(টপিক#১০৬৯) [*আমাদের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৬:ইয়া-সীন পারা:২৩ ১৩-৩২ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৬৯)
[*আমাদের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৬:ইয়া-সীন
পারা:২৩
১৩-৩২ নং আয়াত:-
ইয়া-সীন:১৩
وَ اضۡرِبۡ لَہُمۡ مَّثَلًا اَصۡحٰبَ الۡقَرۡیَۃِ ۘ اِذۡ جَآءَہَا الۡمُرۡسَلُوۡنَ ﴿ۚ۱۳﴾
আর তাদের কাছে বর্ণনা করুন এক জনপদের অধিবাসীর দৃষ্টান্ত; যখন তাদের কাছে এসেছিল রাসূলগণ।
ইয়া-সীন:১৪
اِذۡ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلَیۡہِمُ اثۡنَیۡنِ فَکَذَّبُوۡہُمَا فَعَزَّزۡنَا بِثَالِثٍ فَقَالُوۡۤا اِنَّاۤ اِلَیۡکُمۡ مُّرۡسَلُوۡنَ ﴿۱۴﴾
যখন আমরা তাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম দুজন রাসূল, তখন তারা তাদের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল, তারপর আমরা তাদেরকে শক্তিশালী করেছিলাম তৃতীয় একজন দ্বারা। অতঃপর তারা বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি।’
ইয়া-সীন:১৫
قَالُوۡا مَاۤ اَنۡتُمۡ اِلَّا بَشَرٌ مِّثۡلُنَا ۙ وَ مَاۤ اَنۡزَلَ الرَّحۡمٰنُ مِنۡ شَیۡءٍ ۙ اِنۡ اَنۡتُمۡ اِلَّا تَکۡذِبُوۡنَ ﴿۱۵﴾
ওরা বলল, ‘তোমরা তো আমাদেরই মত মানুষ, আর পরম দয়াময় তো কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা কেবল মিথ্যাই বলছ।’
ইয়া-সীন:১৬
قَالُوۡا رَبُّنَا یَعۡلَمُ اِنَّاۤ اِلَیۡکُمۡ لَمُرۡسَلُوۡنَ ﴿۱۶﴾
তারা বললেন, ‘আমাদের রব জানেন— নিশ্চয় আমরা তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি।
ইয়া-সীন:১৭
وَ مَا عَلَیۡنَاۤ اِلَّا الۡبَلٰغُ الۡمُبِیۡنُ ﴿۱۷﴾
স্পষ্টভাবে প্রচার করাই আমাদের দায়িত্ব।’
ইয়া-সীন:১৮
قَالُوۡۤا اِنَّا تَطَیَّرۡنَا بِکُمۡ ۚ لَئِنۡ لَّمۡ تَنۡتَہُوۡا لَنَرۡجُمَنَّکُمۡ وَ لَیَمَسَّنَّکُمۡ مِّنَّا عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۱۸﴾
জনপদবাসীরা বলতে লাগলো, “আমরা তো তোমাদেরকে নিজেদের জন্য অমঙ্গলজনক মনে করি। যদি তোমরা বিরত না হও তাহলে আমরা তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে নিহত করবো এবং আমাদের হাতে তোমরা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।
ইয়া-সীন:১৯
قَالُوۡا طَآئِرُکُمۡ مَّعَکُمۡ ؕ اَئِنۡ ذُکِّرۡتُمۡ ؕ بَلۡ اَنۡتُمۡ قَوۡمٌ مُّسۡرِفُوۡنَ ﴿۱۹﴾
রসূলরা জবাব দিল, তোমাদের অমঙ্গল তোমাদের নিজেদের সাথেই লেগে আছে। তোমাদের উপদেশ দেয়া হয়েছে বলেই কি তোমরা একথা বলছো? আসল কথা হচ্ছে, তোমরা সীমালংঘনকারী লোক।
ইয়া-সীন:২০
وَ جَآءَ مِنۡ اَقۡصَا الۡمَدِیۡنَۃِ رَجُلٌ یَّسۡعٰی قَالَ یٰقَوۡمِ اتَّبِعُوا الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿ۙ۲۰﴾
ইতিমধ্যে নগরীর দূর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি দৌঁড়ে এসে বললো, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! রসূলদের কথা মেনে নাও।
ইয়া-সীন:২১
اتَّبِعُوۡا مَنۡ لَّا یَسۡـَٔلُکُمۡ اَجۡرًا وَّ ہُمۡ مُّہۡتَدُوۡنَ ﴿۲۱﴾
অনুসরণ কর তাদের যারা তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎপথপ্রাপ্ত।
ইয়া-সীন:২২
وَ مَا لِیَ لَاۤ اَعۡبُدُ الَّذِیۡ فَطَرَنِیۡ وَ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۲۲﴾
কেন আমি এমন সত্ত্বার বন্দেগী করবো না যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যাঁর দিকে তোমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে?
ইয়া-সীন:২৩
ءَاَتَّخِذُ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اٰلِہَۃً اِنۡ یُّرِدۡنِ الرَّحۡمٰنُ بِضُرٍّ لَّا تُغۡنِ عَنِّیۡ شَفَاعَتُہُمۡ شَیۡئًا وَّ لَا یُنۡقِذُوۡنِ ﴿ۚ۲۳﴾
তাঁকে বাদ দিয়ে কি আমি অন্য উপাস্য বানিয়ে নেবো? অথচ যদি দয়াময় আল্লাহ‌ আমার কোন ক্ষতি করতে চান তাহলে তাদের সুপারিশ আমার কোন কাজে লাগবে না এবং তারা আমাকে ছাড়িয়ে নিতেও পারবে না।
ইয়া-সীন:২৪
اِنِّیۡۤ اِذًا لَّفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۲۴﴾
‘এরূপ করলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়ব।
ইয়া-সীন:২৫
اِنِّیۡۤ اٰمَنۡتُ بِرَبِّکُمۡ فَاسۡمَعُوۡنِ ﴿ؕ۲۵﴾
‘নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের উপর ঈমান এনেছি, অতএব তোমরা আমার কথা শোন।’
ইয়া-সীন:২৬
قِیۡلَ ادۡخُلِ الۡجَنَّۃَ ؕ قَالَ یٰلَیۡتَ قَوۡمِیۡ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿ۙ۲۶﴾
(শেষ পর্যন্ত তারা তাঁকে হত্যা করে ফেললো এবং) সে ব্যক্তিকে বলে দেয়া হলো, “প্রবেশ করো জান্নাতে।” সে বললো, “হায়! যদি আমার সম্প্রদায় জানতো।
ইয়া-সীন:২৭
بِمَا غَفَرَ لِیۡ رَبِّیۡ وَ جَعَلَنِیۡ مِنَ الۡمُکۡرَمِیۡنَ ﴿۲۷﴾
‘কিরূপে আমার রব আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন।’
ইয়া-সীন:২৮
وَ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلٰی قَوۡمِہٖ مِنۡۢ بَعۡدِہٖ مِنۡ جُنۡدٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَ مَا کُنَّا مُنۡزِلِیۡنَ ﴿۲۸﴾

এরপর তার সম্প্রদায়ের ওপর আমি আকাশ থেকে কোন সেনাদল পাঠাইনি, সেনাদল পাঠাবার কোন দরকারও আমার ছিল না।
ইয়া-সীন:২৯
اِنۡ کَانَتۡ اِلَّا صَیۡحَۃً وَّاحِدَۃً فَاِذَا ہُمۡ خٰمِدُوۡنَ ﴿۲۹﴾
সেটা ছিল শুধুমাত্র এক বিকট শব্দ। ফলে তারা নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
ইয়া-সীন:৩০
یٰحَسۡرَۃً عَلَی الۡعِبَادِ ۚؑ مَا یَاۡتِیۡہِمۡ مِّنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿۳۰﴾
বান্দাদের অবস্থার প্রতি আফসোস, যে রসূলই তাদের কাছে এসেছে তাঁকেই তারা বিদ্রূপ করতে থেকেছে।
ইয়া-সীন:৩১
اَلَمۡ یَرَوۡا کَمۡ اَہۡلَکۡنَا قَبۡلَہُمۡ مِّنَ الۡقُرُوۡنِ اَنَّہُمۡ اِلَیۡہِمۡ لَا یَرۡجِعُوۡنَ ﴿ؕ۳۱﴾
ওরা কি লক্ষ্য করে না, ওদের পূর্বে কত মানবগোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করেছি, যারা ওদের মধ্যে ফিরে আসবে না।
ইয়া-সীন:৩২
وَ اِنۡ کُلٌّ لَّمَّا جَمِیۡعٌ لَّدَیۡنَا مُحۡضَرُوۡنَ ﴿٪۳۲﴾
তাদের সবাইকে একদিন আমার সামনে হাজির করা হবে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৩-২১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে একটি জনবসতির ঘটনা বর্ণনার নির্দেশ দিচ্ছেন, যে জনবসতির নিকট দু’জন রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে বসতির লোকেরা দু’জন রাসূলকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। তৎক্ষণাৎ তাদের দু’জনের শক্তি বৃদ্ধি কল্পে তৃতীয় আরেকজনকে নাবী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল এবং নাবীগণ বললেন যে, আমরা তোমাদের নিকট দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছি, আমরা মিথ্যাবাদী না। নাবীগণের এ কথার উত্তরে জনবসতির অধিবাসীগণ বলল : তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ, সুতরাং দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা কোন মানুষকে রাসূল করে পাঠাতে পারেন না। বরং তোমরা এ ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলছ। যেমন তাদের উক্তি :

(ذٰلِكَ بِأَنَّه۫ كَانَتْ تَّأْتِيْهِمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنٰتِ فَقَالُوْآ أَبَشَرٌ يَّهْدُوْنَنَا ز فَكَفَرُوْا وَتَوَلَّوْا وَّاسْتَغْنَي اللّٰهُ ط وَاللّٰهُ غَنِيٌّ حَمِيْدٌ)

“তা এ জন্য যে, তাদের নিকট তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ আসতেন। তখন তারা বলত : মানুষই কি আমাদেরকে পথের সন্ধান দিবে? অতঃপর তারা কুফরী করল ও মুখ ফিরিয়ে নিলো; কিন্তু এতে আল্লাহর কিছু যায় আসে না। আর আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত।” (সূরা তাগাবুন ৬৪ : ৬)

জনবসতির কথার প্রত্যুত্তরে নাবীগণ তাদেরকে বললেন যে, আমাদের দায়িত্ব শুধু তোমাদের নিকট স্পষ্টভাবে আল্লাহ তা‘আলার বাণী পৌঁছে দেয়া আর এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিপালক অবগত আছেন যে, আমরা তোমাদের নিকট তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। তিনিই আমাদের ব্যাপারে সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(قُلْ كَفٰي بِاللّٰهِ بَيْنِيْ وَبَيْنَكُمْ شَهِيْدًا)

“বল : ‎‘আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।” (সূরা আনকাবুত ২৯ : ৫২) উপরোক্ত আলোচনা থেকে কয়েকটি বিষয় জানা যায় :

১. পূর্ববর্তী উম্মাতের কাছে যারা রাসূল হিসেবে এসেছেন তারা সবাই মানুষ ছিলেন এবং যাদের কাছে এসেছিলেন তারাও জানত যে, এরা আমাদের মত মানুষ। অতএব কেন আমরা এরূপ মানুষের কথা মানব। যেমন সূরা ইসরার ৯৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেয় কিন্তু তারা নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মাটির মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। এ আয়াত থেকে তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।

২. তারা যখন দু’জন রাসূলকে সাধারণভাবে অস্বীকার করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তৃতীয় আরেকজনকে প্রেরণ করলেন এবং তারা বললেন : নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের কাছে প্রেরিত রাসূল। তারপরেও যখন অস্বীকার করল, তখন রাসূলগণ বললেন : আল্লাহ তা‘আলা জানেন, অবশ্যই আমরা তোমাদের কাছে নিশ্চিত প্রেরিত রাসূল। অর্থাৎ তাদের অস্বীকার যত বাড়ল রাসূলদের কথার গুরুত্বও তত বাড়ল।

উক্ত গ্রাম কোথায় ও তিনজন প্রেরিত রাসূল কারা ছিলেন তা নিয়ে কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে কোন কোন মুফাসসিরদের ধারণা, সে গ্রামটি ছিল আন্তাকিয়া। যেমন ইবনু আব্বাস, কা‘ব ও ওহাব বিন মুনাব্বাহ (রাঃ) বলেছেন। মু’জামুল বুলদানের বর্ণনানুযায়ী ‘আন্তাকিয়া’ শাম দেশের একটি প্রাচীন নগরী। যা তার সমৃদ্ধি ও স্থাপত্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এ নগরীর দুর্গ ও নগর প্রাচীন দর্শনীয় বস্তু ছিল। এতে খ্রিস্টানদের বড় বড় স্বর্ণ-রৌপ্যের কারুকার্য খচিত সুশোভিত গির্জা অবস্থিত রয়েছে। এটি একটি উপকূলীয় নগরী। ইসলামী আমলে শামবিজয়ী সাহাবী আবূ ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রাঃ) এ শহরটি জয় করেছিলেন। নাবী তিনজন ছিলেন- সাদেক, সাদুক ও শামুল। (ইবনু কাসীর)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এ এলাকাবাসীর ঘটনা বর্ণনা করার নির্দেশ দেয়ার কারণ হলো যাতে মক্কাবাসীসহ পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে মুহাম্মাদ কোন নতুন নাবী নন, পূর্বে অনেক নাবী এসেছেন এবং এটাও যেন জানতে পারে, রাসূল গায়েব জানেন না বরং ওয়াহী মারফত পূর্ববর্তীদের এসব ঘটনা জেনেছেন। রাসূলগণ যে দাওয়াত নিয়ে এসেছেন তা বর্জন করলে ধ্বংস অনিবার্য এ কথাও যাতে জেনে নিতে পারে।

(إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ) تطير

অর্থ কুলক্ষণ গ্রহণ করা। অর্থাৎ তারা রাসূলগণকে বলল, তোমাদের আগমনে আমরা অকল্যাণকর ও আমাদের জন্য অশুভ মনে করছি। যদি তোমরা চলে না যাও তাহলে পাথর মেরে হত্যা করব এবং আমাদের থেকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।

(قَالُوْا طَآئِرُكُمْ مَّعَكُمْ)

অর্থাৎ তাদের কথার উত্তরে রাসূলগণ বললেন : তোমাদের অকল্যাণ তোমাদের সাথেই, কেননা তোমরা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। যেমন সালেহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় বলেছিল :

(قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَنْ مَّعَكَ ط قَالَ طَآئِرُكُمْ عِنْدَ اللّٰهِ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ تُفْتَنُوْنَ)‏

“তারা বলল : ‎ ‘তোমাকে ও তোমার সঙ্গে যারা আছে তাদেরকে আমরা অমঙ্গলের কারণ মনে করি।’ সে বলল : ‎ ‘তোমাদের অকল্যাণ আল্লাহর ইখতিয়ারে, বস্তুত তোমরা এমন এক সম্প্রদায় যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে।’’ (সূরা নামল ২৭ : ৪৭) এমনকি তারা সত্যের দা‘ওয়াত গ্রহণ করা থেকে বিরতই থাকল এবং রাসূলগণকে হত্যা করার পরিকল্পনা করল।

ঐ জনবসতির একজন মু’মিন ব্যক্তি ছিল যে শহরের শেষ প্রান্তে বসবাস করত। সে তাদের নিকট ছুটে আসলো ও বলল : হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা প্রেরিত ব্যক্তি (রাসূলগণ)-দের অনুসরণ করো। অনুসরণ করো তাদের যারা তোমাদের নিকট কোনই পারিশ্রমিক চায় না। তাঁদের স্বার্থের জন্য নয়, বরং তোমাদের কল্যাণার্থেই তাঁরা তোমাদেরকে সৎ পথের দিকে আহ্বান করছেন। সুতরাং তাঁদের আহ্বানে তোমাদের সাড়া দেয়া উচিত এবং তাঁদের আনুগত্য করা কর্তব্য। এতদসত্ত্বেও তারা ঈমান আনল না, রাসূলগণকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং তাঁদেরকে অকল্যাণের কারণ মনে করল। এ লোকটির নাম কী ছিল তা নিয়ে অনেক মতামত পাওয়া যায়। তবে অনেকে বলেছেন : তার নাম ইয়াসিন হাবীব।

বিঃদ্রঃ কুরআন যে সকল ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানের নাম বা অন্য কিছু অস্পষ্ট করে ছেড়ে দিয়েছে এবং সহীহ হাদীসে তার কোন বর্ণনা নেই তা জানা কোন জরুরী বিষয় নয়। বরং এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ধর্মকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার শামিল।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. রাসূলগণের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে তাদের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। কাউকে মানার জন্য বাধ্য করা নয়। বর্তমানে ‘আলিম সমাজের দায়িত্বও তা-ই। তারা মানুষকে হক্বের পথে দা‘ওয়াত দিবে।
২. দা‘ওয়াতী কাজ করে বিনিময় গ্রহণ না করাটাই উত্তম। যেমন নাবী-রাসূলগণ বিনিময় গ্রহণ করেননি। তবে যদি এর জন্য এমন সময় ব্যয় হয় যে কারণে পরিবারের ব্যয়-ভার উপার্জন করতে সময় পাওয়া যায় না তাহলে উপযুক্ত পরিমাণ বিনিময় নেওয়া যেতে পারে।
৩. রাসূলগণ মানুষ, তাদেরকে রিসালাত দেয়া হয়েছে মানুষকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান করার জন্য।
৪. যা জানলে কোন উপকারে আসবে না তা থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
২২-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

ঐ ব্যক্তি যে শহরে একাই মু’মিন ছিল এবং শহরের শেষ প্রান্তে বসবাস করত সে নিজ সম্প্রদায়ের নিকট তাঁর নিজের আমল ও আক্বীদার কথা বর্ণনা করে শুনাচ্ছেন। আমি তো শুধু এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করি। যেহেতু তিনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন তাহলে কেন আমি তাঁর ইবাদত করব না? এটাও নয় যে, আমরা তাঁর ক্ষমতার বাইরে চলে গেছি, তাই তাঁর সাথে আমাদের কোনই সম্পর্ক নেই? বরং আমরা তাঁর ক্ষমতাধীন, আমাদের সবাইকেই তাঁর সামনে একত্রিত হতে হবে। আমি কি আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে অন্য মা‘বূদ গ্রহণ করব; যদি দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা আমার কোন ক্ষতি করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোন উপকারে আসবে না এবং তারা আমাকে মুক্তও করতে পারবে না। সুতরাং কেন তাদের ইবাদত করব?

আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

(قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَّا تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللّٰهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّه۪ٓ أَوْ أَرَادَنِيْ بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِه۪ ط قُلْ حَسْبِيَ اللّٰهُ ط عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُوْنَ)‏

“বল : তোমরা কি ভেবে দেখছ যে, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কি সেই অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহকে বন্ধ করতে পারবে? বল : আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তারই ওপর নির্ভর করে।” (সূরা যুমার ৩৯ : ৩৮)

অতএব আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে ঐ বাতিল মা‘বূদদেরকে যদি আমি আহ্বান করি যারা কোনই উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না তাহলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়ব। তাই আমি তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান নিয়ে আসলাম। তোমরা আমার কথা শুন অর্থাৎ রাসূলদের রিসালাতের অনুসরণ করো। এ কথা বলার পর পরই তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল। (তাফসীর সা‘দী)

(قِيْلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَ)

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদার লোকটির মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করে বলছেন : মৃত্যুর পর লোকটিকে বলা হলো যে, তুমি জান্নাতে প্রবেশ করো। তখন লোকটি তার সম্প্রদায়ের জন্য আফসোস করে বলল : যদি আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমার এ মর্যাদার কথা জানতে পারত যে, আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন! তাহলে তারাও ঈমান আনত।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা দিচ্ছেন, পরবর্তীতে তাদের নিকট আর কোনই সতর্ককারী পাঠানো হয়নি এবং তার কোন প্রয়োজনও ছিল না। তারা মু’মিন ব্যক্তিকে হত্যা করার ফলে তাদের ওপর এসেছিল এক মহানাদ, যা তাদেরকে ধ্বংস ও নিথর নিস্তব্ধ করে দিয়েছিল।

সুতরাং যেসব জনবসতির নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দাওয়াত পৌঁছবে কিন্তু তারা তা মেনে নিবে না তাহলে তাদের ওপর এরূপ ধ্বংসাত্মক শাস্তি আপতিত হবে, তা থেকে মুক্তির উপায় থাকবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সৎ কর্মের প্রতিদান জান্নাত, যারা ঈমানের সাথে সৎ কর্ম করবে তাদের জন্যই এ প্রতিদান।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ কোন উপকার বা ক্ষতি করার মালিক নয়।
৩. আল্লাহ তা‘আলাকে ছাড়া অন্যের পূজা বা উপাসনা করা স্পষ্ট বিভ্রান্তি।
৪. নাবী, রাসূল ও সৎ ব্যক্তিদের হত্যা করার পরিণাম খুবই খারাপ।
৩০-৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির জন্য আফসোস করে বলছেন, তাদের নিকট যখনই কোন রাসূল আগমন করেছে তখনই তারা তাঁদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে। আর এ কারণে তারা কিয়ামতের মাঠে কতই না লজ্জিত হবে। অথচ তারা এ কথা চিন্তা করে না যে, তাদের পূর্বে কত শক্তিশালী জনগোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি আর কোনদিন তাদের নিকট ফিরে আসবে না। তাদের সকলকে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে, আর আমিই তাদের এ ঠাট্টা-বিদ্রূপের শাস্তি প্রদান করব। আল্লাহ তা‘আলা বাণী,

(وَإِنَّ كُلًّا لَّمَّا لَيُوَفِّيَنَّهُمْ رَبُّكَ أَعْمَالَهُمْ ط إِنَّه۫ بِمَا يَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ)

“যখন সময় আসবে তখন অবশ্যই তোমার প্রতিপালক তাদের প্রত্যেককে তার কর্মফল পুরাপুরি দেবেন। তারা যা করে তিনি সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” (সূরা হূদ ১১ : ১১১)

তাদের এ সকল ঠাট্টা-বিদ্রূপের ফলে কিয়ামতের মাঠে তারা লজ্জিত হবে এবং বলবে, কেন আমরা রাসূলগণকে মিথ্যা মনে করেছিলাম এবং কেনইবা তাদের অবাধ্য হয়েছিলাম? কিন্তু তখন আর এ আফসোস করে কোনই লাভ হবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰي يَدَيْهِ يَقُوْلُ يٰلَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلًا – يٰوَيْلَتٰي لَيْتَنِيْ لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيْلًا)‏‏

“জালিম ব্যক্তি সেদিন নিজ দু’হাত‎ দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে সৎ পথ অবলম্বন করতাম! ‘হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম!” (সূরা ফুরকান ২৫ : ২৮)

সুতরাং রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করা তাঁর জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পরেও হতে পারে। যেমন মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা, অপমানজনক কথা বলা অথবা তাঁর হাদীসকে উপক্ষো করে চলা। আমাদের এসব থেকে সতর্ক হওয়া আবশ্যক। কেননা এসব কাজ ঈমান বিনষ্টের কারণ।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. যারা সত্য পথের অনুসারী, যারা মানুষকে দীনের পথে আহ্বান করে তাদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপমূলক কথা-বার্তা বলা যাবে না।
২. অপরাধীরা কিয়ামতের মাঠে লজ্জিত হবে।
৩. রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিয়ে ঠাট্টা করা ঈমান বিনষ্টের অন্যতম কারণ।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১৩-১৭ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তোমার কওমের সামনে তুমি ঐ লোকদের ঘটনা বর্ণনা কর যারা এদের মত তাদের রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করেছিল। এটা হলো ইনতাকিয়া শহরের ঘটনা। তথাকার বাদশাহর নাম ইনতায়খাস। তার পিতা ও পিতামহেরও এই নামই ছিল। রাজা ও প্রজা সবাই মূর্তিপূজক ছিল। তাদের কাছে সাদিক, সদূক ও শালুম নামক আল্লাহর তিনজন রাসূল আগমন করেন। কিন্তু এ দুর্বত্তরা তাদেরকে অবিশ্বাস করে। সতুরই এই বর্ণনা আসছে যে, এটা যে ইনতাকিয়ার ঘটনা একথা কোন কোন লোক স্বীকার করেন না। প্রথমে তাদের কাছে দু’জন নবী আগমন করেন। তারা তাদেরকে অস্বীকার করলে তাঁদের শক্তি বৃদ্ধিকল্পে তৃতীয় একজন নবী আসেন। প্রথম দু’জন নবীর নাম ছিল শামউন ও বুহনা এবং তৃতীয়জনের নাম ছিল বুলাস। তাঁরা তিনজনই বলেনঃ “আমরা আল্লাহর প্রেরিত যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের মাধ্যমে তোমাদেরকে হুকুম করেছেন যে, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না।”

হযরত কাতাদা ইবনে দাআমাহ (রঃ)-এর ধারণা এই যে, এই তিনজন বুযর্গ ব্যক্তি হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রেরিত ছিলেন। ঐ গ্রামের লোকগুলো তাদেরকে বললোঃ “তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ। তাহলে এমন কি কারণ থাকতে পারে যে, তোমাদের কাছে আল্লাহর অহী আসবে আর আমাদের কাছে আসবে না? হ্যা, তোমরা যদি রাসূল হতে তবে তোমরা ফেরেশতা হতে।” অধিকাংশ কাফিরই নিজ নিজ যুগের রাসূলদের সামনে এই সন্দেহই পেশ করেছিল। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ওটা এ কারণে যে, তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ দলীল প্রমাণসহ আগমন করতো তখন তারা বলতোঃ মানুষ কি আমাদেরকে হিদায়াত করবে?”(৬৪:৬) অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তারা বলেছিল- তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ, তোমরা চাচ্ছ যে, আমাদের পিতৃপুরুষরা যাদের ইবাদত করতো তা হতে আমাদেরকে ফিরিয়ে দিবে, সুতরাং আমাদের কাছে প্রকাশ্য দলীল আনয়ন কর।”(১৪:১০) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা যদি তোমাদের মত মানুষের আনুগত্য কর তাহলে অবশ্যই তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।”(২৩:৩৪) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “মানুষকে তাদের কাছে হিদায়াত আসার পর ওর উপর ঈমান আনতে শুধু এটাই বাধা দিয়েছে যে, তারা বলেঃ আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন?”(১৭:৯৪) এই কথা ঐ লোকগুলোও তিনজন নবীকে বলেছিলঃ “তোমরা আমাদের মতই মানুষ। আসলে আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা মিথ্যা কথা বলছো।” নবীগণ উত্তরে বললেনঃ আল্লাহ্ খুব ভাল জানেন যে, আমরা তাঁর সত্য রাসূল। যদি আমরা মিথ্যাবাদী হতাম তবে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই আমাদেরকে মিথ্যা বলার শাস্তি প্রদান করতেন। কিন্তু তোমরা দেখতে পাবে যে, তিনি আমাদের সাহায্য করবেন এবং আমাদেরকে সম্মানিত করবেন। ঐ সময় তোমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, পরিণাম হিসাবে কে ভাল! যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। আকাশসমূহে ও যমীনে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন, আর যারা বাতিলের উপর ঈমান এনেছে ও আল্লাহকে অস্বীকার করেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।”(২৯:৫২)

নবীগণ বললেনঃ স্পষ্টভাবে পৌছিয়ে দেয়াই শুধু আমাদের দায়িত্ব। মানলে তোমাদেরই লাভ, আর না মানলে তোমাদেরকেই এ জন্যে অনুতাপ করতে হবে। আমাদের কোন ক্ষতি নেই। কাল তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
১৮-১৯ নং আয়াতের তাফসীর:

ঐ গ্রামবাসীরা রাসূলদেরকে বললোঃ “তোমাদের আগমনে আমরা বরকত ও কল্যাণ লাভ করিনি, বরং আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। জেনে রেখো যে, তোমরা যদি তোমাদের এ কাজ হতে বিরত না হও, বরং এসব কথাই বলতে থাকো তবে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবো এবং আমাদের পক্ষ হতে তোমাদের উপর বেদনাদায়ক শাস্তি আপতিত হবে।” রাসূলগণ উত্তরে বললেনঃ “তোমাদের অমঙ্গল তোমাদেরই সাথে। তোমাদের কাজই খারাপ। তোমাদের উপর বিপদ আপতিত হবার এটাই কারণ হবে। তোমরা যেমন কাজ করবে তেমনই ফল পাবে।

এ কথাই ফিরাউন ও তার লোকেরা হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর কওমের মুমিনদেরকে বলেছিল। যখন তারা কোন আরাম ও শান্তি লাভ করতো তখন বলতোঃ “আমরা তো এর প্রাপকই ছিলাম। আর যখন তাদের উপর কোন বিপদ আপতিত হতো তখন হযরত মূসা (আঃ) ও মুমিনদেরকে কুলক্ষণে মনে করতো। যার জবাবে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ … (আরবী) অর্থাৎ “জেনে রেখো যে, আল্লাহর কাছে তাদের অমঙ্গল তাদের সাথেই।” অর্থাৎ তাদের বিপদাপদের কারণ তাদের খারাপ আমল, যার শাস্তি আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের উপর আপতিত হচ্ছে।

হযরত সালেহ (আঃ)-এর কওমও তাঁকে এ কথাই বলেছিল এবং তিনিও এ জবাবই দিয়েছিলেন। স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কেও একথাই বলা হয়েছিল। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন তাদের কাছে কোন কল্যাণ পৌঁছে তখন তারা বলেঃ এটা আল্লাহর পক্ষ হতে এবং যখন কোন অকল্যাণ পৌঁছে তখন বলেঃ এটা তোমার পক্ষ হতে। তুমি বলঃ সবই আল্লাহর পক্ষ হতে সুতরাং এই কওমের কি হয়েছে যে, তারা কথা বুঝতেই চাচ্ছে না?”(৪:৭৮)

নবীরা তাদেরকে বললেনঃ এটা কি এজন্যে যে, আমরা তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি এবং তোমাদের মঙ্গল কামনা করছি তোমাদেরকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান করছি? তোমরা আমাদেরকে তোমাদের অমঙ্গলের কারণ মনে করে ফেললে এবং আমাদেরকে ভয় দেখাতে লাগলে! আর তোমরা আমাদের সাথে মুকাবিলা করতে প্রস্তুত হয়ে গেলে! প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। দেখো, আমরা তোমাদের মঙ্গল কামনা করছি, আর তোমরা আমাদের অমঙ্গল কামনা করছে। একটু চিন্তা করে বলতো, এটা কি ইনসাফের কাজ হচ্ছে? বড় আফসোসের বিষয় যে, তোমরা ইনসাফের সীমালংঘন করে ফেলেছে এবং ইনসাফ হতে বহু দূরে সরে পড়েছো!
২০-২১ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত, কাবুল আহ্বার (রঃ) এবং হযরত অহাব ইবনে মুনাব্বাহ্ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ঐ গ্রামবাসীরা শেষ পর্যন্ত ঐ নবীদেরকে হত্যা করে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একজন মুসলমান ছিল যে ঐ গ্রামেরই শেষ প্রান্তে বসবাস করতো। তার নাম ছিল হাবীব, সে রেশমের কাজ করতো এবং কুষ্ঠরোগী ছিল। সে ছিল খুব দানশীল। সে যা উপার্জন করতো তার অর্ধেক আল্লাহর পথে দান করে দিতো। তার হৃদয় ছিল খুবই কোমল এবং স্বভাব ছিল খুবই উত্তম। সে জনগণ হতে পৃথক থাকতো। একটি গুহায় বসে আল্লাহর ইবাদত করতো। যখন সে কোন প্রকারে তার কওমের ঘৃণ্য চক্রান্তের কথা জানতে পারলো তখন সে আর ধৈর্য ধারণ করতে পারলো না। সে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসলো। কেউ কেউ বলেন যে, সে ছুতার ছিল। একটি উক্তি আছে যে, সে ছিল ধোপা। উমার ইবনে হাকাম (রঃ) বলেন যে, সে জুতা সেলাই করতো। আল্লাহ তার প্রতি রহমত নাযিল করুন! সে এসে তার কওমকে বুঝাতে লাগলো। সে তাদেরকে বললোঃ “তোমরা এই রাসূলদের অনুসরণ কর। তাঁদের কথা মেনে চল। তাদের পথে চল। দেখো, তারা নিজেদের উপকারের জন্যে কোন কাজ করছেন না। তারা যে তোমাদের কাছে আল্লাহ তা’আলার বাণী পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন এ জন্যে তোমাদের কাছে তার কোন বিনিময় প্রার্থনা করছেন না। তারা যে তোমাদের মঙ্গল কামনা করছেন এর কোন পুরস্কার তারা তোমাদের কাছে চাচ্ছেন না। আন্তরিকতার সাথে তারা তোমাদেরকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান করছেন! তোমাদেরকে তারা সঠিক ও সরল পথ প্রদর্শন করছেন! তারা নিজেরাও ঐ পথেই চলছেন! সুতরাং তোমাদের অবশ্যই তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়া উচিত ও তাদের আনুগত্য করা কর্তব্য।” কিন্তু তাঁর কওম তার কথা মোটেই মানলো না, বরং তাকে তারা শহীদ করে দিলো ।। আল্লাহ্ তা’আলা তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন!
২২-২৫ নং আয়াতের তাফসীর:

ঐ সৎ লোকটি, যে আল্লাহর রাসূলদেরকে অবিশ্বাস, প্রত্যাখ্যান ও অপমান করতে দেখে দৌড়িয়ে এসেছিল এবং যে স্বীয় কওমকে নবীদের আনুগত্য করার জন্যে উৎসাহিত করছিল, সে এখন নিজের আমল ও আকীদার কথা তাদের সামনে পেশ করলো এবং তাদেরকে মূলতত্ত্ব সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে ঈমানের দাওয়াত দিলো। সে তাদেরকে বললোঃ “আমি তো শুধু এক ও অংশীবিহীন আল্লাহরই ইবাদত করি। একমাত্র তিনিই যখন আমাকে সষ্টি করেছেন তখন কেন আমি তার ইবাদত করবো না? এটাও নয় যে, আমরা এখন তার ক্ষমতার বাইরে চলে গেছি, সুতরাং তার সাথে আমাদের এখন আর কোন সম্পর্ক নেই? না, না। বরং আমাদের সবকেই আবার তার সামনে একত্রিত হতে হবে। ঐ সময় তিনি আমাদেরকে আমাদের ভাল ও মন্দের পুরোপুরি প্রতিদান প্রদান করবেন। এটা কতই না লজ্জার কথা যে, আমি ঐ সৃষ্টিকর্তা ও ক্ষমতাবানকে

ছেড়ে অন্যদের উপাসনা করবো, যে না কোন ক্ষমতা রাখে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার উপর কোন বিপদ আসলে ঐ বিপদ দূর করতে পারে, না দয়াময় আল্লাহ আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে তাদের কোন সুপারিশ আমার কোন কাজে আসতে পারে! আমার প্রতি আপতিত কোন বিপদ হতে তারা আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। যদি আমি এরূপ করি তবে অবশ্যই আমি স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়বো। হে আমার কওম! তোমরা তোমাদের যে প্রকৃত মা’বুদকে অস্বীকার করছো, জেনে রেখো যে, আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। অতএব, তোমরা আমার কথা শোনো।” এই আয়াতের ভাবার্থ এও হতে পারে যে, ঐ সৎ লোকটি আল্লাহ্ তা’আলার ঐ রাসূলদেরকে বলেছিলঃ “আপনারা আমার ঈমানের উপর সাক্ষী থাকুন। আমি ঐ আল্লাহর সত্তার উপর ঈমান এনেছি যিনি আপনাদেরকে সত্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন। তাহলে লোকটি যেন ঐ রাসূলদেরকে নিজের ঈমানের উপর সাক্ষী করছে। পূর্বের চেয়ে এই অর্থটি বেশী স্পষ্ট। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত কা’ব (রাঃ), হযরত অহাব (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, ঐ লোকটি এ কথা বলামাত্র তারা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং তাকে হত্যা করে ফেলে। তথায় এমন কেউ ছিল না যে তার পক্ষ অবলম্বন করে তাদেরকে বাধা প্রদান করে। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, তারা তাকে পাথর মারতে থাকে আর সে মুখে উচ্চারণ করেঃ “হে আল্লাহ! আমার কওমকে আপনি হিদায়াত দান করুন, যেহেতু তারা জানে না। এমতাবস্থায় তারা তাকে শহীদ করে দেয়। আল্লাহ্ তার প্রতি দয়া করুন!
২৬-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, ঐ কাফিররা ঐ পূর্ণ মুমিন লোকটিকে নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করলো। তাঁকে ফেলে দিয়ে তার পেটের উপর চড়ে বসলো এবং পা দিয়ে পিষ্ট করতে লাগলো, এমন কি তাঁর পিছনের রাস্তা দিয়ে নাড়িভূড়ি বেরিয়ে পড়লো! তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ জানিয়ে দেয়া হলো। মহান আল্লাহ্ তাঁকে দুনিয়ার চিন্তা ও দুঃখ হতে মুক্তি দান করলেন এবং শান্তির সাথে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দিলেন। তার শাহাদাতে আল্লাহ তা’আলা সন্তুষ্ট হলেন। জান্নাত তার জন্যে খুলে দেয়া হলো এবং তিনি জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি লাভ করলেন। নিজের সওয়াব ও পুরস্কার এবং ইযযত ও সম্মান দেখে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লোঃ “হায়! আমার কওম যদি জানতে পারতো যে, আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আমাকে খুবই সম্মান দান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মুমিন ব্যক্তি সবারই শুভাকাক্ষী হয়ে থাকে। তারা প্রতারকও হয় না এবং তারা কারো অমঙ্গল কামনা করে না। তাই তো দেখা যায় যে, এই আল্লাহভীরু লোকটি নিজের জীবদ্দশাতেও স্বীয় কওমের মঙ্গল কামনা করেন এবং মৃত্যুর পরেও তাদের শুভাকাক্ষীই থাকেন। ভাবার্থ এও হতে পারে যে, তিনি বলেনঃ “হায়! যদি আমার কওম এটা জানতো যে, কি কারণে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং কি কারণেই বা আমাকে সম্মানিত করেছেন তবে অবশ্যই তারাও ওটা লাভ করার চেষ্টা করতো। তারা আল্লাহ তা’আলার উপর ঈমান আনতো এবং রাসূলদের (আঃ) আনুগত্য করতো।” আল্লাহ তাঁর প্রতি দয়া করুন এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন! তিনি তার কওমের হিদায়াতের জন্যে কতই না আকাক্ষী ছিলেন।

হযরত ইবনে উমায়ের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী (রাঃ) নবী (সঃ)-কে বলেনঃ “আপনি আমাকে আমার কওমের নিকট প্রেরণ করুন, আমি তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করবো।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “আমি আশংকা করছি যে, তারা তোমাকে হত্যা করে ফেলবে।” তিনি তখন বললেনঃ “আমি ঘুমিয়ে থাকলে তারা আমাকে জাগাবেও না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “আচ্ছা, তাহলে যাও।”

অতঃপর তিনি চললেন। লাত ও উযযা প্রতিমাদ্বয়ের পার্শ্ব দিয়ে গমনের সময়। তিনি ও দুটিকে লক্ষ্য করে বললেনঃ “তোমাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সময় এসে গেছে।” তাঁর এ কথায় পুরো সাকীফ গোত্রটি বিগড়ে যায়। তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “হে আমার কওমের লোক সকল! তোমরা এই প্রতিমাগুলোকে পরিত্যাগ কর। আসলে লাত ও উযযা কিছুই নয় ! হে আমার ভাই ও বন্ধুরা! বিশ্বাস রাখো যে, প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিমাগুলো কোন কিছুরই অধিকার ও ক্ষমতা রাখে না। তোমরা ইসলাম কবূল করে নাও, শান্তি লাভ করবে। সমস্ত কল্যাণ ইসলামের মধ্যেই রয়েছে। তিনি এই কথাগুলো তিনবার মাত্র উচ্চারণ করেছেন, ইতিমধ্যে একজন দুবৃত্ত তাকে দূর হতে তীর মেরে দেয় এবং তাতেই তিনি শহীদ হয়ে যান। এ খবর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি বলেন, এ ঘটনাটি সূরায়ে ইয়াসীনে বর্ণিত ঘটনার মতই। এই সূরায় বর্ণিত লোকটি বলেছিলঃ “হায়! আমার সম্প্রদায় যদি জানতে পারতো যে, কি কারণে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন।” (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মুআম্মার ইবনে হাযাম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত কা’ব আহবার (রাঃ)-এর নিকট বানু মাযিন ইবনে নাজ্জার গোত্রভুক্ত হযরত হাবীব ইবনে যায়েদ ইবনে আ’সেম (রাঃ)-এর ঘটনাটি যখন বর্ণনা করা হলো, যিনি ইয়ামামার যুদ্ধে মুসাইলামা কাযযাব কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন, তখন তিনি বলেনঃ “আল্লাহর কসম! এই হাবীবও ঐ হাবীবেরই মত ছিলেন যার বর্ণনা সূরায়ে ইয়াসীনে রয়েছে। তাঁকে ঐ কাযযাব (চরম মিথ্যাবাদী) জিজ্ঞেস করেছিলঃ “তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর রাসূল?” তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ “হ্যা। আবার সে জিজ্ঞেস করেঃ “তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আমি আল্লাহর রাসূল?” তিনি উত্তর দেনঃ “আমি শুনি না।” তখন ঐ অভিশপ্ত মুসাইলামা তাঁকে বলেঃ “তুমি এটা শুনতে পাও, আর ওটা শুনতে পাও না?” তিনি জবাব দেনঃ “হ্যা।” অতঃপর সে তাঁকে একটি করে প্রশ্ন করতো এবং প্রতিটির জবাবে তার দেহের একটি করে অঙ্গ কেটে নিতো। কিন্তু তবুও তিনি ইসলামের উপর অটল ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ঐ অভিশপ্ত মুসাইলামা তাঁকে শহীদ করে দেয়। আল্লাহ্ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট রাখুন!

এরপর ঐ লোকদের উপর আল্লাহ্ যে গযব নাযিল হয় এবং যে গযবে তারা ধ্বংস হয়ে যায় তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। যেহেতু তারা আল্লাহর রাসূলদেরকে মিখ্যা প্রতিপন্ন করেছিল এবং আল্লাহর অলীকে হত্যা করেছিল। সেই হেতু তাদের উপর আল্লাহর আযাব আপতিত হয় এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। কিন্তু তাদেরকে ধ্বংস করার জন্যে আল্লাহ তাআলা না আকাশ হতে কোন সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন, না প্রেরণের কোন প্রয়োজন ছিল। তার জন্যে তো শুধু হুকুম দেয়াই যথেষ্ট। তাদের উপর ফেরেশতামণ্ডলী অবতীর্ণ করা হয়নি। বরং কোন অবকাশ ছাড়াই তাদেরকে আযাবে গ্রেফতার করা হয়। তাদের সবাইকে এক এক করে ধ্বংসের ঘাটে নামানো হয়। হযরত জিবরাঈল (রাঃ) আগমন করেন এবং তাদের শহর ইনতাকিয়ার দরযার চৌকাঠ ধরে এমন জোরে এক শব্দ করেন যে, তাদের কলেজা ফেটে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তাদের রূহ বেরিয়ে পড়ে।

হযরত কাতাদা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তাদের কাছে যে তিনজন রাসূল এসেছিলেন তারা হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রেরিত দূত ছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, বাহ্যতঃ জানা যাচ্ছে যে, তারা স্বতন্ত্র রাসূল ছিলেন। ঘোষিত হচ্ছেঃ … (আরবী) অর্থাৎ “যখন আমি তাদের নিকট পাঠিয়েছিলাম দুইজন রাসূল, কিন্তু তারা তাদেরকে মিথ্যাবাদী। বললো; তখন আমি তাদেরকে শক্তিশালী করেছিলাম তৃতীয় একজন দ্বারা।” তারপর ঐ তিনজন রাসূল ইনতাকিয়াবাসীদেরকে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি।” যদি ঐ তিনজন হযরত ঈসা (আঃ)-এর সাহায্যকারীদের মধ্য হতে তাঁর পক্ষ হতে প্রেরিত হতেন তবে তারা এরূপ কথা বলতেন না, বরং অন্য বাক্য বলতেন, যার দ্বারা এটা জানা যেতো যে, তারা হযরত ঈসা (আঃ)-এর দূত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

তারা যে হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রেরিত দূত ছিলেন না তার আর একটি ইঙ্গিত এই যে, তাঁদের কথার জবাবে ইনতাকিয়াবাসীরা বলেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ।” এটা লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, কাফিররা সদা এ উক্তিটি রাসূলদের ব্যাপারেই করতো। যদি ঐ তিনজন রাসূল হাওয়ারীদের মধ্য হতেই হতেন তবে তারা স্বতন্ত্রভাবে রিসালাতের দাবী কেন করবেন? আর ঐ ইনতাকিয়াবাসীরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কেনই বা করবে? দ্বিতীয়তঃ ঐ ইনতাকিয়াবাসীদের নিকট যখন হযরত ঈসা (আঃ)-এর দূত গিয়েছিলেন তখন ঐ গোটা গ্রামের লোকেরাই তার উপর ঈমান এনেছিল। এমনকি ওটাই ছিল প্রথম গ্রাম, যার সমস্ত অধিবাসীই হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর ঈমান এনেছিল। এজন্যেই খৃষ্টানদের যে চারটি শহরকে মুকাদ্দাস বা পবিত্র বলা হয়, ওগুলোর মধ্যে এটিও একটি। তারা বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইবাদতের শহর এজন্যেই বলে যে, ওটা হযরত ঈসা (আঃ)-এর শহর। আর ইনতাকিয়াকে মর্যাদা সম্পন্ন শহর বলার কারণ এই যে, সর্বপ্রথম তথাকার লোকই হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর ঈমান এনেছিল। ইসকানদারিয়ার মর্যাদার কারণ এই যে, এখানে তারা তাদের মাযহাবী পত্রধারীদের বচনের উপর ইজমা করেছে। আর রুমিয়্যার মর্যাদার কারণ হচ্ছে এই যে, কুসতুনতীন বাদশাহর শহর এটাই এবং সেই তাদের ধর্মের সাহায্য করেছিল এবং এখানেই তাদের বরকত ছিল। অতঃপর সে যখন কুসতুনতুনিয়া শহর বসিয়ে দেয় তখন তাবাররুক রূমিয়া হতে এখানেই রেখে দেয়া হয়। সাঈদ ইবনে বিতরীক পমুখ খৃষ্টান ঐতিহাসিকদের ইতিহাসসমূহে এসব ঘটনা উল্লিখিত হয়েছে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণও এটাই লিখেছেন। সুতরাং জানা গেল যে, ইনতাকিয়াবাসীরা হযরত ঈসা (আঃ)-এর দূতদের কথা মেনে নিয়েছিল। অথচ এখানে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা রাসূলদেরকে মানেনি এবং তাদের উপর আল্লাহর আযাব এসেছিল এবং তাদেরকে তচনচু করে দেয়া হয়েছিল। সুতরাং এটা প্রমাণিত হলো যে, এটা অন্য ঘটনা এবং ঐ তিনজন রাসূল স্বতন্ত্র রাসূল ছিলেন। ইতাকিয়াবাসী তাদেরকে মানেনি। ফলে তাদের উপর আল্লাহর আযাব এসেছিল এবং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিল। তাদেরকে সকালের প্রদীপের মত নির্বাপিত করে দেয়া হয়েছিল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

তৃতীয়তঃ ইনতাকিয়াবাসীদের ঘটনা, যা হ্যরত ঈসা (আঃ)-এর হাওয়ারীদের সাথে ঘটেছিল ওটা হলো তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পরের ঘটনা। আর হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) ও পূর্বযুগীয় গুরুজনদের একটি জামাআত হতে বর্ণিত আছে যে, তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পরে কোন বস্তীকে আল্লাহ তাআলা। আসমানী আযাব দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেননি। বরং মুমিনদেরকে কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়ে কাফিরদের মাথা নীচু করে দেখিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রথম যুগসমূহকে ধ্বংস করে দেয়ার পর আমি মূসা (আঃ)-কে বি (তাওরাত) দিয়েছিলাম।”(২৮:৪৩) আর এই বস্তীটির আসমানী ধ্বংসের উপর কুরআনের আয়াতসমূহ সাক্ষী রয়েছে। এগুলো দ্বারা ইনসাফ সুস্পষ্ট। তাছাড়া এর দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে, এটা ইনতাকিয়ার ঘটনা নয়, যেমন পূর্ব যুগীয় কোন কোন গুরুজনের উক্তি রয়েছে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য এই বিখ্যাত শহর ইনতাকিয়া নয়। এটাও হতে পারে যে, এটা ইনতাকিয়া নামক অন্য কোন শহর। আর এটা হয়তো ঐ শহরেরই ঘটনা। কেননা, যে ইনতাকিয়া শহরটি প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে তা আল্লাহর আযাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মশহর নয়। খৃষ্টানদের যুগেও না এবং তাদের পূর্ববর্তী যুগেও না। মহান আল্লাহই এসব ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ দুনিয়ায় তিন ব্যক্তি সবচেয়ে অগ্রগামী। হযরত মূসা (আঃ)-এর দিকে অগ্রগামী ছিলেন হযরত ইউশা ইবনে নূন (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ)-এর দিকে অগ্রগামী ছিলেন ঐ তিন ব্যক্তি, যাদের বর্ণনা সূরায়ে ইয়াসীনে রয়েছে এবং হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর খিদমতে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ)।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা সম্পূর্ণরূপে মুনকার বা অস্বীকৃত হাদীস। এটা শুধু হুসাইন ইবনে আশকার রিওয়াইয়াত করেছেন। তিনি একজন শীয়া এবং তিনি পরিত্যজ্য। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী)
৩০-৩২ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দাদের উপর দুঃখ ও আফসোস করছেন যে, কাল। কিয়ামতের দিন তারা কতই না লজ্জিত হবে! তারা সেদিন বারবার বলবেঃ “হায়! আমরা নিজেরাই তো নিজেদের অমঙ্গল ডেকে এনেছি।” কোন কোন কিরআতে (আরবী) রয়েছে। ভাবার্থ এই যে, কিয়ামতের দিন। আযাব দেখে তারা হাত মলবে যে, কেন তারা রসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল এবং কেন আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল?

দুনিয়ায় তাদের অবস্থা তো এই ছিল যে, যখনই তাদের কাছে কোন রাসূল এসেছেন তখনই তারা কোন চিন্তা-ভাবনা না করেই তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলেছে এবং মন খুলে তাঁদের সাথে বেআদবী করেছে ও তাদেরকে অবজ্ঞা করেছে।

যদি তারা একটু চিন্তা করতো তবে বুঝতে পারতো যে, তাদের পূর্বে বহু মানব গোষ্ঠীকে আল্লাহ্ ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাদের কেউই রক্ষা পায়নি এবং কেউই তাদের কাছে ফিরে আসেনি।

এর দ্বারা দারিয়া সম্প্রদায়ের দাবীকে খণ্ডন করা হয়েছে। তারা বলে যে, মানুষ এই দুনিয়া হতে চলে যাবে এবং পরে আবার এই দুনিয়াতেই ফিরে আসবে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অবশ্যই তাদের সকলকে একত্রে আমার নিকট উপস্থিত করা হবে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত মানুষকে কিয়ামতের দিন হিসাব নিকাশের জন্যে হাযির করা হবে এবং সেখানে প্রত্যেক ভাল মন্দের প্রতিদান দেয়া হবে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের প্রত্যেককেই তোমার প্রতিপালক তাদের আমলের পূর্ণ প্রতিদান প্রদান করবেন।”(১১:১১১) এক কিরআতে (আরবী) রয়েছে। এ সময় (আরবী) শব্দটি (আরবী) বা হ্যা বাচক হবে। আর (আরবী) পড়ার সময় (আরবী) শব্দটি (আরবী) বা না বাচক হবে এবং (আরবী) শব্দটি (আরবী)-এর অর্থ দেবে। তখন অর্থ হবেঃ কেউ নয় কিন্তু সবাই আমার নিকট হাযিরকত হবে। দ্বিতীয় কিরআতের ভাবার্থ এটাই হবে। এসব। ব্যাপারে মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*উদাহরণের সাহায্যে আখেরাতের আলােচনা উপস্থাপন : ওহী ও রেসালাত এবং আখেরাতের হিসাব নিকাশের বিষয় প্রতিবেদন আকারে উপস্থাপনের পর এক্ষণে কাহিনী আকারে তুলে ধরা হচ্ছে। এ কাহিনী অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। এতে ঈমানের দাওয়াত গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের কী পরিণতি হয়, তা যেন চাক্ষুষ দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। ‘তাদের কাছে উদাহরণ হিসাবে সেই গ্রামবাসীকে তুলে ধরাে, যখন তাদের কাছে রসূলরা এলাে…'(আয়াত ১৩-১৯) কোরআন এই গ্রাম ও গ্রামবাসীর পরিচয় উল্লেখ করেনি। এ সম্পর্কে বিভিন্ন রকমের বর্ণনা রয়েছে। এ পরিচয় স্পষ্ট না করা দ্বারা বুঝা যায়, এই গ্রামের নাম ও অবস্থান উল্লেখ করলে এই কাহিনীর শিক্ষা ও তাৎপর্যে কোনা হ্রাস বৃদ্ধি ঘটতাে না। এ জন্যে নির্দিষ্ট করে নামােল্লেখ করেনি বরং কাহিনীর শিক্ষাটাই তুলে ধরেছে। এই গ্রামে আল্লাহ তায়ালা প্রথমে দু’জন রসূলকে পাঠিয়েছিলেন, যেমন হযরত মূসা ও হারুন(আ.)-কে ফেরাউনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। গ্রামবাসী তাদের দু’জনকেই প্রত্যাখ্যান করলাে। এরপর আল্লাহ তায়ালা তৃতীয় আরেকজন রাসূল পাঠিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করলেন। তারপর তিন জনই ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন করে দাওয়াত দিয়ে বললেন, আমরা তােমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল। এ পর্যায়ে গ্রামবাসী আপত্তি জানালাে। তাদের এ আপত্তি নতুন কিছু নয়, নবুওত ও রেসালাতের ইতিহাসে এ আপত্তি বার বার তােলা হয়েছে। তারা বললাে, ‘তােমরা তাে আমাদেরই মতাে মানুষ।…দয়াময় আল্লাহ তায়ালা কোনাে কিছুই নাযিল করেননি… তােমরা স্রেফ মিথ্যাবাদী।’ রসূলের মানবত্ব নিয়ে বার বার উত্থাপিত এই আপত্তিটা চিন্তা, উপলব্ধির ক্ষেত্রে সরলতা ও রাসূলের দায়িত্ব সম্পর্কে নিদারুণ অজ্ঞতারই বহিপ্রকাশ। লােকেরা সব সময় এরূপ আশাই পােষণ করতাে যে, রসূলের জীবন ও ব্যক্তিত্ব হবে রহস্যময় এবং তা নিয়ে সমাজে নানারকমের কিসসা কাহিনী প্রচলিত থাকবে। আকাশের দূত পৃথিবীতে আসবে, আর তাকে ঘিরে মজার মজার কিসসা কাহিনী চালু হবে না- এটা কেমন কথা? রসূল নিরেট সহজ সরল রহস্য থাকবে না- এও কি সম্ভব? মানব সমাজের সর্বত্র, হাটে-মাঠে-বাজারে, যেসব মামুলী ও নগণ্য ধরনের মানুষ ঘুরে বেড়ায়, সেই ধরনের একজন নিরীহ সাধারণ মানুষ আবার রসূল হয় কি করে? এ হচ্ছে নিরেট নির্বোধসুলভ চিন্তাধারা। রহস্যময়তা ও অসচ্ছতা নবী রসূলদের জীবনের কোনাে অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নয়। বিশেষত এই শিশুসুলভ বালখিল্যতার দাবী অনুসারে তাে তা হতেই পারে না। তবে একটা বিরাট রহস্য এখানে অবশ্যই রয়েছে। একটা নিরেট বাস্তব ঘটনার মধ্যে নিহিত রয়েছে এই রহস্যটা। সেই বাস্তব ঘটনা হলাে, এই বিশাল মানব জাতির মধ্য থেকে একজন নির্দিষ্ট মানুষের মধ্যে এরূপ অসাধারণ যােগ্যতা বিদ্যমান থাকা যে, সে মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে আকাশ থেকে অবতীর্ণ ওহী গ্রহণ করার যােগ্যতা লাভ করে। এ কাজটা সমাধা করার জন্যে তারা যে ফেরেশতা পাঠানাের প্রস্তাব দিচ্ছিল, তার চেয়েও এটা অনেক বেশী বিস্ময়কর ঘটনা। রেসালাত হচ্ছে মানুষের জীবন যাপনের জন্য আল্লাহর রচিত ও মনােনীত বিধান। রসূলের জীবন হচ্ছে আল্লাহর বিধানের অনুসারী জীবন কেমন হওয়া উচিত তার বাস্তব নমুনা। রসূল(স.) তার জাতিকে আহ্বান জানান মানুষ হিসেবে এই নমুনা অনুসরণ করার জন্যে। সেটা করতে হলে তাদের রসূলকে অবশ্যই মানুষ হতে হবে, যাতে তিনি এমন জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিতে পারেন, যা তারাও অনুসরণ করতে সক্ষম। এ জন্যে রাসূল (স.)-এর জীবন তার উম্মতের সামনে উন্মুক্ত ও দর্শনযােগ্য ছিলাে। মহান আল্লাহর চিরঞ্জীব গ্রন্থ কোরআনও তাঁর জীবনের, এমনকি ব্যক্তিগত ও ঘরােয়া জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুঁটিনাটি বিষয় পর্যন্ত চিরদিনের জন্যে সংরক্ষণ করেছে। কোনাে কোনাে সময়ে রসূলের মনের কোণে উকি দেয়া চিন্তা ভাবনা পর্যন্ত ভবিষ্যত প্রজন্মের মানুষেরা জানতে পারে এবং এগুলাের মধ্য দিয়ে আল্লাহর নবী হয়ে আগত এই মানুষটির অন্তকরণ কেমন, তা দেখতে পায়। কিন্তু এই দিবালােকের মতাে স্পষ্ট সত্যটার প্রতিই মানুষ চিরকাল আপত্তি জানিয়ে আসছে। সেই গ্রামের অধিবাসীরাও তাদের কাছে আগত তিন জন রাসূল কে বলেছিলাে, ‘তােমরা আমাদেরই মতাে মানুষ ছাড়া তাে আর কিছু নও।’ অর্থাৎ তারা বলতে চেয়েছে যে, তােমরা রসূল নও, আর দয়াময় আল্লাহ তােমাদের কাছে কিছুই নাযিল করেননি। অর্থাৎ তােমরা যে দাবী করাে, মহান আল্লাহ আমাদের ওপর ওহী নাযিল করেছেন এবং আমাদের সবাইকে তা শুনতে আদেশ দিয়েছেন, সে দাবী সত্য নয়। ‘তােমরা কেবল মিথ্যা দাবী করছো। অর্থাৎ তােমাদের রসূল হবার দাবি মিথ্যা। রসূলরা যেহেতু নিজেদের সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত ছিলেন এবং তাদের কর্তব্যের সীমা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তারা জবাব দিলেন, “আমাদের প্রতিপালক জানেন যে, আমরা তােমাদের কাছে রসূল হয়ে এসেছি এবং কোনাে রাখঢাক না করে তার দ্বীন প্রচার করাই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব।’ বস্তুত আল্লাহ তায়ালা জানেন, এটাই যথেষ্ট। আর রসূলদের দায়িত্ব দ্বীনের প্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়। সে কাজ তারা সমাধা করেছেন। এরপর মানুষ কি করবে এবং কোন ফলাফল বরণ করবে, সে ব্যাপারে সে স্বাধীন। রসূল ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক শুধু এতােটুকু যে, আল্লাহর পাঠানাে প্রতিটি বাণী তিনি মানুষের কাছে হুবহু পৌছে দেবেন। এ কাজ যখন সম্পন্ন হবে তখন আর সব কিছু আল্লাহর হাতে ন্যস্ত। কিন্তু নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী পথভ্রষ্ট লােকেরা এই সহজ সরল বিষয়টাকে সহজভাবে গ্রহণ করে না। তারা সত্যের আহ্বায়ক ও প্রচারকদের অস্তিত্বই বরদাশত করতে রাযি হয় না। ফলে এক ধরনের অন্যায় আভিজাত্যবােধ ও পাপাচারমূলক দম্ভ তাদের পেয়ে বসে এবং যুক্তির মােকাবেলায় নিষ্ঠুর হিংস্রতার আশ্রয় নেয়। কারণ বাতিল শক্তি অত্যন্ত সংকীর্ণমনা ও হৃদয়হীন হয়ে থাকে। ‘তারা বললাে, আমরা তােমাদের কারণে অমংগলের আশংকা করছি। তােমরা এই প্রচারকার্য যদি না থামাও, তাহলে আমরা তােমাদের পাথর নিক্ষেপে মেরে ফেলবাে এবং আমাদের পক্ষ থেকে তােমরা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।’ অর্থাৎ তােমাদের দিক থেকে আমরা অশুভ লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি এবং তােমাদের প্রচারকার্য চলতে থাকলে আমরা ঘােরতর অমংগল ঘটে যাওয়ার আশংকাবােধ করছি। কাজেই তোমরা যদি এ কাজ বন্ধ না করো, তাহলে আমরা চুপ করে বসে থাকবাে না এবং তােমাদের প্রচারকার্য চালিয়ে যেতে দেবাে না। তােমাদের পাথর মেরে শেষ করে দেবাে এবং কঠিন শাস্তি দেবাে। এভাবে বাতিল শক্তি তার আগ্রাসী চরিত্র নগ্নভাবে তুলে ধরলাে, সৎপথ প্রদর্শকদের শাসানি ও হুমকি দিলাে, সত্যের শান্তশিষ্ট ও মার্জিত দাওয়াতের বিরুদ্ধে গোয়ার্তুমি করলো, কথাবার্তায় ও মানসিকতায় চরম ঔদ্ধত্য এবং ধৃষ্টতার পরিচয় দিলাে, কিন্তু রসূলদের ঘাড়ে যে দায়িত্ব অর্পিত ছিলাে, তা তাদের উগ্র বাতিল শক্তির এই রক্তচক্ষুর ভ্রকুটি উপেক্ষা করে সত্যের পথে অবিচল থাকতে ও এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করলাে, তারা বললাে, তােমাদের অমংগল তাে তােমাদের সাথেই রয়েছে।’ অর্থাৎ কারাে মুখ দেখলে বা কেউ দাওয়াত দিলেই অকল্যাণ হবে, এটা একটা ভিত্তিহীন জাহেলী ধারণা। রসূলরা জনগণকে বুঝালেন যে, এটা একটা কু-সংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা। কোনাে জাতির ভাগ্যে ভালাে বা মন্দ যা-ই ঘটুক, তা তাদের বাইর থেকে আসে না; বরং তা তাদের নিজেদের সাথেই থাকে, তাদের কার্যকলাপ ও মনমানসিকতা, তাদের উপার্জন ও পেশাগত সততা বা অসততার ওপর নির্ভরশীল। নিজেদের ভাগ্য ভালাে বা মন্দ করার ক্ষমতা তাদের নিজেদের হাতেই রয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা কোনাে মানুষের ভালোই চান বা মন্দই চান, সেটা তার নিজের মন-মানসিকতা, চরিত্র ও কার্যকলাপের মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত এবং বাস্তবায়িত হয়। তার ভাগ্যের ভালাে মন্দ সে নিজেই বহন করে। এটাই হচ্ছে প্রকৃত সত্য ও প্রামাণ্য বাস্তবতা। কারাে মুখ দেখলে অমংগল, কোন জায়গায় অমংগল, কিংবা কোনাে কথাবার্তায় অমংগল, এ জাতীয় কথাবার্তা নিতান্তই অসার কু-সংস্কার মাত্র। এর কোনাে বােধগম্য ভিত্তিই নেই। ‘তারা বললাে, তােমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেও?’ অর্থাৎ তােমাদের স্মরণ করিয়ে দিলাম বলে কি তােমরা আমাদের পাথর নিক্ষেপে মেরে ফেলবে এবং শাস্তি দেবে? এই নাকি স্মরণ করানাের প্রতিদান? অর্থাৎ চিন্তা ভাবনা ও মূল্যায়নে তােমরা সীমা অতিক্রমকারী। সে জন্যেই তােমাদের যখন সদুপদেশ দেয়া হয় তখন তােমরা হুমকি ও শাসানি দাও এবং দাওয়াত দিলে শাস্তি দেয়া ও পাথর মেরে হত্যা করার ভয় দেখাও। রাসূলের দাওয়াত গ্রহণে অক্ষম ও ছিপি আঁটা মনের অধিকারী লােকদের এই ছিলাে প্রতিক্রিয়া। সূরার প্রথম ভাগে এ ধরনের অন্তরের কথাই বলা হয়েছে এবং এই নমুনার মানুষেরই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পক্ষান্তরে অপর নমুনার লােকেরা, যারা কিতাবের অনুসারী এবং আল্লাহ তায়ালাকে না দেখে ভয় করে, তাদের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া হতাে ঠিক এর বিপরীত।

‘শহরের প্রান্ত থেকে এক লােক ছুটে এলাে। সে বললাে, হে আমার জাতি, তােমরা রাসূলের, দাওয়াত মেনে নাও…’ আমার কথা শোনো। এটা ছিলাে সত্যের দাওয়াতের প্রতি নির্মল ও বিকারমুক্ত একটি বিবেকের সাড়া দানের ঘটনা। এই সাড়াদানে পরম নিষ্ঠা, সরলতা, প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা, উপলব্ধির বিশুদ্ধতা ও সুস্পষ্ট সত্যকে দুরন্ত তেজস্বিতা সাথে গ্রহণের মানসিকতা সক্রিয় ছিলাে। এই ব্যক্তি রসূলের দাওয়াতের কথা শুনে তার যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে সংগে সংগেই তা গ্রহণ করে। সে তার জাতিকে উদ্দেশ্য করে যে ভাষণ দিয়েছিলাে, তাতে সে সেসব অকাট্য সাক্ষ্য প্রমাণ এবং যুক্তির উল্লেখও করেছিলাে, যা বিবেচনা করার পরই সে ঈমান এনেছিলাে। তার হৃদয় যখন ঈমানের তাৎপর্য উপলব্ধি করলাে, তখন এ সত্য তার অন্তরের অন্তস্তলে ঢুকে তাকে অস্থির করে তুললাে। তাই সে নীরব থাকতে পারলাে না। নিজের চারপাশে গােমরাহী পাপাচার ও অনাচারের ধুম পড়তে দেখে সে নিজ গৃহে নিস্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকা পছন্দ করেনি। তার হৃদয়ে স্থায়ীভাবে অবস্থানরত ও চেতনায় প্রবলভাবে সক্রিয় সত্যকে নিয়েই সে চেষ্টা চালালাে। তার জাতি যখন দাওয়াত প্রত্যাখ্যান ও রসূলদেরকে হুমকি ধমকি দিয়ে বিদায় দিতে সচেষ্ট, ঠিক তখনই সে এই চেষ্টাটা চালালাে। শহরের এক প্রান্ত থেকে সে এলাে। তার লক্ষ্য ছিলাে স্বীয় জাতিকে সত্যের দিকে দাওয়াত দেয়ার কর্তব্য পালন, তাদের বাড়াবাড়ি করতে বাধা দেয়া এবং রসূলদের ওপর নির্যাতন চালাতে না দেয়া। এটা সুস্পষ্ট যে, লোকটা কোনাে প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ছিলাে না। তার নিজ গােত্র বা আত্মীয়স্বজন সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব সংঘাতের ক্ষেত্রে তার প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে আসবে, এমন নিশ্চয়তাও ছিলাে না। বিবেকের অভ্যন্তরে নিহিত সজীব আকীদা বিশ্বাস তাকে অনুপ্রাণিত করছিলাে ও শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে এসেছিলাে। ‘সে বললাে, হে আমার জাতি, রসূলদের কথামতাে চলাে, যারা তােমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চায় না এবং নিজেরাও সৎপথে পরিচালিত, তাদের পদাংক অনুসরণ করাে।’ যে ব্যক্তি এ ধরনের আহ্বান জানাতে পারে, অথচ কোন পারিশ্রমিক চায় না, কোনাে ধন সম্পদ চায় না, সে সত্যবাদী না হয়েই পারে না। নচেত আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট না হয়ে থাকলে কিসের খাতিরে সে এই কষ্ট করবে? কোন কারণে সে দাওয়াতের কাজটাকে এতাে গুরুত্ব দেবে? মানুষ যে আদর্শ পছন্দ করে না, তাই নিয়ে তাদের সাথে সংঘাতের মুখে দাড়ানাের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? জনগণের পক্ষ থেকে অত্যাচার, নিপীড়ন ও ঠাট্টা-বিদ্রুপের শিকার হবার ঝুঁকি তারা কেন নেবে, যখন তা থেকে কোনাে উপার্জন বা প্রতিদানের গরয নেই? ‘যারা সৎপথে পরিচালিত।’ তাদের দাওয়াতের পদ্ধতি দেখেই বুঝা যায় তারা সৎপথে পরিচালিত, কেননা তারা এক আল্লাহকে মেনে নেয়ার দাওয়াত দেয়, একটা সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র জীবন বিধানের দিকে আহ্বান জানায়। এমন একটা আকীদা ও আদর্শের দিকে আহ্বান জানায় যাতে কোন অস্পষ্টতা, অস্বচ্ছতা ও কূ-সংস্কার নেই। তাই সংগতভাবেই বলা যায় তারা নিখুঁত, নির্ভুল ও বিশুদ্ধ পথের দিকে আহ্বান জানায়। এরপর পুনরায় সে নিজের ঈমান আনার কারণ ব্যাখ্যা করতে থাকে এবং তাদের মধ্যকার সচেতন ও জাগ্রত বিবেকের কাছে আবেদন জানাতে থাকে, আমার কী হয়েছে যে, আমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তার এবাদাত করবাে না? অথচ তার কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে… সুস্পষ্ট গােমরাহীতে লিপ্ত হবাে।’ এ হচ্ছে মহান স্রষ্টা সম্পর্কে সচেতন বিবেকের প্রশ্ন। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আমি তার এবাদাত করবাে না, এটা কিভাবে সম্ভব? এই স্বতস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক পথ থেকে কে আমাকে দূরে সরাবে? মানবীয় বিবেক ও মন মগয প্রথম সুযােগেই তার স্রষ্টার দিকে আকৃষ্ট হয়। এ থেকে সে কখনাে বিপথে যায় না, যদি না তাকে তার নিজ স্বভাব প্রকৃতির বাইরের কোনাে উপকরণ বিপথগামী করে। মহান স্রষ্টার দিকে আকৃষ্ট হওয়াটাই সৃষ্টির প্রথম ও সর্বোচ্চ অগ্রগণ্য কাজ। এ জন্যে তার নিজ স্বভাব প্রকৃতির বাইরের কোনাে আকর্ষণীয় উপকরণের কোনােই প্রয়ােজন নেই। একজন ঈমানদার ব্যক্তি তার অন্তরের অন্তস্তল থেকে এটা অনুভব করে। তাই সে অত্যন্ত সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় এ কথাটা উচ্চারণ করে। এতে কোনাে বক্রতা বা জোড়াতালি দেয় না। মােমেন এটাও তা সত্যনিষ্ঠ বিবেক দ্বারা অনুভব করে যে, সকল সৃষ্টি শেষ পর্যন্ত স্রষ্টার কাছে ফিরে যাবে। যেমন প্রত্যেক জিনিস তার উৎসের দিকে ফিরে যায়। তাই বলা হয়েছে, তার দিকেই। তােমরা সবাই ফিরে যাবে। অর্থাৎ সে প্রশ্ন রাখছে, আমি কেন আমার স্রষ্টার এবাদাত করবাে না, যখন আমাকে এবং জনগণকেও তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। কেননা তিনি সকলেরই স্রষ্টা এবং তার ইবাদত করা তাদেরও কর্তব্য। এরপর এর বিপরীত পথটাও পর্যালােচনা করা হচ্ছে এবং তাকে সুস্পষ্ট গােমরাহী বলা হচ্ছে, আমি কি তাকে ছাড়া অন্যদের ইবাদত করবে যে স্বাভাবিক যুক্তি সৃষ্টিকে স্রষ্টার এবাদাতে উদ্বুদ্ধ করে, সেই যুক্তি বর্জনকারীর চেয়ে বিপথগামী আর কেউ হতে পারে না। বিনা প্রয়ােজনে স্রষ্টা ছাড়া অন্য কারাে এবাদাতে নিরত হওয়ার মতাে গােমরাহী আর কিছু হতে পারে না। স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে যে ব্যক্তি এমন সব দুর্বল মাবুদের উপাসনা করে, যারা তাকে তার স্রষ্টা কোনাে বিপদে ফেললে তা থেকে উদ্ধার করতে পারে না। সেই ব্যক্তির চেয়ে পথভ্রষ্ট আর কেউ হতে পারে না। ‘আমি তাহলে সুস্পষ্ট গােমরাহীতে লিপ্ত হবাে।’ এবার এই ব্যক্তি তার স্বভাবজাত সত্যবাদী মুখ দিয়ে তার স্বজাতির মুখের ওপর নিজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছে এবং তার স্বজাতির প্রত্যাখ্যান, হুমকি শাসানী ও চোখ রাঙানীর কোনাে তােয়াক্কাই সে করছে না। কেননা বিবেকের কণ্ঠস্বর সকল হুমকি ও শাসানীর ঊর্ধ্বে, ‘আমি তােমাদের প্রতিপালকের ওপর ঈমান এনেছি। অতএব আমার কথা শােনাে।’ এভাবে সে তার সর্বশেষ ঈমানী ঘােষণা উচ্চারণ করলাে এবং সবাইকে সাক্ষী রেখেই তা করলাে। সেই সাথে সে তাদেরও তার মতাে ঘােষণা দিতে উদ্বুদ্ধ করলাে। এ ঘােষণার উদ্দেশ্য এও হতে পারে যে, জনগণ কি বলবে, তার কোনাে পরােয়া সে করে না। কাহিনী পরম্পরা থেকে মনে হয়, তারা তাকে আর বাঁচতে দেয়নি, তৎক্ষণাৎ হত্যা করে ফেলেছে। এটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করা হলেও পার্থিব জীবন ও শহরবাসীর ওপর এখানে যবনিকা পড়ে গেছে। তাকে পুনরায় তুলে ধরা হয়েছে, যাতে আমরা সােচ্চার কণ্ঠে সত্যের ঘোষণাকারী এই শহীদকে দেখতে পাই। আমরা তাকে দেখতে পাই, বিবেকের বক্তব্য প্রতিধ্বনিত করে এবং নির্যাতনকারী ও হুমকিদাতাদের মুখের ওপর শেষ ঘােষণা উচ্চারণ করে পরপারে পাড়ি জমাতে। এরপরের আয়াতগুলাে থেকে আমরা জানতে পারি আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে এমন সম্মান ও মর্যাদা সঞ্চিত করে রেখেছেন, যা একজন নিষ্ঠাবান মােমেন বীর শহীদের উপযুক্ত। ‘তাকে বলা হলাে, জান্নাতে প্রবেশ করাে। সে বললাে, ‘হায় আমার জাতি যদি জানতাে আমার প্রভু আমাকে ক্ষমা করেছেন ও সম্মানিত করেছেন।’ বস্তুত দুনিয়ার জীবন আখেরাতের জীবনের সাথেই যুক্ত। মৃত্যুকে আমরা শুধু ধ্বংসের জগত থেকে চিরস্থায়িত্বের জগতে স্থানান্তর হিসেবেই দেখতে পাই। মৃত্যু যেন মােমেনের একটা পদক্ষেপ, যা দ্বারা সে দুনিয়ার সংকীর্ণ পরিসর থেকে জান্নাতের বিশাল পরিসরে পৌছে যায় । বাতিল শক্তির আস্ফালন থেকে সে চলে যায় সত্যের অনন্ত প্রশান্তির কোলে, আল্লাহ বিরােধী শক্তির হুমকি থেকে জান্নাতের অনাবিল শান্তির ভুবনে এবং জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে প্রত্যয়ের আলােতে। আমরা মােমেন ব্যক্তিটাকে এখানে জান্নাতের ক্ষমা ও সম্মানের দুর্লভ নেয়ামতে ভূষিত দেখতে পাই। সে আনন্দ ও সন্তোষের সাথে তার জাতিকে স্মরণ করছে এবং আক্ষেপ করছে যে, আল্লাহ। তায়ালা তাকে যে মর্যাদা ও সন্তোষ দান করেছেন তা যদি তারা দেখতাে, তাহলে দৃঢ়তম প্রত্যয়ের সাথে সত্যকে জানতে পারতাে। | এটা ছিলাে ঈমানের প্রতিদান। পক্ষান্তরে বিদ্রোহ ধ্বংস করা আল্লাহর কাছে এতাে সহজ যে, সে জন্যে তার ফেরেশতা পাঠানাের প্রয়ােজনই পড়ে না। ওটা তার কাছে অতি মাত্রায় দুর্বল ব্যাপার। ‘আমি তার জাতির ওপর তার পরে আকাশ থেকে কোন বাহিনী পাঠাইনি, পাঠানাের ইচ্ছাও আমার ছিলাে না। সে তাে ছিলাে একটা চিৎকার মাত্র। তাতেই তাদের সবার প্রাণ প্রদীপ নিভে গেলাে।’ এখানে সেই জাতিটাকে এতাে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে যে, তাদের ধ্বংসযজ্ঞের কোনাে দীর্ঘ বিবরণ দেয়া হয়নি। কেবল একটামাত্র চিৎকার তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলাে । এরপর যবনিকাপাত ঘটে তাদের ঘৃণ্য ও অপমানজনক ধ্বংসের ওপর।

# যে মােশরেকরা রাসূলুল্লাহ(স.)-কে মিথ্যাবাদী বললাে এবং তার আনীত ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলাে, তাদের সম্পর্কে সূরার প্রথম অধ্যায়ে যে পাঠ দান করা হয়েছে, তার মধ্যে তাদের বুঝানের জন্যে পল্লীবাসী কয়েকজন মানুষের উদাহরণ দেয়া হয়েছে এবং পরিশেষে তাদের পরিণতি কি হবে সে বিষয়ে আলােচনার পর আলােচ্য আয়াতগুলােতে যে শিক্ষা আমরা দেখতে পাচ্ছি তাতে বলা হচ্ছে, ‘অতপর ওরা (আল্লাহর প্রেরিত শাস্তিতে) নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।…’ এরপর আলােচ্য অধ্যায়ে বলা হচ্ছে যে, সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের স্বভাব ও ব্যবহার সকল জনপদে একই প্রকার থাকতে দেখা গেছে। তারপর জানানাে হচ্ছে যে, অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ঘটনাবলী জানার পরও সাধারণভাবে যে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে না তাতে তাদের লাভ কি! তারা তাে পূর্ববর্তীদের মতাে সবাই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে এবং কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পুর্বে আর কখনও ফিরে আসবে না। তাই বলা হচ্ছে, ‘সবাই সেদিন আমি মহান সম্রাটের দরবারে একত্রিত হবে।’ এরপর শুরু হচ্ছে বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর ক্ষমতার নানা প্রকার নিদর্শনের বর্ণনা। এ সব নিদর্শন রয়েছে মানুষের নিজের অস্তিত্বের মধ্যে, ছড়িয়ে রয়েছে পারিপার্শ্বিক সকল কিছুর মধ্যে এবং অতীতের ইতিহাসের পাতায় পাতায়… এতদসত্তেও ওরা সত্যকে অস্বীকার করে চলেছে। অথচ এসব মানুষ, ‘আযাব কেন আসছে না, কত দেরী হবে আযাব আসতে, নিয়ে এসাে না তোমার আযাব’ এসব বলে বলে ব্যস্ততা দেখায়। কারণ তারা আযাব আসার কথা বিশ্বাসই করতে চায় না। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা বলে, কখন সংঘটিত হবে তােমাদের প্রতিশ্রুত সে আযাব, নিয়ে এসাে না জলদি করে, যদি তােমরা (তােমাদের ওয়াদায়) সত্যবাদী হয়ে থাকো।’ ওদের জলদি আযাব নাযিল করার দাবীর জওয়াবে কেয়ামতের দিনে সংঘটিতব্য বিভিন্ন আযাবের মধ্য থেকে কিছু কিছু শাস্তির বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করা হচ্ছে, যা শুনে তারা নিজেদের প্রত্যাবর্তনের স্থান (অদৃষ্টি দিয়ে এমনভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারবে যেন তারা তাদের (বাহ্যিক) চোখ দিয়ে সে কঠিন আযাব তাদের সামনে হাযির দেখতে পাবে। এরশাদ হচ্ছে, হায় আফসােস মানুষের জন্যে… সেদিন সবাই আমার কাছে জড়াে হবে'(আয়াত ৩০-৩২)

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# প্রাচীন কুরআন ব্যাখ্যাদাতাগণ সাধারণভাবে এ মত পোষণ করেছেন যে, এ জনপদটি হচ্ছে সিরিয়ার ইন্তাকিয়া শহর। আর এখানে যে রসূলদের কথা বলা হয়েছে তাদেরকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে যে বিস্তারিত কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তাতে একথাও বলা হয়েছে যে, সে সময় ইন্তাখিশ ছিল এ এলাকার বাদশাহ। কিন্তু এ পুরো কাহিনীটিই ইবনে আব্বাস, কাতাদাহ, ইকরামাহ, কাবুল আহবার ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ প্রমুখ মনীষীগণ খৃস্টানদের অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে গ্রহণ করেছেন এবং ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ইন্তাকিয়ায় সালুতী পরিবারের (Seleuci dynasty) ১৩ জন বাদশাহ এনটিউকাস (Antiochus) নামে রাজ্য শাসন করেছিল। এ নামের শেষ শাসকের শাসন এবং সে সাথে গোটা পরিবারের শাসনকালও খৃস্টপূর্ব ৬৫ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যুগে ইন্তাকিয়াসহ সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের সমগ্র এলাকা রোমানদের শাসনাধীনে ছিল। তাছাড়া হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজেই তাঁর সহচরদেরকে ইসলাম প্রচারের জন্য ইন্তাকিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, খৃস্টানদের কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে এ মর্মে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে বাইবেলের ‘প্রেরিতদের কার্য’ অধ্যায় থেকে জানা যায়, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার কয়েক বছর পর খৃস্টান ধর্মপ্রচারকগণ প্রথমবার সেখানে পৌঁছেছিলেন। এখন একথা সুস্পষ্ট যে, যাদেরকে আল্লাহ‌ রসুল বানিয়ে পাঠাননি এবং আল্লাহ‌র রসূল যাদেরকে নিযুক্ত করেননি তারা যদি নিজস্ব উদ্যোগে ধর্মপ্রচারে বের হন, তাহলে কোন ধরনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে তাদেরকে আল্লাহ‌র রসূল গণ্য করা যেতে পারে না। তাছাড়া বাইবেলের বর্ণনা মতে ইন্তাকিয়া হচ্ছে প্রথম শহর যেখানকার অইসরাঈলিরা বিপুল সংখ্যায় ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং ঈসায়ী গীর্জা অসাধারণ সাফল্যের অধিকারী হয়েছিল। অথচ কুরআন এখানে যে জনপদটির কথা বলছে সেটি এমন একটি জনপদ ছিল যার অধিবাসীরা রসূলদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তার ফলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ‌র আযাবের শিকার হয়েছিল। ইন্তাকিয়া যে এমন ধরনের ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিল যাকে রিসালাত অস্বীকার করার কারণে আগত আযাব গণ্য করা যেতে পারে, তার কোন প্রমাণ ইতিহাসে নেই।

এসব কারণে জনবসতি বলে এখানে ইন্তাকিয়া বুঝানো হয়েছে একথা গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন বা হাদীসে এ জনবসতিটিকে চিহ্নিত করা হয়নি। এমনকি এ রসূলগণ কারা ছিলেন এবং কোন যুগে এদেরকে পাঠানো হয়েছিল, কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে একথাও জানা যায়নি। কুরআন মজীদ যে উদ্দেশ্যে এ কাহিনী এখানে বর্ণনা করছে তা বুঝার জন্য জনপদের ও রসূলদের নাম জানার কোন প্রয়োজন নেই। কাহিনী বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরাইশদেরকে একথা জানানো যে, তোমরা হঠকারিতা ও সত্য অস্বীকার করার সে একই নীতির ওপর চলছো যার ওপর চলেছিল এ জনপদের লোকেরা এবং তারা যে পরিণাম ভোগ করেছিল সে একই পরিণামের সম্মুখীন হবার জন্য তোমরা প্রস্তুতি নিচ্ছো।
# অন্য কথায় তাদের বক্তব্য ছিল, তোমরা যেহেতু মানুষ, কাজেই তোমরা আল্লাহ‌ প্রেরিত রসূল হতে পারো না। মক্কার কাফেররাও এ একই ধারণা করতো। তারা বলতো, মুহাম্মাদ ﷺ রসূল, নন, কারণ তিনি মানুষঃ

وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ

“তারা বলে, এ কেমন রসূল, যে খাবার খায় এবং বাজারে চলাফেরা করে।” (আল ফুরকান, ৭)

وَأَسَرُّوا النَّجْوَى الَّذِينَ ظَلَمُوا هَلْ هَذَا إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ أَفَتَأْتُونَ السِّحْرَ وَأَنْتُمْ تُبْصِرُونَ

“আর জালেমরা পরস্পর কানাঘুষা করে যে, এ ব্যক্তি ( অর্থাৎ মুহাম্মাদ ﷺ ) তোমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কি! তারপর কি তোমরা চোখে দেখা এ যাদুর শিকার হয়ে যাবে? ” (আল আম্বিয়া, ৩)

কুরআন মজীদ মক্কার কাফেরদের এ জাহেলী চিন্তার প্রতিবাদ করে বলে, এটা কোন নতুন জাহেলিয়াত নয়। আজ প্রথমবার এ লোকদের থেকে এর প্রকাশ হচ্ছে না। বরং অতি প্রাচীনকাল থেকে সকল মূর্খ ও অজ্ঞের দল এ বিভ্রান্তির শিকার ছিল যে, মানুষ রসূল হতে পারে না এবং রসূল মানুষ হতে পারে না। নূহের (আঃ) জাতির সরদাররা যখন হযরত নূহের রিসালাত অস্বীকার করেছিল তখন তারাও একথাই বলেছিলঃ

مَا هَذَا إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُرِيدُ أَنْ يَتَفَضَّلَ عَلَيْكُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَأَنْزَلَ مَلَائِكَةً مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي آبَائِنَا الْأَوَّلِينَ

“এ ব্যক্তি তোমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। সে চায় তোমাদের ওপর তার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে। অথচ আল্লাহ‌ চাইলে ফেরেশতা নাযিল করতেন। আমরা কখনো নিজেদের বাপ-দাদাদের মুখে একথা শুনিনি।” (আল মু’মিনূন, ২৪)

আদ জাতি একথাই হযরত হূদ (আঃ) সম্পর্কে বলেছিলঃ

مَا هَذَا إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يَأْكُلُ مِمَّا تَأْكُلُونَ مِنْهُ وَيَشْرَبُ مِمَّا تَشْرَبُونَ – وَلَئِنْ أَطَعْتُمْ بَشَرًا مِثْلَكُمْ إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ

“এ ব্যক্তি তোমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। সে তাই খায় যা তোমরা খাও এবং পান করে তাই যা তোমরা পান করো। এখন যদি তোমরা নিজেদেরই মতো একজন মানুষের আনুগত্য করো তাহলে তোমরা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (আল মু’মিনূন, ৩৩-৩৪)

সামূদ জাতি হযরত সালেহ (আঃ) সম্পর্কেও এ একই কথা বলেছিলঃ

أَبَشَرًا مِنَّا وَاحِدًا نَتَّبِعُهُ “আমরা কি আমাদের মধ্য থেকে একজন মানুষের আনুগত্য করবো?” (ক্বামার, ২৪) আর প্রায় সকল নবীর সাথেই এরূপ ব্যবহার করা হয়। কাফেররা বলেঃ إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا

“তোমরা আমাদেরই মতো মানুষ ছাড়া আর কিছুই নও।” নবীগণ তাদের জবাবে বলেনঃ

إِنْ نَحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ

“অবশ্যই আমরা তোমাদের মতো মানুষ ছাড়া আর কিছুই নই। কিন্তু আল্লাহ‌ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার প্রতি চান অনুগ্রহ বর্ষণ করেন।” (ইবরাহীম, ১১)

এরপর কুরআন মজীদ বলছে, এ জাহেলী চিন্তাধারা প্রতি যুগে লোকদের হিদায়াত গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে এবং এরই কারণে বিভিন্ন জাতির জীবনে ধ্বংস নেমে এসেছেঃ

أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَبَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ فَذَاقُوا وَبَالَ أَمْرِهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ – ذَلِكَ بِأَنَّهُ كَانَتْ تَأْتِيهِمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَقَالُوا أَبَشَرٌ يَهْدُونَنَا فَكَفَرُوا وَتَوَلَّوْا

“তোমাদের কাছে কি এমন লোকদের খবর পৌঁছেনি? যারা ইতিপূর্বে কুফরী করেছিল তারপর নিজেদের কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করে নিয়েছে এবং সামনে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এসব কিছু হয়েছে এজন্য যে, তাদের কাছে তাদের রসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসতে থেকেছে কিন্তু তারা বলেছে, “এখন কি মানুষ আমাদের পথ দেখাবে? এ কারণে তারা কুফরী করেছে এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।” (আত তাগাবুন, ৫-৬)

وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُؤْمِنُوا إِذْ جَاءَهُمُ الْهُدَى إِلَّا أَنْ قَالُوا أَبَعَثَ اللَّهُ بَشَرًا رَسُولًا

“লোকদের কাছে যখন হিদায়াত এলো তখন এ অজুহাত ছাড়া আর কোন জিনিস তাদের ঈমান আনা থেকে বিরত রাখেনি যে, তারা বললো, “আল্লাহ্‌ মানুষকে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন?” (বনী ইসরাঈল, ৯৪)

তারপর কুরআন মজীদ সুস্পষ্টভাবে বলছে, আল্লাহ‌ চিরকাল মানুষদেরকেই রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন এবং মানুষের হিদায়াতের জন্য মানুষই রসূল হতে পারে। কোন ফেরেশতা বা মানুষের চেয়ে উচ্চতর কোন সত্ত্বা এ দায়িত্ব পালন করতে পারে নাঃ وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ – وَمَا جَعَلْنَاهُمْ جَسَدًا لَا يَأْكُلُونَ الطَّعَامَ وَمَا كَانُوا خَالِدِينَ “তোমার পূর্বে আমি মানুষদেরকে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছি, যাদের কাছে আমি অহি পাঠাতাম। যদি তোমরা না জানো তাহলে জ্ঞানবানদেরকে জিজ্ঞেস করো। আর তারা আহার করবে না এবং চিরকাল জীবিত থাকবে, এমন শরীর দিয়ে তাদেরকে আমি সৃষ্টি করিনি।” (আল আম্বিয়া, ৭-৮)

وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا إِنَّهُمْ لَيَأْكُلُونَ الطَّعَامَ وَيَمْشُونَ فِي الْأَسْوَاقِ

“আমি তোমার পূর্বে যে রসূলই পাঠিয়েছিলাম তারা সবাই আহার করতো এবং বাজারে চলাফেরা করতো।” (আল ফুরকান, ২০)

قُلْ لَوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ مَلَكًا رَسُولًا

“হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, যদি পৃথিবীতে ফেরেশতারা নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে থাকতো, তাহলে আমি তাদের প্রতি ফেরেশতাদেরকেই রসূল বানিয়ে নাযিল করতাম।” (বনী ইসরাঈল, ৯৫)
# এটি আরো একটি মূর্খতা ও অজ্ঞতা। মক্কার কাফেররা এ মূর্খতা ও অজ্ঞতায় লিপ্ত ছিল। বর্তমান কালের তথাকথিত মুক্ত বুদ্ধির প্রবক্তারাও এতে লিপ্ত রয়েছে এবং প্রাচীনতম কাল থেকে প্রত্যেক যুগের অহী ও রিসালাত অস্বীকারকারীরা এতে লিপ্ত থেকেছে। চিরকাল এদের সবার চিন্তা ছিল, মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ‌ আদতে কোন অহী নাযিল করেন না। তিনি কেবলমাত্র উর্ধ্ব জগতের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত। মানুষদের ব্যাপার মানুষদের নিজেদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন।
# রব্বুল আলামীন তোমাদের কাছে যে পয়গাম পৌঁছিয়ে দেবার জন্য আমাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ আমাদের নেই। এরপর তা মেনে নেয়া বা না মেনে নেয়া তোমাদের ইচ্ছাধীন। তোমাদের ওপর বল প্রয়োগ করে মেনে নিতে বাধ্য করার দায়িত্ব আমাদের ওপর সোপর্দ করা হয়নি। আর তোমরা না মেনে নিলে তোমাদের কুফরীর কারণে আমরা পাকড়াও হবো না। বরং তোমাদের এ অপরাধের জন্য তোমাদের নিজেদেরকেই জবাবদিহি করতে হবে।
# তাদের এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল একথা বুঝানো যে, তোমরা আমাদের জন্য কুলক্ষুণে ও অশুভ। তোমরা এসে আমাদের উপাস্য দেবতাদের বিরুদ্ধে যেসব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছো তার ফলে দেবতারা আমাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে এবং এখন আমাদের ওপর যেসব বিপদ আসছে তা আসছে তোমাদেরই বদৌলতে। ঠিক এ একই কথাই আরবের কাফের ও মুনাফিকরা নবী ﷺ এর বিরুদ্ধে বলতোঃ

وَإِنْ تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ يَقُولُوا هَذِهِ مِنْ عِنْدِ

“যদি তারা কোন কষ্টের সম্মুখীন হতো, তাহলে বলতো, এটা হয়েছে তোমার কারণে।”(আন নিসা, ৭৮)

তাই কুরআন মজীদে বিভিন্ন স্থানে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ ধরনের জাহেলী কথাবার্তাই প্রাচীন যুগের লোকেরাও তাদের নবীদের সম্পর্কে বলতো। সামূদ জাতি তাদের নবীকে বলতো اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَنْ مَعَكَ “আমরা তোমাকে ও তোমার সাথীদেরকে অমঙ্গলজনক পেয়েছি।” (আন্ নামলঃ ৪৭)

আর ফেরাউনের জাতিও এ একই মনোভাবের অধিকারী ছিলঃ

فَإِذَا جَاءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوا لَنَا هَذِهِ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوا بِمُوسَى وَمَنْ مَعَهُ

“যখন তারা ভালো অবস্থায় থাকে তখন বলে, এটা আমাদের সৌভাগ্যের ফল এবং তাদের ওপর কোন বিপদ এলে তাকে মূসা ও তাঁর সাথীদের অলক্ষুণের ফল গণ্য করতো। (আল আরাফ, ১৩১)
# কেউ কারোর জন্য অপয়া ও অলক্ষণ নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির তাকদীরের লিখন তার নিজেরই গলায় ঝুলছে। কোন অকল্যাণ ও অঘটন ঘটলে তা হয় তার নিজের তাকদীরের ফল এবং শুভ ও কল্যাণকর কিছু ঘটলে তাও হয় তার তাকদীরের ফল।

وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ – بنى اسرائيل – 13

“প্রত্যেক ব্যক্তির কল্যাণ ও অকল্যাণের পরোয়ানা আমি তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছি।”

# আসলে তোমরা কল্যাণ থেকে পালাতে চাও এবং হিদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহী পছন্দ করো। তাই তোমরা যুক্তির মাধ্যমে হক ও বাতিলের ফায়সালা করার পরিবর্তে কুসংস্কার ও পৌরানিক ভাব কল্পনার মাধ্যমে বাহানাবাজি করছো।
# এ একটি বাক্যের মাধ্যমেই সেই ব্যক্তি নবুওয়াতের সত্যতার সপক্ষে সমস্ত যুক্তি বর্ণনা করে দিয়েছেন। দু’টি কথার মাধ্যমেই একজন নবীর সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে। এক, তাঁর কথা ও কাজ। দুই, তাঁর নিঃস্বার্থপর হওয়া। সে ব্যক্তির যুক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, প্রথমত তাঁরা একটি ন্যায়সঙ্গত কথা বলছেন এবং তাঁদের নিজেদের চরিত্র একেবারে নিষ্কলুষ। দ্বিতীয়ত তাঁরা নিজেদের কোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এ দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছেন একথা কেউ চিহ্নিত করতে পারবে না। এরপর তাঁদের কথা কেন মেনে নেয়া হবে না তার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সে ব্যক্তির এ যুক্তি উদ্ধৃত করে কুরআন মজীদ লোকদের সামনে একটি মানদণ্ড তুলে ধরেছে যে, নবীর নবুওয়াত যাচাই করতে হলে এরই নিরিখে যাচাই করো। মুহাম্মাদ ﷺ এর কথা ও কাজ একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, তিনি সঠিক পথে রয়েছেন এবং তাছাড়া তাঁর প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের পেছনে কোন ব্যক্তিগত স্বার্থের লেশমাত্রও নেই। এরপর কোন বিবেকবান ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি তাঁদের কথা প্রত্যাখ্যান করবে কিসের ভিত্তিতে?
# এ বাক্যটি দু’টি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশটিতে রয়েছে উন্নত যুক্তিবাদিতা এবং দ্বিতীয় অংশে সত্য প্রচারের সর্বোত্তম কৌশলের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। প্রথম অংশে তিনি বলছেন, স্রষ্টার বন্দেগী করা বুদ্ধি ও প্রকৃতির দাবীর নামান্তর মাত্র। অযৌক্তিক কথা যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে যারা মানুষ সৃষ্টি করেনি মানুষ তাদের বন্দেগী করবে এটাই অযৌক্তিক। যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন মানুষ তাঁর বন্দেগী করবে, এটা অযৌক্তিক নয়। দ্বিতীয় অংশে তিনি নিজের জাতির লোকদের মধ্যে এ অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন যে, তোমাদের একদিন মরতে তো হবেই এবং যে আল্লাহ‌র বন্দেগী করতে আজ তোমাদের আপত্তি তখন তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে। এখন তোমরা নিজেরাই ভেবে দেখো, তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তোমরা কোন্‌ কল্যাণের আশা পোষণ করতে পারো।
# তারা আল্লাহর এত প্রিয়ও নয় যে, আমি সুস্পষ্ট অপরাধ করবো এবং তিনি নিছক তাদের সুপারিশে আমাকে মাফ করে দেবেন। আবার তাদের এত শক্তিও নেই যে, আল্লাহ‌ আমাকে শাস্তি দিতে চান এবং তারা নিছক নিজেদের শক্তির জোরে আমাকে তাঁর কবল থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারেন।
# এ বাক্যের মধ্যে আবার সত্য প্রচারের একটি সূক্ষ্ম কৌশলের অবতারণা করা হয়েছে। একথা বলে সে ব্যক্তি তাদের অনুভূতিকে এভাবে সজাগ করেন যে, আমি যে রবের প্রতি ঈমান এনেছি তিনি কেবল আমারই রব নন বরং তোমাদেরও রব। তাঁর প্রতি ঈমান এনে আমি ভুল করিনি বরং তাঁর প্রতি ঈমান না এনে তোমরাই ভুল করছো।
# শাহাদাতের সৌভাগ্য লাভ করার সাথে সাথেই তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হলো। যখনই মৃত্যুর দরজা পার হয়ে তিনি অন্য জগতে পৌঁছে গেলেন, ফেরেশতারা সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত ছিলেন এবং তারা তখনই তাঁকে এ মর্মে সুসংবাদ দিয়ে দিলেন যে, সুসজ্জিত বেহেশত তাঁর অপেক্ষায় রয়েছে। এ বাক্যটির ব্যাখ্যার ব্যাপারে মুফাস্‌সিরদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। কাতাদাহ বলেন, “আল্লাহ্‌ তখনই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন, তিনি সেখানে জীবিত রয়েছেন এবং আহার লাভ করছেন।” অন্যদিকে মুজাহিদ বলেন, “ফেরেশতারা একথা সুসংবাদ হিসেবে তাঁকে জানিয়ে দেন এবং এর অর্থ হচ্ছে, কিয়ামতের পরে যখন সকল মু’মিন জান্নাতে প্রবেশ করবেন তখন তিনিও তাদের সাথে প্রবেশ করবেন।”
# এটি সেই মু’মিন ব্যক্তির উন্নত নৈতিক মানসিকতার একটি শ্রেষ্ঠতম আদর্শ। যারা এ মাত্র হত্যা কর্ম সংঘটিত করেছিল তাদের বিরুদ্ধে তাঁর মনে কোন ক্রোধ ও প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল না। তিনি আল্লাহ‌র কাছে তাদের জন্য কোন বদদোয়া করছেন না। এর পরিবর্তে তিনি এখনো তাদের কল্যাণ কামনা করে চলছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর মনে যদি কোন আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়ে থাকে তাহলে তা ছিল কেবলমাত্র এতটুকু যে, হায়, আমার জাতি যদি আমার এ শুভ পরিণাম জানতে পারতো এবং আমার জীবন থেকে না হলেও আমার মৃত্যু থেকেও যদি শিক্ষা নিয়ে সত্য-সঠিক পথ অবলম্বন করতো। এ ভদ্র-বিবেকবান মানুষটি নিজের হত্যাকারীদের জন্যও জাহান্নামের প্রত্যাশা করতেন না। বরং তিনি চাইতেন তারা ঈমান এনে জান্নাতের অধিকারী হোক। এরই প্রশংসা করে হাদীসে বলা হয়েছে,نصح قومه حيا وميتا “এ ব্যক্তি জীবিত অবস্থায়ও নিজের জাতির কল্যাণকামী থেকেছে এবং মৃত্যুর পরও।”

এ ঘটনাটি বর্ণনা করে মহান আল্লাহ‌ মক্কার কাফেরদেরকে পরোক্ষভাবে এ সত্যটির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর সাথী মু’মিনরাও তোমাদের ঠিক তেমনি যথার্থ কল্যাণকামী যেমন এ মর্দে মু’মিন তাঁর জাতির কল্যাণকামী ছিল। তোমাদের সকল প্রকার উৎপীড়ন-নিপীড়ন সত্ত্বেও এরা তোমাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ স্পৃহা পোষণ করে না। তোমাদের সাথে এদের শত্রুতা নেই। ববরং এদের শত্রুতা তোমাদের গোমরাহীর সাথে। তোমরা সত্য-সঠিক পথে ফিরে আসবে, কেবল এজন্যই এরা লড়াই করছে। এছাড়া এদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই।

যেসব আয়াত থেকে বরযখের (মৃত্যের পর থেকে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত) জীবনের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় এ আয়াতটি তার অন্যতম। এ থেকে জানা যায় মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়-কাল চূড়ান্ত অস্তিত্ব বিলুপ্তির যুগ নয়। কোন কোন স্বল্পজ্ঞান-সম্পন্ন লোক এরকম ধারণা পোষণ করে থাকে। বরং এ সময় দেহ ছাড়াই প্রাণ জীবিত থাকে, কথা বলে ও কথা শোনে, আবেগ-অনুভূতি পোষণ করে, আনন্দ ও দুঃখ অনুভব করে এবং দুনিয়াবাসীদের ব্যাপারেও তার আগ্রহ অব্যাহত থাকে। যদি এমনটি না হতো, তাহলে মৃত্যুর পর এ মর্দে মু’মিনকে কেমন করে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয় এবং তিনিই বা কেমন করে তাঁর জাতির জন্য এ আকাঙ্ক্ষা করেন যে, হায়, যদি তারা তাঁর এ শুভ পরিণাম সম্পর্কে জানতে পারতো।

# মুল শব্দটি হচ্ছে “নিভে গেল”। এ শব্দের মধ্যে রয়েছে একটি সূক্ষ্ম ব্যাঙ্গ। নিজেদের শক্তির জন্য তাদের অহংকার এবং সত্যদ্বীনের বিরুদ্ধে তাদের সমস্ত ক্ষোভ ও আক্রোশ ছিল যেন একটি জলন্ত অগ্নিশিখা। তারা মনে করছিল, এটি ঐ তিন জন নবী ও তাঁদের অনুসারীদেরকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেবে। কিন্তু আল্লাহ‌র আযাবের একটি আঘাতেই এ অগ্নিশিখা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
# এমন ভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে যে, কোথাও তাদের সামান্যতম চিহ্নও নেই। যে একবার পড়ে গেছে সে আর ওঠেনি। দুনিয়ায় আজ তাদের নাম নেবার মতো একজন লোকও বেঁচে নেই। তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিই নয়, তাদের বংশধারাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

Leave a Reply