(টপিক#১০৬৭) [*কোরআনে জান্নাত ও জাহান্নামের চিত্র :-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৫:ফা-ত্বির পারা:২২ ৩৩-৪৫ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬৭)
[*কোরআনে জান্নাত ও জাহান্নামের চিত্র :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৫:ফা-ত্বির
পারা:২২
৩৩-৪৫ নং আয়াত:-
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩৩
جَنّٰتُ عَدۡنٍ یَّدۡخُلُوۡنَہَا یُحَلَّوۡنَ فِیۡہَا مِنۡ اَسَاوِرَ مِنۡ ذَہَبٍ وَّ لُؤۡلُؤًا ۚ وَ لِبَاسُہُمۡ فِیۡہَا حَرِیۡرٌ ﴿۳۳﴾
চিরস্থায়ী জান্নাতে তারা প্রবেশ করবে। সেখানে তাদেরকে সোনার কংকন ও মুক্তা দিয়ে সাজানো হবে। সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩৪
وَ قَالُوا الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡۤ اَذۡہَبَ عَنَّا الۡحَزَنَ ؕ اِنَّ رَبَّنَا لَغَفُوۡرٌ شَکُوۡرُۨ ﴿ۙ۳۴﴾
তারা বলবে, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর; যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করেছেন; নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালক বড় ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী;
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩৫
الَّذِیۡۤ اَحَلَّنَا دَارَ الۡمُقَامَۃِ مِنۡ فَضۡلِہٖ ۚ لَا یَمَسُّنَا فِیۡہَا نَصَبٌ وَّ لَا یَمَسُّنَا فِیۡہَا لُغُوۡبٌ ﴿۳۵﴾
যিনি নিজ অনুগ্রহে, আমাদেরকে স্থায়ী আবাস দান করেছেন; যেখানে আমাদেরকে কোন প্রকার ক্লেশ স্পর্শ করে না এবং স্পর্শ করে না কোন প্রকার ক্লান্তি।’
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩৬
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَہُمۡ نَارُ جَہَنَّمَ ۚ لَا یُقۡضٰی عَلَیۡہِمۡ فَیَمُوۡتُوۡا وَ لَا یُخَفَّفُ عَنۡہُمۡ مِّنۡ عَذَابِہَا ؕ کَذٰلِکَ نَجۡزِیۡ کُلَّ کَفُوۡرٍ ﴿ۚ۳۶﴾
আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য আছে জাহান্নামের আগুন। তাদের উপর ফায়সালা দেয়া হবে না যে, তারা মরবে এবং তাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তিও লাঘব করা হবে না। এভাবেই আমরা প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে শাস্তি দিয়ে থাকি।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩৭
وَ ہُمۡ یَصۡطَرِخُوۡنَ فِیۡہَا ۚ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا نَعۡمَلۡ صَالِحًا غَیۡرَ الَّذِیۡ کُنَّا نَعۡمَلُ ؕ اَوَ لَمۡ نُعَمِّرۡکُمۡ مَّا یَتَذَکَّرُ فِیۡہِ مَنۡ تَذَکَّرَ وَ جَآءَکُمُ النَّذِیۡرُ ؕ فَذُوۡقُوۡا فَمَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ نَّصِیۡرٍ ﴿٪۳۷﴾
তারা সেখানে চিৎকার করে করে বলবে “হে আমাদের রব! আমাদের এখান থেকে বের করে নাও, আমরা সৎকাজ করবো, আগে যে কাজ করতাম তা থেকে আলাদা।” (তাদেরকে জবাব দেয়া হবে এই বলে,) “আমি কি তোমাদের এতটুকু আয়ুষ্কাল দান করিনি যে সময়ে কেউ শিক্ষাগ্রহণ করতে চাইলে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারতো? আর তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসে গিয়েছিল। এখন স্বাদ আস্বাদন করো, জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।”
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩৮
اِنَّ اللّٰہَ عٰلِمُ غَیۡبِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّہٗ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۳۸﴾
নিশ্চয় আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনের গায়েবী বিষয় অবগত। নিশ্চয় অন্তরে যা রয়েছে সে সম্বন্ধে তিনি সম্যক জ্ঞাত।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৩৯
ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَکُمۡ خَلٰٓئِفَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ فَمَنۡ کَفَرَ فَعَلَیۡہِ کُفۡرُہٗ ؕ وَ لَا یَزِیۡدُ الۡکٰفِرِیۡنَ کُفۡرُہُمۡ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ اِلَّا مَقۡتًا ۚ وَ لَا یَزِیۡدُ الۡکٰفِرِیۡنَ کُفۡرُہُمۡ اِلَّا خَسَارًا ﴿۳۹﴾
তিনিই তোমাদেরকে যমীনে স্থলাভিষিক্ত করেছেন। কাজেই কেউ কুফরী করলে তার কুফরীর জন্য সে নিজেই দায়ী হবে। কাফিরদের কুফরী শুধু তাদের রবের ক্রোধই বৃদ্ধি করে এবং কাফিরদের কুফরী শুধু তাদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৪০
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ شُرَکَآءَکُمُ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ؕ اَرُوۡنِیۡ مَاذَا خَلَقُوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ اَمۡ لَہُمۡ شِرۡکٌ فِی السَّمٰوٰتِ ۚ اَمۡ اٰتَیۡنٰہُمۡ کِتٰبًا فَہُمۡ عَلٰی بَیِّنَتٍ مِّنۡہُ ۚ بَلۡ اِنۡ یَّعِدُ الظّٰلِمُوۡنَ بَعۡضُہُمۡ بَعۡضًا اِلَّا غُرُوۡرًا ﴿۴۰﴾
বলুন, ‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে তোমাদের যেসব শরীকদের ডাক, তাদের কথা ভেবে দেখেছ কি? তারা যমীনে কিছু সৃষ্টি করে থাকলে আমাকে দেখাও; অথবা আসমানের সৃষ্টিতে তাদের কোন অংশ আছে কি? না কি আমরা তাদেরকে এমন কোন কিতাব দিয়েছি যার প্রমানের উপর তারা নির্ভর করে ?’ বরং যালিমরা একে অন্যকে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুরই প্রতিশ্রুতি দেয় না।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৪১
اِنَّ اللّٰہَ یُمۡسِکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ اَنۡ تَزُوۡلَا ۬ۚ وَ لَئِنۡ زَالَتَاۤ اِنۡ اَمۡسَکَہُمَا مِنۡ اَحَدٍ مِّنۡۢ بَعۡدِہٖ ؕ اِنَّہٗ کَانَ حَلِیۡمًا غَفُوۡرًا ﴿۴۱﴾
নিশ্চয় আল্লাহ্‌ আসমানসমূহ ও যমীনকে ধারণ করেন, যাতে তারা স্থানচ্যুত না হয়, আর যদি তারা স্থানচ্যুত হয়, তবে তিনি ছাড়া কেউ নেই যে, তাদেরকে ধরে রাখতে পারে । নিশ্চয় তিনি অতি সহনশীল, অসীম ক্ষমাপরায়ণ।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৪২
وَ اَقۡسَمُوۡا بِاللّٰہِ جَہۡدَ اَیۡمَانِہِمۡ لَئِنۡ جَآءَہُمۡ نَذِیۡرٌ لَّیَکُوۡنُنَّ اَہۡدٰی مِنۡ اِحۡدَی الۡاُمَمِ ۚ فَلَمَّا جَآءَہُمۡ نَذِیۡرٌ مَّا زَادَہُمۡ اِلَّا نُفُوۡرَۨا ﴿ۙ۴۲﴾
তারা শক্ত কসম খেয়ে বলতো, যদি কোন সতর্ককারী তাদের কাছে আসতো তাহলে তারা দুনিয়ার প্রত্যেক জাতির তুলনায় বেশী সৎপথের অনুগামী হতো।কিন্তু যখন সতর্ককারী তাদের কাছে এলো তখন তার আগমন তাদের মধ্যে সত্য থেকে পলায়ন ছাড়া আর কোন জিনিষের বৃদ্ধি ঘটায়নি।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৪৩
اسۡتِکۡـبَارًا فِی الۡاَرۡضِ وَ مَکۡرَ السَّیِّیَٴ ؕ وَ لَا یَحِیۡقُ الۡمَکۡرُ السَّیِّیٴُ اِلَّا بِاَہۡلِہٖ ؕ فَہَلۡ یَنۡظُرُوۡنَ اِلَّا سُنَّتَ الۡاَوَّلِیۡنَ ۚ فَلَنۡ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللّٰہِ تَبۡدِیۡلًا ۬ۚ وَ لَنۡ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللّٰہِ تَحۡوِیۡلًا ﴿۴۳﴾
তারা পৃথিবীতে আরো বেশী অহংকার করতে থাকে এবং দুষ্ট চাল চালতে থাকে, অথচ দুষ্ট চাল তার উদ্যোক্তাদেরকেই ঘিরে ফেলে। এখন তারা কি পূর্বের জাতিদের সাথে আল্লাহ‌ যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তাদের সাথে অনুরূপ পদ্ধতিরই অপেক্ষা করছে? যদি একথাই হয়ে থাকে তাহলে তুমি আল্লাহর পদ্ধতিতে কখখনো কোন পরিবর্তন পাবে না এবং কখখনো আল্লাহর বিধানকে তার নির্ধারিত পথ থেকে হটে যেতেও তুমি দেখবে না।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৪৪
اَوَ لَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ وَ کَانُوۡۤا اَشَدَّ مِنۡہُمۡ قُوَّۃً ؕ وَ مَا کَانَ اللّٰہُ لِیُعۡجِزَہٗ مِنۡ شَیۡءٍ فِی السَّمٰوٰتِ وَ لَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّہٗ کَانَ عَلِیۡمًا قَدِیۡرًا ﴿۴۴﴾
এরা কি পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করেনি এবং এদের পূর্ববতীদের পরিণাম কি হয়েছিল তা কি দেখেনি? ওরা তো এদের অপেক্ষা অধিকতর বলশালী ছিল। আল্লাহ এমন নন যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কোন কিছু তাঁকে ব্যর্থ করতে পারে। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।
ফা-ত্বির:- ৩৫:৪৫
وَ لَوۡ یُؤَاخِذُ اللّٰہُ النَّاسَ بِمَا کَسَبُوۡا مَا تَرَکَ عَلٰی ظَہۡرِہَا مِنۡ دَآبَّۃٍ وَّ لٰکِنۡ یُّؤَخِّرُہُمۡ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ۚ فَاِذَا جَآءَ اَجَلُہُمۡ فَاِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِعِبَادِہٖ بَصِیۡرًا ﴿٪۴۵﴾
আর আল্লাহ্ মানুষদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করলে, ভূ-পৃষ্ঠে কোন প্রাণীকেই তিনি রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন তাদের নির্দিষ্ট সময় এসে যাবে, তখন তো আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সম্যক দ্রষ্টা ।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩৩-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:

পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর যাদেরকে কিতাবের উত্তরাধীকারী করা হয়েছে অর্থাৎ উল্লিখিত তিন শ্রেণি প্রতিদান এ আয়াতগুলো উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তারা চিরসুখের সাথে জান্নাতে বসবাস করবে: তথায় তাদের কোনই দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। এ সমস্ত লোকেরা অর্থাৎ উম্মাতে মুহাম্মাদীর যে তিন শ্রেণির লোক রয়েছে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তথায় তাদেরকে স্বর্ণ নির্মিত কংকন ও মুক্তা দ্বারা অলংকৃত করা হবে। যেমন সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ হুরাইরাহ্ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: মু’মিনের অলংকার ঐ পর্যন্ত হবে যে পর্যন্ত ওযূর পানি পৌঁছে থাঁকে। (সহীহ মুসলিম হা: ৬০৯) এবং সেখানে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ হবে রেশমের। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি দুনিয়ায় রেশম পরিধান করবে সে আখিরাতে রেশম পরিধান করতে পারবে না” এবং তিনি আরো বলেন: তোমরা স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্রে পানাহার করো না। দুনিয়ায় এগুলো তাদের (কাফিরদের) জন্য এবং আখিরাতে তোমাদের অর্থাৎ ঈমানদারদের জন্য।” (সহীহ বুখারী হা: ৫৮৩৩, ৫৮৩১, সহীহ মুসলিম হা: ২০৬৭, ৫৩০৪)

আর জান্নাতীরা তথায় এ সকল ভোগ-বিলাস যখন উপভোগ করবে তখন এ বলে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করবে যে, সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা ও দুঃশ্চিন্তা দূরীভূত করে দিয়েছেন এবং তথায় তাদের কোন কিছুর অভাব থাকবে না আর তারা আরো বলবে যে, প্রশংসা মাত্রই ঐ আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে স্থায়ী আবাস দিয়েছেন। যেখানে ক্লেশ ও ক্লান্তি আমাদেরকে স্পর্শ করে না। আল্লাহ তা‘আলার এ অনুগ্রহ ব্যতীত আমাদের তা লাভ করা সম্ভব ছিল না।

সহীহ হাদীসে এসেছে, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের কাকেও তার ‘আমাল কখনো জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকেও না? তিনি বললেন: আমাকেও না। তবে আমাকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রহমাত ও অনুগ্রহ দ্বারা আচ্ছাদিত করে রেখেছেন।” (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৬৭, সহীহ মুসলিম হা: ৭৪১)

সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ সা‘ঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতীদেরকে বলবেন, হে জান্নাতবাসীরা! তারা উত্তর দিবে হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা হাজির আছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছ? তারা উত্তর দিবে আমাদের কী হলো যে, আমরা সন্তুষ্ট হব না অথচ আপনি আমাদেরকে ঐ জিনিস দান করেছেন যা এর পূর্বে আপনার আর কোন সৃষ্টিকে দেননি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: আমি তোমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম জিনিস দান করব। তারা বলবে: হে আমাদের রব! এর চেয়ে উত্তম জিনিস আর কী আছে? আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: তোমাদের ওপর আমার সন্তুষ্টি অবধারিত হয়ে গেছে। এরপর আমি আর কোনদিন তোমাদের ওপর রাগান্বিত হব না। (সহীহ বুখারী হা: ৬৫৪৯, সহীহ মুসলিম হা: ২৮২৯, ১৮৩)

আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

(كُلُوْا وَاشْرَبُوْا هَنِيْـٓئًامَّبِمَآ أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ)‏

“তোমরা খাও এবং পান কর‎ তৃপ্তির সাথে, তোমরা অতীত দিনসমূহে যা করেছিলে তার বিনিময়ে।” (সূরা হাক্কাহ ৬৯:২৪)

সুতরাং জান্নাতীরা জান্নাতে চির সুখে বসবাস করবে, কোন কিছুর ঘাটতি থাকবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. জান্নাতীদের জন্য জান্নাতে স্বর্ণ নির্মিত কংকন ও রেশমের পোশাক থাকবে।
২. জান্নাতীরা কোন প্রকার দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে না।
৩৬-৩৭ নং আয়াতের তাফসীর:

ঈমানদার সৎলোকদের আখেরাতে জান্নাতের আরাম-আয়েশের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ কাফির-মুশরিক অসৎলোকদের অবস্থা বর্ণনা করছেন যে, তারা কিয়ামতের দিন ফায়সালার পর জাহান্নামে প্রবেশ করবে। সেখানে তারা কঠিন শাস্তি ও যন্ত্রণার মুখোমুখি হবে কিন্তু তাতে তারা মৃত্যুবরণও করবে না এবং তাদের থেকে কোন শাস্তি কমও করা হবে না। আল্লাহর বাণী,

(إِنَّه۫ مَنْ يَّأْتِ رَبَّه۫ مُجْرِمًا فَإِنَّ لَه۫ جَهَنَّمَ ط لَا يَمُوْتُ فِيْهَا وَلَا يَحْيٰي)‏

“যে তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য আছে জাহান্নাম, সেথায় সে মরবেও না, বাঁচবেও না।” (সূরা তা-হা- ২০:৭৪) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(إِنَّ الْمُجْرِمِيْنَ فِيْ عَذَابِ جَهَنَّمَ خٰلِدُوْنَ -‏ لَا يُفَتَّرُ عَنْهُمْ وَهُمْ فِيْهِ مُبْلِسُوْنَ )‏

“নিশ্চয়ই অপরাধীরা জাহান্নামের শাস্তিতে থাকবে চিরকাল- তাদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং তারা হতাশ হয়ে পড়বে।” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৭৪-৭৫)

সহীহ হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যারা চিরস্থায়ী জাহান্নামের অধিবাসী তারা সেখানে মৃত্যুবরণও করবে না এবং তারা সেখানে বেঁচেও থাকবে না (অর্থাৎ সুখময় জীবন লাভ করবে না)। (সহীহ মুসলিম) এবং তারা শাস্তির যন্ত্রণায় সেখানে চিৎকার ও অর্তনাদ করতে থাকবে আর আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফরিয়াদ করবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি দিয়ে দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিন, আমরা সৎ আমল করে আসব। কিন্তু তাদের আবেদন গ্রহণ করা হবে না। বরং তাদেরকে বলা হবে যে, তোমাদেরকে দীর্ঘ জীবন দান করা হয়েছিল, তখন সৎ আমল করার অনেক সুযোগ ছিল কিন্তু তা করনি। সুতরাং এখন শাস্তি আস্বাদন করো। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

(فَذُوْقُوْا فَلَنْ نَّزِيْدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا) ‏

“অতএব এখন তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ কর, আর আমি তো তোমাদের শাস্তিই বৃদ্ধি করতে থাকব।” (সূরা নাবা ৭৮:৩০)

তারা সেখানে শুধু শাস্তির মধ্যেই জীবন কাটাবে, কোন প্রকার শান্তি লাভ করবে না। আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি তিনি যেন আমাদেরকে এদের মধ্যে শামিল না করেন। আমীন!

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আখিরাতে কাফির-মুশরিকরা জাহান্নামে এমন জীবন লাভ করবে যে, না বাঁচবে, না মরবে অর্থাৎ কঠিন শাস্তির মধ্যে থাকবে।
৩৮-৪১ নং আয়াতের তাফসীর:

আকাশ ও জমিনের সকল গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন এমনকি মানুষের অন্তরের খবরও জানেন, সে কথাই এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনিই মানুষকে জমিনে একজনকে অন্যজনের প্রতিনিধি করেছেন। অর্থাৎ একজন জমিনে আসবে, তার সময় শেষে চলে যাবে আবার অন্যজন দুনিয়াতে আসবে, জমিন আবাদ করবে, এভাবেই কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَا۬ءَ الْأَرْضِ)

“এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন।” (সূরা নামল ২৭:৬২)

অতঃপর তিনি বলেন: কেউ যদি কুফরী করে তাহলে তার শাস্তি তাকেই পেতে হবে। আর কাফিরদের কুফরী কোনই ফায়দা দেয় না, শুধু আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধই বৃদ্ধি করে এবং তাদের নিজেদেরই ক্ষতি হয়।

(قُلْ اَرَءَیْتُمْ شُرَکَا۬ءَکُمُ…. اِنَّھ۫ کَانَ حَلِیْمًا غَفُوْرًاﭸ)

আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর সকল মুশরিকদেরকে আহ্বান করে বলেন: তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্য যাদের ইবাদত কর, সমস্যা নিরসনে ও কল্যাণ লাভের জন্য আহ্বান কর, আমাকে দেখাও তো তারা পৃথিবীর কোন কিছু সৃষ্টি করেছে কি? অথবা আকাশ-জমিন সৃষ্টি করাতে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে কিনা? নাকি আমি তোমাদেরকে এমন কিতাব দিয়েছি যাতে শিরক করার কথা উল্লেখ রয়েছে ফলে তোমরা সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছ। না, এসব কিছুই নেই, বরং পূর্বে যত কিতাব নাযিল করা হয়েছে বা যত নাবী কিতাব নিয়ে এসেছেন তাতে এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নির্দেশই ছিল।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَآ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا نُوْحِيْٓ إِلَيْهِ أَنَّه۫ لَآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنَا فَاعْبُدُوْنِ‏)‏

“আমি তোমার পূর্বে যখন কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তার প্রতি এ ওয়াহী করেছি, ‘আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; সুতরাং আমারই ‘ইবাদত কর‎।’’ (সূরা আম্বিয়া ২১:২৫)

তাহলে এসব মুশরিকরা কেন আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্যান্য বাতিল মা‘বূদের ইবাদত করে? তারা যদি কোন কিছু সৃষ্টিই না করতে পারে তাহলে তারা কিভাবে ইবাদত পাওয়ার যোগ্য হতে পারে? সুতরাং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে হবে, কারণ তিনি সবকিছুর স্রষ্টা। যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনিই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। এ সম্পর্কে সূরা আল ফুরক্বান-এর ৩ ও সূরা র্আ রা‘দ-এর ১৬ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

অর্থাৎ এসব মুশরিক জালিমরা একে অপরকে যে প্রতিশ্র“তি দেয় তা ধোঁকা ছাড়া কিছুই নয়। কারণ তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে যেসব শিরক করে তাদের কাছে তার তো কোন প্রমাণ নেই। তাই বিভিন্ন আশা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে নিজেদের পথে আহ্বান করে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তিনিই আকাশমণ্ডলী ও জমিনকে স্থির করে রাখেন যাতে তা স্থানচ্যুত না হয়, নড়াচড়া না করতে পারে ও ঢলে না পড়ে। কেননা আকাশ-জমিন সর্বদা কম্পন করতে থাকলে, নড়াচড়া করলে তাতে বসবাস করা সম্ভব হবে না, সর্বদা মানুষ শংকিত থাকবে কখন যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে আর আকাশ ভেঙ্গে পড়লে বা জমিন কম্পন করতে থাকলে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্থির করে রাখার নেই।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَيُمْسِكُ السَّمَا۬ءَ أَنْ تَقَعَ عَلَي الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِه۪ ط إِنَّ اللّٰهَ بِالنَّاسِ لَرَؤُوْفٌ رَّحِيْمٌ‏)‏

“আর তিনিই আকাশকে স্থির রাখেন যাতে তা পতিত না হয় পৃথিবীর ওপর তাঁর অনুমতি ব্যতীত। আল্লাহ নিশ্চয়ই মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।” (সূরা হাজ্জ ২২:৬৫)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(وَمِنْ اٰيٰتِه۪ٓ أَنْ تَقُوْمَ السَّمَا۬ءُ وَالْأَرْضُ بِأَمْرِه۪)

“আর তার দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে যে, তারই আদেশে আসমান ও জমিন স্থির আছে।” (সূরা রূম ৩০:২৫)

অতএব আল্লাহ তা‘আলা যদি এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ না করেন তাহলে এমন কেউ নেই যে, এগুলোর লক্ষচ্যুত হওয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সকল কিছু সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ তা‘আলাই, অন্য কোন অংশীদার নয়।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শিরক করে তাদের কোন প্রমাণ নেই, আল্লাহ তা‘আলা কোন কিতাবে এরূপ করার নির্দেশ দেননি।
২. একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই আকাশ ও জমিনের নিয়ন্ত্রণকারী, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নয়।
৪২-৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের পূর্বে মক্কার কাফির-মুশরিকরা শপথ করে বলত যে, যদি আমাদের নিকট কোন সতর্ককারী রাসূল আগমন করে তবে অবশ্যই আমরা পূর্ববর্তী জাতিসমূহ থেকে আগত রাসূলের অধিক অনুসারী হব, তাঁর অবাধ্য হব না এবং তাঁকে মেনে নিব।

(إِحْدَي الْأُمَمِ)

অন্য যে কোন সম্প্রদায় বলতে ইয়াহূদ ও খ্রিস্টানদেরকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যদি আামাদের কাছে কোন নাবী আসে তাহলে পূর্ববর্তী ইয়াহূদ ও খ্রিস্টান জাতি থেকে আমরা অধিকতর সৎ পথের অনুসারী হব, নাবীর আনুগত্য করব। যেমন তাদের উক্তিন

‏(أَوْ تَقُوْلُوْا لَوْ أَنَّآ أُنْزِلَ عَلَيْنَا الْكِتٰبُ لَكُنَّآ أَهْدٰي مِنْهُمْ ج فَقَدْ جَا۬ءَكُمْ بَيِّنَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَهُدًي وَّرَحْمَةٌ ج فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَّبَ بِاٰيٰتِ اللّٰهِ وَصَدَفَ عَنْهَا)

“অথবা যাতে এ কথা বলতে না পার, ‘যদি আমাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হত তবে আমরা তো তাদের অপেক্ষা অধিক হিদায়াতপ্রাপ্ত হতাম।’ এখন তো তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে স্পষ্ট প্রমাণ, হিদায়াত ও রহমত এসেছে। অতঃপর যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে?” (সূরা আনআম ৬:১৫৫-১৫৭)

কিন্তু আফসোসের বিষয়, যখনই তাদের নিকট রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পাঠানো হল তখনই তারা তার অনুসরণ করা থেকে বিমুখ হয়ে গেছে। এসবের কারণ ছিল আগত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মনোপুত হয়নি, তাদের দাবী মত হয়নি। তার অনুসরণ করলে তাদের মর্যাদা, ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। তাই তারা পৃথিবীতে নিজেদের ক্ষমতা ও বড়ত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখতে চাইতো এবং অন্যদেরকে অধিনস্থ রাখার জন্য কূট ষড়যন্ত্র করত। তাদের এ সকল ষড়যন্ত্র তাদেরকেই পরিবেষ্টন করেছে। তাদের ষড়যন্ত্র নিজেদের ছাড়া অন্য কারো কোন ক্ষতি করেনি।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তাঁর বিধান সকলের ক্ষেত্রে একই। তাঁর বিধানের কোন পরিবর্তন নেই এবং কোন ব্যতিক্রমও নেই। পূর্ববর্তীদের অবাধ্যতার কারণে যে অবস্থা হয়েছিল তাদের অবস্থাও অনুরূপ হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ, যেমন মক্কার কাফিররা শপথ করে বলত, রাসূল আগমন করলে তার অনুসরণ করবে কিন্তু আগমন করার পর তাদের মনোপুত না হওয়ায় মেনে নিতে পারেনি।
২. অধিকাংশ মানুষ নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য করতে পরওয়া করে না।
৪৪-৪৫ নং আয়াতের তাফসীর:

প্রথম আয়াতে আল্লাহ মক্কার কাফির-মুশরিকসহ সকল যুগের নাস্তিকদেরকে লক্ষ্য করে বলছেন: তারা জমিনে সফর করুক, ফলে দেখতে পারবে তাদের পূর্ববর্তী জাতির যারা কুফরী করেছে তাদের কি করুণ দশা হয়েছিল। যেমন ‘আদ, সামুদ জাতি, কারূন ও ফির‘আউন ইত্যাদি। তাদের যদি উপদেশ গ্রহণ করার মত অন্তর থাকে তাহলে সতর্ক হবে। কারণ পূর্বে যে সকল অবাধ্য জাতি ছিল তারা মক্কার কাফিরদের তুলনায় অনেক শক্তিশালী ছিল এবং ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল, তথাপি তারা আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার কারণে তাঁর শাস্তি থেকে রেহাই পায়নি। সুতরাং তারা যেন ঐ সকল পূর্ববর্তী লোকদের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং আল্লাহর আনুগত্য করে। নতুবা তারাও আল্লাহর শাস্তির মুখোমুখী হবে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তিনি যদি মানুষকে তাদের পাপের জন্য পাকড়াও করেন তাহলে ভূ-পৃষ্ঠে একটি প্রাণীও জীবিত থাকত না। কিন্তু তিনি তা না করে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। যাতে তারা তাওবাহ্ করতে পারে। এ সম্পর্কে সূরা নাহ্ল-এর ৬১ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতিদের ইতিহাস কুরআনে তুলে ধরার কারণ হল তাদের থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা যে, তারা কেন ধ্বংস হয়েছিল। অনুরূপ আমরা যেন তাতে লিপ্ত না হই।

২. মানুষের সকল পাপের কারণে আল্লাহ তা‘আলা পাকড়াও করেন না, বরং অবকাশ দেন যাতে পাপ থেকে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত সময় অতিক্রম হওয়ার পর প্রতিদান দিতে পারেন।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৩৩-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেনঃ সৌভাগ্যবান লোকদেরকে আমি আমার কিতাবের ওয়ারিশ করেছি, আর কিয়ামতের দিন তাদেরকে আমি চিরস্থায়ী নিয়ামত বিশিষ্ট জান্নাতে প্রবিষ্ট করবো। সেখানে আমি তাদেরকে স্বর্ণ ও মুক্তা নির্মিত কংকন পরাবো। যেমন সহীহ হাদীসে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “মুমিনের অলংকার ঐ পর্যন্ত হবে যে পর্যন্ত অযুর পানি পৌছে থাকে।”

সেখানে তাদের পোশাক হবে খাঁটী রেশমের, দুনিয়ায় তাদেরকে যা পরিধান করতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়ায় যে ব্যক্তি রেশম পরিধান করবে, আখিরাতে সে তা পরিধান করতে পাবে না।” তিনি আরো বলেছেনঃ “এটা (রেশম) তাদের (কাফিরদের) জন্যে দুনিয়ায় এবং তোমাদের (মুসলমানদের) জন্যে আখিরাতে।”

হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জান্নাতবাসীদের অলংকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ “তাদেরকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকার পরানো হবে। সেগুলো মণি-মুক্তা দ্বারা জড়ানো হবে। তাদের (মাথার) উপর রাজা-বাদশাহৃদের মুকুটের মত মুকুট থাকবে যা মণি-মুক্তা দ্বারা নির্মিত হবে। তারা হবে নব্য যুবক। তাদের দাড়ি-গোঁফ গজাবে না। তাদের চোখে সুরমা দেয়া থাকবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

তারা বলবেঃ প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করেছেন। যিনি আমাদের থেকে দুনিয়া ও আখিরাতের চিন্তা, উদ্বেগ, লজ্জা ও অনুতাপ দূর করে দিয়েছেন।

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “যারা লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ (আরবী) পাঠ করে তাদের কবরে ও হাশরের ময়দানে কোন ভয়-ভীতি থাকবে না। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে, তারা তাদের মাথা হতে মাটি ঝেড়ে ফেলছে এবং বলছেঃ প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের ভয়-ভীতি ও দুঃখ দুর্দশা দূর করে দিয়েছেন।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠকারীদের মৃত্যুর সময়, কবরে এবং কবর হতে উঠবার সময় কোনই ভয়-ভীতি থাকবে না। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে, পুনরুত্থানের সময় তারা তাদের মাথা হতে মাটি ঝেড়ে ফেলছে এবং বলছেঃ প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করেছেন। আমাদের প্রতিপালক তো ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী’।” (এ হাদীসটি তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, তাদের বড় বড় পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এবং ছোট ছোট নেকীগুলো মর্যাদার সাথে কবুল করা হয়েছে।

তারা আরো বলবেঃ ‘শোকর আল্লাহর যিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে স্থায়ী আবাস দিয়েছেন। আমাদের আমল তো এর যোগ্যই ছিল না। যেমন সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কাউকেও তার আমল কখনো জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনাকেও না?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, আমাকেও , তবে এ অবস্থায় যে, আমার প্রতি আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ হবে।”

তারা বলবেঃ এখানে তো ক্লেশ আমাদেরকে স্পর্শ করে না এবং ক্লান্তিও স্পর্শ করে না।’ রূহ্-এ আলাদা খুশী এবং দেহেও আলাদা শান্তি। দুনিয়ায় তাদেরকে আল্লাহর পথে যে কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল এটা তারই প্রতিদান। আজ শুধু শান্তি আর শান্তি। তাদেরকে বলে দেয়া হবেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা পানাহার কর তৃপ্তি সহকারে, তোমরা অতীত দিনে যা করেছিলে তার বিনিময়ে।” (৬৯:২৪)
৩৬-৩৭ নং আয়াতের তাফসীর:

সৎ লোকদের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ্ তা’আলা এখন দুষ্ট ও পাপীদের বর্ণনা দিচ্ছেন। তারা জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে থাকবে। তাদের আর মৃত্যু হবে না। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেখানে তারা মরবেও না, বাঁচবেও না।” (২০:৭৪) সহীহ্ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী তাদের সেখানে মৃত্যুও হবে না এবং তারা সেখানে বেঁচেও থাকবে না (অর্থাৎ সুখময় জীবন লাভ করবে না)।” তারা বলবেঃ “হে জাহান্নামের দারোগা! আল্লাহকে বল যে, তিনি যেন আমাদের মৃত্যু ঘটিয়ে দেন। তখন উত্তর দেয়া হবেঃ “তোমাদেরকে তো এখানেই অবস্থান করতে হবে।” তারা মৃত্যুকেই নিজেদের জন্যে আরাম ও শান্তিদায়ক মনে করবে। কিন্তু মৃত্যু আসবেই না এবং তাদের শাস্তিও কম করা হবে না। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “পাপীরা চিরকাল জাহান্নামের শাস্তির মধ্যে থাকবে, যে শাস্তি কখনো সরবেও না এবং কমও হবে না।” (৪৩:৭৪-৭৫)

তারা সমস্ত কল্যাণ হতে নিরাশ হয়ে যাবে। যেমন এক জায়গায় ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “জাহান্নামের আগুন সদা-সর্বদা তেজ হতেই থাকবে।” (১৭:৯৭) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা আস্বাদ গ্রহণ কর, আমি তো তোমাদের শাস্তিই শুধু বৃদ্ধি করবো।” (৭৮:৩০)

মহা প্রতাপান্বিত আল্লাহ্ বলেন:এই ভাবেই আমি প্রত্যেক অকৃজ্ঞকে শাস্তি দিয়ে থাকি। সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে নিষ্কৃতি দিন এবং দুনিয়ায় ফিরে যেতে দিন। এবার দুনিয়ায় গিয়ে আমরা সৎ কর্ম করবো এবং পূর্বে যা করতাম তা করবো না। কিন্তু আল্লাহ্ রাব্বল আলামীন খুবই ভাল জানেন যে, তারা দুনিয়ায় ফিরে গেলে আবার অবাধ্যাচরণই করবে। সুতরাং তাদের ঐ মনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা হবে না। অন্য স্থানে তাদের আকাঙ্ক্ষার জবাবে বলা হয়েছে ? তোমরা তো তারাই যে, যখন তোমাদের সম্মুখে আল্লাহর একত্রে বর্ণনা দেয়া হতো তখন তোমরা তা অস্বীকার করতে, তার সাথে শরীক স্থাপন করতে, তাতে তোমরা আনন্দ পেতে। কাজেই বেশ বুঝা যাচ্ছে যে, তোমাদেরকে যদি আবার দুনিয়ায় ফিরিয়ে দেয়া হয় তবে তোমরা তাই করবে যা করতে নিষেধ করা হতো।

আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে আরো বলবেনঃ তোমরা দুনিয়ায় বেশ দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলে। তোমরা এ দীর্ঘ সময়ে বহু কিছু করতে পারতে। যেমন কেউ সতেরো বছরের জীবন লাভ করলো। এই সতেরো বছরে সে বহু কিছু করতে পারে। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ “জেনে রেখো যে, দীর্ঘ জীবন আল্লাহর পক্ষ হতে হুজ্জত হয়ে যায়। সুতরাং দীর্ঘ জীবন হতে আমাদের আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত। যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন কোন কোন লোকের বয়স শুধু আঠারো বছর ছিল।” অহাব ইবনে মুনাব্বাহ্ (রঃ) বলেন যে, (আরবী) আল্লাহ্ তা’আলার এই উক্তি দ্বারা বিশ বছর বয়স বুঝানো হয়েছে। হাসান (রঃ) বলেছেন চল্লিশ বছর। মাসরূক (রঃ) বলেন যে, চল্লিশ বছর বয়সে মানুষের সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, চল্লিশ বছর বয়স হলে আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার ওযর পেশ করার সুযোগ থাকে না। তাঁর থেকে ষাট বছরের কথাও বর্ণিত আছে। আর এটাই অধিকতর সঠিকও বটে, যেমন একটি হাদীসে রয়েছে। যদিও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) হাদীসটির সনদের ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তাঁর এ সমালোচনা ঠিক নয়। হযরত আলী (রাঃ) হতেও ষাট বছরই বর্ণিত আছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন একটি ঘোষণা এও হবেঃ ‘ষাট বছরে পদার্পণ করেছে এরূপ লোক কোথায়?’ এটা ঐ বয়স যে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে এতো দীর্ঘ জীবন দান করিনি যে, সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারতে?” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটির সনদ সঠিক নয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহই ভাল জানেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলা যে বান্দাকে এতোদিন জীবিত রেখেছেন যে, তার বয়স ষাট অথবা সত্তর বছরে পৌছে গেছে, আল্লাহর কাছে তার কোন ওযর চলবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এ কথা তিনি তিনবার বলেন।

সহীহ্ বুখারীর কিতাবুর রিকাকে আছে যে, ঐ ব্যক্তির ওযর আল্লাহ্ কেটে দিয়েছেন যাকে তিনি দুনিয়ায় ষাট বছর পর্যন্ত রেখেছেন। এই হাদীসের অন্য সনদও রয়েছে। অন্য সনদ যদি নাও থাকতো তবুও ইমাম বুখারী (রঃ)-এর হাদীসটিকে তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে আনয়নই ওর বিশুদ্ধতার জন্যে যথেষ্ট ছিল। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ কথা বলেন যে, হাদীসটির সনদের সত্যাসত্য যাচাই করা জরুরী। ইমাম বুখারী (রঃ)-এর হাদীসটিকে সহীহ বলার তুলনায় ওটার একটা যবের মূল্যের সমানও দাম নেই। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

ডাক্তারদের মতে মানুষের স্বাভাবিক বয়সের সীমা হলো একশ’ বিশ বছর। ষাট বছর পর্যন্ত তো মানুষ যুবক রূপেই থাকে। তারপর তার রক্তের গরম কমতে থাকে এবং শেষে অচল বৃদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং আয়াতের এই বয়স উদ্দেশ্য হওয়াই সমীচীন। এ উম্মতের অধিকাংশের বয়স এটাই। এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের বয়স ষাট হতে সত্তর বছর। এর চেয়ে বয়স বেশী হয় এরূপ লোকের সংখ্যা খুব কম।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটি সম্পর্কে বলেন যে, এর আর কোন সনদ নেই। এটা বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার যে, ইমাম সাহেব কি করে এ কথা বলেছেন। এটা অন্য একটি সনদে ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) বর্ণনা করেছেন। স্বয়ং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটি অন্য সনদে তার জামে’ কিতাবে কিতাবুল যুহদে বর্ণনা করেছেন)

একটি দুর্বল হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর বছরের লোকও খুব হবে। অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তাঁর উম্মতের বয়স সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “তাদের বয়স পঞ্চাশ হতে ষাট বছর পর্যন্ত হবে। আবার জিজ্ঞেস করা হলোঃ “সত্তর বছর বয়স কারো হবে কি? তিনি জবাবে বলেনঃ “এটা খুব কম হবে। আল্লাহ তাদের উপর ও আশি বছর বয়সের লোকের উপর দয়া করুন!” (এটা বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন) সহীহ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বয়স তেষট্টি বছর ছিল। একটি উক্তি আছে যে, তার বয়স ষাট বছর হয়েছিল। এ কথাও বলা হয়েছে যে, তাঁর বয়স। পঁয়ষট্টি বছরে পৌঁছেছিল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমাদের কাছে তো সতর্ককারীও এসেছিল। অর্থাৎ তোমাদের সাদা চুল দেখা দিয়েছিল, অথবা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) এসেছিলেন। এই দ্বিতীয় উক্তিটি সঠিকতর। ইবনে যায়েদ (রঃ) (আরবী) অর্থাৎ প্রথম সতর্ককারীদের মধ্যে ইনি একজন সতর্ককারী। (৫৩:৫৬) সুতরাং বয়স দিয়ে, রাসূল পাঠিয়ে আল্লাহ তাআলা স্বীয় হুজ্জত পুরো করেছেন। যখন জাহান্নামীরা মত্যুর আকাক্ষা করবে তখন তাদেরকে জবাব দেয়া হবে। তোমাদের কাছে সত্য এসেছিল। অর্থাৎ আমি রাসূলদের তোমাদের কাছে সত্যসহ পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা স্বীকার করনি। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত শাস্তি প্রদান করিনি।”(১৭:১৫) অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখনই তাতে (জাহান্নামে) কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তাদেরকে রক্ষীরা জিজ্ঞেস করবেঃ তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা বলবেঃ অবশ্যই আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, আমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী গণ্য করেছিলাম এবং বলেছিলামঃ আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা তো মহা বিভ্রান্তিতে রয়েছো। (৬৭:৮-৯)

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ সুতরাং তোমরা শাস্তি আস্বাদন কর। অর্থাৎ তোমরা যে নবীদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলে তার শাস্তির স্বাদ আজ গ্রহণ কর।

এরপর প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই। আজ অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তাদের সাহায্যের জন্যে কেউই এগিয়ে আসবে না। আর তাদের কেউই আযাব থেকে বাচার কোন পথ পাবে না এবং কেউ তাদেরকে আযাব থেকে রক্ষা করতেও পারবে না।
৩৮-৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় ব্যাপক ও অসীম জ্ঞানের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি আসমান ও যমীনের সবকিছুই পূর্ণরূপে অবগত রয়েছেন। মানুষের অন্তরের গোপন কথাও তাঁর কাছে পরিষ্কার। তিনি স্বীয় বান্দার প্রত্যেক কাজের বিনিময় প্রদান করবেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ তিনি তোমাদের এককে অপরের প্রতিনিধি করে দিয়েছেন। কাফিরদের কুফরীর শাস্তি তাদেরকেই পেতে হবে। তারা যতো কুফরীর দিকে অগ্রসর হয়, তাদের উপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি ততো বেড়ে যায়। ফলে তাদের ক্ষতিও আরো বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে মুমিনের বয়স যতো বেশী হয় ততই তার পুণ্য বৃদ্ধি পায় এবং মর্যাদা বেড়ে যায়। আর আল্লাহ তাআলার কাছে তা গৃহীত হয়।
৪০-৪১ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সাঃ)-কে বলছেন যে, তিনি যেন মুশরিকদেরকে বলেনঃ আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাকছে, তারা কি সৃষ্টি করেছে আমাকে তা একটু দেখিয়ে দাও তো, অথবা এটাই প্রমাণ করে দাও যে, আকাশমণ্ডলীর সৃষ্টিতে তাদের কি অংশ রয়েছে? তারা তো অণু পরিমাণ জিনিসেরও মালিক নয়। তাহলে তারা যখন সৃষ্টিকারী নয় এবং সৃষ্টিতে অংশীদারও নয় এবং অণু পরিমাণ জিনিসেরও মালিক নয় তখন তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে তাদেরকে কেন ডাকছো? আচ্ছা, এটাও যদি না হয় তবে কমপক্ষে তোমরা তোমাদের কুফরী ও শিরকের কোন লিখিত দলীল পেশ কর। কিন্তু তোমরা এটাও পারবে না। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমরা শুধু তোমাদের প্রবৃত্তি ও মতের পিছনে লেগে রয়েছে। দলীল-প্রমাণ কিছুই নেই। তোমরা বাতিল, মিথ্যা ও প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েছে। একে অপরকে তোমরা প্রতারিত করছে। নিজেদের মনগড়া মিথ্যা মা’ৰূদের দুর্বলতাকে সামনে রেখে সঠিক ও সত্য মা’বুদ আল্লাহ তা’আলার ব্যাপক ও অসীম শক্তির প্রতি লক্ষ্য কর যে, আসমান ও যমীনে তাঁরই হুকুম কায়েম রয়েছে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে স্থির রয়েছে। এদিক ওদিক চলে যায় না। আকাশকে তিনি যমীনের উপর পড়ে যাওয়া হতে মাহফুয রেখেছেন। প্রত্যেকটাই তাঁর হুকুমে নিশ্চল ও স্থির রয়েছে। তিনি ছাড়া অন্য কেউই এগুলোকে স্থির রাখতে পারে না এবং সুশৃংখলভাবে কায়েম রাখতে পারে না। এই সহনশীল ও ক্ষমাপরায়ণ আল্লাহকে দেখো যে, তাঁর সৃষ্টজীব ও দাস তাঁর নাফরমানী, শিরক ও কুফরীতে ডুবে থাকা সত্ত্বেও তিনি সহনশীলতার সাথে তাদেরকে ক্ষমা করে চলেছেন। অবকাশ ও সুযোগ দিয়ে তিনি তাদের পাপরাশি ক্ষমা করতে রয়েছেন।

এখানে ইবনে আবি হাতিম (রঃ) একটি গারীব এমনকি মুনকার হাদীস আনয়ন করেছেন। তাতে রয়েছে যে, হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে একদা মিম্বরে হযরত মূসা (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণনা করতে শুনেছেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হযরত মূসা (আঃ)-এর অন্তরে একদা খেয়াল জাগলো যে, মহামহিমান্বিত আল্লাহ কি নিদ্রা যান? তখন আল্লাহ তা’আলা একজন ফেরেশতাকে তার কাছে পাঠিয়ে দেন যিনি তাঁকে তিনদিন পর্যন্ত ঘুমাতে দিলেন না। অতঃপর তিনি তার দু’হাতে দু’টি বোতল দিলেন এবং তাঁকে বললেনঃ “এগুলো হিফাযত করুন যেন পড়ে না যায় এবং না ভাঙ্গে।” হযরত মূসা (আঃ) ওগুলো রক্ষা করে চললেন। কিন্তু তার উপর নিদ্রার প্রকোপ ছিল বলে তন্দ্রা আসছিল। তন্দ্রায় ঝুঁকে পড়তেই তিনি সতর্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষে দ্রিা তাঁর উপর চেপে বসলো এবং তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ফলে বোতল দু’টি তাঁর হাত হতে পড়ে গিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। এতে তাঁকে জানানো উদ্দেশ্য ছিল যে, ঘুমন্ত ব্যক্তি যখন দু’টি বোতল ধরে রাখতে পারে না তখন আল্লাহ তা’আলা যদি নিদ্রা যেতেন তাহলে আসমান ও যমীনের হিফাযত কি করে সম্ভব হতো? কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বর্ণনা নয়, বরং এটা বানী ইসরাঈলের মনগড়া গল্প। এ কি সম্ভব যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর ন্যায় একজন বড় মর্যাদা সম্পন্ন নবী এ ধরনের চিন্তা করতে পারেন যে, আল্লাহ তা’আলা নিদ্রা যান? অথচ আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বিশেষণের মধ্যে বলে দিয়েছেন যে, তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। যমীন ও আসমানের যাবতীয় বস্তুর মালিক তিনিই?

হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা নিদ্রা যান না, আর এটা তাঁর শানের বিপরীত যে, তিনি নিদ্রা যাবেন। তিনি পাল্লাকে উঁচু-নীচু করে থাকেন। দিনের আমল রাতের পূর্বে এবং রাতের আমল দিনের পূর্বে তাঁর কাছে পৌছে যায়। জ্যোতি অথবা আগুন তাঁর হিজাব বা পর্দা। যদি তা খুলে দেয়া হয় তাহলে যেখান পর্যন্ত তাঁর দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হবে সেখান পর্যন্ত সমস্ত মাখলূক তাঁর চেহারার তাজাল্লীতে জ্বলে পুড়ে যাবে।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, একটি লোক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কাছে আগমন করলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “কোথা হতে আসলে?” সে উত্তর দিলোঃ “সিরিয়া হতে।” তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “সেখানে কার সাথে সাক্ষাৎ করেছো?” সে জবাবে বললোঃ “হযরত কা’ব (রাঃ)-এর সাথে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “কা’ব (রাঃ) কি বর্ণনা করলেন?” লোকটি উত্তর দিলো যে, হযরত কা’ব (রাঃ) বললেনঃ “আসমান একজন ফেরেশতার কাঁধ পর্যন্ত ঘুরতে আছে।” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) লোকটিকে বললেনঃ “তুমি কি তাঁর কথাটিকে সত্য বলে মেনে নিলে, না মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিলে?” লোকটি জবাব দিলোঃ “আমি কিছুই মনে করিনি।” তখন তিনি বললেনঃ “হযরত কা’ব (রাঃ) ভুল বলেছেন।” অতঃপর তিনি (আরবী)-এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন। (এ হাদীসটি ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ বিশুদ্ধ) অন্য সনদে আগুন্তুক লোকটির নাম হযরত জুনদুব বাজালী (রাঃ) বলা হয়েছে। ইমাম মালিকও (রঃ) একথা খণ্ডন করতেন যে, আসমান ঘুরতে রয়েছে। আর তিনি এ আয়াত হতেই দলীল গ্রহণ করতেন এবং ঐ হাদীস থেকেও দলীল গ্রহণ করতেন যাতে রয়েছে। যে, পশ্চিমে একটি দরযা রয়েছে যেটা তাওবার দরযা, ওটা বন্ধ হবে না যে পর্যন্ত না পশ্চিম দিক হতে সূর্য উদিত হবে। এ হাদীসটি সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ। এসব ব্যাপারে মহান ও পবিত্র আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৪২-৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:

কুরায়েশরা ও অন্যান্য আরবরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আগমনের পূর্বে কসম করে করে বলেছিল যে, যদি তাদের কাছে আল্লাহ্ তা’আলার কোন রাসূল আগমন করেন তবে দুনিয়ার সবারই চেয়ে তারা তাঁর অনুগত হবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এ জন্যে যে, তোমরা যেন বলতে না পারঃ আমাদের পূর্ববর্তী জামাআতের উপর কিতাব নাযিল হয়েছিল, কিন্তু আমরা তো তা থেকে বে-খবরই ছিলাম। অথবা তোমরা বলবেঃ যদি আমাদের উপর কিতাব নাযিল করা হয় তবে আমরা তাদের চেয়ে অনেক বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত হবো। নাও, এখন তো তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে দলীল এসে গেছে এবং হিদায়াত ও রহমতও এসেছে। সুতরাং ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বড় যালিম আর কে আছে যে আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অবিশ্বাস করেছে এবং ওগুলো হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? যারা আমার নিদর্শন হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় সত্যবিমুখিতার জন্যে আমি তাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দেব।”(৬:১৫৬-১৫৭) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ “তারা অবশ্যই বলতো যে, যদি আমাদের কাছে পূর্ববর্তীদের যিকর আসে তবে অবশ্যই আমরা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হবো। অতঃপর তারা তাকে অস্বীকার করে, অতএব সত্বরই তারা জানতে পারবে।”

তাদের কাছে আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এবং তাঁর সর্বশেষ ও সর্বোত্তম কিতাব অর্থাৎ কুরআন কারীম এসে গেছে। কিন্তু এরপরেও তাদের কুফরী ও অবাধ্যতা আরো বেড়ে গেছে। তারা আল্লাহ তা’আলার কথা মানতে অস্বীকার করেছে ও অহংকার করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা নিজেরা তো মানেইনি, এমনকি চক্রান্ত করে আল্লাহর বান্দাদের তাঁর পথে আসতে বাধা দিয়েছে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত যে, এর শাস্তি তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। তারা আল্লাহ তা’আলার ক্ষতি করছে না, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করছে।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা কূট ষড়যন্ত্র হতে বেঁচে থাকবে। কূট ষড়যন্ত্রের বোঝা ষড়যন্ত্রকারীকেই বহন করতে হবে এবং তাকে আল্লাহ তা’আলার নিকট জবাবদিহি করতে হবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কারাযী (রঃ) বলেছেনঃ “তিনটি কাজ যে করে সে মুক্তি ও পরিত্রাণ পায় না। তার কাজের প্রতিফল নিশ্চিতরূপে তারই উপর পড়ে। কাজ তিনটি হলোঃ কট ষড়যন্ত্র করা, বিদ্রোহ করা ও ওয়াদা ভঙ্গ করা।” অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেন।

মহান আল্লাহ বলেনঃ তারা কি প্রতীক্ষা করছে তাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত বিধানের? অর্থাৎ তাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের মতই অন্যায় ও অসৎ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে তারা আল্লাহ তা’আলার যে গযবে পতিত হয়েছিল এলোকগুলো তারই অপেক্ষায় রয়েছে। আল্লাহর বিধানের কোন পরিবর্তন নেই।

এবং তার বিধানের কোন ব্যতিক্রমও কখনো হয় না। আল্লাহ যে কওমের উপর শাস্তি অবতীর্ণ করার ইচ্ছা করেছেন তা পরিবর্তনের ক্ষমতা কারো নেই। তাদের উপর থেকে আযাব সরবেও না এবং তারা তা থেকে বাচতেও পারবে না। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৪৪-৪৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে খবর দিচ্ছেন ও তাঁকে বলতে হুকুম করছেনঃ ঐ অস্বীকার কারীদেরকে বলে দাও যে, দুনিয়ায় ঘুরে ফিরে দেখো তো, তোমাদের ন্যায় অস্বীকারকারী তোমাদের পূর্ববর্তীদের কি পরিণতি হয়েছে? তাদের নিকট থেকে নিয়ামত ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, তাদের ঘরবাড়ী উজাড় করে দেয়া হয়েছে, তাদের শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের ধন-দৌলত ধ্বংস হয়েছে, তাদের সন্তান-সন্ততিকেও ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর আযাব তাদের উপর থেকে কোনক্রমেই সরেনি। তাদের উপর থেকে বিপদ কেউই সরাতে পারেনি। তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কেউই তাদের কোন উপকার করতে পারেনি। আল্লাহ তা’আলাকে কেউ অপারগ করতে পারে না। তার কোন ইচ্ছা লক্ষ্যশূন্য হয় না। তাঁর কোন আদেশ কেউ রদ করতে পারে না। সারা বিশ্বজগত সম্বন্ধে তিনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তিনি সব কিছুই করতে পারেন। আল্লাহ্ তা’আলা যদি মানুষকে তাদের সমস্ত কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করতেন। ও শাস্তি দিতেন তবে আসমান ও যমীনে যত প্রাণী আছে সবাই ধ্বংস হয়ে যেতো। জীব-জন্তু, খাদ্যবস্তু সবই বরবাদ হয়ে যেতো। জীব-জন্তুর আবাসস্থলে এবং পাখীর বাসায়ও তাঁর আযাব পৌঁছে যেতো। দুনিয়ায় কোন জীব-জন্তু বেঁচে থাকতো না। কিন্তু এখন তাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছে এবং আযাবকে বিলম্বিত করা হয়েছে। সময় আসছে যে, কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে এবং হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে যাবে ! আনুগত্যের বিনিময়ে পুরস্কার এবং অবাধ্যতার বিনিময়ে শাস্তি দেয়া হবে। সময় এসে যাবার পর আর মোটেই বিলম্ব করা হবে না। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দাদের উপর লক্ষ্য রেখে চলেছেন। তিনি উত্তম দর্শক।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# মুফাসসিরগণের একটি দলের মতে এ বাক্যের সম্পর্ক নিকটবর্তী দু’টি বাক্যের সাথেই রয়েছে। অর্থাৎ সৎকাজে অগ্রগামীরাই বড় অনুগ্রহের অধিকারী এবং তারাই এ জান্নাতগুলোতে প্রবেশ করবে। অন্যদিকে প্রথম দু’টি দলের ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের পরিণামের কথা চিন্তা করে এবং নিজেদের বর্তমান অবস্থা থেকে বের হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারে। আল্লামা যামাখ্ শারী এ অভিমতটি বলিষ্ঠভাবে বিবৃত করেছেন এবং ঈমাম রাযী একে সমর্থন দিয়েছেন।

কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসির বলেন, ওপরের সমগ্র আলোচনার সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। আর এর অর্থ হচ্ছে, এ তিনটি দলই শেষ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে, কোন প্রকার হিসেব-নিকেশ ছাড়াই বা হিসেব নিকেশের পর এবং সব রকমের জবাবাদিহি থেকে সংরক্ষিত থেকে অথবা কোন শাস্তি পাওয়ার পর যে কোন অবস্থাতেই হোক না কেন কুরআনের পূর্বাপর আলোচনা এ ব্যাখ্যার প্রতি সমর্থন দিচ্ছে। কারণ সামনের দিকে কিতাবের উত্তরাধিকারীদের মোকাবিলায় অন্যান্য দল সম্পর্কে বলা হচ্ছে, “আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন।” এ থেকে জানা যায়, যারা এ কিতাবকে মেনে নিয়েছে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত এবং যারা এর প্রতি ঈমান আনতে অস্বীকার করেছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। আবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীসও এর প্রতি সমর্থন জানায়। হযরত আবুদ দারদা এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং একে উদ্ধৃত করেছেন ইমাম আহমাদ, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম, তাবারানী, বায়হাকী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ। হাদীসে নবী করীম ﷺ বলছেনঃ

فَأَمَّا الَّذِينَ سَبَقُوا فَأُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَأَمَّا الَّذِينَ اقْتَصَدُوا فَأُولَئِكَ الذين يُحَاسَبُونَ حِسَاباً يَسِيراً وَأَمَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ يُحْبَسُونَ فِى طُولِ الْمَحْشَرِ ثُمَّ هُمُ الَّذِينَ تتلقاهم اللَّهُ بِرَحْمَتِهِ فَهُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَذْهَبَ عَنَّا الْحَزَنَ

“যারা সৎকাজে এগিয়ে গেছে‌ তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে কোনরকম হিসেব-নিকেশ ছাড়াই। আর যারা মাঝপথে থাকবে তাদের হিসেব-নিকেশ হবে, তবে তা হবে হালকা। অন্যদিকে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে তাদেরকে হাশরের দীর্ঘকালীন সময়ে আটকে রাখা হবে, তারপর তাদেরকে আল্লাহর রহমতের মধ্যে নিয়ে নেয়া হবে এবং এরাই হবে এমনসব লোক যারা বলবে, সেই আল্লাহর শোকর যিনি আমাদের থেকে দুঃখ দূর করে দিয়েছেন।”

এ হাদীসে নবী করীম ﷺ নিজেই এ আয়াতটির পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। এখানে ঈমানদারদের তিনটি শ্রেণীর পরিণাম আলাদা আলাদাভাবে তুলে ধরেছেন। মাঝখানে অবস্থানকারীদের “ হালকা জবাবদিহির” সম্মুখীন হবার অর্থ হচ্ছে, কাফেরদেরকে তো তাদের কুফরীর শাস্তি ছাড়াও তাদের প্রত্যেকটি অপরাধ ও গোনাহের পৃথক শাস্তিও দেয়া হবে। কিন্তু এর বিপরীতে ঈমানদারদের মধ্যে যারা ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের কাজ নিয়ে হাজির হবে তাদের সৎ ও অসৎ কাজগুলোর সম্মিলিত হিসেব-নিকেশ হবে। প্রত্যেক সৎকাজের জন্য আলাদা পুরস্কার ও প্রত্যেক অসৎ কাজের জন্য আলাদা শাস্তি দেয়া হবে না। আর ঈমানদারদের মধ্যে থেকে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করবে তাদেরকে হাশরের সমগ্র সময়-কালে আটকে রাখা হবে-একথার অর্থ হচ্ছে এই যে, তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে না বরং তাদেরকে আদালতের কার্যকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত আটকে রাখার শাস্তি দেয়া হবে। অর্থাৎ হাশরের সমগ্র সময়-কাল (না জানি তা কত শত বছরের সমান দীর্ঘ হবে) তার পূর্ণ কঠোরতা সহকারে তাদের ওপর দিয়ে অতিক্রান্ত হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ‌ তাদের প্রতি রহম করবেন এবং আদালতের কাজ শেষ হবার সময় হুকুম দেবেন, ঠিক আছে, এদেরকেও জান্নাতে দিয়ে দাও। এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বিভিন্ন উক্তি মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সাহাবী যেমন, হযরত উমর (রা.), হযরত উসমান (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আবুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত আয়েশা (রা.), হযরত আবু সাঈদ ধুদরী (রা.) এবং হযরত বারাআ ইবনে আজেব (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। আর একথা বলা নিস্প্রয়োজন যে, সাহাবীগণ এহেন ব্যাপারে কোন কথা ততক্ষণ পর্যন্ত বলতে পারেন না। যতক্ষণ না তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামের মুখে তা শুনে থাকবেন।

কিন্তু এ থেকে একথা মনে করা উচিত নয় যে, মুসলমানদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে তাদেরকে কেবলমাত্র “আদালত সমাপ্তিকালীন” সময় পর্যন্ত আটকে রাখারই শাস্তি দেয়া হবে এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ জাহান্নামে যাবেই না। কুরআন ও হাদীসে বহুবিধ অপরাধের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এসব অপরাধকারীদের ঈমানও তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে পারবে না। যেমন যে মু’মিন কোন মু’মিনকে জেনে বুঝে হত্যা করে আল্লাহ‌ নিজেই তার জন্য জাহান্নামের শাস্তি ঘোষণা করেছেন। অনুরূপভাবে উত্তরাধিকার আইনের আল্লাহ‌ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা ভংগকারীদের জন্যও কুরআন মজীদে জাহান্নামের শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। সূদ হারাম হবার হুকুম জারী হবার পর যারা সূদ খাবে তাদের জন্য পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে, তারা আগুনের সাথি। এছাড়াও আরো কোন কোন কবীরাহ গোনাহকারীদের জন্যও হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, তারা জাহান্নামে যাবে।
# সব ধরনের দুঃখ। দুনিয়ায় যেসব চিন্তা ও পেরেশানীতে আমরা লিপ্ত ছিলাম তার হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া গেছে। কিয়ামতে নিজের পরিণাম সম্পর্কে যে দুশ্চিন্তা ছিল তাও খতম হয়ে যাবে এবং এখন সামনের দিকে অখণ্ড নিশ্চিন্ততা, সেখানে কোন প্রকার দুঃখ কষ্টের প্রশ্নই থাকে না।
# আমাদের অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং কর্মের যে সামান্যতম পুঁজি আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম তাকে বিপুল মর্যাদা ও মূল্যদান করে তার বিনিময়ে তাঁর জান্নাত আমাদের দান করেছেন।
# দুনিয়া আমাদের আখেরাতের সফরের একটি মনযিল ছিল। এ মনযিলটি আমরা অতিক্রম করে চলে এসেছি। হাশরের ময়দানও এ সফরের একটি পর্যায় ছিল। এ পর্যায়ও আমরা পার হয়েছি। এখন আমরা এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছি যেখান থেকে বের হয়ে আর কোথাও যেতে হবে না।
# অন্যকথায় আমাদের সমস্ত পরিশ্রম ও কষ্টের অবসান ঘটেছে। এখন এখানে আমাদের এমন কোন কাজ করতে হবে না যা করতে আমাদের পরিশ্রম করতে হবে এবং যা শেষ করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বো।
# আল্লাহ‌ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর যে কিতাব নাযিল করেছেন তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছে।
# এখানে এমন প্রত্যেকটি আয়ুষ্কালের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে মানুষ সত্য ও মিথ্যা এবং ভালো ও মন্দের মধ্যে ফারাক করতে চাইলে করতে পারে এবং গোমরাহী ত্যাগ করে হিদায়াতের পথে পাড়ি দিতে চাইলেও দিতে পারে। এ বয়সে পৌঁছে যাবার আগে যদি কোন ব্যক্তি মরে গিয়ে থাকে তাহলে এ আয়াতের দৃষ্টিতে তাকে কোন প্রকার জবাবদিহি করতে হবে না। তবে যে ব্যক্তি এ বয়সে পৌঁছে গেছে তাকে অবশ্যই তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। আর তারপর এ বয়স শুরু হয়ে যাবার পর যতদিন সে বেঁচে থাকবে এবং সতর্কতার সাথে সহজ-সরল পথে চলার জন্য যতই সুযোগ সে পেয়ে যেতে থাকবে ততই তার দায়িত্ব কঠিন হয়ে যেতে থাকবে। এমনকি যে ব্যক্তি বার্ধক্যে পৌঁছেও সোজা হবে না তার জন্য কোন ওজরই থাকবে না। একথাটিই একটি হাদীসে হযরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ যে ব্যক্তি কম বয়স পাবে তার জন্য তো ওজরের সুযোগ থাকে কিন্তু ৬০ বছর এবং এর বেশী বয়সের অধিকারীদের জন্য কোন ওজর নেই। (বাখারী, আহমাদ, নাসায়ী, ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতেম ইত্যাদি)
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, পূর্ববর্তী প্রজন্ম ও জাতিদের অতিবাহিত হওয়ার পর এই পৃথিবীর বুকে তিনি তোমাদেরকে তাদের জায়গায় স্থাপন করেছেন। দুই, তিনি পৃথিবীতে তোমাদেরকে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করার যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা তোমাদের এ জিনিসগুলোর মালিক হবার কারণে নয় বরং মূল মালিকের প্রতিনিধি হিসেবে তোমাদের এগুলো ব্যবহার করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
# যদি পূর্বের বাক্যের এ অর্থ গ্রহণ করা হয় যে, তোমাদেরকে তিনি পূর্ববর্তী জাতিদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন তাহলে এ বাক্যটির অর্থ হবে, যারা অতীতের জাতিসমূহের পরিণাম থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং যে কুফরীর বদৌলতে জাতিসমূহ ধ্বংস হয়ে গেছে সেই একই কুফরী নীতি অবলম্বন করেছে তারা নিজেদের এ নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ করবেই। আর যদি এ বাক্যটির এ অর্থ গ্রহণ করা হয় যে, আল্লাহ‌ তোমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করেছেন তাহলে এ বাক্যের অর্থ হবে, যারা নিজেদের প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা ভুলে গিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে বসেছে অথবা যারা আসল মালিককে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী করেছে তারা নিজেদের এ বিদ্রোহাত্মক কর্মনীতির অশুভ পরিণাম ভোগ করবে।
# “তোমাদের” শরীক শব্দ ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা তো আসলে আল্লাহর শরীক নয়, মুশরিকরা নিজেরাই তাদেরকে আল্লাহর শরীক বানিয়ে রেখেছে।
# আমার লেখা এমন কোন পরোয়ানা কি তাদের কাছে আছে যাতে আমি একথা লিখে দিয়েছি যে, অমুক অমুক ব্যক্তিকে আমি রোগ নিরাময় বা কর্মহীনদের কর্মসংস্থান অথবা অভাবীদের অভাব পূরণ করার ক্ষমতা দিয়েছি কিংবা অমুক অমুক ব্যক্তিকে আমি আমার ভূপৃষ্ঠের অমুক অংশের কর্তৃত্ব দান করেছি এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকদের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার দায়িত্ব এখন তাদের হাতে কাজেই আমার বান্দাদের এখন তাদের কাছেই প্রার্থনা করা উচিত, তাদের কাছেই নজরানা ও মানত করা উচিত এবং যেসব নিয়ামতই তারা লাভ করে সেজন্য ঐ সব ছোট খোদাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। এ ধরনের কোন প্রমাণপত্র যদি তোমাদের কাছে থাকে তাহলে তা সামনে হাজির করো। আর যদি তা না থাকে তাহলে তোমরা নিজেরাই চিন্তা করো, এসব মুশরিকী আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মধারা তোমরা কিসের ভিত্তিতে উদ্ভাবন করেছো? তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, পৃথিবী ও আকাশে কোথাও তোমাদের এসব বানোয়াট উপাস্যদের আল্লাহর সাথে শরীক হবার কোন আলামত পাওয়া যায়? এর জবাবে তোমরা কোন আলামত চিহ্নিত করতে পারো না। তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আল্লাহ‌ কি তাঁর কোন কিতাবে একথা বলেছেন অথবা তোমাদের কাছে বা ঐসব বানোয়াট উপাস্যদের কাছে আল্লাহর দেয়া এমন কোন পরোয়ানা আছে যা এ মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, তোমরা যেসব ক্ষমতা-ইখতিয়ার তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট করছো আল্লাহ‌ নিজেই তাদেরকে সেগুলো দান করেছেন? তোমরা এটাও পেশ করতে পারো না। এখন যার ভিত্তিতে তোমরা এ আকীদা তৈরি করে নিয়েছো সেটি কি? তোমরা কি আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের মালিক, যার ফলে আল্লাহর ক্ষমতা ইখতিয়ার যাকে ইচ্ছা ভাগ বাটোয়ারা করে দিচ্ছো?
# এসব ধর্মীয় নেতা, পীর, পুরোহিত, গুরু, পণ্ডিত, মাশায়েখ ও দরগাহের খাদেম এবং এদের এজেন্টরা নিছক নিজেদের দোকানদারীর পসরা সাজিয়ে বসার জন্য জনসাধারণকে বোকা বানাচ্ছে এবং নানা গাল গল্প তৈরি করে লোকদেরকে মিথ্যা ভরসা দিয়ে চলছে যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে অমুক অমুক সত্তার শরণাপন্ন হলে তোমাদের দুনিয়ার সমস্ত কাজের সমাধা হয়ে যাবে এবং আখেরাতে তোমরা যতই গোনাহ নিয়ে হাজির হও না কেন তারা তা ক্ষমা করিয়ে নেবে।
# আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত রাখার কারণেই এ সীমাহীন বিশ্ব-জাহান প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। কোন ফেরেশতা, জিন, নবী বা অলী একে ধরে রাখছে না। বিশ্ব-জাহানকে ধরে রাখা তো দূরের কথা এ অসহায় বান্দারা তো নিজেদেরকেই ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে না। প্রত্যেকেই নিজের জন্ম ও স্থায়িত্বের জন্য মহান সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তাদের মধ্য থেকে কারো সম্পর্কে একথা মনে করা যে, আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারে তার কিছুটা অংশ আছে, নিছক বোকামী ও প্রতারণার শিকার হওয়া ছাড়া আর কি হতে পারে?
# আল্লাহর সমীপে এত বড় গোস্তাখী করা হচ্ছে এবং এরপরও তিনি শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, এটা তাঁর নিছক সহনশীলতা ও ক্ষমাগুণের পরিচায়ক।
# নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের লোকেরা সাধারণভাবে এবং কুরাইশরা বিশেষভাবে ইহুদি ও খৃস্টানদের বিকৃত নৈতিক অবস্থা দেখে একথা বলতো। তাদের এ উক্তি ইতিপূর্বে সূরা আল আন’আমেও ( ১৫৬-১৫৭ আয়াত) উল্লেখিত হয়েছে এবং সামনে সূরা সাফফাতেও ( ১৬৭-১৬৯ আয়াত) আসছে।
# আল্লাহর এ আইন এদের ওপরও জারি হয়ে যাবে। যে জাতি নিজের নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে তাকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দেয়া হবে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*কোরআনে জান্নাত ও জাহান্নামের চিত্র : পূর্বোল্লিখিত জান্নাত ও এর মধ্যকার নেয়ামতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘এটাই মহা অনুগ্রহ…’ (আয়াত ৩৪-৩৫)  আলােচ্য আয়াতে জান্নাতের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে দু’ধরনের নেয়ামতের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। একটি হচ্ছে চাক্ষুষ বস্তুজাত নেয়ামত আর অপরটি হচ্ছে অনুভব্য মানসজাত নেয়ামত। প্রথমটি দেখা যায় আর দ্বিতীয়টি অন্তর দিয়ে অনুভব করা যায়। যেমন বলা হচ্ছে, সেখানে তারা স্বর্ণ নির্মিত, মােতি খচিত কংকণ দ্বারা অলংকৃত হবে। সেখানে তাদের পােশাক হবে রেশমের এই আয়াতে যেসব নেয়ামতের কথা বলা হয়েছে সে গুলাে নিতান্তই বস্তুগত নেয়ামত যা চোখে দেখা যায়। এগুলাের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত আকষর্ণ থাকে, আগ্রহ থাকে। অপরদিকে আর একশ্রেণীর নেয়ামতের কথা বলা হচ্ছে যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে, যার সম্পর্ক মন মস্তিষ্কের সাথে। যেমন সন্তুষ্টি, শান্তি ও পরিতুষ্টি- এ বিষয়টি আয়াতে এভাবে এসেছে, আর তারা বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের দুঃখ দূর করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমাদের পালনকর্তা ক্ষমাশীল, গুণগ্ৰাহী'(৩৪-৩৫) আলােচ্য আয়াতে দুনিয়া ও আখেরাতের দুঃখ দুর্দশা দূর করার কথা বলা হয়েছে, ক্ষমার কথা বলা হয়েছে, প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে, স্থায়ী নিবাসের কথা বলা হয়েছে এবং আরাম ও শান্তির কথা বলা হয়েছে। সাথে সাথে বলা হয়েছে, এ সকল নেয়ামত আল্লাহ তায়ালা নিতান্তই অনুগ্রহ দিয়ে বান্দাকে দান করবেন। এসব নেয়ামত অধিকারবলে বা দাবী করে কেউ লাভ করতে পারবে না; বরং আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে যাকে দান করবেন কেবল সেই এর অধিকারী হবে। আলােচ্য আয়াতে যে পরিবেশের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা আরামের পরিবেশ, শান্তির পরিবেশ ও ভােগ বিলাসিতার পরিবেশ। এই পরিবেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন সব শব্দ চয়ন করা হয়েছে যা ব্যঞ্জনা ও দ্যোতনার দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে দয়া ও মমত্বের এক অপূর্ব দৃশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। যেখানে কষ্ট নেই, ক্লান্তি নেই, আছে কেবল শান্তি ও আরাম। তাই আয়াতে এমন শব্দ পরিহার করা হয়েছে যার উচ্চারণ কষ্টসাধ্য এবং যা কঠোরতার দ্যোতনা প্রকাশ করে। আর সে কারণেই দুঃখ শব্দের জন্যে ‘হুযন’-এর পরিবর্তে ‘হাম্ম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তেমনি ‘জান্নাত’ শব্দের পরিবর্তে “দারুল মুকামাহ’ বা আবাসস্থল ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, হুযন’-এর তুলনায় ‘হাম্ম এবং ‘জান্নাত’-এর তুলনায় দারুল মুকামাহ’ শব্দ দুটোর উচ্চারণ সহজ ও স্বাভাবিক। মােটকথা, নম্রতা, কোমলতা ও সরলতার একটা ভাব আলােচ্য আয়াতে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এখন আমরা বিপরীত দিকটার প্রতি দৃষ্টিপাত করছি। এখানে আমরা দেখতে পাই উদ্বেগ উৎকন্ঠা এবং অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার চিত্র। এই চিত্রটি আমরা নিচের আয়াতে এভাবে দেখতে পাই, ‘আর যারা কাফের হয়েছে, তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন…’ (আয়াত ৩৬-৩৭) কাফের মােশরেকরা জাহান্নামের আগুনে চিরকাল জ্বলতে থাকবে। তাদের এই শাস্তি কখনও লঘু করা হবে না। এমনকি মৃত্যুন্ত্রণায় কাতরাতে থাকলেও মৃত্যু তাদের স্পর্শ করবে না। তারা সেখানে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকবে, বিলাপ করতে থাকবে, আর্তনাদ করতে থাকবে এবং অনুনয় বিনয় করে বলতে থাকবে, আমাদের এখান থেকে বের করে নাও, আমরা আগের মতাে কাজ করবাে না। তাদের এই বক্তব্যে অপরাধের স্বীকারােক্তি রয়েছে, আর সাথে সাথে রয়েছে অনুশােচনা, কিন্তু সময় ততােক্ষণে পার হয়ে গেছে। অনুশােচনায় কোনাে লাভ হবে না। তাই তাদের এই বক্তব্যের উত্তর দেয়া হচ্ছে অত্যন্ত কঠোর ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। বলা হচ্ছে, ‘আমি কি তােমাদের এতােটা বয়স দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে?’ অর্থাৎ যে বয়স তােমাদের দেয়া হয়েছিলাে তা উপদেশ গ্রহণের জন্যে যথেষ্ট ছিলাে, কিন্তু তােমরা এর সদ্ব্যবহার করনি। তাছাড়া তােমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিলাে, কিন্তু তা সত্তেও তােমরা সতর্ক হওনি, উপদেশ গ্রহণ করনি। কাজেই এখন জাহান্নামের শাস্তি ভােগ করাে। তােমাদের রক্ষা করার মতাে এখানে কেউ নেই। এখানে আমরা বেশ কিছু বিপরীতমুখী চিত্র দেখতে পাই। যেমন, সুখ শান্তির বিপরীতে রয়েছে উদ্বেগ অশান্তির চিত্র; দোয়া ও কৃতজ্ঞতার সুরেলা কণ্ঠের বিপরীতে রয়েছে আর্তনাদ ও চিৎকারের মর্ম-বিদারী কণ্ঠ। আদর আপ্যায়ন ও সাদরে গ্রহণের বিপরীতে রয়েছে উপেক্ষা এবং ভর্ৎসনার চিত্র। কোমল সুর ও সুসংহত ছন্দের বিপরীতে রয়েছে কর্কশ সুর ও তীব্র ছন্দের অস্তিত্ব। মােটকথা, আংশিক ও সামষ্টিক প্রতিটি ক্ষেত্রে পরস্পর বিপরতিমুখী দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করা হয়েছে। এসব দৃশ্যের অবতারণার পর চূড়ান্তভাবে একটি মন্তব্য পেশ করা হচ্ছে। সেটা হচ্ছে এই ‘আল্লাহ আসমান যমীনের অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। তিনি অন্তরের বিষয় সম্পর্কেও সবিশেষ অবহিত'(আয়াত ৩৮)। কিতাব নাযিল করা, এই কিতাবের ধারক ও বাহকদের মনােনীত করা, অত্যাচারী বান্দাদের ক্ষমা করা, সকর্মশীল বান্দাদের উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করা এবং কাফেরদের জন্যে কঠিন শাস্তি ও পরিণতির ঘােষণা দেয়া- এসব কিছু করা কেবল সেই মহান সত্ত্বার পক্ষেই সম্ভব যিনি ব্যাপক জ্ঞান | এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী। এই হিসেবে উপরের মন্তব্যটি অবশ্যই একটি যথার্থ মন্তব্য। কারণ, আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন একমাত্র সেই মহান সত্ত্বা, যিনি আসমান যমীনের সকল ভেদ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। শুধু তাই নয়; বরং মানুষের অন্তর জগতে কি ঘটছে তার খবরও তিনি রাখেন, কাজেই এই ব্যাপক ও সূক্ষ্ম জ্ঞানের বদৌলতে ওপরে বর্ণিত কাজগুলাে সমাধা করা একমাত্র তাঁরই পক্ষে সম্ভব।
# আলােচ্য সূরার এই শেষ পর্বটিতেও বেশকিছু হৃদয়স্পর্শী আলােচনা এসেছে এবং একাধিক ব্যঞ্জনার উপস্থিতি রয়েছে। যুগ থেকে যুগান্তরে এবং কাল থেকে কালান্তরে মানবতার রূপ কি ছিলাে এখানে সে আলােচনা এসেছে। ইহলােক ও উর্ধ্বলােকসহ গােটা বিশ্বজগতে আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারাে শরীকানা আছে কিনা সে আলোচনা এসেছে। আসমান ও যমীনের পরিচালনার পেছনে আল্লাহর যে কুদরতী ও অদৃশ্য হাতটি কাজ করছে, তার আলােচনা এসেছে। এরপর আলােচনায় এসেছে সেসব লােকদের প্রসংগ যারা আল্লাহর সুস্পষ্ট নিদর্শন ও দলীল প্রমাণগুলাে অস্বীকার করেছে। অথচ তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলেছিলাে যে, যদি কোনাে সতর্ককারীর আগমন ঘটে তাহলে তারা অন্য যে কোনাে সম্প্রদায়ের তুলনায় অধিকতর হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে, কিন্তু পরবর্তীকালে তারা এই ওয়াদা ভংগ করে এবং এর বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে কাংখিত সতর্ককারীর আগমনের পর তাদের ঘৃণা উপেক্ষা আরও বেড়ে যায়। এদের প্রসংগে আলোচনা করতে গিয়ে পূর্ববর্তী কাফের সম্প্রদায়ের মর্মান্তিক পরিণতির কথাও আলােচনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এসব ধ্বংসলীলা স্বচক্ষে দেখেও এরা আল্লাহকে ভয় করে না। অনুরূপ পরিণতি যে এদেরও হতে পারে সে কথা এরা চিন্তা করে না। অথচ এর ভালাে করেই জানে যে, আল্লাহর বিচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোনােই উপায় নেই। সব শেষে মনে ভয় জাগানাের মতাে একটি উক্তি করা হয়েছে।  *কারাে উত্থান কারাে পতন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার এক চিরন্তন রীতি : ‘যদি আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্যে পাকড়াও করতেন, তাহলে ভূপৃষ্ঠে চলমান কাউকে ছেড়ে দিতেন না’… তবে এটা তারই অপার করুণা ও মেহেরবানী যে, তিনি মানুষকে সুযােগ দিয়ে থাকেন এবং এই ধ্বংসাত্মক ও প্রলয়ংকর শাস্তি মুলতবি করে দেন। ‘তিনিই তােমাদেরকে পৃথিবীতে স্বীয় প্রতিনিধি করেছেন…'(আয়াত ৩৯) পৃথিবীর বুকে এক প্রজন্মের পর আর এক প্রজন্ম আসছে। এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মের উত্তরাধিকারী হচ্ছে। এক রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটছে আর এক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটছে। এক প্রদীপ নিভছে আর এক প্রদীপ জ্বলছে। এই যে বিলুপ্তি ও উৎপত্তির ধারাবাহিকতা, তা যুগ যুগ ধরে চলছে। এই চিরন্তন গতির দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালে মানুষ এতে উপদেশ গ্রহণ করার মতাে এবং শিক্ষণীয় অনেক কিছুই পাবে। তখন অস্তিত্বমান লােকেরা বুঝতে পারবে যে, একদিন তারাও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে, অতীতের গহ্বরে বিলীন হয়ে যাবে। পরবর্তী যুগের লােকেরা তাদের ঘটনাবলীর কথা আলােচনা করবে, তাদের রেখে যাওয়া নিদর্শনগুলাে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে, গবেষণা করবে, ঠিক যেমনটি তারা তাদের পূর্ববর্তী লােকদের বিষয়ে করে থাকে। আর এভাবেই উদাসীন ও অচেতন লােকদের মাঝে চেতনার সৃষ্টি হবে। তখন তারা আল্লাহর কুদরতী হাতটি দেখতে পাবে, যে হাতটিতে রয়েছে মানুষের জীবন মৃত্যু, যে হাতটিতে রয়েছে ক্ষমতার ছড়ি, যে হাতটিতে রয়েছে রাষ্ট্রের উত্থান পতন। যে হাতটি হচ্ছে যাবতীয় ক্ষমতার উৎস এবং যে হাতটিতে রয়েছে প্রজন্মের উত্তরাধিকার। সব কিছুরই উৎপত্তি ঘটবে, লয় ও বিলুপ্তি ঘটবে, কিন্তু যে সত্ত্বার কোনাে লয় নেই, কোনাে ধ্বংস নেই, কোনাে বিলুপ্তি নেই; বরং যে সত্ত্বা চিরন্তন, অমর ও অবিনশ্বর। তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহ। যে সত্ত্বার লয় ঘটে, বিলুপ্তি ঘটে, সে সত্ত্বা কখনও অমর হতে পারে না, চিরন্তন হতে পারে না। যারা একটি নির্দিষ্ট কালের জন্যে জীবনযাত্রায় বের হয়েছে, যাদের রেখে যাওয়া কীর্তি ও নিদর্শন দেখার মত লােকের আগমন ঘটবে, যাদের সর্বশেষ মুহুর্তে নিজেদের ব্যাপারে একটু সতর্ক হওয়া, নিজেদের পেছনে কিছু সুন্দর স্মৃতি রেখে যাওয়া এবং পরকালের মুক্তির জন্যে কিছু করে যাওয়া উচিত। মানুষের সামনে যখন উৎপত্তি ও বিলুপ্তি, উত্থান ও পতন, অস্থায়ী ক্ষমতা, নশ্বর জীবন এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের আগমন- এ সবের দৃশ্য আসে, তখন তার মনে এ জাতীয় চিন্তারই উদ্রেক হয়। তখন সে এই আয়াতের তাৎপর্য বুঝতে পারে, ‘তিনিই তােমাদের পৃথিবীতে স্বীয় প্রতিনিধি…’ সে বুঝতে পারে, প্রতিটি মানুষ এককভাবে নিজের কৃতকর্মের জন্যে দায়ী হবে। কেউ কারও দায়ভার বহন করবে না এবং কেউ কাউকে রক্ষাও করতে পারবে না। কেউ যদি আল্লাহর ডাকে সাড়া না দেয়; বরং উপেক্ষা করে, অস্বীকার করে এবং ভুল পথে পা বাড়ায় তাহলে এর পরিণতি এককভাবে তাকেই ভােগ করতে হবে। সে কথাই আলাচ্য আয়াতের নিচের অংশে বলা হয়েছে, ‘অতএব যে কুফরী করবে, তার কুফরী তার ওপরই বর্তাবে'(আয়াত ৩৯)। আয়াতে বলা হয়েছে যে, কুফরীর পরিণাম হবে আল্লাহর ক্রোধ। যদি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কারও প্রতি ক্রোধান্বিত হন, তাহলে তার ধ্বংসের আর কি বাকী থাকে। কারণ এই ক্ষতি ও ধবংসই হচ্ছে চূড়ান্ত। এর পর আর কোনাে ক্ষতি ও ধ্বংস থাকতে পারে না।
# পরবর্তী আয়াতে ইহলােক ও ঊর্ধ্বলােকে তথাকথিত দেব দেবীদের কোনাে অবদান, কোনাে শরীকানা বা কোনাে প্রভাব প্রতিপত্তি আছে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন তােলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বলাে, তােমরা কি তােমাদের সে শরীকদের কথা ভেবে দেখেছো, যাদের তােমরা আল্লাহর পরিবর্তে ডাকো? তারা পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করে থাকলে আমাকে দেখাও…'(আয়াত ৪০) অত্যন্ত সুস্পষ্ট যুক্তি এবং জাজ্জল্যমান দলীল প্রমাণ এই যে, পৃথিবী এবং এর মধ্যকার প্রতিটি বস্তু মানুষের চোখের সামনে রয়েছে, এই পৃথিবীর কোনাে অংশ বা বস্তু আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কোনাে শক্তি সৃষ্টি করেছে বলে কেউ কি দাবী করতে পারবে? এমন দাবী করার মতাে ধৃষ্টতা কেউ দেখালে সাথে সাথে এই পৃথিবীর প্রতিটি অংশ ও প্রতিটি বস্তু সেই দাবী নাকচ করে দেবে এবং চিৎকার করে বলে ওঠবে, পথিবীর সব কিছুর স্রষ্টা হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। কারণ তার সৃষ্টি নৈপুণ্যের মাঝেই এমন কিছু নমুনা ও বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে, যার দাবীদার আর কেউ হতে পারে না, আর তা সম্ভবও নয়। কেননা, তার সৃষ্টির অনুরূপ সৃষ্টি নৈপুণ্য প্রদর্শন করার মতাে ক্ষমতা এই নশ্বর সৃষ্টি জগতের কারাে নেই। এই তথাকথিত ও কল্পিত দেব-দেবীদের কোনাে মালিকানা উর্ধ্বলােকে আছে কি? না, তা তাে সম্ভবই নয়। পৃথিবীর কোনাে অংশের মালিকানার দাবীই যদি তাদের পক্ষে সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে সে বিশাল উর্ধজগতের মালিকানা দাবী করা তাদের পক্ষে কিভাবে সম্ভব? এই কল্পিত মাবুদদের কেউ কি দাবী করে বলতে পারবে, উর্ধ্বজগতের সৃষ্টির পেছনে তার অবদান আছে অথবা এর মালিকানায় তার কোনাে অংশ আছে। এমনকি যারা জ্বিন অথবা ফেরেশতাদের পূজা করে থাকে তারাও কোনাে দিন এমন দাবী করতে পারে না। তারা বড় জোর এতােটুকু বলে থাকে যে, জিন পরীর সাহায্যে তারা গায়ব বা অদৃশ্য জগতের খবরাখবর লাভ করে। অথবা আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে ফেরেশতারা সুপারিশ করবে। আবার প্রশ্ন করা হচ্ছে, ‘না আমি তাদের কোনো কিতাব দিয়েছি যে, তারা তার দলীলের উপর কায়েম রয়েছে?’ অর্থাৎ সে কল্পিত শরীকদের হাতে এমন কোনাে ঐশী গ্রন্থও নেই যার ওপর ভিত্তি করে তারা এমন দাবী করতে পারে। প্রশ্নটি কল্পিত দেব-দেবীদের লক্ষ্য করেও হতে পারে এবং স্বয়ং এদের পূজারীদের লক্ষ্য করেও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এর অর্থ দাঁড়াবে, দেব-দেবীর পূজারীরা নিজেদের এই পৌত্তলিক আকীদা বিশ্বাস কোথা থেকে পেয়েছে। এই আকীদা বিশ্বাস কি তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কোনাে ঐশীগ্রন্থ থেকে পেয়েছে? না, এমন দাবী ওরা কখনও করতে পারে না। এই প্রশ্ন দ্বারা প্রচ্ছন্নভাবে এখানে একটি বাস্তব সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর তাহলাে, আকীদা বিশ্বাসের উৎস হচ্ছে আল্লাহর বাণী, আর এটাই হচ্ছে একমাত্র নির্ভরযােগ্য উৎস। এ জাতীয় উৎসের দাবীদার মােশরেক সম্প্রদায় কখনও হতে পারে না, অথচ আল্লাহর রসূল(স.)-ই সে দাবী করতে পারেন। কারণ, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন ঐশী বাণী লাভ করেছেন। এরপরও কাফের মােশরেকরা তাকে উপেক্ষা করছে কেন? ‘বরং যালেমরা একে অপরকে কেবল প্রতারণামূলক ওয়াদা দিয়ে থাকে'(৪০-এর শেষাংশ) অর্থাৎ কাফের মােশরেকদের দল সব সময়ই একে অপরকে বলে বেড়ায় যে, তাদের আদর্শই হচ্ছে পরম আদর্শ এবং অবশেষে তাদেরই বিজয় হবে, কিন্তু এসব কথা বলে এরা নিজেরাও প্রতারিত হয় এবং অন্যদেরও প্রতারিত করে। এই ধােকা প্রতারণার মাঝেই তাদের নিষ্ফল জীবন কেটে যায়।
# ইহলােক উর্ধ্বলোক কোথাও আল্লাহর সাথে কারও কোনাে শরীকানা নেই, কোনাে অবদান নেই বা কোনাে শরীকের অস্তিত্ব নেই- এই সত্য প্রমাণ করার পর পরবর্তী আয়াতে আর একটি সত্যের প্রমাণ দেয়া হচ্ছে। যেমন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ আসমান ও যমীনকে স্থির রাখেন…'(আয়াত ৪১) এই যে আসমান এই যে যমীন, এই যে মহাশূন্যের ওপর ভাসমান অগণিত গ্রহ নক্ষত্র যা নিজ নিজ কক্ষপথে অনন্ত অসীম কাল থেকে এবং বিরামহীনভাবে, অলঙ্ঘনীয় একটি নিয়মের অধীনে ঘুরে বেড়ায়, এদের ধারণ করার মতাে খুঁটিও নেই, কোনাে রশিও নেই। এই বিশাল বিস্ময়কর সৃষ্টি জগতের প্রতি মানুষ যদি গভীর দৃষ্টি এবং চিন্তাশীল মন নিয়ে তাকায়, তাহলে সে নিশ্চিতভাবে দেখতে পাবে, উপলব্ধি করতে পারবে, একটি অদৃশ্য, ক্ষমতাধর ও শক্তিধর হাত এর পেছনে কাজ করছে। এই গােটা সুষ্টি জগতকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং একে ধ্বংস থেকে রক্ষা করছে। যদি আসমান ও যমীন নিজ নিজ স্থান থেকে বিচ্যুত হতাে এবং এর নিয়ম শৃংখলার মাঝে বিপর্যয় ঘটতাে, তাহলে এসবকে অন্য কোনাে শক্তি রক্ষা করতে পারতাে না। কারণ, এই বিপর্যয় যখন ঘটবে তখন গােটা সৃষ্টি জগতেরও বিলুপ্তি ঘটবে। সেই মুহূর্তে গ্রহ নক্ষত্র ধ্বংস হবে, সৌরজগত ধ্বংস হবে। এই মহাশূন্যে তখন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ধ্বংসের হাত থেকে একে কেউ রক্ষাও করতে পারবে না। পার্থিব জীবনের চূড়ান্ত হিসাব নিকাশের এটাই হচ্ছে নির্ধারিত সময়। এটাই হচ্ছে সেই চরম মুহূর্ত যখন মানুষ ভিন্ন একটি জগতে পাড়ি জমাবে, সে জগতের সব কিছুই হবে এই পার্থিব জগত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সত্য বাস্তব তথ্যটি তুলে ধরার পর বলা হয়েছে, ‘তিনি সহনশীল, ক্ষমাশীল।’ তিনি সহনশীল, তাই মানুষকে সুযােগ দেন। তাদের পাপাচারের কারণে পৃথিবীটা ধ্বংস করে দিচ্ছেন না। হিসাব নিকাশের নির্ধারিত মুহূর্তটির জন্যে তাদের সুযোগ দিচ্ছেন যেন তারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হতে পারে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে এবং সৎকাজে আত্মনিয়ােগ করতে পারে। তিনি ক্ষমাশীল, তাই তিনি মানুষকে তার প্রতিটি পাপের জন্যে শাস্তি দেন না, পাকড়াও করেন না; বরং তাদের অনেক ভুলক্রটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। যদি তাদের মাঝে কল্যাণের কোনাে লক্ষণ দেখতে পান। আয়াতের এই বক্তব্যের মাঝে একটা প্রচ্ছন্ন সতর্কবাণী রয়েছে। অর্থাৎ যারা গাফেল তারা যেন সতর্ক হয়ে যায় এবং তাওবার ও ক্ষমার এই বিরাট সুযােগটি হাতছাড়া না করে। কারণ, এমন সুযােগ পুনরায় আসবে না। এখন সেই জাতি ও সম্প্রদায়ের কথা আলােচনা করা হচ্ছে যারা আল্লাহর নামে শপথ করে ওয়াদা করে তা ভংগ করে এবং পৃথিবীর বুকে নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। এদের হুঁশিয়ার করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে, আল্লাহর নিয়মের কোনাে ব্যতিক্রম হয় না, তিনি নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেন না। এটাই হচ্ছে তার নিয়ম ও বিধান, এই নিয়মের কোনো হেরফের হয় না।
# বলা হচ্ছে, ‘তারা জোর শপথ করে বলতাে, তাদের কাছে কোনাে সতর্ককারী আগমন করলে…'(আয়াত ৪২-৪৩) তৎকালীন আরব দেশের বাসিন্দারা তাদের প্রতিবেশী ইহুদী জাতির স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে, এদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতাে। ওরা যে নবী রসূলদের হত্যা করতাে এবং সত্যের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে সে সম্পর্কেও আরবের লােকেরা জানতাে। সে কারণে তারা ইহুদী সম্প্রদায়কে এড়িয়ে চলতাে এবং অত্যন্ত জোরালােভাবে কসম খেয়ে বলতাে যে, তাদের কাছে কোনাে সতর্ককারীর আগমন ঘটলে তারা অন্য যে কোনাে জাতির তুলনায় অধিকতর সৎপথের অনুসারী হবে। অন্য যে কোনাে জাতি বলতে তারা ইহুদী জাতিকে বুঝাত। সুস্পষ্টভাবে তাদের নাম উচ্চারণ করার ইচ্ছা তাদের ছিলাে না বলেই এ ধরনের ইংগিতময় বর্ণনাভঙ্গির আশ্রয় নিতাে অঙ্গীকারের । তারা এই অংগীকার এমনভাবে করতাে যেন শ্রোতারা তাদের সাক্ষী হিসেবে থাকতে পারে এবং অন্ধকার যুগে তাদের ধর্মীয় চেতনা কেমন ছিলাে তা বুঝতে পারে, কিন্তু পরবর্তীকালে আল্লাহ তায়ালা যখন তাদের ইচ্ছা পূরণ করে তাদের জন্যে একজন সতর্ককারী প্রেরণ করলেন, ঠিক তখনই তারা তাদের করা ওয়াদা থেকে পিছপা হয়ে পড়ে। সে সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘অতপর যখন তাদের কাছে সতর্ককারী আগমন করলো, তখন তাদের ঘৃণাই কেবল বেড়ে গেলো'(আয়াত ৪২) এটা অত্যন্ত ঘূণ্য আচরণ। যারা এতাে জোরালাে কসম খেতে পারে, তাদের দ্বারা এ জাতীয় আচরণ কিভাবে প্রকাশ পায় সেটাই ভাববার বিষয়। শুধু তাই নয়, এরা উল্টো আরও বাহাদুরী দেখায়, ষড়যন্ত্র করে বেড়ায়। তাদের এই ঘৃণ্য স্বভাব ও আচরণের বিষয়টি উল্লেখ করে কোরআন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলছে, কুচক্র কুচক্রীদেরই ঘিরে ধরে।'(আয়াত ৪৩) অর্থাৎ যারা ষড়যন্ত্র করে বেড়ায়, যারা কুচক্রের আশ্রয় নেয়, তারা নিজেরাই সে জালে আটকা পড়ে। যদি তাই হয়, তাহলে তাদের ভাগ্যেও সেই একই পরিণতি অপেক্ষা করছে, যে পরিণতির শিকার হয়েছে তাদের পূর্ববর্তী আল্লাহদ্রোহী জাতিগুলাে। এ খবর তাে তাদের জানাই আছে। বিদ্রোহী জাতিগুলাের জন্যে এটাই হচ্ছে আল্লাহর চিরন্তন বিধান। এই বিধানের কোনাে ব্যতিক্রম নেই। তাই বলা হয়েছে, ‘অতএব তুমি আল্লাহর বিধানে পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর রীতি নীতিতে কোনাে রকম বিচ্যুতিও পাবে না'(আয়াত ৪৩) মানুষের জীবনে এবং এই পৃথিবীর বুকে যা কিছু ঘটছে তা অনর্থক ঘটছে না, যেমন তেমনভাবে ঘটছে না; বরং এর পেছনে অলংঘনীয় ও অপরিবর্তনীয় এবং স্থিতিশীল একটি প্রাকৃতিক নিয়ম কাজ করে চলেছে। এই বাস্তব সত্যটি আল্লাহ তায়ালা কোরআনের মাধ্যমে মানব জাতির সামনে তুলে ধরছেন এবং তাকে শিক্ষা দিচ্ছেন, যাতে সে ঘটনাপ্রবাহকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে এবং স্থান ও কালের সীমিত গভিতে আবদ্ধ হয়ে জীবন ও জগতের শাশ্বত নিয়ম নীতি সম্পর্কে গাফেল না থাকে। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা জীবনের দায় দায়িত্ব এবং জগতের নিয়ম নীতি জম্পর্কে মানবীয় দৃষ্টিভংগিকে উর্ধ্বে তুলে ধরছেন এবং তাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, এই বিধান অপরিবর্তনীয়, এই নিয়ম নীতি অলঙ্ঘনীয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ কোরআন তাদের সামনে পূর্ববর্তী জাতিগুলাের ঘটনা তুলে ধরছে।
# এরপর আর একটি শিক্ষণীয় বিষয়ের অবতারণা হচ্ছে, তা হলাে এই, ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখতে পেতাে তাদের পূর্ববর্তীদের কি পরিণাম হয়েছে…'(আয়াত ৪৪) মানুষ যদি খােলা চোখ ও সচেতন মন নিয়ে পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়ায়, ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের অবস্থা লক্ষ্য করে এবং তাদের অতীত ও বর্তমানের প্রতি তুলনামূলক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, তা হলে তাদের মনে এর অবশ্যই একটা ছাপ পড়বে, শুভ চেতনার উদ্রেক হবে এবং আল্লাহভীতি জন্ম নেবে। এ কারণেই পৃথিবীতে ভ্রমণ করতে, বিগত জাতিগুলাের পরিণতি প্রত্যক্ষ করতে এবং পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া জাতি গােষ্ঠীর ধ্বংসাবশেষগুলাে দেখার কথা কোরআন পাকে বার বার বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মন মগয থেকে গাফলতির পর্দা সরিয়ে দেয়া। কারণ, মানুষ এসব দেখে না, দেখলেও তা অনুভব করে না। আবার অনুভব করলেও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। ফলে এই গাফলতির কারণেই সে আল্লাহর শাশ্বত ও চিরন্তন বিধানের কথা বেমালুম ভুলে যায় এবং ঘটনাপ্রবাহের তাৎপর্য অনুধাবন করতে ও এগুলােকে শাশ্বত নিয়ম নীতির সাথে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয়। অথচ এটাই হচ্ছে অন্যতম মানবীয় বৈশিষ্ট্য, যার ফলে চিন্তাশীল ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সাথে অন্যান্য জীব জন্তুর পার্থক্য সূচিত হয়। পশুর জীবন হচ্ছে পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন, বন্ধনহীন ও লাগামহীন। অপরদিকে মানুষের গােটা জীবন এবং জাগতিক নিয়ম নীতি ও বিধি বিধান হচ্ছে একটি অভিন্ন একক। অতীতের শক্তিধর ও ক্ষমতাধর জাতি গুলোর করুণ পরিণতির দিকে তাকিয়ে মানুষ যখন দেখতে পায় যে, তাদের এই বিশাল শক্তি ক্ষমতা তাদেরকে এই করুণ পরিণতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি, তখন সে তার চেতনায় আল্লাহর মহাশক্তির অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। সে তখন সুনিশ্চিতভাবে জানতে পারে যে, এই সেই মহাশক্তি যার সামনে টিকে থাকার ক্ষমতা কারও নেই, যাকে জয় করার মতাে শক্তিও কারও নেই। এই সেই শক্তি যা বিগত জাতিগুলােকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, কাজেই এই শক্তি বর্তমান যুগের জাতিগুলােকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। সে কথারই প্রতিধ্বনি করে বলা হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে কোনাে কিছুই আল্লাহকে অক্ষম করে দিতে পারে না। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান'(আয়াত ৪৪) কোনাে কিছুই আল্লাহকে অপারগ অক্ষম করতে পারে না। কারণ, তিনি একাধারে অসীম শক্তি এবং অপার জ্ঞানের অধিকারী। তাঁর জ্ঞানের বাইরে কোনাে কিছুই নেই এবং তার ক্ষমতার বাইরেও কোনাে কিছু নেই। তাঁর হাত থেকে ছুটে যাওয়ার ক্ষমতাও কারও নেই এবং তাঁর দৃষ্টির আড়ালে থাকার ক্ষমতাও কারও নেই। নিসন্দেহে তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।

# ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সূরার শেষ অংশে আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার পাশাপাশি তার সহনশীলতা ও দয়া মায়ার প্রসংগ উল্লেখ করা হয়েছে এবং জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, এই সহনশীলতা ও দয়া-মায়ার কারণে পরকালের সূক্ষ্ম হিসাব নিকাশ ও ন্যায়বিচার আচারে কোনাে প্রভাব পড়বে না। বলা হচ্ছে, ‘যদি আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্যে পাকড়াও করতেন…'(আয়াত ৪৫) মানুষ আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করছে, পৃথিবীর বুকে নৈরাজ্য ও বিশৃংখলার সৃষ্টি করছে, যুলুম অত্যাচার করছে। এ সব নিতান্তই গর্হিত ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ, তাতে কোনােই সন্দেহ নেই। এখন যদি আল্লাহ তায়ালা এসব গহিত, ঘৃণ্য জঘন্য ও গুরুতর অপরাধগুলাের জন্যে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের বাসিন্দাদের পাকড়াও করতেন, তাহলে গােটা পৃথিবীটাই বসবাসের অযােগ্য হয়ে পড়তাে, তা কেবল মানুষের জন্যেই নয়, বরং অন্যান্য সকল প্রাণীর জন্যেও। আয়াতের এই বলিষ্ঠ বর্ণনার মাধ্যমে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরাধগুলাের জঘন্যতা ও ঘৃণ্যতার ভাব ফুটিয়ে তােলা হয়েছে এবং সাথে সাথে এর জীবনবিধ্বংসী প্রভাবের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। কারণ, সে সবের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে পাকড়াও করা হলে জীবনের কোনাে অস্তিত্বই থাকতে পারে না এই পৃথিবীর বুকে, কিন্তু আল্লাহ পাক যেহেতু সহনশীল ও ক্ষমাশীল, তাই তিনি মানুষকে সুযােগ দেন। সে কথাই বলা হচ্ছে, ‘কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন।’ অর্থাৎ তিনি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পার্থিব জীবন পর্যন্ত এখানে থাকার সুযােগ দেন। গােষ্ঠীকে এই সুযােগ দেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাদের উত্তরাধিকার হস্তান্তর করার সময় পর্যন্ত। আর জাতিকে এই সুযােগ দেন এই বিশ্বের নির্ধারিত আয়ু এবং মহাপ্রলয়ের আগমনের মুহূর্ত পর্যন্ত, এই সুযােগ তাদের কেবল সংশােধনের আশায়ই দেয়া হয়, কিন্তু সেই চরম মুহূর্তটি যখন ঘনিয়ে আসবে তখন আর এক মুহূর্তের জন্যেও সুযােগ দেয়া হবে না। এখন কাজের আর কোনাে সুযােগ নেই। এখন আসবে হিসাব নিকাশের পালা। আল্লাহ তায়ালা এই হিসাব নিকাশ নিতে গিয়ে কারাে প্রতি বিন্দুমাত্রও অবিচার করবেন না। কারণ, ‘তখন আল্লাহর সব বান্দা তার দৃষ্টিতে থাকবে।'(আয়াত ৪৫) এই হচ্ছে আলােচ্য সূরার শেষ বক্তব্য। শুরু হয়েছিলাে আসমান ও যমীনের সৃষ্টিকর্তার প্রশংসার মধ্য দিয়ে, যিনি পাখা বিশিষ্ট ফেরেশতাদের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে তাঁর বাণী প্রেরণ করেন। সে বাণীতে জান্নাতের সুসংবাদ অথবা জাহান্নাম সম্পর্কে হুশিয়ারী থাকে। সূরার মাঝের অংশে জগত সম্পর্কিত বিভিন্ন বর্ণনা ও দৃশ্য এসেছে। পরিশেষে জীবনের শেষ পরিণতি এবং মানুষের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আলােকপাত করে বক্তব্য শেষ করা হয়েছে।

Leave a Reply