أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬৬)
[*তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যাতে কখনোই নোকসান হবে না।:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৫:ফা-ত্বির
পারা:২২
২৭-৩২ নং আয়াত:-
ফা-ত্বির:- ৩৫:২৭
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً ۚ فَاَخۡرَجۡنَا بِہٖ ثَمَرٰتٍ مُّخۡتَلِفًا اَلۡوَانُہَا ؕ وَ مِنَ الۡجِبَالِ جُدَدٌۢ بِیۡضٌ وَّ حُمۡرٌ مُّخۡتَلِفٌ اَلۡوَانُہَا وَ غَرَابِیۡبُ سُوۡدٌ ﴿۲۷﴾
আপনি কি দেখেন না, আল্লাহ্ আকাশ হতে বৃষ্টিপাত করেন, তারপর আমরা তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উদগত করি। আর পাহাড়ের মধ্যে আছে বিচিত্র বর্ণের পথ—শুভ্র, লাল ও নিকষ কাল ।
ফা-ত্বির:- ৩৫:২৮
وَ مِنَ النَّاسِ وَ الدَّوَآبِّ وَ الۡاَنۡعَامِ مُخۡتَلِفٌ اَلۡوَانُہٗ کَذٰلِکَ ؕ اِنَّمَا یَخۡشَی اللّٰہَ مِنۡ عِبَادِہِ الۡعُلَمٰٓؤُا ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَزِیۡزٌ غَفُوۡرٌ ﴿۲۸﴾
আর মানুষের মাঝে, জন্তু ও গৃহপালিত জানোয়ারের মাঝেও বিচিত্র বর্ণ রয়েছে অনুরূপ। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই কেবল তাঁকে ভয় করে ; নিশ্চয় আল্লাহ্ প্রবল পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।
ফা-ত্বির:- ৩৫:২৯
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَتۡلُوۡنَ کِتٰبَ اللّٰہِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اَنۡفَقُوۡا مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ سِرًّا وَّ عَلَانِیَۃً یَّرۡجُوۡنَ تِجَارَۃً لَّنۡ تَبُوۡرَ ﴿ۙ۲۹﴾
যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যা রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে খরচ করে, নিঃসন্দেহে তারা এমন একটি ব্যবসায়ের প্রত্যাশী যাতে কোনক্রমেই ক্ষতি হবে না।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩০
لِیُوَفِّیَہُمۡ اُجُوۡرَہُمۡ وَ یَزِیۡدَہُمۡ مِّنۡ فَضۡلِہٖ ؕ اِنَّہٗ غَفُوۡرٌ شَکُوۡرٌ ﴿۳۰﴾
(এ ব্যবসায়ে তাদের নিজেদের সবকিছু নিয়োগ করার কারণ হচ্ছে এই যে) যাতে তাদের প্রতিদান পুরোপুরি আল্লাহ তাদেরকে দিয়ে দেন এবং নিজের অনুগ্রহ থেকে আরো বেশী করে তাদেরকে দান করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও গুণগ্রাহী।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩১
وَ الَّذِیۡۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ مِنَ الۡکِتٰبِ ہُوَ الۡحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِعِبَادِہٖ لَخَبِیۡرٌۢ بَصِیۡرٌ ﴿۳۱﴾
(হে নবী!) আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে যে কিতাব পাঠিয়েছি সেটিই সত্য, সত্যায়িত করে এসেছ তার পূর্বে আগত কিতাবগুলোকে। অবশ্যই আল্লাহ নিজের বান্দাদের অবস্থা অবগত আছেন এবং সব জিনিসের প্রতি দৃষ্টি রাখেন।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩২
ثُمَّ اَوۡرَثۡنَا الۡکِتٰبَ الَّذِیۡنَ اصۡطَفَیۡنَا مِنۡ عِبَادِنَا ۚ فَمِنۡہُمۡ ظَالِمٌ لِّنَفۡسِہٖ ۚ وَ مِنۡہُمۡ مُّقۡتَصِدٌ ۚ وَ مِنۡہُمۡ سَابِقٌۢ بِالۡخَیۡرٰتِ بِاِذۡنِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ ہُوَ الۡفَضۡلُ الۡکَبِیۡرُ ﴿ؕ۳۲﴾
তারপর আমি এমন লোকদেরকে এ কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছি যাদেরকে আমি (এ উত্তরাধিকারের জন্য) নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে বাছাই করে নিয়েছি। এখন তাদের মধ্য থেকে কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী, কেউ মধ্যপন্থী এবং কেউ আল্লাহর হুকুমে সৎকাজে অগ্রবর্তী, এটিই অনেক বড় অনুগ্রহ।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২৭-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলার আশ্চর্যজনক কিছু নিদর্শনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। একই আকাশ থেকে একই প্রকার পানি বর্ষণ করে একই জমিনে বিভিন্ন রঙ, যেমন সাদা, কালো, হলুদ লাল ইত্যাদি রঙের শাক-সবজি ও ফলমূল সৃষ্টি করেন। আবার এ সকল শাক-সবজি ও ফলমূলের আলাদা আলাদা স্বাদ। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُّتَجٰوِرٰتٌ وَّجَنّٰتٌ مِّنْ أَعْنَابٍ وَّزَرْعٌ وَّنَخِيْلٌ صِنْوَانٌ وَّغَيْرُ صِنْوَانٍ يُّسْقٰي بِمَا۬ءٍ وَّاحِدٍ قف وَنُفَضِّلُ بَعْضَهَا عَلٰي بَعْضٍ فِي الْأُكُلِ ط إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ)
“পৃথিবীতে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূখণ্ড, এতে (পৃথিবীতে) আছে বিভিন্ন আঙ্গুর-কানন, শস্যক্ষেত্র, একাধিক শীষবিশিষ্ট অথবা এক শীষবিশিষ্ট খেজুর বৃক্ষ, সিঞ্চিত একই পানিতে, এবং ফল হিসেবে তাদের কতককে কতকের ওপর আমি শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।” (সূরা রাদ ১৩:৪)
আবার তিনি পাহাড়ের মধ্যে বিচিত্র বর্ণের, যেমন শুভ্র, লাল ও কালো রাস্তা তৈরী করেছেন। যা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতার ওপর প্রমাণ বহন করে।
جُدَدٌ শব্দটি جده-এর বহুবচন, অর্থ রাস্তা বা দাগ।
غَرَابِيْبُ শব্দটি غربيب-এর বহুবচন। যখন কালো রঙের ঘনত্ব বা গাঢ়তা প্রকাশ করার জন্য أسود শব্দের সাথে غَرَابِيْبُ শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন এর অর্থ দাঁড়ায় কুচকুচে বা মিসমিসে কালো। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তা’আলা পাহাড়ে কুচকুচে কালো গিরিপথ রেখে দিয়েছেন।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা মানুষ, জীবজন্তু ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করেছেন, অথচ সবাই একই বীর্য থেকে সৃষ্টি। তাদের মধ্যে আফ্রিকার লোকজন সম্পূর্ণ কালো বর্ণের, রোমীরা হয় সম্পূর্ণ সাদা বর্ণের, আরবীরা মধ্যম বর্ণের। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَمِنْ اٰيٰتِه۪ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ط إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّلْعٰلِمِيْنَ)
“আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতা। নিশ্চয়ই এতে রয়েছে নিদর্শন জ্ঞানীদের জন্য।” (সূরা রূম ৩০:২২)
এমনকি একই প্রকারের জন্তুর মধ্যেও বিভিন্ন প্রকারের রঙ রয়েছে এবং আরো বিস্ময়ের বিষয় যে, একটি জন্তুরই দেহের বিভিন্ন অংশের রং বিভিন্ন হয়ে থাকে। এগুলো মূলত আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতার প্রমাণ বহন করে।
(إِنَّمَا يَخْشَي اللّٰهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَا۬ءُ)
-এ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলার বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই তাঁকে ভয় করে। কারণ তারা আল্লাহ তা‘আলার মহত্ত্ব ও বড়ত্ত্ব সম্পর্কে জানে ও বুঝে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার এ সকল ক্ষমতা এবং তাঁর কর্ম-নিপুণতা একমাত্র তারাই বুঝতে সক্ষম যারা জ্ঞানী। অবশ্য এ জ্ঞানী বলতে যারা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর জ্ঞানে জ্ঞানী। বলা বাহুল্য তাঁরা যত আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে, ততই আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে। সুতরাং যার মধ্যে আল্লাহ-ভীতি নেই জেনে রাখুন যে, সে সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. ‘আলিম বা জ্ঞানী লোকদের মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল যে, তারাই মূলতঃ আল্লাহকে ভয় করে।
২৯-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে দীনের এমন একটি ব্যবসায়ের সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যবসায় কোন লোকসান নেই। তা হল সৎ আমল ও উত্তম গুণাবলী অর্জন করা। যথা মু’মিনরা আল্লাহ তা‘আলার কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং তাদেরকে যা রিযিক দেয়া হয়েছে তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহ তা‘আলার পথে খরচ করে। এর দ্বারা তারা এমন এক ব্যবসা করে যে ব্যবসায় কখনো লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلٰي تِجَارَةٍ تُنْجِيْكُمْ مِّنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ – تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَرَسُوْلِه۪ وَتُجَاهِدُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ بِأَمْوٰلِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ط ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)
“হে মু’মিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন বাণিজ্যের সন্ধান দিব যা তোমাদেরকে রক্ষা করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে? (তা এই যে) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম যদি তোমরা জানতে!” (সূরা সফ ৬১:১১-১২)
সুতরাং ঈমান আনার পর আল্লাহ তা‘আলার কিতাব তেলাওয়াত, সালাত কায়েম, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা বিরাট লাভজনক ব্যবসা।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তাদেরকে তাদের এ ব্যবসায়ের প্রতিদান তিনি পুরোপুরিভাবে দেবেন এমনকি তাদেরকে আরো বৃদ্ধি করে দেবেন। আল্লাহ তা‘আলা বড় ক্ষমাশীল ও গুণগ্রাহী।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিনদের ঈমান ও অন্যান্য সৎ আমল একজন ব্যবসায়ীর মূলধনের মতোই যার মাধ্যমে তারা অধিক পরিমাণে লাভবান হবে।
২. আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করলে তা অধিক পরিমাণে পাওয়া যাবে। এর ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই।
৩১-৩২ নং আয়াতের তাফসীর:
(وَالَّذِیْٓ اَوْحَیْنَآ اِلَیْکَ …. اِنَّ اللہَ بِعِبَادِھ۪ لَخَبِیْرٌۭ بَصِیْرٌﭮ)
অত্র আয়াতে কুরআনুল কারীমের সত্যতা প্রমাণে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্বীয় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেন: হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তোমার প্রতি যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য, এতে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় নেই। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَأَنْزَلْنَآ إِلَيْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتٰبِ)
“আমি তোমার ওপর এ কিতাব অবতীর্ণ করেছি সত্যসহ যা সত্যায়নকারী পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের।” (সূরা বাকারাহ ২:২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(نَزَّلَ عَلَیْکَ الْکِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْھِ وَاَنْزَلَ التَّوْرٰٿةَ وَالْاِنْجِیْلَ)
“তিনি সত্যসহ তোমার ওপর কিতাব নাযিল করেছেন যা পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী। তিনি আরো নাযিল করেছেন তাওরাত এবং ইঞ্জিল।” (সূরা আলি ইমরান ৩:৩)
(ثُمَّ اَوْرَثْنَا الْکِتٰبَ …. ذٰلِکَ ھُوَ الْفَضْلُ الْکَبِیْرُﭯﺚ)
উক্ত আয়াতে উম্মাতে মুহাম্মাদীর মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এবং সেই সাথে আমলের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্তি রয়েছে সে কথাও বলা হয়েছে। যেমন উম্মাতে মুহাম্মাদীর মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্য একটি আয়াতে বলেন,
(وَكَذٰلِكَ جَعَلْنٰكُمْ أُمَّةً وَّسَطًا لِّتَكُوْنُوْا شُهَدَآءَ عَلَي النَّاسِ وَيَكُوْنَ الرَّسُوْلُ عَلَيْكُمْ شَهِيْدًا)
“আর এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী ন্যায়পরায়ণ উম্মত করেছি যেন তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষী হও এবং রাসূলও তোমাদের জন্য সাক্ষী হন।” (সূরা বাকারাহ ২:১৪৩)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তা‘আলা উক্ত তিন শ্রেণির বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন:
প্রথম শ্রেণি হলেন যারা তাদের নিজের প্রতি অত্যাচারী। অর্থাৎ এমন লোক, যারা কিছু ফরয বিধান পালনে শৈথিল্য করে এবং কিছু হারাম কর্মেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। অথবা ঐ সকল ব্যক্তি যারা সগীরা গুনাহ করে ফেলে।
দ্বিতীয় শ্রেণি: এরা হলো এমন লোক যারা ওয়াজীবসমূহ যথাযথভাবে পালন করে এবং হারাম কাজগুলো বর্জন করে।
তৃতীয় শ্রেণি: এরা হলো ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা ফরযসমূহ তো আদায় করেই এমনকি নফল, মুস্তাহাব কাজগুলোও যথাযথভাবে আদায় করে এবং সর্বদা হারাম কর্ম থেকে বিরত থাকে।
ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: এ তিন শ্রেণিই উম্মাতে মুহাম্মাদীর অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ প্রত্যেকটি কিতাবের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন। এদের মধ্যে নিজেদের ওপর কেউ জুলুম করেছে, তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে, কেউ মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেছে, তাদের সহজ হিসাব নেয়া হবে, আর কেউ কল্যাণ কাজে অগ্রগামী, তারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। কেউ কেউ বলেছেন: যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে তারা এ উম্মাতের অন্তভুর্ক্ত নয়। সঠিক কথা হলো তারাও এ উম্মাতের মধ্যে শামিল। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমার উম্মাতের কবীরা গুনাহকারী অপরাধীরাও আমার শাফায়াত পাবে। (তিরমিযী হা: ২৪৩৫, আবূ দাঊদ হা: ৪৭৩৯ সহীহ)
الْفَضْل বা অনুগ্রহ দ্বারা যে অনুগ্রহ করার কথা বলা হয়েছে তা হলোন তাদেরকে এ কিতাব দেয়ার জন্য মনোনীত করা এবং তা দান করা। আর এটাই হলো সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ।
আমরা যেন সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার ফরযসহ অন্যান্য ইবাদত পালন করত হারাম কাজ বর্জন করে তৃতীয় শ্রেণির লোকের মধ্যে শামিল হয়ে সৌভাগ্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন একটি সত্য কিতাব যাতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই এবং এটি পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা প্রমাণকারী।
২. উম্মাতে মুহাম্মাদীর মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হলাম।
৩. উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে আমলের দিক দিয়ে তিন শ্রেণির মানুষ রয়েছে। একটি হলো নিজের প্রতি অত্যাচারী, অপরটি হলো মধ্যমপন্থী এবং তৃতীয়টি হলো কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২৭-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:
প্রতিপালকের পরিপূর্ণ ক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য করলে বিস্মিত হতে হয় যে, একই প্রকারের বস্তুর মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের নমুনা চোখে পড়ে! আসমান হতে একই পানি বর্ষিত হয়, আর এই পানি হতে বিভিন্ন রং বেরং-এর ফল উৎপাদিত হয়। যেমন লাল, সবুজ, সাদা ইত্যাদি। এগুলোর প্রত্যেকটির স্বাদ পৃথক, গন্ধ পৃথক। যেমন অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “কোথাও আঙ্গুর কোথাও খেজুর আবার কোথাও শস্য ইত্যাদি।” (১৩:৪)
অনুরূপভাবে পাহাড়ের সৃষ্টিও বিভিন্ন প্রকারের। কোনটি সাদা, কোনটি লাল . এবং কোনটি কালো। কোনটিতে রাস্তা ও ঘাঁটি আছে, কোনটি দীর্ঘ এবং কোনটি অসমতল। এই প্রাণহীন জিনিসের পর এখন প্রাণীসমূহের প্রতি লক্ষ্য করা যাক।
এদের মধ্যেও আল্লাহ তা’আলার বিভিন্ন প্রকারের কারিগরী দেখতে পাওয়া যায়। মানুষ, জানোয়ার এবং চতুষ্পদ জন্তুর প্রতি লক্ষ্য করলে তাদের বিভিন্ন প্রকার অসামঞ্জস্য দেখা যাবে। মানুষের মধ্যে বার্বার, হাবশী এবং তামাতিমরা সম্পূর্ণ কালো বর্ণের হয়ে থাকে। রোমীরা হয় অত্যন্ত সাদা বর্ণের, আরবীয় মধ্যম ধরনের এবং ভারতীয়রা তাদের কাছাকাছি। এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র, এতে জ্ঞানীদের জন্যে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।” (৩০:২২) অনুরূপভাবে চতুষ্পদ জন্তু ও অন্যান্য প্রাণীর রং এবং রূপও পৃথক পৃথক। এমনকি একই প্রকারের জন্তুর মধ্যেও বিভিন্ন প্রকারের রং রয়েছে এবং আরো বিস্ময়ের বিষয় যে, একটি জন্তুরই দেহের রং বিভিন্ন হয়ে থাকে। সুবহানাল্লাহ্! সবচেয়ে উত্তম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কতই না কল্যাণময়!
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক নবী (সঃ)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেঃ “আপনার প্রতিপালক কি রং করে থাকেন?” উত্তরে নবী (সঃ) বলেনঃ “হ্যা, তিনি এমন রং করেন যা কখনো উঠে যায় না। যেমন লাল, হলদে, সাদা।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটিকে মুসাল ও মাওকুফ বলা হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই তাকে ভয় করে। কারণ তারা জানে ও বুঝে। প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি যত বেশী আল্লাহ সম্বন্ধে অবগত হবে ততই সে মহান, শক্তিশালী ও জ্ঞানী আল্লাহর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হবে এবং তার অন্তরে তাঁর ভয় তত বেশী হবে। যে জানবে যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান সে পদে পদে তাঁকে ভয় করতে থাকবে। আল্লাহ সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান তার অন্তরে স্থান পাবে। সে তার সাথে কাউকেও শরীক করবে না। তাঁর কৃত হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম জানবে। তার কথার প্রতি বিশ্বাস রাখবে এবং তার কথা রক্ষা করতে চেষ্টা করবে। তার সাথে সাক্ষাৎকে সে সত্য বলে মেনে নিবে। ভীতিও একটি শক্তি। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে এ ভীতি পর্দা স্বরুপ দাঁড়িয়ে থাকে। আল্লাহর নাফরমানীর মাখঝানে এটা বাধা হয়ে যায়। হসান বসরী (রঃ) বলেন যে, আলেম তাকেই বলে যে আল্লাহকে না দেখেই তাকে ভয় করে এবং তাঁর সন্তুষ্টির কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে ও তাঁর অসন্তুষ্টির কাজকে ঘৃণা করে এবং তা হতে বিরত থাকে।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, কথা বেশী বলার নাম ইলম নয়, বরং ইলম বলা হয় আল্লাহকে অধিক ভয় করাকে। ইমাম মালিক (রঃ)-এর উক্তি আছে যে, অধিক রিওয়াইয়াত করার নাম ইলম নয়, বরং ইলম একটা জ্যোতি যা আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দার অন্তরে ঢেলে দেন।
হযরত আহমাদ ইবনে সালেহ মিসরী (রঃ) বলেন যে, ইলম অধিক রিওয়াইয়াত করার নাম নয়, বরং ইলম তাকে বলে যার অনুসরণ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে ফরয করা হয়েছে। অর্থাৎ কিতাব ও সুন্নাহ, যেগুলো সাহাবী ও ইমামদের মাধ্যমে পৌঁছেছে। যেগুলো রিওয়াইয়াত দ্বারাই আবার পৌঁছে থাকে। জ্যোতি বান্দার আগে আগে থাকে, সে তার দ্বারা ইলমকে ও তার মতলবকে বুঝে থাকে। বর্ণিত আছে যে, আলেম তিন প্রকারের রয়েছে। তারা হলোঃ আল্লাহ সম্পর্কে আলেম ও আল্লাহর আদেশ সম্পর্কে আলেম, আল্লাহ সম্পর্কে আলেম ও আল্লাহর আদেশ সম্পর্কে আলেম নয় এবং আল্লাহর আদেশ সম্পর্কে আলেম ও আল্লাহ সম্পর্কে আলেম নয়। সুতরাং আল্লাহ সম্পর্কে আলেম ও তার আদেশ সম্পর্কেও আলেম হলো ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর হুদূদ ও ফারায়েযকেও জানে। আলেম বিল্লাহ হলো ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহকে ভয় করে বটে, কিন্তু তার হুদূদ ও ফারায়েযের জ্ঞান রাখে না। আর আলেম বিআমরিল্লাহ হলো ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর হুদূদ ও ফারায়েয সম্পর্কে জ্ঞান রাখে বটে, কিন্তু তার অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকে না।
২৯-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা তার মুমিন বান্দাদের উত্তম গুণাবলীর বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়নে রত থাকে, ঈমানের সাথে তা পাঠ করে, ভাল আমল ছেড়ে দেয় না, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় ও দান-খয়রাত করে, গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করে, আল্লাহর বান্দাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে এবং এসবের সওয়াবের আশা শুধু আল্লাহর কাছে করে, আর তা পাওয়া নিশ্চিতরূপেই সত্য। যেমন এই তাফসীরের শুরুতে ফাযায়েলে কুরআনের বর্ণনায় আমরা আলোচনা করেছি যে, কুরআন কারীম ওর পাঠককে বলবেঃ “প্রত্যেক ব্যবসায়ী তার ব্যবসার পিছনে লেগে থাকে, আর তুমি আজ সমস্ত ব্যবসার পিছনে রয়েছ।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দিবেন এবং তিনি নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বেশী দিবেন যা তাদের কল্পনায়ও থাকবে না। আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল এবং বড় গুণগ্রাহী। ছোট ছোট আমলেরও তিনি মর্যাদা দিয়ে থাকেন।
হযরত মাতরাফ (রঃ) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলতেন যে, এটা কারীদের আয়াত।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা তাঁর যে বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন তার এমন সাত প্রকারের সকার্যের তিনি প্রশংসা করেন যা সে করেনি। আর যে বান্দার প্রতি অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হন তার এমন সাত প্রকারে দুষ্কার্যের তিনি নিন্দে করেন যা সে করেনি।”
# আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আমি তোমার প্রতি যে কিতাব অর্থাৎ কুরআন অবতীর্ণ করেছি তা সত্য। পূর্ববর্তী কিতাবগুলো যেমন এর সত্যতার খবর দেয়, অনুরূপভাবে এই কিতাবও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতার সমর্থক। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের সবকিছু জানেন ও দেখেন। অনুগ্রহের হকদার কে তিনি তা ভালরূপেই জানেন। নবীদেরকে তিনি স্বীয় প্রশস্ত জ্ঞানে সাধারণ লোকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। অতঃপর নবীদেরও পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা ও ফযীলত নির্ধারণ করেছেন এবং সাধারণভাবে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর মর্যাদা সবচেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন। নবীদের সবারই প্রতি আল্লাহর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক!
# আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি এই সম্মানিত কিতাব অর্থাৎ কুরআন কারীম আমার মনোনীত বান্দাদের হাতে প্রদান করেছি অর্থাৎ এই উম্মতে মুহাম্মাদীর (সঃ) হাতে। অতঃপর তাদের মধ্যে তিন প্রকারের লোক হয়ে যায়। কেউ কেউ তো কিছু আগে-পিছে হয়ে যায়, তাদেরকে নিজের প্রতি অত্যাচারী বলা হয়েছে। তাদের দ্বারা কিছু হারাম কাজও হয়ে যায়। আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ মধ্যপন্থী রয়েছে, যারা হারাম থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং ওয়াজিবগুলো পালন করেছে, কিন্তু মাঝে মাঝে মুস্তাহাব কাজগুলো তাদের ছুটেও গিয়েছে এবং কখনো কখনো সামান্য অপরাধও তাদের হয়ে গেছে। আর কতকগুলো লোক আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণের কাজে অগ্রগামী রয়েছে। ওয়াজিব কাজগুলো তো তারা পালন করেছেই, এমনকি মুস্তাহাব কাজগুলোকেও তারা কখনো ছাড়েনি। আর হারাম কাজগুলো হতে তো দূরে থেকেছেই, এমনকি মাকরূহ কাজগুলোকেও ছেড়ে দিয়েছে। তাছাড়া কোন কোন সময় মুবাহ কাজগুলোকেও ভয়ে পরিত্যাগ করেছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, মনোনীত বান্দা দ্বারা উম্মতে মুহাম্মাদিয়াকে (সঃ) বুঝানো হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহর সব কিতাবেরই ওয়ারিস বানিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছে তাদেরকে ক্ষমা করা হবে। তাদের মধ্যে যারা মধ্যপন্থী তাদের সহজভাবে হিসাব নেয়া হবে। আর যারা কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী তাদেরকে বিনা হিসাবে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ বলেনঃ “আমার উম্মতের কাবীরা গুনাহকারীদের জন্যেই আমার শাফা’আত।” (এ হাদীসটি আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী লোকেরা তো বিনা হিসাবেই জান্নাতে চলে যাবে। আর নিজেদের উপর অত্যাচারকারী ও আরাফবাসীরা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর শাফা’আতের বলে জান্নাতে যাবে। মোটকথা, এই উম্মতের হালকা পাপকারীরাও আল্লাহ তাআলার মনোনীত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। পূর্বযুগীয় অধিকাংশ গুরুজনের উক্তি এটাই বটে। কিন্তু পূর্বযুগীয় কোন কোন মনীষী এটাও বলেছেন যে, এ লোকগুলো না এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত, না তারা আল্লাহর মনোনীত বান্দা এবং না তারা আল্লাহর কিতাবের ওয়ারিশ। বরং এর দ্বারা কাফির, মুনাফিক ও বাম হাতে আমলনামা প্রাপকদেরকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এই তিন প্রকারের লোক তারাই যাদের বর্ণনা সূরায়ে ওয়াকিয়ার প্রথমে ও শেষে রয়েছে। অর্থাৎ এই তিন প্রকার যে গণনা করা হয়েছে তারা মনোনীত বান্দা নয়, বরং তারা সেই বান্দা যারা (আরবী) বলে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু সঠিক উক্তি এটাই যে, তারা এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। ইবনে জারীরও (রঃ) এটাকে গ্রহণ করেছেন এবং আয়াতের বাহ্যিক শব্দগুলোও এটাই প্রমাণ করে। হাদীসসমূহ দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হয়।
প্রথম হাদীসঃ হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে (আরবী) -এই আয়াতের ব্যাপারে নবী (সঃ) বলেছেনঃ “এরা (এই তিন প্রকারের) সবাই একই মর্যাদা সম্পন্ন এবং তারা সবাই জান্নাতী।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি গারীব এবং এতে এমন একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন যার নাম উল্লেখ করা হয়নি। হাদীসটির ভাবার্থ এই যে, এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দিক দিয়ে এবং জান্নাতী হওয়ার দিক দিয়ে তিন প্রকারের লোকই যেন একই। হ্যাঁ, তবে মর্যাদার দিক দিয়ে তাদের মধ্যে পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে)
দ্বিতীয় হাদীসঃ হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করার পর বলেনঃ “কল্যাণের কাজে যারা অগ্রগামী তারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে, মধ্যপন্থী লোকদের সহজভাবে হিসাব নেয়া হবে এবং যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছে তাদেরকে ময়দানে মাশারে আটক রাখা হবে। অতঃপর আল্লাহর রহমতে তারা মাফ পেয়ে যাবে। তারা বলবেঃ ঐ আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করেছেন, আমাদের প্রতিপালক তো ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী। যিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে স্থায়ী আবাস দিয়েছেন যেখানে ক্লেশ আমাদেরকে স্পর্শ করে না এবং ক্লান্তিও স্পর্শ করে না।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমেও হাদীসটি সামান্য রদবদলসহ বর্ণিত আছে। তাফসীরে ইবনে জারীরেও হাদীসটি উল্লিখিত হয়েছে। তাতে আছে। যে, হযরত আবূ সাবিত (রাঃ) মসজিদে এসে হযরত আবু দারদা (রাঃ)-এর পাশে বসে পড়েন এবং বলেনঃ “হে আল্লাহ! আমার ভীতি দূর করে দিন, আমার অসহায়তার উপর দয়া করুন এবং আমাকে একজন উত্তম সাথী ও বন্ধু মিলিয়ে দিন।” তাঁর এই প্রার্থনা শুনে হযরত আবু দারদা (রাঃ) তাঁকে বললেন, তুমি যদি তোমার এ কথায় সত্যবাদী হও তবে আমি তোমার বন্ধু ও সাথী। তোমাকে আমি একটি হাদীস শুনাচ্ছি যা আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে শুনেছি এবং আজ পর্যন্ত ঐ হাদীসটি আমি কাউকেও শুনাইনি। তিনি (নবী সঃ) (আরবী)-এই আয়াতটি পাঠ করে বলেছেনঃ “কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী লোকেরা বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যাবে। আর মধ্যপন্থী লোকদের সহজ হিসাব নেয়া হবে এবং নিজেদের উপর অত্যাচারীকে ঐ স্থানে দুঃখ-কষ্ট পৌঁছানো হবে। আল্লাহর রহমতে তাদের দুঃখ-কষ্ট ও চিন্তা-ভাবনা দূর হলে তারা বলবেঃ প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করেছেন।”
তৃতীয় হাদীসঃ হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবী) এ আয়াত সম্পর্কে বলেনঃ “এদের সবাই এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) চতুর্থ হাদীস ও হযরত আউফ ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের তিনটি অংশ হবে। একটি অংশ বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। দ্বিতীয় অংশের অতি সহজ করে হিসাব নেয়া হবে। অতঃপর তারা জান্নাতে চলে যাবে। তীয় দলকে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং তাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে। কিন্তু ফেরেশতারা হাযির হয়ে বলবেনঃ “আমরা তাদেরকে এমন অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা (আরবী) লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ বলতে রয়েছে।” তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “তারা। সত্য বলেছে। আমি ছাড়া কেউ মাবুদ নেই। তাদের (আরবী) লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ বলার কারণে তাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট কর এবং তাদের পাপগুলো জাহান্নামীদের উপর চাপিয়ে দাও।” এরই বর্ণনা (আরবী) এই আয়াতে রয়েছে। অর্থাৎ তারা নিজেদের (পাপের) বোঝাসহ তাদের বোঝা বহন করবে।'(২৯:১৩) এর সত্যতা তাতেই রয়েছে যাতে ফেরেশতাদের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে কিতাবের ওয়ারিশ বানিয়েছেন তাদের বর্ণনা দিয়ে তাদের তিনটি শ্রেণীর কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছে তাদের পুরোপুরিভাবে হিসাব নেয়া হবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি খুবই গারীব বা দুর্বল)
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, কিয়ামতের দিন এই উম্মতের তিনটি দল হবে। একটি দল বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যাবে, একটি দলের সহজভাবে হিসাব নেয়া হবে এবং একটি দল পাপী হবে যাদেরকে আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, অথচ তিনি দলটিকে ভালরূপেই জানেন। ফেরেশতারা বলবেনঃ “হে আল্লাহ! এদের বড় বড় পাপ রয়েছে, কিন্তু তারা আপনার সাথে কাউকেও শরীক করেনি।” তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “তাদেরকে আমার রহমতের মধ্যে দাখিল করে দাও।” অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ আয়াতটিই পাঠ করেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হ্যরত সানুল হানাঈ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে (আরবী) -এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “হে বৎস! এরা সব জান্নাতী লোক। (আরবী) (কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী) লোক তারাই যারা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর যুগে ছিল। যাদেরকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। (আরবী) (মধ্যপন্থী) লোক তারাই যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পদাংক অনুসরণ করতো এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাঁর সাথে মিলে যায়। আর (আরবী) হলো আমার তোমার মত লোক।” (এটা আবূ দাউদ তায়ালেসী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এটা আমাদের খেয়াল করা উচিত যে, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) তো (আরবী) অর্থাৎ কল্যাণকর কাজে অগ্রগামীদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, এমন কি তাদের চেয়েও উত্তম ছিলেন। অথচ তিনি শুধু বিনয় প্রকাশার্থে নিজেকে কত নীচে নামিয়ে দিয়েছেন! হাদীসে এসেছে যে, সমস্ত স্ত্রী লোকের উপর হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর এমন ফযীলত রয়েছে যেমন ‘সারীদ’ নামক খাদ্যের ফযীলত রয়েছে সমস্ত খাদ্যের উপর।
হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) হলো আমাদের গ্রাম্য লোকেরা, (আরবী) হলো আমাদের শহরের লোকেরা এবং (আরবী) হলো আমাদের মুজাহিদরা। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত কা’ব আহবার (রঃ) বলেন যে, এই তিন প্রকারের লোকই এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত এবং এরা সবাই জান্নাতী। কেননা, আল্লাহ তা’আলা এই তিন প্রকার লোকের বর্ণনা দেয়ার পর জান্নাতের উল্লেখ করেছেন অতঃপর বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ যারা কুফরী করেছে তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন। সুতরাং এ লোকগুলো জাহান্নামী। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত কা’ব (রাঃ)-কে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “কা’ব (রাঃ)-এর প্রতিপালকের শপথ! এরা সব একই দলের লোক। হাঁ, তবে আমল অনুপাতে তাদের মর্যাদা কম ও বেশী হবে।” আবু ইসহাক (রঃ) এ আয়াতের ব্যাপারে বলেন যে, এই তিন দলই মুক্তিপ্রাপ্ত। মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়্যাহ (রঃ) বলেন যে, এটা দয়া ও অনুগ্রহ প্রাপ্ত উম্মত। এ উম্মতের পাপীদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে, এর মধ্যপন্থীরা আল্লাহর নিকট জান্নাতে থাকবে এবং এর কল্যাণকর কার্যে অগ্রগামী দল উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। মুহাম্মাদ ইবনে আলী বাকির (রাঃ) বলেন যে, এখানে যে লোকদেরকে (আরবী) বলা হয়েছে তারা হলো ঐ সব লোক যারা পাপও করেছে, পুণ্যও করেছে।
এসব হাদীস ও আসার দ্বারা এটা পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, এ আয়াতটি এই উম্মতের এ তিন প্রকার লোকের ব্যাপারে সাধারণ। সুতরাং আলেমগণ এই নিয়ামতের উপর লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ঈর্ষার পাত্র এবং এই নিয়ামতের তাঁরাই সবচেয়ে বেশী হকদার। যেমন কায়েস ইবনে কাসীর (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মদীনাবাসী একজন লোক দামেস্কে হযরত আবু দারদা (রাঃ)-এর নিকট গমন করে। তখন হযরত আবূ দারদা (রাঃ) লোকটিকে জিজ্ঞেস করেনঃ “ভাই! তোমার এখানে আগমনের কারণ কি? উত্তরে লোকটি বলেঃ “একটি হাদীস শুনবার জন্যে যা আপনি রাসূলুল্লাহ (সঃ) থেকে বর্ণনা করে থাকেন।” তিনি বললেনঃ “কোন ব্যবসার উদ্দেশ্যে আসনি তো?” জবাবে সে বললোঃ “না।” তিনি আবার প্রশ্ন করলেনঃ “অন্য কোন প্রয়োজনে এসেছো কি?” সে উত্তর দিলোঃ “না।” তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ “তাহলে তুমি কি শুধু এই হাদীসের সন্ধানেই এসেছো?” সে জবাব দিলোঃ “জ্বি, হ্যাঁ।” তখন তিনি বললেনঃ “নিশ্চয়ই আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি- “যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে সফরে বের হয়, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথে চালিত করেন এবং (রহমতের) ফেরেশতারা ইলম অনুসন্ধানকারীর উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাদের উপর তাঁদের ডানা বিছিয়ে দেন। আসমান ও যমীনে অবস্থানকারী সবাই বিদ্যানুসন্ধানীর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে, এমনকি পানির মধ্যে মাছগুলোও (ক্ষমা প্রার্থনা করে)। (মূখ) আবেদের উপর আলেমের ফযীলত এমনই যেমন চন্দ্রের ফযীলত সমস্ত তারকার উপর। নিশ্চয়ই আলেমরা নবীদের ওয়ারিশ। আর নবীরা দ্বীনার (স্বর্ণমুদ্রা) ও দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা)-এর ওয়ারিশ করেন না, বরং তারা ওয়ারিশ করেন ইলমের। যে তা গ্রহণ করে সে খুব বড় সম্পদ লাভ করে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইবনে মাজাহ্ (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন) আমি এ হাদীসের সমস্ত ধাৱা, শব্দ এবং ব্যাখ্যা সহীহ বুখারীর কিতাবুল ইলম-এর শরাতে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে। সূরায়ে তোয়া-হার শুরুতে ঐ হাদীসটি গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন আলেমদেরকে বলবেনঃ “আমি তোমাদেরকে ইলম ও হিকমত শুধু এ জন্যেই দান করেছি যে, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করতে চাই, তোমাদের দ্বারা যা-ই কিছু হয়ে থাক না কেন আমি তার কোন পরোয়া করি না।”
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ দ্বারা যে কথা বুঝতে চাওয়া হয়েছে তা এই আল্লাহর সৃষ্ট এ বিশ্ব-জাহানে কোথাও একঘেয়েমি ও বৈচিত্রহীনতা নেই। সর্বত্রই বৈচিত্র। একই মাটি ও একই পানি থেকে বিভিন্ন প্রকার গাছ উৎপন্ন হচ্ছে। একই গাছের দু’টি ফলেরও বর্ণ, দৈহিক কাঠামো ও স্বাদ এক নয়। একই পাহাড়ের দিকে তাকালে তার মধ্যে দেখা যাবে নানা রংগের বাহার। তার বিভিন্ন অংশের বস্তুগত গঠন প্রণালীতে বিরাট পার্থক্য পাওয়া যাবে। মানুষ ও পশুদের মধ্যে একই মা-বাপের দু’টি সন্তানও একই রকম পাওয়া যাবে না। এ বিশ্ব-জাহানে যদি কেউ মেজাজ, প্রকৃতি ও মানসিকতার একাত্মতা সন্ধান করে এবং বিভিন্নতা, বৈচিত্রতা ও বৈষম্য দেখে আতংকিত হয়ে পড়ে, যেদিকে ওপরের ১৯ থেকে ২২ আয়াতে ইশারা করা হয়েছে, তাহলে এটা হবে তার নিজের বোধশক্তি ও উপলব্ধির ত্রুটি। এই বৈচিত্র ও বিরোধই জানিয়ে দিচ্ছে এ বিশ্ব-জাহানকে কোন মহাপরাক্রমশালী জ্ঞানী সত্তা বহুবিধ জ্ঞান ও বিজ্ঞতা সহকারে সৃষ্টি করেছেন এবং এর নির্মাতা একজন নজীরবিহীন স্রষ্টা ও তুলনাবিহীন নির্মাণ কৌশলী। তিনি একই জিনিসের কেবল একটি মাত্র নমুনা নিয়ে বসে পড়েননি। বরং তাঁর কাছে প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য একের পর এক এবং অসংখ্য ও সীমাহীন ডিজাইন রয়েছে। তারপর বিশেষ করে মানবিক প্রকৃতি ও বুদ্ধি বৈচিত্র সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে যে কোন ব্যক্তি একথা বুঝতে পারে যে, এটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয় বরং প্রকৃতপক্ষে অতুলনীয় সৃষ্টি জ্ঞানের নিদর্শন। যদি জন্মগতভাবে সমস্ত মানুষকে তাদের নিজেদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, প্রবৃত্তি, কামনা, আবেগ অনুভূতি ঝোঁক প্রবণতা ও চিন্তাধারার দিক দিয়ে এক করে দেয়া হতো এবং কোন প্রকার বৈষম্য বিভিন্নতার কোন অবকাশই না রাখা হতো তাহলে দুনিয়ায় মানুষের মতো একটি নতুন ধরনের সৃষ্টি তৈরি করাই হতো পুরাপুরি অর্থহীন। স্রষ্টা যখন এ পৃথিবীতে একটি দায়িত্বশীল ও স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী সৃষ্টিকে অস্তিত্বশীল করার ফায়সালা করেছেন তখন তার কাঠামোর মধ্যে সব রকমের বিচিত্রতা ও বিভিন্নতার অবকাশ রাখা ছিল সে ফায়সালার ধরনের অনিবার্য দাবী। মানুষ যে কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল নয় বরং একটা মহান বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার ফলশ্রুতি, এ জিনিসটি এর সবচেয় বড় সাক্ষ্য প্রদান করে। আর একথা সুস্পষ্ট যে, বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই অনিবার্যভাবে তার পেছনে পাওয়া যাবে এক বিজ্ঞানময় সত্তার সক্রিয় সংযোগ। বিজ্ঞানী ছাড়া বিজ্ঞানের অস্তিত্ব কেবলমাত্র একজন নির্বোধই কল্পনা করতে পারে।
# যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলীর ব্যাপারে যতবেশী অজ্ঞ হবে সে তার ব্যাপারে তত বেশী নির্ভীক হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর শক্তিমত্তা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানময়তা, ক্রোধ, পরাক্রম সার্বভৌম কর্তৃত্ব-ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাবালী সম্পর্কে যে ব্যক্তি যতবেশী জানবে সে ততবেশী তার নাফরমানী করতে ভয় পাবে। কাজেই আসলে এ আয়াতে জ্ঞান অর্থ দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অংক ইত্যাদি স্কুল কলেজে পঠিত বিষয়ের জ্ঞান নয়। বরং এখানে জ্ঞান বলতে আল্লাহর গুণাবলীর জ্ঞান বুঝানো হয়েছে। এজন্য শিক্ষিত ও অশিক্ষিত হবার প্রশ্ন নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না সে যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হলেও এ জ্ঞানের দৃষ্টিতে সে নিছক একজন মূর্খ ছাড়া আর কিছু নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলী জানে এবং নিজের অন্তরে তাঁর ভীতি পোষণ করে সে অশিক্ষিত হলেও জ্ঞানী। এ প্রসঙ্গে একথাও জেনে রাখা উচিত যে, আয়াতে উল্লেখিত উলামা শব্দটির অর্থ এমন পারিভাষিক উলামাও নয় যারা কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও ইলমে কালামে জ্ঞান রাখার কারণে দ্বীনী আলেম বলে পরিচিত। তারা সঠিক তখনই এ আয়াতটির প্রয়োগ ক্ষেত্রে পরিণত হবে যখন তাদের মধ্যে আল্লাহভীতি থাকবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একথাই বলেছেনঃ
ليس العلم عن كثرة الحديث ولكن العلم عن كثرة الخشية “বিপুল সংখ্যক হাদীস জানা জ্ঞানের পরিচায়ক নয় বরং বেশী পরিমাণ আল্লাহভীতিই জ্ঞানের পরিচয় বহন করে।”
হযরত হাসান বাসরীও একথাই বলেছেনঃ
العالم من خشى الرحمن بالغيب ورغب فيما رغب الله فيه وزهد فيما سخط الله فيه-
“আল্লাহকে না দেখে যে ভয় করে সেই হচ্ছে আলেম। আল্লাহ যা কিছু পছন্দ করেন সেদিকেই আকৃষ্ট হয় এবং যে বিষয়ে আল্লাহ নারাজ সে ব্যাপারে সে কোন আগ্রহ পোষণ করে না।”
# তিনি এমন পরাক্রমশালী যে, নাফরমানদের যখনই চান পাকড়াও করতে পারেন। তাঁর পাকড়াও মুক্ত হবার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু তাঁর ক্ষমতাগুণের ফলেই জালেমরা অবকাশ পেয়ে চলছে।
# ঈমানদারদের এ কাজকে ব্যবসায়ের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। কারণ মানুষ ব্যবসায়ে নিজের অর্থ, শ্রম ও মেধা নিয়োগ করে কেবলমাত্র আসল ফেরত পাবার এবং শ্রমের পারিশ্রমিক লাভ করার জন্য নয় বরং বাড়তি কিছু মুনাফা অর্জন করার জন্য। অনুরূপভাবে একজন মু’মিন ও আল্লাহর হুকুম পালন, তাঁর ইবাদাত-বন্দেগী এবং তাঁর দ্বীনের জন্য সংগ্রাম-সাধনায় নিজের ধন, সময়, শ্রম ও যোগ্যতা নিয়োগ করে শুধুমাত্র এসবের পুরোপুরি প্রতিদান লাভ করার জন্য নয় বরং এই সঙ্গে আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে বাড়তি অনেক কিছু দান করবেন এই আশায়। কিন্তু উভয় ব্যবসায়ের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ পার্থিব ব্যবসায়ে নিছক মুনাফা লাভেরই আশা থাকে না, লোকসান এবং দেউলিয়া হয়ে যাবার আশঙ্কাও থাকে। কিন্তু একজন আন্তরিকতা সম্পন্ন বান্দা আল্লাহর সাথে যে ব্যবসায় করে তাতে লোকসান ও ক্ষতির কোন আশঙ্কাই নেই।
# নিজের আন্তরিকতা সম্পন্ন মু’মিনদের সাথে আল্লাহ এমন সংকীর্ণমনা প্রভুর মতো ব্যবহার করেন না, যে কথায় কথায় পাকড়াও করে এবং সামান্য একটি ভুলের দরুন নিজের কর্মচারীর সমস্ত সেবা ও বিশ্বস্ততা অস্বীকার করে। তিনি মহানুভব দানশীল প্রভু। তাঁর বিশ্বস্ত বান্দার ভুল ভ্রান্তি তিনি উপেক্ষা করে যান এবং তার পক্ষে যা কিছু সেবা করা সম্ভব হয়েছে তাকে যথার্থ মূল্য দান করেন।
# এর অর্থ হচ্ছে, পূর্বে আগত নবীগণ যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তিনি তার বিরোধী কোন নতুন কথা বলছেন না। বরং সকল নবী চিরকাল যে আদি ও চিরন্তন সত্য পেশ করে গেছেন তিনি তারই পুনরাবৃত্তি করছেন।
# বান্দার কল্যাণ কোন্ জিনিসের মধ্যে রয়েছে তার নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের উপযোগী নীতি কি এবং তার প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ নীতি নিয়ম কি কি এ সত্যগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়াই হচ্ছে এখানে আল্লাহর এ গুণাবলী বর্ণনা করার উদ্দেশ্য। এ বিষয়গুলো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। কারণ বান্দার প্রকৃতি ও চাহিদা একমাত্র তিনিই জানেন এবং তার প্রকৃত প্রয়োজন ও কল্যাণের প্রতি একমাত্র তিনিই দৃষ্টি রাখেন। বান্দা নিজেকে তত বেশী জানে না যত বেশী তার স্রষ্টা তাকে জানেন। তাই সত্য সেটিই এবং একমাত্র সেটিই হতে পারে যা তিনি অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন।
# মুসলমানদেরকে। সমগ্র মানবজাতি থেকে ছাঁটাই বাছাই করে তাদেরকে বের করা হয়েছে। এভাবে তারা হবে আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং মুহাম্মাদ ﷺ এর পরে এ কিতাব নিয়ে তারা অগ্রসর হবে। যদিও কিতাব পেশ করা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির সামনে কিন্তু যারা এগিয়ে এসে তা গ্রহন করে নিয়েছে তাদেরকে এ মর্যাদা ও গৌরবের জন্য নির্ধারিত করে নেয়া হয়েছে যে, তারাই হবে কুরআনের ন্যায় মহিমান্বিত কিতাবের ওয়ারিস এবং মুহাম্মাদ ﷺ এর ন্যায় মহান রসূলের শিক্ষা ও হিদায়াতের বিশ্বস্ত সংরক্ষক।
# এ মুসলমানরা সবাই একরকম নয়। বরং এরা তিন শ্রেনীতে বিভক্ত হয়ে গেছেঃ
একঃ নিজেদের প্রতি জুলুমকারী। এরা হচ্ছে এমন সব লোক যারা আন্তরিকতা সহকারে কুরআনকে আল্লাহর কিতাব এবং মুহাম্মাদ ﷺ কে আল্লাহর রসূল বলে মানে কিন্তু কার্যত আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের অনুসরণের হক আদায় করে না। এরা মু’মিন কিন্তু গোনাহগার। অপরাধী কিন্তু বিদ্রোহী নয়। দুর্বল ঈমানদার, তবে মুনাফিক এবং চিন্তা ও মননের দিক দিয়ে কাফের নয়। তাই এদেরকে আত্মনিপীড়ক হওয়া সত্ত্বেও কিতাবের ওয়ারিসদের অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাদের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। নয়তো একথা সুস্পষ্ট, বিদ্রোহী, মুনাফিক এবং চিন্তা ও মননের দিক দিয়ে কাফেরদের প্রতি এ গুণাবলী আরোপিত হতে পারে না। তিন শ্রেণীর মধ্য থেকে এ শ্রেণীর ঈমানদারদের কথা সবার আগে বলার কারণ হচ্ছে এই যে, উম্মাতের মধ্যে এদের সংখ্যাই বেশী।
দুইঃ মাঝামাঝি অবস্থানকারী। এরা হচ্ছে এমন লোক যারা এ উত্তরাধিকারের হক কমবেশী আদায় করে কিন্তু পুরোপুরি করে না। হুকুম পালন করে এবং অমান্যও করে। নিজেদের প্রবৃত্তিকে পুরোপুরি লাগামহীন করে ছেড়ে দেয়নি বরং তাকে আল্লাহর অনুগত করার জন্য নিজেদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু কখনো তার বাগডোর ঢিলে করে দেয় এবং গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এভাবে এদের জীবনে ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের কাজের সমাবেশ ঘটে। এরা সংখ্যায় প্রথম দলের চাইতে কম এবং তৃতীয় দলের চেয়ে বেশী হয়। তাই এদেরকে দু’নম্বরে রাখা হয়েছে।
তিনঃ ভালো কাজে যারা অগ্রবর্তী। এরা হয় কিতাবের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রথম সারির লোক। এরাই আসলে এ উত্তরাধিকারের হক আদায়কারী। কুরআন ও সুন্নাতের অনুসরণের ক্ষেত্রেও এরা অগ্রগামী। আল্লাহর পয়গাম তাঁর বান্দাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার ক্ষেত্রেও এরা এগিয়ে থাকে। সত্যদ্বীনের জন্য ত্যাগ স্বীকারেও এরাই এগিয়ে যায়। তাছাড়া সত্য, ন্যায়, সুকৃতি ও কল্যাণের যে কোন কাজেও এরাই হয় অগ্রবর্তী। এরা জেনে বুঝে গোনাহ করে না। আর অজান্তে কোন গোনাহর কাজ অনুষ্ঠিত হলেও সে সম্পর্কে জানার সাথে সাথেই এদের মাথা লজ্জায় নত হয়ে যায়। প্রথম দু’টি দলের তুলনায় উম্মাতের মধ্যে এদের সংখ্যা কম। তাই এদের কথা সবার শেষে বলা হয়েছে, যদিও উত্তরাধিকারের হক আদায় করার ক্ষেত্রে এরাই অগ্রগামী।
“এটিই অনেক বড় অনুগ্রহ” বাক্যটির সম্পর্ক যদি নিকটতম বাক্যের সাথে ধরে নেয়া হয় তাহলে এর অর্থ হবে, ভালো কাজে অগ্রগামী হওয়াই হচ্ছে বড় অনুগ্রহ এবং যারা এমনটি করে মুসলিম উম্মাতের মধ্যে তারাই সবার সেরা। আর এ বাক্যটির সম্পর্ক পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে মিল রেখে করা হলে এর অর্থ হবে, আল্লাহর কিতাবের হওয়া এবং এ উত্তরাধিকারের জন্য নির্বাচিত হওয়াই বড় অনুগ্রহ এবং আল্লাহর সকল বান্দাদের মধ্যে সেই বান্দাই সর্বশ্রেষ্ঠ যে কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান এনে নির্বাচনে সফলকাম হয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
অতপর শুরু হচ্ছে নতুন এক অধ্যায়, যা এক প্রশস্ত ও দিগন্তব্যাপী উপত্যকায় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। (আয়াত ২৭-৩৮) এ অধ্যায়ের আলােচনায় সৃষ্টির বুকে ছড়িয়ে থাকা বিশাল গ্রন্থ ও আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত কিতাবের তুলনামূলক আলােচনা করা হয়েছে। বিশাল প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা বিশাল গ্রন্থের সুবিস্তীর্ণ ও চমৎকার পাতাগুলাে থেকে এ পাঠ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ পাতাসমূহের রং বিভিন্ন প্রকৃতি ও এর বিন্যাস বৈচিত্র্যময়। এ সব পাতা যে সব বৃক্ষ থেকে এসেছে তার ফলগুলােও নানা বর্ণের ও নানা স্বাদের; আর সেই বিশাল উপত্যকার পাশে অবস্থিত পাহাড় পর্বতশুলােও খােলা প্রকৃতির বুকে যেন আর একটি বিশাল গ্রন্থ। অপর দিকে আল্লাহর কাছ থেকে প্রেরিত কিতাবে এবং তার বর্ণনায় যে সত্য প্রকাশিত হয়েছে, তা বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত সত্য বিষয়গুলাের সত্যতার সাক্ষ্য বহন করে। আর আরশে মােয়াল্লায় লিখিত এই যে আল কিতাব (যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে চিরদিন সঠিক পথ দেখানাের ব্যবস্থা করেছেন, যা (বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন ভাষায় তিনি নাযিল করেছেন), সে কিতাবের ওয়ারিস হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ। যুগে যুগে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী মুসলিম উম্মাহর (তাদের আত্মসমর্পণের ধরন ও আন্তরিকতার তারতম্য অনুসারে) বিভিন্ন শ্রেণী গড়ে ওঠেছে। যেহেতু তারা আল্লাহর কাছে নিজেদের সােপর্দ করেছে, এ জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের ক্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করার পর তাদের তার নেয়ামত দান করবেন বলে ভরসা দিয়েছেন, তারা সেসব নেয়ামত পাওয়ার আশায় অপেক্ষারত রয়েছে, তারা নিজেদের মহান পরওয়ারদেগারের কৃপাধন্য অবস্থায় দেখতে চায় এবং তাঁর নেয়ামতভরা জান্নাতে স্থান লাভ করার জন্যে আকাংখী হয়ে রয়েছে। তারা এটাও আশা করে যে, তাদের সামনে থাকবে বিপদগ্রস্ত ও আযাবে পতিত কাফেরদের দৃশ্য। এই দীর্ঘ ও বিস্ময়কর অধ্যায়টির নানামুখী আলােচনা এই বর্ণনার ওপর শেষ হচ্ছে যে, না-ফরমানদের পরিণতি কি হবে না হবে তা সুনিশ্চিতভাবে কেউই জানে না একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া, যিনি বক্ষসমূহের মধ্যে অবস্থিত সর্ববিষয়ের খবর রাখেন। তাই তিনি বলছেন, ‘তুমি কি দেখোনি যে, আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন… নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মহাশক্তিমান ক্ষমাশীল।'(আয়াত ২৭-২৮) *জীবন ও জগতের এক বিস্ময়কর উপস্থাপনা : জীবন ও জগতের এটা এক বিস্ময়কর উপস্থাপনা। এর মাধ্যমে এই মহাগ্রস্থ আল কোরআনের মূল উৎসের পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ, এই উপস্থাপনা ও আলােচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে গােটা পৃথিবী এবং এর মধ্যকার জীব ও জড় জগতের বর্ণবৈচিত্র্য, যার সাক্ষাত আমরা পাই ফল-মূল, পাহাড় পর্বত, মানব জাতি এবং বিভিন্ন প্রজাতির জীব-জন্তুর মাঝে। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে গোটা পৃথিবীর এই বৈচিত্র্যময় জীব ও জড় জগতের আলােচনা করা হয়েছে এবং মানব হৃদয়কে এর দ্বারা আলােড়িত ও আন্দোলিত করা হয়েছে। প্রথমেই আকাশ থেকে বৃষ্টিপাতের দৃশ্যটি চিত্রায়িত করা হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, কিভাবে ওই বৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন বর্ণের ফলমূল উৎপন্ন করা হয়। আলােচনায় ফলের রং বা বর্ণের বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ, বিষয়টি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং বিস্ময়কর। পৃথিবীর বুকে এমন কোনাে শিল্পী নেই যে তার তুলির আঁচড়ে ফলের বিচিত্র সব রঙের প্রতিফলন ঘটাতে পারে। কারণ, একশ্রেণীর ফলের রঙের সাথে অন্য শ্রেণীর ফলের রংয়ের মিল নেই। এমনকি একই শ্রেণীর ফলের রংয়ের মাঝেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। গভীরভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, একই শ্রেণীর ফলের রঙের মাঝে কিছুটা হলেও পার্থক্য রয়েছে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ফলের বর্ণবৈচিত্র্যের পর আসছে পাহাড় পর্বতের বর্ণবৈচিত্রের আলােচনা। এটাও একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ফল-মূল ও পাহাড় পর্বতের মাঝে বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনাে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে উভয় শ্রেণীর মাঝে একটা স্বাভাবিক মিল দেখা যাবে। পাহাড় পর্বতে যে সব পাথরখন্ড পাওয়া যায় তার রংও বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে এবং ফলের রঙের সাথে এর যথেষ্ট সাদৃশ্যও রয়েছে। এমনকি আকৃতির ক্ষেত্রেও এই সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় এই সাদৃশ্য এতােই গভীর থাকে যে, ফল আর পাথরের মধ্যকার পার্থক্যটুকু নির্ণয় করা আমাদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়ে। ‘পর্বতসমূহের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন বর্ণের গিরিপথ…'(আয়াত ২৭) আলোচ্য আয়াতে বিভিন্ন বর্ণের গিরিপথের উল্লেখ করা হয়েছে। এটাও একটা বাস্তব সত্য। সাদা বর্ণের গিরিপথগুলাের মাঝে এমনিভাবে লাল বর্ণের গিরিপথগুলাের মাঝেও পার্থক্য দেখা যায়। কোনটা হালকা বর্ণের, কোনটা গভীর বর্নের আবার কোনটা মিশ্র বর্নের। এ ছাড়া কালো বর্ণের গিরিপথ রয়েছে। এখানে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, আর তা হচ্ছে, ফল-মূলের বর্ণ-বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পাথর ও গিরিপথের বর্ণবৈচিত্র্যের কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষের হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়া হয়েছে এবং তার মাঝে উচ্চমাত্রায় সৌন্দর্যানুভূতি জাগিয়ে তােলা হয়েছে। এর ফলে তার দৃষ্টিতে বিভিন্ন বস্তুর রূপ বিমূর্ত হয়ে ধরা পড়বে। তার দৃষ্টিতে পাথরের রূপ আর ফলের রূপ এখানে এসে একই মাত্রায় ধরা পড়বে। অথচ উভয়টির প্রকৃতি ও কার্যকারিতার মাঝে বিরাট পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু তা সত্তেও মানুষ যখন বস্তুনিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তখন উভয়টির রূপের মাঝে এক অভিন্ন উপাদান লক্ষ্য করে যা সত্যিই দেখার মতাে এবং উপলব্ধি করার মতাে। এরপর মানব জাতির বর্ণবৈচিত্রের কথা আলােচিত হয়েছে। এই বর্ণবৈচিত্র্য কেবল বিভিন্ন গােষ্ঠী ও জাতির লােকদের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য নয়; বরং একই গােষ্ঠী ও জাতির প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। শুধু তাই নয়; বরং এই বর্ণবৈচিত্র্য একই মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেয়া যমজ সন্তানদের মাঝেও লক্ষণীয়। বিভিন্ন প্রজাতির জীব জন্তু ও প্রাণীর মাঝেও এই বর্ণবৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। চতুষ্পদ জন্তুসহ পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী সব ধরনের প্রাণীর মাঝেই এই রং ও বর্ণের পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। ফল-মূল এবং পর্বতগিরির বর্ণ যেমন আকর্ষণীয়, ঠিক তেমনি আকষণীয় বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু ও প্রাণীর বর্ণও। নিসন্দেহে বলা যায়, গােটা প্রাণীজগত হচ্ছে এমন একটি গ্রন্থের নাম, যার প্রতিটি পৃষ্ঠা দৃষ্টিনন্দন, যার গঠন ও অলংকরণ বিস্ময়কর। এ গ্রন্থটি মানুষের চোখের সামনে মূল সত্য তুলে ধরে এবং এর পাতাগুলাে মেলে ধরে। পবিত্র কোরআন বলছে, যে সকল জ্ঞানী লােক এই গ্রন্থ অধ্যয়ন করে, অনুধাবন করে এবং এর বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে, কেবল তারাই আল্লাহকে ভয় করে। কোরআনের ভাষা হচ্ছে এই- ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাকে ভয় করে।'(আয়াত ২৮) জগত নামক এই বিশাল গ্রন্থের মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠাই এখানে মেলে ধরা হয়েছে। এই কয়টি পৃষ্ঠা যারা পাঠ করে এর মর্মবাণী অনুধাবন করতে পারে, একমাত্র তারাই আল্লাহকে চিনতে পারে, আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জানতে পারে, তার অপার কুদরত ও ক্ষমতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে এবং তার মাহাত্ম ও বড়ত্ব অনুভব করতে পারে। ফলে একমাত্র তারাই তাকে সত্যিকার অর্থে ভয়ও করতে শেখে এবং যথার্থরূপে তাঁর এবাদাত বন্দেগী করতে পারে। তারা কিন্তু এটা কোনাে অজানা অনুভূতি বা ভয় ভীতির বশবর্তী হয়ে করে না; বরং গভীর জ্ঞান ও প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়েই তারা এটা করে থাকে। এই যে গােটা কয়েক পৃষ্ঠা এ হচ্ছে, জগত নামক এই বিশাল গ্রন্থের সামান্য কয়টি নমুনা। অপরদিকে এই গ্রন্থের বিভিন্ন রং ও বর্ণ হচ্ছে এর অন্তর্নিহিত গঠন, বিন্যাসগত সৌন্দর্যের প্রতীক, যা কেবল তারাই উপলব্ধি করতে পারে যারা এই গ্রন্থ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অধিকারী। এই জ্ঞান হৃদয়ে অনুভূতি জাগায়, হৃদয়কে করে আন্দোলিত। এই জ্ঞানের সাহায্যে মানুষ সুন্দর জগতের গঠন বিন্যাস এবং এর রং ও রূপের মাঝে আল্লাহর সুনিপুণ হাতকে কর্মরত দেখতে পায়। মনে হয় এই জগতের রূপরেখা ও আকৃতি প্রকৃতির মাঝে সৌন্দর্যের উপাদান ইচ্ছাকৃতভাবেই রাখা হয়েছে। কারণ অনেক বন্ধু ও প্রাণী কেবল এই সৌন্দর্যের সাহায্যেই তার প্রাকৃতিক ধর্ম পালন করে থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমরা ফুলের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা বলতে পারি। ফুলের রূপ ও গন্ধের আকর্ষণেই মৌমাছি এবং প্রজাপতি ছুটে আসে, আর এর ফলে মূল কাজটি সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ মৌমাছি ও প্রজাপতি ফুলের রেণু বহন করে নিয়ে যায়, যার সাহায্যে ফলের সৃষ্টি হয়। তাহলে বুঝা গেলাে যে, ফুল তার রূপের সাহায্যেই তার প্রাকৃতিক দায়িত্বটা পালন করে যাচ্ছে। প্রজাতির লিংগের ক্ষেত্রেও এই গুরুত্ব আমরা দেখতে পাই। রূপের কারণেই বিপরীত লিংগের প্রতি আকর্ষণ অনুভূত হয় এবং এর ফলে দুটো ভিন্নধর্মী লিংগের প্রাণী তার প্রাকৃতিক দায়িত্ব পালন করে চলে। তাই বলতে পারি, রূপও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও স্বভাবজাত দায়িত্ব পালনে সাহায্য করে থাকে। এই জগতের গঠন ও বিন্যাসে রূপ একটি বাঞ্ছিত উপাদান বলেই পবিত্র কোরআনে এর প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ অর্থাৎ তিনি সৃষ্টির ক্ষেত্রেও শক্তিধর এবং কর্মফল প্রদানের ক্ষেত্রেও শক্তিধর। তেমনিভাবে আল্লাহর কিতাব পাঠ করার মাঝে ভিন্ন একটি তাৎপর্য রয়েছে, এখানে পাঠ করার অর্থ কেবল সুর করে অথবা বিনা সুরে এর বাক্যগুলাে আবৃত্তি করা নয়; বরং এর অর্থ হচ্ছে, গভীর দৃষ্টি সংবেদনশীল মন নিয়ে পাঠ করা এবং এমনভাবে পাঠ করা যেন এর ফলে তার মাঝে চৈতন্যের সৃষ্টি হয়, গভীর প্রভাব সৃষ্টি হয় এবং তার আচার আচরণে সুস্পষ্ট পরিবর্তন সূচিত হয়। ফলে সে নামায কায়েম করবে, আল্লাহর দেয়া ধন সম্পদ থেকে গােপনে প্রকাশ্যে দান করবে এবং এর প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহর সন্তুষ্টি রেযামন্দি কামনা করবে। পবিত্র কোরআনের ভাষায় এটাকে বলা হয়েছে লােকসানবিহীন ব্যবসা। কারণ, যারা আল্লাহর দেয়া ধন সম্পদ থেকে দান করে তারা ভালাে করেই জানে যে, প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহর কাছ থেকে তারা যা পাবে তা এই পার্থিব ধন সম্পদ থেকে অতি উত্তম। তারা আরও বিশ্বাস করে যে, তাদের এই ব্যবসা নিশ্চিত লাভের ব্যবসা। এখানে ক্ষয় ক্ষতির কোনােই আশঙ্কা নেই। কারণ, এই ব্যবসার অপর পক্ষ হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। এই ব্যবসা হচ্ছে পরকালীন জীবনের জন্যে। কাজেই এই ব্যবসায় লাভ সুনিশ্চিত এবং তাও হবে পরিপূর্ণ; বরং আল্লাহর মেহেরবানী ও দয়ায় এই লাভ বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন ক্ষমাশীল ও গুণগ্রাহী । তাই তিনি বান্দার ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করে দেন এবং তার কর্মের যথার্থ মর্যাদা ও উপযুক্ত প্রতিদান দিয়ে থাকেন। আল্লাহর এই গুণটিকে ‘শােকর’ বা কৃতজ্ঞতা শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, কৃতজ্ঞতার মাঝে সন্তুষ্টি ও প্রতিদানের একটা ভাব নিহিত আছে। দ্বিতীয়ত, এই বর্ণনাভংগির মাধ্যমে বান্দাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। আর সেটা হলাে, যদি আল্লাহ তায়ালা নিজেই বান্দার কর্মের জন্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারেন, তাহলে আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের জন্যে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কি বান্দার উচিত নয়?
*আল্লাহর কিতাবের প্রকৃতি : এখানে আল্লাহর কিতাবের প্রকৃতি বর্ণনা করা হচ্ছে এবং এর বাণী ও বক্তব্য যে সত্য সে কথাও বলা হচ্ছে। এর পর আলােচনা করা হবে এই কিতাবের ধারক বাহকদের সম্পর্কে। বলা হচ্ছে, ‘আমি তােমার প্রতি যে কিতাব প্রত্যাদেশ করেছি, তা সত্য…’ (আয়াত ৩১) এই মহাগ্রন্থের বাণী ও বক্তব্য যে সত্য তা এর আলােচিত সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণের মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়। কারণ, এই নিখিল বিশ্বের মাঝে যা কিছু সত্য ও বাস্তব, তারই যথার্থ ও সঠিক প্রতিফলন এতে ঘটেছে। তাই এই গ্রন্থটিকে বলা যায় একটি আক্ষরিক পৃষ্ঠা আর গােটা সৃষ্টি জগতকে বলা যায় এক একটি নীরব পৃষ্ঠা। তাছাড়া একই উৎস থেকে প্রাপ্ত পূর্ববর্তী অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের সত্যায়নও হচ্ছে এই গ্রন্থের মাধ্যমে । কারণ, এর উৎস হচ্ছে এক অভিন্ন। তবে মানুষের প্রয়ােজন, চাহিদা ও অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করেই আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কেতাব অবতীর্ণ করেন। কারণ, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সব কিছু জানেন ও দেখেন। এই গ্রন্থ আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ উম্মতকে দান করেছেন। এর জন্যে তিনি এই উম্মতকে নির্বাচিত করেছেন। বলা হয়েছে, ‘অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করেছি তাদেরকে, যাদের আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনােনীত করেছি।'(আয়াত ৩২)। এই মনােনয়ন একদিকে যেমন মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও সম্মান প্রমাণ করে, তেমনি প্রমাণ করে এই মনােনয়নের মাধ্যমে আরােপিত গুরুদায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি। এখন এই গুরুদায়িত্ব পালনে আল্লাহর মনােনীত উম্মত কি সাড়া দেবে? এই গুরুদায়িত্বের জন্যে মনােনীত করার ফলেই আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতকে প্রতিদানের ক্ষেত্রেও সম্মানে ভূষিত করেছেন, এমনকি এই উম্মতের কেউ ভুল ত্রুটি করলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে এই সম্মান থেকে বঞ্চিত করবেন না। তাই বলা হয়েছে, ‘তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং তাদের কেউ কেউ আল্লাহর নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথেও অগ্রগামী'(আয়াত ৩২) প্রথম দল হচ্ছে পাপীদের। এদের সৎ কাজের তুলনায় পাপের সংখ্যা বেশী। এদের সংখ্যাই সাধারণত বেশী। সম্ভবত সে কারণেই এদের কথা প্রথমে বলা হয়েছে আর দ্বিতীয় দলটি হচ্ছে মধ্যপন্থীদের। অর্থাৎ এদের অসৎ ও সৎকাজ দুটোই সমান সমান। আর তৃতীয় দলটি হচ্ছে সৎকাজে অগ্রগামীদের। আল্লাহর নির্দেশে এরা সৎকাজে এগিয়ে থাকে। পাপের তুলনায় এদের সৎকাজের পাল্লা সব সময়ই ভারি, কিন্তু আল্লাহর দয়া ও কূপার ক্ষেত্রে এই তিনটি দলই সমান। কারণ, এদের প্রত্যেককেই আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে স্থান দেবেন এবং আয়াতে বর্ণিত বিভিন্ন নেয়ামত তাদের দান করবেন। অবশ্য জান্নাতে এদের স্তর ভিন্ন ভিন্ন হবে। আল্লাহর মনােনয়ন ও প্রতিদানের মাধ্যমে এই উম্মতের প্রাপ্ত যে মর্যাদার কথা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে তার অতিরিক্ত কোনাে ব্যাখ্যা এখানে দিতে চাই না। আয়াতের বক্তব্যে যতােটুকু বুঝা যাচ্ছে ততােটুকুই যথেষ্ট। অর্থাৎ আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী ও দয়ায় এই উম্মতের সবাই এক সময় জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং আল্লাহর জানা ও নির্ধারিত নেয়ামত ভােগ করবে।