(বই#১০৭৪) [এরূপ সাফল্যের জন্য সাধনা করা উচিত:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৭:সাফফাত পারা:২৩ ৪০- ৭৪ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭৪)
[এরূপ সাফল্যের জন্য সাধনা করা উচিত:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৭:সাফফাত
পারা:২৩
৪০- ৭৪ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪০
اِلَّا عِبَادَ اللّٰہِ الۡمُخۡلَصِیۡنَ ﴿۴۰﴾
তবে তারা নয়, যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪১
اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ رِزۡقٌ مَّعۡلُوۡمٌ ﴿ۙ۴۱﴾
তাদের জন্য রয়েছে জ্ঞাত রিযিক,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪২
فَوَاکِہُ ۚ وَ ہُمۡ مُّکۡرَمُوۡنَ ﴿ۙ۴۲﴾
সব রকমের সুস্বাদু জিনিস যেখানে তাদেরকে মর্যাদা সহকারে রাখা হবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪৩
فِیۡ جَنّٰتِ النَّعِیۡمِ ﴿ۙ۴۳﴾
নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতের মধ্যে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪৪
عَلٰی سُرُرٍ مُّتَقٰبِلِیۡنَ ﴿۴۴﴾
তারা মুখোমুখি হয়ে পালঙ্কে আসীন হবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪৫
یُطَافُ عَلَیۡہِمۡ بِکَاۡسٍ مِّنۡ مَّعِیۡنٍۭ ﴿ۙ۴۵﴾
তাদেরকে ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে প্রবাহিত (শারাবের) পানপাত্র,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪৬
بَیۡضَآءَ لَذَّۃٍ لِّلشّٰرِبِیۡنَ ﴿ۚۖ۴۶﴾
যা হবে শুভ্র উজ্জ্বল, পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪৭
لَا فِیۡہَا غَوۡلٌ وَّ لَا ہُمۡ عَنۡہَا یُنۡزَفُوۡنَ ﴿۴۷﴾
ওতে ক্ষতিকর কিছুই থাকবে না এবং ওতে তারা নেশাগ্রস্তও হবে না,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪৮
وَ عِنۡدَہُمۡ قٰصِرٰتُ الطَّرۡفِ عِیۡنٌ ﴿ۙ۴۸﴾
তাদের সঙ্গে থাকবে আনতনয়না ডাগর চোখ বিশিষ্টা।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৪৯
کَاَنَّہُنَّ بَیۡضٌ مَّکۡنُوۡنٌ ﴿۴۹﴾
এমন নাজুক যেমন হয় ডিমের খোসার নিচে লুকানো ঝিল্লি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫০
فَاَقۡبَلَ بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ یَّتَسَآءَلُوۡنَ ﴿۵۰﴾
তারপর তারা একজন অন্যজনের দিকে ফিরে অবস্থা জিজ্ঞেস করবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫১
قَالَ قَآئِلٌ مِّنۡہُمۡ اِنِّیۡ کَانَ لِیۡ قَرِیۡنٌ ﴿ۙ۵۱﴾
তাদের কেউ বলবে, ‘আমার ছিল এক সঙ্গী;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫২
یَّقُوۡلُ اَئِنَّکَ لَمِنَ الۡمُصَدِّقِیۡنَ ﴿۵۲﴾
সে আমাকে বলতো, তুমিও কি সত্য বলে মেনে নেবার দলে?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫৩
ءَ اِذَا مِتۡنَا وَ کُنَّا تُرَابًا وَّ عِظَامًا ءَ اِنَّا لَمَدِیۡنُوۡنَ ﴿۵۳﴾
যখন আমরা মরে যাবো, মাটির সাথে মিশে যাবো এবং অস্থি পিঞ্জরই থেকে যাবে তখন সত্যিই কি আমাদের শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫৪
قَالَ ہَلۡ اَنۡتُمۡ مُّطَّلِعُوۡنَ ﴿۵۴﴾
আল্লাহ্‌ বলবেন, ‘তোমরা কি তাকে দেখতে চাও?’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫৫
فَاطَّلَعَ فَرَاٰہُ فِیۡ سَوَآءِ الۡجَحِیۡمِ ﴿۵۵﴾
এ বলে যেমনি সে নিচের দিকে ঝুঁকবে তখনই দেখবে তাকে জাহান্নামের অতল গভীরে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫৬
قَالَ تَاللّٰہِ اِنۡ کِدۡتَّ لَتُرۡدِیۡنِ ﴿ۙ۵۶﴾
বলবে, ‘আল্লাহর কসম! তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংসই করেছিলে,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫৭
وَ لَوۡ لَا نِعۡمَۃُ رَبِّیۡ لَکُنۡتُ مِنَ الۡمُحۡضَرِیۡنَ ﴿۵۷﴾
আমার রবের মেহেরবাণী না হলে আজ আমিও যারা পাকড়াও হয়ে এসেছে তাদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫৮
اَفَمَا نَحۡنُ بِمَیِّتِیۡنَ ﴿ۙ۵۸﴾
আচ্ছা, তাহলে কি এখন আমরা আর মরবো না?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৫৯
اِلَّا مَوۡتَتَنَا الۡاُوۡلٰی وَ مَا نَحۡنُ بِمُعَذَّبِیۡنَ ﴿۵۹﴾
প্রথম মৃত্যুর পর এবং আমাদেরকে শাস্তিও দেয়া হবে না !’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬০
اِنَّ ہٰذَا لَہُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ﴿۶۰﴾
নিশ্চয়ই এ মহাসাফল্য।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬১
لِمِثۡلِ ہٰذَا فَلۡیَعۡمَلِ الۡعٰمِلُوۡنَ ﴿۶۱﴾
এরূপ সাফল্যের জন্য সাধকদের সাধনা করা উচিত,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬২
اَذٰلِکَ خَیۡرٌ نُّزُلًا اَمۡ شَجَرَۃُ الزَّقُّوۡمِ ﴿۶۲﴾
আপ্যায়নের জন্য কি এটিই উত্তম, না যাক্কুম বৃক্ষ?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬৩
اِنَّا جَعَلۡنٰہَا فِتۡنَۃً لِّلظّٰلِمِیۡنَ ﴿۶۳﴾
সীমালংঘনকারীদের জন্য আমি এ সৃষ্টি করেছি পরীক্ষাস্বরূপ;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬৪
اِنَّہَا شَجَرَۃٌ تَخۡرُجُ فِیۡۤ اَصۡلِ الۡجَحِیۡمِ ﴿ۙ۶۴﴾
এ বৃক্ষ জাহান্নামের তলদেশ হতে উদগত হয়,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬৫
طَلۡعُہَا کَاَنَّہٗ رُءُوۡسُ الشَّیٰطِیۡنِ ﴿۶۵﴾
এর মোচা যেন শয়তানের মাথা,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬৬
فَاِنَّہُمۡ لَاٰکِلُوۡنَ مِنۡہَا فَمَالِـُٔوۡنَ مِنۡہَا الۡبُطُوۡنَ ﴿ؕ۶۶﴾
জাহান্নামের অধিবাসীরা তা খাবে এবং তা দিয়ে পেট ভরবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬৭
ثُمَّ اِنَّ لَہُمۡ عَلَیۡہَا لَشَوۡبًا مِّنۡ حَمِیۡمٍ ﴿ۚ۶۷﴾
তদুপরি তাদের জন্য থাকবে ফুটন্ত পানির মিশ্রণ।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬৮
ثُمَّ اِنَّ مَرۡجِعَہُمۡ لَا۠ اِلَی الۡجَحِیۡمِ ﴿۶۸﴾
এরপর তাদের প্রত্যাবর্তন হবে। এ অগ্নিময় দোজখের দিকে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৬৯
اِنَّہُمۡ اَلۡفَوۡا اٰبَآءَہُمۡ ضَآلِّیۡنَ ﴿ۙ۶۹﴾
এরা এমনসব লোক যারা নিজেদের বাপ-দাদাদেরকে পথভ্রষ্ট পেয়েছে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৭০
فَہُمۡ عَلٰۤی اٰثٰرِہِمۡ یُہۡرَعُوۡنَ ﴿۷۰﴾
এবং নির্বিচারে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৭১
وَ لَقَدۡ ضَلَّ قَبۡلَہُمۡ اَکۡثَرُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿ۙ۷۱﴾
ওদের পূর্বেও অধিকাংশ পূর্ববর্তীরা বিপথগামী হয়েছিল,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৭২
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا فِیۡہِمۡ مُّنۡذِرِیۡنَ ﴿۷۲﴾
এবং আমি অবশ্যই ওদের মধ্যে সতর্ককারী প্রেরণ করেছিলাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৭৩
فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُنۡذَرِیۡنَ ﴿ۙ۷۳﴾
সুতরাং লক্ষ্য কর, যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল, তাদের পরিণাম কি হয়েছিল?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত -৭৪
اِلَّا عِبَادَ اللّٰہِ الۡمُخۡلَصِیۡنَ ﴿٪۷۴﴾
তবে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের কথা স্বতন্ত্র ।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪০-৪৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

পূর্বের আয়াতগুলোতে কাফির-মুশরিকদের শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করার পর এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর একনিষ্ঠ মু’মিন বান্দারা পরকালে যে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে থাকবে তার বিবরণ তুলে ধরেছেন। জান্নাতীরা জান্নাতে পরম সুখে বসবাস করবে। তাদের জন্য সেখানে থাকবে অপরিমেয় রিযিক, ফল-মূল আর তারা সেখানে সম্মানের সাথে থাকবে। সুখময় বাগানসমূহে তারা পরস্পর মুখোমুখী হয়ে বসে থাকবে। তাদেরকে তথায় পরিবেশন করা হবে বিশুদ্ধ সুরাপূর্ণ পান পাত্র।

كاس মদভর্তি পান পাত্রকে বলা হয়। مَعِيْنٍ হলো প্রবাহিত ঝর্ণা।

অর্থাৎ- প্রবাহিত ঝর্ণার ন্যায় জান্নাতে সর্বদা শরাব বা পানীয় দ্রব্য পাওয়া যাবে। আর সে শরাব হবে শুভ্র, উজ্জ্বল এবং পানকারীদের জন্য সুস্বাদু। যা পান করলে পানকারীগণ মাতাল হবে না এবং কোন প্রকার ক্ষতিও হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(یَطُوْفُ عَلَیْھِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُوْنَﭠﺫ بِاَکْوَابٍ وَّاَبَارِیْقَﺃ وَکَاْسٍ مِّنْ مَّعِیْنٍﭡﺫ لَّا یُصَدَّعُوْنَ عَنْھَا وَلَا یُنْزِفُوْنَﭢﺫ )‏

“তাদের সেবায় ঘোরাফেরা করবে চির কিশোররা। পানপাত্র, ঘটি ও শরাবে পরিপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে, (এরা হাজির হবে।) সেই সুরা পানে তাদের মাথা ব্যথা হবে না, তারা জ্ঞানহারাও হবে না।” (সূরা ওয়া-ক্বি‘আহ্ ৫৬ : ১৭-১৯)

এরপর বলা হচ্ছে যে, জান্নাতে জান্নাতীদের জন্য থাকবে আনতনয়না, আয়তলোচনা অর্থাৎ- বড় ও টানা টানা চক্ষুবিশিষ্ট হুর/তরুণীগণ, তাদেরকে মনে হবে যেন তারা সুরক্ষিত মণি-মুক্তার মতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَحُوْرٌ عِيْنٌ-‏ كَأَمْثَالِ الْلُّؤْلُؤِ الْمَكْنُوْنِ)

“আর (তাদের জন্য থাকবে) সুন্দর চক্ষুধারী হূর, সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ।” (সূরা ওয়া-ক্বি‘আহ্ ৫৬ : ২২-২৩) এ আয়াতে জান্নাতী হুরদের তিনটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে যেগুলো হলো- ১. বড় বড় চক্ষু, ২. টানা টানা চক্ষু, ৩. মণি-মুক্ত/ডিমের মতো সুরক্ষিত হবে।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(فِيْهِنَّ قٰصِرٰتُ الطَّرْفِ لا لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنْسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَآنٌّ – فَبِأَيِّ اٰلَا۬ءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ – كَأَنَّهُنَّ الْيَاقُوْتُ وَالْمَرْجَانُ)

“সেখানে রয়েছে বহু আনতনয়না স্ত্রীগণ, যাদেরকে তাদের পূর্বে কোন মানুষ অথবা জিন স্পর্শ করেনি। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নেয়ামত অস্বীকার করবে? তারা যেন হীরা ও মতি; (সূরা র্আ রহমান ৫৫ : ৫৬-৫৮)

সুতরাং এরূপ নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত পেতে হলে অবশ্যই ঈমানের সাথে সৎ আমল করতে হবে এবং ঈমান বিনষ্টকারী কাজে লিপ্ত হওয়া যাবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. জান্নাতীদের জন্য তথায় সকল প্রকার পানীয় পানের ব্যবস্থা থাকবে।
২. জান্নাতে অনন্যা সুন্দরী হুরগণ থাকবে, যারা আনয়তনয়না ও আনুগত্যশীলা হবে।

৫০-৬১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতীদের আরও কিছু অবস্থা বর্ণনা করছেন, তারা জান্নাতে যাওয়ার পর পরস্পর মুখোমুখী হয়ে একজন অন্যজনের দুনিয়ার অবস্থা বর্ণনা করবে এবং দুনিয়ায় তার যে সকল বন্ধু-বান্ধব ছিল তাদের কথাও বলবে। জনৈক জান্নাতী দুনিয়ার একজন বন্ধুর অবস্থা বর্ণনা করে বলবে : আমার একজন বন্ধু ছিল। সে পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করত এবং তা অসম্ভব মনে করত। তখন সে তার সাথীদেরকে বলবে : তোমরা কি তাকে উঁকি মেরে দেখতে চাও? তখন তারা তাকে দেখবে জাহান্নামের মধ্যে। আর তখন তারা মহান আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং বলবে- আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে পথ প্রদর্শন না করলে আমরাও ভ্রষ্ট হয়ে যেতাম। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَنَزَعْنَا مَا فِيْ صُدُوْرِهِمْ مِّنْ غِلٍّ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهٰرُ ج وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ هَدٰنَا لِهٰذَا قف وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلَآ أَنْ هَدٰنَا اللّٰهُ ج لَقَدْ جَا۬ءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ ط وَنُوْدُوْآ أَنْ تِلْكُمُ الْجَنَّةُ أُوْرِثْتُمُوْهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ)

“আমি তাদের অন্তর হতে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দেব, তাদের পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদী এবং তারা বলবে, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাদেরকে এর পথ দেখিয়েছেন। ‘আল্লাহ আমাদেরকে পথ না দেখালে আমরা কখনও পথ পেতাম না। আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ তো সত্যবাণীই নিয়ে এসেছিল,’ এবং তাদেরকে আহ্বান করে বলা হবে, ‘তোমরা যা করতে তারই জন্য তোমাদেরকে এ জান্নাতের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৪৩)

(أَفَمَا نَحْنُ بِمَيِّتِيْنَ)

জাহান্নামীদের এ অবস্থা দেখে জান্নাতীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলবে : আমরা যে জান্নাতী জীবন ও তাঁর নেয়ামত পেয়েছি তা কি চিরকালের জন্য নয়? সত্যই কি এখন আর আমাদের মৃত্যু আসবে না? এটা স্বীকৃতিসূচক জিজ্ঞাসা। অর্থাৎ এখন আমাদের এ জীবন চিরকালের জন্য। আমরা চিরকাল জান্নাতে এবং তোমরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। না তোমাদের মৃত্যু হবে যে, তোমরা জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে। আর না আমাদের মৃত্যু হবে যে, আমরা জান্নাতের নেয়ামতসমূহ থেকে বঞ্চিত হব। যেমন হাদীসে এসেছে “মৃত্যুকে একটি ভেড়ার আকৃতিতে জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে জবেহ করা হবে। ফলে কারো আর মৃত্যু হবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৪৭৩০)

(الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ) অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাত পাওয়াটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ الْمَوْتِ ط وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُوْرَكُمْ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ ط فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ط وَمَا الْحَيٰوةُ الدُّنْيَآ إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُوْرِ)

“সকল আত্মাই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী এবং নিশ্চয়ই কিয়ামত দিবসে তোমাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে; অতএব যে (জাহান্নামের) আগুন হতে মুক্ত হয়েছে ও জান্নাতে প্রবিষ্ট হয়েছে, ফলতঃ নিশ্চয়ই সে সফলকাম; আর পার্থিব জীবন প্রতারণার সম্পদ ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরা আলি ইমরান ৩ : ১৮৫) সুতরাং এ জান্নাত পাওয়ার জন্য প্রত্যেক আদম সন্তানকে ঈমানের সাথে সৎ আমল করা উচিত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. জান্নাতে জান্নাতীরা তাদের দুনিয়ার অবস্থা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করবে।
২. জান্নাতীরা জান্নাতে আর কোনদিন মৃত্যু বরণ করবে না। সেখানে তারা চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে।
৬২-৭৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

জান্নাতীদের খাবার, পানীয়, আরাম-আয়েশের অবস্থা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতসমূহে আবারো জাহান্নামীদের আরো কিছু অবস্থা বর্ণনা করেছেন। জাহান্নামীরা জাহান্নামে যাক্কুম নামক কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ ভক্ষণ করবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(ثُمَّ إِنَّكُمْ أَيُّهَا الضَّآلُّوْنَ الْمُكَذِّبُوْنَ -‏ لَاٰكِلُوْنَ مِنْ شَجَرٍ مِّنْ زَقُّوْمٍ)

“অতঃপর হে বিভ্রান্ত মিথ্যা প্রতিপন্নকারীরা! তোমরা অবশ্যই যাক্কূম বৃক্ষ হতে আহার করবে।” (সূরা ওয়া-ক্বি‘আহ্ ৫৬ : ৫১-৫২)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ বৃক্ষের বর্ণনা দিয়ে বলেন, এটি এমন একটি বৃক্ষ যা জাহান্নামের তলদেশ থেকে উদ্গত হয়, আর এর মোঁচা শয়তানের মাথার মতো। অপরাধীরা তা দ্বারা তাদের উদর পূর্ণ করবে। এ বৃক্ষ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

(وَإِذْ قُلْنَا لَكَ إِنَّ رَبَّكَ أَحَاطَ بِالنَّاسِ ط وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِيْٓ أَرَيْنٰكَ إِلَّا فِتْنَةً لِّلنَّاسِ وَالشَّجَرَةَ الْمَلْعُوْنَةَ فِي الْقُرْاٰنِ ط وَنُخَوِّفُهُمْ لا فَمَا يَزِيْدُهُمْ إِلَّا طُغْيَانًا كَبِيْرًا)‏

“স্মরণ কর‎, আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছেন। আমি যে দৃশ্য তোমাকে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে উল্লিখিত অভিশপ্ত বৃক্ষটিও কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্য। আমি তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করি, কিন্তু এটা তাদের ঘোর অবাধ্যতাই বৃদ্ধি করে।” (সূরা বানী ইসরা-ঈল ১৭ : ৬০)

তাদের জন্য তথায় এ বৃক্ষ ব্যতীত আর কোনই খাবার থাকবে না। যার ফলে তারা বাধ্য হয়ে এ বৃক্ষ ভক্ষণ করবে এবং পেট পূর্ণ করে নেবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(لَيْسَ لَهُمْ طَعَامٌ إِلَّا مِنْ ضَرِيْعٍ -‏ لَّا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِيْ مِنْ جُوْعٍ)‏

“তাদের জন্য বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত লতাগাছ ব্যতীত কোন খাদ্য নেই; যা তাদেরকে পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুধাও মেটাবে না।” (সূরা গা-শিয়াহ্ ৮৮ : ৬-৭) এবং তাদের জন্য সেখানে পানীয় হিসেবে থাকবে গরম পানি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : (يَطُوْفُوْنَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ حَمِيْمٍ اٰنٍ) “তারা জাহান্নামের ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটোছুটি করবে।” (সূরা র্আ রহ্মান ৫৫ : ৪৪) তাদের এ সকল শাস্তির কারণ হলো, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভ্রষ্ট নিয়ম-নীতির অনুসরণ করত। আল্লাহ তা‘আলার বিধি-বিধান মেনে চলত না, যার ফলে তারা এ শাস্তির হক্বদার হয়েছে। يهرعون শব্দটি يسرعون এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ত্বরা করা, দৌড়ানো, অতি আগ্রহের সাথে গ্রহণ করা বা লুফে নেয়া।

(وَلَقَدْ ضَلَّ قَبْلَهُمْ)

অর্থাৎ শুধু এরা পথভ্রষ্ট হয়নি, বরং তাদের পূর্ববর্তী অধিকাংশ মানুষই পথভ্রষ্ট ছিল।

(وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا فِيْهِمْ مُّنْذِرِيْنَ)

অর্থাৎ তাদের পূর্ববর্তী মানুষের নিকট সতর্ককারী রাসূল পাঠিয়েছিলাম। তারা সত্যের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন এবং তা গ্রহণ না করলে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির ব্যাপারে তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেছেন, কিন্তু আগত রাসূলদের দাওয়াতে তাদের ওপর কোন প্রভাব পড়েনি; পরিণামে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যেমন পরবর্তী আয়াতে তাদের শিক্ষামূলক পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

(إِلَّا عِبَادَ اللّٰهِ الْمُخْلَصِيْنَ)

অর্থাৎ শিক্ষামূলক পরিণতি থেকে শুধু তারাই নিস্কৃতি পেয়েছিল যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ঈমান ও তাওহীদ গ্রহণ করার তাওফীক দান করে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন।

مخلصين (বিশুদ্ধচিত্ত) ঐ সকল মানুষ যারা শাস্তি থেকে বেঁচেছিল। এক্ষণে منذرين (যে দলকে সতর্ক ও ধ্বংস করা হয়েছিল তাদের) বর্ণনার পর কিছু منذرين (সতর্ককারী) নাবীদের কথা বর্ণনা করা হচ্ছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. “যাক্কূম” নামক বৃক্ষ খেয়ে জাহান্নামীরা ক্ষুধা নিবারণ করতে চাইলেও তা হবে তাদের জন্য কষ্ট বৃদ্ধির কারণ।
২. দীনের বিধি-বিধান মেনে চলার সঠিক মূলনীতি হল কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর অনুসরণ করা, যেভাবে অনুসরণ করেছেন সালাফে সালেহীনগণ।
৩. জাহান্নামীদের এরূপ ন্যাক্কারজনক শাস্তি দেয়ার কারণ একটাই তা হল- তারা ঈমান আনেনি।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪০-৪৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা লোকদেরকে সম্বোধন করে বলছেনঃ তোমরা অবশ্যই বেদনাদায়ক শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করবে এবং তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল পাবে। এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় মনোনীত বান্দাদের এর থেকে পৃথক করে নিচ্ছেন যে, তারা নয় যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “মহাকাশের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে।”(১০৫: ১-৩) মহামহিমান্বিত আল্লাহ আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে। অতঃপর আমি তাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পরিণত করি, কিন্তু তাদেরকে নয় যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ।”(৯৬:৪-৬) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের প্রত্যেকেই ওটা (জাহান্নাম) অতিক্রম করবে, এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাকীদেরকে উদ্ধার করবো এবং যালিমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দিবো।”(১৯:৭১-৭২) অন্য এক জায়গায় প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ, তবে দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ব্যক্তিরা নয়।”(৭৪:৩৮-৩৯)

এজন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানে বলেনঃ “তারা নয় যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা।” বেদনাদায়ক শাস্তিতে পতিত ব্যক্তিদের হতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে পৃথক করে নিয়েছেন যাতে তারা কঠিন শা হিসাব-নিকাশের ভীষণ বিপদ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। তাদেরকে যাবতীয় বিপদাপদ থেকে দূরে রাখা হবে। আর ঐ সব বান্দার নেক আমলগুলোকে একটির বদলে দশগুণ তা হতে সাতশগুণ এমনকি আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছানুযায়ী আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়া হবে ।

আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ তাদের জন্যে আছে নির্ধারিত রিযক। কাতাদা (রাঃ) ও সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা জান্নাতকে বুঝানো হয়েছে। তা হবে নানা প্রকারের ফলে পরিপূর্ণ। সেখানে তারা হবে মহাসম্মানের অধিকারী। সুখদ কাননে তারা মুখোমুখি হয়ে আসনে সমাসীন থাকবে। মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ তারা এমনভাবে বসে থাকবে যে, কারো পৃষ্ঠ দেশ কেউ দেখতে পাবে না।

হযরত যায়েদ ইবনে আবি আওফা (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট হাযির হয়ে (আরবী)-এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন এবং বলেনঃ “প্রত্যেকে এমনভাবে সামনা সামনি হয়ে বসে থাকবে যে, তাদের দৃষ্টি পরস্পরের মুখমণ্ডলের উপর পতিত হবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি গারীব)

মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদেরকে ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে বিশুদ্ধ সুরাপূর্ণ পাত্র। প্রবাহিত শরাব হতে পূর্ণ পেয়ালা তাদের মধ্যে পরিবেশিত হবে। তা হবে ধবধবে সাদা ও সুমিষ্ট। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের সেবায় ঘোরাফিরা করবে চির কিশোরেরা পানপাত্র, কুজা প্রস্রবণ নিঃসৃত সুরাপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে। সেই সুরা পানে তাদের শিরঃপীড়া হবে , তারা জ্ঞান হারাও হবে না।”(৫৬:১৭-১৯) দুনিয়ার মদে এই ক্ষতি রয়েছে। যে, এটা পান করলে পেটে অসুখ হয়, মাথা ব্যথা হয় এবং জ্ঞান লোপ পায়। কিন্তু জান্নাতের সুরার মধ্যে এসব মন্দ গুণ কিছুই নেই। এর রঙ সুদৃশ্য এবং পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু। এর উল্টো হচ্ছে দুনিয়ার মদ। তাতে দুর্গন্ধ বিদ্যমান এবং রঙ দেখতেও ঘৃণাবোধ হয়।

এখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ জান্নাতের শরাব সম্পর্কে বলেনঃ তাতে ক্ষতিকর কিছুই থাকবে না। এবং তাতে তারা মাতালও হবে না। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ গুরুজনের মতে (আরবী) শব্দ দ্বারা পেটের ব্যথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ দুনিয়ার মদ্যপানে যেমন পেটের ব্যথা হয় জান্নাতের মদ্য পানে তা হবে না। কেউ কেউ বলেন যে, (আরবী) শব্দের অর্থ হলো শিরঃপীড়া। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, ঐ সুরা পানে জ্ঞান লোপ পাবে না। সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন যে, তাতে কোন ঘৃণার বস্তু থাকবে না এবং কোন কষ্টও হবে না। তবে হযরত মুজাহিদ প্রমুখ গুরুজনের উক্তিটিই সঠিক যে, (আরবী) শব্দ দ্বারা পেটের ব্যথাকে বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তাতে তারা মাতালও হবে না।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, শরাবে চারটি মন্দ গুণ রয়েছে। যেমন- মাতলামী, মাথা ব্যথা, বমন এবং মূত্র দোষ। মহামহিমান্বিত আল্লাহ জান্নাতের শরাবের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, তাতে উক্ত দোষগুলোর একটিও থাকবে না।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদের সঙ্গে থাকবে আনত নয়না, আয়ত লোচনা হুরীগণ। তারা নিজেদের স্বামীদের ছাড়া আর কারো চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করবে না। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ গুরুজন এই মত পোষণ করেন। (আরবী) অর্থ সুলোচনা। কেউ কেউ বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে বড় চক্ষু। আর একটি অর্থ হলো আনত নয়না। অবশ্য এটা সৌন্দর্যের চরম বিকাশ ও উত্তম চরিত্রের পরিচায়ক। জুলাইখা হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর মধ্যে এই উভয়বিধ সৌন্দর্য দেখেছিলেন। একদা জুলাইখা হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে উত্তমরূপে সাজিয়ে মিসরের ভদ্র মহিলাদের সামনে হাযির করেন। তারা নবী (আঃ)-এর রূপ ও চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য দেখে বলে উঠেছিলঃ “অদ্ভূত আল্লাহর মাহাত্ম্য! এতো মানুষ নয়, এতো এক মহিমান্বিত ফেরেশতা?” জুলাইখা তখন বলেছিলেনঃ “এ-ই সে যার সম্বন্ধে তোমরা আমার নিন্দে করেছে। আমি তো তা হতে অসঙ্কর্ম কামনা করেছি, কিন্তু সে নিজেকে পবিত্র রেখেছে।” তিনি বাহ্যিক সৌন্দর্যের সাথে আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যও বহাল রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন অতি সৎ, পবিত্র, বিশ্বস্ত, পুণ্যবান এবং আল্লাহভীরু। জান্নাতী হুরীরাও ঠিক অনুরূপ। তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেনঃ তারা যেন সুরক্ষিত ডিম্ব। তারা সুন্দর তনুধারিণী উজ্জ্বল গৌর বর্ণের সঙ্গিনী।

আলী ইবনে আবি তালহা (রাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, (আরবী)-এর অর্থ হচ্ছে (আরবী) অর্থাৎ “যেন তারা রক্ষিত মুক্তা।” এর স্বপক্ষে কবি আবু দুহায়েলের কাসীদা হতে একটি পংক্তি এখানে উদ্ধৃত হচ্ছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “মহিলাটি ডুবুরীর ঐ মুক্তার ন্যায় পরমা সুন্দরী, যাকে সুরক্ষিত জওহর হতে পৃথক করা হয়েছে।” হাসান (রঃ), সুদ্দী (রঃ), সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) প্রমুখ মনীষীবর্গ বলেন যে, (আরবী)-এর অর্থ হচ্ছে ঐ সুরক্ষিত মুক্তা যেখানে কারো হাত পৌছেনি এবং যাকে ঝিনুক থেকে বের করা হয়নি। ওটা যেন ডিম্বের উপরের পরদার মাঝে সুরক্ষিত অংশ বিশেষ, যা কেউ স্পর্শ করেনি। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে মহামহিমান্বিত আল্লাহর (আরবী)-এর ভাবার্থ বুঝিয়ে দিন! রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “এর ভাবার্থ হলো- বড় চক্ষু ও কালো পলক বিশিষ্ট হর।” আমি আবার জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) (আরবী)-এর ভাবার্থ কি? তিনি উত্তর দিলেনঃ “ডিম্বের মধ্যস্থিত সাদা ঝিল্লীর মত তাদের দেহ।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন লোকদেরকে কবর হতে উঠানো হবে তখন সর্বপ্রথম আমিই দণ্ডায়মান হবে। যখন সকলকে প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহর নিকট হাযির করা হবে তখন আমিই হলো তাদের খতীব বা ভাষণদানকারী। যখন তারা চিন্তাযুক্ত থাকবে তখন আমিই তাদেরকে সুসংবাদ দান করবো। যখন তারা বন্দী অবস্থায় থাকবে তখন আমিই তাদের জন্যে সুপারিশ করবো। সেই দিন প্রশংসার পতাকা আমার হাতেই থাকবে। আদম সন্তানের মধ্যে সেই দিন আমিই হবো সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। এটা আমি অহংকার করে বলছি না। কিয়ামতের দিন আমার সামনে ও পিছনে এক হাজার খাদেম ঘুরাঘুরি করবে যারা রক্ষিত ডিম্ব বা এমন মুক্তার মত হবে যেগুলোকে স্পর্শ করা হয়নি। একমাত্র আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
৫০-৬১ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, জান্নাতবাসীরা একে অপরের সামনা সামনি হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অর্থাৎ তারা দুনিয়ার মাঝে কে কেমন অবস্থায় ছিল এবং সেখানে তাদের দিনগুলো কিভাবে অতিবাহিত হয়েছিল সে সম্বন্ধে একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। চৌকির উপর পরস্পর তারা হেলান দিয়ে বসে থাকবে। শত শত সুদৃশ্য পরি-চেহারার সেবক তাদের হুকুমের অপেক্ষায় সদা প্রস্তুত থাকবে। ঐ জান্নাতীরা বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য ও পানীয় এবং রঙ বেরঙ-এর পোশাকের মধ্যে ডুবে থাকবে। তাদের মধ্যে সুরা পরিবেশিত হবে। এবং তারা এমন সব সুখের সামগ্রী লাভ করবে যা কোন কানও শুনেনি, চক্ষুও অবলোকন করেনি এবং হৃদয়ও কল্পনা করেনি। কথা প্রসঙ্গে তাদের একজন বলবেঃ দুনিয়ায় আমার এক বন্ধু ছিল। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, (আরবী) শব্দের অর্থ শয়তান। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সে এক মুশরিক ব্যক্তি। দুনিয়াতে মুমিনদের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। এ দু’জন মনীষীর কথার মধ্যে বৈপরীত্য কিছুই নেই। কেননা, শয়তান জ্বিনদের মধ্য থেকেও হয়ে থাকে এবং সে অন্তরে সন্দেহের উদ্রেক করে। আর মানুষের মধ্যেও শয়তান থাকে, সেও গোপনে কথা বলে যা কান শ্রবণ করে। এই উভয় প্রকার মত একে অপরের পরিপূরক। এই উভয় প্রকারের শয়তান কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি) আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জ্বিনের মধ্য হতে অথবা মানুষের মধ্য হতে।”(১১৪:৪-৬) এ জন্যেই ঘোষিত হয়েছেঃ “তাদের কেউ বলেআমার ছিল (দুনিয়ায়) এক সঙ্গী। সে আমাকে বলতো ? তুমি কি এতে বিশ্বাসী যে, আমরা যখন মরে যাবো এবং আমরা মৃত্তিকা ও অস্থিতে পরিণত হবো তখনো কি আমাদেরকে প্রতিফল দেয়া হবে?” অর্থাৎ আমার ঐ বন্ধুটি আমাকে বলতোঃ তুমি কি কিয়ামত, হিসাব-নিকাশ ও প্রতিফল দিবসে বিশ্বাসী? এটা সে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করতো। কেননা, সে তো অবিশ্বাস করতো।

মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, -এর অর্থ হলো হিসাব গ্রহণ করা। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল ফারাযী (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলো আমল অনুযায়ী প্রতিফল প্রদান করা। উভয় মতই ঠিক।

মহান আল্লাহর বাণীঃ “তোমরা কি প্রত্যক্ষ করতে চাও?’ মুমিন ব্যক্তি তার জান্নাতী বন্ধু ও সহচরকে পৃথিবীর ঐ বন্ধুর কথা বলবে। (আরবী) অর্থাৎ ‘অতঃপর সে ঝুঁকে দেখবে এবং তাকে দেখতে পাবে জাহান্নামের মধ্যস্থলে।’ ইবনে আব্বাস (রাঃ), সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ), খালীদুল আসরী (রঃ), কাতাদা (রঃ), সুদ্দী (রঃ), আতাউল খুরাসানী (রঃ) এবং হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, (আরবী)-এর অর্থ হলো জাহান্নামের মধ্যস্থল। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, সেই মুমিন ব্যক্তি তার বন্ধুটিকে মস্তক গলা অবস্থায় জাহান্নামের মধ্যে দেখতে পাবে। কা’ব (রঃ) বলেন যে, জান্নাতে জানালা রয়েছে। সুতরাং কেউ তার শত্রুদেরকে দেখতে ইচ্ছা করলে উঁকি দিলেই দেখতে পাবে। ফলে সে খুব বেশী বেশী আল্লাহ তা’আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।

জান্নাতী ব্যক্তি তাকে দেখেই বলবেঃ তুমি আমার জন্যে এমন ফাঁদ পেতেছিলে যাতে আমাকে ধ্বংস করেই ছাড়তে। কিন্তু মহান আল্লাহর শুকরিয়া যে, তিনি আমাকে তোমার খপ্পর থেকে রক্ষা করেছেন। যদি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ না হতো তবে আমি বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতাম। তোমার মত আমাকে জাহান্নামে জ্বলতে হতো। আল্লাহ আমাকে সুপথ প্রদর্শন করে একত্ববাদের দিকে ধাবিত করেছেন।

“আমাদের তো মৃত্যু হবে না প্রথম মৃত্যুর পর এবং আমাদেরকে শাস্তিও দেয়া হবে না।” এটা মুমিন বান্দাদের কথা, যাতে তাদের আনন্দ ও সাফল্যের সংবাদ রয়েছে। জান্নাতে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। সেখানে না আছে মৃত্যু, না আছে ভয় এবং না আছে শাস্তির কোন সম্ভাবনা। এজন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ এটা তো মহা সাফল্য।’

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, জান্নাতীদেরকে বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের আমলের বিনিময়ে খুব আনন্দের সাথে পানাহার করতে থাকো। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ এখানে ঐ কথারই ইঙ্গিত রয়েছে যে, জান্নাতীরা জান্নাতে কখনো মৃত্যুবরণ করবে না। তখন তারা জিজ্ঞেস করবেঃ “আমাদের আর মৃত্যু তো হবে না, তবে কখনো শাস্তি দেয়া হবে কি?” উত্তরে বলা হবেঃ “না।” হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ “জেনে রেখো যে, প্রত্যেক নিয়ামত মৃত্যুর দ্বারা লয়প্রাপ্ত হয়।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ “এরূপ সাফল্যের জন্যে সাধকদের উচিত সাধনা করা।” কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এটা জান্নাতীদের কথা। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এটা মহান আল্লাহর উক্তি। অর্থাৎ এরূপ রহমত ও নিয়ামত লাভ করার জন্যে মানুষের পূর্ণ আগ্রহের সাথে দুনিয়ায় কাজ করা উচিত যাতে পরকালে উক্ত নিয়ামত তারা লাভ করতে পারে। এই আয়াতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি কাহিনী রয়েছে যা নিম্নে বর্ণিত হলোঃ

বানী ইসরাঈলের দু’জন লোক যৌথভাবে ব্যবসা করতো। তাদের নিকট আট হাজার স্বর্ণমুদ্রা মজুদ ছিল। তাদের একজন ব্যবসায়ের কৌশল ভাল জানতো এবং অপরজন ব্যবসা তেমন বুঝতো না। তাই অভিজ্ঞ লোকটি তার সঙ্গীকে বললো যে, সে যেন তার অংশ নিয়ে পৃথক হয়ে যায়। সুতরাং উভয়ে ভিন্ন হয়ে গেল। অতঃপর ঐ অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী দেশের বাদশাহর মৃত্যুর পর তার। রাজপ্রাসাদ এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় করে নিলো এবং তার ঐ সঙ্গীটিকে ডেকে বললোঃ “দেখতো বন্ধু, আমি কেমন জিনিস ক্রয় করেছি?” সঙ্গীটি তার খুব প্রশংসা করলো। তারপর সে সেখান হতে বিদায় হয়ে গেল। অতঃপর সে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলোঃ “হে আল্লাহ! আমার এ সঙ্গী লোকটি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রায় পার্থিব প্রাসাদ ক্রয় করেছে। আমি আপনার নিকট জানাতে একটি ঘরের আবেদন জানাচ্ছি। আমি এক হাজার স্বর্ণমুদা আপনার মিসকীন বান্দাদের মধ্যে দান করে দিচ্ছি।” অতঃপর সে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা সাদকা করে দিলো। কিছুকাল পর ঐ অভিজ্ঞ লোকটি এক হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) খরচ করে বিয়ে করলো। বিয়েতে সে তার ঐ পুরাতন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে আনলো এবং বললোঃ “বন্ধু! আমি এক হাজার দীনার খরচ করে ঐ সুন্দরী মহিলাটিকে বিয়ে করে ঘরে আনলাম।” এবারও সে তার খুব। বাইরে এসে সে মহান আল্লাহর পথে এক হাজার দীনার দান করে দিলো এবং তার নিকট প্রার্থনা করলোঃ “হে আল্লাহ! আমার এ বন্ধুটি এ পরিমানই টাকা খরচ করে এই দুনিয়ার একটি স্ত্রী লাভ করলো। আর আমি এর দ্বারা আপনার নিকট আয়ত লোচনা হুরী কামনা করছি।” আরো কিছুকাল পর ঐ দুনিয়াদার লোকটি এ লোকটিকে ডেকে নিয়ে বললোঃ “বন্ধু! আমি দুই হাজার দীনার খরচ করে দু’টি ফলের বাগান ক্রয় করেছি। দেখো তো কেমন হয়েছে?” এ লোকটি তার বাগান দুটি দেখে খুব প্রশংসা করলো এবং বাইরে এসে স্বীয় অভ্যাস মত আল্লাহ তা’আলার দরবারে আরয করলোঃ “হে আল্লাহ! আমার এ বন্ধু দু’হাজার দীনারের বিনিময়ে দু’টি বাগান ক্রয় করেছে। আমি আপনার নিকট জান্নাতে দু’টি বাগানের জন্যে আবেদন করছি। আর এই দু’হাজার দীনার আমি আপনার নামে সাদকা করছি।” অতঃপর সে দু’হাজার দীনার সাদকা করে দিলো। তারপর যখন তাদের দু’জনের মৃত্যু হয়ে গেল তখন ঐ সাদকা প্রদানকারীকে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দেয়া হলো। সেখানে সে এক অতি পরমা সুন্দরী রমণী লাভ করলো এবং দু’টি সুন্দর বাগান প্রাপ্ত হলো। এ ছাড়া আরো এমন বহু নিয়ামত সে লাভ করলো যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না। ঐ সময় তার পার্থিব ঐ সঙ্গীর কথা মনে পড়লো। ফেরেশতারা তাকে বললেনঃ “সে তো জাহান্নামে রয়েছে। তুমি ইচ্ছে করলে উঁকি মেরে তাকে দেখতে পার।” সে তখন উঁকি দিয়ে দেখলো যে, তার ঐ সঙ্গীটি জাহান্নামের আগুনে জ্বলছে। সে তখন তাকে সম্বোধন করে বললোঃ “তুমি তো আমাকেও প্রায় তোমার ফাঁদে ফেলে দিয়েছিলে। এটা আমার প্রতি আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ যে, তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, (আরবী) এটা তাশদীদ দিয়ে পড়াই অধিক সঙ্গত। ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, আবু হাফস (রঃ) ইসমাঈল সুদ্দী (রঃ)-কে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “এটা তোমাকে কে বলেছে?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমি এইমাত্র এটা পড়লাম। আমি আপনার নিকট হতে এটা জেনে নিতে চাই।” তখন তিনি বলেনঃ তবে শুননা ও স্মরণ রেখো। বানী ইসরাঈলের মধ্যে দুই জন অংশীদার ছিল। একজন ছিল মুমিন এবং অপরজন ছিল কাফির। তারা ছয় হাজার দীনার তিন হাজার করে ভাগ করে নিয়ে পৃথক হয়ে গেল। তারপর কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। একদা দু’জনের সাক্ষাৎ হলো। কাফির লোকটি মুমিন লোকটিকে বললোঃ “তোমার মাল-ধন তুমি কি করেছো? তা দিয়ে কোন কাজ করেছো, না ব্যবসায়ে লাগিয়েছো?” মুমিন লোকটি উত্তরে বললোঃ “আমি কিছুই করিনি। তুমি তোমার সম্পদ দিয়ে কি করেছো তাই বল।” কাফির লোকটি তখন বললোঃ “এক হাজার দীনার দিয়ে আমি জমি, খেজুরের বাগান ও নদী ক্রয় করেছি।” মুমিন লোকটি বললোঃ “সত্যিই কি তাই করেছো?” উত্তরে কাফির লোকটি বললোঃ “হ্যা, সত্যিই।” অতঃপর মুমিন লোকটি ফিরে আসলো। রাত্রি হলে সে আল্লাহর ইচ্ছা মত নামায পড়লো। নামায শেষে এক হাজার দীনার সামনে রেখে সে বললোঃ “হে আল্লাহ! ঐ কাফির এক হাজার দীনারের বিনিময়ে জমি, বাগান ও নহর ক্রয় করেছে। আগামীকাল তার মৃত্যু হলে সবই সে ছেড়ে যাবে। আমি এই এক হাজার দীনারের বিনিময়ে জান্নাতের জমি, বাগান ও নহর ক্রয় করতে চাই।” অতঃপর সকালে সে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করে দিলো। এরপর আরো কিছুকাল অতিবাহিত হলো। হঠাৎ একদিন উভয়ের সাক্ষাৎ হয়ে গেল। কাফির তার মুমিন সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলোঃ “তোমার সম্পদ কি করেছো? কোন ব্যবসায়ে লাগিয়েছ কি?” মুমিন জবাবে বললো:“না। তবে তোমার সম্পদ তুমি কি করেছো তাই বল?” জিজ্ঞেস করলো মুমিন কাফিরকে। উত্তরে কাফির বললোঃ “হাজার দীনারের বিনিময়ে কিছু সঙ্গিনী ক্রয় করেছি। তারা আমার জন্যে সদা প্রস্তুত থাকে এবং আমার হুকুমের তাবেদারী করে।” মুমিন লোকটি তাকে বললোঃ “সত্যিই কি তুমি এ কাজ করেছো?” সে জবাব দিলো:“হ্যা, সত্যিই।” তারপর মুমিন লোকটি সেখান হতে চলে এসে রাত্রে আল্লাহর ইচ্ছা মত নামায আদায় করলো এবং নামায শেষে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা সামনে রেখে আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করতে লাগলোঃ “হে আল্লাহ! আমার ঐ সাথীটি দুনিয়ার সঙ্গিনী ক্রয় করেছে। সে যদি মারা যায় তবে এ সবই রেখে যাবে অথবা তারা মারা গেলে একে তারা ছেড়ে যাবে। হে আল্লাহ! আমি এ দীনার দিয়ে জান্নাতের সঙ্গিনী ক্রয় করতে চাই।” অতঃপর সকালে সে ঐ এক হাজার দীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে দিলো। তারপর আরো কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আবার একদিন উভয় বন্ধুর সাক্ষাৎ ঘটলো। তাদের মধ্যে আলাপ হতে লাগলো। মুমিন ব্যক্তির এক প্রশ্নের উত্তরে কাফির ব্যক্তি বললোঃ “আমার মনের যত বাসনা ছিল সবই প্রায় পূর্ণ হয়েছে। এখন শুধু একটি কাজ হাতে রয়েছে। তাহলো এই যে, একটি মহিলার স্বামী মারা গেছে। আমি তাকে এক হাজার দীনার উপঢৌকন রূপে পাঠিয়েছিলাম। সে ওর দ্বিগুণ দীনার নিয়ে আমার কাছে এসেছে।” মুমিন বললোঃ “তুমি তাহলে এ কাজ করেছো?” সে উত্তরে বললোঃ “হ্যা।” তারপর মুমিন লোকটি সেখান হতে ফিরে এলো এবং রাত্রে আল্লাহ যা চাইলেন সেই মত সে নামায আদায় করলো। এরপর সে অবশিষ্ট এক হাজার দীনার হাতে নিয়ে প্রার্থনা শুরু করলোঃ “হে আল্লাহ! আমার ঐ কাফির সঙ্গীটি দুনিয়ার রমণীর মধ্যে একটি রমণীকে হাজার দীনারের বিনিমেয় বিয়ে করেছে। আগামীকাল এ খ্রীকে রেখে সে মারা যেতে পারে অথবা তার এ স্ত্রীটিও তাকে রেখে মৃত্যুবরণ করতে পারে। আমি এই দীনারের বিনিময়ে আপনার নিকট জান্নাতী আয়ত নয়না হুরীর প্রস্তাব রাখলাম।” অতঃপর সকালে সে ঐ দীনারগুলো মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করে দিলো। বলা বাহুল্য যে, মুমিন লোকটির নিকট আর কোন অর্থই অবশিষ্ট থাকলো না। এবার সে সূতার তৈরী সাধারণ জামা গায়ে দিয়ে একটি কম্বল হাতে নিয়ে এবং একটি কোদাল কাঁধে করে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো। পথে এক ব্যক্তি তাকে দেখে বললোঃ “তুমি আমার গবাদি পশুর দেখা শুনা করবে এবং গোবর উঠাবে আর এর বিনিময়ে আমি তোমার পানাহারের ব্যবস্থা করবো। এতে তুমি সম্মত আছ কি?” মুমিন লোকটি এতে সম্মত হয়ে গেল এবং কাজ করতে শুরু করলো। ঐ মালিকটি ছিল অত্যন্ত নির্দয় ও কঠোর হৃদয়ের লোক। কোন পশুকে দুর্বল ও অসুস্থ দেখলে সে মনে করতো যে, ঐ সহিস তার পশুর খাদ্য চুরি করে। এই বদ ধারণার বশবর্তী হয়ে সে ঐ মুমিন লোকটিকে নির্মমভাবে প্রহার করতো। তার এরূপ অত্যাচারে সে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লো এবং তার ঐ কাফির সঙ্গীটিকে স্মরণ করলো যে, তারই ক্ষেত-খামারে সে কাজ করবে। এর বিনিময়ে হয়তো সে তাকে খেতে-পরতে দিবে এবং এটাই তার জন্যে যথেষ্ট। এই ভরসায় সে রওয়ানা হয়ে গেল। তার দরযার সামনে এসে বিরাট গগনচুম্বী প্রাসাদ দেখে তো তার চক্ষু স্থির। দেওড়ীতে পাহারাদার! তাদের নিকট সে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলো এবং বললোঃ “আমার নাম শুনলেই এ বাড়ীর মালিক খুশী হয়ে আমাকে প্রবেশের অনুমতি দিবে।” প্রহরীরা বললোঃ “তোমার কথা যদি সত্য হয় তবে এই এক কোণে চুপ করে পড়ে থাকো। সকাল হলে তার সামনে নিজেই গিয়ে পরিচয় দান করবে।” সে তাই করলো। এক পাশে গিয়ে কম্বলের অর্ধেকটি বিছিয়ে দিলো এবং বাকী অর্ধেক গায়ে দিয়ে রাত্রি কাটিয়ে দিলো।

সকাল বেলা তার ঐ কাফির সঙ্গীটি ঘোড়ায় চড়ে প্রাতঃ ভ্রমণে বের হয়েছে এমন সময় মুমিন লোকটি তার সামনে হাযির হলো। তার এই দুরবস্থা দেখে সে অত্যন্ত বিস্মিত হলো এবং জিজ্ঞেস করলোঃ “তোমার এ অবস্থা কেন? টাকা পয়সা কি করেছো?” উত্তরে মুমিন ব্যক্তি বললোঃ “ওটা আর জিজ্ঞেস করো না ভাই। বরং আমাকে তোমার ক্ষেত-খামারের কাজে নিয়োগ কর। মজুরী কিছু লাগবে না, শুধু দু’ বেলা খেতে দিলেই চলবে। আর যখন আমার পরনের এ বস্ত্রগুলো পুরোনো হয়ে যাবে তখন নতুন কাপড় কিনে দিবে আর কি?” সে উত্তরে বললোঃ “আরে, অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন, আমি বরং এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা তোমার জন্যে করে দিবো। এখন তুমি বল তোমার মাল-ধন কি করেছো? সে উত্তর দিলোঃ “একজনকে কর্জ দিয়েছি।” জিজ্ঞেস করলোঃ “কাকে কর্জ দিয়েছো?” উত্তর হলোঃ “এমন একজনকে কর্জ দিয়েছি যিনি তা অস্বীকার করবেন না এবং নষ্ট হতেও দিবেন না। তিনি আমার প্রতিপালক মহান আল্লাহ!” একথা শুনে কাফির লোকটি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললোঃ “তুমি তো দেখি বড় নির্বোধ! আমরা পচে গলে মাটিতে পরিণত হবো, অতঃপর পুনরুজ্জীবিত হবো ও প্রতিদান পাবো এতে তুমি বিশ্বাসী! তোমার যখন এমন বিশ্বাস তখন তুমি চলে যাও, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।” এই বলে সে চলে গেল। মুমিন লোকটি সেখান থেকে বিদায় হলো এবং অতি কষ্টে জীবন যাপন করতে লাগলো। আর ঐ কাফির পরম সুখে দিন যাপন করতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত উভয়েই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। তারপর মুমিন লোকটিকে জান্নাত দান করা হলো। সে বিরাট ময়দান, খুরমা-খেজুরের বাগান ও প্রবাহিত নদী দেখে অত্যন্ত বিস্ময়বোধ করলো এবং ফেরেশতাদেরকে জিজ্ঞেস করলোঃ “এগুলো কার জন্যে?” তারা উত্তর দিলোঃ “এগুলো সবই তোমার ।” তারপর আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে দেখলো যে, অসংখ্য দাস-দাসী অপেক্ষমান রয়েছে। জিজ্ঞেস করলোঃ “এগুলো কার জন্যে?” উত্তর হলোঃ “এগুলোও তোমারই জন্যে।” সে বললোঃ “সুবহানাল্লাহ! এটাতো আমার প্রতি আল্লাহর বড়ই মেহেরবানী।” আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে দেখতে পেলো যে, ইয়াকুত পাথরের তৈরী এক মহল রয়েছে এবং ওর মধ্যে আনত নয়না ও আয়ত লোচনা হরীরা অবস্থান করছে। প্রশ্ন করে জানতে পারলো যে, এগুলো তারই জন্যে। এসব দেখে তো তার চক্ষু স্থির! অতঃপর তার ঐ কাফির সাথীর কথা তার মনে পড়লো। আল্লাহ তা’আলা তাকে দেখাবেন যে, সে জাহান্নামে জ্বলতে রয়েছে। তাদের মধ্যে ঐ সব কথোপকথন হবে যার বর্ণনা এখানে দেয়া হয়েছে। মুমিনের উপর দুনিয়ায় যে বিপদাপদ এসেছিল তা সে স্মরণ করবে। তখন মৃত্যু অপেক্ষা কঠিন বিপদ আর কিছুই তার কাছে অনুভূত হবে না।
৬২-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা জান্নাতের বিভিন্ন নিয়ামতের বর্ণনা দেয়ার পর বলেনঃ জান্নাতের এসব নিয়ামত উত্তম, না ‘যাককূম’ নামীয় বৃক্ষ? অর্থাৎ যা জাহান্নামে রয়েছে। এর অর্থ নিকৃষ্ট একটি গাছ হতে পারে যা জাহান্নামের সকল প্রকোষ্ঠে প্রসারিত। যেমন ‘বা’ নামক একটি গাছ, যার শাখা জান্নাতের প্রতিটি কামরায় প্রবিষ্ট রয়েছে। এও হতে পার যে, ওটা যাকূম জাতীয় গাছ। অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “অতঃপর হে বিভ্রান্ত মিথ্যা আবোপকারীরা! তোমরা অবশ্যই আহার করবে যাকূম বৃক্ষ হতে।”(৫৬:৫১-৫২)

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি এটা যালিমদের জন্যে সৃষ্টি করেছি পরীক্ষা স্বরূপ।’ কাতাদা (রঃ) বলেন যে, যাকূম গাছের উল্লেখ পথভ্রষ্টদের জন্যে ফিত্না হয়ে গেছে। তারা বলেঃ “আরে দেখো, দেখো। এ নবী বলে কি শুন! আগুনে নাকি গাছ হবে? আগুনতো গাছকে জ্বালিয়ে দেয়। সুতরাং এটা কোন ধরনের কথা?” তাদের একথা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “নিশ্চয়ই এ বৃক্ষ উদ্গত হয় জাহান্নামের তলদেশ হতে।’ হ্যা, এই গাছ আগুন থেকেই জন্মে এবং আগুনই ওর খাদ্য। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, অভিশপ্ত আবু জেহেল এ কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়তো এবং বলতোঃ “আমি তো মজা করে খেজুর ও মাখন বাবো এবং এরই নাম যাকূম। মোটকথা এটাও একটা পরীক্ষা। ভাল লোকেরা এতে ভয়ে আঁৎকে উঠে, আর মন্দ লোকেরা একে হেসে উড়িয়ে দেয়। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি যে দৃশ্য তোমাকে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে উল্লিখিত অভিশপ্ত বৃক্ষটিও শুধু মানুষের জন্যে। আমি তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করি, কিন্তু এটা তাদের ঘোর অবাধ্যতাই বৃদ্ধি করে।”(১৭:৬০)

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “ওর মোচা যেন শয়তানের মাথা।’ এ কথা দ্বারা উক্ত গাছের কদর্যতা বর্ণনা করা হয়েছে। অহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রঃ) বলেন যে, শয়তানের মস্তক আকাশে প্রতিষ্ঠিত। এ গাছের মোচাকে শয়তানের মস্তকের সাথে তুলনা করার উদ্দেশ্য শুধু এটাই যে, যদিও কেউ কখনো শয়তানকে দেখেনি, তবুও তার নাম শুনামাত্রই তার জঘন্য রূপের ছবি মানুষের মানসপটে ভেসে ওঠে। উক্ত গাছেরও অবস্থা এইরূপ। এর ভিতর ও বাহির উভয়ই খারাপ। একথাও বলা হয়েছে যে, এটা এক প্রকার সর্প বিশেষ যার মস্তক অত্যন্ত ভয়ংকর। একটি উক্তি এও আছে যে, ওটা এক প্রকার উদ্ভিদ, যা অত্যন্ত জঘন্যভাবে বর্ধিত ও বিস্তৃত হয়ে থাকে। কিন্তু এ দুটি সম্ভাবনা সঠিক নয়। সঠিক ওটাই যা আমরা বর্ণনা করলাম।

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা এটা হতে ভক্ষণ করবে এবং উদর পূর্ণ করবে এর দ্বারা। সেই দুর্গন্ধময় তীব্র তিক্ত তরু জোরপূর্বক তাদেরকে খাওয়ানো হবে। আর এটা তারা খেতেও বাধ্য হবে। এটাও এক প্রকারের শাস্তি। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের জন্যে খাদ্য থাকবে না যারী [(আরবী) আরব দেশের এক প্রকার গুল্ম। এটা যখন সবুজ থাকে তখন একে (আরবী) (শিবরাক) বলা হয়। আর যখন শুকিয়ে যায় তখন একে (আরবী) (যারী) বলা হয়। এটা খুব বিষাক্ত এবং কোন জন্তুই এটা খায় না] ব্যতীত। যা তাদেরকে পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তও করবে না।” (৮৮:৬-৭)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “যদি যাকূম বৃক্ষের এক ফোঁটা রস দুনিয়ার সমুদ্রে পতিত হয় তবে সারা বিশ্ববাসীর সমস্ত খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে যার খাদ্য এটাই হবে তার কি অবস্থা হবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এরপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ তদুপরি তাদের জন্যে থাকবে ফুটন্ত পানির মিশ্রণ।’ অথবা ভাবার্থ হচ্ছেঃ ঐ জাহান্নামী গাছকে জাহান্নামী পানির সাথে মিশিয়ে তাদেরকে পান করানো হবে। আর এই গরম পানি ওটাই হবে যা জাহান্নামীদের ক্ষতস্থান হতে রক্ত, পুঁজ ইত্যাদি আকারে বের হয়ে আসবে এবং তাদের চক্ষু হতে ও গুপ্তাঙ্গ হতে বেরিয়ে আসবে।

হযরত আবু উমামা বাহিলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেনঃ “যখন এই পানি তাদের সামনে ধরা হবে তখন তা তাদের নিকট অপছন্দনীয় হবে। আর যখন তা তাদের চেহারার সামনে তুলে ধরা হবে তখন ওর তাপে তাদের চেহারা ঝলসে যাবে। আর যখন তারা ওটা পান করবে তখন তাদের নাড়িভূড়ী কেটে নিম্ন রাস্তা দিয়ে বের হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন যে, জাহান্নামীরা যখন ক্ষুধার কথা বলবে তখন তাদেরকে যাকূম খাওয়ানো হবে। ফলে তাদের মুখের চামড়া সম্পূর্ণ খসে পড়বে। এমনকি কোন পরিচিত ব্যক্তি সেই মুখের চামড়া দেখেই তাদেরকে চিনে নিবে। তারপর পিপাসায় ছটফট করে যখন পানি চাইবে তখন গলিত তামার ন্যায় গরম পানি তাদেরকে পান করতে দেয়া হবে। ওটা চেহারার সামনে আসা মাত্রই চেহারার গোশত ঝলসিয়ে দিবে এবং সমস্ত গোশত খসে পড়বে। আর পেটে গিয়ে ওটা নাড়িভূড়ি বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে এবং উপর থেকে লোহার হাতুড়ী দ্বারা প্রহার করা হবে। ফলে দেহের এক একটি অংশ পৃথক। পৃথক হয়ে যাবে। তখন তারা মৃত্যু কামনা করতে থাকবে।

প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “অতঃপর তাদের গন্তব্য হবে অবশ্যই প্রজ্বলিত অগ্নির দিকে। সেখানে তাদের উপর বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি হতে থাকবে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা জাহান্নামের অগ্নি ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটাছুটি করবে।”(৫৫:৪৪) হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবী) রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! দুপুরের পূর্বেই জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে পৌঁছে যাবে। আর সেখানেই তারা দুপুরের বিশ্রাম করবে।” অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই দিন হবে জান্নাতবাসীদের বাসস্থান উৎকৃষ্ট এবং বিশ্রামস্থল মনোরম।”(২৫-২৪) মোটকথা কায়লুলার (দুপুরের বিশ্রামের) সময় উভয় দল নিজ নিজ ঠিকানায় অবস্থান করবে। এই অর্থের জন্যে (আরবী) শব্দটি (আরবী)-এর উপর (আরবী)-এর (আরবী)-এর জন্যে হবে। এটা ওরই প্রতিফল যে, তারা তাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছিল বিপথগামী এবং তারা তাদের পদাংক অনুসরণে ধাবিত হয়েছিল। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, বাধ্য হয়ে এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) বলেন যে, নির্বোধ হিসেবে তাদের পদাংক অনুসরণ করেছিল।
৭১-৭৪ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা পূর্বযুগের উম্মতদের সংবাদ প্রদান করছেন যে, তাদের অধিকাংশই ছিল পথহারা। তারা আল্লাহ তা’আলার অংশী স্থাপন করতো। তাদের নিকট আল্লাহর নবী এসে তাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, ভয় দেখিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, অংশী স্থাপন করা, কুফরী করা এবং নবীদেরকে (আঃ) মিথ্যা প্রতিপন্ন করা প্রভৃতি কাজে আল্লাহ চরম রাগান্বিত হন। এগুলো হতে বিরত না হলে তাদের উপর আল্লাহর গযব নেমে আসবে। এতদসত্ত্বেও তারা রাসূলদের বিরোধিতা করেছে ও তাঁদেরকে মিথ্যাবাদী জেনেছে। ফলে তাদের পরিণাম হয়েছে অত্যন্ত শোচনীয়। অবশ্য আল্লাহ তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে সাহায্য করেছেন এবং জয়যুক্ত করে সম্মানিত করেছেন।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

‘তারা সেদিন আযাবে শরীক থাকবে।'(আয়াত ৩৩-৩৬) এরপর এই মন্তব্যকে পূর্ণতা দেয়া হয়েছে এই ধিকৃত কথার বক্তাদের নিন্দা ও সমালােচনার মাধ্যমে। বরঞ্চ তিনি সত্য নিয়ে এসেছেন এবং রসূলদের সমর্থন করেছেন…'(আয়াত৩৭-৪০) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত এইসব খাটি বান্দাদের উল্লেখ করার পর আখেরাতে তারা কেমন পুরস্কৃত হবে তাও বর্ণনা করা হয়েছে। ‘তাদের জন্যে রয়েছে সুবিদিত জীবিকা, ফলমূল এবং তারা হবে পরম সম্মানিত।'(আয়াত৪১-৪৯) এখানে তাদের অতিরিক্ত নেয়ামতের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে, যা নেয়ামতের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি। এ নেয়ামত হৃদয় মন ও অনুভূতি- সব কিছুকেই পরিতৃপ্ত করবে। প্রথমত তারা আল্লাহর খাটি বান্দা। এতে তাদের উচ্চতর সম্মানে ভূষিত হবার ইংগিত রয়েছে। দ্বিতীয়ত তারা উচ্চতর জগতে সম্মানিত হবে। এ সম্মানের কোনাে শেষ নেই। তাদের জন্যে থাকবে ফলমূল এবং তারা মুখােমুখি খাটের ওপর বসে থাকবে। তাদের সেবা করা হবে। ফলে তারা বিন্দুমাত্র কষ্ট পাবে না। ‘তাদের ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে বিশুদ্ধ শরাবের পরিপূর্ণ পানপাত্র। শুভ্র উজ্জ্বল, পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু। তাতে শিরপীড়ার উপাদানও থাকবে না এবং তাতে তারা মাতালও হবে না।’ শরাবের এর চেয়ে সুন্দর গুণাবলী আর হতে পারে না। এ সব গুণাবলীর কারণে শরাবের প্রকৃত স্বাদ উপভােগ করা যাবে এবং তা সমস্ত দোষক্রটি থেকে মুক্ত থাকবে। তাই কোনাে মাতলামির কারণে মাথা ঘুরবে না এবং এর স্বাদেও কখনাে পরিবর্তন আসবে না। আর তাদের কাছে থাকবে আনতনয়না প্রশস্ত চক্ষু বিশিষ্ট রমণীরা। অর্থাৎ এমন জীবন্ত হুররা, যারা সতী ও লাজুক হওয়ার কারণে তাদের প্রিয়জন ব্যতীত আর কারাে দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। অথচ তারা বড় বড় চোখ বিশিষ্ট সুন্দরী রমণী। তারা সব ধরনের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে এবং অত্যন্ত কোমল স্বভাবের হবে, যেমন কতিপয় আচ্ছাদিত ডিম, কেউ তা দেখেও না, স্পর্শও করে না।

# এরপর পুনরায় এই সব খাটি বান্দার চিত্রায়িত বিবরণ দেয়া হচ্ছে। তাদের সব রকমের আয়েশ আরামের উপকরণ সরবরাহ করার পর তারা পরস্পরে যেমন প্রথম সাক্ষাতে ঝগড়াঝাটি শুরু করে দেয়, তার পরিবর্তে তারা প্রশান্ত পরিবেশে অতীতের কথা মনে করবে এবং সংগীদের। কাছে তার কিছু কিছু বর্ণনা করবে। ‘তাদের একজন বলবে, আমার একজন সংগী ছিলাে।’ (আয়াত ৫১-৫৩) তার সেই সংগী আখেরাতে বিশ্বাস করতাে না। সে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করতাে, হাড়গােড় মাটিতে মিশে যাওয়ার পর আবার মানুষ কি বেঁচে ওঠবে এবং তার বিচারও হবে? এই কাহিনী বেহেশতের সংগীদের কাছে বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে হবে, তার সেই সাথীকে একটু খুঁজে দেখা যাক আজ তার কী পরিণতি হবে। সে স্বভাবতই জানবে যে, সে জাহান্নামবাসী হয়েছে। তখন সে তাকে দেখবে এবং সংগীদেরও দেখবার জন্য ডাকবে। সে বলবে, তােমরা কি দেখতে পাচ্ছ। সে দেখবে, তাকে জাহান্নামের মাঝখানে। তৎক্ষণাত সে জাহান্নামের মাঝখানে থাকা তার পুরনাে সাথীকে বলবে, ওহে অমুক, তুমি তাে তোমার কুপ্ররােচণা দ্বারা আমাকে ধ্বংস করার উপক্রম করেছিলে। আল্লাহ তায়ালা যদি আমার ওপর অনুগ্রহ না করতেন এবং তােমার কথামত চলতে উদ্বুদ্ধ করতেন, তাহলে আমিও তােমার মতাে গোল্লায় যেতাম। ‘সে বলবে, আল্লাহর কসম, তুমি আমাকে ধ্বংস করার উপক্রম করেছিলে। আমার প্রভুর অনুগ্রহ না হলে আমিও পৌছে যেতাম।’ অর্থাৎ অনিচ্ছা সত্তেও বধ্যভূমিতে নেয়া হয়, এমন লােকদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। তার সাথীকে জাহান্নামে দেখে তার ভেতরে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সেই অগাধ নেয়ামতের কথা স্মরণ হবে, যা সে ও অন্যান্য খাটি বান্দারা পেয়েছে। তাই এর পর্যালােচনা করা ও এর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা জরুরী মনে করে সে বলবে ‘আমরা কি তখন আর মরবাে না?’ (আয়াত ৫৮-৬০) এখানে এমন একটা মন্তব্য সন্নিবেশিত হয়েছে, যা অন্তরে চেতনার সঞ্চার করে এবং এরূপ প্রতিদান লাভের জন্যে কাজ করার প্রেরণা যোগায়। এ ধরনের জিনিসের জন্যই সকল কর্ম সম্পাদনকারীর কাজ করা উচিত।’ অর্থাৎ এ ধরনের নেয়ামত লাভের জন্যে, যা কখনাে হাতছাড়া হয় না, ফুরিয়ে যায় না, মৃত্যু যার অবসান ঘটায় না এবং কোনাে আযাবের আশঙ্কা যাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে না। এর জন্যে সকলের কাজ করা উচিত। এ ছাড়া আর যেসব জিনিসের পেছনে মানুষ পৃথিবীর জীবন ও সময় ব্যয় করে, তা এই চিরস্থায়িত্বের বিচারে সম্পূর্ণ মূল্যহীন। | কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ, সন্তোষজনক ও চিরস্থায়ী নেয়ামতের মধ্যে এবং অপর পক্ষের জন্যে নির্ধারিত পরিণতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
# পরবর্তী আয়াতগুলােতে এই শেষােক্ত পক্ষের পরিণামের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এটা কি উত্তম আপ্যায়ন, না যাক্কুম গাছ? ওটা আমি যালেমদের শাস্তি দেয়ার জন্যে প্রস্তুত রেখেছি।'(আয়াত ৬২-৬৮) এই চিরস্থায়ী নেয়ামত ভালাে ও মর্যাদাপূর্ণ, না যাক্কুম গাছ। যাক্কুম গাছ কি রকম? এটা এমন গাছ, যা উৎপন্ন হয় দোযখের তলদেশে, এর আকৃতি যেন শয়তানের মাথার মতো।’ শয়তানের মাথা কি রকম তা কেউ জানে না। তবে এই উপমা নিসন্দেহে আতংক সৃষ্টি করে। এর কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। আর এটা যাদের খেতে হবে ও পেট ভরে খেতে হবে, তাদের কী অবস্থা হবে তা সহজেই বুঝা যায়। এই গাছ আল্লাহ তায়ালা যালেমদের শাস্তির জন্যে তৈরী করেছেন। এর নাম যখন কাফেররা শুনেছিলাে, তখন উপহাস করে বলেছিলাে, দোযখের ভেতর কিভাবে গাছ জন্মাবে এবং তা পুড়ে ভষ্ম হবে না? আবু জাহল বললাে, হে কোরায়শী জনমন্ডলী, তােমরা জানাে, মােহাম্মদ যে যাক্কুমের গাছের ভয় দেখায় তা কী? তারা বললাে, না। সে বললাে, ‘ইয়াসরিবের মাখনের সাথে খেতে হয় এমন এক মজাদার খাবার। আল্লাহর কসম, আমি সুযােগ পেলে তৃপ্তি সহকারে যাক্কুম খেয়ে নেবাে’ কিন্তু এই যাক্কুমের গাছ তাদের পরিচিত সেই খাবার নয়। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। ‘তারা ওটা খাবে এবং পেট ভরে খাবে।’ বস্তুত শয়তানের মাথার মতো এই ফল তাদের গলায় কাঁটার মতাে বিধবে, তাদের পেট জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেবে। অথচ এটা জাহান্নামের ভেতরে জন্মে এবং পােড়ে না। কেননা ওটা জাহান্নামেরই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এটা খাওয়ার পর ঠান্ডা পানীয়ের প্রবল চাহিদা হবে যাতে এর জ্বালা নিবারণ হয়, কিন্তু এরপর গরম ও দূষিত পানি তাদের পান করতে হবে। তদুপরি তাদের জন্যে থাকবে পুজ মিশ্রিত ফুটন্ত পানি।’ এই নাশতা খাওয়ার পর তারা জাহান্নামে রক্ষিত খাবার টেবিলে ভুরি ভােজনের জন্যে ছুটে যাবে। আহ, সে কি জঘন্য খাবার এবং কি জঘন্য আপ্যায়ন। অতপর তারা জাহান্নামের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। এখানেই শেষ হচ্ছে জাহান্নামের এই নযীরবিহীন দৃশ্যের বর্ণনা। আর এখানেই শেষ সূরার প্রথম অংশ বা অধ্যায়। এ যেন বাস্তব দৃশ্যেরই একটা অংশ।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এমন রিযিক যার সমস্ত গুণাবলী বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। যা পাওয়ার ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। যে ব্যাপারে তারা একেবারে নিশ্চিন্ত যে, তা তারা চিরকাল পেতে থাকবে। যে ব্যাপারে কি পাওয়া যাবে কি না পাওয়া যাবে, এ ধরনের কোন অনিশ্চয়তা নেই।
# এর মধ্যে এদিকেও একটি সূক্ষ্ম ইশারা রয়েছে যে, জান্নাতে আহার্য দ্রব্যাদি খাদ্য হিসেবে নয় বরং স্বাদ উপভোগের জন্য ব্যবহৃত হবে। অর্থাৎ সেখানে খাবার এ উদ্দেশ্যে খাওয়া হবে না যে, শরীরের ক্ষয় হয়ে যাওয়া অংশগুলোর শূন্যতা পূরণ করা হবে। কারণ সে চিরন্তন জীবনে শরীরের অংশগুলোর কোন ক্ষয়ই হবে না। মানুষের সেখানে ক্ষুধাও লাগবে না। এ দুনিয়ায় শরীরের অংশের ক্ষয়ের কারণে মানুষের ক্ষুধা পায়। আর শরীর নিজেকে জীবিত রাখার জন্য সেখানে খাদ্যও চাইবে না। এ কারণে জান্নাতের খাদ্যের জন্য فواكه (ফাওয়াকেহ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থের মধ্যে “খাদ্যে পরিণত হওয়া” এর পরিবর্তে “স্বাদ উপভোগ করা” এর অর্থ অধিকতর লক্ষণীয়।
# আসলে এখানে শরাব শব্দটি সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি। বরং শুধুমাত্র كَأْسٍ (পানপাত্র) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু আরবী ভাষায় كَأْسٍ শব্দটি ব্যবহার করে সবসময় শরাব অর্থই গ্রহণ করা হয়। যে পেয়ালায় শরাবের পরিবর্তে দুধ বা পানি থাকে অথবা যে পেয়ালার কিছুই থাকে না তাকে كَأْس (কাস) বলা হয় না।” কাস শব্দটি একমাত্র তখনই বলা হয় যখন তার মধ্যে মদ থাকে।
# দুনিয়ায় ফল ও খাদ্য বস্তু পচিয়ে যে শরাব তৈরি করা হয় এ শরাব তেমন ধরনের হবে না। বরং তা প্রাকৃতিকভাবে ঝরণা থেকে উৎসারিত হবে এবং নদীর আকারে প্রবাহিত হবে। সূরা মুহাম্মাদের এ বিষয়বস্তুটি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

وَأَنْهَارٌ مِنْ خَمْرٍ لَذَّةٍ لِلشَّارِبِينَ

“আর শরাবের নদী, যা পানকারীদের জন্য হবে সুস্বাদু।”
# শরাবের পানপাত্র নিয়ে ঘুরে ঘুরে জান্নাতীদের মধ্যে কারা পরিবেশন করবে সেকথা এখানে বলা হয়নি‌। এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে অন্যান্য স্থানেঃ

وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ غِلْمَانٌ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ لُؤْلُؤٌ مَكْنُونٌ

“আর তাদের খিদমত করার জন্য ঘুরবে তাদের খাদেম ছেলেরা যারা এমন সুন্দর যেমন ঝিনুকে লুকানো মোতি।” (আত্ তূর, ২৪)

وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُخَلَّدُونَ إِذَا رَأَيْتَهُمْ حَسِبْتَهُمْ لُؤْلُؤًا مَنْثُورًا

“আর তাদের খিদমত করার জন্য ঘুরে ফিরবে এমন সব বালক যারা হামেশা বালকই থাকবে। তোমরা তাদেরকে দেখলে মনে করবে মোতি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।” (আদ দাহর, ১৯)

তারপর এর বিস্তারিত বর্ণনা হযরত আনাস (রা.) ও হযরত সামুরাহ ইবনে জুনদুবের (রা.) বর্ণিত রসূলুল্লাহ সল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসগুলো থেকে পাওয়া যায়। সেগুলোতে বলা হয়েছে “মুশরিকদের সন্তানরা জান্নাতবাসীদের সেবক হবে।” (আবু দাউদ তায়ালিসী, তাবারানী ও বাযযার) এ হাদীসগুলো সনদের দিক দিয়ে দুর্বল হলেও অন্যান্য বহু হাদীস থেকেও জানা যায়, যে শিশুরা বয়প্রাপ্ত না হয়ে মারা যায় তারা জান্নাতে যাবে। তাছাড়া একথাও হাদীস থেকে জানা যায় যে, যেসব শিশুর পিতামাতা জান্নাতবাসী হবে তারা নিজেদের বাপ-মায়ের সাথে থাকবে, যাতে তাদের চোখ শীতল হয়। এরপর অবশ্যই এমন সব শিশু থেকে যায় যাদের বাপ-মা জান্নাতী হবে না। কাজেই তাদের ব্যাপারে একথা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় যে, তাদেরকে জান্নাতবাসীদের খাদেম বানিয়ে দেয়া হবে। (সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনার জন্য “ফাতহুল বারী” ও “উমদাতুল কারী”র জানায়েয অধ্যায়ের ‘মুশরিকদের সন্তানদের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে’ অনুচ্ছেদে, “রাসায়েল ও মাসায়েল” ৩ খণ্ড ১৭৭-১৮৭ পৃষ্ঠা দেখুন।)
# দুনিয়ার শরাবে যে দু’ধরনের দোষ থাকে তা হবে তার স্পর্শ মুক্ত। দুনিয়ার শরাবের এক ধরনের দোষ হচ্ছে মানুষ তার কাছে আসতেই প্রথমে তার পচা দুর্গন্ধ নাকে পৌঁছে যায়। তারপর তার স্বাদ মানুষের জিহ্বাকে তিক্ত ও বিস্বাদ করে দেয়। এরপর গলার নিচে নামার সাথে সাথেই তা পেট চেপে ধরে। তারপর তা মাথায় চড়তে থাকে এবং মাথায় চক্কর দিতে থাকে। এরপর তা যকৃত বা কলিজাকে প্রভাবিত করে এবং মানুষের স্বাস্থের ওপর তার খারাপ প্রভাব পড়তে থাকে। তারপর যখন নেশা খতম হয়ে যেতে থাকে তখন মানুষ নিদ্রালুতা ও অবসাদে আক্রান্ত হয়। এসব হচ্ছে শারীরিক ক্ষতি। দ্বিতীয় ধরনের দোষ হচ্ছে, শরাব পান করে মানুষ বকবক করতে থাকে, উল্টা-পাল্টা আজে-বাজে অর্থহীন কথা বলতে থাকে, এগুলো শরাবের মানসিক ক্ষতি। দুনিয়ায় মানুষ কেবলমাত্র আনন্দ লাভের জন্য এ সমস্ত ক্ষতি বরদাশত করে। আল্লাহ‌ বলেন, জান্নাতের শরাবে আনন্দলাভ করা যাবে পূর্ণভাবে لَذَّةٍ لِلشَّارِبِينَ কিন্তু উপরোক্ত দু’ধরনের ক্ষতির কোনটারই সম্ভাবনা সেখানে থাকবে না।
# নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে না।
# সম্ভবত এরা সেসব মেয়ে হবে যারা প্রাপ্ত বয়স্কা হবার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে এবং যাদের পিতামাতা জান্নাতলাভের অধিকারী হয়নি। অনুমানের ভিত্তিতে একথা বলা যেতে পারে যে, এ ধরনের ছেলেদেরকে যেমন জান্নাতবাসীদের সেবায় নিযুক্ত করে দেয়া হবে এবং তারা হামেশা বালকই থাকবে ঠিক তেমনি এ ধরনের মেয়েদেরকে জান্নাতবাসীদের জন্য হূরে পরিণত করা হবে এবং তারা চিরকাল উঠতি বালিকাই থাকবে। অবশ্য এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন।
# মূলে বলা হয়েছে كَأَنَّهُنَّ بَيْضٌ مَكْنُونٌ “যেন তারা গোপন বা সংরক্ষিত ডিম” তাফসীর বিশারদগণ এ শব্দগুলোর বিভিন্ন ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। কিন্তু সঠিক ব্যাখ্যা সেটিই যেটি হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) নবী ﷺ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, আমি নবী করীমকে ﷺ এ আয়াতটির অর্থ জিজ্ঞেস করি। জবাবে তিনি বলেন, তাদের কোমলতা ও নাজুকতা এমন ঝিল্লির মতো হবে যা ডিমের খোসা ও তার সাদা অংশের মাঝখানে থাকে। (ইবনে জারীর)
# তোমারাও কি এমন দুর্বল বিশ্বাসীদের দলে ভিড়লে যারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের মতো অযৌক্তিক কথা মনে নিয়েছে?
# এ থেকে অনুমান করা যায়, আখেরাতে মানুষের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও বাকশক্তি কোন্ ধরনের হবে। জান্নাতে বসে এক ব্যক্তি যখন চাইবে কোন টেলিভিশন যন্ত্রের সহায়তা ছাড়াই সামান্য একটু ঝুঁকে পড়ে এমন এক ব্যক্তিকে দেখে নেবে যে তার থেকে নাজানি কত হাজার মাইল ব্যবধানে জাহান্নামের আযাবের মধ্যে আছে। তারপর এখানেই শেষ নয়, তারা দু’জনই কেবল দু’জনকে দেখতে পাচ্ছে না বরং তাদের মধ্যে কোন টেলিফোন বা রেডিও যোগাযোগ ছাড়াই তারা সরাসরি কথার আদান-প্রদানও করছে। এত দূরের ব্যবধান থেকে তারা কথা বলবে এবং পরস্পরের কথা শুনবে।
#‌ বর্ণনাভঙ্গী পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, নিজের জাহান্নামী বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ এ জান্নাতী লোকটি তার নিজের সাথে কথা বলতে থাকবে এবং এ তিনটি বাক্য তার মুখ থেকে এমনভাবে বের হবে যেন কোন ব্যক্তি নিজেকে সব ধরনের প্রত্যাশা ও অনুমানের ঊর্ধ্বের অবস্থায় পেয়ে চরম বিস্ময় ও আনন্দ বিহ্বলতার মধ্যে স্বতস্ফূর্তভাবে বলে যাচ্ছে। এ ধরনের কথায় কোন বিশেষ ব্যক্তিকে সম্বোধন করা হয় না এবং এখানে মানুষ যে প্রশ্ন করে তার উদ্দেশ্য আসলে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় না। বরং সেখানে মানুষের নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ ঘটে তার নিজের ভাষায়। এ জান্নাতী লোকটি জাহান্নামী লোকটির সাথে কথা বলতে বলতে সহসা অনুভব করতে থাকবে যে, তার সৌভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। এখন মৃত্যুও নেই, শাস্তিও নেই। সমস্ত কষ্টের অবসান ঘটেছে এবং সে এখন চিরন্তন জীবনের অধিকারী হয়েছে। এ অনুভূতির ভিত্তিতে সে স্বতস্ফূর্তভাবে বলে ওঠে, আমি এখন এ মর্যাদায় উপনীত হয়েছি?
# যাক্কুম এক ধরনের গাছ। তিহামা এলাকায় এ গাছ দেখা যায়। এর স্বাদ হয় তিতা, গন্ধ বিরক্তিকর এবং ভাঙলে এর মধ্য থেকে এক ধরনের দুধের মতো পদার্থ বের হয় যা গায়ে লাগলে গা ফুলে ওঠে ও ফোস্কা পড়ে।
# অস্বীকারকারীরা একথা শুনে কুরআনের নিন্দা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিদ্রূপ করার একটি নতুন সুযোগ পেয়ে যায়। এর ফলে তারা ঠাট্টা করে বলতে থাকে, নাও এখন নতুন কথা শোনো, জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে নাকি আবার গাছ জন্মাবে।
# এখানে এরূপ ভুল বুঝাবুঝি হওয়া চাই না যে, শয়তানের মাথা কে দেখেছে যে যাক্কুম গাছের ফুলকে তার সাথে তুলনা করা হয়েছে? আসলে এটি একটি কাল্পনিক উপমা। সাধারণভাবে প্রত্যেক ভাষার সাহিত্যে এর সাহায্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যেমন আমরা একটি মেয়ের পরমা সুন্দরী হবার ধারণা প্রকাশ কারার জন্য বলি, বাহ্! মেয়েটি পরীর মতো সুন্দরী। অন্যদিকে কোন মেয়ের ন্যায় চরম কদাকার রূপ বর্ণনা করার জন্য বলি, মেয়েটি যেন একটি পেত্নী। কোন ব্যক্তির নূরানী চেহারার বর্ণনা দেবার জন্য বলে থাকি, ঠিক ফেরেশতার মতো চেহারা। আর কেউ যদি অত্যন্ত ভয়াল ভীষণ আকৃতি নিয়ে সামনে আসে তাহলে আমরা বলি, তাকে ঠিক শয়তানের মতো দেখাচ্ছে।
# এ থেকে বুঝা যায় যে, জাহান্নামবাসীরা যখন ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে যেতে থাকবে তখন তাদেরকে হাঁকিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে যেখানে রয়েছে যাক্কুম গাছ ও টগবগে ফুটন্ত পানির ঝরণা। তারপর সেখান থেকে খানাপিনা শেষ করার পর তাদেরকে আবার তাদের জাহান্নামে ফিরিয়ে আনা হবে।
# তারা নিজেদের বুদ্ধি ব্যবহার করে তাদের বাপ-দাদাদের থেকে যে রীতি-রেওয়াজ চলে আসছে তা সঠিক কিনা সেকথা কোনদিন চিন্তা করেনি। ব্যাস, যে পথে অন্যদেরকে চলতে দেখেছে চোখ বন্ধ করে তারা সে পথেই চলতে থেকেছে।

Leave a Reply