أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০২৫)
[মহাগ্রন্থ আল কোরআন সম্পর্কে কিছু কথা :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৯:আল-আনকাবুত
পারা:২১
৪৭-৫৫ নং আয়াত:-
২৯:৪৭
وَ کَذٰلِکَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ ؕ فَالَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰہُمُ الۡکِتٰبَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِہٖ ۚ وَ مِنۡ ہٰۤؤُلَآءِ مَنۡ یُّؤۡمِنُ بِہٖ ؕ وَ مَا یَجۡحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا الۡکٰفِرُوۡنَ ﴿۴۷﴾
এভাবেই আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং যাদেরকে আমি গ্রন্থ দিয়েছিলাম তারা এতে বিশ্বাস করে এবং এদের মধ্যেও কেউ কেউ এতে বিশ্বাস করে।কেবল অবিশ্বাসীরাই আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে।
২৯:৪৮
وَ مَا کُنۡتَ تَتۡلُوۡا مِنۡ قَبۡلِہٖ مِنۡ کِتٰبٍ وَّ لَا تَخُطُّہٗ بِیَمِیۡنِکَ اِذًا لَّارۡتَابَ الۡمُبۡطِلُوۡنَ ﴿۴۸﴾
আর আপনি তো এর আগে কোন কিতাব পড়েননি এবং নিজ হাতে কোন কিতাবও লেখেননি যে, বাতিলপন্থীরা সন্দেহ পোষণ করবে।
২৯:৪৯
بَلۡ ہُوَ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ فِیۡ صُدُوۡرِ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ ؕ وَ مَا یَجۡحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۴۹﴾
আসলে এগুলো হচ্ছে উজ্জ্বল নিদর্শন এমন লোকদের মনের মধ্যে যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে এবং জালেমরা ছাড়া আর কেউ আমার আয়াত অস্বীকার করে না।
২৯:৫০
وَ قَالُوۡا لَوۡ لَاۤ اُنۡزِلَ عَلَیۡہِ اٰیٰتٌ مِّنۡ رَّبِّہٖ ؕ قُلۡ اِنَّمَا الۡاٰیٰتُ عِنۡدَ اللّٰہِ ؕ وَ اِنَّمَاۤ اَنَا نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۵۰﴾
তারা আরও বলে, ‘তার রব- এর কাছ থেকে তার কাছে নিদর্শনসমূহ নাযিল হয় না কেন?’ বলুন, ‘নিদর্শনসমূহ তো আল্লাহ্রই কাছে। আর আমি তো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র।’
২৯:৫১
اَوَ لَمۡ یَکۡفِہِمۡ اَنَّاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ یُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَرَحۡمَۃً وَّ ذِکۡرٰی لِقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ ﴿٪۵۱﴾
এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমরা আপনার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয় । এতে তো অবশ্যই অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা ঈমান আনে।
২৯:৫২
قُلۡ کَفٰی بِاللّٰہِ بَیۡنِیۡ وَ بَیۡنَکُمۡ شَہِیۡدًا ۚ یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِالۡبَاطِلِ وَ کَفَرُوۡا بِاللّٰہِ ۙ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۵۲﴾
বলুন, ‘আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট। আসমানসমূহ ও যমিনে যা আছে তা তিনি জানেন। আর যারা বাতিলে বিশ্বাস করে ও আল্লাহ্র সাথে কুফরী করে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।’
২৯:৫৩
وَ یَسۡتَعۡجِلُوۡنَکَ بِالۡعَذَابِ ؕ وَ لَوۡ لَاۤ اَجَلٌ مُّسَمًّی لَّجَآءَہُمُ الۡعَذَابُ ؕ وَ لَیَاۡتِیَنَّہُمۡ بَغۡتَۃً وَّ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۵۳﴾
এরা তোমার কাছে দাবী করছে আযাব দ্রুত আনার জন্য। যদি একটি সময় নির্ধারিত না করে দেয়া হতো, তাহলে তাদের ওপর আযাব এসেই যেতো এবং নিশ্চিতভাবেই (ঠিক সময় মতো) তা অকস্মাৎ এমন অবস্থায় এসে যাবেই যখন তারা জানতেও পারবে না।
২৯:৫৪
یَسۡتَعۡجِلُوۡنَکَ بِالۡعَذَابِ ؕ وَ اِنَّ جَہَنَّمَ لَمُحِیۡطَۃٌۢ بِالۡکٰفِرِیۡنَ ﴿ۙ۵۴﴾
এরা তোমার কাছে আযাব দ্রুত আনার দাবী করছে অথচ জাহান্নাম এ কাফেরদেরকে ঘেরাও করে নিয়েছে।
২৯:৫৫
یَوۡمَ یَغۡشٰہُمُ الۡعَذَابُ مِنۡ فَوۡقِہِمۡ وَ مِنۡ تَحۡتِ اَرۡجُلِہِمۡ وَ یَقُوۡلُ ذُوۡقُوۡا مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۵۵﴾
সেদিন শাস্তি ওদেরকে গ্রাস করবে ওদের উপর দিক ও নিচের দিক হতে এবং তিনি বলবেন, ‘তোমরা যা করতে তার স্বাদ গ্রহণ কর।’
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মানবতার মহাগ্রন্থ আল কোরআন সম্পর্কে কিছু কথা : ‘আর এমনিভাবে আমি মহান আল্লাহ তােমার ওপর এই আল কিতাব (কোরআনুল করীম) নাযিল করেছি… অতপর, যাদের আমি মহান আল্লাহ দিয়েছি এই আল কিতাব (মহাগ্রন্থ আল কোরআন), যা হচ্ছে সুমহান ও সমুন্নত আকাশের সর্বোচ্চ স্থানে আরবী ভাষায় লিখিত (মূল কিতাব), তারা বিশ্বাস করে এ কিতাবকে (আল্লাহর কিতাব বলে), আর ওদের মধ্যেও অনেকে বিশ্বাস করে, আর কাফের ব্যক্তি ছাড়া এ কিতাব কেউ অস্বীকার করে না।’ ‘ফা-যালিকা’ বলে বুঝানাে হচ্ছে, একই পথের সন্ধান নিয়ে এসেছে এসব কিতাব এবং এই কারণে সেগুলাে পরস্পর সম্পর্কেযুক্ত আর সেই একই পদ্ধতিতে নাযিল হয়েছে এ পাক কালাম, যার কোনাে পরিবর্তন হয় না। এ কিতাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই নিয়মে যে নিয়মে এর আগে অন্যান্য রসূলদের কাছে ওহী এসেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘এমনিভাবে আমি মহান আল্লাহ তােমাদের কাছে কিতাব নাযিল করেছি’ অতপর দেখুন আল কোরআনের সামনে দুটি সারিতে মানুষ দাড়িয়ে একটি সারিতে দেখা যাচ্ছে সেসব মানুষ যারা আহলে কিতাব ও কোরায়শের লােকদের মধ্য থেকে ঈমান এনেছে, আর অপর সারিতে রয়েছে তারা যারা ঈমান আনতে অস্বীকার করেছে এবং অস্বীকার করেছে আল কোরআনকে আল্লাহর প্রেরিত কিতাব বলে মানতে, অথচ তারা নিজেদের ঈমানদার মনে করে, মােহাম্মদ(স.)-কে রসূল বলে সাক্ষ্য দেয় এবং তাদের কিতাবের মধ্যে উল্লেখিত পরবর্তীতে শেষ কিতাব আসবে বলে সাক্ষ্য দেয়। এরপর বলা হচ্ছে, ‘কাফেররা ছাড়া আমার আয়াতগুলাে কেউ অস্বীকার করে না।’ অর্থাৎ এ আয়াতগুলাে সুদৃঢ়ভাবে এবং সুস্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে, এ কিতাব তারাই অস্বীকার করতে পারে যাদের আত্মার ওপর এবং চোখের ওপর মােটা পর্দা পড়ে গেছে। যার কারণে ওরা এমন জাজ্জল্যমান সত্য দেখেও গ্রহণ করে না! আর কুফর-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আবরণী বা মােটা পর্দা। এই পর্দা অর্থেই এখানে কুফুর ব্যবহার করা হয়েছে। যার ফলে সে হঠকারীরা সত্যকে দেখে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে রাসূল, তুমি তা ইতিপূর্বে কখনাে কোনো পুস্তক পড়নি, আর তুমি নিজের হাতেও কখনাে কিছু লেখনি, তুমি জানলে হয়তাে এই মিথ্যুকরা সন্দেহ করতে পারতাে।’ এভাবে কোরআনুল করীম তাদের সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলােকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে দিচ্ছে এবং এমন সহজ সরলভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে, যেন একটি কিশাের ছেলেও তা বুঝতে পারে। দেখুন না, রাসূল(স.) তাদের মধ্যেই তাে দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠেছেন এবং তার জীবনের চল্লিশ বছরেরও বেশী সময় তাদের মধ্যে কেটেছে। যে জীবন যৌবনের উত্তাল তরংগাভিঘাতে বেতাল, আজ প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়ে মিথ্যা কথা বলবেন এটা কিভাবে মনে করা যায়?- এ পর্যন্ত যে বান্দা কোনাে পড়া লেখা করেনি আজকে হঠাৎ করে সে এমন এক মহাশ্চর্য ও তুলনাহীন গ্রন্থ রচনা করবে, যার একটি আয়াতের সমকক্ষ কোনাে আয়াত কেউ তৈরী করতে পারে না, এ থেকেও কি বুঝা যায় না যে, অবশ্যই এ কিতাবের প্রণেতা কোনাে মানুষ হতে পারে না। আরবের ভাষাবিদ পন্ডিতরা- আরবী ভাষায় যাদের এতাে ব্যুৎপত্তি, তারা সবাই একত্রিত হয়েও যখন অনুরূপ একটি ছত্র তৈরী করতে পারলাে না, তখন কি তাদের চিন্তা করা দরকার নয় যে, তারা অনুরূপ কথা বা গ্রন্থ তৈরী করতে না পারলে দুনিয়ার অন্য কোন মানুষের পক্ষে এতাে বড় একটি কিতাব রচনা করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় নিরক্ষর মােহাম্মদ কেমন করে এতাে বড় গ্রন্থ তৈরী করবে যার মধ্যে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে নিয়ে মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্যে প্রয়ােজনীয় সকল পথনির্দেশনা, রয়েছে নিকট ও দূর অতীতের ঘটনাপঞ্জি, রয়েছে সর্বকালের সর্ববিষরে তুলনাহীন সমাধান, যারা অনুরূপ কোনাে গ্রন্থ আজও পর্যন্ত কোনাে পাঠক বা কোনাে লেখক তৈরী করতে পারেনি। এরপরও তাদের সন্দেহের আর কোনাে সুযােগ থাকে কি। সুতরাং আর কোনাে প্রমাণের প্রয়ােজন নেই, আল কোরআন নিজেই নিজের প্রমাণ দিচ্ছে যে, এটা কোনাে মানুষের রচিত গ্রন্থ নয়। এ কিতাব মানুষের শক্তি ও জ্ঞানের উর্ধে এক কিতাব। মানুষের সকল প্রকার চেষ্টা সাধনা এমন একটি কিতাব রচনা করতে গিয়ে চিরদিনের জন্যে ব্যর্থ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এই গােটা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত যেসব সত্য মানুষকে বরাবর অভিভূত করেছে, সেই একইভাবে আল কোরআনও চরম ও পরম সত্য হিসেবে সত্যসন্ধিৎসু হৃদয়ে চিরদিন বিষয় জাগিয়েছে এবং জাগাবে। আল কোরআনের প্রতিটি কথা সত্যপিপাসু অন্তরে এ প্রতীতি জাগায় যে, অবশ্যই এর পেছনে রয়েছে এক মহাশক্তি, যার সাথে তুলনা করার কেউ নেই এ বিশ্ব ভুবনে। কী চমৎকার এর প্রতিটি ছত্র, কী মনােরম এর শব্দ গাঁথুনি, কী মধুময় এর ছন্দ বিচিত্রা, কী মনােলােভা এর বর্ণনা ভংগি, কী সামঞ্জস্যপূর্ণ এর বাক্যশৈলী, আর কত আবেগময় এর কথাগুলাে! এর প্রতিটি বাক্যের মধ্যে রয়েছে এক একটি সাম্রাজ্যের প্রশন্ততা। এমন মহাশ্চর্য গ্রন্থ কি কোনাে মানুষ রচনা করতে পারে? না, কেউ পারেনি আজ পর্যন্ত, আর কেউ পারবে না কোনাে দিন তাই এই কালামের ঘোষণা, ‘এ হলে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ, যা সংরক্ষিত থাকে ইলমওয়ালা (জ্ঞানী) লােকদের বুকের মধ্যে। যালেম ব্যক্তিরা ছাড়া আমার আয়াতগুলাে কেউ অন্বীকার করে না।’
*জ্ঞানান্ধ কাফেররাইই শুধু অলৌকিক কিছু দেখতে চায় : যাদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জ্ঞান দান করেছেন, তাদের বুকের মধ্যে একথাগুলাে সুম্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে হাযির হতে থাকবে। না থাকবে সেখানে কোনাে দ্বিধা দ্বন্দ্ব বা সন্দেহ, আর না থাকবে সেখানে কোনাে কিছু ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা। এসব হচ্ছে এমন সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ, যা তারা তাদের অন্তরের গভীরে অনুভব করে এবং তাদের দিল নিশ্চিন্ত ও পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। এরপর তারা আর কোনাে দলীল প্রমাণ চায় না, তারা বুঝে, এ কিতাবই হচ্ছে তাদের জন্যে উৎকৃষ্ট দলীল। আর যে এলেমের কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা অন্তরের মধ্যে গভীরভাবে প্রােথিত হয়, ইলমের দ্বারাই মানুষ সত্যকে চিনতে পারে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং সেই ইলেমের দ্বারাই তার সামনে জীবনে চলার পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। জীবনের সাফল্যের সরল সােজা পথ পেয়ে যায়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা বলে, কেন নাযিল হয় না তার ওপর এমন কিছু নিদর্শন তার রবের কাছ থেকে। বলো, নিদর্শনসমূহ তো আল্লাহর কাছেই আছে, আমি তাে শুধু খােলাখুলিভাবে সতর্ককারী মাত্র।’ মােহাম্মদ(স.)-এর কাছে যে অলৌকিক ক্ষমতা দেখানাের দাবী তারা করছিলাে, তা দ্বারা তারা বুঝাতে চাইছিলাে সেসব ক্ষমতার কথা, যা তার পূর্ববর্তী রসূলদের দান করা হয়েছিলাে এবং যা দেখে সেসব যমানার লােকেরা চমকৃত হতাে, কিন্তু অল্প কিছুসংখ্যক লােক ছাড়া তারা ঈমান আনতাে না। যার কারণে সর্বগ্রাসী গযব নাযিল হয়ে সে কিছু সংখ্যক লােক ছাড়া গােটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হতাে। সর্বশেষ রসূল মােহাম্মদ(স.)-এর উম্মতের ওপর আল্লাহ তায়ালা সে ধরনের আযাব নাযিল করতে চাননি, যেহেতু তিনিই শেষ পথপ্রদর্শক এবং তাঁর উম্মতই পরর্তী সকল মানুষের জন্যে হবে আদর্শ উম্মত ও পথ প্রদর্শক, এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের সরাসরি নিদর্শন না পাঠিয়ে বুদ্ধি ও জ্ঞান আকর্ষণকারী হিসেবে আল কোরআন নাযিল করলেন এবং এ পবিত্র কালামের প্রতিটি আয়াতকেই বানিয়ে দিলেন এক একটি বিরাট মােজেযা (অলৌকিক নিদর্শন), কিন্তু এসব আয়াত মােযেজা হিসেবে তাদের চোখেই ধরা পড়বে যারা চিন্তা করবে ও বুঝার চেষ্টা করবে। অন্যান্য রসূলদের মােজেজা তাে তাদের জীবনের সাথেই জড়িত ছিলাে। তাদের ইন্তেকালের সাথে সেগুলাে শেষ হয়ে গেছে, আল্লাহর এই মহান কিতাব পরবর্তীকালের সকল যমানার লােকের জন্যেই মােজেযা হিসেবে কাজ করবে। যারা এ কিতাব পড়বে, চিন্তা করবে এবং এর থেকে শিক্ষা নিতে চাইবে তাদের সবার জন্যে এ কিতাব আল্লাহর ক্ষমতার বিশেষ নিদর্শন হিসেবে কাজ করবে। আর আল্লাহর ই ও ক্ষমতাবলে এ কিতাব সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাফেজদের ও আলেমদের বুকের মধ্যে, যাতে করে সদা-সর্বদা এ কিতাব পঠিত হতে থাকে, অনুসন্ধিৎসু মানুষ এর থেকে হেদায়াতের আলাে পেতে থাকে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে, নিদর্শনসমূহ তাে আল্লাহর হাতে… তিনি এ মােজেজা বা তার ক্ষমতার নিদর্শন সেসব ক্ষেত্রে ও সময়ে প্রকাশ করেন যখন তিনি তা প্রকাশ করতে চান। কখন তিনি প্রকাশ করবেন তা তিনিই জানেন, তাকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষমতা কারও নেই। তাই রসূলুল্লাহ(স.)-কে বলা হচ্ছে, ‘তুমি তাদের বলে দাও। আল্লাহকে পরামর্শ দেয়া আমার কাজ নয়, আমার দায়িত্বও এটা নয়, আর এ সম্পর্কে কিছু বলাটা আমার জন্যে আদবের খেলাফ, আমি তাে শুধু সুম্পষ্টভাবে ভীতি প্রদর্শনকারী মাত্র।’ অর্থাৎ অন্যায় পথে চলার ফলে কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে বলে আমি ভয় দেখাই এবং সময় থাকতেই সতর্ক হতে হবে বলে আমি জানাই। আমাকে এ কাজের জন্যেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাই আমি এ দায়িত্ব পালন কৰি, এতে যে শিক্ষা নেয়ার দরকার মনে করবে সে নেবে, বাকি আল্লাহর হাতেই তাদের সকল পরিণতি নির্ভর করছে। রসূল(স.)-এর কাজের মধ্যে প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষকে অন্যান্য সব ভুল ও সন্দেহযুক্ত আকীদা বিশ্বাস (অর্থাৎ এর এই ক্ষমতা, ওর সে ক্ষমতা ইত্যাদি) থেকে মুক্ত করে সবাইকে এক আকীদা- সকল শক্তি ক্ষমতার মালিক এক আল্লাহ তায়ালা, সকলকে একমাত্র তারই মুখাপেক্ষী হতে হবে এবং এই জন্যেই নিষ্ঠার সাথে তার যাবতীয় হুকুম পালন করতে হবে-এই বিশ্বাসের ওপর মানুষকে সংঘবদ্ধ করার জন্যে চেষ্টা করাই তার প্রধান দায়িত্ব। এখানে আরও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে তিনি রসূল হলেও অবশ্যই একজন মানুষ। সুতরাং এটা মনে রাখতে হবে, তাঁর মধ্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর গুণাবলী আসতে পারে না। যখন রসূলদের হাতে অলৌকিক কিছু ক্ষমতা দেয়া হয় তখন সেগুলাে যে আল্লাহরই ক্ষমতা এবং তার ইচ্ছাতেই সেগুলাে দেখানাের যােগ্যতা নবীদের দেয়া হয়েছে- এ হিসাব না করে ভ্রান্ত মানুষ সে ক্ষমতাগুলােকে তাদেরই ক্ষমতা বলে ধরে নিয়েছে এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল না হয়ে সে রসূলদের ইন্তেকালের পর তাদের মূর্তি তৈরী করে পূজা করতে শুরু করেছে। এ জন্যেই মােহাম্মদ(স.)-কে সাফ সাফ বলতে হুকুম দেয়া হয়েছে, ‘আমি পরিষ্কারতাবে শুধু ভীতি প্রদর্শনকারী মাত্র।’ মক্কায় কাফেররা দাবী করছিলাে পূর্ববর্তী নবীদের মতােই তাদেরও অলৌকিক ক্ষমতা দেখানাে হােক। তখন তারা এ হিসাব করতে প্রস্তুত ছিলাে না যে, মহাগ্রন্থ আল কোরআনই সেই মোজেজা এবং আল্লাহর মেহেরবানী অভূতপূর্ব দান। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওদের জন্যে কি এটা যথেষ্ট নয় যে, আমি মহান আল্লাহ, তােমার কাছে এই মহামূল্যবান কিতাব আল কোরআন পাঠিয়েছি যা তাদের সামনে পাঠ করা হয়। অবশ্যই এর মধ্যে রয়েছে (আল্লাহর) রহমত ও ঈমানদারদের জন্যে উপদেশ।’ আল্লাহর শোকর গুজারী যদি না করা হয় এবং তার ক্ষমতাকে যদি পরওয়া না করা হয়, তাহলে তার নেয়ামত ও পরিচালনাকে অমান্য করা হবে। তাদের জন্যে কি এটাই যথেষ্ট নয় যে, এই কোরআন দ্বারা তারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মেহেরবানীর মধ্যে বাস করবে? খােদ আকাশের মালিক তাদের ওপর এই কোরআনের মাধ্যমেই এই ধূলার ধরণীতে নেমে আসছেন। তিনি তাদের সাথে তাদের অন্তরের প্রয়াজন সম্পর্কে কথা বলছেন এবং তাদের চতুষ্পার্শ্বস্ত বিষয়াদির জ্ঞান তাদের দিচ্ছেন, তাদের এ চেতনা দিচ্ছেন যে, সদা সর্বদা আল্লাহর নযর তাদের ওপর রয়েছে। এমনভাবে তিনি তাদের সাহায্য করছেন যে, তাদের জীবনের প্রতিটি কাজের ব্যাপারে তিনি তাদের সাথে কথা বলছেন। তাদের তিনি জানাচ্ছেন অতীতের ঘটনাবলী এবং সেগুলাে থেকে তিনি তাদের ভবিষ্যতের জীবনের জন্যে শিক্ষা দিচ্ছেন। এই আল কোরআনের মাধ্যমেই তিনি তাদের জানাচ্ছেন, এই বিশাল বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে তারা এক তুচ্ছ সৃষ্টি মাত্র। যারা নিজেদের ভালাে মন্দ কিছুই না বুঝার কারণে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তারা আছে তাদের এই পৃথিবীতে। আর তাদের জন্যে রয়েছে এই তেজোদ্বীপ্ত সূর্য যার চতুর্দিকে ঘুরছে বিশাল এ পৃথিবী। আর তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা এই মহা শূন্যলােকে নড়নশীল এক গুচ্ছ বিন্দুসম… যাদের আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এতদসত্তেও আল্লাহ রব্বুল ইযযত তাদের এতাে সম্মানিত করেছেন। তিনি তাদের এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখেন না যে, নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে তারা যেতে পারবে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই এর মধ্যে রয়েছে রহমত ও উপদেশ সেই জাতির জন্যে যারা ঈমান আনে। অর্থাৎ, যারা ঈমান আনে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অস্তিত্ব, শক্তি ক্ষমতা ও তার পাকড়াও করার ক্ষমতার ওপর, তারাই হচ্ছে এমন সব মানুষ, যারা তাদের অন্তরের মধ্যে রব্বুল আল্লামীনের রহমত অনুভব করে এবং তারা স্মরণ করে এ কিতাবের মাধ্যমে আল্লাহর মেহেরবানী ও মানব জাতির ওপর তার অপার এহসানকে। যখন আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজের দিকে ও তার খাবারের ভান্ডারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানান, তখন তারা গভীরভাবে অনুভব করে তার মেহেরবানীর কথা। আহা, কত মহান তিনি। কতাে বড় তিনি মায়াময় প্রভু তিনি। হাঁ, এসব অনুভূতিশীল ও কৃতজ্ঞ বান্দাদেরই তাে আল কোরআন উপকার করতে পারে, কারণ এরাই হচ্ছে যিন্দা দিল, এরা প্রকৃতপক্ষে বেঁচে আছে তাদের অন্তরের মধ্যে। এদের জন্যেই তাে আল্লাহ তায়ালা তার ধনভান্ডারের দরজা খুলে রেখেছেন, তার সম্পদ অবারিত করে দিয়েছেন তাদের জন্য এবং তাদের আত্মাকে তার মহামূল্যবান জ্ঞান ও আলাে দ্বারা সমুজ্জ্বল করে দেন। অতপর যারা এসব কিছু বুঝে না বা বুঝতে চায় না, আল কোরআনের ওপর ঈমান আনার শর্ত হিসেবে পূর্বের মতাে কোনাে মােজেযা দেখানাের দাবী করে, তারাই হচ্ছে সেসব মানুষ প্রকৃতপক্ষে যারা অন্ধ হয়ে গেছে, যাদের সামনে আল কোরআনের নূর প্রতিভাত হয় না। এহেন হঠকারী ব্যক্তিদের হেদায়াতের দিকে টেনে আনার চেষ্টা সম্পূর্ণ বৃথা। যেহেতু হেদায়াত পাওয়ার শর্ত হচ্ছে (হেদায়াত লাভ করার জন্যে) আকাংখী হওয়া। আল্লাহর এরশাদে বলা হয়েছে, ‘বলাে, আমার ও তােমার মাঝে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট। তিনি জানেন সব কিছু যা আছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মাঝে… আর যারা বাতিল বা মিথ্যাকে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর সাথে কুফরী করে, তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।'(আয়াত ৫২) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মাঝে যা কিছু আছে তার মালিক সম্পর্কে সাক্ষ্যদানই হচ্ছে সব থেকে বড় শাহাদাত, কারণ তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি সুনিশ্চিতভাবে জানেন যে, তারা বাতিল ব্যবস্থার ওপর রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা বাতিলকে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর সাথে কুফরী করে, তারাই তাে ক্ষতিগ্রস্ত।’ ‘খাসিরূন’- ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণভাবে সকল সত্য বিরােধীদের বলা হয়েছে অর্থাৎ, এ বিরােধীগােষ্ঠী সব ব্যাপারেই ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সবখানেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত, নিজেদের জীবনের জন্যে ক্ষতিগ্ৰস্ত, হেদায়াত লাভ করার ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত, দ্বীনের ওপর টিকে থাকার প্রশ্নে ক্ষতিগ্রস্ত, নিশ্চিন্ত হাসিলের ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত এবং সত্য ও নূর লাভ করার ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত। অবশ্যই আল্লাহর ওপর ঈমান আনা- এটা অর্জন করার বিষয়, ব্যক্তিগতভাবে গুণ অর্জন করতে হয় এবং যে ঈমান আনবে সে (ব্যক্তিগতভাবে) এর প্রতিদান পাবে, উপরন্তু সে পাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ মর্যাদা। ঈমান আনার পর এই মর্যাদা লাভের অনুভূতি এনে দেবে তার অন্তরের মধ্যে এক অব্যক্ত প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা এবং এরই কারণে সে মযবূতভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে সত্য ও ন্যায়ের পথের ওপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিপদ আপদ, ভাগ্য বিপর্যয় যাই আসুক না কেন, সর্বাবস্থায় সে দৃঢ়তা অবলম্বনের শক্তি পাবে, তার উপস্থাপিত দলীলের ওপর সে নিজে হবে আস্থাবান, আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে হবে নির্লিপ্ত নিশ্চিন্ত এবং শুভ পরিণতি সম্পর্কে তার মধ্যে থাকবে দৃঢ় প্রত্যয়। অবশ্যই এসব অমূল্য নেয়ামত মানুষকে চেষ্টা করেই অর্জন করতে হয়। আর এই জিনিসটা থেকেই কাফেররা বঞ্চিত থাকে। অর্থাৎ এ সব নেয়ামত অর্জন করার জন্যে না থাকে তাদের কোনাে নিয়ত, না থাকে তাদের কোনাে চেষ্টা, এটাই তাদের বড় ক্ষতির কারণ, এটাই তাদের আসল বঞ্চনা। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত’।
*জাহান্নাম পাপিষ্ঠদের সারাক্ষণ ঘিরে রাখবে : এরপর কথা আসছে ওই সব মােশরেকদের সম্পর্কে, কথা আসছে তাদের প্রতি শীঘ্র আযাব নেমে আসা সম্পর্কে। বলা হচ্ছে, জাহান্নাম তাদের খুব কাছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা জলদি করছে আযাবের ব্যাপারে… আর (তখন) তিনি বলবেন, স্বাদ গ্রহণ করাে এসব কাজের শাস্তির, যা তােমরা (পৃথিবীর জীবনে) করতে থেকেছো'(আয়াত ৫৩-৫৫) অর্থাৎ, মােশরেকরা অবশ্যই সতর্ককারীর হুশিয়ারী সংকেত শুনতাে। আযাব আসায় বিলম্ব হতে দেখে মনে করতাে, এসব ভূয়া কথা বুঝতে পারতাে না এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আযাব বিলম্বিত করার পেছনে কোন মহা হেকমত নিহিত রয়েছে। এ জন্যে তারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে বার বার দাবী জানাতাে জলদি করে আযাব নাযিল করার জন্যে। আর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এটা হয়েছে যে, আযাব পাঠাতে দেরী করা হয়েছে, যাতে করে তাদের অহংকার ও উচ্ছৃংখলতার পেয়ালা পূর্ণ হয়ে যায়, অথবা অনেক সময় মােমেনদের পরীক্ষা করার জন্যে এবং তাদের ঈমান ও দৃঢ়তা বৃদ্ধির সুযােগ দেয়ার জন্যে আযাব নাযিলে দেরী করা হয়েছে। আবার কখনাে বা আযাব নাযিলে বিলম্ব করা হয়েছে যে, আল্লাহ আলেমুল গায়ব, তাঁর গায়বী এলেম দ্বারা তিনি জানেন যে, কাফেরদের সারিতে এমন কিছু লােক আছে, যারা দোদুল্যমান অবস্থায় আছে, ইসলামের বিজয় দর্শনে যাদের মন এগিয়ে আসবে বলে তিনি জানেন, তাদের সে শুভ দিন আসার সুযােগদানের উদ্দেশ্যে বিলম্বিত করা হচ্ছে, যেন তারা এ নেয়ামত গ্রহণ করতে পারে এবং টলটলায়মান অবস্থা পরিহার করে হেদায়াতের ওপর মযবুত হয়ে যেতে পারে। আর এ কারণেও আযাব নাযিল করতে বিলম্ব করা হয় যে, আল্লাহ তায়ালা জানেন, সে হঠকারী লােকদের বংশে কিছু নেক লােক জন্ম নেবে, তারা আল্লাহর নেক বান্দারূপে জীবন যাপন করবে, অনাগত ভবিষ্যতে এসব লােকেরা বাপ দাদার ধর্ম ত্যাগ করে সত্য দ্বীনের দিকে চলে আসবে, আরও অনেক কারণ আছে যার জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন আযাব নাযিল করতে বিলম্ব করেন, যা আমরা জানি না। কিন্তু মােশরেকরা আল্লাহর হেকমত ও তদবীর সম্পর্কে অবগত না হওয়ার কারণে দাবী করে বলছিলাে যেন জলদি করে আযাব নাযিল করা হয়। যদি এক নির্দিষ্ট সময়ে আযাব নাযিল হওয়াটা পূর্বে নির্ধারিত না থাকতাে তাহলে অবশ্যই সাথে সাথে তাদের ওপর আযাব এসে পড়তাে এখানে আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে সেই আযাব দান করার ওয়াদা করছেন যার জন্যে ওরা ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলাে। আসবেই সে আযাব যথাযথ সময়ে, এমন সময়ে আসবে যখন তারা আর আযাব চাইবে না বা তার জন্যে অপেক্ষাও করবে না। সে সময় হঠাৎ করে আযাব এসে গেলে তারা হতবাক হয়ে যাবে এবং হঠাৎ করেই আসবে সে মহা বিপদ। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই তাদের ওপর আযাব হঠাৎ করে এসে পড়বে, যখন তারা বুঝতেই পারবে না।’ প্রকৃতপক্ষে, পরবর্তীকালে বদর যুদ্ধ উপলক্ষে তাদের ওপর সেই আযাব এসে গিয়েছিলাে এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছিলেন। তারা তাদের নিজের চোখেই দেখে নিয়েছিলাে কেমন করে আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর তার ওয়াদা পূরণ করেছেন। তবে পূর্বেকার আযাব এবং এই আযাবের মধ্যে পার্থক্য ছিলাে এই যে, পূর্বে যেমন সর্বগ্রাসী আযাব নাযিল করে সমগ্র ইসলাম বিরােধী জনপদকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, বর্তমান আযাবে নির্বিচারে সবাইকে ধ্বংস করা হয়নি, বরং তাদের মাথাগুলােকে শুধু শেষ করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তাদের দাবী অনুযায়ী পূর্বের নবী রসূলদের নিকট যে মাজেজা প্রেরণ করা হয়েছিলো, এ রকম বস্তুগত মােযেজা এ সময়ে নাযিল করা হয়নি। যদি সবার দেখা ও বুঝার মতা বস্তুগত কোনাে মােজেযা রাসুল(স.)-এর আমলে পাঠানাে হতো, তাহলে ওই রকমই সর্বগ্রাসী আযাব নাযিল হয়ে যেতাে, আল্লাহ তায়ালা তার গায়বী এলেম দ্বারা জানতেন যে, মক্কার অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর হেকমত ও তদবীর বুঝতাে না। এ জন্যে তারা রসূলুল্লাহ(স.)-কে চ্যালেঞ্জ করে জলদী আযাব নিয়ে আসার জন্যে দাবী জানাচ্ছিলাে। অথচ জাহান্নাম তাদের লুফে নেয়ার জন্যে ওৎ পেতে রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর ওরা তােমার কাছে দাবী জানাচ্ছে জলদি আযাব নিয়ে আসার জন্যে, অথচ প্রকৃতপক্ষে জাহান্নাম তাে তাদের ঘিরেই রেখেছে।’ মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বর্ণনাপদ্ধতি এতই সুন্দর যে, পড়ার সময় মনে হয় বর্ণিত ঘটনাগুলাে যেন চোখের সামনে ভাসছে, আর ভবিষ্যতের বিষয় গুলো এমন চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে যেন সেগুলাে চর্ম চোখে দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতের ভীতিজনক যেসব দৃশ্যের বর্ণনা দান করা হয়েছে, সেগুলাে চোখের অন্তরালে থাকলেও অনুভূতির মধ্যে এক প্রচন্ড ভীতির সঞ্চার করে। এমতাবস্থায় ওরা যখন আযাব নাযিলের ব্যাপারে বেশী ব্যস্ততা দেখায়, তখন তা তাদের পরিণতি আরও মারাত্মক করে তােলে। যে ব্যক্তিকে জাহান্নাম পরিবেষ্টন করে রেখেছে সে কোন সাহসে এবং কোন আশায় আযাবের ব্যাপারে ব্যস্ততা দেখায়। তার কি চিন্তা করা উচিত নয় যে, তার জীবন এবং জীবনের পরিণতি তাে তার হাতের মধ্যে নয়? এটা কি কঠিন চিন্তা নয় যে, সে বে-খবর অবস্থায় মেকি আশার জাল বুনতেই থাকৰে এবং অকল্পনীয়ভাবে হঠাৎ করে আযাব এসে যাবে? আল কোরআনের অনবদ্য বাচনভংগিতে এমনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে জাহান্নামের মধ্যে আযাবে লিপ্ত ব্যক্তিদের পাঠকের মধ্যে প্রচন্ড কম্পন সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু হায়, সে অর্বাচীনরা সেই আযাবের জন্যেই ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘কি অবস্থা হবে সেদিন যেদিন তাদের জাহান্নামের আযাব ঢেকে ফেলবে তাদের ওপর দিক থেকে এবং পায়ের নীচে থেকে, আর তাদের বলবে, স্বাদ গ্রহণ করো (সেই আযাবের) যা তােমাদের কাছে তােমাদের কাজের বিনিময়ে নেমে আসবে।'(আয়াত ৫৫) আসলে এ ভয়ংকর দৃশ্য নিজেই হবে ভীতিপ্রদ। উপরন্তু এর সাথে যােগ হবে প্রচন্ড তিরস্কারের ওপর তিরঙ্কার। বলা হবে, ‘স্বাদ গ্রহণ করো সেই কাজের যা তােমরা পৃথিবীর জীবনে করতে থেকেছো’ এটাই হচ্ছে আযাব সম্পর্কে পরিণতি, আর এটাই হলাে আল্লাহর হুশিয়ারীকে ভালোভাবে দেখার ফল। যারা রসূলুল্লাহ(স.)-কে অস্বীকার করেছে, তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছে এবং তাকে নানাভাবে ঠাটা-বিদ্রুপ করেছে, তাদের সেই কঠিন আযাবের মধ্যে এমনভাবে ছেড়ে দেয়া হবে যে তাদের ওপর ও নীচের দিক থেকে ঢেকে রাখবে সেই ভয়ংকর আযাব। এক কথায় সব দিক থেকে তারা আযাব দ্বারা ঘেরাও হয়ে থাকবে, আর সে অবস্থার মধ্যে থেকেও তাদের দৃষ্টি পড়বে, সেসব মােমনদের অবস্থানের দিকে, যাদের তারা নানাভাবে দুনিয়ার জীবনে নির্যাতন করেছে এবং দ্বীন ইসলাম থেকে তাদের সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। একমাত্র তাদের রবের এবাদাত তারা করুক এটা তারা সহ্য করতে পারেনি, যার জন্যে তারা নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে, তাদের দ্বীন ইসলাম থেকে সরিয়ে নেয়ার কুমতলবে নানাভাবে তাদের প্ররােচিত করেছে, কুপামর্শ দিয়েছে যেন তারা তাদের আকীদা পরিত্যাগ করে, আর এই অসৎ উদ্দেশ্যে তারা নানা প্রকার ফিকির ফন্দি এঁটেছে। এহেন কুচক্রীদের চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্যে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত মহব্বতের সাথে ও অতি হৃদয়ন্প্শী ভাষায় মােমনদের সত্যের পথে দৃঢ় হয়ে থাকার জন্যে আহ্বান জানান।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪৭-৪৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা যেমন পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন তেমনি এ কুরআন আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর নাবীর প্রতি নাযিল করেছেন। পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তথা আহলে কিতাবের মধ্য থেকে ঐ সকল ব্যক্তিরা কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছে যারা তাদের নাবীর ওপর নাযিলকৃত কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়নি। যেমন আবদুল্লাহ বিন সালাম, সালমান ফারসী। যারা কাফির কেবল তারাই আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে।
(وَمَا كُنْتَ تَتْلُوْا مِنْ قَبْلِه)
‘তুমি তো পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করনি’ অর্থাৎ হে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি তো নিরক্ষর, লিখতে, পড়তে জানোনা; পূর্বে কোন কিতাব পড়ওনি এবং লেখওনি। তারপরেও কেন মিথ্যুকরা সন্দেহ করে যে, তুমি এ কিতাব নিজে রচনা করেছো। যেমন কুরআনে বর্ণিত হয়েছে:
(وَقَالُوْآ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ اكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلٰي عَلَيْهِ بُكْرَةً وَّأَصِيْلًا)
“তারা বলে: ‘এগুলো তো সেকালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে; এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তার নিকট পাঠ করা হয়।’’ (সূরা ফুরকান ২৫:৫) তাদের একথার উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ أَنْزَلَهُ الَّذِيْ يَعْلَمُ السِّرَّ فِي السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ ط إِنَّه۫ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا)
“বল: ‘এটা তিনিই অবতীর্ণ করেছেন যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমুদয় অদৃশ্যের রহস্য অবগত আছেন; নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’ (সূরা ফুরকান ২৫:৬)
নিরক্ষর হওয়া নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য একটি বড় মু‘জিযাহ। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের সপ্রমাণ করার জন্য যেসকল মু‘জিযাহ প্রদান করেছেন তার মধ্যে অন্যতম একটি হল পূর্ব থেকেই নিরক্ষর। তিনি লেখতে জানতেন না এবং পড়তেও জানতেন না। এ অবস্থাতেই মক্কায় চল্লিশটি বছর অতিবাহিত করেন। তিনি কোন কিতাবধারীদের কাছেও যাননি যে, তাদের কাছ থেকে কিছু শুনে নেবেন। চল্লিশ বছর পর হঠাৎ তাঁর পবিত্র মুখ থেকে এমন কালাম উচ্চারিত হতে থাকে যা বিষয়বস্তু ও অর্থের দিক দিয়ে ছিল মু‘জিযাহ, তেমনি শাব্দিক বিশুদ্ধতা ও ভাষালঙ্কারের দিক দিয়েও ছিল অতুলনীয়।
সুতরাং যারা মনে করবে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটা নিজে রচনা করেছে সে নির্বোধ ব্যতীত আর কিছুই নয় এবং সে একজন জালিম। কেননা যে কোনদিন কোন গ্রন্থ পাঠ করেনি এবং যে লেখতেও জানে না তার ব্যাপারে যদি বলা হয়, সে এ গ্রন্থ রচনা করেছে এটা যারা বলবে তারা নির্বোধ ও মূর্খ ব্যতীত আর কিছুই হতে পারে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নিশ্চয়ই কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন নিরক্ষর, তিনি লেখতে পড়তে জানতেন না।
৫০-৫২ নং আয়াতের তাফসীর:
কাফির-মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর ঈমান না আনার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ওযর-আপত্তি পেশ করত, বিভিন্ন নিদর্শন দেখানোর দাবী করত সে কথাই এখানে বলা হয়েছে। একদা তারা ওযর পেশ করে বলল: ‘যদি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যিই নাবী হয়ে থাকে তাহলে পূর্ববর্তী নাবীদের মত সে নিদর্শন নিয়ে আসে না কেন?’ তাদের এ কথার উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেন, হে রাসূল! তুমি বলে দাওন নিদর্শন দেখানোর মালিক আল্লাহ তা‘আলা, আমি শুধু একজন সতর্ককারী। কোন নিদর্শন দেখানো বা নিয়ে আসা আমার এখতিয়ারে নেই। মূলত এসব দাবীর উদ্দেশ্য হল তারা ঈমান আনবে না, যদিও বাহ্যিক আচরণে নিদর্শন নিয়ে আসার দাবী করে থাকে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এটা কি নিদর্শন হিসেবে তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার ওপর কুরআন নাযিল করেছি, যা তাদের নিকট পাঠ করা হয়। মূলত কুরআনই তো একটা সর্বাপেক্ষা বড় নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَوَلَمْ يَكُنْ لَّهُمْ اٰيَةً أَنْ يَّعْلَمَه۫ عُلَمٰٓؤُا بَنِيْٓ إِسْرَا۬ئِيْلَ)
“বানী ইস্রাঈলের পণ্ডিতগণ এটা অবগত আছেন এটা কি তাদের জন্য নিদর্শন নয়?” (সূরা শু‘আরা ২৬:১৯৭) এ নিদর্শন সম্পর্কে সূরা ত্বহার ১৩৩ নং আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেন, হে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তারা যদি বিশ্বাস স্থাপন না করে তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট। তিনি সকল বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনিই কিয়ামতের দিন হক ও বাতিলের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন। তখন বুঝতে পারবে কারা সঠিক পথের অনুসারী ছিল আর কারা ছিল গোমরাহ।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন হল সর্বাপেক্ষা বড় নিদর্শন।
২. কিয়ামতের দিন হক ও বাতিল পৃথকভাবে চেনা যাবে।
৫৩-৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফির-মুশরিকদেরকে যে আযাবের ভয় দেখাতেন তা তারা বিশ্বাস করত না। তারা মনে করত এটা একটা অনর্থক মিথ্যা ভয় দেখানো ছাড়া কিছুই নয়।
তাই তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আবেদন করত তিনি যে আযাবের ভয় তাদেরকে দেখাচ্ছেন তা দ্রুত আসুক। যেমন তারা বলত:
(وَإِذْ قَالُوا اللّٰهُمَّ إِنْ كَانَ هٰذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَا۬ءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمِ)
“স্মরণ কর! যখন তারা বলছিল, ‘হে আল্লাহ! এটা যদি তোমার পক্ষ হতে সত্য হয়, তবে আমাদের ওপর আকাশ হতে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দাও।” (সূরা আনফাল ৮:৩২)
তাদের উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি এ শাস্তির সময়কাল নির্ধারিত না থাকত তাহলে তাদেরকে তাদের প্রার্থনা অনুসারে শাস্তি প্রদান করা হত। তবে যেদিন নির্ধারিত কাল এসে যাবে সেদিন শাস্তি তাদেরকে ওপর থেকে, নীচ থেকে, অর্থাৎ চতুরদিক থেকে পরিবেষ্টন করে নিবে। সে শাস্তি থেকে কেউ তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَهُمْ مِّنْ جَهَنَّمَ مِهَادٌ وَّمِنْ فَوْقِهِمْ غَوَاشٍ ط وَكَذٰلِكَ نَجْزِي الظّٰلِمِيْنَ)
“তাদের শয্যা হবে জাহান্নামের এবং তাদের ওপরে আচ্ছাদনও, এভাবেই আমি জালিমদেরকে প্রতিফল দেব।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৪১)
কিয়ামতের দিন ফেরেশতারা তাদেরকে বলবে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ কর।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يَوْمَ يُدَعُّوْنَ إِلٰي نَارِ جَهَنَّمَ دَعًّا ط - هٰذِهِ النَّارُ الَّتِيْ كُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُوْنَ)
“সেদিন তাদেরকে চরমভাবে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের অগ্নির দিকে, এতো সেই অগ্নি যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে।” (সূরা তূর ৫২:১৩-১৬)
অতএব নির্ধারিত সময় এসে গেলে শাস্তি থেকে আর রেহাই পাওয়া যাবে না। তাই আমাদের উচিত নির্ধারিত সময় অর্থাৎ শাস্তির সময় আসার পূর্বেই মন্দ আমল বাদ দিয়ে সৎ আমল করা নতুবা কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে, ঐ নির্ধারিত সময়েই সংঘটিত হবে।
২. কাফিরদেরকে জাহান্নামে চতুরদিক থেকে শাস্তি দেয়া হবে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, যেভাবে পূববর্তী নবীগণের প্রতি আমি কিতাব নাযিল করেছিলাম ঠিক তেমনিভাবে এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি। দুই, আমি এই শিক্ষা সহকারেই একে নাযিল করেছি যে, আমার পূর্ববর্তী কিতাবগুলো অস্বীকার করে নয় বরং সেগুলো সব স্বীকার করে নিয়েই একে মানতে হবে।
# পূর্বাপর বিষয়বস্তু নিজেই একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, এখানে সমস্ত আহলি কিতাবেরর কথা বলা হয়নি। বরং এমনসব আহলি কিতাবের কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহর কিতাবের সঠিক জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যারা কেবলমাত্র এ কিতাব বহনকারী চতুষ্পদ জীবের মতো নিছক কিতাবের বোঝা বহন করে বেড়াতেন না বরং প্রকৃত অর্থেই ছিলেন কিতাবধারী। তাদের সামনে যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ববর্তী কিতাবগুলোকে সত্যায়িত করে এ শেষ কিতাবটি এলো তখন তারা কোনো প্রকার জিদ, হঠকারিতা ও সংকীর্ণ স্বার্থ প্রীতির আশ্রয় নিলেন না এবং তাকেও ঠিক তেমনি আন্তরিকতা সহকারে স্বীকার করে নিলেন যেমন পূর্ববর্তী কিতাবগুলোকে স্বীকার করতেন।
# “এদের” শব্দের মাধ্যমে আরববাসীদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, সত্যপ্রিয় লোকেরা, তারা আহলি কিতাববা অ-আহলি কিতাব যারাই হোক না কেন, সর্বত্রই এর প্রতি ঈমান আনছে।
# এখানে তাদেরকে কাফের বলা হয়েছে যারা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ প্রীতি ত্যাগ করে সত্য কথা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। অথবা যারা নিজেদের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ও অবাধ স্বাধীনতার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করার ব্যাপারে পিছটান দেয় এবং এরই ভিত্তিতে সত্য অস্বীকার করে।
# এটি নবী (সা.) এর নবুওয়াতের স্বপক্ষে একটি যুক্তি। ইতিপূর্বে সূরা ইউনুস ও সূরা কাসাসে এ যুক্তি আলোচিত হয়েছে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনুস ২১ টীকা এবং সূরা কাসাস ৬৪ ও ১০৯ টীকা। এ বিষয়বস্তুর আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নাহল, ১০৭; সূরা বনী ইসরাঈল ১০৫; আল মু’মিনুন ৬৬; আল ফুরকান ১২; আশ শূরা ৮৪; টীকাগুলো অধ্যয়ন সহায়ক হবে)।
এ আয়াতে যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে, নবী (সা.) ছিলেন নিরক্ষর। তার স্বদেশবাসী ও আত্মীয়-বান্ধবগণ, যাদের মধ্যে তিনি শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত জীবনকাল অতিবাহিত করেছিলেন, সবাই ভালোভাবে জানতো তিনি সারা জীবন কখনো কোন বই পড়েননি এবং কলম হাতে ধরেননি। এ সত্য ঘটনাটি পেশ করে মহান আল্লাহ বলেছেন, এটি একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, আসমানী কিতাবসমূহের শিক্ষাবলী, পূর্ববর্তী নবীগণের অবস্থা, বিভিন্ন ধর্ম ও দ্বীনের আকিদা-বিশ্বাস, প্রাচীন জাতিসমূহের ইতিহাস এবং সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিক জীবন যাপনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী সম্পর্কে যে গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের প্রকাশ ও নিরক্ষর নবীর কণ্ঠ থেকে হচ্ছে তা তিনি অহী ছাড়া অন্য কোন উপায়ে অর্জন করতে পারতেন না। যদি তিনি লেখাপড়া জেনে থাকতেন এবং লোকেরা তাকে বই পড়তে এবং অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে দেখতো তাহলে তো অবশ্যই বাতিলপন্থীদের জন্য এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করার কোন ভিত্তি থাকতো যে, এসব জ্ঞান অহীর মাধ্যমে নয় বরং জাগতিক মেধা, প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। কিন্তু তার নিরক্ষরতা তো তার সম্পর্কে নামমাত্র কোন সন্দেহ পোষণ করার সুযোগ ও ভিত্তিও অবশিষ্ট রাখেনি। এখন নিছক হঠকারিতা ছাড়া তার নবুওয়াত অস্বীকার করার আর এমন কোন কারণই নেই যাকে কোন পর্যায়েও যুক্তিসঙ্গত বলা যেতে পারে।
# একজন নিরক্ষরের পক্ষে কুরআনের মতো একটি কিতাব পেশ করা এবং সহসা এমনসব অসাধারণ বিস্ময়কর ঘটনাবলীর প্রকাশ যেগুলোর জন্য পূর্বাহ্ণে প্রস্তুতি গ্রহণ করার কোন উদ্যোগ আয়োজন কখনো কারো চোখে পড়েনি, এগুলোই বুদ্ধিমান বিচক্ষণ লোকদের দৃষ্টিতে তার নবুয়তের প্রমাণ পেশকারী উজ্জ্বলতম নিদর্শন। দুনিয়ার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের মধ্য থেকে যারই অবস্থা পর্যালোচনা করা যাবে, তারই নিজস্ব পরিবেশে মানুষ এমনসব উপাদানের সন্ধান লাভ করতে পারবে যেগুলো তার ব্যক্তিত্ব গঠনে এবং তার অসাধারণ কৃতিত্ব প্রকাশের জন্য তাকে প্রস্তুত করার ব্যাপারে সক্রিয় ছিল। তার পরিবেশ ও তার ব্যক্তিত্ব গঠনের উপাদানের মধ্যে একটা পরিষ্কার সম্পর্ক পাওয়া যায়। কিন্তু মুহাম্মাদ ﷺ এর ব্যক্তিত্বে যেসব বিস্ময়কর গুনাবলী ও কৃতিত্বের প্রকাশ ঘটেছিল তার কোন উৎস তার পরিবেশে খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর ছিল না। এখানে মুহাম্মাদ ﷺ এর ব্যক্তিত্ব গঠনের উপাদানের সাথে কোনো প্রকার দূরবর্তী সম্পর্ক রাখে এমনসব উপাদান সেকালে আরবীয় সমাজের এবং আশপাশে যেসব দেশের সাথে আরবদের সম্পর্ক ছিল তাদের সমাজের কোথাও থেকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। এ বাস্তবতার ভিত্তিতেই এখানে বলা হয়েছে, মুহাম্মাদ ﷺ এর সত্ত্বা একটি নিদর্শনের নয় বরং বহু নিদর্শনের সমষ্টি। মূর্খ এর মধ্যে কোন নিদর্শন দেখতে পায় না, এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু জ্ঞানীরা এ নিদর্শনগুলো দেখে মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কেবলমাত্র একজন নবীই এ কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারে।
# মু’জিযা, যেগুলো দেখে বিশ্বাস করা যায় সত্যই মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর নবী।
# নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের প্রতি কুরআনের মতো একটি কিতাব নাযিল হওয়া, এটি তোমাদের রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য যথেষ্ট হবার মতো বড় মু’জিযা নয় কি? এর পরও কি আর কোন মু’জিযা থাকে? অন্য মু’জিযাগুলোতো যারা দেখেছে তাদের জন্য মু’জিযা ছিল কিন্তু এ মু’জিযাটি তো সর্বক্ষণ তোমাদের সামনে রয়েছে, প্রতিদিন তোমাদের পড়ে শুনানো হচ্ছে। তোমরা সবসময় তা দেখতে পারো। কুরআন মাজীদের এ যুক্তি প্রমাণ পেশ করার পরও যারা নবী (সা.)কে সাক্ষর প্রমাণ করার চেষ্টা করে তাদের দুঃসাহস দেখে অবাক হতে হয়। অথচ এখানে কুরআন পরিষ্কার ভাষায় নবী করীমের ﷺ নিরক্ষর হবার বিষয়টিকে তার নবুয়তের স্বপক্ষে একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে পেশ করছে। যে সব হাদীসের ভিত্তিতে নবী করীম ﷺ সাক্ষর ছিলেন অথবা পরে লেখাপড়া শিখেছিলেন দাবী করা হয়, সেগুলো তো প্রথম দৃষ্টিতেই প্রত্যাখ্যান করার যোগ্য। কারণ কুরআন বিরোধী কোন হাদীসই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তারপর এগুলো নিজেই এত দুর্বল যে, এগুলোর ওপর কোন যুক্তির ভিত্ খাড়া করা যেতে পারে না। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বুখারীর একটি হাদীস। তাতে বলা হয়েছেঃ হুদায়বিয়া সংঘটিত হওয়ার সময় যখন চুক্তিনামা লেখা হচ্ছিল তখন মক্কার কাফেরদের প্রতিনিধিরা রাসূলে করীমের ﷺ নামের সাথে রাসূলুল্লাহ লেখার ওপর আপত্তি জানায়। তখন নবী (সা.) চুক্তি লেখককে (অর্থাৎ হযরত আলী) নির্দেশ দেন, ঠিক আছে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে তার জায়গায় লেখো “মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ।” হযরত আলী ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিতে অস্বীকার করেন। নবী করীম ﷺ তার হাত থেকে কলম নিয়ে নিজেই শব্দটি কেটে দেন এবং ‘মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ’ লিখে দেন। কিন্তু হাদীসটি বারাআ ইবনে আযিব থেকে বুখারীতে চার জায়গায় এবং মুসলিমে দু’জায়গায় উদ্ধৃত হয়েছে। প্রত্যেক জায়গায় এর শব্দাবলি বিভিন্ন।
একঃ বুখারী চুক্তি অধ্যায়ে এর শব্দগুলো হচ্ছে নিম্নরূপঃ قَالَ لِعَلِىٍّ امْحُهُ فَقَالَ عَلِىٌّ مَا أَنَا بِالَّذِى أَمْحَاهُ فَمَحَاهُ رَسُولُ اللَّهِ بِيَدِهِ- “নবী করীম ﷺ আলীকে বললেন এ শব্দগুলো কেটে দাও। আলী বললেন, আমি তো কেটে দিতে পারি না। শেষে নবী করীম ﷺ নিজ হাতে তা কেটে দেন।”
দুইঃ এ কিতাবে অন্য একটি হাদীসের শব্দাবলি হচ্ছেঃ ثُمَّ قَالَ لِعَلِىٍّ امْحُ رَسُولُ اللَّهِ قَالَ لاَ وَاللَّهِ لاَ أَمْحُوكَ أَبَدًا ، فَأَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ الْكِتَابَ ، فَكَتَبَ هَذَا مَا قَاضَى عَلَيْهِ مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ “তারপর আলীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ শব্দ কেটে দাও। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, আমি কখনো আপনার নাম কাটবো না। শেষে নবী করীম ﷺ দলীলটি নিয়ে লিখলেন, “এটি সেই চুক্তি যা আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ সম্পাদন করেছেন।”
তিনঃ তৃতীয় হাদীসও বারাআ ইবনে আযিব থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং ইমাম বুখারী এটি জিযিয়া অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেনঃ وَكَانَ لاَ يَكْتُبُ فَقَالَ لِعَلِىٍّ امْحُ رَسُولَ اللَّهِ فَقَالَ عَلِىٌّ وَاللَّهِ لاَ أَمْحَاهُ أَبَدًا قَالَ فَأَرِنِيهِ قَالَ فَأَرَاهُ إِيَّاهُ ، فَمَحَاهُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِيَدِهِ- “নবী করীম ﷺ নিজে লিখতে পারতেন না। তিনি হযরত আলীকে বললেন, রাসূলুল্লাহটা কেটে দাও। আলী বললেন, আল্লাহর কসম, আমি এ শব্দগুলো কখনোই কাটবো না। একথায় নবী করীম ﷺ বলেন, যেখানে এ শব্দগুলো লেখা আছে সে জায়গাটা আমাকে দেখিয়ে দাও। তিনি তাকে জায়গাটি দেখিয়ে দিলেন এবং নবী (সা.) নিজের হাতে সে শব্দগুলো কেটে দিলেন।
চারঃ চতুর্থ হাদীসটি বুখারীর যুদ্ধবিগ্রহ অধ্যায়ে এভাবে উদ্ধৃত হয়েছেঃ فَأَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْكِتَابَ وَلَيْسَ يُحْسِنُ يَكْتُبُ فَكَتَبَ هَذَا مَا قَاضَى مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ “কাজেই নবী করীম ﷺ সে দলীলটি নিয়ে নিলেন অথচ তিনি লিখতে জানতেন না এবং তিনি লিখলেন। এটি সেই চুক্তি যেটি স্থির করেছেন মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ।”
পাঁচঃ একই বর্ণনাকারী বারাআ ইবনে আযিব থেকে মুসলিমের কিতাবুল জিহাদে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে, নবী করীম ﷺ আলীর অস্বীকৃতির কারণে নিজের হাতে “আল্লাহর রাসূল” শব্দ কেটে দেন।
ছয়ঃ এ কিতাবে অন্য একটি হাদীস একই বর্ণনাকারী থেকেই বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ হযরত আলীকে বলেন, রাসূলুল্লাহ শব্দ কোথায় লেখা আছে আমাকে দেখিয়ে দাও। হযরত আলী তাকে জায়গাটি দেখিয়ে দিলেন এবং তিনি সেটি বিলুপ্ত করে আবদুল্লাহর পুত্র লিখে দেন। উল্লেখিত হাদীসগুলোর বর্ণনার মধ্যে যে অস্থিরতা ফুটে উঠেছে তা পরিষ্কারভাবে একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, মাঝখানের বর্ণনাকারীরা হযরত বারাআ ইবনে আযিব (রা.) এর শব্দগুলো হুবহু উদ্ধৃত করেননি। তাই তাদের কারো একজনের বর্ণনার ওপর নির্ভর করে পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে একথা বলা যেতে পারে না যে, নবী করীম ﷺ “মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ” শব্দগুলো নিজ হাতেই লেখেন। হতে পারে, সঠিক ঘটনা হয়তো এ রকম ছিলঃ যখন হযরত আলী “রাসূলূল্লাহ” শব্দ কেটে দিতে অস্বীকার করেন তখন তিনি তার কাছে থেকে সে জায়গাটি জিজ্ঞেস করে নিয়ে নিজের হাতে সেটি কেটে দেন এবং তারপর তার সাহায্যে বা অন্য কোন লেখকের সহায়তায় মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ শব্দ লিখে দিয়ে থাকবেন। অন্যান্য হাদীস থেকে জানা যায়, এ সময় দু’জন লেখক চুক্তিনামা লেখার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, এদের একজন ছিলেন হযরত আলী (রা.) এবং অন্যজন ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ (ফাতহুল বারি, ৫ খণ্ড, ২১৭ পৃষ্ঠা)। কাজেই একজন লেখক যে কাজ করেননি দ্বিতীয়জন যে তা করেছেন, এটা মোটেই অসম্ভব নয়। তবুও যদি বাস্তবেই এটা ঘটে থাকে যে, নবী করীম ﷺ নিজের নাম নিজের পবিত্র হাতে লিখে দিয়েছেন, তাহলে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। দুনিয়ায় এ ধরণের বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যে, একজন নিরক্ষর লোক শুধুমাত্র নিজের নামটি লেখা শিখে নিয়েছে, এ ছাড়া আর কিছুই লিখতে পড়তে পারে না।
অন্য যে হাদীসটির ভিত্তিতে নবী (সা.) কে সাক্ষর দাবী করা হয়ে থাকে সেটি মুজাহিদ থেকে ইবনে আবী শাইবা এবং আমর ইবনে শূবাহ উদ্ধৃত করেছেন। তার শব্দাবলি হচ্ছেঃ مَا مَاتَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حَتَّى كَتَبَ وَقَرَأَ
“ইন্তিকালের পূর্বে রাসূলুল্লাহ ﷺ লিখতে ও পড়তে শিখেছিলেন।” কিন্তু প্রথমত সনদের দিক দিয়ে এটি অত্যন্ত দুর্বল রেওয়ায়েত, যেমন হাফেয ইবনে কাসীর বলেন, فضعيف لااصل له- এটি দুর্বল রেওয়ায়েত, এর কোন ভিত্তি নেই। দ্বিতীয়ত এর দুর্বলতা ও সুস্পষ্ট। অর্থাৎ যদি নবী করীম ﷺ পরবর্তী পর্যায়ে লেখাপড়া শিখে থাকেন, তাহলে এটা সাধারণ্যে প্রচারিত হবার কথা। বহু সংখ্যক সাহাবী এ বিষয়টি বর্ণনা করতেন। এই সঙ্গে নবী করীম ﷺ কার কাছে বা কার কার কাছে লেখাপড়া শিখেছেন তাও জানা যেতো। কিন্তু একমাত্র মুজাহিদ যার কাছ থেকে একথা শুনেন সেই আওন ইবনে আবদুল্লাহ ছাড়া আর কেউ একথা বর্ণনা করেননি। আর এই আওনও সাহাবী নন। বরং তিনি একজন তাবেঈ। কোন সাহাবী বা কোন্ কোন্ সাহাবী থেকে তিনি একথা শুনেছেন তাও তিনি ঘুণাক্ষরেও বলেননি। একথা সুস্পষ্ট, এ ধরনের দুর্বল রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে এমন কোন কথা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যা অত্যন্ত সুপরিচিত ও ব্যাপকভাবে প্রচারিত ঘটনার বিরোধিতা করে।
# নিঃসন্দেহে এ কিতাব অবতীর্ণ হওয়া আল্লাহর মহা অনুগ্রহ স্বরূপ। এর মধ্যে রয়েছে বান্দার জন্য বিপুল পরিমাণ উপদেশ ও নসিহত। কিন্তু এ থেকে একমাত্র তারাই উপকৃত হতে পারে যারা এর প্রতি ঈমান আনে।
# বারবার চ্যালেঞ্জের কণ্ঠে দাবী জানাচ্ছে, যদি তুমি রসূল হয়ে থাকো এবং আমরা যথার্থই সত্যের প্রতি মিথ্যা আরোপ করে থাকি, তাহলে তুমি যে আযাবের ভয় আমাদের দেখিয়ে থাকো তা নিয়ে আসছো না কেন?
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪৭-৪৯ নং আয়াতের তাফসীর
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! আমি যেমন পূর্ববর্তী নবীদের (আঃ) কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছিলাম, অনুরূপভাবে এই কিতাব অর্থাৎ কুরআন কারীম তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি। আহলে কিতাবের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যারা আমার এই কিতাবের মর্যাদা দিয়ে থাকে এবং সঠিকভাবে এটা পাঠ করে। সুতরাং যেমন তারা তাদের প্রতি অবতারিত কিতাবের উপর ঈমান এনেছে, অনুরূপভাবেই এই পবিত্র কিতাবকেও তারা মেনে চলে। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ), হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) প্রমুখ। আর ঐ লোকেরাও অর্থাৎ কুরায়েশ প্রভৃতি গোত্রের মধ্য হতেও কতকগুলো লোক এর উপর ঈমান এনে থাকে। হ্যা, তবে যারা বাতিল দ্বারা হককে গোপন করে এবং সূর্যের আলো হতে চক্ষু বন্ধ করে নেয় তারা তো এই কিতাবকেও অস্বীকারকারী।
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার উপর এই কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তুমি তো তোমার বয়সের একটা বড় অংশ এই কাফিরদের মধ্যে অতিবাহিত করেছে। সুতরাং তারা তো ভালরূপেই জানে যে, তুমি লেখা পড়া জানতে না। সমস্ত গোত্র ও সারা দেশবাসী এ খবর রাখে যে, তোমার কোন আক্ষরিক জ্ঞান ছিল না। এতদসত্ত্বেও যখন তুমি এক চারুবাক সম্পন্ন ও জ্ঞানপূর্ণ কিতাব পাঠ করছো তখন তো তা প্রকাশ্য ব্যাপার যে, এটা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতেই এসেছে। তুমি তো একটি অক্ষরও কারো কাছে শিখখানি, অতএব কি করে তুমি এত বড় একটা কিতাব রচনা করতে পার?
রাসূলুল্লাহ (সঃ) সম্পর্কে এই কথাটিই পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও ছিল। যেমন কুরআন কারীমে ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যারা আক্ষরিক জ্ঞান বিহীন রাসূল ও নবী (সঃ)-এর অনুসরণ করে, যার গুণাবলী তারা তাদের কাছে বিদ্যমান তাওরাত ও ইঞ্জীলে পেয়ে থাকে, যে তাদেরকে ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ করে।” (৭:১৫৭)
বড় মজার কথা এই যে, আল্লাহর নিস্পাপ নবী (সঃ)-কে সব সময়ের জন্যে লিখা হতে দূরে রাখা হয়। একটি অক্ষরও তিনি লিখতে পারতেন না। তিনি লেখক নিযুক্ত করেছিলেন, যারা আল্লাহর অহী লিখতেন। প্রয়োজনের সময় দুনিয়ার বাদশাহদের নিকট চিঠি-পত্র তারাই লিখতেন। পরবর্তী ফকীহদের মধ্যে কাযী আবুল ওয়ালীদ বাজী প্রমুখ গুরুজন বলেছেন যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন নিম্নলিখিত বাক্যটি রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বহস্তে লিখেছিলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এ হচ্ছে ঐ শর্তসমূহ যেগুলোর উপর মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল্লাহ (সঃ) ফায়সালা করেছেন। কিন্তু তাঁর এ উক্তি সঠিক নয়। কাযী সাহেবের মনে এধারণা জন্মেছে সহীহ বুখারীর ঐ রিওয়াইয়াত হতে যাতে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) ওটা নিলেন ও লিখলেন।” কিন্তু এর ভাবার্থ (আরবি) অর্থাৎ “অতঃপর তিনি হুকুম করলেন তখন লিখা হলো।” পূর্ব ও পশ্চিমের সমস্ত আলেমের এটাই মাযহাব। এমন কি তারা বাজী (রঃ) প্রমুখ গুরুজনের উক্তিকে কঠিনভাবে খণ্ডন করেছেন এবং তাঁদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা তাঁদের কবিতা ও ভাষণেও এঁদের উক্তি খণ্ডন করেছেন। কিন্তু এটাও স্মরণ রাখার বিষয় যে, কাযী সাহেব প্রমুখ মনীষীদের এটা ধারণা মমাটেই নয় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভালরূপে লিখতে পারতেন। বরং তারা বলতেন যে, সন্ধিপত্রে তার উপরোক্ত বাক্যটি লিখে নেয়া তাঁর একটি মু’জিযা ছিল। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন যে, দাজ্জালের দু’চক্ষুর মাঝে কাফির’ লিখা থাকবে এবং অন্য এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, কুফর’ লিখিত থাকবে, যা প্রত্যেক মুমিন পড়তে পারবেন। অর্থাৎ লেখা পড়া না জানলেও সবাই পড়তে সক্ষম হবে। এটা মুমিনের একটা কারামাত হবে। অনুরূপভাবে উপরোক্ত বাক্য লিখে ফেলা আল্লাহর নবী (সঃ)-এর একটি মু’জিযা ছিল। এর ভাবার্থ এটা মোটেই নয় যে, তিনি লেখাপড়া জানতেন।
কোন কোন লোক এই রিওয়াইয়াত পেশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তেকাল হয়নি যে পর্যন্ত না তিনি কিছু শিখেছেন। কিন্তু এ রিওয়াইয়াতটি সম্পূর্ণ দুর্বল, এমন কি ভিত্তিহীনও বটে। কুরআন কারীমের এ আয়াতটির প্রতি লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় যে, কত জোরের সাথে এটা আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর লেখাপড়া জানার কথা অস্বীকার করছে এবং কত জোরালো ভাষায় এটাও অস্বীকার করছে যে, তিনি লিখতে পারতেন।
এখানে যে ডান হাতের কথা বলা হয়েছে তা প্রায় বা অধিকাংশ ক্ষেত্র হিসেবে। নতুবা লিখী তো ডান হাতেই হয়। যেমন মহান আল্লাহর উক্তিঃ (আরবি) অর্থাৎ “না কোন পাখী যা ডানার সাহায্যে উড়ে।” (৬:৩৮) কেননা, প্রত্যেক পাখীই তো ডানার সাহায্যেই উড়ে।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিরক্ষরতার বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তুমি লেখাপড়া জানলে মিথ্যাচারীরা তোমার সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করার সুযোগ পেতো যে, তুমি পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ পড়ে, লিখে বর্ণনা করছে। কিন্তু এখানে তো এরূপ হচ্ছে না। এতদসত্ত্বেও এই লোকগুলো আল্লাহর নবী (আঃ)-এর উপর এই অপবাদ দিচ্ছে যে, তিনি তাদের পূর্ববর্তীদের কাহিনী বর্ণনা করছেন, যা তাদের সামনে সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করা হয়। অথচ তারা ভালরূপেই জানে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) লেখাপড়া জানেন না।
তাদের কথার উত্তরে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তুমি বলে দাওঃ এটা তিনিই নাযিল করেছেন যিনি আসমান ও যমীনের গোপনীয় বিষয় সম্যক অবগত আছেন।” (২৫:৬)
এখানে আল্লাহ পাক বলেনঃ বস্তত যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের অন্তরে এটা স্পষ্ট নিদর্শন। অর্থাৎ এই কুরআনের আয়াতগুলো সুস্পষ্ট ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। আলেমদের পক্ষে এগুলো বুঝ, মুখস্থ করা এবং জনগণের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া খুবই সহজ। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কুরআন আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্যে, কে আছে উপদেশ গ্রহণের জন্যে?” (৫:৪০)
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক নবী (আঃ)-কে এমন একটি জিনিস দেয়া হয়েছে যা দেখে লোকে ঈমান আনে। অনুরূপভাবে আল্লাহ আমার প্রতি একটি জিনিস অহী করেছেন। আমি আশা করি যে, সব নবী (আঃ)-এর অনুসারীদের চেয়ে আমার অনুসারীদের সংখ্যা বেশী হবে।”
সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা (স্বীয় নবীকে সঃ) বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! আমি তোমাকে পরীক্ষা করবো এবং তোমার কারণে জনগণকেও পরীক্ষা করবো। আমি তোমার উপর এমন একটি কিতাব অবতীর্ণ করবো যা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা যাবে না। তুমি তা ঘুমন্ত ও জাগ্রত সর্বাবস্থায় পাঠ করতে থাকবে!” অর্থাৎ এটা পানিতে ধুলেও নষ্ট হবে না। যেমন অন্য হাদীসে এসেছেঃ “কুরআন চামড়ার মধ্যে থাকলেও তা আগুনে পুড়বে না। কেননা, তা বক্ষে রক্ষিত থাকবে। পুস্তকটি মুখে পড়তে খুব সহজ। এটা অন্তরে সদা গাঁথা থাকে। শব্দ ও অর্থের দিক দিয়েও এটি একটি জীবন্ত মু’জিযা। এ কারণেই পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে এই উম্মতের একটি বিশেষণ এও বর্ণনা করা হয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ তাদের কিতাব তাদের বক্ষে থাকবে।” ইমাম ইবনে জারীর কথাটি খুব পছন্দ করেছেন যে, আল্লাহ পাকের (আরবি)-এই উক্তির ভাবার্থ হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! তুমি এই কিতাবের পূর্বে কোন কিতাব পড়তে না এবং নিজের হাতে কিছু লিখতে না। এই সুস্পষ্ট আয়াতগুলো আহলে কিতাবের জ্ঞানী ও বিদ্বান লোকদের বক্ষে বিদ্যমান রয়েছে। কাতাদা (রঃ) ও ইবনে জুরায়েয (রঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। প্রথমটি হাসান বসরী (রঃ)-এর উক্তি। আওফীও (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটা বর্ণনা করেছেন। যহ্হাকও (রঃ) এ কথাই বলেছেন। এটাই বেশী প্রকাশমান। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যালিমরাই আমার নিদর্শন অস্বীকার করে থাকে। যারা সত্যকে বুঝেও না এবং ওদিকে আকৃষ্টও হয় না। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যাদের উপর তোমার প্রতিপালকের বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে। তারা ঈমান আনবে না যদিও তাদের কাছে সমস্ত আয়াত এসে যায়, যে পর্যন্ত না তারা বেদনাদায়ক শাস্তি অবলোকন করে।” (১০:৯৬-৯৭)
৫০-৫২ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা কাফিরদের হঠকারিতা ও অহংকারের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর কাছে এমনই নিদর্শন দেখতে চেয়েছিল যেমন হযরত সালেহ (আঃ)-এর কাছে তাঁর কওম নিদর্শন তলব করেছিল। অতঃপর মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলে দাও- আয়াত, ‘জিযা এবং নিদর্শনাবলী দেখানো আমার সাধ্যের বিষয় নয়। এটা আল্লাহর কাজ। তিনি তোমাদের সৎ নিয়তের কথা জানলে অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে মু’জিযা দেখাবেন। আর যদি তোমরা হঠকারিতা কর এবং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতেই থাকো তবে আল্লাহ তোমাদের অধীনস্থ নন যে, তোমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি কাজ করবেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “নিদর্শনাবলী পাঠাতে আমাকে শুধু এটাই বিরত রেখেছে যে, পূর্বযুগীয় ললাকেরা ওগুলো অবিশ্বাস করেছিল। পর্যবেক্ষণ হিসেবে আমি সামূদ সম্প্রদায়কে উন্ত্রী দিয়েছিলাম, অতঃপর তারা ওর সাথে যুলুম করেছিল।” (১৭:৫৯)।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও- আমি তো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র। আমার কাজ শুধু তোমাদের কানে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া। আমি তো তোমাদেরকে তোমাদের ভাল মন্দ বুঝিয়ে দিয়েছি। পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে অবহিত করেছি। এখন তোমরা বুঝে সুঝে কাজ কর। সুপথে পরিচালিত করা ও পথভ্রষ্ট করা আল্লাহর কাজ। তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ পথ দেখাতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তাদেরকে হিদায়াত করা তোমার কাজ নয়, বরং আল্লাহ যাকে চান হিদায়াত করে থাকেন।” (২:২৭২) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনই তার কোন পথ-প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে ।” (১৮১৭)।
আল্লাহ তা’আলা কাফির ও মুশরিকদের অত্যধিক মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সত্যতার নিদর্শন দেখতে চাচ্ছে, অথচ তাদের কাছে অতি মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব এসে গেছে, যার মধ্যে কোনক্রমেই মিথ্যা প্রবেশ করতে পারে না। এতদসত্ত্বেও তারা নিদর্শন দেখতে চাচ্ছে, এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে! এই কিতাব তো সবচেয়ে বড় মুজিযা। দুনিয়ার সমস্ত বাকপটু এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এবং এর মত কালাম পেশ করতে সম্পূর্ণরূপে অপারগ হয়ে গেছে। গোটা কুরআনের মুকাবিলা করা তো দূরের কথা, দশটি সূরা, এমন কি একটি সূরা আনয়ন করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। তাহলে এতো বড় মু’জিযা কি তাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে, তারা অন্য নিদর্শন তলব করছে? এটি তো একটি পবিত্র গ্রন্থ যার মধ্যে অতীতের ও ভবিষ্যতের খবর এবং বিবাদের মীমাংসা রয়েছে। এটা এমন এক ব্যক্তির মুখে পঠিত হচ্ছে যিনি আক্ষরিক জ্ঞানশূন্য। যিনি কারো কাছে ‘আলিফ, বা’ও পাঠ করেননি। যিনি কখনো একটি অক্ষরও লিখেননি এবং লিখতে জানেন না। যিনি কখনো বিদ্বানদের সাথেও উঠাবসা করেননি। তিনি এমন একটি কিতাব পাঠ করছেন যার দ্বারা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা জানা যাচ্ছে। যার ভাষা লালিত্যপূর্ণ, যার ছন্দে মাধুর্য রয়েছে এবং যার বাচনভঙ্গী মনোমুগ্ধকর। যার মধ্যে দুনিয়াপূর্ণ উৎকৃষ্টতা বিদ্যমান রয়েছে। বানী ইসরাঈলের আলেমরাও এর সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। পূর্ববর্তী কিতাবগুলো এর সত্যতার সাক্ষী। ভাল লোকেরা এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং এর উপর আমলকারী। এতো বড় মুজিযার বিদ্যমানতায় অন্য মু’জিযা দেখতে চাওয়া এর প্রতি চরম বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ এতে অবশ্যই মুমিন সম্প্রদায়ের জন্যে অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে। এই কুরআন সত্যকে প্রকাশকারী, মিথ্যাকে ধ্বংসকারী। এই কিতাব পূর্ববর্তীদের ঘটনাবলী মানুষের সামনে তুলে ধরে মানুষকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণের সুযোগ দিচ্ছে এবং পাপীদের পরিণাম প্রদর্শন করে মানুষকে। পাপকর্ম হতে বিরত রাখছে।
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ তুমি তাদেরকে বলে দাওআমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি তোমাদের অবিশ্বাস ও হঠকারিতা এবং আমার সত্যবাদিতা ও শুভাকাঙ্ক্ষা সম্যক অবগত। আমি যদি তাঁর উপর মিথ্যা আরোপ করতাম তর্ধে অবশ্যই তিনি আমা হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন। তিনি এ ধরনের লোকদের হতে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ছাড়েন না। যেমন আল্লাহ ঘোষণা করেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সে যদি আমার নামে কিছু রচনা করে চালাতে চেষ্টা করতো, তবে অবশ্যই আমি তার দক্ষিণ হস্তে ধরে ফেলতাম এবং কেটে ফেলতাম তার জীবন ধমনী। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই, যে তাকে রক্ষা করতে পারে।” (৬৯:৪৪-৪৭)
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে তা তিনি অবগত। অর্থাৎ কোন গোপন বিষয় তাঁর কাছে গোপন নেই।
অতঃপর ঘোষিত হচ্ছে। যারা অসত্যে বিশ্বাস করে ও আল্লাহকে অস্বীকার করে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাদের দুষ্কর্মের প্রতিফল প্রদান করবেন। এখানে তারা যে ঔদ্ধত্যপনা দেখাচ্ছে এর শাস্তি তাদেরকে গ্রহণ করতেই হবে। আল্লাহকে অস্বীকার করা এবং প্রতিমাগুলোকে মেনে চলা, এর চেয়ে বড় যুলুম আর কি হতে পারে? তিনি সবকিছুই জানেন এবং তিনি বড় বিজ্ঞানময়। পাপীদেরকে তাদের পাপকর্মের শাস্তি না দিয়ে তিনি ছাড়বেন না।
৫৩-৫৫ নং আয়াতের তাফসীর
মুশরিকরা যে অজ্ঞতার কারণে আল্লাহর আযাব চাচ্ছিল তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, এই মুশরিকরা নবী (সঃ)-কে আল্লাহর শাস্তি আনয়নের কথা বলেছিল এবং স্বয়ং আল্লাহর নিকটও প্রার্থনা করেছিল। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “(স্মরণ কর) যখন তারা বলেছিল- হে আল্লাহ! এটা যদি তোমার নিকট হতে সত্য হয় তবে আকাশ হতে আমাদের উপর প্রস্তর বর্ষণ কর অথবা আমাদের কাছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আনয়ন কর।” (৮:৩২)
এখানে তাদেরকে জবাব দেয়া হচ্ছে- যদি বিশ্বপ্রতিপালকের পক্ষ হতে এটা নির্ধারিত না থাকতো যে, এই কাফিরদেরকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে তবে তাদের শাস্তি চাওয়া মাত্রই তাদের উপর অবশ্যই শাস্তি নেমে আসতো। এখন তাদের এর প্রতিও বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তাদের অজ্ঞাতসারে তাদের উপর শাস্তি আকস্মিকভাবে এসে পড়বে। তারা শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলছে, তাদের জেনে রাখা উচিত যে, জাহান্নাম তো তাদেরকে পরিবেষ্টন করবেই। অর্থাৎ এটা নিশ্চিত কথা যে, শাস্তি তাদের উপর আসবেই।
হযরত শা’বী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “এই বাহূরে আখ্যরই (সবুজ সাগর) সবুজ সাগর বলতে আরবগণ আরব উপকূল হতে ভারতের মধ্যবর্তী জলরাশিকে বুঝে। হবে ঐ জাহান্নাম যাতে তারকারাজি ঝরে পড়বে এবং সূর্য ও চন্দ্র আলোশূন্য হয়ে এতে নিক্ষিপ্ত হবে। এটা জ্বলে উঠবে এবং জাহান্নামে পরিণত হবে।” (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
সাফওয়ান ইবনে ইয়া’লা (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “সমুদ্রই জাহান্নাম। তখন হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত ইয়ালা (রাঃ)-কে জনগণ জিজ্ঞেস করে- আপনারা দেখেন না যে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে।” (১৮:২৯) উত্তরে ইয়া’লা (রাঃ) বলেনঃ “যার হাতে ইয়া’লার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! আমি তাতে কখনো প্রবেশ করবো না যে পর্যন্ত না আমাকে আল্লাহর সামনে পেশ করা। হবে এবং এর এক ফোটাও আমার কাছে পৌঁছবে না যে পর্যন্ত না আমাকে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট হাযির করা হবে।” এটা মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে। এ তাফসীরও খুবই গরীব এবং এ হাদীসও অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ সেই দিন শাস্তি তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে ঊর্ধ্ব ও অধঃদেশ হতে। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ তাদের জন্যে জাহান্নামের (অগ্নির) বিছানা হবে এবং তাদের উপরে (আগুনেরই) ওড়না হবে।” (৭:৪১ আর একটি আয়াতে আছেঃ(আরবি)
অর্থাৎ “তাদের উপরে হবে আগুনের সামিয়ানা এবং নীচে হবে আগুনেরই বিছানা।” (৩৯:১৬) অন্য এক আয়াতে রয়েছেঃ অর্থাৎ “যদি কাফিররা ঐ সময়ের কথা জানতো যখন তারা তাদের সামনে হতে ও পিছন হতে আগুন সরাতে পারবে না।” (২১:৩৯) এসব আয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, এই কাফিরদেরকে চতুর্দিক হতে আগুন পরিবেষ্টন করবে। তাদের সামনে হতে, পিছন হতে, উপর হতে, নীচ হতে, ডান দিক হতে এবং বাম দিক হতে আগুন তাদেরকে ঘিরে ফেলবে। একদিক হতে তো তাদের উপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহর শাসন, গর্জন ও ধমক আসতে থাকবে, অপরদিক হতে সদা তাদেরকে বলা হবেঃ তোমরা যা করতে তার স্বাদ গ্রহণ কর। সুতরাং এক তো এই বাহ্যিক ও দৈহিক শাস্তি, দ্বিতীয়তঃ এই মানসিক শাস্তি। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে, সেই দিন বলা হবে- জাহান্নামের যন্ত্রণা আস্বাদন কর। আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।” (৫৪:৪৮-৪৯) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের অগ্নির দিকে, (বলা হবে) এই সেই আগুন যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে। এটা কি যাদু? না কি তোমরা দেখছো না? তোমরা এতে প্রবেশ কর, অতঃপর তোমরা ধৈর্যধারণ কর অথবা না কর উভয়ই তোমাদের জন্যে সমান। তোমরা যা করতে তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হচ্ছে।” (৫২:১৩-১৬)