: أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬৫)
[* ঈমান ও ইসলামই হবে মর্যাদা লাভের একমাত্র উপায়:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৫:ফা-ত্বির
পারা:২২
১০-২৬ নং আয়াত:-
ফা-ত্বির:- ৩৫:১০
مَنۡ کَانَ یُرِیۡدُ الۡعِزَّۃَ فَلِلّٰہِ الۡعِزَّۃُ جَمِیۡعًا ؕ اِلَیۡہِ یَصۡعَدُ الۡکَلِمُ الطَّیِّبُ وَ الۡعَمَلُ الصَّالِحُ یَرۡفَعُہٗ ؕ وَ الَّذِیۡنَ یَمۡکُرُوۡنَ السَّیِّاٰتِ لَہُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ؕ وَ مَکۡرُ اُولٰٓئِکَ ہُوَ یَبُوۡرُ ﴿۱۰﴾
যে কেউ সম্মান-প্রতিপত্তি চায়, তবে সকল সম্মান-প্রতিপত্তির মালিক তো আল্লাহ্ই তাঁরই দিকে পবিত্র বাণিসমূহ হয় সমুত্থিত এবং সৎকাজ, তিনি তা করেন উন্নীত । আর যারা মন্দকাজের ফন্দি আঁটে তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। আর তাদের ষড়যন্ত্র, তা ব্যর্থ হবেই।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১১
وَ اللّٰہُ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ثُمَّ جَعَلَکُمۡ اَزۡوَاجًا ؕ وَ مَا تَحۡمِلُ مِنۡ اُنۡثٰی وَ لَا تَضَعُ اِلَّا بِعِلۡمِہٖ ؕ وَ مَا یُعَمَّرُ مِنۡ مُّعَمَّرٍ وَّ لَا یُنۡقَصُ مِنۡ عُمُرِہٖۤ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ ؕ اِنَّ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرٌ ﴿۱۱﴾
আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে তারপর শুক্র থেকে এরপর তোমাদের জুটি বানিয়ে দিয়েছেন (অর্থাৎ পুরুষ ও নারী)। কোন নারী গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসব করলে কেবলমাত্র আল্লাহর জানা মতেই তা করে থাকে। কোন আয়ু লাভকারী আয়ু লাভ করলে এবং কার আয়ু কিছু কম করা হলে তা অবশ্যই একটি কিতাবে লেখা থাকে। আল্লাহর জন্য এসব একদম সহজ।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১২
وَ مَا یَسۡتَوِی الۡبَحۡرٰنِ ٭ۖ ہٰذَا عَذۡبٌ فُرَاتٌ سَآئِغٌ شَرَابُہٗ وَ ہٰذَا مِلۡحٌ اُجَاجٌ ؕ وَ مِنۡ کُلٍّ تَاۡکُلُوۡنَ لَحۡمًا طَرِیًّا وَّ تَسۡتَخۡرِجُوۡنَ حِلۡیَۃً تَلۡبَسُوۡنَہَا ۚ وَ تَرَی الۡفُلۡکَ فِیۡہِ مَوَاخِرَ لِتَبۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِہٖ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۱۲﴾
আর সাগর দুটি একরূপ নয়ঃ একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়, অন্যটির পানি লোনা খর। আর প্রত্যেকটি থেকে তোমরা তাজা গোশত খাও এবং আহরণ কর অলংকার, যা তোমরা পরিধান কর। আর তোমরা দেখ তার বুক চিরে নৌযান চলাচল করে, যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১৩
یُوۡلِجُ الَّیۡلَ فِی النَّہَارِ وَ یُوۡلِجُ النَّہَارَ فِی الَّیۡلِ ۙ وَ سَخَّرَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ۫ۖ کُلٌّ یَّجۡرِیۡ لِاَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ ذٰلِکُمُ اللّٰہُ رَبُّکُمۡ لَہُ الۡمُلۡکُ ؕ وَ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖ مَا یَمۡلِکُوۡنَ مِنۡ قِطۡمِیۡرٍ ﴿ؕ۱۳﴾
তিনি রাতকে দিনে পরিণত করেন এবং দিনকে পরিণত করেন রাতে, তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন; প্রত্যেকেই এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করে। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। সার্বভৌমত্ব তাঁরই। আর তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুরের আঁটির উপরে পাতলা আবরণ বরাবর (অতি তুচ্ছ) কিছুরও মালিক নয়।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১৪
اِنۡ تَدۡعُوۡہُمۡ لَا یَسۡمَعُوۡا دُعَآءَکُمۡ ۚ وَ لَوۡ سَمِعُوۡا مَا اسۡتَجَابُوۡا لَکُمۡ ؕ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ یَکۡفُرُوۡنَ بِشِرۡکِکُمۡ ؕ وَ لَا یُنَبِّئُکَ مِثۡلُ خَبِیۡرٍ ﴿٪۱۴﴾
তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনতে পারে না এবং শুনে নিলেও তোমাদের কোন জবাব দিতে পারে না। এবং কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরক অস্বীকার করবে। প্রকৃত অবস্থান এমন সঠিক খবর একজন সর্বজ্ঞ ছাড়া কেউ তোমাদের দিতে পারে না।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১৫
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ اِلَی اللّٰہِ ۚ وَ اللّٰہُ ہُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿۱۵﴾
হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী; আর আল্লাহ্, তিনিই অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১৬
اِنۡ یَّشَاۡ یُذۡہِبۡکُمۡ وَ یَاۡتِ بِخَلۡقٍ جَدِیۡدٍ ﴿ۚ۱۶﴾
তিনি চাইলে তোমাদের সরিয়ে কোন নতুন সৃষ্টি তোমাদের জায়গায় আনবেন।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১৭
وَ مَا ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ بِعَزِیۡزٍ ﴿۱۷﴾
এমনটি করা আল্লাহর জন্য মোটেই কঠিন নয়।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১৮
وَ لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی ؕ وَ اِنۡ تَدۡعُ مُثۡقَلَۃٌ اِلٰی حِمۡلِہَا لَا یُحۡمَلۡ مِنۡہُ شَیۡءٌ وَّ لَوۡ کَانَ ذَا قُرۡبٰی ؕ اِنَّمَا تُنۡذِرُ الَّذِیۡنَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّہُمۡ بِالۡغَیۡبِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ ؕ وَ مَنۡ تَزَکّٰی فَاِنَّمَا یَتَزَکّٰی لِنَفۡسِہٖ ؕ وَ اِلَی اللّٰہِ الۡمَصِیۡرُ ﴿۱۸﴾
কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা উঠাবে না। আর যদি ভারাক্রান্ত ব্যক্তি নিজের বোঝা উঠাবার জন্য ডাকে, তাহলে তার বোঝার সামান্য একটি অংশ উঠাবার জন্যও কেউ আসবে না, সে তার নিকটতম আত্মীয় স্বজন হলেও। তুমি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারো যারা না দেখে তাদের রবকে ভয় করে এবং নামায কায়েম করে।আর যে ব্যক্তিই পবিত্রতা অবলম্বন করে সে নিজেরই ভালোর জন্য করে এবং ফিরে আসতে হবে সবাইকে আল্লাহরই দিকে।
ফা-ত্বির:- ৩৫:১৯
وَ مَا یَسۡتَوِی الۡاَعۡمٰی وَ الۡبَصِیۡرُ ﴿ۙ۱۹﴾
অন্ধ ও চক্ষুষ্মান সমান নয়,
ফা-ত্বির:- ৩৫:২০
وَ لَا الظُّلُمٰتُ وَ لَا النُّوۡرُ ﴿ۙ۲۰﴾
না অন্ধকার ও আলো সমান পর্যায়ভুক্ত,
ফা-ত্বির:- ৩৫:২১
وَ لَا الظِّلُّ وَ لَا الۡحَرُوۡرُ ﴿ۚ۲۱﴾
না শীতল ছায়া ও রোদের তাপ একই পর্যায়ের
ফা-ত্বির:- ৩৫:২২
وَ مَا یَسۡتَوِی الۡاَحۡیَآءُ وَ لَا الۡاَمۡوَاتُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُسۡمِعُ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَاۤ اَنۡتَ بِمُسۡمِعٍ مَّنۡ فِی الۡقُبُوۡرِ ﴿۲۲﴾
এবং সমান নয় জীবিত ও মৃত।আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শ্রবণ করান; আর তুমি মৃতকে শোনাতে পার না।
ফা-ত্বির:- ৩৫:২৩
اِنۡ اَنۡتَ اِلَّا نَذِیۡرٌ ﴿۲۳﴾
আপনি তো একজন সতর্ককারী মাত্র।
ফা-ত্বির:- ৩৫:২৪
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ بِالۡحَقِّ بَشِیۡرًا وَّ نَذِیۡرًا ؕ وَ اِنۡ مِّنۡ اُمَّۃٍ اِلَّا خَلَا فِیۡہَا نَذِیۡرٌ ﴿۲۴﴾
আমি তো তোমাকে সত্যসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি।
ফা-ত্বির:- ৩৫:২৫
وَ اِنۡ یُّکَذِّبُوۡکَ فَقَدۡ کَذَّبَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ۚ جَآءَتۡہُمۡ رُسُلُہُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ وَ بِالزُّبُرِ وَ بِالۡکِتٰبِ الۡمُنِیۡرِ ﴿۲۵﴾
আর তারা যদি আপনার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে এদের পূর্ববর্তীরাও তো মিথ্যা আরোপ করেছিল—তাদের কাছে এসেছিল তাদের রাসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণাদি, গ্রন্থাদি ও দীপ্তিমান কিতাবসহ।
ফা-ত্বির:- ৩৫:২৬
ثُمَّ اَخَذۡتُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَکَیۡفَ کَانَ نَکِیۡرِ ﴿٪۲۶﴾
তারপর যারা মানেনি তাদেরকে আমি পাকড়াও করেছি এবং দেখে নাও আমার শাস্তি ছিল কেমন কঠোর।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*ঈমান ও ইসলামই হবে মর্যাদা লাভের একমাত্র উপায় : মৃত ও উষর মাটিকে সজীবতা উর্বরতা দানের দৃশ্য থেকে বিস্ময়করভাবে একটা মনস্তাত্ত্বিক ও একটা অনুভূতি-নির্ভর বিষয়ে আলােচনার পট পরিবর্তন ঘটেছে। পট পরিবর্তন ঘটেছে উচ্চতা, মর্যাদা, সম্মান, প্রতাপ, মহত্ত্ ও শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে। তারপর এই বিষয়টাকে উত্তম ও মহৎ বাণীর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে, যা মহান আল্লাহর কাছে ওঠে যায়। এটা সংযুক্ত করা হয়েছে সৎ কাজের সাথেও, যাকে আল্লাহ তায়ালা আরাে সমুন্নত করেন। সেই সাথে এর বিপরীত দিকটাও তুলে ধরা হয়েছে। এই দিকটা হলাে ষড়যন্ত্র ও কুটিল চক্রান্তের যা পতনশীল ও ধ্বংসশীল। আল্লাহ তায়ালা বলেন যে ব্যক্তি সম্মান চায়, তার জানা উচিত, সম্মান কেবল আল্লাহর জন্যে। পবিত্র কথা তার কাছেই ওঠে যায়। আর সৎকাজকে আল্লাহ আরাে সমুন্নত করেন আর যারা কুটিল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে তাদের জন্যে কঠিন শাস্তি রয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে।’ খরা উপদ্রুত নির্জীব ভূমির পুনরুজ্জীবনের সাথে পবিত্র কথা ও সৎকাজের যােগসূত্রটা সম্ভবত পবিত্র জীবন, যা উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান। তাছাড়া জীবন ও সৃষ্টি জগতের স্বভাব প্রকৃতির মধ্যে যে যোগসূত্র রয়েছে, সেটাও নির্জীব ভূমি এবং পবিত্র কথা ও কাজের মাঝে যােগসূত্র স্থাপন করে। এই যােগসূত্রের কথা সূরা ইবরাহীমে বলা হয়েছে। ‘তুমি কি দেখনি, আল্লাহ তায়ালা কিভাবে পবিত্র কথার উদাহরণ হিসাবে পবিত্র বৃক্ষের উল্লেখ করেছেন, যার মূল মাটিতে প্রতিষ্ঠিত এবং শাখা প্রশাখা আকাশে ছড়িয়ে রয়েছে। এই বৃক্ষ তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রতি মুহূর্তে তার খাদ্য সরবরাহ করে। আর মানুষ যাতে স্মরণ করে, সে জন্যে আল্লাহ তায়ালা রকমারি উদাহরণ দেন, আর অপবিত্র কথা অপবিত্র বৃক্ষের মতাে, যা পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে উৎখাত হয়ে যায় এবং তার কোনাে স্থিতি থাকে না।’ কথা ও বৃক্ষের স্বভাব প্রকৃতি এবং উভয়ের জীবন ও বিকাশ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা সম্পূর্ণ বাস্তব উপমা। বৃক্ষ যেমন বাড়ে, বড় হয় ও ফল দেয়, ঠিক তেমনি কথাও বাড়ে, প্রসার লাভ করে ও ফলপ্রসূ হয়। মক্কার কোরায়শরা তাদের ধর্মীয় মর্যাদা টিকিয়ে রাখার জন্য শিরক করতো। কেননা এই ধর্মীয় মর্যাদা ও শিরকী আকীদা বিশ্বাসের কল্যাণেই তারা সমস্ত আরব গােত্রগুলাের ওপর নেতৃত্ব কর্তৃত্ব চালাতাে এবং এই নেতৃত্বের বলে নানা রকমের সুযােগ সুবিধা ভােগ করতাে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় যে সুবিধা তারা ভোগ করতাে, তা ছিলাে স্বভাবতই সম্মান, প্রতাপ ও নিরাপত্তা। এ কারণেই তারা বললাে, ‘তােমার সাথে যদি আমরা হেদায়াতের পথ অনুসরণ করি, তাহলে আমরা দেশ থেকে উৎখাত হয়ে যাবে।’ এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘যারা মর্যাদা ও সম্মান চায়, তাদের জানা উচিত, মর্যাদা ও সম্মান আল্লাহরই।’ এই সত্যটা যদি হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়, তবে এই একটা কথাই বর্তমান সমাজে বিদ্যমান সমস্ত মাপকাঠি, মূল্যবােধ, পরিকল্পনা ও উপায়-উপকরণ সম্পূর্ণরূপে পাল্টে ফেলতে সক্ষম। বস্তুত সম্মান, মর্যাদা, প্রভাব প্রতিপত্তি ও প্রতাপ সবই আল্লাহর। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে কাছে এর ছিটেফোঁটাও নেই, কণামাত্রও নেই, কাজেই যে ব্যক্তি সম্মান চায়, তার সম্মানের একমাত্র উৎস যিনি, তাঁর কাছ থেকেই তা চাওয়া উচিত। এটা সে তার কাছ থেকেই পেতে পারে আর কারাে কাছ থেকে নয়, আর কারো সাহায্য বা আশ্রয়ে নয় এবং কোনাে উপায়েই নয়। কোরায়শ গােত্র যে পৌত্তলিক আকীদা বিশ্বাসের উসিলায় মানুষের কাছ থেকে সম্মান ও প্রতাপ প্রত্যাশা করতাে এবং ইসলামের অনুসরণে সেই সম্মান ও প্রতাপ হারানাের ভয় পেতাে, তারা সে ইসলামই যে হেদায়াত তথা সত্যের পথ, সে কথাও স্বীকার করতাে। সেসব মানুষ, সেসব গােত্র, সম্মান ও প্রতাপের উৎস নয় এবং কাউকে সম্মান দেয়া বা না দেয়ার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাদের যদি কোনাে শক্তি বা ক্ষমতা থেকে থাকে, তবে তার প্রথম উৎসই আল্লাহ তায়ালা, তাদের যদি কোনাে প্রতাপ ও নিরাপত্তা থেকে থাকে তবে তা আল্লাহ তায়ালাই দিয়েছেন। তারা যদি সম্মান মর্যাদা চায়, প্রতাপ ও নিরাপত্তা চায়, তবে তাদের এর প্রথম উৎসের কাছেই যাওয়া উচিত যারা আল্লাহর কাছ থেকেই এ সব পায়, তাদের কাছে নয়। সেই আসল মালিকের কাছ থেকে তা নেয়া উচিত, যিনি এককভাবে সকল সম্মানের মালিক। যে মানুষেরা তাদেরই মতাে আল্লাহর মুখাপেক্ষী, তাদের বর্জিত ও পরিত্যক্ত জিনিসের মুখাপেক্ষী হওয়া উচিত নয়। এটা ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের একটা মৌল তত্ত্ব। এ তত্ত্ব মানুষের ধ্যান ধারণা, চিন্তাধারা, মানদন্ড ও মূল্যবােধ, সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা, জীবনাচার ও জীবন পদ্ধতি, উপায় উপকরণ সব কিছুকেই সংশােধন করে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম। একমাত্র এই আকীদা বিশ্বাস অন্তরে বদ্ধমূল হলেই তা নিয়ে সারা দুনিয়ার সামনে বুক ফুলিয়ে অটুট মনােবল নিয়ে অকুতােভয়ে ও অনমনীয়ভাবে দাঁড়ানাে এবং সম্মান মর্যাদা ও প্রতাপের একমাত্র পথ চিনে সেদিকে যাত্রা করা সম্ভব। এ আকীদা বিশ্বাস হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকলে তা পৃথিবীর কোনাে স্বৈরাচারী সৃষ্টির সামনে মানুষের মাথা নত হতে দেয় না, কোনাে ভয়াবহ দুর্যোগ দুর্বিপাকে অসহিষ্ণু ও হিন্মতহারা হতে দেয় না। কোনাে ভয়াবহ বিপর্যয়েও নীতি বিসর্জন দিতে দেয় না। কোনাে সমাজ ব্যবস্থা, কোনাে শাসন ব্যবস্থা, কোনাে রাষ্ট্র, কোনাে স্বার্থ এবং পৃথিবীর কোনাে শক্তির কাছেই মাথা নােয়াতে দেয় না। কেনই বা দেবে সম্মান প্রতাপ সবই তাে আল্লাহর। তার অনুমতি ও সম্মতি ছাড়া আর কারাে কাছে তাে এর ছিটেফোটাও থাকতে পারে না। এ কারণেই পবিত্র কথা ও সৎকাজের উল্লেখ করা হয়েছে। একমাত্র তাঁর কাছেই ওঠে যায় পবিত্র কথা, আর সৎকাজ তিনিই সমুন্নত করেন।’ উল্লেখিত মহাসত্যের উল্লেখের পর এই প্রত্যক্ষ মন্তব্যের মধ্যেই এর প্রকৃত তাৎপর্য ও মর্ম নিহিত রয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে সম্মান চায়, তাকে এই সম্মান লাভের উপায় জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। উপায়টা হলো, পবিত্র ও ন্যায়সংগত কথা এবং সৎ ও ন্যায়সংগত কাজ। পবিত্র কথা মহান আল্লাহর কাছে ওঠে যায়। সৎকাজ আল্লাহ তায়ালা নিজেই নিজের কাছে ওঠিয়ে নেন ও সম্মানিত করেন। তাই যে ব্যক্তি সৎকাজ করে তাকেও তিনি সম্মান প্রতাপের অধিকারী করেন। প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদাবােধ এমন একটা জিনিস, যা বাইরের জগতে প্রকাশ পাওয়ার আগে মানুষের অন্তরেই অবস্থান করে। যার অন্তরে এটা অবস্থান করে সে এ ধারা অবমাননা ও অবনতির সকল উপকরণের উর্ধে উঠে যায় এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে কাছে সে মাথা নােয়ায় না। আত্মমর্যাদাবোধ দ্বারা, সে সর্বপ্রথম নিজের প্রবৃত্তির উর্ধে ওঠে, প্রবৃত্তির সমস্ত খায়েশকে সে পদদলিত করে, সকল লােভ ও ভীতিকে সে উপেক্ষা করে এবং বিরােধী শক্তির সকল হুমকি ও আক্ষালনকে সে বুড়ো আংগুল দেখায়। এই পর্যায়ে উন্নীত হবার পর আর কেউ তাকে অবদমিত করতে ও-মাথা নােয়াতে বাধ্য করতে পারে না। কেননা মানুষকে তার নিজের প্রবৃত্তির খায়েশ, লােভ ও ভয়ভীতিই মাথা নত করতে বাধ্য করে। এগুলো যে জয় করতে পারে, সে সব কিছুই জয় করতে পারে, সকল পরিস্থিতি ও সকল মানুষকে সে পদানত করতে পারে। এটাই সত্যিকার সম্মান, সত্যিকার মর্যাদ্বাবােধ, যা মানুষকে দেয়, অনমনীয় মনােবল, অপরাজেয় শক্তি ও অদম্য ক্ষমতা। আত্মসম্মানবোধ কোনাে যুক্তিহীন গোয়ার্তুমির নাম নয়। সত্যকে উপেক্ষা করার স্পর্ধা, বাতিলকে গ্রহণ করার ধৃষ্টতা এবং দম্ভ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আগ্রাসী স্বেচ্ছাচারী আচরণকে আত্ম সম্মানবোধ, বলা হয় না। অনুরূপভাবে ঝোক ও আবেগের সামনে দুর্বলতা প্রদর্শনের নামও নয় অমর্যাদবােধ। সত্য, ন্যায় ও সুবিচারের নীতিমালা পদদলিত করে অন্ধ শক্তি, প্রদর্শনকে আত্মমর্যাদাবোধ বলা যায় না। আত্মসম্মান মর্যাদাবোধ মহত্ব-ও শ্রেষ্ঠত্ব কেবল প্রবৃত্তির খায়েশ, আবেগ ও লােভ লালসার উর্ধ্বে ওঠা, মনের হীনতা ও নীচতাকে জয় করা এবং আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্যান্য শক্তির সামনে নতিস্বীকার থেকে,বিরত থাকার নাম। অতপর আল্লাহর আনুগত্য, তার কাছে নতিস্বীকার, তার ভয় ও তাকওয়া, সুযোগে ও দুর্যোগে একমাত্র আল্লাহর প্রতি মনােনিবেশ করার-নামই আত্মসম্মানবােধ ও আত্মমর্যাদাবােধ আল্লাহর কাছে এই নতিস্বীকার মানুষের মাথা যারা আল্লাহকে মানে না তাদের সকলের সামনে উঁচু ইয়।কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টি হাড়া-সে আর কারো সন্তুষ্টির পরােয়া করে না। এ পর্যন্ত গেল সমান, মর্যাদা ও প্রতাপের ক্ষেত্রে পবিত্র কথা ও সৎকাজের ভূমিকা এবং অবদান সংক্রান্ত বক্তব্য। উভয়ের মধ্যে যােগসূত্র এটাই। এরপর এর বিপরীত দিকটা তুলে ধরা আর যারা কুটিল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং ভাদের ষড়যন্ত্র ধ্বংস হবে। মূল আয়াতে ‘ইয়ামকুরুনা’ শব্দটা রয়েছে, যা প্রধানত খারাপ ও দূরভিসন্ধিমূলক কাজ করা অর্থে ব্যবহৃত হয়। যারা এটা করে তাদের জন্যে কঠিন শাস্তি রয়েছে, তাছাড়া তাদের এই সব দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র ব্যর্থ নিক্ষল তার হবেই। তা সফলও হবে না, টিকেও থাকবে না। পূর্ববর্তী আয়াতে মৃত ভূমিকে পুনরুজ্জীবিত কৱা ও তাকে ফলপ্রসূ করা সম্পর্কে যে কথা রয়েছে, তার সাথে সমন্বয় বিধানের জন্যে এখানে এ কথা বলা হয়েছে। যারা, যড়য়্ত্রে লিপ্ত, তারা মিথ্যা সম্মান প্রতিপত্তি এবং কল্পিত বিজয় লাভের আশায় এটা করছে। ব্রাহ্যত তাদেরকে বিজয়ী শক্তিশালী ও প্রতিপত্তিশালী মনে হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে শুধু পবিত্র কথাই পৌছে, এবং সংকাজকে তিনিই নিজের কাছে ওঠান। এই দুটো দ্বারাই সম্মান ও প্রতিপত্তি ব্যাপকতার অর্থে অর্জিত হয়। পক্ষান্তরে কথায় ও কাজে যড়যন্ত্র করা সম্মান মর্যাদা লাভের পথ নয়, যদিও কোনাে স্বৈরাচারী শক্তি সাময়িকভাবে তা অর্জন করে, কিন্তু এর শেষ পরিণাম ধ্বংস ও কঠিন শান্তি। এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি যা তিনি কখনাে ভংগ করেন না। তবে তিনি তার নির্ধারিত সময় আসা পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীদের সুযােগ দিতেও পারেন ।
*মানব জন্মের ইতিবৃত্ত : এরপর যে- বিষয়টা আলােচনায় আসছে, তা হলাে মানুষের জন্মের ইতিবৃত্ত। ইতিপূর্বে | সামগ্রিকভাবে পানি থেকে জীবন উদ্ভবের বিষয় আলােচিত হয়েছে। মায়ের গর্ভে অবস্থান থেকে শুরু করে পৃথিবীতে দীর্ঘ বা স্বল্প আয়ু-লাভের বিষয় পর্যন্ত সবই এর আওতায় এসেছে। বস্তুত এ সরই আল্লাহর, জ্ঞানের আওতাভুক্ত। ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর বীর্য থেকে…'(আয়াত ১১) মাটি থেকে মানুষের প্রথম সৃষ্টির বিষয়টা কোরআনে বার বার আলােচিত হয়েছে। অনুরূপভাবে মাতৃগর্ভে তার অবস্থানের বিভিন্ন স্তর একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। একটা স্তর, হলাে বীর্য। আর মাটি একটা জীবনহীন উপাদান। তবে বীর্য সজীব উপাদান সর্বপ্রথম আলােচিত ঘটনা হলাে পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব। এটা কিভাবে হলাে এবং কিভাবে প্রথম উপাদানের সাথে মিলিত হলাে, তা কেউ জানে না। মানব জাতির কাছে এটা, এখনাে-এক অজানা রহস্য। অথচ এটা একটা, বাস্তব ও প্রকাশ্য ঘটনা। একে অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই। অপরদিকে এটা যে সেই মহাশক্তিধর জীবনদাতা ও বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং একত্বের নিদর্শন, তাও অস্বীকার করা সম্ভব নয়। নির্জীব থেকে সজীবে স্থানান্তর একটা বিরাট ও সুদূরপ্রসারী স্থানান্তর, যা স্থান ও কালের সকল দুরত্বের চেয়ে বৃহত্তর। যারা বিশ্ব জগতের হতবুদ্ধিকর রহস্যাবলী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে তাদের এ চিন্তা কখনাে শেষ হবে না -এর প্রতিটা রহস্য অপর রহস্য থেকে বৃহত্তর বিস্ময়কর। এরপর শুক্রবিন্দু থেকে নিয়ে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে একটি জীবকোষ কেমন করে পূর্ণাংগ ভ্রুণে পরিণত হয়, তা একবার খেয়াল করুন। আর খেয়াল করুন কেমন করে সেই ভ্রুণের মধ্যে, নর ও নারীর পৃথক পৃথক চিহ্নগুলো পরিলক্ষিত হয়, কিভাবে তাদের আকৃত্তি,প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের হয়, সে দিকে আল কোরআন এই আয়াতের মধ্যে ইশারা, করেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর তিনি তােমাদের জোড়া জোড়া বানিয়েছেন’ এ আয়াতাংশের দুটি উদ্দেশ্য হতে পারে। এক তোমরা যখন ভ্রুন অবস্থায় ছিলে তখনই তিনি ভােমাদের নর নারী বানিয়েছেন; অথবা দুই, একথা দ্বারা এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, যখন তােমরা শিশুরূপে জন্মগ্রহণ করাে তখন নর-শিশু বা নারী শিশুরূপে গ্রহণ করো, অথবা তােমাদের মধ্যে কোনাে এক শিশু নর ও নারী উভয়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শুক্রবিন্দু রূপান্তরিত হয়ে এই দুষ্টু শ্রেণী মানুষে কিভাবে পরিণত হয় তা অবশ্যই এক অতি বিস্ময়কর ব্যাপার। এবারে ভেকে দেখুন, একটি শুক্রবিন্দুর মধ্যে কোথায় লুকিয়েছিলাে সেই জীবকোষটি, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয়ে এক বিশাল বপু ধারী ও নানাবিধ যোগ্যতার অধিকারী মানুষে রূপান্তরিত হলে কেথায় ছিলাে অজানা সেই কোষটি যার মধ্যে নিহিত ছিলাে নানা বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এ সুন্দর মানুষটি? আপনার সন্ধানী দৃষ্টিতে এটাও ধরা পড়বে যে, এই সাধারণ একটি জীবকোষই ভাগ ভাগ হয়ে নিজ নিজ জুড়ির | সাথে মিশে নতুন এক সৃষ্টি হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। বিশেষ বিশেষ অংগ প্রত্যংগের অধিকারী হয় এবং বিশেষ কিছু দায়িত্ব পালন করার উপযোগী হয়ে দিনে দিনে বর্ধিত হতে থাকে। তারপর যে লক্ষ্যে তাকে পয়দা করা হয়েছে তা পূরণ করার জন্যে তার অংগগুলাে পরস্পর সহযােগিতা করে এবং পরিশেষে সে এমন আশ্চর্য ধরনের এক সৃষ্টিতে পরিণত হয় যা বিশ্বের বুকে এমন এমন দায়িত্ব পালন করে যা অন্য কোনাে জীবজন্তু পালন করতে পারে না। এইভাবে সে. সকল সৃষ্টি থেকে পৃথক ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এক সৃষ্টিতে পরিণত হয়। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব মানব শিশু একই ধরনের শুক্রবিন্দু থেকে পূর্ণাংগ মানব আকারে যখন দুনিয়ায় আসে তখন তারা দেখতে পায়, একই প্রকার হলেও মানব শিশু একদিকে যেমন নর ও নারীতে ভাগ হয়ে যায়, তেমনি। প্রত্যেকেই আকৃতি প্রকৃতি ও চেহারা ছবির দিক দিয়ে একে অপর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয় এবং এই বৈশিষ্ট্য এতােই চমকপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ণ যে খেয়াল করলে দেখা যায়, পৃথিবীর এই কোটি কোটি মানুষ, সকল দিক দিয়ে কেউ কারাে সমান নয়, সমান নয় তাদের আকৃতি প্রকৃতি, সমান নয় তাদের মন মানসিকতা, গলার আওয়ায ও রুচিবােধ, সমান নয় তাদের মেজাজ ও ঝোকপ্রবণতা, সমান নয় তাদের চাহিদা ও কর্মক্ষমতা, সমান নয় তাদের বয়স, সমান নয় তারা কোনাে দিক দিয়েই। এতদসত্তেও তারা একে অপরের সম্পূরক হিসাবে জোড়ায় জোড়ায় বাস করে, স্বামী স্ত্রী হিসাবে ঘর সংসার করে এবং তাদের শুক্র দ্বারা অপর আরাে অনেক সৃষ্টি দুনিয়ায় আনতে সক্ষম হয়। এভাবে চলতে থাকলে তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের পথপরিক্রমা এবং এসব পূর্ব নির্ধারিত সৃষ্টির উৎকর্ষ কোনাে সময়েই থেমে থাকে না। বস্তুজগতের মধ্যে সৃষ্টির ক্রমবিকাশের এই যে ধারা তা এতােই অমােঘ ও বৈচিত্র্যময়, যা রােধ করার সাধ্য কারাে নেই। এসব বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যগুলাের দিকে আল কোরআনের বহু জায়গায় ইংগিত দেয়া হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এসব রহস্যপূর্ণ জীবের কথা, যেন মানুষ ধীরস্থিরভাবে এবং অন্তরদৃষ্টি দিয়ে এসবের দিকে তাকায় এবং হৃদয় দিয়ে বুঝার চেষ্টা করে। এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে তাদের আত্মা জেগে ওঠে এবং ওপরে বর্ণিত ঘটনাবলীর চমকপ্রদ ছবি, তার স্রষ্টা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্যে তাকে উদ্বুদ্ধ করে। *সৃষ্টিজগতের সব কিছুই আল্লাহর জ্ঞান দ্বারা পরিবেষ্টিত : এখানে যে বিষয়ের প্রতি ইংগিত করা হলাে তার পাশাপাশি বিশ্ব জাহানে পরিব্যাপ্ত আল্লাহর জ্ঞানভাণ্ডারের ছবি তুলে ধরা হয়েছে (যার বর্ণনা ইতিপূর্বে সূরা সাবায় এসে গেছে)। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জ্ঞানভান্ডার কত ব্যাপক, কত সূক্ষ্ম, কত রহস্যময়, তা বুঝা তখন সহজ হয়ে যায় যখন নারীদের জরায়ু মধ্যস্থিত ভ্রুণ সম্পর্কে একটু গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করা হয়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে বা তার অজান্তে কোনাে মতেই পেটে কোনাে বাচ্চা ধারণ করে না।’ অর্থাৎ, মানুষ থেকে নিয়ে জীবজন্তু, পাখীকুল, মাছ, বুকে হাঁটা প্রাণী সরীসৃপ, কীট পতংগ এবং আমাদের জানা অজানা অন্য সকল প্রাণীই জন্মগ্রহণ করার পূর্বে ডিম্বকোষের মধ্যে অবস্থান করে। এখন প্রশ্ন জাগে, এ ডিম্বকোষ কি? এর জওয়াব হচ্ছে, এ হচ্ছে এক বিশেষ স্থূল পদার্থ, এটার পরিবৃদ্ধি মায়ের শরীরের মধ্যে সম্পূর্ণ হয় না; বরং এটা মায়ের শরীরের মধ্য থেকে ডিম্বকোষ আকারে খসে এসে আলাদা হয়ে যায়, তারপর মায়ের শরীরের বাইরে এসে ভ্রুণ আকারে গর্ভাশয়ের সূতিকাগৃহে অথবা কৃত্রিম অন্য কোনাে সূতিকাগৃহে বাড়তে থাকে এবং অবশেষে পরিণত হয় একটি পূর্ণাংগ ভ্রুণে। তারপর মাতৃদেহের তাপে অথবা অন্য কোনাে কৃত্রিম পদ্ধতিতে এক বিশেষ তাপমাত্রায় রেখে একে তাপ দেয়া হতে থাকলে এই ভ্রুণটি এক সময় স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। এভাবে এই বিশাল বিশ্বের মধ্যে প্রতিপালিত হয় এবং যতাে বাচ্চাই ভূমিষ্ঠ হয়, সবই আল্লাহর জানা। অর্থাৎ সবই তাঁর জ্ঞানের পরিধির মধ্যে রয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অসীম জ্ঞানের এমন ছবি আঁকার মতাে বুদ্ধি কোনাে মানুষের মাথায় আসতে পারে না, এ বিষয়ে তাদের পক্ষে কোনাে ধারণা বা কোনাে ব্যাখ্যা দান করাও সম্ভব নয়। যেমন আমরা সূরা ‘সাবায় ইংগিত দিয়েছি, আল্লাহ জাল্লা শানুহু, তিনিই যে এ মহাগ্রন্থ আল কোরআনের অবতরণকারী, এর প্রমাণ তিনি নিজেই। আর এই যে হৃদয়গ্রাহী বাণী, এর মাধুর্য বা এর চমৎকারিত্ব বিকাশে অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলাের মধ্যে এটাও এক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। এ মহান কালামের ঐশীবাণী হওয়ার ব্যাপারে এক অত্যুজ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে হযরত ওমর(রা.)-এর কাহিনীটি (অর্থাৎ তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত ঘটনটি) চিরদিন মানুষ স্মরণ করতে থাকবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘কোনাে বয়স্ক লােকের বয়স বাড়ানাে বা কমানাে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত (হঠাৎ করে আসে না, বরং) তা লিখিত রয়েছে এক গ্রন্থে (যা সৃষ্টির অনেক পূর্ব থেকেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে), আর এ কাজ আল্লাহর জন্যে বড়ই সহজ…'(আয়াত ১১) অতএব, গাছগাছালি, পাখীকুল, জীব জানেয়ার ও মানুষ- এক কথায় সকল প্রাণিজগতের জন্যে বয়স ও আয়ুকাল সম্পর্কিত নিয়ম নীতি যে সর্বকালে একই থেকেছে ও থাকবে, তা যে কোনাে ভাবুক হৃদয়ে বরাবর অনুভূত হয়েছে ও হবে; তবে হ্যাঁ, সময়ান্তরে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আবহাওয়ার কারণে মানুষের বর্ণে ও ভাষায়, আচার-আচরণে এবং তাদের স্বভাব চরিত্রে কিছু না কিছু পার্থক্য থেকেছে ও থাকবে- এটাই তাে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। অগণিত এ বিশাল মানবগোষ্ঠী, যার সকল অবস্থা একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ জানে না, তাদের যথাযথ সংখ্যা ও প্রয়ােজন এবং সেসব প্রয়ােজন মেটানাের ব্যবস্থা করা, তাদের বয়স ও জীবনকাল নির্ধারণ করা- বাড়ানাে বা কমানাের ক্ষমতা কারও জানা নেই একমাত্র তিনি ছাড়া। তার অসীম ক্ষমতাবলে তিনি এসব কাজ আনজাম দিয়ে থাকেন, তার জ্ঞানভাণ্ডারে নিহিত রয়েছে কে কত দিন বাঁচবে, আর কে কখন কোথায় মৃত্যুবরণ করবে। কে বয়ােবৃদ্ধ হয়ে জীবনকাল শেষ করবে আর কে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। আরও সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে বুদ্ধিমান মানুষ বুঝতে পারবে যে, শুধু পূর্ণাংগ মানুষ বা জীব জন্তুই নয়; বরং প্রতিটি মানুষের শরীরের প্রত্যেকটি অংগ প্রত্যংগ এ কথার সাক্ষ্য বহন করছে, এগুলাের কোনােটির ওপরেই একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই, এমনকি দিগন্তব্যাপী অগণিত বৃক্ষরাজির পত্রপল্লব এ সবারই আয়ুকালও পূর্বনির্ধারিত। কখন কোন চারটি অংকুরিত হবে, দর্শকবৃন্দের কাজল আঁখিকে কতদিন তার কাহিনী শ্যামলিমায় মােহিত করতে থাকবে আর কখনই বা ম্লান হয়ে দৃষ্টির অগােচরে ঝরে পড়বে, এ সকল খবরই অন্তরীক্ষে একমাত্র মহিমাময় প্রভুর জ্ঞানভান্ডারে সুরক্ষিত রয়েছে। চাইলে তিনি তাদের বেঁচে থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে দেন, আবার চাইলে পূর্ণত্বপ্রাপ্তির পূর্বেই তাদের অকালে ঝরিয়ে দেন, সব তাঁরই লীলা। দেখুন না সুউচ্চ সেই আকাশের বুকে উড্ডীয়মান পক্ষীকুলের দিকে, সেখানে পাখনা বিস্তারকারী অথবা পাখনার ঝাপটায় অগ্রসরমান কোনাে পাখীর কোন পাখনা বায়ুর চাপে খসে পড়ছে, যুদ্ধরত কোন পশুর শিং ছুঁচালাে ও অক্ষত অবস্থায় থাকছে আর কোন শিংটি ভেংগে যাচ্ছে, এই যে অসংখ্য মানুষের চোখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন অথবা তার একগুচ্ছ চুলের দিকে তাকান, কোন চুলটি ঝরে পড়বে আর কোনটি মযবুত হয়ে টিকে থাকবে, তা সবই মহান আল্লাহর জানা রয়েছে। এ সব কিছুই একটি গ্রন্থে আল্লাহর সূক্ষ্মাতিসূক্ম জ্ঞানভান্ডারে রক্ষিত রয়েছে। আর এই ভাবে সকল কিছুকে সযত্নে সংরক্ষণ করতে গিয়ে তাঁর কোনাে কষ্ট বা সংকট হয় না। বলা হচ্ছে, অবশ্যই তা আল্লাহর কাছে সহজ। এভাবে যখন ওপরে বর্ণিত বিষয় সম্পর্কে মানুষ চিন্তা ভাবনা করতে থাকে, তার চিন্তাস্রোত যখন আরও প্রখর হয়, তারপর এ চিন্তার বাইরের বিষয়গুলােও যখন সে চিন্তা করে, তখন সে বুঝতে পারে এ দুচিন্তাধারার মধ্যে কত যােজনব্যাপী পার্থক্য, তখনই সে আল্লাহর বিস্ময়কর জ্ঞান সম্পর্কে সম্যকভাবে কিছু আঁচ করতে পারে, আর তখনই সে সত্যের ভাণ্ডারের দিকে কদমে কদমে এমনভাবে এগিয়ে যেতে থাকে যা অন্য কোনাে স্বাধীন চিন্তার মানুষ অনুধান করতে পারে না; তখনই সে বুঝতে পারে, প্রকৃত সত্য জানার জন্যে এই সত্যানুসন্ধিৎসা এবং তার মনের মহাসত্যের ছবি আঁকার এই প্রচেষ্টা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা থেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জিনিস। এ হচ্ছে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ মালিকের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এক বিশেষ বিস্ম্ময়কর প্রক্রিয়া। এভাকে মানুষের বয়স ও জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আদের মধ্যে চিন্তাশক্তির প্রসার ঘটছে ও এগিয়ে চলেছে তাদের জীবন যাত্রার অগ্রগতি। একইভাবে জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে মানুষের আয়ও পূর্বাপেক্ষা বাড়ছে, বাড়ছে তাদের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে আরও বেশী বেশী সম্পদ খরচ করার যােগ্যতা, আরও বেশী সংগঠিত হচ্ছে তাদের চিন্তা চেতনা, তাদের প্রক্রিয়াগত প্রয়াস, কাজ ও প্রভাব বলয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এও দেখা যাচ্ছে যে, সেসব ওসব অঞ্চলে দিনে দিনে মৃত্যুর হার বাড়ছে, অগ্রগতি থেমে যাচ্ছে এবং বেহুদা ব্যয়বেড়ে চলেছে। কম শ্রমে বেশী পাওয়ার আকাংখার প্রসার ঘটছে এবং অলসতা ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার কোনাে কোনাে অঞ্চলে বয়স ও আয় কৃদ্ধির মধ্যে এএক সুষম অবস্থা বিরাজমান রয়েছে। সেসব অঞ্চলে সুসামঞ্জস্যভাবে অগ্রগতি ও জ্ঞান গবেষণার কাজ এগিয়ে চলেছে বিভিন্নমুখী উন্নয়ন কর্মকান্ড এগিয়ে যাচ্ছে এবং তার প্রভাৰ ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের অঞ্চলগুলােতে। আবার কোনাে কোনাে অঞ্চলে এই অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে এবং মানুষ সীমাহীনভাবে এমন সব আমােদ প্রমাদ ও খেলাধুলায় মেতে ওঠছে, যাদের জীবনের সমৃদ্ধির জন্য না রাখছে কোনাে অবদান, না আছে আল্লাহর কাছে তার কোনাে মূল্য। এ সব কিছুই লিখিত রয়েছে এক মহাগ্ৰন্থ (যা সাধারণভাবে দৃষ্টিতে পড়ে না) সব কিছুই এ মহাবিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে বিরাজ কছে, যার খবর একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো কাছে নেই। পৃথিবীতে যভাে মানবগোষ্ঠী বর্তমান রয়েছে আল্লাহর কাছে সেগুলাে সবই কয়েকজন একক ব্যক্তির সমতুল্য, যতো জাতি আছে তারা কয়েকজন মানুষের মতাে তাদের সবাই কেউ অধিক বয়স পায় অথবা অল্প বয়সেই দুনিয়ার খেলা সাংগ করে বিদায় নেয়। আল কোরআন আলােচ্য আয়াতে সে সত্যের দিকেই ইশারা করেছে। কিন্তু আমরা তাে সামান্য মানুষ আমাদের দৃষ্টিতে সকল বস্তুই জীবন্ত প্রাণীর মতাে মনে হয় ব্যক্তিগতভাবে আমার তো মনে হয়, পাহাড় পর্বত থেকে যেসব শিলাখণ্ডের পতন ঘটে এগুলােও জীবন্ত । নির্দিষ্ট এক সময় পর্যন্ত এরা নিজ নিজ স্থানে বিশেষ কিছু ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সে সময় ফুরিয়ে গেলে আল্লাহর ইচ্ছাতেই এগুলাে স্থানচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। গুহাগুলো যেন জীবন্ত, প্রাণপ্রবাহের ছাপ রেখে ছুটে চলেছে আবহমানকাল ধরে কুলু কুলু নাদিনী তুলে। এ সব নদ-নদী অবশেষে মহাসাগরের দিকে ধাবিত হয়ে নিজেদের বিলীন করে দিচ্ছে এবং এভাবেই তারা খুঁজে পাচ্ছে তাদের জীবনের ঠিকানা, এভাবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণায় যেসব শিলার আয়ুষ্কাল অনেক দীর্ঘ, তাদের অনেকগুলাে অচিরেই স্থানচ্যুত হয়ে গড়িয়ে পড়ছে সমতল ভূমির দিকে, আবার কোনাে কোনােটা তদের অনুমিত মেয়াদ-পূরণ করতে পারছে, কোনাে কোনাে গুহা পরিণতি প্রাপ্তির আশায় অপেক্ষমাণ রয়েছে অথবা অনুমিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই হয়তবা ভেংগে অথবা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে কোনাে কোনো নদী আবহমানকাল ধরে উদ্দাম-উচ্ছল গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে, আবার এর কোনাে কোনােটা ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে মরে যাচ্ছে এবং আমরা তাদের গতি হারিয়ে ফেলছে। একবার তাকিয়ে দেখুন এসব বস্তুনিচয়ের দিকে, যা মানুষ তার হাত দিয়ে গড়ে তুলছে বিশালকায় প্রাসাদ অথবা সাদামাটা ছােট ছােট অনাড়ম্বর গৃহ, দীর্ঘস্থায়ী তৈজসপত্র, কলকব্জা অথবা ঠুনকো ও ভংগুর দ্রব্যাদি, টেকসই বস্ত্রাদি অথবা স্বল্পমেয়াদী কাপড় চোপড় এ সব কিছুর জন্যে রয়েছে পূর্বনির্ধারিত অবস্থানকাল, যা সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর এলেমের মধ্যে রয়েছে। সব কিছুই তাদের নিজ নিজ কাজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে মহাজ্ঞানী ও সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকেফহাল বিশ্ব সম্রাটের পরিচালনায়।
*সৃষ্টির বৈচিত্র্যের সাথে মানুষের যােগসূত্র : এভাবে মানুষ যখন বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা রহস্যরাজির দিকে তাকায় তখন তার হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার খুলে যায়, জেগে ওঠে তার সুপ্ত চেতনা, নব নব পদ্ধতিতে তার জীবন দরিয়ায় নেমে আসে অভাবিতপূর্ব এক গতি। আর তখনই প্রাকৃতিক এ সব দৃশ্যরাজি অবলােকনে মােহিত এ সব মানব হৃদয় অনুভব করতে থাকে মহান বিশ্বপতির শক্তি ক্ষমতা এবং তাদের বাহ্যিক চর্মচক্ষু ওসব কিছুর মধ্যে দেখতে থাকে এমন সব সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম, যা সহজে তারা বিস্মৃত হতে পারে না, অবহেলা করতে পারে না, অথবা বিভ্রান্ত হয় না। এমনই এক পর্যায়ে এসে তারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মারেফাত সন্দর্শনে ধন্য হয়, হৃদয় প্রাণ দিয়ে রহমানুর রহীম আল্লাহর দৃষ্টিশক্তির আকাশচুম্বী প্রসারতা অনুভব করে, তার মেহেরবানীর পরশ পেয়ে সে ধন্য হয়, তাঁর সর্বব্যাপী শক্তি ক্ষমতার চেতনায় মুগ্ধ হয়ে যায় গােটা মানব সত্ত্বা। আর তখনই সৃষ্টি বৈচিত্র্যের সব কিছুর সাথে তাদের এক অদেখা যোগসূত্র কায়েম হয়ে যায়। এই ভাবে আল কোরআন মানব হৃদয়ে তার নির্দিষ্ট আসন প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশ্বের এই বিশাল ক্ষেত্রের দিকে তাকালে যে সব রহস্যরাজি চোখকে ধাধিয়ে দেয় সেগুলাের মধ্যে সকল সৃষ্টির জন্যে অপরিহার্য এক বন্ধু হচ্ছে পানি। কিভাবে এই পানি সৃষ্টি হয় তার দিকে খেয়াল করলে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। এই পানির প্রকারভেদ ও বিচিত্র পর্যালােচনা মানুষকে মুগ্ধ করে, যেমন এক দিকে দেখা যায় মিষ্টি পানি, অপরদিকে রয়েছে এমন লবণাক্ত পানি যে গলার নীচে যেতে চায় না। সাগর মহাসাগরের মধ্যে শুধু নয়, নদীতেও দেখা যায় লােনা ও মিষ্টি পানির ধারা পাশাপাশি প্রবাহিত হচ্ছে, একটি ধারা অপর ধারার মুখােমুখি রয়েছে, কিন্তু পরস্পর মিশে যাচ্ছে। কে সেই শক্তিমান যার ইচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণ মানতে বাধ্য হচ্ছে এই তরল পদার্থদ্বয়? তিনিই আল্লাহ রব্বুল আলামীন যিনি অন্যান্য সব কিছুর মতাে এগুলােকেও নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারই ইচ্ছায় একটি আর একটির সাথে মিশতে পারছে না। আর তারই মেহেরবানীতে এ দুটি ধারা পৃথকভাবে মানুষের খেদমত করে চলেছে। তাই এরশাদ হচ্ছে ‘(পানির দিকে তাকিয়ে দেখাে, সেখানেও) দুটো সমুদ্র এক সমান নয়, একটির পানি সুমিষ্ট…কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারবে'(আয়াত ১২) পানি সৃষ্টির ব্যাপারে যখন চিন্তা করা হয় তখন বিভিন্ন প্রকার পানি বানানের ইচ্ছা কেন করা হলাে তা তাে বুঝা যাচ্ছে। অবশ্যই এর মধ্যে রয়েছে এক বিশেষ যুক্তি বুদ্ধি, যেমন আমরা এর বাহ্যিক অবস্থা দেখে কিছুটা বুঝতে পারি। মিঠা পানি তৃপ্তি সহকারে পান করা যায় এবং অত্যন্ত সহজে ও আরামের সাথে এই সুপেয় বস্তুটি গলার মধ্য দিয়ে দেহের মধ্যে প্রবেশ করে। এভাবে এই মিঠা পানির সদ্ব্যবহার করা হয় এবং আমাদের জীবনকে সচল ও কর্মঠ বানিয়ে রাখার জন্যেই যে এ পদার্থটি সৃষ্টি করা হয়েছে তা বেশ বুঝা যায়। সুতরাং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টি কৌশলের নেয়ামত আমরা ভােগ করে চলেছি, এ মহা নেয়ামত দ্বারা আমাদের উপকার হচ্ছে এবং এর দ্বারা আমরা অশেষ উপকারও পাচ্ছি। তিনিই সকল প্রাণীর পরিচালক। আবার যখন সাগর মহাসাগরের লােনা ও তিক্ত স্বাদযুক্ত পানির কথা চিন্তা করা হয় তখন হয়রান হয়ে যেতে হয়, কেন এ বিশাল লােনা বারিধির আয়ােজন! এ বিস্ময়কর বিশ্বের গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন বিজ্ঞানী বলছেন-[দেখুন, নিউইয়র্ক সায়ন্ত একাডেমীর চেয়ারম্যান বিজ্ঞানী ক্রাসী মরিসন রচিত ‘ম্যান ক্যান নট লিভ এলােন’ গ্রন্থটি মাহমুদ সালেহ আল ফালাকী ‘আল ইলমু ইয়াদউ ইলাল ঈমান’ নাম দিয়ে এর আরবী অনুবাদ প্রকাশ করেছেন] ‘আবহমানকাল ধরে পৃথিবীর পেটের মধ্যে থেকে যে গ্যাস ওঠে আসছে, যার বেশীর ভাগই হচ্ছে বিষাক্ত এবং মানুষের জীবনের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর, এতদসত্তেও একটা বিশুদ্ধ বায়ু অবশিষ্ট থেকে যাচ্ছে যা মানুষের জীবন যাপনের জন্যে প্রয়ােজন। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ থেকে আসা গ্যাস বাতাসকে সংক্রমিত করা সত্তেও এতাে বিপুল পরিমাণ বিশুদ্ধ বায়ু দূষণমুক্ত থেকে যাচ্ছে যা মানুষ ও সকল জীবজন্তুর শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করার জন্যে যথেষ্ট এবং পরিপূর্ণ ভারসাম্যপূর্ণভাবে সেই পরিমাণে গ্যাস বের হচ্ছে, যা সকল প্রাণীর ব্যবহার ও পানোপযােগী পানিকে বিশুদ্ধ রাখতে পারে। এ গ্যাসের দ্বারাই প্রস্তুত এই সাগর মহাসাগর ও নদ নদী। এ সবের মধ্যে এতােটা ভারসাম্যপূর্ণভাবে মিঠা পানি ও লােনা পানির সরবরাহ আসছে যেন প্রয়ােজনীয় সকল প্রকার গাছপালা উৎপন্ন এবং সব জীব-জন্তুর প্রয়োজন মেটে।’ এইভাবে আমাদের সামনে সৃষ্টির রহস্যভান্ডারের কিছু জট খুলছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি সব কিছুর মধ্যে এক আশ্চর্য রকমের যােগসূত্র ও ভারসাম্য রয়েছে। দেখতে পাচ্ছি সবাই যেন পরস্পরের প্রয়ােজনে কাধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং এর কাউকেই বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করা যায় না, কারাে অস্তিত্বই এককভাবে কল্পনা করা যায় না। এইভাবে সব কিছুকে পারস্পরিক নির্ভরশীল করে পয়দা করা এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সবাইকে পরিচালনা করা, একমাত্র বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব। তিনি সবাইকে ও সব কিছুকে তার অদৃশ্য হাত দ্বারা পরিচালনা করছেন। তার এই সূহ্ম পরিচালনার পথে কেউই কোনাে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না, কেউ এটা মনে করতে পারে না, এ সব কিছুই আকস্মিক কোনাে ঘটনার ফল। এরপর, এ দুধরনের সাগরের মধ্যে বিরাজমান পার্থক্য দ্বারা এটা প্রতীয়মান হয় যে, এ পার্থক্যের প্রয়ােজন রয়েছে এবং এ পার্থক্য আপনা থেকেই হয়ে যায়নি; বরং এ সব পার্থক্য সৃষ্টিকর্তার অপার করুণারই বহিপ্রকাশ। এর মধ্যেই রয়েছে সৃষ্টিকুলের নানাবিধ কল্যাণ। আলােচ্য সূরার মধ্যে আরও কিছু ইংগিত আসবে, যা দ্বারা চেতনাশীল লােকদের কাছে এ মহাবিশ্বে বিরাজমান জীবজন্তু ও বিষয় আশয় সম্পর্কে এবং তাদের পয়দা করার পেছনে যে এক মহৎ উদ্দেশ্য সক্রিয় রয়েছে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠবে। এরপর জানানাে হচ্ছে, এই ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির সাগর দুটোর স্রোতধারাগুলােকে মানুষের প্রয়ােজনেই এইভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর এদের প্রত্যেকটি থেকেই তােমরা টাটকা ও তরতাজা গােশত সংগ্রহ করে আহার্য হিসাবে ব্যবহার করছ এবং বের করছ এগুলাে থেকে অলংকার হিসাবে ব্যবহার করার উপযােগী বহু মণিমুক্তা (যা তােমরা পরিধান করাে), আর তােমরা দেখে নৌযানগুলো, যা মহা বারিধির বুক চিরে চিরে এগিয়ে যায় গন্তব্য পথে।’ এখানে তাজা গােশত বলতে সামুদ্রিক মাছকে বুঝানাে হয়েছে, আবার কেউ কেউ সাগরের জীবজন্তুও বুঝিয়েছেন।[মাছ ও পানির মধ্যে অবস্থিত জীব-জন্তুর গোশত এবং স্থলভাগের জীবজন্তুর গােশতের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে। হাঁ, খাদ্য হিসেবে আল্লাহ তায়ালা গােশত (লাহম) শব্দটি যখন ব্যবহার করেছেন তখন বুঝতে হবে, মাছের প্রকৃতি থেকে ভিন্ন পানির মধ্যে অবস্থিত অন্য প্রাণীও হালাল। এই মত পােষণকারীরা সকল সামুদ্রিক প্রাণীর গােশত খাওয়ার পক্ষপাতী নন, যেহেতু সেগুলাের মধ্যে হিংস্র পশুর স্বভাব বিরাজ করে, আর যেহেতু মানুষ যা খায় নিজের অজান্তেই তার প্রকৃতি গ্রহণ করে। এ জন্যেই সচেতন মুসলমানরা সমুদ্রের হিংস্র প্রাণী, যেমন হাংগর, কুমির ইত্যাদির গোশত ভক্ষণ করে না। অপরদিকে, সামুদ্রিক কচ্ছপের গোশত অনেকটা গরুর গোশতের মতই স্বাদযুক্ত; বরং গরুর গোশত থেকেও একটু বেশী মিষ্টি স্বাদযুক্ত, কিন্তু যেহেতু পুকুর বা নদীর ক্চ্ছপের মতাে এগুলাে কামড়ায় না- এ জন্যে এগুলাের গােশত খাওয়া নিসন্দেহে হালাল। আলােচ্য আয়াতে এবং কোনাে কোনাে হাদীসে সম্ভবত এমনই সকল ছােট বড়াে সামুদ্রিক জীবের গোশত ভক্ষণ করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। (অবশ্য কচ্ছপ হালাল হওয়ার ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে -সম্পাদক)] আর সামুদ্রিক বিভিন্ন পদার্থকে অলংকার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যেমন ছােট বড় আকারের মুক্তা এবং সুদর্শন সামুদ্রিক পাথর। লুলু বলতে বুঝায় সেসব মূল্যবান পাথর যা অত্যন্ত মূল্যবান এবং যার রং পরিবর্তন হয় না। এগুলাে পাওয়া যায় নানা আকার আকৃতি ও নানা বর্ণের সামুদ্রিক শামুকের মধ্যে। এ মূল্যবান পাথর সেসব শামুকের দেহের মধ্যেই পয়দা হয়। এগুলাে বালুকণার মতাে ক্ষুদ্র, আবার কখনাে পানির ফোটার মতাে বৃহৎ আকারের হয়ে থাকে। তারপর এই শামুকের দেহ পরিবর্তিত হয়ে যায়। বাহ্যিক অবয়ব একটি বিশেষ স্খলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খসে পড়ে এক শিলাখন্ডের মধ্যে প্রবেশ করে এবং সেখানে নতুন এক অবয়ব ধারণ করে, যাকে সে সামুদ্রিক শিলাখন্ডটি ঘিরে রাখে যেন অত্যন্ত ধীর গতিসম্পন্ন সে শামুকটি অন্য কিছু দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। এরপর এক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ খােলসমুক্ত শামুকের দেহটি শক্ত হয়ে যায়, এরপর সে শামুকের মধ্যে মুক্তা তৈরীর কাজ শুরু হয়। তারপর আসছে ‘মারজান’-এর গঠন প্রক্রিয়ার বিবরণ । এটা হচ্ছে এক জ্যান্ত ঝোপঝাড় জাতীয় বৃক্ষ, যা সমুদ্রের অভ্যন্তরে পয়দা হয় এবং মাইলের পর মাইল ব্যাপী ছড়িয়ে থাকে। এগুলাে এতাে বেশী পরিমাণে সমুদ্র গর্ভে বিস্তৃত থাকে যে, কখনও কখনও নাবিকদের জন্যে এগুলাে বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, সামুদ্রিক মাছ ও জীবজন্তু যাইই এই ঝোপ বৃক্ষের মধ্যে প্রবেশ করুক না কেন, সেখানে চরম বিপদে পড়ে যায়, তারপর সেখান থেকে বেরােনাের জন্যে বিশেষ বিশেষ পথ খুঁজে বের করে এবং লতাপাতা জাতীয় কিছু অলংকার নিয়েই বেরােয়। এগুলোকেই বলা হয় মারজান। আর বিরাটকায় নৌযানসমূহ সাগর নদীর বুক চিরে দেশ থেকে দেশ-দেশান্তরে এগিয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে আল্লাহরই ইচ্ছাতে এবং পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তক্রমে কোনাে কোনাে জাহাজ ভেংগে চুরমার হয়ে যায়। পানির ওপর এতাে বড় বড় জাহাজ ও নৌকাগুলাে যে ভেসে থাকে তার কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝা যায় যে, পানির মধ্যে অবস্থিত বিশেষ ঘনত্ব এবং আরও কিছু এমন উপাদান আছে, যা এই বিশালকায় জাহাজগুলােকে পানির ওপর ভাসিয়ে রাখে এবং তার ওপর দিয়ে চলাচল করতে সাহায্য করে। অনুরূপভাবে বাতাসের মধ্যেও আছে এমন সব বহু উপাদান, যা দিবানিশি মানুষের খেদমত করে যাচ্ছে। প্রকৃতির বুকে আরও বহু শক্তি মানুষের খেদমতে নিয়ােজিত রয়েছে, যেমন বাম্পশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি ইত্যাদি। এসব কিছুই মানুষের খেদমতের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রিত ও নিয়ােজিত রয়েছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যাতে করে তােমরা তাঁর মেহেরবানী লাভ করার জন্যে চেষ্টা করতে পারাে…।’ অর্থাৎ সফর ও বাণিজ্য কাজের মাধ্যমে, তরতাজা গােশত ও অলংকার দ্বারা উপকৃত মাধ্যমে এবং নদীর পানির ওপর দিয়ে নৌযানসমূহ দেশ দেশান্তরে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তােমরা যেন তার মেহেরবানী লাভ করতে পারাে। আর যেন তােমরা শোকরগুজারী করতে পারো। আর অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় উপকরণ তােমাদের জন্যে সহজ করে দিয়েছেন এবং সেসব উপকরণ একেবারে তােমাদের সামনে তােমাদের দোরগােড়ায় পৌছে দিয়েছেন। এরপর রাত ও দিনের আনাগােনার দৃশ্য পেশ করে বিশ্ব পরিক্রমার এই পর্যায়টি সমাপ্ত করা হচ্ছে। তারপর জানানাে হচ্ছে যে, এক নিয়মের অধীন সুনির্দিষ্ট এক সময় পর্যন্ত সূর্য ও চাঁদকে পরিচালনা করা হচ্ছে। এ নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনাে ক্ষমতাই তাদের নেই। তাই এরশাদ হচ্ছে , ‘তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং প্রবেশ করান দিনকে রাত্রির মধ্যে এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়ন্ত্রণ করেন, এদের প্রত্যেকেই সুনির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত এক সময় পর্যন্ত ডিউটি পালন করে চলেছে ও চলতে থাকবে।’ দিনের মধ্যে রাতকে এবং রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করানাে, এ দুটি বড়ই চমকপ্রদ দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। একবার অন্তরের চোখ দিয়ে এ দুটি দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে দেখুন, দেখুন এ ছবিটির দিকে, কেমন করে অন্ধকার রাত দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে এবং কেমন করে আঁধারের পর্দা চিরে পূর্ব দিগন্তে আলাের আভা ফুটে ওঠে। আবার দেখুন, পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম দিগন্তের দিকে, কেমন করে দিনের সমুজ্জ্বল আলাে ক্রমান্বয়ে ম্লান হয়ে আসে, কেমন করে আঁধারের পর্দা চতুর্দিকে প্লাবিত হয় এবং অবশেষে প্রবল প্রতাপান্বিত দিবাকর ধীর পদক্ষেপে অস্তাচলে চলে যায়। আবার তাকিয়ে দেখুন, রাত্রির মধ্যে দিনের প্রবেশের দৃশ্যের দিকে যখন প্রভাতবেলা শ্বাস ফেলতে শুরু করে এবং একটু একটু করে ঘন্ধকারের নিকষ কালাে পর্দা অপসারিত হতে থাকে, আর ধীরে ধীরে সকাল বেলার শুভ্র সমুজ্জ্বল আলাের মেলা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অবশেষে উদিত হয় তেজোদীপ্ত সূর্য বীরবিক্রমে এবং চতুর্দিকে তার অনিরুদ্ধ আলাের বন্যায় প্লাবিত করে দেয়। এমনিভাবে আলােচ্য আয়াতের আর একটি অর্থ করা হয়েছে। অর্থাৎ, শীতকালে যখন রাতের সময় দীর্ঘায়িত হয়ে যায়, তখন সে যেন দিনের বরাদ্দকৃত সময় কিছুটা খেয়ে ফেলে এবং এইভাবে যেন সে দিনের সীমারেখার মধ্যে ঢুকে পড়ে। আবার গ্রীষ্মকালে যখন দিন বেড়ে যায় তখন সেও যেন রাত্রির সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে তার হিসসা কিছুটা খেয়ে ফেলে। এমনি করে তারা যেন একই নিয়মে একে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। এই উভয় দৃশ্যই ভাবুক হৃদয়ে চিন্তা জাগায়, কখনও সে এসব চমৎকার দৃশ্যের প্রভাবে তার হৃদয়ে পরম প্রশান্তির পরশ অনুভব করে, আবার কখনও এসব কিছুর শক্তিমান পরিচালকের অপ্রতিরােধ্য ক্ষমতা সন্দর্শনে তার হৃদয়ে জাগে তার সম্পর্কে এক প্রবল ভীতি ও তার হুকুমে বাছ বিচার করে চলার এক তীব্র অনুভূতি। কারণ এসব কিছুর মাধ্যমে সে যেন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের শক্তি ক্ষমতাকে বাস্তবে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে থাকে এবং তারই ক্ষমতাবলে অন্য দৃশ্যটি যা গুটিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে তাও সে দেখে- এইভাবে সে যেন দেখে একটি সূতা ছাড়া হচ্ছে এবং অপরটি গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং কখনও অপরটি ছাড়া হচ্ছে এবং এইটিকে গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব কিছুই সংঘটিত হচ্ছে এক সূক্ষ্ম ও সর্ববিজয়ী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে, যা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কেউ বদলাতে পারে না, বিলম্বিত অথবা ত্বরান্বিতও করতে পারে না। এ নিয়ম শৃংখলার মধ্যে নেই কোনাে অস্থিরতা, নেই কোনাে পেরেশানী। আর যুগ যুগ ধরে কোনো সময়েই এবং কখনও এমন হয়নি যে, এ নিয়ম শৃংখলার মধ্যে এতােটুকু চিড় ধরেছে, এসেছে কোনাে প্রকার ব্যতিক্রম বা বিভিন্নতা। বছরের পর বছর ধরে সদা সর্বদা এই একই নিয়ম সর্বদা বিরাজমান রয়েছে। আবার সূর্য ও চাঁদকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি এবং তাদের নির্ধারিত এক সময় পর্যন্ত চলতে থাকার বিধানের দিকে দেখুন, আর এ বিষয়ের দিকেও যে, এদের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এ সব বিষয়ে আর কেউ কিছুই জানে না… তিনিই শেষ (অর্থাৎ তার ওপরেই সব কিছুর পরিসমাপ্তি)। এটা এমনি এক সত্য, যা সকল মানুষই সর্বদা দেখছে (অর্থাৎ পৃথিবীতে তিনি ছাড়া আর কেউই অমর নয়, এটা কে না জানে)। তারা হয়ত জ্যোতির্মন্ডলের এই দুই সত্ত্বাকে দেখে এবং এদেরই মতাে আকাশমন্ডলীতে অবস্থিত তারকারাজি, তাদের কক্ষপথ ও সেই কক্ষপথে পরিভ্রমণ করা সম্পর্কে চিন্তা করে, আরও হয়ত চিন্তা করে এসব জ্যোতিষ্কের অস্তিত্বের মেয়াদ সম্পর্কে অথবা এসবের কোনােটারই কোনাে কর্মকান্ড সম্পর্কে কিছুই বুঝে না… আসলে আকাশের মধ্যে দৃশ্যমান এ দুটি সত্ত্বা ও তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে যেমন প্রকাশ্যভাবে কিছু বুঝা যায়, তেমনি এ দুটি সত্ত্বার আরাে কিছু ব্যাপার আছে যা মানুষের দৃষ্টি ও চিন্তার অন্তরালে রয়ে গেছে। সকল দৃষ্টিতেই এদের উদয় ও অস্ত যাওয়ার বিষয়টি বর্তমান রয়েছে। এদের অবিরাম গতিতে চলতে থাকার নেই কোনাে বিরতি বা এদের গতি কোনাে সময় থেমে যায়নি, এটা এতাে বড় এক সত্য যা বুঝার জন্যে বেশী কোনাে জানা বা চিন্তা ভাবনার প্রয়ােজন হয় না। আর এভাবেই এ চাঁদ সুরুজের গতি থেকে এমন এক সত্য বুঝা যায় যা সকল যামানার সকল মানুষের জন্যে সমানভাবে বােধগম্য। আল কোরআন যখন নাযিল হয়, তখনকার তুলনায় আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে আমরা এ সত্যটিকে আরাে অনেক গভীরভাবে বুঝতে সক্ষম হচ্ছি, এজন্যে একথাটা বুঝা এ পর্যায়ে প্রধান বিষয় নয়। আসল যে বিষয়টি বুঝার জন্যে আমাদের আহ্বান জানানাে হচ্ছে তা হচ্ছে তাদের কাছে ওহীর মাধ্যমে যা কিছু পাঠানাে হয়েছিলাে, আমাদের কাছেও অবিকল সেসব জিনিসই পৌছে গেছে, তাদের অন্তরগুলােকে যেসব বিষয় নাড়া দিতাে সেসব বিষয় দ্বারা আমাদের অন্তরও আন্দোলিত হওয়া উচিত। আজ আমাদের অন্তরও আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বিস্ময়কর ক্ষমতা অবলােকনে বিমুগ্ধ হওয়া উচিত। যেহেতু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের শক্তি ক্ষমতার হাত চিরদিনের মতাে আজও সবখানে একইভাবে প্রসারিত হয়ে রয়েছে। আর সত্যিকারে বলতে গেলে, মানুষের অন্তরের জীবনই আসল জীবন।। এ বিভিন্ন প্রকারের দৃশ্য হৃদয়ের ওপর গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং এসব কিছুর মালিক ও প্রতিপালক সম্পর্কে অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তি প্রমাণ পেশ করে আমাদের জানায়, এসব কিছুর ওপরই সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতা পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, যিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, আরাে জানায় যে, শিরকের যতাে দাবীই করা হয়ে থাকে তা সব কিছুই মিথ্যা এবং এসব অলীক জিনিসের উপাসকদের জন্যে রয়েছে কেয়ামতের দিনে শুধু ক্ষতিই ক্ষতি। এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই রাতকে দিনের ভেতর এবং দিনকে রাতের ভেতর প্রবেশ করান, তিনি (তােমাদের সুবিধার জন্যে) সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন, এরা সবাই… অন্য তােমাকে কেউই কিছু অবহিত করতে পারবে না।'(আয়াত ১৩-১৪) তিনিই তােমাদের আল্লাহ, আর একমাত্র তিনিই তােমাদের রব প্রতিপালক মালিক মনিব প্রভু ও শাসনকর্তা, যিনি মেঘমালা বহনকারী বাতাস পাঠিয়েছেন এবং মরে যাওয়ার পর পৃথিবীকে পুনরায় যিন্দা করেছেন, যিনি তােমাদের মাটি দ্বারা পয়দা করেছেন, যিনি তোমাদের জোড়া জোড়া হিসাবে বানিয়েছেন, একমাত্র তিনিই জানেন গর্ভবতী মহিলারা তাদের গর্ভে কি ধারণ করে এবং কি জন্ম দেয়, আর যিনি জানেন কে অধিক বয়স পায় এবং কার বয়স কমিয়ে দেয়া হয়। যিনি সৃষ্টি করেছেন দু’ধরনের সমুদ্র, যিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে প্রবেশ করান রাতের মধ্যে, যিনি সূর্য ও চাঁদকে তার আয়াত্তাধীনে রেখেছেন ও চিরদিন নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন, এরা এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত গতিসম্পন্ন রয়েছে… হাঁ, সেই সত্তাই তিনি আল্লাহ তায়ালা ‘তােমাদের রব’। *সবকিছুর ওপরই আল্লাহর ক্ষমতা পরিব্যাপ্ত : ‘তাঁরই বাদশাহী- সকল কিছুর ওপর একমাত্র তারই শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত। তাকে বাদ দিয়ে তােমরা সাহায্যের জন্যে যাকেই ডাক না কেন এবং যে জিনিসের কাছেই নিজেদের সােপর্দ করাে না কেন, সে সব কিছুই বাতিল মিথ্যা। তারা খেজুরের আঁটির ওপর অবস্থিত তুচ্ছ পাতলা ঝিল্লি মালিকও হতে পারে না। কিতমীর শব্দটির অর্থ হচ্ছে খেজুরের আঁটির পাতলা ঝিল্লির খােলস; অর্থাৎ আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ওরা সাহায্যের জন্য ডাকে তারা অন্য কিছুর মালিক হওয়া তাে দূরের কথা, এ তুচ্ছ ঝিল্লির খােলসের মালিক হওয়ারও যােগ্য নয়। তারপর ওদের প্রকৃত অবস্থা পরীক্ষা করে দেখতে বলা হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি ওদের ডাকো, ওরা তােমাদের ডাক শুনতে পাবে না।’ কারণ ওরা হয়তাে পাথরের তৈরী মূর্তি অথবা কাঠ-খড় মাটি দিয়ে তৈরী পুতুল, অথবা গাছ, তারকারাজি বা গ্রহ উপগ্রহ অথবা ফেরেশতা অথবা জ্বিন… আর খেয়াল করলে ওরা অবশ্যই বুঝবে যে, এদের কেউই প্রকৃতপক্ষে খেজুর দানার উপরস্থ তুচ্ছ আবরণীরও মালিক নয়, আর এরা কেউই তাদের এ ভ্রান্ত ও স্বকল্পিত দাসদের কথা শুনতে পায় না; আসলেই ওরা কেউ শোনার ক্ষমতা রাখে না অথবা মানুষের কথা শােনে না। আর যদি ওদের কেউ কেউ শুনতে পায়ও তবু তারা কোনাে জওয়াব দেয় না, জওয়াব দেয়ার ক্ষমতাও রাখে না। যেমন জ্বিন ও ফেরেশতাদের অবস্থা। জ্বিন জাতি জওয়াব দেয়ার ক্ষমতা রাখে এবং ফেরেশতারা ভ্রান্ত মানুষের জওয়াব দেয় না বা ডাকে সাড়া দেয় না। দুনিয়ার জীবনে এই হচ্ছে তাদের অবস্থা। অতপর কেয়ামতের দিন ওরা এসব ভুল পথ ও ভুল পথের পথিকদের থেকে সম্পূর্ণভাবে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘কেয়ামতের দিন ওরা তােমাদের এই শিরক (অর্থাৎ শক্তি ক্ষমতায় আল্লাহর সাথে তাদের কিছু অংশ আছে বলে তােমরা যে মনে করবে) সে কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করবে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন সকল বিষয়ে খবর রাখেন এবং সবজান্তা হওয়ার পজিশনে থেকেই তিনি সর্ববিষয়ে মানুষকে জানাচ্ছেন, জানাচ্ছেন দুনিয়া ও আখেরাত সম্পর্কে। ‘আর তার মতাে এইভাবে কেউ তােমাকে জানাবে না।’ এসব বক্তব্য পেশ করার পর আলােচনার এ অধ্যায়টি শেষ হচ্ছে এবং সমাপ্ত হচ্ছে এই পরিক্রমা ও সারাবিশ্বের বুকে অবস্থিত সকল কিছুর রােজনামচা। অতপর আলােচ্য বিষয়গুলাে থেকে মানব হৃদয় এমন এক জ্ঞানের ভান্ডার লাভ করছে যা তাকে তার জীবনের মৌলিক বিষয়গুলাে বুঝতে সাহায্য করছে এবং এসব পার্থিব জীবনেও তার উপকারে আসছে। আর এটা জোর করেই বলা যায়, বিশ্ব রহস্য ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলােচ্য এই একটিমাত্র সূরাতে যেসব কথা এসেছে এবং আল্লাহকে চেনার ব্যাপারে এবং তার শক্তি ক্ষমতা বুঝার ব্যাপারে যে সব বিবরণ দেয়া হয়েছে, তা যে কোনাে সত্যানুসন্ধিৎসু বা হেদায়াতপ্রার্থীর জন্যে যথেষ্ট, তাদের জন্যেও যথেষ্ট যারা দলীল প্রমাণ পেতে চায়!
# এরশাদ হচ্ছে, ‘হে মানুষ, তােমরা সবাই আল্লাহ তায়ালার মুখাপেক্ষী, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা (তােমাদের কারােই মুখাপেক্ষী নন) তিনি সম্পূর্ণ… কঠোরভাবে পাকড়াও করেছি। (ইতিহাস খুলে তােমরা আজ দেখে নাও তাদের জন্যে) আমার আযাব কতাে ভয়ংকর ছিলাে!’ (আয়াত ১৫-২৬) আবারও জনগণকে উদাত্ত কণ্ঠে আহবান জানানাে হচ্ছে, যেন তারা আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটির দিকে আর একবার গভীরভাবে খেয়াল করে দেখে নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা করে এবং কোন অবস্থার সম্মুখীন সে হতে চলেছে সে বিষয়ে বুঝার জন্যে ধীরস্থিরভাবে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তারা যেন রসূলুল্লাহ(স.)-এর দিকে তাকায় এবং দুনিয়ার সুখ সৌন্দর্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে একবার ভেবে দেখো যে, জেনে বুঝে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল পথে চলার পরিণতি কি সাংঘাতিক হতে পারে যেমনটি তাদের সামনে এ সূরার দ্বিতীয় অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ইংগিতে আর একটি অতিরিক্ত কথা বলা হয়েছে যে, হেদায়াতের প্রকৃতি গােমরাহীর প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, আর এ দুয়ের মধ্যে অত্যন্ত গভীর ও মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যেমন পার্থক্য রয়েছে ভালাে চোখ ও খারাপ চোখ, অন্ধকার ও আলাে, ছায়া ও রৌদ্র এবং জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে। গভীর দৃষ্টি দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখুন, কেমন চমৎকার সাদৃশ্য রয়েছে সত্য সঠিক পথের সাথে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন চোখের, খররােদ ও স্নিগ্ধ ছায়ার। আর জীবন তাে হচ্ছে এ সবের মধ্যে এক সাধারণ বিষয় এবং তুলনা করার মাধ্যম। যেমন সাদৃশ্য রয়েছে অন্ধত্ব ও অন্ধকারের মধ্যে, রৌদ্র ও মৃত্যুর মধ্যে। এই উভয়বিধ অবস্থার মধ্যে যেমন রয়েছে মিল, তেমনি যেন রয়েছে এদের মাঝে এক অদেখা সম্পর্ক। তারপর হুশিয়ার করা ও ভীতি প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে মিথ্যাবাদী ও মিথ্যা আরােপকারীদের পরিণতির দিকে ইশারা করার সাথে সাথে এ অধ্যায়ের আলােচনা সমাপ্ত করা হয়েছে। ‘হে মানবমন্ডলী, তােমরাই অভাবগ্রস্ত এবং আল্লাহর মুখাপেক্ষী, আর অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা অভাবমুক্ত, চির প্রশংসিত…’ হেদায়াতের দিকে আহ্বান জানানাের প্রয়ােজনে এই সব সত্য কথা সত্য তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে অবশ্যই মানুষকে উপদেশ দেয়া একান্ত দরকার। এ সব তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে মানুষকে অন্ধকার থেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত আলাে ও তার হেদায়াতের দিকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। তাদের উপদেশ দান করা এ জন্যেই জরুরী মনে করা হয়েছে যে, আসলে তারা তাে অভাবী, সব কিছুর জন্যে আল্লাহর মুখাপেক্ষী, আর মহান পরওয়ারদেগারই হচ্ছেন সকল প্রকার অভাব অভিযােগ এবং সমস্ত সংকট সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আরও খেয়াল করুন, যে সময়ে তাদের আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে এবং তারই এবাদাত ও তার নেয়ামতসমূহ লাভ করায় তার প্রশংসা করতে আহ্বান জানানাে হচ্ছে, ঠিক সেই একই সময়ে তাদের জানানাে হচ্ছে যে, তিনি তাদের যাবতীয় কর্মকান্ড থেকে পরন্মুখ। কেউ কিছু করলেই কি, আর না করলেই বা কি, কোনাে অবস্থাতেই তাঁর কোনাে ক্ষতি বৃদ্ধি নেই। মহান আল্লাহ তিনি, তিনি আপন গরিমায় গরীয়ান, নিজের গুণাবলীতে তিনি চির অম্লান, চির পরিশুদ্ধ। ওরা কোনাে অবস্থাতেই তাকে (কোনাে ব্যাপারেই) অক্ষম করতে পারে না, পারে না তার ওপর কোনাে প্রকার প্রাধান্য বিস্তার করতে। তিনি তাে চাইলে যে কোনাে মুহূর্তে ধরাপৃষ্ঠ থেকে তাদের মুছে ফেলতে পারেন এবং তাদের স্থলে অনায়াসে ও অবলীলাক্রমে তাদেরই মতাে একই মানবগােষ্ঠী থেকে নতুন আর এক সৃষ্টি নিয়ে আসতে পারেন, অথবা অন্য কোনাে শ্রেণীকেও পৃথিবীতে তাদের স্থলাভিষিক্ত করাতে পারেন, আর এটা আল্লাহর কাছে বড়ই সহজ কাজ। মানুষের পক্ষে এ সব বাস্তবতার নিরিখে অবশ্যই একটু চিন্তা করা দরকার, যাতে তার ঘাড়ে অহংকার সওয়ার না হয়ে যায়। আর কি করে তাদের অন্তরে আত্মম্ভরিতা পয়দা হতে পারে যখন তারা বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত দেখতে পাচ্ছে, প্রত্যক্ষ করছে সকল ক্ষেত্রে তারই কৃতিত্ব। তিনি তাদের কাছে তার বার্তাবাহক পাঠাচ্ছেন এবং সে রসূলরা তাদের গােমরাহী থেকে হেদায়াতের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন এবং অন্ধকার থেকে তাদের আলাের দিকে টেনে তুলছেন। এতদসত্তেও এমনভাবে তাদের ওপর নিজেদের বড়ত্ব প্রদর্শনের খায়েশ সওয়ার হয়ে যাচ্ছে যে, তারা নিজেদের আল্লাহর ওপর বিরাট কিছু ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু তারা একটুখানি চিন্তা করে দেখে না যে, আসলে তারা হেদায়াত গ্রহণ করলে অথবা তার এবাদত বন্দেগী করলে আল্লাহর কোনাে উপকার হচ্ছে কি না। মহান আল্লাহ, তিনি তাে নিজ ক্ষমতাবলে বলীয়ান, আপন মহিমায় অনন্য। কেউ তার কথা শুনলেই বা কি আর না শুনলেই বা কি, তিনি তাঁর নিজ ক্ষমতায় চির অম্লান, তিনি সর্বপ্রকার অভাব অভিযােগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, তিনি তাঁর কৃতিত্বের কারণে চির প্রশংসিত। অবশ্যই আল্লাহ রব্বুল আলামীন বান্দাদের প্রতিনিয়তই ছাড় দিয়ে চলেছেন এবং তাদের ওপর তার নেয়ামতের বারিধারা বর্ষণ করে চলেছেন, তাদের কাছে অগণিত রসূল প্রেরণ করে হেদায়াতের আলাে দ্বারা তাদের প্লাবিত করে দিয়েছেন। তারপর খেয়াল করে দেখুন এই রসূলদের কী দুর্বিষহ অবস্থা। তাদের সহনশীলতার অবস্থাও লক্ষণীয়। কেমন অম্লান বদনে তারা কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছেন। বিভিন্নভাবে এসব দুর্বিষহ কষ্টের বোঝা বহন করে চলেছেন। তাদের অস্বীকার করার কারণে এবং তাদেরকে বিভিন্নভাবে তকলীফ দেয়ার কারণে তারা এসব কষ্ট পাচ্ছেন; এতদসত্তেও আল্লাহ তায়ালা তার এসব নেক বান্দাকে তার মেহেরবানী, করুণা ও মান সম্ভ্রম দিয়েই চলেছেন, দিয়ে চলেছেন তাদের তাঁর এহসান ও করুণারাশি। মহান রহমানুর রহীম, মহিমাময় আল্লাহর মহিমা এভাবেই প্রকাশ পায়। কেননা এসব গুণ তার সত্ত্বারই বৈশিষ্ট্য। তার সেই বান্দাদের প্রতি তিনি এ জন্যে দয়া করেন না যে, তারা তাদের হেদায়াত গ্রহণের মাধ্যমে মালিকের রাজ্য কিছু বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অথবা সত্য থেকে তারা চোখ বুজে থাকা ও তাদের অন্ধ হয়ে থাকার কারণে মালিকের রাজ্যে কিছু ঘাটতি হয়ে যাচ্ছে বলে কারাে ওপর তিনি রাগ করছেন। আর এ কারণেও তিনি সেই সব বান্দার ওপর রহমত নাযিল করেন না যে, মালিকের বড়ই প্রিয় ও বিরল সৃষ্টি, তাদের পুনরায় ফিরে পাওয়া অথবা তাদের বদলে অনুরূপ জনগণকে আবার পাওয়া বড়ই কঠিন, এ জন্যে তারা যাইই করুক না কেন তাদের মাফ করতেই হবে। *মানবসন্তানের প্রতি আল্লাহর অপার করুণা : মানুষ যখন আল্লাহর অপার করুণারাশির দিকে মুখ তুলে চায় তখন তারা হয়রান পেরেশান হয়ে যায়। তারা দেখে, এই তুচ্ছ অজ্ঞান, অক্ষম ও দুর্বল মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মেহেরবানী ও রহমত পেয়ে এবং তার পরিচালনায় কত অকল্পনীয় কৃতিত্বের ছাপ রাখছে। মানুষ পৃথিবীর অধিবাসীদের মধ্যে একটি অতি ছােট্ট সৃষ্টি, আর এই মহাবিশ্বে সূর্যকে যেসব গ্রহ প্রদক্ষিণ করে চলেছে তাদের মধ্যে পৃথিবী একটি অতি ছােট্ট গ্রহ। অগণিত-অসংখ্য তারকারাজির মতােই সূর্যও একটি তারকা। এখন তাকিয়ে দেখুন নভোমন্ডলের মধ্যে। কেমন করে বিশাল ও অনন্ত আকাশের বুকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলােকবিন্দুর মতাে ফুটে রয়েছে এই তারাগুলাে। হাঁ এই যে আকাশ, কোনাে দিন কোনাে মানুষ তার কুল কিনারা করতে পারেনি- পারবেও না কোনাে দিন। আর এসব কিছুই তাে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সৃষ্টির মধ্যে এমন কিছু বা কয়েকটি সৃষ্টি, যার সন্ধান মানুষ কোনােদিন করতে পারেনি। এরপর দেখুন মানুষকে এই পৃথিবীর বুকে একেবারে অসহায় ও দিশেহারা অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়নি। সে তার মালিকের কৃপাধন্য সৃষ্টি হিসাবে তার মহান পরিচালনা পাচ্ছে। কত সৌভাগ্যশালী সে, এই সুবিশাল সৃষ্টিরাজ্যে সে জানে না কিসে তার ভালাে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাকে সৃষ্টি করলেন এবং প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দিলেন যেন সে তার মালিকের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সন্দেহমুক্ত জ্ঞানের আলােকে পৃথিবীকে পরিচালনা করতে পারে। তাকে খেলাফতের এ মহান দায়িত্ব পালনের সরঞ্জামাদিও দান করলেন। এ সরঞ্জামাদির মধ্যেই কত কি যে রয়েছে আমরা তা জানি না। হতে পারে তিনি মানুষের নিজ দেহ সত্ত্বার মধ্যে এমন কিছু যােগ্যতা ও গুণাবলী দিয়েছেন, যা দ্বারা সে প্রাকৃতিক বস্তু শক্তি ও বিষয়াবলীকে বশীভূত করতে পারে। সব কিছুকে কাজে লাগানাের এই যােগ্যতাই তাকে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের যােগ্যতা দান করেছে, কিন্তু হায়, মানুষ অহংকারের কারণে পরম করুণাময় আল্লাহর শােকরিয়া আদায় না করে অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়, নিজেকে ভুল পথে চালিত করে এবং অপরকেও চরম ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। অবশেষে সে তার রবের সাথে শিরকের পাপে লিপ্ত হয়ে যায় অথবা একসময় নিজ মালিককে অস্বীকার করে বসে। আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা পর্যায়ক্রমে অসংখ্য রাসূল পাঠিয়েছেন, তাদের সঠিক পথ দেখানাের জন্যে পাঠিয়েছেন একজন রসূলের পর অন্য রসূল এবং রসূলদের কাছে আসমানী কিতাবসমূহ ও বিভিন্ন মোজেজা পাঠিয়েছেন, এইভাবে চলতে থেকেছে সকল যামানায় বান্দার ওপর আল্লাহর মেহেরবানী এবং সর্বশেষে শেষ কিতাব নাযিল হয়েছে, যা অনাগত ভবিষ্যতের সকল মানুষকে সত্য পথ দেখাতে থাকবে এবং অতীতের মানুষ ও তাদের সত্য পথ গ্রহণ না করার কারণে কি কি পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এ কিতাব তাদের, সে বিষয় ওয়াকেফহাল করতে থাকবে। ভবিষ্যতের মানুষকে জানাতে থাকবে যে, অতীতের মানুষকে কত অধিক শক্তি সরঞ্জাম দেয়া হয়েছিলাে এবং তাদের কত প্রভূত জ্ঞান বিজ্ঞান শেখানাে হয়েছিলাে। এ কিতাবের মাধ্যমে আরও জানা যাবে, এতাে সব জ্ঞান বিজ্ঞানের অধিকারী থাকা সত্তেও আল্লাহ তায়ালার আযাবের সামনে তারা কত দুর্বল ও কত অসহায় হয়ে পড়েছিলাে; বরং প্রকৃত সত্য কথা এই, এদের কারাে কারাে সম্পর্কে আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা (কেয়ামতের দিনে) নিজেই বলবেন, তুমি (এটা) করেছো, আর এ জন্যই আজকে তুমি পরিত্যক্ত হয়েছো।’ সে হতভাগাকে তিনি আরও বলবেন, আজকে তােমার জন্যে তােমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে, অথচ এই এই আচরণ হত আজকে তােমার নাজাতের উপায়। এই মানুষসহ সব কিছু সৃষ্টি এবং এই মহাবিশ্বের বুকে অবস্থিত বাসিন্দাদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র কিছু সৃষ্টি মাত্র- যা কিছু সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। সে সবের মধ্যে এগুলাে সবই হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র কিছু অনুসারী। বিশাল জগতের তুলনায় এসব দৃশ্য ও বস্তুনিচয় সবই অতি তুচ্ছ এবং অতি নগণ্য। আর আল্লাহ তায়ালা, তিনিই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এবং এ সবের মধ্যে যা কিছু আছে সব একমাত্র তাঁরই সৃষ্টি। এ সব কিছু সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি শুধুমাত্র তার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন আর অমনি সবকিছু পয়দা হয়ে গেছে। সকল ক্ষমতার মালিক তিনি, যখনই কিছু তিনি পয়দা করতে চান শুধু ইচ্ছা করেন, আর অমনি তার অস্তিত্ব বাস্তবে এসে যায়। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মেহেরবানী ও পরিচালনায় এ সব সত্য উদঘাটনের জন্যে মানুষই প্রকৃতপক্ষে বেশী যােগ্য। আল্লাহ তায়ালা চান যে, মানুষ সত্য অস্বীকার করা ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া সত্তেও তার পরিচালনা ও মেহেরবানী লাভ করার মাধ্যমে যিন্দা থাকুক। এমনিভাবে অবশেষে তাঁর দিকে তারা ফিরে আসবে ও তার ডাকে সাড়া দেবে। এইভাবে মানুষের মূল্যায়ন করায় এ কথা জানা যায়, তাদের মধ্যে আবেগ ও মহব্বতের স্রোতধারা অতি সংগােপনে নিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে, যা তাকে পৃথিবীর প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখে, কঠিন থেকে কঠিন জীবন সংগ্রামে উজ্জীবিত করে এবং পরিশেষে তাদের সত্য পথের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মহাগ্রন্থ আল কোরআনও এইভাবে তাদের মধ্য অবস্থিত সত্য-সন্ধানী হৃদয়কে জাগিয়ে তুলতে চায়। কারণ আল কোরআন জানে, শাশ্বত সমুজ্জ্বল প্রভা অবশেষে মানুষের মনকে জয় করবেই। সত্যের বিজয় এ জন্যেও অবশ্যম্ভাবী যে, এ মহাগ্রন্থ স্বয়ং বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার কিতাব এবং এ কিতাব পরম সত্যের বাণী বহন করে এনেছে। সুতরাং এ পবিত্র কিতাব অবশ্যই সত্য কথা প্রকাশ করেছে এবং তা সত্যকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যেই নাযিল হয়েছে। এ কিতাব কখনই তার আহ্বান জানানাের কাজ থামিয়ে দেবে না- যতােদিন না সত্যের বাণী দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে, আর যতদিন না সত্যের সমুজ্জল বাতি ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠবে। এ বাতি সত্যের দিকে ছাড়া অন্য কোনাে দিকে মানুষকে পরিচালনা করে না এবং অন্য কোনো দিকে মানুষকে এগিয়ে দিতে জানে না।
*মানুষের অবশ্যম্ভাবী চুড়ান্ত পরিণতি : এ পাক পবিত্র কালাম প্রত্যেক বিদগ্ধ অন্তরে আর একটি মহাসত্যের পরশ বুলিয়ে দেয়, তা একান্তই স্বভাবসিদ্ধ একক সত্য আর সে সত্য গ্রহণ করা দ্বারা যে প্রতিদান পাওয়া যাবে তা দুনিয়া ও আখেরাতে অন্য কেউ তাকে দিতে পারে না। অবশ্যই এ কথা সত্য যে, মানুষকে হেদায়াতের পথে আহ্বান জানাতে গিয়ে আল্লাহর রসূল নিজের সম্পর্কে, নিজের নিরাপত্তা বা সুখ শান্তি সম্পর্কে কোনােদিন চিন্তা করেননি। তিনি তাে শুধু নিজের সেই দায়িত্ব সম্পর্কেই চিন্তা করেছেন যা নিয়ে তিনি প্রেরিত হয়েছেন। তার পূর্ববর্তী রসূলরাও একইভাবে তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কেই চিন্তা করেছেন এবং এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের পরিণতি কি হবে সে কথা একবারও ভেবে দেখেননি। এইভাবে যে নিজেকে পবিত্র করবে সে তার নিজের অস্তিত্ব এবং নিজের সত্তাকেই কলুষমুক্ত করবে। কারণ নিজেকে পবিত্র করার কাজ তার নিজেকেই করতে হবে, অন্য কেউ তা করে দেবে না এবং যে যা করবে সব কিছুই সে আল্লাহরই কাছে ফিরে যাবে এবং সেখানেই তার চূড়ান্ত বিচার হবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘কেউ কারাে বােঝা বহন করবে না এবং (সেদিন) কঠিন বােঝার ভারে কষ্ট পেতে থাকা কোনাে ব্যক্তির বােঝা (শত আকুতি করলেও) অন্য কেউ বহন করে দেবে না, যতাে নিকটবর্তী আত্মীয়ই হােক না কেন।’ আবারও এরশাদ হচ্ছে, ‘যে পবিত্রতা গ্ৰহণ করবে, অবশ্যই সে নিজের স্বার্থেই তা গ্রহণ করবে, আর তার কাছেই চূড়ান্তভাবে সবাইকে ফিরে যেতে হবে।’ স্বাভাবিকভাবে মানুষকে অবশ্যই যে চূড়ান্ত পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে এবং সেখানে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে বলে যে খবর দেয়া হয়েছে তা তার নৈতিক চেতনাবােধের ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং একইভাবে তার বাস্তব আচরণকেও প্রভাবিত করে। এ জন্যে প্রত্যেক মানুষের চেতনার এ সত্যটি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যে, তাকে অপরের কোনাে কাজ, কথা বা আচরণের জন্যে কৈফিয়ত দিতে হবে না, অথবা একজনের অপরাধের জন্যে অন্যজনকে পাকড়াও করা হবে না, অথবা অন্য কেউ তাদের কাজের দরুন নাজাতও পাবে না। এজন্যে যতােক্ষণ সে জাগ্রত অবস্থায় আছে এবং তার জ্ঞান ও চেতনা সুস্থ আছে, ততােক্ষণ তাকে তার নিজের কাজের হিসাব নিজেকেই নিতে হবে। একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন পার্থিব জীবনের সকল কাজ সম্পর্কে আল্লাহর কাছে তাকে জওয়াবদিহি করতে হবে। সুতরাং সেদিন আসার পূর্বেই তার আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত। আজকেই তাকে এ কথা ভালােভাবে বুঝে নিতে হবে যে, সেই ভয়ানক দিনে পুত্র কন্যা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব কেউই তাকে সাহায্য করতে আসবে না। এ জন্যে অন্য কারও ওপর নির্ভর করা হবে একটা ধােকা মাত্র। অন্য কেউই তার কোনাে বােঝা বহন করে দেবে না। আজকে যেমন তার নিজ ব্যবহার ও কাজের দরুন সে নিশ্চিন্ত বােধ করছে, তেমনি কেয়ামতের দিনও তাকে একমাত্র তার নিজের কাজের জন্যেই দায়ী করা হবে। কোনাে দল বা দলের কে কি করছে সে জন্যে অন্য কোনাে ব্যক্তিকে দায়ী করা হবে না। এ জন্যে দলীয় কোনাে ভ্রান্তির জন্যে তার হতাশ হওয়া বা তার নেক কাজের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হওয়ার কোনাে আশংকা নেই। তবে দল ভুল করতে থাকলে তাকে সদুপদেশ দিয়ে যেতে হবে, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যেই এটা একটা কর্তব্য। অর্থাৎ দলীয় জীবনে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কাজ ও আচরণের জন্যে দায়ী হওয়ার সাথে সাথে তার দলের জন্যেও দায়ী হবে। যদি সে দলের কোনাে ভুল ভ্রান্তি সংশােধনের জন্যে চেষ্টা না করে বা সদুপদেশ দিতে না থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই এজন্যে জিজ্ঞেস করা হবে। এখানে উপদেশদান বা চেষ্টা করাই তার দায়িত্ব! কিন্তু কোনাে ব্যক্তি একথা বলে রেহাই পাবে না যে, তাকে কেউ শােধরায়নি, কেউ উপদেশ দেয়নি বা তাকে সঠিক পথ দেখানাের চেষ্টা করেনি। একমাত্র না জানার কারণে কোনাে ভুল ভ্রান্তি হয়ে গেলে সেখানে ক্ষমার সুযােগ রয়েছে। মৌলিক ন্যায় অন্যায়ের চেতনাবােধটুকু প্রত্যেক মানুষের অস্তিত্বের মধ্যে রেখে দেয়া হয়েছে, যাকে বলা যায় বিবেকবুদ্ধি। এই বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে যে কাজ করবে সে অবশ্যই (আল্লাহর রহমতে) সঠিক পথে চলতে পারবে। অবশ্যই আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা গােটা দলকে এক সাথে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না। তিনি প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। কারণ প্রত্যেক মানুষকে ভালাে মন্দের বুঝ দেয়া হয়েছে, কাজেই অন্য মানুষ বা নেতা তাকে বিভ্রান্ত করেছে- একথা বলে রেহাই পাওয়া যাবে না। ব্যক্তির জন্যে নিজেকে সঠিক পথে পরিচালিত করার পরই তার দ্বিতীয় কর্তব্য হচ্ছে অপরকে উপদেশদান এবং সংশােধনের জন্যে তাদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়া, এইভাবেই সে খেলাফতের ভূমিকা পালন করবে। দলের অন্যান্য ব্যক্তিদের শােধরানাের জন্যে সে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে যাবে। সাধ্যের বাইরে সে কিছুই করতে পারে না। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা একথা জানেন বিধায় তিনি সাধ্যের বাইরে কিছু করার জন্যে কাউকে দায়িত্বও দেন না। এ জন্যে যে ব্যক্তি সচেতনভাবে দলীয় মানুষদের সঠিক পথ দেখানাের জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করে যাবে, তাদের দলের কোনাে ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে দায়ী করা হবে না। দলের জন্যে এটা আল্লাহর একটা বিরাট এহসান। এ এহসান সে পালন করেছে কিনা তার জন্যেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একইভাবে যে ব্যক্তিগতভাবে অন্যায় কাজ করবে ও ভুল পথে চলতে থাকবে, তার দল ভালাে কাজ করতে থাকলেও এ ভুল পথের পথিক তার কোনাে ফায়দা পাবে না, ইতিপূর্বেও একাধিক জায়গায় এ আলােচনা এসে গেছে। এ সত্যটি আল কোরআন তার নিজস্ব অনন্য পদ্ধতিতে অংকিত করেছে, যার কারণে হৃদয়ের গভীরে কঠিনভাবে এর প্রভাব পড়ে। আল কোরআন দাবী করে বলছে, যার যে কাজ করার সে তারই বােঝা বহন করবে, তারই ফল ভােগ করবে এবং কিছুতেই কেউ অন্য কারও বােঝা বহন করে দেবে না। ‘সেই কঠিন দিনে মানুষ যখন নিজ নিজ বােঝা বহন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন সাহায্যের জন্যে আপনজন বা আত্মীয়স্বজনকে ডাকতে থাকবে, কিন্তু আফসোস, তখন কেউই তাদের ডাকে জবাব দেবে না, তাদের বোঝা হালকা করার জন্যে এগিয়ে আসবে না। *হাশরের ময়দানের কিছু বর্ণনা : এই হচ্ছে সেই ভয়ানক দৃশ্যের বর্ণনা, যা হাশরের ময়দানে সবার সামনে এসে হাযির হবে। দেখা যাবে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজের কর্মকান্ডের বােঝা বয়ে চলেছে; অবশেষে একসময় তারা পৌছুবে বিচার দন্ডের সামনে, অর্থাৎ মহা বিচারকের আদালতে, আর সেই অবস্থানে বসে সবার মধ্যে দুঃখ কষ্ট থেকে বাঁচার এক কঠিন প্রয়াস ফুটে উঠবে… আরও ফুটে উঠবে সেই দৃশ্য, যেখানে দেখা যাবে কষ্টের বােঝা একটু হালকা করার জন্যে প্রত্যেকেই নিজ নিজ সংগী-সাথী, আপনজন ও আত্মীয়স্বজনের কাছে আকুল আবেদন জানাতে থাকবে, কিন্তু কেউই এতােটুকু সহানুভূতি বা সমবেদনা জানানাের জন্যে এগিয়ে আসবে না। অনাগত দিনের অবশ্যম্ভাবী সেসব ভয়ানক অবস্থা সামনে রেখেই আজকের জনমানবকে রসূলুল্লাহ(স.)-এর শিক্ষার দিকে খেয়াল করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। তাকে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে, ‘অবশ্যই তুমি তাদের সতর্ক করতে পারবে যারা তাদের মালিককে না দেখেই ভয় করবে এবং নামায কায়েম করবে।’ অর্থাৎ উপরােল্লেখিত সম্ভাবনাময় জনপদ সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, তারাই হবে সেসব মানুষ যাদের হুঁশিয়ার করা হলে তারা সে হুঁশিয়ারীকে সাদরে গ্রহণ করবে এবং কোনাে প্রকার অবজ্ঞা প্রদর্শন না করে সাথে সাথে সাবধান হয়ে যাবে, তাদের রবকে তারা ভয় করবে এবং কোনাে প্রকার বাড়াবাড়ি করবে না, তারপর তাদের রবের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে নিজেদের জীবনে নামায কায়েম করা ও সমাজে নামাযের ব্যবস্থা নিয়মিতভাবে কায়েম করবে এবং নিরংকুশভাবে তারা নিজেদের জীবনের সর্বত্র তাদের মালিকের আনুগত্য করবে; ওরাই হচ্ছে সেসব মানুষ, যারা রসূলের কাছ থেকে ফায়দা পাবে এবং তার ডাকে সাড়া দিতে পারবে। সুতরাং যারা আল্লাহকে ভয় করবে না এবং যারা নামায কায়েম করবে না, তাদের কোনাে দায়িত্ব রসূলের ওপর নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে পবিত্রতা অর্জন করবে সে তার নিজের জন্যেই তা গ্রহণ করবে।’ অর্থাৎ, যে এ পবিত্রতা অর্জন করবে, সে তা করবে তার নিজের জন্যে, নিজের ছাড়া অন্য কারাে জন্যে নয়, কথাটা বড়ই সূক্ষ্ম অর্থবােধক শব্দ, এ শব্দটির মধ্যে বহু ব্যাপকতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তরের পরিচ্ছন্নতা, আবেগপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ রাখা ও অনুভূতিকে কলুষমুক্ত রাখার কথা প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে। ব্যবহারে, ঝোকপ্রবণতায় এবং জীবনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে যার প্রতিফলন ঘটবে। এ শব্দটি বড়ই প্রাণােদ্দীপক যা মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর সবাইকে আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে।’ সেদিন তিনিই হিসাব গ্রহণকারী হবেন, আর ভালাে বা মন্দ সকল কিছুর প্রতিদানও তিনিই দেবেন। এ জন্যে কোনাে নেক কাজের পুরস্কার থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না এবং কোনাে মন্দ কাজ যে নযরের বাইরে পড়ে যাবে তাও নয়; আর এমন গোঁজামিলও কখনও দেয়া হবে না যে, একজনের পুরস্কার বা শাস্তি অন্য একজন পেয়ে যাবে, অর্থাৎ, পৃথিবীতে যেসব ভুল ভ্রান্তি হয়ে থাকে, হাশরের সে মহাবিচার দিনে সেই ধরনের কোনাে ভুল ভ্রান্তির আশংকা থাকবে না। আলোচ্য আয়াতাংশে এই নিশ্চয়তাই দেয়া হয়েছে।
# আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কাছে ঈমান ও কুফর কখনও সমান হবে না। সমান হবে না ভালাে ও মন্দ, হেদায়াত ও গোমরাহী। যেমন সমান নয় অন্ধত্ব ও দৃষ্টিশক্তি, অন্ধকার ও আলাে, ছায়া ও রৌদ্র এবং জীবিত ও মৃত। একটু খেয়াল করে দেখুন, প্রকৃতিগতভাবে কুফরের সাথে অন্ধত্ব, অন্ধকার, রৌদ্র ও মৃত্যুর একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে…’ ঈমান হচ্ছে নূর, এক স্নিগ্ধ ও পবিত্র জ্যোতি, অন্তরের মধ্যে এ জ্যোতি প্রবেশ করে গােটা অন্তর ও প্রাণকে উদ্ভাসিত করে, উদ্ভাসিত করে অংগ প্রত্যংগসমূহকে, মানুষের সকল অনুভূতিকে আলােকিত করে, এ এমন এক নূর যা সকল বিষয়ের তাৎপর্য প্রকাশ করে দেয়, সকল মূল্যবােধ জাগরিত করে এবং বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে অবস্থিত পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করে, এ সবের মধ্যে অবস্থিত দূরত্বের ব্যবধান সম্পর্কে তাকে জানিয়ে দেয়। অতপর একজন মােমেন ঈমানের এ নূর দেখতে পায় এবং এরই আলােকে সে সকল দিকে তাকায়, যার ফলে সব কিছুর সঠিক তাৎপর্য বুঝা তার জন্যে সহজ হয়। এই নূরের আলােকেই সে জীবনের বন্ধুর পথে চলে, যার কারণে তার কাছে পথের এই নানাবিধ অবস্থা কোনাে অজানা জিনিস বলে মনে হয় না, আর এ কারণেই কোনাে অবস্থাতেই সে নিজেকে পরাজিত মনে করে না, নড়বড়ে হয় না। সে জীবনের পথ-পরিক্রমায় অকুতােভয় অনড় অবিচল হয়, কখনও চিত্ত তার বিহ্বল হয় না এবং কোনাে সময়েই সে নিজেকে দিশাহারা বােধ করে না। হাঁ, ঈমানই হচ্ছে মােমেনের প্রকৃত চোখ, যার দ্বারা সে দেখে, যার দ্বারা সে প্রতিটি বিষয়ের গভীরে তাকায়, সে সকল কিছুর তাৎপর্য ঈমানেরই মহান আলােকে বুঝতে পারে। জীবনের পথে চলতে গিয়ে ঝড় ঝঞা যাই-ই আসুক না কেন, কোনাে অবস্থাতেই সে অস্থির হয় না এবং কোনাে আঘাতেই সে ভেংগে পড়ে না। ঈমানের মধুর পরশই হয় তার সাথী, যা প্রতিটি পদে পদে তাকে সঞ্জীবিত করতে থাকে। এই ঈমানই এমন এক উজ্জ্বল আলাে, যা শত হতাশার ঘন অন্ধকারেও তাকে পথ দেখাতে থাকে, তাকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান বানায় এবং তার হৃদয়-প্রাণকে পরম পরিতৃপ্তিতে ভরে দেয়। ঈমান এমন এক সুশীতল শান্তির ছায়া, যা জীবনের খরতাপসম্পন্ন রৌদ্রের দিনে শ্রান্ত-ক্লান্ত মােসাফেরকে মায়াময় স্নিদ্ধ আশ্রয় দান করে, যার ধারক বাহক প্রত্যেক ব্যক্তিই এখানে পূর্ণ পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে এবং এটি অন্তরকেও আনন্দ দেয়। এ এমন এক ছায়া যা সন্দেহ, হতাশা, বঞ্চনা, পেরেশানী এবং আঁধারে ঢাকা অহেতুক অমূলক অহংকারের বেড়াজাল থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়। প্রকৃতপক্ষে ঈমানই হচ্ছে যিন্দেগী, প্রতিটি অন্তর ও প্রতিটি চেতনাকে উজ্জীবিত করার জন্যে ঈমান হচ্ছে এক জীবন্ত শক্তি। মানুষ যখন কোনাে বিষয়ে মনস্থ করে এবং কোনাে বিষয়ে অগ্রসর হতে চায়, তখন ঈমানই তাকে সে পথে চালিকা শক্তি যােগায়, যেমন বলা যায় ঈমান হচ্ছে কোনাে নির্মাণ কাজের মূল পরিচালক এবং ঈমানই প্রতিটি উদ্যোগকে ফলপ্রসূ বানায়, এ শক্তি সরল সঠিক পথে চলার জন্যে মানুষকে শক্তি যােগায়, সাহস যােগায়- যােগায় উদ্দীপনা। ঈমানের এ শক্তিশালী বাতি নিভে যায় না এবং কখনও তা মানুষকে স্তিমিত হতে দেয় না। এর মধ্যে অর্থহীনতা বা যুক্তি বহির্ভূত কিছু নেই বা এটা কখনাে ধ্বংস হবারও নয়। অপরদিকে ‘কুফর’ হচ্ছে অন্ধত্ব, অন্তরের জন্যে এক বন্ধ্যাত্ব, সত্য ও ন্যায়ের জন্য কুফর এমনই এক অন্ধত্ব যে, এটা কোনাে যুক্তি প্রমাণ মেনে নেয় না এবং যা প্রকৃতপক্ষে ও বাস্তবে সত্য বলে প্রমাণিত, কুফর তা দেখতে পায় না। ঘটনাবলী এবং তার মূল্যবােধের তাৎপর্য দেখতে পায় না। দেখতে পায় না সেই মহাসত্যকে যার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বাস্তবে মহব্বতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে চলেছে। কুফর হচ্ছে এক অন্ধকার অথবা সকল দিক দিয়েই এটা অন্ধকারাচ্ছন্ন এক অনুভূতি; তাই যখনই মানুষ ঈমানের নূর থেকে দূরে সরে যায়, তখনই তারা নানাপ্রকার এবং বিভিন্নমুখী অন্ধকারের মধ্যে পতিত হয়। এমন সংকট সমস্যার মধ্যে তারা ঘেরাও হয়ে যায় যে, সেই কঠিন অন্ধকারের জাল ছিন্ন করা তাদের জন্যে সুকঠিন হয়ে পড়ে। কুফরের কারণে এমন সব কঠিন সংকটের মধ্যে মানুষ পতিত হয় যে, কোনাে জিনিসকেই তারা তার আসল রূপে দেখতে পায় না। কুফর (সত্য অস্বীকৃতির মনোভাব) মানুষকে সত্য সঠিক বিষয় বুঝতে দেয় না; বরং সত্য থেকে তাদের বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। কুফর এক প্রচন্ড তাপ প্রবাহ, যা অন্তরকে ঝলসে দেয়, অস্থিরতা, পেরেশানী, লক্ষ্য নির্ধারণে অপারগতা এবং সত্য সন্দর্শনে বা সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে তৃপ্তিহীনতার দুর্ভোগ এনে দেয়, পরিশেষে কুফরী মনােভাব মানুষকে জাহান্নামের ভীষণ উত্তপ্ত শাস্তির মধ্যে নিয়ে যাবে! কুফর বা কুফরী মনােভাব হচ্ছে যেন একটি এক মৃত্যু, অন্তর ও বিবেকের দিক দিয়ে এক চরম ও কঠিন মৃত্যু। এ মনােভাব মানুষকে জীবনের মূল উৎস থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়, দূরে সরিয়ে দেয় সেই পথ থেকে যা মানুষকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে নিয়ােজিত থাকে। এ প্রবণতা মানুষকে সঠিক চিন্তা করতে দেয় না এবং সে সত্যের প্রস্রবণ থেকে আকন্ঠ পান করার ইচ্ছাই হচ্ছে মানব জীবনের মজ্জাগত চাহিদা, সেখানে তাকে ঢুকতেই দেয় না। প্রত্যেক ব্যক্তিরই রয়েছে নিজস্ব এক প্রকৃতি এবং এই প্রকৃতি অনুসারে চললে তার প্রতিদান পাওয়াও তার জন্যে নির্ধারিত, আর এ জন্যেই প্রকৃতির আহ্বানে যে সাড়া দেবে আর যে দেবে না, সে কখনও বরাবর হবে না হতেও পারে না।
*প্রত্যেক মানুষের স্বভাব প্রকৃতিই আলাদা : আসুন এবার আমরা নবী(স.)-এর দিকে তাকাই, দেখা যাক তিনি কোনদিকে আমাদের আহবান জানাচ্ছেন এবং কোন জিনিস থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে নিতে চাইছেন, তাঁর জীবনের বাস্তব কার্যাবলীর মাধ্যমে আমাদেরকে কোন সীমানার মধ্যে থাকতে তিনি উদ্বুদ্ধ করছেন এবং আল্লাহর দিকে দাওয়াত দান করায় কি ভূমিকা তিনি পালন করছেন। অতপর স্বেচ্ছাচারী শাসক ও পরিচালকবর্গের নাগপাশ থেকে দূরে সরে থাকার জন্যে তিনি কি আমাদের কি প্রােগ্রাম দিচ্ছেন? এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শােনান তাকে যাকে তিনি (শােনাতে) চান… সুতরাং দেখ, কেমন ছিলাে আমার আযাব?’ (আয়াত ২২-২৬)। প্রকৃতিগতভাবে মানুষের সৃষ্টির মধ্যেই মতভেদের বীজ রয়ে গেছে। মানুষের স্বভাব প্রকৃতি ও মেজাজের মধ্যে এবং মানুষের গঠন প্রকৃতির মধ্যে যে ভাবে পার্থক্য রয়েছে, সেই ভাবেই রয়েছে তাদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার দাওয়াতকে গ্রহণ করার যােগ্যতার মধ্যে পার্থক্য, আর এই কারণেই আল্লাহর নযরে কেউ চক্ষুম্মান আর কেউ অন্ধ। তারা বিভিন্ন জন সৃষ্টি বৈচিত্র্যকে বিভিন্নভাবে দেখে। তারা ছায়া ও উত্তাপ, অন্ধকার ও আলাে এবং জীবন ও মৃত্যুর তাৎপর্য বিভিন্নভাবে দেখে। এ সব কিছুর ওপরে রয়েছে আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডারে রক্ষিত মানুষের নিয়তি ও আল্লাহ জাল্লা শানুহুর বিজ্ঞানময় মহা রহস্যভান্ডার এবং তার যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতা। তারপর আসছে রসূল(স.)-এর প্রসংগ। জানান হচ্ছে যে, তিনি একজন সতর্ককারী ছাড়া আর কিছুই নন। অর্থাৎ সতর্ক করার পর তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। তার মানবীয় ক্ষমতা এই পর্যন্তই শেষ। অতপর কবরে যারা শায়িত রয়েছে তাদের শােনানাের দায়িত্ব তার নয় এবং মৃত অন্তর নিয়ে যারা বেঁচে আছে তাদেরও জোর করে হেদায়াতের পথে নিয়ে আসার কাজও তার নয়, কারণ তারাও তাে মৃতদেরই শামিল। আর একমাত্র আল্লাহই যাকে ইচ্ছা তাকে শােনাতে সক্ষম, একমাত্র তাঁরই রয়েছে যা ইচ্ছা তা করার ক্ষমতা। অতএব কেউ যদি গোমরাহ হয়ে যায়, দেখে শুনে জেনে বুঝেও যদি কেউ সঠিক পথ গ্রহণ না করে, তাহলে সে বিষয়ে রসূলের কোনাে দায়িত্ব নেই। তার দায়িত্ব হচ্ছে বুদ্ধিমত্তার সাথে ও সুন্দর সুমিষ্ট কথা দ্বারা মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানানাে। সত্যের পক্ষে সর্বপ্রকার যুক্তি এবং (আল্লাহর দেয়া তথ্য অনুযায়ী) অতীতের ঘটনাবলী তুলে ধরা, এই ভাবেই তার রেসালাতের দায়িত্ব পালন করা। এরপর আল্লাহ তায়ালা যাকে শােনাতে চাইবেন সে শুনবে, আর যার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা চাইবেন না, সে শুনবে না। ইতিপূর্বে যেসব আলােচনা এসেছে তাতে দেখা গেছে) আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে বলেছেন, ‘তুমি ওদের জন্যে চিন্তা ও আফসােস করতে করতে নিজেকে ধ্বংস করে দিয়াে না।’ অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে সুসংবাদদানকারী এবং সতর্ককারী হিসাবে। পাঠিয়েছেন। তার অবস্থা অন্য যে সব রসূল গুজরে গেছেন তাদের মতই। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘প্রত্যেক জাতির কাছেই এইভাবে কোনাে না কোনাে সতর্ককারী এসেছে।’ এরপর যদি তিনি তার জাতির মধ্য থেকে অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হন তাহলে তার আর করার কি আছে। কেননা মানব জাতির ইতিহাস তাে বরাবর এটাই দেখেছে, তারা সকল যামানায় রসূলদের এইভাবে অভ্যর্থনা (?) জানিয়েছে। রসূলদের কোনাে ত্রুটির কারণে বা তাদের কথার মধ্যে কোনাে যুক্তি ছিলাে না বলে এমনটি হয়েছে তা নয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি ওরা তােমাকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে (তাে এটা কোনাে নতুন ব্যাপার নয়) যেহেতু ইতিপূর্বে যারা এসেছে তাদেরও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে….’ আর সুস্পষ্ট দলীল বলতে বুঝায় সত্যের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের দলীল প্রমাণ, যা মানবীয় বুদ্ধির খােরাক হিসাবে যথেষ্ট, এ সবের মধ্যে রয়েছে রসূলদের প্রদত্ত বিশেষ বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা বা মােজযা, যা তাদের দেয়া হয়েছে অথবা রসূলের বাগ্মিতা ও ক্ষুরধার যুক্তিপূর্ণ ভাষণ, অত্যাশ্চর্য। বাক্যবহ আসমানী কিতাবসমূহ যা অতি মূল্যবান উপদেশবাণীসহ পুস্তক আকারে নাযিল হয়েছে, এসেছে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও মানবীয় দায়িত্ব হিসাবে স্মরণিকা আকারে। এই ভাবে সে কিতাব সমৃদ্ধ ও সুন্দর সমুজ্জ্বলরূপে সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু যত রসূলই দুনিয়ায় এসেছেন তাদের উম্মতরা তাদের বরাবর এইভাবেই অভ্যর্থনা(?) জানিয়েছে বলে জানা যায়। অতীতের সে সকল কিতাবের মধ্যে সব থেকে বেশী উল্লেখযােগ্য। হচ্ছে মূসা(আ.)-এর কাছে অবতীর্ণ কিতাব তাওরাত, আর অন্য সবাই ও তাদের কাছে সুস্পষ্ট কিতাব, দলীল প্রমাণ ও প্রেরিত পুস্তক। সব কিছু আসা সত্তেও তারা রসূলদের প্রত্যাখ্যান করেছে। রসূলদের অভ্যর্থনা করতে গিয়ে এবং তাদের আনীত হেদায়াতের পথে প্রদর্শিত দলীল প্রমাণাদির সাথে সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে এইই ছিলাে জাতিসমূহের ভূমিকা। সুতরাং মােহাম্মাদুর রাসূল(স.)-এর প্রতি এই নিষ্ঠুর ব্যবহার কোনাে নতুন ব্যাপার ছিলাে না বা এটা ছিলাে না কোনাে ভিন্ন ঘটনা। অতীতের ঘটনাবলীর মত এভাবেই তাদের সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার চলতে থাকবে যারা আল্লাহ তায়ালার পথে, সত্য সঠিক পথে কাজ করতে থাকবে ও মানুষকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে থাকবে। এখানে মােশরেকদের সামনে অতীতের সত্য বিরােধী ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের কঠিন পরিণতির ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে, যেন তারা সময় থাকতেই সাবধান হতে পারে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর পাকড়াও করলাম আমি তাদের যারা কুফরী করেছিলাে।’ এরপর বিস্ময়ভরা এক চরম ভীতিজনক প্রশ্ন করা হচ্ছে। ‘সুতরাং কেমন হলাে তাদের শাস্তি?’ আসলে এ আযাব ছিলাে বড়ই কঠিন এবং তাদের যখন পাকড়াও করা হল তখন তারা এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত হল। অতএব পূর্ববর্তীদের ভীষণ পরিণতির কথা স্মরণ করে পরবর্তীদের সাবধান হওয়া দরকার। আল কোরআনের এই বিশেষ উপস্থাপন প্রক্রিয়ার সাথে আলােচ্য প্রসংগ শেষ হচ্ছে।