(বই#১০৩৮)   [ ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ :-] www.motaher21.net সূরা:- ৩১:লুকমান পারা:২১ ২০-৩৪ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৩৮)
[ ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩১:লুকমান
পারা:২১
২০-৩৪ নং আয়াত:-
৩১: ২০
اَلَمۡ تَرَوۡا اَنَّ اللّٰہَ سَخَّرَ لَکُمۡ مَّا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ وَ اَسۡبَغَ عَلَیۡکُمۡ نِعَمَہٗ ظَاہِرَۃً وَّ بَاطِنَۃً ؕ وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یُّجَادِلُ فِی اللّٰہِ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ وَّ لَا ہُدًی وَّ لَا کِتٰبٍ مُّنِیۡرٍ ﴿۲۰﴾
তোমরা কি দেখো না, আল্লাহ‌ যমীন ও আসমানের সমস্ত জিনিস তোমাদের জন্য অনুগত ও বশীভুত করে রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও গোপন নিয়ামতসমূহ সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন? এরপর অবস্থা হচ্ছে এই যে, মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহ‌ সম্পর্কে বিতর্ক করে, তাদের নেই কোনো প্রকার জ্ঞান, পথনির্দেশনা বা আলোক প্রদর্শনকারী কিতাব।
৩১:২১
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ اتَّبِعُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَا وَجَدۡنَا عَلَیۡہِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ لَوۡ کَانَ الشَّیۡطٰنُ یَدۡعُوۡہُمۡ اِلٰی عَذَابِ السَّعِیۡرِ ﴿۲۱﴾
আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর’, তখন তারা বলে, ‘আমাদের বাপ-দাদাকে যাতে পেয়েছি আমরা তো তাই মেনে চলব।’ যদিও শয়তান তাদেরকে দোযখ-যন্ত্রণার দিকে আহবান করে,?
৩১:২২
وَ مَنۡ یُّسۡلِمۡ وَجۡہَہٗۤ اِلَی اللّٰہِ وَ ہُوَ مُحۡسِنٌ فَقَدِ اسۡتَمۡسَکَ بِالۡعُرۡوَۃِ الۡوُثۡقٰی ؕ وَ اِلَی اللّٰہِ عَاقِبَۃُ الۡاُمُوۡرِ ﴿۲۲﴾
যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং কার্যত সে সৎকর্মশীল, সে তো বাস্তবিকই শক্ত করে আঁকড়ে ধরে একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। আর যাবতীয় বিষয়ের শেষ ফায়সালা রয়েছে আল্লাহরই হাতে।
৩১:২৩
وَ مَنۡ کَفَرَ فَلَا یَحۡزُنۡکَ کُفۡرُہٗ ؕ اِلَیۡنَا مَرۡجِعُہُمۡ فَنُنَبِّئُہُمۡ بِمَا عَمِلُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۲۳﴾
আর কেউ কুফরী করলে তার কুফরী যেন আপনাকে কষ্ট না দেয় । আমাদের কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমরা তাদেরকে তারা যা করত সে সম্পর্কে অবহিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ্ অন্তরসমূহে যা রয়েছে সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।
৩১:২৪
نُمَتِّعُہُمۡ قَلِیۡلًا ثُمَّ نَضۡطَرُّہُمۡ اِلٰی عَذَابٍ غَلِیۡظٍ ﴿۲۴﴾
আমি স্বল্পকাল তাদেরকে দুনিয়ায় ভোগ করার সুযোগ দিচ্ছি, তারপর তাদেরকে টেনে নিয়ে যাবো একটি কঠিন শাস্তির দিকে।
৩১:২৫
وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَہُمۡ مَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ لَیَقُوۡلُنَّ اللّٰہُ ؕ قُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ ؕ بَلۡ اَکۡثَرُہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۵﴾
তুমি যদি ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর, ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন?’ তাহলে ওরা নিশ্চয় বলবে, ‘আল্লাহ।’বল, ‘সর্বপ্রশংসা আল্লাহরই’; কিন্তু ওদের অধিকাংশই জানে না।
৩২:২৬
لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿۲۶﴾
আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তা আল্লাহরই; নিশ্চয় আল্লাহ্, তিনি তো অভাবমুক্ত, চির প্রশংসিত ।
৩১:২৭
وَ لَوۡ اَنَّ مَا فِی الۡاَرۡضِ مِنۡ شَجَرَۃٍ اَقۡلَامٌ وَّ الۡبَحۡرُ یَمُدُّہٗ مِنۡۢ بَعۡدِہٖ سَبۡعَۃُ اَبۡحُرٍ مَّا نَفِدَتۡ کَلِمٰتُ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ ﴿۲۷﴾
পৃথিবীর সমস্ত বৃক্ষ যদি কলম হয় এবং এ যে সমুদ্র এর সাথে যদি আরও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও আল্লাহর বাণী (লিখে) শেষ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
৩১:২৮
مَا خَلۡقُکُمۡ وَ لَا بَعۡثُکُمۡ اِلَّا کَنَفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ ؕ اِنَّ اللّٰہَ سَمِیۡعٌۢ بَصِیۡرٌ ﴿۲۸﴾
তোমাদের সমগ্র মানবজাতিকে সৃষ্টি করা এবং তারপর পুনর্বার তাদেরকে জীবিত করা (তার জন্য) নিছক একটিমাত্র প্রাণী (সৃষ্টি করা এবং তাকে পুনরুজ্জীবিত) করার মতই ব্যাপার। আসলে আল্লাহ‌ সবকিছুই শোনেন ও দেখেন।
৩১:২৯
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ یُوۡلِجُ الَّیۡلَ فِی النَّہَارِ وَ یُوۡلِجُ النَّہَارَ فِی الَّیۡلِ وَ سَخَّرَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ۫ کُلٌّ یَّجۡرِیۡۤ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی وَّ اَنَّ اللّٰہَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ ﴿۲۹﴾
তুমি কি দেখো না, আল্লাহ‌ রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে আসেন এবং দিনকে রাতের মধ্যে? তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মের অধীন করে রেখেছেন, সবই চলছে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। আর (তুমি কি জানো না) তোমরা যা কিছুই করো না কেন আল্লাহ‌ তা জানেন।
৩১:৩০
ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡحَقُّ وَ اَنَّ مَا یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہِ الۡبَاطِلُ ۙ وَ اَنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡعَلِیُّ الۡکَبِیۡرُ ﴿٪۳۰﴾
এ সবকিছু এ কারণে যে, আল্লাহই হচ্ছেন সত্য এবং তাকে বাদ দিয়ে অন্য যেসব জিনিসকে এরা ডাকে তা সবই মিথ্যা, আর আল্লাহই সমুচ্চ ও শ্রেষ্ঠ।
৩১:৩১
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ الۡفُلۡکَ تَجۡرِیۡ فِی الۡبَحۡرِ بِنِعۡمَتِ اللّٰہِ لِیُرِیَکُمۡ مِّنۡ اٰیٰتِہٖ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّکُلِّ صَبَّارٍ شَکُوۡرٍ ﴿۳۱﴾
তুমি কি দেখো না সমুদ্রে নৌযান চলে আল্লাহর অনুগ্রহে, যাতে তিনি তোমাদের দেখাতে পারেন তার কিছু নিদর্শন। আসলে এর মধ্যে রয়েছে বহু নিদর্শন প্রত্যেক সবর ও শোকরকারীর জন্য।
৩১:৩২
وَ اِذَا غَشِیَہُمۡ مَّوۡجٌ کَالظُّلَلِ دَعَوُا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۚ فَلَمَّا نَجّٰہُمۡ اِلَی الۡبَرِّ فَمِنۡہُمۡ مُّقۡتَصِدٌ ؕ وَ مَا یَجۡحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا کُلُّ خَتَّارٍ کَفُوۡرٍ ﴿۳۲﴾
আর যখন তরঙ্গ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ছায়ার মত , তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে পৌঁছান তখন তাদের কেউ কেউ মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে ; আর শুধু বিশ্বাসঘাতক, কাফির ব্যক্তিই আমাদের নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে।
৩১:৩৩
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمۡ وَ اخۡشَوۡا یَوۡمًا لَّا یَجۡزِیۡ وَالِدٌ عَنۡ وَّلَدِہٖ ۫ وَ لَا مَوۡلُوۡدٌ ہُوَ جَازٍ عَنۡ وَّالِدِہٖ شَیۡئًا ؕ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّکُمُ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا ٝ وَ لَا یَغُرَّنَّکُمۡ بِاللّٰہِ الۡغَرُوۡرُ ﴿۳۳﴾

হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর এবং সেদিনকে ভয় কর, যেদিন পিতা সন্তানের কোন উপকারে আসবে না, সন্তানও তার পিতার কোন উপকারে আসবে না। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং শয়তান যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে।
৩১:৩৪
اِنَّ اللّٰہَ عِنۡدَہٗ عِلۡمُ السَّاعَۃِ ۚ وَ یُنَزِّلُ الۡغَیۡثَ ۚ وَ یَعۡلَمُ مَا فِی الۡاَرۡحَامِ ؕ وَ مَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌ مَّاذَا تَکۡسِبُ غَدًا ؕ وَ مَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌۢ بِاَیِّ اَرۡضٍ تَمُوۡتُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ ﴿٪۳۴﴾
নিশ্চয় আল্লাহ্ , তাঁর কাছেই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা মাতৃগর্ভে আছে। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্‌ স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।

ফী জিলালিল কুরআন‌ বলেছেন:-

কোরআনে আল্লাহর পথে আহবানকারীর মূল দায়িত্ব বলা হয়েছে, ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ ধৈর্য দৃঢ়তা, নীচু আওয়াজ, মধ্যমপন্থা পদচারণা, মধুর বাচনভংগী কর্কষ কণ্ঠস্বর বর্জন। এসব বৈশিষ্ট উল্লেখের পর তৃতীয় স্তরে মানব জীবনের কল্যাণার্থে তাদের জীবন ধারার সাথে ওৎপ্রােতভাবে জড়িত আল্লাহ তায়ালার অন্তহীন কুদরত ও প্রাকৃতিক নিদর্শনসমূহের প্রতি এখানে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ হচ্ছে সকল নেয়ামত, যা থেকে তােমরা প্রতিনিয়ত জীবনধারণের বিভিন্ন উপায় উপকরণ গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালার এ অন্তহীন নেয়ামত, অনুগ্রহ ও অশেষ অনুদান ভােগ করেও তােমাদের হৃদয়ে আল্লাহর সাথে দ্বন্দে ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হতে এতটুকু লজ্জা ও অনুতপ্ততার অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে না। এমনিভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে মানুষের ব্যাধি সমূহের নিরাময়ের ব্যবস্থা বলার পর অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল পন্থায় তৃতীয় স্তরে মানসিক ব্যাধিসমূহ দূরীকরণের পন্থা বাতলিয়ে দেয়া হচ্ছে।  *অসংখ্য নেয়ামতে ঘেরা আমাদের জীবন : এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমরা কি লক্ষ্য করাে না যে, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের… যদিও শয়তান তাদেরকে ভীষণ শাস্তির দিকেই আহ্বান জানায়।'(আয়াত ২০-২১) এ ভাষ্য কোরআনুল কারীমে বিভিন্ন বাচনভংগী ও পদ্ধতিতে বারবার উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রত্যেকবারই তা একটি নবতর আবেদনে উদ্ভাসিত হয়েছে। মানব মন গভীর অনুভূতি ও আবেগ সহকারে যতবার প্রকৃতি জগতে আল্লাহর অসীম কুদরতসমূহ নিদর্শন করবে ও আল্লাহর অনুগ্রহসমূহের প্রতি চিন্তা ও গবেষণায় নিয়ােজিত হবে তততবারই তা নতুন নতুন রূপ নিয়ে তার কছে প্রকাশিত হবে। মানুষ যখন গভীর মনােনিবেশ সহকারে আকাশ ও যমীনে আল্লাহ তায়ালার অন্তহীন সৃষ্টি, এর তাৎপর্য চিন্তা করে, তখন সে বুঝতে পারে যে, এর বিস্ময়কর অপরূপ কলাকৌশল সে তার সমগ্র জীবনব্যাপী চিন্তা গবেষণা দ্বারাও সমাপ্ত করতে পারবে না। যতােবার মানুষ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, ততােবারই তা নতুনরূপে, নতুন সাজে তার সামনে ভেসে উঠবে। মানুষ অবাক ও বিস্ময়ের সাথে এ প্রকৃতির রূপ সূধা পান করবে। তার অবস্থান ও অস্তিত্বকে হৃদয়ের সকল অনুভূতি, আবেগ, উচ্ছাস ও মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে উপভােগ করবে। মানব জীবনের সামষ্টিক প্রয়ােজন পূরণের প্রেক্ষিতে বিশ্ব প্রকৃতি প্রতিনিয়ত মানুষের সেবায় নিয়ােজিত থাকে। প্রকৃতির ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সকল বস্তু, পদার্থ ও শক্তি অবিচ্ছিন্ন ও অব্যাহতভাবে মানুষের প্রয়ােজন পূরণে নিয়ােজিত থাকার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের নিদর্শন রয়েছে। এ সব কিছুর পশ্চাতে একক শক্তিমান সত্ত্বার অস্তিত্ব ও তারই সুষ্ঠু পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিশ্বাস আনা ছাড়া মানুষের আসলে কোনাে গত্যন্তরও নেই। এক অদৃশ্যমান মহাশক্তির নিয়ন্ত্রণ ও তার অস্তিত্বের প্রতি আত্মসমর্পণ ও আস্থা স্থাপনেরও কোনাে বিকল্প নেই । এ সৃষ্টিকূলে, মহাশূন্যে, দূর দূরান্তের একটি ক্ষুদ্রতম গ্রহের অবস্থান ও পৃথিবীর বুকে সকল সৃষ্টির সৃষ্টি নৈপুণ্য বিন্যাস সাধনের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও কুদরতের অন্তহীন নিদর্শন ও প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। এ সমগ্র পৃথিবীর অস্তিত্ব আল্লাহ তায়ালার কূল মাখলুকাতের তুলনায় একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দুসম। এ সমগ্র পৃথিবীর তুলনায় মানুষও দুর্বল জীর্ণ শীর্ণ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি অণু পরিমাণ মাত্র । একটু ক্ষুদ্র কণার চেয়ে মানুষের ক্ষমতা ও অস্তিত্ব বরং আরও ক্ষুদ্র। পারিপার্শিক সৃষ্টিকূলের তুলনায় বস্তুতান্ত্রিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের দৃষ্টিতেও মানুষের অস্তিত্ব ওজন ও শক্তির পরিমাণ খুবই সামান্য। অথচ আল্লাহ তায়ালার মহান অনুগ্রহে আল্লাহ তায়ালা মানব দেহে আত্মা ঠুকে দেয়ার মাধ্যমে তার বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার নেয়ামতে তাকে সম্মান ও মর্যাদা দানের কারণে মানুষ নিজের চেয়ে অনেক বেশী ওজন, পরিধি ও শক্তি সম্পন্ন প্রাণী ও প্রাকৃতিক শক্তিকেও নিজের সেবায় নিজের আনুগত্যে নিয়ােজিত করতে পেরেছে। বিশ্ব প্রকৃতি ও ক্ষুদ্রতম সৃষ্টিকণাটিও আল্লাহর পুঞ্জীভূত রহমত ও কল্যাণের অবদান। মানুষের প্রতি আল্লাহর এ সীমাহীন অনুগ্রহ অনন্ত প্রেম ও ভালবাসা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা যে সমগ্র সৃষ্টিকূলকেই তাদের কল্যাণের নিমিত্তেই তাদের সেবা ও আনুগত্যে নিয়ােজিত রেখেছেন, উল্লেখিত আয়াতে সে বিষয়ের প্রতি প্রচ্ছন্ন ইংগিত নিহিত রয়েছে। আলােচ্য আয়াতে মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য, প্রত্যক্ষ পরােক্ষ নেয়ামত ও প্রকৃতির রাজ্যকে মানুষের অনুগত করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার অশেষ অনুগ্রহ ও অনুদানের কথা বর্ণিত রয়েছে। আয়াতে আসমান ও যমীনের সমগ্র সৃষ্টিকেই মানব কল্যাণে মানুষের সেবায় অনুগত ও বশীভূত করার মহান নেয়ামতের উল্লেখ রয়েছে। আসলে এ ক্ষুদ্রতম সৃষ্টি মানুষের অস্তিত্বই তাে আল্লাহ তায়ালার সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ। এ ক্ষুদ্র মানবকূলকে অপরাপর বিশাল সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব, প্রাধান্য, শক্তি, সম্মান ও মর্যাদা প্রদানও মহান রাকলুল আলামীনের মহা নেয়ামাত। মানব কূলের হেদায়াত, মুক্তি ও শান্তির জন্য নবী ও রাসূল প্রেরণ, হেদায়াতের নিখুঁত ও নির্ভুল উৎস আসমানী কিতাব সমূহ অবতীর্ণ করা ও তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও চিরস্থায়ী নেয়ামত। আল্লাহর সাথে মানবাত্মার গভীর সম্পর্ক মানুষের প্রতিটি নিশ্বাস-প্রশ্বাস, রক্তের প্রতিকণার প্রবাহ, হৃদয় ও শিরার প্রতিটি স্পন্দনের সাথে জড়িত। বিশ্ব প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য, ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত প্রতিটি শব্দ ও আওয়ায, অন্তরে উদ্বেলিত প্রতিটি অনুভূতি ও চিন্তা, প্রতিটি মস্তিষ্ক উদগত বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও পরিকল্পনা কি এ আল্লাহর মহান অনুগ্রহ ছাড়া আসলেই কল্পনা করা যায়? মানুষ কি কখনও আল্লাহর নেয়ামত, অনুগ্রহ ও দান ছাড়া এ সব কিছুর সন্ধান পেতাে? আকাশ রাজ্যের সকল সৃষ্টিকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন। সূর্যের রশ্মি, চাঁদের জোৎস্না, দিক-নির্দেশনার জন্য সপ্তর্ষিমন্ডল, অগণিত গ্রহ, নক্ষত্র, তারকারাজী, মেঘমালা, বৃষ্টি, প্রবাহমান বায়ু তরঙ্গ বিদ্যুৎ সকল কিছুই তাে আল্লাহর মহান অনুগ্রহে মানব সেবায় নিয়ােজিত রয়েছে। মানুষের জন্যই তাে আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা এ বিশ্ব জগতের সকল সৃষ্টিকে তার অনুগত করে দিয়েছেন। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা এ বিশাল রাজ্যে এ বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে খেলাফতের মহান দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করেছেন, এ যমীনের রাষ্ট্র ক্ষমতা তাকে অর্পণ করেছেন। মানুষের জন্যই সমুদ্রের অতলে, ধরাপৃষ্ঠের গভীর নিচে অসংখ্য প্রাণীকূল, অগণিত মূল্যবান খনিজ সম্পদ সঞ্চিত করে রেখেছেন। এর মধ্যে অনেক কিছুকে প্রকাশ্য মানুষের দৃষ্টি গােচরে রেখেছেন, অনেক নেয়ামত মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে এখনও গুপ্ত ও গচ্ছিত রয়েছে। এর মধ্যে এমন নেয়ামত রয়েছে যা মানুষের ইন্দ্রিয় স্পর্শ ও দৃশ্যমান, অনেক এমন আছে যার কোনাে আকার নেই বরং মানুষের অনুভূতি চিন্তার জগতে তা বিদ্যমান। মানুষ তা শুধু অনুভবই করতে পারে; ইন্দ্রিয় চোখে তার কিছুই দেখতে পায় না। আবার এমন এক নেয়ামত আছে যা মানুষের আবেগ-অনুভূতির ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তা ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিতেও ধরা যায় না। সে অনন্ত রহস্য রুহানী ও ঈমানী শক্তি দিয়ে উপলব্ধি করা যায় । দিন ও রাতের প্রতিটি মুহূর্তেই আল্লাহর এ অনন্ত অসীম নেয়ামতসমূহ দ্বারা মানব জীবন পরিচালিত নিয়ন্ত্রিত ও পরিবেষ্টিত হয়ে আছে। আল্লাহর নেয়ামতের অন্তহীন চাদরের প্রান্তসীমা, সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানুষ কিছুতেই খুঁজে পায় না। আল্লাহর অগণিত নেয়ামতের পরিসংখ্যান কম্পিউটার কেন আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত কোন যান্ত্রিক প্রক্রিয়াও গুণে শেষ করতে পারে না।  *মানব জাতির কলংক নাস্তিক গােষ্ঠী : অথচ আফসােস! মানব সমাজে এমন কিছুসংখ্যক নাস্তিক মুরতাদ রয়েছে, যারা তাদের চারিপার্শ্বে বিদ্যমান এ অন্তহীন নেয়ামত সম্পর্কে ক্ষণিকের জন্য চিন্তা-গবেষণা করে না। আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত হয় না, আল্লাহ তায়ালার শােকরিয়া আদায় করে না, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। আল্লাহ তায়ালার অন্তহীন নেয়ামতের তীব্র অনুভূতি তাদের হৃদয় অনুভব করে না। আল্লাহ তায়ালার এ বিশাল অনুগ্রহ এ এক অদৃশ্য মহান শক্তিমান সত্ত্বার অস্তিত্ব ও কুদরতকে তারা স্বীকার করে না, বরং নাস্তিক ও মুরতাদ বলে পরিচয় দিতে তারা গর্ববােধ করে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘মানব মন্ডলীর মধ্যে এমন কিছুসংখ্যক লােক রয়েছে যারা কোন প্রকার ইলম, পথ নির্দেশনা ও উজ্জ্বল গ্রন্থের প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে দ্বন্দ্ব ও বাক বিতন্ডায় লিপ্ত হয়।'(আয়াত ২০) পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ তায়ালার সুস্পষ্ট হেদায়াত ও বিশ্ব প্রকৃতির অন্তহীন নেয়ামতের নিদর্শন সত্ত্বেও মানব সমাজে এমন কিছুসংখ্যক নাস্তিক অবিশ্বাসী কাফের মুরতাদ রয়েছে যারা অসীম নেয়ামতের পরিবেষ্টনীর মধ্যে জীবন যাপন করে এর অপূর্ণ নেয়ামত থেকে প্রতিনিয়ত ফায়দা হাসিল করে। কিন্তু এ সত্ত্বেও তারা কোনাে হেদায়াতের গ্রন্থের প্রমাণ ব্যতীতই আল্লাহর ব্যাপারে অনর্থক দ্বন্দ্ব ও বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হয়। অত্যন্ত নিকৃষ্ট জঘন্য ও ঘৃণিত পন্থায় প্রকৃত সত্য ও প্রকৃতিগত দ্বীনের প্রতি অস্বীকৃতি জানায়। তাদের এ ঘৃণিত আচরণে প্রকৃত হৃদয়বান ও আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাসী ব্যক্তির অন্তরাত্মা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ অবিশ্বাসী সম্প্রদায় আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব সম্পর্কেই অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। তারা আল্লাহ সম্পর্কে অযথাই দ্বন্দ্ব সংঘাত ও বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হয়। তারা আল্লাহদ্রোহী হিসাবেই জীবন যাপন করে ও এভাবেই অন্যদের সাথে তাদের সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তােলে। তারা প্রকৃতি বিরােধী নাস্তিক্যবাদী জীবনযাত্রা শুরু করে। তারা আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের দাওয়াত কে বর্জন করে। তারা আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নেয়ামতকে অস্বীকার করতে কোনােপ্রকার লজ্জা ও সংকোচ বোধ করে না। আল্লাহর অস্তিত্বে সন্দেহ পোষণ, আল্লাহর পরিপূর্ণ নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা ও আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের দ্বন্দ্ব কলহে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে তারা কোনাে ইলম পথ-নির্দেশনা, যুক্তি প্রমাণ, তথ্য ও উজ্জ্বল কিতাবের প্রমাণ উপস্থাপনের ওপর নির্ভর করে না। বরং তারা নিছক অজ্ঞতা, ও বক্রতার কারণেই বিভ্রান্ত পথের অনুসারী হয়। এর পাশাপাশি তারা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাবের অনুসরণের পথে বাপ দাদাদের অনুসৃত চিরাচরিত প্রচলিত কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারেরই অনুসরণ করে, যেমন পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ তায়ালার অবতীর্ণ কিতাবের অনুসরণ করাে, তখন তারা বলে, আমরা বরং আমাদের মা বাপকে যে ব্যবস্থার ওপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করবাে।'(আয়াত ২১) উল্লেখিত আয়াতে বলা হয়েছে যে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার অন্ধ অনুসরণের এ আবেগই হচ্ছে তাদের একমাত্র প্রমাণ বা সনদ। এ অদ্ভুত দাবীই তাদের একমাত্র সম্বল। তাদের অনুসরণের পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে কোন জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, সুস্থ বিবেক বুদ্ধি, যুক্তি প্রমাণ ও সুস্থ চিন্তা ভিত্তিক নয়, বরং তা একান্তভাবে অন্ধ আবেগের ওপর নির্ভরশীল। ইসলাম মূলত মানুষকে এ অন্ধ বিশ্বাস আবেগ ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-চেতনা থেকে মুক্ত করতে চায়। অন্ধ মানসিক গােলামীর শৃংখল থেকে মুক্ত করে ইসলাম মানুষের চিন্তা-চেতনা বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনাকে জাগ্রত করতে চায়। মানুষের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ও উন্মেষের মুক্ত রাজপথে তাকে টেনে আনতে চায়। অথচ সমাজের কতিপয় গবেট মূর্খজীবী, ইসলামের আলােকোজ্জ্বল পথে আসার পরিবর্তে, প্রচলিত বিপর্যস্ত সমাজ ব্যবস্থার মানসিক গােলামী, কুপমন্ডুকতা ও ভ্রান্ত ব্যবস্থার জিঞ্জিরে বন্দী থাকাকেই যুক্তিসংগত মনে করে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার অনুসরণই হচ্ছে তাদের সবচেয়ে বড় যুক্তি ও প্রমাণ। মূলত ইসলাম হচ্ছে মুক্ত চিন্তার আদর্শ। ইসলাম মুক্ত বিবেকের বাণী । ইসলাম মুক্ত চেতনার প্রতীক। ইসলামই হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল ও অন্ধ মানসিক গােলামী থেকে মুক্তির প্রগতিশীল আদর্শ। ইসলামই জড়তা নির্জীব, নিষ্ক্রিয়তা মুক্ত ও কর্মময় জীবনের আদর্শ। এতদসত্তেও মানব সমাজের পেঁচক ও চামচিকে স্বভাবের কিছুসংখ্যক লােক প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার তাগুতের অন্ধ গােলামীতে নিজেদেরকে বন্দী করে রাখতে চায়। অন্তরাত্মাকে আলােকিত করার এ জ্যোতির্ময় হেদায়াতকে তারা প্রতিহত করতে চায়। এ অন্ধ আবেগ তাড়িত বুদ্ধিজীবী নামধারী মুর্খজীবীরা উজ্জ্বল গ্রন্থের প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে নিরর্থক বিতর্ক দ্বন্দ্ব ও বাক বিতন্ডায় লিপ্ত হয়। এ আয়াতের পরবর্তী অংশে তাই অন্ধ মানসিক গােলামীতে লিপ্ত অজ্ঞ মূর্খ সম্প্রদায়ের অজ্ঞতার পরিণতি সম্পর্কে সাবধান ও সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে, অনন্ত আখেরাতে তাদের সন্দেহবাদী অন্ধ গােলামীর বিভীষিকাময় শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যদিও শয়তান তাদেরকে আহ্বান করছে জাহান্নামের কঠোর শাস্তির দিকে।'(আয়াত ২১) আয়াতের আলােচ্য অংশে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় এ অন্ধ অনুসরণকারীদের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই এ আহ্বান আল্লাহর পথের দাওয়াত নয় বরং এ হচ্ছে শয়তানের পথের আহ্বান, আর এ আহ্বানের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে জাহান্নামের কঠোরতম শাস্তি। এরপরও কি এ অজ্ঞ জাহেল সম্প্রদায় জিদ ও হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে জাহান্নামের কঠোর আযাবের পথের অনুগামী হবে? আয়াতে এ অভিশপ্ত, বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অজ্ঞতাপ্রসূত পথ নির্দেশনা ও হঠকারী পথের অনুসরণের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
*মোমেন এর সফলতা ও কাফেরদের ব্যর্থতা : আল্লাহর পথে চলার পক্ষে মূল্যবান দলীল প্রমাণ উপস্থাপনের পরক্ষণেই আল্লাহর অনন্ত নেয়ামতের প্রতি আস্থা স্থাপনকারী কৃতজ্ঞ লােকদের প্রতি ইংগিত প্রদান করা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে স্বীয় মুখমন্ডলকে আল্লাহর প্রতি নিবদ্ধ করে। (স্বতস্ফূর্তভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে) সে যেন একটি মযবুত রজ্জু (হাতল) ধারণ করলো, মানুষের সকল কর্মের চূড়ান্ত ফলাফল তাে আল্লাহর নিকট রয়েছে।’ উরওয়াতুল উসকা’-এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, তা মানুষের জন্যে এমন এক বন্ধন যা কখনও বিচ্ছিন্ন হয় না। সুখে দুঃখে যা কোনপ্রকার খেয়ানত, বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে না। রাতের তিমির অন্ধকারেও এই মজবুত রজ্জু (হাতল) ধারণকারী ব্যক্তি পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত হয় না। উরওয়াতুল উসকা হচ্ছে এমন এক দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও মযবুত বিশ্বাস, এমন এক স্থির সংযােগ ও এমন এক স্থির আত্মা যে সকল অবস্থায় সকল পরিবেশে আল্লাহ তায়ালার মর্জির ওপর সন্তুষ্ট থাকে, এ ধরনের হৃদয় স্বস্তি ও একাগ্রচিত্ততার সাথে তার রবের সিদ্ধান্ত ও মর্জীর কাছে স্বতস্ফূর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে, তা হৃষ্টচিত্তে আল্লাহ তায়ালার সকল সিদ্ধান্তকে কবুল করে। তার জীবনে আবর্তিত ও সকল ঘটনা সকল পরিবর্তনকে সে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। উচু মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলে যেমন তার মনে বিন্দুমাত্র গর্ব ও অহংকার সৃষ্টি হয় না, তেমনি কঠিন বিপদ-আপদ ও মুসীবতের মধ্যেও সে হৃদয় ভেংগে পড়ে না, নুয়ে যায় না, হীনমন্যতায় ভােগে না, হতাশ ও নিরাশায় পতিত হয় না। কোন আকস্মিকতা ও দুর্ঘটনায় তার স্মৃতিভ্রম হয় না। সকল পরিবেশে ঈমানের দৃঢ়তাকেই সে সংরক্ষণ করে। বিশ্বাসের পতাকাকে সমুন্নত রাখে । কোন কঠিন পরিণতি তার মধ্যে বিরূপ মনােভাব ও প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক করে না। মতিভ্রম, চিন্তার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত হতে দেয় না। আসলে দ্বন্দ্ব সংঘাত ও আশংকা ভরা মানুষের জীবনের এ সফর দীর্ঘ এ পৃথিবীতে না পাওয়ার ব্যথা বেদনা ও দারিদ্র ও বঞ্চনার চেয়ে সম্পদশালী হওয়া ও অত্যধিক প্রাপ্তির ফেতনা কোনােক্রমেই ছােট নয়। বিপদ ও মুসীবতের যন্ত্রণা ও যাতনার আনন্দ বিলাসে ‘উরওয়াতুল উসকা’ অবলম্বনকারী তাই দৃঢ়ভাবে এ রজ্জু (হাতল) ধারণ করে থাকে। কখনও রজ্জু থেকে সে সংযােগ বিচ্ছিন্ন হয় না । সকল পরিস্থিতি ও পরিবেশে দৃঢ়ভাবে সে এ রজ্জুকেই আঁকড়ে থাকে। এ আয়াতে উরওয়াতুল উসকা’ বলতে আল্লাহর রজ্জু, ইসলামের রজু তথা নিষ্ঠা ও একাগ্রচিত্ততার সাথে আল্লাহর নিকট স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসমর্পণকে বুঝানাে হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে যে, সে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ তাে মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাবজাত ধর্ম হওয়া উচিৎ যে, আল্লাহর নিকট প্রত্যাগমনই তার চূড়ান্ত ও সর্বশেষ আবাসস্থল। তাই মানুষের মুখমন্ডল ও দৃষ্টি একমাত্র আল্লাহর প্রতি নিবদ্ধ ও সমর্পিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ও অপরিহার্য। দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে সকল মানুষের একমাত্র আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত হেদায়াতের পথই অবলম্বন করা জরুরী। অতপর এরশাদ হচ্ছে, ‘যে কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে, তার কুফরী করতে বাধ্য করবে'(আয়াত ২৩-২৪) পূর্ববর্তী আয়াতে যারা আল্লাহর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আল্লাহর মর্জির নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের বৈশিষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের পরিচিতি ও পরিণতির চিত্র পরিবেশিত হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহর সাথে যারা কুফরী করে তাদের পরিণতি, ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের ডােগ বিলাসের উপকরণ ও সম্পদ যে তাদের জন্য একটি আত্মপ্রতারণা বৈ আর কিছুই নয়, তার বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব ভােগ বিলাস সম্পদ উপভোগ ও আল্লাহর নাফরমানী ও অবাধ্যতার কারণে তাদের চূড়ান্ত পরিণাম যে জাহান্নামের কঠোর যন্ত্রণাদায়ক শান্তি- তারও উল্লেখ রয়েছে। ‘যে কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে তার কুফরী যেন তােমাকে দুশ্চিন্তায় ও উদ্বিগ্নতায় লিপ্ত না করে'(আয়াত ২৩) ওদের কুফরী তােমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন করার মতাে কোনাে ব্যাপার নয়। ওরা অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার পাকড়াওর মধ্যে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালার পাকড়াও খুব কঠিন, তা থেকে তাদের মুক্তি ও রেহাই পাওয়ার কোনাে পথ নেই। ওরা ওদের কর্মতৎপরতার অপরাধেই আল্লাহর কাছে ধরা পড়ে যাবে। ওদের প্রকাশ্য ও গােপন এমন কি ওদের হৃদয়ে যে গােপন প্রত্যাশা, অসৎ নিয়ত ও বাসনা নিহিত রয়েছে তা আল্লাহর অবগতির বাইরে নয় তাও আল্লাহ তায়ালা ভালােভাবে জানেন। এবার আয়াতের শেষাংশে এরশাদ হচ্ছে, ‘আমারই নিকট তাদের প্রত্যাগমন স্থল অতপর আমি তাদের সকল কর্মতৎপরতা সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করানাে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরের সকল বিষয় সম্পর্কেও অবগত'(আয়াত ২৩) এ পৃথিবীর স্বল্পকালীন ও সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভােগ-বিলাসের উপায়-উপকরণ হিসেবে যে সকল সম্পদ আমি তাদের দিয়েছি, যার মূল্য খুবই নগণ্য, এটা খুবই ক্ষণস্থায়ী গুরুত্বহীন, যা তাদেরকে প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে, আখেরাতে এর প্রতিদান পরিশােধ করার তারা কোনােই ক্ষমতা রাখে না। আখেরাত হচ্ছে অন্তহীন। একবার যে আখেরাতের যিন্দেগীতে পদার্পণ করবে, তার সেখান থেকে ফিরে আসার কোনাে উপায়ই থাকবে না। দুনিয়ার স্বল্পমেয়াদী জীবনে আমি তাদেরকে যে সম্পদ ও নেয়ামত দিয়েছি, আখেরাতে এর প্রতিদান প্রদানের কোনাে সামর্থ। কাৱােই থাকবে না। অতপর আয়াতের বাকী অংশে বলা হয়েছে যারা আল্লাহর মর্জির নিকট আত্মসমর্পণের বদলে অবাধ্যতা, নাফরমানী, কুফরীর পথ বেছে নিয়েছে তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভােগ করতে বাধ্য করা হবে। এ প্রসংগ উত্থাপন করে বলা হয়েছে, ‘তাদেরকে তাড়িয়ে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির পানে নেয়া হবে'(আয়াত ২৪) এটা শাস্তি গ্রহণে বাধ্য করার প্রসংগের উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত আযাব হচ্ছে দু’ধরনের, একটি মানসিক যা অপমানজনক। অপরটি দৈহিক যা কষ্টদায়ক। আয়াতে গালীয শব্দ যারা দৈহিক কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের উপস্থাপনা ভংগী এ ব্যাপারে সত্যিই বিস্ময়কর। কোনাে কোনাে আয়াতে ‘মাহীন’ শব্দ দ্বারা মানসিক অপমানজনক শাস্তির উল্লেখ রয়েছে; আর এ আয়াতে কোরআনের নিজস্ব বাচনভংগীতে ‘গালীয’ শব্দ হতে দৈহিক কষ্টদায়ক শাস্তির প্রতি ইংগিত রয়েছে। আবার অন্যান্য আয়াতে ‘আলীম’ শব্দ দ্বারা শারীরিক যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কথা উল্লিখিত হয়েছে। ‘নাদতররু’ শব্দ দ্বারা তাদেরকে আযাবের দিকে যেতে বাধ্য করার প্রসংগ আলােচিত হয়েছে, অর্থাৎ আযাবের এ বিভীষিকা ও ভয়াবহতা অবলোকন করে কেউ সানন্দে স্বেচ্ছায় হেসে খেলে নেচে গেয়ে আযাবের দিকে যাবে না, বরং আযাব থেকে পলায়নের জন্য ছাগলের মতাে পিছটান দিতে চাইবে, তখন ফেরেশতারা শিকল দিয়ে বেঁধে তাদের টেনে হেঁচড়ে আযাবের দিকে যেতে বাধ্য করবে। আল কোরআনের অদ্ভূত ও বিস্ময়কর বাচনভংগী এটা! এখানে ‘ইদতিরার’ অর্থাৎ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরকে আযাবের দিকে যেতে বাধ্য করা হবে। এ দ্বারা এ দিকের প্রতিও প্রচ্ছন্ন ইংগিত রয়েছে যে তারা আযাব থেকে বেঁচে থাকার প্রত্যাশা পােষণ করলেও তাদের বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। আযাবের দিকে না গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করলে বা আযাব থেকে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে চাইলে পালাতে পারবে না। আয়াতে তাদের অসহায়তা, অক্ষমতা ও অপারগতার এক করুণ চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, বাধ্য হয়েই তাদেরকে এই কঠিন যন্ত্রণাদায়ক আযাব ভোগ করতে হবে। আয়াতে মােমেনদের অবস্থার প্রতিও ইংগিত প্রদান করা হয়েছে। এদের প্রশান্ত অবস্থা বলা হচ্ছে, যে এরা আল্লাহর মর্জির ওপর সন্তুষ্ট, শান্ত ও স্থির। একে একনিষ্ঠতা একাগ্রচিত্ততার সাথে আত্মসমর্পণকারীদের অবস্থার এক তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আল্লাহর নিকট মযবুত রঞ্জু বা হাতল ধারণকারী স্পতস্ফূর্তভাবে আত্মসমর্পণকারী সম্প্রদায় আর নিরেট অজ্ঞতা প্রসূত প্রমাণহীনভাবে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি সন্দেহবাদী কুফরীর পথগামী নাস্তিক মুরতাদদের মধ্যে কতাে দূরত্ব কতো যােজন ব্যবধান তাও এখানে দেখানাে হয়েছে। আল্লাহর সাথে মযবৃত সম্পর্ক স্থাপনের ফলশ্রুতিতে আল্লাহর রজ্জু ও হাতলকে মযবুতভাবে ধারণ করে তারা আল্লাহর হেদায়াতকে গ্রহণ করে। পরিনামে তারা আল্লাহর পথের অনুগামী হয়। এখানে কাফেরদের সামনেও এ মহাসত্যের আবেদন তুলে ধরা হয়েছে। তারা এ স্বভাবজাত মহা সত্যের স্বীকৃতি দেয় না সুসন্মানিত আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে কবুল করে না। বরং তারা সুদৃঢ় মহাসত্যকে অস্বীকার করে এক বক্র পথেরই অনুগামী হয়।

*তাওহীদের প্রতি মানব প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি : এরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করাে আসমান ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা কে?… নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অভাব মুক্ত সম্পদশালী ও পরম প্রশংসিত।'(আয়াত ২৫) মানব মনের স্বভাবজাত প্রকৃতি মানুষের সুস্থ বিবেকের নিকট যদি এ প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় যে আসমান যমীনের সৃষ্টিকর্তা কে? তখন সে এ মহা সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না যে, অনন্ত সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। মানুষের মননশীলতা, মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি, বিস্তৃত মহাকাশ, এ সীমাহীন পৃথিবীর অবস্থান, এ চলমান বিশ্বের সকল কর্মচাঞ্চল্য প্রতিটি সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণেই এ লক্ষণ বিদ্যমান। সৃষ্টির পরিচালনা, উদ্ভব, উৎপাদন, পরিবর্ধন ও পরিবর্তনের মধ্যে প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য শক্তিমান সত্ত্বার ইচ্ছাশক্তি কাজ করছে। সে অদৃশ্য শক্তিমান সত্তা এক একক। এ পৃথিবীর কোনাে কিছুরই স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অপর কেউ- এটা কেউই কখনাে দাবী করে না। কেউ এর অংশীদারিত্বের দাবীও করে না। এ বিশ্বাস সবাই করে যে কোন এক অদৃশ্য ক্রিয়াশীল সত্তার অস্তিত্ব ও তারই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া এসব কিছুর কল্পনাই করা যায় না। মানুষের মন স্বাভাবিকভাবে এ প্রশ্নের স্বতস্ফূর্তভাবে এই জবাব প্রদান করে যে, এ সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একক শক্তিমান সত্ত্বা আল্লাহ তায়ালা। মানব প্রকৃতি স্বতসিদ্ধভাবে এ মহাসত্যের স্বীকৃতি প্রদানে বাধ্য। এ স্বভাবজাত মহাসত্যকে অস্বীকার ও বর্জন করার কোনাে যৌক্তিকতা সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কল্পনাই করতে পারে না। এ চিরন্তন সত্যের স্বতস্ফূর্ত স্বীকৃতির প্রমাণই আলােচ্য আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। মক্কার পৌত্তলিক মােশরেকরা তাদের হঠকারিতার কারণে অজ্ঞতা প্রসূতভাবে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খালেস তাওহীদের বিরােধিতার কারণে তাদের শিরক মিশ্রিত আকীদার অপনােদন করা ও তাকে মিথ্যা প্রমাণ করার লক্ষ্যেই এই আয়াতে বিশেষভাবে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এ প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক দলীল তাদের সামনে উত্থাপনের পর তাদের নিজস্ব স্বীকৃতিমূলক উচ্চারণের পরে কোন যুক্তি প্রমাণের অবতারণার প্রয়ােজনই আর অবশিষ্ট থাকে না। বিশেষ করে যখন তাদের বিবেকের সামনে এ প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, বল আসমান ও যমীনকে কে পয়দা করেছে? উত্তরে তারা বললাে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা।’ এ জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল(স.)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন যেন তিনি ওদের এই জবাবটি দিতে গিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর প্রশংসা দ্বারা কথা শুরু করেন। এ কথার নির্দেশ দিতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘বল আলহামদুলিল্লাহ…’ অর্থাৎ প্রকৃতির সব কিছুর মধ্যে সত্য সুস্পষ্টভাবে বিরাজ করছে, এই চিরসত্য বিষয়টি যখন তােমরা নিয়ত দেখতে পাচ্ছ তখন আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও কৃতিত্বের কথা ঘােষণা কর- এ জন্যও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর প্রশংসা করাে যে সৃষ্টির সব কিছুর মধ্যে সর্বত্র তার শক্তি ক্ষমতার নিদর্শনগুলাে, তােমরা দেখতে না চাইলেও তােমাদের নযরে পড়ছে; সুতরাং সর্বাবস্থায় কৃতজ্ঞচিত্তে তার প্রশংসাগীতি গাইতে থাকে। এরপর, কেন আল্লাহ তায়ালার কৃতিত্বের কথা ঘােষণা করা হবে তা জানাতে গিয়ে আরও জোরালাে একটি যুক্তি প্রদর্শন করার পর বলা হচ্ছে, ‘বরং অধিকাংশ মানুষ জানে না বা তাদের জ্ঞানের সদ্ব্যবহার করে না। আর এই কারণেই তারা নানা প্রকার যুক্তিহীন তর্ক-বিতর্ক করে এবং প্রকৃতির মধ্যে যে সত্যটি পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে তা ইচ্ছা করেই ভুলে যায়, অর্থাৎ তা দেখেও দেখে না, এমনকি গােটা বিশ্বের সবকিছু প্রতিনিয়ত যে মহা স্রষ্টার অস্তিত্বের কথা জানাচ্ছে সেটাও তারা উপেক্ষা করে। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই যে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন এ কথার স্বীকৃতি অবশ্যই তাদের প্রকৃতির মধ্যে বর্তমান রয়েছে এবং সেই অনুযায়ী তারা এ কথাও স্বীকার করে যে, বিশ্ব জাহানের মধ্যে অবস্থিত যেখানে যা কিছু রয়েছে সব কিছুর মালিক একমাত্র তিনিই। সৃষ্টির এ সবকিছুর মধ্যে কিছু বস্তুকে তিনি মানুষের নিয়ন্ত্রণে এনে দিয়েছেন এবং আরও অনেক কিছু আছে যে সবের মধ্যে মানুষের কোনােই নিয়ন্ত্রণ নেই। তারপরও এটা সত্য যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যকার সব কিছু থেকে তিনি মুখাপেক্ষিহীন। তিনি নিজে নিজেই চির প্রশংসিত; এমনকি কোন একজন মানুষও যদি তার প্রশংসা না করে তবুও তার প্রশংসার কোনাে অভাব নেই, ‘আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর, নিশ্চয়ই তিনি অভাবমুক্ত প্রশংসিত।’
*আল্লাহর প্রশংসা লেখা কখনাে শেষ হবেনা : জগৎ জোড়া দৃশ্যের ছবি সামনে তুলে ধরে আলােচনার ধারাকে এখানেই সমাপ্ত করা হচ্ছে। এ ছবির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা জানাতে চেয়েছেন যে তিনি সকল কিছুর প্রয়ােজন ও সকল দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তার প্রাচুর্য সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলছেন যে তার ভান্ডার অফুরন্ত এবং সকল সীমাবদ্ধতার উর্ধে এবং তার জ্ঞানেরও নেই কোন সীমা বা শেষ। তাঁর নতুন নতুন জিনিস দান করার ক্ষমতার কোনাে শেষ নেই, তাঁর কুদরত অন্তহীন। আকাশ মন্ডলী পৃথিবীর মধ্যে কোথাও তার স্বাধীন ইচ্ছাকে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যমীনের… নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়'(আয়াত ২৭)  ‘আর সারা পৃথিবীর গাছ-গাছালি যদি কলম হত… নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সব কিছু শুনেন সব কিছু দেখেন'(আয়াত ২৭) ওপরের আয়াতে যে কথাগুলাে বলা হয়েছে এবং যে সব দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে তা মানুষের সীমাবদ্ধ বুদ্ধিতেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। কথাগুলাে এ জন্য বলা হচ্ছে যেন, মানুষ অসীম জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা সম্পর্কে চিন্তা করে স্বয়ং তাঁর সম্পর্কে নয়। আসলে এ ধরনের বস্তুগত জিনিস ও উদাহরণ ছাড়া মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন সম্পর্কে বুঝবার অন্য কোনাে মাধ্যম নেই। মানুষ তার জ্ঞান-গরিমার কথা লিপিবদ্ধ করে, তাদের কথাগুলােকে বিধিবদ্ধ করে রাখে এবং তাদের কলমের মাধ্যমে তাদের জ্ঞান-গবেষণার কথা অপরের কাছে পৌছানাের ব্যবস্থা করে; আর এসব কলম তারা সংগ্রহ করে ঝোপ-ঝাড়-জংগল বা পৃথিবীর খনিজ পদার্থ থেকে এবং এসব থেকে নির্গত বিভিন্ন উপাদান থেকে নির্মিত কলম ব্যবহার করতে গিয়ে কালি বা অনুরূপ কিছুকে তার কাজে লাগায়, কিন্তু এ সব কালি হয় তারা দোয়াতে অথবা কোন শিশিতে রাখে। এ জন্যই এই কালি ও কলমের উদাহরণ দিয়ে বুঝনাে হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালার জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা লিখতে গিয়ে পৃথিবীর সকল গাছ পালাকে যদি কলম বানানাে হতাে এবং পৃথিবীর সকল সমুদ্রকে যদি কালিতে পরিণত করা হত, এমনকি আজকের এই সাত মহাসাগরগুলাের সাথে যদি যােগ করা হতাে অনুরূপ আরও সাতটি মহাসাগরকে অতপর এসব সম্মিলিত পানি যদি কালিতে রূপান্তরিত হয়ে সে কলম সমূহের জন্য লেখার উপাদানে পরিণত হতাে এবং সেসব কলম একত্রিত হয়ে যদি লিখতে শুরু করে দিতাে আল্লাহ তায়ালার জ্ঞান-গরিমার কথা ও তার কীর্তি গাথা; তাহলে বিশ্বজোড়া সাগর-মহাসাগর রূপ কালি সবই ফুরিয়ে যেত, তবুও মহামহিম আল্লাহ পাকেরই কথা ফুরাতাে না। আসলে লেখক ও লেখার সকল উপাদান যতাে বেশীই হােক না কেন-এসবই তাে সীমাবদ্ধ; কিন্তু লেখা হবে যার কথা, যার অসীম জ্ঞানের কথা, তিনি ও তাঁর জ্ঞান সবই সীমাহীন। সুতরাং সীমাহীন-এর কথা সীমাবদ্ধ জীব ও উপকরণ-এর আওতাভুক্ত হওয়া কখনই সম্ভব নয়। সেই কারণেই দেখা যায়, পৃথিবীর সূচনা থেকে লেখকরা আজ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার কথা লিখেছেন ও লিখে চলেছেন কিন্তু আজ পর্যন্ত যতাে কথাই লেখা হয়েছে, কেউ দাবী করতে পারেনি যে তার কথা লেখা শেষ হয়ে গেছে। আবহমান কাল ধরে লেখা চলতে থাকলেও তার সম্পর্কে লেখা কোনাে দিন শেষ হবে না। দুনিয়ার কোনাে ব্যক্তি যখন তার কথা লেখে তখন সে তার সীমাবদ্ধ যােগ্যতা দ্বারা অসীমের কথা লিখতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। সে যতাে চেষ্টাই করুক না কেন তার সকল যোগ্যতা ও শক্তি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কথা কোনােদিন শেষ হবে না। অবশ্য তার গুণগান কেউ গাইতে পারুক আর নাই পারুক তাতে তার কিছুই যায় আসে না, তার গুণাবলীর কথা কেউ লিখতে পারুক আর নাইই পারুক তা কোনদিন ফুরিয়ে যাবে না, কারণ তার জ্ঞানের কোনো সীমা নেই এবং নেই তার কোনাে শেষ । তার ইচ্ছা কোনাে দিন থামবে তার ইচ্ছা এবং সেই অনুযায়ী কাজ চলতেই থাকবে, তার ইচ্ছার কোনাে সীমা নেই, নেই কোনাে প্রতিবন্ধকতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর কথা লিখতে সকল গাছপালা কলম হয়ে কাজ করার পর অবশেষে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে এবং সকল সাগর মহাসাগর কালি হয়ে লেখার খেদমত আঞ্জাম দিতে দিতে নিঃশেষ হয়ে যাবে, তবুও আল্লাহ তায়ালার কথা ফুরাবে না। বিশ্ব জগতের প্রাণী ও প্রাণহীন সকল বস্তু শেষ হয়ে যাবে। সকল রূপ-রস-গন্ধ এবং সকল আকৃতি ও প্রকৃতি ও বিনীত মানুষের অন্তর চিরস্থায়ী সৃষ্টিকর্তার সামনে অমলীন ও অপরিবর্তিত অবস্থায় শুধু টিকে থাকবে, এ অন্তর কোনাে দিন তাঁর সামনে থেকে দূরে সরে যাবে না। মহাশক্তিমান, মহা বিজ্ঞানময় সকল বিষয়ের পরিচালনাকারী সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতার পরিধি কোন দিন বিলীন হয়ে যাবে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মহাশক্তিমান মহা বিজ্ঞানময়।’ এই বিশ্বজোড়া ভীত-সন্ত্রস্ত, অনুগত ও বিনয়-নম্রতা-ভরা দৃশ্য যখন সামনে আসে তখন অতি সুন্দরভাবে মানুষের সামনে প্রমাণিত হয় যে, তাদেরকে সৃষ্টি করা ও পুনরায় তাদেরকে যিন্দা করে তােলা আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে অতি সহজ ও সাধারণ ব্যাপার। এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমাদেরকে সৃষ্টি করা ও পুনরায় যিন্দা করা (আল্লাহ পাকের কাছে) একটি মাত্র প্রাণীকে সৃষ্টি করার শামিল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শুনেন ও দেখেন।’ আল্লাহ তায়ালার মহান ইচ্ছা শক্তি সকল কিছুকে সৃষ্টি করেছেন, যখনই কোন কিছুকে তিনি সৃষ্টি করার এরাদা করেন, তখনই তা বাস্তবায়িত হয়ে যায়। এ সৃষ্টিক্রিয়া একজন বা একাধিক মানুষের জন্য সমান কথা (অর্থাৎ, একজনকে সৃষ্টি করতে গিয়ে তার যে ইচ্ছাশক্তির প্রয়ােগ প্রয়ােজন, বহু জনের জন্যও সেই একটিমাত্র ইচ্ছাই যথেষ্ট)। এই বেশীর জন্য তাঁর যে একটু বেশী চেষ্টা প্রয়ােজন তা কখনও নয় এবং প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদাভাবেও তার কোনাে চেষ্টা বা ইচ্ছাশক্তি প্রয়ােগ করা লাগে না। কাজেই একজনের জন্য যে ইচ্ছা শক্তিকে তিনি প্রয়ােগ করেন, কোটি কোটি প্রাণীর জন্যও সেই একই ইচ্ছা শক্তি যথেষ্ট। এ জন্য একটিমাত্র কথাই যথেষ্ট হয়ে যাও অর্থাৎ এই একটি কথাতেই তার মহান ইচ্ছা যখন প্রকাশিত হয় তখনই তা বাস্তবে এসে যায় । এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই তাঁর কাজ হচ্ছে এই, যখন তিনি কিছু করার এরাদা করেন তার জন্য শুধু বলেন, হও’ আর অমনি হয়ে যায়।’ আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর জ্ঞান-এর শক্তি এবং এর প্রয়ােগের ফলই হচ্ছে সৃষ্টি, পুনরুত্থান এবং এ দুই অবস্থাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হবে হিসাব নিকাশ এবং সূক্ষ ও পুংখানুপুংখ বিচার করার পর সংঘটিত হবে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তার প্রতিদান দেয়ার পালা। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শুনেন ও দেখেন।’
*মহাবিশ্বের সর্বত্র আল্লাহর চিরঞ্জীব সত্ত্বার ছায়া : পরিশেষে এ সূরাটির পরিসমাপ্তিতে শেষ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা সেই একই বিষয় যার ওপর ইতিপূর্বে তিনটি অধ্যায়ের মধ্যে আলােচনা করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সত্য ও চিরস্থায়ী এবং তিনি ছাড়া অন্য যা কিছু আছে তা সবই ক্ষণস্থায়ী, মিথ্যা এবং ধ্বংসশীল। বাতিল সেসব জিনিস যাদেরকে ভ্রান্ত মানুষ আল্লাহর ক্ষমতায় অংশীদার মনে করে, তাদের সামনে মাথা নােয়ায় এবং তাদের কাছে সাহায্যের জন্য মিনতি করে প্রার্থনা জানায়। এ কারণেই এই শেষের অধ্যায়টিতে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কারও সামনে মাথা নত করা যাবে না। না বুঝে কারাে ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা চলবে না এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীন ব্যতীত কাউকেই নিরংকুশ আনুগত্য দেয়া যাবে না। এ প্রসংগে শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে স্থিরভাবে বুঝা গেল যে, এটা হবে সেই ভয়াবহ দিন যে দিন পিতা পুত্রের কোনাে কাজে লাগবে না এবং কোনাে সন্তান ও পিতার কোনাে উপকারে আসবে না। এ সব বিষয়ের সাথে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী বহু নতুন ও মযবুত কথা জানা যায়, যার বিশদ বর্ণনা এ প্রসংগে এসেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি কি এ বিষয়টি চিন্তা করে দেখােনি, আল্লাহ তায়ালা (কিভাবে) রাতকে দিনের ভেতর প্রবেশ করান আবার দিনকে রাতের…মহান সত্ত্বাই হচ্ছেন সত্য! তাকে ছাড়া এরা অন্য যা কিছুই ডাকুক না কেন তা (সম্পূর্ণ) বাতিল, মহান আল্লাহ তায়ালা, তিনি সুউচ্চ ও অতি মহান'(আয়াত ২৯-৩০) এরপর আসছে দিবাভাগের মধ্যে রাতের প্রবিষ্ট হওয়ার দৃশ্য, আসছে রাত্রির মধ্যে দিনের প্রবেশের অভিজ্ঞতা, আর এই উভয় অবস্থার মধ্যে মৌসুম পরিবর্তনকালে কখনও হয় দিন বড়, আবার কখনও হয় রাত বড়। এখানে বিস্ময়কর যে বিষয়টি আমরা দেখতে পাই তা হচ্ছে, এক নির্দিষ্ট পরিমাপ অনুসারে এই কম বেশী হওয়ার অবস্থাটি আবহমান কাল ধরে চলে আসছে, এ নিয়মের কোনাে ব্যতিক্রম কেউ কোনদিন দেখতে পায়নি। কিন্তু বড়ই আজব ব্যাপার! মানুষের অন্তরে মহাবিস্ময়কর ব্যাপারটি একটুও দাগ কাটে না। হ্যা এতটুকু বুঝা যায় যে সুদীর্ঘকাল ধরে মানুষের সামনে যখন কোনাে ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে এবং খুব কাছাকাছি থেকে এবং অতি সহজে যখন মানুষ কোনাে মূল্যবান তথ্য লাভ করে, তখন তার সঠিক মূল্যায়ন করা তার জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে; সে অবস্থায় তার চেতনা স্তিমিত এবং ভোতা হয়ে যায়, তখন কোনাে বিষয়ই আর তার মনে দোলা দেয় না, তার দৃষ্টি এ সবের রহস্যের দিকে আকৃষ্ট হয় না, তার হৃদয়ে এ সব প্রশ্ন জাগায় না যে, কে এর পরিচালক, কার ইচ্ছাতে এ মহাবিশ্ব একই নিয়মে চলছে, কোন মহাশক্তিধরের বলিষ্ঠ হাত এসব কিছুকে এমন এক কঠিন নিয়ম-শৃংখলায় বেঁধে রেখেছে যার মধ্যে কেউ কোনাে দিন কোনাে ব্যতিক্রম ঘটাতে পারেনি একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখুন, সে আদিগন্ত পরিব্যাপ্ত রহস্যরাজির দিকে, যার নিরন্তর অনিরুদ্ধ আবর্তন ও পরিক্রমা শ্রান্তি ক্লান্তিহীনভাবে আবহমানকাল ধরে চলছে, যার কোনাে ব্যতিক্রম কোনাে দিন হয়নি, যা কোনদিন এক মুহূর্তের জন্যও থেমে যায়নি। অনুসন্ধিৎসু নয়ন মেলে একবার তাকান, আপনার প্রাণ জুড়িয়ে যাবে, পরম পরিতৃপ্তিতে আপনার প্রাণ ঠান্ডা হয়ে যাবে, দেখবেন আপনার হৃদয়ের গভীর থেকে, আপনার অজান্তেই উত্থিত হয়ে আসছে একটি কথা। হ্যা, অবশ্যই একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই এসব কিছু করতে সক্ষম, তিনি এ সবের সৃষ্টি ক্রিয়া শুরু করেছেন এবং তিনিই এসব কিছুকে, তারই ইচ্ছামত এক নির্দিষ্ট নিয়মে প্রসারিত করে চলেছেন। সূর্য ও চাঁদের সাথে আবর্তনের সম্পর্ক এবং এক নির্দিষ্ট ধারায় এগুলাের গতিতে চলতে থাকার দিকে তাকালে এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝা যায়। সূর্য ও চাঁদকে নিয়ন্ত্রণ করা যেমন এক বিস্ময়কর ব্যাপার তেমনি রাত ও দিন এবং তাদের মধ্যে কম-বেশী হওয়ার যে ধারা চলছে তার থেকেও সূর্য ও চাঁদের নিয়ন্ত্রিত থাকাটা আরও বেশী আজব ব্যাপার। একমাত্র মহাশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ আল্লাহ তায়ালাই এদেরকে নিয়ন্ত্রিত করেন। তিনিই সেই মহাশক্তিমান পরওয়ারদেগার যিনি সব কিছু করতে সক্ষম এবং যিনি জানেন এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পৌছানাের জন্য এসব গ্রহ উপগ্রহ ও আলোর গােলকসমূহ নিজ নিজ গতিপথে কতােকাল ধরে চলতে থাকবে। একইভাবে দিনের মধ্যে রাতের প্রবেশ করা এবং রাতের মধ্যে দিনের প্রবেশ করা কতােকাল ধরে চলবে? একমাত্র তিনিই জানেন সূর্য ও চাঁদকে এই নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চালানাের রহস্য কি। সূর্য ও চাঁদ এমন দুটি সত্তা যা নিরন্তর মানুষের নযরে পড়ছে এবং যার দ্বারা সরাসরিভাবে মানুষ উপকার পাচ্ছে, এ দুটি গােলক রাত ও দিনের গতির মতই বিস্ময়কর বলে স্পষ্টভাবে মানুষ প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছে, এ জন্য এ দুটি সম্পর্কে এই একই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা সেসব বিষয়ে খবর রাখেন যা তােমরা করছাে।’ এইভাবে সৃষ্টিলােকের বাস্তবতার মধ্যে এই গায়বী সত্যটি প্রকাশিত হয়েছে। এ এমন এক শক্তি, মানব জীবনের সাথে যার মজবুত ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।  *আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র সত্য : তারপর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ অনুভব করে যে, ওপরে বর্ণিত তিনটি সত্য সকল শক্তির বড় শক্তি আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত, যার ইচ্ছাতে দৃশ্য অদৃশ্য সকল বিস্ময়কর বস্তুগুলাে টিকে রয়েছে। তিনিই সেই প্রথম ও চূড়ান্ত সত্য, যার থেকে অন্যান্য বাস্তবতা প্রকাশ পায়। এই মহাশক্তি থেকে শক্তি পেয়ে সকল গ্রহ-উপগ্রহ ও ছায়ালােকে অবস্থিত সকল তারকারাজি আবর্তিত হচ্ছে। নীচের আয়াতটি এসব কথার প্রমাণ হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছে, খেয়াল করো, চিরস্থায়ী সত্য একমাত্র আল্লাহ, আর তিনি ছাড়া অন্য যাদেরকে তারা ডাকে সেগুলাে সবই মিথ্যা ও ধ্বংসশীল এবং আল্লাহ তায়ালাই মহান-তিনিই বড়।’ সৃষ্টির মধ্যে এই হচ্ছে সেই মহাবিস্ময়, যা সদা-সর্বদা টিকে আছে এবং সুক্ষ রশিতে পরস্পর সবাই আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। এসব তথ্য এই মহা সত্য ব্যক্ত করছে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর অস্তিত্ব সন্দেহাতীতভাবে সত্য ও সঠিক। যেসব ব্যক্তি বা বস্তুর পূজা ওরা করে এবং যাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশায় ওরা প্রার্থনা জানায় তা সবই মিথ্যা। সারা জগৎব্যাপী সুশৃংখল এ মহা ব্যবস্থাপনা পাক পরওয়ারদেগারের সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণেই এ বিশ্বের সব কিছুর অস্তিত্ব বরাবর টিকে আছে। আল্লাহর অস্তিত্বই চিরসত্য, তিনি সকল সীমাবদ্ধতা ও কমতি থেকে পবিত্র। তিনিই এ সৃষ্টি জগতকে বাস্তবায়িত করেছেন, তিনিই এর হেফাযত করছেন। তিনিই একে পরিচালনা করছেন, সবাইকে টিকিয়ে রাখা ও স্থায়িত্ব দান করা পারস্পরিক সম্পর্কের কাজ করার যােগ্যতা দান করা- এ সব সে মহান সত্ত্বারই কাজ। আল্লাহ তায়ালা যা চান, তাইই হয়। ‘এসব এই জন্য যেহেতু আল্লাহ তায়ালাই সত্য।’ আর তিনি ছাড়া যা কিছু আছে সবই বাতিল-মিথ্যা। তিনি ছাড়া যা কিছু আছে সবই পরিবর্তনশীল, সবই মিথ্যা, সবই ধ্বংসশীল। তিনি ছাড়া বিশ্বজগতে যা কিছু আছে সব বাড়তি-কমতি আছে। সবার মধ্যেই পর্যায়ক্রমে শক্তি ও দুর্বলতা, উন্নতি ও অবনতি, অগ্রগতি ও পশ্চাতগতি আসে এবং তিনি ছাড়া সবাই না থেকে হা-তে এসেছে, আর বাস্তবে আসার পর তারা আবার সবাই শেষ হয়ে যাবে। তিনি একক, পবিত্র তিনি, সকল প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতার উর্ধে তিনি। তিনি চিরস্থায়ী, চির অম্লান। অব্যয় অক্ষয়, সকল প্রকার পরিবর্তনের উর্ধে, তার কোন শুরু নাই, নাই তার কোন শেষ । এরপর বাকি থাকবেন তিনি চিরদিন, নিজ অস্তিত্বের মধ্যেই তিনি চিরদিন থাকবেন, সকল প্রকার কল্পনার উর্ধে। তাই বলা হয়েছে, ‘হা এইটিই হবে যেহেতু তিনিই সত্য।’ আছেন তিনি চিরদিন থাকবেনও চিরদিন, তার গুণাবলী বর্ণনা করার মত কোন ভাষা মানুষের কাছে নেই, কোন মানুষ তার শক্তি ক্ষমতার কোন ব্যাখ্যাও দিতে পারে না। চিরদিন তিনি আছেন। যার শক্তি ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষ অন্তরে অনুভবই করতে পারে, তার বিবেক দিয়ে তাকে বুঝতে পারে এবং মানবজাতি তার সকল সত্তায় তার কথা ভাবতে পারে, কিন্তু কতাে বড় তিনি, কতাে মহান তিনি, কত বিপুল তার ক্ষমতা এগুলাে অনুধাবন করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। আর এই ভাবে ‘আল্লাহ তায়ালা, তিনি মহান তিনিই বড়’ অর্থাৎ তিনি ছাড়া এমন মহান আর কেউ হতে পারে না। আর বড় একমাত্র তিনি। এই রহস্যভরা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামীন সম্পর্কে যে অনবদ্য বর্ণনা এসেছে, অনুরূপ কোনাে বর্ণনা পৃথিবীর আর কেউ কোনাে দিন দিতে পারেনি। আমি তাে মনে করি আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা সম্পর্কে আল কোরআনে পরিবেশিত তথ্যরাজির সমকক্ষ তথ্য আর কেউ দিতে পারে না, সে মর্যাদাবান প্রভু প্রতিপালকের মর্যাদায় ব্যাখ্যাও কেউ দিতে পারে না। তার মর্যাদাতে তিনি একক, তাঁর মাহাত্ম বাড়ে কমে না। তার মর্যাদা বয়ান করতে গিয়ে আল কোরআনের উপস্থাপনা যেমন হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে, তেমনি আর কারও কথা, ভাষা-ব্যাখ্যা জাগাতে পারে না।

*পানির বুকে নৌ চলাচল আল্লাহর এক অপূর্ব নিদর্শন : বিশ্ব প্রকৃতির বৈচিত্রময় দৃশ্যের বর্ণনা শেষে আসছে আর একটি আলােকময় অবস্থার বর্ণনা, এমন একটি অবস্থার চিত্র যা মানুষের জীবনের সাথে ওৎপ্রােতভাবে জড়িত, আর তা হচ্ছে সাগরের বুকে পরিভ্রমণরত নৌ-জাহাজের দৃশ্য। অকুল সাগরে যখন এই নৌবহর পাড়ি জমায়, দেশ থেকে দেশ-দেশান্তরে এগিয়ে চলে, বিশাল এই সাগর বক্ষে যখন এসব জাহাজ প্রচন্ড ঝড় তুফানের মুখােমুখি হয়, তখন হতাশাগ্রস্ত এ নৌবহরের যাত্রীদেরকে বাঁচানাের মত কেউ থাকে না চরম এই অসহায় অবস্থায় আল্লাহ রব্বুল আলামীন বড় মেহেরবাণী করে তাদেরকে রক্ষা করেন। এবং অবশেষে নিরাপদে তাদের ঘরে ফিরিয়ে আনেন। মানুষ যখন মহাসাগরের বুকে এ বিভীষিকাময় বিপর্যস্ত অবস্থায় পতিত হয় তখন তাদের কী ভীষণ দুর্দশা হয় তার এক অনুপম ছবি আঁকা হয়েছে আলােচ্য অধ্যায়ে। কূল কিনারাহীন এই সাগর বক্ষে জাহাজের আরােহীদের হৃদয় যখন মহা-বিপদাশংকায় গাছের পাতার মতাে প্রকম্পিত হতে থাকে, তাদেরকে উদ্ধার করা ও স্থলভাগে পৌছে দেয়ার যে মর্মস্পর্শী বর্ণনা এখানে পাওয়া যায় তা তুলনাহীন। দেখুন এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমরা কি (এটা) লক্ষ্য করােনি যে, (উত্তাল) সাগরে (একমাত্র) আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে জলযান ভেসে চলেছে, যাতে করে তিনি… তখন তাদের কিছুলােক (বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের) মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করে, অবশ্য আমার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহকে বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ ছাড়া কেউই অস্বীকার করতে পারে না'(আয়াত ৩১-৩২) এই যে নৌবহর সাগর-মহাসাগরের বুকে পাড়ি জমায়, একবার ভেবে দেখুন, কার ওপর ভরসা করে, কোন শক্তি বলে এগুলাে সাগরের বুকে চলে? কোন শক্তি এ সব নৌবহরকে তাদের গন্তব্য স্থলে নিয়ে যায়, এ সবই আল্লাহ পাকের মেহেরবাণী! তিনি তার অপার করুণায় মানুষকে দেশ-দেশান্তরে নিয়ে যান, যেন তারা একে অপরের সাথে বাণিজ্য-বিনিময় করে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। মানুষের কল্যাণে নিয়ােজিত এসব জাহাজ ঘাের বিপদ সংকুল সাগরের বুকে মহান আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নিয়মে চলে। তার এ নিয়ম পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে পানি ভাগে, স্থলভাগে, আকাশ ও অন্তরীক্ষের সবখানে তিনি এ নিয়ম অনুসারে চলার দায়িত্ব দিয়েছেন সমুদ্রকে, জাহাজকে, বাতাসকে, পৃথিবীকে ও আকাশকে। প্রাকৃতিক এসব আইনের কারণেই এসব নৌবহরের পক্ষে কুল-কিনারাহীন সাগরের বুক চিরে পাড়ি জমানাে সম্ভব হয় এবং বিভিন্ন দেশের। উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে গিয়ে এতাে বিশাল তরংগাভিঘাতেও এসব জাহাজ যে সে মহাসাগরের মধ্যে ডুবে যায় না অথবা স্থির হয়ে থেকেও যায় না তা একমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালারই ইচ্ছায়। ওপরে বর্ণিত সে সকল বস্তুকে প্রদত্ত বৈশিষ্টের মধ্যে যদি সামান্যতম ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে কোন জাহাজের পক্ষে মহাসাগরের বুকে চলাচল করা সম্ভব হত না। পানির তরলতায় সামান্য একটু পরিবর্তন যদি হয়ে যেত, যদি এ পানি হয়ে যেত সামান্য একটু ঘন অথবা জাহাজ নির্মাণের ধাতব পদার্থ যদি আর একটু ভারী হয়ে যেত তাহলে তা সে গভীর সাগরের বুকে ভেসে থাকতে পারত না। লক্ষণীয় যে বাতাসের বর্তমান চাপ থেকে সাগর বক্ষে যদি আর একটু বেশী চাপ পড়ত যদি পানির স্রোত এবং বাতাসের গতি এখন যেভাবে চলছে, তার থেকে একটু ভিন্ন হয়ে যেতাে, যদি পানিকে পানি বানিয়ে রাখার প্রয়ােজনে প্রদত্ত তাপমাত্রার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন করে দেয়া হতাে। বর্তমান পানির স্রোত, বাতাসের গতি যে সীমায় আছে তার থেকে একটু এদিক ওদিক যদি হয়ে যেত তাহলে সব কিছুই লন্ডভন্ড হয়ে যেতাে। এটা আল্লাহ তায়ালারই মেহেরবাণী যে তিনি সব কিছু তদারক করে চলেছেন এবং প্রত্যেকটি জিনিসকে প্রয়ােজনীয় মাত্রায় এমনভাবে স্থাপন করে রেখেছেন যে সব কিছু আপন আপন লক্ষ্যেকে ঠিক রেখে সুসামঞ্জস্যভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সমুদ্রের বুকে তীব্র স্রোত, বৃষ্টি-বাদল, ঝড় তুফান যাই আসুক না কেন, সব কিছুই, আল্লাহ রব্বুল আলামীন কর্তৃক নির্ধারিত এক বিশেষ নিয়মের অধীন কাজ করে চলেছে এবং এ জন্য যাদেরকে তিনি আপন আপন ঘরে পৌঁছে দেবেন বলে পূর্বেই ঠিক করে রেখেছেন তারা ঠিকই শত বিপদের মধ্য দিয়ে এ মহাসাগরসমূহে পাড়ি দেয় এবং নিরাপদে আবার ঘরে ফিরে আসে। সমুদ্র ভ্রমণকালে এসব জাহাজের নাবিক ও যাত্রীরা ঠিকই অনুভব করে যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউই বাঁচানেওয়ালা নেই। এসব জাহাজ সর্বাবস্থায় তারই ইচ্ছা ও মেহেরবাণীতে সমুদ্র বুকে পাড়ি জমায়। এরপর এসব জাহাজ তারই নেয়ামত ও মেহেরবাণী বহন করে দেশ-দেশান্তরে পৌঁছে দেয়। এসব তথ্যের ব্যাখ্যায় যে কথাটা আসে তা হচ্ছে, ‘যেন তিনি তোমাদেরকে (এসব নেয়ামতের মধ্যে) তাঁর মেহেরবাণীর নিদর্শনসমূহ থেকে কিছু কিছু অংশ দেখিয়ে দেন।’ অর্থাৎ, তার মেহেরবাণীর এসব নিদর্শন তিনি বান্দাদের নযরের সামনে পেশ করেন। যেন তারা এসব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তার এসব নিদর্শন তারাই দেখতে পায় যারা দুটি চোখ মেলে দেখতে চায়, যারা এসব নিদর্শন থেকে চোখ বন্ধ করে নেয় না বা তারা এগুলোকে গােপনও করতে চায় না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই এর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক দৃঢ় সংকল্প ব্যক্তি এবং কৃতজ্ঞ চিত্ত লােকের’ অর্থাৎ তারাই দেখতে পায় যারা দুঃখ-বেদনায় অবিচল ও সত্যনিষ্ঠ থাকে এবং যারা স্বাচ্ছন্দে থাকাকালে কৃতজ্ঞতা ভরে আল্লাহ পাকের দরবারে লুটিয়ে পড়ে। সত্যিকারে বলতে কি, ওপরে উল্লেখিত উভয় অবস্থাতেই মানুষ ভ্রান্তিজালে আটকা পড়ে যায় এবং নানা প্রকার অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে বসে।
*বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া : মানুষকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন সৃষ্টির সেরা বানিয়েছেন এবং তাকে নানা প্রকার জ্ঞান গরিমা-দ্বারা ভূষিত করেছেন; কিন্তু মানুষ একটু কষ্টে পড়লে ঘাবড়ে যায়, দৃঢ়-চিত্ততা অবলম্বন করতে পারে না। আবার যখন নানাবিধ নেয়ামত পায় তখন সে যে নেয়ামত দাতার শােকরিয়া আদায় করতে গিয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং আল্লাহর কাছে তার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য আত্ম-নিবেদিত প্রাণ হয়ে যাবে- তা হয় না; বরং দেখা যায়, তাদেরকে কোনাে মুসীবত স্পর্শ করলে তারা ব্যাকুল চিত্তে কাতর ধ্বনি করতে থাকে, ‘আর যখন তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নানাবিধ কষ্ট থেকে নাজাত দেন, তখন তাদের মধ্যে খুবই অল্প কিছুসংখ্যক লােক-ছাড়া বাকি লােকেরা না শােকরি করতে থাকে’ অর্থাৎ তার প্রতি কৃতজ্ঞতা সূচক কথা না বলে তার প্রশংসা ও কৃতিত্বের কথা ঘােষণা না করে এবং তার হুকুম পালনে যত্নবান না হয়ে অন্য কারও কৃতিত্বের কথা প্রচার করতে শুরু করে দেয়। আয়াতে এই কথাটাই প্রকাশ পেয়েছে, ‘আর যখন পাহাড়সম ঢেউ এসে তাদের ঢেকে ফেলে তখন তারা ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং তার সমীপে ব্যাকুল চিত্তে মিনতি জানাতে থাকে।’ সে মহা বিপদের উদাহরণ হচ্ছে এই যে, পাহাড়ের মত উচু ঢেউ যখন তাদের ওপর দিয়ে এসে তাদেরকে ঢেকে ফেলে এবং জাহাজটি যখন বিশাল মহাসাগরের বুকে উত্তাল তরংগের প্রচন্ড আঘাতে ওযনবিহীন পাখনার মত দুলতে থাকে তখন মানুষের শক্তি-ক্ষমতার মিথ্যা আত্মবিশ্বাস মুহুর্তেই দূর হয়ে যায়। তখন তারা তাদের কাল্পনিক শক্তি-ক্ষমতার কথা ভুলে যায়। এ আত্মবিশ্বাসই তাদেরকে সচ্ছলতার সময়ে ধোকার মধ্যে ফেলে রেখেছে এবং কর্তব্য কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, তাদেরকে তাদের মধ্যে অবস্থিত স্বাভাবিক দুর্বলতা এবং তাদের সৃষ্টিকর্তা থেকে ভুলিয়ে রেখেছে। অবশেষে যখন তাদের এসব বাধা-বিঘ্ন কেটে গেছে এবং তাদের আমল প্রকৃতি যখন সকল পর্দা থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছে, দৃঢ়তার সাথে তারা যখন তাদের রব-এর দিকে এগিয়ে গেছে তাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে মনােযােগী হয়েছে এবং একনিষ্ঠভাবে তাকে আনুগত্য দিয়েছে; তখন তারা তাদের সকল শরীকদেরকে অস্বীকার করেছে, সকল হস্তক্ষেপকারীকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে এবং আল্লাহকে একনিষ্ঠভাবে ডেকেছে। ‘তারপর যখন তিনি তাদেরকে রক্ষা করে স্থলভাগের দিকে নিয়ে যান, তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ(বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝে দোল খায়।’ মােমেনের আত্মমর্যাদার দাবী হচ্ছে, সে সুখে দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করবে এবং সর্বাবস্থায় এবং সকল কিছুর জন্য আল্লাহ পাকের কৃতিত্ব ঘােষণা করবে এবং একমাত্র তার কাছেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। প্রকৃতপক্ষে সকল কিছুর শুকরিয়া পাওয়ার অধিকারী একমাত্র তিনি। সুতরাং এ বিষয়ে মধ্যম পথ অবলম্বনকারী হওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকারান্তরে এ কথাই জানানাে যে, শক্তি-ক্ষমতা ও কৃতিত্বের কিছু অংশ অন্য কারও হাতে আংশিক হলেও আছে বলে স্বীকার করা। ওদের মধ্যে আরও একটি গ্রুপ আছে যারা আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর কৃতিত্ব মানতে চায় না, বরং বিপদমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে ও সুদিনের মুখ দেখামাত্র তারা তার ক্ষমতার নিদর্শনগুলােকে সরাসরি অস্বীকার করে বসে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার কথা জানাতে গিয়ে আল কোরআন বলছে, (‘আমি সকল ক্ষমতার মালিক আল্লাহ বলছি), আমার (শক্তি-ক্ষমতার) নিদর্শনগুলােকে একমাত্র তারাই অস্বীকার করে যারা চরম অবাধ্য ও ধোকাবাজ।’ এখানে খাত্তার শব্দটি বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা ভীষণ ও মারাত্মক রকমের বিশ্বাসঘাতক এবং কাফুর বলতে বুঝায় সেসব মানুষকে যারা, আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর নেয়ামতসমূহকে ভীষণভাবে অস্বীকারকারী এবং চরম অকৃতজ্ঞ। এই চরম অর্থবােধক শব্দগুলােই এখানে বিশেষভাবে প্রযােজ্য, কারণ সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর শক্তি ক্ষমতার এতােসব সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখা সত্তেও যারা তাঁকে মানতে চায় না, একমাত্র তার কাছে মাথা নত না করে তারা অলীক ও অতি ক্ষণস্থায়ী কিছু ব্যক্তি বা বস্তুকে ক্ষমতাধিকারী মনে করে; আর শুধু মনে করেই যে ক্ষান্ত হয়, তাও নয়, বরং শক্তি-ক্ষমতার মিথ্যা দাবীদার ও কল্পিত ক্ষমতাধরদের প্রতিভূ মনে করে নিজ হাতের প্রস্তুত করা (দেব-দেবতার) মূর্তিসমূহের সামনে তারা তাদের মাথা নত করে, তাদের কাছে সাহায্য চায় এবং তাদেরকেই ভাল-মন্দের কর্তা মনে করে। সর্বশক্তিমান ও পরম করুণাময় আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার বান্দাদেরকে বড়ই মহব্বত করেন এবং ওই সব অকূল সাগরের বুকে উত্তাল তরংগের মধ্যে পতিত হতাশাগ্রস্ত যাত্রীদের এমন দয়া করে উদ্ধার করার পর তারা তার গুণগান না করে অন্য কারাে গুণ কীর্তন করবে এটা কতাে কঠিন কথা, এর দ্বারা সুস্পষ্ট সত্যকে তারা অস্বীকার করে এবং এর দ্বারা তারা তাদের প্রকৃতিকে কত ভীষণভাবে অপমান করে তা একটুও ভেবে দেখে না। তরংগাভিঘাতে বিক্ষুব্ধ মহাসাগর বক্ষের বিভীষিকাময় সে অবস্থার দিকে লক্ষ্য করুন এবং সে ভীষণ বিপদে পতিত হতাশাগ্রস্ত জাহাজের যাত্রীদের দিকেও একবার কল্পনার দৃষ্টিতে দেখুন; সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এবং সবাইকে ভুলে গিয়ে কিভাবে কায়মনােবাক্যে তারা রব্বুল আলামীনকে ডাকছে। আসলে এই সময়েই তারা তাদের সত্য সঠিক প্রকৃতির মুখােমুখী হয় এবং এই সময়েই তারা সঠিকভাবে তাদের স্রষ্টাকে চিনতে পারে, এই সময়েই তাদের আন্তরিকতা, তাদের জ্ঞানের গর্ব ও শক্তি ক্ষমতার বড়াই সব দূর হয়ে যায়। জীবনে যত বিপদই আসুক না কেন- কূলহীন, কিনারাহীন সাগরবক্ষে এ মহা বিপদের কোনাে তুলনা নেই, পৃথিবীর সকল বিপদের মধ্যে এটাই সব থেকে বড় বিপদ। এ মহা বিপদকালে মানুষ তাদের তুচ্ছতা, তাদের দুর্বলতা এবং তাদের সীমাবদ্ধতার কথা সম্যক উপলব্ধি করে। এ সময়ে, এমনই এক কঠিন বিপদের মধ্যে তারা পতিত হয় যে তখন কারও কথা মনে থাকে না। পরিবার পরিজন ও দুনিয়ার সকল শক্তি ক্ষমতার কথা ভুলে তারা একাগ্রচিত্তে নিজেদেরকে বিশ্বপ্রভুর দরবারে নিবেদন করে। এ সময় পিতা তার সন্তানের কথা ভুলে যায়। বিপদের ঘনঘটা সন্তান ও পিতার মাঝে এমনভাবে আড় হয়ে দাঁড়ায় যে তখন দুনিয়ার কোনাে কিছুই মনে থাকে না, কারও কথাই মনে করার অবসর থাকে না। প্রত্যেক ব্যক্তিই তখন নিজেকে একান্ত একাকী অনুভব করে। অনুভব করে যে, তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। কারও ক্ষমতা নেই সামান্যতম সহায়তা দেয়ার, তখন সকল আত্মীয়তা ও সকল বন্ধন শুধু অবান্তর অনভিপ্রেত অনাকাংখিতই মনে হয়- তাই নয় বরং তখন সকল আত্মীয়তা ও সকল বন্ধন যেন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

*যেদিন কেউই কারাে উপকার করতে পারবেনা : হে মানুষ, তােমরা তােমাদের মালিককে ভয় করাে, এমন একটি দিনকেও ভয় করাে, যেদিন কোনাে পিতা তার সন্তানের পক্ষ থেকে বিনিময় আদায়… জীবন তোমার কোনােরকম প্রতারিত করতে না পারে এবং প্রতারক (শয়তান) যেন কখনাে তােমাদের আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে কোনাে ধোকা দিতে না পারে। (আয়াত ৩৩) কেয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনে যে কঠিন আতংক মানুষকে পেয়ে বসবে তা হচ্ছে তাদের মানসিক আতংক। এ আতংক তাদের চেতনা ও অন্তরকে এমন কঠিনভাবে অবসাদগ্রস্ত করে দেবে যে দেহের সকল শক্তি নিশেষে খতম হয়ে যাবে। (দেখুন ‘মাশাহিদুল আলামে ফিল কোরআনে-গ্রন্থের আল আলামুল আখরুফিল কোরআন অধ্যায়টি পৃ. ৪২-৪৪) এ সময়ে আত্মীয়তা ও সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে, দয়া মায়া মমতার সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। বংশীয় সম্পর্ক সবই কেটে যাবে, সন্তান ও পিতার ভালােবাসার সকল বন্ধন শেষ হয়ে যাবে- আরও যত প্রকার সম্পর্ক আছে তাও হাশরের সে কঠিন দিনে শেষ হয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষ নিজেকে সেদিন একান্ত একাকী ও অসহায় অনুভব করবে। কেউ কাউকে সে মহা বিপদে সাহায্য করতে পারবে না। সেদিন নিজের কাজ ও নিজের পাওনা পাওয়া ছাড়া এ সময়ে কেউ কারও কোনও উপকার করতে পারবে না। এত কঠিন এ সময়কার এই বিপদ যার কোনাে তুলনা করা যায় না। এ জন্য আজ সময় থাকতেই মানুষকে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে চলার জন্য আহ্বান জানানাে হচ্ছে। এই আল্লাহ ভীতিই মানুষকে সেদিন আল্লাহ তায়ালার প্রিয়পাত্র হতে সাহায্য করবে এবং তাদের মিনতি সেদিন বৃথা যাবে না। আখেরাতের অবস্থার চিত্রটি এখানে এমন মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে যা যে কোনাে হৃদয়কে আকৃষ্ট করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা সত্য।’ অর্থাৎ তিনি তার ওয়াদা খেলাফ করবেন না এবং তার ওয়াদা করা শাস্তি বা প্রতিদানকে তিনি বিলম্বিতও করবেন না। সেদিনকার কঠিন ও ভয়াবহ দিন থেকে কেউ কোথাও পালিয়ে যেতে পারবে না এবং কেউ সে দিনের সুক্ষ হিসাব গ্রহণ থেকে দূরে সরে যেতে পারবে না। যে যেটুকু করেছে তার সুক্ষাাতিসুক্ষ বিচার করে যার যেটুকু পাওনা তাকে তা যথাযথভাবে বুঝিয়ে দেয়া হবে। এ বিচারের হাত থেকে না পিতা রেহাই দিতে পারে সন্তানকে, না সন্তান পিতাকে। সুতরাং, দুনিয়ার জীবন যেন তােমাদেরকে ধোকা না দেয়। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন এবং এ জীবনে যা কিছু আকর্ষণীয়, তা যেন তােমাদেরকে ধোকার মধ্যে ফেলে না রাখে যে, চাকচিক্যময় তােমাদের এ জীবন বরাবর একই রকম থাকবে। একটু খেয়াল করে দেখলে তােমরা বুঝতে পারবে যে তােমাদের এখানকার ভােগ-বিলাসের যাবতীয় দ্রব্য এবং আমোদ-ফুর্তির বিষয়সমূহ সবই সাময়িক এবং অতি ক্ষণস্থায়ী। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই এসব তােমাদেরকে দেয়া হয়েছে। সীমাবদ্ধ সে সময়টি শেষ হয়ে গেলেই এগুলো তােমাদের থেকে দূরে সরে যাবে; অতএব বুঝা দরকার যে এগুলাে দিয়ে তােমাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে যে, ভােগ-বিলাসের এসব জিনিসের মধ্যে তােমরা মজে যাও, না তােমাদের পরবর্তী যিন্দেগীকে সমৃদ্ধ করার জন্য তোমরা ব্ৰতী হও। আবারও স্মরণ করানাে হচ্ছে, ‘এবং তােমাদেরকে যেন (এসব বস্তু) আল্লাহ থেকে গাফেল না করে দেয়’ অর্থাৎ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভুলে থাকার জন্য সম্পদ-সমৃদ্ধির আকর্ষণ তােমাদেরকে দারুণভাবে প্রলুব্ধ করে, নানা কর্মব্যস্ততা পরকালীন জীবনের কথা মনে করা থেকে ভুলিয়ে রাখে, অথবা শয়তান এমন সব আজে বাজে কথা মনের মধ্যে জাগাতে থাকে যে মানুষকে কিছুতেই স্মরণ করতে দেয় না যে এ জীবনের কোনাে শেষ আছে এবং পরকাল বলে কিছু থাকতে পারে। এসব শয়তানও তো আছে অনেক কিসিমের, যেমন সম্পদের প্রতি অদম্য লােভ এবং সম্পদের অহংকার এক শয়তান, জ্ঞানের অহংকার এক শয়তান, বয়সের অহংকার এক শয়তান, শক্তির দৰ্প এক শয়তান, ক্ষমতার বড়াই এক শয়তান, কুপ্রবৃত্তির তাড়ন এক শয়তান এবং দুর্দম যৌন আবেগ এক শয়তান। অপর দিকে এসব শয়তানকে ঠেকানাের জন্য ডাল স্বরূপ কাজ করে আল্লাহতায়ালার ভয় এবং আখেরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস!

*যে বিষয়গুলাে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন : আলােচ্য সূরাটির চতুর্থ ও শেষ অধ্যায়ে আখেরাতের এই ভয়াবহ দৃশ্য পেশ করার পর গভীরভাবে হৃদয়কে বশীভূত করার জন্য আখেরাত সংঘটিত হওয়ার কথাটি অত্যন্ত জোরালােভাবে আসছে, যাতে করে আখেরাতের ভয়াবহ দৃশ্যের বর্ণনা হৃদয়কে বিগলিত করতে পারে। এ বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ রব্বুল আলামীন-এর জ্ঞানকে ছবির মতাে তুলে ধরা হয়েছে এবং জানানাে হয়েছে যে মানুষ গায়ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, আর এটাই হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় কমতি। সূরাটির সকল অংশে এ কথাটিকে তুলে ধরা হয়েছে, বরং এই মহা বিস্ময়কর কিতাবের সর্বত্র মানুষের এই দুর্বলতার কথাটিকে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে যেন মানুষ তার সীমাবদ্ধতাকে স্মরণ করে নতি স্বীকার করে এবং কেয়ামতের বাস্তবতা অনুধাবন করে,সময় থাকতেই সাবধান হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার কাছে কেয়ামতের আগমনের (সঠিক) জ্ঞান আছে, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন (তিনি ছাড়া আর কেউই জানে না কখন কোথায় বৃষ্টি বর্ষিত হবে), তিনিই জানেন যা শুক্রকীটে (মজুদ) রয়েছে (তা ছেলে না মেয়ে, শুক্রকণায় থাকা পর্যন্ত তা কেউই জানে না), কোনাে মানুষ বলতে পারে না (সে নিজে) আগামীকাল সে কি (রিযিক কিংবা কি কর্মফল) কামাই করবে, না কেউ এ কথা বলতে পারে যে কোন যমীনে সে মৃত্যুবরণ করবে, নিসন্দেহে (এ তথ্যগুলাে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন, (তিনি) সর্বজ্ঞ সর্ববিষয়ে (তিনি অবহিত)'(আয়াত ৩৪) আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা কেয়ামতকে মানুষের কাছে অদৃশ্য বানিয়ে রেখেছেন। একমাত্র তিনি ছাড়া সে দিনের রহস্য সম্পর্কে আর কেউ কিছুই জানে না। আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়টিকে পরিপূর্ণভাবে রহস্যময় করে রাখতে চেয়েছেন, যাতে করে মানুষ এ বিষয়ের ব্যাপারে সারাক্ষণ ভয়ে থাকে, এর জন্য প্রতীক্ষা করতে পারে এবং এর মুখােমুখী হওয়ার জন্য সদা-সর্বদা প্রস্তুত থাকে; অথচ কবে কেয়ামত সংঘটিত হবে তা কেউই জানে না; অবশ্যই যে কোনাে মুহূর্তে হঠাৎ করে সে ভয়াবহ দিন এসে যাবে, সে সময়ে সে সফরের পাথেয় যোগাড় করার জন্য সে কঠিন দিনে বিলম্বিত করার কোনাে সাধ্য কারও থাকবে না, কোনাে কাজে আসবেন না না তার সহায় সম্পদ। আর আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর বুঝমতােই বৃষ্টি বর্ষণ করেন, বর্ষণ করেন সেই পরিমাণে যা তার মর্জিতে আসে; আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যে জ্ঞান, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দান করেছেন তার দ্বারা সে এমন এক পরিমাপ যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যার দ্বারা সে বৃষ্টি আসার পূর্বে তার পূর্বাভাস হয়তাে জানতে পারে। তাই বলে সে বৃষ্টি আসার জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণাদি সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না। তাই আল্লাহ তায়ালার কালাম আমাদেরকে জানিয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। কারণ তিনিই সেই সব কারণ ও উপকরণাদি সৃষ্টি করেন যা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন। সুতরাং বৃষ্টি বর্ষণের জন্য আল্লাহ তায়ালা যে বিশেষ ক্ষমতাটির প্রয়ােগ জরুরী বলে আমরা জানি তা হচ্ছে বৃষ্টি আনয়নের জন্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালার নিজের ক্ষমতা ও ইচ্ছা শক্তি। আলােচ্য আয়াতটিতে এ পথটিকেই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘গায়বের খবর একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানেন, একান্তভাবে এ ক্ষমতাটি তার হাতে নিবদ্ধ’-একথাটি যারা মানতে চায় না তারা নানা প্রকার কল্পনাপ্রসূত কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পায়, অথচ ভ্রান্ত মানুষ এটা হিসাব করতে চায় না যে সকল বিষয়ের সকল অবস্থার প্রকৃত ও নিশ্চিত জ্ঞান এক আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও হাতে নেই। একমাত্র তার জ্ঞানই সঠিক ও পূর্ণাংগ এবং সে জ্ঞান এমন চিরস্থায়ী যে তার মধ্যে কোনাে কমবেশী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তিনিই (নিশ্চিতভাবে) জানেন যে মাতৃগর্ভে শুক্রকীটটির মধ্যে কি আছে’ এখানে বলা হয়েছে, একান্তভাবে আল্লাহ তায়ালাই জানেন কেয়ামতের জ্ঞান ও রহস্যের প্রতীক মাতৃগর্ভে অবস্থিত ভ্রুণ সম্পর্কে, বলা হচ্ছে, এ বিষয় দুটি শুধু তিনিই জানেন, আর কেউই এ বিষয়ে কিছু জানে না, জানে না নিশ্চিতভাবে এসব অন্য কেউ। জরায়ুর মধ্যে কি আছে, প্রতি মুহূর্তে কি বর্ধিত হচ্ছে, বাড়তি বা কমতি হওয়ায় কি উন্নতি হচ্ছে, সন্তান ধারণের পর জরায়ুর মধ্যে সংকোচন বা বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত জ্যান্ত না মৃত, পুরুষ না নারী ভ্রুণ- এ বিষয়ে নিশ্চয়তার সাথে কেউ কিছুই জানে না, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই এ বিষয়ে জানেন। গর্ভ ধারণের প্রথম মুহূর্তে পুং জীবকোষ ও ডিম্বকোষের সম্মিলন কেমন করে হয় এবং কিভাবে ভ্রুণ গঠিত হয়, এর বৈশিষ্ট, অবস্থা এবং এর শক্তি ক্ষমতা সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না। এসবের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ জাল্লা শানুহর কাছেই রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘কোন ব্যক্তি জানে না, আগামীকাল কে কি রােযগার করবে।’ অর্থাৎ, কেউ জানে না, কে কি ভাল জিনিস উপার্জন করবে এবং কে কি মন্দ উপার্জন করবে, কে উপকৃত হবে, আর কে তার নিজ উপার্জন দ্বারা তার নিজেরই ক্ষতি ডেকে আনবে; কার জীবন সহজ হবে আর কার জীবন হবে সমস্যা-সংকুল; কে সুস্থ থাকবে আর কে হবে অসুস্থ। কে আল্লাহ তায়ালার অনুগত থাকবে আর কে করবে নাফরমানী। এখন উপার্জন শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় আগামীকাল মানুষ আর্থিক যেসব জিনিস লাভ করবে তার ওপর; কিন্তু আগামীকাল কি হবে না হবে সবই অদৃশ্যের আঁধারে আবদ্ধ হয়ে লুকিয়ে রয়েছে, তা পর্দার আড়ালে ঢাকা রয়েছে আর মানুষও রয়েছে অদৃশ্যের আঁধারের মুখােমুখী দাড়িয়ে, পর্দার ওপাশে কোন পরিণতি অপেক্ষা। করছে তার জন্য তা দেখার ক্ষমতা তার নেই। আর এইভাবে ‘ মানুষ জানে না কোন যমীনে সে মৃত্যু বরণ করবে।’ সেটা এমন এক বিষয় যা পুরােপুরি অজানার ঘন অন্ধকারে ঢাকা রয়েছে। সে অন্ধকারের পর্দা এতােই পুরু যে তা ভেদ করে সেখানকার কোনাে খবর আমাদের কান পর্যন্ত পৌছায় না বা সে দৃশ্য আমাদের দৃষ্টি স্পর্শ করে না। এই কঠিন পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ বড়ই অসহায় বােধ করে এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে গুটি শুটি হয়ে যায় এবং সে বিশ্ব সম্রাটের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় যেহেতু শত চেষ্টা করেও এ রহস্য জাল ভেদ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তখনই সে গভীরভাবে অনুভব করে যে, তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তি কতাে সীমাবদ্ধ। সে তার অক্ষমতার কথা উপলব্ধি করে, তার মেকী অহংকার ও ভালমন্দ বিচার ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার দাবী দূরীভূত হয়। গায়বের দুর্ভেদ্য প্রাচীরের সামনে দাড়িয়ে মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে, মহাবিশ্বের জ্ঞানভান্ডার থেকে অতি সামান্যই তাকে দেয়া হয়েছে এবং সে জানে না এ প্রাচীরের অপর দিকে কী নিগূঢ় রহস্য ভান্ডার রয়েছে যা কোনাে দিন মানুষ জানতে পারেনি। আর আগামীকাল কী ঘটবে তা তারা বুঝতে পারতাে না। এমনকি পরবর্তী মুহূর্তে কী ঘটবে তাও তারা বুঝতে পারত না, আর এই অক্ষমতার উপলব্ধিই মানুষকে তার অংহকার এবং নিজের বড়ত্বের চেতনা থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। আল কোরআনের এই প্রবল প্রভাবপূর্ণ ও গভীর আলােচনার ধারা মানুষের অন্তরের মধ্যে হাশরের মাঠ সম্পর্কে প্রচন্ড এক আশংকার অনুভূতি জাগায়। সকল যামানা ও সকল দেশ, বর্তমানের বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের দৃশ্যমান সত্য এবং দূর ভবিষ্যৎ ও সর্বকালের সর্ব অবস্থা ও সকল কিছুর তুলনায় প্রশস্ত সে ভয়ংকর হাশরের ময়দানের ভয় মানুষের অন্তরের সুবিস্তীর্ণ ক্ষেত্র দখল করে রেখেছে; মানুষের আশা আকাংখার মধ্যে এবং মানুষের দৃঢ় চিন্তা-ভাবনার মধ্যেও রয়েছে এ প্রচন্ড ভীতি; এ ভীতি হচ্ছে বহু দূরে অবস্থিত কেয়ামত সম্পর্কে, এ প্রচন্ড আশংকা হচ্ছে অনেক অনেক দূরে অবস্থিত বৃষ্টির উৎস থেকে বারিবর্ষণ সম্পর্কে, এ কঠিন আতংক হচ্ছে চোখের আড়ালে গােপন স্থানে অবস্থিত বাচ্চাদানির মধ্যে ভ্রুণ সম্পর্কে। এ সংশয় হচ্ছে আগামীকালের উপার্জন সম্পর্কে, এ ভীতি রয়েছে সেসব জিনিসের জন্য যা নিকট দূরত্বে রয়েছে এবং যা রয়েছে অজানার মধ্যে অদৃশ্য, মারাত্মক ভয় বিরাজ করে মৃত্যু ও দাফনের দিন ক্ষণ ও মৃত্যুর পর কোথায় দাফন করা হবে সেই স্থান সম্পর্কে, অথচ এগুলাে সবই হচ্ছে ধারণার অতীত ব্যাপার। কেয়ামতের সেই সুবিশাল ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে সর্বকালের সারাবিশ্বের সকল মানুষের কল্পনাতীত এ মহা-মহা সমাবেশে মানুষ উর্ধশ্বাসে তাদের শেষ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করবে; কিন্তু মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বর্ণনার মধ্যে সে ভয়াবহ দিনের দৃশ্য এমন ছবির মত তুলে ধরা হয়েছে যে, এ বর্ণনা পাঠকালে যে কোনাে ব্যক্তির অন্তর, সে ভয়ংকর দিনের সকল অবস্থার সংস্পর্শে এসে দুরু দুরু করে কাপতে থাকে। এ সময়ে সকল অবস্থা একত্রিত হয়ে, অন্তরের মধ্যে গায়বের প্রশ্নের ওপর কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় এবং আমরা সবাই যেন একটি আবদ্ধ জানালার সামনে দাড়িয়ে জানালার ওপাশের অবস্থা জানার জন্য আমরা অধীরভাবে প্রতীক্ষা করতে থাকি। আমাদের কাছে মনে হতে থাকে; যদি সূচের ছিদ্রের মতাে একটি অতি সূক্ষ ছিদ্র পথেও ওপাশের দৃশ্যটি দেখতে পেতাম তাহলে জানা অজানার ব্যবধান ঘুচে যেত এবং এই নিকট এবং সে দূর সবই একাকার হয়ে সকল রহস্যের দ্বার উঘাটিত হয়ে যেতাে। আর তাহলে সব দূরের বিষয়ের জট আমাদের সামনে খুলে যেতাে, তার মধ্যে রয়েছে সৃষ্টি-কাজে পিতামাতার ভূমিকা অন্যতম। কিন্তু না, এ বাতায়ন পথে সে অজানা রহস্যকে জানার জন্য কোনাে সামান্যতম ছিদ্রও নেই এবং মানুষের কাছে এ রহস্যের দ্বার চিরদিন অবরুদ্ধই রয়ে গেছে।(এ বাক্যটি গৃহীত হয়েছে লেখকের রচিত ‘আত্তাসওয়ীরুল ফান্নীউ ফিল কোরআন’ গ্ৰন্থের অধ্যায়- ‘আত তানাসিকুল ফান্নিউ’ থেকে) কারণ এ বিষয়টি জানা মানুষের ক্ষমতার বাইরে এবং মানুষের জ্ঞান-সীমার সম্পূর্ণ বাইরের বিষয়। সে অজানা রহস্য একান্তভাবে আল্লাহ তায়ালাই জানেন অন্য কারও পক্ষেই তা জানা সম্ভব নয়। তবে আল্লাহ তায়ালা তার এই গায়বী ইলম কাউকে যৎ কিঞ্চিৎ কিছু দিতে চাইলে দিতে পারেন, এটা সম্পূর্ণ তাঁর নিজের ব্যাপার এবং এ ব্যাপারে কেউ কোন বাহাদুরীর দাবী করতে পারে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালাই (সকল বিষয়ে) ওয়াকেফহাল’ অর্থাৎ জাননেওয়ালা এবং সকল বিষয়ে খবর রাখনেওয়ালা তিনি ছাড়া নেই আর কেউ। এইভাবেই সূরাটি সমাপ্ত হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ সে ভয়ানক দূরবর্তী ও দিগন্তব্যাপী সর্ববিষয়ের গভীর ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াদির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যেই সূরাটির অবতারণা, যা জানার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে থাকে, চলমান জীবন যে মহাকালের সফরে থাকাকালে পার্থিব জীবনের মধ্যে ক্ষণিকের যাত্রা বিরতিতে আত্মতৃপ্তি বােধ করে, তাদের এই অসার প্রয়াসের তুচ্ছতা জানানাে এবং দূরের হলেও সুনিশ্চিত পরিণতির দিকে তাদেরকে অগ্রসর করে দেয়াই সূরাটির কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য। তাই মানুষকে উদাত্ত কণ্ঠে ধীরস্থিরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে এবং পরবর্তীতে কী পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে, সে বিষয়টিকে রেখে নিজের জীবনের হীতকর্তব্য নির্ধারণ করে নিতে আহ্বান জানানাে হচ্ছে। দুনিয়ার বাস্তবতার মধ্য দিয়ে ধীর মন্থর পদক্ষেপে সে তাে তার নিশ্চিত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। তার সামনে দিগন্তব্যাপী এক মহা পুস্তক এই গােটা বিশ্বে রয়েছে এবং তার মধ্যস্থিত দৃশ্যসমূহ ও বিশাল এ জীব জগৎ এসব কিছুর দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করার জন্য তাকে বারবার আহবান জানানাে হচ্ছে যেন সে নিজ মালিককে চিনতে পারে, তারই পরিপূর্ণ আনুগত্যে আত্মনিয়ােগ করতে পারে এবং সময় থাকতেই মহাকালের সফরের জন্য পাথেয় সংগ্রহে তৎপর হতে পারে। নাতিদীর্ঘ এ সূরাটি মাত্র চৌত্রিশটি আয়াত নিয়ে গঠিত। এরই মধ্যে মহাবিশ্বের মহান প্রতিপালক তার সম্পর্কে জানানাে ও মানুষকে কর্তব্য সচেতন করার জন্য যে অমিয় মহাবাণী প্রেরণ করেছেন তা বিদগ্ধ হৃদয়ে অবশ্যই গভীরভাবে রেখাপাত করে। সুতরাং বড়ই বরকতময় তিনি, অযাচিত যার মেহেরবাণী, সকল অন্তরের তিনি সৃষ্টিকর্তা। আর হাঁ, সেই মহান আল্লাহ তায়ালাই তাে মহামূল্যবান গ্রন্থ আল কোরআনের অবতরণকারী- অবশ্যই এ পাক কালাম মনের নানা জটিলতা ও বক্রতারূপ ব্যাধির আরোগ্য দানকারী এবং মােমেনদের জন্য তা হেদায়াত ও রহমত, যা মযলুম ও দুঃখী জনগণের ব্যথাহত অন্তরে নিরবধি সিঞ্চন করে যাচ্ছে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# কোন জিনিসকে কারো জন্য অনুগত করে দেয়ার অর্থ হচ্ছেঃ এক, জিনিসটিকে তার অধীন ও ব্যবহারোপযোগী করে দেয়া হবে। তাকে যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় ও ব্যবহার করার ক্ষমতা তাকে দেয়া হবে। দুই, জিনিসটিকে কোন নিয়মের অধীন করে দেয়া হবে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য তা উপকারী ও লাভজনক হয়ে যাবে এবং এতে তার স্বার্থ উদ্ধার হবে। পৃথিবী ও আকাশের সমস্ত জিনিসকে মহান আল্লাহ‌ একই অর্থে মানুষের জন্য অনুগত করে দেননি। বরং কোন জিনিসকে প্রথম অর্থে এবং কোনটিকে দ্বিতীয় অর্থে অনুগত করে দিয়েছেন। যেমন পানি, মাটি, আগুন, উদ্ভিদ, খনিজ পদার্থ, গবাদি পশু ইত্যাদি আমাদের জন্য প্রথম অর্থে এবং চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদিকে দ্বিতীয় অর্থে আমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন।
# যেসব নিয়ামত মানুষ কোন না কোনভাবে মানুষ অনুভব করে এবং তার জ্ঞানে ধরা দেয় সেগুলো প্রকাশ্য নিয়ামত। আর যেসব নিয়ামত মানুষ জানে না এবং অনুভব ও করে না সেগুলো গোপন নিয়ামত। মানুষের নিজের শরীরে এবং তার বাইরে দুনিয়ায় তার স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে এমন অগণিত ও অসংখ্য জিনিস রয়েছে কিন্তু মানুষ জানেও না যে, তার স্রষ্টা তার হেফাযত ও সংরক্ষণের জন্য, তাকে জীবিকা দান করার জন্য, তার বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনের জন্য এবং তার কল্যাণার্থে কত রকমের সাজ-সরঞ্জাম যোগাড় করে রেখেছেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মানুষ যতই গবেষণা করছে ততই তার সামনে আল্লাহর এমনসব নিয়ামতের দরোজা উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে যা পূর্বে তার সম্পূর্ণ অগোচরে ছিল। আবার আজ পর্যন্ত যেসব নিয়ামতের জ্ঞান মানুষ লাভ করতে পেরেছে সেগুলো এমনসব নিয়ামতের তুলনায় তুচ্ছ যেগুলোর ওপর থেকে এখনো গোপনীয়তার পর্দা ওঠেনি।
# ঝগড়া ও বিতর্ক করে এমন ধরনের বিষয়াদি নিয়ে যেমন, আল্লাহ‌ আছে কিনা? আল্লাহ‌ কি একা, না আরো আল্লাহ‌ আছেন? তার গুণাবলী কি এবং তিনি কেমন? নিজের সৃষ্টিকুলের সাথে তার সম্পর্ক কোন পর্যায়ের? ইত্যাদি ইত্যাদি।
# তাদের কাছে জ্ঞানের এমন কোন মাধ্যমে নেই যার সাহায্যে তারা সরাসরি সত্যকে দেখতে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার সন্ধান পেতে পারে অথবা এমন কোন পথপ্রদর্শকের পথনির্দেশনাও তাদের কাছে নেই যিনি নিজে সত্যকে দেখে তাদেরকে সে সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন। কিংবা আল্লাহর এমন কোন কিতাব তাদের কাছে নেই যার ওপর তারা এ বিশ্বাসের ভিত্তি রাখতে পারে।
# প্রত্যেক জাতির, পরিবারের ও ব্যক্তির বাপ-দাদারা অবশ্যই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, এমন কোন কথা নেই। পদ্ধতিটির বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসাই তার সত্য হবার প্রমাণ নয়। বাপ-দাদা যদি পথভ্রষ্ট হয়ে থাকে, তাহলেও চোখ বন্ধ করে তাদেরই পথে পাড়ি জমানো হবে এবং কখনো এ পথটি কোনো দিকে গিয়েছে এ ব্যাপারে কোনো প্রকার অনুসন্ধান করার প্রয়োজনই অনুভব করা হবে না, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনো এমন অজ্ঞতার কাজ করতে পারে না।
# নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর বন্দেগীতে নিয়োজিত করে। নিজের কোন জিনিসকে আল্লাহর বন্দেগীর বাইরে রাখে না। নিজের সমস্ত বিষয় আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেয় এবং তার প্রদত্ত পথনির্দেশকে নিজের সারা জীবনের আইনে পরিণত করে।
# নিজেকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করার ঘোষণা দেয়া হবে কিন্তু কার্যত আল্লাহর অনুগত বান্দার নীতি অবলম্বন করা হবে না, এমনটি যেন না হয়।
# সে এও ভয় করবে না যে, সে ভুল পথনির্দেশ পাবে এবং আল্লাহর বন্দেগী করলে তার পরিণাম ধ্বংস হবে, এআশঙ্কাও করবে না।
# সম্বোধন করা হয়েছে নবী (সা.) কে। অর্থ হচ্ছে, হে নবী! যে ব্যক্তি তোমার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করে, সে তো নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে একথা মনে করে যে, ইসলামকে প্রত্যাখ্যান এবং কুফরীকে মেনে নিয়েও তার ওপর জোর দিয়ে সে তোমাকে অপমানিত করেছে কিন্তু আসলে সে নিজেই নিজেকে অপমানিত করেছে। সে তোমার কোন ক্ষতি করেনি বরং নিজেই নিজের ক্ষতি করেছে। কাজেই সে যদি তোমার কথা না মানে তাহলে তার পরোয়া করার প্রয়োজন নেই।
# তোমরা যে এতটুকু কথা জানো ও স্বীকার করো এ জন্য তোমাদের ধন্যবাদ। কিন্তু এটাই যখন প্রকৃত সত্য তখন প্রশংসা সমস্তই একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত হওয়া উচিত। বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিতে যখন অন্য কোন সত্তার কোন অংশ নেই তখন সে প্রশংসার হকদার হতে পারে কেমন করে?
# অধিকাংশ লোক জানে না যে, যদি আল্লাহকে বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা বলে না মেনে নেয়া হয় তাহলে এর অনিবার্য ফল ও দাবী কি হয় এবং কোন কথাগুলো এর বিরুদ্ধে চলে যায়। যখন এক ব্যক্তি একথা মেনে নেয় যে, একমাত্র আল্লাহই পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা তখন অনিবার্যভাবে তাকে একথাও মেনে নিতে হবে যে, ইলাহ ও রবও একমাত্র আল্লাহই। ইবাদাত ও আনুগত্যের হকদারও একমাত্র তিনিই। একমাত্র তারই পবিত্রতা ঘোষণা করতে এবং তারই প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করতে হবে। তিনি ছাড়া আর কারো কাছে প্রার্থনা করা যেতে পারে না। নিজের সৃষ্টির জন্য আইন প্রণেতা ও শাসক তিনি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। একজন স্রষ্টা অন্যজন হবেন মাবুদ, এটা সম্পূর্ণ বুদ্ধি বিরোধী ও বিপরীতমুখী কথা। মূর্খতার মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে আছে একমাত্র এমন ব্যক্তিই একথা বলতে পারে। তেমনিভাবে একজনকে স্রষ্টা বলে মেনে নেয়া এবং তারপর অন্য বিভিন্ন সত্তার মধ্য থেকে একজনকে প্রয়োজন পূর্ণকারী ও সংকট নিরসনকারী, অন্যজনের সামনে ষষ্ঠাংগ প্রণিপাত হওয়া এবং তৃতীয় একজনকে ক্ষমতাসীন শাসকের স্বীকৃতি দেয়া ও তার আনুগত্য করা-এসব পরস্পর বিরোধী কথা। কোন জ্ঞানী ব্যক্তি এসব কথা মেনে নিতে পারে না।
# কেবল এতটুকুই সত্য নয় যে, পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলীর স্রষ্টা আল্লাহ‌ বরং পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে যেসব জিনিস পাওয়া যায় তিনিই এসবের মালিক। আল্লাহ‌ তার এ বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করে একে এমনিই ছেড়ে দেননি যে, যে কেউ চাইলেই এর বা এর কোন অংশের মালিক হয়ে বসবে। নিজের সৃষ্টির তিনি নিজেই মালিক। এ বিশ্ব-জাহানে যা কিছু আছে সবই তার মালিকানাধীন। এখানে তার ছাড়া আর কারো সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবার এখতিয়ার নেই।
# “আল্লাহর কথা” মানে তার সৃষ্টিকর্ম এবং তার শক্তি ও জ্ঞানের নিদর্শন। এ বিষয়বস্তুটি সূরা আল কাহফের ১০৯ আয়াতে এর থেকে আরো একটু ভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এক ব্যক্তি ধারণা করবে, বোধ হয় এ বক্তব্যে বাড়াবাড়ি বা অতিকথন আছে। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলে এক ব্যক্তি অনুভব করবে, এর মধ্যে তিল পরিমাণও অতিকথা নেই। এ পৃথিবীর গাছগুলো কেটে যতগুলো কলম তৈরি করা যেতে পারে এবং পৃথিবীর বর্তমান সাগরের পানির সাথে আরো তেমনি সাতটি সাগরের পানিকে কালিতে পরিণত করলে তা দিয়ে আল্লাহর শক্তি, জ্ঞান ও সৃষ্টির কথা লিখে শেষ করা তো দূরের কথা হয়তো পৃথিবীতে যেসব জিনিস আছে সেগুলোর তালিকা তৈরি করাই সম্ভবপর হবে না। শুধুমাত্র এ পৃথিবীতেই যেসব জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলোই গণনা করা কঠিন, তার ওপর আবার এই অথৈ মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিবরণ লেখার তো কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।

এ বর্ণনা থেকে আসলে এ ধরনের একটি ধারণা দেয়াই উদ্দেশ্য যে, এত বড় বিশ্ব-জাহানকে যে আল্লাহ‌ অস্তিত্ব দান করেছেন এবং আদি থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত এর যাবতীয় আইন্তশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পরিচালনা করে চলেছেন তার সার্বভৌম কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে তোমরা যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্তাকে উপাস্যে পরিণত করে বসেছো তাদের গুরুত্ব ও মর্যাদাই বা কি। এই বিরাট-বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান এবং নিছক জ্ঞানটুকু পর্যন্ত লাভ করার ক্ষমতা কোন সৃষ্টির নেই। তাহলে কেমন করে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, সৃষ্টিকুলেরর মধ্য থেকে কেউ এখানে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ক্ষমতার কোন অংশও লাভ করতে পারে, যার ভিত্তিতে সে ভাগ্য ভাঙা গড়ার ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসে।
# তিনি একই সময় সমগ্র বিশ্ব-জাহানের আওয়াজ আলাদা আলাদাভাবে শুনছেন এবং কোন আওয়াজ তার শ্রবণেন্দ্রিয়কে এমনভাবে দখল করে বসে না যার ফলে একটি শুনতে গিয়ে অন্যগুলো শুনতে না পারেন। অনুরূপভাবে তিনি একই সময় সমগ্র বিশ্ব-জাহানকে তার প্রত্যেকটি জিনিস ও ঘটনা সহকারে বিস্তারিত আকারেও দেখছেন এবং কোন জিনিস দেখার ব্যাপারে তার দর্শনেন্দ্রিয় এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে না যে, একটিকে দেখতে গিয়ে তিনি অন্যগুলো দেখতে অপারগ হয়ে পড়েন। মানবকুলের সৃষ্টি এবং তাদের পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারটিও ঠিক এই একই পর্যায়ের। সৃষ্টির প্রারম্ভকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যতগুলো মানুষ জন্ম নিয়েছে এবং আগামীতে কিয়ামত পর্যন্ত জন্ম নেবে তাদের সবাইকে তিনি আবার মাত্র এক মুহূর্তেই সৃষ্টি করতে পারেন। তার সৃষ্টিক্ষমতা একটি মানুষের সৃষ্টিতে এমনভাবে লিপ্ত হয়ে পড়ে না যে, সে একই সময়ে তিনি অন্য মানুষদের সৃষ্টি করতে অপরাগ হয়ে পড়েন। একজন মানুষ সৃষ্টি করা বা কোটি কোটি মানুষ সৃষ্টি করা দু’ টোই তার জন্য সমান।
# রাত ও দিনের যথারীতি নিয়মিত আসাই একথা প্রকাশ করে যে, সূর্য ও চন্দ্র একটি নিয়মের নিগড়ে বাঁধা। সূর্য ও চন্দ্রের উল্লেখ এখানে নিছক এ জন্য করা হয়েছে যে, এ দু’ টি মহাশূন্যের সবচেয়ে দৃশ্যমান জিনিস এবং মানুষ অতি প্রাচীনকাল থেকে এদেরকে উপাস্যে পরিণত করে আসছে এবং আজও বহুলোক এদেরকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। অন্যথায় প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ‌ পৃথিবীসহ বিশ্ব-জাহানের সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রকে একটি অনড় নিয়ম-শৃঙ্খলা ও আইনের নিগড়ে বেঁধে রেখেছেন। এ থেকে এক চুল পরিমাণ এদিক ওদিক করার ক্ষমতা তাদের নেই।
# প্রত্যেকটি জিনিসের যে বয়স তথা সময়-কাল নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সেই সময় পর্যন্ত তা চলছে। চন্দ্র, সূর্য বা বিশ্ব-জাহানের অন্য কোন গ্রহ-নক্ষত্র কোনটাই চিরন্তন ও চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেকের একটি সূচনাকাল আছে। তার পূর্বে তার অস্তিত্ব ছিল না। আবার প্রত্যেকের আছে একটি সমাপ্তিকাল তারপর আর তার অস্তিত্ব থাকবে না। এ আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা বুঝিয়ে দেয়া যে, এ ধরনের ধ্বংস ও ক্ষমতাহীন বস্তু ও সত্তাগুলো উপাস্য হতে পারে কেমন করে?
# প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতাধর কর্তা, সৃষ্টি ও পরিচালনা ব্যবস্থাপনার আসল ও একচ্ছত্র মালিক।
# তারা সবাই নিছক তোমাদের কাল্পনিক খোদা। তোমরা কল্পনার জগতে বসে ধারণা করে নিয়েছো যে, অমুকজন আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার অংশীদার এবং অমুক মহাত্মা সংকট নিরসন ও অভাব মোচন করার ক্ষমতা রাখেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের কেউ কোন কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না।
# প্রত্যেকটি জিনিসের ঊর্ধ্বে এবং সবার শ্রেষ্ঠ। তার সামনে সব জিনিসই নিচু। প্রত্যেকের চেয়ে তিনি বড় এবং সবাই তার সামনে ছোট।
# এমন নিদর্শনাবলী দেখাতে চান যা থেকে জানা যায় একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহই সমস্ত ক্ষমতার মালিক। মানুষ যতই বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন ও সমুদ্র যাত্রার উপযোগী জাহাজ নির্মাণ করুক এবং জাহাজ পরিচালনা বিদ্যা ও তার সাথে সম্পর্কিত তথ্য জ্ঞান্তঅভিজ্ঞতায় যতই যতই পারদর্শী হোক না কেন সমুদ্রে তাকে যেসব ভয়ংকর শক্তির সম্মুখীন হতে হয় আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া সেগুলোর মোকাবিলায় সে একা নিজের দক্ষতা ও কৌশলের ভিত্তিতে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে সফর করতে পারে না। তার অনুগ্রহ দৃষ্টি সরে যাবার সাথে সাথেই মানুষ জানতে পারে তার উপায়-উপকরণ ও কারিগরী পারদর্শিতা কতটা অর্থহীন ও অকেজো। অনুরূপভাবে নিরাপদ ও নিশ্চিত অবস্থায় মানুষ যতই কট্টর নাস্তিক ও মুশরিক হোক না কেন, সমুদ্রে তুফানে যখন তার নৌযান ডুবে যেতে থাকে তখন নাস্তিকও জানতে পারে আল্লাহ‌ আছেন এবং মুশরিকও জেনে ফেলে আল্লাহ‌ মাত্র একজনই।
# যাদের মধ্যে এ দু’টি গুণ পাওয়া যায় তারা যখন এ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে সত্যকে চিনতে পারে তখন তারা চিরকালের জন্য তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করে তাকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে। প্রথম গুণটি হচ্ছে, তাদের বড়ই সবরকারী (صبار) তথা অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে। তারা অস্থিরমতি হবে না বরং তাদের পদক্ষেপে দৃঢ়তা থাকবে। সহনীয় ও অসহনীয়, কঠিন ও কোমল এবং ভালো ও মন্দ সকল অবস্থায় তারা একটি সৎ ও সুস্থ বিশ্বাসের ওপর অটল থাকবে। তাদের মধ্যে এ ধরনের কোন দুর্বলতা থাকবে না যে, দুঃসময়ের মুখোমুখি হলে আল্লাহর সামনে নতজানু হয়ে কান্নাকাটি করতে থাকবে আস সুসময় আসার সাথে সাথেই সবকিছু ভুলে যাবে। অথবা এর বিপরীত ভালো অবস্থায় আল্লাহকে মেনে চলতে থাকবে এবং বিপদের একটি আঘাতেই আল্লাহকে গালি দিতে শুরু করবে। দ্বিতীয় গুণটি হচ্ছে তাদেরকে বড়ই শোকরকারী (شكور) তথা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী হতে হবে। তারা নিমকহারাম ও বিশ্বাসঘাতক হবে না, উপকারীর উপকার ভুলে যাবে না। বরং অনুগ্রহের কদর করবে এবং অনুগ্রহকারীর জন্য একটি স্বতন্ত্র কৃতজ্ঞতার অনুভূতি হর-হামেশা নিজের মনের মধ্যে জাগ্রত রাখবে।
# এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। মাঝপথকে যদি সরল ও সঠিক পথের অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে এর অর্থ হবে, তাদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই হয় যারা তুফানে ঘেরাও হবার পর যে তাওহীদের স্বীকৃতি দিয়েছিল সে সময় অতিক্রান্ত হবার পরও তার ওপর অবিচল থাকে এবং এ শিক্ষাটি তাদেরকে চিরকালের জন্য সত্য ও সঠিক পথযাত্রীতে পরিণত করে। আর যদি মাঝপথের অর্থ করা হয় মধ্যমপন্থা ও ভারসাম্য, তাহলে এর অর্থ হবে, তাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক এ অভিজ্ঞতা লাভের আগের সময়ের মতো নিজেদের শিরক ও নাস্তিক্যবাদী চিন্তা-বিশ্বাসে আর তেমন একনিষ্ঠ ও শক্তভাবে টিকে থাকে না। এর দ্বিতীয় অর্থ হবে, সে সময় অতিক্রান্ত হবার পর তাদের মধ্য থেকে কিছু লোকের মধ্যে আন্তরিকতার যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। আল্লাহ‌ এখানে এ দ্ব্যর্থক বাক্যাংশটি এ তিনটি অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করার জন্যই ব্যবহার করেছেন, এটারই সম্ভাবনা বেশি। তবে উদ্দেশ্য সম্ভবত একথা বলা যে, সামুদ্রিক ঝড়ের সময় সবার টনক নড়ে যায় এবং বুদ্ধি ঠিকমত কাজ করে। তখন তারা শিরক ও নাস্তিক্যবাদ পরিহার করে সবাই এক আল্লাহকে ডাকতে থাকে সাহায্যের জন্য। কিন্তু নিরাপদে উপকূলে পৌঁছে যাবার পর স্বল্প সংখ্যক লোকই এ অভিজ্ঞতা থেকে কোন স্থায়ী শিক্ষা লাভ করে। আবার এ স্বল্প সংখ্যক লোকেরাও তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল, যারা চিরকালের জন্য শুধরে যায়। দ্বিতীয় দলের কুফরীর মধ্যে কিছুটা সমতা আসে। তৃতীয় দলটি এমন পর্যায়ের যাদের মধ্যে উক্ত সাময়িক ও জরুরী সময়কালীন আন্তরিকতার কিছু না কিছু বাকি থাকে।
# এর আগের আয়াতে যে দু’টি গুণের বর্ণনা এসেছে তার মোকাবিলায় এখানে এ দু’টি দোষের উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বাসঘাতক এমন এক ব্যক্তি যে মারাত্মক রকমের বেঈমানী করে এবং নিজের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার পালন করে না। আর অকৃতজ্ঞ হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যার প্রতি যতই অনুগ্রহ করা হোক না কেন সে তা কখনোই স্বীকার করে না এবং নিজের অনুগ্রহকারীর প্রতি আগ্রাসী আচরণ করে। এসব দোষ যাদের মধ্যে পাওয়া যায় তারা বিপদ উত্তীর্ণ হবার পর নিঃসংকোচে নিজেদের কুফরী, নাস্তিকতা ও শিরকের দিকে ফিরে যায়। ঝড়-তুফানের সময় তারা আল্লাহর অস্তিত্বের এবং একক আল্লাহর অস্তিত্বের কিছু চিহ্ন ও নিদর্শন বাইরে ও নিজেদের মনের মধ্যেও পেয়েছিল এবং এ সত্যের স্বতঃস্ফুর্ত অনুভূতিই তাদেরকে আল্লাহর শরণাপন্ন হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল একথা তারা মানতে চায় না। তাদের মধ্যে যারা নাস্তিক তারা তাদের এ কাজের যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে তা হচ্ছে এই যে, এ তো ছিল একটা দুর্বলতা। কঠিন বিপদের সময় অস্বাভাবিক অবস্থায় আমরা এ দুর্বলতার শিকার হয়েছিলাম। নয়তো আসলে আল্লাহ‌ বলতে কিছুই নেই। ঝড়-তুফানের মুখ থেকে কোন আল্লাহ‌ আমাদের বাঁচায়নি। অমুক অমুক কারণে ও উপায়ে আমরা বেঁচে গেছি। আর মুশরিকরা তো সাধারণভাবেই বলে থাকে, অমুক অমুক সাধুবাবা অথবা দেবী ও দেবতার ছায়া আমাদের মাথার ওপর ছিল। তাদের কল্যাণেই আমরা এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছি। কাজেই তীরে পৌঁছেই তারা নিজেদের মিথ্যা উপাস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকে এবং তাদের দরজায় গিয়ে শিন্নী চড়াতে থাকে। তাদের মনে এ চিন্তার উদয়ই হয় না যে, যখন সবদিকের সব আশা-ভরসা-সহায় ছিন্ন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তখন একমাত্র এক লা-শরীক আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ ছিল না এবং তারই শরণাপন্ন তারা হয়েছিল।
# বন্ধু, নেতা, পীর এবং এ পর্যায়ের অন্যান্য লোকেরা তবু তো দূর সম্পর্কের। দুনিয়ায় সবচেয়ে নিকট সম্পর্ক হচ্ছে সন্তান ও পিতামাতার মধ্যে। কিন্তু সেখানে অবস্থা হবে যদি পুত্র পাকড়াও হয়, তাহলে পিতা এগিয়ে গিয়ে একথা বলবে না যে, তার গোনাহের জন্য আমাকে পাকড়াও করো। অন্যদিকে পিতার দুর্ভোগ শুরু হয়ে গেলে পুত্রের একথা বলার হিম্মত হবে না যে, তার বদলে আমাকে জাহান্নামে পঠিয়ে দাও। এ অবস্থায় নিকট সম্পর্কহীন তিন ব্যক্তিরা সেখানে পরস্পরের কোনো কাজে লাগবে এ আশা করার কি অবকাশই বা থাকে। কাজেই যে ব্যক্তি দুনিয়ায় পরের জন্য নিজের পরকাল ঝরঝরে করে অথবা অন্যের ওপর ভরসা করে নিজে ভ্রষ্টতা ও পাপের পথ অবলম্বন করে সে একটা গণ্ডমূর্খ। এ প্রসঙ্গে ১৫ আয়াতের বিষয়বস্তুও সামনে রাখা উচিত। সেখানে সন্তানদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, দুনিয়াবী জীবনের বিভিন্ন কাজে-কারবারে অবশ্যই পিতা-মাতার সেবা করতে ও তাদের কথা মেনে চলতে হবে কিন্তু ধর্ম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার কথায় গোমরাহীর পথ অবলম্বন কোনমতেই ঠিক নয়।
# আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বলতে কিয়ামতের প্রতিশ্রুতির কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ একদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। তখন আল্লাহর আদালত প্রতিষ্ঠিত হবেই। সেখানে প্রত্যেককে তার নিজের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
# দুনিয়ার জীবন স্থুলদর্শী লোকদেরকে নানা রকমের ভুল ধারণায় নিমজ্জিত করে। কেউ মনে করে, বাঁচা-মরা যা কিছু শুধুমাত্র এ দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এরপর আর দ্বিতীয় কোন জীবন নেই। কাজেই যা কিছু করার এখানেই করে নাও। কেউ অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও প্রাচুর্যের নেশায় মত্ত হয়ে নিজের মৃত্যুর কথা ভুলে যায় এবং এ ভুল ধারণা পোষণ করতে থাকে যে, তার এ আরাম-আয়েশ ও কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী, এর ক্ষয় নেই। কেউ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে কেবলমাত্র বৈষয়িক লাভ ও স্বাদ-আহলাদকে একমাত্র উদ্দেশ্য মনে করে নেয় এবং “জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন” ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যকে কোন গুরুত্বই দেয় না। এর ফলে তার মনুষ্যত্বের মান যত নিচে নেমে যেতে থাকে না কেন তার কোন পরোয়াই সে করে না। কেউ মনে করে বৈষয়িক সমৃদ্ধিই ন্যায়-অন্যায় সত্য-মিথ্যার আসল মানদণ্ড। এ সমৃদ্ধি যে পথেই অর্জিত হবে তাই সত্য এবং তার বিপরীত সবকিছুই মিথ্যা। কেউ এ সমৃদ্ধিকেই আল্লাহর দরবারে অনুগৃহীত হবার আলামত মনে করে। এর ফলে সে সাধারণভাবে মনে করতে থাকে, যদি দেখা যায় যে কোন উপায়েই হোক না কেন একজন লোক বিপুল সম্পদের অধিকারী হতে চলেছে, তাহলে সে আল্লাহর প্রিয়পাত্র এবং যার বৈষয়িক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে, তা হক পথে থাকা ও সৎ নীতি অবলম্বন করার কারণেই হোক না কেন তার পরকাল ঝরঝরে হয়ে গেছে। এ ধারণা এবং এ ধরনের যত প্রকার ভুল ধারণা আছে সবগুলোকেই মহান আল্লাহ‌ এ আয়াতে “দুনিয়ার জীবনের প্রতারণা” বলে উল্লেখ করেছেন।
# الْغَرُورُ প্রতারক শয়তানও হতে পারে আবার কোন মানুষ বা একদল মানুষও হতে পারে, মানুষের নিজের মন ও প্রবৃত্তিও হতে পারে এবং অন্য কোন জিনিসও হতে পারে। কোন বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ বস্তু নির্ধারণ না করে এ বহুমুখী অর্থের অধিকারী শব্দটিকে তার সাধারণ ও সার্বজনীন অর্থে ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, বিভিন্ন লোকের কাছে প্রতারিত হবার মূল বিভিন্ন হয়ে থাকে। যে ব্যক্তিবিশেষ করে যে উপায়েই এমন প্রতারণার শিকার হয়েছে যা সঠিক দিক থেকে ভুল দিকে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তা-ই তার জন্য “আল গারূর” তথা প্রতারক।

“আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত করা” শব্দ গুলো ব্যাপক অর্থের অধিকারী। বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা এর অন্তর্ভুক্ত। কাউকে তার “প্রতারক” এ নিশ্চয়তা দেয় যে, আল্লাহ‌ আদতেই নেই। কাউকে বুঝায়, আল্লাহ‌ এ দুনিয়া সৃষ্টি করে হাত-পা গুটিয়ে বসে গেছেন এবং এখন এ দুনিয়া তিনি বান্দাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। কাউকে এ ভুল ধারণা দেয় যে, আল্লাহর এমন কিছু প্রিয়পাত্র আছে, যাদের নৈকট্য অর্জন করে নিলে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তুমি নিশ্চিতভাবেই ক্ষমার অধিকারী হবে। কাউকে এভাবে প্রতারণা করে যে, আল্লাহ‌ তো ক্ষমাশীল ও করুণাময়। তোমরা পাপ করতে থাকো, তিনি ক্ষমা করে যেতে থাকবেন। কাউকে বুঝায়, মানুষ তো নিছক একটা অক্ষম জীব ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে দেয় এই বলে যে, তোমাদের তো হাত-পা বাঁধা, যা কিছু খারাপ কাজ তোমরা করো সব আল্লাহই করান। ভালো কাজ থেকে তোমরা দূরে সরে যাও, কারণ আল্লাহ‌ তা করার তাওফীক তোমাদের দেন না। না জানি আল্লাহর ব্যাপারে এমনিতর কত বিচিত্র প্রতারণার শিকার মানুষ প্রতিদিন হচ্ছে। যদি বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি গোমরাহী, গোনাহ ও অপরাধের মূল কারণ হিসেবে দেখা যাবে, মানুষ আল্লাহর ব্যাপারে কোন না কোন প্রতারণার শিকার হয়েছে এবং তার ফলেই তার বিশ্বাসে দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি অথবা সে নৈতিক চরিত্রহীনতার শিকার হয়েছে।
# এটি আসলে একটি প্রশ্নের জবাব। কিয়ামতের কথা ও আখেরারতের প্রতিশ্রুতি শুনে মক্কার কাফেররা রসূলুল্লাহ ﷺ কে বারবার এ প্রশ্নটি করতো। প্রশ্নটি ছিল, সে সময়টি কবে আসবে? কুরআন মজীদে কোথাও তাদের এ প্রশ্নটি উদ্ধৃত করে জবাব দেয়া হয়েছে আবার কোথাও উদ্ধৃত না করেই জবাব দেয়া হয়েছে। কারণ শ্রোতাদের মনে এ প্রশ্ন জাগরুক ছিল। এ আয়াতটিতেও প্রশ্নের উল্লেখ ছাড়াই জবাব দেয়া হয়েছে।

“একমাত্র আল্লাহই সে সময়ের জ্ঞান রাখেন” এ প্রথম বাক্যটিই মূল প্রশ্নের জবাব। তার পরের চারটি বাক্য এ জবাবের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছে। যুক্তির সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, যেসব বিষয়ের প্রতি মানুষ নিকটতম আকর্ষণ অনুভব করে সেগুলো সম্পর্কেও তার কোন জ্ঞান নেই। তাহলে সারা দুনিয়ার শেষ ক্ষণটি কবে ও কখন আসবে, একথা জানা তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব? তোমাদের সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা বিরাটভাবে নির্ভর করে বৃষ্টির ওপর। কিন্তু আল্লাহর হাতে রয়েছে এর পুরো যোগসূত্র। যেখানে যখন যতটুকু চান বর্ষণ করান এবং যখনি চান থামিয়ে দেন। কেউ একটুও জানে না কোথায় কখন কতটুকু বৃষ্টি হবে এবং কোন ভূখণ্ড তা থেকে বঞ্চিত হবে অথবা কোন ভূখণ্ডে বৃষ্টি উল্টো ক্ষতিকর প্রমাণিত হবে। তোমাদের বীর্যে তোমাদের স্ত্রীদের গর্ভসঞ্চার হয় এবং এর সাথে তোমাদের বংশধারার ভবিষ্যত জড়িত। কিন্তু তোমরা জানো না এ গর্ভে কি লালিত হচ্ছে এবং কোন আকৃতিতে ও কোন্ ধরনের কল্যাণ বা অকল্যাণ নিয়ে তা বের হয়ে আসবে। আগামীকাল তোমাদের কি হবে তা-ও তোমরা জানো না।

একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা তোমাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। কিন্তু এক মিনিট আগেও তোমরা তার খবর পাও না। তোমরা এও জানো না, তোমাদের এ জীবনের সমাপ্তি ঘটবে কোথায় কি অবস্থায়। এ সমস্ত তথ্যজ্ঞান আল্লাহ‌ নিজেরই কাছে রেখেছেন এবং এর কোন একটির জ্ঞানও তোমাদের দেননি। এর মধ্যে প্রত্যেকটি জিনিসই এমন যে সম্পর্কে তোমরা পূর্বাহ্ণেই কিছু জানতে চাও যাতে এ জ্ঞানের সাহায্যে তোমরা আগেভাগেই কিছু পদক্ষেপ নিতে পারো। কিন্তু সেসব ব্যাপারে আল্লাহর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং তার ফায়সালার ওপর ভরসা করো। এভাবে দুনিয়ার শেষক্ষণটির ব্যাপারেও আল্লাহর ফায়সালারপ্রতি আস্থা স্থাপন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এর জ্ঞানও কাউকে দেয়া হয়নি এবং দেয়া যেতে পারে না।

এখানে আর একটি কথাও ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার। সেটি হচ্ছে, যেসব বিষয় আল্লাহ‌ ছাড়া কেউ জানে না তেমনি ধরনের গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়াবলীর কোন তালিকা এখানে দেয়া হয়নি। এখানে তো কেবলমাত্র হাতের কাছের কিছু জিনিস উদাহরণস্বরূপ পেশ করা হয়েছে। যেগুলোর প্রতি মানুষের গভীরতম ও নিকটতম আকর্ষণ ও আগ্রহ রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা ঠিক হবে না যে, মাত্র এ পাঁচটি বিষয়ই গায়েবের অন্তর্ভুক্ত, যে সম্পর্কে আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ কিছুই জানে না। অথচ গায়েব এমন জিনিসকে বলা হয় যা সৃষ্টির অগোচরে এবং একমাত্র আল্লাহর দৃষ্টি সম্মুখে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এ গায়েবের কোন সীমা পরিসীমা নেই। (এ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নাহল, ৮৩ টীকা)।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২০-২১ নং আয়াতের তাফসীর:

প্রথমত আল্লাহ তা‘আলা বান্দার প্রতি তিনি যে রহমত বা অনুগ্রহ দান করেছেন সে কথাই বর্ণনা করেছেন। তিনি বান্দার জন্য আকাশমণ্ডলী ও জমিনে যা কিছু আছে সকল কিছুকে নিয়োজিত রেখেছেন। এবং বান্দার জন্য তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ সম্পূর্ণ করেছেন। আকাশ, নক্ষত্র, চাঁদ, সূর্য সকল কিছুই মানব জাতির কল্যাণার্থে নিয়োজিত। অনুরূপভাবে জমিনে নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা, ক্ষেত্র-খামার, ফুল-ফল ইত্যাদি।

এ সকল জিনিস কেবল মানুষের উপকারার্থেই সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রকাশ্য নেয়ামত ও অনুগ্রহের অর্থ হল, যা জ্ঞান ও ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায়। আর অপ্রকাশ্যগুলো হল, যা মানুষের অনুভূতির বাইরে।

(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُّجَادِلُ)

এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা হাজ্জের ৩ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা কাফির-মুশরিকদের নির্বুদ্ধিতার কথা বর্ণনা করে বলেছেন, তাদেরকে যদি বলা হয় আল্লাহ তা‘আলা যা অবতীর্ণ করেছেন তার অনুসরণ কর তখন তারা বলে যেন না, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করব। যদিও তাদের পূর্বপুরুষগণ নির্বোধ ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَآ أَنْزَلَ اللّٰهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَآ أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ اٰبَا۬ءَنَا ط أَوَلَوْ كَانَ اٰبٰ۬ؤُهُمْ لَا يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَّلَا يَهْتَدُوْنَ)‏

“আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ কর; তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার ওপর আমাদের পিতৃপুরুষগণকে পেয়েছি; যদিও তাদের পিতৃপুরুষদের কোনই জ্ঞান ছিল না এবং তারা হিদায়াতপ্রাপ্তও ছিল না। তবুও কি (তারা তাদের অনুসরণ করবে)।” (সূরা বাকারাহ ২:১৭০)

কোন প্রকার দলীল-প্রমাণ ব্যতিরেকে একজনের অনুসরণ করাটা বোকামী ব্যতীত আর কিছুই হতে পারে না। তাদের অবস্থা এমন যেন, তারা যুদ্ধ করবে অথচ তাদের হাতে কোনই তরবারি নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এমন নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়া থেকে হেফাযত করুন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আকাশমণ্ডলী ও জমিনের সকল জিনিস আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপকারার্থে সৃষ্টি এবং নিয়োজিত করেছেন।
২. না জেনে কোন বিষয়ে কথা বলা উচিত নয়।
৩. দলীল-প্রমাণ ছাড়া কারো কথা গ্রহণ করা যাবে না।
২২-২৪ নং আয়াতের তাফসীর:

যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে ও তাঁর আনুগত্য করে এবং যাবতীয় আদেশ পালন ও নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত বিষয় থেকে বিরত থেকে নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পণ করে সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করল যা কখনো ছিঁড়ে জাহান্নামে পড়ে যাবে না। আল্লাহ তা‘আলাকে পাওয়ার জন্য এ রজ্জুই যথেষ্ট।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা প্রদান করে বলছেন: তোমার আহ্বান শোনার পর যদি কেউ কুফরী করে তাতে তুমি দুঃখ প্রকাশ কর না। তারা এ দুনিয়াতে কুফরী করার পর অবশেষে আমার নিকটই তাদেরকে ফিরে আসতে হবে। তাদের দুনিয়ার জীবন একদিন শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং তখন তাদেরকে কুফরীর শাস্তি প্রদান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(قُلْ إِنَّ الَّذِيْنَ يَفْتَرُوْنَ عَلَي اللّٰهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُوْنَ ط مَتَاعٌ فِي الدُّنْيَا ثُمَّ إِلَيْنَا مَرْجِعُهُمْ ثُمَّ نُذِيْقُهُمُ الْعَذَابَ الشَّدِيْدَ بِمَا كَانُوْا يَكْفُرُوْنَ)‏

“বল: ‘যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তারা সফলকাম হবে না।’ পৃথিবীতে তাদের জন্য আছে কিছু সুখ-সম্ভোগ; পরে আমারই নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর কুফরীর কারণে তাদেরকে আমি কঠোর শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাব।” (সূরা ইউনূস ১০:৬৯-৭০)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে। ইবাদতের মধ্যে কোন প্রকার একনিষ্ঠতার ঘাটতি থাকলে চলবে না।
২. দুনিয়া একদিন শেষ হয়ে যাবে। আর তখন মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার নিকটেই ফিরে যেতে হবে।
২৫-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র রব, তিনি ব্যতীত আর কোন রব নেই, তিনিই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও সব কিছুর মালিকন এ আয়াতগুলো সে কথাই প্রমাণ করে। এমনকি এ কথা মক্কার কাফির-মুশরিকরাও স্বীকার করত যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কোন মালিক নেই। আকাশমণ্ডলী, জমিন সকল কিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। এ কথা স্বীকার করার পর আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ইবাদত করা মুর্খতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ স্বীকার করলেই কেউ মু’মিন হবে না যতক্ষণ না সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য সম্পাদন করবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কোন মালিক নেই।
২. সর্বাবস্থায় সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য নিবেদন করতে হবে।
২৭-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার মহত্ত্ব, গর্ব, প্রতাপ, তাঁর সুন্দর নামাবলী ও সুউচ্চ গুণাবলীর প্রতি ইঙ্গিত বহনকারী সে অফুরন্ত বাণীর কথা উল্লেখ হয়েছে ; যা কেউ পরিপূর্ণরূপে গণনা করতে, জানতে বা তার গভীরতায় পৌঁছতে সক্ষম নয়। যদি কেউ তাঁর সে বাণী গণনা করতে বা লিখতে চায়, তাহলে সারা পৃথিবীর সমস্ত গাছ-পালার তৈরী কলম ক্ষয় হয়ে যাবে, সাগরসমূহের পানির তৈরী কালি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু মহান আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান, তাঁর সৃষ্টি ও কারিগরির বিস্ময়কর নিপুণতা এবং তাঁর মহত্ত্ব ও মর্যাদার কথা লিপিবদ্ধ করে শেষ করা সম্ভব না। সাত সমুদ্র অতিশয়োক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, নচেৎ নির্দিষ্ট সংখ্যা উদ্দেশ্য নয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী ও নিদর্শনাবলী গণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(قُلْ لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمٰتِ رَبِّيْ لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَنْ تَنْفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّيْ وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِه۪ مَدَدًا) ‏

“বল:‎ ‘আমার প্রতিপালকের কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হবার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবেন আমরা এটার সাহায্যার্থে অনুরূপ আরও সমুদ্র আনলেও।’ (সূরা কাহফ ১৮:১০৯)

হাদীসে এসেছে:

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: হে আল্লাহ তা‘আলা! আপনার নেয়ামতের গণনা তত আমি করতে পারব না যতটা আপনি নিজের নেয়ামতের বর্ণনা নিজেই দিয়েছেন। (সহীহ মুসলিম হা: ৩৫২, আবূ দাঊদ হা: ৮৭৯) এ সম্পর্কে আরো আলোচনা সূরা কাহফের শেষে করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন যে, সমস্ত মানুষকে সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করা আমার কাছে একটি লোককে মেরে জীবিত করার মতই সহজ। কোন কিছু হওয়ার জন্য আমার শুধু হুকুম করাই যথেষ্ট । আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(إِنَّمَآ أَمْرُه۫ ٓ إِذَآ أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَّقُوْلَ لَه۫ كُنْ فَيَكُوْنُ)‏

“বস্তুতঃ তাঁর সৃষ্টিকার্য এরূপ যে, যখন তিনি কোন কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তাকে বলেনঃ “হও”, অমনি তা হয়ে যায়।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৮২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(وَمَآ أَمْرُنَآ إِلَّا وَاحِدَةٌ كَلَمْحٍۭ بِالْبَصَرِ) ‏

“আমার আদেশ তো একটি কথায় নিষ্পন্ন, চোখের পলকের মত।” (সূরা কামার ৫৪:৫০)

আল্লাহ তা‘আলা চাওয়া মাত্রই সকল কিছু হয়ে যাবে কিয়ামতও অনুরূপভাবে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য গুণাবলীর অধিকারী যা মানুষের পক্ষে গণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়।
২. কোন কিছুর জীবন ও মরণ আল্লাহ তা‘আলার নিকট কোন কঠিন ব্যাপার নয়।
২৯-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন যে, রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়া আমারই কাজ। শীতের দিনে রাত বড় ও দিন ছোট এবং গ্রীষ্মকালে দিন বড় ও রাত ছোট হওয়া আমারই শক্তির প্রমাণ।

চাঁদ-সূর্যের চক্র ও আবর্তন আমারই আদেশক্রমে হয়ে থাকে। এগুলো নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চলতে থাকে।

(اِلٰٓی اَجَلٍ مُّسَمًّی)

‘নির্ধারিত সময় পর্যন্ত’ এর দুটি অর্থ হতে পারেন

(এক) সূর্যের জন্য যতটুকু সময় বেধে দেয়া হয়েছে সে ততটুকু সময় আলো দিয়ে থাকে। আর চাঁদের জন্য যতটুকু সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে সে ততটুকু সময় আলো দিয়ে থাকে।

(দুই) চন্দ্র ও সূর্যের প্রত্যেককে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে, যখন সময় শেষ হয়ে যাবে তখন তারা উদয় হবে না, তখনই কিয়ামত সংঘটিত হবে। হাদীসে এসেছে:

আবূ যার (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত: রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন: হে আবূ যার! ঐ সূর্য কোথায় যায় তা তুমি জান কি? উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: এটা গিয়ে আল্লাহ তা‘আলার আরশের নীচে সিজদায় পড়ে যায় এবং স্বীয় প্রতিপালকের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করতে থাকে। এটা খুব নিকটবর্তী যে, একদিন তাকে বলা হবে ‘যেখান হতে এসেছো সেখানে ফিরে যাও।’ (সহীহ বুখারী হা: ৪৮০২, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৯)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা যা কর আল্লাহ তা‘আলা সে সম্পর্কে অবহিত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللّٰهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَا۬ءِ وَالْأَرْضِ ط إِنَّ ذٰلِكَ فِيْ كِتٰبٍ ط إِنَّ ذٰلِكَ عَلَي اللّٰهِ يَسِيْرٌ)

“তুমি কি জান না যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে নিশ্চয়ই‎ আল্লাহ তা জানেন। এ সকলই আছে এক কিতাবে; নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর নিকট সহজ।” (সূরা হাজ্জ ২২:৭০)

এগুলো এরই প্রমাণ যে, আল্লাহ তা‘আলাই সত্য মা‘বূদ এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে তারা মিথ্যা। আল্লাহ তা‘আলা সুউচ্চ ও মহান। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বরং সবাই তাঁরই মুখাপেক্ষী, সবাই তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর দাস। সুতরাং যে আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টিকে যথাযথভাবে পরিচালনা করছেন আমরা একমাত্র সেই আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করব।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র মা‘বূদ, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সঠিক মা‘বূদ নেই।
২. দিবা-রাত্রির ছোট বড় হওয়া, চন্দ্র-সূর্য নিয়ন্ত্রণা করা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই কাজ।
৩. আল্লাহ তা‘আলা সুউচ্চ ও সবচেয়ে বড়।

৩১-৩২ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আরো কিছু ক্ষমতার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: সাগরে যে নৌযানসমূহ ভাসমান ও চলাচল করে তাও কেবল আমারই নির্দেশে হয়ে থাকে। লোহা পানিতে রাখলে ভেসে থাকে না, কিন্তু যখন তা নৌকা আকারে বানিয়ে পানিতে ছেড়ে দাও তখন কার নির্দেশে ভেসে থাকে? আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِيَ فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِه۪ ج وَسَخَّرَ لَكُمُ الْأَنْهٰرَ) ‏

“যিনি নৌযানকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তাঁর নির্দেশে সমুদ্রে বিচরণ করে এবং যিনি তোমাদের (কল্যাণে) নিয়োজিত করেছেন নদীসমূহকে।” (সূরা ইবরাহীম ১৪:৩২)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(وَهُوَ الَّذِيْ سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوْا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَّتَسْتَخْرِجُوْا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُوْنَهَا ج وَتَرَي الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِيْهِ وَلِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِه۪ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ)

“তিনিই সমুদ্রকে অধীন করেছেন যাতে তোমরা তা হতে তাজা মৎস্য আহার করতে পার এবং যাতে তা হতে আহরণ করতে পার রত্নাবলী যা তোমরা ভূষণরূপে পরিধান কর‎; এবং তোমরা দেখতে পাও তার বুক চিরে নৌযান চলাচল করে এবং তা এজন্য যে, তোমরা যেন তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর‎; (সূরা নাহল ১৬:১৪)

অতএব আল্লাহ তা‘আলা যদি নৌযানগুলোকে সমুদ্রে চলার আদেশ না করতেন তাহলে এগুলো সমুদ্রে চলাচল করতে পারত না।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষের একটি মন্দ অভ্যাসের কথা উল্লে¬খ করেছেন, যে সম্পর্কে পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে। তা হল যখন মানুষ বিপদে পড়ে তখন বিশুদ্ধচিত্তে, একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহ তা‘আলাকেই ডাকে। কিন্তু যখনই তাদেরকে এ বিপদ থেকে মুক্তি দেয়া হয় তখনই তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভুলে যায় এবং তাঁর সাথে শরীক করে বসে।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فِي الْبَحْرِ ضَلَّ مَنْ تَدْعُوْنَ إِلَّآ إِيَّاهُ ج فَلَمَّا نَجَّاكُمْ إِلَي الْبَرِّ أَعْرَضْتُمْ ط وَكَانَ الْإٍنْسَانُ كَفُوْرًا)‏

“সমুদ্রে যখন তোমাদেরকে বিপদ স্পর্শ করে তখন কেবল তিনি ব্যতীত অপর যাদেরকে তোমরা আহ্বান করে থাক তারা অন্ত‎র্হিত হয়ে যায়; অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে আনেন তখন তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৬৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(فَإِذَا رَكِبُوْا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللّٰهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ ৫ ج فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَي الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُوْنَ)‏

“তারা যখন নৌযানে আরোহন করে তখন তারা বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে ভিড়িয়ে তাদেরকে রক্ষা করেন, তখন তারা শিরকে লিপ্ত হয়” (সূরা আনকাবুত ২৯:৬৫) তখনকার মক্কার মুশরিকরা বিপদে পড়লে সকল মা‘বূদ বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকত, কিন্তু বর্তমানে একশ্রেণির নামধারী মুসলিম বিপদে পড়লে আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন মাযার, বাবা, ওলী ও গাওস-কুতুবের কাছে দৌড়ায়। তৎকালীন মুশরিকদের চেয়েও এদের বিশ্বাস জঘন্য।

مقتصد দ্বারা প্রকৃত উদ্দেশ্য হল, যারা এ প্রকার বিপদের সম্মুখীন হয়েছে এবং তিনি তাদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। তাদের উচিত ছিল পরিপূর্ণভাবে তাঁর আনুগত্য করা ও সৎ আমলে আত্মনিয়োগ করা। কিন্তু এটা না করে তাদের কেউ কেউ মধ্যমপন্থী থাকে এবং কেউ কেউ পূর্ণ ভাবেই কুফরীর দিকে ফিরে যায়।

ختار বলা হয় গাদ্দার বা বিশ্বাস ঘাতককে। ختر এর অর্থ হচ্ছে পূর্ণ বিশ্বাসঘাতক।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলার অপার নেয়ামত যে, তিনি সাগরে নৌযান ভাসমান রেখে চলাচল করার উপযোগী করে দিয়েছেন।
২. একশ্রেণির মানুষ বিপদে পড়লে আল্লাহ তা‘আলাকে আহ্বান না করে বিভিন্ন মাযার, ওলী-আওলিয়া ও দরগাহ শরীফে বিপদ মুক্তির জন্য গমন করে যা প্রকাশ্য শির্ক।
৩. সকল বিপদাপদ ও মুশকিলের আসান দাতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তাই তাঁকেই আহ্বান করা উচিত।
৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:

অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে তাঁর নির্দেশ পালন ও নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত বিষয় থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাক্বওয়াবান হওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করছেন এবং কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তের ভয় প্রদর্শন করে বলছেন: সেদিন একমাত্র তাক্বওয়া ও সৎ আমল ব্যতীত সন্তান পিতার কোন উপকারে আসবে না এবং পিতাও সন্তানের কোনই উপকারে আসবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(یَوْمَ یَفِرُّ الْمَرْئُ مِنْ اَخِیْھِﭱﺫ وَاُمِّھ۪ وَاَبِیْھِﭲﺫ وَصَاحِبَتِھ۪ وَبَنِیْھِﭳﺚ لِکُلِّ امْرِیٍٔ مِّنْھُمْ یَوْمَئِذٍ شَاْنٌ یُّغْنِیْھِﭴ)

“সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তাঁর নিজের ভাই হতে, এবং তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী ও তার সন্তান হতে, তাদের প্রত্যেকের সেদিন এমন গুরুতর অবস্থা হবে যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে।” (সূরা আবাসা ৮০:৩৪-৩৭) এখানে ঐ শ্রেণির পিতা-পুত্রকে বুঝানো হয়েছে যাদের মধ্যে একজন মু’মিন, অপরজন কাফির। কেননা মু’মিন পিতা কিংবা পুত্র স্বীয় কাফির পুত্রের কিংবা পিতার শাস্তি বিন্দুমাত্রও হ্রাস করতে পারবে না। তবে যদি উভয়ে মু’মিন হয় তাহলে পিতা-মাতা সন্তানের জন্য এবং সন্তান পিতা-মাতার জন্য সুপারিশ করতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيْمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَآ أَلَتْنٰهُمْ مِّنْ عَمَلِهِمْ مِّنْ شَيْءٍ ط كُلُّ امْرِئٍۭ بِمَا كَسَبَ رَهِيْنٌ)

“এবং যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তান-সন্ততিও ঈমানে তাদের অনুসারী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং আমি তাদের কর্মফলের ঘাটতি করব না, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী।” (সূরা তুর ৫২:২১)

তারপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে নসীহত করেছেন যে, দুনিয়ার চাকচিক্যময় জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে। তোমরা দুনিয়ার চাক্যচিক্যে পড়ে আখিরাতকে ভুলে যেও না। তোমরা শয়তানের প্রতারণায় পড়ো না। শয়তান শুধু ধোঁকা দিতেই জানে, সে কখনো কারো উপকার করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيْهِمْ ط وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطٰنُ إِلَّا غُرُوْرًا‏)‏

“(শয়তান) সে তাদেরকে প্রতিশ্র“তি দেয় এবং তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে; আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্র“তি দেয় তা ছলনামাত্র।” (সূরা নিসা ৪:১২০)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করতে হবে।
২. পার্থিব মোহে পড়ে পরকালকে ভোলা যাবে না।
৩. কিয়ামতের দিন কেউ কারো কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারবে না।
৩৪ নং আয়াতের তাফসীর:

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এমন পাঁচটি জিনিসের বর্ণনা দিচ্ছেন যেগুলো সম্পর্কে একমাত্র তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না। আর এগুলোই হল সেই গায়েবের চাবিকাঠি যেগুলো সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে। এ পাঁচটি বিষয় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই জ্ঞানায়ত্ব। হাদীসে এসেছে:

ইবনু উমার (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “অদৃশ্যের চাবিকাঠি পাঁচটি। যেগুলো আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কেউ জানে না।

১. কিয়ামতের জ্ঞান
২. বৃষ্টি বর্ষণ করা, তথা কখন কোথায় বৃষ্টি বর্ষণ হবে তা তিনিই জানেন।
৩. মাতৃগর্ভে যা আছে
৪. আগামীকাল মানুষ কী উপার্জন করবে।
৫. এবং কার কোথায় মৃত্যু হবে।
(সহীহ বুখারী হা: ৪৬২৭, ৪৭৭৮, ৭৩৭৯)

ইমাম বুখারী (رحمه الله) এ আয়াতের তাফসীরে উল্লে¬খ করেছেন যে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনগণের মাজলিসে বসেছিলেন, এমন সময় তাঁর নিকট জনৈক লোক এসে তাঁকে ঈমান, ইসলাম ও ইহসান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর বলল: কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? তিনি উত্তর দিলেন, এটা প্রশ্নকারীর চেয়ে উত্তরদাতা বেশি জানে না। তবে আমি তোমাকে এর কতগুলো নিদর্শনের কথা বলছি। যখন দাসী তার মনিবকে জন্ম দেবে এবং যখন উলঙ্গ পা ও উলঙ্গ দেহবিশিষ্ট লোক যারা ছাগল চরাতো তারা বড় বড় অট্টালিকা তৈরী করে প্রতিযোগিতা করবে। এগুলো হল কিয়ামতের নিদর্শন। পাঁচটি বিষয় যা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কেউ জানেন না। অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৭৭, সহীহ মুসলিম হা: ১০০৯)

এ সম্পর্কে আরো তাফসীর সূরা আন‘আমের ৫৯ নং আয়াতে করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. অদৃশ্যের চাবিকাঠি পাঁচটি।
২. অদৃশ্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা রাখেন, অন্য কেউ নয়।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২০-২১ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলেনঃ দেখো, আকাশের তারকারাজি তোমাদের সেবার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সর্বক্ষণ জ্বলজ্বল করে তোমাদেরকে আলো প্রদান করছে। বাদল, বৃষ্টি, শিশির, শুষ্কতা ইত্যাদি সবই তোমাদের উপকারে নিয়োজিত আছে। আকাশ তোমাদের মযবূত ছাদ স্বরূপ। তিনি তোমাদেরকে নহর, নদ-নদী, সাগর-উপসাগর, গাছ-পালা, ক্ষেত-খামার, ফল-ফুল ইত্যাদি যাবতীয় নিয়ামত দান করেছেন। এ প্রকাশ্য অসংখ্য নিয়ামত ছাড়াও অপ্রকাশ্য আরো অসংখ্য নিয়ামত তিনি দান করেছেন। যেমন রাসূলদেরকে প্রেরণ, কিতাব নাযিলকরণ ইত্যাদি। যিনি এতোগুলো নিয়ামত দান করেছেন, তার সত্তার উপর সবারই ঈমান আনয়ন করা একান্তভাবে উচিত ছিল। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় এই যে, এখনো বহু লোক আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে রয়েছে। এর পিছনে তাদের অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা ছাড়া আর কোন দলীল ও যুক্তি-প্রমাণ নেই। মহান আল্লাহ বলেনঃ যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার অনুসরণ কর, তখন তারা নির্লজ্জের মত উত্তর দেয়- আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি তারই অনুসরণ করবো।

তাদের এই জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ শয়তান যদি তাদের পূর্বপুরুষদেরকে জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তির দিকে আহ্বান করে থাকে তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে? এদের পূর্বপুরুষরা ছিল এদের পূর্বসূরি এবং এরী হচ্ছে তাদের উত্তরসূরি।
২২-২৪ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ চিত্তে আমল করে, যে সত্যভাবে আল্লাহর অনুগত হয়, যে শরীয়তের অনুসারী হয়, আল্লাহর আদেশের উপর আমল করে এবং তার নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকে সে দৃঢ় রঞ্জুকে ধারণ করলো, সে যেন আল্লাহর ওয়াদা নিয়েছে যে, সে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা পাবে। কাজের শেষ পরিণতি আল্লাহরই অধিকারে রয়েছে।

এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ তুমি কাফিরদের কুফরীর কারণে মোটেই চিন্তিত হয়ো না। তাদেরকে আমারই কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। সে সময় আমি তাদেরকে তাদের আমলের পূর্ণ প্রতিফল প্রদান করবো। আমার কাছে তাদের কোন আমলই গোপন নেই। আমি স্বল্পকালের জন্যে তাদেরকে জীবনোপকরণ ভোগ করতে দিবো। অতঃপর তাদেরকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করবো। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে তারা সফলকাম হবে না, পার্থিব সুখ-সম্ভোগ তো এদের জন্য রয়েছে, পরে আমারই নিকট এদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তাদেরকে তাদের কুফরীর কারণে কঠিন শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাববা।” (১০:৬৯-৭০)

২৫-২৬ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ মুশরিকরা এটা স্বীকার করতো যে, সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ। তা সত্ত্বেও তারা অন্যদের ইবাদত করতো। অথচ তারা ভালরূপেই জানতো যে, সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই নয়। সবই তার অধীনস্থ। ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছে? এ প্রশ্ন তাদেরকে করলে তারা সাথে সাথেই উত্তর দিতো যে, এসবের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই বটে। তাই আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেনঃ তুমি তাদেরকে বলে দাও প্রশংসা যে আল্লাহরই তা তো তোমরা স্বীকারই করছো। প্রকৃত ব্যাপার তো এই যে, মুশরিকদের অধিকাংশই অজ্ঞ।

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে ছোট, বড়, প্রকাশ্য, গোপনীয় যা কিছু আছে সবই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং সব তারই মালিকানাধীন। তিনি সবকিছু হতেই অভাবমুক্ত এবং সবই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনিই একমাত্র প্রশংসার যোগ্য। শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী তিনিই। সৃষ্টিকার্যে ও আহকাম ধার্য করার ব্যাপারে তিনিই প্রশংসার যোগ্য।

২৭-২৮ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা তাঁর ইযত, শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব, বুযর্গী, মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের বর্ণনা দিচ্ছেন। নিজের পবিত্র গুণাবলী, মহান নাম ও অসংখ্য কালেমার বর্ণনা প্রদান করছেন। না কেউ তা গণনা করে শেষ করতে পারে, না তার পরিধি কারো জানা আছে। তার প্রকৃত তথ্য কারো জানা নেই। মানব-নেতা, শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) বলতেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনার নিয়ামতের গণনা ততো আমি করতে পারবো না যতোটা আপনি নিজের নিয়ামতের বর্ণনা নিজেই দিয়েছেন” বা “আপনার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে আমি শেষ করতে পারবো না যেমন আপনি নিজের প্রশংসা নিজে করেছেন।”

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ জগতের সমস্ত গাছ-পালাকে যদি কলম বানানো হয় এবং সাগরের সমস্ত পানিকে যদি কালি বানানো হয়, এরপর আরো সাতটি সাগরের পানি মিলিত করা হয়, অতঃপর আল্লাহ তা’আলার শ্রেষ্ঠত্ব, গুণাবলী, বুযর্গী এবং বাণীসমূহ লিখতে শুরু করা যায় তবে এই সমুদয় কলম ও কালি শেষ হয়ে যাবে, তথাপি একক ও শরীক বিহীন আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী শেষ হবে না। এতে এটা মনে করা চলবে না যে, যদি সাতের অধিক সাগরের পানি একত্রিত করা হয় তবে আল্লাহর গুণাবলী লিখার জন্যে যথেষ্ট হবে। এটা কখনো নয়। এ গণনা শুধু আধিক্য প্রকাশের জন্যে বলা হয়েছে। এটাও মনে করা চলবে না যে, মাত্র সাতটি সাগর আছে যা সমগ্র দুনিয়াকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। অবশ্য বানী ইসরাঈলের রিওয়াইয়াতে এ সাতটি সাগরের কথা বলা হয়েছে বটে, তাকে আমরা সত্যও বলতে পারি না এবং মিথ্যাও না। তবে আমরা যে তাফসীর করেছি তার পৃষ্ঠপোষক নিম্নের আয়াতটিকে বলা যেতে পারে। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “(হে নবী সঃ)! তুমি বলঃ আমার প্রতিপালকের কথা লিপিবদ্ধ করবার জন্যে সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হবার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে সাহায্যার্থে এর অনুরূপ আরো সমুদ্র আনলেও।” (১৮:১০৯) এখানে একটি সমুদ্র উদ্দেশ্য নয়, বরং এক একটি করে যতই হালে না কেন, তবুও আল্লাহর কালেমা শেষ হবে না।

হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন, যদি আল্লাহ তা’আলা লিখাতে শুরু করেন ও বলেনঃ এ কাজ লিখো, ও কাজ লিখো, এভাবে লিখতে লিখতে সমস্ত কলম ভেঙ্গে শেষ হয়ে যাবে, তবুও লিখা শেষ হবে না ।

মুশরিকরা বলতো যে, এ কালাম শেষ হয়ে যাবে। এ আয়াত দ্বারা তাদের উক্তিকে খণ্ডন করা হয়েছে। না আল্লাহর বিস্ময়কর ব্যাপারগুলো শেষ হবে, না তার জ্ঞানের পরিধি জরিপ করা যাবে, না তার জ্ঞান ও সিফাতের পরিমাপ করা সম্ভব হবে। আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় সমস্ত বান্দার জ্ঞান এমনই যেমন সমুদ্রের পানির তুলনায় এক ফোটা পানি। আল্লাহর কথা শেষ হবার নয়। আমরা তার যে প্রশংসা করি, তাঁর প্রশংসা এর বহু উপরে।

মদীনায় ইয়াহূদী আলেমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেছিল ও “আপনি যে পাঠ করে থাকেন (আরবি) অর্থাৎ “তোমাদেরকে খুব অল্প জ্ঞানই দেয়া হয়েছে। (১৭:৮৫) এর দ্বারা উদ্দেশ্য কারা, আমরা, না আপনার কওম?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমরা ও তোমরা সবাই।” তারা পুনরায় বলেঃ “তাহলে আপনি কালামুল্লাহর এ আয়াতের অর্থ কি করবেন যেখানে বলা হয়েছে যে, তাওরাতে সবকিছুরই বর্ণনা রয়েছে?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “জেনে রেখো যে, তোমাদের কাছে যা কিছু রয়েছে ওগুলো আল্লাহ তা’আলার কালেমার তুলনায় অতি অল্প। তোমাদের জন্যে যথেষ্ট হয় এ পরিমাণই তিনি তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন।” ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা (আরবি) -এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। কিন্তু এর দ্বারা জানা যাচ্ছে আয়াতটি মাদানী হওয়া উচিত। অথচ এটা প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে যে, এটা মক্কী আয়াত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

আল্লাহ তা’আলা সবকিছুর উপরই বিজয়ী। সবকিছুই তার কাছে যৎকিঞ্চিৎ ও বিজিত। কিছুই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। তিনি নিজের কথায়, কাজে, আইন-কানুনে, বুদ্ধিতে ও অন্যান্য গুণাবলীতে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ববিজয়ী এবং প্রতাপশালী ।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ সমস্ত মানুষকে সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে মেরে ফেলে পুনরুজ্জীবিত করা আমার কাছে একটি লোককে মেরে জীবিত করার মতই সহজ। কোন কিছু হওয়ার ব্যাপারে আমার শুধু হুকুম করাই যথেষ্ট। কোন কিছু করতে আমাকে চোখের পলক ফেলার সমানও সময় লাগে না। দ্বিতীয়বার হুকুম করার আমার প্রয়োজন হয় না। কোন উপকরণ ও যন্ত্রপাতিরও দরকার হয় না। একটা হুকুমেই কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। একটি শব্দ মাত্রই সবাই জীবিত হয়ে উঠবে। আল্লাহ সবকিছু শুনেন এবং সবকিছু দেখেন। একটি লোকের কথা ও কাজ যেমন তাঁর কাছে গোপন থাকে না, অনুরূপভাবে সারা দুনিয়ারও কিছুই তার কাছে লুক্কায়িত নয়।
২৯-৩০ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন ও রাত্রিকে কিছু ছোট করে দিবসকে বাড়িয়ে দেয়া এবং দিবসকে কিছু ছোট করে রাত্রিকে বাড়িয়ে দেয়া আমারই কাজ। শীতের দিনে রাত্রি বড় ও দিন ছোট এবং গ্রীষ্মকালে দিন বড় ও রাত্রি ছোট হওয়া আমারই শক্তির প্রমাণ। চন্দ্র-সূর্যের চক্র ও আবর্তন আমারই আদেশক্রমে হয়ে থাকে। এগুলো নির্ধারিত স্থানের দিকেই চলে। নিজ স্থান থেকে এতোটুকুও এদিক ওদিক যেতে পারে না।

হযরত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে আবু যার (রাঃ)। এই সূর্য কোথায় যায় তা তুমি জান কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-ই খুব ভাল জানেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এটা গিয়ে আল্লাহর আরশের নীচে সিজদায় পড়ে যায় এবং স্বীয় প্রতিপালকের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করতে থাকে। এটা খুব নিকটবর্তী যে, একদিন তাকে বলে দেয়া হবে- “যেখান হতে এসেছে সেখানে ফিরে যাও।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সূর্য ‘সাফিয়াহ’ (পশ্চাৎ ভাগের ফৌজ)-এর ন্যায় কাজ করে। দিনে নিজের চক্রের কাজে লেগে থাকে, তারপর অস্তমিত হয়ে আবার রাত্রে যমীনের নীচে চলে গিয়ে ঘুরতে থাকে। অতঃপর পরের দিন আবার সকালে উদিত হয়। এভাবেই চাঁদও কাজ করতে থাকে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। যেমন অন্য জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তুমি কি জান না যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন?” (২২:৭০) তিনি সবারই সৃষ্টিকর্তা এবং সবারই খবর তিনিই রাখেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহ তিনিই যিনি সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং অনুরূপ সংখ্যক যমীন।” (৬৫:১২)।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এগুলো এরই প্রমাণ যে, আল্লাহই সত্য এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে তা মিথ্যা। আল্লাহ, তিনি তো সমুচ্চ, মহান। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন এবং সবাই তারই মুখাপেক্ষী। সবাই তার সৃষ্ট এবং তাঁর দাস। কারো এ ক্ষমতা নেই যে, তাঁর হুকুম ছাড়া একটি অণুকে নড়াতে পারে। একটি মাছি সৃষ্টি করার জন্যে যদি সমস্ত দুনিয়াবাসী একত্রিত হয় তবুও তারা তাতে অপারগ হয়ে যাবে। এ জন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহই সত্য এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে তা মিথ্যা। আল্লাহ সমুচ্চ ও মহান। তার উপর কারো কোন কর্তৃত্ব চলে না। তাঁর কাছে সবাই হেয় ও তুচ্ছ।
৩১-৩২ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেনঃ আমার আদেশে সাগরে জাহাজ চলতে থাকে। যদি আমি জাহাজগুলোকে পানিতে ভাসার ও পানি কেটে চলার আদেশ না করতাম এবং ওগুলোর মধ্যে এ ক্ষমতা না রাখতাম তবে ওগুলো কেমন করে পানিতে চলতো? এর মাধ্যমে আমি মানুষের কাছে আমার শক্তির প্রমাণ পেশ করছি। দুঃখের সময় ধৈর্যধারণকারী ও সুখের সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীরা এ থেকে বহু শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।

যখন কাফিরদেরকে সমুদ্রের তরঙ্গমালা ঘিরে ফেলে এবং তাদের জাহাজ ডুবুডুবু অবস্থায় পতিত হয় আর পাহাড়ের ন্যায় তরঙ্গমালা জাহাজকে এধার থেকে ওধার ও ওধার থেকে এধার ঠেলে নিয়ে যায় তখন তারা শিরক ও কুফরী ভুলে যায় এবং কেঁদে কেঁদে বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “সমুদ্রে যখন তোমাদেরকে বিপদ স্পর্শ করে তখন তোমরা আল্লাহ ছাড়া সবকেই ভুলে যাও।” (১৭:৬৭) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “যখন তারা নৌকায় আরোহণ করে।” (২৯:৬৫) মহান আল্লাহ বলেনঃ যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে পৌছান তখন তাদের কেউ কেউ কাফের হয়ে যায়। মুজাহিদ (রঃ) এই তাফসীর করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলভাগে পৌছিয়ে দেন তখন তারা শিক করতে শুরু করে দেয়।” (২৯:৬৫) আর ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন (আারবি)-এর অর্থ হচ্ছে কাজে মধ্যমপন্থী। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আারবি)

অর্থাৎ তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘোর যালিম হয়ে যায় এবং কেউ কেউ মধ্যমপন্থী থাকে।” (৩৫:৩২) এও হতে পারে যে, উভয়কেই লক্ষ্য করে বলা হয়েছে। প্রকৃত মতলব এই যে, যারা এ প্রকার বিপদের সম্মুখীন হয়েছে এবং যিনি তাদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন, তাদের উচিত ছিল পরিপূর্ণভাবে তাঁর অনুগত হওয়া ও সৎ আমলে আত্মনিয়োগ করা। আর সদা-সর্বদা সৎ আমলের প্রচেষ্টা চালানো। কিন্তু এ না করে তাদের কেউ কেউ মধ্যমপন্থী থাকে এবং কেউ কেউ পূর্ণভাবেই কুফরীর দিকে ফিরে যায়।

(আারবি) বলা হয় গাদ্দার বা বিশ্বাসঘাতককে। (আারবি) এর অর্থ হচ্ছে পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা।

(আারবি) বলে (আারবি) বা অস্বীকারকারীকে, যে নিয়ামতরাশিকে অস্বীকার করে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ভুলে যায়।
# আল্লাহ তা’আলা মানুষকে কিয়ামতের দিন হতে ভয় প্রদর্শন করছেন এবং তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতির নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলছেনঃ তোমরা এমন দিনকে ভয় কর যেদিন পিতা পুত্রের কোন উপকার করতে পারবে না এবং পুত্রও পিতার কোন কাজে আসবে না। সেই দিন একে অপরের কোন সাহায্য করতে পারবে না। তোমরা দুনিয়ার উপর কোন ভরসা করো না এবং আখিরাতকে ভুলে যেয়ো না। তোমরা শয়তানের প্রতারণায় পড়ো না। সে তো শুধু পর্দার আড়াল থেকে শিকার করতে জানে।

অহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, হযরত উযায়ের (আঃ) যখন নিজ সম্প্রদায়ের কষ্ট দেখলেন এবং তাঁর চিন্তা ও দুঃখ বেড়ে গেল, তখন তিনি আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তিনি বলেনঃ “আমি অনুনয়-বিনয়ের সাথে খুব কাঁদলাম ও মিনতি করলাম। আমি নামায পড়ি, রোযা রাখি ও দু’আ করতে থাকি। একবার খুব মিনতির সাথে দুআ করছি ও কাঁদছি, এমন সময় আমার সামনে একজন ফেরেশতা আসলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ ভাল লোক কি মন্দ লোকের জন্যে সুপারিশ করবে? পিতা কি পুত্রের কোন কাজে আসবে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “কিয়ামতের দিন তো ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসার দিন। ঐ দিন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সামনে থাকবেন। কেউই তাঁর বিনা হুকুমে মুখ খুলতে পারবে না। কাউকেও কারো ব্যাপারে পাকড়াও করা হবে। না পিতাকে পুত্রের পরিবর্তে এবং না পুত্রকে পিতার পরিবর্তে পাকড়াও করা হবে। ভাই ভাই-এর বদলে দোষী বলে সাব্যস্ত হবে না এবং প্রভুর বদলে গোলাম ধরা পড়বে না। কেউ কারো জন্যে দুঃখ ও শোক প্রকাশ করবে না এবং কারো প্রতি কারো কোন খেয়ালই থাকবে না। কেউ কারো উপর কোন দয়া করবে না এবং কারো প্রতি কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশও করবে না। কারো প্রতি কেউ কোন ভালবাসা দেখাবে না। সেদিন কাউকেও কারো পরিবর্তে পাকড়াও করা হবে না। সবাই নিজ নিজ চিন্তায় ব্যাকুল থাকবে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বোঝা নিয়ে ফিরবে, একে অপরের বোঝা সেদিন বহন করবে না।
# এগুলো হচ্ছে গায়েবের চাবি কাঠি যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না। আল্লাহ যাকে জানিয়ে দেন সে ছাড়া আর কেউই জানতে পারে না। কিয়ামত সংঘটিত হবার সঠিক সময় না কোন নবী-রাসূলের জানা আছে, না কোন নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতার জানা আছে। অনুরূপভাবে বষ্টি কখন, কোথায়, কতটুকু বর্ষিত হবে তার জ্ঞান আল্লাহ্রই আছে। তবে এ কাজের ভারপ্রাপ্ত ফেরেশতাকে যখন নির্দেশ দেয়া হবে তখন তিনি জানতে পারবেন। এভাবে গর্ভবতী নারীর জরায়ুতে পুত্র সন্তান আছে কি কন্যা সন্তান আছে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। অবশ্যই এ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ফেরেশতাকে যখন হুকুম করা হয় তখন তিনি তা জানতে পারেন যে, সন্তান নর হবে কি নারী হবে, পুণ্যবান হবে কি পাপী হবে। অনুরূপভাবে কেউই জানে না যে, সে আগামীকাল কি অর্জন করবে এবং এটাও কেউই জানে না যে, কোথায় তার মৃত্যু ঘটবে। অন্য আয়াতে আছে (আারবি)

অর্থাৎ “গায়েবের চাবিকাঠি তাঁর নিকটেই আছে, তিনি ছাড়া কেউ তা জানে ।” (৬:৫৯) হাদীসে রয়েছে যে, গায়েবের চাবি হচ্ছে এই পাঁচটি জিনিস যেগুলোর বর্ণনা(আারবি) এই আয়াতে রয়েছে। মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু বুরাইদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “পাঁচটি জিনিস রয়েছে যেগুলোর খবর আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।” অতঃপর তিনি। (আারবি) এ আয়াতটিই পাঠ করেন।

সহীহ বুখারীর শব্দ এও রয়েছে যে, এ পাঁচটি জিনিস হলো গায়েবের চাবি, যেগুলো আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না।”

মুসনাদে আহমাদে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উক্তি রয়েছেঃ “পাঁচটি জিনিস ছাড়া আমাকে সবকিছুরই চাবি দেয়া হয়েছে।” অতঃপর তিনি এ আয়াতটিই পাঠ করেন।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) জনগণের মজলিসে বসেছিলেন, এমন সময় তাঁর নিকট একটি লোক এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেঃ “ঈমান কি”? রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বলেনঃ “ঈমান এই যে, তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাবসমূহের উপর, তাঁর রাসূলদের উপর, আখিরাতের উপর এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর।” লোকটি জিজ্ঞেস করলো: “ইসলাম কি?” তিনি উত্তর দিলেনঃ “ইসলাম এই যে, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে ও তার সাথে কাউকেও শরীক করবে না, নামায কায়েম করবে, ফরয যাকাত আদায় করবে এবং রমযানের রোযা রাখবে।” লোকটি বললো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ইহসান কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “ইহসান এই যে, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তুমি তাকে দেখছো, অথবা যদিও তুমি তাকে দেখছো না কিন্তু তিনি তোমাকে দেখছেন (এরূপ খেয়াল রেখে তাঁর ইবাদত করবে)।” লোকটি বললো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?” তিনি উত্তর দিলেন, “এটা জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি বেশী জানে না। তবে আমি তোমাকে এর কতকগুলো নিদর্শনের কথা বলছি। যখন দাসী তার মনিবের জন্ম দেবে এবং যখন উলঙ্গ পা ও উলঙ্গ দেহ বিশিষ্ট লোকেরা নেতৃত্ব লাভ করবে। কিয়ামতের জ্ঞান ঐ পাঁচটি জিনিসের অন্তর্ভুক্ত যেগুলো আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না।” অতঃপর তিনি (আারবি) -এ আয়াতটি পাঠ করলেন। এরপর লোকটি চলে গেল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে বললেনঃ “যাও, তোমরা লোকটিকে ফিরিয়ে আন।” জনগণ দৌড়িয়ে গেল। কিন্তু লোকটিকে কোথাও দেখতে পেলো না। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “ইনি ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আঃ)। মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্যে তিনি আগমন করেছিলেন। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। আমরা এ হাদীসের ভাবার্থ সহীহ বুখারীর শরাহতে ভালভাবে বর্ণনা করেছি)

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) তার হাতের তালু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাঁটুর উপর রেখে প্রশ্নগুলো করেছিলেন যে, ইসলাম কি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “ইসলাম এই যে, তুমি তোমার চেহারা মহামহিমান্বিত আল্লাহর কাছে সমর্পণ করবে এবং সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি এক, তার কোন অংশীদার নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিবে।

যে, মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল।” হযরত জিবরাঈল (আঃ) তখন বলেনঃ “এরূপ করলে কি আমি মুসলমান হয়ে যাবো?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হ্যা, এরূপ করলে তুমি মুসলমান হয়ে যাবে।” হযরত জিবরাঈল (আঃ) তখন বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে বলে দিন, ঈমান কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “ঈমান এই যে, তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহর উপর, পরকালের উপর, ফেরেশতাদের উপর, কিতাবের উপর, নবীদের উপর, মৃত্যুর উপর, মৃত্যুর পর পুনজীবনের উপর, জান্নাতের উপর, জাহান্নামের উপর, হিসাবের এবং মীযানের উপর। আরো বিশ্বাস রাখবে তকদীরের ভাল-মন্দের উপর।” হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “এরূপ করলে কি আমি মুমিন হবো?” তিনি জবাব দেনঃ “হ্য, এরূপ করলে তুমি মুমিন হবে।” অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “সুবহানাল্লাহ! এটা ঐ পাঁচটি জিনিসের অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই।” অতঃপর তিনি (আরবি)-এই আয়াতটি পাঠ করে শুনিয়ে দেন। নিদর্শনগুলোর মধ্যে এও রয়েছে যে, মানুষ লম্বা-চওড়া অট্টালিকা নির্মাণ করতে শুরু করবে।

মুসনাদে আহমাদে একটি সহীহ সনদের সাথে বর্ণিত আছে যে, বানু আমির গোত্রের একটি লোক নবী (সঃ)-এর নিকট এসে বললো: “আমি আসবো কি?” নবী (সঃ) তখন লোকটির কাছে তার খাদেমকে পাঠালেন, যেন সে তাকে আদব বা দ্রতা শিক্ষা দেয়। কেননা, সে অনুমতি চাইতে জানে না। তাকে প্রথমে সালাম দিতে হবে এবং পরে বলতে হবেঃ “আমি আসতে পারি কি?” লোকটি শুনলো এবং সালাম করে আগমনের জন্যে অনুমতি প্রার্থনা করলো। অনুমতি পেয়ে সে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয় এবং বলেঃ “আপনি আমাদের জন্যে কি নিয়ে এসেছেন। তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমি তোমাদের জন্যে কল্যাণই নিয়ে এসেছি। শুনো, তোমরা এক আল্লাহরই ইবাদত করবে। লাত ও উয্যাকে ছেড়ে দেবে। দিন-রাত্রে পাঁচ ওয়াক্ত নামায কায়েম করবে, বছরের মধ্যে এক মাস রোযা রাখবে, ধনীদের নিকট হতে যাকাত আদায় করবে এবং দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করবে।” লোকটি জিজ্ঞেস করলো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জ্ঞানের মধ্যে এমন কিছু বাকী আছে কি যা আপনি জানেন না।?” তিনি জবাবে বললেনঃ “যা, এমন জ্ঞানও রয়েছে যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না।” অতঃপর তিনি(আরবি)-এই আয়াতটিই পাঠ করেন। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, একজন গ্রামবাসী (বেদুইন) নবী (সঃ)-এর নিকট এসে বলেঃ “আমার স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছে, বলুন তো তার কি সন্তান হবে?

আমাদের শহরে দুর্ভিক্ষ পড়েছে, বলুন তো বৃষ্টি কখন হবে? আমি কখন জন্মগ্রহণ করেছি তা তো আমি জানি, এখন বলুন তো কখন আমি মৃত্যুমুখে পতিত হবো?” তার এসব প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন যে, তিনি এগুলোর খবর রাখেন না। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এগুলোই হলো গায়েবের চাবি যেগুলো সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, গায়েবের চাবিকাঠি আল্লাহ তা’আলার নিকটই রয়েছে।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “যে তোমাদেরকে বলে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আগামীকালকের কথা জানতেন, তুমি বুঝবে যে, সে মিথ্যাবাদী। আল্লাহ তা’আলা তো বলেন যে, কাল কি করবে তা কেউ জানে না।” কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এমন কতকগুলো জিনিস আছে যেগুলোর জ্ঞান আল্লাহ তা’আলা কাউকেও দেননি। ওগুলোর জ্ঞান নবীদেরও নেই, ফেরেশতাদেরও নেই। কিয়ামতের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই আছে। কারো এ জ্ঞান নেই যে, সে কোন সালে, কোন মাসে এবং কোন দিনে আসবে। অনুরূপভাবে বৃষ্টি কখন হবে এ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই রয়েছে। গর্ভবতী নারীর জরায়ুতে পুত্র সন্তান আছে কি কন্যা সন্তান আছে, সন্তান লাল বর্ণের হবে কি কালো বর্ণের হবে এ জ্ঞানও আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। কেউ এটা জানে না যে, সে আগামীকাল ভাল কাজ করবে কি মন্দ কাজ করবে, মরবে কি বেঁচে থাকবে। হতে পারে যে কালই মৃত্যু বা কোন বিপদ এসে পড়বে। কেউই জানে না যে, কোথায় তার মৃত্যু হবে, কোথায় তার কবর হবে। হতে পারে যে, তাকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হবে অথবা কোন জনমানবহীন জঙ্গলে মৃত্যুবরণ করবে। কেউই জানে না যে, সে কঠিন মাটিতে, না নরম মাটিতে প্রোথিত হবে। হাদীস শরীফে আছে যে, যে ব্যক্তির মৃত্যু অন্য দেশের মাটিতে লিখা তাকে কোন কার্যোপলক্ষে সেখানে যেতে হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এ কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন।

আলী হামদানের কবিতায় এ বিষয়টিকে খুব ভালভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একটি হাদীসে আছে যে, কিয়ামতের দিন যমীন আল্লাহকে বলবেঃ “এগুলো আপনার আমানত যা আপনি আমার কাছে রেখেছিলেন।” (তিবরানী (রঃ) প্রমুখ গুরুজনও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

Leave a Reply