(বই#১০৭৬) [* দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত নয়:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৭:সাফফাত পারা:২৩ ১১৪- ১৪৮ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭৬)
[* দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত নয়:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৭:সাফফাত
পারা:২৩
১১৪- ১৪৮ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১৪
وَ لَقَدۡ مَنَنَّا عَلٰی مُوۡسٰی وَ ہٰرُوۡنَ ﴿۱۱۴﴾ۚ
নিশ্চয় আমি অনুগ্রহ করেছিলাম মূসা ও হারূনের প্রতি,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১৫
وَ نَجَّیۡنٰہُمَا وَ قَوۡمَہُمَا مِنَ الۡکَرۡبِ الۡعَظِیۡمِ ﴿۱۱۵﴾ۚ
তাঁদের উভয়কে ও তাঁদের জাতিকে উদ্ধার করেছি মহাক্লেশ থেকে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১৬
وَ نَصَرۡنٰہُمۡ فَکَانُوۡا ہُمُ الۡغٰلِبِیۡنَ ﴿۱۱۶﴾ۚ
তাঁদেরকে সাহায্য করেছি, যার ফলে তাঁরাই বিজয়ী হয়েছে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১৭
وَ اٰتَیۡنٰہُمَا الۡکِتٰبَ الۡمُسۡتَبِیۡنَ ﴿۱۱۷﴾ۚ
তাঁদের উভয়কে অত্যন্ত সুস্পষ্ট কিতাব দান করেছি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১৮
وَ ہَدَیۡنٰہُمَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ ﴿۱۱۸﴾ۚ
উভয়কে সঠিক পথ দেখিয়েছি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১১৯
وَ تَرَکۡنَا عَلَیۡہِمَا فِی الۡاٰخِرِیۡنَ ﴿۱۱۹﴾ۙ
এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তাঁদের উভয়ের সম্পর্ক সুখ্যাতি অক্ষুণ্ন রেখেছি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২০
سَلٰمٌ عَلٰی مُوۡسٰی وَ ہٰرُوۡنَ ﴿۱۲۰﴾
মূসা ও হারূনের প্রতি সালাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২১
اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۲۱﴾
নিশ্চয় আমি এইভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২২
اِنَّہُمَا مِنۡ عِبَادِنَا الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۲۲﴾
নিশ্চয় তারা উভয়ে ছিলেন আমাদের মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২৩
وَ اِنَّ اِلۡیَاسَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۲۳﴾ؕ
নিশ্চয় ইল্‌য়্যাসও ছিলেন রসূলদের একজন;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২৪
اِذۡ قَالَ لِقَوۡمِہٖۤ اَلَا تَتَّقُوۡنَ ﴿۱۲۴﴾
যখন তিনি তার সম্পপ্রদায়কে বলেছিলেন, ‘তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২৫
اَتَدۡعُوۡنَ بَعۡلًا وَّ تَذَرُوۡنَ اَحۡسَنَ الۡخَالِقِیۡنَ ﴿۱۲۵﴾ۙ
তোমরা কি বা’আলকে ডাকো এবং পরিত্যাগ করো শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহকে,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২৬
اللّٰہَ رَبَّکُمۡ وَ رَبَّ اٰبَآئِکُمُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۱۲۶﴾
আল্লাহকে, যিনি প্রতিপালক তোমাদের এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের?’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২৭
فَکَذَّبُوۡہُ فَاِنَّہُمۡ لَمُحۡضَرُوۡنَ ﴿۱۲۷﴾ۙ
কিন্তু তারা তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল, কাজেই তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির জন্য উপস্থিত করা হবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২৮
اِلَّا عِبَادَ اللّٰہِ الۡمُخۡلَصِیۡنَ ﴿۱۲۸﴾
তবে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১২৯
وَ تَرَکۡنَا عَلَیۡہِ فِی الۡاٰخِرِیۡنَ ﴿۱۲۹﴾ۙ
আর ইলিয়াসের সম্পর্কে সুখ্যাতি আমি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অব্যাহত রেখেছি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩০
سَلٰمٌ عَلٰۤی اِلۡ یَاسِیۡنَ ﴿۱۳۰﴾
ইলিয়াসের প্রতি সালাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩১
اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۳۱﴾
নিশ্চয় আমি এইভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩২
اِنَّہٗ مِنۡ عِبَادِنَا الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۳۲﴾
তিনি তো ছিলেন আমাদের মুমিন বান্দাদের অন্যতম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩৩
وَ اِنَّ لُوۡطًا لَّمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۳۳﴾ؕ
নিশ্চয় লূতও ছিলেন রসূলদের একজন।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩৪
اِذۡ نَجَّیۡنٰہُ وَ اَہۡلَہٗۤ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿۱۳۴﴾ۙ
আমি তাকে এবং তার পরিবারের সকলকে উদ্ধার করেছিলাম;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩৫
اِلَّا عَجُوۡزًا فِی الۡغٰبِرِیۡنَ ﴿۱۳۵﴾
পিছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত এক বৃদ্ধা ছাড়া।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩৬
ثُمَّ دَمَّرۡنَا الۡاٰخَرِیۡنَ ﴿۱۳۶﴾
তারপর বাকি সবাইকে ধ্বংস করে দেই।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩৭
وَ اِنَّکُمۡ لَتَمُرُّوۡنَ عَلَیۡہِمۡ مُّصۡبِحِیۡنَ ﴿۱۳۷﴾
এখন তোমরা দিনরাত তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকা অতিক্রম করে থাক।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩৮
وَ بِالَّیۡلِ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۱۳۸﴾٪
এবং রাতে, তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৩৯
وَ اِنَّ یُوۡنُسَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۳۹﴾ؕ
আর অবশ্যই ইউনুস রসূলদের একজন ছিলেন।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪০
اِذۡ اَبَقَ اِلَی الۡفُلۡکِ الۡمَشۡحُوۡنِ ﴿۱۴۰﴾ۙ
স্মরণ করুন, যখন তিনি বোঝাই নৌযানের দিকে পালিয়ে গেলেন,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪১
فَسَاہَمَ فَکَانَ مِنَ الۡمُدۡحَضِیۡنَ ﴿۱۴۱﴾ۚ
অতঃপর লটারি হলে সে হেরে গেলেন।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪২
فَالۡتَقَمَہُ الۡحُوۡتُ وَ ہُوَ مُلِیۡمٌ ﴿۱۴۲﴾
অতঃপর এক বড় আকারের মাছ তাকে গিলে ফেলল, আর তিনি ছিলেন ধিকৃত।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪৩
فَلَوۡ لَاۤ اَنَّہٗ کَانَ مِنَ الۡمُسَبِّحِیۡنَ ﴿۱۴۳﴾ۙ
তিনি যদি আল্লাহর তাস্‌বীহকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হতেন,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪৪
لَلَبِثَ فِیۡ بَطۡنِہٖۤ اِلٰی یَوۡمِ یُبۡعَثُوۡنَ ﴿۱۴۴﴾ۚؒ
তাহলে তিনি পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মাছের পেটে থেকে যেতেন।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪৫
فَنَبَذۡنٰہُ بِالۡعَرَآءِ وَ ہُوَ سَقِیۡمٌ ﴿۱۴۵﴾ۚ
অতঃপর ইউনুসকে আমি গাছ-পালাহীন সৈকতে নিক্ষেপ করলাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪৬
وَ اَنۡۢبَتۡنَا عَلَیۡہِ شَجَرَۃً مِّنۡ یَّقۡطِیۡنٍ ﴿۱۴۶﴾ۚ
এবং তার ওপর একটি লতানো গাছ উৎপন্ন করলাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪৭
وَ اَرۡسَلۡنٰہُ اِلٰی مِائَۃِ اَلۡفٍ اَوۡ یَزِیۡدُوۡنَ ﴿۱۴۷﴾ۚ
এরপর আমি তাঁকে এক লাখ বা এর চেয়ে বেশী লোকদের কাছে পাঠালাম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪৮
فَاٰمَنُوۡا فَمَتَّعۡنٰہُمۡ اِلٰی حِیۡنٍ ﴿۱۴۸﴾ؕ
তারা ঈমান আনলো এবং আমি একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত তাদেরকে টিকিয়ে রাখলাম।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*ইবরাহীম (আ.)-এর পরবর্তী নবী রসূলদের ঘটনাবলী : ওপরে যে দুই জন নবীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের উভয়ের বংশের মধ্যে ছিলেন নবী মূসা ও হারুন। ‘আমি মহান আল্লাহ, মেহেরবানী করেছি মূসা ও হারুনের ওপর… ওরা দুজনই ছিলাে আমার মােমেন বান্দা।'(আয়াত ১১৪-১২২) মূসা ও হারুন(আ.)-এর সময় যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলাে থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের তৎকালীন সকল মানবমন্ডলীর মধ্য থেকে পছন্দ করে নবী বানিয়েছেন এবং তাদের প্রতি বিরাট মেহেরবানী দান করেছেন। শুধু কি তাই? তাদের প্রতি যেমন প্রভূত ইহসান করেছেন, তেমনি ইহসান করেছেন তাদের জাতির সাথেও। তাঁদের সেসব কঠিন কঠিন দুঃখ থেকে নাজাত দিয়েছেন যার বিবরণ অন্যান্য সূরার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। তিনি তাদের ফেরাউন ও তার সর্দারদের সীমাহীন যুলুম নির্যাতন থেকে রক্ষা করেছেন। অবশেষে ফেরাউন ও তার সভাসদদের ওপর তাদের বিজয়ী করেছেন। অতপর তাদের সুস্পষ্ট কিতাব দান করে এবং সরল সঠিক ও মযবুত পথে পরিচালনা করে সম্মানিত করেছেন। এ হচ্ছে সেই মযবুত পথ যার সন্ধান তিনি মুমিনদের দিয়েছেন এবং তাদের অনাগত ভবিষ্যতে বহুকাল ধরে মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায় বাঁচিয়ে রেখেছেন। মহাকালের শেষ অবধি মানুষের মধ্যে তাদের চর্চা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। তারপর মূসা ও হারুনের প্রতি আল্লাহর সালাম বর্ষণের সাথে এ প্রসংগের ইতি টানা হয়েছে। অতপর সূরাটির বিভিন্ন অংশে ইহসানকারীদের সাথে আল্লাহ তায়ালা কত সদ্ব্যবহার করেন এবং তাদের কতভাবে পুরস্কৃত করেন সে বিষয়ে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে; উল্লেখিত হয়েছে তাদের সেই মযবুত ঈমানের কথা যার কারণে মােমেনদের তিনি চিরদিন সম্মানিত করে থাকেন। এরপর মূসা ও হারুনের ঘটনাবলীর মতােই নবী ইলিয়াস(আ.)-এর আমলে সংঘটিত ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। অবশ্য সাধারণভাবে জানা যায়, প্রাচীন আমলের ইতিহাসে তাঁকে ইলিয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে পাঠানাে হয়েছে সিরিয়ায় একটি জাতির কাছে, যারা বা’ল নামক এক প্রতিমার পূজা করতাে, তাদের নগরীর কিছু কিছু ভগ্নাবশেষ এখনও লেবাননের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বিভিন্ন পল্লীতে দেখা যায়। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই সে আমার অনুগত বান্দাদের মধ্যে একজন ছিল।'(আয়াত ১২৩-১৩২) ইলিয়াস(আ.) ও তাঁর জাতিকে তৌহিদী বিশ্বাস গ্রহণ করার জন্যে আহবান জানিয়েছেন এবং বা’ল নামক এক পাথর মূর্তির পূজার অসারতা ও কদর্যতা বর্ণনা করে তিনি এ অন্যায় কাজ পরিত্যাগ করার জন্যে তাদের প্রাণপণ উপদেশ দিয়েছেন। তিনি তাদের একথা বুঝানাের চেষ্টা করেছেন যে, পূজা অর্চনা অন্ধ আনুগত্য করা একমাত্র তাঁর জন্যেই সম্ভব যিনি সর্বোত্তম সৃষ্টিকারী। মানুষ ইট পাথর বা মাটি দিয়ে যেসব মূর্তি বানায় তাদের ওরা সৃষ্টিকর্তা মনে করে, তাদের সামনে মাথা নত করে এবং তাদের খুশী করার চেষ্টা করে, এটা জঘন্য শিরক। এজন্যে আল্লাহ তায়ালা তাদের চিন্তা করার আহ্বান জানাচ্ছেন যে, সৃষ্টিকারী বলে যাদের তােমরা প্রচার করছো তারা তাে এমনই নিকৃষ্ট যে, একটি মাছিও সৃষ্টি তারা করতে পারে না, অথচ তাকে পরিত্যাগ করছে যিনি সকল দিক দিয়ে পূর্ণাংগ সৃষ্টিকর্তা। তিনিই তাদের এবং তাদের পূর্ববর্তী সকল বাপ দাদাদের রব, মালিক মনিব, প্রতিপালক ও একচ্ছত্র অধিপতি। একইভাবে ইবরাহীম(আ.) ও তার পিতা এবং তার জাতির মূর্তিপূজা রূপ জঘন্য আচরণকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অন্যান্য রসূলরাও তাদের মূর্তিপূজারী জাতির অন্ধ বিশ্বাসজনিত পূজা অর্চনাকে ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু মহান এই পয়গম্বরকেও প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাই আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা কসম খেয়ে বলছেন এবং পরিপূর্ণ গুরুত্ব সহকারে জানাচ্ছেন যে, অনিচ্ছা সত্তেও তাদের সবাইকে মিথ্যাচার ও প্রত্যাখ্যানের স্বাদ গ্রহণের জন্যে (কেয়ামতের দিন) একত্রিত করা হবে। এই কঠিন পরিণতি থেকে ওদের মধ্যকার তারাই রেহাই পাবে যারা ঈমান এনেছে এবং একান্তভাবে জীবনের সকল দিক ও বিভাগে আল্লাহর নিরংকুশ নিশর্ত আনুগত্য করেছে। ইলিয়াস(আ.) সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত আলােচনার ইতি টানতে গিয়ে পুনরায় রসূলদের সকলের সেই মূল দায়িত্ব সম্পর্কে জানানাে হচ্ছে যা পালনের মাধ্যমে তাদের বিভিন্নভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। ইহসানকারীদের প্রতিদান সম্পর্কিত বর্ণনা এসেছে এবং ঈমান ও মােমেনের যথাযথ মূল্য জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ওপরে বর্ণিত ইলিয়াস(আ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত এখানে আরও একবার পেশ করার পর আমরা আয়াত ‘সালামুন আলা ইল ইয়াসীন’-এর ওপর একটু চিন্তা ভাবনা করতে চাই। দেখুন, ইলিয়াস নামটিকে একটু টেনে সুর দিয়ে উচ্চারণ করতে গিয়ে আল কোরআনে ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুযায়ী কী চমৎকার একটি ধ্বনি উত্থিত হয়েছে।(দেখুন ‘আতাসওয়ীরুল ফান্নীউ ফিল কোরআন’) ইল ইয়াসীন ইল ইয়াসীন। এরপর নযর পড়ছে লূত(আ.)-এর কিসসার প্রতি, যার বর্ণনা ইবরাহীম(আ.) সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বার বার এসেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিসন্দেহে লূত ছিলো রাসূলদের একজন… রাতের বেলায়, তবুও কি তােমরা (এই বিরাট ঘটনা থেকে) কিছু শিক্ষা গ্রহণ করবে না?'(আয়াত ১৩৩-১৩৮) নূহ(আ.) সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে তার সাথে উপরােক্ত (লূত আ.-এর) ঘটনার বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়। উক্ত কাহিনী থেকে লূত(আ.) এর পয়গম্বর হওয়া এবং তার স্ত্রী ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গযব থেকে নাজাত লাভ করার কথা জানা যায়, জানা যায় সত্য প্রত্যাখ্যানকারী ও সত্য পথ পরিহারকারীদের সম্পূর্ণভাবে ধংস হয়ে যাওয়ার সংবাদও। এতে গভীরভাবে সেসব আরবদের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে এ প্রসংগের ইতি টানা হয়েছে, যারা সকাল সন্ধ্যা লূত(আ.)-এর ধংসপ্রাপ্ত এলাকার পাশ দিয়ে যাতায়াত করে, কিন্তু তাদের হৃদয়ে সাড়া জাগে না, তারা সেসব ধ্বংসাবশেষের কাহিনীর কথা খেয়ালও করে না। আফসােস, তারা সেই চরম দুঃখজনক পরিণতির কোনাে ভয়ও করে না।

*হযরত ইউনুস(আ.)-এর ঘটনা : মাছওয়ালা নবী ইউনুস(আ.)-এর বৃত্তান্ত বর্ণনার সাথে এ অধ্যায়টি সমাপ্ত হচ্ছে। ‘আর ইউনুসও একজন রসূল ছিলাে…. অতপর তারা ঈমান আনল, যার কারণে আমি মহান আল্লাহ এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের ধনদৌলতসহ বিভিন্ন জীবন সামগ্রী সরবরাহ করতে থাকলাম।’ ইউনুস(আ.)-এর কওম যে ঠিক কোন এলাকায় বসবাস করতাে আল কোরআন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানায়নি, তবে সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে যে, তারা সাগর উপকূলবর্তী কোনাে এক এলাকায় বাস করত। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তাঁর কওমের দুর্ব্যবহারের কারণে তাঁর অন্তরটা অত্যন্ত সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিলাে, যার কারণে তিনি তাদের আসন্ন আযাবের ভয় দেখালেন এবং ভীষণভাবে রেগে গিয়ে তাদের পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। অতপর তার ক্রোধ তাঁকে সাগর সৈকতের দিকে নিয়ে গেলাে, যেখানে গিয়ে তিনি এক সমুদ্রগামী লােক ভর্তি জাহাজে আরােহণ করলেন। জাহাজ যখন গভীর মহাসাগরে উপনীত হলাে তখন সমুদ্র বক্ষ প্রচন্ড বায়ু ও উত্তাল তরংগাভিঘাতে উন্মত্ত হয়ে উঠলাে। এসময় আরােহীরা প্রমাদ গুনল যে, অবশ্যই জাহাজের মধ্যে এমন কোনাে অলক্ষুণে ব্যক্তি উপস্থিত রয়েছে যার কঠিন অপরাধের কারণে তাদের আজকের এই দুর্গতি; তাকে সাগরবক্ষে নিক্ষেপ করলেই হয়তাে এই জাহাজটি ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার পেয়ে যাবে। অতপর তারা যাত্রীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে সেই অপরাধী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে উদ্যোগী হলাে এবং অবশেষে তাতে ইউনুস(আ.)-এর নাম ওঠলাে। যদিও উপস্থিত যাত্রীদের মধ্যে তিনি ভালাে মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন, তা সত্তেও লটারির মাধ্যমে তাঁর নাম উঠানোতে তারা একে অধিকতর গুরুত্ব দিলাে এবং নির্দ্বিধায় তাকে সেই বিক্ষুব্ধ সাগরের বুকে নিক্ষেপ করলাে, আর অমনি এক বৃহদাকার মাছ এসে তাকে গিলে ফেললাে। তিনি তাে নিন্দিতই ছিলেন, অর্থাৎ প্রকৃতই তিনি নিন্দার পাত্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাকে যে দায়িত্বে নিয়ােজিত করেছিলেন সেই মহা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পরিত্যাগ করে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন। আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই তিনি তার জাতিকে ছেড়ে দিয়ে শুধু নিজের জানটা নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। এরপর মাছের পেটের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যখন ত্রুটি ধরা পড়লাে তখন তিনি আল্লাহ রব্বুল আলামীনের তাসবীহ জপতে শুরু করলেন, তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন এবং বুঝলেন যে, অবশ্যই তিনি তার অপরাধের কারণে যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। ‘সুতরাং তিনি পড়তে শুরু করলেন, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোনাে মাবুদ নেই, অবশ্যই আমি যালেমদের দলভুক্ত হয়ে পড়েছি।’ অতপর মেহেরবান আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করলেন এবং তাকে পুরােপুরিভাবে ক্ষমা করে দিলেন। তারপর সেই মাছটি তাকে উগরে দিলাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তিনি তাসবীহ জপতে শুরু না করতেন তাহলে অবশ্যই কেয়ামত পর্যন্ত সেই মাছের পেটের মধ্যেই থেকে যেতেন।’ মাছটি তাকে উগরে দেয়ার পর তিনি যে মুহূর্তে বাইরে এলেন তখন তিনি উলংগ ও অসুস্থ অবস্থায় একটি দ্বীপের কিনারায় উৎক্ষিপ্ত হলেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর তার জন্যেই আমি মহান আল্লাহ উৎপন্ন করলাম লতাবিশিষ্ট একটি লাউ গাছ।’ ‘ইয়াকতীন’ বলতে কোনাে কোনাে সময় পানিকদু বা লাউও বুঝায়। ইউনুস(আ.) যখন দ্বীপের কিনারায় নিক্ষিপ্ত হলেন তখন তাঁকে সেই দ্বীপে উৎপন্ন লাউয়ের বিরাট পাতা ছায়া করে ফেললাে এবং সেই পাতাগুলাে তাঁর গায়ে মাছি পড়া থেকে তাঁকে রক্ষা করলাে। কথিত আছে, এমন গাছের কাছেও নাকি মাছি ঘেঁষে না। অবশ্য এটা ছিলাে সম্পূর্ণ আল্লাহর তদবীর ও মেহেরবানীরই ফল। তারপর তিনি পুরােপুরি সুস্থ হয়ে ওঠলে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তাঁর পরিত্যক্ত জাতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি রাগ করে যখন তাদের ছেড়ে চলে এসেছিলেন তখন তারা একথা মনে করে ভীষণভাবে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাে যে, আল্লাহর রসূল ইউনূস(আ.) তাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অবশ্যই তাদের সেই আযাব ঘিরে ফেলবে যার ভয় তিনি তাদের দেখিয়েছিলেন। এজন্যে ইউনুস(আ.) বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তারা অবিলম্বে ঈমান এনে ফেলেছিলাে এবং তাওবা এস্তেগফার করে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছিলাে। কাজেই আল্লাহ তায়ালাও তাদের ডাকে সাড়া দিলেন এবং তাঁর রসূলকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে পাওনা শাস্তি থেকে তাদের রেহাই দিলেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর তারা ঈমান আনল, যার কারণে আমি মহান আল্লাহ, এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের দুনিয়ার সুখ সম্পদ দিয়ে ধন্য করলাম।’ এরা সংখ্যায় লাখখানেক কি তার থেকেও হয়তাে কিছু বেশী ছিলাে, তারা সবাই ইউনুস(আ.)-এর ফিরে যাওয়ার পর ঈমান এনােছিলাে। উপস্থিত প্রসংগের আলােচনায় ঈমানদারদের শুভ পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা গেলাে এবং পাশাপাশি, পেছনের অন্যান্য কাহিনী থেকেও বেঈমানদের ওপর কি কি শাস্তি নেমে এসেছে তা বুঝা গেলাে। সুতরাং মােহাম্মদ(স.)-এর জাতি যখন এ ঘটনাবলী পড়বে তখন তাদের বুঝমতাে যে কোনাে পথ বেছে নিতে পারবে। এভাবে সূরাটির এ অধ্যায়টিতে বর্ণিত দীর্ঘ এক ঐতিহাসিক কাহিনীর আলােচনা শেষ হচ্ছে, যার ধারা বর্ণনা নূহ(আ.) এর আমল থেকে চলে আসছে। যাদের বিভিন্ন আদলে সতর্ক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে ঈমান এনেছে এবং অনেকে ঈমান আনেও নাই।

 

 

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১১৪-১২২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীদ্বয় মূসা ও হারূন (আঃ)-এর আলোচনা নিয়ে এসেছেন। তিনি তাঁদেরকে নবুওয়াত ও রিসালাত দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন এবং (الْكَرْبِ الْعَظِيْمِ) তথা ফির‘আউনের অত্যাচার ও দাসত্ব থেকে তাঁদেরকে নাজাত দিয়েছেন।
১২৩-১৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় বান্দা ও নাবী ইলিয়াস (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এছাড়া সূরা আন‘আমের ৮৩-৮৫ নম্বর আয়াতে ১৮ জন নাবীর তালিকায়ও তাঁর নাম রয়েছে। ইলিয়াস (আঃ) হলেন হারুন (আঃ)-এর বংশোদ্ভূত হিযক্বীল (আঃ)-এর পর এবং আল-ইয়াসা‘ (আঃ)-এর পূর্বে দামেষ্কের পশ্চিমে বা‘লাবাক্কা (بعلبك) অঞ্চলে বানী ইসলাঈলের প্রতি প্রেরিত একজন নাবী। অনেকে সে জায়াগার নাম সামেরা বলেছেন যা ফিলিস্তিনের মধ্যে পশ্চিমে অবস্থিত। সেখানকার মানুষ বা’আল (بعل) নামক এক মূর্তির উপাসনা করত। তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ তা‘আলার ভয় প্রদর্শন করলেন এবং মূর্তির পূজা করতে নিষেধ করলেন। তাদের সামনে স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলার অনুদান তুলে ধরলেন যে, তিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্বপরুষদেরকে সৃষ্টি করেছে, তোমাদেরকে উত্তম অবয়ব দান করেছেন। সুতরাং তোমরা সে আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে বা‘আল দেবতার ইবাদত করছ? কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর কথায় কর্ণপাত করল না, বরং তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং শির্কের ওপর অটল রইল। অবশেষে তারা শাস্তির হক্বদার হয়ে গেল।

(إِلْ يَاسِيْنَ) ‘ইলয়াসীন’ ইলিয়াস শব্দের রূপান্তর। যেমন রূপান্তরে তুরে সাইনা-কে তুরে সীনীনও বলা হয়।

ইলয়াস (আঃ) কে কোন কোন কিতাবে ঈলিয়াও বলা হয়েছে। কুরআনের অধিকাংশ জায়গায় নাবী ও রাসূলদের বর্ণনা করার পর এ বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে যে, সে আমার মু’মিন বান্দাদের একজন ছিল। এর দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে- (১) তাঁর মহান চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ, যা ঈমানের জরুরী অংশ। যাতে সে-সকল মানুষ, যারা অনেক নাবীদের চারিত্রিক দুর্বলতার কথা বলে থাকে, তাদের কথা খন্ডন হয়ে যায়। যেমন বর্তমান তাওরাত ও ইনজিলে অনেক নাবীদের বিষয়ে এরূপ মনগড়া কেচ্ছা কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। (২) ঐ সকল মানুষের ধারণা খন্ডন, যারা অনেক নাবীদের গুণাবলীতে অতিরঞ্জিত করে, তাদের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার গুণ ও ক্ষমতা সাব্যস্ত করে। অর্থাৎ তারা অব্যশই নাবী ছিলেন, আর ছিলেন আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বা দাস। তারা না ছিলেন মা‘বূদ, বা তাঁর অংশ, আর না ছিলেন তাঁর অংশীদার।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. বানী ইসরাঈল আহলে কিতাব হওয়া সত্ত্বেও এবং তাদের মাঝে অসংখ্য নাবী-রাসূলের আগমন সত্ত্বেও সঠিক শিক্ষা ও প্রচারের অভাবে মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়েছিল। অনুরূপ মুসলিমদের মাঝে বিশুদ্ধ আকীদাহ ও আমলের প্রচার ও প্রসার না থাকায় অনেকে পীরপূজা, কবর পূজা ইত্যাদিতে লিপ্ত।
২. মানুষের মাঝে আল্লাহ তা‘আলার মহত্ত্ব ও বাতিল মা‘বূদের দুর্বলতা তুলে ধরতে হবে, তাহলে বাতিল মা‘বূদ সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে।
৩. সর্বদা সমাজের কতক ন্যায়নিষ্ঠ মানুষকে তাওহীদের দাওয়াতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। কারণ তাওহীদবিহীন কোন ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়।
১৩৩-১৩৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানে আল্লাহ তা‘আলা লূত (আঃ)-এর নবুওয়াত ও তাঁর অবাধ্য সম্প্রদায়ের ধ্বংসের কথা বর্ণনা করছেন। এ সম্পর্কে পূর্বে একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

عَجُوْزًا বা বৃদ্ধা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো লূত (আঃ)-এর স্ত্রী। তাঁর স্ত্রী কাফির ছিল, তাই তাকেও ধ্বংস করে দেয়া হয়।

(وَإِنَّكُمْ لَتَمُرُّوْنَ عَلَيْهِمْ)

‘আর তোমরা তো তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘরের ওপর দিয়ে যাতায়াত কর ভোর বেলায়’ এখানে মক্কাবাসীকে সম্বোধন করা হয়েছে, যারা ব্যবসায়ের জন্য সফর করতে গিয়ে সে বিধ্বস্ত এলাকার ওপর দিয়ে যাতায়াত করত। তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমরা সকাল ও রাতে সে এলাকা দিয়ে অতিক্রম করছ, যেখানে বর্তমানে মৃত সাগর অবস্থিত, যা দেখতেও বড় বিশ্রী এবং পচা-সড়া ও দুর্গন্ধময়। তোমরা কি তাদের এ অবস্থা দেখেও এ কথা অনুধাবন করতে পারছ না যে, রাসূলদেরকে মিথ্যা মনে করার ফলে তাদের এ নিকৃষ্ট পরিণতি। তবে তোমাদের আচরণের ফলও তাদের থেকে পৃথক কেন হবে? তোমরাও সেই কর্মই করছ, যা তারা করেছে। তবে এর পরেও তোমরা আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সূরা আ‘রাফের ৮০-৮৪, হূদের ৭৬-৮৩ নম্বর আয়াতে করা হয়েছে।
১৩৯-১৪৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ইউনুস (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

ইউনুস (আঃ) সম্পর্কে কুরআনের ৬টি সূরার ১৮টি আয়াতে বর্ণনা এসেছে। সূরা ইউনুসের ৯৮ নম্বর আয়াতে তাঁর নাম ইউনুস, সূরা আম্বিয়ার ৮৭ নম্বর আয়াতে যুন-নূন (ذو النون) এবং সূরা কালামের ৪৮ নম্বর আয়াতে তাঁকে সাহেবুল হূত (صاحب الحوت) বলা হয়েছে। ‘নূন’ ও ‘হূত’ উভয় শব্দের অর্থ মাছ। যুন-নূন ও সাহেবুল হূত অর্থ মাছওয়ালা। একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন।

সংক্ষিপ্ত ঘটনা : আল্লাহ তা‘আলা ইউনুস (আঃ)-কে ইরাকের নীনাওয়া (বর্তমান মুসেল) নামক শহরের নিকটবর্তী জনপদের অধিবাসীদের প্রতি নাবী হিসেবে প্রেরণ করেন। এখানে আশুরীদের শাসন ছিল, যারা এক লক্ষ্য বানী ইসরাঈলকে বন্দী করে রেখেছিল, সুতরাং তাদের হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য ইউনুস (আঃ)-কে নাবী করে প্রেরণ করা হয়। তিনি যথারীতি তাঁর সম্প্রদায়কে তাওহীদের দিকে আহ্বান করলেন। কিন্তু তারা তাঁর কথায় কর্ণপাত করল না এবং ঈমানও আনল না। বারংবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ইতোমধ্যে তাঁর জাতির ওপর আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। তিনি জনপদ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, তিনদিন পর তোমাদের ওপর আযাব আসতে পারে। তারা ভাবল নাবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে তাঁর জাতি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও শির্ক হতে তাওবা করে এবং সকলকে নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে আসন্ন গযব হতে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করে, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের তাওবা কবূল করেন এবং আযাব তুলে নেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَلَوْلَا کَانَتْ قَرْیَةٌ اٰمَنَتْ فَنَفَعَھَآ اِیْمَانُھَآ اِلَّا قَوْمَ یُوْنُسَﺋ لَمَّآ اٰمَنُوْا کَشَفْنَا عَنْھُمْ عَذَابَ الْخِزْیِ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَمَتَّعْنٰھُمْ اِلٰی حِیْنٍ)

“অতএব কোন জনপদবাসী কেন এমন হল না যে, তারা এমন সময় ঈমান আনত যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? তবে ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতীত। তারা যখন ঈমান আনল তখন আমি তাদের হতে পার্থিব জীবনের অপমানজনক শাস্তি তুলে নিলাম এবং তাদেরকে কিছু কালের জন্য জীবনোপকরণ ভোগ করতে দিলাম।” (সূরা ইউনুস ১০ : ৮৬)

ওদিকে ইউনুস (আঃ) ভেবেছিলেন যে, তাঁর জাতি আল্লাহ তা‘আলার গজবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে জানতে পারলেন যে, আদৌ গযব আসেনি। তখন তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন যে, এখন তাঁর জাতি তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসেবে তৎকালীন প্রথানুযায়ী তাকে হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে এমনকি আল্লাহ তা‘আলার হুকুমেরও অপেক্ষা না করে রাগান্বিত হয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এ কথাই অত্র সূরার ১৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে।

أَبَقَ শব্দের অর্থ প্রভুর নিকট থেকে কোন গোলাম পালিয়ে যাওয়া। ইউনুস (আঃ)-এর জন্য এ শব্দ ব্যবহার করার কারণ এই যে, তিনি আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি না নিয়েই নিজ এলাকা থেকে চলে গিয়েছিলেন। নাবীরা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা। তাঁদের সামান্য পদস্খলনও বিরাটাকারে ধরপাকড়ের কারণ হয়ে যায়। এ কারণেই এ কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

মাছের পেটে ইউনুস (আঃ) :

হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হলে মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে।

سَاهَمَ অর্থ লটারী করা। অর্থাৎ কাকে নদীতে ফেলবে এ জন্য লটারী করা হয়। লটারীতে পরপর তিনবার ইউনুস (আঃ) এর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন।

ادحاض অর্থ কাউকে অকৃতকার্য করে দেয়া, পরাজিত হওয়া। অর্থাৎ বারবার লটারীতে তিনবার ইউনুস (আঃ) এর নাম উঠতে থাকে ফলে পরাজিত ব্যক্তির ন্যায় সাগরে নিক্ষেপ করা হয়।

নদীতে ফেলে দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে একটি বিরাটকার মাছ তাঁকে গলধঃকরণ করে। কিন্তু তিনি মাছের পেটে হযম হননি বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা। মাওয়ার্দী বলেন : মাছের পেটে অবস্থান করাটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিল না বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকে। (কুরতুবী, সূরা আম্বিয়ার ৮৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর)

ইউনুস (আঃ)-এর মুক্তি :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَلَوْلَآ أَنَّه۫ كَانَ مِنَ الْمُسَبِّحِيْنَ)

অর্থাৎ যদি মাছের পেটে যাওয়ার পূর্ব থেকেই তাঁর অধিক ইবাদত ও সৎআমল না থাকত এবং মাছের পেটে যাওয়ার পর তাওবা ইস্তিগফার ও তাসবীহ পাঠ না করত তাহলে মাছের পেটেই থেকে যেতো, সেখানেই তার কবর হতো এবং সেখান হতেই কিয়ামতের দিন পুনরুত্থান হতো। তাওবাহ-ইস্তিগফার ও তাসবীহ দ্বারা বিপদাপদ দূর হয় এবং তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সূরা আম্বিয়ায় বর্ণিত হয়েছে যে, ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে থাকাবস্থায় বিশেষভাবে এ কালেমা পাঠ করতেন-

( لَّآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنْتَ سُبْحٰنَكَ ﺣ إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِيْنَ)

‘তুমি ব্যতীত কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; তুমি পবিত্র, মহান! আমি তো সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আম্বিয়া ২১ : ৮৭)

তাঁর অধিক পরিমাণ ইবাদত ও সৎ আমল এবং তাওবা ইস্তিগফারের ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওবা কবূল করত মাছের পেট থেকে জীবিত অবস্থায় নদীর তীরে তরুলতাহীন শূন্য এলাকায় রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَنَبَذْنٰهُ بِالْعَرَا۬ءِ) العراء

অর্থ গাছ-পালা তরুলতা শূন্য এলাকা। অর্থাৎ মাছের পেট থেকে নিক্ষেপিত হয়ে এক মরু এলাকায় পতিত হলেন, যেখানে কোন গাছ পালা কিছুই ছিল না। তখন ইউনুস (আঃ) স্বাভাবিকভাবেই রুগ্ন ছিলেন। ঐ অবস্থায় সেখানে উদ্গত লাউ জাতীয় গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করেছিলেন যা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ছিল।

يَّقْطِيْنٌ ঐ সকল গাছকে বলা হয়, যা নিজ কান্ডের ওপর দাঁড়াতে পারে না। যেমন লাউ, কুমড়া ইত্যাদি গাছ। কোন বর্ণনাতে লাউ গাছের কথা উল্লেখ রয়েছে। ছায়া ও অন্য উপকার নেয়ার জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

অতঃপর সুস্থ হয়ে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে নিজ জাতির কাছে ফিরে আসেন। জাতির লোকেরা তাঁর প্রতি ঈমান আনল এবং শির্ক থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহ তা‘আলা ইবাদত করতে লাগল, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দুনিয়ার সুখসম্পদ ভোগ করার সুযোগ করে দেন।

(وَأَرْسَلْنٰهُ إِلٰي مِائَةِ) এখান থেকে কোন কোন মুফাসসিরগণ বলতে চেয়েছেন যে, ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে যাওয়ার পর নবুওয়াত পেয়েছেন। আল্লামা বাগাভী (রহঃ) বলেন : এ ঘটনার পরে তাঁকে অন্য এক জাতির কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। তাদের সংখ্যা ছিল এক লাখ অথবা ততোধিক। কিন্তু কুরআন ও হাদীস থেকে এ উক্তির কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। এখানে ঘটনার শুরুতেই ইউনুস (আঃ)-এর রিসালাত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, মাছের ঘটনা নাবী হওয়ার পর ঘটেছে। অতঃপর এখানে বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করার কারণ এই যে, সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে পুনরায় সেখানেই প্রেরণ করা হয়েছিল। এতে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, তারা অল্পসংখ্যক লোক ছিল না, বরং তাদের সংখ্যা ছিল লাখেরও ওপরে।

সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত নাবীদের দাওয়াত কবূল করে নেয়া। তাহলে দুনিয়ার শাস্তি হতে রক্ষা ও পরকালে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আর ইউনুস (আঃ)-এর উক্ত দু‘আ দু‘আয়ে ইউনুস নামে পরিচিত।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : বিপদগ্রস্ত কোন মুসলিম যদি (নেক মকসূদ হাসিলে নিয়তে)

( لَّآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنْتَ سُبْحٰنَكَ ﺣ إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِيْنَ)

দু‘আ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তা কবূল করবেন। (তিরমিযী হা. ৩৫০৫, মিশকাত হা. ২২৯২, সহীহ)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কোন মানুষের জন্য এ কথা বলা সমীচীন নয় যে, সে বলবে : আমি “ইউনুস ইবনু মাত্ত্বা” থেকে উত্তম। (সহীহ বুখারী হা. ৩৩৯৫-৩৪১৩, সহীহ মুসলিম হা. ১৬৭) অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোন নাবীর মর্যাদার ওপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মর্যাদা বর্ণনা করা যাবে না, সমষ্টিগতভাবে বর্ণনা করা যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. বিভ্রান্ত জাতির দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে তাদেরকে ছেড়ে চলে যাওয়া কোন সমাজ সংস্কারকে উচিত নয়।
২. কঠিন মুহূর্তেও কেবল আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
৩. খালেস তাওবা ও সৎ আমলের কারণে অনেক সময় আল্লাহ তা‘আলা গযব উঠিয়ে নেন।
৪. আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশনা ব্যতীত যেহেতু কোন নাবীর জন্যও কোন কিছু করা সমীচীন নয় অতএব সাধারণ মানুষের উচিত আল্লাহ তা‘আলার বিধান যথাযথভাবে পালন করা।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১১৪-১২২ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারূন (আঃ)-এর প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তার বর্ণনা দিচ্ছেন এবং তাঁদেরকে ও যেসব লোক তাঁদের সাথে ঈমান এনেছিল তাদেরকে ফিরাউনের ন্যায় শক্তিশালী শত্রুর কবল হতে মুক্তি দেয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। সে তাদেরকে জঘন্যভাবে অবনমিত করতো এবং তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করতো ও কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত রাখতো। ফিরাউন তাদের দ্বারা নিকৃষ্ট ও নিম্ন পর্যায়ের সেবা গ্রহণ করতো। এরূপ নিকৃষ্টতম শত্রুকে আল্লাহ তাদের চোখের সামনে ধ্বংস করে দেন এবং হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারূন (আঃ)-এর কওমকে বিজয় দান করেন। ফিরাউন ও তার লোকদের ভূসম্পত্তি ও ধন-দৌলতের মালিক তাদেরকে বানিয়ে দেন যেগুলো তারা যুগ যুগ ধরে জমা করে রেখেছিল।

অতঃপর মহান আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-কে অতি স্পষ্ট, সত্য ও প্রকাশ্য মহাগ্রন্থ তাওরাত দান করেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি মূসা (আঃ) ও হারূন (আঃ)-কে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী কিতাব (তাওরাত) দান করেছিলাম, যা ছিল হিদায়াত ও জ্যোতি স্বরূপ।”(২১:৪৮)।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি উভয়কে দিয়েছিলাম বিশদ কিতাব এবং তাদেরকে পরিচালিত করেছিলাম সরল পথে অর্থাৎ কথায় ও কাজে। আর আমি তাদের উভয়কে পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। অর্থাৎ তাদের পরবর্তী লোকেরা তাঁদের প্রশংসা ও গুণকীর্তন করতে থাকবে। এর ব্যাখ্যায় মহান আল্লাহ বলেনঃ সবাই তাদের উপর সালাম বর্ষণ করে থাকে।

এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরক পুরস্কৃত করে থাকি। তারা উভয়েই ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।
১২৩-১৩২ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত কাতাদা (রঃ) ও মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (র) বলেনঃ “বলা হয় যে, ইলিয়াস ছিল হযরত ইদরীস (আঃ)-এর নাম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, ইলিয়াসই ছিলেন ইদরীস (আঃ)। যহাক (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত হাকীল নবী (আঃ)-এর পরে তাঁকে বানী ইসরাঈলের মধ্যে প্রেরণ করেন। বানী ইসরাঈল ঐ সময় ‘বা’আল’ নামক মূর্তির পূজা। করতো। হযরত ইলিয়াস (আঃ) তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকলেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপাসনা করতে নিষেধ করলেন। তাদের বাদশাহ তা কবুল করে নেয়। কিন্তু পরে সে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যায়। অতঃপর তারা সবাই ভ্রান্ত পথেই রয়ে যায়। তাদের কেউই তার উপর ঈমান আনলো না। আল্লাহর নবী (আঃ) তাদের উপর বদ দূআ করেন। ফলে তিন বছর ধরে সেখানে বৃষ্টিপাত বন্ধ তাকে। তখন তারা সবাই হযরত ইলিয়াস (আঃ)-এর কাছে এসে বলেঃ “আপনি দুআ করুন! আমাদের উপর বৃষ্টিপাত হলেই আমরা কসম করে বলছি যে, আমরা ঈমান আনয়ন করবো।” হযরত ইলিয়াস (আঃ)-এর দু’আর ফলে আল্লাহ তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। কিন্তু এর পরেও তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে কুফরীর উপরই অটল থেকে গেল। তাদের এ আচরণ দেখে হযরত ইলিয়াস (আঃ) আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন যে, তাঁকে যেন আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়। হযরত ইয়াসা ইবনে উখতূব (আঃ) তাঁর নিকটই লালিত পালিত হয়েছিলেন। হযরত ইলিয়াস (আঃ)-এর এই দু’আর পর তাকে নির্দেশ দেয়া হলো যে, তিনি যেন অমুক নির্দিষ্ট স্থানে গমন করেন এবং সেখানে যে যানবাহন পাবেন তাতেই যেন আরোহণ করেন। যথাস্থানে পৌঁছে তিনি নূরের একটি ঘোড়া দেখতে পান এবং তাতেই আরোহণ করেন। আল্লাহ তাকেও জ্যোতির্ময় করলেন এবং পাখা প্রদান করলেন। তিনি ফেরেশতাদের সাথে স্বীয় পাখার উপর ভর করে উড়তে লাগলেন। এই ভাবে একজন মানুষ আসমানী ও যমীনী ফেরেশতায় পরিণত হয়ে গেলেন। (অহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রঃ) আহলে কিতাব হতে এটা বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ)

মহান আল্লাহ বলেন যে, ইলিয়াস (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়কে বললেনঃ “তোমরা কি আল্লাহকে ভয় কর না যে, তাকে ছেড়ে অন্যের উপাসনা কর?” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) অর্থ হলো ‘রব’ বা প্রতিপালক। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এটা ইয়ামনীদের ভাষা। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এটা ইযদ শানুআদের ভাষা। ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন:“আমাকে সংবাদ দেয়া হয়েছে যে, তারা একটি মহিলার মূর্তির পূজা করতো। তার নাম ছিল বা’আল। আবদুর রহমান (রঃ) বলেন যে, ওটা একটা মূর্তি ছিল। শহরবাসীরা ওর পূজা করতো। ঐ শহরের নামও ছিল বাআলাক’। হযরত ইলিয়াস (আঃ) তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা সকলের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ছেড়ে মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়েছে? অথচ আল্লাহ তো তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের সৃষ্টিকর্তা এবং প্রতিপালক। একমাত্র তিনিই তো ইবাদতের যোগ্য।”

প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “কিন্তু তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলেছিল, কাজেই তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির জন্যে উপস্থিত করা হবে। তবে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের কথা স্বতন্ত্র ।” তাদেরকে তিনি রক্ষা করবেন।

আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ আমি ইলিয়াস (আঃ)-এর জন্যে পরবর্তী লোকদের উত্তম প্রশংসা প্রচলিত রেখেছি যে, প্রত্যেক মুসলমান তার উপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ করে থাকে।

(আরবী) শব্দের দ্বিতীয় রূপ (আরবী) রয়েছে। যেমন (আরবী) কে (আরবী) বলা হয়। এটা বানু আসাদ গোত্রের ভাষা। অনুরূপভাবে (আরবী) -কে (আরবী) এবং (আরবী) কে (আরবী) বলা হয়ে থাকে। ফল কথা, এটা আরবে সুপ্রচলিত শব্দ। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর এক কিরআতে (আরবী) পড়া হয়েছে। অর্থাৎ (আরবী) বা মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধর।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “এই ভাবে আমি সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম।” এর তাফসীর পূর্বেই গত হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
১৩৩-১৩৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলার বান্দা ও রাসূল হযরত লূত (আঃ)-এর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। তাঁকে তাঁর কওমের নিকট প্রেরণ করা হলে তারা তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ও তার পরিবারবর্গকে তার শাস্তি থেকে রক্ষা করলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী তাঁর জাতির সাথেই ধ্বংস হয়ে গেল। বিভিন্ন প্রকার আযাব তাদের উপর আপতিত হয় এবং যেখানে তারা অবস্থান করতো সেই স্থানটি এক দুর্গন্ধময় বিলে পরিণত হয়। ওর পানি দুর্গন্ধযুক্ত ও বিবর্ণ ছিল। বিলটি মানুষের চলাচলের রাস্তার ধারেই পড়ে। ভ্রমণকারীরা দিনরাত সদা-সর্বদা ঐ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতো এবং সকাল-সন্ধ্যা উক্ত দৃশ্য দেখতো। এই জন্যে আল্লাহ বলেনঃ এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? অর্থাৎ তোমরা কি অনুধাবন কর না যে, কিভাবে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করেছেন? এরূপ যেন না হয় যে, এই শাস্তিই তোমাদের উপরও এসে পড়ে।
১৩৯-১৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত ইউনুস (আঃ)-এর ঘটনা সূরায়ে ইউনুসে বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কারো একথা বলা উচিত নয় যে, সে হযরত ইউনুস ইবনে মাত্তা (আঃ) হতে উত্তম।” মাত্তা সম্ভবতঃ হযরত ইউনুস (আঃ)-এর মাতার নাম। আর এটা তাঁর পিতার নামও হতে পারে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ স্মরণ কর, যখন সে পলায়ন করে বোঝাই নৌযানে পৌঁছলো। অর্থাৎ যখন তিনি পালিয়ে গিয়ে মালভর্তি জাহাজে আরোহণ করেন তখন জাহাজ চলতে শুরু করা মাত্রই ঝড় এসে গেল এবং চারদিক থেকে ঢেউ উঠতে লাগলো এবং জাহাজ দোল খেয়ে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। অবস্থা এমনই দাড়িয়ে গেল যে, সবাই মৃত্যুর আশংকা করতে লাগলো।

(আরবী) অর্থাৎ লটারী করা হলো এবং তিনি পরাজিত হলেন। আরোহীরা বললোঃ যাকে লটারীতে পাওয়া গেল তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ কর তাহলেই জাহাজ

ঝটিকা মুক্ত হবে। তিনবার লটারী করা হলো এবং প্রতিবারই নবী (আঃ)-এর নাম উঠলো। তবে আরোহীরা তাঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে ইতস্ততঃ করছিল। কিন্তু নিজেই তিনি কাপড় চোপড় ছেড়ে সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়লেন। মহান আল্লাহ সবুজ সাগরের (সবুজ সাগর বলতে আরবরা আরব উপকূল হতে ভারতের মধ্যবর্তী জলরাশিকে বুঝে) এক বৃহৎ মাছকে আদেশ করলেন যে, সে যেন নবী (আঃ)-কে গলাধঃকরণ করে। উক্ত মাছটি তাঁকে গিলে ফেলে। তবে এতে নবী (আঃ)-এর দেহে কোন আঘাত লাগেনি। মাছটি সমুদ্রে চলাফেরা করতে লাগলো। যখন হযরত ইউনুস (আঃ) সম্পূর্ণরূপে মাছের পেটের মধ্য চলে গেলেন তখন তিনি মনে করলেন যে, তিনি মরে গেছেন। কিন্তু মাথা, হাত, পা প্রভৃতি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে নড়তে দেখে তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি বেঁচে আছেন। তখন তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে নামায শুরু করে দেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার জন্যে এমন এক স্থানে আমি মসজিদ বানিয়েছি যেখানে কেউই কখনো পৌঁছবে না।”

তিনি কত দিন মাছের পেটে ছিলেন এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন তিন দিন, কেউ বলেন সাত দিন, কেউ বলেন চল্লিশ দিন এবং কেউ বলেন এক দিনেরও কিছু কম অথবা শুধুমাত্র এক রাত মাছের পেটের মধ্যে অবস্থান করেছিলেন। এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন একমাত্র আল্লাহ। কবি উমাইয়া ইবনে আবিস সালাতের কবিতায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আপনি (আল্লাহ) স্বীয় অনুগ্রহে ইউনুস (আঃ)-কে মুক্তি দিয়েছেন যিনি কতিপয় রাত্রি মাছের পেটে যাপন করেছিলেন।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ “সে যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করতো।” অর্থাৎ যখন তিনি সুখ সুবিধা ও স্বচ্ছলতার মধ্যে ছিলেন তখন যদি তিনি সৎ কাজ না করে থাকতেন তাহলে তাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত থাকতে হতো ওর উদরে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “আরাম-আয়েশ ও সুখ ভোগের সময় আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করো, তাহলে ক্লেশে ও চিন্তাক্লিষ্ট সময়ে আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন।” একথাও বলা হয় যে, যদি তিনি নামাযের নিয়মানুবর্তী না হতেন বা মাছের পেটে নামায না পড়তেন অথবা (আরবী) (২১:৮৭)-এ কালেমাটি পাঠ না করতেন (তবে কিয়ামত পর্যন্ত মাছের পেটের মধ্যেই থাকতেন)। মহান আল্লাহ অন্য জায়গায় এ কথাই বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সে অন্ধকারে ডাক দিয়ে বলেঃ আপনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, আপনি মহান ও পবিত্র এবং নিশ্চয়ই আমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুঃখ-দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা হতে মুক্তি দিলাম আর এভাবেই আমি মুমিনদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি।”(২১:৮৭-৮৮)

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে যখন (আরবী) এ কালেমা পাঠে রত ছিলেন তখন এই কালেমা আল্লাহর আরশের আশে পাশে ঘুরতে থাকে। তা শুনে ফেরেশতারা বলেনঃ “হে আল্লাহ! এটা তো বহু দূরের শব্দ, কিন্তু এটা তো আমাদের নিকট পরিচিত বলে মনে হচ্ছে (ব্যাপার কিঃ)” উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলেন:“বলতো এটা কার শব্দ?” ফেরেশতারা জবাব দিলেনঃ “তা তো বলতে পারছি না!” তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “এটা আমার বান্দা ইউনুস (আঃ)-এর শব্দ।” ফেরেশতারা একথা শুনে আরয করলেনঃ “তাহলে কি তিনি ঐ ইউনুস যার সকার্যাবলী এবং প্রার্থনা সদা আকাশ মার্গে উঠে থাকতো! হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাঁর প্রতি করুণা বর্ষণ করুন! তার প্রার্থনা কবুল করুন। তিনি তো সুখ স্বচ্ছন্দের সময়ও আপনার নাম নিতেন। সুতরাং তাকে এই বিপদ হতে মুক্তি দান করুন!” হান আল্লাহ বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই আমি তাকে মুক্তি দান করবো। অতঃপর তিনি মাছকে নির্দেশ দিলেন এবং সে তাকে এক তৃণহীন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলো। সেখানে মহান আল্লাহ হযরত ইউনুস (আঃ)-এর অসুস্থতা ও দুর্বলতার কারণে তার উপর এক লাউ গাছ উদাত করলেন। একটি বন্য গাভী বা হরিণী সকাল-সন্ধ্যা তাঁর নিকট এসে তাঁকে দুধ পান করাতো। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) আমরা ইতিপূর্বে হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটি সূরায়ে আম্বিয়ার তাফসীরে লিপিবদ্ধ করেছি।

দজলার তীরে অথবা ইয়ামনের সুজলা, সুফলা ও শস্য-শ্যামলা ভূমিতে তাঁকে রাখা হয়েছিল। ঐ সময় তিনি পাখীর ছানার ন্যায় অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তাঁর শুধু নিঃশ্বাসটুকু বের হচ্ছিল। সম্পূর্ণরূপে চলৎশক্তি রহিত ছিলেন।

(আরবী) শব্দের অর্থ হলো কদুর গাছের লতা অথবা সেই গাছ যার শাখা হয়। এছাড়া ঐ সব গাছকেও (আরবী) বলা হয় যেগুলোর বয়স এক বছরের বেশী হয় না। এ গাছ তাড়াতাড়ি জন্মে এবং পাতা ঘন ছায়াযুক্ত হয়। তাতে মাছি বসে না। এটা খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। উপরের ছালসহ খাওয়া চলে। সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) লাউ বা কদু খেতে খুবই ভালবাসতেন এবং পাত্র থেকে বেছে বেছে নিয়ে তা খেতেন।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তাকে আমি লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ইতিপূর্বে হযরত ইউনুস (আঃ) নবী ছিলেন না। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, মাছের পেটে যাওয়ার পূর্ব হতেই তিনি নবী ছিলেন। এই দ্বিমতের সমাধান এভাবে হতে পারে যে, প্রথমে তাকে তাদের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছিল। এখন দ্বিতীয়বার আবার তাঁকে তাদেরই প্রতি প্রেরণ করা হয় এবং তারা সবাই ঈমান আনে ও তাঁর সত্যতা স্বীকার করে। বাগাবী (রঃ) বলেন যে, মাছের পেট হতে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি অন্য কওমের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন। এখানে শব্দটি বরং অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ ত্রিশ হাজার বা এর চেয়েও কিছু বেশী বা সত্তর হাজারের বেশী অথবা এক লক্ষ দশ হাজার। একটি মারফু’ হাদীসের বর্ণনা হিসেবে তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ বিশ হাজার। এ ভাবার্থও বর্ণনা করা হয়েছে যে, মানুষের অনুমান এক লক্ষের অধিকই ছিল। ইবনে জারীর (রঃ)-এর মত এটাই। অন্য আয়াতসমূহে যে (আরবী) রয়েছে, এগুলোর ক্ষেত্রেও তার ঐ একই মত। অর্থাৎ এর চেয়ে কম নয়, বরং বেশী। মোটকথা, হয়রত ইউনুস (আঃ)-এর কওমের সবাই আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করে এবং তাকে সত্য নবী বলে স্বীকার করে নেয়।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি তাদেরকে কিছু কালের জন্যে অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের জন্যে পার্থিব জীবনোপভোগ করতে দিলাম। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “কোন গ্রামবাসীর উপর আযাব এসে যাওয়ার পর তাদের ঈমান আনয়ন তাদের কোন উপকারে আসেনি, ইউনুস (আঃ)-এর কওম ছাড়া, তারা যখন ঈমান আনলো তখন আমি তাদের থেকে লাঞ্ছনাজনক আযাব উঠিয়ে নিলাম এবং কিছু কালের জন্যে তাদেরকে জীবনোপভোগ করতে দিলাম।” (১০:৯৮)

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# ফেরাউন ও তার জাতি তাদেরকে যে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল তা থেকে।
# হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলের নবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কুরআন মজীদে মাত্র দু’জায়গায় তাঁর আলোচনা এসেছে। এ জায়গায় এবং সূরা আল আন’আমের ৮৫ আয়াতে। আধুনিক গবেষকগণ খৃষ্টপূর্ব ৮৭৫ থেকে ৮৫০ এর মধ্যবর্তী সময়টাকে তাঁর সময় হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি ছিলেন জিল’আদ-এর অধিবাসী (প্রাচীন যুগে জিল’আদ বলা হতো বর্তমান জর্দান রাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলীয় জিলাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ইয়ারমুক নদীর দক্ষিণে অবস্থিত এলাকাকে।) বাইবেলে তাঁকে এলিয় তিশবী (Elijah the Tishbite) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী নিচে দেয়া হলোঃ

হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের ইন্তেকালের পরে তাঁর পুত্র রহুব’আম এর অযোগ্যতার ফলে বনী ইসরাঈল রাজ্যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একভাগে ছিল বাইতুল মাকদিস ও দক্ষিণ ফিলিস্তীন। এটি ছিল দাউদের পরিবারের অধিকারভুক্ত। আর উত্তরে ফিলিস্তীন সমন্বয়ে গঠিত দ্বিতীয় ভাগটিতে ইসরাঈল নামে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। পরে সামেরীয়া তার কেন্দ্রীয় স্থান হিসেবে গণ্য হয়। যদিও উভয় রাষ্ট্রের অবস্থাই ছিল দোদুল্যমান কিন্তু ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রথম থেকেই এমন মারাত্মক বিকৃতির পথে এগিয়ে চলছিল যার ফলে তার মধ্যে শিরক, মূর্তিপূজা, জুলুম, নিপীড়ন, ফাসেকী ও চরিত্রহীনতা বেড়ে চলছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত যখন ইসরাঈলের বাদশাহ আখিয়াব (Ahab) সাইদা (বর্তমান লেবানন) এর রাজকন্যা ইজবেলকে বিয়ে করে তখন এ বিকৃতি ও বিপর্যয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ মুশরিক রাজকন্যার সংম্পর্শে এসে আখিয়াব নিজেও মুশরিক হয়ে যায়। সে সামেরীয়ায় বা’আল–এর মন্দির ও যজ্ঞবেদী নির্মাণ চালায় এবং ইসরাঈলের শহরগুলোতে প্রকাশ্যে বা’আলের নামে বলিদানের প্রচলন করে।

এহেন সময় হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম অকস্মাক জনসম্মুখে হাজির হন। তিনি জালআদ থেকে এসে আখিয়াবকে এ মর্মে নোটিস দেন যে, তোমার পাপের কারণে এখন ইসরাঈল রাজ্যে এক বিন্দুও বৃষ্টি হবে না, এমনকি কুয়াসা ও শিশিরও পড়বে না। আল্লাহর নবীর এ উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হলো এবং সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত বৃষ্টি একদম বন্ধ থাকলো। শেষ পর্যন্ত আখিয়াবের হুঁশ হলো। সে হযরত ইলিয়াসের সন্ধানে করে তাঁকে ডেকে পাঠালো। তিনি বৃষ্টির জন্য দোয়া করার আগে ইসরাঈলের অধিবাসীদেরকে আল্লাহ‌ রব্বুল আলামীন ও বা’আলের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে ভালোভাবে জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি হুকুম দিলেন, একটি সাধারণ সমাবেশে বা’আলের পূজারীও এসে তার উপাস্য দেবতার নামে বলিদান করবে এবং আমিও আল্লাহ‌ রব্বুল আলামীনের নামে কুরবানী করবো। দু’টি কুরবানীর মধ্য থেকে মানুষের হাতে লাগানো আগুন ছাড়াই অদৃশ্য আগুন দ্বারা যেটিই ভস্মীভূত হবে তার উপাস্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যাবে। আখিয়াব একথা মেনে নিল। ফলে কারমাল(Carmel) পর্বতে বা’আলের সাড়ে আটশো পূজারী একত্র হলো। ইসরাঈলীদের সাধারণ সমাবেশে তাদের সাথে হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালামের মোকাবিলা হলো। এ মোকাবিলায় বা’আল পূজকরা পরাজিত হলো। হযরত ইলিয়াস সবার সামনে একথা প্রমাণ করে দিলেন যে, বা’আলা একটি মিথ্যা খোদা এবং আসল খোদা হচ্ছে সেই এক ও একক খোদা যাঁর পক্ষ থেকে তিনি নবী নিযুক্ত হয়ে এসেছেন। এরপর হযরত ইলিয়াস সেই জনসমাবেশে বা’আলের পূজারীদের হত্যা করান এবং তারপর বৃষ্টির জন্য দোয়া করেন। তাঁর দোয়া সঙ্গে সঙ্গেই কবুল হয়ে যায় এবং সমগ্র ইসরাঈল রাজ্যে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়।

কিন্তু এসব মু’জিযা দেখেও স্ত্রৈণ আখিয়াব তার মূর্তিপূজক স্ত্রীর গোলামী থেকে বের হয়ে আসেনি। তার স্ত্রী ইজবেল হযরত ইলিয়াসের দুশমন হয়ে গেলো এবং সে কসম খেয়ে বসলো, যেভাবে বা’আলের পূজারীদের হত্যা করা হয়েছে ঠিক অনুরূপভাবেই হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালামকেও হত্যা করা হবে। এ অবস্থায় ইলিয়াসকে দেশত্যাগ করতে হলো। কয়েক বছর তিনি সিনাই পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নিলেন। এ সবময় তিনি আল্লাহর কাছে যে ফরিয়াদ করেছিলেন বাইবেল তাকে এভাবে উদ্ধৃত করছেঃ

“আমি বাহিনীগণের ঈশ্বর সদাপ্রভূর পক্ষে অতিশয় উদ্যোগী হইয়াছি ; কেননা, ইস্রায়েল সন্তানগণ তোমার নিয়ম ত্যাগ করিয়াছে, তোমার যজ্ঞবেদি সকল উৎপাটিন করিয়াছে ও তোমার ভাববাদিগণকে খড়গ দ্বারা বধ করিয়াছে ; আর আমি কেবল একা আমিই অবশিষ্ট রহিলাম, আর তাহারা আমার প্রাণ লইতে চেষ্টা করিতেছে।” ১—রাজাবলি ১৯: ১০ এ সময় বায়তুল মাকদিসের ইহুদী শাসক ইয়াহুরাম (Jehoram) ইসরাঈলের বাদশাহ আখিয়াবের মেয়েকে বিয়ে করলো এবং ইতিপূর্বে ইসরাঈলে যেসব বিকৃতি বিস্তার লাভ করেছিল এ মুশরিক শাহজাদীর প্রভাবে ইয়াহুদীয়া রাষ্ট্রেও তা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। হযরত ইলিয়াস এখানেও নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করলেন এবং ইয়াহুরামকে একটি পত্র লিখলেন। বাইবেলে এ পত্র এভাবে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

“তোমার পিতা দাউদের ঈশ্বর সদাপ্রভূ এইভাবে এই কথা কহেন, তুমি আপন পিতা যিহোশাফটের পথে ও যিহূদা-রাজ আসার পথে গমন কর নাই; কিন্তু ইস্রায়েলের রাজাদের পথে গমন করিয়াছ এবং আহাব-কুলের ক্রিয়ানুসারে যিহূদাকে ও যিরূশালেম নিবাসীদিগকে ব্যভিচার করাইয়াছ; আর তোমা হইতে উত্তম যে তোমার পিতৃকুলজাত ভ্রাতৃগণ, তাহাদিগকে বধ করিয়াছ ; এই কারণ দেখ, সদাপ্রভূ তোমার প্রজাদিগকে, তোমার সন্তানদিগকে, তোমার ভার্য্যাদিগকে ও তোমার সমস্ত সম্পত্তি মহা আঘাতে আহত করিবেন। আর তুমি অন্ত্রের পীড়ায় অতিশয় পীড়িত হইবে, শেষে সেই পীড়ায় তোমার অন্ত্র দিন দিন বাহির হইয়া পড়িবে।” ২—রাজাবলি ২১: ১২-১৫

এ পত্রে হযরত ইলিয়াস যা কিছু বলেছিলেন তা পূর্ণ হলো। প্রথমে ইয়াহুরামের রাজ্য বহিরাগত আক্রমণকারীদের দ্বারা বিধ্বস্ত হলো এবং তার স্ত্রীদেরকে পর্যন্ত শত্রুরা পাকড়াও করে নিয়ে গেলো। তারপর সে নিজে অন্ত্ররোগে মারা গেলো। কয়েক বছর পর হযরত ইলিয়াস আবার ইসরাঈলে পৌঁছে গেলেন। তিনি আখিয়াব ও তার পুত্র আখযিয়াহকে সত্য সঠিক পথে আনার জন্য লাগাতার প্রচেষ্টা চালালেন। কিন্তু সামেরীয়ার রাজ পরিবারে যে পাপ একবার জেঁকে বসেছিল তা আর কোনভাবেই বের হলো না। শেষে হযরত ইলিয়াসের বদদোয়ায় আখিয়াবের পরিবার ধ্বংস হয়ে গেলো এবং তারপর আল্লাহ‌ তাঁর নবীকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিলেন। এ ঘটনাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য বাইবেলের নিম্নোক্ত অধ্যায়গুলো দেখুনঃ ১–রাজাবলি, অধ্যায় ১৭, ১৮, ১৯, ২১ ; ২–রাজাবলি অধ্যায় ১ ও ২ এবং ২–বংশাবলি, অধ্যায় ২১
# বা’আল-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছ প্রভু, সরদার ও মালিক। স্বামীর প্রতিশব্দ হিসেবেও এ শব্দটি বলা হতো এবং কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সূরা বাকারার ২২৮ , সূরা নিসার ১২৭ , সূরা হূদের ৭২ এবং সূরা নূরের ৩১ আয়াতসমূহ। কিন্তু প্রাচীন যুগে সিরিয়ার বিভিন্ন ‘জাতি-গোষ্ঠী’ এ শব্দটিকে উপাস্য ও প্রভু অর্থে ব্যবহার করতো এবং তারা একটি বিশেষ দেবতাকে বা’আল নামে চিহ্নিত করে রেখেছিল। বিশেষ করে লেবাননের ফনিকি সম্প্রদায়ের (Phoenicians) সবচেয়ে বড় পুরুষ দেবতা ছিল বা’আল এবং তার স্ত্রী আশারাত(Ashtoreth) ছিল তাদের সবচেয়ে বড় দেবী। বা’আল বলতে সূর্য বা বৃহস্পতি গ্রহ বুঝায় এবং আশারাত বলতে চাঁদ বা শুক্রগ্রহ বুঝায়। এ ব্যাপারে গবেষক ও বিশষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। যাই হোক না কেন একথা ঐতিহাসিক দিক দিয়ে প্রমাণিত যে ব্যবিলন থেকে নিয়ে মিসর পর্যন্ত সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় বা’আল পূজা বিস্তার লাভ করেছিল। বিশেষ করে লেবানন সিরিয়া ও ফিলিস্তীনের মুশরিক জাতিগুলো আপাদমস্তক এর মধ্যে ডুবে ছিল। বনী ইসরাঈল যখন মিসর থেকে বের হবার পর ফিলিস্তীন ও পূর্ব জর্দানে এসে বসবাস শুরু করলো এবং তাওরাতের কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করে তারা ঐ মুশরিক জাতিগুলোর সাথে বিয়ে শাদী ও সামাজিক সম্পর্ক কায়েম করতে শুরু করলো তখন তাদের মধ্যেও এ রোগ বিস্তার লাভ করতে লাগলো। বাইবেলের বর্ণনা মতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রথম খলিফা হযরত ইউশা’ বিন নূনের ইন্তেকালের পরপরই বনী ইসরাঈলের মধ্যে এ নৈতিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়ের সূচনা হয়ে গিয়েছিলঃ “ইস্রায়েল-সন্তানগণ সদাপ্রভূর দৃষ্টিতে যাহা মন্দ, তাহাই করিতে লাগিল; এবং বাল দেবগনের সেবা করিতে লাগিল।——-তাহারা সদাপ্রভূকে ত্যাগ করিয়া বাল দেবের ও অষ্টারেৎ দেবীদের সেবা করিত।” বিচারকর্তৃগণ ২: ১১-১৩ “ইস্রায়েল-সন্তানগণ কানানীয়, হিত্তীয়, ইমোরীয়, পরিযীয়, হিব্বীয় ও যিবূযীয়গণের মধ্যে বসতি করিল; আর তাহারা তাহাদের কন্যাগণকে বিবাহ করিত, তাহাদের পুত্রগণের সহিত আপন আপন কন্যাদের বিবাহ দিত ও তাহাদের দেবগণের সেবা করিত।” বিচারকর্তৃগণ ৩: ৫-৬ সে সময় ইসরাঈলীদের মধ্যে বা’আল পূজার এত বেশী প্রচলন হয়ে পড়েছিল যে, বাইবেলের বর্ণনা মতে তাদের একটি জনপদে প্রকাশ্যে বা’আলের যজ্ঞবেদী নির্মিত হয়েছিল এবং সেখানে বলিদান করা হতো। আল্লাহর অনুগত জনৈক ইসরাঈলী এটা বরদাশত করতে পারলো না। সে রাতের বেলা চুপিচুপি যজ্ঞবেদীটি ভেঙে ফেললো। পরদিন জনতার একটি বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। তারা শিরকের এ আড্ডাখানা উচ্ছেদকারী ব্যক্তির হত্যার দাবী করতে লাগলো। ( বিচারকর্তৃগণ ৬: ২৫-৩২ ) শেষ পর্যন্ত এ অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটালেন হযরত সামুয়েল, তালূত এবং হযরত দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিমুস সালাম। তাঁরা কেবল বনী ইসরাঈলেরই সংস্কার করলেন না, নিজেদের রাজ্যেও শিরক ও মূর্তিপূজা নির্মূল করলেন। কিন্তু হযরত সুলাইমানের মৃত্যুর পর এ ফিতনাটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং বিশেষ করে উত্তর ফিলিস্তীনের ইসরাঈল রাষ্ট্রটি বা’আল পূজার বন্যায় বিপুল স্রোতে ভেসে গেলো।
#‌ এ শাস্তির বাইরে একমাত্র তারাই থাকবে যারা হযরত ইলিয়াসের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেনি এবং যাদেরকে আল্লাহ‌ এ জাতির মধ্য থেকে তাঁর বন্দেগীর জন্য বাছাই করে নিয়েছিলেন।
# মূল শব্দগুলো হচ্ছে سَلَامٌ عَلَى إِلْ يَاسِينَ এ সম্পর্কে কোন কোন মুফাসসির বলেন, এটি হযরত ইলিয়াসের দ্বিতীয় নাম। যেমন হযরত ইবরাহীমের দ্বিতীয় নাম ছিল আব্রাহাম। আর অন্য কোন কোন মুফাসসিরের মতে আরববাসীদের মধ্যে ইবরানী (হিব্রু) ভাষায় শব্দাবলীর বিভিন্ন উচ্চারণের প্রচলন ছিল। যেমন মীকাল ও মীকাইল এবং মীকাইন একই ফেরেশতাকে বলা হতো। একই ঘটনা ঘটেছে হযরত ইলিয়াসের নামের ব্যাপারেও। স্বয়ং কুরআন মজীদে একই পাহাড়কে একবার “তূরে সাহনা” বলা হচ্ছে এবং অন্যত্র বলা হচ্ছে, “তূরে সীনীন।”
# এখানে হযরত লূতের (আ) স্ত্রীর কথা বলা হয়েছে, যে হিজরাতের হুকুম আসার পর তার মহান স্বামীর সাথে যায়নি বরং নিজের সম্প্রদায়ের সাথে থাকে এবং আযাবে নিক্ষিপ্ত হয়।
# এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কুরাইশ ব্যবসায়ীরা সিরিয়া ও ফিলিস্তীন যাবার পথে লূতের সম্প্রদায়ের বিধ্বস্ত জনপদ যেখানে অবস্থিত ছিল দিনরাত সে এলাকা অতিক্রম করতো।
# কুরআন মজীদে এ তৃতীয়বার হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামের বিষয় আলোচিত হয়েছে। এর আগে সূরা ইউনুস ও সূরা আম্বিয়ায় তাঁর আলোচনা এসেছে এবং আমি তার ব্যাখ্যা করেছি। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা ইউনুস, ৯৮-১০০ টীকা এবং সূরা আল আম্বিয়া, ৮২-৮৫ টীকা)
# মূলে ابق শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি কেবলমাত্র তখনই ব্যবহার করা হয় যখন গোলাম তার প্রভুর কাছ থেকে পালিয়ে যায়। الاباق هرب العبد من سيده অর্থাৎ “ইবাক অর্থ হচ্ছে প্রভুর কাছ থেকে গোলামের পালিয়ে যাওয়া।” (লিসানুল আরব)
# এ বাক্যগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে ঘটনার যে চিত্রটি সামনে ভেসে ওঠে তা হচ্ছেঃ

একঃ হযরত ইউনুস যে নৌকায় আরোহণ করেছিলেন তা তার ধারণা ক্ষমতার চাইতে বেশী বোঝাই (Overloade) ছিল।

দুইঃ নৌকায় লটারী অনুষ্ঠিত হয় এবং সম্ভবত এমন সময় হয় যখন সামূদ্রিক সফরে মাঝখানে মনে করা হয় যে, নৌকা তার ধারণ ক্ষমতার বেশী বোঝা বহন করার কারণে সকল যাত্রীর জীবন বিপদের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। কাজেই লটারীতে যার নাম উঠবে তাকেই পানিতে নিক্ষেপ করা হবে, এ উদ্দেশ্যে লটারী করা হয়।

তিনঃ লটারীতে হযরত ইউনুসের নামই ওঠে। তাঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয় এবং একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেলে।

চারঃ হযরত ইউনুসের এ পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তিনি নিজে প্রভুর (অর্থাৎ মহান আল্লাহ) অনুমতি ছাড়াই তাঁর কর্মস্থল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। “আবাকা” শব্দটি এ অর্থই প্রকাশ করছে ওপরের ৭৮ টীকায় এ ব্যাখ্যাই করা হয়েছে। “মুলীম” শব্দটিও একথাই বলছে। মুলীম এমন অপরাধীকে বলা হয় যে নিজের অপরাধের কারণে নিজেই নিন্দিত হবার হকদার হয়ে গেছে, তাকে নিন্দা করা হোক বা না হোক। (يقال قد الام الرجل اذا مايلام عليه من الامر وان لم يلم- ابن جرير)

# এর দু’টি অর্থ হয় এবং দু’টি অর্থই এখানে প্রযোজ্য। একটি অর্থ হচ্ছে, হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম পূর্বেই আল্লাহ‌ থেকে গাফিল লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না বরং তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা ছিলেন আল্লাহর চিরন্তন প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণাকারী। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যখন তিনি মাছের পেটে পৌঁছলেন তখন আল্লাহরই দিকে রুজূ’ করলেন এবং তারই প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষাণা করতে থাকলেন। সূরা আল আম্বিয়ায় বলা হয়েছেঃ

فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

“তাই সে অন্ধকারের মধ্যে তিনি ডেকে উঠলেন, তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, পাক-পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধী।”
# এর অর্থ এ নয় যে, এ মাছটি কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকতো এবং হযরত ইউনুস (আ) কিয়ামত পর্যন্ত তার পেটে বেঁচে থাকতেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে, কিয়ামত পর্যন্ত এ মাছের পেটই তাঁর কবরে পরিণত হতো। প্রখ্যাত মুফাসসিরগণ এ আয়াতটির এ অর্থই বর্ণনা করছেন।
# হযরত ইউনুস (আ) যখন তাঁর অপরাধ স্বীকার করে নিলেন এবং একজন মু’মিন ও ধৈর্যশীল বান্দার ন্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা গাইতে লাগলেন তখন আল্লাহর হুকুমে মাছ তাঁকে উপকূলে উদগীরণ করলো। উপকূলে ছিল একটি বিরাণ প্রান্তর। সেখানে সবুজের কোন চিহ্ন ছিল না এবং এমন কোন জিনিসও ছিল না যা হযরত ইউনুসকে ছায়াদান করতে পারে। সেখানে খাদ্যেরও কোন সংস্থান ছিল না।

এখানে এসে অনেক বুদ্ধি ও যুক্তিবাদের দাবীদারকে একথা বলতে শুনা গেছে যে, মাছের পেটে ঢুকে যাবার পর কোন মানুষের জীবিত বের হয়ে আসা অসম্ভব। কিন্তু বিগত শতকের শেষের দিকে এ তথাকথিত বুদ্ধিবাদ ও যুক্তিবাদিতার কেন্দ্র ভূমির (ইংল্যাণ্ড) উপকূলের সন্নিকটে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাটি তাদের দাবী খণ্ডন করে। “১৮৯১ সালের আগষ্ট মাসে Star of the East নামক জাহাজে চড়ে কয়েকজন মৎস্য শিকারী তিমি শিকারের উদেশ্যে গভীর সমুদ্রে যায়। সেখানে তারা ২০ ফুট লম্বা, ৫ ফুট চওড়া ও ১০০ টন ওজনের একটি বিশাল মাছকে আহত করে। কিন্তু তার সাথে লড়াই করার সময় জেমস বার্ডলে নামক একজন মৎস্য শিকারীকে তার সাথীদের চোখের সামনেই মাছটি গিলে ফেলে। একদিন পরে জাহাজের লোকেরা মাছটিকে মৃত অবস্থায় পায়। বহু কষ্টে সেটিকে তারা জাহাজে ওঠায় এবং তারপর দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তার পেট কাটলে জেমস তার মধ্য থেকে জীবিত বের হয়ে আসে। এ ব্যক্তি মাছের পেটে পুরা ৬০ ঘণ্টা থাকে।” (উর্দূ ডাইজেষ্ট, ফেব্রুয়ারী ১৯৬৪) চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ অবস্থায় প্রাকৃতিকভাবে যদি এমনটি হওয়া সম্ভবপর হয়ে থাকে, তাহলে অস্বাভাবিক অবস্থায় আল্লাহর মু’জিযা হিসেবে এমনটি হওয়া কেমন করে অসম্ভব হতে পারে? ( বর্তমানে উইকিপিডিয়াতে ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করা আছে : James Bartley (1870–1909) is the central figure in a late nineteenth-century story according to which he was swallowed whole by a sperm whale. He was found still living days later in the stomach of the whale, which was dead from constipation. The story originated of an anonymous firm, began to appear in American newspapers. The anonymous article appeared in the St. Louis Globe Democrat of Saint Louis, Missouri, then the note appeared in other newspapers with the title “A Modern Jonah” or something similar in multiple newspapers. The news spread beyond the ocean in articles as “Man in a Whale’s Stomach. “Rescue of a Modern Jonah” in page 8 of the August 22, 2017 issue of the Yarmouth Mercury newspaper of Great Yarmouth on England.- এ্যাপ নির্মাতা, মো: নুর হোসেন, আরবী ও বাংলা সার্চ ( উইকিপিডিয়া লিংক )
# “এক লাখ বা এর বেশী” বলার মানে এ নয় যে, এর সঠিক সংখ্যার ব্যাপারে আল্লাহর সন্দেহ ছিল। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যদি কেউ তাদের জনবসতি দেখতো তাহলে সে এ ধারণাই করতো যে, এ শহরের জনসংখ্যা এক লাখের বেশীই হবে কম হবে না। সম্ভবত হযরত ইউনুস যে শহরটি ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছিলেন এটি সেই শহরই হবে। তাঁর চলে যাবার পর সে শহরের লোকেরা আযাব আসতে দেখে যে ঈমান এনেছিল তার অবস্থা ছিল এমন তাওবার মতো যা কবুল করে নিয়ে তাদের ওপর থেকে আযাব হটিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামকে পুনর্বার তাদের কাছে পাঠানো হলো, যাতে তারা নবীর প্রতি ঈমান এনে যথারীতি মুসলমান হয়ে যায়। এ বিষয়টি বুঝার জন্য সূরা ইউনুসের ৯৮ আয়াতটি সামনে থাকা দরকার।
# হযরত ইউনুসের (আ) এ ঘটনা সম্পর্কে আমি সূরা ইউনুস ও সূরা আম্বিয়ার ব্যাখ্যায় যা কিছু লিখেছি সে সম্পর্কে কেউ কেউ আপত্তি উঠিয়েছেন। তাই সঙ্গতভাবেই এখানে অন্যান্য মুফাসসিরগণের উক্তিও উদ্ধৃত করছিঃ

বিখ্যাত মুফাসসির কাতাদা সূরা ইউনুসের ৯৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ “এমন কোন জনপদ দেখা যায়নি যার অধিবাসীরা কুফরী করেছে এবং আযাব এসে যাবার পরে ঈমান এনেছে আর তারপর তাদেরকে রেহাই দেয়া হয়েছে। একমাত্র ইউনুসের সম্প্রদায় এর ব্যতিক্রম।। তারা যখন তাদের নবীর সন্ধান করে তাঁকে না পেয়ে অনুভব করলো আযাব নিকটে এসে গেছে তখন আল্লাহ‌ তাদের মনে তাওবার প্রেরণা সৃষ্টি করলেন।” (ইবনে কাসীর, ২ খণ্ড, ৪৩৩ পৃষ্ঠা)

একই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী লিখছেন, এ জাতির কাহিনী হচ্ছেঃ “হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মসুল এলাকায় নিনেভাবাসীদের কাছে আগমন করেছিলেন। তারা ছিল কাফের ও মুশরিক। হযরত ইউনুস তাদেরকে এক ও লা-শরীক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার ও মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করার আহবান জানান। তারা তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে। হযরত ইউনুস তাদেরকে জানিয়ে দেন, তৃতীয় দিন আযাব আসবে এবং তৃতীয় দিন আসার আগেই অর্ধ রাতে তিনি জনপদ থেকে বের হয়ে পড়েন। তারপর দিনের বেলা যখন এ জাতির মাথার ওপর আযাব পৌঁছে যায় …………………. এবং তাদের বিশ্বাস জন্মে যে, তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে তখন তারা নিজেদের নবীকে খুঁজতে থাকে কিন্তু তাঁকে খুঁজে পায় না। শেষ পর্যন্ত তারা সবাই নিজেদের ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে খোলা প্রান্তরে বের হয়ে আসে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও তাওবা করে। ………………………….. আল্লাহ‌ তাদের প্রতি করুণা করেন এবং তাদের দোয়া কবুল করেন।” (রূহুল মা’আনী, ১১ খণ্ড, ১৭০ পৃষ্ঠা)

সূরা আম্বিয়ার ৮৭ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী লিখেছেনঃ “হযরত ইউনুসের নিজের জাতির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে বের হয়ে যাওয়া ছিল হিজরাতের কাজ। কিন্তু তাঁকে এর হুকুম দেয়া হয়নি।” (রুহুল মা’আনী, ১৭ খণ্ড, ৭৭ পৃষ্ঠা) তারপর তিনি হযরত ইউনুসের দোয়ার বাক্যাংশ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ এর অর্থ বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ “অর্থাৎ আমি অপরাধী ছিলাম। নবীদের নিয়মের বাইরে গিয়ে হুকুম আসার আগেই হিজরাত করার ব্যাপারে আমি তাড়াহুড়া করেছিলাম। হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে এটি ছিল তাঁর নিজের গোনাহের স্বীকৃতি এবং তাওবার প্রকাশ, যাতে আল্লাহ‌ তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।” (রূহুল মা’আনী ১৭ খণ্ড, ৭৮ পৃষ্ঠা)

এ আয়াতটির টীকায় মওলানা আশরাফ আলী থানবী লিখেছেনঃ “তাঁর নিজের জাতি তাঁর প্রতি ঈমান না আনায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে যান এবং জাতির ওপর থেকে আযাব হটে যাবার পরও নিজে তাদের কাছে ফিরে আসেননি। আর এ সফরের জন্য আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষাও করেননি।” (বায়ানুল কুরআন)

এ আয়াতের টীকার মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী লিখেছেনঃ “জাতির কার্যকলাপে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুদ্ধচিত্তে শহর থেকে বের হয়ে যান। আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করেননি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে, তিনি দিনের মধ্যে তোমাদের ওপর আযাব নেমে আসবে। إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ……………. বলে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন এ মর্মে যে, অবশ্যই আমি তাড়াহুড়া করেছি, তোমার হুকুমের অপেক্ষা না করেই জনপদের অধিবাসীদের ত্যাগ করে বের হয়ে পড়ি।”

সূরা সা-ফফা‌-তের ওপরে উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম রাযী লিখেছেনঃ হযরত ইউনুসের অপরাধ ছিল, তাঁর যে জাতি তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল আল্লাহ‌ তাকে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এ আযাব নির্ঘাত এসে যাবে। তাই তিনি সবর করেননি। জাতিকে দাওয়াত দেবার কাজ বাদ দিয়ে বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ দাওয়াতের কাজ সবসময় জারী রাখাই ছিল তাঁর দায়িত্ব। কারণ আল্লাহ‌ তাদেরকে ধ্বংস না করার সম্ভাবনা তখনো ছিল।” (তাফসীরে কবীর, ৭ খণ্ড, ১৬৮ পৃষ্ঠা)

আল্লামা আলুসী إِذْ أَبَقَ إِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ সম্পর্কে লিখেছেনঃ “আবাকা এর আসল মানে হচ্ছে, প্রভুর কাছ থেকে দাসের পালিয়ে যাওয়া। যেহেতু হযরত ইউনুস তাঁর রবের অনুমতি ছাড়াই নিজের জাতির কাছ থেকে পলায়ন করেছিলেন তাই তাঁর জন্য এ শব্দটির ব্যবহার সঠিক হয়েছে। “তারপর সামনের দিকে তিনি আরো লিখেছেনঃ “তৃতীয় দিনে হযরত ইউনুস আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই বের হয়ে গেলেন। এখন তাঁর জাতি তাঁকে না পেয়ে তাদের বড়দের ছোটদের ও গবাদি পশুগুলো নিয়ে বের হয়ে পড়লো। আযাব অবতীর্ণ হবার বিষয়টি তাদের কাছে এসে পৌঁছেছিল। তারা আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলো। আল্লাহ‌ তাদেরকে মাফ করে দিলেন।” (রূহুল মা’আনী, ২৩ খণ্ড, ১০৩ পৃষ্ঠা)

মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী وَهُوَ مُلِيمٌ এ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “অভিযোগ এটিই ছিল যে, ইজতিহাদী ভুলের দরুন আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে জনপদ থেকে বের হয়ে পড়েন এবং আযাবের দিন নির্ধারণ করে দেন্‌”

আবার সূরা আল কলম—-এর فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تَكُنْ كَصَاحِبِ الْحُوتِ আয়াতের টীকার মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী লিখেছেনঃ “অর্থাৎ মাছের পেটে প্রবেশকারী পয়গম্বরের (হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম) মতো মিথ্যা আরোপকারীদের ব্যাপারে সংকীর্ণমনতা ও ভাতি-আশংকার প্রকাশ ঘটাবে না।” তারপর একই আয়াতের وَهُوَ مَكْظُومٌ বাক্যাংশের টীকায় তিনি লিখেছেনঃ “অর্থাৎ জাতির বিরুদ্ধে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে দ্রুত আযাবের জন্য দোয়া এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন।”

মুফাসসিরগণের এসব বর্ণনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনটি ভুলের কারণে হযরত ইউনুসের (আ) ওপর অসন্তোষ ও ক্রোধ নেমে আসে। এক, তিনি নিজেই আযাবের দিন নির্দিষ্ট করে দেন। অথচ আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন ঘোষণা হয়নি। দুই, সেদিন আসার আগেই হিজরাত করে দেশ থেকে বের হয়ে যান। অথচ আল্লাহর হুকুম না আসা পর্যন্ত নবীর নিজ স্থান ত্যাগ করা উচিত নয়। তিন, সে জাতির ওপর থেকে আযাব হটে যাওয়ার পর তিনি নিজে তাদের মধ্যে ফিরে যাননি।

Leave a Reply