أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭৭)
[*মুমিনদের সাহায্য করার ব্যাপারে নীতি :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৭:সাফফাত
পারা:২৩
১৪৯-১৮২ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৪৯
فَاسۡتَفۡتِہِمۡ اَلِرَبِّکَ الۡبَنَاتُ وَ لَہُمُ الۡبَنُوۡنَ ﴿۱۴۹﴾ۙ
ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আল্লাহর জন্য কি কন্যাসন্তান এবং ওদের নিজেদের জন্য পুত্রসন্তান?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫০
اَمۡ خَلَقۡنَا الۡمَلٰٓئِکَۃَ اِنَاثًا وَّ ہُمۡ شٰہِدُوۡنَ ﴿۱۵۰﴾
অথবা ওরা কি উপস্থিত ছিল, যখন আমি ফিরিশতাদেরকে নারীরূপে সৃষ্টি করেছিলাম?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫১
اَلَاۤ اِنَّہُمۡ مِّنۡ اِفۡکِہِمۡ لَیَقُوۡلُوۡنَ ﴿۱۵۱﴾ۙ
ভালো করেই শুনে রাখো, আসলে তারা তো মনগড়া কথা বলে যে,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫২
وَلَدَ اللّٰہُ ۙ وَ اِنَّہُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۵۲﴾
আল্লাহর সন্তান আছে এ কথা বলা যথার্থই তারা মিথ্যাবাদী।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫৩
اَصۡطَفَی الۡبَنَاتِ عَلَی الۡبَنِیۡنَ ﴿۱۵۳﴾ؕ
আল্লাহ কি নিজের জন্য পুত্রের পরিবর্তে কন্যা পছন্দ করেছেন?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫৪
مَا لَکُمۡ ۟ کَیۡفَ تَحۡکُمُوۡنَ ﴿۱۵۴﴾
তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কিরূপ বিচার কর?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫৫
اَفَلَا تَذَکَّرُوۡنَ ﴿۱۵۵﴾ۚ
তবে কি তোমরা উপদেশ গ্ৰহণ করবে না?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫৬
اَمۡ لَکُمۡ سُلۡطٰنٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۵۶﴾ۙ
অথবা তোমাদের কাছে তোমাদের এসব কথার সপক্ষে কোন পরিষ্কার প্রমাণপত্র আছে?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫৭
فَاۡتُوۡا بِکِتٰبِکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۱۵۷﴾
তাহলে আনো তোমাদের সে কিতাব, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫৮
وَ جَعَلُوۡا بَیۡنَہٗ وَ بَیۡنَ الۡجِنَّۃِ نَسَبًا ؕ وَ لَقَدۡ عَلِمَتِ الۡجِنَّۃُ اِنَّہُمۡ لَمُحۡضَرُوۡنَ ﴿۱۵۸﴾ۙ
ওরা আল্লাহ এবং জ্বিন জাতির মধ্যে বংশীয় সম্পর্ক স্থির করেছে, অথচ জ্বিনেরা জানে যে, তাদেরকেও (শাস্তির জন্য) উপস্থিত করা হবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৫৯
سُبۡحٰنَ اللّٰہِ عَمَّا یَصِفُوۡنَ ﴿۱۵۹﴾ۙ
ওরা যা বলে, তা হতে আল্লাহ পবিত্র, মহান।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬০
اِلَّا عِبَادَ اللّٰہِ الۡمُخۡلَصِیۡنَ ﴿۱۶۰﴾
যেগুলো তাঁর একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া অন্যেরা তাঁর ওপর আরোপ করে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬১
فَاِنَّکُمۡ وَ مَا تَعۡبُدُوۡنَ ﴿۱۶۱﴾ۙ
কাজেই তোমরা ও তোমাদের এ উপাস্যরা,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬২
مَاۤ اَنۡتُمۡ عَلَیۡہِ بِفٰتِنِیۡنَ ﴿۱۶۲﴾ۙ
তোমরা (ওদেরকে) আল্লাহ সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬৩
اِلَّا مَنۡ ہُوَ صَالِ الۡجَحِیۡمِ ﴿۱۶۳﴾
শুধু প্ৰজ্জলিত আগুনে যে দগ্ধ হবে সে ছাড়া ।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬৪
وَ مَا مِنَّاۤ اِلَّا لَہٗ مَقَامٌ مَّعۡلُوۡمٌ ﴿۱۶۴﴾ۙ
আমাদের প্রত্যেকের জন্যই নির্ধারিত স্থান রয়েছে;
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬৫
وَّ اِنَّا لَنَحۡنُ الصَّآفُّوۡنَ ﴿۱۶۵﴾ۚ
এবং নিশ্চয়ই আমরা সারিবদ্ধ খাদেম।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬৬
وَ اِنَّا لَنَحۡنُ الۡمُسَبِّحُوۡنَ ﴿۱۶۶﴾
এবং নিশ্চয়ই আমরা তাসবীহ পাঠকারী।”
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬৭
وَ اِنۡ کَانُوۡا لَیَقُوۡلُوۡنَ ﴿۱۶۷﴾ۙ
তারা তো আগে বলে বেড়াতো,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬৮
لَوۡ اَنَّ عِنۡدَنَا ذِکۡرًا مِّنَ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۱۶۸﴾ۙ
‘পূর্ববর্তীদের গ্রন্থের মত যদি আমাদের কোন গ্রন্থ থাকত,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৬৯
لَکُنَّا عِبَادَ اللّٰہِ الۡمُخۡلَصِیۡنَ ﴿۱۶۹﴾
‘আমরা অবশ্যই আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হতাম।’
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭০
فَکَفَرُوۡا بِہٖ فَسَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۷۰﴾
কিন্তু ওরা তা (কুরআন) প্রত্যাখ্যান করল এবং শীঘ্রই ওরা এর পরিণাম জানতে পারবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭১
وَ لَقَدۡ سَبَقَتۡ کَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۷۱﴾ۚۖ
আমার প্রেরিত বান্দাদেরকে আমি আগেই, প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে,
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭২
اِنَّہُمۡ لَہُمُ الۡمَنۡصُوۡرُوۡنَ ﴿۱۷۲﴾۪
অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করা হবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭৩
وَ اِنَّ جُنۡدَنَا لَہُمُ الۡغٰلِبُوۡنَ ﴿۱۷۳﴾
এবং নিঃসন্দেহে আমার বাহিনীই বিজয়ী হবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭৪
فَتَوَلَّ عَنۡہُمۡ حَتّٰی حِیۡنٍ ﴿۱۷۴﴾ۙ
অতএব কিছু কালের জন্য তুমি ওদেরকে উপেক্ষা কর।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭৫
وَّ اَبۡصِرۡہُمۡ فَسَوۡفَ یُبۡصِرُوۡنَ ﴿۱۷۵﴾
আর আপনি তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করুন, শীঘ্রই তারা দেখতে পাবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭৬
اَفَبِعَذَابِنَا یَسۡتَعۡجِلُوۡنَ ﴿۱۷۶﴾
তারা কি আমার আযাবের জন্য তাড়াহুড়া করছে?
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭৭
فَاِذَا نَزَلَ بِسَاحَتِہِمۡ فَسَآءَ صَبَاحُ الۡمُنۡذَرِیۡنَ ﴿۱۷۷﴾
যখন তা নেমে আসবে তাদের আঙিনায়, সেদিনটি হবে যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল তাদের জন্য বড়ই অশুভ।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭৮
وَ تَوَلَّ عَنۡہُمۡ حَتّٰی حِیۡنٍ ﴿۱۷۸﴾ۙ
অতএব কিছু কালের জন্য তুমি ওদের উপেক্ষা কর।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৭৯
وَّ اَبۡصِرۡ فَسَوۡفَ یُبۡصِرُوۡنَ ﴿۱۷۹﴾
আর আপনি তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করুন, শীঘ্রই তারা দেখতে পাবে।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৮০
سُبۡحٰنَ رَبِّکَ رَبِّ الۡعِزَّۃِ عَمَّا یَصِفُوۡنَ ﴿۱۸۰﴾ۚ
তারা যেসব কথা তৈরি করছে তা থেকে পাক-পবিত্র তোমার রব, তিনি মর্যাদার অধিকারী।
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৮১
وَ سَلٰمٌ عَلَی الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۸۱﴾ۚ
আর শান্তি বৰ্ষিত হোক রাসূলদের প্ৰতি!
সূরা:- ৩৭:সাফফাত-১৮২
وَ الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۸۲﴾٪
এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রব্বুল আলামীনেরই জন্য।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
আলােচ্য সূরাটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত আয়াতগুলাের আলােকে কেমনভাবে অতীতে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর বান্দাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে তাদের কথা জানা গেছে। সেসব কাফের মােশরেকদের কঠিন পরিণতির কথাও জানা গেছে, যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদের পূজা অর্চনা বা অন্ধ আনুগত্য করে অথবা তার সাথে তার সৃষ্টির কাউকে শরীক করে। সেসব সত্যবিরােধী ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের পাকড়াও করার ঘটনা সামনে রেখে এবং সূরাটির প্রথম পাঠের মধ্যে প্রকাশিত সত্যটিকে কেন্দ্র করে রসূলুল্লাহ(স.)-কে সম্বোধন করা হয়েছে, যেন পাঠকের দৃষ্টি মােশরেকদের সেই ঘৃণ্য কথার দিকে আকৃষ্ট হয় যা তারা ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলতাে। তারা ফেরেশতাদের আল্লাহর কন্যা বলে অভিহিত করতাে, যা এ সূরাটির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে। সকল যামানার কাফের ও মােশরেকরা যে বানােয়াট কথা বলে থাকে সেই মনগড়া মিথ্যা সম্পর্কে শেষ নবী মােহাম্মদ(স.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন তিনি তাদের সাথে যুক্তিপূর্ণ বিতর্কে লিপ্ত হন, তিনি যেন তাদের সাথে আলােচনা করেন, তাদের সেই চরম মূর্খতাপূর্ণ উক্তি সম্পর্কে যেন চ্যালেঞ্জ করেন যা তারা বলতাে। তারা বললাে, আল্লাহ সােবহানাহ ওয়া তায়ালার সাথে জিনদের বংশগত কিছু সম্পর্ক আছে। তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর এই শেষ রসূল(স.)-কে পাঠানোর পূর্বে তারা কাতরভাবে আকাংখা প্রকাশ করতাে যে, কত ভালাে হতাে যদি তাদের কাছে কোনাে রাসূল প্রেরিত হতেন। এতে বুঝা যায়, তারা যে মত ও পথের ওপর ছিলো এবং যে সমাজব্যবস্থা তাদের মধ্যে বিরাজ করছিলাে, তাতে তারা মােটেই শান্তি পাচ্ছিলাে না। এজন্যে তারা চাইছিলাে যে, বিশ্ব পালকের পক্ষ থেকে তাদের জন্যে কোনাে পথপ্রদর্শক এসে তাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। সুতরাং ওদের প্রশ্ন করার জন্যে রসূলকে নির্দেশ দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, সেই রসূলই যখন তাদের মাঝে এসে গেলাে তখন কেন তাকে তারা অস্বীকার করছে। কেন তাকে মিথ্যাবাদী বানাচ্ছে? আল্লাহ তায়ালা চাইছেন যে রসূলুল্লাহ(স.) তাদের সাথে এভাবে আলােচনা করুক এবং তাদের বিবেককে জাগানাের চেষ্টা করুক। এই রাসূল তাে তাদের অজানা কোনাে লােক নন, জীবনের এমন একটি বড় অংশ তিনি তাদের মধ্যেই কাটিয়েছেন। যার মধ্যে মানুষের সকল ভালােমন্দ স্বভাব ও চেতনার পরীক্ষা হয়ে যায়। তিনি তাে সেই আল আমীন যাকে তারা পরােপকারী এবং সকল গুণের অধিকারী বলে জেনেছে ও মেনেছে, কিন্তু পরবর্তীতে তার ওপর নানা প্রকার অপবাদ দিয়ে কোনােটাই তারা প্রমাণ করতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা চাইছেন, তিনি তাদের সাথে একথা বলে আলােচনায় প্রবৃত্ত হােন যে, সেই মহান রেসালাতের বার্তা যখন তাদের কাছে পৌছে দেয়া হলাে তখন কোন যুক্তিতে তারা তাকে অস্বীকার করছে। এরপর রসূলুল্লাহ(স.)-কে বিজয়ী করার জন্যে আল্লাহর ওয়াদা ও নিশ্চয়তা দানের সাথে সূরাটি শেষ করা হচ্ছে। আরও জানানাে হচ্ছে যে, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তার রসূলদের বিজয়ী করে থাকেন এবং তিনি সেসব দুর্বলতা বা সৃষ্টজীবের মধ্যে বিরাজমান সেসব ত্রুটি ও কমতি থেকে মুক্ত, যা ওরা তার সম্পর্কে বলাবলি করে থাকে। তাদের খেয়াল করা দরকার যে, সকল কৃতিত্ব একমাত্র আল্লাহর যিনি জগতসমূহের মালিক ও প্রতিপালক। ‘অতএব তুমি দৃঢ়তা অবলম্বন করাে… তােমাদের দাবীর সপক্ষে দলীলস্বরূপ কোনাে গ্রন্থ নিয়ে এসাে, যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।'(১৪৯-১৫৭) *কাফেরদের অযৌক্তিক দাবীর অসারতা : মানুষ যে যাইই করুক না কেন, অবশেষে তাদের মিথ্যা ধরা পড়বেই, তাদের যুক্তিহীন কাজের জন্যে কখনও বিবেক তাদের দংশন করে, আর কখনওবা তাদের মিথ্যা আচরণের জন্যে নিজেদের পরিবার ও পরিবেশের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়। মক্কা ও তার আশপাশের পৌত্তলিকদের অবস্থা এমন ছিলাে যে, তারা কন্যা সন্তানদের ওপর পুত্র সন্তানদের প্রাধান্য দিতে এবং কন্যা সন্তানদের তারা অপয়া দুর্লক্ষুণে ও দুখ কষ্টের কারণ বলে মনে করতাে। সাধারণভাবে তারা নারীদের পুরুষের তুলনায় কম মর্যাদাশীল বলে ভাবত। এর পরও তারা মনে করতাে যে, ফেরেশতারা হচ্ছে সবাই নারী এবং তারা আল্লাহর কন্যা। তাই এখানে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের সেই অযৌক্তিক কথার জওয়াব দিতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবে বলছেন যে, কাল কেয়ামতের দিন ইচ্ছাকৃত এসব মিথ্যা ও বানােয়াট কথার কারণে অবশ্যই তাদের তিনি পাকড়াও করবেন, তাদের এইসব নির্বোধ কাজ ও আচরণের জন্যে পাকড়াও রবেন, তাদের কাছে এইসব যুক্তিবুদ্ধিহীন উক্তি ও পদক্ষেপের জন্যে কৈফিয়ত তলব করবেন, যা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা প্রয়ােগ করতাে। যেসব মাপকাঠি দিয়ে তারা জীবনের অনেক কিছুর ভালাে মন্দের বিচার করতাে, সেইগুলাে দিয়েই তিনি তাদেরকে ধরবেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করো তাদের কাজের যৌক্তিকতা সম্পর্কে… তােমার রবের জন্যে কি কন্যারাই উপযুক্ত আর তােমাদের জন্যেই রয়েছে সকল পুত্র ধনেরা?’ ( আহ কি চমৎকার তােমাদের পছন্দ জ্ঞান- তাই না?) | একদিকে তােমরা নারীদের কম মর্যাদাবান বলে অভিহিত করছে; আর যাঁকে রব বলে তােমরা জান ও মান বলে দাবী করাে- তাঁর জন্যে তােমরা (তােমাদের বিবেচনায়) সেই কম মর্যাদাবান কন্যাদেরকে এবং তােমাদের নিজেদের জন্যে পুত্রদের বরাদ্দ করছো। অর্থাৎ মুখে মুখে রব, প্রতিপালক, মালিক-মনিব-ক্ষমতাবান ইত্যাদি গালভরা মহাসম্মানসূচক বুলি আওড়াও আর তার জন্যে বরাদ্দ করাে সেই তুচ্ছ (?) কন্যাদের যাদের জন্মের খবরে তােমাদের মুখ ঘনান্ধকারে ছেয়ে যায়, সেটাই কি মালিকের জন্যে তােমাদের পছন্দ? এটাই কি তােমাদের সুবিচারের নমুনা? বাহ, কি চমৎকার তােমাদের বুদ্ধি এবং কি চমৎকার তােমাদের যৌক্তিকতা! আসলে তাদের কোনাে কথাই যুক্তির ধােপে টেকে না; সুতরাং জিজ্ঞেস কর তাদের কিভাবে তারা এই মিথ্যা ও রােগগ্রস্ত ধারণা করতে পারে! একইভাবে তাদের এটাও জিজ্ঞেস করাে, এসব বেওকুফী তারা কেন করে? কোথায় পেয়েছে তারা ফেরেশতাদের নারী হওয়ার খবর? ওরা কি তাদের সৃষ্টি প্রক্রিয়া দেখেছে? না ওরা তাদের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছে। ‘আর যখন আমি মহান আল্লাহ (তাদের বিবেচনায়) ফেরেশতাদের নারীরূপে সৃষ্টি করছিলাম তখন ওরা দেখছিলাে নাকি?’ আর দেখুন, আল্লাহর বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা ও মনগড়া কথা তারা বানিয়ে বানিয়ে বলছিলাে। সেগুলাে আল কোরআনে কিভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘দেখাে তাদের মিথ্যা দোষারােপের কথার দিকে, ‘তারা এভাবে বলে, আল্লাহ জন্ম দিয়েছেন, কিন্তু তারা মিথ্যাবাদী।’ তার এতােদূর মিথ্যাবাদী যে, যা তারা বলে তা নিজেরাই বিশ্বাস করে না; তা না হলে আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে জানা ও মানা সত্তেও তার জন্যে তারা নিজেদের অপ্রিয় জিনিসটি (কন্যা সন্তান) পছন্দ করতে পারে কি? তারা নিজেদের কথায় সত্যবাদী হলে কম মর্যাদাপূর্ণ ও তাদের নিজেদের কাছে অপছন্দীয় সেই কন্যা সন্তানদের আল্লাহর জন্যে তারা পছন্দ করে কেমন করে? ‘পুত্রের তুলনায় মেয়েদের (আল্লাহ তায়ালা) পছন্দ করেছেন।’ ‘কি হলাে তােমাদের, কেমন ফয়সালা করছাে তােমরা? তােমরা একটুও শিক্ষা গ্রহণ করাে কি?’ অর্থাৎ তােমাদের এই আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষে কোত্থেকে দলীল বা যুক্তি প্রমাণ হাযির করবে? ‘আছে নাকি তােমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনাে দলীল প্রমাণ (যার ভিত্তিতে এসব কথা তােমরা বলাে?) যদি থেকেই থাকে এমন কোনাে প্রমাণ তাে নিয়ে এসো না লিখিত সেই যুক্তিপূর্ণ কিতাব, যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো!’ দেখুন তাদের আর একটি মিথ্যা ও মুখােরােচক গল্প, পাক-পরওয়ারদেগার আল্লাহ তায়ালা ও জিনদের মাঝে কোনাে বংশীয় সম্পর্কের কল্পনাপ্রসূত কথা, ওরা তাঁর ও জ্বিনদের মধ্যে বংশীয় বা ঔরসগত সম্পর্ক নিরূপণ করে, আর জ্বিনরা তাে জেনেই নিয়েছে যে, তাদের আল্লাহর দরবারে হাযির করা হবে।’ তারা আর একটি ধারণাও করে যে, (সম্ভবত) ফেরেশতারাই আল্লাহ তায়ালার কন্যা, তার সেই সন্তানদের জিনরা জন্ম দিয়েছে, আর এই জন্যেই সেসব জ্বিনের সাথে তার বংশগত এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। অথচ জ্বিনরা জানে যে, তারা নিজেরা আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মতােই এক বিশেষ সৃষ্টি এবং কেয়ামতের দিন তাদের আল্লাহর হুকুমে তার দরবারে একত্রিত করা হবে। কাজেই দেখা গেলাে, কোনাে যুক্তিতেই আল্লাহর সাথে কারাে বংশীয় বা আত্মীয়তার কোনাে সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে না। এভাবে এইসব মিথ্যা ও মনগড়া কাহিনী থেকে আল্লাহ তায়ালা যে সম্পূর্ণ পবিত্র তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলাে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘মহান আল্লাহ, মহা পবিত্র তিনি সেইসব জিনিস থেকে যা ওরা তার ওপর আরােপ করছে।’ তবে মনে রাখতে হবে যে, সকল জ্বিন এক প্রকার নয়, তাদের মধ্যে অনেক মােমেন জ্বিনও আছে; তাদের কেয়ামতের সেই কঠিন আযাবে নিপতিত জ্বিনদের থেকে দূরে রাখা হবে এবং যাদের জোর করে সেই কঠিন আযাবের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তবে, বাদ দেয়া হবে তাদের যারা আল্লাহর মােখলেস বান্দা।’ অতপর মােশরেক ও তাদের কাল্পনিক মাবুদদের সম্বােধন করা হচ্ছে এবং তাদের বাজে ও সত্য বিরােধী আকীদাসমূহের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। এভাবে ব্যাখ্যায় বুঝা যাচ্ছে যে, ফেরেশতাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে মােশরেকদের দিকে মনােযােগ দেয়া হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব (হে কাফেররা), তােমরা… আমরা তার পবিত্রতা ও মাহাত্ম ঘোষণা করি।'(আয়াত ১৬১-১৬৬) ফেরেশতাদের সেইসব মিথ্যা গল্পের ব্যাপারে খবর নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের জন্যে এমন স্থান নির্ধারিত রয়েছে যার বাইরে তারা যেতেই পারে না। কেননা তারা তাে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে অবস্থিত তারই বান্দা। আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে থেকে তাদের প্রত্যেকের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। আনুগত্যভরা হৃদয় নিয়ে তারা সবাই আল্লাহর সামনে অবনমিত হয় এবং এজন্যে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে তারা আল্লাহর কৃতিত্বের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে সদা- সর্বদা তার গুণগান গায় এবং তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ সীমা ও স্থানে অবস্থান করে। যেখান থেকে (ইচ্ছা করলেও) তারা বেরােতে পারে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা তাে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং নিজ ক্ষমতায় অনন্য। এরপর মােশরেকদের সম্পর্কে কথা আসছে, যারা মুক্ত মনে ও নির্দ্বিধায় এসব খােশগল্প রচনা করে; অতপর তাদের বিভিন্ন বিষয়ক চুক্তি এবং বহু মানুষের সাথে করা ওয়াদা সম্পর্কিত কথা পেশ করা হচ্ছে। এসব মােশরেকের সেসব আক্ষেপপূর্ণ কথা তুলে ধরা হচ্ছে। যা তারা আহলে কিতাবদের হিংসা করতে গিয়ে বলতাে। ‘তারা বলতাে, তাদের কাছে যদি অনুরূপ কোনাে আসমানী কিতাবের মাধ্যমে আগত মূল্যবান উপদেশমালা থাকতো, থাকতাে যদি প্রাচীনকালে আগত মহামানব ইবরাহীম অথবা তার পরবর্তীতে আসা অন্য কোনাে মহামানবের উপদেশবাণী, তাহলে তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তারা খাঁটি ঈমানদার এবং ভালাে মানুষ হয়ে যেতাে এবং আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাদের পছন্দ করতেন, মর্যাদাবান বানাতেন। তাই ওদের কথার উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা অবশ্যই বলতাে, যদি আমাদের কাছে থাকতাে পূর্ববর্তী জনগণের কাছে আসা কোনাে আসমানী কিতাব বা কোনাে উপদেশবাণী, তাহলে আমরা তার খাটি ও খাস বান্দায় পরিণত হয়ে যেতাম।’ অবশেষে যখন তাদের কাছে সেই উপদেশমালা এসে গেলাে, যা এর আগে আসা অন্য সকল কিতাব ও উপদেশবাণী থেকে শ্রেয়, তখন তারা অপছন্দ করলাে এবং সে আসমানী বার্তা প্রত্যাখ্যান করলাে। এরশাদ হয়েছে, ‘তারা সে বার্তা অস্বীকার করলাে, ফলে শীঘ্রই তারা জানতে পারবে।’ শীঘ্রই তারা জানতে পারবে কথাটির মধ্যে অত্যন্ত কঠিন এক ধমকের ইংগিত নিহিত রয়েছে। রয়েছে তাদের অস্বীকৃতির উপযােগী শাস্তির সংকেত। কারণ এ হেদায়াত বাণী ছিলাে তাদেরই কাম্য এবং কাংখিত বার্তা। তারা ওয়াদা করেছিলাে, আসমানী কিতাব এলে তার ওপর ঈমান আনবে এবং আল্লাহ তায়ালা যখন তাদের এ কামনা পূরণ করলেন তখন তারা তা প্রত্যাখ্যান করলাে। আর সেই তিরস্কারের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই রসূলদের সাথেও সাহায্য ও বিজয়ের ওয়াদা করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্যে ওয়াদা প্রদান করা হয়েছে, অবশ্যই ওদের সমর্থন দেয়া হবে, ওদের সাহায্য করা হবে এবং নিশ্চয়ই আমার সেনাদল বিজয়ী হবে’ অর্থাৎ তাদের প্রতি প্রদত্ত ওয়াদা পূরণ করা হবে এবং আল্লাহর কথাকে সত্যে পরিণত করা হবে। কারণ অন্তরের অনেক গভীরে আকীদা বিশ্বাসের শিকড় প্রােথিত হয়ে গেছে এবং বিভিন্ন প্রকার বাধা বিপত্তি সত্তেও ঈমানের ভিত্তি মযবুতভাবে সংস্থাপিত হয়েছে। প্রত্যাখ্যানকারীরা সত্যের বাতি নিভিয়ে দেয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে, নবীকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যা দিয়েছে, সত্যের অনুসারীদের মারধর করেছে এবং তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। আল্লাহর রসূলদের নেতৃত্বে ইসলামী ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর মােশরেক ও কাফেরদের সকল আকীদা বিশ্বাস সেই সকল রসূলদের প্রভাবাধীন বিস্তীর্ণ এলাকাসহ আরও বহু এলাকা থেকে বিদায় নিয়েছে, তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দূরীভূত হয়েছে এবং তাদের রাজ্যে একমাত্র সেইসব আকীদা চালু হয়েছে যা নিয়ে রসূলরা দুনিয়ায় এসেছেন। তাদের প্রচারিত আকীদা মানুষের অন্তর ও তাদের বুদ্ধিকে পরিচালনা করেছে এবং তাদের ধারণা ও তাদের চেতনা বদলে দিয়েছে। এরপর দুনিয়ার যত বিভ্রান্তি এসে থাক না কেন এবং যতাে মত ও পথই চালাবার চেষ্টা চলে থাক না কেন, অবশেষে আল্লাহর বিশাল এ সাম্রাজ্যের সর্বত্র তার ক্ষমতা চালু হয়ে গেছে এবং রসূলরা তাদের কাছে আনীত আল্লাহর দেয়া আকীদাগুলােকে পর্যুদস্ত করার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, সকল চিন্তাধারা ও সকল দর্শন পরাজয় বরণ করেছে, এমনকি সেই এলাকাতেও সেইসব দার্শনিক চিন্তা পরাভূত হয়েছে যেখানে তার উৎপত্তি হয়েছিলাে এবং রসূলদের আনীত মতাদর্শ পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চিরদিনের জন্যে আল্লাহর ওয়াদা বহাল রয়েছে যে, রসূলদের (এবং তাদের অবর্তমানে তাদের প্রতিনিধিগণকে) আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য দান করা হবে এবং তার বাহিনীই অবশেষে বিজয়ী হবে। এই হচ্ছে সাধারণভাবে সত্যের প্রকৃতি এবং তা পরিষ্কারভাবে সর্বকালে পৃথিবীর সর্বত্র পরিদৃশ্যমান রয়েছে এবং আল্লাহর দিকে আহবানের জন্যে উচ্চারিত সকল দাওয়াতের মধ্যে এই কথাটাই তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দাওয়াতদানকারী মােমেনদের বিশেষভাবে আল্লাহর সেনাদল বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং জানানাে হয়েছে যে, অবশ্যই এই সেনাদলকে বিজয়ী করা হবে, যেখানে যেখানে তারা বাধাপ্রাপ্ত হবে বা তাদের কাজ করার পথে জটিলতা আসবে যেখানে অবশ্যই তারা গায়বী মদদ লাভ করবে। তাদের জীবন বিপন্ন করার জন্যে বা তাদের কাজ ব্যাহত করার জন্যে যত প্রকার জটিলতাই সৃষ্টি করা হােক এবং যত আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরকই ব্যবহার করা হােক না কেন, সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য মােমেনদের জন্যে অবধারিত। মিথ্যা প্রচার এবং মনগড়া কথা, সামরিক শক্তি প্রদর্শন ও একমাত্র শত্রুতার উদ্দেশ্যেই যে বিরােধিতা করা হয়-এসবের ফল এক এক সময় এক এক রকমের হয়ে থাকে; কিন্তু অবশেষে রসূলদের প্রতি আল্লাহর দেয়া ওয়াদাই সত্যে পরিণত হয়। অবশ্য একথা সত্য, যখন আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তার সেনাদলকে সাহায্য করার ওয়াদা করা হয়, তখন সারা দুনিয়ার সকল শক্তি একত্রিত হয়েও তাদের পর্যুদস্ত করতে চাইলে তারা ব্যর্থ হয়ে যায়। মােমেনদের প্রতি আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাহায্যের ওয়াদা হচ্ছে তার সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন নিয়মের মধ্যে অন্যতম। গ্রহ উপগ্রহ ও তারকারাজির সুসংগঠিত আবর্তনের মধ্যে তার এ নিয়ম চালু রয়েছে, রাত্রি দিনের আনাগােনার মধ্যেও এটা আছে। এই নিয়মের অধীনেই বৃষ্টির পানি বর্ষিত হয়ে মৃত যমীন থেকে জীবনের উৎপত্তি হচ্ছে, সবাই ও সবার জীবন আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্যলিপির কাছে দায়বদ্ধ হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ সবাইকেই তার মুখাপেক্ষী থাকতে হয়, যখন যার জন্যে ইচ্ছা তিনি তার এ অমােঘ ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন, কিন্তু ভবিষ্যত কি হবে না হবে এবং মানুষের সীমাবদ্ধ জীবনের পরিণতি কি হবে তা বাহ্যিক কিছু লক্ষণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হলেও মানুষ অনেকাংশে অনুমান করতে পারে অবশ্য এটা সত্য যে, এ সব লক্ষণ কোনােকালেই পরিবর্তন হয় না বা এসব লক্ষণের বিপরীত কোনাে দিন কিছু হয়েছে বলে দেখা যায়নি। এসব লক্ষণ মানুষের অজান্তেই বাস্তবায়িত হতে থাকে, যা না হলেও সরাসরি মানুষ অধিকাংশ সময়ে অবচেতন মনে অনুভব করে। কারণ মানুষ চায়, বিজয় আকারে আল্লাহর ফয়সালা ও সরাসরি সাহায্য তাৎক্ষণিক আসুক; কিন্তু তাদের ইচ্ছা ও চাহিদা মতােই আল্লাহর সাহায্য আসবে এমন নয়। তাঁর সাহায্যদানের বিশেষ এক পদ্ধতি রয়েছে যা নতুন কোনাে এক নিয়মে তারা অনুভব করবে, তবে নির্দিষ্ট এক সময় পার হওয়ার পরই তা বাস্তবায়িত হবে।
*মুমিনদের সাহায্য করার ব্যাপারে আল্লাহর নীতি : আল্লাহ তায়ালা তার সেনাবাহিনী এবং তাঁর রসূলদের অনুসারীদের প্রতি নানা প্রকার সাহায্যের যে ওয়াদা করেছেন তা এক নির্দিষ্ট নিয়মে তিনি দান করে থাকেন; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা দিতে চান অন্য আর এক প্রকার সাহায্য, যা হবে আরও বেশী ভালাে, আরও টেকসই। অতএব, আল্লাহ তায়ালা যা চান তাইই হবে। তাতে যদি তার সেনাবাহিনীকে আরও বেশীদিন কষ্ট পেতে হয় অথবা আরও বেশীদিন সহ্য করতে হয় বা পেছনের তুলনায় যদি আরও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় অথবা অনুমানের চাইতে আরও বেশী অপেক্ষা করতে হয় তাহলে তাই হবে। বদর যুদ্ধের পূর্বে মুসলমানরা তাে চেয়েছিলাে যে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাটি তাদের হস্তগত হােক; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা চেয়েছিলেন তুচ্ছ ও সামান্য লাভজনক সেই কাফেলা তাদের হস্তগত হােক; বরং তাদের মােকাবেলা হােক কোরায়শদের বিশাল বাহিনীর সাথে এবং তারা যুদ্ধ করুক দুর্ধর্ষ এক সেনাদলের সাথে। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা চেয়েছিলেন ইসলাম ও মুসলমানের আরও বড় কল্যাণ হােক; এজন্যে আল্লাহর ইচ্ছাতেই তার রসুল তার সেনাদল এবং তার দাওয়াতের বিজয় আসতে বিলম্ব হয়েছিলাে। এটাও হয়েছে যে, কোনাে কোনাে যুদ্ধে আল্লাহর সৈন্য পরাজিত হয়েছে এবং আজও কখনও কখনও তাদের ওপর মসিবত আসে- আসে তাদের ওপর নানা পরীক্ষা। কারণ এইসব বিপদ-আপদের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাদের আরও বড় বড় সমর ক্ষেত্রে সাহায্য পাওয়ার যােগ্য করে গড়ে তুলতে চান, আর এজন্যে তিনি তাদের চতুর্দিকের পরিবেশ ও তাদের ধারণ ক্ষমতাকে এতােদূর প্রস্তুত করতে চান যেন সেই কঠিন সময়ে আরও ব্যাপকভাবে তারা আল্লাহর সাহায্য কাজে লাগাতে পারে, আরও দীর্ঘ দিন ধরে তার সাহায্য পেতে পারে এবং এ সাহায্যের প্রভাব আরও গভীরভাবে ও দীর্ঘতর সময় পর্যন্ত তাদের উৎসাহিত করতে পারে। অতীতের ইতিহাস সামনে রাখলে উপরােক্ত কথাটির যথার্থতা মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে এবং দেখতে পাবে যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার ওয়াদা পূর্ণ করেছেন, তার নিয়ম প্রমাণিত হয়েছে, যার ব্যতিক্রম কোনাে দিন হয়নি এবং আল্লাহর এ ওয়াদার বাস্তবতা একক বা কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা অথবা কোনাে আকস্মিক ঘটনা বলে মানুষ কখনও বুঝেনি। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই (আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ জানাচ্ছি যে,) আমার সাহায্য দেয়ার ওয়াদা আমার প্রেরিত বান্দাদের ওপর সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অবশ্যই ওরা সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছে এবং আমার বাহিনী (অবশেষে) অবশ্যই বিজয়ী হবে।’ এ চূড়ান্ত ওয়াদার ঘােষণা দেয়ার সময় এবং এই ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণের সময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূল(স.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তিনি সেই অন্যায়কারী কাফের মােশরেকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং তাদের জন্যে প্রদত্ত আল্লাহর ওয়াদা ও চূড়ান্ত কথা যথার্থভাবে প্রমাণিত হওয়ার জন্যে তাদের ছেড়ে দেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চাইছেন যে, মহানবী(স.) তাদের কঠিন ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। কারণ তাদের ওপর শাস্তি যে নেমে আসবেই, এটাও আল্লাহর ওয়াদা। এ ওয়াদা যখন বাস্তবায়িত হবে তখন তাদের কি করুণ পরিণতি হবে তা নিজ চোখে দেখার জন্যে আল্লাহ তায়ালা জাল্লা শানুহু তাঁর নবীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব (হে নবী), কিছুকালের…যাও, শীঘ্রই ওরা (তাদের এই নির্মম সত্য প্রত্যাখ্যানের) পরিণাম (নিজেরাই) প্রত্যক্ষ করবে।'(আয়াত ১৭৪-১৭৯) অর্থাৎ, হে রসূল, ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তাদের সংগে ছিন্ন কর সমস্ত সম্পর্ক এবং তাদের সাথে কোনাে প্রকার মেলামেশা করাে না; ছেড়ে দাও তাদের সেই দিনের জন্যে যখন তাদের তুমি আযাবের মধ্যে আহাজারি করা অবস্থায় দেখতে পাবে এবং দেখবে তাদের ও তােমার সম্পর্কে আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালার দেয়া ওয়াদা কেমন করে পূর্ণ হচ্ছে। আজকের এই সুখের দিনে সেই অকৃতজ্ঞ ও অপরিণামদর্শী ব্যক্তিরা আমার অমােঘ আযাবের ব্যাপারে কত ব্যস্ততাই না দেখাচ্ছে। আফসােস, যখন তাদের ওপর সেই আযাব এসেই পড়বে, তখন তাদের কি অবস্থা যে হবে তা এখন কিছুতেই কল্পনা করা যায় না; সেই জাতির এলাকায় তখন আযাব এসে যাবে তখন তারা নিজেদের নিন্দিত, বিপর্যন্ত ও আত্ম-গ্লানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় দেখতে পাবে, কষ্টের চোটে হাত-পা ছুঁড়তে থাকবে, কিন্তু সেই আযাব থেকে বাঁচার কোনাে উপায়ই তারা খুঁজে পাবে না। কারণ ইতিপূর্বে তাদের সতর্ক করার জন্যে বহু সতর্ককারী পর্যায়ক্রমে তাদের কাছে এসেছে। তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ বার বার এসেছে। এ ভয়ানক নির্দেশের মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড এক ধমক। বলা হচ্ছে, ‘ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।’ একইভাবে ইংগিত দেয়া হচ্ছে এক অতি কঠিন অবস্থার দিকে যা শীঘ্রই আসবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তুমি দেখাে, অতপর শীঘ্রই ওরাও দেখবে।’ কিন্তু কি দেখবে সে কথাটি অস্পষ্ট অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, যার কারণে এতাে সাংঘাতিক পরিণতির ইংগিত পাওয়া যাচ্ছে যা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। সূরাটি সমাপ্ত করতে গিয়ে যাবতীয় দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে আল্লাহর পবিত্র হওয়ার কথা ঘােষণা করা হচ্ছে, তাঁর বিশেষ মর্যাদার কথা জানানাে হচ্ছে, আরও জানানাে হচ্ছে যে, সকল রসূলদের প্রতি আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অজস্র সালাম। ঘােষণা দেয়া হচ্ছে যে, সকল প্রশংসা ও কৃতিত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্যে, যিনি গােটা বিশ্বজগতের মালিক ও প্রতিপালক, যার ক্ষমতায় ভাগ বসানাের কেউ নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘সকল মান মর্যাদার অধিকারী তােমার রব, তিনি পবিত্র সেই সকল দুর্বলতা ও মুখাপেক্ষিতা থেকে যা তাঁর সম্পর্কে ওরা বলে থাকে। সকল রসূলদের প্রতি সালাম এবং যাবতীয় প্রশংসা ও কৃতিত্ব আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগতের মালিক-মনিব ও প্রতিপালক।’ এটাই হচ্ছে আলােচিত সূরার মধ্যে বর্ণিত বিষয়সমূহ বিবেচনার উপযুক্ত পরিসমাপ্তি, আর যা কিছু সূরাটির মধ্যে আলােচনা করা হয়েছে সেসব কিছুর মূল জিনিসই হচ্ছে তার শেষের এই কথাগুলাে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৪৯-১৬০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
যে সকল কাফির-মুশরিক ফেরেশতাদের ইবাদত করত এবং তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা সন্তান মনে করত বা এখনো এরূপ মনে করে তাদের বিশ্বাসকে খন্ডন করে দলীল পেশ করা হয়েছে। প্রথমত তাদের এ বিশ্বাস স্বয়ং তাদের প্রচলিত প্রথা-পদ্ধতির দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কারণ, তারা কন্যা-সন্তানকে লজ্জার কারণ মনে করে। যে বস্তু নিজেদের জন্য লজ্জাজনক তা আল্লাহ তা‘আলার জন্য কেন লজ্জাজনক হবে না? তাদের কাছে এর কোন প্রমাণ আছে কি? কোন দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য তিন রকম দলীল হতে পারে- ১. চাক্ষুষ প্রমাণ ২. ইতিহাস ভিত্তিক প্রমাণ অর্থাৎ এমন ব্যক্তির উক্তি যা সর্বজন স্বীকৃত। ৩. যুক্তিভিত্তিক দলীল। প্রথমোক্ত দলীল নিশ্চিত অনুপস্থিত, কারণ আল্লাহ তা‘আলা যখন ফেরেশতা সৃষ্টি করেন তখন তারা উপস্থিত ছিলো না। কাজেই ফেরেশতাগণ যে নারী, তা জানা সম্ভব নয়। সুতরাং তারা যেসব কথা বলে তা মনগড়া ও মিথ্যা।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
(أَلَكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنْثٰي - تِلْكَ إِذًا قِسْمَةٌ ضِيْزٰي)
“তবে কি তোমাদের জন্য পুত্র, আর তাঁর জন্য কন্যা সন্তান? এই প্রকার বন্টন তো অসঙ্গত।” (সূরা নাজ্ম ৫৩ : ২১-২২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(أَفَأَصْفَاكُمْ رَبُّكُمْ بِالْبَنِيْنَ وَاتَّخَذَ مِنَ الْمَلٰ۬ئِكَةِ إِنَاثًا ط إِنَّكُمْ لَتَقُوْلُوْنَ قَوْلًا عَظِيْمًا)
‘‘তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদেরকে পুত্র সন্তানের জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং তিনি কি নিজে ফেরেশতাদেরকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছেন? তোমরা তো নিশ্চয়ই ভয়ানক কথা বলে থাক!” (সূরা বানী ইসরা-ঈল ১৭ : ৪০)
এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা নাহ্ল-এর ৫৭-৫৯ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যে-সকল দোষত্র“টি থেকে মুক্ত সে-সকল দোষত্র“টি থেকে তাঁকে মুক্ত ঘোষণা করতে হবে, আর পবিত্রতার সাথে তাসবীহ বর্ণনা করতে হবে।
(وَجَعَلُوْا بَيْنَه۫ وَبَيْنَ الْجِنَّةِ نَسَبًا)
এখানে মুশরিকদের ঐ বিশ্বাসের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তারা মনে করত- আল্লাহ তা‘আলা ও জিনদের মাঝে একটি দাম্পত্য সম্পর্ক রয়েছে।
ফেরেশতারা হল কন্যা, আর তাদের মাতা হল জিনেরা। এভাবে আল্লাহ তা‘আলা ও জিনদের মাঝে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে। অথচ এ উক্তি কিভাবে সত্য হতে পারে? যদি তা-ই করা হতো তাহলে জিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কী জন্য তাঁর সামনে উপস্থিত করবেন, কী জন্য তাদের থেকে ভাল-মন্দ কাজের হিসাব নেবেন। তিনি কি আত্মীয়তা সম্পর্ক খেয়াল রাখবেন না? স্বয়ং জিনেরাও অবগত আছে যে, তাদেরকেও তাদের অপরাধের কারণে পাকড়াও করা হবে। সুতরাং কিভাবে জিনদের মাঝে ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে আত্মীয়তা সম্পর্ক থাকতে পারে? তাই তারা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে যে সকল অশালীন কথা-বার্তা বলে তা থেকে তিনি পবিত্র।
(إِلَّا عِبَادَ اللّٰهِ الْمُخْلَصِيْنَ)
অর্থাৎ কেবল আল্লাহ তা‘আলার বিশুদ্ধ বান্দারাই আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে এমন কথা বলে না যা তাঁর শানে উপযোগী নয়। এ ক্ষেত্রে মু’মিনরাই স্বচ্ছ ও নির্ভেজাল প্রমাণভিত্তিক আকীদাহ পোষণ করে থাকে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার কোন সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন নেই।
২. যারা আল্লাহ তা‘আলার জন্য সন্তান নির্ধারণ করে তারা র্শিক করল। আর আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রকার শরীক থেকে মুক্ত।
৩. ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তান নয়, বরং তাঁর একান্ত অনুগত বান্দা।
১৬১-১৭০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের লক্ষ্য করে বলছেন : তোমরা ও তোমাদের বাতিল উপাস্যগুলো, তাদেরকে ছাড়া কাউকে পথভ্রষ্ট করার ক্ষমতা রাখো না, যারা আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানে পূর্ব থেকেই জাহান্নামী এবং সে জন্যই তারা কুফর ও শির্কের ওপর অটল আছে। সৎ লোকদেরকে কখনো তোমরা তোমাদের র্শিকি মতবাদ গ্রহণ করাতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(إِنَّكُمْ لَفِيْ قَوْلٍ مُّخْتَلِفٍ - يُّؤْفَكُ عَنْهُ مَنْ أُفِكَ)
“নিশ্চয়ই তোমরা পরস্পর বিরোধী কথায় লিপ্ত। যে ব্যক্তি সত্যভ্রষ্ট সে-ই তা পরিত্যাগ করে” (সূরা যা-রিয়া-ত ৫১ : ৮-৯)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের কথা তুলে ধরে বলেন, তারা বলে- আমাদের প্রত্যেকের নির্ধারিত স্থান ও কর্ম রয়েছে, যা অতিক্রম করা বা সীমালঙ্ঘন করা আমাদের সমীচীন নয়। আমরা তাঁর সম্মুখে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর তাসবীহ তাহলীল পাঠ করি। অর্থাৎ উদ্দেশ্য হল- ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি এবং একনিষ্ঠ বান্দা। যারা সর্বদা তাঁর ইবাদত এবং তাসবীহ-তাহলীল পাঠে রত। তারা আল্লাহ তা‘আলার কন্যা নন যেমন মুশরিকরা ধারণা করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, “তারা বলে, ‘দয়াময় আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি পবিত্র, মহান! বরং তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তারা সুপারিশ করে শুধুমাত্র তাদের জন্য যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের মধ্যে যে বলবে, ‘আমিই মা‘বূদ তিনি ব্যতীত’, তাকে আমি প্রতিফল দেব জাহান্নাম; এভাবেই আমি জালিমদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।” (সূরা ‘আম্বিয়া- ২১ : ২৬-২৯)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, মক্কার মুশরিকরা আকাক্সক্ষা করে বলত, যদি আমাদের নিকট কোন নাবী-রাসূল আসত তাহলে আমরা অবশ্যই পূর্বের লোকদের চেয়ে বেশী সঠিক পথের অনুসারী হতাম, আমরা একেবারে আল্লাহ তা‘আলার একনিষ্ঠ বান্দা হয়ে যেতাম। এখানে ذِكْرًا অর্থ আল্লাহ তা‘আলার কোন গ্রন্থ বা নাবী, যেমন পূর্বে অনেক গ্রন্থ ও নাবী প্রেরণ করা হয়েছে। যথা তাওরাত, ইনজিল ইত্যাদি। কিন্তু যখনই তাদের নিকট নাবী-রাসূল সত্য-দীন নিয়ে এসেছেন তখনই তারা তাঁর সাথে কুফরী করেছে। এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা আল আন‘আম-এর ১০৯, ১৫৬-১৫৭ ও সূরা আল ফা-ত্বির-এর ৪২ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. পথভ্রষ্ট লোক ব্যতীত সৎ ও মু’মিন ব্যক্তিরা কখনো শয়তানের অনুসরণ করে না।
২. মানুষের মতো ফেরেশতারাও আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে।
৩. একশ্রেণির লোক- যারা বলে সত্য পেলে অনুসরণ করব, কিন্ত যখন সত্য তুলে ধরা হয় আর তাদের মনঃপূত না হয় তখন তারা তা বর্জন করে।
১৭১-১৮২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসসমূহ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণ করার পর ১৬৭-১৭৯ আয়াতসমূহে কাফিরদের হঠকারিতা বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের পূর্বে বাসনা প্রকাশ করত যে, কোন নাবী আগমন করলে তারা ঈমান আনবে। কিন্তু যখন নাবীর আগমন হল আর তা তাদের মনপুত হল না তখন তারা জেদ ও হঠকারিতার পথ অবলম্বন করল।
অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে যে, আপনি তাদের উৎপীড়ন ও নির্যাতনে মনঃক্ষুণœ হবেন না। সেদিন দূরে নয়, যখন আপনি বিজয়ী ও কৃতকার্য হবেন এবং তারা হবে পরাভূত ও আযাবের লক্ষ্যবস্তু। এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা সে দিকেই ইঙ্গিত করে বলছেন : যারা তাঁর অনুসারী, যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, একমাত্র তাঁরাই ‘ইবাদত করে, তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে না তারাই আল্লাহ তা‘আলার সাহায্যপ্রাপ্ত হবে এবং তারাই বিজয়ী হবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(كَتَبَ اللّٰهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِيْ ط إِنَّ اللّٰهَ قَوِيٌّ عَزِيْزٌ)
“আল্লাহ লিখে রেখেছেনঃ আমি এবং আমার রাসূলগণ নিশ্চয়ই জয় লাভ করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিশালী, মহাপ্রতাপশালী।” (সূরা মুজা-দালাহ্ ৫৮ : ২১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(إِنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا فِي الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُوْمُ الْأَشْهَادُ)
“নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদের ও মু’মিনদেরকে সাহায্য করব পার্থিব জীবনে ও যেদিন সাক্ষীগণ দন্ডায়মান হবে।” (সূরা মু’মিন ৪০ : ৫১) সুতরাং রাসূল ও তাদের অনুসারীরা দুনিয়াতে সর্বদা শত্র“দের বিরুদ্ধে দলীল-প্রমাণ দ্বারা বিজয়ী হবেন এবং যাদেরকে যুদ্ধ জিহাদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে তারাও আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য প্রাপ্ত হবেন এবং বিজয়ী হবেন যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীরা হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলার এ প্রতিশ্রুতি কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে সে-সকল মু’মিনদের জন্য যারা সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
(فَإِذَا نَزَلَ بِسَاحَتِهِمْ)
আরবি বাক-পদ্ধতিতে আঙিনায় নেমে আসার অর্থ কোন বিপদ একেবারে সামনে এসে উপস্থিত হওয়া বুঝায়। সকাল বলার কারণ হল- আরবরা শত্র“দের ওপর রাতের বেলা হামলা করত না, যদিও রাতে তাদের এলাকায় চলে যেত তবুও সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করত। হাদীসে এসেছে যখন মুসলিমরা খায়বার আক্রমন করে তখন তাদেরকে দেখে ইয়াহূদীরা ঘাবড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহু আকবার বলে এ বাক্যাবলী উচ্চারণ করলেন :
خَرِبَتْ خَيْبَرُ إِنَّا إِذَا نَزَلْنَا بِسَاحَةِ قَوْمٍ {فَسَاءَ صَبَاحُ المُنْذَرِينَ}
খায়বার বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমরা যখন কোন সম্প্রদায়ের আঙিনায় অবতরণ করি, যাদেরকে পূর্ব-সতর্ক করা হয়েছিল, তখন তাদের সকাল খুবই মন্দ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৩৭১)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে বলেন : তুমি কিছু সময়ের জন্য তাদেরকে উপেক্ষা করে চলো এবং তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে যাও। অচিরেই তারা তাদের কর্মের প্রতিফল বুঝতে পারবে। তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে যা কিছু শরীক করে তিনি সেগুলো হতে পবিত্র ও মহান।
(سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُوْنَ)
অর্থাৎ আল্লাহ এ সংক্ষিপ্ত তিনটি আয়াতের মধ্যে সূরার সমস্ত বিষয়বস্তু ভরে দিয়েছেন। তাওহীদের বর্ণনা দ্বারা সূরার সূচনা হয়েছিল, যার সারমর্ম ছিল মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে যেসব বিষয় বর্ণনা করে, আল্লাহ তা থেকে পবিত্র। আলোচ্য সূরার প্রথম দিকে সে বিষয়বস্তু নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। এরপর সূরায় নাবীদের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর মুশরিকদের বিশ্বাস, সন্দেহ ও আপত্তিসমূহ যুক্তি ও উক্তির মাধ্যমে খণ্ডন করে বলা হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত বিজয় সত্যপন্থীদেরই অর্জিত হবে। এ আয়াতগুলোর প্রথমে মুশরিকদের কল্পকাহিনীর চিন্তা-চেতনা ও বাতিল মা‘বূদ থেকে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূলদের প্রতি সালাম প্রেরণ করা হয়েছে, কারণ তাঁরাই পৃথিবীবাসির প্রতি আল্লাহর তাওহীদের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজের প্রশংসা করে বান্দাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন- আল্লাহ নাবী-রাসূল ও কিতাব দিয়ে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, অতএব তোমরা আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. যারা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে সৎ আমল করবে তারাই সর্বদা বিজয়ী হবে।
২. যারা ইসলামের দা‘ওয়াত পাওয়ার পরও তা কবূল করে না তাদেরকে এড়িয়ে চলতে হবে।
৩. শাস্তি তার নির্ধারিত সময়ে আসবেই, কেউ তখন তা ঠেকাতে পারবে না।
৪. প্রশংসা মাত্রই আল্লাহ তা‘আলার, যাঁর কোনই শরীক নেই। যিনি সমস্ত পৃথিবীর প্রতিপালক।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১৪৯-১৬০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের অহমিকার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা নিজেদের জন্যে তো পুত্র সন্তান পছন্দ করছে, আর আল্লাহর জন্যে নির্ধারণ করছে কন্যা সন্তান। তাদের কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে শুনলে তাদের মুখ কালো হয়ে যায়, অথচ তারা আল্লাহর জন্যে ওটাই সাব্যস্ত করে। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদেরকে জিজ্ঞেস কর তো যে, এটা কি ধরনের বন্টন যে, তোমাদের জন্যে তো পুত্র সন্তান, আর আল্লাহর জন্যেই রয়েছে কন্যা সন্তান?
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ আমি কি ফেরেশতাদেরকে নারীরূপে সৃষ্টি করেছিলাম, আর তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে? যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা ঐ ফেরেশতাদেরকে নারী রূপে সাব্যস্ত করেছে যারা রহমানের (আল্লাহর) বান্দা, তারা কি তাদের সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করেছে? সত্বরই তাদের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তারা জিজ্ঞাসিত হবে।”(৪৩:১৯) প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের মিথ্যা উক্তি মাত্র যে, আল্লাহর সন্তান রয়েছে, অথচ তিনি সন্তান থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। এর ফলে তাদের তিনটি মিথ্যা ও তিনটি কুফরী পরিলক্ষিত হয়। (এক) ফেরেশতারা আল্লাহর সন্তান। (দুই) তারা আবার কন্যা। (তিন) তারা নিজেরাই ফেরেশতাদের পূজা করে। পরিশেষে এমন কোন জিনিস আল্লাহকে বাধ্য করেছে যে, তিনি নিজের জন্যে পুত্র গ্রহণ করেননি, বরং গ্রহণ করেছেন কন্যা? অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তোমাদেরকে তিনি দান করেছেন পুত্র আর নিজের জন্যে ফেরেশতাদেরকে গ্রহণ করেছেন কন্যারূপে? এটা তো তোমাদের অতি নিম্ন পর্যায়ের বাজে ও ভিত্তিহীন কথা!” আরো বলা হয়েছেঃ “তোমাদের কি বিবেক বুদ্ধি নেই যে, তোমরা যুক্তিহীন কথা বলছো? তোমরা কি বুঝ না যে, আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা খুবই বড় অপরাধ? তবে কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? তোমাদের কি সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ আছে? যদি থেকে থাকে তবে তা পেশ কর? অথবা তোমাদের কাছে যদি কোন ঐশী বাণী থাকে তবে তাই আনয়ন কর? এটা এমনই এক বাজে কথা যে, এর স্বপক্ষে কোন জ্ঞানসম্মত ও শরীয়ত সম্মত দলীল প্রমাণ নেই। থাকতেই পারে না।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা আল্লাহ ও জ্বিন জাতির মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থির করেছে। অথচ জ্বিনেরা জানে যে, তাদেরকেও শাস্তির জন্যে উপস্থিত করা হবে।
‘ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা’ মুশরিকদের এই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে হযরত আবু বকর (রাঃ) প্রশ্ন করেনঃ “তাহলে তাদের মাতা কারা?” উত্তরে তারা বলেঃ “জ্বিন প্রধানদের কন্যারা।” অথচ অবস্থা এই যে, স্বয়ং জ্বিনেরা জানে এবং বিশ্বাস করে যে, যারা এই রূপ বলে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে। তাদের মধ্যে আল্লাহর কতক শত্রু এমনই চরম পরিচয় দেয় যে, শয়তানকে তারা আল্লাহর ভাই বলে থাকে। (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা) আল্লাহ তাআলা এ থেকে আমাদেরকে নিরাপদে রাখুন! তারা যা বলে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র ও বহু ঊর্ধে রয়েছেন। পরে যে ইসতিসনা বা স্বতন্ত্র করা। হয়েছে তা হলো ইসতিসনা মুনকাতি এবং তা (আরবী)-এর সাথে করা হয়েছে। কিন্তু এ অবস্থায় (আরবী) ক্রিয়া পদটির সর্বনামে সমগ্র মানব জাতিকে বুঝাবে। এতে ঐ সব লোককে পৃথক করা হবে, যারা সত্যের অনুগত এবং সমস্ত নবী রাসূলের প্রতি ঈমান রাখে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এই ইসতিসনা হচ্ছে (আরবী)-এর জন্যে অর্থাৎ তাদের সকলকেই আযাবে পতিত হতে হবে, কিন্তু তারা নয় যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা। এ উক্তিটির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
১৬১-১৭০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা মুশরিকদেরকে জানাচ্ছেনঃ তোমাদের পথভ্রষ্টতা ও অংশীবাদী শিক্ষা শুধু তারাই গ্রহণ করবে যাদেরকে জাহান্নামের জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। যারা অন্তর থাকা সত্ত্বেও বুঝে না, চক্ষু থাকা সত্ত্বেও দেখে না এবং কান থাকা সত্ত্বেও শুনে না, তারা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট এবং তারা বেখেয়াল।” অপর জায়গায় বলা হয়েছেঃ “তাতে তারাই পথভ্রষ্ট হয় যাদের বোধশক্তি রহিত ও যারা মিথ্যার বেশাতি চড়ায়।”
অতঃপর মহান আল্লাহ্ ফেরেশতাদের নিষ্কলুষিতা, তাদের আত্মসমর্পণ, ঈমানে সন্তুষ্টি এবং আনুগত্যের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা নিজেরাই বলেঃ আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই নির্ধারিত স্থান রয়েছে এবং ইবাদতের জন্যে বিশেষ জায়গা আছে। সেখান থেকে আমরা সরতে পারি না বা কমবেশীও করতে পারি না।’
হযরত সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) একদা তাঁর সাথীদেরকে বলেনঃ “আসমান চড় চড় শব্দ করছে এবং প্রকৃতপক্ষে ওর এরূপ শব্দ করাই উচিত। কেননা, ওর এমন কোন স্থান ফাকা নেই যেখানে ফেরেশতাদের কেউ না কেউ রুকূ’ বা সিজদার অবস্থায় থাকেন না।” অতঃপর তিনি (আরবী) হতে (আরবী) পর্যন্ত আয়াত তিনটি তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটি ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়ার আকাশে এমন কোন স্থান নেই যেখানে কোন ফেরেশতা সিজদারত বা দণ্ডায়মান অবস্থায় না রয়েছেন।”
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, প্রথমে নারী-পুরুষ সবাই মিলে একত্রে নামায পড়তো। অতঃপর (আরবী)-এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর পুরুষদেরকে সামনে বাড়িয়ে দেয়া হলো এবং নারীদেরকে পিছনে সরিয়ে দেয়া হলো।
“আমরা সব ফেরেশতা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে থাকি” এর বর্ণনা (আরবী)-এর তাফসীরে গত হয়েছে।
অলীদ ইবনে আবদিল্লাহ (রঃ) বলেনঃ এই আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে নামাযের সারি ছিল না। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সারিবদ্ধভাবে নামায পড়া শুরু হয়। হযরত উমার (রাঃ) ইকামতের পর মানুষের দিকে মুখ করে বলতেনঃ “সারি ঠিক ও সোজা করে নাও এবং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাও। আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদের মত তোমাদেরকেও সারিবদ্ধ দেখতে চান। যেমন তারা বলেনঃ “আমরা তো সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হই। হে অমুক! তুমি সামনে বেড়ে যাও এবং হে অমুক! তুমি পিছনে সরে যাও।” অতঃপর তিনি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে নামায শুরু করতেন। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “তিনটি বিষয়ে আমাদেরকে লোকদের উপর (অন্যান্য উম্মতের উপর) ফযীলত বা মর্যাদা দান করা হয়েছে। যেমনঃ আমাদের (নামাযের) সারিসমূহ ফেরেশ্তাদের সারির ন্যায় করা হয়েছে, আমাদের জন্যে সমগ্র যমীনকে সিজদার স্থান বানানো হয়েছে এবং ওর মাটিকে আমাদের জন্যে পবিত্র করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাদের উক্তি উদ্ধৃত করেনঃ “আমরা অবশ্যই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণাকারী। আমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে থাকি। আমরা স্বীকার করি যে, তিনি সর্বপ্রকারের ক্ষয়-ক্ষতি হতে পবিত্র। আমরা সকল ফেরেশতা তাঁর আজ্ঞাবহ এবং তাঁর মুখাপেক্ষী। তাঁর সামনে আমরা আমাদের নম্রতা ও অপারগতা প্রকাশ করে থাকি।” এই তিনটি হলো ফেরেশতাদের বিশেষণ। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, তাসবীহ্ পাঠের অর্থ হচ্ছে নামায আদায় করা। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “কাফিররা বলেঃ আল্লাহর সন্তান রয়েছে, অথচ তিনি তা হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র, অবশ্য ফেরেশতারা তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা তাঁর আজ্ঞাবহ। তার হুকুমের উপর তারা আমল করে থাকে। তিনি তাদের সামনের ও পিছনের খবর রাখেন। তারা কারো জন্যে সুপারিশ করারও অধিকার রাখে না। তবে তিনি সম্মত হয়ে যাকে অনুমতি দেন সেটা স্বতন্ত্র কথা। তারা আল্লাহ্ ভয়ে সদা প্রকম্পিত থাকে। তাদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ছাড়া নিজেদেরকে ইবাদতের যোগ্য মনে করবে, আমি তাদেরকে জাহান্নামে প্রবিষ্ট করবো। এভাবেই আমি যালিম ও সীমালংঘন কারীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি।”(২১:২৬-২৯)
প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ তারাই তো বলে এসেছে যে, পূর্ববর্তীদের কিতাবের মত যদি তাদের কোন কিতাব থাকতো তবে অবশ্যই তারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হয়ে যেতো। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ তারা খুব কঠিন শপথ করে করে বলতোঃ যদি আমাদের বিদ্যমানতায় আল্লাহর কোন নবী এসে পড়েন তবে আমরা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেবো এবং হিদায়াতের পথে সর্বাগ্রে দৌড়িয়ে যাবো। কিন্তু যখন আল্লাহর নবী এসে গেলেন তখন তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পেলো।”(৬:১০৯)
এখানে বলা হয়েছে যে, যখন তাদের এ আকাঙ্ক্ষা পুরো করা হলো তখন তারা কুফরী করতে লাগলো। আল্লাহর সাথে কুফরী করা এবং নবী (সঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পরিণতি কি তা তারা অতি সত্বরই জানতে পারবে।’
১৭১-১৭৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ আমি পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও লিপিবদ্ধ করেছি এবং পূর্ববর্তী নবীদের (আঃ) মাধ্যমেও দুনিয়াবাসীকে শুনিয়ে দিয়েছি যে, দুনিয়া ও আখিরাতে আমার রাসূল ও তাদের অনুসারীদের পরিণামই হবে উত্তম। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ্ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেনঃ অবশ্যই আমি ও আমার রাসূলরাই জয়যুক্ত থাকবো, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শক্তিশালী ও মহা পরাক্রমশালী ।”(৫৮:২১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদেরকে ও মুমিনদেরকে সাহায্য করবো পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীরা দণ্ডায়মান হবে।” (৪০:৫১) এখানেও মহান আল্লাহ্ ঐ কথাই বলেনঃ আমার রাসূলদের সাথে আমার এই ওয়াদা হয়ে গেছে যে, অবশ্যই তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। আমি নিজেই তাদেরকে সাহায্য করবো। তুমি তো জান যে, কিভাবে তাদের শত্রুদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। তুমি মনে রেখো যে, আমার বাহিনীই হবে বিজয়ী। তুমি একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ধৈর্য সহকারে তাদের ব্যাপারটা দেখতে থাকো। তাদের দেয়া কষ্ট সহ্য করে যাও। তুমি তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকো যে, কিভাবে আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করবেন এবং কিভাবে তারা হবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত! তারা নিজেরাও শীঘ্রই তা প্রত্যক্ষ করবে।
বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, তারা বিভিন্ন প্রকারের ছোট ছোট আযাবের শিকার হওয়া সত্ত্বেও এখনো বড় আযাবকে অসম্ভব মনে করতে রয়েছে! আর বলছে যে, ঐ আযাব কখন আসবে? তাই তাদেরকে জবাবে বলা হচ্ছেঃ তাদের আঙিনায় যখন শাস্তি নেমে আসবে ওটা তাদের জন্যে খুবই কঠিন দিন হবে। তাদেরকে সেদিন সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হবে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) অতি প্রত্যুষে খায়বারের মাঠে উপস্থিত হন। জনগণ অভ্যাসমত চাষের যন্ত্রপাতি নিয়ে শহর হতে বের হয়েছে। হঠাৎ তারা আল্লাহর সেনাবাহিনী দেখে পালিয়ে যায় এবং শহরবাসীকে খবর দেয়। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলে ওঠেনঃ “আল্লাহ্ বড়ই মহান। খায়বারবাসীর জন্যে বড়ই বিপদ। যখন আমরা কোন কওমের ময়দানে অবতরণ করি তখন ঐ সতর্কিকৃতদের বড়ই দুর্গতি হয়ে থাকে।”
পুনরায় মহান আল্লাহ্ স্বীয় নবী (সঃ)-কে জোর দিয়ে বলেনঃ হে নবী (সাঃ)! কিছুকালের জন্যে তুমি তাদেরকে উপেক্ষা করতে থাকো এবং তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে যাও। শীঘ্রই তারা নিজেরাও (তাদের দুর্গতি) প্রত্যক্ষ করবে।
১৮০-১৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা সেই সমুদয় বিষয় হতে নিজের পবিত্রতা বর্ণনা করছেন যেগুলো যালিম ও মিথ্যাবাদী মুশরিকরা তাঁর প্রতি আরোপ করে থাকে। যেমন তারা বলে যে, আল্লাহর সন্তান আছে ইত্যাদি। আল্লাহ্ তা’আলা অতি মহান এবং এমন মর্যাদার অধিকারী যা কখনো নষ্ট হবার নয়। ঐ মিথ্যাবাদী ও মিথ্যারোপকারী মুশরিকদের অপবাদ হতে তিনি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র।
আল্লাহর রাসূলদের (আঃ) প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। কেননা, তাঁদের কথাগুলো ঐসব দোষ হতে মুক্ত যেসব দোষ মুশরিকদের কথাগুলোর মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। নবীরা যেসব কথা বলেন এবং তারা মহান আল্লাহর সত্তার যে শাবলী বর্ণনা করে থাকেন সেগুলো সবই সঠিক ও সত্য। তাঁর সত্তার জন্যেই প্রশংসা শোভনীয়। দুনিয়া ও আখিরাতে শুরুতে ও শেষে প্রশংসা একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। সর্বাবস্থায়ই প্রশংসা প্রাপ্তির যোগ্য শুধুমাত্র তিনিই। তাঁর মহিমা ঘোষণা দ্বারা সর্ব প্রকারের ক্ষতি তাঁর পবিত্র সত্তা হতে দূর প্রমাণিত হয়। তাহলে এটা অতি আবশ্যকীয় যে, সর্বপ্রকারের পূর্ণতা তাঁর একক সত্তার মধ্যে থাকবে। এটাকেই পরিষ্কার ভাষায় হামদ বা প্রশংসা দ্বারা সাব্যস্ত করা হয়েছে, যাতে ক্ষতিসমূহ না সূচক হয় এবং পূর্ণতা হ্যা সূচক হয়। কুরআন কারীমের বহু আয়াতে তাসবীহ্ ও হামদের একই সাথে বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
হযরত কাতাদা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমরা আমার উপর সালাম পাঠাবে তখন অন্যান্য নবীদের উপরও সালাম পাঠাবে। কেননা, তাঁদেরই মধ্যে আমিও একজন নবী।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমাদেও এটা বর্ণিত আছে)
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) যখন সালামের ইচ্ছা করতেন তখন এই আয়াত তিনটি পড়ে সালাম করতেন। (এ হাদীসটি হাফিয আবু ইয়ালা (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর ইসনাদ দুর্বল)
হযরত শা’বী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন পরিমাপ যন্ত্র ভর্তি পুণ্য লাভ করতে চায় সে যেন কোন মজলিস হতে উঠে যাওয়ার সময় এই আয়াত তিনটি পাঠ করে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমাদে এ রিওয়াইয়াতটি হযরত আলী (রাঃ) হতে মাওকুফরূপে বর্ণিত হয়েছে)
ইমাম তিবরানী (রঃ)-এর হাদীস গ্রন্থে হযরত আরকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে এ আয়াত তিনটি তিনবার পাঠ করবে সে পরিমাপ যন্ত্র ভরে ভরে পুণ্য লাভ করবে।”
মজলিসের কাফফারার ব্যাপারে বহু হাদীসে নিম্নোক্ত কালেমাটি পাঠ করার কথা এসেছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি এবং আপনার প্রশংসা করছি। আপনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। আপনার নিকট আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও আপনার নিকট তাওবা করছি।” এই মাসআলার উপর আমি একটি স্বতন্ত্র কিতাব লিখেছি।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এখান থেকে আর একটি বিষয় শুরু হচ্ছে। প্রথম বিষয়টি ১১ আয়াত থেকে শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ মক্কার কাফেরদের সামনে এ প্রশ্ন রাখা হয়েছিলঃ “তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তাদেরকে সৃষ্টি করা বেশী কঠিন কাজ, না আমি যেগুলো সৃষ্টি করে রেখেছি সেগুলো?” এখন তাদেরই সামনে এ দ্বিতীয় প্রশ্ন আনা হচ্ছে। প্রথম প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল কাফেরদেরকে তাদের এ ভ্রষ্টতা সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া যে, তারা মৃত্যু পরের জীবন ও শাস্তি-পুরস্কারকে অসম্ভব মনে করতো এবং এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিদ্রূপ করতো। এখন এ দ্বিতীয় প্রশ্নটি তাদের এ মূর্খতা সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার জন্য পেশ করা হচ্ছে যে, তারা বলতো আল্লাহর সন্তান আছে এবং অনুমানের ঘোড়া দাবড়িয়ে যাকে ইচ্ছা তাকেই আল্লাহর সন্তান বলে আখ্যায়িত করতো।
# হাদীস থেকে জানা যায়, আরবে কুরাইশ, জুহাইনিয়া, বনী সালেমাহ, খুযা’আহ, নবী য়ুলাহ এবং অন্যান্য গোত্র বিশ্বাস করতো, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে তাদের এ জাহেলী আকীদার কথা বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন সূরা আন নিসা ১১৭ ; আন নাহল ৫৭-৫৮ , বনী ইসরাঈল ৪০ ; আয যুখরুফ ১৬-১৯ এবং আন নাজম ২১-২৭ আয়াতসমূহ।
# ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা মনে করার জন্য দু’টি বুনিয়াদই হতে পারে। এ ধরনের কথা তারা বলতে পারে প্রত্যক্ষ দর্শনের ভিত্তিতে অথবা এ ধরনের দাবী যারা করে তাদের কাছে আল্লাহর এমন কোন কিতাব থাকতে হবে যাতে আল্লাহ নিজেই ফেরেশতাদেরকে নিজের কন্যা বলে উল্লেখ করে থাকবেন। এখন এ বিশ্বাসের প্রবক্তারা যদি কোন প্রত্যক্ষ দর্শনের দাবী করতে না পারে এবং এমন কোন কিতাবও তাদের কাছে না থাকে, যাতে একথা বলা হয়েছে, তাহলে নিছক উড়ো কথার ভিক্তিতে একটি দ্বীনী বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করে নেয়া এবং বিশ্ব-জাহানের মালিকের সাথে সুস্পষ্ট হাস্যকর কথা সম্পৃক্ত করে দেয়ার চাইতে বড় মূর্খতা ও বোকামি আর কী হতে পারে।
# মূলে ‘মালাইকা’র (ফেরেশতাবৃন্দ) পরিবর্তে ‘আল জিন্নাহ’ (اَلْجَنَّة) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কোন কোন শ্রেষ্ঠ তাফসীকারের মতে এখানে ‘জিন’ শব্দটি তার আভিধানিক অর্থের (অর্থাৎ গুপ্ত সৃষ্টি) প্রেক্ষিতে ‘মালাইকা’ তথা ফেরেশতা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ ফেরেশতাও আসলে একটি গোপন জীবই। পরবর্তী বিষয়বস্তু এখানে জিন শব্দটি ফেরেশতা অর্থে ব্যবহার করারই দাবী জানায়।
# এ আয়াতের দ্বিতীয় অনুবাদ এও হতে পারেঃ “কাজেই তোমরা ও তোমাদের এ ইবাদাত, এর ভিত্তিতে তোমরা কাউকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারো না কিন্তু একমাত্র তাকে যে ………………..।” এ দ্বিতীয় অনুবাদের প্রেক্ষিতে এর অর্থ হবে, হে পথভ্রষ্টের দল। এই যে, তোমরা আমাদের পূজা করছো এবং আমাদেরকে আল্লাহর রব্বুল আলামীনের সন্তান গণ্য করছো, এর মাধ্যমে তোমরা আমাদেরকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারো না। এর মাধ্যমে তো কেবলমাত্র এমন নির্বোধই ফিতনার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে পারে, যে সর্বনাশের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। অন্য কথায় বলা যায়, ফেরেশতারা তাদেরকে বলছেঃ “পাতো এ ফাঁদ অন্য পাখির জন্য।”
# আল্লাহর সন্তান হওয়া তো দূরের কথা, আমাদের অবস্থা তো হচ্ছে এই যে, আমাদের মধ্যে যার জন্য যে মর্যাদা ও স্থান নির্ধারিত হয়েছে তা থেকে সামান্যতমও এদিক ওদিক করার ক্ষমতা কারো নেই।
# আল্লাহর সেনাদল বলতে এমন ঈমানদারদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা আল্লাহর রসূলের আনুগত্য করে এবং তাঁর সহযোগী হয়। তাছাড়া এমন অদৃশ্য শক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত হয় যাদের সাহায্যে মহান আল্লাহ সত্যপন্থীদেরকে সাহায্য-সহায়তা দান করে থাকেন।
এ সাহায্য ও বিজয়ের অর্থ অবশ্যই এ নয় যে, প্রত্যেক যুগে আল্লাহর প্রত্যেক নবী এবং তাঁর প্রত্যেক অনুসারী দল রাজনৈতিক বিজয়ই লাভ করবেন। বরং এ বিজয় বহু ধরনের হবে। রাজনৈতিক বিজয়ও এর মধ্যে একটি। যেখানে আল্লাহর নবীগণ এ ধরনের প্রাধান্য লাভ করেননি সেখানেও তাঁদের নৈতিক প্রাধান্য প্রমাণিত হয়েই থাকবে। যেসব জাতি তাদের কথা মানেনি এবং তাদের দেয়া হিদায়াতের বিরোধী পথ অবলম্বন করেছে তারা শেষ পর্যন্ত বরবাদই হয়ে গেছে। মূর্খতা ও ভ্রষ্টতার যে দর্শনই মানুষ তৈরি করেছে এবং যে বিকৃত জীবনাচরণই জোরপূর্বক প্রচলন করা হয়েছে তা সবই কিছুদিন পর্যন্ত টিকে থাকার পর শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু হাজার হাজার বছর থেকে আল্লাহর নবীগণ যে সত্যগুলোকে প্রকৃত সত্য হিসেবে পেশ করে এসেছেন তা আগেও ছিল অপরিবর্তনীয় এবং আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। কেউ তাকে স্বস্থান থেকে নড়াতে পারেনি।
# বেশীদিন যেতে না যেতেই তারা নিজেদের পরাজয় ও তোমার বিজয় স্বচক্ষে দেখে নেবে। একথা যেভাবে বলা হয়েছিল ঠিক সেভাবেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এ আয়াতগুলো নাযিল হবার পর বড়জোর ১৪/১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে থাকবে। মক্কার কাফেররা নিজেদের চোখেই রসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর নিজের শহরে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ দেখে নিয়েছে এবং তারপর এর কিছুকাল পরেই তারা দেখে নিয়েছে, ইসলাম কেবলমাত্র আরবের ওপরেই নয় বরং বিশাল পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের ওপরও বিজয়ী হয়েছে।