أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬৮)
[*আল-কুরআন হলো বিজ্ঞানময় কিতাব, এর প্রতিটি আদেশ, নিষেধ ও নির্দেশনা বিজ্ঞানসম্মত।]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৬:ইয়া-সীন
পারা:২২
১-১২ নং আয়াত:-
ইয়া-সীন:১
یٰسٓ ۚ﴿۱﴾
ইয়া-সীন,
ইয়া-সীন:২
وَ الۡقُرۡاٰنِ الۡحَکِیۡمِ ۙ﴿۲﴾
শপথ প্রজ্ঞাময় কুরআনের,
ইয়া-সীন:৩
اِنَّکَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ۙ﴿۳﴾
নিশ্চয় আপনি রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত;
ইয়া-সীন:৪
عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ؕ﴿۴﴾
সরল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত।
ইয়া-সীন:৫
تَنۡزِیۡلَ الۡعَزِیۡزِ الرَّحِیۡمِ ۙ﴿۵﴾
এ কুরআন প্রবল পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু আল্লাহর কাছ থেকে নাযিলকৃত।
ইয়া-সীন:৬
لِتُنۡذِرَ قَوۡمًا مَّاۤ اُنۡذِرَ اٰبَآؤُہُمۡ فَہُمۡ غٰفِلُوۡنَ ﴿۶﴾
যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন এমন এক জাতিকে যাদের পিতৃ পুরুষদেরকে সতর্ক করা হয় নি, সুতরাং তারা গাফিল।
ইয়া-সীন:৭
لَقَدۡ حَقَّ الۡقَوۡلُ عَلٰۤی اَکۡثَرِہِمۡ فَہُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۷﴾
তাদের অধিকাংশই শাস্তি লাভের ফায়সালার হকদার হয়ে গেছে, এজন্যই তারা ঈমান আনে না।
ইয়া-সীন:৮
اِنَّا جَعَلۡنَا فِیۡۤ اَعۡنَاقِہِمۡ اَغۡلٰلًا فَہِیَ اِلَی الۡاَذۡقَانِ فَہُمۡ مُّقۡمَحُوۡنَ ﴿۸﴾
আমি তাদের গলায় বেড়ি পরিয়ে দিয়েছি, যাতে তাদের চিবুক পর্যন্ত জড়িয়ে গেছে, তাই তারা মাথা উঠিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইয়া-সীন:৯
وَ جَعَلۡنَا مِنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡہِمۡ سَدًّا وَّ مِنۡ خَلۡفِہِمۡ سَدًّا فَاَغۡشَیۡنٰہُمۡ فَہُمۡ لَا یُبۡصِرُوۡنَ ﴿۹﴾
আমি তাদের সামনে একটি দেয়াল এবং পেছনে একটি দেয়াল দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। আমি তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি, এখন তারা কিছুই দেখতে পায় না।
ইয়া-সীন:১০
وَ سَوَآءٌ عَلَیۡہِمۡ ءَاَنۡذَرۡتَہُمۡ اَمۡ لَمۡ تُنۡذِرۡہُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۱۰﴾
আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন বা না করুন, তাদের পক্ষে উভয়ই সমান; তারা ঈমান আনবে না।
ইয়া-সীন:১১
اِنَّمَا تُنۡذِرُ مَنِ اتَّبَعَ الذِّکۡرَ وَ خَشِیَ الرَّحۡمٰنَ بِالۡغَیۡبِ ۚ فَبَشِّرۡہُ بِمَغۡفِرَۃٍ وَّ اَجۡرٍ کَرِیۡمٍ ﴿۱۱﴾
তুমি তো তাকেই সতর্ক করতে পারো যে উপদেশ মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে, তাকে মাগফেরাত ও মর্যাদাপূর্ণ প্রতিদানের সুসংবাদ দাও।
ইয়া-সীন:১২
اِنَّا نَحۡنُ نُحۡیِ الۡمَوۡتٰی وَ نَکۡتُبُ مَا قَدَّمُوۡا وَ اٰثَارَہُمۡ ؕؑ وَ کُلَّ شَیۡءٍ اَحۡصَیۡنٰہُ فِیۡۤ اِمَامٍ مُّبِیۡنٍ ﴿٪۱۲﴾
আমি অবশ্যই একদিন মৃতদেরকে জীবিত করবো, যা কিছু কাজ তারা করেছে তা সবই আমি লিখে চলছি এবং যা কিছু চিহ্ন তারা পেছনে রেখে যাচ্ছে তাও আমি স্থায়ী করে রাখছি। প্রত্যেকটি জিনিস আমি একটি খোলা কিতাবে লিখে রাখছি।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :
يس (ইয়া-সীন) এগুলো “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এর আসল উদ্দেশ্য বা অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। এ শব্দটি এ সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখ থাকায় উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
ফযীলত :
সূরা ইয়া-সীনের ফযীলতের ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, এটা কুরআনের অন্তর, মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট তা পাঠ করলে তার মৃত্যু সহজ হয়, কেউ রাত্রে এ সূরা পাঠ করলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়, সূরা ইয়া-সীন একবার পাঠ করলে দশবার কুরআন খতম করার সমান সওয়াব পাওয়া যায় ইত্যাদি। এগুলোর প্রত্যেকটির সনদ বানোয়াট বা দুর্বল। এ সূরার ফযীলত সংক্রান্ত কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না। (ইবনু কাসীর)
১-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রাসূল হিসেবে মেনে নিত না। হুদায়বিয়ার সন্ধি লেখার সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলী (রাঃ)-কে নির্দেশ দিয়ে বললেন লেখ :
هذا ما صالح عليه محمد رسول الله
অর্থাৎ এগুলো হচ্ছে সে-সব কথা যার ওপর ভিত্তি করে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্ধি করলেন। এ কথার প্রেক্ষিতে কুরাইশদের পক্ষ থেকে বলা হল : আমরা যদি আপনাকে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল হিসেবে মেনে নিতাম তাহলে আপনার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হত না। (আর রাহীকুল মাখতুম)
তাদের এ কথার উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ করে বলেন যে, তুমি অবশ্যই একজন প্রেরিত রাসূল এবং সরল সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত।
আল্লাহ বলেন :
وَيَقُوْلُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَسْتَ مُرْسَلًا ط قُلْ كَفٰي بِاللّٰهِ شَهِيْدًاۭ بَيْنِيْ وَبَيْنَكُمْ لا وَمَنْ عِنْدَه۫ عِلْمُ الْكِتٰبِ))
“যারা কুফরী করেছে তারা বলে, ‘তুমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল নও।’ বল : ‘আল্লাহ এবং যাদের নিকট কিতাবের জ্ঞান আছে, তারা আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।’’ (সূরা রা‘দ ১৩ : ৪৩)
আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
(تِلْكَ اٰيٰتُ اللّٰهِ نَتْلُوْهَا عَلَيْكَ بِالْحَقِّ ط وَإِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِيْنَ)
“এগুলো আল্লাহর নিদর্শন যা তোমার নিকট সত্যরূপে পাঠ করছি আর নিশ্চয়ই তুমি রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা বাকারাহ ২ : ২৫২)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ কুরআন অবতীর্ণ করার মূখ্য উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেন : মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ এ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন যাতে সে সকল লোকদেরকে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি ও জাহান্নামের ভয় দেখাতে পারেন যাদের পূর্বপুরুষদেরকে ভীতি-প্রদর্শন করা হয়নি, তারা এ সম্পর্কে গাফেল ছিল। কারণ আল্লাহ কোন জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ না করে শাস্তি দেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ حَتّٰي نَبْعَثَ رَسُوْلًا)
“আমি রাসূল না পাঠান পর্যন্ত কাউকেও শাস্তি দেই না।” (সূরা ইসরা ১৭ : ১৫)
এখানে মূলত উদ্দেশ্য আরবরা, কেননা তাদের নিকট পূর্বে দীর্ঘ সময়ব্যাপী কোন ভীতি প্রদর্শনকারী আসেনি। তবে আরবগণ উদ্দেশ্য হলেও সকল মানব জাতি এতে শামিল। (ইবনু কাসীর)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তাদের অধিকাংশের জন্য الْقَوْلُ (বাণী) অর্থাৎ তাঁর শাস্তির বাণী অবধারিত হয়ে গেছে, সুতরাং তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তা‘আলা ঈমান ও কুফর এবং জাহান্নাম ও জান্নাতের উভয় পথ মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। ঈমানের পথে দাওয়াত দেয়ার জন্য নাবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তারপরেও একশ্রেণির মানুষ ঈমানের পথ বর্জন করে কুফরীর পথ অবলম্বন করবে। তাদের ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির কথা অবধারিত হয়ে গেছে যেহেতু, তারা ঈমান আনবে না। পূর্ববর্তী নাবীদের উম্মাতের অধিকাংশ ব্যক্তিরাই ঈমান বর্জন করে কুফরীর পথ অবলম্বন করেছিল। এ উম্মাতেরও প্রথম দিকে এমন ছিল, কিয়ামত পর্যন্ত এরূপ থাকবে। সুতরাং তাদেরকে যতই সরল পথে আহ্বান করা হোক তারা ঈমান আনবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَوْ شِئْنَا لَاٰتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدٰهَا وَلٰكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّيْ لَأَمْلَئَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ)
“আমি যদি ইচ্ছা করতাম, তবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সরল সঠিক পথ দান করতাম, কিন্তু আমার এ বাণী নির্ধারিত হয়ে রয়েছে যে, আমি অবশ্যই জিন ও মানুষ উভয়কে দিয়েই জাহান্নাম পরিপূর্ণ করব।” (সূরা সাজদাহ ৩২ : ১৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(إِنَّ الَّذِيْنَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَتُ رَبِّكَ لَا يُؤْمِنُوْنَ- وَلَوْ جَا۬ءَتْهُمْ كُلُّ اٰيَةٍ حَتّٰي يَرَوُا الْعَذَابَ الْأَلِيْمَ) “
নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে, তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের নিকট সর্বপ্রকার নিদর্শন আসে, যতক্ষণ না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।” (সূরা ইউনুস ১০ : ৯৬-৯৭)
সুতরাং দীনের দাওয়াত পাওয়ার পরেও একশ্রেণির মানুষ কুফরী করবে, তাই বলে দাওয়াতী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা যাবে না, কারণ হিদায়াতের মালিক আল্লাহ তা‘আলা। কার মাধ্যমে কাকে হিদায়াত দেবেন তা আল্লাহ ভাল জানেন। অতএব দীনের দাওয়াতী কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল এবং সরল-সঠিক পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
২. আল-কুরআন হলো বিজ্ঞানময় কিতাব, এর প্রতিটি আদেশ, নিষেধ ও নির্দেশনা বিজ্ঞানসম্মত।
৩. কুরআন অবতীর্ণ করার আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সরল-সঠিক পথের দিশা দেওয়া, যাতে ইহকালে শান্তি ও আখিরাতে নাজাত লাভ করতে পারে।
৪. দাওয়াত দিলে সবাই ঈমান আনবে এমন নয়, বরং যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির বাণী অবধারিত হয়ে গেছে তারা ঈমান আনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
৮-১২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে অধিকাংশ মানুষের ওপর আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির বাণী অবধারিত হয়ে গেছে ফলে তারা ঈমান আনবে না। তাদেরকে জাহান্নাম ও আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির ভয় দেখানো ও না দেখানো উভয়ই সমান, ঈমানের জন্য তাদের অন্তর নরম হবে না।
অত্র প্রথম দু আয়াতে ঈমান না আনার কয়েকটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের গলদেশ থেকে চিবুক পর্যন্ত বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাদের অবস্থা ঐ ব্যক্তির মতো যার গলদেশে বেড়ী পরিয়ে দেয়া হয়েছে ফলে মুখমন্ডল ও চক্ষুদ্বয় ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে, নীচের দিকে তাকাতেই পারে না। অতএব তারা নিজেরদেরকে কোন গর্তে পতিত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে না। اغلال অর্থ বেড়ী, শিকল যা গলায় পেঁচানো হয়।
আর তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে অহংকার, বিদ্বেষ ও হঠকারীতার প্রাচীর দাঁড় করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা সত্য বিষয় দেখতে পায় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلٰهَه۫ هَوٰهُ وَأَضَلَّهُ اللّٰهُ عَلٰي عِلْمٍ وَّخَتَمَ عَلٰي سَمْعِه۪ وَقَلْبِه۪ وَجَعَلَ عَلٰي بَصَرِه۪ غِشٰوَةً ط فَمَنْ يَّهْدِيْهِ مِنْمبَعْدِ اللّٰهِ ط أَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ)
“তুমি কি লক্ষ্য করেছো তাকে, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের মা’বূদ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কর্ণ ও হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর ওপর রেখেছেন আবরণ। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে হিদায়াত করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” (সূরা জাসিয়াহ ৪৫ : ২৩)
সুতরাং তাদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতা তাদেরকে সত্য থেকে দূরে রেখেছে যার ফলে তারা সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলে পার্থক্য করতে পারে না। মিথ্যার অনুসরণ করতে করতে তাদের অন্তরে, চোখে, কর্ণে মিথ্যার আবরণ পড়ে গেছে যার ফলে তারা সত্য কোন বিষয় চিনতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(خَتَمَ اللّٰهُ عَلٰي قُلُوْبِهِمْ وَعَلٰي سَمْعِهِمْ ط وَعَلٰٓي أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ ز وَّلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ)
“আল্লাহ তাদের অন্তরসমূহের ওপর ও তাদের কানের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তাদের চক্ষুসমূহের ওপর আবরণ পড়ে আছে, আর তাদের জন্য রয়েছে গুরুতর শাস্তি।” (সূরা বাকারাহ ২ : ৭)
অতঃপর যাদেরকে সর্তক করা উচিত এবং যাদেরকে সতর্ক করলে ফলাফল আশাব্যঞ্জক হবে তাদের দিক নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তোমার সতর্কবাণী তাদের জন্যই কাজে আসবে যারা উপদেশবাণী মেনে চলে এবং না দেখে তাদের প্রতিপালক দয়াময় আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে। তারাই সুসংবাদ ও ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত এবং তাদের জন্যই রয়েছে বিরাট পুরস্কার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(إِنَّ الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَّغْفِرَةٌ وَّأَجْرٌ كَبِيْرٌ)
“নিশ্চয়ই যারা না দেখেও তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।” (সূরা মুলক ৬৭ : ১২) এ সম্পর্কে সূরা আল ফা-ত্বির-এর ১৮ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(إِنَّا نَحْنُ نُحْيِ….. مُّبِيْنٍ)
‘নিশ্চয়ই আমি মৃতদেরকে জীবিত করি…’ এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা চারটি বিষয়ের কথা বর্ণনা করেছেন। তা হলো-
১. আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের পূর্বে মৃতকে জীবিত করবেন।
২. দুনিয়ার জীবনে মানুষ যে সকল ভাল-মন্দ কাজ করে তা লিখে রাখেন।
৩. পৃথিবীতে মানুষ মৃত্যুর সময় যে সকল জিনিস রেখে মারা যায় তাও লিখে রাখেন।
৪. আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি জিনিস স্পষ্ট কিতাবে তথা লাওহে মাহফূজে সংরক্ষণ করে রাখেন।
মৃত্যুর পর মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই পুনরায় জীবিত করবেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী-
(زَعَمَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْآ أَنْ لَّنْ يُّبْعَثُوْا ط قُلْ بَلٰي وَ رَبِّيْ لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ ط وَذٰلِكَ عَلَي اللّٰهِ يَسِيْرٌ )
“কাফিররা ধারণা করে যে, তারা কখনো পুনরুত্থিত হবে না। বল : নিশ্চয়ই হবে, আমার প্রতিপালকের শপথ! তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমরা যা করতে তোমাদেরকে সে সম্বন্ধে অবশ্যই অবহিত করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ।” (সূরা তাগাবুন ৬৪ : ৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(وَأَقْسَمُوْا بِاللّٰهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ لا لَا يَبْعَثُ اللّٰهُ مَنْ يَّمُوْتُ ط بَلٰي وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا وَّلٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ)
“তারা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর শপথ করে বলে : ‘যার মৃত্যু হয় আল্লাহ তাকে পুনর্জীবিত করবেন না।’ তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেনই। অবশ্যই, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এটা অবগত নয়।” (সূরা নাহল ১৬ : ৩৮)
এ সম্পর্কে আরো অনেক দলীল-প্রমাণ কুরআনে বিদ্যমান।
مَا قَدَّمُوْا দ্বারা ঐ সকল আমল বা কৃতকর্মকে বুঝানো হয়েছে, যা মানুষ নিজের জীবনে করে থাকে। এবং وَاٰثَارَهُمْ দ্বারা সেসব ভাল ও মন্দ আমলের নমুনাকে বোঝানো হয়েছে যা পৃথিবীতে চলমান অবস্থায় রেখে গিয়েছে এবং তার মৃত্যুর পর মানুষ অনুসরণ করে থাকে। যদি ভাল নমুনা রেখে যায় তাহলে নেকী পাবে, আর খারাপ রেখে গেলে গুনাহর ভাগী হবে।
যেমন হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি ইসলামে কোন ভালো রীতি (বা কর্ম) প্রবর্তন করে, তার জন্য রয়েছে তার সওয়াব এবং তাদের সমপরিমাণ সওয়াব যারা ঐ রীতির অনুকরণে আমল করে। এতে তাদের কারো সওয়াব সামান্য পরিমাণ হ্রাস করা হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতি (বা কর্মের) সূচনা করে, তার জন্য রয়েছে তার পাপ এবং তাদের সমপরিমাণ পাপও যারা ঐ রীতির অনুসরণে আমল করে। এতে তাদের কারো পাপ সামান্য পরিমাণ হ্রাস করা হবে না। (সহীহ মুসলিম হা. ১০১৭)
وَاٰثَارَهُمْ এর আরেকটি অর্থ হলো পদচিহ্ন। অর্থাৎ মানুষ পুণ্য ও পাপকর্মের জন্য যে সফর করে বা এক স্থান থেকে অন্য স্থান চলাচল করে তার পদচিহ্ন লিপিবদ্ধ করা হয়। যেমন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে মসজিদে নববীর নিকটে কিছু খালি জায়গা ছিল। বানু সালামাহ গোত্রের লোকেরা সেখানে ঘর তৈরীর ইচ্ছা করল যাতে সহজেই সালাতের জন্য আসা যাওয়া করা যায়, যেন কষ্ট না হয়। যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কথা অবগত হলেন, তখন তিনি তাদেরকে মসজিদের নিকটে ঘর তৈরী করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন :
(دِيَارَكُمْ تُكْتَبْ آثَارُكُمْ)
অর্থাৎ তোমাদের ঘর যদিও দূরে, তবুও তোমরা সেখানেই থাক। তোমরা যত পা হেটে আসবে তা লিপিবদ্ধ করা হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ১৫৫১)
ইমাম ইবনু কাসীর বলেন : প্রত্যেক অর্থই স্ব-স্ব স্থানে সঠিক। পরস্পরের মাঝে কোন বিরোধ নেই। বরং দ্বিতীয় অর্থে অধিক সতর্কীকরণ রয়েছে যে, যখন মানুষের পদচিহ্ন পর্যন্ত লেখা হয়, তখন মানুষ যে ভাল ও মন্দ কর্মের নমুনা রেখে যায় এবং তার মৃত্যুর পর মানুষ অনুসরণ করে, তা তো অধিকরূপেই লেখা হবে।
অনুরূপ আরো একটি হাদীস “ যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার তিন প্রকার আমল ছাড়া সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়-(ক) এমন জ্ঞান যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। (খ) নেক সন্তান, যে মৃত পিতা-মাতার জন্য দু’আ করে। (গ) অথবা সাদকায়ে জারিয়া (চলমান সাদকাহ) যার দ্বারা মানুষ তার মৃত্যুর পর উপকৃত হয়। (সহীহ মুসলিম হা. ৪৩১০)
সর্বশেষে আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে স্মরণ করে দিচ্ছেন- তোমরা যা কিছু করছ সব কিছু একটি সুস্পষ্ট কিতাব তথা লাওহে মাহফূজে লিখে রাখা হচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(وَوُضِعَ الْكِتٰبُ فَتَرَي الْمُجْرِمِيْنَ مُشْفِقِيْنَ مِمَّا فِيْهِ وَيَقُوْلُوْنَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هٰذَا الْكِتٰبِ لَا يُغَادِرُ صَغِيْرَةً وَّلَا كَبِيْرَةً إِلَّآ أَحْصَاهَا ج وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا ط وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا)
“এবং উপস্থিত করা হবে ‘আমলনামা এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধিদেরকে দেখবে আতঙ্কগ্রস্ত এবং তারা বলবে, ‘হায়, দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! যাতে ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়া হয়নি; বরং সমস্ত হিসাব রেখেছে।’ তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে; তোমার প্রতিপালক কারো প্রতি জুলুম করেন না।” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৪৯)
সুতরাং মানুষ যা কিছু করে এবং যা কিছুর নমুনা দুনিয়াতে রেখে যায় সব কিছু লিখে রাখা হয়। যদি দুনিয়াতে ভাল কোন নমুনা রেখে যায় তাহলে তার নেকীও তার আমলনামায় যোগ হবে, আর বিপরীত হলে তাও আমলনামায় যোগ হবে। তাই আমাদের উচিত সতর্ক হওয়া, আমরা পৃথিবীতে মানুষের জন্য কী আদর্শ রেখে যাচ্ছি? তাদেরকে কী শিক্ষা দিচ্ছি- যা দিচ্ছি তা কি ভাল কাজ, না মন্দ কাজ। কারণ এর ভাল-মন্দ ফলাফল আমাকেও ভোগ করতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মানুষ যেসব কারণে ঈমান আনতে পারে না তার কয়েকটি কারণ জানতে পারলাম।
২. প্রত্যেক মানুষকে তার আমলের প্রতিদান দেয়ার জন্য পুনরুত্থান করা হবে।
৩. যারা না দেখেই আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত প্রতিদান।
৪. মানুষ নিজের কর্মের প্রতিদান তো পাবেই, সেই সাথে দুনিয়াতে যেসব কর্মের নমুনা রেখে যায় তার প্রতিদানও পাবে। নমুনা ভাল হলে ভাল প্রতিদান, আর মন্দ হলে মন্দ পরিণাম।
৫. মানুষ মারা গেলে জীবিতদের পক্ষ থেকে কুরআন তেলাওয়াত করে বখশে দিলে তার নেকী মৃতব্যক্তি পায় না, এমন কোন রীতি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেননি এবং সাহাবীদের মাঝেও ছিল না। বরং হাদীসে উল্লেখিত তিনটি পথ আছে যার মাধ্যমে মৃতব্যক্তি নেকী পায়।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক বস্তুরই একটি দিল বা অন্তর রয়েছে। কুরআন কারীমের দিল হলো সূরায়ে ইয়াসীন।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা গারীব হাদীস এবং এর একজন বর্ণনাকারী অজ্ঞাত)
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি রাত্রে সূরায়ে ইয়াসীন পাঠ করে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং যে সূরায়ে দুখান পাঠ করে তাকেও মাফ করে দেয়া হয়।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু ইয়া’লা (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ খুবই উত্তম)
হযরত মুগাফফাল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “সূরায়ে বাকারাহ হলো কুরআনের কুজ বা চূড়া। এর একটি আয়াতের সাথে আশিজন করে ফেরেশতা অবতরণ করেন এবং এর একটি আয়াত অর্থাৎ আয়াতুল কুরসী আরশের নীচ হতে নেয়া হয়েছে এবং এর সাথে মিলানো হয়েছে। সূরায়ে ইয়াসীন কুরআনের দিল বা হৃদয়। এটাকে যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও আখিরাতের বাসনায় পাঠ করে, আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করে দেন। তোমরা এ সূরাটি তোমাদের ঐ ব্যক্তির সামনে পাঠ করো যে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে।” উলামায়ে কিরামের উক্তি রয়েছে যে, যে কঠিন কাজের সময় সূরায়ে ইয়াসীন পাঠ করা হয় আল্লাহ তা’আলা ঐ কঠিন কাজ সহজ করে দেন। মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে এরূপ ব্যক্তির সামনে এ সূরাটি পাঠ করলে আল্লাহ তা’আলা রহমত ও বরকত নাযিল করেন এবং তার রূহ সহজভাবে বের হয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। মাশায়েখও বলেন যে, এরূপ সময়ে সূরায়ে ইয়াসীন পাঠ করলে আল্লাহ তা’আলা আসানী করে থাকেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের প্রত্যেকেই এই সূরাটি মুখস্থ করুক এটা আমি কামনা করি ।” (এ হাদীসটি বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১-৭ নং আয়াতের তাফসীর:
(আরবী) বা বিচ্ছিন্ন ও কর্তিত শব্দগুলো যা সূরাসমূহের শুরুতে এসে থাকে, যেমন এখানে (আরবী) এসেছে, এগুলোর পূর্ণ বর্ণনা আমরা সূরায়ে বাকারার কুতে দিয়ে এসেছি। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কেউ কেউ বলেছেন যে, (আরবী) -এর অর্থ হলোঃ “হে মানুষ!’ অন্য কেউ বলেন যে, হাবশী অষায় এটা ‘হে মানুষ।’ এ অর্থে এসে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, এটা আল্লাহ্ তা’আলার নাম।
এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ শপথ জ্ঞানগর্ভ কুরআনের, যার আশে পাশেও বাতিল আসতে পারে না। এরপর তিনি বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহর সত্য রাসূল। তুমি সরল সঠিক পথে রয়েছে। আর তুমি আছো পবিত্র দ্বীনের উপর। তুমি যে সরল পথে রয়েছে তা হলো দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর পথ। এই দ্বীন অবতীর্ণ করেছেন তিনি যিনি মহা মর্যাদাবান এবং মুমিনদের উপর বিশেষ দয়াকারী। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! নিশ্চয়ই তুমি সরল সোজা পথের দিকে পথ প্রদর্শন করে থাকো।” যা ঐ আল্লাহর পথ যিনি আসমান ও যমীনের মালিক এবং যার নিকট সমস্ত কাজের ফলাফল। যাতে তুমি সতর্ক করতে পার এমন এক জাতিকে যাদের পিতৃপুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়নি, যার ফলে তারা গাফিল। শুধু তাদেরকে সম্বোধন করার অর্থ এই নয় যে, অন্যেরা এর থেকে পৃথক। যেমন কিছু লোককে সম্বোধন করণে জনসাধারণ তা হতে বাদ পড়ে যায় না। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সারা দুনিয়ার জন্যে পাঠানো হয়েছিল। যেমন এটা (আরবী) (৭:১৫৮)-এই আয়াতের তাফসীরে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদের অধিকাংশের জন্যে সেই বাণী অর্থাৎ তার শাস্তির বাণী অবধারিত হয়ে গেছে, সুতরাং তারা ঈমান আনবে না। তারা তো অবিশ্বাস করতেই থাকবে।
৮-১২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা বলছেনঃ এই হতভাগ্যদের হিদায়াত পর্যন্ত খুবই কঠিন এমনকি অসম্ভব। এরা তো ঐ লোকদের মত যাদের হাত গর্দানের সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে। আর তাদের মাথা উঁচু হতে রয়েছে। গর্দানের বর্ণনা দিতে গিয়ে হাতের বর্ণনা ছেড়ে দিয়েছেন। প্রকৃত কথা এই যে, তাদের গর্দানের সাথে হাত। মিলিয়ে বেঁধে দেয়া হয়েছে। আবার বলা হয়েছে যে, মাথা উঁচু হয়ে থাকবে। এমন হয়েও থাকে যে, বলার সময় একটি কথার উল্লেখ করে দ্বিতীয়টি বুঝে নিতে হয়, প্রথমটির কথা আর উল্লেখ করতে হয় না। আরব কবিদের কবিতাতেও এ ধরনের কথা দেখতে পাওয়া যায়।
(আরবী) শব্দের অর্থই হলো দুই হাত গর্দান পর্যন্ত তুলে নিয়ে গর্দানের সাথে বেঁধে দেয়া। এ জন্যেই গর্দানের উল্লেখ করা হয়েছে, আর হাতের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ভাবার্থ হলোঃ আমি তাদের হাত তাদের গর্দানের সাথে বেঁধে দিয়েছি, সেহেতু তারা কোন ভাল কাজের দিকে হাত বাড়াতে পারে না। তাদের মাথা উঁচু এবং হাত তাদের মুখে, তারা সমস্ত ভাল কাজ করার ব্যাপারে শক্তিহীন।
গর্দানের এই বেড়ির সাথে সাথেই তাদের সম্মুখে প্রাচীর ও পশ্চাতে প্রাচীর স্থাপিত রয়েছে। অর্থাৎ হক থেকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। সত্যের কাছে আসতে পারছে না, অন্ধকারে চাকা আছে, চোখের উপর পর্দা পড়ে আছে, হককে দেখতে পায় না। না সত্যের দিকে যাবার পথ পাচ্ছে, না সত্য হতে কোন উপকার লাভ করতে পারছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবী) অর্থাৎ (আরবী) দিয়ে। লিখিত রয়েছে। এটা এক প্রকারের চক্ষু রোগ। এটা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ঈমান, ইসলাম এবং তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ “যাদের উপর তোমার প্রতিপালকের বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে তারা ঈমান আনবে না, যদিও তুমি তাদের কাছে সমস্ত আয়াত আনয়ন কর যে পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবলোকন করে।” আল্লাহ তা’আলা যেখানে প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, কে এমন আছে যে ঐ প্রাচীর সরাতে পারে?
একবার অভিশপ্ত আবু জেহেল বললোঃ “যদি আমি মুহাম্মাদ (সঃ)-কে দেখতে পাই তবে এই করবো, সেই করবো।” এ সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। লোকেরা তাকে বলতোঃ “এই যে মুহাম্মাদ (সঃ)?” কিন্তু সে তাঁকে দেখতেই পেতো না। সে জিজ্ঞেস করতোঃ “কোথায় আছে? আমি যে দেখতে পাচ্ছি না।”
একবার ঐ মালউন একটি সমাবেশে বলেছিলঃ “দেখো, এ লোকটি বলে যে, যদি তোমরা তার আনুগত্য কর তবে তোমরা বাদশাহ হয়ে যাবে, আর মৃত্যুর পর তোমরা চিরস্থায়ী জীবন লাভ করবে। আর যদি তার বিরুদ্ধাচরণ কর তবে এখানে অসম্মানের মৃত্যুবরণ করবে এবং পরকালে আল্লাহর আযাবে পতিত হবে। আজ তাকে আসতে দাও।” ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেখানে আগমন করলেন। তাঁর হাতে মাটি ছিল। তিনি সূরায়ে ইয়াসীনের (আরবী) পর্যন্ত আয়াতগুলো পাঠ করতে করতে আসছিলেন। আল্লাহ তা’আলা তার জন্যে তাদেরকে অন্ধ করে দিলেন। তিনি তাদের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে চলে গেলেন। ঐ হতভাগ্যের দল তার বাড়ী ঘিরে বসেছিল। এর অনেকক্ষণ পর এক ব্যক্তি বাড়ী হতে বের হলেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমরা এখানে করছো কি?” তারা উত্তরে বললোঃ “আমরা মুহাম্মাদ (সঃ)-এর অপেক্ষায় রয়েছি। আজ তাকে আমরা জীবিত ছাড়ছি না।” লোকটি বললেনঃ তিনি তো এখান দিয়েই গেলেন এবং তোমাদের সবারই মাথায় মাটি নিক্ষেপ করেছেন। মাথা ঝেড়েই দেখো। তারা মাথা ঝেড়ে দেখে যে, সত্যি তাদের মাথায় মাটি রয়েছে।” আবু জেহেলের কথাটির পুনরাবৃত্তি করা হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “সে ঠিকই বলেছে। সত্যিই আমার আনুগত্য তাদের জন্যে দো-জাহানে সম্মান ও মর্যাদার কারণ এবং আমার বিরুদ্ধাচরণ তাদের জন্যে উভয় জগতে অসম্মান ও অবমাননার কারণ। তাদের উপর আল্লাহর মোহর লেগে গেছে। তাই ভাল কথা তাদের উপর ক্রিয়াশীল হয় না। সূরায়ে বাকারার মধ্যেও এই বিষয়ের একটি আয়াত গত হয়েছে। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ যাদের উপর তোমার প্রতিপালকের বাণী বাস্তবায়িত হয়ে গেছে তারা ঈমান আনবে না যে পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবলোকন করে ।”(১০:৯৬-৯৭)
আল্লাহ্ পাক বলেনঃ তুমি শুধু তাদেরকেই সতর্ক করতে পারবে যারা উপদেশ মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে এবং এমন স্থানেও তাকে ভয় করে যেখানে দেখার কেউই নেই। তারা জানে যে, আল্লাহ তাদের অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তিনি তাদের আমলগুলো দেখতে রয়েছেন। সুতরাং হে নবী (সঃ)! তুমি এ ধরনের লোকদেরকে পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়ে দাও। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যারা তাদের প্রতিপালককে না দেখে ভয় করে তাদের জন্যে ক্ষমা ও বড় পুরস্কার রয়েছে।” (৬৭:১২) মহান আল্লাহ বলেনঃ আমিই মৃতকে করি জীবিত। কিয়ামতের দিন আমি নতুনভাবে তাদেরকে সৃষ্টি করতে সক্ষম। এতে ইঙ্গিত রয়েছে এরই দিকে যে মৃত অন্তরকেও জীবিত করতে আল্লাহ পূর্ণ ক্ষমতাবান। তিনি পথভ্রষ্টদেরকে পথ দেখাতে সক্ষম। অন্য স্থানে মৃত অন্তরগুলোর বর্ণনা দেয়ার পর কুরআন হাকীমে ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা জেনে রেখো যে, আল্লাহ যমীনকে ওর মরে যাওয়ার পর। জীবিত করেন, আমি তোমাদের জন্যে আয়াতসমূহ বর্ণনা করেছি যাতে তোমরা অনুধাবন কর।”(৫৭:১৭)।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমি লিখে রাখি যা তারা অগ্রে প্রেরণ, করে ও যা পশ্চাতে রেখে যায়। অর্থাৎ তারা তাদের পরে যা ছেড়ে এসেছে তা যদি ভাল হয় তবে পুরস্কার এবং খারাপ হলে শাস্তি রয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি ইসলামে কোন ভাল নীতি চালু করে, সে তার প্রতিদান পাবে এবং তার পরে যারা ওর উপর আমল করবে তারও প্রতিদান সে পাবে এবং ঐ আমলকারীদের প্রতিদান কিছুই কম করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ নীতি চালু করে সে এজন্যে গুনাহগার হবে এবং তার পরে যারা ওর উপর আমল করবে তারও গুনাহ তার উপর পড়বে এবং ঐ আমলকারীদের গুনাহ কিছুই কম করা হবে না। (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) একটি দীর্ঘ হাদীসে এর সাথেই মুযার গোত্রের চাদর পরিহিত লোকদের ঘটনাও রয়েছে এবং শেষে (আরবী) পড়ারও বর্ণনা রয়েছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন ইবনে আদম মারা যায় তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, শুধু তিনটি আমল বাকী থাকে। একটি হলো ইলম যার দ্বারা উপকার লাভ করা হয়, দ্বিতীয় হলো সৎ ছেলে যে তার জন্যে দু’আ করে এবং তৃতীয় হলো সাদকায়ে জারিয়া, যা তার পরেও বাকী থাকে।” (এ হাদীসটিও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
মুজাহিদ (রঃ) হতে এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, পথভ্রষ্ট লোক, যে তার পথভ্রষ্টতা বাকী ছেড়ে যায়। সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, প্রত্যেক পাপ ও পুণ্য, যা সে জারি করেছে ও নিজের পিছনে ছেড়ে গেছে। বাগাভীও (রঃ) এ উক্তিটিকেই পছন্দ করেছেন।
এই বাক্যের তাফসীরে অন্য উক্তি এই যে, (আরবী) দ্বারা পদচিহ্নকে বুঝানো হয়েছে, যা দেখে মানুষ ভাল অথবা মন্দের দিকে যাবে।
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ হে ইবনে আদম! যদি আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা তোমার কোন কাজ হতে উদাসীন থাকতেন তবে বাতাস তোমার যে পদচিহ্নগুলো মিটিয়ে দেয় সেগুলো হতে তিনি উদাসীন থাকতেন। আসলে তিনি তোমার কোন আমল হতেই গাফিল বা উদাসীন নন। তোমার যতগুলো পদক্ষেপ তাঁর আনুগত্যের কাজে পড়ে তার সবই তাঁর কাছে লিখিত হয়। তোমাদের মধ্যে যার পক্ষে সম্ভব সে যেন আল্লাহর আনুগত্যের দিকে পা বাড়ায়। এই অর্থের বহু হাদীস রয়েছে।
প্রথম হাদীসঃ হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মসজিদে নববীর (সঃ) আশে পাশে কিছু ঘরবাড়ী খালি হয়। তখন বানু সালমা গোত্র তাদের মহল্লা হতে উঠে এসে মসজিদের নিকটবর্তী বাড়ীগুলোতে বসবাস করার ইচ্ছা করে। এ খবর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি তাদেরকে বলেনঃ “আমি একথা জানতে পেরেছি, এটা কি সত্য?” তারা উত্তরে বলেঃ “হ্যা।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে সম্বোধন করে দু’বার বললেনঃ “হে বানু সালমা! তোমরা তোমাদের বাড়ীতেই অবস্থান কর। তোমাদের পদক্ষেপ আল্লাহ তাআলার কাছে লিখিত হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
দ্বিতীয় হাদীসঃ হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বানু সালমা গোত্র মদীনার এক প্রান্তে ছিল। তারা তাদের ঐ স্থান পরিবর্তন করে মসজিদের নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করার ইচ্ছা করলো। তখন (আরবী)-এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। তখন নবী (সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “নিশ্চয়ই তোমাদের পদক্ষেপ লিখিত হয়। তার একথা শুনে বানু সালমা গোত্র আর স্থানান্তরিত হলো না। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন এবং তিনি এটাকে হাসান গারীব বলেছেন) বাযযারের (রঃ) এই রিওয়াইয়াতেই আছে যে, বানু সালমা গোত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে তাদের বাড়ী মসজিদ হতে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ার অভিযোগ করে। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। অতঃপর তারা ঐ দূরবর্তী স্থানেই বাস করতে থাকে। কিন্তু এতে অস্বাভাবিকতা রয়েছে। কেননা এতে এই আয়াতটি এই ব্যাপারে অবতীর্ণ হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। অথচ এই পূর্ণ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
তৃতীয় হাদীসঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আনসারদের বাসভূমি মসজিদ হতে দূরে ছিল। তখন তারা মসজিদের নিকটবর্তী। স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার ইচ্ছা করে। ঐ সময় আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। তখন তারা বলেঃ “আমরা আমাদের বাড়ী ঠিকই রাখলাম। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটি মাওকুফ)
চতুর্থ হাদীসঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, একটি লোক মদীনায় মারা যান। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর জানাযার নামায পড়েন। অতঃপর তিনি বলেনঃ “হায়! সে যদি নিজের জন্মস্থান ছাড়া অন্য কোন স্থানে মারা যেতো তাহলে কতই না ভাল হতো! কেউ জিজ্ঞেস করলেনঃ “কেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “যখন কোন মুসলমান বিদেশে মারা যায় তখন তার দেশ থেকে ঐ বিদেশ পর্যন্ত স্থান মাপ করা হয় এবং সেই হিসেবে জান্নাতে তার স্থান লাভ হয়।” [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ (রঃ)]
হযরত সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি নামায আদায় করার জন্যে হযরত আনাস (রাঃ)-এর সাথে চলতে থাকি। আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে তাড়াতাড়ি চলতে থাকি। তখন তিনি আমার হাত ধরে নেন এবং তার সাথে ধীরে ধীরে হালকা হালকা পা ফেলে আমাকে নিয়ে চলতে থাকেন। আমরা নামায শেষ করলে তিনি বলেনঃ আমি একদা হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ)-এর সাথে মসজিদের দিকে চলছিলাম। আমি দ্রুত পদক্ষেপে চলছিলাম। তখন তিনি আমাকে বলেনঃ “হে আনাস (রাঃ)! তোমার কি এটা জানা নেই যে, এই পদচিহ্নগুলো লিখে নেয়া হচ্ছে?”” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এই উক্তিটি প্রথম উক্তির আরো বেশী পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কেননা, যখন পদচিহ্নকে পর্যন্ত লিখে নেয়া হয় তখন ছড়িয়ে পড়া ভাল মন্দকে কেন লিখে নেয়া হবে না? এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি প্রত্যেক জিনিস স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি। এটা হলো উম্মুল কিতাব। এই তাফসীরই গুরুজন হতে (আরবী) (১৭:৭১)-এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ “যেদিন সমস্ত মানুষকে তাদের ইমামসহ আহ্বান করবো।” যেমন আর এক জায়গায় মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং কিতাব উপস্থিত করা হবে ও নবীদেরকে ও সাক্ষীদেরকে আনয়ন করা হবে।”(৩৯:৬৯) অন্য এক স্থানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং উপস্থিত করা হবে আমলনামা এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে আতংকগ্রস্ত এবং তারা বলবেঃ হায় দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! এটাতো ছোট বড় কিছুই বাদ দেয় না; বরং ওটা সবই হিসাব রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে; তোমার প্রতিপালক কারো প্রতি যুলুম করেন না।”(১৮:৪৯)
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# (৩৬-ইয়াসিন) : নামকরণ:
যে দু’টি হরফ দিয়ে সূরার সূচনা করা হয়েছে তাকেই এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
# (৩৬-ইয়াসিন) : নাযিলের সময়-কাল :
বর্ণনাভঙ্গী দেখে অনুভব করা যায়, এ সূরার নাযিল হবার সময়টি হবে নবী করীমের ﷺ নবুওয়াত লাভ করার পর মক্কায় অবস্থানের মধ্যবর্তী যুগের শেষের দিনগুলো। অথবা এটি হবে তাঁর মক্কায় অবস্থানের একেবারে শেষ দিনগুলোর একটি সূরা।
# (৩৬-ইয়াসিন) : বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয় :
কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের মুহাম্মাদ ﷺ এর নবুওয়াতের ওপর ঈমান না আনা এবং জুলুম ও বিদ্রূপের মাধ্যমে তার মোকাবিলা করার পরিণামের ভয় দেখানোই এ আলোচনার লক্ষ্য। এর মধ্যে ভয় দেখানোর দিকটি প্রবল ও সুস্পষ্ট। কিন্তু বার বার ভয় দেখানোর সাথে যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিষয়বস্তু বুঝাবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
। তিনটি বিষয়ের ওপর যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে:
। তাওহীদের ওপর বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী ও সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে।
। আখেরাতের ওপর বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী, সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তি ও মানুষের নিজের অস্তিত্বের সাহায্যে।
। মুহাম্মাদী নবুওয়াতের সত্যতার ওপর একথার ভিত্তিতে যে, তিনি নিজের রিসালাতের ক্ষেত্রে এ সমস্ত কষ্ট সহ্য করেছিলেন নি:স্বার্থভাবে এবং এ বিষয়ের ভিত্তিতে যে, তিনি লোকদেরকে যেসব কথার প্রতি আহবান জানাচ্ছিলেন সেগুলো পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত ছিল এবং সেগুলো গ্রহণ করার মধ্যেই ছিল লোকদের নিজেদের কল্যাণ।
। এ যুক্তি প্রদর্শনের শক্তির ওপর ভীতি প্রদর্শন এবং তিরস্কার ও সতর্ক করার বিষয়বস্তু অত্যন্ত জোরে শোরে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে হৃদয়ের তালা খুলে যায় এবং যাদের মধ্যে সত্যকে গ্রহণ করার সামান্যতম যোগ্যতাও আছে তারা যেন কুফরীর ওপর বহাল থাকতে না পারে।
। ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও তাবারানী প্রমুখগণ মা’কাল ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী ﷺ বলেন, يس قَلْبُ الْقُرْآنِ অর্থাৎ এ ইয়া-সীন সূরাটি কুরআনের হৃদয়। এটি ঠিক তেমনই একটি উপমা যেমন সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন বলা হয়েছে। ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন গণ্য করার কারণ হচ্ছে এই যে, তার মধ্যে কুরআন মজীদের সমস্ত শিক্ষার সংক্ষিপ্তসার এসে গেছে। অন্যদিকে ইয়াসীনকে কুরআনের স্পন্দিত হৃদয় বলা হয়েছে এজন্য যে, কুরআনের দাওয়াতকে সে অত্যন্ত জোরেশোরে পেশ করে, যার ফলে জড়তা কেটে যায় এবং প্রাণপ্রবাহ গতিশীল হয়।
। এই হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার থেকেই হযরত ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন যে, নবী (ﷺ) বলেন, اقْرَءُوا سُورَةَ يس على موتاكم “তোমাদের মৃতদের ওপর সূরা ইয়াসীন পাঠ করো।” এর পেছনে যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা হচ্ছে এই যে, এর মাধ্যমে মরার সময় মুসলমানের অন্তরে কেবলমাত্র ইসলামী আকীদা বিশ্বাসই তাজা হয়ে যায় না বরং বিশেষভাবে তার সামনে আখেরাতের পূর্ণ চিত্রও এসে যায় এবং সে জানতে পারে দুনিয়ার জীবনের মনযিল অতিক্রম করে এখন সামনের দিকে কোন্ সব মনযিল পার হয়ে তাকে যেতে হবে। এ কল্যাণকারিতাকে পূর্ণতা দান করার জন্য আরবী জানে না এমন ব্যক্তিকে সূরা ইয়াসীন শুনাবার সাথে সাথে তার অনুবাদও শুনিয়ে দেয়া উচিত। এভাবে উপদেশ দান ও স্মরণ করিয়ে দেবার হক পুরোপুরি আদায় হয়ে যায়।
# ইবনে আব্বাস, ইকরামা, দ্বাহ্হাক, হাসান বসরী ও সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার বক্তব্য মতে এর অর্থ হচ্ছে, “হে মানুষ” অথবা “ওহে লোক” এবং কোন কোন মুফাস্সির একে “ইয়া সাইয়েদ” এর সংক্ষিপ্ত উচ্চারণও গণ্য করেন। এ ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে ধরা যায় নবী ﷺ কে উদ্দেশ্য করে এ শব্দগুলো বলা হয়েছে।
# এভাবে বক্তব্য শুরু করার কারণ নাউযুবিল্লাহ এ নয় যে, নবী ﷺ তাঁর নবুওয়াতের ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দিহান ছিলেন এবং তাঁকে নিশ্চয়তা দান করার জন্য আল্লাহর একথা বলার প্রয়োজন হয়েছিল। বরং এর কারণ হচ্ছে এই যে, সে সময় কুরাঈশ বংশীয় কাফেররা অত্যন্ত জোরেশোরে নবী করীমের ﷺ নবুওয়াত অস্বীকার করছিল। তাই আল্লাহ কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই তাঁর ভাষণ শুরুই করেছেন এ বাক্য দিয়ে যে, “তুমি নিশ্চয়ই রসূলদের অন্তর্ভুক্ত।” অর্থাৎ যারা তোমার নবুওয়াত অস্বীকার করছে তারা বিরাট ভুল করছে। তারপর একথার ওপর কুরআনের কসম খাওয়া হয়েছে এবং কুরআনের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে “বিজ্ঞানময়” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমার নবী হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এ কুরআন যা পুরোপুরি জ্ঞানে পরিপূর্ণ। এ জিনিসটি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যে ব্যক্তি এমন জ্ঞানপূর্ণ বাণী উপস্থাপন করছেন তিনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রসূল। কোন মানুষ এমন ধরনের বাণী রচনা করার ক্ষমতা রাখে না। আর মুহাম্মাদ ﷺ কে যারা জানতো তাদের পক্ষে কোনক্রমেই এ বিভ্রান্তির শিকার হওয়া সম্ভব ছিল না যে, এ বাণী তিনি নিজে রচনা করে আনছেন অথবা অন্য কোন মানুষের কাছ থেকে শিখে এসে শুনাচ্ছেন। (এ বিষয়বস্তু বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনুস ২০ , ২১ , ২২ , ৪৪ , ৪৫ ; বনী ইসরাঈল, ১০৪ , ১০৫ , টীকা; সূরা নূরের ভূমিকা; সূরা আশ্ শূআরা ১ ; আন নামল ৯২ ; আল কাসাস ৬২ , ৬৩ , ৬৪ , ১০২-১০৯ ; আল আনকাবুত ৮৮-৯১ টীকা এবং আর রুমের ঐতিহাসিক পটভূমি ( ভূমিকা) ও ১, ২, ৩ টীকা।)
# এখানে কুরআন নাযিলকারীর দু’টি গুণের কথা বলা হয়েছে। এক, তিনি প্রবল ও পরাক্রান্ত। দুই, তিনি করুণাময়। প্রথম গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সত্যটি সম্পর্কে সতর্ক করা যে, এ কুরআন কোন অক্ষম উপদেষ্টার উপদেশ নয় যে, একে উপেক্ষা করলে তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। বরং এটি এমন বিশ্ব-জাহানের মালিকের ফরমান যিনি সবার ওপর প্রবল পরাক্রান্ত, যাঁর ফায়সালাসমূহ প্রয়োগ করার পথে কোন শক্তি বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না এবং যাঁর পাকড়াও থেকে রেহাই পাবার ক্ষমতা করো নেই। আর দ্বিতীয় গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ অনুভূতি সৃষ্টি করা যে, তিনি নিছক দয়াপরবশ হয়ে তোমাদের হিদায়াত ও পথ দেখাবার জন্য নিজের রসূল পাঠিয়েছেন এবং এ মহান কিতাবটি নাযিল করেছেন, যাতে তোমরা গোমরাহী মুক্ত হয়ে এমন সরল সঠিক পথে চলতে পারো যে পথে চলে তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য লাভ করতে পারবে।
# এ আয়াতের দু’টি অনুবাদ হতে পারে। এর একটি অনুবাদ ওপরে করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি এও হতে পারে যে, “একটি জাতির লোকদেরকে তুমি সে জিনিসের ভয় দেখাও যার ভয় তাদের বাপ-দাদাদেরকেও দেখানো হয়েছিল, কারণ তারা গাফলতিতে ডুবে আছে।” প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে বাপ-দাদা বলতে নিকট অতীতে অতিক্রান্ত বাপ-দাদাদের কথা বুঝানো হবে। কারণ দূর অতীতে আরব ভূখণ্ডে বহু নবী-রসূল এসেছিলেন। আর দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করলে এর অর্থ দাঁড়াবে প্রাচীনকালে এ জাতির পূবর্পুরুষদের কাছে নবীদের মাধ্যমে যে পয়গাম এসেছিল এখন তাকে পুনরুজ্জীবিত করো। কারণ এরা তা ভুলে গেছে। এদিক দিয়ে দু’টি অনুবাদের মধ্যে আসলে কোন বৈপরীত্য নেই এবং অর্থের দিক দিয়ে উভয় অনুবাদ সঠিক ও অর্থবহ।
এ জায়গায় সন্দেহ জাগে যে, এ জাতির পূর্ববর্তী লোকেরা এমন একটি যুগ অতিক্রম করেছিল যখন তাদের কাছে কোন নবী আসেনি, এ সময়ে নিজেদের গোমরাহীর জন্য তারা নিজেরা কেমন করে দায়ী হতে পারে? এর জবাব হচ্ছে, আল্লাহ যখনই দুনিয়ায় কোন নবী পাঠান তখনই তাঁর শিক্ষা ও হিদায়াতের প্রভাব দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং বংশ পরম্পরায় এ প্রভাব বিস্তার লাভ করতে থাকে। এ প্রভাব যতদিন টিকে থাকে এবং নবীর অনুসারীদের মধ্যে যতদিন পর্যন্ত এমনসব লোকের আবির্ভাব ঘটতে থাকে যারা হিদায়াতের প্রদীপ উজ্জ্বল করে যেতে থাকেন ততদিন পর্যন্তকার সময়কে হিদায়াতবিহীন গণ্য করা যেতে পারে না। আর যখন এ নবী শিক্ষার প্রভাব একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অথবা তা পুরোপুরি বিকৃত হয়ে যায় তখন সেখানে নতুন নবীর আবির্ভাব অপরিহার্য হয়ে ওঠে। নবী ﷺ এর আগমনের পূর্বে আরবে হযরত ইবরাহীম, ইসমাঈল, শোআইব, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালামের শিক্ষার প্রভাব চতুর্দিকে ছড়িয়েছিল। আর মাঝে মাঝে এ জাতির মধ্যে এমনসব লোকের আবির্ভাব ঘটতো অথবা বাইর থেকে আগমন হতে থাকতো যারা এ প্রভাবগুলোকে তরতাজা করে তুলতেন। যখন এ প্রভাবগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কাছাকাছি পৌঁছে যায় এবং আসল শিক্ষাও বিকৃত হয়ে যায় তখন মহান আল্লাহ নবী ﷺ কে পাঠান এবং এমন ব্যবস্থা অবলম্বন করেন যার ফলে তাঁর হিদায়াতের প্রভাব নিশ্চিহ্ন হতে পারবে না এবং তা বিকৃত হতেও পারবে না। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা সাবা, ৫ টীকা)।
# যারা নবী ﷺ এর দাওয়াতের মোকাবিলায় জিদ ও গোয়ার্তুমির পথ অবলম্বন করেছিল এবং তাঁর কথা কোনভাবেই মানবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখানে তাদের কথা বলা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তারা শাস্তি লাভের ফায়সালার হকদার হয়ে গেছে, তাই তারা ঈমান আনছে না।” এর অর্থ হচ্ছে, যারা উপদেশে কান দেয় না এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের মাধ্যমে প্রমাণ পুরোপুরি উপস্থাপিত হবার পরও সত্য অস্বীকার ও সত্যের সাথে শত্রুতার নীতি অবলম্বন করে চলতেই থাকে তাদের ওপর তাদের নিজেদেরই কৃতকর্মের দুর্ভোগ চাপিয়ে দেয়া হয় এবং তারপর তাদের ঈমান লাভের সৌভাগ্য হয় না। এ বিষয়বস্তুকে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে এ বাক্যের মধ্যে প্রবেশ করে দেয়া হয়েছে যে, “তুমি তো এমন ব্যক্তিকেই সতর্ক করতে পারো যে উপদেশ মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে।”
# এ আয়াতে বেড়ি মানে হচ্ছে তাদের নিজেদের হঠকারিতা। তাদের জন্য সত্য গ্রহণ করার পথে এটি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। “চিবুক পযর্ন্ত জড়িয়ে গেছে” এবং “মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে”-এর অর্থ হচ্ছে, অহংকারবশতঃ ঘাড় তেড়া করে দাঁড়িয়ে থাকা। আল্লাহ বলছেন, তাদের জিদ ও হঠকারিতাকে আমি তাদের ঘাড়ের বেড়িতে পরিণত করে দিয়েছি এবং যে অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় তারা লিপ্ত রয়েছে তার ফলে তাদের ঘাড় এমনভাবে বাঁকা হয়ে গেছে যে, কোন উজ্জ্বলতর সত্য তাদের সামনে এসে গেলেও তারা সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করবে না।
# সামনে একটি দেয়াল ও পেছনে একটি দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেবার অর্থ হচ্ছে এই যে, এ হঠকারিতা ও অহংকারের স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে তারা পূর্বের ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না এবং ভবিষ্যত পরিণামের কথাও চিন্তা করে না। তাদের অন্ধ স্বার্থপ্রীতি তাদেরকে এমনভাবে চারদিক থেকে ঢেকে নিয়েছে এবং তাদের বিভ্রান্তি এমনভাবে তাদের চোখের ওপর আচ্ছাদন টেনে দিয়েছেন যার ফলে প্রত্যেক সুস্থবোধ সম্পন্ন ও অন্ধ স্বার্থপ্রীতিহীন মানুষ যে উন্মুক্ত সত্য দেখতে পায় তা তারা দেখতে পায় না।
# এর অর্থ এ নয় যে, এ অবস্থায় সত্যদ্বীনের কথা প্রচার করা অর্থহীন। বরং এর অর্থ হচ্ছে, তোমার সাধারণ প্রচার সব ধরনের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তাদের মধ্য থেকে কিছু লোকের কথা ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে এবং কিছু লোকের কথা সামনের দিকের আয়াতে আসছে। প্রথম ধরনের লোকদের মুখোমুখি হয়ে যখন দেখবে তারা অস্বীকার, অহংকার, বিদ্বেষ ও বিরোধিতার ওপর স্থির হয়ে আছে তখন তাদের পেছনে লেগে থাকার দরকার নেই। কিন্তু তাদের এ আচরণে হতাশ হয়েও মনোবল হারিয়ে নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ো না। কারণ, তুমি জানো না, মানুষের এ ভীড়ের মধ্যে আল্লাহর এমন বান্দা কোথায় আছে যে উপদেশ গ্রহণ করবে এবং আল্লাহকে ভয় করে সরল-সঠিক পথে চলে আসবে। তোমার সত্য প্রচারের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এ দ্বিতীয় ধরনের লোকদের সন্ধান করা এবং তাদেরকে ছাঁটাই বাছাই করে বের করে আনা। একদিকে হঠকারীদেরকে ত্যাগ করে যেতে হবে এবং অন্যদিকে এ মূল্যবান সম্পদ হস্তগত করতে হবে।
# এ থেকে জানা যায়, মানুষের আমলমানা তিন ধরনের বিষয় সম্বলিত হবে। এক, প্রত্যেক ব্যক্তি যা কিছু ভালো-মন্দ কাজ করে তা আল্লাহর দফতরে লিখে নেয়া হয়। দুই, নিজের চারপাশের বস্তুসমূহের এবং নিজের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর মানুষ যে প্রভাব (Impression) রাখে তা সবই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং এ সমস্ত চিহ্ন এক সময় এমনভাবে সামনে ভেসে উঠবে যে, তার নিজের আওয়াজ শোনা যাবে, তার নিজের চিন্তা, নিয়ত ও ইচ্ছা-সংকল্পসমূহের সমস্ত কথা তার মানসপটে লিখিত আকারে দৃষ্টিগোচর হবে এবং এক একটি ভাল ও মন্দ কাজ এবং তার সমস্ত নড়াচড়া ও আচরণের ছবি সামনে এসে যাবে। তিন, মৃত্যুর পর নিজের ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর এবং নিজের সমাজ ও সমগ্র মানবজাতির ওপর নিজের ভালো ও মন্দ যেসব প্রভাব সে রেখে গেছে তা যতক্ষণ পর্যন্ত এবং যেখানে যেখানে সক্রিয় থাকবে তা সবই তার হিসেবে লেখা হতে থাকবে। নিজের সন্তানদেরকে সে ভালো মন্দ যা কিছু শিক্ষা দিয়েছে, নিজের সমাজ ক্ষেত্রে যা কিছু সুকৃতি বা দুষ্কৃতি ছাড়িয়েছে এবং মানবতার পক্ষে যে ফুল বা কাঁটা গাছ বপন করে গেছে এসবের পূর্ণ রেকর্ড ততক্ষণ পর্যন্ত তৈরী করা হতে থাকবে যতক্ষণ তার বপন করা এসব চারা দুনিয়ায় ভালো-মন্দ ফল উৎপাদন করে যেতে থাকবে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই মক্কী সূরা ঘন ঘন বিরতির সাথে ঝংকারপূর্ণ ছন্দময় ছােট ছােট আয়াতে পরিপূর্ণ। এজন্যে পয়তাল্লিশ আয়াত বিশিষ্ট পরবর্তী সূরা ফাতেরের চেয়ে ছােট হওয়া সত্তেও এ সূরার আয়াত সংখ্যা তিরাশি। ঘন ও ঝংকারপূর্ণ ছন্দময় ছােট ছােট আয়াতের কারণে সূরাটা বৈশিষ্ট্যময় হয়ে আছে। এ কারণে সূরাটা স্নায়ুমন্ডলীর ওপর ক্রমাগত ধাক্কা ও ঝাঁকুনি দিতে থাকে। সূরার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এখানে ক্রমাগত যে দৃশ্যাবলী তুলে ধরা হয়েছে, তা এর আয়াতগুলাের প্রভাব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে পাঠকের মনে সূরার যে ছাপ পড়ে, তা অত্যন্ত গভীর, নিবিড় ও বিচিত্র। সূরার প্রধান আলােচ্য বিষয় অন্যান্য মক্কী সূরার মতােই। আকীদার ভিত্তি গড়া-ই এর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। শুরু থেকেই এতে আলাচিত হয়েছে ওহীর প্রকৃতি ও রেসালাতের সত্যতা, ইয়াসীন, বিজ্ঞানময় কোরআনের কসম, তুমি অবশ্যই রসূলদের অন্যতম। তুমি নির্ভুল পথের ওপরে আছাে। এ কিতাব মহাপরাক্রমশালী দয়াময়ের পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে…। কিছুক্ষণ পরেই আসছে গ্রামবাসীর কাছে রসূলদের আগমনের ঘটনা। এ ঘটনা বলার উদ্দেশ্য হলাে ওহী ও রসূলের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা। ঘটনায় এই পরিণামটা দেখানাে হয়েছে কোরআনের নির্ধারিত রীতি অনুসারে। নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ঘটনাবলীর সাহায্য নেয়ার ক্ষেত্রে কোরআন সব সময় এই রীতি অনুসরণ করে থাকে। সূরার সমাপ্তির কাছাকাছি গিয়ে সে এই বিষয়টার পুনরাবৃত্তি করে- আমি তাকে কবিতা শিখাইনি এবং সেটা তার জন্যে শােভনীয় নয়। এটা তাে কেবল স্মরণিকা এবং সুস্পষ্ট কোরআন, যাতে সে সেই ব্যক্তিকে সতর্ক করে দিতে পারে, যার ভেতরে এখনাে উজ্জীবনী শক্তি রয়েছে, আর যাতে কাফেরদের ওপর আল্লাহর বাণী কার্যকর হয়।’ অনুরূপভাবে এ সূরায় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং একত্ব সম্পর্কেও আলােচনা করা হয়েছে। এতে শিরকের প্রতি ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছে এমন এক মােমেন ব্যক্তির মুখ দিয়ে, যে রসূলদের ব্যাপারে নিজ জাতির সাথে তর্ক করার জন্যে শহরের এক প্রান্ত থেকে এসেছিলাে। সে বলছিলাে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আমি তাঁর এবাদাত করবাে না কী কারণে? অথচ তােমাদের সবাইকে তার কাছে ফিরে যেতে হবে… সূরার শেষভাগে এই বিষয় নিয়ে আবারাে আলােচনা করা হয়েছে। তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কতকগুলাে মাবুদকে গ্রহণ করেছে আর ভেবেছে যে, তাদেরকে সাহায্য করা হবে। অথচ তারা তাদের সাহায্য করতে সক্ষম যে বিষয়টার ওপর এ সূরায় সবচেয়ে বেশী জোর দেয়া হয়েছে, তা হলো আখেরাত ও কেয়ামত। এ বিষয়টা সূরার একাধিক জায়গায় আলােচিত হয়েছে। যেমন সূরার প্রথম ভাগে রয়েছে, আমিই তাে মৃতদের জীবন দেই, এবং তারা যা কিছু সকাজ করে তা ও তার ফলাফল আমি লিখে রাখি। গ্রামবাসীর ঘটনায় মােমেন ব্যক্তিটার ওপর যে শােচনীয় বিপর্যয় নেমে এসেছিলাে, আয়াতে তার তাৎক্ষণিক প্রতিফল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে তার বেহেশতে প্রবেশকে, ‘তাকে বলা হলো, বেহেশতে প্রবেশ করাে। সে বললো, হায়, আমার জাতি যদি জানতাে যে, আমাকে আমার প্রভু ক্ষমা করেছেন এবং সম্মানিত করেছেন’- সূরার মাঝখানে আবার আলােচিত হযেছে। যেমন তারা বলে, ‘এই প্রতিশ্রুতি কবে পূরণ হবে, যদি তুমি সত্যবাদী হও? তারা একটা চিৎকার ছাড়া আর কিছুরই প্রতীক্ষা করছে না। এরপর কেয়ামতের একটা পূর্ণাংগ দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। সূরার শেষভাগে এ বিষয়টা একটা সংলাপ আকারে বিবৃত হয়েছে, সে আমার কাছে একটা নমুনা তুলে ধরেছে আর নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে গেছে। ‘সে বলেছে, হাড়গুলাে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার পর কে ওগুলাে জীবিত করবে। বলে দাও, যিনি ওগুলাে প্রথমে সৃষ্টি করেছিলেন, তিনিই এখন জীবিত করবেন। তিনি তাে প্রত্যেকবারের সৃষ্টি সম্পর্কে অভিজ্ঞ।’ আকীদাকে তার ভিত্তিমূল থেকে গড়ে তােলার সাথে সংশ্লিষ্ট এসব যুক্তিতর্ক মক্কী সূরায় বার বার উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। তবে তা প্রত্যেকবার একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়। প্রতিবার তার পটভূমিও হয় স্বতন্ত্র, তার বর্ণনাভংগিও হয় ভিন্ন রকমের এবং তার প্রভাবও পড়ে ভিন্ন ধরনের। আলােচ্য সূরার এই সাড়া জাগানাে বক্তব্যগুলাে বিশেষভাবে কেয়ামতের দৃশ্যগুলাে থেকে সংগৃহীত। তা ছাড়া এতে বর্ণিত কাহিনীটার বিভিন্ন দৃশ্য, তার সংলাপ ও বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা, যুগে যুগে যারা আল্লাহদ্রোহিতায় লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়েছে তদের ধ্বংসযজ্ঞ, রকমারি তাৎপর্যবহ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, যেমন উর্বর মাটিতে উর্বরতা ও জীবনীশক্তি সঞ্চারের দৃশ্য, দিনের আলাে নিভে যাওয়ার পর রাতের অন্ধকার নেমে আসার দৃশ্য, সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণের দৃশ্য, চাঁদের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে পুরনাে খেজুরের ডালের মত আকৃতি গ্রহণের দৃশ্য, অতীতের মানুষদের বংশধরকে বহনকারী জাহাজের দৃশ্য, মানুষের অনুগত পশুদের দৃশ্য সবই আলােচনায় এসেছে। সামান্য এক ফোটা বীর্য থেকে প্রবল প্রতাপান্বিত বাকপটু মানুষের জন্ম লাভের দৃশ্য এবং সবুজ গাছ থেকে আগুন জ্বলার দৃশ্য থেকে এগুলাে সংগৃহীত। এ সব দৃশ্যের পাশাপাশি আরাে কিছু সাড়া জাগানাে চিত্র রয়েছে, যা মানুষের চেতনাকে স্পর্শ করে ও জাগ্রত করে। তার মধ্যে সেসব কাফেরের চিত্র অন্যতম, যারা ইসলামের দাওয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং যাদের ওপর আল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হওয়ায় আর কোন নিদর্শন ও সতর্কবাণী দ্বারা তাদের কোনাে লাভ হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তাদের ঘাড়ের ওপর শিকল লাগিয়েছি, যা থুতনি পর্যন্ত চলে গেছে। ফলে তারা উর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে। আর আমি তাদের সামনে প্রাচীর ও তাদের পেছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি এবং তাদের আচ্ছাদিত করে দিয়েছি। ফলে তারা দেখতে পায় না। এর মধ্যে তাদের গােপন ও প্রকাশ্য সত্ত্বার চিত্রও রয়েছে, যা আল্লাহর জ্ঞানের সামনে সমভাবেই উন্মােচিত এবং যাকে কোনাে আবরণ দিয়ে ঢাকা যায় না। এর মধ্যে তাদের সৃষ্ট পদ্ধতির বিবরণও রয়েছে, যা একটা মাত্র শব্দের মধ্যেই সীমিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তিনি যখন কিছু চান তখন তার একমাত্র আদেশ হয়ে থাকে এই যে, তিনি বলেন, “হও’, আর তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। এ সবই মানব হৃদয় স্পর্শকারী প্রভাবশালী উপকরণ। প্রকৃতির অংগনেও এগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব মানুষ স্বচক্ষে দেখতে পায়। সূরার মূল ভাষ্যে এর বিষয়গুলােকে তিন ভাগে বিভক্ত করে পেশ করা হয়েছে। প্রথম ভাগটা শুরু হয়েছে দুটো অক্ষর সহযােগে অর্থাৎ ইয়াসীন এই নামে শপথ করার মধ্য দিয়ে। সেই সাথে শপথ করা হয়েছে যে, মােহাম্মদ(স.) অবশ্যই রসূল এবং তিনি অবশ্যই সঠিক পথের ওপর বহাল আছেন। সঠিক পথের ওপর বহাল থেকে তিনি দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী উদাসীন লােকদের সেই ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিচ্ছেন। সেই ভয়াবহ পরিণতি হলাে আল্লাহর এই ফয়সালা যে, তারা আর কখনাে হেদায়াতের পথ পাবে না এবং চিরদিনই তাদের হেদায়াতের পথে অন্তরায় থেকে যাবে, আর এ কথাও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ওহীর সতর্কবাণী শুধুমাত্র তাদের জন্যেই লাভজনক হয়ে থাকে যারা ওহীর স্মরণিকা অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখেও ভয় করে। ফলে তাদের হৃদয় হেদায়াতের যুক্তি প্রমাণগুলাে ও ঈমানের আহবান গ্রহণ করার যােগ্য হয়ে ওঠে। এরপর রসূল(স.)-কে গ্রামবাসীর ঘটনা বর্ণনা করতে আদেশ দেয়া হচ্ছে, যাতে আল্লাহর নবীর দাওয়াত অস্বীকার করার পরিণাম কী হয়ে থাকে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এর পাশাপাশি মােমেনের হৃদয়ে ঈমানের প্রকৃতি কিরূপ এবং ঈমানের সুফল কী হয়ে থাকে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্যে দ্বিতীয় অংশটা শুরু হচ্ছে সেই বান্দাদের প্রতি আক্ষেপ প্রকাশের মধ্য দিয়ে, যারা অনবরতই রসূলদের প্রত্যাখ্যান করতে অভ্যস্ত, যারা প্রত্যাখ্যানকারীদের ধ্বংসের ইতিহাস থেকে কোনাে শিক্ষাও গ্রহণ করে না এবং সৃষ্টি জগতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর বিপুলসংখ্যক নিদর্শন দেখেও যাদের বিবেক জাগ্রত হয় না। সূরার ভূমিকায় বর্ণিত সেসব প্রাকৃতিক নিদর্শন এবং কেয়ামতের বিস্তারিত বিবরণও এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। তৃতীয় অংশে সূরার সব কটা আলােচ্য বিষয়ের সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হয়েছে। শুরুতেই বলা হয়েছে যে, মােহাম্মদ(স.) যে কোরআন নিয়ে এসেছেন তা কোনাে কবিতা তাে নয়ই, এমনকি কবিতার সাথে তার কোনাে সম্পর্কও নেই। এরপর আল্লাহর একত্বের কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। অতপর পৌত্তলিকতাকে ধিক্কার দিয়ে বলা হচ্ছে যে, যে সমস্ত মূর্তি তারা স্বয়ং সংরক্ষণ করে, তাদের তারা কিভাবে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদের কাছে সাহায্য চায়? এ অংশে কেয়ামত ও আখেরাতের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে। মানব জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, প্রথম বার তাদের জন্ম হয়েছে বীর্য থেকে। এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে এ জন্যে যেন তারা বুঝতে পারে, মাটিতে মিশে যাওয়া হাড়গোড় পুনরায় জীবিত করা প্রথম বারের জনের মতােই। এতে অবাক হবার কিছুই নেই। এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এক ধরনের সবুজ গাছে আগুন থাকে। অথচ বাইর থেকে তা একেবারেই অসম্ভব মনে হয় সেই সাথে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে যে, তাদের মতাে আরাে বহু মানুষকে সৃষ্টি করার ক্ষমতাও তার রয়েছে- তা ইহকালেই হােক বা পরকালেই হােক। এরপর শেষ কথাটা বলা হয়েছে এই যে, তিনি যখন কোন কিছু ইচ্ছা করেন, তখন শুধু বলেন ‘হও’, অমনি তা হয়ে যায় । অতএব সেই সত্তার মাহাত্ম্য ঘােষণা কর, যার হাতে যাবতীয় জিনিসের সর্বময় ক্ষমতা ও মালিকানা নিহিত এবং তার কাছেই তােমরা সবাই ফিরে যাবে।’ এবার আমরা এই সংক্ষিপ্ত আলােচনার পর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হচ্ছি।
# ‘ইয়াসীন, বিজ্ঞ কোরআনের শপথ, তুমি অবশ্যই রসূল…'(আয়াত ১-১২) মহান আল্লাহ ‘ইয়া ও সীন’ এই দুটো অক্ষরের এবং কোরআনের শপথ করেছেন। একই সাথে বিচ্ছিন্ন কয়েকটা অক্ষর ও কোরআনের কসম খাওয়া থেকে আমার সেই মতটাই সত্য প্রমাণিত হয়, যা আমি ইতিপূর্বে বিভিন্ন সূরার শুরুতে বিদ্যমান বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহের ব্যাখ্যা ও এগুলাের সাথে কোরআনের উল্লেখের তাৎপর্য বিশ্লেষণ প্রসংগে বলেছি। কোরআন যে আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে, তার একটা নিদর্শন এই যে, এই কোরআন এই আরবী বর্ণমালা দিয়েই লিখিত। এই বর্ণমালা ব্যবহার করা আরবদের কাছে অতি সহজ কাজ। অথচ কোরআনের ভাষাগত ও ভাবগত গাঁথুনি এতাে উচ্চাংগের যে, তা এই বর্ণমালা দিয়ে তৈরী করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কোরআনের কসম খেতে গিয়ে কোরআন নিজেকে হাকীম অর্থাৎ বিজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করেছে। হেকমত বা বিজ্ঞতা কোন বুদ্ধিমান প্রাণীরই গুণ বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে। তাই কোরআনকে এই বিজ্ঞ’ বিশ্লেষণে বিশেষিত করার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তাকে যেন প্রকারান্তরে একটা ইচ্ছাশক্তি বিশিষ্ট প্রাণীর মর্যাদা দেয়া হলাে। বস্তু এটা তাকে ‘বিজ্ঞ’ আখ্যায়িত করার স্বতস্ফূর্ত দাবী। এটা যদিও রূপক ও কল্পিত, কিন্তু এ দ্বারা একটা বাস্তবতাকে চিত্রিত করা হয়েছে ও সত্যের কাছাকাছি আনা হয়েছে। বস্তুত কোরআনের আত্মা বা রূহ আছে, কোরআন একটা জীবন্ত ও প্রাণবন্ত গ্রন্থ। একটা প্রাণীকে যদি কোনাে মানুষ অন্তর দিয়ে ভালােবাসে এবং হৃদয় উজাড় করে তার প্রতি মমত্ব প্রকাশ করে, তবে সেও যেমন তার প্রতি মমতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে, কোরআনও ঠিক তেমনি। কোনাে মানুষ যদি কোরআনের জন্যে নিজের হৃদয়কে উন্মুক্ত ও একনিষ্ঠ করে দেয়, তাহলে সে তার এমন বহু গােপন রহস্যের সন্ধান পাবে, যা অন্যেরা পায় না। অনুরূপভাবে কোনাে ব্যক্তি যেমন তার কোনাে বন্ধুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কিছু সময় অবস্থান করলে সে তার বহু গুণ বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ ও তার ভক্ত হয়ে যেতে পারে, তেমনি কোনাে মানুষ কোরআনের ঘনিষ্ঠ হলে সেও কোরআনের বহু মনােমুগ্ধকর গুণ বৈশিষ্ট্যের সন্ধান লাভ এবং তার ভক্ত প্রেমিক হয়ে যেতে পারে। রসূল(স.) অন্যদের কোরআন পাঠ শুনতে খুবই ভালোবাসতেন। এ জন্যে তিনি কোনাে বাড়ীর ভেতর থেকে কোরআন পড়ার শব্দ শুনতে পেলেই তার দরজার ওপর দাড়িয়ে তন্ময় হয়ে শুনতেন, যেমন কোনাে প্রেমিক তার প্রেমিকার কথা শুনতে দাঁড়ায় ও মনােযােগ দিয়ে শােনে। কোরআন প্রত্যেককে তার সাধ্য অনুপাতে সম্বোধন করে, তার হৃদয়ের তীব্র সংবেদনশীল তন্ত্রীতে আঘাত করে এবং পরিমিত ও পরিকল্পিতভাবে তাকে আহ্বান করে। যে কৌশলে ডাকলে তার মনােযােগ আকর্ষণ করা যাবে ও তাকে শােধরানাে যাবে, সেই কৌশল অনুসারেই ডাকে। কোরআন বিজ্ঞানসম্মতভাবে ও বিচক্ষণতার সাথে মানুষকে লালন পালন করে এবং একটা নিখুত নির্ভুল বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে তাকে শিক্ষা দেয়। সে পদ্ধতিটা এমন নিপুণ ও অব্যর্থ যে, তা মানুষের সকল সুপ্ত শক্তির বন্ধন খুলে দেয় ও সক্রিয় করে দেয় এবং সেগুলােকে নির্ভুল ও সঠিক গন্তব্যের দিকে চালিত করে। কোরআন মানব জীবনের জন্যে এমন একটা বিধানও দেয়, যা সেই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির আওতায় যাবতীয় মানবীয় তৎপরতার অনুমতি দেয়। *রেসালাতের মহান ঘোষণা : মহান আল্লাহ ইয়া ও সীন এবং বিজ্ঞানময় কোরআনের কসম খেয়ে রসূল(স.)-এর রেসালাতের সত্যতা ঘােষণা করছেন, নিশ্চয় তুমি একজন রসূল।’ মহান আল্লাহর কসম খাওয়ার প্রয়ােজন হয় না; কিন্তু তার পক্ষ থেকে কোরআনের ও কোরআনের অক্ষরের কসম খাওয়া দ্বারা কোরআনের এবং তার বর্ণমালার মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। কেননা মহান আল্লাহ খুব মর্যাদাশালী জিনিস ছাড়া আর কোনাে কিছুর কসম খান। তিনি এমন সব জিনিসেরই কসম খান যা কসম খাওয়ার যোগ্য। ‘নিশ্চয় তুমি রসূলদের অন্তর্ভুক্ত।’ এই বাচনভংগি থেকে মনে হয়, রসূলদের পাঠানাে একটা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী। তবে এ বিষয়টা প্রমাণ করা এখানে আসল উদ্দেশ্য নয়, আসল উদ্দেশ্য হলাে মােহাম্মদ(স.)-কে এসব রসূলের অন্যতম বলে প্রমাণ করা। এখনে এই কসম দ্বারা স্বয়ং রসূলকে সম্বোধন করা হয়েছে অস্বীকারকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী মােশরেকদের নয়, যাতে এই শপথ, রাসূল ও রেসালাত সব রকমের বিতর্কের উর্ধে থাকে। এটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষভাবে রসূল(স.)-কে অবহিতকরণের শামিল। নিশ্চয় তুমি রসূলদের অন্তর্ভুক্ত। তুমি সঠিক পথের ওপর আছ। রসূলের সত্যতা প্রমাণ করার পর রেসালাতের স্বভাব প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য কি, তা বর্ণনা করা হয়েছে। রেসালাতের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য হলাে, তা নির্ভুল, নিখুঁত ও সহজ সরল। তা একান্ত সােজা পথ। তাতে কোনাে বক্রতা নেই। এতে সত্য স্বচ্ছ, স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহান ও অকাট্য। কোনাে অস্পষ্টতা ও অসচ্ছতা নেই। প্রবৃত্তির খেয়ালখুশী বা স্বার্থের টান তাকে বিপথগামী করতে পারে না। যে চায় সে সহজেই সঠিকভাবে তা পেতে পারে। রিসালাত নির্ভুল ও নিখুঁত হওয়ার কারণে তা সহজ সরলও বটে, এতে কোনাে জটিলতা, দুর্বোধ্যতা ও অস্পষ্টতা নেই। সত্যকে তা অত্যন্ত খােলাসা করে ও প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করে। এতে কোনাে সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ থাকে না এবং কোনাে ব্যাখ্যারও প্রয়াজন হয় না। জ্ঞানী ও মুর্খ, নগরবাসী ও গ্রামবাসী, প্রাসাদবাসী ও কুঁড়েঘরবাসী নির্বিশেষে সকলেই এর আহ্বানে সাড়া দিতে পারে। তারা তাদের যাবতীয় প্রয়োজনও এ থেকে পূরণ করতে পারে এবং নিজের জীবন, জীবন যাপন পদ্ধতি এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ভুল, সঠিক ও শান্তিময় করতে পারে। রিসালাত বিশ্ব নিখিলে প্রচলিত প্রাকৃতিক নিয়মের সাথেও সংগতিপূর্ণ। মানুষের চারপাশের যাবতীয় বস্তু এবং প্রাণীর সাথেও তা সংগতিপূর্ণ। ফলে প্রকৃতির বস্তুনিচয় পরস্পরে যেমন সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না, তেমনি মানুষকেও তার সাথে সংঘাতে লিপ্ত হতে বাধ্য করে না। সমগ্র প্রাকৃতিক জগতে যতাে বস্তু ও প্রাণী রয়েছে, সে সবের ওপর এবং সমগ্র বিশ্ব জগতের ওপর কর্তৃত্বশীল সমস্ত নিয়মবিধির সাথেও তা সংগতিপূর্ণ, একে অপরের সহযােগী ও পরিপূরক। একমাত্র রেসালাতই মানুষদের আল্লাহকে পাওয়ার সঠিক, নির্ভুল ও অব্যর্থ পথ দেখায়। রেসালাতের অনুসারী কখনাে তার স্রষ্টাকে হারানাের ও বিপথগামী হবার আশংকা বােধ করে না। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির সন্ধান পায়। *কোরআন মানুষকে সহজ সরল পথের সন্ধান দেয় : কোরআন এই সঠিক, নির্ভুল ও সহজ সরল পথের সন্ধানদাতা ও গাইড ।কোরআনকে সাথে নিয়ে মানুষ যেখানেই যাবে, দেখবে কোরআন তাকে সত্যের গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সত্যের পথ দেখাচ্ছে, সত্যের বিধি বিধান ও মূল্যবােধ যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করছে। ‘পরম দয়ালু মহা প্রতাপশালীর পক্ষ থেকে এর অবতরণ। এখানে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নিজের পরিচয় দিচ্ছেন, যাতে তারা তার নাযিলকৃত কিতাবেরও সঠিক পরিচয় পায়। তিনি মহাশক্তিশালী ও মহাপ্রতাপশালী, যা ইচ্ছা করেন তা অবাধে করেন, তিনি বান্দাদের প্রতি আচরণে দয়ালু। আর এই কিতাব নাযিল করার উদ্দেশ্য হলাে সতর্ক করা ও প্রচার করা। ‘যাতে তুমি সতর্ক করতে পার সেই জাতিকে, যাদের পূর্বপুরুষদের সতর্ক করা হয়নি, ফলে তারা উদাসীন রয়ে গেছে।’ গাফলত বা উদাসীনতা মনমগয বিনষ্ট করার সবচেয়ে শক্তিশালী ও সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র । উদাসীন মন নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় থাকে। নিস্ক্রিয় থাকে শিক্ষা গ্রহণ, প্রভাব বিস্তার এবং সাড়াদানেও। হেদায়াতের অকাট্য প্রমাণাদি মনের গােচরীভূত হওয়া সত্তেও মন তা অনুভব ও উপলব্ধি করে না, স্পন্দিত ও সচকিত হয় না। এ জন্যে আরব জাতি যে উদাসীনতা। ও অজ্ঞতায় নিমজ্জিত ছিলাে, তা দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় ছিলাে তাদের সতর্কীকরণ। কেননা হযরত ইসমাঈল(আ.)-এর বংশধর এই আরবদের কাছে ইসমাঈলের পর বহু প্রজন্ম অতিবাহিত হওয়া সত্তেও আর কোন রাসূল তথা আর কোনাে সতর্ককারী আসেনি। উদাসীন লােকদের সতর্ক করলে অনেক সময় তাদের উদাসীনতা ও নিস্ক্রিয়তা দূর হয়ে যায়। এরপর এই উদাসীন লোকদের পরিণতি এবং তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা নিজ জ্ঞানের ভিত্তিতে যে ফয়সালা করেছেন তা জানিয়ে দিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশের ওপর মহান আল্লাহর ফয়সালা কার্যকর হয়ে গেছে, ফলে তারা আর ঈমান আনবে না। অর্থাৎ তাদের ব্যাপারে ফয়সালা হয়ে গেছে এবং তাদের অধিকাংশের ব্যাপারে আল্লাহর পরিকল্পনা কার্যকর হয়ে গেছে। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রকৃত অবস্থা এবং তাদের আবেগ অনুভূতির প্রকৃত ধরন কি তা জানেন। এ জন্যে তাদের অধিকাংশের সর্বশেষ অবস্থা হবে এই যে, তারা ঈমান আনবে না। কেননা তাদের মনমগযে হেদায়াতের আলাে পৌছতে পারেনি এবং তাদের হৃদয় হেদায়াতের সাক্ষ্য প্রমাণ দেখতে পায়নি। পরবর্তী আয়াতে এই মানসিক অবস্থার একটা অনুভবযােগ্য চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানাে হয়েছে যেন কাফেররা এমনভাবে শিকলে বাঁধা যে, তারা কিছুই দেখতে পায় না, ঈমান আনা ও হেদায়াত পাওয়ার পথ প্রাচীর দিয়ে আটকানাে রয়েছে এবং তাদের চোখ পর্দা দিয়ে ঢাকা রয়েছে, ফলে তারা দেখতে পাবে না। ‘আমি তাদের ঘাড়ে শিকল পরিয়েছি, সে শিকল থুতনি পর্যন্ত পৌছে গেছে…’ (আয়াত ৮-৯) অর্থাৎ তাদের হাতগুলাে শিকল দিয়ে ঘাড় পর্যন্ত বাঁধা এবং থুতনির নীচে রক্ষিত। এ জন্যে তাদের মাথা জোরপূর্বক উচু করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা সামনে কিছুই দেখতে পায় না। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে তাদের দেখার ও বিবেচনার স্বাধীনতা নেই। তাদের সামনে ও পেছনে এমন প্রাচীর রয়েছে যা সত্য ও হেদায়াতকে তাদের চোখ থেকে আড়াল করে রেখেছে। ফলে তাদের শিকলের বাঁধন শিথিল করে দিলেও প্রাচীরের কারণে তাদের দৃষ্টি সামনে পৌছে না। তা ছাড়া পর্দা দিয়ে চোখ ঢেকে রাখায় দেখার পথও রুদ্ধ। যদিও এই কল্পিত দৃশ্যটা অত্যন্ত ভয়ংকর, কিন্তু মানুষ এই শ্রেণীর কিছু লােকের সাথে মিলিত হয়ে থাকে। তার মনে হয় যেন সুস্পষ্ট সত্যকে দেখতে পায় না এবং সত্যের ও তার মাঝে এ ধরনের কোনাে প্রতিবন্ধক আছে বলেও সে বুঝতে পারে না। হাতের ওপর এই শিকল যদি পরানাে নাও হয় এবং মাথা যদি জোর করে উচু করে রাখা নাও হয়, তবুও তাদের মন ও অন্তর চক্ষুকেও জোরপূর্বক হেদায়াতের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং হেদায়াতের সাক্ষ্য প্রমাণ প্রাচীর দিয়ে আড়াল করে রেখে দেখতে দেয়া হয় না। অনুরূপভাবে যারা কোরআনকে প্রত্যাখ্যান করে, তাদের অবস্থাও অনুরূপ। কেননা কুরআন সত্যের সাক্ষ্য প্রমাণ সােচ্চার কণ্ঠে ঘােষণা করে চলেছে; বরং প্রকৃতপক্ষে কোরআন নিজেই এতাে শক্তিশালী প্রমাণ যে, কোন মানুষ তা অস্বীকার করতে পারে না। ‘তাদের তুমি সতর্ক করাে আর নাই করে একই কথা। তারা ঈমান আনবে না।’ আল্লাহ তায়ালা যেহেতু তাদের অন্তরের অবস্থা জানেন এবং তার ভেতরে যে ঈমান ঢুকতে পারে না, সেটা তার কাছে সুস্পষ্ট, তাই তিনি নিজ জ্ঞানের ভিত্তিতে ফয়সালা করেছেন যে, তারা কখনােই ঈমান আনবে না। কেননা যে হৃদয় ঈমান আনার জন্যে প্রস্তুত নয় এবং প্রাচীর পর্দা ও শিকল দিয়ে তাকে ঈমান থেকে দূরে রাখা হয়েছে, নিছক সতর্কীকরণে সে হৃদয়ের কোনাে লাভ হবে না। সতর্কীকরণ দাওয়াত গ্রহণের যােগ্যতাসম্পন্ন জীবন্ত হৃদয়কে সজাগ সচেতন করতে পারে, নতুন করে হৃদয় সৃষ্টি করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তুমি তাে কেবল সেই ব্যক্তিকে সতর্ক করতে পারবে, যে ওহীর বিধানের অনুসরণ করে…'(আয়াত ১১) ওহীর বিধান বা যিকির দ্বারা এখানে কোরআনকে বুঝানাে হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোরআনের অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখেও ভয় করে, কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই সতর্কীকরণ দ্বারা উপকৃত হয়। যেন একমাত্র তাকেই সতর্ক করা হয়েছে আর কাউকে নয়। যেন রসূল(স.) সতর্কীকরণকে শুধু তার জন্যেই বরাদ্দ করেছেন। অথচ মূলত তা ছিলাে সবার জন্যে। তবে তাদের হেদায়াতের পথে অনেক বাধা এসে দাঁড়ায়। তাই শুধুমাত্র কোরআনের অনুসারী ও না দেখে আল্লাহকে ভয় করে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে হেদায়াত সীমিত হয়ে যায়। সতর্কীকরণ দ্বারা উপকৃত হওয়ার পর এই ব্যক্তি সুসংবাদ লাভের যােগ্য হয়ে যায়। ‘অতএব তাকে সুসংবাদ দাও ক্ষমার ও পরম সম্মানজনক প্রতিদানের।’ অর্থাৎ যেসব গুনাহ তার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু তার ওপর সে লেগে থাকেনি; বরং দ্রুত তাওবা করতে সচেষ্ট হয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান দেয়া হবে। না দেখে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা এবং কোরআনকে অনুসরণ করার জন্যে। হৃদয়ে একই সাথে এ দুটো জিনিস অবস্থান করে। যার হৃদয়ে আল্লাহর ভয় আছে, সে আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুসরণ না করে পারে না। সেই সাথে সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহর বিধান অনুসরণে অবিচল থাকাও অবশ্যম্ভাবী। প্রসংগক্রমে আখেরাত ও হিসাব নিকাশের উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে, ‘নিশ্চয়ই আমি মৃতদেরকে জীবিত করি…'(আয়াত ১২) মৃতদের পুনরুজ্জীবন দীর্ঘকাল যাবত বিতর্কের বিষয় ছিলাে। এ সূরায় এ ব্যাপারে একাধিক উদাহরণ পেশ করা হবে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সতর্ক করছেন যে, তারা যে কাজই করুক, সব গুনে গুনে লিখে রাখা হচ্ছে। এর কোনােটাই হিসাব থেকে বাদ পড়বে না বা ভুলে যাওয়া হবে । মহান আল্লাহ স্বয়ং জীবন ও মৃত্যু দেন। তিনিই সমস্ত কৃতকর্ম ও তার ফলাফল লিখে রাখেন এবং গুনে গুনে রাখেন। কাজেই মহান আল্লাহর পক্ষে সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবেই তা করা হবে। আর ইমামুম মুবীন, ‘লওহে মাহফুজ’ বা অনুরূপ অন্যান্য শব্দের সহজতম ব্যাখ্যা হলাে, মহান আল্লাহর আদি ও নির্ভুল জ্ঞান। এই জ্ঞান প্রতিটি জিনিসকে ধারণ করে রাখে।