(বই#১০২৯)   [ তারা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না? ] www.motaher21.net সূরা:- ৩০:আর্-রূম পারা:২১ ৮-১৬ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০২৯)
[ তারা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না? ]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩০:আর্-রূম
পারা:২১
৮-১৬ নং আয়াত:-
৩০:৮
اَوَ لَمۡ یَتَفَکَّرُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ ۟ مَا خَلَقَ اللّٰہُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَاۤ اِلَّا بِالۡحَقِّ وَ اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ وَ اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ النَّاسِ بِلِقَآیِٔ رَبِّہِمۡ لَکٰفِرُوۡنَ ﴿۸﴾
তারা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না? আল্লাহ্‌ আসমানসমূহ, যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই তো তাদের রবের সাক্ষাতের ব্যাপারে কাফির।
৩০:৯
اَوَ لَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ؕ کَانُوۡۤا اَشَدَّ مِنۡہُمۡ قُوَّۃً وَّ اَثَارُوا الۡاَرۡضَ وَ عَمَرُوۡہَاۤ اَکۡثَرَ مِمَّا عَمَرُوۡہَا وَ جَآءَتۡہُمۡ رُسُلُہُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ ؕ فَمَا کَانَ اللّٰہُ لِیَظۡلِمَہُمۡ وَ لٰکِنۡ کَانُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ ؕ﴿۹﴾
তারা কি জমিনে ভ্রমণ করে না? তাহলে তারা দেখত যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল, শক্তিতে তারা ছিল এদের চেয়ে প্রবল, তারা জমি চাষ করত, তারা সেটা আবাদ করত এদের আবাদ করার চেয়ে বেশী। আর তাদের কাছে এসেছিল তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ; বস্তুত আল্লাহ্ এমন নন যে, তাদের প্রতি যুলুম করেন, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করেছিল।
৩০:১০
ثُمَّ کَانَ عَاقِبَۃَ الَّذِیۡنَ اَسَآءُوا السُّوۡٓاٰۤی اَنۡ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ کَانُوۡا بِہَا یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿٪۱۰﴾
শেষ পর্যন্ত যারা অসৎকাজ করেছিল তাদের পরিণাম হয়েছিল বড়ই অশুভ, কারণ তারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলেছিল এবং তারা সেগুলোকে বিদ্রূপ করতো।
৩০:১১
اَللّٰہُ یَبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُہٗ ثُمَّ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۱۱﴾
আল্লাহ্ সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তিনি এর পুনরাবৃত্তি করবেন , তারপর তোমাদেরকে তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তন করানো হবে।
৩০:১২
وَ یَوۡمَ تَقُوۡمُ السَّاعَۃُ یُبۡلِسُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ ﴿۱۲﴾
যেদিন কিয়ামত হবে সেদিন অপরাধীরা হতাশ হয়ে পড়বে।
৩০:১৩
وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّہُمۡ مِّنۡ شُرَکَآئِہِمۡ شُفَعٰٓؤُا وَ کَانُوۡا بِشُرَکَآئِہِمۡ کٰفِرِیۡنَ ﴿۱۳﴾
তাদের বানানো শরীকদের মধ্য থেকে কেউ তাদের সুপারিশ করবে না এবং তারা নিজেদের শরীকদের অস্বীকার করবে।
৩০:১৪
وَ یَوۡمَ تَقُوۡمُ السَّاعَۃُ یَوۡمَئِذٍ یَّتَفَرَّقُوۡنَ ﴿۱۴﴾
যেদিন কিয়ামত হবে সেদিন মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়বে।
৩০:১৫
فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَہُمۡ فِیۡ رَوۡضَۃٍ یُّحۡبَرُوۡنَ ﴿۱۵﴾
অতএব যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তারা জান্নাতে খোশহালে থাকবে।
৩০:১৬
وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا وَ لِقَآیِٔ الۡاٰخِرَۃِ فَاُولٰٓئِکَ فِی الۡعَذَابِ مُحۡضَرُوۡنَ ﴿۱۶﴾
আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার নিদর্শনাবলী ও পরলোকের সাক্ষাতকারকে মিথ্যা বলেছে তাদেরকে আযাবে হাজির রাখা হবে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# আখেরাতের পক্ষে একটি স্বতন্ত্র যুক্তি। এর অর্থ হচ্ছে যদি এরা বাইরে কোথাও দৃষ্টি দেবার পূর্বে নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতো তাহলে নিজেদের মধ্যেই এমন সব যুক্তি পেয়ে যেতো যা বর্তমান জীবনের পরে আর একটি জীবনের প্রয়োজনের সত্যতার প্রমাণ করতো। মানুষের এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাকে পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস থেকে আলাদা করেঃ

একঃ পৃথিবী ও তার পরিবেশের অসংখ্য জিনিস তার বশীভূত করে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলো ব্যবহার করার ব্যাপক ক্ষমতা তাকে দান করা হয়েছে।

দুইঃ নিজের জীবনের পথ বেছে নেবার জন্য তাকে স্বাধীন ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। ঈমান ও কুফরী, আনুগত্য ও বিদ্রোহ এবং সুকৃতি ও দুষ্কৃতির পথের মধ্য থেকে যে কোনো পথেই নিজের ইচ্ছামত সে চলতে পারে। সত্য ও মিথ্যা এবং সঠিক ও বেঠিক যে কোন পথই সে অবলম্বন করতে পারে। প্রত্যেকটি পথে চলার সুযোগ তাকে দেয়া হয়েছে এবং এ চলার জন্য সে আল্লাহর সরবরাহকৃত উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে পারে তা আল্লাহর আনুগত্যের বা তাঁর নাফরমানির যে কোন পথই হোক না কেন।

তিনঃ তার মধ্যে জন্মগতভাবে নৈতিকতার অনুভূতি রেখে দেয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে সে ইচ্ছাকৃত কাজ ও অনিচ্ছাকৃত কাজের মধ্যে ফারাক করে, ইচ্ছাকৃত কাজকে সৎকাজ ও অসৎকাজ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে এই মত অবলম্বন করে যে, সৎকাজ পুরস্কার লাভের এবং অসৎকাজ শাস্তি লাভের যোগ্য হওয়া উচিত।

মানুষের নিজের সত্তার মধ্যে এই যে তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় এগুলো একথাই প্রমাণ করে যে, এমন কোন সময় আসা উচিত যখন মানুষের সমস্ত কাজের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তাকে দুনিয়ায় যা কিছু দেয়া হয়েছিল তা ব্যবহার করার ক্ষমতাকে সে কিভাবে কাজে লাগিয়েছে? যখন দেখা যাবে, নিজের নির্বাচনের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে সে সঠিক পথ অবলম্বন করেছে, না ভুল পথ? যখন তাঁর ঐচ্ছিক কার্যাবলী যাচাই করা হবে এবং সৎকাজে পুরস্কার ও অসৎকাজে শাস্তি দেয়া হবে। একথা সুনিশ্চিত যে, মানুষের জীবনের কার্যাবলী শেষ হবার এবং তার কর্মদপ্তর বন্ধ হয়ে যাবার পরই এ সময়টি আসতে পারে, তার আগে আসতে পারে না। আর এ সময়টি অবশ্যই এমন সময় আসা উচিত যখন এক ব্যক্তি বা একটি বা জাতির নিজের কার্যাবলীর মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে যেসব প্রভাব বিস্তার করে যায় উক্ত ব্যক্তি বা জাতির মৃত্যুতে তার ধারাবাহিকতা খতম হয়ে যায় না। তার রেখে যাওয়া ভালো বা মন্দ প্রভাবও তো তার আমলনামায় লিখিত হওয়া উচিত। এ প্রভাবগুলো যে পর্যন্ত না পুরোপুরি প্রকাশ হয়ে যায় সে পর্যন্ত ইনসাফ অনুযায়ী পুরোপুরি হিসেব-নিকেশ করা এবং পুরোপুরি পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া কেমন করে সম্ভব? এভাবে মানুষের নিজের অস্তিত্ব একথার সাক্ষ্য পেশ করে এবং পৃথিবীতে মানুষকে যে মর্যাদা দান করা হয়েছে তা স্বতঃস্ফুর্তভাবেএ দাবী করে যে, দুনিয়ার বর্তমান জীবনের পরে আর একটি জীবন এমন হতে হবে যেখানে আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে, ইনসাফ সহকারে মানুষের জীবনের সমস্ত কার্যাবলীর হিসেব-নিকেশ করা হবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কৃতকর্ম অনুসারে প্রতিদান দেয়া হবে।
# এ বাক্যে আখেরাতের সপক্ষে আরো দু’টি যুক্তি পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মানুষ যদি নিজের অস্তিত্বের বাইরে বিশ্ব ব্যবস্থাকে গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে তাহলে দু’টি সত্য সুস্পষ্টভাবে তাঁর দৃষ্টিগোচর হবেঃ

একঃ এ বিশ্ব-জাহানকে যথার্থ সত্যের ভিত্তিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা কোন শিশুর খেলা নয়। নিছক মন ভুলাবার জন্য নিজের খেয়ালখুশি মতো সে উল্টা পাল্টা ধরনের যে কোন রকমের একটা ঘর তৈরি করেনি যা তৈরি করা ও ভেঙ্গে ফেলা দুটোই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। বরং এটি একটি দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা। এর প্রতিটি অণু ও পরমাণু এ কথারই সাক্ষ্য দিয়ে চলছে যে, একে পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সহকারে তৈরি করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে একটি আইন সক্রিয় রয়েছে। এর প্রত্যেকটি জিনিসই উদ্দেশ্যমুখি। মানুষের সমগ্র সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থ ব্যবস্থা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান একথারই সাক্ষ্যবহ। দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসের পেছনে সক্রিয় নিয়ম-নীতি উদ্ভাবন করে এবং প্রত্যেকটি বস্তু যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তা অনুসন্ধান করেই মানুষ এখানে এ সবকিছু তৈরি করতে পেরেছে। অন্যথায় যদি একটি অনিয়মতান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যহীন খেলনার মধ্যে একটি পুতুলের মতো তাকে রেখে দেয়া হতো, তাহলে কোনো প্রকার বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা কল্পনাই করা যেতে না। এখন যে জ্ঞানবান সত্ত্বা এহেন প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্যমুখিতা সহকারে এ দুনিয়া তৈরি করেছেন এবং এর মধ্যে মানুষের মতো একটি সৃষ্টিকে সর্ব পর্যায়ের বৃদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক শক্তি, ক্ষমতা ও ইখতিয়ার, স্বাধীন নির্বাচনক্ষমতা ও নৈতিক অনুভূতি দিয়ে নিজের দুনিয়ার অসংখ্য সাজ-সরঞ্জাম তার হাতে সঁপে দিয়েছেন, তিনি মানুষকে উদ্দেশ্যবিহীন সৃষ্টি করেছেন একথা কেমন করে তোমাদের বোধগম্য হলোঃ তোমরা কি দুনিয়ার ভাঙ্গা ও গড়া, সুকৃতি ও দুষ্কৃতি, জুলুম ও ইনসাফ এবং ন্যায় ও অন্যায়ের যাবতীয় কাজ কারবার করার পর এমনিই মরে মাটিতে মিশে যাবে এবং তোমাদের কোন ভালো বা মন্দ কাজের কোন ফলাফল দেখা যাবে না? তোমরা কি নিজেদের এক একটি কাজের মাধ্যমে তোমাদের ও তোমাদের মতো হাজার হাজার মানুষের জীবনের ওপর এবং দুনিয়ার অসংখ্য জিনিসের ওপর বহুতর শুভ ও অশুভ প্রভাব বিস্তার করে চলে যাবে এবং তোমাদের মৃত্যুর পর পরই এই সমগ্র কর্মদপ্তরকে এমনি গুটিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করে দেয়া হবে?

এ বিশ্ব ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণ করার পর দ্বিতীয় সত্যটি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে সেটি হচ্ছে, এখানে কোন জিনিসই চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেকটি জিনিসের একটি নির্ধারিত জীবনকাল রয়েছে। সেখানে পৌঁছে যাবার পর তা শেষ হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ব্যাপারেও একথাই সত্য। এখানে যতগুলো শক্তিই কাজ করছে তারা সবই সীমাবদ্ধ। একটি সময় পর্যন্ত তারা কাজ করছে। কোনো এক সময় তারা অবশ্যই নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং এ ব্যবস্থাটি খতম হয়ে যাবে। প্রাচীনকালে যেসব দার্শনিক ও বিজ্ঞানী দুনিয়াকে আদি ও চিরন্তন বলে প্রচার করতো তাদের বক্তব্যও তবুও তো সর্বব্যাপী অজ্ঞতা ও মূর্খতার দরুন কিছুটা স্বীকৃতি লাভ করতো কিন্তু দীর্ঘকাল ব্যাপী নাস্তিক্যবাদী ও আল্লাহ‌ বিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্ব-জগতের নশ্বরতা ও অবিনশ্বরতা নিয়ে যে বিতর্ক চলে আসছিল, আধুনিক বিজ্ঞান প্রায় চূড়ান্তভাবেই সে ক্ষেত্রে নিজের ভোটটি আল্লাহ‌ বিশ্বাসীদের পক্ষে দিয়ে দিয়েছে। কাজেই বর্তমানে নাস্তিক্যবাদীদের পক্ষে বুদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের নাম নিয়ে এ দাবী উত্থাপন করার কোনো অবকাশই নেই যে, এ দুনিয়া চিরকাল আছে, চিরকাল থাকবে এবং কিয়ামত কোনো দিন আসবে না। পুরাতন বস্তুবাদীতার যাবতীয় ভিত্তি এ চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, বস্তুর বিনাশ নেই, কেবলমাত্র রূপান্তর ঘটতে পারে। তখনকার চিন্তা ছিল, প্রত্যেক পরিবর্তনের পর বস্তু বস্তুই থেকে যায় এবং তার পরিমাণ কোনো কম বেশি হয় না। এরই ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত শোনানো হতো যে, এ বস্তুজগতের কোন আদি অন্ত নেই। কিন্তু বর্তমানে আণবিক শক্তি (Atomic Energy) আবিষ্কারের ফলে এ সমগ্র চিন্তার ধারাই উলটে গেছে। এখন একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শক্তি বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে এবং বস্তু আবার শক্তিরূপে আত্নপ্রকাশ করে, এমন কি শেষ পর্যন্ত তার আকৃতিও থাকে না। ভৌতিক অবস্থানও থাকে না। এখন তাপের গতির দ্বিতীয় আইন (second law of thermo-dynamics) একথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এ বস্তুজগত না অনাদি হতে পারে, না অনন্ত। অবশ্যই এক সময় এর শুরু এবং এক সময় শেষ হতে হবে। তাই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে বর্তমানে কিয়ামত অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আর একথা সুস্পষ্ট যে, বিজ্ঞান যদি আত্মসমর্পণ করে তবে দর্শন কিসের ভিত্তিতে কিয়ামত অস্বীকার করবে?
# মৃত্যুর পর নিজের রবের সামনে হাজির হতে হবে, একথা বিশ্বাস করে না।
# আখেরাতের পক্ষে এটি একটি ঐতিহাসিক যুক্তি। এর অর্থ হচ্ছে, কেবল দুনিয়ার দু’চারজন লোকই তো আখেরাত অস্বীকার করেনি বরং মানব ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিপুল সংখ্যক মানুষকে এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। বরং অনেক জাতির সমস্ত লোকই আখেরাত অস্বীকার করেছে অথবা তা থেকে গাফিল হয়ে গেছে কিংবা মৃত্যু পরের জীবন সম্পর্কে এমন মিথ্যা বিশ্বাস উদ্ভাবন করে নিয়েছে যার ফলে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস অর্থহীন হয়ে গেছে। তারপর ইতিহাসের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা একথা জানিয়ে দিয়েছে যে, যেভাবেই আখেরাত অস্বীকার করা হোক না কেন, তার অনিবার্য ফল স্বরূপ মানুষের নৈতিক চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তারা নিজেদেরকে দায়িত্বহীন মনে করে লাগামহীন ও স্বেচ্ছাচারীতে পরিণত হয়েছে। তারা জুলুম, বিপর্যয়, ফাসেকী ও অশ্লীল আচরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ জিনিসটির বদৌলতে জাতিসমূহ একের পর এক ধ্বংস হতে থেকেছে। হাজার বছরের ইতিহাসে মানব বংশ একের পর এক যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তা কি একথা প্রমাণ করে না যে, আখেরাত একটি সত্য, যা অস্বীকার করা মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বস্তুকে সবসময় মাটির দিকে নেমে আসতে দেখেছে বলেই সে ভারী জিনিসের আকর্ষণ স্বীকার করে। সে বিষ খেয়েছে সে-ই মারা পড়েছে, এ জন্যই মানুষ বিষকে বিষ বলে মানে। অনুরূপভাবে আখেরাত অস্বীকার যখন চিরকাল মানুষের নৈতিক বিকৃতির কারণ প্রমাণিত হয়েছে তখন এ অভিজ্ঞতা কি এ শিক্ষা দেবার জন্য যথেষ্ট নয় যে, আখেরাত একটি জাজ্বল্যমান সত্য এবং তাকে বাদ দিয়ে দুনিয়ার জীবন যাপন করা ভুল?

টিকা:৯) মূল শব্দ হচ্ছে وَأَثَارُوا الْأَرْضَ কৃষিকাজ করার জন্য লাঙ্গল দেয়া অর্থেও এ শব্দের ব্যবহার হতে পারে আবার মাটি খুঁড়ে ভূগর্ভ থেকে পানি উঠানো, খাল খনন এবং খনিজ পদার্থ ইত্যাদি বের করাও হয়।
# যারা নিছক বস্তুগত উন্নতিকে একটি জাতির সৎ হবার আলামত মনে করে এখানে তাদের যুক্তির জবাব রয়েছে। তারা বলে যারা পৃথিবীর উপায়-উপকরণকে এত বিপুল পরিমাণে ব্যবহার (Exploit) করেছে তারা দুনিয়ার বিরাট উন্নয়নমূলক কাজ করেছে এবং একটি মহিমান্বিত সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। কাজেই মহান আল্লাহ‌ তাদেরকে জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত করবেন এটা কেমন করে সম্ভব! কুরআন এর জবাব এভাবে দিয়েছে “এমন উন্নয়নমূলক কাজ” পূর্বেও বহু জাতি বিরাট আকারে করেছে। তারপর কি তোমরা দেখনি সে জাতিগুলো তাদের নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি সহকারে ধূলায় মিশে গেছে এবং তাদের “উন্নয়নের” আকাশচুম্বি প্রাসাদ ভুলুণ্ঠিত হয়েছে? যে আল্লাহর আইন ইহজগতে সত্যের প্রতি বিশ্বাস ও সৎ চারিত্রিক গুণাবলী ছাড়া নিছক বস্তুগত নির্মাণের এরূপ মূল্য দিয়েছে সে একই আল্লাহর আইন কি কারণে পারলৌকিক জগতে তাকে জাহান্নামে স্থান দেবে না?
# এমন নিদর্শনাবলী নিয়ে যা তাদেরকে সত্য নবী হবার নিশ্চয়তা দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। এখানকার পূর্বাপর আলোচনার প্রেক্ষাপট নবীদের আগমনের কথা উল্লেখ করার অর্থ হচ্ছে এই যে, একদিকে মানুষের নিজের অস্তিত্বের মধ্যে, এর বাইরে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থায় এবং মানুষের ইতিহাসের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় আখেরাতের সাক্ষ্য বিদ্যমান ছিল। অন্যদিকে একের পর এক নবীগণ এসেছেন। তাদের সাথে তাদের নবুওয়াত সত্য হবার সুস্পষ্ট আলামত পাওয়া যেতো এবং যথার্থই আখেরাতের আগমন সম্পর্কে তারা মানুষকে সতর্কও করতেন।
# এরপর এ জাতিগুলো যে ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে তা তাদের ওপর আল্লাহর জুলুম ছিল না বরং তা ছিল তাদের নিজেদের জুলুম। এসব জুলুম তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর করেছিল। যে ব্যক্তি বা দল নিজে সঠিক চিন্তা করে না এবং অন্যের বুঝিয়ে দেবার পরও সঠিক নীতি অবলম্বন করে না সে নিজেই নিজের অশুভ পরিণামের জন্য দায়ী হয়। এ জন্য আল্লাহকে দোষারোপ করা যেতে পারে না। আল্লাহ‌ নিজের কিতাব ও নবীগণের মাধ্যমে মানুষকে সত্যের জ্ঞানের সত্যতা যাচাই করতে পারে। এ পথনির্দেশনা এবং উপকরণাদি থেকে আল্লাহ‌ যদি মানুষকে বঞ্চিত করে থাকতেন এবং সে অবস্থায় মানুষকে ভুল পথে যাবার ফল পেতে হতো তাহলে নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিরুদ্ধে জুলুমের দোষারোপ করার অবকাশ সৃষ্টি হতে পারতো।
# কথাটি দাবীর ভঙ্গিতে বলা হলেও দাবীর স্বপক্ষে যুক্তিও এর মধ্যে রয়ে গেছে। সুস্পষ্ট বুদ্ধিবৃত্তি একথার সাক্ষ্য দিয়ে থাকে যে, সৃষ্টির সূচনা করা যার পক্ষে সম্ভবপর তাঁর পক্ষে একই সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি করা আরো ভালোভাবেই সম্ভবপর। সৃষ্টির সূচনা তো একটি বাস্তব সত্য, বিষয়টি সবার সামনেই রয়েছে। কাফের ও মুশরিকরাও এটাকে আল্লাহর কাজ বলে স্বীকার করে। এরপর যে আল্লাহ‌ এ সৃষ্টির সূচনা করেন তিনি এর পুনরাবৃত্তি করতে পারেন না, তাদের এ চিন্তা একেবারেই অর্থহীন ও অযৌক্তিক।
# আল্লাহর দিকে ফিরে যাবার এবং তাঁর সামনে উপস্থিত হবার সময়।
# মূল শব্দ হচ্ছে اِبْلَاس এর অর্থ হচ্ছে চরম হতাশা ও দুঃখ-বেদনার কারণেকোন ব্যক্তির একেবারে হতবাক ও স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। আশার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেখে বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে যাওয়া এবং কোনো যুক্তি ও সমর্থন না পাওয়ার কারণে রুদ্ধশ্বাস হওয়া। এ শব্দটি যখন অপরাধীর জন্য ব্যবহার করা হয় তখন মনের পাতায় তার যে ছবি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তিকে অপরাধ করার সময় হাতে নাতে পাকড়াও করা হয়েছে। সে পালাবার কোন পথ পাচ্ছে না এবং নিজের সাফাই গাইবার জন্য কোন জিনিস পেশ করে বের হয়ে আসার আশাও রাখে না। তাই তার কণ্ঠরুদ্ধ এবং চরম হতাশা ও মনমরা অবস্থায় সে অবাক বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত একথাটাও উপলব্ধি করতে হবে যে, এখানে অপরাধী বলতে কেবল দুনিয়ায় যারা হত্যা, চুরি, ডাকাতি ও এ ধরনের অন্যান্য অপরাধ করে তাদের কথা বলা হয়নি বরং এমন সব লোকের কথা এখানে বলা হয়েছে যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, তাঁর রসূলদের শিক্ষা ও পথনির্দেশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে এবং আখেরাতে জবাবদিহি করার কথা অস্বীকার করে অথবা সে ব্যাপারে নির্বিকার থেকে এবং দুনিয়ায় আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদের অথবা নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করতে থেকেছে। এ মূল ভ্রষ্টতার সাথে সাধারণ্যে অপরাধ বলা হয়ে থাকে এমন কাজ তারা করলেও বা না করলেও কিছু আসে যায় না। এছাড়াও এমনসব লোকও এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে যারা আল্লাহকে মেনে নিয়ে তাঁর রসূলদের প্রতি ঈমান এনে আখেরাতকে স্বীকার করে নিয়ে তারপর আবার জেনে বুঝে নিজেদের রবের নাফরমানী করেছে এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেদের বিদ্রোহী নীতিতে অবিচল থেকেছে। এরা নিজেদের প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীতে আখেরাতের জগতে হঠাৎ করে জেগে উঠবে এবং দেখবে, সত্যিই তো এখানে সেই পরবর্তী জীবন শুরু হয়ে গেছে, যা অস্বীকার করে অথবা যাকে উপেক্ষা করে তারা দুনিয়ার কাজ করতো। তখন তাদের বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে যাবে এবং তাদের ওপর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যাবে يُبْلِسُ الْمُجْرِمُونَ বাক্যাংশে যার ছবি অংকন করা হয়েছে।
# তিন ধরনের সত্তার ওপর শরীক শব্দটির প্রয়োগ হয়। এক, ফেরেশতা, নবী, আউলিয়া, শহীদ ও পুণ্যবান লোক। মুশরিকরা বিভিন্ন যুগে এদেরকে আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতার অধিকারী গণ্য করে এদের সামনে বন্দেগী ও পূজার যাবতীয় অনুষ্ঠান পালন করতো। কিয়ামতের দিন তারা পরিষ্কার বলে দেবে, এসব কিছু করেছো তোমরা আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বরং আমাদের শিক্ষা ও পথনির্দেশের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করে। তাই তোমাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তোমাদের শাফাআতের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে আমরা কিছু আবেদন নিবেদন করবো, এ আশা আমাদের ব্যাপারে করো না। দুই, এমন সব জিনিস যেগুলোর চেতনা নেই অথবা প্রাণ নেই। যেমনঃ চাঁদ, সূর্য, তারকা, গাছ, পাথর ও পশু ইত্যাদি। মুশরিকরা তাদেরকে খোদায় পরিণত করে, এদের পূজা-উপাসনা করে এবং এদের কাছে প্রার্থনা নিবেদন করে। কিন্তু এই জড় ও নির্জীব জিনিসগুলো একথা জানতেই পারে না যে, আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষ এসব নজরানা তাদের জন্য উৎসর্গ করছে। একথা সুস্পষ্ট যে, এদের মধ্যে একজনও তাদের সুপারিশের জন্য সামনে অগ্রসর হবে না। তিন, এমন সব বড় বড় অপরাধী যারা নিজেরাই চেষ্টা করে, ধোঁকা ও প্রতারণার পথ অবলম্বন করে, মিথ্যার জাল ছড়িয়ে দিয়ে অথবা শক্তি প্রয়োগ করে দুনিয়ায় আল্লাহর বান্দাদের থেকে নিজেদের বন্দেগী ও পূজা আদায় করে নিয়েছে। যেমন শয়তান, ভণ্ড ও ধর্মীয় নেতা এবং জালেম ও স্বৈরাচারী শাসনকর্তা ইত্যাদি। এরা সবাই সেখানে বিপদের শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িতে থাকবে। নিজেদের এ ভক্তবৃন্দের সুপারিশের সামনে অগ্রসর হওয়া তো দূরের কথা বরং তারা নিজেদের আমলনামার বোঝা হালকা করার চেষ্টা করতে থাকবে। হাশরের ময়দানে তারা একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে থাকবে যে, এদের অপরাধের জন্য এরা নিজেরাই দায়ী এবং এদের পথভ্রষ্টতার জন্য আমাদের দুর্ভোগ পোহানো উচিত নয়। এভাবে মুশরিকরা সেখানে কোনো দিক থেকে কোনো প্রকার শাফাআত লাভ করতে সক্ষম হবে না।
# সে সময় মুশরিকরা একথা স্বীকার করবে যে, তাদেরকে আল্লাহর শরীক করে তারা ভুল করেছিল। প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্য থেকে কারো আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বে কোনো অংশ নেই, এ সত্যটি তখন তাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে। তাই দুনিয়ায় আজ তারা যে শিরকের ওপর টিকে থাকার জন্য চাপ দিচ্ছে আখেরাতে তাকেই অস্বীকার করবে।
# দুনিয়ায় আজ জাতি, বংশ, গোত্র, স্বদেশ, ভাষা, পরিবার এবং অর্থনৈতিক রাজনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যতগুলো দলীয় বিভক্তি রয়েছে এসবই সেদিন ভেঙ্গে পড়বে। নির্ভেজাল আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে নতুন করে এখন ভিন্নতর দল গঠিত হবে। একদিকে সমগ্র মানব জাতির পূর্বের ও পরের সমগ্র প্রজন্মের মধ্য থেকে মু’মিন ও সৎ লোকদেরকে ছেঁটে আলাদা করে নেয়া হবে এবং তাদের সবাই হবে একটি দলভুক্ত। অন্যদিকে এক ধরনের ভ্রান্ত মতবাদ ও বিশ্বাস পোষণকারী এবং এক এক ধরনের অপরাধী মানুষদেরকে সেই বিশাল জনসমুদ্র থেকে ছাঁটাই বাছাই করে আলাদা করে নেয়া হবে এবং তাদের পৃথক পৃথক দল সৃষ্টি হয়ে যাবে। অন্য কথায় এভাবে বলা যায়, ইসলাম যেসব জিনিসকে এ দুনিয়ায় বিভেদ অথবা ঐক্যের ভিত্তি গণ্য করে এবং যেগুলোকে জাহেলিয়াত পন্থীরা এখানে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে, আখেরাতে তারই ভিত্তিতে বিভেদও হবে আবার ঐক্যও।

ইসলাম বলে, মানুষদেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করার এবং পরস্পরের সাথে জুড়ে দেবার আসল জিনিস হচ্ছে তাঁর আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক চরিত্র। যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর নির্দেশের ওপর তাদের জীবন ব্যবস্থার ভিত গড়ে তোলে তারা সবাই একই দলভুক্ত। তাদের সম্পর্ক বিভিন্ন বংশ ও দেশের সাথেও হতে পারে। অন্যদিকে কুফরী ও ফাসেকীর পথ অবলম্বনকারীরা অন্য একটি দলভুক্ত। তাদের সম্পর্ক যে কোনো বংশ ও দেশের সাথেও হতে পারে। এদের উভয়ের জাতীয়তা এক হতে পারে না। এরা দুনিয়ায় সম্মিলিতভাবে একক জীবনপথ নির্মাণ করে তার ওপর একসাথে চলতে পারে না। ওদিকে আখেরাতেও তাদের পরিণাম একই রকম হতে পারে না। দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত তাদের পথ ও মনযিল পরস্পর থেকে আলাদা হয়। পক্ষান্তরে জাহেলিয়াতপন্থীরা প্রত্যেক যুগে এ ব্যাপারে জোর দিতে থেকেছে এবং আজও তারা এ ব্যাপারে অবিচল যে, বংশ, দেশ ও ভাষার ভিত্তিতে মানুষের দলবদ্ধ হওয়া উচিত। যাদের মধ্যে এ ভিত্তিগুলোর ব্যাপারে একাত্মতা রয়েছে তাদের ধর্ম ও আকীদা-বিশ্বাসের বিভিন্নতা সত্ত্বেও এক জাতিতে পরিণত হয়ে এমনি ধরনের অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়া উচিত এবং জাতীয়তাবাদের এমন একটি জীবন ব্যবস্থা থাকা উচিত যেখানে তাওহীদ, শিরক ও নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসীরা সবাই একসাথে চলতে পারে। এটিই ছিল আবু জেহেল, আবু লাহাব ও কুরাইশ সরদারদের চিন্তাধারা। তারা বারবার মুহাম্মাদ ﷺ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছিল যে, এ ব্যক্তি এসে আমাদের জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কুরআন মাজীদ এখানে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করছে যে, এ দুনিয়ার মিথ্যার ভিত্তিতে তোমরা এই যেসব দল গঠন করেছো এগুলো সবই শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পড়বে। ইসলাম দুনিয়ার এ জীবনে যে বিশ্বাস জীবনাদর্শ ও নৈতিক চরিত্রের ভিত্তিতে পার্থক্য সৃষ্টি করতে চায় মানব জাতির মধ্যে তারি ভিত্তিতে স্থায়ী পার্থক্য গড়ে উঠবে। যাদের গন্তব্য এক নয় তাদের জীবনের পথই বা কেমন করে এক হতে পারে।
# ‘একটি বাগান’ একথাটি এখানে বাগানের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষার মতো আমাদের ভাষায়ও একটি পরিচিত বর্ণনাভঙ্গী রয়েছে।কোন ব্যক্তি কাউকে কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে বলে এবং একই সঙ্গে একথাও বলে, যদি তুমি একাজটি করে দাও তাহলে আমি তোমাকে একটি জিনিস দেবো। এখানে একটি জিনিসের অর্থ এ হয় না যে, সংখ্যার দিক দিয়ে তা একটিই হবে। বরং এর উদ্দেশ্য হয়, এর পুরস্কারস্বরূপ তোমাকে একটি অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস দেবো, যা পেয়ে তুমি আনন্দে উৎফুল্ল হবে।
# এখানে يُحْبَرُونَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আনন্দ, স্বাদ, আড়ম্বর, জাঁকজমক ও মর্যাদার ধারণা এর অর্থের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ সেখানে অত্যন্ত মর্যাদা সহকারে রাখা হবে, আনন্দে ও আরাম-আয়েশে থাকবে এবং সব রকম ভোগে পরিতৃপ্ত হবে।
# একথাটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য যে, ঈমানের সাথে সৎকাজের কথা বলা হয়েছে, যার ফলে মানুষ মহান মর্যাদা সম্পন্ন পরিণামফল ভোগ করবে। কিন্তু কুফরীর অশুভ পরিণাম বর্ণনা প্রসঙ্গে অসৎকাজের কোনো বর্ণনা দেয়া হয়নি। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় যে, মানুষের পরিণাম নষ্ট করার জন্য কুফরীই যথেষ্ট। অসৎকাজের সাথে তার শামিল হওয়ায় বা না হওয়ায় কিছু যায় আসে না।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
আর যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিজয়ের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন সেই বৃহত্তম সত্যের সাথে যুক্ত যার ওপর এই সৃষ্টি জগত প্রতিষ্ঠিত এবং যেহেতু আখেরাতের ব্যাপারটাও এই মহাসত্যের সাথে যুক্ত, সেহেতু পরবর্তী আয়াতে এই বিশ্বজগতের প্রতি আরেকবার মানুষের পর্যবেক্ষণমূলক দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। মানুষকে আরাে একবার আকাশ, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যবর্তী যাবতীয় সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করতে এবং তার নিজের সৃষ্টি বৈচিত্র্য সম্পর্কেও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, যাতে সে সেই বৃহত্তম সত্যকে উপলব্ধি করে। কেননা তারা আখেরাত ও রসূল প্রদত্ত দাওয়াতের প্রতি যখন উদাসীন হয়, তখন এই মহাসত্যকেও অবজ্ঞা অবহেলা করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা কি তাদের নিজেদের সত্ত্বা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে না…'(আয়াত -৮) অর্থাৎ তারা স্বয়ং এবং তাদের চারপাশের অন্যান্য যাবতীয় সৃষ্টি যেভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে, তাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, এই বিশ্বজগত প্রাকৃতিক সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আবহমানকাল ধরে তা নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে চলছে। কখনাে তাতে কোনাে গােলযােগ ঘটে না। কখনাে তার নিয়মে পরিবর্তন আসে না। কখনাে তার আগমন নির্গমনের সময় পিছিয়ে যায় না। কখনাে একটার সাথে অন্যটার সংঘর্ষ হয় না। সব সময় সূক্ষ্মভাবে, সঠিকভাবে ও পরিকল্পিতভাবে তার ব্যবস্থা চলে। বিশ্বজগত যে মহাসত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ও চলছে, তার স্বাভাবিক দাবী এই যে, পরবর্তী এমন একটা জগত ও জীবন থাকা অপরিহার্য, যেখানে কর্মফল দেয়া হবে এবং সৎ ও অসৎ কাজের পূর্ণ ফল বা প্রতিদান পাওয়া যাবে। বস্তুত এ বিশ্বের প্রতিটা জিনিসের সুনির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল রয়েছে, প্রত্যেকের আয়ুষ্কাল সুপরিকল্পিত ও মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত। এখানে সব কিছুই নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে। এক মুহূর্তও আগে বা পিছে ঘটে না। আর মানুষ যদি নাও জানে কবে কেয়ামত হবে, তবু তার অর্থ এ নয় যে, কেয়ামত কখনাে হবে না। যারা দুনিয়ার বাহ্যিক দিক সম্পর্কেই শুধু জানে এবং তা নিয়েই বিভাের থাকে, কেয়ামতের ও আখেরাতের অনির্দিষ্টতা তাদের প্রতারিত করে এবং তারা মনে করে, তাদের কখনাে আল্লাহর মুখােমুখি হতে হবে না। উপরোক্ত আয়াতে (৮ নং) আকাশ, পৃথিবী ও এই দু’য়ের মধ্যবর্তী যাবতীয় সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানানাে হয়েছে। মহাবিশ্ব, তার ভেতরকার রকমারি সৃষ্টি, বস্তু ও প্রাণী, আকাশ ও জ্যোতিঙ্কমন্ডলী, নক্ষত্র ও গ্রহ-উপগ্রহ, বড় ও ছােট, গােপন ও প্রকাশ্য এবং জানা অজানা অসংখ্য সৃষ্টি এ পর্যবেক্ষণের আওতায় এসে যায়। এই ব্যাপকতা পর্যবেক্ষণের পর পরবর্তী আয়াতে (৯ নং) ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানানাে হয়েছে। এসব অধ্যায়ে আল্লাহর চিরাচরিত প্রাকৃতিক বিধানের কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এই বিধান কখনাে একবারের জন্যেও নিস্ক্রিয় হয় না, কার্যকারিতার সময় পিছিয়ে যায় না কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট হয় না। ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে তো দেখতে পেতাে তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণতি হয়েছিলাে…'(আয়াত ৯ ও ১০) অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলাের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করার আহ্বান জানানাে হয়েছে এ আয়াতে। তারা তাে অতীতের অন্যান্য মানুষের মতােই। তাদের পরিণতি থেকেই জানা যায় তাদের উত্তরাধিকারীদের পরিণাম কী হতে পারে। আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান সবার ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযােজ্য। এ বিধান একটা চিরস্থায়ী সত্য এবং এর ওপরই মহাবিশ্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এ সত্য মানব জাতির কোনাে বিশেষ প্রজন্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে না, কিংবা কারাে প্রতি অযথা এমন ভাবাবেগও প্রদর্শন করে না যা স্বতই পরিবর্তনশীল। সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালকের এমন কোনাে পক্ষপাতদুষ্ট বা বৈষম্যমূলক আচরণ করার কথা কল্পনাও করা যায় না। এ দুটো আয়াতে পার্থিব জীবনের প্রকৃত স্বরূপ, যুগ যুগ ধরে তার সাথে সংযুক্ত অন্যান্য বিষয় এবং সর্বকালের মানুষের উৎস ও পরিণতি যে একই হয়ে থাকে, সে কথা উপলব্ধি করার আহ্বান জানানাে হয়েছে। এর উদ্দেশ্য এই যে, মানব জাতির কোনাে প্রজন্ম যেন নিজের জীবন, ধ্যান ধারণা ও মূল্যবােধ সম্পর্কে একপেশে বিচ্ছিন্ন অবস্থান গ্রহণ না করে এবং এ কথা ভুলে না যায় যে, মানব জাতির সকল প্রজন্মের সাথে তার সংযােগ সম্পর্ক রয়েছে, এই সকল মানব প্রজন্মগুলাের ভাগ্য যে প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে নির্ধারিত হয়, সেই প্রাকৃতিক বিধান এক ও অভিন্ন এবং সকল প্রজন্মের জীবনে কার্যকর স্থায়ী মূল্যবােধগুলােও এক অভিন্ন। ‘এসব ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি রসূল(স.)-এর সময়কার মােশরেকদের পূর্বে মক্কায় বসবাস করতাে। তারা ওদের চেয়েও শক্তিশালী ছিলাে’, ‘আর তারা যমীন চাষ করতাে।’ অর্থাৎ যমীন চাষ করে তার ভেতর থেকে সম্পদ আহরণ করতাে। তারা পৃথিবীকে ওদের চেয়ে বেশী গড়েছিলাে।’ অর্থাৎ আরবদের চেয়েও তারা অধিকতর সভ্য ছিলাে এবং তাদের চেয়েও বেশী গঠনমূলক কাজ করতে সক্ষম ছিলাে। এর পর তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক অংশ নিয়েই সন্তুষ্ট রইলাে এবং আখেরাত সম্পর্কে জানতে চাইলাে না। ‘তাদের কাছে রাসূলের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছিলাে।’ অর্থাৎ তারা এসব সুস্পষ্ট নিদর্শন গ্রাহ্য করলাে না এবং ঈমানও আনলাে না। ফলে তাদের বিবেক সেই আলাের অধিকারী হলাে না, যা দিয়ে সঠিক পথ দেখা ও চেনা যায়। তাই আল্লাহ তায়ালা নবীদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের ক্ষেত্রে আল্লাহর যে শাশ্বত বিধান কার্যকরি হয়ে থাকে, তাদের ওপরও তাই হলাে। তাদের এতাে শক্তি ও সহায় সম্পদ কোনাে কাজে লাগলাে না, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সবই বিফলে গেলাে। তারা তাদের আচরণের সমুচিত ফল পেলাে, তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা কোনাে অত্যাচার করেননি; বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছিলাে। ‘অতপর অসৎ কর্মকারীদের পরিণাম হলাে খুবই খারাপ।’ এই খারাপ পরিণাম অসৎ কর্মকারীদের সমুচিত ও সুযােগ্য শাস্তি। কেননা তারা আল্লাহর আয়াতগুলাে অমান্য করেছে এবং তার প্রতি বিদ্রুপ করেছে। আল্লাহর আয়াতগুলাে প্রত্যাখ্যানকারী ও আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের উপাসনাকারীদের পৃথিবীর নানা জায়গায় ভ্রমণ করার জন্যে কোরআন আহ্বান জানায়, যাতে তারা নিজ নিজ স্থানে কচ্ছপের মতাে অবরুদ্ধ হয়ে না যায় এবং পূর্ববর্তী প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণাম দেখে যেন শিক্ষা গ্রহণ করে এবং উপলব্ধি করে যে, আল্লাহর নীতি ও বিধান এক, তিনি কাউকে স্বজনপ্রীতি বা পক্ষপাতিত্ব দেখান না। কোরআন এ আহ্বান জানায় এ জন্যে, যেন তারা বুঝতে পারে যে, মানব জাতি জন্মগতভাবে এক জাতি, আল্লাহর নবীদের দাওয়াত চিরকাল এক ও অভিন্ন এবং মানব জাতির সকল প্রজন্মের একই পরিণতি। এই চিন্তাধারাই ইসলাম মুসলমানদের বিবেকে বদ্ধমূল করে দিতে চায় এবং কোরআন এ বিষয়ে বার বার আহ্বান জানায়। বিশ্বজগত ও বিশ্ব ইতিহাস পর্যবেক্ষণের এই দুটো আহ্বান জানানাের পর মানুষকে সেই মূল তত্ত্বের দিকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে, যা সম্পর্কে অনেকেই উদাসীন। সেই মূলতত্ত্ব হলাে আখেরাত বা পরকাল। এটা হলাে মহাবিশ্ব যে মহাসত্যের ওপর দাড়িয়ে আছে, তারই একটা অংশ। ‘আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সূচনা করেন, পুনরায় তার পুনরাবৃত্তি করেন, পুনরায় তােমরা তার দিকে ফিরে যাবে।’ এটা একটা সহজ সরল তত্ত্ব। এর উভয় অংশের মধ্যে যোগাযোগ বা সমন্বয়ও সুস্পষ্ট। দ্বিতীয় বার সৃষ্টি করা প্রথম বারের সৃষ্টির মতােই। এতে অভিনবত্ব কিছু নেই। এ দুটো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত, বিচ্ছিন্ন নয়। আল্লাহই প্রথম বার সৃষ্টি করেছেন এবং দ্বিতীয় বারও তিনিই সৃষ্টি করবেন। প্রথম সৃষ্টির উদ্দেশ্য বান্দাদের শিক্ষা দেয়া ও লালন পালন করা, আর দ্বিতীয় সৃষ্টির উদ্দেশ্য বান্দাদের কর্মফল দান। পরকালের বিষয় আলােচনা করতে গিয়ে কেয়ামতের একটা দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে কেয়ামতের মাঠে একত্রিত হবার পর কাফের ও মােমেনদের শেষ পরিণতি দেখানাে হয়েছে এবং শরীক গ্রহণ ও মােশরেকদের ধ্যান ধারণা যে কত হাস্যকর, কলংকজনক তা তুলে ধরা হয়েছে। ‘যেদিন কেয়ামত হবে, অপরাধীরা হতাশ হবে…'(আয়াত ১২-১৬) এই সেই কেয়ামত, যার কথা অনেকেই ভুলে থাকে। আবার অনেকে অস্বীকারও করে। অথচ তা একদিন সংঘটিত হবেই । অপরাধীরা সেদিন হতভম্ব ও হতাশ হয়ে যাবে। মুক্তির কোনাে আশা তাদের থাকবে না। পৃথিবীতে যাদের তারা সুপারিশকারী মনে করতাে, তারাও কিছু করবে না। ফলে তারা নিরুপায় হয়ে যাবে। কেউ তাদের উদ্ধারকারী থাকবে না। যাদেরকে তারা পৃথিবীতে উপাসনা করতাে এবং বিশ্ব প্রভুর সাথে যাদের শরীক করতাে, তাদের সেদিন অস্বীকার করবে। সেদিন মােমেন ও কাফেরদের পথ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে, যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কাজ করেছে, তারা বাগানে আনন্দে মেতে থাকবে। সেখানে কেবল সুখ, শান্তি ও আনন্দের সামগ্রীই পাবে। পক্ষান্তরে যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতগুলাে ও আখেরাতের সাক্ষাতের কথা অস্বীকার করেছে, তাদের আযাবে উপস্থিত করা হবে। ওটাই চূড়ান্ত ফলাফল সকর্মশীল ও অসৎ কর্মশীলদের জন্যে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৮-১০ নং আয়াতের তাফসীর:

যারা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অস্বীকার করে, যারা বলে দুনিয়াই শেষ, পরকাল বলতে কিছু নেই; এসব বস্তুবাদীদের এমন বিশ্বাসকে দূরীভূত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একাকী গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করার দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা নিজেদের ব্যাপারে একটু চিন্তা করে দেখ না! তোমরা কিছুই ছিলে না, তোমাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের অস্তিত্ব দান করলেন, আস্তে আস্তে বড় করলেন অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে উপনীত করেছেন। এভাবে সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবেন? আকাশমণ্ডলী ও জমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সব কিছু আল্লাহ তা‘আলা যথাযথভাবে ও নির্ধারিত সময়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর যখন সে নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাবে তখন কিছুই বাকী থাকবে না, সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে, তোমরাও মারা যাবে। পরে দুনিয়ার কর্মের হিসাব দেয়ার জন্য পুনরুত্থিত করা হবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ পুনরুত্থানকে অবিশ্বাস করে, অসম্ভব মনে করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَا خَلَقْنَا السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لٰعِبِيْنَ مَا خَلَقْنٰهُمَآ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ مِيْقَاتُهُمْ أَجْمَعِيْنَ)

“আমি আকশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যস্থিত কোন কিছুই খেল-তামাশার ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এ দু‘টি যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই এটা জানে না। সকলের জন্য নির্ধারিত রয়েছে তাদের বিচার দিবস।” (সূরা দুখান ৪৪:৩৮-৪০)

এ সকল জিনিসই প্রমাণ করে সৃষ্টিকর্তা বলতে একজন রয়েছেন, তিনিই হলেন আল্লাহ তা‘আলা।

আর এসব সৃষ্টি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, যা প্রমাণ করে যেন সকলকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং দুনিয়ার কর্মের হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত হতে হবে। পূর্বে যারা পৃথিবীতে এসেছিল তারা শক্তি ও ক্ষমতায় অনেক শক্তিশালী ছিল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়ার কারণে তাদের শক্তি ও ক্ষমতা আপতিত শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারেনি। সুতরাং জমিনে সফর করে তাদের থেকে শিক্ষা নাও, তারা আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়ার কারণে শাস্তি প্রাপ্ত হয়েছে এবং দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়েছে। এদের সবাইকে আবার পুনরুত্থিত করা হবে।

সুতরাং কেউ যদি আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করে বা তার সাক্ষাতকে অস্বীকার করে তাহলে তাকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
৩. পূর্ববর্তী শাস্তিপ্রাপ্ত জাতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সতর্ক হতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি বিন্দু পরিমাণ জুলুম করেন না।
৫. নাবী-রাসূলদের প্রতি ঈমান আনতে হবে, তাঁদের সাথে কুফরী করা যাবে না।
৬. পাপী ব্যক্তি যত শক্তিশালীই হোক না কেন আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না।
৭. সকলকে পুনরুত্থিত হতে হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

১১-১৭ নং আয়াতের তাফসীর:

(اَللّٰهُ يَبْدَؤُا الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهُ)

এখানে পুনরায় বস্তুবাদীদের বিশ্বাসকে খণ্ডন করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং দুনিয়ার কর্মের হিসাব-নিকাশের জন্য তিনিই পূর্বের ন্যায় সৃষ্টি পুনরাবৃত্তি করবেন। অর্থাৎ দুনিয়াতে যে আকৃতি ও অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সে আকৃতিতেই পুনরুত্থান করবেন, কিঞ্চিৎ পরিমাণ পরিবর্তন হবে না। সুতরাং সকলকে তাঁর দিকে ফিরে যেতে হবে এতে কোন সংশয় নেই।

(يُبْلِسُ الْمُجْرِمُوْنَ)

‘সেদিন পাপীরা হতাশ হয়ে পড়বে।’ যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন পাপীরা নিজেদের ব্যাপারে একেবারে নিরাশ হয়ে যাবে। কারণ সুপারিশ পাওয়ার আশায় যে সকল মা‘বূদের ইবাদত করত তারা কোন সুপারিশ করতে পারবে না। বরং তারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত করত তাদেরকেই অস্বীকার করবে। এ সম্পর্কে সূরা মারইয়াম ৮২ নং আয়াতসহ অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।

(يَوْمَئِذٍ يَّتَفَرَّقُوْنَ)

‘সেদিন মানুষ আলাদা আলাদা হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ মু’মিনরা কাফিরদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে। কিভাবে আলাদা হবে তা পরের দু’আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যারা ঈমান এনেছে ও সৎ আমল করেছে তারা জান্নাতে চলে যাবে এবং সেখানে তারা আনন্দ-উল্লাসে থাকবে। পক্ষান্তরে যারা কাফির ও মুশরিক তারা জাহান্নামে চলে যাবে এবং তারা সেখানে কঠিন শাস্তিভোগ করবে।

(فَسُبْحَانَ اللّٰهِ)

অর্থাৎ এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংবাদ যে, তিনি সকল অপূর্ণতা, মন্দ ও সাদৃশ্য থেকে পবিত্র। তিনি সকল প্রকার অপূর্ণাঙ্গ গুণ, কোন সৃষ্টির সদৃশ হওয়া থেকে ঊর্ধ্বে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করা ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করার। ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময় উল্লেখ করা হয়েছে; বলা হল কোথায়ন তিনি বললেন:

(حِيْنَ تُمْسُوْنَ)

এখানে মাগরীব ও ইশার সালাতের সময় উল্লেখ করা হয়েছে।

(وَحِيْنَ تُصْبِحُوْنَ)

এখানে ফজরের সালাতের সময় উল্লেখ করা হয়েছে। وَعَشِيًّا এখানে আসর সালাতের সময় উল্লেখ করা হয়েছে। (وَّحِيْنَ تُظْهِرُوْنَ) আর এখানে যোহরের সালাতের সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(أَقِمِ الصَّلٰوةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ إِلٰي غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْاٰنَ الْفَجْرِ ط إِنَّ قُرْاٰنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْدًا)

“সূর্য ঢলে পড়ার পর হতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত‎ সালাত কায়েম কর এবং কায়েম কর ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের সালাত (ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৭৮)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই, অন্য কেউ নয়। সুতরাং তিনিই সকল ইবাদত পাওয়ার যোগ্য।
২. পাপীরা কিয়ামতের মাঠে নিরাশ হয়ে যাবে, তাদের পক্ষে কোন সুপারিশকারী থাকবে না।
৩. সকলকে পুনরুত্থিত হয়ে কর্মের হিসাব দিতে হবে।
৪. কিয়ামতের মাঠে জান্নাতী ও জাহান্নামীরা পৃথক হয়ে যাবে।
৫. সুপারিশ পাওয়ার আশায় আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য যাদের ইবাদত করা হয় তারা সেদিন কোন উপকার করতে পারবে না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৮-১০ নং আয়াতের তাফসীর

যেহেতু এ সৃষ্টি জগতের অণু-পরমাণু আল্লাহ তা’আলার অসীম ক্ষমতার প্রকাশ এবং তার আধিপত্য ও সার্বভৌম ক্ষমতার নিদর্শন, সেহেতু ইরশাদ হচ্ছে- তোমরা সমগ্র সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা কর। আল্লাহর অসীম ক্ষমতার নিদর্শনসমূহ দেখে তাঁর পরিচয় লাভ কর এবং তাঁর মহাশক্তির মর্যাদা দাও। কখনো কখনো ঊর্ধাকাশের সৃষ্টি নৈপুণ্যের প্রতি লক্ষ্য কর এবং কখনো কখনো যমীনের সৃষ্টিতত্ত্বের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। এসব বৃথা বা বিনা কারণে সৃষ্টি করা হয়নি। বরং মহান আল্লাহ মহৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এগুলো সৃষ্টি করেছেন। এগুলোকে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর অসীম ক্ষমতার নিদর্শনরূপে। প্রত্যেক জিনিসের একটা নির্ধারিত সময় রয়েছে। কিয়ামতেরও একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, যা অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করে না।

এরপর নবীদের সত্যবাদিতা প্রকাশ করতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ চেয়ে দেখো, তাঁদের বিরুদ্ধবাদীদের পরিণাম হয়েছে কত মন্দ! পক্ষান্তরে যারা তাদেরকে মেনে নিয়েছে, উভয় জগতে তাদের কি ধরনের মর্যাদা ও সম্মান লাভ হয়েছে! তোমরা সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে দেখো, তোমাদের পূর্বের ঘটনাবলীর নিদর্শন দেখতে পাবে। তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো তোমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ছিল। তোমাদের অপেক্ষা ধন-দৌলত তাদের বেশী ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যও তারা তোমাদের চেয়ে বেশী করতো। জমি-জমা ও ক্ষেত-খামারও ছিল তাদের তোমাদের চেয়ে অনেক বেশী। তাদের কাছে রাসূলগণ মু’জিযা ও দলীল প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ঐ হতভাগ্যেরা তাদেরকে মেনে নেয়নি, বরং তাঁদেরকে তারা অবিশ্বাস করেছিল। তারা নানা প্রকারের মন্দকার্যে লিপ্ত থাকতো। অবশেষে আল্লাহর গযব তাদের উপর পতিত হলো। ঐ সময় তাদেরকে উদ্ধার করে এমন কেউ ছিল না। এটা তাদের প্রতি আল্লাহর যুলুম ছিল না। তিনি তাদের মন্দ কর্মের পরিণতি হিসেবেই তাদের প্রতি শাস্তি নাযিল করেছিলেন। আল্লাহর আয়াতসমূহকে তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতো, তাঁর কথায় তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ তাদের বে-ঈমানীর কারণে আমি তাদের অন্তর ও দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দিই এবং তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরিয়ে বেড়াতে ছেড়ে দিই।” (৬:১১১) আরো বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যখন তারা বক্রপথ অবলম্বন করলো তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন।” (৬১:৫) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “যদি তারা বিমুখ হয়ে যায় তবে জেনে রেখো যে, তাদের কতক পাপের কারণে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করতে চান।” (৫:৪৯) এর উপর ভিত্তি করে শব্দটি (আরবি) বা (আরবি) যবরযুক্ত হবে (আরবি) ক্রিয়ার বা কর্ম হয়ে। এটাও একটা উক্তি যে, (আরবি) এখানে এভাবেই পতিত হয়েছে যে, তাদের পরিণাম মন্দ হয়েছে, কেননা তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতো এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো। এই হিসেবে এই শব্দটি যবরযুক্ত হবে (আরবি)-এর (আরবি) বা বিধেয় হয়ে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এই ব্যাখ্যাই করেছেন এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত কাতাদা (রঃ) হতে কথাটা বর্ণনাও করেছেন। যহহাকও (রঃ) একথাই বলেন এবং প্রকৃত ব্যাপারও তাই। কেননা, এরপরেই আছেঃ(আরবি) েঅর্থাৎ “তা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো।”
১১-১৬ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, তিনি প্রথমে যেমন সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করেছেন, যেভাবে তিনি প্রথমে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার পর পুনরায় সৃষ্টি করতে তিনি সক্ষম হবেন। সবকেই কিয়ামতের দিন তার সামনে হাযির করা হবে। সেখানে তিনি প্রত্যেককে তাদের কৃতকর্মের ফলাফল প্রদান করবেন। আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের উপাসনা করেছে, তাদের কেউই সেদিন তাদের সুপারিশের জন্যে এগিয়ে আসবে না। কিয়ামতের দিন পাপী ও অপরাধীরা অত্যন্ত অপদস্থ ও একেবারে নির্বাক হয়ে যাবে। যখন তারা সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে যাবে তখন তাদের মিথ্যা ও বাতিল উপাস্যরা তাদের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এই বাতিল উপাস্যদের অবস্থাও তাদের মতই হবে। তারা পরিষ্কারভাবে তাদের উপাসকদেরকে বলে দেবে যে, তাদের সাথে তাদের কোনই সম্পর্ক নেই। কিয়ামত সংঘটিত হবার সাথে সাথেই তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যাবে। তারপর আর তাদের মধ্যে কোন দেখা সাক্ষাৎ হবে না। সৎকর্মশীলরা ইল্লীঈনে চলে যাবে এবং পাপী ও অপরাধীরা চলে যাবে সিজ্জীনে। ওরা সবচেয়ে উঁচু স্থানে অতি উৎকৃষ্ট অবস্থায় অবস্থান করবে। আর এরা সর্বনিম্ন স্থানে অতি নিকৃষ্ট অবস্থায় থাকবে। আল্লাহ তা’আলা এখানে একথাই বলছেন যে, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে তারা জান্নাতে আনন্দে থাকবে এবং যারা কুফরী করেছে এবং আল্লাহর নিদর্শনাবলী ও পরলোকের সাক্ষাৎকার অস্বীকার করেছে, তারাই শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1029)
[Do they not contemplate within themselves?]
www.motaher21.net
Sura:30
Para:21
Sura: Ar-Roum
Ayat: – 8-16

30:8

اَوَ لَمۡ یَتَفَکَّرُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ ۟ مَا خَلَقَ اللّٰہُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَاۤ اِلَّا بِالۡحَقِّ وَ اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ وَ اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ النَّاسِ بِلِقَآیِٔ رَبِّہِمۡ لَکٰفِرُوۡنَ ﴿۸﴾

Do they not contemplate within themselves? Allah has not created the heavens and the earth and what is between them except in truth and for a specified term. And indeed, many of the people, in [the matter of] the meeting with their Lord, are disbelievers.

 

Signs of Tawhid

Allah tells us that pondering His creation will show that He exists and that He is Unique in creating it, and that there is no god nor lord besides Him.

So He says:

أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا فِي أَنفُسِهِمْ

Do they not reflect upon themselves!

Thinking and pondering how Allah created various things in the upper and lower realms and in the space between, realizing that this was not created in jest or in vain, but in truth, and that it will continue until an appointed time, the Day of Resurrection, as Allah says:

مَا خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالاْاَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلاَّ بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُّسَمًّى

Not but for just ends and for a term appointed, did Allah create the heavens and the earth, and all between them:

وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ بِلِقَاء رَبِّهِمْ لَكَافِرُونَ

And indeed many of mankind deny meeting with their Lord.

Then Allah tells us of the truth of the Message brought by the Messengers and how He supported them with miracles and clear signs, such as when He destroyed those who disbelieved in them and saved those who believed in them

30:9

اَوَ لَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ؕ کَانُوۡۤا اَشَدَّ مِنۡہُمۡ قُوَّۃً وَّ اَثَارُوا الۡاَرۡضَ وَ عَمَرُوۡہَاۤ اَکۡثَرَ مِمَّا عَمَرُوۡہَا وَ جَآءَتۡہُمۡ رُسُلُہُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ ؕ فَمَا کَانَ اللّٰہُ لِیَظۡلِمَہُمۡ وَ لٰکِنۡ کَانُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ ؕ﴿۹﴾

Have they not traveled through the earth and observed how was the end of those before them? They were greater than them in power, and they plowed the earth and built it up more than they have built it up, and their messengers came to them with clear evidences. And Allah would not ever have wronged them, but they were wronging themselves.

 

أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الاَْرْضِ

Do they not travel in the land,

means, `do they not understand and think and see and hear about the people of the past,’

Allah says:

فَيَنظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ كَانُوا أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً
..

and see what was the end of those before them! They were superior to them in strength,

meaning, `the nations of the past who came before you were stronger than you to whom Muhammad has been sent; they had more wealth and more sons. You have not been given one-tenth of what they were given. They stayed longer in this world than you will stay. They were more civilized than you and were more prosperous in the land than you.’ Yet despite all that, when their Messengers came to them with clear signs, while they were enjoying their life of luxury, Allah punished them for their sins and they had no one who could protect them from Allah. Their wealth and sons could not protect them from the wrath of Allah in the slightest, and Allah was not at all unjust towards them when He sent His punishment upon them. It is as Allah says:
.
وَأَثَارُوا الاْأَرْضَ وَعَمَرُوهَا أَكْثَرَ مِمَّا عَمَرُوهَا

وَجَاءتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ فَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ

they tilled the soil and populated it in greater numbers than these have done:there came to them their apostles with Clear (Signs):it was not Allah Who wronged them,

وَلَكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ

but they used to wrong themselves.

They brought destruction upon themselves, when they rejected and mocked the signs of Allah. All of this only happened because of their previous sins and their rejection (of the Messengers).

Allah says:

ثُمَّ كَانَ عَاقِبَةَ الَّذِينَ أَسَاوُوا السُّوأَى أَن كَذَّبُوا بِأيَاتِ اللَّهِ وَكَانُوا بِهَا يَسْتَهْزِوُون

30:10

ثُمَّ کَانَ عَاقِبَۃَ الَّذِیۡنَ اَسَآءُوا السُّوۡٓاٰۤی اَنۡ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ کَانُوۡا بِہَا یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿٪۱۰﴾

Then the end of those who did evil was the worst [consequence] because they denied the signs of Allah and used to ridicule them.

 

Then evil was the end of those who did evil, because they denied the Ayat of Allah and made a mockery of them.

This is like the Ayat:

وَنُقَلِّبُ أَفْيِدَتَهُمْ وَأَبْصَـرَهُمْ كَمَا لَمْ يُوْمِنُواْ بِهِ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَنَذَرُهُمْ فِى طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ

And We shall turn their hearts and their eyes away, as they refused to believe therein for the first time, and We shall leave them in their trespass to wander blindly. (6:110)

فَلَمَّا زَاغُواْ أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ

So when they turned away, Allah turned their hearts away. (61:5)

فَإِن تَوَلَّوْاْ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُصِيبَهُم بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ

And if they turn away, then know that Allah’s will is to punish them for some sins of theirs. (5:49)

It was said that the meaning of the phrase
ثُمَّ كَانَ عَاقِبَةَ الَّذِينَ أَسَاوُوا السُّوأَى
(Then evil was the end of those who did evil), is that;

evil was their inevitable end, because they rejected the signs of Allah and made fun of them.

This is the view of Ibn Jarir, which he recorded from Ibn Abbas and Qatadah.

Ibn Abi Hatim also recorded it from them and from Ad-Dahhak bin Muzahim.

This is the apparent meaning — and Allah knows best — of the phrase:
وَكَانُوا بِهَا يَسْتَهْزِوُون
(and made a mockery of them).

30:11

اَللّٰہُ یَبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُہٗ ثُمَّ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۱۱﴾

Allah begins creation; then He will repeat it; then to Him you will be returned.

 

Allah said:

اللَّهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ

Allah originates the creation, then He will repeat it,

Just as He was able to create it in the first place, so He is also able to repeat it.

ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

then to Him you will be returned.

on the Day of Resurrection, when each will be requited according to his deeds.

Then Allah says:

وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يُبْلِسُ الْمُجْرِمُونَ

30:12

وَ یَوۡمَ تَقُوۡمُ السَّاعَۃُ یُبۡلِسُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ ﴿۱۲﴾

And the Day the Hour appears the criminals will be in despair.

 

And on the Day when the Hour will be established, the criminals will be plunged into destruction with despair.

Ibn Abbas said,

“The sinners will be filled with despair.”

Mujahid said,

“The sinners will be exposed;”

according to another report he said,

“The sinners will grieve.

30:13

وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّہُمۡ مِّنۡ شُرَکَآئِہِمۡ شُفَعٰٓؤُا وَ کَانُوۡا بِشُرَکَآئِہِمۡ کٰفِرِیۡنَ ﴿۱۳﴾

And there will not be for them among their [alleged] partners any intercessors, and they will [then] be disbelievers in their partners.

 

وَلَمْ يَكُن لَّهُم مِّن شُرَكَايِهِمْ شُفَعَاء

No intercessors will they have from those whom they made equal with Allah,

means, the gods whom they used to worship instead of Allah will not intercede for them;

وَكَانُوا بِشُرَكَايِهِمْ كَافِرِينَ

and they will reject and deny their partners.

they will reject them and betray them despite their desperate need of them.

Then Allah says:

وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يَوْمَيِذٍ يَتَفَرَّقُونَ
30:14

وَ یَوۡمَ تَقُوۡمُ السَّاعَۃُ یَوۡمَئِذٍ یَّتَفَرَّقُوۡنَ ﴿۱۴﴾

And the Day the Hour appears – that Day they will become separated.

 

And on the Day when the Hour will be established — that Day shall (all men) be separated.

Qatadah said:

“By Allah, this refers to the separation after which there will be no reunion.”

In other words, if one person is taken up to the highest heights and another is sent down to the lowest depths of Hell, that is the last they will ever see of one another.

Allah says:

فَأَمَّا الَّذِينَ امَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَهُمْ فِي رَوْضَةٍ يُحْبَرُونَ

30:15

فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَہُمۡ فِیۡ رَوۡضَۃٍ یُّحۡبَرُوۡنَ ﴿۱۵﴾

And as for those who had believed and done righteous deeds, they will be in a garden [of Paradise], delighted.

 

Then as for those who believed and did righteous good deeds, such shall be honored and made to enjoy a luxurious life in a Garden of Delight.

Mujahid and Qatadah said,

“This means, they will enjoy a life of luxury.”

Allah says about the disbelievers:

وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِأيَاتِنَا وَلِقَاء الاْأخِرَةِ فَأُوْلَيِكَ فِي الْعَذَابِ مُحْضَرُونَ

30:16

وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا وَ لِقَآیِٔ الۡاٰخِرَۃِ فَاُولٰٓئِکَ فِی الۡعَذَابِ مُحۡضَرُوۡنَ ﴿۱۶﴾

But as for those who disbelieved and denied Our verses and the meeting of the Hereafter, those will be brought into the punishment [to remain].

 

And as for those who disbelieved and denied Our Ayat, and the meeting of the Hereafter, such shall be brought forth to the torment.

For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran

Leave a Reply