(বই#১০৩২)   [ নির্ভেজাল তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩০:আর্-রূম পারা:২১ ২৮-৩৬ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৩২)
[ নির্ভেজাল তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩০:আর্-রূম
পারা:২১
২৮-৩৬ নং আয়াত:-
৩০:২৮
ضَرَبَ لَکُمۡ مَّثَلًا مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ ؕ ہَلۡ لَّکُمۡ مِّنۡ مَّا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ مِّنۡ شُرَکَآءَ فِیۡ مَا رَزَقۡنٰکُمۡ فَاَنۡتُمۡ فِیۡہِ سَوَآءٌ تَخَافُوۡنَہُمۡ کَخِیۡفَتِکُمۡ اَنۡفُسَکُمۡ ؕ کَذٰلِکَ نُفَصِّلُ الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ ﴿۲۸﴾
আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছেনঃ তোমাদেরকে আমরা যে, রিয্‌ক দিয়েছি, তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের কেউ কি তাতে অংশীদার? ফলে তোমরা কি এ ব্যাপারে সমান? তোমরা কি তাদেরকে সেরূপ ভয় কর যেরূপ তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ভয় কর? এভাবেই আমরা নিদর্শনাবলী বিস্তারিত বর্ণনা করি সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা অনুধাবন করে।
৩০:২৯
بَلِ اتَّبَعَ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡۤا اَہۡوَآءَہُمۡ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ۚ فَمَنۡ یَّہۡدِیۡ مَنۡ اَضَلَّ اللّٰہُ ؕ وَ مَا لَہُمۡ مِّنۡ نّٰصِرِیۡنَ ﴿۲۹﴾
কিন্তু এ জালেমরা না জেনে বুঝে নিজেদের চিন্তা-ধারণার পেছনে ছুটে চলছে। এখন আল্লাহ‌ যাকে পথভ্রষ্ট করেছেন কে তাকে পথ দেখাতে পারে? এ ধরনের লোকদের কোন সাহায্যকারী হতে পারে না।
৩০:৩০
فَاَقِمۡ وَجۡہَکَ لِلدِّیۡنِ حَنِیۡفًا ؕ فِطۡرَتَ اللّٰہِ الَّتِیۡ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیۡہَا ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِخَلۡقِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ٭ۙ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٭ۙ۳۰﴾
কাজেই আপনি একনিষ্ঠ হয়ে নিজ চেহারাকে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত রাখুন । আল্লাহর ফিতরাত ( দ্বীন ইসলাম), যার উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই । এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।
৩০:৩১
مُنِیۡبِیۡنَ اِلَیۡہِ وَ اتَّقُوۡہُ وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ لَا تَکُوۡنُوۡا مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ ﴿ۙ۳۱﴾
তোমরা বিশুদ্ধ চিত্তে তাঁরই অভিমুখী হয়ে থাক আর তাঁরই তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সালাত কায়েম কর। আর অন্তর্ভুক্ত হয়ো না মুশরিকদের,
৩০:৩২
مِنَ الَّذِیۡنَ فَرَّقُوۡا دِیۡنَہُمۡ وَ کَانُوۡا شِیَعًا ؕ کُلُّ حِزۡبٍۭ بِمَا لَدَیۡہِمۡ فَرِحُوۡنَ ﴿۳۲﴾
যারা নিজেদের আলাদা আলাদা দ্বীন তৈরি করে নিয়েছে আর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রত্যেক দলের কাছে যা আছে তাতেই তারা মশগুল হয়ে আছে।
৩০:৩৩
وَ اِذَا مَسَّ النَّاسَ ضُرٌّ دَعَوۡا رَبَّہُمۡ مُّنِیۡبِیۡنَ اِلَیۡہِ ثُمَّ اِذَاۤ اَذَاقَہُمۡ مِّنۡہُ رَحۡمَۃً اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ بِرَبِّہِمۡ یُشۡرِکُوۡنَ ﴿ۙ۳۳﴾
লোকদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, যখন তারা কোন কষ্ট পায় তখন নিজেদের রবের দিকে ফিরে তাকে ডাকতে থাকে তারপর যখন তিনি নিজের দয়ার কিছু স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান তখন সহসা তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়,
৩০:৩৪
لِیَکۡفُرُوۡا بِمَاۤ اٰتَیۡنٰہُمۡ ؕ فَتَمَتَّعُوۡا ٝ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۳۴﴾
ওদেরকে আমি যা দিয়েছি, তা অস্বীকার করার জন্য। সুতরাং তোমরা ভোগ করে নাও, অতঃপর শীঘ্রই জানতে পারবে।
৩০:৩৫
اَمۡ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ سُلۡطٰنًا فَہُوَ یَتَکَلَّمُ بِمَا کَانُوۡا بِہٖ یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۳۵﴾
আমি কি ওদের নিকট এমন কোন দলীল অবতীর্ণ করেছি, যা ওদেরকে আমার কোন অংশী স্থাপন করতে বলে?
৩০:৩৬
وَ اِذَاۤ اَذَقۡنَا النَّاسَ رَحۡمَۃً فَرِحُوۡا بِہَا ؕ وَ اِنۡ تُصِبۡہُمۡ سَیِّئَۃٌۢ بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ اِذَا ہُمۡ یَقۡنَطُوۡنَ ﴿۳۶﴾
যখন লোকদের দয়ার স্বাদ আস্বাদন করাই তখন তারা তাতে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং যখন তাদের নিজেদের কৃতকর্মের ফলে তাদের ওপর কোন বিপদ এসে পড়ে তখন সহসা তারা হতাশ হয়ে যেতে থাকে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*মােশরেকদের স্ববিরোধিতা : পূর্ববর্তী আলােচনায় মহান আল্লাহর অতুলনীয় সৃষ্টি বৈচিত্র্যের বিবরণ দেয়ার পর এবার নতুন বিষয়ের অবতারণা করা হচ্ছে, ‘আল্লাহ তােমাদের মধ্য থেকেই একটা উদাহরণ দিয়েছেন…'(আয়াত ২৮) আল্লাহ তায়ালাও উদাহরণটা দিয়েছেন মােশরেকদের বুঝানাের জন্যে, যারা জ্বিন, ফেরেশতা, মূর্তি, গাছ, ইত্যাকার কোনাে সৃষ্টিকে আল্লাহর সাথে শরীক করতাে, অথচ তারা তাদের যে সব দাসদাসী আছে, তাদের কাউকে তাদের ধন সম্পদে শরীক করতে রাযি হবে না এবং কোনাে ব্যাপারেই তারা তাদের গােলাম বাঁদিকে নিজেদের সমপর্যায়ে আনতে প্রস্তুত হবে । তাদের আচরণের এই অসংগতি বিস্ময়কর। আল্লাহ তায়ালা একক স্রষ্টা ও একক রিযিকদাতা হওয়া সত্তেও মােশরেকরা তার সাথে তাঁর দাসদের শরীক বানাতে চায়। অথচ তাদের নিজেদের কোনাে সম্পদে এ দাসদাসীদের কাউকে শরীক বানাতে প্রস্তুত নয়। তাদের এই সম্পদও তাে তাদের নিজেদের সৃষ্টি করা নয়। বরং আল্লাহর দেয়া। বস্তুত এটা এক আশ্চর্য রকমের স্ববিরােধিতা। এই উদাহরণটা বিস্তারিতভাবে আলােচিত হয়েছে এভাবে, ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের নিজেদের মধ্য থেকে একটা উদাহরণ দিয়েছেন।’ অর্থাৎ এমন একটা উদাহরণ দিয়েছেন, যা তােমাদের কাছ থেকে দূরের নয় যে, তা দেখতে তােমাদের দূরে কোথাও যেতে হবে বা কাউকে তােমাদের কাছে নিয়ে আসতে হবে না। ‘তােমাদের কি পছন্দ হবে যে, আমি যে সম্পদ তােমাদেরকে দিয়েছি, তার কোনাে কিছুতে তােমাদের কোনাে দাসদাসী শরীক হােক এবং তােমরা তাদের সমান হয়ে যাও?’ জানা কথা যে, তােমরা তাদের নিজেদের সমান করা তাে দূরের কথা, তাদের তােমাদের সামান্যতম সম্পদের শরীক বানাতেও রাযি হবে না। ‘তােমরা নিজেদের যেমন ভয়ংকর, তেমনি তাদেরও ভয় করাে।’ অর্থাৎ স্বাধীন লােকদের শরীক করলে তাদের সম্পর্কে যেমন বিচার-বিবেচনা করাে, দাসদাসীদের শরীক করেও তেমনি করতে রাযি হবে কি? তারা তােমাদের সমকক্ষ হয়ে তোমাদের ওপর জোর যুলুম চালাক, তা বরদাশত করবে কি? তােমাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ মহলে এরূপ করতে কি তােমরা প্রস্তুত হবে? তা যখন হবে না, তখন সেই অতুলনীয় মর্যাদাসম্পন্ন মহিমান্বিত আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে কেন এমন ধৃষ্টতা তােমাদের। এটা এমন একটা সুস্পষ্ট উদাহরণ, যা নিয়ে বিতর্কের কোনােই অবকাশ নেই। এটা সাধারণ যুক্তি ও সুস্থ বিবেক বুদ্ধি দ্বারাই বুঝা যায়। ‘আমি এভাবেই বুদ্ধিমানদের কাছে বিশদভাবে আয়াতগুলাে তুলে ধরি।’ শিরকের তুচ্ছ দাবীর ক্ষেত্রে তাদের এই স্ববিরােধিতা তুলে ধরার পর এই স্ববিরােধিতার আসল কারণ উদঘাটন করা হচ্ছে, ‘আসলে অত্যাচারীরা না জেনে শুনে নিজেদের প্রবৃত্তির অন্ধ অনুসরণ করছে।'(আয়াত ২৯) বস্তুত প্রবৃত্তি এমন এক জিনিস, যার কোনাে নিয়ামক বা নিয়ন্ত্রণকারী থাকে না। একে পরিচালনা করার জন্যে কোনাে নির্দিষ্ট ছকও নেই, মাপকাঠিও নেই। প্রবৃত্তি যখন যা খুশী তাই করে এবং তাই চায়। তার ইচ্ছা, আকাংখা, কামনা বাসনার কোনাে সীমা-পরিসীমা নেই, কোনাে ভালােমন্দের বাছ বিচার নেই, এবং কোনাে ন্যায় অন্যায় নেই। এটা এমন এক গােমরাহীর উৎস, এমন এক বিদ্রোহের উস্কানিদাতা, যার উপস্থিতিতে হেদায়াতের এবং আনুগত্যের পথে ফেরার আর কোনাে আশা থাকে না। ‘অতএব যাকে আল্লাহ তায়ালা বিপথগামী করেছেন, তাকে কে সৎপথে চালাবে?’ অর্থাৎ প্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে যাকে আল্লাহ তায়ালা বিপথগামী করেছেন, তাকে আর কে হেদায়াত করবে? ‘তার কোনাে সাহায্যকারী নেই।’ অর্থাৎ তাকে তার খারাপ পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কেউ নেই। এই পর্যায়ে এসে প্রবৃত্তির দাসদের সম্পর্কে আলােচনা শেষ করে রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে বলা হচ্ছে, তিনি যেন আল্লাহর প্রামাণ্য দ্বীনের ওপর অবিচল থাকেন, যা আল্লাহর সৃষ্টি করা প্রাকৃতিক বিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ। বস্তুত এটা হচ্ছে একটা মাত্র একক আকীদা ও আদর্শ। মােশরেকদের ধর্ম যেমন তাদের বহু দলে-উপদলে এবং জাতি-উপজাতিতে বিভক্ত করেছে, আল্লাহর দ্বীন তেমন নয়। এতে কোনাে দল-উপদল সৃষ্টির অবকাশ নেই। ‘অতএব তুমি আল্লাহর দ্বীনের প্রতি একাগ্র হও।'(আয়াত ৩০, ৩১ ও ৩২) বিশ্ব প্রকৃতির বিভিন্ন দৃশ্য ও নিদর্শন দেখানাের পর যখন নির্ভুল প্রকৃতি এবং নিখুঁত স্বভাবের ধর্ম ইসলামের প্রতি পাঠকের মন আকৃষ্ট হয়েছে, যখন বিপথগামীরা তাদের বিপথগামিতার সমস্ত যুক্তি প্রমাণ হারিয়ে ফেলেছে, সমস্ত সাজ সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র তাদের হাতছাড়া হয়েছে, তখনই আল্লাহর দ্বীনের অনুগত হবার ও তা গ্রহণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। বস্তুত এ নির্দেশ সঠিক সময়েই দেয়া হয়েছে। আর কোরআন এভাবে ইসলামের জন্যে সবচেয়ে মযবুত যুক্তি পেশ করেছে, যা কেউ প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা রাখে না। ‘অতএব তুমি একাগ্র হয়ে দ্বীনের অনুগত হও।’ অর্থাৎ সােজাসুজিভাবে এই সরল সঠিক ধর্মের অনুগত হও। কেননা এই দ্বীন মানুষকে সমস্ত ভ্রান্ত, অসত্য ও অন্যায় পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে, সমস্ত অজ্ঞতা, প্রবৃত্তি পূজা ও অযৌক্তিক পথ থেকে রক্ষা করে। আল্লাহর এই নির্ভুল দ্বীনের অনুসারী হয়ে অন্য সব মতবাদ ও মতাদর্শ পরিত্যাগ করাে। ‘আল্লাহর প্রকৃতি, যার ওপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোনাে পরিবর্তন নেই।’ এ কথা দ্বারা মানবীয় স্বভাব ও ইসলামের প্রকৃতির মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে। উভয়টাই আল্লাহর সৃষ্টি। উভয়টাই আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ। উভয়টাই পরস্পরের সাথে সুসমন্বিত। যে আল্লাহ তায়ালা মানুষের মন সৃষ্টি করেছেন তিনিই তার জন্যে এই দ্বীন নাযিল করেছেন, যাতে করে এ দ্বীন তাকে সঠিক পথে চালিত করে, সকল ব্যাধি থেকে মুক্ত করে এবং সকল গােমরাহী থেকে পরিশুদ্ধ করে। আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে নিজেই সবচেয়ে ভালাে জানেন। তিনি সূক্ষ্মজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ। আল্লাহর সৃষ্টি করা স্বভাব প্রকৃতি যেমন অপরিবর্তনীয় ও স্থিতিশীল, তেমনি তার নাযিল করা দ্বীনও স্থিতিশীল ও চিরঞ্জীব। ‘আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনাে পরিবর্তন নেই।’ মানুষের মন যখন সুস্থতা, স্বভাবিকতা থেকে বিচ্যুত ও বিপথগামী হয়, তখন ইসলাম ছাড়া আর কোনাে জিনিস তাকে সুস্থতা স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনতে পারে না। কেননা ইসলাম নিজেই স্বভাব ধর্ম। মানুষের স্বভাব ও বিশ্বজগতের স্বভাব প্রকৃতির সাথে তা সম্পূর্ণরূপে সুসমন্বিত।

এটাই হচ্ছে সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জানে না।’ এর ফলে (এই না জানার কারণে) তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং সেই মযবুত ও সঠিক পথ থেকে দূরে সরে (চলে) যায় যা তাদেরকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেয়ার জন্যে নিবেদিত ছিলাে। যদিও রসূলুল্লাহ(স.)-এর দিকে রুজু করার জন্যে এখানে দাওয়াত দেয়া হচ্ছিলাে, তবুও সত্য সঠিক মযবুত ইসলামী জীবন বিধানের দিকে মুখ ফেরানাের কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সকল যমানার সকল মানুষ যেন কোরআন হাদীসে বর্ণিত ইসলামের পরিপূর্ণ জীবন-বিধানের অনুসারী হয়ে যায়। যতাে দিন রসূল(স.) বেঁচে ছিলেন ততােদিন তাকে দেখে তাঁর সাহাবায়ে কেরামরা। শিক্ষা লাভ করেছেন। তার ইন্তেকালের পর, তার প্রদত্ত যাবতীয় শিক্ষা কোরআন ও হাদীস থেকে গ্রহণ করতে হবে। আর এ জন্যেই সদা সর্বদা আল কোরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করতে হবে।  *মতভেদ ও দলাদলি হচ্ছে মােশরেকদের চরিত্র : ‘একাগ্রচিত্তে তার দিকে ঝুঁকে থাকো, তাকেই ভয় করাে এবং নামায কায়েম করাে; আর খবরদার, সেসব মােশরেকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেয়াে না যারা তাদের দ্বীনের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং এইভাবে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। ওদের প্রত্যেক দল নিজ নিজ মত নিয়ে উল্লসিত হয়ে রয়েছে।’ এভাবেই আল্লাহকেন্দ্রিক হয়ে থাকা যাবে এবং প্রতিটি ব্যাপারে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হবে। এটাই তাকওয়া-পরহেযগারীর উপযােগী পদ্ধতি, এটাই বিবেকসম্মত কাজ এবং গােপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর পথে টিকে থাকার জন্যে সতর্কতা অবলম্বনের নিয়ম । জীবন পথে এভাবে অগ্রসর হলে তবে আশা করা যায়, যাই করা হােক না কেন এবং যেখানেই থাকা হােক না কেন, সত্য-সচেতন হয়ে থাকা সম্ভব হবে। আবারও স্মরণ করানাে হচ্ছে যে, আল্লাহর নিষ্ঠাপূর্ণ বান্দা হতে হলে এবং তার বান্দা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গেলে সর্বপ্রথম সালাত কায়েম করতে হবে। সময় হওয়ার সাথে সাথে এক আল্লাহর দরবারে হাযিরা দেয়ার মাধ্যমে ঈমানের বাস্তব প্রমাণ পেশ করতে হবে এবং এই সালাতই তাকে মােশরেকদের থেকে ভিন্ন এক জাতি হিসেবে চিহ্নিত এবং প্রমাণিত করবে। স্মরণ রাখতে হবে, মােশরেকদের পরিচয় দিতে গিয়ে এবং তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে মহাগ্রন্থ আল কোরআন জানাচ্ছে যে, ‘তারা দ্বীন ইসলামের মধ্যে নানা প্রকার মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং নিজেরাও বহু দলে বিভক্ত হয়ে গেছে।’ তারা সমাজের বুকে বহু রংয়ের এবং বহু ধরনের শিরক মিশ্রিত ধর্ম চালু করেছে, কেউ জ্বিনদের পূজা করে, কেউ পূজা করে ফেরেশতাদের, কেউ বাপ-দাদাদের আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়ে তাদের পূজা করে, কেউ পূজা করে রাজা বাদশাদের, কেউ বা পূজা করে জ্যোতির্বিদ ও ধর্মযাজকদের। ওদের মধ্যে কেউ পূজা করে গাছপালার? কেউ পূজা করে গ্রহ-নক্ষত্রের, কেউ আগুনের পূজা করে, আবার কেউ পূজা করে রাত ও দিনের এবং কেউ পূজা করে মিথ্যা যৌনাভূতি ও ভােগ-লালসার- আর এতাে সব করেও তাদের শিরকের ধরন ও প্রকারের শেষ নেই। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর প্রত্যেক দল যে যেটা নিয়ে আছে তাতেই তারা খুশী।’ এমনই এক অবস্থার মধ্যে এমন মযবুত ও নির্ভুল জীবন ব্যবস্থা তাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে যার কোনাে পরিবর্তন নেই এবং যা কোনাে সময়ে মতভেদের দ্বারা খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাবে না, আল্লাহর দিকে ছাড়া মানুষকে অন্য কোনাে দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে না। এ ব্যবস্থা মানুষের গতি ফিরিয়ে দেবে সেই আল্লাহর দিকে, যার হুকুমে চলছে আকাশমন্ডলী ও বিশাল এ ধরনী, আর আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর (মানুষ ছাড়া) সবাই ও সব কিছু যার অনুগত হয়ে রয়েছে। ‘আর যখন মানুষকে কোনাে দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করে তখন তারা তাদের রবের দিকে রুজু হয়ে তাকে কাতর কণ্ঠে ডাকতে থাকে’ এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা মােহর মেরে বন্ধ করে দিয়েছেন তাদের অন্তর যারা তাদের জ্ঞান কাজে লাগায় না। ‘অতএব, সবর করাে। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য; আর হে রসূল, তােমাকে যেন সেসব লােকেরা ব্যতিব্যস্ত করে না ফেলে যারা সত্যিকারে বিশ্বাস করে না।’ আরব জাহেলিয়াতের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে যে মনগড়া দেব-দেবীর পূজা অর্চনা চলে আসছিলাে, শিরক ও মূর্তি-পূজা এবং মূর্খতা ও হঠকারিতা গােটা সমাজকে যে ভীষণভাবে গ্রাস করে রেখেছিলাে, ইসলামের আলােকে সেই কঠিন অবস্থা থেকে তারা কিভাবে মুক্তি পেলাে, বর্তমান ভাষণে অতি সুন্দরভাবে তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠেছে। ইসলামের সুমহান ও সম্মাহনী আলােকে আঁধারের ঘাের কেটে গিয়ে উদিত হয়েছে সত্যের সূর্য। ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের ছোঁয়া পেয়ে সুখে দুঃখে এবং সংকটে সচ্ছলতায় ফুটে ওঠেছে মানবতার আসল রূপ। সাধারণভাবে মানুষ তার শক্তি ক্ষমতা ও চিন্তা ভাবনা দ্বারা তার সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয় না, বরং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বিচার ও সিদ্ধান্তের ওপর যখন নিজেকে সােপর্দ করে তখন সে আর কখনও পেরেশান হয় না। তার জীবনের সকল সমস্যার জন্যে আল্লাহ পরওয়ারদেগারের ওপর যখন সে পুরােপুরি তাওয়াক্কুল করে, তখনই তার অস্থিরতা দূর হয়ে যায়। যেহেতু তিনিই সব কিছুর মালিক এবং তিনিই প্রশস্ত করেন রুজি রােজগারের ভান্ডার আর যার জন্যে ইচ্ছা তার জন্যে এ ভান্ডার তিনিই সংকীর্ণ করেন। আর মানুষের মধ্যে যার জন্যে যে পরিমাণ রিযিক তিনি বরাদ্দ করেছেন সেই পরিমাণ সামনে রেখে তিনি তাদের শিখিয়েছেন সেই পদ্ধতি যার মাধ্যমে তারা বাড়াতে পারে তাদের আয়-রােজগার এবং এভাবেই মহান আল্লাহ তাদের অন্যায় পন্থা গ্রহণ করা থেকে পবিত্র করেন। এমনই নিপুণ ও মযবুত এই পদ্ধতি, যার যথার্থতা সম্পর্কে কেউ দ্বিমত পােষণ করে না এবং এ পদ্ধতি তাকে চূড়ান্ত সফলতার দিকে এগিয়ে দেয়। এসব নিয়ম নীতি ও পদ্ধতি অবলম্বনেই মানুষ তার মহান সৃষ্টিকর্তাকে জানতে পারে, যিনি সবারই জীবন-মৃত্যুর মালিক। এখন সে মােশরেকরা যেসব শরীকদের আল্লাহর ক্ষমতার অংশীদার মনে করে, তারা একটুও চিন্তা করে না যে, বাস্তবে ওই কল্পিত অংশীদাররা কি কাজটা করে বা করতে পারে? ওদের ওই হঠকারী চিন্তা ও নির্বুদ্ধিতার কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তাদের সাবধান করে বলছেন যে, তাদের কাছে সত্য সমাগত হওয়ার পরে তারা যদি সাবধান না হয় এবং এখনও শিরকের ওপর টিকে থাকে, তাহলে তাদের জীবনে সকল দিক থেকে নেমে আসবে চরম অশান্তি ও বিশৃংখলা। এই বিষয়টিই আল আমীন মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.) তাদের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন এবং এই মহা সত্যই মুসলমানদের এগিয়ে দিয়েছে দ্বীন ইসলামের সকল বিধান মযবুতভাবে ধারণ করার দিকে। যারা ইসলামের যৌক্তিকতা ও সৌন্দর্য জেনে বুঝে মন প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেছে, তারা এ বিষয়ে তৃপ্ত ও নিশ্চিন্ত যে, তারা সেই কঠিন দিন আসার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত সরল সঠিক ও সুন্দরতম জীবন বিধান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে, যেদিন কেউ কোনাে কাজ করতে পারবে না এবং কোনাে কিছু কেউ অর্জনও করতে পারবে না। সেদিন থাকবে শুধু হিসাব নিকাশ ও সেই কাজের প্রতিদান, যা পার্থিব জীবনে তারা করেছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা রিযিকের কথা বলতে গিয়ে, রিযিকের বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এক প্রকার রিযিক হচ্ছে তাই যার সম্পর্ক হচ্ছে সেসব জিনিসের সাথে, যা মানুষের বস্তুগত জীবনের সাথে জড়িত, যেমন বৃষ্টির পানি। যা আকাশ থেকে নেমে আসে এবং মরে যাওয়া যমীনকে পুনরায় যিন্দা করে তােলে। এই পানিতেই নৌ-জাহাজগুলাে আল্লাহর হুকুমে দেশ থেকে দেশ-দেশান্তরে নানা প্রকার পণ্যসামগ্রী বহন করে নিয়ে যায়। আর এক প্রকার রিযিক হচ্ছে মানুষের আত্মার খোরাক, যা মৃত অন্তরসমূহকে জীবিত করার জন্যে রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার সুস্পষ্ট নিদর্শন আকারে নাযিল হয়; কিন্তু হায়, এতাে পরিষ্কার ও দৃষ্টি আকর্ষণী কথা এবং যুক্তি থাকা ওই কথাগুলাের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না আত্মপূজারী ব্যক্তিরা, স্বার্থান্বেষী মহল ও দুনিয়াদার লােকেরা, তারা এসব সত্য সঠিক ও বিবেকগ্রাহ্য কথাগুলাে থেকে হেদায়াত গ্রহণ করে না এবং খেয়াল করে শােনেও না। এরপর আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের সামনে তাদের জন্মবৃত্তান্ত তুলে ধরছেন, জানাচ্ছেন তারা কিভাবে সৃষ্টি হলাে, বেড়ে ওঠলাে, অবশেষে কিভাবে তারা আপন সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাবে। সেদিন যালেমদের ওযর অজুহাত তাদের কোনাে প্রকার সাহায্য করবে না এবং সেদিন তাদের কোনাে তাওবাও কবুল করা হবে না। আলােচ্য ভাষণটি রসূলুল্লাহ(স.)-এর দৃঢ়তা এবং তার কাজের স্থায়িত্ব সম্পর্কে জানানাের সাথে শেষ হচ্ছে। জানানাে হচ্ছে, এ মিশন পরিপূর্ণ করতে গিয়ে তিনি আল্লাহর ওপর পুরােপুরি তাওয়াক্কুল করেছেন এবং সর্বাবস্থায় সবর করেছেন। কঠিন থেকে কঠিন অবস্থার মধ্যেও তিনি বিচলিত হননি, যার ফলে আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা নিশ্চিতভাবে সত্য প্রতিষ্ঠার ওয়াদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘আর যখন মানুষকে কোনাে দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে তখন সে কায়মনোবাক্যে তাদের রবের দিকে রুজু করে… নিশ্চয়ই এর মধ্যে রয়েছে মােমেনদের জন্যে অবশ্য অবশ্যই বহু নিদর্শন।’ ওপরের আয়াতগুলােতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জীবনের সাধারণ অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে জানাচ্ছেন যে, মানুষ হিসেবে তার কোনাে কিছুরই কোনাে স্থায়িত্ব নেই, নেই তার মতামতের কোনাে স্থিরতা। সে আজকে এক পথে চলছে তাে কালকে আর এক পথে চলে, কোনাে সময়ে এক মত গ্রহণ করছে, আবার কোনাে সময়ে অন্য মতের দিকে চলে যাচ্ছে, সত্যিকারে বলতে গেলে কি সুস্পষ্টভাবে কোনাে জীবন বিধান তার কাছে নেই, যার ওপর সে স্থির হয়ে টিকে থাকতে পারে। তার জীবনের নিরন্তর পথপরিক্রমায় সে সর্বদাই পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছে, যে অবস্থাটা তার সামনে আসে তার ওপর ভিত্তি করে সে কিছু আন্দাজ-অনুমান করে ভবিষ্যত পথ রচনা করে। আবার কিছুদিন পরে তা যখন ভুল প্রমাণিত হয় তখন সে আবার আর এক পথ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এভাবে বার বার ঠোকর খেয়ে খেয়ে এবং নানাভাবে কষ্ট পাওয়ার পর অবশেষে সে ফিরে আসে তার(প্রকৃত) রব প্রতিপালকের কাছে এবং আশ্রয়প্রার্থী হয় সেই মহাশক্তিধরের কাছে, যার কোনাে লয় নেই, কোনাে ক্ষয় নেই, যিনি ছাড়া বাচানেওয়ালাও কেউ নেই, তার দিকে ফিরে যাওয়া ব্যতীত দুঃখ কষ্ট এবং শেষ পরিণতির কঠিন অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ারও কোনাে উপায় নেই, কিন্তু এরপর যখন বিপদ কেটে যায়, দুঃখ কষ্ট লাঘব হয়ে যায়, আল্লাহর রহমত নেমে আসে, তখন তাদেরই মধ্যে একটি দল তাদের রবের সাথে শরীক করতে শুরু করে দেয়।
*ভােগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়ে শিরকে লিপ্ত হওয়া : এখানে মােশরেকদের মধ্য থেকে সেই দলটিকে সম্বােধন করা হচ্ছে, যারা মােহাম্মদ(স.)-এর রেসালাতকে দেখেছে, বুঝার চেষ্টা করেছে এবং অনেকাংশে আকৃষ্ট হয়েছে, কিন্তু পার্থিব স্বার্থ, সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ এবং আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ও তাদের বিরােধিতার ভয় তাদেরকে সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে দিচ্ছে না। তাই তাদের শক্তভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, সত্য ও মিথ্যা, সার ও অসার, পার্থিব জীবনের তুচ্ছতা ও পরকালীন জীবনের স্থায়িত্বের কথা জানা বুঝা সত্তেও যখন উপস্থিত আনন্দ-অভিলাষ ও সুযােগ-সুবিধার আকর্ষণ থেকে তারা মুক্ত হতে পারছে না, তখন তারাও ওই পথভ্রষ্ট লােকদের দলভুক্ত বলেই গণ্য হবে, যারা জেনে বুঝে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই বলা হচ্ছে, ‘ঠিক আছে, খেয়ে পরে নাও, ফুর্তি করে প্রাণ ভরে দুনিয়ার মজা লুটে নাও এবং কানায় কানায় ভরে ফেলে তােমাদের আনন্দের পেয়ালা; অবশ্যই শীঘ্রই তােমরা জানতে পারবে (এর পরিণতি কি)!’ এ এক সাংঘাতিক রকমের ধমক, এক ধমকের মধ্যে রয়েছে ভয় ও কঠিন শাস্তির ইংগিত। কোনাে কর্তৃপক্ষ বা শাসনকর্তার পক্ষ থেকে যখন এ রকম ভয় দেখানাে হয় তখন মানুষ ভয়ে জড়ােসড়াে হয়ে যায়, অথচ এ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে যখন এ কঠিন শাস্তি নেমে আসবে বলে ভয় দেখানাে হয়, তখন এই হঠকারী শ্রোতাদের মধ্যে তেমন কোনাে প্রতিক্রিয়াই দেখা যাচ্ছে না। এটা কি আশ্চর্যের বিষয় নয়! মহান আল্লাহ কোনাে কিছু করতে চাইলে শুধু বলেন, হয়ে যাও (আর অমনি তা হয়ে যায়)। তিনিই আজ বলছেন, খেয়ে পরে নাও, ফুর্তি করাে, দুনিয়ার মজা লুটে নাও। অর্থাৎ ফাঁসির আসামীকে যেমন বলা হয়, কি খাবে বলাে, যা তােমার মনে চায় তােমাকে তা-ই দেয়া হবে, কারণ এর পরেই আসছে মৃত্যুর ভয়ানক ছােবল রূপ যন্ত্রণা। অনুরূপভাবে যা খুশী দুনিয়ার স্বাদ গ্রহণের অর্থ হচ্ছে, পরকালে তাে তােমাদের ভাগ্য লিখনে রয়েছে শাস্তিই শাস্তি, যে শাস্তির কোনাে সীমা বা শেষ থাকবে না। এই ভয়ানক আযাব আসার ব্যাপারে ব্যস্ততা দেখানাের পরে আবারও তারা ফিরে আসে এবং আতংকভরা মন নিয়ে রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে জানতে চায়, যে শিরকের ওপর তারা টিকে আছে, এর পক্ষে কোনাে কথা পাওয়া যায় কিনা। কারণ তারা তাে মনে করে, আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত পাওয়ার পথে এ শিরক কোনাে অন্তরায়ই নয় এবং যে কুফরী কাজে তারা লিপ্ত রয়েছে, এটাও তাদের আল্লাহর রহমত পাওয়ার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করছে না। এ বিষয়ে এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি, মহান আল্লাহ, এমন কোনাে দলীল প্রমাণ কি নাযিল করেছি যা তাদের শিরকের কাজকে সমর্থন দিচ্ছে বলে মনে হয়?’ অবশ্যই আকীদা বিশ্বাসের ব্যাপারে আল্লাহর কাছ থেকে ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কোনাে কথা গ্রহণযােগ্য নয়। আমি কি ওদের শিরকের কাজকে সমর্থন করতে গিয়ে কোনাে শক্তিশালী যুক্তি বা দলীল প্রমাণ নাযিল করেছি? এ প্রশ্ন দ্বারা সে জঘন্য অপরাধের প্রতি চূড়ান্ত ঘৃণা প্রদর্শনই করা হয়েছে এবং তাদের কটাক্ষ করে তাদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারা হয়েছে তাদের সেসব বাজে কথাকে। এভাবে ওপরে বর্ণিত আয়াতের মাধ্যমে তাদের শিরকের আকীদাকে এক নির্জলা মিথ্যা ও নির্বুদ্ধিতা বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, প্রমাণ করা হয়েছে তাদের বেওকুফী । আসলে তারা নিজেরাও জানে, এসব কাজের পেছনে কোনাে যুক্তি নেই; তবুও তারা এই অন্ধত্বের মধ্যে ডুবে রয়েছে নিছক সাময়িক আবেগ উচ্ছ্বাস, আনন্দ অভিলাষ এবং উপস্থিত স্বার্থের কারণে। এরপর চিন্তা করতে গেলে আর একটি মৌলিক এবং সিদ্ধান্তকর কথা সামনে এসে যায়, আর তা হচ্ছে, দুনিয়ায় যে কোনাে বিশ্বাসের পেছনে একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ ভিত্তি ছাড়া অন্য কোনাে ভিত্তি নেই, আর এই কারণে অন্য কোনাে বিশ্বাসের কোনাে স্থায়িত্বও নেই। অতএব, কোনাে মত ও পথের পক্ষে অন্য যেসব দলীল-প্রমাণ, যুক্তি যা-ই পেশ করা হােক না কেন, তা আপেক্ষিক, তুচ্ছ ও দুর্বল- এটা যে কতাে বড়ো সত্য কথা তা যতাে বেশী চিন্তা করা হবে ততাে বেশী অনুধাবন করা যাবে। এরপর মানব জীবনের পাতাগুলাের মধ্য থেকে আর একটি পাতা ওল্টানাে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, মানুষ যখন সুখে থাকে এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকে, তখন তার প্রাণবস্ততা, দেহ সৌষ্ঠব এবং আন্তরিকতা তাকে বেশী দূরের জিনিস চিন্তা করতে দেয় না। কিন্তু যখন অচিরেই এসব আবেগ উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে আসে, তখন চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে ধরে নানা প্রকার সংকট-সমস্যা। এভাবে, জীবন সায়াহ্নে বা রােগব্যাধি ও সংকট সমস্যায় ভরা কঠিন দিনের সংস্পর্শে এসে সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায়, তখন সে কষ্ট পেতে থাকে দারুণ আত্মশ্লাঘায়, তখন পরম করুণাময় আল্লাহর রহমত পাবে বলে আর কিছুতেই মনে করতে পারে না। তাই, এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যখন আমি মহান আল্লাহ মানুষকে রহমতের স্বাদ গ্রহণ করাই তখন তারা খুশীতে আত্মহারা হয়ে যায়। যখন তাদের আচরণের কারণে তারা বিপদগ্রস্ত হয় তখন তারা চূড়ান্তভাবে হতাশ হয়ে যায়।’ এ আয়াত এমন এক ব্যক্তির ছবি তুলে ধরেছে যার জীবনের কোনাে স্থায়িত্ব নেই। যে এমন কোনাে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে স্থির হয়ে থাকে না যে, সকল কাজ তার সেই অবস্থানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। সে মানে না এমন কোনাে সূক্ষ্ম মানদন্ড, যা নানা প্রকার বিপদ আপদের মধ্যে পরিবর্তন হওয়া থেকে তাকে রক্ষা করবে। আর এখানে যেসব মানবগােষ্ঠী সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে তারা ঈমানের মানদন্ডের ওপর টিকে থাকে না এবং ঈমানের মাপকাঠিতে নিজেদের পরিমাপও করে না। তারা আল্লাহর রহমত লাভ করে কৃতজ্ঞ হয় না; বরং সুখের দিনে চরম অহংকারী কোনাে ব্যক্তির মতাে তারা এমন খুশী হয়ে যায় যা তাদের কর্তব্য কাজ থেকে বিচ্যুত করে দেয়, ভুলিয়ে দেয় তাদের অস্তিত্বের কথা, ভুলিয়ে দেয় তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য। তখন তারা একেবারে আনন্দ ফুর্তির মধ্যে ডুবে যায় এবং আনুগত্য দানের মাধ্যমে নেয়ামতদাতার কোনাে শােকরগােযারী তারা করে না। এমতাবস্থায় তারা কিছুতেই বুঝতে পারে না যে, এসব নেয়ামতের মধ্যে রেখে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। তারপর যে কোনাে সময়ে তিনি চাইবেন, তাদের লাগাম ছাড়া চালচলন এবং অনিয়ন্ত্রিত কাজের কারণে তাদের পাকড়াও করবেন। অবশ্য কঠিন থেকে কঠিন অবস্থার মধ্যে রেখে পরীক্ষা করাটা আল্লাহর এক মহা হিকমত। তারা হতাশ হয়ে যায় এবং আল্লাহ তায়ালা তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা দূর করবেন না, যেহেতু তারা আল্লাহর নেয়ামতের শােকারী করে না এবং আল্লাহর সাথে কোনাে সম্পর্ক রাখে না। আসলে এরা আল্লাহর নিয়ম জানে না এবং তার হিকমতও বুঝে না, এরা হচ্ছে সেই জাতি যাদের কাছে সঠিক কোনাে জ্ঞান নেই। তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিকটাই শুধু জানে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ পর্যন্ত তওহীদ ও আখিরাতের বর্ণনা মিলেমিশে চলছিল। এর মধ্যে যেসব নিদর্শনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে তওহীদের প্রমাণও রয়েছে এবং এ প্রমাণগুলো আখেরাতের আগমন যে অসম্ভব নয় সে কথা প্রমাণ করে। এরপর সামনের দিকে নির্ভেজাল তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা আসছে।
# পৃথিবী ও আকাশ এবং তাদের মধ্যকার যাবতীয় জিনিসের স্রষ্টা ও মালিক হচ্ছেন আল্লাহ, মুশরিকরা একথা স্বীকার করার পর তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে কাউকে আল্লাহর সার্বভৌম সত্ত্বার গুণাবলী ও ক্ষমতার অংশীদার গণ্য করতো। তাদের কাছে প্রার্থনা করতো তাদের সামনে মানত ও নযরানা পেশ করতো এবং বন্দেগী ও পূজার অনুষ্ঠান করতো। এসব বানোয়াট শরীকদের ব্যাপারে তাদের মূল আকীদার সন্ধান পাওয়া যায় তাদের কা’বা ঘর তাওয়াফ করার সময় পঠিত “তালবীয়াহ” থেকে। এসময় তারা বলতোঃ

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ

“আমি হাজির আছি, হে আমার আল্লাহ‌ আমি হাজির আছি। তোমার কোনো শরীক নেই, তোমার নিজের শরীক ছাড়া। তুমি তারও মালিক এবং যা কিছু তার মালিকানায় আছে তারও মালিক তুমি।” (তাবারানীঃ ইবনে আব্বাস বর্ণিত) এ আয়াতটিতে মহান আল্লাহ‌ এ শিরকটিই খণ্ডন করছেন। এখানে দৃষ্টান্তটির অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ‌ প্রদত্ত সম্পদে কখনো আল্লাহরই সৃষ্টি যে মানুষ ঘটনাক্রমে তোমার দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে তোমার অংশীদার গণ্য হতে পারে না। কিন্তু তোমরা অদ্ভূত ধান্দাবাজী শুরু করেছো, আল্লাহর সৃষ্ট বিশ্ব-জাহানে আল্লাহর সৃষ্টিকে নির্দ্ধিধায় তাঁর সাথে তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বে শরীক গণ্য করছো। এ ধরনের নির্বোধ জনোচিত কথাগুলো চিন্তা করার সময় তোমাদের বুদ্ধি-জ্ঞান কি একেবারে বিনষ্ট হয়ে যায়? (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন সূরা আন নাহল ৬২ টীকা।)

# যখন কোন ব্যক্তি সহজ-সরল বুদ্ধির কথা নিজেও চিন্তা করে না এবং অন্যের বুঝাবার পরও বুঝতে চায় না তখন তার বুদ্ধির ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হয়। এরপর এমন প্রত্যেকটি জিনিস, যা কোন নিষ্ঠাবান ও বিবেকবান ব্যক্তিকে সত্য কথা পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করে, তা এ হঠকারী মূর্খতাপ্রিয় ব্যক্তিকে আরো বেশি গোমরাহীতে লিপ্ত করতে থাকে। এ অবস্থাটিকেই প্রকাশ করা হয়েছে “পথ ভ্রষ্টতা” শব্দের মাধ্যমে। সত্যপ্রিয় মানুষ যখন আল্লাহর কাছে সঠিক পথনির্দেশ লাভের সুযোগ চায় তখন আল্লাহ‌ তার সত্য আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তার জন্য বেশি করে সঠিক পথনির্দেশের কার্যকারণসমূহ সৃষ্টি করে দেন। আর গোমরাহী প্রিয় মানুষ যখন গোমরাহীর ওপর টিকে থাকার জন্য জোর দিতে থাকে তখন আল্লাহ‌ তার জন্য আবার এমন সব কার্যকারণ সৃষ্টি করে যেতে থাকেন যা তাকে বিপথগামী করে দিনের পর দিন সত্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।
# এখানে “কাজেই” শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা হচ্ছে, সত্য যখন তোমাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে এবং তোমরা যখন জানতে পেরেছো এ বিশ্ব-জাহানের ও মানুষের স্রষ্টা, মালিক ও সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন শাসনকর্তা এক আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ নয় তখন এরপর অপরিহার্য ভাবে তোমাদের কার্যধারা এ ধরনের হওয়া উচিত।
# কুরআন “দ্বীন” শব্দটিকে যে বিশেষ অর্থে পেশ করছে “দ্বীন” শব্দটি এখানে সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে বন্দেগী, ইবাদাত ও আনুগত্য লাভের অধিকার একমাত্র লা-শরীক আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারো নেই। এতে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব, গুণাবলী ক্ষমতা ও অধিকারে কাউকে তাঁর সাথে সামান্যতমও শরীক করা যায় না। এখানে মানুষ নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহ সহকারে একথা মেনে নেয় যে, সে তার সমস্ত জীবনে আল্লাহর পথনির্দেশ এবং তাঁর আইন মেনে চলবে।
# “একনিষ্ঠ হয়ে নিজের চেহারা এদিকে স্থির নিবদ্ধ করো” অর্থাৎ এরপর আবার অন্যদিকে ফিরো না। জীবনের জন্য এ পথটি গ্রহণ করে নেবার পর অন্য কোন পথের দিকে দৃষ্টি ও দেয়া যাবে না। তারপর তোমাদের চিন্তা-ভাবনা হবে মুসলমানের মতো এবং তোমাদের পছন্দ অপছন্দও হবে মুসলমানদের মতো। তোমাদের মূল্যবোধ ও মানদণ্ড হবে তাই যা ইসলাম তোমাদের দেয়। তোমাদের স্বভাব-চরিত্র এবং জীবন ও কার্যক্রমের ছাঁচ ইসলামের চাহিদা অনুযায়ী হবে। ইসলাম যে পথে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনধারা চালাবার বিধান দিয়েছে তোমাদের সে পথেই নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালিত করতে হবে।
# সমগ্র মানব জাতিকে এ প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ‌ ছাড়া তাদের আর কোন স্রষ্টা, রব, মাবুদ ও আনুগত্য গ্রহণকারী নেই। এ প্রকৃতির ওপর তোমাদের প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া উচিত। যদি স্বেচ্ছাচারীভাবে চলার নীতি অবলম্বন করো তাহলে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করবে। আর যদি অন্যের বন্দেগীর শিকল নিজের গলায় পরে নাও তাহলেও নিজের প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করবে। এ বিষয়টি নবী ﷺ বহু হাদীসে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ

مَا مِنْ مَوْلُودٍ يُولَدُ إِلاَّ عَلَى الْفِطْرَةِ ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ ، كَمَا تُنْتَجُ الْبَهِيمَةُ بَهِيمَةً جَمْعَاءَ هَلْ تُحِسُّونَ فِيهَا مِنْ جَدْعَاءَ

“মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভকারী প্রত্যেকটি শিশু আসলে মানবিক প্রকৃতির ওপরই জন্ম লাভ করে। তারপর তার মা-বাপই তাকে পরবর্তীকালে ইহুদী, খৃস্টান ও অগ্নিপূজারী হিসেবে গড়ে তোলে।”

এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন প্রত্যেকটি পশুর পেট থেকে পুরোপুরি নিখুঁত ও সুস্থ পশুই বের হয়ে আসে। কোন একটা বাচ্চাও কান কাটা অবস্থায় বের হয়ে আসে না। পরে মুশরিকরা নিজেদের জাহিলী কুসংস্কারের কারণে তার কান কেটে দেয়।

মুসনাদে আহমাদ ও নাসায়ীতে আর একটি হাদীস আছে, তাতে বলা হয়েছেঃ এক যুদ্ধে মুসলমানরা শত্রুদের শিশু সন্তানদেরকেও হত্যা করে। নবী (সা.) এর কাছে এ খবর পৌঁছে যায়। তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হন এবং বলেনঃ

مَا بَالُ أَقْوَامٍ جَاوَزَهُمُ الْقَتْلُ الْيَوْمَ حَتَّى قَتَلُوا الذُّرِّيَّةَ

“লোকদের কি হয়ে গেছে, আজ তারা সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং শিশুদেরকেও হত্যা করেছে? ”

একজন জিজ্ঞেস করলো, এরা কি মুশরিকদের সন্তান ছিল না। জবাবে তিনি বলেনঃ

إِنَّها خِيَارَكُمْ أَبْنَاءُ الْمُشْرِكِينَ

“তোমাদের সর্বোত্তম লোকেরা তো মুশরিকদেরই আওলাদ।” তারপর বলেনঃ

كُلُّ نَسَمَةٍ تُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ حَتَّى يُعْرِبَ عَنْهَ لِسَانُهَا فَأَبَوَاهَا يُهَوِّدَانِهَا اوَيُنَصِّرَانِهَا-

“প্রত্যেক প্রাণসত্ত্বা প্রকৃতির ওপর জন্ম নেয়, এমনকি যখন কথা বলতে শেখে তখন তার বাপ-মা তাকে ইহুদী খৃস্টানে পরিণত করে।”

অন্য একটি হাদীসে ইমাম আহমাদ (রা.) ঈযায ইবনে হিমার আল মুজাশি’য়ী থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, একদিন নবী ﷺ নিজের ভাষণের মাঝখানে বলেনঃ

ان ربى يقول إِنِّي خَلَقْتُ عِبَادِيَ حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ، وَإِنَّهُم أَتَتْهُمُ الشَّيَاطِينُ فَاضْلَتْهُمْ عَنْ دِينِهِمْ، وحَرَّمَتْ عَلَيْهِمْ مَا أَحْلَلْتُ لَهُمْ، وَأَمَرَتْهُمْ أَنْ يُشْرِكُوا بِي مَا لَمْ أُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا-

“আমার রব বলেন, আমার সমস্ত বান্দাদেরকে আমি একনিষ্ঠ সত্যপথাশ্রয়ী করে সৃষ্টি করেছিলাম, তারপর শয়তানরা এসে তাদেরকে দ্বীন থেকে বিপথগামী করে এবং তাদের জন্য আমি যা কিছু হালাল করে দিয়েছিলাম সেগুলোকে হারাম করে নেয় এবং তাদেরকে হুকুম দেয়, আমার সাথে এ জিনিসগুলোকে শরীক গণ্য করো, যেগুলোকে শরীক করার জন্য আমি কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করিনি।”
# আল্লাহ‌ মানুষকে নিজের বান্দায় পরিণত করেছেন। কেউ চাইলেও এ কাঠামোয় কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। মানুষ বান্দা থেকে অ-বান্দা হতে পারে না এবং আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ বানিয়ে নিলেও প্রকৃতপক্ষে সে মানুষের ইলাহ হতে পারে না। মানুষ নিজের জন্য যতগুলো উপাস্য তৈরি করে নিক না কেন, মানুষ যে, এক আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারো বান্দা নয় এ বাস্তব সত্যটি অকাট্য ও অবিচল রয়ে গেছে। মানুষ নিজের মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে যাকে ইচ্ছা আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতার ধারক গণ্য করতে পারে এবং যাকে চায় তাকে নিজের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার মালিক মনে করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ও বাস্তব সত্য এটিই যে, সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী একমাত্র আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ নয়। কেউ তাঁর মতো ক্ষমতার অধিকারী নয় এবং মানুষের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার শক্তিও আল্লাহ‌ ছাড়া কারো নেই।

এ আয়াতটির আর একটি অনুবাদ এও হতে পারেঃ “আল্লাহর তৈরি কাঠামোয় পরিবর্তন করা যাবে না।” অর্থাৎ আল্লাহ‌ যে প্রকৃতির ওপর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাকে বিকৃত করা ও ভেঙ্গে ফেলা উচিত নয়।
# শান্ত সমাহিত ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকাই সঠিক ও সহজ পথ।
# আল্লাহ অভিমুখী হওয়ার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তিই স্বেচ্ছাচারীতার নীতি অবলম্বন করে নিজের প্রকৃত মালিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অথবা যে ব্যক্তিই অন্যের বন্দেগীর পথ অবলম্বন করে নিজের রবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার এ নীতি পরিহার করতে হবে এবং প্রকৃতপক্ষে যে আল্লাহর বান্দা হিসেবে সে জন্মলাভ করেছে সেই এক আল্লাহর বন্দেগীর দিকে তাকে ফিরে যেতে হবে।
# তোমাদের মনে এ ভয় জাগরুক থাকতে হবে যে, যদি আল্লাহর জন্মগত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও তোমরা তাঁর মোকাবিলায় স্বাধীনতার নীতি অবলম্বন করে থাকো, অথবা তাঁর পরিবর্তে অন্য কারো বন্দেগী করে থাকো, তাহলে এ বিশ্বাসঘাতকতা ও নিমকহারামির জন্য তোমাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই তোমাদের এমন নীতি ও মনোভাব থেকে দূরে থাকা উচিত যা তোমাদের জন্য আল্লাহর আযাব ভোগ করাকে অবধারিত করে তোলে।
# আল্লাহর দিকে ফেরা এবং তাঁর গযবের ভয় করা-এ দু’টিই মানসিক কর্ম। এ মানসিক অবস্থাটির প্রকাশ এবং এর সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠার জন্য অনিবার্যভাবে এমন কোনো দৈহিক কর্মের প্রয়োজন যার মাধ্যমে বাইরেও প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে অমুক ব্যক্তি যথার্থই এ লা-শারীক আল্লাহর বন্দেগীর দিকে ফিরে এসেছে। মানুষের নিজের মনের মধ্যেও এ আল্লাহ‌ ভীতির দিকে ফিরে আসার অবস্থাটি একটি কার্যকর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনবরত বিকাশ লাভ করতে থাকে। তাই মহান আল্লাহ‌ এই মানসিক পরিবর্তনের হুকুম দেবার পর সাথে সাথেই এ দৈহিক কর্ম অর্থাৎ নামায কায়েম করার হুকুম দেন। মানুষের মনে যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো চিন্তা নিছক চিন্তার পর্যায়েই থাকে ততক্ষণ তার মধ্যে দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব সৃষ্টি হয় না। এ চিন্তা ভাটা পড়ে যাওয়ার চিন্তা থাকে এবং এ চিন্তার পরিবর্তন আসারও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সে সেই অনুযায়ী কাজ করতে থাকে তখন তার মধ্যে এ চিন্তা শিকড় গেড়ে বসে যেতে থাকে এবং যতই সে তদনুযায়ী কাজ করতে থাকে ততই তা শক্তিমত্তা ও দৃঢ়তা বেড়ে যেতে পেতে থাকে। এমন কি এ আকীদা ও চিন্তা পরিবর্তিত হওয়া এবং এতে ভাটা পড়ে যাওয়া ক্রমেই দুষ্কর হয়ে যেতে থাকে। এ দৃষ্টিতে বিচার করলে আল্লাহ‌ অভিমুখী হওয়া এবং আল্লাহ‌ ভীতিকে শক্তিশালী করার জন্য প্রতিদিন নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার চাইতে বেশি কার্যকর আর কোনো কাজ নেই। কারণ অন্য যে কোনো কাজই হোক না কেন তা বিলম্বে আসে অথবা নামায এমন একটি কাজ যা নিয়মিতভাবে কয়েক ঘণ্টা পরপর একটি নির্দিষ্ট আকৃতিতে মানুষকে স্থায়ীভাবে পালন করতে হয়। কুরআন ঈমান ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ যে পাঠ মানুষকে দিয়েছে তা যাতে সে ভুলে না যায় এ জন্য বারবার তার পুনরাবৃত্তি করতে হয়। তাছাড়া মানবগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কারা বিদ্রোহের নীতি পরিহার করে রবের প্রতি আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করেছে, কাফের ও মু’মিনদের কাছে একথা এ জন্য প্রকাশ হওয়া দরকার যে, এর ফলে একটি সমাজ ও দল গঠিত হতে পরে। তারা আল্লাহর পথে পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করতে পারে। ঈমান ও ইসলামের সাথে যখনই তাদের দলেরকোন ব্যক্তির সম্পর্ক ঢিলা হয়ে যেতে থাকে তখনই কোন আলামত সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র মু’মিন সমাজকে তার অবস্থা জানিয়ে দেয়। কাফেরদের কাছে এর প্রকাশ হওয়া এ জন্য প্রয়োজন যে, এর ফলে তাদের হৃদয় অভ্যন্তরে ঘুমিয়ে থাকা প্রকৃতি তার নিজের শ্রেণীর মানুষদেরকে আসল ইলাহ রব্বুল আলামীনের দিকে বার বার ফিরে আসতে দেখে জেগে উঠবে এবং যতক্ষণ তারা জাগবে না ততক্ষণ আল্লাহর অনুগতদের কর্ম তৎপরতা দেখে তাদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি হতে থাকবে। এ দু’টি উদ্দেশ্যর জন্যও নামাজ কায়েম করাই হবে সব চেয়ে বেশি উপযোগী মাধ্যম।

এ প্রসঙ্গে একথাটিও সামনে রাখতে হবে যে, নামায কায়েম করার এ হুকুমটি মক্কা মু’আয্‌যমায় এমন এক যুগে দেয়া হয় যখন মুষ্টিমেয় কয়েক জন মুসলমানের ক্ষুদ্র দলটি কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের জুলম ও নিপীড়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিল এবং এরপরও ন’বছর পর্যন্ত এ নিষ্পেষণের ধারা অব্যাহত ছিল। সে সময় দূরের কোথাও ইসলামী রাষ্ট্রের নাম নিশানা ছিল না। যদি ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া নামায অর্থহীন হয়ে থাকে, যেমন কতিপয় নাদান মনে করে থাকেন, অথবা ইকামাতে সালাত অর্থ আদতে নামায কায়েম করা না থাকে বরং “রবুবিয়াত ব্যবস্থা” পরিচালনা হয়ে থাকে, যেমন হাদীস অস্বীকারকারীরা দাবী করে থাকেন, তাহলে এ অবস্থায় কুরআন মজীদের এ ধরনের হুকুম দেয়ার অর্থ কী? আর এ হুকুম আসার পর ৯ বছর পর্যন্ত নবী ﷺ ও মুসলমানরা এ হুকুমটি কিভাবে পালন করতে থাকেন?
# ওপরে যে প্রাকৃতিক দ্বীনের কথা বলা হয়েছে মানব জাতির আসল দ্বীনই হচ্ছে সেই প্রাকৃতিক দ্বীন, এখানে এদিকেই ইশারা করা হয়েছে। এ দ্বীন মুশরিকী ধর্ম থেকে ক্রম-বিবর্তনের মাধ্যমে তাওহীদ পর্যন্ত পৌঁছে নি। যেমন আন্দাজ অনুমানের মাধ্যমে একটি ধর্মীয় দর্শন রচনাকারীরা মনে করে থাকেন। বরং দুনিয়ায় যতগুলো ধর্ম পাওয়া যায় এ সবেরই উৎপত্তি হয়েছে এ আসল দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি সাধনের মাধ্যমে। এ বিকৃতি আসার কারণ হলো এই যে, বিভিন্ন ব্যক্তি প্রাকৃতিক সত্যের ওপর নিজেদের নতুন নতুন কথা বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের জন্য এক একটি আলাদা ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই মূল সত্যের পরিবর্তে এ বর্ধিত জিনিসেরই ভক্ত অনুরক্ত হয়ে গেছে। যার ফলে তারা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র ফিরকায় পরিণত হয়েছে। এখন সঠিক পথনির্দেশনা লাভ করতে চাইলে যে প্রকৃত সত্য ছিল দ্বীনের মূল ভিত্তি, প্রত্যেক ব্যক্তিকেই সেদিকে ফিরে যেতে হবে। পরবর্তীকালের যাবতীয় বর্ধিত অংশ থেকে এবং তাদের ভক্ত-অনুরক্তদের দল থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে একেবারেই আলাদা হয়ে যেতে হবে। তাদের সাথে তারা যে সম্পর্ক সূত্রই কায়েম রাখবে সেটিই তাদের দ্বীনের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হবে।
# তাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে যে তাওহীদের প্রমাণ রয়ে গেছে একথাটিই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। যেসব সহায়কের ভিত্তিতে আশার প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল যখনই সেগুলো ভেঙে পড়তে থাকে তখনি তাদের অন্তর ভেতর থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বলে চিৎকার করতে থাকে যে, বিশ্ব-জাহানের মালিকই আসল শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী এবং তাঁরই সাহায্যে তারা নিজেদের ধ্বংসরোধ ও ক্ষতিপূরণ করতে পারে।
# অন্যান্য উপাস্যদেরকে মানত ও নযরানা পেশ করার কাজ শুরু হয়ে যায়। এই সঙ্গে একথাও বলা হতে থাকে যে, অমুক হযরতের বদৌলতে এবং অমুক মাজারের অনুগ্রহে এ বিপদ সরে গেছে।
# কোন যুক্তির ভিত্তিতে তারা একথা জানতে পারলো যে, আপদ-বিপদ থেকে আল্লাহ‌ রক্ষা করেন না বরং এসব বানোয়াট উপাস্যরা রক্ষা করে থাকে? বুদ্ধিবৃত্তি কি এর সাক্ষ্য দেয়? অথবা আল্লাহর এমন কোন কিতাব আছে কি যার মধ্যে তিনি বলেছেন, আমি আমার সার্বভৌম কর্তৃত্ব অমুক অমুক ব্যক্তিকে দিয়ে দিয়েছি, এখন থেকে তারাই তোমাদের সমস্ত কাজ করে দেবে?
# ওপরের আয়াতে মানুষের মূর্খতা ও অজ্ঞতা এবং তার অকৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাকে পাকড়াও করা হয়েছিল। এ মানুষের হীন প্রবৃত্তি ও তার সংকীর্ণমনতার জন্য তাকে পাকড়াও করা হয়েছে। এ হীনচেতা কাপুরুষটি যখন দুনিয়ায় কিছু ধন-সম্পদ, শক্তি ও মর্যাদা লাভ করে এবং দেখে তার কাজ খুব ভালোভাবে চলছে তখন এ সবকিছু যে মহান আল্লাহর দান, একথা আর তার একদম মনে থাকে না। তখন সে মনে করতে থাকে তার মধ্যে এমন অসাধারণ কিছু আছে যার ফলে সে এমন কিছু লাভ করেছে যা থেকে অন্যরা বঞ্চিত হয়েছে। এ বিভ্রান্তির মধ্যে অহংকার ও আত্মগরিমার নেশায় সে এমনই বিভোর হয়ে যায় যার ফলে সে আল্লাহ‌ ও সৃষ্টি কাউকেও ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে না। কিন্তু যখনই সৌভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে হিম্মত হারিয়ে ফেলে এবং দুর্ভাগ্যের একটিমাত্র আঘাতই তার হৃদয়াবৃত্তি ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। তখন এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, হীনতম কাজ করতেও সে কুণ্ঠিত হয় না, এমন কি শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যাও করে বসে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন :-
২৮-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:

সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ এবং তিনিই সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার হকদার, এ চিরন্তন সত্যবাণীর কথা এখানে মহান আল্লাহ উদাহরণের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। যেমন মানুষের মধ্য হতে মানুষের চাকর বা কর্মচারী থাকে। মানুষ তাদেরকে নিজেদের ধন-সম্পদে শরীক ও সমান করতে অপছন্দ করে। তাহলে আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি মানুষ, ফেরেশতা, নাবী, নেক বান্দা, বৃক্ষ ও পাথরের মতো বস্তু কিভাবে আল্লাহ তা‘আলার সমকক্ষ ও শরীক হতে পারে? অথচ এ সকল বস্তু আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি এবং তাঁরই দাস বা গোলাম। অর্থাৎ যেমন তোমাদের বিচারেই প্রথম বিষয়টি হয় না, অনুরূপ দ্বিতীয় বিষয়টিও হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে অন্যকে শরীক করা এবং তাকেও বিপদ দূরকারী, প্রয়োজন পূরণকারী হিসেবে বিশ্বাস করা নেহাত ভ্রষ্টতা।

তারপর আল্লাহ বলছেন, তোমরা কি নিজেদের অধীনস্থ দাসকে সেরূপ ভয় কর যেরূপ স্বাধীন ব্যক্তিরা একে অপরকে ভয় করে থাকে? অর্থাৎ যেমন শরীকানার ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি থেকে খরচ করতে দ্বিতীয় শরীকের জিজ্ঞাসাবাদের আশঙ্কা করে থাক অনুরূপ তোমরা কি আপন দাসকে সে ভয় করে থাক? তা কর না। কারণ, তোমরা তাদেরকে তোমাদের ধন-সম্পদে শরীক করে নিজেদের সমমর্যাদা দিতেই চাইবে না, তবে তাদের ব্যাপারে আর ভয় কিসের?

সুতরাং মানুষ যেমন নিজের সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়ে অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদেরকে অংশীদার বানাতে চায় না এবং সমমর্যাদা দিতে চায় না, তেমনি আল্লাহ তা‘আলাও কখনো তাঁর কোন বান্দা, ফেরেশতা ও সৃষ্টিকে নিজের শরীক করে নেননি। এভাবে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পরেও যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কোন মাখলূককে শরীক করে নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে তারা মূলত নিজেদের কৃপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে থাকে। এদেরকে সঠিক পথ দেখানোর কেউ নেই।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলার কোন অংশীদার নেই, তিনি একক অদ্বিতীয়।
২. নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণে সঠিক পথ পাওয়া সম্ভব নয়, সঠিক পথ পেতে হলে কুরআন ও সহীহ সুন্নার অনুসরণ করতে হবে।

৩০-৩২ নং আয়াতের তাফসীর:

(فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيْفًا)

অর্থাৎ যখন জানা গেল শির্ক অযৌক্তিক ও মহা অন্যায়। সুতরাং যাবতীয় শির্ক জাতীয় চিন্তাধারা ও আমল পরিত্যাগ করে শুধু ইসলামের দিকে মুখ কর অর্থাৎ সর্বাবস্থায় তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيْفًا ج وَلَا تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ)‏

“আর তোমাকে এও নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ‘তুমি একনিষ্ঠভাবে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হও এবং কখনই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না” (সূরা ইউনূস ১০:১০৫)

الدِّيْنِ অর্থাৎ ইসলাম, ঈমান ও ইহসান। তোমার অন্তর, শরীর ও ইচ্ছাকে দীনের বাহ্যিক যাবতীয় ইবাদত যেমন সালাত, সিয়াম, হাজ্জ, যাকাত ও অন্যান্য এবং আভ্যন্তরীণ ইবাদত যেমন ভালবাসা, ভয় করা, আশা করা, আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করা ইত্যাদির প্রতি মনোনিবেশ কর। আর শরীয়তে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ইহসান হলন তুমি এমনভাবে ইবাদত করবে যেন তুমি আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাচ্ছ আর যদি দেখতে না পাও তাহলে জেনে রেখ আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে দেখছেন।

حَنِيْفًا অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে, সব মা‘বূদ ও তাগুতকে বর্জন করে ইবাদত করবে। কোন পীর, অলী-আওলিয়া ও দরগার অভিমুখী হয়ে নয়। এভাবে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করাকেই (فِطْرَتَ اللّٰهِ) বলা হয়েছে। এ ফিতরাতের ওপর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

কুরআন ও হাদীসে ফিতরাত দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে:
১. ইসলাম। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: প্রত্যেক সন্তান ফিতরাতের ওপর জন্ম গ্রহণ করে। অর্থাৎ ইসলামের ওপর জন্ম গ্রহণ করে। অতঃপর পিতা-মাতা তাকে ইয়াহূদী বানায় অথবা খ্রিস্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়। (সহীহ বুখারী হা: ১৩৫৮, সহীহ মুসলিম হা: ২৬৫৮)

২. রাসূলদের সুন্নাত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছেন যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: পাঁচটি কাজ করা ফিতরাতের অন্তর্ভুক্তন খাতনা করা, নাভির নিচের পশম পরিস্কার করা, বগলের পশম তোলা, নখ খাট করা ও গোঁফ খাট করা। (সহীহ বুখারী হা: ৫৮৮৯, সহীহ মুসলিম হা: ২৫৭)

অর্থাৎ এ ফিতরাত ও দীনের আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কোন পরিবর্তন নেই। এর বিপরীত কোন নির্দেশ আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত সকলকে ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নির্দেশ বহাল থাকবে। এটাই হল মজবুত দীন। এ দীন দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা সকল নাবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন, এ দীনের অনুসরণ করলেই তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে পৌঁছে দিবে। কিন্তু এ সঠিক দীন সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের জ্ঞান নেই, ফলে আল্লাহ তা‘আলাকে পাওয়ার জন্য পীর-ফকিরের অসিলা ধরে। আর কতক জনের জ্ঞান থাকলেও তা মেনে চলে না।

(مُنِيْبِيْنَ إِلَيْهِ) – اناب، ينيب

অর্থ অভিমুখী হওয়া, অর্থাৎ তুমি নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে। অন্তর এবং শরীর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার দিকেই অভিমুখী হবে, তাঁর দিকেই মুতাওজ্জুহ হবে। কোন বাবা, পীর ও দরগার দিকে মুতাওজ্জুহ হওয়া যাবে না। এতে শরীয়তের বাহ্যিক-আভ্যন্তরীণ সকল ইবাদত শামিল। তা দেখা যাক আর না দেখা যাক। যেমন সালাত আদায় করা একটি বাহ্যিক ইবাদত, তা দেখা যায়। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অভিমুখী হয়ে তাঁর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য সালাত আদায় করতে হবে। ভয় করা একটি ইবাদত যা দেখা যায় না। ভয় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই করতে হবে, যে ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ কোন ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না সে ক্ষেত্রে কোন পীর, বাবা বা অন্য কেউ ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে এ বিশ্বাস করা যাবে না, এটা শির্ক।

(وَاَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ)

সালাত কায়েম কর, আর আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা করে বলেন: তারা তাদের দীনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছে অথচ পৃথিবীর বুকে দীন মাত্র একটি, তাহল সবাই এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু এ মুশরিকরা কেউ প্রতিমার পূজা করে, কেউ আগুনের পূজা করে, কেউ চন্দ্র-সূর্যের পূজা করে, কেউ সৎ ব্যক্তিদের পূজা করে। এভাবে তারা দীনকে বিভক্ত করে নিয়েছে। উচ্চ বংশের লোকেরা যার ইবাদত করবে নিচু বংশের লোকেরা তার ইবাদত করতে পারবে না একশ্রেণির লোকদের ইবাদত করতে হয় না, তারা মারেফতের জগতে চলে গেছে আরেক শ্রেণি যারা ততদূর পৌঁছতে পারেনি তাদের ইবাদত করতে হয়। এটা দীনকে বিভক্ত করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়া ছাড়া কিছুই নয়। পূর্বে ইয়াহূদী-খ্রিস্টানেরা তাদের ধর্মে মনমত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করে দলে দলে বিভক্ত হয়েছিল। মূলত আল্লাহ তা‘আলা এসব বাণী দ্বারা মুসলিমদেরকে সতর্ক করছেন যারা দীনকে বিভাজন করে নিয়ে নিজেরা বিভক্ত হয়ে গেছে তাদের মত তোমরাও হয়ো না। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْم بَعْدِ مَا جَا۬ءَهُمُ الْبَيِّنٰتُ ط وَأُولٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ)

“তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তাদের কাছে প্রমাণ আসার পর মতভেদে লিপ্ত হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।” (সূরা আলি ইমরান ৩:১০৫)

شِيَعًا শব্দটি شيعة এর বহুবচন। অর্থ দল, মত ইত্যাদি।

فَرِحُوْنَ অর্থাৎ যে দলের কাছে যে সকল দলীল-প্রমাণ রয়েছে তা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট। তারা তাদের দলীল-প্রমাণ দ্বারা মনে করে আমরাই হক অন্য সবাই বাতিল।

সুতরাং পৃথিবীর বুকে দীন একটাইন আর তা হল ইসলাম। সকলে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে এ দীন দিয়ে যুগে যুগে অসংখ্য নাবী-রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে। যারা এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত থেকে বের হয়ে গেছে তারাই বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয় তারা ইসলামের বাইরে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. দীনে হানীফে তথা তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে।
২. প্রত্যেক মানুষ ইসলাম ও তাওহীদের ওপর জন্মগ্রহণ করে।
৩. আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি পদ্ধতির কোনই পরিবর্তন-পরিবর্ধন নেই।
৪. সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্যের মাপকাঠি না।
৫. একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই ভয় করতে হবে।
৬. দীনের ওপর সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে যার যার খেয়াল-খুশিমত দল বা তরীকা তৈরী করে বিভক্ত হওয়া যাবে না।
৭. সকল ইবাদতে মুতাওজ্জুহ হতে হবে আল্লাহ তা‘আলার দিকে; অন্য কারো দিকে নয়।

৩৩-৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:

এ আয়াতগুলোতে মূলত অধিকাংশ মানুষের চিরাচরিত স্বভাব ও অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যখনই মানুষ কোন বিপদ-আপদ দ্বারা আক্রান্ত হয়। যেমন অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ, ঝড়-তুফান, সমুদ্রের ঢেউয়ে ডুবে যাওয়ার আশংকা করা ইত্যাদি তখনই একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে আহ্বান করে এবং তাদের বাতিল মা‘বূদেরকে অস্বীকার করে। অতঃপর যখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এ বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দান করেন তখনই তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করে। মক্কার মুশরিকদের এরূপ স্বভাব ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের একশ্রেণির মুসলিম মক্কার মুশরিকদের থেকেও জঘন্য। এসব নামধারী মুসলিমরা বিপদে পড়লে বিভিন্ন বাবার মাযারে, দরগাহে ও পীর সাহেবদের কাছে যায়। অথচ উচিত ছিল একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাওয়া ও তাঁর অভিমুখী হওয়া। এ সম্পর্কে ইতোপূর্বে সূরা আনকাবুতের ৬৫-৬৬, সূরা হূদের ৯-১০ নং আয়াতসহ অন্যান্য স্থানেও আলোচনা করা হয়েছে।

 

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২৮-২৯ নং আয়াতের তাফসীর

মক্কার কুরায়েশরা ও মুশরিকরা তাদের বুযর্গদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করতো। সেই সাথে তারা এটাও বিশ্বাস করতো যে, এরা সবাই আল্লাহর বান্দা ও তার অধীনস্থ। সুতরাং তারা হজ্ব ও উমরার সময় (আরবি) বলার সাথে সাথে বলতোঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আমি আপনার নিকট হাযির আছি, আপনার কোন শরীক বা অংশীদার নেই, কিন্তু এই শরীক যে নিজে এবং যে জিনিসের সে মালিক, সবই আপনার অধিকারভুক্ত।” অর্থাৎ শরীকরা এবং তারা যা কিছুর মালিক তার সব কিছুর মালিক আপনিই। সুতরাং তাদেরকে এমন এক দৃষ্টান্ত দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যা তারা স্বয়ং নিজেদেরই মধ্যে পেয়ে থাকে এবং যেন তারা একথাটা নিয়ে ভালভাবে চিন্তা ভাবনা করে দেখতে পারে। তাদেরকে বলা হচ্ছে- যা তোমরা বলছো তাতে তোমরা নিজেরাই কি সম্মত হবে? মালিকের ধন-সম্পদের উপর তার গোলাম কি সমানভাবে মালিক হয়? আর সব সময় কি তার এ উৎকণ্ঠা থাকে যে, তার গোলামরা তার ধন-সম্পদ বন্টন করে নিয়ে যাবে? না, তা কখনোই নয়। তাই তাদেরকে বলা হচ্ছে- যখন তোমরা নিজেদের জন্যে এটা পছন্দ কর না যে, গোলামরা তোমাদের ধন-সম্পদের অংশীদার হয়ে যাক, তখন আল্লাহ তা’আলার জন্যে তা পছন্দ করতে পার কি করে? যেমন গোলাম মালিকের সমকক্ষ হতে পারে না, তেমনই আল্লাহর কোন বান্দা তার শরীক ও সমকক্ষ হতে পারে না। সত্যিই এ ধরনের কথা অতি বিস্ময়কর ও বে-ইনসাফি বটে। কি করে মানুষ আল্লাহর জন্যে এমন কিছু প্রমাণ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে যেতে পারে যা তারা নিজেদের জন্যে চিন্তা করতে কষ্ট পায়। নিজেদের কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে শুনলেই তারা দুঃখিত হয় এবং মুখ কালো করে

ফেলে। তারাই আবার আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাদেরকে তাঁর কন্যা। বলে থাকে। এটা অতি অবিচারমূলক কথা নয় কি? অনুরূপভাবে নিজেদের গোলামদেরকে যারা নিজেদের শরীক মনে করতে কখনই পারে না, তারাই আবার কি করে আল্লাহর বান্দা বা দাসকে তার শরীক মনে করে? এগুলো চরম অবিচারমূলক কথা।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কাফিররা লাব্বায়েক বলতো এবং লা শারীকা লাকা বলে আল্লাহর অংশীদার উড়িয়ে দিতো। তারাই আবার পরক্ষণে তার শরীক সাব্যস্ত করে তার আনুগত্য স্বীকার করে নিতো। এ কারণেই এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। বলা হয়েছেঃ তুমি যখন নিজ গোলামকে শরীক স্বীকার করতে পার না তখন আল্লাহর বান্দাকে তার শরীক মনে কর কোন বিচারে? এ পরিষ্কার কথাটা বলার পর ইরশাদ হচ্ছে- এভাবেই আমি বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের নিকট নিদর্শনাবলী বিবৃত করি।’ মুশরিকদের কাছে জ্ঞান সম্মত ও শরীয়ত সম্মত কোনই দলীল নেই। তারা যা কিছু বলছে সবই অজ্ঞতা ও প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই বলছে। যখন তারা হক পথ হতে সরে গেছে তখন তাদেরকে আল্লাহ ছাড়া কেউই হক পথে আনতে পারবে না। তাদের কোন সাহায্যকারী নেই। কে আছে যে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠোট হেলাতে পারে? কে আছে যে তার উপর দয়া করতে পারে যার উপর আল্লাহ দয়া না করেন? তিনি যা চান তাই হয় এবং যা চান না তা হয় না।
৩০-৩২ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তোমরা একনিষ্ঠ হয়ে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও, যে দ্বীনকে আল্লাহ পাক তোমাদের জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। হে নবী (সঃ)! যে দ্বীনকে আল্লাহ তোমার হাতে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। প্রতিপালকের শান্তিপূর্ণ প্রকৃতির উপর তারাই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে যারা এই দ্বীনে ইসলামের অনুসারী। এরই উপর অর্থাৎ তাওহীদের উপর আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি রোজে আযলের উপর সকলকে অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছেন। তিনি সেই দিন বলেছিলেনঃ “আমি কি তোমাদের সবারই প্রতিপালক নই?” তখন সবাই সমস্বরে উত্তর দিয়েছিলঃ “হ্যা, অবশ্যই আপনি আমাদের প্রতিপালক।” হাদীসটি ইনশাআল্লাহ সত্বরই বর্ণনা করা হবে।

আল্লাহ তা’আলা সমগ্র সৃষ্টিকে নিজ দ্বীনের উপর সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তী সময়ে লোকেরা কেউ ইয়াহূদিয়্যাৎ কেউ নাসরানিয়্যাৎ ককূল করে নিয়েছে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমরা আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। ইমাম বুখারী (রঃ) এ অর্থই করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির অর্থ দ্বীন ও ফিতরাতে ইসলাম।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক শিশু ফিত্রাত বা প্রকৃতির উপর ভূমিষ্ট হয়ে থাকে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও মাজুসী করে গড়ে তোলে। যেমন বকরীর নিখুঁত বাচ্চা পয়দা হয়। অতঃপর বকরীর মালিক ওর কান কেটে দেয়। তারপর তিনি (আরবি) এ আয়াতটি, তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আসওয়াদ ইবনে সারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট গমন করি ও তাঁর সাথে (কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। আল্লাহর ফলে আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করি। সেদিন মুসলমানরা বহু কাফিরকে হত্যা করে, এমনকি ছোট ছোট শিশুদের উপরও তারা হস্তক্ষেপ করে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জানতে পেরে খুব অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! এটা কেমন ধারা হলো যে, তোমরা সীমালংঘন করলে? কি করে আজ ছোট ছোট শিশুদেরকে হত্যা করা হলো?” কোন এক ব্যক্তি উত্তরে বললো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তারাও তো কাফিরদের সন্তান?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “না! না জেনে রেখো যে, কাফিরদের শিশুরা তোমাদের অপেক্ষা বহুগুণে উত্তম। সাবধান! শিশুদেরকে কখনো হত্যা করো না। যারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক তাদেরকে হত্যা করা হতে বিরত থাকবে। প্রত্যেক শিশু ফিত্রাতের উপর পয়দা হয়। তারা যা বলে তা ফিত্রাত মুতাবেকই বলে। তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে ইয়াহূদী ও নাসরানী করে গড়ে তোলো।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক শিশুই ফিত্রাতের উপর জন্মগ্রহণ করে, অতঃপর তারা কথা বলতে শিখে। তারপর সে হয়তো অকৃতজ্ঞ (কাফির) হয়ে যায় অথবা কৃতজ্ঞ (মুসলমান) হয়ে যায়।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মুশরিকদের সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “যখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে সৃষ্টি করেন তখন হতেই তিনি জানেন যে, তারা বড় হলে কি আমল করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার উপর এমন এক যুগ এসেছে যে, আমি বলতাম, মুসলমানদের সন্তানরা মুসলমানদের সাথে এবং মুশরিকদের সন্তানরা মুশরিকদের সাথে হবে। শেষ পর্যন্ত অমুক ব্যক্তি আমাকে অমুক ব্যক্তি হতে শুনালো যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মুশরিকদের সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাবে বলেনঃ “তারা বড় হলে কি ধরনের কাজ করবে ও কি মতামত গ্রহণ করবে তা আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত আইয়াম ইবনে হিমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি ভাষণে বলেন, আল্লাহ তা’আলা আমাকে আদেশ করেছেন যে, আজ তিনি আমাকে যা শিখিয়েছেন এবং তোমরা যা হতে অজ্ঞ রয়েছ, আমি যেন তা তোমাদেরকে শিখিয়ে দিই। আল্লাহ বলেছেনঃ “আমি আমার বান্দাদেরকে যা, দিয়েছি তা তাদের জন্যে হালাল করেছি। আমি আমার সমস্ত বান্দাকে একনিষ্ঠ খাটি ধর্মের অনুসারী করেছি। শয়তান তাদে থেকে বিভ্রান্ত করে দেয়। হালাল বস্তুকে তাদের জন্যে হারাম করে এবং আমার সাথে শরীক স্থাপন করার জন্যে তাদেরকে প্ররোচিত করে। সে এমন কথা বলে যার কোন দলীল প্রমাণ নেই।” আল্লাহ তাআলা দুনিয়াবাসীর প্রতি লক্ষ্য করেছেন এবং আরব আজম সকলকে তিনি অপছন্দ করেছেন। শুধু গুটিকতক আহলে কিতাবকে তিনি পছন্দ করেছেন। তিনি আমাকে বলেনঃ “আমি তোমাকে শুধু পরীক্ষার জন্যে পাঠিয়েছি। তোমারও পরীক্ষা নেয়া হবে এবং তোমার কারণে সবারই পরীক্ষা নেয়া হবে। আমি তোমার উপর এমন কিতাব অবতীর্ণ করবো যা পানি দিয়ে ধৌত করা যাবে না। তুমি ওটা উঠতে বসতে পাঠ করতে থাকবে।” অতঃপর আল্লাহ তাআলা আমাকে বলেছেন যে, আমি যেন কুরায়েশদেরকে সাবধান করে দিই। আমি আশংকা প্রকাশ করলাম যে, তারা হয়তো আমার মস্তক খুলে নিয়ে রুটি বানিয়ে নেবে। তখন আমার প্রতিপালক আমাকে বললেনঃ “জেনে রেখো যে, তাদেরকে আমি বের করে দেবো। যেমন তারা তোমাকে বের করে দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তুমি যুদ্ধ কর, আমি তোমাকে সাহায্য করবো। তুমি খরচ কর, তোমার উপর খরচ করা হবে। তুমি সৈন্য পাঠিয়ে দাও, আমি আরো পাঁচগুণ সৈন্য পাঠিয়ে দেবো। তুমি তোমার অনুগতদেরকে সাথে নিয়ে নাফরমানদের উপর আক্রমণ চালিয়ে দাও।” জান্নাতীরা তিন প্রকারের হয়ে থাকে। প্রথম প্রকার হলো ন্যায় বিচারক বাদশাহ, যাকে সঙ্কর্মের তাওফীক দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকার হলো এমন মেহেরবান সহৃদয় লোক যে প্রত্যেক আত্মীয়ের জন্যেই কোমল। তৃতীয় প্রকার হলো ঐ পাকদামান মুসলমান যে ভিক্ষা বৃত্তি হতে বেঁচে থাকে। অথচ পরিবারস্থ বহু লোকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত। আর জাহান্নামীরা পাঁচ প্রকারের হয়ে থাকে। প্রথম প্রকার হলো ঐ দুর্বল ব্যক্তি যার আকল বা জ্ঞান নেই, সে তোমাদের মধ্যে তোমাদের অনুসারী বা তাবে’ স্বরূপ। তারা (হালাল) স্ত্রী ও (হালাল) মাল তালাশ করে না। দ্বিতীয় প্রকার হলো এমন খিয়ানতকারী যার কোন লাভ তার জন্যে লুক্কায়িত থাকে না, যদিও ছোট হয়, কিন্তু সে খিয়ানত করবেই। তৃতীয় প্রকার হলো ঐ ব্যক্তি যে সকাল বিকাল তোমাকে তোমার পরিবার ও মাল হতে ধোকা দেয়। তারপর তিনি কৃপণতা ও মিথ্যার এবং বদখাসলত অশ্লীলভাষীর উল্লেখ করেন। (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে)

মহান আল্লাহ বলেনঃ এটাই সরল দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। তারা অজ্ঞানতার কারণেই আল্লাহর পবিত্র দ্বীন হতে দূরে সরে যায়, ফলে দ্বীন হতে বঞ্চিত হয়ে যায়। যেমন অন্য আয়াতে তিনি বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমার লালসা থাকলেও অধিকাংশ লোক ঈমানদার নয়।” (১২:১০৩) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যদি তুমি ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানরত অধিকাংশের অনুসারী হও তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে ভ্রষ্ট করে ফেলবে।” (৬:১১৭)

মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা বিশুদ্ধ চিত্তে তার অভিমুখী হয়ে তাঁকে ভয় কর, তাঁরই দিকে ঝুঁকে থাকে এবং তাঁরই দিকে মনোনিবেশ কর। তোমরা নামায কায়েম কর যা সব থেকে বড় ইবাদত এবং সবচেয়ে বড় আনুগত্য। তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। তোমরা নিখুঁতভাবে তার একত্বে বিশ্বাসী হও। তাকে ছেড়ে তোমার মনোবাসনা অন্যের কাছে পূরণের আশা করো না।

হযরত মুআয (রাঃ)-এর কাছে হযরত উমার (রাঃ) এ আয়াতের অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেনঃ “এগুলো তিনটি জিনিস এবং এগুলোই নাজাতের উপায়। প্রথম হলো আন্তরিকতা, যা হলো ফিত্রাত বা প্রকৃতি, যার উপর আল্লাহ তা’আলা সমগ্র সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয় হলো নামায। প্রকৃতপক্ষে এটাই দ্বীন। তৃতীয় হলো ইতাআত বা আনুগত্য। এটাই হলো মানুষের জন্যে রক্ষাকবচ।” একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “আপনি ঠিকই বলেছেন। তাহলে তো আপনাকে মুশরিকদের সাথে মেলামেশা করতে হবে না এবং তাদের কোন কাজে সাহায্য করা চলবে না। তাদের মত কোন কাজই করা যাবে না।”

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমরা ঐ মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে না যারা নিজেদের দ্বীনকে বদল করে দিয়েছে, কোন কোন কথা মেনে নিয়েছে এবং কোন কোন কথা অস্বীকার করেছে।

(আরবি)-এর দ্বিতীয় পঠন রয়েছে। (আরবি) অর্থাৎ তারা দ্বীনকে ছেড়ে দিয়েছে। যেমন ইয়াহুদী, নাসারা, অগ্নিপূজক, মূর্তিপূজক ও অন্যান্য বাতিল পন্থীরা কার্যতঃ তাদের দ্বীনকে ছেড়ে দিয়েছিল। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “যারা নিজেদের দ্বীনে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও, তাদের বিষয়টি আল্লাহর প্রতি অর্পিত।” (৬:১৫৯)

উম্মতে মুহাম্মদী (সঃ)-এর পূর্বে যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তারা সবাই বাতিল দ্বীনকে ধারণ করে নিয়েছিল। প্রত্যেক দলই দাবী করতো যে, তারা সত্য দ্বীনের উপর রয়েছে এবং অন্যান্য সব দলই বিপথে আছে। আসলে হক বা সত্য তাদের সব দল হতেই লোপ পেয়েছিল। এই উম্মতের মধ্যেও বিভিন্ন দল সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে একটি দল সত্যের উপর রয়েছে এবং অন্যান্য সব দলই বিভ্রান্ত। এই সত্যপন্থী দলটি হলো আত্মলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত, যারা আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতে রাসূল (সঃ)-কে ম্যবৃতভাবে ধারণ করে রয়েছে যার উপর সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন ও মুসলিম ইমামগণ ছিলেন। পূর্বযুগেও এবং এখনও। যেমন মুসতাদরাকে হাকিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মুক্তিপ্রাপ্ত দলটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ ‘মুক্তিপ্রাপ্ত দল ঐটি যারা ওরই অনুসরণ করবে যার উপর আজ আমি ও আমার সাহাবীগণ রয়েছি।”
৩৩-৩৬ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাব ও অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন যে, যখন তাদের। উপর দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ আপতিত হয় তখন অংশীবিহীন আল্লাহর কাছে তারা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কষ্ট ও বিপদ হতে মুক্তিলাভের জন্যে প্রার্থনা করে। তারপর যখন আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নিয়ামত তাদের উপর বর্ষণ করেন তখন তারা তার সাথে শিরক করতে শুরু করে দেয়।

(আরবি)-এর (আরবি)-কে কেউ কেউ (আরবি) বলেন, আবার কেউ কেউ। (আরবি) বলেন। এখানে (আরবি) ই এ বাক্যের জন্যে উত্তম বলে মনে হচ্ছে। কেননা, আল্লাহ তাআলা এটা তাদের জন্যে নির্ধারণ করেছেন, অতঃপর তাদেরকে ধমক দিচ্ছেন যে, শীঘ্রই তারা জানতে পারবে।

কোন কোন বুযুর্গ ব্যক্তি বলেনঃ “যদি পুলিশ কাউকে ভয় দেখায় ও ধমক দেয় তবে সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাহলে এটা বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার যে, ঐ সত্তার ধমকে আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হই না যার অধিকারে সব কিছুই রয়েছে এবং কোন কিছু করার জন্যে হও’ বলাই যার জন্যে যথেষ্ট।”

অতঃপর মুশরিকদের নিকট কোন দলীল প্রমাণ না থাকার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ পাক বলেনঃ আমি তাদের শিরকের কোন দলীল অবতীর্ণ করিনি।

এরপর অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী মানুষের একটি বদ-স্বভাবের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। অতি অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া সব মানুষই সুখের সময় আল্লাহকে ভুলে যায়।

Leave a Reply