ও অস্পষ্টতা। এই দাওয়াত ছিলাে অত্যন্ত নিখুঁত ও পরিপাটিভাবে সাজানাে, দাওয়াতী কাজে লিপ্ত যে কোনাে ব্যক্তি বা দল তার এই দাওয়াতের অনুকরণ করতে পারে । প্রথমে তিনি দাওয়াতের মূল কথাটা এভাবে তুলে ধরেন, আল্লাহর ইবাদত করাে ও আল্লাহকে ভয় করে। অতপর এই মূলকথাটা জনগণের কাছে প্রিয় করে তােলার জন্য বলেন, ‘তােমরা যদি জানতে তবে এটাই তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর।’ এই মন্তব্যের মাধ্যমে জনগণকে অজ্ঞতা দূর করতে উৎসাহিত এবং নিজেদের জন্যে সর্বোত্তম জিনিস বাছাই করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এটা মূলত একটা গভীর সত্য কথা নিছক উদ্বুদ্ধকরণের উদ্দেশ্যে এ কথা বলা হয়নি। তারপর তৃতীয় পর্যায়ে তাদের আকীদা-বিশ্বাসকে অন্যায় অসত্য আকীদা বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তার একাধিক যুক্তিও প্রদর্শন করেছেন। প্রথমত, তারা যার উপাসনা করে তা হচ্ছে, কাঠের তৈরী পুতুল। এটা একটা হাস্যকর উপাসনা, বিশেষত যখন এই উপাসনার কারণে তারা আল্লাহর এবাদাত থেকে বিচ্যুত হয়। দ্বিতীয় কথা হলাে, তারা তাদের এই এবাদাতের পেছনে কোনাে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। তারা কেবল মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রচারণা চালিয়ে থাকে। তারা এসব পুতুলকে পূর্বে কোনা দৃষ্টান্ত ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে বলে প্রচারণা চালায়। তৃতীয়ত এসব পুতুল, তাদের জন্যে কোনাে উপকার বয়ে আনে না এবং তাদেরকে কোনাে জীবিকা এনে দেয় না। ‘তােমরা আল্লাহ ছাড়া আর যার যার উপাসনা করে থাকো, তারা তােমাদের কোনাে জীবিকা সরবরাহ করতে পারে না।’ চতুর্থ পর্যায়ে তিনি তাদের আল্লাহর কাছ থেকে জীবিকা চাইতে উদ্বুদ্ধ করেন। বস্তুত এটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়ােজনীয় জিনিস। অতপর আল্লাহর কাছে জীবিকা চাও।’ জীবিকার চিন্তা মানুষের মনকে অস্থির ও দিশেহারা করে দেয় এবং সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখে, বিশেষত যাদের অন্তরে ঈমান দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল হয়নি তাদেরকেই বেশী ব্যস্ত রাখে। কিন্তু একমাত্র আল্লাহর কাছে জীবিকা চাওয়া একটা বাস্তব ব্যাপার। এটা কেবল মানুষের মনের সুপ্ত ইচ্ছাকে উস্কে দেয়া নয়। সবার শেষে দুনিয়ার সকল নেয়ামত ও সম্পদদাতার শােকর আদায় ও এবাদাত করার জন্যে তাদের আহবান জানানাে এভাবে, ‘তোমরা তাঁর ইবাদত ও শোকর করো।’ অতপর তাদেরকে জানানো হয় যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনাে পালাবার জায়গা নেই। তাই আল্লাহর একনিষ্ঠ এবাদাতকারী ও শােকরগােযার বান্দা হিসেবে তার দিকে প্রত্যাবর্তন করাই সর্বোত্তম পন্থা, ‘তােমরা তারই দিকে প্রত্যাবর্তন করবে।’ এরপরও যদি তারা রসূলের দাওয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাহলে তাতে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের কোনােই ক্ষতি হবে না। ইতিপূর্বে অনেকেই মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। রসূলদের কাজ প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। তোমরা যদি মিথ্যা সাব্যস্ত করাে, তাহলে তােমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। রসূলের কাজ প্রকাশ্য প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। এভাবে হযরত ইবরাহীম তার জাতিকে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে সৎপথে আনার চেষ্টা করেছেন। এই পন্থাটা সকলের জন্যেই অনুকরণীয়।

*দাওয়াত অস্বীকারকারিদের প্রতি কোরআনের আহবান : হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কাহিনীর সমাপ্তি টানার আগে দাওয়াত অস্বীকারকারীদের উদ্দেশ্যে কয়েকটা কথা বলা হয়েছে, যা প্রত্যেক কাফেরকে এবং বিশেষত আখেরাত অস্বীকারকারীকে বলা হয়ে থাকে। এই কথাগুলাে তারা কি দেখেনা আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টির সূচনা ও পুনঃসৃষ্টি করেন?(আয়াত ১৯-২৩) আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তনের বিষয় অস্বীকার করে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই এ ধরনের সম্বােধন করা হয়ে থাকে। এই সম্বােধনে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্ব প্রকৃতিকে এবং এর ক্ষেত্র হলাে আকাশ ও পৃথিবী। ঈমানের নিদর্শন ও তার সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে গােটা প্রকৃতিকে তুলে ধরা কোরআনের রীতি। এ মহাবিশ্ব মানুষের সামনে একটা খোলা পৃষ্ঠা, তার মন ও বিবেক এখানে আল্লাহর নিদর্শনাবলী, তার অস্তিত্ব ও একত্বের অকাট্য প্রমাণ সমূহ, এবং তার প্রতিশ্রুতির সত্যতার প্রমাণসমূহ খুঁজতে পারে, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী চিরদিন জনসমক্ষে উপস্থিত থাকে। এগুলাে তার স্মৃতিশক্তি থেকে কখনাে হারিয়ে যায় না। তবে এগুলােকে দীর্ঘকাল দেখতে দেখতে মানুষ এর নতুনত্বের ভাবমূর্তি হারিয়ে ফেলে। আর বারবার দেখার কারণে মনের ওপর এর প্রভাবও ক্ষীণ হয়ে আসে। তাই কোরআন মানুষকে প্রকৃতির সেই চমৎকার দৃশ্যের দিকে ফিরিয়ে নিতে চায় এবং এ সব দৃশ্যের রহস্য ও শিক্ষা অনুসন্ধান করতে উদ্ধুদ্ধ করে। এগুলাে থেকে সে এমন সব সাক্ষ্য প্রমাণ করে যা চোখ দিয়ে দেখা যায় এবং যা দ্বারা চেতনা ও অনুভূতি প্রভাবিত হয়। সে এ দ্বারা সেই সব নিষ্প্রাণ ও নির্জীব তর্ক শাস্ত্রীয় ও মনস্তাত্বিক বিতর্কের পথ অবলম্বন করে না, যা ইসলামী চিন্তাধারার অভ্যন্তরে বাইরের বস্তুবাদী দর্শন থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। তাই এ চিন্তাধারা কোরআনের অজানা অচেনা ও অগ্রহনযােগ্য। অথচ কোরআন তার নিজস্ব মত ও পথ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। ‘তারা কি দেখেনি কিভাবে আল্লাহ সৃষ্টির সূচনা করেন এবং তার পুনরাবৃত্তি করেন। এ কাজটা আল্লাহর কাছে সহজ।'(আয়াত ১৯) আল্লাহ তায়ালা কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন, সেটা তারা নিশ্চয়ই দেখে থাকে। বিকাশমান উদ্ভিদে, পরিণতির দিকে অগ্রসরমান ডিম ও ভ্রুণে এবং প্রত্যেক অস্তিত্বহীনের অস্তিত্ব গ্রহণের সময় এটা লক্ষ্য করা যায়। এ সব বস্তুর কোনােটাই মানুষ এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে না, এমনকি সে দাবীও করতে পারে না। বস্তুত জীবনের রহস্য চিরদিনই দুর্বোধ্য। জীবনের সৃষ্টিকর্তা কে ও কিভাবে তা সৃষ্টি হয় তা কেউ জানে না, সৃষ্টির চেষ্টা বা দাবী করার তাে প্রশ্নই ওঠে না। এর একমাত্র ব্যাখ্যা এই যে, এগুলাে আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা প্রতি মুহূর্তে সবার চোখের সামনে কতাে নতুন নতুন সৃষ্টি করে চলেছেন, তার কোনাে ইয়ত্তা নেই। সবাই তা দেখতে পায় এবং কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না। মানুষ যখন স্বচক্ষেই সৃষ্টির প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছে তখন যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি এগুলাে ধ্বংস করে পুনরায় সৃষ্টি করতেও সক্ষম। এ কাজটা আল্লাহর কাছে সহজ। সৃষ্টিজগতে এমন কোনাে জিনিস নেই যা সৃষ্টি করা আল্লাহর কাছে কঠিন, কিন্তু আল্লাহ মানুষের ভাষায় কথা বলেন এবং মানুষের মানদন্ডে পরিমাপ করেন। মানুষ মনে করে, যে কোনাে জিনিস দ্বিতীয় বার সৃষ্টি করা প্রথম বার সৃষ্টি করার চেয়ে সহজ। নচেত আল্লাহর কাছে প্রথম সৃষ্টি দ্বিতীয় সৃষ্টির মতােই এবং দ্বিতীয় সৃষ্টি প্রথম সৃষ্টির মতােই। এ কাজের জন্যে তার শুধু ইচ্ছা করা এবং ‘হও’ বলাই যথেষ্ট। অতপর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পৃথিবী পরিভ্রমণের আহ্বান জানান এবং আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শনাবলী দেখতে বলেন। এক্ষেত্রে জীব ও জড়- সবই সমান। সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে দেখলে সে বুঝতে পারবে, যিনি প্রথম সৃষ্টি করেন, পুনরায় সৃষ্টি করে পরকালীন জগতের উদ্ভব ঘটাতে তার কোনাে কষ্টই হয় না। ‘বলো, তােমরা পৃথিবী পরিভ্রমণ করাে…'(আয়াত ২০) পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করলে মানুষের চোখ ও মন অনেক নতুন দৃশ্য দেখতে পায়, অথচ যেখানে সে বাস করে, সেখানে সব কিছু তার কাছে পুরনাে ও পরিচিত হয়ে যায়। ফলে সেখানকার কোনাে দৃশ্য দেখে সে অবাক হয় না। পরে সে যখন ভ্রমণ করে তখন নতুন জায়গার প্রত্যেক নতুন দৃশ্যের ব্যাপারে তার চেতনা অনুভূতি সজাগ ও কৌতুহলী হয়ে ওঠে। অথচ তার নিজ এলাকায় সে একই জিনিস দেখে তার কোনাে কৌতূহলই সৃষ্টি হতাে না। সফর থেকে ফিরে আসার পর হয়তাে সেসব জিনিস দেখেই সে অবাক হবে, যা দেখে সে ইতিপূর্বে অবাক হতাে না। তার নিজ এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলাে তাকে এমন অনেক কথা বলবে, যা ইতিপূর্বে বলতাে না বা বলতাে, কিন্তু সে তা বুঝতাে না। কোরআন নাযিলকারী মহান আল্লাহর পবিত্রতা ঘােষণা করছি। অন্তরাত্মার গােপন রহস্য সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান! বলাে তােমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করাে, অতপর দেখাে আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন!’ এখানে কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন, অতীতকাল সূচনা ক্রিয়া ব্যবহার করায় মনে একটা বিশেষ চিন্তাধারার উদ্রেক করে। অমনি পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু দেখতে পাবেন, যা জীবনের প্রথম উন্মেষ ও সৃষ্টির সূচনা কিভাবে হয়েছিলাে, তার প্রমাণ বহন করে। যেমন আধুনিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিকরা যখন অনুসন্ধানকার্য চালিয়ে জানতে চেষ্টা করছেন কিভাবে জীবনের উন্মেষ, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন ঘটেছে। অবশ্য আজো তারা জীবনের রহস্য উদঘাটনে কোনাে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেননি। তারা আজো জানতে পারেননি জীবন কী, কোথা থেকে তা পৃথিবীতে এলাে এবং পৃথিবীতে প্রথম জীবিত প্রাণীর উদ্ভব কিভাবে ঘটলাে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে জীবনের প্রথম উদ্ভব সম্পর্কে তত্ত্বানুসন্ধান ও পরবর্তী জীবন সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের সময় যুক্তি প্রদর্শনের পথনির্দেশক স্বরূপ। এই চিন্তাধারার পাশাপাশি আরাে একটা চিন্তাধারা মাথা তােলে। সেটা এই যে, এ আয়াত দ্বারা যাদের প্রথম সম্বোধন করা হয়েছে, তারা তাে আধুনিক কালের মতাে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাতে সক্ষম ছিলাে না। তাই আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা বিজ্ঞানীরা যে তথ্য অর্জন করতে চায়, সে তথ্য অর্জন করা তৎকালের আরবদের পক্ষে অসম্ভব ছিলাে। অতএব, কোরআন আয়ত্তাধীন অন্য একটা পন্থায় তাদের পরকালীন জীবনের সম্ভাব্যতা উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলাে। সেই পন্থাটা ছিলাে এই যে, উদ্ভিদ, জীবজন্তুতে ও মানুষের ভেতরে কিভাবে জীবনের উদ্ভব ঘটে সেটা পর্যবেক্ষণ করা। আগেই বলেছি, পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করার উদ্দেশ্য হলাে বিভিন্ন নতুন নতুন দৃশ্য দেখে অনুভূতিকে জাগ্রত ও সচকিত করার সুযােগ সৃষ্টি করা এবং জীবন সৃষ্টিতে আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শনাবলী পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানানাে। এই জীবন প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি জায়গায় সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলাে পর্যবেক্ষণ করার জন্যেই আল্লাহ তায়ালা বেশী করে ভ্রমণ করতে বলেছেন। এখানে কোরআনে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল আরাে বেশী গুরুত্বপূর্ণ একটা সম্ভাবনা বিদ্যমান সেটা এই যে, আল্লাহ তায়ালা এমন পথনির্দেশ দিতে চান, যা সর্বকালের, সকল পর্যায়ের ও সকল শ্রেণীর মানুষের জীবনের সাথে এবং তাদের সকল সমস্যা ও সকল জীবনােপকরণের সাথে সামঞ্জস্যশীল, যাতে সকল প্রজন্মের প্রতিটি মানুষ তার জীবনের পরিবেশ ও পরিস্থিতির অনুকূল কর্মপন্থা অবলম্বন করে। এভাবে জীবনের চিরস্থায়ী উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নিশ্চিত হয়। তাই উল্লিখিত দু’ধরনের চিন্তাধারা পরস্পর বিরােধী নয়। এটাই সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।’ অর্থাৎ নিজের এই সীমাহীন ও সর্বময় ক্ষমতা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা জীবনের প্রথম সৃষ্টি ও পুনর্বার সৃষ্টির ব্যবস্থা করেন। তার এই ক্ষমতা মানুষের কল্পিত ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। যেসব নিয়ম কানুনের আওতায় নিজেদের সীমিত অভিজ্ঞতার আলােকে মানুষ কোনাে জিনিসকে সম্ভব’ ও কোনাে জিনিসকে ‘অসম্ভব’ আখ্যায়িত করে, মানুষের সীমিত অভিজ্ঞতায় সম্ভব অসম্ভব নির্বিশেষে সবই আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার আওতাধীন। সেই সীমাহীন সর্বময় ক্ষমতাধিকারী আল্লাহই যাকে ইচ্ছা-শাস্তি দেন, যাকে ইচ্ছা দয়া করেন এবং একমাত্র তার কাছেই সবাই ফিরে যেতে বাধ্য। কেউ এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে না।(আয়াত ২১-২২) আর আযাব ও রহমত আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কেননা তিনি ন্যায়ের পথ ও অন্যায়ের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, মানুষকে এই দুটোর মধ্য থেকে যে কোনাে একটা বেছে নেয়ার যােগ্যতা দান করেছেন, তার জন্যে পথ সহজ করে দিয়েছেন এবং যে কোনাে পথ অবলম্বনে স্বাধীন করে দিয়েছেন। তবে আল্লাহর পথ ও সৎপথ অবলম্বন করলে তার জন্যে আল্লাহর সাহায্য অবধারিত হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে সৎপথকে অবজ্ঞা ও অগ্রাহ্য করলে এবং তা থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখলে গােমরাহী ও আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। এভাবেই আযাব ও রহমত নির্ধারিত হয়। ‘আর তার দিকেই তােমরা ফিরে যাবে।’ ‘তুকলাবুন’ শব্দটা দ্বারা এমন প্রত্যাবর্তন বুঝানাে হয়েছে যা যন্ত্রণাময়। পরবর্তী আয়াতের বক্তব্য এর সাথে সংগতিশীল, ‘তােমরা পৃথিবীতেও তাকে ঠেকাতে পারাে না, আকাশেও না।’ অর্থাৎ এই মহাবিশ্বে তােমাদের এমন কোনাে ক্ষমতাই নেই, যা দ্বারা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন রােধ করতে পারাে। এই ক্ষমতা পৃথিবীতেও নেই। আর আকাশের যে সব কিছুকে তােমরা কখনাে কখনাে উপাসনা করাে এবং তাদের আকাশের শক্তি মনে করাে, যথা জ্বিন ও ফেরেশতা তাদেরও নেই। ‘আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তােমাদের অভিভাবক ও সহায় নেই। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনাে অভিভাবক ও সহায় কোথা থেকে আসবে? মানুষের মধ্য থেকে সহায় ও অভিভাবক কিভাবে হবে? জ্বিন ও ফেরেশতা থেকেই বা কিভাবে আসবে? সবাই তাে আল্লাহর সৃষ্টি ও আল্লাহর বান্দা তারা তো নিজেদেরই কোনাে লাভ লােকসান করতে পারে না, অন্যের লাভ-লােকসান করার তাে প্রশ্নই ওঠে না। ‘যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী ও তার সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে, তারা আমার রহমত থেকে হতাশ হয়ে গেছে এবং তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।'(আয়াত ২৩) কারণ মানুষের মনমগয আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী ও অবাধ্য না হওয়া এবং আল্লাহর ও তার সম্পর্ক ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না। অনুরূপভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ না ঘটা ও তাঁর রহমত থেকে হতাশ না হওয়া পর্যন্ত মানুষ আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী ও অবাধ্য হয় না। উভয় অবস্থার পরিণাম সুবিদিত, তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

*ইবরাহীম(আ.)-কে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র : কাহিনীর মাঝখানের এই প্রাসংগিক আলােচনা, যা প্রত্যেক কাফের ও হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর জাতির প্রসংগে এসেছে। শেষ হবার পর এবার হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর জাতি তার দাওয়াতের কী জবাব দিয়েছিলাে তা জানানাে হচ্ছে। এ জবাবটা বড়ই বিস্ময়কর মনে হয়। ক্ষমতার গর্বে মত্ত হলে মানুষ কতাে আগ্রাসী ও উদ্ধত হতে পারে, তা এখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। তার জাতির একমাত্র জবাব ছিলাে এই যে, ইবরাহীমকে হত্যা করাে অথবা পুড়িয়ে দাও। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে আগুন থেকে বাঁচালেন। এতে মােমেনদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাকে হত্যা করাে অথবা পুড়িয়ে দাও।’ এই হলাে তার সেই সুস্পষ্ট, সহজ, সরল দাওয়াতের জবাব, যা দ্বারা তিনি তার জাতির মন ও বিবেককে আবেদন জানিয়েছিলেন। আমি আগেই বলেছি, এই দাওয়াত কতাে উৎকৃষ্ট মানের ছিলাে এবং কত অনুকরণীয় ভংগিতে দেয়া হয়েছিলাে। যেহেতু পুরাে একটা জাতি তার সমগ্র ঔদ্ধত্য ও আগ্রাসন নিয়ে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিলাে এবং তিনি এ আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা করতেও সক্ষম ছিলেন না । কেননা তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অক্ষম ও অসহায় এক ব্যক্তি। তাই এখানে মহান আল্লাহ তার সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে অলৌকিক পন্থায় হস্তক্ষেপ করলেন, ‘আল্লাহ তাকে আগুন থেকে রক্ষা করলেন।’ যে অলৌকিক পন্থায় তাকে আগুন থেকে রেহাই দেয়া হয়েছিলাে, তাতে ঈমান আনতে মানসিকভাবে প্রস্তুত- এমন ব্যক্তি মাত্রেরই জন্যে শিক্ষণীয় নিদর্শন ছিলাে। কিন্তু এমন অলৌকিক মােজযা দেখেও সে জাতি ঈমান আনলাে না। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, অলৌকিক ঘটনাবলী মানুষকে হেদায়াত করে না, হেদায়াত ও ঈমানের মানসিক যােগ্যতা এবং প্রস্তুতিই তাকে হেদায়াতের দিকে এগিয়ে দেয়। এই ঘটনায় মােমেনদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে, প্রথম নিদর্শন হলাে আগুন থেকে হযরত ইবরাহীমের নিস্তার লাভ। দ্বিতীয় নিদর্শন হলাে, আল্লাহ তায়ালা যাকে নিস্তার দিতে চাইলেন, সেই একমাত্র ব্যক্তিকে সমগ্র জাতি মিলেও কষ্ট দিতে পারলাে না। তৃতীয় নিদর্শন এই যে, কুফরী ও অবিশ্বাসের ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ হঠকারী ব্যক্তি বা জাতিকে অলৌকিক ঘটনা দ্বারা হেদায়াত করা যায় না। যারা দাওয়াত ও আন্দোলনের ইতিহাস, মানুষের মনােজগতের পরিবর্তন এবং হেদায়াত ও গােমরাহীর উপকরণাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, তাদের জন্যে এতে এই নিদর্শনাবলী রয়েছে। হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর আগুন থেকে নিস্তার পাওয়ার পর কাহিনীর পরবর্তী অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। এতােবড় জ্বলজ্যান্ত মােজেযা দেখেও যখন তার জাতির মন নরম হলাে না, তখন তিনি তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাওয়ার আগে নিম্নরূপ বক্তব্য রাখলেন, ‘ইবরাহীম বললাে, তােমরা তাে আল্লাহ ছাড়া মূর্তিকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছো কেবল পার্থিব জীবনে পরস্পরের মধ্যে মৈত্রী প্রীতি গড়ার জন্যে। এরপর কেয়ামতের দিন তােমরা পরস্পরকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং পরস্পরকে শাপ শাপান্ত করবে। তােমাদের আশ্রয় হলাে জাহান্নাম। তােমাদের কোনাে সহায্যকারী থাকবে না।’ (আয়াত-২৪) অর্থাৎ তােমরা এসব মূর্তির উপাসনা যুক্তিসংগত ও ন্যায়সংগত বলে বিশ্বাস করে নয়, বরং পরস্পরের প্রতি সৌজন্য প্রকাশের খাতিরে করে থাকো। সত্য ও ন্যায় কারাে কাছে প্রকাশিত হয়ে গেলেও কেবল পারস্পরিক মৈত্রী সম্প্রীতিকে অগ্রগণ্য মনে করার কারণেই তােমরা এই মূর্তিপূজা ত্যাগ করাে না। যারা আকীদা, আদর্শ ও নীতি একনিষ্ঠভাবে গ্রহণ করে না, তাদের মধ্যেই এরূপ ঘটে থাকে, ফলে পারস্পরিক সন্তুষ্টির খাতিরে নীতি ও আদর্শ অকাতরে বিসর্জন দেয়া হয়। নিজের প্রিয়জনকে অসন্তুষ্ট করার চেয়ে আদর্শ বিসর্জন দেয়া সেক্ষেত্রে সহজ বিবেচিত হয়। এ হলাে এক ধরনের আপােষহীন হঠকারিতা, যাতে কোনাে নমনীয়তার অবকাশ থাকে না। এরপর দেখানাে হচ্ছে তাদের পরকালীন অবস্থা। সেখানে দেখা যাবে এর ঠিক বিপরীত অবস্থা। দুনিয়ার জীবনে যে প্রীতি ও মৈত্রীর খাতিরে তারা অবিচলভাবে মূর্তিপূজা আঁকড়ে ধরেছিলাে, কেয়ামতের দিন সেই মৈত্রী পরিণত হবে শক্রতায়, পারস্পরিক অভিসম্পাতে এবং সম্পর্কচ্ছেদে, ‘অতঃপর কেয়ামতের দিন তােমরা পরস্পরকে অস্বীকার করবে…’ অর্থাৎ যেদিন কেউ কারাে প্রাধান্য মানবে না, বন্ধুরা পরস্পরকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং একে অপরকে বিপথগামী করার দায়ে অভিযুক্ত করবে ও অভিশাপ দেবে, কিন্তু এভাবে পরস্পরকে অস্বীকার ও শাপশাপান্ত করায় কোনাে লাভ হবে না এবং এতে কারাে আযাব দূর হবে না, ‘তােমাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম এবং তােমাদের কোনাে সাহায্যকারী থাকবে না।’ অর্থাৎ যে আগুনে তারা ইবরাহীম(আ.)-কে পােড়াতে চেয়েছিলাে এবং যে আগুন থেকে আল্লাহ তায়ালা তাকে রেহাই দিলেন, সেই আগুন হবে তাদের আশ্রয়স্থল এবং তা থেকে তাদের কেউ উদ্ধার করবে না। এখানে এসে সমাপ্ত হলাে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর দাওয়াত এবং তার অকাট্য মােজেযা তার সমগ্র জাতির মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যিনি তার ওপর ঈমান আনলেন তিনি হলেন হযরত লুত। এই হযরত লুতের স্ত্রীও ঈমান আনলাে না। হযরত লুত হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর ভাইয়ের ছেলে ছিলাে বলে কথিত আছে। তিনি তাকে সাথে নিয়ে কেলদানী জাতি অধ্যুষিত ইরানের উর থেকে জর্দান নদীর কিনারে হিজরত করলেন, লূত তার ওপর ঈমান আনলাে। সে বললাে, আমি আমার প্রভুর কাছে হিজরত করবাে…’ এখানে হযরত লূতের ‘আমি আমার প্রভুর কাছে হিজরত করবাে’ কথাটা লক্ষণীয়। লক্ষণীয় যে, তিনি কি জন্যে হিজরত করলেন। তিনি নিস্তার পাওয়ার জন্যে বা কোনাে আয় উপার্জন, ব্যবসা বা ভূমির জন্যে হিজরত করেননি। হিজরত করেছেন স্বীয় প্রভুর দিকে, অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য ও নিরাপত্তা লাভ করার জন্যে। তার কাছে নিজের দেহ বাঁচানাের চেয়ে আকীদা ও আদর্শ বাঁচানাে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজের মন ও সমগ্র সত্ত্বাকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করার জন্যে কুফরী এবং গােমরাহীর স্থান থেকে বহু দূরে চলে যেতে চেয়েছেন। কেননা তার জাতির হেদায়াত ও ঈমানের কোনাে আশা আর অবশিষ্ট ছিলাে না। আল্লাহ হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর মাতৃভূমি, জাতি ও পরিবার পরিজন ত্যাগ করে চলে যাওয়ার ক্ষতি এভাবে পূরণ করলেন যে, তাকে এমন এক বংশধর উপহার দিলেন, যাদের ভেতর দিয়ে আল্লাহর নবুওত ও রেসালাত পৃথিবীতে চালু থাকলাে। তার পরের সকল নবী তার বংশধরের মধ্য থেকেই এসেছিলেন। এটা দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট সম্পদ। ‘আমি তাকে ইসহাক ও ইয়াকুব দান করলাম…’ এটা আল্লাহর এক অনবদ্য দান। এর মধ্য দিয়ে হযরত ইবরাহীমের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় আল্লাহর পরিপূর্ণ সন্তোষই প্রতিফলিত হয়েছে। যে ব্যক্তিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাে একটা পাষন্ড জাতি, তার চারপাশে শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলাে। এ ছিলাে যথার্থ পুরস্কার।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৪-১৫ নং আয়াতের তাফসীর:

নূহ (عليه السلام) একজন উলূল আযম রাসূল তথা শ্রেষ্ঠ ৫ জন রাসূলের একজন এবং তিনি পৃথিবীর বুকে প্রথম রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে স্বজাতীর কাছে দাওয়াত দেয়ার জন্য প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁকে আয়ূ দিয়েছিলেন ৯৫০ বছর। নূহ (عليه السلام) প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য, একাকী, যৌথ অনেকভাবে দাওয়াতী কাজ করেছেন। এত বছর দাওয়াতী কাজ করার পরেও অল্প কিছু লোক ব্যতীত সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক তাঁর প্রতি ঈমান নিয়ে আসেনি।

ফলে আল্লাহ তা‘আলা নূহ (عليه السلام) ও যারা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিল তাদের বাদে সকলকে প্লাবনে ডুবিয়ে মারেন। নূহ (عليه السلام)-এর দাওয়াতী পদ্ধতি সূরা নূহে আলোচনা করা হবে ইনশা আল্লাহ তা‘আলা।

১৬-২৭ নং আয়াতের তাফসীর:

উক্ত আয়াতগুলোতে ইবারাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতাসহ জাতিকে যেভাবে তাওহীদের দিকে আহ্বান করেছিলেন এবং তাঁর আহ্বানে জাতির লোকেরা যেভাবে বিরোধিতা করেছিল ও তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করে শাস্তি প্রদান করার জন্য ইচ্ছা করেছিল সে বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে।

(فَاٰمَنَ لَه۫ لُوْطٌ)

অর্থাৎ এত নির্যাতন ও বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ইবরাহীম (عليه السلام) দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে লূত (عليه السلام) ইবরাহীম (عليه السلام)-এর প্রতি ঈমান আনেন। পরে তাঁকেও নবুওয়াত দেয়া হয়।

(وَقَالَ إِنِّيْ مُهَاجِرٌ إِلٰي رَبِّيْ)

অর্থাৎ যখন ইবরাহীম (عليه السلام) দেখলেন তাঁর জাতির লোকেরা দাওয়াত কবুল করছে না তখন তিনি হিজরত করে শামে চলে গেলেন। সাথে লূত (عليه السلام) ও স্ত্রী সারাও হিজরত করেছিলেন।

(وَوَهَبْنَا لَه۫ٓ إِسْحٰقَ وَيَعْقُوْبَ)

অর্থাৎ শামে হিজরত করার পর আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (عليه السلام)-কে ইসহাক ও ইয়াকুব নামক দুটি সন্তান দান করেন। ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পর যত নাবী এসেছেন সবাই তাঁর বংশ থেকে। এমনকি নবুওয়াতের ধারা শেষ হয়েছে আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমে।
ইবরাহীম (عليه السلام) ও স্বজাতির সাথে তাঁর ঘটনা সম্পর্কে পূর্বে একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. কাফির-মুশরিকদেরকে সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াত দিতে হবে।
২. কাফির-মুশরিকদেরকে যখন তাওহীদের দাওয়াত দিব তখন তাদের বাতিল মা‘বূদগুলোর অক্ষমতা তুলে ধরব।
৩. যারা আল্লাহর পথে অবিচল থাকে তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে সাহায্য করেন।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# যারা হযরত নূহের (আ) প্রতি ঈমান এনেছিলেন এবং যাদেরকে আল্লাহ‌ নৌকায় আরোহণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সূরা হূদে এর সুস্পষ্ট বর্ণনা এভাবে দেয়া হয়েছেঃ

حَتَّى إِذَا جَاءَ أَمْرُنَا وَفَارَ التَّنُّورُ قُلْنَا احْمِلْ فِيهَا مِنْ كُلٍّ زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ وَأَهْلَكَ إِلَّا مَنْ سَبَقَ عَلَيْهِ الْقَوْلُ وَمَنْ آمَنَ وَمَا آمَنَ مَعَهُ إِلَّا قَلِيلٌ

“শেষ পর্যন্ত যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং চুলা উথলে উঠলো তখন আমি বললাম, (হে নূহ) এতে উঠিয়ে নাও প্রত্যেক শ্রেণীর (প্রাণীদের) এক এক জোড়া এবং নিজের পরিবার পরিজনদেরকে। তবে যাদেরকে সঙ্গে না নেবার জন্য পূর্বেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের কথা আলাদা। আর তার সাথে ঈমান এনেছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজন।” (৪০ আয়াত)

# এর অর্থ এও হতে পারে যে, এ ভয়াবহ শাস্তি অথবা এ যুগান্তকারী ঘটনাটিকে পরবর্তীকালের লোকদের জন্য শিক্ষণীয় করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে এবং সূরা কামারে একথাটি যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে একথাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, নৌকাটিই ছিল শিক্ষণীয় নিদর্শন। শত শত বছর ধরে সেটি পর্বত শৃঙ্গে অবস্থান করছিল। এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছিয়ে যেতে থেকেছে যে, এ ভূখণ্ডে এক সময় এমন ভয়াবহ প্লাবন এসেছিল যার ফলে এ নৌকাটি পাহাড়ের মাথায় উঠে যায়। সূরা আল কামারে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَدُسُرٍ – تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِمَنْ كَانَ كُفِرَ – وَلَقَدْ تَرَكْنَاهَا آيَةً فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ

“আর নূহকে আমি আরোহণ করালাম তখতা ও পেরেকের তৈরি নৌকায়। তা চলছিল আমার তত্ত্বাবধানে সেই ব্যক্তির জন্য পুরস্কার স্বরূপ যাকে অস্বীকার করা হয়েছিল। আর আমি তাকে ছেড়ে দিলাম একটি নিদর্শনে পরিণত করে; কাজেই আছে কি কেউ শিক্ষা গ্রহণকারী? ”

সূরা আল কামারের এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জারীর কাতাদার এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেনঃ সাহাবীগণের আমলে মুসলমানরা যখন আল জাযীরায় যায় তখন তারা জুদী পাহাড়ের ওপর (অন্য একটি বর্ণনা মতে বাকেরওয়া নামক জনবসতির কাছে) এ নৌকাটি দেখে। বর্তমানকালে মাঝে মাঝে এ ধরনের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখা গেছে যে, নূহের নৌকা অনুসন্ধান করার জন্য অভিযাত্রী দল পাঠানো হচ্ছে। এর কারণ বর্ণনা করে বলা হয়, অনেক সময় বিমান আরারাতের পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করার সময় আরোহীরা একটি পর্বতশৃঙ্গে একটি নৌকার মতো জিনিস দেখেছে। (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফঃ ৪৭ এবং হূদঃ ৪৬ টীকা)
# তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন সূরা আল বাকারাহ- ১৫, ১৬ ও ৩৫ ; আলে ইমরান- ৭ ; আল আন’আম -০৯ ; হূদ-৭ ; ইবরাহীম-৬ ; আল হিজর-৪ ; মারয়াম-৩ ; আল আম্বিয়া-৫ ; আশ শু’আরা-৫ , আস সাফ্‌ফাত-১৩ ; আয্‌ যুখরুফ-৩ ;এবং আয যারিয়াত-২ রুকু’ সমূহ।
# তার সাথে কাউকে শরীক এবং তার নাফরমানী করতে ভয় করো।
# তোমরা এ মূর্তি তৈরি করছো না বরং মিথ্যা তৈরি করছো। এ মূর্তিগুলোর অস্তিত্ব নিজেই একটি মূর্তিমান মিথ্যা। তার ওপর তোমাদের এ আকীদা-বিশ্বাস যে, এরা দেব-দেবী, আল্লাহর অবতার, তাঁর সন্তান, আল্লাহর সান্নিধ্যে অবস্থানকারী ও তাঁর কাছে শাফা’আতকারী অথবা এদের মধ্য থেকে কেউ রোগ নিরাময়কারী আবার কেউ সন্তান-দাতা এবং কেউ রিযিকদাতা-এসবই মিথ্যা কথা। তোমরা নিজেদের ধারণা ও কল্পনার মাধ্যমে এসব রচনা করেছো। আসল সত্য এছাড়া আর কিছুই নয় যে, এগুলো নিছক হাতে গড়া নিষ্প্রাণ মূর্তি এবং এদের কোন ক্ষমতা ও প্রভাব নেই।
# এ কয়েকটি বাক্যের মধ্যে হযরত ইবরাহীম (আ) মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সমস্ত যুক্তি একত্র করেছেন। কাউকে মাবুদ বা আরাধ্য করতে হলে এ জন্য যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে হবে। একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ এ হতে পারে, তার নিজের সত্তার মধ্যে মাবুদ হবার কোন অধিকার থাকে। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, সে মানুষের স্রষ্টা এবং মানুষ নিজের অস্তিত্বের জন্য তার কাছে অনুগৃহীত। তৃতীয় কারণ হতে পারে, সে মানুষের লালন-পালনের ব্যবস্থা করে। তাকে রিযিক তথা জীবন ধারণের উপকরণ সরবরাহ করে। চতুর্থ কারণ হতে পারে, মানুষের ভবিষ্যত তার অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল এবং মানুষ আশঙ্কা করে তার অসন্তুষ্টি অর্জন করলে তার নিজের পরিণাম অশুভ হবে। হযরত ইবরাহীম বলেন, এ চারটি কারণের কোন একটিও মূর্তি পূজার পক্ষে নয়। বরং এর প্রত্যেকটিই নির্ভেজাল আল্লাহর প্রতি আনুগত্যেও দাবী কর। “এ নিছক মূর্তিপূজা” বলে তিনি প্রথম কারণটিকে বিলুপ্ত করে দেন। কারণ নিছক মূর্তি মাবুদ হবার ব্যক্তিগত কি অধিকার বিলুপ্ত করেন। তারপর “তোমরা তাদের স্রষ্টা” একথা বলে দ্বিতীয় কারণটিকে বিলুপ্ত করেন। এরপর তারা তোমাদের কোনো প্রকারের কোন রিযিক দান করতে পারে না, একথা বলে তৃতীয় কারণটিকে বিলুপ্ত করেন। আর সবশেষে বলেন, তোমাদের তো আল্লাহর দিকে ফিরে যেতেই হবে, এ মূর্তিগুলোর দিকে ফিরে যেতে হবে না। কাজেই তোমাদের পরিণাম ও পরকালকে সমৃদ্ধ বা ধ্বংস করার ক্ষমতাও এদের নেই। এ ক্ষমতা আছে একমাত্র আল্লাহর হাতে। এভাবে শিরককে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে তিনি তাদের ওপর একথা সুস্পষ্ট করে দেন যে, মানুষ যে সমস্ত কারণে কাউকে মাবুদ বা আরাধ্য গণ্য করতে পারে তার কোনটাই এক ও লা-শারীক আল্লাহ‌ ছাড়া আর কাউকে ইবাদাত করার দাবী করে না।
# যদি তোমরা আমার তাওহীদের দাওয়াতকে এবং তোমাদের নিজেদের রবের দিকে ফিরে যেতে হবে এবং নিজেদের সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে-এসব কথাকে মিথ্যা বলো, তাহলে এটা কোন নতুন কথা নয়। ইতিহাসে এর পূর্বেও বহু নবী (যেমন নূহ, হূদ, সালেহ আলাইহিমুস সালাম প্রমুখগণ) এ একই দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন এবং তাদের জাতিরাও তাদেরকে এমনিভাবেই মিথ্যুক বলেছে। এখন তারা এ নবীদেরকে মিথ্যুক বলে তাদের কোন ক্ষতি করতে পেরেছে, না নিজেদের পরিণাম ধ্বংস করেছে, এটা তোমরা নিজেরাই দেখে নাও।
# এখান থেকে নিয়ে لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি) পর্যন্ত আয়াতগুলো মূল আলোচনার মাঝখানে স্বতন্ত্র প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে আনা হয়েছে। হযরত ইবরাহীমের কাহিনীর ধারা বর্ণনা ছিন্ন করে আল্লাহ‌ মক্কার কাফেরদেরকে সম্বোধন করে একথাগুলো বলেছেন। এ বিষয়ের সাথে এ প্রাসঙ্গিক ভাষণের সম্পর্ক হচ্ছে এই যে, মক্কার যে কাফেরদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য এ ভাষণ দেয়া হচ্ছে তারা দু’টি মৌলিক গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল। একটি ছিল শিরক ও মূর্তিপূজা এবং অন্যটি ছিল আখেরাত অস্বীকৃতি। এর মধ্য থেকে প্রথম গোমরাহীকে বাতিল করা হয়েছে হযরত ইবরাহীমের ওপর উদ্ধৃত ভাষণের মাধ্যমে। এখন দ্বিতীয় গোমরাহীটিকে বাতিল করার জন্য আল্লাহ‌ তার নিজের পক্ষ থেকে এ বাক্য কয়টি বলেছেন। এভাবে একই বক্তব্যের ধারাবাহিকতার মধ্যে দু’টি বিষয়কেই বাতিল করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

# একদিকে অসংখ্য বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করে এবং অন্যদিকে সকল শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গেও বিলুপ্তির সাথে সাথে আবার নতুন ব্যক্তিবর্গ অস্তিত্ব লাভ করতে থাকে। মুশরিকরা এসব কিছুকে আল্লাহর সৃষ্টি হবার কথা অস্বীকার করে না তেমনি তারাও একথা অস্বীকার করতো না। তাই তাদের স্বীকৃত কথার ওপর এ প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে, তোমাদের দৃষ্টিতে যে আল্লাহ‌ বস্তুকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেন এবং তারপর মাত্র একবার সৃষ্টি করে শেষ করেন না বরং তোমাদের চোখের সামনে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জিনিসগুলোর জায়গায় আবার একই জিনিস অনবরত সৃষ্টি করে চলেন, তার সম্পর্কে তোমরা কেমন করে একথা ভাবতে পারলে যে, তোমাদের মরে যাবার পর তিনি আর পুনর্বার তোমাদের জীবিত করে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন না। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা আন নামল, ৮০ টীকা)
# যখন আল্লাহর শিল্পকারিতার বদৌলতে প্রথমবারের সৃষ্টি তোমরা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছো তখন তোমাদের বোঝা উচিত, একই আল্লাহর শিল্পকারিতার মাধ্যমে দ্বিতীয়বার ও সৃষ্টি হবে। এ ধরনের কাজ করা তার ক্ষমতার আওতা বহির্ভূত নয় এবং আওতা বহির্ভূত হতেও পারে না।
# তোমরা পালিয়ে এমন কোন জায়গায় চলে যেতে পারো না যেখানে গিয়ে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারো। তোমরা ভূগর্ভের তলদেশে কোথাও নেমে যাও অথবা আকাশের কোন উচ্চ মার্গে পৌঁছে যাও না কেন সব জায়গা থেকেই তোমাদেরকে ধরে আনা হবে এবং নিজেদের রবের সামনে হাজির করা হবে। সূরা আর রাহমানের এ কথাটিই জ্বিন ও মানুষকে সম্বোধন করে চ্যালেঞ্জের সুরে এভাবে বলা হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও শাসন থেকে বের হয়ে যেতে পার তাহলে একটু বের হয়ে দেখিয়ে দাও। তা থেকে বের হবার জন্য শক্তির প্রয়োজন এবং সে শক্তি তোমাদের নেই। কাজেই তোমরা কোনক্রমেই বের হতে পারো না।

يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ تَنْفُذُوا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانْفُذُوا لَا تَنْفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَانٍ-( الرحمن-33)

# আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেদের শক্তির জোরে রক্ষা পাওয়ার ক্ষমতা তোমাদের নেই এবং তোমাদের এমন কোন অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক বা সাহায্যকারীও নেই যে আল্লাহর মোকাবিলায় তোমাদের আশ্রয় দিতে পারে এবং তার কাছে জবাবদিহি থেকে তোমাদের বাঁচাতে পারে। যারা শিরক ও কুফরী করেছে, আল্লাহর বিধানের সামনে মাথা নত হতে অস্বীকার করেছে এবং বুক ফুলিয়ে আল্লাহর নাফরমানী করেছে এবং তার যমীনে ব্যাপকভাবে জুলুম ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, সমগ্র বিশ্ব-জাহানে তাদের সাহায্য ও সহায়তা দানকারী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবার এবং আল্লাহর আযাবের ফায়সালাকে তাদের ওপর কার্যকর হওয়া থেকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা কারো নেই। অথবা সমগ্র বিশ্ব-জগতে এমন একজনও নেই যে আল্লাহর আদালতে দাঁড়িয়ে একথা বলার সাহস রাখে যে, এরা আমার লোক কাজেই এরা যা কিছু করেছে তা মাফ করে দেয়া হোক।
# আমার রহমতে তাদের কোন অংশ নেই। আমার অনুগ্রহের অংশ লাভের আশা করার কোন অবকাশ তাদের জন্য নেই। একথা সুস্পষ্ট যখন তারা আল্লাহর আয়াত মেনে নিতে অস্বীকার করলো তখন আল্লাহ‌ ঈমানদারদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা থেকে স্বতঃষ্ফুর্তভাবে তাদের লাভবান হবার অধিকার প্রত্যাহার করে নিলেন। তারপর যখন তারা আখেরাত অস্বীকার করলো এবং কখনো তাদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে একথা স্বীকারই করলো না তখন এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, তারা আল্লাহর দান ও মাগফিরাতের সাথে কোনো প্রকার আশার সম্পর্ক রাখেনি। এরপর যখন নিজেদের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে তারা আখেরাতের জগতে চোখ খুলবে এবং আল্লাহর যেসব আয়াতকে তারা মিথ্যা বলেছিল সেগুলোকেও সত্য হিসেবে স্বচক্ষে দেখে নেবে তখন সেখানে আল্লাহর রহমতের অংশ লাভের প্রার্থী হবার কোন কারণ তাদের থাকতে পারে না।
# এখান থেকে বর্ণনা আবার ইবরাহীমের কাহিনীর দিকে মোড় নিচ্ছে।
# হযরত ইবরাহীমের ন্যায়সঙ্গত যুক্তির কোন জবাব তাদের কাছে ছিল না। তাদের যদি কোন জবাব থেকে থাকে তাহলে তা এই ছিল যে, হক কথা বলছে যে কণ্ঠটি সেটি স্তব্ধ করে দাও এবং যে ব্যক্তি আমাদের ভুল আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরছে এবং তা থেকে আমাদের বিরত থাকতে বলছে তাকে জীবন্ত রেখো না। “হত্যা করো ও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারো” শব্দাবলী থেকে একথা প্রকাশিত হচ্ছে যে, সমগ্র জনতা হযরত ইবরাহীমকে মেরে ফেলার ব্যাপারে একমত ছিল তবে মেরে ফেলার পদ্ধতির ব্যাপারে ছিল বিভিন্ন মত। কিছু লোকের মত ছিল, তাকে হত্যা করা হোক। আবার কিছু লোকের মত ছিল, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হোক, এর ফলে ভবিষ্যতে যারা এ ভূখণ্ডে হক কথা বলার পাগলামী করতে চাইবে এটা তাদের জন্য একটা শিক্ষা হয়ে থাকবে।
# এ থেকে স্বতঃষ্ফুর্তভাবে একথা প্রকাশ হয় যে, তারা শেষ পর্যন্ত হযরত ইবরাহীমকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত করেছিল। তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এখানে শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ‌ তাকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করেন। কিন্তু সূরা আল আম্বিয়ায় পরিষ্কার করে বলা হয়েছেঃ আল্লাহর নির্দেশে আগুন হযরত ইবরাহীমের জন্য ঠাণ্ডা ও নিরাপদ বস্তু হয়ে যায়,قُلْنَا يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ “আমি বললাম, হে আগুন! ঠাণ্ডা হয়ে যাও এবং শান্তি ও নিরাপত্তা হয়ে যাও ইবরাহীমের প্রতি।” ( ৬৯ আয়াত ) একথা বলা নিষ্প্রয়োজন, তাকে যদি আগুনের মধ্যে নিক্ষেপই না করা হয়ে থাকতো তাহলে আগুনকে ঠাণ্ডা হয়ে যাও এবং তার প্রতি শান্তি ও নিরাপত্তা হয়ে যাও এ হুকুম দেবার কোন অর্থই হয় না। এ থেকে এ কথা পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত বস্তুর ধর্ম বা প্রকৃতি মহান আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি যখনই চান যে কোন বস্তুর ধর্ম ও বিশেষত্ব পরিবর্তন করতে পারেন। সাধারণভাবে আগুনের ধর্ম হচ্ছে জ্বালানো এবং দগ্ধীভূত হবার মতো প্রত্যেকটি জিনিসকে পুড়িয়ে ফেলা। কিন্তু আগুনের এ ধর্ম তার নিজের প্রতিষ্ঠিত নয় বরং আল্লাহ‌ প্রতিষ্ঠিত। তার এ ধর্ম আল্লাহকে এমনভাবে বেঁধে ফেলেনি যে, তিনি এর বিরুদ্ধে কোন হুকুম দিতে পারেন না। তিনি নিজে আগুনের মালিক। যে কোন সময় তিনি তাকে জ্বালাবার কাজ পরিত্যাগ করার হুকুম দিতে পারেন। যে কোন সময় নিজের এক ইঙ্গিতে তিনি অগ্নিকুণ্ডকে ফুল বাগানে পরিণত করতে পারেন। এ অস্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় তার রাজ্যে প্রতিদিন হয় না। কোন বড় রকমের তাৎপর্যবহ শিক্ষা ও প্রয়োজনের খাতিরেই হয়ে থাকে। কিন্তু নিয়মমাফিক যেসব জিনিস প্রতিদিন দেখতে আমরা অভ্যস্ত সেগুলোকে কোনক্রমেই এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করা যেতে পারে না যে, সেগুলোর মধ্যে তার শক্তি আবদ্ধ হয়ে গেছে এবং নিয়ম বিরোধী কোন ঘটনা আল্লাহর হুকুমেও সংঘটিত হতে পারে না।
# এর মধ্যে ঈমানদারদের জন্য এ মর্মে নিদর্শন রয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পরিবার, বংশ, জাতি ও দেশের ধর্ম পরিত্যাগ করে যে সত্য জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি শিরকের অসারতা ও তাওহীদের সত্যতা জানতে পেরেছিলেন তারই অনুসরণ করেন। আবার এ মর্মেও নিদর্শন রয়েছে যে, তিনি নিজ জাতির হঠকারিতা ও কঠোর জাতীয় স্বার্থ প্রীতি ও বিদ্বেষ অগ্রাহ্য করে তাকে মিথ্যার পথ থেকে সরিয়ে আনার ও সত্য গ্রহণ করার জন্য অনবরত প্রচার কার্য চালিয়ে যেতে থাকেন। তাছাড়া এ ব্যাপারেও নিদর্শন রয়েছে যে, তিনি আগুনের ভয়াবহ শাস্তি মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে যান এবং সত্য ও ন্যায়ের পথ পরিহার করতে প্রস্তুত হননি। নিদর্শন এ ব্যাপারেও রয়েছে যে, মহান আল্লাহ‌ হযরত ইবরাহীম আলাইহিম সালামকেও পরীক্ষার পুলসেরাত পার না করিয়ে ছাড়েননি। আবার এ ব্যাপারেও যে, হযরত ইবরাহীমকে আল্লাহ‌ যে পরীক্ষার সম্মুখীন করেন তাতে তিনি সাফল্যেও সাথে উত্তীর্ণ হন, তবেই আল্লাহর সাহায্য তার জন্য আসে এবং এমন অলৌকিক পদ্ধতিতে আসে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড তার জন্য ঠাণ্ডা করে দেয়া হয়।
# বক্তব্যের ধারাবাহিকতা থেকে বুঝা যায়, আগুনের মধ্য থেকে নিরাপদ বের হয়ে আসার পর হযরত ইবরাহীম (আ) লোকদেরকে একথা বলেন।
# তোমরা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে মূর্তিপূজার ভিত্তিতে নিজেদের সামাজিক জীবন গড়ে তুলেছো। এ ব্যবস্থা দুনিয়ার জীবনের সীমানা পর্যন্ত তোমাদের জাতীয় সত্ত্বাকে একত্র করে রাখতে পারে। কারণ এখানে সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে যে কোন আকীদার ভিত্তিতে লোকেরা একত্র হতে পারে। আর যত বড় মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর আকীদার ভিত্তিতেই যে কোন ঐক্য ও সমাজ গড়ে উঠুক না কেন তা পারস্পরিক বন্ধত্ব, আত্মীয়তা, ভ্রাতৃত্ব ও অন্যান্য সকল ধর্মীয়, সামাজিক, তামাদ্দুনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হতে পারে।
# মিথ্যা আকীদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তোমাদের এ সামাজিক কাঠামোর আখেরাতে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। সেখানে পারস্পরিক প্রীতি-ভালোবাসা, সহযোগিতা, আত্মীয়তা এবং আকীদা-বিশ্বাস ও কামনা-বাসনার কেবলমাত্র এমন ধরনের সম্পর্ক বজায় থাকতে পারে যা দুনিয়ায় এক আল্লাহর বন্দেগী এবং সৎকর্মশীলতা ও আল্লাহভীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। কুফরী ও শিরক এবং ভুল পথ ও কুপথের সাথে জড়িত যাবতীয় সম্পর্ক সেখানে ছিন্ন হয়ে যাবে। সকল ভালোবাসা শত্রুতায় পরিণত হবে। সমস্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি ঘৃণায় রূপান্তরিত হবে। পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, পীর-মুরীদ পর্যন্ত একে অন্যেও ওপর লানত বর্ষণ করবে এবং প্রত্যেকে নিজের গোমরাহীর দায়-দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে বলবে, এই জালেম আমাকে ধ্বংস করেছে, কাজেই একে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হোক। একথা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে। যেমন সূরা যুখরুফে বলা হয়েছেঃ

الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ

“বন্ধুরা সেদিন পরস্পরের শত্রুহয়ে যাবে, মুত্তাকীরা ছাড়া।”

সূরা আ’রাফে বলা হয়েছেঃ

كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَعَنَتْ أُخْتَهَا حَتَّى إِذَا ادَّارَكُوا فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَاهُمْ لِأُولَاهُمْ رَبَّنَا هَؤُلَاءِ أَضَلُّونَا فَآتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِنَ النَّارِ

“প্রত্যেকটি দল যখন জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন তার কাছের দলের প্রতি লানত বর্ষণ করতে করতে প্রবেশ করবে, এমনকি শেষ পর্যন্ত যখন সবাই সেখানে একত্র হয়ে যাবে তখন প্রত্যেক পরবর্তী দল পূর্ববর্তী দলের পক্ষে বলবেঃ হে আমাদের রব! এ লোকেরাই আমাদের পথভ্রষ্ট করে, কাজেই এদেরকে দ্বিগুণ আগুনের শাস্তি দিন।” (আয়াতঃ৩৮)

সূরা আহযাবে বলা হয়েছেঃ

وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا – رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا

“আর তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের সরদারদেরও বড়দের আনুগত্য করেছি এবং তারা আমাদের বিপথগামী করেছে। হে আমাদের রব! তুমি তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদের ওপর বড় রকমের লানত বর্ষণ করো।”
# বক্তব্যের বিন্যাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আগুন থেকে বের হয়ে আসেন এবং তিনি ওপরে উল্লেখিত কথাগুলো বলেন, তখন সমগ্র সমবেত জনতার মধ্য থেকে একমাত্র হযরত লূত (আ) তার আনুগত্য গ্রহণ করার ঘোষণা করেন। হতে পারে সে সময় আরো বহুলোক মনে মনে হযরত ইবরাহীমের সত্যতা স্বীকার করে থাকবে। কিন্তু সমগ্র জাতি ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইবরাহীমের দ্বীনের বিরুদ্ধে যে ক্রোধ ও আক্রোশ প্রবণতার প্রকাশ সে সময় সবার চোখের সামনে হয়েছিল তা প্রত্যক্ষ করেকোন ব্যক্তি এ ধরনের ভয়ঙ্কর সত্য মেনে নেবার এবং তার সাথে সহযোগিতা করার সাহস করতে পারেনি। এ সৌভাগ্য মাত্র এক ব্যক্তিরই হয়েছিল এবং তিনি হচ্ছেন হযরত ইবরাহীমেরই ভাতিজা হযরত লূত (আ)। শেষে তিনি হিজরাতকালেও নিজের চাচা ও চাচীর (হযরত সারাহ) সহযোগী হয়েছিলেন।
# এখানে একটি সন্দেহ দেখা দেয় এবং এ সন্দেহটি নিরসন করার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ এক ব্যক্তি প্রশ্ন করতে পারে যে, তাহলে এ ঘটনার পূর্বে কি হযরত লূত (আ) কাফের ও মুশরিক ছিলেন এবং আগুন থেকে হযরত ইবরাহীমের নিরাপদে বের হয়ে আসার অলৌকিক কাণ্ড দেখার পর তিনি ঈমানের নিয়ামত লাভ করেন? যদি একথা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে নবুয়তের আসনে কি এমনকোন ব্যক্তি সমাসীন হতে পারেন যিনি পূর্বে মুশরিক ছিলেন? এর জবাব হচ্ছে, কুরআন এখানে فَآمَنَ لَهُ لُوطٌ এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছে। এ থেকে অনিবার্য হয়ে উঠে না যে, ইতিপূর্বে হযরত লুত বিশ্ব-জাহানের প্রভু আল্লাহকে না মেনে থাকবেন বা তার সাথে অন্য মাবুদদেরকেও শরীক করে থাকবেন বরং এ থেকে কেবলমাত্র এতটুকুই প্রমাণিত হয় যে, এ ঘটনার পর তিনি হযরত ইবরাহীমের রিসালাতের সত্যতা স্বীকার করেন এবং তার আনুগত্য গ্রহণ করেন। ঈমানের সাথে (لام) শব্দ ব্যবহার করা হয় তখন এর অর্থ হয়কোন ব্যক্তির কথা মেনে নেয়া এবং তার আনুগত্য করা। হতে পারে হযরত লূত (আ) তখন ছিলেন একজন উঠতি বয়সের তরুণ এবং সচেতনভাবে নিজের চাচার শিক্ষার সাথে তিনি এ প্রথমবার পরিচিত হবার এবং তার রিসালাত সম্পর্কে জানার সুযোগ লাভ করে থাকবেন।
# তিনি আমার রবের জন্য হিজরত করছি। এখন আমার রব আমাকে যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানে যাব।
# তিনি আমাকে সহায়তা দান ও হেফাজত করার ক্ষমতা রাখেন এবং আমার পক্ষে তিনি যে ফয়সালা করবেন তা বিজ্ঞজনোচিত হবে।
#হযরত ইসহাক (আ) ছিলেন তার পুত্র এবং হযরত ইয়াকুব ছিলেন পৌত্র। এখানে হযরত ইবরাহীমের (আ) অন্যান্য পুত্রদের উল্লেখ না করার কারণ হচ্ছে এই যে, ইবরাহীম সন্তানদের মাদয়ানী শাখায় কেবলমাত্র হযরত শো’আইব আলাইহিস সালামই নবুয়ত লাভ করেন এবং ইসমাঈলী শাখায় মুহাম্মাদ ﷺ এর নবুয়ত লাভ পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরে আর কোন নবী আসেননি। পক্ষান্তরে হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম থেকে যে শাখাটি চলে তার মধ্যে একের পর এক হযরত ঈসা (আ) পর্যন্ত নবুয়ত ও কিতাবের নিয়ামত প্রদত্ত হতে থাকে।
# হযরত ইবরাহীমের (আ) পরে যেসব নবীর আবির্ভাব হয় সবাই এর মধ্যে এসে গেছেন।
# এখানে একথা বলাই উদ্দেশ্য যে, ব্যবিলনেরর যেসব শাসক, পণ্ডিত ও পুরোহিত হযরত ইবরাহীম (আ) এর দাওয়াতকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল এবং সেখানকার যে সকল মুশরিক অধিবাসী চোখ বন্ধ করে ঐ জালেমদের আনুগত্য করেছিল তারা সবাই দুনিয়ার বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এমনভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে, আজ দুনিয়ার কোথাও তাদের কোন নাম নিশানাও নেই। কিন্তু যে ব্যক্তিকে আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার অপরাধে তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত যাকে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় স্বদেশভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে আল্লাহ‌ এমন সফলতা দান করেন যে, চার হাজার বছর থেকে দুনিয়ার বুকে তার নাম সমুজ্জ্বল রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। দুনিয়ার সকল মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদী রব্বুল আলামীনের সেই খলিল তথা বন্ধুকে একযোগে নিজেদের নেতা বলে স্বীকার করে। এ চল্লিশ’শ বছরে দুনিয়া একমাত্র সেই পাক-পবিত্র ব্যক্তি এবং তার সন্তানদের থেকেই যা কিছু হিদায়াতের আলোকবর্তিকা লাভ করতে পেরেছে। আখেরাতে তিনি যে মহাপুরস্কার লাভ করবেন তাতো তার জন্য নির্ধারিত হয়েই আছে কিন্তু এ দুনিয়ায়ও তিনি যে মর্যাদা লাভ করেছেন তা দুনিয়ার বৈষয়িক স্বার্থ উদ্ধার প্রচেষ্টায় জীবনপাতকারীদের একজনও লাভ করতে পারেনি।

Leave a Reply